দ্যুতির গোয়েন্দাগিরি – রাজেশ বসু
নতুন বাড়িতে এসে বাবা-মায়ের খুব মন খারাপ। নির্জন, ফাঁকা জায়গা। টিভিতে পছন্দের সব চ্যানেল আসে না ঠিকঠাক। দোকান-বাজার কম। এমনকী, গল্প করার জন্য মনের মতো লোকও নেই তেমন। বিস্তর অভিযোগ। দ্যুতির কিন্তু প্রথম দিন থেকেই দারুণ ভাল লেগে গিয়েছে জায়গাটা। কত গাছপালা, পাখি, প্রজাপতি। মাথার উপর ঝকঝকে নীল আকাশ। রাতে কত তারা দেখা যায়। সবচেয়ে বড় কথা, ফুরফুরে মিষ্টি হাওয়া। অসুবিধে একটাই। বন্ধুদের মিস করছে খুব। কলকাতা ছেড়ে আসতে এই একটিই যা কষ্ট হয়েছে দ্যুতির। আসলে কিছু করার নেই। বাবা ব্যাঙ্কে চাকরি করেন। বদলির চাকরি। এই ক্লাস সিক্স পর্যন্ত উঠতেই তিনবার বদলি হয়েছেন বাবা। প্রতিবার একাই যান। মা আর দ্যুতি থেকে যান। এবারই প্রথম ওঁরা তিনজনেই এসেছেন। আসলে কাছাকাছি একটি মিশনারি ইশকুল হয়েছে নতুন। সেখানেই ভরতি হয়ে গিয়েছে দ্যুতি। জুনের মাঝামাঝি থেকে ক্লাস শুরু আবার। আপাতত গরমের ছুটি।
স্নানটান সেরে একতলায় ছাদের ঘরে বসে মন দিয়ে গল্প লিখছিল দ্যুতি। ডিটেকটিভ গল্প। দ্যুতির মোস্ট ফেভারিট। দেশি-বিদেশি সবই পড়ে ও। এখন আবার লেখার নেশাও চেপেছে। লিখবে এবং গল্পের ছবিও নিজেই আঁকবে। আঁকতেও খুব ভালবাসে ও। এ ব্যাপারে দুর্দান্ত একজন সঙ্গীও জুটে গিয়েছে। তিনি হলেন সান্যালদাদু। দ্যুতিদের বাড়ির উলটো দিকের ছোট্ট দু’তলা বাড়িটিতে থাকেন। একা থাকেন। বিয়ে-থা করেননি। সরকারি কোনও গোয়েন্দাবিভাগে চাকরি করতেন। অবসরের পর এখানে বাড়ি করেছেন। খুব সুন্দর ছবি আঁকেন। দেখতেও ভারী সুন্দর। টকটকে গায়ের রং। মুখভরতি সাদা দাড়ি। কিছু দাঁত যা পড়ে গিয়েছে শুধু। সান্যালদাদুকে দ্যুতি ‘সোনাদাদু’ বলে ডাকে। সোনাদাদুকে একটা ফোন করলে হয়, ভাবল দ্যুতি। আসলে গল্পটার একটি জায়গায় আটকে গিয়েছে দ্যুতি। সোনাদাদুকে বললে ঠিক সল্ভ করে দেবেন।
ভাবতে ভাবতে সোনাদাদুর দু’তলার স্টাডির দিকে তাকিয়েছিল দ্যুতি। এই ঘরেই বেশিরভাগ সময় কাটান সোনাদাদু। পড়েন, ছবি আঁকেন। দ্যুতি দেখল, একটি কাগজ ঘরের জানলা থেকে উড়ে এসে নীচে সূর্যমুখী ফুলগাছগুলোর উপর পড়ল। পরক্ষণেই কিছু পড়ে যাওয়ার শব্দ, তার পরেই পরদার পিছন থেকে দু’টো হাত বেরিয়ে এসে জানলাটাও বন্ধ করে দিল দুড়ুম করে। একটু পরে বাড়ির বাকি জানলাগুলোও বন্ধ হয়ে গেল দুমদুম করে। ওই একইভাবে, সন্তর্পণে হাত বাড়িয়ে। যতদূর দেখা যায় চেষ্টা করেও সোনাদাদুর মুখ দেখতে পেল না ও।
আশ্চর্য তো। সোনাদাদু হঠাৎ দিনদুপুরে সব জানলা বন্ধ করে দিচ্ছেন কেন। তাও ওভাবে মুখ লুকিয়ে। তার উপর ওভাবে বাগানে কাগজ ফেলা? সোনাদাদু খুব পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন মানুষ। বাতিল কাগজ কক্ষনও এভাবে বাগানের গাছের উপর ফেলবেন না।
মা স্নানে ঢুকেছেন মায়ের মোবাইলটা দ্যুতি সঙ্গে নিয়ে বসে ছিল। চট করে একটা ফোন করল সোনাদাদুকে। ফোন বাজল এবং হঠাৎ করে কেটে গেল। রি-ডায়াল করতে ঘোষণা হল ‘সুইচড অফ’!
ব্যাপারটা হল কী? চিন্তায় পড়ল দ্যুতি। একবার গিয়ে দেখে আসবে নাকি? অন্যকিছু না তো? বিপদে পড়েছেন? তাই কাগজে লিখে কোনও সংকেত ছুড়ে দিয়েছেন ওর উদ্দেশে! এ সময়টায় এই ঘরে বসে গল্পটল্প পড়ে ও, সেটা জানেন সোনাদাদু। কিন্তু, কী বিপদে পড়তে পারেন? না, একটু বেশিই ভাবছে ও। হেসে ফেলল দ্যুতি। মা ঠিকই বলেন, রহস্য গল্প পড়ে পড়ে সব কিছুর মধ্যেই রহস্য খুঁজতে শুরু করেছে ও।
এমন সময় কী কাণ্ড। শার্ট-প্যান্ট চাপিয়ে কাঁধে ঢাউস একটি ব্যাগ ঝুলিয়ে বেরিয়ে এলেন সোনাদাদু। দরজায় তালা দিলেন। কোথাও বেড়াতে যাচ্ছেন মনে হচ্ছে। কই, মনে করার চেষ্টা করল দ্যুতি, বেড়াতে যাবেন এমন কথা তো বলেননি ওকে। বাব্বা, আবার একটি কালো রোদচশমাও পরেছেন। সবচেয়ে বড় কথা, মুখে জ্বলন্ত সিগারেট। ক’দিন আগেই দ্যুতি নিজে প্রমিস করিয়েছে, ওসব খারাপ অভ্যেস একদম ছাড়তে হবে। সোনাদাদু ওর হাত ধরে কথা দিয়েছেন পর্যন্ত। রাগ করে দ্যুতি মুখ ঘুরিয়ে নিতে গিয়ে দেখল, সোনাদাদু অনেকটা নিচু হয়ে ঝুকে সূর্যমুখী গাছের উপর পড়ে থাকা কাগজটা হাতে তুলে নিলেন। তারপর একটু চোখ বুলিয়ে তালগোল পাকিয়ে ছুড়ে ফেলে দিলেন আবার। সোনাদাদুকে এতটা নিচু হতে এই প্রথম দেখল ও। বাতের ব্যথায় হাঁটু প্রায় ভাঁজ করতেই পারেন না। অবশ্য ব্যথার ওষুধ খেলে অন্য কথা। কিন্তু সোনাদাদু তো পেনকিলার খাওয়া পছন্দ করেন না। বলেন, ‘ওসবের অভ্যেস করলে যেটুকু নিজে থেকে হেঁটে-চলে বেড়াচ্ছি, সেটুকুও যাবে রে!
সেই সোনাদাদু! না, দ্যুতি ডাকবে না ভেবেছিল, শেষ পর্যন্ত ডেকেই ফেলল চিৎকার করে, “সোনাদাদু, কোথায় যাচ্ছ তুমি?”
চমকে উঠলেন সোনাদাদু। দ্যুতিকে দেখে হাত নাড়লেন একটু।
“কোথায় যাচ্ছ বললে না?” দ্যুতি বলল আবার।
সোনাদাদু কিছু বললেন না। মুখটা তুলে হাসলেন। ছেলে-ভোলানো। বড়রা যেমন হাসেন আর কী। ডান হাতটা নেড়ে দিলেন টা-টা করার মতো। তারপর লোহার গেট খুলে বেরিয়ে গেলেন তড়বড়িয়ে। দ্যুতি দেখল, সোনাদাদু গেটটা লাগালেন না ঠিকমতো। আধখোলা হয়ে পড়ে রইল। এমন ভুলোমন আগে কখনও দেখেছে কি ও সোনাদাদুকে?না। মনে পড়ছে না। আর-একবার ফোন করল ও সোনাদাদুকে। এবারও সুইচড অফ!
স্নান সেরে বেরিয়েছেন মা। একটু পুজো করবেন। তারপর চুল আঁচড়াবেন। তারপর খাওয়া। দ্যুতি ঠিক করল চট করে একবার সোনাদাদুর বাগান থেকে ঘুরে আসবে। কাগজে কী ছিল দেখতে খুব কৌতূহল হচ্ছে। সত্যি যেন একটা রহস্যের গন্ধ পাচ্ছে। কোথাও একটা ভীষণ খটকা লাগছে। কোথায়? কোথায়? দ্যুতি বুঝতে পারছে না। হঠাৎ মনে হল, সোনাদাদুর হাসিটা! ঠিক। সোনাদাদুর হাসিটাই সবচেয়ে গোলমেলে।
একছুটে বাড়ি থেকে বেরিয়ে সোনাদাদুর বাগানে এল দ্যুতি। লোহার গেট খুলল পা দিয়ে ঠেলে। হাত দেবে না কোনও কিছুতে। গোয়েন্দারা এমনই করে। সূর্যমুখী গাছগুলোর নীচেই কাগজটা পেয়ে গেল। কম্পিউটারে প্রিন্ট করা কাগজ। দ্যুতির বাড়িতেও আছে। এ ফাইভ সাইজের। কালো কালির জেলপেনে ছবি এঁকেছেন সোনাদাদু। একটি মানুষের স্কেচ। দু’হাতে দু’টো পতাকা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সে। মোট চারটি স্কেচ। চাররকম ভঙ্গিতে পতাকা ধরে আছে সে।।
ছবির নীচে ইংরেজিতে কয়েকটি অক্ষর লেখা। এস ই এম এ পি এইচ। আরও হয়তো কিছু লেখার ইচ্ছে ছিল। কেউ যেন হঠাৎ টেনে নিয়েছে কাগজটা। কালির লম্বা দাগ পড়েছে। কী লিখছিলেন সোনাদাদু? নিজের নাম? কিন্তু তবে স্পেলিং তো হবে এস আই এম এইচ এ পি আর এ এস এ ডি। মানে সিংহপ্রসাদ। একটু আনকমন নাম সোনাদাদুর। কিন্তু যা লিখেছেন তাতে অক্ষরগুলো তো মিলছে না। বাড়ির বন্ধ সদর দরজার দিকে তাকাল দ্যুতি। পেল্লাই একটা পিতলের তালা ঝুলছে দরজায়। এটিও আগে দেখেনি দ্যুতি। বাইরে গেলে কালো রঙের চ্যাপটা মতো একটি চাইনিজ তালা দরজায় লাগান সোনাদাদু।
ছবি আঁকা কাগজটা নিয়ে ফিরে এল দ্যুতি। বুকের মধ্যে ধুকপুকুনি শুরু হয়েছে হঠাৎ। একদম নিশ্চিত ও, কিছু একটা গন্ডগোল হয়েছে। হয়েছেই। সোনাদাদু গোপন সংকেতে তাই জানিয়েছেন। দু’-তিনদিন আগেই ক্রিপটোগ্রাফি শব্দটির মানে বলেছিলেন সোনাদাদু। গ্রিক শব্দ ‘ক্রিপ্টোস’ আর ‘গ্রাফোস’ মিলে এসেছে ‘ক্রিপটোগ্রাফি’। মানে গুপ্ত বা সাংকেতিক লিপি। সোনাদাদু বলেছিলেন, “গোয়েন্দা গল্প লিখবি, ভাল কথা। তবে এমনি এমনি লিখলে তো হবে না! পড়তে হবে। শিখতে হবে। জানতে হবে অনেক কিছু। তথ্যপ্রদানের কতরকম যে গোপন উপায় আছে জেনে রাখতে হবে না!”
মা চুল আঁচড়াচ্ছেন এখন। কম্পিউটারে বসে পড়ল দ্যুতি। ভাগ্যিস ইন্টারনেটটা এখানে আসে ঠিকমতো। গুগ্ল-এ গিয়ে এস ই এম এ পি এইচ অক্ষরগুলো পরপর লিখে সার্চবক্সে মাউস ক্লিক করল ও। হুস করে দশটা ওয়েবসাইট খুলে গেল। ‘সেমাফ’ বলে কিছু নেই তেমন। তবে ‘ডু ইউ মিন সেমাফর’ অপশন আসছে। তাই ক্লিক করল দ্যুতি। নিমেষে অসংখ্য সাইট। উইকিপিডিয়াতেই পেয়ে গেল যা চাইছে ও। আর সঙ্গে সঙ্গে বুকের মধ্যে এবার তুমুল হাতুড়ির পিটুনি। ঠিক যা সন্দেহ হয়েছিল। সোনাদাদুর ওই রকম বিচ্ছিরি দেঁতো হাসি।
মা ডাক দিলেন, “এখন কম্পিউটার খুলে গেম খেলার সময়? খাবি আয় শিগগির।”
কিন্তু দ্যুতির এখন কি আর খাওয়ার সময় আছে! যা সাংঘাতিক জিনিস আবিষ্কার করে বসেছে ও। কী করে এখন? হঠাৎ মনে পড়ল এখানে এসেই বাবা স্থানীয় থানার ফোন নম্বরটা ছোট নীল ডায়েরিটায় লিখে রেখেছিলেন, “আমাদের বাড়িটা যা সেক্লুডেড এরিয়ায়। সান্যালবাবুর বাড়িটা ছাড়া একশো মিটারের মধ্যে অন্য কোনও বাড়ি নেই। থানার নম্বরটা নোট করে রাখি বাবা। কখন কী কাজে আসে।”
মায়ের মোবাইল হাতে নীল ডায়েরির পাতা ওলটাতে শুরু করল দ্যুতি।
॥ ২ ॥
দ্যুতি বন্দ্যোপাধ্যায় এখন সত্যিই একজন গোয়েন্দা। ভবিষ্যতের মিস জেন মার্পেল। যে বুদ্ধিতে এমন নিখুঁত ছকে কষা অপরাধের কিনারা ও করেছে, তা আগাথা ক্রিস্টির মিস মার্পেলও পারতেন কি না সন্দেহ, এমনই বলছে সকলে। অবশ্য এও ঠিক, দ্যুতির ফোনে গুরুত্ব দিয়ে পনেরো মিনিটের মধ্যে দারোগাবাবু সদলবলে চলে না এলে কিছুই সম্ভব ছিল না।
ঘটনাটা হল, পাশের বাড়িতে একজন ভীষণ বিপদে পড়েছেন, বলামাত্র পুলিশ চলে এল দ্যুতিদের বাড়ি। দ্যুতির কাণ্ড দেখে বাবাকে অফিসে ফোন করলেন মা। তিনিও চলে এলেন। সবাই মিলে যাওয়া হল সোনাদাদুর বাড়ি। দরজার তালা ভাঙা হল। ওঃ, সে সময় দ্যুতির বুকের মধ্যে যা ধড়ফড়ানি হচ্ছিল। অঘটন যে কিছু একটা ঘটেছে, একদম নিশ্চিত ছিল ও। তবু ধড়ফড়ানিটা কমছিল না। সেটা অবশ্য সোনাদাদুকে কী অবস্থায় পাবে, সেটার জন্যেও হচ্ছিল।
যাই হোক, সেরকম ভয়ানক কিছু হয়নি। সোনাদাদুকে মুখ-হাত-পা বাঁধা অবস্থায় তাঁর স্টাডিতেই পাওয়া গেল। মাথায় আঘাত ছিল। অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলেন। তবে আঘাত গুরুতর হলেও প্রাণের ভয় নেই। ব্যাপারটা হল, অঘোরলাল হালদার নামে এক ব্যক্তি সোনাদাদুর পূর্বপরিচিত ছিল। গোয়েন্দাদপ্তরে যখন চাকরি করতেন, সে সময় তার কোয়ার্টারে মালির কাজ করত অঘোরলাল। বয়সে বছর পাঁচ-সাতের ছোট ছিল সে। আশ্চর্য ব্যাপার এই যে, সোনাদাদুর সঙ্গে চেহারায় অদ্ভুত মিল ছিল এই অঘোরলালের। হাইটও প্রায় সমান সমান। অমিল বলতে শুধু অঘোরলাল ছিল রোগাপটকা এবং দাড়ি-গোঁফটোফ তো ছিলই না, সে বয়সেই মাথাজোড়া মস্ত টাক। তবে তার স্বভাব-চরিত্র ভাল ছিল না একদম। চুরির দায়ে চাকরি যায় তার। তার পর থেকে নানারকম ফন্দিফিকির করে রোজগার করত সে।
মাস ছয়েক আগে এখানকার বাজারে হঠাৎ দেখা হয়ে যায় দু’জনের। পিছনে পড়ে থেকে সে চিনে নেয় সোনাদাদুর বাড়ি। কৃতকর্মের জন্যে শাস্তি অনেক পেয়েছে মনে করে সোনাদাদু তাকে বেশ কিছু টাকা দিয়ে সাহায্যও করেন। সম্ভবত তখনই তার আরও লোভ চেপে বসে। আজ আবার সে হাজির হয়। সাহায্য চায় প্রথমে। তারপর কথায় কথায় সোনাদাদুর সঙ্গে দু’তলাতেও উঠে আসে। তারপরেই স্বমূর্তি ধারণ করে। অতর্কিতে সোনাদাদুর মুখ-হাত-পা বেঁধে ফেলে সে। হাতের কাছে যা পায় লুটের পর আলমারির চাবির জন্য সোনাদাদুকে মারধর শুরু করে দেয়। তাতেই সোনাদাদু হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে যান। অঘোরলাল ভাবে, সোনাদাদু মারা গিয়েছেন। ঠিক সেই সময় দ্যুতির ফোন আসে। ভয়ে লাইন কেটে ফোন সুইচ অফ করে দেয় অঘোরলাল। তারপর সোনাদাদুর ছদ্মবেশ ধরেই বেরিয়ে আসে সে। যদিও সে ছদ্মবেশ দ্যুতির চোখে ধরা পড়ে যায়। কারণ, সোনাদাদু যে বাতের রোগে ভুগছিলেন, নিচু হতেই পারতেন না, এ তথ্য জানা ছিল তার। যা দেখে দ্যুতির খটকা লাগে। তবে আসল খটকা হল, দাঁত। সোনাদাদুর সামনের পাটির যে প্রায় সবক’টি দাঁতই পড়ে গিয়েছে, এটা হয়তো তার খেয়াল হলেও মনে ছিল না। পান খাওয়া লাল সেঁতো হাসিটি দূর থেকেও নজর এড়ায়নি দ্যুতির। সিগারেট ধরানোটাও আর একটি ভুল। তবে বিপদের গন্ধ বুঝে প্রথমেই যদি সোনাদাদু চট করে স্কেচটা এঁকে জানলা দিয়ে না ফেলতেন, তা হলে হয়তো দ্যুতির পুলিশকে ডাকার মতো সাহস হত না। আর অঘোরলালও ইতিমধ্যে ধরা পড়ত না।
সকলে চলে যেতে মা বললেন, “সেমাফর কী যেন, এই ব্যাপারটা আবার একটু বল তো আমাকে।”
“খুব সোজা!” মাথা দুলিয়ে বলল দ্যুতি। এর মধ্যেই আরও অনেক তথ্য জেনে নিয়েছে ও। মাকে বেশ গুছিয়ে বলে দিল।
ফরাসি বৈজ্ঞানিক ক্লদ শ্যাপ ১৭৯০ সালের গোড়ায় দিকে একটি সাংকেতিক লিপি তৈরি করেন। ক্রমে তা সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। ইংরেজিতে ‘সেমাফর অ্যালফাবেট্স’ নামে পরিচিত এটি। মূলত বিপদকালীন বার্তা বোঝাতেই এটি ব্যবহৃত হয়। দু’হাতে দু’টো ফ্ল্যাগ শরীরের বিভিন্ন দিকে রেখে এক-একটি অক্ষর বোঝানো হয়। ইন্টারনেটে একাধিক সাইটে অ্যালফাবেট্সগুলো দেওয়া আছে। তাতেই দ্যুতি বুঝতে পারে, সোনাদাদু ছবিতে এইচ ই এল পি, অর্থাৎ হেল্প শব্দটি লিখেছিলেন। দ্যুতি যদি না বুঝতে পারে সেজন্য ‘সেমাফর’ শব্দটিও লিখে দিচ্ছিলেন দাদু। অন্য কিছু যে লেখা চলবে অঘোরলাল একেবারে মুখ্যু নয়। ক্লাস সেভেন পাশ। পুরোটা লিখতে পারেননি। অঘোরলাল হাত থেকে কাগজ কেড়ে নিতে যায়। তখন তাড়াতাড়ি জানলা দিয়ে কাগজটা নীচে ফেলে দেন সোনাদাদু। ছোট্ট ক্লু। তাতে কী, দ্যুতির কাছে তা-ই যথেষ্ট ছিল। কারণ, গোয়েন্দার নজর তো আছেই ওর।
২০ মার্চ ২০০৯
অলংকরণ: ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য