দ্য ক্যাচার ইন দ্য রাই – ২১

অধ্যায় একুশ

ওটাই আসলে আমার বাসায় ফেরা সবচেয়ে সেরা ছুটি ছিল। বিল্ডিং-এ ফিরেই দেখি সচরাচর রাতে এলিভেটরের দায়িত্বে থাকা পিট ঐদিন নেই। তার বদলে অন্য একটা ছেলে ছিল দায়িত্বে। তাই ধরে নিলাম যে কোনো সমস্যা সৃষ্টি না করলে আমি খুব সহজেই বাসায় গিয়ে ফিবির সাথে কিছুক্ষণ কথা বলে ফিরে আসলেও কেউ আমার বাসায় আসার ব্যাপারটা টেরই পাবে না। আসলেই ঐ ছুটিতে সুযোগটা অনেক বড়ো ছিল। এলিভেটরের দায়িত্বে থাকা ছেলেটাও ছিল একটু গর্দভ প্রকৃতির, যেটা সবকিছুকে আরো সহজ করে দিয়েছিল। আমি এগিয়ে গিয়ে তাকে খুবই সাধারণ গলায় বললাম আমাকে ডিকস্টাইন্সদের অ্যাপার্টমেন্টে নিয়ে যেতে। ডিকস্টাইন্সরা আমাদের ফ্লোরের অন্য অ্যাপার্টমেন্টটাতেই থাকে। নিজেকে যাতে সন্দেহমূলক না দেখায় সেজন্য লাল শিকারি টুপিটাও মাথা থেকে খুলে নিয়েছিলাম। তাকে বলে এমনভাবে এলিভেটরে ঢুকলাম যেন আমার অনেক তাড়া আছে।

সেও ভেতরে ঢুকে এলিভেটরের দরজা লাগিয়ে আমাকে ওপরে নিয়ে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতই ছিল, ঠিক তখনই বলে উঠলো, ‘তারা তো বাসায় নেই। পনেরো তলার একটা পার্টিতে গেছে তারা।’

‘সমস্যা নেই ওতে,’ বললাম। ‘আমার তাদের জন্য অপেক্ষা করারই কথা ছিল। আমি তাদের ভাতিজা।’

শুনে ছেলেটা স্টুপিডদের মতো সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকালো আমার দিকে। ‘আপনার বরং লবিতে বসে অপেক্ষা করাই ভালো হবে,’ বলল এরপর।

‘আমি লবিতেই বসতাম—আসলেই বসতাম,’ বললাম। ‘তবে আমার পায়ের অবস্থা খুব একটা ভালো না। পা’টা আমাকে খুবই নির্দিষ্ট অবস্থানে রাখা লাগে। আমার মনে হয় আমি তাদের দরজার বাইরে থাকা চেয়ারটাতেই ভালো করে বসতে পারবো।’

সে আসলে বুঝতেই পারেনি যে আমি কী নিয়ে কথা বলছি। তাই কোনোরকমে বোঝার ভান ধরে ‘ওহ’ বলে এলিভেটরটা ওপরের দিকে উঠার সুইচে চাপলো। ঠিকঠাকেই চলছিল তখন সবকিছু। ব্যাপারটা অবশ্য বেশ মজার। কোনোভাবেই বুঝতে পারবে না এমন কিছু কাউকে বললে, সে না বুঝেও বুঝার ভান ধরে যা করতে বলা হয় সেটাই করে।

কাঙ্ক্ষিত ফ্লোরে এসে পৌঁছানোর পর খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে এলিভেটর থেকে বেরিয়ে আগানো শুরু করলাম ডিকস্টাইন্সদের দরজার দিকে। অবশ্য পিছন থেকে এলিভেটরের দরজা লাগানোর শব্দ শুনেই স্বাভাবিক পায়ে এগিয়ে গেলাম আমাদের বাসার দরজার দিকে। ততক্ষণ পর্যন্ত সবই ঠিকভাবে চলছিল। আমারও তখন নিজেকে মদ্যপ মাতাল মনে হচ্ছিল না। এরপর চাবি বের করে খুবই আস্তে আস্তে দরজাটা খুলে ঢুকলাম বাসার ভেতরে। একদমই নিঃশব্দে। আমি আসলে চোর হলে ভালোই নাম করতে পারতাম।

বাসার বারান্দাটা ঘুটঘুটে অন্ধকার হয়েছিল। স্বাভাবিকভাবেই এতো রাতে অন্ধকারই থাকার কথা। আর স্বাভাবিকভাবেই আমিও কোনো আলো জ্বালতে পারছিলাম না। তাই খুবই সাবধানে একটু একটু করে এগুচ্ছিলাম যাতে কোনো কিছু হড়কে পড়ে হট্টগোল সৃষ্টি না করি। আমি তখন নিশ্চিতই ছিলাম যে আমি বাসায় পৌছে গেছি। আমাদের বারান্দটায় অদ্ভুত এক ধরনের ঘ্রাণ ছিল যেটা অন্য কোথাও পাওয়া যেত না। আমি নিজেও জানি না ঘ্রাণটা কিসের ওটা কলিফ্লাওয়ারের সুবাসও না, পারফিউমেরও না। আমি নিজেও জানি না কিসের—তবে ওটা শুঁকলেই বুঝা যায় যে আমি বাসায় চলে এসেছি। এগুতে এগুতে কোটটা খুলে চিন্তা করলাম বারান্দার ক্লজেটে রাখবো, তবে ক্লজেটে এতো পরিমাণ হ্যাঙার আছে যে ডালা খুললেই হ্যাঙারের শব্দে ঘর ভরে উঠবে। তাই চিন্তাটা বাদ দিলাম। তারপর আমি ধীর পায়ে নিঃশব্দে এগুনো শুরু করলাম ফিবির রুমের দিকে। আমি জানতাম যে আমাদের বাসার কাজের মহিলা শব্দ টের পাবে না। মহিলা আমাকে বলেছিল, ছোটোবেলায় তার ভাই নাকি তার কানে পাইপ ঢুকিয়ে দিয়েছিল। এরপর থেকে মহিলা শুধু এককানেই শুনতে পায়। মহিলা আসলেই বধির টাইপের ছিল। তবে আমার বাবা-মা, বিশেষ করে আমার মায়ের শ্রবণশক্তি ছিল ব্লাডহাউন্ডের মতো। তাই তাদের রুমের দরজা পার হওয়ার সময় আরো আস্তে আস্তে গেলাম। এমনকি তখন শ্বাস আঁটকে রেখেছিলাম। ঘুমানো অবস্থায় বাবাকে মাথায় চেয়ার দিয়ে আঘাত করলেও বাবা ঘুম থেকে উঠবে না। তবে আমার মার কথা আলাদা। সাইবেরিয়ায় কেউ হাঁচি দিলেও মা সেটা ঠিকই শুনে ফেলবে। মা আসলে প্রচুর নার্ভাস প্রকৃতির। বেশির ভাগ সময়ই মা সারারাত জেগে শুধু সিগারেট টানে 1

অবশেষে প্রায় আধঘণ্টা পর ফিবির রুমে গিয়ে পৌছুলাম। যদিও সে রুমে ছিল না। আমি ভুলেই গিয়েছিলাম ওটা। ডি.বি. হলিউড বা কিছুর জন্য বাসার বাইরে থাকলে ফিবি সবসময়ই তার রুমে ঘুমায়। সে ঐ রুমটা পছন্দও করে কারণ ওটা বাসার সবচেয়ে বড়ো রুম। তাছাড়া ঐ রুমটায় রয়েছে এক বিশাল ডেস্ক—যেটা ডি.বি. ফিলাডেলফিয়ার এক মদ্যপ মহিলার থেকে কিনেছিল, আর ছিল দশ মাইলের মতো লম্বা-চওড়া এক বিশাল খাট। যাই হোক, ডি.বি. বাসায় না থাকলে ফিবি ঐ রুমেই ঘুমায়, আর ডি.বি.রও এতে কোনো আপত্তি নেই। ঐ টেবিলে বসে ফিবির হোমওয়ার্ক দৃশ্যটা আসলে সবারই দেখা উচিৎ। ডেস্কটা খাটের মতোই বিশাল। ওখানে বসে হোমওয়ার্ক করার সময় ফিবিকে আসলে বলতে গেলে দেখাই যায় না। ফিবি আসলে ঐধরনের জিনিসই পছন্দ করে। সে তার নিজের রুমটা অত পছন্দ করে না কারণ রুমটা নাকি অনেক ছোটো। তার মতে সে জিনিসপত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখতেই পছন্দ করে। বাচ্চা ফিবির আসলে ছড়িয়ে রাখার মতো জিনিসই বা কী আছে? কিছুই না।

যাইহোক, যত নিঃশব্দে সম্ভব ডি.বি.র রুমে গিয়ে ডেস্কের ল্যাম্পটা জ্বালালাম। ফিবি তখনো ঘুমাচ্ছিল। লাইট জ্বালানোর পর আমি কতক্ষণ তাকিয়ে রইলাম। হালকা একটু কাৎ হয়ে শুয়েছিল ফিবি, ঘুমানোর সময় তার মুখটা হাঁ হয়েছিল। দৃশ্যটা খুবই কিউট। ব্যাপারটা বেশ হাস্যকর, বড়োদেরকে মুখ হাঁ করে ঘুমাতে দেখলে খুবই বিরক্তিকর লাগে, তবে বাচ্চাদেরকে লাগে কিউট। তাদেরকে সবকিছুতেই খুব সুন্দর লাগে।

খুব নিঃশব্দে রুমের ভেতর হাঁটা শুরু করলাম। রুমের জিনিসগুলো দেখছিলাম। আমার বেশ ভালো লাগছিল তখন। আমার তখন মনে হচ্ছিল না যে আমি নিউমোনিয়া আক্রান্ত হয়ে মারা যাবো। আমার শুধু ভালো লাগছিল। বিছানার সাথে থাকা চেয়ারটাতে ফিবির কাপড়গুলো গুছিয়ে রাখা ছিল। ফিবি যথেষ্ট পরিচ্ছন্ন মেয়ে, অন্তত বাচ্চারা যতটুকু পরিচ্ছন্ন হতে পারে আর কী। মানে সে কখনোই তার কাপড়-চোপড় এখানে সেখানে ছুঁড়ে ফেলে রাখে না। ও অলস মেয়ে না। চেয়ারের মাথায় ঝুলিয়ে রেখেছিল কানাডা থেকে মায়ের কিনে দেওয়া তামাটে বর্ণের জ্যাকেটটা। আর তার জামা এবং অন্যান্য কাপড়গুলো গুছিয়ে রাখা ছিল চেয়ারের সিটে। চেয়ারের নিচে মেঝেতে তার জুতা আর মোজাগুলো। ঐ জুতাগুলো আগে কখনো দেখিনি। জুতাগুলো নতুন, গাঢ় বাদামী রঙের। কানাডা থেকে মায়ের কিনে দেওয়া জ্যাকেটটার সাথে খুবই মানানসই সেগুলো। আমার মায়ের কিছু জিনিস কেনার চোখ খুবই ভালো। মা কখনো ভালো আইসস্কেট বা এমনকিছু কিনতে পারে না, তবে পোশাকের ক্ষেত্রে মায়ের চোখ একদম নিখুঁত। মানে ফিবি সবসময়ই এমন এমন পোশাক পরে যেগুলো দেখলে অন্য যে কেউ হিংসা করতে পারে। বেশির ভাগ বাচ্চাদের পোশাকের অবস্থাই খারাপ থাকে, এমনকি তাদের বাবা-মা অনেক ধনী হলেও। এই দিক দিয়ে ফিবির কোনো চিন্তাই নেই।

এগিয়ে গিয়ে ডি.বি.র ডেস্কে বসে ডেস্কের জিনিসগুলোর দিকে তাকালাম। ডেস্কের বেশির ভাগ জিনিসই ফিবির স্কুলের। বেশির ভাগই বই। সবার ওপরে থাকা বইটার নাম অ্যারিথম্যাটিক ইজ ফান! বইটা হাতে নিয়ে মলাটটা উলটে দেখলাম প্রথম পৃষ্ঠায় লেখা—

ফিবি ওয়েদারফিল্ড কলফিল্ড
৪বি-১

ব্যাপারটা বেশ হাস্যকর। ফিবির মধ্য নাম জোসেফিন, ওয়েদারফিল্ড না। যদিও সে জোসেফিন নামটা অতটা পছন্দ করে না। সে জন্য প্রতিবারই বাসায় এসে দেখি সে নতুন কোনো মধ্যনাম রেখে বসে আছে।

অ্যারিথম্যাটিক বইটার নিচে ছিল জিওগ্রাফির বই, আর জিওগ্রাফির বইটার নিচে ছিল একটা স্পেলিং-এর বই। বানানে ফিবি খুবই ভালো। সে আসলে সব বিষয়েই ভালো, তবে স্পেলিং-এ সেরা। বানানের বইটার নিচে ছিল বেশ কয়েকটা নোটবুক। ফিবির আসলে কয়েক হাজার নোটবুক রয়েছে। আমার মনে হয় না অন্য কোনো বাচ্চার তার থেকে বেশি নোটবুক রয়েছে। ওপরে থাকা নোটবুকটা হাতে নিয়ে খুলে দেখি প্রথম পৃষ্ঠায় লেখা—

বার্নিস ছুটিতে আমার সাথে দেখা করবে

তোমার সাথে অনেক অনেক গুরুত্বপূর্ণ আলাপ আছে আমার

ঐ পৃষ্ঠায় শুধু ঐটুকুই লেখা ছিল।

পরের পৃষ্ঠায় লেখা—

দক্ষিণ পূর্ব আলাস্কায় এতো বেশি কৌটার ফ্যাক্টরি কেন?

কারণ ওখানে প্রচুর পরিমাণ স্যামন আছে।

ওখানে কেন বিশাল বন রয়েছে?

কারণ ওখানে দুঃস্বপ্ন রয়েছে।

আলাস্কার এস্কিমদের জীবনযাত্রা সহজ করার জন্য আমাদের সরকার কী করছে?

আগামীদিনের জন্য ওটাকে দেখে রাখছে।

ফিবি ওয়েদারফিল্ড কলফিল্ড

ফিবি ওয়েদারফিল্ড কলফিল্ড

ফিবি ওয়েদারফিল্ড কলফিল্ড

ফিবি ডব্লিউ কলফিল্ড

ফিবি ওয়েদারফিল্ড কলফিল্ড।

প্লিজ শার্লিকে দাও এটা!

শার্লি তুমি বলেছিলে তুমি ধনুরাশির কিন্তু তুমি তো বৃষরাশির, আমার বাসায় আসার সময় সাথে করে স্কেট নিয়ে আসবে।

ডি.বি.র ডেস্কে বসেই পুরো নোটবুকটা পড়লাম। পড়তে বেশি সময় লাগেনি আমার। আসলে ফিবি বা অন্য কোনো বাচ্চার নোটবুক আমি সারা দিন-রাত ধরে পড়তেও আমার ক্লান্তি লাগবে না। বাচ্চাদের নোটবুক খুবই হাস্যকর। পড়া শেষে একটা সিগারেট ধরালাম। ওটাই আমার শেষ সিগারেট ছিল। ঐদিন সারাদিনে আমি প্রায় তিন কার্টুনের মতো সিগারেট টেনেছি। যাই হোক, সিগারেট শেষ করে অবশেষে ফিবিকে ডেকে তুললাম। মানে আমার পক্ষে তো সারাদিনই আর ডেস্কে বসে থাকা সম্ভব ছিল না। তাছাড়া যেকোনো সময় আমার বাবা-মায়েরও ঘুম থেকে জেগে উঠার শঙ্কা ছিল। আমি শুধু চাচ্ছিলাম ধরা পড়ে যাওয়ার আগে ফিবিকে শুধু একবার হ্যালো বলতে, যদি ধরা পড়ে যাই আর কী। সেজন্যই ফিবির ঘুম ভাঙিয়েছিলাম।

তাকে ঘুম থেকে তোলাটা খুবই সহজ। মানে তাকে জাগানোর জন্য অত জোরে ডাকা লাগে না। বলতে গেলে শুধু তার মাথার পাশে বসে আস্তে করে, ‘উঠো, ফিবি’ বললেই সে ঘুম থেকে উঠে যায়।

‘হোল্ডেন!’ ঘুম থেকে জেগেই বলে আমাকে হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরলো ফিবি। সে খুবই আদুরে মেয়ে। মানে বাচ্চারা যতটুকু আদুরে হয় আর কী। আমি তাকে আলতো করে চুমু খেলাম। এরপর ফিবি বলল, ‘তুমি বাসায় এসেছো কখন?’ আমাকে দেখে প্রচণ্ড খুশি ছিল ও। তাকে দেখেই সেটা বুঝা যাচ্ছিল।

‘আস্তে বলো। মাত্রই এসেছি। কী অবস্থা তোমার?’

‘আমি ভালো আছি। তুমি আমার চিঠি পেয়েছিলে? আমি তোমাকে পাঁচ- পৃষ্ঠার — ‘

‘হ্যাঁ—এতো জোরে কথা বলো না। ধন্যবাদ চিঠির জন্য।

ফিবি আমাকে একটা চিঠি পাঠিয়েছিল। যদিও আমি তাকে ওটার জবাব দেবার সুযোগ তখনো পাইনি। চিঠিতে সে তার স্কুলের একটা নাটক নিয়ে লিখেছিল। সে আমাকে বলেছিল আমি যেন শুক্রবারে কোনো ডেটে না গিয়ে বা কোনো কিছুতে ব্যস্ত না হয়ে তাদের নাটকটা দেখতে যাই।

‘নাটকের কী অবস্থা?’ জিজ্ঞেস করলাম। ‘ওটার নাম যেন কী বলেছিলে?’

‘অ্যা ক্রিসমাস প্যাজেন্ট ফর আমেরিকানস। নাটকটা খুবই বাজে, তবে আমি বেনেডিক্ট আর্নল্ড। নাটকের সবচেয়ে বড়ো পার্টটাই আমার,’ ও বলল। খোদা, সে ততক্ষণে আসলেই পূর্ণ সজাগ হয়ে গিয়েছিল। তার ব্যাপারে কিছু বলার সময় সে সবসময়ই খুব উত্তেজিত হয়ে থাকে। ‘আমি মরে যাচ্ছি—এই দৃশ্য দিয়েই শুরু হবে নাটক। তারপর ক্রিসমাসে ইভে এক গোস্ট এসে আমাকে জিজ্ঞেস করবে আমি কি লজ্জিত কি না। জানোই তো, মানে আমার দেশের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করার জন্য আমি লজ্জিত কি না। তুমি কি আসবে নাটকটা দেখতে?’ সে ততক্ষণে শোয়া থেকে বিছানায় উঠে বসেছে। ‘আমি তোমাকে এটার ব্যাপারেই লিখে জানিয়েছি। তুমি আসবে?’

‘অবশ্যই আমি আসব। নিঃসন্দেহেই আসবো।’

‘বাবা যেতে পারবে না। বাবাকে ক্যালিফোর্নিয়ায় যেতে হবে,’ ও বলল। খোদা, সে আসলেই পূর্ণ সজাগ হয়ে গিয়েছিল। তার এভাবে পুরোপুরি সজাগ হতে দুই সেকেন্ডও লাগে না। সে বিছানায় হাঁটুতে বসে আমার হাতটা ধরে রেখেছিল। ‘শুনো, মা বলেছিল তুমি বুধবার বাসায় আসবে,’ সে বলল। ‘বুধবারের কথা বলেছিল।’

‘আমি আগেই চলে এসেছি। এখন বেশি জোরে কথা বলো না। এতো জোরে জোরে কথা বললে সবার ঘুম ভেঙে যাবে।’

‘কয়টা বাজে এখন? মা বলেছিল তাদের বাসায় আসতে অনেক রাত হবে। কানেটিকাটের নরওয়াকে একটা পার্টিতে গেছে বাবা-মা,’ ফিবি বলল। ‘বলো তো বিকেলে আমি কী করেছি? কোন মুভিটা দেখেছি? আন্দাজ করো।’

‘আমি জানি না—শুনো, তারা কোন সময় ফিরবে সেটা কি বলে— ‘

‘দ্য ডক্টর দেখেছি,’ ফিবি বলল। ‘লিস্টার ফাউন্ডেশনে তারা এই বিশেষ মুভিটা এনেছে। মাত্র একদিনের জন্য ছিল ওটা। আজকেই ছিল ঐ দিনটা। মুভিটা ছিল কেন্টাকির একটা ডাক্তারকে নিয়ে যে পঙ্গু ও হাঁটতে না পারা বাচ্চাকে কম্বল দিয়ে চেপে মেরে ফেলেছিল। তারপর এর জন্য কর্তৃপক্ষ তাকে জেলে নিয়ে যায়। মুভিটা খুব ভালো ছিল।’

‘একটু শুনো তো, তারা কি বলে যায়নি তারা কোন সময় ফির…’

‘পঙ্গু বাচ্চা মেয়েটার জন্য প্রচুর মায়া ছিল তার, মানে ডাক্তারটার। সে জন্যই সে মেয়েটা কম্বল দিয়ে চেপে মেরে ফেলেছিল। তারপর পুলিশ তাকে ধরে নিয়ে যায়, যাবজ্জীবনের সাজা হয় তার। তবে খুন করা ওই বাচ্চা মেয়েটা সবসময়ই তাকে জেলে এসে দেখে যেতো, তাকে ধন্যবাদ জানাতো তার উপকারের জন্য। ডাক্তারটা আসলে দয়ালু খুনি ছিল। সে জানতো তার জেলে থাকা উচিৎ কারণ ঈশ্বরের থেকে কাউকে ছিনিয়ে আনার কোনো অধিকার তার নেই। আমার ক্লাসের বন্ধু অ্যালিস হোমবোর্গের মা নিয়ে গিয়েছিল আমাদের। সে আমার বেস্ট ফ্রেন্ড। পুরো ক্লাসে মধ্যে সেই একমাত্র মেয়ে যে— ‘

‘একটু থামবে?’ বললাম। ‘আমি একটা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করেছি তোমাকে? বাবা-মা কি তোমাকে বলে গেছে তারা ঠিক কয়টায় ফিরবে?’

‘না, তবে অনেক রাতের আগে ফিরবে না। বাবা গাড়ি নিয়ে গেছে যাতে আসার সময় ট্রেন নিয়ে দুঃশ্চিন্তা না করা লাগে। আমাদের গাড়িতে এখন রেডিও আছে। তবে মা বলেছে রাস্তায় গাড়ি চালানোর সময় ওটা কেউ বাজাতে পারে না।’

শুনে কিছুটা স্বস্তি পেলাম। মানে শেষমেশ ধরা পড়ার পর কি হবে এই শঙ্কাটা পুরোপুরি দূর হয়ে গিয়েছিল আমার মধ্য থেকে। তারা যদি আমাকে ধরেও ফেলে, ধরে ফেলুক, তাতে আর কিছু যাবে আসবে না।

ফিবিকে তখন দেখতে খুবই সুন্দর লাগছিল। নীল রঙের একটার পাজামা মানে নাইট ড্রেস পরে রেখেছিল। ওটার কলারে লাল রঙের হাতির ছবি ছিল। হাতি খুব পছন্দ করত ফিবি।

‘তো, মুভিটা খুবই ভালো ছিল, তাই না?’ বললাম।

‘হ্যাঁ, তবে অ্যালিসের সর্দি লেগেছে, আর তার মা পুরোটা সময়ই তাকে জিজ্ঞেস করেছে যে তার জ্বর আসছে কি না। সেটাও আবার একদম মুভি চলার সময়ে। প্রতিবারই গুরুত্বপূর্ণ দৃশ্যগুলোর সময় তার মা আমার ওপর দিয়ে ঝুঁকে অ্যালিসকে জিজ্ঞেস করেছে তার জ্বর আসছে কি না। প্রায় রাগই উঠে গিয়েছিল আমার তখন।’

এরপর তাকে রেকর্ডের ব্যাপারে বললাম। ‘তোমার জন্য একটা রেকর্ড কিনেছি। তবে বাসায় আসার সময় হাত থেকে পড়ে গিয়ে ওটা ভেঙে গেছে।’ আমার পকেট থেকে ভাঙা টুকরোগুলো বের করে ওকে দেখালাম। ‘আমি তখন ড্রাংক ছিলাম,’ বললাম।

‘টুকরোগুলো দাও আমাকে,’ সে বলল। ‘আমি ওগুলো জমিয়ে রাখবো।’ বলেই খপ করে আমার হাত থেকে টুকরোগুলো নিয়ে তার নাইট টেবিলের ড্রয়ারে রেখে দিলো। ও আসলেই খুব মজার মানুষ।

‘ডি.বি. কি ক্রিসমাসে আসবে?’ জিজ্ঞেস করলাম।

‘মা বলেছে, আসতেও পারে, নাও আসতে পারে। নিশ্চিত না। তার হয়তো হলিউডেই থাকা লাগতে পারে, অ্যানাপোলিস নিয়ে একটা মুভি লেখার কথা ওর।’

‘অ্যানাপোলিস, ওহ খোদা!’

‘এটা নাকি একটা লাভ স্টোরি। আন্দাজ করো তো ঐ মুভিতে কে আছে? কোন মুভি স্টার রয়েছে ওটাতে?’

‘আমার এটা নিয়ে আগ্রহও নেই। অ্যানাপোলিস। ডি.বি. অ্যানাপোলিস নিয়ে কতটুকু জানে? সে যে ধরনের গল্প লিখে তার সাথে এটার সম্পর্ক কী?’ বললাম। ব্যাপারটায় খুবই বিরক্ত হচ্ছিলাম। হারামি হলিউড! ‘তোমার হাতে কী হয়েছে?’ ফিবির হাতের কনুইয়ে লাগানো টেপটার দিকে নির্দেশ করে বললাম। তার নাইট ড্রেসের হাতার আড়ালে ছিল না বলেই ওটা চোখে পড়েছে আমার।

‘পার্কের সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় আমাদের ক্লাসের কার্টিস ওয়েইট্রব নামের এক ছেলে আমাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছিল,’ ও বলল। ‘দেখবে কতটুকু ব্যথা পেয়েছি?’ কথা বলতে বলতেই সে হাত থেকে টেপ খোলা শুরু করে দিয়েছিল।

‘ওটা ওভাবেই রাখো। সে তোমাকে ধাক্কা দিয়েছিল কেন?’

‘আমি জানি না। মনে হয় সে আমাকে ঘৃণা করে,’ ফিবি বলল। ‘সেলমা অ্যাটারবুরি আর আমি দুইজন মিলে তার উন্ডব্রেকারে কালি লাগিয়ে দিয়ে এসেছি।’

‘এটা তো ভালো না। তুমি কি বাচ্চা নাকি?’

‘না, তবে প্রতিবারই পার্কে গেলে ছেলেটা আমাকে ফলো করে। সে সবসময়ই আমাকে ফলো করে। আমার খুবই ভয় লাগে ছেলেটাকে।

‘হয়তো সে তোমাকে পছন্দ করে। কালি লাগানোর কোনো কারণ ছিল না—’

‘আমি চাই না সে আমাকে পছন্দ করুক,’ বলে আমার দিকে অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকালো ফিবি। ‘হোল্ডেন,’ ও বলল, ‘তুমি বুধবারের আগে বাসায় আসলে কীভাবে?’

‘কী?’

খোদা, ফিবি খুবই চালাক ছিল। তার থেকে কিছুই লুকানো সম্ভব না। যদি কেউ ভেবে থাকে তার কোনো বুদ্ধি নেই, তাহলে সে একটা পাগল।

‘তুমি বুধবারের আগে বাসায় আসলে কীভাবে?’ জিজ্ঞেস করল ফিবি। ‘তোমাকে স্কুল থেকে বেরটের করে দেয়নি তো?’

‘আমি তো তোমাকে বলেছিই। তারা আমাদেরকে আগে ছুটি দিয়েছে। তারা আমাদের পুরো স্কুল—’

‘তোমাকে বের করে দিয়েছে না?’ বলে আমার পায়ে ঘুষি মারলো। কেউ খারাপ কিছু করলে প্রচুর রাগ উঠে যায় ওর। ‘তোমাকে বের করে দিয়েছে, হোল্ডেন!’ বলে হাত দিয়ে মুখ চেপে ধরলো। সে খুবই আবেগী এক মেয়ে।

‘কে বলেছে আমাকে বের করে দিয়েছে? কেউ তো বলেনি—’

‘তোমাকে বের করে দিয়েছে, আমি জানি,’ বলে আবারো আমাকে ঘুষি মারলো। কেউ যদি ভেবে থাকে ওর ঘুষিতে ব্যথা লাগে না, তাহলে সে কখনোই তার ঘুষি খায়নি। ‘বাবা তোমাকে মেরে ফেলবে।’ ও বলল। এরপর মাথায় বালিশ চাপা দিয়ে বিছানায় উলটো হয়ে শুয়ে পড়লো। সে প্রায়ই এই কাজটা করে। মাঝেমধ্যে আসলেই পাগলের মতো হয়ে যায়।

‘এই থামো তো এখন,’ বললাম। ‘কেউই আমাকে মারবে না। এমনকি কেউ আমাকে—এই ফিবি, মাথার ওপর থেকে বালিশ সরাও। কেউ মারবে না আমাকে।’

তবে সে বালিশ সরালো না। আসলে সে নিজে থেকে না চাইলে তাকে দিয়ে কিছু করানো সম্ভব না। সে বারবারই বলে যাচ্ছিল, ‘বাবা তোমাকে মেরে ফেলবে।’ অবশ্য বালিশ চাপা দিয়ে রাখায় তার কথা অতটা ভালো ভাবে বুঝাও যাচ্ছিল না।

‘কেউই আমাকে মারবে না। কারণ প্রথমত আমি এখান থেকে চলে যাচ্ছি। ভালো করে শুনো, আমি হয়তো যেখানে সেখানে গিয়ে কোনো র‍্যাঞ্চে-ট্যাঞ্চে কাজ পেয়ে যাবো। আমি এক লোককে চিনি কলোরাডোতে যার দাদার একটা র‍্যাঞ্চ। আমি হয়তো সেখানে কাজ পেয়ে যাবো,’ বললাম। ‘যদি আমি যাই, তাহলে চলে যাওয়ার পরও তোমার সাথে যোগাযোগ রাখবো। মাথার ওপর থেকে ওটা সরাও। হেই, ফিব, প্লিজ?’

সে তবুও সরালো না। টেনে বালিশটা সরানোর চেষ্টা করলাম। যতই চেষ্টা করছিলাম ততই শক্তি বাড়াচ্ছিল ও। তার সাথে লড়াই করে আসলে জেতা সম্ভব না। সে যদি মাথার ওপর বালিশ চাপা দিয়ে রাখতে চায়, তাহলে সে সেটা রাখবেই। ‘ফিবি, প্লিজ, শান্ত হও,’ ক্রমাগত বলেই যাচ্ছিলাম। ‘হেই, হেই, ওয়েদারফিল্ড, প্লিজ।’

তারপরও সে সরালো না। মাঝেমধ্যে আসলে তাকে তেল মারলেও কোনো কাজ হয় না। শেষমেশ ওখান থেকে উঠে লিভিং রুমের টেবিলে থাকা বাক্সটা থেকে কয়েকটা সিগারেট নিয়ে পকেটে ভরে নিলাম। আমার সিগারেট একদম শেষ হয়ে গিয়েছিল তখন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *