দ্বিতীয় পক্ষ
আমার প্রথম পক্ষের বউটি ছিল বড়ো সাদাসিধে। টাটকা পাঁউরুটির মতো নরম তুলতুলে। ফোলা ফোলা গাল। কাঁচের মতো চোখ। বড়ো বড়ো চোখের পাতা। ফর্সা ধবধবে রং। খুব নীচু গলায় কথা বলত। ধীর চলন। ধীর বলন। সবাই বলত, আহা, মা লক্ষ্মী যেন পট ছেড়ে নেমে এসেছে। শোভনের কি ভাগ্য! এ যেন বানরের গলায় মুক্তোর মালা। আমি ঠিক বানর নই, তবে গো-হাড়গিলের সঙ্গে কিছুটা মিল আছে। আয়নার সামনে দাঁড়ালে মনটা কেমন কেমন করে ওঠে। এই যদি মানবের চেহারা হয় দানব কাকে বলে। এতখানি একটা বুকের ছাতি। এক ইঞ্চিও খালি নেই, সর্বত্র কুঁচি কুঁচি লোম। মুখটা কেমন চোয়াড়ে মার্কা। এমন একটা অকাব্যিক চেহারা খুব কম দেখা যায়। হাসলে মূলোর মত দাঁত বেরিয়ে পড়ে। চোখের দৃষ্টি যেন, আবার খাব সন্দেশ। সব সময়েই ঘোলাটে লাল। নেশা ভাঙ না করেই এই অবস্থা, করলে কী হত!
আমার দোষ নেই। আমার যখন যৌবন আসছে, বয়সা লেগে গলা ভারি, ঠোঁটের ওপর কচি গোঁফের রেখা, সেই সময়ে এক ব্যায়াম-বীরের পাল্লায় পড়ে মিস্টার ইণ্ডিয়া হবার ইচ্ছে হয়েছিল। সেই সময় আমি ডেলি এক-শো ডন, দু-শো বৈঠক মারতুম। ডাম্বেল, বারবেল, প্যারালালবার, রোমান রিং নিয়েও কস্তাকস্তি চলত। শরীরের যেখানে যত মাংসপেশী ঘুমিয়ে ছিল সব ঠেলেঠুলে উঠে পড়ল। নিজেই অবাক, মানুষের এত সব থাকে! বেশ মজা লাগত। নেশাও ধরে গিয়েছিল। রোমান রিং করতে গিয়ে চোয়াল ভেঙে যাচ্ছিল, সে খেয়াল ছিল না। দেখতে দেখতে একটা হেঁড়ে মতো লোক হয়ে গেলুম। হাতুড়ি পেটানো চেহারা।
শরীর যখন সেট করে গেল তখন আমার ব্যায়াম-গুরু বললেন, হলো বটে, তবে কী জান গরিবের যা হয়, ঘি, দুধ, মাখন, ডিম, ছানা তো তেমন পড়ল না; তার ফলে শরীরটা একটু পাকতেড়ে হয়ে গেল। খুব ইচ্ছে সিনেমার হিরো হব, হল না। আমার দোষ নয়। দোষ বাংলা ছবির চলনের। মেয়ে-মেয়ে চেহারা না হলে হিরো হওয়া যায় না। গাছের ডাল ধরে বাঁকা শ্যাম হয়ে দাঁড়াতে হবে আর পেঁয়াজ খোসা শাড়ি পরে নায়িকা বেসুরো গান গাইবে—তুমি আমার আমি তোমার, হে রে রে রে করে একবার এ গাছের ডাল ধরে কেতরাতে কেতরাতে ও-গাছ, সে-গাছের ডাল ছুঁয়ে ছুঁয়ে আদিখ্যেতা করবে। বেশি ছোটাছোটি করতে পারবে না, কারণ কোমরে বাত। হেঁপো নায়ক বেতো নায়িকা। শুকনো গাছের ডাল। ফুচকে ডিরেক্টার। এক ডিরেক্টার বললে, এ দেশে যখন র্যাম্বো হবে তখন তোমার মতো ঘোড়ার দরকার হবে। এখন ডন বৈঠক চালিয়ে যাও। এখনকার স্ক্রিনে ওই চেহারা গান গাইছে দেখলে অডিয়েন্স মূর্ছা যাবে। উত্তমকুমারের যুগ ভাই, এখানে খাপ খুলতে এস না।
মনের দুঃখে ঘুরে বেড়াই। না হল সিনেমা, না হল প্রেম। ডিরেক্টারদের কত বোঝালুম, মশাই, যে কোনো ওজনের নায়িকাকে আমি ঝাড়া তিন ঘণ্টা পায়ের তলায় আর মাথার তলায় হাতদিয়ে তুলে পাঁজাকোলা করে রাখতে পারি। ট্রায়াল দিয়ে দেখুন। এ হল বারবেল ভাঁজা হাত। অন্য যে কোনো নায়ক পারবেই না। হার্ট অ্যাটাক হয়ে যাবে। আমি ওয়েট-লিফটার। ডিরেকটার বললেন, তোমার অ্যাপ্রোচে ভুল হচ্ছে। নায়িকারা বারবেল নয়। সিনেমা ব্যায়ামাগার নয়। আমাদের সিনেমায় দুটোই সাবজেক্ট, প্রেম আর ব্যর্থ প্রেম। এর বাইরে কেরামতি করতে গেলেই ফ্লপ। ছোটোখাটো দু একটা প্রেম করতে গেলুম। বাবা, সেখানে যা কম্পিটিশান! চাকরির বাজারকেও হার মানায়। একটা পোস্ট, এক হাজার অ্যাপ্লিক্যান্ট। শেষে একটা কারখানা করে ফেললুম। আমার ওই লোহালক্কড় আর নাট বল্টুই ভালো। প্রাণ খুলে ঘষা যায়। টাইট দেওয়া যায়। গ্রূপ কাটা যায়। আর আমার ব্যায়াম-গুরুর রয়্যাল এনফিল্ড মোটর বাইকটা কিনে নিলুম। ব্যাপারটা বেশ জমে গেল। বাংলা ছবিতে নায়িকা তুলে আমার ক-পয়সা হত! যা হত তাও আবার ট্যাক্সে যেত। মালে উড়ত। এ তবু লোহা তুলে দুটো পয়সার মুখ দেখলুম। বাড়ি হল। ভুরভুরে একটা সেকেণ্ড হ্যাণ্ড গাড়ি হল। গাড়িটা মোটর সাইকেলের মতো শব্দ করলেও চলে। ধমকাতে ধমকাতে চলে। মাঝে মাঝে গা-ঝাড়া দেয়। একবার এক সায়েব আমার গাড়ি চেপে বলেছিলেন, ভেরি ইন্টারেস্টিং। এর একটা নিজস্ব ক্যারেকটার আছে।
চেহারার গরমের সঙ্গে টাকার গরম। ডবল গরমে ব্যাপারটা কেমন যেন হয়ে গেল। আমাদের ফ্যামিলিটা চিরকালই একটু গোঁয়ারগোবিন্দ টাইপ। আমার বাবার এমন গোঁ ছিল যে সবাই বলত রাইনোসেরাস অফ নর্থ ক্যালকাটা। আমার মা আবার ঋষি বঙ্কিমচন্দ্রের জেলার মেয়ে। যেমন রাগী তেমনি গম্ভীর। ফলে আমার মেজাজও সেইরকম হয়েছে। আমি আমার মা দু-জনে মিলে আমার সেই প্রথম পক্ষের তুলতুলে বউটাকে ধামসে ধামসে শেষ করে দিলুম। বেড়ালের যা স্বভাব, নরম মাটি দেখলেই আঁচড়াবে।
বাবা চলে যাবার পর মা একটু আয়েসী হয়ে পড়েছিল। তা ছাড়া যারা একটু ধর্মকর্ম নিয়ে থাকে তারা নিষ্ঠুর হয়। হতেই হবে। সারা দিন মালা জপ করতে করতে মন ইষ্টমুখী। ইষ্ট ছাড়া আর কাউকে ভালোবাসা অন্যায়। ধার্মিকরা মানুষকে সেবাপরায়ণ হতে বলেন। আমার প্রথম পক্ষের বউ সেবা করে করে, সেবা করে করে কাহিল হয়ে পড়ল। আর আদর্শ স্বামী হল ওভারসিয়ারের মতো। তার কাজ হল বউ সংসারে কাজ করছে কি না দেখা। পান থেকে চুন খসলেই হম্বিতম্বি করা। ছড়ি ঘোরানো। আমার মতো একটা স্বামী তো আর স্ত্রৈণ হতে পারে না। মাঝেমধ্যে হাতটাতও চালিয়ে দিতুম। ফোঁসফোঁস করে কাঁদত। বড়ো বড়ো চোখের পাতা জলে ভিজে বেশ দেখাত। সে আর এক বিউটি। সকলে আমার প্রশংসাই করত। সবাই বলত, এ দেখি রাম-ভক্ত হনুমান নয়, মা-ভক্ত ভোম্বল। আমার ডাকনাম ভোম্বল।
আমরা তাকে সেবাপরায়ণা, সহনশীলা, সতীসাধ্বী করতে চেয়েছিলাম। একথা তো ঠিক, সংসারের কড়ায় বেশ করে ভাজা ভাজা করতে না পারলে মেয়েরা খোলতাই হয় না। মানুষও তো চামড়া। কাঁচা চামড়াকে কষা হরীতকীর জলে অষ্টপ্রহর ভিজিয়ে রেখে পাকা করতে হয়। তা করব কী? সে মরেই গেল। আমার খুব দুঃখ হল। মা বললে, ছেলেদের অত নরম হলে চলে না। সবাই কি আর সব কিছু নিতে পারে? পারে না। পরীক্ষায় ফেল করেছে। হেরে গেছে। আত্মহত্যা করেছে। দেখিস নি অনেক নতুন কাপড় এক ধোপেই ছিঁড়ে যায়! আমরা তখন বলি, ধোপে টিকল না!
সত্যি আমার মা সিদ্ধিলাভ করেছে। তা না হলে এমন সুন্দর সুন্দর কথা বেরোয়! ঠাকুর রামকৃষ্ণের মতো। মায়ের কথায় ভেতরটা ঠাণ্ডা হয়ে গেল। আরে আমার বন্ধু বিভাসের কী হল? ইণ্ডিয়ান নেভিতে চাকরি পেয়ে চলে গেল। এক মাসের মধ্যে ন্যাড়া মাথা হয়ে ফিরে এল। আমরা বললুম, এ কী রে! বিভাস বললে, ভাই, প্রথমেই তো চুল কদমছাঁট করে দিলে। তারপর সে কী ট্রেনিং রে ভাই! মাস্তুল বেয়ে ওঠো মাস্তুল বেয়ে নামো। দড়ি ধরে ঝুলতে ঝুলতে এ জাহাজ থেকে ও জাহাজে যাও। একটা জাহাজের গোটা ডেক জল আর বুরুশ দিয়ে ঘষে ঘষে ধোও। সে যে কী কান্ড রে ভাই! পালিয়ে এসেছি। তা পালাব বললেই কী পালানো যায়। বিভাসকে আবার পাকড়াও করে নিয়ে গেল। তারপর কী হল জানি না! বিভাস পালিয়ে এসেছিল আই. এন. এস বিক্রম থেকে। আমার বউ পালালো আমাদের বিক্রম থেকে।
আজকাল বাড়ি যেমন খালি পড়ে থাকে না, থাকার উপায় নেই, রোজগেরে ছেলেও তেমন পড়ে থাকে না। প্রথম প্রথম দিনকতক লোকে রাস্তায় ঘাটে আঙুল তুলে দেখাত, ওই দেখো, ওই লোকটার বউ আত্মহত্যা করেছে। মায়ের নামেও নানা কথা বলত। ‘মুখে হরি বলি, কাজে অন্য করি।’ শুনিয়ে শুনিয়ে গান গাইত। আমার পাশের বাড়িতে একটা ডেঁপো মেয়ে আছে। সেই মেয়েটাই বেশি গাইত। কী করব, এসবের তো প্রতিবাদ চলে না। মা বলতেন, সহ্য কর। ঠাকুর রামকৃষ্ণ বলে গেছেন, শ, ষ, স। সহ্য কর, সহ্য কর সহ্য কর। কেউ কেউ আবার গল্প শোনাতো, ‘আহা কত্তার কী দয়ার শরীর!’ গল্পটা আমার জানা। তিন ছেলে চোরকে ধরে পেটাচ্ছে। চোরের আর্তচিৎকার শুনে কত্তা দোতলা বারান্দায় বেরিয়ে এলেন। নীচের উঠোনের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘ওরে তোরা করছিস কী! তোদের কী এতটুকু দয়ামায়া নেই! কৃষ্ণের জীব। ধরে পেটাচ্ছিস! ওটাকে বস্তায় ভরে, মুখে দড়ি বেঁধে গঙ্গার জলে ফেলে দিয়ে আয়।’ চোর হাতজোড় করে ওপরের বারান্দার দিকে মুখ তুলে বললে, ‘আহা কত্তার আমার কী দয়ার শরীর!’
দিনকয়েক মা খুব ভয়ে ভয়ে ছিলেন। যতই জপধ্যান করুন, যুগধর্ম বলে একটা জিনিস তো আছে! প্রায় জিজ্ঞেস করতেন, ‘হ্যাঁ রে, পুলিশে আবার ধরে টানাটানি করবে না তো?’
ভয় পাবারই কথা। কাগজ-টাগজ পড়েন। দেখেন তো, শাশুড়িরা আজকাল কী হারে নিগৃহীতা হচ্ছেন। ধরে সেন্ট্রাল জেলে চালান করে দিলেই হল। বউদের ইউনিয়ন হয়েছে। শাশুড়িদের কোনো ইউনিয়ন নেই। আমি মাকে সাহস দিতুম, ‘তুমি ভেব না মা। যেখানে যা পুজো দেবার নিয়ম, সব দিয়ে দেবতাদের সন্তুষ্ট করে ফেলেছি। ভগবান আমাদের সহায়। হিন্দু ম্যারেজের সুবিধেটা কী জান, কোথাও কোনো রেকর্ড থাকে না।’ সাহস দিলে কী হবে। আবার এও ভাবতুম মানুষ বড়ো সাংঘাতিক জীব। যীশুকেই ক্রুশে ঝুলিয়ে দিলে। এখন মায়ের মতো ধার্মিক আর আমার মতো মাতৃভক্তকে ধরে পুরে দিলেই হল। যুগধর্মের কাছে জপের মালার ধর্ম কি দাঁড়াতে পারবে!
যাক, টাকার ধর্মে সবই হয়। আমার প্রথম পক্ষটা এতই বোকা ছিল, এত অজ্ঞ, যে তার এইটুকু জ্ঞান ছিল না আত্মহত্যা করার আগে একটা চিরকুটে লিখতে হয়, ‘আমার মৃত্যুর জন্য কেহ দায়ী নয়।’ এটা লিখে মরতে না হয় আর পাঁচটা মিনিট দেরি হত। আমি যার জন্যে এত ভাবলুম সে আমার জন্যে এইটুকু ভাবতে পারল না। দুনিয়ায় স্বার্থ ছাড়া কিছুই নেই। মনটা এত খিঁচড়ে গেল যে প্রথম পক্ষকে ভুলেই গেলুম।
আজকাল কাগজে পাত্র-পাত্রীর কলাম হয়েছে। দ্বোজপক্ষে আপত্তি নেই দেখে গোটা কতক চিঠি ছাড়লুম। একটা লেগে গেল। আসলে বিয়ে একটা নেশা। সিগারেট খাওয়ার মতো। একটা ধরালে আর একটা। আর একটা ধরালে আর একটা। মনটা ফস ফস করে। মেয়েটাকে দেখে এলুম। বয়েস হয়েছে। বেশ শক্তসমর্থ। খুব ফ্রি। জড়তা নেই। আঙুলে শাড়ির আঁচল পেঁচাবার লজ্জা নেই। সত্যি কথা বলতে কী, এই প্রথম আমি প্রেমে পড়লুম। মন্ত্রমুগ্ধ ফণীর মতো অবস্থা হল। কথায় কথায় জানলুম, ইনি অ্যামেচার অভিনেত্রী। এক সময় স্পোর্টসে অল্পস্বল্প নাম হয়েছিল। এক-শো মিটার দৌড়ে চ্যাম্পিয়ান হতো। আমি বললুম, ‘পছন্দ। আমি একটা পয়সাও নোবো না।’
কে একজন বলেছেন, ‘দিচ্ছে কে?’
মুখের ওপর এইরকম বলায় খুব রাগ হল। অপমানিত বোধ করলুম। পরে জেনেছিলুম, কথাটা বলেছিল মেয়েটির ভাই। একটা ডেঁপো ছেলে। যাক, আমি তাকে তখনকার মতো ক্ষমা করে দিলুম। সেই প্রথম বুঝেছিলুম, ভালোবাসা মানুষকে কত উদার করে দেয়। ওই জন্যেই শ্রীচৈতন্য বারে বারে বলেছিলেন, ওরে পাগলা, প্রেম কর, প্রেম কর। ভালোবেসে যা। মেরেছো কলসীর কানা, তা বলে কী প্রেম দোবো না। আমার আগের বিয়েটা শুধুই বিয়ে ছিল। এ বিয়েটা হল প্রেম।
বসে পড়লুম পিঁড়েতে। প্রথম ধাক্কাটা খেলুম শুভদৃষ্টির সময়। চাদরের তলায় আমার দ্বিতীয় পক্ষ, বলতে লজ্জা করছে চোখ মেরে দিলে। ঠাস করে। কেমন যেন ভড়কে গেলুম। চাদরের তলা থেকে বেরিয়ে এসে পুরোহিত মশাইয়ের অনুমতি নিয়ে একটা সিগারেট ধরিয়ে ফেললুম। তিনি একটু ব্যঙ্গ করেই বললেন, ‘হ্যাঁ হ্যাঁ, খান খান, আজকালকার বিয়ে আবার বিয়ে! দামড়া-দামড়ির হাত-ধরাধরি।’ বৃদ্ধ মানুষ। কাঠ খোঁচা চেহারা। শুনে আমার খুব খারাপ লাগল। বাকি সবাই হ্যা হ্যা করে হাসল। আমার মনে তখন উড়ো ঝাপটা একটা গানের কলি ভাসছে, ‘বুকে শেল মেরেছে, হৃদয়ে শেল মেরেছে।’
তিন টানে অত বড়ো একটা সিগারেট শেষ করে বসে গেলুম, যদিদং হৃদয়ং মম, তদিদং হৃদয়ং করতে। মেয়েকে কে যে আমার হাতে সম্প্রদান করছেন বুঝতে পারলুম না। মেয়ের হাত আর আমার হাত এক হওয়ামাত্রই, হাতের তালুতে কুড়ু কুড়ু করে দিলে। কোথা থেকে চার-পাঁচটা সাঙ্ঘাতিক ফচকে মেয়ে এসে, আমার কান দুটো ধরে আচ্ছা করে মলে দিল। আর চেনা নেই শোনা নেই পাঞ্জাবি পাজামা পরা মহা একটা চ্যাংড়া ছেলে এসে বাসরঘরে সারারাত আমার বউয়ের সঙ্গে হ্যা হ্যা করে কাটিয়ে দিলে। মনে হচ্ছিল, আমি বিয়ে করেছি না ওই পল্লবকুমার করেছে! মিনিট পনেরো-র জন্যে বউকে খালি পেয়ে একটু রাগ রাগ গলায় জিজ্ঞেস করলাম, ‘ছোঁড়াটা কে?’
বউ বললে, ‘তুমি কী এইরকম গেঁয়ো ভাষায় কথা বলো নাকি?’
বিয়ের ঘণ্টা চারেকের মধ্যে আমাকে ‘তুমি’ বলে সম্বোধন করাটা আমার কাছে ধৃষ্টতা বলেই মনে হল। আমি তো জানি ফুলশয্যার রাতের শেষের দিকটায় অনেক সাধ্য-সাধনা করে বউকে দিয়ে ‘তুমি’ বলাতে হয়। সেই ‘তুমি’-তে আলাদা একটা রস থাকে। আমার আবার সেই ‘হিট’ গানের লাইনটা মনে পড়ছে—‘বলি কি বলি না, বলা তো হল না, হায়!’
যাক, বসে আছি বউয়ের এলাকায়, এখানে কান ধরে টানার, চুল ধরে টানার মতো অনেকে আছে। তাই রাগ সামলে বললুম, ‘ছোঁড়া, ছুঁড়ি, শব্দটা এমন কিছু খারাপ নয়।’
‘ভাষা দিয়ে কালচার বোঝা যায়। দেখি তোমার হাত আর পা দেখি।’
তার মানে? বেশ ঘাবড়ে গেলুম। এক হোমিয়োপ্যাথিক ডাক্তার আছেন শুনেছি, তিনি পা দেখে ওষুধ দেন। পা দেখে রোগ ঠিক করেন।
ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলুম, ‘হাত পা দেখবে কেন?’
‘কালচার মাপব।’
সে আবার কী রে বাবা। ফুলপাড় কোঁচার তলা থেকে পা বের করে সামনে রাখলুম।
‘হুঁ, এ তো দেখছি দামড়া পা। তোয়ালে, সাবানটাবান ওই এরিয়ায় যায়? যায় না! এই ময়লা গোদা-পা, তুমি বিছানায় তুলবে? এই পায়ের পাতা দিয়ে তুমি আমার পায়ের পাতা স্পর্শ করবে? ম্যা গে:।’
তার সারা শরীর শিউরে উঠল। মনে মনে আমিও ছোটো হয়ে গেলুম। পা হল শরীরের স্ট্যাণ্ড। টেবিলের টপটা নিয়েই লোকে মাথা ঘামায়। পায়া নিয়ে কার মাথাব্যথা!
‘পরশু পা ঠিক করে বিছানায় উঠবে। তা না হলে অ্যালাউ করব না। সারা রাত মালা পরে মেঝেতে বসে থাকতে হবে। আমার সাফ কথা। হাইজিনের ব্যাপারে আমি স্ট্রিক্ট। হাত দেখি, ডান হাতের চেটো!’
ভয়ে বয়ে বললুম, ‘সিগারেট আমি বেশি খাই না। তুমি যা ভাবছ তা নেই।’
‘কি ভাবছি!’
‘আঙুলের পাশে নিকোটিনের দাগ। আমার স্বাস্থ্য সম্পর্কে তোমার ভাবনা হচ্ছে আর কী!’
‘রামো! তোমার স্বাস্থ্য সম্পর্কে আমার ভাবনা হবে কেন। আজকালকার মেয়েরা বিধবা হয় না। এটা তো আমার সেকেণ্ড ম্যারেজ। থার্ডও বলতে পারো। টমকে আমি সেই ষোলো বছর বয়সেই রেজেস্ট্রি করে বিয়ে করেছিলুম। ছ-বছর চুটিয়ে প্রেম করার পর অলোকের সঙ্গে আলাপ হয়ে গেল পুরী হোটেলে। টমের হিংসে। ছেলেরা তো একটু জেলাস হয়। তা ছাড়া বেশির ভাগ ছেলেই বোকা। টম সুইসাইড করলে। পুওর চ্যাপ। অলোককে ভালো লাগল না। বছর তিনেক খেলিয়ে ছেড়ে দিলুম। বিকাশ এল। বিকাশ ছেলেটা ভালো ছিল। ভালো ইনকাম করত। মিথ্যে বলব না, আমার পেছনে লাখ তিনেক খরচ করেছিল। মোস্ট ট্রাবলসাম ছিল ওর মা-টা। বুড়িটা আমার লাইফ হেল করে দিয়েছিল। বললুম, হয় তুমি মাকে কাশীটাশী কোথাও নড়া ধরে ফেলে দিয়ে এসো, আর না হয় আমার আশা ছাড়ো। রোজ রাতে বুড়ি পাশের ঘরে অ্যাজমার কাশি কাশবে, এ একেবারে অসহ্য। আমার নার্ভাস ব্রেকডাউন হয়ে যাচ্ছে। ফরাসী দেশ হলে আমি তোমার বিরুদ্ধে বিশ লাখ টাকার একটা ক্ষতিপূরণ মামলা দায়ের করে দিতে পারতুম। এই ব্যাকওয়ার্ড দেশে সেটা সম্ভব নয়। তা সেই মাতৃভক্ত পাঁঠাটা আমাকে ছেড়ে দিলে।’
আমি ভয়ে ভয়ে একটা সিগারেট ধরালুম। হাত কাঁপছে। আমার দ্বিতীয় পক্ষ বললে, ‘কী ব্র্যাণ্ড?’
মুখ দিয়ে কথা সরল না। প্যাকেটটা তুলে দেখালুম।
‘খুব চিপ ব্র্যাণ্ডের সিগারেট খাও তো! ভালো সিগারেট থাকলে একটা টান টানতুম। মুখটা কেমন যেন ফ্যাক ফ্যাক করছে।’
‘তুমি সিগারেট খাও?’
‘কেন খাব না! সেই কলেজ লাইফ থেকেই তো ধরেছি। মাঝে হাফ টোব্যাকো ফেলে দিয়ে গাঁজা ভরে খেতুম। এখন সেটা ছেড়েছি। তবে খুব যখন ফ্র্যাসট্রেশান হয় তখন আবার খাই। বেশ লাগে। আমাদের এই অভিনয় লাইনে মন মেজাজ কখন কীরকম থাকবে বলা শক্ত।’
‘তুমি অভিনয় করো নাকি? কই তোমার নাম তো শুনিনি, কোথাও কোনো ছবিও দেখিনি।’
‘তোমার তো কালচার নেই। আর্ট থিয়েটার কাকে বলে জান? ওয়ান ওয়াল কাকে বলে জান? কোনোও দিন দেখেছ? আমার নাম শুনবে কী করে? তোমার দৌড় তো যাত্রা, হাতিবাগানের থিয়েটার, হিন্দি ছবি। কোনো দিন অ্যাকাডেমি অফ ফাইন আর্টস কী রবীন্দ্রসদনে গেছ?’
নার্ভাস হয়ে বলে ফেললুম, ‘না ভাই।’
আমার দ্বিতীয় পক্ষ ভেঙচি কেটে বললেন, ‘কেন ভাই?’
শেষে মরিয়া হয়ে বলে ফেললুম, ‘আমারও কিন্তু মা আছেন।’
‘নো প্রবলেম, আমি ঢুকলেই বুড়ি বেরিয়ে যাবে। সে আমি দাওয়াই দিয়ে দেবো। ও তুমি আমার হাতে ছেড়ে দাও।’
আমার মাথার চুল খাড়া হয়ে উঠল। বলে কী! শেষে আমি মিন মিন করে বললুম, ‘ধরো আমি তোমাকে বিয়ে করি নি।’
‘অত সহজ নয়। ধরতে হলে সঙ্গে অন্য জিনিসও ধরাতে হবে। ব্যাপারটা তো কোর্টে চলে যাবে। শুনেছি তোমার বাড়ি আছে। বাড়িটা লিখে দাও, আর পঞ্চাশ হাজার টাকা ক্যাশ ডাউন করো। তাহলে তোমার ওই ধরাটা ধরা যাবে।’
আমি গোটাকতক ঢোঁক গিললুম। এ তো দেখি আচ্ছা ফ্যাস্তা কলে পড়ে গেলুম। বললুম, ‘ঠিক এই দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে বিয়ে করা উচিত নয়। সংসার লন্ডভন্ড হয়ে যাবে।’
‘কেন? রথের যদি উলটো রথ হয়, সংসার পুরাণের উলটো পুরাণ হবে না কেন! ঘুঘু দেখেছো, ফাঁদ দেখোনি। আমি তো রাত বারোটার সময় মাল খেয়ে টলতে টলতে ফিরব। রাস্তায় দাঁড়িয়ে তোমার নাম ধরে চেঁচাব ভোমলা, ভোমলা। তারপর ঢুকেই তোমাকে পেটাবো। জাস্ট উলটে নোবো গুরু। ভোরবেলা জড়ানো গলায় বলব, অ্যায় লেবু চা লে আও। কী, ভয় পেয়ে গেলে মাইরি! বুমেরাং শুনেছো, বুমেরাং।’ আমার দ্বিতীয় পক্ষ রাজিয়া সুলতানার মতো হাসতে লাগল। হঠাৎ হুলু লুলু, হুলু লুলু করে উলুর শব্দে চমকে উঠলুম। ‘কী হচ্ছে? কীসের আওয়াজ?’ আতঙ্ক। দ্বিতীয় পক্ষ বললে, শেয়াল কাঁদছে ভাই। যেখানে যত শেয়াল ছিল সব একসঙ্গে কেঁদে উঠল ভাই। তোমার মা এখন কার গালে ঠোনা মারবেন ভাই। তুমি এখন কাকে ময়দা ঠাসা করবে ভাই।
ভয় পেলে মানুষের সাহস বাড়ে। আমি আদি অকৃত্রিম স্বামীর ভাষায় ন্যাকা ন্যাকা গলায় বললুম—‘হ্যাঁ গা, এ কী তোমার অভিনয়!’