দ্য অ্যামিটিভিল হরর – ৩

তৃতীয় অধ্যায় 

১৯-২১ ডিসেম্বর। 

রাতের বেলা সদর দরজায় কারও নক করার শব্দ পেয়ে হুট করেই ভেঙে গেল জর্জের ঘুমটা। বিছানাতে উঠে বসল সে। 

আশেপাশে তাকাল ও, ঘুটঘুটে অন্ধকার। প্রথম একটু অবাক হলো, কোথায় এলো ও? কয়েক মুহূর্ত পরেই মনে পড়ল, নিজের নতুন বাড়ির সবচেয়ে বড়ো শোবার ঘরটায় রয়েছে সে। পাশে কম্বলের তলায় গভীর ঘুমে অচেতন ক্যাথি। আড়চোখে একবার ওকে দেখে নিল জর্জ, অন্ধকার অনেকটাই সয়ে এসেছে ওর চোখে। 

আবার দরজা নক করার শব্দ এলো। 

“যিশুর দিব্যি, এত রাতে কে এলো?” আপনমনে বিড়বিড় করে উঠল জর্জ।

পাশের টেবিলে রাখা নিজের হাতঘড়িটা তুলে নিল ও। রাত সোয়া তিনটা বাজে। আবার দরজা নক করার শব্দ, এবার আরেকটু জোরে। এবার শব্দটা নিচতলা থেকে নয়, দোতালার বামদিক থেকে এলো! 

রীতিমতো চমকে উঠল জর্জ। 

উঠে দাঁড়াল সে। মেঝেতে গালিচা এখনও পাতা হয়নি, তাই বেজায় ঠান্ডা লাগছিল ওর পায়ে। হেঁটে হেঁটে সেলাইঘরে ঢুকল সে। এখানকার একটা জানালা দিয়ে অ্যামিটিভিল নদী স্পষ্ট দেখা যায়। জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল জর্জ। কালিগোলা অন্ধকার যেন গ্রাস করেছে পৃথিবীকে। তখনই আবার সেই শব্দ! “আজব ব্যাপার,” বলে উঠল জর্জ, “হ্যারি কোথায়? এই সময়ে ও চুপচাপ কেন?” 

সহসা ওপর তলার মেঝেতে জোরে কিছু পড়ার শব্দ হলো। চমকে উঠে মাথা নিচু করে ফেলেছিল জর্জ। পরক্ষণেই শুরু হলো একটা হালকা কিচকিচে শব্দ। ওপরের ঘরটায় ড্যানি আর ক্রিস শুয়ে আছে। ওদের মধ্যেই হয়তো কেউ কোনো ভারী খেলনা ঘুমের ঘোরে মেঝেতে ফেলে দিয়েছে। কিন্তু এমন কোনো ভারী খেলনা কি ওদের আছে? জর্জ তো দেখেনি। 

একে তো খালি পা, তার ওপর জর্জের পরনে পায়জামা ছাড়া আর কিছুই নেই। ঠান্ডায় রীতিমতো ঠকঠক করে কাঁপতে লাগল সে। এই ঠান্ডার মধ্যে, এত রাতে… কে শব্দ করছে? আবার জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল সে। হুট করেই ওর নজর পড়ল নৌকা রাখার ছাউনিতে… ওখানে একটা কিছু নড়াচড়া করছে! জানালার পাল্লা ওপরে ওঠাতেই হিমেল হাওয়ার ধাক্কায় রীতিমতো জমে গেল সে… 

“কে? কে ওখানে?” একটু সামলে নিয়ে চিৎকার করে উঠল জর্জ। এতক্ষণে ডেকে উঠল হ্যারি। নিচে দাঁড়িয়ে আছে ও। ভালো করে খেয়াল করল জর্জ… হ্যারির প্রায় সামনা-সামনি একটা অদ্ভুত ছায়ামূর্তি। 

“হ্যারি, ধরো ওকে,” চেঁচিয়ে উঠল জর্জ। তখনই ছাউনির বামপাশ থেকে ‘ঠক-ঠক’ করে শব্দ হলো। চট করে সেদিকে ঘুরে তাকাল হ্যারি, তারপর গলা ফাটিয়ে ডাকতে শুরু করল! শুধু কি তাই? উন্মাদের মতো লাফালাফি করতে লাগল পুরো উঠান জুড়ে। যেন শিকলটা ওকে ঠেকিয়ে রেখেছে, ছাড়া পেলেই কাউকে ছিঁড়ে ফালা ফালা করে ফেলবে! তাড়াতাড়ি জানালার পাল্লা নামিয়ে দিয়ে শোবার ঘরের দিকে দৌড় দিলো জর্জ। 

ক্যাথি ততক্ষণে জেগে গেছে। 

‘কী হয়েছে জর্জ? এত রাতে গোলমাল কীসের?” বলে টেবিল ল্যাম্পটা জ্বালিয়ে দিলো সে। ওদিকে পায়জামা খুলে প্যান্ট পরতে ব্যস্ত জর্জ। 

“কী হয়েছে জর্জ?” জর্জের থমথমে মুখে দিকে নজর পড়েছে ক্যাথির, ‘তোমাকে এমন দেখাচ্ছে কেন?” 

“কিছু হয়নি সোনা, আমি বাড়ির পিছনটা একটু দেখতে যাচ্ছি। নৌকা রাখার ছাউনির ওখানে হ্যারি কিছু একটা দেখেছে… সম্ভবত বিড়াল… ওকে সামলাই গিয়ে, নইলে চেঁচিয়ে পুরো পাড়ার ঘুম মাথায় তুলবে ব্যাটা। শার্ট পরে নিল জর্জ, তারপর চেয়ার থেকে নিজের পুরোনো নেভি-ব্লু জ্যাকেটটা তুলে নিল, “আমি এখনই আসছি, তুমি বসে থেকো না… ঘুমিয়ে পড়ো।” 

“আচ্ছা শোনো, জ্যাকেটটা হাতেই রেখে দিয়ো না, পরে নাও, বাইরে অনেক ঠান্ডা,” এই বলে ল্যাম্পটা অফ করে শুয়ে পড়ল ক্যাথি। হাঁপ ছেড়ে বাঁচল জর্জ, বেজায় ভুলো মনের মেয়ে ক্যাথি। সকালে উঠে রাতের এই ঘটনার কথা ওর মনেই থাকবে না। 

রান্নাঘরের দরজা দিয়ে উঠানে বেরিয়ে এলো জর্জ। হ্যারি তখনও ছায়ামূর্তিটাকে লক্ষ করে চেঁচিয়ে চলেছে। সুইমিং পুলের বেড়ার পাশে পড়ে থাকা একটা চার ফুট লম্বা আর দুই ফুট চওড়া কাঠের তক্ত তুলে নিল জর্জ। তারপর দৌড় দিলো নৌকা রাখার ছাউনির দিকে। ছায়ামূর্তিটা ছাউনির কাছেই দাঁড়িয়ে ছিল, জর্জকে দেখেই কেমন যেন কেঁপে উঠল ওটা। আবার জোরে ‘ঠক-ঠক’ শব্দ হলো। তক্তাটা শক্ত করে ধরল জর্জ। 

“হে ঈশ্বর!” ছাউনির কাছে এসে রীতিমতো চমকে উঠল জর্জ। দরজাটা হাট করে খোলা! বাতাসে রীতিমতো দুলছে ওটা। এই কারণেই কি শব্দটা হচ্ছে? কিন্তু ওটা খুলল কী করে? জর্জের স্পষ্ট মনে আছে রাতে ঘুমানোর আগে দরজা আটকে দিয়েছিল সে। 

“আশ্চর্য! এই দরজা তো লাগিয়ে দিয়েছিলাম,” আপনমনেই বলে উঠল।

আবার চেঁচিয়ে উঠল হ্যারি। 

“আহ হ্যারি, থামো তো… বিরক্ত লাগছে,” খেঁকিয়ে উঠল জর্জ। 

.

আধা ঘণ্টা পর। 

চুপচাপ বিছানায় শুয়ে আছে জর্জ। ঘুম আসছে না! দীর্ঘকাল মার্কিন মেরিন বাহিনীতে ছিল সে, বেশিদিন হয়নি চাকরি ছেড়েছে। হুটহাট ঘুম থেকে ওঠার অভ্যাস তার আছে। কেন যেন ওর মনে হচ্ছে কোনো একটা বিপদ হতে যাচ্ছে ওদের সবার, তাই ঘুম আসছে না। 

অদ্ভুত সব চিন্তা এসে ভিড় করল জর্জের মাথায়। গত কয়েক বছরে ওর জীবনে অনেক কিছুই বদলে গেছে। আগের বিয়েটা টিকল না, চাকরি ছেড়ে দিলো, দ্বিতীয় বিয়ে করল, এই পক্ষের বউয়ের আবার তিনটা বাচ্চা আছে, নতুন বাড়ি কেনার জন্য বেশ কিছু জিনিস বন্ধক রাখতে হয়েছে ওকে ব্যাংকে! এসবের আসলেই কি কোনো অর্থ আছে? অ্যামিটিভিলের খরচও অনেক বেশি, অন্য সব হিসাব বাদ দিয়ে শুধু ভূমি করের কথাই ধরা যাক না… তিনগুণ বেশি টাকা দিতে হবে। ওই নতুন স্পিডবোটটার আসলেই কি কোনো দরকার আছে ওর? সব দিকেই খরচ বেড়ে গেল, এত টাকা সে কোথা থেকে জোগাড় করবে? লং আইল্যান্ড ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে ব্যাবসা শুরু করেছিল, ওখানে সুদের হার খুবই বেশি। ইতোমধ্যেই অনেক ক্ষতি হয়ে গেছে ব্যবসায়। ব্যাংকের কর্তাদের চিন্তাধারা না বদলালে ওর ব্যবসায় লাভ আসবে না। আর আজকাল সরকার যা শুরু করেছে! মানুষের হাতে টাকাই থাকছে না। লোকেরা যদি জমি না কেনে… বাড়ি না বানায়… তবে ভূমি জরিপ সংস্থার আর কী প্রয়োজন? এভাবে চললে বেশিদিন লাগবে না ওর ব্যাবসাতে লালবাতি জ্বলতে। 

ঘুমের মধ্যে পাশ ফিরল ক্যাথি। ওর একটা হাত এসে পড়ল জর্জের ঘাড়ে আর মাথাটা বুকের কাছে। ক্যাথির চুলে মিষ্টি গন্ধ। ক্যাথি সবসময় পরিপাটি থাকতে পছন্দ করে, এই ব্যাপারটাই জর্জের খুব ভালো লাগে। নিজের বাচ্চাগুলোকেও মেয়েটা একই রকম পরিচ্ছন্ন আর পরিপাটি রাখে। ক্যাথির বাচ্চা? এখন তো ওরা জর্জেরও সন্তান। যত যা-ই হয়ে যাক… ক্যাথি মেয়েটা আসলেই ভালো, বাচ্চাগুলোও বেজায় লক্ষ্মী। 

সিলিংয়ের দিকে চেয়ে রইল জর্জ। তিন তলাতে শুয়ে আছে ড্যানি আর ক্রিস। ড্যানি এখন বেশ বড়ো হয়েছে, ছেলেটা ভালো। কোনো কাজ দিলে মন দিয়ে করে। শুরুর দিকে ড্যানি ওকে ‘জর্জ’ বলে ডাকত। এখন ছেলেটার সাথে দূরত্ব ঘুচেছে, “বাবা” বলেই ডাকে। ক্যাথির আগের স্বামীর সাথে কখনও দেখা হয়নি জর্জের, ভালোই হয়েছে। বাচ্চাগুলোর মধ্যে ড্যানির সাথেই ওর ভাব বেশি। ক্রিসও নিজের সৎ বাবাকে বেশ পছন্দই করে। ক্যাথি বলে ক্রিস একদম হুবহু ওর বাবার চেহারা পেয়েছে। ঘন কালো কোঁকড়া চুল আর ভাসা-ভাসা চোখ। ওর চোখদুটো বেশি ভালো লাগে জর্জের। ছেলেটাকে বকলে মাথা নিচু করে থাকে, তারপর মুখটা একটু উঁচু করে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রয়। ওই চাহনির সামনে জর্জের সমস্ত রাগ পানি হয়ে যায়, ক্রিসকে কোলে নিয়ে চুমু খায় সে। 

দুই ভাই-ই নিজেদের বোন মিসিকে খুব ভালোবাসে। জর্জের বেজায় ভালো লাগে ব্যাপারটা। পাঁচ বছর বয়স, কিন্তু মেয়েটা যথেষ্ট বুদ্ধিমান। শুরুতে ওকে নিয়েই একটু ভয়ে ছিল জর্জ। কিন্তু মেয়েটা খুব সহজেই ওকে আপন করে নিয়েছে। মিসি ওকে খুবই পছন্দ করে, ওর সব কথা শোনে। ক্যাথিকেও অনেক ভালোবাসে মেয়েটা। 

“নাহ,” আপনমনেই বলল জর্জ, “আমি আসলেই ভাগ্যবান, এত ভালো একটা বউ পেলাম… সাথে তিনটে লক্ষ্মী বাচ্চা। এতকিছু একেবারে কতজনের কপালেই বা জোটে?” ভোর ছ’টারও খানিকটা পরে ঘুম এলো জর্জের। আর কয়েক মিনিট পরেই জেগে উঠল ক্যাথি। 

অবাক হয়ে আশেপাশে তাকাল সে। দেখতে দেখতে একটা রাত কেটে গেল নতুন বাড়িটাতে! কত বড়ো এই শোবার ঘরটা! পাশে অঘোরে ঘুমাচ্ছে ওর স্বামী, তিনটে বাচ্চাও হয়তো এখনও ঘুমিয়েই আছে। ক্যাথি কি কখনও ভেবেছিল যে এত বড়ো একটা বাড়ির মালকিন হবে ও? ঈশ্বর যখন দেন, একদম সবকিছুই দিয়ে দেন! 

কিন্তু ক্যাথি ভুলে গেছিল, যে ঈশ্বর যখন নিয়ে নেন তখন একদম নিষ্ঠুরের মতোই সবকিছু কেড়ে নেন। 

খুব সাবধানে জর্জের হাতটা সরিয়ে খাট থেকে নেমে এলো ক্যাথি। বেচারা জর্জ আগের দিন প্রচুর খেটেছে, আজ একটু বেলা পর্যন্ত ঘুমাক। অনেক কাজ এখনও বাকি। রান্নাঘরটা এখনও নিজের পছন্দমতো গুছিয়ে নিতে পারেনি ক্যাথি, বাচ্চারা ঘুম থেকে ওঠার আগেই যতটা সম্ভব কাজ এগিয়ে রাখতে হবে। 

ধীরে ধীরে নিচতলায় নেমে এলো ক্যাথি। রান্নাঘরটা ভালো করে ঘুরে ফিরে দেখল সে, বাইরে অন্ধকার এখনও কাটেনি। সুইচ টিপে আলো জ্বেলে দিলো। থালা, গ্লাস আর বিভিন্ন সরঞ্জাম ভরতি বাক্সগুলো মেঝেতে রাখা, তাকেও পড়ে আছে কতগুলো বাক্স। ঘরের মাঝখানে একটা ছোট্ট টেবিল, ওর ওপর উলটা করে বসানো ক’টা চেয়ার। ওগুলোও নামাতে হবে। অগোছালো হয়ে পড়ে আছে সবকিছু। মুচকি হাসল ক্যাথি। ঘরটাকে এমন সুন্দর করে সাজাবে ও, যা দেখে সবার তাক লেগে যাবে। দুশ্চিন্তা এড়ানোর জন্য মাঝে মাঝেই ধ্যান করে ক্যাথি, এই ঘরে বেশ শান্তিতেই সেটা করা যাবে। এক বছর ধরে এটা করে সে, জর্জ শিখিয়েছে। 

 দু’বছর আগে থেকেই অবসর সময়ে ধ্যান করে জর্জ। আগের স্ত্রীর সাথে ছাড়াছাড়ির পর থেকে মানসিকভাবে প্রচণ্ড অবসাদগ্রস্থ হয়ে পড়ে ও। তারপর কিছু বন্ধুর পরামর্শে ধ্যান করা শুরু করে। ওদের বিয়ের পর ক্যাথিকেও ব্যাপারটা বুঝিয়েছে সে। এখন বলতে গেলে সারাটা দিনই ব্যস্ত থাকে জর্জ, তারপরেও ধ্যান করার জন্য পাঁচ-সাত মিনিট সময় বের করেই নেয় সে। তবে গত কয়েকদিন বাড়ি বদলের চাপে ধ্যান করা হয়ে উঠেনি ওদের। 

কফি তৈরির যন্ত্রটা ধুয়ে, মুছে পরিষ্কার করে সেটাতে কফি তৈরির সরঞ্জাম ঢালল ক্যাথি। তারপর প্লাগে লাগিয়ে দিয়ে একটা সিগারেট ধরাল। কফি হওয়ার আগ পর্যন্ত সিগারেট খাওয়া যাক। দিনের প্রথম সিগারেটের পর কফি না হলে ক্যাথির চলেই না। সিগারেট খেতে খেতে পেনসিল আর প্যাড নিয়ে টেবিলে বসে পড়ল সে। সারাদিন বাড়ির কী কী কাজ করবে তার একটা তালিকা বানাল। আজ উনিশ তারিখ, শুক্রবার। বড়োদিনের ছুটি শেষ হওয়ার আগ পর্যন্ত বাচ্চাদের নতুন স্কুলে ভর্তি করা যাচ্ছে না। 

বড়োদিন! আর তো বেশিদিন বাকি নেই। কিন্তু তেমন কিছুই তো করা হয়নি… 

হুট করেই ক্যাথির মনে হলো ওর দিকে কেউ তাকিয়ে আছে। চমকে উঠে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল সে। রান্নাঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে আছে ছোট্ট মিসি! 

“মিসি! তুমি তো আমাকে ভয় পাইয়ে দিয়েছিলে,” কপট রাগ দেখাল ক্যাথি, “তা কী হয়েছে? এত সকালে কেন উঠেছ তুমি?” 

ছোট্ট মেয়েটার চোখদুটো আধবোজা, সোনালি চুলগুলো এসে পড়েছে মুখের ওপর। অবাক চোখে আশপাশটা দেখল সে, যেন বুঝতে পারছে না যে কোথায় এসে পড়েছে! 

“মা,” কেমন যেন থমথমে কণ্ঠে বলে উঠল সে, “আমি বাড়ি ফিরে যেতে চাই!” 

“আরে বোকা মেয়ে! তুমি তো বাড়িতেই আছ… এটা আমাদের নতুন বাড়ি। এসো, কাছে এসো।” 

অদ্ভুত ভঙ্গিতে এগিয়ে এলো মিসি, তারপর ঝাঁপিয়ে পড়ল মায়ের কোলে। বাড়ির দু’জন মেয়েই সকাল সকাল রান্নাঘরে, ঠিক পঞ্চাশ-ষাট বছর আগের আমেরিকাতে যেমনটা হতো। আস্তে আস্তে পিঠে চাপড় মারতে মারতে মিসিকে দোল খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিলো ক্যাথি। 

জর্জ নিচে নামল ন’টার পরে। ততক্ষণে ড্যানি আর ক্রিস সকালের নাস্তা শেষ করে বাইরে হ্যারির সাথে খেলায় মত্ত। পুরো জায়গাটা ঘুরে ঘুরে দেখছে ওরা। ঘুম পাড়ানোর পর মিসিকে ওর ঘরে রেখে এসেছে ক্যাথি, এখনও উঠেনি সে। 

রান্নাঘরের দরজার পুরোটাই অবরোধ করে দাঁড়াল জর্জের বিশাল দেহ। মুখ তুলে চাইল ক্যাথি। বেশ অগোছালো লাগছে জর্জকে। চোয়ালের নিচের দিকের দাড়ি কামায়নি, উষ্কখুষ্ক হয়ে আছে ওর গাঢ় সোনালি চুল আর দাড়ি। গোসল শেষে সবসময়ই চুল আঁচড়ায় জর্জ… এর মানে আজ সে গোসলই করেনি! 

“কী ব্যাপার?” বলে উঠল ক্যাথি, “আজ অফিস যাবে না?” 

“নাহ,” ক্লান্ত ভঙ্গিতে টেবিলে বসল জর্জ, “ট্রাক থেকে বাকি মালামাল নামিয়ে ওটাকে ডিয়ার পার্কে রেখে আসতে হবে। কেন যে কালই সব কিছু নামিয়ে ফেললাম না। একদিন বেশি রাখার মাশুল হিসেবে এখন পঞ্চাশ ডলার অতিরিক্ত গুণতে হবে… বুঝলে?” হাই তুলল সে। তারপর চারপাশটা ভালো করে দেখল। 

হুট করেই অদ্ভুতভাবে কেঁপে উঠল জর্জ, “কী ঠান্ডারে বাবা! কী ব্যাপার ক্যাথি? তুমি হিটার চালু করোনি?” 

রান্নাঘরের জানালার পাশ দিয়ে ড্যানি আর ক্রিস চেঁচাতে চেঁচাতে হ্যারির পিছন পিছন ছুটে গেল। জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে ওদের দেখল জর্জ। 

“কী ব্যাপার ক্যাথি? এদের সমস্যা কী? সকাল সকাল এভাবে চেঁচামেচি না করলেই কি হয় না? তুমি ওদের মানা করছ না কেন?” কোনো কারণ ছাড়াই রেগে গেল সে। 

বাসন ধুতে ধুতে ওর দিকে ঘুরে তাকাল ক্যাথি, “আমার ওপর মেজাজ দেখাচ্ছ কেন? তুমি ওদের বাবা না? নিজেই মানা করতে পারছ না?” 

সজোরে টেবিলে চাপড় মারল জর্জ, ক্যাথি এমন চমকে উঠল যে আরেকটু হলে লাফিয়ে উঠত। 

“একদম ঠিক,” বলল জর্জ, “বেশ, আমিই মানা করছি।” রান্নাঘরের দরজাটা খুলে বাইরে গেল সে। ড্যানি, ক্রিস আর হ্যারি আগের মতো চিৎকার করে যাচ্ছিল। 

“অ্যাই, তোমরা তিন জন, অনেক হয়েছে, এখন খেলাধুলা বন্ধ,” এই বলে বাচ্চাদের কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে দড়াম করে দরজা বন্ধ করে দিলো জর্জ। তারপর গট গট করে হেঁটে বেরিয়ে গেল রান্নাঘর থেকে। 

রীতিমতো হতবাক হয়ে গেল ক্যাথি। এই প্রথম বাচ্চাদের ওপর মেজাজ দেখাল জর্জ, তা-ও এমন সামান্য একটা কারণে? ওকে এমন মেজাজ খারাপ করতে এর আগে কখনও দেখেনি সে। 

একা একাই ট্রাক থেকে সব সরঞ্জাম নামাল জর্জ, তারপর নিজের মোটরসাইকেলটা পিছনে তুলে নিয়ে গাড়িটাকে ফেরত দিতে ডিয়ার পার্কের দিকে নিয়ে চলল সে। মোটরসাইকেলে করে ফিরবে ও। 

*** 

বাড়ি ফিরে সারাদিন খিটখিট করতে লাগল জর্জ। দাড়ি তো কামালোই না, গোসলও করল না। একটুক্ষণ পরপর ক্যাথিকে এসে বলতে লাগল, “অনেক ঠান্ডা, এত ঠান্ডা কেন লাগছে?” বাচ্চারা ততক্ষণে তিন তলায় উঠে গেছে। সেখানে তাদের খেলার শব্দেও বিরক্ত হতে লাগল জর্জ। 

রাত এগারোটা বেজে গেল, জর্জ তখনও “ঠান্ডা ঠান্ডা” বলে একটু পরপর গজরাচ্ছে। বাচ্চারা ঘুমাতে চলে গেছিল, ক্যাথিও রাত পোশাক পরে তৈরি হয়ে নিল। সারাটাদিন টুকিটাকি কাজ আর বাচ্চাদের জর্জের কাছ থেকে সামলে রাখতেই ব্যস্ত ছিল মেয়েটা। ক্যাথির মনটা বেজায় খারাপ, বাচ্চাদের দেখলেই রাগ করছে জর্জ! ও তো আগে এমন করেনি। ঘুমানোর আগে বাথরুমগুলো পরিষ্কার করার ইচ্ছা ছিল ক্যাথির, কিন্তু আজ সে অনেক ক্লান্ত হয়ে গেছে… তাই ভাবল সকালে উঠেই কাজটা করবে। 

ওদিকে নিচতলার বসার ঘরে ফায়ারপ্লেসে একটার পর একটা কাঠের গুঁড়ি গুঁজে দিচ্ছে জর্জ। প্রচণ্ড আগুনে রীতিমতো গর্জন করছে ফায়ারপ্লেসটা, কিন্তু জর্জের মনঃপুত হচ্ছে না। থার্মোস্টাটে ঘরের তাপমাত্রা পঁচাত্তর ডিগ্রি ফারেনহাইট…. তারপরেও জর্জের শরীর থেকে শীত শীত ভাব যাচ্ছিল না। সারাদিনে অন্তত বারো বার সে বেসমেন্টের অয়েল বার্নারটা ঠিক আছে না-কি পরীক্ষা করেছে। 

অবশেষে বারোটার দিকে শোবার ঘরে ঢুকল সে। বিছানাতে পড়তেই ঘুম! রাত সোয়া তিনটার দিকে ঘুম ভেঙে গেল ওর। বিছানায় উঠে বসল সে, চারপাশটা খেয়াল করতে লাগল ভালো করে। মনে হচ্ছে কিছু একটা ঠিক নেই! আচ্ছা, নৌকা রাখার ছাউনিটার দরজা কি সে লাগিয়ে দিয়েছে? ঠিক মনে পড়ছে না। তাড়াতাড়ি নিচে নেমে বাইরে গেল সে। দরজাটা শুধু বন্ধই না বরং তালা লাগানো। 

পরের দুটো দিন লুৎজ পরিবারের সবার মধ্যেই কেমন যেন একটা পরিবর্তন এলো। বাচ্চারা খুব বেশি জ্বালাতে লাগল ওদের মাকে, জেদি আর একগুঁয়ে হয়ে উঠল হ্যারি… ক্যাথিও একটুতেই রেগে উঠছিল। 

ব্যাপারগুলো খেয়াল করলেও পাত্তা দিলো না জর্জ। নতুন জায়গায় এমন একটু-আধটু হয়। এসব নিয়ে বেশি ভাবলে চলে? 

আর পাত্তা দেবেই বা কেন? সে নিজেও তো বদলে গেছিল। টানা দু’দিন গোসল করল না, দাড়িও কামাল না। অথচ আগে কখনোই এমনটা করেনি সে! পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা নিয়ে বেজায় খুঁতখুঁতে জর্জ। সে এমন নোংরামি করছে! 

শুধু কী তাই? ব্যাবসার প্রতি নিবেদিত প্রাণ জর্জ কেমন যেন বেপরোয়া হয়ে উঠল। 

দুই বছর আগে শারলিতে একটা নতুন অফিস খুলেছিল সে। দক্ষিণ তীরের ঠিকাদারদের সাথে কাজ করত সেই অফিস। নতুন বাড়িতে আসার পর থেকে ওই অফিসের কোনো খোঁজই সে নিচ্ছিল না। সিয়োসেটের পুরোনো অফিসে ফোন দিয়ে বলল এক সপ্তাহের মধ্যে বাকি থাকা জমি জরিপের কাজগুলো শেষ করতে, কারণ ওর টাকা দরকার। সেখানকার লোকেরা তো হতবাক! বস কোনোদিন তাদের সাথে এভাবে কথা বলেনি! অফিসটা নতুন বাড়ির বেসমেন্টে নিয়ে আসার ব্যাপারেও আর ভাবছে না সে। 

ক্যাথির সামনে পড়লেই সে বলে উঠত, “ক্যাথি বুঝলে, এই বাড়ির আবহাওয়া এত ঠান্ডা! মাঝে মাঝে মনে হয় যেন একটা বিরাট ফ্রিজের মধ্যে এসে ঢুকেছি।” ক্যাথি অবাক হতো, কারণ ওর এত ঠান্ডা লাগত না। দিনের বেশিরভাগ সময়ই ফায়ারপ্লেসের সামনে বসে থাকতে লাগল জর্জ, ওখানে বেশি বেশি কাঠের গুঁড়ি গুঁজে দিতে লাগল। গনগনে আগুনের তাপেও ওর মন ভরত না… মাঝে মাঝে সেই নৌকা রাখার ছাউনিটার সামনে গিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকত। শূন্য দৃষ্টিতে চেয়ে থাকত জায়গাটার দিকে। তারপর বাড়ির ভেতর ফিরে আসত। অদ্ভুত ব্যাপার হলো এখনও জর্জ জানে না যে কেন সে ওভাবে জায়গাটার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকত… কী দেখতে চাইত? ওর ভাষ্যমতে, “কেন ওখানে যেতাম? আমি নিজেও জানি না। অদ্ভুত এক আকর্ষণ যেন আমাকে টেনে নিয়ে যেত ওখানে। অনেক চেষ্টা করেও সেই টান এড়াতে পারতাম না।” 

তৃতীয় রাতেও সোয়া তিনটার দিকে ঘুম ভেঙে গেল জর্জের। কেন যেন ওর মনে হচ্ছিল কেউ উঠানে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কিন্তু সেই রাতে আর বাইরে বের হলো না জর্জ। ইদানীং বাচ্চাদেরও অসহ্য লাগে ওর। এই বাড়িতে আসার পর থেকেই একটু বেশিই দুষ্ট হয়ে গেছে ওরা, কথাই শুনতে চায় না! না না, এমনটা হতে দেওয়া যাবে না। ওদের শাসন করা প্রয়োজন… যদি তাতেও কাজ না হয় তবে শাস্তি দিতেও পিছপা হবে না জর্জ। 

ওদিকে ক্যাথির মনের অবস্থাও খানিকটা অমনই। একটুতেই বাচ্চাদের ওপর রেগে যাচ্ছিল সে। মাত্র এই ক’দিনে জর্জের সাথে যথেষ্ট দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছিল ওর। বড়োদিনের আগে বাড়িটাকে একদম পরিপাটি করে গুছিয়ে ফেলার ইচ্ছা ওর কিন্তু বাচ্চাদের জ্বালাতনে তা আর হচ্ছে কই? 

অবশেষে চতুর্থ রাতে একদম ফেটে পড়ল ক্যাথি। ড্যানি, ক্রিস আর মিসিকে বড়ো একটা কাঠের খুন্তি দিয়ে পেটাতে শুরু করল সে, ওদের চিৎকারের শব্দ শুনে জর্জ এসে পড়ল। কিন্তু সে ক্যাথিকে তো আটকালোই না… বরং চামড়ার একটা বেল্ট নিয়ে যোগ দিলো ওর সাথে! 

ভরপুর মার খেলো বাচ্চারা। 

ওদের অপরাধ? ভুল করে খেলাঘরের অর্ধচন্দ্রাকার জানালার কাচ ভেঙে ফেলেছিল! মাত্র এটুকুর জন্য এমন মার? 

মিস্ত্রি ডেকে খুব অল্প খরচেই তো জানালাটা ঠিক করে নেওয়া যেত! এখনও ঘটনাটার কথা উঠলে জর্জ আর ক্যাথি লজ্জা পায়। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *