দ্য এস্কেপ অভ আর্সেন লুপাঁ

দ্য এস্কেপ অভ আর্সেন লুপাঁ

অনুবাদ: মহিউল ইসলাম स

কারাগারের ছোট্ট সেলের দরজাটা যখন খুলে গেল, আর্সেন লুপাঁ তখন তার খাওয়াদাওয়ার পর্বটা মাত্র শেষ করে পকেট থেকে একটা সিগার বের করে পরীক্ষা করছিল গভীরে মনোযোগে। সিগারটা খুব উন্নতমানের, গায়ে জড়ানো ব্যান্ডটা সোনালি রঙের। সেই ব্যান্ডটার দিকেই গভীর মনোযোগে তাকিয়ে ছিল সে। অখণ্ড মনোযোগের জন্যই মূলত পুরো ব্যাপারটা গার্ডের চোখে পড়ার আগেই সিগারটা ড্রয়ারে ঢুকিয়ে দ্রুত সেখান থেকে সরে আসার সুযোগটা সে পেল না। গার্ড দেখে ফেলল সবকিছু। গার্ড সেলের ভেতরে ঢুকল। আর্সেন লুপাঁর শরীরচর্চার সময় হয়ে গেছে।

“তোমার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম, মাই ডিয়ার বয়!” স্বভাবসুলভ বিখ্যাত সেই হাস্যরস মেশানো গলায় বলল লুপাঁ।

তারপর স্বাভাবিক ভঙ্গিতে সেল থেকে বেরিয়ে এলো গার্ডের সাথে। দুজনে কারাগারের করিডোরের বাঁকটা পেরিয়ে যেতে না যেতেই অন্য দুজন লোক আর্সেন লুপাঁর সেলটাতে প্রবেশ করল এবং পুরো সেলটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পরীক্ষা করে দেখল পাক্কা এক মিনিট। এই দুজনের একজন ইন্সপেক্টার ডিউজি, আর আরেকজন ইন্সপেক্টর ফোলফ্যান্ট। দুজনেরই গভীর সন্দেহ যে আর্সেন কারাগারের বাইরে তার শাগরেদদের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ চালিয়ে যাচ্ছে। এটা নিশ্চিত করতেই তাদের এই গোপন তল্লাশি। আগের দিন সন্ধ্যায় কোর্ট রিপোর্টারের বরাত দিয়ে ‘দ্য গ্র্যান্ড জার্নাল’ পত্রিকা নিচের লাইনগুলো প্রকাশ করেছে।

মসিয়ে,

সাম্প্রতিক একটা আর্টিকেলে আপনি আমার ব্যাপারে যেভাবে উল্লেখ করেছেন তা মোটেই গ্রহনযোগ্য নয়। আমার ট্রায়াল শুরু হওয়ার কিছুদিন আগেই এ ব্যাপারে আপনাকে তলব করব আমি।

  • আর্সেন লুপাঁ

হাতের লেখা যে লুপাঁর তাতে কোনো সন্দেহ নেই। অতএব, চিঠিটা আর্সেন লুপাঁ-ই পাঠিয়েছে। আর পাঠাতে যখন পেরেছে তখন কিছু চিঠি যে পাচ্ছেও তাতেও কোনো সন্দেহ নেই। সবকিছু মিলিয়ে এটা জলের মতো পরিষ্কার যে প্রচণ্ড ধৃষ্টতার সাথে জেল থেকে পালিয়ে যাওয়ার যে ঘোষণা আর্সেন দিয়েছিল সেটার চূড়ান্ত প্রস্তুতি চলছে।

ব্যাপারটা নিয়ে রীতিমতো হইচই শুরু হয়ে গেছে। ভারপ্রাপ্ত বিচারপতির আদেশে নিরাপত্তা বিভাগের প্রধান, মঁসিয়ে দুদো, সশরীরে কারাগার পরিদর্শন করেছেন এবং আর্সেন লুপাঁর ব্যাপারে প্রয়োজনীয় সব সতর্কতা জোরদার করার নির্দেশ দিয়ে গেছেন। পাশাপাশি ইন্সপেক্টর ডিউজি আর ফোলফ্যান্টকে পাঠানো হয়েছে লুপাঁর সেল তল্লাশি করার জন্য। এসব ক্ষেত্রে যা যা করা হয় তার সবই করা হলো। সেলের প্রত্যেকটা ইট পরীক্ষা করা হলো, পুরো বিছানা তোলপাড় করে দেখা হলো। কিন্তু কিছুই পাওয়া গেল না। হতাশ হয়ে হাল ছেড়ে দিয়ে দুই ইন্সপেক্টর মাত্র সেল থেকে বের হয়ে আসতে যাচ্ছিল এমন সময় সেই গার্ড হন্তদন্ত করে সেলে প্রবেশ করেই বলল,

“ওই ড্রয়ার… টেবিলের ড্রয়ারে দেখুন। সেলে ঢোকার সময় ওকে ড্রয়ারটা বন্ধ করতে দেখেছি আমি।”

গার্ডের কথা শুনে ড্রয়ার খোলা হলো। প্রায় সাথে সাথে ডিউজির মুখ থেকে বেরিয়ে এলো,

“আ! যাক… এবার ধরেছি ব্যাটাকে।”

পাশ থেকে ফোলফ্যান্ট বলল, “যা কিছু পাওয়া যাবে তার একটা তালিকা চাইতে পারেন সিকিউরিটি চিফ। লিস্টটা করে ফেলতে হবে। “

“খুব ভালো সিগার। ব্যাটার পছন্দ আছে।”

“আপাতত এখানেই থাকুক, আগে চিফকে জানানো দরকার।”

.

ঠিক দুই মিনিট বাদে। সিকিউরিটি চিফ দুদো খুব সতর্কতার সাথে ড্রয়ারের প্রতিটা জিনিস পরীক্ষা করে দেখল। প্রথমেই অনেকগুলো পত্রিকার কাটিং দেখা গেল, সবগুলোতে আর্সেন লুপাঁ সংক্রান্ত খবর, তারপর একটা টোব্যাকো বক্স, সাথে একটা পাইপ। ‘অনিয়ন পিল’ শিরোনামে কিছু কাগজপত্রও দেখা গেল। আর দুইটা বই। একটা হলো কারলাইলের ‘হিরো- অরশিপ’ বইটার ইংরেজি সংস্করণ। অন্যটা ‘ম্যানুয়াল অব এপিকটেটাস’ বইয়ের জার্মান সংস্করণ। জার্মান সংস্করণটার চেহারা দেখার মতো, ১৬৩৪ সালে লেডেন থেকে প্রকাশিত। বইগুলো খুলে দেখা গেল, অসংখ্য আন্ডরলাইন আর প্রতিটা পৃষ্ঠায় লেখা বিভিন্নরকম নোট। এসব আন্ডারলাইন আর নোটগুলো কি বিশেষ কোনো সংকেত বা এ-রকম কিছু? না কি শুধুই একজন সচেতন পাঠকের নির্দোষ অভ্যাস? তারপর অভিজ্ঞ চোখে তামাকের বাক্স আর পাইপটা পরীক্ষা করল সিকিউরিটি চিফ দুদো। সবার শেষে সেই সিগারটা হাতে তুলে নিল সে।

তারপর বেশ অবাক চোখে বলল, “সিগারে আমাদের বন্ধুর রুচি তো দেখছি খুব উন্নত। হেনরি ক্লে ব্র্যান্ডের সিগার।”

সিগার জিনিসটা সিকিউরিটি চিফ নিজেও বেশ পছন্দ করে। অনেকটা অভ্যাসবশত-ই সিগারটাকে কানের কাছে নিয়ে দু’আঙুলে একটা চাপ দিলো সে। দু’আঙুলের মাঝে মড়াৎ করে একটা শব্দ তুলে ভেঙে গেল সিগার। বিস্ময়ের একটা ধ্বনি আপনা থেকেই বেরিয়ে এলো মঁসিয়ে দুদোর মুখ থেকে। ভাঙা সিগারটাকে আরও ভালোভাবে দেখতেই সিগারের তামাকের ভেতর একটা সাদা কিছু আবিষ্কার করল সে। একটা পিনের সাহায্যে খুব সাবধানে সাদা জিনিসটাকে বের করে আনতেই দেখা গেল, গোল করে প্যাঁচানো পাতলা একটা কাগজ। চওড়ায় একটা টুথপিকের চেয়ে বেশি হবে না। জিনিসটা একটা চিঠি সেটা বুঝতেও সময় লাগল না। সাবধানে গোল করে প্যাঁচানো চিঠি খোলা হলো। মেয়েলি হাতের লেখায় লেখা আছে:

‘বাক্স বদলানো হয়ে গেছে। দশটার মধ্যে আটটাই পুরোপুরি প্রস্তুত। পা দিয়ে সামনের দিকে চাপ দিলে পেট নিচে নেমে যাবে। প্রতিদিন বারোটা থেকে ষোলোটা পর্যন্ত। এইচ-পি অপেক্ষা করবে। কিন্তু কোথায়? এখনই উত্তর পাঠাও। বেশি চিন্তা কোরো না, বন্ধুর চোখ সবসময় আছে তোমার ওপর।’

খুব বেশি চিন্তা করতে হলো না মঁসিয়ে দুদোকে। বলল, “বেশ ভালোভাবেই বোঝা যাচ্ছে… ঝুড়ি… আটটা কম্পার্টমেন্ট… বারোটা থেকে ষোলোটা মানে দুপুর বারোটা থেকে বিকেল চারটা বোঝানো হচ্ছে।”

“এইচ-পি? এই এইচ-পি দিয়ে কি বোঝানো হচ্ছে?”

“এইচ-পি দিয়ে সম্ভবত অটোমোবাইল বোঝানো হচ্ছে। এইচ-পি, অর্থাৎ হর্স পাওয়ার। এইচ-পি দিয়ে মোটরের শক্তি বোঝানো হয়। একটা চব্বিশ এইচ-পি মানে চব্বিশ হর্স-পাওয়ার ক্ষমতাসম্পন্ন একটা অটোমোবাইল বা গাড়ি।”

তারপর মঁসিয়ে দুদো উঠতে উঠতে বলল, “বন্দির সকালে নাস্তা কি শেষ হয়েছে?”

“হ্যাঁ।”

“সিগারের চেহারা দেখে যা মনে হচ্ছে, এই গোপন বার্তা এখনও দেখেনি লুপাঁ। আর বার্তাটি পৌঁছানোর বেশিক্ষণ হয়নি।”

“কিন্তু পৌঁছল কীভাবে?”

“সকালের নাস্তার সাথেই এসে পৌঁছেছে সম্ভবত।”

“অসম্ভব। লুপাঁকে বাইরে থেকে খাবার আনার অনুমতি দেওয়ার একমাত্র কারণ, যাতে ওর দুরভিসন্ধি ধরতে পারি আমরা। আর প্রতিবার ওর খাবার ভালোভাবে পরীক্ষা করা হয়।”

“আজকে সন্ধ্যায় লুপাঁর ওপর ভালোভাবে চোখ রাখতে হবে। আপাতত ওকে কিছুক্ষণ বাইরে কোথাও ব্যস্ত রাখো। এরমধ্যে আমি এই চিঠি নিয়ে এক্সামিনিং জাজের সাথে একটু আলাপ করে আসি। আর চিঠির একটা ফটোগ্রাফও রাখতে হবে। আর ঘন্টাখানেকের মধ্যে এই সিগারের মতো আরেকটা তৈরি করে, তার মধ্যে এরকম আরেকটা চিঠি ঢুকিয়ে জায়গা মতো রেখে দিতে হবে। লুপাঁ যাতে কোনোভাবেই কোনো কিছু সন্দেহ করতে না পারে।”

সন্ধ্যায় মঁসিয়ে দুদো আবার এলেন সেলে। সাথে ইন্সপেক্টর ডিউজি। এককোণে স্টোভের ওপর তিনটা খালি থালা।

“ওর খাওয়া হয়েছে?”

“হ্যাঁ।” উত্তর দিল সেলের গার্ড।

“ডিউজি, ম্যাকারনিগুলো কুচি কুচি করে কেটে ভেতরটা ভালো করে দেখো। আর রোলের রুটিটাও খুলে দেখো, ভেতরে কিছু পাও কিনা। … তারপর কিছুটা সময় দিয়ে আবার জিজ্ঞেস করল, “কিছু আছে?”

“না, চিফ।”

মঁসিয়ে দুদো খুব সাবধানে প্লেট, কাটা চামচ আর ছুরিটা পরীক্ষা করলেন। সাধারণ একটা ছুরি, মাথাটা গোলাকার। ছুরির হাতলটা ধরে একটু ঘোরাতেই একটা প্যাচ খুলে গেল। ছুরির হাতলটা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে খুলতেই দেখা গেল ভেতরটা ফাঁপা। ফাঁপা জায়গাটাতে একটা কাগজ লুকানো।

“আর্সেন লুপাঁর মতো চালাক একটা লোকের তুলনায় বেশ বোকার মতো কাজ হয়েছে বলতেই হবে।” অবজ্ঞাভরে বলল দুদো, “ডিউজি, তুমি এখনই রেস্টুরেন্টে চলে যাও, ভালো করে খোঁজ-খবর করো।”

আদেশটা দিয়েই লুকানো বার্তাটা খুলল সে। পড়তে শুরু করল:

‘তোমার ওপর আমার বিশ্বাস আছে। এইচ পি প্রতিদিন দূর থেকে অনুসরণ করবে। আমি একটু সামনে থাকব। অউ রেভো, প্রিয় বন্ধু।’

বেশ আহ্লাদিত কণ্ঠে মঁসিয়ে দুদো বলে উঠল, “যাক, পুরো ব্যাপারটা আমাদের হাতে চলে এসেছে। এখন একটু বুদ্ধি করে পরবর্তী চালটা চাললেই আর্সেন লুপাঁর কেল্লা ফতে। “

“কিন্তু লুপাঁ যদি আঙুলের ফাঁক গলে বেরিয়ে যায়?” পাশ থেকে বলে উঠল গার্ড।

“আমরা আগে থেকেই সবরকম পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত থাকব। আমাদের হাতে লোকবল তো কম নেই। আর খোদার কসম, লুপাঁ যদি বেশি চালাকির চেষ্টা করে তাহলে খুব খারাপ হয়ে যাবে।” দাঁতে দাঁত পিষে বলল দুদো, “পালের গোদার মুখ থেকে কথা বের করা যায়নি, কিন্তু সাগরেদগুলো আর কতক্ষণ মুখ বন্ধ করে থাকতে পারবে!”

***

বলার মতো তেমন কিছু ছিল না আর্সেন লুপাঁর। কয়েক মাস ধরে এক্সামিনিং জাজ জুলি বোভিয়ের খুব চেষ্টা চরিত্র করলেন। তদন্ত বলতে তেমন কিছু হলো না। বিচারক আর আইনজীবীর কিছু ইন্টারেস্টিং আর্গুমেন্ট ছাড়া তেমন উপভোগ্য কিছু লক্ষ করা গেল না আলোচিত আর্সেন লুপাঁ কেসে। মাঝে মাঝে সৌজন্যতাবশত আর্সেন লুপাঁকে কথা বলার সুযোগও দেওয়া হতো। একদিন বলল,

“জি, মঁসিয়ে বিচারক মহোদয়, আপনি যা বলছেন তার প্রতিটি কথা সত্য। ক্রেডিট লিওনাইসের ডাকাতি, রু দ্য বেবিলনের চুরি, ব্যাংক নোট জালিয়াতি, এছাড়া আমসনিল, গোরেট, গ্রোসেইলারস, মালাকুইস-সহ অন্যান্য সব ঘটনাই আমার কীর্তি। “

“কিন্তু এসব কীর্তি কীভাবে ঘটালে?…”

বিচারক মহাদয় আরও কিছু বলতে চাইছিলেন কিন্তু লুপাঁ তাকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে বলল, “বলে লাভ নেই। বললে তো অনেক কথা বলতে হবে। সব আপনি বুঝবেনও না। আর আমি সব দোষ স্বীকার করছি তো, কীভাবে ঘটনা ঘটল সেটা আর জরুরি থাকছে না।”

অনেক চাপাচাপির পর শেষ পর্যন্ত হাল ছেড়েই দিয়েছিলেন। কিন্তু ওই দুই বার্তা বিচারক মহাশয়ের দৃষ্টিগোচর হওয়ার পর আবার নড়েচড়ে বসলেন তিনি। আবার নিয়মিত দুপুর বেলায় তাকে প্রিজন ভ্যানে কারাগার থেকে আদালতে নিয়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটতে লাগল। প্রিজন ভ্যানে যাওয়ার সময় প্রতিবার একটা নির্দিষ্ট সংখ্যক কয়েদি থাকত লুপাঁর সাথে। আদালতের কার্যক্রম শেষে কারাগারে ফিরতে ফিরতে তিনটা থেকে চারটা বেজে যেত।

কিন্তু একদিন বিকেলটা অন্যান্য দিনের মতো থাকলেও, ঘটনা ছিল একটু ভিন্ন। অন্যান্য কয়েদিদের কার্যক্রম শেষ না হওয়ায় কারা কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত নিল, লুপাঁকে প্রথমে কারাগারে রেখে আসা হবে। কারণ এই দুর্ধর্ষ লোককে দিন থাকতে থাকতে জায়গামতো রেখে আসাটাই বুদ্ধিমানের কাজ। তাই সেদিন নিজের প্রিজন-ভ্যানটাতে একাই ছিল লুপাঁ।

এই প্রিজন-ভ্যানগুলো লম্বালম্বি দুই ভাগে বিভক্ত। দুই ভাগের মাঝে চলাচল করার মতো একটা করিডোর। করিডোরের প্রতি পাশে পাঁচটা করে ছোটো ছোটো সেল। প্রত্যেকটা সেলে একজন কয়েদি কোনোরকমে বসতে পারে। আর করিডোরের মাথায় একজন গার্ড থাকে কয়েদিদের ওপর চোখ রাখার জন্য।

আর্সেন ছিল ডান পাশের তিন নম্বর সেলে। সেলে বসেই ভারী যন্ত্রদানবটা চালু হওয়ার বিকট শব্দ শুনতে পেল সে। খুব শান্ত মস্তিষ্কে হিসেব কষে বুঝতে পারল কখন গাড়িটা জাস্টিস প্যালেস অতিক্রম করল। তারপর গাড়ি সেন্ট মিশেল ব্রিজের কাছে পৌঁছতেই আর্সেন ডান পা দিয়ে ওর সেলের মেঝেতে একটা মাঝারি চাপ দিল। চাপ লাগতেই একটা ধাতব ক্লিক শব্দ হলো এবং ছোট্ট সেলের পেছনের ধাতব দেয়ালটা একটু সরে গেল। প্লেট সরে যেতেই আর্সেন দেখল তাকে দুই চাকার ঠিক মাঝের সেলটা বরাদ্দ করা হয়েছিল অতিরিক্ত সাবধানতাবশত।

চারপাশে একবার বাজ পাখির দৃষ্টি হেনে অপেক্ষা করল একটু। সেন্ট মিশেলের সীমানা পাড় হওয়ার আগেই প্রিজন ভ্যানের গতি কমতে শুরু করছিল। সেন্ট জার্মেইনের কোণায় এসে থেমে গেল ভ্যান। একটা ঘোড়ায় টানা মালগাড়ি রাস্তায় উলটে আছে। ব্যস্ত পথে ব্যাপক গোলোযোগ শুরু হয়ে গেছে। দেখতে না দেখতেই যানবাহনের একটা বড়সড় জটলা পাকিয়ে গেল। সাথে শত জনতার চিৎকার চ্যাঁচামেচি। আর্সেন আরেকটা প্রিজন ভ্যান দেখতে পেল। ভ্যানটা বেশ কাছে চলে আসতেই সে সরে যাওয়া প্লেটটাকে আরেকটু সরিয়ে ফেলল। তারপর একটা পা চাকায় রেখে নিচে নেমে এলো। আর্সেনের এই কীর্তি দেখে পাশের এক কোচোয়ান একটু হইচই করতে শুরু করেছিল বটে, কিন্তু যানবাহনের হট্টগোলে কোচোয়ানের চিৎকার ঢাকা পরে গেল। কেউ খেয়াল করছে না দেখে কোচোয়ান আরেকটু জোরেশোরে চ্যাঁচামেচি করে সবার দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করল, কিন্তু আর্সেন লুপাঁ ততক্ষণে বেরিয়ে গেছে।

দ্রুত কয়েকটা পদক্ষেপে রাস্তা পেরিয়ে সাইডওয়াকে উঠল আর্সেন। সাইডওয়াকে উঠতেই হাঁটার গতি স্বাভাবিক করে নিল। তারপর খুব শান্ত ভঙ্গিতে নিজের গন্তব্য ঠিক করে নিয়ে আবার এগুতে শুরু করল ধীরলয়ে।

হেমন্তের উষ্ণ বিকেল। মানুষজন ফুরফুরে মেজাজে বাইরে ঘোরাফেরা করছে। রাস্তার পাশের ক্যাফেগুলো কাস্টমারে ভরা। এমনই একটি ক্যাফের বাইরের দিকের বারান্দায় বসল আর্সেন। একটা বক আর এক প্যাকেট সিগারেট অর্ডার করল। একটা সিগারেটের সাথে গ্লাসটা ধীরে ধীরে শেষ করল সে। তারপর আরেকটা সিগারেট ধরিয়ে ওয়েটারকে ডাকল। ওয়েটারকে বলল ক্যাফের মালিককে ডেকে আনতে।

ক্যাফের মালিক আসার পর সবাই যাতে শুনতে পায় সেভাবে উচ্চস্বরে বলতে শুরু করল আর্সেন লুপাঁ, “মঁসিয়ে, আমি আমার মানিব্যাগটা ভুলে ফেলে এসেছি। আমার বিল শোধ করার জন্য যদি কয়েকটা দিন সময় দিলে সত্যিই আন্তরিকভাবে কৃতজ্ঞ থাকব। তবে আমি যেহেতু বেশ স্বনামধন্য ব্যক্তি, আশা করছি আমাকে কয়েক দিন সময় দিতে দ্বিধা করবেন না আপনি। আমার নাম হয়তো শুনে থাকবেন, আমি আর্সেন লুপাঁ।”

ক্যাফের মালির এমন একটা দৃষ্টিতে আর্সেনের দিকে তাকাল যে বুঝে উঠতে পারছেন না, এই কাস্টমার তার সঙ্গে মশকরা করছে কিনা।

“সেই কুখ্যাত বা বিখ্যাত লুপাঁ। কিছুদিন আগে গ্রেফতার হয়ে এখন সাঁৎ করাগারের একজন কয়েদি হিসেবে আছি। এই মুহূর্তে অবশ্য ফেরারি। আশা করছি এবার আমার কথা বিশ্বাস হবে আপনার।”

ক্যাফের সবার মনোযোগ ততক্ষণে এদিকে চলে এসেছিল। সবাই বেশ অবাক হয়ে হতভম্বের মতো তাকিয়ে রইলো, কেউ কেউ মশকরা ভেবে হো হো করে উঠল। আর কিংকর্তব্যবিমূঢ় মালিককে সেই অবস্থাতেই রেখে ক্যাফে থেকে বেরিয়ে এলো আর্সেন।

আবার সিগারেটে ফুঁ দিতে দিতে অলস ভঙ্গিতে হাঁটতে শুরু করল সে। হাঁটতে হাঁটতে রাস্তার পাশের দোকানগুলোতেও চোখ বুলিয়ে নিচ্ছিল আর দশটা সাধারণ পথচারীদের মতো। হাঁটতে হাঁটতে একসময় আবিষ্কার করল সে পোর্ট রয়্যালে চলে এসেছে। দিক পালটে সে আবার শান্ত পদচারণায় সাঁৎ কারাগারের দিকে অগ্রসর হলো। কিছুক্ষণের মধ্যে কারাগারের উঁচু দেয়ালগুলো দেখতে পেল। এবার একজন প্রহরীর দিকে এগিয়ে গিয়ে বলল,

“এটা কি সাঁৎ কারাগার?”

“হ্যাঁ।”

“আমি আমার সেলে ফেরত যেতে চাই। ফেরার পথে প্রিজন ভ্যান আমাকে মাঝ রাস্তায় রেখে চলে এসেছে। আমি সৎ লোক, সুযোগ পেলেই পালানো আমার ধাতে নেই। “

“বিরক্ত কোরো না ছোকরা, ভাগো এখান থেকে।” গরগর করে উঠল প্রহরী।

“ক্ষমা করবেন। কিন্তু আমাকে আমার সেলে ফিরতেই হবে। আর আপনি আর্সেন লুপাঁকে এখন ঢুকতে না দিলে সেটার ফলাফল ভালো নাও হবে পারে, প্রিয় প্রহরী বন্ধু!”

“আর্সেন লুপাঁ! কি যা-তা বকছ!”

“হ্যাঁ।” হালকা রসিয়ে পকেট হাতড়ে আর্সেন বলল, “দুঃখিত আমার সাথে আমার ভিজিটিং কার্ড নেই।”

ভূত দেখার মতো চেহারা নিয়ে আর্সেনকে আগাগোড়া দেখল প্রহরী। তারপর হন্তদন্ত হয়ে বেল বাজাতে শুরু করল। কারাগারের ফটক ঈষৎ ফাঁকা হলো। আর্সেন ভেতরে ঢুকল। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে কারা-কর্মকর্তা তার সামনে আসল। চোখে অবিশ্বাসের দৃষ্টি, তাতে মেশানো জলন্ত রাগ।

“রাগ করবেন না, মঁসিয়ে। ওরা ব্যবস্থা খারাপ করেনি। চেষ্টার কোনো ত্রুটিও রাখেনি। আর সাথে বিশ জন সাদা পোশাকের সদস্য তো ছিল-ই। তবে আমার কাছে ব্যক্তিগতভাবে এই আয়োজন কম মনে হয়েছে।”

তারপর একটু ঘাড় ঝাঁকিয়ে আর্সেন গাঢ় গলায় বলল, “আবার ক্ষমা চেয়েই বলছি। যখন আমার এই কারাগার থেকে বেরিয়ে যেতে ইচ্ছে হবে তখন কারও সাহায্যের দরকার হবে না।”

ঘটনার দুই দিন পর ‘একো দ্য ফ্রান্স’ পত্রিকা এই পলায়ন কাণ্ডের বিস্তারিত বিবরণ প্রকাশ করল। ততদিনে ‘একো দ্য ফ্রান্স’ হয়ে উঠেছে আর্সেন লুপাঁ সংক্রান্ত ঘটনার অঘোষিত মুখপাত্র। অনেকের ধারণা আর্সেন এই পত্রিকার বড়ো শেয়ার হোল্ডারদের একজন। প্রকাশিত খবরে পুলিশের হাতে পড়া সেই দুটো গোপন বার্তা, পুলিশের অভ্যন্তরীণ কার্যক্রমের অসামঞ্জস্যতা, পলায়নের সময়কার বিস্তারিত বিবরণ-সহ সবকিছুই উঠে এসেছিল। এছাড়া খবরে এ-ও জানা যায় যে ঘটনার পরে রেস্টুরেন্টের ওয়েটারদের সাথে কথা বলেছিলেন ইন্সপেক্টর ডিউজি, কিন্তু সেখান থেকেও বিশেষ কোনো তথ্য উদ্ধার করা যায়নি। সাথে পাঠকরা বুঝতে পারল কত বিচিত্ররকম রিসোর্স আছে এই আর্সেন লুপাঁ নামক রহস্যময় মানুষটার মধ্যে। যে প্রিজন-ভ্যানটা সেদিন তাকে নিয়ে ফিরছিল সেটা একেবারে হেসেখেলে নিজের ইচ্ছামতো সাজিয়ে নিয়েছিল সে, তারপর কোনো এক অবিশ্বাস্য উপায়ে সেটাকে কারাগারের ছয়টি প্রিজন- ভ্যানের মধ্যে ঢুকিয়েও ফেলেছিল।

সবমিলিয়ে সবাই খুব ভালোভাবে বুঝতে পারল, আর্সেন লুপাঁর পলায়ন এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। বিচারকার্য চলাকালীন এক পর্যায়ে বিচারক এই পলায়নের ঘটনা আমলে নিলে আর্সেনকে বেশ বিরক্ত মনে হলো।

গম্ভীর গলায় সে বলল, “একটা কথা জেনে রাখবেন, মঁসিয়ে, যা দেখেছেন আমার পালানোর আসল পরিকল্পনার তুলনায় কিছুই না।”

“কিছুই না মানে? ঠিক বুঝলাম না।”

“আপনার বোঝা এত জরুরিও নয়।”

তারপরেও বিচারক যখন ব্যাপারটার দিকে জোর দিচ্ছিলেন তখন আর্সেন শুধু বলল, “এতকিছু জেনে কী হবে। ট্রায়ালের দিন উপস্থিত না হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমি।”

“ট্রায়ালের দিন থাকবেন না মানে?”

“জি! ট্রায়ালের দিন থাকব না। আর কোনোকিছুই আমাকে আমার এই সিদ্ধান্ত থেকে টলাতে পারবে না।”

আর্সেনের এমন ঘোষণার পরে আইন কর্মকর্তাদের মধ্যে অনেক তৎপরতা দেখা গেল কিন্তু কেউ কোনো কূল-কিনারা করতে পারল না। আসল রহস্য আর্সেনের মধ্যেই রয়ে গেল। কিন্তু পরবর্তীতে সে কি এই রহস্য প্রকাশ করেছিল? কীভাবে করেছিল? কেন-ই বা করেছিল।

.

কিছুদিন পর আর্সেন লুপাঁর কারাকক্ষটি বদলে ফেলা হলো। বিচারক প্রাথমিক তদন্ত বন্ধ করে দিলেন। ফলে পরবর্তী দুই মাসে আদালতের কার্যক্রম তেমন দেখা-ই গেল না। এই দুটো মাসের প্রায় পুরোটা সময় আর্সেনকে তার সেলেই শুয়ে থাকতে দেখা গেল। বা শুয়ে না থাকলে দেয়ালের দিকে মুখ করে চুপচাপ তাকিয়ে থাকতে। সেল বদলের পর আর্সেন কেমন একটা ঝিমিয়ে গেল যেন। নিজের উকিলের সাথে কথা বলতেও যেন ভীষণ অনীহা। সারাদিনের কথাবার্তা বলতে গার্ডদের সাথে সংক্ষিপ্ত দুয়েকটি বাক্য বিনিময়

ট্রায়ালের সপ্তাহ দুয়েক আগে আর্সেনের পুরোনো সেই প্রাণচঞ্চলতা ফিরে এলো। জোরাজুরি করে আবার সকালে ঘণ্টাখানেক ব্যায়াম ও হাঁটাহাঁটির অনুমতি নিয়ে নিল। ব্যায়াম আর হাঁটাহাঁটির পুরোটা সময় দুজন সশস্ত্র গার্ড তার সার্বক্ষণিক সঙ্গী।

অন্যদিকে সাধারণ জনতার আগ্রহের পারদ ওপরে উঠেই চলছিল। আর্সেন কবে জেল থেকে পালাবে সেটা নিয়ে তাদের নানান জল্পনাকল্পনা। পত্রিকায় আর্সেনের সর্বশেষ খবর পাওয়ার জন্য উৎকণ্ঠিত প্রতীক্ষা সংবাদপত্র বিক্রির দোকানগুলোতে। নিজের প্রাণচাঞ্চল্য, উদ্দীপনা, দুঃসাহসিকতা, প্রতিভা আর সবকিছু দিয়ে সাধারণের মন জয় করে নিয়েছিল। আর্সেন লুপাঁকে পালাতে হবে। এটাই যেন সবার চাওয়া। কিন্তু এত দেরি হচ্ছে কেন সেটাই সবার উৎসাহ উদ্দীপনার বিষয়। প্রতিদিন সকালে প্রিফেক্ট অভ পুলিশ নিজের সেক্রেটারিকে জিজ্ঞেস করেন,

“এখনও পালায়নি?”

“না, মঁসিয়ে।”

“তাহলে কাল বোধহয়।”

ট্রায়ালের আগের দিন ‘গ্র্যান্ড জার্নাল’-এর অফিসে ফোন করল এক ভদ্রলোক। ফোন করে কোর্ট রিপোর্টারের সাথে দেখা করতে চাইলেন। কোর্ট রিপোর্টার দেখা করতে গেলে অদ্ভুত এক আগন্তুক রিপোর্টারের ওপর একটা কার্ড ছুড়ে দিয়ে দ্রুত সটকে পড়ল। কার্ডে লেখা ছিল, ‘আর্সেন লুপাঁর কথার কোনো নড়চড় হয় না।’

***

এরকম একটু চাঞ্চল্যকর পরিস্থিতিতে ট্রায়াল শুরু হলো। আদালত প্রাঙ্গণে অগণিত মানুষের ভিড়। সবাই বিখ্যাত আর্সেন লুপাঁকে একনজর দেখতে চায়। বিচারক, ম্যাজিস্ট্রেট, রিপোর্টার, অভিনেতা-অভিনেত্রী-সহ নানান পেশার বিখ্যাত লোকজনদের দেখা গেল দর্শক সারিতে।

কিছুক্ষণ আগে বৃষ্টি হচ্ছিল। মেঘাচ্ছন্ন, বিষণ্ণ ছিল দিনটা। আদালত কক্ষেও অন্ধকার অন্ধকার ভাব। গার্ডরা যখন বন্দিকে নিয়ে এলো তখন বন্দির জবুথবু হাঁটাচলা, বোকার মতো চাহনি আর হাস্যকর অভিব্যক্তি দেখে দর্শকরা খুব একটা খুশি হতে পারল না। বন্দির উকিল বেশ কয়েকবার বন্দির সাথে কথা বলার চেষ্টা করল কিন্তু বন্দির কাছ থেকে ‘শুধু মাথা নাড়া’ ছাড়া আর কোনো প্রতিক্রিয়া পাওয়া গেল না।

শেষে সাড়া না পেয়ে উকিল ঘটনা বর্ণনা করল। তারপর বিচারক কথা বলতে শুরু করলেন।

“কাঠগড়ায় দাড়িয়ে থাকা বন্দি। আপনার নাম, বয়স আর কাজ?”

 বন্দির কাছ থেকে কোনো উত্তর পাওয়া গেল না।

“আপনার নাম বলুন! আমি আপনার নাম জিজ্ঞাসা করেছি।”

ভারি একটা গলা খুব ধীর গতিতে বলে উঠল, “বোউন্দ্র, দেসিরে।”

দর্শকদের মধ্যে একটা জোরালো গুঞ্জন শোনা গেল। কিন্তু বিচারক মহাশয় সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে কার্যক্রম এগিয়ে নিলেন।

“বোউন্দ্র দেরিসে? নতুন ছদ্মনাম! যা-ই হোক, আপনার আরও ডজনখানেক ছদ্মনামের সাথে পরিচিত আমরা। এটাও সম্ভবত সেরকম কিছু। তবে আমরা আপনাকে আর্সেন লুপাঁ বলেই সম্বোধন করছি কারণ সেই নামেই আপনি আমাদের কাছে বেশি পরিচিত।”

বলতে বলতে সামনে রাখা কাগজগুলোর ওপর চোখ বুলিয়ে নিলেন বিচারক। তারপর বলতে শুরু করলেন,

“অনেক খোঁজাখুজির পরেও আপনার অতীত ইতিহাস সম্পর্কে তেমন কিছু জানতে পারিনি আমরা। অপরাধের জগতে আপনার অপরাধ সবার চেয়ে আলাদা। আমরা জানি না আপনি কে, কোথা থেকে এসেছেন, আপনার বংশ পরিচয় কী—সবকিছুই আমাদের কাছে বিরাট রহস্য। বছর তিনেক আগে আর্সেন লুপাঁ নাম নিয়ে আপনি উদিত হয়েছিলেন। আপনার বুদ্ধিমত্তা, বিবেক আর অদ্ভুত ধরনের নৈতিকতা দিয়ে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন। কারো কারো মনও কেড়ে নিয়েছিলেন। এর আগে আপনার জীবন কেমন ছিল সে ব্যাপারে আমাদের তেমন কোনো ধারণা নেই। এমনও হতে পারে বছর আষ্টেক আগে রোস্টার নামে যে লোক ডিকসনের সাথে কাজ করত সেই আসলে আর্সেন লুপাঁ। আবার এমনও হতে পারে ছয় বছর আগে ডা. আলতেয়ারের ল্যাবরেটরিতে একজন রাশিয়ান ছাত্র যোগ দিয়েছিল সেই আর্সেন লুপাঁ। আমরা সবাই জানি, রহস্যময় সেই ছাত্রটি ব্যাকটেরিওলোজি নিয়ে একটা হাইপোথিসিস দিয়ে গোটা বিশ্বকে চমকে দিয়েছিল। তবে মাঝে মাঝে নানান ভয়ংকর চর্মরোগ নিয়ে ঝুঁকিপূর্ণ নানান এক্সেপেরিমেন্ট করে দুর্নামও জুটিয়েছিলেন। আবার এটাও অসম্ভব না যে জাপানিজ জু-জুৎসুর সেই বিখ্যাত প্রফেসর আদতে আর্সেন লুপাঁ। আমাদের বিশ্বাস করার যথেষ্ট কারণ আছে যে গ্র্যান্ড প্রিক্স দে এক্সপোজিশনের চ্যাম্পিয়ন সেই সাইক্লিস্ট আসলে আর্সেন লুপাঁ। পুরষ্কারের সেই চার হাজার ফ্রাঁ পাওয়ার পর সেই সাইক্লিস্টকে আর কখনও দেখা যায়নি। এমনও হতে পারে চ্যারিটি বাজারের ঘটনায় অনেকের প্রাণ বাঁচানো লোকটা আসলে আপনি-ই, আর্সেন লুপাঁ। লোকগুলোকে বাঁচানোর পর সবার পকেট মেরেছিলেন আপনি।“

একটু বিরতি নিয়ে বিচারক আবার বলতে শুরু করলেন, “এ ধরনের কাজগুলো করতে আপনাকে সর্বোচ্চ লেভেলের শারীরিক ও মানসিক শক্তি, সামর্থ্য অর্জন করতে হয়েছে। আপনি এই সব ঘটনার সত্যতা স্বীকার করছেন?”

বিচারক যখন এতসব কিছু বলছিলেন তখন বন্দি যেন অনেক কষ্টে নিজেকে দাঁড় করিয়ে রাখছিল। বারবার বাম পা থেকে ডান পায়ে নিজের শরীরের ভর দিয়ে কোনো রকমে ভারসাম্য রক্ষা করছিল যেন। বিচারকের বক্তব্য শেষ হওয়ার পর তাকে দেখে মনে হচ্ছিল, এতসব কথার কিছুই তার কান পর্যন্ত পৌঁছায়নি। ফলে দ্বিতীয়বারের মতো আবার প্রশ্ন করা হল তাকে।

এবার শরীরের সমস্ত শক্তি একসাথে জড়ো করে বন্দি উচ্চারণ করল,

“বোউদ্রু, দেসিরে।”

এবার বিচারকের ঠোঁটের কোণায় একটা বিদ্রুপের হাসি ফুটে উঠল। তারপর বললেন, “জনাব আর্সেন লুপাঁ, আমি বুঝতে পারছি না এরকম আচরণের উদ্দেশ্য কী। নিজের কৃতকর্ম অস্বীকার করার জন্য আপনি যদি এমন অথর্বের অভিনয় করতে চান তাহলে করতে পারেন। কিন্তু এ-জন্য আপনার বিচারকার্য থেমে থাকবে না।”

এরপর তিনি আরও কিছু চুরি, প্রতারণা-সহ বেশ কিছু অভিযোগ বর্ণনা করলেন। এরপর সাক্ষীদের সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হলো। কিছু জিনিসপত্রও আদালতে হাজির করা হয়েছিল অপরাধের আলামত হিসেবে। এসব গৎবাঁধা জিনিসপত্র দর্শকসারিতে বসে থাকা সবাইকে যেন একটু ক্লান্ত করে তুলছিল। কিন্তু এমন সময় ডাক পড়ল ডিটেকটিভ গাঁইমার্সের। এবার আবার প্রাণচাঞ্চল্য ফিরে এলো দর্শকদের মাঝে।

একদম শুরু থেকেই বিখ্যাত গোয়েন্দা গাঁইমার্দের কাজকর্ম ছিল বেশ রহস্যময় এবং তার নিজস্ব স্টাইলে রহস্য সমাধান করাটা ডিপার্টমেন্টের খুব কাজে লাগছিল, তাই তার কাজ নিয়ে তেমন একটা প্রশ্নের মুখোমুখিও হতে হয়নি কখনও। বন্দির দিকে বেশ কয়েকবার সন্দেহের দৃষ্টি নিয়ে তাকালো গাঁইমার্দ। তারপর আস্তে আস্তে আর্সেন লুপাঁকে গ্রেফতার করার বিবরণ দিলো সংক্ষিপ্তভাবে। তবে কথা বলার সময়ও সে বারবার সন্দেহের দৃষ্টিতে কয়েদির দিকে তাকাচ্ছিল। এই পুরোটা সময় গোয়েন্দা মহাশয়ের মধ্যে এক ধরনের অস্বস্তি লক্ষ করা যাচ্ছিল।

গাঁইমার্দের অস্বস্তি দেখে বিচারক একবার বললেন, “অসুস্থতাবোধ করলে আপাতত একটু বিরতি নিতে পারেন। আমরা কিছুক্ষণ পর আবার শুরু করতে পারি।”

“না, সে-রকম কিছু নয় কিন্তু…” তাৎক্ষণিক উত্তর দিল গাঁইমার্দ, তারপর একটু থেমে বলল, “আমি কয়েদিকে আরও কাছ থেকে দেখার অনুমতি চাই। কিছু একটা গন্ডোগোল মনে হচ্ছে।”

বিচারক সম্মতি জানালে গাঁইমার্দ কয়েদির দিকে এগিয়ে গেল। কয়েক মিনিট ধরে খুব মনোযোগ সহকারে কয়েদির দিকে তাকিয়ে থাকল। তারপর নিজের জায়গায় ফিরে এসে খুব গম্ভীর গলায় বলল,

“আমার সামনে যে বন্দি দাঁড়িয়ে আছে সে আর্সেন লুপাঁ নয়।”

গাঁইমার্দের কথা শেষ হওয়া মাত্র পুরো কক্ষে পিনপতন নীরবতা নেমে এলো। বিচারক মহাশয় খানিকটা হতভম্বের মতো বললেন, “তা কী করে হয়? আপনি ঠিক বলছেন তো?”

উত্তরে গাঁইমার্দ বললেন, “প্রথমবার তাকালে এই বন্দির সাথে আর্সেন লুপাঁর একটা সাদৃশ্য পাওয়া যায় বটে। তবে নাক, চিবুক, চুল আর গায়ের রং ভালোভাবে লক্ষ করলেই বোঝা যায় যে এই লোক আর্সেন লুপাঁ নয়। আর বিশেষ করে চোখ, ওই মাতালের মতো চোখ আর্সেন লুপাঁর হতে পারে না।”

“আপনি কি বলতে চাচ্ছেন আমরা ভুল লোকের বিচার করছি?”

“আমার মতে তাই। আসল আর্সেন লুপাঁ কোনো এক অজানা উপায়ে এই মাতালকে তার জায়গায় রেখে নিজে গায়েব হয়ে গেছে।”

আদালত কক্ষের নাটকীয়তায় দর্শক সারিতে অনেকেই হো হো করে হেসে উঠল, যেন এমনটাই হওয়ার কথা ছিল। কেউ কেউ বেশ বিরক্তি প্রকাশ করল। তবে সবমিলিয়ে মনে হলো, দর্শকরা সবাই যেন এই নাটকের জন্যই অপেক্ষা করছিল। সিকিউরিটি চিফ মঁসিয়ে বোভিয়ের, কারাগারের জেলার এবং গার্ডদের ডেকে পাঠালেন বিচারক।

সবাই উপস্থিত হলে বিচারকার্য আবার শুরু হলো। মঁসিয়ে বোভিয়ের এবং জেলার দু’জনেই বন্দিকে খুব ভালোভাবে দেখে শুনে মন্তব্য করল, আর্সেন লুপাঁর সাথে এই বন্দির চেহারায় সামান্য মিল আছে বটে, কিন্তু এই লোক আর্সেন লুপাঁ নয়।

এরপর দুই গার্ডকে দেখানো হলো। তারা দু’জনেই বলল, এই লোক-ই আর্সেন লুপাঁ।

একজন গার্ড বলল, “আমার ধারণা এটাই আর্সেন লুপাঁ।”

এবার বিচারক ধৈর্য হারিয়ে বিরক্ত হয়ে বললেন, “আপনার ধারণা? ধারণা আবার কী? আপনি কি নিশ্চিত নন?”

“কয়েদিকে যে অনেকবার দেখেছি এমন নয়। এই কয়েদির সেলে আমার ডিউটি থাকত সন্ধ্যার পরে। ওই সময় সে হয় শুয়ে থাকত, নাহয় দেওয়ালের দিকে মুখ করে বসে থাকত। আর এই কয়েদি আমার সেকশনে এসেছে-ই মাত্র দুই মাস আগে।”

“এই দুই মাসের আগে সে কোথায় ছিল?”

“এর আগে এই কয়েদির সেল ছিল কারাগারের অন্য একটা অংশে। দুই মাসে আগে তাকে আমাদের ২৪ নম্বর সেলে আনা হয়।”

পাশ থেকে জেলার সাহেব বলে উঠলেন, “মাস দুয়েক আগে এই কয়েদি পালানোর চেষ্টা করেছিল। তখন আমরা তার সেল পালটে দিয়েছিলাম।”

“এই দুই মাসে আপনার সাথে আর দেখা হয়নি কয়েদির?”

“না। সে এমন কিছু ঘটায়নি যে জন্য আমাকে ব্যক্তিগতভাবে তার সেলে যেতে হবে। তাই দেখা হওয়ার কারণ ঘটেনি।”

“মোটকথা, এখন আপনি বলতে চাইছেন যে এই কয়েদি আর্সেন লুপাঁ নয়?”

“না।”

“তাহলে এই লোক কে?”

“ঠিক বলতে পারছি না।”

“তারমানে এই মুহূর্তে বিচারের জন্য এমন একজন লোককে এখানে হাজির করা হয়েছে যে গত দুই মাস যাবৎ আর্সেন লুপাঁ সেজে তার সেলে বসে আছে। এই ঘটনাকে আপনি কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন?”

“ব্যাখ্যা করতে পারব না।”

যারপরনাই বিরক্ত হয়ে বিচারক ফিরলেন বন্দির দিকে এবং জিজ্ঞেস করলেন,

“বন্দি, আপনি বলুন, কবে থেকে আপনি সাঁৎ কারাগারে আছেন?’

সাজিয়ে গুছিয়ে উত্তর দেওয়ার মতো অবস্থা বন্দির কখনেই ছিল না। তবে অনেক চেষ্টা চরিত্র করে আর বিভিন্ন রকম প্রশ্নের পরে ঘটনা যেটা আবিষ্কার করা গেল সেটা হলো,

দু’মাসের চেয়ে বেশি আগে সে একবার জেলে এসেছিল। সেখান এক রাত থাকার পরে তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়। ফেরার পথে দুজন গার্ড তাকে প্রিজন ভ্যানে তুলে আনে। এবং ২৪ নম্বর সেলে পাঠিয়ে দেয়। জেলে যেহেতু সমস্যার কিছু নেই। প্রতিদিন সময়মত খাবার-দাবার পাওয়া যায়। ঘুমের সময়ও কেউ বিরক্ত করে না, তাই তার কোনো অভিযোগও ছিল না।

এই গল্প বিশ্বাস করা চলে। তারপরেও এই বন্দি সত্য বলছে কিনা সেটা নিশ্চিত করার দায়িত্ব দেওয়া হল সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে। এবং সেটা না হওয়া পর্যন্ত আদালত মুলতুবি ঘোষণা করা হলো।

***

এরপর কারাগারের রেকর্ড খুঁজে কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া গেল। আট সপ্তাহ আগে বোউন্দ্র দেসিরে নামে একজনকে কারাগারে আনা হয়েছিল। পরদিন তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়। লোকটি দুপুর দুইটায় কারাগার ত্যাগ করে। একই দিন দুপুর দুইটায় লুপাঁকে কারাগার থেকে আদালতে নিয়ে যাওয়া হয়।

তাহলে কি প্রিজন ভ্যানে তোলার সময় গার্ডরা-ই ভুলটা করেছে? চেহারায় সামান্য মিল থাকাতেই কি বোউন্দ্র দেসিরের কপালে এই ভোগান্তি জুটল?

একইসাথে আরেকটা প্রশ্ন চলে আসে। ভুলটা কি হয়ে গিয়েছিল? না-কি আগে থেকেই এমন বন্দোবস্ত করে রাখা হয়েছিল যেন ভুলটা হয়ে যায়।

বোউন্দ্র দেসিরের ব্যাপারে খোঁজখবর নিয়ে তার নাড়িনক্ষত্রের খবর বের করে ফেলতে তেমন একটা সময় লাগল না। একটা বস্তিতে থাকত সে। টোকাইদের সাথে এটা সেটা কুড়িয়ে বিক্রি করে খাবার জোগাড় করত। বছর খানেক আগে হঠাৎ গায়েব হয়ে যায়। গরিব লোক, কেউ খোঁজও রাখেনি।

আর্সেন লুপাঁ কীভাবে এবং কোন উপায়ে এই লোককে নিজের জায়গায় রেখে নিজে গায়েব হয়ে গেল সেটা নিয়ে অনেক অনেক তত্ত্ব তৈরি হলো। কিন্তু তার কোনোটাই খুব একটা সন্তোষজনক নয়।

মাস খানেক এই ব্যাপারে তদন্ত চলল। কিন্তু রহস্যের সমাধান হলো না। বোউদ্রুকে তো আর অনন্তকাল বিনা অপরাধে কারাগারে আটকে রাখা যায় না। শেষ পর্যন্ত তাকে ছেড়ে দেওয়া হলো। তবে সাঁৎ কারাগারের চিফ নির্দেশ দিলেন যেন কড়া নজর রাখা হয় বোউদ্রুর উপর। বুদ্ধিটা অবশ্য গাঁইমার্দের। গাঁইমার্দের মতে আর্সেন লুপাঁ এই লোককে নিজের জায়গায় রেখে সবাইকে ধোঁকা দিতে পেরেছে। তারমানে আবার এই লোককে দরকার হওয়া আর্সেন লুপাঁর জন্য খুব একটা অস্বাভাবিকও নয়। তাই এই লোকের ওপর ঠিকভাবে নজর রাখতে পারলে, খোদ আর্সেন লুপাঁকে যদি না-ও পাওয়া যায়, তাহলেও তার এক-দুই জন শাগরেদকে পেয়ে যাওয়া উচিত।

পুরো বিষয়টা দেখভালের দায়িত্ব পড়ল ইন্সপেক্টর ফোলফ্যান্ট আর ডিউজির ওপর। এরাই গাঁইমার্দকে এ ব্যাপারে সাহায্য করবে।

.

জানুয়ারির এক কুয়াশা ঘেরা সকালে বোউন্দ্র দেসিরে কারাগারের বাইরে পা রাখল। এখন সে মুক্ত। প্রথমে সে কারাগারের সামনের পথটা দিয়ে এগোতে শুরু করল, তারপর একটা মোড় নিয়ে সেইন্ট জ্যাকস সড়ক ধরল। পথে একটা পুরাতন কাপড়ের দোকানে নিজের জ্যাকেট আর ভেস্টটা বিক্রি করে অন্য একটা জ্যাকেট নিল। একটা বাসস্টপে এলো। একটা বাস আসলো কিন্তু তাতে তিল ধারণের ঠাঁই নেই। কন্ট্রোলার তাকে টিকেট নিয়ে ওয়েটিং-রুমে অপেক্ষা করতে বলল।

ওয়েটিং রুমের ওপর থেকে চোখ না সরিয়েই গাঁইমার্দ তার দুই সহকারীকে বলল,

“একটা ক্যারেজ থামাও… না, একটা না দুটো। আমি নিজেও যেতে চাই। দু’জন দুটোতে যাবে। আমি তোমাদের যে-কোনো একটাতে উঠে যাব। বোউদ্রুকে চোখের আড়াল করতে চাই না।“

সহকারীরা কথা মতো কাজ করল। কিন্তু বোউদ্রুর দেখা নেই এখনও। বিরক্ত হয়ে ওয়েটিং-রুমে ঢুকে গেল গাঁইমার্দ। কিন্তু ওয়েটিং-রুম ফাঁকা। ভেতরে কেউ নেই।

“গাধা গাঁইমার্দ। বের হওয়ার আরেকটা দরজা আছে সেটা ভুলেই গিয়েছিলাম!” নিজের ওপর বিরক্ত হয়ে বিড়বিড় করল গাঁইমার্দ।

ওয়েটিং-রুম থেকে একটা করিডোর এগিয়ে গিয়ে সেন্ট মার্টিন রোডে মিশেছে। গাঁইমার্দ দৌড়ে করিডোরের দরজায় আসলো। ভাগ্য ভালো তার। বোউন্দ্র তখন মাত্র একটা বাসে উঠছে। বাসটা সবেমাত্র মোড় পেরিয়ে রিভোলি রোডে ঢুকল তখনই গাঁইমার্দ বাসে উঠল। বেশ কিছুটা দৌড়ে এসে বাসটা শেষ পর্যন্ত ধরতে পেরেছে সে। কিন্তু তাড়াহুড়োয় দুই সহকারীকে হারাতে হলো। বাকি এখন যা করার একই করতে হবে।

বোউন্দ্রর দিকে তাকালো গাঁইমার্দ। একটা বেঞ্চের ওপর বসে ঢুলছে উজবুকটা, মাথাটা একবার ডানে আরেকবার বামে হেলে পড়ছে বাসের গতির সাথে তাল রেখে। মুখ হালকা খোলা। আদর্শ উজবুকের প্রতিমূর্তি। এমন একটা উজবুক বিখ্যাত গোয়েন্দা গাঁইমার্দকে আজ লেজে খেলাচ্ছে। ভাগ্যের বড়ো নির্মম পরিহাস।

লাফায়েত গ্যালারির সামনে এসে বোউদ্রু বাস থেকে নেমে পড়ল। নেমেই লা মুয়েতে ট্রামওয়ে ধরে সামনে এগিয়ে গেল কিছুদূর। এভাবে এক রাস্তা থেকে আরেক রাস্তা ধরে হাঁটাহাঁটি করল অনেক্ষণ। ঘন্টাখানেকের বেশি এভাবে এলামেলো হাঁটাহাঁটির পর একটা নীরব জায়গায় বসল সে। গাছে ঘেরা জায়গাটা সহজে কারও চোখে পড়ে না। শেষ পর্যন্ত ধৈর্য হারাল গাঁইমার্দ। এগিয়ে গিয়ে বোউদ্রুর পাশের সিটে বসল। একটা সিগারেট জ্বালিয়ে বোউঞকে উদ্দেশ্য করে বলল, “দিনটা সুন্দর!”

বোউন্দ্র কোনো উত্তর দিলো না। কিন্তু হঠাৎ অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো সে। হাসি শুনেই গাঁইমার্দের ঘাড়ের পশম দাঁড়িয়ে গেল। এই হাসি চেনে সে।

এক ঝটকায় দাঁড়িয়ে বোউধ্রুর কলার চেপে ধরল গাঁইমার্দ। এবার ভালোভাবে দেখতেই বুঝতে পার, এখন যার দিকে তাকিয়ে আছে সে বোউঞ নয়। একদম সঠিকভাবে বললে, দেখতে বোউদ্রুর মতো-ই, কিন্তু চোখের চাহনি বলে ওটা অন্য কেউ, ওটা আর্সেন লুপাঁ।

“আর্সেন লুপাঁ! আর্সেন লুপাঁ।” দাঁতে দাঁত চেপে বলল গাঁইমার্দ।

রাগে অন্ধ হয়ে লুপাঁর গলা চেপে মাটিতে চেপে ধরল সে। বয়স পঞ্চাশ হলেও গায়ে শক্তি জোয়ানদের মতো। তবে আর্সেন লুপাঁ শুধু ছোট্ট একটা জু- জুৎসুর প্যাচ দিলো। গলা ছেড়ে না দিয়ে উপায় থাকল না গাঁইমার্দের। পরমুহূর্তেই বুঝতে পারল ডান হাতটাও এমন বেকায়দায় ধরে ফেলেছে আর্সেন যে আর কিছু করারও নেই।

“আমার কাছ থেকে জু-জুৎসুর ক্লাস নিলে, ঠিকই জানতেন এই কৌশলটার নাম উডি-শি-ঘি। আর আমি এখন চাইলেই আপনার ডান হাতটা ভেঙে দিতে পারি। যদিও সেটাই আপনার প্রাপ্য। আপনাকে আমি এত সম্মান করি। অথচ এমন একটা সময়ে নিজের রাগ সংবরণ করতে পারলেন না আপনি। যোগ্য প্রতিপক্ষের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন!”

গাঁইমার্দ কিছু বলতে পারল না। এই যে এখন আর্সেন লুপাঁ পালিয়ে যাচ্ছে তার কারণ সে নিজে। তার নিজের বক্তব্যের কারণেই আদালত এই ভুলটা করে ফেলেছে। রাগে ক্ষোভে চোখ দিয়ে পানি বেরিয়ে এলো তার।

“আহারে মঁসিয়ে গাঁইমার্দ। নিজেকে এতটা অপরাধী ভাববেন না। আপনি না বললে অন্য কাউকে দিয়ে কাজ উদ্ধার করেই নিতাম। বেচারা বোউ দ্রু আর্সেন লুপাঁর শাস্তি ভোগ করবে তা তো হতে পারে না।”

“সেদিন আদালতে তুমিই ছিলে।” বিড়বিড় করল গাঁইমার্দ।

“সেদিন আদালতেও আমি-ই ছিলাম। এখানেও আমি-ই আছি।”

“কিন্তু এটা কীভাবে সম্ভব?”

“না না, গাঁইমার্দ। কোনো জাদুটোনা নয়। সেদিন আদালতে জজ সাহেব তো বললেন-ই, এই দক্ষতা অর্জন করতে বহুদিনের সাধনা লাগে।”

“কিন্তু তোমার চোখ? তোমার চেহারা?”

“আপনার বোঝার কথাও নয়।” হালকা গলায় বলল আর্সেন লুপাঁ, “যদি আঠারো মাস সেইন্ট লুইস হাসপাতালে ডাক্তার আলতেয়ার সেজে কাজ করতেন তাহলে বুঝতে পারতেন। হাসপাতালের কাজটা আমার ভালোই লাগত, কিন্তু এখন এই আর্সেন লুপাঁর কাজটা আরও বেশি ভালো লাগে।“

একটু থেমে আবার বলতে শুরু করল লুপাঁ, “চেহারা-সুরত পালটে দেওয়া এমন কোনো কঠিন কাজ নয়। হাইপোডার্মিক প্যারাফিন ইনজেকশন প্রথম কাজটা করে দিয়েছিল। আর প্যারাগার্লিক এসিড তো এক মুহূর্তে গায়ের রং বদলে ভারতীয়দের মতো রং এনে দেবে। আর ২৪ নম্বর সেলে যাওয়ার পর খাওয়াদাওয়াটা বদলে শরীরটাকে বদলানো জন্য দুই মাস অনেক সময়। আর পাঁচ ফোঁটা অ্যাট্রোপাইন চোখের দৃষ্টি মাতালদের মতো ফ্যাকাশে করে দিয়েছে। ব্যস, এতেই কাজ হয়ে গেছে।”

“কিন্তু ওই গার্ডদের বোকা বানালে কীভাবে?”

“ওদের চোখে ধুলো দেওয়ার জন্য পরিবর্তনটা ধীরে করতে হয়েছিল। এতই ধীরে যে তারা যেন পার্থক্য ধরতে না পারে।”

“আর বোউদ্রু দেসিরে?”

“বোউদ্রু আসলেই আছে। গরীব, নিরীহ, বেচারা বোউন্দ্র। গত বছর ওর সাথে প্রথম দেখা হয়। আমার চেহারার সাথে সামান্য মিলও আছে। কোনো বিপদের সময় কাজে লাগতে পারে ভেবে ওকে আমার আয়ত্তে রেখেছিলাম। আমার এক বন্ধু একরাতের জন্য ওর কারাগারে থাকার ব্যবস্থা করে। পরের দিন আমার সাথে কারাগার থেকে বের হয় সে। কাকতালীয় ঘটনা ঘটার ব্যবস্থা করা এমন কিছু কঠিন কাজ নয়। বোউদ্রু যে আসলেই আছে এবং সে যে সাঁৎ কারাগারে এসেছিল সেটা সন্দেহাতীতভাবে দেখানো জরুরি ছিল। এজন্যই বোউদ্রুর একদিনের হাজতবাস দরকার ছিল। যাতে বিচার বিভাগের লোক ওকে দিয়ে দুয়ে দুয়ে চার মেলাতে পারে। কিন্তু এই দুই যে সেই দুই নয় সেটা কোনোভাবেই জানতে না পারে।”

“হ্যাঁ। সবকিছু ভালোই সাজিয়েছ।” বলল গোয়েন্দা গাঁইমার্দ।

“আর শেষে চাললাম আমার ট্রাম্প কার্ড। সবাই ভেবেই নিয়েছিল আমি অবশ্যই পালিয়ে যাব। ট্রায়ালের দিন আমি উপস্থিত থাকব না। মনে মনে তুমিও সম্ভবত সেটাই ধরে রেখেছিলে। এজন্য আপনি যখন শুধু একবার বললেন আমি আর্সেন লুপাঁ নই, তখন সবাই সেটা বিশ্বাস করে নিল। সত্যি কথা বলতে সবাই বিশ্বাস করে নেওয়ার জন্য রেডি-ই ছিল, শুধু একজনের বলা দরকার ছিল।”

একটা লম্বা নিঃশ্বাস ছাড়ল গাঁইমার্দ।

“আর কারাগারে আমাদের সেই কথোপকথনের সময় আমি বলেছিলাম, ঠিক চারটার সময় আপনার বাসায় চায়ের দাওয়াত নেব। পুরোপুরি বিশ্বাস না করলেও আমার কথাটা নিশ্চয়ই আপনার মাথায় গেঁথে ছিল।”

“তাহলে সেই প্রিজন-ভ্যান?”

“ওটা ব্লাফ ছিল।” হাসতে হাসতে বলল লুপাঁ, “কয়েকজন পুরোনো বন্ধু নাটকটা সাজাতে সাহায্য করেছিল। একটা পুরাতন ভ্যান আমার কথামতো সাজিয়ে দেয়া হয়েছিল। সেটা দিয়েই পথের মাঝে নাটকটি মঞ্চায়ন করা হয়। সবাইকে মিথ্যে অভিনয় করে দেখানোর দরকার ছিল যে আমি চাইলেই পালাতে পারি। যখন পালিয়েও ফিরে এলাম তখন পরবর্তীতে যে কোনো সময় পালানোটা ছিল সময়ের ব্যাপার মাত্র। অন্তত দর্শকদের কাছে তাই।”

“ওই সিগারটা?”

“আমার নিজের হাতের কারসাজি। আর ওই ফাঁপা ছুরিটাও।”

“ওই চিঠিগুলো?”

“আমার-ই লেখা। “

“আর কারাগারের বাইরে তোমার সেই সাহায্যকারী?”

“সে-রকম কারও অস্তিত্ব নেই।”

“তবে একটা প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে, কারাগারের অ্যান্থোপলোজিকাল সার্ভিস ডিপার্টমেন্ট কেন বুঝতে পারল না যে তুমি বোউদ্রু নও, তুমি আর্সেন লুপাঁ। তোমার নাক, কান আর মাথার পরিমাপ নেওয়ার পর তো তোমাকে শনাক্ত করতে খুব একটা কষ্ট হওয়ার কথা নয় ওদের।”

“পরিমাপ নেওয়ার পর শনাক্ত করতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। কিন্তু পরিমাপ থাকলে তো। সে-জন্য অবশ্য অনেক টাকা খরচ করতে হয়েছিল। আমেরিকা যাওয়ার বহু আগেই আমি এক লোককে টাকা খাইয়ে অ্যান্থোপোলোজিক্যাল সার্ভিসের তথ্য-ব্যাংক থেকে আমার শনাক্তকরণ চিহ্নগুলো বদলে দিয়েছিলাম। অর্থাৎ ওদের কাছে আমাকে শনাক্ত করার কোনো উপায় নেই। “

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল গাঁইমার্দ। তারপর ধীরে ধীরে বলল, “এখন কোথায় যাবে বা কী করবে ভাবছ?”

“এখন আর কিছু না। শান্তিমতো বিশ্রাম নেব। ঠিকমত খাওয়াদাওয়া করব। মাঝে মাঝে নিজের চেহারা সুরত বদলে ফেলাটা খারাপ নয়। কিন্তু এখন আর্সেন লুপাঁ আবার নিজের চেহারায় ফিরতে চায়।”

গাঁইমার্দের সাথে কিছুক্ষণ চুপচাপ হাঁটল আর্সেন। একসময় দাঁড়িয়ে বলল, “কিছু বলতে চাইছেন, গাঁইমার্দ?”

“তুমি তো তোমার পালানোর সত্যটা প্রকাশ করবে তাই না? কীভাবে আমাকে-সহ সবাইকে বোকা বানালে, সেটা…”

“না, এটুকু গোপনই থাকবে। সত্যটা প্রকাশ করে দেওয়ার চেয়ে এই পরিস্থিতিতে আমার রহস্যময় অন্তর্ধান-ই বেশি মুখোরোচক হবে মানুষের জন্য আর লাভজনক হবে আমার জন্য। একটা রহস্যময় ইমেজ ধরে রাখা আমার ব্যাবসার জন্য ভালো। এখন বিদায়, বন্ধু। একটা ডিনারের দাওয়াত আছে। পোশাক পরে তৈরি হয়েই বেরিয়ে পড়তে হবে।”

“তা কোথায় ডিনারে যাচ্ছ?”

“ব্রিটিশ অ্যাম্বাসেডরের সাথে।”

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *