অধ্যায় এক
আমার ব্যাপারে যদি শুনতে চান, তাহলে হয়তো প্রথমেই জানতে চাইবেন আমি কোথায় জন্মেছিলাম, আমার বিদঘুটে শৈশব কেমন ছিল এবং আমার জন্মের আগে আমার বাবা-মা অন্য কিছু নিয়ে কতটা ব্যস্ত ছিল এবং হাবিজাবি জাতীয় আরো নানাকিছু। তবে যদি সত্যটা জানতে চান, তাহলে আমার এসবের কিছুই বলার ইচ্ছা নেই। প্রথমত, ঐ ব্যাপারগুলোকে আমার প্রচণ্ড বিরক্তিকর মনে হয়, আর দ্বিতীয়ত আমার বাবা-মা যদি তাদের ব্যক্তিগত ব্যাপারে কিছু বলতে শুনে তাহলে প্রচণ্ড ক্ষেপে যাবে। ওসব বিষয় নিয়ে তারা খুবই স্পর্শকাতর, অভিমানী। আমার বাবা একটু বেশিই অভিমানী। এটা বলবো না যে তারা মানুষ হিসেবে ভালো না, তবে তারা প্রচণ্ড অভিমানী। আর তাছাড়া আমিও আপনাদেরকে আমার অটোবায়োগ্রাফি বা এমন কিছু শোনাতে যাচ্ছি না। আমি শুধু গত ক্রিসমাসে আমার সাথে ঘটা কিছু গোলমেলে ব্যাপার নিয়ে—যেটার কারণেই আমাকে শান্ত হওয়ার জন্য এখানে আসা লেগেছে। ডি.বি.কে আমি সবসময়ই এটার ব্যাপারে বলি, হাজার হোক সে আমার ভাই। ডি.বি. হলিউডে কাজ করে। আমার এই বাজে জায়গাটা থেকে হলিউড খুব একটা দূরে না। প্রতি সপ্তাহেই ডি.বি. আমাকে দেখতে আসে। সম্ভবত আগামী মাসে বাসায় যাওয়ার সময় সে-ই আমাকে ড্রাইভ করে নিয়ে যাবে। মাত্রই একটা জাগুয়ার কিনেছে ও। হলিউডের কাজ করেই সে ঘণ্টায় দুইশো মাইল গতিতে চলতে পারা গাড়িটা কিনেছে। এটা কিনতে তার খরচ হয়ে চার হাজার ডলার। তার এখন অনেক টাকা হয়েছে। আগে কিন্তু এতো পয়সা-কড়ি ছিল না। বাসায় থাকার সময় সে ছিল সাধারণ এক লেখক মাত্র। সাধারণ না, বেশ ভালো লেখকই বলা যায়। কিছু ছোটো গল্প নিয়ে খুব সুন্দর একটা বই লিখেছিল। দ্য সিক্রেট গোল্ডফিশ, বইটার নাম হয়তো শুনে থাকতে পারেন। ‘দ্য সিক্রেট গোল্ডফিশ’ই ছিল বইটির সেরা গল্প। গল্পটি ছিল এক বাচ্চাকে নিয়ে, যে কখনো তার গোল্ডফিশ কাউকে দেখতে দিতো না, কারণ সে ওটা তার নিজের টাকা দিয়ে কিনেছিল। গল্পটি আমার খুবই ভালো লেগেছিল। আর এখন সে কাজ করে হলিউডের ‘পতিতা’ লেখক হিসেবে। আমি যদি কোনো কিছু একদম ঘৃণা করে থাকি, তাহলে সেটা হলো সিনেমা। আমার সামনে কখনো ওটার নামও নেবেন না কেউ।
যাই হোক, আমি যেদিন পেন্সি প্রেপ ছাড়লাম সেদিন থেকে বলা শুরু করছি। পেন্সি প্রেপ হচ্ছে অ্যাগারস্টাউন, পেনসিলভেনিয়ার একটি স্কুল। অনেকে হয়তো নাম শুনেছেন স্কুলটার। নয়তো অ্যাডে দেখেছেন। প্রায় হাজারটা ম্যাগাজিনে বিজ্ঞাপন দেয় এই স্কুল। প্রতিটা বিজ্ঞাপনেই দেখা যায়, সুঠাম দেহের এক লোক ফেন্সের ওপর দিয়ে ঘোড়া নিয়ে লাফিয়ে যাচ্ছে। অর্থটা এমন যেন পেন্সিতে পুরোটা সময়ই পোলো খেলা যায়। আর বিজ্ঞাপনগুলোতে ঘোড়াওয়ালা লোকটার নিচে লেখা থাকে, ‘১৮৮৮ সাল থেকেই আমরা বাচ্চা ছেলেদেরকে চিত্তাকর্ষক ও পরিষ্কার-মস্তিষ্ক বিশিষ্ট যুবকে রূপান্তরিত করে আসছি।’ তবে আমি কখনো ঐ এলাকার কোনো জায়গায় একটা ঘোড়াও দেখিনি, পোলো খেলা তো পরের কথা। আর তারা অন্যান্য আরো বিভিন্ন স্কুল থেকে খুব একটা বেশি পরিমাণ রূপান্তরিতও করে না। সত্যি বলতে আমি পেন্সিতে চিত্তাকর্ষক এবং পরিষ্কার-মনের কাউকে দেখিনি। হয়তো দুইজন আছে, বেশি হলে। তবে তারাও এখানে এসে হয়নি বলেই আমার ধারণা, সম্ভবত তারা এভাবেই এসেছিল এখানে।
যাই হোক, ঐদিন ছিল শনিবার। স্যাক্সন হলের সাথে ফুটবল খেলা ছিল পেন্সির। পেন্সিতে সবসময় স্যাক্সন হলের সাথে খেলাটাকে খুব বড়ো কিছু বলে ধরা হয়। ঐ খেলাটা ছিল বছরের শেষ খেলা। যদি পেন্সি ঐ ম্যাচ না জিতে তাহলে হয়তো অনেকে আত্মহত্যাও করে বসতে পারে। আমার মনে আছে ঐদিন বিকাল তিনটার দিকে আমি থমসেন হিলের চূড়ায় থাকা বিপ্লবী যুদ্ধের এক বিদঘুটে ক্যাননের পাশে দাঁড়িয়েছিলাম। ওখান থেকে পুরোটা মাঠই দেখা যায়। দেখতে পাচ্ছিলাম মাঠে দুই দলের খেলোয়াড়েরা একে-অন্যের সাথে বুনো লড়াইয়ে মেতে আছে। তবে গ্র্যান্ডস্ট্যান্ডে চোখে পড়ার মতো কিছু ছিল না, কিন্তু ওখান থেকে পেন্সির পক্ষে প্রচুর চিয়ার আর স্যাক্সন হলকে দেওয়া প্রচুর দুয়োর শব্দ শুনতে পাচ্ছিলাম। এটাই স্বাভাবিক, কারণ আমি ছাড়া স্কুলের সবাই ঐদিন গ্র্যান্ডস্ট্যান্ডে ছিল আর সফরকারী দল কখনো সাথে করে খুব বেশি সমর্থক নিয়ে আসে না।
ফুটবল খেলাগুলোতে কখনোই খুব বেশি মেয়ের উপস্থিতি দেখা যায় না। শুধুমাত্র সিনিয়ররাই সাথে করে মেয়ে নিয়ে আসতে পারতো। যে দৃষ্টিভঙ্গিতেই দেখা হোক না কেন, পেন্সি ছিল খুবই বাজে একটা স্কুল। খেলার ফাঁকে ফাঁকে আমি অন্তত অল্প কয়েকজন হলেও মেয়ের উপস্থিতি দেখতে পছন্দ করি। খেলার ওপর তাদের মনোযোগ থাকুক বা না থাকুক, অন্তত উপস্থিত থাকলেই হয়। তারা খেলা দেখতে এসে অযথাই হাত নাড়ুক বা নাক ঝাড়ুক বা বোকার মতো ফিকফিক করে হাসুক না কেন, তাতে আমার আপত্তি নেই। স্কুলের হেডমাস্টারের মেয়ে সেলমা থার্মার মাঝেমধ্যেই কিছু খেলা দেখতে আসে। যদিও সেলমা যথেষ্ট সুন্দরী, তবে আকাঙ্খায় পাগল করে দেওয়ার মতো মেয়ে না ও। অ্যাগারস্টাউন থেকে আসার সময় একবার বাসে তার পাশে বসেছিলাম আমি। কথাও বলেছিলাম। ওকে আমার ভালো লাগে। তার নাকটা বেশ বড়ো, সবসময় দাঁত দিয়ে নখ কামড়ানোর ফলে নখগুলো রক্তাক্ত হয়ে থাকে আর কৃত্রিম স্তনজোড়ায় বুক সবসময়ই উঁচু হয়ে থাকে। তবে তাকে দেখলে একটু দুঃখই লাগে আমার। তার ব্যাপারে আমার যেটা সবচেয়ে বেশি লাগে সেটা হলো—সে কখনোই তার বাবা কত মহৎ মানুষ সেটা বুঝানোর চেষ্টা করে না। সম্ভবত সে জানে তার বাবা একজন জালিয়াত।
আমি ঐদিন গ্র্যান্ডস্ট্যান্ডে সবার সাথে থাকার বদলে থমসেন হিলে দাঁড়িয়েছিলাম, কারণ মাত্রই পেন্সিং দলের সাথে নিউইয়র্ক থেকে ফিরে এসেছি। পেন্সিং দলের ম্যানেজার ছিলাম আমি। খুবই বড়ো ব্যাপার এটা। আমরা নিউইয়র্কে গিয়েছিলাম ম্যাকবার্নি স্কুলের সাথে পেন্সিং ম্যাচ খেলার জন্য। তবে খেলতে পারিনি। কারণ যাওয়ার সময় সাবওয়েতে আমি পেন্সিং’র সব সরঞ্জাম ফেলে গিয়েছিলাম। অবশ্য পুরো দোষটা আমার না। আমরা গিয়ে কোথায় নামবো সেটার জন্য আমাকে বারবারই ম্যাপ দেখতে হচ্ছিল, তাই সরঞ্জামের প্রতি কোনো খেয়াল ছিল না। সেজন্যই ডিনারের সময়ের বদলে পেন্সিতে আমাদেরকে আড়াইটায় ফিরে আসতে হয়েছে। ফিরে আসার পথে ট্রেনে পুরোটা সময়ই আমাকে একঘরে রেখেছিল। অবশ্য একদিক থেকে ভাবলে ব্যাপারটা বেশ মজার ছিল।
তবে মাঠে না নামার আরেকটা কারণও ছিল। ঐসময় আমি আমার ইতিহাস শিক্ষক মি. স্পেন্সারকে বিদায় জানাতে যাচ্ছিলাম। লোকটার ইনফ্লুয়েঞ্জা হয়েছিল, আর আমারও মনে হচ্ছিল ক্রিসমাস ভ্যাকেশন শুরু হওয়ার আগে হয়তো তাঁর সাথে আমার আর দেখা হবে না। তিনি আমাকে নোট লিখে জানিয়েছিলেন যে আমি যেন বাড়ি যাওয়ার আগে তাঁর সাথে একবার দেখা করে যাই। তিনি জানতেন আমি আর পেন্সিতে ফিরে আসবো না।
ওহ, বলতে ভুলেই গিয়েছিলাম। স্কুল থেকে আমাকে বের করে দিয়েছে তারা। ক্রিসমাসের ছুটির পর আমাকে আর এখানে ফিরে না আসতে বলে দেওয়া হয়েছে। কারণ আমি চারটা সাবজেক্টে পাশ করার কোনো শর্তই পূরণ করতে পারিনি এবং কোনো ক্লাসেই অ্যাপ্লাই করিনি। তারা আমাকে অনেকবারই সতর্কতা দিয়েছে ক্লাসে অ্যাপ্লাই করার জন্য, বিশেষ করে মিডটার্মের দিকে তো আরো বেশি করে দিয়েছে। এমনকি হেডমাস্টার থার্মারের সাথে কথা বলার জন্য আমার বাবা-মাকেও ডেকে আনা হয়েছিল তখন। কিন্তু আমি অ্যাপ্লাই করিনি। তাই তারা আমাকে স্কুল থেকে বহিষ্কার করে দিয়েছে। পেন্সিতে প্রায়ই ছাত্রদেরকে বহিষ্কার করা হয়। পেন্সির শিক্ষাগত নিয়মকানুন খুব কড়া এবং রেটিংও বেশ ভালো তাদের।
যাই হোক, তখন ছিল ডিসেম্বর মাস। দিনটাও ছিল প্রচুর ঠান্ডা। বিশেষ করে বিদঘুটে হিলটার ওপরে ঠান্ডা ছিল আরোও অনেক বেশি। আমার পরনেও তেমন ভারী পোশাক ছিল না, হাতে গ্লাভসও না। ঐদিনের এক সপ্তাহ আগেই কে যেন আমার রুম থেকে উটের পশমে তৈরি কোট চুরি করে নিয়ে গিয়েছিল, পশমের গ্লাভসগুলোও ছিল কোটের পকেটে। পেন্সিতে প্রচুর হারামি রয়েছে। পেন্সিতে আসা অনেকেই বেশ ধনী-বনেদি পরিবারের, কিন্তু হারামির কোনো অভাব নেই ওখানে। স্কুল যত ব্যয়বহুল হয়, সেখানে হারামির সংখ্যাও বেশি হয়—মজা করছি না, কথাটা আসলেই সত্য। যাই হোক, কনকনে ঠান্ডায় বিদঘুটে ক্যাননের পাশে দাঁড়িয়ে নিচের মাঠের খেলা দেখছিলাম আমি। তবে খেলার প্রতি কোনো মনোযোগ ছিল না। আমি আসলে ওখানে দাঁড়িয়েছিলাম বিদায়ের কোনো একটা সুখস্মৃতি পাওয়ার জন্য। মানে আমি আগেও অনেক স্কুল-জায়গা ছেড়েছি, তবে কোনোবারই জানতাম না যে আমি এগুলো ছেড়ে যাচ্ছি। আসলে স্মৃতিটা দুঃখময় হোক বা খারাপ হোক, যেটাই হোক না কেন—তা নিয়েও আমার কোনো মাথাব্যথা নেই। একটা জায়গা ছেড়ে যাওয়ার সময় আমি শুধু এটাই জানতে চাই যে আমি জায়গাটা ছেড়ে যাচ্ছি। যদি এটা জানা না থাকে, তাহলে খারাপটাও অনেক বেশি লাগে।
আমার কপাল ভালো ছিল। হুট করেই এমন একটা স্মৃতির কথা মনে পড়ে গেলো যেটার মাধ্যমে আমি আসলেই বুঝতে পারবো যে আমি এখান থেকে চলে যাচ্ছি। ঘটনাটা হলো—গত অক্টোবরের দিকে আমি, রবার্ট টিচেনার আর পল ক্যাম্পবেল মিলে অ্যাকাডেমিক বিল্ডিংয়ের সামনে ফুটবল খেলছিলাম। তারা দু’জনই মানুষ হিসেবে খুব ভালো, বিশেষ করে টিচেনার বেশি ভালো। তখন সময়টা ছিল ডিনারের কিছুটা আগে, বাইরে অন্ধকারও ধীরে ধীরে বাড়ছিল। তবে তারপরও আমরা বল নিয়েই খেলছিলাম। প্রকৃতি আরো অন্ধকার হচ্ছিল, তবু খেলা থামাইনি আমরা। এমনকি একটা সময় অন্ধকারের কারণে বলই ঠিকমতো দেখা যাচ্ছিল না, তারপরও খেলেই যাচ্ছিলাম। তবে বায়োলোজির শিক্ষক মি. জাম্বেসির নির্দেশে একটা সময় আমাদেরকে খেলা থামাতে বাধ্য হতে হয়েছিল। একাডেমিক বিল্ডিংয়ের জানালা দিয়ে তিনি মাথা বের করে আমাদেরকে বলেছিলেন খেলা থামিয়ে ডিনারের জন্য তৈরি হতে। যদি আমার কখনো স্কুলের কোনো স্মৃতি মনে করার দরকার হয়, তাহলে আমি খুব সহজেই এই স্মৃতিটার কথা মনে করতে পারবো। যখন খুশি তখন এই স্মৃতিটা মনে করতে পারবো আমি। স্মৃতিটা মাথায় আসতেই আমি ঘুরে পাহাড়ের অন্যপাশে দৌড়ানো শুরু করলাম। মি. স্পেন্সারের বাসাটা ওদিকেই। তিনি ক্যাম্পাসে থাকতেন না। থাকতেন অ্যান্থোনি ওয়েইন অ্যাভিনিউতে।
মেইন গেইট পর্যন্ত দৌড়ে গিয়ে থেমে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে শ্বাস নেওয়ার চেষ্টা করলাম। আমার ফুসফুসের অবস্থা আসলে খুব একটা ভালো ছিল না। সত্যি বলতে আমি খুবই বড়োসরো চেইন স্মোকার। মানে এক সময় ছিলাম আর কী। এখানে আসার পর তারা আমাকে স্মোকিং থামাতে বাধ্য করেছে। আর তাছাড়া গত বছর আমার উচ্চতাও সাড়ে ছয় ইঞ্চি বেড়েছিল। আসলে সত্যি বলতে আমার টিবি রোগটাও হয়েছে এই কারণেই, সে জন্যই আমাকে এখানে আসতে হয়েছে অসংখ্য পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার জন্য। যদিও আমার শরীর স্বাস্থ্য দেখতে কিন্তু বেশ ভালোই।
যাই হোক, কিছুক্ষণ শ্বাস নিয়ে আবার দৌড় শুরু করলাম ২০৪ নং রুট দিয়ে। রাস্তাটা বরফে ভরা ছিল। দৌড়ে যাওয়ার সময় প্রায় পড়েই গিয়েছিলাম। অবশ্য আমি নিজেও জানতাম না কেন দৌড়াচ্ছিলাম। মনে হয় তখন দৌড়াতেই ইচ্ছা করছিল। রাস্তাটা পার হতেই আমার মনে হলো আমি হয়তো অদৃশ্য হয়ে গেছি। আসলে ঐ বিকালটাই ছিল অদ্ভুত, ঠান্ডা ছিল প্রচণ্ড, সূর্যের অস্তিত্বের কোনো ছিঁটেফোঁটাও ছিল না, আর তাছাড়া রাস্তা পার হওয়ার সময় প্রতিবারই সবারই মনে হয় যে সে অদৃশ্য হয়ে গেছে।
যাই হোক, স্পেন্সারের বাসার দরজায় গিয়ে জোরে জোরে ডোরবেলে চাপতে শুরু করলাম। আসলেই ঠান্ডায় জমে গিয়েছিলাম ঐদিন। আমার কান ব্যথা করছিল প্রচণ্ড, আঙুলগুলোও ঠিকমতো নাড়াতে পারছিলাম না। ‘প্লিজ, প্লিজ,’ প্রায় চেঁচিয়েই হাঁক ছাড়ছিলাম ‘দরজাটা কেউ খুলুন প্লিজ!’ বেশ কিছুক্ষণ পর অবশেষে মিসেস স্পেন্সার এসে দরজাটা খুললেন। তাদের কোনো কাজের লোক বা এমন কেউ ছিল না। দরজায় কেউ আসলে সবসময় নিজেরাই গিয়ে সারা দিতো। তাদের আসলে অত বেশি টাকা-পয়সা ছিল না।
‘হোল্ডেন!’ মিসেস স্পেন্সার বললেন। ‘তোমাকে দেখে খুবই ভালো লাগছে। ভেতরে আসো, সোনামণি। ঠান্ডায় তো একদম জমে গিয়েছো দেখি!’ আমার মনে হয় তিনি আমাকে দেখে আসলেই খুশি হয়েছিলেন। আমাকে পছন্দ করতেন তিনি। অন্তত আমার ধারণা এটা।
দ্রুতই বাসার ভেতরে ঢুকে গেলাম। ‘কেমন আছেন, মিসেস স্পেন্সার?’ জিজ্ঞেস করলাম। ‘মি. স্পেন্সার কেমন আছে?’
‘তোমার কোটটা খুলে রাখো আগে,’ তিনি বললেন। আমার প্রশ্নটা তিনি শুনতেই পাননি। উনার কানে আসলে কিছুটা সমস্যা ছিল।
কোটা নিয়ে হলের ক্লজেটে ঝুলিয়ে রাখলেন তিনি। আমিও ভেতরে ঢুকে হাত দিয়ে চুলগুলোতে একটু ব্যাকব্রাশ করে নিলাম। আমার চুলগুলো সবসময়ই ছোটো ছোটো করে ছাটা থাকে। সেজন্যই কখনো চিরুনি ব্যবহার করা লাগে না। ‘কেমন আছেন, মিসেস স্পেন্সার?’ আবারো জিজ্ঞেস করলাম আমি। এবার একটু জোরে বললাম।
‘আমি ভালোই আছি, হোল্ডেন।’ ক্লজেটের ডালাটা লাগাতে লাগাতে বললেন তিনি। ‘তুমি কেমন আছো?’ উনার জিজ্ঞেস করার ভঙ্গিটাতেই আমি বুঝে গেলাম যে মি. স্পেন্সার আমাকে স্কুল থেকে বের করে দেওয়ার ব্যাপারটা উনাকে বলে দিয়েছেন।
‘ভালো,’ আমি বললাম। ‘মি. স্পেন্সারের অবস্থা কী? ইনফ্লুয়েঞ্জা কি সেরেছে?’
‘হ্যাঁ, হোল্ডেন। সে এখন ভালোই বোধ… আসলে আমি ঠিক বলতে পারবো না কেমন বোধ করছে… তার রুমেই আছে। গিয়ে দেখা করে আসো।’