দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ : নবাব দরবার ও রাজা-রাজড়া

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ – নবাব দরবার ও রাজা-রাজড়া

‘রাজায় রাজায় যুদ্ধ হয়, উলু খাগড়ার প্রাণ যায়।’—প্রবাদ

পলাশীর ষড়যন্ত্র বাংলার সাধারণ মানুষের চেতনায় কোনো রেখাপাত করেছিল বলে মনে হয় না। এ দেশের রাষ্ট্রীয় উত্থান পতনের সঙ্গে জনজীবনের মানসিক যোগ এমনিতে খুবই ক্ষীণ। ‘খোকা ঘুমুল পাড়া জুড়োল বর্গী এল দেশে, বুলবুলিতে ধান খেয়েছে খাজনা দেব কিসে’ বা ‘মগের মুল্লুক’ জাতীয় ছড়া ও প্রবাদ থেকে বর্গি হাঙ্গামা, মগ জলদস্যর অত্যাচার, ইত্যাদি কোনো কোনো রাষ্ট্রীয় ভাগ্য বিপর্যয়ের সার্বজনিক ছবি মেলে। কিন্তু পলাশীর যুদ্ধ সম্বন্ধে মুর্শিদাবাদের একটি আঞ্চলিক গ্রাম্য সংগীত (সূচনার গোড়ায় গোড়ায় উদ্ধৃত) ছাড়া আর কোনো ছড়া বা প্রবাদ মেলে না। ঐ ঘটনা লোকের চোখে না পড়া কিছু আশ্চর্যের কথা নয়। পলাশীর প্রাঙ্গণে কত বড়ো রাষ্ট্রবিপ্লবের সূচনা হল তা তখনো কেউ বোঝেনি—সাধারণ লোক দূরে থাক, মোগল মনসবদার, হিন্দু জমিদার বা ইংরাজ কোম্পানী কতা পর্যন্ত না। সে কালের আদার কারবারীরা জাহাজের খবরে প্রয়োজন বোধ করত না। যুগী জেলে চাষী তাঁতী ফড়িয়া ব্যাপারীরাও পলাশীর খবর নিয়ে মাথা ঘামায় নি। তখন তখন কোনো খবর পেয়েছিল কি না তাতেও সন্দেহ আছে। রাজশক্তি বা ভূমিস্বত্ব যে যে শ্রেণীতে বিন্যস্ত ছিল একমাত্র সেই সেই শ্রেণীর মানুষদের কাছে রাষ্ট্রীয় উত্থান পতন বড়ো হয়ে দেখা দিত। সমাজের অপেক্ষাকৃত উচ্চ স্তরে পরবর্তীকালে পলাশীর ঘটনাবলী পল্লবিত হয়ে নানা গল্পের আকার ধারণ করে, যার কিছু কিছু মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কারের ‘রাজাবলী’ এবং রাজীবলোচন মুখোপাধ্যায়ের ‘মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র রায়স্য চরিত্রং’ এ প্রথম লিপিবদ্ধ আকারে পাওয়া যায়। যে স্তরে গল্পগুলি চালু ছিল তা চণ্ডাল কৈবর্ত বা আতরাফ মুসলমানদের সমাজ নয়, উৰ্দ্ধতন হিন্দু জমিদার ও ভদ্র লোকের সমাজ। অভিজাত মুসলমান আশরাফ সমাজে প্রচলিত ফার্সী ইতিহাসগুলিতে কেবল বকশী, দেওয়ান, ফৌজদারান, মনসবদারা আদি মোগল রাজপুরুষদের চক্রী রূপে চিত্রিত করা হয়েছিল। সে সকল গ্রন্থে হিন্দু জমিদারদের উল্লেখ দেখা যায় না। কিন্তু হিন্দু ভদ্র সমাজে মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র ও অন্যান্য বড়ো বড়ো জমিদারদের চক্রান্তে যোগদানের গল্প চালু হয়েছিল, অপরপক্ষে এ গল্পও প্রচলিত ছিল যে নাটোরের ধর্মপ্রাণা রানী ভবানী কাপুরুষতার জন্য রাজা কৃষ্ণচন্দ্রকে কঠিন বিদ্রুপ করেছিলেন। ইতিহাস শুধু সত্য ঘটনাবলীর নিখুঁত উপাদান নির্ভর বিবরণ নয়। তদানীন্তন ও পরবর্তীকালে সমাজ মানসে সে সব ঘটনা প্রতিফলিত হয়ে যেমন আকার ধারণ করেছিল তাও তো এক জাতের ইতিহাস। সে হিসাবে এই প্রচলিত কাহিনীগুলির ঐতিহাসিক মূল্য কম নয়। ভুল করে হোক, ঠিকভাবে হোক, এই সব কাহিনীতে যাঁরা ষড়যন্ত্রকারী অথবা ষড়যন্ত্রীর বিরুদ্ধপক্ষ রূপে চিত্রিত হয়েছেন, সেই মীর জাফর, রায় দুর্ল্লভ, রামনারায়ণ, রাজবল্লভ, কৃষ্ণচন্দ্র, রানী ভবানী ইত্যাদিরা কেউ সাধারণ মানুষ ছিলেন না—তাঁরা সকলে সুবাহ্‌ বাংলায় জনসাধারণের উপর প্রভুত্বের যে কাঠামো নবাবী আমলে গড়ে উঠেছিল তার কোনো না কোনো একটি কোঠায় অবস্থিত ছিলেন। সে কালে নবাবী শাসন ও রাজশাসন এই দুই স্তরে ক্ষমতা বিন্যস্ত ছিল। উপরের কোঠায় ছিল মুর্শিদাবাদের রাজশক্তি আর তার নীচের কোঠায় ছিল আঞ্চলিক ভূমিশক্তি।

পলাশীর ষড়যন্ত্রের পিছনে নরগণের উপর প্রভুত্বের এই যে কাঠামো কার্যকর হয়েছিল, মুর্শিদকুলী খানের আমলে তার উদ্ভব হয়। জাফর খান ওরফে মুর্শিদকুলী খান বাংলার প্রথম স্বাধীন নবাব। তাঁর নিজামতে সমাজ নিয়ন্ত্রণের কাঠামোয় যে আমূল পরিবর্তন ঘটেছিল তা মোটামুটিভাবে পলাশীর যুদ্ধ পর্যন্ত অক্ষুণ্ণ ছিল। ঐ জাফরখানী কাঠামো মীর কাশিমের নিজামতে ইংরাজের চাপের বিরুদ্ধে আত্মরক্ষার শেষ তাগিদে বিকৃত আকার ধারণ করে এবং মহম্মদ রেজা খানের নিয়াবতে ধ্বসে পড়ে। স্বাধীন নবাবী আমলে সুবাহ্‌ বাংলায় সমাজের উপর প্রভুত্বের আকার প্রকার সম্বন্ধে দু একটা কথা পলাশীর ষড়যন্ত্রের আলোচনায় অপ্রাসঙ্গিক হবে না।

বাদশাহ আওরঙ্গজেবের আমলে অন্যান্য সুবাহ্‌র মতো সুবাহ্‌ বাংলাতে ও দিল্লী থেকে একজন নাজিম ও একজন দেওয়ান আলাদা আলাদা করে নিযুক্ত হতেন। নিজামতে মনসবদারদের পরিচালিত অশ্বারোহী বাহিনীর তদারকি, এবং অন্যান্য যাবতীয় সামরিক শাসনকার্য ও দেশের শান্তি রক্ষার দায়িত্ব নির্বাহ হত। দেওয়ানীতে প্রধানত হিন্দু রাজস্ব কর্মচারীদের দিয়ে জমিদারদের কাছ থেকে মালজমির খাজনা এবং হাট গঞ্জ বাজার জলচৌকি থেকে সায়ের (অর্থাৎ ব্যবসায়ের উপর মাশুল) আদায় করানো হত। এ ছাড়া দেওয়ানী বিভাগে কারচুপি ও তছরূপ আটকানোর উদ্দেশ্যে এবং জমিদার রায়তের ভূমিস্বত্বের প্রমাণ রাখার জন্য একজন স্বাধীন বঙ্গাধিকারী কানুনগো মহাশয় ছিলেন, যাঁর অধীনে পরগনায় পরগনায় কানুনগোরা ও মৌজায় মৌজায় পাটোয়ারীরা দলিল ও হিসাব রাখত। কতকগুলি মৌজা (গ্রাম) নিয়ে এক একটি পরগনা এবং কতকগুলি পরগনা নিয়ে এক একটি সরকার গঠিত হত, এবং মোগল শাসনতন্ত্র অনুয়ায়ী প্রত্যেক সরকারে নিজামতের একজন ফৌজদার ও দেওয়ানীর একজন আমিল যথাক্রমে শান্তিরক্ষা ও রাজস্ব আদায়ের কাজে ব্যাপৃত থাকতেন। জমিদারদের শায়েস্তা রাখা প্রত্যেক ফৌজদারের অন্যতম কর্তব্য বলে পরিগণিত হত। বাদশাহী মনসবদারগণের মধ্যে নির্দিষ্ট পদানুক্রম ও তদনুযায়ী সওয়ার না থাকলে কাউকে ফৌজদার পদে নিয়োগ করা হত না। এই প্রতিপত্তির জোরে যে কোনো ফৌজদার দরকার হলে জমিদারদের সরিয়ে দেওয়ানী বিভাগের আমিল, সাজোয়াল, ওয়াদাদার, ইজারাদার মারফৎ সরাসরি খাজনা আদায়ের শক্তি রাখতেন। প্রত্যেক পরগনায় বংশানুক্রমিক ভাবে একজন স্থানীয় জমিদার বা চৌধুরী নিযুক্ত রাখা হত। সরকারের খাজনা আদায় করে দেওয়ানী বিভাগের আমিলদের হাতে তুলে দেওয়া এঁদের হক ছিল। তা ছাড়া পরগনায় পরগনায় নির্দিষ্ট সংখ্যক পাইক রেখে চুরি ডাকাতি রোধ করার দায়িত্ব এদের উপর অর্পিত ছিল। উপরোক্ত খিদমতের জন্য তাঁদের মালজমি ও সায়ের জমার খাজনা থেকে দশ ভাগের এক ভাগ প্রাপ্য ছিল। অবাধ্য না হলে তাঁদের এই বংশানুক্রমিক হক থেকে চ্যুত করা হত না। নিজামত, দেওয়ানী ও কানুনগোই কর্মচারীরা যে অর্থে সরকারী চাকরী করতেন এবং বদলি হতেন, জমিদার, চৌধুরী ও তালুকদার (জমিদারের অধীন পরগনার এক অংশের হকদার) সেই অর্থে সরকারী কর্মচারী ছিলেন না, তাঁরা ছিলেন আঞ্চলিক ভূশক্তির বংশানুক্রমিক প্রতিভূ। জমি থেকে এঁরা যে খাজনা তুলে দিতেন তার এক অংশ যেত-খালসায় অর্থাৎ কেন্দ্রীয় তহবিলে। আর এক অংশ মনসবদাররা পদানুযায়ী নির্দিষ্ট সংখ্যক সওয়ার রাখার জন্য জায়গীর হিসাবে ভোগ করতেন। জমিদারীতে জমিদারের যেমন হক থাকত জায়গীরে মনসবদারের তেমন হক থাকত না। সরকারী তহবিল থেকে মনসবদারদের সরাসরি নগদ বেতন না দেওয়া হলে তার পরিবর্তে কোনো কোনো এলাকার খাজনা সাময়িক ভাবে তাঁদের জায়গীর হিসেবে নির্দিষ্ট হত। নিজামত ও দেওয়ানীর প্রধান প্রধান রাজপুরুষ নিজ নিজ মনসব পদানুক্রম অনুযায়ী কম-বেশী জায়গীর পেতেন, অথবা খালিসা থেকে সরাসরি নগদ মাইনে নিতেন। খালিসা ও জায়গীর মিলিয়ে মালজমি থেকে যে খাজনা আদায় হত তার বাইরে বাজে জমিন দপ্তরের আওতায় কিছু নিষ্কর জমি ছিল যা নবাব সরকার বা জমিদারেরা মদদ্‌-ই-মাশ, লাখেরাজ, খয়রাত, আয়মা, পীরোত্তর, দেবোত্তর, ব্রহ্মোত্তর, মহত্রাণ, চাকরান, পাইকান হিসেবে বিতরণ করতেন।

মোটামুটি এই ছিল বাদশাহী আমলে মোগল সওয়ার বাহিনী ও ভূমিশাসনের কাঠামো। নবাবী আমলে এই কাঠামোয় বিশেষ বিশেষ পরিবর্তন ঘটল। সুবাহ্‌ বাংলা বিহার ওড়িশার মোগল শাসক শ্রেণী দিল্লী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবার ফলে এই পরিবর্তনগুলি দেখা দিল। আগে দিল্লী থেকে সমস্ত মোগল সাম্রাজ্য জুড়ে মনসবদারদের নিয়োগ, অপসারণ, স্থানান্তর ও পদোন্নতি নিয়ন্ত্রিত হত এবং সেই সূত্রে বছর বছর বাংলা এবং অন্যান্য সুবাহ্‌র মধ্যে তাঁদের আনাগোনা চলত। আওরঙ্গজেবের প্রিয়পাত্র মুর্শিদকুলী খান প্রথম একাধারে নাজিম ও দেওয়ান নিযুক্ত হওয়ায় নিজামত ও দেওয়ানীর পার্থক্য কার্যত মুছে গেল। বাংলার নবাবেরা একাধারে নাজিম ও দেওয়ান রূপে কার্যত স্বতন্ত্র হয়ে যাবার পর মোগল শাসক শ্রেণীর চলনশীলতার গতিবেগ স্তিমিত হয়ে এল। দিল্লী ও অন্যান্য সুবাহ্‌র সঙ্গে যোগসূত্র একেবারে ছিন্ন হয়ে গেল তা বলা যায় না। নবাবেরা সাত হাজারী মনসবদার পদে অধিষ্ঠিত থেকে বাদশাহী দরবারের প্রধান প্রধান ওমরাওদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে রইলেন। তাঁদের অধীনস্থ হাজারী, দু হাজারী, চার হাজারী মনসবদারও অন্যান্য সুবাহ্‌র মোগল রাজপুরুষদের সঙ্গে রক্তের সম্পর্ক ও শ্রেণীগত সহানুভূতির মাধ্যমে অদৃশ্য যোগসূত্রে বাঁধা থাকলেন। কিন্তু সরকারী পদে অধিষ্ঠিত রাজপুরুষদের নিয়োগ ও পদোন্নতির নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র বাদশাহী দরবার থেকে নবাব দরবারে স্থানান্তরিত হওয়ায় সুবাহ্ বাংলার মনসবদার শ্রেণীর ক্ষমতার ভিত্তিও সর্বভারতীয় মোগল সাম্রাজ্য থেকে সুবাহ্‌ বাংলায় সরে গিয়ে আগের চেয়ে দুর্বল হয়ে পড়ল। তাঁদের সর্বভারতীয় ক্ষমতা একটি আঞ্চলিক কাঠামোর মধ্যে আবদ্ধ হয়ে যাবার সঙ্গে সঙ্গে ঐ কাঠামোর মধ্যে আঞ্চলিক শক্তিগুলির জায়গা করে দিতে হল। মনসবদার, জগৎ শেঠ ও জমিদারদের নিয়ে সুবাহ্ বাংলায় নতুন করে সামাজিক প্রভুত্বের কাঠামো গড়ে উঠল।

মনসবদারান্‌ নামধেয় মোগল শাসক শ্রেণী মূলত বাদশাহী সওয়ারদের ফৌজী নেতৃবৃন্দ ছিলেন। বাঙালী হিন্দু রাজকর্মচারীদের অনুপ্রবেশের ফলে এই ইরান তুরান ও হিন্দুস্তান সম্ভূত অশ্বারূঢ় শাসক শ্রেণীর আভ্যন্তরীণ চরিত্র উল্লেখযোগ্য ভাবে পাল্টে গেল। বাংলাদেশের কর্দমাক্ত জলাকীর্ণ নিম্নভূমিতে অশ্বারোহী বাহিনী অকেজো বিবেচনা করে মুর্শিদকুলী খান খরচ কমাবার জন্য সদরের তিন হাজার সওয়ারী ফৌজ বরখাস্ত করে মনসবদারদের জায়গীরগুলি বহুলাংশে ওড়িশাতে সরিয়ে বাংলা সুবাহ্‌র তিন চতুথাংশ মালজমি খালিসার অন্তর্ভুক্ত করে নিলেন।১০ এইভাবে জমির উপর মোগল ফৌজী নেতৃবৃন্দের প্রত্যক্ষ প্রভুত্ব কয়েকটি মাত্র সামরিক গুরুত্বপূর্ণ ফৌজদারী এলাকায় সীমাবদ্ধ হয়ে গেল। মোগল শাসনতন্ত্র অনুযায়ী সুবা বাংলার ৩৪টি সরকারের প্রত্যেকটিতে আলাদা আলাদা করে ফৌজদার থাকার কথা, কিন্তু নবাবরা সরকারগুলি তুলে দিয়ে ১৩টি সুবৃহৎ চাকলা গঠন করে তার মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন জমিদারী তালুকদারী স্বত্ব একত্রে সমন্বয় করে ২৫টি বড়ো বড়ো ইহ্‌তমাম১১ সৃষ্টি করলেন। নিজামতের সামরিক কর্তৃত্বাধীনে মাত্র দশটি নিয়াবতী ও ফৌজদারী এলাকা রইল যেখানে মনসবদার শ্রেণীর সরাসরি শাসন বজায় থাকল। এগুলির মধ্যে বৃহত্তম এলাকাটি ছিল ঢাকার নায়েব নাজিম শাসিত নিয়াবত, অন্য নয়টি—চট্টগ্রাম (ইসলামাবাদ), মেদিনীপুর, পূর্ণিয়া (জালালগড়), রাজশাহী, সিলেট, রংপুর, রাঙামাটি, কাটোয়া ও হুগলীর ফৌজদারদের শাসিত প্রত্যন্ত বা বন্দর এলাকা। প্রথম আচমকা বর্গি আক্রমণের সময় আলিবর্দি খান যখন মারাঠাদের হাতে বন্দী হতে হতে কোনোমতে ওড়িশা থেকে বর্দ্ধমানে পালিয়ে এলেন, তখন বোঝা গেল মুর্শিদকুলী খান কর্তৃক মুর্শিদাবাদের নিজামত সদরে মাত্র ২০০০ ঘোড়সওয়ার ও ৪০০০ পদাতিক মোতায়েন রাখা১২ এবং আভ্যন্তরীণ অঞ্চলগুলি থেকে ফৌজদারী শাসন প্রত্যাহার করে নেওয়া আখেরে ভালো হয়নি। ঢাকার নিয়াবত এবং পূর্ণিয়া, চট্টগ্রাম, সিলেট, রঙপুর ও মেদিনীপুরের প্রত্যন্ত ফৌজদারী এলাকা বহুতর ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র তালুক ও জমিদারী নিয়ে গঠিত হয়েছিল। এই কটি অঞ্চলে সরাসরি সরকারী সামরিক শাসন বজার থাকল বটে, কিন্তু তার বাইরে সে সময় গোটা গোটা ইহতমাম জুড়ে এক একটি বৃহদাকার জমিদারী আপন আপন কলেবর বৃদ্ধি করে চলল। বর্ধমান, বিষ্ণুপুর, বীরভূম, নদীয়া, যশোহর, রাজশাহী ও দিনাজপুর—এই সাতটি জমিদারী তখন আর নিছক জমিদারী নয়—আসলে সেগুলি নবাবী রাষ্ট্রের অন্তর্গত এক একটি বিস্তীর্ণ স্বায়ত্তশাসিত রাজ্য বিশেষ। পরস্পরের মধ্যে যুদ্ধে ব্যাপৃত এই সব হিন্দু ও পাঠান রাজা মহারাজার ইহত্‌মাম সমূহে কোনো সরকারী আমিল রইল না। স্থানীয় আমিল মারফৎ প্রত্যক্ষ রাজস্ব আদায় পদ্ধতি ব্যয়সাপেক্ষ বলে তা তুলে নেওয়া হল—কেবল প্রয়োজন বোধে মুর্শিদাবাদ থেকে এক এক জন আমিল পাঠিয়ে খাজনা আদায় করা হত।১৩ নচেৎ এমনিতে জমিদাররা সরাসরি জগৎ শেঠের দেওয়া কর্জের মাধ্যমে ঠিক সময়ে মুর্শিদাবাদে খাজনা জমা করে দিতেন, আবার জগৎ শেঠের কুঠীর হুন্ডীর মাধ্যমে দিল্লীতে বাদশাহী নজরানা চলে যেত।১৪ প্রকৃতপক্ষে জগৎ শেঠের কুঠীই তখন নবাবী রাজকোষ হয়ে দাঁড়িয়েছে এবং জমিদারদের কিস্তী ও টাঁকশালের মুদ্রা নিয়ন্ত্রণ করে সুবাহ্‌ বাংলা বিহার জুড়ে টাকার আনাগোনার উপর জগৎ শেঠ তাঁর সর্বময় কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে নিয়েছেন। এইভাবে জগৎ শেঠ ও জমিদারদের উপর ভিত্তি করে নেহাৎ অল্প ব্যয়ে একটি গোটা রাজস্ব ব্যবস্থা ও দেওয়ানী শাসনযন্ত্র গড়ে উঠল। খরচ কাতর মুর্শিদকুলী খানের হিসাবী মনোভাবের পরিচয়বাহী এই নতুন ভূমিশাসন ব্যবস্থা ১৭২৮ খ্রীস্টাব্দে সুজাউদ্দীন খানের হাতে ঈষৎ সংশোধিত আকার নিয়ে পলাশীর যুদ্ধ পর্যন্ত বজায় ছিল। নীচে এর পরিচয় দেওয়া হচ্ছে।

খালিসার অন্তর্ভুক্ত ১৫টি গোটা গোটা ইহুতমাম জোড়া বড়ো জমিদারী ও ১০টি ক্ষুদ্রতর জমিদারী ও মুস্কুরী তালুক সমম্বিত এলাকা অর্থাৎ মোট ২৫টি খালিসার ইহ্‌তমাম তৎসহ ১৩টি আলাদা আলাদা জায়গীর এই নিয়ে গঠিত সমগ্র খালিসা (১২৫৬ পরগনা) ও জায়গীর (৪০৪ পরগনা) সমন্বিত মোট ৩৮ (২৫ + ১৩) খাতের জমা তুমরী তেশকিশ (১৭২৮ খৃঃ)১৫:

১৫টি বড়ো জমিদারী দ্বারা গঠিত ১৫টি ইহ্‌তমাম (খালিসা)।

(১) বর্ধমান—পরগনা ৫৭, জমা ২০,৪৭, ৫০৬ টাকা। দিগ্‌বিজয়ী মহারাজ কীর্তিচন্দ্রের নবাবী অনুগ্রহপুষ্ট সুবিশাল বর্ধমান রাজ্য গঠিত হবার আগে দক্ষিণ রাঢ় দেশে অনেকগুলি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্য ছিল। এদের মধ্যে একটি রাঢ়ী ব্রাহ্মণদের আদি নিবাস প্রাচীন ভুরসুট রাজ্য:

আসীদ্দক্ষিণরাঢ়ায়াং দ্বিজানাং ভূরিকর্মণাং।

ভুরিসৃষ্টিরিতি গ্রামো ভূরিশ্রেষ্ঠীজনাশ্রয়ঃ॥১৬

এই প্রাচীন ব্রাহ্মণ রাজ্য তিনটি শাখায় বিভক্ত, তার মধ্যে একটি শাখার দুর্গস্বামী কবি ভারতচন্দ্র রায় গুণাকরের পিতা নরেন্দ্রনারায়ণ রায়। অন্য একটি শাখা সম্বন্ধে কিছু জানা যায় না, আর বৃহত্তম শাখার রাজা ভবানীপুর দুর্গের স্বামী লক্ষ্মীনারায়ণ। আর একটি প্রাচীন রাজ্য গোপভূমের সদগোপদের অমরাগড় রাজ্য। নিম্নবর্ণের ও বাগদীদের সহায়তায় পুষ্ট চিতুয়া ও বরদার বর্গক্ষত্রিয় (বাগদী) নরপতি শোভসিংহ১৭ তখন এই অঞ্চলের সবচেয়ে প্রতাপান্বিত জমিদার। নিকটে কীর্তিচন্দের পিতামহ কৃষ্ণরাম রায়ের চার পাঁচটি পরগনা সম্বলিত মাঝারী আকারের জমিদারী ছিল। কৃষ্ণরামের পূর্বপুরুষ আবু রায় পাঞ্জাবী ক্ষেত্রী জাতীয় ব্যবসায়ী ছিলেন, স্থানীয় ফৌজদারকে আকস্মিক বিপদের সময় খাদ্য ও যানবাহন যুগিয়ে ইনি ১৬৮০ খ্রীস্টাব্দে কয়েকটি মহলের চৌধুরী নিযুক্ত হন। পরে সরকার থেকে পূর্বতন জমিদার রাম রায়কে বরখাস্ত করে আবু রায়ের এক ছেলেকে বর্ধমান পরগনা দেওয়া হয়। এঁর বংশধর কৃষ্ণরাম। কৃষ্ণরাম বর্ধমানের সঙ্গে আজমৎশাহী পরগনা যুক্ত করে সম্রাট আলমগীরের বাদশাহী ফারমান নিয়ে বেশ জাঁকিয়ে বসেছেন,১৮ এমন সময় চিতুয়ার বাগদী রাজা শোভা সিংহ পাঠান রহিম খানের সহায়তায় মোগলদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে বর্ধমানে চড়াও হলেন। কৃষ্ণরামকে হত্যা করে শোভসিংহ তাঁর কুমারী কন্যা সত্যবতী ও অন্যান্য পরিবারবর্গকে অন্তঃপুরায়ত্ত করলেন। বড়ো ছেলে জগৎরাম তদানীন্তন রাজধানী ঢাকায় পালালেন। সে সময় (১৬৯৬ খৃঃ) বর্ধমান এবং একই সঙ্গে হুগলী, মেদিনীপুর ও যশোহরের ফৌজদার তিন হাজারী মনসবদার নুরুল্লাহ খান যশোরে বসে অর্থকরী ব্যবসায় বাণিজ্যে নিয়ত ছিলেন, তাঁর কাপুরুষতায় চারিদিকে বিদ্রোহানল ছড়িয়ে পড়ল। ফৌজদারের পৃষ্ঠদর্শন করে উৎসাহিত বিদ্রোহীরা হুগলী দখল করল, কিন্তু নিকটস্থ ওলন্দাজদের কামানের গোলায় টিকতে না পেরে শোভা সিংহ বর্ধমানে ফিরে এলেন। নিহত কৃষ্ণরামের সুন্দরী কন্যার দিকে তাঁর নজর পড়ল। রিয়াজ-উস-সলাতীনের ভাষায়, ‘সেই অপূর্ব চীনী মৃগের উপর এই রাতের কুত্তা ঝাঁপ দিতে উদ্যত হলে সিংহীর মত তেজস্বিনী কুমারী রক্তচক্ষুর এক পলকে অন্তর্বাসের মধ্যে লুকানো শাণিত ছুরিকা বের করে নাভী থেকে তলপেট পর্যন্ত ঐ হতভাগাকে চিরে ফেললেন এবং তারপর সেই ধারাল ছুরিতেই নিজের প্রাণসূত্রে ছেদন করলেন।’১৯ বৰ্গক্ষত্রিয়হন্ত্রী ক্ষেত্ৰীতনয়ার পলাতক ভাই জগৎরাম বিজয়ী মোগলদের পিছন পিছন ফিরে এসে বিদ্রোহীদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেওয়া চারটি পরগনা পেলেন—বর্ধমান পরিবারের উপর এইবার নিজামতের সুনজর বিশেষভাবে গিয়ে পড়ল। বিদ্রোহীদের ঘাঁটি ছিল চন্দ্রকোণা দুর্গ। দেওয়ান হয়ে বাংলায় এসে ১৭০২ খ্রীস্টাব্দে মুর্শিদকুলী খান তা দখল করে বর্ধমানের অন্তর্ভুক্ত করে দিলেন।২০ এই সময় অকস্মাৎ বিশ্বাসঘাতকের হাতে জগৎরাম খুন হলে তাঁর বড়ো ছেলে কীর্তিচন্দ রাজা হয়ে (১৭০২-১৭৪০) নবাব সরকারের নেক নজরে থেকে রাজ্য বিস্তারে মন দিলেন। কখনো মাল জামিন হয়ে,২১ কখনো বা ফৌজ পাঠিয়ে, কখনো নিজামতের হুকুমে, একে একে দক্ষিণরাঢ়ের প্রাচীনতর রাজ্যগুলি কীর্তিচন্দ গ্রাস করলেন।

হুগলীর অন্তর্গত ভূরসুট পরগনার দূর্গস্বামীদের উপর হুগলীর ফৌজদারের দৃষ্টি প্রসন্ন ছিল না, তার উপর এঁদের এক জ্ঞাতিশত্রু রাজবল্লভ কীর্তিচন্দের দেওয়ান ছিলেন। কথিত আছে, এক রাতের মধ্যে কীর্তিচন্দের ফৌজ এসে ভবানীপুর ও পেঁড়ো দুর্গ দখল করেছিল। ১৭১২ খ্রীস্টাব্দে এই ঘটনা ঘটে, কবি ভারতচন্দ্র মামাবাড়ি পালিয়ে যান।২২ হুগলীর ফৌজদারীর মধ্যেই মনোহরশাহী নামে আর একটি জমিদারী ফৌজদারের বিষদৃষ্টিতে পড়েছিল, তাও কীর্তিচন্দের হস্তগত হল, এবং তারকেশ্বরের কাছে বলাগড়ের রাজার জমিও তিনি দখল করলেন। মওলঘাটের চৌধুরীদের উপর মুর্শিদকুলী খান ক্রুদ্ধ হয়ে ঐ পরগনা কীর্তিচন্দের জমিদারীর অর্ন্তভুক্ত করে দিলেন। ঘাটালের কাছে স্বয়ং সমরে অবতীর্ণ হয়ে কীর্তিচন্দ চন্দ্রকোনা এবং বরদা রাজ্য থেকে শোভা সিংহের উত্তরাধিকার প্রাপ্ত স্থানীয় ভূস্বামীদের সম্পূর্ণ ধ্বংস করে নির্মম প্রতিশোধ নিলেন। বিদ্রোহের পরেই সরকারী হুকুমে এরা বর্ধমানের বশংবদ হন, এখন সে সব রাজ্য নিশ্চিহ্ন হল।২৩ এরপর যুদ্ধ করে তিনি বন বিষ্ণুপুরের রাজা গোপাল সিংহকে কাবু করে ফেলেছেন, এমন সময় বর্গি আক্রমণ শুরু হওয়ায় রাঢ়ের এই দুই প্রধান রাজা বিবাদ মিটিয়ে বর্গি প্রতিরোধে নামলেন। বর্ধমানের রাজকর্মচারী মানিকচন্দের অধীনে কীর্তিচন্দের ফৌজ আলিবর্দি খানের শিবিরে যোগ দিল। লক্ষ্য করবার মতো জিনিস এই যে অন্যান্য জমিদারদের সঙ্গে কীর্তিচন্দের যুদ্ধবিগ্রহে নবাব সরকার থেকে কোনো বাধা দেওয়া হয়নি, বরং উল্টে ১৭৩৬ খ্রীস্টাব্দের একটি বাদশাহী ফারমানে চন্দ্রকোনা অভিযানে বিজিত পরগনাগুলির উপর কীর্তিচন্দ্র রায়ের অধিকার কায়েমী করে দেওয়া হয়েছিল।২৪ যশোহরের বিদ্রোহী রাজা সীতারাম রায়, বন বিষ্ণুপুরের পরম বৈষ্ণব রাজা গোপাল সিংহ, বীরভূমের পাঠান রাজা বদি-উজ-জামান খান, নাটোরের পুণ্যশ্লোকা রানী ভবানী, নদীয়ার চতুর চূড়ামণি রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায় ইত্যাদি অনেক প্রধান প্রধান জমিদার কীর্তিচন্দের প্রতিবেশী ছিলেন, কিন্তু তাঁর মত আজানুলম্বিত বাহু প্রবল প্রতাপান্বিত নরপতি বোধহয় কেউ ছিলেন না। এই ধর্মশীল রাজা শত শত ব্রাহ্মণ ভোজন করাতেন, এবং বন কেটে কাঞ্চন নগর বসিয়ে, যাগেশ্বরে দীঘি নির্মাণ করে ও গঙ্গার ঘাট বাঁধিয়ে অক্ষয় কীর্তি রেখে যান। দেশের অন্যান্য জমিদাররা তাঁর নামে ভয়ে থরহরি কাঁপতেন। ধর্মমঙ্গলের কবি ঘনরাম চক্রবর্তী তাঁর বৃত্তিভোগী ছিলেন, এবং ভনিতায় ‘মহারাজ চক্রবর্তী’ কীর্তিচন্দের বন্দনা করেছিলেন।২৫ বর্গি আক্রমণের প্রারম্ভে তিনি মারা গেলে বর্ধমান শহর শোক সাগরে ডুবে গিয়েছিল। এই নিয়ে একটি শোকগাথা রচিত হয়:২৬

রাজা রাজবলহ।
যাগেশ্বরে দিয়া দীঘি নাম রহিল॥
বন কেটে বসালেন রাজা কাঞ্চননগর।
হেদে হে ধার্মিক রাজা দয়ার সাগর॥
বর্ধমানে বাড়ি তোমার দীঘনগরে হাট।
সাধ করে বাঁধালেন রাজা মা গঙ্গার ঘাট॥
ধর্মশীল মহারাজা পাপে না দেন মন।
কত শত করান রাজা ব্রাহ্মণ ভোজন॥
আজান বাহু ছিল তোমার জানে জগতে তে।
অর্জন রাজার সমান তুমি ছিলে ক্ষমতাতে॥
জমিদারেরা ছিল দেশে বড়োই অত্যাচারী।
তোমার নামে কাঁপত তারা সদাই থরহরি॥
বর্গি ভয় হতে রাজা আমাদের রাখলে যতনেতে।
তোমার সমান দয়াল রাজা না দেখি ধরাতে॥
ক্ষেত্ৰীকুলে জনম তোমার তরয়ালের ধনী।
চন্দ্রকোনা জয় করিতে সাজিলেন আপনি॥
দক্ষিণ ছেড়ে এলেন রাজা সাত গাড়ি টাকা।
মাল মুলুকে লুটে নিলে যমে দিলে দাগা॥
আষাঢ়েতে রথযাত্রা অঘ্রাণ মাসে রাস।
অঘ্রাণ মাসে মরলেন রাজা স্বর্গে করলেন বাস॥
হাঁড়া হাঁড়া ঘৃত জ্বলে জ্বলে চন্দন কাঠ।
দাঁইহাটে রহিল রাজার শানবাঁধা ঘাট॥
পাখে কান্দে পাখুড়ী কান্দে কান্দে রাজ তোতা।
মা জননী এসে বলে বাছা গেলি কোথা॥
শহরের লোক কান্দে করে হায় হায়।
হেঁটমুণ্ড করে কান্দে হরেকৃষ্ণ রায়।
হাতিশালে হাতি কান্দে ঘোড়া না খায় পানি।
বিনিয়ে বিনিয়ে কান্দে কীর্তিচান্দের রানী॥
ছোটরানীর কাপড়খানি বড়োরানীকে সাজে।
রানীর কপালে সিন্দুরের ফোটা গঙ্গাজলের মাঝে॥
হাতিশালে হাতি কান্দে পাইশালে ঘোড়া।
মানিকচান্দ বাবু কান্দে ভিজে জামাজোড়া॥

এই শোকগাথায় যে অস্পষ্ট বিবরণ আছে তা থেকে মনে হয় বর্গি হামলার প্রথম চোটে কীর্তিচন্দের সাত গাড়ি টাকা লুট হয়ে যায় এবং দক্ষিণ থেকে দ্রুত বর্ধমান প্রত্যাবর্তনের সময় তাঁর অকস্মাৎ মৃত্যু হয়। অসময়ে বাপের মৃত্যু হওয়ায় চিত্রসেন রায়ের উপর বর্গি হামলা প্রতিরোধের দায়িত্ব বর্তায়। কিন্তু তাতে জমিদারীর বিস্তার থেমে থাকেনি। শোভা সিংহ পরিচালিত বাগদী বিদ্রোহের অব্যবহিত আগে ১৬৯৪ খ্রীস্টাব্দেই আওরঙ্গজেবের হুকুম অনুযায়ী অমরাগড়ের সদগোপ রাজারা বর্ধমান বংশের অধীন হয়ে গিয়েছিলেন। কীর্তিচন্দের ছেলে চিত্রসেন রায় অমরাগড়ের শেষ রাজাকে বলপূর্বক উৎখাত করে গোপভূম থেকে সদগোপ শক্তি নিশ্চিহ্ন করে দেন। নবাব সরফরাজ খানের একজন আমলার যোগসাজসে চিত্রসেন রায় নরসিংহ দেব রায়ের জমিদারী অরসা পরগনা হস্তগত করেন। কিন্তু বেশী দিন রাজ্যভোগ তাঁর কপালে লেখা ছিল না। অপুত্রক অবস্থায় ১৭৪৪ খ্রীস্টাব্দে তাঁর মৃত্যু হলে পর কীর্তিচন্দের ভ্রাতুষ্পুত্র তিলকচন্দের উপর জমিদারী বর্তাল। চিত্রসেনকে বর্গি প্রতিরোধের নায়ক খাড়া করে তাঁর সভাপণ্ডিত বাণেশ্বর বিদ্যালঙ্কার সংস্কৃত ‘চিত্রচম্পূ’ কাব্য রচনা করেছিলেন। চিত্রসেনের রাজত্বকালে বর্গিদের পুনঃপুনঃ আক্রমণে বর্ধমান রাজ্য ছারখার হয়ে গেছিল, তিলকচন্দের কালে হামলা থামবার পর দেশে শান্তি ফিরে এল। কথিত আছে তিলকচন্দের মা বর্গির হাঙ্গামায় বর্ধমান ছেড়ে পালিয়ে পররাজ্য কাউগাছিতে তিলকচন্দকে প্রসব করেন, এবং সেইখানেই জবরদস্ত রানী বিষ্ণুকুমারীর সঙ্গে তিলকচন্দের বিবাহ সম্পন্ন হয়। এই বিবাহের ফলে মহাধড়িবাজ মহারাজ তেজচন্দ ভূমিষ্ঠ হন। তিলকচন্দ সংস্কৃত পণ্ডিতদের পোষণ করতেন এবং তাঁর সভাপন্ডিত শম্বুরাম বিদ্যালঙ্কার মহারাজ রাজবল্লভ সেনের আহুত বৈদ্যোপবীত বিধায়ক পণ্ডিত সভায় উপস্থিত ছিলেন। নদীয়ার শ্রেষ্ঠ নৈয়ায়িক শঙ্কর তর্কবাগীশ, কাউগাছির বিখ্যাত নৈয়ায়িক শঙ্কর বাচস্পতি এবং আরো অনেক পণ্ডিত তিলকচন্দের কাছে নিষ্কর জমি পেয়েছিলেন।২৮

কলকাতায় তিলকচন্দ একটি বসতবাটি তৈরী করিয়েছিলেন। এই বাড়ীতে থেকে রামজীবন কবিরাজ নামে এক গোমস্তা রাজার কলকাতার কাজকর্ম দেখাশুনা করতেন। ১৭৫৫ খ্রীস্টাব্দে ইংরেজদের সঙ্গে বর্ধমানরাজের একটা ছোটখাট সংঘর্ষ বাধে। জন উড একজন লোভী ইংরেজ বণিক। বর্ধমানের গোমস্তার সঙ্গে তাঁর কিছু ব্যবসায়িক লেনদেন ছিল। উড সাহেব কি করে কোম্পানীর দস্তক লটকে নিজের পণ্যদ্রব্য বেচাকেনা করবেন সেই তালে থাকতেন। রামজীবন কবিরাজের সঙ্গে ঝগড়া করে তিনি মেয়র কোর্টে নালিশ আনলেন। কোর্টে ডিক্রী হল সাহেব বর্ধমানের গোমস্তার কাছে ৬৯৫৭ টাকা পাবেন। গোমস্তা রামজীবন আদালতে কোনো কথা বলতে রাজি হলেন না। তাঁর বক্তব্য, উড সাহেবের কাছে তাঁর প্রভুর কোনো দেনা নেই। আদালতে যে তমসুক সাহেব দেখিয়েছেন, বর্ধমানরাজ তা আর একজন লোককে আগে এক সময় দিয়েছিলেন। সে লোকটির সঙ্গে রাজার অনেক দেনা পাওনার ব্যাপার ছিল, সেই সূত্রে পাওনা মিটাবার জন্য রাজা তাকে তমসুক দেন, সে তা উডের কাছে হস্তান্তর করে। তা ছাড়া বর্ধমানরাজ ইংলণ্ডেশ্বরের কোনো প্রজা নন, তিনি মোগল বাদশাহর একজন প্রধান প্রজা, এবং এই মামলার নিষ্পত্তি করতে হলে তিনি মোগল আদালতে যেতে রাজি আছেন। এমন কি যে লোকটিকে তিনি তমসুক দিয়েছিলেন সেও নবাবের প্রজা, এবং মেয়র কোর্টের আওতায় এই বিবাদ পড়তেই পারে না। কিন্তু ইংরাজ আদালতে এ সব ওজর টিকল না। ডিক্রী নিয়ে সাহেব রাজার বাড়ী ক্রোক করতে এলে, গোমস্তা তখনি বাড়ী ছেড়ে মনিবের কাছে খবর দিতে চলে গেলেন। বাড়ীতে ডিক্রীদার প্রচুর টাকাকড়ি, মনিমুক্তা এবং অনেক টাকার অঙ্কের সব কাগজ হস্তগত করলেন।২৯ এই খবর পেয়ে তিলকচন্দ নিরতিশয় ক্রুদ্ধ হলেন। বর্ধমানের যেখানে যেখানে ইংরেজ কুঠি ছিল তাতে তালা লাগিয়ে রাজা ইংরেজদের গোমস্তাদের হাজতে পুরলেন, তাঁর সুবিস্তৃত অধিকারে ইংরেজ বাণিজ্য বন্ধ হয়ে গেল। অমনি ইংরেজরা নবাব দরবারে ছুটল। আলিবর্দি খান তখন মৃত্যুশয্যায়। রাজকার্য চালাচ্ছেন নবাবের নাতি। ইংরেজদের প্রতি সিরাজউদ্দৌলাহ্ মোটেই প্রসন্ন ছিলেন না। কিন্তু তিনি যখন শুনলেন, নবাবী হুকুমের অপেক্ষা না রেখেই রাজা নিজের হুকুমে চৌকী বসিয়েছেন, তখন রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে তিলকচন্দের উপর পরোয়ানা পাঠালেন। ইংরাজ দপ্তরে রক্ষিত ঐ পরোয়ানার অনুবাদে দেখা যায় নবাবের আদেশের অপেক্ষা না রেখে স্বেচ্ছাচারের জন্য রাজাকে প্রচণ্ড ধমকে দেওয়া হয়েছে। যে সব চৌকী বসিয়ে তিলকচন্দ ইংরাজ কুঠী বন্ধ করেছিলেন, নবাবী হুকুমে তাঁকে সেগুলি তখনি তুলে নিতে হল। ইংরাজরা যে নিতান্ত অসঙ্গত ভাবে বর্ধমানের রাজার বাড়ি ক্রোক করেছে সে কথা কোথায় পড়ে রইল।৩০

এর এক বছরের মধ্যেই ইংরেজদের সঙ্গে নবাব সিরাজউদ্দৌলাহ্‌র সংঘর্ষ বেধে গেল। তখন তাঁর সঙ্গে কলকাতা অভিযানে বর্ধমানের যে ফৌজ গেছিল তাতে দেওয়ান মানিকচন্দ ছিলেন এবং তাঁরই হাতে বিজিত কেল্লা রাখার ভার দিয়ে নবাব ফিরে আসেন। কিন্তু মাদ্রাজ থেকে ইংরেজ নওয়ারা আসা মাত্র মানিকচন্দ রণে ভঙ্গ দেন।

পলাশীর যুদ্ধের সময় তিলকচন্দের জমিদারীর আয়তন ছিল ৫১৭৪ বর্গমাইল৩১ এবং পরবর্তীকালের বর্ধমান, হুগলী এই দুই সমগ্র ইংরাজ কালেক্টরী ও মেদিনীপুরের কিয়দংশ জুড়ে এই জমিদারী বিস্তৃত ছিল। আয়তনে নাটোরের জমিদারী এর চেয়ে বৃহত্তর হলেও জমার হিসাবে বর্ধমান ছিল বঙ্গের বৃহত্তম জমিদারী এবং জেমস গ্রান্ট এর সঙ্গে তাঞ্জোরের৩২ মারাঠা রাজ্য এবং চৈৎ সিংহের বানারস রাজ্যের তুলনা করেছিলেন।

(২) রাজশাহী-পরগনা ১৩৯, জমা (জায়গীর বাদে) ১৬,৯৬,০৮৭।

নাটোর পরিবারের আকস্মিক অভ্যুদয়ের আগে রাজশাহীর জমিদারী একটি প্রাচীন পশ্চিমাগত লালা কায়স্থ পরিবারের হাতে ছিল। নিকটে চারটি প্রাচীন রাজ্য বরেন্দ্রভূমের পণ্ডিতদের আশ্রয় স্থলরূপে পরিগণিত হত:

সান্তোলং লস্করপূরং নবদ্বীপ ভূষণা।
মণ্ডলানি চ চত্বারি শস্তানি বহুপণ্ডিতৈঃ॥

(লঘুভারত)৩৩

পরবর্তীকালে লস্করপুর (পুঁটিয়া) ও নবদ্বীপ ছাড়া অন্য রাজ্যগুলি একে একে নাটোরের বারেন্দ্র ব্রাহ্মণ জমিদারদের কবলিত হয় এবং আরো অন্যান্য জমিদারী নিয়ে বিশ বছরের মধ্যে অর্ধেক বাংলা জোড়া নাটোর রাজ্য গজিয়ে ওঠে।

নাটোর গাঁয়ে একটি একান্নবর্তী ব্রাহ্মণ পরিবার ছিল। রঘুনন্দন, রামজীবন ও বিষ্ণুরাম, এই তিন ভাই পুঁটিয়ার ঠাকুরের আশ্রয়ে লেখাপড়া শিখতেন। এঁদের বাবা বামদেব লস্করপুর কাছারীতে বারই হাটির তহশীলদার ছিলেন। লস্করপরের জমিদার রঘুনন্দনের উপর প্রীত হয়ে তাঁকে মুর্শিদাবাদে পুঁটিয়া রাজ্যের উকীল পদে নিযুক্ত করেন। উকীল বলতে তখনকার দিনে আদালতের উকীল বোঝত না। এক দরবার থেকে অন্য দরবারে নিযুক্ত দূত বা প্রতিনিধিকে ওয়াকিল বলা হত। বড়ো বড়ো জমিদার এবং রাজারা, নবাব সরকারে ওয়াকিল বা উকীল নিযুক্ত রাখতেন। মুর্শিদাবাদ দরবারে এক বা একাধিক প্রধান রাজপুরুষের কৃপাদৃষ্টি লাভ করে সরকার মহলে নিজের প্রভুর স্বার্থের রক্ষণাবেক্ষণ করা উকীলের কাজ ছিল। পরে যখন ইংরেজরা মুর্শিদাবাদ থেকে কলকাতায় রাজধানী সরিয়ে নিয়ে যায় তখন বড়ো বড়ো জমিদারও নিজের নিজের উকীলদের কলকাতায় স্থানান্তরিত করেন এবং যতদিন তাঁদের রাজ্যগুলি টিকে ছিল ততদিন (অর্থাৎ চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত পর্যন্ত) নবাবী ও ইংরাজ রাষ্ট্রের অন্তর্গত রাজা মহারাজাদের পক্ষ থেকে উকীল মারফৎ কূটনৈতিক তৎপরতা রাজ্যশাসন পদ্ধতির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গরূপে বজায় ছিল।৩৪ রঘুনন্দন যখন লস্করপুরের উকীল হয়ে মুর্শিদাবাদে আসেন, তখন পুঁটিয়ার ঠাকুরের বিশেষ বন্ধু দর্পনারায়ণ সদর কানুনগো ছিলেন। রঘুনন্দন বুদ্ধিমান ও বিচক্ষণ কর্মচারী, তিনি শীঘ্রই বঙ্গাধিকারী মহাশয়ের নায়েব রূপে নবাব সরকারে প্রবিষ্ট হলেন এবং পরে দেখা গেল তিনি মুর্শিদকুলী খানের সুনজরে পড়ে দেওয়ানী বিভাগের বিশিষ্ট রাজপুরুষের ভূমিকায় উদয় হয়েছেন। ১৭১৬ খ্রীস্টাব্দে তাঁকে সায়রা মহলের ইজারাদার এবং ১৭২২ এ তাঁকে টাঁকশালের দারোগা পদে দেখা যায়। দেওয়ানী বিভাগের মধ্যে গুপ্ত থেকে তিনি পর পর চার পাঁচটি বড় বড় জমিদারী নিজের মেজ ভাই রামজীবন এবং রামজীবনের ছেলে কালু কোঁয়ার (অর্থাৎ কালিকাপ্রসাদ) এর নামে বন্দোবস্ত করে নেন।৩৫

(১ম) বানগাছীর চৌধুরীদ্বয় ভগবতীচরণ ও গনেশ নারায়ণ খাজনা দিতে না পারায় ভিতর থেকে কলকাঠি নেড়ে রঘুনন্দন ওই জমিদারী ভাইয়ের নামে পত্তন করিয়ে নেন। এই ঘটনা ঘটে ১৭০৬ খ্রীস্টাব্দে। এই থেকে নাটোর জমিদারীর শুরু।

(২য়) সান্তোল (সাঁতোর) রাজ রামকৃষ্ণ প্রাচীন পরগনা ভাতুড়িয়ার পরাক্রান্ত জমিদার ছিলেন। তাঁর স্ত্রী রানী সর্বাণীর নাম বরেন্দ্রভূমিতে এখনো রানী ভবানীর নামের সঙ্গে উচ্চারিত হয় এমনি তাঁর পুণ্যের মহিমা। সবণিীর এক ছোট বোন ছিলেন—তাঁর নাম রুদ্রাণী। শ্যালিকার রূপে মুগ্ধ হয়ে সান্তোলরাজ রামকৃষ্ণ রুদ্রাণীকে বিয়ে করবার প্রস্তাব দিয়ে সুহৃদ পণ্ডিত জয়দেব তর্কালঙ্কারকে, সাঁতোর থেকে ডেমরায় (সর্বাণীর পিতৃগৃহ) দূত পাঠান। জয়দেব কন্যার রূপে মুগ্ধ হয়ে তাঁকে হঠাৎ বিয়ে করে ফেললেন। এই জয়দেবই নদীয়ার পণ্ডিত সংক্রান্ত প্রবাদে এখনো এই ভাবে কীর্তিত হয়ে আসছেন—‘হরের গদা, গদার জয়। জয়ার বিশু লোকে কয়।’৩৬ সান্তোলরাজ তাঁর সভাপণ্ডিতদের আচার ব্যবহার লক্ষ্য করে তাঁদের পূর্ণ-ব্রাহ্মণ, অর্ধ-ব্রাহ্মণ, ত্রিপাদ ব্রাহ্মণ ও একপাদ ব্রাহ্মণ নাম দিয়ে যে চার ভাগ করেছিলেন, তার মধ্যে জয়দেব অর্ধ-ব্রাহ্মণ শ্রেণীভুক্ত ছিলেন:

ভেজে পক্ককরঞ্জাম্লং জয়দেবঃ সুপণ্ডিতঃ।

আরক্তাঙ্গুলিচিহ্নেন স চাদ্ধব্রাহ্মণোহ ভবৎ.।।৩৭

এই অম্লমধুর অর্ধব্রাহ্মণ (তাঁর জ্ঞাতিভাই দিব্য সিংহ পূর্ণব্রাহ্মণদের একজন ছিলেন) রূপসী রুদ্রাণীকে হঠাৎ বিয়ে করে ফেলে ‘যঃ পলায়তি স জীবতি’ মন্ত্র জপ করতে করতে সান্তোল রাজ্য-সীমা পার হয়ে সোজা নদীয়া রাজ্যে আশ্রয় নেন। এই ঘটনা যখন ঘটে তখন কৃষ্ণনগরে প্রবাদ কীর্তিত ‘রাঘব রায়ের কাল’ চলছে—রাঘব রায় মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের প্রসিদ্ধ পূর্বপুরুষ ছিলেন। পণ্ডিতবর জয়দেব কৃষ্ণনগরের রাজার বৃত্তি ও ভূমি পেয়ে রুদ্রাণীকে নিয়ে সুখে নবদ্বীপে আছেন, এমন সময় খবর এল সাঁতোরে সর্বাণী বিধবা হয়েছেন। রুদ্রাণী রাজরানী না হলেও পুত্রবতী হয়েছিলেন, সর্বাণী বিপুল রাজ্যের অধীশ্বর হয়েও নিঃসন্তান বিধবা হয়ে বাকী জীবন কাটালেন। পূজাআর্চা দানধ্যানেই তাঁর দিন কাটত। অনেক বয়স হয়ে যাওয়ায় বিধবা কানে শুনতে পেতেন না, তাঁর স্বামীর ভাইপো বলরাম যা পারতেন জমিদারী চালাতেন। সর্বাণীর দানের বহর দেখে অসন্তুষ্ট হয়ে মুর্শিদকুলী খান পরুষ ভাষায় আওরঙ্গজেবের কাছে ১৭০৪ খ্রীস্টাব্দে নিবেদন করেন—‘চাকলা ঘোড়াঘাটের ভাতুড়িয়া ও গয়রহের জমিদার সবণিী দেবীর দর্শন ও শ্রবণশক্তির হ্রাস হওয়ায় কার্যপরিচালনে সম্পূর্ণ অক্ষম; তাঁহার স্বামী পূর্বে এই মহালের ভারপ্রাপ্ত ছিলেন, মহালের গোমস্তাগণ এক্ষণে তাঁহার আদেশ মান্য করে না, অনেক রাজস্ব বাকী ও লুটপাট হইতেছে।৩৮ ১৭১০ খ্রীস্টাব্দে ব্রাহ্মণকুল ও প্রজাপুঞ্জের আশ্রয়রূপা এই নবাব সরকারে অনাদৃতা রমণী স্বর্গলাভ করলেন। তখন বলরামও বুড়ো অকর্মণ্য হয়ে পড়ায় রঘুনন্দনের পৃষ্ঠপোষক মুর্শিদকুলী খান রামজীবন ও কালিকাপ্রসাদের নামে বাদশাহী ফরমান আনিয়ে ভাতুড়িয়া পরগনা নাটোরের অধিকারভুক্ত করলেন। নাটোরে রক্ষিত বাহাদুর শাহের এই ফারসী ফারমানের বঙ্গানুবাদ নিম্নরূপ:

‘মহামান্য দস্তখতী সনন্দ এই যে সন পাঁচ জুলুস (রাজত্বের পঞ্চম বর্ষ) ১১ই শাবান বাদশাহ সরকারের হিতকারী, সম্মানভাজন সুচরিত্র অনুগ্রহপাত্র বীর মুর্শিদকুলী খাঁ হুজুরে প্রার্থনা করেন যে “ভাতুড়িয়া পরগনায় (যাহা বঙ্গদেশের কর্মচারীগণের তন্‌খার জন্য নির্দিষ্ট আছে) জমিদারী কার্যের নিতান্ত বেদবস্ত ঘটিয়াছে, তথাকার জমিদারী শ্ৰীমতী সর্বাণী দর্শন ও শ্রবণশক্তিবিহীনা ও কার্যপরিচালনে অক্ষম ছিলেন। সম্প্রতি তাঁহার নিঃসন্তান পরলোক প্রাপ্তি হইয়াছে। তাঁহার স্বামীর ভ্রাতুস্পুত্র বলরাম বৃদ্ধ হওয়ায়, তদীয় দর্শন ও শ্রবণশক্তির হ্রাস হইয়াছে, তিনি নিঃসন্তান, তাঁহার দ্বারা জমিদারী কার্য নির্বাহ হয় না। এজন্য অধীন (কুলী খাঁ) সর্বাণীর মৃত্যুর পরে জমিদারী কার্যে সম্পূর্ণ কুশল রামজীবন ও কালু কোঁয়ারকে মহালের সুশাসন ও উন্নতিবিধান জন্য ঐ জমিদারী বন্দোবস্ত করিয়া দিয়াছে। ভরসা যে, হুজুরের সম্মতিক্রমে দস্তখতী সনন্দ দেওয়া হইবে।” এই আবেদন গ্রাহ্য করা হইল। এক্ষণে কর্তব্য যে, বর্তমান ও ভাবী করোরিয়ান্‌ ও মুতঃসুদ্দীগণ এই আদেশ অনুসারে উক্ত প্রশংসিত ব্যক্তিদ্বয়কে এই জমিদারীর ভারপ্রাপ্ত জানিবেন।৩৯

(৩য়) প্রাচীন লালাবংশীয় রাজশাহী রাজা উদয়নারায়ণ সুবিস্তীর্ণ রাজ্যের অধিকারী ছিলেন—সাঁওতাল পরগনা, উত্তর বীরভূম ও মুর্শিদাবাদ বড়নগর থেকে পদ্মর অপর পার পর্যন্ত বিস্তৃত এই রাজ্য রাজশাহী জেলার তিনগুণ ছিল। প্রাচীন রাজশাহী পরগনার পার্শ্ববর্তী বিস্তীর্ণ ভূখণ্ড সমূহ প্রথমত মুর্শিদকুলী খানের কৃপায় উদয়নারায়ণের জমিদারী ভুক্ত হয়েছিল। কিন্তু উদয়নারায়ণ বেশি দিন দেওয়ানের সুনজরে থাকতে পারেননি। রাজস্ব আদায় ও শান্তিরক্ষার ব্যাপারে উদয়নারায়ণকে সাহায্য করতে মুর্শিদকুলী খান দুইশত ঘোড়সওয়ার সমেত গোলাম মহম্মদ ও কালু জমাদার নামে দুই নায়ক পাঠিয়েছিলেন। তখন মুর্শিদকুলী খান সবে ঢাকা থেকে মুর্শিদাবাদে দেওয়ানী বিভাগ সরিয়ে এনেছেন, রাজধানীর নিকটেই উদয়নারায়ণ ও গোলাম মহম্মদের সামরিক প্রতিপত্তি হঠাৎ বর্ধিত হওয়ায় তিনি সন্ত্রস্ত হলেন। ঐ সময় সেনা-নায়ক গোলাম মহম্মদের অশ্বারোহী দল বকেয়া মাইনের জন্য গ্রামে গ্রামে লুঠতরাজ শুরু করায় মুর্শিদকুলী খান সুযোগ পেয়ে একদল সৈন্য পাঠালেন। উদয়নারায়ণ উত্তর বীরভূমের বীরকিটী গ্রামে গভীর খাত কেটে দুর্গ নির্মাণ করে রেখেছিলেন, বাদশাহী সৈন্যকে তাঁর সেনাপতি গোলাম মহম্মদ বাধা দিলে দুর্গের সামনে মুড়মুড়ে ডাঙা বা মুণ্ডমালার মাঠে দুইপক্ষের যুদ্ধ হল। ক্ষিতীশ বংশাবলী অনুসারে কৃষ্ণনগরের যুবরাজ রঘুরাম বাদশাহী সৈন্যদলে উপস্থিত ছিলেন, তাঁর অব্যর্থ বর্মভেদী শরসন্ধানে মর্মবিদ্ধ হয়ে বিদ্রোহী সেনানায়কের ভবলীলা সাঙ্গ হল। উদয়নারায়ণ বিষ খেয়ে হংস সরোবরের তীরে আত্মহত্যা করলেন, মতান্তরে নাটোরের রঘুনন্দন কর্তৃক ধৃত হয়ে মুর্শিদাবাদের কারাগারে তাঁর মৃত্যু হল। রাজশাহী জমিদারী নাটোরের অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেল, এবং উদয়নারায়ণের বংশধররা নাটোরের বৃত্তিভোগী রূপে কালাতিপাত করতে লাগলেন। এর পরেও কিছু কাল পর্যন্ত রাজশাহী পরগনার পার্শ্ববর্তী সুলতানপুর পরগনা উদয়নারায়ণের বংশধর চাঁদসিংহ ও সাহেবরামের নামে বন্দোবস্ত ছিল, কিন্তু ক্রমে তাও নাটোর রাজ্যের অন্তর্গত হয়ে গেল। পরবর্তীকালে রাজশাহী জমিদারী যখন নাটোর বংশের হস্তচ্যুত হয়, তখন নাটোর বৃত্তিভোগী উদয়নারায়ণের বংশধররা কিছুকাল রাজশাহীর ইংরাজ কালেক্টরের বৃত্তিভোগ করেছিলেন।৪০ লালা উদয়নারায়ণ বৈষ্ণব ছিলেন, তাঁর প্রতিষ্ঠিত মদনগোপালের দারুমূর্তি উত্তরকালে রানী ভবানীর বড়নগরস্থিত রাজরাজেশ্বরী মন্দিরের পূর্বদক্ষিণ কোণে আর একটি মন্দিরে স্থাপিত হয়ে নাটোর বংশের বৈষ্ণব শাখা কর্তৃক পূজিত হত।

(৪র্থ) শোভা সিংহের অভ্যুত্থান এবং উদয়নারায়ণের হাঙ্গামাকালে মহম্মদপুরে রাঢ়ী কায়স্থ জমিদার সীতারাম রায় নিঃশব্দে নদনদী ও জঙ্গলের আড়ালে গড়খাত ঘেরা জায়গায় নগর পত্তন করে শক্তি বৃদ্ধি করছিলেন। মুর্শিদাবাদ দরবারে তাঁর বেশ প্রতিপত্তি থাকলেও ভূষণার ফৌজদার আবু তোরাবের সঙ্গে তাঁর আদৌ প্রীতির সম্পর্ক ছিল না। নবাব এবং ফৌজদারের মনোমালিন্যের সুযোগে ‘হামবড়াইয়ের মাথায় হাঙ্গামার টুপী চাপিয়ে’ (রিয়াজ-উস-সলাতীন) রাজা সীতারাম ফৌজদার সাহেবের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করলেন। মুর্শিদাবাদে দেওয়ান মুর্শিদকুলী খান তখন সবে নাজিম (সুবাদার) হয়ে বসে সমস্ত ফৌজদারীগুলিতে নিজের লোক লাগাবার সুযোগ সন্ধান করছিলেন। অখণ্ড হিন্দুস্থানের শেষ একচ্ছত্র অধীশ্বর মহাপ্রতাপান্বিত সম্রাট আওরঙ্গজেবের আমলে গুরুত্বপূর্ণ ফৌজদারীগুলিতে বাদশাহ স্বয়ং বাছাই করা মনসবদার নিয়োগ করতেন বলে সুবাহ্ বাংলার নাজিমদের অপ্রতিহত শক্তি স্থাপনের কোন উপায় ছিল না। শোভা সিংহের বিদ্রোহকালে যশোহর, হুগলী, বর্ধমান ও মেদিনীপুরের ফৌজদার নুরুল্লাহ্‌ খানের উপরে অসন্তুষ্ট হয়ে আওরঙ্গজেব তাঁর ‘দুগ্ধভ্রাতার’ (সম্রাটের দুধভাই বা foster brother হিসেবে নুরুল্লাহ্‌ খান অতগুলি সরকারের ফৌজদার হয়েছিলেন) হাত থেকে হুগলী, বর্ধমান ও মেদিনীপুরের ফৌজদারী সরিয়ে নেন। এর পরেও ঠুঁটো জগন্নাথ সেজে নুরুল্লাহ্ খান ও তাঁর ছেলে মীর খলিল যশোহরে অনেকদিন বসেছিলেন, কিন্তু তাঁর দুই পৌত্র দায়েমল্লাহ্‌ ও কায়েমউল্লাহ্‌ নাবালক বলে ফৌজদারী পান না এবং নিষ্কর্মা অবস্থায় বিবাদ করতে করতে পরস্পরকে হত্যা করেন।৪১ সে অবধি যশোহরে আর কোনো ফৌজদার নিয়োগের কথা শোনা যায় না, কিন্তু কিছুদিনের জন্য ভূষণায় একটি নতুন ফৌজদারী পদ সৃষ্টি করে তাতে বাদশাহজাদা আজিম-উস-শান নিজের এক আত্মীয় আবু তোরাবকে সীতারামের সন্নিহিত অঞ্চলের ফৌজদার নিযুক্ত করেন। এদিকে সুবাহ্‌দার হয়ে নবাব জাফর খান (অথাৎ মুর্শিদকুলী খান) প্রথমেই হুগলী থেকে বাদশাহের নিযুক্ত ফৌজদারকে হটিয়ে নিজের লোক নিযুক্ত করলেন। ভূতপূর্ব সুবাহ্‌দার আজিম-উস-শানের প্রিয়পাত্র আবু তোরাব বাদশাহ পরিবার সংশ্লিষ্ট উচ্চবংশজাত রাজপুরুষ, তাই নবনিযুক্ত নাজিমকে তিনি তোয়াক্কা করতেন না।৪২ মুনিরাম নামে সীতারামের এক বুদ্ধিমান কায়স্থ উকীল নবাব দরবারে থেকে নানা কৌশলে নবাব জাফর খানকে সন্তুষ্ট রাখতেন। দরবারে ‘কৌন্‌ সীতারাম’ প্রশ্ন উঠলে জবাব দেওয়া হত ‘জিসকা উকীল মুনিরাম।’৪৩ রামরূপ বা রঘুরাম ঘোষ নামে সীতারামের আর একজন বিশ্বস্ত কায়স্থ সহকারী ছিলেন, যাঁর বিপুল বপু ও বিরাট মুণ্ডের জন্য লোকে তাঁকে সেনাপতি মেনহাতী বলে ডাকত। ভূষণা এলাকায় মেনাহাতীর প্রাবল্যে সীতারামের উত্তরোত্তর শক্তিবৃদ্ধি হতে দেখে শঙ্কিত হয়ে আবু তোরাব নবাবের সাহায্য চেয়ে পাঠালে, নবাব তাতে কান দিলেন না। এর পরের ঘটনা (১৭১৪ খ্রীস্টাব্দ) সলীমুল্লাহ্‌-কৃত ‘তারিখ-ই-বাংলা’ অনুসারে বিবৃত করা যাক:৪৪

জঙ্গল, খাল, বিল প্রভৃতির আশ্রয়ে থেকে সীতারাম বাদশাহের কর্মকর্তাদের গ্রাহ্য করতেন না এবং নিজের জমিদারীর সীমার মধ্যে তাঁদের প্রবেশ করতে দিতেন না। তাঁর অনেক তীরন্দাজ ও বর্শাধারী রায়বংশী পাইক থাকায় ফৌজদার ও থানাদারের লোকজনদের সঙ্গে সর্বদাই হাঙ্গামা বাধত। তিনি তাদের দখল দিতেন না, আশেপাশের অন্যান্য তালুকদারদের সম্পত্তিও লুঠ করতেন। ফৌজের সংখ্যা নিতান্ত কম হওয়ায়, মীর আবু তোরাব এই দুর্দান্ত জমিদারকে দমন করতে অক্ষম হলেন। অগত্যা নবাব মুর্শিদকুলীর কাছে মদৎ চাইলেন, কিন্তু নবাব এ ব্যাপারে কোনো নজরই দিলেন না। মীর সাহেব সীতারামকে পাকড়াবার জন্য ফৌজ পাঠালে, তিনি শিয়ালের মতো জঙ্গলে ঢুকে যেতেন আর তীর তলোয়ার দিয়ে লড়াই করে ফৌজদারী সেপাইদের ‘হয়রান’ করতেন। খোলা জায়গায় মুখোমুখি লড়াই করতেন না; ফৌজদারী সৈন্যবল বেশি দেখলে, গভীর জঙ্গল ও নদীর মাঝারে আশ্রয় নিতেন। সৈন্যদল তা ভেদ করতে না পেরে ফিরে আসত। তিনিও তখনি বের হয়ে ক্ষিপ্রহাতে লুঠপাট করতেন। কেউ তাঁকে কায়দা করতে পারত না, কখনো কারও হাতে পড়তেন না। শেষে আবু তোরাব তাঁর দমনের জন্য পীর খান নামক সেনা-নায়কের অধীনে দুশো সওয়ার নিযুক্ত করলেন। সীতারাম খবর পেয়ে, গুপ্ত জায়গায় এইভাবে কতকগুলি অনুচর রেখে দিলেন, যাতে তারা আচমকা চড়াও হয়ে পীর খানকে সসৈন্যে নিপাত করতে পারে। এই সময় আবু তোরাব দলবল নিয়ে শিকারে বেরিয়েছিলেন। তিনি সীতারামের এলাকার কাছে হাজির হলে, পীর খাঁ আসছে ভেবে, সীতারাম তাঁর হাতিয়ারবন্দ পাইকদের অতর্কিত ভাবে সবেগে আক্রমণের আদেশ দিলেন। আবু তোরাব অসতর্ক ছিলেন, হঠাৎ জঙ্গল থেকে সীতারামের দল তাঁর উপর গিয়ে পড়ল। ‘আমি আবু তোরাব’ ‘আমি আবু তোরাব’ বলা সত্ত্বেও তারা কান দিল না, কারণ কেউ তাঁকে চিনত না। রায় বেঁশে বশা চালিয়ে তাঁকে ত্বরায় ঘোড়া থেকে ভূঁয়ে ফেলল; ফৌজদার নিহত হলেন। সীতারাম সামনে এসে রক্তাক্ত দেহ ফৌজদারকে ধরাশায়ী দেখে, শিরে করাঘাত ও নানারূপ আক্ষেপ করলেন। অনুচরদের বললেন, ‘পীর খাঁর জায়গায় এই মহাত্মাকে কেন নিহত করলে? মুর্শিদকুলী এখনি ভীষণ প্রতিশোধ নেবেন, তোমাদের ও আমার জীয়ন্তে খাল খিঁচে দেবেন আর সমস্ত মহম্মদাবাদ ছারখার করবেন। ভবিতব্য যা ছিল, ঘটেছে, আর উপায় নেই।’

আবু তোরাবের মৃত্যুসংবাদ পেয়ে মুর্শিদকুলী খান বাদশাহের আক্রোশের ভয়ে থরহরি কম্পমান হলেন।৪৫ নিজের শ্যালিকার স্বামী বখ্‌শ আলী খানকে ফৌজদার নিযুক্ত করে, সসৈন্যে সীতারামকে ধরতে পাঠালেন। জমিদারদের ভয় দেখিয়ে কড়া হুকুম জারী হল—যেন তাঁরা কোনো দিক দিয়ে সীতারামকে বের হতে না দেন। যাঁর জমিদারীর সীমা দিয়ে সীতারাম পালাবেন, তাঁর জমিদারী উচ্ছেদ করে তাঁকে শাস্তি দেওয়া হবে। জমিদাররা বাদশাহের আদেশের চেয়ে কুলী খানের আদেশ বেশি মান্য করতেন। তাঁরা তটস্থ হয়ে চারদিক থেকে সদলবলে সীতারামের পালানোর পথ আটকালেন। বখ্‌শ আলী সীতারামকে সপরিবারে বন্দী করে শিকল পরিয়ে মুর্শিদাবাদে চালান দিলেন। নবাবের আদেশে তাঁর মুখ গরুর চামড়ায় ঢেকে মুর্শিদাবাদের পূবদিকে ঢাকা ও মহম্মদাবাদ যাবার রাস্তায় তাঁকে শূলে দেওয়া হল। অন্যান্য জমিদারদের ভয় দেখানোর জন্য ঐ মৃতদেহ নিকটস্থ গাছে লটকানো হল, এবং অপরাধীর রক্ত যাতে মাটিতে না পড়ে এজন্য নীচে একটা পাত্র রাখা হল। সীতারামের পরিবার যাবজ্জীবন মহম্মদাবাদে কারারুদ্ধ হলেন। ভূষণার জমিদারী রামজীবনের উপর বর্তাল এবং সীতারামের সমস্ত অস্থাবর সম্পত্তি খাস-নবিশীতে বাজেয়াপ্ত হল। তাঁর সমূলোৎপাটনের পর সরকারী আখবরাৎ মারফৎ এই ব্যাপার বাদশাহের গোচর করা হল।

সলীমুল্লাহ্‌র উপরোক্ত মূল বিবৃতিতে নেই এই রকম নানা কাহিনী যশোহর অঞ্চলে প্রচলিত ছিল যার সবকিছু উড়িয়ে দেওয়া যায় না। প্রবাদ অনুসারে নবাবী ফৌজের সঙ্গে যে সব জমিদারী পাইকান্ এসেছিল তাদের নায়ক ছিলেন নাটোরের দেওয়ান দয়ারাম রায় এবং তাঁরই কৌশলে প্রত্যূষের কুজ্‌ঝটিকার সুযোগ নিয়ে দুর্গে অনুপ্রবেশ করে একদল গুপ্তঘাতক মলত্যাগের সময় সেনাপতি মেনাহাতীর মুণ্ড কেটে নেয়। নবাব সেই ভীম মুণ্ড দেখে ‘এই বাহাদুরকে কেন জানে মারলে’ বলে অনেক আক্ষেপ করে তা সীতারামের কাছে পাঠিয়ে দেন এবং সীতারামের অনুচররা তার উপর একটি নড়বড়ে ইটের স্তম্ভ রচনা করে যা ভাঙা অবস্থায় এই শতকের গোড়া পর্যন্ত স্থানীয় লোকেরা দেখিয়ে দিত। অন্ততঃ দয়ারাম যে সীতারামের পতনের একজন প্রধান নায়ক রূপে অকুস্থলে হাজির ছিলেন, তার অভ্রান্ত প্রমাণ এই যে সীতারামের আরাধ্য কৃষ্ণজী মূর্তিখানি তিনি মহম্মদপুর থেকে দীঘাপতিয়া (দয়ারামের জমিদারী) নিয়ে গিয়ে সেখানে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সীতারামের বহুতর দেব মন্দির ও বিগ্রহাদি যাতে রক্ষা পায় তার জন্য রানী ভবানী ভূষণা জমিদারীর অনেক জমি দেবোত্তর হিসেবে উৎসর্গ করে দেন, যার ফলে নাটোর রাজ্যের পতনের পরও ঐ সকল দেবদেবী বিংশ শতকের গোড়া পর্যন্ত সুচারু ভাবে পূজিত হতেন। সীতারামের তৃতীয় রানী এবং শিশু সন্তানরা পালিয়ে কলকাতায় আশ্রয় নিয়েছিলেন, কিন্তু নবাব জাফর খানের নির্দেশ মতো হুগলীর ফৌজদারের দেওয়া হুমকীতে ভীষণ ভয় পেয়ে ইংরেজরা তাঁদের ধরিয়ে দেয়। মহম্মদপুরে সীতারামের সব বংশধরকে নজরবন্দী রাখা হয়, মহারানী ভবানী দয়াপরবশ হয়ে তাঁদের জন্য কিছু ভূসম্পত্তি আলাদা করে দেন। উকীল মুনিরামের পুত্র মৃত্যুঞ্জয় রানী ভবানীর রাজত্বে চাকলা ভূষণার নায়েব হয়েছিলেন, তাঁর অর্জিত ভূসম্পত্তির আয় ৩০ হাজার টাকায় দাঁড়িয়েছিল। সেনাপতি মেনাহাতী চিরকুমারও নিঃসন্তান ছিলেন, কিন্তু তাঁর ছোট ভাই রামশঙ্করের ছেলে ব্রজকিশোর নাটোর সরকারে উঁচু পদে থেকে দশশালা বন্দোবস্তের ডৌল বা খাজনার হিসাব প্রস্তুত করে দিয়েছিলেন এবং রামশঙ্কর নিজে সীতারাম ও মেনাহাতীর মৃত্যুর দশ বছর পরে ১৭২৪ খ্রীস্টাব্দে রায়গ্রামে একটি সুন্দর জোড়াবাংলা মন্দির নির্মাণ করেছিলেন।৪৭

(৫ম) ঐ বছরই রঘুনন্দন দেওয়ানী হিসাবপত্রের চরম নিকাশ চুকিয়ে চিত্রগুপ্তের খাতার অন্তর্গত হলেন, কিন্তু প্রবাদ কথিত ‘রঘুনন্দনী বাড়’ তাতে মোটেই থামল না। সরকার মহম্মদাবাদের অন্তর্গত টংকী স্বরূপপুরের দুইজন পাঠান জমিদার সুজাৎখান ও নিজাৎখান আশেপাশে ঘোর অত্যাচার আর লুঠপাট শুরু করেছিলেন। তাঁদের এমন বাড় বাড়ল যে নবাব সরকারে চালানী ষাট হাজার টাকা খাজনা তাঁরা যশোহর থেকে মুর্শিদাবাদের রাজপথ থেকে লুঠ করে নিলেন। চোর ডাকাতের রক্তপিপাসু নবাব জাফর খান খবর শুনে কারা ডাকাতি করছে খুঁজে বের করবার জন্য একজন দারোগার অধীনে কতকগুলি গোয়েন্দা লাগিয়ে শীঘ্রই আসল তথ্য আবিষ্কার করলেন। অমনি হুগলীর ফৌজদারের কাছে নবাব প্রেরিত গ্রেফতারী পরওয়ানা ছুটল। ফৌজদার আহ্‌সান উল্লাহ্‌ খান শিকারের ভান করে হুগলী থেকে নির্গত হয়ে বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো পাঠানদের কেল্লার উপর পতিত হলেন। ‘ডাকাতদের’ ধরে শিকল পরিয়ে হাত পা কাটা অবস্থায় ঘোড়ার জিনের শক্ত চামড়ায় আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে মুর্শিদাবাদে চালান দিলেন। নবাব তাদের যাবজ্জীবন হাজতে পুরে অস্থাবর সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করলেন, আর রামজীবনের সঙ্গে জমিদারী বন্দোবস্ত করে দিলেন।৪৮ টংকী স্বরূপপুর যশোহর থেকে মাত্র পাঁচ মাইল এবং ভূষণা থেকে খুব দূরে নয়, তা সত্ত্বেও হুগলীর ফৌজদারের উপর পাঠান পীড়নের ভার পড়া থেকে অনুমান করা চলে যে মুর্শিদকুলী খান তাঁর জীবনের শেষ দিকে ঐ দুই জায়গা থেকে ফৌজদারী শাসন প্রত্যাহার করে নিয়ে নাটোরের মাধ্যমে নিখরচায় দেশ শাসন-পদ্ধতি অবলম্বন করেছিলেন।

বিশাল রাজ্যের অধীশ্বর হয়েও রাজা রামজীবন ব্যক্তিগত জীবনে সুখ পাননি। একের পর এক আঘাতে তাঁর হৃদয় বিদীর্ণ হয়েছিল। কিন্তু বুড়ো বয়সে বধূ মাতা ভবানীকে এনে তিনি নাটোর বংশকে অক্ষয় পুণ্যের অধিকারী করে যান। অষ্টাদশ শতকের টানা পোড়েনের মধ্যে অহল্যাবাই ও রানী ভবানীর মধ্যে হিন্দু সমাজ ও ধর্মের সনাতন আদর্শ যে ভাবে মূর্ত হয়েছিল শত শত বৎসরের ভারতবর্ষের ইতিহাসেও তার নজির মেলে না। বিংশ শতকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবনে, এবং ঊনবিংশ শতকে রামমোহন রায়ের সাধনায়, বাঙালির হৃদয়ের অন্তরতর ধ্যান ধারণা যেমন চাক্ষুষ রূপ ধারণ করেছিল, অষ্টাদশ শতকে সেই রকম সুগভীর অন্তর্বাহী আদর্শের জীবন্ত প্রতিমা হিসেবে যদি কারো নাম করতে হয়, তবে তিনি রানী ভবানী। বর্তমান প্রসঙ্গে শুধু ১৭৫৭ পর্যন্ত তাঁর জীবনী বিবৃত করে তাঁর শেষ জীবনের কথা অন্য অধ্যায়ে বিবৃত হবে। যে সকল পারিবারিক দুর্ঘটনার সূত্রে আট বছর বয়সে ভবানী তের বছরের বর রামকান্তর বৌ হয়ে নাটোর পরিবারে আসেন, তার জমাট মেঘ সারা জীবন ধরে তাঁর রানীগিরির উপর একটা কালো ছায়া ফেলে রেখেছিল। কথায় আছে ‘কোথা রানী ভবানী কোথা পাড়ার শেজমুতনী’,৪৯ কিন্তু নবাব আলিবদি খানের আমলে ঐ পারিবারিক কলহের সূত্রে রানী ভবানীকেও কিছু দিনের জন্য গৃহহারা হতে হয়েছিল এবং গায়ের গয়না পর্যন্ত বেচতে হয়েছিল। ১১৩১ সনে (১৭২৪-৫ খ্রীঃ) নাটোর পরিবারে পর পর তিনটি মৃত্যু ঘটল। রঘুনন্দনের ছেলে অপুত্রক অবস্থায় গত হলেন। রঘুনন্দন মুর্শিদাবাদ থেকে নাটোরে এসেছিলেন, তিনিও ভগ্ন হৃদয়ে মৃত্যুমুখে পতিত হলেন। তাঁর বংশ ঐখানেই লোপ পেল। জমিদারী রামজীবন এবং কালু কোঁয়ারের নামে লেখা ছিল, হঠাৎ একটি মাত্র মেয়ে রেখে কালিকাপ্রসাদও রামজীবনের বুকে শেল হেনে চলে গেলেন। বংশ রক্ষার জন্য বৃদ্ধ রামজীবন একটি দত্তক পুত্র গ্রহণ করলেন—ইনিই ভবানীর স্বামী রামকান্ত। ঐখানে গোলযোগের সূত্রপাত হল। রামজীবনের কনিষ্ঠ ভাই বিষ্ণুরাম কুষ্ঠরোগে মারা যান। কিন্তু তাঁর ছেলে দেবীপ্রসাদ সুস্থ পুরুষ ছিলেন—তাঁর ধারায় পুত্র গৌরীপ্রসাদ ও পৌত্র গঙ্গাপ্রসাদ নাটোর বংশের কনিষ্ঠ শাখা অব্যাহত রাখেন। বংশানুক্রমিক ভাবে এঁরা রামকান্ত, ভবানী এবং ভবানীর দত্তকপুত্র রাজা রামকৃষ্ণর শত্রুতা করে গেছিলেন। তাঁদের দোষ দেওয়া যায় না—রক্তের স্বাভাবিক ধারায় তাঁরা একদল নাটোর বাসিন্দার সহানুভূতি আকর্ষণ করতে পেরেছিলেন। রঘুনন্দন, রামজীবন ও বিষ্ণুরাম একান্নবর্তী ছিলেন—দায়ভাগ অনুযায়ী তাঁদের সম্পত্তি এজমালী সম্পত্তি। কিন্তু অষ্টাদশ শতকে যে সব বড়ো বড়ো জমিদারী এক একটি রাজ্যে পরিণত হয়েছিল, নবাব দরবারের সম্মতিক্রমে সেই সব জমিদার পরিবারের পারিবারিক প্রথা ছিল এই যে রাজ্য ভাগ হবে না।

দেওয়ান দয়ারাম রায় আত্মারাম চৌধুরীর ‘সুন্দরী ও সুলক্ষণা’ কন্যা৫০ উমাকে দেখে মুগ্ধ হয়ে তাঁকে রামকান্তর বধূরূপে নির্বাচন করেন। এই উমাই রানী ভবানী। তাঁর বাবা আত্মারাম চৌধুরী ছাতিন গাঁয়ের জমিদার—মা নাটোরের গুরুবংশের মেয়ে। রানী ভবানীর মামাবাড়ির পূর্বপুরুষ শ্ৰীগৰ্ভ ঠাকুরের কাছে রামজীবন ও রঘুনন্দন শক্তিমন্ত্রে দীক্ষা নিয়েছিলেন। যে মন্দিরে দুই ‘শর্মা’ (তখনো তাঁরা রাজা হননি) দীক্ষা নেন তার ভগ্নাবশেষের মধ্যে তন্ত্রোক্ত পঞ্চমুণ্ডীর আসন এই শতকের গোড়া পর্যন্ত দেখা যেত। কথিত আছে, পিঙ্গলবর্ণ হোমাহুতি মন্দিরের ছাদ স্পর্শ করেছে দেখে শ্রীগর্ভ ঠাকুর বলেন, ‘যা তোরা রাজা হইবি।’ শ্রীগর্ভ ঠাকুরের পুত্র হরিদেব, তৎকন্যা কস্তুরী দেবী, এঁর গর্ভে আত্মারাম চৌধুরীর ঔরসে ভবানীর জন্ম হয়। শ্রীগর্ভ ঠাকুরের প্রপৌত্র রুদ্রানন্দ (রঘুনাথ তর্কবাগীশ) ভবানী ও তাঁর স্বামী রামকান্তর দীক্ষাগুরু ছিলেন। মাতুলালয় বড়িয়া পাকুড়িয়াতে নয়টি শিবমন্দির ও পাঁচশত পুষ্করিণী উত্তরকালে ভবানীর গুরুভক্তির চিহ্ন বহন করে রেখেছিল। কিন্তু যে স্থান বিশেষভাবে এবং বংশানুক্রমে নাটোর বংশের তপস্যার ক্ষেত্র ছিল তা হল ভাবদা ভবানীপুরের পীঠস্থান ও ভবানীদেবীর মন্দির রানী ভবানী ও তাঁর পুত্র রাজা রামকৃষ্ণর সাধনার লীলাভূমি।

১৭৩৪ খ্রীস্টাব্দে রাজা রামজীবন রায় দেহত্যাগ করলে কুমার রামকান্ত ‘মহারাজ’ এবং তাঁর পত্নী উমা ‘রানী ভবানী’ নামে পরিচিত হলেন।৫১ কিন্তু নিরুপদ্রবে রাজ্যভোগ তাঁদের কপালে লেখা ছিল না। এর আগে একবার রামকান্তকে দত্তক নেবার সময় এবং আর একবার রামকান্তর বিয়ের সময় দেবীপ্রসাদের দাবি নিয়ে নাটোরে কথা উঠেছিল। ভাইপোকে সম্পূর্ণ বঞ্চিত করা রামজীবনের অভিপ্রায় ছিল না— তিনি দশ আনা ও ছয় আনা অংশে রাজ্য দুইভাগ করে দশ আনা রামকান্তকে এবং ছয় আনা দেবীপ্রসাদকে দেবার কথা চিন্তা করেছিলেন। রামজীবনের মৃত্যুর পর ঐ ভিত্তিতে রাজ্য ভাগ করে দেওয়ান দয়ারাম রায় বিবাদ মিটিয়ে নেবার পক্ষপাতী ছিলেন। নবাব সুজাউদ্দীন খানের কাছ থেকে সমগ্র জমিদারীর বন্দোবস্ত পেয়ে রামকান্তর এই প্রস্তাব মনঃপূত হল না। দেবীপ্রসাদের আশে পাশে একদল নেশাখোর ও দুশ্চিরত্র জুটেছিল—কুসঙ্গে পড়ে দেবীপ্রসাদ দয়ারামের প্রস্তাবে কান না দিয়ে তলে তলে চক্রান্ত শুরু করেছিলেন। ১৭৪০ খ্রীস্টাব্দে সম্ভবত নবাব সরফরাজ খানের আমলে—পাতিলাদহ ও স্বরূপপুর পরগনা যুক্ত হয়ে রামকান্তর জমিদারী আরো বৃদ্ধি পেল। কিন্তু বিচক্ষণ তিলী বংশীয় দেওয়ান দয়ারামকে রাজা রামকান্ত পথের কাঁটা মনে করতে লাগলেন এবং পিতা রামজীবনের মৃত্যুকালীন সদুপদেশ অগ্রাহ্য করে ‘দাদাকে’ (ওই নামে দয়ারামকে ডাকার পিত্রাদেশ ছিল) দেওয়ানী থেকে বরখাস্ত করে বসলেন।

সেই সময় মোটেই শুভ নয়—সরফরাজ খানের বিরুদ্ধে আলিবর্দি খানের চক্রান্তে রাষ্ট্রবিপ্লব হতে চলেছে। যথারীতি নবাব সরফরাজের ফৌজের সঙ্গে যে সব জমিদারী পাইকান গিরিয়ার যুদ্ধে গিয়েছিল তার মধ্যে নাটোরের পাইক ছিল। রামকান্তের পাইকরা গোপনে বিপক্ষ দলে যোগ দিয়ে আলিবর্দির সৈন্যদের রাত্রিবেলা পথ দেখিয়ে সরফরাজের শিবির আক্রমণে সহায়তা করল।৫২ যুদ্ধে আলিবর্দি জয়ী হলেন, কিন্তু তাতে রামকান্তর ভালো হল না। বরং দেবীপ্রসাদের দল সুবর্ণসুযোগ পেল। মুর্শিদাবাদের রাজনীতি সম্পর্কে রামকান্তর সম্যক জ্ঞান ছিল না—যাঁর জ্ঞান ছিল সেই দয়ারাম তাঁর পক্ষে নেই। রামকান্তর বিরুদ্ধে নাটোরে একটি দল গড়ে উঠেছিল। তারা নতুন নবাবকে প্ররোচিত করল যে দত্তক পুত্র প্রকৃত উত্তরাধিকারী নন এবং তাঁর শাসনের বিশৃঙ্খলায় খাজনার ঘাটতি পড়ছে। রামকান্ত নিশ্চিন্ত হয়ে নাটোরে বসে আছেন—এমন সময় তাঁর মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। দেবীপ্রসাদকে দখল দিতে নবাবী ফৌজ হঠাৎ এসে হাজির হল।

তখন ১৭৪১ খ্রীস্টাব্দ—ভবানীর বয়স মাত্র ষোল বছর—তিনি গর্ভবতী। নবাবী ফৌজ প্রাসাদ লুঠ করছে শুনে রামকান্ত ভবানীর হাত ধরে জল নিস্ক্রমণ পথে বের হয়ে গেলেন—সঙ্গে জিনিসপত্র কিছু নিতে পারলেন না। সম্বল—ভবানীর গায়ের অলঙ্কার। জলপথে মুর্শিদাবাদে হাজির হয়ে রাজ্যহারা রামকান্ত ও ভবানী দয়ারামের শরণাপন্ন হলেন। যে বালিকা বধুকে দয়ারাম নাটোরে এনেছিলেন সেই অন্তঃসত্ত্বা তরুণীকে পথের উপর দেখে প্রৌঢ় কূটনীতিবিশারদের মন গলল। বধূর গায়ের অলঙ্কার এক লক্ষ টাকা ঋণে জগৎ শেঠের কুঠীতে বাঁধা রেখে চার মাসের চেষ্টায় দয়ারাম রাজ্য পুনরুদ্ধার করলেন।

অতঃপর দয়ারাম পুনরায় রাজ্যভার গ্রহণ করায় সুশৃঙ্খল বন্দোবস্ত হল। এই সময় ভবানীর প্রকৃত চরিত্রের কিছু কিছু আভাস পাওয়া গেল। রাজ্য পুনর্লাভের আনন্দে রামকান্ত রানী ভবানীর জন্য একটি বহুমূল্য মুক্তার মালা এবং ভবানীপুর পীঠস্থানের দেবী ভবানীর জন্য অপেক্ষাকৃত কম মূল্যের আর একটি মুক্তার মালা আনিয়েছিলেন। তার পরের ঘটনা সম্বন্ধে ‘রানী ভবানী’র লেখক দুর্গাদাস লাহিড়ীর কাছে ১৯০৮ নাগাদ এক চিঠিতে নাটোর বংশীয় একজন নিম্নরূপ বিবৃতি দিয়েছেন:

‘আমি আমার বংশীয় প্রাচীন ঠাকুর মহাশয়দিগের নিকট শুনিয়াছি;—মহারাজ রামকান্ত রায় রানী ভবানীর জন্য ৫২,০০০ বাহান্ন হাজার টাকা মূল্যের একছড়া মুক্তার মালা এবং ভবানীর জন্য ৩০,০০০, ত্রিশ হাজার টাকা মূল্যের একছড়া মুক্তার মালা: আনিয়াছিলেন। ভ্রমক্রমে বাহান্ন হাজার টাকার মালাছড়াই ভবানীপুরে মা ভবানীর জন্য প্রেরিত হয়। তৎপরে রানী ভবানী তাহা জানিতে পারিয়া রাজা রামকান্তকে বলিলেন,—“আমাকে অধিক মূল্যের মালা দিয়া মা’কে কম মূল্যের মালা দিতে যে ইচ্ছা করিয়াছিলেন তাহা উচিত হইয়াছিল না; সেই জন্যই মা দয়া করিয়া আমাদের ভ্রম সংশোধন করিয়াছেন। ইহা আমাদের পরম সৌভাগ্য। কিন্তু ত্রিশ হাজার টাকা মূল্যের মালাছড়া যখন মা ভবানীর জন্য আনা হইয়াছিল, তখন তাহা ব্যবহার করা কর্তব্য নহে। অতএব উহা মা’কেই দিতে হইবে। বিশেষত আপনি যেমন মা’কে এক ছড়া মালা অৰ্পণ করিয়াছেন, তদ্রূপ আপনার প্রদত্ত মালা আমিও মা’কে দিয়া চরিতার্থতা লাভ করিব।” এই বলিয়া রামকান্তের অনুমতি গ্রহণে ত্রিশ হাজার টাকার মালাছড়াও রানী ভবানী মা ভবানীকে অপর্ণ করেন। আমি স্বচক্ষে ঐ দুই মালাছড়াই মা-ভবানীর গলায় দেখিয়াছি। কিয়ৎকাল পূৰ্ব্বে মা-ভবানীর বাটীতে যে বৃহৎ চুরি হইয়াছিল, ঐ চুরির সময় অন্যান্য অলঙ্কারের সহিত ঐ মহামূল্য মালা দুই ছড়াও অপহৃত হইয়াছে। এই চুরির পরিমাণ মোট তিন লক্ষ পঁচিশ হাজার টাকা ছিল।’৫৩

রানী ভবানী রাজ্য পুনর্লাভের সময় সবে যৌবনে পদার্পণ করেছেন। যুবতী সুলভ স্বামীর গরবিনীর ভাব ও রানীগিরির প্রতিপত্তিবোধ যে তাঁর ষোলো আনা ছিল তার প্রমাণ আছে। স্বামীর জীবৎকালে ১৬৭৫ শকে কাশীতে ভবানীশ্বর শিব স্থাপনা করে মন্দিরগাত্রে তিনি যে শিলালিপি উৎকীর্ণ করিয়েছিলেন তাতে সেই দৃপ্ত সুর পাওয়া যায়:

বাণব্যাহৃতিরাগেন্দুসমিতে শকবৎসরে।

নিবাসনগরে শ্রীমদ্বিশ্বনাথস্য সন্নিধৌ॥

ধরামরেন্দ্রবারেন্দ্র গৌড় ভূমীন্দ্র ভামিনী।

নির্মমে শ্রীভবানী শ্রীভবানীশ্বরমন্দিরম্‌॥৫৪

এই ‘ধরাপতি বারেন্দ্র-গৌড় ভূপতির ভামিনী শ্রীভবানী’ বিধবা হবার পর তাঁর অসংখ্য দানপত্রগুলিতে শুধু এই স্বাক্ষর করতেন: ‘শ্রীরানী ভবানী দেব্যা।’ ঐ মন্দির নির্মাণ কালেই ১৭৫২ খ্রীস্টাব্দে বা তার পর বৎসর রামকান্ত অকালমৃত্যু বরণ করেন৫৫ —রানীর বয়স তখন মাত্র সাতাশ। নাটোর থেকে পালিয়ে মুর্শিদাবাদ ঘোরাফেরার সময় তিনি একটি পুত্র সন্তান প্রসব করেছিলেন—১১ মাসে সেই শিশু (নাম রাখা হয়েছিল কাশীকান্ত) মৃত্যুমুখে পতিত হয়। তারপরের ছেলেটিও ভবানীর বুকে শেল হেনে অন্নপ্রাশনের আগে চলে যায়। এর পর রানী একটি কন্যা প্রসব করেন—তার নাম রাখা হয় তারা। এই একমাত্র মেয়েকে তিনি খাজুরা গ্রামনিবাসী রঘুনাথ লাহিড়ী নামে এক ব্রাহ্মণ সন্তানের সঙ্গে বিয়ে দিয়েছিলেন। বিধবা রানী আশা করেছিলেন মেয়ে জামাই রাজ্যের উত্তরাধিকারী হবে—সেই আশায় রঘুনাথের নামে জমিদারী বন্দোবস্ত করিয়েছিলেন। কিন্তু সে আশাও টিকল না। ১৭৫৬ খ্রীস্টাব্দে তারাসুন্দরী বিধবা হয়ে মার কাছে ফিরে এলেন। ভবানীর বুকের ভেতরটা পুড়ে গেল—সেই সঙ্গে রাজ্যের উত্তরাধিকার নিয়েও তাঁর শঙ্কার উদ্রেক হল।

নাটোরের শত্রুপক্ষ তখন মৃত দেবীপ্রসাদের পুত্র গৌরীপ্রসাদকে কেন্দ্র করে ঘোঁট পাকাচ্ছে। ভবানীর শ্বশুর রামজীবনের একটি নাতনী ছিল। আগে বলা হয়েছে—ইনি কালু কোঙারের কন্যা। রাজশাহী জেলার আটগ্রামের রায়বংশে এঁর বিয়ে হয়। এঁর গর্ভে রামকৃষ্ণ নামে একটি পুত্র হয়েছিল—ভবানী যথাবিধি ১৭৫৮ নাগাদ সেই বালকটিকে দত্তক পুত্র রূপে গ্রহণ করলেন।৫৬ এতে আবার বিরুদ্ধ পক্ষ থেকে সোরগোল উঠল। এ ব্যাপারে নদীয়ার পণ্ডিতদের বিধান এই ছিল যে ভ্রাতুষ্পুত্র বিদ্যামান থাকাতে দত্তক গ্রহণ সিদ্ধ নয়। মহারাজ রামকান্তের শ্রাদ্ধকালীন যে বিপুল দানাদি ক্রিয়া রানী ভবানী দশ লক্ষ টাকা ব্যয়ে সম্পন্ন করেছিলেন, সেই সূত্রে প্রভূত ভাবে উপকৃত কাশীর পণ্ডিতদের সঙ্গে নাটোর রাজবাড়ির ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের সূত্রপাত হয়। বিরুদ্ধপক্ষের মুখ বন্ধ করবার জন্য বিধবা রানীর স্বপক্ষে বেনামি পণ্ডিত প্রমুখ তিরিশ জন কাশীর পণ্ডিত—যাঁরা নাটোর রাজ দরবার থেকে বাৎসরিক চল্লিশ হাজার টাকা বৃত্তি পেতেন—এমন এক ব্যবস্থাপত্র লিখেছিলেন যাতে ঐ দত্তক গ্রহণ সিদ্ধ হয়।৫৭ নবাব দরবারে এবং পরবর্তীকালে ইংরাজদের কাছে লেখালেখি করেও গৌরীপ্রসাদ কোনো ফল পেলেন না। জামাই রঘুনাথের নামে আগে জমিদারী লেখা ছিল—তাঁর মৃত্যুর পর সরাসরি রানী ভবানীর নামে জমিদারী বন্দোবস্ত হল।৫৮।

প্রকৃতপক্ষে রানী ভবানী দেওয়ান দয়ারামের সহায়তায় স্বামীর মৃত্যুর পর নিজে থেকেই জমিদারী পরিচালনা করে আসছিলেন। তিনি লেখাপড়া জানতেন এবং যদি ‘এখনকার রানী ভবানী…নানা শাস্ত্র ও দর্শন বিদ্যাতে অতি সুখ্যাতি পাইয়াছেন’—‘স্ত্রীশিক্ষাবিধায়কের’৫৯ এই উক্তিতে কিছু অত্যুক্তি থাকে, জমিদারী কার্য সংক্রান্ত হিসাব নিকাশে এবং দানাদি ধর্মচচা সংক্রান্ত ব্যবহারিক সংস্কৃত ভাষায় তিনি যে সম্পূর্ণ পারদর্শী ছিলেন তাতে সন্দেহ নেই। জমিদারীর ভার গ্রহণ করার পর তিনি দেখলেন রাজা রামজীবনের আমল থেকে ব্রাহ্মণদের অনেক লাখেরাজ জমি দেওয়া হয়ে আসছে যার দানপত্রে রামজীবনের স্বাক্ষর নেই দেওয়ান দাদার স্বাক্ষর আছে। রানী হাসতে হাসতে লাখেরাজ বাতিল করার উদেশ্য জ্ঞাপন করলে, দয়ারাম রায় তা করতে বারণ করলেন, কারণ রামকান্তের সঙ্গে ভবানীর বিয়ের পণপত্রেও স্বাক্ষর দেওয়ান দাদার, রাজা রামজীবনের নয়। লাখেরাজ বাতিল হলে, পণপত্রও অসিদ্ধ হয়। রানী হাসলেন, কিছু বললেন না। ব্রাহ্মণদের লাখেরাজ অনেক বৃদ্ধি পেল। রানী ভবানীর আমলের নাটোর জমিদারীর ইতিহাসকার মাহমুদ সাহেব লিখেছেন, রাজশাহীর সুবিস্তীর্ণ জমিদারী জুড়ে লক্ষ লক্ষ সাধারণ প্রজার চোখে চিরস্মরণীয়া রানী ভবানী এবং তাঁর রাজকর্মচারীবৃন্দই দেশের রাজশক্তি স্বরূপ ছিলেন। সরকার বলতে লোকে তাঁকেই বুঝত। নাটোরের রাজবাড়ি থেকে সারা জমিদারী জুড়ে বিভিন্ন স্তরের যে সব কর্মচারী রাজশাসনের জাল বিস্তৃত করে রেখেছিলেন, মফঃস্বলে সেই জমিদারী কর্মচারীরাই লোকের চোখে সরকারের প্রতিনিধিত্ব করতেন। রানীর পাইকরা দেশে শান্তি রক্ষা করত, রানীর দেওয়ানী কর্মচারীরা বাঁধ দিয়ে পুলবন্দী’ করে বন্যার হাত থেকে দেশ রক্ষা করতেন, তাঁর লোকজন অসংখ্য পুষ্করিণী খনন, মন্দির নির্মাণ, সরাইখানা নির্মাণ কার্যে সদা ব্যাপৃত থাকতেন, তাঁরই বৃত্তিতে হাজার হাজার ব্রাহ্মণ, পণ্ডিত এবং কবিরাজের জীবিকা নির্বাহ হত। নবাব সরকারের অস্তিত্ব এই সুবিস্তৃত গ্রামবাংলার ভূখণ্ডে অনুভূত হত না, জনমানসে প্রকৃতপক্ষে তিনিই রানী ছিলেন।৬০

রাজ্যভার গ্রহণ করার পর রানী ভবানীর চরিত্রের আর একটি দিক প্রস্ফুটিত হল। যতদিন তিনি সধবা ছিলেন, তাঁর দানাদি ক্রিয়াকর্মের সীমা নির্দিষ্ট ছিল, কারণ তখনো বিষয় সকল হস্তগত হয়নি। ঐ সময় তিনি নিত্য নৈমিত্তিক ক্রিয়া ও ব্ৰতাদি নিষ্ঠাভরে সম্পন্ন করতেন, তাছাড়া দেবালয় স্থাপন, জলাশয় খনন, অন্ন দান, বস্ত্র দান, দরিদ্র বা দায়গ্রস্ত ব্রাহ্মণ ও অন্যান্য জাতীয় কন্যাদের বিবাহদান, ইত্যাদি কিছু কিছু পরহিতকর পুণ্যকার্য সীমিত অর্থের দ্বারা অনুষ্ঠান করতেন। বিষয় হাতে পাওয়ার পর বিধবা রানী কঠোর নিয়ম পালনের সঙ্গে সঙ্গে দানাদি পুণ্য কর্মে পূর্বাপেক্ষা মুক্ত হস্ত হলেন। স্বামীর পারলৌকিক ক্রিয়া সম্পন্ন করার সময় তাঁর ইচ্ছা হল, লে মাত্র ব্রাহ্মণ ভোজন ও দানাদি কর্মে শ্রাদ্ধ সংক্রান্ত কার্য আবদ্ধ না রেখে সর্বত্সাধারণের জলকষ্ট নিবারণ নিমিত্ত পুষ্করিণী খনন করা হোক। গুরুদেবের সানন্দ সম্মতি ক্রমে স্বামীর পারলৌকিক ক্রিয়ার অঙ্গরূপে তিনি বরেন্দ্রভূমির বিস্তীর্ণ তাপদগ্ধ ভূখণ্ডে সহস্র সহস্র পুষ্করিণী খনন করার লোকহিতকর পুণ্য কাজে তাঁর লোকবল ও অর্থবল নিয়োগ করলেন। এই সময় তিনি আর একটি কাজে হাত দেন। নাটোরের উত্তরে ভাবদা ভবানীপুরে সতীদেহের পতিত অংশবিশেষের উপর মা-ভবানীর পীঠস্থান ছিল—সেই মুক্তামালাদ্বয় শোভিত ভবানী মূর্তি সন্দর্শনে প্রতি বছর বহু লোক যেত। কিন্তু কোনো পথ না থাকায় লোকে খুব কষ্ট পেত। ভবানীর আদেশে তীর্থযাত্রীদের জন্য চৌগ্রাম থেকে ভবানীপুর পর্যন্ত স্থানে স্থানে পান্থনিবাস বিশিষ্ট বিস্তীর্ণ রাজপথ, জলাভূমির উপর ইষ্টকনির্মিত সেতু, জলকষ্ট নিবারণের জন্য সোপানাবলী বিশিষ্ট পুষ্করিণী ইত্যাদি নির্মিত হল। ‘রানী ভবানী’ উপন্যাসকার দুর্গাদাস লাহিড়ী এই শতাব্দীর গোড়ায় এই সব কীর্তিচিহ্নের স্মৃতি মন্থন করে লিখেছিলেন—‘এই যে উত্তরবঙ্গে বহুতর প্রাচীন সরোবর ও দীর্ঘিকা দৃষ্ট হয় উহার অধিকাংশই সেই সদনুষ্ঠানের [রাজা রামকান্তর পারলৌকিক ক্রিয়ার] ফল। ঐ যে সুপরিসর রাজপথ চৌগ্রাম হইতে বাহির হইয়া পাকুড়িয়ার মধ্য দিয়া ভবানীপুরের পীঠস্থানে মিলিত হইয়াছে; এই যে পথের দুই পার্শ্বে নৌকা চলাচলের জন্য প্রণালী রহিয়াছে, আর ঐ যে স্থানে স্থানে শিবালয় ও পান্হনিবাসের ভগ্নস্তূপে অতীত গৌরবের ক্ষীণ স্মৃতি বিদ্যমান আছে; সকলই মহারানী ভবানীর পুণ্যকীর্তি। উত্তরবঙ্গের সুপ্রসিদ্ধ “ভবানী-জাঙ্গাল”—মহারানী ভবানীরই পুণ্যকীর্তি।’ চৌগ্রাম থেকে ভবানীপুরে যে রাস্তা গেছে সেই পথের মধ্যে বিলগ্রাম নামক স্থানে তিনটি খিলানের উপর নির্মিত এই ‘ভবানী জাঙ্গাল’ নামক সেতু অগণিত তীর্থযাত্রীদের একটি বিস্তীর্ণ জলপ্রবাহ অতিক্রম করিয়ে দিত যা ভবানীপুর হয়ে চলন বিল পর্যন্ত বয়ে গেছে। সেতুর চারিদিকে চারটি শিবমন্দির ছিল। রাজপথ প্রথমে নির্মিত হয়; ভবানী জাঙ্গাল তার পরে। এই জাঙ্গালের সঙ্গে তারাসুন্দরীর মৃত্যকাহিনী জড়িত আছে। সে কথা পরে হবে।

স্বামীর শ্রাদ্ধকার্য সমাপনান্তে ভবানী ব্রহ্মচারিণী হয়ে মুর্শিদাবাদের সমীপে বড়নগরে গঙ্গাতীরবাসিনী হন। স্বামীর সঙ্গে তিনি যখন নাটোর থেকে মুর্শিদাবাদে পালিয়ে আসেন, সম্ভবত সেই সময় বড়নগরের আবাস স্থাপিত হয়েছিল। ভবানী এখানে দেবালয় স্থাপন করে জপে তপে মন দেন—মধ্যে মধ্যে নাটোর পরিদর্শনে যেতেন। বিধবা মেয়ে তারা এইখানেই তাঁর বিধবা মায়ের আশ্রয়ে ফিরে আসেন। কিশোরী তারাসুন্দরী তাঁর মায়ের রূপ পেয়েছিলেন। বাড়ি থেকে গঙ্গা দেখা যেত। তখন ১৭৫৬ খ্রীস্টাব্দ চলছে—তারার বয়স চৌদ্দর বেশি নয়। একদিন স্নান করে চুল এলিয়ে তিনি খোলা ছাদে উঠে এসেছেন, এমন সময় গঙ্গাবক্ষে প্রমোদ তরণী থেকে তাঁর উপর তরুণ নবাবজাদা সিরাজউদ্দৌলাহ্‌র দৃষ্টি পড়ল। কথিত আছে তাঁর রূপে উন্মত্ত হয়ে উচ্ছৃঙ্খল নবাবজাদা তারা হরণের চেষ্টায় প্রবৃত্ত হলেন। গঙ্গার অন্য পারে সাধকবাগে মস্তারাম বাবাজী নামে এক রামোপাসক ছিলেন যাঁর আখড়ায় রানী ভবানী অনেক সাহায্য পাঠাতেন। ত্রিশূল হাতে সেই বৈষ্ণব আখড়ার রুদ্রমূর্তি সন্ন্যাসীরা তারা হরণের চেষ্টা ব্যর্থ করলেন। তারার মৃত্যু রটনা করে দিয়ে রানী তাঁর গুরুদেব রঘুনাথ তর্কবাগীশের সঙ্গে মেয়েকে মথুরায় জগৎ শেঠ ভবনে পাঠিয়ে পরে কাশীতে আনিয়ে সেখানে মেয়ের সঙ্গে মিলিত হন। মোগল অভিজাত মনসবদার সমাজের চোখে একজন বিধবা হিন্দু জমিদার তনয়ার লাঞ্ছনা এত চাঞ্চল্যকর ব্যাপার নয় যে কোনো ফার্সী ইতিহাসে এই ঘটনার উল্লেখ থাকবে। কিন্তু ‘সিয়র-উল-মুতাখ্‌খিরীন্‌’ আদি গ্রন্থে এর বর্ণনা না থাকলেও এ সম্বন্ধে দেশব্যাপী, এবং বিশেষ করে নাটোরে ও বড়নগরে, এত প্রবাদ আছে যে তা অবিশ্বাস করা চলে না।৬১ সিরাজের পক্ষে যে ফরাসী সেনাপতি অস্ত্রধারণ করতে প্রস্তুত ছিলেন সেই মঁসিয় ল’র একটি উক্তি থেকে বর্ণিত ঘটনার সম্ভাব্যতার আভাস মেলে। মঁসিয় ল’ তাঁর স্মৃতিকথায় লিখেছেন—‘হিন্দু মেয়েরা গঙ্গাতীরে স্নান করতে অভ্যস্তা তাদের মধ্যে কে কে সুন্দর, চরেদের মুখ থেকে সেই খবর যোগাড় করে সিরাজউদ্দৌলাহ্ তাদের ধরে আনবার জন্য ছোট ছোট নৌকায় তাঁর অনুচরদের পাঠাতেন।’৬২ সিরাজউদ্দৌলাহ্‌র এই জাতীয় দৈনন্দিন কার্যকলাপের সাধারণ বর্ণনা দিয়ে তদানীন্তন প্রত্যক্ষদর্শী ঐতিহাসিক গোলাম হোসেন খান ক্ষান্ত হয়েছেন, আলাদা আলাদা করে এক একটি ঘটনার বিবৃতি দেওয়া প্রয়োজন বোধ করেননি।

১৭৫৭ খ্রীস্টাব্দ সুবাহ্ বাংলার এক পঞ্চমাংশ জুড়ে মহারানী ভবানীর জমিদারী বিস্তৃত ছিল। রেনেলের সার্ভে অনুযায়ী নাটোর রাজ্যের আয়তন ছিল ১২,৯০৯ বর্গমাইল। মুর্শিদাবাদ জেলার উত্তর পশ্চিম অংশ, রাজশাহী, বগুড়া, পাবনা, ফরিদপুরের প্রায় সমগ্র ভাগ, রংপুর ও যশোহর জেলার প্রায় অর্ধাংশ নিয়ে এই জমিদারী অবস্থিত ছিল। তাই উঁচু-নিচুর প্রভেদ করতে হলে কথায় বলত, কোথায় রানী ভবানী, কোথায় ফুলী জেলেনী।

(৩) দিনাজপুর—পরগনা ৮৯, জমা (জায়গীর বাদে) ৪৬২৯৬৪।

সপ্তদশ শতকের হাবেলী পিঞ্জরা জমিদারী বর্ধিত হয়ে মুর্শিদকুলী খানের আমলে বিশাল দিনাজপুর রাজ্যের আকার ধারণ করে। উত্তরাধিকার সূত্রে হাবেলী পিঞ্জরা পেয়ে দিনাজপুরের কায়স্থ রাজারা আশেপাশের জমিদারদের সঙ্গে দুই পুরুষ ধরে অনবরত যুদ্ধবিগ্রহ করতে করতে কখনো বা বিশেষ বিশেষ পরগনার দেওয়ানী সনদ প্রাপ্ত হয়ে, দিনাজপুর রাজ্য গঠন করেন। ঢাকা ও মুর্শিদাবাদের নবাবরা দিনাজপুরের দুই জঙ্গী রাজা প্রাণনাথ ও রামনাথকে তাঁদের সমর পথে কিছুমাত্র বাধা না দিয়ে বরঞ্চ সময় সময় দেওয়ানী সনদ দিয়ে বা বাদশাহী ফারমান আনিয়ে দিয়ে নানা প্রকারে সাহায্য করেছিলেন। দিনাজপুর জমিদারী যিনি প্রতিষ্ঠা করেন সেই শুকদেব তাঁর কনিষ্ঠ পুত্র প্রাণনাথের মতো ‘যুদ্ধং দেহি’ গোছের নরপতি ছিলেন না, ভাগ্যবলে এবং কৌশলে জমিদার হয়েছিলেন। তাঁর বাবা হরিরাম ঘোষ দক্ষিণ রাঢ়ের কুলাই গ্রামের কুলীন কায়স্থ ছিলেন (বর্ধমানের মনোহরশাহী পরগনা)। সরকার পিঞ্জরার জমিদার শ্ৰীমন্ত রায় হরিরামের সঙ্গে নিজের মেয়ের বিয়ে দেন এবং ঐ বিবাহে সঞ্জাত দৌহিত্র শুকদেবকে জমিদারী দিয়ে পরলোক গমন করেন। শ্ৰীমন্ত রায় জমিদার হবার আগে নায়েব কানুনগো ছিলেন বলে শোনা যায়, সম্ভবত সেই সূত্রে সরকার পিঞ্জরা তাঁর হস্তগত হয়েছিল। শ্রীমন্তের দৌহিত্র শুকদেবও করিৎকর্মা পুরুষ ছিলেন। খেতলালের জমিদারের সেরেস্তায় তিনি বংশানুক্রমিক ভাবে কাজ করতেন। ক্রমে সেখানে দেওয়ান হয়েছিলেন। বেওয়ারিশ অবস্থায় মনিবের মৃত্যু হলে শুকদেব আর একজন আমলার সহযোগে সরকার ঘোড়াঘাটের খেতলাল জমিদারী ভাগাভাগি করে নেন। তাঁর ভাগে পড়ে সাত আনা। অবশিষ্ট নয় আনি থেকে পার্শ্ববর্তী ইদ্রাকপুর জমিদারীর উদ্ভব হয়। ১৬৭৭ খ্রীস্টাব্দে শুকদেব মারা যান। তাঁর ছোট ছেলে প্রাণনাথ (আনুমানিক ১৬৮২-১৭২৩) যুদ্ধবিগ্রহ করে দিনাজপুরকে বঙ্গের অন্যতম প্রধান জমিদারীতে পরিণত করেন।

প্রাণনাথ আশেপাশের বারোজন ছোট ছোট ভূস্বামীকে উৎখাত করে পরে মালিগাঁও পরগনা দখল করেন এবং মালদা জেলার এক বৃহৎ অংশ নিজের অধিকারে আনেন। শুকদেবের ‘সুখসাগর’ দীঘির অনুসরণে প্রাণনাথ ২৬০০ ফুট লম্বা এবং ৮০০ ফুট চওড়া একটি দীর্ঘিকা খনন করে তার নাম দেন প্রাণসাগর। এর পাড়ে একটি শিবমন্দির ছিল। ঊনবিংশ শতকে দিনাজপুরের রাজাদের অবস্থা পড়ে যাবার পর গভীর জঙ্গলে ঐ সরোবর ও মন্দির আবৃত হয়ে যায়। দিনাজপুর শহরের যে অংশটি প্রাণনাথের সময় গড়ে ওঠে তার নাম ছিল প্রাণনাথপুর। কিন্তু লোকে বলে তাঁর রাজবাটি শহরের চব্বিশ মাইল উত্তরে প্রাণনগরে অবস্থিত ছিল। যে চতুষ্কোণ টিবি দেখিয়ে ঊনবিংশ শতকের লোকেরা তার নীচে প্রাণনাথের প্রাসাদের ধ্বংসাবশেষ নির্দেশ করত তার চারদিকে হিংস্র শার্দূল অধ্যুষিত জঙ্গল গড়ে উঠেছিল। সে জঙ্গল এত ঘন যে হাতীর পিঠে শিকারে এসে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ই. ডি. ওয়েস্টাকট একটি ক্ষুদ্রাকৃতি ভগ্ন ঠাকুর-বাড়ি ছাড়া কিছু দেখতে পাননি। শহরের বারো মাইল উত্তরে কান্তনগরে রাজা প্রাণনাথ একটি সুন্দর নবরত্ন মন্দির গড়ে প্রায় শেষ করে এনেছিলেন, ১৭২৩-এর ফান মাসে তাঁর মৃত্যু হলে পরবর্তী রাজা রামনাথ ১৭২৪ খ্রীস্টাব্দে তা সম্পূর্ণ করেন।

নিঃসন্তান প্রাণনাথের দত্তক পুত্র রামনাথ (১৭২৩-১৭৬০) চার লক্ষ টাকার উপর নজরানা দিয়ে ১৭২৪ খ্রীস্টাব্দে বাদশাহ মুহম্মদ শাহের ফারমান বলে ‘মহারাজ বাহাদুর’ হয়ে জমিদারীতে সুপ্রতিষ্ঠিত হন। নবাব সরকারের দেওয়ানী সনদ বলে তাঁর তিনটি আলাদা আলাদা জমিদারী প্রাপ্তি হয় এবং তাঁর সময়েই দিনাজপুর রাজ্য পূর্ণ আকার ধারণ করেছিল। তিনি যে নিজে প্রচণ্ড বলশালী যোদ্ধা ছিলেন তার প্রমাণ স্বরূপ তাঁর বংশধররা সন্দিহান ওয়েস্টমাকট সাহেবকে রাজবাটিতে রক্ষিত মহারাজ রামনাথের বর্ম ও বর্শা দেখিয়ে দিয়েছিলেন। জনশ্রুতি আছে যে তিনি নাটোরের রাজার সঙ্গে মিলে প্রতিবেশী জমিদারদের উপর চড়াও হয়ে তাঁদের জমি ভাগভাগি করে নিতেন। এইভাবে নাটোর ও দিনাজপুরের দুই রাজা পরগনা খাট্টা দখল করে ভাগ করে নিয়েছিলেন। প্রবাদ অনুসারে গোবিন্দনগরের জমিদারের উপর চড়াও হবার আগে এক ব্রাহ্মণের সহায়তায় ঐ জমিদারের আরাধ্যা দেবী চামুণ্ডার মূর্তিখানি তিনি খাল কেটে চুরি করে দিনাজপুরের রাজবাটি পর্যন্ত ভাসিয়ে নিয়ে আসেন। রাজবাটি তাঁর সময় পুনর্নির্মিত হয়। নানা কারুকার্য শোভিত তোরণ দ্বার এবং গড়খাত ও দেওয়ালের বেষ্টনী নির্মাণ করে তিনি প্রাসাদের শোভা ও নিরাপত্তা বিধানের প্রয়াস পান। লোকে বলে, তাঁর রাজত্বের গোড়ায় রঙপুরের ফৌজদার সৈয়দ মহম্মদ খান পূর্ববর্তী প্রাসাদে চড়াও হয়ে পুরান ফারমান সমেত অনেক কিছু লুঠ করে নিয়ে যান,৬৩ তাই এই ব্যবস্থা। অথচ নবাব দরবারে তাঁর এত খাতির ছিল যে তিনি কোনোরকম ‘হস্ত ও বুদ’ অনুসন্ধান বা আমিলের শাসন থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত থেকে প্রায় স্বাধীনভাবে রাজ্যশাসন করতেন। তবে বর্গি হাঙ্গামার সময় মুর্শিদাবাদে নবাবের হাতে আটক হলে তিনি শেষে জগৎ শেঠের নামে বার লক্ষ টাকার হুণ্ডী দিয়ে ছাড়া পান।৬৫ ‘শুকসাগর’ এবং ‘প্রাণসাগরের’ পর তিনি ‘রামসাগর’ সৃষ্টি করেছিলেন। প্রবাদ আছে ঐ দীঘি খননের সময় তিনি প্রচুর গুপ্তধন পেয়েছিলেন। বীর্যবান রামনাথ তাঁর চার স্ত্রীর প্রত্যেকের গর্ভে একটি পুত্র ও একটি কন্যা উৎপাদন করে ১৭৬০ খ্রীস্টাব্দে সাধনোচিত ধামে গমন করেন। উত্তরাধিকারী বৈদ্যনাথের হাতে তিনি ৪১১৯ বর্গমাইল বিস্তৃত রাজ্য রেখে গেছিলেন।৬৬

(৪) নদীয়া—পরগনা ৭৩, জমা–৫,৯৪,৮৪৬।

উখড়া বা নদীয়া জমিদারীর উদ্ভবের আগে নদীয়া অঞ্চলের ভূস্বামীদের মধ্যে একটি রাজবংশের চিহ্ন ‘দে গাঁর টীবি’ নামে লোকে নির্দেশ করে থাকে। এই দেবগ্রামের কুম্ভকারজাতীয় রাজা দেবপাল সপরিবারে মুসলমানদের হাতে নষ্ট হন এবং প্রবাদ কীর্তিত ‘রাঘব রায়ের কাল’-এ দেববংশের বিস্তৃত ভূসম্পত্তি উখড়ার অন্তর্গত হয়ে যায়। এ সম্পর্কে দেবী অন্নদার মুখে কবি ভারতচন্দ্র রায় গুণাকর এই ভবিষ্যৎ বাণী অর্পণ করেছেন:

দেগাঁয় আছিল রাজা দেপাল কুমার।
পরশ পাইয়াছিল বিখ্যাত সংসার॥
আমার কপটে তার হয়েছে নিধন।
রাঘবেরে দিব আমি তার রাজ্যধন॥

প্রবাদ আছে স্পর্শমণির অশুভ স্পর্শে দেবপালের উত্থান ও পতন সংঘটিত হয়েছিল। নদীয়া রাজবংশের ব্রাহ্মণ্য শাসনে ভূতপূর্ব নিম্নবর্ণের রাজশক্তি বিলুপ্ত হয়ে যায়। নদীয়া রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা ভবানন্দ মজুমদার (রাঘব রায়ের ঠাকুরদা) ভারতচন্দ্রের অন্নদামঙ্গলের পাতায় সজীব হয়ে আছেন, কিন্তু নানা কাহিনীর মধ্যে থেকে তাঁর সম্বন্ধে নির্ভুল তথ্য আহরণ করা সহজ নয়। কৃষ্ণনগর বংশের আত্মীয় রাজীবলোচন শমা ‘মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র রায়স্য চরিত্রং’ গ্রন্থে ভবানন্দের যে ইতিহাস বিকৃত করেছেন তা হুবহু ভারতচন্দ্রের অন্নদামঙ্গল কাহিনী থেকে নেওয়া এবং তাতে পৌরাণিক ঐতিহাসিক অথবা প্রকৃত অপ্রাকৃত ঘটনাবলীর মধ্যে কোনো সীমারেখা নির্দিষ্ট নেই। সংস্কৃতে রচিত ক্ষিতীশবংশাবলী চরিতম্‌কেও ফার্সী তাওয়ারিখের মতো নির্ভরযোগ্য ইতিহাস বলে ধরা চলে না। কিন্তু ভারতচন্দ্রের মঙ্গলকাব্য, ‘ক্ষিতীশবংশাবলীচরিত’ ও রাজীবলোচন শর্মার চরিত কথা থেকে কৃষ্ণনগর বংশ সম্পর্কে যে সব কাহিনী ও ঘটনা পাওয়া যায়, তাই থেকে তৎকালীন হিন্দুদের ইতিহাস চেতনার আকার প্রকার সম্বন্ধে একটা স্পষ্ট ধারণা গড়ে নেওয়া যেতে পারে।

অন্নদামঙ্গলের হরি হোড় বৃত্তান্ত, অন্নদা কর্তৃক হরি হোড় ত্যাগ ও ভবানন্দ মজুমদারের গৃহে যাত্রা, পথে ঈশ্বর পাটনীর সঙ্গে দেবী অন্নদার চিরস্মরণীয় সাক্ষাৎসার (‘প্রণমিয়া পাটুনি কহিছে জোড় হাতে। আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে’) ইত্যাদি অলৌকিক কাহিনী রাজীবলোচন শর্মা নির্জলা ইতিহাস জ্ঞানে তাঁর চরিত কথায় সমাবিষ্ট করেছেন: ‘ভবানন্দ রায় মজুমদারের বাটীতে আশ্চর্য্য এক প্রকরণ হইল তাহার বৃত্তান্ত এই দড়গাছি নামে এক গ্রাম তাহাতে হরি হেডের বসতি। হরি হোড় অতি বড়ো ধনবান এবং পণ্যশীল অত্যন্ত ধার্মিক। লক্ষ্মী সর্বদা স্থিরা হইয়া হরি হোড়ের নিবাসে বসতি করেন। বহুকাল এইরূপে গত হইলে হরি হোড়ের পরিবার অতি বিস্তর সর্বদা বিবাদ করিতে প্ৰবৰ্ত্ত বাটীর মধ্যে হাটের কোলাহলের ন্যায় লক্ষ্মী বিবেচনা করিলেন এ বাটীতে আর তিষ্ঠান গেল না অতএব আমার পরম ভক্ত ভবানন্দ মজুমদার তাহার বাটীতে গমন করি’…। পথে ঈশ্বরী পাটনীর সঙ্গে দেবীর সাক্ষাৎ হল, তার কাছে দেবী নিজেকে ভবানন্দ মজুমদারের বিবাহিতা কন্যা বলে পরিচয় দিলেন। কিন্তু দেবীর পাদস্পর্শে নৌকার অভ্যন্তরস্থ জলসেচনী স্বর্ণময় হয়ে যাওয়ায় সেই মাঝির মেয়ে (রাজীবলোচনের বিবৃতিতে সে স্ত্রীলোক—‘আমি অতি দুঃখিনী’) বুঝতে পারল জগৎ জননী তার কাছে ছল করে এসেছেন। …‘তখন লক্ষ্মী হাস্য করিয়া কহিলেন ঈশ্বরী পাটনী তুমি আমায় অনেক তপস্যা করিয়াছ আমি বড় বাধ্য আছি বর যাজ্ঞা কর। ঈশ্বরী পাটনী কহিলেক মা গো তোমার কৃপায় আমার সকল পূর্ণ হইল যদি বর দিবেন তবে এই বর দিউন যে আমার সন্তান যাবৎ – থাকিবেক কেহ দুঃখ না পায় এবং দুগ্ধ ভাত খাউক। তথাস্তু বলিয়া দেবী অন্তর্ধান হইলেন।’ অতঃপর ভবানন্দ মজুমদারের স্ত্রী রাতে স্বপ্নে দেখলেন অপূর্ব এক কন্যা তাঁকে বলছেন—আমি তোমার বাটীতে আসিয়াছি এবং আমার একটি ঝাঁপি তোমার ঘরে রাখিয়াছি—তুমি সর্বদা আমার পূজা করিবা এবং ঝাঁপিটি খুলিবা না।’ এর পর রাজীবলোচন একটি তথ্য পরিবেশন করেছেন—‘রায় মজুমদারের স্ত্রী প্রাতে গাত্রোত্থন করিয়া দেখেন ঘরের মধ্যস্থলে ঝাঁপী। স্নান করিয়া ঝাঁপী মস্তকে লইয়া অপূৰ্ব এক স্থানে রাখিয়া নানাবিধ আয়োজন করিয়া লক্ষ্মীর পূজা করিলেন। অদ্যাপি সেই ঝাঁপী আছে।’৬৮ ঝাঁপী ভবানন্দের পরিবারে যে প্রকারেই আসুক, কৃষ্ণনগর রাজবংশ এই ঘটনায় আস্থা রাখতেন এবং তা থেকেই তাঁদের সৌভাগ্যের সূচনা গুণতেন, এটা লক্ষণীয় বস্তু। এ থেকে অতীতের সম্বন্ধে সে কালের মানুষের ধ্যান ধারণার পরিচয় মেলে। হরি হোড় নামে সদাশয় ধনবান বণিক কাল্পনিক চরিত্র না হয়ে সত্যকার লোক হওয়া অসম্ভব নয় এবং হয়তো এই কাহিনীর মধ্যে মোগল আমলে ব্রাহ্মণেতর নিম্নবর্ণ লোকেদের ক্ষয়িষ্ণু অবস্থার উপর নদীয়ার ব্রাহ্মণ্য শক্তি ও বৈভবের প্রতিষ্ঠা ইঙ্গিতে নির্দিষ্ট হয়ে থাকতে পারে।

ভবানন্দ কুলীন ব্রাহ্মণ ছিলেন না কিন্তু কৌলীন্য না থাকলেও সরকার সাতগাঁয়ের অস্থায়ী কানুনগো পদ এবং পরগনা উখড়ার ক্রোরী পদ লাভ করে তিনি লক্ষ্মীর ঝাঁপী আয়ত্ত করতে সক্ষম হয়েছিলেন।৬৯ কথিত আছে রাজা প্রতাপাদিত্যের বিরুদ্ধে মোগল সেনাপতি মানসিংহের অভিযানে যানবাহন ও খাদ্য সরবরাহ করে তিনি বাদশাহ্‌ জাহাঙ্গীরের সুনজরে পড়েন এবং ১৬০৬ খ্রীস্টাব্দে বাদশাহী ফারমানের বলে চোদ্দটি পরগনার জমিদারী প্রাপ্ত হন। এইভাবে তাঁর সৌভাগ্য রবি উদিত হলে পর ভবানন্দ বাগুয়ান থেকে (লোকে বলে এইখানে মানসিংহ তাঁর অতিথি হয়েছিলেন) মাটিয়ারীতে নিবাস উঠিয়ে নিয়ে যান এবং এখানে তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র গোপালের ঔরসে রাঘব রায়ের জন্ম হয়। রাঘব রায় মাটিয়ারী থেকে রেউই নামে এক মৃগ ময়ূর কাননাদি শোভিত মনোরম স্থানে রাজধানী স্থানান্তরিত করেন। তখন সেখানে কয়েক ঘর গোপ ছাড়া কেউ ছিল না, তারা ধুমধাম করে কৃষ্ণ পূজা করত বলে তাঁর পুত্র রুদ্র রায় রেউই নাম পরিবর্তন করে কৃষ্ণনগর নামকরণ করেন। উনবিংশ শতকের প্রথম দিকের লোকেদের কাছে— ‘রাঘব রাগের কাল’ বলতে এক বহু দূরবর্তী সত্য যুগের কথা মনে হত—‘রাঘব রায়ের কালে পড়ে আছে’ বলে সংকেতে বহুদিন আগেকার কথা বোঝাত।৭০ রাঘব রায়ের কাল প্রকৃতপক্ষে বাদশাহ আওরঙ্গজেবের আমলের গোড়ার দিক—ঐ সময় নদীয়ার জমিদারী বিশালায়তন হয়ে রাজ্যের আকার ধারণ করে। ভবানন্দ লোক সমক্ষে রায় মজুমদার বলে পরিচিত ছিলেন—রাঘব রায় প্রথম বাদশাহের সুবাহ্‌দারকে নিয়মিত খাজনা দানে তুষ্ট করে মহারাজ উপাধি পেয়েছিলেন। রাজীবলোচন শর্মা তাঁর চরিত্র বর্ণনা করতে গিয়ে লিখেছেন—‘কতক কালানস্তরে রায় মজুমদার তিন পুত্রের বিবাহ দিলেন কালক্রমে গোপাল রায়ের পুত্র হইল নাম রাখিলেন রাঘব রায় ভবানন্দ রায় পৌত্র দর্শন করিয়া বিবেচনা করিলেন এ পৌত্র অতি প্রধান মনুষ্য হইবেক সর্ব লক্ষণে লক্ষণাক্রান্ত।… পরে রাঘব রায় সৰ্ব্ব শাস্ত্রে গুণবান অতিবড় দাতা সৰ্ব্বদা যাবতীয় প্রজার প্রতিপালনে মতিমান সৰ্ব্ব লক্ষণাক্রান্ত দান ধ্যান যোগ সদালাপ বিশিষ্ট লোকের সমাদর রাজ্য সুদ্ধ সকল লোকের নিকট মহৎ সুখ্যাত্যাপন্ন জমিদারীর বাহুল্য হইতে লাগিল…।’

সপ্তদশ শতাব্দীতে নবদ্বীপের শ্রেষ্ঠ পণ্ডিত গদাধর ভট্টাচার্য চক্রবর্তীকে রাজা রাঘব রায় ১৬৬১ খ্রীস্টাব্দে ৩৬০ বিঘা নিষ্কর জমি দান করেছিলেন।৭১ প্রজাদের জলকষ্ট দূর করবার জন্য এই আদর্শ নরপতি শান্তিপুর ও কৃষ্ণনগরের মধ্যস্থলে বিশ হাজার টাকা ব্যয়ে এক বিস্তীর্ণ দীঘি খনন করে তার পূর্বতটে ঘাট, অট্টালিকা ও মন্দির নির্মাণ করেন। মন্দির গাত্রে এই শ্লোক খোদিত আছে:

শাকে সোমনবেষু চন্দ্ৰগণিতে পুন্যৈকরত্না করো
ধীর শ্ৰীযুত রাঘবোদ্বিজমনির্ভূমীভুজামগ্রণীঃ।
নির্ম্মায় স্ফুরদুর্মিনির্মলজলপ্রদ্যোতিনীং দীর্ঘিকাং।
তত্তীরে কৃত রম্য বেশ্মনি শিবং দেবং সমাস্থাপয়ৎ॥

অর্থাৎ ১৫৯১ শকে (১৬৬৯ খ্রীস্টাব্দে) ভূস্বামীদের অগ্রগণ্য দ্বিজমণি ধীর শ্ৰীযুত রাঘব স্ফুরদুর্মি নির্মল জল প্রদ্যোতিনী দীর্ঘিকা নির্মাণ করে তার তীরে কৃত রম্য মন্দিরে শিব স্থাপন করেছিলেন। এই বৃহৎ অনুষ্ঠানে তিনি অঙ্গ বঙ্গ কলিঙ্গ কাশী কাঞ্চী থেকে দলে দলে পণ্ডিত আমন্ত্রণ করে দুধ ঘি মধু মদের নদী বইয়ে দেন এবং গম যব তণ্ডুল মটরদানার স্তূপীকৃত পাহাড় উত্থিত করেন।

রাঘব রায়ের পুত্র রুদ্র রায় পিতার মতো প্রজাহিতৈষী নৃপতি ছিলেন। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির এজেন্ট Hedge সাহেবের ডায়ারীতে ১৬৮২ খ্রীস্টাব্দের অক্টোবর মাসের রোজনামচায় দেখা যায়—‘ভোর বেলা শ্রীনগর গ্রাম পার হয়ে বিকেল বেলা পাঁচটা নাগাদ আমরা রেউই পর্যন্ত পৌঁছে গেলাম। এই গ্রামের মালিক হলেন উদয় রায় (? রুদ্র রায়) নামে এক জমিদার যিনি প্রায় হুগলীর অপর পার পর্যন্ত গঙ্গার এই ধারের সমস্ত দেশের মালিক। গাঁয়ের লোকেরা বলে ইনি তাঁর ভূসম্পত্তির খাতে বাদশাহকে বছরে কুড়ি লক্ষ টাকা খাজনা দেন। দু বছর আগে তিনি মোগল বাদশাহ ও তাঁর পেয়ারের লোককে এক লক্ষ টাকা নজরানা দিয়েছিলেন যাতে তিনি তাঁর দেশে এসে মৃগয়া ও পক্ষী শিকার করা থেকে বিরত হন—কারণ বাদশাহের দুর্দান্ত দুঃশীল অনুচরেরা তাঁর প্রজাদের লুঠপাট করে সর্বস্বান্ত করবে বলে তাঁর মনে ভয় হয়েছিল।’৭২ রাঘব রায়ের কাল থেকে রেউইয়ের চারপাশে গড়খাই কাটা ছিল, রুদ্র রায় একটি খাল কেটে তার সঙ্গে গড়খাইয়ের সংযোগ স্থাপন করে সেই জায়গার নাম দেন কৃষ্ণনগর এবং সেখান থেকে শান্তিপুর পর্যন্ত প্রশস্ত রাজপপ নির্মাণ করেন। খাজনার দায়ে তাঁকে ঢাকায় যেতে হয়েছিল—সেখানে নবাবকে তুষ্ট করে আলানা খান নামে এক বিখ্যাত মুসলমান স্থপতিকে সঙ্গে নিয়ে এসে কৃষ্ণনগরে একটি নতুন রাজবাড়ি তৈরি করান—সঙ্গে সঙ্গে হাতি ঘোড়ার জন্য একটি পিলখানা এবং নাচগানের জন্য আলাদা এক নাচঘর। ঐ মুসলমান স্থপতির কবর কৃষ্ণনগরের চকে দেখা যায়—আল্লা দস্তুর পীর নামে লোকে সেখানে পুজো দিত। রাজা রুদ্র রায় একটি আদর্শ ব্রাহ্মণ প্রধান অঞ্চল সৃষ্টি করবার সঙ্কল্প নিয়ে একশো আট ঘর সুপণ্ডিত নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণকে ভূসম্পত্তি দান করে ব্ৰহ্মশাসন নামে এক গ্রাম স্থাপন করেন—পরবর্তীকালে এই গ্রামের চন্দ্রচূড় তর্কচূড়ামণি মহারাজ গিরীশচন্দ্রের আমলে তন্ত্রোক্ত জগদ্ধাত্রী পূজার প্রচার করেছিলেন এবং নদীয়া রাজবংশের চেষ্টায় এই পূজা সার্বজনীন আকৃতি লাভ করেছিল।৭৩ রুদ্র রায়ের আমলে ভারতবর্ষের দিকপাল নৈয়ায়িক গদাধর ভট্টাচার্য চক্রবর্তী বার্ধক্যে পদার্পণ করেছিলেন। এবং ঐ কালে নদীয়ার নব্য ন্যায় বহুতর গুরু ও শিষ্য কর্তৃক চর্চিত হয়ে উন্নতির চরম দশা প্রাপ্ত হয়েছিল। শঙ্কর তর্কবাগীশের প্রাধান্য কালে ১৭৯১ খ্রীস্টাব্দে যেখানে এক নবদ্বীপেই ১৫০ জন অধ্যাপক ও ১১০০ ছাত্রের উল্লেখ পাওয়া যায়, সেখানে গদাধর ভট্টাচার্য চক্রবর্তীর জীবদ্দশায় রঘুরামের রাজত্বকালে ৪০০০ ছাত্র ও তদনুপাতে ৫৫০ জন অধ্যাপক চতুষ্পঠীতে বিদ্যাচচা করতেন। রুদ্র রায় অধ্যাপক মণ্ডলীকে অনেক নিষ্কর জমি দিয়ে নবদ্বীপে আগত বিদেশী ছাত্র মণ্ডলীর ব্যয়ভার নির্বাহের জন্য ভূসম্পত্তি নির্দিষ্ট করে এই ভারতবিশ্রুত বিদ্যাচর্চা কেন্দ্রের প্রভাব আরো সুদূর প্রসারী করে তুলেছিলেন।

রুদ্র রায়ের মৃত্যুর পর তাঁর তিন পুত্র জ্যেষ্ঠা মহিষীর গর্ভজাত রামচন্দ্র ও রামজীবন এবং কনিষ্ঠা মহিষীর গর্ভজাত রামকৃষ্ণ পরস্পরের সঙ্গে উত্তরাধিকার নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা শুরু করায় উখড়া জমিদারী নবাব সরকারের ক্রমবর্ধমান প্রভাবের বশবর্তী হয়ে পড়ে এবং এক এক বার এক এক জন খাজনার দায়ে বা পরস্পরের কূটচালে ঢাকায় বা পরে মুর্শিদাবাদে বন্দী হতে থাকেন। কনিষ্ঠার গর্ভজাত রামকৃষ্ণকে রাজা রুদ্র রায় উত্তরাধিকারী মনোনীত করে গেলেও হুগলীর ফৌজদার ও ঢাকার নাজিমের৭৪ আজ্ঞাক্রমে জ্যেষ্ঠ রামচন্দ্র প্রথমে জমিদারীতে নিযুক্ত হন, কিন্তু সহোদর রামজীবন তাঁকে হটিয়ে দেন, পরে আবার রামচন্দ্র নিজের ভাইকে বিতাড়ন করে রাজ্য দখল করেন। শীঘ্রই তাঁর মৃত হওয়ায় রামজীবন আবার দু দিনের রাজা হয়ে বসেন, কিন্তু কয়েকদিন যেতে না যেতেই বৈমাত্রেয় ভাই রামকৃষ্ণের কৌশলে ঢাকায় বন্দী হন। রামকৃষ্ণের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হওয়া মাত্র শোভা সিংহের বিভ্রাট উপস্থিত হয় এবং বর্ধমান থেকে পালিয়ে এসে জগৎরাম কিছুদিন গোপনে মাটিয়ারীতে রামকৃষ্ণের আশ্রয় নেন। ক্ষিতীশ-বংশাবলী চরিতে বলা হয়েছে—‘অথ সসৈন্যবলবাহনশোভাসিংহঃ সমাগত্য হতপরিবারং কৃষ্ণরামরায়ং নিহত্য বর্ধমানমুপপ্লাবয়ামাস। পলায়নপরায়ঞ্চ জগৎরামং রামকৃষ্ণরায়ো মাটিয়ারিপ্রদেশে নিভৃতং স্থাপয়ামাস। শোভাসিংহশ্চ হতশেষে কৃষ্ণরামপরিবারে পলায়মানে বর্ধমানে বাধিপত্য বিস্তারয়ামাস।’ এখানে রামকৃষ্ণ কর্তৃক বর্ধমানে স্বাধিপত্য প্রতিষ্ঠার যে কথা বলা হয়েছে তা অমূলক হলেও মোগল সেনাপতি জবরদস্ত খানের বিদ্রোহ দমন অভিযানে নদীয়া ও অন্যান্য জমিদারদের দলবল যোগ দিয়েছিল অনুমান করা যায়। নানা হানাহানির মধ্য দিয়ে নবাব সরকারের প্রতি নদীয়া রাজবংশের অবিচলিত আনুগত্যও বেশ লক্ষণীয় বস্তু। এই নীতির বলে যেখানে চিতুয়ার শোভসিংহ রাজশাহীর উদয়নারায়ণ ভূষণার সীতারাম রায় ধনে প্রাণে নষ্ট হয়েছেন, সেখানে বর্ধমানের জগৎরাম, নদীয়ার রামকৃষ্ণ এবং নাটোরের রঘুনন্দন রীতিমতো রাজ্যবিস্তার করতে সক্ষম হয়েছেন। রামকৃষ্ণের আমলে যশোহরের সঙ্গে নদীয়ার সীমানা নিয়ে বিবাদ হয় এবং রামকৃষ্ণ যশোহর আক্রমণ করেন বলে শোনা যায়। ‘রামকৃষ্ণ মহারাজ পরমধাৰ্ম্মিক এবং সুবার নিকট যথেষ্ট মাদাম্বিত যে রাজকর পূর্বে নির্ধারিত ছিল তাহা অপেক্ষা কিছু অল্প করিয়া যথেষ্ট সৈন্য রাখিয়া রাজ্যের বাহুল্য করিলেন। রামকৃষ্ণ মহারাজ বাইশ লক্ষের জমিদারী করিয়া পরম সুখে কালযাপন করেন তাঁহার অবর্তমানে রামজীবন রায় রাজা হইলেন।’৭৫

শোভাসিংহের বিদ্রোহ দমন উপলক্ষে বাদশাহজাদা আজিম-উস-শান ঢাকায় সুবাহদার হয়ে এসেছিলেন, তিনি সৈন্যসহায়তা পেয়ে রামকৃষ্ণের উপর বিশেষ প্রীত ছিলেন। দেওয়ান মুর্শিদকুলী খানের সঙ্গে বাদশাহজাদার বিবাদ উপস্থিত হলে খাজনার দায়ে দেওয়ান রাজাকে আটক করেন এবং বসন্ত রোগে ভুগে অপুত্রক অবস্থায় আজিম-উস-শানের প্রিয়পাত্র রামকৃষ্ণ রায় পরলোকগত হন। আজিম-উস-শান এই সংবাদে বিশেষ দুঃখিত হয়ে রামকৃষ্ণের কোনো বংশধরকে অনুসন্ধান করে রাজ্য দান করার জন্য মুর্শিদকুলী খানকে বার বার অনুরোধ করতে লাগলেন। দেওয়ান বাদশাহজাদাকে জানালেন—কোনো বংশধর নেই, তবে কারাগারে এঁর জ্যেষ্ঠ ভাই রামজীবন পড়ে আছেন। অগত্যা রামজীবনকে উখড়ার জমিদার নিযুক্ত করা হল।৭৬ রাজ্য ফিরে পেয়ে রামজীবন নাটক অভিনয়াদি আমোদ প্রমোদে প্রবৃত্ত হলেন এবং অবিলম্বে খাজনার দায়ে এবার মুর্শিদাবাদে—আটক হলেন। তাঁর পুত্র রঘুরাম রাজশাহীর বিদ্রোহী রাজা উদয়নারায়ণের সেনাপতিকে অব্যর্থ শরসন্ধানে নিপাত করে পুরস্কার স্বরূপ পিতাকে ছাড়িয়ে আনলেন। রামজীবনের পর রঘুরাম রাজা হলেন। এঁর আজ্ঞায় শ্রীরামকৃষ্ণ সার্বভৌম সংস্কৃতে বিখ্যাত ‘পদাঙ্কদৃত’ কাব্য রচনা করেন।৭৭

১৭১০ খ্রীস্টাব্দে রঘুরামের একটি পুত্র সন্তান ভূমিষ্ঠ হলে ‘ব্রাহ্মণেরা বেদধ্বনি করিতে লাগিলেন। পরে জ্যোতিষী ভট্টাচার্য্যেরা নানা শাস্ত্র বিচার করিয়া দেখিলেন অপূর্ব বালক হইয়াছে। রাজার নিকট নিবেদন করিলেন মহারাজ এই যে রাজপুত্র হইয়াছেন ইহার দীর্ঘ পরমায়ু হইবেক, সর্ব শাস্ত্রে মহামহোপাধ্যায় এবং বুদ্ধিতে বৃহস্পতির ন্যায় এবং ধর্মাত্মা হইবেন। সকল লোক ইহার অতিশয় যশ ঘুষিবেক। মহারাজচক্রবর্তী হইয়া বহুকাল রাজ্য করিবেন। মহারাজ ইহার গুণে কুল উজ্জ্বল হইবেক। রাজা জ্যোতিষী ভট্টাচার্য্যেরদিগের বাক্য শ্রবণ করিয়া অত্যন্ত হর্ষযুক্ত হইলেন। কিছু কালানন্তরে নর্তকীরা আসিয়া রজনীতে রাজার সম্মুখে নৃত্য করিতে প্রবৰ্ত্ত হইল। দিবারাত্রি সর্বদাই নগরস্থ লোকেরদিগের আনন্দের সীমা নাই এইরূপে কালক্ষেপণ করেন। রাজপুত্র দিনে ২ চন্দ্রের ন্যায় বৃদ্ধি পাইতেছেন, নাম রাখিলেন কৃষ্ণচন্দ্র। কালক্রমে বিদ্যা অভ্যাস করিতে প্রবৰ্ত্ত হইলেন, পরে বাঙ্গালা ও ফারসি শাস্ত্রে পণ্ডিত হইয়া অস্ত্রবিদ্যাতে প্রবৰ্ত্ত হইয়া অল্পদিনেই অস্ত্রশিক্ষা করিয়া রাজকীয় ব্যাপার শিক্ষা করিতে লাগিলেন। রাজারদিগের যেমন নীতিবর্ত্ম আছে তাহা শিক্ষা করিলেন অল্পকালের মধ্যে সকল বিষয়ের পারগ হইলেন। রাজা রঘুরাম রায় দেখিলেন পুত্র সর্বগুণালঙ্কৃত হইলেন…’।৭৮ ধুমধাম করে কৃষ্ণচন্দ্রের বিয়ে দিয়ে রঘুরাম একটি বধূ আনলেন-কৃষ্ণনগরে ‘শোভার সীমা নই। সহস্র সহস্র পতাকা, রক্ত, পীত, শুভ্র, নীল ইত্যাদি উড্ডীয়মানা নানা জাতীয় বাদ্যোদম রাজপুরে মহামহোৎসব অন্য রাজগণ দর্শন করিয়া ধন্য ধন্য করিতেছেন।’

১৭২৮ খ্রীস্টাব্দে রঘুনাথের দেহান্ত হল, কৃষ্ণচন্দ্রের বয়স তখন আঠার। সেই বয়সেই তাঁর কলাকৌশল এবং নিজের অভীষ্ট সাধনে চাতুর্যের পরিচয় পাওয়া গেল। লোকে বলে তাঁর বাবা কোনো অনির্দিষ্ট কারণে তাঁকে উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত করে নিজের ছোট ভাই রামগোপালকে মনোনীত করে যান। ধূর্ত কৃষ্ণচন্দ্র কাকাকে পথের মাঝে তামাক সেবনে নিরত করে নবাব দরবারে হাজির হয়ে নিজের জমিদারী লিখিয়ে নেন। গল্পটি আগাগোড়া বানানো হওয়াই সম্ভব, কিন্তু কৃষ্ণচন্দ্রের শঠতা সম্পর্কে জনমানসে যে ধারণা ছিল এতে তার আভাস পাওয়া যায়। লম্পট এবং নানারকম কুরুচিপূর্ণ আমোদ প্রমোদের প্রবর্তক বলেও তাঁর একটা অখ্যাতি ছিল। রাজা হবার পর তিনি আর একটি বিয়ে করেছিলেন। সে সম্বন্ধে প্রচলিত গল্পটিতেও তাঁর চরিত্রের আর একটি দিক সম্বন্ধে লোকের ধারণার কিছু কিছু পরিচয় মেলে। একদিন রাজা নৌকা করে বেড়াতে যাচ্ছেন এমন সময় নৌকারীর ঘাটে একটি ব্রাহ্মণের মেয়েকে জলক্রীড়া করতে দেখে তাঁর অঙ্গসৌষ্ঠবে আবিষ্ট হয়ে মেয়ের বাপকে ডাকলেন। বাপ উচ্চ ঘরের কুলীন রাজার বংশমর্যাদা সে তুলনায় অনেক খাটো।৭৯ কিন্তু সে আপত্তি টিকল না। বিয়ে করে মেয়েটিকে রাজবাটিতে এনে গর্বিত রাজা বললেন, ‘দেখ এখানে এসে তুমি রূপার পালঙ্কে শুতে পারলে।’ সেই কুলীন কন্যা তখনি দৃপ্ত সুরে উত্তর দিলেন, ‘আর একটু উত্তরে গেলে সোনার খাটে শুতে পারতাম।’ আর একটু উত্তর বলতে মুর্শিদাবাদের নবাবী অন্তঃপুরের তাৎপর্য গ্রহণ করে রাজা তেজস্বিনী স্ত্রীর উপর বড়ই সন্তুষ্ট ভাব প্রদর্শন করলেন।৮০

এই চতুর চূড়ামণি রসিক প্রবর কৃষ্ণচন্দ্র সর্বনৃপতিসার আদর্শ গুণগ্রাহী নৃপতিরূপে আজও জনমানসের অক্ষয় সিংহাসনে আরূঢ় হয়ে আছেন। তিনি শুধু এক জন রাজা নন, সামাজিক বিবর্তনের প্রতিফলকরূপে তিনি একটি গোটা শতাব্দী—অষ্টাদশ শতকের বাঙালি সমাজ মানসের কল্পনারূপ।৮১ সে যুগের আদর্শ মানব বলতে এখনকার লোকে নিশ্চয় তাঁর কথা স্মরণ করবে না—রানী ভবানী, হাজী মহম্মদ মহসীন বা সাধক রামপ্রসাদের কথা ভাববে। কিন্তু নানা দিক থেকে এই বিদ্যানুরাগী কবিগুণগ্রাহী দেবদ্বিজপণ্ডিত প্রতিপালক রাজা গোটা সমাজের উপর তাঁর ধূর্ত বুদ্ধি ও বিচক্ষণ মনের ছাপ রেখে গেছিলেন। নদীয়া, কুমারহট্ট, শান্তিপুর ও ভাটপাড়া, এই চারটি পণ্ডিত সমাজের পতিরূপে কৃষ্ণচন্দ্রের বন্দনা করে তাঁর সভা-কবি ভারতচন্দ্র ‘অন্নদামঙ্গলে’ রাজার যে পরিচয় দেন তাতে সেই ধর্মধ্বজ সমাজপতির বহুমুখী প্রভাব অনুভূত হয়:

নদীয়া প্রভৃতি চারি সমাজের পতি।
কৃষ্ণচন্দ্র মহারাজ শুদ্ধ শাস্তিমতি॥
প্রতাপ তপনে কীৰ্ত্তিপদ বিকশিয়া।
রাখিলেন রাজলক্ষ্মী অচলা করিয়া॥

আর একটু এগিয়ে গিয়ে ঊনবিংশ শতকের মাঝামাঝি সময় লোকে তাঁকে কি ভাবে মনে রেখেছিল এবং তাঁর প্রভাব সমাজ মানসের উপর তখনো কত গভীর ভাবে কাজ করছিল তার পরিচয় রেখে গেছেন গুপ্ত কবি—‘সংবাদ প্রভাকরের’ পাতায়:

‘আমরা যে কালে মনুষ্য রূপে জন্মগ্রহণ করিয়াছি সে কাল আমাদিগের পক্ষে কাল স্বরূপ হইয়াছে। এই কাল রাঙ্গার পক্ষে [অর্থাৎ লাল মুখো সাহেবের পক্ষে] পক্ষ হইয়া কালো দেশের আলো নির্ব্বাণ করিয়াছে। সে স্বাধীনতা কোথা? সে সুখ কোথা? সে ধর্ম্ম কোথা? সে কৰ্ম্ম কোথা? সে বিদ্যা কোথা? সে চালনা কোথা? সে পাণ্ডিত্য কোথা? সে কবিত্ব কোথা? সে সমাদর কোথা? এবং সে উৎসাহ ও অনুরাগই বা কোথা? স্বাধীনতা সংহারের সঙ্গে সঙ্গেই কাল সমস্ত উদরস্থ করিয়াছেন। আমরা অধুনা রঘুকুলতিলক ভগবান রামচন্দ্রের কথা উল্লেখ করিতে ইচ্ছা করি না। দ্বারকাধিপতি ভগবান্‌ শ্রীকৃষ্ণ এবং হস্তিনাধিপতি পাণ্ডুকুলপ্রদীপ মহারাজ যুধিষ্ঠিরের প্রসঙ্গ করিতে চাহি না। নবরত্ন সভার অধীশ্বর মহারত্ন বিক্রমাদিত্যের নাম উচ্চারণ করিব না, কেবল নবদ্বীপাধিপতি মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র রায়ের সময়কেই স্মরণ করিতেছি। ঐ সময়ে যে যে ব্যাপার হইয়াছিল বর্তমান কালে তাহার শতাংশের একাংশ থাকিলেও কত সুখের ব্যাপার হইত। উক্ত মহারাজ নানা শাস্ত্রালংকৃত পণ্ডিত ও সজ্জনের হৃদয়পদ্ম-প্রকাশকারি রবিস্বরূপ কবিগণকে অতিশয় সমাদর করিতেন। গৌরব পূৰ্ব্বক গুণের পরীক্ষা করিয়া উৎসাহ বর্দ্ধানাৰ্থ সৰ্ব্বদাই পারিতোষিক ও বৃত্তি প্রদান করিতেন। তৎসমকালে এই বঙ্গদেশে যে সকল ধনাঢ্য ভূম্যধিকারি মহাশয়েরা সজীব ছিলেন তাঁহারাও তাঁহার দৃষ্টান্তানুসারে কৰ্ত্তব্য কৰ্ম্ম সাধন করিতেন, অর্থাৎ তাবতেই পণ্ডিত ও কবিদিগ্যে যথাসাধ্য সম্ভব মতো সাহায্য করত সম্যক প্রকারেই অনুরাগের পথ পরিষ্কৃত করিতেন। এই কালে সেই কালের চিহ্ন কিছুই নাই। এইক্ষণেও অনেক সুপণ্ডিত ও সুকবি হইতেছেন, কিন্তু কি আক্ষেপ! কেহই তাঁহারদিগ্যে আদর করেন না, উৎসাহ দেন না, গুণের পুরস্কার করা দূরে থাকুক, একবার আহ্বান করিয়া জিজ্ঞাসাও করেন না। অধ্যাপক পণ্ডিতেরা কোনোরূপ পাণ্ডিত্য প্রকাশ করিলে এবং কোনো কবি কবিত্ব দর্শাহিলে যত্ন পূৰ্ব্বক তাহার মর্ম্ম গ্রহণ করা চুলায় পড়ক, বরং বিপরীতভাবে হাস্য পরিহাস করিয়া সেই সকল প্রকৃষ্ট পদার্থকে রসাতলে নিক্ষেপ করেন। …শাস্ত্রালাপ একেবারে লোপ হইয়া গেল, অধিকাংশ মহাশয় শুদ্ধ অলীকামোদে কাল হরণ করিতেছেন। প্রাচীন বা আধুনিক কাব্য লইয়া আমোদ করা অভ্যাস নাই, যেহেতু তাহার বিন্দুমাত্র বুঝিতে পারেন না, মনে বড় উল্লাস হইলে এক রাত্রি বন্ধু বান্ধবকে নিমন্ত্রণ করিয়া যাত্রা দিয়া বসিলেন, যাত্রাওয়ালা ‘ফেলুয়া, ভুলুয়া’ সং আনিয়া উপস্থিত করিল, তাহারা বহুবিধ অঙ্গ ভঙ্গি ও রঙ্গ ভঙ্গ করিয়া গীত ধরিল। …বাবুরা এই প্রকার সং ঢং ও রং দেখিয়া ও টং শুনিয়া আহ্লাদে আপনারাই জং বাহাদুর সাজিয়া বসেন।৮২

একশো বছরের ব্যবধানে বাঙালির কাছে কৃষ্ণচন্দ্রের রাজত্বকাল এইভাবে নবরত্ন সভার ছটায় উদ্ভাসিত বিক্ৰম সংবতের মতো একটি কিংবদন্তীময় স্বর্ণময় যুগ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। বাঙালির চোখে কৃষ্ণচন্দ্রের সভায় সব পাণ্ডিত্য, সব কবিত্ব, সব সংস্কৃত শাস্ত্র চর্চা, সব বাংলা কাব্য সৃজন ও অনুশীলন, এক জায়গায় সমাবিষ্ট হয়েছিল। এ সবই শুধু পরবর্তীকালের কিংবদন্তী নয়। কৃষ্ণচন্দ্রের সভা যে সমসাময়িক লোকের চোখেও কত উজ্জ্বল হয়ে ঠেকত, তা ভারতচন্দ্র কৃত কৃষ্ণচন্দ্রের সভাবর্ণন পড়লেই একেবারে স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

নিবেদনে অবধান কর সভাজন।
রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের সভার বিবরণ॥
চন্দ্র সবে ষোলকলা হ্রাস বৃদ্ধি তায়।
কৃষ্ণচন্দ্র পরিপূর্ণ চৌষট্টি কলায়॥

কালীভক্ত কৃষ্ণচন্দ্র, তাঁর দুই ‘সদা জ্যোৎস্নাময়’ পক্ষ এবং পঞ্চপুত্রের বর্ণনা করে ভারতচন্দ্র তারপর কৃষ্ণচন্দ্রের আত্মীয় স্বজন বৈবাহিক জ্ঞাতি ইত্যাদিকে দ্বিতীয় পর্যায়ে রেখে তৃতীয় পর্যায়ে বিভিন্ন শ্রেণীর সভাসদ, অর্থাৎ পণ্ডিত, কবি, কুলীন, ভক্ত, গণক, বৈদ্য, পারিষদ, দেওয়ান, রায় বক্সী, আমীন, পেশকার, গায়ক, বাদক, নর্তক, সেপাহীর জমাদার, মুখ্য তীরন্দাজ, সওয়ার নায়ক, হাবসী ইত্যাদি নানা প্রকার রাজপুরুষ ও যোদ্ধৃবর্গের বর্ণনা করেছেন। এই স্বয়ংসম্পূর্ণ সভার বর্ণনা থেকে যে অখণ্ড রাজত্বের ছবি ফুটে ওঠে সেই স্মৃতি অবলম্বন করে কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত পরবর্তীকালে কৃষ্ণচন্দ্রের রাজত্বকালকে স্বাধীনতা ও স্বায়ত্তশাসনের যুগ বলে নির্দিষ্ট করেছিলেন। আর একটু সতর্ক থেকে শিবনাথ শাস্ত্রীও এই শতকের গোড়ায় লিখেছেন—‘নদীয়া রাজগণ এই বিস্তীর্ণ রাজ্যের অধিকারী ছিলেন ; বহু সংখ্যক পদাতিক ও অশ্বারোহী সৈন্য রাখিতেন;৮৩ সর্বদাই দেশের অপরাপর রাজগণের সহিত যুদ্ধ বিগ্রহে প্রবৃত্ত থাকিতেন; এবং নামত যবন রাজদিগের অধীনে থাকিয়াও সর্ব বিষয়ে স্বাধীন রাজার ন্যায় বাস করিতেন।৮৪ খাজনার দায়ে নবাব আলিবর্দি খান নদীয়ার জমিদারকে যে মুর্শিদাবাদে আটক করে রেখেছিলেন তা ভারতচন্দ্র বিলক্ষণ অবগত ছিলেন, অথচ নিজের প্রভুকে ‘স্ফুরদ্বীর্য’ ‘সূর্যোল্লসৎ’ ‘মহারাজ রাজাধিরাজ প্রতাপ’৮৫ রূপে অভিহিত করতে কবির কোনো দ্বিধা হয়নি, এবং ‘রসমঞ্জরীর’ ভূমিকায় রায়গুণাকর উচ্ছলিত ছন্দে রাজার এই বর্ণনা করেছিলেন:

রাঢ়ীয় কেশরী গ্রামী গোষ্ঠীপতি দ্বিজ স্বামী
তপস্বী শাণ্ডিল্য শুদ্ধাচার।
রাজঋষি গুণযুত রাজা রঘুরাম সুত,
কলিকালে কৃষ্ণ অবতার॥
কৃষ্ণচন্দ্র মহারাজ সুরেন্দ্র ধরণী মাঝ
কৃষ্ণনগরেতে রাজধানী।
সিন্ধু অগ্নি রাহু মুখে শশী ঝাঁপ দেয় দুখে।
যার যশে হয়ে অভিমানী॥

বস্তুত পক্ষে নবাব সরকারের দৃষ্টিকোণ থেকে যে লোক দেওয়ানী সনদ দ্বারা নিযুক্ত খিদমৎকারি জমিদার মাত্র সেই একই লোক দেশবাসী প্রজাদের দৃষ্টিকোণ থেকে সর্বশক্তিমান মহারাজ হওয়ায়, কবি ভারতচন্দ্রের বা অন্যান্য সমসাময়িক লোকের চোখে এ দুয়ের মধ্যে কোনো বৈসাদৃশ্য ছিল না। অগ্নিহোত্র এবং বাজপেয় যজ্ঞ সম্পাদন করে তিনি সমবেত পণ্ডিত মণ্ডলীর কাছে ‘অগ্নিহোত্রী বাজপেয়ী শ্ৰীমন্মহারাজ রাজেন্দ্র রায় নামে আখ্যায়িত হয়েছিলেন। এই যজ্ঞে ‘অঙ্গ বঙ্গ কলিঙ্গ রাঢ় গৌড় কাশী দ্রাবিড় উৎকল কাশ্মীর’ ইত্যাদি নানা দেশ থেকে পণ্ডিতেরা এসে যোগদান করেন এবং সকলে যথাযোগ্য ‘বিদায়’ প্রাপ্ত হন।৮৬

কিন্তু নিরুপদ্রবে রাজ্যসুখ সম্ভোগ করা মহারাজের কপালে রেখা ছিল না। ১৭২৮ থেকে ১৭৮২ পর্যন্ত কৃষ্ণচন্দ্রের রাজত্বকালে বাংলাদেশে যে রাষ্ট্রবিপ্লব ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের প্লাবন বয়ে গেছিল তাতে পুনঃ পুনঃ তাঁর রাজ্যনাশ সম্ভাবনা, এমন কি প্রাণ সংশয় পর্যন্ত দেখা দিয়েছিল। কিন্তু এই শঠ, নির্ভীক, প্রত্যুৎপন্নমতি রাজা ক্ষুরধার বুদ্ধির বলে বার বার বিপদের বেড়া জাল কেটে বেরিয়ে এসেছিলেন। ‘তিনি যৌবনের প্রারম্ভ হইতেই যেরূপ বিপজ্জালে জড়িত হইয়াছিলেন এবং তাঁহার অধিকার কালে রাজ্য মধ্যে যতপ্রকার বিপদ ঘটিয়াছিল, এরূপ কোনো এক ব্যক্তির ভাগ্যে ঘটিতে দেখা যায় না। অথচ কোনো বিপদ তাঁহাকে অভিভূত করিতে পারে নাই। অসীম প্রত্যুৎপন্নমতিত্বগুণে তিনি বিপজ্জাল কাটিয়া বাহির হইতেন, চতুর্দিকে যখন বিপদ ঘিরিয়া আসিত তখনো তিনি পাত্র মিত্র সভাসদ লইয়া আমোদ প্রমোদে কালযাপন করিতেন। গুণগ্রাহিতা ও গুণীগণের উৎসাহদান কার্যে ইনি বিক্রমাদিত্যের অনুসরণ করিয়াছিলেন। …ইহা বলিলে বোধহয় অত্যুক্তি হয় না, যে, বঙ্গদেশ যে আজিও ভারত সাম্রাজ্যের মধ্যে বিদ্যা, বুদ্ধি, সুরসিকতা প্রভৃতির জন্য প্রতিষ্ঠালাভ করিতেছে, কৃষ্ণচন্দ্রের রাজসভা তাহার পত্তন ভূমিস্বরূপ ছিল।’ শিবনাথ শাস্ত্রীর এই উক্তি অনুধাবন করলে প্রতিপন্ন হয় যে মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র আঠার শতকের সমাজের ‘হিতোপদেশ’ অভিনয়ে কেবল ‘প্রত্যুৎপন্নমতির’ ভূমিকাটি নেননি। নবাব মীরজাফর, নায়েব নাজিম মহম্মদ রেজা খান বা রাজা রামকৃষ্ণ (নাটোর) যেখানে ‘যদ্‌ ভবিষ্য’দের দলে ভিড় করেছেন সেখানে কৃষ্ণচন্দ্র তাঁর অক্ষয় কীর্তির বলে ‘অনাগত বিধাতার’ ভূমিকায় উত্তীর্ণ হয়েছিলেন। বর্গির বিভ্রাট, মীরকাশিমের কোপানল, ছিয়াত্তরের মন্বন্তর, ইংরেজদের ইজারাদারের হাতে রাজ্য হস্তান্তর, ইত্যাদি নানা ঝামেলা ও হামলার মধ্যে দিয়ে ধূর্ত রাজা প্রাণ, মান ও রাজ্য রক্ষা করতে সমর্থ হয়েছিলেন এবং এত বিপদের মধ্যেও তাঁর রাজসভার জ্যোতি দেশের লোকের চোখে একটুও ম্লান হয়নি। বর্গি বিভ্রাট নিবারণ কল্পে মহারাজ কর্তৃক দেবী অন্নদার আরাধনা এবং ভারতচন্দ্রকে ‘অন্নদামঙ্গল’ রচনার নির্দেশ দান থেকে প্রমাণ হয়, এক এক বার বিপদ এসেছে এবং তা কাটিয়ে উঠে রাজার যশঃ প্রভা আরো উজ্জ্বল হয়েছে। ভারতচন্দ্রের পৌরাণিক বর্ণনায় দেখতে পাই দেবী অন্নদা ভবিষ্যদ্‌বাণী করে মহারাজ ও রায়গুণাকরকে স্বপ্নাদেশ প্রদান করছেন:

শাকে আগে মাতৃকা যোগিনীগণ শেষে।৮৭
বর্গির বিভ্রাট হইবে এই দেশে॥
আলিবর্দ্দি কৃষ্ণচন্দ্রে ধরে লয়ে যাবে।
নজরানা বলি বার লক্ষ টাকা চাবে॥
বদ্ধ করি রাখিবেক মুরসিদাবাদে।
মোর স্তুতি করিবেক পড়িয়া প্রমাদে॥

বর্ধমান, বিষ্ণুপুর, বীরভূম ইত্যাদি গঙ্গার পশ্চিম তীরবর্তী রাজ্যগুলি বর্গিবিভ্রাটে পর্যুদস্ত হওয়ায় ১৭৪০ খ্রীস্টাব্দে রাঢ় অঞ্চল থেকে মুর্শিদাবাদে খাজনা আসা বন্ধ হয়ে যায়। আলিবর্দি গঙ্গার অপর তীরের রাজ্যগুলি থেকে জোর করে টাকা আদায় করে বর্গিদের মোকাবিলা করতে নামেন। দিনাজপুর, রাজশাহী ও নদীয়ার রাজাদের এই টাকার ঘাটতি মেটাতে হয়েছিল এবং যদিও কৃষ্ণচন্দ্রের রাজ বর্গির হামলা থেকে সম্পূর্ণ ছাড়া পায়নি, তবুও খাজনার দায়ে তিনি ১৭৪২ খ্রীস্টাব্দের পরে মুর্শিদাবাদে কিছুদিন আটক ছিলেন। ঐ সময় নবাব দরবার থেকে সুজন সিংহ সাজোয়াল নিযুক্ত হয়েছিলেন।৮৮ রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের কাছে দেবী অন্নদার স্বপ্নাদেশ শিরোধার্য হতে পারে, কিন্তু নবাব আলিবর্দি খানের উপর দেবী মাহাত্ম্য বলবৎ হবার কিছুমাত্র সম্ভাবনা ছিল না। বারো লক্ষ টাকা পুরো মিটিয়ে দেবার মুচলেকা দিয়েই (‘লিখি দিলা সেই রাজা দিব বার লক্ষ’) কৃষ্ণচন্দ্র সেবার ছাড়া পান। যে দেওয়ানের কার্যকুশলতায় রাজা ঐ বারো লক্ষ টাকা যোগাড় করতে পেরেছিলেন তাঁর নাম রঘুনন্দন মিত্র:

কুল্ল মলে রঘুনন্দন রিগ্ধ দেয়ান।
তার ভাই রামচন্দ্র রাঘব ধীমান॥

দেওয়ান রঘুনন্দন সম্পর্কে পরবর্তীকালে দেওয়ান কার্তিকেয় চন্দ্র রায় একটি কথা লিপিবদ্ধ করেছেন। এবার নবাব দরবারে ঢুকতে গিয়ে নদীয়ার দেওয়ানের গায়ের কাপড় বর্ধমানরাজ কীর্তিচন্দের দেওয়ান মানিকচন্দের গায়ে ঠেকে গেলে ক্রুদ্ধ স্বরে পাঞ্জাবী রাজপুরুষ হিন্দীতে বললেন: ‘দেখতে নেহি পাজী।’ কায়স্থকুলতিলক তৎক্ষণাৎ উত্তর দিলেন, ‘হাঁ নওকর সবহি পাজী হ্যায়, কৌই ছোটা কৌই বড়া।’ এরকম সমুচিত কথা বলে রঘুনন্দন ভালো করলেন না, কারণ পরে মানিকচন্দ আরো বড়ো হয়ে বর্ধমানরাজ সরকার থেকে নবাব সরকারে প্রবিষ্ট হন এবং সিরাজউদ্দৌলাহ্‌র বিশেষ অনুগ্রহভাজন হন মানিকচন্দের হাতে সিরাজ কলকাতার কেল্লা রেখে শওকজঙ্গের বিরুদ্ধে যুদ্ধ যাত্রা করেন, কিন্তু ক্লাইভ ও ওয়াটসনের বিরুদ্ধে কোনো যুদ্ধ না করে মানিকচন্দ কলকাতা থেকে পালিয়ে এসেছিলেন)। মুর্শিদাবাদে উচু পদ পেয়ে মানিকচন্দ রঘুনন্দনের সর্বনাশ করার ফিকির খুঁজতে লাগলেন। ঐ সময় পলাশী পরগনায় দস্যুদের হাতে নবাবী খাজনা লুঠ হলে মানিকচন্দের ষড়যন্ত্রে দোষী সাব্যস্ত হয়ে রঘুনন্দনের মৃত্যুদণ্ড বিধান হল। রাজা কৃষ্ণচন্দ্র এতে মর্মাহত হয়ে রঘুনন্দনের পরিবারকে পলাশী পরগনায় চোদ্দশ বিঘা জমি মহত্রাণ প্রদান করেন, এই শতাব্দীর গোড়ায় ঐতিহাসিক কালীপ্রসন্ন বন্দ্যোপাধ্যায় তাদের ঐ জমি ভোগ করতে দেখেছিলেন।৮৯ রঘুনন্দনের মৃত্যুর পর কালীপ্রসাদ সিংহ নামে আর এক জন কার্যদক্ষ কায়স্থ কৃষ্ণচন্দ্রের প্রধান কর্মচারী নিযুক্ত হন—রাজীবলোচন মুখোপাধ্যায় এঁকে পলাশীর ষড়যন্ত্রের অন্যতম নায়ক রূপে খাড়া করেছেন।

বর্গির হাঙ্গামা শেষ হতে না হতেই কৃষ্ণচন্দ্র আবার খাজনার দায়ে আবদ্ধ হলেন। এইভাবে একাধিক বার মুর্শিদাবাদে নজরবন্দী হলেও, শোনা যায় আলিবর্দি খান তাঁকে যথেষ্ট সম্মান দেখিয়ে ‘ধর্মচন্দ্র’ উপাধি দান করেছিলেন। এইবার এই রঘুকুলতিলক ধর্মচন্দ্র কৌশলে নবাবকে নদীয়ার বাঁশঝাড়ময় জলাভূমি ও কলকাতা সন্নিহিত বাদা অঞ্চল দেখিয়ে জমিদারীর দুরবস্থা প্রতিপন্ন করলেন এবং অনেক টাকার ছাড় পেলেন। এই রকম আরো গল্প আছে। ঢাকার নায়েব মহারাজ রাজবল্লভ যখন আলিবর্দির রাজত্বের শেষ দিকে বিশেষ প্রতিপত্তিশালী মোগল রাজপুরুষ হয়ে উঠেছেন, তখন নাকি তাঁর হাতে রাখি পরিয়ে দিয়ে কৃষ্ণচন্দ্র কয়েক লক্ষ টাকার মাপ নিয়ে আসেন। অথচ ‘ক্ষিতীশ- বংশাবলী চরিতম্‌’এ দেখা যায় রাজবল্লভ যখন কাশী কাঞ্চি ও নবদ্বীপ থেকে পণ্ডিত আনিয়ে বৈদ্যদের উপবীত বিধানের উদ্যোগ করছিলেন, তখন তলে তলে কৃষ্ণচন্দ্র ঐ আয়োজন পণ্ড করবার তালে ছিলেন। মুখোমুখি রাজবল্লভের মতো ক্ষমতাবান রাজপুরুষের বিরোধিতা করা বিচক্ষণ কৃষ্ণচন্দ্র যুক্তিযুক্ত বিবেচনা করেননি, কিন্তু নিজের সভায় কোনো বৈদ্যকে বা পিরালী ব্রাহ্মণকে তিনি উপবীত ধারণ করে আসতে দিতেন না। রাজবল্লভ কর্তৃক অক্ষত যোনি হিন্দু বালবিধবাদের বিবাহ চালু করার চেষ্টা এই হিন্দু সমাজপতির প্ররোচনায় তাঁর সভাসদ প্রখ্যাত স্মৃতিশাস্ত্রের অধ্যাপক রামগোপাল ন্যায়ালংকার শাস্ত্রমতে সম্পূর্ণ অসিদ্ধ বলে প্রমাণ করেছিলেন।

বর্গির আক্রমণ থেকে নিরাপদ কোনো সুরক্ষিত জায়গায় রাজধানী স্থাপনের মানসে কৃষ্ণচন্দ্র কৃষ্ণনগর থেকে ছয় ক্রোশ উত্তরে শিবনিবাস নামে এক নগরের পত্তন করে তার চারপাশে একদল দুর্ধর্ষ গোয়ালার বসতি করান। রাজীবলোচন মুখোপাধ্যায় এই নগরের স্থাপনের যে বর্ণনা দিয়েছেন তা থেকে স্বয়ং সম্পূর্ণ হিন্দু রাজ্যের সামাজিক গঠন কি রকম হওয়া উচিত তার পরিচয় পাওয়া যায়। ‘…চারিদিগ্যে যে নদী আছে সেই গড় হইল দক্ষিণদিগের নদী বন্ধন করিয়া প্রধান পথ করিলেন এবং সৈন্যের থাকনের স্থান করিলেন বড় ২ কামান দুই পার্শ্বে রাখিলেন হঠাৎ পুরমধ্যে শত্রু প্রবেশ করিতে না পারে তৎপরে অপূর্ব অট্টালিকা তৎপরে বাদ্যাগার তারপরে অতি উচ্চ অট্টালিকা তাতে ঘড়ি তদূর্দ্ধে ঘন্টা তারপর চারি দরজা মধ্যে সদাগরদিগের থাকনের স্থান এবং হাট নানা জাতীয় দ্রব্যের ক্রয় বিক্রয় হইবেক তন্মধ্যে বিস্তারিত পথ কিঞ্চিৎ দূরে গিয়া এক অট্টালিকা তাতে নানা জাতীয় যন্ত্র লইয়া যন্ত্রীরা বাদ্যোদম করিবেক পরে রাজবাটী প্রথম এক চতুঃসীমা দক্ষিণদ্বারী এক অট্টালিকা তাহাতে রাজকীয় ব্যাপার হইবেক। তিন পার্শ্বে অট্টালিকা তাতে ভৃত্যেরা থাকিবে পরে এক চতুঃসীমা তাতে ঈশ্বরের আলয় অপূর্ব রম্য স্থান সহস্র ২ লোকে দর্শন করিতে পারে পরে একখান পুরী তাতে মহারাজার বিরাজ করণের স্থান চারিদিগে অট্টালিকা পরে অন্তঃপুর অতি বৃহৎ বাটী নানা স্থানে নানাপ্রকার অট্টালিকা। অন্তঃপুরের কিঞ্চিৎ দূরে এক পুষ্পেদ্যান চতুর্দিকে প্রাচীর মহারানী প্রভৃতি পুষ্পেদ্যানে গমন করিতে পারেন পুষ্পেদ্যানে নানাজাতীয় পুষ্প তন্মধ্যস্থানে এক অট্টালিকা তাহাতে বসিয়া রানী নৃত্যকীরদিগের নৃত্য দর্শন করেন ও গীত বাদ্য শ্রবণ করেন। পশ্চিমদিগের যে পথ সেই দিয়া কিঞ্চিৎ গমন করিলে এক ধর্মশালা সেখানে অন্ধ আতুর পঙ্গু এবং উদাসীন যে কেহ উপনীত হইবেক যার যে স্বেচ্ছা আহারের দ্রব্য পাইবেক ভাণ্ডার পরিপূর্ণ করিয়া দ্রব্য রাখিলেন…। মহারাজ সপরিবারে নূতন বাটীতে আগমন করিয়া সকল পুরী দেখিয়া সন্তুষ্ট হইয়া পাত্রকে রাজপ্রসাদ দিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন অধ্যাপকেরদিগের স্থান করিয়াছ পাত্র নিবেদন করিলেন মহারাজার যে পুষ্পের বাগান হইয়াছে তাহারি নিকট স্থান আছে…রাজাজ্ঞানুসারে পৃথক ২ পাঠশালা প্রস্তুত করাইলেন সেই সকল পাঠশালায় প্রধান ২ পণ্ডিতেরা বসতি করিয়া অধ্যাপনন করাইতে লাগিলেন এবং নানা দেশীয় গুণবান লোক আসিয়া গুণ শিক্ষা করান এবং করেন রাজা শুভক্ষণে পুরমধ্যে প্রবেশ করিলেন আহ্লাদের সীমা নাই।’ ১৮৪৬ খ্রীস্টাব্দে এখানে এসে বিশপ হেবার কতকগুলি জঙ্গলে ভরা দালান ছাড়া কিছু দেখতে পাননি। রাজপ্রাসাদ কে ভেঙেছে জিজ্ঞাসা করায় স্থানীয় লোকেরা তাঁকে অম্লান বদনে বলেছিল— ‘সিরাজউদ্দৌলাহ্‌’।৯০

শিবনিবাস হিন্দু রাজ্যের সামাজিক সংবিধান অনুযায়ী গঠিত হলেও কৃষ্ণচন্দ্রের রাজ্যে বহু মুসলমান প্রজার বাস ছিল, তাদের বিচারের জন্য রাজা এক কাজী রেখেছিলেন। কথিত আছে, মহারাজের কাজী মায়ের পারলৌকিক কাজে রাজাজ্ঞা লঙ্ঘন করে গরু কুরবানী করায়, ক্রুদ্ধ কৃষ্ণচন্দ্র তাঁর বাড়ি আটক করার নির্দেশ দেন। কাজী সাহেব ঐ সময় মহারাজের জমাদার জাফর খানের পরামর্শ মতো কিছুদিন লুকিয়ে ছিলেন, পরে জমাদারের অনুনয়ে বিনয়ে তাঁর ক্রোধ প্রশমিত হলে কাজীর পুত্র পিতার পদে নিযুক্ত হন। কিন্তু কৃষ্ণচন্দ্র আর কাজী বদরুদ্দিনের মুখ দর্শন করেননি। যে জমাদারের কথায় তিনি কাজীকে গৃহে প্রত্যাবর্তন করতে অনুমতি দেন সেই জাফর খান এক জন সাধক পুরুষ ছিলেন, শিবনিবাসে তাঁর সমাধিতে এই শতাব্দী পর্যন্ত হিন্দু মুসলমান নির্বিশেষে সব লোক সিন্নি দিয়ে আসছে।৯১ লোকে বলে, শিবনিবাসে থাকতে একবার যোগবলে তিনি পুরীর শ্রীক্ষেত্রে মন্দিরের আগুন নিবিয়েছিলেন। মহারাজের রাজসভায় হিন্দুস্থানী সংগীত এবং মুসলমান গায়ক, নর্তক ও বাদকদের বিশেষ কদর ছিল।

কালায়ত গায়ন বিশ্রাম খাঁ প্রভৃতি।
মৃদঙ্গী সমজ খেল কিন্নর আকৃতি॥
নর্তক প্রধান শের মামুদ সভায়।
মোহন খোশালচন্দ্র বিদ্যাধর প্রায়॥

মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের অধিকারে গোপাল ঠাকুরের পূজার সুব্যবস্থা নিমিত্ত বহু দেবোত্তর সম্পত্তি উৎসর্গ করা থাকলেও তিনি নিজে গোঁড়া শাক্ত এবং তন্ত্রসাধক ছিলেন, এবং চৈতন্যোপাসক গৌড়ীয় বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের উপর তাঁর অত্যন্ত দ্বেষ ছিল বলে প্রচার আছে। ‘নদীয়ার পণ্ডিতরাও জাত বৈষ্ণবদের অত্যন্ত ঘৃণার চোখে দেখতেন। কৃষ্ণচন্দ্রের আমলে মহাপ্রভুর জন্মস্থানে বৈষ্ণবরা কোণঠাসা হয়ে ছিল। কথিত আছে সভাস্থলে রাজা একদিন চৈতন্য সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে স্বভাবসিদ্ধ বিষোদ্‌গার করছেন এমন সময় এক স্পষ্টবক্তা বৈষ্ণব কঠিন বিদ্রুপ করে বললেন—‘মহারাজ আপনার এই চৈতন্যদ্বেষ সম্পূর্ণ স্বাভাবিক ও শাস্ত্রসম্মত। পুরাণাদি পাঠ করে দেখুন, যে দেশে যখনই বিষ্ণু মানবদেহ ধারণ করেছেন তখনই সেই দেশের পরপারবাসী রাজগণের সঙ্গে তাঁর বিবাদ হয়েছে। অযোধ্যায় রামচন্দ্র জন্মগ্রহণ করলে অপর পারের রাবণের সঙ্গে তাঁর বিবাদ হয়। গোকুলে শ্রীকৃষ্ণ ভূমিষ্ঠ হলে পরপারে কংসের বিদ্বেষ প্রজ্জ্বলিত হয়ে ওঠে। এতে প্রমাণ হচ্ছে আপনার এই বিদ্বেষ শাস্ত্র মতো এবং একেবারে স্বাভাবিক।’৯২ শ্রীচৈতন্য যে কৃষ্ণের অবতার, গৌড়ীয় বৈষ্ণব সমাজের এই তত্ত্ব রাজা মানতেন না। কিন্তু রাঘব রায়ের বংশধর রঘুরাম সূত কৃষ্ণচন্দ্রকে নিশ্চয় কৃষ্ণদ্বেষী বলে চিহ্নিত করা যায় না। বৃদ্ধ বয়সে গঙ্গাবাস করার সময় গঙ্গাতীরে হরিহর মন্দির নির্মাণ করে কৃষ্ণচন্দ্র এই শ্লোক খোদিত করেছিলেন:

গঙ্গাবাসে বিধিশ্রুত্যনুগত সুকৃত ক্ষোণিপালঃ শকেস্মিন্।
শ্রীযুক্ত বাজপেয়ী ভুবি বিজিত মহারাজ রাজেন্দ্র দেবঃ॥
ভেত্ত্বং ভ্রান্তিং মুরারি ত্রিপূরহরভিদাসজ্ঞাতাং পামরানাং।
অদ্বৈতং ব্রহ্মরূপং হরিহর মুময়া স্থাপয়শ্লোনয়াচ॥

অর্থাৎ, যে সকল পামর শিব ও বিষ্ণুকে পৃথক জ্ঞানে একে অপরের বিদ্বেষ করে সেই সকল নিরয়গামী ব্যক্তিদের ভ্রান্তিভেদ নিমিত্ত ভুবনজয়ী বাজপেয়ী মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র কর্তৃক ১৬৯৮ শকে (১৭৭৬ খ্রীস্টাব্দে) গঙ্গাবাসে এই মন্দির ও তন্মধ্যে হরিহরের অদ্বৈত মূর্তি লক্ষী ও উমার সঙ্গে স্থাপিত হল।৯৩

কৃষ্ণচন্দ্রের রাজত্বে নব্যন্যায়, স্মৃতি, ষড়দর্শন, জ্যোতিষ এবং তন্ত্রের বিশেষ চর্চা হয়েছিল এবং বহু প্রধান প্রধান পণ্ডিত যাঁরা সকলে তাঁর সভার অন্তর্গত ছিলেন না তাঁরাও রাজার কাছ থেকে নিষ্কর জমি লাভ করেছিলেন। নবদ্বীপে তখনো তরুণ শঙ্কর তর্কবাগীশের প্রাধান্য শুরু হয়নি—হরিরাম তর্কসিদ্ধান্ত প্রধান নৈয়ায়িক পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। ১৭৫১ খ্রীস্টাব্দে শঙ্কর তর্কবাগীশ যখন প্রথম কৃষ্ণচন্দ্রের কাছ থেকে ৯৫ বিঘা ভূমি পান, তখন বয়োজ্যেষ্ঠ নৈয়ায়িক বিশ্বনাথ ন্যায়ালঙ্কারও আলাদা আলাদা দুটি নিষ্কর জমি (৮৯ বিঘা ও ৯৫ বিঘা) পেয়েছিলেন। ‘হরের গদা, গদার জয়, জয়ার বিশু লোকে কয়’—এই পরম্পরায় বিশ্বনাথ ন্যায়ালঙ্কার নবদ্বীপের মুখ উজ্জ্বল করে রেখেছিলেন। তাঁকে শঙ্করসহ অন্যান্য নবদ্বীপের পণ্ডিতের সঙ্গে রাজবল্লভের বিখ্যাত পণ্ডিত সভায় উপস্থিত হতে দেখা যায়। কিন্তু সে যুগের সকল পণ্ডিত নবদ্বীপের প্রাধান্য বা কৃষ্ণচন্দ্রের আধিপত্য মেনে নিতে প্রস্তুত ছিলেন না। শঙ্কর সহ যে চারজন পণ্ডিত গঙ্গার পূর্বকুলের প্রধান নৈয়ায়িক রূপে একটি সংস্কৃত শ্লোকে উল্লিখিত হয়েছেন—‘শ্রীকান্তঃ কমলাকান্তো বলরামশ্চ শঙ্করঃ’—তাঁদের মধ্যে পুঁড়ার কমলাকান্ত বিদ্যালঙ্কার অহংকার করে বলতেন—কমলাকান্ত শর্মা যে স্থানে থাকবেন, সেই স্থানই নবদ্বীপ।’ কমলাকান্ত রানী ভবানীর বৃত্তি ও ভূমিদান লাভ করেছিলেন, কিন্তু কৃষ্ণচন্দ্রের আশ্রয় নেননি। ‘আমি যেখানে সেখানে নবদ্বীপ’ একথা যথার্থ যিনি বলতে পারতেন সেই শঙ্করের একমাত্র সমকক্ষ ত্রিবেণীর জগন্নাথ তর্কপঞ্চাননের সঙ্গেও কৃষ্ণচন্দ্রের সম্পর্কটি ঠিক সুমধুর ছিল না। কৃষ্ণচন্দ্রের অন্যায় হস্তক্ষেপ উপেক্ষা করে জগন্নাথ তর্কপঞ্চানন একজন দরিদ্র ব্রাহ্মণকে প্রায়শ্চিত্ত করিয়ে জাতে তুলেছিলেন বলে, কৃষ্ণচন্দ্র অসন্তুষ্ট হয়ে ১৫ দিন ব্যাপী বাজপেয় যজ্ঞের অনুষ্ঠানে জগন্নাথকে বাদ দিয়ে দূর দূরান্ত থেকে পণ্ডিতদের ডেকে আনেন। যজ্ঞের পঞ্চম দিনে জগন্নাথ নিজেই একশো ছাত্র নিয়ে শিবনিবাসে এসে পৌঁছলেন। কৃষ্ণচন্দ্রের আতিথ্য গ্রহণ না করে নিজের ব্যয়ে স্বতন্ত্র আবাসে রইলেন এবং পণ্ডিতমণ্ডলীর সঙ্গে যথারীতি আলাপ আলোচনায় প্রবৃত্ত হলেন। যজ্ঞশেষে রাজা পণ্ডিতকে জিজ্ঞাসা করলেন—‘যজ্ঞ কেমন হল?’ পণ্ডিত উত্তর দিলেন—‘যে যজ্ঞে জগন্নাথ রবাহূত, সেই যজ্ঞের মহিমার সীমা কি?’ পরে জগন্নাথের সাহায্যে কোনো এক বিপদ থেকে মুক্ত হয়ে রাজা গলায় সোনার কুঠার বেঁধে পণ্ডিতের কাছে ক্ষমা ভিক্ষা করেছিলেন।৯৪

ভারতচন্দ্র যখন ‘গুণাকর’ উপাধি পেয়ে কৃষ্ণচন্দ্রের সভায় অবস্থিতি করছিলেন তখন প্রধান নৈয়ায়িক হরিরাম তর্কসিদ্ধান্ত বা প্রধান স্মার্ত রামগোপাল ন্যায়ালঙ্কার ইত্যাদি কাউকে সেখানে উপস্থিত দেখেননি—এঁরা নিজ নিজ ভূমি ও ভদ্রাসনের উপর বাস করে বিদ্যাচর্চা করতেন বলে ধরে নেওয়াই সঙ্গত। রাজার আত্মীয় স্বজন রাজকর্মচারী ও যোদ্ধৃবর্গদের বাদ দিয়ে ভারতচন্দ্র যেসব গুণীজনকে সভাসদ ও পারিষদ রূপে দেখেছিলেন তাঁদের তালিকা নিম্নরূপ:

কালীদাস সিদ্ধান্ত পণ্ডিত সভাসদ।
কন্দর্প সিদ্ধান্ত আদি কত পারিষদ॥
কৃষ্ণ মুখোপাধ্যায় কুলীন বড় প্রিয়।
মুক্তিরাম মুখুর্য্যা গোবিন্দ ভক্ত দড়॥
গণক বাড়ুর্য্যা অনুকূল বাচস্পতি।
আর কত গণক গণিতে কি শকতি॥
বৈদ্য মধ্যে প্রধান গোবিন্দরাম রায়।
জগন্নাথ অনুজ নিবাস সুগন্ধ্যায়॥
অতিপ্রিয় পারিষদ শঙ্কর তরঙ্গ।
হরহিত রাম বোল সদা অঙ্গ সঙ্গ॥

পারিষদ দলের মধ্যে ভারতচন্দ্র নিজের এবং গোপাল ভাঁড়ের নাম করেননি, কিন্তু এই দুই জনের জন্যই কৃষ্ণচন্দ্রের রাজসভা বাঙালির স্মৃতিপটে আজও উজ্জ্বল হয়ে ফুটে আছে। অষ্টাদশ শতকের আর একজন স্মরণীয় পুরুষ রামপ্রসাদ সেন রাজার কাছে ভূমি এবং ‘কবিরঞ্জন’ উপাধি লাভ করেছিলেন, কিন্তু এই সাধক কখনো রাজসভায় অবস্থান করেননি।

কৃষ্ণচন্দ্রের রাজসভায় ভারতচন্দ্রের আগমনের বৃত্তান্ত ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের ‘কবি জীবনী’ থেকে সবিশেষ ভাবে জানা যায়। ভারতচন্দ্রের পিতা পেঁড়ো দুর্গ থেকে বর্ধমান সৈন্যের দ্বারা বিতাড়িত হবার পর কোনো গতিকে বর্ধমানরাজের কাছ থেকে কিছু জমি ইজারা নিতে পেরেছিলেন। ভারতচন্দ্র পারস্য ভাষায় পাণ্ডিত্য অর্জন করে ঐ ইজারা সংক্রান্ত বিষয়ের ‘মোক্তার’ হয়ে বর্ধমান গমন করেন। রাজারা যেমন নবাব দরবারে ‘উকীল’ রাখতেন, ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অধীনস্থ ভূস্বামী তালুকদার ও ইজারাদাররা তেমনি রাজদরবারে ‘মোক্তার’ রাখা সঙ্গত মনে করতেন। খাজনা বাকি পড়ায় বর্ধমানের রাজপুরুষরা ঐ ইজারা খাস করে নিয়ে ভারতচন্দ্রকে কারারুদ্ধ করেন। কোনো গতিকে সেখান থেকে পালিয়ে ভারতচন্দ্র ওড়িশাতে মারাঠাদের অধিকারে আশ্রয় নিলেন এবং শ্রীক্ষেত্রে বৈরাগী হয়ে সন্ন্যাসীর বেশে একদল বৈষ্ণবের সঙ্গে তীর্থ করতে বেরোলেন। পথে তাঁর স্ত্রীর আত্মীয়স্বজনরা ভারতচন্দ্রকে ধরে গেরুয়া ছাড়িয়ে দাড়ি গোঁফ কামিয়ে স্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে নিয়ে গেলেন—শুভদৃষ্টির পর এই দ্বিতীয়বার সাক্ষাৎ। এরপর বিষয়কার্যে প্রবৃত্ত হয়ে ভারতচন্দ্র ফরাসডাঙ্গায় এসে ফরাসীদের দেওয়ান ইন্দ্রনারায়ণ চৌধুরীর আনুকূল্যে রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের দৃষ্টিতে পড়েন। কৃষ্ণচন্দ্রের বৃত্তি নিয়ে কিছুদিন রাজসভায় থেকে তারপর কৃষ্ণচন্দ্রের কাছ থেকে ৬০০ টাকা খাজনায় মূলাজোড় ইজারা নিয়ে সেখানে বৃদ্ধ পিতা নবীনা স্ত্রী ও শিশুপুত্র নিয়ে বাস করতে শুরু করেন। এখানেও তিনি শান্তি পেলেন না। বর্গির আক্রমণে পালিয়ে এসে বর্ধমানরাজ পরিবার কাউগাছীতে দুর্গ নির্মাণ করে রামদেব নাগ নামে অত্যাচারী কর্মচারীর নামে মূলাজোড় পত্তনি করে নিলেন। ভারতচন্দ্র এই পত্তনির ব্যাপারে কৃষ্ণচন্দ্রের কাছে অনেক ওজর আপত্তি তুলেও কোনো ফল পেলেন না, রাজা বললেন, ‘বর্ধমানেশ্বর যখন আমার অধিকারে বাস করলেন, তখন আমার কত আহ্লাদ বিবেচনা কর, এবং পত্তনির জন্য রানী যখন স্বয়ং পত্র লিখেছেন তখন তাঁর সম্মান ও অনুরোধ রক্ষা করা অগ্রে উচিত হচ্ছে।’ রামদেব নাগের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে ভারতচন্দ্র সংস্কৃত নাগাষ্টক শ্লোক রচনা করে প্রভুর কাছে প্রেরণ করলেন। তার মর্মার্থ এই: ‘চল্লিশ বছর বয়সে মহারাজের আশ্রয়ে এসে গঙ্গাতীরে মূলাজোড়ে বাটী নির্মাণ করেছি, সেই বাটী এবং বাটীতে অধিষ্ঠিত ধাতুরচিত দশভূজা, শালগ্রাম শিব ও রাধাকৃষ্ণ মূর্তি সবই নাগের গ্রাসে চলেছে। আমার পিতা বৃদ্ধ, পুত্র শিশু, স্ত্রী বিরহিণী, বন্ধুবান্ধবরা সচকিত। হে কৃষ্ণস্বামী, আপনার কি স্মরণ নেই, পুরাকালে কালিয় হ্রদের নাগ সমস্ত জনপদ গ্রাস করতে চলায়, আপনি ত্রাণ করতে এসেছিলেন? ইদানীংকালে সেই নাগকে আপনি দমন না করলে, সবই নাগের গ্রাসে যায়।’৯৫ এই আটখানি শ্লোক পাঠ করে রাজা অত্যন্ত সন্তুষ্ট হলেন, এবং বর্ধমান পরিবারকে অনুরোধ করে রামদেব নাগের দৌরাত্ম্য নিবারণ করলেন। তিনি যে রাজ্যহারা রাজপুত্র একথা রায়গুণাকর কখনো ভুলতে পারেননি। কৃষ্ণনগর প্রবাসে বর্ষার দিনে বিরহী যক্ষের মতো এক অনির্দেশ্য বিষাদ ষড়ঋতুর আবর্তনের তালে তালে তাঁর বুক মথিত হয়ে উঠত।

বর্ষা বর্ণনা
প্রথমেতে জ্যৈষ্ঠ মাসনিদাঘের পরকাশ,
কৃষ্ণনগরেতে বাসগেল এক বর্ষা।
শরদে অম্বিকা পূজারাজঘরে দশভূজা,
দেখিনু মৈনাকানুজাজগতের হর্ষা॥
হিম শীত তার পরশীর্ণ করে কলেবর,
পুণ্যাবাদে যাব ঘরসেই ছিল ভর্সা।
বসন্ত নিদাঘ শেষপুন তোর পরবেশ,
ভারত না গেল দেশআ, আরে বর্ষা॥

কোথায় বা ঘর কোথায় বা ভরসা। কোনোখানে তিনি সুস্থির হয়ে বসতে পারেননি। দেশব্যাপী রাষ্ট্রবিপ্লবের তাড়নায় এবং অতৃপ্ত ঐহিক সুখের কামনায় পোঁড়ো থেকে মণ্ডলঘাট, (বাল্যকাল), মণ্ডলঘাট থেকে বাঁশবেড়িয়া (ফার্সী অধ্যয়ন), বাঁশবেড়িয়া থেকে বর্ধমান (মোক্তারি), বর্ধমান থেকে শ্রীক্ষেত্র (সন্ন্যাস), শ্রীক্ষেত্র থেকে ফরাসডাঙ্গা (ইন্দ্রনারায়ণ চৌধুরীর আশ্রয়), ফরাসডাঙ্গা থেকে কৃষ্ণনগর (কৃষ্ণচন্দ্রের আশ্রয়), কৃষ্ণনগর থেকে মূলাজোড় (বিক্ষুব্ধ প্রৌঢ় কাল)—এই রকম দেশ থেকে দেশান্তরে ঘুরে বেরিয়েছেন। তাই এই বিরহী যক্ষ লিখেছিলেন—

বর্ষা বর্ণনা
ভুবনে করিল তৃর্ণনদ নদী পরিপূর্ণ,
বিরহিনী বেশ চূর্ণভাবিয়া অভর্সা।
বিদ্যুতের চক্‌মকিডাহুকের মকমকি,
কামানল ধক্‌ধকিবড় হৈল কর্ষা॥
ময়ূর ময়ূরী নাচেচাতকিনী পিউ যাচে
আর কি বিরহ বাঁচেবুঝিনু নিষ্কর্ষা।
ভারতের দুঃখমুলকেবল হৃদয়ে শূল,
ফুটালি কদম্বফুলআ, আরে বর্ষা॥

এর সবটুকু অনির্দেশ্য বেদনানুভূতি নয়, কারণ অতৃপ্ত বিষয় বাসনার সুরও থেকে থেকে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।

বাসনা বর্ণনা
বাসনা করয়ে মনপাই কুবেরের ধন,
সদা করি বিতরণতুষি যত আশনা।
আশ নাই, আরো চাইইন্দ্রের ঐশ্বৰ্য্য পাই,
ক্ষুধামাত্র সুধা খাইযমে করি ফাঁসনা॥
ফাঁসনা কেবল রৈলবাসনা পূরণ নৈল।
লাভে হোতে লাভ হৈললোকে মিথ্যা ভাষনা।
ভাসনাই কারে বলেভারত সন্তাপে জ্বলে,
কলার বাসনা হোলেআ, আরে বাসনা॥

কৃষ্ণচন্দ্রের রাজসভায় ধর্মানুচরণের অত্যন্ত প্রাবল্য থাকলেও, শুদ্ধাচারের যে তেমন, প্রতিষ্ঠা ছিল না, সে কথা সুপরিজ্ঞাত। রাজসভার নাগরিক রুচি ভারতচন্দ্রের কবিতায় অভ্রান্ত ভাবে প্রতিফলিত হয়েছিল। রাধাকৃষ্ণের প্রণয় ঘটিত ব্যঙ্গ ছলে কোনো এক সভাসদের উপর কটাক্ষ করে রায় গুণাকর লিখেছিলেন:

কৃষ্ণের উক্তি
বয়স আমার অল্পনাহি জানি রস কল্প,
তুমি দেখাইয়া অল্পজাগাইলা যামী।
ননী ছানা খাওয়াইয়ারসরঙ্গ শিখাইয়া,
অঙ্গ ভঙ্গ দেখাইয়াতুমি কৈলা কামী॥
তুমি বৃষভানু সুতাঅশেষ চাতুরী যুতা,
তোমার ননদীপুতাসব জানি আমি।
আগে হানি নেত্র বাণকাড়িয়া লইলে প্রাণ,
আগে হানি নেত্র বাণআ, আরে মামী॥
রাধিকার উক্তি উত্তর
চূড়াটি বাঁধিয়া চুলেমালা পর বনফুলে
দান মাগো তরুমূলেআমি তেমন মাগিনে।
মোরে দেখিবার লেগেঅনুরাগ রাগে রেগে
রাত্রি দিন থাক জেগেআমি তেমন্ জাগিনে॥
বুক বাড়ায়েছে নন্দযার তার সনে দ্বন্দ্ব
কোন দিন হবে মন্দআমি তোমায় লাগিনে।
গুণ্ডার বিষম কাযসে ভয়ে পড়ুক বাজ,
মামী বোলে নাহি লাজআ, আরে ভাগিনে॥

কৃষ্ণচন্দ্রের সামনে তাঁরই প্রচ্ছন্ন সম্মতিক্রমে একজন সভাসদকে কটাক্ষ করে রাধা কৃষ্ণের এই নিকৃষ্ট রূপ উপস্থাপন করা হয়েছিল, একথা মনে রাখলে কৃষ্ণচন্দ্রের রাজসভার রুচি সম্বন্ধে একটা ধারণা করা যাবে। রাজা নিজে একটি ধেড়ে (উদবিড়াল) পুষেছিলেন, রায়গুণাকর সেটিকে ছেড়ে কথা কননি:

ধেড়েকুলে জন্ম পেয়েবিলে খালে ধেয়ে ধেয়ে
বেড়াইতে ঘুষ খেয়েলোকে দিত তেড়ে।
তেড়ে না পাইতে মাচ্‌বেড়াইতে পাছ পাছ
এখন বাছের বাছদিতে লও কেড়ে॥
কেড়ে লোতে কেহ যায়কৌতুক না বুঝ তায়,
ক্রোধে ফোলো বাঘ প্রায়ফোঁস ফোঁস ছেড়ে।
ছেড়ে গেড়ে ডোবা জলরাজপুরে পেয়ে স্থল
তোলা জলে কুতূহলসাবাস রে ধেড়ে॥
ধেডে বড় দাগাবাজজলে পেয়ে স্ত্রীসমাজ
ব্যস্ত করে দেয় লাজকূলে ডুব পেড়ে।
পেড়ে যত রাঙ্গা শাড়িধোরে করে কাড়াকাড়ি
কেহ দিলে তাড়াতাড়িপ্রবেশয়ে গেড়ে॥৯৬
গেড়ে হতে পুন আসিভুস করে উঠে ভাসি
সবে দেখে বলে হাসিবড় দুষ্ট ধেড়ে॥ ইত্যাদি।

ব্রাহ্মদের উদয় হবার আগে ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগ পর্যন্ত এই জাতীয় রুচি বলবৎ ছিল, এবং কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তও যথেষ্ট অনুরাগের সঙ্গে ভারতচন্দ্রের এই কবিতাগুলি তাঁর জীবনীতে সমাবিষ্ট করেছিলেন। ভারতচন্দ্রের বাক্‌চাতুরী, ফারসী জ্ঞান এবং ফারসী প্রয়োগে গুপ্তকবি বিশেষ ভাবে মুগ্ধ হয়ে এই দৃষ্টান্ত উদ্ধৃত করেছিলেন:

‘কর্‌দ্রাফথ্‌ বর্ণন।

করদ্ৰাফ্‌থ্‌। —এই শব্দটি পারস্য শব্দ, ইহার অর্থ কাহার দ্বারা এ কৰ্ম্ম হইয়াছে এবং কে এ কৰ্ম্ম করিয়া প্রস্থান করিল

কামিনী যামিনী মুখেনিদ্রাগতা হয়ে মুখে
ধীর শঠ তার মুখেচুম্বিতে চুম্বন সুখে
ধীরে ধীরে কর্দ্দোরফ্‌থ্‌।
নিদ্রা হতে উঠে নারীঅলসে অবশ ভারি
আরসিতে মুখ হেরিচুম্ব চিহ্ন দৃষ্টি করি
ভাবে ভাল্ কর্দ্দোরফ্‌থ্‌॥

দৃষ্টান্ত দিয়ে গুপ্ত কবি লিখেছেন—‘এই কবিতায় যে আশ্চর্য কৌশল ও বিদ্যা প্রকাশ পাইয়াছে তাহা রসজ্ঞ জনেরাই জানিতে পারিবেন।’ রাজা কৃষ্ণচন্দ্র এবং তাঁর সভাসদরা এই রকম আশ্চর্য কৌশল ও বিদ্যার রসজ্ঞ ছিলেন। নবমী পূজার দিন মহিষ বলি উপলক্ষে রাজা খেউড় প্রবর্তন করেছিলেন বলে শোনা যায়। মহারাজ নিজে, যুবরাজ শিবচন্দ্র এবং অন্যান্য রাজকুমাররা স-কার ব-কারের খেউড় রচনা করে গাইতেন, এবং কখনো কখনো ছড়া কাটাকাটি উত্তর প্রত্যুত্তর হত। এ বস্তুর এত প্রসার হয়েছিল যে হালিশহরে কালীভক্ত সাধক রামপ্রসাদ এবং বৈষ্ণব আজু গোসাঁইয়ের গানে গানে উত্তর প্রত্যুত্তর লোকের মুখে মুখে ফিরত। সাধারণের মনে এই ‘অজ্ঞান’ ও ‘দৌর্বল্য’ জনিত কৌতুক কলাপ পরবর্তীকালের ব্রাহ্মভাবাপন্ন লোকেরা প্রসন্ন মনে গ্রহণ করেননি। মাইকেল মধুসূদন কৃত শর্মিষ্ঠা নাটকের আলোচনা প্রসঙ্গে রাজেন্দ্রলাল মিত্র ১৮৭৪ এর ‘বিবিধার্থসংগ্রহে’ নবদ্বীপাধিপতি কৃষ্ণচন্দ্র রায়কে এই রুচি বিকৃতির আদি কারণ বলে নির্দিষ্ট করে লিখেছিলেন—‘তিনি সুচতুর ও সুপণ্ডিত ছিলেন ও তাঁহার নিকট গুণিগণের প্রচুর সমাদর ছিল; কিন্তু লাম্পট্যদোষে তাঁহার সে সমুদয় গুণগরিমা কলুষিত হইয়াছিল। …দেশের কোন অত্যন্ত ধনী ও ক্ষমতাসম্পন্ন ব্যক্তির দৃষ্টান্তে অনেক মন্দ ব্যবহার প্রচলিত হইতে পারে; কিন্তু তাহার খ্যাতি হ্রাস হইলে ও জ্ঞানালোকের কিঞ্চিন্‌মাত্র ব্যাপ্তি হইলে অবশ্যই সে ব্যবহার দূষ্য বোধে পরিত্যক্ত হইয়া উঠে। কিন্তু কৃষ্ণচন্দ্রের প্রচলিত কবি ও খেউড় সে দশা শীঘ্র প্রাপ্ত হয় নাই। কলিকাতার সুবিখ্যাত রাজা নবকৃষ্ণ ও তৎপর কতকজন ধনাঢ্য ব্যক্তি ঐ কদর্য্য বিননাদের উৎসাহী হন। তাঁহাদিগের অপসৃতির পর গত বিংশতি বৎসরের মধ্যে কবির হ্রাস হইয়াছে।’৯৭

রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের যুগের রুচিতেও ভাঁড়ের রসিকতা কিছুটা নিম্ন স্তরের ঠেকত। গুপ্ত কবি মন্তব্য করেছেন—‘গোপাল ভাণ্ড কেবল ভাণ্ডই ছিল, তাহার অপর কোনো কাণ্ডজ্ঞান ছিল না।’৯৮ গোয়ারির পথে আজু গোঁসাই গোপালের সঙ্গে এক ব্যক্তির সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিয়ে বললেন—‘ইনি তোর মতো আকাট মুখ্যু নন, বহু শাস্ত্র পড়েছেন—যাকে বলে বিদ্যের জাহাজ।’ গোপাল নির্বিকার ভাবে বলল—‘বিদ্যের জাহাজ তো ডাঙায় কেন, জলে ভাসিয়ে দিন।’ কোনো সমসাময়িক বৃত্তান্তে গোপাল ভাঁড়ের উল্লেখ নেই, ভারতচন্দ্রের সভাবর্ণনেও তাকে কৃষ্ণচন্দ্রের সভায় উপস্থিত দেখা যায় না। কিন্তু গোপাল ভাঁড় সম্পূর্ণ কল্পিত চরিত্র না হওয়াই সম্ভব। কুমুদ নাথ মল্লিক গোপালকে জাতিতে নাপিত (মতান্তরে কায়স্থ) এবং শান্তিপুরের অধিবাসী বলে উল্লেখ করেছেন। তার সম্বন্ধে একশোর উপর গল্প প্রচলিত আছে, তার মধ্যে অনেকগুলি পরবর্তীকালের সংযোজন হলেও কতকগুলি গল্পের উৎপত্তি নবাবী আমলে হয়েছিল বলে অনুমান করা যায়। তবে বেশির ভাগ গল্প ১৭৮০ খ্রীস্টাব্দের কাছাকাছি ইংরাজ আমলের গোড়ার দিকের গল্প বলে মনে হয়—তখন কৃষ্ণচন্দ্রের শেষ বয়স।১০০ গোপাল নামে সত্যিই কেউ থাকুক বা না থাকুক, তার গল্পগুলি থেকে অষ্টাদশ শতকের সাধারণ জনের হাসি তামাশা এবং রাজসভার রসিকতা সম্বন্ধে একটা মোটামুটি আঁচ পাওয়া যেতে পারে। এ দুয়ের মধ্যে খুব তফাৎ ছিল না তাও গোপাল ভাঁড়ের গল্প থেকে বোঝা যায়। একদিন রাজা কৃষ্ণচন্দ্র গম্ভীর হয়ে গোপালকে জিজ্ঞাসা করলেন—‘তোমার আমার মধ্যে কত তফাৎ জানো?’ গোপাল অমনি মেপে উত্তর দিল ‘আজ্ঞে দেড় হাত।’ বস্তুত সে যুগে সামাজিক ক্রিয়াকলাপের মধ্যে উচ্চ-নীচ বিশেষ খুবই বিধিবদ্ধ ভাবে মেনে চলা হলেও, সমাজের সব স্তরের লোক একজন নেতৃস্থানীয় সমাজপতির আওতায় সমবেত ভাবে একই ধরনের নাচ গান, আমোদ, আহ্লাদ, রসিকতা কথকতায় অংশগ্রহণ করত। উচ্চ-নীচ বিশেষ এবং উচ্চ-নীচ ভেদ এক কথা নয়—উনবিংশ শতকের মতো ধনী দরিদ্রের আলাদা অস্তিত্ব ও সংস্কৃতি তখনো সেরকম পরিস্ফুট হয়ে ওঠেনি। উচ্চ-নীচ যেমন বিধিবদ্ধ ভাবে বিশিষ্ট ছিল তেমনি তাদের সম্পর্কও সহজ এবং ঘনিষ্ঠ ছিল। গোপাল ভাঁড়ের গল্পে দেখা যায়, রাজাকে যা তা বলতে গোপালের মুখে কিছুমাত্র আটকাত না। গোপালকে নিয়ে খেতে বসে রাজা জিজ্ঞাসা করলেন ছত্রিশ ব্যঞ্জনের মধ্যে কি দিয়ে শুরু করা যায়, গোপাল বলল, ‘কচু পোড়া খান, দেখবেন পোড়া মুখে সবই ভালো লাগছে।’ গোপালকে জব্দ করার জন্য রাজা ‘স্বপ্ন’ দেখলেন, এক অচেনা পথের দুই ধারে দুজনে পড়ে গেছেন, রাজা ক্ষীরের পুকুরে, গোপাল গুয়ের পুকুরে। স্বপ্ন শুনে গোপাল বলে উঠল, সেও স্বপ্ন দেখেছে দুজনে দুধার থেকে উঠে এসে পরস্পরের গা চাটাচাটি করছে। উনবিংশ শতকের পরিমার্জিত রুচিতে এ গল্পগুলি নিতান্ত অশ্লীল ঠেকত,১০১ কিন্তু গোপালের রসিকতায় যখন তখন হাগু হিসুর প্রাদুর্ভাব ব্যাখ্যা করতে হলে এ কথা ভুললে চলবে না যে শুধু সর্বসাধারণের মধ্যে নয়, গণ্যমান্যদের মধেও রসিকতার স্তর এইখানে নেমে আসে।

গোপালের নামে প্রচলিত আদি গল্পগুলি যে রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের রাজত্বকালের দুটি ভিন্ন ভিন্ন সময়ের অন্তর্ভুক্ত করা যায়, তা আগে ইঙ্গিত করা হয়েছে। প্রথম পর্যায়ের শুরু হয় নবাবী আমলের শেষ দিকে। এই আমলের ‘খটাঙ্গ পুরাণ’ গল্পটি এখনো ছেলেদের কাছে সুপরিচিত। নবাব তখন মুর্শিদাবাদে নিশ্চিন্ত আয়েসে নবাবী করছেন, কোনো কাজ কর্ম নেই। একদিন তাঁর খেয়াল হল, মাটির তলায় কি আছে তা জানা দরকার। ওমরাও আলেমরা বোঝালেন এ সব শক্ত ব্যাপার গণনা করতে হলে নবদ্বীপ থেকে গণক আনিয়ে রীতিমতো তল্লাস করিয়ে নেওয়া চাই। নিরুপায় কৃষ্ণচন্দ্রের রাজ্য থেকে এক দল পণ্ডিত আনিয়ে নবাব উত্তর তলব করলেন। তাঁরা কাঁপতে কাঁপতে যে সব উত্তর দিলেন, মাটি খুঁড়ে তা প্রমাণ না হওয়ায় নবাব সরোষে তাঁদের সবাইকে হাজতে আটক করলেন। রাজাকে নিতান্ত বিমর্ষ দেখে গোপাল কৃষ্ণনগর রাজসভা থেকে ‘পণ্ডিত গোপাল জ্যোতিষগিরি খটাঙ্গ পুরাণনিধি’ পরিচয় নিয়ে মুর্শিদাবাদ দরবারে হাজির হল। হাতে তার লাল শালুতে বাঁধা বিরাট লম্বা কি একখানা ভারি মতো জিনিস দেখে নবাব অভিভূত হয়ে জানতে চাইলেন, ওটি কি পুঁথি। গোপাল তার অদ্ভুত সংস্কৃতে উত্তর দিল:

সর্ব পুরাণানি শ্রেষ্ঠম্‌
খট্টাঙ্গ পুরাণম্।
কেবলম্‌ কেবলম্
সকল শাস্ত্র সারম্॥

নবাব ভূগর্ভস্থ কেন্দ্ৰবন্তু সম্বন্ধে ঐ সুমহান শাস্ত্রে কি নির্দেশ আছে জানতে চাইলে গোপাল লাল শালুর দু তিন পর্দা সরিয়ে কি দেখল, অবশেষে মাথা নেড়ে বলল:

যদা হিন্দুরা মরতি
চিতাং প্রজ্জ্বলতি
ধূম্রাদি উৰ্দ্ধলোকং গমিষ্যতা।
তদা সর্বে হিন্দু পণ্ডিতাঃ
ঊর্দ্ধং গণনং শক্লোতি॥

নবাব সংস্কৃত জানেন না, তাঁকে বুঝিয়ে বলা হল, হিন্দু পণ্ডিতরা মাটির নীচের গণনা কখনো করতে পারবে না বলে শাস্ত্রে নির্দেশ আছে, কারণ মরবার পর হিন্দুদের চিতা জ্বললে তার ধোঁয়া উপরের দিকে উঠে যায়, এবং সেই কারণে একমাত্র উর্ধলোক সম্বন্ধেই পণ্ডিতরা গণনায় সক্ষম। শাস্ত্রের এই সূক্ষ্ম যুক্তি শুনে নবাব ভারি খুশি হয়ে পণ্ডিতদের ছেড়ে দিলেন। খট্টাঙ্গ সম্বন্ধে তাঁর বিশেষ কৌতুহল হল। গোপালকে তিনি প্রশ্ন করলেন—‘খট্টাঙ্গ পুরাণনিধি মহাশয়, আপনার এই অপূর্ব শাস্ত্রে যখন এত কঠিন কঠিন তত্ত্বের মীমাংসা আছে, তখন নিশ্চয় মাটির নীচের বস্তু কারা গণনা করতে পারবে সেই নির্দেশও আছে।’ গোপাল মাথা দোলাতে দোলাতে এক কোণে কাউকে কিছু দেখতে না দিয়ে শালুর আরো কয়েক পদা সরিয়ে কি দেখল কে জানে, পরে বলল, ‘সঠিক সঠিকম্‌’। নবাব অধীর আগ্রহে জিজ্ঞাসা করলেন—‘কি লেখা আছে, পণ্ডিত মশায়? গোপাল বলল:

যবনাদি স্লেচ্ছাদি যদা যদা মরিষ্যতি
তদা তদা কবরং খননং কৃত্বা।
ভূমিতলে প্রথিতা সন্তি।
যবনা বা ম্লেচ্ছ পণ্ডিতাহি কেবলা
ভূনিম্নস্থ বার্ত্তা বক্তুম্‌
সমর্থা ভবিষ্যন্তি॥

অস্যার্থ:— যবন বা ম্লেচ্ছগণ যখন মারা যায়, তখন কবর খুঁড়ে তাঁদের মাটিতে পোরা হয়। অতএব মাটির তলায় কি আছে তা কেবল যবন বা ম্লেচ্ছ পণ্ডিতরাই বলতে পারবেন। নবাব একথা শুনে মোল্লাদের দিকে তাকালেন, ভয়ে তাদের মুখ সাদা হয়ে গেল। গোপাল সদলবলে কৃষ্ণনগরে ফিরে এলে রাজা উৎকণ্ঠিত কৌতূহল রোধ করতে না পেরে জানতে চাইলেন, ‘তোমার ওই লাল শালুর মধ্যে কি শাস্ত্র জড়ানো আছে গোপাল?’ গোপাল শালু সরিয়ে দেখাল, একখানা ভাঙা খাটের পায়া। নবাব, রাজা, পণ্ডিত, মোল্লা, ভাঁড় সমাবেশে যে অখণ্ড ছবি এই গল্পে ফুটে উঠেছে, তা থেকে নবাব দরবার সম্বন্ধে সে যুগের সাধারণ মানুষের আগাগোড়া ভ্রান্ত অথচ সম্পূর্ণ সজীব ধারণাগুলি বেশ ধরা যায়।

গোপাল ভাঁড়ের দ্বিতীয় পর্যায়ের গল্পগুলি ইংরাজ আমলের গোড়ার দিকে দানা বেঁধেছিল। আজু গোঁসাই, গোয়ারি, উলা, গুপ্তিপাড়া ইত্যাদির পুনঃ পুনঃ উল্লেখ থেকে তাই প্রমাণ হয়। রামপ্রসাদের প্রতিদ্বন্দ্বী আজু গোঁসাই হালিশহরের লোক ছিলেন। হালিশহর, গোয়ারি, গুপ্তিপাড়া ইত্যাদি কলকাতার একটু উত্তরে গঙ্গাতীরবর্তী জায়গাগুলি তখন বেশ জমজমাট হয়ে উঠেছে। প্রবাদ ছিল, ‘উলোর পাগল, গুপ্তিপাড়ার বাঁদর, হালিশহরের ত্যাঁদড়।’১০২ রাজার ভাঁড় গোপাল একদিন বেশ সেজেগুজে গুপ্তিপাড়ার পথ দিয়ে তাড়াতাড়ি বেয়াই বাড়ি যাচ্ছে, এমন সময় গুপ্তিপাড়ার একদল পাজি লোক তাকে জব্দ করার মতলব আঁটল। সে পথে ভিন গাঁয়ের নতুন লোকেরা গেলেই এরা তাদের নাকাল করে ছাড়ত—লোকে কথায় বলত, ‘গুপ্তিপাড়ার মাটি, বাঁদর গড়ে খাঁটি।’ একটা লোক চট করে পেঁকো পুকুরের কাদা মেখে এসে গোপালকে জড়িয়ে ধরে হাউ হাউ করে কাঁদতে লাগল—‘ওরে রাঙাদারে অ্যাদ্দিন তুই কোথায় ছিলি রে—ঠাকুমা যে তোর কথা ভাবতে ভাবতে পটল তুললরে।’ গাছতলায় উলোগুপ্তিপাড়ার লোকেরা বসে মজা দেখছিল, গোপালের হাল দেখে তারা খিলখিল করে হাসতে লাগল। ব্যাপার বুঝে গোপাল বাঁ হাতের তেলোয় প্রস্রাব করে লোকটার মুখে চোখে আদর করার ঢঙে মাখিয়ে দিতে দিতে বলল, ‘ভাই কালুরে, দুঃখ করিসনে, ঠাক্‌মা কি কারো চিরকাল বেঁচে থাকে রে?’ এ গল্পের টীকা নিস্প্রয়োজন। ১৮৮৫ খ্রীস্টাব্দে চণ্ডীচরণ সেন তাঁর ‘মহারাজ নন্দকুমার বা শতবর্ষ পূর্বে বঙ্গের সামাজিক অবস্থা’ নামে ঐতিহাসিক উপন্যাসে উল্লেখ করেছেন যে একশো বছর আগে অনেক স্ত্রীলোক রামায়ণ মহাভারত কবিকঙ্কণ চণ্ডী না শুনে বিদ্যাসুন্দর, শ্রীকৃষ্ণের রাসলীলা, রসিকরঞ্জন, গোপাল ভাঁড়ের রসিকতা এই সব পুঁথি মুখে মুখে শুনতে ভালোবাসত।১০৩

মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র কুমারটুলীর মৃৎশিল্পী ও শান্তিপুরের তাঁতীদের নানা প্রকারে সহায়তা করে রাজ্যের সৌষ্ঠব বৃদ্ধি করেছিলেন। পথ ঘাট সরোবর পান্থনিবাস ইত্যাদি জনহিতকর কার্যের দিকে তাঁর বিশেষ লক্ষ ছিল।১০৪ তাঁর সুবিস্তৃত রাজ্যের আয়তন ছিল ৩১৫১ বর্গমাইল। কবি ভারতচন্দ্র নদীয়া রাজ্যের এই সীমা নির্দেশ করেছেন:

অধিকার রাজার চৌরাশী পরগনা।
খাঁড়ি জুড়ি১০৫ কবি দপ্তরে গণনা॥
রাজ্যের উত্তর সীমা মুরসিদাবাদ।
পশ্চিমের সীমা গঙ্গা ভাগিরথী খাদ॥
দক্ষিণের সীমা গঙ্গাসাগরের ধার।
পূৰ্ব্বসীমা ধুল্যাপুর বড় গঙ্গা পার॥

৫। বীরভূম—পরগনা ২২, জমা ৩,৬৬,৫০৯।

রাজনগরের বিস্মৃতিমলিন প্রান্তরে বীরভূমের পাঠান রাজাদের পরিত্যক্ত প্রাসাদের ধ্বংসস্তূপ আজও দাঁড়িয়ে আছে। সেই উদ্ভিদাকীর্ণ সর্পসঙ্কুল ভগ্ন দালানের উপরে উঠলে পিছন দিকে বহু দূর পর্যন্ত দৃষ্টি চলে। ১৮৬৪ খ্রীস্টাব্দে যখন গ্রাম বাংলার ঐতিহাসিক উইলিয়াম উইলসন হান্টার এখানে পৌঁছন, তখনো ঐ ভঙ্গুর অট্টালিকায় ভূতপূর্ব রাজারা নিতান্ত দরিদ্রভাবে বাস করছিলেন। প্রাসাদে হান্টার রাজাদের একটি বংশাবলী পান, তাঁর মুনশী শেখ রহিম বক্স্‌ সিউড়িতে বসে সেই ফার্সী পুঁথির নকল ও অনুবাদ করেন। প্রথম দিকের রাজাদের সম্বন্ধে ঐ পুঁথিতে রাজত্বকালের তারিখ ছাড়া আর বিশেষ কিছু পাওয়া যায় না, কিন্তু একটি লক্ষণীয় জিনিস চোখে পড়ে। দেওয়ান রণমস্ত খান বাহাদুর থেকে বদি-আল-জামান খান পর্যন্ত প্রথম যে চারজন জমিদারের নাম আছে, তাঁদের প্রত্যেকের উপাধি রয়েছে দেওয়ান। পঞ্চম জমিদার মহম্মদ আসাদ আল জামান খানের উপাধি দেওয়া হয়েছে রাজা। প্রথম দিকে বীরভূমের জমিদারদের কেন দেওয়ান উপাধি ছিল সে সম্বন্ধে ফার্সী পুঁথিতে কোনো ব্যা্‌খ্যা না থাকলেও হান্টারের পণ্ডিত নবীন চন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় স্থানীয় জনশ্রুতি থেকে এই পাঠান পরিবারের রাজত্বপ্রাপ্তি সম্বন্ধে যে কাহিনী সংগ্রহ করেন তা থেকে এই রহস্য কিছুটা পরিষ্কার হতে পারে।১০৬

হান্টারের পণ্ডিতের কাহিনী অনুসারে পাঠান-রাজাদের আগে রাজনগরে বীর রাজা নামে এক হিন্দু ব্রাহ্মণ বংশীয় নরপতি ছিলেন। তাঁর রাজ্যে পশ্চিম থেকে আগত আসাদুল্লাহ্‌ খান এবং জুনায়েদ খান নামে দুই বলবান পাঠান ভাই উচ্চ-সামরিক পদ পান। রানীর জ্বলন্ত রূপে উত্তেজিত হয়ে পাঠান সেনাপতি আসাদুল্লাহ্ রাজাকে মারবার মতলবে রানীর কানে মন্ত্র দিতে লাগলেন। রাজা কুস্তি ভালোবাসতেন। কুস্তির আখড়ায় তাঁর আদেশে অনুচররা আসাদুল্লাহ্‌কে ভেতরে ঢুকতে না দেওয়ায় ক্রুদ্ধ হয়ে পাঠান সেনাপতি তাঁর ভাই জুনায়েন্দকে ডেকে এনে জোর করে ঢুকে রাজার উপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন। জুনায়েদের সঙ্গে রানীর গুপ্ত প্রণয় ছিল। রানীর ইঙ্গিতে তিনি লড়াইরত রাজা ও ভাই আসাদুল্লাহকে কুয়োর মধ্যে ঠেলে ফেলে দিলেন। রানীর ভয়ে কোনো অনুচর এগিয়ে এসে বাধা দেবার সাহস করল না। রানী রাজ্যভার গ্রহণ করে জুনায়েদ খানকে দেওয়ান নিয়োগ করলেন। নিজের একটি ছেলে রেখে রানা মারা গেলে সৈন্যরা বিদ্রোহ করল, জুনায়েদ সেই বিদ্রোহ দমন করে বাহাদুর খানের হাতে রাজ্য দিয়ে অল্প দিন পরেই মারা গেলেন। বাহাদুর খান বা রনত খান ১৬০০ খ্রীস্টাব্দে দেওয়ান নামে১০৭ রাজশাসন করতে শুরু করেন, তাঁর আমল থেকে পাঠান রাজত্বের শুরু হয়। রাজনগরের পাঠান রাজবংশের বংশাবলীতে রনমস্ত খানের নামই প্রথম, তাঁর আদি পুরুষদের নাম নেই, জুনায়েদ খানেরও উল্লেখ নেই। বাঙলার অধিকার নিয়ে পাঠান এবং মোগলদের এখন লড়াই চলছিল সেই সময় রাজনগরে ভূতপূর্ব হিন্দু ভূঁইয়াদের হটিয়ে তাঁদের পাঠান রণ-নায়করা নিজেদের ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা করেন বলে মেনে নেওয়াই যুক্তি সঙ্গত হবে। জেমস গ্রান্টও লিখেছেন, শেহ শাহর বংশধররা বিতাড়িত হবার পর ঝাড়খণ্ডের জংলি লোকেদের আক্রমণ থেকে সীমান্ত রক্ষা করার জন্য বীরভূমে একদল সমরপটু মুসলমান চাষী এনে তাদের রণনায়ক পদে এই পাঠান বংশকে নিযুক্ত করা হয়। ঘাট-ওয়াল রূপে ঐ রণদুর্মদ মুসলমান প্রজারা পাঠান জমিদারদের অধীনে প্রত্যেকে কিছু কিছু জমি পায়। সে হিসাবে বীরভূমকে দেওয়ানী সনদ দ্বারা স্বীকৃত সাধারণ জমিদারীগুলির পর্যায়ে না পাঠিয়ে ফেলে গ্রান্ট ঐ জমিদারীর সঙ্গে ইওরোপের প্রাচীন প্রত্যন্ত সামন্ত রাজ্যগুলির তুলনা দিয়েছেন। কারণ বীরভূমের বহু পরিমাণ জমির উপর বাদশাহ খাজনা ছিল না, এই নিষ্কর জমির আয়ে সীমান্ত রক্ষার জন্য সৈন্যদলের ব্যয় ভার নিবাহ হত।১০৮

ফার্সী পুঁথির গোড়ায় লেখা আছে—‘এই কিতাব বীরভূমের খানদানের কিতাব—এতে প্রত্যেক রাজা কোন্ বছর মসনদে ওঠেন, কতদিন তাঁর রাজত্ব ছিল, তিনি কোথায় থাকতেন, এবং কোন্ বিমারীতে তিনি মারা যোন, তা লেখা আছে।’ প্রথম দুইজন জমিদার সম্বন্ধে শুধু এই মাত্র দেখা যায়: ‘দেওয়ান রনমস্ত খান ১০০৭ বঙ্গাব্দের জ্যৈষ্ঠ মাসের প্রথম থেকে ১০৬৬ বঙ্গাব্দের পয়লা কার্তিক পর্যন্ত রাজত্ব করে বিমারীতে মারা যান [১৬০০—১৬৫৯ স্ত্রীঃ]। মৃতের পুত্র খাজা কামাল খান বাহাদুর ১০৬৬ বঙ্গাব্দ থেকে ১১০৪ বঙ্গাব্দ পর্যন্ত রাজত্ব [১৬৫৯—১৬৯৭ খ্রীঃ] করে বিমারীতে মারা যান। বড়ো ফুল বাগিচায় তাঁর কবর আছে। তিনি আটত্রিশ বছর, চার মাস, তের দিন রাজত্ব করেন।’ এঁদের আমলে বাংলাদেশে মোগল শাসন সুপ্রতিষ্ঠিত হয়, কিন্তু জঙ্গলময় বীরভূমের প্রত্যন্ত জমিতে সরাসরি মোগল শাসন প্রবর্তন না করে সুবাহদাররা রাজনগরের পাঠান জমিদারদের কাছ থেকে জমার বদলে শুধু পেশকাশ নিয়ে তাঁদের হাতে দেশের ভার সমর্পণ করেন।

রাজনগরের পাঠান বংশের তৃতীয় জমিদার আসাদুল্লাহ্‌ খান ইতিহাসে পরিচিত লোক। বংশাবলীতে শুধু এইটুকু দেখা যায়—‘দেওয়ান খ্বাজার ছেলে দেওয়ান আসাদ উল্লাহ্‌ খান ১১০৪ বঙ্গাব্দ থেকে ১১২৫ বঙ্গাব্দ পর্যন্ত [১৬৯৭—১৭১৮ খ্রীঃ] রাজত্ব করেন। তাঁর রাজত্বের কাল মোট একুশ বছর এক মাস কুড়ি দিন। তিনি তাঁর দুই ছেলে আজিম খান এবং বদি-আল-জামান খানকে উত্তরাধিকারী নিয়োগ করে মারা যান।’ জেমস গ্রান্টের মতে এই বংশে ইনিই প্রথম দেওয়ানী সনদ দ্বারা নিযুক্ত হন, কিন্তু হান্টারের পণ্ডিত লিখেছেন তাঁর ছেলে বদি-আল-জামান খান প্রথম দেওয়ানী সনদ পেয়েছিলেন। সম্ভবত দ্বিতীয় মতটিই সঠিক কারণ ফার্সী ইতিহাস সমূহে দেখা যায় আসাদুল্লাহ্‌ খানের আমলে বীরভূম ও বিষ্ণুপুরের রাজারা অন্যান্য দেওয়ানী সনদ নিযুক্ত জমিদারদের মতো নবাব সরকারের মুখাপেক্ষী ছিলেন না। সে সময় মুর্শিদকুলী খান সবে আজিম-উস-শানের অধীনে নায়েব নাজিম হয়ে সারা বাংলাদেশের জন্য খাজনার নতুন বন্দোবস্ত করছেন। দেওয়ানী সনদ নিযুক্ত জমিদাররা মুর্শিদাবাদে হাজিরা দিতে বাধ্য ছিলেন, খাজনায় ঘাটতি পড়লে তাঁরা আটক হতেন। সলিমুল্লাহ্‌র মতে মুর্শিদকুলী খান ঐ সব জমিদারদের প্রয়োজন বোধে কিছু দিন মলমূত্র সুবাসিত অন্ধকূপে ‘বৈকুণ্ঠ’ বাস করাতেন। পরবর্তী নবাব সুজাউদ্দিন খান যে সব জমিদাররা বহুদিন স্ত্রীপুত্রের মুখ দেখেননি তাঁদের দয়া করে মুর্শিদাবাদের কয়েদখানা থেকে ছেড়ে দেন। কিন্তু বীরভূম বিষ্ণুপুরের প্রত্যন্ত জমিদাররা এবং ত্রিপুরা, কুচবিহার ও আসামের চতুর্ধারী স্বাধীন রাজারা এই ব্যবস্থার অধীন ছিলেন না। ‘গভীর জঙ্গলে এবং পাহাড় পর্বতের আড়ালে আশ্রিত বীরভূম বিষণপুরের জমিদাররা নিজেরা নবাবের সামনে হাজিরা দিতেন না। তাঁরা উকীলের মারফৎ পেশকাশ ও নজর পাঠাতেন। বীরভূমের জমিদার আসাদুল্লাহ্‌ খান ধার্মিক মহানুভব লোক বলে এবং তাঁর সম্পত্তির অর্ধেক আলিম, পীর ও ধার্মিক লোকদের মধ্যে মদদ্‌-ই মাশ হিসেবে উৎসর্গ থাকায়, মুর্শিদকুলী খান তাঁর উপর কোনো পীড়ন করা থেকে বিরত ছিলেন। কিন্তু বিষ্ণুপুরের জমিদারেরা খরচপাতি বেশি এবং মহল থেকে খাজনা আদায় কম বলে তিনি তাঁকে শায়েস্তা করার দিকে নজর দিয়েছিলেন। ত্রিপুরা, কুচবিহার এবং আসামের রাজারা নিজেদের চতুর্ধারী রাজন্য বলে পরিচয় দিতেন এবং হিন্দুস্থানের বাদশাহ্র কাছে মাথা নত না করে নিজেদর নামে টাঁকশাল থেকে তংকা চালাতেন।’১০৯

নবাব দরবারে আসাদুল্লাহ্‌ খান যাঁকে উকীল রেখেছিলেন তিনি ধর্মমঙ্গল কাব্যের কবি হিসেবে ভণিতায় নিজের পরিচয় রেখে গেছেন।১১০ কায়স্থ নরসিংহ বসু বর্ধমান শহরের দক্ষিণে শাঁখারী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন—এই পরিবার মহারাজ কীর্তিচাঁদের প্রজা (‘অধিকারী দেশের শ্রীকীর্তিচন্দ্র রায়। জগজনে যাহার যশের গুণ গায়॥’)। বাংলা ও ফার্সী আয়ত্ত করে তিনি ‘নানা দেশে রোজগার’ করতে বের হন, অবশেষে মুর্শিদাবাদের নবাব দরবারে বীরভূম রাজনগরের রাজা আসাদুল্লাহ্‌র তরফে উকীল নিযুক্ত হন। নিজের প্রভুর মহিমা ও পরাক্রম বর্ণনা করতে গিয়ে এই কায়স্থ উকীল ধর্মমঙ্গলে লিখেছেন:

বাঙ্গলায় বীরভূম বিখ্যাত অবনি।

শ্রীআসাদুল্লা১১১—খান রাজা শিরোমণি॥

প্রবল প্রতাপ ভূপ সময়ে প্রচণ্ড।

সব দেশে যশ গায় রাজা ঝারিখণ্ড॥

অস্ত্রে শস্ত্রে নিপুণ বিখ্যাত মহীতলে।

দ্বাদশ হাজার চালি যার আগে চলে॥

তীরন্দাজ ধানুকির নাহিক সুমার।

অশ্বপতি তুরঙ্গ টাঙ্গন দু-হাজার॥

সব বলে পরিপূর্ণ রিপু নাহি আঁটে।

বিশাশয় নৃপতি যাহার আজ্ঞা খাটে॥

দেশে নাঞি ডাকাচুরি রিপু কম্পমান।

তার দ্বারে থাকে সদা হাথে করা প্রাণ॥

এখানে দুটি জিনিস লক্ষ্য করবার মতো। প্রথমত মুর্শিদাবাদ থেকে অনতিদূরে বীরভূমের রাজারা দু-হাজার পাঠান ঘোড়সওয়ার এবং বারো হাজার ঢালী ও তীরন্দাজের সমাবেশ করেছিলেন। নবাবরা এই সামরিক শক্তির নিকট উপস্থিতি সম্বন্ধে বিলক্ষণ সচেতন ছিলেন। দ্বিতীয়ত ঝাড়খণ্ডের জংলি লোকেদের সান্নিধ্য সত্ত্বেও বীরভূমে এই সময় চুরি ডাকাতি কম ছিল। এহেন পরাক্রান্ত পাঠানের জমিদারীও ঠিক সময়ে নবাব দরবারে সালিয়ানা খাজনার সব টাকা জমা না পড়ায় বিপন্ন হল। নরসিংহ উকীল অনেক বলে কয়ে নবাব জাফর খানের কাছ থেকে কিছু সময় নিয়ে টাকার যোগাড় করতে রাজনগর গেলেন।

বীরভূম বিদায় নিতে বাকি কর।
রাতে দিনে চল্যা শেষে দাখিল নগর॥
সবিশেষ সকল কহিল সমাচার।
নৃপ আজ্ঞা খাজনার কি করি বিচার॥
নিকাশ বলিল দিব টাকা এক লাখ।
কার্তিকের তিরিশে ভর‍্যা পাচার বেবাক॥
জামাজোড়া শিরোপা দিলেন মহারাজ।
বিদায় করিল যাহ মুরসুন্দাবাদ॥

রাজার শিরোপা পেয়ে মুর্শিদাবাদে টাকা রওনা করিয়ে দিয়ে বসুজা নিজে বের হয়ে পড়লেন। পথে জুঝাটির খেজুরতলায় জাগ্রত ধর্মঠাকুরের পূজা বেদীতে পূজা দিতে গিয়ে দৈবযোগে ধর্মঠাকুরের সাক্ষাৎ পেলেন:

কতদূরে লোকজন রাখিয়া বাহন।
একলা গেলাম ধর্ম করিতে দর্শন॥
অপূর্ব সন্ন্যাসী এক আস্যা উপস্থিত।
আশীর্বাদ দিয়া কন গাও কিছু গীতি॥
অপরূপ বচন বলিল মহাশয়।
চারি পার্শ্বে মোহিত কতক হইল ভয়॥
ভূমে পড়া দণ্ডবত জুড়্যা দুই কর।
মাথা তুল্যা চাহিতে সন্ন্যাসী অগোচর॥

এই রকম অলৌকিক ভাবে ধর্মমঙ্গল রচনার আদেশ পেয়ে ভয়বিহ্বল বসুজা সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে এবার বাড়ি হয়ে অবশেষে নবাব দরবারে পৌঁছলেন। ধর্ম ঠাকুরের কৃপায় কাজ হাসিল হল—উকীল নবাব দরবারে টাকা জমা দিয়ে প্রভুর রাজ্য রক্ষা করলেন:

অনাদ্যের আজ্ঞা হৈল রচিতে সঙ্গীত।
পথে যাই মনে অকস্মাৎ উঠে গীত॥
রাত্যে দিনে চল্যা যাই বিলম্ব না হয়।
ধর্মের কৃপায় হইল দরবারে জয়॥
* * *
দিনে দরবার করি রাত্রে করি গীত।
ধর্যের কৃপায় পূর্ণ হইল সঙ্গীত॥

১৭১৪ খ্রীস্টাব্দে এই সকল ঘটনা ঘটেছিল। কায়স্থ উকীলের বর্ণনা থেকে বেশ বোঝা যায় যে মুর্শিদকুলী খানের নিজামত শুরু হবার পর থেকে রাজনগরের দেওয়ানরা আর আগের মতো স্বায়ত্বশাসন বজায় রাখতে পারেননি। হান্টারের পণ্ডিত লিখেছেন, নবাবকে প্রয়োজন কালে সৈন্য সাহায্য দিয়ে আসাদুল্লাহ্ পেশকাশ মকুব করিয়ে নেন, কিন্তু এ ব্যাপারে আসাদুল্লাহর উকীলের সাক্ষ্যই মানতে হবে। সম্ভবত আসাদুল্লাহ্‌র রাজত্বের প্রথম দিকে মুর্শিদাবাদে শুধু নজর ও পেশকাশ যেত কিন্তু তাঁর মৃত্যুর চার বছর আগে যে হুজুরে খাজনা চালান দিতে হচ্ছিল আর অভ্রান্ত প্রমাণ আছে নরসিংহ বসুর ‘ধর্মমঙ্গলে’। আসাদুল্লাহ্‌ খান সৈন্যসংখ্যা বাড়িয়েছিলেন। তাঁর বেশির ভাগ সময় নমাজ পাঠে এবং আল্লাহ্র ভাবনায় কাটত। তিনি অনেক মসজিদ নির্মাণ করেন এবং বহু দীঘি খনন করে রাজনগরে প্রজাদের জলকষ্ট নিবারণ করেন। প্রসঙ্গত বলা যায় যে তখনো দেশের হিতৈষী জমিদারের সৃষ্ট বিশাল দীর্ঘিকাগুলি কচুপানায় আবদ্ধ হয়নি—water hyacinthএর প্রাদুর্ভাব ঘটে ইংরাজ আমলে।

১৭১৮ খ্রীস্টাব্দে আসাদুল্লাহ্‌ খানের মৃত্যুর পর বদি-আল-জামান খান দেওয়ান নাম নিয়ে রাজত্ব শুরু করলে মুর্শিদাবাদের নবাবের তরফ থেকে তাঁকে দেওয়ানী সনদ দেওয়া হল এবং নতুন বন্দোবস্তে ৩ লক্ষ ৪৬ হাজার টাকা ধার্য হল। নবাব সুজাউদ্দীন খানের হুকুমে তাঁর ছেলে সরফরাজ খান সামরিক অভিযান করে পাঠান জমিদারের উপর এই নতুন বন্দোবস্ত চাপালেন। সম্ভবত পিতার আজ্ঞা রাখতে বদি-উজ-জামান খান নিজের ভাই আজিম খানের উপরে শাসনের দায়িত্ব অর্পণ করে রেখেছিলেন—তিনি নিজে কোনো কাজকর্ম দেখতেন না। তাঁর বীর পুত্র আলি নকি খানের১১২ উপর সৈন্য চালনার ভার ছিল, আর নওবৎ খান তাঁর দেওয়ান ও মন্ত্রী ছিলেন। বদি-উজ্জামানের সময় কাটত বাঁশী বাজিয়ে এবং টাকা উড়ত নাচে গানে হৈ হুল্লোড়ে।১১৩ নবাব দরবারে খবর পৌঁছল, বদি-উজ্জামান মাল জমি থেকে যে চৌদ্দ লক্ষ টাকা আলিম এবং গরিবদের জন্য সরানো ছিল তা নাচের দল ও অন্যান্য আমোদ প্রমোদের পিছনে খরচ করছেন। পাহাড় জঙ্গলের আড়ালে থেকে পাঠান জমিদার পূর্বেকার পেশকাশের উপরি যে অতিরিক্ত খাজনা নির্ধারিত হয়েছিল তা বন্ধ করে ছিলেন। বীরভূমের গিরিসঙ্কটগুলির ঘাটে ঘাটে মোতায়েন ঘাটোয়াল সৈন্যরা নবাবী সৈন্য ও লোকজনের আনাগোনা বন্ধ করে দিলে পর নবাব সুজাউদ্দিনের টনক নড়ল। হাজী আহমদ (আলিবর্দি খানের বড়ো ভাই) রায় রায়ান আলমচন্দ এবং জগৎ শেঠ ফতেহ্‌চন্দের পরামর্শ অনুযায়ী নবাবজাদা সরফরাজ খানকে এই বিদ্রোহী জমিদার দমনে পাঠানো হল। সরকরাজের এই সময় যাত্রার কথা পূর্বেই উল্লিখিত হয়েছে। বর্ধমানের দিক থেকে বিশাল নবাবী ফৌজ রাজনগরের দিকে এগোতে শুরু করলে নৃত্যক্রীড়াসক্ত বদিউজ্জামানের হুঁশ হল। তিনি বুঝলেন সরফরাজ খানের শর্তে নবাব দরবারে বশ্যতা স্বীকার করে নেওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ হবে। সরফরাজ খান প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন বশ্যতা মেনে নিলে পাঠান জমিদারের উপর কোনো শাস্তি বিধান হবে না। নবাবজাদার মধ্যস্থতায় এই প্রথম বীরভূমের নরপতি মুর্শিদাবাদে হাজিরা দিলেন। নবাব প্রসন্ন হয়ে বদিউজ্জামান খানকে খিলাৎ দিলেন। নতুন বন্দোবস্ত অনুসারে স্থির হল এখন থেকে বীরভূমের জমিদার পূর্বোক্ত সাড়ে তিন লাখের কাছাকাছি খাজনা দেবেন এবং সব জমিদাররা যে প্রথায় খাজনা দেন এবং নবাবী হুকুম তামিল করেন সেই প্রথা অনুসারে চলবেন। দেওয়ান বদিউজ্জামান খানের তরফ থেকে মুর্শিদাবাদ দরবারে মাল জামিন রইলেন বর্ধমানের মহারাজ কীর্তিচন্দ। দিল্লীতে নাদির শাহ চড়াও হবার কিছু আগে পাঠান জমিদার রাজনগরে ফিরে যাবার অনুমতি পেলেন।১১৪ নাদির শাহী হাঙ্গামার সময় মুর্শিদাবাদেও গণ্ডগোল উপস্থিত হল। সুজাউদ্দিন খানের মৃত্যুর পর সরফরাজ খান মসনদে ওঠা মাত্রই হাজি আহমদ ও জগৎ শেঠের ষড়যন্ত্রে পাটনার নায়েব নাজিম আলিবর্দি খান নতুন নবাবের উপর চড়াও হয়ে তাঁকে সম্মুখ সমরে সংহার করলেন। বীরভূমের জমিদারের সঙ্গে সরফরাজ খানের সখ্যতা স্থাপিত হয়েছিল বলে পরাজিত নবাবকে তাঁর মাহুত একদিনের পথ রাজনগরে আশ্রয় নিতে বার বার পরামর্শ দিয়েছিল,১১৫ কিন্তু হঠাৎ তীর লেগে হাতির পিঠে সরফরাষ্ট্রের ভবলীলা সাঙ্গ হল। এই সব গণ্ডগোল মিটতে না মিটতেই সমস্ত রাঢ় জুড়ে বর্গিদের হানা শুরু হয়ে গেল, বর্ধমান বিষ্ণুপুরের মতো বীরভূমের জমিদারকেও হামলার মোকাবিলা করতে এগোতে হল।

বর্গি হাঙ্গামার সময় পাঠান রাজার বীর পুত্র আলি নকি খানের অসম সাহসিকতা ও সমর কুশলতা সম্বন্ধে গত শতকে বীরভূমে অনেক গল্প প্রচলিত ছিল। শোনা যায় মীরজাফরের জামাই (মীর কাশিম?) মারাঠাদের লোহার খাঁচায় বন্দী হলে আলি নকি খান তাঁর সহোদর ভাই আহমদ আল জামান খানের সঙ্গে ছদ্মবেশে মারাঠাদের শিবিরে ঢুকে মারাঠাদের সলাপরামর্শ গোপনে জেনে নিয়ে আচমকা আক্রমণে শিবির বিধ্বস্ত করে বন্দী জামাইকে ছাড়িয়ে আনেন। ফার্সী পুঁথি অনুসারে বদি আল জামান খানের (রাজত্বকাল ১৭১৮—১৭৫১) চার ছেলে, যথাক্রমে আহমদ আল জামান খান, মহম্মদ আলি নকি খান, আসাদ আল জামান খান (রাজত্বকাল ১৭৫২—১৭৭৭) এবং মহম্মদ বাহাদুর আল জামান খান (রাজত্বকাল ১৭৭৮—১৭৮৯)। প্রথম দুইজন সহোদর ভাই। তৃতীয় জন এঁদের বৈমাত্রেয় ভাই এবং শেষ জন জারজ সন্তান। জ্যেষ্ঠ হওয়া সত্ত্বেও আহমদ আল জামান খান এবং তাঁর ভাই আলি নকি খান কেন সিংহাসন থেকে বঞ্চিত হয়েছিলেন সে সম্বন্ধে হান্টারের পণ্ডিত যে কাহিনী বলেছেন তার মধ্যে কিছু সত্যি আছে বলে মনে হয়। সৈফুল হক নামে এক ফকির হিন্দুস্তান থেকে বীরভূম দরবারে এসে হাজির হন। দেওয়ান বদি আল জামান তাঁর মুখে কোরান শুনতে ভালোবাসতেন। শেষে এমন অবস্থা হল যে রাজকার্যে তাঁকে পাওয়াই যায় না। দুই ভাই পরামর্শ করলেন এই ফকিরকে না সরাতে পারলে রাজ্যের সর্বনাশ হবে। নবাবের অনুমতি নিয়ে তারা ফকিরকে মেরে ফেললেন। এই ঘটনায় বদিউজ্জামান মর্মাহত হলেন, তাঁর আর রাজত্ব করার ইচ্ছা রইল না। দুই ভাইয়ের মনেও তীব্র অনুশোচনা হল। বাবার ইচ্ছা অনুযায়ী তাঁরা মসনদের অধিকার ছেড়ে মুর্শিদাবাদ দরবারে বাস করতে লাগলেন, তাঁদের বৈমাত্রেয় ভাই আসাদ জামান খান বদিউজ্জামানের বর্তমানেই ১৭৫২ খ্রীস্টাব্দে ‘রাজা’ হলেন। এই বংশে তিনিই প্রথম রাজা। নগরের রাজধানী ঢেলে সাজিয়ে তিনি অনেক ধনী সওদাগরদের বসতি করিয়ে এর বাণিজ্য ও সমৃদ্ধি বাড়িয়েছিলেন। প্রবাদ আছে বীরভূমের চোদ্দ মাইল উত্তরে মল্লারপুর গাঁয়ে মল্লার সিংহ নামে এক ধার্মিক ও সর্বজনপ্রিয় ভূস্বামী ছিলেন। নগরের রাজা তাঁকে জোর করে মুসলমান করতে চান এই মিথ্যা খবর শুনে তিনি আত্মহত্যা করেন। এই খবরে মর্মাহত হয়ে রাজা মিথ্যাবাদী কুচক্রীকে বের করবার জন্য অনেক তল্লাস চালান, কিন্তু সে লোকটিকে ধরা যায়নি।

রাজার বড়ো দুই ভাই ও বুড়ো বাবা আরো অনেক দিন বেঁচেছিলেন। বদিউজ্জামানের রাজত্বকালে গিবধারের রাজা একবার বীরভূমের বাহিনীকে যুদ্ধে হারিয়ে দিয়েছিলেন। তখন আলি নকি খান যুদ্ধ করে বাবার শত্রুকে পরাস্ত করেন এবং সেই সময় বৈজনাথের মন্দির সহ দেওঘর শহর বীরভূমের অধিকারে চলে আসে। নবাব দরবারে থাকার সময় আলি নকি খান একবার একটা হাতিকে দাঁতে সুদ্ধ পাকড়ে দূরে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিলেন বলে প্রবাদ ছিল। পণ্ডিত নবীনচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাহিনী অনুসারে বর্ধমানের মানিকচন্দ, মোহনলাল এবং অন্যান্যদের সঙ্গে আলি নকি খানও সিরাজের কলকাতা আক্রমণের সময় উপস্থিত ছিলেন এবং নবাবকে তিনি সবচেয়ে জোরদার ভাবে যুদ্ধে সহায়তা করেছিলেন। গল্পে আছে, তরুণ নবাব একদিন জানতে চাইলেন বীরভূমে সবচেয়ে সুন্দরী কে? রক্তচক্ষু পাঠান জবাব দিলেন—‘আমার আম্মা এবং বহিনদের মতো দেখতে জেনানারা সবচেয়ে খুবসুরৎ।’ বলে নবাবকে তলোয়ারের এক কোপ মারলেন। নবাবের উপর সেই কোপ না পড়ে একটা পাথরের থামের উপর পড়ল, থামটা তখনি দুইখান হয়ে গেল। এরপর দুই ভাই কিছুদিন দরবার থেকে সরে রইলেন, কিন্তু পরে তাঁরা নাকি আবার দরবারে স্থান পেয়েছিলেন। আলি নকি খান তাঁর বাবার বোনকে বিয়ে করে একটি পুত্র লাভ করেছিলেন। সেই ছেলেটি ছিল দুই পাঠান ভাইয়ের নয়নের মণি। অল্প বয়সে তার মৃত্যু হলে শোকে আহমদ জামান খান ১৭৬২ খ্রীস্টাব্দে আত্মহত্যা করেন, তাঁকে বড়ে ইমাম বাড়ায় কবর দেওয়া হয়। ছেলে ও দাদার শোকে জীবনের বাকি দুই বছর কোনোমতে কাটিয়ে বীর আলি নকি খান ২১শে ফাল্গন ১৭৬৪ খ্রীস্টাব্দে মৃত্যুমুখে পতিত হন, দাদার কবরের সামনে তাঁর মরদেহ সমাধিস্থ করা হয়। বদিউজ্জামান খান ১৭৭১ খ্রীস্টাব্দ পর্যন্ত বেঁচেছিলেন, ফুলবাগে তাঁকে কবর দেওয়া হয়েছিল।

আলি নকি খান কর্তৃক বর্ধিত বদি-আল-জামান খানের রাজ্য বাংলায় সবচেয়ে বড়ো মুসলমান জমিদারী ছিল। রেনেলের পরিমাপ অনুযায়ী এর আয়তন ৩৮৫৮ বর্গমাইল ছিল, কিন্তু সে তুলনায় বীরভূমের সাড়ে তিন লক্ষ টাকা খাজনা প্রায় একই আয়তনের নদীয়া ও দিনাজপুর জমিদারীর ছয় সাত লক্ষ টাকা খাজনার চেয়ে অনেক কম ছিল বলতে হবে। এর কারণ রাজ্যের মাত্র এক তৃতীয়াংশ নবাবী মালজমির আওতায় ছিল, বাকি দুই তৃতীয়াংশ ঘাটোয়ালদের মধ্যে বিলি করা ছিল অথবা দক্ষিণ বিহারের জংলি রাজাদের কাছ থেকে জোর করে ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছিল। এই সব পশ্চিমাঞ্চল পাহাড় জঙ্গলে ভরা হলেও তার মধ্য দিয়ে অজয় নদী প্রবাহিত ছিল বলে সহজে শস্য চালান দেওয়া যেত, এবং তার ফলে এর আয় মালজমির চেয়ে কিছু কম নয় বলে গ্রান্ট নিজের অভিমত প্রকাশ করেছিলেন।১১৬

৬। কলকাতা—পরগনা ২৭, জমা ২,২২,৯৫৮

সুজাউদ্দিন খানের ১৭২৮ খ্রীস্টাব্দের ‘জমা তুমারী তেশকিশ’ বন্দোবস্তে এই বহুতর ছোট ছোট তালুকের সমষ্টি কলকাতা অঞ্চল মাহমুদ শরীফের ইমাম নামে অন্তর্ভুক্ত ছিল। তার মধ্যে একটি ইংরাজদের কলকাতা, সুতানটি ও গোবিন্দপুরের তালুক। পলাশীর যুদ্ধের পর গোটা ইহ্‌তমাম ইংরাজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির জমিদারী নামে লিখিত হয়।১১৭ ফাররুকশিয়রের ১৭১৭-র ফারমান অনুযায়ী এই এলাকার অংশ বিশেষের জমিদারী অনেক আগেই ইংরাজদের পাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু কলকাতার আশেপাশের যে এলাকা ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির জন্য দেশের সার্বভৌম সম্রাট ফাররুকশিয়র নির্দিষ্ট করেছিলেন, তার দশ ভাগের নয় ভাগই সম্রাটের অধীন সুবাহ্‌দার মুর্শিদকুলী খান ইংরাজদের দখল করতে দেননি।১১৮ নবাবরা প্রথম থেকেই ইংরাজ শক্তি বাড়তে দেওয়ার ঘোর বিরোধী ছিলেন। রাজশাহী, বর্ধমান, দিনাজপুর ইত্যাদি জমিদারদের রাজ্যবিস্তারে তাঁরা নানাভাবে সাহায্য করলেও ইংরাজদের এলাকা কি করে সংকুচিত রাখা যায় সে দিকে তাঁদের দৃষ্টি সর্বদাই সজাগ ছিল।

ইংরেজদের কুঠি প্রথমে কলকাতায় ছিল না। মোগল ফৌজদারের অধীন হুগলী বন্দরে তারা প্রথম কুঠি (ফ্যাক্টরী) বসিয়েছিল। তখন শাহজাহানের আমল। আওরঙ্গজেবের আমলে মাদ্রাজ ও বোম্বাইয়ের মতো বাংলায় একটি নতুন দুর্গ তৈরি করে সেখান থেকে ব্যবসা চালাবার দাবি তুলে ইংরাজরা নিতান্ত মূর্খের মতো বিদ্রোহ করে বসল। তখন সারা ভারতবর্ষ জোড়া সাম্রাজ্যের অধীশ্বর মহামহিম বাদশাহ আলমগীরের নামে সবাই ভয়ে কাঁপে। হুগলীর ফৌজদার এক লহমায় ফ্যাক্টরী থেকে ইংরাজদের উৎখাত করলেন (১৬৮৬ খ্রীঃ)। চট্টগ্রাম বন্দর অবরোধ করতে এসে কায়দা করতে না পেরে নিস্ফল আক্রোশে ইংরাজরা সমুদ্র তীরবর্তী ছোট বন্দর বালেশ্বর জ্বালিয়ে দিল। হুগলী থেকে পালিয়ে সমুদ্রের দিকে নেমে গিয়ে ইংরেজরা কিছুদিন সুতানটি গ্রাম এবং তারপর হিজলী বন্দরে আস্তানা গাড়ল, কিন্তু মোগল প্রতাপে ও জ্বরের প্রকোপে কোনো জায়গায় টিকতে পারল না। বাংলার সুবাহ্‌দার দেখলেন এরকম লড়াই চললে বাণিজ্যের সমূহ ক্ষতি হবে। তাই তিনিই শেষ পর্যন্ত ইংরাজদের ডেকে ফিরিয়ে এনে ১৬৯০ খ্রীস্টাব্দে সুতানটি গ্রামে ফ্যাক্টরী গড়তে দিলেন। শোভা সিংহের বিদ্রোহের সময় সেখানে ইংরাজরা কেল্লা বানিয়ে তার দু বছর বাদে (১৮৯৮) সুতানটি, গোবিন্দপুর ও কলকাতা এই তিন মৌজার বন্দোবস্ত নিয়ে দিল্লী ও ঢাকার অলক্ষ্যে একটি নতুন ক্ষমতার কেন্দ্র গড়ে তুলতে সক্ষম হল। সে জায়গা সুন্দরবনের সন্নিহিত বাদা অঞ্চল। মোগল সওয়ার বাহিনীর প্রতাপ হুগলী পর্যন্ত অটুট থাকলেও অত দক্ষিণে সওয়ারদের বেগ ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়ে যেত। কুঠি ও দুর্গের পাশ দিয়ে প্রবাহিত গঙ্গাপথে সমুদ্রের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ ছিল এবং আস্তে আস্তে সমুদ্রের উপর ইংরাজ নৌবহরের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হলে পর ঐ নিম্ন জলাভূমি বেষ্টিত দুর্গ রীতিমতো শক্ত ঘাঁটি হয়ে উঠল।

কিন্তু এতে ইংরেজদের সন্তুষ্টি হল না। তারা চাইছিল ঐ সমস্ত বাদা অঞ্চলটাই তাদের জমিদারী হোক। নবাবরা কেন তা হতে দেবেন? অতএব কোম্পানির কর্তারা ঘোড়া ডিঙিয়ে ঘাস খাবার মতলব আঁটলেন। সারম্যান সাহেব দিল্লীতে দূত হয়ে গিয়ে সেখান থেকে বাদশাহী ফারমানে চব্বিশ পরগনা অঞ্চলের আটত্রিশখানা গ্রামের অধিকার লিখিয়ে নিয়ে এলেন। নিষ্কর বাণিজ্যের অধিকারও আদায় হল। নবাব জাফর খান এতে বিশেষ বিরক্ত হলেন। বিনা মাশুলে সওদা করতে দেবো না একথা বলার এক্তিয়ার তাঁর ছিল না। মোগল বাদশাহ তাঁর প্রভু, বাদশাহী ফারমান তিনি অগ্রাহ্য করতে পারেন না। কিন্তু বাদা অঞ্চলের জমিদারী যাতে ইংরেজদের হাতে না গিয়ে পড়ে সেই ব্যবস্থা তাঁর কর্মচারীরা করে দিল। সে অঞ্চলে ইংরেজদের তালুক ছাড়াও আরো অনেক ছোট ছোট ভূস্বামীর তালুক ছিল। তারা নবাবের কর্মচারীদের প্ররোচনায় কেউই ক্ষতিপূরণ নিয়ে উঠে যেতে রাজি হল না। ছোট তালুকদারদের অধিকারের ওজর তুলে নবাব সরকার ইংরেজ কোম্পানিকে বাদশাহী দরবারে মোটা ঘুষ দিয়ে আদায় করা হক থেকে বঞ্চিত করলেন।১১৯ পলাশীর যুদ্ধের আগে পর্যন্ত এই অঞ্চল আর ইংরেজদের হাতে এল না। ইতিমধ্যে কলকাতা সুতানটি ও গোবিন্দপুর মৌজাই তাদের ক্ষমতা ও সমৃদ্ধি বর্ধনের পক্ষে যথেষ্ট হল। অষ্টাদশ শতকের গোড়ায় কলকাতাতে পনের হাজারের বেশি লোক ছিল না। বর্গি হাঙ্গামার সময় সেখানে বহু লোক পালিয়ে আসায় জনসংখ্যা বেড়ে এক লক্ষের কাছাকাছি গিয়ে দাঁড়াল—‘মারাঠা ডিচ’ কেটে ঐ সুযোগে ইংরেজরা ঘাঁটি শক্ত করে নিল। নবাব আলিবর্দি খান দেখলেন, নবার সরকারের হাত থেকে পালিয়ে বেশ কিছু লোক কলকাতায় আশ্রয় নিচ্ছে। ১৭৫১ খ্রীস্টাব্দের একটি নবাবী পরওয়ানাতে দেখা যায়—‘রামকৃষ্ণ শেঠ নামে কলকাতার এক মহাজন মুর্শিদাবাদের সায়ের চৌকিতে মাশুল না দিয়ে সওদার মাল নিয়ে গেছে—তাকে ধরে এনে এই চোপদারের সঙ্গে এখনই রাজধানীতে পাঠান হোক।১২০ বেওয়ারিশ মৃত লোকদের সম্পত্তি নিয়েও খিটমিট লাগল। নবাব আলিবর্দির বক্তব্য, এ সব সম্পত্তি বিনা ওজরে নবাব দফতরে জমা করে দিতে হবে। ইংরাজরা নানা ওজর আপত্তি তুলতে লাগল। হাজী সলিন্‌স্‌ নামে একজন তুর্ক বেওয়ারিশ অবস্থায় মারা গেলে, কোম্পানি তাঁর সম্পত্তি দখল করল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত নবাবের চাপে পড়ে তার মূল্য হিসেবে পাঁচ হাজার টাকা ও সুদ হিসাবে পাঁচশো টাকা নবাব সরকারে পৌঁছে দিতে বাধ্য হল।১২১

১৭৫০ খ্রীস্টাব্দে কলকাতার খাজনা দ্বিগুণ করে দেবেন এই প্রতিশ্রুতি দিয়ে প্রসিদ্ধ মিথ্যাবাদী হলওয়েল কোম্পানি কর্তৃক কলকাতার ‘চিরন্তন জমিদার’ (Perpetual Zaminder) নিযুক্ত হয়ে এলেন। তাঁর অত্যাচারে চার দিকে ত্রাহি ত্রাহি রব উঠল। চাষের জমির অভাবে কলকাতার খাজনা প্রধানত, কয়েকটি পণ্যের ইজারা, কাছারির জরিমানা ও ইৎলাক থেকে আসত। এ সবের পরিমাণ হু হু করে বেড়ে গেল। সমস্ত দেশীয় বণিকদের মেয়র কোর্টের এক্তিয়ার থেকে সরিয়ে জমিদারের কাছারীর আওতায় স্থাপন করা হল, কাছারী বিপুল বিক্রমে জরিমানা ও ইংলাক আদায় করতে লাগল। ইংলাকের প্রকোপ ছিল সবচেয়ে ভয়াবহ। যার উপরে কাছারীতে হাজির হবার পরোয়ানা জারি হত তার উপরে তৎক্ষণাৎ পিয়ন বসত এবং মামলার নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত পিয়নের খরচ বাবদ সে লোককে ইৎলাক বা ব্যয়ভার বহন করতে হত। কাছারীতে এক এক সময় ১৫০০ মামলা ঝুলে থাকত। আর ঐ সব লোক মাসের পর মাস পিয়নের ভরণ-পোষণের খরচ এবং সেই পরিমাণে কোম্পানির খরচ বাবদ মোটা টাকা গুণে দিত। হলওয়েল চুরি ডাকাতির জন্য শারীরিক শাস্তি কমিয়ে দিয়ে তার বদলে জরিমানা প্রবর্তন করেও খাজনার পরিমাণ অনেক বাড়িয়ে তুলেছিলেন, এবং বেশ্যাদের লাইসেন্স দিয়ে কলকাতায় বসতি করিয়ে সেই খাতে নতুন উপার্জনের উপায় উদ্ভাবন করেছিলেন।১২২

১৭৫৭ খ্রীস্টাব্দে রাষ্ট্রবিপ্লবের ফলে ইংরাজরা কলকাতার পাশ্ববর্তী ২৪ পরগনার জমিদারী হতে পেল। হুগলী নদীর পূর্বপারে প্রধানত ফোর্ট উইলিয়ামের দক্ষিণে এই জমিদারী বিস্তৃত ছিল। এর আয়তন ৮৮২ বর্গমাইল।১২৩ ইংরাজদের তখনো বিশ্বাস হয়নি তারা সমগ্র হিন্দুস্তানের মালিক হতে চলেছে, তাই কি করে কলকাতা ও চব্বিশ পরগনার উপর তাদের অধিকার আইন মাফিক চিরতরে কায়েম করা যায় সেজন্য তারা নবাব ও বাদশাহ্‌র কাছ থেকে জমির উপর স্বীকৃত ভিন্ন ভিন্ন স্বত্বগুলির সব কটির জন্য আলাদা আলাদা পরোয়ানা আদায়ে তৎপর হল। ১৭৫৮ খ্রীস্টাব্দে দেওয়ানী সনদের বলে কলকাতার বন্দর, শহর ও দুর্গ এলাকা কোম্পানির লাখেরাজ জমি বলে নির্দিষ্ট হল। দেওয়ানী সনদ বলে প্রাপ্ত ২৪ পরগনার জমিদারী পরে বাদশাহী ফারমান দ্বারা কোম্পানির ‘আল তামগা’ বা চিরকালীন সম্পত্তি বলে ঘোষিত হল। এতেও কো পানির ভয় ভাঙল না, কারণ জমিদারকে সরকারে খাজনা দিতে হয়, এবং সেই হিসেবে তাদের জমিদারী হয় খালসা বিভাগের নয় কোনো জাগীরদারের অধীন থেকে যেতে বাধ্য। অতএব ক্লাইভকে ১৭৫৯ খ্রীস্টাব্দে ২৪ পরগনার জায়গীরদার নিয়োগ করে নবাব সরকার কোম্পানিকে হুকুম দিলেন তাঁরা যেন এখন থেকে নবনিযুক্ত জায়গীরদারকে বছর বছর খাজনা জমা দিয়ে যান। ক্লাইভের জায়গীরের মেয়াদ শেষ হয়ে যাবার পর বাদশাহী ফারমানের বলে ইংরাজ ঈস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানি চিরতরে একই জায়গায় জায়গীরদার এবং জমিদার হয়ে বসল, এবং ঐ জায়গীর-জমিদারীর মধ্যেই কলকাতা শহর তাদের লাখেরাজ রূপে নির্দিষ্ট রইল।১২৪

৭। বন বিষ্ণুপুর—জমা ১,২৯,৮০৩ (মোগল শাসন বহির্ভূত, পরগনা বিভাগহীন)।

বন বিষ্ণুপুরের মল্ল রাজারা মুর্শিদকুলী ও আলিবর্দির সমসাময়িক গোপাল সিংহ পর্যন্ত ৫৫ পুরুষ ধরে রাজত্ব করেছিলেন বলে তাঁদের বংশাবলীতে উল্লেখ আছে। গোপাল সিংহের পুত্র চৈতন্য সিংহের রাজত্বকালে ইংরাজদের সূর্যাস্ত আইনে এই প্রাচীন রাজ্য ধ্বংস হয়ে যায়। হান্টারের পণ্ডিত নবীন চন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় বাঁকুড়া কালেক্টরীতে গোপাল সিংহ লিখিত একটি ইতিহাস পেয়েছিলেন বলে উল্লেখ করেছেন এবং সেই অনুযায়ী তিনি বিষ্ণুপুরের কাহিনী রচনা করেন। এই কাহিনী মতে বিষ্ণুপুর বংশের প্রতিষ্ঠাতা রঘুনাথ ক্ষত্রিয়কুলোদ্ভব রাজকুমার হলেও বাগদীদের মধ্যে মানুষ হয়েছিলেন। পরবর্তীকালে তাঁর বংশধররা দেবদ্বিজ প্রতিপালক বৈষ্ণব ধর্মাবলম্বী ক্ষত্রিয় রাজন্য রূপে প্রতিষ্ঠা লাভ করেন। কিন্তু লোকের কাছে তাঁদের ‘বাগদীরাজা’ পরিচয়টি ঘুচে যায়নি। বিষ্ণুপুর বংশাবলীতে দেখা যায় ৫১তম পুরুষ রঘুনাথ সিংহ (১৬২৬—১৬৫৬ খ্রীঃ) প্রথম ‘সিংহ’ উপাধি ধারণ করে রাজত্ব করেন—তাঁর পূর্বপুরুষদের সকলের উপাধি ছিল ‘মল্ল’। রঘুনাথ সিংহ সম্বন্ধেও তাঁর পুত্র বীরসিংহ লালজীর মন্দিরে উৎকীর্ণ শিলালিপিতে বলেছেন—‘মল্লাধিপঃ শ্রীরঘুনাথ সূনুর্দদৌ নৃপঃ শ্ৰীযুতবীরসিংহঃ’। মাল, বাগদী, সাঁওতাল ইত্যাদি আদিবাসীদের প্রধান রূপে উদিত হয়ে এঁরা পরে বিভিন্ন ক্ষত্রিয় বংশের সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন করেন—পণ্ডিতের কাহিনীতে বার বার এইসব উচ্চবর্ণে আদান-প্রদান উল্লিখিত হয়েছে।১২৫ বিষ্ণুপুরের রাজবাড়িতে যে ইন্দ্রপূজা প্রচলিত আছে তাতে চারপাশ থেকে বহু সাঁওতাল এসে সমবেত হয়, কারণ প্রবাদ অনুসারে তাদের সাহায্যে এঁরা প্রদ্যুম্নপুরের ভূতপূর্ব রাজাকে উৎখাত করে রাজ্যলাভ করেছিলেন এবং পরে সেখান থেকে বিষ্ণুপুরে রাজধানী সরিয়ে নিয়ে গেছিলেন। বিষ্ণুপুরে একটি মল্লাব্দ প্রচলিত আছে—বলা হয় আদি পুরুষ রঘুনাথের রাজত্ব লাভ থেকে এর শুরু। বংশাবলীতে ইনি আদি মল্ল নামে উল্লিখিত হয়েছেন এবং মল্লাব্দ অনুসারে তিনি ৬৯৪ খ্রীস্টাব্দে রাজা হয়েছিলেন। আদি মল্ল, তৎপুত্র জয় মল্ল এবং অধস্তন উনবিংশ পুরুষ জগৎ মল্ল (৯৯৭—১০০৭ খ্রীঃ), এই তিন জনের প্রত্যেকেই প্রদ্যুস্মপুর থেকে বিষ্ণুপুরে রাজধানী স্থানান্তর করেছিলেন বলে জনশ্রুতি আছে। কিন্তু প্রত্নতত্ত্বে চৌদ্দ শতকের আগে বিষ্ণুপুরের অস্তিত্বের কোনো প্রমাণ মেলে না। বিষ্ণুপুরের চার মাইল উত্তরে একটি প্রাচীন মন্দির আছে, তাতে কোনো শিলালিপি না থাকলেও স্থানীয় ঐতিহ্য অনুযায়ী ঐ ষন্তেশ্বর মন্দির পৃথ্বী মল্ল কর্তৃক ৬৪১ মল্লাব্দে নির্মিত হয়। কিন্তু এতেও সন্দেহ আছে—বংশাবলী অনুযায়ী ৩৭তম পুরুষ পৃথ্বী মগ্ন ৬০১—৬২৫ মল্লাব্দ ১৩১৯—১৩৩৪) পর্যন্ত রাজত্ব করেন এবং ৬৪১ মল্লাব্দে দীনবন্ধু মল্ল রাজা ছিলেন।১২৬ জনশ্রুতির উপর আস্থা রাখা চলে না এবং বংশাবলীর গোড়ার দিকটাও বানানো বলে জেমস গ্রান্ট সন্দেহ প্রকাশ করেছেন।

বংশাবলীর ৪৯তম পুরুষ বীর হাম্বিরকে প্রথম ইতিহাসের আলোতে দেখা যায়, কারণ তাঁর রাজত্বে (১৫৮৭—১৬২০) শ্রীচৈতন্য প্রচলিত গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্মের জোয়ারে বন বিষ্ণুপুর প্লাবিত হয়। সমসাময়িক ‘প্রেমবিলাসে’ ঐ ঘটনার প্রামাণ্য বিবরণ আছে। চৈতন্যের মৃত্যুর পর বৃন্দাবনের গোস্বামীর গৌড়দেশে বৈষ্ণব ধর্ম প্রচারের জন্য শ্রীনিবাসের সঙ্গে গাড়ি ভর্তি ১২১ খানি অমূল্য ভক্তিগ্রস্থ পাঠিয়েছিলেন। ঝাড়খণ্ডের সুগভীর নয়নাভিরাম কান্তার অতিক্রম করে বৃন্দাবনের তিন সন্ন্যাসী ছয়জন সশস্ত্র ব্রজবাসীর সঙ্গে গাড়ি বোঝাই পুঁথি নিয়ে ১৫৮৭ খ্রীস্টাব্দে বিষ্ণুপুর রাজ্যে এসে পড়লেন। তাঁরা জানতেন না সেখানকার রাজা বীর হাম্বির একজন ডাকাত। মালের সন্ধান সুলুক নেবার জন্য রাজার গুপ্তচররা পথের উপর দাঁড়িয়ে দেখছিল—ঐ গাড়িতে কি আছে তাদের এই প্রশ্নের উত্তরে একজন সন্ন্যাসী ভক্তি গদ গদ সুরে বললেন ‘রত্ন’। পথশ্রমে ক্লান্ত হয়ে ব্রজবাসীরা রাত্রে ঘুমিয়ে পড়েছেন। এমন সময় দুইশো ডাকাত রাহাজানি করে গাড়িসুদ্ধ চম্পট দিল। ঐ অমূল্য রত্নের শোকে শ্রীনিবার পাগলের মতো পথে পথে দীন মলিন বেশে ঘুরে বেড়াতে লাগলেন। পথে এক সুন্দর ব্রাহ্মণ কুমারের সঙ্গে দেখা হতে সন্ন্যাসী তাঁর কাছে জানতে চাইলেন:

কহ দেখি কেবা রাজা কি নাম হয়।
ধার্মিক কি অন্য মন তাঁহার আশয়॥
তিঁহো কহে রাজা হয় বড় দুরাচার।
দস্যুবৃত্তি করে সদা অত্যন্ত দুর্ব্বার॥
ধরে কাটে ধন লুটে নাচলে ঘাট বাট।
বীর হাম্বির নাম রাজার মল্লপাট॥১২৭

বীর হাষির অনেক ধন লাভের আশায় সে রাত্রে ঘুমাননি—তাঁর জ্যোতিষী গণনা করে বলেছিলেন তাঁর গাড়ি বোঝাই রত্ন প্রাপ্তি হবে। বাক্স খুলে ডাকাত রাজা প্রথমেই দেখলেন মুক্তার মতো অক্ষরে লেখা সারি সারি পুঁথি। জ্যোতিষীকে ডেকে বললেন—‘এই তোমার ভবিষ্যদ বাণী।’ লজ্জায় জ্যোতিষী চুপ করে রইলেন। রাজা বললেন—‘রত্ন বই কি। যে জহরৎ চেনে তার কাছে এগুলো রত্ন বটে।’ গুপ্তচরকে তিনি জিজ্ঞাসা করলেন—‘কোন্‌ সাধু কোন্ পণ্ডিতের আজীবন সাধনার ফল নিয়ে এসেছো তোমরা? তাঁদের উপর তো কোনো অত্যাচার হয়নি? আমার বোধ হচ্ছে তাঁদের নিঃশ্বাসে আমার রাজপ্রাসাদ দগ্ধ হয়ে যাবে।’ গুপ্তচরেরা জানাল, নিরীহ সাধুদের উপর তারা কোনোও অত্যাচার করেনি, বাক্স কৌশলে হস্তগত হয়েছে। অনুতপ্ত হৃদয়ে রাজা চুপ করে বসে রইলেন। রানী সুদক্ষিণা তাঁকে অন্তঃপুরে নিয়ে গেলেন।১২৮

রাজার সভায় ভাগবত পাঠ হত। ব্রাহ্মণ কুমারের সঙ্গে সন্ন্যাসী শ্রীনিবাস সেখানে এলেন। সেদিন পণ্ডিত ‘রাস পঞ্চাধ্যায়ী’ পাঠ করেছিলেন। শ্রীনিবাস দেখলেন পণ্ডিত রাস পঞ্চাধ্যায়ীর অর্থ কিছুই জানেন না, অধীর হয়ে বললেন—‘ব্যাস ভাষিত এই গ্রন্থ ভাগবত। শ্রীধর স্বামীর টীকা আছয়ে সম্মত ॥’ রাজা পণ্ডিতকে জিজ্ঞাসা করলেন—‘কি বা অর্থ কর, ব্রাহ্মণ কেন বা দোষয়?’ পণ্ডিত শ্রীধর স্বামীর টীকার ধার ধারতেন না, রুষ্ট হয়ে তিনি বললেন—‘কোথাকার ক্ষুদ্র বিপ্র, মধ্যে কহে কথা।’ রাজা তাতে কর্ণপাত না করে শ্রীনিবাসকে ভাগবতের ব্যাখ্যা করতে আদেশ করলেন। শ্রীমুখের অর্থ শুষে পাষাণ হৃদয় গলে গেল, রাজা আপন মাথায় হাত দিয়ে কাঁদতে লাগলেন। রাজা তাঁর পরিচয় জিজ্ঞাসা করতে শ্রীনিবাস বৃন্দাবন থেকে তাঁর আগমন বার্তা জানিয়ে হৃত পুঁথির জন্য খেদ করতে করতে বললেন গোস্বামীদের এই গচ্ছিত রত্ন উদ্ধার না হলে তাঁর মৃত্যুই শ্রেয়।

রাজা কহে বহু ভাগ্য বংশের আমার।
এই দেশে আগমন হৈল যে তোমার॥
চুরি না করিলে নহে তোমার আগমন।
অধমেরে কৃপা করে কে আছে এমন॥
যেমত গাড়ি সব তেমত আছয়।
উচিত যে শাস্তি হয় কর মহাশয়॥
আমার উদ্ধার লাগি তোমার আগমন।
আমা হেন মহাপাপী নাহি কোনজন॥
ইহা বলি কাঁদে রাজা ভূমে গড়ি যায়।
সুবর্ণের প্রায় দেহ গড়াগড়ি যায়॥

আষাঢ় মাসের কৃষ্ণপক্ষে শ্রীনিবাস আচার্য রানী সহ রাজাকে শ্রীরূপ গোস্বামীর গ্রন্থ মতানুসারে মন্ত্রদীক্ষা দিলেন। বিষ্ণুপুরে বিরাট সমাজ বিপ্লবের সূচনা হল। আদিবাসী অধ্যুষিত জংলী ডাকাতের রাজ্য বৈষ্ণব ধর্মের মহিমায় ব্রাহ্মণ প্রধান ধর্ম রাজ্যে পরিণত হল। লুটপাট বন্ধ হয়ে ভক্তির জোয়ার বইল। শত বর্ষ পরে Abbc Raynal এ রাজ্যে এসে দেখেছিলেন—‘এখানে ডাকাতি বা রাহাজানির কথা শোনা যায় না। কোনো পরবাসী রাজ্যে আসা মাত্র এ রাজ্যের আইনের বলে তার নিরাপত্তা বিধান হয়। পথপ্রদর্শকরা তাকে বিনা খরচায় এক জায়গা থেকে আর এক জায়গায় নিয়ে যায় এবং তার ধন প্রাণ রক্ষার জন্য দায়ী থাকে। এক পথপ্রদর্শকের কাছ থেকে অন্য পথপ্রদর্শকের আওতায় যাবার সময় নতুন পথপ্রদর্শক আগের লোককে তার আচরণ সম্পর্কিত ছাড়পত্র দেয়—যা পরে ছাপ মেরে রাজার দরবারে পাঠানো হয়। তিন দিনের বেশি দেশে না থাকলে ঐ পর্যন্ত রাজ্যের খরচায় তাকে এবং তার মালগুলিকে পার করে দেওয়া হয়। কোনো গণ্ডগোল বা দুর্ঘটনায় আটকে না পড়লে তিন দিনের পরবর্তী খরচা পরদেশীকে বহন করতে হয়। দেশের প্রজারা পরস্পরের সাহায্য করে বলে পরবাসীও এই ভাবে উপকৃত হয়। পরস্পরের কোনো ক্ষতি যাতে না হয় এই জন্য কোনো থলি বা দামি জিনিস পেলেই এরা প্রথমে যে গাছ পায় তাতে তা ঝুলিয়ে রেখে নিকটতম চৌকিদারকে খবর দিয়ে দেয়, আর চৌকিদার ঢাক পিটিয়ে জনসাধারণকে সেই খবর জানিয়ে দেয়।১২৯

বীর হাম্বির প্রসিদ্ধ ভক্ত রূপে পরিচিত হয়ে বৃন্দাবনে তীর্থ করতে গিয়ে শ্রীজীব গোস্বামীর কাছ থেকে ‘চৈতন্যদাস’ নাম লাভ করেন। ১৬০৫ খ্রীস্টাব্দ নাগাদ খেতুরীতে গৌরাঙ্গ বিগ্রহ স্থাপনার মহোৎসবে উপস্থিত হয়ে তিনি শতবর্ষ প্রবীনা চৈতন্যজায়া বিষ্ণুপ্রিয়াকে সশরীরে দেখতে পেয়েছিলেন বলে শোনা যায়। তাঁর রচিত বহু গীতের মধ্যে দুইটি মাত্র নরহরি চক্রবর্তী ‘ভক্তিরত্নাকর’ গ্রন্থে সংকলিত করেছিলেন, তার একটি থেকে দস্যু রাজার ভাবান্তরের মর্মস্পর্শী পরিচয় পাওয়া যায়:

শুনগো মরম সখি কালিয়া কমল আঁখি
কিবা কৈল কিছুই না জানি।
কেমন করয়ে মন সব যেগো উচাটন
প্রেম করি খোয়াইনু পরানি॥
শুনিয়া দেখিনু কালা দেখিয়া পাইনু জ্বালা
নিবাইতে নাহি পায় পানি।
অগুরু চন্দন আনি দেহতে লেপিনু ছাপি
না নিবায় হিয়ার আগুনি॥
বসিয়া থাকিয়া যবে আসিয়া উঠায় তকে
লৈয়া যায় যমুনার তীর।
কি করিতে কি না করি সদাই ঝুরিয়া মরি
তিলেক নাহিক রহি ধীর॥
শাশুড়ী ননদী মোর সদাই বাসয়ে চোর
গৃহপতি ফিরিয়া না চায়।
এ বীর হাম্বির চিত্ত শ্রীনিবাস অনুগত

মজি গেলা কালচাঁদের পায়॥

দোল, রাস ইত্যাদি উৎসব বীর হাষির প্রথম বিষ্ণুপুরে প্রবর্তন করেন—তার আগে নিম্নবর্ণের মধ্যে বাগদী রামাই পণ্ডিত প্রবর্তিত ধর্মপূজার প্রাবল্য ছিল। বিষ্ণুপুরে যে অপূর্ব রাসমঞ্চ দেখে আজও অগণিত লোক মুগ্ধ হয়, তাতে কোনো শিলালিপি না থাকলেও স্থানীয় প্রবাদ অনুসারে তা বীর হাম্বির নির্মাণ করিয়েছিলেন। মুসলমান ধাঁচে তৈরি বিরাট দুর্গদ্বারগুলি এবং সুবৃহৎ দল মাদল কামান তাঁর আমলে সৃষ্ট হয়েছিল বলে অনুমিত হয়। সে সময় মোগল পাঠানের সংগ্রাম চলছে—বীর হাম্বির মোগল সেনাপতি মানসিংহের পক্ষ অবলম্বন করে তাঁর পুত্র জগৎসিংহকে পাঠানদের শিবির থেকে উদ্ধার করে নিরাপদে বিষ্ণুপুর নিয়ে এসেছিলেন বলে শোনা যায়।১৩০ দক্ষিণ রাঢ়ে বর্ধমান রাজ্যের উদয় হতে তখনো একশো বছর দেরি—বিষ্ণুপুর রাজ্য এ সময়ে আরো বহু দূর বিস্তৃত ছিল। বীর হাম্বিরের নিজের অধিকারে পনেরটি প্রধান দুর্গ ছিল এবং তাঁর অধীন বার জন রাজার আরো বারখানা দুর্গ ছিল।১৩১ পৌষ মাসের পূর্ণিমায় পুষ্য অভিষেক উৎসবে এই সামন্ত রাজারা এসে মল্লাধিপের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করতেন—যুদ্ধের সময় প্রয়োজন মতো সামরিক সাহায্যও করতেন। স্থানীয় কিম্বদন্তী এবং স্থানে স্থানে মন্দির ও দুর্গের অবশেষ বিচার করে অভয়পদ মল্লিক বগড়ি, সিমলাপাল, জামকুণ্ডী, রায়পুর, ইন্দাস, ছাতনা, মালিয়ারা, শূরভূম, চন্দ্রকোণা, গড়বেতা ইত্যাদি রাজ্যগুলি বিষ্ণুপুরের সামন্ত রাজ্য বলে উল্লেখ করেছেন—এগুলির কিছু কিছু বীর হাম্বিরের কালে বর্তমান ছিল, অন্যগুলি পরবর্তীকালে বিষ্ণুপুর বংশীয় আত্মীয় পুরুষরা স্থাপন করেছিলেন। বীর হাম্বিরের পিতা ধাড়ি মল্পের সময় থেকে বিষ্ণুপুরের রাজারা এক লক্ষ সাত হাজার টাকার পেশকাশ দিয়ে পাঠান সুলতানদের বশ্যতা স্বীকার করেছিলেন। বীর হাম্বির মাঝে মাঝে মোগল বা পাঠানদের পেশকাশ দিলেও একরকম স্বাধীন নরপতিই ছিলেন বলতে হবে। বৈষ্ণব হবার পর তাঁর চৌর্য বৃত্তি এক অভিনব খাতে প্রবাহিত হয়। বীরভূমের এক ধরণী ব্রাহ্মণের ঘর থেকে এক মনোমুগ্ধকর মদনমোহন বিগ্রহ চুরি করে এনে তিনি সেটি পারিবারিক বিগ্রহরূপে প্রতিষ্ঠা করেন। ‘মদনমোহন বন্দনা’ কবিতায় দেখা যায়, কাঁদতে কাঁদতে বিগ্রহের গায়ের গন্ধ চিনে সেই ব্রাহ্মণ ঠিক যেখানে বিগ্রহ লুকানো ছিল সেখানে উপস্থিত হলে, ব্রহ্মহত্যার ভয়ে রাজা তাঁর সামনে বিগ্রহ উপস্থিত করলেন। সাড়ম্বর পূজা দেখে ব্রাহ্মণের তৃপ্তি হল না:

ছিলিরে দুঃখীর ঘরে এলি রাজার পাশ।
চালচলন ফিরে গেল পেয়ে এলে বাস॥
কৈ সে চূড়া ধড়া কৈ মোহন বাঁশী।
এ বেশ তো নয় যাহা দেখতে ভালবাসি॥
জানিরে তোর ধারা তোরে বলা লে বৃথা।
মা বাপে কাঁদান তোর চিরকালের প্রথা॥

তারপর অনাগত ভবিষ্যতে পুনরপি বিগ্রহ হস্তান্তর ও রাজ্য বিপর্যয়ের ইঙ্গিত করে ব্রাহ্মণ বিদায় হলেন:

মল্লরাজের সময় ভাল, হইলে সদয়।
সময় গেলে কবে তারে দেখ কাঁদতে হয়॥১৩২

কিন্তু বিগ্রহ বাঁধা দেবার মতো দুঃসময়ের আরো দেড়শো বছর দেরি ছিল। মদনমোহনের কৃপায় বিষ্ণুপুর রাজ্যের উত্তরোত্তর শ্রীবৃদ্ধি হতে লাগল। বীর হাম্বিরের জ্যেষ্ঠ পুত্র ধাড়ি হাম্বিরকে সিংহাসন চ্যুত করে রঘুনাথ সিংহ (১৬২৬—১৬৫৬) রাজা হন। তিনি বিষ্ণুপুরকে নতুন সাজে সাজালেন। পাঁচটি বড়ো বড়ো বাঁধ, একটি প্রস্তর নির্মিত রথ, তিনটি পোড়ামাটির মন্দির নির্মিত হল। কথিত আছে শাহ সুজা—যিনি তাঁকে রাজমহলে আটকে রেখে বহু দিনের বাকি পেশকাশ আদায় করেছিলেন—তাঁর আচরণে সন্তুষ্ট হয়ে মল্ল নামের পরিবর্তে সিংহ উপাধি প্রদান করে বিষ্ণুপুর রাজাদের ক্ষত্রিয়ত্বের দাবি সুপ্রতিষ্ঠিত করে দেন। রঘুনাথ সিংহের পুত্র বীরসিংহ (১৬৫৫—১৬৮২) অতি বড়ো পাষণ্ড ছিলেন। প্রহ্লাদকুলে দৈত্যের মতো ভ্রাতৃহত্যা, পুত্রনিধন, ব্রহ্মোত্তর আত্মসাৎ প্রাচীরের মধ্যে গেঁথে প্রজাহত্যা, খণ্ড খণ্ড করে বিদ্রোহীর দেহ বিভাজন ইত্যাদি কর্ম করে তিনি ক্ষত্রিয়জনোচিত পরাক্রম প্রকাশ করেছিলেন। মদনমোহন এই বৈষ্ণবকুল কলঙ্কের জন্য কোনো শাস্তি বিধান না করে এঁর নিরীহ প্রপৌত্র চৈতন্য সিংহকে ত্যাগ করে বাগবাজারে গোকুল মিত্রের বাড়ি চলে যান। দৈবক্রমে বীর সিংহের তিন কুমারের একজন ঘাতকের হাত থেকে বেঁচে গিয়েছিলেন ইনি দুর্জন সিংহ (১৬৮২—১৭০২)। মদনমোহনের জন্য এ পর্যন্ত কোনো মন্দির ছিল না—তিনি মন্দির নির্মাণ করে তাতে ভক্তিভরে বিগ্রহ স্থাপন করেন। এর আমলে রাজ্যের দক্ষিণ প্রান্তে শোভা সিংহের বিদ্রোহ শুরু হয়—কথিত আছে যুবরাজ রঘুনাথ সিংহ১৩৩ এই বিদ্রোহ দমনে মোগলদের বিশেষ ভাবে সাহায্য করে নিহত শোভা সিংহের কন্যা চন্দ্রপ্রভাকে জ্যেষ্ঠা মহিষীরূপে নিয়ে আসেন। বলা হয় সেই সঙ্গে বিদ্রোহীদের শিবির থেকে রঘুনাথ সিংহ মুসলমান নর্তকী লালবাইকেও বিষ্ণুপুরে নিয়ে আসেন। কারো কারো ধারণা শোভা সিংহের মৃত্যুর পর যিনি বিদ্রোহীদের নায়ক হন সেই পাঠান সেনাপতি রহিম খানের বিবি ছিলেন এই লালবাই।

বর্ধমানের কীর্তিচন্দ এবং দ্বিতীয় রঘুনাথ সিংহ একই বছর (১৭০২) রাজা হন। দ্বিতীয় রঘুনাথ সিংহ যতদিন জীবিত ছিলেন, ততদিন বিষ্ণুপুর আক্রমণ করে মহারাজ কীর্তিচন্দ তেমন কায়দা করতে পারেননি। অস্বাভাবিক ভাবে ১৭১২ খ্রীস্টাব্দে রঘুনাথ সিংহের মৃত্যু হয়। লালবাইয়ের নাম অনুসারে লালবাঁধ নামে এক বিস্তীর্ণ জলাশয় সৃষ্টি করে তিনি তার পারে উপপত্নীর জন্য এক মনোরম আবাস তৈরি করিয়েছিলেন। তিনি এখানেই পড়ে থাকতেন। ক্ষত্রিয় বীরচূড়ামণি মুসলমান রক্ষিতার সঙ্গে মুসলমানী খানা খেতেন। পাটরানীর গর্ভজ যুবরাজ গোপাল সিংহ তখন সবে কৈশোরে পদার্পণ করেছেন। হঠাৎ খবর রটে গেল লালবাইয়ের পীড়াপীড়িতে রাজা নিজে মুসলমান হতে রাজি হয়ে রাজ্যসুদ্ধ লোককে ধর্মান্তরিত করবার সঙ্কল্প নিয়েছেন। বিষ্ণুপুরের শ্মশানঘাটের কাছে নতুন মহলের পশ্চিম কোণে যে জায়গা এখনো ভোজনতলা বলে নির্দেশ করা হয় সেখানে হাজার লোককে খানা খাইয়ে জাতিনাশের সুবৃহৎ আয়োজন হল। রাজ্যময় প্রজারা হাহাকার করতে লাগল। যুবরাজ গোপাল সিংহ ও মন্ত্রীদের সঙ্গে পরামর্শ করে প্রধানা মহিষী আগে থেকেই কর্তব্য কর্ম স্থির করে রেখেছিলেন। লালবাইয়ের তত্ত্বাবধানে খানা পরিবেশনের আয়োজন চলছে, এমন সময় মহারাজ্ঞীর এক বাণে রাজার বক্ষ বিদীর্ণ হয়ে গেল। লোহার জিঞ্জির পরিয়ে লালবাইকে লালবাঁধে সলিল সমাধি দেওয়া হল। ১৮৯৬ খ্রীস্টাব্দে সেই দীঘি থেকে একটি নরকঙ্কাল এবং কতকগুলি ভাঙা মুসলমানী ভোজন পাত্র তোলা হয়েছিল। জনতার আক্রোশে লালবাইয়ের অট্টালিকা চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হল। মহারাজ্ঞী পতিবধ করে নিহত রাজার চিতায় আরোহণ করলেন। শ্যামবাঁধের পশ্চিমে ঐ সতীকুণ্ড দেখিয়ে আজও লোকে বলে—‘পতিঘাতিনী সতী।’

পরম বৈষ্ণব গোপাল সিংহ (১৭১২—১৭৪৮) পিতৃহত্যার ষড়যন্ত্রে গভীর ভাবে লিপ্ত ছিলেন। মহারাজ কীর্তিচন্দ এইবার সুযোগ পেলেন। বিষ্ণুপুরের সামন্ত রাজ্যগুলি—যা থেকে এত দিন নব দরবারে পেশকাশ ছাড়া কিছু যেত না—বন বিষ্ণুপুরের এক্তিয়ার চ্যুত হয়ে বর্ধমানের আওতায় মুর্শিদকুলী খানের নতুন জমা বন্দোবস্তের অন্তর্গত হতে লাগল। বন বিষ্ণুপুর রাজ্যও আর কেবল পেশকাশ দেওয়া রাজ্য রইল না—১৭১৫ খ্রীস্টাব্দে দেওয়ানী সনদ দ্বারা গোপাল সিংহকে জমিদার নিযুক্ত করে নবাব জাফর খান আরো সাত বছর পরে বিষ্ণুপুর ইহমামটিকে দুটি পরগনায় ভাগ করে জমাবন্দী করলেন।১৩৪ কিন্তু এতে কার্যত বন বিষ্ণুপুরের স্বাধীনতা খুব একটা খর্ব হল না। আবে রাইনল গোপাল সিংহের আমলে বন বিষ্ণুপুর পর্যটন করে দেখেছিলেন, রাজা নবাবকে যখন যতখানি ইচ্ছা সেই মতো খাজনা দেন। সুজাউদ্দিন খানের আমলে এ রাজ্য বশে আনার চেষ্টা হয়েছিল, কিন্তু হলওয়েলের অতিরঞ্জিত বিবরণ অনুযায়ী বাঁধগুলি খুলে দিয়ে গোপাল সিংহ জল প্লাবনের দ্বারা নবাবী ফৌজের প্রতিরোধ করেছিলেন।১৩৫ আবে রাইনলের চোখে বন বিষ্ণুপুর সত্যযুগের আদর্শের মতো ঠেকেছিল। এখানে রক্তপাত নেই, হানাহানি নেই, এখানকার অধিবাসীরা তাদের আদ্যিকালের সুখ শান্তি এবং চরিত্রের মাধুর্য বজায় রেখেছে বলে তাঁর মনে হয়েছিল। দেশের লোকের ধারণা এতখানি স্বপ্ন-ঘেঁষা ছিল না। কথায় বলে ‘গোপাল সিংহের বেগার’। রাজার হুকুম ছিল সায়ং সন্ধ্যা কৃষ্ণের নাম জপ করতে হবে, রাজার গুপ্তচরের ভয়ে রাজ্যের লোক সেই আদেশ খুব প্রকাশ্য ভাবে পালন করত। মদনমোহন এই বেগারের ব্যবস্থায় রাজার উপর বিশেষ প্রীত হয়েছিলেন বলে শোনা যায়, কারণ বর্গি আক্রান্ত হয়ে রাজা যখন যুদ্ধ থেকে বিরত হয়ে গড়সুদ্ধ লোককে হরিনাম সঙ্কীর্তনের আদেশ দিয়েছিলেন (রাজা বলে শুন বাছা বলিরে বচন। আত্য কি আর আছে, আছেন মদনমোহন॥ সত্বরে ঘোষণা দাও প্রতি ঘরে ঘরে। হরিনাম সঙ্কীর্তন করুক উচ্চৈঃ স্বরে ॥হস্ত হৈতে অস্ত্র রাজা দূরে নিক্ষেপিল। ‘হরি হরি বল’ বলে নাচিতে লাগিল ॥), তখন স্বয়ং মদনমোহন নাকি দলমাদল কামান দেগে বর্গি বিতাড়ন করেছিলেন।

১৭৪৮ খ্রীস্টাব্দে বিষ্ণুপুরের শেষ নরপতি হতভাগ্য চৈতন্য সিংহ রাজা হলেন। বর্গিরা ক্ষান্ত হলেও তাঁর রাজ্যে এক নতুন উপদ্রব শুরু হল। গোপাল সিংহের আর এক নাতি দামোদর সিংহ সিংহাসনের দাবি এনে গৃহবিবাদ শুরু করলেন। সমস্ত জীবন চৈতন্য সিংহ গৃহবিবাদে বিপর্যস্ত হয়েছিলেন এবং এই সূত্রেই মদনমোহন বিগ্রহ হাতছাড়া হয়ে শেষে কলকাতার মহাজনের কাছে বাঁধা পড়ে। গৃহবিবাদের ফলে মুর্শিদাবাদের নবাব এতদিনে বন বিষ্ণুপুরের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করবার সুযোগ পেলেন। ইংরেজদের সমসাময়িক চিঠিপত্রে দেখা যায়, কলকাতা ও পূর্ণিয়া জয়ের পর নবাব সিরাজউদ্দৌলাহ্‌ বন বিষ্ণুপুরের বিরুদ্ধে অভিযান পাঠানোর তোড়জোড় করছেন বলে জোর গুজব রটেছে। তার পর কি হল, সংবাদদাতা ডাক্তার ফোর্থ ফলতায় সিলেক্ট কমিটির কাছে আর জানাননি।১৩৭ কিন্তু স্থানীয় কাহিনী এই যে নবাবী ফৌজ নিয়ে দামোদর সিংহ বন বিষ্ণুপুরে চড়াও হয়েছিলেন। সে যাত্রায় রাজ্যের উত্তর সীমায় দামোদর নদীর তীরে যুদ্ধ করে বন বিষ্ণুপুরের সেনাপতি কমল বিশ্বাস হামলা আটকাতে সমর্থ হন। দামোদর সিংহ কোনোমতে প্রাণ হাতে করে পালালেও বিবাদের ভঞ্জন এতে হয়নি তার প্রমাণ পরে পাওয়া গিয়েছিল।১৩৮

চৈতন্য সিংহের আমলে রাধাশ্যাম মন্দির নির্মিত হবার সঙ্গে সঙ্গে বিষ্ণুপুরের অদ্বিতীয় মন্দির স্থাপত্য কলার ধারা শেষ হয়ে যায়। রাজ পরিবারের ব্যয়ে মোট বারোটি প্রধান পোড়ামাটির মন্দির এই পর্যন্ত নির্মিত হয়েছিল—(১) মল্লশ্বর (‘বসুকরনবগণিতে) মল্লশকে শ্ৰীবীরসিংহেন। অতিললিতং দেবকুলং নিহিতং শিবপাদপদ্মেষু ॥’ বসু = ৮, কর ২ নব = ৯, অথাৎ মল্লাব্দ ৮২৯ বা খ্রীষ্টাব্দ ১৫২৩, কিম্বা অঙ্কের বামগতিতে মল্লাব্দ ৯২৮ বা খ্রীস্টাব্দ ১৬২২। বংশাবলী অনুযায়ী ৮২৯ মল্লাব্দে রাজা বীর মল্ল এবং ৯২৮ মল্লাব্দে রাজা ধাড়ি হাম্বির।১৩৯ যেহেতু বীর হাম্বির পুত্র ধাড়ি হাম্বির বৈষ্ণব, অতএব এই শিব মন্দির ‘বীরসিংহ’ উপাধিতে বীর মল্ল নির্মাণ করেছিলেন ধরা চলে); (২) শ্যামরায় (বীর হাম্বির পুত্র রঘুনাথ সিংহ, ১৬৪২ খ্রীঃ); (৩) জোড়া বাংলা (ঘুনাথ সিংহ, ১৬৫৫); (৪), কালাচাঁদ (রঘুনাথ সিংহ, ১৬৫৬); (৫) লালজী (রঘুনাথের পাষণ্ড পুত্র বীর সিংহ, ১৫৫৮); (৬) মদন গোপাল (বীর সিংহের মহিষী, ১৬৬৫); (৭) মুরলীমোহন (বীরসিংহর মহিষী চূড়ামণি, ১৬৬৫); (৮) মদনমোহন (দুর্জন সিংহ, ১৬৯৪); (৯) জোড়া মন্দির (গোপাল সিংহ? ১৭২৬); (১০) রাধা গোবিন্দ (গোপাল সিংহের ভাই কৃষ্ণ সিংহ, ১৭২৯); (১১) রাধামাধব (গোপাল সিংহের ভাই কৃষ্ণসিংহের স্ত্রী চূড়ামণি, ১৭৩৭); (১২) রাধাশ্যাম (চৈতন্য সিংহ, ১৭৫৮)।১৪০ এই তালিকা লক্ষ্য করলে দেখা যাবে যে মুসলমানী অনুরক্ত দ্বিতীয় রঘুনাথ সিংহের আমলে গোপাল ঠাকুরের কোনো মন্দির তৈরি হয়নি। কিন্তু তাঁর সময় বিষ্ণুপুর সংগীত চর্চার অন্যতম কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল। পাঁচশো টাকা মাস মাইনে দিয়ে তিনি দিল্লী থেকে হিন্দুস্থানী গায়ক বাহাদুর খানকে বিষ্ণুপুরে আনিয়েছিলেন। বাহাদুর খানের শিষ্য গদাধর চক্রবর্তীর শিষ্য কৃষ্ণমোহন গোস্বামী, তৎ শিষ্য রামশঙ্কর ভট্টাচার্য, তৎ শিষ্য ক্ষেত্রমোহন গোস্বামী বিষ্ণুপুর ‘ঘরানা’ অব্যাহত রেখেছিলেন। ভারতীয় সংগীতে স্বরলিপির উদ্ভাবক ক্ষেত্রমোহন গোস্বামী কলকাতার জোড়াসাঁকোর ঠাকুর বাড়ির গায়ক ছিলেন।১৪১

চৈতন্য সিংহের আমলে দক্ষিণ রাঢ়ে ক্রমবর্ধমান বর্ধমান রাজ্যের প্রভায় বন বিষ্ণুপুর রাজ্য নিষ্প্রভ হয়ে আসছিল। রেনেলের ১৭৭৯ খ্রীস্টাব্দের সার্ভের দ্বারা কৃত পরিমাপ অনুযায়ী এই রাজ্যের আয়তন ১২৫৬ বর্গমাইল ছিল। কিন্তু বন বিষ্ণুপুরের শিলালিপিগুলির অবস্থান থেকে বোঝা যায় এক কালে এই রাজ্য উত্তরে দামিন-ই-কোহ্ (সাঁওতাল পরগনা), পশ্চিমে ঝাড়খণ্ড, পূর্বে বর্ধমানের সমতল এবং দক্ষিণে মেদিনীপুর জেলার উত্তর দিক পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। ১৭৫৭ খ্রীস্টাব্দে রাজ্যের আয়তন সাড়ে বারোশ বর্গমাইলের বেশি না হলেও রাজারা পলাশীর যুদ্ধের পরে পর্যন্ত নিজেদের মোটামুটি স্বয়ং-শাসিত নরপতি বলে ভাবতে অভ্যস্ত ছিলেন এবং মুর্শিদাবাদে এবং কলকাতায় কি রাষ্ট্রবিপ্লব ঘটে গেছে তার তোয়াক্কা করতেন না। তাই দেখা যায়, পলাশীর যুদ্ধের পর নবাবী পরোয়ানা অনুযায়ী ইংরাজদের বাণিজ্য সর্বত্র নিষ্কর বলে ঘোষিত হলেও চৈতন্য সিংহ তাতে কান দেননি। নবাবী সনদ ও পরোয়ানা ফুৎকারে উড়িয়ে দিয়ে ইংরাজদের কাছ থেকে তিনি আগেকার হারে মাশুল আদায় করে যাচ্ছিলেন। এতে অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে ইংরাজরা ঐ বছর নভেম্বর মাসে নবাব দরবারে নির্দেশ দিয়েছিল, বিষ্ণুপুরের রাজা ও অন্যান্য স্বেচ্ছাপরিচালিত জমিদারদের উচিত মতে শায়েস্তা (‘Punished in an exemplary manner’) করা হোক।১৪২ পরবর্তী ইতিহাস থেকে জানা যায়, ইংরাজরা নিজেরাই এই কার্য হাতে নিয়ে বিষ্ণুপুর রাজ্য ছারখার করে ছেড়েছিল।

৮। ইউসুফপুর—পরগনা (সৈয়দপুর সহ) ২৩, জমা ১,৮৭,৭৫৪।

১৭২২ খ্রীস্টাব্দে প্রদত্ত মুর্শিদকুলী খানের সনদ বলে উত্তর রাঢ়ীয় কুলীন কায়স্থ কৃষ্ণরাম রায়ের (১৭০৫—১৭২৯) নামে উপরোক্ত ২৩টি পরগনা জমা বন্দী হয়। এই পরিবার চাঁচড়া বা যশোরের জমিদার বংশ বলে পরিচিত এবং এঁদের প্রধান পরগনা ইউসুফপুর থেকে সমস্ত জমিদারীর নাম ইউসুফপুর হয়েছে। কৃষ্ণরামের বাবা মনোহর রায় (১৬৫৮—১৭০৫) চাঁচড়া বংশের প্রধান পুরুষ ছিলেন এবং অপদার্থ ফৌজদার নুরুল্লাহ্‌ খানের প্রিয়পাত্র রূপে ঢাকার নবাব দরবারে প্রতিপত্তি লাভ করে তিনি ১৬৯৬ খ্রীস্টাব্দে ইউসুফপুর পরগনা হস্তগত করেন। মনোহরের বাবা কন্দর্প রায় (১৬১৯—৫৮) প্রথম চাঁচড়ায় এসে বসতি স্থাপন করেছিলেন, কিন্তু জমিদারীর উৎপত্তি হয়েছিল আরও আগে যশোরেশ্বর মহারাজ প্রতাপাদিত্যের আমলে। কন্দর্পের ঠাকুরদাদা ভবেশ্বর রায় মোগলদের সেনাবিভাগে কাজ করতেন এবং প্রতাপাদিত্যের গতিবিধির উপর নজর রাখবার জন্য সৈয়দপুর ইত্যাদি চারটি পরগনার উপর জায়গীর দিয়ে তাঁকে মূলগ্রামে (সৈয়দপুর পরগনা) কেল্লাদার নিযুক্ত রাখা হয়। ১৫৮৪ খ্রীস্টাব্দে প্রাপ্ত ঐ জায়গীরের সনদ থেকে পরবর্তীকালে চাঁচড়া বা যশোর জমিদারীর উৎপত্তি হয়েছিল। ১৫৮৮ খ্রীস্টাব্দে ভবেশ্বরের মৃত্যু হলে তাঁর ছেলে মহতাবরাম (১৫৮৮—১৬১৯) কেল্লাদার হন এবং মানসিংহ যখন প্রতাপাদিত্যকে দমন করতে আসেন তখন মহতাবরাম মোগল ফৌজের সঙ্গে ছিলেন। ১৬১০ খ্রীস্টাব্দে প্রতাপাদিত্যের পতনের পর ইনায়েত খান ফৌজদার হলেন। তখন মহাতাবরামের কেল্লাদার পদ টিকল না, নিষ্কর জায়গীরও বাতিল হল। তৎপরিবর্তে সুবাহ্‌দার ইসলাম খান সৈয়দপুর ইত্যাদি চারটি পরগনা মহতাবরামের জমিদারী হিসেবে জমাবন্দী করে দিলেন। শাহ সুজার আমল থেকে নিয়ম হল, ছোট ছোট জমিদার সরাসরি ঢাকায় খাজনা না দিয়ে কোনো নিকটবর্তী বড়ো জমিদারের ‘সামিল’ হয়ে তাঁর মারফৎ টাকা পাঠাবেন। তখন থেকে প্রধান জমিদার কন্দর্প রায় ছোট ছোট জমিদারদের খাজনা বাকি পড়লে তাঁদের সম্পত্তি কবালা করে নিয়ে নিজ নামে খাজনা দিতে শুরু করলেন। চাঁচড়ার পুরনো কাগজপত্রে দেখা যায়, এইভাবে দাঁতিয়া পরগনা তাঁর হাতে এসেছিল। দাঁতিয়ার ইতিবৃত্তে লেখা আছে ‘সাবেক’ জমিদার আরজান উল্যা চৌধুরী (নগরঘাট)। ১১ আনা অংশ, পরুষরাম মিত্র ৩ আনা ও রুক্মিণী কান্ত মিত্র ২ আনা ষোল আনা ৩ জনের ছিল, কন্দর্প রায়ের সামিল ছিল পরে অনেক কর বাকি পড়িলে সরবরাহ করিতে না পারিলে বাকিতে কবলা লিখিয়া দিলেন ১০৪৯ সাল।’১৪৩ কন্দর্পের মৃত্যু হলে তাঁর ছেলে মনোহর রায় ঐ একই উপায়ে রাজ্য বিস্তার করতে লাগলেন। কাছাকাছি সব জমিদারের মালগুজারী ঢাকার নির্দেশ অনুসারে তাঁর সামিল ছিল। যাঁরা খাজনা দিতে পারতেন না তাঁদের মালজামিন হিসেবে মনোহর ধারে টাকা দিলেন, এবং যাঁরা শোধ করতেন না বা ঝগড়াঝাঁটি করতেন তাঁদের খাজনা ঢাকায় জমা করে তিনি নিজের নামে জমিদারীর সনদ লিখিয়ে নিতেন। এই উপায়ে মনোহর ইউসুফপুর সহ আরো অনেকগুলি পরগনা কব্জা করে নেন। চাঁচড়ার পুরোন কাগজপত্রে মনোহর রায়ের ইউসুফপুর পরগনা প্রাপ্তির বিবরণ এই—‘সাবেক জমিদার কালিদাস রায় ও পরমানন্দ রায় ও রামকৃষ্ণ দত্ত, রামনারায়ণ দত্ত, রামজীবন দত্ত ইহারা ছিল। মাল গুজারি মনোহর রায়ের সামিল ছিল। পরে অনেক বাকি আটকিলে সরবরাহ করিতে না পারিয়া বাকিতে কবলা করিয়া দিলেক। সাবেক জমিদারের সন্তান বেবাকদী ও শেকাটী গ্রামে বর্তমান আছে।’১৪৪ উক্ত কালিদাস রায় মহারাজ প্রতাপাদিত্যের সেনাপতি ছিলেন। মনোহর রায়ের আমলে জমিদারীর আয় বহু বৃদ্ধি পেলেও প্রবল প্রতাপান্বিত সীতারাম রায়ের হাতে পর্যুদস্ত হয়ে তাঁকে ভূষণার বশ্যতা স্বীকার করতে হয়েছিল।

মনোহর রায়ের পর তাঁর ছেলে কৃষ্ণরাম (ইনি মুর্শিদকুলী খানের সনদ পেয়েছিলেন তা আগে বলা হয়েছে) এবং তার পর কৃষ্ণরামের ছেলে শুকদেব (১৭২৯—৪৫) রাজা হন। কৃষ্ণরামের এক ভাই শ্যামসুন্দর মনোহরের বিধবা রানীর আদরের ছোট ছেলে ছিলেন। বুড়ী ঠাকুরমার কথা ঠেলতে না পেরে শুকদেব রায় কাকার সঙ্গে বারো আনা ও চার আনা ভাগে জমিদারী ভাগাভাগি করে নেন। বারো আনা ভাগ পড়ে শুকদেবের হাতে, এর নাম ইউসুফপুর। চার আনা পান শ্যামসুন্দর (১৭৩১—১৭৫০) এর নাম সৈয়দপুর। খুড়ো ভাইপোর মৃত্যুর পর ইউসুফপুর এবং সৈয়দপুরের জমিদার হন যথাক্রমে নীলকণ্ঠ রায় (১৭৪৫—১৭৬৪) এবং রামগোপাল রায় (১৭৫০-১৭৫৭)। সৈয়দপুরের জমিদার রামগোপাল অপদার্থ এবং অপুত্রক ছিলেন। বেওয়ারিশ অবস্থায় তাঁর মৃত্যু হলে নবাব সরকার থেকে তাঁর সম্পত্তি চাঁচড়ার প্রতিবাদ অগ্রাহ্য করে হুগলীর ফৌজদার মীর্জা মহম্মদ সালাহ্‌উদ্দিনকে দেওয়া হয়, এবং পরে ঐ সৈয়দপুরের জমিদারী উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাতঃস্মরণীয় হাজি মহম্মদ মহসিন প্রাপ্ত হন। আগে বলা হয়েছে যে পলাশীর যুদ্ধের পর অনেক ভূস্বামীকে হটিয়ে দিয়ে নবাব মীরজাফর ঈস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে ২৪ পরগনা জমিদারী লিখে দেন। যাঁদের সম্পত্তি চব্বিশ পরগনার মধ্যে পড়েছিল তাঁদের মধ্যে হাজি মহম্মদ মহসিনের ভগ্নিপতি মীর্জা সালাহ্‌উদ্দিন অন্যতম ছিলেন। ফৌজদার হিসাবে নবাব দরবারে তাঁর প্রতিপত্তি থাকায়, ক্ষতিপূরণ হিসাবে নবাব মীরজাফর তাঁকে ‘বেওয়ারিশ’ সৈয়দপুর জমিদারী লিখে দেন। চাঁচড়ার রাজবংশ এই চার আনা হস্তান্তর খুশি মনে নিতে পারেননি। চাঁচড়ার পুরোন কাগজপত্রে লিখিত আছে যে চার আনার অংশীদার রামগোপাল অনেক বকেয়া খাজনা ও দেনার দায়ে বারো আনার অংশীদার নীলকণ্ঠকে তাঁর অংশ দখল দিয়ে দিয়েছিলেন—‘১১৬৪ সালে (১৭৫৭) নীলকণ্ঠ রায় মহাশয়ের নিকট ৮৭,৯৭২ টাকা ৭ আনা পণরাজী লইয়া বিক্রী কবলা করিয়া দেন। নীলকণ্ঠ রায় উক্ত ৮৭,৯৭২ টাকা ৭ আনা পণ ও ১০,০০০ হাজার টাকা সেলামি মোট ৯৭,৯৭২ দিয়া উক্ত চারি আনা হিস্যা দখল করিয়া লন এবং ১১৬৫ সাল অগ্রহায়ণ মাস পর্যন্ত (১৭৫৭, ডিসেম্বর) তাহার দখলে ছিল। পরে হুগলীর ছলাউদ্দিন মহম্মদ খাঁ নবাব মীরজাফরালি খাঁর আমলে উক্ত কিংপং সৈদপুর ও ওগয়রহ চারি আনা হিস্যা বেওয়ারিশ বলিয়া খেলাপ এজাহার করিয়া সন ১১৬৫ সালের পৌষ মাসে (১৭৫৮ জানুয়ারি) খামকা জবরদস্তি করিয়া দখল করিয়া লয়েন। সেই সময়ে উক্ত চারি আনা বাহির হইয়া যায়।’১৪৫ রেনেলের সার্ভের সময় সমগ্র ইউসুফপুর ও সৈয়দপুর এলাকার আয়তন ছিল (কিছু নতুন এলাকাসহ) ১৩৬৫ বর্গমাইল। ইউসুফপুরের অংশীদার নীলকণ্ঠ রায়ের সঙ্গে সমগ্র যশোহর খুলনা জেলার প্রায় এক চতুর্থাংশ জুড়ে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত হয়েছিল।

বার ভুঁইয়ার অন্যতম যশোর রাজবংশের দীপ বহু দিন নির্বাপিত হওয়ায় এই সময় থেকে চাঁচড়া বংশকে লোকে যশোরের জমিদার বলে মানতে শুরু করলেও, মাতা যশোরেশ্বরীর পূজার অধিকার চাঁচড়া বংশের উপর নয়, বসন্ত রায়ের বংশধরদের উপর বর্তেছিল।১৪৬ যশোরেশ্বীর কালীর মতো ভয়ংকর কালীমূর্তি যেমন ভূভারতে নেই, যশোরেশ্বরীর উপাসক প্রতাপাদিত্যের মতো ভয়ংকর প্রকৃতির লোক তেমন বার ভূঁইয়াদের মধ্যে ছিল না। খুড়া বসন্ত রায়, তাঁর বড়ো ছেলে এবং বড়ো ছেলের গর্ভবতী বৌকে ঠাকুরদাদার বাৎসরিক শ্রাদ্ধের সভায় তিনি তলোয়ার দিয়ে খান খান করে কেটেছিলেন। বসন্ত রায়ের যে ছেলে কচু বনে লুকিয়ে প্রাণরক্ষা করেন, সেই কচু রায়ের বংশধরেরা যশোর-খুলনার নিম্ন অংশে আরো কিছু দিন রাজত্ব করেন। তাঁরা মা যশোরেশ্বরীর জন্য দেবোত্তর জমি ও সেবাইৎ নির্দিষ্ট করে দিয়েছিলেন। তারপর তাঁদের দুর্দশার সুযোগে কোটি কোটি শাখা-প্রশাখা মেলে সুন্দরবন যশোরেশ্বরীর পীঠস্থান আচ্ছন্ন করতে এগিয়ে এল। সেবাইৎ পুরোহিতরা উত্তরে পালিয়ে গেলেন। যশোরেশ্বরীর পূজা দিতে জঙ্গলের ডাকাতরা ছাড়া আর কেউ রইল না। তখন থেকে যশোরেশ্বরী ডাকাত কালী নামে পরিচিত হন। প্রতাপাদিত্যের বংশধররা আস্তে আস্তে কবে যে বিস্মৃতির তলে তলিয়ে গেলেন তা আর খেয়াল করা যায় না। প্রতাপাদিত্যের ছেলেরা বিনষ্ট হলেও, তাঁর যে জামাই ভয়ংকর শ্বশুরের খড়্গের কোপ থেকে পালিয়ে রক্ষা পান, সেই রামচন্দ্র রায়ের ঔরসে জাত প্রতাপাদিত্যের দৌহিত্ররা উত্তরাধিকার সূত্রে চন্দ্রদ্বীপের রাজা হয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথের বিভাকে সত্যি সত্যিই ‘বৌ ঠাকুরাণীর ঘাট’ থেকে ফিরে যেতে হয়নি, চন্দ্রদ্বীপের রাজা রামচন্দ্র তাঁকে স্ত্রীর মর্যাদা দিয়ে স্বগৃহে স্থান দিয়েছিলেন।

যশোরেশ্বরী চাঁচড়া বংশের অধিকারে না এলেও, তাঁদের রাজ্যে দশ মহাবিদ্যার১৪৭ প্রতিষ্ঠা হয়েছিল। দূর্গানন্দ নামে এক ব্রহ্মচারী সারা ভারতের তীর্থ দর্শন করে কোথাও মাতৃকা দেবীর দশবিধ মূর্তির একত্র সমাবেশ দেখতে না পেয়ে নবাব সুজাউদ্দিন খান এবং রাজা শুকদেব রায়ের আনুকূল্যে চাঁচড়ায় দশমহাবিদ্যার মন্দির স্থাপন করেন। বারো আনার মালিক শুকদেব এবং চার আনার মালিক শ্যামসুন্দর দুজনেই স্বীকৃত হন যে তাঁদের অধিকারভুক্ত প্রজাদের প্রত্যেকে বার্ষিক এক সের গল ও ৫ গণ্ডা কড়ি দিয়ে দশমহাবিদ্যার সেবার ব্যবস্থা করবে। চার আনা অংশ মীর্জা সালাহ্‌উদ্দিনের হাতে যাবার পর তাঁর স্ত্রী মন্নুজান খানম তাঁর অংশের বাবদ ৩৫১ টাকা বার্ষিক বৃত্তি ধরে দেন এবং এই ধর্মপ্রাণ মহিলার ভাই হাজি মহম্মদ মহসিনের কালেও ঐ ব্যবস্থা চলে এসে পরে ১৮৩৭ খ্রীস্টাব্দে মহসিন এস্টেটের মতওয়ালীর নির্দেশে তা বন্ধ হয়ে যায়। এদিকে চাঁচড়ার রাজবংশ ইউসুফপুর, জমিদারী থেকে বিচ্যুত হওয়ায় দশমহাবিদ্যার সেবার জন্য ইউসুফপুরের বৃত্তিও বন্ধ হয়ে যায়। যৎসামান্য ভাবে দশমাতৃকা পূজা সম্পন্ন হতে থাকে। কালের আবর্তনে কি প্রাচীন যশোরেশ্বরী কালী, কি বা অপেক্ষাকৃত আধুনিক দশমহাবিদ্যা, কারোরই পূর্বগৌরব টিকল না।১৪৮

৯। লস্করপুর—পরগনা ১৫, জমা ১,২৫,৫১৬।

এ পর্যন্ত বর্ণিত জমিদারীগুলি বাংলাদেশের প্রধান প্রধান রাজ্য ছিল। অন্য জমিদারীগুলির সংক্ষিপ্ত পরিচয় দিলেই যথেষ্ট। লস্করপুরের বারেন্দ্র ব্রাহ্মণ জমিদাররা পুটিয়ার ঠাকুর নামে পরিচিত। মুর্শিদকুলী খানের সমকালীন দর্পনারায়ণ ঠাকুর নাটোর প্রতিষ্ঠাতা রঘুনন্দনের প্রভু ছিলেন এবং তাঁর জমিদারী লক্ষণীয় ভাবে ‘রঘুনন্দনী বাড়’ থেকে রক্ষা পেয়েছিল। দর্পনারায়ণের পাঁচ পুরুষ আগে বৎসাচার্যের উদ্যোগে, সম্ভবত পাঠান মোগল দ্বন্দ্বের সময় এই জমিদারীর উৎপত্তি হয়েছিল, এবং এই সুচিরস্থায়ী ক্ষুদ্র রাজ্য (৪৯৯ বর্গমাইল) চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের পর নাটোরের মতো লুপ্ত না হয়ে বরং কিছুটা বৃদ্ধি পেয়েছিল।১৪৯

১০। রোকুনপুর—পরগনা বা পরগনার অংশবিশেষ ৬২, জমা ২,৪২,৯৪৮।

এটি কোনো রাজ্য নয়, নানা চাকলায় ছড়ানো অসংখ্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পরগনার অংশ বিশেষ সমন্বয়ে গঠিত, কিন্তু যেহেতু এটি প্রধান কানুনগো পরিবার বঙ্গাধিকারী মহাশয়দের সম্পত্তি, তাই ঐ পরিবার সম্বন্ধে কয়েকটি কথা এই প্রসঙ্গে বলা যেতে পারে। এই বংশের প্রতিষ্ঠাতা ভগবান রায় ও বঙ্গবিনোদ রায় নামে দুই ভাই কাটোয়ার কাছে খাজুরডিহি গ্রামের মিত্র বংশীয় উত্তররাঢ়ী কায়স্থ ছিলেন এবং তাঁরা দুজনে পরপর বাংলার প্রধান কানুনগো পদে নিয়োজিত হয়ে বিশেষ দক্ষতার সঙ্গে কার্য সম্পন্ন করায় তাঁদের বংশধররা—হরিনারায়ণ, দর্পনারায়ণ, শিবনারায়ণ ও লক্ষ্মীনারায়ণ—বঙ্গাধিকারী উপাধিতে ভূষিত হয়ে বংশানুক্রমিকভাবে ঐ কাজে প্রতিষ্ঠিত থাকেন। মুর্শিদাবাদ দরবারে ক্রমান্বয়ে নবাব, জগৎশেঠ ও বঙ্গাধিকারী পদমর্যাদায় শ্রেষ্ঠ ছিলেন। কিন্তু হরিনারায়ণের সময় বাদশাহ আওরঙ্গজেব বাংলার অর্ধেক কানুনগোই পদ বঙ্গাধিকারীদের হাত থেকে সরিয়ে নিয়ে তাতে ভট্টবাটীতে অবস্থিত দ্বিতীয় প্রধান কানুনগো বংশ কান্দীর সিংহদের নিযুক্ত করেন। তাঁরাও জাতিতে উত্তররাঢ়ী কায়স্থ কিন্তু আলাদা বংশ। ‘তারিখ-ই-বাংলা’ ও ‘রিয়াজ-উস-সলাতীনে’ দেখা যায় দাক্ষিণাত্যে আওরঙ্গজেবের কাছে নিকাশী কাগজপত্র ও খাজনা দিতে যাবার সময় দেওয়ান মুর্শিদকুলী খান বঙ্গাধিকারী দর্পনারায়ণের নিকাশী স্বাক্ষর পাওয়ার জন্য অনেক পীড়াপীড়ি করেন, কিন্তু কানুনগো রসুম বাকি থাকার অভিযোগে দর্পনারায়ণ তাতে অস্বীকৃত হন। জয়নারায়ণ নামক অপর অর্ধাংশের কানুনগোর নিকাশী সই সহ বাদশাহের কাছে খাজনা দাখিল করা হয়। পরে সুযোগমতো দর্পনারায়ণকে তসরূপের দায়ে জড়িয়ে ফেলে মুর্শিদকুলী খান তাঁকে কারারুদ্ধ করে অশেষ যন্ত্রণা দিয়ে তাঁর ভবলীলা সাঙ্গ করে দেন। তাঁর ছেলে শিবনারায়ণ বিভিন্ন পরগনা থেকে অল্প খাজনায় বাছা বাছা মহল নিয়ে রুকুনপুর জমিদারী গঠন করেন। এই জমিদারী এত জায়গায় ছড়ানো যে রেনেলের সার্ভেতে তার পরিমাপ করা সম্ভব হয়নি। তবে এর আয়তন ৬০০ বর্গমাইলের মতো হবে বলে গ্রান্ট সাহেব আন্দাজ করেছিলেন। শিবনারায়ণের ছেলে লক্ষ্মীনারায়ণ পরে রুকুনপুরের জমিদার এবং অর্ধবাংলার কানুনগো হয়েছিলেন এবং শোনা যায় তিনি সিরাজউদ্দৌলাহ্‌র বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিলেন। দেওয়ান গঙ্গাগোবিন্দ সিংহ প্রথমে এঁর অধীনে নায়েব কানুনগো রূপে কাজ করতেন এবং তাঁর হাতে লক্ষ্মীনারায়ণ নিজের নাবালক ছেলে সূর্যনারায়ণকে সঁপে দিয়ে যান। বঙ্গাধিকারী মহাশয়দের পারিবারিক বিশ্বাস এই যে গঙ্গাগোবিন্দ সিংহর ষড়যন্ত্রে রুকুনপুর জমিদারী তাঁদের হাতছাড়া হয়ে যায়।১৫০

১১। মাহমুদশাহী—পরগনা ২৯, জমা (জায়গীর বাদে) ১,১০,৬৩৩।

সীতারাম রায়ের পতনের পর নলদী সমেত তাঁর জমিদারীর অধিকাংশ নাটোরের অধিকারে চলে যায়, বাকি অংশ মাহমুদশাহী তত উর্বর ছিল না। ঐ অংশ বরাবর নলভাঙা বংশের অধিকৃত ছিল, পরে তাঁরা সীতারামের বশীভূত হন। সীতারাম নিহত হলে পর ১৭২২ খ্রীস্টাব্দে নলভাঙার ব্রাহ্মণ জমিদার বংশের রাজা রামদেবের সঙ্গে নবাব মুর্শিদকুলী খান এই জমিদারীর বন্দোবস্ত করেন। রামদেবের পূর্বপুরুষ রণবীর খাঁ স্থানীয় পাঠানদের উচ্ছেদ করে মোগলদের সম্মতিক্রমে মাহমুদশাহী দখল করেছিলেন। রণবীর থেকে অধস্তন অষ্টম পুরুষ রাজা রামদেব দেবরায় (১৬৯৮—১৭২২) রাজা সীতারাম রায়ের বশ্যতা স্বীকার করে রাজ্য রক্ষা করেন। বিদ্রোহী সীতারামের বংশবদ বলে নবাব রামদেবের হাত থেকে জমিদারী কেড়ে নিতে মনস্থ করেন। কিন্তু বিশ্বস্ত আম মোক্তার কৃষ্ণচন্দ্র দাসের চেষ্টায় রাজ্য রক্ষা হয়। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের পর এই জমিদারীর বৃহত্তর অংশ নড়াইলের বাবুদের হস্তগত হয়। জমিদারীর আয়তন ছিল ৮৪৪ বর্গমাইল।

১২। ফতেসিংহ—পরগনা ১১, জমা ১,৮৬,৪২১।

মুর্শিদাবাদের নীচে ভাগীরথী তীরে অবস্থিত এই মধ্যমাকৃতি জমিদারী রাজশাহী বীরভূম ও বর্ধমানের সংযোগ-স্থল। মুর্শিদকুলী খানের আমলে হরিপ্রসাদ নামে এক ভূমিহর ব্রাহ্মণের সঙ্গে এর বন্দোবস্ত হয়। নিঃসন্তান অবস্থায় তাঁর মৃত্যু হলে বৈদ্যনাথ নামে তাঁর এক কর্মচারী নিজের ছেলে নীলকণ্ঠের নামে আলিবর্দির আমলে জমিদারী বন্দোবস্ত করে নেন। কিন্তু নীলকণ্ঠর হাত থেকে অনেক তালুক খালসার মুৎসুদ্দি তালুকদারদের হাতে খসে পড়ায় এর খাজনা এবং আয়তন দুইই অনেক কমে গিয়েছিল। রেনেলের সার্ভের সময় এর আয়তন ২৫৯ বর্গমাইল ছিল।১৫১

১৩। ইদ্রাকপুর—পরগনা ৬০, জমা ৮১,৯৭৫।

দিনাজপুরের সঙ্গে ভাগাভাগি করে একই সময়ে এই জমিদারীর উৎপত্তি হয়েছিল তা আগে বলা হয়েছে। এঁরাও কায়স্থ। মুর্শিদকুলী খানের আমলে বিশ্বনাথের সঙ্গে বন্দোবস্ত ছিল। এই জমিদারী সরকার ঘোড়াঘাটের অন্তর্গত। রেনেলের পরিমাপ অনুযায়ী ঘোড়াঘাটের যে আয়তন তা থেকে দিনাজপুরের অংশ বাদ দিলে ইদ্রাকপুরের আয়তন হবে ১২৩২ বর্গমাইল।

১৪। ত্রিপুরা (মোগল শাসনাধিকৃত অংশ) পরগনা ৪, জমা (জায়গীর বাদে) ৪৭, ৯৯৩।

মোগলরা ত্রিপুরা রাজ্যের সমতল ভূমির অন্তর্গত যে অংশ আয়ত্তে এনেছিল তার নাম দিয়েছিল রোশনাবাদ। পার্বত্য জংলি প্রদেশ বৃটিশ আমলে করদ রাজ্যে পরিণত হয় এবং রোশনাবাদ থেকে কুমিল্লা বা ত্রিপুরা জেলার উৎপত্তি হয়। সমগ্র রাজ্যটির আয়তন ৬৬১৮ বর্গমাইল হলেও যে সমতল অংশ মোগল রাজস্ব ব্যবস্থার অন্তর্ভুক্ত হয় তার পরিমাণ ১৩৬৮ বর্গমাইল। মুর্শিদকুলী খানের আমলে চার পরগনার জন্য নামমাত্র জমা ধার্য হয়। পরে মীর হবীব নামক মোগল সেনানায়ক রোশনাবাদ পুনরাধিকার করে ২৪টি পরগনায় বিভক্ত করেন এবং প্রকৃতপক্ষে মোগল ফৌজদাররা ‘আবওয়াব ফৌজদারী’ নাম দিয়ে ১,৮৪,৭৫১ টাকা আদায় করতে সমর্থ হন। ত্রিপুরা রাজ্যে এই সময় ভীষণ অন্তর্বিবাদ চলছিল। ফলে রাজ্যের বহু অংশ শামসের গাজী নামে এক বিদ্রোহীর অধিকারে চলে যায়। ১৭৬০ নাগাদ কৃষ্ণমাণিক্য পিতৃরাজ্য পুনরুদ্ধার করেন।

১৫। পাচেত—পরগনা ২, জমা ১৮,২০৩।

পাচেত বা পঞ্চকোটি বাংলার পশ্চিম সীমায় অবস্থিত জঙ্গলাকীর্ণ জমিদারী ছিল। আয়তন ২৭৭৯ বর্গমাইল। জমিদাররা রাজপুত, এঁরা পেশকাশ ছাড়া কিছু দিতেন না। পঞ্চকোটি সহ পনেরটি গোটা গোটা ইহ্‌তমাম জোড়া জমিদারীর কথা উপরে বর্ণিত হল। সব মিলিয়ে ৬১৫টি পরগনা এই পনের-খানা ইহ্‌তমামের অন্তর্গত ছিল। এক এক পরগনায় একাধিক জমিদার ও তালুকদার থাকা সম্ভব হলেও এক একটি ইহতমাম এক এক জন জমিদারের দায়ভুক্ত থাকত। এই পনেরটি বৃহৎ ইহতমাম জমিদারীর মোট জমা পঁয়ষট্টি লক্ষ টাকার উপর। সমস্ত বাংলা সুবাহর খাজনা ছিল এক কোটি বেয়াল্লিশ লক্ষ টাকা। অতএব বাংলার উদ্বৃত্ত ফসল বা ভূমি রাজস্বের প্রায় অর্ধেক এই পনের জন বড়ো বড়ো জমিদার বা রাজার নিয়ন্ত্রণে ছিল বললে বাড়িয়ে বলা হবে না। এবার যে সব ইহ্‌তমাম অনেকগুলি ছোট ছোট জমিদারী ও তালুকের সমন্বয়ে গঠিত হয়েছিল, সেগুলির হিসাব নেওয়া যাক। এই জাতীয় ইহ্‌তমামে কোনো প্রধান জমিদার ছিল না। তংপরিবর্তে কোনো ফৌজদার বা আমিল বা নায়েব নাজিমের কর্তৃত্বে খাজনা আদায় হত।

ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জমিদারী সম্বলিত ১০টি ইহ্‌তমাম (খালসা)।

১৬। জালালপুর (ঢাকা নিয়াবত)—পরগনা ১৫৫, জমা (জায়গীর বাদে) ৮,৯৯,৭৯০।

ঢাকা থেকে নিজামত মুর্শিদাবাদে চলে যাবার সময় ঢাকার নিয়াবত সৃষ্টি হয়। আলিবর্দির আমলে নওয়াজিশ মহম্মদ খান ঢাকার নায়েব নাজিম ছিলেন এবং তাঁর দুই কর্মচারী হোসেন কুলী খান এবং রাজবল্লভ সেন ঢাকা নিয়াবতের শাসনকার্য পরিচালনা করতেন। সিরাজউদ্দৌলাহ্‌ রাজবল্লভকে সরিয়ে জসরত খানকে ঢাকার শাসনভার অর্পণ করেন। এই সুবিস্তীর্ণ প্রদেশের অধিকাংশ খাজনা নওয়ারা ইত্যাদির জন্য জায়গীর হিসাবে সরিয়ে রাখার ফলে, খালসা জমি অল্পই বাকি ছিল, এবং সেখানে ছোট বড়ো অসংখ্য জমিদার থাকায় কোনোও একজন রাজা নদীয়া, বর্ধমান ও রাজশাহীর মতো সর্বময় কর্তৃত্ব বিস্তার করতে পারেননি। খালসার অন্তর্ভুক্ত জমিদারের কাছ থেকে খাজনা আদায় করার জন্য মুর্শিদকুলী খান মহম্মদ শরীফ নামে একজন ইহ্‌তমামদার নিয়োগ করেছিলেন,১৫২ কিন্তু প্রকৃতপক্ষে জমিতে তাঁর কোনো হক ছিল না—নানা স্তরের ছোট বড়ো জমিদার, কয়েকটি প্রাচীন রাজবংশ এবং অসংখ্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র তালুকদার জমির স্বত্ব ভোগ করতেন, আর সুযোগমতো পরস্পরের জমি হাতাবার চেষ্টা করতেন।

এই প্রদেশে মোগল শাসন প্রবর্তনের শুরুতে ঈশা খানের পরিবার, ভাওয়ালের গাজী বংশ, চন্দ্রদ্বীপের রাজবংশ, বিক্রমপুরের চাঁদ রায়, কেদার রায়, ইত্যাদি বার ভুঁইয়া নামে চিহ্নিত কয়েকটি প্রধান প্রধান পাঠান ও কায়স্থ বংশের রাজত্ব ছিল। একমাত্র চন্দ্রদ্বীপের রাজবংশ ছাড়া কারো রাজত্ব শেষ পর্যন্ত টেকেনি। বারো ভুঁইয়ার মধ্যে প্রধান ঈশা খানের পরিবার প্রথমে সোনার গাঁয়ে এবং পরে জঙ্গলবাড়িতে (ময়মনসিংহ) রাজত্ব করতেন। সমধিক প্রাচীন গাজী বংশ ভাওয়ালে রাজত্ব করতেন। এই দুই প্রাচীন পাঠান বংশ মোগলদের বশ্যতা স্বীকার করে আরো অনেকদিন রাজত্ব করেছিলেন, কিন্তু মুর্শিদকুলী খানের আমলে এঁদের পূর্ব গৌরব আর কিছু মাত্র অবশিষ্ট ছিল না। কেদার রায় মানসিংহের সঙ্গে লড়াই করে নিহত হন এবং তাঁর আরাধ্যা শিলাময়ী দেবী শ্রীপুর থেকে আমের (অম্বর) রাজ্যে স্থানান্তরিত হন। কেদার রায়ের পরিবার থেকে চাঁদ রায়ের বিধবা কন্যা সোনা বিবিকে বারো ভুঁইয়াদের প্রধান যোদ্ধা ও নরপতি বীরশ্রেষ্ঠ ঈশা খান একজন বিশ্বাসঘাতক কর্মচারীর সহায়তায় অপহরণ করে নিয়ে গিয়ে বিয়ে করেছিলেন। স্বামীর উপযুক্ত স্ত্রী সোনা বিবি বীর রমণী ছিলেন। কথিত আছে মগেদের হাত থেকে দুর্গ রক্ষা করতে গিয়ে যুদ্ধ করতে করতে তিনি প্রাণ হারান।

সোনারগাঁও রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা ঈশা খানের অধিকার ঢাকা, ময়মনসিংহ ও ত্রিপুরা জেলার ২২টি পরগনার উপর বিস্তৃত ছিল। এই পাঠান বীরের পূর্বপুরুষ অযোধ্যা থেকে আগত একজন হিন্দু রাজপুত ছিলেন বলে প্রসিদ্ধি আছে। ঈশা খানের পুত্র মুসা খান ১৬১১ খ্রীস্টাব্দে মোগলদের সঙ্গে যুদ্ধে পরাজিত হয়ে জাহাঙ্গীরের বশ্যতা স্বীকার করেন এবং বাদশাহ কর্তৃক সোনারগাঁও অঞ্চলের জায়গীরদার নিযুক্ত হন। তিনি, তাঁর পুত্র মাসুম খান এবং পৌত্র মনোয়ার খান আসাম ও চট্টগ্রাম অভিযানে মোগল বাহিনীর সঙ্গে ছিলেন। ঈশা খানের বংশধররা সোনারগাঁও থেকে জঙ্গলবাড়িতে বাস উঠিয়ে নিয়ে যান। মুর্শিদকুলী খানের আমলে ময়মনসাহী ও আলেপসাহী নামে দুটি বড়ো বড়ো পরগনা এঁদের হাতছাড়া হয়ে ময়মনসিংহের দুটি প্রধান হিন্দু জমিদার পরিবারের হাতে চলে যায়। মুসা খানের পৌত্র হায়াৎ খান নতুন জমিদারী সনদ বলে ১১টি পরগনার উপর কর্তৃত্ব করতেন। তাঁর পুত্র হায়বৎ খানের সময় জঙ্গলবাড়ি জমিদারী দুইভাগে ভাগ হয়ে যায়। হায়বৎ খান নিজে হায়বৎনগর প্রতিষ্ঠা করে সেখানে সাতটি পরগনার উপর জমিদারী করতে শুরু করেন, আর বাকি চারটি পরগনা জঙ্গলবাড়ি শাখার জমিদারের হাতে থেকে যায়। দেওয়ানী লাভের সময় ইংরেজরা হায়বৎনগর জমিদারী থেকে চারটি পরগনা সরিয়ে হিন্দু জমিদারদের সঙ্গে বন্দোবস্ত করে দেয়। অন্য তরফে জঙ্গলবাড়ি জমিদারী দ্রুত অবনত হতে হতে জঙ্গলবাড়ি, জাফরাবার্দ, কারিখাই ও কত্রাবু, এই চার অংশে খণ্ডিত হয়ে পড়ে। ঋণের দায়ে বা নীলামে বিক্রী হতে হতে সবকটি অংশই ঈশা খাঁর বংশধরদের হাতছাড়া হয়ে যায়। অষ্টাদশ শতকের যবনিকা পতনের সময় দেখা যায়, জঙ্গলবাড়ির জমিদাররা এক হাজরাদি পরগনা ছাড়া সব হারিয়েছেন। ১৮০০ খ্রীস্টাব্দে তাঁরা সমস্ত জমিদারী স্বত্ব ছেড়ে দিয়ে ইংরাজ সরকারের কাছ থেকে ৩৮৪০ টাকা ভাতা গ্রহণ করে কোনোক্রমে কালাতিপাত করতে থাকেন।

বাঙালি মুসলমানদের ইতিহাসে একটি১৫৩ জিনিস লক্ষ্য করবার মতো। তাদের চোখে মোগলরা শত্রু হলেও, পাঠান ভুঁইয়াদের তারা মনে মনে আপনার করে নিয়েছিল। দীনেশ চন্দ্র সেন সংগৃহীত সপ্তদশ অষ্টাদশ শতকের পূর্ববঙ্গ গীতিকাগুলির অন্তর্গত ‘সখিনা’ গীতিকাতে দেখা যায়, ঈশা খানের পরিবারের আর এক বীরাঙ্গনা বধু সকিনা তাঁর স্বাধীনতাকামী স্বামীর উদ্ধার সঙ্কল্পে মোগল বাহিনীর বিরুদ্ধে বুকে লোহার বর্ম এঁটে সমরে অবতীর্ণ হয়েছেন। কিন্তু যুদ্ধে জয়ী হতে না হতে খবর এল তাঁর বন্দী স্বামী ফিরোজ খাঁ (ঈশা খাঁর পৌত্র) মোগলদের বশ্যতা স্বীকার করে সকিনাকে তালাক-নামা লিখে দিয়েছেন। সেই খবরে বজ্রাহত হয়ে সকিনা ঘোড়া থেকে পড়ে গেলেন:

আউলিয়া পড়ে কন্যার দীঘল মাথার কেশ।
পিন্ধন হইতে খুলে কন্যার পুরুষের বেশ।।১৫৪

শায়েস্তাবাদ, নাজিরপুর, বুজুর্গ্‌-উমেদপুর ইত্যাদি কয়েকটি সমৃদ্ধ মুসলমান জমিদারী ঢাকা নিয়াবতের বিভিন্ন স্থানে ছড়ানো ছিল। দয়াল চৌধুরী নামে এক হিন্দু বুজুর্গ্‌-উমেদপুরের জমিদার ছিলেন, বিদ্রোহের অপরাধে তাঁকে সরিয়ে আগা বাকরকে তাঁর স্থলে ১৭৩৭ খ্রীস্টাব্দে বা তার পরে জমিদার নিযুক্ত করা হয়। আগা বাকর ও তাঁর ছেলে আগা সাদিক ঢাকা, মুর্শিদাবাদ যাতায়াত করতেন, নবাব মহলে তাঁদের জানাশোনা ছিল। হোসেনকুলী খানের বিরুদ্ধে চক্রান্ত পাকাবার সময় তরুণ সিরাজউদ্দৌলাহ্‌ আগা সাদিককে কুলী খাঁর বিরুদ্ধে উত্তেজিত করে তোলেন। জমিদারী সংক্রান্ত ব্যাপারে আগা সাদিকের সঙ্গে হোসেন কুলী খানের ঝগড়া চলছিল। সিরাজের প্ররোচনায় আগা সাদিক মুর্শিদাবাদ থেকে ঢাকায় ফিরে হঠাৎ হোসেন কুলী খানের ভ্রাতুষ্পুত্রকে খুন করে বসলেন। এ ব্যাপারে নবাব পরিবারের হাত আছে ভেবে শহরের লোকেরা গোড়াতে স্থাণু হয়ে ছিল। পরে জানা গেল আগা সাদিকের হাতে কোনো পরোয়ানা নেই, তখন হোসেন কুলী খানের লোকেরা চড়াও হয়ে আগা বাকরকে হত্যা করল। আগা সাদিক কোনোমতে মুর্শিদাবাদে পালিয়ে গেলেন।১৫৫ রাজবল্লভের হুকুমে ঢাকার নিয়াবতের তরফ থেকে আগা বাকরের সব সম্পত্তি ১৭৫৩ খ্রীস্টাব্দে বাজেয়াপ্ত হল। এর পরেই হোসেন কুলী খান খুন হলেন এবং সিরাজউদ্দৌলাহ্‌ মসনদে ওঠা মাত্র ১৭৫৭ খ্রীস্টাব্দে আগা সাদিক, বীর দর্পে ফিরে এলেন। মীরজাফর ঐ বছরই নবাব হয়ে আগা সাদিককে জমিদারীতে বহাল করে তাঁর ছেলে মহম্মদ সালেহ্‌কে পরগনার ওয়াদাদার নিযুক্ত করলেন। কিন্তু ততদিনে মহারাজ রাজবল্লভ আবার ঢাকার নিয়াবতের শাসনকার্য হাতে পেয়েছেন। আগা সাদিকের মৃত্যু হওয়া মাত্র ১৭৬০ খ্রীস্টাব্দে মহম্মদ সালেহ্‌কে হটিয়ে রাজবল্লভ বুজুর্গ-উমেদপুর জমিদারী হস্তগত করলেন।১৫৬ ঐ সময় রাজনগর, বুজুর্গ-উমেদপুর এবং কার্তিকপুর জমিদারী তিনি নিজের নামে লিখিয়ে নেন, এবং বিক্রমপুরের অধিকাংশ রাজনগর জমিদারীর অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়।

সমস্ত ঢাকা নিয়াবত জুড়ে অসংখ্য ছোট ছোট তালুক ছিল। ফলে জমিদারদের নিজেদের হাতে বেশি জমি ছিল না—অধিকাংশ জমা জমিদারদের অধীনস্থ তালুকদারদের কাছ থেকে আদায় হত। তালুকগুলির মধ্যে আবার বহু সংখ্যক হাওয়ালার উৎপত্তি হয়েছিল। এক বুজুর্গ-উমেদপুর পরগনাতেই রাজবল্লভের জমিদারী প্রাপ্তির আগে থেকে ৫৯৪ খানা জঙ্গলবাড়ি তালুক ছিল। এই জঙ্গলবাড়ি তালুক ও তদধীন হাওয়ালাগুলির খাজনা আদায়ের জন্য ৪৭টি ‘জিম্মা’ তৈরি করে প্রধান প্রধান তালুকদারদের জিম্মাদার নিযুক্ত করা হয়। জিম্মাদাররা ছোট ছোট তালুকদারদের কাছ থেকে খাজনা আদায় করে দিতেন। রাজবল্লভের ছেলে গোপালকৃষ্ণ নিজের জমিদারীর মধ্যেই ছলে বলে কৌশলে অধীনস্থ তালুকদারদের কাছ থেকে সম্পত্তি ছিনিয়ে নিয়ে নিজের দুই ছেলে কালীশঙ্কর ও পীতাম্বরের নামে দুটি নিজ তালুক সৃষ্টি করায়, ৪৭টি জিম্মা, নিজ তালুক কালীশঙ্কর এবং নিজ তালুক পীতাম্বর নিয়ে সমগ্র বুজুর্গ-উমেদপুর জমিদারী গঠিত হয়।১৫৭

খালসা ও জায়গীর মিলিয়ে ঢাকার নিয়াবত সুবাহ্ বাংলার এক সুবৃহৎ অংশ ছিল। পরবর্তী কালে এই এলাকা থেকে ঢাকা, বাকরগঞ্জ, ফরিদপুর এই তিনটি জেলার উৎপত্তি হয় এবং ময়মনসিংহ জেলার অনেক অংশও ঢাকার নিয়াবতে অবস্থিত ছিল। খালসা ও জায়গীর খাজনা এক সঙ্গে ধরলে এখানকার খাজনার মোট পরিমাণ ছিল ২১,৮৩,৯৯০ টাকা এবং এর আয়তন ছিল ১৫,৩৯৭ বর্গমাইল। খালসা অংশটি জালালপুর পরগনা শিরোনামায় ঢাকা-জালালপুর নামে অভিহিত হত।

১৭। সেরপুর ধরমপুর—(পূর্ণিয়ার ফৌজদারী) পরগনা ১৩, জমা ৯৮,৬৬৪।

এই এলাকা নিয়ে পূর্ণিয়ার ফৌজদারী গঠিত হয়। ১৭২৮ খ্রীস্টাব্দে সইফ খান পূর্ণিয়ার ফৌজদার ছিলেন। ফৌজদারের জায়গীর হিসাবে ১,৮০,১৬৬ টাকা সরানো ছিল, অবশিষ্ট ৯৮,৬৬৪ টাকা খালসায় যেত। আলিবর্দি খান নবাব হয়ে নিজের ভ্রাতুষ্পুত্র ও জামাই সৈয়দ আহম্মদ খানকে পূর্ণিয়ার ফৌজদার নিযুক্ত করেন। নবাবের জীবৎকালেই জামাইয়ের মৃত্যু হলে তাঁর অপর দৌহিত্র শওকৎ জঙ্গ (সৈয়দ আহম্মদ খানের ছেলে) পৃর্ণিয়ার ফৌজদার হন। আগতন ৫১১৯ বর্গমাইল।

১৮। সেখেরকুণ্ডী (রঙপুর) পরগনা ২৪৪, জমা ২,৩৯,১২৩।

কুচবিহার থেকে বিজিত মোগল অঞ্চল রঙপুর নামে পরিচিত ছিল। রঙপুর বা ঘোড়াঘাটের ফৌজদার এখানকার ছোট বড়ো জমিদারদের শাসনে রাখতেন। ফৌজদারের জন্য জায়গীর হিসাবে ৯০,৫৪৮ টাকা সরানো ছিল। আয়তন ২৬৭৯ বর্গমাইল।

১৯। কাঁকজোল (রাজমহল) পরগনা ১০, জমা ৭৪,৩১৭।

রাজমহলের ফৌজদারের অধীন। তাঁর জন্য জায়গীর জমা আলাদা করা ছিল। এই প্রদেশ হিন্দু মুসলমান ভূস্বামীদের মধ্যে প্রায় সমান ভাগে বিভক্ত দেখা যায়।

২০। তমলুক (হিজলীর ফৌজদারী) পরগনা—১৬, জমা ১,৮৫,৭৬৫।

তমলুক, জালামুঠা, সুজামুঠা, মাজনামুঠা, মহিষাদল প্রভৃতি পরগনা ওড়িশা থেকে খারিজ হয়ে হিজলীর ফৌজদারীর অন্তর্গত হয়। ১৭২৮ খ্রীস্টাব্দে সমগ্র হিজলীর বন্দোবস্ত হয় শুকদেব নামে এক ব্রাহ্মণের সঙ্গে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এই অঞ্চলে দুর্গ নির্মাণ করে পাঁচটি প্রাচীন কৈবর্ত বংশ রাজত্ব করত—তমলুক, বালিসীতা (ময়নাচূড়া), সুজামুঠা, তুর্কা ও কুতুবপুর। তমলুক বংশাবলীতে দেখা যায় এই বংশের ৪২তম রাজা ভাঙ্গর ভুঁইয়া রায় ১৪০৪ খ্রীস্টাব্দে মারা যান। বংশাবলীতে এইটি প্রথম তারিখ এবং সে অনুসারে অন্তত পঞ্চদশ শতক থেকে এই কৈবর্ত রাজারা এখানে রাজত্ব করে আসছিলেন। ময়নাচূড়ার রাজাদের আদিপুরুষ কালিন্দীরাম সামন্ত ওড়িশার রাজাদের সামন্তরূপে বালিসীতা দুর্গ থেকে রাজত্ব করতেন। তাঁর ষষ্ঠ বংশধর গোবর্ধনানন্দ ময়না দুর্গ দখল করে ওড়িশার রাজাদের কাছ থেকে ‘বাহুবলীন্দ্র’ উপাধি পান। নবাবী আমলের শেষ দিকে এই কৈবর্তবংশের দ্বাদশ রাজা জগদানন্দ বাহুবলীন্দ্র মুর্শিদাবাদ দরবারে সম্মানিত জমিদার ছিলেন।১৫৮

২১। সিলেট—পরগনা ৩৬, জমা ৭০,০১৬।

এখানেও একজন ফৌজদার শাসন পরিচালনা করতেন, এবং তাঁর আলাদা জায়গীর নির্দিষ্ট ছিল। ফৌজদারের অধীনে বহু ছোট জমিদার ছিলেন।

২২। ইসলামাবাদ— (চট্টগ্রাম)।

১৭২৮ খ্রীস্টাব্দে এই এলাকার প্রায় সবই জায়গীরে বন্টিত ছিল বলে খালসায় খাজনা আসত না। জায়গীর জমায় এর খাজনা পরে দেখানো হবে। এই প্রদেশেও ফৌজদার নিযুক্ত ছিলেন। তাঁর অধীনে মগেদের আটকানোর জন্য বহু সৈন্য মোতায়েন ছিল বলে একে থানাদারী প্রদেশ বলা হত। এই সব সৈন্যদের জন্য নির্দিষ্ট ছোট ছোট জায়গীরগুলি পরবর্তীকালে—মগ আক্রমণ রহিত হবার পর—নির্দিষ্ট খাজনায় বহু সংখ্যক ক্ষুদ্রায়তন জমিদারীতে পরিণত হয়। ১৭৬০ খ্রীস্টাব্দে এখানে অন্তত ১৪০০০ ক্ষুদ্র ভূস্বামী ছিলেন।

২৩। চাকলা বন্দর বালেশ্বর—পরগনা ২৮, জমা ১,২৯,৪৫০।

ওড়িশার এই অঞ্চল এবং তৎসহ আসাম সীমানায় খড়িবাড়ির অন্তর্ভুক্ত খোস্তাঘাট ১৭২৮ খ্রীস্টাব্দে বাংলার অন্তর্ভুক্ত ছিল, পরে বাংলা থেকে খারিজ হয়।

২৪। সায়রাৎ মহল—পরগনা ৩, জমা ৯,১৩,৬৪৭।

সওদার উপর সা’ইর (Sayer) বা শুল্ক নিয়ে এই বিভাগ গঠিত হয়েছিল—এতে তিনটি এলাকার মাশুল অন্তর্ভুক্ত ছিল। (১) চুনাখালি—মুর্শিদাবাদ নগর ও তৎপার্শ্ববর্তী কাশিমবাজার ইত্যাদি বন্দরের শুল্ক। (২) বখশ বন্দর বা হুগলী—৩৭ খানি গঞ্জ বা বাজারের সা’ইর ও বাণিজ্যের মাশুল। (৩) দার-উল-জার্ব, বা মুর্শিদাবাদ টাঁকশালের আয়।

২৫। মজকুরী জমিদারী—পরগনা ১৩৬, জমা ৭,৮৫,২০১।

এই মজকুরী জমিদারী ও তালুকগুলি আয়তনে ছোট এবং বিভিন্ন চাকলায় ছড়ানো ছিল। এগুলি ২১টি বিভাগে সমাবেশ করে খাজনা আদায় করা হত। এক একটি বিভাগে এক একজন জমিদার থাকার কথা ছিল, কিন্তু পরে ক্রমাগত বিভাজন হতে হতে বহু ভূস্বামীর উৎপত্তি হয়। ১৭২৮ খ্রীস্টাব্দে ২১ ভাগের তালিকা নিম্নে দেওয়া হল:

(১) ভিরোল—পরগনা ১৩, জমা ২৪১,৩৯৭। সরকার সিরীসাবাদ।

(২) মণ্ডলঘাট—পরগনা ৫, জমা ১,৪৬,২৬১। ১৭২৮-এ পদ্মনাথ নামে এক স্বাধীন জমিদার ছিলেন। পরে বর্ধমানের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়।

(৩) অরসা—পরগনা ১১, জমা ১,২৫,৩৫১। ১৭২৮-এ জমিদার ছিলেন রঘুদেব। পরে বর্ধমানের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়।

(৪) চুণাখালি—পরগনা ৩, জমা ৯৫,৪০৭। এর মধ্যে মুর্শিদাবাদ শহর ও খাস তালুকগুলি অবস্থিত ছিল—এগুলি সমীপবর্তী রাজশাহী জমিদারী থেকে আলাদা।

(৫) আসদনগর—পরগনা ৩, জমা ৬২,৭৯৮। সরকার সিরীসাবাদ।

(৬) জাহাঙ্গীরপুর—পরগনা ১১, জমা ৬৪,২৪৯।

(৭) আটিয়া, কাগমারী, বড়বাজু—পরগনা ১০, জমা ৬৭,৮৮৩। চাকলা ঘোড়াঘাটের তিনটি মুসলমান জমিদারী। আটিয়ার পন্নী বংশ অতি সম্ভ্রান্ত ও প্রাচীন মুসলমান বংশ। এঁরা নিজেদের গৌড়ের শেষ পাঠান সুলতান সুলেমান কর্‌রানীর বংশধর বলে দাবি করেন। এই বংশের প্রতিষ্ঠাতা সইদ খান পন্নী (সোলেমানের পৌত্র) আটিয়া পরগনা লাভ করে জাতিবর্ণ নির্বিশেষে সমস্ত প্রজাদের মধ্যে এক পঞ্চমাংশ কর্ষিত জমি ‘সরকমী’ নামক নিষ্কর দান করেন। তাঁর পৌত্র মইন খান চৌধুরী আওরঙ্গজেবের কাছ থেকে আটিয়ার ‘চৌধরাই’ ফারমান পান। এঁর ছেলে খোদা নেওয়াজ খান নবাবের কোপে পড়ে রানী ভবানীর কাছে কিছু দিনের জন্য জমিদারী হারিয়েছিলেন বলে কথিত আছে, পরে সম্পত্তি পুনরুদ্ধার করেন। তাঁর ছেলে আলেপ খানের সময় চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত হয়।১৬০

(৮) সিলবার্সা—পরগনা ১, জমা ৫৭,৪২১। বগুড়ার এই প্রাচীন মুসলমান বংশ ১৬৭৫ খ্রীস্টাব্দ থেকে এর জমিদার। আওরঙ্গজেবের আমলে সৈয়দ আহমদ সিলবার্সার চৌধুরী নিযুক্ত হন। ইংরেজ আমলে তাঁর অন্যতম বংশধর ছিলেন সৈয়দ আলতাফ আলী।

(৯) তাহিরপুর—পরগনা ৩, জমা ৫৫,৭৯১। চাকলা ঘোড়াঘাট। রাজশাহী জেলার প্রাচীন হিন্দু জমিদার বংশ।

(১০) চাঁদলাই—পরগনা ৭, জমা ৫৫,৭২৯।

(১১) পিতলাদি ও কুণ্ডী—পরগনা ৭, জমা ৬৭,৬৩২।

(১২) সন্তোষ—পরগনা ২, জমা ৯৪,৮০৭।

(১৩) আলেপসিংহ ও ময়মনসিংহ—পরগনা ২, জমা ৭৫,৭৫৫। শ্রীকৃষ্ণ হাওলাদার মুর্শিদকুলী খানের আমলের একজন কানুনগো ছিলেন। অবাধ্য জমিদারদের শায়েস্তা করে খাজনা আদায় করে দেওয়ার পুরস্কার স্বরূপ তিনি ১৭১৮ খ্রীস্টাব্দে ময়মনসিংহের চৌধুরী নিযুক্ত হন। তাঁর ছেলে চাঁদ রায় খালসা বিভাগের প্রধান (সিয়র-উল-মুতাখ্‌খিরীনের চাইন রায়, রায় রায়ান?) হয়ে বাবার নামে জাফরশাহী পরগনা লিখিয়ে নেন। সে সময় ময়মনসিংহ অর্ধসভ্য পাহাড়ী উপজাতি অধ্যুষিত জংলী অঞ্চল ছিল। রাস্তাঘাট ছিল না। শ্রীকৃষ্ণ জঙ্গল কেটে বসতি করান এবং পশ্চিম থেকে ব্রাহ্মণ কায়স্থ পরিবার আনিয়ে পণ্ডিত পুরোহিত কর্মচারীর অভাব মোচন করেন। খাল কেটে, পুল বেঁধে তিনি চাষবাস প্রবর্তন করেন এবং হাট গঞ্জ বাজার স্থাপন করেন। মুসলমান পীর ও মসজিদ এবং হিন্দু পুরোহিত ও মন্দির প্রতিপালন নিমিত্ত তিনি বহু নিষ্কর জমি দান করেন। ১৭৫৮ খ্রীস্টাব্দে শ্রীকৃষ্ণ হাওলাদার মারা যান। তাঁর সমসাময়িক শ্রীকৃষ্ণ আচার্য চৌধুরী মুক্তাগাছা বংশের আদি পুরুষ। তিনিও বারেন্দ্র ব্রাহ্মণ এবং নবাবের রাজস্ব কর্মচারী ছিলেন এবং ১৭২৭ খ্রীস্টাব্দে তিনি আলেপশাহী বা আলেপসিংহ পরগনা প্রাপ্ত হয়ে জঙ্গল কেটে চাষবাস শুরু করান।১৬১

(১৪) সাতসইকা—পরগনা ৩, জমা ৫১,১৬৭। মহম্মদ আকরাম চৌধুরীর সঙ্গে বন্দোবস্ত ছিল।

(১৫) মহম্মদ আমিনপুর—পরগনা ১৪, জমা ১,৪০,০৪৬ (জায়গীর বাদে)। সরকার সাতগাঁও।

(১৬) পেত্তাস, খড়দা, ফতেহ্‌জঙ্গপুর—পরগনা ৯, জমা ১,০০,৮৭৮। চাকলা ঘোড়াঘাটের এই তিন জমিদারী পরে দিনাজপুরের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়।

(১৭) পুখুরিয়া, জাফরশাহী—পরগনা ৫, জমা ৫৪,৫১৯। সরকার বাজুহা-তে অবস্থিত দুটি ভিন্ন ভিন্ন জমিদারী। একটি পরে রাজশাহী, অন্যটি ঢাকা জালালপুরের অন্তর্গত হয়।

(১৮) মৈহাটি—পরগনা ১৭, জমা ২৮,৮৩১। সরকার সাতগাঁও।

(১৯) তালুকদারান্ হুজুরী—পরগনা ২, জমা ৯৫,৮৫৫।

মুর্শিদাবাদ ও হুগলী অঞ্চলের ৯৮ জন হুজুরী তালুকদার। এঁরা কোনো জমিদারের অধীনস্থ ছিলেন না, সরাসরি খালসায় খাজনা দিতেন।

(২০) সায়রৎ মহল আকবর নগর—পরগনা ২, জমা ৫৪,৪৩২। পরে এটি রাজমহলের ফৌজদারী ভুক্ত হয়।

(২১) মজকুরী মহল—পরগনা ৮, জমা ৪৮,৯৯২।

বিভিন্ন স্থানে ছড়ানো ছোট ছোট মহল।

উপরোক্ত ২৫টি ইহতমামে বিভক্ত সমগ্র খালসার খাজনা ছিল মোট ১,০৯,১৮,০৮৪। খালসা বিভাগে মোট পরগনার সংখ্যা ১২৫৬। ২৫টি ইহ্‌তমামের মধ্যে ১৫টি বৃহৎ জমিদারী এবং অন্য দশটি বহুতর জমিদার সম্বলিত ইহ্‌তমাম। এবার খাল থেকে সরানো জায়গাগুলির হিসাব নেওয়া যাক।

জায়গীর

প্রথমেই বলা দরকার যে জায়গীর এলাকার মধ্যেও জমিদারী, তালুক ইত্যাদি ভূস্বত্ব ছিল। তফাতের মধ্যে, জমিদার প্রদত্ত খাজনা খালসায় না গিয়ে জায়গীরদারের কাছে যেত। অর্থাৎ জায়গীর ভোগী মনসবদাররা এবং তাঁদের নৌবহর ও সৈন্য সামন্তরা রাজকোষ থেকে বেতন না নিয়ে সরাসরি নির্দিষ্ট ভূস্বামীদের কাছ থেকে টাকা আদায় করতেন। মোগল শাসকশ্রেণী আর্থিকভাবে এই জায়গীরগুলির উপর দাঁড়িয়েছিল।

১। সরকার আলী—পরগনা ৬০, জমা ১০,৭০,৪৬৫।

এটি আকবরের আমল থেকে বাংলার নাজিম বা সুবাহ্‌দারের জায়গীর রূপে নির্দিষ্ট ছিল এবং নাজিম পরিবার এর তত্ত্বাবধান করতেন। বাংলার নাজিমরা মোগল দরবারে হফং হজারী মনসবদার ছিলেন। বলা বাহুল্য, সাত হাজারীর উপযুক্ত জায়গীর তাঁদের প্রাপ্য ছিল। গোটা পরগনা এবং পরগনার টুকরো মিলিয়ে মোট ২৯৬ খানা তরফ জুড়ে এই জায়গীর ছিল এবং এই টুকরোগুলি বাংলার মোট ৩৪ খানা সরকারের মধ্যে ২১ খানা সরকারে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল। তার অর্ধেক ঢাকার নিয়াবতে ও হিজলীর ফৌজদারীতে এবং অপর অর্ধ যশোহর, রাজশাহী, কৃষ্ণনগর ও দিনাজপুর জমিদারীতে অবস্থিত ছিল। রেনেল এর পরিমাপ করেননি, কিন্তু গ্র্যান্ট আন্দাজ মতো ৫,৫০০ বর্গমাইল লিখে রেখেছিলেন। এত বড়ো জায়গীর আকবরের আমল থেকে নাজিমের নামে সরিয়ে রাখার কারণ, সুবাহ্‌ বাংলায় যে মোগল বাহিনী মোতায়েন থাকত, তার খরচ বহুলাংশে এই জায়গীর থেকে নাজিমরা নির্বাহ করতেন। শুধু তাই নয়, সন্ধিবিগ্রহ এবং দৌত্যের খরচ, নাজিমের অধীন সদর নিজামত আদালতের যাবতীয় ব্যয় এবং নাজিম পরিবারের নিজস্ব খরচাও ‘সরকার আলী’ জায়গীর থেকে নির্বাহ হত। বাংলার স্বাধীন নবাবদের আমলে নাজিম ও দেওয়ানের আলাদা আলাদা পদ ঘুচে গেলে পর, সুজাউদ্দিন খানের আমল থেকে দেখা যায়, দেওয়ানী বিভাগের খালসার কর্মচারীরাই এই জায়গীর পরিচালনা করছেন। প্রসঙ্গত বলা যায় যে নবাব সিরাজউদ্দৌলাহ্‌ এবং নবাব মীরজাফরের নিজামত পর্যন্ত ‘সরকার আলীর’ চরিত্র অপরিবর্তিত ছিল, কিন্তু মীরজাফরকে হটিয়ে তাঁর জামাই মীরকাশিম যখন শ্বশুরের নায়েব হিসাবে নিজামত পরিগ্রহ করেন, তখন এই জায়গীর খালসায় বাজেয়াপ্ত হয় এবং মোগল বাদশাহ্‌কে বলে কয়ে মীরকাশিম শ্বশুরের জন্য নতুন একটি ‘সদর আলী’ জায়গীর তৈরি করে দেন। মীরজাফর তখনো নামে নাজিম, তাই তাঁর পদমর্যাদা অনুযায়ী এর আয় আরো একটু বাড়িয়ে ১১,৫২,৮৭৯ টাকা করে দেওয়া হয়। নামে মাত্র নাজিম মীরজাফরের এই নতুন জায়গীরদারের বৃহত্তর অংশ গিয়ে পড়ে রানী ভবানীর ভাতুড়িয়া জমিদারীতে।১৬২ রানী ভবানীর জন্য নানকর হিসাবে ৪৮১০ টাকা ধরে দিয়ে ভাতুড়িয়ার বাকি আয় (মোট জমা ছিল ৭৮,৯৯০ টাকা) মীরকাশিম শ্বশুরকে দিয়ে দেন। কিন্তু আগে ‘সরকার আলী’ থেকে যেমন সওয়ার বাহিনী ও দৌত্যের খরচ নির্বাহ হত, ঠুঁটো জগন্নাথ মীরজাফরের তেমন খরচ ছিল না। তবে সদর নিজামত আদালতের কর্তৃত্ব তখনো তাঁর হাতে ছিল এবং সেই খরচ বাদে ‘সদর আলী’ জায়গীরের সমস্ত আয়টুকু তাঁর ব্যক্তিগত আয়ে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল।

২। বন্দেওয়ালা বর্গাহ্‌—পরগনা ২০, জমা ১,৪৬,২৫০।

বাদশাহী আমল থেকে এই জায়গীর সুবাহ্ বাংলার দেওয়ানের জন্য নির্দিষ্ট ছিল। বাংলার দেওয়ানারা পদমর্যাদায় চার হাজারী মনসবদার ছিলেন এবং তাঁদের ২৫০০ সওয়ার থাকার কথা ছিল। তদনুযায়ী ৯৭টি ভগ্ন পরগনা নিয়ে বন্দেওয়ালা বর্গাহ্‌ জায়গীর গঠিত হয়। এর অর্ধেক ছিল রানী ভবানীর বাহিরবন্দ ও ভিতরবন্দ জমিদারীতে, বাকি অর্ধেক রঙপুরের ফৌজদারীতে। গ্রান্টের আন্দাজ অনুযায়ী এর আয়তন ছিল ২০০০ বর্গমাইল। বলা বাহুল্য, স্বাধীন নাজিমরা যুগপৎ দেওয়ান হয়ে যাবার পর থেকে তাঁরাই এর আয় ভোগ করতেন। মীরকাশিমের আমলে দেখা যায়, তিনি এর নাম বদলে মোদর-উল-মোহন রেখে এর আয় বাড়িয়ে ২,৩৮,৯৯২ টাকা করেছেন। ১৭৬৫ খ্রীস্টাব্দে ইংরাজ ঈস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি দেওয়ান হয়ে এই দেওয়ানী জায়গীর ‘আলতামগা’ আকারে, অর্থাৎ চিরকালীন ভাবে, প্রাপ্ত হয়েছিল।

৩। আমীর-উল-উমরা—পরগনা ১৮, জমা ১,৪৬,২৫০।

নবাব সুজাউদ্দিন খানের আমল পর্যন্ত এই জায়গীর মোগল সাম্রাজ্যের বকশী বা সেনাপতি খান দৌরানের জন্য নির্দিষ্ট ছিল। দিল্লীর সেনাপতি যাতে সুবাহ্ বাংলার প্রত্যন্ত এলাকাগুলির নিরাপত্তার দিকে অন্তত স্বার্থপ্রণোদিত হয়ে নজর রাখেন, এই উদ্দেশ্যে বুদ্ধি করে বকশী বা সেনাপতির জায়গীরের ৬৩ খানা টুকরো নিম্নবঙ্গের সমুদ্রোপকূলে, ঢাকা নিয়াবতে, সিলেট ফৌজদারীতে এবং আসাম প্রান্তের খাড়িবাড়িতে ছড়িয়ে রাখা ছিল। বর্গি আক্রমণ শুরু হবার পর থেকে আলিবর্দি খান দিল্লী দরবারে খাজনা পাঠানো বন্ধ করে দেন। অতএব অনুমান করা চলে ঐ সময় থেকে এই জায়গীরের আয় আর দিল্লীর বকশীর কাছে না গিয়ে মুর্শিদাবাদের নবাবের কাছে যেত। মীরকাশিমের আমলে দেখা যায় ‘আমীর-উল-উমরা’ জায়গীর বাজেয়াপ্ত করে তা থেকে তিনি ‘বকশিয়ান আজম’ নামে এক নতুন জায়গীর সৃষ্টি করেছেন, তার হ্রাস প্রাপ্ত আয় ১,০৮,৫৩০ টাকা।

৪। ফৌজদারান্‌—পরগনা ৭৫, জমা ৪,৯২,৮০০।

১৭২৮ খ্রীস্টাব্দে সুজাউদ্দিন খানের নিজামতের গোড়ার দিকে বিভিন্ন সরকারে যাঁরা ফৌজদার ছিলেন, তাঁদের নামে এই জায়গীরগুলি লেখা ছিল। ১৭২৮ থেকে ১৭৫৭ পর্যন্ত বহু ফৌজদারের অদল বদল হয়েছিল, কিন্তু ইতস্তত বিক্ষিপ্ত ভাবে কয়েকজন ফৌজদারের নাম পাওয়া গেলেও ধারাবাহিক ভাবে সব ফৌজদারের নামের তালিকা নেই। ফৌজদার বদলী হলেও নির্দিষ্ট ফৌজদারীর জায়গীর ঠিকই থাকত এবং পলাশীর যুদ্ধের পরেও কিছুদিন এই খাতে একই হিসাব ধরা ছিল। লক্ষণীয় বস্তু হল এই যে, ফৌজদাররা প্রায় সকলেই মোগল মনসবদার এবং উচ্চবংশীয় মুসলমান। এই গুরুত্বপূর্ণ সামরিক পদে পলাশীর যুদ্ধ পর্যন্ত মহারাজ নন্দকুমারের মতো দু-এক জন ছাড়া কোনো হিন্দুর অনুপ্রবেশ হয়নি, এবং নন্দকুমার নিজেও পলাশীর যুদ্ধের সময় হুগলীর অস্থায়ী নায়েব ফৌজদার ছিলেন। ১৭২৮-এর বন্দোবস্তে বা তার পরে হুগলীর ফৌজদারের নামে কোনো আলাদা জায়গীর ধরা ছিল না। কেবল মাত্র সামরিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ পাঁচখানি প্রত্যন্ত প্রদেশের ফৌজদারের জন্যে স্থায়ীভাবে দেওয়ানী বিভাগে জায়গীর নির্দিষ্ট করা ছিল:

(১) ঢাকা নিয়াবত—পরগনা ১১, জমা ১,০০,১৪৫।

১৭২৮ খ্রীস্টাব্দে ঢাকার নায়েব নাজিম ছিলেন নবাব সুজাউদ্দিনের আত্মীয় মুর্শিদকুলী খান, যিনি পরে ওড়িশার নায়েব নাজিম হন এবং আলিবর্দি খান কর্তৃক ওড়িশা থেকে বিতাড়িত হন। ঢাকা প্রদেশের থানাজাত সৈন্য, তোপখানার দারোগাই এবং নওয়ারার খরচের জন্য এই জায়গীর ধরা ছিল। সমস্ত জায়গীর নিয়াবতের মধ্যেই ছিল।

(২) সিলেটের ফৌজদারী—পরগনা ৪৮, জমা ১,৭৯,১৬৬।

১৭২৮ খ্রীস্টাব্দে ফৌজদার শামসের খান এবং তাঁর অধস্তন চার জন সেনানায়কের জন্য নির্দিষ্ট ছিল। জায়গীরের বেশির ভাগ সিলেটের মধ্যে হলেও এক সপ্তমাংশ রাজমহল ফৌজদারীর মধ্যে অবস্থিত ছিল। আওরঙ্গজেবের মৃত্যুর অব্যবহিত পরে হরেকৃষ্ণ নামে এক হিন্দু দুই বছরের জন্য (১৭০৯—১১) ফৌজদার হয়েছিলেন, কিন্তু তাঁকে হত্যা করে ভূতপূর্ব ফৌজদার শুকুরাল্লাহ্‌ খান পুনরায় ঐ পদে নিযুক্ত হন। শুকুরাল্লাহ্‌ খানের পর পূর্বোক্ত শামসের খান ফৌজদার হন এবং তিনিও যুদ্ধে নিহত হন। তারপর যথাক্রমে ফৌজদার হন বহরাম খান (১৭৪৪ খ্রীঃ), আলাকুলি বেগ (১৭৪৮), তালিব আলী, নজিব আলী (১৭৫১), শাহ মতজঙ্গ নওয়াজিশ মহম্মদ খান (১৭৫৭)১৬৩

(৩) পূর্ণিয়ার ফৌজদারী—পরগনা ৯, জমা ১,৮০,১৬৬।

১৭২৮ খ্রীস্টাব্দে সইফ খান ফৌজদার ছিলেন। ১৭৫৬ খ্রীস্টাব্দে ফৌজদার ছিলেন সিরাজউদ্দৌলাহ্‌র মাসতুতো ভাই ও প্রতিদ্বন্দ্বী শওকৎ জঙ্গ।

(৪) রাজমহল ফৌজদারী—পরগনা ৪, জমা ১৬,৬৬৬।

১৭২৮ খ্রীস্টাব্দে ফৌজদার ছিলেন আলিবর্দি খান। পরে পদোন্নতি হয়ে তিনি আজিমাবাদের (পাটনার) নায়েব নাজিম এবং তারপর সুবাহ্ বাংলা বিহার ওড়িষার নাজিম অর্থাৎ সুবাহ্‌দার হয়েছিলেন। ১৭৫৭ খ্রীস্টাব্দে ফৌজদার ছিলেন মীরজাফরের ভাই মীর দাউদ।

(৫) ঘোড়াঘাট ফৌজদারী—পরগনা ৩, জমা ১৬,৬৬৬।

১৭২৮ খ্রীস্টাব্দে ঘোড়াঘাট বা রঙপুরের ফৌজদার হন করম আলী। পলাশীর বিপ্লবের পর কিছুদিন মীরকাশিম রঙপুরের ফৌজদার ছিলেন এবং এই জায়গীরের টাকার বলেই তিনি মুর্শিদাবাদের তখৎ দখল করতে সমর্থ হন।

৫। মনসবদারান্‌—পরগনা ২০, জমা ১,১০,৮৫২।

এই ছোট ছোট মহলগুলি প্রধানত ঢাকা নিয়াবত এবং সিলেট, হিজলী ও রাজমহল ফৌজদারীতে অবস্থিত ছিল। ২১ জন নিম্নপদস্থ মনসবদারের জন্য এই জায়গীরগুলি নির্দিষ্ট ছিল। এঁরা সবাই পাঁচশ জাৎ পদের বা তার নিম্নতন মনসবদার। নাজিমরা ডেকে পাঠালে এঁরা নিজেদের শ’ দু তিন সওয়ার নিয়ে সশরীরে হাজিরা দিতেন।

৬। জমিনদারান্—পরগনা ২, জমা ৪৯,৭৫০।

চারজন প্রত্যন্ত জমিদার—ত্রিপুরা, মুচোয়া, সুসঙ্গ এবং তেলিয়াগঢ়ি গিরিবর্ত্ম—নিজেদের জমিদারীর মধ্যে সীমান্তরক্ষার খরচ হিসাবে এই জায়গীরগুলি ভোগ করতেন। ত্রিপুরা ও সুসঙ্গ বংশ অতি প্রাচীন। প্রাচীন কাল থেকে গারো পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত, সুসঙ্গ পরগনা এক ব্রাহ্মণ রাজবংশের অধিকারে ছিল। মোগল শাসনের প্রারম্ভে সুসঙ্গের রাজারা ত্রিপুরা বংশের মতোই স্বাধীন ছিলেন। মালিক রঘুনাথ বাদশাহী সৈন্যের সাহায্যে গারোদের দমন করে প্রথম অগুরু কাঠের পেশকাশ দেন। রঘুনাথের পৌত্র রামজীবন সিংহ বাদশাহী সনদ দ্বারা প্রথম ‘জমিদার’ নিযুক্ত হন।

৭। মদদ ই মাশ—পরগনা ৭, জমা ২৫,৬৬৫।

পাণ্ডুয়া বা পেঁড়োর মসজিদ ও মাদ্রাসার ভোগে এবং দরবেশ ও আলিম প্রতিপালনার্থে, বর্ধমানে ও রাজমহলে এই জায়গীরগুলি সৃষ্টি করা হয়েছিল।

৮। শালিয়ানাদারান্‌—পরগনা ৯, জমা ২৫,৬৬৫।

জমিদার ও অন্যান্য বাৎসরিক কিছু ভাতার নিমিত্ত সিলেট ফৌজদারীতে এই জায়গীরগুলি বাঁধা ছিল।

৯। ইনাম আল তমগা—পরগনা ১, জমা ২১২৭।

একমাত্র এই জায়গীর খানা বংশানুক্রমিক ছিল। এমনিতে পদান্তর বা পদচ্যুতি হলে জায়গীর আর থাকত না। ইসলামের আইন ব্যাখ্যাকারী দুজন মৌলবী এই আলতামগা বা চিরস্থায়ী জায়গীর লাভ করেছিলেন।

১০। রুজিআনদারান্‌—জমা ৩৩৭।

একজন মোল্লাকে প্রদত্ত লস্করপুরের এক ছোট তালুক।

১১। আমলে নওয়ারা—পরগনা ৫৫, জমা ৭,৭৮,৯৫৪।

মগ ও হার্মাদ আক্রমণ রোধ করার জন্য ঢাকা বন্দরে ৭৬৮ খানা সশস্ত্র রণতরী সম্বলিত নওয়ারা মোতায়েন ছিল। জলযুদ্ধে পটু পর্তুগীজ ও ফিরিঙ্গী নাবিকদের দিয়ে এই নওয়ারা চালানো হত। তাদের মাস মাইনে দিয়ে নওয়ারা মোতায়েন রাখতে মাসে ২৯,২৮২ টাকা খরচ হত, সেই সঙ্গে পুরোন রণতরী মেরামত ও নতুন রণতরী বানানো বাবদ মোট বাৎসরিক ৮,৪৩,৪৫২ টাকার কাছাকাছি পরিমাণ অর্থ লাগত। সেই ব্যয় নির্বাহের জন্য চাকলা জাহাঙ্গীরপুরের ৯৯ খানা বাছা বাছা সমৃদ্ধ মহল এবং সিলেট ফৌজদারীতে ১৩ খানা মহল, এই মোট ১১২ খানা মহলের জায়গীর নওয়ারার জন্য বাঁধা ছিল। তা ছাড়া প্রত্যন্ত প্রদেশের জমিদারদের কাছ থেকে পেশকাশ হিসাবে ৫০,০০০ টাকার উপর আদায় হত, কিন্তু অন্যান্য মুদ্রা থেকে সিক্কা রূপাইয়াতে পরিণত করার বাটা দিতে ১৪,০০০ টাকা চলে যেত। এই পুরো হিসাবপত্র ও জমাখরচ নিয়ন্ত্রণ নওয়ারার পেশকার রাজবল্লভ সেনের হাতে ছিল। নবাবজাদা সিরাজউদ্দৌলাহ্‌ অভিযোগ এনেছিলেন যে রাজবল্লভ নওয়ারার জায়গীর থেকে অনেক টাকা সরিয়েছেন। ঐ অভিযোগের সূত্র ধরে কৃষ্ণদাসের কলকাতা পলায়ন ও তাই থেকে সিরাজ-ইংরাজ সংঘর্ষ ইতিহাসের সুবিদিত ঘটনা।

১২। আমলে আসাম—পরগনা ১৩, জমা ১,৩৫,০৬০।

ঢাকা, ইসলামাবাদ (চাটগাঁ), রাঙ্গামাটি ও সিলেট অবস্থিত এই জায়গীর থেকে পূর্ব সীমান্ত রক্ষার ব্যয় নির্বাহ হত। এই টাকায় ৮১১২ সওয়ার এবং তোপখানার গোলন্দাজ রাখার ব্যবস্থা ছিল।

১৩। খেদা আফিল—জমা ৪০,১০১।

হাতি ধরার খরচের জন্য ত্রিপুরা ও সিলেটের এই মহলগুলির নির্দিষ্ট ছিল। এবার সংক্ষেপে উপরোক্ত হিসাবের যোগফল দেখা যাক:

খালসাপরগনাজমা
১৫টি বৃহৎ জমিদারী ইহ্‌তমাম৬১৫৬৫,২২,১১১
৯টি বিভিন্ন জমিদারী সমষ্টি সম্বলিত ইহ্‌তমাম৫০৫২৬,১০,৭৭২
২১ মজকুরী তালুক ও জমিদারী১৩৬১৭,৮৫,২০১
   
 ১২৫৬১০৯,১৮,০৮৪
জায়গীরপরগনাজমা
নাজিম, দেওয়ান, ফৌজদারান্‌ মনসবদারান্‌ ইত্যাদি রাজপুরুষ২১২২১,৪৯,২৪২
নওয়ারা, সীমান্ত সওয়ার ও রণহস্তী১৯২১৬৪১১,৭৮,২৩৫
   
 ৪০৪৩৩,২৭,৪৭৭
সুজাউদ্দিন খানের আমলে মোট খালসা ও জায়গীর (১৭২৮)১৬৬০১,৪২,৪৫,৫৬১
১৭২২ এর পুরা জমার জন্য এর সঙ্গে যোগ করতে হবে ৪২,৬২৫
মুর্শিদকুলী খানের জমা কামিল তুমারী (১৭২২)১৬৬০১,৪২,৮৮,১৮৬

হিসাব অনেক দীর্ঘ হল। কিন্তু এই বন্দোবস্তের সংখ্যাতত্ত্বমূলক ফিরিস্তি থেকে গোটা নবাবী রাষ্ট্রের বৈষয়িক কাঠামো সম্বন্ধে যতখানি সামগ্রিক ধারণা করা সম্ভব, তেমন আর কিছু থেকে নয়। এই বন্দোবস্ত পর্যবেক্ষণ করলে এক নজরে প্রতীয়মান হয় যে, মাল জমির উদ্বৃত্ত ফসল কেনাবেচার মাধ্যমে টাকায় পরিণত হয়ে সেই টাকা দুটি প্রধান শ্রেণীর মধ্যে ভাগ হত—মোগল শাসক শ্রেণী এবং স্থানীয় ভূস্বামী বৰ্গ। মোগল শাসক শ্রেণীর ভোগের জন্য নির্দিষ্ট ছিল ‘জমা’। কৃষকদের কাছ থেকে এই জমা আদায় করে দিতেন জমিদার তালুকদার ও অন্যান্য ভূস্বামী। এই ‘খিদমতের’ জন্য তাঁরা ‘রসুম’ ও ‘নানকর’ পেতেন। রসুম ও নানাকর নিয়ে তাঁরা যে জমা আদায় করে দিতেন, তার এক অংশ যেত খালসায় অর্থাৎ নবাব সরকারে, অন্য অংশ যেত জায়গীরদারদের হাতে। খালসা ও জায়গীরের গোটা আয়ে নবাব, নবাবের অধীনস্থ মোগল রাজপুরুষ এবং তাঁদের চালিত সওয়ার বাহিনী ও নওয়ারা, গোলন্দাজ বরকন্দাজ ইত্যাদির ব্যয় নির্বাহ হত। যেহেতু জমিদারদের যথাযথ দায়িত্ব পালনের উপর গোটা মোগল শাসক শ্রেণী ও সমর বাহিনীর বৈষয়িক ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত ছিল। তাই জমিদারদের বশে রাখার জন্য ঢাকায় নায়েব নাজিম এবং রঙপুর, রাজমহল পূর্ণিয়া, সিলেট ইত্যাদি প্রত্যন্ত প্রদেশ এবং কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ আভ্যন্তরীণ কেন্দ্রে মনসবদার শ্রেণীভুক্ত ফৌজদাররা মোতায়েন থাকতেন। ঠিক মতো সময়ে খাজনা আদায় করে জমিদারদের উপর নবাবী কর্তৃত্ব বজায় রাখার জন্য মুর্শিদকুলী খান পুণ্যাহ প্রথা চালু করেছিলেন।১৬৫ বছরের প্রথম দিন (পয়লা বৈশাখ) জমিদাররা (বা তাঁদের উকীলরা) নৌকায় বা পালকিতে চড়ে বাংলা দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে এসে মুর্শিদাবাদে সমবেত হয়ে নবাব দরবারে হাজিরা দিতেন। গত বছর ঐ একই দিনে মুর্শিদাবাদে এসে তাঁরা যে খাজনা দিতে অঙ্গীকার বদ্ধ হয়েছিলেন, সেই খাজনার শেষ কিস্তি তাঁরা এই সময়ে নবাব সমীপে সেলাম করে সোনার মোহরের নজরানা সহ পেশ করতেন এবং নবাব পদমর্যাদানুযায়ী জমিদার ও আমিলদের খেলাৎ বা শিরোপা, অর্থাৎ মাথা থেকে পা পর্যন্ত পাগড়ী, পোশাক ও কোমরবন্দ দান করতেন।১৬৬ নিজেদের নিজেদের জমিদারীতে ফিরে গিয়ে জমিদাররা আবার আমলা ও প্রজাদের ডেকে জমিদারী পুণ্যাহ পালন করতেন, সেখানে অপেক্ষাকৃত কম জাঁকালো ভাবে একই অনুষ্ঠান হত। মুর্শিদাবাদে কিস্তী দেবার সময় জমিদাররা প্রয়োজন মতো জগৎ শেঠের কাছ থেকে কর্জ পেতেন। গোটা রাজস্ব ব্যবস্থা যাতে কিস্তীতে কিস্তীতে যথা সময়ে আবর্তিত হতে পারে, সেই জন্য জগৎ শেঠের সাহায্য কি নবাব, কি জমিদার সবার পক্ষে অপরিহার্য ছিল। পুণ্যাহের দিন মুর্শিদাবাদে নবাব ও তাঁর অধীনস্থ বেতন বা জায়গীর ভোগী রাজ-পুরুষরা, জগৎ শেঠ এবং বাংলার জমিদারবৃন্দ মুখোমুখি হয়ে গোটা শাসন ব্যবস্থার একটা চাক্ষুষ দৃশ্যপট উপস্থাপন করতেন, এবং ঐ দিন দরবারের মধ্যে কার কি স্থান তা স্পষ্ট হয়ে যেত। আলিবর্দি খানের আমলের একটি পুণ্যাহ অনুষ্ঠানে দেখা যায়, বাংলা দেশের নানা দিক থেকে অন্তত ৪০০ জমিদার ও অন্যান্য রাজকর্মচারী এসে খাজনা দাখিল করেছেন।১৬৭ বস্তুত পক্ষে মুর্শিদকুলী খান তাঁর নবনির্মিত সুবাহ্‌ শাসনযন্ত্রের কোঠায় কোঠায় মোগল মনসবদারান্‌, জগৎ শেঠ ও আমিল, কানুনগো, জমিদার বর্গের স্থান নির্দিষ্ট করে এক নতুন ক্ষমতার কাঠামো তৈরি করেছিলেন, এই কাঠামোর অভ্যন্তর থেকে পলাশীর ষড়যন্ত্রের উদ্ভব হয়।

জমির বন্দোবস্তের হিসাব থেকে সমাজের উপরিস্থিত মহলের দুটি কোঠা ধরা পড়েছে—উপরের কোঠায় মোগল শাসক শ্রেণী ও নীচের কোঠায় হিন্দু ও পাঠান জমিদার বর্গ। এবার আর একটি কোঠার দিকে নজর দিলে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত মহলের পুরো কাঠামোটা চোখে পড়বে। অষ্টাদশ শতকের গোড়া থেকে নবাবী রাষ্ট্র ব্যবস্থার অন্তর্দেশ পর্যন্ত দেশীয় বণিকশক্তির প্রভাব গভীরভাবে সঞ্চারিত হয়েছিল। নবাব দরবার ও বিদেশী কোম্পানিগুলির মধ্যে দেশীয় শেঠ সাহুকর ও সওদাগর মধ্যস্থরূপে অবতীর্ণ হওয়ায় রাষ্ট্রীয় সন্ধিবিগ্রহে এদের ভূমিকা উত্তরোত্তর গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। জগৎ শেঠের ষড়যন্ত্রে আলিবর্দি খান সরফরাজ খানকে হটিয়ে মসনদ দখল করেছিলেন। তাঁর আমল থেকেই দরবারে শেঠ সওদাগরদের প্রভাব বিশেষ ভাবে চোখে পড়তে থাকে। মারাঠাদের প্রতিরোধ সাধনে আলিবর্দি খান জগৎ শেঠ ও অন্যান্য সওদাগরদের কাছ থেকে যে বিরাট পরিমাণ অর্থ সাহায্য পেয়েছিলেন, তাতে দরবারে তাঁদের প্রতিপত্তি আরো বেড়ে গিয়েছিল।

সপ্তদশ শতকে বাংলাদেশে মোগল রাষ্ট্রশক্তি যখন পূর্ণমাত্রায় বজায় ছিল তখন সওদাগরদের স্থান এত উঁচুতে ছিল না। মীর জুমলা ও শায়েস্তা খানের মতো বড়ো বড়ো রাজপুরুষরা নিজেরা ফলাও সওদা করতেন, সে তুলনায় যাঁরা পেশাগত ভাবে সওদাগর ছিলেন তাঁরা কিছুটা নিষ্প্রভ হয়ে পড়েছিলেন। অপরপক্ষে অষ্টাদশ শতকে প্রধানত পেশাদার সওদাগররাই সওদা করতেন, রাজপুরুষদের মধ্যে কারবার করার চল আর তত ছিল না। আলিবর্দির দাদা হাজি আহমদ এবং সিরাজউদ্দৌলাহ্‌র মা আমিনা বেগম সোরা বেচাকেনা করতেন, কিন্তু সেটা ব্যতিক্রম। বাদশাহ আওরঙ্গজেবের ভাষায় বলতে গেলে রাজপুরুষদের কারবার হল ‘সওদা-ই-খাস’। আর তা লক্ষণীয় ভাবে কমে গিয়ে তার তুলনায় সাধারণ সওদাগরদের ‘সওদা-ই-আম’ বেড়ে গিয়েছিল। বাদশাহজাদা আজিম-উশ-শান বাংলার সুবাহ্‌দার হয়ে এসে সওদা করতে শুরু করেছেন শুনে ক্রুদ্ধ হয়ে বৃদ্ধ সম্রাট পুত্রকে লিখেছিলেন: ‘সরকারী জুলুমকে সওদা-ই-খাস’ নাম দিয়ে চালানোর কি মানে হয়? সওদা-ই-আম এর জায়গায় সওদা-ই-খাস ফলানোর কোন্ হক আছে?’ অর্থাৎ আম্‌ জনতার রুজি রোজগার বরবাদ করে খাস রাজপুরুষদের কারবারে নামার কি যুক্তি? এর সঙ্গে সম্রাট আওরঙ্গজেব ফারসী বয়েৎ-এর আকারে একখানা দার্শনিক তত্ত্বও জুড়ে দিয়েছিলেন:

কিনছে যে ফের বেচছে সেই
কেনায় বেচায় আমরা নেই।১৬৮

আম জনতার মতো সওদায় নামা যে ক্ষমতাবান রাজপুরুষের শোভা পায় না এই বোধ অষ্টাদশ শতকের উচ্চপদস্থ মুসলমান মনসবদারদের মধ্যে দানা বেধেছিল—আরওরঙ্গজেবের তিরস্কারের জন্যই হোক বা অন্য কোনো কারণেই হোক। ইংরেজ রাজশক্তি প্রতিষ্ঠিত হবার পর মোগল রাজপুরুষরা নবাবী আমলের যে গুণ বিশেষ ভাবে স্মরণ করতেন তা এই যে সে সময়ে ব্যবসা বাণিজ্যে রাজপুরুষদের অযথা হস্তক্ষেপ ছিল না। সরকারী পদের অপব্যবহার করে কেউ একচেটিয়া কারবার চালাতে পারতেন না। এই কথা মনে করে পরবর্তীকালে মোগল রাজপুরুষ মহম্মদ রেজা খান তাঁর ইংরেজ প্রভুদের স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন যে আলিবর্দির আমলে দূর দূরান্ত থেকে সওদাগররা এসে অবাধে বেচা কেনা করত। সে আমলে সমুদ্রপথে বাংলার বাণিজ্য মোটামুটি ভাবে ইংরেজ, ওলন্দাজ ও ফরাসী ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিগুলির হাতে চলে গেলেও জলপথে ও স্থলপথে তখনো আগ্রা, ফারুকাবাদ, লাহোর, মুলতান, সরত (Surat) ও হায়দরাবাদ থেকে বড়ো বড়ো সওদাগররা এসে বছর বছর কম করে সত্তর লক্ষ টাকার কাপড় ও রেশম কিনে নিয়ে যেতেন।১৬৯ এরও আগে মুর্শিদকুলী খানের আমলে সমুদ্রপথে বাংলার বহির্বাণিজ্য যখন ইওরোপীয় কোম্পানিগুলির হাতে সম্পূর্ণভাবে চলে যায়নি তখন হুগলী বন্দরে এশিয়া ও ভারতবর্ষের বিভিন্ন স্থান থেকে (রিয়াজ-উস-সলাতীনের ভাষায় ‘চীন, ইরান, তুরান থেকে’) বড়ো বড়ো সওদাগররা এসে সমবেত হতেন। রিয়াজের লেখকের ধারণা ছিল যে মুর্শিদকুলী খান আমদানী রপ্তানীর উপর উচিত শুল্কের বেশি এক পয়সা নিতেন না বলে ঐ সময় হুগলী বন্দর আরো জনবহুল হয়ে ওঠে। ‘আরব, আজম (অর্থাৎ ইরান ইত্যাদি) দেশের সব বন্দরগুলির সওদাগর, ঈশাই ইংরেজ জাহাজের মালিক এবং ধনী মোগলরা এখানে বসতি করেছিল কিন্তু এদের মধ্যে অন্যান্য জাতির সওদাগরদের চেয়ে মোগল সওদাগরদের সঙ্গতি বেশি ছিল।১৭০ পরে হুগলীর ফৌজদারদের অত্যাচারে এবং কলকাতার উত্তরোত্তর শ্রীবৃদ্ধির ফলে, হুগলী বন্দর আর আগের মতো জমজমাট রইল না। তা সত্ত্বেও আলিবর্দির সমকালীন আরমানী সওদাগররা বেশ জমাট ভাবে হুগলী থেকে সমুদ্রপথে ও নদীপথে ব্যবসা করত। এ ছাড়া সপ্তদশ শতক থেকেই কাশিমবাজারে ও পরে মুর্শিদাবাদে রেশম কেনার জন্য ধনী গুজরাটী বণিকদের উপনিবেশ গড়ে উঠেছিল। গুজরাট থেকে বাংলার তাঁতীদের জন্য তুলা আমদানী হত, এবং পরিবর্তে জলপথে গুজরাটে রেশম যেত। এই পুরো কারবার শেঠ সাহুকর সর্‌রাফ গোছের মহাজনরা হুণ্ডীর লেনদেনের মাধ্যমে খুব সহজ করে দিয়েছিলেন। নিম্ন বঙ্গে সুদূর কাশ্মীর থেকে কাশ্মীরী সওদাগররা এসে বছর বছর নিমক মহলের ইজারা নিয়ে সমুদ্রোপকূলের অপর্যাপ্ত লবণ ক্রয় করে নিয়ে যেত। আরমানী, মোগল, গুজরাটী, পাঞ্জাবী, কাশ্মীরী ও হিন্দুস্থানী সওদাগরদের সমাগমে সুবাহ্‌ বাংলার বাণিজ্যে কোনো ভাঁটা পড়তে পারেনি। মুর্শিদাবাদ, পাটনা, ঢাকা, হুগলী এবং ক্রমে ক্রমে কলকাতায় বহু শেঠ ও সওদাগর সমবেত হয়ে টাকাকড়ি লেনদেন ও জিনিসপত্রের কেনাবেচা করে সুবাহ্‌র সমৃদ্ধি অব্যাহত রেখেছিলেন।

আলিবর্দি খানের আমলে আবওয়াব ধরেও রাজস্ব ও শুল্কের হার এত নীচু ছিল যে শেঠ, সওদাগর ও জমিদারদের হাতে যথেষ্ট টাকা জমত এবং প্রয়োজন মতো—বিশেষ করে বর্গি হাঙ্গামা প্রতিরোধের জন্য তাঁরা অনায়াসে এক একবারে থোক টাকা দিয়ে নবাবকে সাহায্য করতেন। অনিচ্ছুক ইওরোপীয় কোম্পানিগুলি এই অর্থদান ব্যাপারটিকে ‘উৎকোচ’ বলে চিহ্নিত করত, কিন্তু দেশীয় শেঠ সওদাগররা একে ‘নজরানা’ বলে ভাবতে অভ্যস্ত ছিলেন। নজরানা দেওয়া এবং খেতাব নেওয়ার মাধ্যমে দরবারে তাঁদের সম্মানিত পদ নির্দিষ্ট হয়ে যেত। তদানীন্তন বড়ো বড়ো সওদাগররা দরবার থেকে জগৎ শেঠ, ফকর-উৎ-তুজ্জর ইত্যাদি খেতাব পেয়ে নিজেদের কৃতার্থ বোধ করতেন। এগুলি শুধু ফাঁকা খেতাব ছিল না, কারণ এ সব থেকেই বোঝা যেত দরবারে এক এক জন শেঠ ও সওদাগরের প্রভাব ও প্রতিপত্তি কতখানি এবং কাকে ধরলে দরবারে কার্যসিদ্ধি হতে পারে। অতএব সময় সময় প্রচুর পরিমাণ অর্থের সরবরাহ করতে হলেও সওদাগরদের চোখে নবাব দরবার স্থানটি কখনো বিভীষিকাময় বধ্যভূমি বলে প্রতীয়মান হয়নি। বরং দরবার থেকে দেশীয় বণিক সাহুকররা ইওরোপীয় কোম্পানিগুলির জোর জবরদস্তির বিরুদ্ধে যথেষ্ট সহায়তা পেতেন। ১৭৪৮ খ্রীস্টাব্দে হুগলীর মোগল ও আরমানী সওদাগরদের জাহাজ সমুদ্রপথে আটক করার অপরাধে আলিবর্দি খান ইংরাজদের বাণিজ্য বন্ধ করে দিয়ে কোম্পানিকে নিম্নরূপ পরোয়ানা দিয়েছিলেন:

‘হুগলীর সৈয়দ, মোগল, আরমানী ও অন্যান্য সওদাগরদের ফরিয়াদ এই যে আপনারা তাঁদের লাখ লাখ টাকার মাল ও দৌলত বোঝাই জাহাজ আটক ও লুঠ করেছেন। বিদেশের খবরে জানলাম, এ সব ফরাসীদের জাহাজ এই অজুহাতে আপনারা হুগলীর দিকের সব জাহাজ আটক করেছেন। মোখা থেকে আন্টনীর লাখ লাখ টাকার মাল বোঝাই জাহাজ, মায় আমার জন্য মোখার মুতাসেদ্দীর নজরানা পর্যন্ত আপনারা আটক করে লুঠ করেছেন। এই সওদাগরেরা রিয়াসতের হিতকারী, তাদের আমদানী রপ্তানী থেকে তামাম লোকের ফায়দা হয় এবং তাদের ফরিয়াদ এত গুরুতর যে আমি ইনসাফ না করে পারলাম না।

যেহেতু আপনাদের বোম্বেটেগিরি করে বেড়োনোর হক নেই তাই আমি লিখে দিলাম এই পরোয়ানা পাওয়া মাত্র সওদাগরদের সব মাল এবং আমার নজরের জিনিসগুলি বেবাক ছেড়ে দেবেন আর নইলে জরুর এ কথা জেনে রাখবেন যে আপনাদের এমন ওয়াজিব সাজা দেওয়া হবে যা আপনারা ভাবতেই পারেন না।’

হুগলীর মোগল ও আরমানী সওদাগরদের জাহাজ আমরা আটক করিনি, ইংল্যান্ডের রাজার জাহাজের ক্যাপ্টেন আটক করেছেন, এই অজুহাত দিয়ে কোম্পানির বড়োকর্তারা সেবার ছাড়া পাননি। শেষ পর্যন্ত জগৎশেঠের কাছে দীন ভাবে সাহায্য ভিক্ষা করে দরবারে অনেক খেসারত দিয়ে তাঁদের পুনরায় কারবার চালু করতে হয়েছিল। ইওরোপীয় কোম্পানিগুলির প্রভাব প্রতিপত্তি দেখে শঙ্কিত হয়ে আলিবর্দি খান বিবাদ বিসম্বাদে দেশীয় শেঠ ও সওদাগরদের পক্ষ নিতেন। তার ফলে মোগল, আরমানী ও হিন্দুস্থানী শেঠ ও সওদাগররা যথেষ্ট নিরাপত্তার সঙ্গে লেনদেন কেনাবেচা করতে পারত। পূর্বোক্ত ঘটনার চার বছর আগে ইংরেজ কোম্পানির সঙ্গে আমীরচন্দ (ইতিহাসের উমির চাঁদ) ও দীপচন্দ ভ্রাতৃদ্বয়ের বিবাদ বেধেছিল। পাটনার সোরা বেচাকেনার বকেয়া পাওনা নিয়ে এই বিবাদ। ইংরেজরা সালিশী না মেনে কলকাতার মেয়র কোর্টে ব্যাপারটা টেনে নিয়ে যাওয়ার সুবাহ্ বাংলার সওদাগরদের নেতা আরমানী বণিক খোজা ওয়াজিদ কোম্পানিকে তিরস্কার করে লিখেছিলেন, ‘আপনারা সওদাগরদের রেওয়াজ উল্টে দিয়েছেন।’ সওদাগরদের রেওয়াজ ছিল সালিশী মানা এবং এই রকম রেওয়াজের মাধ্যমে দেশীয় শেঠ সওদাগররা একটি অদৃশ্য ঐক্যের সূত্রে বাঁধা ছিলেন। তাই সোরা নিয়ে খোজা ওয়াজিদ ও আমীরচন্দের রেষারেষি থাকলেও ওয়াজিদ এক্ষেত্রে দেশীয় বণিকদের মুখ্য রূপে আমীরচন্দের পক্ষই অবলম্বন করেছিলেন। আমীরচন্দ দীপচন্দের প্রচুর প্রতিপত্তি থাকায়, এবং তার উপর স্বয়ং খোজা ওয়াজিদ তাঁদের পক্ষ অবলম্বন করায়, শেষ পর্যন্ত তাঁদেরই জয় হল। যে সরকারে সব চেয়ে বেশি সোরা উৎপন্ন হত সেই সরকার সরণে দীপচন্দ ১৭৪৫ খ্রীস্টাব্দে হঠাৎ ফৌজদার নিযুক্ত হয়ে ইংরেজদের তখনকার মতো কোণঠাসা করে দিলেন। লক্ষণীয় ব্যাপার এই যে আমীরচন্দ দীপচন্দের প্রতি অবিচারের কথা শুনে নবাব আলিবর্দি খান স্বয়ং এসে দীপচন্দকে সরকার সরণের ফৌজদার নিযুক্ত করে যান।১৭২

আলিবর্দির আমলের শেষ দিকে নবাব দরবারে তিনজন শেঠ ও সওদাগরের সব চেয়ে বেশি প্রতিপত্তি ছিল। এঁরা হলেন মুর্শিদাবাদের জগৎশেঠ ভ্রাতৃদ্বয়, হুগলীর খোজা ওয়াজিদ এবং কলকাতা ও পাটনার আমীরচন্দ দীপচন্দ ভ্রাতৃদ্বয়। সর্‌রাফ, সাহুকর, শেঠ ইত্যাদি যে সব মহাজনরা টাকা পয়সা, সোনারূপা, হুণ্ডী চিঠ্‌ঠি বিনিময়ের (exchange) ব্যবসা করতেন, তাঁদের মুখ্য ছিলেন জগৎ শেঠ। অপরপক্ষে যে সব সওদাগর খুচরা বেচাকেনা না করে পাইকারী (Wholesale) কারবার চালাতেন, তাঁদের প্রধান ছিলেন খোজা ওয়াজিদ। এই আরমানী সওদাগর দরবার থেকে ‘ফকর-উৎ-তুজ্জর’ বা ‘বণিকদের গৌরব’ খেতাব পেয়েছিলেন। হাজি মুস্তাফা কৃত সিয়র-উল-মুতাখ্‌খিরীনের টীকায় দেখা যায়, মুস্তফার সমকালীন নবাব মুবারকউদ্দৌলাহ্ যেমন ঠাঁটে থাকতেন, আগেকার কালে খোজা ওয়াজিদও তেমন ঠাঁটে থাকতেন। সে এমন জাঁকজমক যে তার তুলনায় ইংরেজ গভর্নর জেনারেল পর্যন্ত নিষ্প্রভ। তাঁর হাতিশালে ১৫টি হাতি, ঘোড়াশালে ৫০টি ঘোড়া, হারেমে ১২০ জন জেনানা, ১৫ জন চোপদার ও ২০০ জন চাকর ছিল। হাজি মুস্তাফার হিসেব অনুযায়ী তাঁর ৫ খানা জাহাজ ও ২০০০ নৌকা ছিল।১৭৩

দরবারে এই সব বড়ো বড়ো শেঠ সওদাগরের প্রভাব কত গভীর ছিল সিরাজউদ্দৌলাহ্‌র প্রথম দিকের সন্ধিবিগ্রহের বিবরণ থেকে তার আঁচ পাওয়া যায়। নবাব হয়ে সিরাজ ইংরাজদের বশ্যতায় আনবার জন্য তর্জন গর্জন ও ভীতি প্রদর্শন শুরু করেন, সেই সময় তাঁর দূত ছিলেন খোজা ওয়াজিদ। বস্তুত তাঁর নবাবীর শুরু থেকেই দেখা যায় যে আরমানী ও অন্যান্য বণিকদের কূটনৈতিক তৎপরতা লক্ষণীয় ভাবে বেড়ে গেছে। রিয়াজ পড়ে মনে হয় অষ্টাদশ শতকের গোড়ার দিকে ‘মোগল’ সওদাগররা সব চেয়ে ধনী বণিক ছিলেন, কিন্তু আলিবর্দির আমল থেকে দেখা যায় আরমানী বণিকরাই বাংলার বণিকদের মধ্যে সর্বাগ্রগণ্য। তাই এতে আশ্চর্যের কিছু নেই যে সিরাজউদ্দৌলাহ্‌র নিজামতের গোড়া থেকে আরমানী বণিকরা রাজকীয় ব্যাপারে আরো তৎপর, আরো প্রতিপত্তিশালী হয়ে উঠেছিল। কূটনীতির দাবা খেলোয়াড়দের মধ্যে এই সময় আর একজন আরমানী সওদাগরকে দেখা যায়—তিনি খোজা পেত্রস। এঁকেও সিরাজউদ্দৌলাহ্ ক্লাইভ কর্তৃক কলকাতা পুনর্দখলের পর দূতিয়ালি করতে পাঠিয়েছিলেন। অনন্তর ‘আলিনগরে’ সিরাজউদ্দৌলাহ্ ও ইংরেজদের মধ্যে যে চুক্তি সম্পাদিত হয়, সেই সাময়িক সন্ধির স্থাপনায় জগৎশেঠের লোক রণজিৎ রায় এবং আমীরচন্দ বিশেষভাবে সাহায্য করেছিলেন।

ভারতীয় বণিকদের ঐতিহ্য অনুসরণ করলে জগৎশেঠ, আরমানী ও অন্যান্য বণিকদের এত ঘনিষ্ঠভাবে রাজনীতির খেলায় জড়িয়ে পড়া একটু বিশেষ রকমের ব্যতিক্রম বলে ঠেকবে। মুর্শিদকুলী খানের সময় মোগল শাসনের কাঠামোতে যে আমূল পরিবর্তন এসেছিল তার ফলেই এটা সম্ভব হয়েছিল। একথাও মনে রাখতে হবে যে আলিবর্দি ও সিরাজের সময় রাজমঞ্চে বড়ো বড়ো অভিনেতা রূপে কয়েকজন শেঠ ও সওদাগরকে দেখা গেলেও বণিকরা সাধারণভাবে বা শ্রেণীবদ্ধ হয়ে রাজনীতির খেলায় নামেনি। বলাই বাহুল্য বাংলার বণিকরা বহু স্তরে বিভক্ত ছিল। সুবর্ণবণিক, গন্ধবণিক, তিলী, সাহা, শেঠ, বসাক ইত্যাদি বাঙালি বণিকরা নানান ব্যবসায়ে-লিপ্ত ছিল, কিন্তু লেনদেন ও ব্যবসা বাণিজ্যের উপরের কোঠায় গুজরাটী, পাঞ্জাবী, কাশ্মিরী, মোগল, আরমানী ও মারওয়াড়ী জগৎশেঠদের প্রাধান্য চোখে পড়ে। সেকেলে প্রবাদ আছে—’আদার কারবারীর জাহাজের খবরে দরকার কি?’ (দাশু রায়ের পাঁচালীতে দেখা যায় ‘আদার ব্যাপারী হয়ে জাহাজে কি কাজ গো,’ আরো আগে সংস্কৃত ‘আত্মতত্ত্ববিবেকে’ আছে ‘কিমার্দ্রকবণিজো বহিত্রচিন্তয়া’) এ থেকেই ব্যবসা বাণিজ্যের একটা সুস্পষ্ট স্তরবিভাগ চোখে পড়ে। যে সব কারবারীদের বিশেষ ভাবে জাহাজের খবর রাখতে হত সেই সব উর্ধতন সওদাগর ও শেঠরাই রাজকীয় খবরাখবর রাখতেন। না রেখে উপায় ছিল না, কারণ তামাক, পান, সোৱা, নুন ইত্যাদি কতকগুলি লাভজনক পণ্য এবং মুর্শিদাবাদ, পাটনা ও ঢাকার টাঁকশালগুলি দরবারের একচেটিয়া ছিল এবং এগুলির ইজারা পেতে হলে দরবারে প্রভাব না থাকলে চলত না। আর ঐ যে জাহাজের কথা বললাম, সেগুলি বেশির ভাগই ইংরাজ ওলন্দাজ ও ফরাসী কোম্পানির হাতে চলে গেছিল এবং ঐ কোম্পানিগুলির সঙ্গে এই সব বড়ো বড়ো শেঠ ও সওদাগরদের বিশেষভাবে কারবার ছিল। স্বভাবতই দরবার ও কোম্পানিগুলির মধ্যে এঁরা মধ্যস্থ ছিলেন। ফলে ইংরেজ ও ফরাসীদের মধ্যে বিবাদের আঁচ নবাব দরবারে পৌঁছবামাত্র দরবারে অনুগৃহীত প্রধান প্রধান শেঠ ও সওদাগরদের রাজকীয় ভূমিকাটি আরো স্পষ্ট ও বিস্তৃত হয়ে উঠল। ভেতরের লোকেই ষড়যন্ত্র করতে পারে। তাই দরবারের অন্তর্ভুক্ত বড়ো বড়ো ব্যবসায়ী ও মহাজনরাই পলাশীর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হলেন।

টীকা

১। পলাশী সম্পর্কিত একটি মাএ প্রবাদ সুশীলকুমার দের সুবৃহৎ বাংলা প্রবাদ (কলকাতা ৩য় সং ১৩৯২) গ্রন্থে পাওয়া যায়: নং ২৮৪৩—‘ঘোড়ার খুরে উড়ে গেল পলাশী পরগনা।’ এটি কোন্‌ ঘটনা সম্বন্ধে তা এত অনিশ্চিত যে অন্যান্য ঐতিহাসিক প্রবাদ সম্বন্ধে মন্তব্য করলেও এই প্রবাদের কোনো ব্যাখ্যা দে মহাশয় দিতে অগ্রসর হননি।

২। সুশীল দে, বাংলা প্রবাদ ৩৮৬ নং। তৎকালে প্রবাদটি প্রচলিত ছিল।

৩। ‘মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র রায়স্য চরিতম’ ১৮০৫ এবং ‘রাজাবলী’ ১৮১০ খ্রীস্টাব্দে মুদ্রিত হয়, অর্থাৎ পলাশীর যুদ্ধের সার্ধ শতবর্ষ পরে। ততদিনে আলিবর্দি খান রাজীবলোচনের হাতে ‘আলাবৃদ্ধি খাঁ’ এবং মৃত্যুঞ্জয়ের হাতে ‘আলাউদ্দীন খাঁ’ নাম প্রাপ্ত হয়েছেন। সিরাজউদ্দৌলাহ্‌ হয়েছেন ‘স্রাজেরদৌলা’ বা ‘শিরাজদ্দৌলা’।

৪। পূর্ববঙ্গের নমঃশূদ্র ও পশ্চিমবঙ্গের মাহিষ্য এই দুই প্রধান চাষি জাতি আগে যথাক্রমে চণ্ডাল ও কৈবর্ত নামে পরিচিত ছিল। আরবী শব্দ তরফ্‌ (শ্রম) থেকে উদ্ভুত আতরাফ (বহুবচন) অর্থ শ্রমজীবী বা অনভিজাত মুসলমান।

৫। ‘ভদ্রলোকের জাতি প্রাণ থাকা ভার হইল’, সিরাজউদ্দৌলাহ্‌র অত্যাচার প্রসঙ্গে বলেছেন রাজীবলোচন মুখোপাধ্যায়। মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়স্য চরিতম (কলকাতা ১৩৪৩), ৩৩ পৃঃ। ইংরাজ আমলের আগে থেকেই ভদ্রলোক শব্দ বিশিষ্ট জন ও বর্ণ হিন্দু অর্থে ব্যবহৃত হত বলে মনে হয়।

৬। আরবী শব্দ শরীফ অর্থাৎ পবিত্র মান্য—বহুবচনে আশরাফ।

৭। নাজিম (সুবাহ্‌দার) থেকে নিজামত, যেমন রাজা থেকে রাজত্ব, অর্থাৎ নাজিমগিরী।

৮। নায়েব (নাজিমের নায়েব বা প্রতিভূ) থেকে নিয়াবত, যেমন নাজিম থেকে নিজামত। অর্থাৎ নায়েবগিরী।

৯। সুজাউদ্দীন খান, আলিবর্দি খান ও সিরাজউদ্দৌলাহ্‌ নবাব নামে অভিহিত হলেও তারা তিন জনেই আইনত ‘হফৎ হজারী মনসবদার’ ছিলেন। Riyazus-Salatin, Passim.

১০। James Grant, ‘Analysis of the Finances of Bengal,’ The Fifth Report from the Select Committee on the Affairs of the East India Company. (London 1812). pp. 236-237, 252. আকবরের আমলে জায়গীর জমা মোট মালজমির দুই পঞ্চমাংশ ছিল, এখন তা সিকিভাগে গিয়ে দাঁড়াল।

১১। ইহ্‌তমাম—এক জন বড়ো জমিদার যে এলাকার ভারপ্রাপ্ত সেই এলাকা। তাঁর ইহতমামে অন্যান্য ক্ষুদে জমিদার ও তালুকদার থাকা সম্ভব। একাধিক বড়ো জমিদারের ইহ্‌তমাম নিয়ে একটি দেওয়ানী চাকলা। মোট ১৩টি চাকলা। তার মধ্যে ২৫টি ইহ্‌তমাম।

১২। Riyaz, p. 257.

১৩। Ratnalekha Ray. Change in Bengal Agrarian Socitey c. 1760—1850 (Delhi 1979). pp. 25-29.

১৪। J.H. Lattle, House of Jagatseth, Passum.

১৫। Grant, Analysis of Bengal Finance, pp. 259-272.

১৬। শ্রীধরাচার্য, ন্যায়কন্দলী (দশম শতাব্দী)। উদ্ধৃতি: ভবতোষ দত্ত (সম্পাঃ), ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত রচিত কবিজীবনী (কলকাতা ১৯৫৮), ৩৬৭ পৃঃ।

১৭। অনিরুদ্ধ রায়, ‘সপ্তদশ শতাব্দীর সুবা বাংলার শেষ বিদ্রোহ,’ ইতিহাস (ঢাকা), ৪ (২-৩), ভাদ্র চৈত্র ১৩৭৭।

১৮। Ratnalekha Ray, Change in Bengal Agrarian Society, pp. 90-93. Riayaz p 233.

১৯। মতান্তরে ছাদ থেকে পড়ে গিয়ে শোভসিংহ প্রাণ হারান। তৎকালীন ফরাসী কুঠিয়াল মাঁর্তা তাই শুনেছিলেন। অনিরুদ্ধ রায় ‘সপ্তদশ শতাব্দীর সুবা বাংলার শেষ বিদ্রোহ,’ ইতিহাস।

২০। অনিরুদ্ধ রায়, ‘সপ্তদশ শতাব্দীর শেষ বিদ্রোহ,’ ইতিহাস।

২১। অর্থাৎ বকেয়া খাজনার দায়ে পড়া জমিদারের জামিন সেজে জমিদারী গ্রাস। James Grant, ‘Analysis of Finances.’ p. 477.

২২। রসমঞ্জরীতে ভারতচন্দ্রের আক্ষেপোক্তি: “রাজবল্লভের কাৰ্য্য কীর্তিচন্দ্র নিল রাজ্য।”

২৩। James Grant, Analysis, p. 318.

২৪। উক্ত ফারমানে চন্দ্রকোনা ও চিতুয়া বরদার অবাধ্য জমিদারদের উপর বাদশাহের ক্রোধ প্রকাশ করা হয়েছিল। এদের হটিয়ে কীর্তিচন্দ্রের মতো শক্তিশালী অথচ অনুগত জমিদারদের পোষণ করা ছিল নবাব সরকারের রাজনীতি। N.K Sinha, Economic History of Bengal vol. II, p 11.

২৫। সুকুমার সেন, বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস ১ম খণ্ড, অপরার্ধ (কলকাতা ১৯৬৩), ১৮৯ পৃঃ পাদটীকা।

২৬। ঐ, ৫৩৬ পৃঃ

২৭। গদ্যে লিখিত ‘চিত্ৰচম্পূ’ বর্গি হাঙ্গামার প্রাচীনতম দেশীয় বিবরুণ (১৭৫০), ভবতোষ দত্ত, কবিজীবনী, ৩৭৪-৫ পৃঃ।

২৮। দীনেশচন্দ্র ভট্টাচার্য, বাঙালির সারস্বত অবদান (কলকাতা চৈত্র ১৩৫৮), ২১২, ২৮৮, ২৯৬ পৃঃ।

২৯। S.C. Hill, Bengali in 1756-57, vol 1. pp. 240-28.

৩০। নবাবী আমল, ১৮৮ পৃঃ।

৩১। রেনেলের সার্ভের ভিত্তিতে জেমস গ্রান্ট এই পরিমাপ দিয়েছেন।

৩২। তাঞ্জাবুর (Thanjavur) বা বিকৃত ইংরাজী উচ্চারণে Tanjore।

৩৩। উদ্ধৃত দীনেশচন্দ্র ভট্টাচার্য, বাঙালির সারস্বত অবদান, ১৯৫ পৃঃ।

৩৪। Fifth Report, p. 131 and Passim

৩৫। কালীপ্রসন্ন বন্দ্যোপাধ্যায়, নবাবী আমল, ৭৯-৯৭ পৃঃ, Kishorichand Mitra, ‘Territorial Aristrocary of Bengal no 4 The Rajas of Rajshah, Calcutta Review vol LVI 1873. HP 1-42, Somendra Chandra Nandy, Life and Times of Cantoo Baboo, Vol 1, Appendix 5, Rani Bhawani of Nator, pp. 570-579.

৩৬। হরিরাম তর্কবাগীশের শিষ্য সুবিখ্যাত গদাধর ভট্টাচার্য চক্রবর্তী, গদাধরের শিষ্য জয়দেব তর্কালঙ্কার, তৎশিষ্য বিশ্বনাথ ন্যায়ালঙ্কার। দীনেশচন্দ্র ভট্টাচার্য, বাঙালীর সারস্বত অবদান, ১৮১, ১৯৪, ২০০ পৃঃ।

৩৭। ঐ ১৯৫ পৃঃ।

৩৮। উদ্ধৃত কালীপ্রসন্ন বন্দ্যোপাধ্যায়, নবাবী আমল, ৮৭-৮ পৃঃ পাদটীকা।

৩৯। ঐ।

৪০। ঐ। ৮০-৮২, ৮৯ পৃঃ: নিখিলনাথ রায়, মুর্শিদাবাদ কাহিনী, ১৬-২৮ পৃঃ।

৪১। সতীশচন্দ্র মিত্র, যশোহর খুলনার ইতিহাস (২য় সং কলকতা ১৯৬৫), ২য় খণ্ড, ৪৬১-৪৬৯ পৃঃ।

৪২। Riyaz ২৬২-৩, ২৬৬ পৃঃ।

৪৩। যশোহর খুলনার ইতিহাস, ৬৩৪ পৃঃ।

৪৪। মূল ফরাসী থেকে কালীপ্রসন্ন বন্দোপাধ্যায়ের অনুবাদ অবলম্বন করে। নবাবী আমল, ৯২-৯৪ পৃঃ।

৪৫। সলিমুল্লাহ্‌ ভুল করে আওরঙ্গজেবের আমল ভেবে জাফর খানের থরহরি কম্প বর্ণনা করেছেন। প্রকৃতপক্ষে যখন আওরঙ্গজেবের দুর্বল বংশধরদের রাজত্ব চলছে।

৪৬। তারিখ-ই-বাংলায় শুধু চামড়ার উল্লেখ আছে। কিন্তু রিয়াজ-উস-সলাতীনে গোচর্ম নির্দেশ করা হয়েছে।

৪৭। উপরোক্ত বিবরণের মূল সতীশচন্দ্র মিত্র, যশোহর খুলনার ইতিহাস।

৪৮। Riyaz, P. 278.

৪৯। সুশীলকুমার দে, বাংলা প্রবাদ, নং ২০৫১।

৫০। হিন্দু কলেজের পাঠ্যপুস্তক বর্ণিত রানী ভবানীর জীবনীতে বিবৃত আছে, ‘যে সকল লোক তাঁহাকে [রানী ভবানীকে] প্রাচীনাবস্থাতে দেখিয়াছিলেন, তাঁহারা কেহ কেহ অদ্যাপি জীবিত আছেন। তাহারা কহেন তিনি অতি সুন্দরী ও সুলক্ষণা ছিলেন। এই জন্য নাটোরের ভূম্যধকারী রাজা রামজীবন রায় আপন পুত্রের সহিত তাঁহার বিবাহ দিয়াছিলেন’। নীলমণি বসাক, নবনারী অর্থাৎ প্রাচীন ও আধুনিক নয় নারীর জীবনচরিত (৫ম সং কলিকাতা, ১৮৭০)

৫১। বঙ্গাব্দ ১১৪১ (ইং ১৭৩৪) এ রামকান্ত মুর্শিদাবাদ থেকে দেওয়ানী সনদ লাভ করেন, Grant, Analysis, p. 373.

৫২। Riyaz, p. 315.

৫৩। দুর্গাদাস লাহিড়ী, রানী ভবানী (৫ম সং কলকাতা, ১৩৩২ ১ম সং ১৩১৬) ৪৫৯-৬০ পৃঃ।

৫৪। নিখিলনাথ রায়, মুর্শিদাবাদ কাহিনী, ২৯৭ পৃঃ।

৫৫। কিন্তু James Grant রামকান্তর মৃত্যুর সন দিয়েছেন বঙ্গাব্দ ১১৫৩ অর্থাৎ ইং ১৭৪৬ খ্রীস্টাব্দ। Analysis p. 398

৫৬। Calendar of Persian Correspondence, Vol. VIII, (Delhi 1953) P. No. 372. লক্ষ্য করতে হবে যে রামকৃষ্ণকে পোষ্যপুত্র নেবার পর তাঁর পরিবারকে রানী যে তালুক লিখে দেন সেই দলিল ১৭৬১ খ্রীস্টাব্দে লিখিত। কিন্তু দুর্গাদাস লাহিড়ীর মতে সম্ভবত পলাশীর যুদ্ধের বছরেই দত্তক গ্রহণ সম্পন্ন হয়। দুর্গাদাস লাহিড়ী, রাজা রামকৃষ্ণ (উপন্যাস) (২য় সং হাওড়া, ১৩৩৮, ১ম সং ১৩১৭), ৪৫৯ পৃঃ।

৫৭। ইংরাজ রেভিনিউ ডিপার্টমেন্টের খালসা বিভাগের ১৫ নভেম্বর ১৭৭৮-এর প্রোসীডিংসে (Vol. 3 p. 312-3) ঐ ব্যবস্থাপত্র দৃষ্ট হয়। Somendra Chandra Nandy, Life and Times of Canto Baboo, Vol. 1. p. 374-5.

৫৮। James Grant, ‘Analysis of the Finances of Bengal,’ Fifth Report, p-400.

৫৯। ‘স্ত্রীশিক্ষা বিধায়ক অর্থাৎ পুরাতন ও ইদানীন্তন ও বিদেশীয় স্ত্রীলোকের শিক্ষার দৃষ্টান্ত ও কথোপকথন’ (গৌরমোহন তর্কালঙ্কার প্রণীত, কলিকাতা স্কুলবুক সোসাইটি)। পুনর্মুদ্রিতঃ অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় (সম্পাঃ) পুরাতন বাংলা গদ্য গ্রন্থ সংকলন ২য় খণ্ড। (কলকাতা, ১৯৮১), ১০৬ পৃঃ।

৬০। A.B.M. Maharnood, ‘The Land Revenue History of the Rajshahi Zamindan (1765-1793),’ Ph.D. Thesis, SOAS London, 1966, pp-298-299.

৬১। দুর্গাদাস লাহিড়ী, রানী ভবানী; নীলমণি বসাক নবনারী, Kishori Chand Mitra, ‘The Territorial Aristocracy of Bengal. No. IV. ‘The Rajas of Rajshahi’ Calcutta Review no. CXI 1873; নিখিলনাথ রায়।

৬১। মুর্শিদাবাদ কাহিনী। Somendra Chandra Nandy, Canto Baboo, Vol. 1, appendix No. 5 ‘Rani Bhawani of Natore’

৬২। S.C. Hill, Bengal in 1756-57, Vol. III, P. 162.

৬৩। বর্গি আক্রমণ কালে গঙ্গার পশ্চিম তীর থেকে (বর্ধমান, বিষ্ণুপুর, বীরভূম ইত্যাদি) খাজনার ঘাটতি পড়ায় আলিবর্দি খান গঙ্গার অন্য তীরস্থ রাজশাহী দিনাজপুর ইত্যাদি জমিদারী থেকে জোর করে আবোয়াব আদায় করতেন। ফৌজদারের হাতে মহারাজ রামনাথের উপরোক্ত নিগ্রহ্‌ এই কারণে হয়ে থাকা সম্ভব।

৬৪। জমিদারি আয়ের পূর্ববর্তী ও বর্তমান হিসাব মিলিয়ে দেওয়ানী বিভাগের খাজনা সংক্রান্ত অনুসন্ধানকে বলত ‘হস্ত-ও-বুদ’ (কি-ছিল-কি-আছে)।

৬৫। কালীপ্রসন্ন বন্দ্যোপাধ্যায়, নবাবী আমল, ১৯০ পূঃ।

৬৬। E. Vesey Westrnacott, ‘The Territorial Aristocracy of Bengal No. III The Dinagepoor Raj.’ Calcutta Review, Vol. LV, 1872, pp 205-224; Ratnalekha Ray, Change in Bengal Agrarian Society, pp. 174-9, Grant, ‘Analysis of Bengal Finances’ pp. 261, 403.

৬৭। ‘আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে’—ভারতচন্দ্র।

৬৮। মূলে নিম্নরেখা নেই। রাজীবলোচন মুখোপাধ্যায়, মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়স্য চরিত্রং ৮-১০ পূঃ, ‘অদ্যাপি’ ১৮০৫ খ্রীঃ।

৬৯। James Grant, Analysis, p-430, আকবরের রাজত্বে গোড়ায় রাজস্ব আদায়ের জন্য ক্রোরী নিযুক্ত হয়েছিল।

৭০। সুশীলকুমার দে, বাংলা প্রবাদ ৭৫৪৪ নং।

৭১। দীনেশচন্দ্র ভট্টাচার্য, বাঙালীর সারস্বত অবদান, ১৮৫ পৃঃ।

৭২। কুমুদনাথ মল্লিক, নদীয়া কাহিনী (২য় সং ১৩১৮) ৩৪ পৃঃ।

৭৩। ঐ ৩২৩ পৃঃ।

৭৪। তখন নিজামত ঢাকায় অবস্থিত ছিল, মুর্শিদকুলী খানের আমলে মুর্শিদাবাদে আসে।

৭৫। রাজীবলোচন শর্মা, মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র রায়স্য চরিত্রং, ১৪ পৃঃ।

৭৬। Kishori Chand Mitra, ‘The Territorial Aristrocracy of Bengal, No. II, The Nadiya Raj,’ Calcutta Review, 1872, p-95.

৭৭। কাব্যটি ১৭২৩ খ্রীস্টাব্দে ‘শ্রীশ্রীরঘুরাম রায় নৃপাতেরাজ্ঞাং গৃহীত্বাদরাৎ’ বিশেষ জনপ্রিয়তা লাভ করে। দীনেশচন্দ্র ভট্টাচার্য বাঙালীর সারস্বত অবদান, ১৯৬ পৃঃ।

৭৮। মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র রায়স্য চরিত্রং, ১৬-১৭ পৃঃ।

৭৯। নদীয়ার রাজবংশ কিশোরকুণী গাইয়ের শ্রোত্রিয় বংশ, কৌলিন্য মর্যাদাহীন।

৮০। এই গল্পের উল্লেখ পাওয়া যায় পণ্ডিত কালীময় ঘটক প্রণীত, প্রথম চরিতাষ্টক গ্রন্থে, অষ্টাদশ সং কলিকাতা, তারিখ নেই (১ম সং ১২৭৪) পৃঃ ১২-১৩। কৃষ্ণচন্দ্র সম্পর্কিত এই স্থানীয় গল্পগুলির মূলানুগ বিবরণ দিয়েছেন কুমুদনাথ মল্লিক।

৮১। ভলতেয়র সম্পর্কে ভিক্‌তর হ্যুগো বলেছিলেন, তিনি একজন পুরুষ নন, তিনি একটি সমগ্র শতাব্দী। আঠার শতকের ইওরোপ সম্পর্কে এই কথা আঠার শতকের বাংলায় কৃষ্ণচন্দ্র সম্বন্ধেও ঘটে।

৮২। সংবাদ প্রভাকর ১৫ ডিসেম্বর, ১৮৫৩, ঈশ্বরচন্দ্র গুত রচিত কবিজীবনী, ৫৫-৫৬ পৃঃ।

৮৩। সেফাহীর জমাদার মামুদ জাফর।
জগন্নাথ শিরপা করিলা যারপর।।
ভূপতির তীরের ওস্তাদ নিরুপম।
মুজফর হুসেন মোগল কর্ণ সম।।
হাজারি পঞ্চম সিংহ ইন্দ্রসেন সুত।
ভগবস্ত সিংহ আদি যুদ্ধে মজবুত।।
যোগিরাজ হাজির প্রভৃতি আয় যত।
ভোজপুরে সওয়ার বোঁদেলা শত শত।।
হাবসী ইমামবক্স হাবসী প্রধান।
হাতী ঘোড়া উট আদি তাহার যোগান। —অন্নদামঙ্গল

৮৪। শিবনাথ শাস্ত্রী, ‘রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ’ (১৯৩৩), শিবনাথ রচনাসংগ্রহ (নিরক্ষরতা দূরীকরুণ সমিতি, কলকাতা ১৯৭৬), ২৩৭ পৃঃ।

৮৫। কৃষ্ণচন্দ্রকে লিখিত সংস্কৃত পত্র, ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত রচিত কবিজীবনী, ২৭ পৃঃ।

৮৬। মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র রায়স্য চরিত্রং ২১-২২ পৃঃ।

৮৭। ১৬৬৪ শক।

৮৮। ‘সাজোয়াল হইল সুজন সর্ব্বভক্ষ।’ ‘বর্গিতে লুঠিলা কত, কত বা সুজন।’ ভারতচন্দ্র, অন্নদামঙ্গল।

৮৯। নবাবী আমল, ১৯০ পৃঃ।

৯০। প্রকৃতপক্ষে কৃষ্ণচন্দ্রের দারিদ্র্যপীড়িত বংশধরদের সময়ে মেরামতির অভাবে শিবনিবাস ভেঙে পড়ে। ১৮৬০ খ্রীস্টাব্দে রানাঘাটের ব্যবসায়ী কৃষ্ণ পান্তীর ভাগ্নে স্বরূপ সরকার চৌধুরী তাঁদের কাছ থেকে শিবনিবাস কিনে নেন।

৯১। কুমুদনাথ মল্লিক, নদীয়া কাহিনী, ৪২-৪৩ পৃঃ।

৯২। ঐ, ১৩৭ পৃঃ।

৯৩। ঐ, ৩০১-২ পৃঃ।

৯৪। জগন্নাথ তর্কপঞ্চাননকে রাজা কৃষ্ণচন্দ্র সাতশো বিঘা ভূমি দান করেন। কালীময় ঘটক ১৮৬৭ খ্রীস্টাব্দ নাগাদ জগন্নাথের বংশাবলীকে ঐ ভূমির উপস্বত্বে স্বচ্ছন্দে জীবিকা নির্বাহ করতে দেখেন। প্রথম চরিতাষ্টক, ২৪ পৃঃ।

৯৫। ‘নাগাষ্টকং’ ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত রচিত কবিজীবনী ২৮-২৯ পৃঃ। উপরের অনুবাদ মূলানুগ, কিন্তু কিছু অংশ বাদ দিয়েছি।

৯৬। গেড়ে—গর্ত, ডোবা।

৯৭। ভবতোষ দত্ত (সম্পাঃ), ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত রচিত কবিজীবনী, পৃঃ ৪১৭-১৮।

৯৮। ঐ ৩১৮ পৃঃ।

৯৯। নুনের ভাঁড়, তেলের ভাঁড়, তাকে কি বলি ভাঁড়।

ভাঁড়ের মধ্যে ভাঁড় ছিল নদের গোপাল ভাঁড়।।

পুরাতন বাংলা প্রবাদে আছে (সুশীল দে, বাংলা প্রবাদ, ৪৭২২ নং।)

১০০। প্রেমেন্দ্র মিত্র (সম্পাঃ) চির নতুন গোপাল ভাঁড় রহস্য (হাস্যরসের ভাণ্ডার) (কলকাতা, তারিখ নেই।)।

১০১। কিন্তু গোপাল নিজের ছেলের কাছে জব্দ হয়েছিল। সে ছেলে ভিড়ের মধ্যে হারিয়ে গিয়ে চেঁচাতে লাগল, ‘গোপাল ও গোপাল।’ গোপাল রেগে কান মলে দিতে আসলে সে কান বাঁচিয়ে বলল—‘ভিড়ের মধ্যে বাবা বলে ডাকলে কত লোকে ছুটে আসবে, তুমি কি চাও সবাই দেখুক কত লোকে আমার বাবা হতে পারে?’

১০২। সুশীলকুমার দে, বাংলা প্রবাদ, ৮৪৬ নং।

১০৩। চণ্ডীচরণ সেন, মহারাজা নন্দকুমার অথবা শতবর্ষ পূর্বে বঙ্গের সামাজিক অবস্থা, (কলকাতা ১৩৮৭ ১ম সং ১২৯২), ২৩০ পৃঃ।

১০৪। প্রথম চরিতাষ্টক, ১০-১১ পৃঃ।

১০৫। খাড়ি ও জুড়ি পরগনা রঘুনাথের রাজত্বকালে নদীয়ার অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল বলে শোনা যায়।

১০৭। দেওয়ান পদবী ব্যবহারের আর একটি সম্ভাব্য ব্যাখ্যা এই যে পূর্ববঙ্গের বড়ো বড়ো পাঠান ভুঁইয়ারাও ওই নামে রাজত্ব করতেন—যেমন ভাওয়ালের গাজী পরিবার এবং ঈশাখানের বংশ। তাঁদের মত রাজনগরের পাঠান ভুঁইয়ারাও দেওয়ান পদবী নিয়েছেন ভাবা যায়। আর একটি উল্লেখযোগ্য কথা এই যে, মোগলদের আগে ভূস্বামীদের ভুঁইয়া বলা হত। মোগলরাই জমিদার নাম বহুলভাবে প্রচার করেন।

১০৮। Analysis of the Finances of Bengal p-262.

১০৯। Riyaz, pp-256-257.

১১০। সুকুমার সেন, বাঙ্গলা সাহিত্যের ইতিহাস ১ম খঃ অপরার্ধ, ১৯৩-১৯৭ পৃঃ।

১১১। সুকুমার সেনের পাঠে আসফুল্লা আছে তা ভুল।

১১২। রিয়াজ-উস্‌-সলাতীনে এই বীর পুত্রের নাম ভুল করে আলি কুলী খান দেওয়া হয়েছে।

১১৩। কিন্তু রিয়াজ-উস-সলাতীনের এই দৃষ্টিভঙ্গীর সঙ্গে হান্টারের পণ্ডিতের বিবরণ মেলে না। পণ্ডিতের বিবরণ অনুযায়ী বদি আল জামান খানের জীবনের বেশির ভাগ ধর্ম চর্চায় কেটেছিলো। নবাব দরবার এবং বীরভূম রাজসভার দৃষ্টি ভঙ্গী স্বভাবতই এই ব্যাপারে পৃথক।

১১৪। Riyaz pp-306-307.

১১৫। Riyaz pp. 316

১১৬। Analysis, p. 408.

১১৭। Ibid, p-262.

১১৮। S.C. Hill, Bengal in 1756-57 p-199. মুর্শিদকুলী খান কার্যত প্রায় স্বাধীন হলেও আইনত বাদশাহর চাকর এবং বাদশাহী ফারমান তাঁর শিরোধার্য। পরবর্তী সব নবাবই বাদশাহের সর্ব্বভৌম কর্তৃত্ব মৌখিক ভাবে মেনে চলতেন।

১১৯। Analysis of Bengal Finance, p-489.

১২০। নবাবী আমল, ১৮৪-৫ পৃঃ।

১২১। ঐ ১১৮ পৃঃ।

১২২। Bengal in 1756-57, pp.266-269.

১২৩। Analysis of Bengal Finance, p. 483.

১২৪। Ibid, pp. 883-890.

১২৫। Hunter, Annals of Rural Bengal, Appendix E. ‘Pandit’s Chronicle of Beshenpore.’

১২৬। ‘Abhaya Pada Mallik, History of Bishnupur Raj (An Ancient Kingdom of West Bengal), (Calcutta 1921), p. 106.

১২৭। প্রেমবিলাস, ত্রয়োদশ বিলাস, অভয়পদ মল্লিক কর্তৃক উদ্ধৃত।

১২৮। দীনেশচন্দ্র সেন, বৃহৎবঙ্গ, ২য় খঃ ৭৫২-৫৬ পৃঃ।

১২৯। History of the Bishnupur Raj, pp. 132-133.

১৩০। Ibid, p. 27.

১৩১। বৃহৎ বঙ্গ, ৭৫২ পৃঃ।

১৩২। ‘মদনমোহন বন্দনা,’ অভয়পদ মল্লিক কর্তৃক উদ্ধৃত।

১৩৩। দ্বিতীয় রঘুনাথ সিংহের রাজত্বকাল ১৭০২-১৭১২ খ্রীস্টাব্দ। শোভাসিংহের বিদ্রোহ ঘটে ১৬৯৬ খ্রীস্টাব্দে। অভয়পদ মল্লিক ভ্রম ক্রমে দ্বিতীয় রঘুনাথের রাজত্বকালে ওই ঘটনা অর্পণ করেছেন। বিদ্রোহকালে রঘুনাথের যে সব কীর্তিকলাপ মল্লিক মহাশয় উল্লেখ করেছেন, তখন তিনি যুবরাজ ছিলেন।

১৩৪। Analysis of the Bengal Finances, pp. 262, 402-3. চন্দ্রকোণা ইত্যাদি প্রত্যন্ত রাজ্য থেকে আগে নবাব সরকারে কেবল পেশকাশ যেত, এই সব রাজ্য বিষ্ণুপুরের আওতায় ছিল। বর্ধমানের অন্তভুক্ত হবার পর এগুলি জমাবন্দী হয়। ঐ ৩০৫-৬ পৃঃ।

১৩৫। History of Bishnupur Raj, appendix-II accounts of Abbe Raynal and Holwell.

১৩৬। মদনমোহন বন্দনা।

১৩৭। Bengal in 1756-57, Vol II, p. 68.

১৩৮। History of the Bishnupur Raj. p. 56.

১৩৯। এই ‘বীরসিংহ’ বংশাবলীর ‘ধাড়ি হাম্বির’ হওয়ার সম্ভাবনা।

১৪০। শিলালিপিগুলি অভয়পদ মল্লিক উদ্ধৃত করেছেন। শিলালিপি থেকে উপরোক্ত তথ্য দেওয়া হল।

১৪১। History of the Bishnupur Raj. pp.111-112.

১৪২। Revd. J. Long. Selections from the unpublished Records of Government for the years 1748 to 1767 Inclusive Relating mainly to the Social Condition of Bengal (Calcutta 1973 reprint) no. 252.

১৪৩। সতীশচন্দ্র মিত্র, যশোহর খুলনার ইতিহাস, ২য় খঃ ৪৯১ পৃঃ।

১৪৪। ঐ, ৪৯৬ পৃঃ।

১৪৫। ঐ ৫০০-৫০১।

১৪৬। মানসিংহ যশোরেশ্বরী মূর্তি আমের নগরে নিয়ে গেছিলেন এই ধারণা ভুল, মানসিংহ কেদার রায়ের উপাস্য দেবী মূর্তি নিয়ে গেছিলেন। ঐ ১৪৪ পৃঃ পাদটীকা।

১৪৭। মুণ্ডমালাতন্ত্র অনুযায়ী ‘দশমহাবিদ্যা’ হলেন:

কালী তারা মহাবিদ্যা ষোড়শী ভুবনেশ্বরী।

ভৈরবী ছিন্নমস্তা চ বিদ্যা ধুমাবতী তথা।।

বগলা সিদ্ধবিদ্যা চ মাতঙ্গী কমলাত্মিকা।

এতা দশমহাবিদ্যাঃ সিদ্ধবিদ্যাঃ প্রকীর্তিতঃ।।

১৪৮। যশোর চাঁচড়ার বিবৃতি সতীশচন্দ্র মিত্রের প্রামাণ্য গ্রন্থে আরো বিশদ ভাবে আছে, তার কিঞ্চিৎ সারাংশ এপানে দেওয়া হল।

১৪৯। ‘The Territorial Aristocracy of Bengal No iv The Rajas of Rajshahi,’ pp. 2-3.

১৫০। নিখিলনাথ রায়, মুর্শিদাবাদ কাহিনী, ৯১-১০৬ পৃঃ।

১৫১। Analysis of the Bengal Finances, pp. 453-437.

১৫২। সতীশচন্দ্র মিত্র, যশোহর-খুলনার ইতিহাস ২য় খঃ ৩য় পরিচ্ছেদ; মুহম্মদ আবদুর রহিম, বাংলার মুসলমানদের ইতিহাস ১৭৫৭-১৯৪৭ (ঢাকা ১৯৭৬) ২৯-৩২ পৃঃ।

১৫৩। বাংলার মুসলমানদের ইতিহাস, পৃঃ ২৯-৩০।

১৫৪। দীনেশচন্দ্র সেন, পুরাতনী (মুসলিম নারী-চিত্র) (কলকাতা ১৯৩৯) পৃঃ ৪৯।

১৫৫। সিয়র মুতাখ্‌খিরীন্‌, ২য় খঃ পৃ ১২২-৩।

১৫৬। Beveridge, Bakarganj, pp. 438-439.

১৫৭। Ratnalekha Ray, Change in Bengal Agrarian Society, pp. 215-216.

১৫৮। ঐ pp. 139-146. প্রসঙ্গত বলা দরকার ময়নাচূড়া হিজলী ফৌজদারীর অন্তর্ভুক্ত ছিল না।

১৫৯। আরবী শব্দ। হিন্দুস্থানী ভাষায় উচ্চারণ সাইয়ার। বাংলায় সায়ের।

১৬০। জ্ঞানেন্দ্রনাথ কুমার, বংশ পরিচয় ২য় খঃ (কলকাতা ফাল্গুন ১৩২৮), পৃঃ ৪৫০-৪৫২। বাংলার মুসলমানদের ইতিহাস, পৃ ৩০।

১৬১। Jadunath Sarkar (ed.) History of Bengal, pp. 414-415. জ্ঞানেন্দ্রনাথ কুমার বংশ পরিচয়, ১ম খঃ (কলকাতা বৈশাখ, ১৩২৮) পৃঃ ৩২-৮৬.

১৬২। রানী সর্বাণী আগে ভাতুড়িয়ার জমিদার ছিলেন।

১৬৩। দীনেশচন্দ্র সেন, বৃহৎবঙ্গ, পৃঃ ১০৯২।

১৬৪। কিন্তু গ্রান্ট অন্যত্র ১৯৩ পরগনা লিখেছেন। উপরের সমস্ত বন্দোবস্তের হিসাব গ্রান্ট থেকে, কালাপ্রসন্ন বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে মিলিয়ে দেওয়া হল।

১৬৫। Abdul Karim, Murshid Quli Khan and His Times (Dacca 1963), p. 90.

১৬৬। Seir Mutaqherin, Vol. I p. 15. Vol II, p. 200.

১৬৭। Yusuf Ali, Ahwal-i-Mahabat Jang translated in Bangal Nawabs, p. 154.

১৬৮। Riyaz ২৪৬-৭ পৃঃ।

১৬৯। Abdul Majed Khan, The Transition in Bengal, p. 171.

১৭০। Riyaz, ৩০ পৃঃ।

১৭১। J. Long, Selections from the unpublished Records of Government, ৪১, নং।

১৭২। Kumkum Banerjee. ‘Indigenous Trade, Finance and Politics: a Study of Patna and It’s Hinterland,’ Ph.D. thesis, Calcutta University, 1987, pp. 126, 131, 133.

১৭৩। Seir, Vol. II p. 400.

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *