দ্য ক্যাচার ইন দ্য রাই – ১৫

অধ্যায় পনেরো

বেশিক্ষণ ঘুমাইনি। যখন ঘুম থেকে উঠি তখন প্রায় সকাল দশটার মতো বাজে। ঘুম থেকে উঠে সিগারেট ধরাতেই প্রচণ্ড ক্ষুধা লাগলো। ব্রোসার্ড আর অ্যাকলির সাথে অ্যাগারস্টাউনে মুভি দেখার সময় যে দুটো হ্যামবার্গার খেয়েছিলাম, তারপর থেকে আর কিছুই খাইনি। কিন্তু সেটা তো অনেক আগের ঘটনা। আমার কাছে মনে হচ্ছিল যেন ওটা পঞ্চাশ বছর আগের ঘটনা। পাশেই ফোন ছিল। ভাবছিলাম ফোন করে নিচ থেকে রুমে খাবার পাঠিয়ে দেওয়ার কথা বলবো। কিন্তু ভয় লাগছিল যে তারা হয়তো খাবার দিতে মরিসকে পাঠাবে মরিসের চেহারা আরেকবার দেখার খুব একটা ইচ্ছা ছিল না আমার। তাই ফোন না করে বিছানায় শুয়েই আরেকটা সিগারেট ধরালাম। ভাবছিলাম জেনকে ফোন দেবো, ফোন দিয়ে জানতে চাইবো সে বাসায় এসেছে কি না, তবে কেন যেন ওকে ফোন দেওয়ার মুড ছিল না।

শেষমেশ স্যালি হায়েসকে ফোন দিলাম। জানি সে বাসায় আছে, কারণ কয়েক সপ্তাহ আগে আমাকে চিঠি লিখে এটাই জানিয়েছিল ও। তাকে নিয়ে আমার যে খুব একটা আগ্রহ ছিল না, তবে তাকে অনেক লম্বা সময় ধরে চিনি একসময় তাকে অনেক বুদ্ধিমান মনে করতাম, ওটা আমার অজ্ঞতা ছিল। আমি তাকে জ্ঞানী ভাবতাম কারণ তার থিয়েটার, মঞ্চনাটক এবং সাহিত্য নিয়ে বেশ জানাশোনা ছিল। কারো যদি এসব বিষয়ে আগ্রহ থাকে তখন সে আসলেই চালাক না গর্দভ সেটা বুঝতে প্রচুর সময় লেগে যায়। আর স্যালির ক্ষেত্রে এটা বুঝতে আমার কয়েক বছর লেগেছিল। তার সাথে যদি আমি ডেট না করতাম তাহলে হয়তো এটা আরো অনেক আগে বুঝে যেতাম। আমার বড়ো সমস্যা এটাই, কারো সাথে ডেট করলে তাকে প্রচুর জ্ঞানী ব্যক্তি মনে করি। ব্যাপারটা এমন না যে আমার সাথে ডেট করে বলেই তারা চালাক, তবে আমি কেন যেন এমনটাই ভাবতাম।

যাই হোক তাকে ফোন দিলাম। প্রথমে তাদের কাজের লোক ফোন ধরল। তারপর তার বাবা। এরপর স্যালি। ‘স্যালি?’ সে ফোনে আসার পর বললাম।

‘হ্যা—কে বলছেন?’ স্যালি বলল। স্যালির কণ্ঠে সবসময়ই কৃত্রিমতার ছাপ থাকত। সে ফোনে আসার আগে তার বাবাকে কিন্তু ঠিকই বলেছিলাম আমি কে।

‘হোল্ডেন কলফিল্ড। কেমন আছো তুমি?’

‘হোল্ডেন! আমি ভালোই আছি। তুমি কেমন আছো?’

‘ভালো। শুনো, এমনিতে কেমন আছো তুমি? মানে স্কুলের দিক দিয়ে?’

‘ভালোই,’ সে বলল। ‘মানে—তুমি তো জানোই।

‘ভালো। আচ্ছা, শুনো, আমি চিন্তা করছিলাম তুমি আজকে ফ্রি আছো কি না। আজকে রবিবার। তবে রবিবারেও তো একটা-দুটো ম্যাটিনি শো চলে। তুমি কি যাবে আমার সাথে?’

‘অবশ্যই। চমৎকার।’

চমৎকার। আমি যদি কোনো শব্দ ঘৃণা করে থাকি, তাহলে সেই শব্দটা হলো চমৎকার। শব্দটা শুনলেই কৃত্রিম মনে হয়। এক মুহূর্তের জন্য আমার মনে হচ্ছিল যে তাকে ম্যাটিনিতে আসতে মানা করে দিই। তারপরও আরো কিছুক্ষণ কথা বললাম আমরা। মানে স্যালি কথা বলল আর কী। প্ৰথমে সে বলল এক হার্ভার্ডের ছেলের কথা—সম্ভবত ফ্রেশম্যান ইয়ারের ছেলে। তবে স্বাভাবিকভাবেই সেটা সে নির্দিষ্ট করে বলেনি। এটাই বলেছে, ছেলেটা নাকি তার সাথে সিরিয়াস রিলেশন গড়ার জন্য খুব তাড়াহুড়ো করছে। সবসময়ই নাকি তাকে ফোন দেয়, রাত-দিন কোনো সময়ই ক্ষান্ত দেয় না। ব্যাপারটা বেশি ভালো লাগলো না আমার যদিও। এরপর সে বলা শুরু করল ওয়েস্ট পয়েন্ট ক্যাডেটের আরেকটা ছেলেকে নিয়ে। ঐ ছেলেটাও নাকি তার জন্য খুব পাগল হয়ে আছে। স্যালির কাছে এগুলো খুবই বড়ো বিষয়। যাইহোক, শেষমেশ তাকে বললাম দুপুর দুইটার দিকে বাল্টিমোরের ঘড়ির নিচে আমার সাথে দেখা করতে। আর আসতে যেন সে দেরি না করে, কারণ শো শুরু হওয়ার কথা আড়াইটার দিকে। স্যালির একটা বদঅভ্যাস হলো সে সবসময়ই দেরি করে। কথা শেষ করে ফোন রেখে দিলাম। মেয়েটা খুবই যন্ত্রণাদায়ক, তবে দেখতে বেশ সুন্দরী ও।

স্যালির সাথে ডেট ফিক্সড করার পর বিছানা থেকে নেমে কাপড় পরে ব্যাগটা গুছিয়ে নিলাম। রুম থেকে বেরুনোর আগে জানালা দিয়ে নিচের দিকে তাকালাম দুঃশ্চরিত্র লোকগুলো কী করছে দেখতে। তবে তারা তখন ভদ্রতার মুখোশের আড়ালে ছিল। সকালটা তাদের কৃত্রিম ভদ্রতার আলোতে মুখরিত হয়েছিল। যাইহোক, কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে রুম থেকে বেরিয়ে এলিভেটরের দিকে গেলাম। চারপাশে একবার তাকিয়ে দেখলাম মরিস আছে কি না। যদিও তার সাথে আরেকবার দেখা হওয়ার কোনো ইচ্ছা আমার ছিল না।

হোটেল থেকে বেরিয়ে একটা ট্যাক্সি ক্যাবে উঠলাম। যদিও আমার বিন্দুমাত্রও ধারণা ছিল না যে কোথায় যাব। আমার যাওয়ার মতো কোনো গন্তব্য ছিল না। ওটা মাত্র রবিবার। বুধবারের আগে বাসায় ফেরা সম্ভব না, আগেভাগে গেলেও হয়তো মঙ্গলবারের আগে যাওয়া যাবে না। আর নিশ্চিতভাবেই আমার অন্য কোনো হোটেলে উঠে আরেকবার মার খাওয়ার কোনো ইচ্ছা ছিল না। তাই ড্রাইভারকে বললাম আমাকে গ্র্যান্ড সেন্ট্রাল স্টেশনে নিয়ে যেতে। জায়গাটা বাল্টিমোরের খুব কাছেই। ভাবলাম যে ওখানে নেমে ওখানের নিরাপদ বাক্সগুলোতে ব্যাগগুলো রেখে নাস্তা করে নেবো। প্রচণ্ড ক্ষুধা লেগেছিল। ক্যাবের ভেতর বসে ওয়ালেটটা বের করে টাকাগুলো গুনে নিলাম একবার। ঠিক মনে ছিল না এর আগে ওয়ালেটে ঠিক কত টাকা ছিল, তবে এটা আসলে ভালো কিছু ছিল না। গত দুই সপ্তাহে আমি প্রচুর টাকা খরচ করেছি। আসলেই প্রচুর টাকা। আমার খরচের হাত অনেক লম্বা। আর যেসব টাকা খরচ না করি, সেগুলো হারিয়ে ফেলি। বেশির ভাগ সময়ই হোটেল, রেস্টুরেন্ট, নাইট ক্লাবে গেলে আমি খুচরা টাকা ফেরত নেই না। এতে আমার বাবা-মা আমার ওপর প্রচুর বিরক্ত হয়। তাদেরকে অবশ্য দোষ দেওয়ার উপায় নেই। যদিও আমার বাবার টাকার কোনো অভাব নেই। আমি নিজেও জানি না বাবা ঠিক কত টাকা উপার্জন করে। বাবা কখনোই আমার সাথে এসব নিয়ে আলোচনা করে না। তবে আমার ধারণা বাবার উপার্জন অনেক বেশি। বাবা একজন আইনজীবি। এই পেশায় টাকার কোনো অভাব নেই। তবে বাবার যে প্রচুর টাকা আছে সেটা বুঝার আরেকটা কারণ হলো বাবা সবসময়ই ব্রডওয়ে শোতে টাকা ইনভেস্ট করে। যদিও শোগুলো সবসময়ই ফ্লপ খায়। বাবার এই অভ্যাসটা মা খুব একটা পছন্দ করে না। আমার ভাই এলি মারা যাওয়ার শোকটা মা খুব একটা কাটিয়ে উঠতে পারেনি। সবসময়ই একটা উদ্বেগ কাজ করে মায়ের মধ্যে। আমি আরেকটা স্কুল থেকে বহিষ্কার হয়েছি শুনলে মায়ের অবস্থা কী হবে ভেবে নিজের ওপরই নিজের ঘৃণা হচ্ছিল তখন।

স্টেশনের বাক্সগুলোর একটায় আমার ব্যাগগুলো রেখে একটা স্যান্ডউইচ বার অ্যান্ড বেড ব্রেকফাস্টে ঢুকলাম নাস্তা করার জন্য। নাস্তায় প্রচুর খাবার খেলাম, অন্তত আমার জন্য পরিমাণটা প্রচুরই ছিল—অরেঞ্জ জুস, বেকন, ডিম, টোস্ট, কফি। সাধারণত আমি নাস্তায় শুধু অরেঞ্জ জুসই খাই। আমি খাই খুবই কম। আসলেই খুব কম খাই। সেজন্যই তো আমি এমন কাঠির মতো শুকনা। আমার জন্য নির্ধারিত ডায়েট হলো প্রচুর পরিমাণ স্টার্চ আর হাবিজাবি খাবার, যাতে আমার শরীরের ওজন কিছুটা বাড়ে। কিন্তু আমি কখনোই সেই ডায়েট মেনে চলি না। বাইরে গেলে বেশির ভাগ সময়ই সুইস চিজ স্যান্ডউইচ আর শিরা মেশানো দুধ খাই। খাবার খুব একটা ভারি না, তবে দুধ থেকে প্রচুর পরিমাণ ভিটামিন পাওয়া যায়। এইচ ভি কলফিল্ড—হোল্ডেন ভিটামিন কলফিল্ড।

ডিম খাওয়ার সময় দেখলাম দুই নান স্যুটকেস নিয়ে এসে কাউন্টারে আমার পাশে বসলো। আন্দাজ করলাম তারা হয়তো এক উপসনালয় থেকে আরেক উপসনালয়ে যাচ্ছে আর ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করছে। কাউন্টারে এসেই তারা বিপাকে পড়ে গেল স্যুটকেস নিয়ে কী করবে তা ভেবে। তাই আমি তাদেরকে সাহায্য করলাম স্যুটকেসগুলো ভালোমতো রাখাতে। তাদের স্যুটকেসগুলো ছিল খুবই কমদামি। আমি জানি এটা খুব একটা গুরুত্বপূর্ণ কিছু না, তবে কারো সাথে কমদামি স্যুটকেস দেখাটা আমি সহ্য করতে পারি না। জানি এটা শুনতে খারাপ শোনাচ্ছে, তবে এমনকি ঐসব মানুষকে ঘৃণাও করে বসি তাদের সাথে কমদামি স্যুটকেস আছে দেখলে। এমনটা আগেও একবার হয়েছিল। এল্কটন হিলসে পড়াকালে স্বল্প সময়ের জন্য ডিক স্ল্যাগল নামের একটা ছেলে আমার রুমমেট ছিল। তার স্যুটকেসগুলো ছিল খুবই সস্তা। সে ওগুলো তাকে রাখার বদলে সবসময়ই রাখতো বিছানার নিচে, যাতে কেউই আমার স্যুটকেসের পাশে তার স্যুটকেসগুলো দেখতে না পারে। ব্যাপারটা আমাকে খুবই হতাশ করত, মাঝেমধ্যে আমার ইচ্ছা করত ওগুলো বের করে এনে আমারগুলোর সাথে বদল করে দিই। আমার স্যুটকেসগুলো মার্ক ক্রসের, গরুর আসল চামড়ায় তৈরি। আমার মনে হয় এগুলোর দামও প্রচুর। যাই হোক, ব্যাপারটা বেশ মজার ছিল। কী ঘটেছিল সেটা বলছি। স্ল্যাগলের দেখাদেখি একদিন থেকে আমি আমার স্যুটকেসগুলো তাকে রাখার বদলে খাটের নিচে রাখতে শুরু করলাম। আমি এই কাজটা করেছিলাম যাতে স্ল্যাগল নিজেকে ছোটো না ভাবে। তবে এরপর সে কী করল? আমি খাটের নিচে রাখা শুরুর পর থেকে সে তার স্যুটকেসগুলো বের করে রাখা শুরু করল তাকের ওপর। তার এমনটা করার কারণ বুঝতে বেশ সময় লেগেছিল আমার। সে এই কাজটা করেছিল যাতে মানুষ তার ব্যাগগুলোকে আমার ব্যাগ মনে করে। আসলেই তার উদ্দেশ্য ছিল এটা। খুবই অদ্ভুত একটা ছেলে ছিল ও। সে সবসময়ই আমার স্যুটকেসগুলোর ব্যাপারে ক্ষুব্ধ ক্ষুব্ধ মন্তব্য করত। সবসময়ই বলত আমার ব্যাগগুলো নাকি অনেক বেশি নতুন আর মধ্যম শ্রেণির। শব্দটা তার খুবই প্রিয় ছিল। সে হয়তো কোথাও ঐ শব্দটা পড়েছিল নয়তো শুনেছিল। আমার কাছে থাকা সব জিনিসই নাকি মধ্যম শ্রেণির ছিল। এমনকি আমার ফাউন্টেন পেনটাও নাকি মধ্যম শ্রেণির ছিল। যদিও সে সবসময়ই ওটা ধার নিতো আমার থেকে, তারপরও ওটা মধ্যম শ্রেণির ছিল। আমরা মাত্র দুইমাস এক রুমে ছিলাম। এরপর দুইজনই অন্য রুমে সরে যাওয়ার আবেদন করেছিলাম। মজার ব্যাপারটা হলো, রুম থেকে সরে আসার পর আমি তাকে কিছুটা মিস করতাম। কারণ তার সেন্স অব হিউমার বেশ ভালো ছিল, আর মাঝেমধ্যে আমরা বেশ মজাও করতাম। হয়তো সেও আমাকে মিস করত। এটাতে আমার অবাক হওয়ার কিছু নেই। প্রথম দিকে সে মজা করার জন্য মধ্যম শ্রেণির শব্দটা বলত, আর আমিও তাতে পাত্তা দিতাম না। এটা আসলেই বেশ মজার ছিল। তবে একটা সময় তার কণ্ঠে আর বিদ্রুপের স্বরটা ছিল না। আসলে ব্যাপারটা হলো, নিজের সাথে কারো থেকে ভালো মানের দামি স্যুটকেস থাকে তাহলে তাদের রুমমেট হওয়াটা বেশ কঠিন ব্যাপার। মানুষ মনে করে কেউ যদি জ্ঞানী হয় এবং ভালো সেন্স অব হিউমার থাকে, তাহলে তারা হয়তো অন্য কারো স্যুটকেস কেমন সেটা নিয়ে খুব একটা ভাবে না। কিন্তু আসলে ব্যাপারটা হলো তারা ওটা নিয়ে ভাবে, প্রচুর পরিমাণ ভাবে। স্ট্র্যাডলেটারের মতো হারামজাদাকে আমার রুমমেট হিসেবে বেছে নেওয়ার একটা মূল কারণও এটা। তার স্যুটকেসগুলোও আমার মতোই ভালো মানের।

যাইহোক, পাশে বসা দুই নানের সাথে আমার কথাবার্তা বেশ ভালোই জমে উঠেছিল। আমার ঠিক পাশেই বসা নানের হাতে ছিল খড়ের তৈরি একটি ঝুড়ি। ক্রিসমাসের সময়ে নান এবং স্যালভেশন আর্মির মেয়েদের সাধারণত এসব নিয়েই টাকা সংগ্রহ করতে দেখা যায়। রাস্তায় বেরুলেই দেখা যায় ওদের। বেশি দেখা যায় ফিফথ অ্যাভিনিউয়ের বড়ো বড়ো ডিপার্টমেন্ট স্টোরের সামনে। যাই হোক, আমার পাশে বসা মহিলার হাত থেকে বাস্কেটটা একসময় নিচে পড়ে গিয়েছিল। আমি ওটা নিচ থেকে তুলে আবার মহিলার হাতে দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম তারাও কি কোনো দাতব্য প্রতিষ্ঠানের জন্য টাকা সংগ্রহ করছে কি না। মহিলা জানালো যে না, তারা টাকা সংগ্রহ করছে না। স্যুটকেসে এই ঝুড়িটা রাখার কোনো জায়গা ছিল না বলেই এটা হাতে করে নিয়ে ঘুরছে। কথা বলার সময় মহিলার মুখে ফুঁটে উঠা হাসিটা বেশ সুন্দর ছিল। নাকটা বেশ বড়ো ছিল মহিলার, আয়রন রিমের একটা চশমাও ছিল মহিলার চোখে। চশমাটা যদিও আকর্ষণীয় ছিল না, তবে মহিলার চেহারাটা ছিল খুবই মিষ্টি। ‘আমি ভেবেছিলাম আপনারা কালেকশন করছেন,’ বললাম। ‘আমি আসলে একটা ছোটোখাটো ডোনেশন দিতে চাচ্ছিলাম। কালেকশন শুরু করলে আপনারা আমার অংশটা ওটার সাথে যুক্ত করে দিতে পারেন।’

‘খুবই মহৎ ইচ্ছা,’ মহিলা বলল। আমার কথা শুনে চশমাপরা মহিলার পাশে থাকা অন্য নানও তাকালো আমার দিকে। ঐ নানটা তখন কালো ছোটো একটা বই পড়ছিল আর কফি খাচ্ছিল। বইটাকে দেখে বাইবেলের মতোই লাগছিল, তবে ওটা অনেক চিকন ছিল। যদিও বইটা বাইবেলের মতোই একটা বই ছিল। তারা দুইজন নাস্তায় শুধু টোস্ট আর কফিই খাচ্ছিল। ব্যাপারটা বেশ খারাপ লাগছিল আমার কাছে। বিশেষ করে আমি যেখানে তাদের সাথে বসেই খাচ্ছিলাম বেকন আর ডিম।

অনেক জোরাজুরি করে দশ ডলার ডোনেট করলাম। নান দুইজন বারবারই জিজ্ঞেস করছিল যে এতো টাকা দিয়ে দেওয়ার পর আমি কি নিজের খরচ সামলাতে পারবো কি না। তাদেরকে বলেছিলাম যে আমার সাথে যথেষ্ট পরিমাণ টাকাই আছে, তবে তারা এটা খুব একটা বিশ্বাস করতে পারেনি। যাইহোক, শেষমেশ টাকাটা তারা গ্রহণ করেছিল। তারা দুইজনই আমাকে প্রচুর ধন্যবাদ দিল। এতো ধন্যবাদ দিচ্ছিল যে নিজের কাছেই খুব লজ্জা লাগছিল। ব্যাপারটা চাপা দেওয়ার জন্য আমি তাদেরকে জিজ্ঞেস করলাম যে তারা কোথায় যাচ্ছে। জবাবে জানালো, তারা স্কুল টিচার, কিছুক্ষণ আগেই শিকাগো থেকে এসেছে ওখানে ওয়ান সিক্সটি-এইটথ বা ওয়ান এইটি-সিক্সথ স্ট্রিটের একটা স্কুলে জয়েন করার জন্য। আমার পাশে বসা মানে চশমাপরা নান আমাকে বলল সে ইংরেজির শিক্ষক আর অন্যজন পড়ায় ইতিহাস এবং আমেরিকান সরকার নিয়ে। এরপর আমার মাথায় একটা অদ্ভুত ভাবনা খেলে গেল। মহিলা একজন নান, আবার ইংরেজিও পড়ায়। স্বাভাবিকভাবে এরজন্য মহিলাকে প্রচুর ইংরেজি বই পড়া লাগে। বইগুলোর সবগুলোতেই যে যৌন উত্তেজনাকর বিষয় থাকে তা নয়, কিন্তু প্রেমময় অনেক কিছুই থাকে বইগুলোতে। এই যেমন থমাস হার্ডির দ্য রিটার্ন অব দ্য নেটিভ বইয়ের ইউস্টেসিয়া ভাইয়ের কথাই ধরা যাক। ইউস্টেসিয়া খুব একটা আবেদনময়ী বা এমন কিছু ছিল না, কিন্তু তারপরও ভেবে কুল পাচ্ছিলাম না ইউস্টেসিয়াকে নিয়ে পড়ার সময় একজন নানের ভাবনা কী হতে পারে। যদিও আমি এটা নিয়ে মহিলাকে কিছু জিজ্ঞেস করিনি। স্বাভাবিকভাবেই, এমন কিছু জিজ্ঞেস করা ঠিক না। শুধু প্রত্যুত্তরে বললাম যে ইংরেজিটা আমার সবচেয়ে প্রিয় সাবজেক্ট।

‘ওহ, তাই? শুনে খুবই ভালো লাগছে।’ বলল চশমাপরা ইংরেজির শিক্ষিকা নান। ‘এই বছর কী পড়েছো তুমি? জানতে বেশ আগ্রহ হচ্ছে।’ মহিলা আসলেই খুব ভালো ছিল।

‘বেশির ভাগ সময়ই আমরা কাটিয়েছি অ্যাঙলো-স্যাক্সন নিয়ে। এছাড়াও বেউলফ, গ্রেন্ডেল, লর্ড র‍্যান্ডাল মাই সন পড়েছি। এক্সট্রা ক্রেডিটের জন্য সিলেবাসের বাইরের কিছু বইও পড়েছি। থমাস হার্ডির দ্য রিটার্ন অব দ্য নেটিভ, রোমিও অ্যান্ড জুলিয়েট আর জুলিয়াস—’

‘ওহ, রোমিও অ্যান্ড জুলিয়েট! চমৎকার! এটাই কি সবচেয়ে বেশি ভালো লাগেনি তোমার?’ মহিলাকে নিশ্চিতভাবেই তখন আর নানের মতো শোনাচ্ছিল না।

‘হ্যাঁ। বেশ ভালো লেগেছে। অনেক পছন্দের একটা বই। বইয়ের কিছু কিছু ব্যাপার আমার তেমন ভালো লাগেনি, তবে হ্যাঁ, সামগ্রিকভাবে বইটা খুবই ভালো।’

‘কোন ব্যাপারগুলো ভালো লাগেনি তোমার? বলতে পারবে আমাকে?’ সত্যি বলতে ঐ নান মহিলার সাথে রোমিও অ্যান্ড জুলিয়েট নিয়ে কথাটা বলতে বেশ লজ্জা লাগছিল। মানে কিছু কিছু ক্ষেত্রে ঐ নাটকটা অনেকটাই যৌন উদ্রেককর। তারপরও যেহেতু মহিলা জিজ্ঞেস করেছিল, তাই আমি কিছুক্ষণ আলোচনা করলাম ওটা নিয়ে। ‘আসলে, রোমিও আর জুলিয়েটের খুব একটা বড়ো ফ্যান না আমি,’ বললাম। ‘আমি তাদেরকে পছন্দ করি ঠিকই, তবে—ঠিক বলতে পারবো না। কিছু কিছু ক্ষেত্রে তারা যথেষ্ট বিরক্তিকর। মানে রোমিও-জুলিয়েটের মৃত্যুর থেকে মার্কুশিওর মৃত্যুতেই বেশি দুঃখ পেয়েছি আমি। ব্যাপারটা হলো মার্কুশিওকে জুলিয়েটের কাজিন—কী যেন নাম—ছুরিকাঘাত করার পর থেকে রোমিওকে আমার খুব একটা ভালো লাগেনি।

‘টাইব্যাল্ট।’

‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, টাইব্যাল্ট,’ আমি বললাম—সবসময়ই ঐ লোকটার নাম ভুলে যাই। ‘দোষটা রোমিও’র ছিল। মানে নাটকে আমার সবচেয়ে পছন্দের চরিত্র মার্কুশিও। মার্কুশিও’র ব্যাপারে ব্যাখ্যা করাটা বেশ কঠিন। চরিত্রটা খুবই বুদ্ধিমান এবং বিনোদনদায়ক ছিল। এমন কোনো চরিত্র মারা গেলে আমার খুবই রাগ লাগে—বিশেষ করে তাদের মৃত্যুটা যদি হয় অন্য কারো দোষে। অন্ততপক্ষে রোমিও-জুলিয়েট তো মরেছিল তাদের নিজের দোষেই।’

‘কোন স্কুলে পড়ো তুমি?’ মহিলা জিজ্ঞেস করল আমাকে। সম্ভবত রোমিও- জুলিয়েট নিয়ে আমার সাথে আর বেশি কথা বলার ইচ্ছা ছিল না মহিলার।

বললাম পেন্সিতে পড়ি। শুনে মহিলা বলল তিনি আগেও এই স্কুলটার নাম শুনেছে এবং স্কুলটা খুবই ভালো একটা স্কুল। যাই হোক, এটা শুনে আর কিছু বললাম না। তখন অন্যজন মানে ইতিহাস ও আমেরিকান সরকারের শিক্ষিকা বলল যে তাদের বেরিয়ে যেতে হবে। আমি তাদের বিলটা দিয়ে দিতে চেয়েছিলাম, কিন্তু তারা তা করতে দেয়নি। চশমাপরা নানই আমাকে বিলটা দিতে দেয়নি।

‘তুমি অনেক ভদ্র এবং অমায়িক ছেলে,’ মহিলা বলল। ‘খুবই ভালো ছেলে তুমি।’ মহিলা আসলেই খুবই আদুরে ছিল। মহিলার আচরণ আমার কাছে অনেকটাই ট্রেনে পরিচয় হওয়া আর্নেস্ট মোরোর মায়ের মতো লাগছিল। বিশেষ করে হাসিটা একই রকম প্রায়। ‘তোমার সাথে কথা বলে খুবই ভালো লেগেছে আমাদের।’

আমারও তাদের সাথে কথা বলে খুব ভালো লেগেছিল। আসলেই ভালো লেগেছিল। আমি আলাপচারিতাটা আরো বেশি উপভোগ করতাম যদি না পুরোটা সময় একটা ভয়ের মধ্যে না থাকতাম। ভয়টা ছিল তারা কি হুট করে জানতে চাইবে কি না আমি ক্যাথলিক না অন্য ধর্মের অনুসারী। ক্যাথলিকরা সবসময়ই তাদের সাথে কথা বলা মানুষটা ক্যাথলিক কি না তা জানতে চায়। আমার ক্ষেত্রে এটা অনেক বেশিই হয়। আমি জানি আমার নামের শেষ অংশটা আইরিশ হওয়াতেই এটা বেশি হয়। আইরিশ বংশোদ্ভূত বেশির ভাগ মানুষই সাধারণত ক্যাথলিক হয়। সত্যি বলতে আমার বাবাও একসময় ক্যাথলিক ছিল। মায়ের সাথে বিয়ে হওয়ার পর বাবা ধর্ম ছেড়ে দিয়েছিল। তবে ক্যাথলিকরা সবসময়ই অন্য মানুষও ক্যাথলিক কি না তা জানতে চায়, এমনকি শেষ নাম না জানলেও। হুটন স্কুলে লুইজ শেনি নামের একটা ক্যাথলিক ছেলেকে চিনতাম আমি। স্কুলে গিয়ে ঐ ছেলেটার সাথে প্রথম দেখা হয়েছিল আমার। স্কুল খোলার দিন ফিজিক্যালের জন্য আমরা দুজনই ইনফার্মারির বাইরে রাখা সামনের চেয়ার দুটোতে বসেছিলাম। বসে থাকা অবস্থায় টেনিস নিয়ে আলাপ করছিলাম আমরা। তার টেনিসের প্রতি ভালো আগ্রহ ছিল। আমিও টেনিসের ভক্ত। সে আমাকে বলেছিল প্রতি গ্রীষ্মেই সে ফরেস্ট হিলসের ন্যাশনালে টেনিস খেলে, আমি বললাম যে আমিও খেলি। তারপর দুইজনই বিখ্যাত ভালো ভালো টেনিস খেলোয়াড় নিয়ে আলোচনা করলাম কিছুক্ষণ। টেনিস নিয়ে তার জানাশোনা বেশ ভালোই ছিল, অন্তত তার বয়সের ছেলের তুলনায় অনেক বেশিই ছিল বলা যায়। এরপর হুট করেই সে জিজ্ঞেস করে বসলো, ‘শহরের ক্যাথলিক চার্চটা কোথায় তা কি জানো তুমি?’ তার প্রশ্ন শুনেই বুঝা যাচ্ছিল যে সে আসলে জানতে চায় আমি ক্যাথলিক কি না। তার উদ্দেশ্য এটাই ছিল। এমন না যে কুসংস্কারগ্রস্ত ছিল, তবে সে শুধু আমার ব্যাপারটা জানতে চাইছিল আর কী। টেনিস নিয়ে আলোচনাটা সে খুবই উপভোগ করছিল ঠিকই, তবে তাকে দেখেই বুঝা যাচ্ছিল যে আমি ক্যাথলিক হলে সে ঐ আলোচনাটা আরো ভালোভাবে উপভোগ করতে পারতো। এই বিষয়গুলো খুবই বিরক্তিকর লাগে আমার কাছে। আমি এটা বলছি না যে এই কারণে আমাদের আলোচনাটা নষ্ট হয়ে গিয়েছিল, তা হয়নি—তবে এতে আলোচনায় কোনো উপকারও হয়নি। এজন্যই এই দুই নান আমি ক্যাথলিক কি না জিজ্ঞেস না করায় খুব সন্তুষ্ট ছিলাম। তারা এটা জিজ্ঞেস করলেও হয়তো কনভার্সেশনটা ভন্ডুল হয়ে যেত না, তবে তখন নিশ্চিতভাবেই আলোচনাটা অন্যরকম হয়ে যেত। আমি বলছি না যে আমি এরজন্য ক্যাথলিকদের দোষ দিচ্ছি। আমি আসলেই কোনো দোষ দিচ্ছি না। আমি ক্যাথলিক হলে তো আমিও এমনটা করতাম। আসলে এই ব্যাপারটা অনেকটা ঐ স্যুটকেসের ব্যাপারটার মতোই। আসলে বলতে চাচ্ছি যে ভালো একটা আলাপচারিতার জন্য এই প্রশ্নটার কোনো প্রয়োজনই নেই। এটাই বলতে চাচ্ছি শুধু।

নান দুইজন যাওয়ার জন্য উঠে দাঁড়ানোর পর স্টুপিডের মতো একটা কাজ করে বসলাম আমি। ব্যাপারটা বেশ লজ্জাজনকও। তাদের সাথে কথা বলার সময় আমি আসলে সিগারেট খাচ্ছিলাম। তারা উঠে দাঁড়ানোর পর তাদেরকে বিদায় বলতে যাবো, তখন ভুলে তাদের মুখের ওপর ধোঁয়া ছুড়ে দিয়েছিলাম। আমি আসলে এটা করতে চায়নি, ভুলে হয়ে গিয়েছিল। এরপর আমি তাদের কাছে অনেকবার ক্ষমা চেয়েছি। নান দুইজন আসলেই খুব ভদ্র আর দয়ালু ছিল, তবে ঘটনা আসলেই লজ্জাজনক ছিল।

তারা চলে যাওয়ার পর আমার খারাপ লাগছিল এটা ভেবে যে আমি তাদের সংগ্রহে মাত্র দশ ডলার দিয়েছিলাম। তবে ব্যাপারটা হলো আমার তখনো স্যালি হায়েসের সাথে ম্যাটিনি ডেটটা বাকি ছিল। আর সেটার টিকিট, খাওয়া-দাওয়ার জন্য কিছু টাকা আমার পকেটে রাখা লাগতোই। তারপরও দুঃখই লাগছিল। হতচ্ছাড়া টাকা-পয়সা—এই বস্তুটা সবসময়ই মানুষকে দুঃখীই করে শুধু।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *