হযরত মুহাম্মদ (স) প্রথম জীবন ও নবুওয়াত
১. হযরত মুহাম্মদ (স)-এর বংশ পরিচয়
হযরত মুহাম্মদ (স)-এর বংশ তালিকা লক্ষ্য করলে দেখা যাবে যে, তিনি কিলাব- এর পুত্র কুশাই, কুশাই-এর পুত্র আবদ মান্নাফ, আবদ মান্নাফ-এর পুত্র হাশিম, হাশিম- এর পুত্র মুত্তালিব এবং আব্দুল মুত্তালিবের পুত্র আবদুল্লাহ-এর সন্তান ছিলেন। প্রাক- ইসলামী ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে বিচার করলে প্রতীয়মান হবে যে, মক্কার প্রকৃত শাসক ছিলেন কুশাই এবং তার মৃত্যুর পর তার উত্তরাধিকারীরা শাসনভার পরিচালনা করে। অবশ্য কুরাইশ বংশের সদস্যদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেলে শাসনক্ষমতা তাদের মধ্যে বিভক্ত হয়ে যায়। এখানে বিচার করতে হবে যে, হযরত মুহাম্মদ (স)-এর জন্মলাভের সময় তার পূর্বপুরুষেরা মক্কার শাসন ব্যবস্থায় বিশেষ ভূমিকা পালন করেছিলেন কি না? অথবা, অনেক পাশ্চাত্য ঐতিহাসকিদের ভাষ্য অনুযায়ী কুরাইশ বংশের প্রাধান্য অতিরঞ্জিত করা হয়েছে। পরবর্তীকালে আব্বাসীয় খিলাফত হাশিম থেকে তাদের বংশানুক্রম টানে; অন্যদিকে তাদের দ্বারা গদিচ্যুত উমাইয়া বংশের পূর্বপুরুষ ছিলেন হাশিমের ভাই আবদ শামস। হাশিম ও আবদ শামস উভয়েই আবদুল মান্নাফের পুত্র। যেহেতু আব্বাসীয় আমলে রচিত ঐতিহাসিক গ্রন্থাবলিতে তাদের চির প্রতিদ্বন্দ্বী উমাইয়াদের শাসনামল অত্যন্ত পক্ষপাতিত্বের সাথে বর্ণিত হয়েছে সেহেতু এটা খুবই স্বাভাবিক যে, হাশিম এবং তাঁর পুত্র ও পৌত্রদের সম্বন্ধে মাত্রাধিক প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে, যা হয়ত তাদের প্রাপ্য নয়। ঐতিহাসিক তথ্যাবলি বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে যে, এই অভিযোগ ভিত্তিহীন। উমাইয়াদের সম্বন্ধে যা কিছু বলা হয়েছে তা সবই সত্য, অতিরঞ্জিত নয় এবং তাদের ইতিহাস রচনায় মিথ্যাচার বা নতুন উদ্ভট তথ্য দিয়ে তাদের ইতিহাস বিকৃত করা হয়নি।
আবদ মান্নাফের চার পুত্র সন্তানই মক্কায় ব্যবসা-বাণিজ্যের উন্নয়নে জড়িত ছিলেন। আবদ শামস ইয়েমেনে, নওফল পারস্যে, আল-মুত্তালিব আবিসিনিয়ায়, এবং হাশিম সিরিয়ায় বাণিজ্য উপলক্ষে যান এবং এভাবে বহির্বাণিজ্যের ফলে কুশাই-এর বংশধরেরা মক্কায় প্রচুর সম্পদের মালিক হন। অবশ্য অন্যান্য গোত্রের লোকেরাও যে মক্কার সাথে বহির্বাণিজ্যে জড়িত ছিল, তা বলাই বাহুল্য, তবে তুলনামূলকভাবে কুরাইশদের অধিক প্রাধান্য ছিল। আবদ শামস তার ছোট ভাই হাশিমকে মক্কায় আগত তীর্থযাত্রীদের খাদ্য ও পানীয় সরবরাহের দায়িত্ব দেন। এর কারণ এই যে, হাশিম কাফেলায় আরবদেশের বাইরে সিরিয়ায় ব্যবসা-বাণিজ্য করতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতেন না। আরব মান্নাফ সহজেই উপলব্ধি করেন যে, বছরে একবার মক্কায় আগত তীর্থযাত্রীদের খাদ্য ও পানিয় সরবরাহের তুলনায় বহির্বাণিজ্য করে অনেক ধনসম্পদ আয় করা যায়। আবদ মান্নাফ এবং তার ভাই হাশিমের সাথে কোন বিরোধ ছিল না; কিন্তু বহির্বাণিজ্যে সিরিয়ায় গিয়ে গাজা অঞ্চলে
আকস্মিকভাবে হাশিমের মৃত্যু হলে তার উত্তরাধিকারীরা বিপর্যস্ত হয়, বিশেষ করে হাশিম ও তাঁর মিত্র গোত্র আল-মুত্তালিব। হাশিমের মৃত্যুর পর তার ভাই আল-মুত্তালিব গোত্রপতি হলেন; কিন্তু আবদ শামসের প্রচণ্ড প্রভাবের ফলে আল-মুত্তালিবের মক্কার শাসন ব্যবস্থায় কোন কর্তৃত্ব ছিল না। অবশ্য পরবর্তী পর্যায়ে তার ভ্রাতুষ্পুত্র ও হাশিমের পুত্র আবদ আল- মুত্তালিব, যাকে তার মা ইয়াসরিবে (মদিনা) লালন-পালন করেন, মক্কায় এসে বসবাস শুরু করলে হাশম গোত্রের আধিপত্য বৃদ্ধি পেতে থাকে।
আব্দুল মুত্তালিব মক্কায় আসার পর, যিনি হযরত মুহাম্মদ (স)-এর পিতামহ ছিলেন, হাশিম গোত্রের প্রভাব ও প্রতিপত্তি বৃদ্ধি পায়। তিনি পবিত্র উপাসনায় কা’বায় আগত তীর্থযাত্রীদের পানি সরবরাহের জন্য একপাশে একটি কুয়ো খনন করেন, যা জমজম নামে পরিচিত। উল্লেখ্য, হযরত ইব্রাহিম যখন কা’বাঘর নির্মাণ করেন ঠিক সে সময়ে এবং তাঁর শিশু পুত্র ইসমাঈল পানির জন্য যখন ছটফট করছিলেন তখন তার মা বিবি হাযেরা কা’বাঘরের কাছে তার পুত্র সন্তানকে বালির ওপর শুইয়ে রেখে পানির জন্য সাফা ও মারওয়া পাহাড়ের মধ্যবর্তী স্থানে ছুটাছুটি করছিলেন। হঠাৎ তিনি দেখেন যে, শিশু ইসমাঈলের পায়ের আঘাতে বালি থেকে ঝরণার মতো পানি বেরিয়ে আসছে। ইসমাঈলের সময়ের জমজম কুয়ো পরবর্তীকালে বন্ধ হয়ে যায় ধুলোবালিতে। আবদুল মুত্তালিব এই জমজম কুয়ো পরবর্তীকালে বন্ধ হয়ে যায় ধুলোবালিতে। আবদুল মুত্তালিব এই জমজম কুয়ো পুনরায় খনন করেন। জমজম কুয়ো খনন করে আবদুল মুত্তালিব প্রমাণ করেন যে, তিনি করিতকর্মা ব্যক্তি এবং বড় দূরদর্শী ছিলেন। যদিও জমজম কুয়ো মক্কার প্রধান বা কেন্দ্রীয় কুয়োতে পরিণত হয়, যা পবিত্র কা’বাঘরের একটি অংশ হিসেবে মর্যাদা লাভ করে, তবুও একথা বলা যাবে না যে, এ কারণে আবদ আল- মুত্তালিব মক্কার খুব প্রভাবশালী ব্যক্তিতে সম্মান লাভ করেন। মক্কার নাগরিক সংস্থা ‘মালার’ অন্যতম কর্তব্য ছিল মক্কায় আগত তীর্থযাত্রীদের জমজমের পানি সরবরাহ করা এবং এই পবিত্র কর্তব্য আবদ আল-মুত্তালিব উত্তরাধিকারসূত্রে তার পিতা হাশিম এবং চাচা আল-মুত্তালিবের কাছ থেকে পেয়েছিলেন।
মক্কায় তৎকালীন সমাজে আবদ আল-মুত্তালিবের মর্যাদা কিরূপ ছিল? তা তার কন্যা সন্তানদের বিবাহ থেকে ধারণা করা যায়। তার কন্যা সাফিয়ার সাথে প্রথমেই উমাইয়ার (আবদ শামস গোত্রের প্রধান) পুত্র হারবের বিয়ে হয়। সাফিয়ার দ্বিতীয় বিয়ে হয় আসাদ গোত্রের আল-আওয়াম বিন খুয়াইলিদের সাথে। আবদ আল-মুত্তালিবের আতিকার নামে তার এক কন্যার বিয়ে হয় মখযুম গোত্রের আবু উমাইয়া বিন আল- মুগিরার সাথে। উমাইয়া নামে আর একটি কন্যার বিয়ে দেওয়া হয় জাহাসের সাথে, যে হারব বিন উমাইয়ার মিত্র ছিল। অপর কন্যা আরওয়ার প্রথমে বিয়ে হয় উমাইর বিন ওয়াহাবের সাথে এবং দ্বিতীয়বার আবদ আদ-দার গোত্রের আকে সদস্যের সাথে। বারা নামে যে কন্যা ছিল তার বিয়ে হয় প্রথমে আবু রুহুমের সাথে এবং দ্বিতীয়বার আবুল আসাদ বিন হিলালের (যিনি মাখযুম গোত্রের ছিলেন) সাথে। সর্বকনিষ্ঠ কন্যা উম্মে হাকিম কুরাইয বা আবদ শামসকে বিয়ে করেন। ঐতিহাসিক ইবন সা’দের মতে আবদ আল-মুত্তালিব মক্কার সর্বশ্রেষ্ঠ ও প্রভাবশালী পরিবারের সদস্যদের সাথে তার ছয় মেয়ের বিয়ে দিয়ে এক অসাধারণ সামাজিক মর্যাদা লাভ করেন।
ইতিহাসে উল্লেখ করা হয়েছে যে, বনু হাশিমের প্রতিনিধি আবদ আল-মুত্তালিবের সাথে হারব বিন উমাইয়া গোত্রের শত্রুতা ছিল এবং এই শত্রুতার মূল উৎস মক্কার আধিপত্য নিয়ে। কিন্তু কোথাও একথা স্পষ্টভাবে বলা হয় নি। প্রাথমিক যুগে না থাকলেও পরবর্তী যুগে হাশিম ও উমাইয়া গোত্রের মধ্যে বিরোধ চরম আকার ধারণ করে (আবদ আল-মুত্তালিবের পৌত্র হযরত মুহাম্মদ (স)-এর সাথে উমাইয়া পৌত্ৰ আৰু সুফিয়ানের সংঘর্ষ ও রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ এর প্রমাণ)। বৈবাহিক সম্পর্ক অন্তত এটা প্রমাণ করে যে, তাদের মধ্যে সখ্যতা রয়েছে। আবরাহা যখন দক্ষিণ আরবের সানা থেকে সমরাভিযান করে মক্কার পবিত্র কা’বাঘর ধ্বংস করতে আসেন তখন মক্কার অভিজাত শ্রেণীর পক্ষ থেকে তার সাথে সমাঝোতায় আসার জন্য সাক্ষাৎ করেন। কিন্তু আবরাহার হস্তীবাহিনী বিধ্বস্ত হয় (সূরা ফিল); কিন্তু আবদ আল-মুত্তালিবের এই কূটনৈতিক মিশন মক্কার বৃহৎ গোত্রদের তরফ থেকে ছিল না, ছিল ক্ষুদ্র সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর পক্ষে। আবদ আল-মুত্তালিবের বিচক্ষণতা সম্বন্ধে যত কিছুই বলা হোক না কেন আবরাহার শোচনীয় পরাজয় এবং আবিসিনীয় বাহিনীর প্রত্যাগমনের ফলে তার কূটনৈতিক মিশনের সাফল্যের কোন প্রশ্নই আসে না। এই ব্যর্থতা মক্কায় আবদ আল-মুত্তালিবের প্রভাবকে হ্রাস করেছিল কিনা তা সঠিকভাবে বলা যায় না, কারণ এই ঘটনার (খ্রি. ৫৭০/৫৭১, যে বছর নবী করিমের জন্ম) পরেই আবদ আল-মুত্তালিবের মৃত্যু হয়। এ ধরনের কূটনৈতিক মিশন প্রমাণ করে যে, মক্কায় বনু হাশিমের প্রভাব ও প্রতিপত্তি বনু উমাইয়ার তুলনায় ক্রমশ হ্রাস পাচ্ছিল।
আবদ আল-মুত্তালিবের মৃত্যুর পর বনু হাশিমের নেতৃত্ব দেন আবদ আল- মুত্তালিবের পুত্র আজ-যুবাইর। এ সময়ে ফিজারের যুদ্ধ এবং ‘হিলফ উল-ফুজুল বা ফুজুলের শান্তি কমিটি, যাতে বিশ বছর বয়স্ক (খ্রি. ৫৯০) হযরত মুহাম্মদ (স) সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। ৫৮৫ থেকে ৫৯০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত দীর্ঘ পাঁচ বছর এই অপবিত্র যুদ্ধ (sacrilegious war) কুরাইশ ও তাদের মিত্র গোত্র কিনানার সাথে তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী গোত্র হাওয়াজিনের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হয়। উল্লেখ্য, এই যুদ্ধে আজ-যুবায়ের কোন বিশিষ্ট ভূমিকা গ্রহণ করতে পারেন নি। ‘হিলফ উল-ফুজুল ছিল অপেক্ষাকৃত দুর্বল গোত্রদের একটি সংঘ, যারা শান্তি কমিটি করে যুদ্ধ বন্ধের চেষ্টা করে। এই কমিটির প্রভাবমালী সদস্য ছিলেন আবদুল্লাহ বিন জুর্দান (তাইম)। ফিজারের যুদ্ধ আরম্ভ হলে তিনি মক্কায় বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেন এবং হিলফ উল-ফুজুল বা শান্তি কমিটির বৈঠক তার ঘরে বসেছিল।
আজ-জুবায়ের অপেক্ষা আবদ আল-মুত্তালিবের অপর পুত্র সন্তান আবু তালেব প্রভাবশালী ছিলেন এবং তিনি হাশিম গোত্রের প্রধান ছিলেন। হিলফ উল-ফুজুলের বছর (খ্রি. ৫৯০) থেকে হযরত মুহাম্মদ (স)-এর মক্কা থেকে মদিনায় হিজরতের (খ্রি. ৬২২) তিন বছর (খ্রি. ৬১৯) পূর্ব পর্যন্ত তিনি হাশিম পরিবারের গোত্রপতি ছিলেন। তার নেতৃত্বাধীনে হাশিম পরিবার বিশেষ আধিপত্য বিস্তার করতে পারে নি। তার অর্থনৈতিক অবস্থা ভাল ছিল না। এ কারণে হযরত মুহাম্মদ (স) তার চাচাতো ভাই এবং আবু তালিবের পুত্র আলীকে তার কাছে রেখেছিলেন। বনু হাশিম গোত্রের প্রভাব বস্তুত আবদ আল-মুত্তালিবের সময় থেকে শুরু হয় এবং আবরাহার পরাজয় তার কূটনৈতিক মিশনের ব্যর্থতা প্রমাণ করে। এর ফলে তার সামাজিক মর্যাদাহানি হয়। আবদ আল-মুত্তালিবের পুত্র আবু তালিব দুর্বল প্রকৃতির মানুষ ছিলেন এবং তার অর্থাভাব ছিল। গোত্রীয় নেতা হিসেবে তার প্রয়োজনীয় গুণাবলির অভাব ছিল।
হযরত মুহাম্মদ (স)-এর পিতা আবদুল্লাহ, আবু তালেব ও আজ-জুবায়েরর আপনা ভাই ছিলেন। পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের মত তিনিও সিরিয়ায় ব্যবসা-বাণিজ্য করতে যেতেন। গাজা থেকে মক্কায় ফেরার পথে খুব অল্প বয়সে মদিনায় আকস্মিকভাবে আবদুল্লাহ মৃত্যুবরণ করেন। হযরত মুহাম্মদ (স)-এর জন্মের (খ্রি. ৫৭০/৫৭১) কিছুদিন আগে তিনি মারা যান। ফলে, পিতৃহীন অবস্থায় হযরত মুহাম্মদ (স)-এর জন্ম হয় ( Posthumous birth)।
হযরত মুহাম্মদ (স)-এর মা ছিলেন আমিনা বিনতে ওয়াহাব। তিনি কুরাইশ গোত্রের যুহরা উপ-গোত্রের লোক ছিলেন। আমিনার মা আবদ আদ-দার গোত্রভুক্ত ছিলেন এবং তার নানী আসাদ গোত্রের ছিলেন। এর ফলে দেখা যায় যে, হযরত মুহাম্মদ (স) তার মায়ের দিক থেকে মক্কার প্রধান প্রধান পরিবারের সাথে সম্পর্কিত ছিলেন।
প্রাক-ইসলামী যুগে আরব দেশে বিদ্যমান গোত্রপ্রথা ছিল খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। এক সময়ে হযরত মুহাম্মদ (স)-এর হাশিম গোত্রের মক্কার শাসন ব্যবস্থায় অসামান্য প্রাধান্য ছিল; কিন্তু হযরত মুহাম্মদ (স)-এর নবুওয়াত লাভের প্রায় এক শতাব্দী আগে থেকে এই বংশের প্রভাব হ্রাস পেতে থাকে। ফলে, হাশিম বংশ রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক দিক থেকে কোনঠাসা হয়ে পড়ে। যদিও হাশিম বংশের সদস্যগণ সিরিয়ায় ব্যবসা-বাণিজ্য অব্যাহত রাখেন, তবুও একথা নিশ্চিত করে বলা যায় যে, তাদের তুলনায় আবদ শামস এবং মাখযুম গোত্র বহির্বাণিজ্যে অনেক বেশি মুনাফা করে অর্থ উপার্জন করে। ঈর্ষান্বিত হয়ে বনু হাশিম, আবদ শামস এবং মাখযুম গোত্রের সাথে বাণিজ্যিক সম্পর্ক অসহযোগিতা করতে থাকে। এর ফলে তারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অবশ্য প্রমাণ রয়েছে যে, হযরত মুহাম্মদ (স) এবং আবু লাহাব-এ দুই বৈরী মনোভাবাপন্ন গোত্রের সাথে যোগাযোগ রাখতেন। এমন কি হযরত মুহাম্মদ (স)-এর কন্যা জয়নবকে আবদ শামস পরিবারের সদস্য আবুল অসি বিন রাবী লাকীনের, যিনি তার খালাতো ভাই ছিলেন, সাথে বিবাহ দেন।
২. হযরত মুহাম্মদ (স)-এর জন্ম এবং প্রথম জীবন
হযরত মুহাম্মদ (স) হস্তীর বছরে জন্মগ্রহণ করেন। এ বছরে দক্ষিণ আরবের সানা থেকে আবিসিনিয়ার খ্রিস্টান রাজ্য আবরাহা মক্কায় অভিযান করে কা’বা ধ্বংস করার পরিকল্পনা করে ব্যর্থ হন। সাধারণত মনে করা হয়ে থাকে যে, খ্রিস্টীয় ৫৭০ অব্দে এই ঘটনা ঘটে। হযরত মুহাম্মদ (স) ছিলেন পিতার মৃত্যুর পর জাত সন্তান (posthumous)। কারণ, তার পিতা আবদুল্লাহ সিরিয়া থেকে বাণিজ্য শেষে দেশে ফিরে মদিনার উপকণ্ঠে হঠাৎ ইন্তেকাল করেন। ফলে পিতামহ আবদ আল-মুত্তালিব তার ভরণ-পোষণের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। শুধু তাই নয়, তিনি তাঁকে আদর করে ডাকতেন ‘মুহাম্মদ’ বা প্রশংসিত। অবশ্য তাঁর মা বিবি আমিনা তার আদরের পুত্র সন্তানকে স্নেহবশে ‘আহমদ’ বলে ডাকতেন। হযরত মুহাম্মদ (স)-এর জন্মের দুই সপ্তাহের মধ্যে মক্কার অভিজাত আরব পরিবারের প্রথা অনুযায়ী শিশু হযরত মুহাম্মদ (স)-কে বানু সা’দ বংশীয়, যা বৃহত্তর হাওয়াযিন গোত্রের অংশ, একজন ধাত্রীর (দাই- মা) নিকট লালন-পালনের জন্য দেওয়া হয়। এর কারণ, মরুভূমির মুক্ত আবহাওয়ায় যাতে শিশু হযরত মুহাম্মদ (স)-এর শারীরিক ও মানসিক বিকাশ ঘটে। যে মহিলার তত্ত্বাবধানে তিনি দুবছর কাটান তার নাম বিবি হালিমা।
অনাথ শিশু হযরত মুহাম্মদ (স)-এর জন্য একের পর এক বিপর্যয় অপেক্ষা করছিল। তাঁর বয়স যখন ছয় বছর (খ্রি. ৫৭৬) তখন তাঁর মা বিবি আমিনা ইন্তেকাল করেন। এর দু বছর পর (খ্রি. ৫৭৮) তাঁর দাদা আবদ আল-মুত্তালিব মৃত্যুবরণ করেন। দাদার মৃত্যুর পর হযরত মুহাম্মদ (স)-এর লালন-পালনে দায়িত্ব গ্রহণ করেন তাঁর চাচা আবু তালিব। ৫৮২ খ্রিস্টাব্দে বার বছর বয়সে তিনি চাচা আবু তালিবের সঙ্গে সিরিয়ায় বাণিজ্য উপলক্ষে যান। তাঁর বয়স যখন পনের থেকে বিশ বছর তখন (খ্রি. ৫৮৫-৫৯০) ফিজারের (হরব-আল-ফিজার) যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এ যুদ্ধে বালক বা কিশোর হযরত মুহাম্মদ (স) অংশগ্রহণ করেন। এই যুদ্ধ সম্বন্ধে তিনি বলেন, “আমি আমার চাচাদেরকে শত্রুপক্ষের তীর থেকে রক্ষা করতাম!” অর্থাৎ শত্রু কর্তৃক নিক্ষিপ্ত তীরগুলো যুদ্ধক্ষেত্র থেকে কুড়িয়ে তিনি চাচাদের হাতে পৌঁছে দিতেন। অহেতুক এই যুদ্ধের বিভীষিকা ও তাণ্ডব লীলা হযরত মুহাম্মদ (স)-এর কোমল হৃদয়ে গভীর রেখাপাত করে। এই আত্মঘাতী অপবিত্র যুদ্ধ (sacrilegious war) বন্ধের জন্য শান্তি কমিটি ‘হিলফ উল- ফুজুল’ গঠনে তার বিশেষ ভূমিকা ছিল। পরবর্তীকালে এ ধরনের শান্তি কমিটি গঠনে তিনি অনুমোদন দেন। এই শান্তি কমিটির উদ্দেশ্য ছিল, শক্তিশালী ও ধনাঢ্য গোত্রগুলোর নিপীড়ন ও অত্যাচার থেকে ছোট ছোট গোত্রগুলোকে রক্ষা করে ন্যায়-বিচার প্রতিষ্ঠা করা। এ ধরনের কার্যকলাপ কুরআনে বর্ণিত নীতি ও শিক্ষার ইঙ্গিত বহন করে।
বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হবার পূর্বে হযরত মুহাম্মদ (স)-এর জীবনে নানা ধরনের ঘটনা ঘটেছিল। দাই-মা বিবি হালিমার তত্ত্বাবধানে থাকাকালীন সময়ে এক অলৌকিক ঘটনা ঘটে। এ সময় দুজন ফেরেশতা তাঁর বক্ষ বিদীর্ণ করে তাঁর আত্মা শুদ্ধি করেন। পবিত্র কুরআনে এ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে : “হে মুহাম্মদ! আমি কী তোমার হৃদয়কে উন্মুক্ত করি নি।” ইবন ইসহাক তার সিরাতুন নবী গ্রন্থে এই অলৌকিক ঘটনার বিশদ বিবরণ দেন। এই ঘটনাটি আধুনিক ঐতিহাসিকগণ বিশ্বাস না করলেও এর আধ্যাত্মিক তাৎপর্য অস্বীকার করা যাবে না। ইবন ইসহাকের ভাষায়,
“আল্লাহর প্রেরিত মহানবী হযরত মুহাম্মদ (স) ধাত্রী-এর মা সা’দ গোত্রের বিবি হালিমা বিনতে আবি ছুয়াইবা বলেন যে, অর্থাভাবে জীবিকার সন্ধানে তিনি, তাঁর স্বামী এবং এক পুত্র সন্তানকে নিয়ে তাঁর গোত্রের অন্যান্য মহিলাদের সাথে মক্কার উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। এ সময় তাঁর পুত্র সন্তান তাঁর স্তন পান করতো। প্রাচীন আরবের প্রথা অনুযায়ী তখন ধনাঢ্য ব্যক্তিগণ নবজাতক শিশুদের জন্য দাই-মা নিযুক্ত করতেন এবং তাঁরা চাইতেন যে, তাঁদের শিশুরা মুরুভূমির মুক্ত পরিবেশে বাস করে সুস্বাস্থ্যের অধিকারী হোক। সাথে সাথে তাদের মানসিক বিকাশও ঘটুক। যে বছর হালিমা তাঁর গোত্র থেকে মক্কার দিকে রওয়ানা হলেন সে বছরটি ছিল খুবই খরা। তাঁদের আহারের কোন সংস্থান ছিল না। তিনি এক শীর্ণকায় স্ত্রী-গাধার উপর চড়ে রওয়ানা হলেন। তাঁর সাথে ছিল তাঁর স্বামী, শিশুপুত্র, এক বুড়ো স্ত্রী-উট এবং সঙ্গী-সাথীরা। স্ত্রী-উটের ওলানে দুধ ছিল না। এ কারণে অভুক্ত অবস্থায় তাঁদের রাত কাটাতে হয়েছে। ক্ষুধার যন্ত্রণায় তাঁর শিশুপুত্র চিৎকার করে কাঁদতে থাকে। হালিমার বুকের দুধও শুকিয়ে গেছে, ফলে তিনি তাঁর শিশুকে স্তন দান করতে পারেন নি। তাঁরা আশা করছিলেন যে, বৃষ্টি হবে এবং শুষ্ক আবহাওয়া চলে গেলে তাঁরা স্বস্তি পাবেন। রাত শেষে ভোরে তাঁরা আবার রওয়ানা হলেন। যে গাধায় হালিমা চড়ে যাচ্ছিলেন তা এতই দুর্বল ছিল যে, তিনি সকলের পিছনে পড়ে গেলেন। তাঁরা বহু কষ্টে মক্কায় পৌঁছে দুই-মায়ের কাজের সন্ধান করতে থাকেন। বিবি হালিমাকে মক্কার কোন মহিলাই তাঁদের শিশুকে তার তত্ত্বাবধানে দিতে রাজি হলেন না। কেবলমাত্র বিবি আমিনা তাঁর পিতৃহীন শিশুপুত্র হযরত মুহাম্মদ (স)-কে লালন- পালনের জন্য তাঁকে দিতে রাজি হলেন। কিন্তু পিতৃহীন হওয়ায় বিবি হালিমা তাঁকে নিতে রাজি হলেন না। এর কারণ, তিনি কোন পুরস্কার বা অর্থ পাবেন না। তাঁদের সঙ্গী অন্যান্য মহিলা এক একটি করে শিশুসন্তান পেলেন, যাদের দাই-মা হিসেবে তাঁরা লালন-পালন করবে। হতাশাগ্রস্ত হয়ে হালিমা অন্যান্য মহিলাদের সাথে সা’দ গোত্রে ফিরে যাবার প্রস্তুতি নিলেন; কিন্তু সকল মহিলার কাছে শিশু সন্তান থাকায় তিনি মনঃক্ষুণ্ণ হলেন। এ কথা ভেবে যে, তিনি দাই-মা হিসেবে কোন শিশু ছাড়াই ফিরে যাচ্ছেন। অবশেষে তিনি অনাথ শিশুপুত্র হযরত মুহাম্মদ (স)-কে লালন-পালনের জন্য গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেন। এ কথা ভেবে যে, হয়ত আল্লাহ তাঁদের বরকত দিবেন। অন্য কোন শিশু না পেয়ে হালিমা শিশু হযরত মুহাম্মদ (স)-কে নেয়ার জন্য তাঁর মা বিবি আমিনার কাছে গেলেন। তিনি ক্ষুধার্ত শিশুকে তাঁর বুকে জড়িয়ে ধরে স্তন দান করলেন। তার শুকনো স্তনে ফোটা ফোটা দুধ বের হতে থাকলে তা হযরত মুহাম্মদ (স)-কে পান করান। আল্লাহর কি কুদরত! শিশু হযরত মুহাম্মদ (স) দুধ পান করার পর অফুরন্ত দুধ বের হতে থাকে হালিমার স্তন থেকে এবং তা তিনি তাঁর নিজের শিশুপুত্রকেও পান করান। এর পর দুটি শিশুপুত্রই গভীর ঘুমে মগ্ন হয়ে পড়ে। আগের রাতে হালিমা ও তাঁর নিজের শিশুপুত্র ক্ষুধার্ত থাকায় ভালভাবে ঘুমাতে পারেন নি। সকালে ঘুম থেকে উঠে হালিমার স্বামী তাদের শীর্ণ স্ত্রী-উটের কাছে গেলেন। তিনি সেখানে গিয়ে উটের ওলান থেকে দুধ বের হতে দেখে অবাক হয়ে যান। তিনি বালতি ভরে দুধ দোহন করে সকলকে পান করালেন। এ ঘটনার পর হালিমার স্বামী হালিমাকে বললেন- “হালিমা, তুমি এক পুতপবিত্র শিশুকে গ্রহণ করেছ।” হালিমা জবাবে বললেন, “আল্লাহর কুদরতে তাই হবে।” তাঁরা আবার যাত্রা শুরু করেন তাদের গোত্রের দিকে। তিনি শিশুপুত্র হযরত মুহাম্মদ (স)-কে নিয়ে তাঁর শীর্ণ ও দুর্বল স্ত্রী-উটের পিঠে চড়ে চলতে থাকেন। হঠাৎ তিনি লক্ষ করলেন যে, স্ত্রী-উটটি দ্রুতবেগে চলতে শুরু করেছে। এত দ্রুত যে, অন্যান্য গাধাকে অতিক্রম করে বহু দূরে চলে গেছে। এ ঘটনায় হালিমা অবাক হলেন এবং ভাবলেন সবই আল্লাহর ইচ্ছা। হালিমা তাঁর সঙ্গীদের ছেড়ে এগিয়ে গেলে তাঁর সঙ্গীরা তাঁকে জিজ্ঞাসা করল, মক্কায় যাবার পথে যে স্ত্রী-উঠের হালিমা চড়ে গিয়েছিলেন এটা সেই উট কি না? হালিমা জবাবে বললেন যে, এটা একই উট। তাঁর সঙ্গীরা তখন বললেন যে, নিশ্চয় কোন অলৌকিক ঘটনা ঘটেছে। অবশেষে হালিমা ও তাঁর শিশুপুত্র, স্বামী এবং অন্যান্য সঙ্গী-সাথীরা সা’দ গোত্রের তাঁবুতে এসে পৌঁছুল। তাঁবুতে ফিরে হালিমা লক্ষ করলেন যে, আশেপাশের শুষ্ক তৃণভূমিতে নতুন তৃণ-গুল্মলতা জন্মেছে এবং শীর্ণকায় পশুগুলো হৃষ্টপুষ্ট হয়েছে। তাঁর স্ত্রী-উটগুলো প্রচুর পরিমাণ দুধ দিতে শুরু করেছে। শিশু হযরত মুহাম্মদ (স) বিবি হালিমার তাঁবুতে আসার পর এই পরিবর্তন লক্ষ্য করা গেল; কিন্তু অন্যান্য তাঁবুর বেদুঈন মহিলাদের স্ত্রী-উটগুলোর ওলান শুষ্কই রয়ে গেল। ঈর্ষান্বিত হয়ে অন্যান্য বেদুঈন গোত্র তাদের মেষ পালককে হালিমার চারণভূমিতে নিয়ে যেতে বললেন; কিন্তু সেখানে তারা কোন তৃণ না পেয়ে দুগ্ধবর্তী হতে পারল না। অন্যদিকে আল্লাহর কুদরতে হালিমার চারণভূমিতে তৃণ থাকায় তাঁর পশুগুলো হৃষ্টপুষ্ট হতে থাকেএবং প্রচুর পরিমাণে দুধ দিতে থাকে।
এভাবে দুবছর আল্লাহর নিয়ামত ভোগ করে শিশু হযরত মুহাম্মদ (স)-কে মক্কায় তাঁর মা বিবি আমিনার কাছে নিয়ে যাওয়া হল। এ দুবছর বিবি হালিমা বুকের দুধ পান করিয়ে শিশু হযরত মুহাম্মদ (স)-কে লালন-পালন করে স্বাস্থ্যবান করে তোলেন। তিনি তাঁকে তাঁর মায়ের কাছে নিয়ে গেলেও মনে মনে আশা করেছিলেন যে, শিশু হযরত মুহাম্মদ (স)-কে আরও কয়েক বছর তাঁর কাছে রাখবেন, যাতে আল্লাহর নিয়ামত তাঁরা ভোগ করতে পারেন। মক্কায় গিয়ে হালিমা বিবি আমিনাকে বললেন যে, মক্কায় প্লেগের সংক্রামক ব্যাধি থেকে বাঁচার জন্য শিশু হযরত মুহাম্মদ (স) তাঁদের সাথে থাকলে তার মঙ্গল হবে। কিছুদিন মক্কায় অবস্থান করে বিবি হালিমা পুনরায় শিশুপুত্র হযরত মুহাম্মদ (স)-কে সাথে নিয়ে সা’দ গোত্রের তাঁবুতে ফিরে আসলেন। এ সময় শিশু হযরত মুহাম্মদ (স) তাঁর দুধ ভাই-এর সাথে তাঁবুর পাশে মেষের পাল নিয়ে চলাফেরা করতেন। একদিন হালিমার নিজের ছেলে ছুটতে ছুটতে তাঁবুতে এসে তাঁর মা ও বাবাকে বলল যে, “সে এক অদ্ভূত দৃশ্য দেখেছে। কুরাইশ বংশের যে শিশু সন্তানকে তার মা-বাবা লালন- পালন করছেন তার কাছে সাদা আলখাল্লা পরা দুজন আগন্তুক এসে তাঁকে মাটিতে শুইয়ে তাঁর বুক ছিরে কি যেন বের করছে।” এ কথা শুনে হালিমা ও তাঁর স্বামী ছুটে শিশু হযরত মুহাম্মদ (স)-এর কাছে গিয়ে তাঁকে খুবই দুর্বল ও ফ্যাকাশে দেখতে পান। হালিমা এবং তাঁর স্বামী তাঁকে বুকে জড়িয়ে ধরে তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন, তার কি হয়েছে? শিশু হযরত মুহাম্মদ (স) বললেন যে, সাদা পোশাক পরা দুজন লোক (ফেরেশতা) এসে তাঁর বুক চিরে তার মধ্যে কি যেন খুঁজতে থাকে। তাঁরা কি খোঁজার চেষ্টা করছিল? তা তিনি জানেন না। এরপর তারা শিশুপুত্র হযরত মুহাম্মদ (স)-কে তাঁদের তাঁবুতে নিয়ে গেলেন। এ ঘটনার পর হালিমার স্বামী বললেন, “হালিমা, এই শিশুপুত্র হযরত মুহাম্মদ (স)-এর নিশ্চয় কিছু পরিবর্তন ঘটেছে। তাঁকে তাঁর মায়ের কাছে নিয়ে যাওয়া উচিত।” এরপর তারা শিশুপুত্র হযরত মুহাম্মদ (স)-কে মক্কায় নিয়ে গিয়ে তাঁর মায়ের কাছে রেখে আসেন। বিবি আমিনা আকস্মিকভাবে তার পুত্রসন্তানকে ফিরিয়ে দেয়ার কারণ জানতে চাইলে দাই-মা হালিমা বললেন যে, তাঁর সন্তান এখন বড় হয়েছে এবং কোন প্রকার দুর্ঘটনা ঘটার আগে তিনি তার কাছে তাঁর সন্তানকে ফিরিয়ে দিতে চান। হালিমার জবাবে সন্তুষ্ট না হয়ে বিবি আমিনা প্রকৃত ঘটনা তাঁর কাছে খুলে বলতে বললেন। পীড়াপীড়ি করলে হালিমা সত্য ঘটনা বললেন। এ কথা শুনে বিবি আমিনা বললেন যে, নিশ্চয় তাঁর ওপর কোন কিছুর আছর হয়েছে। হালিমা বললেন যে, তা সম্ভব। তখন বিবি আমিনা এ কথা বিশ্বাস করলেন না। তিনি বললেন যে, শয়তান কখনোই তাঁর সন্তানকে বিভ্রান্ত করতে পারবে না এবং হালিমাকে তিনি একথাও বললেন যে, তাঁর পুত্রসন্তান একদিন মহান ব্যক্তি হবেন। তিনি হালিমাকে আরও বলেন যে, “তিনি যখন অন্তঃসত্ত্বা তখন তাঁর শরীর থেকে এমন এক আলোকরশ্মির ছটা বের হয় যার ফলে সিরিয়ায় অবস্থিত প্রাসাদসমূহ উজ্জ্বল হয়ে উঠে। তিনি আরও বলেন যে, শিশুপুত্র হযরত মুহাম্মদ (স) যখন তাঁর গর্ভে তখন অন্তঃস্বত্ত্বাকালীন অবস্থায় তিনি কোন কষ্ট অনুভব করেন নি। তিনি হালিমাকে আরও বলেন যে, শিশু হযরত মুহাম্মদ (স)-এর জন্মের সময় তাঁর কোন কষ্ট হয় নি। জন্মের পর নবজাতক তাঁর দুহাত মাটিতে রেখে মাথা তুলেছে।”
বিবি হালিমার কাছে শিশুপুত্র হযরত মুহাম্মদ (স) পাঁচ বছর পর্যন্ত ছিলেন (খ্রি. ৫৭০/১-৫৭৫/৬)। ছয় বছর বয়সে তিনি তাঁর মা বিবি আমিনার তত্ত্বাবধানে আসেন। কিন্তু শিশু হযরত মুহাম্মদ (স) মাতৃস্নেহ বেশি দিন ভোগ করতে পারেন নি। মক্কা থেকে মদিনায় গিয়ে বাবা-মার আত্মীয়-স্বজনের সাথে দেখা করার জন্য বিবি আমিনা তাঁর শিশুপুত্রকে নিয়ে যান। মদিনা থেকে মক্কায় প্রত্যাবর্তনের সময় বিবি আমিনা ‘আবওয়া’ নামক স্থানে এসে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং সেখানে কিছুদিনের মধ্যে ইন্তেকাল করেন। মা আমিনার মৃত্যুর পর সাত বছর বয়স্ক বালক হযরত মুহাম্মদ (স)-এর দেখাশোনার ভার পড়ে তাঁর দাদা আবদ আল-মুত্তালিবের ওপর।
ইবন ইসহাক তাঁর ‘সিরাতুন নবী’তে তথ্যবহুল, নির্ভরযোগ্য ও মূল্যবান বিবরণ দিয়েছেন রাসূলের জীবনের বিভিন্ন ঘটনা সম্বন্ধে। বিবি হালিমার কাছে লালন- পালনকালে তাঁর বুক চিরে কলূষিত জিনিস বের করে নবীর অন্তঃকরণ বা হৃদয় পবিত্রকরণ একটি অলৌকিক ঘটনা। ইবন ইসহাক বলেন যে, হাওর বিন ইয়াজিদ নামের এক সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি তাঁকে বলেন যে, তিনি এক বুদ্ধিমান ও জ্ঞানী ব্যক্তির, যার নাম খালিদ বিন মাদান আল-কালাই, কাছ থেকে শুনেছেন যে, নবী করিমের সাহাবীগণ একদিন আল্লাহর প্রেরিত পুরুষ হযরত মুহাম্মদ (স)-এর নিকট তাঁর জীবনবৃত্তান্ত শুনতে চাইলেন। তাঁর বর্ণনায়, “আমি এমন এক ব্যক্তি যার জন্য ইব্রাহিম প্রার্থনা করেন, এবং ঈসা আমার আগমনের বার্তা দেন” (সূরা বাকারা ২, ১২৩; সূরা সাফ্ফ ৬১, ৬)। আমি যখন মাতৃগর্ভে ছিলাম তখন তিনি দেখেন যে, তাঁর দেহ থেকে এক ঝলক রশ্মি বেরিয়ে সিরিয়ার প্রাসাদগুলোকে আলোকিত করছে। আমি সা’দ বিন বকর গোত্রে লালিত- পালিত হই (আমার দাই-মা ছিলেন হালিমা)। আমি একদিন আমার দুধ-ভাই-এর সাথে তাঁবুর পিছনে মেষ চরাচ্ছিলাম। তখন সাদা পোশাকে আচ্ছাদিত দুজন লোক আমার কাছে আসেন। তাঁদের হাতে সোনার পাত্রের মধ্যে বরফ ছিল। তারা আমাকে এক জায়গায় নিয়ে শুইয়ে দিয়ে আমার বুক ছিরে ফেলে হৃৎপিণ্ড বের করে তা দুখণ্ড করেন এবং এর ভিতর থেকে দূষিত কোন পদার্থ বের করে ছুঁড়ে ফেলে দেন। এরপর তাঁরা আমার হৃৎপিণ্ড এবং সমস্ত দেহ বরফ দিয়ে পরিষ্কার করে পবিত্র করেন। অতঃপর তাঁদের দুজনের মধ্যে একজন অন্যজনকে বললেন, ‘তাঁকে [হযরত মুহাম্মদ (স)] দশজন লোকের সাথে ওজন কর।’ আমাকে তখন দশজন লোকের সাথে ওজন করা হল এবং আমি তাদের তুলনায় অনেক ভারী হলাম। এরপর ঐ ব্যক্তি বললেন, “তাঁকে একশত ব্যক্তির সাথে ওজন কর।’ তাই করা হলে দেখা গেল যে, আমি একশত জনের চেয়েও ওজনে ভারী। এরপর ঐ ব্যক্তি আবার তার সঙ্গীকে বললেন, ‘তাঁকে এক হাজার লোকের সাথে ওজন কর।’ তাই করা হলে দেখা গেল আমি এক হাজার লোকের চেয়ে ওজনে ভারী।” এ কথার অর্থ হচ্ছে যে, নবী করিম ছিলেন মানব সৃষ্টির সেরা সৃষ্টি। তিনি মহান এবং তাঁর গুণাবলি তুলনাবিহীন।
ইবন ইসহাকের ‘সিরাতে’ নবী করিমের জীবনবৃত্তান্তের অনেক আলেখ্য লিপিবদ্ধ আছে। তাঁর গ্রন্থ হারিয়ে গেলেও ইবন হিশাম তাঁর ‘সিরাতুন নবীতে’ ইবন ইসহাকের তথ্যাবলি নিষ্ঠা ও সততার সাথে সন্নিবেশিত করেন। ইবন ইসহাক বলেন, দাদা আবদ আল-মুত্তালিবের মৃত্যুর পর ৫৭৯ খ্রিস্টাব্দে তাঁর চাচা আবু তালিব স্নেহযত্নে বালক হযরত মুহাম্মদ (স)-কে লালন-পালনের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। যদিও তিনি বিত্তশালী ছিলেন না একদিন আবু তালিব কাফেলায় মক্কা থেকে সিরিয়ায় বাণিজ্য উপলক্ষে যাত্রার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, এমন সময় বার বছরের বালক হযরত মুহাম্মদ (স) চাচার কাছে আসলেন। এই কাফেলা ৫৮২ খ্রিস্টাব্দে সিরিয়ায় যায় এবং হযরত মুহাম্মদ (স)-এর ইচ্ছানুক্রমে তাঁকে এই কাফেলায় সামিল করা হয়। কাফেলা বসরায় পৌঁছলে বাহিরা নামক একজন খ্রিস্টান পাদ্রী হযরত মুহাম্মদ (স)-এর সাথে দেখা করেন। এই খ্রিস্টান পাদ্রীর খ্রিস্টধর্ম সম্বন্ধে যথেষ্ট জ্ঞান ছিল এবং তাওরাত ও ইঞ্জিলে বর্ণিত পয়গম্বরদের আবির্ভাব সম্বন্ধে যথেষ্ট জ্ঞান রাখতেন। বাহিরা সবসময় একটি গুহায় সন্ন্যাসীর জীবন কাটান এবং কাফেলা তার গুহার পাশ কাটিয়ে চলে গেলেও কখনো গুহা থেকে বের হতেন না। কিন্তু বালক হযরত মুহাম্মদ (স)-কে নিয়ে আবু তালিব যখন কাফেলার সাথে বসরার দিকে আসছিলেন তখন বাহিরা কেন যেন তাঁদের জন্য অনেক খাদ্য তৈরি করে রাখলেন। এ ধরনের আচরণ বাহিরাকে কোন দিন করতে দেখা যায় নি। কারণ, তিনি সমাজ বর্জিত জীবনযাপন করতেন এবং জ্ঞানচর্চা ও তপস্যা নিয়ে সময় ব্যয় করতেন। অনেকে বলেন যে, তিনি তার গুহায় বসে হঠাৎ একদিন এক পয়গম্বরকে দেখতে পান এই গয়গম্বর যে মক্কা থেকে আগত আৰু তালিবের ভ্রাতুষ্পুত্র হযরত মুহাম্মদ (স) সে ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই। তবু তিনি এই কাফেলার সদস্যদের সাথে সাক্ষাতের জন্য অপেক্ষা করতে থাকেন। কাফেলা বসরায় আসার সময় বাহিরা গুহা থেকে বাইরে বেরিয়ে এসে দেখতে পান যে, এই কাফেলায় এক বালক রয়েছে। তিনি আরও লক্ষ্য করলেন যে, একটি মেঘখণ্ড তাঁর মাথায় ছায়া দিচ্ছে এবং তিনি হাঁটার সময় এই মেঘখণ্ডটি তাঁর মাথায় ভেসে বেড়াচ্ছে। তিনি আরও লক্ষ্য করলেন যে, কাফেলা একটি গাছের নিচে তাঁবু ফেললে এই বালকটির মাথার ওপর গাছগুলো ঝুঁকে পড়ে ছায়া দিচ্ছে। গাছের পাতাগুলো তার দিকে নুয়ে পড়েছে। এই দৃশ্য দেখে গুহা থেকে বেরিয়ে বাহিরা কাফেলার কাছে গিয়ে অভিনন্দন জানান এবং বলেন যে, তাঁরা যদি ইচ্ছা করেন তাহলে তাঁদের জন্য আহারের ব্যবস্থা করা হবে। বস্তুত তিনি তাদের জন্য খাবারের ব্যবস্থা আগে থেকেই করে রেখেছিলেন। পাদ্রী বাহিরার এ ধরনের আচরণে কাফেলার বণিকেরা বিস্মিত হলেন। কারণ, ইতিপূর্বে বহুবার বসরায় তাঁরা তাঁবু ফেলেছিলেন কিন্তু বাহিরা তাঁদেরকে কখনো আপ্যায়ন করান নি। বাহিরা স্বীকার করেন যে, পূর্বে তিনি তাঁদের জন্য ভোজনের ব্যবস্থা করতে পারেন নি। কিন্তু যখন তিনি এবারে আয়োজন করেছেন কখন তিনি সাদরে তাঁদের আহারের জন্য আবেদন জানান। খুশিমনে কাফেলার বয়স্ক সব সদস্য আহার করতে থাকলে বাহিরা বলেন যে, সকলকেই নিমন্ত্রণ করা হয়েছে। বয়স্ক সদস্যদের দিকে তাকিয়ে বাহিরা যখন দেখলেন যে, ভবিষ্যতের পয়গম্বরের কোন চিহ্ন তাঁদের মধ্যে নেই তখন তিনি একটু অবাক হলেন। বাহিরা তাঁদের উদ্দেশ্যে বললেন, “হে কুরাইশ গোত্র, আপনাদের মধ্য থেকে কোন ব্যক্তিই যেন আমার আহার গ্রহণ থেকে বিরত না থাকে।” এর জবাবে তাঁরা বললেন, “হে বাহিরা, আপনার আপ্যায়নের জন্য ধন্যবাদ, এক বালক ছাড়া কাফেলার সব সদস্যই আপনার ভোজে যোগ দিয়েছে। যেহেতু সে দলের মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ; তাই তাকে আনা হয় নি।” বাহিরা জবাবে বললেন, “এ কাজটি ঠিক হয়নি। তাঁকে অনুগ্রহ করে ডেকে ভোজে অংশ নিতে বলুন।” এমন সময় কাফেলার এক বয়স্ক সদস্য উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, “দেবী লাত এবং উজ্জার শপথ, এটি খুবই লজ্জার কথা যে, কুরাইশ বংশের আবদুল্লাহ বিন আবদ আল- মালিকের পুত্রকে ভোজে ডাকা হয় নি।” বালক হযরত মুহাম্মদ (স) যখন ভোজে আসলেন তখন পাদ্রী বাহিরা খুব পরখ করে তাঁকে দেখতে লাগলেন। বাহিরা ধর্মগ্রন্থে উল্লেখিত পয়গম্বরের শারীরিক গঠন হযরত মুহাম্মদ (স)-এর মধ্যে রয়েছে কিনা লক্ষ্য করে নিশ্চিত হলেন যে, তা আছে। ভোজন শেষে যখন বয়স্ক সদস্যরা তাঁবুতে ফিরে গেলেন তখন বাহিরা বালক হযরত মুহাম্মদ (স)-কে বললেন, “আল-লাত এবং আল- উজ্জার নামে আমি কি আপনাকে কোন প্রশ্ন করতে পারি?” বাহিরা প্রাক-ইসলামী যুগের (আইয়ামে জাহেলিয়া) দেবীদের নাম করার কারণ, পৌত্তলিক মক্কাবাসী তাদের নামে শপথ করতেন। বালক হযরত মুহাম্মদ (স) বাহিরাকে বলেন, “আপনি আল-লাত ও আল-উজ্জার নাম উচ্চারণ করে কোন কিছু জিজ্ঞাসা করবেন না। কারণ, আমি আল্লাহর নামে বলছি যে, আমি এই দুই দেবী অপেক্ষা অন্য কিছুকে বেশি ঘৃণা করি না।” বাহিরা দুঃখ প্রকাশ করে বললেন, “তাহলে আল্লার নামে শপথ নিয়ে আমি আপনাকে যে কথা জিজ্ঞাসা করছি তার জবাব দিন।” বালক হযরত মুহাম্মদ তাঁকে অনুমতি দিলে বাহিরা তাঁর ঘুমন্ত অবস্থার কথা, তাঁর দৈহিক গঠন এবং অন্যান্য বিষয়ে নানা প্রশ্ন করেন। বালক হযরত মুহাম্মদ (স) তাঁর প্রশ্নের যে সমস্ত জবাব দেন তাতে বাহিরা তাঁর ধর্মগ্রন্থে উল্লেখিত তথ্যের সাথে সাদৃশ্য খুঁজে পান। এরপর পাদ্রী বাহিরা হযরত মুহাম্মদ (স)- এর পিঠে কোন ছাপ আছে কি না পরীক্ষা করেন। তিনি তাঁর ঘাড়ের মাঝখানে ছোট কাচের পাত্রের গোলাকার আকৃতির এক কাল দাগ দেখতে পান। এটিকি পয়গম্বরের সীল বলা হয়ে থাকে। এরপর পাদ্রী হযরত মুহাম্মদ (স)-কে সাথে নিয়ে আবু তালিবের কাছে গিয়ে তাঁর সাথে হযরত মুহাম্মদ (স)-এর সম্পর্কের কথা জিজ্ঞাসা করেন। আবু তালিব বলেন যে, “হযরত মুহাম্মদ (স) তাঁর ছেলে।” বাহিরা বলেন, “হযরত মুহাম্মদ (স) তাঁর সন্তান হতে পারে না। কারন, তাঁর পিতা অনেক আগেই মারা গেছেন।” এ কথা শুনে আবু তালিব অবাক হলেন এই ভেবে যে, পাদ্রী কিভাবে একথা জানলেন। তিনি স্বীকার করলেন যে, হযরত মুহাম্মদ (স) তাঁর ভাই-এর ছেলে, অর্থাৎ ভ্রাতুষ্পুত্র। তাঁর মা গর্ভবতী অবস্থায় তাঁর পিতার মৃত্যু হয়। পৌত্তলিকতা বিরোধী খ্রিস্টান পাদ্রী বাহিরা আবু তালিবকে পরামর্শ দিলেন যে, তিনি যেন অনতিবিলম্বে সিরিয়া থেকে মক্কায় হযরত মুহাম্মদ (স)-কে নিয়ে ফিরে যান। তিনি আবু তালিবকে সতর্ক করে দেন যে, তিনি যেন কুচক্রী ইহুদীদের কোপানল থেকে তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্রকে রক্ষা করেন। তিনি আরও বলেন, ধর্মগ্রন্থ থেকে হযরত মুহাম্মদ (স) সম্বন্ধে তিনি যা জেনেছেন তা যদি কুচক্রী ইহুদী সম্প্রদায় জানতে পারে তাহলে তারা হযরত মুহাম্মদ (স)-এর মারাত্মক ক্ষতি করবে। তিনি ভবিষ্যৎ বাণী করেন যে, ধর্মগ্রন্থে প্রতিশ্রুত নবী হিসেবে (সর্বশেষ নবী) হযরত মুহাম্মদ (স) আবির্ভূত হবেন। বাহিরার পরামর্শ মত আবু তালিব দেরি না করে অতি সত্বর সিরিয়া থেকে হযরত মুহাম্মদ (স)-কে নিয়ে মক্কায় ফিরে যান।
৩. খাদিজার সাথে হযরত মুহাম্মদ (স)-এর বিবাহ
হযরত মুহাম্মদ (স)-এর জীবনের প্রথম পর্বের সর্বাপেক্ষা যুগসন্ধিক্ষণকারী ঘটনা হচ্ছে খাদিজা বিনতে খুওয়াইলিদ বিন আসাদের বিবাহ। ঐতিহাসিকদের বর্ণনায় জানা যায় যে, হযরত মুহাম্মদ (স)-এর সততা, অনুপত চরিত্র, সত্যনিষ্ঠা, অসাধারণ নৈতিক গুণাবলি ও বিশ্বাসযোগ্যতার কথা জানতে পেরে মুগ্ধ হয়ে তাঁকে তাঁর (খাদিজা) বাণিজ্যের তত্ত্বাবধায়ক ও প্রতিনিধি নিযুক্ত করেন। তিনি মক্কার একজন ধনাঢ্য বিধবা ব্যবসায়ী ছিলেন এবং মক্কা থেকে সিরিয়ায় কাফেলা পণ্যদ্রব্য নিয়ে তাঁর প্রতিনিধিদের পাঠাতেন। তিনি প্রথমে আবু হালা-বিন বানাস তামিমিকে বিয়ে করেন। আবু হালার মৃত্যুর পর বনু মখযুম গোত্রের আতিক নামে এক ব্যক্তির সাথে দ্বিতীয়বার তাঁর বিয়ে হয়। পরপর দুই স্বামীর মৃত্যুর পর খাদিজা বৈধব্য জীবন কাটাচ্ছিলেন। হযরত মুহাম্মদ (স)-এর তত্ত্বাবধানে সিরিয়ায় বাণিজ্যের সম্প্রসারণ হলে তিনি তার প্রতিনিধির প্রতি খুব খুশি হন। তার বাণিজ্যিক দক্ষতা, সাধুতা, আমানতদারী এবং চারিত্রিক নিষ্কলুষতায় মুগ্ধ হয়ে খাদিজা হযরত মুহাম্মদ (স)-এর কাছে বিয়ের প্রস্তাব পাঠান। হযরত মুহাম্মদ (স) খাদিজার প্রস্তাবে রাজী হলেন। এ সময় খাদিজার বয়স ছিল চল্লিশ এবং হযরত মুহাম্মদ (স)-এর পঁচিশ বছর। ৫৯৫ খ্রিস্টাব্দে তাঁদের বিয়ে সম্পন্ন হয়। তাঁদের বিবাহিত জীবন হযরত মুহাম্মদ (স)-এর নবুওয়াতের দশম বছর অর্থাৎ ৬২০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত স্থায়ী হয়। কারণ, এ বছর খাদিজা চৌষট্টি বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন। হযরত মুহাম্মদ (স)-এর ঔরষে হযরত খাদিজার, যিনি পরে “খাদিজাতুত তাহিরা” নামে অভিহিত হন, গর্ভে তিনপুত্র এবং চার কন্যা জন্মে— তাঁরা হচ্ছেন (তিন পুত্র) কাশেম, আবদুল্লাহ আল-তৈয়ব এবং আত-তাহির- যারা শৈশবে মৃত্যুবরণ করেন এবং চার কন্যা— উন্মে কুলসুম, রোকেয়া, যয়নব এবং ফাতেমা। পুত্র তিনটি শৈশবেই মারা যান। তাঁর কন্যারা তাঁর মৃত্যুর পর জীবিত ছিলেন। ৬৯৫ সাল থেকে প্রতি বছর ইবন সা’দের ভাষ্য অনুযায়ী, খাদিজা একটি করে সন্তান প্রসব করেন অর্থাৎ চল্লিশ বছরে তাঁর বিয়ে হলে সর্বশেষ সন্তান প্রসবের সময় তাঁর বয়স ছিল আটচল্লিশ। এটা অবশ্য মোটেই অস্বাভাবিক নয়; তবে অনেকের কাছে এটা অলৌকিক ঘটনা বলে মনে হতে পারে। এ প্রসঙ্গে ইবন সা’দ, ইবন হিশাম অথবা আত-তাবারী কোন মন্তব্য করেন নি।
খাদিজার সাথে বিবাহের পর হযরত মুহাম্মদ (স) মক্কার অভিজাত শ্রেণীবর্গের সাথে মিশতে পারলেন, যা তাঁর ধর্মপ্রচারে পরবর্তীকালে সহায়ক ছিল। অন্যদিকে খাদিজার প্রতিনিধি হিসেবে হযরত মুহাম্মদ (স)-এর বাণিজ্যিক সাফল্য তাঁর সুনাম বৃদ্ধি করে এবং এ কথা মনে করার যথেষ্ট কারণ আছে যে, বিয়ের পরেও তিনি স্বয়ং সিরিয়ায় বাণিজ্য উপলক্ষে না গেলেও তার প্রতিনিধির মাধ্যমে তাঁর নিজস্ব পুঁজি খাটিয়ে বহির্বাণিজ্যে অংশ নেন। ব্যবসা করলেও মক্কার বৃহত্তর বণিক গোষ্ঠীর সাথে হযরত মুহাম্মদ (স)-এর তেমন সখ্যতা গড়ে উঠে নি। এ কারণে ব্যবসায়ে মুনাফার মাত্রা তাঁর খুব কম ছিল। এ সময়ে আবদ শামস পরিবারের প্রাধান্য বেশি ছিল এবং তাঁর কন্যা জয়নবের সাথে আবদ শামস পরিবারের এক সদস্যের বিয়ে দিয়ে তাঁদের সাথে সম্পর্ক গড়ে তুলেন। জয়নবের বিয়ে হয় তাঁর খালাতো ভাই আবুল আস-ইবন রাবী লাকীতের (অর্থাৎ খাদিজার বোনের ছেলে) সাথে। লক্ষণীয় যে, হযরত মুহাম্মদ (স)-এর অপর দুই কন্যা রোকেয়া ও উম্মে কুলসুমের বিবাহ হয় ইসলামের চির শত্রু আবু লাহাবের দুই পুত্রের সাথে, যারা ওতবা এবং ওতাইবা নামে পরিচিত ছিলেন। (কিন্তু আকদের পর আবু লাহাবের, যিনি হযরত মুহাম্মদ (স)-এর চাচা ছিলেন, নির্দেশে তার দুই পুত্র হযরত মুহাম্মদ (স)-এর কন্যাদের ঘরে তুলে নিবার পূর্বে তালাক দেন। সুতরাং এ কথা বলা যায় যে, হযরত মুহাম্মদ (স) স্বগোত্রীয় সদস্যদের সাথে সখ্যতা স্থাপনের চেষ্টা করে মক্কার সমাজে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করেন।
ষষ্ঠ শতাব্দীতে মক্কায় একজন মহিলা ব্যবসায়ীকে জাগতিক বিষয়েই সচেতন হতে দেখা যায় নি। তিনি হযরত মুহাম্মদ (স)-এর আধ্যাত্মিক ক্ষমতার প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। মোদ্দা কথা, খাদিজা হযরত মুহাম্মদ (স)-এর আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতার ক্ষেত্রে বিশেষ আগ্রহী ছিলেন এবং সর্বাত্মক সমর্থন দেন। এ কথা নিশ্চিত করে বলা যায় যে, খাদিজা হযরত মুহাম্মদ (স)-এর ঐশীবাণী লাভে তিনি বিশ্বাস করেন এবং তিনি হেরা পর্বেতের গুহা থেকে ঐশীবাণী লাভ করে কাঁপতে কাঁপতে ঘরে ফিরে আসলে তিনি কম্বল দিয়ে তাঁকে চেপে ধরেন। তিনি তাঁকে অভয় ও উৎসাহ দিয়ে বলেন যে, তিনি আল্লাহর পয়গম্বর হিসেবে প্রেরিত হয়েছেন। বস্তুত খাদিজাই প্রথম ইসলাম ধর্মে দীক্ষা লাভ করেন। হযরত মুহাম্মদ (স)-এর ওহী লাভের পর খাদিজা তাঁর অন্ধ ও বৃদ্ধ চাচাতো ভাই ওয়ারাকা-বিন-নওফল বিন আসাদের, যিনি তাওরাত ও ইঞ্জিলে গভীর জ্ঞান রাখতেন, কাছে গিয়ে ঘটনাটি বললেন। এ কথা শুনে ওয়ারাকা বললেন, “অনুরূপ ঐশীবাণী মুসা ও ঈসার কাছে এসেছিল। সুতরাং হযরত মুহাম্মদ (স) অচিরেই নবী হবেন।” ওয়ারাকা একজন আধ্যাত্মিক ব্যক্তি ছিলেন, যিনি পরবর্তীকালে খ্রিস্ট ধর্ম গ্রহণ করেন। খাদিজা ওয়ারাকার ধর্মীয় মতবাদ (হানিফ) বিশ্বাস করতেন এবং হযরত মুহাম্মদ (স)-ও তার দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করেন।
বিবাহের পরের বছরগুলো (খ্রি. ৫৯৫-৬১০) হযরত মুহাম্মদ (স)-এর জন্য নবুওয়াত লাভের প্রস্তুতি হিসেবে গণ্য করা যায়। এ সময়ে হযরত মুহাম্মদ (স)-এর নবুওয়াত লাভ এবং ইসলাম প্রচারের প্রস্তুতি পর্ব কি রূপ ছিল তা সঠিকভাবে বর্ণিত হয় নি। যাহোক, এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যায় যে, ৬০৫ খ্রিস্টাব্দে কা’বাঘরের সংস্কারের পর পবিত্র কাল পাথর স্থাপনের জন্য যখন গোত্রপতিদের মধ্যে কলহ শুরু হল তখন হযরত মুহাম্মদ (স), পঁয়ত্রিশ বছর বয়সে, এক সমাধান দিয়ে রক্তপাত বন্ধ করেন। তিনি নিজের গায়ের চাদরের ওপর কাল পাথরটি রেখে এর চার প্রান্ত কলহরত গোত্রের চারজনকে ধরে পাথরটি বয়ে নিয়ে আসতে বলেন। এরপর হযরত মুহাম্মদ (স) নিজের হাতে কাল পাথরটি তুলে যথাস্থানে রাখলেন। উপস্থিত বুদ্ধি, অসাধারণ ব্যক্তিত্ব বিচক্ষণতার ফলে হযরত মুহাম্মদ (স) এক ভয়াবহ রক্তপাত বন্ধ করতে সক্ষম হন। ৬০৫ খ্রিস্টাব্দে, পঁয়ত্রিশ বছর বয়সে, তার মধ্যে ভাবান্তর দেখা দেয়। তিনি প্রতি বছর একমাস মক্কার অদূরে হেরা পাহাড়ের গুহায় গভীর ধ্যান ও বন্দেগীতে রত থাকতেন। তিনি সেখানে স্রষ্টা ও তাঁর সৃষ্টির ধ্যানে মগ্ন থাকতেন। এভাবে চল্লিশ বছর বয়সে ৬১০ খ্রিস্টাব্দে তিনি ওহী লাভ করে নবী হলেন। এ সময়ে হযরত মুহাম্মদ (স) আল্লাহর প্রত্যক্ষ হেফাজতে ছিলেন এবং তাঁকে মহান সৃষ্টিকর্তা দিক নির্দেশনা দিচ্ছিলেন। সূরা দুহা (৯৩)-এর ৩ থেকে ৮ নম্বর আয়াতে হযরত মুহাম্মদ (স)-এর প্রতি আল্লাহর কৃপাদৃষ্টির উল্লেখ পাওয়া যায়।
৪. নবুওয়াত
(ক) আজ-জুহরী বর্ণিত হাদিসসমূহ : ঐতিহাসিকদের বিবরণ থেকে জানা যায় যে, হযরত মুহাম্মদ (স) চল্লিশ বছর বয়সে নবুওয়াত লাভ করেন। ‘ওহীর’ মাধ্যমে তাঁর কাছে কুরআন নাজিল করা হয়। আল্লাহর প্রেরিত স্বর্গীয় দূত ও সংবাদদাতা জিবরাইল এই ঐশীবাণী নিয়ে আসেন বিভিন্ন স্তরে। হেরা পর্বতের গুহায় ধ্যানমগ্ন অবস্থায় ৬১০ খ্রিস্টাব্দে তিনি মহান আল্লাহর কাছ থেকে ঐশীবাণী লাভ করেন। ঐশীবাণীর বিবরণ বিভিন্ন সূত্র থেকে পাওয়া গেলেও সর্বাপেক্ষা নির্ভরযোগ্য ও তথ্যবহুল বিবরণ দেন প্রখ্যাত ঐতিহাসিক ও হাদিসকার আজ-জুহরী। তাঁর প্রকৃত নাম ইবন শিহাব আজ জুহরী (জন্ম খ্রি. ৭৪২)। তিনি হযরত মুহাম্মদ (স)-এর গোত্রভুক্ত ছিলেন। কখন কিভাবে কার মাধ্যমে কুরআনের বাণী অবতীর্ণ হয় এবং মাঝে মাঝে ঐশীবাণী না আসার কারণ সম্বন্ধে আজ-জুহরী গবেষণামূলক প্রবন্ধ রচনা করেন। সাধারণভাবে ঐশীবাণী না আসাকে “ফাতরা’ বলা হয়েছে। আজ-জুহরী বর্ণিত যে সমস্ত হাদিস থেকে ঐশীবাণী প্রসঙ্গে সঠিক তথ্য জানা যায় তা হচ্ছে :
(ক) আয়েশা থেকে উরওয়ান, উরওয়ান থেকে আজ-জুহরী এবং জুহরী থেকে শ্রবণ করে আন-নুমান-বিন রশিদ আয়েশার কথা উল্লেখ করে বলেন, “আল্লাহর রসূল প্রথম দিকে স্বপ্নাদিষ্ট হয়ে ওহী লাভ করতেন।” এই পদ্ধতি ‘আররুয়া-আস-সাদিকা’ নামে পরিচিত। সূরা অবতীর্ণ হওয়া ছিল রাতের পর প্রত্যুষ হওয়ার মত।
(খ) নবী করিম (স) একাকিত্ব ও নিঃসঙ্গতা পছন্দ করতেন। এ কারণে প্রায়ই তিনি সুউচ্চ হেরা পাহাড়ের গুহায় ধ্যানমগ্ন থাকতেন, যাকে ‘তাহাহ’ বলা হয়েছে। তিনি পরপর কয়েক রাত আল্লাহর বন্দেগী করে ঘরে ফিরতেন। কখনো কখনো গুহা থেকে খাদ্য সংগ্রহের জন্য তাঁর পরিবারের কাছে ফিরে আসতেন; এরপর আবার হেরা পাহাড়ের গুহায় তপস্যা করতেন। এখানে ধ্যানমগ্ন অবস্থায় তাঁকে বলা হয়েছিল যে, তিনি আল্লাহর প্রেরিত পুরুষ বা পয়গম্বর হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন।
(গ) আজ-জুহরী বর্ণিত হাসিদ থেকে জানা যায় যে, নবী করিম (স) একদিন দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ কিসের চাপে হাঁটু গেড়ে বসে পড়েন এবং উঠে দাঁড়াবার ক্ষমতা লোপ পাওয়ায় হামাগুড়ি দিয়ে চলে গেলেন এবং এভাবে চলে যাওয়ায় তিনি তাঁর কাঁধে প্রচণ্ড ব্যথা অনুভব করলেন। এরপর তিনি তাঁর স্ত্রী বিবি খাদিজার ঘরে গিয়ে বললেন, “আমাকে কম্বল চাপা দাও (জাম্মিলুনি) যতক্ষণ না আমার ভয় দূর হয়।” এরপর জিবরাঈল তাঁর কাছে এসে বলেন যে, “মুহাম্মদ, তুমি আল্লাহর প্রেরিত পুরুষ-পয়গম্বর।”
(ঘ) হযরত মুহাম্মদ (স)-এর ভাষ্য অনুযায়ী, (জুহরী বর্ণিত) আমি হেরা পাহাড়ের চূড়া থেকে লাফ দিবার যখন চিন্তাভাবনা করছি তখন জিবরাঈল আমার কাছে এসে বলেন, “হে মুহাম্মদ, আমি জিবরাঈল, আল্লাহর তরফ থেকে তোমার জন্য সুসংবাদ এনেছি। মহান আল্লাহ তোমাকে পয়গম্বর করেছেন।”
(ঙ) একদিন জিবরাঈল (আ) এসে হযরত মুহাম্মদ (স)-কে বললেন, “পড়।’ জবাবে হযরত মুহাম্মদ (স) বললেন, “আমি পড়তে পারি না; অথবা বলা হয়েছে আমি কি পড়ব? আমি ত পড়তে জানি না।” এরপর জিবরাঈল (আ) তাঁকে তিনবার খুব জোরে দুমড়াতে মুচড়াতে লাগলেন যতক্ষণ না পর্যন্ত তিনি ক্লান্ত না হয়ে পড়েন। এরপর জিবরাঈল (আ) বললেন, “পড়, সেই প্রভুর নামে যিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন।” এরপর হযরত মুহাম্মদ (স) পাঠ করেন।
(চ) একদিন হযরত মুহাম্মদ (স) খুব অস্থিরভাবে বিবি খাদিজার ঘরে এসে বললেন যে, তাঁর খুব দুশ্চিন্তা হচ্ছে। তারপর তিনি তাকে তার অভিজ্ঞতার কথা বললেন (জিবরাঈলের আগমন প্রসঙ্গে)। হযরত মুহাম্মদ (স)-এর কথা শুনে বিবি খাদিজা আনন্দে চিৎকার করে বললেন যে, এটি তো খুবই শুভ সংবাদ, কারণ, তিনি পয়গম্বর হয়েছেন। খাদিজা তাকে আরও পরামর্শ দেন যাতে তিনি আল্লাহর নির্দেশিত পথে চলতে পারেন, আত্মীয়-স্বজনের উপকার করতে পাররেন; তিনি যেন সবসময় সত্যের পথে চলতে পারেন এং তাঁর প্রতি যে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে তা যেন নিষ্ঠার সাথে পালন করতে পারেন। বিবি খাদিজা (রা) তাঁর স্বামীকে কষ্টসহিষ্ণু হতে বলেন, অতিথিদের আপ্যায়ন এবং গরিব-দুঃখীদের সাহায্য করার পরামর্শ দেন। বস্তুত বিবি খাদিজাই প্রথম মুসলিম হিসেবে সম্মানের অধিকারী হয়েছিলেন।
(ছ) ওহী নাজেলের পর হযরত মুহাম্মদ (স) ঘরে ফিরে তার স্ত্রী বিবি খাদিজাকে তাঁর অভিজ্ঞতার কথা বললে খাদিজা তাঁকে তাঁর চাচাতো ভাই ওয়ারাকা বিন নওফেলের কাছে নিয়ে যান। খাদিজা ওয়ারাকাকে হযরত মুহাম্মদ (স)-এর কথা শুনতে বললেন। ওয়ারাকা হযরত মুহাম্মদ (স)-কে তাঁর অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে বললেন। তাঁর কথা শুনে ওয়ারাকা বললেন, “এটি হচ্ছে ‘নামুস’, যা তাঁর পূর্বে মুসা বিন ইমরানের কাছে পাঠানো হয়েছিল। এটি ঐশীবাণী: ওয়ারাকা আরও বলেন যে, যদি বৃদ্ধ না হয়ে হযরত মুহাম্মদ (স)-এর মতো হতেন তাহলে অবশ্যই তিনি তাঁকে সাহায্য করতেন। হযরত মুহাম্মদ (স) ওয়ারাকাকে জিজ্ঞাসা করলেন, “তাঁর নবুওয়াত লাভের ফলে তিনি কি তাঁর গোত্র থেকে বিতাড়িত হবেন? জবাবে তিনি বললেন, “কোন মানুষ তুমি যা লাভ করেছ তা পায় নি। সুতরাং এতে অবশ্যই শত্রুতার সৃষ্টি হবে। আমি যদি তোমার মত জোয়ান হতাম তাহলে বীরদর্পে তোমার সাহায্যে এগিয়ে আসতাম।”
(জ) হযরত মুহাম্মদ (স) বলেন যে, তার কাছে পবিত্র কুরআনের প্রথম যে অংশ অবতীর্ণ হয়েছিল তা হচ্ছে সূরা আলাক (৯৬)। এর পর সূরা কলম (৬৮); সূরা মুদ্দাছছির (৭৪) এবং সূরা দুহা (৯৩)।
সূরা আলাকে বলা হয়েছে : “পাঠ কর, তোমার প্রতিপালকের নামে, যিনি সৃষ্টি করেছেন মানুষকে রক্তপিণ্ড থেকে। পাঠ কর, তোমার প্রতিপালক মহামহিমান্বিত, যিনি কলম দিয়ে তোমাকে শিক্ষা দিয়েছেন- শিক্ষা দিয়েছেন মানুষকে, যা জানত না।”
(খ) হযরত মুহাম্মদ (স)-এর দিব্যদৃষ্টি : নবী করিম হযরত মুহাম্মদ (স) কোন্ কোন্ মাধ্যমে আল্লাহর কাছে ওহী বা ঐশীবাণী লাভ করেছিলেন- তা বিভিন্ন সূত্রে বর্ণিত হয়েছে। এগুলোর মধ্যে কুরআন ও হাদিসে উল্লেখিত মাধ্যমগুলো হচ্ছে (ক) দিব্যদৃষ্টি বা ‘কালব-ই-ওহী’; (খ) স্বপ্নাদিষ্ট বা ‘কাসাফ’; (গ) জিবরাঈল কর্তৃক সশরীরে এসে ওহী নাজিল; (ঘ) ঘণ্টা ধ্বনির সাথে সাথে ওহী লাভ।
হযরত মুহাম্মদ (স) যে দিব্যদৃষ্টি বা ‘কালব’ দিয়ে ওহী লাভ করেন- তার উল্লেখ কুরআন ও হাদিসে রয়েছে। এটি ‘আর-রুয়া-আস-সাদিক’ নামে অভিহিত। এটি স্বপ্নাদিষ্ট থেকে পৃথক। সূরা নাজমের (৫৩) ১ থেকে ১৮ আয়াতে এ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে :
“শপথ নক্ষত্রের, খন তা হয় অস্তমিত,
তোমাদের সঙ্গী বিভ্রান্ত নয়, বিপথগামীও নয় এবং সে মনগড়া কথাও বলে না;
এটা (কুরআন) তো ওহী, যা তার প্রতি প্রত্যাদেশ হয়, তাকে শিক্ষাদান করে শক্তিশালী (জিবরাঈল),
যখন বৃক্ষটি, যাদ্বারা শোভিত হবার তাদ্বারা ছিল মণ্ডিত,
তার দৃষ্টি বিভ্রম হয় নি, দৃষ্টি লক্ষ্যচ্যুতও হয় নি।
সে তো তার প্রতিপালকের মহান নিদর্শনাবলী দেখেছিল।”
(গ) হেরা গুহায় ধ্যান : ‘তাহান্মুথ’
হযরত মুহাম্মদ (স) যে মক্কার অদূরে অবস্থিত হেরা পর্বতের গুহায় গিয়ে ধ্যানমগ্ন হতেন তা সকল ঐতিহাসিক একবাক্যে স্বীকার করেছেন। কিন্তু ওয়াটের ভাষ্য যে, যেহেতু প্রচণ্ড গ্রীষ্মকালে আল-তায়েফে যাওয়া সকলের জন্য সম্ভব হয় না, সেজন্য হযরত মুহাম্মদ (স) এবং তাঁর পরিবারবর্গ হেরা গুহায় আশ্রয় নিতেন তা বিশ্বাসযোগ্য নয়। প্রথমত, ৬০৫ খ্রিস্টাব্দ থেকে নবীর ভাবান্তর হলে তিনি আল্লাহর বন্দেগী করার জন্য নির্জন গুহায় ধ্যানমগ্ন ছিলেন দীর্ঘ পাঁচবছর। অর্থাৎ ৬১০ খ্রিস্টাব্দে ঐশীবাণী লাভের পূর্ব পর্যন্ত তিনি এভাবে কাটান। এ সময়ে গুহায় তাঁর পরিবারের কোন সদস্য থাকত না। এটি হযরত মুহাম্মদ (স)-এর আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতার একটি নিদর্শন এবং তিনি আল্লাহর সান্নিধ্য কামনা করতেন। ওয়াট এখানে ভুল ব্যাখ্যা দিয়েছেন। একই ভাবে খ্রিস্টান পাদ্রী বাহিরা, যার সাথে নবীর বসরায় দেখা হয়েছিল, এক গুহায় বাস করতেন। ইহুদী ও খ্রিস্টান ধর্মে এই ধারনের কৃচ্ছ্রসাধন ও নিঃসঙ্গ উপাসনার অনেক ঘটনা রয়েছে।
‘তাহান্মুথের’ প্রকৃত অর্থ বলা দুষ্কর; তবে ব্যাখ্যাদানকারীগণ এর অর্থ করেছেন তপস্যা, ধ্যান, বন্দেগী। এইচ হার্সফেল্ড বলেন যে, এই শব্দটি হিব্রু তেহিনট (tehinot)। যা তেহিনথ (thehinnoth) থেকে গ্রহণ করা হয়েছে- যার অর্থ সৃষ্টিকর্তা, ঈশ্বর, আল্লাহর কৃপালাভের জন্য প্রার্থনা। ‘তাহাথের’ আর একটি ব্যাখ্যা হচ্ছে “পাপ কাজ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য ভাল কাজ করা।
হেরা পাহাড়ের গুহায় হযরত মুহাম্মদ (স)-এর ধ্যান-বন্দেগী প্রসঙ্গে ওয়াট বলেন যে, বাল্যকাল থেকেই হযরত মুহাম্মদ (স) মক্কার সামাজিক এবং ধর্মীয় অনাচারের কথা জানতেন। তিনি অনাথ থাকায় মক্কার সামাজিক দুরবস্থার কথা ভালভাবে উপলব্ধি করেন। তিনি মক্কার শিক্ষিত ও জ্ঞানবুদ্ধিসম্পন্ন অধিবাসীদের মধ্যে প্রচলিত (বিশেষ করে হানিফ গোষ্ঠী) এক ধরনের একেশ্বরবাদে বিশ্বাসী ছিলেন। সে সময়ে পৌত্তলিকতার প্রভাব ও প্রাধান্য ছিল অপরিসীম : এ কারণে একেশ্বরবাদের প্রচার হয় নি। হযরত মুহাম্মদ (স) ধর্মীয় সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেন। এ কারণে তিনি ধর্মীয় কলূষতা ও পাপাচারে ভীতশ্রদ্ধ হয়ে নির্জনে নিভৃতে হেরা গুহায় আল্লাহর বন্দেগী করতেন। তিনি আল্লাহর করুণা ভিক্ষা করতেন, সান্নিধ্য চাইতেন এবং তাঁর গোত্রের ধর্মীয় কুসংস্কারের পাপ থেকে তাদের মুক্তি কামনা করতেন। সাধারণভাবে মনে করা হয়ে থাকে যে, এভাবে ধ্যানমগ্ন থাকা অবস্থায় রবিউল আওয়াল মাসের ১২ তারিখে তিনি ‘ওহী’ লাভ করে নবী হন। কুরআন অবতীর্ণ হয়েছিল খণ্ডে খণ্ডে, এক সাথে নয়। এ কারণে কোন কোন সূরা কখন, কোথায়, কিভাবে অবতীর্ণ হল- তা সঠিকভাবে বলা মুস্কিল। অবশ্য পরবর্তীকালে খলিফা ওসমানের শাসনামলে কুরআন সংকলিত হয় যায়েদ বিন সাবিতের তত্ত্বাবধানে।
(ঘ) নবুওয়াত লাভ : আজ-জুহরী তাঁর বর্ণিত হাদিসের চার জায়গায় হযরত মুহাম্মদ (স)-কে আল্লাহর প্রেরিত পুরুষ বা পয়গম্বর বলে উল্লেখ করেছেন। অবশ্য কুরআনে বহুবার এ কথার উল্লেখ পাওয়া যায় যে, পথপ্রদর্শক, সাবধানকালী হিসেবেই পয়গম্বরদের অভিহিত করা হয়েছে। মক্কী সূরায় ফেরেশতা জিবরাঈলকে নাম হিসেবে উল্লেখ করা হয় নি। তবে তিনি যে আল্লাহর তরফ থেকে প্রত্যাদেশ রাসূলের কাছে নিয়ে আসতেন তার উল্লেখ পাওয়া যায়। এ প্রসঙ্গে বলা প্রয়োজন যে হযরত মুহাম্মদ (স)- এর কাছে যে সমস্ত সূরা নজিল হয়েছিল সেগুলোর তাৎক্ষণিক ব্যাখ্যা দেওয়া সম্ভব হয় নি। পরবর্তী পর্যায়ে অন্যান্য সূরার আয়াত নাজিল করে সেগুলোর ব্যাখ্যা দেওয়া হয়। পবিত্র কুরআনে এজন্য একই কথা বহু জায়গায় পুনরাবৃত্তি করা হয়েছে। উপরন্তু, এমনও হয়েছে যে প্রথম পর্যায়ে নাজিল হওয়ার পর পরবর্তী পর্যায়ে অন্য আয়াত দিয়ে পূর্বের আয়াত সংশোধন (মাশুক) করা হয়েছে। সূরা নাজমের (৫৩) কয়েকটি আয়াত এভাবে পরিবর্তিত হয়েছে (পরবর্তী পর্যায়ে আলোচিত হয়েছে)। ঐশীগ্রহণের ক্ষেত্রে এমন হয়েছে যে প্রত্যাদেশ কখনো কখনো হযরত মুহাম্মদ (স)-এর অবচেতন মনে প্রক্ষিপ্ত হতো; এক্ষেত্রেও জিবরাঈল বার্তা বাহকের কাজ করেছেন।
(ঙ) ‘পাঠ কর’ : কুরআন ও হাদিসে উল্লেখ আছে যে, হযরত মুহাম্মদ (স) পাঠ করার জন্য আদিষ্ট হয়েছেন। সূরা আল-আলাক (৯৬)-এর ওপর অনেক ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে। আজ-জুহরী বর্ণিত হাদিসে বলা হয়েছে-ফেরেশতা হযরত মুহাম্মদ (স)-এর কাছে এসে বললেন, “ইকরা” বা “পাঠ কর”। এর জবাবে হযরত মুহাম্মদ (স) জবাব দিলেন, “লা আকরায়ু” অর্থাৎ ‘আমি পাঠ করতে পারি না। এখানে পাঠ অর্থ-পড়া নয়, উচ্চারণ করা। কোন কোন হাদিসে ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে যে, জিবরাঈলের গায়েবী আওয়াজ শুনে হযরত মুহাম্মদ (স) এমনই বিচলিত হয়েছিলেন যে, তাঁর মুখ দিয়ে স্বর বের হচ্ছিল না। তখন জিবরাঈল অভয় দিয়ে তাঁকে দ্বিতীয়বার বলেন, ‘পাঠ কর।’ প্ৰথম বার হযরত মুহাম্মদ (স) জবাব দেন, “মাযা-আকরায়ু” অর্থাৎ “আমি কি পাঠ করব? ঐতিহাসিক তাবারী হাদিসকার আবদুল্লাহ বিন সাদ্দাদের হাদিসের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন যে, হযরত মুহাম্মদ (স) প্রকৃত অর্থে বলেছিলেন, “আমি কি পাঠ করব?” “আমি পাঠ করতে জানি না” বলেন তিনি। যা হোক, হাদিসকারগণ-”মা আনা বি-কারিয়িন” অর্থ “আমি পাঠক নই বা আমি পাঠে অভ্যস্ত নই”-এভাবেও ব্যাখ্যা দিয়েছেন। উল্লেখ যে, ‘কারউন’ (পাঠ করা) থেকেই পবিত্র ধর্মগ্রন্থ কুরআনের উৎপত্তি হয়েছে। কুরআন শব্দটি সম্ভবত সিরিয়াক qeryana” থেকে উদ্ভূত। এর অর্থ বাইবেল পাঠ। ‘কারায়া’ ক্রিয়াপদ-যার অর্থ ‘পাঠ করা’। কিন্তু এখানে গ্রন্থ থেকে পাঠ নয়, স্মৃতি থেকে অথবা শ্রবণ থেকে পাঠ, যা হযরত মুহাম্মদ (স)-এর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। হেরা পাহাড়ে হযরত মুহাম্মদ (স)-এর আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতা ছিল সম্পূর্ণ মনস্তাত্ত্বিক। কারণ গায়েবী আওয়াজ শুনে তাঁকে পাঠ করতে বা পুনরাবৃত্তি (recite) করতে বলা হচ্ছে। তিনি স্বইচ্ছায় বা স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে পাঠ করছেন না। তাঁর ইচ্ছার পিছনে চালিকা শক্তি রয়েছে। অদৃশ্য বজ্রের মত কণ্ঠস্বর স্বভাবত তাঁকে এমনই অস্থির করে যে, তিনি কাঁপতে কাঁপতে তাঁর স্ত্রী খাদিজার ঘরে গিয়ে তাকে কম্বল ঢাকা দিতে বলেন। যাহোক, গায়েবী আওয়াজে (জিবরাঈল) দ্বিতীয়বার বলল “পড়, সেই প্রভুর নামে যিনি তোমাকে এক রক্তপিণ্ড (আল-আলাক) থেকে সৃষ্টি করেছেন।” দ্বিতীয়বারে হযরত মুহাম্মদ (স) আল্লাহর প্রেরিত বাণী পাঠ করলেন। পরবর্তীকালে এটি কুরআনের ৯৬ সূরায়ে, সূরা আল-আলাকে পরিণত হয় এবং নামাজের সময় পঠিত হয়। দ্বিতীয়বার পড়তে বলায় হযরত মুহাম্মদ (স) সহজে যা পড়লেন (বে-ইসমে) তার পরবর্তীকালে “বিসমিল্লাহ’ বা ‘আল্লাহর নামে পরিণত হয়। প্রত্যেক ঈমানদার মুসলিম নামাজ, পানাহার, কোন কাজ করার সময় ‘বিসমিল্লাহ’ বলেন।
মুসলিম ধর্মবেত্তাগণ একমত পোষণ করেন যে, পবিত্র কুরআনের সর্বপ্রথম সূরা হচ্ছে আল-আলাক! কুরআনের অর্থ কোন সূরা এ দাবি করতে পারে নি। হযরত মুহাম্মদ (স) যখন প্রত্যাদেশ লাভ করেন তখন তিনি ‘পাঠে’ জড়িত ছিলেন এবং সে মুহূর্তে তাঁর পরবর্তীকালের সাহাবীগণও জড়িত ছিলেন স্বাভাবিক কারণে। কারণ, তিনি তখনও ধর্ম প্রচার শুরু করেন নি। কালেমা শাহাদাতে বলা হয়েছে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মদুর রাসূলুল্লাহ” অর্থাৎ “আল্লাহ ছাড়া কোন উপাস্য নেই” এবং “মুহাম্মদ আল্লাহর পয়গম্বর বা প্রেরিত পুরুষ।” এ প্রসঙ্গে বলা প্রয়োজন যে, শাহাদাতের শেষের অংশ কুরআনে নেই; হাদিসে বর্ণিত হয়েছে। এক হাদিসে বলা হয়েছে যে, জিবরাঈল একদিন হযরত মুহাম্মদ (স)-এর নিকট এসে বললেন, “আমি জিবরাঈল এবং তুমি মুহাম্মদ, আল্লাহর প্রেরিত পুরুষ।”
(চ) সূরা আল-মুদ্দাছছির (৭৪ : ১-২) : জাবির বিন আবদুল্লাহ আল-আনসারী থেকে বর্ণিত একটি হাদিসে উল্লেখ আছে যে, সূরা আল-মুদ্দাছছির কুরআনের প্রথম সূরা। এর যুক্তি দেওয়া হয়েছে যে, এই সূরায় বলা হয়েছে “হে বস্ত্রাচ্ছাদিত। উঠ, সতর্কবাণী প্রচার কর।” সূরা মুদ্দাছির প্রথম প্রত্যাদেশ নয়, তবে ইসলাম প্রচারের প্রথম নির্দেশ হতে পারে। এ কারণে হযরত মুহাম্মদ (স)-এর জড়তা, দ্বিধা ও স্থবিরতা পরিত্যাগ করে তাওহীদ প্রচারের জন্য আদিষ্ট হলেন। অবশ্য ৬১০ খ্রিস্টাব্দে ওহী লাভ করে নবী হবার সাথে সাথে ধর্মপ্রচার সম্ভব হয় নি। ৬১০ থেকে ৬১৩ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত তিনি গোপনে ধর্ম প্রচার করেন। পরবর্তীতে আল্লাহর নির্দেশে প্রকাশ্যে ধর্ম প্রচার শুরু করেন। সুতরাং বলা যায় যে, সূরা আলাক প্রথম প্রত্যাদেশ এবং সূরা মুদ্দাছির হচ্ছে ধর্ম প্রচারের জন্য প্রথম ঐশীবাণী।
ওয়াট হযরত মুহাম্মদ (স)-এর ধর্মপ্রচারক দু’ভাগে ভাগ করেছেন (ক) গোপনে ধৰ্ম প্রচার (non-Public Ministry) এবং (খ) প্রকাশ্যে ধর্ম প্রচার (Public Ministry)। ইবন ইসহাক বলেন, “এরপর আল্লাহ তাঁর পয়গম্বরকে (মুহাম্মদ) তাঁর নবুওয়াত প্রাপ্তির তিন বছর পর প্রকাশ্যে তাঁর কাছে যা অবতীর্ণ হয়েছে (তাওহীদ) তা প্রচার করতে এবং আল্লাহর বাণী প্রচার করে পৌত্তলিকদের মোকাবিলা করতে এবং একেশ্বরবাদে দীক্ষা দিতে আদেশ করেন।” ঐশীবাণী ছিল এরূপ : তুমি (মুহাম্মদ) নিজের নিকট- আত্মীয়স্বজনকে পাপ ও ঈশ্বরদ্রোহিতার অবশ্যম্ভাবী ফল সম্বন্ধে সতর্ক করে দাও। “ একথা সত্য যে ফেরেশতা জিবরাঈল হযরত মুহাম্মদ (স)-এর কাছে প্রথম প্রত্যাদেশ নিয়ে আসেন, যার ফলে তিনি নবী হলেন। কিন্তু মক্কায় অবস্থানকালে তাঁর ধর্মপ্রচারের প্রথম তিন বছর (৬১০-৬১৩ খ্রিঃ) তিনি যখন গোপনীয়ভাবে ধর্মপ্রচার করছিলেন তখন ফেরেশতা ইসরাফিল, যিনি রোজ কিয়ামতের পূর্বে শিঙ্গায় ফুঁ দিবেন, হযরত মুহাম্মদ (স)-এর কাছে ঐশীবাণী নিয়ে আসেন। হযরত মুহাম্মদ (স)-এর মক্কায় প্রথম তিন বছর সময়কালকে নবুওয়াতের যুগ এবং প্রকাশ্যে ধর্মপ্রচারের দশ বছরকে রিসালাতের যুগ বলা হয়েছে। ঐতিহাসিক ও ধর্মবেত্তাদের ভাষ্য অনুযায়ী হযরত মুহাম্মদ (স)-এর এই ধর্মপ্রচারের সময়কাল মোটামুটি সঠিক। হযরত মুহাম্মদ (স) যখন কুরাইশদের বিরোধিতা ও অমানুষিক উৎপীড়নের আশঙ্কার গোপনীয়ভাবে মক্কায় ধর্মপ্রচার করছিলেন তখন যারা ইসলাম কবুল করেন তাঁদের মধ্যে সর্বাগ্রে নাম করতে হয় তাঁর স্ত্রী বিবি খাদিজা (রা)। তিনি বয়স্কদের এবং মহিলাদের মধ্যে প্রথম মুসলমান। এরপর কনিষ্ঠদের মধ্যে হযরত আলী (রা)। এরপর বয়স্ক পুরুষদের মধ্যে হযরত আবু বকর (রা), যিনি হযরত মুহাম্মদ (স)-এর শ্বশুর এবং হযরত আয়েশা (রা)-এর পিতা ছিলেন। প্ৰথম দিকের অন্যান্য মুসলমানদের মধ্যে যাদের নাম করতে হয় তাঁরা হচ্ছে বেলাল, জায়েদ বিন-হারেস, ওসমান, আবদুর রহমান, সা’দ, যুবাইর ও তালহা। তিন বছরে গোপনে ধর্ম প্রচার করে নব-দীক্ষিত মুসলমানদের সংখ্যা পৌঁছায় ত্রিশের কোঠায়।
(ছ) হযরত মুহাম্মদ (স)-এর ভীতি ও হতাশা : ঐশীবাণী লাভ করা হযরত মুহাম্মদ (স)-এর জীবনের এক অবিস্মরণীয় অভিজ্ঞতা। বিশেষত দুটি কারণে। প্রথমত, ঐশীবাণী (ওহী) অবতীর্ণ হলে হযরত মুহাম্মদ (স) সর্বপ্রথম উপলব্ধি করলেন যে, তিনি ফেরেশতা জিবরাঈলের মাধ্যমে মহান সৃষ্টিকর্তার সান্নিধ্য লাভ করতে যাচ্ছেন। এ ধরনের ভীতি থেকেই তিনি বস্ত্রাচ্ছাদিত হতে চেয়েছিলেন (আল-মুয্যাম্মিল)। দ্বিতীয়ত, তিনি নবী হওয়ার জন্য মানসিকভাবে কতটুকু প্রস্তুত ছিলেন তা বিবেচ্য। এ কারণে একদিকে প্রত্যাদেশ লাভ, অন্য দিকে নবুওয়াতপ্রাপ্তি এবং পরবর্তী পর্যায়ে ধর্ম প্রচার। ওয়াট, হতাশা থেকে হযরত মুহাম্মদ (স)-এর আত্মহত্যার প্রবণতার কথা বলেছেন; বিশেষ করে যখন সাময়িকভাবে ওহী নাজিল স্থগিত হল। এ মন্তব্য সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। হযরত মুহাম্মদ (স) যে নির্ভিক ছিলেন তার প্রমাণ পাওয়া যায় ওহী নাজেলের পূর্বে যৌবনে ফিজারের যুদ্ধে তিনি শত্রুপক্ষের তীর কুড়িয়ে হিশাম গোত্রের সদস্যদের দিয়েছিলেন। ভীতির প্রশ্নে বলা যায় তুর পাহাড়ে হযরত মুসা যখন আল্লাহর সাথে সরাসরি কথা বলেন এবং তাঁর কাছ থেকে তাওরাতের পাথরখণ্ড লাভ করেন তখন তিনিও ভীত ও সন্ত্রস্ত ছিলেন। কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে, তিনি দুর্বলচিত্ত, অস্থিরমতিত্ব ও অযোগ্য ছিলেন। আজ-জুহরী এ প্রসঙ্গে যে কথা বলেছেন তা কতটুকু সত্য তা বিচার করে দেখতে হবে। ওয়াট নিজেই বলেছেন যে, খোদাভীতি ওল্ড টেস্টামেন্টের (মুসা) পয়গম্বর এবং খ্রিস্টান সাধু-সন্ন্যাসীদের (পাদ্রী) মধ্যে কম-বেশি বিদ্যমান ছিল।
(জ) খাদিজা এবং ওয়ারাকার উৎসাহ দান : ওয়াট বলেন যে, প্রত্যাদেশ পাওয়ার পর তিনি তাঁর আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেললে তাঁর স্ত্রী বিবি খাদিজা তাঁকে উৎসাহ ও সমর্থন দেন। এ ধরনের মন্তব্য অগ্রহণযোগ্য। কারণ, চল্লিশ বছর ধরে হযরত মুহাম্মদ (স) নবুওয়াতের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। দাই-মা হালিমার কাছে তিনি সহিষ্ণুতা শেখেন। দুই ফেরেশতা তার বুক চিরে কলুষিত বস্তু বের করে তাঁকে পবিত্র করেন। বসরায় পাদ্রী বাহিরা ভবিষ্যদ্বাণী করেন যে, তিনি পয়গম্বর হবেন। ‘হিলফ-উল-ফুজুল’ এবং কৃষ্ণপাথর তিনি নির্দিষ্ট স্থানে রেখে যে নেতৃত্ব দেন তাতে তাঁর আত্মবিশ্বাস এবং দায়িত্বশীলতা প্রমাণ করে। গায়েবী আওয়াজে তিনি বিচলিত হলে তিনি তাঁর স্ত্রী সান্ত্বনা ও সমর্থন চান, যেটা সব স্বামীর জন্য কাম্য। এতে আত্মবিশ্বাস না থাকার প্রশ্ন আসে না।
বর্ণিত আছে যে, নবুওয়াত প্রাপ্তির পর হযরত মুহাম্মদ (স) খাদিজার ঘরে ঘটনা জানালে তাঁর স্ত্রী তাঁকে তাঁর চাচাতো ভাই ওয়ারাকা ইবন নওফেলের কাছে নিয়ে যান। ওয়ারাকা ছিলেন অন্ধ ও বৃদ্ধ; কিন্তু তাঁর তাওরাত ও ইঞ্জিলে অসীম জ্ঞান ছিল। প্রত্যাদেশের ঘটনা শুনে তিনি মন্তব্য করেন, “অনুরূপ ঐশীবাণী মুসা ও ঈসার কাছেও এসেছিল; সুতরাং হযরত মুহাম্মদ (স) অচিরেই নবী হবেন।” ওয়ারাকা হযরত মুহাম্মদ (স)-কে পাদ্রী বাহিরার মত বিশ্বাস ঘাতক ইহুদী এবং অবিশ্বাসীদের থেকে দূরে থাকার পরামর্শ দেন। ওয়ারাকার আশ্বাসবাণী এবং বিবি খাদিজার উৎসাহ ও প্রভাব নবীর মনে আত্মপ্রত্যয়ের সূচনা করে। ওয়ারাকা প্রত্যাদেশকে ‘নামুস’ বলেছেন। লক্ষণীয় যে ‘তাওরাতের স্থলে’ নামুস শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। ‘নামুস’ গ্রিক শব্দ, অপর দিকে তাওরাত কুরআনে উল্লেখিত শব্দ। ওয়ারাকা ‘নামুস’ শব্দ ‘কেন ব্যবহার করলেন তা সঠিকভাবে বলা যাবে না, তবে তার মন্তব্য সত্য। তবে এখানে প্রশ্ন থেকে যায় যে, তিনি হযরত মুহাম্মদ (স)-কে নবী হিসেবে স্বীকার করেও এবং তাঁর চাচাতো বোন খাদিজা ইসলাম কবুল করলেও তিনি কেন ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে মুসলমান হলেন না? এখানে এভাবে ব্যাখ্যা দেওয়া যায় যে, তিনি খ্রিস্টান ছিলেন না, যদিও ওয়াট এ কথা বলেন, (পূর্বে আলোচিত হয়েছে) : তিনি একেশ্বরবাদী হানিফ, যারা ইব্রাহীমের অনুসারী ছিলেন, গোষ্ঠীভুক্ত ছিলেন। তাছাড়া, হযরত মুহাম্মদ (স)-এর নবুওয়াতের দু বা তিন বছরের মধ্যে ওয়ারাকা মৃত্যুবরণ করেন।
৫. হযরত মুহাম্মদ (স)-এর আধ্যাত্মিক চেতনা
Hero and Hero worship সিরিজ-এ হযরত মুহাম্মদ (স) সম্বন্ধে প্ৰখ্যাত পাশ্চাত্য চিন্তাবিদ থমাস কার্লাইল যে বক্তৃতা দেন তা গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়েছে। এই বক্তৃতার পর পাশ্চাত্যে হযরত মুহাম্মদ (স) সম্বন্ধে অনেক ভ্রান্ত ধারণা দূর হয় [পূর্বে তাঁকে ভণ্ড (false) নবী (মূর) বলা হয়েছে] এবং তাঁর নবুওয়াতের যথার্থতা এবং নবী হিসেবে হযরত মুহাম্মদ (স)-এর নিষ্ঠা, একাগ্রতা ও যোগ্যতা প্রমাণিত হয়। ৬১৩ খ্রিস্টাব্দের পর আল্লাহর প্রত্যাদেশ লাভ করে তিনি প্রকাশ্যে ধর্মপ্রচার শুরু করলে তাঁকে নানা ধরনের শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন সহ্য করতে হয়। ধর্ম প্রচারের জন্য যে কোন ধরনের নির্যাতন ও উৎপীড়নের জন্য তাঁর মানসিক প্রস্তুতি, নব-দীক্ষিত মুসলমানদের অসাধারণ নৈতিক ক্ষমতা এবং নবীর প্রতি তাঁদের অকুণ্ঠ সমর্থন প্রমাণ করে যে, ইসলাম এক বৈপ্লবিক ধর্ম। যা আইয়ামে জাহেলিয়া যুগের পাপাচার ও ধর্মীয় অনাচার দূর করে এক নতুন আলোকবর্তিকা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। উল্লেখ্য, হযরত মুহাম্মদ (স)-এর সাহাবীগণও নির্যাতন সহ্য করে তাঁর নেতৃত্বে সমর্থন জানান। তারা হযরত মুহাম্মদ (স)- এর মহান ব্রতকে কার্যকরী করার জন্য সকল প্রকার আত্মত্যাগ করেন। হযরত মুহাম্মদ (স)-কে হত্যার হুমকি দেওয়া হলে হাশিম ও মোত্তালেব গোত্রের সকলে মিলে তাঁকে সকল প্রকার বিপদ থেকে রক্ষার প্রতিশ্রুতি দেন। অত্যাচার ও উৎপীড়নের এই অগ্নি পরীক্ষায় হযরত মুহাম্মদ (স) যে ধৈর্য ও সাহসিকতা প্রদর্শন করেন তা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল।
খ. কুরআনের মৌলিকত্ব : কুরআনের মৌলিকতা সম্বন্ধে কোন বিতর্ক নেই। কুরআনের ঐশীবাণী অনেক সামাজিক, নৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিজনিত সমস্যাবলির সমাধান দিলেও সকল সমস্যার সমাধান একবারে (মক্কায়) দিতে পারে নি, স্তরে স্তরে ওহী নাজিলের মাধ্যমে অবস্থা বিবেচনা করে সমাধান দেওয়া হয়েছে মদিনায়। মক্কার প্রথম পর্যায়ে অবতীর্ণ ওহীগুলোকে ঐশ্বরিক বাণী বলা হয়েছে; যা নিঃসন্দেহে তৎকালীন সমাজের প্রেক্ষাপটে শুধু মৌলিক ও সৃজনশীলই নয়, বৈপ্লবিকও বটে। ওয়াট এ সমস্ত ঐশীবাণীকে creative irruption বলেছেন।
মক্কায় বিরাজমান জঘন্য পরিস্থিতিতে কুরআনের অমোঘ বাণীর প্রয়োজনীয়তা ছিল। এই পরিস্থিতি ৬১০ খ্রিস্টাব্দে কুরআন অবতীর্ণ হবার পূর্ব পর্যন্ত বিরাজ করে। কুরআনে আরবী ভাষায় নাজিল হয় এবং শুদ্ধ ও ছন্দময় সাহিত্যিক ভাষা এই ধর্মগ্রন্থে দেখা যায়। নলডেকে বলেন যে, কুরআন ছন্দায়িত গদ্যে অবতীর্ণ হয়েছে। জার্মান কবি গ্যাটের ভাষায়, “Its style in accordance with its contents and aim is stern, grand, terrible-even and anon truly sublime Thus the book will go on exercising through all ages a most potent influence.”
কুরআনের মক্কা পর্যায়ে যে আয়াতসমূহ নাজিল হয়েছে তা দেখে মনে হয় যে, তাতে আরব তথা মক্কাবাসীর মনমানসিকতা প্রতিফলিত হয়েছে। প্রমাণস্বরূপ বলা যায় যে আরব ছাড়া উট সম্বন্ধে সূরা গ্যাশিয়ার (৮৮) ১৭ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
“তবে কি তারা (মক্কাবাসীরা) লক্ষ্য করে না যে, উট কিভাবে সৃষ্টি করা হয়েছে?”
কুরআনে বর্ণিত মহান আল্লাহর গুণাবলি ও ক্ষমতা সম্বন্ধে ‘আবরগণ অবহিত হয় বিভিন্ন ঐশীবাণীর মাধ্যমে, যা ইসলাম আবির্ভাবের পূর্বে তারা তা জানতো না।
ওয়াট বলেছেন যে, কুরআনের মক্কা পর্বে অবতীর্ণ সূরায় ‘রিবা’ বা সুদ প্ৰসঙ্গে কোন উল্লেখ নেই। মক্কার বাণিজ্যিক পরিবেশে কুষিদ প্রথা ছিল খুবই স্বাভাবিক এবং কুষিদ প্রথা দোষের কিছু ছিল না। ইসলামের আবির্ভাবের পূর্বে আরব তথা মক্কার সমাজে ভাল- মন্দ কাজ সম্বন্ধে কোন সঠিক ধারণা ছিল না, এ কারণে কুষিদ প্রথা অব্যাহত থাকে। তবে কুষিদ প্রথা যা শোষণমূলক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা, সম্মানজনক ছিল না, তা মক্কাবাসীরা জানতেন। ইসলামের আবির্ভাবের পর যখন নব-দীক্ষিত মুসলিম সম্প্রদায় গড়ে উঠে তখন কুষিদ প্রথার প্রতি নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। এই নিষেধাজ্ঞা ইহুদি সম্প্রদায়ের ওপর প্রযোজ্য ছিল। কারণ, ইহুদি সম্প্রদায় এই ঘৃণ্য কাজে নিয়োজিত ছিল।
ওয়াটের মতে, কুরআনের আদি পর্বে অবতীর্ণ সূরায় বর্ণিত ঘটনাবলির সাথে প্রাক- ইসলামী যুগের মক্কার অবস্থার কোন কোন ক্ষেত্রে বৈপরীত্য নেই। যেমন- কৃষিদ প্ৰথা (বহু পরে নিষিদ্ধ হেয়ছে মদিনায়, যা ইহুদি বিরোধী পদক্ষেপ) এবং মুরুয়া বা গোত্রপ্রীতি। তিনি প্রখ্যাত জার্মান ইসলামী চিন্তাবিদ গোল্ডজিহের (Goldziher ) -এর সমালোচনা করেন। গোল্ডজিহের তার তথ্যবহুল এবং নির্ভরযোগ্য Muhammanische Studien গ্রন্থের প্রথম পরিচ্ছেদে ‘Muruwah and Din’ প্রসঙ্গে বলেন যে, এ দুটি পরস্পরবিরোধী, ‘মুরুয়া’ প্রাক ইসলামী যুগের গোত্রপ্রীতি এবং দ্বীন অর্থ আল্লাহর প্রেরিত ধর্ম; কিন্তু ওয়াট মনে করেন যে, এ দুটির মধ্যে গোল্ডজিহের যে বৈপরীত্য দেখিয়েছেন তা সর্বক্ষেত্রে সটিক নয়। এ কথা অবশ্য অনস্বীকার্য যে, হযরত মুহাম্মদ (স) আল্লাহর যে ঐশীবাণী প্রচার করেছেন তা আরবদেশে প্রাক-ইসলামী যুগে এক আধ্যাত্মিক ও বৈপ্লবিক চিন্তাধারা। যেমন- একেশ্বরবাদ, রোজ কিয়ামত ইত্যাদি। যদি বৈপরীত্য না থাকতো তাহলে ধর্ম প্রচারে হযরত মুহাম্মদ (স) প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হতেন না। ওয়াট আরও বিশ্লেষণ করে বলেন যে, ‘মুরুয়া’ দু’ধরনের : প্রথমত, ধর্মীয় এবং মানবিক; দ্বিতীয়ত, নৈতিক। প্রথম মতবাদের সাথে মানবতাবাদ জড়িত মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব, কৃতিত্ব এবং ধর্মীয় কুসংস্কার, ঘৃণিত আচার অনুষ্ঠান, যা কুরআনে ধিকৃত হয়েছে। দ্বিতীয়, যে নৈতিক বিষয়াবলি মুরুয়ার অন্তর্গত, তা হচ্ছে যুদ্ধে বীরত্ব, তেজস্বিতা, বিপদে ধৈর্য, বদান্যতা, বিশ্বাসযোগ্যতা ইত্যাদি। এ সমস্ত বিষয়ে কুরআনে বিরূপ মন্তব্য পাওয়া যায় না, বরং ধর্মগ্রন্থে এ সমস্ত অসাধারণ মানবিক গুণাবলি মক্কাবাসীরা চর্চা না করায় তাদের তিরস্কার করা হয়েছে।
ওয়াট, গোল্ডজিহেরের প্রথম পরিচ্ছেদে বর্ণিত ‘মরুয়া ও দ্বীন’ প্রসঙ্গে বলেন যে, এই প্রবন্ধে নানা ধরনের বিতর্কমূলক মন্তব্য রয়েছে। গোল্ডজিহের ‘মরুয়া ও দ্বীন’ প্রসঙ্গে বলেন যে, এই প্রবন্ধে নানা ধরনের বিতর্কমূরক মন্তব্য রয়েছে। গোল্ডজিহের ‘মরুয়া ও দ্বীনের’ মধ্যে প্রভেদ বর্ননা করতে গিয়ে তিনটি বিষয়ে আলোচনা করেন। যথা- (ক) প্রতিহিংসা গ্রহণ, যার জন্য হযরত মুহাম্মদ (স) ক্ষমা প্রদর্শনের পরামর্শ দেন, (খ) ইসলাম মদ্যপান এবং নালী ভোগের ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা জারি করে ব্যক্তিস্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করে, (গ) স্বাধীনচেতা এবং স্বাধীনভাবে বসবাসকারী আরব বেদুঈনদের পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ বা সালাতের বিধান দিয়ে তাদের স্বাতন্ত্রবোধে আঘাত করা, (ঘ) শেষোক্ত বিষয়ে কোন মতবিরোধ নেই, কারণ এটি ‘মুরুয়ার’ ধর্মীয় বিষয়। অপর দুটি মন্তব্য (গোল্ডজিহেরের) সন্তোষজনক নয়। বিবাহ ও মদ্যপান সম্বন্ধে ইসলাম যে বিধান দিয়েছে, তা ইসলামের মৌলিক ধর্মীয় মতবাদপ্রসূত নয়, বরং যাযাবর এবং স্থায়ীভাবে বসবাসের মধ্যে বিদ্যমান প্রভেদের জন্য। ওয়াটের এই শেষোক্ত মন্তব্য অত্যন্ত অস্পষ্ট এবং বিভ্রান্তিকর। প্রথমত, মদ্যপান প্রসঙ্গে কেবলমাত্র মক্কার স্থায়ীলোকেরা মদ্যপান করত, মরুবাসী বেদুইনরা নয়। নারীর অমর্যাদা কুরআনের পাতায় পাতায় উল্লেখ হয়েছে। যথা— শিশু কন্যাকে জীবিত হত্যা, একাধিক নারী বিবাহ, ইচ্ছামত তালাক (যিহার) প্রভৃতি। ইসলাম এ সমস্ত সামাজিক অনাচার বন্ধ করেছে। তাহলে ওয়াটের মন্তব্য ‘not due to anything specifically islamic’। অর্থাৎ বিশেষভাবে ইসলামিক (শরিয়ত) বিধানের জন্য নয় ‘বোধগম্য’ না হওয়ায় অগ্রহণযোগ্য। প্রাচীন আরব প্রথা অনুযায়ী রক্তপাত হলে তা রক্তপাত করে প্রতিশোধ নিতে হতো (blood for blood) অর্থাৎ “খুনের বদলে খুন”। কিন্তু কখনো কখনো ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারকে খুন খেসারত বা ‘দিয়াত’ (blood money) প্রদান করে যুদ্ধের অবসান হত। এই রক্তপাত বন্ধের জন্য বিভিন্ন আয়াত নাজিল হয়েছে এবং ক্ষমা প্রদর্শনের মহৎ গুণের উল্লেখ আছে। সূরা নূরের (২৪) ২২ নম্বর আয়াতে এ ধরনের নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
হযরত মুহাম্মদ (স) এক আধ্যাত্মিক চেতনা বা অবস্থার (trance) মধ্যে কুরআনের বাণীগুলো পেয়েছিলেন। তিনি সেগুলো মনে ধরে রেখে (তিনি কখনো কোন আয়াত নিজে লিপিবদ্ধ করেন নি, এ জন্য যে, সম্ভবত তিনি ‘উম্মী’বা নিরক্ষর ছিলেন) এবং পরে তা তাঁর সাহাবীদের কাছে বর্ণনা করেন। অবশ্য যখনই তিনি প্রত্যাদেশ পেতেন তখনই তা বর্ণনা করে সাহাবীদের লিপিবদ্ধ করতে বলতেন। তিনি প্রত্যাদেশ এবং তাঁর মস্তিষ্ক- প্রসূত কোন বিবরণের (যেমন- হাদিস) মধ্যে কিভাবে পার্থক্য করেছিলেন তা সঠিকভাবে বলা যাবে না। তবে তিনি যে নির্ভুলভাবে পার্থক্য করেছিলেন, তাতে কোন সন্দেহ নেই; নতুবা কুরআন ও হাদিস পৃথকভাবে সংকলিত হতে পারত না। আমরা কখনোই বলতে পারব না যে, তিনি যে ঐশীবাণী পেয়েছিলেন তাতে তিনি তাঁর নিজের কথা সংযোগ করেছিলেন। অবশ্য কুরআনের আয়াতগুলো যে পুনর্গঠন করেছিলেন তাতে কোন সন্দেহ নেই, কিন্তু কোন পরিবর্তন করেন নি। অবশ্য মুসলিম ধর্মবেত্তাগণ স্বীকার করেছেন যে, এক সূরার আয়াত অন্য সূরার আয়াত দ্বারা বাতিল করা হয়েছে। আরবীতে এই পরিবর্তনকে বলা হয় ‘মানসুরা’। সূরা বাকারার (২) ১০৬ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে :
“আমি কোন আয়াত রহিত করলে কিংবা বিস্মৃত হতে দিলে তা থেকে উত্তম কিংবা তার সমতুল্য কোন আয়াত নাজিল করি।”