দ্বিতীয় জন

দ্বিতীয় জন

প্রিয়াংকার খুব খারাপ ধরনের একটা অসুখ হয়েছে।

অসুখটা এমন যে কাউকে বলা যাচ্ছে না। বললে কেউ বিশ্বাস করবে না, কিংবা বিশ্বাস করার ভান করে আড়ালে হাসাহাসি করবে। একজনকে অবিশ্যি বলা যায়–জাভেদকে। জাভেদ তার স্বামী। স্বামীর কাছে কিছুই গোপন থাকা উচিত নয়। অসুখ-বিসুখের খবর সবার আগে স্বামীকেই বলা দরকার।

কিন্তু মুশকিল হচ্ছে জাভেদের সঙ্গে প্রিয়াংকার পরিচয় এখনো তেমন গাঢ় হয় নি। হবার কথাও নয়। তাদের বিয়ে হয়েছে একুশ দিন আগে। এখনো প্রিয়াংকার তুমি বলা রপ্ত হয় নি। মুখ ফসকে আপনি বলে ফেলে। এরকম গম্ভীর, বয়স্ক একজন মানুষকে তুমি বলাও অবিশ্যি খুব সহজ নয়। মুখে কেমন বাধো-বাধে ঠেকে। প্রিয়াংকা চেষ্টা করে আপনি তুমি কোনোটাই না বলে চালাতে, যেমন— তুমি চা খাবে? না বলে— চা দেব? এইভাবে দীর্ঘ আলাপ চালানো যায় না, তার চেয়েও বড় কথা— মানুষটা খুব বুদ্ধিমান। ভাববাচ্য কিছুক্ষণ কথা বলার পরই সে হাসিমুখে বলে, তুমি বলতে কষ্ট হচ্ছে, তাই না?

তুমি বলতে কষ্ট হওয়াটা দোষের কিছু না। প্রিয়াংকার বয়স মাত্র সতেরো। তাও পুরোপুরি সতেরো হয় নি। জুন মাসে হবে। এখনো দুমাস বাকি। আর ঐ মানুষটার বয়স খুব কম ধরলেও ত্রিশ। তার বয়সের প্রায় দ্বিগুণ। সারাক্ষণ গম্ভীর থাকে বলে বয়স আরো বেশি দেখায়। বরের বয়স বেশি বলে প্রিয়াংকার মনে কোনো ক্ষোভ নেই। বরদের চেংড়া দেখালে ভালো লাগে না। তাছাড়া মানুষটা অত্যন্ত ভালো। ভালো এবং বুদ্ধিমান। কমবয়েসী বোকা বরের চেয়ে বুদ্ধিমান বয়স্ক বর ভালো।

বিয়ের রাতে নানা কিছু ভেবে প্রিয়াংকা আতঙ্কে অস্থির হয়েছিল। ধ্বকধ্বক করে বুক কাঁপছিল। কপাল রীতিমতো ঘামছিল। মানুষটা সঙ্গে-সঙ্গে তা বুঝে ফেলেছিল। কাছে এসে ভারী গলায় বলল, ভয় করছে? ভয়ের কী আছে বল তো?

প্রিয়াংকার বুকের ধ্বকধ্বকানি আরো বেড়ে গেল। সে হ্যাঁ না কিছুই বলল না। একবার মনে হল সে অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছে। মানুষটা তখন নরম গলায় বলল, ভয়ের কিছু নেই। ঘুমিয়ে পড়। বলেই প্রিয়াংকার গায়ে চাদর টেনে দিল। তার গলার স্বরে কিছু একটা ছিল। প্রিয়াংকার ভয় পুরোপুরি কেটে গেল এবং প্রায় সঙ্গে-সঙ্গে ঘুমিয়ে পড়ল। অনেক রাতে একবার ঘুম ভেঙে দেখে লোকটি অন্যপাশ ফিরে ঘুমুচ্ছে। খানিকক্ষণ জেগে থেকে প্রিয়াংকা আবার ঘুমিয়ে পড়ল। ঘুম ভাঙল অনেক বেলায়। লোকটি তখন পাশে নেই।

একটা মানুষকে চেনার জন্যে একুশ দিন খুব দীর্ঘ সময় নয়। তবু প্রিয়াংকার ধারণা মানুষটা ভালো, বেশ ভালো। এরকম একজন মানুষকে তার অসুখের কথাটা অবশ্যই বলা যায়। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে অসুখটার সঙ্গে এই মানুষটার সম্পর্ক আছে। এই কারণেই তাকে বলা যাবে না। কিন্তু কাউকে বলা দরকার। খুব তাড়াতাড়ি বলা দরকার। নয়তো সে পাগল হয়ে যাবে। কিছুটা পাগল সে বোধহয় হয়েই গেছে। সারাক্ষণ অস্থির লাগে। সন্ধ্যা মেলাবার পর শরীর কাঁপতে থাকে। তৃষ্ণায় বুক শুকিয়ে কাঠ হয়ে থাকে। গ্লাসের পর গ্লাস পানি খেলেও তৃষ্ণা মেটে না। সামান্য শব্দে ভয়ংকর চমকে উঠে। সেদিন বাতাসে জানালার কপাট নড়ে উঠল। সঙ্গে-সঙ্গে ভয়ে অস্থির হয়ে গোঙানির মতো শব্দ করল প্রিয়াংকা। হাতের চায়ের কাপ থেকে সবটা চা ছলকে পড়ল শাড়িতে। ভাগ্যিস আশেপাশে কেউ ছিল না। কেউ থাকলে নিশ্চয়ই খুব অবাক হত। প্রিয়াংকার ছোটমামা যেমন অবাক হলেন।

তিনি প্রিয়াংকাকে দেখতে এসেছিলেন। তার দিকে তাকিয়েই বিস্মিত গলায় বললেন, তোর কী হয়েছে রে?

প্রিয়াংকা হালকা গলায় বলল, কিছু হয় নি তো। তুমি কেমন আছ মামা?

আমার কথা বাদ দে। তোকে এমন লাগছে কেন?

কেমন লাগছে?

চোখের নিচে কালি পড়েছে। মুখ শুকনো। কী ব্যাপার?

কোনো ব্যাপার না মামা।

গালটাল ভেঙে কী অবস্থা! তুই কথাও তো কেমন অন্য রকমভাবে বলছিস।

কী রকমভাবে বলছি?

মনে হচ্ছে তোর গলাটা ভাঙা।

ঠাণ্ডা লেগেছে মামা।

প্রিয়াংকা কয়েকবার কাশল। মামাকে বুঝাতে চাইল যে তার সত্যি-সত্যি কাশি হয়েছে, অন্য কিছু না। মামা আরো গম্ভীর হয়ে গেলেন। শীতল গলায় বললেন,

আর কিছু না তো?

না।

ঠিক করে বল।

ঠিক করেই বলছি।

প্রিয়াংকার কথায় তার মামী খুব আশ্বস্ত হলেন বলে মনে হল না। সারাক্ষণ গম্ভীর হয়ে রইলেন। চায়ের কাপে দুটা চুমুক দিয়েই রেখে দিলেন। যাইরে মা। বলেই কোনোদিকে না তাকিয়ে হনহন করে চলে গেলেন। মামা চলে যাবার এক ঘণ্টার ভেতরই মামি এসে হাজির। বোঝাই যাচ্ছে মামা পাঠিয়ে দিয়েছেন।

মামি প্রিয়াংকাকে দেখে আঁতকে উঠলেন। প্রায় চেঁচিয়েই বললেন, এক সপ্তাহ আগে তোকে কী দেখেছি আর এখন কী দেখছি? কী ব্যাপার তুই খোলাখুলি বল তো? কী সমস্যা?

প্রিয়াংকা শুকনো হাসি হেসে বলল, কোনো সমস্যা না।

মামি কঠিন গলায় বললেন,

তুই বলতে না চাইলে আমি কিন্তু জামাইকে জিজ্ঞেস করব। জামাই আসবে কখন?

ও আসবে রাত আটটার দিকে। ওকে কিছু জিজ্ঞেস করতে হবে না মামি। আমি বলছি।

বল। কিছু লুকুবি না।

প্রিয়াংকা প্রায় ফিসফিস করে বলল, আমি ভয় পাই, মামি।

কিসের ভয়?

কী যেন দেখি।

কী দেখিস?

নিজেও ঠিক জানি না কী দেখি।

ভাসা-ভাসা কথা বলবি না। পরিষ্কার করে বল কী দেখিস।

প্রিয়াংকা এক পর্যায়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে বলল, মামি আমি বোধহয় পাগল হয়ে গেছি। আমি কী সব যেন দেখি।

সে কী দেখে তা তিনি অনেক প্রশ্ন করেও বের করতে পারলেন না। প্রিয়াংকা অন্য সব প্রশ্নের জবাব দেয় কিন্তু কী দেখে তা বলে না। এড়িয়ে যায় বা কাঁদতে শুরু করে।

তোর কি বর পছন্দ হয়েছে?

হ্যাঁ।

সে কি তোকে ভয়-টয় দেখায়?

কী যে তুমি বল মামি, আমাকে ভয় দেখাবে কেন?

রাতে কি তোরা একসঙ্গে ঘুমাস?

প্রিয়াংকা লজ্জায় বেগুনি হয়ে গিয়ে বলল, হ্যাঁ।

সে কি তোকে অনেক রাত পর্যন্ত জাগিয়ে রাখে?

কী সব প্রশ্ন তুমি কর মামি?

আমি যা বলছি তার জবাব দে।

না জাগিয়ে রাখে না।

মামি অনেকক্ষণ থাকলেন। প্রিয়াংকাদের ফ্ল্যাট ঘুরে-ঘুরে দেখলেন। কাজের মেয়ে এবং কাজের ছেলেটির সঙ্গে কথা বললেন। কাজের মেয়েটির নাম মরিয়ম। দেশ খুলনা। ঘরের যাবতীয় কাজ সে-ই করে। কাজের ছেলেটির নাম জীতু মিয়া। তার বয়স নয়-দশ। এদের দুজনের কাছ থেকেও খবর বার করার চেষ্টা করা হল।

আচ্ছা মরিয়ম তুমি কি ভয়-টয় পাও?

না। ভয় পামু ক্যা?

রাতে কিছু দেখটেখ না?

কী দেখুম?

আচ্ছা ঠিক আছে–যাও।

প্রিয়াংকার মামি কোনো রহস্য ভেদ করতে পারলেন না। তার খুব ইচ্ছা ছিল জাভেদের সঙ্গে পুরো ব্যাপারটা নিয়ে আলাপ করবেন, পরামর্শ করবেন। প্রিয়াংকার জন্যে পারা গেল না। সে কঁদো-কঁদো গলায় বলল, মামি তুমি যদি তাকে কিছু বল তাহলে আমি কিন্তু বিষ খাব। আল্লাহর কসম বিষ খাব। নয়তো ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়ব।

তিনি কিছু জিজ্ঞেস করলেন না। কারণ, প্রিয়াংকা সত্যি বিষ-টিষ খেয়ে ফেলতে পারে। আমার মৃত্যুর জন্যে কেউ দায়ী নয়—এই কথা লিখে একবার সে এক বোতল ডেটল খেয়ে ফেলেছিল। অনেক ডাক্তার-হাসপাতাল করতে হয়েছে। এই কাণ্ড সে করেছিল অতি তুচ্ছ কারণে। তার এক বান্ধবীর সঙ্গে ঝগড়া করে। এই মেয়ের পক্ষে সবই সম্ভব। তাকে কিছুতেই ঘটানো উচিত নয়।

জাভেদ এল রাত সাড়ে আটটার দিকে। জাভেদের সঙ্গে খানিকক্ষণ টুকটাক গল্প করে প্রিয়াংকার মামি ফিরে গেলেন। তার মনের মেঘ কাটল না। হল কী প্রিয়াংকার? সে কী দেখে?

প্রিয়াংকা নিজেও জানে না তার কী হয়েছে। মামি চলে যাবার পর তার বুক ধ্বক-ধ্বক করা শুরু হয়েছে। অল্প-অল্প ঘাম হচ্ছে। অসম্ভব গরম লাগছে। কিছুক্ষণ পরপর মনে হচ্ছে বোধহয় নিশ্বাস বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।

তারা খাওয়াদাওয়া করে রাত সাড়ে দশটার দিকে ঘুমুতে গেল। জাভেদ বিছানায় শোয়ামাত্র ঘুমিয়ে পড়ে। আজো তাই হল। জাভেদ ঘুমুচ্ছে। তালে-তালে নিশ্বাস পড়ছে। জেগে আছে প্রিয়াংকা। কিছুক্ষণের মধ্যেই তার পানির পিপাসা পেল। প্রচণ্ড পানির পিপাসা। পানি খাবার জন্য বিছানা ছেড়ে নামতে হবে। যেতে হবে পাশের ঘরে কিন্তু তা সে করবে না। অসম্ভব। কিছুতেই না। পানির তৃষ্ণায় মরে গেলেও না। এই পানি খেতে গিয়েই প্রথমবার তার অসুখ ধরা পড়েছিল। ভয়ে ঐদিনই সে মরে যেত। কেন মরল না? মরে গেলেই ভালো হত। তার মতো ভিতু মেয়ের মরে যাওয়াই উচিত।

ঐ রাতে সে বেশ আরাম করে ঘুমুচ্ছিল। হঠাৎ বৃষ্টি হবার জন্যে চারদিক বেশ ঠাণ্ডা। জানালা দিয়ে ফুরফুরে বাতাস আসছে। ঘুমুবার জন্যে চমকার রাত। এক ঘুমে সে কখনো রাত পার করতে পারে না। মাঝখানে একবার তাকে উঠে পানি খেতে হয় কিংবা বাথরুমে যেতে হয়। সেই রাতেও পানি খাবার জন্যে উঠল। জাভেদ কাত হয়ে ঘুমুচ্ছে। গায়ে পাতলা চাদর দিয়ে রেখেছে। অদ্ভুত অভ্যাস মানুষটার। যত গরমই পড়ক গায়ে চাদর দিয়ে রাখবে। প্রিয়াংকা খুব সাবধানে গায়ের চাদর সরিয়ে দিল। আহা, আরাম করে ঘুমুক। কেমন ঘেমে গেছে।

স্বামীকে ডিঙিয়ে বিছানা থেকে নামল। স্বামী ডিঙিয়ে উঠানামা করা ঠিক হচ্ছে না–হয়তো পাপ হচ্ছে। কিন্তু উপায় কী! প্রিয়াংকা ঘুমায় দেয়ালের দিকে। খাট থেকে নামতে হলে স্বামীকে ডিঙাতেই হবে।

তাদের শোবার ঘর অন্ধকার, তবে পাশের ঘরে বাতি জ্বলছে। এই একটা বাতি সারারাতই জ্বলে। ঘরটা জাভেদের লাইব্রেরি ঘর। এই ঘরেই জাভেদ পরীক্ষার খাতা দেখে, পড়াশোনা করে। ঘরে আসবাবপত্র তেমন কিছু নেই। একটা বুক-শেলফে কিছু বই, পুরনো ম্যাগাজিন। একটা বড় টেবিলের উপর রাজ্যের পরীক্ষার খাতা। একটা ইজিচেয়ার। ইজিচেয়ারের পাশে সাইড টেবিলে টেবিলে ল্যাম্প।

দরজার ফাঁক দিয়ে স্টাডি রুমের আলোর কিছুটা প্রিয়াংকাদের শোবার ঘরেও আসছে। তবুও ঘরটা অন্ধকার স্যান্ডেল খুঁজে বের করতে অনেকক্ষণ মেঝে হাতড়াতে হল। স্যান্ডেল পায়ে পরামাত্র পাশের ঘরে কিসের যেন একটা শব্দ হল।

ভারী অথচ মৃদু গলায় কেউ একজন কাশল, ইজিচেয়ার টেনে সরাল। নিশ্চয়ই মনের ভুল। তবু প্রিয়াংকা আরো কিছুক্ষণ অপেক্ষা করল। না, আর কোনো শব্দ নেই। শুধু সদর রাস্তা দিয়ে দ্রুতবেগে ট্রাক যাওয়া-আসা করছে। তাহলে একটু আগে পাশের ঘরে কে শব্দ করছিল? অবিকল নিশ্বাস নেবার শব্দ। প্রিয়াংকা দরজা ঠেলে পাশের ঘরে ঢুকেই জমে পাথর হয়ে গেল। ইজিচেয়ারে জাভেদ বসে আছে। হাতে বই। জাভেদ বই থেকে মুখ তুলে তাকাল। নরম গলায় বলল, কিছু বলবে?

কতটা সময় পার হয়েছে? এক সেকেন্ডের একশ ভাগের এক ভাগ না অনন্তকাল? প্রিয়াংকা জানে না। সে শুধু জানে সে ছুটে চলে এসেছে শোবার ঘরে— ঝাঁপিয়ে পড়েছে বিছানায়। তার সমস্ত শরীর কাঁপছে। সে কি অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছে? নিশ্চয়ই অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছে। ঘর দুলছে। চারদিকের বাতাস অসম্ভব ভারী ও ঊষ্ণ। জাভেদ জেগে উঠেছে। সে বিছানায় পাশ ফিরতে-ফিরতে বলল, কী?

প্রিয়াংকা বলল, কিছু না। জাভেদ ঘুম জড়ানো স্বরে বলল, ঘুমাও! জেগে আছ কেন? বলতে-বলতেই ঘুমে জাভেদ এলিয়ে পড়ল। জাভেদকে জড়িয়ে ধরে সারারাত জেগে রইল প্রিয়াংকা। একটি দীর্ঘ ও ভয়াবহ রাত। স্বামীকে জড়িয়ে ধরে প্রিয়াংকা শুয়ে আছে। তার সমস্ত ইন্দ্রিয় পাশের ঘরে। সে স্পষ্টই শুনছে ছোটখাটো শব্দ আসছে পাশের ঘর থেকে। নিশ্বাস ফেলার শব্দ, বইয়ের পাতা ওল্টাবার শব্দ, ইজিচেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালে যেমন ক্যাচক্যাচ শব্দ হয় সেরকম শব্দ, গলায় শ্লেষ্ম পরিষ্কার করার শব্দ। শেষ রাতের দিকে শোনা গেল বারান্দায় পায়চারির শব্দ। কেউ-একজন বারান্দায় এ-মাথা থেকে ও-মাথায় যাচ্ছে, আবার ফিরে আসছে। এইসব কি কল্পনা? নিশ্চয়ই কল্পনা। রাস্তা দিয়ে ট্রাক যাওয়ার শব্দ ছাড়া আর কোনো শব্দ আসছে না।

ফজরের আজানের পর প্রিয়াংকার চোখ ঘুমে জড়িয়ে এল। ঘুম ভাঙল বেলা সাড়ে নটায়। ঘরের ভেতর রোদ ঝলমল করছে। জাভেদ চলে গেছে কলেজে। মরিয়ম, জীতু মিয়ার সঙ্গে তারস্বরে ঝগড়া করছে। প্রিয়াংকার সব ভয় কপূরের মতো উড়ে গেল। রাতে সে যে অসম্ভব ভয় পেয়েছিল এটা ভেবে এখন নিজেরই কেমন হাসি পাচ্ছে। সে স্বপ্ন দেখেছিল। স্বপ্ন ছাড়া আর কিছুই না। মানুষ কত রকম দুঃস্বপ্ন দেখে। এও একটা দুঃস্বপ্ন। এর বেশি কিছু না। মানুষ তো এরচেয়েও ভয়াবহ দুঃস্বপ্ন দেখে। যে, নিজেই কতবার দেখেছে। একবার স্বপ্নে দেখেছিল—সম্পূর্ণ নগ্ন পায়ে বাসে করে কোথায় যেন যাচ্ছে। ছিঃ ছিঃ কী ভয়ংকর স্বপ্ন!

প্রিয়াংকা বিছানা থেকে নামতে-নামতে ডাকল, মরিয়ম।

জে আম্মা।

ঝগড়া করছ কেন মরিয়ম?

জীতু কাচের জগটা ভাইঙ্গা ফেলছে আম্মা।

চিৎকার করলে তো জগ ঠিক হবে না। চিল্কার করবে না।

জিনিসের উপর কোনো মায়া নাই … মহব্বত নাই …

ঠিক আছে, তুমি চুপ কর। তোমার স্যার কি চলে গেছেন?

জে।

বাজার করে দিয়ে গেছেন?

জে।

কখন আসবেন কিছু বলে গেছেন?

দুপুরে খাইতে আসবেন।

আচ্ছা যাও। তুমি আমার জন্য খুব ভালো করে এক কাপ চা বানিয়ে আনে।

নাশতা খাইবেন না আম্মা?

না। তোমার স্যার নাশতা করেছে?

জে।

মরিয়ম চা আনতে গেল। প্রিয়াংকা মুখ ধুয়ে চায়ের কাপ নিয়ে বসল। এখন তার করার কিছুই নেই। দুজন মানুষের সংসার। কাজ তেমন কিছু থাকে না। এসংসারে কাজকর্ম যা আছে সবই মরিয়ম দেখে এবং খুব ভালোমতোই দেখে। চুপচাপ বসে থাকা ছাড়া প্রিয়াংকার কোনো কাজ নেই। এই ফ্লাটে অনেক গল্পের বই আছে— গল্পের বই পড়তে প্রিয়াংকার ভালো লাগে না। ইউনিভার্সিটির ভর্তি পরীক্ষার জন্যে পড়াশোনা করা দরকার। পড়তে ভালো লাগে না, কারণ প্রিয়াংকা জানে পড়ে লাভ হবে না। সে পাস করতে পারবে না। কোনো একটা কলেজেই তাকে বি. এ. পড়তে হবে। কে জানে হয়তো জাভেদের কলেজেই। যদি তাই হয় তাহলে জাভেদ কী তাকে পড়াবে? ক্লাসে তাকে কী ডাকবে— স্যার?

চায়ের কাপ নিয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়াতেই মরিয়ম তাকে একটা চিঠি দিল।

কিসের চিঠি মরিয়ম?

স্যার দিয়া গেছে।

চিঠি না— চিরকুট। জাভেদ লিখেছে— প্রিয়াংকা, তোমার গা-টা গরম মনে হল। তৈরি হয়ে থেকো। আমি দুপুরে তোমাকে একজন ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাব।

প্রিয়াংকার মনটা হঠাৎ ভালো হয়ে গেল। মানুষটা ভালো। হৃদয়বান এবং বুদ্ধিমান। স্বামীদের কতরকম অন্যায় দাবি থাকে তার তেমন কিছু নেই। অন্যদের দিকেও খুব তীক্ষ্ণ দৃষ্টি। প্রিয়াংকা কেন, আজ যদি জীতু মিয়ার জ্বর হয় তাকেও সে সঙ্গে-সঙ্গে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবে। জাভেদ এমন একজন স্বামী যার উপর ভরসা করা যায়।

যে যাই বলুক, এই মানুষটাকে স্বামী হিসেবে পেয়ে তার খুব লাভ হয়েছে। জাভেদের আগে একবার বিয়ে হয়েছে সেটা নিশ্চয়ই অপরাধ নয়। বেচারার স্ত্রী মারা গেছে বিয়ের আট মাসের মাথায়। স্ত্রীর মৃত্যুর সঙ্গে-সঙ্গে সে বিয়ে করার জন্যেও অস্থির হয়ে পড়ে নি। দুবছর অপেক্ষা করেছে। মামা-মামি যে তাকে দোজবর একটি ছেলের সঙ্গে বিয়ে দিয়েছেন এই নিয়েও প্রিয়াংকার মনে কোনো ক্ষোভ নেই। মামা দরিদ্র মানুষ। তিনি আর কত করবেন। যথেষ্টই তো করছেন। মামি নিজের গয়না ভেঙে তাকে গয়না করে দিয়েছেন। কজন মানুষ এরকম করে? আট নটা নতুন শাড়ি কিনে দিয়েছেন। এর মধ্যে একটা শাড়ি আছে বারোশ টাকা দামের।

জাভেদের আগের স্ত্রীর অনেক শাড়ি এই ঘরে রয়ে গেছে। ঐ মেয়েটির শাড়ির দিকে তাকালেই মনে হয় খুব শৌখিন মেয়ে ছিল। ড্রেসিং টেবিল ভর্তি সাজগোজের জিনিস। কিছুই ফেলে দেয়া হয় নি। বসার ঘরে মেয়েটির বড় একটি বাঁধানো ছবি আছে। খুব সুন্দর মুখ। তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছা করে।

এই ডাক্তার জাভেদের বন্ধু।

কাজেই ডাক্তার অনেক আজেবাজে রসিকতা করল—যেমন হাসিমুখে বলল, ভাবীকে এমন শুকনো দেখাচ্ছে কেন? সংসারে নতুন কেউ আসছে নাকি? হা-হাহা। বুদ্ধিমান হয়ে ঠিক কাজটি করে ফেলেন নি তো?

দুসপ্তাহও হয় নি যার বিয়ে হয়েছে তার সঙ্গে কী এরকম রসিকতা করা যায়? রাগে প্রিয়াংকার গা জ্বলতে লাগল।

ডাক্তার তাকে একগাদা ভিটামিন দিলেন এবং বললেন, ভাবীকে মনে হচ্ছে রাতে ঘুমুতে-টুমুতে দেয় না? দুপুরে ঘুমিয়ে পুষিয়ে নেবেন। নয়তো শরীর খারাপ করবে—হা-হা-হ।

প্রিয়াংকা বাড়ি ফিরল রাগ করে। সন্ধ্যা মেলাবার পর সেই রাগ ভয়ে রূপান্তরিত হল। সীমাহীন ভয় তাকে গ্রাস করে ফেলল। এ-ঘর থেকে ও-ঘর যেতে ভয়। বারান্দায় যেতে ভয়। হাতমুখ ধুতে বাথরুমে গিয়েছে—বাথরুমের দরজা বন্ধ করার সঙ্গে-সঙ্গে মনে হল আর সে দরজা খুলতে পারবে না। দরজা আপনাআপনি আটকে গেছে। সে দরজা খোলার চেষ্টা না করেই কঁপা গলায় ডাকতে লাগল-মরিয়ম, ও মরিয়ম। মরিয়ম।

রাতে আবার ঐদিনের মতো হল। জাভেদ পাশেই প্রায় নিশ্চিন্তে ঘুমুচ্ছে আর প্রিয়াংকা স্পষ্টই শুনছে স্যান্ডেল পরে বারান্দায় কে যেন পায়চারি করছে। প্রিয়াংকা নিজেকে বুঝল— ও কেউ না, ও হচ্ছে মরিয়ম। মরিয়ম হাঁটছে। ছোট-ছোট পা ফেলছে। মরিয়ম ছাড়া আর কে হবে। নিশ্চয়ই মরিয়ম। স্যান্ডেলে কেমন ফটফট শব্দ হচ্ছে। জাভেদ যখন স্যান্ডেল পরে হাঁটে তখন এরকম শব্দ হয় না। একবার কি বারান্দায় উঁকি দিয়ে দেখবে? কী হবে উঁকি দিলে? কিছুই হবে না। ভয়টা কেটে যাবে। রাত একটা বাজে— এমন কিছু রতি হয় নি। রাত একটায় ঢাকা শহরের অনেক দোকান-পাট খোলা থাকে। এই তো পাশের ফ্ল্যাটের বাচ্চাটা কঁদছে। এখন নিশ্চয়ই বারান্দায় যাওয়া যায়।

খুব সাবধানে জাভেদকে ডিঙিয়ে প্রিয়াংকা বিছানা থেকে নামল। তার হাত-পা কাঁপছে, তৃষ্ণায় বুক ফেটে যাচ্ছে, কানের কাছে কেমন আঁ-আঁ শব্দ হচ্ছে। সব অগ্রাহ্য করে বারান্দায় চলে এল। আর তার সঙ্গে-সঙ্গে বারান্দায় দাঁড়ানো মানুষটা বলল, প্রিয়াংকা এক গ্লাস পানি দাও তো।

বিছানায় যে মানুষটা শুয়ে আছে এই মানুষটাই সেই জাভেদ। আর পরনে জাভেদের মতোই লুঙি, হাতকাটা গেঞ্জি। মুখ গম্ভীর ও বিষণ্ণ।

প্রিয়াংকা ছুটে শোবার ঘরে চলে এল। কোনোমতে বিছানায় উঠল— ঐ তো জাভেদ খুমুচ্ছে–গায়ে চাদর টানা। এতক্ষণ যা দেখেছি ভুল দেখেছি। যা শুনেছি তাও ভুল। কিছু-একটা আমার হয়েছে। ভয়ংকর কোনো অসুখ। সকাল হলে আমার এই অসুখ থাকবে না। আল্লাহ, তুমি সকাল করে দাও। খুব তাড়াতাড়ি সকাল করে দাও। সব মানুষ জেগে উঠুক। সূর্যের আলোয় চারদিকে ভরে যাক। সে জাভেদকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। জাভেদ ঘুম-ঘুম গলায় বলল, কী হয়েছে?

সকালবেলা সত্যি-সত্যি সব স্বাভাবিক হয়ে গেল। রাতে এরকম ভয় পাওয়ার জন্যে লজ্জা লাগতে লাগল। জাভেদ কলেজে চলে যাবার পর সে স্বাভাবিক ভঙ্গিতে মরিয়মকে তরকারি কাটায় সাহায্য করতে গেল। মরিয়ম বলল,

আফার শইল কী খারাপ?

না।

আফনের কিছু করণ লাগত না আফা। আফনে গিয়া হুইয়া থাকেন।

এইমাত্র তো ঘুম থেকে উঠলাম এখন আবার কী শুয়ে থাকব?

চা বানায়া দেই?

দাও। আচ্ছা মরিয়ম, তোমার আগের আপাও কি আমার মতো চা খেত?

হ। তয় আফনের মতো চুপচাপ থাকত না। সারাদিন হইচই করত। গানবাজনা করত।

মারা গেলেন কীভাবে?

হঠাৎ মাথা খারাপ হইয়া গেল। উল্টাপাল্টা কথা কওয়া শুরু করল–কী জানি দেখে।

প্রিয়াংকা শঙ্কিত গলায় বলল, কী দেখে?

দুইটা মানুষ না-কি দেখে। একটা আসল একটা নকল। কোনটা আসল কোনটা নকল বুঝতে পারে না।

তুমি কী বলছ তাও তো আমি বুঝতে পারছি না।

পাগল মাইনষের কথার কি ঠিক আছে আফা? নেন চা নেন।

প্রিয়াংকা মাথা নিচু করে চায়ের কাপে ছোট-ঘোট চুমুক দিচ্ছে। একবারও মরিয়মের দিকে চোখ তুলে তাকাচ্ছে না। তার ধারণা, তাকালেই মরিয়ম অনেক কিছু বুঝে ফেলবে। বুঝে ফেলবে যে প্রিয়াংকারও একই অসুখ হয়েছে। সে চায়

মরিয়ম কিছু বুঝুক। কারণ তার কিছুই হয় নি। অসুখ করেছে। অসুখ কি মানুষের করে না? করে। আবার সেরেও যায়। তারটা সারবে।

রাত গভীর হচ্ছে। বাইরে বৃষ্টি পড়ছে টুপটুপ করে। খোলা জানালায় হাওয়া আসছে। প্রিয়াংকা জাভেদকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে আছে। তার চোখে ঘুম নেই।

পাশের ঘরে বইয়ের পাতা ওল্টানোর শব্দ হচ্ছে। এই যে সিগারেট ধরাল। সিগারেটের ধোয়ার গন্ধ ভেসে আসছে। ইজিচেয়ার থেকে উঠল—কঁাচক্যাচ শব্দ হচ্ছে ইজিচেয়ারে।

প্রিয়াংকা স্বামীকে সজোরে জড়িয়ে ধরে কাঁপা গলায় ডাকল—এই-এই।

ঘুম ভেঙে জাভেদ বলল, কী?

প্রিয়াংকা ফিসফিস করে বলল, না কিছু না। তুমি ঘুমাও।

1 Comment
Collapse Comments

Next

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *