অধ্যায় বাইশ
লিভিং রুম থেকে ফিরে এসে দেখি ফিবি তার মাথা থেকে বালিশ সরিয়ে ফেলেছে। জানতাম সে সরিয়ে ফেলবে। তবে সে তখনো আমার দিকে তাকাচ্ছিল না, যদিও সে তখন সোজাভাবেই শুয়ে ছিল। যখন আমি আবার ফিরে গিয়ে বিছানার পাশে গিয়ে বসলাম, সে তখন আমাকে মুখ ঝামটা দিয়ে অন্য দিকে ঘুরিয়ে দিল। আমার দিকে প্রচণ্ড ক্ষীপ্ত ছিল ও, যেমনটা পেন্সিংয়ের সরঞ্জাম হারিয়ে ফেলার পর পেন্সির পেন্সিং টিম হয়েছিল।
‘হ্যাজেল ওয়েদারফিল্ডের কী অবস্থা?’ বললাম। ‘তাকে নিয়ে নতুন কিছু লিখেছো? আমার স্যুটকেসে তোমার পাঠানো গল্পটা এখনো আছে। স্যুটকেসটা এখন স্টেশনে আছে। খুবই ভালো গল্প লিখেছো।’
‘বাবা তোমাকে মেরে ফেলবে।’
খোদা, তার মনে যদি কোনো ভাবনা জেঁকে বসে তাহলে সহজে তার মন থেকে সেই ভাবনা দূর করা সম্ভব না।
‘না, বাবা মারবে না। বাবা আমাকে বড়োজোর বেশি হলে প্রচণ্ড ধমক দেবে। তারপর আমাকে পারলে মিলিটারি স্কুলে পাঠিয়ে দেবে। বেশি হলে এটুকুই হবে। আর সবচেয়ে বড়ো কথা আমি তো তখন এখানে থাকবোই না। দূরে চলে যাবো। আমি হয়তো তখন কলোরাডোর ঐ র্যাঞ্চটাতে থাকবো।’
‘আমাকে হাসিয়ো না তো। তুমি ঘোড়াও চড়তে পারো না।’
‘কে পারে না? অবশ্যই পারি, আর তারা দুই মিনিটের মধ্যে এটা শিখিয়ে দিতে পারবে,’ বললাম। ‘ওটা খোঁচানো বন্ধ করো তো।’ ফিবি তখন তার কনুইয়ে লাগানো টেপটা খোঁচাচ্ছিল। ‘এই হেয়ারকাট কে দিয়েছে তোমাকে?’ জিজ্ঞেস করলাম। তখন খেয়াল করলাম যে তার হেয়ারকাটটা খুবই বাজে ছিল ঐবার। তার চুলগুলো একটু বেশিই ছোটো ছিল।
‘তোমার জানার দরকার নেই ওটা,’ ও বলল। সে মাঝেমধ্যে খুবই মেজাজ দেখায়। ভালোই বদমেজাজী। ‘তো আমি ধরে নিচ্ছি যে তুমি সব সাবজেক্টেই ফেইল করেছো,’ খুবই ক্রুব্ধ কণ্ঠে বলল ফিবি। ব্যাপারটা একদিক থেকে বেশ মজার ছিল। বাচ্চা হলেও তখন তাকে স্কুল টিচারের মতো শোনাচ্ছিল।
‘না, সব সাবজেক্টে করিনি,’ বললাম। ‘ইংরেজিতে পাশ করেছি।’ তারপর খেলাচ্ছলে তার পিঠে একটা চাপড় দিলাম। খুবই আস্তে করে দিয়েছিলাম। তবে সে ওটা খেলাচ্ছলে নেয়নি। শরীরে টোকা লাগতেই সে আমার হাতে ঘুষি মারার চেষ্টা করল, তবে ঘুষিটা লাগাতে পারেনি।
তারপর হঠাৎ করে বলে উঠলো, ‘তো, কেন করেছো ওটা?’ সে আসলে আমার ফেইল করার কারণ জানতে চাচ্ছে। সে যেভাবে আমাকে প্রশ্নটা করল তাতে আমার কিছুটা দুঃখই লাগলো।
‘খোদা, ফিবি, আমাকে এটা জিজ্ঞেস করো না। সবাইকে এই প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে ক্লান্ত হয়ে গেছি,’ বললাম। ‘আমার ফেইল করার হাজারটা কারণ আছে। আমার জীবনে পড়া সবচেয়ে বাজে স্কুল ওটা। মিথ্যাবাদী আর ধাপ্পাবাজ হারামিতে ভরা একটা স্কুল। তুমি জীবনেও কখনো একসঙ্গে এতো হারামি আর অন্য কোথাও দেখতে পাবে না। যেমন ধরো, কয়েকজন মিলে তাদের রুমে বসে আড্ডা দিছে, আর তখন কেউ এসে তাদের আড্ডায় যুক্ত হতে চাইলে তারা তাকে যুক্ত হতে দেয় না। তবে নির্বোধ গর্দভ আর হারামি হলে আলাদা কথা। এমনকি তারা গুজবও ছড়িয়েছিল যে আমি নাকি অনেক ভীতু বলেই তাদের সাথে আড্ডায় যোগ দেই না। রবার্ট অ্যাকলি নামের এক বিরক্তিকর ছেলেও তাদের আড্ডায় যুক্ত হতে চেয়েছিল, অনেক চেষ্টাও করেছে সে, কিন্তু তারা তাকে সাথে নেয়ইনি। না নেওয়ার কারণ শুধু ছেলেটা একটু বিরক্তিকর ছিল। আমার আসলে ওটা নিয়ে কথাও বলতে ভালো লাগছে না। খুবই বাজে একটা স্কুল ওটা। আমার কথা বিশ্বাস করো।’
ফিবি কিছু বলল না, তবে সে ঠিকই আমার কথা শুনছিল। তার ঘাড়ের পিছন দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারছিলাম যে সে আমার কথা শুনছে। তাকে কিছু বলা হলে সে সবসময়ই তা শুনে। আর সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো বেশির ভাগ সময় তাকে কী বলা হচ্ছে তা আগে থেকেই জানে ও। সে আসলেই জানে।
আমি পেন্সি নিয়েই কথা বলছিলাম। আসলে তখন ওটা নিয়েই কথা বলতে ইচ্ছা করছিল আমার।
‘এমনকি ফ্যাকাল্টির কয়েকজন ভালো ভালো শিক্ষকও ধাপ্পাবাজ প্রকৃতির, বললাম। ‘স্কুলে মি. স্পেন্সার নামে বৃদ্ধ এক শিক্ষক আছে। লোকটার বউ সবসময়ই তাদের বাসায় গেলে আমাকে হট চকলেট দিতো। তারা আসলেই খুব ভালো মানুষ। কিন্তু স্কুলের হেডমাস্টার থার্মার খুবইবড়ো এক হারামি। সে প্রায় সময়ই ইতিহাসের ক্লাসে এসে পিছনের দিকে বসে থাকত। প্রায়ই আধ-ঘণ্টা পিছনে বসে থেকে ক্লাস শুনতো। তার ভাবটা এমন যে সে ছদ্মবেশে ক্লাস কেমন হয় তা পরিদর্শন করছে। কিন্তু ক্লাসে এসে কিছুক্ষণ পর পরই সে মি. স্পেন্সারের পড়ানোয় বাঁধা দিয়ে ফালতু কিছু কৌতুক বলা শুরু করত। আর স্পেন্সারও তখন ধাপ্পাবাজদের মতো এতো হাসা হাসতো যেন হেডমাস্টার থার্মার কোনো প্রিন্স বা এমন কিছু। কখনোই বলত না যে তার ক্লাসে যেন বাঁধা না দেয়।’
‘গালাগালি করো না এতো।’
‘তুমি ওখানে গেলে বমি করে দেবে, জায়গাটা এতোই বাজে,’ বললাম। ‘এরপর ধরো ভেটেরান ডে’র কথা। স্কুলে একটা ভেটেরান ডে আছে, যেদিন পেন্সির সেই ১৭৭৬ সাল থেকে পড়া সাবেক ছাত্ররা তাদের স্ত্রী-সন্তান নিয়ে স্কুলে ঘুরতে আসে। একদিন ঐ ডে’তে পঞ্চাশ বছর বয়স্ক একজন লোক এসেছিল। সে স্কুলে এসে সরাসরি আমাদের রুমে চলে গিয়েছিল, জিজ্ঞেস করেছিল সে আমাদের বাথরুম ব্যবহার করলে আমরা কিছু মনে করবো কি না। আমি জানি না সে আমাদের কেন এটা জিজ্ঞেস করেছিল—বাথরুমটা করিডোরের শেষ মাথায়। সে তখন নিজে থেকেই বলেছিল, সে আসলে দেখতে চায় বাথরুমের দরজায় এখনো তার নামের আদ্যক্ষরগুলো লেখা আছে কি না। লোকটা সেই নব্বই হাজার বছর আগে স্কুলের ছাত্র থাকার সময় বাথরুমের দরজায় তার নাম লিখে গিয়েছিল, সে এটাই দেখতে চায় যে নামটা এখনো ওখানে আছে কি না। তাই আমি আর আমার রুমমেট লোকটাকে বাথরুমে নিয়ে গেলাম, আর লোকটাও বাথরুমের দরজাগুলো তার নাম খোঁজা শুরু করল। নাম খোঁজার পুরোটা সময়ই বকবক করছিল লোকটা। বলছিল পেন্সিতে কাটানো সময়টাই নাকি তার জীবনের সবচেয়ে সেরা সময়, আমাদেরকে ভবিষ্যত নিয়ে অনেক উপদেশও দিচ্ছিল। লোকটা প্রচণ্ড বিষণ্ণ করে তুলেছিল আমাকে। আমি এটা বলছি না যে লোকটা খারাপ ছিল। না, লোকটা আসলে ভালোই ছিল, তবে খারাপ লোকেরাই যে কাউকে বিষণ্ণ করে তা কিন্তু নয়। ভালো লোকেরাও অন্যদেরকে হতাশ, বিষণ্ণ করতে পারে। বাথরুমের দরজায় নিজের লেখা নাম খুঁজতে খুঁজতে কাউকে ভবিষ্যৎ নিয়ে বলেও হতাশ করে তোলা যায়। আমি জানি না ঠিক অবশ্য। হয়তো লোকটার কথা অতটা খারাপ লাগতো না যদি লোকটার কথা বলার সময় শ্বাস নিতে তেমন সমস্যা না হতো। সিঁড়ি দিয়ে ঐ পর্যন্ত আসতে আসতেই লোকটার শ্বাস উঠে গিয়েছিল। আর অদ্ভুতভাবে শ্বাস নেওয়া কারো কথা তো অতটা ভালোভাবে শোনা যায় না। যাইহোক, লোকটা শ্বাস টানতে টানতে আর বাথরুমের দরজায় নিজের নাম খুঁজতে খুঁজতে আমাকে আর স্ট্র্যাডলেটারকে বলছিল আমরা পেন্সি থেকে কী কী পেতে পারি ভবিষ্যতে। খোদা, ফিবি, আমি আসলে ওসব বলে বোঝাতে পারবো না। পেন্সিতে চলা কোনো কিছুই আমি পছন্দ করতে পারিনি। আমি ব্যাখ্যা করতে পারবো না ঐ স্কুলটাকে।’
ফিবি তখন কিছু একটা বলেছিল, তবে আমি তা শুনতে পাইনি। সে আসলে তখন তার মুখের একটা অংশ বালিশে চাপা দিয়ে রেখেছিল, তাই তার কথা আমি তেমন একটা বুঝতে পারছিলাম না।
‘কী?’ আমি বললাম। ‘মুখের ওপর থেকে বালিশ সরাও। ওটা থাকায় তোমার কথা বুঝতে পারছি না আমি।’
‘তুমি তো দুনিয়ায় যা ঘটছে তার কোনো কিছুই পছন্দ করো না।’
তার কথাটা শুনে আরো বেশি খারাপ লাগলো আমার।
‘অবশ্যই আমি পছন্দ করি। অবশ্যই করি। এটা বলো না। এটা কেন বললে তুমি?’
‘কারণ তুমি করো না। তুমি কোনো স্কুলই পছন্দ করো না। দুনিয়ার লক্ষ লক্ষ জিনিসই তোমার অপছন্দের। তুমি কিছুই পছন্দ করতে পারো না।
‘আমি পছন্দ করি। আসলে তোমার ভুলটা এখানেই। তুমি এই কথা কেন বললে?’ আমি বললাম। খোদা, ফিবি আসলেই আমাকে প্রচণ্ড বিষণ্ণ করে তুলছিল।
‘কারণ তুমি পছন্দ করো না কিছুই,’ ফিবি বলল। ‘তুমি পছন্দ করো এমন একটা জিনিসের নাম বলো তো।’
‘একটা জিনিস? যেটা আমি পছন্দ করি?’ আমি বললাম। ‘আচ্ছা, ঠিক আছে।’
সমস্যাটা হলো, আমি আসলে তখন কোনো কিছুতেই মনস্থির করতে পারছিলাম না। মাঝেমধ্যে আসলে কিছুতে মনস্থির করা বেশ কঠিন
‘এমন একটা কিছু যেটা আমি অনেক পছন্দ করি? এটাই জানতে চাইছো?’ আমি জিজ্ঞেস করলাম।
সে কোনো জবাব দিলো না যদিও। সে আসলে বিছানার অন্য কোণায় প্রায় গুটিসুটি হয়ে পড়েছিল। আমার থেকে হাজার মাইল দুরে মনে হচ্ছিল তাকে। ‘বলো,’ আমি বললাম। ‘যেটা আমি অনেক বেশি পছন্দ করি নাকি যেটা আমি শুধু পছন্দ করি?’
‘অনেক বেশি পছন্দ করো যেটা সেটার নামই বলো।’
‘আচ্ছা,’ আমি বললাম। সমস্যাটা হলো আমি আসলে তখন কোনো কিছুতেই মনোযোগ দিতে পারছিলাম না। আমি তখন শুধু ভাবছিলাম পুরোনো খড়ের তৈরি ঝুড়ি নিয়ে টাকা সংগ্রহ করা দুই নানকে নিয়ে। বিশেষ করে রিমের চশমাপরা ঐ নানটার কথা। আর ভাবছিলাম এঙ্কটন হিলসের জেমস ক্যাসল নামের এক ছেলেকে নিয়ে। এল্কটন হিলসে থাকাকালে জেমস ক্যাসল স্কুলের খুবই দেমাগী ছেলে ফিল স্তাবিলকে নিয়ে একটা কথা বলেছিল যেটা সে ফিরিয়ে নিতে পারেনি। সে স্তাবিলকে খুবই দাম্ভিক প্রকৃতির ছেলে বলে মন্তব্য করেছিল। কথাটা স্তাবিলের কানে চলে গিয়েছিল। স্তাবিলের এক হারামজাদা চামচা গিয়ে বলে দিয়েছিল তাকে। কথাটা শোনার পর স্তাবিল তার সাথে করে তার ছয় দোসর নিয়ে জেমস ক্যাসেলকে তার রুমে আঁটকে বলে জেমস যেন তার কথাটা ফিরিয়ে নেয়। কিন্তু জেমস সেটা করেনি। এরপরই তারা অত্যাচার করা শুরু করে জেমসের ওপর। তারা কী করেছিল সেটা আমি উচ্চারণ করে কাউকে বলতে পারবো না—এতোই জঘন্য ছিল কাজটা—তবে তারপরও জেমস তার কথাটা ফিরিয়ে নেয়নি। জেমস ছিল খুবই শুকনো একটা ছেলে। তার হাতের কবজিগুলো ছিল পেন্সিলের মতো শুকনো। শেষমেশ স্তাবিলের সাঙ্গপাঙদের অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে জানালা দিয়ে ঝাঁপ দিয়ে বসে জেমস। আমি তখন শাওয়ারে ছিলাম, তারপরও আমি মাটিতে তার ধুপ করে পড়ার শব্দটা ঠিকই শুনতে পেয়েছিলাম। আমি শব্দ শুনে তখন ভেবেছিলাম জানালা দিয়ে হয়তো কারো রেডিও বা কিছু একটা পড়ে গেছে অথবা কারো ডেস্ক উলটে গেছে। কোনো মানুষ যে যে পড়ে গেছে তা ভাবিওনি। ঠিক তখনই বাইরে থেকে হই-হুল্লোড় শব্দ শুনতে পেলাম। সবাইই করিডোর ধরে সিঁড়ির দিকে দৌড়ে যাচ্ছিল তখন। এতো শব্দ শুনে আমিও বাথরোব পরে বেরিয়ে দৌড় লাগালাম সিঁড়ির দিকে। সিঁড়ি দিয়ে নেমে দেখি জেমস ক্যাসল পাথরের ফলকের ওপর মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। মাটিতে পড়ার সাথে সাথেই মরে গিয়েছিল জেমস। তার দেহের চারপাশটা জুড়ে শুধু রক্তই ছড়িয়েছিল। তবে কেউই তার লাশের কাছে যাওয়ার সাহস পাচ্ছিল না। তার শরীরের তখনো আমার থেকে ধার নেওয়া টারটলনেক সোয়েটারটা পরা ছিল। তবে এরপরও স্কুল কর্তৃপক্ষ স্তাবিলের দলবলকে তেমন কোনো শাস্তি দেয়নি, তারা শুধু তাদেরকে স্কুল থেকে এক্সপেল করেছিল মাত্র, জেলেও পাঠায়নি।
হ্যাঁ, আমার মাথায় তখন এদুটো ব্যাপারই ছিল। মজার ব্যাপারটা হলো আমি আসলে জেমস ক্যাসেলকে অতটা ভালোভাবে চিনতামও না। সে খুবই চুপচাপ এক ছেলে ছিল। আমার ম্যাথ ক্লাসে ছিল ও, তবে তার সিটটা ছিল আমার সিটের ঠিক উলটো দিকে। আর সে ক্লাসে কখনো উঠে দাঁড়িয়ে কিছু জিজ্ঞেস করত না বা ব্ল্যাকবোর্ডের কাছেও যেতো না। সব স্কুলেই কিছু কিছু ছেলে আছে যারা কখনোই ক্লাসে উঠে দাঁড়িয়ে কিছু বলে না বা ব্ল্যাকবোর্ডে কিছু লিখতে যায় না। জেমস ছিল ওরকমই। আর আমার মনে হয় তার সাথে আমার কথাও মাত্র একবারই হয়েছে। সেটাও সে আমার থেকে টারটলনেক সোয়েটারটা ধার নিতে চেয়েছিল। সে যখন আমার থেকে সোয়েটারটা ধার চাইলো তখন আমি আরেকটু হলেই হার্টঅ্যাটাকে মরতে বসেছিলাম। মানে সে আমার সাথে কথা বলায় এতটাই চমকে গিয়েছিলাম আমি তখন। আমার মনে আছে আমি তখন বাথরুমে দাঁত ব্রাশ করছিলাম। সে বলেছিল তার কাজিনের সাথে করে নাকি সে ড্রাইভে যাবে, তাই আমার টারটলনেকটা তাঁর দরকার। আমি তখন এটাও জানতাম না যে সে আমার টার্টলনেক সোয়েটারটার ব্যাপার জানে। আমি তখন তার ব্যাপারে শুধু এটুকুই জানতাম যে আমার আগের রোলটা তার। ক্যাবেল আর, ক্যাবেল ডব্লিউ, ক্যাসল, কলফিল্ড—আমার এখনো মনে আছে এটা। আর সত্য বলতে আমি আসলে ঐদিন তাকে আরেকটু হলেই সোয়েটারটা ধার দিতে চাইনি। তাকে অতটা ভালো করে চিনতাম না বলেই দিতে চাইনি।
‘কী?’ আমি ফিবিকে বললাম। সে আসলে আমাকে কিছু একটা বলেছিল, কিন্তু আমি শুনতে পাইনি মনোযোগ অন্যদিকে থাকায়।
‘তুমি কিছুর কথাই ভাবতে পারছো না, তাই না?
‘অবশ্যই পারছি।’
‘তাহলে বলো।’
‘আমি এলিকে পছন্দ করি,’ বললাম। ‘আর আমি এখন যেটা করছি সেটা করতে পছন্দ করি। মানে তোমার সাথে এখানে বসে গল্প করা, কোনো কিছু নিয়ে চিন্তা করা।’
‘এলি মৃত—তুমিই সবসময় বলো এটা। আর কেউ যদি মরে গিয়ে স্বর্গে চলে যায় তাহলে সেটা কিন্তু সত্যিই—’
‘আমি জানি সে মৃত,’ বললাম। ‘তোমার কি মনে হয় আমি সেটা জানি না? তবে তারপরও তো আমি তাকে পছন্দ করতে পারবো, তাই না? কেউ একজন মারা গেছে বলেই যে তাকে পছন্দ করা ছেড়ে দিতে হবে—এমন তো নিশ্চয় না, বিশেষ করে সেই মানুষটা যদি জীবিত মানুষদের থেকে হাজারগুণ ভালো হয়ে থাকে?’
ফিবি কিছু বলল না। যখন সে বলার মতো কিছু পায় না, তখন সে চুপ করে থাকে।
‘যাই হোক, আমি এই মুহূর্তের সময়টা পছন্দ করি,’ আমি বললাম। ‘মানে ঠিক এই মুহূর্তটা। তোমার সাথে বসে গল্প করা—’
‘কিন্তু এটা সত্যিকারের তেমন কিছু না।’
‘এটা অবশ্যই সত্যিকারের কিছু। নিশ্চিতভাবেই এটা কিছু। এটা কেন বাস্তব কিছু হবে না? মানুষ কখনোই কোনো কিছুকে বাস্তব ভাবতে পারে না। এটায় প্রচুর বিরক্ত আমি।’
‘গালি বন্ধ করো। আচ্ছা ঠিক আছে, অন্য কিছুর কথা বলো। তুমি হতে চাও এমন কিছুর কথা বলো। মানে বিজ্ঞানী বা উকিল বা এমন কিছু।’
‘আমি বিজ্ঞানী হতে পারবো না। বিজ্ঞানে আমি তেমন একটা ভালো না।’
‘তাহলে কি উকিল হবে? বাবার মতো?’
‘আমার মনে হয় উকিলের কাজটা বেশ ভালোই। তবে আমার কাছে এটা তেমন আকর্ষণীয় লাগে না,’ আমি বললাম। ‘মানে তারা যদি সবসময়ই নির্দোষ লোকদের বাঁচানোর কাজ করে, তাহলে তারা ঠিক আছে। তবে উকিল হলে তো এসব কাজ করা সম্ভব না। উকিল হলে আমার প্রধান কাজই হবে প্রচুর পরিমাণ টাকা উপার্জন করা, গলফ খেলা, ব্রিজ খেলা, গাড়ি কেনা, মার্টিনি ড্রিংক করা আর প্রচুর ধনী-নামীদামি লোকের মতো ভান করা। মানে এসবই করা লাগে। তাছাড়া আমি যদি উকিল হয়ে মানুষের জীবন বাঁচাইও, তাহলে আমি কীভাবে নিশ্চিত হবো যে আমি ওটা একজন নির্দোষ লোককে বাঁচানোর জন্য করছি নাকি নির্দোষ লোককে বাঁচিয়ে নিজের খ্যাতি বাড়ানোর জন্য করছি? মুভিগুলোতে এসবই দেখায় তাই না? উকিলরা নির্দোষ কাউকে বাঁচানোর পরে সবাই তাকে অভিনন্দন জানায়, তার জন্য করতালি দেয়, তার পিঠে চাপড় দেয়, সাংবাদিকেরা দাঁড়িয়ে থাকে তার বক্তব্য নেওয়ার। যদি এমনই তাহলে আমি কীভাবে বুঝবো যে আমি ধাপ্পাবাজি করছি না? সমস্যাটা হলো, আমি তা বুঝতেই পারবো না।’
আমি নিশ্চিত না ফিবি আসলে আমার কথা বুঝতে পারছিল কি না। সে তো আসলে একটা বাচ্চা মেয়ে মাত্র। তবে সে আমার কথা শুনছিল অন্তত। যদি কেউ অন্তত কারো কথা ভালো করে শুনে, তাহলে সে অতটা অবুঝও না।
‘বাবা তোমাকে মেরে ফেলবে। বাবা আসলেই এবার মেরে ফেলবে তোমাকে,’ সে বলল।
আমি আসলে তখন তার কথা শুনছিলাম না। আমি তখন অন্য একটা ব্যাপার নিয়ে ভাবছিলাম। ‘তুমি জানো আমি কী হতে চাই? মানে যদি আমার নিজের ইচ্ছায় কিছু হওয়ার সুযোগ পাই আর কী। ‘
‘কী?’
‘তুমি কি ঐ গানটা শুনেছো, ‘ইফ অ্যা বডি ক্যাচ অ্যা বডি কামিং থ্রু দ্য রাই’? আমি—’
‘এটা না। আসল লাইনটা হচ্ছে ‘ইফ অ্যা বডি মিট অ্যা বডি কামিং থ্রু দ্য রাই’!’ ফিবি বলল। ‘এটা একটা কবিতা। রবার্ট বার্নসের কবিতা।’
‘আমি জানি এটা রবার্ট বার্নসের কবিতা।’
ফিবির কথা অবশ্য ঠিক। আমিই লাইনটা ভুল করেছি। আমি আসলে তখন এটা জানতামও না।
‘আমি ভেবেছিলাম ‘ইফ অ্যা বডি ক্যাচ অ্যা বডি’,’ আমি বললাম। ‘যাই হোক, আমি সবসময়ই কল্পনায় এক রাইক্ষেতে অনেকগুলো ছোটো ছোটো বাচ্চা খেলা করছে। হাজার হাজার বাচ্চা খেলছে ঐ শস্যের মাঠে। মাঠে বাচ্চারা ছাড়া আর কেউ নেই, মানে বড়ো কেউ নেই। আর আছি শুধু আমি। আমি ওখানের বিশাল খাদের ধারে দাঁড়িয়ে আছি। আমার ওখানে কাজ একটাই, যদি কোনো বাচ্চা খাদের কিনারে চলে আসে তাহলে তাকে ধরা, যাতে তারা খাদের কিনারা দিয়ে পড়ে না যায়। সারাদিন আমার কাজ এই একটাই। ক্যাচার ইন দ্য রাই। আমি জানি এটা খুবই অদ্ভুত, পাগলাটে, তবে আমি শুধু এটাই হতে চাই। আমি জানি এটা অনেক পাগলাটে।’
আমার কথা শুনে বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো ফিবি। তারপর অনেকক্ষণ পর ও বলল, ‘বাবা তোমাকে নিশ্চিত মেরে ফেলবে।’
‘আমার তা নিয়ে কোনো চিন্তাও নেই,’ বলে বিছানা থেকে উঠে দাঁড়ালাম আমি। আমার তখন হুট করেই এঙ্কটন হিলসের ইংরেজির শিক্ষক মি. আন্টোলিনিকে ফোন দেওয়ার ইচ্ছা হলো। তিনি এখন নিউইয়র্কে থাকেন। এল্কটন হিলস ছাড়ার পর তিনি এখন এনওয়াইইউতে ইংরেজির ক্লাস করান। ‘আমার একটা ফোন করতে হবে,’ আমি বললাম ফিবিকে। ‘এখনই আসছি। ঘুমিয়ে পড়ো না আবার।’ চাচ্ছিলাম না আমি লিভিং রুমে কথা বলার সময় ফিবি আবার ঘুমিয়ে পড়ুক। আমি জানতাম সে এমনিও ঘুমাবে না, তারপরও একদম নিশ্চিত হওয়ার জন্য বলেছিলাম।
তাকে বলে দরজার দিকে হেঁটে যাচ্ছি তখন ফিবি ডাকলো, ‘হোল্ডেন!’ ডাক শুনে ঘুরে দাঁড়ালাম আমি।
সে ততক্ষণে বিছানায় উঠে বসেছে আবার। তাকে দেখতে খুবই সুন্দর লাগছিল তখন। ‘ফিলিস মারগুলিসের থেকে ঢেকুর তোলা শিখছি আমি,’ সে বলল। ‘শুনো।’
আমি শুনলাম। তেমন একটা ভালো ঢেকুর ছিল না। ‘গুড,’ বলে লিভিং রুমের পা বাড়ালাম মি. আন্টোলিনিকে ফোন দেওয়ার জন্য।