দ্বি-বৈবাহিক কাঁটা – নারায়ণ সান্যাল
রচনাকাল : প্রাকৃপূজা ’94
[ শারদীয়া ‘নবকল্লোল’ ’94-এ প্রকাশিত ]
পুস্তকাকারে প্রকাশ : বইমেলা ’95
গ্রন্থ ক্রমিক : ’97
প্রচ্ছদ পরিকল্পনা : খালেদ চৌধুরী
প্রচ্ছদ আলোকচিত্র : প্রসেনজিৎ দাশগুপ্ত
অলঙ্করণ : সন্দীপন ভট্টাচার্য, অলকানন্দা সেনগুপ্ত
উৎসর্গ : ডাঃ দেবাশিস কুমার রায়
কৈফিয়ৎ
নাগচম্পা’র ট্রায়াল বলটাকে ‘এলেবেলে’ বলে ধরে নিলে এই কাহিনীটি পি. কে. বাসু— কাঁটা সিরিজের পঞ্চদশী কণ্টক। এই গোটা গোয়েন্দা-সিরিজের উৎসমুখে কী জাতের অনুপ্রেরণা তার স্বীকৃতি নতুন করে দেবার অপেক্ষা রাখে না। শরদিন্দু ‘দ্য প্রিজনার অব জেন্দার ‘পেনাস্রাবলম্বনে’ রচনা করেছিলেন : ঝিন্দের বন্দী। মূল কাঠামোটুকু নিয়ে বিদেশী কাহিনীকে সম্পূর্ণ ভারতীয় পরিবেশে রূপান্তরিত করে পরিবেশন করেছিলেন। কৈফিয়তে তিনি বলেছিলেন ‘নাম দিয়াই বংশ-পরিচয় স্বীকর করিলাম’।
কথাটা এ-ক্ষেত্রেও বলা চলে। পি. কে. বাসু’র বিচারে দ্বি-বৈবাহিক শব্দটি Bigamous শব্দের বঙ্গানুবাদ।
কিন্তু জেন্দার রাজাকে ঝিন্দের কারাগারে বন্দী করা যে কী পরিমাণ ঝকমারির ব্যাপার, সে- বিষয়ে বোধকরি আপনাদের সম্যক ধারণা নেই। ধরুন আলোচ্য কাহিনীটি। যে ইংরেজি-গল্পের অনুপ্রেরণায় এটি রচিত তার কাহিনী বিন্যাসের সঙ্গে এর আসমান-জমিন ফারাক। সে ইংরেজি- গল্পের হত্যাকারীর লিঙ্গ পর্যন্ত বদলে দিতে বাধ্য হয়েছি। কারণ দক্ষিণ ক্যালিফোর্নিয়ার মার্কিন সমাজে যে ঘটনা-পরম্পরা সম্পূর্ণ বিশ্বাসযোগ্য, শহর কলকাতার বাঙালি সমাজে তা পাঠক- পাঠিকা মেনে নেবেন না। পাঠক-পাঠিকাকে দোষ দিয়ে কী লাভ? আমি নিজেও তা বিশ্বাস করতে পারিনি। তাই লিখতেও পারিনি। ফলে আদ্যন্ত পরিবর্তন করতে হল। গল্প শুরু করার আগেই হাটের মাঝে হাঁড়ি ভাঙাটা বুদ্ধিমত্তার পরিচায়ক হবে না। তাই শুধু বলি : ইংরেজি বইয়ের হত্যাকারী যদি পুরুষ, তা হলে বাঙলায় সে স্ত্রী-লোক অথবা ভাইসিভার্সা।
এবার কাহিনী-গোমাতার বৃক্ষারোহণ প্রসঙ্গে আসা যাক। অর্থাৎ লেখক যেখানে সজ্ঞান অ্যানাক্রনিজম্ স্বীকার করে কাহিনী লিপিবদ্ধ করে গেছেন। কাহিনীবিন্যাসের প্রয়োজনে একটি মফঃস্বলের চার্চ ও তার ‘ডেথ-চেম্বার’ অপরিহার্য হয়ে পড়ল। লেখক অনায়াসে কলকাতার অনতিদূরে একটি খ্রীস্টান উপনগরী কল্পনা করে অমন একটি গীর্জার ছবি আঁকতে পারতেন! কিন্তু তিনি সে পথে যাননি। তিনি নস্ট্যালজিয়ার শিকার হয়েছেন। তাঁর মনে পড়ে গেছে : জাগুলিয়ার মোড় থেকে বাঁক মেরে সেই মেরী নগরে যাবার কথা। সেই ক্রিশ্চান জনপদের বিভিন্ন চরিত্র— বৃদ্ধা মিস্ পামেলা জনসন, মিনতি, ডাক্তার পীটার দত্ত এবং বিশেষ করে মেরীনগরের মিস্ মার্সেল’, ঊষা বিশ্বাস!
লেখক নস্ট্যালজিয়ার প্রেরণায় পথ হারালেন। ভুলে গেলেন, প্রথমবার উনি মেরীনগরে যান সত্তরের দশকে। মিস্ পামেলা জনসনের প্রয়াণের অব্যবহিত পরে। তাঁর মরকতকুঞ্জে।
ফলে, এখন সে শহরের বর্ণনা দিতে গেলে দেখাতে হয় সব কিছুর বয়সই বিশ-পঁচিশ বছর বৃদ্ধি পেয়েছে। লেখক সে-সম্বন্ধে অনবহিত বলেও মনে হয় না। তাই প্রীতম হেনার ফুটফুটে বাচ্চা দুটো বড় হয়ে গেছে। রাকেশ এখন মার্কিন-মুলুকে এঞ্জিনিয়ারিং পড়ছে, মীনা এখন স্কুলে পড়ায়। সে এম. এ., বি. এড্.! কিন্তু সেই অনুসারে লেখক ষাট বছর বয়সী পি. কে. বাসুকে অশীতিপর করেননি, ত্রিশ বছরের সুজাতাকে করেননি পঞ্চাশোর্ধ্বা প্রৌঢ়া।
এটা লেখকের সজ্ঞান অ্যানাক্রনিজম।
গল্প-গোমাতার বৃক্ষারোহণ!
ক্ষমা-ঘেন্না করে মেনে নিন।
এ কাহিনীতে যাঁরা প্রুফ দেখেছেন, কম্পোজ করেছেন, অলঙ্করণ করেছেন, তাঁদের নাম প্রকাশক যথাস্থানে সকৃতজ্ঞভাবে স্বীকৃতি দিয়েছেন।
কিন্তু লেখক হিসাবে বিশেষ একজনের অবদান পৃথকভাবে স্বীকার করার প্রয়োজন। তার সঙ্গে আমার যে সম্পর্ক গড়ে উঠেছে তাতে কৃতজ্ঞতা, ধন্যবাদের প্রশ্ন ওঠে না; কিন্তু সেটা স্বীকার না করা পর্যন্ত আমার মনটাও যে শান্ত হচ্ছে না। সে আমার গুণগ্রাহী পুত্রপ্রতিম : শ্রী প্রসেনজিৎ দাশগুপ্ত।
প্রথমত, যে মূল ইংরেজি কাহিনীর পেনাম্রাবলম্বনে এই বাঙলা কাহিনীটি রচিত সেটি সে-ই আমাকে সরবরাহ করেছিল। তাছাড়া মার্কিন মুলুকের ঘটনা-পরম্পরা শহর কলকাতার পটভূমিতে কীভাবে বিশ্বাসযোগ্য করে তোলা যেতে পারে সে বিষয়েও প্রভূত ‘সাজেশান্’ দিয়ে আমার কাজকে সহজ করে দিয়েছে। সবার উপরে যে দুটি যমজ গ্রন্থের (একই সঙ্গে প্রকাশিত ‘যমদুয়ারে পড়ল-কাঁটা’-সমেত) জন্য দু-দুটি রঙিন আলোকচিত্র সরবরাহ করেছে। দুটিই তার পিতৃদেব হাওড়া আদালতের স্বনামধন্য অ্যাডভোকেট শ্রী সত্যজিৎ দাশগুপ্তের— টেবিলের ছবি। খানকতক প্রামাণিক আইনের বই, পাইপ, চশমা ইত্যাদি সাজিয়ে সে পি. কে. বাসু সাহেবের টেবিলটার এতাবৎ কল্পচিত্রের নয়নগ্রাহ্য রূপারোপ করতে সক্ষম হয়েছে।
অত্যন্ত পরিতাপের কথা, গ্রন্থটি প্রকাশিত হতে যেটুকু সময় লেগেছে তার ভিতর অ্যাডভোকেট দাশগুপ্ত স্বর্গারোহণ করেছেন, ফলে এই যুগল আলোকচিত্র পি. কে. বাসর টেবিলের কল্পরা শুধু নয়, সত্যজিৎ দাশগুপ্তের স্মৃতিভারাক্রান্ত!
নারায়ণ সান্যাল
1.8.94