চতুর্দশ অধ্যায়
২ জানুয়ারি।
সকাল সকাল বাড়ি থেকে বের হলো জর্জ, বরফের ওপর সেই পায়ের ছাপগুলো তখনও মিলিয়ে যায়নি। হ্যারির ঘর ছাড়িয়ে গ্যারেজে ঢোকার রাস্তার সামনে এসে শেষ হয়েছে ওগুলো। আরেকটু এগিয়ে গেল জর্জ… গ্যারেজের দরজার সামনে এসে রীতিমতো আঁতকে উঠল সে! গ্যারেজের অত মজবুত দরজাটা লোহার কাঠামো থেকে কেউ যেন ভেঙে বের করে ফেলেছে!
গতরাতে নিজেই দরজাটায় তালা লাগিয়ে দিয়েছিল জর্জ! রীতিমতো মুচড়ে ছুটিয়ে ফেলা হয়েছে ওটাকে… এভাবে ওটাকে বের করে আনা একা কারও পক্ষে সম্ভব নয় আর বেশ জোরে আওয়াজও হওয়ার কথা! জর্জ কোনো আওয়াজ কেনো পেল না? তারচেয়ে বড়ো কথা হলো এমন কাজ করতে রীতিমতো আসুরিক শক্তির প্রয়োজন, কোনো মানুষের পক্ষে এটা সম্ভব না।
থম মেরে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল জর্জ। পায়ের ছাপ… তারপর ভাঙা গ্যারেজের দরজা! এসব কী হচ্ছে? কয়েকদিন আগে সদর দরজাটাও এভাবে ঝুলে পড়েছিল। আচ্ছা পায়ের ছাপগুলো তো শুয়োরের মতো… সেদিন রাতের বেলা মিসির পিছনে একটা শুয়োর দেখেছিল না সে? ভাঙা দরজাটার ফাঁক দিয়ে ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে বেশ জোরেই বলে উঠল সে, “বালের বাড়ি! এখানে এত অদ্ভুত ঘটনা কেন ঘটে? “
আলো জ্বালিয়ে চারপাশটা ভালো করে দেখল জর্জ। তার মোটরসাইকেল, বাচ্চাদের সাইকেল, ডিফেওদের রেখে যাওয়া বৈদ্যুতিক ঘাস কাটার যন্ত্র, ডিয়ার পার্ক থেকে নিয়ে আসা বাগানে বসার বেঞ্চ, পানি দেওয়ার পাইপ, নানান যন্ত্রপাতি আর তেলের টিনগুলো ঠিক আগের মতোই আছে। আধখোলা পাল্লার ফাঁক দিয়ে ঢোকা তুষারে মেঝে ভরে আছে, কিন্তু এখানে কারও পায়ের ছাপ নেই। বোঝাই যাচ্ছে বেশ কয়েক ঘণ্টা আগে ভাঙা হয়েছে দরজাটা।
“কেউ কি আছেন না কি এখানে?” বোকার মতো চেঁচিয়ে উঠল জর্জ। কেউ রাতের বেলা এলেও কি সে বসে থাকবে না কি? দমকা একটা হাওয়া বয়ে গেল গ্যারেজের দরজার বাইরে, যেন জর্জের কথার জবাব দিতে এসেছে!
কিছুক্ষণ পর গাড়িতে করে অফিসের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ল জর্জ। অফিসে আসার পর কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে রইল সে। সকালের দিকে একটু ভয় পেয়ে গেছিল, কিন্তু এখন আবার রাগ হচ্ছে। গ্যারেজের দরজা ঠিক করাতে অনেক টাকা খরচ হবে। মোটামুটি দুই থেকে তিনশ ডলার লাগার কথা, বীমা কোম্পানি এই টাকা দেবে না এটা প্রায় নিশ্চিত! এই অবস্থায় টাকা পকেট থেকে দেওয়া খুবই কঠিন ওর জন্য।
মেজাজ এতই খারাপ যে ফোর্ড ভ্যানটা চালিয়ে অমন বরফে ঢাকা রাস্তা পেরিয়ে কী করে সে সিয়োসেটে পৌঁছল সেটাও মনে নেই! খুব বেশি রেগে গেলে অনেকেরই এমনটা হয়। পরবর্তীটে আমাদেরকে জর্জ জানিয়েছে, “আসলে দুর্ঘটনাগুলো এভাবেই ঘটে, সেদিন রীতিমতো আনমনে গাড়ি চালিয়েছিলাম! এতটাই রাগ উঠেছিল যে নিজের নিরাপত্তার কথাও খেয়াল ছিল না!”
যা-ই হোক, খুব তাড়াতাড়ি কাজে ডুবে গেল সে। কিছুক্ষণের জন্য ভুলেই গেল ওশান অ্যাভিনিউয়ের ১১২ নম্বর বাড়িটার কথা!
***
বাড়ি থেকে বেরোবার আগে ভাঙা দরজা আর ওখানকার পায়ের ছাপগুলোর ব্যাপারে ক্যাথিকে বলেছিল জর্জ।
জর্জ চলে যাওয়ার পরপরই দু’বার ওর মাকে ফোন দিয়েছিল ক্যাথি, কিন্তু ওপাশ থেকে কেউ ফোন ধরেনি। তারপর ক্যাথির মনে পড়ল যে জোয়ান সাধারণত শুক্রবারের দিন সুপারমার্কেটে যান, শনিবারের ভিড় এড়াতে তিনি শুক্রবার সকালে বাজার করে নেন। দোতালায় উঠল ক্যাথি, ঘরগুলোর পর্দা আর গালিচাগুলো পরিষ্কার করতে হবে। পুরো বাড়িটা ভালো করে পরিষ্কার করতে হবে, নিজেকে ব্যস্ত রাখতে হবে। জর্জ আসার আগ পর্যন্ত একা একা বসাই যাবে না, নইলে উদ্ভট সব চিন্তা মাথায় আসবে।
চাদর পালটে বালিশগুলো ঝাড়তে শুরু করল সে। ঠিক তখনই পিছন থেকে কে যেন জড়িয়ে ধরল ওর কোমর। বুকের ভিতরটা ধক করে উঠল ক্যাথির, কোনোমতে সে বলল, “ড্যানি?”
আরও শক্ত করে চেপে ধরা হলো ওকে। এই স্পর্শের সাথে রান্নাঘরের সেই স্পর্শের অনেকটা পার্থক্য রয়েছে! অনেক বেশি শক্ত এটা… ক্যাথির মনে হচ্ছে যেন কোনো পুরুষ মানুষ চেপে ধরেছে ওকে।
“আমাকে ছেড়ে দাও, দয়া করে ছেড়ে দাও, “ ফুঁপিয়ে উঠল ক্যাথি।
হঠাৎ করেই শিথিল হয়ে এলো বাঁধনটা, অদৃশ্য হাতদুটো সরে গেল কোমর থেকে। কিন্তু পরক্ষণেই কাঁধদুটো বেশ জোরে খামচে ধরলো কেউ। ওকে নিজের দিকে ঘোরাতে চেষ্টা করছে অদৃশ্য লোকটা!
ঠিক তখনই সস্তা পারফিউমের সেই পরিচিত গন্ধটা এসে লাগল ওর নাকে। এক জোড়া অদৃশ্য হাত ওর হাতদুটো ধরে টানতে লাগল। ক্যাথির বুঝতে বাকি রইল না যে ওকে নিয়ে দু’জন অশরীরী রীতিমতো টানাটানি করছে! এদের হাত থেকে ছাড়া পাওয়ার কোনো উপায় নেই… তবে কি ও মরে যাবে? কাঁধের চাপটা আরও বেড়ে গেল… আর সহ্য করতে পারল না ক্যাথি, জ্ঞান হারাল সে।
***
কতক্ষণ যে অচেতন ছিল তা ঠিক মনে নেই ক্যাথির। জ্ঞান ফিরতেই ও দেখল যে বিছানাতে পড়ে আছে, দেহের অর্ধেকটা ঝুঁকে আছে মেঝের দিকে আরেকটু হলেই মাথা ফেটে যেত। তাড়াতাড়ি উঠতে গিয়ে মাথাটা আবার চক্কর দিয়ে উঠল, কোনোমতে ছেলেদের নাম ধরে ডাক দিলো সে। ওর ডাক শুনে ড্যানি এসে পলো। ক্যাথির মনে হচ্ছিল কিছুক্ষণের মধ্যে ও আবার অজ্ঞান হয়ে যাবে।
“ড্যানি, তোমার বাবাকে ফোন করো,” কোনোমতে বলল ক্যাথি।
কয়েক মিনিট পর ড্যানি ফিরে এসে বলল, “বাবা তো অফিসে নেই, অন্য একটা লোক ফোন ধরেছিল। সে বলল বাবা অফিস থেকে বেরিয়ে গেছে, বাড়িতেই আসছে মনে হয়!”
জর্জের কিন্তু বাড়ি পৌঁছতে পৌঁছতে বিকাল হয়ে গেল।
অ্যামিটিভিলে গাড়ি ঢুকতেই কী ভেবে যেন ম্যারিক রোডের দিকে গাড়ি ঘোরাল জর্জ। উইচেস ব্রু পানশালায় থামল সে, এক গ্লাস বিয়ার না হলে আর চলছেই না।
আজকেও পানশালার ভিতরটা বলতে গেলে ফাঁকাই। জুকবক্স আর টিভি বন্ধ রয়েছে। শুধুমাত্র বারটেন্ডারের গ্লাস ধোয়ার শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। জর্জ ঢুকতেই মুখ তুলে চাইল লোকটা, “আরে! আপনাকে আবার দেখে ভালো লাগছে!”
“যাক, চিনেছেন তবে? আমারও ভালো লাগছে,” হাসল জর্জ, “এক গ্লাস মিলারস।”
এক দৃষ্টিতে বারটেন্ডারের দিকে চেয়ে রইল জর্জ। মন দিয়ে গ্লাসে মিলার স ব্রান্ডের বিয়ার ঢালছে সে। বয়স মেরেকেটে ত্রিশের আশেপাশে হবে, বেশ নাদুস- নুদুস। এত অল্পবয়স্ক ছোকরাদের বারটেন্ডার হিসেবে কাজ করতে তেমন দেখাই যায় না। ছোকরাকে দেখেই বোঝা যায় ও শুধু মদ বেচেই না, চেখেও দেখে।
গ্লাস এগিয়ে দিলো বারটেন্ডার। এক চুমুকে প্রায় অর্ধেকটা খালি করে গ্লাসটা নামিয়ে রাখল জর্জ। তারপর বলল, “আচ্ছা, একটা কথা বলুন তো। ডিফেওদের আপনি ব্যক্তিগতভাবে চিনতেন?
আবার একটা গ্লাস ধোয়াতে মন দিয়েছিল সে, মুখ না তুলেই বলল, “চিনতাম তবে ব্যক্তিগতভাবে অত ভালো সম্পর্ক ছিল না। ওই মুখে চেনা আরকি। কেন?”
“আমি তো ওদের বাড়িতেই থাকি আজকাল আর তাছাড়া…”
“আরে জানি তো,” জর্জকে কথা শেষ করতে দিলো না বারটেন্ডার। বেশ বিরক্ত হলো জর্জ। কিন্তু কিছু বলল না।
“গতবার যখন এসেছিলেন, “ বলে চলল ছোকরা, “বলেছিলেন ওশান অ্যাভিনিউয়ের ১১২ নম্বর বাড়িটাতে থাকেন, ওটাই তো ডিফেওদের বাড়ি ছিল।”
“হুম,” আরেক চুমুকে গ্লাসটা খালি করে দিলো জর্জ, “আচ্ছা ওরা কি এখানে আসত?”
গ্লাস ধোয়া শেষ, পরিষ্কার গ্লাসটা তাকে রেখে বারটেন্ডার বলল, “শুধু রনি আসতো। মাঝে মাঝে ওর বোন ডনকেও নিয়ে আসত। ছেলেটা ভালোই ছিল। জর্জের ফাঁকা গ্লাসটা তুলে নিল সে, “আসলে আপনি দেখতে অনেকটাই রনির মতো। সেই চাহনি, একই রকম দাড়ি… বয়সে একটু বড়ো ওর চেয়ে…. এই যা!”
“হুম, ওদের বাড়ির ব্যাপারে কোনো কথা বলত রনি?”
আরেক গ্লাস বিয়ার জর্জের সামনে রাখল বারটেন্ডার, “বাড়ির ব্যাপারে? কী কথা বলবে?”
“এইতো… ওখানে অদ্ভুত কোনো ঘটনা ঘটে না কি? হুম?” গ্লাসে চুমুক দিলো জর্জ।
“কেন? এখন কি বাড়িটাতে অদ্ভুত কিছু ঘটে না কি? খুনগুলো হওয়ার পর এলাকার লোকেরাও বাড়িটা এড়িয়ে চলে অবশ্য!”
“না না,” হাত তুলল জর্জ, “আচ্ছা, ওই রাতের ঘটনার আগে রনির আচরণ কি বদলে গেছিল? মানে কিছু বলেছিল আপনাকে?”
আশেপাশে ভালো করে দেখে নিল বারটেন্ডার, তারপর ফিসফিসিয়ে বলল, “রনি নিজে থেকে আমাকে তেমন কিছু বলেনি অবশ্য, কিন্তু…” খানিকটা সামনে এগিয়ে এলো সে, “তবে ওরা না, একটু কেমন যেন ছিল! একবার ওদের বাড়িতে বেশ বড়ো একটা পার্টি দেওয়া হয়েছিল। সেই সময়ে অতিথিদের মদ পরিবেশনের জন্য আমাকে রেখেছিলেন রনির বাবা।”
দ্বিতীয় গ্লাসের অর্ধেকটা খালি করে দিলো জর্জ, “হুম, বাড়িটা সম্পর্কে আপনার মতামত?
“বিরাট বাড়ি,” নিজের হাতদুটো ছড়িয়ে বাড়িটার আকার বোঝানোর চেষ্টা করল ছোকরা, “ওদের টাকাপয়সা বেশ ভালোই ছিল। তবে পুরো বাড়িটা দেখার সুযোগ পাইনি। বেসমেন্টে কাজে ব্যস্ত ছিলাম তো। বিয়ার, হুইস্কি, রাম আরও নানান মদের ছড়াছড়ি হয়েছিল সেই রাতে… মি. আর মিসেস ডিফেওর বিবাহবার্ষিকীর পার্টি ছিল,” তারপর আরেকবার আশপাশটা ভালো করে দেখে বলল, “ওখানে একটা গোপন ঘর আছে, জানেন?”
“তাই না কি?” না জানার ভান করল জর্জ।
‘হ্যাঁ, একবার বেসমেন্টে গিয়ে বড়ো দেওয়াল আলমারির পিছনটা খুঁজে দেখুন… পেয়ে যাবেন! অদ্ভুত ব্যাপার আসলে!”
“তাই না? আচ্ছা ওই ঘরে হতোটা কী?” একটু ঝুঁকে পড়ল জর্জ।
“অদ্ভুত সেই ঘরটা,” ঘোরলাগা স্বরে বলে যেতে লাগল বারটেন্ডার, “সেই রাতে হুট করেই ওটা খুঁজে পাই আমি। সিঁড়ির পাশের বড়ো দেওয়াল আলমারিতে মদের বোতল আর বরফ রাখছিলাম, একটা বোতল বাড়ি খেলো হুট করেই দেওয়ালে… ফাঁপা আওয়াজ হলো রীতিমতো! মানে ওপাশে কোনো দেওয়াল নেই! একদম আগের যুগের সিনেমাগুলোর দৃশ্যের মতো!”
“আহা, আমি জিজ্ঞাসা করেছি ওই ঘরে হতোটা কী?”
“তা জানি না,” মাথা ঝাঁকাল বারটেন্ডার, “আমি প্লাইউডে ধাক্কা দিতেই গোপন দরজাটা খুলে গেল। অন্ধকার একটা জায়গা… কোনো আলো ছিল না। কিছুক্ষণ পর একটা সুইচবোর্ড খুঁজে পেলাম… সবগুলো সুইচ টেপার পরেও কোনো বাল্ব জ্বলল না। অবশেষে পকেট থেকে দেশলাই বের করে একটা কাঠি জ্বালালাম। অদ্ভুত সেই ঘরটা… দেওয়ালগুলো লাল!”
“মজা করছেন না কি?” হাসল জর্জ।
বুকে বাম হাত রেখে বারটেন্ডার বলল, “ঈশ্বরের দোহাই, আমরা একটা কথাও মিথ্যা নয়! বিশ্বাস করুন! আপনি নিজে গিয়েই দেখুন, ওখানে আসলেই অমন একটা ঘর আছে!”
দ্বিতীয় গ্লাস পুরো শেষ করে ফেলল জর্জ, তারপর টেবিলে এক ডলারের একটা নোট রাখল, “এটা বিয়ারের দাম,” তারপর আরেকটা নোট রেখে বলল, “এটা আপনার বখশিস।”
“আরে! ধন্যবাদ স্যার…” একটা নোট ক্যাশে রেখে আরেকটা পকেটে ঢোকাতে ঢোকাতে বলল বারটেন্ডার, “আসলে জানেন… ওই ঘরটা না… ভালো না! মাঝে মাঝে খারাপ স্বপ্ন দেখি আমি! ওটা নিয়ে!”
“দুঃস্বপ্ন? খুলে বলুন তো।”
“মানে ঠিক বলে বোঝাতে পারব… মাঝে মাঝেই আমি দেখি কিছু অদ্ভুত লোক ওই ঘরে একত্রিত হয়েছে, তারা সবাই মিলে অনেকগুলো কুকুর আর শুয়োরকে কুপিয়ে মেরে ফেলে! তারপর ওদের রক্ত একটা বাটিতে নিয়ে অদ্ভুত সব কাজ করে!”
“কুকুর আর শুয়োর?”
“হুম,” হাত নাড়ল বারটেন্ডার, “আসলে ওই লাল ঘরটা দেখে ভয় পেয়েছিলাম! তাই এসব উদ্ভট স্বপ্ন দেখি।”
বাড়িতে ঢুকেই জর্জ দেখল ক্যাথি চুপচাপ বসার ঘরে বসে আছে। মুখটা থমথম করছে ওর। জর্জের বুঝতে বাকি রইল না আবারও অদ্ভুত কিছু ঘটেছে। ক্যাথি ধীরে ধীরে সব খুলে বলল ওকে, জর্জও উইচেস ব্রুর বারম্যানের কাছে শুনে আসা কথাগুলো বলল। এটাও জানাতে ভুলল না যে ওই লোকটাও লাল ঘরটা দেখেছে। অবশেষে দু’জনেই বুঝতে পারল যে বাস্তবতা থেকে আর পালিয়ে লাভ নেই, বাড়িটাতে এমন কিছু ঘটছে যা বিজ্ঞানের ব্যাখ্যার বাইরে!
“জর্জ, তুমি ফাদার ম্যানকুসোকে ফোন করো,” কেঁদে ফেলল ক্যাথি, “ওনাকে বলো এখানে আরেকবার আসতে।”
***
প্রধান যাজক-সহ রেক্টরির আরও সব বয়স্ক যাজকেরা বেশ চিন্তায় পড়ে গেছেন ফাদার ম্যানকুসোকে নিয়ে। সকালবেলা সবাই মিলে ওনাকে দেখতেও এসেছিলেন। উনি তাদের জানিয়েছেন যে সকাল থেকে শরীরটা একটু ভালো। প্রধান যাজক বললেন, “দেখো ফ্রাংক, তুমি কয়েকদিন টানা বিশ্রাম নাও। তোমার কাজগুলো আমি আরেকজনকে দিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।” প্রথমে খানিকটা আপত্তি করলেও অবশেষে ব্যাপারটা মেনে নিলেন ফাদার। প্রধান যাজকের ইশারায় ফাদারের টেবিলে জমে থাকা কাজের ফাইলগুলো নিজের ব্রিফকেসে তুলে নিলেন একজন বয়জেষ্ঠ্য যাজক।
“তুমি ভবন ছেড়ে বাইরে কোথাও যেয়ো না ফ্রাংক, আর তোমার যে কাগজগুলো টাইপ করা বাকি আছে সেগুলো আমাদের কেরানি করে নেবে,” হাসলেন প্রধান যাজক, “বিশ্রাম নাও আর ঈশ্বরের কাছে সাহায্য চাও!”
কিছুক্ষণের মধ্যেই বেরিয়ে গেলেন সবাই। তাদের সাথে ভবনের নিচতলা পর্যন্ত এলেন ফাদার ম্যানকুসো, তারপর আবার ফিরে গেলেন নিজের অ্যাপার্টমেন্টে। উনি ঢোকার প্রায় সাথে সাথেই ফোনটা বাজতে শুরু করল।
ফাদারের হাতে সার্জিকাল গ্লাভস পরা, একটা ড্রয়ারে এগুলো খুঁজে পেয়েছিলেন তিনি। প্রধান যাজক একবার প্রশ্ন করেছিলেন এগুলোর ব্যাপারে। ফাদার উত্তর দিয়েছিলেন, “ঠান্ডা লাগছে তো, তাই পরেছি!” কথাটা মিথ্যা। হাতের ঘাগুলো তিনি সবাইকে দেখাতে চাচ্ছিলেন না। কী লাভ দেখিয়ে? এরা তো কেউই ডাক্তার না।
পাঁচবার রিং হওয়ার পর ফোনটা ধরলেন ফাদার।
“হ্যালো, ফাদার ম্যানকুসো বলছি।”
“হ্যালো ফাদার,” ওপাশ থেকে পরিষ্কার গলায় জবাব এলো, “আমি জর্জ… জর্জ লুজ।”
জর্জের ফোন! ব্যাপারটা একেবারেই আশা করেছিলেন না ফাদার। এতদিন জর্জ আর ওর পরিবারকে নিয়ে কত ভেবেছেন তিনি, কিন্তু একবারও ফোন দেয়নি ছোড়াটা!
“জর্জ!” অবাক কণ্ঠে বলে উঠলেন তিনি, যেন জর্জ ওনার সামনেই দাঁড়িয়ে। ওনার কথাটা কেমন যেন প্রশ্নের মতো শোনাল জর্জের কাছে।
“হ্যাঁ, জর্জ, ক্যাথির স্বামী!”
“ও, হাই, কেমন আছ?”
ফোনটা ধরে কয়েক মুহূর্ত চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল জর্জ, তারপর রিসিভারে হাত দিয়ে ঢেকে, খানিকটা দূরে দাঁড়ানো ক্যাথিকে বলল, “আজ ফাদারের হলো কী? উনি তো মনে হয় আমাকে চিনছেনই না!”
ব্যাপারটা কিন্তু এমন ছিল না, জর্জকে ঠিকমতোই চিনতে পেরেছিলেন ফাদার। কিন্তু লাইনে কোনো প্রকার ঝামেলা ছাড়াই জর্জের সাথে কথা বলতে পারছেন এটা কেন যেন তার বিশ্বাস হচ্ছিল না।
জর্জের কথাগুলো কানে চলে গেল ফাদারের।
“আহা জর্জ,” একটু কাশলেন ফাদার, “তোমাকে আমি চিনব না কেন? আসলে গত কয়েকদিন অনেক চেষ্টা করেও তোমার সাথে যোগাযোগ করতে পারিনি। আর আজ তুমি নিজেই ফোন দিলে… তাই একটু অবাক হয়েছি আরকি!”
“ওহ আচ্ছা আচ্ছা, বরফ পড়ছে তো, তাই লাইনে সমস্যা হয় অনেক আজকাল,” এই বলে থেমে গেল জর্জ।
ফাদার ভেবেছিলেন জর্জ আরও কিছু বলবে, কিন্তু আর কিছুই বলল না সে। “জর্জ, তুমি আছো?” ফিসফিসিয়ে বললেন ফাদার।
“হ্যাঁ ফাদার আমি আছি,” পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ক্যাথির মুখের দিকে তাকাল জর্জ, “ক্যাথি আমার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। বলছিলাম কী, আপনি আরেকবার আসবেন আমাদের এখানে? বাড়িটাকে মনে হয় আরেকবার শুদ্ধ করা প্রয়োজন।”
একটু চমকে উঠলেন ফাদার। গতবার ওই বাড়িতে যাওয়ার পর থেকেই ওনার অসুখ আর ভালো হচ্ছে না! গ্লাভস পরা হাতটার দিকে চাইলেন তিনি। “আপনি কি আজই আসতে পারবেন ফাদার?” বলে উঠল জর্জ।
চিন্তায় পড়ে গেলেন ফাদার ম্যানকুসো। তিনি ওই বাড়িতে আর যেতে চান না, কিন্তু সেটা জর্জকে বলাটা কি ঠিক হবে?
“জর্জ শোনো,” দীর্ঘশ্বাস ফেললেন তিনি, “আমি আজ যেতে পারব না। বেশ বাজে রকমের একটা ফ্লু বাঁধিয়েছি, শরীরটা ভালো না। আর তাছাড়া ডাক্তারও মানা করে দিয়েছেন এই ঠান্ডাতে বের হতে… বুঝতেই পারছ…”
“আচ্ছা আচ্ছা,” ওনাকে কথা শেষ করতে দিলো না জর্জ, “তাহলে কবে আসবেন আপনি?”
বেজায় বিপদে পড়ে গেলেন ফাদার। জর্জ তো একেবারে মরিয়া হয়ে আছে! কী করে এখন ওকে পাশ কাটাবেন তিনি।
“আচ্ছা আবার শুদ্ধীকরণের কী দরকার? একবার তো হলোই। আর তাছাড়া এসব কাজ তো তাড়াহুড়া করে হয় না, তুমি জানোই।’
“ফাদার… আপনি একেবারেই ভাববেন না,” অস্থির কণ্ঠে বলল জর্জ, “এক কাজ করুন না, আজকেই একটু কষ্ট করে আসুন। আপনার না আমাদের বাড়িতে একদিন রাতের খাবার খাওয়ার কথা ছিল? ক্যাথি আপনার জন্য স্টেক বানাবে… ও স্টেকটা যা বানায় না… একবার খেলে সারাজীবন মনে থাকবে! দরকার হলে রাতেও এখানেই থাকবেন।”
“না না জর্জ, এটা সম্ভব না। আমি অসুস্থ।”
“আরে আসুন, ভালো মদের ব্যবস্থাও আছে! মদ খেয়ে তো আপনি রাতে ফিরতেও পারবেন না, এখানেই থেকে যাবেন।”
নিজের কানকে যেন বিশ্বাস হচ্ছিল না ফাদারের! এভাবে কেউ একজন যাজকের সাথে কথা বলে? জর্জ কবে থেকে এত অভদ্র হলো?
“শোনো জর্জ, তোমার মতো ছেলে-ছোকরা নই আমি বুঝলে? যে মদের লোভ দেখালেই…” খেঁকিয়ে উঠলেন তিনি।
“ফাদার… আমরা অনেক বিপদে আছি! আপনি ছাড়া কেউ সাহায্য করতে পারবে না!”
রাগ পানি হয়ে গেল ফাদারের, “কী হয়েছে? তোমরা ঠিক আছ তো?”
“বাড়িতে অদ্ভুত সব ঘটনা ঘটছে… অপার্থিব সব ঘটনা! আমরা এমন কিছু জিনিস দেখেছি…” জর্জের কথা শেষ হওয়ার আগেই লাইনে ‘ঘরঘর’ শব্দ শুরু হলো।
“কী বলছ জর্জ? আমি তোমার কথা শুনতে পাচ্ছি না!”
এরপর প্রায় কয়েক মিনিট কেউই কারও কোনো কথা শুনতে পেল না। দু’জনেই একটানা ঘরঘর শব্দ শুনতে পাচ্ছিল। বিরক্ত হয়ে এক সময় ফোন রেখে দিলো জর্জ।
ঘরের আশপাশে একবার ভালো করে চোখ বুলিয়ে নিল সে, তারপর ক্যাথিকে বলল, “ফোন এমনি এমনি ঝামেলা করছে না… মনে হয় ওই অদ্ভুত ব্যাপারগুলো আবার শুরু হয়েছে!”
রিসিভার নামিয়ে রাখার সাথে সাথে ফাদার ম্যানকুসোর হাতের যন্ত্রণা খুব বেশি বেড়ে গেল!
“হে ঈশ্বর ক্ষমা করে দিন আমায়,” আর্তনাদ করে উঠলেন তিনি, “জর্জ অন্য কোনো যাজক খুঁজে নিক! কিন্তু ওই বাড়িতে আমি আর কখনও যাব না!”