দ্বিতীয় দৃশ্য – কলকাতার পথ

দ্বিতীয় দৃশ্য – কলকাতার পথ

কলকাতার ধূলিধূসর, ধুম্রমলিন ললাটের উপরে ধীরে ধীরে সন্ধ্যার আবছায়া ঘনিয়ে আসছে।

এই সন্ধ্যা থেকেই শুরু হয় কলকাতার আসল জীবন। দিনের বেলায় কলকাতার জনঅরণ্যে, কর্মব্যস্ততায় বা কেরানিদের আনাগোনায় এমন কিছু দেখা যায় না, যাতে রহস্যের আভাসমাত্র আসে। সন্ধ্যা থেকেই রহস্যের সূচনা— বিশেষ করে শনিবারের সন্ধ্যায়। পথে পথে তখন একে একে গ্যাসের আলো২.১ জ্বলে ওঠে, মাথার উপরকার স্তব্ধ আকাশের বুকে কালো রেখা কেটে প্যাঁচার ঝাঁক ঝটপট করে উড়ে যায় এবং অলি-গলির আনাচেকানাচে অন্ধকার থেকে কালো কালো কুৎসিত মুখ উঁকিঝুঁকি মারতে শুরু করে। এখন সাধুর বিশ্রামের সময় এবং শয়তানের জাগরণ লগ্ন।

পথে এখন শ্রান্ত কেরানিদের ক্লান্ত মুখ আর দেখা যাচ্ছে না এবং কলকাতার যে-সব পথ দিনের বেলায় লোক আর গাড়ির ভিড়ে শব্দিত ও স্পন্দিত হয়ে ওঠে, সে পথগুলি এখন স্থির ও বিজন হয়ে আছে। রাত নয়টার পরে ক্লাইভ স্ট্রিট২.২, স্ট্র্যান্ড রোড২.৩, হাইকোর্টের২.৪ আশেপাশের রাস্তা ও রাধাবাজার২.৫ ও মুগাঁহাটা২.৬ প্রভৃতি পল্লিতে গেলে একটা অস্বাভাবিক স্তব্ধতায় আপনি বিস্মিত হয়ে যাবেন। আরও একটু রাত হলে এ অঞ্চলে চলতে গেলে গা ছমছম করে ও নিজের পায়ের শব্দে নিজেরই বুক চমকে ওঠে। কোথাও লোকজন নেই— আছে খালি নীরবতা ও অন্ধকার! পথগুলো যেন ভূতুড়ে পথ— প্রেতলোকের রহস্য যেন তাদের চারিদিকে স্তম্ভিত হয়ে আছে!

কিন্তু চিৎপুর রোডের উত্তরাংশ এখনও ঘুমায়নি— যদিও তার দৃশ্য গেছে বদলে। তার পথিকদের চেহারায় আর ব্যস্ততা বা কর্মশ্রান্তি বা মলিনতার কোনো চিহ্নই নেই— তাদের দেখলেই বোঝা যায়, তারা বেরিয়েছে অবসর যাপনের আনন্দের সন্ধানে। দিনের বেলায় এরাই যে ময়লা, ঘামে ভেজা জামাকাপড় পরে এই পথ দিয়েই আধসিদ্ধ ভাত-তরকারি-ভরা পেটে ছ্যাকড়াগাড়ির২.৭ ঘোড়ার মতো আপিসের দিকে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটেছে, তারপর সারাদিন কলম পিষে, বড়োবাবুর বকুনি ও সাহেবের হুমকি হজম করে ধুঁকতে ধুঁকতে বাড়ির পানে ফিরে এসেছে, এদের দিকে তাকিয়ে এখন আর হলপ করে কেউ সেকথা বলতে পারবে না। কাল রবিবার, সকালে উঠে আর আপিসের তাড়া নেই, সকলের মুখ তাই নিশ্চিন্ত আনন্দে উদ্ভাসিত! ছোটো-বড়ো করে ছাঁটা চকচকে চুলে বাঁকা টেড়ি কাটা, ‘হেজেলিন স্নো’২.৮ মেখে মুখের রং তাজা, অনেকের চোখে শখের চশমা, ঠোঁটে সস্তাদামের সিগারেট, গায়ে মিহি কাপড়ের চুড়িদার পাঞ্জাবি, পরনে দেশি তাঁতের ফিনফিনে কোঁচানো কাপড়, বাঁ-হাতে ‘রিস্ট ওয়াচ’, ডান হাতে রুপো বাঁধানো ছড়ি, আঙুলে আংটি ও পায়ে নানা আকারের শৌখিন জুতো! কেউ কেউ পকেট ভরে টাকা নিয়েছে এবং রৌপ্যের ‘গন্ধ’ পেয়ে সুখের পায়রারাও অমনি বন্ধুত্বের ভান দেখিয়ে তাদের সঙ্গী হয়েছে। বিডন স্কোয়ারের মোড়ে২.৯ ফুলওয়ালার কাছ থেকে দলের বড়োবাবুরা কয়েক ছড়া করে বেলফুল কিনলেন। একছড়া খুলে তখনই নিজের হাতে জড়িয়ে নিলেন— বাকিগুলি যথাসময়ে কোনো বারান্দা বিলাসিনীর সাধের খোঁপায় গিয়ে উঠবে। … দু-ধারের বারান্দার দিকে নির্লজ্জ ও সতৃষ্ণ দৃষ্টিনিক্ষেপ করতে করতে বাবুরা তাড়াতাড়ি ছুটছেন— এখনই আটটা বেজে যাবে, তার আগেই ‘মামার দোকানে’২.১০ ঢুকে সুরা দেবীকে ক্রয় করা চাই। —এই আবুহোসেনরা২.১১ আজ একদিনেই হয়তো আপিসের সারা মাসের শ্রমলব্ধ অর্থকে ফুর্তির স্রোতে অতলে তলিয়ে দেবে, শেষরাতে বা কাল সকালে এরা যখন অবসাদে এলিয়ে পড়ে, অনিদ্রায় ও নেশায় টকটকে রাঙা চক্ষু নিয়ে ধুঁকতে ধুঁকতে বাড়ির দিকে ফিরবে, তখন এদের ট্যাঁক হাতড়ালে কেউ একটা আধলাও আর আবিষ্কার করতে পারবে না!

রাস্তা দিয়ে গাড়ির পর গাড়ি ছুটেছে— টমটম, ল্যান্ডো, ফিটন, পালকি গাড়ি, মোটরবাস ও সবচেয়ে বেশি ‘ট্যাক্সি’। কোনো গাড়িতে সুবর্ণ-গর্দভরা বিশ্বজগৎ সম্বন্ধে সম্পূর্ণ উদাসীন হয়ে বসে আছে— তাদের মুখের ভাব দেখলে মনে হয়, দুনিয়ায় যেন তারা ছাড়া আর মানুষ নেই— পথ দিয়ে যারা যাচ্ছে, তারা যেন কীটপতঙ্গেরই সামিল, তারা গাড়ির তলায় চাপা পড়লেও সংসারের কিছুমাত্র লোকসান হবে না! এইসব লক্ষ্মী প্যাঁচা দিবানিদ্রায় দিন কাটিয়ে সন্ধ্যার অন্ধকারে জেগে ওঠে ওই চামচিকে-বাদুড়- প্যাঁচাদেরই মতো, এবং রাত্রিবেলায় বাড়ির বাইরে বাঁধা নির্দিষ্ট সুখ-নীড়ের দিকে ধাবিত হয়— নিয়মিতরূপে সেখানে না গেলে এদের একঘেয়ে জীবনের অবসাদ কিছুতেই ঘুচতে চায় না। …অনেক গাড়ির আরোহীরাই মাড়োয়ারি। ছাতু খেয়ে কাঠখোট্টার মুল্লুকে মানুষ হয়ে এই জীবগুলি বোঁচকা-বুঁচকি মাথায় করে প্রথম বাংলাদেশে এসে আড্ডা গেড়ে বসে। তারপর গেল যুদ্ধের সময়ে ‘স্পেকুলেশন’-এর মহিমায় অকস্মাৎ স্বর্ণ-রৌপ্যের বোঝায় অতিরিক্ত ভারগ্রস্ত হয়ে পড়ে। সেই ভার এখন তারা চটপট কমিয়ে ফেলবার জন্যে অত্যন্ত ব্যস্ত হয়ে উঠেছে। বিলাসী বাঙালির আদরের শহর কলকাতা— হাল-ফ্যাশানে প্রাচ্যে অগ্রগণ্য। বাঙালি বাবুদের দেখাদেখি মেড়ুয়ারাও ছাতুর স্বাদ ভুলে ‘সভ্য’ হয়ে উঠছে— মুখে ভাঙা ভাঙা বাংলা বুলি, পরনে বাংলা পোশাক! অনেকেই টিকি ছেঁটেছে বা সংক্ষিপ্ত করে এনেছে— মাথায় দশ আনা ছ-আনা২.১২ চুলের বাহার! বাঙালি আবুহোসেনরা তাদের জ্বালায় অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে— কারণ শহরের ভালো ভালো ডানাকাটা পরির দল আজ ছাতুখোরদের সোনার টিকিতে বাঁধা! তারা নতুন বড়োমানুষ, কথায় কথায় টাকা বৃষ্টি করে— বাবুদের সাধ্য কী তাদের সঙ্গে পাল্লা দেন! কিন্তু বাবুর দলকে আমি অভয় দিচ্ছি! দু-দিন সবুর করলেই মেওয়া ফলবে! মাড়োয়ারিরা বাঙালি বাবুদের উপরে টেক্কা মারবার জন্য যেরকম উঠে পড়ে লেগেছে, টাকা নিয়ে যেরকম ছিনিমিনি খেলা শুরু করেছে— তাতে বেশ বোঝা যাচ্ছে, রসাতলে যেতে তাদের আর বেশি দেরি লাগবে না। ফিরিঙ্গিদের২.১৩ নকল করে যেমন অনেক নব্য বাবু চুলোয় গিয়েছেন, বাবুদের নকল করতে গিয়ে মাড়োয়ারিরাও তেমনি গোল্লায় যাবেই যাবে।

ট্যাক্সিতে চড়ে যাচ্ছে অধিকাংশ হঠাৎ-বাবুর দল। বাপ-মায়ের লোহার সিন্দুকে বা গয়নার বাক্সে সকলের অগোচরে হাত চালিয়ে, বা ‘হ্যান্ড নোট’ কেটে বা অন্য উপায়ে এদের অনেকে হঠাৎ কিছু টাকা সংগ্রহ করেছে— এখন তারই সদব্যবহার করতে চলেছে। দিনকতক পরেই এদের ট্যাঁক ফের গড়ের মাঠ হবে, তারপর হয়তো একদিন দেখা যাবে, ট্যাক্সির ভাড়া দিতে না পেরে অনেকেই আদালতে গিয়ে শুষ্ক মুখে আসামি হয়ে দাঁড়িয়েছে!

সোনাগাছি২.১৪ বা রুপোগাছির২.১৫ কাছে গিয়ে অধিকাংশ গাড়িই খালি হয়ে যাচ্ছে। গাড়ি থেকে যারা নামছে তাদের ভিতরে কেবল সুবর্ণ-গর্দভ, মাড়োয়ারি বা হঠাৎ-বাবুরাই নেই— একটু কাছে এগিয়ে এলেই দেখবেন, অনেক বিখ্যাত জজ, ম্যাজিস্ট্রেট, ব্যারিস্টার, উকিল, অ্যাটর্নি, ডাক্তার, এম.এল.সি২.১৬, নন কো-অপারেটর২.১৭, বক্তা, পণ্ডিত সম্পাদক ও সাহিত্যিকও এই দলে আছেন! এমনকী, শহর থেকে বারবনিতা উঠিয়ে দেবার জন্য যেসব সচ্চরিত্র সাধু ব্যক্তি প্রকাশ্য সভায় প্রাঞ্জল ভাষায় বক্তৃতা দিয়ে বাহাদুরি নিচ্ছেন, তাঁদেরও কেউ কেউ যে এ দলে নেই, এমন মিথ্যাকথাও আমি বলতে পারব না। আমার নৈশ-ভ্রমণে আমি হিন্দু, ক্রিশ্চান, মুসলমান ও ব্রাহ্ম সমাজের অনেক বড়ো বড়ো মাথাওয়ালা লোককে স্বচক্ষে এইসব স্থানে দর্শন করেছি! প্রথম প্রথম অবাক হতুম, নিজের চোখকে বিশ্বাস করতুম না। এখন দেখে দেখে আর অবাক হই না—কারণ এখন আর চোখের উপরে নয়, কলকাতার বাসিন্দাদের তথাকথিত সাধুতার উপরেই আমি সমস্ত বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছি। কোথায়, কবে, কাকে দেখেছি, সে কথা আমি অবশ্য এখানে বলতে চাই না— কিন্তু একথা আমি জোর করে বলতে পারি যে কলকাতার অধিকাংশ লোকই জাতি-ধর্ম-নির্বিশেষে বারবনিতার ঘরে আসা-যাওয়া করে। সমাজে এরা কেউ ধরা পড়ে না— এদের মুখোশ এমনি নিখুঁত!

রাত যত বাড়তে থাকে, কলকাতার সমস্ত অংশ যত স্তব্ধ হয়ে আসে, চিৎপুরের উল্লাসধ্বনি ততই উচ্চতর হয়ে ওঠে! তখন দেখা যাবে, আশপাশের অলি-গলি থেকে সারি সারি ট্যাক্সি বেরিয়ে এসে চিৎপুর রোডের উপর দিয়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে ময়দানের দিকে ছুটছে! অধিকাংশ গাড়ির আরোহীই তখন চুচ্চুড়ে মাতাল এবং প্রায় প্রত্যেক গাড়িতেই একটি বা দুটি স্ত্রীলোক পুরুষদের কোলে বা বুকের ওপর খোঁপায় মালা জড়িয়ে নেশায় এলিয়ে পড়ে আছে! গাড়ির ভেতর বসেই সবাই বিকট স্বরে হইহই করছে, কেউ সচিৎকারে প্রেম জানাচ্ছে, কেউ অশ্লীল ভাষায় গান গাইছে, কেউ নেশার খেয়ালে আবোল-তাবোল বকছে! কোনো কোনো গাড়িতে আবার হারমোনিয়াম বাজিয়ে গানও চলছে এবং সেসব গান হচ্ছে এই ধরনের—

আমার ভালোবাসা আবার কোথায় বাসা বেঁধেচে!
মাসে মাসে বাড়চে ভাড়া,
বাড়িউলি দিচ্ছে তাড়া,
গয়লাপাড়ার ময়লা ছোঁড়া প্রাণে মেরেচে!

প্রকাশ্য রাস্তায়, সকলের চোখের সামনেই, খোলা গাড়ির ভিতরে স্ত্রী-পুরুষে চুম্বন-আলিঙ্গনও বাদ যায় না।

কলকাতার নানা পথের ওপরে যেসব কালী বা অন্যান্য দেবতার মন্দির আছে, সন্ধ্যারতির সময়ে সেখানে গিয়ে দাঁড়ালে একটি বিষয় লক্ষ করবেন! মন্দিরের সামনে স্ত্রী-পুরুষের জনতা। দু-চারজন খাঁটি ভক্ত এবং গরিব ভদ্রঘরের মেয়েও সেখানে থাকেন বটে —কিন্তু বাদবাকি বেশিরভাগই শিকারি পুরুষ, ভদ্রঘরের কুচরিত্র স্ত্রীলোক বা বারবনিতা। কোনো কোনো ভদ্রঘরের মেয়ের মাথার ওপরে হয়তো অভিভাবক নেই, এবং তারা যে কারণেই হোক বাজারের বারনারীর মতো প্রকাশ্যে রূপ-যৌবন বিক্রি করতে পারে না। তারা এইসব মন্দিরে সন্ধ্যাবেলায় দেব-দর্শনের ছলে আসে। রতনে রতন চেনে! কোনো শিকারি পুরুষের সঙ্গে আধ-ঘোমটার ফাঁকে চোখাচোখি হলেই তাদের এখানে আসার উদ্দেশ্য সিদ্ধ হয়। তারপর তারা যখন ঘরের দিকে ফেরে, তখন প্রায়ই দেখা যায় তাদের পেছনে পেছনে মধুলুব্ধ ভ্রমরেরও অভাব নেই! সময়ে সময়ে বড়ো বড়ো পাকা শিকারিরাও ভ্রমে পড়ে গৃহস্থের সতী কুলবধূর পেছনে অনুসরণ করে। পরিণাম— লগুড়ের রসাস্বাদ করে খোঁড়াতে খোঁড়াতে পলায়ন। কিন্তু এত লাঞ্ছনাতেও হতভাগ্যদের চৈতন্য হয় না— মন্দির-দ্বারে পরদিন ঠিক আবার নির্দিষ্ট সময়ে গিয়ে ধরনা দেয়। এক শ্রেণির পুরুষ আছে, সাধারণ বারবনিতার চেয়ে এইরকম অপ্রকাশ্য কুলটাদেরই তারা বেশি পছন্দ করে। বারবনিতারাও এই-প্রকৃতির পুরুষদের চরিত্র বোঝে। তাই তাদেরও অনেক মন্দিরে গিয়ে সন্ধ্যারতি দেখবার অছিলায়, মুখে ঘোমটা টেনে গৃহস্থের বউ সেজে পুরুষদের চোখে ধুলো দিতে ছাড়ে না। …এই নারীর পেছন নেওয়া অভ্যাসের ফলে মাঝে মাঝে কতক বিয়োগান্ত প্রহসনের অভিনয় হয়। অনেক সময়ে এক নারীর পেছনে একাধিক রূপ-রসিকের সমাগম হয়। তখন প্রত্যেকে প্রত্যেককে ছাঁটবার মতলবে হরেকরকম কৌশল অবলম্বন, চোখরাঙানি, মারামারি কিছুই বাদ যায় না। মানুষের ভেতরে এখনও কুকুর-বিড়ালের স্বভাব প্রচ্ছন্ন হয়ে আছে।

শেষরাত্রে গঙ্গার ধারে এই ধরনের আর এক দৃশ্য দেখা যায়। রাতশেষে অন্ধকারে মুখ ঢেকে অনেক পরপুরুষ-দৃষ্টি-ভীত কুলনারী প্রাতঃস্নানে যান। তাঁরা যে সবাই সতী-সাবিত্রী তা নয়। তাঁদের ভেতরেও অনেক ভেজাল আছে— তারা এই সুবর্ণ সুযোগের সদব্যবহার করতে ছাড়ে না। শিকারি পুরুষরাও এ সন্ধান রাখে। তারাও দলে দলে এই সময়ে বেরিয়ে পড়ে, এবং ওত পেতে বসে থাকে। অনেকের সন্ধানে খালি বাড়ি আছে। হস্তগত শিকারকে নিয়ে পুরুষরা এইসব বাড়ির ভেতরে গিয়ে ঢোকে। মাঝে মাঝে সুচরিত্র তরলমতি মেয়েরাও এদের প্রলোভনে পড়ে নিজেদের সর্বনাশ সাধন করে— কেউ কেউ আর ইহজীবনে বাড়িতে ফেরে না। সঙ্গে পুরুষ-রক্ষক না থাকলে, শেষরাতে বাড়ির মেয়েদের কখনো গঙ্গাস্নানে যেতে দেওয়া উচিত নয়।

বড়োবাজারের দিকে গঙ্গাতীরেও পশ্চিমা মেয়েদের জন্যে খালি বাড়ি আছে শুনেছি— কিন্তু আমি নিজের চোখে তা দেখিনি। এসব বাড়িতে মেয়েদের জন্যই নাকি বাহির থেকে পুরুষ সংগ্রহ করা হয়। পশ্চিমা যুবতীরা নাকি এখানে এসে সংগৃহীত পুরুষদের সহবাসে আপনাদের বাসনা চরিতার্থ করে যায় এবং বলাবাহুল্য যে, এজন্যে তাদের টাকা খরচও করতে হয়। কিন্তু শোনা-কথায় নির্ভর করে এ সম্বন্ধে আমি আর বেশি কিছু বলতে পারি না। ব্যাপারটা সত্যও হতে পারে, মিথ্যাও হতে পারে— তবে কলকাতায় অসম্ভব বলে কিছু নেই।

অসম্ভব নয় বলছি এইজন্যে যে, এর চেয়েও উদ্ভট কাণ্ড আমি বাঙালি-পাড়ায় ঘটতে দেখেছি। এই কদর্য ‘রোম্যান্স’-এর নায়িকা হচ্ছেন, কলকাতার কোনো প্রাচীন ও বিখ্যাত ধনী পরিবারের এক মহিলা। অল্পবয়সেই তাঁর স্বামী পরলোকে যান— বিধবা পত্নীর মাথার ওপরে আর দ্বিতীয় অভিভাবক না রেখে। গঙ্গার কাছাকাছি কোনো পল্লিতে এই মহিলা একাকিনী প্রকাণ্ড এক অট্টালিকায় বাস করতেন, একমাত্র শিশুপুত্রকে নিয়ে। এঁর লালসা মেটাবার পদ্ধতি ছিল যেমন কুৎসিত, তেমনই অভিনব। শেষরাতে উনি গাড়িতে চড়ে সঙ্গে জন কয়েক বিশ্বাসী দারোয়ান নিয়ে ‘গঙ্গাস্নানে’ যেতেন— যদিও স্নান করতেন না! আগেই বলেছি, এসময়ে শ্রেণিবিশেষের পুরুষও শিকারের খোঁজে বেরোয়। এই রূপসি যুবতী সেই শিকারিদের ওপরেই শিকার করতেন! যাকে দেখে তাঁর পছন্দ হত, তাকে তিনি নিজের বাড়িতে নিয়ে আসতেন। কেউ কেউ প্রকাণ্ড গাড়ি ও দারোয়ান দেখে তাঁর সঙ্গে আসাটা নিরাপদ বিবেচনা করত না— এহেন রূপসির লোভ ছেড়েও প্রাণপণে পালাতে চাইত— ভাবত বোধ হয়, এ হচ্ছে কোনো বিপজ্জনক ফাঁদ! সেক্ষত্রেও কমলি কিন্তু তাদের ছাড়ত না২.১৮। মহিলার ইঙ্গিত পাবামাত্রই দারোয়ান সেই কাপুরুষ প্রেমিককে ছোঁ মেরে গাড়ির ভেতর টেনে তুলত! গাড়ি যখন প্রকাণ্ড অট্টালিকার ফটকের মধ্যে ঢুকত, বন্দি বেচারি তখন ভয়ে কাঠ হয়ে ভাবত— আজ সে নিশ্চয়ই গুম খুন হবে। …ওই মহিলাটি একসময়ে প্রায়ই অজানা প্রেমিকের জন্য এমনই অপূর্ব অভিসার-যাত্রা করতেন। এখন তিনি শান্ত হয়েছেন— কারণ তাঁর পুত্র সাবালক।

ঢং, ঢং, ঢং! ঘড়িতে রাত তিনটে বাজল। এই সময়ে সে-রাতের মতো ফুর্তিতে ক্ষান্তি দিয়ে অধিকাংশ শখের বাবুই বাড়িমুখো হন। চিৎপুরের চারিদিক ঘন ঘন মোটরের ভেঁপুতে শব্দিত হয়ে ওঠে। অনেকেই ট্যাঁকের শেষ কড়িটি পর্যন্ত সে রাত্রের অধিষ্ঠাত্রী দেবীর চরণে সমর্পণ করে আসে, তাদের আজ শ্রীচরণ-ভরসা বই আর গতি নেই। পানের ‘পিক’ লাগা এলোমেলো জামাকাপড়, উশকোখুশকো চুলে, নেশায় জবাফুলের মতো টকটকে চোখে, গ্যাসপোস্টে ক্রমাগত ধাক্কা খেয়ে টলতে টলতে ‘রাতের পাখি’রা বাসায় ফেরে— পথের মোড়ে মোড়ে তখন পাহারাওয়ালারা বাড়ির রোয়াকে বসে বসে ঝিমোয়— হঠাৎ পদশব্দ শুনে ধড়মড়িয়ে জেগে, ‘কোন শ্বশুরা রে!’ — বলে হুমকি দিয়ে দাঁড়িয়ে ওঠে এবং অনেককেই ধরে গুঁতো মারতে মারতে থানায় টেনে নিয়ে যায়!

যেখানে পাহারাওয়ালা নেই, সেখানে আচম্বিতে আকাশ থেকে সদ্য-পতিতের মতো এক-একটা কালো-মুশকো লম্বা-চওড়া জোয়ান মূর্তি আবির্ভূত হয়! তারপর মাতালদের নেশা ছুটতে না ছুটতে তাদের শাল-আলোয়ান বা রেশমি-চাদর, ঘড়ি বা চেন যা কিছু পায় টেনে ছিনিয়ে নিয়ে যেমন হঠাৎ দেখা দিয়েছিল তেমনি হঠাৎ অন্তর্হিত হয়! যারা তাদের বাধা দেবার সাহস রাখে তাদের পুরস্কার— একখানা ধারালো ও চকচকে ছয় ইঞ্চি ইস্পাতের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ পরিচয়! এমনই সব বিপদ এড়িয়ে রাতের যে পাখিগুলি শেষটা নিজেদের ডেরায়— পতিব্রতা সতীরা যেখানে সারা রাত অশ্রুজলে শয্যা সিক্ত করেছে— গিয়ে আবার হাজির হতে পারে, তারা যথার্থই ভাগ্যবান! অর্থনাশ, স্বাস্থ্যনাশ, অপমান— এমনকী প্রাণনাশের ভয় পর্যন্ত না রেখে যারা নিত্য এহেন জীবনযাপন করে, তারা যে কোন ধাতুতে তৈরি মানুষ সেটা একবার ভেবে দেখুন!

কলকাতার ফিরিঙ্গি পল্লির দৃশ্য রাত্রে ভিন্নরকম। সেখানকার প্রকাশ্য জীবনলীলা দেখা যায় প্রধানত চৌরঙ্গি২.১৯, কার্জন পার্ক২.২০, ইডেন গার্ডেন২.২১, গড়ের মাঠ২.২২ ও ঘোড়-দৌড়ের মাঠের২.২৩ ভেতরে। বাঙালি পাড়ার সঙ্গে এ অঞ্চলের প্রধান পার্থক্য হচ্ছে— এখানে সাধারণত হট্টগোল ও মলিনতা নেই। মানুষগুলিও যেমন সুন্দর ফিটফাট, পাড়াও ঠিক তেমনি। চৌরঙ্গির ধারে ধারে অগণ্য দোকান ও হোটেল আলোকমালা পরে পথিককে যেন সাদর আহ্বান করছে। হোটেলগুলির ভিতরকার দৃশ্য দেখলে মনে হয়, যেন সমুজ্জ্বল পরিস্থানের এক-একটি টুকরো কোনো গতিকে হঠাৎ খসে এখানে এসে পড়েছে! এত আলো। এত লতাপাতা ফুল! এত সাজসজ্জা! চোখ তৃপ্ত হয়ে যায়। তালে তালে মধুর স্বরে ঐকতান বাজছে, জীবন্ত ছবির মতো সুন্দর লোকগুলি আনাগোনা করছে, কোথাও একটু বেসুরো আওয়াজ নেই; সমস্তই ধরাবাঁধা নিয়মে শৃঙ্খলার সঙ্গে সম্পাদিত হচ্ছে! বাঙালি এমনভাবে জীবনকে উপভোগ করতে জানে না।

এ অঞ্চলে পথের ধারে ধারে বায়োস্কোপ ও থিয়েটারের আলোকোজ্জ্বল অট্টালিকাগুলির সম্মুখভাগ লোকে লোকারণ্য হয়ে থাকে। সে ভিড়ের ভেতরে বাঙালি, মাড়োয়ারি, মুসলমান ও ইউরোপীয় অনেক জাতের লোকই দেখা যায়। মাঝে মাঝে কাঁটা-জঙ্গলে ফুটন্ত গোলাপের মতো, দলে দলে কালো চেহারার মধ্যে আলো করা রূপ ও পোশাক নিয়ে শ্বেতাঙ্গসুন্দরীরা নয়ন-মনকে মোহিত করে দেন। অধিকাংশ রঙ্গালয়ের সামনে প্রায়ই রূপপিপাসী বাঙালি যুবকরা দল বেঁধে দাঁড়িয়ে থাকে। মোটরের পর মোটর আসছে আর ঝাঁকে ঝাঁকে বিলাতি রূপসি রং-বেরঙের নানান হালফ্যাশনের পোশাক পরে নামছে এবং যুবকরা হতাশ অথচ সতৃষ্ণ নয়নে তাদের পানে তাকিয়ে আছে! কিন্তু হায়, এ যে গাছে কাঁঠাল গোঁফে তেল। কবি দ্বিজেন্দ্রলাল তো স্পষ্টই বলে গেছেন, কেবলমাত্র নয়ন দিয়ে ষোলো বছরের জ্যান্ত মেয়ে ‘আহার’ করা সম্ভব নয়! এবং রবীন্দ্রনাথও এদেরই মনের কথা এই দুই পঙক্তিতে ব্যক্ত করেছেন—

বিধি ডাগর আঁখি যদি দিয়েছিল,
সেকি, আমার পানে ভুলে পড়িবে না!২.২৪

আধুনিক বিলাতি রূপসিদের নৈশ পোশাক একান্ত মারাত্মক। একে তো তাঁদের রং ফাটা বেদানার মতো অপূর্ব, তার ওপরে সেই যৌবনপুষ্ট তনুলতার ঊর্ধ্বাংশ একেবারেই উন্মুক্ত— অনেকেরই দুধের মতো ধবল উচ্চ বক্ষ বিচিত্র নগ্ন সৌন্দর্যে দর্শকের চক্ষুকে রীতিমতো স্থির করে দেয়! খুনিরা মানুষের দেহকে হত্যা করে, কিন্তু শ্বেতাঙ্গসুন্দরীরা হত্যা করে মানুষের মনকে! আইন অনুসারে এঁদের শাস্তি হওয়া উচিত। যুবকরা সাবধান, ফিরিঙ্গি পাড়ার এসব আলেয়ার আলোর দিকে তাকানো মিছে— কারণ এরা দেখা দেয়, ধরা দেয় না! …এই ভিড়ের মধ্যে এক শ্রেণির বঙ্গবালাও বিচরণ করেন— তাঁদের পোশাক কিম্ভূতকিমাকার— দেশি-বিলাতি ফ্যাশনের ‘ঘণ্ট’ বিশেষ! তবে অনেকেই বোধ হয় এই ভেবে দুঃখ পান যে, কেন এঁরা এখনও বুকের কাপড় খুলে পথে বেরোতে শেখেননি? আমাদের বিশ্বাস, অদূর ভবিষ্যতে খুব সম্ভব এমন দুঃখ প্রকাশেরও অবকাশ থাকবে না— ‘আসিবে, সেদিন আসিবে!’

সন্ধ্যাবেলায় এখানে এরকম খালি ফিটন গাড়ি পথে পথে ঘুরে বেড়ায়। তার সহিস, কোচম্যান, ঘোড়া ও আকার কিছুই ছ্যাকড়াগাড়ির মতো নয়। এসব গাড়ি রহস্যপূর্ণ। আপনি যদি রসিক হন, তবে এই গাড়িগুলিকে দেখলেই চিনতে পারবেন। এর ভেতরে উঠে বসুন, চালক আপনাকে বিনাবাক্যব্যয়ে শ্রেণিবিশেষের শ্বেত-রূপসির কাছে নিয়ে যাবে। তারা শুভ্র টাকার বিনিময়ে আপনার কয়লা-কালো রং ভুলে অনায়াসে দেহকে বিকিয়ে দেবে। তবে আপনার দেহে ফিরিঙ্গি পোশাক থাকা চাই। সন্ধ্যার মুখে অনেক বাঙালির ছেলেকে এই উদ্দেশ্যে এখানে ঘুরুর-ঘুরুর করতে দেখবেন!

বিলাতি রূপজীবিনীরা সন্ধ্যার সময়ে পথের ওপরেও আবির্ভূত হয়। কিন্তু সাধারণ ভদ্র মেমদের সঙ্গে তাদের পার্থক্য, চক্ষু কিঞ্চিৎ শিক্ষিত না হলে ধরা যায় না। তবে একটু লক্ষ করলেই সাধারণ বারবনিতার বিশেষত্ব তাদের খেলো অথচ রংচঙে পোশাকে, অবসাদগ্রস্ত চোখে, অত্যধিক পাউডার-রং মাখা মুখে আর হাবভাব চলাফেরার মধ্যেই নিশ্চিত রূপে প্রকাশ পায়। গড়ের মাঠের কোণে ‘কার্জন পার্কে’ খানিকক্ষণ বসে থাকলেই প্রায় এদের দেখা মেলে! ‘ইডেন গার্ডেন’ও এদের একটি মস্ত শিকার স্থান। সেখানে রাতের আবছায়ায় প্রায়ই ঝোপেঝাপে পরপুরুষের সঙ্গে আলুথালু বেশে ফিরিঙ্গি রূপসিদের আবিষ্কার করতে বিশেষ বেগ পেতে হয় না।

গঙ্গার ঘাটে শেষরাত্রে একশ্রেণির ‘ভদ্রনারী’-র ব্যবহারের কথা আগেই উল্লেখ করেছি, সাহেব পাড়াতেও সেই দলের ফিরিঙ্গি বা ইহুদি প্রভৃতি জাতের মেয়ের অভাব নেই। তবে সন্ধ্যার সময়েই তারা বেরোয় পুরুষের মাথা খেতে। তাদের অনেকে টেলিগ্রাফ অফিসে কাজ করে, অনেকে টাইপরাইটার চালায়, অনেকে বিলাতি দোকানে ‘শপ-গার্ল’-এর কাজ করে। অনেকের আবার স্বামীও আছে! যারা স্বাধীন, তারা পথ থেকে শিকার সংগ্রহ করে চুপিচুপি বাড়ি ফিরে যায়। যারা স্বাধীন নয়, তাদের জন্য পুরুষকে খালি বাড়ি বা অন্য কোনোরকম বন্দোবস্ত করতে হয়। টাকা পেলে এরা সাদা-কালো চেহারা বাছে না, সকলের সঙ্গেই সমানভাবে আনন্দ করবে। সঙ্গে সঙ্গে থিয়েটার-বায়োস্কোপে যাবে, হোটেলে গিয়ে খাবে, মোটরে উঠে ‘জয় রাইড’ করবে। হয়তো ক্রমাগত গৌরবর্ণকে উপভোগ করে করে শ্যামবর্ণ এদের কাছে লোভনীয় বলে বোধ হয়। সাধারণত এরা গাড়ির ভেতরেই পরপুরুষের আলিঙ্গনে আত্মসমর্পণ করে। রাত্রিবেলায় গড়ের মাঠের আড়ালে আবছায়ায় এবং ঘোড়দৌড়ের মাঠের আনাচেকানাচে গেলে এই জাতীয় অনেক স্ত্রীলোকের লীলাখেলা স্বচক্ষে দেখতে পাবেন। শ্বেতাঙ্গ পাহারাওয়ালারা এদের উপরে খুব সতর্ক দৃষ্টি রাখে। মাঝে মাঝে এরা গাড়ির ভেতরে পরপুরুষের সঙ্গে অকথ্য অবস্থায় ধরা পড়ে যায়। তখন এদের লাঞ্ছনার সীমা থাকে না। আমি একবার এই দলের একটি নারীর দুর্গতি দেখেছিলুম। ‘স্ট্র্যান্ড’-এর ওদিকে গাড়ির ভেতরে সে ধরা পড়েছিল। পুরুষটি ছিল গোরা। সে তো গাড়ি থেকে নেমে পড়ে কামান থেকে নির্গত গোলকের চেয়েও বেগে প্রাণপণে চম্পট দিলে— ধরা পড়ল স্ত্রীলোকটি। ‘সার্জেন্ট’-এর নির্দয় প্রহারে তার শ্বেতমুখ একেবারে রক্তাক্ত হয়ে উঠল।

কড়েয়া ও ওয়াটগঞ্জে পৃথিবীর নানা জাতীয় বারবনিতা বাস করে। কিন্তু সেখানকার পথের দৃশ্যে বিশেষ কিছু জীবনের লক্ষণ দেখা যায় না! সে অঞ্চলের জীবন-নাট্য অভিনীত হয় প্রাচীরের আড়ালে। বাঙালি সেখানে খুব কম যায়। সাধারণত জাহাজি গোরা, কেল্লার সৈনিক, চীনা, জাপানি ও নিম্নশ্রেণির মুসলমান প্রভৃতি জাতি সেখানকার নৈশ অভিনয়ের প্রধান অভিনেতা।

বর্তমান কলকাতার পথের আর এক বিশেষত্ব, গুন্ডার ভয়। এই জাতীয় ‘ভদ্রলোক’গুলি অত্যন্ত পরিশ্রমী, দিনের বেলাতেও তাঁরা ব্যবসায়ে ব্যস্ত থাকেন, রাত্রে তো কথাই নেই। আগে কাশী ও মির্জাপুর প্রভৃতি শহর গুন্ডার জন্য বিখ্যাত ছিল, কলকাতা কিন্তু তাদের ওপরে রীতিমতো টেক্কা মেরেছে— অথচ এখানে পুলিশবাহিনী সংখ্যায় ও প্রতাপে ভারতে অদ্বিতীয়।

গুন্ডা সমাজে যাঁরা সম্ভ্রান্ত, সে মহাত্মাদের প্রধান আড্ডা হচ্ছে মেছোবাজারে ও তার আশেপাশে। জাতে তারা মুসলমান— আর অর্থ সম্পত্তিতে তাদের ধনকুবের বললেও চলে। হিন্দুস্থানি গুন্ডারা সাধারণত বড়োবাজার অঞ্চলে থাকে। এদের যারা দলপতি, তারা প্রায়ই এক একটা কোকেন বা জুয়ার আড্ডা খুলে বসে। আর একশ্রেণির সর্দার গুন্ডার দল গঠন করে, তাদের কাজ পথিকের যথাসর্বস্ব কেড়ে নেওয়া আর ডাকাতি করা। তার ওপরে কলকাতার প্রত্যেক পল্লিতেই জন কয়েক করে স্থানীয় গুন্ডা থাকে পাড়ার লোকেদের কাছে যারা যমের মতো।

রাত্রে মেছোবাজারের কফিখানাগুলি লোকে লোকারণ্য হয়ে থাকে। এ জনতার মধ্যে আপনি যাদের দেখবেন, তাদের বারো আনাই সাংঘাতিক চরিত্রের লোক। যত খুনে, জুয়াড়ি, গুন্ডা, চোর, ডাকাত আর পকেট কাটা ওইখানে একসঙ্গে বসে খাওয়া-দাওয়া ও মেলামেশা করে, অর্থাৎ কফিখানা হচ্ছে তাদের ক্লাবের মতো। অধিকাংশ দাগি বা পলাতক গুন্ডাই দিনের বেলায় পুলিশের ভয়ে বাইরে মুখ দেখাতে পারে না, তাই রাত্রিই হচ্ছে তাদের উপভোগের কাল। খাওয়া-দাওয়া ও গল্পসল্পের পর তারা চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে— শিকারের খোঁজে।

সাধারণত গুন্ডারা নিজেদের পাড়ায় অত্যাচার করে না। এ সদাশয়তার কারণ নিজের পাড়ার প্রতি প্রেম নয়, এতে ধরা পড়বার ভয় বেশি বলেই গুন্ডারা ভিন্ন পাড়ায় জোরজুলুম করতে যায়। রাত্রে মেছোবাজার যে ভয়ানক স্থান, তাতে আর সন্দেহ নেই। কিন্তু আজ চোদ্দো-পনেরো বছর ধরে মেছোবাজার দিয়ে অনেক রাতে আমি একলা আনাগোনা করেছি, কিন্তু কখনো কোনো বিপদে পড়িনি। অথচ এ অঞ্চলে বেশি রাতে যে লোকগুলিকে দেখা যায়, তাদের অধিকাংশই ব্যাঘ্রের মতো হিংস্র। অত্যন্ত সহজে ও অনায়াসে তারা এঁটো মাটির ভাঁড়ের মতো যেকোনো পথিকের দেহ এক আছাড়ে ভেঙে গুঁড়ো করে দেবার জন্য সর্বদাই প্রস্তুত হয়ে থাকে! তবু আমি তাদের সুনজরে পড়িনি। মেছোবাজারে প্রায়ই যেসব খুনোখুনি ও মারামারির খবর পাওয়া যায়, তার অধিকাংশই গুন্ডাদের নিজেদের মধ্যেই দলাদলির ফলে হয়ে থাকে।

এদের আপনা-আপনির মধ্যে মারামারি ও খুনজখম লেগেই আছে। এর একটা দৃষ্টান্ত আমি দিচ্ছি। প্রায় পনেরো ষোলো বছর আগেকার কথা। রহস্যময় জায়গায় যাওয়ার অভ্যাস আমার অনেকদিন থেকে— এটা আমার একটা রোগ বললেও চলে। আমার এক শৈশব বন্ধু ছিল, তার নাম এখানে করতে চাই না। তবে এইটুকু বলতে পারি, খুব সম্ভ্রান্ত ব্রাহ্মণ বংশে তার জন্ম— তার পিতা ছিলেন সাহিত্য সেবক ও উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মচারী। কিন্তু এমন বংশের ছেলে হয়েও আমার বন্ধুটি কুসঙ্গে মিশে বিগড়ে যায়। যত গুন্ডার দলে ছিল তার আনাগোনা। তার গায়েও খুব জোর ছিল, আমি তাকে পনেরো-কুড়ি জন হিন্দুস্থানি গুন্ডাকে একলা মেরে তাড়িয়ে দিতে দেখেছি। এই বন্ধুকে আমি একদিন ধরে বসলুম, ‘আমাকে একবার গুন্ডার আস্তানা দেখাও।’ সে রাজি হয়ে একদিন সন্ধ্যাবেলায় আমাকে গ্যাঁড়াতলার২.২৫ একটা বাড়িতে নিয়ে এল। সে বাড়িটি উঁচু একতলা— তার তলায় এক মদের দোকান ছিল। বাড়িটি এখন নেই— ইমপ্রূভমেন্ট স্কিমের কবলে পড়ে অদৃশ্য হয়েছে।

বাড়ির পাশে ছিল একটি সরু গলি। সেই গলি দিয়ে আমরা বাড়ির ভেতর ঢুকলুম— গলিটিও যেমন অন্ধকার, বাড়িটিও তেমনি। এখানকার জীবরা আলোকে বোধ হয় একটা অকেজো উৎপাতের মতো ভাবে।

অন্ধকার হাতড়াতে হাতড়াতে একটা ভাঙা সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠছি— এমন সময় একটা বাজখাঁই গলার আওয়াজ জিজ্ঞাসা করলে, আমরা কে? চারিদিক চেয়েও প্রশ্নকর্তাকে দেখতে পেলুম না, আমার মনে হল অন্ধকারই যেন কথা কইলে! ভয় পেয়ে জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়ালুম এবং প্রতি মুহূর্তে একখানা শানিত ছোরার ঠান্ডা স্পর্শ লাভের আশা করতে লাগলুম।

আমার বন্ধু বেশ সহজভাবেই বললে, ‘কে, আমির নাকি? আরে ভাই, আমাকে চিনতে পারছিস না?’

অন্ধকার আর কোনো কথা কইলে না।

আমি হাঁপ ছেড়ে বন্ধুর সঙ্গে একেবারে মদের দোকানের ছাদের উপরে গিয়ে উঠলুম। সেখানেও প্রদীপ নেই। তবে আকাশের স্বাভাবিক আলোর প্রভাবে অন্ধকার সেখানে আবছায়ায় পরিণত হয়েছে।

দেখলুম ছাদের উপরে প্রায় পনেরো-ষোলোজন মুসলমান বসে আছে। তাদের সামনে দু-তিনটে মদের বোতল, কতগুলো মাটির ভাঁড় আর খানকতক শালপাতা— বোধ হয় তাতে চাট আছে। তারা গল্প করতে করতে মাঝে মাঝে মদ খাচ্ছে। প্রত্যেকেরই চেহারায় এমন একটা ভাব মাখানো, যা দেখলেই বুক ছ্যাঁৎ করে ওঠে।

আমার বন্ধু তাদেরই ভিতর গিয়ে একজনের গলা জড়িয়ে ধরে বসে পড়ল এবং আর একজনের হাত থেকে ফস করে মদের ভাঁড়টা ছিনিয়ে নিয়ে এক চুমুকে নিঃশেষ করে দিলে। অন্যান্য সকলে হো হো করে হেসে উঠল।

তারপর আবার গল্প আর মদ চলতে লাগল। আমার দিকে কেউ ফিরেও চাইলে না, আমি যে তাদেরই এক ইয়ারের সঙ্গে সেখানে গেছি, আমার এই পরিচয়ই যেন যথেষ্ট।

.

খানিক পরেই দেখলুম ছাদের এক কোণে একটা গোলমাল উঠল। এতক্ষণ দেখিনি, সেখানে চার-পাঁচজন লোক বসে বসে কী খেলছিল— খুব সম্ভব জুয়া। গোলমালের সঙ্গে সঙ্গেই একজন লোক, আর একজনকে ঘুসি মারলে। ঘুসি খেয়ে সেও ঘুসি ফিরিয়ে দিলে। তারপরেই প্রথম লোকটা এক নিমেষে কাপড়ের ভিতর থেকে একখানা ছুরি বার করে দ্বিতীয় লোকটাকে মারতে গেল এবং দ্বিতীয় লোকটা হাত দিয়ে সে আঘাতটা নিবারণ করলে বটে, কিন্তু ছুরিখানা তার হাতের ভিতরে বেশ খানিকটা বসে গেল!

তারপর কী যে হল, বিশেষ বুঝতে পারলুম না, কিন্তু ছাদের ওপরে যে যেখানে ছিল সবাই দাঁড়িয়ে উঠল। খানিক কুৎসিত ভাষার স্রোত ছুটল, তারপরে লোকগুলো দুই দলে ভাগ হয়ে বিষম মারামারি শুরু করে দিলে। আমি তো প্রথমটা ভয়ে একেবারে আড়ষ্ট হয়ে গেলুম! চোখের সামনে দেখলুম, একজন লোক আর একজনের মাথার ওপরে একটা মদের বোতল তুলে প্রচণ্ড এক আঘাত করলে—’বাপরে বাপ, জান গিয়া’ বলে আহত লোকটা ছাদের উপর ঘুরে পড়ে গেল।

আমি বুঝলুম, এখানে আর এক মুহূর্ত থাকা উচিত নয়! দৌড়ে সিঁড়ির দিকে গেলুম, নীচে অমনি চিৎকার শুনলুম— ‘পুলিশ! পুলিশ!’ আমার বুকের রক্ত যেন জল হয়ে গেল! এখানে এসে পুলিশের হাতে ধরা পড়লে, আমি আর লোকসমাজে মুখ দেখাব কেমন করে? আমি যে এখানে দর্শকের মতো এসেছি, কে সে কথা বিশ্বাস করবে?

হঠাৎ পেছন থেকে আমার হাত ধরে কে টানলে! চমকে দেখি আমার বন্ধু!

সে বললে, ‘এদিকে আয়!’ বলেই আমাকে টেনে নিয়ে ছাদের ধারে ছুটে গেল।

‘পুলিশ আসছে— লাফিয়ে পড়!’ আমি কোনো জবাব দিতে না দিতেই শূন্যে এক লাফ মেরে ছাদের ওপর থেকে সে অদৃশ্য হল!

আমিও আর ভাবনা-চিন্তার অবকাশ পেলুম না— মরি আর বাঁচি যা থাকে কপালে, এই ভেবে দিলুম এক লাফ, এবং পর-মুহূর্তে একেবারে মেছোবাজার স্ট্রিটের২.২৬ ওপরে গিয়ে পড়লুম! তারপর উঠেই প্রাণপণে দৌড়।

আমার বন্ধুকে আর কখনো গুন্ডার আস্তানায় নিয়ে যাবার জন্য অনুরোধ করিনি। সে শখ আমার মিটে গেছে।

***

টীকা

২.১ গ্যাসের আলো— সেই সময়ে চোর, ডাকাত, গুন্ডাদের স্বর্গরাজ্য ছিল শহরের রাজপথ। কলকাতা শহরেও শুরুর দিকে বিপদে না পড়লে মানুষ রাতে খুব একটা বাইরে বেরোতেন না। ঊনবিংশ শতকের শেষ অবধি ইলেকট্রিক তো ছাড়, গ্যাসের আলোর কৌলীন্যও জোটেনি মহানগরীর কপালে। তাহলে রাস্তায় আলো কি জ্বলতই না? জ্বলত। আর তা ছিল কেরোসিনের বাতি। কিন্তু তার আগে? উনিশ শতকের গোড়ার দিকে শহরের রাস্তায় ছিল না পথবাতি। সন্ধ্যা নামলেই দরজায় কুলুপ আঁটতেন বাসিন্দারা। ঘরের ভেতর জ্বলত রেড়ির তেলের প্রদীপ। রাতবিরেতে বাইরে বেরোনোর দরকার হলে জ্বেলে নেওয়া হত পাটকাঠির ডগায় মশাল। ওই শতকের মাঝামাঝি কলকাতার রাস্তায় কেরোসিনের আলো জ্বালানোর ব্যবস্থা করে পুরসভা। রবীন্দ্রনাথ জানাচ্ছেন, “… কেরোসিনের আলো পরে যখন এল তার তেজ দেখে আমরা অবাক।” তবে রাস্তায় উজ্জ্বল আলোর ব্যবস্থা থাকলেও, বাড়িতে কিন্তু তখনও মহাবিক্রমে রাজত্ব করছে রেড়ির তেলের প্রদীপ বা সেজ। তাই প্রতি পাড়াতেই ছিল একটা রেড়ির তেলের কল বা দোকান। কলকাতায় গ্যাসবাতির প্রচলন হয় উনিশ শতকের মাঝামাঝি। তবে তার আগে, ১৮০৭ সালের ১৬ অগস্ট লন্ডনের রাস্তায় জ্বলে ওঠে গ্যাসের আলো। ১৮২২ সালের ৩০ মার্চ তখনকার এক বাংলা দৈনিকের খবরে জানা যায়, “ইংলণ্ড দেশে নল দ্বারা এক কল সৃষ্টি হইয়াছে, তাহার দ্বারা বায়ু নির্গত হইয়া অন্ধকার রাত্রিতে আলো হয়। … অনুমান হয় লটারির অধ্যক্ষরাও লটারির উপস্বত্ব হইতে কলিকাতার রাস্তাতে ঐরূপ আলো করিবেন।” সংবাদপত্রের ‘অনুমান’ সত্যি হতে লেগে গেল আরও পঞ্চাশ বছর। ১৮৫৭ সালের ৬ জুলাই কলকাতার রাস্তায় পুরসভার লটারির টাকাতেই প্রথম জ্বলল গ্যাসবাতি। গ্যাসলাইট আসার পরেও যে অবস্থা খুব একটা বদলেছিল তা কিন্তু নয়। খুব ভালো গ্যাসবাতিও ২৫ ওয়াটের বাল্‌বের তুলনায় কম আলো দিত। সে বাতি আবার লাগানো থাকত বহু দূরে দূরে— ফলে রাস্তায় গ্যাসবাতির তলাটুকু বাদ দিলে বাকিটা ঘন অন্ধকারেই ঢাকা থেকে যেত। প্রথম গ্যাসবাতি জ্বলেছিল কলকাতার হৃৎপিণ্ড চৌরঙ্গী রোডে। গ্যাস ল্যাম্পের উচ্চতা ছিল মাটি থেকে ১১ ফুট আর দুটি পোস্টের মধ্যে দূরত্ব ১৫০ ফুট। তাতেই মানুষ আনন্দে আত্মহারা হয়ে গান বেঁধেছিল, “রাত্রিতে গ্যাসলাইট জ্বালো, আর অন্ধকার নাই/ অন্ধকার রাত্রে দিনের মতো চলে যাই।”

হুতোম লিখেছেন, সন্ধ্যা হলেই পুরসভার মুটে বগলে মই নিয়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটত পথে পথে আলো জ্বালতে। মই বেয়ে ল্যাম্পপোস্টে উঠে প্রথমে ন্যাকড়া বুলিয়ে পরিষ্কার করত আলোর শেডের কাচ। তারপর চাবি ঘুরিয়ে চালু করত গ্যাস। সবশেষে দেশলাই জ্বালিয়ে ধরাত বাতি। আলো জ্বালানো-নেভানোর সময় নিয়ে প্রচণ্ড কড়াকড়ি ছিল পুরসভার। ১৯০৮ সালের কর্পোরেশন অফ ক্যালকাটা-র অ্যালম্যানাকে দস্তুরমতো ঘণ্টা-মিনিট উল্লেখ করে বছরভর প্রতিদিনের বাতি জ্বালানো ও নেভানোর নির্ঘণ্ট বেঁধে দেওয়া হয়েছে। (উদাহরণ- ডিসেম্বর মাসের ১ থেকে ১৫ তারিখ পর্যন্ত আলো জ্বালানোর সময় বিকেল ৫টা বেজে ৫০ মিনিট। আলো নেভানোর সময় ভোর ৫টা বেজে ৩৫ মিনিট। আবার ওই মাসেরই ১৬ থেকে ৩১ তারিখ পর্যন্ত আলো জ্বালানোর সময় বিকেল ৫টা বেজে ৪৩ মিনিট। আলো নেভানোর সময় ভোর ৫টা বেজে ৪৫ মিনিট।) বলা বাহুল্য, সাহেবি আমলে এর নড়চড় বড়ো একটা হত না। আলো জ্বালাতে ব্যবহার হত কয়লার গ্যাস। জোগান দিত ওরিয়েন্টাল গ্যাস কোম্পানি। পাইপলাইনের সাহায্যে পরবর্তীকালে সেই গ্যাসের আলো ঢুকে পড়ে শহরের উচ্চবিত্ত বাড়িতেও। শোনা যায়, এর পথিকৃৎ শোভাবাজার রাজবাড়ি। আর গ্যাসবাতি দিয়ে অভিজাত হগ মার্কেট সাজানো হয় ১৯০৪ সালের ১ মে থেকে ১৯১১ সালের ৩০ এপ্রিল সময়কালে। শহরের রাস্তায় গ্যাসবাতির একচ্ছত্র আধিপত্যে ভাগ বসাতে বৈদ্যুতিক আলোর বিকাশ ১৮৮৯ সালে। কলকাতায় প্রথম যে রাস্তা বিজলিবাতির আলোর স্পর্শ পায়, তা হল হ্যারিসন রোড, অধুনা মহাত্মা গাঁধী রোড। গোটা প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ করতে লেগে যায় তিন বছর। ১৮৯২ সালে হ্যারিসন রোড জুড়ে আলোর বন্যা বয়ে যায়। সৌজন্যে কিলবার্ন অ্যান্ড কোম্পানি। তবে এরও আগে ১৮৭৯ সালের ২৪ মে তত্কালীন ব্রিটিশ রাজধানীতে প্রথম বিজলিবাতির প্রদর্শন করেন পি. ডব্লিউ. ফ্লুরি অ্যান্ড কোম্পানি। তার মাত্র দু-বছর পরেই ৩০ জুন ১৮৮১ ম্যাকিনন অ্যান্ড ম্যাকেঞ্জি কোম্পানির গার্ডেনরিচের সুতোকলে ৩৬টা ইলেকট্রিক বাল্ব জ্বালিয়ে তাক লাগিয়ে দেয় দেশি সংস্থা দে শীল অ্যান্ড কোম্পানি। ১৮৯৫ সালে ক্যালকাটা ইলেকট্রিক লাইটিং অ্যাক্ট পাশ করে তদানীন্তন বাংলার সরকার। ১৮৯৭-এর ৭ জানুয়ারি ২১ বছরের জন্য শহরকে আলোকিত করার লাইসেন্স মঞ্জুর হয় ইন্ডিয়ান ইলেকট্রিক কোম্পানি লিমিটেডের এজেন্ট কিলবার্ন অ্যান্ড কোম্পানির নামে। ভিক্টোরীয় যুগের গ্যাসবাতি জ্বলত পেটা লোহার কারুকাজ করা পোস্ট বা ব্র্যাকেট থেকে। বিজলিবাতির আদি যুগে রাস্তার পাশের এই পোস্টগুলোই ব্যবহার হত আলো জ্বালাতে। তবে কাচের মনোহারি আস্তরণ বাতিল করে এনামেলের শেড থেকে ঝুলত নগ্ন বাল্ব। ১৯৫১ সাল অবধি কলকাতায় গ্যাসের আলো ছিল ১৯০০০, যা ১৯৬০ সালে হয় ৩৮০০ আর গ্যাসের আলো কলকাতা থেকে অদৃশ্য হয়ে যায় ১৯৭০ সালে। ক্রমে ইতিহাসের পাতাতেই ঠাঁই হয় সুদৃশ্য পোস্টগুলোর।

২.২ ক্লাইভ স্ট্রীট— এখন যেখানে ক্লাইভ স্ট্রীট, ইংরেজরা আসার আগে সেটা ভাগীরথী নদীর এলাকায় ছিল। কালের প্রভাবে সেই জল ধুয়ে চর, মাটি আর পায়ে চলা পথ জেগে ওঠে। এটি কলকাতার প্রাচীনতম পথগুলির একটা। ১৭৫৭ সালে পলাশির যুদ্ধ জেতার পর লর্ড ক্লাইভ নিজেই এই রাস্তার নাম রাখেন ক্লাইভ স্ট্রিট। তিনি নিজে এই রাস্তায় যে বাড়িটিতে থাকতেন সেটিই এখন রয়্যাল এক্সচেঞ্জ বিল্ডিং। এই রাস্তা এককালে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল। কোম্পানির কাউন্সিলের সদর দপ্তর সেকালের পুরোনো ফোর্ট উইলিয়ামের মধ্যে ছিল। আর কেল্লা ছিল ক্লাইভ স্ট্রিটের মাঝবরাবর প্রায় লালদিঘি অবধি। হরিসাধন মুখোপাধ্যায় তাঁর ‘কলিকাতা সেকালের ও একালের’ বইতে লিখছেন, “আজকাল যাহা ক্লাইভ-স্ট্রীট বলিয়া সাধারণে পরিচিত, দুইশতাধিক বৎসর পূৰ্ব্বে, তাহাই প্রাচীন কলিকাতার ‘সাহেবী-কোয়ার্টার’ ছিল। প্রাসাদ-সৌন্দর্য্যময়ী চৌরঙ্গী, তখন জঙ্গলের মধ্যে শার্দ্দূল ও বন্যবরাহের ক্রীড়াভূমি, দস্যু ও চোরের প্রধান আশ্রয়-কেন্দ্র ছিল। এই ক্লাইভ-স্ট্রীটই তখন সরাসরি বড়বাজার পর্য্যন্ত গিয়াছিল ও ইহাই কলিকাতার প্রধান বন্ধু বলিয়া পরিগণিত হইত। তখন ইহার নাম ক্লাইভ স্ট্রীট ছিল না—কি ছিল, তাহাও প্রকাশ নাই। তবে ইংরাজেরা এই পথটিকে Road to Great Bazar বলিয়াই উল্লেখ করিতেন।”

পরে এই রাস্তা দিয়েই যেতে হত দরমাহাটা নামে এক এলাকায়। সেখানে দরমার মাদুর ইত্যাদি বিক্রি হত। এর উত্তর-পশ্চিম কোণে ছিল হলওয়েল মনুমেন্ট, রাইটার্স বিল্ডিং-এর সামনেই। একে কেন্দ্র করে বেরিয়েছে ফেয়ারলি প্লেস, ক্লাইভ ঘাট স্ট্রিট, ক্লাইভ রো, ক্যানিং স্ট্রিট, চার্নক প্লেস ইত্যাদি। ১৯৪৭ সালের ১৩ আগস্ট পুরসভার অধিবেশনে ক্লাইভ স্ট্রিটের নাম বদলে নেতাজির নামে রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ১৯৫৭ সালের ৯ আগস্ট থেকে এই রাস্তার নাম হয় নেতাজি সুভাষ রোড। সঙ্গে ১৮৯২ সালে জন গোদারের তোলা ক্লাইভ স্ট্রিটের ছবি।

২.৩ স্ট্র্যান্ড রোড— এখন যেখানে স্ট্র্যান্ড রোড, এককালে এখানে ছিল গঙ্গার পলি আর এক বিখ্যাত ঘাট। বহু বছর আগে চন্দ্রনাথ পাল নামে একজন মুদি দোকানদার ছিলেন। যেসব ব্যবসায়ী আর দোকানদাররা এখানে নৌকা থেকে নামতেন, তাঁরা ওই দোকান থেকে জিনিস কিনতেন। তাঁর নামেই এই ঘাটের নাম হয় চাঁদপাল ঘাট। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির পদস্থ কর্মচারীরা এই ঘাটেই নামলে তাঁদের সম্মানে তোপধ্বনি করা হত কেল্লা থেকে। ওয়ারেন হেস্টিংস-এর সঙ্গে ফিলিপ ফ্রান্সিসের ঝগড়ার শুরুই হয় ১৯টির বদলে ১৭টি তোপধ্বনি করায়।

প্রথমে এই রাস্তার নাম ছিল স্ট্র্যান্ড ব্যাংক। একবার সুমাত্রা নামে একটি জাহাজ এখানে ডুবে যায় আর সেই ধ্বংসাবশেষ মিশে যায় মাটির সঙ্গে। এই নতুন গড়ে ওঠা শক্ত মাটির নাম হয় সুমাত্রা স্যান্ড। ১৮৭০ সালে এখানেই পোর্ট কমিশনারেট গড়ে ওঠে। স্ট্র্যান্ড রোডটি ১৮২৮ সালে লটারি কমিটি দ্বারা নির্মিত হয়েছিল। ১৮২৩ সালে রাস্তার কাজ শুরু হয়। এই রাস্তাতেই আছে টাঁকশালের নকশাকার জেমস প্রিন্সেপের নামে প্রিন্সেপ ঘাট, জানবাজারের বিখ্যাত বাবু রাজচন্দ্র দাসের (রাণী রাসমণির স্বামী) নামে বাবুঘাট, ইংরেজ সেনাপতি আউট্রামের নামে আউট্রাম ঘাট। এই রাস্তার পাশেই আছে সুসজ্জিত ইডেন গার্ডেনস। সঙ্গে ফ্রান্সিস ফ্রিথের তোলা ১৮৯০ সালের স্ট্র্যান্ড রোড।

২.৪ হাইকোর্টের— ভারতের প্রাচীনতম হাইকোর্ট। ১৮৬১ সালের হাইকোর্ট আইন বলে ১৮৬২ সালের ১ জুলাই কলকাতা হাইকোর্ট স্থাপিত হয়। সেই সময় এই হাইকোর্টের নাম ছিল হাই কোর্ট অফ জুডিকেচার অ্যাট ফোর্ট উইলিয়াম। বর্তমানে সমগ্র পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ কলকাতা হাইকোর্টের অধিকারক্ষেত্রের অন্তর্গত। আন্দামান ও নিকোবরের রাজধানী পোর্ট ব্লেয়ারে কলকাতা হাইকোর্টের একটি সার্কিট বেঞ্চ আছে। কলকাতা শহরের সাম্মানিক নাগরিক শেরিফের ঐতিহ্যশালী দপ্তরটি এই আদালতের ভেতরে অবস্থিত।

হাইকোর্ট ভবনটি ইউরোপীয় গঠনশৈলীর গথিক স্থাপত্যবিশিষ্ট বেলজিয়ামের ইপ্রেস ক্লথ হলের আদলে নির্মিত। উল্লেখ্য, প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ক্লথ হল ক্ষতিগ্রস্থ হলে সেটি পুনর্নিমাণের জন্য ওই শহরের মেয়র কলকাতা থেকে এক সেট প্ল্যান চেয়ে পাঠিয়েছিলেন। ১৮৬৪ সালের মার্চ মাসে ভবনটির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হয়। নির্মাণকার্য শেষ হতে সময় লেগেছিল আট বছর। এই ভবনে একটি ১৮০ ফুট উঁচু টাওয়ার আছে। হাইকোর্ট ভবনের নকশাটি বেশ জটিল। এই প্রসঙ্গে রথীন মিত্র লিখেছেন:

একটা চতুষ্কোণীর চারধারে অবস্থিত একটি আয়তাকার স্থাপত্য। ভেতরে অনেকগুলি বিচার কক্ষ, অন্যান্য ঘর। ছাদের সঙ্গে লোহার একটি সুন্দর গম্বুজ আছে, যা ভেতরের গরম হাওয়া টেনে বের করে নিয়ে বাহিরে পাঠিয়ে দিতে পারে। বাড়ির ভেতরের বাতাস হয়ে যায় নির্মল ঠান্ডা। চারিদিকে সুন্দর বাগান, ফোয়ারা।

পরবর্তী পর্যায়ে স্থান সংকুলান না হওয়ায় ১৯১০ খ্রিস্টাব্দে উত্তর দিকে সংলগ্ন আরও একটি ভবন নির্মাণ করা হয় এবং পরবর্তী ১৯৭০ খ্রিস্টাব্দে দক্ষিণ দিকে হাইকোর্ট ভবনের বর্তমান স্থাপত্যের সঙ্গে সমতা রেখে আর-একটি নতুন ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। চতুর্ভুজাকার এই হাইকোর্ট ভবন দৈর্ঘ্যে ৪২০ ফুট এবং প্রস্থে ৩০০ ফুট। সঙ্গে ১৮৯০ সালে লাইফ ম্যাগাজিনের তোলা কলকাতা হাইকোর্ট।

২.৫ রাধাবাজার— ‘কলিকাতা সেকালের ও একালের’ গ্রন্থে হরিসাধন মুখোপাধ্যায় লিখছেন, “সাবর্ণ মহাশয়েরা, সেই পুরাকালে কলিকাতার জন-সংখ্যা বৃদ্ধি ও আংশিক উন্নতিকল্পে যথেষ্ট সহায়তা করিয়াছিলেন। তাঁহাদের শ্যামরায়জীউর উৎসব উপলক্ষ্যে, সাময়িক অনেক হাট-বাজার ও মেলার অনুষ্ঠান হইত। তাহাদের শ্যামরায় বিগ্রহের দোল-যাত্রা উপলক্ষ্যে, তৎকালের উপযোগী, একটা মেলা লালদীঘিতে বসিত। এই শ্যামরায়ের দোলের উৎসব ক্ষেত্র ছিল বলিয়াই বোধ হয় পার্শ্বস্থানগুলির লালদীঘি, রাধাবাজার, লালবাজার ইত্যাদি নামকরণ হইয়াছিল।” প্রায় ৩২৫ বছর আগে এক বসন্তে, কয়েকজন ফিরিঙ্গি ছোকরা গ্রামের ভেতরে ঘুরতে বেরিয়েছিল। হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ তাদের কানে এল গানের সুর। সেই সুর অনুসরণ করে তারা এগোতে এগোতে পৌঁছোল এক দিঘির পাড়ে। সেখানে তারা যা দেখল, তা বিস্ময়কর! দিঘির দক্ষিণে এবং উত্তরে দুটি খাড়াই মঞ্চ। তার একটিতে গোবিন্দজি এবং অন্যটিতে শ্রীরাধিকার অধিষ্ঠান। দুই দেব-দেবীকে মাঝে রেখে চলছিল দোলখেলা। যাঁরা দোল খেলছিলেন তাঁদের পোশাকেও ছিল অভিনবত্ব। আবিরে চারদিক লাল। পিচকারিতে তরল রং নিয়ে চলছিল খেলা। কাতারে কাতারে লোক এসেছেন সেই উৎসবে। বসেছিল মেলাও। দিঘির উত্তর পাড়ে অর্থাৎ রাধাবাজারে, স্তূপ করে রাখা ছিল আবির। পথঘাটের সঙ্গে দিঘির জলও লাল হয়ে গিয়েছিল। গোপিনীদের নৃত্য, উত্তেজক চটকদারি সংগীত আর চারপাশের পরিবেশ সেই ইংরেজ ছোকরাদের প্ররোচিত করে তোলে। এই গোপিনীরা যে আসলে সকলেই পুরুষ, তা ভাবতেও পারেনি ওই ফিরিঙ্গি ছোকরারা। প্রাচীন গ্রিসের ‘স্যাটারনালিয়া’-র সঙ্গে এই রং-উৎসবের মিল খুঁজে পেয়ে তারা ভেবেছিল বুঝি ‘কামোৎসব’। এরপরে তারাও অংশ নিতে ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করে। ফলে এক কাণ্ড ঘটে বসল! এটা ফিরিঙ্গিদের বেয়াদপি মনে করে নেটিভরা তাদের উৎসবে ঢুকতে বাধা দিলেন। শুধু তাই নয়! তাদের পিঠে পড়েছিল চড় থাপ্পড়। বৈদ্যনাথ মুখোপাধ্যায়ের একটি প্রবন্ধে ঘটনাটির উল্লেখ মেলে।

২.৬ মুগঁাহাটা— আগে নাম ছিল মুরগিহাটা। এখন ব্রেবোর্ন রোড। পর্তুগিজ নাবিক ভাস্কো-দা-গামা প্রথম ভারতে আসেন ১৪৯৮ খ্রিস্টাব্দে। তিনি বঙ্গদেশে না এলেও তাঁর আসার মাত্র উনিশ বছর পরেই, ১৫১৭-এ আর-এক পর্তুগিজ নাবিক ডি জোয়াও সিলভেরিয়া বাণিজ্যতরী নিয়ে চট্টগ্রাম বন্দরে আসেন। ইতিহাস বলে ওই নাবিক বাণিজ্য করবার অনুমতি প্রার্থনা করেন তৎকালীন শাসকের কাছে। কেউ কেউ বলেন, সেই শাসক হলেন গৌড়েশ্বর হুসেন শাহ। তথ্যটা বিতর্কিত হলেও এটা জানা যায় যে বাংলার শাসকের কাছ থেকে অনুমতি তখন মেলেনি। হতোদ্যম না হয়ে পর্তুগিজরা বছর বছর নৌবহর পাঠাতে থাকে অনুমতির আশায়। তারপর নানা ঘাতপ্রতিঘাতের মধ্যে দিয়ে পর্তুগিজরা শেষ পর্যন্ত বাংলায় বাণিজ্য করবার অনুমতি লাভ করে। ষোড়শ শতকের শেষ দিক থেকে বাংলার পশ্চিম অংশে এসে সপ্তগ্রাম, হুগলি, ব্যান্ডেল প্রভৃতি অংশ ঘুরে পর্তুগিজরা কলকাতায় বসতি স্থাপন করে সপ্তদশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে। ইংরেজ বণিক জোব চার্নক মুঘলদের সঙ্গে বিরোধ করে যখন সুতানুটি আসেন, পর্তুগিজরা ততদিনে এই অঞ্চলে ঘাঁটি তৈরি করে ফেলেছে। খানিকটা তাদের সহায়তা নিয়েই জোব চার্নক এখানে বসতি তৈরি করেন। সেখানে খড়ের চালা দেওয়া একটা অস্থায়ী উপাসনাগারও তৈরি করে তারা। প্রাচীনতম ধরলে সেটাই ছিল কলকাতার আদি খ্রিস্ট উপাসনালয়। কেউ কেউ বলেন, ১৬৯৩-এ চার্নকের মৃত্যুর পর জন গোল্ডসবরো সুতানুটি থেকে কুঠি তুলে পর্তুগিজদের সেখান থেকে বিতাড়িত করে তাদের জায়গা দখল করে ঘাঁটি তৈরি করেন। সেই জায়গাটা হল এখনকার ডালহৌসির জিপিও এলাকা। বিতাড়িত পর্তুগিজরা খানিকটা দূরে এখনকার মুরগিহাটা অঞ্চলে চলে যায় এবং আর-একটা উপাসনালয় তৈরি করে। তবে সেটি ছিল অস্থায়ী কাঠামো। পরে ১৭৯৭-তে নতুন গির্জাভবনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হয়। জেমস্ ড্রাইভারের পরিকল্পনায় তৈরি গির্জা তৈরিতে খরচ হয় নব্বই হাজার সিক্কা টাকা। পর্তুগিজ ধনী ব্যবসায়ী ব্যারেটো অনেক টাকা দান করেন ওই গির্জার জন্যে৷ নির্মাণকাজ সম্পূর্ণ হলে রোসারি ভার্জিন মেরির নামে উৎসর্গ করে ১৭৯৯ সালের ২৭ নভেম্বর চার্চ খুলে দেওয়া হয়৷ দুদিকে দুটো মিনার, মাঝে ত্রিভুজাকৃতি চুড়ো দেওয়া এই উপাসনালয়কে কলকাতার অন্যতম সুদৃশ্য গির্জা বলা হয়। সঙ্গের ছবিতে জেমস বেইলি ফ্রেজারের আঁকা পর্তুগিজ চার্চ।

২.৭ ছ্যাকরা গাড়ি— গাড়ি টানার কাজে ঘোড়াকে নানান উপায়ে ব্যবহার করা হত। উদ্দেশ্য দ্রুতগতিতে যাতায়াত। ব্রাউনলো নামে এক সাহেব বের করলেন ‘ব্রাউনবেরি’ নামে গাড়ি। সাবেকি পালকিতেই চারটি চাকা বসিয়ে সামনে ঘোড়া জুতে দিয়ে বানিয়ে ফেললেন এক ঘোড়ায় টানা ‘ব্রাউনবেরি’ গাড়ি, ১৮২৭-এ। ব্রাউন বেরির ভাড়া ছিল প্রথম একঘণ্টায় চোদ্দো আনা, পরের প্রতি ঘণ্টায় আট আনা আর সারাদিনের জন্য নিলে চার টাকা। নানান ধরনের ঘোড়ার গাড়ি ছিল। সাহেবদের জন্য দামি গাড়ি, সাধারণ কর্মচারীদের জন্য আলাদা গাড়ি। নানান নামের এইসব ঘোড়ার গাড়ি। চেরট, ফিটন, ল্যান্ডো, টমটম, ছ্যাকরা গাড়ি এইরকম। অনেক বড়ো বড়ো কোম্পানি হয়েছিল ঘোড়ার গাড়ি তৈরি করার জন্য। এক্কা গাড়ি, টমটম, ছ্যাকরা গাড়ি এসব নামগুলো প্রবাদের মতো হয়ে গেছে। রবীন্দ্রনাথ তাঁর ছেলেবেলা বইতে লিখছেন, “আমি জন্ম নিয়েছিলুম সেকেলে কলকাতায়। শহরে শ্যাকরাগাড়ি ছুটছে তখন ছড়্‌ছড়্‌ করে ধুলো উড়িয়ে, দড়ির চাবুক পড়ছে হাড়-বের করা ঘোড়ার পিঠে। না ছিল ট্রাম, না ছিল বাস, না ছিল মোটরগাড়ি।” এইসব ছ্যাকরা গাড়িদের আড্ডা ছিল ধর্মতলার মোড়ে। তখন এখানে এক মস্ত পুকুর ছিল। ক্ষিতীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখছেন, “এখানে স্থূলকায় ভদ্রলোকেরা পরস্পরের মধ্যে বিশেষ বন্ধুতা সত্ত্বেও কিরূপে পরস্পরকে এড়াইবার চেষ্টা করিতেন তাহা দেখিলে হাস্য সম্বরণ করা দুরূহ হইত।” সঙ্গে ১৮৯৫ সালে স্টুয়ার্ট অ্যান্ড কোং-এর ছ্যাকরা গাড়ির বিজ্ঞাপন।

২.৮ হেজেলিন স্নো— ১৮৮০ সালে লন্ডনে দুই আমেরিকান সাইলাস বরো এবং হেনরি ওয়েলকাম মিলে বরো ওয়েলকাম অ্যান্ড কোং প্রতিষ্ঠা করেন। ত্বকের যত্ন নেবার জন্য ১৮৯১ সালে উইচ হ্যাজেল গাছের রস থেকে প্রস্তুত হ্যাজেলিন তাঁরা বিক্রি করতে শুরু করেন। প্রথম বিজ্ঞাপনে লেখা ছিল, “Prescribed in cases of haemorrhage from the nose, lungs, womb, rectum, &c. Is a valuable agent in the treatment of bruises, sprains, inflammation, peritonitis, piles, fistula, anal fissure, ulcers, varicose veins, eczematous surfaces, tonsillitis, pharyngitis, nasal and post-nasal catarrh, stomatitis, leucorrhoea, nasal polypi, &c.” এই হ্যাজেলিন ক্রিম আর স্নো একেবারে চ্যাটচ্যাটে ছিল না আর ত্বকের সুরক্ষাও দিত। এর হালকা মিষ্টি গন্ধও একে আকর্ষক করে তুলেছিল। ভারতে, বিশেষ করে কলকাতায় এই হেজেলিন স্নো দারুণ জনপ্রিয় হয়। ১৯০২ সালে শ্যামাচরণ দে প্রণীত “শুশ্রূষা” বইতে তিনি লিখেছেন, “বোলতা বা ভিমরুল দংশনে দষ্ট স্থান স্ফীত বা বেদনাযুক্ত হইলে গোবর গরম করিয়া পুলটিশের ন্যায় ব্যবহার করিলেও উপকার দর্শে। হেজেলিন ক্রিম (Hazeline cream) লাগাইলেও তৎক্ষণাৎ জ্বালা নিবারণ হয়।” কাজী নজরুল ইসলাম নাকি খুব শৌখিন ছিলেন। স্নানের সময় ল্যাভেন্ডার গন্ধযুক্ত সাবান মাখতে ভালোবাসতেন। মুখে মাখতেন হেজেলিন-স্নো। বুদ্ধদেব বসু তাঁর তিথিডোর উপন্যাসে লিখেছেন, “শ্বেতার সামনে নামিয়ে একটু দূরে আলগোছে বসলেন খাটের উপর। মেঝেতে হাঁটু তুলে বসে, হাঁটুতে থুতনি ঠেকিয়ে শ্বেতা আস্তে আস্তে বের করল আলতা, সিঁদুর, পাউডার, সেন্ট, মাথার তেল, চুলের কাটা, চুলের ফিতে, সাবান, হেজলিন স্নো আর একবাক্স ডিম–সন্দেশ। কিছু বলল না, একটু দেখল তাকিয়ে, তারপর একটি একটি করে প্রত্যেকটির গায়ে হাত বুলিয়ে বুলিয়ে আবার তুলে রাখল সেই কাগজের বাক্সে।” সঙ্গে ১৮৯৬ সালে হেজেলিনের বিজ্ঞাপন।

২.৯ বিডন স্কোয়ার— বাংলার লেফটেন্যান্ট গভর্নর সিসিল বিডনের নামে এই বিডন স্কোয়ার এককালে কোম্পানির বাগান নামে পরিচিত ছিল। এই স্থানটি ঐতিহাসিক। আনন্দমঠ গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হওয়ার চোদ্দো বছর পরে ১৮৯৬ খ্রিস্টাব্দে কলকাতার বিডন স্কোয়ার উদ্যানে (অধুনা রবীন্দ্রকানন) ডি. ওয়াচার সভাপতিত্বে কংগ্রেসের যে অধিবেশন হয়, তাতেই দেখা যায় যে, রবীন্দ্রনাথই সর্বপ্রথম এক মহতী সভায় বন্দেমাতরম সংগীতটি গাইছেন। পূর্ণচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় লিখেছেন— ‘এই গীতটির একটি সুর বসাইয়া উহার গাওনা হইত।’ রবীন্দ্রনাথের কণ্ঠে এই গান শুনে মদ্রদেশীয় এক ভদ্রলোক নাকি চোখের জল ধরে রাখতে পারেননি। ১৯০৯ সালের ১৩ জুন এখানেই অরবিন্দ ঘোষ তাঁর বিখ্যাত ‘বিডন স্কোয়ার বক্তৃতা’-টি দেন। এ নিয়ে ‘বেঙ্গলি’ পত্রিকায় লেখা হয়, “In spite of the foul weather a large number of people assembled on Sunday afternoon at Beadon Square where a big Swadeshi meeting was held under the presidency of Babu Ramananda Chatterji, Editor of the Prabasi. Several speakers addressed the meeting. We publish below an authorised version of Mr. Aurobindo Ghose’s speech delivered at that meeting.”

২.১০ মামার দোকান— তখন পুলিশ আর শুঁড়ি দুজনকেই ‘মামা’ নামে ডাকা হত। উৎস- অপরাধ জগতের ভাষা, ভক্তিপ্রসাদ মল্লিক, ১৯৭২।

২.১১ আবু হোসেন— ১৮৯৩ সালে লেখা গিরিশচন্দ্র ঘোষের লেখা ৩ অঙ্ক ১৩ দৃশ্যের একটি হাসির নাটক। ৯টি মূল চরিত্র। প্রথম অভিনয় হয়েছিল মিনার্ভা থিয়েটারে। মূল কাহিনি আরব্য রজনী থেকে নেওয়া। আবু হোসেন নামে এক গরিব মানুষকে এক রাতের জন্য রাজা বানিয়ে দেন বাদশা হারুন অল রসিদ। সেই এক রাতে হঠাৎ এত অর্থ আর ক্ষমতা পেয়ে আবু কী করে, তা নিয়েই এই নাটক। সেই এক রাতেই সে রাজার বাঁদি রোশনারার প্রেমে পড়ে তাকে বিয়েও করে। পরদিন আবার সে আগের মতো হয়ে যায়। এই নাটকের “রাম রহিম না জুদা করো” গান এককালে মুখে মুখে ফিরত। আবুর চরিত্রে অভিনয় করতেন অভিনেতা অর্ধেন্দু মুস্তাফী। এখানে সদ্য বেতন পাওয়া কর্মচারীদের আবু হোসেনের সঙ্গে তুলনা করা হচ্ছে।

২.১২ দশ আনা ছ’ আনা— সামনের চুল লম্বা এবং পিছনের চুল খাটো করে ছাঁটার পদ্ধতি বিশেষ।

২.১৩ ফিরিঙ্গি— পর্তুগিজ শব্দ ফ্রান্সেস (Frances) থেকেই ফিরিঙ্গি শব্দের উদ্ভব। শব্দটি দিয়ে যে-কোনো ইউরোপীয় জাতি বোঝানো হত। ইংরেজিতে ফিরিঙ্গি শব্দের চারটি বানান দেখা যায়। যেমন- feringi, firingi, feringee, feringhee। ফিরিঙ্গি শব্দের তিনটি মূল অর্থ রয়েছে। যেমন- পর্তুগিজ ও ভারতীয় মিশ্রণজাত জাতি, ইউরেশিয়ান ও খ্রিস্টান। ব্রিটিশ আমলের প্রথম দিকে ফিরিঙ্গি শব্দটি সম্মানার্থে ব্যবহৃত হত। পরে ফিরিঙ্গি শব্দটি তুচ্ছার্থে বা নেতিবাচক অর্থে ব্যবহৃত হয়। জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাসের মতে, ফরাসি franc হতে feringi, firingi, feringee, feringhee শব্দ চারটির উৎপত্তি। ‘আরব ও পারসিকদিগের সঙ্গে প্যালেস্টাইন নিয়ে ধর্মযুদ্ধের (crusade) সময় ইউরোপের খ্রিস্টানগণ ফ্রাঙ্ক নামে অভিহিত হতেন। ঐ সময় সকলের বোধগম্য এক নতুন ভাষার সৃষ্টি হয়, এর নাম ছিল Lingua Franca বা ফ্রাঙ্ক ভাষা। পারসিক বা আরবগণ শব্দটিকে ফেরঙ্গ উচ্চারণ করতেন। এ ফেরঙ্গ শব্দের অপভ্রংশ ফিরিঙ্গি। পাশ্চাত্য দেশ অর্থে ফিরঙ্গ দেশ, তদ্দেশবাসি ফিরিঙ্গি।’ সংস্কৃত অভিধান শব্দকল্পদ্রুম ও বাচস্পত্যে ‘ফিরঙ্গ’ শব্দটি আছে। সুতরাং বলা যায়, ফিরিঙ্গি শব্দটি একেবারে নতুন নয়। আবুল ফজলের ‘আইন-ই-আকবরি’ ও ভারতচন্দ্র রায়গুণাকরের অন্নদামঙ্গলে ‘ফিরিঙ্গি’ বলতে শুধু পর্তুগিজদের বোঝানো হয়েছে। পরে ইউরোপবাসীর সঙ্গে ভারতীয়দের মিশ্রণে সৃষ্ট সংকর জাতও ফিরিঙ্গি আখ্যা পায়। (‘বলা তো যায় না, ফিরিঙ্গির বাচ্চা কখন রং বদলায়’- দেশে বিদেশে, সৈয়দ মুজতবা আলী)।

২.১৪ সোনাগাছি— কলকাতার তথা ভারতের বৃহত্তম পতিতাপল্লি। সোনাগাছির পথ চলা প্রথম শুরু হয়েছিল উনিশ শতকে। গোটা ভারতকেই তখন আস্তে আস্তে দখল করার পথে এগোচ্ছে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। কলকাতা তখন ব্রিটিশরাজের নয়া রাজধানী। নতুন রাজ্য শাসন করার জন্য ইংল্যান্ড থেকে এসেছেন একদল তরুণ যুবা। তাদের বয়স কম, শরীরে তরুণ রক্ত। নতুন দেশে এসে তার জৌলুস দেখে তাঁদের তো চক্ষু চড়কগাছ। দেদার ধনদৌলতে শিগগিরই তাঁদের পকেট ভরে উঠতে লাগল। ফুর্তিতে মন দিলেন তাঁরা। বিবি-বাচ্ছা সবই তো এদিকে ইংল্যান্ডে। কী করবেন? অগত্যা এদেশি কালা নেটিভদের বিধবা মেয়েগুলোকে ধরে ধরে আনতে লাগলেন সোনাগাছিতে (তখনও অবশ্য সোনাগাছি ‘সোনাগাছি’ হয়নি)। কলকাতা শহরে বেশ্যাবৃত্তির বোধহয় সেই শুরু। কেউ কেউ বলেন অবশ্য, ওই যে পুবে কর্ণওয়ালিস স্ট্রিট ও পশ্চিমে চিৎপুর- তার মধ্যিখানের গোটা জায়গাটা নিয়ে যে বেশ্যাদের উপনিবেশ গড়ে উঠেছিল, সেই জায়গাটা কিন্তু আদতে নাকি ছিল প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরের। তাঁর ও স্থানীয় কয়েকজন ধনী জমিদার ‘বাবু’-র উদ্যোগেই নাকি শুরু হয়েছিল সোনাগাছির ব্যবসা। সানাউল্লাহ বা সোনাগাজি নামে এক মুসলমান সাধুবাবার মাজার ছিল এখানে। তাঁর নামে তারপর একসময় জায়গাটার নাম হয় ‘সোনাগাজি’ ও সেই নামই আস্তে আস্তে ‘সোনাগাছি’ হয়ে ওঠে। কথিত আছে, প্যারিসের বিখ্যাত যৌনকর্মীরাও কলকাতার এই সোনালি অঞ্চল (Golden district)-এর খ্যাতি সম্পর্কে অবহিত ছিলেন। এই সোনাগাজির প্রভাব বাংলা বটতলা সাহিত্যে কম ছিল না। ১২৮২ সালে অখিলচন্দ্র দত্ত লেখেন পয়ার ছন্দে ‘সোনাগাজির খুন’। ১৮৮০ সালে ‘অজ্ঞাতনামা’ লেখকের হাতে রচিত হয় নাটক ‘বেশ্যালীলা’। নাটকটির প্রেক্ষাপট ছিল সোনাগাছি। তারপর থেকে আজ পর্যন্ত বাংলায় অনেক সাহিত্যই লেখা হয়েছে সোনাগাছির প্রেক্ষাপটে। বর্তমানে প্রায় দশ হাজার যৌনকর্মী এখানে বাস করেন।

২.১৫ রুপোগাছি— সোনাগাছির সঙ্গে নাম মিলিয়ে গরানহাটা এলাকার পতিতাপল্লির নাম রাখা হয়েছিল রুপোগাছি। এখানের বারবনিতারা সংখ্যা ও কৌলীন্যে সোনাগাছির পরেই, তাই এই নাম। বর্তমান নাম নিমতলা স্ট্রিট।

২.১৬ এম এল সি— মেম্বার অফ লেজিসলেটিভ কাউন্সিল। ১৯১৯ সালের ভারত শাসন আইন বলে স্থাপিত হয় বঙ্গীয় প্রাদেশিক আইনসভা বা বেঙ্গল লেজিসলেটিভ কাউন্সিল। ১৯২১ সালের ১ ফেব্রুয়ারি, ডিউক অফ কনট আনুষ্ঠানিকভাবে এই সভার উদ্বোধন করেন।

২.১৭ নন কো-অপারেটর— অসহযোগ আন্দোলনের নেতা। অসহযোগ আন্দোলন মহাত্মা গান্ধি ও ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস পরিচালিত ভারতব্যাপী অহিংস গণ আইন অমান্য আন্দোলনগুলির মধ্যে সর্বপ্রথম। ১৯২০ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ১৯২২ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত চলা এই আন্দোলন ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে ‘গান্ধি যুগ’-এর সূত্রপাত ঘটায়।

২.১৮ কমলি কিন্তু তাঁদের ছাড়ত না— দুজন সাধু দেখলেন, গঙ্গার জলে একটা কালো কম্বল ভেসে যাচ্ছে। তাই দেখে সেটা আনার জন্য একজন গিয়ে সেই কম্বলে হাত দিয়ে যেই তুলতে গেছেন, কম্বলটা অমনি তাঁকে জড়িয়ে ধরেছে। আসলে সেটা ছিল ভালুক। সে ভেসে যেতে যেতে আশ্রয় মনে করে সাধুকেই জড়িয়ে ধরেছে। অপর সাধুটি দেখলেন যে তিনি কম্বল নিয়ে উঠছেন না। তখন বললেন, “আরে ভেইয়া কমলি কো ছোড় দো, চলা আও।” তিনি তখন বলছেন, “ভাইয়া হাম তো কমলি কো ছোড় দেতা, লেকিন কমলি হামকো ছোড়তা নেহি।” মানে বিষয় হতে দূরে থাকতে গেলেও বিষয় তোমাকে ছেড়ে দেবে না। হিন্দি হলেও প্রবাদটি বাংলা ভাষায়ও প্রচলিত। ‘বিরক্তিকর বিষয় ত্যাগ করলেও অনিচ্ছাসত্ত্বেও ওই ব্যাপারে জড়িয়ে পড়তে হয়’- এমন অর্থ প্রকাশে প্রবাদটি প্রচলিত। এই গল্পটি স্বামী বিবেকানন্দ আমেরিকায় বলেছিলেন।

২.১৯ চৌরঙ্গী— চৌরঙ্গী ছিল ময়দানের পুবে ছোট্ট একটা গ্রাম। একে চেরাঙ্গী বা চিরাঙ্গী-ও বলা হত। উত্তরে কলিঙ্গা, পশ্চিমে চৌরঙ্গী রোড, দক্ষিণে পার্ক স্ট্রিট আর পুবে ছিল সার্কুলার রোড। একে ডিহি বিরজী বলা হত। এখানে তখন গভীর জঙ্গল। বুনো শুয়োর বা বাঘের উৎপাত। সম্ভবত চৌরঙ্গী রোড শহরের প্রথম সড়কপথগুলির মধ্যে একটি, ব্রিটিশদের আগমনের পূর্বে সড়কটি কালীঘাট ও চৌরঙ্গী গ্রামের সাথে যুক্ত ছিল। চৌরঙ্গী গ্রামের নামকরণ করা হয়েছিল রহস্যময় ধর্মাবলম্বী চৌর্যঙ্গনাথের নামে, যেখানে তাঁর ঘাঁটি বা ডেরা ছিল। ইংরেজ শাসন সত্ত্বেও এই নামটি থেকে যায় এবং ভারতের স্বাধীনতার পর কংগ্রেস সরকারের শাসনের সময় পরিবর্তিত হয়। অনেকে অবশ্য এঁর নাম জঙ্গলগিরি চৌরঙ্গী বলেন। উনিশ শতক অবধি তাঁর স্থাপিত ভাঙাচোরা মন্দিরটি দেখা যেত। ‘কলিকাতা সেকালের ও একালের’ বইতে হরিসাধন মুখোপাধ্যায় লিখেছেন, “এখন যে চৌরঙ্গী-সাহেবী-কোয়াটার, কলিকাতা নগরীর মুকুটমণি, আগে তাহা বনজঙ্গল সমাচ্ছন্ন একখানি ক্ষুদ্র গ্রাম ছিল। এই গ্রাম ও তাহার আশেপাশের স্থানগুলি গভীর জঙ্গলপূর্ণ ছিল। দিনের বেলায় লোকে সাহস করিয়া গোবিন্দপুর বা সুতানুটি যাইতে পারিত বটে, কিন্তু সন্ধ্যার পর বাঘের ভয়ে, বা গভীর রাত্রে ডাকাতের ভয়ে কেহই চৌরঙ্গীর এ জঙ্গল পার হইত না। জঙ্গলগিরি চৌরঙ্গী নামক এক সন্ন্যাসী এই জঙ্গলে বাস করিতেন। তাঁহার নাম হইতেই এই ক্ষুদ্র গ্রামের নাম চৌরঙ্গী হইয়াছিল। জঙ্গলগিরি সম্বন্ধে আমরা ইতিপূৰ্ব্বে অনেক কথা বলিয়াছি। চৌরঙ্গী একটা গ্রামের বা স্থানের নাম। এই গ্রামের নাম হইতেই রাস্তার নামকরণ হইয়াছে। ১৭১৪ খৃঃ অব্দেও চৌরঙ্গীর নাম শোনা যায়। হলওয়েল সাহেবও চৌরঙ্গীর রাস্তাকে ‘কালীঘাটের রাস্তা’ ‘Road to Colligot’ বলিয়া উল্লেখ করিয়া গিয়াছেন। আজ কাল যাহা বেণ্টিঙ্ক ষ্ট্রীট ও সেই বেণ্টিঙ্ক ষ্ট্রীট যেখানে ধৰ্ম্মতলায় মিশিয়াছে, তাহা ইংরাজদের কলিকাতার আগমনের বহুপূৰ্ব্ব হইতেই একটা সরু রাস্তা ছিল। এই সরু রাস্তার দুই ধারে গভীর জঙ্গল। এই জঙ্গল মধ্যবর্তী পথ দিয়াই, যাত্রীগণ চিত্তেশ্বরীর মন্দির হইতে কালীঘাটে যাইত। পুরাতন ম্যাপ, সমূহে চৌরঙ্গ একটা স্থানের নাম বলিয়াই উল্লিখিত। পরে এই চৌরঙ্গী নাম, রাস্তাকে দান করা হইয়াছে।

সেকালের চৌরঙ্গীর কথা এস্থলে একটু বলা প্রয়োজন। অনেকের মতে, জঙ্গলগিরি চৌরঙ্গী সন্ন্যাসী হইতেই, এই চৌরঙ্গী নাম হইয়াছে। দলগিরি চৌরঙ্গীর প্রবাদ, কেহ বা সত্য বলিয়া বিশ্বাস করেন— কেহ বা অনাস্থা প্রকাশ করেন। অনেকে বলেন— জঙ্গলগিরি বর্তমান কালীমূর্তির মুখের প্রস্তরখানি কুড়াইয়া পান। পোস্তা হইতে কালীগ্নি অংশভুক্ত যে প্রস্তরখণ্ড কাপালিকগণ কর্তৃক গভীর জঙ্গল মধ্যে রক্ষিত হইয়াছিল— একটা প্রবাদ মতে চৌরঙ্গী সন্ন্যাসীর আবিষ্কৃত মুখপ্রস্তরখানি তাহা বই আর কিছুই নহে। হঠ-প্রদীপ গ্রন্থে চৌরঙ্গীগিরির উল্লেখ দেখিতে পাওয়া যায়। উইলসন সাহেবও তাঁহার ‘হিন্দুধৰ্ম্ম সম্প্রদায়’ গ্রন্থে লিখিয়াছেন— ‘আদিনাথ গোরক্ষের পর চৌরঙ্গী, ষষ্ঠ বংশীয় শিষ্য ও ভক্ত কবীরের সমকালবৰ্ত্তী। এই কবীর সুলতান ইব্রাহিম লোদির দ্বারা সম্যক রূপে লাঞ্ছিত হইয়াছিলেন। ১৫২৬ খৃঃ অব্দ পর্যন্ত সুলতান লোদির রাজত্বকাল।’ ১৫২০ হইতে ১৫৩০ খৃঃ অব্দে সম্ভবতঃ শেঠ-বসাকের গোবিন্দপুরে আগমন করেন। বাবু গৌরদাস বসাকের মতে—দশনামা শৈবসন্ন্যাসী চৌরঙ্গীগিরি, সশিষ্য গঙ্গাসাগর যাইতেছিলেন। গঙ্গাতীরে কালীর প্রস্তর-খোদিত মুখমণ্ডল প্রাপ্ত ইষ্টয়, উক্তস্থানে কুটীর বাধিয়া পূজা প্ৰবৰ্ত্তন করেন। কিয়ংকাল পরে জঙ্গলগিরি নামক তাঁহার এক শিষ্যের হস্তে কালীপূজার ভাৱ দিয়া তিনি গঙ্গাসাগরে চলিয়া যান। প্রস্তর-ফলক প্রাপ্তি সম্বন্ধে কিম্বদন্তী এই, যে চৌরঙ্গী সন্ন্যাসী একদিন দেখিতে পাইলেন, যে গভীর বনমধ্যে একটা নির্জন স্থানে এক পয়স্বিনী গাভী দাঁড়াইয়া রহিয়াছে। তাহার বাঁট চইতে অজস্র দুগ্ধধারা নিম্নস্থ একটা স্থানের উপর পড়িতেছে। ইহাতে সন্দিগ্ধচিত্ত হইয়া, সন্ন্যাসী সেই স্থান খনন করিতে করিতে কালীর প্রস্তরময় মুখ প্রাপ্ত হন। উহাই কালীঘাটের কালীমন্দিরের মাতৃমূর্তি।”

১৮ শতকের মাঝামাঝি সময়ে ব্রিটিশরা ফোর্ট এলাকার বাইরে তাদের বসতি সম্প্রসারণ শুরু করে, চৌরঙ্গীর চারপাশের এলাকাটি প্রথম সম্প্রচারের একটি অংশ এবং ১৯৪৭ সালে তাদের প্রস্থান পর্যন্ত একই এলাকা তাদের গর্ব ও বাণিজ্যিক কেন্দ্র ছিল। চৌরঙ্গী এলাকার ব্রিটিশ উন্নয়নকালে প্রায়শই তারা রাস্তার পূর্বপাশে বিশাল বাংলো এবং ঘর নির্মাণ করে, এইভাবে কলকাতা নগরটি পরিণত হয় প্রাসাদনগরীতে। এই সময়টি ছিল কলকাতার একটি চমৎকার যুগ এবং এই সময়ে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের দ্বিতীয় প্রধান শহর হয়ে উঠেছিল। সড়কটির পশ্চিম প্রান্ত বরাবর বাগান এলাকা দ্বারা গঠিত এবং বিশাল প্রাসাদের সারি সহ একটি বিশাল খোলা এলাকা, যাকে বলা হয় ময়দান। ফোর্ট উইলিয়ামের নিরাপত্তার কারণে ময়দানে ইচ্ছাকৃতভাবে খোলা এলাকা তৈরি করা হয়েছিল এবং এলাকাটি উন্নয়নমুক্ত ছিল। পরবর্তী সময়ে লোয়ার সার্কুলার রোডের পশ্চিম দিকের অংশ (এখন এক্সাইড ক্রসিং) থেকে এসপ্ল্যানেডের কার্জন পার্ক পর্যন্ত রাস্তাটির প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ মোড়ে জলাধার তৈরি করা হয়েছিল। এর মধ্যে মাত্র একটি এখন বিদ্যমান- মনোহরদাস তড়াগ, পার্ক স্ট্রিট এবং চৌরঙ্গীর জংশনে রয়েছে। পুনরুদ্ধারকৃত জলাধারগুলির মধ্যে একটি ছিল যেখানে কলকাতা ইনফরমেশন সেন্টার এবং ময়দান পুলিশ স্টেশন এখন দাঁড়িয়ে আছে, অন্য আর-একটি স্থান যেখানে মেট্রো স্টেশন এখন দাঁড়িয়েছে, এবং যেখানে এখনও এসপ্ল্যানেড বাস-টার্মিনাস দাঁড়িয়ে আছে সেখানে তৃতীয়টি ছিল। বর্তমানে রাস্তার সৌন্দর্য আর নেই এবং কেবলমাত্র যুগ যুগের অঙ্কন এবং স্কেচ দেখতে পাওয়া যাবে। ট্রামের আবির্ভাবের ফলে, টালিগঞ্জের সঙ্গে এসপ্ল্যানেডের সংযোগ স্থাপনের জন্য চৌরঙ্গীর পশ্চিম প্রান্ত বরাবর ট্রাম ট্র্যাক স্থাপন করা হয়েছিল। এই ট্র্যাকগুলিও বর্তমানে আর নেই। সঙ্গের ছবিটি ১৮৭০ সালে বোর্ন অ্যান্ড শেপার্ডের তোলা চৌরঙ্গী রোডের।

২.২০ কার্জন পার্ক— রাণী রাসমণি রোডের ঠিক গায়েই অবস্থিত সুরেন্দ্রনাথ পার্ক আগে কার্জন পার্ক নামে পরিচিত ছিল। ১৮৩৬-৪২ অবধি ভারতের গভর্নর জেনারেল ছিলেন লর্ড অকল্যান্ড। তাঁরই মস্তিষ্কপ্রসূত এই পার্ক। কার্জন পার্কের ভাষা উদ্যানের উত্তর-পশ্চিম কোণে রয়েছে শহরের একটি উল্লেখযোগ্য ‘হেরিটেজ’ স্থাপত্য, পানিঅটি ফাউন্টেন। জয়পুর মার্বেলে তৈরি এই সৌধটি তৈরি হয়েছিল ১৮৯৮ সালে, তদানীন্তন ভাইসরয়ের সচিব দেমেত্রিউস পানিঅটির স্মরণে। এই পানিঅটি ছিলেন গ্রিক; চার পুরুষ ধরে তাঁদের পরিবারের অনেকেই ছিলেন কলকাতাবাসী। ‘পরশপাথর’ ছবিতে পরেশবাবুর ভূমিকায় তুলসী চক্রবর্তীকে দেখা গিয়েছিল বৃষ্টির ছাঁট থেকে বাঁচতে ওই সৌধের নিচে আশ্রয় নিতে। শংকরের ‘চৌরঙ্গী’ উপন্যাসের শুরুও এই পার্কে, “ওরা বলে— এসপ্ল্যানেড্‌। আমরা বলি— চৌরঙ্গী। সেই চৌরঙ্গীরই কার্জন পার্ক। সারাদিন ঘুরে ঘুরে ক্লান্ত শরীরটা যখন আর নড়তে চাইছিল না, তখন ওইখানেই আশ্রয় মিলল। ইতিহাসের মহামান্য কার্জন সায়েব বাংলাদেশের অনেক অভিশাপ কুড়িয়েছিলেন। সুজলা সুফলা এই দেশটাকে কেটে দুভাগ করবার বুদ্ধি যেদিন তার মাথায় এসেছিল, আমাদের দুর্ভাগ্যের ইতিহাস নাকি সেই দিন থেকেই শুরু হয়েছিল। কিন্তু সে তো অনেক দিন আগেকার কথা। বিশ শতকের এই মধ্যাহ্নে মে মাসের রৌদ্রদগ্ধ কলকাতার বুকে দাঁড়িয়ে আমি ইতিহাসের বহুধিকৃত সেই প্রতিভাদীপ্ত ইংরেজ রাজপুরুষকে প্রণাম করলাম; তাঁর পরলোকগত আত্মার সদ্গতি প্রার্থনা করলাম। আর প্রণাম করলাম রায় হরিরাম গোয়েঙ্কা বাহাদুর কে টি, সি আই ই-কে। তাঁর পায়ের গোড়ায় লেখা- Born June 3, 1862. Died February 28, 1935.” সঙ্গে ১৯০২ সালে তোলা কার্জন পার্ক।

২.২১ ইডেন গার্ডেন— ইংরেজ পার্ক কালচারের একটি যদি হয় কার্জন পার্ক, তবে অপরটি অবশ্যই ইডেন গার্ডেন। এর ইতিহাসের শুরু ভারতের গভর্নর জেনারেল, মানে বড়োলাট অকল্যান্ডের সময়ে। তিনি ১৮৩৬ থেকে ১৯৪২ সাল পর্যন্ত ছিলেন এ দেশে। তাঁরা ছিলেন ১৪ জন ভাইবোন। তাঁর দুই বোন এমিলি ও ফ্যানি ভারতে এসে বেশ কিছুদিন ভাইয়ের কাছে ছিলেন। তখন কোম্পানি আমল, ভারতের রাজধানী ছিল কলকাতা। স্বভাবতই তাঁরা কলকাতাতেই ছিলেন। ছোটো থেকেই বাগানের খুব শখ ছিল এমিলির, তাঁর ইচ্ছাতেই শুরু হয় বাগান তৈরির কাজ। স্থপতি ক্যাপ্টেন ফিটজেরাল্ড তাঁদের ভাবনা বাস্তবায়িত করেন। ১৮৪০ সালেই তৈরি হয়ে যায় অকল্যান্ড সার্কাস গার্ডেন, পরে অবশ্য নাম বদলে তা করা হয় ইডেন গার্ডেন্স।

লর্ড অকল্যান্ডের আসল নাম জর্জ ইডেন, তিনি ছিলেন অকল্যান্ডের প্রথম আর্ল, তাই তিনি লর্ড অকল্যান্ড নামেই খ্যাত। তাঁর বাবার নাম উইলিয়াম ইডেন। কলকাতা হাইকোর্টের অদূরে ও ক্রিকেট মাঠ ইডেন গার্ডেন লাগোয়া এই উদ্যানে লোকের আনাগোনা নেই বললেই চলে। বাগান খোলা থাকে দুপুরে, তখন ভিতরে ঘুরে বেড়াতে বাধা নেই। প্যাগোডার দুপাশে একটি করে জলাশয় আছে, অত্যন্ত মনোরম। প্যাগোডা থেকে একটি জলাশয়ে যাওয়ার পথে বর্মা মুলুক থেকে আনা মূর্তি সাজানো হয়েছে। তাজং স্টাইলে তৈরি এই সদ্যসমাপ্ত প্যাগোডাটি লর্ড ডালহৌসির চোখে পড়ে যখন তিনি প্রোম শহর দখল করেন। এমন সুন্দর কারুকাজ করা স্থাপত্য তো রাজধানীর বুকেই মানায়! ডালহৌসির নির্দেশেই সেই স্থাপত্য খুলে ফেলে কলকাতায় আনা হল এবং পুনর্নির্মাণ করা হল। প্রথমে ফোর্ট উইলিয়ামে খণ্ডাংশগুলি রাখা ছিল, তারপরে বর্মা মুলুক থেকে আনা কারিগররা এটি স্থাপন করেন ইডেন গার্ডেনের ভিতরে। মূল প্যাগোডাটি তৈরি হয়েছিল ১৮৫২ সাল নাগাদ, প্রোমের প্রয়াত শাসক মং হননের স্ত্রী মা কিন এটি স্থাপন করিয়েছিলেন। খরচ পড়েছিল তৎকালীন সময়ে দেড় হাজার টাকা। বাগানের ভিতরে একটি নহবতখানাও রয়েছে। তবে পুরোনো কলকাতার নহবতখানার মতো এখানে সানাই বাজত কি না জানা নেই, সম্ভবত পাশ্চাত্য সংগীতের আসরই এখানে বসত। রয়েছে একটি সুন্দর ফোয়ারাও।

১৮৬৪ সালে, এই স্থানে, আজকের ইডেন গার্ডেন্স স্টেডিয়াম নির্মাণের কাজ শুরু হয়। ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত, ইডেন গার্ডেন্স স্টেডিয়ামে ক্রিকেট ও ফুটবল দুটোই খেলা হত। ১৯৩৪ সালে, এই স্টেডিয়ামে প্রথমবারের জন্য টেস্ট ক্রিকেট খেলা হয় ও ১৯৮৭ সালে, এই স্টেডিয়ামে প্রথমবার একদিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ম্যাচ খেলা হয়। এই স্টেডিয়ামে প্রথম কোনও বড়ো ফুটবল ম্যাচ খেলা হয় ১৯৬৭ সালে, ইস্টবেঙ্গল ও মোহনবাগানের মধ্যে। সঙ্গে ১৮৬০ সালে তোলা ইডেন গার্ডেনের ছবি।

২.২২ গড়ের মাঠ— কলকাতা রেড রোডের পাশে বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে অবস্থিত ‘কলকাতা ময়দান’। ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি পলাশির যুদ্ধে সিরাজ-উদ্-দৌলাকে হারানোর পর এই অঞ্চলে তৈরি করে ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গ। এই দুর্গ রক্ষার্থেই দুর্গের আশেপাশের অঞ্চলের জঙ্গল কেটে তৈরি হয় এই বিশাল মাঠ। এটা ছিল ‘ফোর্ট উইলিয়াম’-এর সম্পত্তি।’ ফোর্ট’ শব্দটির বাংলা শব্দ ‘দুর্গ’ এবং এর প্রতিশব্দ ‘গড়’ থেকেই এই মাঠের নাম হয় ‘গড়ের মাঠ’। পলাশির যুদ্ধে জয়লাভের এক বছর পর ১৭৫৮ সালে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি গোবিন্দপুর গ্রামের কেন্দ্রস্থলে নতুন ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গের নির্মাণকার্য শুরু করে। উক্ত গ্রামের বাসিন্দাদের আর্থিক ক্ষতিপূরণ এবং তালতলা, কুমারটুলি ও শোভাবাজার অঞ্চলে জমি দেওয়া হয়। ১৭৭৭ সালে দুর্গনির্মাণের কাজ শেষ হয়। “যে ব্যাঘ্র-সংকুল জঙ্গলটি চৌরঙ্গী গ্রাম থেকে নদীকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছিল, সেই জঙ্গলটি কেটে পরিষ্কার করে দেওয়া হয়। এরই ফলে কলকাতার গৌরব ময়দানের বিস্তৃর্ণ তৃণক্ষেত্রটির সৃষ্টি হয়। এই মুক্ত প্রাঙ্গণের উদ্ভব এবং দক্ষিণের বসতি অঞ্চলকে বিচ্ছিন্ন করে রাখা খালটি বুজিয়ে দেওয়ার ফলে ইউরোপীয় বাসিন্দারা দুর্গের আবদ্ধ সংকীর্ণ পরিমণ্ডল পরিত্যাগ করতে শুরু করেন। অবশ্য ১৭৪৬ সাল থেকেই চৌরঙ্গী অঞ্চলে বাসিন্দাদের সরে আসা শুরু হয়েছিল।” (কটন, ১৯০৯)

১৯০৯ সালে এইচ. ই. এ. কটন আরও লিখেছেন, “The great Maidan presents a most refreshing appearance to the eye, the heavy night dew, even in the hot season, keeping the grass green. Many of the fine trees with which it was once studded were blown down in the cyclone of 1864. But they have not been allowed to remain without successors, and the handsome avenues across the Maidan still constitute the chief glory of Calcutta. Dotting the wide expanse are a number of fine tanks, from which the inhabitants were content in former days to obtain their water-supply.”

১৮৫৯ সালে জন এলিয়ট ড্রিঙ্কওয়াটার বেথুন কলকাতায় প্রথম বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করলে রক্ষণশীল কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত লেখেন:

যত ছুঁড়িগুলো তুড়ি মেরে কেতাব হাতে নিচ্ছে যবে,

এ বি শিখে, বিবি সেজে, বিলাতী বোল কবেই কবে;

আর কিছুদিন থাক রে ভাই! পাবেই পাবে দেখতে পাবে,

আপন হাতে হাঁকিয়ে বগি, গড়ের মাঠে হাওয়া খাবে।

এর কিছুকাল পরেই জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর স্ত্রী কাদম্বিনী দেবীকে ময়দানে নিয়ে গিয়ে অশ্বচালনা শিক্ষা দেন। এতে বাঙালি সমাজের রক্ষণশীলতায় প্রচণ্ড আঘাত লাগে এবং বাঙালি সমাজে এক অভূতপূর্ব সংস্কার সাধিত হয়। ব্রিটিশ শাসনে ইংরেজ সেনারা ময়দানে বাঙালি ছেলেদের দেখলেই লাথি মারত। বাঙালিরা এতটাই ভীরুস্বভাবের ছিল যে এর কোনও প্রতিবাদই করত না। সরলা দেবী চৌধুরানী এই ঘটনায় অত্যন্ত ব্যথিত হন। তিনি দুর্গাপূজায় বীরাষ্টমী ব্রতের সূচনা করেন। এই ব্রতে যুবকদের অন্যায়ের প্রতিবাদ করার শপথ নিতে হত। এই ঘটনা পরবর্তীকালে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল। টেনিদা তো গড়ের মাঠে গোরা পিটিয়ে চ্যাম্পিয়ান।

ময়দানে একাধিক ক্ষুদ্রাকার সবুজ বাংলো অবস্থিত। এগুলি বিভিন্ন ক্রীড়াপ্রতিষ্ঠানের সম্পত্তি। খেলাধুলোর জন্য ময়দানে ছোটো ছোটো খেলার মাঠও রয়েছে। বড়ো বড়ো ক্লাবগুলির নিজস্ব মাঠ কাঠের গ্যালারি দিয়ে বাঁধানো। মোহনবাগান অ্যাথলেটিক ক্লাব, ইস্টবেঙ্গল ক্লাব ও মহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব ময়দানের প্রধান ক্রীড়াসংস্থা। এ ছাড়াও অনেক ছোটো ক্লাবের তাঁবুও ময়দানে অবস্থিত। ১৯০১ সালে জামশেদজি ফ্রামজি ম্যাডান বায়োস্কোপ নিয়ে এলে ময়দানে একটি তাঁবুতে সিনেমা দেখানোর ব্যবস্থা করা হয়। পরে ম্যাডান বায়োস্কোপ নামে একটি ছবিঘর খোলেন। এই ম্যাডান-ই পরবর্তীকালে এনফিলস্টোন বায়োস্কোপ নাম নেয়। সত্যজিৎ রায়ের একাধিক ছবির শ্যুটিং-ও ময়দানে হয়েছে। এমনকি তাঁর শেষ ছবি “আগন্তুক”-এও এই গড়ের মাঠকে দেখতে পাই।

২.২৩ ঘোড়দৌড়ের মাঠ— এই মাঠ ব্রিটিশ ভারতের প্রথম রেসকোর্স (১৮১২ সালে) এবং এখনও পোলোর সঙ্গে সমকালীন ভারতে অশ্বারোহী কার্যকলাপের বৃহত্তম ও গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র। কলকাতার রেসকোর্স ভারতের এক বৃহত্তম রেসকোর্স। ভারতে হর্স রেসের প্রবণতা বৃদ্ধি পেতে শুরু করল ব্রিটিশ আমলে। প্রথম ঘোড়ার দৌড় শুরু হল মাদ্রাজে, সালটা ১৭৭৭। আর ১৭৯৯ সাল নাগাদ ঘোড়ার দৌড়ের জন্য তৈরি করা হল আলাদা রেস ট্র্যাক। ১৮০০ সালে বোম্বাইতে চার্লস ফোবস, জি হল প্রমুখেরা মিলে প্রতিষ্ঠা করলেন বোম্বাই টার্ফ ক্লাবের। ১৮১৯ সালে পুনেতে প্রথমবারের মতো ঘোড়ার দৌড় আয়োজন করা হয়েছিল। বাঙ্গালোর টার্ফ ক্লাবের প্রতিষ্ঠা অবশ্য অনেকটাই দেরিতে, ১৯২০ সাল নাগাদ। ১৮৪৬ সাল নাগাদ আগা খানের পরিবারে ছিলেন তখনকার দিনে বেশ সুপ্রতিষ্ঠিত একাধিক ঘোড়সওয়ার, যাঁরা ভাইসরয় কাপের মতো গুরুত্বপূর্ণ টুর্নামেন্ট জিতেছিলেন। ইন্দোরের মহারাজা প্রতাপ সিংহ নিজেই ছিলেন তৎকালীন যুগে দেশের বিখ্যাত ঘোড়সওয়ারদের মধ্যে একজন।

পলাশির যুদ্ধের পর থেকেই বাংলায় ইংরেজদের আগমন বৃদ্ধি পেতে থাকে। সেনাবাহিনীর জন্য বেস ক্যাম্পও তৈরি করা হয়। এই সেনাবাহিনী অবসর সময়ে বিনোদনের জন্য ঘোড়ার দৌড়ের প্রতিযোগিতা শুরু করেছিল। কলকাতার নিকটে আকরা নামক জায়গায় মোটামুটিভাবে ১৭৬৯ সালের জানুয়ারি নাগাদ একটা ঘোড়ার দৌড় আয়োজন করা হয়েছিল, কিন্তু এটা ছিল শুধুমাত্র খেলার ছলে। এরপর এইভাবেই প্রায় চার দশক ধরে হর্স রেস চলতে থাকল, আর সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ঘোড়দৌড়ের জনপ্রিয়তাও বাড়তে থাকল। ইতিমধ্যে লর্ড ওয়েলেসলি কলকাতায় এলেন গর্ভনর জেনারেল হয়ে। ১৭৯৮ সাল নাগাদ পশুপ্রেমী ওয়েলসলি ঘোড়ার দৌড়ের যবনিকা টানলেন। বন্ধ হল ঘোড়ার দৌড়। কিন্তু বন্ধ বললেই কি বন্ধ করা যায়? খেলাপ্রেমী মানুষের কাছ থেকে খেলা কেড়ে নেওয়া কি অতই সহজ ব্যাপার? না। ১৮০৩ সালে প্রতিষ্ঠা করা হল বেঙ্গল জকি ক্লাব এবং এরা নিজেদের অনুশীলনের জন্য ময়দান চত্বরটা বেছে নিল। বেঙ্গল জকি ক্লাবের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল ইংল্যান্ডের জকি ক্লাবের। ১৮১২ সাল নাগাদ নতুনভাবে রেসকোর্স গড়ে তোলা হল বর্তমান রেসকোর্সের জায়গাতেই। কিন্তু কলকাতার রেসের ক্ষেত্রে সবথেকে যুগান্তকারী ঘটনা সম্ভবত তখনই হল, যখন প্রতিষ্ঠা করা হল ক্যালকাটা টার্ফ ক্লাব। সালটা ১৮৪৭, ভারত স্বাধীনতা পাওয়ার ঠিক একশো বছর আগে। পাঁচ কমিটির সদস্য ক্লাব পরিচালনা করার দায়িত্বে ছিলেন। আর রেস তত্ত্বাবধানের দায়িত্বে ছিলেন পাঁচজন স্টুয়ার্ড। এখনও পর্যন্ত অবশ্য এই স্টুয়ার্ডরাই রেস পরিচালনা করে আসছেন। ১৮৫৬ সালে ক্যালকাটা ডার্বি বন্ধ করে চালু করা হল ভাইসরয় কাপ। তখন এই কাপ দেখার সুযোগ পেতেন শুধুমাত্র তাঁরাই, যাঁদের আমন্ত্রণ করা হত। কিন্তু কলকাতায় হর্স রেসের এক ব্যাপক পরিবর্তন হল ১৮৬০ সাল নাগাদ। লর্ড উলরিখ ব্রাউন, অনেকের কাছেই এই নামটা অজানা। তৎকালীন সময়ে তিনি ছিলেন আইসিএস অফিসার। যাঁর একার উদ্যোগে কলকাতায় ঘোড়ার দৌড় এক অন্য মাত্রা লাভ করল। ১৮৭২ সাল নাগাদ প্রথমবার টোটে উপস্থাপিত করা হল এবং সেই বছরই প্রথম মনসুন রেসও চালু হল। ১৮৮০ সাল থেকে সকালের বদলে দুপুরে রেস করার সিদ্ধান্ত নিল কর্তৃপক্ষ আর তার সঙ্গে সেই বছরই প্রথমবারের মতো পোলো খেলারও আয়োজন করা হয়েছিল। ইতিমধ্যে ক্যালকাটা টার্ফ ক্লাবের দায়িত্ব গ্রহণ করলেন স্যর উইলিয়াম ম্যাকফেরসন, রেসের মাঠে যাঁর অবদান অনস্বীকার্য।

সালটা ১৮৮৯, ক্যালকাটা টার্ফ ক্লাবের অধীনে চলে এল নয় নয় করে দেশের প্রায় বাহান্নটি রেসের মাঠ। অবশ্য দক্ষিণ ভারতের রেসের মাঠগুলো দেখাশোনা করত বোম্বাই টার্ফ ক্লাব। ইতিমধ্যে ভারতীয়দের জন্যও খুলে দেওয়া হয়েছিল রেসের মাঠের দরজা। ক্যালকাটা টার্ফ ক্লাবের মুকুটে আরও একটি স্বর্ণপালক যুক্ত হল ১৯০৫ সালে, যখন ইংল্যন্ডের রাজা পঞ্চম জর্জ প্রথমবারের মতো ক্লাবে এলেন। এর ঠিক বছর সাতেক পরে ১৯১২ সালে আবার রানি মেরিকে সঙ্গে নিয়ে ক্লাবে এসেছিলেন রাজা স্বয়ং। আর সেই বছরই ক্যালকাটা টার্ফ ক্লাবের নামের আগে যুক্ত হল ‘রয়্যাল’ শব্দটি। ক্লাবের নতুন নাম হল ‘রয়্যাল ক্যালকাটা টার্ফ ক্লাব’। এরপর সময় গড়িয়েছে নিজের গতিতে। দেশ স্বাধীনতা পেয়েছে, রেসের মাঠেরও উত্থান-পতন ঘটেছে। প্রথমদিকে অবশ্য সমাজের এলিট গোষ্ঠীর মধ্যে ঘোড়ার রেস জনপ্রিয় ছিল। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তারও পরিবর্তন হয়েছে। কথায় আছে, কলকাতার অলিতে গলিতে ইতিহাস রয়েছে, আর এই রেসের মাঠ তো ইতিহাসের আঁতুড়ঘর। রেসের মাঠে গেলে আপনার ইচ্ছে করবেই ঘোড়ার উপর বাজি ধরতে। যদি এমনটা হয়, আপনার মন সায় দিল না বাজি ধরতে, তখন? তখন নাহয় রয়্যাল ক্যালকাটা টার্ফ ক্লাবে ইতিহাসের গন্ধ মাখা সুবর্ণ অতীতটা অনুভব। না, কলকাতা রেসকোর্স দুশো বছরেও বুড়ো হয়নি, চাকচিক্য কিছু কমলেও, রেসকোর্স তার নীরব ইতিহাস আর আভিজাত্য আজও বহন করে চলেছে মাত্র। বাংলা সিনেমায় ‘শুধু একটি বছর’, বা সত্যজিতের ‘সীমাবদ্ধ’ ছবিতে রেসকোর্সকে দেখা গেছে। কেসের ব্যাপারে স্বয়ং ফেলুদাকেও রেসের মাঠে যেতে হয়েছিল। সঙ্গে ১৮৬০ সালে ভাইসরয় কাপের দিন তোলা রেসকোর্সের ছবি।

২.২৪ বিধি ডাগর আঁখি—

সম্পূর্ণ গান

বিধি ডাগর আঁখি যদি দিয়েছিল

সে কি আমারি পানে ভুলে পড়িবে না॥

দুটি অতুল পদতলে রাতুল শতদল

জানি না কী লাগিয়া পরশে ধরাতল,

মাটির ‘পরে তার করুণা মাটি হল— সে পদ মোর পথে চলিবে না?

তব কণ্ঠ ‘পরে হয়ে দিশাহারা

বিধি অনেক ঢেলেছিল মধুধারা।

যদি ও মুখ মনোরম শ্রবণে রাখি মম

নীরবে অতি ধীরে ভ্রমরগীতিসম

দু কথা বল যদি ‘প্রিয়’ বা ‘প্রিয়তম’, তাহে তো কণা মধু ফুরাবে না।

হাসিতে সুধানদী উছলে নিরবধি,

নয়নে ভরি উঠে অমৃতমহোদধি—

এত সুধা কেন সৃজিল বিধি, যদি আমারি তৃষাটুকু পুরাবে না॥

রাগ: ভৈরবীতাল: ত্রিতালরচনাকাল (বঙ্গাব্দ): ১০ আশ্বিন, ১৩০৪রচনাকাল (খ্রিস্টাব্দ): ১৮৯৭

পর্যায়- প্রেম ও প্রকৃতি

২.২৫ গ্যাঁড়াতলা— কলুটোলার পাশের রাস্তা। জলধর সেনের স্মৃতিতর্পণ-এ এই জায়গার গোটা মানচিত্র পাই। “এক দিন রাত্রি দশটা সাড়ে দশটার সময় উপেনদাদা সেই বারান্দায় বেড়াচ্ছিলেন, হঠাৎ তাঁর দৃষ্টি ‘হিতবাদী’ আপিসের দিকে পড়লো। তিনি দেখলেন– আমি একলা বসে কী লেখাপড়া করছি। তখনই লোক পাঠিয়ে তিনি আমাকে ডেকে নিয়ে গেলেন। দেবেনদাদা তখন সেই বারান্দায় বসেছিলেন। আমি যেতেই উপেনদাদা বল্লেন– জলধর, তুমি এখনও বাড়ী যাওনি। আমি বললাম – এখনো ত সময় হয় নি, আমি ১২/১টার কমে যাইনে। তিনি বিস্মিত হয়ে বললেন– রাত ১২/১টা পর্য্যন্ত না খেয়ে থাক? আর তার পর? এই গ্যাঁড়াতলা দিয়ে বাসায় যাও? ভয় করে না? আমি বিনীতভাবে বললাম– অনেক দিনই রাত্রে অনাহারে কাটাতে হয় দাদা। আর, পথের কথা যা বলছেন,- আমি গ্যাঁড়াতলা দিয়ে যাইনে, বরাবর কলুটোলা দিয়ে গিয়ে মেডিকেল কলেজের সামনে কলেজ স্ট্রীট ও সেখান থেকে বরাবর কর্ণওয়ালিশ স্ট্রীট ধরে হেদোয় যাই।”

২.২৬ মেছোবাজার স্ট্রীটের— বুদ্ধদেব বসু তাঁর “যাহা বাহান্ন তাহা তিপ্পান্ন” গল্পে এই জায়গার কথা বলেছেন, “আমি তখন আমহার্স্ট স্ট্রিট-এর সেই মেসটায় থাকি। সেই যে বাসি পাউরুটির রংয়ের তে-তলা লম্বা বাড়িটা;— মেছোবাজার আর আমহার্স্ট স্ট্রিট-এর মোড়ের কাছাকাছি; একটু এগুলেই সেন্ট পলস স্কুল..”। লেডি অবলা বসু তাঁদের নিজস্ব জলিবোট বেয়ে চন্দননগর থেকে প্রায় প্রতিদিন বিকালে নৈহাটি ঘাটে যেতেন জগদীশচন্দ্রকে আনতে। তাঁদের বিয়ের প্রথম বছরটি এভাবেই কেটে যায়। এরপর চন্দননগর থেকে তিনি চলে আসেন মেছোবাজার স্ট্রিটে। বোন সুর্বণপ্রভা বসুর সঙ্গে শেয়ারে বাসা ভাড়া নেন। এই বাড়ির সামনে ছিল বাগান, খেলার মাঠ ও পুকুর। ১৮৯২ সাল পর্যন্ত তাঁরা এই বাড়িতে ছিলেন। পরে ইন্টালির কনভেন্ট রোডে একটি বাড়ি ভাড়া নেন।

ফেলুদার সোনার কেল্লায় মক্কেল সুধীর ধরের বাড়ি ছিল সাত নম্বর মেছোবাজার স্ট্রিট, রাস্তার ওপরেই।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *