1 of 2

দ্য ওবলঙ বক্স

দ্য ওবলঙ বক্স

ইন্ডিপেন্ডেন্স!

ক্যাপ্টেন থার্ডির সুদৃশ্য ও সুবিশাল ডাক-জাহাজের নাম ইন্ডিপেন্ডেন্স’।

বছর-কয়েক আগেকার কথা, চার্লস্টিন, এস-সি. থেকে নিউইয়র্ক শহরে যাবার জন্য ইন্ডিপেন্ডেন্সর টিকিট কেটেছিলাম।

জুনের ১৫ তারিখে আমাদের জাহাজটার নোঙর তোলার কথা। তবে এও সত্য যে, আবহাওয়া স্বাভাবিক থাকলে তবেই জাহাজ ছাড়বে। আমি জাহাজ ছাড়ার একদিন আগে, অর্থাৎ ১৪ তারিখে জাহাজে হাজির হলাম। একদিন আগে যাওয়ার উদ্দেশ্য, শোবার ঘরের কিছু ব্যবস্থাদি করে নেওয়া দরকার। জাহাজ ঘাটায় পা দিয়ে দেখলাম, আমাদের সঙ্গে অনেক যাত্রীই উপস্থিত হয়েছে। একই জাহাজে তারাও যাবে। তবে তাদের মধ্য মহিলারাই সংখ্যায় বেশি।

আমি যাত্রী তালিকাটার ওপর চোখ বুলিয়ে দেখলাম, তাদের মধ্যে কয়েকজন আমার পরিচিত। স্ত্রী তালিকাটার ওপর চোখ বুলাতে বুলাতে অন্যান্য পরিচিতদের মধ্যে মি. কর্ণেলিয়াস ওয়াটের নামটা দেখে আমার বুকের ভেতরে রীতিমত একটা খুশির জোয়ার বয়ে চলল। সে একজন প্রখ্যাত তরুণ শিল্পী।

মি. ওয়াট আমার একজন অভিন্ন হৃদয় বন্ধু দীর্ঘদিন ধরে তার সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব। মি. ওয়াট সি-বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার সহপাঠী ছিল। সেখানকার ছাত্রবস্থাতেই আমাদের মধ্যে বন্ধুত্বের সূত্রপাত হয়। তারপর ক্রমে তা ঘনিষ্ঠ থেকে ঘনিষ্ঠতর হতে থাকে।

সে ছিল একজন প্রতিভাসুলভ সাধারণ মেজাজ মর্জির মানুষ। তার চরিত্রে মানুষের প্রতি বিদ্বেষ, অনুভূতিপ্রবণতা আর উৎসাহ-উদ্যমের সংমিশ্রণ ঘটেছিল। এসব গুণের সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধে ছিল উষ্ণ ও আন্তরিক ও সহানুভূতি সম্পন্ন অনন্য হৃদয়।

আমি জাহাজে উঠে শোবার কামরাগুলোর ওপর চোখ বুলাতে বুলাতে দেখতে পেলাম, তিন-তিনটি শোবার ঘরের দরজায় তার নামের কার্ড ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে। আমি আবার যাত্রী-তালিকাটার ওপর চোখ বুলাতে গিয়ে হঠাই আমার দৃষ্টি থমকে গেল। দেখলাম, সে নিজের নামে, স্ত্রীর আর দুবোনের জন্য টিকিট কেটেছে।

শোবার ঘরগুলো খুব বড়সড়, প্রতিটাতে দুটো বার্থের ব্যবস্থা রয়েছে। একটার ওপর কিছুটা জায়গা ছেড়ে দিয়ে আর একটা বার্থের ব্যবস্থা। তবে এও সত্য যে, বার্থগুলো এতই ছোট যে, একজনের বেশি লোক শোওয়া সম্ভব নয়। আর একটা ব্যাপারে আমার মনে খটকা লাগল। ব্যাপারটা কিছুতেই আমার মাথায় এলো না, লোকের সংখ্যা চারজন, আর সে শোবার ঘর ভাড়া করেছে তিনটি ব্যাপারটা কি? কিছুতেই মনের ধন্ধটাকে কাটাবার মতো পথ বের করতে পারলাম না।

আসলে তখন আমার মনে এমন একটা অবস্থা চলছিল যখন কোনো মানুষ খুবই নগণ্য ব্যাপার স্যাপার নিয়ে খুবই বেশি রকম কৌতূহলাপন্ন হয়ে পড়ে।

এই কারণের জন্যই তো লজ্জার সঙ্গেই আমি মেনে নিচ্ছি শোবার ঘরের এ হিসেব না মেলার ব্যাপারটাকে কেন্দ্র করে আমার অন্তরের অন্তঃস্থলে হরেক রকম অশালীন, অসঙ্গত ও অশোভন চিন্তা ভাবনার জট মাথার মধ্যে পাকাতে আরম্ভ করল।

এও সত্য স্বীকার করছি, এসব নিয়ে আমার চিন্তা-ভাবনা করানিপ্রয়োজন। সবকিছু জেনে বুঝেও আমি এ সম্যাটার সমাধান করতেই মন প্রাণ সঁপে দিলাম।

সত্যি কথা বলতে কি, সমস্যাটা আমার প্রতিটা মুহূর্ত জুড়ে রইল। দীর্ঘ সময় ধরে ভাবনা-চিন্তার পর শেষপর্যন্ত আমি এমন একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছলাম যে কথা ভেবে আমি নিজেই যারপরনাই অবাক হয়ে গেলাম। আমি আপন মনেই বার বার বলতে লাগলাম–এতটা সময় এর জন্য ব্যয় করার তো কোনো দরকার ছিল না। আরও আগেই তো ভাবনাটা আমার মাথায় আসা দরকার ছিল। কেনই বা এতক্ষণ কথাটা আমার মাথায় আসেনি?’

দীর্ঘ সময় ধরে ভাবনার জট ছাড়াতে ছাড়াতে আমি এক সময় স্বগতোক্তি করে উঠলাম– চতুর্থ লোকটা, যে আমার মাথায় দীর্ঘ সময় ধরে জগদ্দল পাথরের মতো চেপে বসেছে সে পরিচারকই হবে। হায়! আমি সত্যি একজন আহাম্মকের শিরোমণি! অনেক আগেই তো এমন সহজ সরল একটা সমাধান আমার মাথায়ই এলো না?’

আমি একপা-দুপা করে হাঁটতে হাঁটতে স্ত্রী-তালিকায় এগিয়ে গেলাম। তালিকাটার কাছে গিয়েই থমকে দাঁড়িয়ে পড়লাম। চোখ তুলে তালিকাটার দিকে তাকালাম। নামগুলো আবারও এক এক করে পড়তে লাগলাম। স্পষ্ট দেখতে পেলাম, দলটার সঙ্গে কোনো পরিচারকই যাচ্ছে না। তবে এও সত্য যে, আসলে দলটার সঙ্গে একটা পরিচারক নেবার কথা ছিল। কেন এমন কথা বলছি, তাই? গোড়াতে পরিচারক কথাটা ঠিকই লেখা হয়েছিল। পরবর্তীকালে কথাটা কেটে-ছেটে বাদ দেওয়া হয়েছে।

আমার মাথায় আবার গুচ্ছের খানেক চিন্তা এসে ভিড় জমাল। আবার চিন্তা জট ছাড়াতে ছাড়াতে এক সময় আপন মনেই বলে উঠলাম–অবশ্যই এমন কোনো অতিরিক্ত মালপত্র যা নিজের হেফাজতে–একেবারে চোখের সামনে রাখতে আগ্রহী যা গুদামে রাখার ইচ্ছে নেই, সে জন্যই হয়তো চতুর্থ শোবার কামরাটা–হঠাই কথাটা আমার চোখের ওপর ভেসে উঠল। আমি সচকিত হয়ে বলে উঠলাম–‘পেয়ে গেছি। আরে, এই তো পেয়ে গেছি–একটা চিত্রশিল্প। ছবি বা ওরকমই কিছু একটা, ইতালিবাসী বুড়ো ইহুদী নিকোলিননার সঙ্গে এটা দিয়েই দাম দস্তুর, মানে দরকষাকষি হচ্ছিল!’ কথাটা আমার মনের মতোই হলো বটে। আর এখনকার মতো মনের গভীরে। উঁকি দিয়ে ওঠা। কৌতূহলটাকে মন থেকে দূরে রাখলাম।

স্ত্রী-তালিকায় ওয়াটের দুটো বোনের নাম দেখলাম। তাদের দুজনকেই আমি চিনি, কেবল চিনি বললে ঠিক হবে না, ভালোই চিনি। তাদের সম্বন্ধে যেটুকু জানতে পেরেছি, উভয়েই যথেষ্টই বুদ্ধি ধরে আর ব্যবহার অমায়িকও বটে।

আর তার স্ত্রী সদ্যবিবাহিতা। তবে এখনও তাকে আমার চোখে দেখা হয়ে ওঠে নি।

ওয়াট অবশ্য আমাকে তার সম্বন্ধে অনেক গল্পই করেছে। আর যা-কিছু বলেছে তাতে আগ্রহ-উৎসাহ যথেষ্টই ছিল। সে যা-কিছু বলেছে তাতে করে ধরে নেওয়া যেতে পারে, তার সহধর্মিণী রূপে গুণে বাস্তবিকই অনন্যা। কেবলমাত্র সুন্দরী যে তা-ই নয়, বিভিন্ন গুণের একত্র সমাবেশ ঘটেছে তার মধ্যে। আর প্রখর বুদ্ধিও ধরে। অতএব এমন একজন মহিলার সঙ্গে পরিচিত হবার আগ্রহ যে আমার মধ্যে জেগেছিল এ-কথা স্বীকার না করলে সত্য গোপন করাই হবে। মোদ্ধা কথা, তার সঙ্গে আলাপ পরিচয়ে উৎসাহ আমার মধ্যে যথেষ্টই ছিল।

আমি যেদিন জাহাজে যাই–চৌদ্দ জুনের কথা বলছি, সেদিন ওয়াটেরও সদলবলে জাহাজে আসার কথা ছিল। আমি ক্যাপ্টেনের মুখে এরকম কথাই শুনেছিলাম–

‘ওয়াট সদলবলে আসবে জানতে পেরে আমি তার আসার অপেক্ষায় নানা অজুহাতে অতিরিক্ত এক ঘণ্টারও কিছু বেশি সময় জাহাজে অপেক্ষা করছিলাম।

ঠিক তখনই মার্জনা ভিক্ষাসহ একটা চিঠি এলো। চিঠির বক্তব্য, মিসেস ডব্লউ হঠাৎ একটু শারীরিক অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। তার পক্ষে আজ আর জাহাজে যাওয়া সম্ভব হচ্ছে না। অতএব বাধ্য হয়েই ওয়াটকে আজকের পরিকল্পনা বাতিল করতে হচ্ছে। অর্থাৎ আগামীকাল জাহাজ নোঙর তোলার সময়ের আগে তার পক্ষে জাহাজে উপস্থিত হওয়া কিছুতেই সম্ভব হচ্ছে না। এর জন্য ক্যাপ্টেন যেন তাকে নিজগুণে মার্জনা করে দেন ইত্যাদি। পূর্বকথিত আগামীকাল এলো, সকালে আমি হোটেলে জাহাজঘাটের উদ্দেশ্যে যাত্রা করার জন্য প্রস্তুতি নিতে লাগলাম। এমন সময় আমার ঘরের দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ হল।

আমি খুলতেই দেখি ক্যাপ্টেন হার্ডি দাঁড়িয়ে। সাদর অভ্যর্থনাসহ তাকে ঘরের ভেতরে নিয়ে বসালাম।

ক্যাপ্টেন হার্ডি কোনোরকম ভূমিকা না করেই সরাসরি বললেন–বিশেষ কোনো জরুরি প্রতিকূল অবস্থার জন্য আমি সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছি দু-একদিনের মধ্যে ‘ইন্ডিপেন্ডেস’ যাত্রা করবে না।’

‘তবে?’ আমি বললাম।

ক্যাপ্টেন হার্ডি বললেন–শুনুন, যাবতীয় সমস্যা কাটিয়ে যাত্রার ব্যবস্থা করে আমি নিজেই এসে আপনাকে যাত্রার দিন ও সময় প্রভৃতি জা নিয়ে যাব।

ক্যাপ্টেনের সিদ্ধান্তের কথা শুনে আমি যারপরনাই অবাক হলাম। কারণ, বাতাস যথেষ্টই আছে, আর তা দক্ষিণমুখিও বটে। অথচ ক্যাপ্টেন বললেন, অবস্থা প্রতিকূল। ব্যাপারটা কিছুতেই আমার মাথায় ঢুকল না।

উপায়ান্তর না দেখে আমি হোটেল ছেড়ে বাড়ি ফিরে আসতে বাধ্য হলাম। আমার পক্ষে ধৈর্য ধরা সম্ভব না হলেও নিজেকে কোনোরকমে সামলে সুমলে রাখা ছাড়া গত্যন্তরও তো কিছু ছিল না। ফলে গভীর উল্কণ্ঠার সঙ্গে ক্যাপ্টেনের তলবের অপেক্ষায় প্রতিটা দিন, প্রতিটা মুহূর্ত কাটাতে লাগলাম।

একদিন, দুদিন করে প্রায় একটা সপ্তাহ কেটে যেতে লাগল। কিন্তু হায়। এর মধ্যে ক্যাপ্টেন হার্ডির কাছ থেকে প্রত্যাশিত আহ্বানটা পেলাম না। আমি ক্রমেই হতাশ হয়ে পড়তে লাগলাম। শেষপর্যন্ত একদিন বহু আকাঙ্ক্ষিত খবরটা এলো। তিনি জাহাজ নোঙর তোলার দিনক্ষণ আমাকে জানালেন। ব্যস, আর দেরি নয়; আমি যথাসময়ে জাহাজে উপস্থিত হলাম। জাহাজ পা দেবার আগেই দেখি রীতিমত যাত্রীর মেলা বসে গেছে। চারদিকে হৈ চৈ শুরু হয়ে গেছে। কত রকম যে কথাবার্তা আর চিৎকার চ্যাঁচামেচি কানে আসতে লাগল, তা বলে শেষ করা যাবে না।

আমি জাহাজে পা দেবার মিনিট দশেকের মধ্যেই ওয়াট সদলবলে সেখানে হাজির হল। চারজনেরই দল বটে। চারজন বলতে দুবোন, নতুন বৌ আর শিল্পী ওয়াট নিজে। লক্ষ্য করলাম শিল্পী ওয়াটের মধ্যে আগেকার যে মানববিদ্বেষী মেজাজ মর্জি অব্যাহতই রয়েছে।

ওয়াটের মেজাজ মর্জির সঙ্গে আমি তো আগে থেকেই পরিচিত। তাই সেটাকে তেমন পাত্তা দিলাম না। সে কিন্তু তার সদ্যবিবাহিতা সহধর্মিণীকেও আমার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিল না। তার আচরণে অবাক না হলেও ব্যাপারটা আমার কাছে সৌজন্য বহির্ভূতই মনে হল।

শেষপর্যন্ত ওয়াটের কোনো মেরিয়ান দাদার সৌজন্য ও কর্তব্যের ঘাটতিটুকু পূরণ করতে এগিয়ে এলো। রূপসি-বুদ্ধিমতি মেয়েটা মিষ্টি মধুর সুরেলা কণ্ঠে দু-চার কথার মাধ্যমে নতুন বৌয়ের সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে দিল। আমিও মুচকি হেসে সৌজন্যের পরিচয় দিতে ভুললাম না।

মিসেস ওয়াটের মুখটা দেকতে পেলাম না। কারণ, ওড়না দিয়ে মুখটাকে আড়াল করে রাখা হয়েছে। আমার অভিবাদন গ্রহণ করার জন্য সৌজন্যবশত সে ওড়নাটাকে মুখের ওপর থেকে সরিয়ে নিল। অস্বীকার করব না, তার মুখের ওপর দৃষ্টি নিবদ্ধ হতেই আমি থমকে না গিয়ে পারলাম না। আমি মুহূর্তের জন্য বিস্ময় বিস্ফারিত চোখে তার মুখের দিকে তাকালাম।

সত্যি কথা অকপটে স্বীকার করলে, তাকে দেখে আমার ধারণা ছিল, সাধারণ অর্থে সুন্দরী না বলে সাদামাটা রূপ বলতে যা বোঝায় মহিলাটি হয়তো ঠিক সেরকমই কিছু একটা অথবা কুৎসিত বলতে যা বোঝায় তার কাছাকাছি এক মহিলা। মোদ্দা কথা, একেবারে কুৎসিত তাকে বলা যায় না। আরও খোলসা করে বললে, সুন্দর আর কুৎসিতের মাঝামাঝি তার রূপ।

এক মুহূর্তের মধ্যে মিসেস ওয়াটের আপাদমস্তক চোখ বুলিয়ে নিয়ে আমি লক্ষ্য করলাম, তার পোশাক আশাক মার্জিত এবং মার্জিত রুচির পরিচয় বহন করছে, সত্য। অতএব ভদ্রমহিলাটি সে বিচক্ষণতা আর মনের রমণীয়তার গুণেই আমার মেজাজি বন্ধুবরের মন জয় করতে সক্ষম হয়েছে, এ বিষয়ে সামান্যতমও সন্দেহের অবকাশ নেই।

মিসেস ওয়াটের সঙ্গে কয়েকটা মাত্র কথা হতে-না-হতেই বন্ধুবর ওয়াটের বোন মেরিয়ান তাকে নিয়ে শোবার ঘরের উদ্দেশে পা-বাড়াল।

পুরনো কৌতূহলটা আবার আমার অন্তরের অন্তঃস্থলে চাঙা হয়ে উঠল। ওই পরিচারকের ব্যাপারটার কথা বলতে চাচ্ছি। আমি নিঃসন্দেহ হলাম, মি. ওয়াটের দলে কোনো পরিচারক নেই। তবে? তবে কি তার সঙ্গে অতিরিক্ত এমন কোনো মালপত্র রয়েছে সেগুলোকে সে নজরের আড়ালে, মাল গুদামে রাখতে আগ্রহী?-তাই যদি সত্যি হয়ে থাকে সেগুলো এখন কোথায় আছে।

ব্যস, আমার মাথার পোকাগুলো আবার অস্থির হয়ে পড়ল। আমার পক্ষে আর কিছুতেই হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকা সম্ভব হলো না। ব্যস, অস্থিরচিত্ত আমি মি. ওয়াটের অতিরিক্ত মালপত্রের খোঁজে বেরিয়ে পড়লাম। অবর্ণনীয় কৌতূহল বুকে নিয়ে জোর তল্লাশি চালাতে লাগলাম।

আমি বহু খোঁজাখুঁজি করেও যখন আমার বাঞ্ছিত মালপত্রের হদিস পেলাম না তখন হতাশ হয়ে জাহাজঘাটের রাস্তায় গিয়ে দাঁড়ালাম।

মিনিট কয়েকের মধ্যেই বেশ বড়সড় আয়তাকার একটা কাঠের বাক্স নিয়ে একটা গাড়ি এসে দরজার কাছাকাছি দাঁড়িয়ে পড়ল। সেটাকে ধরাধরি করে জাহাজে তুলে নেওয়া হল।

একটু পরেই খালাসিরা নোঙর তুলল। অচিরেই জাহাজটা নড়েচড়ে উঠল। এবার জাহাজটা হেলেদুলে ধীর মন্থর গতিতে বন্দর থেকে ক্রমেই দূরে সরে যেতে লাগল।

কিছুক্ষণের মধ্যেই আমাদের জাহাজ উত্তাল-উদ্দাম সমুদ্রের বুকে গিয়ে পড়ল।

যে বাক্সটার কথা উল্লেখ করেছি সেটা যে আয়তাকার তা-তো আগেই বলেছি। সেটার দৈর্ঘ্য ছয় ফুট আর প্রস্থ আড়াই ফুট। সত্যি বাক্সটা বিচিত্র আকার বিশিষ্টই বটে।

বাক্সটাকে দেখেই আমি বুঝে নিয়েছি যা অনুমান করেছিলাম সেটা অবিকল সেইরকমই একটা সামগ্রী। আর আপনাদের অবশ্যই স্মরণ থাকার কথা, আমি আর যা-কিছু অনুমান করেছিলাম, আমার শিল্পী বন্ধু ওয়াটের বাড়িতে অমূল্য সম্পদ বলতে যা-কিছু আছে তা হচ্ছে–কয়েকটা চিত্রশিল্প, অন্তত একটা শিল্পকর্ম তো আছেই। এরকম কথা কেন বলছি? আমি নিশ্চিত করে জানি সপ্তাহ কয়েক আগে থেকেই সেনিকোলিনোর একটা ছবির ব্যাপারে দরকষাকষি করছিল।

আর এখন চোখের সামনে যে আয়তাকার বাক্সটা দেখতে পাচ্ছি এটা দেখলেই সহজেই অনুমান করে নেওয়া যেতে পাওে, এর ভেতর কৃতী চিত্রশিল্পী লিয়োনাদ্রোর ‘শেষ ভোজ’ চিত্রশিল্পটা ছাড়া অন্য কোনো সম্পদ থাকতে পারে না, কিছুতেই না।

আর বন্ধুবর ওয়াট যখন ফ্লোরেন্স শহরে বসবাস করছিল তখন তার পরিচিত তরুণ চিত্রকর রুবিনির নিপণ তুলির টানে আঁকা ‘শেষ ভোজ’ ছবিটার একটা কপি কিছুদিন ধরে নিকোলিনোর জিম্মায় আছে বলেই আমার জানা আছে। অতএব আমি মনে করি যে, এসব ব্যাপারের চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হয়ে গেছে।

এসব ব্যাপার-স্যাপার নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করে আমি নিজের বুদ্ধিসুদ্ধি দেখে মনে মনে না হেসে পারলাম না।

ওয়াটের ব্যাপার-স্যাপার দেখে আমি ধরেই নিলাম, যে তার শিল্প সম্বন্ধীয় কাজকর্মের ব্যাপারে আমার কাছে কিছু গোপন করতে পারে। অর্থাৎ তার শিল্প জগৎ সম্বন্ধে কিছু কিছু ব্যাপার আমার কাছে গোপন করার মানসিকতা তার মধ্যে জেগেছে। এই প্রথম, এর আগে আমার চোখে এরকম কোনো ব্যাপার কোনোদিনই পড়েনি।

তবে একটা ব্যাপার আমাকে রীতিমত গোলকধাঁধায় ফেলে দিয়েছে। যাকে বলে আমি একেবারে চক্করে পড়ে গেলাম।

সত্যি বলছি, পরিস্থিতিটা আমাকে এমন বোকা বানিয়ে দিল যা আমি স্বপ্নেও কোনোদিন ভাবতে পারিনি। আয়তাকার সে বাক্সটাকে অতিরিক্ত কামরাটায় আদৌ ঢোকানো হলো না। অথচ আমি শতকরা একশ ভাগই নিশ্চিত ছিলাম যে, বাক্সটাকে সে কামরাটাতেই রাখার ব্যবস্থা করবে। কিন্তু সময়মত দেখা গেল, সেটাকে ওয়াট তার নিজের ঘরেই রাখার নির্দেশ দিল।

ওয়াটের নির্দেশে বাক্সটাকে ওয়াটের ঘরে ঢুকিয়ে দেওয়া হল। আর দেখা গেল, সেটা ঘরের প্রায় পুরো মেঝেটাই দখল করে নিয়েছে।

কিন্তু কার্যত যা ঘটল তা হল, বাক্সটা কামরাটা জুড়ে থাকায় আমার শিল্পী বন্ধু আর তার স্ত্রীর পক্ষে চলাফেরাই সমস্যা হয়ে দাঁড়াবে। আর যা সমস্যা হবে বলে আমার মনে হলো তা হচ্ছে, বাক্সটার গায়ে আলকাতরা দিয়ে বড় বড় হরফে যা লেখা রয়েছে তা থেকে সে উগ্র, একেবারেই অসহনীয় ও অবাঞ্ছিত গন্ধ বেরোচ্ছে তা অবশ্যই বিরক্তির উদ্রেক ঘটাবে।

বাক্সটার গায়ে আলকাতরা দিয়ে বড় বড় হরফে লিখে রাখা হয়েছে মিসেস এডিলেড মার্টস, আলবানি, নিউইয়র্ক। অবধায়ক কর্ণেলিয়াস ওয়াট, এস্কয়ার। আর লেখা হয়েছে–এটা ওপরের দিক।’ সবার তলায় আছে–‘সাবধানে ব্যবহার করবেন। এবার আমার ভালোই জানা আছে, আলবানির মিসেস এডিলেড কার্টিস হচ্ছেন আমার শিল্পী বন্ধু ওয়াটের শাশুড়ি ঠাকুরাণী। কিন্তু বাক্সটার গায়ে লেখা পুরো ঠিকানাটাই আমার মধ্যে কেমন যেন রহস্যের সঞ্চার করল। আমি নিজের বিচার বিবেচনা বোধ অনুযায়ী যা বুঝলাম আমাকে হকচকিয়ে দেওয়াই যেন তার উদ্দেশ্য। নইলে এমন একটা ঠিকানা সে কেনই বাক্সটার গায়ে লিখতে যাবে?

আমি ভেবে চিন্তে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলাম, রহস্য সঞ্চারকারী কাঠের বাক্সটা এবং তার ভেতরে সে মালপত্রই থাক না কেন সেগুলোকে কিছুতেই আমার মানববিদ্বেষী বন্ধুবর ওয়াটের নিউইয়র্কের অন্তর্গত চেম্বার্স স্ট্রিটের স্টুডিও ছাড়িয়ে আরও উত্তর দিকে কিছুতেই নিয়ে যেতে দেব না। যে কোন মূল্যেই হোক, আমাকে সে-কাজে বাধা দিতেই হবে। আমাদের জাহাজ উত্তাল-উদ্দাম সমুদ্রের বুক চিড়ে তরতর করে এগিয়ে চলল। আবহাওয়া ছিল। জাহাজের যাত্রীদের মনে আনন্দ অব্যাহতই রইল। তারা পুলকানন্দে পরস্পরের সঙ্গে গল্পগুজবে মেতে রইল।

তবে একটা ব্যাপার আমার নজর এড়াল না। অন্য সব যাত্রীর মতো আমার বন্ধুবর ও তার বোনরা যেন মন খুলে অন্য সবার মতো আনন্দ করতে পারছে না। তারা যেন কেমন ব্যতিক্রম। অন্য সবার সম্পর্কেও আমার ধারণা উল্লেখযোগ্য ভালো। হলো না।

খুবই সত্য যে, বন্ধুবর ওয়াটের আচার আচরণকে আমি বিশেষ গুরুত্ব দেই না। তাকে পাত্তা দেওয়ার দরকারই আমি মনে করি না। তবে তাকে একটু বেশি রকম মনমরা বলেই মনে হল। তাকে অধিকাংশ সময়ই কেমন যেন গোমরা মুখ করেই থাকতে দেখলাম। তবে এও সত্য যে, বন্ধুবরের খামখেয়ালিপনা সম্বন্ধে আমি মনে মনে তৈরি হয়েই ছিলাম। আর এও স্বীকার করে নিচ্ছি, তার বোনদের ব্যাপার-স্যাপার সম্বন্ধে আমার পক্ষে কোনো অজুহাত খাড়া করা সম্ভব নয়।

আমি লক্ষ্য করলাম, ওয়াটের বোন দুটো পুরো সমুদ্রযাত্রার বেশিরভাগ সময়ই নিজেদের শোবার ঘরের মধ্যেই কাটিয়ে দিচ্ছে। জাহাজের অন্য যাত্রীদের সঙ্গে কথাবার্তা বলা ও মেলামেশা করার জন্য বার বার বলা সত্ত্বেও তাদের উৎসাহি করা গেল না। বরং নিজেদের কামরাটার মধ্যে নিজেদের বন্দি করে রাখতেই তাদের বেশি। আগ্রহী দেখা গেল।

আর মিসেস ওয়াট? তাকে একটু বেশিমাত্রায় হাসিখুশি–প্রাণোচ্ছল মনে হল। আসলে মহিলাটি খুবই গল্পবাজ ও ফুর্তিবাজ। আর সমুদ্রযাত্রার পক্ষে ব্যাপার খুবই আকর্ষণীয়, তুচ্ছ করার অবশ্যই নয়। বিশেষ করে জাহাজের মহিলা যাত্রীদের সঙ্গে তো অচিরেই তার হৃদ্যতার সম্পর্ক গড়ে উঠল। রসান দিয়ে দিয়ে তুচ্ছ ঘটনাকেও হৃদয়গ্রাহী করে পরিবেশন করার ক্ষমতা দিয়ে সে আমাদের সবাইকে রীতিমত মাতিয়ে রাখল।

প্রকৃত ব্যাপারটা অল্পকালের মধ্যেই আমার কাছে পরিষ্কার হয়ে গেল। অনুসন্ধিৎসু চোখে তার ভাবসাব লক্ষ্য করে আমি বুঝে নিলাম, মিসেস ব্লউর গল্প কথা শুনে অন্যরা যত না হাসে, আনন্দে গদগদ হয়ে ওঠে তার চেয়ে অনেক, অনেক বেশি হাসাহাসি করে তাকে দেখে।

রুচিশীল ভদ্ৰব্যক্তি তার সম্বন্ধে আড়ালেও তেমন কিছু বলাবলি করে না। কিন্তু মহিলারা মুখে কলুপ এঁটে থাকতে পারল না। তারা নিজেদের মধ্যে বলাবলি করতে লাগল–‘ভদ্রমহিলার মনটা পরিষ্কার। তার কাছে কিছুই ঢাকঢাক গুড়গুড় নেই–যাকে বলে পুরোপুরি খোলা মনের মানুষ। তবে তিনি কিছুটা উদাসীন প্রকৃতির মানুষ, অস্বীকার কার নয়। একেবারেই অশিক্ষিত, অবশ্যই সভ্যতা-ভব্যতা বলতে কিছুই জানে না।

আমি ভদ্রমহিলাকে যতই দেখতে লাগলাম ততই বিস্ময়ে হতবাক হয়ে পড়তে লাগলাম, আমার শিল্পমনকে বন্ধুবর ওয়াটসনের মানুষ কি করে এরকম একজন মহিলার জালে ধরা দিল! সত্যি ব্যাপারটা আমাকে যারপরনাই বিস্মিত করল।

আরও ভেবে-চিন্তে সিদ্ধান্তে পৌঁছালাম। মালকড়ি, মানে ধন-সম্পদ এ সমস্যার একটা সমাধান হতে পারত সত্য। কিন্তু ওয়াটের বক্তব্য অনুযায়ী তা-ও তো না। কারণ ওয়াট তো আমাকে খোলাখুলিই বলেছে, মহিলা একটা কাণাকড়িও নিয়ে আসেনি। অর্থাৎ একেবারেই নিঃস্ব রিক্ত অবস্থায় সে তার ঘর করতে এসেছে। আর সে এও বলেছে মহিলাটি ভবিষ্যতে উত্তরাধিকার সূত্রে যে কিছু এমন পাবে তার কোননা। সম্ভাবনাও নেই। তবে কীসের মোহে যে আমার বন্ধুবর তার খপ্পরে পড়েছে তার কূলকিনারা করা আমার পক্ষে সম্ভব হলো না। ওয়াট আমার প্রশ্নের উত্তরে অবশ্য একবার বলেছিল, –’ভালোবাসার খাতিরেই সে বিয়ে করেছে। একমাত্র ভালোবাসার খাতিরেই। আর এও বলেছে–তার স্ত্রীরত্বটি ভালোবাসার তুলনায় যোগ্যতরই বটে।

বন্ধুবরের মুখে এসব কথা শুনে ভাবতে ভাবতে আমার মাথাটা কেমন যেন ঝিমঝিম করত, আমি ধাঁধায় পড়ে যেতাম। বারবার একই কথা আমার মাথায় চক্কর মারত–কি ব্যাপার, ওয়াটের মাথাটাথা কি খারাপ হয়ে গেল!’

কিন্তু এ ছাড়া তো আমার মাথায় অন্য কিছুই আসছে না, ভাবতেই পারছি না। মাথার দোষ দেখা না দিলে এমন কথা তো অন্তত ওয়াটের মতো রুচিবান যুবকের মুখে আশা করাই যায় না। আরও আছে, তাকে যে আমি কেবলমাত্র রুচিবান মনে করি তা-ই নয়। বিচক্ষণ আর খুঁত খুঁতে মেজাজেরও বটে।

সবচেয়ে বড় কথা, ওয়াট একজন শিল্পী। সে শিল্পের একজন রীতিমত সমঝদার। তার পক্ষে ব্যুৎ! আর ভাবতে পারছি না।

তবে এটাও মিথ্যা নয় যে, মহিলাটি তাকে খুবই পছন্দ করত, মনে-প্রাণে ভালোবাসে। কথায় কথায় সে ওয়াটকে ‘প্রেমিক প্রবর’ আর ‘প্রেমিক স্বামী’ প্রভৃতি বিশেষণ ব্যবহার করে সম্বোধন করে। আর এও সত্য, তার এ ধরনের সম্বোধনকে নিয়ে সবাই হাসিঠাট্টা করে, কেউ কেউ তো সামনাসামনি রসিকতা করে বহুরকম মন্তব্য করতেও ছাড়ে না। কিন্তু আর একটা ব্যাপার কেবলমাত্র আমার চোখেই পড়েনি, জাহাজের অন্যান্য যাত্রীরাও অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে লক্ষ্য করেছে, আমার বন্ধুবর খোলাখুলিভাবেই তার স্ত্রী-রত্নটাকে এড়িয়ে চলতেই বেশি উৎসাহি। সব চেয়ে বেশি করে লক্ষণীয় ব্যাপার হচ্ছে, অধিকাংশ সময়ই মি. ওয়াট নিজের শোবার কামরাটার মধ্যে একেবারে নিঃসঙ্গ অবস্থাতে কাটায়। আর তার সহধর্মিণী? সে মর্জিমাফিক বড়। কেবিনে বসে খুশিমনে সবার সঙ্গে বসে হাসিঠাট্টা গল্পগুজবে মেতে থাকে। স্বামী দেবতাটি কোথায়, কি অবস্থায় আছে সেদিকে কিছুমাত্র খেয়াল তার থাকে না। দরকারও মনে করে না। অবাক হবার মতো ব্যাপার নয় কি? ব্যাপারটাকে কেন্দ্র করে জাহাজের অন্য সবাই কিভাবে জানি না। আমি কিন্তু কিছুতেই স্বাভাবিক বলে মেনে নিতে তিলমাত্র উৎসাহও পাই না।

আমি ঘুরে ঘুরে অনুসন্ধিৎসু চোখে সবকিছু দেখে শুনে যা বুঝেছি তাতে শেষমেশ এ সিদ্ধান্তই নিয়েছি অদৃষ্টের বিড়ম্বনাবশত বা আবেগ উচ্ছ্বাসে অভিভূত হয়ে আমার শিল্পমনস্ক বন্ধুবর ওয়াট এমন এক মহিলার সংস্পর্শে এসেছে, নিজেকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে নিয়েছে যার ফলে তাকে যারপরনাই নিম্নস্তরে নেমে যেতে হয়েছে। আর এর পরিণতি যা হওয়া স্বাভাবিক এক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। আর আজ তা স্বাভাবিক বিরক্তির উদ্রেক করছে, তাকে অতিষ্ট করে তুলছে।

সবকিছু দেখে-শুনে আজ আমার মনে বন্ধুবর ওয়াটের জন্য করুণার উদ্রেক হচ্ছে, কিছুমাত্রও সন্দেহ নেই। কিন্তু, কিন্তু শেষ ভোজের ব্যাপারে এমন লুকোচুরি ধান্ধাবাজিকে মার্জনা করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়, কিছুতেই নয়।

এক বিকেলে আমি ডেকে রেলিং ধরে উত্তাল-উদ্দাম সমুদ্রের দিকে আনমনে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে দাঁড়িয়ে ছিলাম। হাজারো ভাবনা চিন্তা মাথার চারদিকে ভিড় জমাচ্ছে।

এমন সময় বন্ধুবর ওয়াট ধীর পায়ে ডেকে এলো।

আমি স্বভাবসুলভ আবেগ-উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে তার দিকে হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে বলে উঠলাম–‘আরে, ওয়াট যে!

সেও মুখে হাসি ফুটিয়ে তুলে আমার সঙ্গে করমর্দন সারতে সারতে বলল ভালো। তারপর তুমি কেমন আছ, বল?

আমি তার হাত ধরে বহুদিনের অভ্যাসমত ডেকে পায়চারি করতে লাগলাম। আমি গোপনে তার ভাবগতিক লক্ষ্য করতে লাগলাম। বুঝতে অসুবিধা হলো না, তার মানসিক পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটেনি, অর্থাৎ বিমর্ষ ভাবটা একই রকম রয়েছে। সে আগাগোড়া মুখ গোমড়া করেই আমার সঙ্গে পায়চারি করতে লাগল।

আমি তার মানসিক পরিস্থিতির কিছুটা অন্তত পরিবর্তন ঘটানোর জন্য বহুভাবে হাসিঠাট্টা শুরু করলাম। বহু চেষ্টা করে হলেও সে ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা ফুটিয়ে তুলল। খুবই সংক্ষেপে হলেও সাধ্যমত আমার রসিকতার জবাবও দিতে লাগল–

অদৃষ্ট বিড়ম্বিত ওয়াট! বেচারা ওয়াট! শেষপর্যন্ত ভাগ্য ঠুকে, সাহস করে তাকে ছোট্ট করে একটা ধাক্কা মারলাম। আগেই ভেবে রেখেছি, কেশ রসান দিয়ে দিয়ে দু চার কথার মাধ্যমে তার মনটাকে একটু হালকা করে নিয়ে তারপর কৌশলে ‘আয়তাকার কাঠের বাক্সটার প্রসঙ্গ তার কাছে পাড়ব। প্রসঙ্গক্রমে তাকে খুবই কৌশলে বুঝিয়ে দেব যে, তার বাক্সটার রহস্য আমি অবগত আছি, অর্থাৎ ওটার ভিতরে কি রক্ষিত আছে, সে ব্যাপারে আমি একেবারে অজ্ঞ নই। তবে খুবই সতর্কতার সঙ্গে খুবই ধীরে ধীরে এবং মেপে মেপে কথা বলে আমাকে অগ্রসর হতে হবে। সামান্য অসাবধানতা বা তড়িঘড়ি কাজ করতে গেলে পুরো ব্যাপারটাই ভেস্তে যেতে পারে।

যাক্, ভাগ্য ঠুকে আমি কাজে লেগে গেলাম। প্রসঙ্গটা শুরু করতে গিয়ে আমি বাক্সটার আয়তন, গঠন ও প্রকৃতির কথা পাড়লাম–‘বন্ধু, তোমার ওই বাক্সটার আকার কিন্তু বাস্তবিকই অদ্ভুত।’

সে মুচকি হাসল।

এবার আমি খুবই ধীরগতিতে এবং সতর্কতার সঙ্গে রসিকতার ভান করে প্রসঙ্গটাকে টেনে নিয়ে যেতে লাগলাম। কখনও বেশ রসান দিয়ে দিয়ে, কখনও কথার ফাঁকে ফাঁকে সর্বজ্ঞের ভাব দেখিয়ে, কখনও একটু-আধটু চোখ রাঙিয়ে আবার কখনও বা হাসতে হাসতে তার বুকে ছোট্ট করে টোকা দিয়ে কথা বলতে লাগলাম।

বন্ধুবর ওয়াটের আচরণ ও কথাবার্তার ধরন-ধারণ দেখে আমি স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। আমি কয়েকমুহূর্ত বজ্রাহতের মতো নিশ্চল-নিথরভাবে, নীরব চাহনি মেলে তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। আসলে সে আমার নির্জল ও নির্দোষ রসিকতাকে যেভাবে গ্রহণ করল, তা দেখে আমি ভাবতে বাধ্য হলাম, বুঝি বা বন্ধু ওয়াটের মস্তিষ্ক বিকৃতিই ঘটেছে, বুঝি পাগলই হয়ে গেছে।

আমি যখন তার সঙ্গে রসিয়ে রসিয়ে কথা বলে চলেছি তখন সে চোখে মুখে এমন। হতাশার ছাপ এঁকে আমার মুখের দিকে নীরবে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইল যেন আমার কথার বিন্দু বিসর্গও সে বুঝতে পারেনি, অর্থাৎ আমার রসিকতাটুকু তার কাছে নিতান্ত অবোধ্য।

আমি তার মুখের ওপর দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখেই কথা বলতে লাগলাম। লক্ষ্য করলাম, আমার বক্তব্যের অর্থ তার কাছে ক্রমে যত পরিষ্কার হতে লাগল ততই যেন তার চোখের মণি উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর হয়ে কোটর থেকে ঠিকরে বেরিয়ে আসতে শুরু করল।

আমার রসিকতার সম্পূর্ণ অর্থটা যখন তার হৃদয়ঙ্গম হলো তখন সে এমন গলা ছেড়ে হাসতে আরম্ভ করল যা আমাকে অবাকই করল। অবাক হবার মতো ব্যাপারই বটে। সে একটানা দশ মিনিট বা তার বেশি সময় ধরে এমন হো হো করে হাসল যা দেখলে যে কেউ অবাক না হয়ে পারবে না।

দীর্ঘসময় ধরে সরবে হেসে আমার বন্ধুটি এক সময় দুম্ করে ডেকের মেঝের ওপর বসে পড়ল। ডেকে রেলিং না থাকলে হয়তো বা সে হাসতে হাসতে উত্তাল সমুদ্রের বুকেই আছাড় খেয়ে পড়ে যেত। ভাগ্য ভালো যে, সেরকম কোনো অঘটন ঘটেনি।

বন্ধুর কাণ্ড দেখে আমি তো রীতিমত হকচকিয়ে গেলাম। তাকে ধরে মেঝে থেকে তুলতে গিয়ে স্তম্ভিত হয়ে গেল। মুহূর্তে ফুসফুস নিঙড়ে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। স্বগতোক্তি করলাম–‘হায় ঈশ্বর! বেচারা ওয়াট কি তবে মরেই গেল!

আমি আর্তনাদ করে উঠলাম। আমার আর্তস্বর শুনেই লোকজন ছুটে ডেকে এলো। সবাই মিলে ধরাধরি করে বন্ধুবর ওয়াটকে তার শোবার ঘরে নিয়ে গেলাম। বহু চেষ্টার মাধ্যমে তার সম্বিৎ ফিরিয়ে আনা সম্ভব হল।

সে চোখ মেলে তাকাল। স্থির তার দৃষ্টি। কয়েক মুহূর্ত নীরবে চোখের মণি দুটোকে বার বার এদিক-ওদিক ঘুরিয়ে উপস্থিত সবার মুখের দিকে তাকাল। তারপর আরও সামান্য বিশ্রামের মাধ্যমে একটু ধাতস্থ হতে পারল। এবার সে কিছুক্ষণ অর্থহীন বুলি আওড়াল। আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর তাকে একা থাকার ব্যবস্থা করে দিয়ে আমরা কামরা ছেড়ে বেরিয়ে ছিলাম।

পরদিন সকালে তার ঘরে গিয়ে দেখি, সে মোটামুটি সুস্থ স্বাভাবিক হয়ে গেছে। সুস্থ ও স্বাভাবিক বলতে আমি কিন্তু তার দৈহিক সুস্থতার কথাই বলতে চাইছি, অবশ্যই মানসিক নয়।

ব্যাপারটা নিয়ে জাহাজের ক্যাপ্টেনের সঙ্গে দু-চার কথা হতেই তিনি আমাকে পরামর্শ দিলেন, আমি যেন তার সংস্রব থেকে দূরে থাকি। আমি করলামও তাই। আসলে ক্যাপ্টেন বন্ধুবর ওয়াটের পাগলামির ব্যাপারে আমার মতামতকে সমর্থন করেই এরকম পরামর্শ দিয়ে সাবধান করে দিলেন। তিনি সব শেষে আমাকে সতর্ক করে দিতে গিয়ে বললেন-দেখুন মিস্টার, এ ব্যাপারে জাহাজের অন্য কোনো যাত্রীর কোনো কথা না বলাই উচিত বলে আমি মনে করছি। আশা করি আপনিও আমার সঙ্গে সহমত পোষণ করবেন, কী বলেন?

আমি ঘাড় নেড়ে তার বক্তব্য সমর্থন করলাম।

আমি বন্ধুবরের সংস্রব এড়িয়ে চললেও তার প্রতি পুরোপুরি উদাসীন হতে পারলাম না। ফলে গোপনে সাধ্যমত তার ওপর সতর্ক দৃষ্টি রেখে চলতে লাগলাম। লক্ষ্য করলাম, সে সম্বিৎ হারিয়ে ফেলার ঘটনাটার পর তার এমনকিছু ঘটনা একের পর এক ঘটতে লাগল যার ফলে তার সম্পর্কে আমার কৌতূহল উত্তরোত্তর বেড়েই চলল।

আমার নিজের স্নায়বিক উত্তেজনা দেখা দিল। ফলে আমি সবুজ চা পান করা শুরু করে দিলাম। আমার রাতের গভীর নিদ্রা ঘুচে গেল। মাঝে-মধ্যে ঘুম চটে যাওয়ায় বিছানায় বসেই বাকি রাতটুকু কাটিয়ে দিই। সত্যিকথা বলতে কি, দুটো রাততো নির্ঘুম অবস্থাতে নিদারুণ অস্থিরতার মধ্যে কাটাতে হয়েছে।

জাহাজের অন্য সব যাত্রীর শোবার ঘরের মতোই আমার কামরাটাও প্রধান কামরা বা খাবার ঘরের ভেতর দিয়ে খোলার ব্যবস্থা করা আছে। আর ওয়াটের কামরা তিনটি রয়েছে প্রধান কামরাটার পিছনে। মাঝখানে একটা ঠেলা-দরজার মাধ্যমে যাতায়াতের ব্যবস্থা এবং এটা দিয়েই প্রধান কামরাটা থেকে সেটাকে পৃথক করে নেওয়ার ব্যবস্থা। রাতেও ঠেলা-দরজাটা খোলাই থাকে, তালা লাগানো হয় না।

রাতে দমকা হাওয়ার চাপে ওই ঠেলা দরজাটা একবার খুলে গেলে সারা রাত খোলাই থাকে। কেউ সেটাকে বন্ধ করতে উৎসাহি হয় না, করেও না। আমার শোবার কামরাটা এমন জায়গায় যে, ওই ঠেলা দরজাটা আমার আসার ঘরের দরজাটা খোলা থাকলে আমি তার ঘরের সবকিছু পরিষ্কার দেখতে পাই। আর গরমের জন্য আমার দরজাটা অধিকাংশ সময় খুলেই বসতে হয়।

আমি যে দু-রাতের কথা বলেছি তা কিন্তু অবশ্যই পর পর দু-রাত নয়। যা-ই হোক, সে রাত দুটোতে নিঘুম অবস্থায় কাটানোর সময় রাত এগারোটা নাগাদ আমি পরিষ্কার দেখতে পেলাম, মিসেস ওয়াট খুবই সন্তর্পণে বন্ধুবর ওয়াটের শোবার কামরাটা ছেড়ে বেরিয়ে গেল।

স্বামীর কামরা থেকে বেরিয়ে মিসেস ওয়াট অতিরিক্ত ঘরটায় বাকি রাতটুকু নির্বিবাদে কাটাল। ভোরের আলো ফোঁটা অবধি সে সেখানেই কাটাল। ভোর হলে স্বামীর তলব পেয়ে আবার তার কামরাটায় ফিরে গেল। তারা যে পরস্পরের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে এ ঘটনাটা চাক্ষুষ করার পর আমার মনে তিলমাত্র সন্দেহও রইল না। তবে কি এটা বিবাহ-বিচ্ছেদেরই প্রস্তুতিপর্ব চলছে? নইলে আলাদা ঘরে রাত কাটাতে যাবেই বা কেন?

আমি আপন মনে বলে উঠলাম–‘উফ’! ব্যাপারটা যে এমন সহজ-সরল তা-তো ভুলেও ভাবিনি! অতিরিক্ত শোবার ঘরের রহস্যভেদ তো হয়েই গেল।

অতিরিক্ত শোবার ঘরের রহস্যটা ছাড়া আরও ব্যাপারের প্রতি দৃষ্টি বিশেষভাবে আকৃষ্ট হল। এটাও আমার মধ্যে কম রহস্যের সঞ্চার করেনি। আমি নিজের কানে শুনেছি, মিসেস ওয়াট বন্ধুবর ওয়াটের কামরা থেকে বেরিয়ে অতিরিক্ত কামরাটায় চলে যাবার পর তার ঘরের ভেতর থেকে সাবধানী চাপা শব্দ বার কয়েক বেরিয়ে এলো।

আমি উকর্ণ হয়ে শব্দটা শুনে ব্যাপারটা সম্বন্ধে ধারণা করার চেষ্টা করলাম। অচিরেই আমার কাছে পরিষ্কার হয়ে গেল, হাতুড়ি দিয়ে একের পর এক আঘাত হেনে আয়তাকার বাক্সটাকে খোলার চেষ্টা করা হচ্ছে। আরও কয়েক মুহূর্ত রুদ্ধশ্বাসে লক্ষ্য করার পর নিঃসন্দেহ হলাম, আমার অনুমানই অভ্রান্ত, বাক্সটাই খোলার চেষ্টা চলছে। বটে। আর একটা ব্যাপারও আমার কাছে পরিষ্কার হয়ে গেল, হাতুড়িটার মাথায় পশম বা তুলা জড়িয়ে দেওয়ার ফলেই শব্দটা এখন অস্পষ্ট ও চাপা শোনাচ্ছে।

যা-ই হোক, বার কয়েক এরকম শব্দটা হবার পর সেটা থেমে গেল। তারপর সম্পূর্ণ নতুন ধরনের একটা শব্দ আমার কানে এলো যাতে আমি বুঝতে পারলাম বাক্সের ডালাটা এবার খোলা হয়েছে। এবার বাক্সটার সঙ্গে বার্থের ঠোকর লাগায় বুঝতে পালাম সেটাকে তো নিচের কাঠের তলায় ঠেলে ঢুকিয়ে দেওয়া হল।

ব্যস, এবার আর কোনো শব্দই নেই। একেবারেই সুনসান। কয়েক মুহূর্ত নিরবচ্ছিন্ন নীরবতার মধ্য দিয়ে কাটার পর এমন চাপা একটা শব্দ কানে আসতে লাগল যাকে ভাষায় প্রকাশ করতে হলে ফোঁপানো শব্দটাই ব্যবহার করা যেতে পারে। তবে এও বলে রাখছি, সবটাই আমার কল্পনার ব্যাপার কি না নিশ্চিত করে বলতে পারি না।

কিন্তু শব্দটা যদি ফোঁপানোর না-ও হয়ে থাকে তবে বার বার দীর্ঘশ্বাস ছাড়ার শব্দ হওয়াও বিচিত্র নয়। তবে ঠিক এরকম একটা শব্দ আমার কানে দীর্ঘসময় ধরে অনবরত বেজেই চলল।

আমি একটা ব্যাপারে নিঃসন্দেহ যে, আমার বন্ধুবর শিল্পমনস্ক মি. ওয়াট তার শিল্পী মনের খেয়াল মেটাতে, চোখের তৃপ্তিলাভের জন্যই বাক্সটাকে খুলেছে। কিন্তু অবাক হবার মতো ব্যাপার যেটা তা হচ্ছে, এর জন্য এমন করে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদার কোনো যুক্তি থাকতে পারে?

আমি আবারও স্বীকার করে নিচ্ছি, আমার এরকম ধারণা জন্মানোর কারণ হিসেবে হয়তো বা ক্যাপ্টেন হার্ডির সবুজ কড়া চা-ই কাজ করছে।

একটা মাত্র রাতেই নয়, দু-দুটো রাতেই আমার স্পষ্ট কানে এসেছে বন্ধুবর মি. ওয়াট আয়তাকার বাক্সটার ঢাকনাটাকে জায়াগামত বসিয়ে হাতুড়ির দিয়ে আঘাত করে পেরেকগুলোকে আবার বসিয়ে দিয়েছে। আর আমি এও লক্ষ্য করেছি, বাক্সটার ব্যবস্থা করার পরই বন্ধুবর পোশাক বদলে নিয়েছে। তারপর শোবার ঘর থেকে বেরিয়ে মিসেস ওয়ার্টকে ডেকে ভেতরে নিয়ে গেছে।

এভাবে আমাদের জাহাজটা উত্তাল-উদ্দাম সাগরের বুকে সাত-সাতটা দিন অনবরত এগিয়ে চলতে লাগল। জাহাজটা অগ্রসর হতে হতে যখন হাতেরাস অন্তরীপের কাছাকাছি পৌঁছালো, তখন দক্ষিণ-পশ্চিম দিক থেকে ভয়ঙ্কর ঝড় ধেয়ে এলো।

আকাশের অবস্থা আবহাওয়ার পরিস্থিতির কথা বিবেচনা করে আমরা আগে থেকেই এরকম অনুমান করেছিলাম।

ঝড়ের আশঙ্কা করে জাহাজের ক্যাপ্টেন পাল-হাল সবকিছুরই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা করে রেখেছিলেন। ভয়ঙ্কর সে ঝড়ের তীব্রতা ক্রমে বেড়েই চলল। আর আটচল্লিশ ঘণ্টার মধ্যেই সেটা পুরোপুরি ঘূর্ণিঝড়ের রূপ নিল।

ব্যস, শুরু হয়ে গেল এক প্রলয়ঙ্কর কাণ্ড। চোখের পলকে জাহাজের পিছনের পালটা ছিঁড়ে টুকরো টুকরো হয়ে গেল। সমুদ্র যেন ক্রমেই উন্মাদনায় মেতে উঠল। একের পর এক পর্বত প্রমাণ ঢেউ ধেয়ে এসে জাহাজের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়তে লাগল। ঠিক সে মুহূর্তেই ঘটে গেল একেবারেই অপ্রত্যাশিত এক দুর্ঘটনা। অতর্কিতে তিনজন লোক জাহাজ থেকে ছিটকে ক্রোধোন্মত্ত সমুদ্রের পানিতে পড়ে গেল।

অভিজ্ঞ ক্যাপ্টেন বহু চেষ্টা করে পরিস্থিতিটাকে একটু সামাল দেবার আগেই সামনের দিককার পালটা ছিঁড়ে টুকরো টুকরো হয়ে গেল। সেটার ব্যবস্থা করতে গিয়েই আমাদের তিনটি ঘণ্টা চলে গেল। জাহাজও আগের চেয়ে অনেক মন্থর হয়ে এলো। সেটা যেন কোনোরকমে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলতে আরম্ভ করল।

ঝড়ের উন্মাদনা সমান তালেই চলতে আরম্ভ করেছে। ঝড়ের বেগ কমবার বা থামবার কোনো লক্ষণই নজরে পড়ছে না। ছিঁড়ে টুকরো টুকরো হয়ে-যাওয়া পাল আরও ছিঁড়তে শুরু করল।

জাহাজের সবাই যখন পালটা মেরামত করতে ব্যস্ত ঠিক তখনই জাহাজের কাঠমিস্ত্রি হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলো। সে বলল–‘জাহাজের খোলে পানি ঢুকে চারফুট দাঁড়িয়ে গেছে। এখনই পানি সরাতে না পারলে প্রমাদ ঘটবে।

বিপদ কখনও একা আসে না। খোলের পানি সরাতে গিয়ে পাম্পযন্ত্রগুলো প্রায় অকেজো হয়ে পড়েছে। জাহাজের সবার মধ্যে আতঙ্কের সঞ্চার হল। শুরু হয়ে গেল চিৎকার চাঁচামেচি। দারুণ হতাশায় সবাই ভেঙে পড়ার যোগাড় হল। ক্যাপ্টেনের নির্দেশে ভারী মালপত্র দমাদম পানিতে ফেলে দিয়ে জাহাজটা হালকা করার কাজে সবাই মেতে গেল। তখনও দুজন অক্ষত রয়েছে। তাড়াতাড়ি সে দুটোর মাথাও কেটে সমুদ্রে ফেলে দেওয়া হল।

দীর্ঘসময় ধরে চেষ্টা করেও পাম্পগুলো মেরামত করা গেল না। আবার এদিকে ক্রমাগত পানির চাপে খোলের তলদেরে চিত্রটাও ক্রমে বড় হতে লাগল। একের পর এক প্রতিকূল পরিস্থিতির উদ্ভব হওয়ায় ক্যাপ্টেনের মুখে হতাশার ছাপ ফুটে উঠল।

সূর্য পাটে বসল। সমুদ্রের বুকে নেমে এলো আলো-আঁধারি। এবার ঝড়ের তাণ্ডব অনেকাংশে কমে গেল। সমুদ্রও শান্ত-স্বাভাবিক হয়ে এলো।

আমরা নতুন করে আশার আলো দেখতে লাগলাম।

রাত আটটায় আকাশ মেঘমুক্ত হল। চাঁদ দেখা দিল। ভাগ্য সামান্য সুপ্রসন্ন হওয়ায় আমাদের মনে খুশির জোয়ার দেখা দিল।

অস্বাভাবিক পরিশ্রমের মাধ্যমে সবচেয়ে বড় নৌকাটাকে মেরামত করা সম্ভব হল। এবার জাহাজের সব কর্মচারী আর বেশিরভাগ যাত্রীকে তাতে তুলে সেটাকে ছেড়ে দেওয়া হল।

নৌকার যাত্রীরা বহু কষ্ট স্বীকার করে তিনদিন ক্রমাগত সমুদ্র পাড়ি দিয়ে ওক্লাকোক খাড়িতে উপস্থিত হল।

জাহাজের পিছনে বাঁধা ছোট্ট নৌকাটা সম্বল করে ক্যাপ্টেন চৌদ্দজন যাত্রীকে নিয়ে তাতে রয়ে গেলেন। বহু কষ্টে সেটাকে সমুদ্রে ভাসানো সম্ভব হল। পানিতে নামিয়ে দেওয়া মাত্র নৌকাটা যে তলিয়ে গেল না সেটাকে অলৌকিক ব্যাপার ছাড়া আর কী-ই বা বলা যেতে পারে?

যা-ই হোক, ছোট নৌকাটায় আশ্রয় নিয়েছেন, ক্যাপ্টেন আর তাঁর সহধর্মিণী, দলবলসহ আমার বন্ধুবর মি. ওয়াট, আমি নিজে, চারজন ছেলে-মেয়ে নিয়ে একজন মেক্সিকান অফিসার আর তার সহধর্মিনী আর একজননিগ্রো খানসামা।

অত্যাবশ্যক কিছু যন্ত্রপাতি, কিছু খাদ্যবস্তু, পিঠের ওপর পোশাক-পরিচ্ছদের গাড়ি নিয়ে বসে থাকার জায়গা ছাড়া নৌকটায় আর জায়গা ছিল না। এ ছাড়া অন্য কিছু রক্ষা করার কথা আমারা ভাবিনি।

কিন্তু নৌকাটা জাহাজ ছেড়ে কিছুটা দূরে যেতেই আমার বন্ধুবর মি.ওয়াট ঝট করে উঠে দাঁড়িয়ে পড়ে ক্যাপ্টেন হার্ডিকে বলল–‘নৌকাটাকে জাহাজের কাছে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে হবে।’

ক্যাপ্টেন সবিস্ময়ে তার মুখের দিকে তাকালেন।

মি. ওয়াট এবার বেশ দৃঢ়তার সঙ্গেই বলল–‘নৌকাটাকে জাহাজের কাছে নিয়ে যেতেই হবে। কারণ, আমার একটা আয়তাকার বাক্স জাহাজে রয়ে গেছে।’

তার কথায় সবাই বিস্ময়ে হতবাক্ হয়ে গেল।

ক্যাপ্টেন একটু রাগত স্বরেই বললেন–আপনি করছেন কি মি. ওয়াট! শান্ত হয়ে বসুন। আপনি কি এতগুলো প্রাণীকে ডুবিয়ে মারতে চান! সমুদ্রের পানি যে জাহাজের একেবারে কাণায় উঠে গেছে তা-তো নিজের চোখেই দেখতে পাচ্ছেন।

‘কিন্তু হায়! আমার আয়তাকার বাক্সটা! ক্যাপ্টেন হার্ডি দয়া করে আপত্তি করবেন না। বাক্সটার ওজন তো সামান্য-খুবই সামান্য। আপনার গর্ভধারিণীর দোহাই, পরম পিতার ভালোবাসার দোহাই আর আপনার মুক্তি-আশার দোহাই–আমার বাক্সটা ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করে অশেষ উপকার করুন।

আমার শিল্পী বন্ধু মি. ওয়াটের কাতর অনুরোধে ক্যাপ্টেন হার্ডির মন মুহূর্তের জন্য একটু দুর্বল হলেও পরমুহূর্তেই গম্ভীর স্বরে বললেন–‘মি. ওয়াট, আমি আপনার কথায় কেবল অবাকই হচ্ছি না, বলতে বাধ্য হচ্ছি–আপনি কী পাগল হয়েছেন! আপনার অনুরোধ রক্ষা করা আমার পক্ষে কিছুতেই সম্ভব নয়। আপনি বসুন! আপনি নৌকাটা ডুবিয়ে ছাড়বেন না দেখছি!’

এবার আমাদের সবাইকে লক্ষ্য করে ক্যাপ্টেন হার্ডি বলে উঠলেন–‘আপনারা ওনাকে ধরুন, জোর করে বসিয়ে দিন–আটকান! নইলে তিনি হয়তো পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়বেন! আরে আরে, এই রে! আমি আগেই আশঙ্কা করেছিলাম। উফ শেষ–সব শেষ হয়ে গেল!

ক্যাপ্টেন হার্ডির মুখের কথাটা শেষ হবার আগেই আমার বন্ধুবর মি. ওয়াট সমুদ্রে ঝাঁপ দিল।

জাহাজ থেকে দড়ি ঝোলানো রয়েছে। কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে উত্তাল-উদ্দাম সমুদ্রের সঙ্গে লড়াই করে সাঁতরে কোনোরকমে দড়ির শেষ প্রান্তটা ধরে ফেলল। তারপর উন্মাদের মতো দড়িটা বেয়ে বেয়ে জাহাজে উঠে গেল। জাহাজে পা দিয়েই লম্বা-লম্বা পায়ে তার শোবার ঘরের দিকে ছুটে চললেন।

ইতিমধ্যে আমরা ঝড়ের ধাক্কায় নৌকার একেবারে শেষ প্রান্তে হুমড়ি খেয়ে পড়লাম। উত্তাল-উদ্দাম সমুদ্রের বুকে আমরা নিতান্তই অসহায় বোধ করতে লাগলাম। আমরা দাঁতে দাঁত চেপে নৌকাটাকে ফেরাবার চেষ্টা করে ব্যর্থ হলাম।

আমি এত বিপদের মধ্যেও ঘাড় ঘুরিয়ে মি. ওয়াটের অবস্থা সম্বন্ধে আঁচ করে নেবার চেষ্টা করলাম। তার বাঁচার কিছুমাত্র আশাও যে নেই, এ ব্যাপারে কিছু মাত্র সন্দেহও রইল না।

শঙ্কটাপন্ন ধ্বংসপ্রায় জাহাজটা থেকে আমাদের নৌকাটার দূরত্ব দ্রুত বেড়ে যেতে লাগল।

আমি আবারও ঘাড় ঘুরিয়ে জাহাজটার দিকে তাকালাম। দেখলাম, আমার বন্দুবর, যাকে বদ্ধ পাগল ছাড়া আর কিছু ভাবা যায় না। সে আয়তাকার বাক্সটাকে। টেনে হিঁচড়ে জাহাজের ডেকের ওপরে উঠছে। ব্যাপারটা আমার বিস্ময়কে তুঙ্গে নিয়ে গেল। আর যা দেখলাম তা হচ্ছে তিন ব্যাসযুক্ত দড়িটা দিয়ে প্যাঁচ দিয়ে দিয়ে বাক্সটাকে আচ্ছা করে বাঁধল। তারপর সেটার সঙ্গে নিজের শরীরটাকেও বেঁধে ফেলল।

ব্যস, এবার মুহূর্তের মধ্যে বাক্সসহ আমার বন্ধুটি দুম্ করে সমুদ্রের বুকে পড়ে গেল। মুহূর্তের মধ্যেই সে চিরতরে বেপাত্তা হয়ে গেল।

আমরা কয়েকমুহূর্ত সে দিকে নীরবে, অপলক চোখে তাকিয়ে থাকলাম। তারপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বৈঠা হাতে তুলে নিলাম। ঘণ্টাখানেক কারো মুখে রা সরল না। সবাই নিশ্চল-নিথর পাথরের মূর্তির মতো বসে রইল।

আমিই চাপা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে প্রথম মুখ খুললাম–‘ক্যাপ্টেন হার্ডি, তারা কত অল্পক্ষণের মধ্যে তলিয়ে গেল লক্ষ্য করেছেন কী?

ক্যাপ্টেন হার্ডি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে নীরবে আমার মুখের দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইল। আমি পূর্ব প্রসঙ্গের জের টেনে এবার বললাম–এত অল্পক্ষণের মধ্যে পানিতে তলিয়ে যাওয়ার ব্যাপারটা খুবই অস্বাভাবিক মনে হচ্ছে নাকি? বাক্সটার সঙ্গে নিজেকে বেঁধে নিয়ে সে যখন পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল তখন কিন্তু আমার মনে খুবই

ক্ষীণ হলেও আশা ছিল শেষমেশ সে প্রাণে বেঁচে যাবে। কিন্তু উফ!

অস্বাভাবিক নয়, বরং খুবই স্বাভাবিকভাবেই ওরা পানিতেই বাক্সসহ তলিয়ে গেছেন। তবে বলা যেতে পারে খুবই দ্রুত কাজটা ঘটে গেছে।

‘উফ্! কী ভয়ঙ্কর ব্যাপার!’

‘বাক্সটাসহ তিনি আবার ভেসে উঠবেন লবণগুলো গলে যাবার পর, তার আগে অবশ্যই নয়।

আমি চমকে উঠে বললাম–‘লবণ! কি বললেন, লবণ!

ক্যাপ্টেন নিজেকে সামলে নিয়ে মৃতলোকে স্ত্রী ও বোনকে দেখিয়ে ক্ষীণ কণ্ঠে উচ্চারণ করলেন–এখন ব্যাপারটা চেপে যান। পরে সুযোগ বুঝে এ প্রসঙ্গে কথা বলব।’ বহু কষ্ট ভোগ করলেও পিতৃদত্ত জীবনটা কোনোরকমে রক্ষা পেল। কিন্তু অদৃষ্ট আমাদের এবং বড় নৌকাটার আরোহীদের বিচ্ছিন্ন করে দিল।

শেষমেশ চার চারটি দিন নিরবচ্ছিন্ন অবর্ণনীয় দুঃখ-কষ্ট ভোগ করে আমরা রনোক দ্বীপের বিপরীত দিকের তীরে আধমরা অবস্থায় নৌকা থেকে নামলাম। এই দ্বীপের তীরে আমাদের সাতদিন কাটাতে হল। উদ্ধারকারীরা আমাদের সঙ্গে কোনোরকম দুর্ব্যবহার করল না।

শেষপর্যন্ত আমরা যাতে নিউইয়র্কে পৌঁছাতে পারি সে ব্যবস্থাও হয়ে গেল। একদিন হঠাৎই ব্রডওয়েতে ক্যাপ্টেন হার্ডির সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। ইন্ডিপেন্ডেন্স’ জাহাজটা ধ্বংস হয়ে যাবার প্রায় একমাস পরের ঘটনা।

তাঁর সঙ্গে কথা বলার সময় প্রসঙ্গক্রমে জাহাজ-দুর্ঘটনার কথা, বিশেষ করে অদৃষ্টবিড়ম্বিত বন্ধুবর ওয়াটের দুর্ভাগ্যের প্রসঙ্গ উঠল।

ক্যাপ্টেন হার্ডির মুখেই তখন এ-কথাগুলো শোনালাম। আমার শিল্পী বন্ধু ওয়াট নিজের স্ত্রীর, দুবোন আর এক পরিচারকের জাহাজের টিকিট কেটেছিল। তাঁর স্ত্রী ছিল যথাযর্থই রূপসি আর গুণবতী। ১৪ জুন, অর্থাৎ যেদিন আমি প্রথম জাহাজে গিয়েছিলাম সেদিন মহিলাটি হঠাৎ রোগগ্রস্থ হয়ে পড়লেন। অল্প রোগভোগের পর হঠাই মারা যায়।

স্ত্রীর অকাল মৃত্যুতে যুবক স্বামী মি. ওয়াট শোকে-দুঃখে পাগলের মতো হয়ে পড়ল। ফলে ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে তার নিউনিয়র্ক যাওয়ার বাধা পড়ল।

পত্নীহারা স্বামী ভাবল, তার প্রিয় পত্নীর মৃতদেহটাকে তার মায়ের কাছে নিয়ে যেতে হবে। কিন্তু কুসংস্কারবশত এ কাজটাকে প্রকাশ্যে করাও সম্ভব নয়, অন্য সবার দিক থেকে আপত্তি উঠবেই। এটা তো খুবই স্বাভাবিকই বটে, একটা মৃতদেহ জাহাজে থাকলে তার সঙ্গে যাত্রা করতে হবে, কথাটা প্রচার হয়ে গেলে দশভাগের নয়ভাগ যাত্রী জাহাজ ছেড়ে চম্পট দেবে।

এরকম একটা মহা সমস্যার সমাধান ক্যাপ্টেন হার্ডির মাথা দিয়েই বেরল। তিনি পরামর্শ দিলেন, মৃতদেহটার গায়ে প্রথমে গন্ধতেল মাখিয়ে দিতে হবে। তারপর বড়সড় একটা বাক্সে প্রচুর পরিমাণে লবণ দিয়ে তারপর মৃতদেহটাকে রেখে ঢাকনা বন্ধ করে দিতে হবে। এবার বাক্সটাকে মালপত্রের মতো জাহাজে তুলে নিতে হবে। ব্যস, কারো মনেই কোনো সন্দেহ জাগবে না।

সবশেষে ক্যাপ্টেন হার্ডি আমার বন্ধুবর ওয়ার্টকে সতর্ক করে দিতে গিয়ে বললেন–‘খবরদার! আপনার স্ত্রীর মৃত্যুসংবাদ যেন ঘুণাক্ষরেও কেউই জানতে না পারে।

আর যেহেতু ব্যাপারটা জানাজানি হয়ে গিয়েছিল যে, আমার শিল্পী বন্ধুবর মি. ওয়াট তাঁর স্ত্রীরও একটা টিকিট কেটেছে। তাই তার স্ত্রী সেজে জাহাজে তাকে সঙ্গদান করতে পারে এমন একজন অবশ্যই জাহাজে যাবে। মৃতার পরিচারিকাকে প্রস্তাব দিতে সে সহজেই সম্মত হল।

প্রথমে যে শোবার ঘরটা পরিচারিকাটার জন্য ভাড়া করা হয়েছিল, সেটা অবশেষে খালিই রাখতে হল। তবে রোজ রাতে সে পরিচারিকা মেয়েটা তার নকল স্ত্রী, স্ত্রীর অভিনয় করতে গিয়ে সে শোবার ঘরটাতেই শোয়। আর দিনে? দিনের বেলা পরিচারিকা মেয়েটা যথাসাধ্য তার মনিবাণির ভূমিকা পালন করে। অসুবিধার কিছু তো ছিল না। কারণ, জাহাজের অন্য কোনো যাত্রী তো আর তাকে চেনে না।

খুবই বেশি রকম অসর্তকতাই স্বাভাবিকভাবেই আমার ভুল হয়েছিল। আর অস্বাভাবিক আবেগপূর্ণ মনোভাব আর অতিরিক্ত কৌতূহলও আমার ভুলের জন্য কম দায়ী নয়। কিন্তু বর্তমানে আমি খুব কম রাতেই ঘুমোতে পারি। কিছুতেই চোখের পাতাগুলো এক করতে পারি না। একটা মুখ প্রতি মুহূর্তেই আমাকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায়। আর ভৌতিক একটা হাসি সর্বক্ষণ আমার কানে বাজে, চিরদিন একই রকমভাবে বাজবে, চিরদিনই।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *