ছোটোগল্প
উপন্যাস
অন্যান্য

দ্বীপ

দ্বীপ (ছোট গল্প)

বয়স হবে বছর কুড়ি, নাম জ্যাক লেতার্ক।

১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দে সে যখন গৃহত্যাগ করে তখন তার বয়স মাত্র কুড়ি। এই বয়সেই সে জন্মভূমি ফ্রান্স ছেড়ে প্রশান্ত মহাসাগরের ফরাসি উপনিবেশ তাহিতি দ্বীপে পাড়ি জমিয়েছে এবং কয়েক দিনের মধ্যেই দ্বীপের ফরাসি গভর্নরের সঙ্গে বিলক্ষণ ভাব জমিয়ে ফেলেছে।

ফ্রান্সের এক কৃষক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিল জ্যাক। তাহিতি দ্বীপে এসেও সে চাষ-আবাদ নিয়ে ভাবতে শুরু করে। এই বিষয়ে গভর্নরের সঙ্গেও তার কিছু কিছু আলাপ হয়েছে।

হঠাৎ একদিন গভর্নর জ্যাককে ডেকে বললেন, এখান থেকে প্রায় চল্লিশ মাইল দূরে একটা দ্বীপ আছে। দ্বীপটা চমৎকার। মাটি উর্বর, যে কোনো ফসল ফলানো যায়। দ্বীপে পানীয় জলের অভাব নেই, ঝরনা আছে। আরও আছে নানা রকম ফলের গাছ। দেখ বাপু- ওখানে গিয়ে যদি স্থায়ীভাবে বসবাস করতে রাজি থাক, তাহলে সরকারের তরফ থেকে ওই দ্বীপ তোমাকে উপহার দেওয়া হবে। এক পয়সাও খাজনা দিতে হবে না।

স্তম্ভিত বিস্ময়ে জ্যাক বলল, এমন চমৎকার জায়গাটা ফরাসি সরকার আমাকে বিনামূল্যে দিয়ে দেবেন কেন?

গভর্নর বললেন, ওখানে কেউ বাস করে না। কেউ যদি ওখানে গিয়ে স্থায়ীভাবে বাস করতে রাজি থাকে তবে ফরাসি সরকার তাকে বিনা-খাজনায় ওই দ্বীপের স্বত্ব ও সুখ-সুবিধা ভোগ করতে দেবেন। তবে দুঃখের বিষয়, এখন পর্যন্ত কেউ ওই দ্বীপের স্বত্ব ভোগ করার জন্য আগ্রহ প্রকাশ করেনি।

জ্যাক প্রশ্ন করল, কারণ কি? খুব সংক্ষেপে উত্তর এল, ইঁদুর!

ইঁদুর! গভর্নরের উত্তর শুনে জ্যাক হতভম্ব। এমন চমৎকার জায়গা ইঁদুরের জন্য পতিত রয়ে গেছে এ কথা কি বিশ্বাসযোগ্য?

হ্যাঁ, ইঁদুর। গভর্নর বলতে শুরু করেন, এই দ্বীপের বুকে ঘুরে বেড়ায় বড়ো বড়ো হিংস্র ইঁদুর। একটা জাহাজডুবি হয়েছিল দ্বীপের কাছে। জাহাজের ইঁদুরগুলি তখন সাঁতার কেটে এসে আশ্রয় নিয়েছিল ওই দ্বীপের উপর। কিছু দিনের মধ্যেই জন্তুগুলো বংশবৃদ্ধি করে ফেলে। ওই দ্বীপে তখন মানুষের বসবাস ছিল। কিছু কালের মধ্যেই দ্বীপবাসীরা ইঁদুরের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে উঠল। হাঁস-মুরগি থেকে আরম্ভ করে ঘরবাড়ি দরজা-জানালা প্রভৃতি সচল-অচল যাবতীয় বস্তুর উপরেই ইঁদুররা দাঁতের ধার পরীক্ষা করতে শুরু করল। দ্বীপবাসীরা বুঝল, এ দ্বীপে মানুষ আর ইঁদুর পাশাপাশি বাস করতে পারবে না। অতএব ইঁদুর-বাহিনীর বিরুদ্ধে মানুষ করল যুদ্ধ। ঘোষণা! ফাঁদ, আগুন, বিষ প্রভৃতি সব রকম মহাস্ত্র প্রয়োগ করেছিল দ্বীপের বাসিন্দারা, কিন্তু ইঁদুররা কাবু হয়নি। অবশেষে মানুষগুলোই কাবু হয়ে পড়ল, দ্বীপ ছেড়ে তারা পলায়ন করল।

হাঁ করে শুনছে জ্যাক। একটু থেমে গভর্নর আবার বললেন, ওখানে এখন মানুষ নেই, ইঁদুরেরাই বসবাস করছে। জাহাজের ইঁদুররা কেমন ছিল জানি না, তবে দ্বীপের উপর যে জগুলো ইঁদুরের উপনিবেশ স্থাপন করেছে, তাদের দৈহিক আয়তন যেমন সাতিশয় বৃহৎ, তাদের স্বভাবও তেমনি অত্যন্ত হিংস্র। এখন বোধহয় বুঝতে পারছ, কেন ওখানে মানুষ থাকে না? শোনো তোমার বয়স অল্প, সাহসও আছে মনে হয়। এমন চমৎকার জায়গাটা কী তুমি ইদরের ভয়ে ছেড়ে দেবে? ভেবে দেখ। স্থায়ীভাবে বাস করতে পারলে ওই দ্বীপের সম্পূর্ণ মালিকানার স্বত্ব ফরাসি সরকার তোমাকে দিয়ে দেবেন। তবে হ্যাঁ, মনে রাখবে- স্থায়ীভাবে বাস করতে হবে।

জ্যাক ভাবল। কয়েকদিন ধরেই ভাবল। গভর্নরের প্রস্তাবটা তার কাছে মনে হল চ্যালেঞ্জ। এই চ্যালেঞ্জ সে গ্রহণ করে নিল মনে মনে। দ্বীপের স্থানীয় অধিবাসীরা ইঁদুরের কাছে পরাজয় স্বীকার করতে পারে, কিন্তু সুসভ্য ফ্রান্সের এক তরুণ কী পিছিয়ে যাবে ইঁদুরের ভয়ে? কখনই নয়। যেমন করে তোক দ্বীপের উপর থেকে ইঁদুরদের তাড়াতে হবে।

কিন্তু জন্তুগুলোকে বিতাড়িত করার উপায়টা কী হতে পারে? বড়ো কঠিন সমস্যা। জ্যাক চিন্তা করতে থাকে…

তাহিতি দ্বীপের রাজধানী পাপেতি। ওই পাপেতির পথে পথে একদিন ঘুরে বেড়াচ্ছে জ্যাক। অন্যমনস্কভাবে হাঁটতে হাঁটতে যে অঞ্চলটায় সে এসে পড়ল, সেখানে বাস করে খুব দরিদ্ৰশ্রেণির মানুষ।

জ্যাক লক্ষ করল, এই অঞ্চলে বিড়ালের সংখ্যা খুব বেশি। তার মনে হল, প্রত্যেকটি বাড়িতেই বাস করে একাধিক মার্জার। যে দিকেই তাকায়, সেই দিকেই তার দৃষ্টিপথে ধরা দেয় শুধু বিড়াল আর বিড়াল আর বিড়াল।

জস্তুগুলোর চেহারা দেখে মনে হয়, তারা বেওয়ারিশ। খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারে গৃহস্থের সাহায্য তারা পায় না। নিজেরাই খেটে খায়!

অকস্মাৎ বিদ্যুৎ-চমকের মতো এক নতুন চিন্তাভোত ধাক্কা মারে জ্যাকের মস্তিষ্কের কোষে ইঁদুরের শত্রু বিড়াল!

সেই রাতে অনেকক্ষণ ধরে চিন্তা করল জ্যাক। পরের দিনই সে কিনে ফেলল একটা পালতোলা নৌকো।

স্থানীয় বাসিন্দা কয়েকটা কিশোর ছেলেকে ডেকে সে জানিয়ে দিল যে, তারা যদি তাকে বিড়াল এন দিতে পারে, তবে সে তাদের পুরস্কার দিতে রাজি আছে। পুরস্কারের মূল্য ধার্য হল প্রতিটি বিড়ালের জন্য এক সেনতিম (সেনতিম- স্থানীয় মুদ্রা)। তবে হ্যাঁ বিড়াল সে অনেকগুলো নিতে চায় বটে, তবে জন্তুগুলো খুব শান্তশিষ্ট হলে চলবে না, মারকুটে দাঙ্গাবাজ হাড়বজ্জাৎ বিড়ালই তার পছন্দ।

বাচ্চারা দারুণ আগ্রহের সঙ্গে জ্যাকের প্রস্তাব গ্রহণ করল। কয়েক দিনের মধ্যেই তাবৎ তাহিতি দ্বীপের সবচেয়ে পাজি আর ওঁচা বিড়ালগুলোকে পাকড়াও করে তারা জ্যাকের কাছে নিয়ে এল।

খুব চটপট হাত চালিয়ে অনেকগুলো খাঁচা তৈরি করে ফেলল জ্যাক। বিড়ালের সংখ্যাও কম নয়- একশো কিংবা তার চেয়েও কিছু বেশি জোগাড় হয়েছে। স্থানীয় একজন মাঝিকে ডেকে বিড়ালগুলিকে নিয়ে জ্যাক নৌকো ভাসিয়ে দিল। নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছে সে বন্দি বিড়ালদের ছেড়ে দিল বেলাভূমির উপর। খাঁচার ভিতর থেকে মুক্তি পেয়েই বিড়ালগুলো দ্রুতবেগে পা চালিয়ে দ্বীপের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেল। জ্যাক আবার ফিরে এল তাহিতির রাজধানী পাপেতি শহরে।

বেশ কয়েক মাস পরে জ্যাক লোক আবার দ্বীপের উদ্দেশ্যে যাত্রা করল। সে আশা করেছিল এত দিনে বিড়াল বাহিনী নিশ্চয়ই ইঁদুরের সংখ্যা কমিয়ে দিয়েছে। কয়েক জন স্থানীয় অধিবাসীর সঙ্গে সে দ্বীপের উপর পদার্পণ করল। সকলেই একটু সতর্ক হঁদুরের আতঙ্ক তাদের মন থেকে মছে যায়নি। খুব সাবধানে তারা বেলাভূমির উপর দিয়ে হেঁটে দ্বীপের ভিতর প্রবেশ করল, কিন্তু একটা ইঁদুরও তাদের নজরে পড়ল না। মাঝে মাঝে দুই-একটা অত্যন্ত বদখৎ চেহারার বিড়াল অবশ্য তাদের দৃষ্টিগোচর হয়েছে, তবে জন্তুগুলি মানুষ দেখেই ঘন ঝোঁপঝাড়ের ভিতর সরে গেছে লোকচক্ষুর সামনে আসতে তারা রাজি নয়।

দ্বীপের পরিবেশ চমৎকার লাগে জ্যাকের কাছে। সে এবার জায়গাটাকে বসবাসের উপযোগী করার জন্যে সচেষ্ট হল। লোকজনের সাহায্যে কিছু দিনের মধ্যেই সে দ্বীপের চেহারা ফিরিয়ে দিল। তাহিতি দ্বীপের স্থাপত্য-শিল্পের অনুকরণে এই দ্বীপের উপর আত্মপ্রকাশ করল একটি সুন্দর কুঁড়েঘর।

হাঁস-মুরগি নিয়ে এসেছিল জ্যাক নৌকো করে। এবার সেগুলিকে জাল দিয়ে ঘেরা জায়গার মধ্যে ছেড়ে দেওয়া হল। জঙ্গল পরিষ্কার করে তৈরি হল নারিকেল কুঞ্জ।

পাপেতি শহরে গিয়ে জ্যাক তার সাফল্যের বিশদ বিবরণী দিল সরকারের কাছে। প্রমাণ-পত্রও পেশ করল। পূর্ব-পরিচিত গভর্নর তাকে অভিনন্দন জানালেন এবং প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী মালিক বলে স্বীকৃতি দিতেও ভুললেন না। ফরাসি সরকার তাকে স্বীকার করার পর সত্যি সত্যি কাগজে-কলমে দ্বীপের মালিক হল জ্যাক লেতার্ক।

আহ্লাদে আটখানা হয়ে জ্যাক দ্বীপের নতুন নামকরণ করল ‘লেতার্কের দ্বীপ’।

তারপর আবার সে ফিরে এল তার দ্বীপে। এবার তার সঙ্গে কেউ নেই। সঙ্গীসাথী না থাকলেও জ্যাক কিন্তু কখনই নিঃসঙ্গ বোধ করে না। গাছে গাছে অজস্র সুমিষ্ট ফল, সুপেয় ঝরনার জল, গৃহপালিত হাঁস-মুরগির ডিম এবং মাঝে মাঝে জিভের স্বাদ ফেরাবার জন্য সমুদ্রের মাছ, কঁকড়া ও কাছিম– আর কি চাই?

লোকজনের সঙ্গ জ্যাকের দরকার নেই। তার দিন কাটে মহা-আনন্দে।

তার হাতে অখণ্ড অবসর, এ কথা মনে করলে ভুল হবে। সারদিন সে কঠিন পরিশ্রম করে। নানা রকম উদ্ভিদ, ফলমূল আর শাক-সবজির চাষ করে সে। হাঁস-মুরগিগুলিকে দেখাশুনা করাও বেশ কষ্টসাধ্য ব্যাপার। ভীষণ কর্মব্যস্ততার মধ্যে দিয়েই জ্যাকের দিন কেটে যায়।

তবে এইভাবে সারা জীবন নিঃসঙ্গ জীবন-যাপনের পরিকল্পনা তার নেই। সে আশা করে, হাঁস-মুরগি, নারিকেলের শাঁস প্রভৃতি চালান দিয়ে সে কয়েক বছরের মধ্যেই বেশ ধনী হয়ে উঠবে, তারপর তাহিতি থেকে একটি স্থানীয় মেয়েকে বিয়ে করে এনে এই দ্বীপেই বাকি জীবনটা সুখে-স্বচ্ছেন্দে কাটিয়ে দেবে।

ভবিষ্যতের রঙিন স্বপ্নে বিভোর হয়ে জ্যাকের দিন কাটে…

হঠাৎ একদিন তার মনে হল, হাঁস-মুরগির সংখ্যা যেন কমে গেছে। ব্যাপারটা সে বুঝতে পারে না। তার পাখিগুলো বেশ সুস্থসবল, আজ পর্যন্ত একটি পাখিকেও সে মরতে দেখে নি। পাখির সংখ্যা গণনা করেনি সে কোনো দিনই। কিন্তু আজ চোখের আন্দাজ থেকেই তার ধারণা হল, হাঁস-মুরগিদের সংখ্যা কমে গেছে এবং যাচ্ছে।

খুব আশ্চর্য হয় জ্যাক। পাখিগুলোর উপর নজর রাখতে লাগল। কয়েক দিন পরেই সে দেখতে পেল, একটা মস্ত বিড়াল ঝোপের ভিতর থেকে বেরিয়ে এসে তারের জাল টপকে হাঁসের দলের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়ল। জ্যাক বাধা দেওয়ার আগেই বিড়ালটা একটা হাঁসের বাচ্চা মুখে নিয়ে আবার তারের জাল পার হয়ে ঝোপের ভিতর মিলিয়ে গেল।

শুধু সেই দিনই নয়, জ্যাক নজর রেখে দেখল পরবর্তী কয়েক দিনের মধ্যেই প্রায় বারো-তেরোটা হাঁস ও মুরগির ছানা বিড়ালের আক্রমণে ইহলীলা সংবরণ করল। আক্রমণের কায়দা ওই একই রকম– তারের জাল টপকে জন্তুগুলো পাখিগুলিকে ধরে নিয়ে যায়। পাখিদের সংখ্যা কমে যাওয়ার রহস্য এইবার জ্যাকের কাছে পরিষ্কার হল।

বেচারা জ্যাক! মার্জার বাহিনীর কীর্তি দেখে তো মাথায় হাত দিয়ে বসে। একটু চিন্তা করতেই তার মনে হয়, শুধু তার পোষা পাখিগুলোকে দিয়েই দ্বীপের গোটা বিড়ালগোষ্ঠী নিশ্চয় ক্ষুন্নিবৃত্তি করে না। কারণ তাহলে এত দিনে পাখির বংশ নিঃশেষ হয়ে যেতে। আজ পর্যন্ত একটা ইঁদুরও তার চোখে পড়েনি, সুতরাং মার্জার বাহিনী নিশ্চয় ইঁদুরের বংশ উজাড় করে দিয়েছে। তবে এতগুলো বিড়াল কি খেয়ে বেঁচে আছে?

জ্যাক ঠিক করল, এইবার ভালো করে বিড়ালদের হালচাল লক্ষ করতে হবে।

সব কাজকর্ম ছেড়ে জ্যাক দ্বীপটাকে পর্যবেক্ষণ করতে শুরু করে। খুব ভোরবেলা এবং সন্ধ্যার সময়ে বেরিয়ে দেখলে, সমুদ্রের তীরে ছোটো ছোটো দলে ভাগ হয়ে বিড়ালগুলি বেড়াতে আসে। বালি খুঁড়ে ধরে শামুক, গুগলি, পাথর সরিয়ে টেনে আনে কাঁকড়া। কয়েকটা অতি উৎসাহী বিড়াল আবার জলে নেমে মাছ ধরছে।

হঠাৎ একদিন বিড়ালগুলোর হিংস্র স্বভাবের পরিচয় পেয়ে স্তম্ভিত হয়ে গেল জ্যাক।

বেলাভুমির কাছে অগভীর জলের ভিতর দিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে একটা কচ্ছপ। হঠাৎ কয়েকটা বিড়াল একসঙ্গে তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল এবং টানাটানি করতে করতে তাকে চিৎ করে ফেলল। কিছুক্ষণের মধ্যেই দাঁতে নখে ছিন্ন-ভিন্ন করে তারা খেয়ে ফেলল কচ্ছপটাকে। পড়ে রইল শুধু কচ্ছপের শক্ত খোলা!

জ্যাক মনে মনে বুঝল, তাহিতি দ্বীপের বিড়াল কেন বন্য প্রকৃতির সংস্পর্শে এসে ভয়ংকর হয়ে উঠেছে, ওদের সম্বন্ধে একটু সাবধান থাকা দরকার।

সে সঙ্গে বন্দুক আনেনি। আনার দরকারও মনে হয়নি। এইবার সে আগ্নেয়াস্ত্রের প্রয়োজন অনুভব করল। কিন্তু বন্দুক যখন নেই, তখন আর কি করা যাবে? বুনো লতা দিয়ে সে ফঁদ পাতল। কিন্তু দুঃখের বিষয়, ফাঁদে একটি বিড়ালও ধরা পড়ল না।

জ্যাক বিড়ালগুলোর আস্তানা আবিষ্কার করেছিল। আগুন আর ধোঁয়ার সাহায্যে সে। জন্তুগুলোকে জব্দ করারও চেষ্টা করেছিল। কিন্তু কোনো ফল হয়নি। বিড়ালগুলো আস্তানা ছেড়ে সাময়িকভাবে সরে পড়ল।

জ্যাক এবার তাহিতির রাজধানী থেকে বিষ এবং বন্দুক নিয়ে এল। বিষ মাখানো টোপ সাজিয়ে লাভ হল না। বিড়ালগুলো অসম্ভব ধূর্ত, তারা বিষাক্ত টোপ স্পর্শও করল না। জ্যাকের বন্দুকের গুলিতে অবশ্য কয়েকটা বিড়াল মারা পড়ল, কিন্তু পাখিগুলোর উপর মার্জার বাহিনীর আক্রমণ বন্ধ করা গেল না। বিড়ালকে লক্ষ্য করে গুলি ছুড়লে অনেক সময় পাখির উপর গুলি লাগার সম্ভাবনা থাকে– কয়েকটা পাখি এইভাবে নিক্ষিপ্ত গুলিতে মারাও পড়েছিল।

জ্যাক আবার যখন তাহিতিতে গেল, তখন তার সমস্যার কথা খুলে বলল গভর্নরকে। গভর্নর তাকে ডিনামাইটের সাহায্য নিতে বললেন। গভর্নরের পরামর্শ জ্যাকের মনঃপূত হল না। ডিনামাইট বিস্ফোরণ দ্বীপের গায়ে বহু গহ্বর ও গর্তের সৃষ্টি করবে এবং যে বিড়ালগুলো বেঁচে যাবে, তারা আবার ওই সব ফাটলে আশ্রয় নিয়ে বংশবৃদ্ধি করে যাবে নির্বিবাদে।

বিড়ালগুলো জ্যাককে এখন ভালোভাবে চিনে নিয়েছে। তারা বুঝেছে, এই লোকটাই হচ্ছে দ্বীপের মধ্যে তাদের একমাত্র শত্রু। জ্যাককে দেখলে তারা সরে যায় বটে, কিন্তু খুব বেশি দূরে পালায় না– অত্যন্ত অনিচ্ছার সঙ্গে কিছুটা পিছিয়ে যায় মাত্র। কয়েকটা জানোয়ার আবার পিঠটাকে ধনুকের মতো বেঁকিয়ে হিংস্রভাবে ফাঁস-ফাঁস করতে থাকে।

জ্যাক এবার ভয় পায়। তার গুলি ফুরিয়ে এসেছে। হাঁস-মুরগির আস্তানাও প্রায় শূন্য। কয়েকটা বড়ো হাঁস শক্তিশালী ডানা আর ধারালো ঠোঁটের সাহায্যে আত্মরক্ষা করছে বটে, কিন্তু তারাও বেশি দিন টিকতে পারবে কি?

জ্যাক ভাবতে থাকে, জন্তুগুলো যদি তাকে দল বেঁধে আক্রমণ করে, তা হলে সে কি করে আত্মরক্ষা করবে? বিড়ালগুলো এখন একেবারেই বন্য প্রাণীতে পরিণত হয়েছে। তাদের পক্ষে সব কিছুই সম্ভব।

রাত্রিবেলা জ্যাক আর ঘরের বাইরে যায় না।

অন্ধকারের মধ্যে মার্জারকছে ক্রুদ্ধ গর্জন কানে আসে… জ্যাক বোঝে, যোদ্ধারা এখন দাঁত আর নখের বোঝাঁপড়া করছে… যুদ্ধের আওয়াজ একদিকে মিলিয়ে যায়, অন্যদিক থেকে আবার নতুন আর একদল যোদ্ধা সগর্জনে সাড়া দেয়… উৎকট, হিংস্র মাজার কণ্ঠের সেই গর্জনধ্বনি চলে সারা রাত ধরে… ঘরের মধ্যে বিনিদ্র চোখে চেয়ে থাকে জ্যাক লেতাৰ্ক… এমনকি

জানালা-দরজাও সে রাত্রে খুলতে সাহস পায় না…।

হঠাৎ এক রাত্রে জ্যাক চমকে উঠল- মাথার উপর কুঁড়ে ঘরের চালের উপর বেজে উঠেছে তীক্ষ্ণ নখরে ঘর্ষণধ্বনি! ঘরের ভিতর মাছ রান্না করছে জ্যাক। সেই মাছের গন্ধে অস্থির হয়ে কয়েকটা বিড়াল ঘরের চালে উঠে আঁচড় কাটছে পাগলের মতো!

চাল ফাঁক করে বিড়ালগুলো ভিতরে আসতে চায়! মানুষের অস্তিত্ব তারা গ্রাহ্য করতে রাজি নয়…

বিড়ালদের উদ্দেশ্য অবশ্য সফল হয়নি।

কিন্তু এই ঘটনায় জ্যাকের মনোবল ভেঙে গেল। যথাসম্ভব তাড়াতাড়ি সাজ-সরঞ্জাম গুটিয়ে সে এক দিন নৌকোয় চড়ে পাড়ি জমাল তাহিতির রাজধানীর দিকে-~

জীবনে আর কোনো দিন জ্যাক ওই দ্বীপে ফিরে যায়নি, যার নাম সে রেখেছিল লেতার্কের দ্বীপ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *