দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ – পাখীর বাগান
বালীর খালের দক্ষিণ ধার ধরিয়া কিয়দ্দূর পশ্চিমাভিমুখে গমন করিলে, একটা বাগানে আসিয়া উপস্থিত হওয়া যায়। কিন্তু আমরা যে সময়ের বিবরণ লিখিতেছি, তখন ইহা ভীষণ জঙ্গলময় ছিল। লোকে ইহাকে ‘পাখীর বাগান’ বলে। কেন যে এই স্থানের নাম ‘পাখীর বাগান’ হইল, বোধ হয়, অনেকেই তাহা অবগত নহেন। লর্ড কর্ণওয়ালিসের শাসন সময়ে ‘রত্নাপাখী’ নামে একজন দুৰ্দ্দান্ত ডাকাইত ছিল। তাহাকে কেহ গ্রেপ্তার করিতে পারিত না। সে সন্ধ্যার সময়ে আপনার সহিত কথাবার্তা কহিয়া, দশ ক্রোশ দূরে ডাকাতি করিয়া, সেই রাত্রেই পুনর্ব্বার আসিয়া আপনার সহিত সাক্ষাৎ করিতে পারিত। তাহার এই অদ্ভুত ক্ষমতা থাকায় লোকে তাহাকে পাখী বলিত এবং ঐ স্থানে তাহার আড্ডা ছিল বলিয়া ঐ স্থান পাখীর বাগান বলিয়া প্রসিদ্ধ হইয়াছিল। সন্ধ্যা উত্তীর্ণ হইয়া গিয়াছে, চারি-পাঁচ দণ্ড রাত্রি হইয়াছে, এমন সময়ে একখানি জেলেডিঙ্গি ঐ জঙ্গলের একধারে আসিয়া লাগিল। একজন দীর্ঘকার গৌরবর্ণ পুরুষ সেই নৌকা হইতে নামিয়া, নৌকাখানি খালধারে তুলিয়া রাখিয়া বনমধ্যে প্রবেশ করিল; এবং সেই রাত্রিকালে সেই জনশূন্য কণ্টকাকীর্ণ সর্পসঙ্কুল নিবিড় বনের মধ্য দিয়া অকুতোভয়ে যাইতে লাগিল।
বিস্তৃত বনের মধ্যপ্রদেশে হোগলদলাবৃত এক জলাশয় ছিল। জলাশয়ের চতুৰ্দ্দিকে বৃহৎ বৃহৎ বৃক্ষ সকল গগনস্পর্শী শাখা-প্রশাখা বিস্তার করিয়া বনস্থল আচ্ছন্ন করিয়াছিল। সেই সকল শাখা পল্লব ভেদ করিয়া সূর্যকিরণ তথায় প্রবেশ করিতে পারিত না। বস্তুতঃ স্থানটি এরূপ ভয়ঙ্কর ছিল যে, দিনমানেও তথায় যাইতে কাহারও সাহস হইত না। জলাশয়ের চতুষ্পার্শ্ব অভেদ্য কেতকী ও বেত্রবনে পরিবৃত। সেই জলাশয়ের মধ্যভাগে নারিকেলপত্রাচ্ছাদিত একটি কাষ্ঠমঞ্চ। আগন্তুক হামাগুড়ি দিয়া বেত্র ও কেতকীবন পার হইয়া সেই জলাশয়ে নামিল, এবং হস্তস্থিত সুদীর্ঘ যষ্টি দ্বারা জলের গভীরতা পরীক্ষা করিতে করিতে কিয়দ্দূর গিয়া জলনিমজ্জিত কি যেন একটা কঠিন পদার্থের উপরে উঠিয়া দাঁড়াইল এবং তথা হইতে যষ্টির উপরে ভর দিয়া লম্ফ প্রদানে মঞ্চোপরি উত্থিত হইল।
মঞ্চের একপার্শ্বে মিট্মিট্ করিয়া একটি প্রদীপ জ্বলিতেছিল, এবং কৃষ্ণবর্ণ যমদূতের ন্যায় কয়েকটা বিকটাকার মূর্তি তথায় উপস্থিত ছিল।
সেই কদাকার ভয়ঙ্কর ব্যক্তিগণ হইতে কিঞ্চিদ্দূরে পৃথগাসনে তাকিয়া হেলান দিয়া পঞ্চাশৎ বর্ষ বয়স্ক একজন গম্ভীরাকৃতি পুরুষ একটি রূপার গুড়গুড়ীতে তামাক খাইতেছিলেন। এই ব্যক্তির নাম রাঘবদাস সেন, জাতিতে কায়স্থ। তৎকালে হুগলী জেলার মধ্যে তিনি একজন সম্ভ্রান্ত লোক • ছিলেন। একজন প্রধান জমীদার বলিয়া সকলেই তাঁহাকে জানিত। যদিও তাঁহার বয়স হইয়াছিল, তথাপি তাঁহার শরীর দুর্ব্বল হয় নাই, তাঁহাকে দেখিলে যুবাপুরুষ বলিয়া ভ্রম হইত। তিনি লাঠী ও তলওয়ার খেলায় বিলক্ষণ নিপুণ ছিলেন। তিনি আগন্তুককে দেখিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “রতন খবর কি?”
রতন। প্রকাণ্ড কাৎলা। কমবেশ্ দশটি হাজার।
রাঘব। (ত্র্যস্তভাবে নল ত্যাগ করিয়া) অ্যাঁ! লোকটা কে রে?
রতন। তা হাতে বহরে খুব, মস্ত বড়লোক।
রাঘব। ব্রাহ্মণ নয় ত?
রতন। আজ্ঞা, রতন কি এতই বেতালিম?
রাঘব। তবু লোকটা কে রে?
রতন। খাদ্য-খাদক সম্বন্ধ বটে।
রাঘব। আরে লোকটাই কে বলনা? রতন। দেওয়ান গোবিন্দরাম।
গোবিন্দরামের নাম শুনিয়া রাঘবের মুখমণ্ডল কিছু অপ্রসন্ন ভাব ধারণ করিল। রাঘব সেন যেন কিছু নিরুৎসাহ হইয়া পড়িলেন।
রতন জাতিতে ব্রাহ্মণ, ইহারই অপর নাম রত্নাপাখী, ইহারই ভয়ে ভাগীরথীর উভয়কূলবাসী লোক সৰ্ব্বদা সশঙ্ক থাকিত। ইহারই ভয়ে কেহ রাত্রে নিশ্চিন্ত হইয়া নিদ্রা যাইতে পারিত না। ইহার নামে ভয় পাইত না, তৎকালে এরূপ লোক অতি অল্প ছিল। এমন কি রতন যেখানে যাইত, সেইখানেই তাহার মর্য্যাদা। সকলেই তাহাকে গুরু অপেক্ষা অধিক খাতির করিত। রতন বড়ই চতুর, রাঘবের ভাব দেখিয়া বুঝিতে পারিল যে, তিনি গোবিন্দরামের নাম শুনিয়া ভয় পাইয়াছেন। অমনি ঈষৎ হাস্য করিয়া বলিল, “ কি সেন মহাশয়, আপনি দেওয়ানের নাম শুনিয়া ভয় পেলেন না কি?”
রাঘব। বাপু ভয়ও নাই, ভরসাও নাই।
রতন। ভরসা নাই বল্লেন কিসে?
রাঘব। গোবিন্দরাম বড় কেও-কেটা নয়, সে রতন শর্ম্মাকে কিছুকাল শেখাতে পারে।
রতন। আমায় শেখায়, এমন লোক ত. বাঙ্গালায় দেখি না।
রাঘব। তুমি বাঙ্গালী লুঠে খাও, সে ইংরেজ লুঠে খায়।
রতন। সে ইংরেজের মাথা খায়, আজ আমি তার মাথা খাব। রতনের কেরামৎ, হিম্মৎ আর তাকৎ কতক আজ তোমাকে দেখাব। এই কাজ করে বুড়ো হলে, এখনও তুমি প্রাণের ভয় কর। রাঘব। দেখ বেল্লিক, আমি দ্রোণ, আর তুই অৰ্জ্জুন—এটি যেন সকল সময়ে মনে থাকে। রতন। (কিঞ্চিৎ লজ্জিত হইয়া) আজ্ঞা, আপনি কি রাগ করলেন?
রাঘব। রাগ করিনি, তবে কি জানিস এরূপ দুঃসাহসী কাজে প্রবৃত্ত হওয়া ভাল নয়। আপনার ভুজবলের অতিরিক্ত কাজ করতে গেলে, একদিন-না-একদিন ঠেকতে হবে।
রতন। আপনি সে ভয় করবেন না, গোবিন্দরাম নৌকা হতে বালীর ঘাটে নেমেছে, একজন মাত্র পাইক সঙ্গে নিয়ে মাঠ দিয়ে যাচ্ছে। আমার সঙ্গে কেবল ঝোড়ো, মাধা আর কালাকে দিন, আমি এখনি কাজ হাঁসিল করে আসছি, খুব দামী দামী জিনিষ তার সঙ্গেই আছে, নৌকায় কেবল কতকগুলো বাসন ও কাপড়-চোপড় মাত্র আছে। জনকতক গোলালোকে গেলেই অনায়াসে সে কাজ সাবাড় করে আসতে পারব।
রাঘব সেন, দেওয়ান গোবিন্দরামকে বেশ জানিতেন। তিনি কিরূপ পরাক্রান্ত ও সম্ভ্রান্তলোক তাহাও তিনি বিশিষ্টরূপে অবগত ছিলেন; কিন্তু দেওয়ান একজন মাত্র লোক সমভিব্যাহারে বহুমূল্য দ্রব্যাদি লইয়া জনহীন প্রান্তর দিয়া গমন করিতেছেন শুনিয়া তাঁহার অর্থলালসা বলবতী হইল, তাঁহার সাহস বাড়িল, আর ইতস্ততঃ না করিয়া, রত্নাপাখী যেরূপ বলিল, তাহাই করিতে হুকুম দিলেন। তৎক্ষণাৎ দুইখানি সড়পি প্রস্তুত হইয়া বাহির হইয়া গেল এবং রতন উপরোক্ত তিনজন দস্যুকে সঙ্গে লইয়া দেওয়ানের অনুসরণ করিল।