দ্বিতীয় আপত্তি।
কেহ কেহ আপত্তি করিতেছেন, বহুবিবাহপ্রথা নিবারিত হইলে, কুলীন ব্রাহ্মণদিগের জাতিপাত ও ধর্ম্মলোপ ঘটিবেক। এই আপত্তি ন্যায়োপেত হইলে, বহুবিবাহ প্রথার নিবারণচেষ্টা কোনও ক্রমে উচিত কর্ম্ম হইত না। কৌলীন্যপ্রথার পূর্ব্বাপর পর্য্যালোচনা করিয়া দেখিলে, এই আপত্তি ন্যায়োপেত কি না, ইহা প্রতীয়মান হইতে পারিবেক; এজন্য, কৌলীন্যমর্য্যাদার প্রথম ব্যবস্থা ও বর্ত্তমান অবস্থা সংক্ষেপে উল্লিখিত হইতেছে।
রাজা আদিসূর, পুত্রেষ্টিযাগের অনুষ্ঠানে কৃতসঙ্কল্প হইয়া, অধিকারস্থ ব্রাহ্মণদিগকে যজ্ঞসম্পাদনার্থে আহ্বান করেন। এ দেশের তৎকালীন ব্রাহ্মণেরা আচারভ্রষ্ট ও বেদবিহিত ক্রিয়ার অনুষ্ঠানে নিতান্ত অনভিজ্ঞ ছিলেন; সুতরাং তাঁহারা আদিসূরের অভিপ্রেত যজ্ঞ সম্পাদনে সমর্থ হইলেন না। রাজা, নিরুপায় হইয়া, ৯৯৯ শাকে[১] কান্যকুজ্বরাজের নিকট, শাস্ত্রজ্ঞ ও আচারপূত পঞ্চ ব্রাহ্মণ প্রেরণ প্রার্থনায়, দূত প্রেরণ করিলেন। কান্যকুব্জরাজ, তদনুসারে, পঞ্চ গোত্রের পঞ্চ ব্রাহ্মণ পাঠাইয়া দিলেন;—
১ | শাণ্ডিল্যগোত্র | ভট্টনারায়ণ। |
২ | কাশ্যপগোত্র | দক্ষ। |
৩ | বাৎস্যগোত্র | ছান্দড়। |
৪ | ভরদ্বাজগোত্র | শ্রীহর্ষ। |
৫ | সাবর্ণগোত্র | বেদগর্ভ।[২] |
ব্রাহ্মণেরা সস্ত্রীক সভৃত্য অশ্বারোহণে গৌড়দেশে আগমন করেন। চরণে চর্ম্মপাদুকা, সর্বাঙ্গ সূচীবিদ্ধ বস্ত্রে আবৃত, এইরূপ বেশে তাম্বুল চর্ব্বণ করিতে করিতে, রাজবাটীর দ্বারদেশে উপস্থিত হইয়া, তাঁহারা দ্বারবানকে কহিলেন, ত্বরায় রাজার নিকট আমাদের আগমনসংবাদ দাও। দ্বারী, নরপতিগোচরে উপস্থিত হইয়া, তাহাদের আগমনসংবাদ প্রদান করিলে, তিনি প্রথমতঃ অতিশয় আহ্লাদিত হইলেন; পরে, দৌবারিকমুখে তাঁহাদের আচার ও পরিচ্ছদের বিষয় অবগত হইয়া, মনে মনে কহিতে লাগিলেন, এ দেশের ব্রাহ্মণেরা আচারভ্রষ্ট ও ক্রিয়াহীন রলিয়া, আমি দুরদেশ হইতে ব্রাহ্মণ আনাইলাম। কিন্তু, যেরূপ শুনিতেছি, তাহাতে উহাদিগকে আচারপূত বা ক্রিয়াকুশল বলিয়া বোধ হইতেছে না। যাহা হউক, আপাততঃ সাক্ষাৎ না করিয়া, উহাদের আচার প্রভৃতির বিষয় সবিশেষ অবগত হই, পরে যেরূপ হয় করিব। এই স্থির করিয়া, রাজ দ্বারবানকে কহিলেন, ব্রাহ্মণ ঠাকুরদিগকে বল, আমি কার্য্যান্তরে ব্যাপৃত আছি, এক্ষণে সাক্ষাৎ করিতে পারিব না; তাঁহারা বাসস্থানে গিয়া শ্রান্তিদূর করুন; অবকাশ পাইলেই, সাক্ষাৎ করিতেছি।
এই কথা শুনিয়া দ্বারবান, ব্রাহ্মণদিগের নিকটে আসিয়া, সমস্ত নিবেদন করিল। রাজা অবিলম্বেই তাঁহাদের সংবর্দ্ধনা করিবেন, এই স্থির করিয়া, ব্রাহ্মণেরা আশীর্বাদ করিবার নিমিত্ত জলগণ্ডুষ হস্তে দণ্ডায়মান ছিলেন; এক্ষণে, ভঁহার অনাগমনবার্ত্তাশ্রবণে, করস্থিত আশীর্বাদবারি নিকটবর্ত্তী মল্লকাষ্ঠে ক্ষেপণ করিলেন; ব্রাহ্মণদিগের এমনই প্রভাব, আশীর্বাদবারি স্পর্শমাত্র, চিরশুষ্ক মল্লকাষ্ঠ সঞ্জীবিত, পল্লবিত ও পুষ্পফলে সুশোভিত হইয়া উঠিল।[৩] এই অদ্ভুত সংবাদ তৎক্ষণাৎ নরপতিগোচরে নীত হইল। রাজা শুনিয়া চমৎকৃত হইলেন। তাঁহাদের আচার ও পরিচ্ছদের কথা শুনিয়া, প্রথমতঃ তাঁহার মনে অশ্রদ্ধা ও বিরাগ জন্মিয়াছিল; এক্ষণে বিলক্ষণ শ্রদ্ধা ও অনুরাগ জন্মিল। তখন তিনি, গলবস্ত্র ও কৃতাঞ্জলি হইয়া, দ্বারদেশে উপস্থিত হইলেন, এবং দৃঢ়তর ভক্তিযোগ সহকারে সাষ্টাঙ্গ প্রণিপাত করিয়া, ক্ষমাপ্রার্থনা করিলেন।[৪]
অনন্তর, রাজা নির্ধারিত শুভ দিবসে সেই পঞ্চ ব্রাহ্মণ দ্বারা পুষ্টিযাগ করাইলেন। যাগপ্রভাবে রাজমহিষী গর্ভবতী ও যথাকালে পুত্রবতী হইলেন। রাজা, যৎপরোনান্তি প্রীত হইয়া, নিজ রাজ্যে বাস করিবার নিমিত্ত, ব্রাহ্মণদিগকে অত্যন্ত অনুরোধ করিতে লাগিলেন। ব্রাহ্মণেরা, রাজার নির্বন্ধ উল্লঙ্ঘনে অসমর্থ হইয়া, তদীয় প্রস্তাবে সম্মত হইলেন, এবং পঞ্চকোটি, কামকোটি, হরিকোটি, কঙ্কগ্রাম, বটগ্রাম এই রাজপ্রদত্ত পঞ্চ গ্রামে[৫] এক এক জন বসতি করিলেন।
ক্রমে ক্রমে এই পাঁচ জনের ষট্পঞ্চাশৎ সন্তান জন্মিল। ভট্ট- নারায়ণের ষোড়শ, দক্ষের ষোড়শ, শ্রীহর্ষের চারি, বেগর্ভের দ্বাদশ, ছান্দড়ের আট[৬]। এই প্রত্যেক সন্তানকে রাজা বাসার্থে এক এক গ্রাম প্রদান করিলেন। সেই সেই গ্রামের নামানুসারে তত্তৎ সন্তানের সন্তানপরম্পরা অমুকগ্রামীণ, অর্থাৎ অমুকগাঁই, বলিয়া প্রসিদ্ধ হইলেন। শাণ্ডিল্যগোত্রে ভট্টনারায়ণবংশে বন্দ্য, কুসুম, দীর্ঘাঙ্গী, ঘোষলী, বটব্যাল, পারিহা, কুলকুলী, কুশারি, কুলভি, সেয়ক, গড়গড়ি, আকাশ, কেশরী, মাষচটক, বসুয়ারি, করাল, এই ষোল গাঁই[৭]। কাশ্যপগোত্রে দক্ষবংশে চট্ট, অম্বুলী, তৈলবাটী, পোড়ারি, হড়, গূড়, ভুরিষ্ঠাল, পলিধি, পাকড়াসী, পূষলী, মূলগ্রামী, কোয়ারী, পলসায়ী, পীতমুণ্ডী, সিমলায়ী, ভট্ট এই ষোল গাঁই[৮]। ভরদ্বাজগোত্রে শ্রীহর্ষবংশে মুখুটী, ডিংসাই, সাহরি, রাই এই চারি গাঁই[৯]। সাবর্ণগোত্রে বেদর্ব্ভবংশে গাঙ্গুলি, পুংলিক, “নন্দিগ্রামী, ঘণ্টেশ্বরী, কুন্দগ্রামী, সিয়ারি, সাটেশ্বরী, দায়ী, নায়েরী, পারিহাল, বালিয়া, সিদ্ধল এই বার গাঁই[১০]। বাৎস্যগোত্রে ছান্দড়বংশে কাঞ্জিলাল, মহিন্তা, পূতিতুণ্ড, পিপলাই, ঘোষাল, বাপুলি, কাঞ্জারী, সিমলাল এই আট গাঁই[১১]।
ভট্রনারায়ণ প্রভৃতির আগমনের পূর্ব্বে, এ দেশে সাতশত ঘর ব্রাহ্মণ ছিলেন। তাঁহারা অবধি হেয় ও অশ্রদ্ধেয় হইয়া রহিলেন, এবং সপ্তশতীনামে প্রসিদ্ধ হইয়া পৃথক্ সম্প্রদায়রূপে পরিগণিত হইতে লাগিলেন। তাঁহাদের মধ্যে জগাই, ভাগাই, সাগাই, নানসী, আরখ, বালথবি, পিখুরী, মুলুকজুরী প্রভৃতি গাঁই ছিল। সপ্তশতী পঞ্চগোত্রবহির্ভূত, এজন্য কান্যকুব্জাগত পঞ্চ ব্রাহ্মণের সন্তানেরা ইঁহাদের সহিত আহার ব্যবহার ও আদান প্রদান করিতেন না; যাঁহারা করিতেন, তাঁহারও সপ্তশতীর ন্যায় হেয় ও অশ্রদ্ধেয় হইতেন।
কালক্রমে আদিসুরের বংশধ্বংস হইল। সেনবংশীয় রাজারা গৌড়দেশের সিংহাসনে অধিরোহণ করিলেন[১২]। এই বংশোদ্ভব অতি প্রসিদ্ধ রাজা বল্লালসেনের অধিকারকালে কৌলীন্যমর্য্যাদা ব্যবস্থাপিত হয়। ক্রমে ক্রমে, কান্যকুব্জাগত ব্রাহ্মণদিগের সন্তানপরম্পরার মধ্যে বিদ্যালোপ ও, আচারভ্রংশ ঘটিয়া আসিতেছিল, তন্নিবারণই কৌলীন্যমর্য্যাদাপনের মুখ্য উদ্দেশ্য। রাজা বলসেন বিবেচনা করিলেন, আচার, বিনয়, বিদ্যা প্রভৃতি সদ্গুণের সবিশেষ পুরষ্কার করিলে, ব্রাহ্মণেরা অবশ্যই সেই সকল গুণের রক্ষাবিষয়ে সবিশেষ যত্ন করিবেন। তদনুসারে, তিনি পরীক্ষা দ্বারা যাঁহাদিগকে নবগুণবিশিষ্ট দেখিলেন, তাঁহাদিগকে কৌলীন্যমর্যাাদা প্রদান করিলেন। কৌলীন্যপ্রবর্ত্তক নয় গুণ এই,—আচার, বিনয়, বিদ্যা, প্রতিষ্ঠা, তীর্থ- দর্শন, নিষ্ঠা, আবৃত্তি, তপস্যা, দান[১৩]। আবৃত্তিশব্দের অর্থ পরিবর্ত্ত; পরিবর্ত্ত চারিপ্রকার, আদান, প্রদান, কুশত্যাগ ও ঘটকার্যে প্রতিজ্ঞা[১৪]। আদান, অর্থাৎ সমান বা উৎকৃষ্ট গৃহ হইতে কন্যা গ্রহণ; প্রদান, অর্থাৎ সমান অথবা উৎকৃষ্ট গৃহে কন্যাদান; কুশত্যাগ, অর্থাৎ কন্যার অভাবে কুশময়ী কন্যার দান; ঘটকাগ্রে প্রতিজ্ঞা, অর্থাৎ উভয় পক্ষে কন্যার অভাব ঘটিলে, ঘটকের সম্মুখে বাক্যমাত্র দ্বারা পরস্পর কন্যাদান। সৎকুলে কন্যাদান ও সৎকুল হইতে কন্যাগ্রহণ কুলের প্রধান লক্ষণ; কিন্তু কন্যার অভাব ঘটিলে, আদান প্রদান সম্পন্ন হয় না; সুতরাং কন্যাহীন ব্যক্তি সম্পূর্ণ কুললক্ষণাক্রান্ত হইতে পারেন না। এই দোষের পরিহারার্থে কুশময়ী কন্যার দান ও ঘটকসমক্ষে বাক্যমাত্র দ্বারা পরস্পর কন্যাদানের ব্যবস্থা হয়।
পূর্ব্বে উল্লিখিত হইয়াছে, কান্যকুব্জাগত পঞ্চ ব্রাহ্মণের ষট্পঞ্চাশৎ সন্তান এক এক গ্রামে বাস করেন; সেই সেই গ্রামের নামানুসারে, এক এক গাঁই হয়; তাঁহাদের সন্তানপরম্পরা সেই সেই গাঁই বলিয়া প্রসিদ্ধ হন। সমুদয়ে ৫৬ গাঁই; ভন্মধ্যে বন্দ্য, চট্ট, মুখুটী, ঘোষাল, পুতিতুণ্ড, গাঙ্গুলি, কাঞ্জিলাল, কুন্দগ্রামী এই আট গাঁই সর্বতোভাবে নবগুণবিশিষ্ট ছিলেন[১৫], এজন্য কৌলীন্যমর্য্যাদা প্রাপ্ত হইলেন। এই আট গাঁইর মধ্যে চট্টোপাধ্যায়বংশে বহুরূপ, সুচ, অরবিন্দ, হলায়ুধ, বাঙ্গাল এই পাঁচ; পুতিতুণ্ডরংশে গোবর্দ্ধনাচার্য্য; ঘোষালবংশে শির; গঙ্গোপাধ্যায়রংশে শ্নিশ; কুন্দগ্রামিবংশে তোষাকর; বন্দ্যোপাধ্যায়বংশে জাহ্লন, মহেশ্বর, দেবল, বামন, ঈশান, মকরন্দ এই ছয়; মুখোপাধ্যায়বংশে উৎসাহ, গরুড় এই দুই; কাঞ্জিলালবংশে কানু, কুতুহল এই দুই; সমুদয়ে এই উনিশ জন কুলীন হইলেন[১৬]। পালধি, পাকড়াশী, সিমলায়ী, বাপুলি, ভুরিষ্ঠাল, কুলকুলী, বটব্যাল, কুশারি, সেয়ক, কুসুম, ধোষলী, মাষচটক, বসুয়ারি, করাল, অম্বুলী, তৈলবাটী, মূলগ্রামী, পূবর্লী, আকাশ, পলসায়ী, কোয়ারী, সাহরি, ভট্টাচার্য্য, সাটেশ্বরী, নায়েরী, দায়ী, পারিহাল, সিয়ারী, সিদ্ধল, পুংসিক, নন্দিগ্রামী, কাঞ্জারী, সিমলাল, বালী, এই ৩৪ গাঁই অষ্টগুণবিশিষ্ট ছিলেন, এজন্য শ্রোত্রিয়সংজ্ঞাভাজন হইলেন[১৭]। পূর্ব্বোক্ত নয় গুণের মধ্যে ইঁহারা আবৃত্তিগুণে বিহীন ছিলেন; অর্থাৎ, বন্য প্রভৃতি আট গাঁই আদানপ্রদানবিষয়ে যেমন সাবধান ছিলেন, পালধি প্রভৃতি চৌত্রিশ গাই তদ্বিষয়ে তদ্রূপ সাবধান ছিলেন না; এজন্য তাঁহাৱা কৌলীন্যমর্য্যাদা প্রাপ্ত হইলেন না। আর দীর্ঘাঙ্গী, পারিহা, কুলভী, গোড়ারি, রাই, কেশরী, ঘণ্টেশ্বরী, ডিংসাই, পীতমুণ্ডী, মহিন্তা, গুড়, পিপলাই, হড়, গড়গড়ি, এই চৌদ্দ গাঁই সদাচার-পরিভ্রষ্ট ছিলেন, এজন্য গৌণ কুলীন বলিয়া পরিগণিত হইলেন[১৮]।
এরূপ প্রবাদ আছে, রাজা বল্লালসেন, কৌলীন্যমর্য্যাদাস্থাপনের দিন স্থির করিয়া, ব্রাহ্মণদিগকে নিত্যক্রিয়াসমাপনান্তে রাজসভায় উপস্থিত হইতে আদেশ করেন। তাহাতে কতকগুলি ব্রাহ্মণ এক প্রহরের সময়, কতকগুলি দেড় প্রহরের সময়, আর কতকগুলি আড়াই প্রহরের সময় উপস্থিত হন। যাঁহাৱা আড়াই প্রহরের সময় উপস্থিত হন, তাঁহারা কৌলীন্যমর্য্যাদা প্রাপ্ত হইলেন; যাঁহারা দেড় প্রহরের সময়, তাঁহারা শ্রেত্রিয়, আর যাঁহারা এক প্রহরের সময়, তাঁহার গৌণ কুলীন, হইলেন। ইহার তাৎপর্য্য এই, প্রকৃত প্রস্তাবে নিত্যক্রিয়া করিতে অধিক সময় লাগে; সুতরাং যাহারা আড়াই প্রহরের সময় অসিয়াছিলেন, তাঁহারা প্রকৃত প্রস্তাবে নিত্যক্রিয়া করিয়াছিলেন; তদ্বারা রাজা তাঁহাদিগকে সদাচারপূত বলিয়া বুঝিতে পারিলেন, এজন্য তাঁহাদিগকে প্রধান মর্য্যাদা প্রদান করিলেন। দেড় প্রহরের সময় আগতেরা আচারাংশে ন্যূন ছিলেন, এজন্য ন্যূন মর্য্যাদা প্রাপ্ত হইলেন; আর এক প্রহরের সময় আগতেরা আচারভ্রষ্ট বলিয়া অবধারিত হইলেন, এজন্য রাজা তাঁহাদিগকে, হেয়জ্ঞান করিয়া, অপকৃষ্ট ব্রাহ্মণ বলিয়া পরিগণিত করিলেন।
এই রূপে কৌলীন্যমর্য্যাদা ব্যবস্থাপিত হইল। নিয়ম হইল, কুলীনেরা কুলীনের সহিত আদানপ্রদান নির্বাহ করিবেন; শ্রোত্রিয়ের কন্যা গ্রহণ করিতে পারিবেন, কিন্তু শ্রোত্রিরকে কন্যাদান করিতে পারিবেন না, করিলে কুলভ্রষ্ট ও বংশজভাবাপন্ন হইবেন[১৯] আর গৌণ কুলীনের কন্যাগ্রহণ করিলে, এক কালে কুলক্ষয় হইবেক; এই নিমিত্ত, গৌণ কুলীনেরা অরি, অর্থাৎ কুলের শত্রু, বলিয়া প্রসিদ্ধ ও পরিগণিত হইলেন[২০]।
কৌলীন্যমর্য্যাদাব্যবস্থাপনের পর, বল্লালসেনের আদেশানুসারে, কতকগুলি ব্রাহ্মণ ঘটক এই উপাধি প্রাপ্ত হইলেন। ঘটকদিগের এই ব্যবসায় নিরূপিত হইল যে, তাঁহারা কুলীনদিগের স্তুতিবাদ ও বংশাবলী কীর্ত্তন করিবেন এবং তাঁহাদের গুণ, দোষ ও কৌলীন্যমর্য্যাদাসংক্রান্ত নিয়ম বিষয়ে সবিশেষ দৃষ্টি রাখিবেন।[২১]।
কুলীন, শ্রোত্রিয় ও গৌণকুলীন ব্যতিরিক্ত আর একপ্রকার ব্রাহ্মণ আছেন, তাঁহাদের নাম বংশজ। এরূপ নির্দিষ্ট আছে, ব্রাহ্মণদিগকে শ্রেণীবদ্ধ করিবার সময়, বল্লালের মুখ হইতে বংশজশব্দ নির্গত হইয়াছিল এইমাত্র; বাস্তবিক, তিনি কোনও ব্রাহ্মণদিগকে বংশজ বলিয়া স্বতন্ত্র শ্রেণীতে বিভক্ত করেন নাই; উত্তর কালে বংশজব্যবস্থা হইয়াছে। যে সকল কুলীনের কন্যা ঘটনাক্রমে শ্রোত্রিয়গৃহে বিবাহিতা হইল, তাঁহারা কুলভ্রষ্ট হইতে লাগিলেন। এই রূপে যাঁহাদের কুলভ্রংশ ঘটিল, তাহারা বংশজসংজ্ঞাভাজন ও মর্য্যাদাবিষয়ে গৌণ কুলীনের সমকক্ষ হইলেন; অর্থাৎ, গৌণ কুলীনের কন্যা গ্রহণ করিলে যেমন কুলক্ষয় হইয়া যায়, বংশজকন্যা গ্রহণ করিলেও কুলীনের সেইরূপ কুলক্ষয় ঘটে। এতদনুসারে বংশজ ত্রিবিধ,—প্রথম, শ্রোত্রিয় পাত্রে কন্যাদাভা কুলীন বংশজ; দ্বিতীয়, গৌণ কুলীনের কন্যাগ্রাহী কুলীন বংশজ; তৃতীয়, বংশজের কন্যাগ্রাহী কুলীন বংশজ। স্থুল কথা এই, কোনও ক্রমে কুলক্ষয় হইলেই, কুলীন বংশজভাবাপন্ন হইয়া থাকেন[২২]।
কৌলীন্যমর্যাদা ব্যবস্থাপিত হইলে, এতদ্দেশীয় ব্রাহ্মণেরা পাঁচ শ্রেণীতে বিভক্ত হইলেন—প্রথম, কুলী; দ্বিতীয়, শ্রোত্রিয়; তৃতীয়, বংশজ; চতুর্থ, গৌণ কুলীন; পঞ্চম, পঞ্চগোত্রবহির্ভূত সপ্তশতী সম্প্রদায়।
কালক্রমে, গৌণ কুলীনেরা শ্রোত্রিয়শ্রেণীতে নিবেশিত হইলেন, কিন্তু সর্ব্বাংশে শ্রোত্রিয়দিগের সমান হইতে পারিলেন না। প্রকৃত শ্রোত্রিয়েরা শুদ্ধ শ্রোত্রিয়, ও গৌণ কুলীনেরা কষ্ট শ্রোত্রিয়, বলিয়া উল্লিখিত হইতে লাগিলেন। গৌণকুলীনসংজ্ঞকালে তাঁহারা যেরূপ হেয় ও অশ্রদ্ধেয় ছিলেন, কষ্টশ্রোত্রিয়সংজ্ঞাকালেও সেইরূপ রহিলেন।
কৌলীন্যমর্য্যাদাব্যবস্থাপনের পর, ১০ পুরুষ গত হইলে, দেবীবর ধটকবিশারদ কুলীনদিগকে মেলবদ্ধ করেন। যে আচার, বিনয়, বিদ্যা প্রভৃতি গুণ দেখিয়া, বল্লাল ব্রাহ্মণদিগকে কৌলীন্যমর্যাদা প্রদান করিয়াছিলেন, ক্রমে ক্রমে তাহার অধিকাংশই লোপাপত্তি পায়; কেবল আবৃত্তিগুণমাত্রে কুলীনদিগের যত্ন ও আস্থা থাকে। কিন্তু, দেবীবরের সময়ে, কুলীনেরা এই গুণেও জলাঞ্জলি দিয়াছিলেন। বল্লালদত্ত কুলমর্য্যাদার আদানপ্রদানের বিশুদ্ধিরূপ একমাত্র অবলম্বন ছিল, তাহাও লয়প্রাপ্ত হয়। যে সকল দোষে এককালে কুল নির্মূল হয়, কুলীনত্রেই সেই সমস্ত দোষে দুষিত হইয়াছিলেন। যে যে কুলীন একবিধ দোবে দূষিত, দেবীবর তঁহাদিগকে এক সম্প্রদায়ে নিবিষ্ট করেন। সেই সম্প্রদায়ের নাম মেল। মেলশব্দের অর্থ দোষমেলন, অর্থাৎ দোষানুসারে সম্প্রদায়বন্ধন[২৩]। দেবীবর ব্যবস্থা করেন, দোষ যায় কুল তায়[২৪]। বল্লাল গুণ দেখিয়া কুলমর্য্যাদার ব্যবস্থা করিয়াছিলেন; দেবীবর দোষ দেখিয়া কুলমর্য্য্যাদার ব্যবস্থা করিয়াছেন। পৃথক্ পৃথক্ দোষ অনুসারে, দেবীবর তৎকালীন কুলীদিগকে ৩৬ মেলে[২৫] বদ্ধ করেন। তন্মধ্যে ফুলিয়া ও খড়দহ মেলের প্রাদুর্ভাব অধিক। এই দুই মেলের লোকেরাই প্রধান কুলীন বলিয়া পরিগণিত হইয়া থাকেন। এবং, এই দুই মেলের লোকেরাই, যার পর নাই, অত্যাচারকারী হইয়া উঠিয়াছেন। যে যে দোষে এই দুই মেল বদ্ধ হয়, তাহা উল্লিখিত হইতেছে।
গঙ্গানন্দমুখোপাধ্যায় ও শ্রীপতিবন্দ্যোপাধ্যায় উভয়ে একৰি দোষে লিপ্ত ছিলেন; এজন্য, দেবীবর এই দুয়ে ফুলিয়ামেল বদ্ধ করেন। নাধা, বন্ধ, বারুইহাটী, মুলুকজুরী এই দোষচতুষ্টয়ে ফুলিয়ামেল বদ্ধ হয়। নাধানামকস্থানবাসী বন্দ্যোপাধ্যায়েরা বংশজ ছিলেন; গঙ্গানন্দের পিতা মনোহর তাঁহাদের বাটীতে বিবাহ করেন। এই বংশজ- কন্যাবিবাহ দ্বারা তাঁহার কুলক্ষয় ও বংশজভাবাপত্তি ঘটে। মনোহরের কুলরক্ষার্থে, ঘটকেরা পরামর্শ করিয়া নাধার বন্দ্যোপাধ্যায়দিগকে শ্রোত্রিয় করিয়া দিলেন। তদবধি নাধার বন্দ্যোপাধ্যায়েরা, বাস্তবিক বংশজ হইয়াও, মাষচটকনামে শ্রোত্রিয় বলিয়া পরিগণিত হইতে লাগিলেন। বস্তুতঃ, এই বিবাহ দ্বারা মনোহরের কুলক্ষয় ঘটিয়াছিল, কেবল ঘটকদিগের অনুগ্রহে কথঞ্চিৎ কুলরক্ষা হইল। ইহার নাম নাধাদোষ। শ্রীনাথচট্টোপাধ্যায়ের দুই অবিবাহিতা দুহিতা ছিল। হাঁইনামক মুসলমান, ধন্ধনামক স্থানে, বলপূর্ব্বক ঐ দুই কন্যার জাতিপাত করে। পরে, এক কন্যা কংসারিতনয় পরমানন্দ পূতিতুণ্ড, আর এক কন্যা গঙ্গাবরবন্দ্যোপাধ্যায় বিবাহ করেন। এই গঙ্গাবরের সহিত নীলকণ্ঠ গঙ্গোর আদানপ্রদান হয়। নীলকণ্ঠগঙ্গোর সহিত আদানপ্রদান দ্বারা, গঙ্গানন্দও যবনদোষে দূষিত হয়েন। ইহার নাম ধন্ধদোষ[২৬]। বারুইহাটীগ্রামে ভোজন করিলে, ব্রাহ্মণের জাতিভ্রংশ ঘটিত। কাঁচনায় মুখুটী অর্জুনমিশ্র ঐ গ্রামে ভোজন করিয়াছিলেন। শ্রীপতিবন্দ্যোপাধ্যায় তাঁহার সহিত আদানপ্রদান করেন। এই শ্রীপতিরন্দ্যোপাধ্যায়ের সহিত আদানপ্রদান দ্বারা গঙ্গানন্দও তদ্দোষে দূষিত হয়েন। ইহার নাম বারুইহাটীদোষ। গঙ্গানন্দভ্রাতৃপুত্র শিবাচার্য্য, মুলুকজুরীকন্যা বিবাহ করিয়া, কুলভ্রষ্ট ও সপ্তশতীভাবাপন্ন হন; পরে শ্রীপতিবন্দ্যোপাধ্যায়ের কন্যা বিবাহ করেন। ইহার নাম মুলুকজুরীদোষ।
যোগেশ্বর পণ্ডিত ও মধুচট্টোপাধ্যায়, উভয়ে একবিধ দোযে লিপ্ত ছিলেন; এজন্য এই দুয়ে খড়দহমেল বন্ধ হয়। যোগেশ্বরের পিতা হরিমুখোপাধ্যায় গড়গড়িকন্যা, যোগেশ্বর নিজে পিপলাই কন্যা, বিবাহ করেন। মধুচট্টোপাধ্যায় ডিংসাই রায় পরমানন্দের কন্যা বিবাহ করেন। যোগেশ্বর এই মধুচট্টোকে কন্যাদান করিয়াছিলেন।
বংশজ, গৌণ কুলীন ও সপ্তশতী সম্প্রদায়ের কন্যা বিবাহ করিলে, এক কালে কুলক্ষয় ও বংশজভাবাপত্তি ঘটে। ফুলিয়ামেলের প্রকৃতি গঙ্গানন্দমুখোপাধ্যায়ের পিতা মনোহর বংশজকন্যা বিবাহ করেন; গঙ্গানন্দভ্রাতৃপুত্র শিৱাচার্য্য মুলুকজুরীকন্যা বিবাহ করেন। খড়দহমেলের প্রকৃতি যোগেশ্বর পণ্ডিতের পিতা হরিমুখোপাধ্যায় গড়গড়িকন্যা, যোগেশ্বর নিজে পিপলাইন্যা, আর মধুচট্টোপাধ্যায় ডিংসাইকন্যা, বিবাহ করেন। মুলুকজুরী পঞ্চগোত্রবহির্ভূত সপ্তশতী- সম্প্রদায়ের অন্তর্বর্ত্তী; গড়গড়ি, পিপলাই ও ডিংসাই গৌণ কুলীন। ফুলিয়া ও খড়দহ মেলের লোকেরা কুলীন বলিয়া যে অভিমান করেন, তাহা সম্পূর্ণ ভ্রান্তিমুলক; কারণ, বংশজ, গৌণ কুলীন ও সপ্তশতী কন্যা বিবাহ দ্বারা বহু কাল তাঁহাদের কুলক্ষয় ও বংশজ- ভাবাপত্তি ঘটিয়াছে। অধিকন্তু, যবনদোষস্পর্শবশতঃ, ফুলিয়ামেলের লোকদিগের জাতিভ্রংশ হইয়া গিয়াছে। এইরূপ, সকল মেলের লোকেরাই কুবিবাহাদিদোষে কুলভ্রষ্ট ও বংশজভাবাপন্ন হইয়া গিয়াছেন। ফলতঃ, মেলবন্ধনের পূর্ব্বেই বল্লাল প্রতিষ্ঠিত কুলমর্য্যাদার লোপাপত্তি হইয়াছে। এক্ষণে যাঁহারা কুলীন বলিয়া অভিমান করেন, তাঁহারা বাস্তবিক বহু কালের বংশজ। যাঁহাৱা বংশজ বলিয়া পরিগণিত হইয়া থাকেন, কৌলীন্যপ্রথার নিয়মানুসারে, ভঁহাদের সহিত ইদানীন্তন কুলাভিমানী বংশজদিগের কোনও অংশে কিছুমাত্র বিভিন্নতা নাই[২৭]।
যেরূপ দর্শিত হইল, তদনুসারে বহু কাল রাঢ়ীয় ব্রাহ্মণদিগের কৌলীন্যমর্য্যাদা লয়প্রাপ্ত হইয়াছে। কৌলীন্যের নিয়মানুসারে কুলীন বলিয়া গণনীয় হইতে পারেন, ইদানীং ঈদৃশ ব্যক্তিই অপ্রাপ্য ও অপ্রসিদ্ধ। অতএব, যখন কুলীনের একান্ত অসদ্ভাব ঘটিয়াছে, তখন, বহুবিবাহপ্রথা নিবারিত হইলে, কুলীনদিগের জাতিপাত ও ধর্ম্মলোপ ঘটিৰেক, এই আপত্তি কোনও মতে ন্যায়োপেত বলিয়া অঙ্গীকৃত হইতে পারে না।
দেবীবর যে যে ঘর লইয়া মেল বদ্ধ করেন, সেই সেই ঘরে আদান প্রদান ব্যবস্থাপিত হয়। মেলবন্ধনের পূর্ব্বে, কুলীনদিগের আট ঘরে পরস্পর আদান প্রদান প্রচলিত ছিল। ইহাকে সর্ব্বদ্বারী বিবাহ কহিত। তৎকালে আদান প্রদানের কিছুমাত্র অসুবিধা ছিল না। এক ব্যক্তির অকারণে একাধিক বিবাহ করিবার আবশ্যকতা ঘটিত না, এবং কোনও কুলীনকন্যাকে যাবজ্জীবন অবিবাহিত অবস্থায় কালযাপন করিতে হইত না। এক্ষণে, অল্প ঘরে মেল বদ্ধ হওয়াতে, কাল্পনিককুলরক্ষার্থে, এক পাত্রে অনেক কন্যাদান অপরিহার্য্য হইয়া উঠিল। এই রূপে, দেবীবরের কুলীনদিগের মধ্যে বহু বিবাহের সূত্রপাত হইল।
অবিবাহিত অবস্থায় কন্যার ঋতুদর্শন শাস্ত্রানুসারে ঘোরতরপাতক- জনক। কাশ্যপ কহিয়াছেন,
পিতুর্গেহে চ য়া কন্যা রজঃ পশ্যত্যসংস্কৃতা।
ভ্রূণহত্যা পিতুস্তস্যাঃ সা কন্যা বৃষলী স্মৃতা॥
যস্তু তাং বরয়েৎ কন্যাং ব্রাহ্মণো জ্ঞানদুর্বলঃ।
অশ্রাদ্ধেয়মপাংক্তেয়ং তং বিদ্যাদ্বৃযলীপতিম্॥(২৮)[২৮]
যে কন্যা বিবাহিত অবস্থায় পিতৃগৃহে রিজস্বলা হয়, তাহার তাহার পিতা ভ্রূণহত্যাপাপে লিপ্ত হন। সেই কন্যাকে বৃষলী বলে। যে জ্ঞানহীন ব্রাহ্মণ সেই কন্যার পাণিগ্রহণ করে, সে অশ্রাদ্ধেও[২৯], অপাংক্তেয়[৩০] ও বৃষলীপতি।
যম কহিয়াছেন।
মত চৈব পিতা চৈব জ্যেষ্ঠো ভ্রাতা তথৈব চ।
ত্রয়ন্তে নরকং যান্তি দৃষ্ট্বা কন্যাং রজস্বলাম্॥ ২৩॥
যস্তাং বিবাহয়েৎ কন্যাং ব্রাহ্মণো মদমোহিতঃ।
অসম্ভাষ্যো হপ্যাংক্তেয়ঃ স বিপ্রো বৃষলীপতিঃ॥২৪॥[৩১]
কন্যাকে অবিবাহিত অবস্থায় রজস্বলা দেখিলে, মাতা, পিতা, জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা, এই তিন জন নরকগামী হয়েন। যে ব্রাহ্মণ, অজ্ঞানান্ধ হইয়া, সেই কন্যাকে বিবাহ করে, সে অসম্ভাষ্য,[৩২] অপাংক্তেয় ও বৃষলীপতি।
পৈঠীনসি কহিয়াছেন,:যাবন্নোদ্ভিদ্যতে স্তনৌ তাবদেব দেয়া। অথ ঋতুমতী ভবতি দাতা প্রতিগ্রহীতা চ নরকমাপ্নোতি পিতৃপিতামহপ্রপিতামহাশ্চ বিষ্ঠায়াং জায়ন্তে। তস্মান্নগ্নিকা দাতব্যা॥[৩৩]
স্তনপ্রকাশের পূর্বেই কন্যাদান করিবেক। যদি কন্যা বিবাহের পূর্ব্বে ঋতুমতী হয়, দাতা ও গ্রহীতা উভয়ে নরকগামী হয়, এবং পিতা, পিতামহ, প্রপিতামহ বিষ্ঠায় জন্মগ্রহণ করেন। অতএব ঋতুদর্শনের পূর্ব্বেই কন্যাদান করিবেক।
ব্যাস কহিয়াছেন,
যদি সা দাতৃবৈকল্যাদ্রজঃ পশ্যেৎ কুমারিকা।
ভ্রুণহত্যাশ্চ তাবত্যঃ পতিতঃ স্যাভদপ্রদঃ॥[৩৪]
যে ব্যক্তি দানাধিকারী, যদি তাহার দোষে কুমারী ঋতুদর্শন করে; তবে, সেই কুমারী অবিবাহিত অবস্থায় যত বার ঋতুমতী হয়, তিনি তত বার ভ্রণহত্যাপাপে লিপ্ত, এবং যথাকালে তাহার বিবাহ না দেওয়াতে, পতিত হন।
অবিবাহিত অবস্থায় কন্যার ঋতুদর্শন ও ঋতুমতী কন্যার পাণিগ্রহণ এক্ষণকার কুলীনদিগের গৃহে সচরাচর ঘটনা। কুলীনেরা, দেবীবরের কপোলকল্পিত প্রথার আজ্ঞাবর্ত্তী হইয়া, ঘোরতর পাতকগ্রস্ত হইতেছেন। শাস্ত্রানুসারে বিবেচনা করিতে গেলে, তাঁহারা বহু কাল পতিত ও ধর্ম্মচ্যুত হইয়াছেন[৩৫]।
কুলীনমহাশয়েরা যে কুলের অহঙ্কারে মত্ত হইয়া আছেন, তাহা বিধাতার সৃষ্টি নহে। বিধাতার সৃষ্টি হইলে, সে বিষয়ে স্বতন্ত্র বিবেচনা করিতে হইত। এ দেশের ব্রাহ্মণেরা বিদ্যাহীন ও আচারভ্রষ্ট হইতেছিলেন। যাহাতে তাঁহাদের মধ্যে বিদ্যা, সদাচার প্রভৃতি গুণের আদর থাকে, এক রাজা তাহার উপায়স্বরূপ কুলমর্য্যাদা ব্যবস্থা, এবং কুলমর্য্যাদা রক্ষার উপায়স্বরূপ কতকগুলি নিয়ম সংস্থাপন, করেন। সেই রাজপ্রতিষ্ঠিত নিয়ম অনুসারে বিবেচনা করিয়া দেখিলে, কুবিবাহাদি দোষে বহু কাল কুলীনমাত্রের কুলক্ষয় হইয়া গিয়াছে। যখন, রাজপ্রতিষ্ঠিত নিয়ম অনুসারে, রাজদন্ত কুলমর্য্যাদার উচ্ছেদ হইয়াছে, তখন কুলীনম্মন্য মহাপুরুষদিগের ইদানীন্তন কুলাভিমান নিরবচ্ছিন্ন ভ্রান্তিমাত্র। অনন্তর, দেবীবর যেরূপে যে অবস্থায় কুলের ব্যবস্থা করিয়াছেন, তাহাতে কুলীনগণের অহঙ্কার করিবার কোনও হেতু দেখিতে পাওয়া যায় না। কুলীনেরা সুবোধ হইলে, অহঙ্কার না করিয়া, বরং তাদৃশ কুলের পরিচয় দিতে লজ্জিত হইতেন। লজ্জিত হওয়া দূরে থাকুক, সেই কুলের অভিমানে, শাস্ত্রের মস্তকে পদার্পণ করিয়া, স্বয়ং নরকগামী হইতেছেন, এবং পিতা, পিতামহ, প্রপিতামহ, তিন পুরুষকে পরলোকে বিষ্ঠাহ্রদে বাস করাইতেছেন। ধন্য রে অভিমান! তোর প্রভাব ও মহিমার ইয়ত্তা নাই। তুই মনুষ্যজাতির অতি বিষম শত্রু। তোর কুহকে পড়িলে, সম্পূর্ণ মতিচ্ছন্ন ঘটে। হিতাহিতবোধ, ধর্ম্মাধর্ম্মবিবেচনা একবারে অন্তর্হিত হয়।
কৌলীন্যমর্য্যাদাব্যবস্থাপনের পর, দশ পুরুষ গত হইলে, দেবীবর, কুলীনদিগের মধ্যে নানা বিশৃঙ্খলা উপস্থিত দেখিয়া, মেলবন্ধন দ্বারা নূতন প্রণালী সংস্থাপন করেন। এক্ষণে, মেলবন্ধনের সময় হইতে দশ পুরুষ অর্তীত হইয়াছে[৩৬]; এবং কুলীনদিগের মধ্যে নানা বিশৃঙ্খলাও ঘটিয়াছে। সুতরাং পুনরায় কোনও নূতন প্রণালী সংস্থাপনের সময় উপস্থিত হইয়াছে। প্রথমতঃ, ব্রাহ্মণদিগের মধ্যে বিশৃঙ্খলা উপস্থিত দেখিয়া, বল্লালসেন তন্নিবারণাভিপ্রায়ে কৌলীন্যমর্য্যাদা সংস্থাপন করেন। তৎপরে, কুলীনদিগের মধ্যে বিশৃঙ্খলা উপস্থিত দেখিয়া, দেবীবর তন্নিবারণাশয়ে মেলবন্ধন করেন। এক্ষণে, কুলীনদিগের মধ্যে যে অশেষবিধ বিশৃঙ্খলা উপস্থিত হইয়াছে, কুলাভিমান পরিত্যাগ ভিন্ন তন্নিবারণের আর সদুপায় নাই। যদি তাঁহারা সুবোষ, ধর্ম্মভীরু ও আত্মমঙ্গলাকাঙক্ষী হন, অকিঞ্চিৎকর কুলাভিমানে বিসর্জ্জন দিয়া, কুলীননামের কলঙ্ক বিমোচন করুন। আর, যদি তাঁহারা কুলাভিমান পরিত্যাগ নিতান্ত অসাধ্য বা একান্ত অবিধেয় বোধ করেন, তবে তাঁহাদের পক্ষে কোনও নূতন ব্যবস্থা অবলম্বন করা আবশ্যক। এ অবস্থায়, বোধ হয়, পুনরায় সর্ব্বদ্বারী বিবাহ প্রচলিত হওয়া ভিন্ন, কুলীনদিগের পরিত্রাণের পথ নাই। এই পথ অবলম্বন করিলে, কোনও কুলীনের অকারণে একাধিক বিবাহের আবশ্যকতা থাকিবে না; কোনও কুলীনকন্যাকে, যাবজ্জীবন বা দীর্ঘ কাল অবিবাহিত অবস্থায় থাকিয়া, পিতাকে নরকগামী করিতে হইবেক না; এবং রাজনিয়ম দ্বারা বহুবিবাহ প্রথা নিবারিত হইলে, কোনও ক্ষতি বা অসুবিধা ঘটিবেক না। এ বিষয়ে কুলীনদিগের ও কুলীনপক্ষপাতী মহাশয়দিগের যত্ন ও মনোযোগ করা কর্ত্তব্য। অনিষ্টকর, অধর্ম্মকর কুলাভিমানের রক্ষাবিষয়ে, অন্ধ ও অবোধেদের ন্যায়, সহায়তা করা অপেক্ষা, যে সকল দোষ বশতঃ কুলীনদিগের ধর্ম্মলোপ ও যার পর নাই অনিষ্টসংঘটন হইতেছে, সেই সমস্ত দোষের সংশোধনপক্ষে যত্নবান্ হইলে, কুলীনপক্ষপাতী মহাশয়দিগের বুদ্ধি, বিবেচনা ও ধর্ম্মের অনুযায়ী কর্ম্ম করা হইবেক।
ইদানীন্তন কুলাভিমানী মহাপুরুষেরা কুলীন বলিয়া অভিমান করিতেছেন, এবং দেশস্থ লোকের পুজনীয় হইতেছেন। যদি তদীয় চরিত্র বিশুদ্ধ ও ধর্ম্মমার্গানুযায়ী হইত, তবে তাহাতে কেহ কোনও ক্ষতিবোধ বা আপত্তি উত্থাপন করিত না। কিন্তু তাঁহাদের আচরণ, যার পর নাই, জঘন্য ও ঘৃণাস্পদ হইয়া উঠিয়াছে। তাঁহাদের আচরণবিষয়ে লোকসমাজে শত শত উপাখ্যান প্রচলিত আছে; এস্থলে সে সকলের উল্লেখ করা নিষ্প্রয়োজন। ফলকথা এই, দয়া, ধর্ম্মভয়, লোকলজ্জা প্রভৃতি একবারে তাঁহাদের হৃদয় হইতে অন্তর্হিত হইয়া গিয়াছে। কন্যাসন্তানের সুখদুঃখগণনা বা হিতাহিতবিবেচনা তদীয় চিত্তে কদাচ স্থান পায় না। কন্যা যাহাতে করণীয় ঘরে অর্পিত হয়, কেবল তদ্বিষয়ে দৃষ্টি থাকে। অঘরে অর্পিতা হইলে কন্যা কুলক্ষয়কারিণী হয়; এজন্য, কন্যার কি দশা হইবেক, সে দিকে দৃষ্টিপাত না করিয়া, যেন তেন প্রকারেণ, কন্যাকে পাত্রসাৎ করিতে পারিলেই, তাঁহারা চরিতার্থ হয়েন। অবিবাহিত অবস্থায়, কন্যা বাটী হইতে বহির্গত হইয়া গেলে, তাঁহাদের কুলক্ষয় ঘটে; বাটীতে থাকিয়া, ব্যভিচারদোষে আক্রান্ত ও ভ্রূণহত্যাপাপে বারংবার লিপ্ত হইলে, কোনও দোষ ও হানি নাই। কঞ্চিৎ কুলরক্ষা করিয়া, অর্থাৎ বিবাহিতা হইয়া, কন্যা বারাঙ্গনাবৃত্তি অবলম্বন করিলে, তাঁহাদের কিঞ্চিন্মাত্র ক্ষোভ, লজ্জা বা ক্ষতিবোধ হয় না। তাহার কারণ এই যে, এ সকল ঘটনায় কুললক্ষী বিচলিত হয়েন না। যদি কুললক্ষী বিচলিতা না হইলেন, তাহা হইলেই তাঁহাদের সকল দিক রক্ষা হইল। কুললক্ষীরও তাঁহাদের উপর নিরতিশয় স্নেহ ও অপরিসীম দয়া। তিনি, কোনও ক্রমে, সেই স্নেহ ও সেই দয়া পরিত্যাগ করিতে পারেন না। এ স্থলে, কুললক্ষীর স্নেহ,ও দয়ার একটি আশ্চর্য্য উদাহরণ প্রদর্শিত হইতেছে।
অমুক গ্রামে অমুক নামে একটি প্রধান কুলীন ছিলেন। তিনি তিন চারিটি বিবাহ করেন। অমুক গ্রামে যে বিবাহ হয়, তাহাতে তাঁহার দুই কন্যা জন্মে। কন্যার জন্মাবধি মাতুলালয়ে থাকিয়া প্রতি- পালিত হইয়াছিল। মাতুলেরা ভাগিনেয়ীদের প্রতিপালন করিতেছেন ও যথাকালে বিবাহ দিবেন এই স্থির করিয়া, পিতা নিশ্চিন্ত খার্কিতেন, কোনও কালে তাহাদের কোনও তত্ত্বাবধান করিতেন না। দুর্ভাগ্যক্রমে, মাতুলদের অবস্থা ক্ষুন্ন হওয়াতে, তাঁহারা ভাগিনেয়ীদের বিবাহকার্য্য নির্ব্বাহ করিতে পারেন নাই। প্রথম কন্যার বয়ঃক্রম ১৮। ১৯ বৎসর, দ্বিতীয়টির বয়ঃক্রম ১৫|১৬ বৎসর, এই সময়ে কোনও ব্যক্তি ভুলাইয়া তাহাদিগকে বাট হইতে বাহির করিয়া লইয়া যায়।
প্রায় এক পক্ষ অতীত হইলে, তাহাদের পিতা এই দুর্ঘটনার সংবাদ পাইলেন, এবং কিঙ্কর্ত্তব্যবিমূঢ় হইয়া, এক আত্মীয়ের সহিত পরামর্শ করিবার নিমিত্ত, কলিকাতায় আগমন করিলেন। আত্মীয়ের নিকট এই দুর্ঘটনায় বৃত্তান্ত বর্ণন করিয়া, তিনি গলদশ্রু লোচনে আকুল বচনে কহিতে লাগিলেন, ভাই এত কালের পর আমায় কুললক্ষী পরিত্যাগ করিলেন; আর আমার জীবনধারণ বৃথা; আমি অতি হতভাগ্য, নতুবা কুললক্ষী বাম হইবেন কেন। আত্মীয় কহিলেন, তুমি যে কখনও কন্যাদের কোনও সংবাদ লও নাই, এ তোমার সেই পাপের প্রতিফল। যাহা হউক, কুলীন ঠাকুর, অনেক ভাবিয়া চিন্তিয়া, অবশেষে কন্যা- পহারীর শরণাগত হইলেন এবং প্রার্থনা করিলেন, আপনি দয়া করিয়া তিন মাসের জন্য কন্যা দুটি দেন, আমি তিন মাস পরে উহাদিগকে আপনার নিকট পঁহুছাইয়া দিব। কন্যাপহারী যাঁহাদের অনুরোধ রক্ষা করেন, এরূপ অনেক ব্যক্তি, কুলীনঠাকুরের কাতরতা দর্শনে ও আর্ত্তবাক্য শ্রবণে অনুকম্পাপরতন্ত্র হইয়া, অনেক অনুরোধ করিয়া, তিন মাসের জন্য, সেই দুই কন্যাকে পিতৃহস্তে সমর্পণ করাইলেন। তিনি, চরিতার্থ হইয়া, তাদের দুই ভাগনীকে আপন বসতিস্থানে লইয়া গেলেন, এবং এক ব্যক্তি, অঘরে বিবাহ দিবার জন্য, চুরী করিয়া লইয়া গিয়াছিল; অনেক যত্নে, অনেক কৌশলে, ইহাদের উদ্ধার করিয়াছি, ইহা প্রচার করিয়া দিলেন। কন্যাৱা না পলায়ন করিতে পারে, এজন্য, এক রক্ষক নিযুক্ত করিলেন। সে সর্ব্বক্ষণ তাহাদের রক্ষণাবেক্ষণ করিতে লাগিল।
এইরূপ ব্যবস্থা করিয়া, কুলীনঠাকুর অর্থের সংগ্রহ ও বরের অন্বেষণ করিবার নিমিত্ত নির্গত হইলেন এবং এক মাস পরে, ভাদ্রমাসের শেষে, বিবাহোপযোগী অর্থ সংগ্রহপূর্ব্বক এক ষষ্টিবর্ষীয় বর সমভিব্যাহারে বাটীতে প্রত্যাগমন করিলেন। বর কন্যাদের চরিত্রবিষয়ে কিঞ্চিৎ জানিতে পারিয়াছিলেন; এজন্য, নিয়মিত অপেক্ষা অধিক দক্ষিণা না পাইয়া, কুলীনঠাকুরের কুলরক্ষা করিতে সম্মত হইলেন না। পর রাত্রিতেই সম্প্রদানক্রিয়া সম্পন্ন হইয়া গেল। কুলীনঠাকুরের কুলরক্ষা হইল। যাঁহাৱা বিবাহক্ষেত্রে উপস্থিত ছিলেন, স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করিয়াছেন, কুললক্ষী বিচলিত হইলেন না, এই আহ্লাদে ব্রাহ্মণের নয়নযুগলে অশ্রুধারা বহিতে লাগিল।
পর দিন প্রভাত হইবামাত্র, বর স্বস্থানে প্রস্থান করিলেন। কতিপয় দিবস অতীত হইলে, বিবাহিতা কুলবালারাও অন্তর্হিতা হইলেন। তদবধি আর কেহ তাঁহাদের কোনও সংবাদ লয় নাই; এবং, সংবাদ লইবার আবশ্যকতাও ছিল না। তাঁহারা পিতার কুলরক্ষা করিয়াছেন। অতঃপর যথেচ্ছাচারিণী হইলে, পিতার কুলোচ্ছেদের আশঙ্কা নাই। বিশেষতঃ, তিনি কন্যাপহারীর নিকট অঙ্গীকার করিয়াছিলেন, তিন মাস পরে কন্যাদিগকে তাঁহার নিকট পঁহুছাইয়া দিবেন। বিবাহের অব্যবহিত পরেই, প্রতিশ্রুত সময় উত্তীর্ণ হইয়া যায়। সে যাহা হউক, কুলীনঠাকুর কুললক্ষীর স্নেহ ও দয়ায় বঞ্চিত হইলেন না, ইহাই পরম সৌভাগ্যের বিষয়। চঞ্চলা বলিয়া লক্ষীর বিলক্ষণ অপবাদ আছে। কিন্তু কুলীনের কুললক্ষী সে অপবাদের আস্পদ নহেন।
অনেকেই এই ঘটনার সবিশেষ বিবরণ অবগত হইয়াছিলেন, কিন্তু, তজ্জন্য, কে কুলীনঠাকুরের প্রতি অশ্রদ্ধা বা অনাদর প্রদর্শন করেন নাই।
- আদিসুরো নবনবর্ত্যধিকনবশতীশতাব্দে পঞ্চ ব্রাক্ষণামানায়য়ামাসু।
কৃষ্ণচন্দ্রচরিত্র। - ভট্টনারায়ণো দক্ষো বেদগর্ভোহথ ছান্দড়ঃ।
অথ শ্রীহর্ষনামা চ কান্যকুব্জাৎ সমাগতাঃ॥
শাণ্ডিল্যগোত্রজশ্রেষ্ঠো ভট্টনারায়ণঃ কবিঃ।
দক্ষোহথ কাশ্যপশ্রেষ্ঠো বাৎস্যশ্রেষ্ঠোহথ ছান্দড়ঃ॥
ভরদ্বাজকুলশ্রেষ্ঠ শ্রীহর্ষে’হর্ষবর্জনঃ।
বেদর্গর্ভোহথ সাবর্ণো যথা বেদ ইতি স্মৃতঃ॥ - বিক্রমপুরের লোকে বলেন, বল্লালসেনের বাটীর দক্ষিণে যে দিঘী আছে, তাহার উত্তর পাড়ে পাকা ঘাটের উপর ঐ বৃক্ষ অদ্যাপি সজীব আছে। বৃক্ষ অতি বৃহৎ; নাম গজারিবৃক্ষ। এজাতীয় বৃক্ষ বিক্রমপুরের আর কোথাও নাই। ময়মনসিংহ জিলার মধুপুর পাহাড় ভিন্ন অন্যত্র কুত্রাপি লক্ষিত হয় না। মল্লকাষ্ঠ স্থলে অনেকে গজের আলানস্তম্ভ বলিয়া উল্লেখ করিয়া থাকেন।
- এই উপাখ্যান সচরাচর যেরূপ উল্লিখিত হইয়া থাকে, অবিকল সেইরূপ নির্দিষ্ট হইল।
- পঞ্চকোটি কামকোটির্হরিকোটিস্তথৈব চ।
কঙ্কগ্রামো বটগ্রামস্তেষাং স্থানানি পঞ্চ চ॥ - ভট্টতঃ ষোড়শোদ্ভুাত দক্ষতশ্চাপি ষোড়শ।
চত্বারঃ শ্রীহর্ষজাতা দ্বাদশ বেদগর্ভতঃ॥
অষ্টারথ পরিজ্ঞেয়া উদ্ভুতাশ্ছান্দড়ান্মুনেঃ॥ - বন্দ্যঃ কুসুমো দীর্ঘাঙ্গী ঘোষলী বটব্যালকঃ।
পারী কুলী কুশারিশ্চ কুলভিঃ সেয়কো গড়ঃ।
আকাশঃ কেশরী মাষো বসুয়ারিঃ করালকঃ।
ভট্টবংশোদ্ভবা এতে শাণ্ডিল্যে ষোড়শ স্মৃতাঃ॥ - চট্টোতম্বুলী তৈলবাটী পোড়ারির্হড়গূড়াকৌ।
ভূরিশ্চ পালধিশ্চৈব পৰ্কটিঃ পুষলী তথা।
মূলগ্রামী কোয়ারী চ পলসায়ী চ পীতকঃ।
সিমলায়ী তথা ভট্ট ইমে কাশ্যপসংজ্ঞকাঃ॥ - আদৌ মুখটী ডিণ্ডী চ সাহরী রাইকস্তথা।
ভারদ্বাজা ইমে জাতাঃ শ্রীহর্ষস্যতনূদ্ভবাঃ॥ - গাঙ্গুলিঃ পুংসিকো নন্দী ঘণ্টা কুন্দ সিয়ারিকাঃ।
সাটা দায়ী তথা নায়ী পারী বালী চ সিদ্ধলঃ।
বেদগর্ভোদ্ভবা এতে সাবর্ণে দ্বাদশ স্মৃতাঃ॥ - কাঞ্জিবিল্লী মহিস্তা চ পূতিতুণ্ডশ্চ পিপ্পলী।
ঘোষালো বাপুিলিশ্চৈব কাঞ্জারী চ তথৈব চ।
সিমলালশ্চ বিজ্ঞেয়া ইমে বাৎস্যকসংজ্যকাঃ॥ - আদিসূরের বংশধ্বংস সেনবংশ তাজা।
বিক্ষক্সেনের ক্ষেত্রজ পুত্র বল্লালসেন রাজা॥ - আচারো বিনয়ো বিদ্যা প্রতিষ্ঠা তীর্থদর্শনম্।
নিষ্ঠাবৃত্তিন্তপো দানং নবধা কুললক্ষণম্॥
এরূপ প্রবাদ আছে, পুর্ব্বে নিষ্ঠা শান্তিস্তপো দানম্ এইরূপ পাঠ ছিল; পরে, বল্লালকালীন ঘটকেরা শান্তিশব্দস্থলে আবৃত্তিশব্দ নিবেশিত করিয়াছেন। - আদানঞ্চ প্রদানঞ্চ কুশত্যাগস্তথৈব চ।
প্রতিজ্ঞা ঘটকাগ্রেষু পরিবর্ত্তশ্চতুর্বিধঃ॥ - বন্দ্যশ্চট্টোহথ মুখুটী ঘোষালশ্চ ততঃ পরঃ।
পুতিতুণ্ডশ্চ গাঙ্গুলিঃ কাঞ্জিঃ কুন্দেন চাষ্টমঃ। - বহুরূপঃ সুচো নাম্না অরবিন্দো হলায়ুধঃ।
বাঙ্গালশ্চ সমাখ্যাতাঃ পঞ্চৈতে চট্টবংশজাঃ।
পুতির্গোবর্দ্ধনাচার্য্যঃ শিরো ঘোষালসম্ভবঃ।
গাঙ্গুলীয়ঃ শিশো নাম্না কুন্দো রোষাকরোহপিচ॥
জাহ্লনাখ্যস্তথা বন্দ্যো মহেশ্বর উদারধীঃ।
দেবলো বামনশ্চৈব ঈশানো মকরন্দকঃ॥
উৎসাহগরুড়খ্যাতৌ মুখরংশসমুদ্ভবৌ।
কানুকুতূহলাবেতৌ কাঞ্জিকুলপ্রতিষ্ঠিতৌ।
উনবিংশতিসংখ্যাতা মহারাজেন পূজিতাঃ॥ - পালধিঃ পর্কটিশ্চৈব সিমলায়ী চ বাপুলিঃ।
ভূরিঃ কুলী বটব্যালঃ কুশারিং মেয়কস্তথা।
কুসুমো ঘোষলী মাষো বসুয়ারিঃ করালকঃ।
তাম্বুলী তৈলবাটী চ মূলগ্রামী চ পুষলী।
আকাশঃ পলসায়ী চ কোয়ারী সাহরিস্তথা।
ভট্টঃ ষাটশ্চ নায়েরী দায়ী পারী সিয়ারিকঃ।
সিদ্ধলঃ পুংসিকো নন্দী কাঞ্জারী সিমললিকঃ।
বালী চেতি চতুস্ত্রিংশদ্বল্লালনৃপপূজিতাঃ॥ - দীর্ঘাঙ্গী পারিঃ কুলভী পোড়ারী রাই কেশরী।
ঘণ্টা ডিণ্ডী পীতমুণ্ডী মহিস্তা গূড় পিপলী।
হড়শ্চ গড়গড়িশ্চৈব ইমে গৌণাঃ প্রকীর্ত্তিতাঃ। - শ্রোত্রিয়ায় সুতাং দত্ত্বা কুলীনো বংশজো ভবেৎ।
- অরয়ঃ কুলনাশকাঃ।
যৎকন্যালভমাত্রেণ সমূলস্তু বিনশ্যতি॥ - বল্লালবিষয়ে নূনং কুলীনা দেবতাঃ স্বয়ম।
শ্রোত্রিয়া মেরবো জ্ঞয়া ঘটকা স্তুতিপাঠকাঃ।
অশং বংশং তথা দোষং যে জানন্তি মহাজনাঃ।
ত এব ঘটকা জ্ঞেয়া ন নামগ্রহণাৎ পরম্॥ - বল্লালের মুখ হইতে বংশজ নির্গত হইয়াছিল এইমাত্র, তিনি বংশজব্যবস্থা করেন নাই, ঘটকদিগের এই নির্দেশ সম্যক্ সংলগ্ন বোধ হয় না। ৫৬ গাঁইর মধ্যে, ৩৪ গাঁই শ্রোত্রিয়, ও ১৪ গাঁই গৌণ কুলীন, বলিয়া ব্যবস্থাপিত হইয়াছিলেন; অবশিষ্ট ৮ গাঁইর লোকের মধ্যে কেবল ১২ জন কুলীন হন, এই ১৯ জন ব্যতিরিক্ত লোকদিগের বিষয়ে কোনও ব্যবস্থা দেখিতে পাওয়া যায় না। বোধ হইতেছে, বল্লাল এই সকল লোকদিগকে বংশজশ্রেণীবদ্ধ করিয়াছিলেন। বোধ হয়, ইঁহারই আদিবংশজ; তৎপরে, আদানপ্রদানদোষে যে সকল কুলীনের কুলভ্রংশ ঘটিয়াছে, তাঁরাও বংশজসংজ্ঞাভাজন হইয়াছেন। ইহাও সম্পূর্ণ সম্ভর বোধ হয়, এই দি- বংশজেরা বক্সালের নিকট ঘটক উপাধি প্রাপ্ত হইয়াছিলেন।
- দোষাম্মেলয়তীতি মেলঃ।
- দোষো যত্র কুলং তত্র।
- ১ ফুলিয়া, ২ খড়দহ, ৩ সর্ব্বানন্দী, ৪ বল্লভী, ৫ সুরাই, আচার্য্যশেখরী, ৭ পণ্ডিতরত্নী, ৮ বাঙ্গাল, ৯ গোপালঘটকী, ১০ ছায়ানরেন্দ্রী, ১১ বিজয়পণ্ডিতী, ১২ চাঁদাই, ১৩ মাধাই, ১৪ বিদ্যাধরী, ১৫ পারিহাল, ১৬ শ্রীরঙ্গভট্টী, ১৭ মালাধরখানী, ১৮ কাকুস্থী, ১৯ হরিমজুমদারী, ২০ শ্রীবর্দ্ধনী, ২১ প্রমেদিনী, ২২ দশরথঘটকী, ২৩ শুভরাজখানী, ২৪ নড়িয়া, ২৫ রায়মেল, ২ চট্টরাঘবী, ২৭ দেহাটী, ২৮ ছয়ী, ২৯ ভৈরবঘটকী, ৩০ আচন্বিতা, ৩১ ঘরাধরী, ৩২ বালী, ৩৩ রাঘবঘোবলী, ৩৪ শুঙ্গসর্ব্বনন্দী, ৩৫ সদানন্দখানী, ৩৬ চন্দ্রবতী।
- অনূঢ়া শ্রীনাথসুতা ধন্ধঘাটস্থলে গতা।
হাঁসাইখানদারেণ যবনেন বলাৎকৃতা॥
ধন্ধস্থানগতা কন্যা শ্রীনাথচট্টজাত্মজা।
যবনেন চ সংসৃষ্টা সোঢ়া কংসসুতেন নৈ।
নাথাইচকট্টের কন্যা হাঁসাইথানদারে।
সেই কন্যা বিভা কৈল বন্দ্য গঙ্গাবরে॥ - কি কি দোষে কোন কোন মেল বদ্ধ হয়, দোষমালাগ্রন্থে তাহার সবিস্তর বিবরণ আছে; বাহুল্যভয়ে এস্থলে সে সকল উল্লিখিত হইল না। যাঁহার সবিশেষ জানিতে চাহেন, তাঁহাদের পক্ষে দোষমালাগ্রন্থ দেখা আবশ্যক।
- উদ্বাতত্বধৃত।
- যাহাকে শ্রাদ্ধে নিমন্ত্রণ করিয়া ভোজন করাইলে শ্রাদ্ধ পণ্ড হয়।
- যাহার সহিত এক পংক্তিতে বসিয়া ভোজন করিতে নাই।
- যমসংহিতা।
- যাহার সহিত সম্ভাষণ করিল পাতক জন্মে।
- জীমূতবাহনকৃত দায়ভাগধৃত।
- ব্যাসসংহিতা। দ্বিতীয় অধ্যায়।
- যদিও, অবিবাহিত অবস্থায় কন্যার ঋভুদর্শন ও ঋতুমতী কন্যার পাণিগ্রহণ শাস্ত্রানুসারে ঘোরতপাতকজনক; কিন্তু, কুলাভিমানী মহাপুরুষেরা উহাকে দোষ বলিয়া গ্রাহ্য করেন না। দোষ বোধ করিলে, অকিঞ্চিৎকরকুলাভিমানের বশবর্ত্তী হইয়া চলিতেন না, এবং কন্যাদিগকে অবিবাহিত অবস্থায় রাখিয়া নিজে নরকগামী হইতেন না, এবং পিতা, পিতামহ, প্রপিতামহ এই তিন পূর্ব্বপুরুষকে পরলোকে বিষ্ঠাকুণ্ডে নিক্ষিপ্ত করিতেন না। হয়ত, তাঁহারা,
কামমামণাতিগৃেহে কন্যর্ত্তুমত্যপি।
নচৈবৈং প্রস্থে গুণহীনায় কহির্চিচৎ॥ ৯। ৮৯॥
কন্যা ঋতুমতী হইয়া মৃত্যুকাল পর্য্যন্ত বরংগৃহে থাকিবেক, তথাপি তাহাকে কদাচ নির্গুণ পাত্রে প্রদান করিবেক না।
এই মানবীয় ব্যবস্থা অবলম্বন করিয়া চলেন বলিয়া ভাবিয়া থাকেন। মনু নির্গুণ পাত্রে কন্যাদান অবিধেয় বলিয়া নির্দেশ করিয়াছেন। কিন্তু, ইদানীন্তন কুলাভিমানীমহাশয়েরা সর্ব্বাপেক্ষা নির্গুণ; আচার, বিনয়, বিদ্যা প্রভৃতি গুণে তাঁহারা একবারে বর্জ্জিত হইয়াছেন। সুতরাং, তাঁহাদের অভিমত শাস্ত্র অনুসারে বিবেচনা ঝরিতে গেলে, এক্ষণকার কুলীন পাত্রে কন্যাদান করাই সর্ব্বতোভাবে অবিধেয় বলিয়া নিঃসংশয়ে প্রতিপন্ন হইবেক।
36.১ হর্ষ, ২ গর্ভ, ও শ্রীনিবাস, ৪ আরব, ৫ ত্রিৰিক্রম, ৬ কাক, ৭ সাধু, ৮ জলাশয়, ৯ বাণেশ্বর, ১০ গুহ, ১১ মাধব, ১২ কোলাহল। শ্রীহর্ষ প্রথম গৌড়দেশে গমন করেন।
১ উৎসাহ, ২ আহিত, ৩ উদ্ধব, ৪ শিব, ৫ নৃসিংহ, ৬ গর্ভেশ্বর, ৭ মুরারি, ৮ অনিরুদ্ধ, ৯ লক্ষ্মীধর, ১০ মনোহর। মুখুটীৰংশে উৎসাহ প্রথম কুলীন হন।
১ গঙ্গানন্দ, ২ রামাচার্য্য, ৩ রাঘবেন্দ্র, ৪ নীলকণ্ঠ, ৫ বিষ্ণু, ৬ রামদেব, ৭ সীতারাম, ৮ সদাশিব, ৯ গোরাচাঁদ, ১০ ঈশ্বর। গঙ্গানন্দ ফুলিয়ামেলের প্রকৃতি। ঈশ্বরমুখোপধ্যায় খড়দহগ্রামবাসী।