দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ – পূর্ব বাঙলা জমিদারী ক্রয় ও প্রজাস্বত্ব আইন
১. পূর্ব বাঙলা বিধান পরিষদে জমিদারী ক্রয় ও প্রজাস্বত্ব বিলের প্রথম খসড়া পেশ
১৯৪৭ সালের এপ্রিল মাসে তৎকালীন মুসলিম লীগ মন্ত্রীসভার পক্ষে রাজস্বমন্ত্রী ফজলুর রহমান বঙ্গীয় বিধান পরিষদে ‘বঙ্গীয় জমিদারী ক্রয় ও প্রজাস্বত্ব বিল পেশ করেছিলেন।[১] বিভিন্ন মহলের আপত্তি সত্ত্বেও বিলটিকে লীগ সরকার সিলেক্ট কমিটিতে বিবেচনার জন্যে পাঠান। কিন্তু ভারতের তদানীন্তন গভর্নর জেনারেল লর্ড মাউন্টব্যাটেন ৩রা জুন ভারত, পাঞ্জাব ও বাঙলাকে বিভক্ত করার সিদ্ধান্ত ঘোষণার ফলে সিলেক্ট কমিটির পক্ষে সে বিষয়ে কোন রিপোর্ট প্রদান সম্ভব হয় না।
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর পূর্ব বাঙলা সরকার জমিদারী ক্রয় এবং প্রজাস্বত্ব সম্পর্কে একটি নোতুন বিল নিজেদের বিধান পরিষদে পেশ করার সিদ্ধান্ত নেন এবং সেই সিদ্ধান্ত অনুসারে মোটামুটিভাবে পূর্ববর্তী বিলটির ভিত্তিতেই তাঁরা ‘পূর্ব বাঙলা জমিদারী ক্রয় ও প্রজাস্বত্ব বিলের’ খসড়া প্রস্তুত করেন।[২] এই খসড়াটিই প্রাদেশিক অর্থমন্ত্রী হামিদুল হক চৌধুরী ৭ই এপ্রিল, ১৯৪৮, পূর্ব বাঙলা বিধান পরিষদে পেশ করেন। এই প্রসঙ্গে বাঙলাদেশে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত এবং তার সংস্কার ও উচ্ছেদ সম্পর্কে বিভিন্ন প্রচেষ্টার উল্লেখ করে তিনি বিলটির কয়েকটি দিক সম্পর্কে নিজের বক্তব্য উপস্থিত করেন।
এই সম্পর্কে হামিদুল হক চৌধুরী প্রথমেই বলেন যে, কৃষকদেরকে জমিস্বত্ব দেওয়ার উদ্দেশ্যে তাঁরা ব্যবস্থা করেছেন যাতে কৃষকরা সরকারকে দেয় খাজনার পঁচিশ গুণ এককালীন দিলে ভবিষ্যতে তাঁদেরকে আর কোন খাজনা দিতে হবে না। এবং স্বাধীন কৃষক হিসেবে তাঁরা জমিস্বত্ব ভোগ করতে পারবেন।[৩] এর ফলে প্রদেশের জীবনে গভীর পরিবর্তনের সূচনা হবে, কৃষকদের জমির আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ হওয়ার ফলে তাঁদের কর্মক্ষমতাও অনেক বৃদ্ধি পাবে, দেশের শিল্পোন্নয়ন দ্রুতগতিতে হবে, ধন-সম্পদের উৎপাদন উন্নত হবে এবং এ সবের ফলেও কৃষকদের অবস্থার মধ্যে সামগ্রিকভাবে অনেক পরিবর্তন আসবে।[৪]
ভবিষ্যতে জমিদারী প্রথার উত্থান আর যাতে না ঘটতে পারে তার জন্যে কোন প্রজা তিন বৎসরের বেশী নিজের জমি চাষের জন্যে অন্যকে বর্গা দিতে পারবেন না বলে বিলটিতে ব্যবস্থা রাখা হয়েছে বলে হামিদুল হক উল্লেখ করেন।[৫] তিনি আরও বলেন যে, ঋণগ্রস্ত খাজনাভোগী জমিদারদের জমিদারী ক্রয়ের ফলে তাঁদের আয় হ্রাস পাওয়ার ফলে তাঁরা যাতে খুব বেশী অসুবিধার মধ্যে না পড়েন তার জন্যে তাঁদের আয় যে পরিমাণ হ্রাস পাবে সেই অনুপাতে জমিদারদের ঋণের বোঝাকেও কমিয়ে আনা হবে। এর ফলে মহাজনদের যে ক্ষতি হবে সেটাকে প্রজাদের মঙ্গলের উদ্দেশ্যে তাঁদের সাহায্য হিসেবেই ধরা যেতে পারে[৬]
জমিদারী ক্রয়ের ফলে অপেক্ষাকৃত অল্পবিত্ত খাজনাভোগীরা যাতে বেশী আঘাত পেয়ে রাষ্ট্রের ওপর একটা বোঝাস্বরূপ হয়ে না দাঁড়ান তার জন্যে ক্ষতিপূরণের হার কিছুটা পরিবর্তন করা হয়েছে বলেও অর্থমন্ত্রী হামিদুল হক উল্লেখ করেন।[৭] এর পরই জমিদারকে ক্ষতিপূরণের প্রসঙ্গ অবতারণা করে তিনি বক্তৃতায় বলেন:
কোনো-রকম ক্ষতিপূরণ না দিয়ে জমিদারী প্রথা উচ্ছেদের দাবী মাঝে মাঝে উত্থাপন করা হয়েছে। এটা কোন নোতুন ব্যাপার নয়। ভূমি রাজস্ব কমিশনের সামনে কতকগুলি সাক্ষ্যের মধ্যে এই চরম অভিমত প্রকাশ করা হয়েছিলো। ক্ষতিপূরণের বিরুদ্ধে যুক্তি প্রসঙ্গে বলা হয়েছিলো যে, জমিদার ও জমির স্বত্বাধিকারীরা ইতিমধ্যে তাঁদের সম্পত্তি থেকে যথেষ্ট মুনাফা অর্জন করেছে। সঠিকভাবে হোক অথবা ভ্রান্তভাবে হোক চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে অনেক লোক নিজেদের সন্তান সন্ততিদের জন্যে ভরণপোষণের ব্যবস্থার উদ্দেশ্যে জমিদারী স্বত্ব খরিদ করেই তাঁদের সঞ্চিত অর্থ নিয়োগ করেছিলো। এই ধরনের স্বত্ব বাজেয়াপ্ত করার ফলে রাষ্ট্র এমন সমস্ত সমস্যার সম্মুখীন হতে পারে যার সমাধান তার পক্ষে সম্ভব নয়। জমিদারী স্বত্বকে রাষ্ট্রের আইনের মাধ্যমে যদি সামগ্রিকভাবে বাজেয়াপ্ত করা হয় তাহলে সর্বত্রই নিরাপত্তার অভাব সম্পর্কে আশঙ্কা দেখা দেবে এবং তার ফলস্বরূপ ব্যক্তিগত উদ্যম সর্বক্ষেত্রে বাধাপ্রাপ্ত হয়ে আমাদের নোতুন রাষ্ট্রের উন্নতি ও বিকাশের ক্ষেত্রে নিদারুণ পরিণতি ডেকে আনবে।
বিনা ক্ষতিপূরণে জমিদারী প্রথা উচ্ছেদের প্রশ্নে নোতুন ‘ইসলামী’ রাষ্ট্র পাকিস্তানে ‘ব্যক্তিগত সম্পত্তির রক্ষকের ভূমিকা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে অর্থমন্ত্রী বৃটিশ সরকার প্রণীত ১৯৩৫ সালের শাসনতন্ত্রের ২৯৯ ধারার উল্লেখ করে বলেন:
আমি বলতে বাধ্য যে আমাদের দেশের সমৃদ্ধি বহুলাংশে ব্যক্তিগত প্রচেষ্টা এবং উদ্যমের উপরই নির্ভরশীল থেকেছে এবং রাষ্ট্রেরও উচিত এই প্রচেষ্টা এবং উদ্যমকে উৎসাহ দান করা। এই কারণেই ১৯৩৫ সালের ভারত সরকার আইনের ২৯৯ ধারা সন্নিবেশিত হয়েছিলো। এই আইনই এখন পর্যন্ত আমাদের সাংবিধানিক আইন হিসেবে প্রচলিত। এই ধারায় খুব নির্দিষ্টভাবে উল্লিখিত হয়েছে যে, কোন জমি অথবা ব্যবসায়িক ও শিল্প প্রতিষ্ঠানকে জোরপূর্বক দখল করার জন্যে কেন্দ্রীয় অথবা প্রাদেশিক কোন বিধান পরিষদই কোন আইন প্রণয়ন করতে পারবে না। এক্ষেত্রে আইন প্রণীত হতে পারে তখনই যখন দখলকৃত সম্পত্তির ক্ষতিপূরণ দেওয়ার আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয় এবং ক্ষতিপূরণের পরিমাণ নির্ধারণ অথবা কোন নীতির ভিত্তিতে ও কিভাবে সেই ক্ষতিপূরণ নির্ধারিত হবে তা উল্লিখিত হয়।
এই প্রদেশে প্রায় ৫১ লক্ষ খাজনাভোগী স্বত্ব আছে এবং এই আয়ের উপর নির্ভরশীল পরিবারসমূহের ভরণপোষণের ব্যবস্থা না করে রাষ্ট্র যদি তাঁদের স্বত্ব কেড়ে নেয় তাহলে ১৫ থেকে ২০ লক্ষ পরিবার সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস হয়ে যাবে এবং অন্য উপায়ে তাঁদের পুনর্বাসনের অসম্ভব দায়িত্ব রাষ্ট্রকে ঘাড়ে নিতে হবে। এই থেকেই সমস্যাটির ব্যাপকতা বিচার করা যেতে পারে।[১০]
এর পর বিনা ক্ষতিপূরণে জমিদারী উচ্ছেদ সমাজে যে ‘অশান্তির’ সৃষ্টি করবে তার উল্লেখ করে তিনি সেই ধরনের প্রস্তাবকে অচিন্তনীয় এবং অবাস্তব বলে বর্ণনা করেন।[১১]
অর্থমন্ত্রী হামিদুল হক পরিষদে যে বিলটি পেশ করেন সেই অনুসারে জমিদারী ক্রয় সম্পন্ন হওয়ার পর কৃষিকার্যে নিযুক্ত সমস্ত কৃষকরাই সরাসরিভাবে প্রাদেশিক সরকারের প্রজায় পরিণত হবেন এবং তাঁদের সকলের মর্যাদা সেই হিসেবে সমান হবে। তাঁদের সব রকম দখলীস্বত্ব বজায় থাকবে কিন্তু একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ জমির যাঁরা মালিক এবং যাঁরা নিজ হাতে চাষ করেন একমাত্র তাঁদের কাছেই তাঁরা জমি হস্তান্তর করতে পারবেন। এই বিলে আরও প্রস্তাব করা হয় যে, জমি ক্রয়ের সময় কোন ব্যক্তিই দুশো বিঘা জমির বেশী জমি নিজের দখলে রাখতে পারবেন না। মাথা পিছু দশ বিঘা হিসেবে রেখে কোন পরিবারের যদি দুশো বিঘা জমি রাখার প্রয়োজন হয় সেক্ষেত্রে অবশ্য তাঁরা দুশোর অধিক বিঘা আইনতঃ রাখতে সক্ষম হবেন।[১২] এদিক দিয়ে বিচার করলে আলোচ্য বিলটি পূর্ববর্তী মুসলিম লীগ সরকারের ১৯৪৭ সালের বিলের থেকে অনেক বেশী পশ্চাদমুখী। কারণ সেই বিলটিতে জমি মালিকানার ঊর্ধ্বতম পরিমাণ ছিলো একশো বিঘা।
হামিদুল হকের হিসেবমতো পূর্ব বাঙলায় তখন দুশো বিঘার ওপর জমিওয়ালা পরিবারের সংখ্যা ছিলো তিন হাজার। এই তিন হাজার পরিবারের অতিরিক্ত জমি সরকারের খাস দখলে এলে পরে তাকে ভূমিহীন ও গরীব কৃষকদের মধ্যে বণ্টনের প্রস্তাব করা হয়। এ ছাড়া কোন ব্যক্তির ষাট বিঘা জমি অথবা তার পরিবারের প্রত্যেকের মাথাপিছু পাঁচ বিঘা হিসেব করে তা যদি ষাট বিঘার বেশী হয় তাহলে সেই পরিমাণ জমির যারা মালিক তাঁরা কোন নতুন জমি খরিদ করতে পারবে না। কোন ব্যক্তির হাতে যাতে ভবিষ্যতে বেশী জমি কেন্দ্রীভূত না হয়, তার জন্যেই বিলে এই সমস্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে বলে হামিদুল হক উল্লেখ করেন।[১৩]
বর্গাপ্রথা সম্পর্কে অর্থমন্ত্রী বলেন যে, তার ভালোমন্দ দুই দিকই আছে। কাজেই তাকে সরাসরি উচ্ছেদ না করলেও ধীরে ধীরে তার উচ্ছেদের একটা পরিকল্পনা করা হয়েছে। সেই সাথে যে পর্যন্ত বর্গাপ্রথা চালু থাকবে সে পর্যন্ত বর্গাদারদেরকে ইচ্ছেমতো জমি থেকে উৎখাত করার বিরুদ্ধে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণের উল্লেখও তিনি বিলটিতে করেন।[১৪] জমিদারী ক্রয় সম্পর্কে অর্থমন্ত্রী বলেন যে, সিলেট থেকে তখনো পর্যন্ত নির্ভরযোগ্য তথ্য না পাওয়ার ফলে সিলেটকে বাদ দিয়েই তিনি এর আর্থিক ফলাফল হিসেব করেছেন। বিলটিতে মোট আয়ের ছয় থেকে পনেরো গুণ ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করা হয়েছে এবং গড়ে দশগুণ ধরে তিনি মোটামুটি হিসেব তৈরী করেছেন বলে উল্লেখ করেন। [১৫]
এই হিসেব মতো সারা দেশে রায়তদের খাজনা বাবদ দেয় টাকার পরিমাণ ৮.২৪ কোটি। কিন্তু এর মধ্যে সমস্ত রকম খাজনা ট্যাক্স নিয়ে সরকারের ঘরে আসে মাত্র ৩ কোটি টাকা। এই অঙ্কের সাথে সরকারের খাজনা আদায়ের খরচা ১৫% হারে ধরে ১.২৪ কোটি যদি বাদ দেওয়া যায় তাহলে জমিদারী ক্রয়ের পর সরকারের মোট মুনাফা দাঁড়ায় প্রায় ৪ কোটি টাকা। জমিদারকে ক্ষতিপূরণ বাবদ সরকারী তহবিল থেকে দিতে হবে প্রায় ৪০ কোটি টাকা এবং এই হিসেব মতো হামিদুল হক দেখান যে, ৪০ কোটি টাকা ব্যয় করে সরকার বৎসরে ৪ কোটি টাকা অতিরিক্ত আয়ের বন্দোবস্ত করতে সক্ষম হবেন।[১৬]
এইভাবে জমিদারী ক্রয় বিল সম্পর্কে পরিষদকে মোটামুটি একটা ধারণা দেওয়ার পর হামিদুল হক তাঁর বক্তৃতার শেষে বলেন:
স্যার, এটা আমাদের একান্ত আন্তরিক কামনা যে, বিলটি আইনে পরিণত এবং কার্যকর হলে তা এক শ্রেণী ও আরেক শ্রেণীর মধ্যে তিক্ততা ও সন্দেহের অবসান ঘটাতে সক্ষম হবে। বিদেশী অনুপ্রেরণা ও নির্দেশের দ্বারা চালিত যে সমস্ত সংগঠনসমূহ বিভিন্ন শ্রেণীর স্বাভাবিক পার্থক্যগুলিকে শ্রেণীসংগ্রাম হিসেবে বাড়িয়ে তুলে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিল করতে চাইছে, সেই সমস্ত সংগঠনগুলির কার্যকলাপও এর ফলে অনেকখানি নিয়ন্ত্রণের মধ্যে আসবে। এই সমস্ত রাজনৈতিক গ্রুপ এবং চক্রের কাছে জনগণের মঙ্গল প্রচারণার একটা আকর্ষণীয় ধুয়া ব্যতীত আর কিছুই নয়। প্রচলিত সামাজিক ব্যবস্থা ধ্বংস করে ক্ষমতা দখলই এই প্রচারণার একমাত্র উদ্দেশ্য। যে কোনরূপে শ্রেণীঘৃণার প্রকাশ আমাদের শিশু- রাষ্ট্রের জন্যে বিপর্যয় ডেকে আনবে এবং আমরা যা কিছু বিশ্বাস করি ও জীবনে যা কিছুকে মূল্যবান মনে করি তাকেই ধ্বংস করার উদ্দেশ্যে নিয়োজিত এই সমস্ত সংগঠনগুলিকে তাঁদের আকাঙ্ক্ষিত সুযোগ এনে দেবে। আমি আজ পরিষদের সামনে যে ব্যবস্থা প্রস্তাব করার সম্মান লাভ করেছি সেই ব্যবস্থা সমাজের বিভিন্ন স্তরের মধ্যে অনেকখানি সমঝোতা সৃষ্টি করে তাঁদেরকে সেই সুযোগ থেকে বঞ্চিত করবে।
কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে এইভাবে বিষোদগার করে পূর্ব বাঙলা সরকারের অর্থমন্ত্রী হামিদুল হক চৌধুরী ‘জমিদারী ক্রয় ও প্রজাস্বত্ব আইন’-এর ওপর তার প্রাথমিক বক্তৃতা শেষ করেন। এই বক্তৃতার শুরুতে তিনি সমগ্র বিলটিকে একটি স্পেশাল কমিটিতে পাঠাবার প্রস্তাব করেন। ৪৫ সদস্য বিশিষ্ট এই কমিটির সদস্যদের নামও তিনি পরিষদে পাঠ করেন। হামিদুল হক প্রস্তাবিত এই কমিটির সদস্যরা হলেন:
(১) মাননীয় অর্থমন্ত্রী, রাজস্ব বিভাগ, (২) মিঃ হামিদুদ্দীন আহমদ, (৩) মিঃ সিরাজউদ্দীন আহমদ, (৪) মিঃ আহমদ আলী মৃধা, (৫) মিঃ দেওয়ান লুৎফর রহমান, (৬) মিঃ নাজির হোসেন খোন্দকার, (৭) মিঃ আবদুল হাকিম বিক্রমপুরী, (৮) মিঃ মুনাওয়ার আলী, মিঃ মহম্মদ আবদুল্লাহ, (১০) মিঃ আসান আলী মুকতার, (১১) মিঃ মির্জা এ হাফিজ, (১২) মিঃ এস্কান্দার আলী খান, (১৩) মিঃ নুরুজ্জামান, (১৪) মিঃ আলী আহমেদ চৌধুরী, (১৫) মিঃ মহম্মদ এ সালাম, (১৬) মওলানা আবদুল হামিদ খান (ভাসানী), (১৭) মিঃ নওয়াব আলী, (১৮) মিঃ মহম্মদ আলী হায়দার খান, (১৯) ডক্টর এ আহাদ (২০) মওলানা আবদুর রশীদ খোন্দকার তর্কবাগীশ, (২১) মিঃ হাফিজুদ্দীন চৌধুরী, (২২) মিঃ ফজলুল কাদের, (২৩) মিঃ আহমদ হোসেন, (২৪) মিঃ শরফুদ্দীন আহমদ, (২৫) মিঃ তফজ্জল আলী, (২৬) মিঃ এটি মাজহারুল হক, (২৭) মিঃ আবদুল মোমিন, (২৮) মিঃ ফজলুর রহমান (নোয়াখালী), (২৯) মিঃ দেওয়ান আবদুল বাসেত, (৩০) মিঃ মহম্মদ আরিফ চৌধুরী, (৩১) মিঃ নুরুল হোসেন খান, (৩২) মিঃ মুকুন্দ বেহারী মল্লিক, (৩৩) মিঃ হারানচন্দ্র বর্মন, (৩৪) মিঃ এমএ সেলিম, (৩৫) মিঃ বসন্তকুমার দাস, (৩৬) মিঃ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত, (৩৭) মিঃ নরেন্দ্রনাথ সিংহী, (৩৮) মিঃ রাজেন্দ্রনাথ সরকার, (৩৯) মিঃ প্রভাসচন্দ্র লাহিড়ী, (৪০) ডক্টর প্রতাপচন্দ্র গুহ রায়, (৪১) মিঃ সুরেশচন্দ্র দাসগুপ্ত, (৪২) মিঃ মনোরঞ্জন ধর, (৪৩) মিঃ গণেন্দ্রচন্দ ভট্টাচার্যী, (৪৪) মিঃ ধনঞ্জয় রায়, (৪৫) মওলানা আবদুল্লা-হেল-বাকী।[১৭]
হামিদুল হক এই নামগুলি প্রস্তাব করার পর বলেন যে, উপরোক্ত স্পেশাল কমিটিকে ৩১শে জুলাই ১৯৪৮-এর মধ্যে তাঁদের রিপোর্ট দাখিল করার নির্দেশ দিতে হবে। কমিটির চেয়ারম্যান হবেন সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী এবং কমিটির বৈঠকে কোরামের জন্যে প্রয়োজন হবে ১১ জনের উপস্থিতি। এই স্পেশাল কমিটি অধিকার, সুবিধা ও কর্তব্যের দিক থেকে সিলেক্ট কমিটির মর্যাদা পাবে বলেও হামিদুল হক উল্লেখ করেন।
২. বিলের ওপর প্রাথমিক বিতর্ক
পূর্ব বাঙলা জমিদারী ক্রয় ও প্রজাস্বত্ব বিল পরিষদে অর্থমন্ত্রী হামিদুল হক কর্তৃক পেশ হওয়ার পর ৭ই এপ্রিল তারিখেই তার ওপর পরিষদ সদস্যেরা সংক্ষিপ্তভাবে নিজেদের প্রাথমিক মন্তব্যসহ বক্তৃতা দেন।
প্রথমেই এটিএম মাজহারুল হক বলেন[১৮] যে, নোতুন বিলটিতে জমিদারদেরকে বাৎসরিক প্রাপ্য খাজনার ১৫গুণ পর্যন্ত ক্ষতিপূরণ দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে অথচ ফ্লাউড কমিশনের সুপারিশ ছিলো ১০গুণ। কাজেই এদিক থেকে বিলটি ফ্লাউড কমিশনের সুপারিশের থেকে বেশী হারে জমিদারদেরকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার ব্যবস্থা করেছে। তিনি বলেন যে, জমিদারদেরকে যদি একান্তই ক্ষতিপূরণ দিতে হয় তাহলে তার পরিমাণ কোনক্রমেই ফ্লাউড কমিশনের সুপারিশের থেকে বেশী হওয়া উচিত নয়।
ক্ষতিপূরণ সম্পর্কে সাধারণভাবে নিজের মত প্রকাশ করতে গিয়ে মাজহারুল হক বলেন যে, তিনি জমিদারদেরকে কোন রকম ক্ষতিপূরণ দেওয়ার সম্পূর্ণ বিরোধী। জমিদারদেরকে ক্ষতিপূরণের স্বপক্ষে যারা জমিদারী ক্রয়ের ক্ষেত্রে তাঁদের অর্থ নিয়োগের প্রশ্ন তুলেছেন তাঁদের জানা উচিত যে, ঈস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী যখন চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মূল চুক্তি সম্পাদন করেছিলো তখন জমিদারদের ওপর দায়িত্ব ছিলো জমির উন্নতি সাধন। কিন্তু জমির উন্নতি সাধনের ক্ষেত্রে জমিদাররা কিছুই করেনি, কাজেই তাঁদের ক্ষতিপূরণ পাওয়ার কোন অধিকারই নেই। ১৯৩৫ সালের ভারতশাসন আইনের ২৯৯ ধারার উল্লেখ করে তিনি বলেন যে, সেই ধারাটির প্রথম অনুচ্ছেদেই বলা হয়েছে যে আইন করে যে কোন সম্পত্তিই সরকার বিনা ক্ষতিপূরণে নিয়ে নিতে পারেন।
এই পর্যায়ে আবদুল খালেক মাজহারুল হকের বক্তৃতায় বাধা দান করে বলেন যে, তিনি সিলেক্ট কমিটির একজন সদস্য। অর্থাৎ সিলেক্ট কমিটির একজন সদস্য হয়ে এই ধরনের মন্তব্য করা তার উচিত নয়।[১৯] হামিদুল হক চৌধুরীও তখন বলেন যে, এই অবস্থায় তাঁর পক্ষে সিলেক্ট কমিটির সদস্য থাকা সম্ভব নয়।[২০] শিক্ষামন্ত্রী আবদুল হামিদও বলেন যে ব্যাপারটা দলীয় বৈঠকে আলোচিত হবে কাজেই তিনি পরিষদে সেইভাবে নিজের মতামত দিতে পারেন না।[২১]
এই সমস্ত সমালোচনার মুখে এটিএম মাজহারুল হক বলেন যে, পরিষদে নিজের মতামত ব্যক্ত করার জন্যে যদি তাঁকে শাস্তি দেওয়া হয় তাহলে তাতে তার কিছু যায় আসে না। তাঁরা তাঁকে বাদ দিতে চাইলে অনায়াসে তা করতে পারেন।[২২]
এরপর তিনি বলেন যে, জমিদারীর ক্ষতিপূরণ যারা দিতে চাইছে তাঁরা নিজেদের স্বার্থেই তা চাইছে। যে সমস্ত খোদ চাষীর উপকারের জন্যে জমিদারী প্রথা তুলে দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে তাঁদের কোন উপকার এর দ্বারা হবে না। তারা কোন ক্ষতিপূরণ দেওয়ার পক্ষপাতী নয় এবং তিনি নিজেও মনে করেন যে, জমিদারীর ক্ষতিপূরণ দেওয়া মোটেই উচিত নয়। এরপর তিনি বলেন যে, ক্ষতিপূরণ একান্ত দিতে চাইলে বিহারের মতো রাজস্বের তিনগুণ হয়তো দেওয়া যেতে পারে কিন্তু তার বেশী কোনক্রমেই নয়।[২৩]
এরপর বিনোদচন্দ্র চক্রবর্তী জমিদারদের অধীনস্থ বিভিন্ন শ্রেণীর কর্মচারীদের প্রসঙ্গ উত্থাপন করে বলেন যে, জমিদারী দেখাশোনার জন্যে যে সমস্ত কর্মচারীরা নিযুক্ত রয়েছে তাঁরা সরকারের কাছে জমিদারী হস্তান্তরিত হওয়ার পর তাঁদের চাকুরী হারাবে। জমিদারী প্রথা উচ্ছেদের ক্ষেত্রে শুধু জমিদার নয়, এই সমস্ত কর্মচারীদের স্বার্থ এবং জীবিকা সংস্থানের উপায় সম্পর্কেও বিবেচনা করা দরকার। কিন্তু সরকারের জমিদারী ক্রয় বিলটিতে তাঁদের সম্পর্কে কোন উল্লেখই নেই। স্পেশাল কমিটির সদস্যদেরকে তিনি এ ব্যাপারটি বিশদভাবে বিবেচনা করে সেই সমস্ত কর্মচারীদেরকে তাঁদের কাজে পুনর্বহাল করার জন্যে আবেদন জানান। [২৪]
মহম্মদ আবদুস সালাম স্পেশাল কমিটির সদস্যসংখ্যা সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেন যে, পরিষদের ১৭১ জন সদস্যের মধ্যে ৪৫ জনকে স্পেশাল কমিটিতে রাখা হয়েছে। কমিটির মধ্যে এত অধিক সংখ্যক সদস্য রাখার পরিবর্তে তিনি সকল পরিষদ সদস্যকে নিয়েই কমিটি গঠনের কথা বলেন। এ প্রসঙ্গে তিনি আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে পরিষদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। তিনি বলেন যে, যে ৪৫ জন সদস্যকে নিয়ে স্পেশাল কমিটি গঠন করা হয়েছে তাঁদের মধ্যে ২০ জন জমিদার শ্রেণীর লোক। এই জমিদারদের দ্বারা প্রজাদের স্বার্থ কিভাবে রক্ষিত হবে সে কথা বিবেচনার জন্যে তিনি পরিষদকে আহ্বান জানান। [২৫]
এরপর সুহরাওয়ার্দী মন্ত্রীসভার প্রাক্তন সদস্য শামসুদ্দীন আহমদ আলোচনা প্রসঙ্গে বলেন যে, ৪৫ সদস্যবিশিষ্ট স্পেশাল কমিটির থেকে ১৭১ সদস্যবিশিষ্ট পরিষদেই বিলটি সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা হওয়া অধিকতর সমীচীন। বিলটিতে জমিদার ও বর্গাদারদের রাজস্বকে পৃথকভাবে দেখার সুপারিশ করে তিনি সত্বর বিনা ক্ষতিপূরণে জমিদারী উচ্ছেদ প্রসঙ্গে বলেন:
জমিদারদেরকে আমাদের সরাসরি বলে দেওয়া উচিত যে, অতীতে তাঁরা জনগণের অর্থ নিয়ে ইচ্ছেমতো ছিনিমিনি খেলেছে কিন্তু এখন পাকিস্তান অর্জিত হওয়ার পর জমির ওপর তাঁদের কোন অধিকার আর নেই। জমিদারদেরকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার প্রশ্নটি নিয়ে অযথা সময় নষ্ট না করে সরকারের উচিত এখনই জমিদারীর ভার নিজের হাতে নেওয়া এবং তারপর উপযুক্ত বিচার বিবেচনার পর স্থির করা জমিদারদেরকে কোন ক্ষতিপূরণ দেওয়া যেতে পারে কিনা। আমি নিজে অবশ্য মনে করি যে, জমিদারদেরকে এক কানাকড়ি ক্ষতিপূরণ দেওয়া উচিত নয়। সুতরাং আমি বলি যে, এটা পৃথকভাবে দেখতে হবে জমিদারদের রাজস্ব ও অন্যদের রাজস্বকে পৃথক করা দরকার। [২৬]
পূর্ব বাঙলা সরকার কর্তৃক আনীত জমিদারী ক্রয় বিলটির কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক সম্পর্কে এর পর মুজিবুর রহমান[২৭] বলেন:
যে ৪৫ জন মেম্বর নেওয়া হয়েছে তাঁদের প্রতি আমার যথেষ্ট শ্রদ্ধা আছে। আমার বন্ধু হামিদুল হক সাহেব নিজেও একজন জমিদার। তাঁর নিজেরও যথেষ্ট স্বার্থ রয়েছে। এতদ্ব্যতীত মেম্বরদের ভিতর যারা এ সম্বন্ধে ওয়াদা করেছেন তাঁরা সে ওয়াদা রাখবেন কিনা তাতে আমার ঘোর সন্দেহ রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, আমরা দেখতে পাই যে গত বিলে[২৮] ছিলো এক পরিবার খাস দখলে ১০০ বিঘার বেশী জমি রাখতে পারবে না। কিন্তু জনাব হামিদুল হক সাহেব এই বিলে ব্যবস্থা করেছেন সে স্থলে ২০০ বিঘা রাখতে পারবে। এখন এক একটা পরিবার কত রকমে পৃথক পৃথক হয়ে পৃথক পৃথক Record-এ প্রতি পরিবারে ২০০ বিঘা করে জমি দখল করবে। এক এক পরিবার কত জায়গায় বিচ্ছিন্ন হবে তারপরে হিসাব করলে সারা বাঙলাদেশে দরিদ্র প্রজাদের জন্য ১ ছটাক জমিও পাওয়া যাবে না। সুতরাং এই বিল অনুসারে ৬ থেকে ১৫গুণ Compensation তার উপর ২০০ বিঘা জমি রাখলে দেশের জনসাধারণের জন্য কিছুই রাখা হবে না। তারপর এই Compensation- এর মাপ জরিপ হওয়া এই মন্ত্রীত্বের জীবনে ও আমাদের মেম্বর জীবনে কুলাবে না। আবার এক মন্ত্রীত্ব আসবে নূতন নূতন মেম্বর আসবে। তাঁরা জনসাধারণের কাছে এমনিভাবে লম্বা লম্বা বক্তৃতা করবে জনসাধারণকে বুঝিয়ে দিবে। আমাদের দাবী, দেশের দাবী এবং আমাদের কথার মূল্য যদি জনসাধারণের কাছে রাখতে হয় তাহলে আমাদের প্রধান মন্ত্রীর কাছে আমাদের নিবেদন যে Ordinance করে অতি সত্বর জমিদারী প্রথা উচ্ছেদ করুন। পরে হিসাব নিকাশ করে যাকে যা দিতে হয় আস্তে আস্তে দিন। তা নাহলে দেশবাসীকে বুঝাতে পারবেন না, দেশে মুখ দেখাতে পারবেন না, দেশের জনসাধারণ বিদ্রোহ করবে। [২৯]
মুজিবুর রহমানের এই বক্তৃতার পর শিক্ষামন্ত্রী আবদুল হামিদ জমিদারী উচ্ছেদ প্রসঙ্গে সংখ্যালঘু সংখ্যাগুরু প্রশ্নের অবতারণা করেন ‘সংখ্যালঘু’ জমিদারদের প্রতি সুবিচারের আহ্বান জানিয়ে পরিষদ সদস্যদের বলেন:
এই বিষয়ে আমরা যখন একটা সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছি তখন আমি আমার বন্ধু শামসুদ্দীন আহমদ অথবা মুজিবুর রহমানের মতো সুর অথবা মেজাজ নেওয়ার পক্ষপাতী নই। স্যার, এ ব্যাপারে পরিষদের ভূমিকা হলো বিচারকের। আপনারা কি এখানে কেবলমাত্র সংখ্যাগুরুদের স্বার্থ দেখার জন্যেই আছেন? সংখ্যালঘুদের স্বার্থের প্রতি দৃষ্টি দেওয়াও কি আপনাদের কর্তব্য নয়? আপনারা হলেন বিচারক। আবেগের দ্বারা চালিত না হয়ে আমি আপনাদেরকে বিষয়টি বিবেচনা করতে এবং এমন একটা সিদ্ধান্তে উপনীত হতে বলি যে সিদ্ধান্ত কার্যকর করা হবে। জমিদারদের মধ্যে দুই শ্রেণী আছে। একদল জমিদার আছে যারা সকাল বেলা উঠে হঠাৎ একদিন দেখলো যে তাঁরা বিরাট ভূসম্পত্তির মালিক হয়ে বসেছে এবং সেই হিসেবে জমিদারীর জন্যে তাঁদেরকে এক কপর্দকও নিয়োগ করতে হয়নি। অন্য জমিদারদেরকে জমি কেনার জন্যে অর্থ নিয়োগ করতে হয়েছে। আপনাদেরকে দেখতে হবে যে জমিদারদেরকে ক্ষতিপূরণ না দিলে তাঁদের ওপর এর কি ফল বর্তাবে। ৩০ শিক্ষামন্ত্রী আব্দুল হামিদের পর শরফুদ্দীন আহমদ বলেন যে, বিলটি জমিদারী উচ্ছেদ সম্পর্কে কোন সময়সীমা নির্দেশ করা হয়নি। এই ধরনের একটা গুরুত্বপূর্ণ বিলে যদি সময় নির্দিষ্ট না থাকে তা হলে জমিদারী উচ্ছেদ অনিশ্চিতভাবে বিলম্বিত হবে বলেও তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেন।[৩১] মাহম্মদ ইসরাইল বলেন যে ৩১শে জুলাই, ১৯৪৮- এর মধ্যেই যাতে স্পেশাল কমিটি তাঁদের রিপোর্ট পরিষদে যথারীতি পেশ করতে পারে সেদিকে লক্ষ্য রাখা দরকার। অতীত অভিজ্ঞতার উল্লেখ করে তিনি বলেন যে, স্পেশাল কমিটি সাধারণতঃ নির্ধারিত সময়ের মধ্যে তাঁদের রিপোর্ট দিতে সক্ষম হন না। [৩২]
বিলটির আলোচনা প্রসঙ্গে খয়রাত হোসেন ক্ষতিপূরণ, ২০০ বিঘা পর্যন্ত জমি রাখার ব্যবস্থা এবং সাধারণভাবে জমিদারী উচ্ছেদ প্রশ্নের উল্লেখ করে বলেন:
জনাব হামিদুল হক চৌধুরী তার বাজেট বক্তৃতায় বলেছিলেন যে বাংলার জনসংখ্যার খুব কম করে হলেও ৪ কোটির ১ কোটি লোক খাজনা আদায় করে খায়, এই এক কোটি লোকের চিন্তা তার মাথার ভিতরে ঢুকে গিয়েছে কি করে তাঁদের Compensate করবেন। যাই হোক আজকে শুনলাম তার এক কোটি কমে ৫০ লক্ষে দাঁড়িয়েছে অর্থাৎ অর্ধেক কমে গিয়েছে। এতদিন আমার জানা ছিলো যে East Bengal Minority Community বলতে হিন্দুদের বুঝায় কিন্তু আজকে মাননীয় আবদুল হামিদ সাহেবের কাছে শুনছি জমিদার জোতদার তাঁরাও Minority Community; তাহলে এই House এর মধ্যে ৭ জন মাত্র মন্ত্রী আছেন তাঁরাও Minority Community. Lord Cornwallis গোটা কয়েক লোক ডেকে নিয়ে জমিদার শ্রেণীর সৃষ্টি করেছিলেন। অথচ হামিদুল হক চৌধুরী সাহেব যার পিছনে সৈন্য আছে, আনসার বাহিনী আছে তিনিও এই জমিদারী প্রথা উচ্ছেদ করতে গিয়ে Compensation এর কথা চিন্তা করছেন। Compensation এর জন্যে শুনা যাচ্ছে যাদের জমির আয় ২ হাজার টাকা তাঁরা জমির আয়ের ১৫গুণ ক্ষতিপূরণ পাবে। এরপর নিশ্চয়ই বড়ো জমিদাররা তাঁদের জমিদারী ৭ নামে ভাগ করে ২ হাজার টাকার বেশী Income না দেখিয়ে মোট মোট Compensation আদায় করবে এবং জমিও এমনভাবে বেনামী করে ভাগ করে দেখাবে যাতে প্রত্যেক খণ্ডিত Family-র ২০০ বিঘার বেশী জমির হিসাব পাওয়া যাবে না। তাঁরা Compensationও আদায় করবে অথচ জমি কিছুই বার করা যাবে না। এখানকার Memberদের অধিকাংশই Compensation-এর পক্ষপাতী। আজকের দিনে যখন কোন election হয় তখন খুব জোর গলায় বলা হয় যে বিনা ক্ষতিপূরণে জমিদারী উচ্ছেদের ব্যবস্থা করবো ইত্যাদি তারপর কাজের বেলায় তার উল্টা। Special Committee মেম্বারদের Report থেকেই তার প্রমাণ পাওয়া যাবে। [৩৩]
স্পেশাল কমিটির সদস্যদের সম্পর্কে খয়রাত হোসেনের এই মন্তব্যের প্রতিবাদ করে ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত বলেন যে, তা কমিটির সদস্যদের প্রতি একটা বিরূপ মন্তব্যস্বরূপ।[৩৪] কিন্তু ধীরেন দত্তের এই প্রতিবাদ সত্ত্বেও রাজশাহীর মাদার বক্স ক্ষতিপূরণের ব্যাপারে স্পেশাল কমিটির ভূমিকা প্রসঙ্গে এর পর বলেন:
জরুরী ব্যবস্থা অবলম্বন করতে গিয়ে যেভাবে মেম্বর নিয়োগ করেছেন তার কোন কাজ আমরা বুঝতে পারি না। এটা সময়ের দাবী যে বিনা খেসারতে জমিদারী প্রথা উচ্ছেদ করতে হবে। আজ যদি Special Committee থেকে এই রকম মতবাদ হয় যে জমিদারকে খেসারত দিতে হবে তাহলে জনসাধারণ অনেকে এটা অনুভব করতে পারবে যে Special Committee-তে যেসব মেম্বর নিয়োগ করা হয়েছিলো তাঁদের নিরপেক্ষ ব্যবস্থার জন্য করা হয় নাই। আমি গভর্নমেন্টকে অনুরোধ করছি যাতে দেশে কোন বিপ্লব সৃষ্টি না হয় তার ব্যবস্থা করুন। – জমিদারীর কোন খেসারত দেওয়া যায় না যেভাবে এবং যে অবস্থায় জমিদারী পরিচালিত হয়েছে তাতে দেশের অজ্ঞ জনসাধারণের মেরুদণ্ড ভেঙে গিয়েছে। এই সব মর্মান্তিক অত্যাচারের কথা যদি আমরা মনে করি তাহলে Compensation-এর কথা কল্পনাও করতে পারি না। অনেকে বলছে Compensation না দিলে জমিদার কি করে বাঁচবে, Special Committee যদি এই সব কথা বিবেচনা করে Compensation দেওয়ার কথা চিন্তা করেন তাহলে আমি বলবো গভর্নমেন্ট অগণিত জনসাধারণের দিকে তাকাবেন, না মুষ্টিমেয় জমিদারের দিকে তাকাবেন। খেসারত দিয়ে জমিদারী প্রথা উচ্ছেদ করলে জমিদারী প্রথা উচ্ছেদের কোন অর্থ হয় না। এ কথা বিবেচনা করা উচিত।[৩৫] বিরোধীদলের নেতা বসন্তকুমার দাস স্পেশাল কমিটির প্রস্তাবকে সমর্থন করেন। শুধু তাই নয়। তিনি আরও বলেন যে, স্পেশাল কমিটির রিপোর্ট পরিষদে পেশ করার পর হয়তো তাকে আবার একটা সিলেক্ট কমিটিতে পাঠানোর আবশ্যক হতে পারে।[৩৬]
সিলেটে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের কতকগুলি বিশেষ দিকের উল্লেখ করে তিনি বলেন যে, সেগুলির প্রতি বিলটিতে কোন লক্ষ্য রাখা হয়নি। এই বিশেষ দিক সম্পর্কে সরকারের করণীয় সম্পর্কে তিনি বলেন:
১৭৯৩ সালে চিরস্থায়ী ব্যবস্থা প্রচলিত হওয়ার সময় ও তার পরেও বাংলার অন্যান্য জেলায় যে নীতি অবলম্বিত হচ্ছে শ্রীহট্টের সঙ্গে তার অনেক পার্থক্য রয়েছে। Government-এর কাগজপত্রে দেখা যায় সিলেটের তৎকালীন কালেক্টর Lindsay সাহেব Sylhet District- এ চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের প্রস্তাব সম্পর্কে যে নীতি উল্লেখ করেছিলেন তাতে শ্রীহট্টের বহু ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র তালুক সৃষ্টি হয়েছিলো। সিলেটে প্রকৃতপক্ষে কোন জমিদার ছিলেন না। যাহাদের সঙ্গে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত হয়েছিলো তাহার অধিকাংশই Permanent Proprietor এই কথাই Lindsay সাহেব বলিয়াছিলেন। শ্রীহট্ট, চট্টগ্রাম ও বাখরগঞ্জ জেলাতেই চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের Best Advantage পেয়েছিলো। কালক্রমে খরিদ বিক্রীর সূত্রে এটির পরিবর্তন হয়ে এসব জেলায়ও বহু বৃহৎ জমিদারী সৃষ্টি হইয়াছে। — শ্রীহট্টে প্রায় সকল পরগণাতে বহু তালুকের জমি এজমালী থাকা শ্রীহট্টের চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের একটি বিশেষত্ব। এই বিশেষত্ব থেকে শ্রীহট্টে স্বত্বের নানা জটিল অবস্থার সৃষ্টি করেছে। সুষ্ঠুভাবে এই সকল জটিল স্বত্বের মীমাংসা করিতে হইলে বহু বৎসর ব্যাপী এক সার্ভে হওয়া দরকার এবং এই সার্ভের ভিত্তিতে Record of Right প্রস্তুত করিতে হইবে। [৩৭]
বিলটির প্রাথমিক আলোচনার শেষে তফজ্জল আলী জমিদারদেরকে ক্ষতিপূরণ দেওয়া এবং বর্গাপ্রথা সংক্রান্ত অংশটিকে মূল বিল থেকে বাদ দেওয়ার প্রস্তাব করে বস্তুতঃপক্ষে জমিদার জোতদারদের সপক্ষে নিম্নলিখিত বক্তব্য হাজির করেন :
বর্গপ্রথাকে পৃথকভাবে বিবেচনা করা উচিত ছিলো এবং তাকে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত উচ্ছেদের জন্যে আনীত বিলের অংশ হিসেবে রাখা উচিত ছিলো না। স্যার, আমি আশা করি কেউ আমাকে ভুল বুঝবেন না। আমি বড়ো জোতদারদের হয়ে অথবা অযৌক্তিকভাবে প্রজাদের হয়ে কথা বলছি না। জমিদারীর ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে কিনা এবং দিলেও তার পরিমাণ কি হবে সে সম্পর্কেও আমি এখন কোন মতামত দিতে চাই না। কিন্তু স্যার, মাননীয় মন্ত্রী যদি এই বিষয়টি এই আইনের বাইরে রাখতেন তাহলেই খুব ভালো হতো। স্যার, আমার ক্ষুদ্র মতে বিলটির সমস্ত অংশই নিতান্ত অস্পষ্ট এবং এতে যে পদ্ধতি অনুসরণের ব্যবস্থা হয়েছে তাতে একটা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত উচ্ছেদ একটা ভয়ানক কঠিন ব্যাপার হয়ে দাঁড়াবে। মাননীয় মন্ত্রী এই সব দিকগুলি বিবেচনা করুন আমি তাই চাই। স্পেশাল কমিটিতে যখন বসবো তখন এগুলি আলোচনার সুযোগ আমরা লাভ করবো। স্যার, কোন বক্তার নাম উল্লেখ না করে আমি বলবো যে, জমিদারদের ন্যায্য এবং আইনসঙ্গত স্বার্থকে উপেক্ষা করার কোন অধিকার আছে এ কথা বলা ঠিক নয়।[৩৮]
‘জমিদারী ক্রয় ও প্রজাস্বত্ব বিল’-এর ওপর প্রাথমিক বিতর্কের শেষে অর্থমন্ত্রী হামিদুল হক চৌধুরী বলেন যে, বড়ো জমিদারদেরকে তাঁরা ৬গুণ ক্ষতিপূরণ দেওয়ার কথা বলেছেন কিন্তু তাঁদের ওপর আরও এত রকম কর ধার্য হয়েছে যে, এই ক্ষতিপূরণ বাস্তবপক্ষে ৪ গুণের বেশী হবে না। সেদিক দিয়ে এই বিলটিকে ১৯৪৭ সালের বিলের থেকে অধিকতর প্রগতিশীল বলে তিনি দাবী করেন, কারণ ঐ পূর্ববর্তী বিলটিতে ক্ষতিপূরণের হার নির্দিষ্ট হয়েছিলো ৮ থেকে ১৫ গুণ।[৩৯]
এরপর ক্ষতিপূরণের প্রসঙ্গটি আলোচনা করতে গিয়ে তিনি বলেন:
১০০ অথবা ১৭৫ বৎসর আগে তাঁদের পূর্বপুরুষদেরকে যে সম্পত্তি দেওয়া হয়েছিলো কোন ব্যক্তি অথবা পরিবারকে পূর্বপুরুষদের সেই সম্পত্তি থেকে কোন ক্ষতিপূরণ না দিয়ে বঞ্চিত করা কি উচিত অথবা ন্যায়সঙ্গত? তাঁদেরকে কিছুই না দিয়ে কিভাবে আপনারা এই জমিদারীগুলি পেতে পারেন? এটা বলা কি উচিত হবে যে, বৎসরের পর বৎসর এবং পুরুষানুক্রমে এই জমিদাররা জনগণকে শোষণ করছে সুতরাং এই জমিদারদের সন্তানদেরকে কোন ক্ষতিপূরণ দেওয়া উচিত নয়? এই জমিদার শ্রেণী দেশের প্রচলিত আইন কানুনের ওপর নির্ভর করে নিজেদের আয় শিল্প, শহরে বাড়ীঘর নির্মাণ অথবা ব্যাংকে নিয়োগ না করে নিজেদের সন্তানদের জীবিকার উদ্দেশ্যে দেশের বিঘোষিত নিরাপদ সম্পত্তি জমিতে নিয়োগ করেছে। অন্যদের সাথে আমি কি হিসাবে তাঁদের পার্থক্য করবো? এটা কোন ব্যক্তির প্রশ্ন নয়, এটা কোন গ্রুপের প্রশ্ন নয়, এটা এমন একটা প্রশ্ন যা দেশের সমস্ত অংশকে স্পর্শ করবে। যদি আমরা এই জমিদারীগুলিকে এবং খাজনাভোগী স্বার্থকে কোন ক্ষতিপূরণ না দিয়ে উচ্ছেদ করি তাহলে তার ফলে দেশের কোন উপকার হবে কিনা সেটা বিশ্লেষণ ও পরীক্ষা করে আমরা দেখতে পারি। পরীক্ষা এবং সমীক্ষার জন্য আমি সংশ্লিষ্ট তথ্য আপনাদের সামনে পেশ করছি। এই সমস্ত সংখ্যা সংগ্রহ করার জন্যে আমি গ্রামে যাইনি, এগুলি রাজস্ব বিভাগ ও কৃষি আয়কর বিভাগের দ্বারা সংগৃহীত হয়েছে। ৫১ লক্ষ খাজনাভোগী স্বার্থ আছে। আমি এর নির্ভুলতার সম্পর্কে কোন প্রমাণ দিতে পারি না। এই স্বার্থগুলি যদি সরকার নিয়ে নেন তাহলে প্রায় ২০ লক্ষ পরিবার সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস হয়ে যাবে এবং রাষ্ট্র যদি তাঁদের ভরণপোষণের দায়িত্ব গ্রহণ না করেন তাহলে তাঁরা দুনিয়ার বুক থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। সুতরাং কোন রাষ্ট্রই তাঁদের ভরণপোষণের দায়িত্বকে পরিত্যাগ অথবা অস্বীকার করতে পারে না। প্রায় ২০,০০০ জন বিহার থেকে এখানে এসেছেন এবং তাঁদের কয়েক মাসের ভরণপোষণের জন্য সরকারকে প্রায় দুই কোটি টাকা ব্যয় করতে হয়েছে। উপযুক্ত ক্ষতি পূরণের ব্যবস্থা না করে নিজের দেশের লোকের সম্পত্তি বিনা ক্ষতিপূরণে বাজেয়াপ্ত করাকে কোন সরকার এবং কোন দায়িত্বসম্পন্ন ব্যক্তিই সম্ভব অথবা অর্থনৈতিক দিক দিয়ে সুবিবেচনামূলক মনে করতে পারে না। খাজনাভোগী স্বার্থকে হাতে নিয়ে এসে আপনারা কৃষকদের উপকার করতে যাচ্ছেন। কিন্তু ক্ষতিপূরণ না দিয়ে যদি আপনারা সেটা করেন তাহলে আপনারা এমন এক শ্রেণীর লোক সৃষ্টি করবেন যাদের ভরণপোষণ আপনাদের নিজেদের খরচেই চালাতে হবে। [৪০]
১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনের ২৯৯ ধারা সম্পর্কে হামিদুল হক বলেন যে, সর্বোচ্চ আদালতের ব্যাখ্যা অনুসারে সেই ধারা বলে কাউকেই জমিদারী, শিল্প, বাণিজ্য অথবা অন্য কোন স্বার্থ থেকে উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ ব্যতীত বঞ্চিত করা চলে না। [৪১]
হামিদুল হক চৌধুরীর এই বক্তৃতার পর বিলটিকে স্পেশাল কমিটিতে সোপর্দ করা এবং তাঁদের রিপোর্ট ৩১শে জুলাই, ১৯৪৮ এর মধ্যে পেশ করার জন্যে নির্দেশ দিয়ে পরিষদের সেদিনকার অধিবেশন সমাপ্ত হয়।
৭ই এপ্রিল পূর্ব বাঙলা পরিষদে জমিদারী ক্রয় ও প্রজাস্বত্ব বিলটি পেশ করার পর সে বিষয়ে কোন উল্লেখযোগ্য সমালোচনা অথবা মন্তব্য কোন বিরোধীদলীয় রাজনৈতিক দল অথবা পত্রপত্রিকায় করা হয়নি। অবশ্য সে সময় সক্রিয় বিরোধী দল বলতে শুধু ছিলো পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি এবং গণতান্ত্রিক যুব লীগ। কমিউনিস্ট পার্টির দ্বিতীয় কংগ্রেস তখন সবে মাত্র শেষ হয় এবং পার্টি কংগ্রেসের সিদ্ধান্ত তাঁদের রাজনৈতিক কর্মধারার মধ্যে এক বিরাট পরিবর্তনের সূচনা করে। সেই পরিবর্তনের মুখে তাঁদের পক্ষে উপরোক্ত বিলটির কোন প্রকাশ্য সমালোচনা সম্ভব হয়নি।
ঢাকা-কেন্দ্রিক গণতান্ত্রিক যুব লীগ সাংগঠনিক দুর্বলতার জন্যে জমিদারী ক্রয় ও প্রজাস্বত্ব বিলটির বিরুদ্ধে কোনও ব্যাপক আলোচনা অথবা আন্দোলন সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়নি তবে ১৯৪৮-এর সেপ্টেম্বর মাসে ঈশ্বরদীতে তাঁদের রাজশাহী বিভাগীয় সম্মেলনে “জমিদারী উচ্ছেদের ভাঁওতা দিয়া কৃষক উচ্ছেদ চলিবে না। বিনা খেসারতে জমিদারী উচ্ছেদ ও কৃষককে জমির মালিক করিতে হইবে” এই শীর্ষক একটি প্রস্তাবে তাঁরা সুস্পষ্টভাবে এ সম্পর্কে নিজেদের বক্তব্য প্রকাশ করেন। প্রস্তাবটির বিবরণ হলো নিম্নরূপ:
বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদ নিজের শাসন ও শোষণ কায়েম করিবার জন্য জমিদারী প্রথা সৃষ্টি করিয়া আমাদের দেশের জনসাধারণের অর্থনৈতিক জীবন পঙ্গু করিয়া দিয়াছে। দেশে চিরস্থায়ী খাদ্য সমস্যার সৃষ্টি করিয়াছে। সাম্রাজ্যবাদ সৃষ্ট এই ঘৃণ্য প্রথার বিরুদ্ধে কৃষকের আন্দেলন বহুদিনের আন্দোলন। আজাদী পাইলে জমিদারী প্রথা উচ্ছেদ করিয়া কৃষককে জমির মালিক করা হইবে – ইহাই ছিলো নেতাদের ওয়াদা। আজ পূর্ব পাকিস্তান সরকার জমিদারী উচ্ছেদের এক বিলও উত্থাপন করিয়াছে। কিন্তু এই বিলে যে সমস্ত ধারা রহিয়াছে তাহা সমস্তই কৃষক স্বার্থের বিরোধী। এই বিলের মূল ধারাগুলি হইতেছে: – (১)। জমিদারদের জন্য ৪০ কোটি টাকারও অধিক ক্ষতিপূরণ, (২) জোতদারদের জন্য জমি, (৩) জমিদারের ঋণ মকুব, (৪) ওয়াকফ্ ও দেবোত্তর সম্পত্তির সুবিধা ইত্যাদি।
এই সম্মেলনের মতে উপরোক্ত সমস্ত ধারাগুলি কৃষক স্বার্থবিরোধী এবং বিনা খেসারতে জমিদারী প্রথা উচ্ছেদ করিয়া কৃষককে জমির মালিক করিবার মূল দাবী গৃহীত হয় নাই। এই বিল পাস হইলে জমিদারী উচ্ছেদের পরিবর্তে কৃষক উচ্ছেদেরই ব্যবস্থা হইবে। জমিদারী উচ্ছেদের নামে এইরূপ কৃষক বিরোধী বিল উত্থাপন করিয়া সরকার পূর্ব পাকিস্তানের জনমতের সঙ্গে চরম বিশ্বাসঘাতকতা করিয়াছে। এই সম্মেলন প্রস্তাবিত বিলের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ করিতেছে এবং অবিলম্বে এই বিল প্রত্যাহার করিয়া বিনা ক্ষতিপূরণে ও “কৃষকই জমির মালিক” এই নীতির ভিত্তিতে জমিদারী উচ্ছেদের দাবী জানাইতেছে। এই সম্মেলন মনে করে যে তুমুল আন্দোলন ব্যতীত সরকার কৃষকের দাবী অনুযায়ী জমিদারী প্রথা উচ্ছেদ করিবে না। কৃষকের শ্রেণী সংগঠনকে জোরদার করিয়াই এই আন্দোলন সফল হইতে পারে। এই সম্মেলন পূর্ব পাকিস্তান যুব সমাজকে কৃষকের শ্রেণী সংগঠনকে সর্বতোভাবে সাহায্য করিয়া জমিদারী উচ্ছেদকে সফল করিবার জন্য আহ্বান জানাইতেছে[৪২]।
জমিদারী প্রথা উচ্ছেদের উদ্দেশ্যে কোন “তুমুল আন্দোলন” সংগঠিত করা বিভিন্ন কারণে গণতান্ত্রিক যুব লীগের দ্বারা আর সম্ভব হয়নি।
৩. বিশেষ কমিটির রিপোর্ট
জমিদারী প্রথা উচ্ছেদ বিল পর্যালোচনার জন্যে নিযুক্ত বিশেষ কমিটির সুপারিশ সম্পর্কে হামিদুল হকের পরবর্তী রাজস্বমন্ত্রী তফজ্জল আলী ৩রা আগস্ট পূর্ব বাঙলা সেক্রেটারীয়েটে একটি সাংবাদিক সম্মেলন করেন।[৪৩] সেই সম্মেলনে তিনি বলেন যে, পূর্ব পাকিস্তানে জমিদারী উচ্ছেদ করতে হলে প্রাদেশিক সরকার কর্তৃক জমিদারদেরকে প্রায় ৩০ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। এবং জমিদারী সরকারী কর্তৃত্বে বর্তানোর পর তার থেকে সরকারের বাৎসরিক আয় দাঁড়াবে ২ কোটি ৪১ লক্ষ ২৮ হাজার টাকার বেশী। জমির সিলিং সম্পর্কে তিনি বলেন যে, মাথা পিছু ১০ বিঘা হিসেবে প্রতি পরিবারের ১০০ বিঘা জমি রেখে উদ্বৃত্ত খাস জমি সরকার নিজের হাতে নিয়ে আসবে এবং পরে তা ভূমিহীন ও গরীব কৃষকদের মধ্যে বণ্টন করবে। যারা নিজে অথবা পরিবারের লোকজন দিয়ে জমি চাষ করে এবং যাদের তিন একরের কম কৃষি জমি আছে তাদেরকেই প্রথম জমি বিলি করা হবে বলে বিশেষ কমিটি সুপারিশ করেন। এই সমস্ত সরকার অধিকৃত জমির প্রজাদেরকে খাজনা দিতে হবে। পূর্বে যে সমস্ত জমি নিষ্কর ছিলো সেগুলিকে নিষ্কর না রেখে তার জন্যেও উপযুক্ত খাজনা ধার্য করা হবে। অর্থাৎ খাজনা কাউকে মাফ করা হবে না।
সরকার কর্তৃক উদ্বৃত্ত জমির দখল নেওয়ার পর যে সকল চাষী পরিবারের ১০০ বিঘার কম জমি আছে তারা ব্যতীত অন্য কেউ অতিরিক্ত জমি ক্রয় করতে পারবে না। যারা কৃষিজীবী নয় তারা কর্তৃপক্ষের পূর্ব অনুমতি নিয়ে জমি ক্রয় করতে পারবে। সাংবাদিক সম্মেলনকে রাজস্ব সচিব আরও জানান যে, প্রতি বৎসর চারটি করে জেলায় জমি নেওয়ার কাজ শুরু হবে এবং এক একটি ক্ষেত্রে সে কাজ শেষ করতে সময় লাগবে তিন বৎসর করে। এইভাবে সমস্ত জমি সরকারের অধীনে নিয়ে আসতে লাগবে চল্লিশ বৎসর। এছাড়া রেকর্ড সংশোধন করতে লাগবে আরও নয় বৎসর। কাজেই পূর্ব বাঙলা পরিষদে জমিদারী ক্রয় ও প্রজাস্বত্ব বিল আইনে পরিণত হওয়ার ৪৯ বৎসর পর পূর্ব বাঙলা থেকে জমিদারী প্রথা উচ্ছেদ হবে। যে সমস্ত জমিতে প্রজা পত্তন করা হয়েছে সেগুলির জন্যে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার যে হার বিশেষ কমিটি কর্তৃক নির্দিষ্ট হয়েছিলো তার একটি তালিকা তিনি দেন এবং তালিকাটিতে মূল বিলের সাথে বিশেষ কমিটির সুপারিশের পার্থক্যও নিম্নলিখিতভাবে উল্লেখ করেন:
রাজস্ব সচিব তফজ্জল আলীর সাংবাদিক সম্মেলনের পর স্পেশাল কমিটির সুপারিশকে সাধারণভাবে অভিনন্দন জানিয়ে দৈনিক আজাদ ৫ই আগস্ট একটি সম্পাদকীয় নিবন্ধে ক্ষতিপূরণ সম্পর্কে বলে :
নীতি হিসাবে আমরা জমিদারীর এই ক্ষতিপূরণ দানের বিরোধী। তবে এই প্রসঙ্গে আমরা একথা স্বীকার করিতে বাধ্য যে, ক্ষতিপূরণকে এই কমিটি যথাসাধ্য কম করিবার জন্য যে চেষ্টা করিয়াছেন, তা বুঝা গিয়াছে। এজন্য সরকার বা দেশবাসীর উপর বিপুল ঋণভারের বোঝা চাপাইয়া দেওয়া যাতে না হয় তার জন্যও তাঁদের তৎপরতা সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করিবে। বন্ডে ক্ষতিপূরণ দানের ব্যাপারে একটা বিষয় লক্ষ্য রাখিয়া কর্তৃপক্ষকে আমরা আইন রচনা করিতে অনুরোধ জানাই। এ টাকা যাতে বিদেশে চলিয়া না যাইয়া এ দেশের শিল্প বাণিজ্যে নিয়োজিত হইতে পারে, তার ব্যবস্থা পাকাপাকি আইনে হওয়া উচিত। তাহা হইলে এই ক্ষতিপূরণের কিছুটা সার্থকতা প্রমাণিত হইতে পারে।
জমিদারী এবং মধ্যস্বত্ব ছাড়াও সরকার কর্তৃক খাসজমি দখল ও সেই জমি ভূমিহীনদের মধ্যে বিতরণের যে কথা রাজস্ব সচিব ৩রা অগাস্টের সাংবাদিক সম্মেলনে বলেছিলেন, সে প্রসঙ্গে ৯ই অগাস্ট অপর একটি সম্পাদকীয় প্রবন্ধে দৈনিক আজাদ বলে:
এই সব কথা বিশ্লেষণ করিলে এই সত্যটাই সর্বপ্রথম স্বীকৃত হয় যে, সরকার “লাঙ্গল যার জমি তার” নীতি মানিয়া লইয়াছেন। পূর্ব পাকিস্তানে ভূমিহীন কৃষি মজুরদের দাবী এভাবে অগ্রগণ্য করিয়া জমিদারী বিলোপ সম্পর্কিত বিশেষ কমিটি একটি কাজের মত কাজ করিয়াছেন। আশা করি, আইন সভায় যখন ইহাকে বিলের আকারে উপস্থিত করা হইবে, তখন ইহা সকলের সমর্থন লাভ করিবে।
এই প্রশান্তির পর কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে বিষোদগার করে উপরোক্ত সম্পাদকীয়টিতে আজাদ আরও বলে:
একদল কমিউনিস্ট এবং বর্ণচোরা কমিউনিস্ট আজ ভূমিহীন কৃষিমজুরদিগকে ক্ষেপাইয়া স্বার্থোদ্ধারের ফিকিরে আছে। তাঁরা তাঁদের দুরবস্থার সুযোগ পুরোপুরি গ্রহণ করিতেছে। ‘তেভাগা আন্দোলন’ এবং ‘টঙ্ক বন্ধ আন্দোলনের’ পশ্চাতে বহুবার যে কমিউনিস্টদের কুচক্রী হস্ত সক্রিয় হইতে দেখা গিয়াছে, তা অস্বীকার করা চলে না। আজ ভূমিহীন কিষাণরা সত্য সত্যই যদি জমির মালিক হয়, তবে কমিউনিস্টদের সকল কারসাজি সত্বরই বিলুপ্ত হইয়া যাইবে।
৩০শে অগাস্ট তারিখের দৈনিক আজাদে ২৮শে অগাস্ট ঢাকার আরমানীটোলার রায় হাউসে অনুষ্ঠিত পূর্ব বাঙলার জমিদারদের একটি ঘরোয়া বৈঠকের খবর জানা যায়। এই বৈঠকে জমিদাররা নিজেদের অবস্থা সম্পর্কে আলোচনা করেন। সে সময় সেস্ বাকীর জন্যে জমিদারী নিলামের যে আইন প্রাদেশিক সরকার পাস করেছিলো সে বিষয়ে আলোচনা প্রসঙ্গে তাঁরা বলেন যে, জমিদাররা সরকারের সেস্ পরিশোধ করতে ইচ্ছুক থাকলেও প্রজাদের কাছে খাজনা ও সেস্ বাকী পড়ায় তাঁরা তা পরিশোধ করতে পারছেন না। জমিদারী প্রথা উচ্ছেদ হয়ে যাবে বলে প্রজারা খাজনা দেওয়া নিরর্থক মনে করছে, এই কারণ দেখিয়ে জমিদারী খাস করার কাজ যাতে বন্ধ রাখা হয় তার জন্যে সরকারকে অনুরোধ জানিয়ে তাঁরা সভায় একটি প্রস্তাব গ্রহণ করেন। এ ছাড়া রাষ্ট্র কর্তৃক ভূমিস্বত্ব দখল করা হলে জমিদারদেরকে যাতে যথোপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয় তার জন্যেও সরকারকে অনুরোধ করে অপর একটি প্রস্তাব তাঁরা গ্রহণ করেন।
জমিদারদের উপরোক্ত স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়সমূহ মুখ্যমন্ত্রী, রাজস্বমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রীর সাথে আলোচনার জন্যে তাঁরা নয়জন সদস্য নিয়ে একটি প্রতিনিধিদল গঠন করেন। এই প্রতিনিধিদের মধ্যে ঢাকার নবাব, গোলাম সাত্তার চৌধুরী, সুবোধচন্দ্র নাগ, রায়বাহাদুর কেশবচন্দ্র বন্দোপাধ্যায়, অমূল্যমোহন রায়, খান বাহাদুর হাবিবউদ্দীন আহমদ সিদ্দিকী প্রভৃতির নাম উল্লেখযোগ্য। পরবর্তী সেপ্টেম্বর মাসে ঢাকায় পূর্ব বাঙলার জমিদারদের একটি সম্মেলন অনুষ্ঠানের সিদ্ধান্তও এই সভায় গৃহীত হয়। ‘পূর্ব বাঙলা জমিদারী ক্রয় ও প্রজাস্বত্ব বিল, ১৯৪৮’ বিবেচনার জন্যে ৪৫ সদস্য বিশিষ্ট স্পেশাল কমিটির প্রথম বৈঠক বসে ১লা জুন, ১৯৪৮। ৭ই এপ্রিলের পরিষদ সিদ্ধান্ত অনুযায়ী কমিটির রিপোর্ট দাখিলের সর্বশেষ তারিখ নির্দিষ্ট হয়েছিলো ১৯৪৮-এর ৩১শে জুলাই। কিন্তু কমিটির পক্ষে ঐ নির্ধারিত তারিখের মধ্যে রিপোর্ট দাখিল করা সম্ভব হয়নি। কারণ ৩১শে জুলাইয়ের মধ্যে তাঁরা মাত্র ১৪টি বৈঠক করেছিলেন এবং সেই সমস্ত বৈঠকে বিলটির সামান্য অংশই বিবেচিত হয়েছিলো।[৪৪] সমস্ত বিলটি বিবেচনার জন্যে তাঁদের আরও ৩৭টি বৈঠক করাতে হয়েছিলো এবং তাঁরা তাঁদের রিপোর্টের চূড়ান্ত খসড়া তৈরীর কাজ শেষ করেছিলেন ১৭ই জানুয়ারী, ১৯৪৯।[৪৫] পরিষদে আনুষ্ঠানিকভাবে রাজস্বমন্ত্রী তাফজ্জল আলী সেটি পেশ করেন ১৯৪৯- এর ১৫ই নভেম্বর।
৪৫ জন সদস্যের মধ্যে ২৩ জন মূল রিপোর্টের সাথে একমত না হওয়ার ফলে ব্যক্তিগত স্বতন্ত্র নোট দেন।[৪৬] যে সদস্যেরা স্বতন্ত্র নোট দেন তাঁদের মধ্যে ছিলেন মুসলিম লীগ দলভুক্ত ঢাকা নবাব পরিবারের এসএ সেলিম এবং সিলেটের মহম্মদ আলী হায়দার খান ও মঈনুদ্দীন আহমদ চৌধুরী।[৪৭] এরা তিনজনই হলেন পূর্ব বাঙলার মুসলমান জমিদারদের শীর্ষস্থানীয়।
রিপোর্টটি প্রেসে যাওয়া পর্যন্ত আরও ১১জনের স্বাক্ষর সংগ্রহ করতে না পারার ফলে তাঁদের স্বাক্ষরও স্পেশাল কমিটির রিপোর্টে সংযোজন করা সম্ভব হয়নি।[৪৮] স্পেশাল কমিটির রিপোর্ট ১৭ই জানুয়ারী, ১৯৪৯ চূড়ান্ত করা হলেও ছাপার কাজ শেষ না হওয়ায় পরবর্তী বাজেট অধিবেশনে রাজস্বমন্ত্রী সেটি পরিষদে পেশ করতে পারেননি।[৪৯] ছাপার কাজ এতো বিলম্বিত হওয়া সত্ত্বেও সেই অতিরিক্ত সময়ের মধ্যে ১১ জন কমিটি সদস্যের স্বাক্ষর সংগ্রহ করা সম্ভব না হওয়ার ব্যাপারটি থেকে মনে হয় যে, ঐ সমস্ত সদস্যেরা স্বতন্ত্র নোট না দিলেও ইচ্ছাকৃতভাবে রিপোর্টটিতে নিজেদের স্বাক্ষর দানে বিরত থাকেন। স্পেশাল কমিটির কয়েকজন সদস্যের উক্তি থেকেও অনেকটা তাই মনে হয়। তাঁরা পরিষদে রিপোর্টটি আলোচনার সময় বলেন যে, স্পেশাল কমিটিতে তাঁরা দলগতভাবে আলোচনা করেননি, করেছিলেন ব্যক্তিগতভাবে। ফলে দেখা গেছে যে কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের কোন কোন সদস্যরা অনেক বিষয় পরস্পরের সাথে একমত হয়েছেন এবং নিজেদের দলীয় সদস্যদের বিরোধিতা করেছেন। [৫০] কংগ্রেস ও মুসলিম লীগভুক্ত জমিদারদের স্বার্থের একাত্মতার কারণেই যে সদস্যদের এই ব্যক্তিগত ভূমিকা সম্ভব হয়েছিলো সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। ব্যবস্থা পরিষদের আলোচনার মধ্যেও এই ভূমিকা সম্পূর্ণভাবে বর্জন করা এই সমস্ত সদস্যদের পক্ষে সম্ভব হয়নি। কংগ্রেস লীগভুক্ত সদস্যদের মধ্যে অনেকেই এ ক্ষেত্রে পরস্পরের সাথে হাত মিলিয়েছিলেন। ব্যাপারটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য এজন্যে যে, কংগ্রেস লীগ সদস্যদের এই ব্যক্তিগত ভূমিকা এবং ‘ঐক্য ফ্রন্ট’ অন্য কোন গুরুতর আলোচনার সময়ে লক্ষিত না হলেও তাঁদের মৌলিক শ্রেণীস্বার্থই তাঁদের মধ্যে এই মিলন ঘটাতে সক্ষম হয়েছিলো।
স্পেশাল কমিটি তাঁদের মূল রিপোর্টে বিলটির কতকগুলি সংশোধন[৫১] প্রস্তাব করেছিলেন। বিলটির প্রথম খসড়ায় মিউনিসিপ্যাল এলাকা এবং মৎস্যচাষের উপযোগী নদীগুলি অন্তর্ভুক্ত ছিলো না, কিন্তু রিপোর্টে সংশ্লিষ্ট ২ ধারা বাতিল করে সেগুলির অন্তর্ভুক্তির সুপারিশ করা হয়। কমিটি দুটি নোতুন অধ্যায় সংযোজন করে তাঁদের একটিতে (Chapter IA ) কতকগুলি জমিদারী স্বত্বকে তৎক্ষণাৎ ক্রয়ের ব্যবস্থা এবং অন্যটিতে (Chapter IB) চাকরান জমিতে চাষীদেরকে স্বত্বদানের সুপারিশ করেন। বিলের ৭ ধারা সংশোধন করে এক ব্যক্তির খাস জমির সিলিং ২০০ বিঘা থেকে কমিয়ে ১০০ বিঘায় নিয়ে আসেন। বিলের ৮ ধারাকে নোতুনভাবে রচনা করে জমিদারী ক্রয়ের পর প্রজারা যাতে ন্যায্য খাজনা দিয়ে সরাসরিভাবে সরকারের অধীনস্থ প্রজা হিসেবে জমি ভোগ দখল করতে পারেন তার জন্যে সুপারিশ করা হয়। ১৯ ধারাকেও স্পেশাল কমিটি ক্ষতিপূরণের নোতুন হার নির্দেশের উদ্দেশ্যে পরিবর্তন করেন। বিলের সপ্তম অধ্যায়কে পুরোপুরি বাতিল করে তার স্থানে নোতুন অধ্যায় সংযোজন করে ব্যবস্থা করা হয় যাতে জমিদারী ক্রয়ের পর বাকী খাজনা ও সেস্ সরকার কর্তৃক আদায় এবং সেই খাজনা ও সেসের শতকরা ৫০ ভাগ ঐসব জমিদারীর পূর্ববর্তী মালিকদেরকে দেওয়া যায়। বিলের ৫৩ ধারা সংশোধন করে কমিটি রায়তদের নিজেদের জমি ইচ্ছেমতো ব্যবহারের অধিকার দান করেন। এছাড়া ৬২ ধারা সংশোধন করে তাঁরা রায়তদের নিজেদের দ্বারা আবার জমি বর্গা দেওয়াকে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করেন। ৮২ ধারায় বিশেষ পরিস্থিতিতে খাজনার নোতুন হার নির্দিষ্ট করার যে ব্যবস্থা ছিলো স্পেশাল কমিটি তা বাতিলের পক্ষে রায় দেন। ৮৪ ধারায় খাজনা মওকুফের যে ব্যবস্থা ছিলো সেটাও তাঁরা তুলে দেওয়ার প্রস্তাব করেন। চতুর্দশ অধ্যায়ে বর্গাপ্রথা সম্পর্কে মূল বিলটির প্রস্তাব হামিদুল হক চৌধুরী ১৯৪৮-এর ৭ই এপ্রিল পরিষদে পেশ করার পর তার ওপর যে প্রাথমিক বিতর্ক অনুষ্ঠিত হয় তাতেও তৎকালীন মুসলিম লীগ পার্লামেন্টারী পার্টি বহির্ভূত বিরোধীদলীয় সদস্য হিসেবে নোতুন রাজস্বমন্ত্রী তফজ্জল আলী মূল বিলটি থেকে বর্গাপ্রথা সংক্রান্ত অধ্যায়টি সম্পূর্ণভাবে বাদ দেওয়ার পক্ষে সুপারিশ করেছিলেন। সেই সুপারিশও স্পেশ্যাল কমিটির রিপোর্টে কার্যকর করা হয়।[৫২]
স্পেশাল কমিটিতে বিলটিকে ‘মৌলিকভাবে’ সংশোধনের ফলে সেটি একটি সম্পূর্ণ নোতুন বিলে পরিণত হয়েছে এই অভিযোগ এনে কংগ্রেস দলীয় সদস্য অমূল্যচন্দ্র অধিকারী সমগ্র বিলটিকে স্পেশাল কমিটিতে আবার নোতুন করে সোপর্দ করার জন্যে একটি সংশোধনী প্রস্তাব আনেন।[৫৩] তিনি তাঁর বক্তব্যের যৌক্তিকতা দেখাতে গিয়ে বলেন[৫৪] যে, দুই ধারায় নোতুনভাবে চাষের জমি ছাড়াও অন্য জমি অন্তর্ভুক্তি করা একটি মৌলিক পরিবর্তন ব্যতীত কিছুই নয়। কতকগুলি বিশেষ জমিদারী তাড়াতাড়ি ক্রয় এবং চাকরান জমি চাষীদেরকে সেই সমস্ত জমিতে স্বত্ব দানের সুপারিশ বিলটির চরিত্রকে মৌলিকভাবে পরিবর্তন করেছে বলেও তিনি অভিযোগ করেন। মনোরঞ্জন ধরসহ কংগ্রেস দলের কয়েকজন নেতৃস্থানীয় সদস্য এ বিষয়ে অমূল্য অধিকারীর সাথে একমত হন এবং বিলটিকে আবার স্পেশাল কমিটিতে পুনর্বিবেচনার জন্যে পাঠাবার সুপারিশ করে পৃথক পৃথক সংশোধনী প্রস্তাব পেশ করেন।[৫৫]
৪. বিরোধী দলীয় সংশোধনী প্রস্তাবের ওপর আলোচনা
জমিদারদেরকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার প্রশ্নেই ব্যবস্থা পরিষদে সব থেকে দীর্ঘ এবং তিক্ত বিতর্ক অনুষ্ঠিত হয়। ‘পূর্ব বাঙলা জমিদারী ক্রয় ও প্রজাস্বত্ব বিলে’ বিনা ক্ষতিপূরণে জমিদারী উচ্ছেদের কোন কথা ছিলো না। উপরন্তু জমিদারদেরকে তাঁদের বাৎসরিক রাজস্বের ৬ থেকে ১৫ গুণ ক্ষতিপূরণ দেওয়ার ব্যবস্থাই সেখানে রাখা হয়েছিলো। সিলেক্ট কমিটি এই হারকে কমিয়ে ২ থেকে ১০ গুণ করেন। এই ব্যবস্থায় কংগ্রেস দলভুক্ত সদস্যেরা সন্তুষ্ট না হয়ে জমিদারদেরকে আরও অনেক বেশী এবং উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দানের জন্যে নানা বক্তব্য হাজির করেন। ক্ষতিপূরণের হার বৃদ্ধির এই প্রস্তাব উত্থাপন করতে গিয়ে বাহ্যতঃ তাঁরা জমিদারী প্রথা উচ্ছেদ সম্পর্কে কোন সরাসরি আপত্তি না তুললেও তাঁদের অধিকাংশই যে, জমিদারী প্রথাকে টিকিয়ে রাখার পক্ষপাতী তা সুস্পষ্টভাবে বোঝা যায়। এঁদের মধ্যে অনেকে আবার দেশের সামগ্রিক উন্নতির প্রচেষ্টার দিকে অধিকতর এবং জরুরীভিত্তিক মনোযোগ দেওয়ার প্রস্তাব করে বলেন যে, অন্যান্য উপায়ে জনগণের অবস্থার উন্নতির দিকেই সরকারের বেশী নজর দেওয়া দরকার। অনেক বড়ো জমিদার নিজেদের জমিদারী প্রথম চোটে যাওয়ার সম্ভাবনাকে রোধ করার জন্যে সমস্ত জমিদারী একত্রে ক্রয় করে নেওয়ার দাবী জানান। কংগ্রেস বহির্ভূত দুই একজন হিন্দু সদস্য অবশ্য সরাসরিভাবে ক্ষতিপূরণ ব্যতীতই জমিদারী উচ্ছেদের কথা বলেন।
অন্যদিকে মুসলিম লীগ দলভুক্ত এবং সেই দল বহির্ভূত কিছু সংখ্যক মুসলমান পরিষদ সদস্য জমিদারী উচ্ছেদের পরিবর্তে ক্ষতিপূরণ দিয়ে জমিদারী ক্রয় প্রস্তাবের ভীষণ বিরোধিতা করেন।
১৫ই নভেম্বর, ১৯৪৯ তারিখে স্পেশাল কমিটির রিপোর্টটি পরিষদে পেশ করার পর ঢাকা এলাকার ভূস্বামীদের প্রতিনিধি শীতাংশুকান্ত আচার্য প্রথমেই জমিদারী প্রথার গুণকীর্তন করতে গিয়ে বলেন[৫৬] যে, হিন্দু যুগে, আকবরের আমলে এবং ঈস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর আমলে জমিদাররা একটা গৌরবময় ভূমিকা পালন করেছেন। জমিদারী প্রথার অবসান জমিদারদের সেই গৌরবময় ভূমিকা থেকে জনগণকে বঞ্চিত করবে একথা পরিষদকে স্মরণ করিয়ে দিয়ে তিনি তার বক্তৃতায় অনেক বিলাপ করেন। এই প্রসঙ্গে তিনি সরকারকে হুশিয়ার করতে গিয়ে যে বক্তব্য পেশ করেন তা খুবই উল্লেখযোগ্য। তিনি বলেন:
জমিদাররা সব সময়েই সরকারের অবৈতনিক খাজনা সংগ্রাহক এবং প্রজা, জনগণ ও সরকারের মধ্যে সংঘর্ষ নিয়ন্ত্রেতা ও বাফার হিসেবে কাজ করে এসেছেন। তাঁরা বরাবর দুপক্ষেরই চাপ সহ্য করে এসেছেন, দুপক্ষেরই হিতার্থে কাজ করেছেন। স্যার, জমিদার হিসেবে, আমার বিদায়ের পূর্বে আমি এই সতর্কবাণী উচ্চারণ করতে চাই যে, সেই বাফাররা যখন আর থাকবে না তখন সরকার সরাসরিভাবে খাজনা দানকারী জনগণের সংস্পর্শে আসবেন এবং সরকারের পক্ষে সেটা মোটেই সুখকর হবে না।[৫৭]
জমিদার ও সরকারের অধীনস্থ প্রজাদের আপেক্ষিক অবস্থার কথা উল্লেখ করে শীতাংশু আচার্য বলেন :
এই আইনের মাধ্যমে সরকার জমিদারদের স্থলাভিষিক্ত হতে যাচ্ছেন। এর ফলে কি প্রজাদের অবস্থার কোন উন্নতি হবে? যদি আপনারা খাস মহল প্রজা অথবা কোর্ট অব ওয়ার্ডস প্রজাদের সাথে জমিদারদের অধীনস্থ প্রজাদের অবস্থার তুলনা করেন তাহলে তৎক্ষণাত, আপনারা তার ফলাফল দেখতে পাবেন। আমি সাহসের সাথে একথা বলবো যে জমিদারদের অধীনস্থ প্রজারা খাস মহলের অধীনস্থ প্রজাদের থেকে অনেক ভালো অবস্থায় আছে। প্রজাদের দুঃখ দুর্দশা লাঘবের জন্যে তাঁদেরকে আপনারা কি আশ্বাস দিয়েছেন, অথবা কী আশ্বাস দেওয়ার কথা বিবেচনা করছেন?[৫৮]
এর পর ক্ষতিপূরণের প্রশ্ন উত্থাপন করে শীতাংশু আচার্য বলেন:
জমিদারীর প্রতি কোন আকর্ষণ আর আমাদের নেই। উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ পেলে আমরা খুশী হয়ে তা সরকারের হাতে তুলে দেবো। কিন্তু এই ক্ষতিপূরণ উপযুক্ত এবং যথেষ্ট হতে হবে। বিলে যে ক্ষতিপূরণের কথা বলা হয়েছে সেটা কোন ক্ষতিপূরণই নয়। তা জবরদস্তিমূলক দখলেরই সমতুল্য। আইন অনুযায়ীও ক্ষতিপূরণ উপযুক্ত ও যথেষ্ট হওয়া দরকার। এ বিষয়ে ক্রয় আইনও সুস্পষ্ট এবং নির্দিষ্ট। যে পর্যন্ত তা অনুসরণ করা হয়েছিলো সে পর্যন্ত তা ঠিকই ছিলো। কিন্তু আজ পাশব সংখ্যাগরিষ্ঠতার মাধ্যমে যদি আপনারা একটা বেআইনী আইনকে আইনে পরিণত করেন তাহলে সেই আইন আপনাদের জন্যে সুবিধাজনক হলেও তার দ্বারা কোন ন্যায়বিচার হবে না। ক্ষতিপূরণ বুলিয়ন অথবা স্টার্লিং, পাউন্ড অথবা ডলারে দেওয়া উচিত যাতে পৃথিবীর যে কোন জায়গায় তা ভাঙ্গানো যায়। নন নেগোশিয়েবল বন্ড দ্বারা যদি ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয় তাহলে সমগ্র চিত্রের রং একেবারে পাল্টে যাবে। এর অর্থ দাঁড়াবে জবরদস্তিমূলক দখল। অনুগ্রহ করে মনে রাখবেন যে, বিতাড়িত জমিদারদের অন্য জীবিকার ব্যবস্থা করার জন্যে তাঁদের নগদ মূলধনের প্রয়োজন হবে এবং সেই মূলধনের কাজ নন- নেগোশিয়েবল বন্ডের দ্বারা সম্পন্ন হবে না।[৫৯]
স্পেশাল কমিটির রিপোর্টে (Chapter 1A) কতকগুলি জমিদারী প্রথম চোটে তাড়াতাড়ি নিয়ে নেওয়ার যে প্রস্তাব হয় সে বিষয়ে শীতাংশুকুমার আচার্য বলেন :
আপনাদের অবগতির জন্য আপনাদের প্রস্তাবের আর একটি জঘন্য দিক সম্পর্কেও আমি কিছু বলবো। মাত্র কয়েকজন জমিদারকে কেন বাছাই করা হয়েছে? অতীতে ভালোভাবে জমিদারী চালানোর শাস্তি হিসেবেই কি তাঁদেরকে এই শাস্তি দেওয়া হচ্ছে? স্যার, আমি এ ব্যাপারে আরও বলতে চাই যে, দুর্ভাগ্যবশতঃ অধিকাংশ বড়ো জমিদাররা হিন্দু হওয়ার ফলে তা প্রস্তাবিত বিলটিকে একটা সাম্প্রদায়িক চরিত্র দান করবে। আমাদের সন্দেহ হয় যে, প্রথম দফা বলিদানের পর উচ্ছেদের পরবর্তী পরিকল্পনাকে সরকার আর স্পর্শ না করে তাকে ঠাণ্ডা গুদাম ঘরে ফেলে রাখবেন। এই অবস্থায়, স্যার, উচ্ছেদ যদি করতেই হয় তাহলে উপর থেকে নীচ পর্যন্ত জমিতে সমস্ত রকম অধিকারই বিলোপ করতে হবে, এইমর্মে কি পরিষদ সুস্পষ্ট রায় দান করবে।[৬০]
এরপর নিজের বক্তৃতা শেষ করার পূর্বে শীতাংশু আচার্য কমিউনিজম সম্পর্কে পরিষদকে ভয় দেখিয়ে এক সতর্কবাণী উচ্চারণ করে বলেন:
আমরা বোধহয় সরকারকে দেখবো কমিউনিজমকে ডেকে আনতে যা আমাদের সরকারের স্বার্থের পক্ষে ক্ষতিকারক হবে। সূত্রপাতের চেহারা যদি এই হয়, তাহলে ভবিষ্যতের চিন্তা করে আমার গা কাঁটা দিয়ে উঠছে। এটা খুব কঠোর শোনাতে পারে কিন্তু যারা এদেশকে বহু শতাব্দী ধরে শাসন করেছে তাঁদের থেকে এই বিদায়কালীন উপদেশ আপনারা গ্রহণ করতে পারেন। তাঁদের অভিজ্ঞতার তুলনায় আপনাদেরকে বড়ো জোর দুগ্ধপোষ্য অথবা গতমাসে ভূমিষ্ট শিশু বলা চলে। [৬১]
ঢাকা এলাকার ভূস্বামীদের প্রতিনিধি শীতাংশুকুমার আচার্যের বক্তৃতা থেকে উপরোক্ত অংশগুলি উদ্ধৃত করার কারণ সমগ্র বিলটির ওপর কংগ্রেস সদস্যদের আলোচনা ও বিতর্ক এইসব বক্তব্যের কাঠামোর মধ্যেই মোটমুটিভাবে সীমাবদ্ধ থাকে। তৎকালে পূর্ব বাঙলার জমিদারী স্বার্থের বড়ো তরফের প্রতিভূ হিসেবে তাঁরা এই ভূমিকা পালন করেন।
২ নম্বর ধারা বাতিল এবং IA ও IB পরিচ্ছেদ সংযোজনের বিষয়ে মনোরঞ্জন ধর কর্তৃক আনীত সংশোধনীর সপক্ষে ১৫ই ও ১৬ই নভেম্বর কংগ্রেস দলের ডেপুটি লীডার ধীরেন দত্ত বক্তৃতা করেন। সংশোধনীর সমর্থনে বক্তৃতা করতে দাঁড়ালেও তাঁর বক্তৃতায় জমিদারী উচ্ছেদ সংক্রান্ত অন্যান্য বিষয়সমূহের উল্লেখ থাকে।
কিছু সংখ্যক জমিদারদের জমিদারী প্রথম দফায় সরকারী কর্তৃত্বে নিয়ে আসার জন্যে IA অধ্যায়ে সিলেক্ট কমিটি যে ব্যবস্থা রাখেন সে সম্পর্কে ধীরেন দত্ত বলেন যে, এর অর্থ হচ্ছে কোন রেকর্ড অব রাইটস তৈরী করার পূর্বেই সমস্ত জমিদারী উচ্ছেদ করা। তার আরও অর্থ হচ্ছে জমিদারদের মধ্যে কারও কারও বিরুদ্ধে সরকারী আমলাতন্ত্র কর্তৃক বিশেষ ব্যবস্থা অবলম্বন! এ প্রসঙ্গে খাজা সেলিমের অনৈক্যমূলক নোটের[৬২] উল্লেখ করে বলেন যে, তিনিও সেই নোটে বলেছিলেন যে রেকর্ড অব রাইটস তৈরী না করে কোন জমিদারী সরকার নিজের হাতে নিতে পারেন না।[৬৩]
তার কারণ খাজা সেলিমের স্পেশাল কমিটির সদস্য হিসেবে ঐ নোট দেওয়ার পর মুসলিম লীগ সরকার তাঁকে মন্ত্রী করে এবং তিনি নিজের পূর্বোক্ত বিরোধিতা বাদ দিয়ে সরকারী মতের সমর্থক হন। এইভাবে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দীনের পরিবারভুক্ত এবং পূর্ব বাঙলার জমিদারদের মধ্যে যে দুতিনজন শীর্ষ স্থানীয় ছিলেন তাঁদের অন্যতম খাজা সেলিমকে “অতিরিক্ত ক্ষতিপূরণ” দেওয়ার উদ্দেশ্যেই তাকে মন্ত্রীত্বের গদিতে বসানো হয়। অন্য যে দুজন অনৈক্যমূলক নোট দিয়েছিলেন তাঁরা হলেন সিলেট জেলার জমিদার মহম্মদ আলী হায়দার খান ও মঈনুদ্দীন আহমদ চৌধুরী।[৬৪]
জমিদারী উচ্ছেদের প্রয়োজনীয়তা সাধারণভাবে স্বীকার করলেও ধীরেন দত্ত পরিষদকে বলেন যে, সেই মুহূর্তে অন্যান্য সমস্যা সমাধানের প্রয়োজনের তুলনায় জমিদারী উচ্ছেদের প্রয়োজন তুলনায় অগুরুত্বপূর্ণ। তিনি বলেন, অধিক খাদ্য উৎপাদন, কৃষির উন্নয়ন, কল- কারখানা প্রতিষ্ঠা, নিরক্ষরতা দূরীকরণ ইত্যাদির ওপরই প্রাথমিক গুরুত্ব আরোপ করা দরকার। শুধু জমিদারী উচ্ছেদ করে এগুলি সম্ভব নয়।[৬৫]
কতকগুলি সাধারণ প্রশ্নের অবতারণা করে, জনগণের ব্যাপক দুঃখ দারিদ্র এবং দেশের অর্থনৈতিক অনুন্নতির উল্লেখ করে কিভাবে জমিদারী উচ্ছেদের প্রশ্নটিকে কংগ্রেস দল “অগুরুত্বপূর্ণ” বলে চালাবার চেষ্টা করছিলো ধীরেন দত্তের ঐ বক্তব্য থেকে সেটা খুব স্পষ্ট। শুধু জমিদারী উচ্ছেদ করে জনগণের দুঃখ দুর্দশা এবং দেশের সত্যিকার অর্থনৈতিক উন্নতি সম্ভব নয় একথা সত্য। কিন্তু এগুলি করার জন্যে জমিদারী উচ্ছেদ যে অন্যতম প্ৰাথমিক প্রয়োজন সে কথা অনস্বীকার্য। ধীরেন দত্ত কিন্তু তার বক্তৃতায় অন্যান্য প্রসঙ্গের অবতারণা করে জমিদারী উচ্ছেদের প্রশ্নে যা বলতে চেয়েছেন তার অর্থ দাঁড়ায় এই যে, জমিদারী উচ্ছেদ ব্যতীতই অধিক খাদ্য উৎপাদন, কৃষির উন্নয়ন, কল-কারখানা প্রতিষ্ঠা, নিরক্ষরতা দূরীকরণ, বস্ত্র সমস্যার সমাধান ইত্যাদি সম্ভব।
ক্ষতিপূরণের প্রশ্নে ধীরেন দত্ত বলেন যে, শুধু ক্ষতিপূরণ দিলেই হবে না। জমিদারদেরকে উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দিয়ে তাঁদের জমিদারী সরকারকে নিতে হবে। এ প্রসঙ্গে তিনি যা বলেন সেটা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য:
সরকারের দরকার দায়িত্ব জ্ঞান বজায় রেখে কথা বলা। আমাদের পাকিস্তান রাষ্ট্রে বিশেষতঃ পূর্ব বাঙলা, যাতে কৃষি ও শিল্পক্ষেত্রে উন্নত হয় তার জন্য আমি খুব উদ্বিগ্ন। যথেষ্ট বিদেশী মূলধন ব্যতীত শিল্পের উন্নতি একেবারে অসম্ভব। নিজেদের জমিদারদেরকে সরকার যদি উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ না দেন তাহলে তাঁরা কি বিদেশী মূলধন প্রত্যাশা করতে পারেন? মন্ত্রী পরিষদের এটা বোঝা দরকার যে, জনগণ যখন মনে করছে যে তাঁদের সম্পত্তি বিনা ক্ষতিপূরণে নিয়ে নেওয়া হচ্ছে এবং শিল্প সংস্থাসমূহও ঐ একইভাবে ক্ষতিপূরণ ব্যতীত নিয়ে নেওয়া হবে, সেই অবস্থায় বিদেশী মূলধন পূর্ব বাঙলায় নিয়োগ সম্ভব হবে না। স্যার, আমি আপনাকে এই বিষয়টি বিবেচনা করতে বলছি। আমি বলছি যে, আমার রাষ্ট্রের উন্নয়নের আকাঙ্ক্ষার দিক থেকে আমি কারো থেকে কম নই। আমি মনে করি বিদেশী মূলধন ব্যতীত এই দেশের কোন উন্নতি সম্ভব নয়। আমি মনে করি বিদেশী মূলধন যাতে আমরা আকৃষ্ট করতে পারি তার জন্যেই যথাযথ ক্ষতিপূরণ দেওয়া দরকার। সেই উদ্দেশ্যে কি পরিমাণ ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করা হয়েছে? প্রকৃতপক্ষে কিছুই নয়।[৬৬]
ধীরেন দত্তের এই বক্তৃতায় সামন্ত স্বার্থের সাথে সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থের যোগসূত্রের ব্যাপারটি আশ্চর্যজনক খোলাখুলিভাবে প্রকাশিত হয়েছে। কৃষিতে সামন্ত উৎপাদন ব্যবস্থার উচ্ছেদ না হলে যথেষ্ট কৃষি উদ্বৃত্ত সম্ভব নয় এবং সেটা সম্ভব না হলে শিল্পোন্নতি বিদেশী সাহায্যের ওপর নির্ভরশীল থাকতে বাধ্য। এজন্যে দেশীয় শিল্পের উন্নতিকে আত্মনির্ভরশীল করার জন্য সামন্ত উৎপাদন ব্যবস্থা এবং তার সাথে সামন্ত স্বার্থের অবসান অপরিহার্য। পূর্ব বাঙলার মতো দেশে কৃষিই শিল্পোন্নয়ন এবং দেশের সামগ্রিক অর্থনীতির ভিত্তিভূমি। এবং কৃষির উন্নতির জন্যে তাই জমিদারী প্রথা উচ্ছেদ অপরিহার্য।
শিল্পোন্নতির ক্ষেত্রে ধীরেন দত্তের বক্তব্য হলো, বিদেশী সাহায্য ব্যতীত শিল্পোন্নয়নই সম্ভব নয়। কাজেই কৃষি উদ্বৃত্তের কথা চিন্তা না করে তিনি বিদেশী অর্থাৎ প্রকৃতপক্ষে সাম্রাজ্যবাদী মূলধনের ওপরেই সম্পূর্ণ গুরুত্ব আরোপ করেছেন। জনস্বার্থের নামে সামন্ত স্বার্থকে যারা টিকিয়ে রাখতে চান তাঁদের পক্ষে এই যুক্তি খুবই স্বাভাবিক।
জমিদারদেরকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার পদ্ধতি সম্পর্কে ধীরেন দত্ত বলেন যে ক্ষতিপূরণের থেকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার পদ্ধতিটি আরও খারাপ, কারণ চল্লিশ বছর ধরে এই ক্ষতিপূরণ জমিদারদেরকে দেওয়ার ব্যবস্থা হয়েছে। তিনি দাবী করেন যে, জমিদারদেরকে শুধু যে ক্ষতিপূরণ দেওয়া উচিত তাই নয়, এই ক্ষতি পূরণের টাকা খুব দ্রুততার সাথে দেওয়া উচিত।[৬৭] সকল শ্রেণীর প্রতিই সরকারের নীতি ন্যায়সঙ্গত হওয়া দরকার এই যুক্তি দেখিয়ে এর পর তিনি বলেন যে সরকারের উচিত জমিদারী উচ্ছেদের পর জমিদারদেরকে পথে না বসিয়ে ‘পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা।[৬৮]
অকৃষি-প্রজাস্বত্ব (Non-agricultural Tenancy) IA পরিচ্ছেদের অন্তর্ভুক্ত করার জন্যে তিনি স্পেশাল কমিটি রিপোর্টের সমালোচনা করেন এবং বিলটিকে তিনি হয় আবার একটি সিলেক্ট কমিটিতে পাঠিয়ে অথবা নোতুনভাবে অন্য একটি বিল তৈরী করে তার থেকে অকৃষি প্রজাস্বত্বকে বাদ দেওয়ার প্রস্তাব করেন। ৬৯
পূর্ব বাঙলায় জমিদারদের তুলনায় জোতদারদের মধ্যে মুসলমানরা সম্প্রদায়গতভাবে শুধু যে সংখ্যায় অনেক বেশী ছিলো তাই নয়, তাঁদের জমির পরিমাণও ছিলো অনেক। উত্তর বাঙলার জোতদারদের ক্ষেত্রে একথা বিশেষভাবে প্রযোজ্য। এই জোতদারদের বিরুদ্ধে ১৯৪৬-৪৭-এর তে-ভাগা আন্দোলন পরিচালিত হয়েছিলো, এরাই ১৯৪৭ সালে মুসলিম লীগ পার্লামেন্টারী পার্টির সভায় বঙ্গীয় বর্গাদার নিয়ন্ত্রণ বিলকে বানচাল করে নিজেদের ভূমিস্বার্থ রক্ষা করেছিলো। ১৯৪৮ সালের এই জমিদারী ক্রয় ও প্রজাস্বত্ব বিলের মধ্যে এবং স্পেশাল কমিটির সুপারিশে জোতদারদের স্বার্থরক্ষার ষোলো আনা প্রচেষ্টা চালানো হয়। জমিদারী প্রথা উচ্ছেদ সত্ত্বেও সামন্ত ভূমিস্বার্থ রক্ষার ক্ষেত্রে কৃষক স্বার্থের বিরুদ্ধে মুসলিম লীগের এই চক্রান্ত সম্পর্কে পরিষদে অনেকেই বক্তৃতা করেন। কংগ্রেস দলের মুখপাত্র হিসেবে এই বিষয়ে ধীরেন দত্তের বক্তব্য উল্লেখযোগ্য:
আমরা যদি এই বিল-এর ৭ ধারার দিকে তাকাই তাহলেই যে কোন ব্যক্তি নিজের অধিকারে কি পরিমাণ জমি রাখতে পারবে সেটা দেখতে পাবো। এই বিলের উদ্দেশ্য অনুযায়ী অধিক পরিমাণ জমি কোন ব্যক্তির নিজের অধিকারে রাখা ঠিক নয়, কারণ গরীব জনগণ ও ভূমিহীনদের মধ্যে জমি বিতরণ করা দরকার। কিন্তু স্যার, জোতদারদের সম্পর্কে বলা হচ্ছে যে তাঁরা ১০০ বিঘা জমি অথবা মাথাপিছু ১০ স্ট্যান্ডার্ড বিঘা জমি যেটাই বেশী হয় সেই পরিমাণ জমি রাখতে পারবে। স্যার, আমার মতে এটা খুব বেশী। আমি মনে করি প্রত্যেক পরিবারে মাথাপিছু ৫ স্ট্যাণ্ডার্ড বিঘাই ন্যায়সঙ্গত পরিমাণ এবং ঊর্ধ্বতম যে পরিমাণ জমি রাখতে দেওয়া হবে তার পরিমাণ ১০০ বিঘার বেশী হওয়া উচিত নয়। যে পর্যন্ত না এটা করা হবে সে পর্যন্ত ২০ জনের একটি পরিবার ২০০ স্ট্যাণ্ডার্ড বিঘা জমি আইনতঃ রাখতে পারবে। এটা মোটেই সঙ্গত নয়। আমরা একটি শ্রেণীর প্রতি ন্যায় এবং অপর একটি শ্রেণীর প্রতি অন্যায় করতে পারি না। এক্ষেত্রে আমি জমিদারদেরকে বোঝাতে চাইছি যাদের সম্পত্তি বিনা ক্ষতি পূরণে নিয়ে নেওয়া হবে। জোতদারদের ক্ষেত্রে শুধু ১০০ বিঘা নয়, মাথাপিছু ১০ স্ট্যান্ডার্ড বিঘা হিসেবে ধরে ৩০ জনের পরিবারে ৩০০ বিঘা পর্যন্ত জমি রাখার সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে। স্যার, এজন্য আমি বলতে চাই যে, আমরা এক শ্রেণীর লোকের প্রতি অতিরিক্ত ন্যায় করছি, তাঁদের প্রতি খুব কোমল ব্যবহার করছি এবং অন্যদের প্রতি অতিরিক্ত রূঢ় ব্যবহার করছি। আমরা চীৎকার শুনতে পাই যে আমাদের মধ্যে অধিকাংশই হচ্ছে জোতদার এবং সেজন্য জনগণের স্বার্থকে জলাঞ্জলী দিয়ে আমরা জোতদারদের স্বার্থ রক্ষা করতে চাই। স্যার, আমি মনে করি এটা খুবই অন্যায় এবং কাউকেই ১০০ বিঘার বেশী জমি রাখতে দেওয়া উচিত নয়।[৭০]
কংগ্রেসের মধ্যে যে বড়ো বড়ো জোতদাররা ছিলো না, তা নয়। যাঁর সংশোধনী প্রস্তাবের পক্ষে ধীরেন দত্ত এই বক্তব্য পেশ করছিলেন সেই মনোরঞ্জন ধর ছিলেন ময়মনসিংহ-এর একজন জাঁদরেল জোতদার। ১৯৪৬-৪৭-এর তে-ভাগা আন্দোলনের সময় কৃষক স্বার্থের বিরোধিতা করে নিজেদের জোতদারী শ্রেণীস্বার্থ রক্ষার ক্ষেত্রে তিনি ঐ অঞ্চলের মুসলমান জোতদারদের সাথে জোট পাকিয়ে অনেক কৃতিত্ব অর্জন করেছিলেন। [৭১] কাজেই জোতদারদের স্বার্থ অনেকাংশে খর্ব করার জন্যে ধীরেন দত্ত এবং অন্যান্য কংগ্রেস সদস্যদের সুপারিশ অর্থ এই নয় যে, তাঁরা প্রকৃতপক্ষে জোতদারী স্বার্থ খর্ব করার পক্ষপাতী ছিলেন। তাঁরা ঐ সুপারিশ নিশ্চিন্তে করতে পেরেছিলেন তার কারণ তাঁরা জানতেন, মুসলিম লীগের মধ্যে জোতদারী স্বার্থের প্রভাব ভয়ানক প্রবল। কাজেই জোতদারী স্বার্থ যতখানি সম্ভব রক্ষা করার ক্ষেত্রে তাঁরাই সব থেকে বেশী সচেষ্ট থাকবে। এবং সে চেষ্টা তাঁরা করলে তার ফলে তাঁদের জোতদারী স্বার্থও রক্ষা পাবে। এসব কথা জেনেই জমিদারদের তুলনায় জোতদারদের শ্রেণীস্বার্থ রক্ষার ক্ষেত্রে মুসলিম লীগের বিশেষ উদ্বেগকে নগ্নভাবে তুলে ধরে তাঁদেরকে বিব্রত করার উদ্দেশ্যেই তাঁরা এটা করেছিলেন। এজন্যে শুধু ধীরেন দত্ত নয়, অন্যান্য কংগ্রেস সদস্যেরাও বিলের উপর বক্তৃতা করতে গিয়ে জোতদারদের প্রসঙ্গ এই একইভাবে উল্লেখ করেছিলেন।
১৬ই নভেম্বর ধীরেন দত্তের বক্তৃতার পর মুসলিম লীগ দলের হামিদউদ্দীন আহমদ তাঁর বক্তৃতায় অন্যান্য প্রসঙ্গের সাথে নানকারদের প্রসঙ্গ উত্থাপন করেন।[৭২] তিনি বলেন যে, জমিদাররা যে কোন সময়ে নানকারদের যে-কোন কাজে গোলামের মতো ব্যবহার করতে পারে এবং যে-কোন সময়ে তাঁদেরকে জমি থেকে উচ্ছেদ করতে পারে। তাঁদের জীবনের এই ভয়াবহ অবস্থা পরিবর্তনের জন্যে জমিতে তাঁদেরকে দখলীস্বত্ব দানের ব্যবস্থা IB পরিচ্ছেদে উল্লিখিত হয়েছে। কিন্তু মনোরঞ্জন ধর তাঁর সংশোধনী প্রস্তাবে নানকারদেরকে সেই সামান্য অধিকার দানের বিরোধিতা করেছেন এবং সেই প্রস্তাব ধীরেন দত্ত কর্তৃক সমর্থিত হয়েছে। যারা দরিদ্র জনগণের সপক্ষে এত বেশী কথা বলেন তাঁদের এই আচরণে হামিদুদ্দীন আহমদ বিস্ময় প্রকাশ করেন। এ প্রসঙ্গে তিনি মনোরঞ্জন ধরের সংশোধনী প্রস্তাবে সব রকম অকৃষি জমিকে বিলের অন্তর্ভুক্ত করার বিরোধিতার কথাও উল্লেখ করেন। ১৫ই নভেম্বর মুকুন্দবিহারী মল্লিকের বক্তৃতায় ৩ বলা হয়েছিলো যে, জমিদাররা যেখানে মাসিক বিশ টাকা বেতনের কর্মচারী দিয়ে জমিদারী রক্ষণাবেক্ষণ করতেন তার জায়গায় জমিদারী উচ্ছেদের পর সরকারকে সেই কাজের জন্য পাঁচশত টাকা মাইনের কর্মচারী রাখতে হবে এবং সেটা সরকারের পক্ষে একটা বোঝাস্বরূপ হয়ে দাঁড়াবে। এই বক্তব্যের উল্লেখ করে হামিদউদ্দীন বলেন যে, জমিদারের ঐ মাসিক বিশ টাকা মাইনের কর্মচারীরা তাঁদের পরিবারের জন্যে প্রতিদিন বিশ টাকা ব্যয় করে এবং দরিদ্র কৃষকদের রক্ত শোষণ করে মাসের বাকী দিনের খরচ চালায়।[৭৪]
অমূল্যচন্দ্র অধিকারী বিলের কয়েকটি গুরুতর ত্রুটির দিকে পরিষদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন যে, চা, চিনি, ইক্ষু ও তুলা ইত্যাদির চাষ অথবা অন্য কোন বৃহৎ শিল্পের ক্ষেত্রে পরিবারের মাথা পিছু ১০ বিঘা অথবা ১০০ বিঘার বেশী জমি রাখা চলবে। কিন্তু সেই ধরনের কোন ব্যতিক্রমের ব্যবস্থা বৃহদাকার সমবায় সমিতি, যৌথ খামার অথবা যান্ত্রিক পদ্ধতিতে চাষের জন্যে রাখা হয়নি। তিনি বলেন যে, এই ব্যবস্থা না থাকায় জমিদারী উচ্ছেদের মূল উদ্দেশ্য কৃষি উন্নতির অনেকখানি ব্যহত হবে।[৭৫]
নন-নেগোশিয়েবল বন্ডের মাধ্যমে জমিদারদেরকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার ব্যবস্থাকে তিনি সম্পত্তিচ্যুত সংখ্যালঘু জমিদারদের অর্থ আটক রাখার একটা কৌশল বলে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন যে, অধিক পরিমাণ জমির মালিক এবং মধ্যবিত্ত শ্রেণীর অধিকাংশই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ভুক্ত। এই আইন কার্যে পরিণত হলে পূর্ব পাকিস্তানে থাকার জন্যে কোন উৎসাহ তাঁদের থাকবে না এবং এর ফলে তাঁরা দলে দলে পশ্চিম বাংলায় চলে যাবে।[৭৬]
বর্গাদারদের সম্পর্কে তিনি বলেন যে, তাঁদেরকে কৃষি শ্রমিক হিসেবেই ধরা হয়েছে এবং তাঁদেরকে কোন অধিকার দানের কথা বিলের মধ্যে নেই। বর্গাদারী নিয়ন্ত্রণের কোন ব্যবস্থাও এতে নেই। এর ফলে যে সমস্ত জোতদাররা খাসে জমি রাখবে তাঁরা বর্গাদারদের ওপর যথেচ্ছ অত্যাচার করার সব রকম সুযোগ-সুবিধা পাবে।[৭৭]
প্রভাসচন্দ্র লাহিড়ী স্পেশাল কমিটিতে আলোচনার ধারা সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলেন:
আমরা যখন স্পেশাল কমিটিতে এই বিল নিয়ে আলোচনা করি তখন আলোচনাকালে কোন দলগত আলোচনা হয়নি, প্রত্যেকেই আমরা ব্যক্তিগতভাবে আলোচনা করেছিলাম। তার ফলে অনেক সময় এমন দেখা গিয়েছে যে, আমাদের দিকের লোক এবং মুসলিম লীগের লোক কোন কোন ব্যাপারে একমত হয়েছেন, আবার এমন হয়েছে যে, আমাদের লোক আমাদের বিরুদ্ধে মত প্রকাশ করেছেন।[৭৮]
মুসলিম লীগ এবং কংগ্রেস দুই দলের মধ্যেই জমিদার জোতদার শ্রেণীর সমাবেশ এবং স্পেশাল কমিটিতে প্রধানতঃ এই দুই শ্রেণীর প্রতিনিধিত্বের জন্যেই যে এই ব্যক্তিগত ভূমিকা এবং ভ্রাতৃত্বমূলক মনোভাব সম্ভব হয়েছিলো সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই।
IA পরিচ্ছেদ সম্পর্কে প্রভাস লাহিড়ী বলেন যে, এতে জমিদার এবং জোতদারদের মধ্যে একটা পার্থক্য করা হয়েছে। সরকার ইচ্ছে করলে জমিদার, যাদের রেকর্ড অব রাইটস তৈরী আছে, তাঁদের জমিজমা নিয়ে যাবেন কিন্তু তাঁদের অধীনস্থ তালুকদার জোতদারদের জমি নেবেন না। কারণ তাঁরা বলবে তাঁদের কাগজপত্র তৈরী নেই। এইভাবে তাঁরা আরও কিছুকাল পর্যন্ত জমির অধিকার ভোগ করবে। জোতদারদেরকে এই বিশেষ সুবিধাদানের জন্যেই উপরোক্ত পরিচ্ছেদ নোতুনভাবে যোগ দেওয়া হয়েছে বলে তিনি সরকারের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন।[৭৯]
খাজনার হার সম্পর্কে বলতে গিয়ে তিনি বলেন যে, বিলে খাজনা কমানোর কোন কথা নেই। উপরন্তু আছে যে, রেভিনিউ অফিসার ইচ্ছে করলে খাজনা বৃদ্ধি করতে পারবেন। রেভিনিউ অফিসারকে এই ক্ষমতা দানের ফলে প্রজাদের স্বার্থ কতখানি রক্ষা হবে সে বিষয়ে প্রভাস লাহিড়ী ঘোরতর সন্দেহ প্রকাশ করেন।[৮০]
জমিদারী উচ্ছেদের পর জমিদারদের অর্থনৈতিক অবস্থা সম্পর্কে তিনি বলেন যে, মূল বিলটি পেশ করার সময় অর্থমন্ত্রী হামিদুল হক চৌধুরী বলেছিলেন যে, জমিদারদেরকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার কারণ তাঁদের পুনর্বাসনে সাহায্য করা। কিন্তু যে পরিমাণ ক্ষতিপূরণ জমিদারদেরকে দেওয়া হচ্ছে এবং যেভাবে দেওয়া হচ্ছে তাতে তাঁদের পুনর্বাসন সম্ভব নয়। এরপর ক্ষতিপূরণের ব্যাপারকে ভাঁওতাবাজী আখ্যা দিয়ে তিনি “জনগণের পক্ষ থেকে” বিনা খেসারতে জমিদারী প্রথা উচ্ছেদের দাবী উত্থাপন করেন। [৮১] জমিদারদের জন্যে যথেষ্ট এবং উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ চেয়ে এবং স্টার্লিং, বুলিয়ন ইত্যাদিতে সেই ক্ষতিপূরণ দানের দাবী জানিয়ে যাঁরা পরিষদ কক্ষে ঝড় তুলেছিলেন তাঁদের দলভুক্ত প্রভাস লাহিড়ীর এই বিনা খেসারতে জমিদারী উচ্ছেদের দাবী নিতান্তই একটা বিদ্বেষপ্রসূত চীৎকার ব্যতীত অন্য কিছুই ছিলো না।
সুরেশচন্দ্র দাসগুপ্ত মনোরঞ্জন ধরের সংশোধনী প্রস্তাবের সমর্থনে বক্তৃতা প্রসঙ্গে বলেন যে, আলোচ্য বিলে জমিদারী প্রথা উচ্ছেদের যে ব্যবস্থা হয়েছে তাতে কায়েমী স্বার্থ থেকেই যাবে। এই কায়েমী স্বার্থ হচ্ছে জোতদারী।[৮২] প্রভাস লাহিড়ীর মতো ভাব ধারণ করে তিনিও এই বলে তাঁর বক্তৃতা শেষ করেন:
জমিদারদের জমি যখন নিচ্ছেন তখন জোতদারদের এবং অন্যান্য সকলের জমি একেবারে নিয়ে নিন। আইনের নতুন ২টি Chapter তুলে দিন। আপনার Revolution করবার বয়স আছে। If you are really a revolutionary, then bring such legislation as will aim at nationalisation of all lands.
মনোরঞ্জন ধর ১৭ই নভেম্বর নিজের সংশোধনী প্রস্তাবের ওপর বক্তৃতা প্রসঙ্গে অনেক বিষয়ের উল্লেখ করেন। মুসলিম লীগ সদস্যদেরকে লক্ষ্য করে তিনি দুঃখের সাথে বলেন যে, তাঁদের সকলেরই একটা প্রবণতা হচ্ছে জমিদারদেরকে আক্রমণ করা। কিন্তু কথা হলো এই যে, প্রথা জমিদাররা সৃষ্টি করেননি। তিনি ভোটার তালিকা থেকে গৃহীত তথ্যের ভিত্তিতে বলেন যে, সারা বাঙলায় জমিদারদের সংখ্যা হচ্ছে ১৯৫০ মাত্র। পূর্ব বাঙলায় তাঁদের সংখ্যা আরও অনেক কম। তিনি বলেন যে, এই সামান্য সংখ্যক জমিদারদের বিরুদ্ধে কেন এই আক্রমণ চালানো হচ্ছে তার কারণ তিনি জানেন না।[৮৪]
জমিদার শ্রেণীভুক্ত লোকদের সংখ্যাল্পতার উল্লেখ করে শোষক শ্রেণী হিসেবে তাঁদের গুরুত্বকে খর্ব করার এই কংগ্রেসী প্রচেষ্টার সাথে মুসলিম লীগের মন্ত্রী আবদুল হামিদ কর্তৃক জমিদারদেরকে “সংখ্যালঘু” হিসেবে বর্ণনা করে সংখ্যাগুরু কৃষকদের হাত থেকে তাদেরকে রক্ষা করার জন্যে পরিষদের কাছে উদাত্ত আহ্বানের[৮৫] স্বার্থগত ঐক্য এক্ষেত্রে সহজেই লক্ষণীয়। এই স্বার্থগত ঐক্যের কারণেই যে স্পেশাল কমিটির আলোচনায় তাঁরা অনেকেই দলগত ভূমিকা পরিত্যাগ করে “ব্যক্তিগতভাবে” অংশগ্রহণ করেছিলেন সে বিষয়েও কোন সন্দেহ নেই।
মনোরঞ্জন ধর এর পর বলেন যে, চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত যুগ যুগ ধরে এদেশে আরও এত রকম কুপ্রথা ও ব্যবস্থা সৃষ্টি করেছে যেগুলির অবসান ব্যতীত শুধুমাত্র জমিদারী প্রথার অবসান অবস্থার কোন উন্নতি সাধন করতে পারে না। শুধু একজন শীতাংসুকুমার আচার্য অথবা ব্রজেন্দ্রকিশোর চৌধুরীর জমিদারী কেড়ে নিলেই এই অবস্থার অবসান ঘটবে না। সেজন্যে এই সমস্ত কুপ্রথা ও ব্যবস্থাগুলির প্রতি অধিকতর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে উপযুক্ত ভূমি সংস্কারের জন্যে পরিষদের কাছে তিনি আবেদন জানান। [৮৬]
মুসলিম লীগ সরকারের জোতদারপ্রীতি সম্পর্কে তিনি তাঁর এই পরিষদ বক্তৃতায় যা বলেন সেটা উল্লেখযোগ্য:
স্যার, আমি জানি যে অবিভক্ত বাঙলায় বর্গাদার সাময়িক নিয়ন্ত্রণ বিল প্রায় আইনে পরিণত হতে যাচ্ছিলো।[৮৭] ঐ একই পার্টি এখানেও ক্ষমতায় এসেছে। কিন্তু সেই পার্টি, যাদের আন্তরিকতা সম্পর্কে আমার বন্ধু শরফুদ্দীন আহমদ এতো ওকালতি করেছেন, তারা রহস্যজনকভাবে সেই প্রস্তাবিত আইনকে হঠাৎ বাদ দিয়ে দিলো। বর্গাদারদের সম্পর্কে তাঁরা সম্পূর্ণ নিশ্চুপ। শুধু তাই নয়, আমার বলতে লজ্জা হচ্ছে যে, সংখ্যাগুরু সদস্যেরা স্পেশাল কমিটির রিপোর্টে বলেছেন কৃষির বর্তমান অবস্থায় অথবা এরই মতো কোন অবস্থায় বর্গাদারী প্রথা যথেষ্ট উপকারী। এই ধরনের কোন নিন্দনীয় বক্তব্যের চিন্তা আমি করতে পারি না এবং আমি আমার সম্মানীয় বন্ধু শরফুদ্দীন আহমদকে বলবো সেই ধারাটি বিবেচনা করে তিনি যেন আমাদেরকে জানান বর্গাদারদের ভাগ্যোন্নতির উদ্দেশ্যে যে আইন প্রস্তাব করা হয়েছিলো সেটা তাঁরা বাদ দিলেন কেন? তার আন্তরিকতা এর দ্বারাই যাচাই হবে তিনি এ ব্যাপারে একটি বিবৃতি দিন। [৮৮]
সংশোধনী প্রস্তাবের ওপর শরফুদ্দীন আহমদের পূর্ববর্তী বক্তৃতার[৮৯] উল্লেখ করে এইভাবে মনোরঞ্জন ধর জোতদার শ্রেণীর প্রতি মুসলিম লীগ সরকারের পক্ষপাতিত্বের ব্যাপারটির প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।
জমিদারীর ক্ষতিপূরণ সম্পর্কে বলতে গিয়ে তিনি বলেন যে, অনেক জায়গায় ক্ষতিপূরণের অর্থ আংশিকভাবে নগদ টাকায় দেওয়া হয়েছে। এখানেও সরকারের উচিত তাই করা। যে সমস্ত জমিদাররা পূর্ব বাঙলা থেকে চলে যাচ্ছে তাঁরাও রাষ্ট্রের নাগরিক এবং তাঁরাও নিজেদের আয়ের একটা ব্যবস্থা দাবী করতে পারে।[৯০]
এই পর্যায়ে হাবিবুল্লাহ বাহার মনোরঞ্জন ধরের বক্তৃতায় বাধা দিয়ে বলেন, ‘থলির বেড়াল এবার বেরিয়ে পড়েছে।’
এর পর মনোরঞ্জন ধর বলেন, জমিদাররা সন্তুষ্ট না হলে তাঁরা দেশের পক্ষে একটা বোঝা হয়ে দাঁড়াবে। তাছাড়া জমিদারীর অধীনে এখন যে সমস্ত কর্মচারীরা আছে জমিদারী উচ্ছেদের ফলে তাঁরা কর্মহীন হয়ে পড়বে। এমনিতেই দেশে বেকার যুবকের সংখ্যা অনেক। তার ওপর এইভাবে বেকারত্ব সৃষ্টি হলে দেশের সমস্যা বাড়বে, কমবে না। কিন্তু জমিদারদেরকে যদি উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয় তাহলে সেই মূলধন দিয়ে তাঁরা কলকারখানা প্রতিষ্ঠা করবে এবং তার ফলে কর্মসংস্থানও বৃদ্ধি পাবে। কেউ কেউ বলেছেন যে, ক্ষতিপূরণের পয়সা নিয়ে জমিদাররা ভারতে চলে যাবে। মনোরঞ্জন ধর এই সমালোচকদের সম্বন্ধে বলেন যে, সরকারী দলের অনেকেই প্রতিমাসে কলকাতায় যান এবং সেখানে তাঁদের ব্যাংক ব্যালেন্সও আছে। কিন্তু এসব করলে তাঁরা নিজেরা পাকিস্তানবিরোধী হন না।[৯১]
এর পর অবলাকান্ত গুপ্ত জমিদারী উচ্ছেদের জন্যে আনীত বিলটিকে বাতিল করার জন্যে নিম্নলিখিত যুক্তি দেন :
এই State Acquisition বিলটা যাতে অবিলম্বে আইনে পরিণত না হয়, তারই চেষ্টা করবার জন্য আমি এখানে দাঁড়িয়েছি। আমার মতটা আমি পরিষ্কার করে বলি। বর্তমান পরিস্থিতিতে আমি এই Reactionary প্রতিক্রিয়াশীল, Corrupted এবং জনসাধারণের আস্থাহীন গভর্নমেন্টের হাতে আর অধিক ক্ষমতা দিতে কিছুতেই রাজী নই। যে ক্ষমতা দেওয়া হয়েছিলো সে ক্ষমতার অপব্যবহার করা হয়েছে। আরও যদি বেশী ক্ষমতা এদের হাতে দেওয়া যায় তাহলে সেটা গণতন্ত্রের নীতিবিরুদ্ধ হবে।[৯২]
একথা সত্য যে, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার মাত্র দুই বৎসরের মধ্যে মুসলিম লীগ সরকার ব্যাপকভাবে জনগণের আস্থা হারিয়েছিলো। ১৯৪৯-এর জুন মাসে টাঙ্গাইল উপনির্বাচনে তাঁদের শোচনীয় পরাজয়ই সেটা অনেকাংশে প্রমাণ করেছিলো। মুসলিম লীগ সরকার যে প্রতিক্রিয়াশীল সরকার তাতেও বিন্দুমাত্র সন্দেহ ছিলো না। এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ব্যাপার হলো, সেই প্রতিক্রিয়াশীল সরকারের হাতে আরও বেশী ক্ষমতা না দেওয়ার প্রথাকে টিকিয়ে রাখার জন্যে কিভাবে সর্বমুখী প্রচেষ্টা চালিয়েছিলো অবলাকান্ত গুপ্তের এই বক্তব্য তারই একটি উৎকৃষ্ট উদাহরণ।
পূর্ব বাঙলা ব্যবস্থা পরিষদে কংগ্রেস লীগ বহির্ভূত বিরোধী দলীয় যে কয়জন সদস্য জমিদারী প্রথার বিরুদ্ধে এবং কৃষক স্বার্থের সপক্ষে সব থেকে জোরালোভাবে নিজেদের বক্তব্য প্রকাশ করেন তাঁদের মধ্যে খয়রাত হোসেন ছিলেন অন্যতম প্রধান। স্পেশাল কমিটির সুপারিশ সম্পর্কে মতামত দিতে গিয়ে তিনি বলেন:
Special Committee তাঁদের কাজ করেছেন। জোতদারদের দুশো বিঘা জমি দেওয়ার কথা ছিলো সেখানে একশ বিঘা দেওয়ার জন্য সুপারিশ করেছেন। Compensation ১৫ গুণ থেকে ১০ গুণ করেছেন। Special Committee-র ৪৫ জন সদস্য যদি ক্ষতিপূরণের হার ১৫ গুণ থেকে ১০ গুণ করতে পারে আমরা এই House-এর ১৭১ জন সদস্য কেন সেই হার আরও কমাতে পারব না? আমাদের উচিত ক্ষতিপূরণ না দেওয়া। আমার বন্ধু টি আলী সাহেব ১৯৪৭৯৩ সনের এপ্রিল মাসে নরসিংদীতে বলেছিলেন যে বিনা ক্ষতিপূরণে জমিদারী উঠিয়ে দেওয়া উচিত। তাঁর একথা বলার অনেকদিন পরে এ বিল এসেছে। তিনি চেষ্টা করলে কখনো ক্ষতিপূরণ না দিতে পারেন। [৯৪]
এর পর বর্গাদারদের ভূমিস্বত্ব সম্পর্কে বলতে গিয়ে খয়রাত হোসেন জোতদার শ্রেণী কর্তৃক জমিদার শ্রেণীর উত্তরাধিকারীতে পরিণত হওয়ার সম্ভাবনা সম্পর্কে নিম্নলিখিত বক্তব্য প্রদান করেন:
আর আমি প্রস্তাব করি যে বর্গাদারদের জমির উপর স্বত্ব দেওয়া হউক। জোতদার বন্ধুদের হাতে গরীব বর্গাদার কি রকম হয়রান হয় তা আপনারা সকলেই জানেন। শরীকের নাম দিয়ে জোতদাররা বহু বিঘা জমি নিতে পারেন। বর্তমানে যেভাবে নজর সেলামী প্রভৃতি আদায় করেন এই আইন হইলেও তাঁরা তা করতে পারেন। কাজেই আমি প্রস্তাব করি যে বর্গাদারদের অধিকার দেওয়া হউক এবং বিনা অপরাধে কোন দিন কোন জোতদার কোন বর্গাদারকে উচ্ছেদ করতে পারবে না। যদি উচ্ছেদ করতে হয় তাহলে Civil court-এ প্রমাণ দিয়ে উচ্ছেদ করতে হবে। বর্গাদারদের যদি জমিতে অধিকার দেওয়া না হয় তাহলে আর একটা বড়ো রকমের জমিদার শ্রেণী শিকড় গেড়ে বসবে। আর আমি বলি যে বর্তমানে যে Compensation-এর হার দেওয়া হয়েছে সেটা উঠিয়ে দেওয়া হউক। প্রয়োজনের চেয়ে যদি বেশী Compensation দেওয়া হয় তাহলে আমি বলবো যে আমাদের দেশ থেকে যে ইংরেজ চলে গেছে তাঁদেরও Compensation দেওয়া হউক।[৯৫]
পূর্ব বাঙলা পরিষদে কংগ্রেস দলের নেতা বসন্তকুমার দাস তাঁর দলের পক্ষ থেকে আনীত সংশোধনী প্রস্তাবসমূহের ওপর আলোচনা করতে গিয়ে জমিদারদের ক্ষতিপূরণ, কোন কোন জমিদারী দ্রুত দখল, মূল বিলের ২ ধারা বাতিল করে অকৃষি জমিকে বিলের আওতাভুক্ত করা, মুসলিম লীগের জোতদারী স্বার্থের প্রতি বিশেষ সুদৃষ্টি ইত্যাদি সম্পর্কে তাঁর দলভুক্ত পূর্ববর্তী বক্তাদের বক্তব্যেরই পুনরুক্তি করেন। এ প্রসঙ্গে জমিদার শ্রেণীর প্রতি সরকারী দল মুসলিম লীগের মনোভাব সম্পর্কে তিনি পরিষদকে বলেন:
স্যার, আমি মনে করেছিলাম যে এই বিতর্ক চলাকালে আমরা পক্ষপাতহীনভাবে এবং প্রতিহিংসাপরায়ণ না হয়ে অগ্রসর হবো। কিন্তু আমাদের বিরোধী পক্ষের সদস্যদের প্রদত্ত বক্তৃতাগুলির ক্ষেত্রে আমি দুঃখের সাথে লক্ষ্য করেছি যে আবেগ, কুসংস্কার এবং যুক্তির প্রতি বেপরোয়াভাব থেকেই ঐ ধরনের বক্তৃতার প্রেরণা এসেছে এবং IA পরিচ্ছেদটি ঢোকানোর পেছনে একমাত্র কারণ হচ্ছে একটি বিশেষ শ্রেণীকে অর্থাৎ বৃহৎ জমিদার শ্রেণীকে খতম করার ব্যবস্থা। আমি জমিদারদের জন্য ওকালতি করছি না, কিন্তু তবু আমি বলবো যে, ঐ ঐ ধরনের ঢালাওভাবে এইসব জমিদারদেরকে অত্যাচারী এবং রক্তশোষক হিসেবে বর্ণনা করতে গিয়ে সব রকম সীমা লংঘন এবং সত্যকার ঘটনা বিকৃত করা হচ্ছে। সত্য কথা বলতে, স্যার, জমিদারী প্রথার মধ্যে সব কিছুই খারাপ ছিলো না। এর ভালো দিকও ছিলো। তাছাড়া, স্যার, জমিদাররাও আর জমিদারী রাখতে খুব উদ্বিগ্ন নয়। যুগের ধারা সম্পর্কে তাঁরাও যে অবহিত নন তা নয়, এবং তাঁরা নিজেরাই বলছেন যে তাঁরা যেতে চান। কিন্তু
তাঁরা বলেন যে, “আপনারা যদি আমাদেরকে উচ্ছেদ করতে চান, আমাদেরকে ভদ্রভাবে উচ্ছেদ করুন।” সেটাই তাঁদের প্রার্থনা। স্যার, আপনি মাননীয় শ্রী শীতাংশু কুমার আচার্যের বক্তৃতা শুনেছেন। তিনি কি বলেন নি যে, আমরা জানি যে আমাদের অস্তিত্ব আর অভিপ্রেত নয়, এবং আমরাও উচ্ছেদ হয়ে যেতে উদ্বিগ্ন। কিন্তু আমাদের সাথে ন্যায়ানুগ আচরণ করুন। আমাদের সাথে এই ধরনের অপরিচ্ছন্ন ও তাচ্ছিল্যপূর্ণ আচরণ করবেন না।”[৯৬]
এর পর বসন্ত দাস মন্ত্রী তফজ্জল আলীর বক্তৃতা উল্লেখ করে বলেন যে, সরকারীভাবে দাবী করা হচ্ছে যে আলোচ্য বিলটি এদেশে বিপ্লব সৃষ্টি করবে। তিনি বলেন যে, বিলটি যে বিপ্লব সৃষ্টি করবে তার পরিণামে এই দেশ পরিণত হবে একটি ভিক্ষুকের দেশে এবং সে সময় তাঁদেরকে ভিক্ষে দেওয়ার কেউ থাকবে না।[৯৭] এমনভাবে কংগ্রেস দলের নেতা তাঁর এই বক্তব্য হাজির করেন যার থেকে মনে হয় যে ভিক্ষুকরা যাতে ভিক্ষে পায় তার সুব্যবস্থা করার জন্যেই জমিদারদের স্বার্থের প্রতি সরকারের সদয় হওয়া দরকার।
বক্তৃতা শেষ করার পূর্বে বৃহৎ জমিদার ও জোতদারদের সম্পর্কে তিনি যা বলেন তা উল্লেখযোগ্য:
স্যার, অতীতে জমিদাররা হয়তো অনেক দুষ্কৃতি করেছে। জমিদাররা অত্যাচারী ছিলো, জমিদাররা রক্তশোষক ছিলো। কিন্তু আমি খুব বেশী ভুল করবো না যদি আমি বলি যে তাঁরা এখন আর অত্যাচারী ও রক্তশোষক নয়। যদি আমরা নিরপেক্ষভাবে বিবেচনা করি তাহলে দেখবো আজকাল এই রক্তশোষকরা হলো আরও নীচু পর্যায়ের অর্থাৎ তাঁরা হলো বৃহৎ জোতদার ও বৃহৎ ভূমিস্বত্বাধিকারী শ্রেণী যাদের বিরুদ্ধে ঐ ধরনের অভিযোগ শোনা যায়। আমি এ ব্যাপারে আর কথা বাড়াতে চাই না। আমি শুধু একথাই বলবো যে আপনারা যদি বৃহৎ জমিদারদেরকে শাস্তি দিতে চান তাহলে আরও অনেকে আছে যাদেরকে রক্তশোষক এবং অত্যাচারী আখ্যা দেওয়া যায় এবং যারা শান্তি পাওয়ার যোগ্য।[৯৮]
কংগ্রেস দলের নেতা বসন্ত কুমার দাস পূর্ব বাঙলার বৃহৎ জমিদারদের বিরুদ্ধে অন্যায় আক্রমণের প্রতিবাদ করে এইভাবে বক্তৃতা শেষ করার পর সর্বশেষ বক্তৃতা করেন রাজস্বমন্ত্রী তফজ্জল আলী। ১৫ই নভেম্বর স্পেশাল কমিটির সুপারিশ পরিষদে পেশ করার পর থেকে কংগ্রেস দলের সংশোধনী প্রস্তাবের ভিত্তিতে কয়েকদিন যে বিতর্ক অনুষ্ঠিত হয় ২১শে নভেম্বরের এই বক্তৃতায় তিনি তার জবাব দেন। অকৃষি জমি সরকারী দখলে নিয়ে আসার জন্যে স্পেশাল কমিটি যে সুপারিশ করে সে সম্পর্কে তফজ্জল আলী বলেন যে, মূল বিলটিতেও অকৃষি জমি বিলের আওতাবহির্ভূত ছিলো না। হাট বাজার ইত্যাদি কয়েক শ্রেণীর অকৃষি জমি মূল বিলের আওতার মধ্যে পড়েছিলো। কাজেই স্পেশাল কমিটি নোতুন একটা কিছু করেনি। তাঁরা শুধু অন্যান্য শ্রেণীর অকৃষি জমিকেও বিলের আওতাভুক্ত করার জন্যে সুপারিশ করেছে মাত্র।[৯৯]
IA পরিচ্ছেদে কতকগুলি বৃহৎ জমিদারী রেকর্ড অব রাইটস তৈরীর পূর্বেই দখলের সুপারিশ সম্পর্কে তিনি বলেন যে, স্পেশাল কমিটি সেটেলমেন্ট সংক্রান্ত যে কোন ব্যবস্থা রদবদল করার অধিকারী। কাজেই সে দিক দিয়ে বিবেচনা করলে পরিচ্ছেদটি মূল বিলের আওতার বাইরে যায়নি।[১০০]
জমিদারী উচ্ছেদ বিলটি সাম্প্রদায়িক বিবেচনাপ্রসূত, বিরোধীদলের এই অভিযোগ অস্বীকার করে তফজ্জল আলী বলেন যে, আলোচ্য বিলটি তাঁরা আকস্মিকভাবে পূর্ব বাঙলা পরিষদে পেশ করেননি। দশ-বারো বৎসর ধরে এ ব্যাপারে নানান চিন্তা ভাবনা করা হয়েছে, ফ্লাউড কমিশনের মতো কমিশন বসানো হয়েছে, এর জন্যে অবিভক্ত বাঙলার মুসলিম লীগ মন্ত্রীসভা ১৯৪৭-এর ৭ই এপ্রিল একটি বিল পূর্বেই তৎকালীন বাঙলার নিম্ন পরিষদে পেশ করেছিলেন। খাজা নাজিমুদ্দীনের পরিবারের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন যে, এই আইনের দ্বারা পূর্ব বাঙলার একটি মহা প্রতিপত্তিশালী মুসলমান পরিবারও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।[১০১]
মুসলিম লীগ সরকার বিলটিতে জোতদারদের স্বার্থ রক্ষার ব্যবস্থা করেছেন এই অভিযোগের জবাবে রাজস্বমন্ত্রী বলেন যে, নির্ধারিত পরিমাণ অর্থাৎ পরিবার প্রতি ১০০ বিঘা জমি বাদ দিয়ে খাস জমি সরকারী দখলে আনার যে ব্যবস্থা করা হয়েছে তার দ্বারা জোতদাররাও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কাজেই সরকার জোতদারদের স্বার্থ রক্ষার চেষ্টা করছেন সে কথা সত্য নয়।[১০২] এখানে লক্ষণীয় এই যে, জোতদারী স্বার্থ সম্পর্কে এই বক্তব্য উপস্থিত করার সময় মন্ত্রী বর্গাদারী সম্পর্কিত অংশটি মূল বিল থেকে কেন বাদ দিলেন সে বিষয়ে কিছু উল্লেখ করা থেকে বিরত থাকেন।
IA পরিচ্ছেদের অংশ আইনে পরিণত হলে সরকার কোর্ট অব ওয়ার্ডস এর সম্পত্তিও নিজের দখলে নিয়ে আসতে পারবেন বলে তফজ্জল আলী উল্লেখ করেন।[১০৩] জমিদারী প্রথা উচ্ছেদের পর জমিদারদের কর্মচারীদের কর্মসংস্থান সম্পর্কে আশালতা সেনের উদ্বেগের উল্লেখ করে তফজ্জল আলী বলেন যে, জমিদারদের যে সমস্ত কর্মচারীদেরকে সরকার যোগ্য মনে করবেন তাঁদের কর্মসংস্থান ও পুনর্বহালের ব্যাপারে সরকার উপযুক্ত ব্যবস্থা নেবেন। ১০৪ সরকার কর্তৃক অকৃষি জমি নিজের কর্তৃত্বাধীনে নিয়ে আসার প্রসঙ্গ তুলে চা বাগানগুলিকে নোতুন কোন অধিকারপ্রাপ্ত শ্রমিকদের হাত থেকে রক্ষার জন্যে পূর্ণেন্দু কিশোর সেনগুপ্তের বক্তব্যকে “সাহায্যমূলক” সমালোচনা হিসেবে বর্ণনা করে মন্ত্রী বলেন যে, চা-বাগানগুলিকে অকৃষি প্রজাস্বত্ব আইনের আওতাভুক্ত রাখার জন্যে সরকার বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন।[১০৫] বিলটি কৃষি সংস্কারের ক্ষেত্রে তেমন কোনই অগ্রগতি সাধন করবে না বলে যারা তার সমালোচনা করছেন তাঁদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন যে, বিলটিতে যে প্রস্তাব করা হয়েছে তার থেকে বেশী বিপ্লবী কিছু করতে গেলে দেশে একটা বিরাট আলোড়ন সৃষ্টি না করে সেটা সম্ভব হবে না। এ জন্যেই যে প্রস্তাব তাঁরা পরিষদে এনেছেন সেটি আইনে পরিণত হলে সেটাই হবে এদেশে ভবিষ্যৎ কৃষি সংস্কারের ভিত্তি।[১০৬]
কৃষি জমি টুকরো টুকরো হয়ে যাওয়ার প্রক্রিয়া বন্ধ করে জমি একত্রীকরণের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে সবুর খান এবং অন্যান্য কয়েকজনের বক্তৃতা প্রসঙ্গে তফজ্জল আলী বলেন যে, সেই প্রয়োজনীয়তা তিনি অন্যদের থেকে কিছু কম বোধ করেন না। মূল বিলের ৮৮ ধারাতে তা কার্যকর করার প্রস্তাবও করা হয়েছিলো, কিন্তু স্পেশাল কমিটি একমত হয়ে উক্ত ধারাটিকে বাতিল করে দেওয়ার ফলে সে ক্ষেত্রে কোন বাস্তব পদক্ষেপ নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। এ প্রসেঙ্গ তিনি হিন্দু ও মুসলমান উত্তরাধিকার আইনেরও উল্লেখ করেন। [১০৭]
এর পর জমিদারীর ক্ষতিপূরণ সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে তফজ্জল আলী বলেন যে, ক্ষতিপূরণ দানের বিরুদ্ধে পরিষদে যারা বক্তব্য পেশ করেছেন তাঁরা বলেছেন লর্ড কর্নওয়ালিসের থেকে বিনামূল্যে যারা জমিদারী পেয়েছিলো তাঁদেরকেই আবার ক্ষতিপূরণ দানের ব্যবস্থা হচ্ছে। মন্ত্রীর মতে কর্নওয়ালিসের থেকে ১৭৯৩ সালে যারা জমিদারী লাভ করেছিলেন সে রকম পরিবারের সংখ্যা পূর্ব বাঙলায় ছয়টির বেশী নয়। অন্য জমিদারেরা নিজেদের পকেট থেকে পয়সা খরচ করেই জমিদারী কিনেছিলেন। কাজেই তাঁদেরকে ক্ষতিপূরণ দানের ব্যাপারে কোন প্রশ্নই উঠতে পারে না।[১০৮]
খয়রাত হোসেন তফজ্জল আলীর নরসিংদী বক্তৃতা সম্পর্কে যে মন্তব্য করেছিলেন তার জবাবে মন্ত্রীর উক্তি খুবই উল্লেখযোগ্য। তিনি বলেন:
জনাব খয়রাত হোসেন নরসিংদীর একটি জনসভার যে বর্ণনা দিয়েছেন সেটা তিনি কোন্ সূত্রে লাভ করেছেন আমি জানি না। উক্ত জনসভায় বিনা ক্ষতিপূরণে জমিদারী নিয়ে নেওয়ার দাবী সমর্থন করে আমি বক্তৃতা করেছিলাম বলে তিনি যা বলেছেন তা হলো সম্পূর্ণ মিথ্যা। আমি বলছি এবং একথা আমি বাড়ীর ছাদে দাঁড়িয়ে চীৎকার করে বলার যোগ্যতা রাখি যে, রাজনৈতিক কাজকর্মের কোন পর্যায়েই আমি একথা বলিনি যে, জমিদারী অথবা কোন রকম খাজনা-আদায়ী স্বত্ব ক্ষতিপূরণ ব্যতীত উচ্ছেদ করা উচিত। জীবনে কোন সময়ে আমি বিনা ক্ষতিপূরণে জমিদারী তুলে দেওয়ার কথা বলেছি এই মর্মে কোন সংবাদপত্রের উল্লেখ করার জন্যে আমি আমার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষদের আহ্বান জানাচ্ছি। স্যার, জমিদারদেরকে ক্ষতিপূরণ না দেওয়াটা হবে একটি ভ্রান্ত নীতি।[১০৯]
এ ব্যাপারে তফজ্জল আলীর বক্তব্যই খুব সম্ভবতঃ সঠিক। কারণ ভূসম্পত্তির মালিক এই ধরনের ব্যক্তিরা বিনা ক্ষতিপূরণে জমিদারী উচ্ছেদের কথা কোন সময়েই বলবেন সেটা মনে হয় না।[১১০]
বিলটিকে আবার স্পেশাল কমিটিতে পাঠানোর বিরোধিতা করে তিনি বলেন যে তার দ্বারা কোন ফল লাভ হওয়ার সম্ভাবনা নেই। কারণ ইতিপূর্বে স্পেশাল কমিটি বিলটির প্রত্যেকটি ধারা এক এক করে বিবেচনা করেছে।
এর পর বিরোধী দল কর্তৃক উত্থাপিত সংশোধনীগুলি ভোটে দেওয়া হয় এবং সেগুলি বাতিল হয়ে যায়। ফলে স্পেশাল কমিটিতে বিলটিকে ফেরত না পাঠিয়ে সেটিকে পরিষদে বিবেচনার সিদ্ধান্তই গৃহীত হয়।
৫. পূর্ব বাঙলা জমিদারী ক্রয় ও প্রজাস্বত্ব বিল-এর ওপর পরবর্তী বিতর্ক
স্পেশাল কমিটির রিপোর্ট আংশিকভাবে পরিবর্তনের জন্যে আবার স্পেশাল কমিটিতে ফেরত পাঠানোয় সংশোধনী প্রস্তাব পরিষদ কর্তৃক বাতিল হয়ে যাওয়ার পর বিলের এক একটি ধারা ধারাবাহিকভাবে বিতর্কিত হতে থাকে। এই বিতর্ক ১৯৫০ সালের ১৬ই ডিসেম্বর পর্যন্ত চলে এবং ঐ দিনই পূর্ব বাঙলা ব্যবস্থা পরিষদ কর্তৃক সমগ্র বিলটি কিছুটা সংশোধিত হয়ে আইনে পরিণত হয়।
স্পেশাল কমিটির রিপোর্টের ওপর বিতর্কের বিস্তৃত বিবরণের কোন প্রয়োজন এখানে নেই। ইতিপূর্বে প্রাথমিক বিতর্কের যে বিবরণ দেওয়া হয়েছে তার থেকেই ভূমি সংস্কার সম্পর্কে জমিদার জোতদার ইত্যাদি ভূস্বামী শ্রেণী এবং তাঁদের রাজনৈতিক প্রতিনিধি কংগ্রেস লীগ সদস্যদের শ্রেণীগত ভূমিকা যথেষ্ট স্পষ্টভাবে দেখা গেছে। এজন্যে বিলটি সম্পর্কে পরবর্তী আলোচনাকালে বিভিন্ন বিষয়ে কংগ্রেস লীগ সদস্যদের বিতর্কের কোন বিস্তৃত বিবরণ আর না দিয়ে এর কয়েকটি বিশেষ দিক সম্পর্কে সংক্ষিপ্তভাবে উল্লেখ করা হলো।
৬. নানকার প্রথার বিলোপ
নানকাররা ছিলো একধরনের ভূমিদাস।[১১১] ভূস্বামীদের বাড়ীতে সব ধরনের কাজ করার শর্তেই নানকারদেরকে কিছু পরিমাণ জমি বিনা খাজনায় “ভোগ” করতে দেওয়া হতো। শুধু যে গৃহভৃত্যের কাজ অথবা কৃষি কাজের জন্যেই এই ধরনের জমি মৌখিক বন্দোবস্ত হতো তাই নয় – ধোপা, নাপিত ইত্যাদিকেও কাজের পরিবর্তে এইভাবে জমি দেওয়া হতো। শুধু জমিও নয়, জমিদাররা অনেক সময় নিজেদের বাড়ীর কাছাকাছি নানকারদেরকে বাস্তুভিটার জন্যেও জায়গা দিতো। এই কাছাকাছি অবস্থানের জন্যে নানকারদের থেকে কাজ আদায়ের অনেকখানি বেশী সুবিধা হতো।
নানকার প্রথা সিলেট জেলাতেই প্রচলিত ছিলো, পূর্ব বাঙলার অন্য কোন অঞ্চলে নয়। অন্যান্য অঞ্চলে কিছু কিছু গৃহকর্মের পরিবর্তে ধোপা, নাপিত ইত্যাদিদেরকে বিনা খাজনায় জমি রাখতে দেওয়ার একটা রেওয়াজ ছিলো। এর মাধ্যমে কিছুটা শোষণ এবং অতিরিক্ত শ্রম আদায়ও হতো। এই প্রথার নাম ছিলো চাকরান। কিন্তু চাকরান প্রথা নানকার প্রথার মতো এতোখানি নির্যাতনমূলক ছিলো না। চাকরান জমি যারা “ভোগ” করতো তাঁরা নানকারদের মতো ভূমিদাস ছিলো না এবং তাঁদের ওপর ভূস্বামীদের অতখানি কর্তৃত্বও থাকতো না। ‘জমিদারী ক্রয় ও প্রজাস্বত্ব বিল’-এর অধীনে পূর্ব বাঙলা ব্যবস্থা পরিষদে নানকার প্রথা উচ্ছেদের জন্যে প্রস্তাব আনা হয় ২রা ডিসেম্বর, ১৯৪৯। তার পূর্বে সিলেট জেলা নানকাররা জমিদার মীরাসদারদের নির্যাতনের বিরুদ্ধে এক ব্যাপক আন্দোলন গড়ে তোলেন এবং নানকারদের সাথে অনেকক্ষেত্রে পুলিশেরও সরাসরি সংঘর্ষ বাধে।[১১২] নানকার প্রথা উচ্ছেদের আন্দোলন এ সবের ফলে সিলেট জেলায় খুব জোরদার হয় এবং সরকার এই প্রথা উচ্ছেদের প্রতিশ্রুতি দেওয়ার পরই সে আন্দোলন নানকাররা প্রত্যাহার করেন। সরকার নানকার প্রথা উচ্ছেদ সংক্রান্ত ধারাগুলিতে প্রথমে কৃষি, বাগিচা অথবা বাস্তুভিটার জন্যে যে সমস্ত নানকার অথবা চাকরানরা মৌখিক জমি বন্দোবস্ত পেয়েছিলো তাঁদেরকে সেই সমস্ত জমিতে দখলী স্বত্ব দানের ব্যবস্থা করেন।[১১৩]
কিন্তু এই দখলী স্বত্ব দানের ক্ষেত্রে সরকার যে নীতি গ্রহণ করেন তার ফলে অনেকাংশে সেই স্বত্ব হয়ে দাঁড়ায় অর্থহীন। কারণ যে সমস্ত জমি অথবা বাস্তুভিটার ওপর নানকারদেরকে দখলীস্বত্ব দেওয়া হয় সেই জমি অথবা বাস্তুভিটা যদি ভূস্বামীদের বাস্তুভিটার এলাকার মধ্যে পড়ে তাহলে নানকারদেরকে সেখান থেকে উচ্ছেদ করার ক্ষমতা ভূস্বামীদেরকে দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। এই উচ্ছেদের জন্যে একটা ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থাও অবশ্য তার মধ্যে থাকে।
এ প্রসঙ্গে ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত এবং প্রভাসচন্দ্র লাহিড়ী দুটি সংশোধনী প্রস্তাব আনেন। ধীরেন দত্ত প্রস্তাব করেন[১১৪] যে, ভূস্বামীর বাস্তুভিটার এলাকায় নানকারের বাস্তুভিটা অথবা অন্য জমি পড়লে ভূস্বামী তাকে উচ্ছেদ করতে পারে কিন্তু তার জন্যে যে ক্ষতিপূরণ দেওয়া দরকার সে ক্ষতিপূরণ আদালতের মাধ্যমে নির্ধারিত হতে হবে। পুরাতন জায়গা থেকে ভিটা উঠিয়ে নোতুন জায়গায় ভিটা তৈরীর জন্যে যে ব্যয় হবে সেই ব্যয়ের হিসেব অনুযায়ীই ক্ষতিপূরণের পরিমাণ নির্ধারিত হওয়া দরকার।
এ ছাড়া আর একটি বিষয়ের উল্লেখ ধীরেন দত্ত করেন। সরকারী প্রস্তাব অনুযায়ী ক্ষতিপূরণের যে কথা বলা হয়েছিলো তা কেবল পাঁচ বিঘা পর্যন্ত জমির ওপর যাদের মৌখিক বন্দোবস্ত ছিলো তাঁদের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য হতো, তার বেশী জমির ক্ষেত্রে নয়। ধীরেন দত্ত প্রস্তাব করেন যে, যে সমস্ত নানকার প্রজাকে এইভাবে উচ্ছেদ করা হবে তাঁদের প্রত্যেককেই জমির পরিমাণ নির্বিশেষে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হোক। কারণ পাঁচ বিঘার অধিক জমি যাদের হাতে আছে তাঁদেরকে উচ্ছেদ করার অধিকার যদি ভূস্বামীদেরকে দেওয়া হয় এবং যারা এইভাবে উচ্ছেদ হয়ে যাবে তাঁদের কোন ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা না থাকে তাহলে তাদের কোন সমস্যার সমাধান না হয়ে দুঃখ দুর্দশা হ্রাসের পরিবর্তে বৃদ্ধি লাভই করবে।[১১৫] এই পর্যায়ে সরকারী মুখপাত্র হামিদুদ্দীন আহমদ[১১৬] জিজ্ঞেস করেন যে, ভূস্বামী যদি দরিদ্র হন তাহলে কি হবে, অর্থাৎ তিনি কিভাবে পাঁচ বিঘার অধিক জমির ক্ষতিপূরণ দান করবেন। এর জবাবে ধীরেন দত্ত বলেন যে, উচ্ছেদ করলে সব ক্ষেত্রেই ক্ষতিপূরণ দিতে হবে এবং ভূস্বামী যদি দরিদ্র হন তাহলে তিনি প্রজাকে উচ্ছেদ করবেন না। কিন্তু উচ্ছেদ করলে তিনি ধনী অথবা দরিদ্র যাই হোন, তাকে যুক্তিসঙ্গত ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।[১১৭] সরকারী প্রস্তাবে ছিলো যে, প্রজাকে উচ্ছেদের পূর্বে আদালতের বাইরে নির্ধারিত ক্ষতিপূরণের টাকা আদালতে জমা দিতে হবে অথবা প্রজাকে আদালতের সামনে লিখিতভাবে স্বীকার করতে হবে যে, তিনি আদালতের বাইরে ভূস্বামীর থেকে প্রয়োজনীয় ক্ষতিপূরণ ইতিপূর্বে লাভ করেছেন। ধীরেন দত্ত বলেন যে, আদালতের বাইরে ক্ষতিপূরণের টাকা প্রজাকে দিয়ে সেই ব্যাপারে আদালতের সামনে স্বীকারোক্তির ব্যবস্থা বাতিল করে আদালতের মাধ্যমেই ক্ষতিপূরণ দানের ব্যবস্থা করা হোক। কারণ আদালতের বাইরে ভূস্বামী ইচ্ছেমতো ক্ষতিপূরণ দিয়ে জবরদস্তিমূলকভাবে প্রজাকে দিয়ে আদালতের সামনে লিখিত স্বীকারোক্তি আদায় করবে।[১১৮]
প্রভাসচন্দ্র লাহিড়ী নানকার প্রজাদেরকে জমি থেকে উচ্ছেদের প্রস্তাবের সমালোচনা করেন। পাঁচ বিঘার অধিক জমি যে সমস্ত প্রজার হাতে আছে তাঁদেরকে উচ্ছেদের ক্ষেত্রে কোন ক্ষতিপূরণ না দিয়েই তাঁদেরকে উচ্ছেদ করা যাবে, এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করে তিনি ধীরেন দত্তের সংশোধনীকেই সমর্থন করেন। কিন্তু ধীরেন দত্ত যেখানে ক্ষতিপূরণের ক্ষেত্রে জমির পরিমাণ নির্দেশের বিরোধী সেখানে তিনি পাঁচ বিঘার পরিবর্তে পাঁচ একর পর্যন্ত জমি যে সমস্ত প্রজাদের হাতে আছে তাঁদেরকে উচ্ছেদের সময় ক্ষতিপূরণ দানের জন্যে সংশোধনী প্রস্তাব দেন।[১১৯]
সরকার পক্ষ ধীরেন দত্ত এবং প্রভাস লাহিড়ী উভয়েরই সংশোধনী প্রস্তাব নাকচ করে দেন। রাজস্বমন্ত্রী তফজ্জল আলী এ প্রসঙ্গে বলেন[১২০] যে, আদালতের মাধ্যমে ক্ষতিপূরণ দানের ব্যবস্থায় প্রজাদের ভূস্বামীর থেকে প্রজাদের সরাসরি ক্ষতিপূরণ লাভের ব্যবস্থায় প্রজাদের অধিক লাভবান হওয়ার সম্ভাবনা। অন্য সংশোধনীটির জবাবে তিনি বলেন যে, পাঁচ বিঘার অধিক জমি যে সমস্ত প্রজাদের আছে তাঁদেরকে যদি ক্ষতিপূরণ দানের ব্যবস্থা হয় তাহলে “অসুবিধার” সৃষ্টি হবে। এক্ষেত্রে অসুবিধা কার হবে এবং মন্ত্রী কার স্বার্থ পাহারা দেওয়ার জন্যে এই ধরনের বক্তব্য উপস্থিত এবং আইন প্রণয়ন করছিলেন সে কথা বলাই বাহুল্য। নানকার প্রজাদের দখলীস্বত্বের ক্ষেত্রে সরকার প্রস্তাব করেন যে ৭ই এপ্রিল ১৯৪৮-এর পূর্বে আদালত, কালেক্টর অথবা রেভিনিউ অফিসারের নির্দেশ ব্যতীত অন্য কোনভাবে যারা উচ্ছেদ হয়েছেন তাঁদের কৃষিজমি ও বাগিচা জমিতে তাঁদেরকে পুনরায় দখলীস্বত্ব দেওয়া হবে। এই প্রস্তাবের বিরুদ্ধে একটি সংশোধনী প্রস্তাব পেশ করেন পূর্ণেন্দুকিশোর সেনগুপ্ত।[১২১] তিনি বলেন যে, নানকার প্রজাদেরকে সত্যিকার কোন সুবিধা দিতে হলে ৭ই এপ্রিল, ১৯৪৮-এর তারিখ সীমা তুলে দিতে হবে। কারণ ঐ তারিখের পরেও অনেকে উচ্ছেদ হয়েছে এবং তাঁদেরও পুনর্বাসন প্রয়োজন। পুনর্বাসনের প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেন যে, শুধু কৃষি ও বাগিচা জমির ক্ষেত্রে দখলী স্বত্ব পুনঃপ্রতিষ্ঠার কথা সরকারী প্রস্তাবে উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু বাস্তুভিটে সম্পর্কে কিছু না বলে তাঁরা সেটা বাদ রেখেছেন। এই অসঙ্গতি দূর করার জন্যে তিনি কৃষি ও বাগিচা জমির সাথে বাস্তুভিটার জমিও অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব করেন।
পূর্ণেন্দুকিশোর সেনগুপ্তের প্রস্তাব সমর্থন করে ধীরেন দত্ত[১২২] বলেন যে, আদালত ইত্যাদির মাধ্যমেও যারা উচ্ছেদ হয়েছে তাঁদেরকেও পুনরায় দখলী স্বত্ব দেওয়া দরকার। কারণ এই দুই ধরনের উচ্ছেদের মধ্যে পার্থক্য প্রকৃতপক্ষে নেই। তাছাড়া এই ব্যবস্থা কার্যকর করার পূর্বেই আদালতে অনেক নোতুন উচ্ছেদ মামলা দায়ের হবে এবং এই নোতুন মামলা এবং পুরাতন মামলার রায় জমিদার মীরাসদাররা নিজেদের সপক্ষেই তাড়াতাড়ি আদালত থেকে বের করবে। কাজেই এই আইন কার্যকর হওয়ার পূর্বেই বহু নানকার প্রজা তাঁদের জমিজমা ও ভিটামাটি থেকে জমিদার মীরাসদারদের দ্বারা উচ্ছেদ হয়ে যাবে। জমির সাথে বাস্তুভিটাকেও আইনের অন্তর্ভুক্ত করার জন্যে পূর্ণেন্দুকিশোর সেনগুপ্তের প্রস্তাবকেও ধীরেন দত্ত সমর্থন করেন।
মন্ত্রী তফজ্জল আলী[১২৩] বলেন যে ৭ই এপ্রিল, ১৯৪৮ এই তারিখকে তাঁরা সীমারেখা হিসেবে নির্দিষ্ট করেছেন কারণ এক জায়গায় একটা সীমা নির্দেশ করাই দরকার। নানকারদের বিষয়ে গণ্ডগোল একমাত্র সিলেট জেলাতেই হয়েছে এবং সেখানে উচ্ছেদ সংক্রান্ত মামলায় কোন রায় দেওয়া হচ্ছে না। কাজেই সে বিষয়ে কোন কিছু করার প্রয়োজন নেই। প্রয়োজন হলে সরকার সে ব্যবস্থা করবেন। মামলার কোন রায় দেওয়া হচ্ছে না, একথা বলতে গিয়ে মন্ত্রী উল্লেখ করেননি সরকার নির্দেশ দিয়ে রায় দান বন্ধ রেখেছেন কিনা। সে নির্দেশ যদি না থাকে তাহলে ‘রায় দান বন্ধ আছে’ এই বক্তব্য অর্থহীন ব্যতীত আর কি? বাস্তুভিটাকে কৃষি ও বাগিচা জমির সাথে একত্রে বিবেচনা করতে অস্বীকার করে মন্ত্রী জানান যে, ভূস্বামীদের সাথে নানকার প্রজাদের খারাপ সম্পর্কের জন্যেই তাঁদেরকে বহু পূর্বেই উচ্ছেদ করা হয়েছে। কাজেই বাস্তুভিটা থেকে যাদেরকে উচ্ছেদ করা হয়েছে তাঁদেরকে আবার সেখানে দখলী স্বত্বদানের প্রশ্ন ওঠে না। এবং তার জন্যে কোন সংশোধনী প্রস্তাব গ্রহণেরও কোন প্রশ্ন ওঠে না।
এর পর সরকার পক্ষ থেকে হামিদুদ্দীন আহমদ[১২৪] এই মর্মে সংশোধনী প্রস্তাব আনেন যে, নানকারদেরকে দখলী স্বত্ব দেওয়ার জন্যে যে ব্যবস্থা করা হচ্ছে সে ব্যবস্থা চা-বাগান অথবা অন্য কোন শিল্প প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে না। জমিদাররা যেভাবে নানকারদেরকে জমিতে বসিয়ে তাঁদের থেকে কাজ নেয় ঠিক সেইভাবে চা-বাগান অথবা অন্যান্য বড়ো প্রতিষ্ঠানেরাও নিজেদের কর্মচারীদেরকে জমি দেয় এবং তাঁরা সেখানে চাষাবাদ ও বসবাস করে। এই সমস্ত কর্মচারীদেরকে চা-বাগান ইত্যাদির এলাকার মধ্যে জমিতে দখলীস্বত্ব দিলে শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কাজেই এই ধরনের কর্মচারীদেরকে উচ্ছেদ করলে তাঁদেরকে ক্ষতিপূরণ দান করতে হবে না।
চা-বাগান ইত্যাদি থেকে ঢালাওভাবে কর্মচারীদের ক্ষতিপূরণ না দিয়ে উচ্ছেদ, বিশেষতঃ বাঙলাদেশের বাইরে থেকে যে সমস্ত পরিবার বহুদিন পূর্বে এসে সারা জীবন চা-বাগানে শ্রমশক্তি বিক্রি করে বার্ধক্যে উপনীত হয়েছেন, তাঁদেরকে ক্ষতিপূরণ না দিয়ে উচ্ছেদের বিরুদ্ধে সুরেশচন্দ্র দাশগুপ্ত প্রতিবাদ করেন। কিন্তু এ ব্যাপারে আলোচনা নিষ্প্রয়োজন এই কথা বলে তফজ্জল আলী হামিদুদ্দীনের সংশোধনীটি পরিষদে পাস করিয়ে নেন।[১২৫]
৭. ওয়াকফ্ ও দেবোত্তর সম্পত্তি এবং কোম্পানী আইন
৭ নম্বর ধারায় পরিবার পিছু ১০০ বিঘা জমি রাখার প্রস্তাব সম্পর্কে সরকারী পক্ষ থেকে নাসিরুদ্দীন আহমদ একটি সংশোধনী প্রস্তাব পেশ করেন।[১২৬] এই সংশোধনীতে কোম্পানী রেজিস্ট্রীকরণের যে বাধ্যবাধকতা বিলটিতে রাখা হয়েছিলো তা উঠিয়ে নেবার প্রস্তাব করা হয়। এর অর্থ প্রকৃতপক্ষে দাঁড়ায় এই যে, কয়েকজন মিলে একটি কোম্পানী গঠন করেছে বলে দাবী করলেই তাঁরা ১০০ বিঘার বেশী জমি হাতে রাখার অধিকার আইনতঃ লাভ করবে। মুসলিম লীগের মঈনুদ্দীন চৌধুরী অপর একটি সংশোধনী প্রস্তাবে সমস্ত রকম খাস জমি মালিকের হাতে রাখার জন্যে প্রস্তাব করেন।[১২৭] এছাড়া ওয়াকফ্-এর মাধ্যমে জমি হাতে রাখার ব্যবস্থাও সরকারী প্রস্তাবের মধ্যে করা হয়।[১২৮] এ ক্ষেত্রে সরকারী পক্ষের এ.এম. আব্দুল হামিদ তাঁর সংশোধনী প্রস্তাব পেশ করতে গিয়ে বলেন যে, দেবোত্তরের পূর্বে “Public” শব্দটি জুড়ে দেওয়ার কারণ ব্যক্তিগত দেবোত্তর এবং সাধারণ দেবোত্তরের মধ্যে তফাত আছে। ব্যক্তিগত দেবোত্তর বস্তুতঃ পরিবারেরই সম্পত্তি, তাতে বাইরের কোন লোকের দাবী দাওয়া নেই। কিন্তু ওয়াক্ফ-এর ক্ষেত্রে “Public” শব্দ জোড়ার প্রয়োজন নেই কারণ ইসলামী শরীয়ত অনুযায়ী সব রকম ওয়াকফ্ মূলতঃ সাধারণের জন্যে উৎসর্গীকৃত।[১২৯] পারিবারিক ওয়াকফ্ বা ওয়াকফ্ আলাল-আওলাদ সম্পর্কে মুসলিম লীগ সরকারের পক্ষ থেকে এই ধরনের তত্ত্বগত প্রশ্ন উঠিয়ে পারিবারিক ওয়াক্ফ সম্পত্তিকে ১০০ বিঘা সিলিং এর আওয়তার বাইরে রাখার প্রস্তাব সুকৌশলে করা হয়। এই সরকারী ব্যবস্থা সম্পর্কে মওলানা ফজলুল করিম বলেন:
বিলে ওয়াকফ্ আলাল-আওলাদ সম্পত্তির উপর হস্তক্ষেপ করা হবে না বলা হয়েছে, কিন্তু পাকিস্তান এখন দারুল ইসলাম[১৩০] গভর্নমেন্টের। এখানে সকল সম্পত্তির উপর হস্তক্ষেপের অধিকার রয়েছে। কাজেই ওয়াকফ্ সম্পত্তিগুলিকে জিয়াইয়া রাখার কোন সঙ্গত কারণ নাই। এ সম্পত্তিগুলি প্রায়ই অন্যায়ভাবে হজম করা হচ্ছে। বড়োই দুঃখের বিষয় আমরা যেভাবে জমিদার ও জোতদারদের Support করি এবং এ আইন পাসের বেলায়ও Support করছি তাতে দেশের জনসাধারণ আমাদের সততার উপর সন্দেহ করবে। আজ এই আইন পাসের ভেতর প্রমাণ হবে আমরা সত্যসত্যই জনসাধারণের হিতার্থে আজাদ মুলুকের আইন পাস করছি, না জমিদারদের ফেন চাটা হয়ে এই আইন পাস করছি। [১৩১] ওয়াকফ্ ও দেবোত্তরের মাধ্যমে জমি হাতে রাখার ব্যবস্থা সম্পর্কে মুনীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য বলেন, সমস্ত মুসলমান জমিদারেরা Wakfal-al-awad করবেন। তাঁদের খাস জমি ছুঁতে পারবেন না। আর হিন্দু জমিদারের জমি দেবোত্তর হবে। তাহলে আপনারা কি নেবেন।[১৩২] ওয়াকফ্ ও দেবোত্তরের মাধ্যমে জমি হাতে রাখা, সমস্ত খাস জমি হাতে রাখা ইত্যাদি প্রস্তাবের মাধ্যমে যে নীতি মুসলিম লীগ সরকার অনুসরণ করছিলেন তার ফলে খোদ কৃষকদের হাতে জমি যাওয়া যে প্রায় অসম্ভব একথা উপলব্ধি করে শাসক শ্রেণীর কর্ণধারদের মধ্যেও কেউ কেউ যে যথেষ্ট বিচলিত হয়ে উঠেছিলেন সেটা এই বিতর্কের মধ্যেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে। দুশো আড়াইশো বিঘা অথবা তারও অধিক জমি খাস দখলে রাখার যে ব্যবস্থা ৭ নম্বর ধারায় রাখা হয়েছিলো সে সম্পর্কে খুলনার আবদুস সবুর খান যে সাবধানবাণী তাঁর স্বশ্রেণীর উদ্দেশ্যে উচ্চারণ করেন এ ক্ষেত্রে তা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য:
স্যার, এখন এই ধরনের যে সংশোধনীগুলি পেশ করা হয়েছে সেগুলির দ্বারা অনেকাংশে দেখা যাবে যে, জমিদারী উচ্ছেদের আসল অর্থ শেষ পর্যন্ত দাঁড়াবে তাঁদের স্থলে জোতদারদেরকে বসিয়ে দেওয়া। এটা একটা বিপজ্জনক ব্যাপার এবং আমি বলতে চাই যে কমিউনিজমের ঢেউ আমাদের দরজায় ধাক্কা দিচ্ছে। তা এখন পার্বত্য চট্টগ্রামের উল্টো দিকে এবং গিলগিটের উল্টো দিকে।[১৩৩] আকস্মিকভাবে এই কমিউনিজম আমাদের মধ্যে একটা তৈরী ক্ষেত্র পেয়ে যেতে পারে। আমার জোতদার বন্ধুরা যদি এই পরিস্থিতির মোকাবেলা করতে না ওঠেন এবং পূর্বাহ্নেই যদি তাঁরা পদক্ষেপ না নেন তাহলে একথা বলতে আমার বিন্দুমাত্র দ্বিধা নেই যে, তাঁরা একদিন নিজেদের অজ্ঞাতসারেই কমিউনিজমের ঢেউয়ের দ্বারা প্লাবিত হবেন এবং এটা মনে করা ভুল হবে যে তার কব্জা থেকে কেউ রক্ষা পেতে পারবে।[১৩৪]
“রেজিস্টার্ড” কোম্পানী, ওয়াক্ফ দেবোত্তর ইত্যাদি সম্পর্কে বিতর্কের জবাবে রাজস্বমন্ত্রী তফজ্জল আলী বলেন যে, কোম্পানীর পূর্বে “রেজিস্টার্ড” শব্দটি তুলে দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে কারণ ১৯১৩ সালের কোম্পানী আইন অনুযায়ী কোম্পানীর অর্থই হলো রেজিস্টার্ড কোম্পানী। কাজেই “রেজিস্টার্ড” শব্দটি এক্ষেত্রে সম্পূর্ণ নিষ্প্রয়োজন মনে করেই তা বাদ দেওয়া হচ্ছে।[১৩৫]
“রেজিস্টার্ড” শব্দটি তুলে দিয়ে জমির মালিকদেরকে অতিরিক্ত জমি হাতে রাখার যে সুযোগ মুসলিম লীগ মন্ত্রী করে দিচ্ছিলেন তা দারুণ সমালোচনার সম্মুখীন, এমনকি তাঁদের নিজেদের দলভুক্ত সদস্যদেরও সমালোচনার সম্মুখীন হওয়ায় ১৯১৩ সালে কোম্পানী আইনের দোহাই পেড়ে রাজস্বমন্ত্রী যে এক্ষেত্রে তাঁদের সম্পর্কে “ভুল বোঝাবুঝির” অবসান ঘটাতে চেয়েছেন সে কথা বলাই বাহুল্য।
স্পেশাল কমিটি সুপারিশ করেছিলেন যে চা, ইক্ষু এবং তুলা শিল্পসংক্রান্ত কোম্পানীগুলি ১০০ বিঘার অতিরিক্ত জমি চা, ইক্ষু ও তুলা চাষের জন্য হাতে রাখতে পারবে। কিন্তু একটি সংশোধনীর মাধ্যমে সরকার এই তিন ধরনের কোম্পানীর পরিবর্তে ঢালাওভাবে যে কোন বড়ো শিল্পের ক্ষেত্রে এই ব্যতিক্রম প্রযোজ্য হবে বলে প্রস্তাব করেন। এই সংশোধনীর সপক্ষে রাজস্ব মন্ত্রী বলেন যে, এই পরিবর্তনের কারণ উপরোক্ত তিন ধরনের শিল্প ছাড়াও অন্যান্য শিল্পের জন্যেও অতিরিক্ত জমি প্রয়োজন হতে পারে। উদাহরণ হিসেবে তিনি ঢাকার নিকটস্থ একটি রাবার শিল্পের[১৩৬] উল্লেখ করেন। এই ধরনের নোতুন কোম্পানীগুলিকে শিল্প সম্প্রসারণের সুযোগ দানের জন্য অতিরিক্ত জমি হাতে রাখার সুযোগ শুধুমাত্র তিন ধরনের শিল্পের ক্ষেত্রে না রেখে তাকে আরও প্রসারিত করা প্রয়োজন বলে তিনি উল্লেখ করেন।[১৩৭]
পূর্বে সরকারী প্রস্তাবে ছিলো যে ১৯৪৮-এর ১লা জুনের পূর্ব পর্যন্ত ওয়াকফ্ ও দেবোত্তরগুলি একশো বিঘার অতিরিক্ত জমি রাখতে পারবে। কিন্তু একটি সরকারী সংশোধনীর মাধ্যমে[১৩৮] এই তারিখ সীমা উঠিয়ে নেওয়া হয়। এ প্রসঙ্গে রাজস্বমন্ত্রী বলেন যে, উপরোক্ত তারিখের পরও হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে যাঁরা সম্পত্তি ওয়াক্ফ ও দেবোত্তর করে জনগণকে দান করতে চান তাঁদেরকে বাধা দেওয়া উচিত হবে না। এজন্যেই তাঁরা এই তারিখ সীমা উঠিয়ে নিচ্ছেন। তবে এই সমস্ত সম্পত্তির আয় কিভাবে ব্যয় হচ্ছে তার হিসেব নেওয়ার দায়িত্ব সরকার নিজ হাতে গ্রহণ করছেন। কাজেই এ ব্যাপারে সরকারের সদিচ্ছায় সন্দেহের কোন কারণ নেই। ১৩৯
৮. টঙ্কপ্রথার বিলোপ
টঙ্ক খাজনার অর্থ হলো জমিদারের জমিতে চাষ আবাদ করে টাকায় খাজনা না দিয়ে অথবা ভাগে খাজনা না দিয়ে বৎসরে একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ শস্য জমিদারকে খাজনা হিসেবে দেওয়া। এই নির্দিষ্ট শস্য খাজনার জন্যেই এই প্রথাকে ভাগ প্রথা বলা চলে না। ভাগচাষীদের থেকেও টঙ্ক খাজনা দানকারী এই কৃষকদের অবস্থা ছিলো আরও খারাপ, তাঁরা ছিলো আরও বেশী নির্যাতিত।
ভাগে খাজনা, সে আধি অথবা তেভাগা যা-ই হোক, উৎপন্ন ফসলের ওপরই দিতে হয়। ফসল ভালো না হলে জমির মালিকও সে বৎসর কম খাজনা পায়। কিন্তু টঙ্ক প্রথা অনুযায়ী জমির মালিকের প্রাপ্য খাজনা ফসলে নির্দিষ্ট, জমির উৎপাদনের ওপর তা নির্ভরশীল নয়। উৎপাদন কম বেশী যা-ই হোক, কৃষককে নির্দিষ্ট পরিমাণ শস্য জমির মালিককে দিতেই হবে। এই অবস্থার জন্যে খরা বা বন্যায় বা অন্য কারণে আশানুযায়ী ফসল না হলে কৃষককে উৎপন্ন ফসলের অর্ধেকেরও বেশি জমির মালিককে দিয়ে খাজনার দায় থেকে মুক্ত হতে হতো। এবং তার ফলে বৎসরের অধিকাংশ সময় অনাহার ব্যতীত তাঁদের অন্য কোন উপায় থাকতো না।
এই প্রথার বিরুদ্ধে ময়মনসিংহ জেলার সুসংদুর্গাপুর পরগণায় এক ব্যাপক কৃষক বিদ্রোহ দেখা দেয় এবং কৃষকদের সেই সংগ্রাম ১৯৪৯ সালে ভয়ানক তীব্র ও সশস্ত্র আকার ধারণ করে।[১৪০] এই সংগ্রামের চাপে সরকার টঙ্ক খাজনাকে টাকায় খাজনাতে রূপান্তরিত করে খাজনার হার কিছুটা কমিয়ে আনার প্রস্তাব ও পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হয়।
নিজেদের শ্রেণীস্বার্থ রক্ষার ক্ষেত্রে কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ দলভুক্ত জমিদার জোতদাররা কিভাবে তৎপর ও কতখানি সতর্ক ছিলো সেটা ইতিপূর্বে উল্লিখিত জমিদারী উচ্ছেদ সংক্রান্ত বিতর্কে দেখা গেছে। নিজেদের স্বার্থ রক্ষা করতে গিয়ে কতপ্রকার স্ববিরোধী ও ভণ্ডামীপূর্ণ যুক্তি দুই পক্ষ থেকেই দেওয়া হয়েছে তার উদাহরণও এই বিতর্কের ক্ষেত্রে অসংখ্য। উৎপন্ন খাজনা বা টঙ্ক খাজনাকে টাকায় খাজনাতে রূপান্তরিত করা সংক্রান্ত বিতর্কের মধ্যেও সেই একই স্ববিরোধিতা, নির্লজ্জতা ও ভণ্ডামী সুস্পষ্টভাবে দেখা যায়।
টঙ্ক এলাকায় টাকায় খাজনা প্রবর্তন করে সেই সাথে খাজনা হ্রাস এবং সেই নোতুন নির্ধারিত খাজনা অনুযায়ী জমিদারদের ক্ষতিপূরণ দানের প্রস্তাব মুসলিম লীগ সরকার করেন। কংগ্রেস সদস্যেরা সদলবলে এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করতে উদ্যত হন এবং তাঁদের পক্ষ থেকে তাঁদের উপনেতা ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত এই মর্মে একটি সংশোধনী প্রস্তাব উত্থাপন করেন যে, টঙ্ক এলাকায় খাজনা হ্রাস করে সেই নোতুন প্রবর্তিত খাজনার ভিত্তিতে ক্ষতিপূরণ নির্ধারণ না করে পূর্ববর্তী দশ বৎসরের খাজনার গড় বের করে তার ভিত্তিতেই ক্ষতিপূরণ নির্ধারণ করা হোক। তাঁরা বলেন যে সেইভাবে ক্ষতিপূরণ নির্ধারণ না করলে জমিদারদের ওপর অন্যায় এবং অত্যাচার করা হবে।[১৪১] মনোরঞ্জন ধর (ময়মনসিংহ জেলার জাঁদরেল জমিদার জোতদার) একদিকে অভিযোগ করেন যে অবিভক্ত বাঙলার মুসলিম লীগ সরকার ও পরবর্তী পূর্ব পাকিস্তান সরকার টঙ্ক প্রজাদের দুঃখ দুর্দশা লাঘবের বিন্দুমাত্র চেষ্টা করেনি এবং অন্যদিকে তিনি ধীরেন দত্তের প্রস্তাব সমর্থন করে দাবী করেন যে, খাজনার হার পরিবর্তন না করে পূর্ববর্তী দশ বৎসরের খাজনার গড়ের হিসেবে ক্ষতিপূরণ নির্ধারণ করা হোক।[১৪২] মুসলিম লীগ সরকারও যে এক্ষেত্রে টঙ্ক প্রজাদের হিতার্থে খাজনা সম্পর্কিত উপরোক্ত প্রস্তাব করেছিলো তা নয়। একদিকে তাঁদের ওপর ছিলো ময়মনসিংহের টঙ্ক এলাকার হাজং ও মুসলমান চাষীদের ব্যাপক ও তীব্র আন্দোলনের চাপ অন্যদিকে এই এলাকার জমিদাররা ছিলেন প্রায় সকলেই হিন্দু সম্প্রদায়ভুক্ত। এজন্যে টঙ্ক এলাকার আন্দোলন দমন করতে গিয়ে তাঁরা নিদারুণ নৃশংসতার পরিচয় দান করলেও ফসলের খাজনাকে টাকার খাজনায় রূপান্তরিত করে সেই সাথে খাজনার পরিমাণ হ্রাস করতেও তাঁদের বিশেষ কোন অসুবিধা হয়নি।
টঙ্ক এলাকায় যে পরিমাণ ফসলে খাজনা নির্দিষ্ট হতো তাতে একর প্রতি খাজনা ২০ টাকা থেকে ৩০ টাকা পর্যন্ত কৃষকদেরকে দিতে হতো। সেদিক থেকে বিচার করলেও এই খাজনা সমতুল্য অন্যান্য এলাকার জমির খাজনা, এমনকি পার্শ্ববর্তী এলাকার খাজনা থেকেও অনেক বেশী ছিলো।
১৬ই ফেব্রুয়ারী ১৯৫০, রাজস্বমন্ত্রী তফজ্জল আলী ‘জমিদারী ক্রয় ও প্রজাস্বত আইন’ অনুমোদনের জন্য সুপারিশ করে যে সর্বশেষ পরিষদ বিবৃতি দেন তাতে তিনি টঙ্ক প্রথা বিলোপ সম্পর্কে বলেন:
স্যার, এই জমিদারী ক্রয় আইন পুরোপুরি প্রবর্তিত হওয়ার পূর্বেই সকল প্রকার ফসলে খাজনা, যা অনেকক্ষেত্রে প্রজাদের ওপর খুবই পীড়নমূলক, এই আইনের বিধান অনুযায়ী ন্যায় ও বিচার সম্মত ভিত্তিতে টাকায় খাজনায় রূপান্তরিত করা হবে।[১৪৩]
৯. ‘জমিদারী ক্রয় ও প্রজাস্বত্ব আইন’ ও পূর্ব বাঙলার কৃষক
‘পূর্ব বাঙলা জমিদারী ক্রয় ও প্রজাস্বত্ব আইন’ যেভাবে প্রণীত হয়েছিলো তাতে প্রকৃতপক্ষে জমিদারী সম্পূর্ণভাবে উচ্ছেদ হয়নি। কারণ এই আইনের মাধ্যমে রাষ্ট্রই জমিদারে পরিণত হয়, পূর্ব বাঙলা সরকারই হয় কৃষকদের থেকে খাজনা আদায়ের অধিকারী। এই ব্যবস্থায় জমিদারদের গোমস্তা ও কর্মচারীদের স্থান দখল করে সার্কেল অফিসার, তহশীলদার, চৌকিদার প্রভৃতি সরকারী কর্মচারীরা এবং তাঁদের মাধ্যমে কৃষকদের থেকে নির্যতানমূলকভাবে খাজনা আদায় এবং তাঁদের ওপর অন্যান্য নানা প্রকার অত্যাচার রীতিমতো অব্যাহত থাকে। ‘জমিদারী ক্রয় ও প্রজাস্বত্ব আইন’ প্রণীত হওয়ার সময় আইনগতভাবে বাৎসরিক কৃষকদের মোট দেয় রাজস্বের পরিমাণ ছিলো ৮.৪২ কোটি টাকা। [১৪৪] কিন্তু জমিদারদের থেকে সরকারের প্রাপ্ত অঙ্কের পরিমাণ ছিলো ২.২৪ কোটি টাকা। [১৪৫] জমিদারী ক্রয় আইনের বিতর্ক চলাকালে হামিদুল হক যে হিসেবে দান করেন সেই অনুযায়ী সরকারের খাজনা আদায় বাবদ খরচা হওয়ার কথা ১.২৪ কোটি টাকা।[১৪৬] এই সরকার কর্তৃক জমিদারী উচ্ছেদের পর ভূমি খাজনা বাবদ সরকারের অতিরিক্ত আয় ৪ কোটি টাকার মতো হবে বলেও হামিদুল হক উল্লেখ করেন। [১৪৭] অর্থাৎ সে সময় সরকারের প্রত্যাশা অনুযায়ী ভূমি রাজস্ব থেকে মোট আয়ের পরিমাণ কোনক্রমেই ৭ কোটি (পূর্ববর্তী ২.২৪+ অতিরিক্ত ৪ কোটি) টাকার বেশি হওয়ার কথা নয়। কিন্তু ভূমি রাজস্ব আয় সংক্রান্ত সরকারী পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায় যে, এই বাবদ সরকারের আয় ১৯৫০ সালের পরবর্তী পর্যায়ে[১৪৮] ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খানের সামরিক বাহিনী কর্তৃক ক্ষমতা দখলের পর থেকে ক্রমাগতভাবে বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং ১৯৭০ সালে তা এসে দাঁড়ায় ১৮.৫০ কোটি টাকায়।[১৪৯] ১৯৫০ সালের ‘জমিদারী ক্রয় ও প্রজাস্বত্ব আইন’ চালু হওয়ার পরও রাষ্ট্রীয় জমিদারীতে কৃষকদের ওপর খাজনা শোষণের পরিচয় এর থেকেই সুস্পষ্টভাবে উদ্ঘাটিত হয়। খাজনা শোষণ ছাড়াও আর একটি বিষয় এখানে উল্লেখযোগ্য। ‘জমিদারী ক্রয় ও প্রজাস্বত্ব বিল’-এর ওপর বিতর্ক চলাকালে সরকার পক্ষ থেকে ভূমিহীন ও গরীব কৃষকদের মধ্যে উদ্বৃত্ত জমি বিতরণের অনেক প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিলো। কিন্তু এই প্রতিশ্রুতি সত্ত্বেও বিলটি আইনে পরিণত হওয়ার পর অতি অল্প পরিমাণ জমিই প্রকৃতপক্ষে কৃষকদের মধ্যে বিতরণ করা হয়। অধিকাংশ জমিই ভূস্বামীরা বেনামী করে নিজেদের দখলে রাখে এবং সরকারও উদ্বৃত্ত জমি বের করা ও কৃষকদের মধ্যে তা বিতরণের ক্ষেত্রে দীর্ঘসূত্রিতা ও শৈথিল্যের মাধ্যমে উদ্বৃত্ত জমি কৃষকদের মধ্যে বিতরণের প্রশ্নটি কার্যক্ষেত্রে ধামাচাপা দেয়। ‘জমিদারী ক্রয় ও প্রজাস্বত্ব আইন’ প্রণয়ন করতে গিয়ে সরকার ময়মনসিংহের হাজং অধ্যুষিত এলাকায় টঙ্ক খাজনা রহিত করে টাকায় খাজনা প্রচলন করে এবং সিলেটের ব্যাপক অঞ্চলে নানকার প্রথা নামক ভূমিদাসত্ব প্রথা উচ্ছেদ করে। এই দুই ক্ষেত্রের সরকারী সংস্কার উপরোক্ত এলাকার কৃষকদের কিছু কিছু নোতুন অধিকার প্রদান করে। কিন্তু হাজং এলাকার কৃষকদের টাকায় খাজনা দেওয়ার ব্যবস্থা করলেও ১৯৫০ সালের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার পর সেই সব এলাকায় মোহাজেরদেরকে বসিয়ে কিভাবে সরকার ব্যাপকভাবে হাজং উচ্ছেদ করে একমাত্র সেদিকে লক্ষ্য রাখলেই এই সরকারী অধিকার প্রদানের’ প্রকৃতস্বরূপ সুস্পষ্টভাবে উপলব্ধি করা সম্ভব হবে।
তথ্যসূত্র
১. দ্রষ্টব্য: বদরুদ্দীন উমর, চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে বাঙলাদেশের কৃষক, তৃতীয় পরিচ্ছেদ।
২. হামিদুল হক চৌধুরী, East Bengal Legislative Assembly Proceedings, Vol. I. No. 4, P 93.
৩. এক বৎসরের দেয় খাজনা দিতে যে কৃষকরা বাধ্যতাবশতঃ মহাজনের বাড়ী ধর্না দেয় তারা এককালীন পঁচিশ বৎসরের খাজনা কিভাবে দেবে সে কথা অবশ্য হামিদুল হক উল্লেখ করেননি।
৪. হামিদুল হক চৌধুরী, পূর্বোক্ত।
৫. পূর্বোক্ত।
৬. পূর্বোক্ত।
৭. পূর্বোক্ত।
৮. ফ্লাউড কমিশন।
৯. হামিদুল হক চৌধুরী, পূর্বোক্ত পৃ ৯৪।
১০ পূর্বোক্ত।
১১ পূর্বোক্ত।
১২ পূর্বোক্ত।
১৩ পূর্বোক্ত পৃ ৯৪-৯৫।
১৪ পূর্বোক্ত পৃ ৯৫
১৫. পূর্বোক্ত পৃ ৯৫-৯৬।
১৬ পূর্বোক্ত পৃ ৯৬।
১৭ পূর্বোক্ত।
১৮ East Bengal Legislative Assembly Proceedings Vol. I, No. 4, P 97-9৪.
১৯ পূর্বোক্ত পৃ ৯৮।
২০ পূর্বোক্ত
২১ পূর্বোক্ত।
২২ পূর্বোক্ত।
২৩ পূর্বোক্ত।
২৪ পূর্বোক্ত পৃ ৯৯।
২৫ পূর্বোক্ত।
২৬ পূর্বোক্ত পৃ ১০০-১০১।
২৭ নোয়াখালীর সদস্য-ব.উ.।
২৮ সুহরাওয়ার্দ্দী মন্ত্রীসভা কর্তৃক ১৯৪৭ সালে আনীত বিল-ব.উ.।
২৯ পূর্বোক্ত পৃ ১০১-১০২।
৩০ পূর্বোক্ত পৃ ১০২-১০৩।
৩১ পূর্বোক্ত পৃ ১০৪-১০৫। ৩২ পূর্বোক্ত পৃ ১০৭।
৩৩ পূর্বোক্ত পৃ ১১০। ৩৪ পূর্বোক্ত।
৩৫ পূর্বোক্ত পৃ ১১১-১১২।
৩৬ পূর্বোক্ত পৃ ১১৪-১১৫। ৩৭ পূর্বোক্ত।
৩৮ পূর্বোক্ত পৃ ১১৬-১১৭।
৩৯ পূর্বোক্ত পৃ ১১৮। ৪০ পূর্বোক্ত পৃ ১১৮-১১৯।
৪১ পূর্বোক্ত পৃ ১১৯।
৪২ ‘পাকিস্তানের বিপ্লবী যুব সমাজের প্রতি ঈশ্বরদীতে অনুষ্ঠিত রাজশাহী বিভাগীয় যুব সম্মেলনে গৃহীত ইস্তাহার, পৃ ১২-১৩।
৪৩ সৈনিক, ১২/০৮/১৯৪৯; আজাদ, ৫/৮/১৯৪৯।
৪৪ East Bengal Legislative Assembly Proceedings, Fourth Session, 1947, P 50 Vol. IV, No. I, P 52.
৪৫ পূর্বোক্ত।
৪৬ পূর্বোক্ত পৃ ৬০
৪৭ পূর্বোক্ত পৃ ২০২-২০৩
৪৮ পূর্বোক্ত পৃ ৬০
৪৯ পূর্বোক্ত পৃ ৫৩
৫০ পূর্বোক্ত পৃ ৮৭
৫১ পূর্বোক্ত পৃ ৫৩
৫২ পূর্বোক্ত Vol. I, No. 4, P 116-117
৫৩ পূর্বোক্ত Vol. I, No. I, P 56.
৫৪ পূর্বোক্ত পৃ ৫৪
৫৫ পূর্বোক্ত পৃ ৫৬
৫৬ East Bengal Legislative Assembly Proceedings, Vol. IV, No. I, P 56
৫৭ পূর্বোক্ত পৃ ৫৬-৫৭।
৫৮ পূর্বোক্ত পৃ ৫৭।
৫৯ পূর্বোক্ত পৃ ৫৮।
৬০ পূর্বোক্ত।
৬১ পূর্বোক্ত।
৬২ পূর্বোক্ত পৃ ৬২।
৬৩ কংগ্রেস দলের নেতা বসন্তকুমার দাসও তাঁর ২১শে নভেম্বরের পরিষদ বক্তৃতায় রেকর্ড অব রাইটস প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে খাজা সেলিমের নোটের উল্লেখ করেন।
৬৪ East Bengal Legislative Assembly Proceedings, Vol. IV, No. I, পূর্বোক্ত P 202।
৬৫ পূর্বোক্ত পৃ ৬৩।
৬৬ পূর্বোক্ত পৃ ৬৪।
৬৭ পূর্বোক্ত পৃ ৭৫।
৬৮ পূর্বোক্ত পৃ ৭৬-৭৭।
৬৯ পূর্বোক্ত পৃ ৭৬।
৭০ পূর্বোক্ত পৃ ৭৭।
৭১ কৃষ্ণবিনোদ রায়: চাষীর লড়াই, পৃষ্ঠা : ৩৫-৩৬, বঙ্গীয় প্রাদেশিক কৃষক সভার পক্ষে বগলা গুহ কর্তৃক ২৪৯, বহুবাজার স্ট্রীট, কলিকাতা থেকে প্রকাশিত।
৭২ EBLA Proceedings, Vol. I, No. I, পূর্বোক্ত, পৃ ৮০।
৭৩ পূর্বোক্ত পৃ ৬০।
৭৪ পূর্বোক্ত পৃ ৮১।
৭৫ পূর্বোক্ত পৃ ৮৩।
৭৬ পূর্বোক্ত পৃ ৮৪।
৭৭. পূর্বোক্ত পৃ ৮৪।
৭৮ পূর্বোক্ত পৃ ৮৭।
৭৯ পূর্বোক্ত পৃ ৮৮-৮৯।
৮০ পূর্বোক্ত পৃ ৮৯।
৮১ পূর্বোক্ত পৃ ৯০।
৮২ পূর্বোক্ত পৃ ১১০-১১১।
৮৩ পূর্বোক্ত পৃ ১১২।
৮৪ পূর্বোক্ত পৃ ১১৭।
৮৫EBLA Proceedings, Vol. I, No. 4.
৮৬ EBLA Proceedings, Vol. I, No. I, P 117.
৮৭ দ্রষ্টব্য: বদরুদ্দীন উমর, চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে বাঙলাদেশের কৃষক, তৃতীয় পরিচ্ছেদ।
৮৮ EBLA Proceedings, Vol. I, No. I, পূর্বোক্ত, পৃ ১২০।
৮৯ পূর্বোক্ত পৃ ১১২-১১৬।
৯০ পূর্বোক্ত পৃ ১২৩।
৯১ পূর্বোক্ত পৃ ১২৩।
৯২ পূর্বোক্ত পৃ ১২৭।
৯৩ এখানে তারিখ ভুল আছে। এ সম্পর্কে অন্যান্যদের সাথে সাক্ষাৎ আলাপের থেকে জানা যায় যে নরসিংদীতে কৃষক সম্মেলন হয়েছিলো ১৯৪৮-এর প্রথম দিকে এবং তফজ্জল আলী তাতে উপস্থিত ছিলেন।
৯৪ EBLA Proceedings, Vol. I, No. I, পূর্বোক্ত, পৃ ১৯১।
৯৫ পূর্বোক্ত, পৃ ১৯১।
৯৬ পূর্বোক্ত পৃ ২০৬-২০৭।
৯৭ পূর্বোক্ত পৃ ২০৭।
৯৮ পূর্বোক্ত পৃ ১১২-১৩।
৯৯ পূর্বোক্ত পৃ ২১৪।
১০০ পূর্বোক্ত পৃ ২১৫।
১০১ পূর্বোক্ত পৃ ২১৭ [এখানে উল্লেখযোগ্য যে এই মহা প্রতিপত্তিশালী পরিবার’-এর সেলিম সাহেব পূর্ব বাঙলা ব্যবস্থা পরিষদের সদস্য ছিলেন। প্রথম দিকে তিনি কংগ্রেসী জমিদার ও কংগ্রেসী সদস্যদের সাথে একযোগে মুসলিম লীগের জমিদারী উচ্ছেদ সংক্রান্ত প্রস্তাবিত বিলের বিরোধিতা করলেও শীঘ্রই তাঁকে পূর্ব বাঙলার মন্ত্রী সভার সদস্য করে নেওয়া হয় এবং এই অতিরিক্ত ক্ষতিপূরণের ফলে তিনি মুখ বন্ধ করেন।-ব.উ.]।
১০২ পূর্বোক্ত পৃ ২১৭-১৮।
১০৩ পূর্বোক্ত পৃ ২১৮।
১০৪ পূর্বোক্ত পৃ ২১৯।
১০৫ পূর্বোক্ত। [চা বাগান মালিকদের স্বার্থ রক্ষার ক্ষেত্রে সিলেট জেলার অধিবাসী কংগ্রেসী সদস্য পূর্ণেন্দু কিশোর সেনগুপ্ত এবং মুসলিম লীগের মন্ত্রী তফজ্জল আলীর মধ্যে ভ্রাতৃত্বভাব লক্ষ্যণীয়।-ব.উ.]।
১০৬ পূর্বোক্ত।
১০৭ পূর্বোক্ত পৃ ২২০, [কৃষি জমি টুকরো টুকরো হওয়ার প্রক্রিয়া বন্ধের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি সত্ত্বেও মন্ত্রী নিজেও স্পেশাল কমিটিতে ৮৮ ধারা বাতিলের সপক্ষে ভোট দিলেন কেন সে সম্পর্কে অবশ্য তিনি কিছু বলেননি।-ব.উ.]।
১০৮ পূর্বোক্ত পৃ ২২১।
১০৯ পূর্বোক্ত পৃ ২২১।
১১০ – নরসিংদীর জনসভা সম্পর্কে ২৫/৪/১৯৬৯ তারিখে তফজ্জল আলী এক সাক্ষাৎকারের সময় আমাকে যা বলেন সেটা নীচে উদ্ধৃত করা হলো। জন সভাটির তারিখ সঠিকভাবে নির্ণয়ের সুবিধের জন্যে তার পূর্ববর্তী একটি ঘটনারও উল্লেখ তাঁর জবানীতেই দিলাম। “রাজশাহী কলেজের ছাত্রদের দ্বারা আমন্ত্রিত হয়ে ৩০শে জানুয়ারী, ১৯৪৮, (তারিখটা স্পষ্ট মনে আছে কারণ ট্রেনে চড়ার পূর্বে সেই রাত্রে স্টেশনেই আমরা গান্ধীজীর হত্যার খবর পেলাম) আমি এবং নঈমুদ্দীন রাজশাহী রওয়ানা হই। রাজশাহী গিয়ে দেখলাম সেখানে ১৪৪ ধারা জারী করেছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও ভুবনমোহন পার্কে ৩১শে জানুয়ারী জনসভা হয়েছিলো এবং সরকারের তরফ থেকে বাধা প্রদানের কোন চেষ্টা হয়নি।
“এর কিছুদিন পর নরসিংদীতে একটা জনসভার ব্যবস্থা করা হয়েছিলো। মহম্মদ আলী এবং আমার সেখানে যাওয়ার কথা ছিলো। কিন্তু ট্রেন ছাড়ার দুঘণ্টা পূর্বে মহম্মদ আলী আমাকে চিঠি লিখে জানালেন যে, মিটিং হতে না পারে তার জন্যে ১৪৪ ধারা জারী করা হয়েছে। আমরা যখন পার্টিতে আছি তখন সেই পার্টির সিদ্ধান্ত অনুসারে জারীকৃত ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করা ঠিক হবে না। এ সত্ত্বেও আমি কিন্তু গেলাম কারণ আমি মনে করলাম যারা সভা অর্গানাইজ করেছিলো তাঁরা Good মুসলিম লীগার এবং না গেলে তাঁদেরকে Let Down করা হবে। নরসিংদী পৌঁছে অবশ্য দেখা গেলো যে মহম্মদ আলীর Information ঠিক ছিলো না। ১৪৪ ধারা জারী করা হয়নি এবং সেখানে একটা বিরাট সভা হয়েছিলো।”
নরসিংদীর এই জনসভা সম্পর্কে কমরুদ্দীন আহমদ ২৬/৪/৬৯ তারিখে এক সাক্ষাৎকারের সময় আমাকে বলেন :
“নরসিংদীতে পুরানো কিছু কৃষক কর্মীরা একটা সভা আহ্বান করেছিলেন এবং সেই সভায় মহম্মদ আলীর সভাপতিত্ব করার কথা ছিলো। সভাটিতে আমাদের এবং মালেক, তফজ্জ্বল আলী প্রভৃতিরও যাওয়ার কথা ছিলো। কিন্তু যাওয়ার দিনে বেলা দশটার সময় অর্থাৎ ট্রেন ছাড়ার কিছু পূর্বে মহম্মদ আলী বলেন যে, তিনি যেতে পারবেন না কারণ জিন্নাহ খবর দিয়েছেন যে আমরা জমিদারী উচ্ছেদ ইত্যাদির কথা বলছি এবং সেটা রাষ্ট্রবিরোধী কথা। কাজেই মিটিং এ যাওয়া তার পক্ষে আর সম্ভব নয়। মালেকও সেই কারণে গেলেন না। তফজ্জ্বল আলী এ খবর না জানার ফলে নরসিংদী পৌঁছে দেখলেন যে মহম্মদ আলীরা আসেননি। সেই দেখে তিনি বক্তৃতা না করেই ফেরত এলেন। এসব কথা আমার খুব স্পষ্ট মনে আছে।”
এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট আরও তথ্যবিবরণের জন্য দ্রষ্টব্য: পূর্ব বাঙলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতির প্রথম খণ্ড পৃ ১০১-১০২।
১১১. তৃতীয় পরিচ্ছেদ দ্রষ্টব্য
১১২ তৃতীয় পরিচ্ছেদ দ্রষ্টব্য
১১৩ পূর্বোক্ত, Assembly Proceedings, Vol. IV, No. 3, P 73.
১১৪ পূর্বোক্ত পৃ ৭৪-৭৫।
১১৫ পূর্বোক্ত পৃ ৭৪।
১১৬ পূর্বোক্ত পৃ ৭৪।
১১৭ পূর্বোক্ত পৃ ৭৪-৭৫।
১১৮ পূর্বোক্ত পৃ ৭৫।
১১৯ পূর্বোক্ত পৃ ৭৬।
১২০ পূর্বোক্ত পৃ ৭৭-৭৮।
১২১ পূর্বোক্ত পৃ ৮০।
১২২ পূর্বোক্ত পৃ ৮০-৮১।
১২৩ পূর্বোক্ত পৃ ৮২-৮৩।
১২৪ পূর্বোক্ত পৃ ৮৫-৮৬।
১২৫ পূর্বোক্ত পৃ ৮৬-৮৭।
১২৬ EB Assembly, Proceedings, Vol. IV, No. 3, P 109-10.
১২৭ পূর্বোক্ত পৃ ১১১।
১২৮ পূর্বোক্ত পৃ ১২৫-২৭।
১২৯ ওয়াকফ্ আলাল-আওলাদ-এর এই ব্যাখ্যা একেবারে ভ্রান্ত। সাধারণ ওয়াকফ্ এবং এর মধ্যে যথেষ্ট তফাত আছে এবং ওয়াকফ্ আলাল-আওলাদের ওপর পারিবারিক দখল ও অধিকার প্রায় সার্বজনীন ব্যাপার।
১৩০ যে সমাজে ইসলামী শাসন কায়েম থাকে তাকে বলা হয় দারুল ইসলাম। যে সমাজ অনৈসলামিক শাসন থাকে তাকে বলা হয় দারুল হরব।
১৩১ EB Assembly, Proceedings, Vol. IV, No. 3, P 4, পূর্বোক্ত, পৃ ১৫৪
১৩২ পূর্বোক্ত পৃ ১৫৬
১৩৩ সবুর খানের এই উদ্বেগের আসল কারণ তৎকালীন পূর্ব বাঙলায় কৃষকদের সশস্ত্র সংগ্রাম এবং বিদ্রোহ। কিন্তু তা সত্ত্বেও দেশীয় পরিস্থিতির কোন উল্লেখ করা থেকে বিরত থেকে কৌশলের সাথে তিনি এখানে চীনে অবস্থানের উল্লেখ করেছেন।
১৩৪ EB Assembly, Proceedings, Vol. IV, No. 4, P. 4.
১৩৫ পূর্বোক্ত পৃ ২৭।
১৩৬ খুব সম্ভবতঃ অতিরিক্ত জমি হাতে রাখার উদ্দেশ্যেই এই “রাবার কোম্পানী” চালু করা হয়েছিলো। কারণ পরবর্তীকালে রাজস্বমন্ত্রী উল্লিখিত এই “কোম্পানীর” কোন হদিস আর পাওয়া যায়নি।
১৩৭ E.B. Assembly. Proceedings vol. IV. No. 4, পূর্বোক্ত, পৃ ২৮
১৩৮ পূর্বোক্ত।
১৩৯ পূর্বোক্ত
১৪০ – এই কৃষক বিদ্রোহ ও সংগ্রামের বিস্তৃত বিবরণের জন্য তৃতীয় পরিচ্ছেদ দ্রষ্টব্য।
১৪১ EB Assembly, Proceedings, Vol. IV, No. 4, P 47-49
১৪২ পূর্বোক্ত P 57-59.
১৪৩ পূর্বোক্ত, Vol. IV, No. 6, P 136.
১৪৪ পূর্বোক্ত, EBLA Proceedings, Vol. I, No. 4, P. 96.
১৪৫ Statistical Digest of East Pakistan, 196৪ হামিদুল হক অবশ্য এই পরিমাণ ৩ কোটি টাকা বলে মোটামুটিভাবে নির্দেশ করে।-ব.উ.].
১৪৬ EB Assembly, Proceedings, Vol. I, No. 4, P 96.
১৪৭ পূর্বোক্ত।
১৪৮ আইয়ুব খানের সামরিক শাসনের পূববর্তী এই খাজনা বৃদ্ধি পায়নি। কিন্তু খাজনা বৃদ্ধির যে সুযোগ আইনের মাধ্যমে সরকার নিজের হাতে রেখেছিলেন সেই সুযোগ ব্যবহার করেই আইয়ুব আমলে বেপরোয়াভাবে খাজনা বৃদ্ধি করা হয়।
১৪৯ Statistical Digest of East Pakistan, 196৪.
১৫৬ । বদরুদ্দীন উমর রচনাবলী খণ্ড ৪