দ্বিতীয় ইনিংসের পর – মতি নন্দী – উপন্যাস
এক
সাতই ডিসেম্বরের ভোরে, রাজধানী এক্সপ্রেসের তেরো নম্বর চেয়ার-কার থেকে কানপুরের প্ল্যাটফর্মে নেমেই সরোজ সাদা শালটা সোয়েটারের উপর জড়িয়ে নিয়ে কৃতজ্ঞ চোখে কামরার জানলার দিকে তাকাল। শালটি মেয়েদের তাই দৈর্ঘ্যে ও প্রস্থে ছোটো। কিন্তু ঊর্ধ্বাঙ্গকে একপাক ঘিরে রাখতে তার অসুবিধে হল না। সে ভেবেছিল পর্দা সরিয়ে এইসময় একজোড়া চোখ তাকে বিদায় জানাবে। সেরকম কিছু হল না। পর্দাটা একই রকম টানা রয়েছে।
ঠান্ডাটা যে কেমন হাতের আঙুল কান আর নাক অসাড় হয়ে আসা থেকেই সে বুঝেছে। শুধু একটা ফুলহাতা সোয়েটারের বর্মে এমন শীতকে ঠেকিয়ে রাখা যায় না। শালটা যদি না দিত…।
সরোজের সঙ্গে যারা নামল তাদের মধ্যে দুজনের সঙ্গে ট্রেনেই তার আলাপ হয়েছে। বছর কুড়ির ছেলেটি তার পাশেই জানলার ধারের চেয়ারে ছিল। নাম জানা হয়নি। কানপুর আই আই টি-তে ইলেকট্রিক্যাল পড়ছে। প্রথম বছর। কথা প্রসঙ্গে জেনেছে, ওরা কাতারে থাকে, বাবা তেলের ইঞ্জিনিয়ার। আগে থাকত দুলিয়াজানে। বিদেশে বসবাসকারী ভারতীয়দের জন্য আই আই টি-তে কিছু আসন বরাদ্দ থাকে, সেই সুযোগ নিয়ে ও পড়তে এসেছে। একটা ইংরেজি খেলার সাপ্তাহিকে মাঝে মাঝে চোখ বোলাচ্ছিল। নিউজিল্যান্ড শুধু তিনটি টেস্ট ম্যাচ খেলতে অল্পদিনের সফরে এসেছে, মাদ্রাজে প্রথম টেস্ট ম্যাচ খেলায় ভারত সাতাশি রানে জিতেছে। দ্বিতীয়টি কানপুরে। শুধু ক্রিকেটেরই ছবি আর কথায় সাপ্তাহিকটি ভরা। সরোজের মনে হল ছেলেটি ক্রিকেট পছন্দ করে না।
প্ল্যাটফর্মে নেমে ছেলেটি একবার শুধু তার দিকে তাকিয়েই বাইরে যাবার জন্য পুবের ফটকের দিকে দ্রুত চলে গেল।
সিগারেট ধরাবার জন্য হাতের গ্রিপটা মেঝেয় রেখে সরোজ আড়চোখে জানলার দিকে আবার তাকাল। পর্দাটা একই ভাবে। ছোট্ট একটু ফাঁক অবশ্য রয়েছে, তাতে ওধার থেকে কেউ তাকিয়ে থাকলেও বোঝা যাবে না।
প্ল্যাটফর্ম কোলাহল বর্জিত, শান্ত। শীতের এই ভোরে রিকশাওয়ালা, কুলি, হোটেলের টাউট, রেলের কর্মী আর ট্রেন থেকে নামা যাত্রী মিলিয়ে জনা চল্লিশ লোক। প্লাটফর্মের চটির দোকানগুলো বন্ধ, চা-এর স্টলে ভিড় নেই। হাঁকহাঁকি, ডাকাডাকি নেই। এতবড়ো স্টেশনটা শীতকাতুরে মানুষের মতো গুটিসুটি হয়ে রয়েছে।
”বাবু হোটেলে যাবেন?”
সরোজ হাত নেড়ে লোকটাকে জানিয়ে দিল সে কথা বাড়াতে ইচ্ছুক নয়। ট্রেনে আলাপ হওয়া দ্বিতীয় লোকটি কুলির মাথায় সুটকেস চাপিয়ে হাতের তালু ঘষতে ঘষতে কাছে এল। লাল পোলোনেক সোয়েটারের উপর কালো কোট। ”আমাদের তো ওভারব্রিজ দিয়ে একদম ওধারে যেতে হবে।”
”হ্যাঁ।”
জানলার দিকে শেষবার তাকিয়ে সরোজ গ্রিপটা তুলে নিয়ে ব্রিজের সিঁড়ির দিকে এগোল। চার বছর আগে শেষ কানপুরে এসেছিল। মোটামুটি শহরটাকে তার মনে আছে।
”শালটা ছোটো বটে কিন্তু খুব কাজের।”
সরোজ জবাব দিল না।
”বলেছিলুম লেট মেক-আপ করে নেবে, দেখলেন তো।”
কবজিতে আঁটা ঘড়িটা চোখের সামনে তুলে ধরে অসম্ভব তৃপ্ত দেখাল লোকটিকে।
”উনি কিন্তু দিল্লিতে মুশকিলে পড়বেন, ওখানে আরও ঠান্ডা…অবশ্য যখন পৌঁছবেন তখন ভালোই রোদ উঠে যাবে। তবু যদি বাতাস চলে…”
”উনিটা কে?”
সরোজ তার গম্ভীর স্বরটা প্রয়োগ করল লোকটিকে নিরুৎসাহ করতে।
”উনি!” লোকটি বিব্রত হবার কোনো লক্ষণ না দেখিয়ে বলল, ”রাতে খাওয়ার পর যার পাশের চেয়ারে গিয়ে বসলেন, আর ওনার মেয়ে উঠে এসে ততক্ষণ আপনার চেয়ারে বসে রইল, সেই ভদ্রমহিলা!”
সরোজ এখনও লোকটির নাম জানে না। জিজ্ঞাসা করতে গিয়েও মনে হল থাক, নাম ধরে সম্বোধন ঘনিষ্ঠতার সুযোগ এনে দেয়, তাহলে বকবকানি আরও বেড়ে যাবে।
ওভারব্রিজের মাঝামাঝি এসে সরোজ পিছনে তাকিয়ে রাজধানী এক্সপ্রেসকে শেষবারের মতো দেখে নিল। আর মিনিট কয়েক পরই ছাড়বে।
”ভদ্রমহিলা খুব কড়াধাতের অথচ মনের মধ্যে কত সফট। আপনার আত্মীয়া?”
এবার সরোজ কৌতূহলী হয়ে পড়ল। একদমই অপরিচিত, মাত্র কাল বিকেলে হাওড়ায় ট্রেনে উঠে লোকটির সঙ্গে প্রথম আলাপ এবং সেটাও প্রায়-ঝগড়ার মতো।
”সফট কেন মনে হল?”
”মেয়েকে দিয়ে শালটা আপনাকে পাঠিয়ে দিলেন, সফট মাইন্ড না হলে কি এই শীতে কেউ গরমকাপড় হাতছাড়া করে?”
”অ। আর কড়াধাত বুঝলেন কী করে?”
”কেন, পাঞ্জাবিটাকে কেমন ডেঁটে দিলেন দেখলেন না?”
কাল বিকেলে ট্রেনে ওঠার পর নিজের কয়েকটা ব্যবহার, কণ্ঠস্বর, ভঙ্গি, মনের অবস্থা সরোজের মনে পড়ল। সিগারেটটা ফেলে দিয়ে লোকটির মুখের দিকে এই প্রথম সে প্রসন্ন চোখে তাকাল। প্রায় বারো ঘণ্টা আগে তেরো নম্বর কামরায় বিরক্ত চোখে তাকানোর ব্যাপারটা ঝট করে মনে ভেসে উঠল।
হাওড়ায় নম্বর খুঁজে সিটটা পাওয়ার পর হ্যান্ড গ্রিপটা র্যাকে তুলে রাখতে গিয়ে সে দেখে একটা ঢাউস সুটকেস জায়গা দখল করে রেখেছে। রুক্ষস্বরে সে বলে উঠেছিল, ”সুটকেস কার?”
লাল পোলোনেক সোয়েটারের উপর কালো কোটপরা তার পাশে দাঁড়ানো রোগা লোকটি ক্ষীণকণ্ঠে জবাব দিয়েছিল, ”আমার।”
সরোজ আঙুল তুলে বলেছিল, ”এতবড়ো সুটকেসের তো লাগেজ ভ্যানে যাবার কথা, চেয়ার-কারে কি এসব তোলে? কমনসেন্স বলে তো একটা কথা আছে, দেখেননি টিকিটে কী লেখা রয়েছে?”
”আমি বরং নামিয়ে রাখছি। এখন আবার বুক করাতে গেলে…” লোকটি হাতঘড়ি দেখে অসহায়ভাবে তাকাল, ”ছাড়তে আর মাত্র চার মিনিট বাকি।”
”নামান।” সরোজ ধমকে উঠল। কিন্তু তখনই মনে হল, অতবড়ো সুটকেস একা নামাবার ক্ষমতা লোকটির নেই।
”সরুন আপনি।”
সুটকেসটা অবশ্য আকারের সঙ্গে মানানসই নয়। সরোজ স্বচ্ছন্দেই নামিয়ে নিল। সুটকেসে জিনিসপত্র কম বোধহয় দু-চারদিনের জন্য কোনো কাজে যাচ্ছে। লোকটিকে দেখে এখন তার মায়া হচ্ছে। কোথায় যে সুটকেসটা রাখবে ভেবে পাচ্ছে না। কামরার মাঝখানে যাতায়াতের পথ, তার একধারে তিনটি অন্যদিকে দুটি চেয়ার। পথটা সরু, ওখানে সুটকেস রাখা যায় না।
”রাজধানীতে এই প্রথম?”
”আজ্ঞে, হ্যাঁ।”
”সিটের নীচে লম্বালম্বি পেতে রাখুন। বসতে কিছুটা অসুবিধে হবে, তা আর কী করবেন…দিল্লি যাচ্ছেন?”
”কানপুর।”
কিছুক্ষণ ধরেই কামরার ওদিকে ভিড়ের আড়ালে একটা কথা কাটাকাটি চলছিল। সরোজ তাতে কান বা চোখ দেওয়ার আগ্রহ বোধ করেনি। ট্রেন ছাড়ার আগে এসব হয়ই। কিন্তু হঠাৎ ইংরেজিতে নারীকণ্ঠে তীক্ষ্নস্বর শুনতে পেয়ে অন্যদের মতো সে-ও কামরার অন্য প্রান্তে তাকাল। মনে হল যে-কারণে একটু আগে তার স্বর রুক্ষ হয়েছিল ঠিক সেই কারণই ঘটেছে। দাঁড়িয়ে থাকা লোকেদের ফাঁক দিয়ে সরোজ দেখতে পেল, ছেলেদের মতো ছাঁটা চুল, সাদা কার্ডিগান এবং মেরুন সিল্কের শাড়িপরা এক মহিলাকে যার মুখটি দেখা যাচ্ছে না। ডানহাতের তর্জনী তুলে মাথায় সবুজ পাগড়ি, এক বৃহৎবপু শিখকে তিনি ইংরেজিতে বোঝাচ্ছেন-”আগে এলেই কি বাঙ্কের সব জায়গা আপনার হয়ে যাবে, এ কেমন যুক্তি? আপনার সিট নাম্বার তো একুশ আর মালপত্র রেখেছেন সাত নম্বরের জায়গায়। এ কেমন করে হতে পারে? তা ছাড়া মানুষ-পিছু একটা মাত্র হাতব্যাগ এই হচ্ছে নিয়ম এবং তা নিজের সিটের উপরেই থাকা বাঞ্ছনীয় আর আপনি ছ-সাতটা মাল…।”
”কে নিয়ম মানে? কেউ মানে না, এ দেশে নিয়মই নেই।” শিখ বিন্দুমাত্র বিচলিত নয় মহিলার তুখোড় ইংরেজিতে। উদাসীনভাবে বাঙ্কের দিকে চোখ তুলে সে ইংরেজিতেই ধীরে ধীরে ”নিয়ম” সম্পর্কে মতামত দিল। কাছের কয়েকজন যাত্রী তাকিয়ে আছে ব্যাপারটা কতদূর গড়ায় দেখার জন্য। তাদের মুখ দেখে মনে হচ্ছে না তারা শিখের বিপক্ষে। নিয়ম মেনে একটি হাতব্যাগ নিয়ে কেউই ওঠেনি।
”তাহলে আপনি মালপত্র হটাবেন না? ঠিক আছে, কন্ডাক্টরকেই বলতে হচ্ছে। চেয়ার-কারকে যেন লাগেজ ভ্যান করে তুলেছেন।”
”জায়গা তো রয়েছে, আপনি রাখুন না আপনার জিনিস…দিন রেখে দিচ্ছি।”
শিখটি মহিলার হাত থেকে প্রায় ছিনিয়েই নিল প্রসাধনের চৌকো বাক্সটি। দুটো কার্ডবোর্ডের প্যাকেটের ফাঁকে জায়গা বার করে বাক্সটি গুঁজে দিল। জিনস ও শার্ট-পরা, চোখে চশমা, লম্বা ছিপছিপে, শ্যামবর্ণা যে-মেয়েটি মহিলার পাশে দাঁড়িয়ে, সে তার হাতে ঝোলান নকশা-করা চামড়ার থলিটি শিখের প্রসারিত হাতের নাগাল এড়িয়ে জানলার পাশে হুকে ঝুলিয়ে দিল।
সরোজ হাতঘড়ি দেখে বিড় বিড় করে তখন বলেছিল, ”আশ্চর্য, পাঁচ মিনিট হয়ে গেল এখনও ছাড়ল না! শিখটা ঠিকই বলেছে, নিয়ম কেউ-ই মানে না।”
”পথে লেট মেক-আপ করে নেবে।”
সরোজ কৌতূহলী চোখে কালো-কোটপরা লোকটির মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, ”বলছেন করে নেবে?”
”অর্ডিনারি মেল ট্রেনই দশ-পনেরো মিনিট লেট ইজি মেক-আপ করে নেয়। আর লেট যদি হয়ই সেটা তো ভালোই।”
লোকটি কোটের পকেট থেকে সিগারেট প্যাকেট বার করে, একটা সিগারেটের মাথা টেনে সরোজের দিকে এগিয়ে ধরল।
”কম্পার্টমেন্টে খাওয়া বারণ।”
লোকটা অপ্রতিভ হয়ে চোরাই জিনিস লুকোবার মতো ব্যস্ততায় প্যাকেট সমেত হাতটা তাড়াতাড়ি কোটের পকেটে ভরে নিল।
”বাইরে টয়লেটের সামনে দাঁড়িয়ে তো খাওয়া যায়।”
”তা যায়, কিন্তু এখন আমার খাবার ইচ্ছে নেই। আপনি খেয়ে আসতে পারেন।”
”না থাক।”
সরোজের পায়ের নীচে কামরার মেঝেটা নড়ে উঠতেই সে দুলে গেল। ট্রেন ছেড়েছে। জানলার পর্দার ফাঁক দিয়ে প্ল্যাটফর্ম ও মানুষজনের দিকে সে তাকিয়ে রইল। পিছিয়ে যাওয়ার এই দৃশ্যটা বাল্যবয়স থেকেই তার ভালো লাগে। অবশ্য চার বছর আগে ছোটোবোন শান্তাকে তার শ্বশুরবাড়ি পৌঁছে দিতে যাওয়ার সময় সে বলেছিল, ”সবকিছু ফেলে এগিয়ে যাওয়ার মধ্যে একটা অদ্ভুত সেনসেশন পাই।”
”দশ মিনিট লেটে ছাড়ল।”
সরোজ উত্তর না দিয়ে কামরার মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকাদের মুখগুলোয় চোখ বোলাল। একটি মুখও চেনা নয়। অনেকেই চেয়ারে বসে পড়েছে। তাদের মাথার পিছনটাই শুধু দেখা যাচ্ছে। কামরার বাইরে যাবার জন্য তাদের প্রান্তের কাচের এক পাল্লার দরজাটা পাঁচ-ছয় মিটার দূরে। চেয়ারে বসতে হবে দরজার দিকে পিছন ফিরে। ধূসর ফিকে নীল উর্দিপরা রেস্টুরেন্টের কর্মীরা দরজার বাইরে ছোট্ট করিডরে কাজে ব্যস্ত। কিছুক্ষণ পর ওরা চা দেবে।
হঠাৎ মনে পড়ায় সরোজ জানতে চাইল, ”লেট হওয়াটা ভালো, এ-কথা বললেন কেন?”
”আর্লি ডিসেম্বরে নর্থ ইউ পি-র শেষরাত যে কী জিনিস…একটু দেরি করে সূর্য ওঠার পর পৌঁছলে তবু শীতটা কম লাগবে।”
সরোজ ভ্রূ এবং কাঁধ তুলে বোঝাল শীতকে সে খুব একটা গ্রাহ্য করে না। একটা ফুলহাতা সোয়েটার, আর একটা মাফলার ছাড়া তার সঙ্গে আর কোনো শীতবস্ত্রও নেই। হালকা হয়ে বেড়াবার জন্য দু’বছর আগে মাদ্রাজে বর্মা বাজার থেকে হাতে বা কাঁধে ঝোলানো যায়, এমন একটা জাপানি গ্রিপ কিনেছিল। এতে প্রায় এক সুটকেস জিনিস আঁটে। যখন বাইরে গেলে স্যুট পরত তখন সুটকেস সঙ্গে নিত। কানপুর থেকে দিল্লি হয়ে সে ফিরবে, আঠারো দিন কলকাতার বাইরে থাকার কথা। টেলেক্সে গতকালই দিল্লি অফিসকে কলকাতায় ফেরার একটা রাজধানীর টিকিট কেটে রাখতে বলেছে।
”আপনি তো কলকাতারই, কবে ফিরবেন?” সরোজ বলল।
”অফিসের কাজ, দিন চারেক লাগবে।”
”কোথায় উঠবেন?”
”হোটেলে, বুক করাই আছে। আপনি?”
”আমিও হোটেলে…”
দুজনে দাঁড়িয়ে কথা বলছিল। সরোজের চোখে পড়ল সাদা কার্ডিগান মেরুন শাড়ির মহিলা উঠে দাঁড়ালেন। ওই প্রান্তের দরজার দিকে এগোচ্ছেন বাইরে যাবার জন্য। সেই সময় দরজা ঠেলে ঢুকল বাচ্চচা-কোলে একটি লোক। মহিলা পাশ ফিরে দাঁড়ালেন পথ দেবার জন্য। সরোজের ভ্রূ কুঁচকে উঠল।
মুখটা চেনা, অত্যন্ত চেনা। কুড়ি-একুশ বছর পরও ভুল হবার কথা নয়। ঠোঁটের নীচে বাঁ ধারে তিলটি এখান থেকেও স্পষ্ট দেখা গেল। একটু চাপা নাক, গালের উঁচু হনু। সরোজের বুকের মধ্যে বাতাসের চাপ তৈরি হচ্ছে, হাতের আঙুলগুলো ঢিলে হয়ে আসছে। মাথার মধ্যে থেকে একটা নির্দেশ মুহূর্তে তার শরীরে ছড়িয়ে পড়ল-বসে পড়ো।
হঠাৎ তাকে বসে পড়তে দেখে কালো কোটপরা লোকটি আর কথা না বলে দরজার দিকে এগোল।
বীণা!
এত বছর পর কিনা একই ট্রেনে! এখন কোথায় থাকে?…কানপুর, দিল্লি? কী করে? ঘরসংসার… চাকরি? বিয়ে নিশ্চয়ই করেছে, সঙ্গের মেয়েটি কি ওরই? আশ্চর্য, এত বছর…কুড়ি না একুশ…অত হবে কি? কানহাইয়ের দু’শো ছাপান্ন কত বছর আগে হয়েছিল…আজ থেকে উনিশ বছর…তারপর এই! ওর সঙ্গে কথা বলা কি উচিত হবে? ওর বয়স এখন কত, চল্লিশ না ঊনচল্লিশ, নিশ্চয় বোধবুদ্ধি এখন অনেক ম্যাচিওরড, ইংরেজি আগেও বলতে পারত, বলার অভ্যাস রয়েছে, বাড়িতে সম্ভবত ইংরেজিতেই কথা বলে, মনে হয় অবস্থা ভালোই…কালচার্ড বলা যায় এমন একটা ফ্যামিলির মাঝখানে রয়েছে। শিখের সঙ্গে যেভাবে কথা বলল তাকে ঠিক ঝগড়া বলা যায় না…উঁচু গলায় তর্ক একটু অ্যাগ্রেসিভ ভঙ্গিতে। ওর কাছে গিয়ে কথা বলা কি দরকার? বললে কীভাবে তাকে নেবে? দরকার কী দেখা হওয়ার, এত বছর তো দিব্যিই কেটে গেল, তার মধ্যে কতবার আর ওকে মনে পড়েছে?
সে এখন জালের মধ্যে জড়িয়ে পড়া একটা জন্তুর মতো অবস্থায়। যতই জাল ছাড়াতে চায় ততই জড়িয়ে যাচ্ছে। তার মনে হল, বীণার চেয়ারের পাশ দিয়ে অন্যমনস্কের মতো বার দুই হেঁটে গেলে কেমন হয়? যদি মুখ তুলে চিনতে পারে, যদি নাম ধরে ডাকে তাহলে মসৃণভাবে ব্যাপারটা ঘটবে। সে প্রথমে অবাক হবে তারপর চিনতে পারবে। আর যদি দেখেও না-চেনার ভান করে তাহলেও ব্যাপারটা ঠিক থাকবে। সে-ও চিনবে না।
একটা মানসিক জড়তা তাকে গুটিয়ে রাখছে। এটা শুধু এখনই নয়, জড়তাটা বরাবরের। ব্যাপারটাকে সে কুনোমি বলতে রাজি নয়, লাজুকতাও নয়। ছোটোবেলা থেকে কখনওই সে বেশি কথা বলায় বা আগ বাড়িয়ে অযাচিত কাজে নেমে পড়ায় নিজেকে নিয়োগ করেনি। তার থেকে অসফল, নিকৃষ্ট, বোকা এবং আকর্ষণরহিতরা চোখে পড়ার জন্য নানান কাণ্ড করেছে যখন, তখন সে চুপচাপ থাকতে চায়। বরাবরই সে পিছনের সারির, ভিড়ের মধ্যে গা ঢাকা দেওয়ার দলে। চোখে পড়ার মতো কাজ করে ফেললেই অস্বস্তি বোধ করেছে। কখনও আক্রমণাত্মক নয়, চিন্তায় প্রথমেই সে ধরে নেয়-হবে না, করা যাবে না। উদ্যোগী হয়ে নতুন কোনো কাজে এগিয়ে যাওয়ার বা ছক কষে কিছু আদায় করার থেকে সে পছন্দ করে, যতটুকু পাওয়া যায় তাই সই।
সরোজ তার এই দুর্বলতাটা সম্পর্কে অত্যন্ত সচেতন। কিন্তু ‘দুর্বল’ শব্দটা কখনও নিজের সম্পর্কে সে মনে মনেও প্রয়োগ করে না। প্রথমে ধারণা হয়েছিল এটা তার মধ্যবিত্ত গড়বুদ্ধি থেকে পাওয়া শোভনতা এবং রুচির সঙ্গে যুক্ত। পরে তার মনে হয়েছে এর মধ্যে রুচিটুচি, শোভন-অশোভন আসে কী করে? স্কুল ছাড়ার কুড়ি বছর পর অঙ্কের মাস্টারমশায়কে একদিন দেখেছিল ওষুধের দোকানে তার পাশে দাঁড়িয়ে কী একটা কিনছেন। সে বলতে পারত ‘কেমন আছেন স্যার, আমি সরোজ আপনার ছাত্র ছিলাম।’ এই বলে তখন একটা প্রণাম। কিন্তু সে ঘুরে দাঁড়িয়েছিল যাতে স্যার তার মুখ না দেখে ফেলেন। তাড়াতাড়ি ওষুধটার দাম চুকিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে এসেই ভেবেছিল-পরিচয় দিয়ে দুটো কথা বললাম না কেন? উনি চিনতে পারেননি। সেটা স্বাভাবিকই। গম্ভীর, সুদর্শন, পরিশ্রমী ছিলেন, ছাত্রদের শ্রদ্ধা পেতেন। স্যারকে তার ভালোই লাগত। বহু কাল পর দেখা হল অথচ সে মুখোমুখি হতে চাইল না! সে ইতিমূলক, উদ্যোগী নয়। স্যার যদি চিনতেন তবেই সে চেনা দিত। কী যেন একটা ভিতর থেকে তাকে টেনে রাখে, সে কুঁকড়ে থাকে।
আধ ঘণ্টা পরই সে নিজেকে বলেছিল, ঠিকই করেছি। কথা মানে তো-এখন কী করছ, ক’টি ছেলেপুলে, তারা কী পড়ছে, এইসব তো! অর্থহীন এসব কথাবার্তার মধ্যে না গেলে কোনো ক্ষতি হবে কি, আমাদের দুজনেরই? আরও আধ ঘণ্টা পর সরোজ নিজেকে বলেছিল-অর্থহীনতার মধ্যে না যাওয়াটাই তো শোভনতা।
কিন্তু বীণাকে দেখেই এইরকম ধপ করে বসে পড়া বা মুখটা একটু নামিয়ে সামনের চেয়ারের আড়ালে রাখার চেষ্টাটার মধ্যে সে কাপুরুষতার ছোঁয়া পেল। এরমধ্যে কোনোরকম শোভনতা বা রুচি নেই।
”অ্যাঁ কী বলছেন?” সরোজ মুখ তুলে তাকাল।
”কোন হোটেলে আপনি?”
”মধুছন্দা।”
”আরে আমিও তো! আপনিও কি অফিসের কাজে?”
”হ্যাঁ।”
সরোজ এবার রেগে ওঠার অবস্থায় পৌঁছচ্ছে। গায়েপড়াদের তার ভালো লাগে না।
”আমার ওষুধ কোম্পানি, পেকার অ্যান্ড লরেন্স, আমেরিকান, হেড অফিসে পার্সোনেলে আছি। একটা ইনভেস্টিগেশনে যাচ্ছি। আপনি?”
”চলুন সিগারেট খেয়ে আসি। বাইরে কথা হবে।”
বীণা সম্ভবত টয়লেটে গেছে। ফিরে আসার আগেই সে বাইরে যেতে চায়। প্রায় বারো ঘণ্টা তারা এই কামরায় থাকবে। বীণা সামনের দিকে সুতরাং সে যতক্ষণ পিছন ফিরে চেয়ারে বসে থাকবে তার মুখ দেখতে পাবে না। তা ছাড়া রাতের খাওয়ার পর আলো কমিয়ে কামরাটা অন্ধকার করে দেওয়া হবে আর ভোররাতে সে কানপুরে নেমে যাবে। এর মধ্যে তাকে দেখে ফেলার সুযোগ বীণা পাচ্ছে না।
প্যাকেটটা বার করে কী ভেবে আবার কোটের পকেটে রেখে মুচকি হেসে লোকটি বলল, ”দাঁড়ান ভালো সিগারেট খাওয়াব। ভাইপো হামবুর্গ থেকে পরশু এসেছে দু’মাসের জন্য। ভালো চাকরি করে।”
লোকটি নিচু হয়ে সুটকেসটাকে বার করার জন্য টানাটানি শুরু করল। সরোজ উঠে দাঁড়াল। বিলিতি সিগারেটের প্রতি তার কোনো পক্ষপাতিত্ব নেই। বরং সে দিশি নিজস্ব অভ্যাসেই আরাম পায়।
”আপনি বার করুন আমি বাইরে গিয়ে দাঁড়াচ্ছি।”
প্যান্টের পকেটে সিগারেট প্যাকেট ও দেশলাইটা আছে কি না, চাপড়ে দেখে নিয়ে সরোজ সরু পথটায় বেরিয়ে এসে মুখ ফিরিয়ে একবার অন্য প্রান্তের দরজাটার দিকে তাকাল।
দরজা ঠেলে বীণা ঢুকছে। বড়োজোর বারো মিটার দূরত্ব। সারি দেওয়া নিয়ন আলোয় উজ্জ্বল কামরা। সোজা সামনের দিকে দেখা না-দেখার মতো চাউনি ফেলে বীণা পাল্লাটা ছেড়ে দিতেই ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। ঠিক সেই সময় ছাড়া পাওয়া একটা বাচ্চচা টলমল করে পথ দিয়ে এগিয়ে আসছিল। ওকে ধরার জন্য সরোজ নিচু হল। একটি যুবক, সম্ভবত বাচ্চচার পিতা, ”বান্টি, বান্টি” বলে ডেকে চেয়ার থেকে উঠল। সরোজ হাত বাড়িয়ে বাচ্চচাটিকে কোলে তুলে হাসি হাসি মুখে সামনে তাকাতেই সোজা বীণার চোখের সঙ্গে তার চোখের ধাক্কা লাগল।
এবার কী হবে!
প্রথমেই তার মনে এই ভাবনাটা জেগে উঠল। বীণার চোখ দুটো সামান্য বড়ো হয়ে উঠেই ছোটো হল। চিনতে পেরেছে। মুখে কোনো ভাব ফুটে ওঠেনি। সত্যিই ম্যাচিওরড হয়েছে। নাটুকে হবার চমৎকার সুযোগটা নিল না। নিজের ওপর ওর নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা অনেকের থেকেই বেশি। বীণা ঝুঁকে মেয়েটির হাঁটু ঘষড়ে ভিতরে ঢুকে চেয়ারে বসল। একবারও এদিকে তাকাল না।
বাচ্চচাটাকে তার বাবার হাতে তুলে দিয়ে সরোজ ঘুরেই, চেয়ারের ওপর রাখা ডালাখোলা সুটকেস হাতড়ানোয় ব্যস্ত লোকটির পাছায় ধাক্কা দিয়ে এবং ‘সরি’ বলে দরজার দিকে এগিয়ে গেল।
কয়েক ঘণ্টা আগে কাল বিকেলে সরোজ আবিষ্কার করেছিল বীণাকে।
‘আবিষ্কার’ শব্দটি সুপ্রযুক্ত হবে কি না সরোজ এই খটকা মাথায় নিয়ে কানপুরের ওভারব্রিজের সিঁড়ি দিয়ে নেমে সরু একটা গেটে পৌঁছল। টিকিট নেবার জন্য একজনের দেখা এতক্ষণে পাওয়া গেল। স্টেশনের বাইরে পঁচিশ-তিরিশটি সাইকেল রিকশা অপেক্ষমাণ। এই শহরে বাস ছাড়া জনগণের জন্য এটাই একমাত্র বাহন। রাজধানীতে ভোরে কম যাত্রী আসে বলেই রিকশা মাত্র এই ক’টি। অন্য সময় এদের ভিড়ে হাঁটাচলা দায় হয়।
”কোথায় যাবেন, হোটেলে?”
”বাবু হোটেলে যাবেন, ব্যবস্থা করে দেব।”
রিকশাওলারা ছেঁকে ধরল। খদ্দের আনতে পারলে হোটেল থেকে কমিশন পাবে।
”হোটেলে আমাদের ঘর বুক করা আছে বাবা, তোমাদের অত আর উপকার করতে হবে না।” কালোকোট চেঁচিয়ে উঠে, মাছি তাড়াবার মতো করে হাতটা মুখের সামনে নাড়তে লাগল।
”দুজনে দুটো রিকশা, কী বলেন?”
”তা ছাড়া কী! একটাতেই দুজনে যাব ভেবেছিলেন নাকি?”
”না না তা নয়, এই কত নেবে মধুছন্দা হোটেল? সিভিল লাইন্সে?”
”দো রুপিয়া।”
”অ্যাঁ!” তারপর সরোজের দিকে ফিরে গলা নামিয়ে বলল, ”কলকাতায় শুনে এসেছি এক টাকা…ধরে ফেলেছে আমরা নতুন লোক।”
”উঠুন, উঠে পড়ুন।”
সরোজ হ্যান্ড গ্রিপটা রিকশার পাদানিতে রেখে উঠে বসল। ”ভীষণ খিদে পাচ্ছে, তাড়াতাড়ি পৌঁছতে হবে।”
”দর না করেই…।”
”এক টাকা যদি বেশি নেয় তো নিক না।”
কাত হয়ে প্যান্টের পকেট থেকে সিগারেট প্যাকেট বার করে সরোজ রিকশাওলাকে রওনা হতে বলল। যতক্ষণ রিকশা চলেছিল সে আর পিছন ফিরে তাকায়নি।
কানপুর চার বছরে একই রয়েছে। সিগারেটে টান দিয়ে সে দু’পাশের বাড়িগুলোকে লক্ষ করল। আগের মতোই তার মনে হল কলকাতার বড়োবাজার, জোড়াসাঁকো বা নিমতলার কোনো পাড়া দিয়ে সে চলেছে। সাইন বোর্ডের বয়ান, রাস্তার দু’ধারে খোলা নর্দমা, পথের মাঝে টাটকা গোবর, উনুনের ধোঁয়া, রাধাগোবিন্দের মন্দির, দাঁতনের জন্য বিছিয়ে রাখা নিমডালের গোছা, সিমেন্টের গাঢ় লাল নীল ফুল লতাপাতা বাড়ির দেয়ালে, রাস্তা দু’ভাগ করে মাঝখান দিয়ে ফুটখানেক উঁচু সরু পাঁচিল, নিচু দোতলা পুরনো বাড়িগুলোর মাঝে হঠাৎ আধুনিক স্থাপত্যের লম্বা বাড়ি, পথচারীদের উদাসীন চলাফেরার মধ্য দিয়েই ঊর্ধ্বশ্বাসে স্কুটার এবং তার থেকেও বিপজ্জনক গতিতে অ্যাম্বাসাডর।
মল রোড পার হয়ে রিকশাটা ডানদিকে ঘোরার সময় সরোজ তাকিয়ে দেখল প্রায় পঞ্চাশ মিটার পিছনে রিকশা থেকে হাত তুলে কালোকোট তাকে মন্থর হবার নির্দেশ দিচ্ছে। সরোজ মুখ ফিরিয়ে নিল। এক ধরনের লোক আছে যারা আঠার মতো অন্যের গায়ে লেগে থাকতে চায়, নিজের চেনা গণ্ডির বাইরে গেলেই নার্ভাস হয়ে পড়ে, অন্যের মুখাপেক্ষী হয় ছোটোখাটো প্রতি ব্যাপারে, এই লোকটাও তাই।
একটি মোটর যাবার মতো সরু ইট বাঁধানো গলি দিয়ে প্রায় পঞ্চাশ মিটার ভিতরে গেলে হোটেল মধুছন্দা। তার চারতলার ছাদের উপর হোটেলের নাম লেখা বিরাট লাল-সাদা সাইনবোর্ডটা দূর থেকে দেখা যায়। রিকশাটা অফিসঘরের সামনে থামতেই গ্রিপটা হাতে নিয়ে সরোজ তিনটে সিঁড়ি ভেঙে ঘরে ঢুকল।
রিসেপশন কাউন্টারে দাড়িওয়ালা যুবকটির চোখের কোলে ঘুমের তলানি এখনও পড়ে আছে। ভারীপাতা তুলে সে তাকিয়ে রইল সরোজের দিকে। সেই সময় কালোকোট রিকশা থেকে নামতে নামতে চেঁচিয়ে বলল, ”স্টেশন থেকে মাইল দেড়েক হবে, কী বলেন?…ভাড়া কি দিয়ে দিয়েছেন?”
”ওহ….হ্যাঁ দিচ্ছি।” সরোজ পকেটে হাত ঢোকাল মানিব্যাগের জন্য।
”রাখুন রাখুন আমি দিয়ে দিচ্ছি, অনেক খুচরো জমে গেছে।”
ব্যগ্র হয়ে কালোকোট হাতে তুলে বাস থামাবার ভঙ্গিতে সরোজকে নিরস্ত করল। যে-কোনো ধরনের আবেগ প্রকাশের জন্য লোকটির দুটো হাতের যে খুবই দরকার হয় এটা সে এবার বুঝে গেল। কথা না বাড়িয়ে সে রিসেপশনিস্টের দিকে ফিরে কাউন্টারে কনুই রেখে ঝুঁকে বলল, ”আমার একটা সিঙ্গল রুম বুকিং আছে…সরোজ বিশ্বাস, কলকাতা থেকে।”
রিসেপশনিস্ট হাত বাড়িয়ে মোটা রেজিস্টারটা টেনে এনে, তার ভেতর থেকে ক্লিপে-আঁটা চিঠি আর চিরকুটের একটা গোছা বার করে, মন দিয়ে সেগুলো উলটেপালটে দেখতে লাগল।
”না, কোনো বুকিং নেই এই নামে।”
”সে কী, আমি তো দু’সপ্তাহ আগে চিঠি দিয়েছি! ফিফটি নাইন বাই টোয়েন্টি, সিভিল লাইন্স, গ্রিন পার্ক…এই ঠিকানাই তো?”
”হ্যাঁ।”
আবার চিঠিগুলো দেখে সে মাথা নাড়ল, ”নেই। কলকাতা থেকে আছে শুধু রবীন্দ্রকুমার মান্না নামে…”
”আমি আমি, আমার নাম রবীন্দ্রকুমার মান্না!…সিঙ্গল রুম।”
উত্তেজিত স্বরে বলে উঠে কালোকোট জ্বলজ্বলে চোখে সরোজের গা ঘেঁষে এগিয়ে এল। নিজের নাম অন্যের মুখে যেন এই প্রথম শুনল। কাউন্টারে হাত দুটি যে কীভাবে রাখবে বুঝে উঠতে পারছে না।
”আমার চিঠি আপনারা পাননি?”
সরোজ আবার জিজ্ঞাসা করল উদ্বিগ্ন স্বরে।
”পেলে তো এর মধ্যেই থাকত।”
সরোজ কয়েক সেকেন্ড মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে বোঝার চেষ্টা করল রিসেপশনিস্ট সত্যি কথা বলছে কি না। অনেক সময় শাঁসালো বা বোকা লোকেদের বেশি রেটে ভাড়া দেবার জন্য ঘর আটকে রেখে বলে দেয়, নেই বা চিঠি পাইনি। মাঝারি স্বাচ্ছন্দ্যের হোটেল কানপুরে কয়েকটা মাত্র, পাঁচতারা হোটেল শুধু একটি। সব হোটেলেই ঘরের টানাটানি লেগেই থাকে আর এখন তো বেশি করেই হবে।
”কিন্তু আমার যে ঘর চাই।”
কণ্ঠস্বর কাতর, ধীর বিপন্ন করে সরোজ বুঝিয়ে দিতে চাইল নতুবা সে বিপদে পড়বে। এরকম পরিস্থিতিতে সে আগে কখনও পড়েনি। এখন কি আবার রিকশায় চড়ে তাকে হোটেলে হোটেলে ঘুরতে হবে! যদি সব জায়গাতেই বলে, খালি ঘর নেই!
”একটাও খালি নেই।”
সরোজ ফ্যালফ্যাল করে বোকার মতো শুধু তাকিয়ে রইল। কী করবে বুঝে উঠতে পারছে না। এমন একটা বিপদের সম্ভাবনাকে সে একবারও ভাবেনি। অন্য হোটেলে খোঁজ করতে যেতে হবে কিন্তু ঘর পাবে কি না সে নিশ্চয়তা নেই। এখানে হয়তো খালি ঘর আছে। দাড়িওলা কিছু টাকা কামাবার জন্য বোধহয় প্যাঁচ কষছে।
সরোজ আবার ঝুঁকে চাপা স্বরে বলল, ‘একস্ট্রা দোব…পাওয়া যাবে?”
রিসেপশনিস্ট ঠোঁট মুচড়ে মাথা নাড়ল।
”ঘর একদম নেই। দুটো ঘর আজ দুপুরে খালি হবে কিন্তু বুক করা আছে।”
রবীন্দ্রকুমার মান্না এবার নড়েচড়ে উঠলেন।
”উনি তো আমার সঙ্গে আমার ঘরেই থাকতে পারেন।”
”তা পারেন, একস্ট্রা চার্জ দিতে হবে।”
”দোব…কত?”
”পঞ্চান্ন টাকা প্লাস একস্ট্রা একটা খাট পঁচিশ টাকা।”
”ঠিক আছে। দুজনকে তাহলে একঘরেই দিন।”
রিসেপশনিস্ট খাতাটা ঘুরিয়ে মান্নার সামনে ঠেলে দিল নাম, ধাম, পেশা, আগমন, সময় ও উদ্দেশ্য লিখে দেবার জন্য। রবীন্দ্র মান্না খাতায় লাইনটানা ঘরগুলো ভরতি করল প্রতিটির শিরোনাম দু’বার করে পড়ে নিয়ে।
”আপনার নামটা বলুন?”
মান্না কলম উঁচিয়ে সরোজের কাছে জানতে চাইল। একটা বিশ্রী পরিস্থিতি থেকে উদ্ধার পাওয়ার স্বস্তিটা সরোজকে ইতোমধ্যে কৃতজ্ঞতায় নরম, ঢিলে করে দিয়েছে। মুখে হাসি ছড়িয়ে সে বলল, ”দিন আমিই লিখছি।”
সরোজ যখন লিখছে তখন মান্না ঘাড় বেঁকিয়ে পড়ে যাচ্ছিল।
”আপনি রিপোর্টার, অ্যাঁ কোন কাগজের?”
বিস্ময়, শ্রদ্ধা, তটস্থতা সবক’টির সম্মিলিত ধাক্কায় মান্না এক পা পিছিয়ে গেল।
”প্রভাত সংবাদ।”
”আমি আনন্দবাজার রাখি…এখানে কিছু রিপোর্ট করতে এসেছেন বুঝি?”
”হ্যাঁ…টেস্ট ম্যাচ।”
মান্না হাঁ করে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে বলল, ”টেস্ট ম্যাচ মানে ক্রিকেটের টেস্ট ম্যাচ?…আমি অবশ্য ক্রিকেট খেলার কিছু বুঝি না, ছোটোবেলায়, না ঠিক ছোটোবেলা নয় কলেজে পড়ার সময় একবার একটা টেস্ট ম্যাচ একদিন শুধু দেখেছিলাম জামাইবাবুর টিকিটে। তবে খবরটবর কিছু কিছু রাখি।”
মুখ টিপে মান্না গভীর কোনো রহস্য যেন উন্মোচন করছে, এমনভাবে শেষ বাক্যটি বলল। সরোজ যথাসাধ্য চোখ দুটিকে অবাক করিয়ে তাকাল।
একতলায় ছোটো উঠোনের তিনদিকে ঘর। আর একদিকে উপরে যাবার সরু সিঁড়ি। তিনতলায় ভিতরের বারান্দা ঘুরে কোণের দিকে নম্বর-আঁটা একটা দরজা। এগারো নম্বর ঘর। প্রৌঢ়-বেয়ারা চাবি দিয়ে দরজা খুলে মান্নার সুটকেস ভিতরে এনে রাখল।
সরু খাট, আয়না লাগানো পালিশ চটা ড্রেসিং-টেবল, চেয়ার, স্টিলের আলমারি যার হাতলে মরচে, প্লাস্টিকের জলের জাগ ও কাচের গ্লাস, সবই একটি করে। খাট ও ড্রেসিং-টেবলের মধ্যে চার হাত মাত্র খালি জায়গা। সরোজ আন্দাজ করল, ওখানেই বাড়তি খাট পড়বে। নিশ্চয় ফোল্ডিং লোহার খাট।
”এ যে অন্ধকূপ, জানলা কই?”
মান্না প্রায় আর্তনাদ করে উঠল।
”এই তো জানলা।”
বেয়ারা দেয়ালে ঝোলানো সবুজ একটা ফুলছাপ দেওয়া কাপড়ের টুকরো সরিয়ে জানালাটা খুলে দিল। দেখা গেল ভিতরের বারান্দা আর দুটো ঘরের দরজা বারান্দার কোণে বসানো কোমর সমান উঁচু জলের ড্রাম।
”ব্যস এই একটা জানলা তা-ও বাইরের দিকে নয়, ভেতরদিকে।” হতাশ মান্না দুটো তালু বেয়ারার দিকে বাড়িয়ে পেতে রইল। বেয়ারার মুখে কোনো বিকার নেই, নিস্পৃহ স্বরে বলল, ”কিছু কি খাবেন?”
”হ্যাঁ হ্যাঁ, দাদার খিদে পেয়েছে, কী মিলবে?” মান্না ব্যস্ত হয়ে উঠল।
বেয়ারা খাদ্য তালিকা মুখস্থ বলে গেল। মান্না জিজ্ঞাসু চোখে সরোজের দিকে তাকাল।
”চার বাটার টোস্ট, দুটো ডবল ডিমের অমলেট আর এক কাপ চা। দুজনের এতে হবে তো?” সরোজের শেষের কথাটি মান্নার জন্য।
”নিশ্চয় নিশ্চয়। তবে চারটের বদলে আটটা টোস্ট করুন, সকালে আবার আমি একটু বেশি…আর জ্যাম জেলিটেলি দেবে তো?”
বেয়ারা মাথা হেলাল। সরোজ ঘরসংলগ্ন স্নানের ঘরের দরজা খুলে উঁকি দিল। প্রায় অন্ধকার এবং ভ্যাপসা দুর্গন্ধ। বেয়ারা সুইচ টিপে আলো জ্বালিয়ে দিল। ছোটো একটা ঘষাকাচের বন্ধ জানলা যেটা হাত তুলে খুলতে হবে। মোজাইকের দেয়াল ও মেঝে। গিজার ও ঝারিসহ জলের কল, প্লাস্টিকের বালতি ও মগ, দেয়ালে কাপড় রাখার রড ও আয়না, বেসিনে মাকড়সার জালের মতো ফাটা দাগ আর হলুদ ছোপধরা একটি কমোড যাতে বসার জন্য গোলকাঠটি নেই।
সরোজ গিজারের চেহারা দেখেই বুঝল ওটি অচল তবু ঝারির কল খুলে জল না পড়ায় সে বেয়ারার দিকে জিজ্ঞাসু চোখে তাকাল।
”ইলেকট্রিক তার খারাপ আছে তাই বন্ধ। বাইরে ড্রামে গরম জল পাবেন, বেয়ারাকে বললে বালতি করে এনে দেবে।”
এবার সে সিস্টার্নের হাতল মোচড়াল। জল বেরোল না। বেয়ারা এগিয়ে এসে হাতলটা দুবার জোরে জোরে ঝাঁকুনি দিয়ে মোচড়াল এবং হেঁচকি তুলে বমি করার মতো কিছু জল ওগরাল।
”এইটুকু জল!”
মান্না বিভ্রান্ত চোখে দুজনের দিকে তাকিয়ে থাকল। সরোজ কোনো মন্তব্য করল না। ভারতের বহু জায়গায় নানা ধরনের হোটেল-বাসের অভিজ্ঞতা থেকে সে জানে, অভিযোগ করে কোনো ফল হয় না। বিনীতকণ্ঠে ‘করে দিচ্ছি’, ‘বলে দিচ্ছি’, ‘এনে দিচ্ছি’ শোনা যাবে কিন্তু করা, বলা বা আনা আর হয়ে ওঠে না।
”ট্যাপ ওয়াটার তো আছে।” সরোজ কলের মাথা ঘোরাতেই তোড়ে জল বেরোল।
”এই দিয়েই কাজ চালাতে হবে আর এটা খাবার জলও।”
”কেন বাইরে থেকে আলাদা খাবার জল এনে দেবে না?”
”একই ট্যাঙ্ক থেকে তো সব কলেই জল আসছে। বাইরে থেকে যা এনে দেবে সেটা এই জলই।”
মান্না হতাশ হয়ে মাথা নাড়ল।
”দুটো তোয়ালে আর দুটো সাবান দিয়ে যাও আর খাট পেতে দিতে বলো। ব্রেকফাস্ট দিতে কতক্ষণ লাগবে?”
”দশ-পনেরো মিনিটে হয়ে যাবে।”
”এ-ঘরের বেয়ারাকে পাঠিয়ে দাও। গরম জল চাই, কলিং বেল কোনটে?”
সরোজ নিজেই সুইচ বোর্ডের কাছে গিয়ে কলিং বেল ছাপ দেওয়া সুইচটা টিপল। বাইরে বারান্দার কোথাও ‘বঁ অ্যাঁ অ্যাঁ অ্যাঁ’ শব্দ হল।
”যাক এটা তাহলে কাজ করে।”
লোকটি ঘর ছাড়তে ইতস্তত করছে। সুটকেসটা বয়ে আনার জন্য বকশিশের প্রত্যাশী। সরোজ তাকে একটা টাকা দিল। খুশি হয়নি, সেলাম দিল না। বয়ে গেল, সরোজ মনে মনে বলল, যেমন হোটেল তেমনই তো বকশিশ হবে।
”বিশ্বাসদা এ কেমন জায়গায় এলুম।”
”এর থেকে ভালো আর কী আশা করেন? ভারতের সব জায়গায়ই এই রেটের হোটেলে এইরকম ঘরই পাবেন।”
তিক্ত স্বরে সরোজ কথাগুলো বলে গ্রিপের চেনটা রাগী মেজাজে একটানে খুলে ফেলল। একে একে ভিতর থেকে জিনিসগুলো বার করে খাটে রাখতে রাখতে আক্ষেপভরে বলল, ”কার মুখ দেখে যে কাল বেরিয়েছিলাম!”
”কিছু বললেন?”
”না বাথরুমে যাবেন তো যান, আমার কিন্তু সময় লাগে।”
”না না আপনি আগে যান। আমি শুধু দাঁত মেজে, দাড়ি কামিয়ে নেব। দশটায় অফিসের লোক আসার কথা তার সঙ্গে বেরোব। ফিরে এসে বাথরুমে ঢুকব।”
”চান করবেন না?”
”ওই তখনই সারব…শীতটা কিন্তু খুব একটা লাগছে না, বোধহয় রাতে পড়বে। আপনি কখন বেরোবেন?”
”দুপুরে। আশ্চর্য! দেখুন দুজনেই কলকাতা থেকে চিঠি নিয়ে আসছি, আপনি ঘর পেলেন অথচ আমি পেলাম না। কতদিন আগে বুক করেছিলেন?”
”আমি তো করিনি। আমাদের এখানকার অফিস বুক করে রেখেছে, হোটেলের সঙ্গে এরিয়া ম্যানেজারের চেনাশোনা আছে।”
”তাই বলুন, ঘর পেতে গেলেও ব্যাকিং দরকার হয়। দাঁত মেজে নিন, ব্রেকফাস্ট এসে পড়বে।”
দুই
উনিশটা বছর নিমেষে পিছিয়ে যাওয়া খুব সহজ ব্যাপার নয়। যে-পথ ধরে পিছিয়ে যাবে, সেই পথে প্রচুর আবর্জনা, খানাখন্দ। সেগুলো ডিঙিয়ে আরও চার বছর পিছিয়ে গেলে বীণার সঙ্গে প্রথম আলাপের দিনটায় পৌঁছনো যাবে। অন্যসময় এটা ক্লান্তিকর একটা কাজ কিন্তু এখন তা নয়। বীণা তার জীবনে একমাত্র সুগন্ধী ফুল আর দগদগে ক্ষত।
স্নান সেরে সরোজ বিছানায় চিত হয়ে মাথার পিছনে দু’হাত রেখে চোখ বুজিয়ে নিজেকে প্রায় সিকি-শতাব্দী পিছনে ঠেলে নিয়ে যাবার চেষ্টা করছে।
অফিসের লোকটি ঠিক দশটায়ই এসেছিল, তার সঙ্গে মান্না বেরিয়ে গেছে। কখন ফিরবে ঠিক নেই। বাইরেই সে খেয়ে নেবে। সরোজও তাই ঠিক করেছে। মল রোডে একটা চিনে খাবারের দোকান গতবার পেয়েছিল, কলকাতার রান্নারই মতো। সেখানেই খেয়ে নেবে। হোটেলের তেল ঝালমশলায় চোবানো স্বাদু খাদের থেকে চিনা খাবার নিরাপদ। একটা টেস্ট ম্যাচ মানে আট-ন’দিন থাকা। শরীরের যাবতীয় নিরাপত্তার দিকে কঠিন নজর দিতে হয়। কলকাতার বাইরে প্রথম বেরিয়েছিল দিল্লিতে ডেভিস কাপের খেলা রিপোর্ট করতে। উঠেছিল কনট প্লেসের একটা হোটেলে। দ্বিতীয় দিন সকাল থেকেই বুঝতে পারে, কী মারাত্মক ভুলই না করেছে সে। গত রাত্রে হোটেলের রেস্টুরেন্টে বসে প্রবল আগ্রহে অচেনা দহি-মাটন আর পনির-পালংয়ের সঙ্গে পাকস্থলীর পরিচয় করিয়ে দিয়ে পরস্পরের প্রতি তীব্র বিদ্বেষে নিশ্চয় সারারাত ধরে ওরা ঝগড়া করে গেছে। তারই ফলে দেহের সঙ্গে সম্পর্ক ত্যাগের জন্য খাদ্যবস্তুগুলির তাড়না সরোজকে বিছানায় শুইয়ে দেয়। সেদিনই প্রধানমন্ত্রীর সফদরজং রোডের আবাসে ছিল খেলার সূচি তৈরির লটারি। সরোজ সারাদিন বিছানায়, রিপোর্ট পাঠাতে পারেনি। পরদিন দিল্লি অফিসে তার জন্য কলকাতা থেকে বার্তা সম্পাদকের টেলেক্স আসে :
”যদি মনে করে থাকেন খেলার সূচি নির্ধারণের জন্য প্রধানমন্ত্রীর অনুষ্ঠানটি রিপোর্ট করার মতো ব্যাপার নয় তাহলে পরের ট্রেনে কলকাতায় ফিরে আসতে পারেন।” টেলেক্সটা হাতে নিয়েই সরোজ দেখেছিল কলকাতা থেকে বিমানে আসা সেদিনের প্রভাত সংবাদের প্রথম পাতায় ডাবল কলাম শিরোনাম : ‘কৃষ্ণনগর আশা প্রেমজিত প্রথম ম্যাচ জিতবে।’ নীচে বারো পয়েন্টে-সরোজ বিশ্বাস। এজেন্সির পাঠানো খবর থেকে ডেস্কে কেউ তৈরি করেছে, তার নাম দিয়ে ছাপা হয়েছে। বরফের চাঙড়ের উপর খালি পায়ে দাঁড়িয়ে থাকার মতো অনুভূতিতে তখন তার সর্বাঙ্গ যেরকম অসাড় হয়ে গেছল অনেকটা সেই জিনিসই গত সন্ধ্যায় রাজধানী এক্সপ্রেসে সে পেয়েছিল যখন মেয়েটি তার চেয়ারের পাশে দাঁড়িয়ে একটু ঝুঁকে বলল, ”মা আপনাকে ডাকছেন।”
সরোজ প্রথমে না-শোনার ভান করে পাশের ছেলেটির কাছ থেকে চেয়ে নেওয়া ম্যাগাজিনটিতে আরও মনোনিবেশ করল মাথাটা ঝুঁকিয়ে দিয়ে। এই সময় মুহূর্তের জন্য তার মনে ভেসে ওঠে ওষুধের দোকানে অঙ্কের মাস্টারমশায়কে দেখে তার ঘুরে দাঁড়ানোটা। পাছে কথা বলতে হয়। সেই দুর্বলতা, সেজন্য সে বরাবরই পিছনের সারির, ভিড়ের মধ্যে গা-ঢাকা দেওয়ার দলে। সরোজের রাগ ধরল নিজের উপর। উদ্ধত আক্রমণাত্মক ভঙ্গিতে মাথাটা ঝাঁকিয়ে মুখ তুলে সে তাকাল।
নেহাতই কিশোরী। মুখটি লম্বাটে। ফিনফিনে কালো মেটাল ফ্রেমের চশমা। লেন্সের পাওয়ার মাইনাস পাঁচের কম তো নয়ই। তবু কৌতূহলে দীর্ঘ হয়ে ওঠা চোখের মণি দুটি দেখতে অসুবিধা হয় না। ওর নীচের ঠোঁট অবাক করায় সরোজকে। বুকের মধ্যে ছ্যাঁত করে উঠল একবার। ছোট্ট এবং পুরু, চিবুকটাও ঝোলানো। আয়নায় বা ছবিতে সরোজ নিজেকে সুযোগ পেলেই খুঁটিয়ে দেখে। নিজের মুখের গড়ন এবং যেগুলোকে তার খুঁত মনে হয়, সবই মুখস্থ রেখেছে। বহুবার মনে হয়েছে তার থুতনিটা আরেকটু চাপা হলে ভালো হয়, কান দুটো খুবই ছোটো, নাকের আর একটু কাছে ভ্রূ দুটোর এগিয়ে আসা দরকার এবং কপালটা ঢিপির মতো উঁচু না হয়ে ঢালু হলে টিকলো নাক ও গালের সঙ্গে মানাত। কিন্তু তার নীচের ঠোঁট ঈষৎ মোটা হওয়াটাকে সে ত্রুটি বলে মনে করে না। মুখের মধ্যে নিয়ে চুষতে চুষতে বীণা বলেছিল, ”বেশ লাগে।”
সরোজের মনে হল এই মেয়েটির নীচের ঠোঁট তারই মতো, চিবুকেও তার আদল আছে। বীণার গায়ের রংই পেয়েছে কিন্তু যথেষ্ট লম্বা, পাঁচ-সাত তো হবেই। আঁটো জিনসটা বোধহয় বিদেশি, ফ্যাকাশে হয়ে আছে দুই ঊরু, হাঁটু ও নিতম্বে। খয়েরি ডোরাকাটা ফুল শার্টটা খুবই কম দামি। মনে হল ব্রেশিয়ার পরেনি। এখন কমবয়সি মেয়েরা সাজসজ্জায় যে হেলাফেলা ভাব দেখায়। তাই মুখে প্রসাধন নেই। উজ্জ্বল চামড়া, পাতলা চুল টান টান হয়ে কপাল কান ঢেকে পিঠে নামানো। তিন-চার সেকেন্ডের মধ্যেই সরোজের ভালো লাগল মেয়েটিকে। এই চেহারার এবং এমনভাবে সাজা মেয়ে ভারতে এখন অন্তত হাজার দশেক, তবু মেয়েটি কী কারণে যেন তাকে আকর্ষণ করল, সজাগ করে তুলল।
”মা আপনাকে ডাকছেন।”
মেয়েটি আবার বাক্যটি পুনরাবৃত্তি করল। স্বরে অধৈর্যতা নেই। মা একজন পুরুষকে ডাকতে পাঠিয়েছে, এটা যেন বেশ মজার ব্যাপার এমন একটা ভাব ট্রেনের দোলানির সঙ্গে সঙ্গে ওর সর্বাঙ্গে ছড়ানো।
সরোজ অন্য সময় অন্য কেউ হলে অবাক হয়ে বলত, অবশ্যি ভ্রূ কুঁচকে, ”কে তোমার মা?… হ্যাঁ হ্যাঁ… ওহ অনেক বছর পর, কোথায় বসেছে?… আশ্চর্য… আচ্ছা আচ্ছা আমি যাচ্ছি, তুমি ওর মেয়ে হও নাকি?” ইত্যাদি।
উঠে দাঁড়িয়ে ম্যাগাজিনটা আসনের উপর রেখে সরোজ পথটা দিয়ে সামনের দিকে এগোল। সে নার্ভাস নয় কিন্তু অনিশ্চিত। কীভাবে কথা বলবে সেটা নির্ভর করছে কীভাবে বীণা শুরু করবে। যেমন ব্যবহার পাবে তেমনই তার আচরণ হবে এটাই তার সিদ্ধান্ত।
”বলো।”
বীণা মাথা নামিয়ে হাতের ঝোলাটার ভিতর কী যেন খুঁজছিল। সরোজ সিঁথিতে সিঁদুর দেখতে না পেয়ে গোলমালে পড়ল। বিধবা! অ-হিন্দু বিয়ে করেছে? নাকি কুমারীই রয়ে গেছে? কুমারী শব্দটা বীণার ক্ষেত্রে যে প্রযোজ্য নয় শুধু সরোজই তা জানে। বীণার কৌমার্য আর বিহারের বোলিং একই দিনে সে নস্যাৎ করেছিল জামসেদপুরে। একটি কিনান স্টেডিয়ামে অন্যটি টাটার গেস্ট হাউসের একটি ঘরে। বরং অবিবাহিতা শব্দটাই টেকনিক্যালি কারেক্ট। কিন্তু মেয়েটি যে ‘মা’ বলল! পালিতা নাকি?
ধীরে সুস্থে বীণা মুখ তুলল। মুখভাবে কোনো আড়ম্বর নেই। এতদিন পর দেখা, সেটা বোঝাবার জন্য কৌতূহল, আড়ষ্টতা, ব্রীড়া, স্বর পরিবর্তন ইত্যাদির মধ্যে না গিয়ে ঝোলার দড়িটা টেনে মুখ বন্ধ করে বলল, ”ব্যস্ত যদি না থাকো তাহলে বলব কিছুক্ষণ বসো।”
বীণা তার পাশে জানলার ধারের একমাত্র খালি চেয়ারটার দিকে আঙুল দিয়ে ইঙ্গিত করে দেখাল। সরোজ পিছনে তাকিয়ে দেখল তার চেয়ারে বসে মেয়েটি পাশের ছেলেটিকে কী জিজ্ঞাসা করছে।
”না ব্যস্ত নই।”
বীণার দিকে পিঠ ফিরিয়ে চেয়ারটায় পৌঁছবার সময় সরোজ সতর্ক হয়েছিল যাতে হাঁটুর সঙ্গে তার স্পর্শ না ঘটে। সে এখন অপরিচিত এক ভদ্রলোক এবং বীণা অবশ্যই অপরিচিতা প্রতিবেশিনী, এভাবেই প্রথমে শুরু হোক।
চেয়ারের পিঠটা পিছনে হেলিয়ে দিল বীণা। সরোজও তাই করবে কি না ভেবে হাতটা আসনের পাশে নিয়ে গিয়েও তুলে নিল। ও যা করবে আমাকে এখনও তাই করতে হবে নাকি! উনিশ-কুড়ি বছর আগে এসব ব্যাপার হত। তখন সে ছিল প্রেমিক।
”হেলিয়ে নাও, তাহলে কথা বলতে সুবিধে হবে।”
সরোজ চেয়ারে পিঠ হেলিয়ে দিয়েও সিধে হয়ে বসে রইল।
”কানপুর যাচ্ছ?”
”হ্যাঁ।” প্রশ্নসূচক ভ্রূ তুলে সে তাকিয়ে রইল।
বীণার ঠোঁটে হাসি জমে উঠল। চেয়ারের দুই হাতলে ওর কনুই, হাতের দশটি আঙুল কোলে জড়াজড়ি করে রাখা অনুত্তেজিত অলসভঙ্গি।
”স্পোর্টস রিপোর্টার এই সময় এই ট্রেনে, এদিকে কানপুরে টেস্ট ম্যাচ…তাই মনে হল।”
”ঠিকই বলেছ।” সরোজের ইচ্ছা হল জিজ্ঞাসা করে, আমি স্পোর্টস রিপোর্টার তা জানলে কী করে? তারপরই মনে হল, নাম দিয়ে কাগজে তার অসংখ্য বার লেখা বেরিয়েছে, বীণা নিশ্চয়ই তা দেখে থাকবে।
”জ্যোতিষকে মনে আছে? এখন দিল্লিতে রেলভবনে ডেপুটি সেক্রেটারি র্যাঙ্কে রয়েছে। কথায় কথায় একদিন ও বলেছিল তুমি স্পোর্টস রিপোর্টারি করছ বাংলা কাগজে, কী নাম কাগজের?”
”প্রভাত সংবাদ।”
”ওহ, বেশ বড়োই কাগজ তো, বাবা পড়তেন।”
”তুমি দিল্লিতে থাকো নাকি?”
”হ্যাঁ, কিন্তু কলকাতার কাগজটাগজ আর পড়া হয় না। বাড়িতে টাইমস আর স্টেটসম্যান দুটো রাখা হয়।”
”দুটো!”
”কর্তার জন্য।”
বীণা ডান পায়ের ওপর বাঁ পা তুলল। নখে গাঢ় খয়েরি রং। সরোজ নিশ্চিত হল দুটির উত্তর পেয়ে। বিধবা নয় এবং বিবাহিতা। কিন্তু সিঁদুর নেই কেন! কৌতূহল দেখানোটা কি ঠিক হবে?
”জ্যোতিষ বলল তোমার লেখা একটু রোমান্টিক, সাহিত্য ঘেঁষা, তাই খুব পপুলার।”
”ওর সঙ্গে দেখা হয়?”
জ্যোতিষের বেকবাগানের বাড়িতে সে আর বীণা বহুবার গেছে। জ্যোতিষের বোন নমিতা আর বীণা কলেজে একই ক্লাসে পড়ত।
”মাঝে মাঝে আসে বউ নিয়ে, দিল্লিতেই বিয়ে করেছে, পাঞ্জাবি মেয়ে। নমিতা এখন জার্মানিতে, ডিভোর্সের পর আর বিয়ে করেনি।”
”তুমি আমাকে দেখলে কখন? ঠিক চিনতে পেরেছ তো!”
বীণা হাসল। উত্তরটা সোজা না দিয়ে বলল, ”আমাকেও তো তুমি দেখতে পেয়েছিলে।”
ভান করে বা মিথ্যে বলে আর লাভ নেই। সরোজ সহজ হবার চেষ্টায় একগাল হেসে বলল, ”কখন দেখতে পেয়েছি বলে তোমার মনে হল?”
”ট্রেন ছাড়ার আগে, আমি ওই গাধাটার সঙ্গে যখন তর্ক করছিলাম।”
”তাহলে আমি খুব একটা বদলাইনি।”
”ভুঁড়ি হয়েছে, চুল পাতলা আর পেকেছেও, এ ছাড়া প্রায় একই রকম, চিনতে অসুবিধা হয় না।”
”আরও আছে, গলায় থাক পড়েছে, হাতদুটোও চর্বিতে গোল হয়ে গেছে আর লুকোনো একটা ছোট্ট টাকও মাথায় ঘাপটি দিয়ে আছে।”
”এবার তোমার পালা, বলো কী কী বদল আমার হয়েছে।”
”একতিলও বদলাওনি।”
”বাজে কথা রাখো, ফ্ল্যাটারি করে কোনো লাভ হবে না।”
সরোজ সামান্য অপ্রতিভ বোধ করলেও তা বুঝতে দিল না। হাসিটা ধরে রাখল। ফ্ল্যাটারি করে লাভবান হবার মতো সম্পর্ক আর তাদের মধ্যে নেই। কিছু একটা বলে তো কথাবার্তা চালিয়ে যেতে হবে, তাই বলা নয়তো বীণার বাহ্যিক বদল অবশ্যই ঘটেছে। চল্লিশের কাছে পৌঁছে ভারতের ক’টা মেয়েই বা শরীরে কুড়ির পর্যায়ের বিভ্রম জাগিয়ে রাখতে পারে?
”মনে হচ্ছে কিছু বলবে, নাকি আমিই বলে দেব।”
”আমি বলেছি একতিলও বদলাওনি। আয়না থাকলে ধরে দেখাতাম, তিলটা সত্যি একই জায়গায় একই সাইজে একই রঙের আজও, কিচ্ছুই বদলায়নি।”
বীণা তার চোখের দিকে সোজা তাকাল এবং কয়েক সেকেন্ড দুজনে চাহনি আবদ্ধ রেখে পরস্পরকে বোঝার চেষ্টা করল। কিন্তু কীই বা আর বোঝার আছে? সরোজ মনে মনে হিসেব কষল, আমাদের মধ্যে তো কোনো প্রয়োজনই আর নেই, না দেহের না মনের। এতকাল দেখা হয়নি কিন্তু দিব্যিই তো আমাদের দিন কেটে গেছে, এভাবে বাকি জীবনটাও কেটে যেত। কয়েক ঘণ্টার জন্য বহু লোকের সঙ্গে আলাপ হয়, এটাও তেমনি। কিছু কৌতূহল তৈরি হওয়া, মিটিয়ে নেওয়া। তবে পার্থক্য এই যে আমরা পরস্পরের জীবনের চারটে বছরের কিছু কিছু খবর জানি। এখন যা-কিছু কথা তা সব ওই চার বছরের চোঁয়া ঢেকুর। ওকে খুশি মনে হচ্ছে, তাহলেই ভালো।
”ভীষণ মোটা হয়ে গেছলাম। গত চার বছর ভিগারাসলি এক্সারসাইজ, জগ আর ডায়াট কন্ট্রোল করে একান্ন কেজি-তে এসেছি। এখন আমার ওয়েস্ট লাইন থার্টি টু।”
”নিশ্বাস বন্ধ করে ভেতরে টেনে ধরে?”
”মোটেই না মোটেই না, নর্ম্যাল ব্রিদিংয়েই থার্টি টু। এখন বসে আছি তাই বোঝা যাবে না।”
কোমরের একরাশ কাপড় থেকে চোখ তুলে সরোজ দেখল বীণার চোখে রীতিমতো উদ্বিগ্নতা। চার বছরে কষ্ট করে পাওয়া কৃতিত্ব কেউ নস্যাৎ করে দিক এটা যেন ও চায় না।
”একটা না হয় কমিয়েছ, আর দুটো?”
”কীসের আর দুটো?”
”ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকসের।”
বীণা কয়েক সেকেন্ড সময় নিল হৃদয়ঙ্গম করতে তারপরই ডান তালুটা আলতোভাবে সামনে ছুড়ে শব্দ করল, ”অ হ হ হ…তোমার স্বভাব আজও বদলায়নি।”
সরোজ চকিত হল। কথাবার্তা পুরনো দিনে না ফিরে যায়! তাহলে কোণঠাসা হয়ে পড়বে সে। বীণা বিশ্বাস করত তাদের বিয়ে হবে, সেই বিশ্বাসেই জামসেদপুরে…।
কথা ঘোরাবার জন্য সে বলল, ”তুমি দিল্লিতে থাকো?”
”হ্যাঁ। কানপুরের পর তো খেলা দিল্লিতে, এসো না আমার বাড়িতে। গ্রেটার কৈলাসে থাকি।”
”আমি চিনি না, চিনে যেতেও পারব না।”
”কোথায় উঠবে ঠিকানাটা দিয়ো, গিয়ে নিয়ে আসব, হয় আমি কিংবা রোজা…”
”রোজা কে?”
”আমার মেয়ে, তোমায় যে ডেকে আনল।”
শিরদাঁড়া সোজা করে গলাটা একটু উঁচিয়ে বীণা মাথা ঘুরিয়ে পিছনে তাকাল। সরোজও তাই করল। মেয়েটি ঝুঁকে কথা বলছে আর পাশের ছেলেটি মাথা কাত করে শুনছে।
”যেজন্য ডাকা,” বীণা গুছিয়ে বসে গলাটাকে গম্ভীর করে বলল, ”রোজা একটা প্রচণ্ড ক্রিকেটপাগল। গত সাত-আট বছরে দিল্লিতে খেলে গেছে এমন কোনও নামী ক্রিকেটার নেই যে ওর অটোগ্রাফ বুক-এ সই দেয়নি। জ্যোতিষ যখন তোমার কথা বলছিল ও তো তখন লাফিয়ে উঠল, একজন স্পোর্টস রিপোর্টারকে আমি চিনি অথচ ওকে এতকাল সেটা বলিনি, এই নিয়ে তো আমাকে খুব এক হাত নিল। নতুন নতুন কারা যেন এখন খুব নাম করেছে বিশেষত একটি বাঙালি ছেলে…”
”ভি. এস. ঘোষাল, ভবানীশঙ্কর ঘোষাল…ভুবু বলেই সবাই ডাকে।”
”রোজা তো পাঁচটা দিন কলেজ কামাই করে সারাক্ষণই রেডিয়োয় কান লাগিয়ে বসেছিল মাদ্রাজে আগের খেলাটার সময়। ডেবুতেই ডাবল সেঞ্চুরি ওর আগে ভারতের কেউ নাকি করেনি?”
”না, এই প্রথম…দারুণ খেলেছে। আমি অবশ্য মাদ্রাজ যাইনি তবে যা শুনেছি মনে হল জিনিয়াস। বাঙালিরা তো খুব বেশি টেস্ট খেলেনি, বহুকাল বাদে পঙ্কজ রায়ের পর একজনকে পাওয়া গেল। ভারতেও ভবানীর মতো এতবড়ো ব্যাটসম্যান কমই হয়েছে। প্রথম টেস্টেই দু’শো এক নট আউট!”
”কলকাতার ছেলে, তোমার সঙ্গে নিশ্চয় আলাপ আছে।”
”হুঁ।” সরোজ দ্বিধা না করেই বলল। আলাপ বলতে যা বোঝায় তা একদমই নেই। বস্তুত ভবানীশঙ্করকে সে প্রায় চেনেই না, এখনও পর্যন্ত কোনও বড়ো ম্যাচে ওকে ব্যাট করতেও দেখেনি। গত বছর রঞ্জি ট্রফিতে প্রথম খেলতে নেমে চারটে সেঞ্চুরি করেছে, সব বাংলার বাইরের মাঠে। তার একটা দিল্লির, একটা কর্ণাটকের বোলিং থেকে। সরোজ তা দেখেনি। বোম্বাইয়ে ইরানি ট্রফিতেও সেঞ্চুরি করে, পুনেতে কোচিং কাম সিলেকশন ক্যাম্পেও বড়ো রান করেছে কিন্তু সরোজ তা-ও দেখেনি। কলকাতার ময়দানে লিগ বা নক আউটের খেলা সে দেখতে যায় না যেহেতু রবিবার তার ছুটির দিন। তা ছাড়া গন্ডা গন্ডা একদিনের ম্যাচের ফলটুকু ছাড়া আর কিছু তার কাগজে ছাপা হয় না। মাঠ থেকে ফলসংগ্রহ করে আনার কাজটা করে জুনিয়র রিপোর্টাররা। ভবানী গত বছর দশ-এগারোটা সেঞ্চুরি করেছে, বছরের সেরা ব্যাটসম্যান হয়েছে, এই পর্যন্তই সে জানে। তবে সি এ বি অফিসে, সেক্রেটারির ঘরে একবার সে ভবানীশঙ্করকে দেখেছিল। হিলহিলে শরীর, রোগাই বলা যায়। অসম্ভব ফরসা, প্রায় ছ’ফুট, চওড়া কবজি, পাতাকাটা চুল ঝকঝকে চোখের মণি, বোতামখোলা শার্টের ফাঁক দিয়ে বুকের চুল দেখা যাচ্ছে, থুতনিটা চাপা, ঈষৎ মোটা নাক এবং পাতলা ভ্রূদুটি জোড়া। সব মিলিয়ে আকর্ষণীয়।
”টিকিটটা তাহলে কাল দুপুরে কার্তিকদার কাছ থেকেই নোব, পরশু ফ্লাইট ক’টায়?”
সরোজ এত ভরাট কণ্ঠস্বর আগে কখনও শোনেনি। সে বাধ্য হয়েছিল ওর মুখের দিকে তাকাতে।
”মর্নিং ফ্লাইট, ঠিক ক’টায় সেটা জেনে নিয়ো।”
সরোজের সঙ্গে চোখাচোখি হতে ভবানীশঙ্কর হেসে মাথাটা ঝোঁকাল এবং বেরিয়ে গেল।
”বোম্বে যাচ্ছে ইরানি ট্রফির জন্য?”
সরোজ জিজ্ঞাসা করেছিল সেক্রেটারিকে।
”হ্যাঁ। যদি ভালো রান পায় তাহলে টেস্টে এসে যাবে। টেকনিকটা ভালো, ফুটওয়ার্ক আছে, সব থেকে বড়ো কথা যেটা…টেম্পারামেন্ট, তা-ও দারুণ।”
ভবানীশঙ্কর আগে কখনও যা করেনি, ইনিংস ওপেন করে অষ্টআশি রান করেছিল আড়াই ঘণ্টায়।
”রোজাও তাই বলল, কলকাতার ছেলে যখন নিশ্চয় কলকাতার রিপোর্টারের সঙ্গে আলাপ আছে। আঙ্কলকে ধরব ভালো করে আলাপ করিয়ে দেবার জন্য। ওর খুব ইচ্ছে বড়ো কোনো প্লেয়ারকে বাড়িতে আনার। ওই বন্ধুবান্ধবদের দেখানো আর কী, বোঝই তো।”
মেয়ের আবদারকে প্রশ্রয় দিয়ে বীণা হাসছে। মুহূর্তে সরোজ প্রায় সিকি শতাব্দী পিছিয়ে বীণাকে দেখতে পেল। তখন সে তার জীবনের দ্বিতীয় রঞ্জি ম্যাচে আসামের দ্বিতীয় ইনিংসে এক ওভারে চারজনকে সুবীরের বলে স্টাম্প করে খবরের কাগজে ছবি আর কয়েকটা লাইন পেয়েছে। একদিন ক্লাবের খেলায় লাঞ্চের পর তাঁবুর বাইরে বেঞ্চে বসে সে দাঁত খুঁটছিল তখন সুবীর দুটি মেয়েকে সঙ্গে করে তার কাছে আসে। পরিচয় দেয়- বোন সুজাতা আর বোনের বন্ধু বীণা সেনগুপ্ত, দুজনেই আই এ সেকেন্ড ইয়ার, ওদের হাতে বই খাতা। সুবীরের বাড়িতে সে কয়েকবার গেছে। অনেকগুলি বোন, এই বোনটিকে সে দেখেছে কি না মনে করতে পারল না। বীণা একটা খাতা খুলে তার দিকে এগিয়ে ধরতেই সে হতবাক হয়ে গিয়েছিল। সই অর্থাৎ অটোগ্রাফ! কেউ তার কাছে এই জিনিসটি কখনও চায়নি, কোনো মেয়ে যে চাইবে সেটা কল্পনা করার মতো সাহসও জোগাড় করা তার পক্ষে সম্ভব ছিল না। ক্লাবের অনেকেই তখন না-দেখার ভান করে লক্ষ করছিল। পঞ্চাশের দশকের গোড়ার দিকে রঞ্জি ট্রফি ক্রিকেটারের সই নেওয়ার জন্য ময়দানে ক্লাব তাঁবুতে দুটি মেয়ের আসা রীতিমতো ঘটনা। সে বিব্রত হয়ে বলেছিল, ”সই!…কী করলাম আমি যে… সুবীরের হাত দিয়ে পাঠিয়ে দিলেই তো হত, কষ্ট করে আবার এখানে আসার…!” সুবীরই জবাব দিয়েছিল, ”তোকে দেখার জন্য এসেছে। কীরকম কিপ করিস স্বচক্ষে দেখবে বলেই…কিন্তু বীণা তোমরা দেরি করে এসেছ। আমাদের ফিল্ডিং তো হয়ে গেছে তবে সরোজের ব্যাটটা দেখতে পাবে।” বীণা সপ্রতিভভাবে বলেছিল, ”তাই দেখব, শুনেছি উনি নাকি খুব পিটিয়ে খেলেন।” সরোজ মনে মনে যতটা বিগলিত হয়েছিল ততটা কৌতূহলীও। মেয়েটি পেশাদার সই-শিকারি নয়, তাহলে বাঁধানো অটোগ্রাফ বুক সঙ্গে থাকত। তাকে দেখবে বলে এসেছে, এটাই যেন কেমন কেমন ঠেকছে!
”তার জন্য এতদূর আসা! বললেই পারতিস বাড়িতে গিয়ে দেখা দিয়ে আসতাম।” সরোজ মিটমিট হেসে বলেছিল।
”বাড়িতে নয়, বাড়িতে নয়, কলেজে একদিন আসুন তাহলে খুব ভালো হয়।”
সুজাতা ব্যগ্র হয়ে বলেছিল, ”আমরা স্কটিশে পড়ি।” সরোজের কৌতূহল বেড়ে গেছল সুবীরের মুখটেপা হাসিতে।
”একবার ঘুরে আয় না ওদের কলেজ থেকে।”
কিছু একটা ব্যাপার আছে, পরে জেনে নেবে। সরোজ খাতার পাতার এককোণে ছোটো অক্ষরে ইংরেজিতে সই করে দিয়েছিল।
”বা-রে, কাকে সই দিলেন সেটা তো লিখলেন না, আর শুধু সই কেন দু-চারটে কথাও তো লিখে দেবেন।”
সুজাতা বলেছিল। ”কী লিখতে হবে?” সরোজ জানতে চায়।
”চেনা পরিচিতদের জন্য যা লিখে দেয়, এসব কি বলে দিতে হয় নাকি?”
সুজাতাকে কিঞ্চিৎ মুখফোঁড় বলে তার মনে হল। দু-চার কথা কী লিখবে সেটা ভাবতে ভাবতে সে বীণার মুখের দিকে তাকিয়েছিল। হঠাৎ-ই তার মনে হল মেয়েটিকে বেশ দেখতে। সপ্রতিভ, বুদ্ধিদীপ্ত মুখ আর দেহগড়নও উদ্দীপক। সে ইংরেজিতে লিখল: ”বীণা সেনগুপ্তকে-তোমার বহু অনুরাগীর মধ্যে যে নিকৃষ্টতম ও অযোগ্য, সরোজ বিশ্বাস।” খাতাটা বন্ধ করে বীণার হাতে দিয়েই সে তাঁবুর মধ্যে চলে যায় প্যাড পরার জন্য। সেদিন পঁয়তাল্লিশ মিনিটে সে একশো এগারো করে তাতে ছিল ন’টা ওভার বাউন্ডারি!
”প্লেয়ারদের বিশেষত ক্রিকেটারদের জন্য মেয়েরা যে কেন এত উতলা হয় আজও বুঝি না। সিরিজের পর সিরিজ তো শুধুই হারে তবু এদের জন্য…”
সরোজ থেমে গেল। আর বেশি বলা ঠিক হবে না। বীণা তার মেয়ের জন্য টেস্ট ক্রিকেটার ধরে দিতে অনুরোধ করছে এবং এত বছর পর প্রথম সাক্ষাতে কিনা এটাই প্রাধান্য নিল! ব্যাপারটা কীরকম যেন হাস্যকর ঠেকছে। তাদের এত নিবিড় সম্পর্কটার কোনো রেশই যেন আর নেই। মানুষ সময়ের সঙ্গে বদলায় ঠিকই, কিন্তু সম্পূর্ণ ভুলে যাওয়া কি সম্ভব!
”তোমার স্বামী কী করেন? বাড়ি কি নিজেদের?”
”হ্যাঁ নিজেদের। মিস্টার রাও এখন একটা ইলেকট্রিকাল বিজনেস গ্রুপের এরিয়া সেলস কন্ট্রোলার, এখন দিল্লিতে নেই একটা প্রোজেক্টের কাজে জয়পুর গেছেন।”
”রাও মানে তেলুগু?”
”না না না, তেলুগু নয় মারাঠি, এই ভুলটা সবাই করে।”
বীণা অনেকক্ষণ ধরে হাসল, তার সঙ্গে সরোজও।
”আমার কি দোষ বলো, রাও যে দুজাতেই আছে… একবার এমন ভুল হয়েছিল নায়ার নিয়ে। কেরলেও নায়ার আছে আবার পাঞ্জাবেও আছে, একই বানান। জানতাম না পাঞ্জাবের উচ্চচারণ নাইয়ার।”
দুজনের মধ্যে পোশাকি ব্যবধানটা অনেক কমে এসেছে। সরোজ ঠিক করল বীণার বর্তমান জীবনের খবর নিতে আর একটু এগোনো যেতে পারে।
”মারাঠিদের বউয়েরা কি সিঁদুর পরে না?”
বীণার ভ্রূ কুঁচকে উঠল। সোজা জবাব দিল না।
”এসবও তুমি লক্ষ করো নাকি!”
চাপা ভর্ৎসনাটা ধরে ফেলে সরোজ প্রসঙ্গান্তরে যাবার চেষ্টা করল।
”দিল্লিতে বাড়ি করেছ মানে ওখানেই সেটল করবে বা করেছ?”
”হ্যাঁ। আমরা নিজেদের দেশে আর ফিরব না। ফিরে লাভই বা কী, রোজাই আমাদের সব, ও দিল্লিরই মেয়ে।”
”কলকাতায় কোথায় গেছলে?”
”দু’দিনের জন্য গেছলাম বড়দির বাড়িতে, ঠিক দুটো দিন। ওর সেজোমেয়ের বিয়ে… সম্পর্ক-টম্পর্ক তো আর তেমন নেই, একদমই যাবার ইচ্ছেও ছিল না, উনিই জোর করে পাঠালেন। রোজাকে মামাবাড়ির আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে রাখার খুবই ইচ্ছে ওঁনার, তাই গেলাম। বড়দির অবস্থা দেখলাম ভালোই।”
সরোজ শুনে গেল আগ্রহ দেখিয়ে। এবার তার ব্যক্তিগত খবরাখবর নিতে বীণার প্রশ্ন করার পালা আসছে। অস্বাচ্ছন্দ্য বোধটা শুরু হবার আগেই রোজাকে দেখা গেল বীণার পাশে।
”মা, তোমার কাছে আর বাবলগাম আছে?”
”নেই, কেন কী হবে, এসব জিনিস অত খাও কেন? দিনরাত শুধু মুখনাড়া…”
”আমার জন্য নয়, পাশের ছেলেটিকে…।”
”থাক এখন। শোনো, আঙ্কলকে বললাম তোমার হিরোর সঙ্গে দিল্লিতে খেলার সময় আলাপ করিয়ে দেবার জন্য আর বাড়িতেও একদিন ডিনারে যাতে আসে।”
”রি-য়্যা-ল্লি!”
রোজা দু’হাত মুঠো করে গোড়ালি তুলে শরীর ঝাঁকাল।
”উফফ কী দারুণ যে হবে। ভবানী ঘোষাল আমাদের বাড়িতে আসছে, ভাবাই যায় না!”
রোজার কণ্ঠস্বরে বা ভাবভঙ্গিতে আদিখ্যেতা নেই, অন্য কেউ হলে মনে হত প্রায় ন্যাকামি কিন্তু সরোজ ওর জ্বলজ্বলে চোখে আর শক্ত করা মুঠোয় অপ্রত্যাশিত বিস্ময় ও আনন্দের ধাক্কা ছাড়া কৃত্রিমতার ছিটেফোঁটাও পেল না।
”কিন্তু খেলার সময় প্লেয়াররা কারুর বাড়িতে যাবে কি না, সেটা আগে থেকে এভাবে ধরে নেওয়া ঠিক হবে না।”
”তুমি বললেও আসবে না, তা হতে পারে!”
সরোজ বিরক্ত বোধ করল, মাথাটাও গরম হয়ে উঠছে। টেস্ট ম্যাচ ও টেস্ট ক্রিকেটাররা এখন যে কত জমকালো ব্যাপার বীণাকে তা বোঝানো যাবে না। সাধারণ রঞ্জি ট্রফি ক্রিকেটারদের সঙ্গে মর্যাদায় বা আভিজাত্যে যে কত তফাত ওর কন্যাস্নেহে ভরা মাথার মধ্যে তা ঢোকানো যাবে না।
”আমি কে যে বললেই আসবে?” সরোজের গলায় ঝাঁঝ এসে পড়েছে। সামলে নিয়ে নরম স্বরে বলল, ”কত স্ট্রিক্ট ডিসিপ্লিনের মধ্যে যে ওদের থাকতে হয়। ম্যানেজারের পারমিশন ছাড়া কেউ এক পা-ও বাইরে যেতে পারে না, গেলেও কাঁটায় কাঁটায় ফিরতে হবে। না হলে বোর্ডের কাছে রিপোর্ট যাবে।”
লহমার জন্য ভেবে নিয়ে সরোজ যোগ করল, ”টেস্ট কেরিয়ারই খতম হয়ে যেতে পারে।”
মুখ তুলে বীণা বিপন্ন চোখে মেয়ের দিকে তাকাল। রোজার চোখ নিষ্প্রভ হয়ে এসেছে। মুঠি শিথিল।
”আঙ্কল আপনি বললেও আসবে না?”
সরোজ ওর করুণ মুখ, মুষড়ে যাওয়া কণ্ঠস্বরে কষ্ট পেল। এইরকম অনুরোধ জীবনে কখনও আসেনি। যদি আসত সে মুহূর্তেই নাকচ করে দিত। এখনই সে তাই করত, শুধু এই মেয়েটির জন্য সে সোজাসুজি না বলতে পারছে না। সারল্য ছাড়াও রোজার সারা অবয়বে এমন কিছু একটা ব্যাপার যার টান সে অনুভব করছে।
”আমি চেষ্টা করব, তবে বেশি আশা কোরো না, হ্যাঁ চেষ্টা করব।”
”মা, অটোগ্রাফ বইটা আঙ্কলকে দাও না… আপনি ইন্ডিয়া আর নিউজিল্যান্ড টিমের সইগুলো জোগাড় করে দিতে পারবেন তো?”
সরোজ আবার বিব্রত বোধ করল। এসব কাজ যে কীভাবে করতে হয় তা সে বুঝে উঠতে পারে না। ক্রিকেটারদের সঙ্গে ছুটতে ছুটতে বাচ্চচা ছেলেরা অটোগ্রাফ বইটা বাড়িয়ে দিয়ে কাকুতি-মিনতি করছে এমন একটা ছবি তার চোখে ভেসে উঠল। অসম্ভব। কিছু সাংবাদিককে সে দেখেছে ড্রেসিংরুমে বা হোটেলে গিয়ে বা নেট প্র্যাকটিসের সময় সই জোগাড় করে। তাদের মতো কাউকে কানপুরে পেলে রোজার বইটা গছিয়ে দেওয়া যাবে। আর না পেলে পরিষ্কার বলে দেবে হল না, সময় করে উঠতে পারিনি।
”দাও চেষ্টা করে দেখব।”
রোজা চেয়ারের সারির ভিতরে এসে ঝুঁকে হুকে ঝোলানো চামড়ার থলিটা নামিয়ে ছোট্ট বইটা বার করে সরোজের হাতে দিল।
”দিল্লিতে আমি আপনার কাছ থেকে বইটা নিয়ে নেব।”
”কী করে?”
”আমি তো খেলা দেখতে যাবই।”
”ওর বাবা যে কমপ্লিমেন্টারি টিকিট পায়! বহু টাকার অ্যাড ওদের কোম্পানি স্যুভেনিরে দেয় তো। প্যাভিলিয়ন ব্লকের টিকিট পায়।”
”আপনাকে আমি ঠিক খুঁজে নেব।”
”নিউজিল্যান্ড টিমে দু-তিনজন ছাড়া সই নেবার মতো এমন কে আর আছে?”
সরোজ অটোগ্রাফ বইটার পাতা ওলটাতে ওলটাতে হালকা স্বরে বলল। প্রথম পাতায় এক জনপ্রিয় গজল গায়কের সই, তারিখটা চার মাস আগের। দ্বিতীয় পাতায় কেন্দ্রীয় এক রাষ্ট্রমন্ত্রীর দস্তখত, একই তারিখ। অস্ফুটে বলল, ”বইটা তো প্রায় নতুনই।”
”সই ভরতি চারখানা বাড়িতে পড়ে আছে।”
বীণা সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠল। চোখে উদ্বেগ। ”বাড়িতে এসো দেখাব।”
সরোজ হাসিমুখে রোজার দিকে তাকাল বীণার কথাটা এড়িয়ে গিয়ে।
”ম্যাকগ্রেগরের সই কেনবার মতো নয়? বারোটা সেঞ্চুরি!”
রোজা তার মায়ের চেয়ারের হাতলে বসল। তর্ক করার জন্য তৈরি সে। এই ধরনের আলোচনায় ঢুকতে সরোজের ভালো লাগে না। শুধু সংখ্যা দিয়ে বড়ো-ছোটো মাপ কষা। ম্যাকগ্রেগরকে এখনও সে ব্যাট করতে দেখেনি, রোজাও দেখেনি।
”ক্রিস বয়েড? এখন তো ওয়ার্ল্ডের সেরা অলরাউন্ডারদের একজন! আটাত্তরটা উইকেট, সাতশো আটাশ রান। টোনি পিকার্ড? গত বছর টেন্টব্রিজে একাই তো নিউজিল্যান্ডকে জিতিয়ে দিচ্ছিল, পাঁচ বলে তিন উইকেট! ওর মতো অফস্পিনার এখন ইন্ডিয়ার আছে কি?”
সরোজ হাসিসমেত মুখটা বীণার দিকে ফিরিয়ে বলল, ”রোজা এখন কী পড়ছে?”
”ফার্স্ট ইয়ার আর্টস, ইকনমিক্স অনার্স… লেডি শ্রীরামে পড়ছে। বড্ড তর্ক করে…যে-কোনো সাবজেক্টে। আমার সঙ্গে তেমন জমে না, বাবাকে পেলে শুরু হয়ে যায় দুজনের।”
”পরে তোমার সঙ্গে কথা বলব, তবে ক্রিকেটটা বাদ দিলেই ভালো হয়।”
সলজ্জমুখে রোজা উঠে দাঁড়াল। আবার সরোজের চেয়ারে সে ফিরে যাবার পর বীণা বলল, ”প্লিজ একটু চেষ্টা কোরো, খুব আশা করে আছে।”
”করব। তবে বুঝতেই পারছ, নিশ্চিত করে তো এসব ব্যাপারে…।”
সরোজ বলতে চেয়েছিল, খেলোয়াড়রা যে-ভাষা পড়তে পারে, সেই ভাষার লোককেই সমীহ করে, তাদের অনুরোধ রাখার চেষ্টা করে। ভারতে বাংলা জানা বড়ো বড়ো খেলোয়াড় ফুটবলে ছাড়া আর কোথায়? বাংলা কাগজের লোক বললে বেশিরভাগই তো দেঁতো হাসি দেখিয়ে দেয়। বহুভাষী এই দেশে খেলোয়াড়দের কাছে কদর ইংরেজি কাগজের আর ম্যাগাজিনের, এই ভাষাটাকেই ক্রিকেটাররা খাতির করে, যেহেতু ভারতের সর্বত্র এই ভাষার কাগজ ওরা দেখতে পায়। আমি বাংলা কাগজের লোক, একমাত্র ভবানীই হয়তো আগ্রহ নিয়ে কথা বলবে কিন্তু অনুরোধ রাখাটা অন্য ব্যাপার। শুনেছি ও বেপরোয়া উদ্ধত প্রকৃতির উড়নচণ্ডে, লঘুগুরু জ্ঞানটা কম।
”গায়ে দেবার জন্য তুমি গরম কিছু আনোনি?”
সরোজ লঘুভঙ্গিতে বলল, ”এ-ব্যাপারেও আমি একদম বদলাইনি।”
”সেকী! কী শীত এই ডিসেম্বরে কানপুরে-দিল্লিতে পড়ে তা কি জানো?”
”তিন-চারবার দিল্লিতে, একবার কানপুরে ডিসেম্বরে থেকেছি, শীত লাগেনি।”
”আমার কাছে একটা শাল আছে ওটা রাখো, বেশি বাহাদুরি কোরো না।”
রাত্রে আমিষ না নিরামিষ খাবে জানার জন্য রেস্টুরেন্টের লোক জিজ্ঞাসা করতে করতে এদিকে এগিয়ে আসছে। সরোজ চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়াল। এবার সে নিজের জায়গায় যাবে।
”এখানে বসেই খেয়ে নাও।”
”আমি রেলের খাবার খাই না।”
সরোজ সরু পথটায় বেরিয়ে এল। তাকে দেখে রোজাও উঠে দাঁড়িয়েছে, সরোজ হাত নেড়ে ডাকল।
”এবার নিজের চেয়ারে বোসো, ডিনার সার্ভ করার সময় হয়ে গেছে। ভেজ না নন-ভেজ?”
”আমরা দুজনেই ভেজ।” বীণা বলল।
এরপর সরোজ নিজের চেয়ারে চলে আসে। কালোকোট পিছন থেকে ঘাড়ের কাছে মুখ এনে বলেছিল, ”আমি বলে দিয়েছি আপনি নন-ভেজ খাবেন…বাঙালি তো…ঠিক বলিনি?” সরোজ ”হুঁ” বলে ঘাড় ফিরিয়ে যোগ করে, ”আমি রাতে খাব না, ওটা আপনার জন্য।” পাশের ছেলেটি এক সময় তাকে বলেছিল, ”অনেক খবর রাখে রোজা, ক্রিকেটের পোকা।”
সরোজ এক সময় ঘুমিয়ে পড়েছিল। তার আগে আধো ঘুম অবস্থায় সে যখন হালকাভাবে অচেতনার গভীরে নেমে যাচ্ছিল তখন বীণাকে বলতে শুনছিল, ”সরোজ মনে হচ্ছে আমি প্রেগনান্ট, তুমিই করেছ, জামসেদপুরে। তোমাকে বিয়ে করতে হবে।”
”তাহলে আমাকে বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। জাতের অমিল বাবা মানবেন না, আমাদের ফ্যামিলি যে কী গোঁড়া তা তুমি জানো না। সবকিছু থেকেই বঞ্চিত করবেন। তা ছাড়া আমি চাকরিও করি না… তুমি অ্যাবোর্শন করিয়ে নাও।”
”আমি তো একটা চাকরি করছি… দুজনের তাতে চলে যাবে। তুমি স্টেট ক্রিকেটার, গ্র্যাজুয়েট, যে-কোনো ফার্মেই পেয়ে যাবে এক সময়।”
”আমাদের বংশে বাপ-মায়ের মনোমতো পাত্রীকে ছাড়া বিয়ে করা যায় না। আমি নিরুপায়, একমাত্র ছেলে আমি…”
”সরোজ এইসব মধ্যযুগীয় কথা এ যুগে অচল। আসলে বিন্দুমাত্রও তুমি ভালোবাসনি, ভালোবাসার ক্ষমতাও তোমার নেই। বাপের সুপুত্তুর সেজে পালাবার গর্ত খুঁজছ…বিট্রেয়ার, ভুল করেছি আমি একটা মেরুদণ্ডহীনকে ভালোবেসে। তুমি চিরকাল বুকে হাঁটবে, কোনোদিনই বড়ো হতে পারবে না, কোনোদিনই টেস্ট খেলতে পারবে না।”
তিন
গোঙানির মতো একটা আওয়াজ মুখ থেকে বেরিয়ে আসতেই সরোজ ধড়মড়িয়ে উঠে বসল। হাতঘড়িতে সময় দেখেই সে প্যান্টটা টেনে নিয়ে পা গলাল।
প্রেসপাস আনতে হবে কমলা টাওয়ার থেকে। দরজায় চাবি দিয়ে দু’পা গিয়েই আবার ঘরে ফিরে এল। বীণার শালটা খাটের উপর পড়ে রয়েছে। ভাঁজ করে হ্যান্ড-গ্রিপের মধ্যে রেখে জিপটা টেনে দিয়ে ভাবল তালাটা লাগিয়ে দেবে কি না। হোটেলে ঘর থেকে কোথাও এখনও পর্যন্ত তার কোনো জিনিস চুরি যায়নি। তবু সে ছোট্ট তালাটা লাগাল। জিনিসটা বীণার!
রিসেপশন কাউন্টারে সকালের দাড়িওলা যুবকটিই রয়েছে। চাবিটা তার হাতে দিয়ে সরোজ জানতে চাইল, কোনো ঘর খালি হবার সম্ভাবনা আছে কি না। যুবক মাথা নাড়ল, তবে যদি কেউ ঘর ছাড়ে তাহলে সরোজকে জানাবে, এই আশ্বাসটুকু দিল।
”কমলা টাওয়ার এখান থেকে কতদূর? হেঁটে যাওয়া যাবে?”
”তা যাবে, তবে আপনি রিকশা নিন। নতুন লোক, চিনে বার করতে অসুবিধে হবে।”
আগের বার সরোজকে প্রেসপাস আনতে যেতে হয়নি। তার কাগজের ফোটোগ্রাফার নিরঞ্জন নিজের পাস আনার সময় তারটাও নিয়ে এসেছিল। এবার নিরঞ্জনের বদলে আসছে রামকুমার দাস। মাস দুয়েক হল বিয়ে করেছে। বউকে সঙ্গে আনবে, উঠবে সম্পর্কিত এক শালার বাড়ি। রামকুমারের সঙ্গে সরোজের ভালো আলাপ নেই। ছেলেটি বছরখানেক চাকরি করছে। পোশাকে ফিটফাট। স্যুট এবং টাই পরা অবস্থায়ই সরোজ ওকে বেশিরভাগ দিন দেখেছে। কাঁধে ঝোলানো চামড়ার ক্যামেরা এবং টেলিলেন্সের ব্যাগটা বিদেশি। ছবির পিছনে ওর লেখা ক্যাপশন থেকে সরোজের মনে হয়েছে লেখাপড়া বেশিদূর এগোয়নি তবে ছবি ভালো তোলে। সে শুনেছে রামকুমার উদ্ধত প্রকৃতির, ধরাকে নাকি সরা জ্ঞান করে।
রামকুমারের সঙ্গে মাঠে ছাড়া দেখা হওয়ার সম্ভাবনা কম। বস্তুত টেস্টম্যাচের সময় ফোটোগ্রাফারদের সঙ্গে রিপোর্টারদের যোগাযোগ প্রায় থাকেই না। দুজনের কাজের ধরন এবং বসার জায়গাও আলাদা। ছবি তোলা, স্থানীয় কোনো স্টুডিয়োর সঙ্গে ব্যবস্থা করে ফিল্ম ডেভেলপ করিয়ে রোলটা কাউকে দিয়ে বা নিজে এয়ারপোর্টে বা এয়ারলাইন্স অফিসে গিয়ে কলকাতার প্লেনে রোলের প্যাকেটটাকে ধরিয়ে দেওয়া-এইসব কাজেই ফোটোগ্রাফাররা ব্যস্ত থাকে। প্লেনের সময় অনুযায়ী ওদের কাজের সময়। তবে সাধারণত লাঞ্চের পরের ছবি নেবার আর সময় থাকে না, ফিল্ম ডেভেলপ করার জন্য ছুটতে হয়। দিনের খেলার শেষ দিকে শুধু একবার ওরা রিপোর্টারের কাছে আসে এয়ারলাইন্সের চালান নম্বরটা ম্যাচ রিপোর্টের সঙ্গে কলকাতার অফিসে পাঠিয়ে দেওয়ার জন্য। দমদমে নম্বরটা দিয়ে অফিসের লোক তাড়াতাড়ি প্যাকেটটা হস্তগত করতে পারে।
মল রোড দিয়ে রিকশাটা কিছুটা গিয়েই ডানদিকের একটা রাস্তা ধরল এবং একটু পরেই বাঁদিকে ঘুরে ঢুকল একটা নোংরা গলিতে। দু’ধারে জুতো, স্টেশনারি, মুদি, দর্জি, মিষ্টি আর পানের দোকান। গলিটা এক এক জায়গায় এমনই সরু দুটি মোটর মুখোমুখি হলে ছোটোখাটো সংকট তৈরি হবে। একটা কবিরাজি দাওয়াখানা আর পাঠশালা পেরিয়ে, গর্তে চাকা পড়ার ঝাঁকুনিটা সামলে অবশেষে রিকশাটা থামল কমলা টাওয়ারের ফটকে। কমলাপৎ পদমপৎ সিংঘানিয়া প্রতিষ্ঠিত সারা ভারতে ছড়ানো বিশাল ব্যবসাবাণিজ্যের সদর দফতর কিনা এইরকম এক গলিতে! সরোজ অবাক হয়ে চারপাশে তাকিয়ে রিকশাওলাকে বিদায় দিয়ে ভিতরে ঢুকে বাঁদিকে অনুসন্ধানের জায়গায় খোঁজ নিল। নাম ও আগমন-উদ্দেশ্য জেনে নিয়ে, সামনের ঘরে তাকে অপেক্ষা করতে বলে লোকটি ফোন তুলল।
দশ মিনিট পর পানের পিক-লাঞ্ছিত সিঁড়ির কোনাগুলি এড়িয়ে সরোজ দোতলায় একটি ঘরে ঢুকল। একটি লোকের মুখোমুখি হয়ে টেবলের বিপরীতে তিন-চারজন বসে। সরোজ ঘরে ঢোকার সময় সম্ভবত জোরালো তর্ক চলছিল, তার রেশটুকু সে শুনতে পেল।
”ওরা যদি দুটো পায়, তাহলে আমরাও দুটো পাব। এ-ব্যাপারে কোনো পক্ষপাতিত্ব হলে….।”
সরোজের মনে হল লোকটি স্থানীয় কাগজের। স্যুট-টাই পরা, ঠোঁটের কোণে পানের রস লাগা, ঘোর কৃষ্ণবর্ণ এই লোকটিকে, সরোজের যতদূর মনে পড়ে, গতবার সাংবাদিকদের জন্য বিনামূল্যে দেওয়া বাড়তি একটা লাঞ্চ বাক্স পাবার জন্য কাকুতি-মিনতি করতে দেখেছিল।
”হাই সরোজ।”
‘বম্বে মনিটর’-এর সুদর্শন অভয়ঙ্কর-প্রেসবক্সে ডাকনাম অভয়-হাত তুলে জানান দিল। সরোজও ছোট্ট করে হাত তুলে টেবলের ওধারের লোকটিকে তার আগমন-উদ্দেশ্য বলতে যাচ্ছিল।
”এই নিন আপনার পাস, রেডিই আছে।”
সরোজ তার হাত থেকে সেফটিপিন লাগানো গোলাপি কার্ডটা হাতে নিয়ে, দেখে নিল তার এবং কাগজের নাম লেখা আছে কি না।
”আমাদের ফোটোগ্রাফার কি তার পাস নিয়ে গেছে?”
”আধঘণ্টা আগে এসেছিলেন।”
”থ্যাঙ্ক ইউ।”
সরোজ তাকাল অভয়ের দিকে।
”কখন এসেছ, কোন হোটেলে?”
”আজই, যে হোটেলে তুমিও উঠেছ?”
”আমি ঘর পাইনি, আর একজনের সঙ্গে শেয়ার করে আছি।”
”কানপুরে এই এক সমস্যা, ভালো হোটেল…”
”তুমি মাঠে যাচ্ছ তো।”
সরোজ থামিয়ে দিল অভয়কে। কথা বলতে শুরু করলে, বিশেষত অভিযোগ সংক্রান্ত হলে, আর থামতে চায় না।
”যাব।”
”তাহলে ওখানেই দেখা হবে।”
নরম তীক্ষ্ন রোদ্দুর। হাওয়া না থাকায় অত্যন্ত মোলায়েম লাগছে। গরম জামা পরার দরকারই হয় না। কমলা টাওয়ার থেকে বেরিয়ে সরোজ হেঁটে মল রোডে এল। এবার খেতে হবে। যতদূর মনে পড়ছে ‘ফুটু’ নামের চিনা রেস্টুরেন্টটা কাছাকাছি কোথাও। বড়ো টেলিগ্রাফ অফিসটা ছাড়িয়ে একটু এগোতেই সে ফুটু পেয়ে গেল।
ভিতরটা প্রায়ান্ধকার। জনা চারেক মাত্র লোক। সে ঢুকতেই তারা ফিরে তাকাল।
ডানদিকে দেয়ালের দিকে মুখ করে সবে বসেছে, তখন পিছন থেকে শুনতে পেল কে যেন বলল। ”সরোজদা!”
মুখ ফিরিয়ে দেখল কোণের চেয়ার থেকে উঠে একটি ছেলে তার দিকে আসছে। জিনস, সাদা পোলো গলা গেঞ্জি তাতে বড়ো লাল-সবুজ অক্ষরে ”লাভ মি” লেখা। আলো কম হলেও কোঁকড়ানো চুলগুলো যে ঈষৎ বাদামি তা বোঝা যাচ্ছে। দীর্ঘকায়, প্রায় ছ’ফুট, বলিষ্ঠ বাহু, চওড়া কাঁধ, সরু কোমর। মুখটা লম্বাটে, টিকোলো নাক, দাড়িগোঁফ কামানো এবং গায়ের রং তামার সঙ্গে চুন মেশানো। প্রথম দর্শনেই মনে হবে সাহেব এবং খেলোয়াড়। সরোজ কলকাতায় একে দু-তিনবার দেখেছে, স্টেট অ্যাথলেটিকস মিটে আর সাউথ ক্লাবে। আলাপ নেই। বয়স তেইশ-চব্বিশের মধ্যেই, নাম জানে না, কোন কাগজের তা-ও জানে না।
”সরোজদা কখন এলেন? প্রেসপাস কালেক্ট করেছেন?”
পরিষ্কার কলকাতার টানে বাংলা। সরোজ অবাক হল।
”হ্যাঁ।”
”কলকাতা থেকে আর কেউ নেই, শুধু আমরা দুজন। বসতে পারি?”
”নিশ্চয়। ভালোই হল, একা একা ভালো লাগে না।”
”আমারও।”
বয় মেনু কার্ড সরোজের সামনে রেখে গেল।
”আমার অর্ডার আমি দিয়ে দিয়েছি, শুধু আপনার বলুন।”
সরোজ কার্ডে চোখ বুলিয়ে দেখল সারা ভারতে চিনা রেস্টুরেন্টগুলোতে যা পাওয়া যায় এখানেও তাই। দামও প্রায় এক।
”সুপ, চিকেন অ্যাসপারাগাস আর মিক্সড চাওমিন।”
সরোজ পরিচিত খাদ্যের বাইরে রসনার অভিযানে যেতে রাজি নয়।
”আপনি বোধহয় আমার নাম জানেন না।”
সরোজ অপ্রতিভ হেসে মাথা নাড়ল।
”শঙ্কর সিং গ্রুয়াল। ড্রাইভিং শেখায় যে গ্রুয়াল স্কুল আমি কিন্তু তাদের কেউ নই। নিউজ ডে-র স্পোর্টস ডেস্কে আছি প্রায় দেড় বছর, এই প্রথম বাইরে বেরোলাম।”
”তোমাকে দু-একবার দেখেছি।”
”টেনিসে?”
”হ্যাঁ, সাউথ ক্লাবে আর অ্যাথলেটিকসেও।”
”ও-দুটো আমার খুব ফেভারিট স্পোর্টস। স্পোর্টস এডিটারের কাছে চেয়ে নিয়ে কভার করেছিলাম।”
”ক্রিকেট করেছ?”
”না। ক্রিকেট জানি, স্কুল টিমে খেলেছিও কিন্তু খুব ডেপথে কখনও যাইনি।”
”তাহলে একেবারে টেস্টম্যাচ দিয়েই শুরু করছ।”
”হ্যাঁ।” শঙ্কর একগাল হাসল। ”মাদ্রাজ টেস্ট করতে গিয়ে অরুণদা এমন পা মচকালেন… দুজন ছুটিতে, ভোম্বলদা রাজি নন, ওঁর মেয়ের পরীক্ষা, তাই…তা ছাড়া আমি তো ঠিক ম্যাচ রিপোর্ট করব না, সাইড লাইটস, ড্রেসিংরুম রিজের ওপরই বেশি জোর দেব, গসিপ কলামে যেমন বেরোয়, আর ইন্টারভিউ এইসব-ভুবু আমার অনেক দিনের বন্ধু তো ভেতরের খবর ঠিক পেয়ে যাব!”
শঙ্করের সামনে বয় একপ্লেট চপসুয়ে রেখে গেল।
”আমি কি শুরু করে দেব…ঠান্ডা হয়ে গেলে….।”
”না, না, তুমি আরম্ভ করো। চিনে খাবারের এই এক ঝামেলা ঠান্ডা খেতে একদমই ভালো লাগে না।”
সরোজ এতক্ষণ কথা শুনতে শুনতে মেপে নিচ্ছিল ওকে। ছেলেমানুষ, অনভিজ্ঞ, বাহাদুরি দেখাবার লোভ সামলাতে পারে না কিন্তু কাজের এবং খাটিয়ে। মনে হচ্ছে খোলামেলা আমুদে, সঙ্গ ছাড়া থাকতে পারে না, ফর্ম্যালিটিজের ধার ধারে না।
”কবে এসেছ, উঠেছ কোথায়?”
”কাল রাতে, উঠেছি আপনার পিছনেই সঙ্গম হোটেলে। বাজে ঘর আর যত টিভি আর রেডিয়োর লোকে ভরা। সকালে গরম জলই পেলাম না।…”
”আমি কোথায় উঠেছি জানলে কী করে?”
”প্রেসপাস নিতে গেছি তখন মোটা বেঁটে একজন বোধহয় বোম্বের, আমি কলকাতা থেকে এসেছি শুনে বলল আপনি মধুছন্দায়।”
”অভয়া, সুদর্শন অভয়ঙ্কর। যেখানেই যায় প্রথমেই খোঁজ নেয় কে কে এসেছে। তোমাকে জিজ্ঞাসা করেনি, রুম চার্জ কত, ঘর কমফর্টেবল কি না, ফুড কেমন?”
”না।”
”করবে।”
সুপ এসে গেছে। ধোঁয়া উঠছে। ঠান্ডা করার জন্য চামচ দিয়ে নাড়তে নাড়তে সরোজ ভাবতে শুরু করল। রোজার অটোগ্রাফ বুকে সই করানো আর দিল্লিতে ওদের বাড়িতে ভবানীকে নিয়ে যাওয়া-এই দুটো কাজ একে দিয়েই করাতে হবে অবশ্য যদি রাজি হয়। তার থেকেও বড়ো কথা, ওর কথাবার্তার মধ্যে সত্যতা আছে কতখানি?
তবে একটা ব্যাপারে শঙ্করের প্রতি তার অবচেতনে বিতৃষ্ণা ঘনিয়ে উঠেছে। ছেলেটি সর্বোচ্চচ পর্যায়ের অর্থাৎ টেস্টমানের ক্রিকেট বোঝে না বলল এবং সেজন্য কোনোরকম জড়তা বা কুণ্ঠা ওর মধ্যে নেই। ও এসেছে ঝগড়াঝাটি, রসালো কথাবার্তা, অপ্রীতিকর ঘটনা অর্থাৎ কেচ্ছা জোগাড় করার জন্য। যেসব খবর তারিয়ে তারিয়ে পাঠকরা পড়বে, যেসব খবরের সঙ্গে খেলার মূল উদ্দেশ্য বা প্রেরণার কোনো সম্পর্ক নেই। পাঠকদের মনের মধ্যে সুপ্ত নীচ প্রবৃত্তি খুঁচিয়ে তুলে একটা নোংরা আবহাওয়া তৈরি করে পাঠক সংগ্রহ করার, কাগজের বিক্রি বাড়ানোর এই পন্থা সরোজ কখনও মেনে নিতে পারেনি। ইদানীং এই পথে অনেকেই যাচ্ছে, সরোজের যাবার ইচ্ছা নেই। খেলার মাঠে খেলা হচ্ছে, তুমি দেখছ, খেলার দোষত্রুটি, ভালোমন্দ যা বুঝলে সেটাই তোমার রিপোর্ট করার বিষয়। কিন্তু কী একটা হাওয়া যেন আসছে, শুধু মাঠের মধ্যের খেলা নয়, তার আড়ালে যে-জগৎ রয়েছে তার খবরও প্রকাশ্যে টেনে আনা দরকার হয়ে পড়ছে। এটাও নাকি জরুরি যেহেতু তা ঘটনা। ‘সব কাগজেই বেরিয়েছে খেলার পর কোচের সঙ্গে ফুটবল সেক্রেটারির গালাগালি হয়েছে, টেন্টের মধ্যে হাতাহাতিও হয়েছে, একজন ফুটবলার কোচকে শুয়োরের বাচ্চচা বলেছে আর তোমার লেখায় এসব কিছুই নেই…খেলার পর করো কী, মুড়ি চিবোতে চিবোতে অফিসে চলে আসো, টেন্টে যাও না কেন?’ ক্রীড়া সম্পাদক রমেন গুহঠাকুরতা এই বলে গত ফুটবল সিজনে ধমকেছিল বিমলেন্দুকে। বিভাগের অন্যরা মুখ নামিয়ে তখন ব্যস্ত হয়ে পড়ে কাগজ-কলম নিয়ে।
সরোজ এই ধরনের খবর সংগ্রহের বিরোধী। গুহঠাকুরতা তা জানে, তবে সিনিয়র রিপোর্টার বলে সাধারণত চুপ করে থাকে। মৃদু অনুযোগ ‘এটা দিলে সরোজ লেখাটা ভালো খুলত’ বা ‘মিস করে গেলে অমন জব্বর ব্যাপারটা !’-এর বেশি কখনও বলেনি। তবে সরোজ শুনেছে আড়ালে তার সম্পর্কে ‘মান্ধাতাপন্থী…নীতিবাগীশ…আধুনিক রিপোর্টিং-এর কিসসু জানে না’ ইত্যাদি গুহঠাকুরতা বলেছে। আর একবার শুনেছিল, ‘একটা অপদার্থ। বেঙ্গলের হয়ে একটু-আধটু খেলেছে, দু-চারটে খেলার উপর লেখা বেরিয়েছিল এখানে সেখানে তাই চাকরিটা পেয়ে গেছল। তখন কাগজের যা চরিত্র ছিল আর এখন… দুনিয়াটা যেভাবে র্যাপিড বদলে গেছে তার সঙ্গে কাগজও বদলাতে বাধ্য। জার্নালিজম যেখানে এসেছে তাতে ও এখন হলে চাকরিই পেত না।…টোটালি মিসফিট।’
কথাগুলো মনে পড়লেই সরোজের হাত কাঁপতে শুরু করে উত্তেজনায়। তার ব্লাডপ্রেশার উঁচুর দিকেই, ডাক্তার উত্তেজিত হতে বারণ করেছে কিন্তু স্মৃতিকে কাজ করা বন্ধ করতে বললে শুনবে কেন? সে লক্ষ করল তার হাতে সুপের চামচটা থরথর কাঁপছে। মনে মনে সে বলে চলল ‘কুল ডাউন, কুল ডাউন সরোজ… ঠান্ডা হও, ঠান্ডা হও।’
”কিছু বললেন?” শঙ্কর ঝুঁকিয়ে দিল মাথাটা।
”এখান থেকে কোথায় যাবে এখন?”
”বড়ো টেলিগ্রাফ অফিসটা পাশেই একবার টেলেক্স ব্যবস্থাটা দেখে নেব। ওখানে আসল লোকটা কে… এক প্যাকেট ডানহিল তার হাতে ধরিয়ে দিতে হবে তো।” শঙ্কর মুখ টিপে হাসছে। সরোজের মনে হল একে পেলে গুহঠাকুরতা খুশিই হবে।
শঙ্করের খাওয়া শেষ হচ্ছে তখন সরোজের জন্য চাওমিন টেবলে এল।
”আপনি এখান থেকে কোথায় যাবেন?”
”একবার মাঠে যাব।”
”আজ কিছু পাঠাবেন? কার্টেন রেইজার?”
”হ্যাঁ। একটা তো পাঠাতেই হয়।”
”আমি টেলেক্স ইনচার্জের সঙ্গে একবার মোলাকাতটা করে আসি। ওখানেই আপনার জন্য অপেক্ষা করব তারপর একসঙ্গে মাঠে যাব।”
সরোজ ঘাড় নাড়ল। শঙ্কর নিজের বিল চুকিয়ে অ্যাডিডাসের একটা নীল রঙের স্পোর্টস কিটব্যাগ বগলে ঝুলিয়ে বেরিয়ে গেল। সরোজের মনে হল ওর জুতোটাও বিলিতি। জিজ্ঞাসা করতে হবে কখনও দেশের বাইরে গেছে কি না।
শঙ্করকে খুঁজতে সরোজ টেলিগ্রাফ অফিসে টেলেক্সের রিসিভিং কাউন্টারের কাছে দাঁড়াল। পাঁচ মিনিট অপেক্ষা করে সে ঘুরতে লাগল নানান ঘরে উঁকি দিয়ে। অবশেষে ওকে দেখতে পেল সদর গেটের কাছে ফাঁকা জায়গাটায় যেখানে টেলিগ্রাফ বাড়ির সীমানা-রেলিং ঘেঁষে ফুটপাথে ত্রিপলের চালার নীচে চায়ের দোকান। শঙ্করের সঙ্গে গলাবন্ধ খয়েরি গরম কোট ও ধুতিপরা এক গৌরবর্ণ মাঝবয়সি লোক চায়ের গ্লাস হাতে। এগিয়ে যেতে যেতে সরোজের চোখে পড়ল, লোকটির টিকিতে গিঁট বাঁধা এবং কপালে লাল ফোঁটা। এঁকে সে চেনে।
”সরোজদা আসুন আলাপ করিয়ে দি…মণীশ শুক্লা এখানকার একজন অফিসার মাঠে টেলেক্স ক্যাম্পে থাকবেন আর ইনি সরোজ বিশ্বাস, কলকাতার বাংলা কাগজ প্রভাত সংবাদের নাম শুনেছেন নিশ্চয়…”
”হ্যাঁ হ্যাঁ, আপনি তো আগে একবার এসেছেন আমার মনে পড়ছে…ই সুধনিয়া, বাবুকে চা দে।”
রেলিংয়ের ওধারে চায়ের দোকানের ছেলেটিকে উদ্দেশ্য করে মণীশ শুক্লা বললেন।
”আপনাদের কোনো অসুবিধা হবে না, আমি সারাক্ষণ মাঠে থাকব…রাত আটটা পর্যন্ত আমাদের ক্যাম্প খোলা থাকবে আর এখানে তো সব সময়ই পাবেন। টেস্টম্যাচের জন্যই আমাকে স্পেশাল ডিউটি দেওয়া হয়েছে।
চায়ের গ্লাস হাতে নিয়ে সরোজ কিঞ্চিৎ কৃতার্থ ভঙ্গিতে বলল, ‘শুক্লাজি আপনার মেমারি অদ্ভুত শার্প, ঠিক চিনতে পেরেছেন তো! জানো শঙ্কর ইনি হেল্প না করলে আমার একটা কপিও ঠিক সময়ে অফিসে ল্যান্ড করত না। হয় কলকাতার লাইন জ্যাম নয় লাইন ডাউন, সে কী অবস্থা! আমি তো কপি এঁনার হাতে জমা দিয়ে নিশ্চিন্তে হোটেলে চলে যেতাম। তখন অবশ্য এত রিপোর্টারের ভিড়ও ছিল না।”
শুক্লাজি মৃদু হাসি দিয়ে প্রশংসাগুলি গ্রহণ করলেন। শঙ্কর চোখ টিপল। সরোজের স্পষ্ট মনে আছে, কিশোর পুত্রকে একদিন খেলা দেখাবার জন্য শুক্লা তাকে ধরেছিল কিন্তু সে মাঠে ঢোকার কোনোরকম পাসই জোগাড় করতে পারেনি। কীভাবে যেন অভয়ঙ্কর শেষদিনে ছেলেটিকে প্রেসবক্সে এনে খেলা দেখিয়েছিল। সরোজের মনে একটা অস্বস্তি ধরল, শুক্লা তার ব্যর্থতা বা গলদটাকে মনে রেখে থাকলে মুশকিলে ফেলতে পারে। তবে লোকটা সাদাসিধে হয়তো প্যাঁচ কষবে না।
”সরোজদা চলুন মাঠে যাই, ইন্ডিয়া টিম তিনটে পর্যন্ত নেট প্র্যাকটিস করবে, তারপর একবার হোটেলে যাব তারপর স্টোরি ফাইল করব।”
সরোজ চায়ের দাম দিতে যাচ্ছিল কিন্তু শুক্লাজির প্রবল আপত্তিকে অসম্মান করতে ভরসা পেল না। দুজনে একটা রিকশায় রওনা হল গ্রিন পার্কের উদ্দেশে।
”ডানহিল দিয়েছ?”
”কখন দিয়েছি! পাওয়া মাত্রেই পকেটে চালান করে দিয়েছে, মনে হয় না খায়। হয়তো ওপরওলাকে ভেট দেবে।”
”শঙ্কর তুমি এত ভালো বাংলা বলো কী করে? দেখলে তো সাহেব মনে হয় তোমাকে!”
”আমি তো দু’বছর বয়স থেকে কলকাতায়। পড়াশুনো ভবানীপুরে মিত্র ইন্সটিট্যুশন আর সেন্ট জেভিয়ার্স…পাড়ার ছেলেরা তো সবই বাঙালি, রাস্তায় রবারের বলও খেলেছি বহুদিন।”
”কে কে আছেন বাড়িতে?”
”গ্র্যান্ডমাদার আর মেইড সারভেন্ট…কাজিনরা থাকে বেলুড়ে, ট্রান্সপোর্ট ব্যবসা আছে…আত্মীয়টাত্মিয় আছে চণ্ডীগড়ে।”
”তুমি দু’বছর থেকে কলকাতায়, চণ্ডীগড়ে জন্মেছ?”
শঙ্কর হাসল। সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিল না। উলটোদিক থেকে রিকশায় আসছে মহারাষ্ট্র ক্রনিকলের বাসু যোগলেকর আর ‘প্রত্যহ’ কাগজের তরুণ লাহিড়ি। সরোজকে দেখে যোগলেকর হাত তুলল, শঙ্করকে এখনও কেউ চেনে না। বাসুর সঙ্গে সরোজের প্রথম পরিচয় কানপুরেই, একই হোটেলে ‘সিধালোক’-এ তারা ছিল।
”ওরা কোথাকার, ইংরেজি কাগজের?”
শঙ্কর ইংরেজি কাগজের লোক, তাই সব ইংরেজি কাগজকে সে প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করে।
”বাসু যোগলেকর, যে হাত তুলল, মারাঠি কাগজের আর তরুণের বাংলা।”
শঙ্কর নিরুৎসুক হয়ে গেল। সরোজ সিগারেট ধরাবার জন্য দেশলাইয়ের দুটো কাঠি নষ্ট করে রিকশার গতি কমার জন্য একটা মোড়ের অপেক্ষায় থেকে বলল, ”বাড়িতে তুমি আর ঠাকুমা, বাবা-মা?”
”একজন মন্ট্রিয়েলে অন্যজন বারমিংহামে।”
শঙ্কর দুটো তালু ছড়িয়ে ব্যবধানটা বোঝাল। সরোজ মুখ ঘুরিয়ে তাকাল। শঙ্করের মুখে ভাবের বদল হয়নি।
”বাবা পাঞ্জাবি মা ইংলিশ। ডিভোর্স হয়ে গেছে। বাবা কানাডায় চলে যাবার আগে আমাকে ঠাকুমার কাছে রেখে যায়, এখনও টাকা পাঠায়। রেস্টুরেন্ট বিজনেসে আছে, অবস্থা ওখানকার স্ট্যান্ডার্ডে ভালোই। আমায় যেতে বলেছিল। কিন্তু আমি রাজি হইনি।”
”কেন, গেলে তো ভালোই হত।”
”তা হত।”
শঙ্করের শুকনো স্বর আরও কৌতূহল থেকে সরোজকে নিরস্ত করল। হয়তো গূঢ় কোনো কারণ আছে।
ইস্পাতের চাদরে তৈরি সবুজ পাল্লার গেটটা অল্প ফাঁক। সেখানে কয়েকজন পুলিশ আর ছোটোখাটো ভিড়। নেট প্র্যাকটিসে ক্রিকেটারদের কাছের থেকে দেখার, অটোগ্রাফ নেওয়ার জন্য সর্বত্রই এই ঝামেলাটা তৈরি হয়। ”নেহি নেহি, ভাগো ভাগো।” শুনতে শুনতে এবং ব্যাটন আন্দোলন দেখতে দেখতে ওরা ভিড়ের কাছে পৌঁছতেই কলরবটা আচমকা থমকে গেল। সবাই শঙ্করের মুখের দিকে তাকাচ্ছে। পুলিশদের মুখে তটস্থ ভাব দেখা দিল।
ইতস্তত ভাব কাটিয়ে সাহসী একটি কিশোর অটোগ্রাফ বইটা শঙ্করের দিকে এগিয়ে ধরল।
”ন্যেও, ন্যেও, নট ন্যাও।”
নিখুঁত সাহেবি বিকৃত উচ্চচারণে কথা ক’টা বলে শঙ্কর খুব ব্যস্ত ভাব দেখিয়ে ভিড়ের মধ্যে ঢুকতেই পুলিশ ব্যাটন চালিয়ে তার জন্য রাস্তা পরিষ্কার করতে শুরু করল। সরোজের ভয় ছিল, এইসব ক্ষেত্রে মাথামোটা পুলিশরা ভিতরে যেতে দিতে চায় না, বিশেষত এই রকম শহরে যেখানে বড়োমাপের খেলা ক্বচিৎ হয়। কড়াকড়ি দেখাতে এরা বদ্ধপরিকর। ওপরওলার নির্দেশ দ্বিগুণ উৎসাহে পালন করে।
শঙ্কর মুখ ফিরিয়ে ইশারায় সরোজকে অনুসরণ করতে বলল। তখন সরোজের কানে এল, ”এর নাম কী রে?” ”কী জানি বোধহয় বয়েড হবে।”
ভিতরে ঢুকে শঙ্কর বলল, ”বহু জায়গায় এই সুবিধেটা পাই, চেহারাটার জন্য মা’কে তখন মনে মনে ধন্যবাদ দিই।”
”হ্যাঁ, এখনও কটা চামড়া, কটা চোখ দেখলে এদেশের লোকে আলাদা খাতির দেখাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। এই পুলিশরা তো অশিক্ষিত গাঁইয়া, শিক্ষিতরাই আহ্লাদে গলে যায় যদি সাহেব তাদের সঙ্গে কথা বলে কি সাহেবদের সেবা করার সুযোগ পায়। সব টেস্ট সেন্টারেই দেখবে, সাহেব জার্নালিস্টরা কী খাতিরটা পায়!”
”আমাকে কী ভেবেছিল বলুন তো?”
সরোজ পা থেকে মাথা পর্যন্ত শঙ্করকে দেখে নিয়ে ওকে খুশি করার জন্যই বলল, ”নিউজিল্যান্ড টিমের কেউ!”
শঙ্করের মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল হাসির আভায়। ”আপনার কি তাই মনে হয়?”
”নিশ্চয়। পাক্কা ক্রিকেটারের মতো তোমায় লাগছে।”
”আপনার সঙ্গে ভুবুর আলাপ আছে?”
”না।”
”করিয়ে দেব। চমৎকার ছেলে, হইচইয়ে, কোনো অহংকার নেই…।”
”শুনেছি একটুতেই মাথা গরম করে ফেলে, লঘুগুরু জ্ঞান থাকে না।”
”সে আর এমন কী।” শঙ্কর কাঁধ দুটো উঁচু করল। ”যে ক্লাস অফ ক্রিকেটার, যে লেভেলে ও পৌঁছেছে সেখানে যা টেনশন, খুব হাই স্ট্রাং হয়ে লড়তেই হয়।”
সদ্য চুনকাম করা দেয়ালে ইংরেজিতে ‘প্রেসবক্স’ এবং ব্লক ও গেট নম্বর লেখা। তির দিয়ে দেখানো একটা সবুজ লোহার গেট। ওরা সেটা অতিক্রম করে ছোট্ট একটা দরজায় দুটি লোক দাঁড়িয়ে আছেন দেখল। এটা প্লেয়ার্স ড্রেসিংরুমে যাবার দরজা। ঝাড়ু দিয়ে পরিষ্কার করা হচ্ছে গ্যালারির পিছনে ফাঁকা জমি আর যাতায়াতের পথ। ওখানে নানাবিধ খাবারের স্টল বসবে কাল থেকে। ধুলোর ঝাপসা দেয়াল উঠেছে। ওরা আর এগোল না, কাঠের গ্যালারির মধ্য দিয়ে একটা সরু পথে ঢুকে পড়ল।
গ্রিন পার্ক মাঠের ঘাস দেখে সরোজ অবাক হল। গতবছর দেখেছে লালচে ঘাস, জায়গায় জায়গায় টাক, মাটি বেরিয়ে। আর এখন তার সামনে বেশিক্ষণ চোখ রাখা যায় না এমন দাউদাউ সবুজ। তার মুখ থেকে অস্ফুটে বেরিয়ে এল, ”বাহ!”
”সরোজদা, ফেন্সিং ডিঙিয়ে এখান থেকেই মাঠে নামতে হবে, পারবেন?”
”দ্যাখো না পারি কি না।”
ব্যস্ত হয়ে সরোজই আগে ডিঙোল। কোমর সমান উঁচু ফেন্সিংয়ের মাঝামাঝি একটা ফোকরে এক পা ঢুকিয়ে অন্য পা ঘুরিয়ে সে সাইকেলে চড়ার মতো উঠল এবং সাইকেল থেকে নামার মতোই পা ঘুরিয়ে সে অন্যধারে নামল। শঙ্কর শুধু ডান হাতে ফেন্সিংয়ের উপরটা ধরে হাইজাম্প দেওয়ার মতো শরীরটাকে ঝাঁকিয়ে তুলে মাঠের মধ্যে পড়ল সাবলীলভাবে।
”শঙ্কর, রিয়েলি তোমাকে ক্রিকেটারের মতোই লাগছে।”
”সরোজদা প্লিজ কল মি শঙ্কু।”
মাঠের অপর দিকে কয়েকটা কংক্রিটের থাম অসমাপ্ত অবস্থায়। নির্মাণের কাজ চলছে, পাকা স্ট্যান্ড আর প্যাভিলিয়ন হবে। দূরে বিরাট উঁচু, ইটের তৈরি একটা চিমনি থেকে ধোঁয়া বেরোচ্ছে। ওদিকটাকে মিল-এন্ড বলে রেডিয়োয় ধারাবর্ণনা দেবার সময়। মাঠের ওদিকেই নেট পড়েছে। মাঠের মাঝে দড়ি দিয়ে ঘেরা ধূসর পিচ। সবুজের মাঝে শুকিয়ে আসা পাঁচড়ার মতো। কয়েকটি লোক শল্যচিকিৎসকের তীক্ষ্ন চোখে পিচের দিকে তাকিয়ে নিজেদের মধ্যে কথা বলছে। দূর থেকে সরোজ চিনতে পারল দুজনকে, ইউ এন আই-এর উন্নি আর ডেইলি মেলের রতন মেনন। পিচ দেখে কী যে ওরা বুঝছে! ভারতে সব টেস্ট সেন্টারে তো একই পিচ, স্লো টার্নার, পাঁচ দিনই ঝিমিয়ে থাকবে। ব্যাটসম্যান আর বোলারেরই নয় সাংবাদিক, দর্শকদেরও ধৈর্যের পরীক্ষা দিতে হয় পাঁচ দিন ধরে। এই নিউজিল্যান্ড টিমটা মাদ্রাজে সাতাশি রানে যে কী করে হারল সরোজের কাছে তার একটাই কারণ মনে হয়-অতি বাজে ব্যাটিং সাইড। মধু ভাণ্ডারকরের স্পিন এমন কিছু ভয়ংকর নয় যে ম্যাচে বারোটা উইকেট পেয়ে যাবে। চিপক আর গ্রিন পার্ক ইডেন আর ফিরোজ শাহ কোটলা একই তো উইকেট! বয়স হয়ে গেছে, একান্নটা টেস্ট খেলে ফেলেছে। বাঁ হাতটা গত আট বছরে কত হাজারবার যে ঘুরিয়েছে! ওর বলে আগের মতো আর নীচ থেকে চটকানি হয় না, বাউন্সও কমে গেছে। স্রেফ ফ্লাইটের চতুরালিতে উইকেট তো পেয়ে যাচ্ছে! আরও পাঁচটা উইকেট পেলেই দু’শো হবে, কোনো মারাঠি বোলার এখনও পায়নি। সেন্টিমেন্টাল কারণেই যে ভাণ্ডারকরকে খেলানো হচ্ছে এটা সবাই বোঝে। দু’শো না হওয়া পর্যন্ত টেস্ট খেলবেই। তার থেকেও বড়ো কথা, সিলেকটরদের এবং বোর্ড মেম্বারদের কেউ কেউ ওর প্রতি স্নেহপ্রবণ। হায়দরাবাদের লেগব্রেক বোলার ফরজন্দ আলি এখনও টেস্ট খেলেনি, মাদ্রাজের মতো এখানেও তাকে পনেরোজনে রাখা হয়েছে। ছেলেটি গতবছর থেকেই তৈরি টেস্ট খেলার জন্য।
শঙ্কর এগিয়ে গেছে ভারতীয় নেটের দিকে। সরোজের মনে হল, রাজীব তারিখ ব্যাট করছে। গত পাঁচ বছরে একুশটা টেস্ট, কখনওই পুরো সিরিজ খেলেনি, সর্বোচ্চচ বাহান্ন রান। ল্যাটা ওপেনিং ব্যাটসম্যান হওয়াটাই নাকি ওর বড়ো ব্যাপার।
”হ্যালো সরো।”
উন্নি নিয়মরক্ষার মতো বলল।
”হ্যালো। কবে এসেছ?”
”আজ সকালে।”
”হ্যালো মেনন।”
”হ্যালো, সরোজদা আপনি মাদ্রাজে যাননি?”
”না।”
ওরা দুজন আধময়লা প্যান্ট-বুশশার্ট পরা এক শীর্ণ প্রৌঢ়ের সঙ্গে কথা বলছিল। বোধহয় পিচ এঁরই তত্ত্বাবধানে তৈরি। আন্দাজে এরা কাজ করে মান্ধাতার ফর্মুলায়। যা বলে তার উলটোটাই ঘটে। নিশ্চয় বলছে থার্ড ডে থেকে বল দারুণ ঘুরবে! সরোজ গুড লেংথের কাছে জমির দিকে সরে গেল। সকালে জল দেওয়া হয়েছে, তারপর রোল। মাটি সামান্য ফাটাফাটা, মাকড়সার জালের মতো। ঘাস প্রায় কিছুই রাখা হয়নি, যা রয়েছে, গিঁটওলা, প্রায় মরা। স্পিনারদের বল ঘোরাতে নাকি সাহায্য করবে।
সরোজের মনে পড়ল, দিল্লির সঙ্গে ইডেনের খেলা ম্যাচটার কথা। ঠিক এই পিচ, এই ঘাস। বাংলার ড্রেসিংরুমে উত্তেজনা, ম্যাচ জিততে চলেছে। ফোর্থ ইনিংসে দিল্লিকে তিনশো চব্বিশ রান করে জিততে হবে হাতে পাঁচ ঘণ্টার মতো সময়। পারবে না। পিচ রোল করে ভেঙে দেওয়া হয়েছে, এবার সুবীরের বল লাট্টুর মতো ঘুরবে। ক্যাপ্টেন আলোক দত্ত বলেছিল, ”স্টেডি সরোজ, এবার ক্যাচ উঠবে হাত ভরে, আঁকুপাকু করার দরকার নেই, প্রত্যেকটা নিতে হবে, একটাও যেন স্টাম্প মিস না হয়।” পাঁচ ঘণ্টা নয়, তিন ঘণ্টাতেই খেলা শেষ হয়ে যায়। দিল্লি দু’উইকেটে তিনশো সাতাশ তুলেছিল। তাতে ছিল অনন্তরামের দু’ঘণ্টায় একশো তেষট্টি, রঞ্জিত শর্মার আধ ঘণ্টায় চুয়ান্ন। সুবীর উইকেট এবং মেডেনও পায়নি একত্রিশ ওভারে দেড়শোর ওপর রান দিয়ে। একটা ক্যাচও সরোজের কাছে আসেনি। গিঁটওলা ঘাস কোনো সাহায্যে আসেনি, উইকেটও ভাঙার বদলে আরও জমাট বেঁধে যায় রোল করার জন্য।
আজকের কার্টেন রেইজারের প্রথমেই এই ঘটনাটা লিখলে কেমন হয়? সরোজ হালকা বোধ করল। বরাবরই, শুরুটা কীভাবে করবে, তাইতে সে ব্যতিব্যস্ত হয়। একই খেলোয়াড়, একই পিচ একই কথা বারবার লেখা! বিদেশিদের ভালোমন্দর জন্য মাথাব্যথা ভারতীয় সাংবাদিক, পাঠক করবে কেন?
তাহলে কী লিখবে? মনে পড়ল রেস্টুরেন্টে শঙ্করের কথাগুলো। ইদানীং যেভাবে টেস্টম্যাচ খেলা হচ্ছে, নীরস বিরক্তিকর একঘেয়ে, শুধু ড্র আর ড্র, তাতে রসালো ড্রেসিংরুম-কেচ্ছা ছাড়া আর তো কিছুই লেখার থাকে না। সম্বল একমুঠো শব্দ, তাই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে প্রতি টেস্টে প্রতিদিন খরচ করে যাওয়া। লিখতেও তার এখন ক্লান্তি লাগে। পাঠকরা কাগজ খুলে কী পড়বে? তাদেরও তো একঘেয়ে খেলার রিপোর্ট পড়ে পড়ে ক্লান্তি এসে গেছে। অন্য কিছু তারা এবার চায়। কন্ট্রোভার্সি, অবজ্ঞা, ঝগড়া, ঈর্ষা, দোষারোপ, হাতাহাতি, সিনেমার ম্যাগাজিনগুলোয় যেরকম বেরোয়!
সরোজ মন্থরভাবে নেটের দিকে এগোল। স্লিপ ক্যাচিং প্র্যাকটিস করছে অর্ধচন্দ্র হয়ে পাঁচজন, বল মারছে ম্যানেজার মনোহরণ। শঙ্কর আর ভবানী একটু একান্তে দাঁড়িয়ে কথা বলছে। ভবানীর হাতে বল, লোফালুফি করছে, আর শঙ্কর কিছু যেন মজার কথা শুনে হাসছে। সবাই কাজে ব্যস্ত অথচ ভবানী অলসভাবে সময় কাটাচ্ছে? ভ্রূ কুঁচকে উঠল সরোজের।
শঙ্কর হাত নেড়ে তাকে ডাকছে। সরোজ এগিয়ে গেল।
”আপনার সঙ্গে তো ভুবুর আলাপ নেই?”
”অল্প মানে মুখচেনা আর কী?”
ঠোঁট ছড়িয়ে ভবানী হাত বাড়াল। সরোজ তালুটা ধরল। কড়া চেটো, আঙুলগুলো ইস্পাতের শিক মনে হল।
”এত তাড়াতাড়ি নাম করে বিখ্যাত হবে জানলে আলাপ করে রাখতাম।”
”আমি আর কী করলাম, আপনারাই তো লিখে বিখ্যাত করেছেন।”
সরোজ মাথা নাড়ল হাসতে হাসতে। খুবই বালকোচিত কথা শুনতে হল এমনভাবে সে ডান হাত তুলে ধরল যেন ভবানীকে থামাতে।
”তোমার বায়োডাটাটা যে একটু চাই।”
ভবানী কিছু বলার আগেই ব্যস্ত হয়ে শঙ্কর বলল, ”ভাববেন না সরোজদা, আমি আপনাকে দিয়ে দেব। ওর লাস্ট পাঁচ বছরের সব আমার কাছে আছে।”
”সব মানে?” ভবানী কৃত্রিম ভয় পাওয়ার মতো চোখ করল।
”না না ওসব ব্যাপার নয়। খেলার দিকের সব-কোন কোন ক্লাব, কে কোচ-”
‘প্লিজ শঙ্কু, আমায় কেউ কোচ করেনি। এখন অনেকেই ক্লেম করছে কিন্তু আমি, সত্যি কথা বলতে, যা কিছু শিখেছি সবই দেখে দেখে।”
”আমি তো সরোজদাকে তাই-ই বলতাম, ভুবু সেলফ মেড ক্রিকেটার। আপনি তো এখান থেকে টেলিগ্রাফ অফিসে যাবেন ডেসপ্যাচ পাঠাতে, তারপর?”
”তারপর আর কী, সোজা হোটেল?”
”রাত্রে খাবেন কোথায়, ফুটু-তে?”
”তা ছাড়া আর যাব কোথায়?”
”এক কাজ করুন, আমি আপনাকে রাত আটটা না…ন’টা নাগাদ ডেকে নেব। দুজনে একসঙ্গে খেতে যাব আর তখন আপনাকে ভুবু সম্পর্কে যা যা জানতে চান বলে দেব, কেমন?”
”ঠিক আছে। ভবানীর কি প্র্যাকটিস হয়ে গেছে?”
ভবানী আড়চোখে ক্যাচিং প্র্যাকটিসের দিকে তাকাল। ঠোঁটের কোনা তাচ্ছিল্যে মুচড়িয়ে বলল, ”একবার তো আপনাদের দেখিয়ে করতেই হবে, নয়তো লিখে দেবেন ঘোষাল অসুস্থ কি ইনডিসিপ্লিনড। ম্যানেজারটাও টিপিক্যাল ইডলি-সম্বরা, হোটেলের লবিতে কাল বসেছিল, ঘড়ি নিয়ে, কে কখন ফিরছে নোট করছিল।”
”মনোহরণ ভালো ফিল্ডার ছিল, ফিটনেস নিয়ে একটু বাড়াবাড়ি করা ছাড়া মানুষটা ভালো।”
”চেনেন নাকি?” শঙ্কর বলল।
সরোজ মাথা নাড়ল।
”ভুবু, যথেষ্ট বিশ্রাম নিয়েছ… এবার এসো।”
মনোহরণের স্বরে হুকুম বা নির্দেশ নয়, অনুরোধ। ভবানী হাত তুলে মনোহরকে ”ওকে” এবং সরোজ আর শঙ্করকে হাসিমুখে ”চলি” বলে মন্থর চালে ফিল্ডারদের দিকে এগোল।
”একদম সোবার্সের মতো হাঁটাটা।”
”সোবার্সকে দেখেছ?”
”না।”
”খুব হাসছিলে দেখলাম, ব্যাপার কী?”
”ব্যাপার কিছুই নয়। অটোগ্রাফের জন্য মেয়েরা হোটেলের লবিতে যা কাণ্ড করছে। যাকে পাচ্ছে তারই সই নিচ্ছে। ঠুকরালের ভাই দেখা করতে এসেছে তারও সইয়ের জন্য ঝাঁপিয়ে পড়ল। যত বলছে আমি জীবনে ক্রিকেট ব্যাটই হাতে নিইনি ততই মেয়েরা অবিশ্বাস করছে। বেচারাকে সই দিয়ে তবে রেহাই পেতে হল। রবি আনন্দের বউ এসেছে, তারও সই চাই! ভুবুর ঘরে লাস্ট কুড়ি ঘণ্টায় আটটা ফোন এসেছে মেয়েদের।”
”সইয়ের জন্য?”
শঙ্কর মুচকে হাসল। ”ফোনে তো আর সই করা যায় না, ওরা সই নয় ভুবুকে চায়। রেস্ট ডে-তে ভুবু কি ফ্রি থাকবে তাহলে ওকে নিয়ে লখনউ বেড়াতে যাবে। একজন বলেছে, ‘তুমি কি ঘরে একা তাহলে গল্প করতে যাব, ভীষণ এক্সাইটেড বোধ করছি তোমার ছবি দেখে, রাতে ঘুম হচ্ছে না।’ তবে ক্লাস ব্যাপার হয়েছে আজ, একটা মেয়ে সোজা চলে গেছে ভুবুর ঘরে। তখন ও খালি গায়ে শুধু শর্টস পরা।…ঠাট্টা করেই এমনি বলেছিল, চুমু দিলে তবে সই দেবে। ব্যস, মেয়েটা ওমনি গলা জড়িয়ে…ভুবুর রুমমেট ফরজন্দ, তার তো ভির্মি লাগার মতো অবস্থা। ছেলেটা অত্যন্ত ভদ্র আর ঠান্ডা, দিনে পাঁচবার নামাজ পড়ে, মেয়ে দেখলে চোখ নামিয়ে নেয়, তাড়াতাড়ি বাথরুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দেয়। সে এক মজার কাণ্ড।”
”তারপর?”
সরোজের বুকের মধ্যে হঠাৎ একটা পাথর জমে ক্রমশ ভারী হয়ে উঠছে। সেটা তার হৃৎপিণ্ডের কাজে ব্যাঘাত ঘটাতে শুরু করেছে। অনেকটা এইরকমই টাটার গেস্ট হাউসের ঘরে ঘটেছিল তার ব্যাপারটা। তবে বীণার সঙ্গে সম্পর্কটা তখন যথেষ্ট ঘনিষ্ঠ হয়ে গেছল।
”আপনি আবার এসব লিখে দেবেন না তো? দেখুন আপনাকে বিশ্বাস করে বলে ফেলছি তারপর…।”
”আরে না না, আমি এসব ব্যাপার নিয়ে কখনও লিখি না।”
”তারপর ভুবু মেয়েটাকে নিয়ে সবে বিছানায় ঝাঁপিয়ে…আর সেই সময়ই ঘরের বেল বেজে উঠল।”
শঙ্কর হতাশার ভঙ্গিতে কাঁধ আর হাত দুটো ঝুলিয়ে মাথা হেলিয়ে দিল। সরোজ বুকের মধ্যে হালকা বোধ করল।
”লন্ড্রির লোক এসেছিল ফরজন্দের প্যান্ট ডেলিভারি দিতে। ও তো ওদিকে দরজা বন্ধ করে কমোডের ওপর বসেই আছে। ভুবু দরজা ধাক্কিয়ে বার করল। মেয়েটা চলে যাবার পর ও ভুবুকে বলতে লাগল, এসব কোরো না, এসব করলে খেলা নষ্ট হয়, তুমি ট্যালেন্টেড, সবে টিমে এসেছ এখন শুধু বড়ো রান পাবার জন্য কনসেনট্রেট করো, হেলথের দিকে নজর রাখো। ভুবু ওকে এক ধমক দিয়ে বলেছে, জ্যাঠামো করতে হবে না, আগে টেস্ট খেল তারপর উপদেশ ঝাড়বি।”
সরোজ শুনতে শুনতে তাকিয়েছিল নেটের দিকে। নাগাড়ে বল করে যাচ্ছে ফরজন্দ আলি। রিস্ট স্পিনার, ক্ল্যাসিকাল ডেলিভারি। বাঁ কাঁধটা ব্যাটসম্যানের দিকে, মাথাটা ঘুরিয়ে আকাশের দিকে তোলা বাঁ হাতের পাশ দিয়ে তাকাচ্ছে, ডান হাতটা একটা চাকার বেড় নিয়ে ঘুরে যাচ্ছে, পিচ থেকে বাউন্স পাচ্ছে ওর বল। ডেলিভারির পরই মুখে উদ্বিগ্নতা। বলটা তার উদ্দেশ্যমতো কাজ করেছে কি না তাই নিয়ে ভাবনায় আচ্ছন্ন হয়ে যাচ্ছে। ছেলেটার বয়স কম, মাত্র কুড়ি।
লেগস্পিনারকে এই বয়সে টেস্টে নামিয়ে দেওয়াটা কি ঠিক হবে? যদি মার খায়? হয়তো ভেঙে পড়বে, চুরমার হয়ে যেতে পারে। সারা জীবনের মতো। এইভাবে অকালে অনেকেই তো ঝরে গেছে!
সিলেক্টররা কি ঝুঁকি নেবে? ওকে খেলিয়ে যদি ম্যাচ হারে? সিলেকশন কমিটির চেয়ারম্যান রাজেন্দ্র ত্রিবেদি অফস্পিনার ছিল, একটি মাত্র টেস্ট খেলেছে, ঝুঁকি নেয়নি কখনও, গতানুগতিক চিন্তা কিন্তু একটা টেস্টে এগিয়ে, এখন হয়তো ওকে নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করা যায়! এদের দিয়ে সাবধানে কাজ করিয়ে নেওয়া, ঠিক সময়ে বল করতে আসা, মার খেলে আড়াল করা ক্যাপ্টেনের এটা বিরাট দায়িত্ব। রবি আনন্দ কি তা পারবে? আনন্দ নিজেও বোলার তবে স্পিনার নয়। এখনও পর্যন্ত এগারোটা টেস্ট ম্যাচে ভারত ওর অধিনায়কত্বে এইসবে একটা ম্যাচে জিতল। বড়োদরের ট্যাকটিসিয়ান নয়, মৃদু চরিত্র, অত্যন্ত থিয়োরি ঘেঁষা, বাঁধা গতে চলে, ব্যক্তিত্ব কম।
”যাক মেয়েটা তাহলে বেঁচে গেল নাকি আবার আসবে?”
”সরোজদা এরা জেনেশুনেই আসে…বাজি ফেলে বলতে পারি আবার আসবে।”
”কত বাজি? আমি বলছি আসবে না।”
”একশো টাকা। নাকি বেশি হয়ে যাচ্ছে…বেশ তাহলে বড়ো একটা রাম, হবে?”
”আমি হারলে দেব। আর জিতলে…আচ্ছা দিল্লি যাচ্ছ তো?”
”নিশ্চয়।”
”ওখানেই নোব।”
”শেষকালে এমন একটা কিছু বলবেন যে আমার সাধ্যের বাইরে হয়ে যাবে…”
”আরে না না টাকার ব্যাপার নয়, একটা অন্য জিনিস, ভুবুকে নিয়ে একজনের বাড়িতে একটু যেতে হবে।”
”ওহহ এই ব্যাপার, আমি ভাবলুম…সে হয়ে যাবে, নো প্রবলেম।”
সরোজ হাঁফ ছাড়ল। নিজের চোখেই দেখেছে ভবানীর সঙ্গে ওর হৃদ্যতা, সুতরাং শঙ্করকে খুশি রাখলে বীণার বাড়িতে নিয়ে যাওয়ায় অসুবিধে হবে না। আজ দিনটা ভালোই যাচ্ছে। হোটেলে এসে বিপদে পড়ে রেহাই পেয়েছে, প্রেসপাস পেতে ঝামেলা হয়নি। একটা কার্টেন রেইজার গোছের একঘেয়ে জিনিস পাঠাতে হবে, সেটারও একটা ছক মোটামুটি মনে মনে তৈরি হয়ে গেছে-ফরজন্দকে খেলাবার জন্য জোর সওয়াল করবে। অবশ্য সিলেক্টরদের মধ্যে সুনীল কাঞ্জিলাল ছাড়া তো সিলেক্টরদের কেউই বাংলা পড়তে জানে না। সুতরাং সে কী লিখল বা না লিখল তাতে কিছুই যায় আসে না। কাঞ্জিলালের সঙ্গে একবার কথা বলতে পারলে ভালো হত। ভবানীকে নাকি ও-ই ঝগড়াঝাটি করে টিমে ঢুকিয়েছে। ছেলেটার আশাতীত পারফরম্যান্স নিশ্চয় কাঞ্জিলালকে এখন তুঙ্গে তুলে রেখেছে।
সরোজ নেটের পিছনে ডেকচেয়ারে বসা মুখগুলোর মধ্যে কাঞ্জিলালকে দেখতে পেল না। ফরজন্দ নেট থেকে বেরিয়ে চেয়ারে গিয়ে বসল। ফেন্সিংয়ের ওধারে শ’খানেক ছেলে। আজ রাতেই প্রথম বারোজন ঠিক হয়ে যাবে। উইনিং কম্বিনেশনকে নাড়ানাড়ি হয়তো করবে না। তাই হলে ও এবারও আসছে না টিমে।
”দু’একটা পয়েন্ট-ফয়েন্ট দিন সরোজদা, শুধু কি গসিপ পাঠাব?”
”কী আর পয়েন্ট দেব।” সরোজ সতর্ক হল। ”পয়েন্ট তো তুমি দেবে। আসল জিনিস হল ভেতরের খবর, তোমার তো সোর্স রয়েইছে। উন্নি ভালো অ্যানালিসিস করে, তোমার ডেস্ককে বলে দাও ইউ এন আই থেকে নিয়ে একটা কিছু বানিয়ে তোমার লেখাটার শুরুতে বসিয়ে দিক। রাতে টিমের নামগুলো বলবে, মনে হয় না বড়ো রকমের কোনো অদলবদল হবে।”
”রামিন্দারকে নাকি বসিয়ে দেবে যদি এবারও ফেল করে, ভুবু এইরকম একটা কানাঘুষো শুনেছে।”
সরোজ উৎকর্ণ হল। রামিন্দারের কথাটা তার মাথায় হালকাভাবে একবার এসেছিল। ইংল্যান্ডের সঙ্গে গত সিরিজে ফেল করেছে, ন’টা ইনিংসে একশো সত্তর রান। শেষ তিনটে সিরিজে একটা সেঞ্চুরি, দুটো ফিফটি। এবার মাদ্রাজে শূন্য আর তিন। সিনিয়র প্লেয়ার, পঞ্চান্নটা টেস্ট খেলেছে, এগারোটা সেঞ্চুরি। তিন হাজারের উপর রান। চট করে বসাবে না তবে ভবানী এসে যাওয়ায় নিশ্চয় বিপদ বোধ করছে।
”ভবানী আর কী বলল রামিন্দার সম্পর্কে?”
”ওর সঙ্গে তেমন কথা বলে না, নিজের ঘরে কানে ওয়াকম্যান লাগিয়ে শুয়েই থাকে।”
”এগুলো তুমি লিখো। রামিন্দার খুবই ভালো ব্যাটসম্যান, ব্যাড প্যাচ সকলেরই আসে, ওরও এসেছে, আবার ঠিক বেরিয়ে আসবে।”
সরোজ দেখল তরুণ লাহিড়ী তার দিকেই আসছে। নাদুসনুদুস, ফরসা, বেঁটে, নস্যি রঙের স্যুট আর মেরুন টাই।
”সরোজদা কোথায় উঠেছেন, মধুছন্দায়? আমি ওর পিছনেই সঙ্গমে, আপনার ওখানে ঘর খালি থাকলে বলবেন।”
”শঙ্করও সঙ্গমে, ওকে চেনো তো?”
শঙ্কর হাত বাড়িয়ে দিল।
”শঙ্কর গ্রুবাল, নিউজ ডে।”
”তরুণ লাহিড়ী, প্রত্যহ। আপনাকে কোথায় দেখেছি যেন, বোধহয় স্টেট অ্যাথলেটিকস মিটে!”
তরুণের তালু থেকে হাতটা ছাড়িয়ে শঙ্কর হাসল মাত্র। নিজেকে ভারিক্কি দেখাবার জন্য চেষ্টা চালাচ্ছে।
”কিছু পেলেন-টেলেন?”
”নাহ, তুমি?”
”সবাই সুস্থ আছে। পারিখের ডান হাতের কেড়ে আঙুলটা ফিল্ড করতে গিয়ে লেগেছিল, এখন ঠিক আছে। ওদের প্র্যাকটিসে আসার কোচটা দেরি করে হোটেলে গেছল, আর কী! ও হ্যাঁ, ভবানীশঙ্করকে মেয়েরা ছেঁকে ধরছে সই নেবার জন্য…ওহ বহুদিন পর একটা বাঙালি টেস্ট খেলছে, শুধু খেলাই নয়, রীতিমতো দাপটে…পিচটা দেখে আপনার কী মনে হল? গ্রাউন্ডসম্যান তো বলল থার্ড ডে থেকে বল ঘুরবে।”
”তোমার কী মনে হচ্ছে?”
”তাই মনে হল।”
”তাহলে তাই লিখে দাও।”
”ভুবু সম্পর্কে কী লিখবেন?”
শঙ্কর গম্ভীর স্বরে জানতে চাইল তবে চোখ উদ্বিগ্ন। ও-যেন ভবানীশঙ্করকে ইজারা নিয়েছে, ভালোমন্দ প্রচারের দায়টাও।
”এখানে রান পাবে।”
”বলছেন?”
তরুণ হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে উঠে বলল, ”পাবে না মানে, আলবাত পাবে। দেখুন আবার ও সেঞ্চুরি করবে।”
”বাজি?”
”নিশ্চয়, দশ টাকা।”
”বেশ।”
শঙ্কর খুশি। বন্ধুর উপর আস্থা যে দেখাবে তাকেই ওর পছন্দ।
”রাতে কী করছেন, আসুন না আমার ঘরে, একটা ছোটো রাম আছে।”
”শঙ্কু আমি এবার টেলিগ্রাফ অফিসে যাব, ওখান থেকে হোটেলে, তিনতলার এগারো নম্বর, ঘরেই থাকব। তরুণ চলি।”
মাঠ ছেড়ে বেরিয়ে আসার সময় দেখল, ভবানীশঙ্কর মাঠটা চক্কর দিয়ে জগ করছে। খেলার ব্যাপারে ছেলেটা সিরিয়াস। সরোজের ভালো লাগল।
ইংরেজি অক্ষরে বাংলা, তা-ও পরিচ্ছন্ন বড়ো হাতের, লিখতে একটু বেশিই সময় লাগে। টাইপটা জানলে সুবিধা হত। সরোজ প্রথমে বিব্রত বোধ করত, বিরক্তও। কয়েকবার ইংরেজিতেই রিপোর্ট পাঠিয়েছিল কিন্তু বার্তা সম্পাদক আপত্তি করেন। ”রোমানে পাঠান। প্রত্যেকের নিজস্ব একটা লেখার স্টাইল থাকে। ইংরেজি থেকে তর্জমা করলে সেটা নষ্ট হয়ে যায়।” এই ছিল তাঁর প্রধান যুক্তি। সরোজ বলেছিল, রোমানে রিপোর্ট পাঠালে অন্য ধরনের অসুবিধাও যে আছে। ”ধরুন, কথাটা কাঠ হয়ে গেল। আমি কাঠ লিখলাম ইংরেজিতে কে এ টি। সেটা বাংলায় হত, কাত! ব্যাপারটা বোঝাই গেল না বা অন্য মানে হয়ে গেল।”
জবাব পায়, ”ওরকম একটু-আধটু তো হতেই পারে। আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে যাবে।”
সরোজ প্রায় এক কলাম লিখল টেস্ট ম্যাচের নির্বাচকদের ও দল গড়ার, পিচের চরিত্র এবং ফলের সম্ভাবনা নিয়ে। নিউজিল্যান্ডের কারুর সম্পর্কে তার চাক্ষুষ ধারণা নেই। তাদের এড়িয়ে গেল। ফরজন্দ সম্পর্কে দুটি প্যারা আলাদাভাবে লিখল। লেগ স্পিনার চাই সাহেবদের বধ করতে আর এই ছেলেটির মধ্যে সম্ভাবনা আছে। কিন্তু নির্বাচকরা কি সাহসী হবেন ওকে খেলাতে?
সম্ভাবনা শব্দটা বসিয়ে সে ভেবেছিল, এতটা বলা কি ঠিক হল! ফরজন্দকে সে কখনও ম্যাচে দেখেনি। তারপর ভাবল, সবাই বলছে, উইকেটও প্রচুর পেয়েছে। গত মরশুমে বোম্বাইয়ের তেরোটার মধ্যে, আটটা উইকেট ওরই ছিল। এলেম না থাকলে কি হয়? রামিন্দারের সম্পর্কে লিখল, নিশ্চয় রানে ফিরে আসবে। কানপুর পিচ ওর ভাগ্য ফিরিয়ে দেবে। এই মাঠে ওর দুটো সেঞ্চুরি আছে, ইত্যাদি।
ভবানীশঙ্করকে নিয়ে একটু মুশকিলে পড়ল। কিছুই জানে না। বাঙালি সেন্টিমেন্টে যা সুড়সুড়ি দেবে এমন জিনিস লিখতে তার আগ্রহ নেই। ওসব তরুণ লাহিড়িদের ব্যাপার। লোভ হল শঙ্করের কাছে শোনা ঘটনাটা লিখে ফেলার। কিন্তু নিরস্ত হল। এসব খেলো জিনিসের সঙ্গে খেলার কী সম্পর্ক?
সরোজের মাথা গরম হয়ে উঠল। এই সব আজেবাজে ব্যাপার লিখে লিখেই ওদের সিনেমা স্টারদের পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। খেলোয়াড়রা শ্রদ্ধা পাবে মাঠের মধ্যে তাদের কাজকর্মের গুণে। মচমচে তেলেভাজার মতো তাদের মাঠের বাইরের কীর্তিকলাপগুলোকে খবরের কাগজ আর ম্যাগাজিনে সাজিয়ে খদ্দের ধরার যেন একটা হুজুগ এসে গেছে। এসব তার দ্বারা হবে না।
লেখাটা জমা দিয়ে সরোজ যখন রাস্তায় এসে দাঁড়াল তখন বিকেল প্রায় শেষ। সে হোটেলের উদ্দেশে হাঁটতে শুরু করল। টেস্ট ক্রিকেট খেলা হবে কিন্তু ঘরমুখো সাধারণ মানুষজনের মধ্যে তার কোনও প্রতিক্রিয়াই নেই। ঠিকই, কেন থাকবে? সরোজ নিজেকেই জবাব দিল। ক্রিকেট সে ভালোবাসে, নয়তো একসময় গভীরভাবে খেলেছিল কেন? কিন্তু এখন তার মনে হয়, এটা এদেশে বন্ধ করে দেওয়াই ভালো। এখন যেন পাঁচ দিনের দুর্গাপুজোর মতোই পাঁচ দিনের এই টেস্টম্যাচ। হইচই ছাড়া আর কিছু নয়। পিকনিকের মতো ব্যাপারটা। খাবার নিয়ে সকালে বেরিয়ে পড়া, সারা দুপুর রোদে বসে কিছু একটা অঘটনের জন্য অপেক্ষা। তারপর ফিরে যাওয়া। এত বছর ভারত খেলছে অথচ একটা ফাস্ট বোলার বেরিয়ে এল না। বিদেশে গিয়ে পরের পর শুধু হেরে আসা। অথচ তাই নিয়ে এইসব হুজুগেদের কোনো মাথাব্যথা নেই। কাজকর্ম ফেলে পাঁচ দিন ধরে মাঠে বসে কী পায়? সেই তো একঘেয়ে ঠুক-ঠুক। নিস্তেজ পিচে একই ধরনের বল। অবধারিত একটা ড্র। আর নানান বিশেষণে ভূষিত করে তাকে প্রশস্তি গাইতে হবে যদি কেউ সেঞ্চুরি করে ফেলে বা পাঁচটা উইকেট পায়।
হোটেলে রিসেপশনে চাবি চেয়ে জানল মান্না চাবি নিয়ে উপরে গেছে আধঘণ্টা আগে। তিনতলায় এসে বন্ধ দরজায় টোকা দিল। ভিতর থেকে কোনো সাড়া না পেয়ে, দরজার তালার হাতলটা মুচড়ে ঠেলতেই খুলে গেল।
ঘরে আলো জ্বলছে। আপাদমস্তক কম্বল মুড়ি দিয়ে মান্না, হয়তো ঘুমোচ্ছে। বাড়তি একটা লোহার ফোল্ডিং খাট, তাতে বিছানা।
সরোজ জুতো না খুলেই খাটের বাইরে পা দুটো বার করে রেখে চিত হয়ে শুয়ে পড়ল। মিনিট পাঁচেক পর খসখস শব্দ হতে মুখ ফিরিয়ে দেখল মান্না বগল চুলকোচ্ছে।
”আপনি বাইরে খেতে যাবেন নাকি ঘরে বসে হোটেলের খাবারই খাবেন?”
মান্না জবাব দিল না। চুলকুনি বন্ধ করে আবার নিথর হয়ে গেছে। কিছুক্ষণ পর মান্নার গলা কম্বলের তলা থেকে বেরিয়ে এল, ”শরীর ভালো নয়।”
”যে-কাজে বেরিয়েছিলেন হয়েছে?”
”অনেকটা।”
সরোজের মনে হল লোকটি কথা বলতে অনিচ্ছুক। আর কিছু সে জানতে চাইল না। টেবলে ইংরেজি খবরের কাগজ দেখে সে হাত বাড়িয়ে তুলে নিয়ে প্রথমেই খেলার পাতায় চোখ বোলাল।
বিমান থেকে নামা নিউজিল্যান্ডারদের গ্রুপফোটো, প্রত্যেকের গলায় মালা। ভারতীয়রা একদিন আগে এসেছে তাই আর গ্রুপফোটো নেই। নেটে ব্যাট করা ভবানীর ডাবলকলাম ছবি। ছেলেটাকে এখন খবরের কাগজ ধরেছে। বহু কাল পর একটা নতুন মুখ পেয়েছে, তা ছাড়া ওর আসাটাও নাটকীয়। ডেবুতেই ডাবল সেঞ্চুরি, ভারতীয়দের মধ্যে প্রথম। বদ্ধ ডোবায় বড়ো একটা পাথর ফেলে যতটা তরঙ্গ তোলা যায়, ভবানী তা করেছে। রামিন্দরেরও একটা।
ছবি, ব্যাট হাতে চেয়ারে বসে। তলায় লেখা : এটাই কি ওর শেষ টেস্ট? নাকি গ্রিন পার্ক দেবে ওকে সবুজ জীবন? সরোজের মনে হল, রামিন্দরের চোখে উদ্বেগ আর শঙ্কা যেন লুকোনো নেই। সরোজ কাগজটা রেখে আবার পাশে তাকাল। মান্নার কপালটুকু কম্বল থেকে বেরিয়ে।
”হয়েছে কী?”
”কিছু না।…ঠান্ডা লেগেছে।”
”আচ্ছা আপনি কোনো গন্ধ পাচ্ছেন?”
সরোজ নাক কুঁচকে জোরে জোরে কয়েকবার শ্বাস নিল।
”না তো!”
কম্বল নামিয়ে রবীন মান্না হাসিমুখ বার করলেন।
”একটা এক্সপেরিমেন্ট করলাম…বিয়ার খেয়েছি তার গন্ধ পান কি না।”
”য়্যাঁ!….কতটা? কখন খেয়েছেন?”
”দুপুরে, এক গ্লাস। ওরা ধরে পড়ল খেতেই হবে। বড্ড স্ট্রেস আর স্ট্রেইন যা কাজ আমার। তাহলে গন্ধ পাননি। ঠিক বলছেন?”
”একদম নয়।”
”আসলে কী জানেন, কলকাতায় একবার খেয়ে বাড়ি ফিরতেই বউ যা শুরু করে…কান্নাকাটি, আমার মাকে ডেকে এনে… সে এক এলাহি ব্যাপার। গা ছুঁয়ে প্রতিজ্ঞা করালে আর ছুঁতে পারবে না। আরে মশাই আমি কি কচি খোকা? মাঝেমাঝে ঠিকই চালিয়েছি, ধরতে পারেনি।”
”নিজের পয়সায় খান না পার্টি খাওয়ায়।”
সরোজ অত্যন্ত স্বাভাবিক নিরুৎসুক স্বরে বলল যেন মান্না আহত না হয়। লোকটার কৃপাতেই তো ঘরে আশ্রয় মিলেছে!
”এমনভাবে ধরে-না কী বলব!” মান্না কম্বল ছুড়ে উঠে বসল উত্তেজিত হয়ে। ”আমি জানি এটা অন্যায়। লোকগুলো সুবিধা নেবে বলেই খাওয়ায়। কিন্তু কী জানেন, খেতে বেশ ভালোই লাগে। মনটাও বেশ ভালো হয়ে যায়। তবে ওই মাপা এক বোতল বিয়ার। গড়ের মাঠে কিছুক্ষণ কাটিয়ে, ছোটো এলাচ দেওয়া মিঠে পান মুখে দিয়ে তবে বাড়ি ফিরি।”
”এখানে তো বউ নেই একটু বেশি খেতে পারতেন?”
”না না মাতালটাতাল হয়ে শেষে কেলেঙ্কারি করে ফেলব। তবে আমি একটা ব্যাপার ঠিক করে রেখেছি, যতদিন চাকরি করছি ততদিনই, তারপর আর ছোঁব না।”
”তার মানে খাওয়াবার লোক যখন আর পাবেন না…”
”দ্যাটস ইট। নিজের পয়সায় এসব বিষ আর খাব না। উফফ ঠিক ধরেছেন তো, এই না হলে রিপোর্টার।
সরোজ ঘড়ি দেখল। শঙ্কর কী বলেছিল সেটা মনে করতে গিয়ে তালগোল পাকিয়ে গেল। ও আসবে না আমি যাব ওর হোটেলে? কিছুক্ষণ ধস্তাধস্তি করে স্মৃতির টুকরোগুলোকে জোড়া দিতে ব্যর্থ হয়ে সে উঠে পড়ল।
”খেতে চললেন?”
”হ্যাঁ। আপনি তো ঘরেই থাকবেন?”
”অম্বলের মতো হচ্ছে, বড্ড বেলা করে রুটি আর মাংস খেয়েছি।”
”যদি কেউ আসে তো বলবেন সঙ্গম হোটেল হয়ে ফুটু-তে গেছি। মনে থাকবে?”
”নিশ্চয়।”
মিনিট চারেক হেঁটে সরোজ সঙ্গমে পৌঁছল। দোতলায় উঠে শঙ্করের ঘরের দিকে যেতে যেতেই শুনতে পেল বন্ধ দরজার ওপারে খুব চড়া গলায় কথা হচ্ছে। কেউ যেন কিছু একটা বোঝাতে চাইছে, আর কেউ যেন তা মানতে চাইছে না।
দরজায় টোকা দিতেই ভিতর থেকে শঙ্করের গলায় ”কাম ইন” শুনে সরোজ নব ঘুরিয়ে পাল্লা খুলল।
তিনটি লোক। শঙ্কর, তরুণ আর অভয়ঙ্কর। টেবলে রামের বড়ো বোতল তার তিন-চতুর্থাংশ খালি। টেবলে দুটি খালি গ্লাস এবং শঙ্করের হাতে একটি। দুটি প্লেটে কাবাব আর কাঁচা পেঁয়াজ, লংকা, শশা।
”ইয়া সরোজদা, আসুন আসুন। সরি আপনার ওখানে যেতে পারিনি। দেখতেই পাচ্ছেন…গ্লাস নিন একটা।” শঙ্কর দু’হাত বাড়িয়ে অভ্যর্থনা জানাল।
”এত চেঁচাচ্ছিল কে, অভয়ঙ্কর?”
”সরোজদা আপনি তো প্রবীণ লোক, অনেক প্লেয়ার দেখেছেন, রঞ্জি ট্রফিতেও খেলেছেন।” তরুণ চেয়ারে সিধে হয়ে বসল। ”আচ্ছা বলুন তো রামিন্দর রান পাচ্ছে না কেন?”
”আমি জানি তাই বলেছি ওর মেন্টাল ডিজেস্টার ঘটেছে।”
”তুমি বোম্বাইয়ের লোক আর রামিন্দরের বাড়ি দিল্লি, ওর ঘরের এসব খবর পেলে কী করে?” তরুণের এই গলাই সরোজ বাইরে থেকে শুনেছে।
”আরে বাবা সব খবর সব জায়গায় পাওয়া যায় যদি ঠিক জায়গায় ঠিক সময়ে কান রাখতে পারো। লাস্ট ইয়ারে রঞ্জি ফাইনাল খেলতে বোম্বাই যখন দিল্লি গেছল তখন ওখানেই প্লেয়াররা সবাই জেনেছিল। রামিন্দার আর পারবে না।”
”ব্যাপারটা কী?”
সরোজের মনে হল কথাগুলো শোনা দরকার সেজন্য এদের দলে ভিড়লে ওরা স্বচ্ছন্দ হবে। টেবলে দুটো বাড়তি গ্লাসের একটা তুলে নেবার সময় একটা কাবাব মুখে ফেলল। শঙ্কর ব্যস্ত হয়ে গ্লাসে রাম ঢেলে দিল, একটু বেশিই। খালি গ্লাস দুটোতেও ঢালতে গেল। তরুণ আর অভয়ঙ্কর একসঙ্গে জানাল আর তারা খাবে না।
”তরুণদা আগাম সেলিব্রেট করছেন ভুবুর সেঞ্চুরির, সরোজদা জল না সোডা?”
”নিশ্চয়। হোক সেঞ্চুরিটা আবার খাওয়াব। একটা বাঙালি ছেলে কতদিন পর যে…সত্যি বলতে কী এইবার প্রেসবক্সে একটু হাত-পা ছড়িয়ে বসতে পারব। এতকাল তো দিল্লি বোম্বাই মাদ্রাজই শুধু জ্যাঠামশাই হয়ে থেকেছে।”
সরোজ জল ঢেলে গ্লাসটা ভরতি করে বড়ো চুমুক দিল। ”রামিন্দারের কী হল, পারবে না কেন?”
”ও যখন ওয়েস্ট ইন্ডিজ ট্যুরে তখন ওর বউ একজনের সঙ্গে অ্যাফেয়ার শুরু করে। এ বিগ সিন্ধি বিজনেসম্যান। ফিরে এসে রামিন্দার জানতে পেরে ভীষণ শকড হয়।”
অভয়ঙ্কর কাবাবের জন্য ঝুঁকল। সরোজ প্লেটটা তুলে এগিয়ে ধরল। দুটো তুলে নিয়ে অভয়ঙ্কর বলল, ”আচ্ছা বানিয়েছে কিন্তু।”
”আনাচ্ছি আর একটা।”
শঙ্কর দরজা খুলে বেরোল। সরোজ জিজ্ঞাসু চোখে অভয়ঙ্করের দিকে তাকাল।
”বউকে ঘরে বন্ধ করে রাখল, হুইপ করল কিন্তু বউ আর বদলাল না, সে-মেয়ে গোঁ ধরেই রইল- রামিন্দারের সঙ্গে থাকবে না। জানোই তো কীরকম ক্রুড, রাফ, আনএডুকেটেড আর বদরাগি। কন্টিনিউয়াস সাত দিন বউকে না খেতে দিয়ে রেখেছিল, এক গ্লাস জল পর্যন্ত নয়।
”এসব খবর কোথা থেকে কী করে পেলে?” তরুণের চ্যালেঞ্জ জানাবার ভঙ্গিটা আসলে উসকানিই।
”আরে বাবা বলেছি না, দিল্লির ক্রিকেটার সার্কলে সবাই জানে।…বউ একদিন পালিয়ে সোজা তার প্যারামারের কাছে চলে যায়, সে তাকে দিল্লির বাইরে একজায়গায় লুকিয়ে রাখে। এদিকে রামিন্দার সেই বিজনেসম্যানের অফিসে গিয়ে রিভলভার দেখিয়ে বলে, বউকে বার করে দাও। অফিসে হইচই কাণ্ড, পুলিশ এসে রামিন্দারকে অ্যারেস্ট করে। সে মামলা এখনও মেটেনি। যাই হোক, লোকটা চেয়েছিল রামিন্দার ডিভোর্স করুক, ও একদমই রাজি নয়। এরপর দু’বার অ্যাটেম্পট হয়েছে ওর লাইফের উপর। প্রথমবার ওর দুটো পাঁজরা ভাঙে স্কুটার অ্যাকসিডেন্টে, আকবর রোডে একটা ট্রাক এসে ধাক্কা মেরেছিল। দ্বিতীয়টা বিড়লা মন্দিরের কাছে রাত্রে গুন্ডারা পিটিয়েছিল, কাগজে এসব বেরোয়নি, দু’মাস হাঁটুতে প্লাস্টার নিয়ে বিছানায় ছিল। এখন ও ভয়ের মধ্যে দিন কাটায়, কখন-যে আবার অ্যাটেম্পট হবে।”
”অভয়ঙ্কর বলছে এজন্যই ও খেলতে পারছে না, আর পারবেও না। কিন্তু আমার মনে হয়েছে ওর ব্যাটিং টেকনিকটাই ভুল।” তরুণ অত্যন্ত গম্ভীর হয়ে সরোজের দিকে তাকাল।
”তিন হাজারের ওপর রান পেয়েছে ভুল টেকনিকে?”
”তখন সাইড অন ব্যাট করত কিন্তু যখন থেকেই ও স্টান্স বদলাল, টু আইড, চেস্ট অন খেলতে শুরু করল তখন থেকেই ট্রাবলে পড়ল।”
সরোজ বিরক্ত বোধ করল। এইসব পণ্ডিতি কথাবার্তা তার কাছে হাস্যকর লাগে। মাদ্রাজ থেকে তরুণের একটা রিপোর্টে পড়েছিল, ম্যাকগ্রেগরের ব্যাটিং গ্রিপে ভুল আছে বলে স্লিপে দু’বারই ধরা পড়েছে। লোকটার ন’টা সেঞ্চুরি আছে টেস্টে।
গ্লাসটা শেষ করে টেবলে রাখা মাত্রই তরুণ সেটায় আবার ঢালার জন্য বোতলটা তুলে নিল। সরোজ স্মিত চোখে তাকিয়ে। শঙ্কর ঘরে ঢুকে বলল, ”এখুনি আনছে।”
”সব থেকে ট্র্যাজিক ব্যাপার হল”, অভয়ঙ্কর গলা নামিয়ে বলল, ”রামিন্দার দিল্লি থেকে পালাতে চায়। বোর্ডের কাছে পারমিশন চেয়েছিল হায়দরাবাদে খেলার জন্য, পারমিশন পায়নি।”
সরোজ লক্ষ করল তরুণের মুখ। ওর কাছে এটা একটা খবর। নিশ্চয় কাল স্টোরি করবে।
”যেজন্য এত ঝামেলা সেই ডিভোর্সটা দিয়ে দিলেই তো হয়, গন্ডগোল আর থাকবে না। আমি হলে তাই করতাম।”
শঙ্কর এককথায় রামিন্দার সমস্যা মিটিয়ে দেবার পথ বাতলাল।
”তুমি এই পাঞ্জাবিকে জানো না শঙ্কু।” অভয়ঙ্কর নিচু গলাতেই বলল, ”ভীষণ রিভেঞ্জফুল। ও একদিন বদলা নেবেই। বউকে যদি খুন করে তাহলে আশ্চর্য হব না।”
একসময় আলোচনা ভবানীশঙ্কর, ফরজন্দ আলি, ভাণ্ডারকর, রেডিয়ো কমেন্টেটর ইত্যাদি ছুঁয়ে ব্যক্তিগত প্রসঙ্গে চলে আসতে তরুণ ঘুম পাচ্ছে বলে উঠে গেল। আর এক প্লেট কাবাব এল। অধিকাংশ শেষ করল সরোজ।
”সরোজদা আপনি একটু হুঁশ রাখবেন।” অভয়ঙ্কর হাসি টিপে রেখে বলল।
”কেন?” ভ্রূ কুঁচকে সরোজ বোঝার চেষ্টা করল।
”আপনার গ্রেট ফ্রেন্ড এসেছে…কমলা টাওয়ারে ঢুকতে দেখলাম…কামদার।”
”সেরেছে।” ভয় পাওয়া ভাব চোখে মুখে ফুটিয়ে সরোজ উঠে দাঁড়াল। এম এস কামদার একদা তিনটি সরকারি ও আটটি বেসরকারি টেস্ট খেলেছেন। বয়স এখন সত্তর। ছোটো ছোটো কাগজের জন্য টেস্টম্যাচ রিপোর্ট করার ইচ্ছায় প্রথমে তিনি কাগজের সম্পাদকদের জ্বালিয়ে মারেন এবং তিন-চারটি কাগজের বরাদ্দ নিয়ে প্রেসবক্সে এসে সাংবাদিকদের ব্যতিব্যস্ত রাখেন। যা টাকা পান তাতে টেস্ট কেন্দ্রে যাওয়া থাকা-খাওয়ার খরচটা উঠে যায়। তবে অনেক জায়গাতেই চেনাশোনা লোকের বাড়িতে ওঠেন আর খাওয়াটা এর-ওর ঘাড় দিয়ে সেরে নেবার চেষ্টায় থাকেন। ওর প্রধান দুর্বলতা, মদ্যপানে। সামান্য পান করেই মাতাল হয়ে চেঁচামেচি আর গালিগালাজ শুরু করে দেন। কেউ খাওয়াবে বললে এই বয়সেও মাইলের পর মাইল হেঁটে যেতে রাজি।
”কোথায় আছে কামদার?”
”জানি না।”
”আর নয়, এবার কেটে পড়ি।” সরোজের সঙ্গে সঙ্গে অভয়ঙ্করও বেরিয়ে এল।
সিঁড়ির কাছে এসে সরোজ ”ওহ ভুলে গেছি, এক মিনিট।” বলেই শঙ্করের ঘরে ফিরে এল।
”তরুণ রাম এনেছে, কাবাব কিছুটা শেয়ার করব।”
সরোজ দুটো দশ টাকা নোট টেবলে রাখল।
”একী একী! না না সরোজদা…”
”কোনো আপত্তি নয়, দাদা দিলে নিতে হয়।”
সরোজ দ্রুত বেরিয়ে সিঁড়িতে অপেক্ষমাণ অভয়ঙ্করের কাছে এসে বলল, ”ওর কলমটা আমার কাছে রয়ে গেছল।”
”ছেলেটা কেমন?”
”ভালো।”
”ঘোষালের খুব বন্ধু।”
”হ্যাঁ।”
হোটেলের ঘর অন্ধকার ছিল। আলো জ্বেলে দেখল মান্না গভীর ঘুমে। নিঃশব্দে সে পোশাক বদলে বিছানায় উঠল। ঘুমিয়ে পড়ার আগে বীণার মুখটা চোখে ভেসে এল। একটু পরে সে-ও ঘুমিয়ে পড়ল।
চার
ভারত টস জিতে ব্যাট করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। রবি আনন্দ ঝুঁকি নিয়ে বীরত্ব দেখাবার মানুষ নয়। তা ছাড়া, গ্রিন পার্ক উইকেটে নতুন বলে পনেরোটা ওভার কাটিয়ে দিতে পারলে একটু ধৈর্যবান প্রথম শ্রেণির ব্যাটসম্যান ক্লান্ত না হওয়া পর্যন্ত খেলে যেতে পারবে এই নিউজিল্যান্ড বোলিংকে।
দুই আম্পায়ার, পুনার নন্দন অধিকারী আর আহমেদাবাদের ছটু পটেল মাঠে নেমেছে তাদের পিছনে জেরি মার্কস আর তার দল। অধিকারীর এটা প্রথম টেস্টম্যাচ।
ফুটবল টিমের মতো নিউজিল্যান্ডাররা মাঠে নামল। একসঙ্গে ছুটে উইকেটে পৌঁছে হাত তুলে দর্শকদের অভিবাদন জানিয়ে, কেউ ছোটাছুটি, কেউ ব্যায়াম শুরু করল। ফিটনেসে যেন টইটম্বুর। সরোজের কাছে মজা পাবার মতো ব্যাপার এটা। এর আগে এমন করে কোনও টেস্ট দলকে সে নামতে দেখেনি। গুরুগম্ভীর চালে ক্যাপ্টেন আস্তে আস্তে হাঁটবে, হাতের বলটা বড়োজোর সামান্য লোফালুফি করতে পারে! তার কয়েক হাত পিছনে টিমের অন্যান্যরা। এটাই রেওয়াজ ছিল। আর এখন? বদলে যাচ্ছে ক্রিকেটের হালচাল। অস্থির, অশান্ত, ছটফটে ভঙ্গির দ্বারা এখনকার ছেলেরা ব্যাপারটাকে উত্তেজক, প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক চেহারা দিচ্ছে। টিভি আর বিজ্ঞাপনের টাকা এটা করিয়েছে।
সরোজ এক্সারসাইজ বুক খুলে প্রথম পাতায়, তারিখ, বার, সময় লিখে অপেক্ষা করতে লাগল ভারতের দুই ওপেনারের মাঠে নামার জন্য।
প্যাভিলিয়নের দিকে সাইট স্ক্রিনের পাশে জমি থেকে চওড়া রকের মতো চার-পাঁচটা ধাপ, তাতে টেবল চেয়ার পাতা, মাথায় শামিয়ানা। টেবলে পিন দিয়ে আঁটা কার্ডে কাগজের নাম লেখা। এই হল প্রেসবক্স। দ্বিতীয় ধাপে সরোজের দু’পাশে স্থানীয় হিন্দি কাগজে দুজন আর মাদ্রাজের ইংরেজি দৈনিক ও ত্রিবান্দ্রামের মালয়ালি সাপ্তাহিক। পিছনে সর্বোচ্চচ ধাপে দুটি সাহেব আর বোম্বাই দিল্লির ইংরেজি দৈনিক। অভিজাত শ্রেণি হিসাবে ওই ধাপটা গণ্য হবে। লাঞ্চ এবং টি-এর পাঁচটি কুপন একজন নাম মিলিয়ে মিলিয়ে বিতরণ করে গেছে।
কে নামবে আলভার সঙ্গে? আজ প্রেসবক্সে পৌঁছে, অন্যান্যদের সঙ্গে ”হ্যালো, হাউ আর ইউ”গুলো সারতে সারতে সরোজ শুনেছিল রামিন্দার নাকি ওপেন করতে চাইছে না। থ্রি ডাউন নামতে চায়।
”সরোজদা, শুনেছেন নাকি কিছু কেন রামিন্দারা ওপেন করতে চাইছে না?” তরুণ উঠে এসে ফিসফিস করে জানতে চাইল।
”না, আমি তো এই প্রথম শুনেছি। তুমি কিছু জানো কি?”
”না। শঙ্কুকে দেখছি না বোধহয় ভবানীর কাছে গেছে। ও এলে হয়তো ঠিক খবর পাওয়া যাবে।”
তরুণ পিছনের ধাপে ডানদিকে নিজের চেয়ারে ফিরে গেল।
মাঠ ঘিরে তুমুল হাততালি, চিৎকার শুরু হতেই সরোজ গলা উঁচিয়ে দেখল আলভা আর রামিন্দার নামছে। শঙ্করও সেই সময় নিজের চেয়ারে এসে বসল।
প্রথম ওভার খেলবে রামিন্দার। মিল এন্ড থেকে বল করবে বয়েড। গরম রোদ, ফুরফুরে বাতাস। আমেজটা শীতের। মাঠের আলো যথেষ্টই। প্রেসবক্সের শামিয়ানাটা না থাকলে ভালোই লাগত। এই সময় বীণার শালটা গায়ে জড়াতে পারলে মন্দ লাগত না। কিন্তু সে ঠিক করে ফেলেছে, ব্যবহার করে শালটাকে ময়লা করবে না। হাতাওলা সোয়েটারেই চালিয়ে নেবে।
বয়েডের প্রথম বল শর্ট লেংথ, অফের বাইরে এবং যথেষ্ট জোরে। রামিন্দার ছেড়ে দিল। লাইন এবং লেংথ খোঁজার সন্ধানটা বয়েড চালিয়ে গেল। মনে হচ্ছে তার সম্মতি ছাড়াই বলটা বেশি সুইং করে যাচ্ছে। রামিন্দারকে ঈষৎ অস্বচ্ছন্দ মনে হল। কোনো রান হল না প্রথম ওভারে।
মার্কস বলটা ছুড়ে দিল থার্ডম্যান থেকে মন্থর গতিতে এগিয়ে আসা স্যান্ডার্সনের উদ্দেশে। সরোজ নড়েচড়ে বসল। ছেলেটি বাঁ হাতে জোরে বল করে। এখন নাকি বিশ্বের সবথেকে দ্রুত। প্রথম বল ফুলটস। আলভা বলটা ঘুরিয়ে দিয়ে থার্ডম্যান থেকে একটা রান নিল। রামিন্দারও একইভাবে একটা রান পেল। ওভারটা শেষ। বয়েড এবার রামিন্দরকে। কিছুটা অনিশ্চিতভাবে রামিন্দার ওভারপিচ হওয়া বলগুলোকে খেলল। এবার স্যান্ডার্সনের সামনে আলভা। প্রথম বলেই একটা রান প্রথম ও দ্বিতীয় স্লিপের মধ্য দিয়ে। রামিন্দার এগিয়ে এসে গুডলেংথ জায়গাটায় ঝুঁকে দেখছে। দু-তিনবার ব্যাট দিয়ে ঠুকল। স্যান্ডার্সন মাথা নেড়ে যেন কিছুর অনুমোদন জানাল। ওভারটা সে শেষ করল দশটা বলে।
পর পর তিনটে নো-বল ডাকল অধিকারী। তৃতীয় ডাকের পর স্যান্ডার্সন অধিকারীর পা থেকে মাথা পর্যন্ত তাকিয়ে নিয়ে বল করতে ফিরে গেল। রামিন্দার বল তিনটি খেলার চেষ্টা করেনি। চতুর্থটা এতবড়ো ওয়াইড হল যে সোজা থার্ড স্লিপ বলটা পেল।
গ্যালারিতে গুঞ্জন উঠল। পটেল যখন এগিয়ে ফলো-থ্রুর জমির উপর চোখ বুলিয়ে স্যান্ডার্সনের দিকে তাকাল কিন্তু কিছু বলল না। স্যান্ডার্সন দৃষ্টিটা অগ্রাহ্য করল।
পাশের হিন্দি কাগজের লোকটির সামনে টেবলে বাইনোকুলার পড়ে। সরোজ ‘মে আই’ বলে অনুমতির জন্য অপেক্ষা না করেই তুলে চোখে রাখল। স্যান্ডার্সনের মুখটা রাগে থমথম লাগছে। মার্কস এগিয়ে এসে কী বলল। ওভারে চারটি অতিরিক্ত রান ছাড়া ব্যাট থেকে রান আসেনি।
এবার টেনশন দেখা দিয়েছে। আলভাকে একটা ঝোড়ো ওভার দিল বয়েড। আলভা স্টাইলিশ স্ট্রোক প্লের জন্য খ্যাত। বিবেচকের মতো সে ডিফেন্সিভ, সতর্ক চোখে ওভারটা শেষ করল। ব্যাকফুটে বলগুলোকে সামলেছে। ওভারে রান হল না।
এখান ওখান থেকে বিদ্রূপাত্মক টিপ্পুনি মাঠে ভেসে গেল স্যান্ডার্সন যখন আবার শুরু করার জন্য ক্যাপটা অধিকারীকে দিতে এগোল। বোলিং মার্কের থেকে একটু বেশিই সে হেঁটে গেল। রামিন্দার স্থির দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে।
সরোজের মনে হল ভুল করছে। অবশ্য ব্যাটসম্যানভেদে এটা নির্ভর করে, কিন্তু সে নিজে কখনও ফাস্ট বোলার যখন বল করার আগে ফিরে যেতে থাকে তখন তার চলার দিকে তাকাত না। অন্যদিকে থাকিয়ে থাকত বোলার যখন বল ছাড়ার আগে লাফিয়ে উঠতে যাচ্ছে তখনই সে পূর্ণদৃষ্টিতে তাকাত। ফাস্ট বোলারের দিকে সারাক্ষণ তাকিয়ে থাকতে কীরকম যেন সম্মোহক বোধ আবিষ্ট করে ফেলে।
স্যান্ডার্সন বলটা একবার নিজের কপালে ঠুকে নিয়েই ঘুরল। এবং ছুটতে শুরু করল। রামিন্দার আদৌ বলটা দেখতে পেয়েছিল কি না সরোজের তাতে সন্দেহ আছে। যদি সে কিছুমাত্রও নড়ে থাকে তাহলে নিশ্চিতই স্কোয়ার লেগের দিকেই। বলটা তার বুকে লাগতেই সে কুঁজো হয়ে বসে দু’হাতে চেপে আস্তে আস্তে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল। স্যান্ডার্সন তখন কোমরে হাত দিয়ে জনতার দিকে তাকিয়ে। চিৎকার তুমুলভাবে এবং গালিগালাজও।
”শালা রাতভোর ড্রিঙ্ক করেছে, খেলবে কী করে?”
সরোজ বিরক্তি চেপে বাইনোকুলারের মালিককে বলল, ”কী করে জানলে? তুমি দেখেছ?”
”জানার কী আছে, রামিন্দার হেভি ড্রিঙ্কার সবাই জানে।”
মালয়ালাম সাপ্তাহিক বিড়বিড় করল : ”ইন্টিমিডেটিং বোলিং…খুন করতে চায়।”
সরোজ মৃদু স্বরে বলল, ”পুরো দোষটাই ব্যাটসম্যানের। এ-বল কোনো টেস্ট ব্যাটসম্যান যদি খেলতে না পারে তাহলে…”
রামিন্দারকে ঘিরে ভিড় এবং শুশ্রূষার তৎপরতা শেষ হল মিনিট দুয়েকেই যখন সে বুকে হাত বোলাতে বোলাতে পায়চারি করে আবার ক্রিজে দাঁড়াল। করতালি ধ্বনি তাকে দেওয়া হল উৎসাহ বর্ধনের জন্য।
কেমন যেন নড়বড়ে মনে হচ্ছে রামিন্দারকে। সরোজ ঝুঁকে ডানদিকে তাকাল। চারটে চেয়ার পরে অভয়ঙ্কর। চোখাচোখি হতেই সে মুখভাবে জানাল-কী বলেছিলাম? তারপর হাত নেড়ে বোঝাল-শেষ হয়ে গেছে।
স্যান্ডার্সনের পরের বলটা খাড়াই লাফিয়ে উঠল। রামিন্দারের গ্লাভসে অথবা ব্যাটের হ্যান্ডেলে লেগে স্লিপের মাথার উপর দিয়ে বাউন্ডারিতে পৌঁছে গেল। উচ্ছ্বাস জানাবার ব্যাপার নয়, কিন্তু জনতা জানাল। বাকি বলগুলো শর্ট, আঘাত করার জন্যই। প্রত্যেকটাই খেলতে গিয়ে সে ফসকাল এবং কোনোক্রমে টিকে গেল।
আলভাকে বিব্রত করার জন্য ফরোয়ার্ড শর্ট লেগকে একটু এগিয়ে আনা হল, স্লিপে এল আর একজন। গ্যালারিতে একটা জটলা পাকিয়ে উঠে হইচই শুরু হয়েছে, পুলিশের লাঠি দেখা যাচ্ছে। আলভা সেদিকে একবার তাকিয়ে নিয়ে স্টান্স নিল।
বয়েডের কাছ থেকে একটা শর্ট বল এবার প্রত্যাশিত। বস্তুত একটার জায়গায় তিনটে এল। চমৎকারভাবে পিছনে হেলে আলভা বলের গতিপথ থেকে নিজেকে সরিয়ে নিল। চতুর্থ বলে সে পিছিয়ে খেলল কিন্তু বলটা ব্যাট-প্যাডের ফাঁক দিয়ে গলে অফ স্ট্যাম্পটাকে জমি থেকে উপড়ে উইকেটকিপারের কাছাকাছি পৌঁছে দিল। আলভা পিছন ফিরে অনুমোদনের ভঙ্গিতে মাথা নেড়ে ব্যাটটা একবার ফাঁকা চালিয়ে ফিরে আসতে শুরু করল।
তিন নম্বর, বলাবাহুল্য, ভবানীশঙ্কর। দীর্ঘ ছিপছিপে, সপ্রতিভ। সরোজ একমত শঙ্করের সঙ্গে, গ্যারি সোবার্সের মতোই ওর চলন। দীর্ঘস্থায়ী হাততালি নিয়ে ভবানী ক্রিজে পৌঁছল। রামিন্দারকে এখন অনেকটা ধাতস্থ দেখাচ্ছে। এগিয়ে এসে কথা বলল, ভবানী মাথা নেড়ে সায় দিয়ে গার্ড নেবার পর কাছের ফিল্ডারদের উপর দিয়ে চোখ আলতো বুলিয়ে স্যান্ডার্সনের বাকি দুটি বল সহজভাবে খেলল।
মাত্র দুটি বল। সরোজের মনে হল, ছেলেটি সেই ধরনের যারা সংকটের মুহূর্তে নার্ভের ক্ষমতাকে গুছিয়ে নিয়ে কাজে লাগাতে পারে…ম্যাচের দিন সকালেও হয়তো উৎকণ্ঠায় ছটফট করে, কিন্তু মাঠে একবার পা দিলেই নিজের উপর পুরো কর্তৃত্ব নিয়ে নেয়, রিফ্লেক্সে বিদ্যুতের গতি আনে। এরাই বড়ো ব্যাপারের ব্যাপারি। ওর দুটি বল খেলা থেকেই সরোজ বুঝেগেল, অন্যেরা সিদ্ধান্তে পৌঁছবার আগে মনটাকে তৈরি করে নিতে যত সময় নেয় ভবানীর যেন তার থেকেও বেশি সময় হাতে থাকে এমন একটা ধারণা দর্শকদের চেতনায় ঢুকে যায়। বড়ো খেলোয়াড়রাই শুধু এটা করতে পারে।
পরের ওভারে যথাসময়ে রামিন্দার ব্যাটটা নামাতে পেরেছিল বলেই বয়েডের পাজি ইয়র্কার সামলাতে পারল। দ্বিতীয় বল বুকের সামনে থেকে ঘোরাল লং লেগে। উইকেটের মধ্যে ওর দৌড়নোটা সরোজের কেমন যেন অপরিচ্ছন্ন লাগল। একদা শর্ট রান নেওয়ায় রামিন্দারকে অনেকে বিশ্বের অদ্বিতীয় বলেছে। দুটো রান সে পড়িমরি করে পেল। বয়েড বিড়বিড় করে মাথা ঝাঁকাল। তার পঞ্চম বল লেগ স্টাম্পে পড়ে অফ স্টাম্পের বেল তুলে নেবার পূর্বমুহূর্তে অধিকারীর চিৎকার ”নো-বল” প্রতিধ্বনিত হল। বয়েড দ্রুত ঘুরে অধিকারীকে কিছু একটা, নিশ্চয় খারাপ কথা, বলতে গিয়ে নিজেকে সামলে নিল।
বয়েড বোলিং মার্কে ফিরল যেন খুশিয়াল মেজাজে। হবে নাই বা কেন। সরোজ ভাবল, ওর প্রত্যয়ের যথেষ্টই কারণ আছে। বয়েড এবং রামিন্দার, দুজনেই বুঝতে পারছে ফিল্ডিং আর বোলিংয়ের মারমুখীন সামগ্রিক চাপটা একটানা বজায় রাখার প্রতিক্রিয়া এবার শুরু হয়েছে। অন্য খেলোয়াড়দের চোখে প্রত্যেক ব্যাটসম্যানের সাহসের একটা মাপ থাকে। তবে গাড্ডায় পড়লেও ভয়টা অনেকখানি কাটিয়ে দিতে পারে পরিচিত পরিবেশ, এমনকী স্লিপ ফিল্ডারদের বকবকানিও ব্যাটসম্যানকে সহজ করে দিতে পারে। সরোজের ইচ্ছা হচ্ছে চেঁচিয়ে রামিন্দারকে বলে-তাড়াহুড়ো নয়, সময় নাও। চারপাশটা দ্যাখো, তাকাও। শুষে নাও তোমার বহু দেখা মুখ, চলাফেরা, রং, শব্দ, এমনকী ওই চিমনির ধোঁয়াও।
বয়েডের শেষ বলটা কোথায় পড়ল সরোজ দেখতে পেলে না, রামিন্দার পা বাড়িয়ে ঝুঁকে পড়ায়। তবে ব্যাটের কানায় লাগার আওয়াজ এবং উইকেটকিপারের নিশ্চিত উল্লাস শুনতে ভুল হয়নি। রামিন্দার আউট।
ঝুঁকে ডানদিকে তাকাল সরোজ। অভয়ঙ্করের মুখ হাসিতে ভরা। পাশের লোককে বাঁ হাতের তালু উলটে ব্যাটের মতো করে ফরোয়ার্ড ডিফেন্সিভ আর ডান হাত দিয়ে বলটা কোথায় লেগেছিল দেখাচ্ছে।
”হি ইজ ফিনিশড।”
কথাটা কানে এল সরোজের। বুকের গভীরে বিষণ্ণতা ছড়িয়ে পড়ল। সে দুঃখ পাচ্ছে রামিন্দারের জন্য। ব্যক্তিগত জীবন যদি সত্যিই ওর খেলার কেন্দ্রবিন্দুতে পৌঁছে থাকে তাহলে শেষ হয়ে গেছে। হয়তো ওর শেষ টেস্টম্যাচটি সে দেখছে।
রামিন্দার সত্যিই কি ভীত? ওকে খুনের চেষ্টা হয়েছে অথচ জ্যামাইকায় দুটো বল বুকে একটা কপালে লাগা সত্ত্বেও সে সাড়ে ছ’ঘণ্টা ভারতীয় ইনিংসে প্রবেশের একটা দরজা বন্ধ করে রেখেছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজ ফাস্ট বোলারদের কাছ থেকে। হারা ম্যাচ ড্র হয়। মাত্র দু’বছর আগের ঘটনা।
ধীরে ধীরে রামিন্দারের প্রত্যাবর্তনটি সরোজ মনে গেঁথে রাখল। ঠিক করে ফেলল আজ সে এইটাই বর্ণনা করবে। মাঠ ছাড়ার আগে ব্যাটটা চোখের সামনে ধরে সে কী যেন দেখার চেষ্টা করল তারপর অদ্ভুত একটা বোকার মতো কিংবা বলা যায় শিশুর মতো অর্থহীন হাসি হেসে সে দর্শকদের আড়ালে চলে গেল।
দীপক ঠুকরাল বাঁহাতি ব্যাটসম্যানদের মধ্যে এখন দেশের সেরা। মাদ্রাজে একটা পঞ্চাশ করেছে। হাততালি বুঝিয়ে দিল, বড় রান তার কাছে থেকে পাওয়ার আশা করা হয়েছে। ভবানী, নিশ্চয় ব্যাটে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে। গুরু যেন আর একটি শিষ্যের জন্য প্রতীক্ষারত। ঠুকরাল ক্রিজের কাছে পৌঁছতেই সে এগিয়ে গেল। কয়েক বার মাথা নাড়া, হাত দিয়ে ব্যস্ত না হবার ভঙ্গি এবং ভবানী আবার স্যান্ডার্সনের সম্মুখীন।
প্রথম বলটা সে কাট করল এবং থার্ডম্যানের তিন হাত দূর দিয়ে সেটা বেরিয়ে গেল তার নড়ার আগেই। পরের বলে কভারে মার্কস প্রস্তুরীভূত হয়ে থাকল। তৃতীয় বলটা ওভারপিচ এবং ফলো-থ্রুতে ব্যস্ত সান্ডার্সন হাত দিয়ে থামাতে গিয়েও হাত সরিয়ে নিল। চতুর্থটি অফ স্টাম্পে ঠুকে দেওয়া এবং শর্ট মিড উইকেট বৃথাই হাত তুলে লাফাল। পঞ্চমটি গুড লেংথ এবং মিডল স্টাম্পে, ভবানী যেন জানতই এমন এক অলস ভঙ্গিতে এক পা বেরিয়ে এল এবং বলটি সাইট স্ক্রিনের দু’হাত সামনে জমিতে নামল।
ষষ্ঠটি সন্ত্রস্ত, ভীত, লেগস্টাম্পের বাইরে দিয়ে পালিয়ে গেল এবং ভবানী ফিরেও তাকাল না।
চার মিনিটের মধ্যে গ্রিন পার্ক দাউদাউ করে উঠল। হিস্টিরিয়াগ্রস্ত মানুষের মতো মাঠের বৃত্তটি খ্যাপা চিৎকারে ভেঙে পড়ার অবস্থায়। সরোজ কৌতূহলী চোখে দু’পাশে তাকাল। দাঁড়িয়ে উঠে দু’হাত মুঠো করে ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে তরুণ চিৎকার করে যাচ্ছে কিন্তু আর্তনাদের মতো একটা আওয়াজ ছাড়া মুখ দিয়ে কিছু বেরোচ্ছে না। শঙ্কর দ্রুত উঠে এসে কানে কানে বলে গেল, ”আজ অন্তত দু’ডজন ফোন আসবে।” সরোজ মাথাটা হেলিয়ে মেনে নিল। ”সিক্সটাকে কী বলব, স্ট্রেট ড্রাইভ?” সরোজ একইভাবে মাথা আবার হেলাল।
নতুন বলের ঝোড়ো দাপট এখনও প্রাণবান তবে ধীরে ধীরে সেটা একসময় স্তিমিত হয়ে আসতই। কিন্তু তার আগেই ভবানী এক ফুঁয়ে ঝড়টাকে সরিয়ে নিশ্বাস ফেলার জায়গা বার করে আনল। পাঁচটা বলে কুড়ি রান। উঁচু পর্যায়ে ব্যাট করার সময় বল ধরে ধরে নির্বাচন করে মারার ব্যাপারটা অনেকটা পুষিয়ে দেয় অত্যন্ত তীক্ষ্ন একটা সচেতনতা। সরোজ নিজের অভিজ্ঞতা থেকে জানে, বড়োদরের বোলার এরপর কী করবে, সেটা ফর্মে থাকা ভালো ব্যাটসম্যান আন্দাজ করে নিতে পারে। এবং ভবানী ফর্মে রয়েছে।
মাথা নীচু করে সরোজ খাতায় লিখে যাচ্ছিল আগের ওভারে তার মনে যেসব ছবি ফুটে উঠেছিল তার বিবরণ। দাবি জানানো একটা চিৎকার এবং সেটাকে ডুবিয়ে তার পিছনে বিরাট হতাশার ধ্বনিতে সে চমকে মুখ তুলে দেখে ঠুকরাল ব্যাট ঘাড়ের কাছে তুলে পাটলের তর্জনীর বা মুখের দিকে অবিশ্বাসভরা চোখে তাকিয়ে।
”কী হল?”
”এল বি ডব্লু।” পাশের লোকটি বলল। পাঁচ নম্বরে অধিনায়ক রবি আনন্দ। হুঁশিয়ার ব্যাট। তিনটি উইকেট ৪১ রানে হারাবার পর এবার নাছোড়বান্দা কাউকে চাই ইনিংসটাকে পোক্তভাবে গাঁথার জন্য। আনন্দ যে সেই কাজের জন্যই নেমেছে সে বুঝিয়ে দিল বয়েডকে মেডেন দিয়ে।
স্যান্ডার্সনকে যে সরিয়ে নেওয়া হবে এটা স্বতঃসিদ্ধ। এবার আসবে রুটিনমাফিকই সিম বোলার ডন লোকাস্ট। চমৎকার লেংথ আর লক্ষ্য, বিপজ্জনক ওর জমি থেকে সরে গিয়ে ঢুকে আসা বলগুলো। ভবানীর কাছ থেকে জনতা আর একবার লঙ্কাকাণ্ড দেখার আশায় আগাম হাততালি দিতে শুরু করেছে।
ভবানীর প্রতিভা সম্পর্কে বাকি সন্দেহটুকু সরোজ কাটিয়ে উঠল পরের ছটি বলকে খেলার ধরন থেকে। প্রত্যেকটিকে সে জমি দিয়ে গড়িয়ে লোকাস্টের কাছে ফিরিয়ে দিল। জনতা এটা অনুমোদন না করলেও হাততালি দিল বোলারকে। সরোজও তালি দিল। ভবানীর জন্য।
আর উইকেট না হারিয়ে লাঞ্চে ভারত ৭৮ রানে পৌঁছল।
সরোজ প্রেসবক্স থেকে নেমে বাইরে রঙিন কাপড়ে ঘেরা একটা জায়গায় এল। কুপনের বিনিময়ে সেখানে কাগজের বাক্সে নিরামিষ খাদ্য বিতরণ হচ্ছে সাংবাদিকদের জন্য-আলুর দম, পুরি আর কালোজাম।
”চমৎকার খেলল।”
স্থানীয় এক সাংবাদিক, সরোজ নামটা মনে করতে পারল না। সে একটু হাসল মাত্র। কী লিখবে সেটা বোধহয় বুঝে নেবার জন্য এটা আলোচনার সূত্রপাত। সরোজ এড়িয়ে গেল। শঙ্করকে দেখতে পাচ্ছে না। নিশ্চয় প্লেয়ার্স ড্রেসিংরুমের কাছাকাছি রয়েছে। তরুণকে দেখেছিল ঊর্ধ্বশ্বাসে টেলেক্স ক্যাম্পের দিকে যেতে। লাঞ্চ পর্যন্ত রিপোর্ট ওকে পাঠাতে হবে ডাক সংস্করণের জন্য।
সরোজ বাক্স হাতে ঘেরা জায়গাটা থেকে বেরিয়ে একান্তে রোদ্দুরে দাঁড়াল। দু’ঘণ্টা খেলা হল। রিপোর্টের শুরুটা মাথায় এসে গেছে। এখন সে কারুর সঙ্গে কথা বলতে চায় না। ভি আই পি, খবরের কাগজ, রেডিয়ো, পি অ্যান্ড টি আর পুলিশ ছাড়া এদিকে আর আছে ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশনের কিছু লোক। খাবারের কোনো স্টল নেই, ফলে ভিড় কম।
১৯৩৮ সিরিজে নটিংহামে প্রথম টেস্টে অস্ট্রেলিয়ার ম্যাককেবের ২৩২ রানের ইনিংসটা সম্পর্কে নেভিল কার্ডাসের লেখার কিছু অংশ সরোজ বছর কুড়ি আগে একটা পত্রিকায় পড়েছিল। আবছা, ভাসাভাসা মনে আছে। আজ যদি ভবানীশঙ্কর তেমন কিছু একটা খেলতে পারে তাহলে কার্ডাসের থেকে যা মনে আছে লেখায় লাগিয়ে দেবে। সে খেতে খেতে চেষ্টা করল কয়েকটা লাইন ধরবার। ‘আজ ম্যাককেব প্রথম টেস্টকে সম্মানিত করল বিশাল ও মহান একটা ইনিংসের দ্বারা।’ সরোজ দুটো শব্দ বদলাল- ‘আজ ভবানীশঙ্কর দ্বিতীয় টেস্টকে…’
বাক্যটিকে সে সম্পূর্ণ করল না। বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে না কি? ৩০০ রানের মধ্যে ম্যাককেবেরই ২৩২। মারতে শুরু করে ছ’টা উইকেট পড়ে যাবার পর, তার আগে ইংল্যান্ড সাড়ে ছ’শো রানের একটা ইনিংস বসিয়ে দিয়েছে অস্ট্রেলিয়ার সামনে। কোনো মিলই নেই পরিস্থিতির সঙ্গে। সিরিজে ১-০ এগিয়ে, এটা দ্বিতীয় টেস্ট প্রথম ইনিংস, আর ছ’টা উইকেটও পড়েনি। বলা উচিত হবে কি, ভবানীশঙ্কর নিউজিল্যান্ড আক্রমণকে চূর্ণ করল অভিজাত বিনয়, সুরুচি এবং সংযম সহকারে?…তার স্পর্শের নিখুঁত সূক্ষ্মতা নান্দনিক বোধকে দোলা দেয়…প্রকাশ সৌষ্ঠবে, শক্তিতে উদভাসিত এই হচ্ছে ক্রিকেট যাতে নেই কোনো লালসা, বীর্যবত্তা কিন্তু নেই কোনো বীভৎসতা, সুযোগ গ্রহণ-কিন্তু নেই কোনো নীচতা, সম্মুখ-সংগ্রাম কিন্তু নেই কোনো চোরাগোপ্তা, চোখ-ধাঁধানো আলংকারিক ক্রিকেট। আর একটি কথাও প্যারাগ্রাফের শেষে ছিল- সব কিছুই হল নিবে আসার প্রহরে।
প্রথম দিনে ভবানীকে নেবার কোনো প্রশ্নই ওঠে না, উঠবে বা হয়তো উঠেছে, রামিন্দারের জন্য তার ব্যর্থতাকে ঘিরে। যদি কার্ডাসকে নকল করতে হয় তাহলে রামিন্দারই ভালো বিষয়।
”হ্যালো বিসওয়াস সাব, একা একা?”
সরোজ ঘুরে গিয়ে দেখল কামদার। মোটা কাচের ওধারে বড় দুটো মণি, কলপ ফিকে হয়ে পিঙ্গল একরাশ চুল, গরমকোটের কলারের ভাঁজ ফাটা এবং জুতোর চামড়ায় অজস্র বলিরেখা-সব কিছুই কামদারের অবস্থার সঙ্গে মানিয়ে।
”কী লিখবে ভাবছ?”
”হ্যাঁ।”
”স্যান্ডার্সনের লাইন অফ অ্যাটাক একদমই ভুল ছিল। আমি হলে লেগ স্টাম্পে পিচ করাতাম, ফার্স্ট ওভারেই তুলে নিতাম ছোকরাকে ব্যাকোয়ার্ড শর্ট লেগে। তুমি তো ইডেনে আমার বল দেখেছ, পারতাম না? কী হে বলো না?”
হেলাফেলা ভঙ্গিতে কামদার বলল কিন্তু তাকিয়ে রইল উৎকণ্ঠিত চোখে। সরোজ দুঃখ পাচ্ছে বৃদ্ধের জন্য। দু’দিক থেকে ভালো কাট করাত, কিছু নামী ব্যাটসম্যান ওর ঝুলিতে আছে। কিন্তু সেই গল্প প্রতিবার তাকে শুনতে হয়েছে, অন্যদেরও একই অভিজ্ঞতা।
”ঘোষাল তো তোমার ছেলে, বলে দিয়ো পা বাড়িয়ে যেন স্যান্ডার্সনকে খেলে।”
”বলব। আর রামিন্দারকে কী বলব?”
কামদার প্রথমে বুঝতে সময় নিল সেকেন্ড দশেক তারপর দৃঢ়ভাবে মাথা নেড়ে বলল, ”ভুল করবে, ওকে বাদ দিলে ভুল করবে। বর্ন ফাইটার, দেখবে ও ঠিক ফিরে আসবে। ভারতে এখন ওর থেকে টেকনিক্যালি পারফেক্ট ব্যাটসম্যান কেউ নেই। তোমার ঘোষাল ইনস্টিংটিভ, ভালো উইকেটে ভালো, ব্যাটে বলে হয়ে গেলে ভালো, রিল্যাক্সড সিচুয়েশনে ভালো।”
সরোজের হাতে খাবারের বাক্স। দুটো পুরি খেয়েছে আর খাবার ইচ্ছে নেই। বাক্সটা ফেলার জন্য এধার-ওধার তাকাতেই দেখল তরুণ আসছে। কামদারের হাত থেকে উদ্ধার পাবার জন্য সে চেঁচিয়ে বলল, ”স্টোরি পাঠালে?”
”ক্যালকাটা লাইনে কী গড়বড় হয়েছে এখন বন্ধ, একটার আগে ঠিক হবে না। শঙ্কর কোথায়?”
”আবার শঙ্কর কেন?”
”ভবানী কী বলল-টলল ওর কাছ থেকে একটু জেনে নিতাম।”
”তুমি নিজে গিয়েও তো জেনে নিতে পারো।”
বাংলায় দুজনের কথা হচ্ছে, কামদার শুনতে শুনতে বোঝার চেষ্টা করছিল। হঠাৎ বলল, ”যদি কথা বলতে হয় তো রামিন্দারের সঙ্গে বলো। জিজ্ঞেস করো কী করে তুমি ওই বলে আউট হলে।”
ওর মুখের দিকে একপলক তাকিয়ে তরুণ বলল, ”আমার ইন্টারেস্ট বেঙ্গলের প্লেয়ারের খবরে। বাক্সে কী খাবার দিচ্ছে সরোজদা, খাওয়া যায়, অম্বল হবে না তো?”
”দ্যাখোই না মুখে দিয়ে।”
তরুণ কুপন হাতে ঘেরা জায়গাটার দিকে এগিয়ে গেল।
”কামদারজি, কোন কাগজের হয়ে কভার করছেন?”
”একটা উর্দু ডেইলি, একটা হিন্দি ম্যাগাজিন।” বৃদ্ধ নিজেকে উৎফুল্ল দেখাবার চেষ্টা করল। ”আজ সকালে আমার কাছে এসেছিল লখনউয়ের এক ইংরেজি কাগজের, কী নাম যেন কাগজটার, লোকটা খুব ধরল রোজ হাফ কলাম কমেন্ট যদি দিই। বলল একশো টাকা দেবে। দিনে একশো, বলো আমার মতো লোকের পক্ষে এতে কি রাজি হওয়া যায়?”
”লিখছেন?”
”না।” প্রাক্তন টেস্ট ক্রিকেটার উদ্ধত ভঙ্গিতে চিবুক তুলে মুখ ঘুরিয়ে নিল। বিপত্নীক, ছেলেপুলে নেই, স্বভাবে উড়নচণ্ডী, কোনোদিন পাকা চাকরি করেনি, খুবই অনটনের মধ্যে জীবনের শেষ অধ্যায় কাটাচ্ছে।
”আমাদের খেলার সময়ে প্রেসবক্সে এত লোক হত না, আমাদের সম্পর্কে এতরকম কথাও কাগজে বেরোত না। এখন তো সব কাগজ, ম্যাগাজিনই নিজের লোক পাঠাচ্ছে। বেশিরভাগই ক্রিকেট বোঝে না, বোঝার দরকারও মনে করে না। তারা চায় স্টোরি। ক্রিকেটের উপরে বসিয়েছে প্লেয়ারদের, খারাপ এটা খুব খারাপ,…আচ্ছা।” আচমকা কথা বন্ধ করে বৃদ্ধ ব্যস্ত হয়ে চলে গেল।
সরোজ তাকিয়ে থেকে কামদারকে দেখছিল। হাতের বাক্সটা পায়ের কাছেই নামিয়ে রাখল। দেখতে পেল ফোটোগ্রাফার রামকুমারকে, সে চা খেতে খেতে কথা বলছে দুটি লোকের সঙ্গে। সে প্রেসবক্সে ফিরে এল। লাঞ্চ শেষ হতে, এখনও পনেরো মিনিট।
যদি সেঞ্চুরি করে তাহলে ভবানীকে নিয়ে সব বাংলা কাগজ কাল উচ্ছ্বাসের বন্যা বইয়ে দেবে। সরোজ ঠিক করে ফেলেছে তার লেখায় প্রাধান্য দেবে রামিন্দারকে। বেচারা! বলটা কেমন ছিল সেটা দেখা হয়নি। ও নাকি ওপেন করতে চায়নি। উচিত হয়নি ওকে প্রথমে পাঠানো।
সরোজ হঠাৎ ভিতর থেকে নাড়া খেয়ে সোজা হয়ে বসল। কার্ডাস তো বহু নামী বা অনামী ক্রিকেটারের মানসিক গঠনের বা চরিত্রের নানান দিক, তাদের বাতিক, অভ্যাস, চলন বলনের ভঙ্গি, তাদের স্বগতোক্তি, মাঠে খেলার মধ্যে অন্যদের সঙ্গে তাদের সংলাপ তাঁর রিপোর্টের মধ্যে বসিয়েছেন এবং পরে স্বীকার করেছেন ওগুলো তার কল্পনাপ্রসূত। তবে কাল্পনিক হলেও ওই ক্রিকেটারদের মুখে বসানো এইসব কথা চরিত্রের সঙ্গে মানিয়ে যায়, তাদের পক্ষে এই কথাগুলো বলা খুবই সম্ভব।
যদি রামিন্দার বলে, সরোজ মনে মনে তৈরি করতে শুরু করল, নিয়তি আমাকে তাড়া করছে নয়তো অমন একটা সহজ বল কেন উইকেটকিপারের হাতে পাঠাব! ‘তুমি কি ভাগ্যে বিশ্বাস করো?’ এর উত্তরে ও বলবে, ‘করতাম না, এখন করি। বলটা খেলব না ভেবেছিলাম কিন্তু শেষ মুহূর্তে কে যেন বলল- প্লে। আমি অন্ধের মতো ব্যাট নিয়ে ঝুঁকলাম।’
কিন্তু রামিন্দার কি এভাবে কথা বলে? হয়তো বলে না কিন্তু তাতে কী? যাকে বউ ছেড়ে গেছে, যাকে হত্যার চেষ্টা হয়েছে, যে অন্য রাজ্যে চলে যেতে চায় সে অদৃষ্টবাদী হতেই পারে। কিন্তু ও কি ইনিংস ওপেন করতে সত্যিই চায়নি? টস হয়ে যাবার পর ড্রেসিংরুমে যদি এমন একটা সংলাপ হয়!
‘রাম, ব্যাটিং অর্ডারটা একটু বদলেছি, দেখে নাও।’
আনন্দ কাগজটা তুলে দিল রামিন্দারের হাতে। চোখ বুলিয়েই তার ভ্রূ কুঁচকে উঠল। ‘এ কী! আমি থ্রি ডাউন?’
‘হ্যাঁ। আমি বুঝতে পারছি তোমার অসুবিধে হচ্ছে নতুন বলে, আগের মতো তোমার রিফ্লেক্স কাজ করছে না, তা ছাড়া মিডল অর্ডারে জোর বাড়াতে তোমার মতো অভিজ্ঞ একজনকে এখন দরকার। মাদ্রাজে সঞ্জীব আর রাতু দুটো ইনিংসেই যেভাবে ফেল করল…’
‘তাই বলে আমাকে তুমি নামিয়ে দেবে পাঁচ নম্বরে!’
‘তোমার ভালোর জন্যই করেছি।’
‘আমাকে সবাই জানে ফাস্ট বোলিংয়ের সামনে শের ব্যাটসম্যান। দুনিয়া জানে আমার সাহস, কীভাবে আমি ছিঁড়ে ছিঁড়ে ওয়েস্ট ইন্ডিয়ানদের খেয়েছি। আর আমি এখন এই নিউজিল্যান্ডারদের বোলিংয়ে নীচে নেমে গেলে লোকে বলবে রামিন্দারটা ভয় পেয়েছে…শের থেকে বিল্লি বনে গেছে, আমাকে দেখে বাচ্চচারাও হাসবে… অসম্ভব।’
‘একটা ইনিংস অন্তত খেলে দ্যাখো।’
‘একটাও না। চিরকাল ওপেন করেছি, আজও করব, ওপেনার থেকেই খেলা শেষ করব। প্লিজ রবি আমার এই অহংকারটুকু তুমি কেড়ে নিয়ো না।’
এই বলে ব্যাটটা তুলে নিয়ে রামিন্দার ড্রেসিংরুম থেকে বেরিয়ে আলভাকে ইশারায় ডাকল মাঠে নামার জন্য।
এরপর মাঠে রামিন্দার তার অহংকার পুনরুদ্ধারের খেলা শুরু করবে। বুকে বল লাগার পর সে যেন সত্যি বাঘ-আহত বাঘ-হয়ে উঠল।
কিন্তু সত্যিই তো তা হয়নি! সরোজ মনে করতে পারছে তখন রামিন্দারের ফ্যাকাশে মুখটা। মৃত্যু যেন হাত বুলিয়ে দিয়ে গেছে।… কিন্তু সে একসময় তো সত্যিই বাঘের মতোই ব্যাট করেছে। লোকে ওইভাবেই তাকে জেনেছে, ওইভাবেই তাকে দেখতে চায়।
সরোজ খাতাটা খুলে বাংলায় লিখে রাখতে শুরু করল তার আজকের রিপোর্টের একটা অংশ। সংলাপটায় যাতে পাঠকরা অভিভূত হয় সেইভাবে রিপোর্টে বসাতে হবে।
”সরোজদা রামিন্দার সম্পর্কে কী লিখবেন।”
অভয়ঙ্কর নিজের চেয়ারে বসতে বসতে চেঁচিয়ে বলল।
”কী লেখা যায়?” সরোজ পালটা প্রশ্ন করল।
”ফিনিশড।”
”তাই লিখব।”
সরোজ খাতায় মন দিল।
লাঞ্চের পর ভবানী আর আনন্দ তিনটি ওভার স্বচ্ছন্দে খেলে গেল। মার্কস একসঙ্গে জোড়াবদল ঘাটাল। এল অফ-স্পিনার পিকার্ড আর ন্যটা স্পিনার ওয়ালেস। দুজনে দুটো মেডেন ওভার পাবার পর বিনামেঘে বজ্রপাতের মতো আনন্দ, শান্তনম, রাতুল পারিখ আর সঞ্জীব শর্মা ৩১ বলের মধ্যে ক্রিজে এসেই ফিরে গেল। ভারত সাত উইকেটে ৯১, ভবানী ৪৩ রানে।
গ্যালারিতে হতাশাজনিত আক্ষেপ ধীরে ধীরে নেমে এল বিস্মিত গুঞ্জনে। চোখের সামনে এসব কী ঘটছে! বল কি খুব ঘুরছে! পিচ কি ভেঙে গেছে নয়তো পিকার্ড তিন জনকে শর্ট লেগে ক্যাচ তোলাল কী করে?
তরুণ চেয়ারে বসছে। সরোজ লক্ষই করেনি ও প্রেসবক্সে ছিল না। শঙ্করের চেয়ারটা এখনও খালি। চোখাচোখি হতেই তরুণ হাতের ইশারায় বোঝাল এতক্ষণ সে টেলেক্স ক্যাম্পে ছিল।
”লাইন খুলেছে?” সরোজ গলা চড়িয়ে জানতে চাইল।
”এই খুলল।”
উইকেটকিপার জয়ন্ত রেগে এসেছে ভবানীর জুড়ি হয়ে। ব্যাটসম্যানের মতো দেখায় এমন একটা ভান সে করতে পারে, কিন্তু তার পরের দুজন, মধু ভাণ্ডারকর আর অরুণ পিল্লাই তা-ও পারে না। পরিস্থিতিটা মনে হল ভবানীর কাছে স্বচ্ছ এবং সরল হয়ে গেছে। ইনিংসের পতন যে আসন্ন এটা বুঝেই সে ড্রাইভ আর কাটের উপর ভরসা করে এবং প্রতি ওভারের শেষ বলে এক রান নিয়ে ষাট পেরিয়ে গেল রেগেকে একবারও ব্যাটে বল ছোঁয়াতে না দিয়ে। সকালের সেই প্রচণ্ড একটা ওভারের মতো রোমহর্ষক সাজে নামার ইচ্ছা ভবানীর ব্যাটিংয়ে ধরা দিচ্ছে না। শান্ত, হিসেব কিন্তু সন্ধানী মনোভঙ্গিই ফুটে উঠছে। সরোজের মনে হল ছেলেটি দায়িত্ব নেবার ইচ্ছা রাখে এবং কঠিন সময়ে দিশাহারা হয় না। বড়োজাতের ক্রিকেটার।
রেগে প্রথম যে বলটা ওয়ালেসের কাছ থেকে পেল সেটাকে মিড উইকেট বাউন্ডারির উপর দিয়ে ফেলার বাসনায় লাফ দিয়ে বেরোল, ফসকাল এবং স্টাম্পড হল। ভাণ্ডারকরের আগমনই ভবানীর কাছে ভারতের ইনিংসে শেষের সংকেত। আট উইকেটে ১১৩। সে ৬৭। এবার সংযমের খোলস থেকে বেরিয়ে আসার সময়। ওয়ালেসের বাকি বলগুলো ভাণ্ডারকর দৈব সাহায্যেই খেলেছিল আটজন দ্বারা ঘেরাও অবস্থায়।
২৫ বল পর খ্যাপা গ্রিন পার্কের চিৎকারের মধ্য দিয়ে ভবানী সেঞ্চুরিতে পৌঁছল। তিনদিক থেকে মাঠের মধ্যে ছুটে গেল কয়েকটি কিশোর, পিছনে তাড়াকরা পুলিশ। তরুণের ঠোঁটের কষে ফেনা দেখা গেল। সে চেয়ার থেকে উঠে দু’ধাপ নীচে বসা স্কোরারের টেবলে হুমড়ি দিয়ে পড়ল ভবানীর চারের ও ছয়ের সংখ্যা জানার জন্য। টুকে রাখার মতো অবস্থায় সে গত দশ মিনিট ছিল না। যখন চারটি ১, চারটি ৬ ও তিনটি ৪ স্কোর বইয়ে স্থান নেয়।
ব্যাটসম্যানরা ক্রিজে নিজেদের জায়গায়, বোলার তৈরি বল করার জন্য, ফিল্ডাররা যে যার স্থানে। উচ্ছ্বাস অভিনন্দন থিতিয়ে এল। সরোজ তার চারপাশের মুখগুলোয় জ্বলজ্বলে আভা দেখতে পাচ্ছে। যাকে পেয়েছে তরুণ তারই হাত ধরে ঝাঁকিয়েছে। ভবানীর প্রাপ্য অভিনন্দনগুলো সে যেন কুড়িয়ে তুলে রাখল। একসময় সে সরোজেরও হাত ধরে গলা নামিয়ে বলে, ”প্রাদেশিকতা ভাববেন না সরোজদা… ক্রিকেট প্রেসবক্সে বাংলা একটু অধিকার পেল, লেখার মতো কিছু একটা তো হাতে এল!”
সরোজ ভেবে পাচ্ছে না কী লিখবে ভবানীর এই বিলম্বিত বিস্ফোরণ বিষয়ে। লংঅফে এবং ডিপ স্কোয়্যারলেগে হাত থেকে তার ক্যাচ পড়েছে, ক্রিজ থেকে এক হাত বেরিয়ে গিয়ে বল ফসকে ফিরে এসেছে নিরাপদে। ভাগ্যবান তো বটেই! তবে তার নিজেকে ভালো লাগছে। উত্তেজনা নিজের মধ্যেও অনুভব করছে, হয়তো তার মুখেও জ্বলজ্বলে কিছু একটা ফুটে উঠেছে।
ভবানীর পক্ষে এভাবে বেপরোয়া মেরে যাওয়া বেশিক্ষণ যে সম্ভব হবে না সরোজ তা জানে। তার নিজেরও এই অভিজ্ঞতা আছে। এখন নিজেকে মারের ঝোঁকের বিরুদ্ধে নিয়ে যাওয়া মানে বিপর্যয় ঘটানো।
চায়ের সাত মিনিট আগে ভারতের ইনিংস শেষ হল ১৯৮ রানে। ভবানী রান আউট ১৪৫। পিল্লাই ০, ভাণ্ডারকর নট আউট ৪। স্কোর কার্ডটা অদ্ভুত দেখাচ্ছে। শুধু একটি লোকই দানবের মতো সেখানে দাঁড়িয়ে।
”জীবনের প্রথম দুটো টেস্টে সেঞ্চুরি এর আগে ভারতের কেউ করেনি। এ ব্যাপারে আমি নিশ্চিত।” সরোজ পিছনের সারিতে কান পেতে রইল। রেকর্ডের খবর সে বিশেষ রাখে না। কিন্তু লেখার দরকার হয়। তবে কলকাতায় ডেস্কের কেউ-না-কেউ ইতোমধ্যেই জেনে গেছে। হয়তো রেডিয়ো কমেন্টেটরদের বা অফিসেরই ছোকরা কারুর কাছ থেকে। তা ছাড়া এজেন্সিও পাঠাবে। না উল্লেখ করলেও তার লেখার মধ্যে কিংবা আলাদা বক্স করে বসিয়ে দেবে। রমেন গুহঠাকুরতা এসব ব্যাপারে খুঁতখুঁতে হুঁশিয়ার।
তরুণ আবার উঠে গেছে। এই নিয়ে দ্বিতীয়বার হয়তো টেলেক্স করতেই গেছে। কিন্তু লিখল কখন? সরোজ প্রেসবক্সের বাইরে এল। চায়ের পর থেকেই লেখা শুরু করা দরকার। টেলেক্স ক্যাম্পে গিয়ে মণীশ শুক্লাকে দেখতে পেল। একগোছা সাদা প্রেস ফর্ম চেয়ে নিয়ে জানতে চাইল কলকাতার লাইন আবার ডাউন হবে না তো?
শুক্লা অবাক হয়ে বলল, ”লাইন তো চালুই আছে আবার ডাউনের প্রশ্নই নেই!”
”সে কী! সকালে গড়বড় ছিল না? এই যে একজন…”
”কলকাতায় তো তরুণ লাহিড়ির দুটো রিপোর্ট গেছে। সকালে মাঠে এসেই একটা দিয়েছিলেন আর লাঞ্চে একটা, এই তো কপি রয়েছে দেখুন না।”
শুক্লা টাইপ করা লম্বা দুটো কাগজ এগিয়ে দিল। ছাপা হওয়ার আগে বিনা সম্মতিতে কারুর রিপোর্ট পড়া অনুচিত বলে সরোজ মনে করে। কিন্তু পেশাগত কারণে বিশেষত প্রতিদ্বন্দ্বিতার ক্ষেত্রে কোনো বুদ্ধিমানই এ হেন ঔচিত্য মেনে চলে না। কয়েক সেকেন্ড ইতস্তত করে সে শুক্লার হাত থেকে টেলেক্স কপি নিল কৌতূহল দমন করতে না পেরে। তরুণও রোমানে লেখে। প্রথম বাক্যটি দেখেই জানল স্টোরি রামিন্দারের সম্পর্কে। তার ব্যক্তিগত জীবনে কী ঘটেছে তার উপরেই গল্পের মতো করে লেখা।
লিখল কখন? কাল রাতেই নিশ্চয়। তাই সে তাড়াতাড়ি উঠে গেল। আর আজ মাঠে এসেই টেলেক্সে ধরিয়ে দিয়েছে। অন্যটিতে তরুণ তার অফিসকে জানাচ্ছে-আউট হবার পর রামিন্দারের সঙ্গে কথা বলেছি, সেটা পাঠাব, ওর স্টোরির সঙ্গে যেন এটা জুড়ে দেওয়া হয়।
এসব যা পাঠাচ্ছে সেটা গোপন রাখার জন্যই তরুণ মিথ্যা বলে যাচ্ছে। সরোজের হাসি পেল। পাঠাক যত খুশি স্টোরি, ইন্টারভিউ, সে তো অন্য কোণ থেকে লিখবে! হ্যাঁ রামিন্দারকে নিয়েই।
কোনো ব্যস্ততা না দেখিয়ে ইনিংস শুরু করল নিউজিল্যান্ডের ওপেনাররা। দুটো মেডেন ওভারের পর শর্মার বলে স্কোয়্যার লেগ থেকে এক রান দিল ম্যাকগ্রেগর। সরোজ অতঃপর মাথা নামিয়ে লেখায় মন দিল।
দিনের শেষে নিউজিল্যান্ড ৬৬ বিনা উইকেটে। নিরাপদ ব্যাটিং, নেতিমূলক বোলিং এবং দর্শক জনতার বিরক্তি প্রকাশ ছাড়া শেষ দেড় ঘণ্টায় আর কিছু ছিল না।
”সরোজদা, বলুন তো ভুবুর ফোরস অ্যান্ড সিক্সেস ক’টা, মিনিটস, ক’টা বল ফেল করেছে?”
”শঙ্কু, সারাদিন ছিলে কোথায়?”
”প্লেয়ার্স এনক্লোজারে, ভি আই পি ব্লকে।”
”খাওয়া-দাওয়া?”
”আরে ভুবুর বন্ধুর কি খাওয়ার অভাব হয়? ফ্লাক্সে আনা হুইস্কি-সোডা পর্যন্ত মিলেছে। চারটে ডিনারের ইনভিটেশন চার রাত্রে। অফ ডে’তে লাঞ্চের। মুশকিল শুধু একটাই, সবাই বলে ভুবুকে সঙ্গে আনুন। কিন্তু ওকে জিজ্ঞেস না করে আমি কী করে কথা দেব? এরপর কানপুরে এলে আর হোটেলে উঠতে হবে না।”
”তুমিই তো দেখছি হিরো।”
”ভুবুর সৌজন্যে। দিন দিন।” পুলক চাপতে চাপতে শঙ্কর খাতাটা টেনে নিয়ে চোখ বুলিয়েই বলল, ”বাংলা ভালো পড়তে পারি না, মুখে বলুন।”
”বলছি বলছি। তা ভুবুকে আজ কত অটোগ্রাফ দিতে হল?”
”অফিসিয়ালদের ও বলে দিয়েছিল অটোগ্রাফ বুকগুলো আমার কাছে জমা দিতে। গোটা কুড়ি আমাকে ওরা দিয়ে গেছল। টি-এর সময় ভুবু সই করে দেয়। এইসব সেক্রেটারিয়াল কাজ করতে করতেই সময় চলে গেল খেলা আর দেখা হল না।… তবে লাভের মধ্যে দুটো মেয়ের সঙ্গে আলাপ হল, ভুবুকে বলতে হবে।”
সরোজ আলোচনা আর এগোতে দিল না। শঙ্কর যা জানতে চায় জানিয়ে দিল।
”এখন হোটেলে যাব। ঘরে বসে টাইপ করে দিয়ে যাব। আটটা পর্যন্ত তো খোলা থাকবে।”
শঙ্কর চলে গেল। তার হোটেল পাঁচ মিনিটের পথ। সরোজও একবার ভেবেছিল নিজের হোটেলে গিয়ে নিরিবিলিতে লিখবে। পরে মনে হয়, যদি কিছু জানার দরকার হয়, এখানে অনেকেই বসে লিখছে, জেনে নেওয়া যাবে। তা ছাড়া প্রেসবক্স তো এখন প্রায় ফাঁকাই।
তরুণ উপরের দিকে একটা ফাঁকা টেবলে গভীর মনোযোগে লিখে যাচ্ছে। আর মাঝে মাঝে মাঠের দিকে শূন্যচোখে তাকিয়ে থাকছে। কয়েকটি অল্পবয়সি ছেলে কৌতূহল ভরে সাংবাদিকরা কী লিখছে জানার চেষ্টায় চেয়ারের পিছনে গিয়ে দাঁড়াচ্ছে। বাইরে দোকানপাটের জায়গায় ঝাড়ু শুরু হয়েছে, ধুলো উড়ছে। অদ্ভুত এক শান্ত পরিবেশ। মনেই হয় না কিছুক্ষণ আগে হাজার চল্লিশ লোক এখানে ছিল।
সরোজ তার লেখা জমা দিয়ে বেরিয়ে এসে শ্রান্ত বোধ করল। প্রায় সাড়ে ন’ঘণ্টা শুধু চেয়ারেই। শরীর টনটন করছে, মাথার মধ্যে সাড়া দেবার ব্যবস্থাটা ঢিলে হয়ে রয়েছে। একেবারে রাতের খাওয়া সেরেই হোটেলে ফিরবে ঠিক করল। শঙ্করকে আজ আর পাওয়া যাবে না, তা ছাড়া একসঙ্গে কোথাও গিয়ে খাওয়া সম্পর্কে কিছু বললও না। হয়তো কোথাও নিমন্ত্রণ পেয়েছে। তরুণকে এড়িয়ে যাওয়াই ভালো। টেলেক্স অপারেটরের ঘাড়ের কাছে ওকে ঝুঁকে থাকতে দেখল। পুরো রিপোর্ট অফিসে না পৌঁছনো পর্যন্ত ও নড়বে না। কখন যে রামিন্দারের সঙ্গে কথা বলে এল!
সরোজ রিকশায় মল রোডে এক পাঞ্জাবি রেস্টুরেন্টে এসে রুটি-মাংস খেয়ে আবার রিকশায় হোটেলে ফিরল।
রবীন মান্না বেরোবার জন্য তৈরি। সরোজ ঘরে ঢুকতেই একগাল হেসে বলল, ”দারুণ খেলল ছেলেটা… না হলে ইন্ডিয়া পঞ্চাশের মধ্যেই তো অল আউট হয়ে যেত, কী বলেন?”
”পঞ্চাশের মধ্যে কেন?”
”ওর রানটা বাদ দিলে তাহলে থাকে আর কত?”
”ত বটে।” সরোজ হাসি চাপল। ”আপনার কাজ চলছে কেমন?”
”কালকেই মনে হচ্ছে শেষ করা যাবে, তাহলে কাল রাতেই রাজধানীতে কলকাতা ফিরে যাব। টিকিটের জন্য বলেছি, বোধহয় পেয়ে যাব।”
”এখন কোথায় বেরোচ্ছেন?”
”ডিপো ম্যানেজারের বাড়িতে।” মান্না হাতঘড়ি দেখাল। ”সাড়ে আটটায় আসার কথা অথচ…বাইরে কি খুব শীত মনে হল?”
”না।”
সরোজ প্যান্ট থেকে লুঙ্গিতে যাওয়ার কাজে ব্যস্ত হল। মান্না সুটকেস থেকে একটা শিশি বার করে, রুমালে সেটা উপুড় করেই রেখে দিল যথাস্থানে।
”খাওয়ার নেমন্তন্ন?”
”হ্যাঁ। মিস্টার দাশগুপ্ত আপনার নাম শুনেছেন বললেন।…কিন্তু আপনার সঙ্গে তো দেখা হয়নি তাই আর বলতে পারেননি।”
মান্না যেন কৈফিয়ত দিচ্ছে বিরাট অপরাধ ঘটে যাওয়ার।
”আরে না না, আমাকে কেন বলবেন…”
খটখট আওয়াজের পর দরজাটা খুলে বেয়ারা উঁকি দল। ”এক সাহেব নীচে অপেক্ষা করছেন।”
”যাচ্ছি, ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যেই ফিরে আসব।”
মান্না ব্যস্ত হয়ে বেরিয়ে গেল। খবরের কাগজটা নিয়ে সরোজ বিছানায় গা ঢেলে দিল।
নিউজিল্যান্ড দ্বিতীয় দিনটা কাটিয়ে দিল পাঁচ উইকেটে ৩৭২ রানে পৌঁছে। সাদামাটা উইকেটে নিরুপদ্রবে তারা স্পিনারদের এখানে ওখানে ঠেলে ধীরগতিতে রান তুলেছে। মার্কসের পন্থাটা পরিষ্কার। যতক্ষণ পারো উইকেটে থাকো, থাকলেই রান আসবে। বোলারদের ক্লান্ত করে করে ক্ষইয়ে দাও, ফিল্ডাররা অপেক্ষা করে করে আর বলের পিছনে ছুটে ছুটে ব্যাজার হোক, ঢিলেমিতে পড়ুক। চিত্তাকর্ষক ক্রিকেট, ভারতে পা দিয়েই যেসব গালভরা কথা সে বলেছিল, আপাতত শিকেয় তোলা থাক। ম্যাচ জিততে হবে। প্রথমদিনেই ভারতকে দু’শো রানের মধ্যে নামিয়ে দিয়ে ক্ষীণ আশা যখন দেখা গেছে সেটাকে তখন স্পষ্ট করে তোলার জন্য মার্কস খেলাটাকে বিস্বাদে ভরিয়ে দিতে দ্বিধা করেনি। এই প্রথম সে অধিনায়ক হয়েছে। ম্যাকগ্রেগর হিসাব কষে পরিকল্পনা অনুযায়ী খেলেছে। দ্বিতীয় দিনের শেষে ৪২০ মিনিট ব্যাট করে সে ১২৯ রানে ক্রিজে রয়ে গেছে।
রবি আনন্দের বোলার বদল আর ফিল্ড সাজানো সরোজকে অবাক এবং বিরক্ত করেছে। আনন্দ যেন ধরেই নিয়েছে নিউজিল্যান্ড আড়াই দিন ধরে ব্যাট করবে সুতরাং যত কম রান ওরা তুলতে পারে সেই চেষ্টাই করা ভালো। একটা ম্যাচে এগিয়ে থাকা অধিনায়ক অবশ্য এভাবেই চিন্তা করবে-জেতার সম্ভাবনা না থাকলে হারার সম্ভাবনা থেকে দূরে সরে যাওয়া। কিন্তু জিততে পারব না, এমন মানসিকতাই বা কেন তাকে চালনা করবে?
ম্যাচ শেষে সাংবাদিকদের কী বলবে, আনন্দ নিশ্চয় সেটা তৈরি করে ফেলেছে-বোলিংয়ে ধার নেই, উইকেটে প্রাণ নেই, ব্যাটসম্যানদের ব্যর্থতা চিন্তা করা যায় না! অর্থাৎ ধারালো বোলিং, সতেজ উইকেট আর ঝুড়ি ভরা রান পেলে তবেই সে অধিনায়কত্ব দেখাতে পারে! ভাণ্ডারকর ৩৬ ওভার বল করে দুটি মাত্র উইকেট পায়। তারপর ওভারের মাঝে হঠাৎ বাম ঊরুর পিছন দিকটা চেপে ধরে খোঁড়াতে শুরু করে বুঝিয়ে দিল হ্যামস্ট্রিং মাসল টেনে ধরেছে। সে মাঠ ছেড়ে চলে আসে। সারাক্ষণ সে জোরের উপর অল্প শর্ট লেংথে বল ফেলে গেছে অফ স্টাম্প বরাবর। আনন্দ তাকে খুশিমতো বল করতে দিয়ে গেছে। সরোজ অবশ্য ভাণ্ডারকরের মাঠ ছেড়ে যাওয়াটাকে ভালো মনে নিতে পারেনি। তার ধারণা, ও পালিয়ে গেল বদনামের ভয়ে। এখনও ওর তিনটি উইকেট দরকার দু’শো ছুঁতে।
একটা ব্যাপারে কেউ বিশেষ গুরুত্ব দিল না অস্বাভাবিক নয় বলেই। রামিন্দার সারাদিন মাঠে নামেনি অসুস্থ বোধ করায়। বুকের এক্স-রে হয়েছে, কিছু পাওয়া যায়নি তবে সামান্য জ্বর। গতকাল অবশ্য ফিল্ড করেছে। রাতেই নাকি বুকে ব্যথা আর জ্বর দেখা দেয়।
আজ আর কার্ডাসকে অনুকরণ করার তো কোনো ইচ্ছা বা প্রেরণা সে বোধ করল না। সোজা বর্ণনা এবং কয়েকটি বহু ব্যবহৃত বিশেষণ ছিটিয়ে বোলিং এবং অধিনায়কত্বের সমালোচনা করল।
শঙ্কর লাঞ্চের পর কিছুক্ষণ প্রেসবক্সে ছিল। তখন সরোজ খেলা দেখার বিরক্তি কাটাতে চেঁচিয়ে ওকে বলে, ”কী হল বাজির? জিতেছি কি?”
”কীসের বাজি?”
”ভুলে গেলে? সেই যে আবার আসবে কি না ভুবুর কাছে!”
”ওহহ… না আপনিই জিতেছেন। আসেনি। ভুবুকেই কাল রাতে গাড়ি পাঠিয়ে নিয়ে গেছল বাড়িতে আর… এত লোকের মধ্যে বলা যায় না, পরে বলব।”
মিনিট পাঁচ পর সরোজ দেখল টেবলের উপর হুমড়ি খেয়ে ঝুঁকে তরুণ কী জিজ্ঞাসা করল শঙ্করকে। ”সে একটা বাজির ব্যাপার,” এই বলে শঙ্কর এড়িয়ে গেল।
রোজার অটোগ্রাফ বইটা আজ সে সঙ্গে এনেছে। দুজন বাদে পুরো নিউজিল্যান্ড টিমটাকেই এখন পাওয়া যাবে। জলপানের জন্য খেলা বন্ধ হতে শঙ্কর উঠল। অনেক বন্ধুবান্ধবী সে সংগ্রহ করে ফেলেছে। এখন তাদের কাছে গিয়ে বসবে। সরোজ ইশারায় তাকে ডাকল।
”একটা রিকোয়েস্ট, রাখতেই হবে। নিউজিল্যান্ডারদের অটোগ্রাফগুলো যদি জোগাড় করে দাও…তুমি ছাড়া তো কেউ আর পারবে না।”
শঙ্কর বিনা বাক্যে বইটা হাত থেকে নিয়ে বলল, ”ইন্ডিয়ানসদেরগুলোও তো চাই?”
”তা তো চাই-ই।”
”ঠিক আছে, এখন আমার কাছে থাক।”
শঙ্কর চলে যাবার জন্য পা বাড়াতেই সরোজ বলল, ”বাজি কিন্তু টেকনিক্যালি আমি জিতেছি।”
শঙ্কর মাথা হেলাল ঠোঁটে হাসি টেনে।
”দিল্লিতে ভুবুকে তাহলে…।”
”নিশ্চয়, বলেছি যখন…।”
চায়ের সময় প্রেসবক্সে লোক কম। তখন অনিল কাঞ্জিলালকে উঁকি দিতে দেখে সরোজ এগিয়ে গেল।
”আরে কাঞ্জি! ব্যাপার কী?”
কাঞ্জিলাল আর সরোজ একসঙ্গে রঞ্জিতে খেলেছে। ব্যাট ভালোই করত…টেকনিক্যালি সাউন্ড। দুটো দলীপ ম্যাচও খেলেছে, সরোজ খেলেনি। দলীপ ট্রফি শুরু হবার আগেই সে বাংলা দল থেকে বাদ পড়েছিল। টেস্ট খেলেনি অথচ পূর্বাঞ্চল থেকে ওকে জাতীয় নির্বাচক করায় অনেকেই কাঞ্জিলালের বিরুদ্ধে লেখে। সরোজ ওর পক্ষ নিয়ে লিখেছিল-বহু বিখ্যাত টেস্ট খেলোয়াড়ের থেকে কাঞ্জিলালের ক্রিকেট-জ্ঞান গভীর।
”রামিন্দারকে নিয়ে তুই কীসব উলটোপালটা লিখেছিস। ও নাকি ওপেন করতে চেয়েছিল, আনন্দ নাকি ওকে থ্রিডাউনে পাঠাতে চেয়েছিল…অ্যাঁ একদমই তো উলটো ঘটনা!”
কাঞ্জিলালের মুখে যত বিস্ময় তার থেকেও বেশি ফুটে উঠল সরোজের মুখে!
”তোকে কে বলল? কাগজে তো আজ কলকাতায় বেরিয়েছে। কানপুরে কি আজকের কলকাতার কাগজ এসে গেছে? আমাদের কাগজ তো এখানে বিক্রির জন্য আসে না!”
”আরে আজ সকালে ছোটোভাইপো ট্রাঙ্ককল করেছিল। কে কী লিখেছে জানতে চাইলুম তখন বলল। তাড়াহুড়োয় টেলিফোনে তো লাইন বাই লাইন বলা সম্ভব নয়। বলল সরোজ বিশ্বাসের লেখার ভঙ্গিটা দারুণ। তবে তরুণ নাকি তোর উলটো কথাই লিখেছে। যাক গে ওরা কেউই বাংলা জানে না, হাতে পেলেও কী লেখা হয়েছে তা পড়তে পারবে না। আরে-” কাঞ্জিলাল মাথাটা নামিয়ে ফিসফিস করে বলল, ”এই নিয়েই কালরাতে হাতাহতি হয়ে গেছে রামিন্দার আর আনন্দে। ওকে তো আনন্দ জোর করে ওপেন করিয়েছে। ওয়েস্ট জোন-সাউথ জোন প্যাক্ট হয়েছে, রামিন্দার ফেল করলেই বসিয়ে দিয়ে বোম্বের নিরু খাম্বাটাকে ঢোকাবে। এদিকে নর্থ আর সেন্ট্রাল আমাকে দলে টানার জন্য…পরে বলব সব…শঙ্কর ছেলেটা কোথায় বল তো, ওকে খুঁজতেই এসেছি। কীসব যা-তা লিখেছে, ভাই বলল কলকাতায় ডেফিনিটলি ভুবুকে নিয়ে কথা উঠবে…ওর ঘরের সামনে মেয়েরা নাকি লাইন দিচ্ছে, ও অটোগ্রাফ দিচ্ছে চুমুর বদলে, মেয়েরা ফোন করছে ওর সঙ্গে শোবার জন্য…আচ্ছা এইসব গাঁজা গুলগপ্পোর কোনো মানে হয়? সম্ভব এসব? এতে ভুবুরই ক্ষতি হচ্ছে। তবু রক্ষে বাংলা কাগজে এসব বেরোয়নি।” আবার মাথা ঝুঁকিয়ে কাঞ্জিলাল ফিসফিস করল, ”কাল রাত সাড়ে এগারোটায় ফিরেছে। মনোহরণ আজ সকালে আমাকে আলাদা ডেকে নিয়ে বলল, ভুবুকে নামিয়ে দিয়ে গেল একটা মেয়ে। স্লাইট নাকি টলছিল। কিন্তু কাল যা ব্যাট করল, এখন তো এই সিরিজেই ওকে কিছু বলা যাবে না। কিন্তু ইডলি-দোসা তো জানিসই কীরকম স্ট্রীক্ট। আমাকে বলল, তুমি ওয়ার্ন করো নয়তো রিপোর্টে আমি এগেনস্টে লিখব। সবে টেস্ট কেরিয়ার শুরু করেছে এখনই যদি এরকম উড়তে শুরু করে…ওকি নিজেকে সোবার্স বা কানহাই ভাবছে নাকি? এরপর শঙ্করের ওইসব লেখা যদি চোখে পড়ে…বারণ করতে হবে আর যেন না লেখে, ভুবুকেও যেন বলে দেয় সমঝে চলে। আমার পক্ষে এসব ব্যাপার নিয়ে বাচ্চচাছেলেদের সঙ্গে বলাবলি করাটাও মুশকিল, ফট করে ছোটোবড়ো কী একটা বলে দেবে।…শোন ওকে তো দেখছি না। তুই বরং শঙ্করকে বুঝিয়ে বসিল। বলবি তো?”
সরোজ মাথা নাড়ল।
”তুইও অমন উলটোপালটা লিখতে গেলি কেন? রামিন্দার তো ইচ্ছে করেই আজ নামল না। তবে আমি ওকে ড্রপ করার বিপক্ষে, লড়তে হবে। শঙ্করকে বলিস।”
কাঞ্জিলাল চলে যাচ্ছে। সরোজ ওর দিকে শূন্যচোখে তাকিয়ে রইল। মাথার মধ্যে এলোমেলো লাগছে। কী বেরিয়েছে, কীভাবে বেরিয়েছে তার লেখাটা? সে তো স্পষ্ট ইঙ্গিতই দিয়েছে রামিন্দারের সঙ্গে আনন্দের কথাগুলো কাল্পনিক।
কাঞ্জিলালকে থামিয়ে অভয়ঙ্কর আর উন্নি কথা বলছে। তরুণ প্রেসবক্সের ধাপগুলোর পাশে সরু প্যাসেজটা দিয়ে ভিড় ঠেলে আসছিল। হাতে কয়েকটা প্রেস ফর্ম। কথা শেষে করে কাঞ্জিলাল ধাপ থেকে প্যাসেজে নামতেই তরুণ হেসে কাঞ্জিলালের সঙ্গে কথা বলতে বলতে বেরিয়ে গেল।
চায়ের পর খেলা শুরু হতেই কাঞ্জিলালের কথাগুলো কিছুক্ষণের জন্য ভুলে গিয়ে সরোজ খেলার দিকে মন দেয়। রিপোর্টের প্রথম ভূমিকা যা থাকবে সেটা লিখে ফেলতে থাকে। দু’তিনবার মাঠের দিকে তাকিয়ে সে বুঝে যায় আর দেখার কিছু নেই। যে-কোনো পাঁচ দিনের খেলার প্রথম দু’দিনের পর ম্যাচটা দুলে ওঠে, হয় ক্যাঁচকোচ শব্দে নয়তো মসৃণভাবে।
লেখার মাঝে বারবার কাঞ্জিলালের কথাগুলো কামড় দিচ্ছিল। রামিন্দার সম্পর্কে ক্ষতিকর কিছু তো সে লেখেনি বরং তাকে বীর হিসাবে দেখাবারই চেষ্টা করেছে। রাতে হাতাহাতির ব্যাপারটা শঙ্করই ভালো জানবে ভুবুর কাছ থেকে। এইসব খবর জানার প্রধান উপায় খেলোয়াড়রাই, তাই অনেক সাংবাদিকই ওদের সঙ্গে দহরম পাতাতে চেষ্টা করে। সফলও হয়, কেননা খেলোয়াড়রাও ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধির জন্য খবরের কাগজের আশ্রয় চায়। তরুণও নিশ্চয় লাইন করেছে কারুর সঙ্গে। তবে ইংরেজি কাগজেই সুবিধাটা বেশি।
সরোজ মুহূর্তের জন্য লেখা থামিয়ে ভাবল, আমিও কি লাইন করব? যে ভঙ্গিতে এতকাল চলেছি সেটা কি বদলাব? ‘টোটালি মিস ফিট’! জার্নালিজম এখন যেখানে এসেছে গুহঠাকুরতা সেইখানে পৌঁছতে চায়। কিন্তু সেখানে খেলাটা কোথায়?
রিপোর্ট জমা দেবার সময় তরুণকে গতদিনের মতোই দেখতে পেল টেলেক্স অপারেটরের ঘাড়ের কাছে দাঁড়িয়ে। পাছে অন্য কেউ পড়ে ফেলে তাই হয়তো পাহারা দিচ্ছে। কিংবা অন্যরা কী লিখছে সেটাও পড়ে নেবে এক ফাঁকে। কিন্তু হাতাহাতির খবরটা কি জেনেছে? কাঞ্জি বেরিয়ে যাবার সময় তরুণের সঙ্গে দেখা হয়েছে। দুজনে কথা বলতে বলতে বেরিয়েছে। নিশ্চয় তখন কাঞ্জি ওকে ব্যাপারটা বলেছে।
”কী হে তরুণ, তোমার ডেসপ্যাচ পৌঁছেছে?”
”না, সরোজদা। ওপাশে দুটো নম্বরই এনগেজড।”
”তুমি ওখানে দাঁড়িয়ে থাকলেই কি লাইন ফ্রি হয়ে যাবে?”
তরুণ বেরিয়ে এল।
”দাঁড়িয়ে থেকে না করালে কপি ফেলে রেখে দেবে।”
”পান সিগারেট খাইয়েছ?”
”ওসবে আর হয় না, একদিনের জন্য খেলা দেখার পাস চেয়েছে তিনজন।”
”কেমন খেলা দেখলে আজ, রামিন্দার তো সারাদিন মাঠেই নামল না।”
”হ্যাঁ তাই তো দেখলাম।” তরুণ হুঁশিয়ার হয়ে গেল। সন্দিগ্ধ চোখে তাকিয়ে কিছু একটা বোঝার চেষ্টা করছে।
”কাঞ্জি বলল রাতে হোটেলে নাকি আনন্দের সঙ্গে ওর ঝগড়া হয়েছে। ওপেন করার ব্যাপারে।”
”তাই নাকি, তাহলে খবর নিতে হয় তো!” তরুণের স্বরে ব্যস্ততা কিন্তু খবরের জন্য নড়ার কোনো চেষ্টা নেই। সরোজ বুঝে গেল খবর যা নেবার নেওয়া হয়ে গেছে।
”রামিন্দারকে এবার বাদ দেওয়া দরকার, এত ফেল করছে।”
সরোজও হুঁশিয়ার হল। এটা টোপ। সে উলটো মনোভাব পেশ করল। ”আমারও তাই মনে হয়, আর ফিরতে পারবে না।”
বিশ্বাস করল না-ফুটে উঠেই মিলিয়ে যাওয়াটা সরোজের চোখে ধরা পড়ল। তার কালকের রিপোর্ট হয়তো পড়ে নিয়েছে এখানে। বড্ড খোলামেলা ব্যবস্থা। এই লোকগুলো ঠিক বোঝে না কী ধরনের প্রতিদ্বন্দ্বিতা রিপোর্টারদের মধ্যে চলে। শুক্লা সকালে সরল মনে তাকে তরুণের রিপোর্ট পড়তে দিল, দেওয়া উচিত নয়।
”আনন্দের ক্যাপ্টেনসি কেমন বুঝলে?”
”এমন কিছু নয়, সো সো, বড্ড ডিফেন্সিভ।”
”কলকাতার কাগজ এখানে পাওয়া যায়? তোমার কাগজ পেয়েছ?”
”না সরোজদা, এখানে দিল্লি, লখনউয়ের কাগজই তো সকালে পাই। আর আমাদের অল্প কিছুই আসে একদিন পর।”
সরোজ আর কথা বাড়াল না। মান্না আজই রাতে হোটেল ছাড়তে পারে বলেছে। দ্রুত সে পা চালাল মধুছন্দার উদ্দেশে।
রিসেপশনিস্ট তাকে জানাল, রবীন মান্না এখুনি চেক আউট করবে জানিয়েছেন। সব বিল মিটিয়েই যাবেন এবং তারপর থেকে ঘরটা সরোজের নামে হবে। আশ্বস্ত হয়ে সে তিনতলার সিঁড়ি ধরল।
মান্না গোছগাছ সেরে তৈরি।
”এখানকার কাজ শেষ, ট্রেনের টিকিটও পেয়ে গেছি, এখুনি বেরোব, যাক দেখাটা হয়ে গেল। আপনার সঙ্গে ভালো করে জমিয়ে আলাপই করা গেল না, কলকাতায় ফিরুন, একদিন বাড়িতে নিয়ে যাব।”
”নিশ্চয় যাব। কিন্তু এত তাড়াতাড়ি বেরোচ্ছেন? এখনও তো…” সরোজ হাতঘড়ি দেখল।
”ম্যানেজারের বাড়ি হয়ে যাব তাই একটু…বিলটা নীচে গিয়ে মিটিয়ে দিচ্ছি।”
সরোজ পকেট থেকে ব্যাগ বার করতেই মান্না তার হাত চেপে ধরল।
”না না, দিতে হবে না।”
”সে কী, পঁচিশ টাকা করে তো আমার দেবার কথা!”
”কথাটথা থাক। কোম্পানির পয়সায় আছি ওটা কোম্পানির ঘাড়েই ফেলে দেব।”
সরোজ আর চাপ দিল না। মান্নার সঙ্গে সে রিসেপশন অফিসে এল। সুটকেস সহ তাকে রিকশায় তুলে দিয়ে সে ভাবল কোথাও গিয়ে খেয়ে নেবে। আর যাবার পথে সঙ্গম হোটেলে ঢুঁ দেবে। যদি শঙ্করকে পাওয়া যায় তাহলে কাঞ্জির অনুরোধটাও জানিয়ে দেবে।
শঙ্কর ঘরে টাইপ করছিল, সরোজকে দেখে বলল, ”এক সেকেন্ড…ততক্ষণ গ্লাসে ঢেলে নিয়ে বসুন।”
টেবলে রামের বোতল আর গ্লাস। সরোজ খাবে কি খাবে না ঠিক করতে পারছিল না। শঙ্কর আড়চোখে দেখে আবদেরে ধমক দিল, ”নিন বলছি।”
”আচ্ছা আচ্ছা।”
মিনিট তিনেক পর শঙ্কর ঘুরে বসল।
”আমার সঙ্গে অনিল কাঞ্জিলালের দেখা হয়েছে। ভুবু আমার লেখা সম্পর্কে অনেক জ্ঞান দিল। আচ্ছা সরোজদা, আজ যে টেস্ট পিছু বারো-চোদ্দো হাজার টাকা একটা প্লেয়ার পায় এটা কি কোনোদিন কল্পনা করতে পেরেছিলেন? পঁচিশ বছর আগে, মনোহরণের কাছেই শুনলাম, দিনে পঞ্চাশ টাকা প্লেয়াররা পেত, তা-ও অনেক ধস্তাধস্তি করে আদায় করতে হত। এই বদলটা, এই যে টাকা পাচ্ছে, আপনি একজন এক্স-রঞ্জি ক্রিকেটার হিসাবে বলুন, এটা আপনি চান কি না?”
”নিশ্চয় চাই। যে-কোনো খেলায় প্লেয়াররা টাকা পাক এটা অবশ্যই চাই।”
”এত টাকা টেস্টম্যাচে আসছে যেহেতু কমার্শিয়াল ইন্টারেস্ট এর মধ্যে এসেছে, দর্শকও বেড়েছে, কোনো টেস্ট সেন্টারেই সিজন টিকিট আনসোল্ড থাকছে না। রেডিয়োয় বল বাই বল কমেন্ট্রি হচ্ছে, টিভি-ও সারাক্ষণ দেখাচ্ছে। ব্যাপারটা তাহলে গুরুত্ব পেয়েছে। টেস্ট প্লেয়াররা এখন ন্যাশনাল লাইম লাইটে এসেছে। তাদের সম্পর্কে ট্রিমেন্ডাস ইন্টারেস্ট পাবলিকের মধ্যে জন্মেছে। তাদের ব্যক্তিগত জীবন, আচার-আচরণ, অভ্যাস, বদভ্যাস সব কিছু সম্পর্কেই জানার জন্য কৌতূহল জন্মেছে। খবরের কাগজ যদি সেই কৌতূহল মেটায় তাহলে তাদের কেন দোষ দেবেন, কেন নিন্দে করবেন? বলুন?”
সরোজ ওর মুখের দিকে শুধু তাকিয়েই রইল। শঙ্কর ঠান্ডা গলায় ক্লাসে ছাত্রদের গ্রামার বোঝাবার মতো ঢঙে বলে গেল।
”আমি যা লিখেছি সেরকম লেখা নাকি ফিল্মি ম্যাগাজিনে বেরোয়। হতে পারে। টেস্ট প্লেয়াররা এখন ফিল্ম স্টারদের থেকে পপুলারিটিতে কম কীসে? উত্তমকুমার প্রথম তিনটে ছবি করে কি এতটা নাম পেয়েছিল যা ভুবু প্রথম তিনটে ইনিংস থেকে পেয়েছে? মাস মিডিয়ায় ক’দিন ধরে অবিরত শুধু ওর নাম, ওর ছবি, ওর মুখের কথা। যে ক্রিকেটের কিছুই জানে না বোঝে না, সে-ও এখন ভুবুর নাম জানে, দেখলে চিনতে পারবে। মাত্র দশ দিনের মধ্যে একটা ছেলে বিখ্যাত হয়ে গেল। …সরোজদা সবই বদলাচ্ছে, রিপোর্টিংয়ের স্টাইলও বদলাচ্ছে, বদলে যেতে বাধ্য। ম্যাচ তো পাঠকরা টিভি-তে দেখে ফেলেছে, যা শোনার রেডিয়োতে শুনে ফেলেছে। এরপর ওদের পড়াতে হলে অন্যভাবে অন্য কিছু আপনাকে লিখতে হবে পড়াবার জন্য! আপনি যদি পুরনো স্টাইলই আঁকড়ে থাকেন, কেউ আর তাহলে আপনার লেখা পড়বে না, আপনার কাগজই তাতে সাফার করবে। তখন বাধ্য হয়েই আপনার ওপরওয়ালা আপনাকে সরিয়ে অন্য লোককে আপনার জায়গায় পাঠাবে। আমি প্রথমে ভাবব আমার কাগজের কথা, কাগজের ইন্টারেস্ট আগে দেখব, তারপর ক্রিকেট-ফ্রিকেট।”
সরোজ অস্বস্তি বোধ করল শঙ্করের ‘আপনি’ ‘আপনাকে সরিয়ে’ এই শব্দ ক’টিতে। তবে ওর যুক্তি সে মন থেকে মানতে পারছে না। স্টার প্লেয়ারদের ব্যক্তিগত জীবনের কথা লিখুক কিন্তু পর্দা তুলে বিছানাতেও উঁকি দেওয়াটা কুরুচি ছাড়া আর কিছু নয়। বাচ্চচা ছেলেমেয়েরাও তো পড়ে। তাদের কাছে খেলার প্রেরণার, উদ্দীপনার, বীরত্বের দিকটাই তুলে ধরা উচিত।
কিন্তু তর্কে নামতে সরোজের ইচ্ছা করছে না। যে যা বোঝে সেইভাবেই চলুক। রামিন্দার ওপেন করতে চায়নি, ক্যাপ্টেনের সঙ্গে এই নিয়ে মতবিরোধ হয়েছে-এটুকু লেখা উচিত। এরপর লেখক বিশ্লেষণ করুক ক্যাপ্টেনের এই জেদের পিছনে কোনো যুক্তি আছে আছে কি না, ভালো একজন ব্যাটসম্যান ফেল করছে তাকে কীভাবে সাহায্য করা যায়, এসব না করে হাতাহাতির গল্পকেও বড়ো করে দেখানো, এ কেমন আধুনিক রিপোর্টিং! সরোজ আপনমনে মাথা নাড়ল।
”ভুবুর রাতে ফেরার ব্যাপারটা?” শঙ্কর জিজ্ঞাসু চোখে তাকাল।
”হ্যাঁ।”
”তাতে কী হয়েছে?” শঙ্কর টাইপ করা কাগজগুলো ভাঁজ করে পকেটে রেখে জুতোয় পা গলাল। ”ও যদি পারে করুক। কটকে গত বছর রঞ্জি ম্যাচে রাত আড়াইটেয় চুর হয়ে ফিরে পরদিন সকালে সত্তর থেকে শুরু করে একশো তিরিশে পৌঁছেছিল পঞ্চান্ন মিনিটে। ফ্রেশ দেখাচ্ছিল যখন আউট হয়ে এল। আজ ও কীরকম ফিল্ড করল বলুন? মনে হল কি লেট নাইট করেছে? ভেতো বাঙালির শরীরের ক্ষমতা দিয়ে ওকে মাপবেন না, বাঙালি মর্যালিটি দিয়েও নয়! হি ইজ এ ফেনোমেনা, অ্যান এক্সেপশনাল হিউম্যান।”
”হতে পারে!” সরোজ ধীরস্বরে বলল। ”ক্রিকেট টিম গেম, টিমের অন্যদের উপর ওর আচরণের প্রভাব পড়তে পারে, ডিসিপ্লিন নষ্ট হতে পারে। একজনকে লাইসেন্স দিলে অন্যরাও চাইবে।”
”কেউই বাচ্চচা ছেলে নয় সরোজদা, ইনফ্লুয়েন্সড হয় যদি হবে। আর ডিসিপ্লিন? রামিন্দার মা তুলে চিৎকার করে খিস্তি করল ক্যাপ্টেনকে, সেও গিয়ে রামিন্দারের মুখে ঘুসি মারল-দুজনের মুখেই অশ্রাব্য ভাষা, জুনিয়র প্লেয়ার, হোটেলের বেয়ারা, আরও অনেকেই দাঁড়িয়ে দেখেছে।”
শঙ্কর উঠে দাঁড়িয়ে প্যান্টের মধ্যে গেঞ্জিটা গুঁজতে শুরু করল। তারপর আয়নার সামনে আঙুল দিয়ে চুল বিন্যস্ত করতে করতে শিস দিল। ডিসিপ্লিন সম্পর্কে আর একটি কথাও সে বলল না। যা বলার যেন বলা হয়ে গেছে।
”আপনি এখান থেকে তো সোজা দিল্লি যাবেন, আমি একটু এধার-ওধার ঘুরে লখনউ, আগ্রা দেখে যাব। আর দিল্লিতে থাকার একটা ব্যবস্থাও করে ফেলেছি, চলুন বেরোই।”
রাস্তায় এসে গ্রিন পার্কের দিকে শঙ্কর হাঁটতে শুরু করল। সরোজের গন্তব্য অন্য দিকে।
”শঙ্কু এক মিনিট, কোথায় থাকবে সেটা জানিয়ো।”
”নিশ্চয়। একটা কনস্ট্রাকশন কোম্পানির গেস্ট হাউসে, কনট প্লেসের কাছেই।”
পাঁচ
তৃতীয় দিন সকালে প্রথম এক ঘণ্টাতেই চারটে উইকেট পড়ে গেল মাত্র ৩৩ রান তুলে। ভাণ্ডারকরের বলে প্রথম ওভারেই স্টাম্পড হল ম্যাকগ্রেগর। তারপর রান আউট আর দুটো এল বি ডব্লু। আবার চিৎকার, মাঠের মধ্যে কমলালেবু, কলা ছুড়ে দেওয়া, বিউগল বাজানো শুরু হয়ে গেল। নিউজিল্যান্ড ৪০৫ নয় উইকেট।
এরপর, প্রায়ই প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে যা ঘটতে দেখা যায়, ব্যাট করতে পারে না বলে যাদের ধরে নেওয়া হয়, সেই শেষ উইকেট জুড়ির হঠাৎ দাঁড়িয়ে যাওয়া। লুইস আর মেনার্ড পাঁচটা ওভার প্রতি বলে ব্যাট চালিয়ে তিনটে ক্যাচ ফেলা, ওভার থ্রো, রান আউট ইত্যাদির সুযোগ থেকে পঁয়তাল্লিশ রান তুলে এবং ফিল্ডিংকে ছত্রখান করে হঠাৎ ডিফেন্সে মনোযোগ দিয়ে ওপেনারদের মতো সতর্ক ব্যাটির শুরু করল। ৪০৫ থেকে ওরা ৪৭৫-এ ইনিংসটা নিয়ে যেতেই দিশেহারা আনন্দ ভবানীশঙ্করকে লং অন থেকে ডেকে এনে হাতে বল তুলে দিল।
স্লো মিডিয়াম পেসে দুটো লংহপ ও একটি ফুলটস দিয়ে এবং আটটি রান বাড়িয়ে ভবানী চতুর্থ বলে মেনার্ডকে বোল্ড করল। ২৮৫ রানে এগিয়ে থেকে নিউজিল্যান্ড প্রথম ইনিংস শেষ করল।
খেলার আড়াই দিন এখনও বাকি। উইকেটে এমন কিছু ঘটেনি যা বোলারদের আশান্বিত করতে পারে। বরং প্রথম দিনের থেকে যেন মন্থরই হয়েছে। ধৈর্য ও সতর্কতা, এই দুটি জিনিস নিয়ে যে-কোনো প্রথম শ্রেণির ব্যাটসম্যান আড়াইটে দিন কাটিয়ে দিতে পারে যদি না ক্লান্ত হয়ে মনোনিবেশ হারায়।
দ্বিতীয় ইনিংস শুরু করতে এল আলভা এবং সরোজকে আশান্বিত করে রামিন্দার। তার মনে হচ্ছে এবার রামিন্দার রান পাবে। উইকেট মন্থর হয়েছে, বাউন্সও আর প্রথম দিনের মতো নেই। ওরা ব্যস্ত হবে না রানের জন্য, সেটাই স্বাভাবিক।
প্রথম তিন ওভার মেডেন নিল। চতুর্থ ওভারে রামিন্দার চমৎকার কভার ড্রাইভে বয়েডের বল বাউন্ডারিতে পাঠাল। মাঠের উচ্ছ্বাস গুঞ্জনে থিতিয়ে আসতে-না-আসতেই আবার সে একইভাবে চার রান নিল। এবারের উচ্ছ্বাস আরও তুমুল।
পাশের লোকটির দুরবিন সরোজ তুলে নিল। রামিন্দার তার মানসিক বাধাগুলো কাটিয়ে গুঁড়িয়ে পথ তৈরি করে বেরোবার চেষ্টা করছে। বেপরোয়া পন্থা। ফাটকায় টাকা খাটাবার মতো। যদি কিছুদূর এভাবে এগোতে পারে তাহলে নিজের উপর ভরসা আসবে। রামিন্দারের কপালে বিজবিজে ঘাম। ঠোঁট চাটছে ঘনঘন। চোখে অনিশ্চয়তা। বিস্ময় আর উন্মাদের মতো অর্থহীন বোধশূন্য চাহনি পরপর ভেসে উঠল।
তৃতীয় বলটা এবার শর্ট পিচ হবেই এবং হলও। বেশি উঠল না। রাইফেলের থেকে বুলেটের মতো শব্দে বলটা পয়েন্ট বাউন্ডারিতে পৌঁছল। রামিন্দার অবাক চোখে তাকিয়ে। ধীরে ধীরে চোয়ালটা শক্ত হয়ে এল। বিড়বিড় করে কিছু বলেই দু’হাত মুঠো করে জোরে ঝাঁকাল।
তিন বলে ১২ রান, টাইমিং নিখুঁত। রামিন্দার ফিরে আসছে। পরের দুটো বল লেগস্টাম্পের বাইরে। ব্যাট চালিয়ে ফসকাল। ষষ্ঠ বল গুড লেংথে রামিন্দার পিছিয়ে ফ্লিক করল স্কোয়্যার লেগে। ঢপ করে একটা শব্দ আর একসঙ্গে হাত তুলে বয়েডের সঙ্গে সাতজন ক্লোজ-ইন ফিল্ডার চিৎকার করে উঠল।
সরোজের গলার কাছে হৃৎপিণ্ড উঠে এসেছে। ব্যাপারটা সম্পর্কে তার কোনো সন্দেহ নেই। পৃথিবীর কোনো আম্পায়ারই, যতই পক্ষপাতিত্ব করুক, এল বি ডব্লু না দিয়ে পারবে না।
পটেলের আঙুল উঠেছে। সেই আঙুল বেয়েই রামিন্দারের চোখ আকাশের দিকে উঠে কয়েক সেকেন্ড থমকে থেকে কুঁকড়ে গেল। আম্পায়ারের দিকে সে স্থির চোখে তাকাল। আগুনঝরা চাহনি। বয়েডকে ঘিরে অভিনন্দনের জোয়ার বইছে। ব্যাটটা দু’হাতে তুলে মাটিতে আছড়ে ফেলল রামিন্দার। এক ফিল্ডার সেটা তুলে ওর দিকে এগিয়ে ধরল। কী যেন রামিন্দার বলল, ফিল্ডারও জবাব দিল। আলভা এগিয়ে এসেছে। ব্যাটটা চেয়ে নিয়ে সে রামিন্দারের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বাহু ধরে টানল। ঝটকা দিয়ে আলভার হাত সরিয়ে সে দ্রুত পায়ে ফিরতে লাগল। তখন ভবানী ক্রিজের দিকে অর্ধেক পথ পেরিয়ে এসেছে।
”বাঁচানো গেল না। এরপর আর ওকে…”
অভয়শঙ্করের গলা শোনা যাচ্ছে। সরোজ খাতায় কয়েকটা কথা দ্রুত লিখে রাখছে মন থেকে হারিয়ে যাবার আগে। এমন সময় টেলেক্স ক্যাম্পের পিয়ন তার সামনে একটা কাগজ এগিয়ে ধরল।
”আপকা হৈ?”
কলকাতা থেকে স্পোর্টস এডিটর রমেন গুহঠাকুরতা জানাচ্ছে; দু’দিন ভালো রিপোর্ট হয়েছে। রামিন্দার সিংয়ের সঙ্গে ইন্টারভিউয়ে আর একটু বাড়তি যেমন, ওর বউ কি ডিভোর্স করেছে? ওর বর্তমান ফর্মের উপর বিবাহিত জীবনের সমস্যা কতটা প্রভাব ফেলেছে?-এই ধরনের খবর থাকলে ভালো হত। ভবানীশঙ্করের সম্পর্কে ঘরোয়া অন্তরঙ্গ স্টোরি চাই। মেয়েদের চুমু তার ব্যাটিংকে ইনস্পায়ার করে কি; রাত করে হোটেলে ফেরা, গাঁজা আর মদের মধ্যে কোনটা সে পছন্দ করে, গার্ল ফ্রেন্ড আছে কি না? এই ধরনের গল্প থাকা বাঞ্ছনীয়। নিউজ যে দারুণ খবর দিচ্ছে, প্রত্যহ পিছিয়ে নেই।
সরোজ কাগজটা মুঠোর মধ্যে দলা পাকিয়ে ছুড়ে ফেলতে গিয়েও ফেলল না। রামিন্দারের সঙ্গে ইন্টারভিউ? ব্যাপার কী? আজ পর্যন্ত সে তো ওর সঙ্গে একবারও কথাই বলেনি!
চা-এ ভারত এক উইকেটে ৪২। আলভা জমাট বেঁধে গেছে ১১ রানে, ভবানীর ১৭ রান তার ধৈর্য পরীক্ষার ফল।
খেলা শেষের তিন ওভার আগে ভবানী প্রথমবার হাঁকাতে গেল ওয়ালেসকে। স্ক্রিনের সামনে ক্যাচটা লুফল লোকাস্ট। ভারতের ঠিক তখন ১০০ রান, ভবানীর ৬২। সে পঞ্চাশ পেরোতেই প্রেসবক্সে রেকর্ড খোঁজা শুরু হয়েছিল, প্রথম দুটো টেস্টে তিনটি সেঞ্চুরি করেছে এমন কেউ আছে কি না। পাওয়া গেল না। জীবনের প্রথম দুই টেস্টে দুটো সেঞ্চুরি পাওয়া গেল, অস্ট্রেলিয়ার ওয়াল্টার্স আর ওয়েস্ট ইন্ডিজের কালিচরণ, লরেন্স রো-র জীবনের প্রথম টেস্টেই দুটি সেঞ্চুরিকে এই রেকর্ডের মধ্যে গণ্য করা হবে কি না তাই নিয়ে দু-তিনজন তর্ক করার চেষ্টাও করল। ভবানীকে নিয়ে চারজনই জীবনের প্রথম দুটি টেস্টে দুটি সেঞ্চুরির রেকর্ড করেছে নিউজিল্যান্ডের বিরুদ্ধে-এটাও রেকর্ড হিসাবে গণ্য হওয়া উচিত, এমন একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছতেই ভবানী আউট হল।
হা-হুতাশ ধ্বনি একটু বেশি সময়ই রইল কেননা ভবানীর ব্যাটিংই দর্শকরা দেখতে চায়। ঠিক সেই সময়ই প্রেসবক্সে আসার পথটায় একজনের চড়া স্বরের কথাগুলো ডুবে যায় সারা মাঠের শব্দের মাঝে।
”হয়্যার ইজ হি?”
লাফ দিয়ে ধাপের উপর উঠে রামিন্দার প্রেসবক্সের সবার মুখের দিকে তাকাচ্ছে।
কে একজন আঙুল দিয়ে সরোজকে দেখিয়ে দিল। কাত হয়ে চেয়ারগুলোর পিছনের চিলতে জায়গা দিয়ে শরীরটাকে হিঁচড়ে হিঁচড়ে সে সরোজের পাশের লোকের পিছনে দাঁড়াল। ওর হাতে প্রভাত সংবাদের কপি দু’ভাঁজ করা, তাতে দেখা যাচ্ছে লাল পেনসিলে আঁকা বৃত্তের মধ্যে একটি খবর।
”আপনি এটা লিখেছেন?”
কপিটা সরোজ হাতে নিল। তার প্রথম দিনের রিপোর্টের মধ্য থেকে রামিন্দারের সঙ্গে ড্রেসিংরুমে রবি আনন্দের কাল্পনিক সংলাপ অংশটুকু আলাদা করে নিয়ে এবং ‘আমি শের-ই থাকতে চাই-রামিন্দার সিং’ এই শিরোনাম দিয়ে চারপাশে লাইন টেনে খবরটা বক্স করে ছাপা হয়েছে। এর সঙ্গে এমন কিছু বাক্য জোড়া হয়েছে যাতে পাঠকরা বোঝেন ওই খবরের লেখকের উপস্থিতিতেই দুজনের মধ্যে কথা হচ্ছিল।
সরোজ হতবাক। এভাবে জিনিসটা যে বেরোবে, তা সে কল্পনাও করতে পারেনি।
”আপনার লেখা?”
রামিন্দারের গলার স্বরে সারা প্রেসবক্সই নয় দু’পাশের গ্যালারি থেকেও বহু লোক উৎসুক চোখে তাকিয়ে।
”হ্যাঁ আমারই কিন্তু ঠিক এভাবে তো…”
”বাস্টার্ড, মিথ্যে কথা লিখে আমার ক্ষতি করার ফল এবার…”
বাঁ হাতে সে সোয়েটারের কলার মুঠোয় ধরে টান দিতে সরোজ চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ানো মাত্র রামিন্দার পাশ থেকে ডান হাতে ঘুসি মারল তার ডান চোয়ালে। সরোজ টেবলে মুখ থুবড়ে পড়ল।
পিছনের সারিতে বসা দুজন রামিন্দারকে জাপটে ধরায়, সে আর আঘাত করার সুযোগ পেল না। তুমুল হইচই আর বিশৃঙ্খলার মধ্যে রামিন্দারকে টানতে টানতে বাইরে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা শুরু হল। হিন্দি ও ইংরেজিতে অশ্রাব্য গালি দিতে দিতে সে বেরিয়ে যাবার আগে চিৎকার করে বলল : ‘এই লোকটা চিট, মিথ্যে জিনিস আমার সম্পর্কে বানিয়ে লিখেছে, এ লোকটার ক্যারেক্টার নেই, এর জন্মের ঠিক নেই…’
সরোজ কিছুক্ষণ মাঠটা, চারপাশের লোকজন ঝাপসা দেখল। ভোমরা ডাকার মতো একটা শব্দ ছাড়া আর কিছু শুনতে পাচ্ছিল না। চোয়ালটা অসাড়। তারপর একসময় সবই সে ফিরে পেল-রং, গতিবিধি, আকৃতি, শব্দ এবং যন্ত্রণা তার ইন্দ্রিয় গ্রাহ্য করতে পারল। একসময় তার মস্তিষ্কও সবকিছুকে একসঙ্গে মিলিয়ে বুঝে নিতে সক্ষম হল। সে সোজা মাঠের দিকে তাকিয়ে স্থির হয়ে বসে রইল। কৌতূহল, সহানুভূতি, প্রশ্ন কোনোকিছুই তার মধ্যে প্রতিক্রিয়ার সঞ্চার করল না। সে যেন পাথর হয়ে গেছে।
”রামিন্দার বাংলা জানে না, কেউ ওকে পড়ে শুনিয়েছে, উসকে দিয়েছে।”
”যাই লিখুক কিন্তু তাই বলে এভাবে প্রেসবক্সে এসে জার্নালিস্টকে মারা…বোর্ড সেক্রেটারি তো এখানে আছে, ড্র্যাস্টিক অ্যাকশন নেবার জন্য আমাদের তরফ থেকে কিছু করা দরকার।”
”একটা চিঠি ড্রাফট করো আমরা সবাই সই করব।”
”ডাক্তার দেখাতে হবে।”
কথার বুদবুদ অনেক উঠল কিন্তু সে একবারও পিছনে বা পাশে মুখ ফেরাল না। শঙ্কর চেয়ারে নেই। তরুণ একবার উঠে এসে কতা বলার চেষ্টা করেছিল ইতিমধ্যে দিনের খেলা শেষ হয়ে গেছে। ভারতের ১০২ রান, দুজনকে হারিয়ে।
সরোজ মাথা গুঁজে রিপোর্ট লিখল। টেলেক্স ক্যাম্পের কর্মচারী প্রেসবক্সেই অপেক্ষা করছিল। তার হাতে কপি দিয়ে সে বেরিয়ে এল, কেউ আর তার সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করেনি।
হোটেলে নিজের ঘরে অন্ধকারে খাটে বসে রইল দেয়ালের দিকে তাকিয়ে। একসময় উঠে আলো জ্বালল। আয়নায় নিজের সঙ্গে চোখাচোখি হতেই চোখ সরিয়ে নিল। সোয়েটারটা খোলার সময় চোয়ালটা ব্যথায় টনটন করে উঠল। দাঁত নড়ে গেছে, ভিতরের গাল কেটে রক্ত বেরোচ্ছিল তখন সে গিলে নিয়েছে, আঘাত কাউকে দেখাতে চায়নি।
স্টিলের আলমারিটা খুলে হ্যাঙার বার করার সময় চোখে পড়ল একটা ছোট হুইস্কির বোতল। লেবেলে লাল কালিতে লেখা-‘আপনার জন্য। ইতি রবীন মান্না।’ ক্যাপটা খোলা। আলোর দিকে তুলে দেখল কিছুটা কম, বোধহয় মান্না নিজেই খেয়েছে। হঠাৎ সে বোতলটা মুখে লাগিয়ে ঢকঢক করে মুখে ঢেলে বিকৃত মুখে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল। তখনও কিছুটা রয়েছে। সেটুকুও এক ঢোঁকে শেষ করে বোতলটা টেবলে রেখে আলো নিভিয়ে সে শুয়ে পড়ল। খিদে বোধ করছে না।
ঘণ্টা দুয়েক পর বাথরুমে যাবার জন্য উঠে আলো জ্বেলেই আয়নায় নিজেকে দেখতে পেল। এবার আর সরে গেল না। আস্তে আস্তে এগিয়ে এসে আয়নার কাচে কপাল ঠেকাল।
আমি কি বদলে গেলাম! সরোজ তীক্ষ্ন চোখে তাকাবার চেষ্টা করল। ওটা কি সরোজ বিশ্বাস? মুখটা দু’পাশে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে সে দেখতে লাগল।
তার মনে হচ্ছে আয়নার লোকটাকে সে এই প্রথমবার দেখছে। এই লোকটা ধূর্ত, ব্যক্তিত্বহীন, চাটুকার, বিবেকহীন। এ সরোজ বিশ্বাসের মতো চেহারাটা পেয়েছে মাত্র। দৃষ্টি মাঝে মাঝে ঝাপসা লাগছে চোখের পাতা ঝুলে আসছে। সে প্রাণপণে চোখ খুলে রাখার চেষ্টা করতে করতে ফিসফিসিয়ে প্রশ্ন করল, ”কে তুমি?” তারপর মাথা নেড়ে বলল, ”চিট, ক্যারেক্টার নেই, জন্মের ঠিক নেই।”
হঠাৎ তার মাথার মধ্যে ক্ষীণভাবে একটা স্বর জেগে উঠল। কে যেন, কে যেন তাকে একসময় বলেছিল, ‘বিট্রেয়ার…ভুল করেছি মেরুদণ্ডহীনকে ভালোবেসে…চিরকাল বুকে হাঁটবে…’ কে বলেছিল?
পেটের মধ্যে গুলিয়ে উঠল সরোজের। বমি করার জন্য সে বাথরুমে ঢুকল। বেরিয়ে এসে দেয়াল, টেবল, চেয়ার ধরে ধরে বিছানায় পৌঁছেই গড়িয়ে পড়ল।
”আহ, ঠিকই বলেছ বীণা।”
চিত হয়ে কথাগুলো বলে সে চোখ বন্ধ করল এবং কয়েক মিনিটের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়ল। আলোটা আর নেভানো হয়নি।
ছয়
কানপুরে ভারত চতুর্থ দিনে চায়ের পরই ইনিংস ও ১৭ রানে হেরে যাবার তিন দিন পর পুরনো দিল্লি স্টেশনে সরোজ ট্রেন থেকে যখন নামল ভোর হতে তখনও ঘণ্টাখানেক বাকি। স্টেশনের ভিতরে গিজগিজে ভিড়। বাইরের রাস্তা হালকা ভিজে, রাতে বৃষ্টি হয়েছিল। ভিতরে একটু গুমোট কিন্তু আরামদায়ক। স্টেশন থেকে বেরোবার গেটে অটো রিকশা আর ট্যাক্সিওয়ালারা, যারাই লটবহর নিয়ে বেরোচ্ছে তাদের পিছু নিচ্ছে। ঠিক কানপুরেরই মতো। এমন অন্ধকারেই আইএনএস-এর রিসেপশনিস্টকে ঘুম ভাঙিয়ে তোলাটা কি মানবিক হবে?
সরোজ স্টল থেকে চা কিনল। মিষ্টি গরম জল কিন্তু এখন ভালো লাগছে। সিগারেট ধরাল। একটা বেঞ্চে কোনোরকমে বসার জায়গা করে, নানাবিধ রেল বিজ্ঞপ্তি আর বিজ্ঞাপন পড়তে পড়তে সে ভোরের জন্য অপেক্ষা করতে লাগল।
আকাশে পুব থেকে আলোর আভা ছড়িয়ে যেতেই সে স্টেশন থেকে বেরোল। দুজন অটো রিকশাওলা গন্তব্য শুনে তাকে প্রত্যাখ্যান করল, একজন জানাল রফি মার্গ চেনে না, এক ট্যাক্সিওলা অসম্ভব ভাড়া হেঁকে বসল এবং অবশেষে এক অটো রিকশাওলা তাকে তুলে নিল। দিল্লির অটো চালকদের সম্পর্কে সারা ভারতে বদনাম আছে, ওরা সওয়ারিকে নতুন বা অনভিজ্ঞ বুঝলেই মিটারে ভাড়া বাড়িয়ে তোলার জন্য পাঁচ মিনিটের পথকে পঁচিশ মিনিট করে দেয় নানা পথ ঘুরিয়ে। নতুন দিল্লির রাস্তা এমনই যে নবাগতের কাছে একইরকম ঠেকে। চেনা জায়গায় যেতে হলে সরোজ এখনও বুঝে উঠতে পারে না কোন রাস্তা দিয়ে যেতে হবে।
ভোরের দিল্লি সরোজের মনোরম লাগল। অটোওলা যদি ঘোরাতে চায় তো ঘোরাক। জলকণা ভরা ঠান্ডা বাতাস মুখে জাপটা দিচ্ছে। বছরের দশ মাস ভ্যাপসা দরদরে গরমে কাটানো কলকাতাবাসীর কাছে শীতের জায়গা আরামেরই হয়। দোকানের বন্ধ শাটার ঘেঁষে ফুটপাথে অনেক লোক এখনও ঘুমোচ্ছে। শীত ঠেকাতে এমন মুড়ি দিয়েছে যেজন্য তাদের এক-একটা পুঁটলির মতো দেখাচ্ছে। মন্থর গতির কিছু পদচারী, সাইকেল আরোহী, হলুদ ট্র্যাফিক সংকেতের দপদপানি, চওড়া নির্জন রাস্তায় ট্রাকের টায়ারের চড়চড় শব্দ, দু’পাশে গাছের ডালপালায় হালকা কুয়াশার মতো ভোরের আলো। সরোজ মুখে বাতাস লাগিয়ে শরীরের ভিতরে শীত পাঠিয়ে দেবার কাজে মগ্ন রইল।
ইন্ডিয়ান ইস্টার্ন নিউজপেপার সোসাইটি অর্থাৎ আইইএনএস কথাটাই সরোজের কাছে একটা হেঁয়ালির মতো। ইস্টার্ন হলে তো পূর্ব ভারতের কাগজের জন্যই সোসাইটি, তা হলে দক্ষিণ আর পশ্চিম ভারতের কাগজগুলো এর সদস্য কেন?
রফি মার্গে সোসাইটির পাঁচতলা বাড়ির সর্বোচ্চচ তলায় আছে কয়েকটি গেস্ট রুম। একতলায় অফিস, বোর্ডরুম আর একটা ক্যান্টিন যেটার কন্ট্রাকক্ট দেওয়া বাইরের লোককে। সদস্যদের কর্মীরা ভাড়া দিয়ে গেস্টরুমে থাকতে পারে হোটেলের মতো। টেস্টম্যাচের সময় ঘর পাওয়া দায় যদি না আগাম বুক করা থাকে। মাঝের তিনটি তলায় দেশের নানান জায়গার খবরের কাগজ, পত্রপত্রিকার নিউজ ব্যুরো, আর নিজস্ব টেলেক্স, টেলিপ্রিন্টার নিয়ে অফিস।
অটো রিকশাটা আইফ্যাক্স বাড়িটা ঘুরে ডানদিকে মভলঙ্কর অডেটোরিয়ম আর এম পি-দের কোয়ার্টার ছাড়াতেই সরোজ ঝুঁকে মুখ বাড়িয়ে বাঁদিকে একটা কাঠের গেট দিয়ে রিকশাটাকে ঢোকাতে বলল। পোর্টিকোয় রিকশাটা থামতে সে দরজা দিয়ে ভিতরে তাকাল। অন্ধকার প্রায়। ডানদিকে রিসেপশন কাউন্টারে লোক নেই। ভাড়া দেবার সময় তার মনে হল সোজা পথেই তাকে আনা হয়েছে, লোকটা সৎ। মনটা প্রফুল্ল হয়ে উঠল, সত্তর পয়সা ফেরত নিল না।
কাউন্টারের পিছনের ঘরে টেলিফোনের পি বি বক্স। সেখান থেকে মাঝবয়সি একটি লোক বেরিয়ে এল। চোখ দেখে মনে হচ্ছে একটু আগেই ঘুম ভেঙেছে।
হোটেলের মতোই প্রাথমিক কাজগুলো। সরোজের জন্য ঘর বুক করাই ছিল। রেজিস্টারের ঘরগুলো ভরতি করে, ঘরের চাবি নিয়ে লিফটের দিকে এগোতে যাবে, তখন লোকটি ডাকল। একটি খাম তার হাতে।
সরোজ অবাক হল। পা দেওয়া মাত্রই চিঠি? আত্মীয় কি বন্ধুদের চিঠি আসে এখানকার অফিসের ঠিকানায়। রিসেপশনিস্টের কাছে পৌঁছবে না। কলকাতা অফিস থেকে আসবে এয়ার প্যাকেট। ডাকে আসা চিঠি নয়। খামটা ছিঁড়ে সে একটা ছোট্ট চিরকুট বার করল।
ইংরেজিতে লেখা : ”ডিয়ার আঙ্কল, আমাদের ফোন নম্বর দিলাম। এসেই ফোন করবে। আমি আবার খোঁজ নেব। সরোজা।” নামটা পড়েই সরোজের ভ্রূ কুঁচকে উঠল। সরোজা থেকে রোজা। কিন্তু তার নামের সঙ্গে এত মিল কেন! তারিখ দেওয়া নেই। বড়ো অক্ষরে ফোন নম্বর লিখে সেটার চারধারে মোটা লাইন টেনে চৌকো ঘর করে দেওয়া।
”কবে এসেছে?”
”কাল সন্ধ্যায়।”
”একটি মেয়ে দিয়ে গেল?”
”বলতে পারব না, আমি ডিউটিতে ছিলাম না।”
এখনই ফোন করা কি উচিত? হয়তো ওদের ঘুম ভাঙেনি। লিফটে ঢুকে সে চার নম্বর বোতাম টিপল। লম্বা বারান্দার একধারে ঘরগুলো, দরজার উপরে নম্বর লেখা। লিফট থেকে বেরিয়ে বাঁদিকে গিয়ে কোণের ঘর। চাবি দিয়ে দরজা খুলে ঘরের যাবতীয় আসবাবে চোখ বুলিয়ে, কাঠের আলমারিতে হ্যান্ডগ্রিপটা ঢুকিয়ে বেলবাজানোর সুইচটা টিপল। লিফট থেকে বেরিয়ে বারান্দার ডান প্রান্তে প্যান্ট্রি। সরোজ কান খাড়া করে সেখান থেকে ক্ষীণ শব্দ পেল বাজারের। অমলেট, টোস্ট, চা-কফি ছাড়া আর কিছু এখানে পাওয়া যায় না। নীচের ক্যান্টিন সন্ধ্যায় বন্ধ হয়ে যায়।
আপাতত খিদেটা মিটিয়ে সে ঘুমোবে। তার আগে বাথরুম যাওয়া। আর…টেবলে চিরকুটটায় চোখ পড়ল। সরোজের ভ্রূ আবার কুঁচকে উঠল। ফোন করাটা কি খুবই জরুরি? ক্রিকেটারদের সই জোগাড় করা আর ভবানীকে ওদের বাড়িতে নিয়ে যাওয়া-এই সব আবদার তার না রাখলেই কি নয়। তার থেকে ঘুমটা অনেক জরুরি। উত্তরপ্রদেশ ক্রিকেট সংস্থার লোকেরা ট্রেনে রিজার্ভেশন পাইয়ে দিয়েছিল তাই শুয়ে আসতে পেরেছে কিন্তু বন্ধ কামরার মধ্যে ঠান্ডাটা ক্রমশ জমাট বেঁধে তাকে এমন চেপে ধরেছিল যে সারারাত কুঁকড়ে থেকে সে শুধু প্রার্থনা করে গেছে একটি কম্বলের জন্য।
দরজায় টোকা পড়তেই সরোজ গোলাকার নবটা ঘুরিয়ে দরজা খুলল। পাজামা আর সোয়েটার পরা লোকটি মুখচেনা। আগের বারও একে দেখেছে। গাড়োয়ালি, নামটা মনে পড়ছে না।
”গুড মার্নিং সাব…কলকাতা থেকে এলেন?”
”না, কানপুর।”
”ক্রিকেটের জন্য?”
সরোজ মাথা নাড়ল।
”আরও তিনজন সাব কাল রাতে এসেছেন, পাঁচ, চার আর দু’নম্বর কামরায় আছেন।”
লোকটিকে খাবার আনতে বলে সে শেভিং ক্রিম, ব্রাশ, সেফটি রেজার, টুথব্রাশ, পেস্ট ইত্যাদি বার করে বাথরুমে যাবার জন্য তৈরি হতে লাগল। তখন চিরকুটটায় আবার চোখ পড়তেই তার মেজাজ সামান্য রুক্ষ হয়ে উঠল। ওদের দরকার যখন ওরাই ফোন করবে। এতকাল কোনো যোগাযোগ যখন ছিল না তখন ভবিষ্যতেও না থাকলে কিছু ক্ষতি বা লাভ হবে না। বীণার প্রতি তার আর আগ্রহ নেই, খুঁচিয়ে পুরনো সম্পর্ক আর এই বয়সে কবর থেকে তুলে আনা যায় না, সম্ভবও নয়। যে যার ছাঁচে ঢুকে গেছে, মনের উপর কঠিন আবরণ পড়েছে। শরীর অবশ্য নিজস্ব নিয়মেই সক্রিয় রয়েছে যাবতীয় চাহিদা নিয়ে। ট্রেনে পাশে বসে কথা বলার সময় বীণা পায়ের উপর পা তুলতেই হালকা সিল্কের শাড়ির নীচে ওর ঊরুর গড়ন ভালোমতোই আভাস দিয়েছিল। তখন তার মনোনিবেশ কিছুটা টাল খেয়েছিল এবং সারাক্ষণই সে বীণার শরীরের নানান জায়গার স্মৃতি হাতড়ে ছবি সংগ্রহ করে তখন আর এখনের মধ্যে যে তুলনার চেষ্টা করে গেছল, সেটা এই মুহূর্তে নিজের কাছে সরোজ কবুল করল। ”এক তিলও বদলাওনি।” কথাটা বলার জন্য তখন উত্তেজিত স্মৃতি তাকে কি উসকে দেয়নি? কথাবার্তায় সে আদিরসের ছোঁয়া দিয়েছিল হালকা রসিকতার ছলে। বীণা তা গ্রহণ করে ”বদমাইশ” বলেছিল। সরোজের হাসি পেল বদমাইশ শব্দটিতে। শালটা দিয়ে যাওয়ার মধ্যে কি বুঝিয়ে গেছে এখনও দুর্বলতা রয়েছে! ওটা ফেরত দিতে হবে।
”পেপার, পেপার।”
বাইরের বারান্দায় হকারের হাঁক। সরোজ তাড়াতাড়ি দরজা খুলে লোকটিকে ডেকে দুটি ইংরেজি কাগজ কিনল। বলেও দিল রোজ যেন দিয়ে যায়। প্যান্ট্রি থেকে ট্রে নিয়ে বেয়ারা আসছে দেখে সরোজ দরজাটা খুলে রেখে ঘরে এসে চেয়ারে বসল।
প্রথম কাগজটা খুলেই সে খেলার পাতায় চলে গেল। বৃষ্টির জন্য নেট প্র্যাকটিসে বঞ্চিত ফিরোজ শাহ কোটলায় ড্রেসিংরমে বসে থাকা ভারত দলের কয়েকজনের একটা তিন কলম ছবি। তিনজন তাশ খেলছে, একজন অটোগ্রাফ খাতায় সই দিচ্ছে আর দরজায় দাঁড়িয়ে মাঠের দিকে যে তাকিয়ে আছে তাকে চিনতে সরোজের এক লহমাও লাগল না।
রামিন্দারের প্রতি সরোজের কোনো বিদ্বেষ নেই। অন্য কাগজকে টেক্কা দেবার জন্য ডেস্ক যদি তার রিপোর্ট থেকে কাল্পনিক সংলাপটা তুলে সেটাকে সত্যি সংলাপ হিসাবে আলাদা করে না ছাপাত তাহলে কিছুই ঘটত না। রামিন্দার-আনন্দ কথাবার্তা যে বানানো সেটা জেনেই এই কাজ গুহঠাকুরতা করেছে। রামিন্দার সম্পর্কে তার সহানুভূতি এখনও অটুট, সে মনেপ্রাণেই চায় এই সরল ও সাহসী জাঠ এবং দর্শনীয়-না-হয়ে-প্রয়োজনীয় ব্যাটসম্যানটি ফর্মে ফিরে আসুক।
তবে রামিন্দার তাকে যে কিছু একটা করে দিয়েছে সরোজ তা বুঝতে পারে। প্রতিদ্বন্দ্বিতা কী জিনিস এখন সে জেনেছে আর বদ্ধপরিকর হয়ে উঠেছে অন্য কাগজকে পিছনে ফেলে দিতে। খবরের জন্য, যে-কোনো পন্থা নিতে হয় নেবে, যতদূর যেতে হয় যাবে, যদি মিথ্যা লিখতে হয় তো লিখবে। ‘টোটালি মিসফিট’ বলার সুযোগ আর দেবে না। এখন সে মনে মনে তারিফ করে সেই ব্যক্তিটিকে যে রামিন্দারকে প্রভাত সংবাদ দেখিয়ে তাকে উত্তেজিত করে প্রেসবক্সে পাঠিয়েছিল। কে সেই ব্যক্তি তা সে এখনও জানে না। তরুণ হতে পারে, শঙ্করও হতে পারে এবং কাঞ্জিলালও, যেই হোক, ওইভাবে সে-ও ঘায়েল করবে। মোট কথা, এখন সবাইকে প্রতিদ্বন্দ্বী ধরে নিয়ে সে চলবে।
কানপুরে কাঞ্জিলাল তার ঘরে রাতে এসেছিল ম্যাচ শেষ হবার পর। চায়ের সময় নির্বাচকরা বসেছিল দিল্লি টেস্টের জন্য দল বাছতে। রামিন্দাকে রাখা হবে কি হবে না শুধু সেজন্যই দেড় ঘণ্টা তপ্ত বিতর্ক হয়েছে। কাঞ্জিলাল রাখার পক্ষে একাই প্রায় যুদ্ধ করেছে এবং জিতেছে। সাংবাদিককে ঘুসি মারার প্রসঙ্গ তুলে দুজন নির্বাচক ওকে বাদ দেওয়ার জন্য চাপ দিয়েছিল।
”তখন আমি বলি, সরোজ বিশ্বাসকে আমি চিনি, আমার বন্ধু, এ-ব্যাপারে ওর সঙ্গে কথাও বলেছি। ও বলেছে ‘রামিন্দারের দোষ নেই আমিই মিথ্যে লিখেছি।’…সরোজ, এটা আমাকে বলতেই হল নয়তো ওকে টিমে রাখা যেত না। বলেছি, মিথ্যে লেখার জন্য ক্ষমা চেয়ে রামিন্দারকে চিঠিও দিয়েছে। তা ছাড়া সাংবাদিক নিজে তো ওর বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ আনেনি…সরোজ আমি বাধ্য হয়ে, মানে, আমি তো জানি তুমিও চাও রামিন্দার থাকুক টিমে। তাই তোমাকে ভাঙিয়ে ওকে ডিফেন্ড করলাম।”
সরোজের কানে, ‘তোমাকে ভাঙিয়ে’ শব্দ দুটো এঁটুলির মতো কামড়ে লেগে রইল। কাঞ্জিলালের কথায় সে একটুও বিব্রত, উত্তেজিত বোধ করেনি। তার মাথায় তখন শুধু একটি জিনিসই কাজ করছিল-এগুলো হচ্ছে ভিতরের খবর। এখন এসবই আমার চাই। কাঞ্জিলাল এবার তোমাকে আমি ভাঙাব।
কাগজে আলভারও একটা ছবি রয়েছে। কানপুরে ১০৪ করে, আউট হয় অষ্টম। ছাপোষা ইনিংস, বিপদের কারণ হবে না বুঝেই জেরি মার্কস ওর দিকে নজরই দেয়নি, চেষ্টাও করেনি ওর উইকেট নেবার। আপাতত আলভা এখন চোখ টেনে রেখেছে। আর একটা খবরে সরোজের চোখ পড়ল, কলকাতা থেকে ঘোষাল আজ এসে পৌঁছয়নি, জানা গেছে কাল সকালের ফ্লাইটে আসছে।
পরের দিন ছিল রেস্ট ডে। সরোজ হোটেলের ঘর থেকে বেরোয়নি। সন্ধ্যায় ভবানীও শঙ্করের সঙ্গে মধুছন্দায় এসেছিল তাকে দেখতে। প্রেসবক্সের ঘটনা নিয়ে কোনো কথা তোলেনি। সরোজ তাতে হাঁফ ছেড়েছিল। তবে শঙ্কর তাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবার প্রস্তাব দিতে সে ‘কিছু হয়নি’ বলে প্রত্যাখ্যান করে।
”আপনার সেই অটোগ্রাফ বুকটায় ইন্ডিয়ান টিমের প্রায় সবারই করেছি। বাকিগুলো আর নিউজিল্যান্ডারদের, ভুবু করে দেবে বলেছে। দিল্লিতে পেয়ে যাবেন।” শঙ্কর ওর দিকে তাকাতে ভবানী সম্মতি জানিয়ে মাথা হেলাল।
”দিল্লিতে কোথায় যেন উঠছ?”
”জায়গাটা ঠিক এখনও জানি না, তবে ইআইএনএস-এর কাছেই। বলেছি তো ফোন করব। আর ভুবু, তুই কিন্তু একদিন সরোজদার…কে হয় আপনার?”
”ফ্রেন্ড।”
”হ্যাঁ ফ্রেন্ডের বাড়িতে যাবি।”
”নিশ্চয়। বলবেন কবে।”
”খেলার দিনগুলোয় তো আর…”
”কেন হবে না! আমি যে-কোনো দিন যেতে পারি।” তাচ্ছিল্য ভরে ঠোঁট মোচড়াল ভবানী।
”ভুবুর রেটিং এখন ভেরি হাই। এসব নিয়ে কথা বলার সাহস এখন কারুর হবে না। দুটো যা সেঞ্চুরি দেখাল!”
শঙ্কর মুগ্ধ চোখে তাকিয়েছিল হাতের আঙুলের নখ পরীক্ষায় মনোযোগী ভবানীর দিকে। তরুণ এসেছিল ওরা চলে যাবার পর। আঘাত ও চিকিৎসা সম্পর্কে প্রথাগত খবর নেওয়া এবং পরামর্শ দেওয়ার পর বলেছিল, ”কলকাতায় একমাত্র শঙ্করের লেখা ছাড়া আর কোথাও আপনার নাম বেরোয়নি। সন্ধেবেলায় টেলিফোন করেছিলাম অফিসে। এমন বিশ্রী একটা লজ্জাকর ব্যাপারে আপনার নাম জড়ানো থাকুক এটা কলকাতার পক্ষেও ভালো দেখায় না, এজেন্সিদেরও রিকোয়েস্ট করেছিলাম আপনার নামটা না দিতে, ওরা দেয়নি, শুধু লেখে ‘এ ডিস্টিংগুইশড ভেটারেন জার্নালিস্ট।’ শঙ্কর যে কেন দিল!”
তরুণ খুবই বিষণ্ণমুখে তার দিকে তাকিয়েছিল। ও বোঝাতে চাইছিল, সরোজের মান-সম্মান শঙ্কর ডুবিয়েছে এবং সে চেষ্টা করেছে বাঁচাতে। শঙ্করের প্রতি তার বিদ্বেষ, ঘৃণা, রাগ জাগানোর সূক্ষ্ম প্রয়াসটা সরোজ বুঝতে পেরেছিল।
”তবে নিউজ ডে-র সার্কুলেশন এত কম, খুব কম লোকই জানবে।” তরুণ সান্ত্বনা দিয়েছিল।
চতুর্থ দিনেই ভারতীয় ইনিংস অপ্রত্যাশিত ভেঙে পড়ে ম্যাচ শেষ হয়ে যায়। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে গ্যালারিতে দু’জায়গায় দাউ দাউ আগুন দেখা দিতেই পুলিশ ও দমকলের লোক আর দর্শকদের ছোটাছুটি শুরু হয়। প্যাভিলিয়নের সামনে উত্তেজিত জনতার থেকে স্লোগান ওঠে ”রবি আনন্দ হায় হায়, রামিন্দার সিং হায় হায়। সিলেকশন কমিটি হায় হায়।”
প্রেসবক্সে যখন সে লিখছিল তখন কামদারের সঙ্গে একবার চোখাচোখি হতেই বৃদ্ধ উঠে আসেন।
”ফিলিং অলরাইট?”
”হ্যাঁ।”
”কিন্তু আমি ফিল করছি না। কীভাবে শেষ হয়ে গেল দেখলে? সাধারণ বোলিং, এত ভালো ব্যাটিং উইকেট, কেন এটা হল?”
”প্যানিক।”
”কেন প্যানিক?”
”রামিন্দার আর ভবানীর কাল উইকেটে থাকতে না পারায় গোটা টিমটারই নার্ভ ফেল করে গেছে।”
”এটাই আপাতদৃষ্টে মনে হয়। কিন্তু তুমি আর একটা ব্যাপার ভাবো, এই টিমটার মরাল বলে কিছু নেই। দুটো দলে ভাগ হয়ে গেছে, নর্থ আর সাউথ, অবিরত খেয়োখেয়ি, আনন্দকে ক্যাপ্টেন করা হয়েছিল রামিন্দারের ক্লেইম বরবাদ করে, ওখানেই টিমের মধ্যে একটা ধারণা এসে যায় ইন্ডিয়ান ক্রিকেটে জাস্টিস বলে কিছু নেই। রামিন্দার পরের পর ফেল করেছে তার একটা কারণ, কাগজে কাগজে লেখা হয়েছে রামিন্দার ক্ষুব্ধ, আনন্দের সঙ্গে কো-অপারেট করবে না, ফলে কথাটা যে মিথ্যা এটা প্রমাণ করার জন্য ও দারুণ খেলবে ঠিক করে নিজেকে প্রেশারের মধ্যে ফেলে দেয় আর তাতেই ও ডুবছে। দেখলে তো রামিন্দার হায় হায় হচ্ছে, যেন আর সবাই মহাত্মা, পাপী শুধু একজনই। এই যে সেদিন দুই সিনিয়র গালাগালি হাতাহাতি করল টিমের বাচ্চচাদের সামনে, তারই প্রতিক্রিয়া ওখানে হল।”
কামদার ডান তর্জনীটা ঘাড়ের পাশ দিয়ে পিছনে মাঠের দিকে নির্দেশ করলেন।
”লড়ে যাবার ইন্সপিরেশন যেখান থেকে আসে”, তর্জনীটা বুকে ঠেকালেন, ”ভেঙে গেছে জায়গাটা। ওরা ধরেই নিয়েছে ম্যাচটা শুধু ওই দুজনের ব্যক্তিগত মর্যাদার ব্যাপার, তাদের কিছু করার নেই।”
”আলভাও অনেকটা দায়ী।” সরোজ বলেছিল। বৃদ্ধ হাসতে শুরু করলেন। ”লিখবে নাকি? লিখো না, সেঞ্চুরি করেছে, সবাই তোমাকে পাগল বলবে। একটা সেলফিশ ইনিংস খেলল।”
”যদি বোলিংয়ের ঘাড় ধরে ঝাঁকুনি দিত, ওর সে ক্ষমতা আছে, অন্তত এই উইকেটে তাই করা উচিত ছিল ফোর্থ উইকেট পড়তেই।”
আমি হলে আজ ফোর্থ ওভার থেকেই করতাম। কোনো উইকেট পড়ুক বা না পড়ুক, দৃষ্টান্ত দিয়ে অন্যদের দেখিয়ে দিতুম ভয় পাওয়ার কিচ্ছু নেই। তার বদলে আলভা এমনভাবে ব্যাট করল যেন ওল্ড ট্র্যাফোর্ডে স্টিকি উইকেটে ভেরিটিকে খেলছে। আসল কালপ্রিট এই লোকটাই। শুধু নিজের জন্য খেলল। সামনেই ইংল্যান্ড ট্যুর, জায়গা পাকা করে রাখল।…যাই এবার, সন্ধ্যায় এক ফ্রেন্ডের বাড়িতে বসব, ছোট্ট পার্টি, টোস্ট করব জাহান্নমে যাওয়া ইন্ডিয়ান ক্রিকেটের নামে।”
কামদার চলে যাওয়ার পর সরোজ মিনিট দুয়েক ভাবল তারপর লিখে ফেলা দেড়খানা পাতা দলা-পাকিয়ে ফেলে নতুন কাজে নেয়। সারা দুপুর গভীর ঘুমের মধ্যে সরোজ কাটাল। দরজায় খটখট শব্দে ঘুম ভাঙে।
”আরে, এসো এসো।” দরজা খুলে দাশরথিকে দেখে সরোজ অবশ্য অবাক হয়নি। দাশরথি তাদের দিল্লি ব্যুরোর রিপোর্টার, দেড় বছর আগে কলকাতা থেকে এসেছে।
”ঘুমোচ্ছিলেন! এই নিন আপনার প্রেসপাস, পেতে যা ঝামেলা! একবার বলে অমুকের কাছে যান, গেলাম তার কাছে। সে বলল আমি নয় তমুকে দেবে। গিয়ে দেখি সে নেই। দেড় ঘণ্টা অপেক্ষা করে… দিল্লিতে এইভাবেই সব হয়, মজার কথা কী জানেন, প্রথমে যে লোকটা বলেছিল অমুকের কাছে যান সেই-ই শেষপর্যন্ত দিল।…যাক গে, এসব কথা, কানপুরে কী হয়েছিল দাদা? কাল কলকাতা থেকে রমেনদা ফোন করে আপনার খোঁজ নিতে বললেন, কানপুরে আপনার হোটেলের ফোন নম্বর জানেন না, তাই আমাকেই বললেন!”
”কিছুই হয়নি। তিলকে তাল করেছে। সামান্য কথা কাটাকাটি তাই নিয়ে…তুমি আছো কেমন?”
”ভালোই, চলে যাচ্ছে…আপনার খাওয়া-দাওয়া কোথায় করবেন…এদের টাকা দিয়ে বলে দেবেন, নীচের ক্যান্টিন থেকে এনে রেখে দেবে।”
দাশরথি কলকাতার কিছু লোকের খবর নিয়ে, সরোজের প্যাকেট থেকে সিগারেট বার করে ধরিয়ে উঠে পড়ল যাবার জন্য।
”যাক তাহলে আপনার কিছু হয়নি। যাই একবার শরৎ হালদারের বাড়ি, ডেকেছেন, ক্যাবিনেট মিটিংয়ে ফরেন টুরিস্টদের কাছে দার্জিলিং প্রহিবিটেড থাকবে কি না সেটা ওঠার কথা ছিল।”
দাশরথি বেরিয়ে যাবার পরই বারান্দা থেকে ওর গলা শোনা গেল, ”হ্যাঁ হ্যাঁ ওই কোণের ঘরটা… হ্যাঁ আছেন।”
দরজাটা ভেজানো, সামান্য ফাঁক রয়েছে। সরোজ দেখতে পেল রোজাকে। তাড়াতাড়ি সে জামাটা টেনে পরতে শুরু করল।
”আঙ্কল আসব?”
”এসো। তোমার নোট পেয়েছি। বোসো…এসেই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, এত টায়ার্ড লাগছিল।” সরোজ ঘড়ি তুলে সময় দেখল। প্রায় ছ’ঘণ্টা ঘুমিয়েছে দশটা থেকে। ট্রেনে যে পোশাকে রোজাকে দেখেছিল, তাই-ই পরা তবে শার্টের বদলে পোলো গলা উলের গেঞ্জি, যেটা অত্যন্ত আঁটো হওয়ায় স্তনের গড়ন সম্পর্কে স্পষ্ট নিখুঁত ধারণা পেতে অসুবিধে হয় না। সরোজ অস্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতে শুরু করল। উঠে গিয়ে বাজারের সুইচ টিপল।
”চা খেতে হবে, তুমি কফি না চা? অমলেট?”
”শুধু কফি, নো শুগার।”
”এখানে পটে চিনি দেয়।…ফিগার ঠিক রাখছ?”
”ফিগারের জন্য নয়, চিনি খাওয়াটাই তো ক্ষতিকর। কেমিক্যালি রিফাইন্ড এই সাদা চিনিতে ভিটামিন, মিনারাল, প্রোটিন, ফ্যাট সবই তো নষ্ট হয়ে গেছে, এর কোনো ফুড ভ্যালুই নেই বরং নানান রোগের কারণ হয়। খাওয়া একদম ছেড়ে দেওয়াই বরং উপকারী।”
বেয়ারা এসেছে। সরোজ তাকে শুধু কফি দিতে বলল। রোজা যে হালকা, চপল, মাথায় ক্রিকেটের খবরে ঠাসা নিছকই ছেলেমানুষ নয় সরোজ তা বুঝতে পারছে।
”চিনিতে দাঁতও নষ্ট হয়।” চিনির বিরুদ্ধে সরোজ এইটুকুই জানে।
”মা খুব মিষ্টি খেত, এক সায়েন্টিস্টের একটা আর্টিকেল একদিন পড়তে দিয়েছিল ব্যস তারপর থেকেই বাড়িতে চিনি আসা টোটালি বন্ধ। সে কী মুশকিলের ব্যাপার, ড্যাডি তো ভীষণ চা খায়, চিনি ছাড়া চা মুখে দেয় আর কাপ নামিয়ে রাখে। পুডিং তৈরি বন্ধ, কেক তৈরি বন্ধ, সফট ড্রিঙ্কস বন্ধ। চিনির বদলে শুরু হল কলকাতা থেকে টিনে করে আনানো গুড় আর পাটালি খাওয়া। এসবে তো আর কেমিক্যালস নেই। উফফ প্রথম প্রথম সে কী কড়াকড়ি। গেস্ট এলে তাকেও চিনি ছাড়া চা বা কফি। আর কেউ আসে না আমাদের বাড়ি। জ্যোতিষমামা তো একদিন পকেটে চিনি নিয়ে এল। শেষে আমি আর ড্যাডি মাকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে শুধু গেস্টদের জন্য চিনির ব্যবস্থা করেছি আর ড্যাডির জন্য স্যাকারিন।”
”জ্যোতিষমামা কে?”
”আপনি চেনেন না? মা যে বলল চেনেন!”
”ওহহ হ্যাঁ চিনি, তোমার মায়ের সঙ্গে পড়ত, কলেজ ক্রিকেট টিমের কিপার ছিল।”
”আপনি ছিলেন বেঙ্গল টিমের।”
সরোজ হাসল শুধু।
”তাই ওকে মামা আর আমাকে আঙ্কল বলছ?”
রোজা অপ্রতিভতা সামলাবার জন্য হাসল। সরোজ হাসিটার মধ্যে একটি শিশুকে দেখতে গেল।
”তাহলে আপনাকে কী বলব বলুন তো?”
”কিছু না, যা বলছ তাই বলো।”
কফি রেখে গেল বেয়ারা। সরোজই দুটো কাপে ঢালল। নিজের কাপে চিনি দেবার সময় রোজার দিকে তির্যক চাউনিতে তাকিয়ে বলল, ”এখন তোমার মা দেখলে কী করত?”
”কিছুই না। যদি ড্যাডি হতেন কফির কাপটা নিয়ে বেসিনে ঢেলে দিয়ে আসত।”
”ভাগ্যিস তোমার ড্যাডি নেই।”
কাপে চুমুক দিল দুজনেই। মুখটা নিচু করার সময় রোজার চশমাটা নাক বেয়ে একটু নেমে গেল। আঙুল দিয়ে সে ঠেলে তুলে দিল। সরোজ ওর চিবুক আর ঠোঁট লক্ষ করল, তারই মতো প্রায়।
”তোমার পাওয়ার কত?”
”লেফট আই মাইনাস ফোর পয়েন্ট সেভেন ফাইভ, রাইট আই মাইনাস ফাইভ।”
”আমারও তাই মনে হয়েছিল। বাড়িতে আর কার চশমা আছে?”
”ড্যাডির, মাইনাস সিক্স। মা তো আমাকে স্কুটার চালাতে দিতে চায় না, বলে লেন্সের এত পাওয়ার অ্যাকসিডেন্ট করে ফেলবে। ড্যাডির সাপোর্ট আমার দিকে, ফ্লাইং ক্লাবে আমাকে ভর্তি করে দেবে বলে মাকে ভয় দেখায়।”
”তোমার স্কুটার আছে?”
”হ্যাঁ, তাতেই তো এসেছি।”
”তা প্লেন চালানো শিখলেই তো পারো।”
রোজার মুখে গাম্ভীর্য ফুটে উঠল, স্বরেও, ”বড্ড খরচ, ড্যাডিকে ট্যাক্স করা হবে।”
ফোন বেজে উঠল। সম্ভবত দাশরথি বা তিনতলায় তার অফিস থেকে কেউ, এইভেবে সরোজ রিসিভার তুলল।
”আরে তুমি, কবে এলে?…আজ দুপুরে…ভবানীও, কাগজে দেখলুম আজ সকালের ফ্লাইটে দিল্লি পৌঁছবে লিখেছে…অ্যাঁ তোমার ওখানে…আবার আমাকে কেন, আমার ঘরে এখন অত্যন্ত মিষ্টি এক অতিথি এসেছে যে একদমই মিষ্টি খায় না…হ্যাঁ, আরে আমার চুলটুল পেকে গেছে ওসব আর…অটোগ্রাফ বইটা এরই, এদের বাড়িতেই ভবানীকে নিয়ে যাবার জন্য বলেছিলাম…এখনই আলাপ হতে পারে, দাঁড়াও ওকে জিজ্ঞাসা করি, এক মিনিট।” সরোজ রিসিভারের মুখে তালুচাপা দিয়ে মাথা ঘুরিয়ে দেখল রোজা তার দিকেই তাকিয়ে। ”ভবানী এক জায়গায় আড্ডা দিতে এসেছে, যাবে নাকি সেখানে।”
”ওহহ নিশ্চয়।” রোজা স্প্রিংয়ের মতো উঠে দাঁড়াল। ”এজন্যই তো আপনার কাছে এসেছি মনে করিয়ে দিতে আর দেখুন…”
”মেঘ না চাইতেই জল। ওরা কিন্তু ড্রিঙ্ক করছে আমাকে জয়েন করার জন্য ফোনটা করেছে।”
”করুক না ড্রিঙ্ক, আমাদের বাড়িতে তো সবাই খায়।”
”হ্যালো শঙ্কু, ঠিকানাটা বলো…দাঁড়াও লিখে নিই…অ্যাঁ লিখতে হবে না সোজা রাস্তা, বলো…শিবাজি স্টেডিয়ামের…হ্যাঁ ইউনাইটেড টেক্সটাইল সাইনবোর্ড তার পাশে ফলের দোকান, তার পাশে প্রাইভেট রাস্তা, গেট আছে সিমেন্ট বাঁধানো, লিফটের দরকার নেই দোতলায় অফিস আর তার সঙ্গেই ফ্ল্যাট, আলাদা দরজা আছে, বেশ…একেবারে ফাইভ স্টার হোটেলের মতো সাজানো…দশ মিনিটের মধ্যে? আচ্ছা চেষ্টা করছি, রোজার স্কুটার আছে, হ্যাঁ, হ্যাঁ ওর নামই, আচ্ছা, আচ্ছা।”
ফোন রেখে দিয়ে সরোজ একগাল হাসল।
”শুনলে তো, জায়গাটা বুঝতে পারলে? এখন তুমিই সারথি, কী লাক তোমার!”
মিনিট পাঁচেকের মধ্যে দুজনে নীচে নেমে এল। ঘরের চাবিটা জমা দিয়ে পোর্টিকোয় রাখা স্কুটারটা দেখে সরোজ বলল, ”নতুনই দেখছি, কবে কিনেছ?”
”এক বছর প্রায়।”
রোজা স্টার্ট দিয়ে উঠে বসল, সরোজ বিব্রত হল ওর পিছনে কীভাবে বসবে তাই ঠিক করতে গিয়ে। রোজা ছেলে হলে ঘোড়ায় চড়ার মতো দু’পাশে পা ঝুলিয়ে বসে কাঁধে হাত রাখত। কিন্তু ও প্রায় অপরিচিত একটা মেয়ে। শাড়ি পরা মেয়েরা একদিকেই দুটো পা রেখে যেমন বসে সেভাবেই বসবে কি না ভাবছিল। তখন রোজা তাড়া দিল, ”উঠুন।”
সরোজ আর কিছু না ভেবে পা সিটের উপর দিয়ে ঘুরিয়ে চড়ে বসল। আর দুটো হাত পিছনে নিয়ে আঁকড়ে ধরল কেরিয়ারটা। তার বুক বা ঊরু রোজাকে যেন স্পর্শ না করে, আড়ষ্ট হয়ে সেদিকে সজাগ থেকে একসময় সে বলল, ”একটু আস্তে চালাও, ভবানী তো আর পালাচ্ছে না।”
পাশ থেকে সে রোজার গালের পেশি হাসিতে নড়ে উঠতে দেখল।
শঙ্করের দেওয়া নির্দেশমতো ওরা ঠিক জায়গায় পৌঁছল। চারতলা অফিস বাড়িটা একটু পুরনো। ছুটি সবে হয়েছে। অনেকেই ফিরে ফিরে রোজার দিকে অথবা ওর বুকের দিকে তাকিয়ে গেল। দোতলায় খোলা দরজা দিয়ে একটা অফিস দেখা যাচ্ছে। পাশের বন্ধ দরজার কলিংবেলে দু’বার চাপ দিল সরোজ। আধ মিনিটের মধ্যে পাল্লা খুলে শর্টস পরা শঙ্কর বলল, ”হাই সরোজদা, হাই রোজা।”
সাত
সোফার একধারে খয়েরি ট্রাকসুট পরা ভবানী বসে। হাতে একটা গ্লাস। পানীয়ের রং দেখে ওতে যে রাম রয়েছে বুঝতে সরোজের অসুবিধে হল না। ভবানী উঠে দাঁড়িয়ে হাত বাড়াল। প্রথমে সরোজ তারপর রোজা।
”সরোজদা কিছু মনে করছেন না তো।”
ভবানী গ্লাসটা তুলে দেখাল।
”আরে না না, এতে মনে করার কী আছে। আজই পৌঁছলে?”
”হ্যাঁ, আটটায় ল্যান্ড করার কথা করলাম দশটায়। ফগ-এর জন্য ডিলেড। নেটও হল না, কালরাত্রের বৃষ্টিতে আরও ভিজে গেছে। ঢেকে রাখতে পারত প্র্যাকটিস পিচটা, এখানকার ব্যাপারই কীরকম গেঁইয়াদের মতো।”
”ব্যাটিং প্র্যাকটিস না করলে তো আপনার অসুবিধে হবে।” রোজার স্বর উদ্বিগ্ন এবং সিরিয়াস।
ভবানী ওর মুখের দিকে তাকিয়ে দৃষ্টিটা একফুট নামিয়ে আবার তুলল। সরোজ অস্বস্তি বোধ করে মুখ ঘুরিয়ে ঘরের কোণে গ্লাসে রাম ঢালায় মনোযোগী শঙ্করকে লক্ষ করার কাজ নিল।
”অসুবিধে আর কী, নিউজিল্যান্ড বোলিং মোটামুটি জানা হয়ে গেছে, কোনো সারপ্রাইজ নেই। আসাম-অন্ধ্রে এরকম বোলার তো প্রচুর আছে।”
সরোজ এহেন বাগাড়ম্বরে না তাকিয়ে পারল না। তখন ভবানীর অলস চাহনি রোজার দুই ঊরুর মধ্যে নিবদ্ধ এবং রোজা সেটা বুঝতে পারছে কিন্তু অগ্রাহ্য করছে। ঠোঁটেও পাতলা হাসি।
”সরোজদা জল না সোডা, রোজা তোমার?”
অন্যত্র তাকাবার সুযোগ পেয়ে সরোজ তাড়াতাড়ি মুখ ফেরাল।
”জল।”
”আমি সোডা। রোজা ভবানীর মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল। সরোজ অস্বস্তি বোধ করল। এতটুকু মেয়ে! ভিন্ন কালচারে মানুষ, কলকাতার মধ্যবিত্ত বাঙালির পক্ষে এদের বুঝে ওঠা শক্ত।
হঠাৎ-ই তার মনে পড়ল বহু বছর আগে রেস্টুরেন্টের ঘটনাটা। সুবীর বলেছিল, একবার ঘুরে আয় না ওদের কলেজ থেকে। সরোজ আগাম বলে রেখে একদুপুরে কথামতো গিয়ে বসেছিল হেদুয়ার উত্তরে পেঙ্গুইন রেস্টুরেন্টে, অপেক্ষা করতে করতে দু’কাপ চা শেষ করে। তারপর সুবীরের বোন সুজাতা, বীণা, আরও দুটি মেয়ের সঙ্গে এসেছিল একটি তরুণ। ওরা বসল পাশের টেবলে অপরিচিতের মতো। কথা বলছিল ক্রিকেট নিয়ে। শুনতে শুনতে সরোজ জেনেছিল তরুণটির নাম জ্যোতিষ, কলেজ টিমে উইকেটকিপার, বাড়ি জামশেদপুরে এবং বিহার টিমে নাকি বাংলার বিরুদ্ধে রঞ্জি খেলেছে। গত বছর। সরোজ আড়চোখে জ্যোতিষের মুখটা দেখে নিয়েই জেনে গেল মিথ্যেবাদী।
”বাংলার কে যেন উইকেটকিপার?” সুজাতা তখন বলেছিল।
”সরোজ বিশ্বাস।”
”কেমন খেলে?” বীণা প্রশ্ন করে জ্যোতিষকে।
মুখটা তাচ্ছিল্যে বেঁকিয়ে জ্যোতিষ বলেছিল, ”ব্যাক স্টপার। লেগ ব্রেকে একেবারেই খেই পায় না। গ্যাদারিংও ক্লামজি।”
”আপনার সঙ্গে নিশ্চয় আলাপ আছে।” সুজাতা বলে।
”তা আছে। সরোজকে একবার তো দেখিয়েই দিয়েছিলাম পায়ে কীভাবে ভর রেখে বসলে লেগসাইড বল নিতে সুবিধে হয়।”
সরোজ তখন মেয়েদের উত্তেজিত মুখের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারে কেন তাকে আসতে বলা হয়েছে। এবার মিথ্যাবাদী জ্যোতিষকে ওরা উলঙ্গ করে দেবে। প্রত্যেকের মুখে চাপা উল্লাস নিষ্ঠুর আমোদের একটা যেন শিকার-খেলা চলছে। খেলিয়ে খেলিয়ে ওরা জালের দিকে নিয়ে যাচ্ছে জ্যোতিষকে। বেচারা জানে না কী ভয়ংকর একটা ব্যাপার তার জন্য অপেক্ষা করছে। সরোজ আর সহ্য করতে না পেরে প্রায় ছুটে রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে গেছল। মেয়েরা অবাক এবং হতাশ হয়েছিল। জ্যোতিষকে ওরা কয়েকদিন পর বলে দেয় কী ঘটতে যাচ্ছিল সেদিন।
”কেন তোমরা বলতে গেলে? বেচারা বরং নাই জানত। কী লজ্জায় পড়ল বলো তো?” সরোজ একবার বীণাকে অনুযোগ করে বলেছিল।
”ওদের কোনো লজ্জাটজ্জা থাকে না। খালি আমার পেছনে ছুঁক ছুঁক, সিনেমা চলো, কোথাও খেতে চলো। হাসাহাসি শুরু হয়ে গেছল ওকে আর সেই সঙ্গে আমাকে নিয়ে। সুজাতারই প্ল্যান ছিল ওকে এক্সপোজ করার।”
”সরোজদা কী ভাবছেন?”
”সরোজদা কিছু ভাবছেন যেন গভীরভাবে।” শঙ্কর পাশে বসে গ্লাসটা তার দিকে এগিয়ে ধরে।
”ভবানীর উপর একটা লিখতে হবে। বলেছিলে ওর সম্পর্কে সব খবর দেবে, মনে আছে?”
”নিশ্চয়, পাঁচ বছর ধরে ওকে চিনি, অনেক কিছু জানি।”
”তাহলে এখনই দাও, রাতে লিখে কালই পাঠিয়ে দেব।”
”এখানে বসে হবে না, পাশের ঘরে চলুন। কাগজ কলম লাগবে তো! আর অটোগ্রাফ বুকটা…”
সরোজ উঠে দাঁড়িয়েছে। শঙ্কর পর্দা সরিয়ে ঘরে ঢুকল। ভবানী চেঁচিয়ে বলল, ”শঙ্কু সব কথা সরোজদাকে বলিসনি যেন।”
সরোজ ঘরে ঢোকার সময় রোজাকে বলতে শুনল, ”কী বলবে না, গার্লফ্রেন্ডদের কথা?”
শঙ্কর পর্দা সরিয়ে বাঁধানো ছোট্ট বইটা রোজাকে ছুড়ে দেবার আগে বলল, ”ক্যাচ।” তার একটা চোখ টিপে, ”দুজনকেই।”
ঘরে দুটো খাট। দামি বেডকভার, এয়ার কুলার, পাকা ও হিটার, ওয়ার্ড-রোব, ড্রেসিং টেবল, বন্ধ জানলায় সাদা লেসের পর্দা, বাথরুমের দাজা, পুরু কার্পেট, দুই খাটের মাঝে টেবল ল্যাম্প, টেলিফোন, একধারে প্রশস্ত খালি জায়গায় দুটি গদির চেয়ার এবং নিচু ব্রেকফাস্ট টেবল। চোখ বোলানো শেষ করে সরোজ চেয়ারে বসল। শঙ্কর একটা সাদা কাগজ আর ডটপেন দিল।
মিনিট কুড়ি পর ঘর থেকে বেরোবার সময় সরোজ আবার একটা ঝাঁকুনি খেয়ে থমকে দাঁড়াল। রোজা জায়গা বদলে ভবানীর পাশে বসে। ভবানীর বাঁ হাত ওর ডান ঊরুর উপর আলতো রাখা। তিনভাগ খাওয়া একটা সিগারেট ভবানী এগিয়ে ধরে। রোজা সেটা তুলে নিয়ে পরপর দুটো টান দিয়ে ফিরিয়ে দিল। সরোজ যখন ওদের সামনে বসছে তখন রোজা নাক দিয়ে ধীরে ধীরে ধোঁয়া ছাড়ছে।
”আমাদের কলেজে একবার নোটিস দিয়েছিল ক্লাসে কী কী করা বারণ। তাতে একটা ছিল স্মোকিং স্ট্রিক্টলি প্রহিবিটেড।”
”সে কী, মেয়েরা ক্লাসেই গাঁজা টানে নাকি!” ভবানী অবাক হয়ে গেল।
রোজা মাথা কাত করল।
”তুমিও টেনেছ নাকি?” শঙ্কর অনিশ্চিতভাবে প্রশ্ন করল।
”একবারই, সামান্য একটু।”
রোজা আবার মাথা কাত করল মুখে হাসি টেনে। ভবানী ও শঙ্করের মধ্যে চোখাচোখি হল।
”তাহলে ভেজাল। আসল হলে আর ক্লাসে বসে খাওয়া যেত না। এমনকী কলেজেও নয়।” ভবানী বলল।
”না না, রিয়্যাল গ্রাস।”
একটু আগে শঙ্কর যে কথাটা বলেছে সরোজের মাথার মধ্যে সেটা দপ করে উঠল: ”ভুবু একবার বাজি ধরে পাইপে গাঁজা ভরে টেনেছিল, সামলাতে পারেনি, ডাক্তার ডাকতে হয়েছিল। দু’দিন ভালো করে হাঁটতে পারেনি।”
”শঙ্কু আমি এবার উঠব রে, দুটো লোকের আসার কথা আছে। রোজা আমাকে লিফট দেবে হোটেল পর্যন্ত, সরোজদা চলি।”
”আঙ্কল, মাকে কী বলব, কবে আসছেন আমাদের বাড়ি?”
”যাব’খন, ভবানী কবে যাচ্ছে?”
”এখানে অদ্ভুত কাণ্ড, চারদিন খেলার পর রেস্ট ডে। আমি ফোর্থ ডে খেলার পরই যাব। রোজা হোটেল থেকে তুলে নিয়ে যেয়ো।”
”অদ্ভুত কেন! দু’দিন খেলার পর, এমনকী একদিন খেলার পরও তো রেস্ট ডে দেওয়া হয়েছে। দু’পক্ষ রাজি হলেই হল। তাহলে আমিও ওইদিন যাব।”
ভবানী ও রোজা সিঁড়ির দিকে এগোল। সরোজ তাদের পিছনে।
”পুলোভারটা পরে নিয়ে আসছি। সিগারেট কিনতে হবে।” শঙ্কর ঘর থেকে চেঁচাল।
”সরি আঙ্কল, পৌঁছে দিতে পারলাম না।” রোজা স্টার্ট দিয়ে স্কুটারে উঠে আন্তরিক স্বরে বলল।
”তাতে কী, এইটুকু তো। হাঁটা তো প্রায় ভুলেই গেছি।”
রোজার পিছনে ভবানী। ওর বসাটা সরোজের অনুমোদন পেল না। বড্ড বেশি এগিয়ে, দুই ঊরুর মধ্যে রোজাকে প্রায় ভরে ফেলেছে।
”সাবধানে যেয়ো।”
রোজা ঘাড় কাত করে স্কুটার ছেড়ে দিল। ভবানী হাত তুলে বিদায় জানাল। স্কুটার মোড় ঘোরার সময় সরোজ দেখল ভবানী দু’হাতে রোজার কোমর জড়িয়ে ধরল।
বিশ্রী লাগছে সরোজের। এত তাড়াতাড়ি এভাবে যে ওরা ঘনিষ্ঠ হবে সেটা ধারণার বাইরে। তাকে অবাক করছে। শঙ্করের কাছে যা শুনল তাতে অবশ্য অশিক্ষিত ভবানীর পক্ষে মেয়েদের সঙ্গে এ হেন আচরণ স্বাভাবিকই। কিন্তু রোজার মতো মেয়ে কেন ওকে এত এগোতে দেবে! গদগদ হয়ে যাবার মতো কাজ কি ভবানী করেছে! ওর ব্যাটিংয়ে যেমন নার্ভ নেই, সবসময় কেতাব মতো খেলে না, মেয়েদের ক্ষেত্রেও তাই। শোভনতা, সাবলীলতার পরোয়া নেই আর তাতেই বোধহয় ও সফল হয়। ওর অমার্জিত, বন্য, অবাস্তব কাজগুলো মেয়েদের বিশেষ করে গুণমুগ্ধা, বীরপূজারিণীদের অবরুদ্ধ ইচ্ছাগুলোকে উত্তেজিত করে দেয়। মনেরও অগোচরে সরোজ ঈর্ষান্বিত হল।
”চলুন, অনেকক্ষণ দাঁড় করিয়ে রাখলাম।”
”চলো। যতটা পড়বে ভেবেছিলাম ততটা ঠান্ডা পড়েনি।”
”নাহ।” কয়েক মিটার চলার পর শঙ্কর বলল, ”দরজা খুলেই আমি ভেবেছিলাম আপনার মেয়ে বোধহয়। মুখের মধ্যে এত মিল!”
”আমিও প্রথম রোজাকে দেখে একটু অবাক হয়েছিলাম।”
”খুব স্মার্ট। ওকে ভুবুর খুব ভালো লেগেছে।”
”তোমাকে বলল?”
”বলবে কী, দেখেই বুঝতে পেরেছি। আপনারা আসার আগে ও জিজ্ঞাসা করেছিল, সরোজদার কেউ হয়টয় না তো?”
”হলে কী হত?” সরোজ কৌতূহল চাপতে পারল না।
জবাব না দিয়ে শঙ্কর হাসিটা টিপে রাখল। সিগারেটের দোকান দেখে এগিয়ে গেল।
”কোথাও খেতে যাবে?”
”না সরোজদা না, বেলা করে খেয়েছি, রাতে খিছু খাব না।”
কনট প্লেসে এক নিরামিষ খাবারের জায়গায় সরোজ ত্রিশ টাকার থালি নিয়ে আহার সেরে, সংসদ মার্গ ধরে হেঁটে ফেরার সময় ভবানীর ‘কেউ হয়টয় না তো’ কথাটাকে মাথায় নাড়াচাড়া করল। যদি তার মেয়ে হত, ভবানী তাহলে অন্যরকম ব্যবহার করত। কিন্তু যে শিক্ষা, রুচি, বা যে কালচারের মধ্যে রোজা বেড়ে উঠেছে তাতে এইসব গায়ে হাত দেওয়া, সিগারেট টানার মতো ব্যাপারগুলো মেনে নেয় কী করে? বাহাদুরি দেখানো! কিংবা হয়তো ওরা এমনভাবেই অভ্যস্ত হয়ে বেড়েছে যেটা তার অভিজ্ঞতার বাইরে। সরোজ রেগে উঠে হাত ঝাঁকাল, আমার মেয়ে হলে এরকম অন্তত হত না। বীণা এভাবে কেন মানুষ করেছে? ও তো সাধারণই ছিল।
বীণাকে বহুক্ষণ পরে তার মনে পড়ল এবং সঙ্গে সঙ্গে মনে হল, সে-ও যেন অনেকটা মেয়ের মতো এইরকমই ছিল আর সে নিজে ভবানীর মতো না হলেও তফাতটা শুধু একজন কয়েক মিনিটে যতটা এগিয়েছে, অন্যজনের সেজন্য কয়েক সপ্তাহ সময় লেগেছিল। সরোজ হেসে ফেলল। তারা দুজন কি একই জাতের!
নিজের ঘরে ফিরেই সে সরোজার চিরকুট থেকে নম্বরটা অপারেটরকে শুনিয়ে রিসিভার রেখে দিল। কীভাবে কথা বলা যায়? গম্ভীর, আটপৌরে, সামাজিক, নাকি তরল, ফাজিল, পূর্ব সম্পর্কের সুতো ধরে টানাটানি?
ফোন বেজে উঠতেই রিসিভার কানে দিয়ে শুনল ওদিকে রিং হচ্ছে। সরোজ অপেক্ষায় রইল।
”মিসেস রাও?”
”স্পিকিং?”
”সরোজ।”
চার সেকেন্ড লাগল তার নামটি বীণার মগজে ঢুকতে।
”আহহ, রোজা কালই তোমার ওখান থেকে ঘুরে এসেছে। খালি বলছে আঙ্কল কবে আসবে কবে আসবে। ভি এস ঘোষালকে আনতে পারবে তো…, ছেলেটি তো আরও নাম করল কানপুরেও সেঞ্চুরি করে। রোজার বন্ধুরাও ওর সঙ্গে মিট করার জন্য ফোন করছে। তা আনতে পারবে তো? কী গো, রোজা রিডিকিউলড হবে না তো? বড়ো মুখ করে ও আঙ্কলের কথা সবাইকে বলেছে।”
বীণার স্বরে ব্যাকুলতার মধ্যে মাখানো রয়েছে আবেদন, যেটা প্রায় ভিক্ষা চাওয়ার পর্যায়ে চলে গেছে।
”রোজা কোথায়?”
”এখনও ফেরেনি।”
”এত রাত পর্যন্ত বাইরে? দিল্লির মতো জায়গা!”
”ওর বাবার আদর আর আশকারায় যা হয়েছে না, আমার কোনো কথাই শোনে না। বন্ধুর বাড়ি যাবে বলে স্কুটার নিয়ে তো বেরিয়েছে।”
নাটকীয় ভঙ্গি আনার জন্য সরোজ কয়েক সেকেন্ড নীরব থেকে বলল, ”সেই বন্ধুটি হচ্ছে ঘোষাল! আজই আলাপ করিয়ে দিয়েছি আর দুজনের বন্ধুত্বও হয়ে গেছে।”
”যাঃ, সত্যি!”
”ও ফিরলেই জিজ্ঞাসা কোরো।…আমাকে তো বিশ্বাস করো না।” স্বরটা ভারী করে হৃদয়ের গভীর থেকে উঠে এল এমন একটা ভাব শেষ বাক্যটিতে সে ঢেলে দিল।
”তুমি আমার এখানে কবে আসছ?” বীণার স্বর মৃদু হয়ে এসেছে।
”খেলার ফোর্থ ডে-র রাতে, স্টোরি পাঠিয়ে দিয়ে যাব। সেদিন শঙ্কর আর ভবানীও যাবে।”
”তার আগেই এসো, কাল?”
”বলতে পারছি না, তবে সময় যদি পাই যাব। বাড়ি তো চিনি না, রোজাকেই এসে নিয়ে যেতে হবে। ভালো কথা, তোমার শালটা খুব কাজে দিয়েছে। ভাবছি ওটা নিয়েই নেব আর ফেরত দেব না।”
”কেন?”
সরোজ জবাব দেওয়ার আগেই বীণা ব্যস্ত হয়ে বলে উঠল, ”ওই এসে গেছে রোজা। পরে তোমার সঙ্গে কথা বলব, কেমন?”
ফোন রাখার শব্দে অপ্রতিভ হয়ে সরোজ রিসিভারটা কিছুক্ষণ হাতেই রেখে অবশেষে বিরক্তিভরে ক্র্যাডলে শুইয়ে রাখল।
পরের দিন সরোজ দুপুরে এই উদ্দেশ্যে কোটলায় গেল যে, প্র্যাকটিস দেখার আর যদি খবর কিছু থাকে বিশেষ করে কাঞ্জিলাল কিছু যদি দিতে পারে!
ফিরোজ শাহ কোটলা ছোটো মাঠ। পাঁচিলে ঘেরার বাইরে সংলগ্ন খোলা জায়গায় নেট প্র্যাকটিস চলছে ভারতীয়দের। মাঠের মধ্যে ক্যাচ ধরার মহড়ায় ব্যস্ত নিউজিল্যান্ডাররা। উইলিংডন প্যাভিলিয়নের দিকের স্ক্রিনের পাশে প্রেস এলাকা। হুবহু কানপুরেরই মতো ব্যাপার। সেই জমি থেকে কয়েকটা ধাপ, তাতে একটি করে ছোটো ফোল্ডিং টেবল ও চেয়ার, উভয়ই নড়বড়ে। জমিতেও কিছু টেবল-চেয়ার। মাথার উপর আচ্ছাদন নেই। পাশে এবং পিছনে ভি আই পি এবং অতিথিদের জন্য ভাড়া করা চেয়ার যাতে ধুলো, কাদা এবং শুকনো পক্ষী পুরীষ লেগে রয়েছে।
সরোজ মাঠের কিনারে দাঁড়িয়েছিল। মাঠ ভিজে, প্লেয়ারদের দৌড়ের সঙ্গে মাটি উঠছে। পিচ ঢাকা দেওয়া পলিথিন চাদরে। যেহেতু আকাশ মেঘলা যে-কোনো সময় বৃষ্টি হতে পারে। অপর প্রান্তে স্ক্রিনের পিছনে আম্বেদকর স্টেডিয়ামে সুব্রত কাপ ফুটবলের খেলা চলছে। মাঝে মাঝে হইহই রব ভেসে আসছে। কিছু লোক কোটলা মাঠের স্ট্যান্ড থেকে ফুটবল মাঠের দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে। শ’খানেক ছেলে ছড়িয়ে রয়েছে প্যাভিলিয়নের কাছাকাছি।
বগলে প্যাড এবং হাতে ব্যাট নিয়ে ভবানী নেটে যাবার জন্য ড্রেসিংরুম থেকে বেরিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসছে। কিছু ছেলে তার দিকে এগিয়ে গেল, অনেকের হাতে অটোগ্রাফ বই। সরোজ অবাক হল রোজাকে দেখে। ভবানীর আশে পাশে হাঁটছে। সেই বিবর্ণ জিনস, হলুদ হাফ শার্ট, নীল কেডস। চুল পিঠে ছড়ানো। এতক্ষণ কোথায় ছিল রোজা? প্যাভিলিয়নে!
কাঁধে ব্যাগ, হাতে ক্যামেরা, রামকুমার আসছিল নেটের দিক থেকে। হাত নেড়ে সরোজ তাকে ডাকল।
”কোথায় উঠেছ?”
”চিত্তরঞ্জন পার্কে মাসিমার বাড়িতে।”
”একটা ছবি দরকার, এই যে মেয়েটা যাচ্ছে ওকে আর ভবানীকে একসঙ্গে।”
”দাঁড় করিয়ে পাশাপাশি নেব?”
”না না, একদম ওদের জানতে দেবে না।”
রামকুমার দ্রুত দুজনের পিছু নিল। রোজাকে এই সময় এখানে যে দেখতে পাবে, সরোজের তা চিন্তার বাইরে। হঠাৎ একটা বিমর্ষতা সরোজকে আচ্ছন্ন করল। রোজার তাকে আর দরকার নেই।
”হ্যালো দাদা, একা চুপচাপ যে, কবে এলেন?”
এখানকার হিন্দি কাগজের রিপোর্টার। সরোজ যথাযোগ্য জবাব দিল। দু-চার কথার পর লোকটি চলে গেল। আর তার ভালো লাগছে না। বেরোবার জন্য গ্যালারির কয়েকটা ধাপ উঠতেই দেখল তরুণ নেমে আসছে।
”টিকিট একদমই বিক্রি হচ্ছিল না। যেই কানপুরে ইন্ডিয়া হারল অমনি হুড়হুড় করে সব শেষ। এখন টিকিট টিকিট হাহাকার। …নেট দেখে এলেন নাকি? …রামিন্দারকে বোধহয় থ্রি ডাউন নামাবে, শান্তনমকে নতুন বলে প্র্যাকটিস করিয়েছে।”
তরুণ উত্তরের জন্য অপেক্ষা না করে পা বাড়াল। সরোজও উত্তর দেবার চেষ্টা করল না। অফিসে গিয়ে একটা কিছু লিখে ফেলতে হবে। শান্তনম রঞ্জিতে কর্ণাটকের হয়ে কয়েকটা ম্যাচ ওপেন করেছে কিন্তু কাদের বলে? টেস্ট খেলার টেনশন আর কেরল বা অন্ধ্রের সঙ্গে খেলার প্রেশার কি এক? সদ্য টেস্ট হেরে সারা টিমটাই এখন টেনশনে রয়েছে। সাউন্ড স্টার্ট দরকার, শান্তনমকে দিয়ে তা সম্ভব নয়, হয়তো ভবানী পারে।
ভবানীর উপর লেখাটা বেয়ারার কাছে রেখে এসেছে, টেলেক্স অপারেটর দুপুরে এলেই যেন হাতে দেয়। রমেন গুহঠাকুরতা যা যা চেয়েছিল তাই সে লিখেছে। ভবানীর সঙ্গে রোজার ছবি যদি লেখাটার সঙ্গে দেওয়া যায় তাহলে খোলতাই হবে। কিন্তু রামকুমারের ফিল্মরোল আজই কলকাতায় পাঠাবার উপায় নেই। এয়ার প্যাকেট ইতিমধ্যেই চলে গেছে। তাহলে লেখাটা ধরে রাখার জন্য গুহঠাকুরতাকে বলতে হয়। ভবানী বড়ো রান করলে এবং মনে হয় করবে কেননা ওর ব্যাটিংয়ের যা ধরন তাতে কোটলা পিচ সহায়কই হবে, তখন লেখা আর ছবি একসঙ্গে বার করলে লেখাটা খুলবে।
সরোজ অফিসে এসেই কলকাতায় গুহঠাকুরতাকে টেলেক্সে তার কথাগুলো জানিয়ে, লিখতে বসল।
”দাদা এই টেস্টে কী হবে মনে হয়, ইন্ডিয়া জিততে পারবে তো?”
দাশরথি নিজের টেবল থেকে উঠে এসে সরোজের সিগারেট প্যাকেট তুলে নিল।
”ব্যাটিং যদি ফেল না করে তাহলে হারব না। জেতার কথা বলতে পারছি না।”
”আমাদের ছেলেটাকে কেমন দেখলেন, ভবানী?”
”ভালোই।”
”রামিন্দার সিংকে রাখাটা উচিত হয়নি, এতবার যে ফেল করেছে! নতুন নতুন ছেলেদের চান্স তো এখনই দেওয়া উচিত!” দাশরথি প্রথম ধোঁয়া ছাড়ল।
”হোম গ্রাউন্ড তাই একটা সুযোগ দিল।”
সরোজ বিরক্ত বোধ করছে। দাশরথি বোধহয় বুঝতে পেরে নিজের টেবলে ফিরে গেল আর কথা না বাড়িয়ে।
লেখার মধ্যেই গুহঠাকুরতার বার্তা এল : ছবির জন্য সে লেখাটা ধরে রাখছে। লেখাটা ভালো হয়েছে, এইরকমই চাই।
নিজের ঘরে এসে সরোজ চা-টোস্ট খেয়ে খবরের কাগজ নিয়ে বিছানায় টান টান হল। পড়ার মধ্যেই বারবার তার মনে উঁকি দিল একটা আশা, বীণা ফোন করবে কিংবা সোজা এসে তাকে নিয়ে যাবে তাদের বাড়িতে। কেন যে মনে হল বুঝতে পারল না।
ঘণ্টাখানেক পর তার ইচ্ছা করল বীণাকে ফোন করতে। রোজা যে আসবে না, এটা সে এখন ধরেই নিয়েছে। ভবানীর সঙ্গে হয়তো এখন হোটেল লবিতে বা অন্য কোথাও সে বসেছে কিংবা কোনো বন্ধুর বাড়িতে ওকে নিয়ে গিয়ে দেখাচ্ছে তার ট্রফিটিকে। নিশ্চয় তাকে আর কোনো দরকার নেই! আর হয়তো দরকার হবে না। যা পাবার তা তো পাওয়া হয়েই গেছে।
কিন্তু বীণার? কাল ওর স্বরে কেমন যেন পুরনো দিনের রেশ ফুটে উঠেছিল। নাকি শুনতে তার ভুল হয়েছে? এত বছর পর একদমই ভুলে যাওয়া সম্পর্কটা ফিরে পাওয়া কি সম্ভব! বীণা খেপে গিয়ে তাকে অভিশাপ দিয়ে সেই যে চলে গেছল তারপর ওকে প্রথম দেখল রাজধানী এক্সপ্রেসে।
অদ্ভুতভাবে প্রায় ভোজবাজির মতোই বীণা কলকাতা থেকে উবে গেছল। প্রথমেই তার মনে হয়েছিল বোধহয় আত্মহত্যা করেছে। বীণা তখন চাকরি করছে, থাকত বহু দূর সম্পর্কের এক আত্মীয়ের বাড়িতে পেয়িং গেস্ট হয়ে। সেখানে খোঁজ নিতে সাহস পায়নি সরোজ। যদি মর্মান্তিক কিছু শুনতে হয়? বীণার বাবা-মা, বোনেরা থাকত জামশেদপুরে। বাবা সেখানেই চাকরি করতেন, অবসর নেবার পর ওখানেই বাড়ি করেন। সরোজের সঙ্গে তাদের একবারই পরিচয় হয়েছিল, যখন জামশেদপুরে খেলতে গেছল। সেখানে খোঁজ নেবার চেষ্টা সে করেনি।
বাকি ছিল অফিস। ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজারের নিজস্ব দপ্তরে বীণা বসত, ফোন করেছিল কথা বলতে চেয়ে। সে শুনতে পাচ্ছিল অপারেটার মেয়েটি প্রশ্ন করছে, অ্যাঁ, বীণা সেনগুপ্তর কল রয়েছে… চাকরি ছেড়ে দিয়েছে, কবে? …ও আচ্ছা। হ্যালো, উনি তো চাকরি চেড়ে চলে গেছেন, তিন সপ্তাহ হল। সে জিজ্ঞাসা করেছিল, কোথায় গেছে? আমরা জানি না।
সরোজ আর কোথাও খোঁজ নেয়নি। সুজাতার বিয়ে হয়ে গেছল, স্বামীর সঙ্গে জার্মানি চলে যায়। সুবীর চাকরি নিয়ে নাগপুরে। বীণা প্রসঙ্গ তোলার মতো শুধু এরাই ছিল। এরপর মাস, বছর গড়িয়ে গেছে। ‘আমি প্রেগনান্ট’ বলে বীণা সেই যে উধাও হল আর কোনো খবর সে পায়নি। যে ভয়টা তার হৃৎপিণ্ডকে মুঠোয় নিয়ে কচলাচ্ছিল যতই সময় পেরিয়েছে সেই মুঠো ক্রমশ শিথিল হতে হতে এক সময় খুলে যায়। সরোজ ভুলে গেছল বীণার অস্তিত্বকেই। পরে তার মনে হত, বীণা মিথ্যা কথা বলে, চাপ তৈরি করে তাকে বিয়েতে বাধ্য করার জন্য প্রেগনান্ট হওয়াটা বানিয়েছিল। না হলে জীবনের এতবড়ো ব্যাপারটায় কোনো মেয়ে দু-চারটে কড়া কথা বলে আর অভিশাপ দিয়েই এমন সহজে পুরুষটিকে ছেড়ে দিতে পারে না।
তার এই মনে হওয়াটাকেই সে এক সময় দৃঢ় বিশ্বাসে নিয়ে যায়। রাজধানী এক্সপ্রেসে বীণাকে দেখেই সে আঁতকে উঠেছিল যেমন, তেমনি একটা ঝড় তার মধ্যে বয়ে গিয়ে বুঝিয়ে দেয় এতকাল সে শেকল আঁটা ছিল এখন মুক্ত। বীণা বিয়ে করেছে, একটি মেয়ে রয়েছে-কৌতূহল তৈরি করবেই। কবে, কীভাবে, কার সঙ্গে বিয়ে, বীণার অতীত ওর স্বামী কতটা জানে-এমন সব প্রশ্ন গত কয়েকদিন মাঝে মাঝেই তার মনে উঁকি দিয়েছে।
উত্তর পেতে বীণাকেই জিজ্ঞাসা করতে হবে। ভেবে রেখেছে, ওর সঙ্গে কথা বলতে বলতে তেমন অবস্থা তৈরি হলেই জিজ্ঞাসা করবে।
সরোজ অপেক্ষাই করে গেল, ফোন বাজল না। একসময় তার মনে হল, বীণারও আর তাকে দরকার নেই।
আট
টস করে আনন্দ আর মার্কস মাঠ থেকে যখন ফিরে আসছে তখন সরোজ প্রেসবক্সে পৌঁছল। আইইএনএস থেকে বেরিয়ে ফুটপাথে দাঁড়িয়ে যখন ট্যাক্সি বা অটো রিকশা, যা পাওয়া যায়, খুঁজছিল তখন ওপারে একটা অটো থেকে হাত বাড়িয়ে ‘দাদা আইয়ে’ বলে ডেকে নিয়েছিল এলাহাবাদের হিন্দি কাগজের এক রিপোর্টার। নয়তো পৌঁছতে আরও দেরি হত। টেবলগুলোয় ছোটো ছোটো কাগজ পিন দিয়ে আঁটা, তাতে খবরের কাগজের নাম লেখা। সরোজের টেবল পড়েছে জমি থেকে তিন ধাপ উপরে এবং কিনারে। তার পাশেই লোহার জালের বেড়া। ওপাশে ভি আই পি আর অতিথিরা।’
মার্কস টস জিতেছে। আম্পায়ার বিহারের মোহন ঘোষ আর তামিলনাড়ুর ইব্রাহিম সৈত ক্রিজে পৌঁছবার আগেই আনন্দ তার লোকেদের নিয়ে মাঠে নামল। হালকা রোদ এবং হালকা মেঘ, বাতাস মৃদু। বল শুরু করল আনন্দ এবং প্রথম ওভার খেলল ম্যাকগ্রেগর। মেডেন ওভার। বল যতটা নিচু হওয়ার কথা তার থেকেও নিচু হয়ে এল। মাত্র একটি বল স্টাম্পে ছিল, বাকিগুলি এল রেগের গ্লাভসে। সরোজের মনে হল আনন্দ আক্রমণাত্মক হতে চায় না। কানপুরে হারের ধাক্কায় যেন খোলসে ঢুকে গেছে।
তবে মাত্র ছটি বল থেকে এত শীঘ্র ধারণায় না আসাই উচিত। অন্তত পাঁচটি ওভার যাক, পেসারের সব ক’টি সিলিন্ডার ততক্ষণে চালু হয়ে যাবে। শর্মার প্রথম ওভারে তিনটি আলগা বল পড়ল তার একটিকে স্কোয়্যার কাট করে বেকার তিন রান পেল।
আনন্দের তৃতীয় ওভার শেষে স্কোরবোর্ডে ১১ রান। ম্যাকগ্রেগর গুড লেংথের কাছে গিয়ে ঝুঁকে পিচ দেখতে লাগল। বেকারও এগিয়ে এসেছে। দুজনের মধ্যে কয়েকটা কথা হল। শর্মা তার ইনসুইং বাগে আনতে পারছে না। রেগে দ্বিতীয় স্লিপের সামনে ঝাঁপিয়ে ল্যাটাবেকারের মিডল স্টাম্প থেকে সরে-আসা বলগুলো ধরল। ওভারের শেষ বল স্ল্যাশ করে সে চার রান পেল থার্ডম্যান বাউন্ডারিতে।
ছয় ওভার, আধ ঘণ্টা এবং ১৫ রান। সচরাচর পাঁচ দিনের ম্যাচের প্রথমদিনের মতোই খেলা প্রায় রুটিন ধরেই। আনন্দ প্রান্ত বদল করে নিজেকে প্যাভিলিয়নের দিকে আনতে চেয়ে ভাণ্ডারকরকে সপ্তম ওভারটা দিল। তার তৃতীয় বলে ম্যাকগ্রেগর ফরোয়ার্ড ডিফেন্সিভ খেলতেই ব্যাকোয়ার্ড শর্ট লেগ ঠুকরাল ঝাঁপিয়ে পড়ল। হাতের বলটা তুলে সে এবং আরও ছয়জন একসঙ্গে চেঁচিয়ে উঠতেই সৈত ডান হাত তুলল।
ম্যাচের সপ্তম ওভারে স্পিনার উইকেট পেল। সরোজ বুঝতেই পারেনি বলটা আদৌ ঘুরেছিল কি না। পড়ে পাওয়া চোদ্দো আনার মতোই যেন উইকেটটা পেয়ে গেল ভাণ্ডারকর, এখন তো ওকে কয়েক ওভার রাখতেই হয়। শর্মাকে সরিয়ে আনন্দ বল নিল। বেকার ও নবাগত ওকোনর চারটি সিঙ্গল নিল স্বচ্ছন্দে।
ভাণ্ডারকরের দ্বিতীয় ওভারে প্রথম বলটিই ওকোনরের কপাল ছুঁয়ে শর্ট স্কোয়ার লেগের হাতে গেল। এভাবে গুড লেংথ থেকে লাফিয়ে ওঠায় প্রথমদিনে লাঞ্চের আগেই, ভারতীয়রাও অবাক হয়েছে মনে হল। রেগে কথা বলল, প্রথম স্লিপে রামিন্দারের সঙ্গে। ভাণ্ডারকর লোক চেয়েছে সিলি মিড-অনে। আনন্দ নিজে সেখানে দাঁড়াল। ওকোনর শান্ত চোখে ফিল্ড দেখে নিয়ে আক্রমণে নামল। তিনটি বাউন্ডারি নিল বাকি পাঁচ বল থেকে। ওর উদ্দেশ্য পরিষ্কার-ভাণ্ডারকর হঠাও। খেলা এতক্ষণে ঝাঁকুনি দিয়ে একটা গতি পেল।
হঠাৎ সরোজের দৃষ্টি ডানদিকে পড়ল। রোজা এবং বীণা চেয়ারের সারির মধ্যে ঢুকে এগোচ্ছে। রোজার হাতে কার্ড, নম্বর মিলিয়ে দেখে নিয়ে দুজনে বসল।
নিশ্চয় কার্ড দুটো ভবানীরই দেওয়া। কয়েকদিন আগে যার শুধু একটা সই পাবার জন্য তাকে ধরাধরি করছিল এখন তারই অতিথি হয়ে টেস্টম্যাচ দেখছে। সরোজ ভাগ্য সম্পর্কে উদাস কোনো সিদ্ধান্তে অবশ্য পৌঁছল না। শুধু স্থির করল, ওদের থেকে দূরে থাকবে। কেন যে স্থির করল নিজেও তা জানে না!
ভাণ্ডারকর বদল হয়ে আবার শর্মা এসেছে। এবার বলের উপর সে অনেকটা নিয়ন্ত্রণ রাখছে। ভাণ্ডারকরকে সরিয়ে নেওয়াটা সরোজের মনঃপূত হল না। আনন্দ যে উইকেট পাওয়ার চেষ্টায় সাহসী হবে না এবার সেটা তার কাছে পরিষ্কার হয়ে উঠল। নিশ্চয় ওর লক্ষ্য প্রথমদিনে আড়াইশো রানের মধ্যে নিউজিল্যান্ডকে বেঁধে রাখা।
বস্তুত ২৪৭ রান উঠল এবং দুই উইকেটে। বেকার উইকেটকিপারকে ক্যাচ দেয় লাঞ্চের পরই আনন্দের বলে। বলটা লাফিয়ে উঠে বেকারকে চমকে দিয়েছিল। ব্যাটের হাতল থেকে বলটা রেগের কাছে যায়। দুটো তারকা চিহ্ন দিয়ে সরোজ খাতায় লিখল: কিছু গোলমাল আছে পিচে। বৃষ্টির জল কি একদিকের গুড লেংথ স্পটে বসেছে? আন্ডার প্রিপেয়ার্ড?
ওকোনর ১০৯ আর মার্কস ৮০ রান নিয়ে প্যাভিলিয়নে ফিরে এল পরদিন আবার নামার জন্য। খেলা ভাঙার সঙ্গে সঙ্গে সরোজ ডানদিকে তাকিয়েছিল। রোজার পরনে হালকা নীল শালোয়ার-কামিজ আর গাঢ় নীল ওড়না। চোখে পড়ার জন্য তাকে বেশিক্ষণ খুঁজতে হয় না। ট্রেনে যে সাজে দেখেছিল, বীণা সেই সাদা কার্ডিগান আর মেরুন সিল্কটাই পরেছে। বয়স অনেক কম দেখাচ্ছে, রোজার দিদি বলে চালিয়ে দেওয়া যায়। রোজা হাত তুলে নাড়তেই সরোজের সামনের দিকে চেয়ারে বসা শঙ্করও হাত নাড়ল। রোজা ইশারায় জানাল বাইরে অপেক্ষা করবে। শঙ্কর মাথা হেলিয়ে দিল। ঠিক এইভাবে লাঞ্চের সময়ও বাইরে যাবার আগে ওরা হাত নেড়েছিল।
ভিড়ের সঙ্গে চলতে চলতে বীণা কৌতূহল ভরে এদিকেই তাকাচ্ছে। হয়তো তাকেই খুঁজছে ভেবে সরোজ মাথাটা নামিয়ে নাকটা প্রায় টেবলে ঠেকিয়ে দিল, ওরা যেন না তাকে দেখতে পায়। সে আর ওদের মুখোমুখি হতে চায় না। তাকে যেমন ওরা ভুলে গেল, সে-ও তেমনি ওদের অগ্রাহ্য করবে।
তবে ফোর্থ ডে রাতে ওদের বাড়িতে নিশ্চয়ই যাবে। তাকে নিয়ে যাবার জন্য রোজা যদি স্কুটারে না আসে তাহলেই ভালো। পিছনে বসার কথা ভাবলেই ওর কোমর জড়িয়ে ধরা ভবানী চোখে ভেসে ওঠে।
ভিড় পাতলা হবার জন্য অপেক্ষা করে সরোজ মাঠ থেকে বেরোল। বাহাদুর শাহ জাফর মার্গের দিকে যাবার জন্য বাঁদিকের রাস্তা ধরে যেতে যেতে বড় মাঠটায় রাখা শ’খানেক মোটরের মধ্যে সরোজ নীল কামিজ আর মেরুন শাড়ি দূর থেকে চিনতে পারল। একটা কালো অ্যাম্বাসাডরে শঙ্কর, রোজা আর বীণা উঠছে। আজ দু’বার শঙ্করের সঙ্গে মুখোমুখি হয়েছে, হেসেছে দুজনে কিন্তু শঙ্কর আগের মতো দাঁড়িয়ে গিয়ে কথা বলেনি।
সরোজ তার রিপোর্টে গুরুত্ব দিল পিচের কয়েকবার অস্বাভাবিক আচরণকে। লেখাটা টেলেক্স অপারেটরের হাতে দিয়ে সে নিজের ঘরে এল। গতকালের মতো আজও সে অপেক্ষা করল ফোন বেজে ওঠার। গতকালের মতোই ক্যান্টিন থেকে আনিয়ে রাখা খাবার খেয়ে সে শুয়ে পড়ল।
দ্বিতীয় দিন লাঞ্চের আগের ওভারে আউট হল ওকোনর। আজ সে পঞ্চাশ রান যোগ করেছে। মার্কস আজও নট আউট থাকল ২০২ রানে। দিনশেষে নিউজল্যান্ড পাঁচ উইকেটে ৫১১। দু’দিনে ছ’শোর কাছে পৌঁছনোর মতো অবস্থা ছিল। ঝুঁকি নিতে চায়নি। কাল সকাল থেকে অবশ্যই পিটিয়ে যাবে। বোলারদের কারুর যে ভেদক্ষমতা নেই সেটাই এবং তার সঙ্গে আনন্দের কল্পনারহিত অধিনায়কত্ব, দুটোই আবার ঘোষিত হল। ম্যাচটা যে ভারতের হাতে আর নেই, চায়ের পর থেকেই তা স্পষ্ট হতে শুরু করে। ভি আই পি বা অতিথিদের অনেকেই চা খেয়ে আর ফিরে আসেনি, অবশ্য বীণা ও রোজা ফিরে এসেছে।
গতদিনেরই পুনরাবৃত্তি। রোজা হাত নেড়েছে, মেরুনের বদলে বীণার সবুজ সিল্ক, চুল ফোলানো, সাদা কার্ডিগানটাই রয়েছে। ওরা বেরিয়ে যাবার মিনিট পাঁচেক পর সরোজ বেরিয়ে আর ওদের দেখতে পায়নি। রাতে সে অপেক্ষা করল ফোনের জন্য। একসময় রিসেপশনে ফোন করে জিজ্ঞাসাও করল বাইরে থেকে তার জন্য কোনো কল এসেছে কি না। একটা ফোন করতে কতটা পরিশ্রম হয়? সেটুকুও বীণা করতে চায় না। সরোজ অনেক রকম যুক্তি নিজেকে সান্ত্বনা দেবার জন্য তৈরি করল। তার মধ্যে-বীণার তো উচিতই নয় তার মুখদর্শনের! এবং তারই বা এত কাঙালেপনা কেন বীণার সান্নিধ্যের জন্য? এই দুটির সদুত্তর সে খুঁজে পায়নি।
তৃতীয় দিনে প্রত্যাশামতোই নিউজিল্যান্ড দ্রুত রান তোলায় মন দিল। মার্কস একঘণ্টায় ৪৫ জুড়ল, বয়েড নিল ৩০। ভাণ্ডারকর খোঁড়াতে খোঁড়াতে মাঠের বাইরে যেতেই প্রেসবক্সে হাসিঠাট্টার দমকা লাগল। মার্কস ২৫১ এবং বয়েড ৪১ করে যথাক্রমে লং অন ও স্লিপে ক্যাচ দিয়ে ফিরে আসার পর সাত উইকেটে ঠিক ৬০০ রানে মার্কস ইনিংস ছেড়ে দিল। নট আউট রইল গ্রে পাঁচ রানে। আনন্দ পেয়েছে চার উইকেট ১৩২ রান দিয়ে।
আলভার সঙ্গে কে নামবে? উন্নির সাহায্যকারী ছেলেটি খবর আনল আর এক ওপেনার শর্মা। সরোজ আজ বীণাকে দেখতে পেল না। তার বদলে রোজারই বয়সি একই রকমের পোশাক, জিনস আর টি শার্টের উপর জিপ খোলা জ্যাকেট পরা একটি মেয়েকে বীণার চেয়ারে বসা দেখল। ইনিংস শুরুর আগে শঙ্কর আর রোজা ফেন্সিংয়ের কাছে এসে কথা বলল। রোজা তাকে চকোলেট দিল। কথা বলতে বলতে রোজা উপরের দিকে তাকিয়ে সরোজকে দেখতে পেয়ে ডান হাত তুলে নাড়ল। হেসে মাথাটা কাত করল সরোজ। রোজা তখন কী যেন বলল শঙ্করকে।
মন্থর কিন্তু নিশ্চিতভাবে আলভা ও শর্মা চা পর্যন্ত একসঙ্গে রইল, ভারতের রান ৯৮। দিনের শেষ ওভারে ওয়ালেসের বলে আলভাকে সিলি পয়েন্টে ধরে নিল মার্কস। প্রায় আড়াইশো মিনিটে এই প্রথম আলভার মনে অন্য কোনো ভাবনা মাথা গলিয়ে তাকে অন্যমনস্ক করে দিয়েছিল। নাইট ওয়াচম্যান নামল পারিখ এবং বাকি বলগুলো আটকাল। শর্মার ৭০ রান, আলভাও আউট হয়েছে ওই রানেই। প্রথম ইনিংসে ভারত ১৪৪ এক উইকেটে। বাকি রইল দুটো দিন। আরও আড়াইশো রান দরকার ফলো-অন বাঁচাতে।
অভয়ঙ্কর তর্কের সুরে কৃষ্ণমূর্তিকে বোঝাচ্ছে, মার্কস দ্বিতীয় দিনের রান তোলার গতি বাড়িয়ে যদি ইনিংসটা সাড়ে পাঁচশো রানে ছেড়ে দিত। তৃতীয় দিনে ব্যাট করে সময় যদি নষ্ট না করত তাহলে ম্যাচটা ড্র হত না।
”ড্র হয়ে গেছে! এখনও তো দু’দিন খেলা রয়েছে!”
”তুমি কি ভেবেছ নিউজিল্যান্ড এই অ্যাটাক নিয়ে ইন্ডিয়ার উনিশটা উইকেট দু’দিনে ফেলে দেবে? মাথা খারাপ!”
সরোজ দেখল রোজা ও তার বান্ধবীকে বেরিয়ে যেতে। সে ভিড়ের মধ্য দিয়ে খুঁটির বেড়া দেওয়া সরু পথ ধরে গেটের বাইরে আসতেই কোটটা হাতে ঝোলানো, টাই-পরা এক সুদর্শন পুরুষ হেসে তার দিকে হাত বাড়িয়ে দিল।
”বীণার কাছে আমার নাম শুনে থাকবেন, জ্যোতিষ।”
সরোজ স্বভাবতই বিস্মিত হল। বয়েস চল্লিশ সদ্য ছাড়ানো, গৌরবর্ণ, গালে গলায় এবং কোমরে চর্বি জমতে শুরু করেছে। সাবধান না হলে ভুঁড়ি হবে। কোঁকড়া এলোমেলো চুল। খুব কাজ আর ব্যস্ততার মধ্যে আছে এমন একটা ভাব অবয়বে।
”হ্যাঁ শুনেছি। এই সেদিন ট্রেনে অদ্ভুতভাবে ওর সঙ্গে দেখা হল অনেক বছর পর।”
”অফিস যাবেন তো, চলুন গাড়ি আছে। আমিও অফিস যাব।”
সরোজ জিজ্ঞাসু চোখে তাকাল।
”আমার অফিস রেল ভবন, আপনার কাছেই।”
জ্যোতিষের ফিয়াট ভিড়ের মধ্য দিয়ে বার করতে সময় লাগল। চালানোটা একটু সহজ হতেই জ্যোতিষ বলল, ”আপনাকে একটা খবর দিচ্ছি, রামিন্দারের সঙ্গে ওর বউয়ের যে ব্যাপারটা চলছিল সেটা মিটে গেছে। মহিলা ফিরে এসেছেন। এখন রামিন্দারের বোনের বাড়িতে।”
”জানলেন কী করে?”
”আমার বউ পাঞ্জাবি। রামিন্দারের বোনের সঙ্গে স্কুল থেকে আলাপ। কাল সন্ধেবেলায় রামিন্দার হোটেলে খবর পেয়ে বোনের কাছে ছুটে এসেছিল। শুনলাম খুব আবেগ-টাবেগের স্রোত বয়ে গেছল, কান্নাকাটিও হয়েছে, যা হয় আর কী।”
”ব্যাপারটা খুব ইন্টারেস্টিং তো। শুনেছি রামিন্দারের লাইফের উপরও অ্যাটেম্পট হয়েছে?”
”ঠিকই শুনেছেন। ভয়ও পেয়েছিল, পাবার মতোই ব্যাপারটা। এখন ওর বউ কিন্তু বিপদের মধ্যে পড়ল। স্বামীকে ছেড়ে যার কাছে চলে গেছল সে তো এবার ছাড়বে না…লোকটা অতি খারাপ, মাফিয়া টাইপের, খুন-টুন অনেক নাকি করিয়েছে। অত্যন্ত ভিন্ডিক্টিভ। …পালিয়ে ননদের বাড়িতে এসে উঠেছে, কেউ জানে না।”
সরোজ উত্তেজনা বোধ করল, কেউ জানে না এমন একটা ব্যাপার জেনে ফেলার জন্যই হয়তো জ্যোতিষ ‘একটু চা খেয়ে নিলে হত না’ প্রস্তাবটা দিতেই সে সাগ্রহে রাজি হয়ে গেল।
কনট প্লেসে ছোটো ঝকঝকে রেস্টুরেন্টে মুখোমুখি বসে সরোজ বলল, ”ব্যাপারটা খুবই সিরিয়াস, দুজনেরই জীবন বিপদের মধ্যে, মাথার উপর খাঁড়া ঝুলছে…আপনি ব্যাপারটা বলে কি ভালো করলেন?”
”কেন!” জ্যোতিষ সচকিত হয়ে উঠল।
”লোক জানাজানি হওয়া কি উচিত?”
”ওহ।” জ্যোতিষ যেন নিশ্চিন্ত হল, ”আপনাকেই শুধু বলেছি আর কাউকে বলবও না।”
”শুধু আমাকেই বললেন, কেন?”
জ্যোতিষের মুখে হালকা হাসির ছায়া ভেসে এল। কাপে চুমুক দিয়ে, সিগারেট ধরিয়ে প্যাকেটটা এগিয়ে দিল।
”দুটো কারণে। কানপুরে রামিন্দার যে কাণ্ডটা করেছে তা কাগজে পড়েছি। তারপরও আপনি ওর সম্পর্কে যা লিখেছেন তা-ও পড়েছি। আমার মনে হয়েছে ওর উপর আপনার অগাধ আস্থা, আপনি ওর ভালো চান। আমি কি ঠিক?”
সরোজ মাথা নোয়াল।
”আপনার দ্বারা ওর ক্ষতি হবে না এ সম্পর্কে আমি নিশ্চিত। অনেকেই ওর এই খারাপ খেলার পিছনের কারণ নিয়ে লিখেছে, তাতে ওর লজ্জা আর যন্ত্রণা আরও বেড়েছে। লেখাপড়া প্রায় করেইনি, একদিক দিয়ে বোকাই। লাইফ রিস্ক করে ওর বউয়ের ফিরে আসার ঘটনাটা রামিন্দারকে ভীষণভাবে নাড়া দিয়েছে মনে হচ্ছে। আমার বউ তখন ওখানে ছিল যখন রামিন্দার আসে। ওর কাছ থেকেই শুনলাম একসময় হঠাৎই কেমন ধীর শান্ত হয়ে শুধু বাইরের দিকে তাকিয়ে চুপ করে থাকে। বারকয়েক শুধু বিড়বিড় করেছে, ব্যস। আপনি ওকে চিনেছেন, এই ব্যাপারটা লিখবেন কি লিখবেন না সেটা আপনিই ঠিক করবেন।”
”বেশ। আর একটা কারণ?”
”বহু বছর আগের কথা।” জ্যোতিষ সিগারেটটা অ্যাশট্রেতে ফেলে দিল। সরু ধোঁয়া উঠছে, কাপের তলানিটা ঢেলে ধোঁয়া বন্ধ করল। ”ব্যাপারটা আপনি জানেন। রেস্টুরেন্টে মেয়েদের সঙ্গে বসে, এক অল্পবয়সি ছোকরা ক্লাসের একটি মেয়েকে ইমপ্রেস করতে লম্বা লম্বা কথা বলছিল, যেসব কথার থ্রি-ফোর্থই মিথ্যে, মনে আছে?”
”আছে।”
”আপনার চলে যাওয়াটা সেদিন ওই মুহূর্তে আমাকে যে কী লজ্জা আর অপমানের হাত থেকে বাঁচিয়েছিল, …অপমানিত হয়েছি পরে, নিজের কাছে, যখন আমাকে একটি ছেলে গোটা ব্যাপারটা বলল। আমি ট্রান্সফার নিয়ে বিদ্যাসাগরে চলে আসি। মিথ্যা কথা বলে আমি বোকামি করেছি ঠিকই কিন্তু আপনার সই এনে বীণা ক্লাসের কয়েকজনকে দেখিয়ে বলেছিল-সরোজ বিশ্বাসের গ্লাভস বইবার যোগ্যতাও যার নেই সে আবার প্রেম করতে চায়, এই দেখ সরোজ বিশ্বাস কী লিখেছে। আমাকে তারপর…আপনাকে রেস্টুরেন্টে এনে…আমি কৃতজ্ঞ আপনি ওখানে আর বসে থাকেননি।”
সরোজ দেখল কথা বলতে বলতে জ্যোতিষের ফরসা মুখ রক্তাভ হয়ে উঠেছে। কুড়ি-বাইশ বছর আগের কথা, কিন্তু ভোলেনি। হৃদয়ে একটা জায়গা আছে যেখানে কিছু বিঁধলে সারাজীবনেও উপড়ে ফেলা যায় না।
”আমার সঙ্গে ওর ঘনিষ্ঠতা হয়েছিল, খুবই।”
”জানি। অনেকেই জানত।”
”বিয়ে হল কীভাবে জানেন কি?”
”না। এখানে হঠাৎ ওর সঙ্গে দেখা এক বন্ধুর বাড়িতে পার্টিতে। মিস্টার রাও অদ্ভুত একটা অত্যন্ত ভালো, প্রগ্রেসিভ, কালচার্ড মানুষ। এখন বয়স পঁয়ষট্টির মতো। হাজার বারো মাসে পান। কলকাতায় বীণা ওর পি.এ. ছিল। তখনই গোপনে বিয়ে আর মিস্টার রাও কিছু পরেই চাকরি ছেড়ে মাদ্রাজে একটা কোম্পানিতে জয়েন করেন তারপর দিল্লিতে।”
”ওদের মধ্যে সম্পর্কটা তাহলে বিয়ের অনেক আগে থেকেই ছিল।” সরোজ নিশ্বাস চেপে রইল উত্তর শোনার জন্য।
”বলতে পারব না। তবে ওদের অফিসের একজনের সঙ্গে পরে আলাপ হয়, কথায় কথায় বলেছিল বিয়ের আগে দুজন প্রায়ই মোটরে বেড়াত, এখানে ওখানে খেতেও দেখা গেছে। আমি আর বেশি জিজ্ঞাসা করিনি। চলুন এবার যাওয়া যাক। দেখা হয়ে ভালোই হল।”
সরোজ ভ্রূ কুঁচকে চেয়ার থেকে উঠল। মোটরে বেড়াতে বা এখানে ওখানে খেতে দেখা গেছে তখন যখন তার সঙ্গে ব্যাপারটা চলছে। অপমানের একটা সূক্ষ্ম জ্বালা তাকে রাগিয়ে তুলল। বীণা তাকে বিশ্বাস করেনি। খেলো, পলকা, ভরসার অযোগ্য হিসাবেই ধরে নিয়েছিল, এদিকে তলায় তলায় খোঁজ করে বেড়াচ্ছিল শক্ত অবলম্বনের।
কিন্তু ওকে কি দোষ দেওয়া যায়? যখন বলল বিয়ে করো তখন কি সে বিয়ে করেছে বা করবে বলে কি কোথাও দিয়েছে? বীণা কোনো ভুল করেনি।
”জানেন কি কাল বীণাদের বাড়িতে ভবানী ঘোষাল আসবে?”
”তাই নাকি!” সরোজ অন্যমনস্কের মতো বলল।
”হ্যাঁ, আজ সকালেই আমাকে ফোন করেছিল, যেতে বলল। ঘোষালের সঙ্গে যে ওদের এত আলাপ আছে আগে কিন্তু কখনও বলেনি!”
”এখানেই রাখুন। বাকিটুকু হেঁটে যাব।”
লিফটে ওঠার আগে সরোজ রিসেপশনিস্টকে বলল, ”খুব ব্যস্ত থাকব, কোনো ফোন এলে আমার ঘরে দেবেন না?”
ঘরে এসে তার মনে হল, মিছিমিছিই বললাম, কোনো ফোনই আসবে না।
এখনও ২৫৬ রান দরকার ফলো-অন থেকে রেহাই পেতে। চতুর্থ দিনে প্রথম ওভারেই স্যান্ডারসনের প্রথম বলটিকে শর্মা গালি দিয়ে পাঠাল। একটা রান সহজে নেওয়া যায় এবং নিল। কিন্তু পারিখকে বোলিংয়ের সামনে দাঁড় না করাবার জন্য নিতে গেল দ্বিতীয় রানও। পৌঁছবার আগেই থার্ডম্যান পিকার্ডের নিখুঁত থ্রো গ্রে-র গ্লাভসে পৌঁছে গেছে। নিজের মূর্খামির জন্য শর্মা আফসোসে মাথা নাড়তে নাড়তে ফিরে এল।
ভবানী নামছে। শঙ্করের কথাটা সরোজের মনে পড়ল, ঠিক যেন গ্যারি সোবার্স! হাততালি এবং স্বাগত কলরব অন্যদের থেকে বেশিই সে পাচ্ছে। রোজা এবং সরোজ দেখল, নতুন একটি মেয়ে, দাঁড়িয়ে মাথার উপর হাত তুলে তালি দিচ্ছে আর চিৎকার করে যাচ্ছে।
আজকের প্রথম ওভারের পাঁচ বল এখনও বাকি। ভবানী গার্ড নিয়ে তাচ্ছিল্যভরে সাজানো ফিল্ডের উপর দিয়ে চোখ বোলাল। সিলি মিড অনে লোক এনেছে মার্কস, সিলি পয়েন্টে নিজে। অবহেলায় ফরোয়ার্ড খেলল সে দুটো বল। বাঁ পা সামান্য এগোল, অল্প ঝোঁকানো মাথা। প্রচণ্ড আস্থা বিচ্ছুরিত হচ্ছে ওর অলস নড়াচড়ার মধ্যে। গড়িয়ে বল দুটো ফিরে গেছে স্যান্ডার্সনের কাছে। সরোজ গভীর মনোযোগে দেখতে দেখতে তারিফ জানিয়ে মাথা নাড়ল। তৃতীয়টি বাউন্সার। মুখ সরিয়ে কোমরের উপর থেকে শরীরটা পিছনে হেলিয়ে দিল। বলটা কপাল ঘেঁষে চলে গেল। ভবানী তাকিয়ে রইল বোলারের দিকে। চতুর্থটি অল্প ওভারপিচ। শেষ মুহূর্তে বলটা সুইং করল, জমিতে পড়ে সরে এল ভিতরে। ভবানী ড্রাইভ করার জন্য পা বাড়িয়েছে, লিফট করা ব্যাটটা নামছে। বলের শেষ মুহূর্তের সরে আসাটা লক্ষ করেই ব্যাটটাকে থমকিয়ে সে বলটা কভার পয়েন্টের মাথার উপর দিয়ে তুলে ফেলে দিল। পারেখ রান নিতে চেয়েছিল, ভবানী ফিরিয়ে দেয়।
ক্যাচ উঠেছিল ভেবে স্বস্তির গুঞ্জন উঠল। সরোজের নিশ্বাস বন্ধ হয়ে গেল অনায়াস ব্যাপারটায়। ওভারের শেষ বল। ভবানী দৌড়ের ভঙ্গি দেখিয়ে পারেখকে তৈরি থাকতে বলল। সে যে এক রান নেবে ঔদ্ধত্যভরে তা ফিল্ডারদের জানিয়ে রেখেই স্টান্স নিল।
অফ স্পিন করিয়ে স্যান্ডার্সন বলটা তুলে দিল। ভবানী ক্রিজ থেকে ঝটিতি বেরিয়ে এসে বলটাকে ধীরে ফাঁকা মিড অফে ঠেলে দিয়ে রান নেবার জন্য দৌড়তে গিয়েই হড়কে পড়ল। স্যান্ডার্সনই দৌড়েছিল বলটা ফিরিয়ে আনতে। যখন বলটা সে তুলেছে ভবানীও তখন জমি থেকে কইমাছের মতো ছিটকে লাফিয়ে উঠে বোলার প্রান্তের দিকে দৌড় শুরু করেছে। স্যান্ডার্সন প্রায় পনেরো মিটার থেকে বলটা ছুড়ে যখন স্টাম্পে মারল ভবানী তখন ঝাঁপ দিয়েছে। চিৎকার করে চারজন ফিল্ডার হাত তুলে ছুটে গেল মোহন ঘোষের দিকে।
আঙুল উঠল।
নিউজিল্যান্ডাররা রণনৃত্য শুরু করেছে স্যান্ডার্সনকে ঘিরে। মাঠ ঘিরে বিস্ময়ের স্তব্ধতা। ভবানী বুটের তলায় ব্যাটটা ঠুকে মুখে হাসি রেখে শূন্য করে ফিরে আসছে। প্রথম ওভারেই দুটো রান আউট। দুটো ভালো উইকেট ভারত হারাল। রামিন্দরের প্রবেশ সংবর্ধিত হল ক্ষীণ কয়েকটি করতালিতে। সরোজ দেখল রোজা দু’হাতে মুখ ঢেকে কুঁজো হয়ে।
কী একটা ভয় ভারতের ব্যাটসম্যানদের মধ্যে যে ভর করল, যার ফলে তারা এলোপাথাড়ি ব্যাট চালাতে শুরু করল। পারিখা শূন্যতেই ফিরে গেল। ঠুকরাল আর শান্তনম দ্বি-অঙ্কে পৌঁছল না। আনন্দ দাঁড়াবার চেষ্টা করেছিল। ওয়ালেসের একটা আর্মার তার প্রতিরোধ ভেঙে দেয়। সে এগারো করেছে। ১৪৪ থেকে ১৮৪, আজ চল্লিশ রান ওঠার মধ্যে ছয়জন আউট। রামিন্দার অচঞ্চলভাবে ১৮ রান নিয়ে লাঞ্চে এল। রেগে দোসর রয়েছে এক রানে। এগারোটা মেডেন নিয়েছে ওয়ালেস, সঙ্গে তিনটি উইকেট।
সরোজ লাঞ্চের সময় তরুণের মুখোমুখি হতেই সে বিষণ্ণ স্বরে বলল, ”দাদা এটা কী হল? শুকনো মাঠে আছাড়! ভুবুর কপালে লেখা টেস্ট রেকর্ড ওর বাঁধা, আমি শঙ্কুর সঙ্গে বাজি ধরেছি দু’ইনিংসেই সেঞ্চুরির। তিন টেস্টে চারটে হত তাহলে।”
”রেকর্ডের জন্য আর একটা ইনিংস তো ওর হাতে রয়েছে। প্রথম তিন টেস্টে তিনটি সেঞ্চুরি আর কারুর নেই তো?”
”কারুর নেই, কারুর নেই।”
অভয়ঙ্করকে সামান্য ফ্যাকাশে দেখাচ্ছে। কথা না বলে চোখ দিয়ে আকাশ দেখিয়ে ঠোঁট ওলটাল। রোজা চেয়ারে নেই।
লাঞ্চের পরই মার্কস বহু আগে প্রাপ্য দ্বিতীয় নতুন বল নিল, সঙ্গে সঙ্গে রামিন্দারের অন্য মূর্তি। তার শান্ত নিষ্কম্প শীতল ব্যাট থেকে এবার হলকা বেরোচ্ছে। মহাদেবের তাণ্ডব নাচ যেন বাইশ গজের স্টেজে শুরু করল। কাট, ড্রাইভ আর হুকে সে নিউজিল্যান্ড বোলিং ছিন্নভিন্ন করার কাজে মেতে উঠল। ৪০ মিনিটে পৌঁছল পঁচাত্তরে, রেগে এক থেকে দুইয়ে। অপ্রত্যাশিত সহায়তা দিয়ে ছোট্ট চেহারার এই মারাঠি উইকেটকিপার একটা প্রান্ত ধরে রেখেছে। সাতটা বল পরেই রামিন্দার নব্বুইয়ে। প্রতিটি মার নিখুঁত, ব্যাটের কানা দিয়ে একটি রানও সে সংগ্রহ করেনি, পরিচ্ছন্ন হিসেবে ফুটওয়ার্ক, সময় বিচারে নির্ভুল। রামিন্দারের মন, মস্তিষ্ক আর শরীর, এক তালে এক ছন্দে মিলে কাজ করছে।
রামিন্দার সাতানব্বুইয়ে, তখনই বয়েডের বল গুডলেংথ থেকে খাড়াই দাঁড়িয়ে উঠল। ড্রাইভ করার জন্য তখন সে বাঁ পা বাড়াতে যাচ্ছে। বলটাকে উঠতে দেখেই পিছিয়ে যাবার চেষ্টা করে কিন্তু পারেনি। বাঁ চোখের পাশে হনুর হাড়ে বলটা যখন লাগল মাঠের সর্বত্র ‘খট’ শব্দটা প্রতিধ্বনিত হয়েছিল। পিছোতে গিয়ে ডান পায়ের বুট স্টাম্পে লেগেছিল। প্রায় একই সঙ্গে বেল ও রামিন্দার জমির উপর পড়ল।
নয়
রাত্রে ভালো ঘুম হল না। ছটফট করেছে অস্বস্তিতে, চটচটে ঘামে বিছানা ভিজেছে। একবার ঘুম ভেঙে গেছল ঘরে আগুন লেগেছে স্বপ্ন দেখে। বিছানায় উঠে বসে হিটারের গাঢ় কমলা রঙের কয়েলগুলোর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে আবার শুয়ে পড়ে। রামিন্দারের জ্ঞান হারানো দেহটা বহন করে আনার দৃশ্যটা তখন সরোজকে তাড়া করেছিল।
ভারতের ইনিংস শেষ হয়েছে ৩০৪ রানে। শেষ দুটি উইকেট নিতে পঁয়তাল্লিশ মিনিট অপেক্ষা করতে হয়েছিল নিউজিল্যান্ডারদের। প্রায় তিনশো রানে পিছিয়ে ফলো-অন করে আলভা ও শর্মা ম্যাচে দ্বিতীয়বার চমৎকারভাবে ইনিংস পত্তন করেছে। দেড়ঘণ্টায় ৫৫ রান তুলেছে দুজনে। তাদের ব্যাটিং থেকেই বোঝা যাচ্ছিল ব্যস্ততা, দ্বিধা বা ভয় থেকে বেরিয়ে আসতে পেরেছে। পঞ্চম দিনটা নির্বিঘ্নে কাটিয়ে দেওয়া এমন কিছু কঠিন ব্যাপার হবে না সবক’টি উইকেটই যখন অটুট রয়েছে।
রমেন গুহঠাকুরতা বার্তায় জানিয়েছে, ছবিগুলো রামকুমার ভালো তুলেছে। ভবানী সম্পর্কে লেখাটা ও সঙ্গে ছবি দেওয়ার মতো জায়গা পাওয়া যাচ্ছে না। ইতিমধ্যে লেখাটায় সে আর কিছু যদি সংযোজন দরকার মনে করে তো করতে পারে।
সরোজ জবাব দেয়নি। লেখা শেষ করে ঘরে এসেছে। বীণার বাড়িতে এখন নিশ্চয় ভবানী আর শঙ্কর মিলে হইচই শুরু করেছে। রোজার বন্ধুরা, বীণার প্রতিবেশীরা জানতে পারছে এখন দেশের সবথেকে পরিচিত যুবকটি কোথায়। এতে হয়তো রাওদের খাতির বাড়বে।
বেয়ারাকে দিয়ে তন্দুরি মুরগি নান আর বিয়ার আনিয়ে সরোজ একাই পার্টি দিল নিজেকে। খাওয়ার মাঝে ফোন এল। ওধারে শঙ্কর।
”সরোজদা কচ্ছেন কী ঘরে বসে, লিখে যাচ্ছেন নাকি এখনও? চলে আসুন চলে আসুন, দারুণ গ্যাদারিং, রোজা, মিসেস রাও আপনার কথা বারবার বলছে। আসলে দোষটা আমারই, আপনাকে নিয়ে আসার কথা ছিল আমারই আর আমি একদমই ভুলে গেছি।”
সরোজ শুনতে শুনতে দ্রুত ভেবে যাচ্ছিল কী বলবে।
”আসছেন তো, প্লিজ আসুন, নইলে এরা আমায় ক্ষমা করবে না।”
”মিসেস রাওকে বরং ডেকে দাও।”
”দিচ্ছি।”
কয়েক সেকেন্ড পরে বীণার গলা ভেসে এল।
”কী ব্যাপার, আসছ?”
”বীণা একদমই ভুলে গেছি বলতে, আজ একজনের বাড়িতে যাওয়ার কথা, নিয়ে যাবার জন্য ভদ্রলোক গাড়ি নিয়ে এসেছেন। আজ মাপ করে দাও।”
”তাহলে আসছ না?”
”না। এখানে অনেকদিন আগেই যাব বলে রেখেছি। শঙ্কু বলল দারুণ জমায়েত, রোজা কী করছে?”
”ও খুব মরোজড, ভবানী যেভাবে আউট হল!”
”আরে ক্রিকেটে এসব ঘটেই…আচ্ছা পরে কথা হবে’খন…গুড নাইট।”
ফোন রেখে সরোজ গুম হয়ে কিছুক্ষণ বসে থেকে খাওয়া শেষ করেই শুয়ে পড়ে। সে এটাকে তার খাঁটি রাগ না অভিমান, কীসের প্রকাশ হিসাবে গণ্য করবে তা ঠিক করতে পারেনি। নিশ্চিন্ত গাঢ় হয়নি তার ঘুম।
বহুদূর থেকে ভেসে আসা দমকলের ঘণ্টার শব্দ তার মাথার মধ্যে বেজে যাচ্ছিল। তাইতে ঘুম ভেঙে যায়। শব্দটা কিন্তু থামল না, মাঝে মাঝেই বেজে যেতে থাকে। চেতনা থেকে ঘুমের রেশ কেটে যেতেই সে ধড়মড়িয়ে উঠে পড়ল। শব্দটা ফোন বাজার।
”হ্যালো।”
”সরোজ? রোজা কোথায়?” বীণার স্বরে আর্তনাদ।
”মানে?” সরোজ অবাক বীণার গলা শুনে এবং প্রশ্নটিতে।
”কাল রাতে ভবানী আর শঙ্করের সঙ্গে বেরোল, শেরাটনে ভবানীকে পৌঁছে দিয়ে ফিরে আসার কথা কিন্তু এখনও ফেরেনি।” কান্নাচাপা উদ্বিগ্ন স্বরে বীণা বলল।
সরোজ টেবলে রাখা ঘড়িটা তুলে সময় দেখল সাতটা-পঁয়ত্রিশ।
”জানো কোথায় ওরা?”
”আমি কী করে জানব।” সরোজের গলায় ঝাঁঝ এসে গেল, ”শেরাটনে খোঁজ নেওয়া উচিত ছিল প্রথমেই, তারপর পুলিশে।”
”শেরাটনের রিসেপশনিস্ট খবর নিয়ে বলল ভবানী কাল হোটেলেই ফেরেনি। ওরা কি কাল রাতে অন্য কোথাও…”, বীণার গলা থেকে এরপর ফোঁপানির মতো আওয়াজ বেরিয়ে এল।
”শঙ্কর কোথায় রয়েছে বলতে পারো?”
”পারি।”
”আমাকে ঠিকানাটা দেবে?”
”ঠিকানা জানি না তবে জায়গাটা চিনি।”
”তাহলে আমি তোমার ওখানে যাচ্ছি, আমাকে একটু জায়গাটা চিনিয়ে দিয়ো।”
বীণা ফোন রাখল। হতভম্ব বোধটা কেটে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সরোজ বেরোবার জন্য তৈরি হতে লাগল। ব্যাপারটার গুরুত্ব এবং আকস্মিকতা তার চিন্তাক্ষমতাকে ঘেঁটে দিয়েছে। গুছিয়ে ভাবার মতো অবস্থা ফিরে পেতে পেতেই দরজায় খটখট শব্দ হল।
”ভেতরে এসো।” দরজার পাল্লাটা সরোজ মেলে ধরে রইল। বীণা ভিতরে এল। সরোজ প্যান্ট্রির দিকে তাকিয়ে একটি লোককে দেখে ইশারায় চা পাঠাতে বলল।
”বোসো, চা খাও।”
”না না না, তুমি আগে নিয়ে চলো।”
সরোজ খাটে বসে পায়ের উপর পা তুলল।
”চা না খেয়ে সকালে নড়তে পারি না।” সরোজ পা দোলাতে শুরু করল। বীণা কিছু বলতে গিয়ে চুপ করে গেল। তবে রাগ চাপার লক্ষণ মুখে ফুটে উঠল।
”ওদের সঙ্গে রোজার আলাপ যদি না করিয়ে দিতে তাহলে এটা ঘটত না।”
”তোমরা, মা-মেয়ে তো পাগল হয়ে উঠেছিলে ভবানীকে বাড়িতে আনার জন্য।”
”পাগল কেন হব।” বীণা ভ্রূ কুঁচকে বলল।
”আমি তোমার বাড়ি চিনি না, কথা ছিল কেউ এসে আমাকে নিয়ে যাবে। যদি কাল নিয়ে যেতে তাহলে এই পরিস্থিতির উদ্ভব হত না।”
”শঙ্কর নিজে থেকেই বলেছিল ও তোমাকে নিয়ে যাবে।”
”আমাকে তুমি ফোন করে এটাও যদি জানাতে তাহলে আমিই শঙ্করকে তাগাদা দিয়ে…কিন্তু তুমি একে তাকে ফোন করে নেমন্তন্ন করতে সময় পাও শুধু আমাকেই…”
”একে তাকে মানে?”
দরজায় টোকা। চা নিয়ে এসেছে। সরোজ দু’পেয়ালা চা তৈরি করছিল, বীণা বলল, ”আমি খাব না। তুমি একটু তাড়াতাড়ি করো।”
কথাটা গ্রাহ্যে না-আনা বোঝাতে সরোজ মন্থরভাবে চামচ নাড়তে লাগল। তারপর ধীরেসুস্থে পেয়ালাটা ঠোঁটের কাছে এনে চুমুকের জন্য সময় দিল।
”প্লিজ, তাড়াতাড়ি।”
”এত উতলা হচ্ছ কেন, রাতে ফেরেনি তো কী হয়েছে?”
”বলছ কী! একটা অল্পবয়সি মেয়ে সারারাত বাড়ির বাইরে দুটো বদমাইশের সঙ্গে কাটাচ্ছে আর তার মা উতলা হবে না?”
”এখন ওরা বদমাইশ হয়ে গেল আর ওদের দেওয়া টিকিটে যখন সেজেগুজে খেলা দেখতে গেছলে তখন কি ওদের দেবদূত মনে হচ্ছিল?”
বীণা রাগে আর বিতৃষ্ণায় মুখ ঘুরিয়ে রাখল। ঠোঁট থরথর করছে, মুঠো বন্ধ, দৃষ্টি জ্বলন্ত। সরোজকে শুনিয়ে আপনমনে বলল, ”ট্রেনে দেখা না হলেই দেখছি মঙ্গল ছিল।”
”কোনোকালে দেখা না হলে আরও মঙ্গল হত, রোজা জন্মাত না, আজকের এই ঝঞ্ঝাটেও পড়তে হত না।”
”হোয়াট ডু ইউ মিন? রোজা জন্মাত না মানে?”
”সরল কথার আবার মানে? রোজা তো আমার মেয়ে।”
বীণা দাঁড়িয়ে উঠল লহমায়।
”কে বলল তোমার মেয়ে? রোজা আমার স্বামীর।” বীণার স্বর চিরে গেল।
সরোজ তীক্ষ্ন চোখে তাকাল। সে যেন প্রত্যয়ের অভাব দেখতে পেল বীণার মুখে। বিবর্ণ হয়ে যাচ্ছে ঠোঁট। চাহনির ঔজ্জ্বল্য স্তিমিত।
”মিথ্যা কথা বোলো না। সরোজের মেয়ে সরোজা, দুজনের মুখের মিলও অদ্ভুত।”
বীণা মাথা নাড়তে লাগল।
”রোজা আমার স্বামীর।”
”তাহলে যে বলেছিলে প্রেগনান্ট হয়েছ?”
”মিথ্যে বলেছিলাম তোমাকে প্রেশার দেবার জন্য, বিয়েতে বাধ্য করার জন্য।”
”তুমি রোজাকে পেটে নিয়েই বিয়ে করেছ?”
”কী আবোলতাবোল বকছ। ওঠো এবার। এসব কথা রোজার কানে গেলে ওর জীবনটাই নষ্ট হয়ে যাবে।”
”নাহ। যতক্ষণ না সত্যি বলছ আমি উঠব না। যদি নিজে ওকে খুঁজে নিতে পারো তো নাও।”
”পুলিশের হেল্প নিয়ে বার করব। তুমি কি ভেবেছ আমি পারি না?”
বীণা দরজার দিকে এগোল। পেয়ালায় আবার চা ঢালতে ঢালতে সরোজ বলল, ”পুলিশ বার করে দেবে ঠিকই। কিন্তু তারপর। বিখ্যাত একটি ছেলে এতে ইনভলভড। খবর চাপা থাকবে না। ছবিসমেত কাগজে খবর বেরোবে। মিস্টার রাওয়ের মানসম্মান…”
সরোজ থেমে গেল এবং দ্রুত উঠে এগিয়ে গেল। বীণা মেঝেয় বসে পড়েছে, ডান হাতটা দেয়াল থেকে বেয়ে বেয়ে নামছে, বাঁ হাত বুকে চেপে ধরা। মুখ কোলের মধ্যে ডুবে গেল। বীণার পাশে উবু হয়ে বসে সরোজ দু’হাতে কাঁধ ধরে নাড়া দিল।
”কী হয়েছে? কী হল?”
”আমি কী করব, কী তখন করতে পারি! সহায় সম্বল নেই, একা… আর কী করার ছিল? তুমিও প্রত্যাখ্যান করলে।”
বীণা কাঁদছে।
.অটোরিকশায় পনেরো মিনিটের মধ্যে ওরা পৌঁছল। দরজার বেলের সুইচ টিপে দুজনে অপেক্ষা করল। সাড়া না পেয়ে আরও কয়েকবার ঘনঘন টিপল।
দরজার ওপাশে মৃদু গজগজানি, পায়ের শব্দ। দরজা খুলে খালি গা, শর্টস পরা শঙ্কর ভারী চোখে তাকিয়ে রইল। ওকে ঠেলে সরোজ তার পিছনে বীণা ভিতরে ঢুকল।
আলো জ্বলছে। মাংস পোড়ার মতো বিশ্রী গন্ধে বাইরের বসার জায়গাটা ভরে আছে। সরোজ বুঝতে পারল এই গন্ধ গাঁজার। শঙ্কর চোখ খুলে তাকাবার চেষ্টা করছে। অবশেষে সোফাটায় বসে পড়ল। হাত তুলে শোবার ঘরের দরজাটা দেখিয়েই সে ধীরে ধীরে শুয়ে পড়ল।
পর্দা সরিয়ে ঘরের মধ্যে কিছু দেখতে পেল না সরোজ। তবে অনুমান করল কেউ একজন শুয়ে। বীণা তার পিছন থেকে উঁকি দিল।
হাতড়ে সুইচ বোর্ড পেয়ে সরোজ একটা সুইচ টিপতেই একটা পাখা ঘুরে উঠল। যে ক’টা সুইচ সব ক’টিই সে টিপল এবং আলোয় ঘর ভরে যেতেই সরোজের পিছন থেকে তীক্ষ্ন আর্তনাদ করে বীণা ছুটে গেল।
রোজা কার্পেটে কাত হয়ে শুয়ে। শঙ্করের ”লাভ মি” ছাপমারা গেঞ্জিটা গায়ে জড়ানো। জিনসের ট্রাউজার্সটা কোমর থেকে নামানো। খাটে চিত হয়ে পা ছড়িয়ে খালি গায়ে শুয়ে ভবানী। বুকটা হাপরের মতো ওঠানামা করছে। সারা ঘর ভরে আছে গাঁজার গন্ধে।
রোজার বুকে কান চেপে বীণা স্পন্দন শোনার পর ট্রাউজার্সটা টেনে তুলতে লাগল। সরোজ জানলা খুলে পাখা চালিয়ে দিল। রোজাকে টেনে বসিয়ে সরোজ ধরে রইল আর বীণা গেঞ্জিটা পরিয়ে দিল।
”এখান থেকে নিয়ে যেতে হবে, এখুনি।”
”চলার ক্ষমতা নেই। ট্যাক্সি ডেকে আনি।”
রাস্তায় বেরিয়েই সরোজ ট্যাক্সি পেল। রোজাকে পাঁজাকোলা করে যখন বেরোল, শঙ্কর এবং ভবানী তখন বেঘোরে। ট্যাক্সিতে তাকে তোলার সময় পথচারী অনেকেই তাকিয়ে গেল। ট্যাক্সিওলা সন্দেহের চোখে রোজার দিকে তাকিয়ে বলল, ”কী হয়েছে?”
”মেয়ে বেহুঁশ হয়ে গেছে জ্বরে। নার্সিং হোমে নিয়ে যাব।” সরোজ কথাটা বলে বীণার দিকে তাকাল। ”চেনা নার্সিং হোম আছে? সেখানেই আগে যাব।”
”আছে।”
.শেষ দিনে টেস্ট ম্যাচটি অকল্পনীয় মোড় নিল। লাঞ্চের পনেরো মিনিট আগে পিকার্ড হ্যাটট্রিক করল আলভা, ঠুকরাল ও শান্তনমকে আউট করে। প্রথম উইকেট পড়তেই ভবানীর বদলে ঠুকরালকে নামতে দেখে প্রেসবক্সে বিস্ময় দেখা দেয়। ঠুকরালের পরও ভবানী মাঠে নামল না। একজন বলল, ক্রাইসিস দেখা দিলে তা সামলাতে ঘোষালকে নীচের দিকে রাখা হয়েছে।
শান্তনম বোল্ড আউট হবার পর ভবানী মাঠে এল। অনিশ্চিত পদক্ষেপ, বারবার মাথা ঝাঁকাচ্ছে, শরীর যেন আর বইতে পারছে না। সে ওয়ালেসের তিনটি বলের সম্মুখীন হয়। প্রথম দুটি ফসকায় এবং স্টাম্প ঘেঁষে চলে যায়। তৃতীয়টিতে বিরক্ত হয়ে দু’পা বেরিয়ে মারতে গিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ে এবং স্টাম্পড। ফেরার সময় ওর মুখ দেখে সরোজের কষ্ট হল। দুই ইনিংসেই শূন্য করার জন্য ভবানীর মুখে যে লজ্জা বা হীনতা বোধ প্রত্যাশিত ছিল তার কোনো চিহ্ন সে দেখতে পেল না; কেননা, ওর স্নায়ুর কাজ করার ক্ষমতা এখন অসাড় হয়ে আছে। ঘোলাটে চাহনিতে তাকাতে তাকাতে সে অদৃশ্য হয়ে গেল প্যাভিলিয়নের মধ্যে।
রামিন্দারের গালের হাড়ে চিড় দেখা গেছে। ডাক্তার জানিয়েছে দু’সপ্তাহ তার খেলার কোনো প্রশ্নই ওঠে না। লাঞ্চে চার উইকেটে ১২৫ রান। আর একটি উইকেট পড়ল ১৩৩ রানে যখন আনন্দ বোল্ড হল বয়েডের ইয়র্কারে।
ড্র হবার ম্যাচ হঠাৎ পরাজয়ের ম্যাচে রূপান্তরিত হল। পরের ব্যাটসম্যান রেগে। হঠাৎ তুমুল উচ্ছ্বাসের মধ্যে দেখা গেল রেগে নয় রামিন্দার মাঠে নামছে। দু’ঘণ্টা আর কুড়ি ম্যান্ডেটরি ওভার তখনও বাকি। যেভাবে উপরের দিকের বাটসম্যানরা আউট হল তাতে শেষের প্রতিরোধ সম্পর্কে কারুরই ভরসা থাকার কথা নয়।
গালে তুলোর উপর প্লাস্টার আঁটা, ওটাই রামিন্দারের সারা অস্তিত্বের মধ্যে প্রথমেই চোখ টেনে রাখল দর্শকদের। চ্যালেঞ্জের সংকেত ওর উঁচু করে তুলে ধরা চিবুকে, হালকা পদক্ষেপে বা শান্ত চাহনিতে। মনে হচ্ছে যেন একটা বাঘ শিকার ধরতে এগোচ্ছে।
সেদিন সরোজ অফিসে ফিরে এসে প্রথমে গুহঠাকুরতাকে একটা টেলেক্স করে। তাতে সে জানায়, ‘ভবানী সম্পর্কে যে লেখাটা পাঠিয়েছিলাম সেটা ছাপবেন না। তাতে যে মেয়েটির কথা লিখেছি আদপে তার কোনো অস্তিত্বই নেই। পরে ভবানী সম্পর্কে লিখব। তার বদলে রামিন্দার সম্পর্কে লেখা পাঠাচ্ছি। কীভাবে সে হারের কিনার থেকে দলকে টেনে আনল এবং তার নিজের প্রত্যাবর্তনের কথা। একটু বড়ো হবে। আশা করি, জায়গার অকুলান হবে না।’
এর পর সরোজ রাশি রাশি শব্দের মধ্যে ডুবে গেল রামিন্দারের ইনিংসটা তুলে আনার জন্য। তার মধ্যে কয়েকবার সে আনমনা হয়েছিল এবং আপনমনে হেসে মাথা নেড়েছিল।