3 of 8

দ্বিতীয় কোকিল

দ্বিতীয় কোকিল

প্রথম কোকিল যখন ভরসা করে লিখেই ফেলেছি তবে দ্বিতীয় এবং তৃতীয় কোকিলেও হাত দেওয়া যায়।

দুই শতাব্দীকাল ধরে প্রকাশিত লন্ডন টাইমসের এই পত্র-সংকলন তিনটি একাধিক কারণে স্মরণীয় এবং অসামান্য।

দীর্ঘকালের টুকরো টুকরো ছবি, আশা-নিরাশা এবং অভাব-অভিযোগের ছিন্ন-চিত্রমালা এই চিঠিগুলির মধ্যে ফুটে উঠেছে। ব্রিটিশ রসবোধের এবং সাহিত্যগুণেরও সমন্বয় ঘটেছে এই পত্রাবলিতে।

কী সব বিচিত্র বিষয়ে চিঠি ছাপা হয়েছে ভাবতে গেলে অবাক হতে হয়।

১৯৪০ সালে এক ভদ্রলোক চিঠি লিখেছেন কী করে টেলিফোনে ভালভাবে কথাবার্তা বলা যায় সেই বিষয়ে। এরই পরের বছরে ১৯৪১ সালে বেশ কয়েকটি চিঠি পরপর বেরিয়েছিল। ধমূপানের জন্যে তামাকপাতার বদলে অন্য কোনও পাতা ব্যবহার করা যায় কিনা বিষয়ে। পাতাগুলোর লাতিন নাম আমি খুব ভাল ধরতে পারলাম না তবে মনে হল ধুতরোপাতা, তুলসীপাতা এমনকী শুকনো জামপাতার কথাও উপদেশ দেওয়া আছে।

বিশেষ মনোজ্ঞ আলোচনা আছে প্রেক্ষাগৃহে নাটক চলাকালীন কোনও দৃশ্যের অভিনয়ে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে করলি দেওয়া উচিত কিনা এ-বিষয়ে। এতে নাটকের রসাস্বাদনে বাধা সৃষ্টি হয়, পত্রদাতা এও জানিয়েছেন যে, স্বয়ং স্যার লরেল অলিভিয়া করতালি শুনে বিরক্ত হয়ে করতালি না দিতে অনুরোধ করেছিলেন দর্শকদের এবং অবশেষে দর্শকদের ধন্যবাদ দিয়েছিলেন, তাঁদের নিস্তব্ধতার জন্যে।

অতঃপর পত্ৰলেখক প্রশ্ন করেছিলেন,

‘Can not managers ask audiences to restrain their clapping until the end of each act?’

‘হলের ম্যানেজাররা কি দর্শকদের বলতে পারেন না যে একটা অঙ্ক শেষ না হওয়া পর্যন্ত হাততালি দেবেন না?

এই সেদিন, ১৯৭৬ সালে মজার সব চিঠি বেরিয়েছিল কন্যাদায়গ্রস্ত পিতাদের।

সেই যে যুগে আশ্চর্য সব কিছুকেই বিলিতি বলা হত, বিলিতি বেগুন (টমাটো), বিলিতি কুমড়ো (মিষ্টি কুমড়ো), বিলিতি মাটি (সিমেন্ট); সেই সময়েই কিংবা তার কিছু পরে আর-একটা প্রবাদ চালু হয়েছিল ‘বিলেত দেশটা মাটির।’

বিলেত দেশটাও যে মাটির, সত্যি সত্যি মাটির, ১৯৭৬ সালের অরক্ষণীয়া কন্যার সাহেব বাবাদের চিঠিগুলো পড়লেই সহজে হৃদয়ঙ্গম হয়।

কন্যাদায়, কন্যার বিবাহের খরচ সে শুধু পণ বা যৌতুক নয়, আদর আপ্যায়ন আছে, সামাজিকতা আছে, চার্চ আছে শুধু এই পোড়ার কপাল, ভারতবর্ষে নয়, দুয়েকটি নগণ্য মাতৃতান্ত্রিক ক্ষুদ্র সমাজ বাদ দিলে, সর্বত্রই সে দায় পাত্রীর বাবার ঘাড়ে এসে পড়ে।।

প্রথম চিঠি লিখেছিলেন একত্রিশ তিন উনিশশো ছিয়াত্তরে সরল প্রকৃতির তিন কন্যার পিতা শ্রীযুক্ত টেরেন্স অ্যালান। চিঠিটি ভিসুভিয়াসের লাভামুখ খুলে দিয়েছিল। এর পক্ষে এবং বিপক্ষে অজস্র চিঠি এসেছিল।

পত্রদাতার প্রথমা কন্যা আত্মসম্মান প্রপীড়িতা শ্রীমতী ক্যারোলিন অ্যালান একটা অত্যন্ত রাগী, বদমেজাজি, চিঠি লিখেছিলেন তাঁর পিতৃদেবের বিরুদ্ধে। সেই চিঠিটি বিষয়ে একটু পরেই আসছি, চিঠিটি খুবই গোলমেলে।

কিন্তু তার আগে মাননীয় টেরেন্স অ্যালানের চিঠিটি একটু পড়ে নিই, বেশ বড় চিঠি একটু সংক্ষিপ্ত করছি: —

৩১/৩/১৯৭৬

টাইমস সম্পাদক সমীপেষু,

মহোদয়,

সেই এক কাল ছিল, যখন মেয়েরা বাড়িতে থাকত কোনও কাজে বেরত না, তাদের যোগ্য বর পাওয়া গেলে বাবা-মা ধন্য বোধ করতেন এবং যথেষ্ট খরচ-খরচা করে বিবাহ দিতেন।

কিন্তু আজকালকার বাজারে যখন মেয়েরাও বাইরে বেরচ্ছে, কাজ করছে তখন বিয়ের এবং বিয়ের ভোজের পুরো দায়টা কেন মেয়ের বাবার ঘাড়ে পড়বে? এখন আর মেয়ের মা-বাবা জামাতা নির্বাচনে কোনও অংশগ্রহণ করেন না, মেয়েও স্বাধীনা এবং আর্থিক সংগতিপনা অথচ বিয়ের ব্যয় সেই মেয়ের বাবাকেই নির্বাহ করতে হচ্ছে। ছেলের বাবার কি এ-ব্যাপারে কোনও দায়িত্ব নেই?

ইতি

ভবদীয়

টেরেন্স অ্যালান

এই পত্রের পক্ষে বিপক্ষে অসংখ্য চিঠির মধ্যে আমরা শুধু অ্যালানসাহেবের কন্যা ক্যারোলিনের চিঠিটি উল্লেখ করছি। শ্রীমতি ক্যারোলিন শুধু তাঁর পিতৃদেবকে নয় অন্য এক সহযোগী পত্রদাতা মরিসনসাহেবকেও আক্রমণ করেছিলেন। আসলে মরিসনসাহেব একটা সমাধান বাতলে ছিলেন, সেটা হল বিয়ের কনের একটা মূল্য ধার্য করা যেটা পাত্রপক্ষ দেবে (আমাদের বরপণের উলটো) এবং সেই টাকাতেই মেয়ের বিয়ের ব্যয় নির্বাহ হবে। উত্তেজিতা ক্যারোলিন লিখেছেন, ‘বিয়ের বাজারে আমাকে যদি নিলামেই তোলা নয় সেই নিলামের টাকা পুরোটা আমিই নেব, আর কেউ নয়, আমার বাবা এক পয়সাও নয়।’

পুনশ্চ:

এই পত্রাবলির এক দশক পরে ১৯৮৫ সালে লন্ডন টাইমস যোগাযোগ করেছিল শ্রীযুক্ত টেরেন্স অ্যালানের সঙ্গে।

হাতি এবং টাইমস কিছু ভোলে না। টাইমস দুশো বছরের পুরনো ভুল সংশোধন করে। শ্ৰীযুক্ত টেরেন্স অ্যালান জানিয়েছিলেন তাঁর বড় মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে ১৯৮২ সালে। পরেরটিরও বিয়ে হয়ে গেছে এবং শেষ মেয়েটির আর অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই বিয়ে হবে।

এবং বলা বাহুল্য, সব বিয়ের সমস্ত খরচটাই ফুলের মালা থেকে শ্যাম্পেন পর্যন্ত সবই বহন করতে হয়েছে টেরেন্স অ্যালানকে।

একথা টাইমস কাগজে কোথাও নেই, কেউ হয়তো স্বীকারও করবে না কিন্তু আমার কেমন মনে হয় এই খরচার জন্যে অ্যালানসাহেব মোটেই দুঃখিত হননি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *