দ্বিতীয় অধ্যায় – হযরত ওমর ফারুক (রা) [ ৬৩৪-৬৪৪ খ্রি. ]
হযরত ওমর (রা)-এর প্রথম জীবন
ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হযরত ওমর (রা) ৫৮৩ খ্রিস্টাব্দে কুরাইশ বংশের আদ্দিয়া (Addiya) গোত্রের একটি সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর ডাক নাম ছিল আবু হাফস; ইসলামে দীক্ষিত হলে তিনি “ফারুক’ উপাধি লাভ করেন। তাঁর পিতার নাম ছিল খাত্তাব এবং মাতার নাম খানতামা। হযরত ওমর (রা) খুব দীর্ঘকায় ছিলেন; তাঁর গাঁয়ের রঙ ছিল শ্যামবর্ণ। শক্তিশালী, তেজস্বী এবং মল্লযুদ্ধ বিশারদ হিসেবে তিনি অল্প বয়সে যথেষ্ট খ্যাতি অর্জন করেন। বালাজুরির মতে, “মহানবীর আবির্ভাবের পূর্বে কুরাইশ বংশের মাত্র সতেরজন শিক্ষিত ব্যক্তির মধ্যে হযরত ওমর (রা) ছিলেন অন্যতম। তিনি একাধারে বাগ্মী ও কবি ছিলেন। ব্যবসা-বাণিজ্য ছিল তাঁর পেশা। বাণিজ্য উপলক্ষ্যে তিনি সিরিয়া ও পারস্য ভ্রমণ করে অভিজ্ঞতা অর্জন করেন।”
হযরত ওমর (রা) এর ইসলাম ধর্মে দীক্ষা একটি অবিশ্বাস এবং গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। প্রথম জীবনে তিনি ইসলামের ঘোর বিরোধী ছিলেন এবং পূর্বপুরুষের ধর্ম ত্যাগ করে কুরাইশগণ ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করলে তাদের উপর নির্যাতন করেন। আবু সুফিয়ানের প্ররোচনায় তিনি একদিন মুক্ত তরবারি নিয়ে মহানবী (স) কে হত্যা করার জন্য রওয়ানা হন। পথিমধ্যে নঈম-বিন-আবদুল্লাহর নিকট তাঁর ভগ্নী ফাতেমা ও ভগ্নীপতি সাঈদের ইসলাম ধর্ম গ্রহণের সংবাদ শুনে তাদের শাস্তি দানের জন্য ছুটে গেলেন। ক্রোধে উন্মত্ত হয়ে তিনি ভগ্নী ও ভগ্নীপতিকে প্রহার করতেও দ্বিধা করলেন না। কিন্তু তাঁরা ইসলাম ধর্ম বর্জন করতে অস্বীকার করলে তিনি কুরআন শরীফের বাণী শ্রবণ করতে চাইলেন। ভগ্নী ফাতিমা সুললিত কণ্ঠে পবিত্র কুরআনের সূরা তা’হা পড়তে থাকলে হযরত ওমর (রা) মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় শ্রবণ করেন এবং তাঁর ভাবান্তর হয়। বিগলিত হৃদয়ে এবং ইসলামের ঐশীবাণীর মাধুর্যে মুগ্ধ হয়ে তিনি সাফা পর্বতের পাদদেশে নবী করীমের নিকট গমন করে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। নবুয়তের সপ্তম বৎসরে তেত্রিশ বৎসর বয়সে হযরত ওমর (রা) ইসলামে দীক্ষিত হলে ইসলামের ইতিহাসে এক গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়ের সূচনা হয়। নবী করীম (স) তাঁকে “ফারুক” বা সত্য-মিথ্যার প্রভেদকারী উপাধিতে ভূষিত করেন।
খিলাফতের পূর্বে ইসলামের সেবা
হযরত ওমরের ইসলাম ধর্ম গ্রহণের ফলে মুসলমানগণ প্রকাশ্যে ধর্ম প্রচার করতে থাকে এবং কা’বা শরীফে প্রকাশ্যে নামায পড়তে শুরু করেন ওমর (রা) এর বীরবিক্রম, তেজস্বীতা, নির্ভীকতায় কুরাইশগণ এতে বাধা দেয় নি; কিন্তু ক্রমশ নির্যাতন বৃদ্ধি পেলে রাসূলে করীম (স) এর নির্দেশে তিনি বিশজনের একটি কাফেলা নিয়ে মক্কা থেকে মদীনায় হিজরত করেন এবং আপদে-বিপদে মহানবীকে হিজরতের সময় সর্বপ্রকার সাহায্য দান করেন। তিনিই সর্বপ্রথম মদীনা মসজিদে আযান প্রথা প্রবর্তন করে মুসল্লীদের মসজিদে আহ্বানের প্রস্তাব দেন; পরবর্তীকালে ঐশীবাণী দ্বারা এটি অনুমোদিত হয়। হযরত ওমর (রা) খিলাফত লাভের পূর্বে মদীনায় অবস্থানকালে বদর, উহুদ, খন্দক, হুনাইন, খাইবার প্রভৃতি যুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। খন্দকের যুদ্ধে তিনি অসীম বীরত্ব এবং অপূর্ব সমর কুশলতার পরিচয় দান করেন। হুদায়বিয়ার সন্ধি সম্পাদনকালে তিনি উপস্থিত ছিলেন এবং মুসলমানদের প্রতি প্রযোজ্য ঘৃণ্য শর্তাবলীর জন্য প্রথমত তিনিই বিরোধিতা করেন। নবী করীম (স) আল্লাহর নির্দেশের কথা এবং মুসলমানদের জন্য এর শুভ পরিণামের কথা তাঁকে জানাইলে তিনি তাঁর সম্মতি জ্ঞাপন করেন। মক্কা বিজয়ের সময় হযরত ওমর (রা) আবু সুফিয়ানকে বন্দী করতে সক্ষম হন। তাবুক অভিযানে তিনি তাঁর সঞ্চিত সম্পদের অর্ধেক যুদ্ধ তহবিলে দান করেন। খাইবার অঞ্চলে বিস্তীর্ণ ভূ-সম্পত্তিও তিনি ইসলামের সেবায় দান করেন। নবী, করীম (স) এর ওফাতে তিনি এতই বিচলিত ও মর্মাহত হয়ে পড়েন যে, তিনি উন্মত্তপ্রায় ও বিক্ষুব্ধ হয়ে পড়েন। খোলা তরবারি হস্তে তিনি বলতে থাকেন, “যে বলবে হযরত (স) ইন্তেকাল করেছেন, আমি তাঁর শিরচ্ছেদ করব।” হযরত আবুবকর (রা) এর প্রথম খলিফা নির্বাচনের সময় তিনি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। খিলাফতকে কেন্দ্র করে মুসলমানদের মধ্যে যে বিভেদ সৃষ্টি হয় তা হযরত আবুবকর (রা) এবং হযরত ওমরের যৌথ প্রচেষ্টায় একটি সুষ্ঠু সমাধানে পৌঁছানো সম্ভব হয়। তিনিই সর্বপ্রথম হযরত আবুবকর (রা) এর হস্ত চুম্বন করে খলিফা হিসেবে স্বীকৃতি দান করেন। তিনি খলিফা আবুবকর (রা) এর প্রধান উপদেষ্টা ও বিচারক (কাজী) ছিলেন।
খিলাফত লাভ
৬৩৪ খ্রিস্টাব্দে খলিফা আবুবকর (রা) অসুস্থ হয়ে পড়লে তাঁর উত্তরাধিকারী নির্বাচনের জন্য বিশিষ্ট মুসলমানদের আহ্বান করেন। খলিফা নির্বাচনে বিভেদ ও বৈষম্য সৃষ্টি হবার সম্ভাবনাকে দূরীভূত করবার এবং ইসলামের ঐক্য, নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখবার জন্য তিনি অন্তিমকালে আবদুর রহমান-বিন-আউফ হযরত ওসমান, হযরত আলী প্রমুখ মুসলিম নেতার সাথে আলোচনা করার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। তাঁদের সাথে পরামর্শ করে তিনি হযরত ওমর (রা)-কে তাঁর উত্তরাধিকারী মনোনীত করেন। হযরত ওমর (রা) এর বলিষ্ঠ মনোবল, চারিত্রিক দৃঢ়তা, ন্যায়নিষ্ঠা, জাগতিক কর্তব্য ও কর্মদক্ষতার কথা চিন্তা করে তাঁকে যোগ্য উত্তরাধিকারী মনোনীত করা হয়। প্ৰথমে হযরত ওমর (রা) এর কঠোর প্রকৃতির জন্য আবদুর রহমান এবং তালহা তাঁকে খলিফা নির্বাচিত করতে নিষেধ করলে হযরত আবুবকর (রা) বলেন যে, “রাষ্ট্রের গুরুদায়িত্বভার গ্রহণ করলে তিনি কোমল ও দয়ালু হবেন।” খলিফা আবুবকরের অন্তিম ইচ্ছায় এবং সমবেত সাহাবীদের মনোনয়ন ও প্রকাশ্য সমর্থনে হযরত ওমর (রা) ৬৩৪ খ্রিস্টাব্দে খোলাফায়ে রাশেদূনের দ্বিতীয় খলিফা নির্বাচিত হন।
ইসলামের সম্প্রসারণ
ইসলামের আবির্ভাব ও সম্প্রসারণ পৃথিবীর ইতিহাসে একটি গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়ের সূচনা করে। ষষ্ঠ শতাব্দীতে হযরত মুহাম্মদ (স) এর জন্মের পূর্বে আরব-ভূখন্ড ছিল কেবলমাত্র একটি ভৌগোলিক সীমারেখা। প্রাচ্য ও প্রতীচ্যের মধ্যস্থলে অবস্থিত সেমিটিক জাতির জন্মভূমি এই উপদ্বীপ সপ্তম শতাব্দীতে রাসূলুল্লাহ (স) এর নেতৃত্বে একটি সর্বজনীন ধর্ম, সংঘবদ্ধ রাষ্ট্র এবং প্রতিরক্ষামূলক সামরিক শক্তিতে রূপান্তরিত হয়। রাসূলে করীম (স) এর ইন্তেকালের এক শতাব্দীর মধ্যে ইসলামের পতাকা পূর্বে মধ্য এশিয়া থেকে পশ্চিমে আটলান্টিক উপসাগরের স্পেন অবধি উত্তোরিত হয়। প্রাচীন শক্তিশালী পারস্য এবং বায়জানটাইন সাম্রাজ্য ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়।
পারস্য বিজয়
সিরিয়া ও পারস্যে মুসলিম যুদ্ধাভিযানকালে হযরত আবুবকর (রা.) ইন্তেকাল করেন। হযরত ওমর (রা) খিলাফত লাভ করে হযরত আবুবকরের অনুসৃত বৈদেশিক নীতি গ্রহণ করেন। ইসলামের শত্রুভাবানপন্ন পাশ্ববর্তী রাষ্ট্রসমূহ হযরত ওমর (রা) এর খিলাফতে ইসলামী হুকুমতের অধীনে আসে।
পারস্য বিজয়ের কারণ : আরব-ভূখণ্ডের পূর্ব দিকে ইরাক (মেসোপটেমিয়া) ও আমুর দরিয়া (অক্সাস) পর্যন্ত বিস্তৃত ইরান দেশ নিয়ে গঠিত বিশাল পারস্য সাম্রাজ্য অবস্থিত ছিল। হযরত ওমর (রা) এর খিলাফতকে সম্প্রসারণের যুগ বলা হয়; কারণ মুসলমানগণ একদিকে বিশাল পারস্য সাম্রাজ্য অপরদিকে বায়জানটাইন সাম্রাজ্য জয় করে ইসলামের শাসনাধীনে আনে। বিভিন্ন কারণে মুসলমানদের সাথে পারসিকদের সংঘর্ষ অবশ্যম্ভাবী হয়ে দাঁড়ায়। আরব-ভূখণ্ডের সংলগ্ন থাকায় পারস্য সাম্রাজ্য নব- প্রতিষ্ঠিত ইসলামী রাষ্ট্রের নিরাপত্তার প্রতি হুমকিস্বরূপ ছিল। সীমান্ত রক্ষা এবং জনসাধারণের জান-মালের রক্ষণাবেক্ষণের প্রয়োজন অনুভব করে হযরত ওমর (রা) সম্প্রসারণ নীতি (Expansionist policy) কার্যকর করেন। মুসলিম অভিযান সর্বদা আত্মরক্ষামূলক ছিল; কখনও সাম্রাজ্যবাদী নীতি থেকে উদ্বুদ্ধ হয়নি। হযরত ওমর (রা) বলেন, “আমার দেশবাসীর নিরাপত্তা বিধান করে যুদ্ধাভিযান প্রয়োজন হয়ে পড়ে।” ধর্ম প্রচার অথবা রাজ্য জয় অপেক্ষা প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা গ্রহণই ছিল হযরত ওমর (রা) এর প্রধান লক্ষ্য। ইরাক সীমান্তে বসবাসকারী আরবগণ আরবের স্বগোত্রীয় আত্মীয়- স্বজনকে ইসলামের বিরুদ্ধে প্ররোচনা দান করত। হিট্টি বলেন, “অন্য কোন পূর্ব পরিকল্পনা ছাড়া আকস্মিক সংঘটিত পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে বৃহত্তর ইসলামী সাম্রাজ্যের সৃষ্টি হয়।” বলা বাহুল্য যে, ইসলামের শক্তি বৃদ্ধিতে পার্শ্ববর্তী পারস্য সাম্রাজ্য বিচলিত হয়ে পড়ে এবং রাসূলে করীমের জীবদ্দশায় একে অঙ্কুরে বিনষ্ট করার প্রয়াস পায়। মহানবীর প্রেরিত দূতকে পারস্য সম্রাট দ্বিতীয় খসরু অপমানিত করবার ধৃষ্টতা দেখান। এতে মুসলমানদের মধ্যে তীব্র অসন্তোষ সৃষ্টি হয়। হযরত আবুবকরের খিলাফত বাহরাইনে বিদ্রোহ দেখা দিলে পারসিকগণ উস্কানিমূলক কার্যকলাপে লিপ্ত হয়। পারস্য সম্রাটের সাহায্যে ব্যতীত ইরাক থেকে মহিলা ভন্ডনবী সাজাহ আরবভূমিতে অভিযান পরিচালনা করতে পারত না। পারসিকদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য হযরত ওমর (রা) প্রথম খলিফার যুদ্ধাভিযানকেও সুসংবদ্ধ করে সুদূরপ্রসারী করেন। মৌলানা মুহাম্মদ আলী যথার্থই বলেন, “বিজয়ের স্পৃহা প্রতিহিংসার স্পৃহা দ্বারা পুনর্জীবিত হল।”
পারস্য অভিযানের অন্যতম প্রধান কারণ ছিল আরববাসীদের সাথে ইরাকের বাণিজ্য সম্পর্ক ছিন্ন হবার সম্ভাবনা। ইউফ্রেটিস এবং টাইগ্রীস নদী দু’টির অববাহিকা ছিল খুবই উর্বর এবং সমৃদ্ধশালী। মরুবাসী আরবগণ বহুদিন থেকে এই অঞ্চরেল সাথে ব্যবসা-বাণিজ্য করত। কিন্তু ঈর্ষান্বিত হয়ে পারস্যবাসী ইসলাম প্রভাবান্বিত আরব ব্যবসায়ীদের অব্যাহতভাবে বাণিজ্য করতে দিতে ইচ্ছুক ছিল না। সুতরাং অর্থনৈতিক প্রয়োজনেও মুসলমানগণ পারস্য অভিযান করতে বাধ্য হয়। এই প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য যে, ঈর্ষাবশে দ্বিতীয় খসরু দূত মারফত প্রেরিত রাসূলে করীমের চিঠি ছিড়ে ফেলেন। মহানবী (স) এই সংবাদ পেয়ে বলেন, “আমার পত্রকে যেমন সে ছিঁড়ে ফেলেছে ঠিক তেমনিভাবে মুসলমানগনের হাতে তার রাজ্যও ছিন্নভিন্ন হবে।
পারস্য বিজয়ের ধারা : প্রথম খলিফা হযরত আবুবকরের নির্দেশে খালিদ-বিন- ওয়ারিদ ইরাক থেকে সিরিয়া গমন করেন। মুসলিম সেনাপতি মুসান্না হীরায় অবস্থান করেছেন। হীরা মুসলমানদের দখলে আসলে পারস্য বাহিনী বিপুল সৈন্য সমাবেশ করে যুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণ করতে থাকে। এতে মুসান্না সাহায্য লাভের আশায় মদীনায় আগমন করলে হযরত আবুবকরকে মৃত্যুশয্যায় দেখতে পান। হযরত ওমর (রা) খিলাফত লাভ করে আবু ওবায়দার নেতৃত্বে একটি নূতন সৈন্যদল গঠন করে মুসান্নার সাহায্যে ইরাকে প্রেরণ করেন। আবু ওবায়দা ও মুসান্নার সম্মিলিত বাহিনী ইউফ্রেটিস অতিক্রম করে হীরার দিকে অগ্রসর হতে থাকে। এদিকে সুদক্ষ যোদ্ধা রুস্তম পারস্য বাহিনীর সেনাধ্যক্ষ নিযুক্ত হলে তিনি দুটি স্বতন্ত্র বাহিনী গঠন করে মুসলমানদের বিরুদ্ধে প্রেরণ করেন। পারস্য সেনাপতি জাবানের নেতৃত্বে পারসিক বাহিনী মুসলিম বাহিনীর গতিরোধ করে। কিন্তু মুসান্না ও আবু ওবায়দার সম্মিলিত বাহিনীর নিকট পারসিক বাহিনী নামারিক নামক স্থানে পরাজিত হয়। ৬৩৪ খ্রিস্টাব্দের সেপ্টেম্বরে সংঘটিত এই সংঘর্ষ নামারিকের যুদ্ধ (Battle of Namariq) নামে পরিচিত। যুদ্ধে জয়লাভ করে মুসলিম বাহিনী হীরা পুর্নদখল করে। নারসী দ্বারা পরিচালিত অপর একটি বাহিনীও আবু ওবায়দার নিকট পর্যদুস্ত হয়। বদ্বীপ অঞ্চল মুসলমানদের অধিকারে আসে।
পারস্য বাহিনী শোচনীয় পরাজয়ের গ্লানি মোচনের জন্য রুস্তম বাহমনে নেতৃত্বে অপর একটি বিশাল বাহিনী মুসলমানদের বিরুদ্ধে প্রেরণ করেন। মুসলিম বাহিনী ইউফ্রেটিস নদীর পশ্চিম তীরে অবস্থান করেছিল। ব্যাবিলনের নিকট অপেক্ষারত মুসলিম বাহিনী আবু ওবায়দার নির্দেশে ইউফ্রেটিস নদীর উপর একটি নৌকার সেতু নির্মাণ করে। মুসান্নার পরামর্শ উপেক্ষা করে তিনি নদী পার হয়ে পারস্য বাহিনীর মোকাবেলা করেন। ৬৩৪ খ্রিস্টাব্দের নভেম্বরে সংঘটিত সেতু বা জসরের যুদ্ধে (The Battle of the Bridge) শত্রুপক্ষের হস্তীবাহিনীর আক্রমণ প্রতিহত করতে না পেরে আবু ওবায়দা হস্তীর পদতলে পিষ্ট হন। এই মর্মান্তিক সংঘর্ষে প্রায় ৬,০০০ মুসলিম সৈন্য নিহত হয় এবং অবশিষ্ট ৩০০০ সৈন্য মুসান্নার নেতৃত্বে নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নিতে সক্ষম হয়।
সেতুর যুদ্ধে মুসলমানদের পরাজয়ে হযরত ওমর (রা) খুবই মর্মাহত হন এবং শত্রুর ক্ষমতাকে ধ্বংস করার জন্য জাবীরের অধীনে এক বিশাল সৈন্যবাহিনী পারস্যে প্রেরণ করেন। খলিফার আহ্বানে বহু মুসলিম ও খ্রিস্টান ইসলামের পতাকাতলে সমবেত হয়। মুসান্নার নেতৃত্বে ৬৩৫ খ্রিস্টাব্দে কুফার নিকটবর্তী বুয়ায়েবের যুদ্ধে (The Battle of Buwayeb ) মুসলিম বাহিনী পারস্য সৈন্যবাহিনীর মোকাবেলা করে এবং শত্রুপক্ষকে বিধ্বস্ত করে। অসংখ্য সৈন্যসহ পারস্য সেনাপতি মিহরান নিহত হয়। এই যুদ্ধে মুসলমানগণ সেতুর যুদ্ধের পরাজয়ের গ্লানি মোচন করতে সক্ষম হয়। এই বিজয়ের ফলে মাদ’ইন (Ma’dain) পর্যন্ত সমগ্র ভূ-খণ্ড ইসলামের পতাকাতলে আসে এবং মেসোপটেমিয়ার নিম্ন ভূ-ভাগের বদ্বীপে মুসলিম আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। এই যুদ্ধের অব্যবহিত পরেই মুসান্না ৬৩৫ খ্রিস্টাব্দে প্রাণত্যাগ করেন। একথা অনস্বীকার্য যে, বীর কেশরী খালিদ-বিন-ওয়ালিদের পরেই দক্ষ সেনাপতি হিসেবে মুসান্নার স্থান ছিল।
বুয়ায়েবের যুদ্ধে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়ে পারস্য সম্রাট মুসলিম বাহিনীর উপর প্রতিশোধ গ্রহণকল্পে সমর প্রস্তুতি আরম্ভ করে। সাসানীয় রাজধানী টেসিফোনে (Ctesiphon) অথবা মাদা’ইনে যুবক সম্রাট তৃতীয় ইয়াজদিগার্দ (Yazdigard III) হৃত পারস্য রাজ্য পুনঃদখলের জন্য মহাবীর রুস্তমের তত্ত্বাবধানে ১,২০,০০০ সৈন্যের এক বিরাট বাহিনী গঠন করেন। খলিফা ওমর (রা) পারস্যের এই সমর প্রস্তুতিতে মুসলিম বাহিনীকে সুসংবদ্ধ করার জন্য সা’দ-বিন-আবি ওয়াক্কাসকে (Sa’d-bin-Abi- Waqqas) প্রধান সেনাপতি নিযুক্ত করেন। খলিফার নির্দেশে সা’দ সমর প্রস্তুতি গ্রহণ করেন এবং পারসিকদের তীব্র আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য সুকৌশলে সৈন্য বিন্যাস এবং বিভিন্ন দলে সৈন্য বিভাজন সমাপ্ত করেন। খলিফার অনুমতি নিয়ে মদীনা থেকে ইরাক পর্যন্ত বিভিন্ন স্থানে তাঁবু ফেলা হয় এবং সম্মুখে পারস্যের সমভূমি ও পশ্চাতে আরবের পর্বতমালা রেখে কাদেসিয়া নামক প্রান্তরে ৬৩৫ খ্রিস্টাব্দের নভেম্বরে মুসলিম সৈন্য সমাবেশ করা হয়। যুদ্ধের প্রারম্ভে খলিফার নির্দেশে পারস্য সম্রাটের নিকট ইসলাম গ্রহণের আমন্ত্রণ জানানো হয়, কিন্তু মুসলিম দূত অপমানিত হয়ে ফিরি আসেন। রুস্তমকেও অনুরূপ আহ্বান করা হলে তিনি ক্রোধান্বিত হয়ে বলেন, “সমগ্র আরবের দম্ভ আমি চূর্ণ করে ছাড়ব।” অসুস্থতার জন্য সা’দ যুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণ করতে না পারলেও নিরাপদ স্থান থেকে তিনি সৈন্যবাহিনীকে নির্দেশ দিতে থাকেন। তিনদিনব্যাপী দুই পক্ষের মধ্যে তুমুল যুদ্ধ সংঘটিত হয়। আরবগণ প্রথম দিনকে “বিশৃঙ্খলার দিন” বা ‘ইয়ামুল আরমাছ’ (Yaumul Armath) বলে অভিহত করেন। কারণ সা’দের আদেশে পারস্যের বিশাল হস্তীবাহিনীকে ছত্রভঙ্গ করে দেওয়া হয়েছিল। দ্বিতীয় দিনটির নামকরণ করা হয়েছিল সাহায্যের দিন বা “ইয়ামুল আগওয়াছ’ (Yaumul Aghwath), কারণ, সুসংবদ্ধ রুস্তমের বাহিনীর মোকবেলায় সা’দকে সাহায্যের জন্য সিরিয়া থেকে কা’কার নেতৃত্বে একটি সেনাবাহিনী প্রেরণ করা হয়। পারস্যের কাদেসিয়ায় উপস্থিত হয়ে কা’কা মল্লযুদ্ধে পারস্য বীর বাহমনকে নিহত করেন। তৃতীয় দিনে মুসলিম ও পারস্য বাহিনীর মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ আরম্ভ হলে সা’দ এবং কা’কা সম্মিলিতভাবে রুস্তমের সুগঠিত বাহনীকে পরাজিত করে বিধ্বস্ত করতে সক্ষম হন। রুস্তম যুদ্ধে নিহত হলে পারস্য বাহিনী বিশৃঙ্খল হয়ে পড়ে এবং মুসলিম বাহিনীর নিকট আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। এই দিনটি দুদর্শার দিন বা ‘ইয়ামুল উম্মাস’ (Yaumul Ummas) অথবা ‘গোলযোগপূর্ণ রাত্রি’ বা ‘লাইলাত-উল-হারীর’ নামে পরিচিত।
ইসলামের ইতিহাসে কাদেসিয়ার যুদ্ধ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই যুদ্ধে মুসলিম সাফল্যের কারণ ছিল বিবিধ। শত্রুবাহিনী চতুগুণ হলেও মুসলমানগণ তাদের চারিত্রিক দৃঢ়তা, আদর্শ, নিষ্ঠা, শৃঙ্খলা এবং শৌর্যবীর্যের পরাকাষ্ঠা দেখিয়েছিলো। অপরদিকে রাজনৈতিক অরাজকতা, সৈন্যবাহিনীতে, বিশৃঙ্খলা পারস্য সাম্রাজ্যের অধঃপতনকে ত্বরান্বিত করে। পারস্য সাম্রাজ্যভুক্ত সেমিটিক খ্রিস্টান আরববাসী আরব-ভূখণ্ডের সেমিটিক মুসলমানদের সাথে আত্মিক যোগসূত্র কায়েম করে এবং জরথুস্ত্র ধর্মাবলম্বী পারসিকদের বিরোধীতা করে। কাদেসিয়া যুদ্ধে জয়লাভ করে মুসলিম বাহিনীর শক্তি এবং আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি পায়। খলিফার অনুমতিক্রমে সা’দ ৬৩৭ খ্রিস্টাব্দে পারস্যের রাজধানী মাদ’ইন (টেসিফোন) দখল করেন। পারস্য সম্রাট প্রাণভয়ে ধন-সম্পদ ও পরিবারবর্গসহ উত্তরাঞ্চলের পার্বত্য এলাকা হুলওয়ান এ পলায়ন করেন। মাদা’ইন জয় করে মুসলমানগণ বিলাস-ব্যসনের প্রচুর উপকরণ ও ধন-সম্পত্তি লাভ করে। মাদাই’ন ইরাকের রাজধানীতে পরিণত হয়। এভাবে ইউফ্রেটিস এবং টাইগ্রীস নদী দুটির মধ্যবর্তী এলাকায় মুসলিম আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়।
মাদা’ইন থেকে পলায়ন করে একশত মাইল দূরবর্তী হুলওয়ানে ইয়াজদিগার্দ পুনরায় সৈন্যবাহিনীকে সুগঠিত করে সা’দ বিন-আবি ওয়াক্কাসের বিরুদ্ধে প্রেরণ করেন। জালুলায় সৈন্য সন্নিবেশিত হয় এবং দুর্গ দখল করে হুলওয়ান ও মিডিয়া থেকে সৈন্য এনে পারস্য বাহিনী একটি তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তোলে। সা’দ শত্রুবাহিনীর মোকাবেলার জন্য হাশিম ও কা’কাকে জালুলায় প্রেরণ করেন। মুসলিম বাহিনীর ১২,০০০ সৈন্য বীরবিক্রমে যুদ্ধ করে বহুদিন দুর্গ অবরোধের পর পারস্য সৈন্যদের বিধ্বস্ত ও ছত্রভঙ্গ করতে সক্ষম হয়। ৬৩৭ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে মুসলিম বাহিনী হুলওয়ান অধিকার করে এবং সেখানে একটি শক্তিশালী সেনানিবাস প্রতিষ্ঠা করে। পারস্য সম্রাট পরাজিত হয়ে কাস্পিয়ান সাগরের নিকটবর্তী আল-রাই-এ পলায়ন করেন। মাদাইন অধিকৃত হলে হযরত ওমর (রা) ইরাকের শাসন-ব্যবস্থার পুনর্গঠন করেন।
হুলওয়ান বিজিত হলে পারস্য সম্রাট খলিফা ওমরের নিকট সন্ধির প্রস্তাব করেন এবং যথারীতি মুসলমান এবং পারসিকদের মধ্যে সন্ধিচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। সন্ধিশর্ত অনুযায়ী পারস্য পর্বতমালা দুই সাম্রাজ্যের সীমানা হিসেবে নির্ধারিত হয়। ৬৩৮ খ্রিস্টাব্দে খলিফার নির্দেশে সা’দ হীরার নিকট কুফায় নূতন রাজধানী স্থাপন করেন। ইউফ্রেটিস নদীর পশ্চিম তীরে অবস্থিত কুফা নগরীর সুবিধা ছিল এই যে, কোন সময়ে আক্রান্ত হলে সহজেই শহর পরিত্যাগ করে সৈন্য ছাউনিকে (Garrison) মরুভূমিতে উঠিয়ে নেওয়া সম্ভব হত। একই বৎসর উতবা উবুল্লার নিকট শাহ্-আল আরবে বসরা শহর নির্মাণ করে অপর একটি সেনানিবাস প্রতিষ্ঠিত করেন। ইরাকে বসরা ও কুফা নগরী প্রতিষ্ঠার ফলে পূর্ব দিকে সামরিক অভিযান প্রেরণের যথেষ্ট সুবিধা হয়। কারণ, এ দুটি সেনানিবাস থেকে যুদ্ধাভিযান করা হত। আরব-ভূখণ্ডের তুলনায় ইরাক সুজলা-সুফলা ছিল; এর জলবায়ুও ছিল স্বাস্থ্যকর; এ কারণে মুসলমানগণ এ দুই শহরে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে থাকে। পরবর্তীকালে এই স্থানে দুটি ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রধান কেন্দ্রে পরিণত হয়। শিক্ষা ও সংস্কৃতির উন্নয়নে এই দুই শহরের গুরুত্বও ছিল অপরিসীম। এখানে অনেক কবি, পণ্ডিত, হাফেজ ও মোহাদ্দিস বসবাস করতেন।
মুসান্নার নিকট নির্মমভাবে পরাজিত হয়ে পারস্য সেনাপতি হরমুজান আহওয়াজ প্রদেশে আত্মগোপন করেন এবং সেখানে শক্তি সংগ্রহ করে মুসলিম বাহিনীকে আক্রমণের পরিকল্পনা করতে থাকেন। উতবা বীর বিক্রমে যুদ্ধাভিযান করে হরমুজানকে কারূন নদী পর্যন্ত বিতাড়িত করেন। উতবার মৃত্যুর পর মুগীরা বসরার শাসনকর্তা নিযুক্ত হয়ে খুজিস্তারেন দিকে অভিযান প্রেরণের প্রস্তুতি গ্রহণ করতে থাকেন। এদিকে মার্ভে অবস্থানকারী ইয়াজদিগার্দ হরমুজানের সাহায্যে একদল সৈন্য প্রেরণ করেন। মুগীরার পরে আবু-মুসা-আল-আসারী শাসনকর্তা নিযুক্ত হলে সুসা অধিকার করে ৬৪১ খ্রিস্টাব্দে পারস্য বাহিনীর পশ্চাদ্ধাবন করেন। রামহরমুজ নামক স্থানে হরমুজান বীরবিক্রমে যুদ্ধ করেও মুসলিম বাহিনীর নিকট পরাজিত হন। নুমানের সেনাপতিত্বে গঠিত মুসলিম বাহিনী সুরক্ষিত সুসতার দুর্গ অধিকার করে হরমুজানকে বন্দী করেন। হরমুজান মদীনায় খলিফার নিকট প্রেরিত হলে তিনি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। বিজিত এলাকায় শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য এবং পারসিকদের ষড়যন্ত্র ও বিশ্বাসঘাতকতায় অতিষ্ঠ হয়ে হযরত ওমর (রা) মুসলিম যুদ্ধাভিযানের নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করেন। সর্বশেষ সাসানীয় সম্রাট তৃতীয় ইয়াজদিগার্দ মনে করেছিলেন যে, মুসলমানগণ মেসোপটেমিয়ার উর্বর অঞ্চলগুলো অধিকার করেই ক্ষান্ত থাকবে, কিন্তু প্রাচীন মিডিয়া সাম্রাজ্য অধিকার করে মুসলিম বাহিনী ইস্পাহানের দিকে অগ্রসর হলে পারস্য সম্রাট প্রমাদ গুনলেন। মুসলিম অভিযান প্রতিহত করবার জন্য পারস্য সম্রাট শেষ উদ্যোগ গ্রহণ করেন। পারস্য সম্রাট তৃতীয় ইয়াজদিগার্দ জুরজান, দামাওয়ান্দ, রায়, ইস্পাহান ও হামাদান প্রভৃতি অঞ্চল হতে সৈন্যবাহিনী সংঘবদ্ধ করে ফিরোজানের নেতৃত্বে ১,৫০,০০০ পারসিক সৈন্যের এক বিরাট বাহিনী আলবুর্জ পাহাড়ের পাদদেশে প্রেরণ করেন। হযরত ওমর (রা) পারস্য বাহিনীর মোকাবেলার জন্য প্রায় ৩০,০০০ সৈন্য সংগ্রহ করে নুমান-বিন-মুকারানকে যুদ্ধ পরিচালনার দায়িত্ব দিলেন। প্রথমে অবশ্য খলিফা স্বয়ং যুদ্ধ পরিচালনা করবার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। পারসিক বাহিনীর সাথে ৬৪১ খ্রিস্টাব্দে নিহাওয়ান্দ নামক স্থানে বীরবিক্রমে যুদ্ধ করে নুমান পারস্য বাহিনীকে বিধ্বস্ত করেন এবং মুসলিম বিজয় সুনিশ্চিত হয়। এই রক্তক্ষয়ী এবং গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধকে ইসলামের ইতিহাসে নিহাওয়ান্দের যুদ্ধ (Battle of Nihawand) নামে অভিহিত করা হয়। যুদ্ধে নুমান শাহাদাত বরণ করেন। মুসলমানদের এই সাফল্যকে “মহা বিজয়” (Victory of Victories) বলে আখ্যায়িত করা হয়; কারণ নিহাওয়ান্দের যুদ্ধে জয়লাভ পারস্য ও মধ্য এশিয়ায় ইসলাম প্রচারে সহায়ক হয়েছিল। পারস্য সাম্রাজ্য ছিন্নভিন্ন হয়ে গেলে মুসলিম বাহিনী ধীরে ধীরে ইস্তাখার (Ishtakhar) অথবা পারসিপলিস (Persepolis), ইস্পাহান, ফারস, কিরমান, তাবারিস্তান, আজারবাইজান, সিস্তান, মাকরান, খোরাসান প্রভৃতি অঞ্চল দখল করতে সক্ষম হয়। পরাজিত পারস্য সম্রাট ইয়াজদিগার্দ ইস্পাহান থেকে ফারগানায় পলায়ন করলে ৬৫১ খ্রিস্টাব্দে আততায়ীর হস্তে নিহত হন। এভাবে পারস্য সাম্রাজ্য ধ্বংস হয়ে মধ্য এশিয়া পর্যন্ত ইসলাম বিস্তৃতি লাভ করে।
৬৪৪ খ্রিস্টাব্দে খলিফা ওমরের ইন্তেকালের মাত্র এক বৎসর পূর্বে আরবে সীমাবদ্ধ নব-প্রতিষ্ঠিত মুসলিম রাষ্ট্র পূর্বদিকে খোরাসান অঞ্চল পর্যন্ত বিস্তৃতি লাভ করে। রাজনৈতিক অরাজকতা, শাসক-গোষ্ঠীর নির্যাতন, জাতীয়তাবোধের অভাব, দুর্নীতি, বিলাস-বাসন, ষড়যন্ত্র, বিশ্বাঘাতকতা, সৈন্য-বাহিনীর শৃঙ্খলা এবং নৈতিক বলের অভাবে পারস্য সাম্রাজ্য মুসলিম বাহিনীর প্রচণ্ড আঘাতে ছিন্নভিন্ন হয়ে পড়ে। অপরদিকে মুসলিম বিজয় একটি নবযুগের সূচনা করে তারা ইরাক ও পারস্যের মত উর্বর ঐশ্বর্যশালী ভূখণ্ডের মালিক হয়, সেমিটিক ধর্ম (ইসলামের তৌহিদ) আর্য ধর্মের (পারসিক অগ্নিপূজা) উপর প্রভুত্ব কায়েম করে। মুসলমানগণ পারসিক যুদ্ধকৌশল, রীতি-নীতি, আচার-ব্যবহার, শাসন-প্রণালী, শিল্প, সাহিত্য, দর্শন, স্থাপত্য ও ভাস্কর্য সম্বন্ধে সম্যক জ্ঞান লাভ করেন এবং সভ্যতার উন্মেষের পথে এটি সহায়ক হয়। ওপর আলোচনা করলে দেখা যাবে যে, পারস্য বিজয়ের ফলে সংযমী, আত্মনির্ভরশীল ও মিতব্যয়ী মুসলমানগণ সর্বপ্রথম বিলাসিতা, উচ্ছৃঙ্খল জীবন ও অনৈসলামিক কার্যকলাপে লিপ্ত হন। জালুলা ও মাদা’ইনের লুণ্ঠিত দ্রব্যসামগ্রী (Booty) খলিফা ওমরের নিকট প্রেরণ করলে তিনি ক্রন্দনরত অবস্থায় বলেন, “এই সমস্ত লুণ্ঠিত দ্রব্যের মধ্যে আমি আমার লোকজনের ভবিষ্যৎ ধ্বংস দেখতে পাচ্ছি।” পারস্য বিজয়ের অন্যতম পরিণতি ছিল ইসলামের দুই সম্প্রদায়ে বিভক্তি- সুন্নী ও শিয়া। পারস্যই শিয়া সম্প্রদায়ের জন্মভূমি।
বায়জানটাইন সাম্রাজ্য বিজয়
আরব দেশের উত্তর-পশ্চিমে সিরিয়া, জর্ডান, প্যালেস্টাইন ও মিসরের বিস্তীর্ণ ভূভাগ নিয়ে পূর্ব রোমান সাম্রাজ্যকে বায়জানটাইন সাম্রাজ্য বলা হত। মহানবী সম্রাট হিরাক্লিয়াসের নিকট দূত প্রেরণ করলে তিনি সেই দূতকে সাদরে অভ্যর্থনা জ্ঞাপন করেন। ধীরে ধীরে এই সোহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্কে অবনতি হতে থাকে এবং প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থার জন্য মুসলমানগণ বায়জানটাইন সাম্রাজ্য জয় করতে বাধ্য হয়।
যুদ্ধের কারণ : ৬২৯ খ্রিস্টাব্দে মহানবীর প্রেরিত দূত হারিস-বিন-উমাইয়া সিরিয়া গমনকালে রোমান সাম্রাজ্যের অধীনস্থ সিরিয়ার প্রাদেশিক শাসনকর্তা খ্রিস্টান দলপতি সোহরাবিল বিন-আমর গাচ্ছানি কর্তৃক মুতায় নিহিত হন। এতে খ্রিস্টান বায়জানটাইন সাম্রাজ্যের সাথে মুসলমানদের সম্পর্ক তিক্ত হতে থাকে এবং রাসূলে করীম হত্যার প্রতিশোধের জন্য মুতায় অভিযান প্রেরণ করেন। খলিফা আবুবকর (রা) এই প্রতিশোধমূলক ব্যবস্থাকে কার্যকর করবার জন্য উসামার নেতৃত্বে ৬৩২ খ্রিস্টাব্দে একটি সৈন্যদল প্রেরণ করেন এবং এতে রাসূলের অন্তিম অভিপ্রায় পূর্ণ হয়। বিশ্বাসঘাতকতা ও ষড়যন্ত্রমূলক কার্যকলাপে খ্রিস্টানদের প্রতি মুসলমানগণ বীতশ্রদ্ধ হয়ে উঠে এবং যুদ্ধ অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়ে। ইসলামের উত্তরোত্তর শক্তি বৃদ্ধিতে পাশ্ববর্তী বায়জানটাইন সাম্রাজ্য ঈর্ষান্বিত হয়ে সিরিয়ার আরব বেদুঈনদের আরব সীমান্তে হানা দিতে প্ররোচিত করে এবং সিরিয়ায় আগত মুসলিম বণিকদের উপর অকথ্য উৎপীড়ন করতে থাকে। হযরত আবুবকর (রা)-এর খিলাফতকালে কতিপয় ভণ্ড নবীর আবির্ভাবে সাময়িক গোলযোগ দেখা দিলে খ্রিস্টান মহিলা ভণ্ড নবী সাজাহ বায়জানটাইন সম্রাটের পৃষ্ঠপোষকতায় আরব দেশে অভিযান করে। এতে মুসলিম রাষ্ট্রের সাথে খ্রিস্টান সাম্রাজ্যের বিরোধিতা সংঘর্ষের পর্যায়ে এসে দাঁড়ায়। ভৌগোলিক অবস্থানের দিক থেকে বিচার করলে দেখা যাবে যে, সিরিয়া ও প্যালেস্টাইন আরবের অন্তর্ভূক্ত ছিল এবং রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কারণে আরব উপদ্বীপের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল দখল করা মুসলমানদের নিতান্ত প্রয়োজন হয়ে পড়ে। নব-প্রতিষ্ঠিত ইসলাম ধর্ম ও রাষ্ট্রের শান্তি, শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা বিধানের জন্য ষড়যন্ত্র ও প্ররোচনায় লিপ্ত বায়জানটাইন সাম্রাজ্য বিজয় অবশ্যম্ভাবী হয়ে দাঁড়ায়। অনুর্বর আরব দেশের তুলনায় ঐশ্বর্য ও বৈভবে ভরপুর সিরিয়া মরুবাসী আরবদেশে বহু দিন থেকে আকর্ষণ করে। যুগ যুগ ধরে আরব-ভূখণ্ড থেকে সিরিয়া অঞ্চলে গমন করে আরবরা। সেখানে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে থাকে। সিরিয়ার আরবদের সাথে আরবের মুসলমানদের বৈবাহিক সম্পর্ক থাকার অর্থনৈতিক উন্নতির আশায় সিরিয়া বিজয়ের প্রয়োজনীয়তা মুসলমানগণ অনুভব করে। বায়জানটাইন সাম্রাজ্যের ঐশ্বর্য ও স্বচ্ছল জীবনযাত্রা আরবদের আকর্ষন করে। ইসলামের সম্প্রসারণকে এই কারণে বিভিন্ন দিক থেকে বিচার করে “সর্বশেষ সেমিটিক অভিযান” (last Semitic migration) বলা হয়েছে।
সিরিয়া বিজয়
হযরত আবুবকর (রা)-এর শাসনকালে সিরিয়ায় একটি সুপরিকল্পিত যুদ্ধাভিযান প্রেরণ করা হয় এবং ৬৩৪ খ্রিস্টাব্দে আজনাদাইনের যুদ্ধে বায়জানটাইন সম্রাট হিরাক্লিয়াসের বিশাল বাহিনী পরাজিত হয়। হিরাক্লিয়াস পরাজয় বরণ করে এন্টিওকে আত্মগোপন করেন। ইত্যবসরে হযরত আবুবকর (রা) ইন্তেকাল করলে ইসলামের দ্বিতীয় সুযোগ্য খলিফা হযরত ওমর (রা) সিরিয়ায় মুসলিম অভিযান অব্যাহত রাখেন। হযরত আবুবকর (রা)-এর নির্দেশে বীরশ্রেষ্ঠ খালিদ-বিন-ওয়ালিদ হীরা থেকে দামেস্কের উপকণ্ঠে আগমন করে প্রচণ্ড আক্রমণ পরিচালনা করেন। মারজরাহিতে গাচ্ছান বংশীয় খ্রিস্টান অধিপতিকে পরাজিত করে তিনি বসরা দখল করেন এবং এই স্থানে (সিরিয়ায়) অবস্থিত মুসলিম বাহিনীর সাথে সংঘবদ্ধ হয়ে জর্ডান নদীর পূর্ব তীরে অবস্থিত ফিহল (Fihl) শহর ৬৩৫ খ্রিস্টাব্দের ২৩শে জানুয়ারীতে অধিকার করেন। এই বৎসরের ২৫শে ফেব্রুয়ারী মারজ-উস-সুফফারে বিধর্মীদের সৈন্যবাহিনী পর্যুদস্ত থেকে দামেস্ক অভিযানের সকল বাধা দূর হয়। ছয় মাস ধরে অবরোধ করবার পর সুরক্ষিত দামেস্ক নগরী ৬৩৫ খ্রিস্টাব্দের সেপ্টেম্বর মাসে মুসলমানগণ দখল করতে সক্ষম হয়। এই বিজয়ের মূলে ছিল খালিদের তেজস্বিতা, সৈন্য বিন্যাস ও অসাধারণ রণকৌশল। আমর ইবন-আল-আস তুমা তোরণে, সোহরাবিলকে ফারাদিস তোরণে, আবু ওবায়দাকে জারিয়া তোরণে এবং ইয়াজীদকে কাইসান তোরণে খালিদ সৈন্য সমাবেশ করে দক্ষতার সাথে দামেস্ক অবরোধ করেন। দামেস্ক বিজয় ইসলামের সম্প্রসারণের ইতিহাসে একটি অবিস্মরণীয় ঘটনা।
বায়জানটাইন সাম্রাজ্যের অন্তর্গত সিরিয়া প্রদেশের রাজধানী দামেস্ক বিজয়ের ফলে সমগ্র সিরিয়া মুসলমানদের করতলগত হয়। প্রাচ্য ও প্রতীচ্যের বাণিজ্য ও কৃষ্টির যোগসূত্রকারী এই শহরের পতনে নির্যাতিত খ্রিস্টান অধিবাসীরা মুসলমানদের সক্রিয় সাহায্য করে। অধিকৃত শহর দামেস্ক পরবর্তীকালে ইসলামের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। মুসলমানগণ বিধর্মীদের জীবন, সম্পত্তি ও গীর্জার নিরাপত্তা বিধান করে একটি সন্ধিপত্রে স্বাক্ষর করে এবং এর পরিবর্তে তাদেরকে ‘জিজিয়া’ কর প্রদানে অঙ্গীকারাবদ্ধ করা হয়। দামেস্ক বিজয় মুসলিম বাহিনীকে উৎসাহিত করে এবং সমগ্র জর্ডান এলাকা ইসলামের পতাকাতলে আসে। দামেস্ক পতনের পর মুসলিম সৈন্যবাহিনী সামান্য বাধার পর হিস দখল করে। এর পর হামা ও বালাবাক মুসলমানদের অধিকারে আসে। আবু ওবায়দা হিমসে, আমর-বিন-আল- আস জর্ডানে এবং খালিদ দামেস্কে অবস্থান করতে থাকেন।
ইয়ারমুকের যুদ্ধ (৬৩৬ খ্রি)
বায়জানটাইন সাম্রাজ্যের গুরুত্বপূর্ণ তিনটি শহর দামেস্ক, হামা ও হিল্স মুসলিম বাহিনী অধিকার করলে সম্রাট হিরাক্লিয়াস ক্রোধান্বিত হয়ে আরমেনিয়ান, সিরিয়ান, রোমান ও আরব-গোত্রীয় খ্রিস্টানদের নিয়ে ২,৪০,০০০ সৈন্যের একটি বিশাল বাহিনী গঠন করেন। এই বাহিনীর প্রধান সেনাপতি ছিলেন সম্রাটের ভ্রাতা থিওডোরাস। দামেস্ক, হিমস প্রভৃতি অঞ্চলে সাময়িকভাবে অধিকার শিথিল করে ২৫,০০০ সৈন্যের মুসলিম বাহিনী জর্ডান নদীর একটি শাখা ইয়ারমুকে বায়জানটাইন সৈন্যবাহিনীর মোকাবেলা করে। কয়েক মাস ধরে খণ্ড যুদ্ধ সংঘটিত হবার পর ৬৩৬ খ্রিস্টাব্দের ২০শে আগস্ট বীরোত্তম খালিদের নেতৃত্বে থিওডোয়াস পরাজিত ও নিহত হন এবং হিরাক্লিয়াসের বিশাল বাহিনী ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়লে অসংখ্য রোমান সৈন্য নিহত হয়। বালাজুরীর মতে, ৭০,০০০ এবং তাবারীর মতে, ১,০০,০০০ রোমান সৈন্য ইয়ারমুকের যুদ্ধে নিহত অথবা আহত হয় এবং ৩,০০০ মুসলিম সৈন্য শাহাদাত বরণ করেন। এই বিপর্যয়ের সংবাদে হিরাক্লিয়াস কনস্টান্টিনোপলে আশ্রয় গ্রহণ করেন এবং মুসলিম বাহিনী সমগ্র সিরিয়া ও জর্ডান দখল করে ইসলামী শাসন কায়েম করে। এর পর সহজেই কিনিসিরিন, এন্টিওক, আলেপ্পো, টায়ার, সিডন প্রভৃতি স্থান মুসলিম অধিকারে আসে। আবু ওবায়দা, আমর-ইবন-আল-আস এবং সর্বোপরি “আল্লাহর অসি” খালিদের অতুলনীয় বীরত্ব, যুদ্ধ-কৌশল, সাংগঠনিক ক্ষমতা এবং ইসলামের জন্য আত্মভোলার ফলে ৬৪০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে সমগ্র সিরিয়া মুসলমানদের পদানত হয়।
প্যালেস্টাইন বিজয়
জেরুজালেম অধিকৃত (৬৩৭ খ্রি) : সিরিয়া ও প্যালেস্টাইন অভিযানে জেরুজালেমের পতন একটি অবিস্মরণীয় ঘটনা। ইয়ারমুকের যুদ্ধের পর ৬৩৭ খ্রিস্টাব্দে আমর-ইবন-আল-আস জেরুজালেম অবরোধ করবার প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। মুসলিম বাহিনীর অবরোধ সংবাদে রোমান শাসনকর্তা আরতাবুন শহর পরিত্যাগ করে পলায়ন করেন। অবরুদ্ধ খ্রিস্টান অধিবাসীগণ মুসলিম সেনাপতির নিকট এই সন্ধিশর্তে আত্মসমর্পন করতে স্বীকৃত হন যে, খলিফা হযরত ওমর (রা) স্বয়ং জেরুজালেমে আগমন করে খ্রিস্টান ধর্মগুরু সাফ্রোনিয়াসের সাথে সন্ধিপত্রে স্বাক্ষর করবেন। সেনাপতি আবু ওবায়দা অবরোধে নেতৃত্ব দান করছিলেন এবং খ্রিস্টানদের শর্ত মেনে নিয়ে খলিফার নিকট সংবাদ প্রেরণ করেন। একজন ভৃত্য সহকারে উষ্ট্রপৃষ্ঠে হযরত ওমর (রা) জেরুজালেমে আগমন করে খ্রিস্টানদের সাথে সন্ধিচুক্তি স্বাক্ষরিত করে শহরের ভার নিজ হস্তে গ্রহণ করেন। সন্ধিশর্ত অনুযায়ী জিজিয়া কর প্রদানের পরিবর্তে খ্রিস্টানদের জান- মাল, গীর্জা, বাসস্থানের নিরাপত্তা প্রদান করা হয়। ইসলাম ধর্ম তাদের উপর চাপিয়ে দেওয়া হবে না এবং গ্রীক ও দুষ্কৃতকারীদের শহর পরিত্যাগ করতে হবে বললেও সন্ধিতে উল্লেখ করা হয়।
জাজিরা বিজয় : ৬৩৮ খ্রিস্টাব্দে রোমান সম্রাটের প্ররোচনায় ৩০ হাজার জাজিরাবাসী বিদ্রোহ ঘোষণা করে মুসলিম আধিপত্য খর্ব করবার চেষ্টা করে। মুসলিম সাম্রাজ্যের নিরাপত্তা বিধানের জন্য আবু ওবায়দা অভিযান পরিচালনা করে জাজিরা দখল করেন। এরূপে সাত বৎসরের মধ্যে (৬৩৩-৬৪০ খ্রিস্টাব্দ) সমগ্র সিরিয়া ও প্যালেস্টাইন ইসলামী শাসনাধীনে আসে। খলিফা ওমর ৬৪০ খ্রিস্টাব্দে মুয়াবিয়াকে সিরিয়ার শাসনকর্তার পদে নিযুক্ত করেন। এ সময় দুর্ভিক্ষ ও মহামারীতে ইসলামের কয়েকজন শ্রেষ্ঠ যোদ্ধা যেমন, আবু ওবায়দা, সোহরাবিল মৃত্যুমুখে পতিত হয়।
খালিদ-বিন-ওয়ালিদ
ইসলামের সর্বশ্রেষ্ঠ রণকুশলী খালিদ-বিন-ওয়ালিদ মক্কার কুরাইশ বংশে জন্মগ্রহণ করেন। হিজরীর ষষ্ঠ সাল পর্যন্ত তিনি মহানবীর ইসলাম প্রচারে বিঘ্ন সৃষ্টি করেন। উহুদের যুদ্ধে বিধর্মীদের হাতে মুসলমানদের পরাজয়ের মূলে ছিল খালিদের অসীম বীরত্ব ও রণকৌশল। হুদায়বিয়ার সন্ধি সম্পাদনের পর তিনি এবং আমর-বিন-আল-আস ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। ইসলামের নিরাপত্তা ও সম্প্রসারণ খালিদ ব্যতীত কখনই সম্ভবপর হত না এবং তিনি ইসলামের সেবায় নিজেকে উৎসর্গ করেন। ৬২৯ খ্রিস্টাব্দে মুতার যুদ্ধে তিনি মুসলিম বাহিনীর নেতৃত্ব করে অসাধারণ বীরত্ব ও রণনৈপুণ্য প্রদর্শন করেন। বিপর্যয়ের হাত থেকে মুসলিম বাহিনীকে রক্ষা করে মুতা অভিযানের পর মদীনায় ফিরলে মহানবী খালিদকে “সায়ফুল্লাহ” (আল্লাহর অসি) উপাধিতে ভূষিত করেন। তাঁর অসীম তেজস্বিতা ও নির্ভীকতার পরিচয় পাওয়া যায় ৬৩০ খ্রিস্টাব্দে মক্কা বিজয়ের সময় এবং দুমাতুল জন্দলের খ্রিস্টান রাজার বিরুদ্ধে যুদ্ধাভিযানে। ৬৩১ খ্রিস্টাব্দে তাঁরই নেতৃত্বে নাজরানের হারিস গোত্র ইসলামে দীক্ষিত হয়।
হযরত আবুবকর (রা)-এর খিলাফতে বীরোত্তম খালিদ ভণ্ডনবী, প্রতারক, প্রবঞ্চক, স্বধর্মত্যাগী পাষণ্ডদের বিরুদ্ধে যে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন তা অন্য কাহারও পক্ষে সম্ভবপর ছিল না। তাঁর বলিষ্ঠ নেতৃত্বে এবং অসামান্য শৌর্য-বীর্যের ফলে আসাদ, তোলায়হা, সাজাহ ও মুসায়লামার রাষ্ট্র ও ধর্মদ্রোহী কার্যকলাপ ধুলিসাৎ হয়ে যায়। রিদ্দা যুদ্ধে খালিদের অতুলনীয় ভূমিকার কথা স্মরণ করে ভন ক্রেমার বলেন, “খালিদের সাহস এবং আবুবকর (রা)-এর বিজ্ঞতা না থাকলে সেদিন (রিদ্দা যুদ্ধে) ইসলামের শত্রুগণ জয়লাভ করত।” আবুবকর (রা)-এর শাসনকালে খালিদ বিদ্রোহী গোত্র ও শত্রুভাবাপন্ন পার্শ্ববর্তী পারস্য ও বায়জানটাইন সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধাভিযান করেন। ৬৩৩ খ্রিস্টাব্দে তিনি উলিসের যুদ্ধে পারস্য সেনাবাহিনীকে পরাজিত করে হীরা দখল করেন এবং ৬৩৪ খ্রিস্টাব্দে আজনাদাইনের যুদ্ধে বায়জানটাইন খ্রিস্টান সৈন্যবাহিনী তাঁর নিকট পরাজয় বরণ করে। হযরত ওমর (রা)-এর খিলাফতে তিনি সিরিয়া অভিযান অব্যাহত রাখেন এবং ইমারমুখের যুদ্ধে রোমানদের পরাস্ত করে দামেস্ক, হিমস, হামা, বালাবাক প্ৰভৃতি শহর দখল করেন। খালিদের সামরিক দক্ষতা, রণকৌশল, শৌর্যবীর্য, অসীম বীরত্ব নিঃসন্দেহে হানিবল, সিজার, নেপোলিয়ন প্রমুখ বিশ্ববিখ্যাত বীরের সমতুল্য ছিল। হযরত ওমর (রা) তাঁকে সিরিয়ার শাসনকর্তা নিযুক্ত করেন।
৬৩৮ খ্রিস্টাব্দে খলিফা ওমর খালিদ-বিন-ওয়ালিদকে শাসনকর্তার পদ থেকে অপসারণ করেন। এই ঘটনা যেমন দুঃখজনক, অপরদিকে তেমনি বিস্ময়কর। ঐতিহাসিকদের মতে, খালিদের পদচ্যুতির জন্য দায়ী হযরত ওমর (রা)-এর ন্যায়পরায়ণতা এবং কর্তব্যজ্ঞান। তাঁর পতনের বিভিন্ন কারণ ছিল। সিরিয়া অভিযানে মুসলিম বাহিনীর সর্বাধিনায়ক হিসেবে যুদ্ধাবসানে খলিফা আয়-ব্যয়ের হিসাব প্রদান করতে বললে খালিদ তা দিতে অস্বীকার করেন। খলিফা এতে স্বভাবত অসন্তুষ্ট হন। দ্বিতীয়, খালিদ সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষক হিসেবে জনৈক কবিকে তাঁর বীর গাঁথার জন্য ১,০০০ দিনার পুরস্কার দেন। সিরিয়ায় তখন দুর্ভিক্ষ এবং মহামারী ভয়াবহ আকার ধারণ করে তখন খালিদের এহেন অমিতব্যয়িতায় খলিফা সন্তুষ্ট হতে পারেননি। অবশ্য খালিদ কৈফিয়ত দেন যে, এই পুরস্কার তিনি তাঁর নিজস্ব তহবিল থেকে দিয়েছেন। তৃতীয়তঃ যুদ্ধক্ষেত্রে খালিদের ঔদ্ধত্য এবং নিষ্ঠুরতা খলিফা মোটেই পছন্দ করতেন না। চতুর্থতঃ গনিমতের হিসাব করে দেখা গেছে যে, তাঁর সম্পত্তির মূল্য ৬০,০০০ দিনারের অধিক হতে পারেনা, অথচ তাঁর সম্পত্তির মোট মূল্য দেখা গেল ৮০,০০০ দিনার। সুতরাং খলিফা ন্যায়সঙ্গতভাবেই ২০,০০০ দিনার মূল্যের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করবার নির্দেশ দেন। পঞ্চমতঃ রিদ্দা যুদ্ধের সময় ইয়ারবু গোত্রের দলপতি মালিক-বিন-নুবিয়াকে পরাজিত ও নিহত করে তাঁর বিধবা পত্নী লায়লাকে বিয়ে করলে খলিফা খালিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনেন। ষষ্ঠতঃ খালিদের শৌর্যবীর্য ও বীরত্ব তাঁকে জনপ্রিয়তার সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছে দিলে খলিফা একথা মনে করে বিচলিত হয়ে উঠলেন যে, মুসলমানগণ ইসলামের সম্প্রসারণের জন্য আল্লাহর পরিবর্তে খালিদকেই স্মরণ করবে। এ প্রসঙ্গে মূইর বলেন, “তিনি (হযরত ওমর) খালিদকে যে তাঁর সরকারি পদ থেকে অপসারণ করেছিলেন তার কারণ জুলুম বা প্রতারণা নহে; বরং তার কারণ এই যে, জনগণ সকল বিজয়ের একমাত্র মালিক আল্লাহর উপর ভরসা ও তাঁর প্রতি দৃষ্টি নিক্ষেপের পরিবর্তে যে রক্ত-মাংসের বাহুর উপর আস্থা স্থাপন করতে প্রলুব্ধ হত, তিনি তাদের পথ থেকে তা অপসারণ করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন।”
মিসর বিজয় (৬৩৯–৬৪২ খ্রি)
কারণ : হযরত ওমরের খিলাফতকে ইসলামের সম্প্রসারণের যুগ বলা হয়ে থাকে। পারস্য ও সিরিয়া বিজয়ের পর স্বভাবত মুসলমানগণ মিসর অভিযান করতে বাধ্য হয়। এর মূলে কতকগুলো সুস্পষ্ট কারণ ছিল। সিরিয়া ও প্যালেস্টাইনে রোমান সৈন্য পরাজিত হলেও মিসরে বায়জানটাইন আধিপত্য অক্ষুণ্ণ ছিল। মুসলিম রাষ্ট্রের সন্নিকটে খ্রিস্টান বায়জানটাইন সাম্রাজ্যের অবস্থিতি ইসলামের জন্য খুবই উদ্বেগজনক ছিল মিসর। ইসলামের প্রাণকেন্দ্র হেজাজের অত্যন্ত নিকটবর্তী থাকায় মুসলিম রাষ্ট্রের নিরাপত্তার জন্য মিসর বিজয়ের প্রয়োজন ছিল। দ্বিতীয়তঃ প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা ছাড়াও সামরিক দিক হতে মিসরের অবস্থান আরব দেশের পক্ষে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মিসরে রোমানদের নৌ- বাহিনীর ঘাঁটি ছিল এবং সুয়েজ ও আলেকজান্দ্রিয়া অঞ্চলের সামরিক গুরুত্ব উপলব্ধি করে শক্তিশালী মুসলিম রাষ্ট্র গঠনে ও নৌবাহিনী গঠনের প্রয়োজনে মিসর বিজয় অবশ্যম্ভাবী হয়ে দাঁড়ায়। আরবগণ মরুভূমি ও অনুর্বর ভূখণ্ড থেকে সুজলা-সুফলা, শস্য- শ্যামলা অঞ্চলে দেশান্তরের নেশায় আরবের উত্তর-পূর্ব ও উত্তর-পশ্চিমে অভিযান করেছিল এর কারণ অর্থনৈতিক দুর্গতি থেকে অব্যাহতি লাভ। মিসরকে বলা হয় ‘নীল নদের দান’। প্রাচীন মিসরীয় সভ্যতার লীলাভূমি মিসর ছিল কৃষি-সম্পদে সমৃদ্ধ। অর্থনৈতিক, সামরিক, রাজনৈতিক প্রয়োজনেই হযরত ওমর মিসরে ইসলামের সম্প্রসারণের মহাপরিকল্পনা করেন। রোমান সম্রাটের বিরুদ্ধাচারণ এবং জাজিরার জনগণকে মুসলমানদের বিরুদ্ধে প্ররোচনা দানের জন্য মিসর অভিযান ত্বরান্বিত হয়।
মিসর অধিকৃত : সিরিয়া এবং পারস্য বিজয়ের পর হযরত ওমরের শাসনকালে মুসলমানগণ মিসরে অভিযান করে। খলিফা জেরুজালেমে আগমন করলে আমর-ইবন- আল-আস মিসর অভিযানের জন্য অনুমতি প্রার্থনা করেন। আমরকে কোন প্রকার সুনির্দিষ্ট আদেশ প্রদান না করে হযরত ওমর মদীনায় ফিরে হযরত ওসমান ও অন্যান্য সাহাবীদের সাথে পরামর্শ করে মদীনা থেকে আমরকে চিঠি প্রেরণ করে অভিযান স্থগিত রাখতে বলেন। আমর প্যালেস্টাইন থেকে মিসরে পদার্পণ করে খলিফার চিঠি খুলে পড়লেন। এতে নির্দেশ ছিল যে, যদি মিসরে পৌঁছবার পূর্বে চিঠি আমরের হস্তগত হয় তা হলে সেনাপতি যেন যুদ্ধাভিযান স্থগিত রাখেন এবং যদি মিসরে পদার্পণ করে আমর চিঠি পান তা হলে আল্লাহর সাহায্য প্রার্থনা করে তিনি যেন মিসর বিজয়ের সকল ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। অতঃপর ৬৩৯ খ্রিস্টাব্দে ৪,০০০ অশ্বারোহী সৈন্য নিয়ে আমর, ওয়াদি- আল-আরিশ নামক স্থান দখল করেন এবং পরে আল-ফারমায় স্বীয় কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত করেন। অতঃপর বিবলস এবং আরও কয়েকটি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র শহর অধিকার করে আমর ব্যাবিলনের নিকটবর্তী হন। এই সময় হযরত ওমর প্রেরিত জুবাইর-ইবন-আল- আওয়ামের নেতৃত্বে ১০,০০০ সৈন্য মিসরে এসে পৌঁছে। ৬৪০ খ্রিস্টাব্দে আমর ২৫,০০০ সৈন্য নিয়ে গঠিত বায়জানটাইন সেনাবাহিনীকে হেলিওপলিসের যুদ্ধে শোচনীয়ভাবে পরাজিত করেন। সেনাপতি থিওডোর আলেকজান্দ্রিয়ায় আত্মগোপন করেন এবং বায়জানটাইন শাসনকর্তা সাইরাস ব্যাবিলন দুর্গে আশ্রয় গ্রহণ করেন। ৬৪১ খ্রিস্টাব্দের ৬ই এপ্রিল মুসলমানগণ দুর্গপ্রাকার অতিক্রম করে ব্যাবিলন অধিকার করেন। মিসর অভিযানের সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ছিল আলেকজান্দ্রিয়ার পতন। সেনাধ্যক্ষ আমরের ব্যক্তিগত পরিচালনায় মুসলমানগণ মিসরে বায়জানটাইন সম্রাটের সামরিক ঘাঁটি আলেকজান্দ্রিয়া অবরোধ করেন। শত্রুপক্ষের সেনাপতি থিওডোর সুরক্ষিত আরেকজান্দ্রিয়া দুর্গে অবস্থান করে মুসলিম আক্রমণ প্রতিহত করতে চেষ্টা করেন। মুসলমানদের সৈন্য-সংখ্যা ছিল মাত্র ২০,০০০; অপরদিকে ৫০,০০০ বায়জানটাইন সৈন্য আলেকজান্দ্রিয়া রক্ষার জন্য নিয়োজিত ছিল। তরুন রোমান সম্রাট কনস্টানস্ দুর্গ থেকে নিক্ষেপণাস্ত্র প্রয়োগ করেও মুসলিম অবরোধ প্রতিহত করতে পারেন নি। ৬৪১ খ্রিস্টাব্দের ৮ই নভেম্বর মুসলিম সৈন্যবাহিনী আলেকজান্দ্রিয়া দখল করে। খ্রিস্টান ধর্মযাজক মুসলমানদের সাথে সন্ধি-চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। রোমান সম্রাট মুসলিম রাষ্ট্রকে ১৩,০০০ দিনার কর দিতে অঙ্গীকারাবদ্ধ হন। সন্ধি-চুক্তি অনুযায়ী খ্রিস্টানদের জিজিয়া কর প্রদানের পরিবর্তে তাঁদের জান-মালের নিরাপত্তা বিধান করা হয়। মিসর বিজয়ের কারণ উল্লেখ করে একজন আরব ঐতিহাসিক বলেন যে, রোমান সম্রাটের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে আলেকজান্দ্রিয়ার ধর্মযাজক নগরের অধিবাসীদের মুসলমানদের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করতে নিষেধ করেন।
আলেকজান্দ্রিয়া বিজয়ের গুরুত্ব : আলেকজান্দ্রিয়া বিজয় ইসলামের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। মুসলমানগণ আলেকজান্দ্রিয়াকে সামরিক ঘাঁটি এবং নৌ- বহরের প্রধান কেন্দ্র হিসাবে ব্যবহার করে জলে ও স্থলে ইসলামের সম্প্রসারণ করতে থাকেন। এখান থেকে মুসলিম অভিযান উত্তর আফ্রিকা বা ইফ্রিকায় পরিচালিত হয় এবং পেনটাপোলিস, বারকা প্রভৃতি অঞ্চল মুসলমানদের অধিকারে আসে। পরবর্তীকালে হযরত ওসমান (রা)-এর খিলাফতে মুসলিম নৌ-বাহিনী গঠিত হলে সাইপ্রাস অধিকার করা সম্ভবপর হয়। মুসলিম প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হলে আমর ৬৪২ খ্রিস্টাব্দে বর্তমান কায়রোর সন্নিকটে আল-ফুসতাত নগরীর পত্তন করেন। এখানে বসরা ও কুফার মত একটি মসজিদও নির্মিত হয়। শাসনকর্তা হিসাবে আমর দক্ষতার পরিচয় দেন এবং জনকল্যাণকর সংস্কার প্রবর্তন করেন। খ্রিস্টানদের সাথে মুসলমানদের ধর্মীয় উদারনীতির জন্য সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপিত হয়। কোন কোন ঐতিহাসিকের মতে, হযরত ওমর (রা)-এর নির্দেশে আমর আলেকজান্দ্রিয়ার বিখ্যাত গ্রন্থাগার অবরোধের সময় ভস্মীভূত করেন। কিন্তু খলিফা ওমরের মত উদার, নীতিজ্ঞানসম্পন্ন ও ধর্মভীরু ব্যক্তি কখনই ধ্বংসকার্য বিশেষ করে শিক্ষামূলক প্রতিষ্ঠান ধ্বংসে লিপ্ত থাকতে পারেন না। গীবন হিট্টি প্রমুখ ঐতিহাসিকগণ একে ভিত্তিহীন এবং কাল্পনিক বলে অভিহিত করেন। মুসলিম আক্রমণের সময় আলেকজান্দ্রিয়ায় কোন উল্লেখযোগ্য গ্রন্থাগার ছিল না। প্রখ্যাত টলেমির গ্রন্থাগার (খ্রি.পূ. ৪৮ সালে) জুলিয়াস সীজার কর্তৃক ভস্মীভূত হয়। পরবর্তীকালে “The Daughter’s Library” নামে অপর যে গ্রন্থাগার নির্মিত হয়েছিল তাও ৩৮৯ খ্রিস্টাব্দে থিওডোসিয়াসের রাজত্বকালে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। মূইরের মতে, “এটি পরবর্তীকালের একটি কল্পিত কাহিনী বটে।” হযরত ওমর (রা)-এর আদেশে আমর সুয়েজ খাল খনন করে নীল নদের সাথে লোহিত সাগরের সংযোগ স্থাপন করেন। ৬৪৩ খ্রিস্টাব্দে এই খাল খননের ফলে মিসর থেকে আরবের সামুদ্রিক বন্দর ইয়ার্নবু পর্যন্ত যাতায়াত ও নৌ-বাণিজ্যের সুবিধা হয়। ৮০ বৎসর পর্যন্ত এটি ব্যবহৃত হবার পর বালি পড়ে এটি বন্ধ হয়ে যায়।
উত্তর আফ্রিকা অভিযান : হযরত ওমর (রা)-এর খিলাফতে আমর-ইবন-আল- আস আলেকজান্দ্রিয়া থেকে উত্তর আফ্রিকা অথবা ইফ্রিকার অভিযান প্রেরণ করেন। রোমানদের ঘন ঘন আক্রমণে অতিষ্ঠ হয়ে আমর ৬৪৪ খ্রিস্টাব্দে বার্কায় একটি সৈন্যদল প্রেরণ করেন। খ্রিস্টান জনসাধারণ বিনাযুদ্ধে আত্মসমর্পণ করে কর দানে স্বীকৃত হয়। বার্কা দখল করে ত্রিপলিতে অভিযান পরিচালিত করা হয় এবং এই অঞ্চলে মুসলিম প্রাধান্য সুপ্রতিষ্ঠিত হয়।
অভিযানের সাফল্যের কারণ : হিট্টি বলেন, “মহানবী (স)-এর ইন্তেকালের পর যেন যাদুমন্ত্রের ছোঁয়াচে অনুর্বর আরব দেশে অসংখ্য বীর এবং অতুলনীয় যোদ্ধা উৎপাদনের ক্ষেত্রে রূপান্তরিত হল। যাদের সংখ্যা এবং গুণাবলির সমকক্ষ আর কোথাও পাওয়া দুষ্কর ছিল।” অনুরূপভাবে এইচ. জি. ওয়েলস বলেন, “যে সামরিক অভিযান আরম্ভ হল তা পৃথিবীর ইতিহাসে সর্বাপেক্ষা গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়। আরব ভূখণ্ড সহসা একটি অত্যুৎকৃষ্ট যোদ্ধাদের বাগানে পরিণত হয়। খালিদের ন্যায় দক্ষ এবং কর্তব্যপরায়ণ যোদ্ধাগণ যেন তারকামণ্ডলে এক একটি উজ্জ্বল নক্ষত্র।” হযরত ওমর (রা) খিলাফত লাভ করে খলিফা আবু বকরের সম্প্রসারণ নীতি অনুসরণ করেন এবং তাঁর দশ বৎসরের (৬৩৪-৪৪ খ্রিস্টাব্দ) শাসনকাল কেবলমাত্র ইসলামের ইতিহাসেই নহে, বিশ্বের ইতিহাসে একটি রোমাঞ্চকর এবং দুঃসাহসিক ঘটনার অবতারণা করে। এই যুদ্ধাভিযানে যাঁরা নেতৃত্ব দান করেন তাঁদের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য ছিলেন খালিদ-বিন-ওয়ালিদ, আমর-বিন-আল-আস এবং সা’দ-বিন-আবি ওয়াক্কাস।
ইসলাম ধর্ম আরব জাতিকে সংঘবদ্ধ করে একটি শক্তিশালী রাষ্ট্রে পরিণত করে এবং ধর্মীয় প্রেরণায় মুসলমানগণ বিধর্মীদের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হয়। ধর্মের অনুশাসন অনুযায়ী বিধর্মীদের সাথে যুদ্ধে জয়ী হলে মুসলমানগণ “গাজী” আখ্যা লাভ করত এবং রণক্ষেত্রে নিহত হলে “শহীদের” সম্মান লাভ করত। ইসলাম প্রচারের নিমিত্ত ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ছিল (Missionary religion) কিন্তু ধর্ম প্রচারের জন্য মুসলমানগণ কখনও যুদ্ধ করে নাই। একথা খুবই ভ্রান্তিকর যে, মুসলমানগণ এক হাতে তরবারি এবং অপর হাতে কুরআন শরীফ নিয়ে ধর্ম প্রচার করত। কুরআনের বিধান অনুযায়ী ধর্মগ্রহণের কোন জবরদস্তি নাই। মুসলিম অভিযানে অনেক ধর্মপ্রাণ ব্যক্তি ইসলামের সেবা করার জন্য অংশগ্রহণ করেন। সম্প্রসারন ব্যতীত ইসলাম আন্তর্জাতিক খ্যাতি অর্জন করতে পারত না এবং বিশ্বে মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চল গড়ে উঠত না। হুরগুরুঞ্জের মতে, “প্রথম খলিফাদের সামরিক সাফল্য ব্যতীত ইসলাম কখনই একটি সর্বজনীন ধর্মে পরিণত হতে পারত না।”
ইসলামের আবির্ভাবের ফলে বিশ্ব থেকে আরব উপদ্বীপের বিচ্ছিন্নতার অবসান হয়। অনুর্বর আরব ভূমিতে যখন অধিক সংখ্যক মুসলমানদের খাদ্যের সংকুলান হল না তখন ইসলামের পতাকাতলে দেশ জয়ের নেশায় তারা আরব দেশের বাইরে অভিযানে যোগদান করে। ধর্মীয় অনুপ্রেরণা ছাড়াও ক্ষুধার তাড়নায় তারা সৈন্যবাহিনীতে যোগদান করে এবং দেশ জয়ের ফলে নতুন বিজিত ভূখণ্ডে বসবাসের স্বপ্ন দেখে। বেকার, হিট্টি প্রমুখ ঐতিহাসিকগণ ইসলামের সম্প্রসারণের মূলে, অর্থনৈতিক কারণের উপর গুরুত্ব আরোপ করেন। হিট্টির মতে, “ধর্মান্ধতা নয় বরং অর্থনৈতিক প্রয়োজনে বেদুঈন দলকে তাঁদের অনুর্বর অঞ্চল থেকে উত্তরের শস্য-শ্যামলা সুন্দর ভূখণ্ডের দিকে পরিচালিত করে।” হিট্টি আরও অভিমত প্রকাশ করেন যে, “ইসলামের সম্প্রসারণ ছিল সর্বশেষ গুরুত্বপূর্ণ সেমিটিক দেশান্তরে গমন।”
রাসূলে করীম একটি কলহপ্রিয় আরব জাতিকে সাম্য, মৈত্রী ও ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে এক নতুন ধর্মভিত্তিক আদর্শ রাষ্ট্রে পরিণত করেন। হযরত আবুবকর (রা) এই নব-প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্র ও ধর্মকে সুসংহত ও সুসংঘবদ্ধ করে শত্রুমুক্ত করেন এবং প্রতিরক্ষামূলক বাহিনী গঠন করে নিরাপত্তা বিধান করেন। খলিফা ওমরের সময়ে ধর্ম ও রাষ্ট্র হিসেবে ইসলাম নতুন প্রেরণা লাভ করে এবং রাজনৈতিক ও সামাজিক অনুশাসনগুলো নিকটবর্তী বিধর্মী রাষ্ট্রের জনসাধারণকে অনুপ্রাণিত করতে থাকে। পারস্য ও বায়জানটাইন সাম্রাজ্যের অধঃপতনের মূলে ছিল তাদের বৈষম্যমূলক সমাজ-ব্যবস্থা এবং রাজনেতিক অরাজকতা। এ কারণে বিজিত দেশের জনসাধারণ স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে মুসলমান বাহিনীকে সাহায্য করে এবং অনেকে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে “মাওয়ালী” সম্প্রদায়ের সৃষ্টি করে। ইসলামের সম্প্রসারণে খলিফার শাসন বিস্তৃতি লাভ করে এবং মদীনার প্রাধান্য আরব-ভূখণ্ডের বাইরে সুপ্রতিষ্ঠিত হয়। রিদ্দা যুদ্ধের ফলশ্রুতি ছিল ইসলামের সম্প্রসারণ। ধর্মীয় প্রেরণা এবং অর্থনৈতিক চাপে এই সম্প্রসারণের প্রয়োজন ছিল সন্দেহ নেই; কিন্তু হিট্টির মতে, “মুসলিম বিজয়কে প্রাচীন নিকট-প্রাচ্য কর্তৃক এর হৃতরাজ্য উদ্ধারের প্রচেষ্টা বলে মনে করা যেতে পারে।”
মুসলিম অভিযান আরবদেশ থেকে পরিচালিত হলে মদীনা নব-বিজিত ইসলামী রাজ্যের প্রাণকেন্দ্রে পরিণত হয়। ইসলামের সম্প্রসারণে বিশ্বের প্রাচীনতম সভ্যতার সংস্পর্শে এসে মুসলিম কৃষ্টি ও সভ্যতার উন্মেষ হয়। এ প্রসঙ্গে বেকার বলেন, “ইসলাম বিচ্ছিন্নতা থেকে বের হয়ে এসে প্রাচ্য-হেলেনিক সভ্যতার উত্তরাধিকারী হল। একে বিশ্ব ইতিহাসের ক্রমবিবর্তনের সর্বশেষ যোগসূত্র বলে মনে করা হয়।
সম্প্রসারণের গুরুত্ব : হুরগুরুঞ্জ বলেন, “প্রথম খলিফাদের সামরিক সাফল্য ব্যতীত ইসলাম কখনই সর্বজনীন ধর্মে পরিণত হতে পারত না।” ধর্ম ও রাষ্ট্র হিসেবে ইসলামের সম্প্রসারণ সামরিক বিজয় ব্যতীত কোনদিনই সম্ভবপর হত না। এই বিজয়ের মূলে পৃথিবীর মানচিত্রে একটি যুগান্তকারী পরিবর্তন পরিলক্ষিত হয় এবং ভৌগোলিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক আলোড়নের সূচনা করে। সেমিটিক জাতির প্রভাব পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়। আল্লাহর একত্ববাদ অপ্রতিদ্বন্দ্বী ধর্মের মর্যাদা লাভ করে। সাম্য, ভ্রাতৃত্ব ও শৃঙ্খলার বন্ধনে অধিবাসীদের সংঘবদ্ধ করা হয়। এই বিজয়ে যাঁরা নেতৃত্ব দান করেন তাঁরা অমর হয়ে রয়েছেন। ধর্ম, সহিষ্ণুতা, নৈতিক মনোবল ও সাংগঠনিক ক্ষমতায় বলীয়ান খলিফা হযরত ওমর (রা) ইসলামের সম্প্রসারণের ইতিহাসে একটি অনবদ্য অধ্যায় রচনা করে গেছেন। তাঁর বলিষ্ঠ নেতৃত্বে ও অনুপ্রেরণায় মুসলিম বাহিনী অসামান্য রণকৌশল, শৃঙ্খলা, কর্তব্যনিষ্ঠা প্রদর্শন করে। ইসলামের সামরিক ইতিহাসের উজ্জ্বল নক্ষত্র ছিলেন খালিদ, আমর, মুসান্না, আবু ওবায়দা, সা’দ- বিন-আবি-ওয়াক্কাস প্রমুখ যুদ্ধবিশারদগণ। হিট্টির মতে, “খালিদ-বিন-ওয়ালিদ, সা’দ- বিন-আবি-ওয়াক্কাস এবং আমর ইবন-আল-আসের ইরাক, পারস্য, সিরিয়া ও মিসর অভিযানসমূহ পৃথিবীর সামরিক ইতিহাসে শ্রেষ্ঠ ও সুপরিকল্পিত অভিযানগুলোর অন্যতম এবং এটি নেপোলিয়ন, হানিবল ও আলেকজান্ডার কর্তৃক পরিচালিত যুদ্ধাভিযানগুলোর সাথে তুলনীয়।”
হযরত ওমর (রা)-এর প্রশাসন ব্যবস্থা
হযরত ওমর (রা) পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বিজেতাদের অন্যতমই ছিলেন না, সুযোগ্য প্রশাসক হিসেবেও তিনি অক্ষর কীর্তি রেখে গেছেন। ইমামুদ্দিন বলেন, তাঁর শাসনকাল ইসলামের কৃতিত্বপূর্ণ সামরিক ইতিহাসে গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায় সংযোজন করেছে। শুধুমাত্র মহান বিজেতাই নন, তিনি ছিলেন সর্বযুগের সর্বশ্রেষ্ঠ শাসক এবং নিরঙ্কুশ সফলকামী জাতীয় নেতাদের অন্যতম।” হযরত ওমর (রা) নিঃসন্দেহে ইসলামের শাসন-ব্যবস্থার প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা। রাসূলে করীমের মদীনা প্রজাতন্ত্র হযরত আবুবকর (রা) এবং বিশেষ করে হযরত ওমর ফারুকের (রা) সময় সম্প্রসারিত হয়ে একটি বিশাল মুসলিম রাষ্ট্রে পরিণত হলে প্রচলিত শাসন ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন করতে হয়রত ওমর (রা) বিজিত অঞ্চলে বিরাজমান রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক অব্যবস্থার কথা চিন্তা করে প্রশাসনকে এরূপ একটি সুষ্ঠু, সুসংহত ও জনগণের উপযোগী করে তোলেন, যা বিশাল মুসলিম রাষ্ট্রের ভিত্তিকে সুদৃঢ় ও শক্তিশালী করে। কুরআন ও হাদিসের নির্দেশ ও আদর্শ মোতাবেক তিনি প্রশাসনকে পুর্ণাঙ্গ ও সুনির্দিষ্ট রূপ দান করেন। তাঁর প্রশাসনের প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাপনা। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালাই ইসলামী গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের সার্বভৌম ক্ষমতার (Theocracy) উৎস। তাঁর প্রতিনিধি সার্বভৌম ক্ষমতা প্রয়োগ করে ইসলামী আদর্শের শাসনব্যবস্থা প্রবর্তন করেন। একনায়কতন্ত্রের পরিবর্তে গণতন্ত্র, নির্বাচনের মাধ্যমে খলিফার নিযুক্তি, পরামর্শ সভার মতানুসারে প্রশাসনিক কাঠামো ও কার্যক্রম গ্রহণ, সাম্য, একতা, ভ্রাতৃত্বের আদর্শে জনকল্যাণকর ব্যবস্থা প্রবর্তন, খলিফার কার্যে জনগণের সমালোচনা করার অধিকার গণতান্ত্রিক সরকারের প্রধান প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল। মৌলানা মুহাম্মদ আলী বলেন, “হযরত ওমরের সময় গণতন্ত্রের আদর্শ যতদূর বহন করা হয়েছিল সে আদর্শ অর্জন করতে বিশ্বের আরও সময় লাগবে। “
উপদেষ্টা পরিষদ : শাসন ব্যবস্থায় হযরত ওমরের কৃতিত্ব ও অবদানের কথা ঐতিহাসিকগণ অকপটে স্বীকার করেন। আমীর আলী বলেন, “ত্রিশ বৎসরের খিলাফতে হযরত ওমরের জীবদ্দশায় ও মৃত্যুর পরে তাঁর অনুসৃত নীতি প্রধানত তাঁরই নিকট থেকে উদ্ভূত হয়েছিল।” হযরত ওমরের গণতান্ত্রিক, শাসন-ব্যবস্থার প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল মজলিস-উর-শূরা (Majlis – us – Shura) অথবা উপদেষ্টা পরিষদ (Consultative Body)। এই উপদেষ্টা পরিষদ আরবে দুভাগে বিভক্ত ছিল, যথা- মজলিস-উস-খাস ও মজলিস-উস-আম। দৈনন্দিন কার্যকলাপের পরামর্শ গ্রহণ করা হত। মজলিস-উস- খাসের নিকট থেকে কিছুসংখ্য বিশিষ্ট মোহাজের নিয়ে এই উচ্চ সভা গঠিত ছিল। উচ্চ পরিষদের সভ্য ছিলেন হযরত ওসমান, হযরত আলী, তালহা, যুবাইর প্রমুখ মক্কাবাসী ঘনিষ্ঠ এবং বয়োজ্যেষ্ঠ সাহাবী; অপরটি নবী করীমের সাহাবিগণ ও মদীনার গণ্যমান্য ব্যক্তিদের দ্বারা গঠিত ছিল বলে এরি নাম ছিল মজলিস উস-আম বা সাধারণ পরিষদ। হযরত ওমর ঘোষণা করেন, পরামর্শ ব্যতীত কোন খিলাফত চলতে পারে না।” কুরআন ও সুন্নাহর নির্দেশ মোতাবেক মসলিস-উশ-শূরার পরামর্শ ব্যতীত তিনি কখনও কোন কার্য সম্পন্ন অথবা সমস্যার সমাধান করতেন না। খলিফা কখনই নিজের মতানুসারে শাসনকার্য পরিচালনা করেন নি। এতে প্রমাণিত হয় যে, তিনি পূর্ণাঙ্গ গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে বিশ্বাসী ছিলেন। মদীনার নদীর মসজিদে ‘মজলিস-উস-শূরার সভা বসত এবং সাধারণ পরিষদে সৈন্য ও কর্মচারী, শাসনকর্তা, বিচারক নিয়োগ ও বদলী, যুদ্ধ ও ব্যবসা সংক্রান্ত বিষয়াদি সম্পন্ন হত এবং রাষ্ট্রের খুঁটিনাটি ব্যাপারেও খলিফা সর্বদা মজলিসের পরমার্শ গ্রহণ করতেন। এই কারণে আল্লামা শিবলী নোমানী বলেন, “বর্তমান যুগের চাহিদা অনুযায়ী গণতন্ত্রের যাবতীয় কায়দা-কানুন হযরত ওমর (রা) করতে না পারলেও তার সময়ে গণতন্ত্রের মৌলিকত্বের যে বিকাশ লাভ করেছিল তাতে কোন সন্দেহের অবকাশ নেই।”
আরব জাতীয়তাবাদ : হযরত ওমরের শাসন-ব্যবস্থার অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল আরব জাতীয়তাবাদকে অক্ষুণ্ণ রাখা। আরব জাতির বৈশিষ্ট্য বজায় রাখবার জন্য তিনি প্রধানত দুটি নীতি অনুসরণ করেন- প্রথমত, আরব উপদ্বীপকে সম্পূর্ণরূপে আরব মুসলিমদের বাসভূমিতে পরিণত করবার জন্য শত্রু ভাবাপন্ন ইহুদী এবং খ্রিস্টানদের আরবদেশের বাইরে বসবাসের নির্দেশ দেন। খাইবারের ইহুদী এবং নাজরানের খ্রিস্টানদের ক্ষতিপূরণ প্রদান করে খলিফা আরবদেশ থেকে বহিষ্কার করে দেন। দ্বিতীয়ত, খলিফার আদেশে আরবদেশের বাইরে মুসলিম সৈন্যদের জমিজমা ক্রয় অথবা চাষাবাদ করা নিষিদ্ধ ছিল। সামরিক বাহিনীকে সেনানিবাসে অবস্থান করতে হত যাতে তাদের যুদ্ধস্পৃহা এবং জাতিগত বিশুদ্ধতা, সামরিক প্রাধান্য ও আভিজাত্য অক্ষুণ্ণ থাকে। এভাবে খলিফা মুসলিম বাহিনীকে পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ সমরপ্রবণ যুদ্ধপ্রিয় জাতিতে এবং ইসলামকে আরব ভূখণ্ডে একটি মাত্র শক্তিশালী ধর্ম ও রাষ্ট্ররূপে পরিণত করতে সক্ষম হন।
প্রাদেশিক শাসন ব্যবস্থা : মুসলিম রাষ্ট্রের পরিধি বিস্তারের সাথে সাথে হযরত ওমর (রা) প্রশাসনিক কাঠামোকে সুষ্ঠু ও কার্যকর করবার জন্য সমগ্র আরব ও বিজিত দেশসমূহকে সামরিক ও প্রশাসনিক প্রয়োজনে ১৪টি প্রদেশে বিভক্ত করেন; যথা মক্কা, মদীনা, সিরিয়া, আলজিরিয়া, বসরা, কুফা, মিসর, প্যালেস্টাইন, ফারস, কিরমান, খোরাসান, মাকরান, সিজিস্তান ও আযারবাইজান। শাসন-ব্যবস্থার বিকেন্দ্রিকরণের ফলে দূরবর্তী অঞ্চলেও সুষ্ঠু শাসন-ব্যবস্থার নিশ্চয়তা বিধান করা হত। প্রত্যেক অঞ্চলকে জিলা ও মহাকুমায় বিভক্ত করে খলিফা আইনের শাসন প্রবর্তন করেন এবং জনসাধারণের শান্তি ও নিরাপত্তা বিধান করেন। প্রদেশের শাসনকর্তা বা ‘ওয়ালী’ এবং জিলার শাসনকর্তা বা ‘আমীন’কে খলিফা উপদেষ্টা পরিষদের সাথে পরামর্শ করে নিযুক্ত করতেন এবং তাঁরা তাঁদের কার্যের জন্য খলিফার নিকট দায়ী থাকতেন। প্রতি বৎসর হজ্ব পালনের সময় শাসনকর্তাগণ মক্কায় আগমন করে তাঁদের কার্যকলাপের বর্ণনা এবং আয়-ব্যয়ের হিসাব প্রদান করতেন।
বিভিন্ন প্রদেশের শাসনকর্তা নিযুক্ত করবার পূর্বে খলিফা ওমর ওয়ালী এবং আমীনদের স্ব স্ব দায়িত্ব, কর্তব্য ও ক্ষমতা তাদের নিয়োগপত্রে লিখে দিবার ব্যবস্থা করেন। জনসাধারণকেও তাদের কর্তব্য ও দায়িত্ব সম্বন্ধে অবহিত করা হত, যাতে শাসনকর্তাগণ স্বৈরাচারী নীতি অবলম্বন করতে না পারেন। খোৎবা এবং ফরমানের মাধ্যমে প্রত্যেক কর্মচারী ও নাগরিককে তা জানান হত। দায়িত্ব পালনে কিছুমাত্র অবহেলা করলে তাদের পদচ্যুত এবং কোন কোন ক্ষেত্রে শাস্তি প্রদান করা হত। বীরকেশরী খালিদের পতন হযরত ওমরের নীতিজ্ঞান, নিষ্ঠা ও কর্তব্যবোধের পরিচায়ক। সরকারি কর্মচারীদের দুর্নীতিমুক্ত করবার জন্য নিয়োগের অব্যবহিত পরেই প্রত্যেক কর্মচারীকে তার স্থাবর-অস্থাবর যাবতীয় সম্পত্তির একটি তালিকা খলিফাকে প্রদান করতে হত। শাসনকালে যদি কারও সম্পত্তি আয়ের অনুপাতে অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পেত তা হলে অতিরিক্ত সম্পত্তি রাষ্ট্র কর্তৃক বাজেয়াপ্ত করা হত। এ নীতির ফলে প্রাদেশিক শাসনকর্তা খালিদ, আবু হোরায়রা ও আমর-বিন-আল-আসের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হয়। শাসন-ব্যবস্থাকে দুর্নীতিমুক্ত করবার জন্য হযরত ওমর (রা) গুপ্তচর প্রথা প্রবর্তন করেন। প্রাদেশিক শাসন সম্বন্ধে সম্যক জ্ঞানলাভ করবার জন্য গুপ্তচর নিযুক্ত করা হয় এবং তাদের মাধ্যমে খলিফা সরকারি কর্মচারীদের উপর কঠোর দৃষ্টি রাখতে সক্ষম হন। ওয়ালিগণ শুধু প্রাদেশিক গভর্নর হিসেবেই কাজ করতেন না বরং প্রদেশের সামরিক, ধর্মীয়, প্রশাসনিক ব্যবস্থা সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার দায়িত্ব ছিল তাদের উপর। প্রাদেশিক সরকারের শাসনকার্য নির্বাহের জন্য বিভিন্ন সরকারি কর্মচারী নিযুক্ত করা হত। যেমন ‘কাজী’ (বিচারক), ‘কাতিব; (প্রধান উপদেষ্টা), ‘কাতিব-উদ-দিওয়ান’ (প্রধান সামরিক উপদেষ্টা), ‘সাহিব-উল-খারাজ’ (রাজস্ব উপদেষ্টা), ‘সাহিব-উল- আহদাত’ (পুলিশ উপদেষ্টা), ‘সাহিব-উল-বায়তুল মাল’ (কোষাধ্যক্ষ)। প্রশাসনিক কাঠামো গঠন করেই খলিফা ওমর ক্ষান্ত ছিলেন না; বিভিন্ন কর্মচারীর যোগ্যতা, অভিজ্ঞতা, মেধা অনুসারে বেতন নির্ধারণ করে দেন। এর ফলে উৎকোচ, প্রতারণা প্রভৃতি অসামাজিক কার্যকলাপ বন্ধ হয়ে একটি প্রগতিশীল, সুসংঘবদ্ধ ও দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন ব্যবস্থা প্রবর্তিত হয়। প্রাদেশিক শাসনকর্তাকে সর্বোচ্চ পাঁচ হাজার দিরহাম পর্যন্ত ভাতা দেওয়া হত। এ ছাড়া তাঁরা গণিমতের অংশও পেতেন। সিরিয়ার শাসনকর্তা মুয়াবিয়া মাসিক এক হাজার দিনার ভাতা পেতেন।
প্রাদেশিক শাসন-ব্যবস্থার অধীনে জেলা প্রশাসক (আমীন), বিচারক (কাজী) ও কোষাধ্যক্ষ তাদের স্ব স্ব কার্য নির্বাহ করতেন। হযরত ওমরের রাজনৈতিক দূরদর্শিতা ও প্রশাসনিক দক্ষতার প্রমাণ পাওয়া যায় তাঁর কার্য-পদ্ধতিতে। তাঁর ব্যক্তিগত সচিব আবদুল্লাহ ইবন-আরকাম সববিষয়ে খলিফাকে সাহায্য করতেন। তিনি সহজ, সরল ও অনাড়ম্বরপূর্ণ জীবনযাত্রা নির্বাহ করতেন বলে প্রশাসকের বিলাস-বাসন খুবই ঘৃণা করতেন। খলিফার নিকট প্রেরিত প্রশাসনিক অভিযোগ স্বয়ং পরীক্ষা করবার জন্য তিনি মোহাম্মদ-বিন-মাসলামা আনসারীকে নিযুক্ত করেন। প্রদেশসমূহে পরিভ্রমণ করে মাসলামা সঠিক সংবাদ আহরণ করতেন এবং খলিফার নিকট তা পেশ করতেন। আমীর আলী যথার্থই বলেছেন, “হযরত ওমর (রা)-কে ইসলামের রাজনৈতিক প্রশাসনের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা বলে মনে করা যেতে পারে।
রাজস্ব ব্যবস্থা : ইসলামী রাষ্ট্রের বিশালতায় এবং সুষ্ঠু রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক পরিবেশ সৃষ্টির উদ্দেশ্যে হযরত ওমর (রা) রাজস্ব-ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন সাধন করেন। সুষ্ঠু কর প্রদানের মাধ্যমে রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক অচলাবস্থা দূরীভূত করে স্থিতিশীল প্রশাসনিক কাঠামো গঠনের জন্য প্রথম বলিষ্ঠ পদক্ষেপ তিনিই গ্রহণ করেন। শিবলী নোমানী বলেন, “বিজিত দেশসমূহের প্রচলিত নিবর্তনমূলক কৃষি-ব্যবস্থার বিলোপ সাধনই ছিল হযরত ওমরের রাজস্ব ব্যবস্থায় একটি সর্বোৎকৃষ্ট বৈপ্লবিক সংস্কার।”
রাসূলে করীম ও হযরত আবুবকরের খিলাফতে কোন প্রকার সুনির্দিষ্ট কর আদায়ের ব্যবস্থা ছিল না। উৎপন্ন দ্রব্যের এক-দশমাংশ অথবা উশর দিতে খলিফা ওমর (রা) ভূমি-রাজস্বের একটি সুপরিকল্পিত ব্যবস্থা প্রণয়নের জন্য রাজস্ব-বিভাগ বা দিওয়ান- উল-খারাজ প্রতিষ্ঠা করেন। বিজিত এলাকা সৈন্যদের মধ্যে জায়গীর হিসেবে বণ্টনের তিনি ঘোর বিরোধী ছিলেন। কারণ এতে একদিকে যেমন কৃষিকার্যের উন্নতি ব্যাহত হত, অপরদিকে সৈন্যবাহিনীর নিয়মানুবর্তিতা ও শৃঙ্খলা নষ্ট হয়ে সামরিক শক্তিহীন ও পঙ্গু হয়ে পড়ত।
হযরত ওমর (রা) ইরাকে প্রথম লোকগণনা (আদমশুমারী) করে দেখলেন যে, একজন সৈন্যের প্রতি তিনজন বিজিত লোক পড়তে পারে। সুতরাং আবদুর রহমান- বিন-আউফ, হযরত বেলাল প্রমুখ সাহাবীর সমর্থন ব্যতীত হযরত ওমর বিজিত এলাকার জমি কৃষকদের মধ্যে বণ্টন করে রাজস্ব নির্ধারণ করে দিলেন। বিজিত অঞ্চলের জমি- জমাকে ব্যক্তিগত সম্পত্তিতে পরিণত করে জায়গীরদার প্রথা প্রবর্তনে তিনি বিরোধিতা করেন; কারণ, বিজিত এলাকার সম্পত্তি রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি এবং এর পূর্বের স্বত্বাধিকারীদেরও ভূমিহীন করার তিনি পক্ষপাতী ছিলেন না।
খলিফা ওমর সর্বপ্রথম ইরাকে ভূমি জরিপ করে সুষ্ঠু বণ্টনের ব্যবস্থা করেন। ওসমান-বিন-হুনাইফ এবং হুদাইবা-বিন-ইয়ামনের সুযোগ্য পরিচালনায়, জরিপ কার্য সমাধা করে বিলি-বন্দোবস্ত ও কর নির্ধারণ করা হয়। জমির উর্বরতার উপর করের মাত্রা নির্ধারিত হতো। মোটামুটি কর্ষণযোগ্য ইরাকী ভূমির পরিমাণ ছিল ৩৬,০০০,০০০ জরীব। প্রতি জরীবে বাৎসরিক কর নির্ধারিত হয় গমে ২ দিরহাম, বার্লিতে ১, ইক্ষুতে ৬, তুলায় ৫, আঙ্গুরে ১০, খেজুরে ১০, তিল জাতীয় দ্রব্যে ৮ দিরহাম। এরূপ ভুমি- রাজস্ব ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন করা হয়। মিসরে নির্ধারিত গমের উপর রাজস্ব কর ছিল প্রতি জরীবে ১ দিনার ও ৩ ইরদাব। পারস্যে প্রাচীন রাজস্ব-ব্যবস্থাই বলবৎ থাকে। সিরিয়ায় রাজস্ব আদায় হয়েছিল বাৎসরিক ১ কোটি ৪০ লক্ষ দিনার। জরিপকার্যে কোন প্রকার গরমিল ধরা পড়লে রাজস্ব শিথিল করা হতো। জমির মালিককে লা-খেরাজ হিসেবে কিছু জমি প্রদানেরও ব্যবস্থা ছিল যাতে তাদের প্রতি অবিচার করা না হয়। এই কর কেবলমাত্র বিজিত অমুসলমান কৃষকদের নিকট থেকে আদায় করা হত।
রাজস্বের উৎস ছিল বিবিধ : (১) খারাজ বা অমুসলমানদের ভূমি কর; (২) উশর বা বাণিজ্যিক কর; (৩) যাকাত বা দরিদ্র্য কর, (৪) জিজিয়া বা নিরাপত্তামূলক সামরিক কর; (৫) গনিমাহ বা যুদ্ধলব্ধ দ্রব্যাদি; (৬) আল-ফে বা রাষ্ট্রীয় ভূমি আয়; (৭) উত্তর বা মুসলমানদের দেয় ভূমি-কর। মহানবী স্বয়ং ইসলামের রাজস্ব-ব্যবস্থার ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করে গেছেন। তাঁর নির্দেশে জমিতে উৎপাদিত শস্য, সোনা-রূপা, উট, মেষ, ছাগলের যাকাত নির্ধারিত হয়েছিল। ঘোড়ার ওপর যাকাত ধার্য করা হয় হযরত ওমরের শাসনকালে। কারণ, এই সময়ে অশ্বের ব্যবসা ছিল খুবই লাভজনক। যাকাত শুধুমাত্র মুসলমানদের নিকট থেকে আদায় করা হতো। এ ছাড়া অমুসলমানদের সামরিক বাহিনীতে যোগদান থেকে নিবৃত করে এবং তাদের জানমাল রক্ষা ও ধর্মীয় স্বাধীনতা প্রদান করে খলিফা বিজিত অঞ্চলে বিধর্মীদের উপর জিজিয়া কর আরোপ করেন। এমনও দৃষ্টান্ত রয়েছে যে, বিধর্মীদের নিরাপত্তা রক্ষায়, অসমর্থ হলে মুসলিম শাসকবর্গ তাদেরকে জিজিয়া ফিরিয়ে দিয়েছেন। সাসানিয় ও বায়জানটাইন রাষ্ট্রে এই কর প্রচলিত ছিল, কিন্তু হযরত ওমর (রা) পারসিক ও কেনান অধিবাসীদের আর্থিক সচ্ছলতার কথা চিন্তা করে জিজিয়া বৃদ্ধি করেন। মাথাপিছু এই করের পরিমাণ ছিল বার্ষিক ৪ দিনার আমর ইবন-আল-আস মিসরে প্রত্যেক অমুসলমান বয়স্ক ব্যক্তির উপর ২ দিনার কর ধার্য করেন।
যুদ্ধে প্রাপ্ত দ্রব্যাদির এক-পঞ্চমাংশ রাজকোষে প্রদান এবং বাকি চারিভাগ সৈন্যদের মধ্যে বণ্টনের ব্যবস্থা ছিল। হযরত ওমরের সময়ে মুসলিম রাষ্ট্র সম্প্রসারিত হলে এক- পঞ্চমাংশ যুদ্ধলব্ধ দ্রব্যাদি বা গনিমাহ রাজস্ব আয়ের একটি অন্যতম প্রধান উৎস ছিল। এই অংশটি নবী করীমের আত্মীয়-স্বজন ও মুসলিম সৈন্য-বাহিনীর সাজ-সরঞ্জামের জন্য নির্দিষ্ট ছিল। রাজস্ব আয়ের অপর একটি উৎস ছিল খাস জমি হতে প্রাপ্ত ভূমি-কর বা ফে। জমি কখনই পতিত অবস্থায় রাখা যেত না। জমি কৃষকদের দ্বারা আবাদ করা হত। পরিত্যক্ত এবং বাজেয়াপ্ত সম্পত্তিও এর অন্তর্ভুক্ত ছিল। পলাতক শত্রু, বিদ্রোহী, মালিকবিহীন ভূমি, অগ্নি উপাসকদের সম্পত্তি থেকে লব্ধ আয়কেও ‘ফে’ বলা হয়। এই আয় রাষ্ট্রের পশুচারণযোগ্য ভূমি থেকে সংগৃহীত হতো।
হযরত ওমরের রাজস্বের অন্যতম প্রধান উৎস ছিল উশর বা বাণিজ্য শুল্ক। মহানবীর প্রবর্তিত এই শুল্কের পরিবর্তন সাধন করে ব্যবসায়ীদের পণ্যদ্রব্যের ওপর শতকরা আড়াই (২ %), অমুসলমান বণিকদের ওপর পাঁচ (৫%) এবং বিদেশীদের ওপর দশ (১০%) বাণিজ্য শুল্ক ধার্য করা হত। ভূমি-রাজস্ব খারাজ ব্যতীত অপর একটি কর কৃষির উৎপন্ন শস্যের ওপর ধার্য করা হয়েছিল। খারাজের তুলনায় কম এই কর কেবলমাত্র জলসেচের ব্যবস্থা ব্যতীত বৃহৎ ভূ-সম্পত্তি হতে আদায় করা হত।
নবী করীমের সময়ে প্রাপ্ত অর্থ সাথে সাথে বণ্টন করা হতো বলে সরকারি কোষাগার বা বায়তুল মালের কোন প্রয়োজন ছিল না। কিন্তু ইসলামের সম্প্রসারণে রাজস্ব বৃদ্ধি পেলে ওয়ালিদ-বিন-হিশামের পরামর্শে হযরত ওমর সর্বপ্রথম একটি “বায়তুল মাল” স্থাপন করেন। আবদুল্লাহ ইবন্-উল-আরফানকে প্রধান কোষাধ্যক্ষ নিযুক্ত করে কেন্দ্রীয় কোষাগারকে তিনি একটি জাতীয় প্রতিষ্ঠানে উন্নীত করেন। এর পাহারার জন্য সশস্ত্র প্রহরী নিযুক্ত ছিল। পরবর্তীকালে প্রদেশেও বায়তুল মাল প্রতিষ্ঠিত হয়। এটি ছিল জনসাধারণের সম্পত্তি এবং এতে খলিফার কোন অধিকার ছিল না।
রাজস্ব বিভাগ বা দিওয়ান-উল-খারাজের প্রধান দায়িত্ব ছিল বায়তুল মালে সঞ্চিত অর্থের সুষম বণ্টন করা। প্রশাসনিক খরচ এবং যুদ্ধাভিযানের খাতে ব্যয়ের তরে যে উদ্বৃত্ত অর্থ বায়তুল মালে থাকত তা মুসলমানদের মধ্যে বণ্টন করে দেওয়া হতো। জাতীয় অর্থের সুষ্ঠু বণ্টনের জন্য হযরত ওমর (রা) সর্বপ্রথমে লোকগণনা বা আদমশুমারীর ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। হিট্টি বলেন, “এই বণ্টনকার্য সম্পন্ন করবার জন্য একটি আদমশুমারীর প্রয়োজন হয় এবং পৃথিবীর ইতিহাসে রাষ্ট্রীয় রাজস্ব বণ্টনের ক্ষেত্রে এটি সর্বপ্রথম লিপিবদ্ধ আদমশুমারী।” এই গণনা দ্বারা প্রত্যেক রাষ্ট্রীয় ভাতা-ভোগদের (Pensioners) নামে বৃত্তি-তালিকা ( Register of pensions) প্রস্তুত করা হয়। প্রত্যেক মুসলিম পুরুষ, স্ত্রী, শিশু, বৃদ্ধ এই তালিকাভুক্ত হয় এবং এই অর্থ তালিকা এরূপ পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে প্রস্তুত করা হয় যে, “প্রত্যেক গোত্রের প্রত্যেকটি ব্যক্তির নাম এতে অন্তর্ভুক্ত ছিল।” এছাড়া অক্ষম, দুর্বল, রুগ্ন, পঙ্গু প্রভৃতি ব্যক্তিদের কোষাগার থেকে বিশেষ ভাতা প্রদানের ব্যবস্থা ছিল। মূইর বলেন, “ওমর (রা) প্রবর্তিত ভাতা- ভোগকারীদের বৃত্তি-তালিকা সম্ভবত দুনিয়ার বুকে তুলনাবিহীন ছিল।” ভাতা প্রদানের সুবিধার্থে প্রত্যেক মুসলমানদের তিন শ্রেণীতে বিভক্ত করা হয়- মহানবীর আত্মীয়-পরিজন, ইসলামের প্রাচীন সেবকবৃন্দ এবং ইসলামের সাহায্যকারী। নবী করীমের বিধবা পত্নীগণের প্রত্যেকে ১০ হাজার হতে ১২ হাজার দিরহাম বাৎসরিক ভাতা পেতেন। বদরের যুদ্ধে অংশগ্রহণকারীরা ৫ হাজার দিরহাম; বদরের যুদ্ধের পূর্বে আনসার ও মুহাজেরগণ ৪ হাজার দিরহাম; তাদের সন্তান ও বংশধরদের ২ হাজার দিরহাম; মক্কার অধিবাসী ও অন্যান্য লোকজনকে ৮ শত দিরহাম দেওয়া হতো। সর্বনিম্ন ভাতা ছিল ২ শত দিরহাম। ভাতা বণ্টনের ব্যবস্থা সম্পর্কে মূইর বলেন, “পৃথিবীর ইতিহাসে আরব জাতির মত ভ্রাতৃত্বের সমতা ভিত্তিতে নিজেদের মধ্যে রাষ্ট্রের যাবতীয় রাজস্ব, যুদ্ধ-লব্ধ সম্পদ এবং বিজিত রাষ্ট্রসমূহের সম্পদ বণ্টন প্রথা সম্ভবত তুলনাবিহীন।
কৃষিকার্যের উন্নয়ন
কৃষিভিত্তিক অর্থনীতির উন্নতিকল্পে হযরত ওমর (রা) কৃষিকার্যের প্রভূত উন্নতি সাধন করেন। আইন প্রণয়ন করে তিনি কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি করবার প্রয়াস পান। যদি কোন ব্যক্তি পরিত্যক্ত জমি গ্রহণের তিন বৎসরের মধ্যে আবাদ না করে তা হলে তাকে উক্ত জমি থেকে বঞ্চিত করা হত। এভাবে অনাবাদি জমি চাষ করে শস্য উৎপাদন বৃদ্ধি করা হয়; ফলে অর্থনৈতিক উন্নতির পথ সুগম হয়। রোমান ও পারসিকদের শাসনকালে যারা জমিজমা থেকে বঞ্চিত হয়েছিল খলিফা তাদের সে সমস্ত জমি ফিরিয়ে দিয়ে কৃষিকার্য করবার সুযোগ দান করেন। সেচ-ব্যবস্থার সুবিধার জন্য খাল খনন করা হয় এবং কৃষি উৎপাদনের জন্য সর্বপ্রকার সরকারি সহায়তা ও উৎসাহ প্রদান করা হয়। মাকরিজির মতে, ১ লক্ষ ২০ হাজার শ্রমিক সেচ প্রকল্পে দৈনিক কাজ করত এবং তাদেরকে নিয়মিত বেতন দেয়া হত।
সামরিক প্রশাসন
হযরত ওমরের খিলাফতে সামরিক বাহিনীকে সুসংহত করবার জন্য একটি প্রশাসনিক কাঠামো গঠন করা হয়; এর উদ্দেশ্য ছিল সুসজ্জিত ও সুসংঘবদ্ধ মুসলিম সৈন্য বাহিনীকে যুদ্ধের জন্য সর্বদা প্রস্তুত (Battle readiness) রাখা। বিশাল ইসলামী রাষ্ট্রে সর্বমোট নয়টি সামরিক বিভাগ বা জুনা (Military division) ছিল; যথা— মদীনা, কুফা, বসরা, ফুসতাত, মিসর, দামেস্ক, হিম্স, প্যালেস্টাইন ও মসুল। এই নয়টি সামরিক ঘাঁটিতে সর্বদা ৪ হাজার অশ্ব ও ৩৬ হাজার অশ্বারোহী সৈন্য সদা প্রস্তুত থাকত। প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য খলিফা সেনাধ্যক্ষদের সকল প্রকার ব্যবস্থা গ্রহণের আদেশ দিতেন। আলেকজান্দ্রিয়ায় আমর-ইবন-আল-আস, আবদুল্লাহ-বিন- কায়েস উপকূলবর্তী শহরগুলো, যেমন জাফফা, আসকালন, সিজারিয়া, আকরে প্রভৃতি রক্ষার জন্য প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। পারস্য দেশে পুরাতন দুর্গ সংস্কার করে ঘাঁটি তৈরি করা হয়।
মুসলিম সৈন্যবাহিনী পদাতিক অশ্বারোহী তিরন্দাজ, বাহক ও সেবক (স্কাউট) প্রভৃতি বিভিন্ন শ্রেণী নিয়ে গঠিত ছিল। প্রত্যেক দশজন সৈন্যের জন্য আমির-উল- আশারা নামক একজন পরিচালক ছিলেন। প্রতি একশত জনের ওপর একজন ‘আল-কায়েদ’ এবং প্রতি দশজন কায়েদের জন্য একজন ‘আমির’ নিযুক্ত করা হত। খলিফা হযরত ওমরের সময় সিরিয়ার শাসনকর্তা মুয়াবিয়া সর্বপ্রথম দেহরক্ষী বাহিনী গঠন করেন। সৈন্যদের শৃঙ্খলা, নিয়মানুবর্তিতা, আনুগত্য, যুদ্ধ-স্পৃহার প্রতি বিশেষ দৃষ্টি রাখা হত। মুসলিম সৈন্যরা লৌহনির্মিত তরবারি, বর্শা, বল্লম, তীর-ধনুক, শিরস্ত্রাণ ব্যবহার করত। রণক্ষেত্রে তাঁরা অগ্র, মধ্য, পশ্চাৎ ও দুই পার্শ্ব এই ভাগে বিভক্ত হয়ে শত্রুর মোকাবেলা করত। জায়গীরের পরিবর্তে খলিফা ওমর (রা) সৈন্যদের নিয়মিত বেতন প্রদান করতেন। সৈন্যগণের প্রারম্ভিক বেতন ছিল প্রথম বৎসরে ২০০ ও পরে ৩০০ দিরহাম। খোরাক ও পোশাক তাঁরা বিনামূল্যে পেত এবং তাঁদের পরিবারও কোষাগার থেকে ভাতা লাভ করত। সৈন্যদের চিকিৎসা ও স্বাস্থ্যকর পরিবেশে বসবাসের জন্য সকল প্রকার সুযোগ-সুবিধা প্রদান করা হতো।
বিচার বিভাগ
বিচার বিভাগের গঠন এবং উন্নতি বহুলাংশে হযরত ওমরের প্রশাসনিক মেধার জন্য সম্ভবপর হয়েছিল। প্রশাসনিক কাঠামোর দুটি পৃথক বিভাগ ছিল- নির্বাহী শাসন ব্যবস্থা (Executive) এবং বিচার বিভাগ (Judiciary)। খলিফা বিচার বিভাগকে নির্বাহী শাসন-ব্যবস্থা থেকে পৃথক করে একটি স্বাধীন ও নিরপেক্ষ প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেন। পূর্বে প্রাদেশিক গভর্নর (ওয়ালী) বিচার বিভাগের কার্যকলাপ পরিচালনা করতেন। স্বাধীন নিষ্কলুষ চরিত্র, ব্যক্তিত্বসম্পন্ন নৈতিক শক্তিতে বলীয়ান, সুস্থ, শিক্ষিত ও শরীয়তের সম্যক জ্ঞানসম্পন্ন ব্যক্তিদের খলিফা ‘মজলিস-উস-সূরার’ সাথে আলোচনা করে প্রত্যেক প্রদেশে প্রধান কাজী (কাজীউল-কুযাত) এবং প্রত্যেক জেলায় একজন কাজী নিযুক্ত করতেন। কাজীদের দুর্নীতি এবং প্রলোভন থেকে দূরে রাখবার জন্য যোগ্যতানুসারে উচ্চহারে বেতন দেওয়া হত এবং নির্ভয়ে ও নিরপেক্ষভাবে বিচারকার্য পরিচালনার জন্য খলিফা সকল প্রকার আশ্বাস দান করতেন। বিচারের জন্য কোন ফি প্রদান করতে হত না এবং সাধারণত বিচারকার্য মসজিদে অনুষ্ঠিত হয়। বিচারকদের কুরআন, হাদিস, ইজমা ও কিয়াস মোতাবেক বিচার করতে হত। বসরা, কুফা, দামেস্ক ও হিমসের জন্য বিশেষ বিচারক (Special Judge) নিযুক্ত করা হত। খলিফা নিঃসন্দেহে বিচার বিভাগের সর্বময় কর্তা ছিলেন এবং প্রয়োজন হলে নিম্ন আদালতের রায় পুনর্বিবেচনা করতেন। আইনের চোখে ধনী-দরিদ্র, উচ্চ-নীচ সকলেই সমান ছিল। বিধর্মীদের বিচারকার্য তাদের নিজস্ব ধর্মীয় অনুশাসনে পরিচালিত হতো।
পুলিশ বিভাগ
খোলাফায়ে রাশেদূনের প্রথম দিকে কোন স্বতন্ত্র পুলিশ বিভাগ ছিল না। জনসাধারণের জীবন ও সম্পত্তি রক্ষার এবং অপরাধমূলক কার্যকলাপ রোধ করে শান্তি ও নিরাপত্তা বজায় রাখার জন্য হযরত ওমর সর্বপ্রথম একটি সুগঠিত পুলিশ বাহিনী সৃষ্টি করেন। এই বাহিনীর কার্যকলাপকে নিয়মিত করবার জন্য দিওয়ান-উল-আহদাত নামে একটি পুলিশ বিভাগের সৃষ্টি করা হয়। পুলিশ বাহিনীর দায়িত্ব ছিল চুরি-ডাকাতি বন্ধ করা, ওজন পরীক্ষা করা, মাদক দ্রব্য বিক্রয় বন্ধ করা ও অবৈধ সম্পত্তির বাজেয়াপ্ত করা। পুলিশ প্রধানের নাম ছিল সাহিব-উল-আহদাত। আবু হোরায়রা বাহরাইনে পুলিশ ক্ষমতার অধিকারী হন। খলিফা ওমরের শাসনের অন্যতম প্রধান কৃতিত্ব ছিল কারাগার প্রতিষ্ঠা। সাফওয়ান-বিন-উমাইয়ার বাসস্থান ৪,০০০ দিরহামে ক্রয় করে তিনি একে কয়েদখানায় রূপান্তরিত করেন। মদীনার কেন্দ্রীয় কয়েদখানা ব্যতীত প্রত্যেক প্রাদেশিক, রাজধানী ও জেলার সদর দফতরে একটি করে কারাগার নির্মাণের আদেশ প্রদান করেন। আবু মাহজান তাউফিককে মদ্যপানের জন্য কারাদণ্ড দেওয়া হয়। হযরত ওমরের খিলাফতে সর্বপ্রথম নির্বাসন দণ্ড প্রবর্তিত হয়।
প্রশাসক ও যোদ্ধা হিসাবে পৃথিবীর ইতিহাসে হযরত ওমর (রা) অক্ষয় কীর্তি রেখে গেছেন। জনদরদী সংস্কারক হিসেবেও তিনি সর্বজনবিদিত ছিলেন। দশ বৎসর খলিফা থাকাকালীন তিনি অসংখ্য মসজিদ, খাল, সেতু, দুর্গ, হাসপাতাল, সড়ক, বিদ্যালয় প্রভৃতি জনকল্যাণকর ও প্রশাসনিক ইমারত নির্মাণ করেন। কৃষিকার্যের সম্প্রসারণ ও উন্নতির জন্য তিনি কয়েকটি খাল খনন করেন। আবু মুসা টাইগ্রীস হতে বসরা পর্যন্ত ৯ মাইল দীর্ঘ খাল খনন করে পানির অসুবিধা দূর করেন। মকবুল বিন-ইয়াসির-এর তত্ত্বাবধানে অপর একটি খাল টাইগ্রীস হতে খনন করা হয়। সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য খাল ছিল আমিরুল- মুমেনীনের খাল। লোহিত সাগরের সাথে নীল নদের সংযোগ রক্ষাকারী এই খাল খনন করে ব্যবসা-বাণিজ্যের পথ সুগম করা হয়েছিল এবং মিসর থেকে আরবদেশে শস্য পরিবহন করা সহজসাধ্য হয়েছিল। আবরদেশের বাইরে তাঁর খিলাফতে বসরা, কুফা ও ফুসতাত নামে তিনটি নুতন ছাউনী-শহরের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হয়। এই তিনটি শহর পরবর্তীকালে শিক্ষা ও জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার প্রধান কেন্দ্রে পরিণত হয়। তিনি হিজরী সনের প্রবর্তন করেন। শিবলী নোমানীর মতে, ফুসতাত শহরে ৩টি মসজিদ, ৮০০ সড়ক এবং ১১৭০টি স্নানাগার ছিল। হযরত ওমর মদীনায় নবীর মসজিদের সম্প্রসারণ ও সংস্কার করেন। তাঁর সময়ে পবিত্র কা’বাগৃহও পুনঃনির্মাণ করা হয়।
মূইর বলেন, “রাসূলুল্লাহর পর ইসলামী সাম্রাজ্যে ওমর ছিলেন সর্বশ্রেষ্ঠ। কারণ দশ বছরের মধ্যে তাঁর বুদ্ধিমত্তা, ধৈর্য ও উদ্যমের ফলে সিরিয়া, মিসর ও পারস্য অধিকৃত হয়।
হযরত ওমর (রা)-এর মৃত্যু
১০ বৎসর ২ মাস খিলাফতের পর হযরত ওমর (রা) ৬৪৪ খ্রিস্টাব্দে ইন্তেকাল করেন। একদিন প্রত্যুষে মসজিদে নামাজ পড়তে যাবার পথে ব্যক্তিগত কারণে আবু লুলু নামক এক পারস্যবাসী খ্রিস্টান তাঁকে ছুরি দিয়ে মারাত্মকভাবে আহত করে এবং এই দুর্ঘটনার কয়েকদিনের মধ্যেই তিনি মৃত্যুবরণ করেন। আবু লুলু কুফার শাসনকর্তা মুগিরার ভৃত্য ছিল এবং মনে করা হয় যে, হরমুজান ও জাফিনা নামক মদীনার দুজন যুদ্ধবন্দীর যোগসাজশে খলিফা ছুরিকাহত হন। আমীর আলী বলেন, “হযরত ওমরের মৃত্যু ইসলামের জন্য এক বাস্তব বিপদস্বরূপ ছিল।”
হযরত ওমর (রা)-এর কৃতিত্ব
বিজেতা : হযরত ওমরের খিলাফত ইসলামের ইতিহাসে একটি গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়ের সূচনা করে। বহুমুখী প্রতিভাসম্পন্ন এবং অসাধারণ গুণাবলির অধিকারী খলিফা ওমর ছিলেন একাধারে পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিজেতা, প্রথিতষশা প্রশাসক, বৈপ্লবিক সংস্কারক, বিচক্ষণ রাজনীতিজ্ঞ, অপ্রতিদ্বন্দ্বী সংগঠক, প্রজাবৎসল ও ন্যায় পরায়ণ শাসক।
হিট্টি বলেন “আবুবকরের আমলে বিশ্বজয়ের উদ্দীপ্ত প্রেরণা ওমরের খিলাফতে পূর্ণাঙ্গতা লাভ করেছিল। শূন্য থেকে আরম্ভ করে আরবীয় মুসলিম খিলাফত বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ শক্তিতে পরিণত হয়।” নব-প্রতিষ্ঠিত মুসলিম রাষ্ট্র রাসূলে করীম (স)-এর ওফাতে এবং আবুবকরের খিলাফতে রিদ্দা যুদ্ধে যখন ধ্বংস হবার উপক্রম হয় তখন হযরত ওমর (রা) বৃহত্তর মুসলিম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দ্বারা ইসলামের শক্তিই শুধু বৃদ্ধি করেন নি, উপরন্তু অভ্যন্তরীণ গোলযোগ বিশ্বজয়ের উদ্দীপনায় ধুলিস্যাৎ করেন। বিজয় ও সম্প্রসারণ ব্যতীত ইসলাম ধর্ম, রাষ্ট্রীয় ও সমাজ ব্যবস্থা আরব উপদ্বীপেই সীমাবদ্ধ থাকত। দুর্দান্ত ও উচ্ছৃঙ্খল আরব বেদুঈনদের সৈন্যবাহিনীতে নিযুক্ত করে হযরত ওমর (রা) তাদেরকে পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ও অপ্রতিদ্বন্দ্বী সামরিক শক্তিতে পরিণত করতে সক্ষম হন। উপরন্তু, আমর-বিন-আল-আস, সা’দ-বিন-আবি-ওয়াক্কাসের মত রণকুশলী, নির্ভীক যোদ্ধাদের তৎপরতা এবং ইসলামের প্রতি আনুগত্যের ফলে পারস্য ও বায়জানাটাইন সাম্রাজ্যের মত দু’টি প্রাক-মুসলিম শক্তির পতন সম্ভবপর হয়েছিল। হযরত ওমর (রা) ব্যক্তিগতভাবে সামরিক অভিযান পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণ করতেন এবং প্রয়োজন হলে স্বয়ং বিজিত শহরে গমন করে নিয়ন্ত্রণভার গ্রহণ করতেন। খ্রিস্টান ধর্মযাজকদের আহ্বানে তিনি উষ্ট্রপৃষ্ঠে মদীনা থেকে জেরুজালেমে গমন করে শহরটির হস্তান্তর গ্রহণ করেন। সামরিক বিভাগ সৃষ্টি করে সৈন্যদের বিভিন্ন ধরনের সুযোগ-সুবিধা প্রদান করে মুসলিম বাহিনীকে যুদ্ধাভিযানের জন্য উদ্দীপিত ও সদাপ্রস্তুত রাখার ব্যবস্থা খলিফার অন্যতম শ্রেষ্ঠ কীর্তি। সৈন্যবাহিনীর শৃঙ্খলা, নিয়মানুবর্তিতা এবং আনুগত্যের প্রতি তিনি কঠোর দৃষ্টি রাখতেন। তাঁর এই সাংগঠনিক ক্ষমতায় ও উদারতায় অনুপ্রাণিত হয়ে মুসলমানদের জন্য পারসিকগণ সেতু নির্মাণ করে। সিরিয়ার খ্রিস্টানগণ মুসলিম বাহিনীতে গুপ্ত সংবাদ সরবরাহ করত, কাদেসিয়ার যুদ্ধে ডাইলামের (Daylam’s ) নেতৃত্বে বহু পারসিক সৈন্য মুসলিম বাহিনীতে যোগদান করে। বিখ্যাত বায়জানটাইন যোদ্ধা জর্জ ইয়ারমুকের যুদ্ধে মুসলমানদের পক্ষে রোমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন। হিট্টি বলেন, “ইসলামের উদ্দীপনার প্রাচ্যের পুনর্জাগরণ হয় এবং সহস্র বৎসর প্রতীচ্যের আধিপত্যের পর প্রাচ্যে পুনরায় এর প্রভাব বিস্তার করতে থাকে। উপরন্তু, নব্য বিজেতাগণ পুরাতনদের তুলনায় সামান্য কর আদায় করত এবং বিজেতাগণ পূর্বের তুলনায় তাদের ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান স্বাধীনভাবে এবং নির্বিঘ্নে পালন করতে পারত।” ধর্মীয় সহিষ্ণুতার নীতিতে আকৃষ্ট হয়ে বিধর্মীগণ স্বেচ্ছায় শুধু আত্মসমর্পণই করেনি বরং অনেক ক্ষেত্রে ইসলামের মাধুর্যে ও সাম্যবাদে প্রভাবান্বিত হয়ে তৌহিদে বিশ্বাস স্থাপন করেছিল। ইসলামী রাষ্ট্র ও ধর্মের সম্প্রসারণ এবং সমাজ ও কৃষ্টির উদ্ভাবনে ইসলামের বিজয়ের কথা স্মরণ করে মৌলানা মুহম্মদ আলী বলেন, “হযরত ওমরের গৌরবোজ্জ্বল কৃতিত্বের মধ্যে সর্বাপেক্ষা আকর্ষণীয় ছিল ইসলামের মহাবিজয়গুলো।”
প্রশাসক : হযরত ওমর (রা) শুধু বৃহত্তর ইসলামী রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতারূপেই অক্ষয় কীর্তি অর্জন করেন নি। বিজিত অঞ্চলে একটি সুষ্ঠু, সামঞ্জস্যপূর্ণ, সংঘবদ্ধ, কেন্দ্ৰীয় শাসনের প্রবর্তন করে তিনি মুসলিম রাষ্ট্রের সংগঠকের (Consolidator) মর্যাদা লাভ করেন। শান্তি, সংহতি, ঐক্য, শৃঙ্খলা এবং নিরাপত্তা বিধানের জন্য খলিফা ওমর (রা) শাসন-ব্যবস্থা পুনর্বিন্যাস করে একটি আদর্শ ইসলামী রাষ্ট্রের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। প্রশাসনিক পুনর্গঠন তাঁর অন্যতম প্রধান কৃতিত্ব ছিল আরব জাতীয়তাবাদকে (Arab Nationalism) সংরক্ষিত করা। আরবদেশকে ইসলামের সুরক্ষিত দুর্গ হিসেবে গঠিত করবার মানসে তিনি শত্রুভাবাপন্ন ইহুদী ও খ্রিস্টানদের আরব-ভূখণ্ডের বাহিরে বসবাস করতে বাধ্য করেন এবং সামরিক আভিজাত্য এবং সংমিশ্রণের ফলে আরব জাতির অধঃপতন রোধ করবার জন্য তিনি সৈন্যবাহিনীকে জায়গীর প্রদানের বিরোধী ছিলেন। মজলিস-উস-শূরা প্রতিষ্ঠা করে তিনি ইসলামী গণতান্ত্রিক আদর্শের সূচনা করেন এবং রাজনৈতিক ও সামরিক বিষয়ে তিনি সর্বদা উপদেষ্টা পরিষদের পরামর্শ গ্রহণ করতেন। হযরত ওমর (রা) বলেন, “পরামর্শ ব্যতীত কোন খিলাফত চলতে পারে না।” স্বৈরাচারী ও একনায়কত্বের পরিপন্থী গণতান্ত্রিক পদ্ধতির ধারক ও বাহক হিসেবে উপদেষ্টা পরিষদের সৃষ্টি খলিফার অসামান্য রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতার পরিচায়ক। একবার যৌতুকের সম্বন্ধে বক্তৃতাকালে একজন মহিলা বলে উঠেন, “ওমর! আল্লাহকে ভয় কর।” খলিফা হযরত ওমর মহিলার সমালোচনায় প্রীত হয়ে বললেন, “এমনকি একজন মহিলাও ওমরের অপেক্ষা বেশি জ্ঞানী।” প্রকৃত অর্থে তাঁকে গণতন্ত্রী বলা যেতে পারে।
হযরত ওমর (রা) নিঃসন্দেহে আরব প্রশাসন-ব্যবস্থার সুযোগ্য প্রতিষ্ঠাতা। ‘প্রশাসনিক মেধা’ (Administrative genius) বলে তাঁকে আখ্যায়িত করা হয়। কারণ তাঁর প্রবর্তিত শাসন-ব্যবস্থা ইসলামের ইতিহাসে শ্রেষ্ঠ অবদানই নয়, বরং যুগ যুগ ধরে এর প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। তিনি কেবলমাত্র সংস্কার করেই ক্ষান্ত ছিলেন না বরং বিভিন্ন ক্ষেত্রে উদ্ভাবনী শক্তির পরিচয় দিয়েছেন। শাসন-ব্যবস্থার বিকেন্দ্রীকরণ করে ইসলামী রাষ্ট্রকে বিভিন্ন প্রদেশ ও জেলায় বিভক্ত করা হয়। খলিফার ব্যক্তিগত তত্ত্বাবধানে গভর্নরগণ ইসলামী কানুন মোতাবেক শাসনকার্য পরিচালিত করতেন। হযরত ওমরের (রা) শাসন-ব্যবস্থার অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল নির্বাহী কার্যক্রম (Executive) হতে বিচার বিভাগকে (Judiciary) বিচ্ছিন্ন করে স্বাধীন, নিরপেক্ষ ও স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা। তাঁর শাসনকালে সর্বপ্রথম ভাতা প্রদানের প্রথা প্রবর্তিত হয় এবং এর জন্য একটি তালিকা (Register) প্রণীত হয়। ভাতা প্রদানের সুবিধার্থে জনসাধারণের যোগ্যতা বিচারের জন্য তিনি সর্বপ্রথম আদমশুমারি (Census) পরিচালনা করেন। হযরত ওমরের পূর্বে হযরত আবুবকর (রা) শুধু খলিফা বলে পরিচিত ছিলেন; কিন্তু স্পুলার-এর মতে, “খলিফা উপাধি ছাড়াও তিনি বিশ্বাসীদের নেতা অথবা ‘আমির-উল-মুমেনীন’ খেতাব গ্রহণ করেন। তাঁর মাধ্যমে কেবলমাত্র ইসলামেই নয়, বরং পৃথিবীর ইতিহাসে একজন প্রথিতযশা রাজনীতিবিদ মদীনার শাসনভার গ্রহণ করেন।”
হযরত ওমর (রা) সর্বপ্রথম হিজরী সালের গণনা দ্বারা নিজস্ব ইসলামী ক্যালেণ্ডার বৎসরের প্রবর্তন করেন। এক্ষেত্রে তাঁর অবদান বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। বিচার বিভাগের কার্যকলাপ শরিয়ত-কুরআন, হাদিস, ইজমা ও কিয়াস মোতাবেক পরিচালনা করতে তিনি নির্দেশ দেন। রাজস্ব-ব্যবস্থার সংস্কার করেও তিনি চিরস্মরণীয় হয়ে রয়েছেন। কৃষির উন্নতির জন্য তিনি ‘আমির-উল-মুমেনীন খাল’ খনন করেন। সেচ- ব্যবস্থা ও পানীয় জল ছাড়াও এই খাল নীলনদের সাথে লোহিত সাগরের সংযোগ স্থাপন করে। একে সুয়েজ খালও বলা যায়। ইসলামের সম্প্রসারণের সাথে সাথে রাজস্ব বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং রাজনৈতিক ও সামরিক খাতে ব্যয় করে উদ্বৃত্ত অংশ ‘বায়তুল মাল’ বা কোষাগারে রাখার ব্যবস্থা প্রচলিত ছিল। এটি খলিফার ব্যক্তিগত সম্পত্তি ছিল না। জমি জরিপ করে জমির সুষম বণ্টন এবং রাজস্ব নির্ধারণ, পুলিশ বাহিনী গঠন করে শান্তি ও নিরাপত্তা রক্ষা, গোয়েন্দা বাহিনী সৃষ্টি করে প্রদেশসমূহ থেকে গোপন তথ্য সংগ্রহ, কারাগার নির্মাণ দ্বারা সমাজবিরোধী লোকদের অন্তরীণ করে রাখা প্রভৃতি কার্য দ্বারা তিনি রাষ্ট্রের নিরাপত্তা বিধান করেন। মৌলানা মুহম্মদ আলী বলেন, “নিশ্চিতরূপে বলা যেতে পারে যে, দাস প্রথা বিলোপের মত গৃহীত বলিষ্ঠ পদক্ষেপ হযরত ওমরের শ্রেষ্ঠ কৃতিত্বের অন্যতম ছিল।” যুদ্ধবন্দীদের দাসরূপে বিক্রয় করবার প্রথা হযরত ওমর উচ্ছেদ করেন এবং সন্ধি চুক্তিতে যুদ্ধবন্দীদের মুক্তি প্রদানের শর্ত লিপিবদ্ধ থাকত। খলিফার আদেশে মিসরের যুদ্ধবন্দীরা মুক্তিলাভ করে। ইসলামী রাষ্ট্রের জিম্মি হিসেবে তারা নানাবিধ সুযোগ-সুবিধা ভোগ করতো। অমুসলমানদের প্রতি খলিফা ধর্মীয় সহিষ্ণুতা প্রদর্শন করতেন এবং জিজিয়া কর প্রদানের পরিবর্তে তাদের জীবন ও সম্পত্তি রক্ষা এবং ধর্মীয় স্বাধীনতা প্রদান করতেন। ইসলামী রাষ্ট্রের নিরাপত্তার বাধাস্বরূপ মনে করে নাজরানের খ্রিস্টান ও খাইবারের ইহুদীদের আরব-ভূমি থেকে বহিষ্কার করা হয় এবং তাদের পরিত্যক্ত সম্পত্তির দ্বিগুণ মূল্য তাদেরকে প্রদান করা হয়; যাতায়াতের বন্দোবস্ত করা হয় এবং জিজিয়া কর থেকে তাদেরকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। খলিফা বৃদ্ধ ও দুঃস্থ খ্রিস্টানদের ভাতা প্রদানেরও ব্যবস্থা করেন। তাঁর নিরপেক্ষ বিচারে অমুসলমানদের প্রতি রূঢ় ব্যবহারের জন্য মুসলমানদের শাস্তি প্রদানে তিনি দ্বিধা করতেন না।
খলিফা ওমরের শাসনকালে নারী জাতির মর্যাদা বৃদ্ধি পায়। প্রাক-ইসলামী আরবে নারীদের যে ঘৃণ্য জীবনযাপন করতে হতো। রাসূলে করীম (স) ও তাঁর প্রথম খলিফাদের সময় তারা নাগরিক মর্যাদা ও সম-অধিকার লাভ করে এবং রাষ্ট্রীয় কার্যে নানাভাবে অংশগ্রহণ করে। যুদ্ধক্ষেত্রে আহত সৈন্যদের সেবায় আরব নারীদের নিয়োজিত করা হতো। শিক্ষাক্ষেত্রে নারী ও পুরুষের সমঅধিকার ছিল। ইসলামী শিক্ষা সম্প্রসারণের জন্য খলিফা ওমর ইবাদাকে হিসে, আবু দারদাকে দামেস্কে ও সায়াদ বিন-জাবোলকে প্যালেস্টাইনে প্রেরণ করেন। ঐতিহাসিকদের মতে, দামেস্কে আবু দারদার ছাত্রসংখ্যা ১৬০০-এ পৌঁছায়। জোসেফ হেল বলেন, “মুসলমানগণ কেবলমাত্র আরবেই নয়, বরং সমগ্র বিজিত অঞ্চলে শিক্ষা বিস্তারের জন্য এমন সমস্ত বিদ্যালয় স্থাপন করেন যার দৃষ্টান্ত প্রাচীনকালে অথবা খ্রিস্টান রাজ্যেও পাওয়া যায় না।” তিনি সে সমস্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্মদাতা যেগুলো বহু শতাব্দী ধরে খিলাফতকে পৃথিবীর রাজশক্তিতে পরিণত করেছেন।
খলিফা ওমরের আমলে বিশাল ইসলামী রাষ্ট্রের অধিবাসীদের দুঃখ-দুর্দশা মোচন ও সুখ-শান্তি বিধানের জন্য তিনি নানাবিধ প্রজাবৎসল কার্যক্রম গ্রহণ করেন। বিভিন্ন স্থানে তিনি স্কুল, হাসপাতাল, মাদ্রাসা, সড়ক, নগর, মসজিদ প্রভৃতি নির্মাণ করেন। সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য নির্মাণ প্রকল্প ছিল কুফা, ফূসতাত ও বসরায় সেনানিবাস ও শহর প্রতিষ্ঠা এই তিনটি শহর পরবর্তীকালে ইসলামী শিক্ষা, কৃষ্টি ও সভ্যতার প্রাণকেন্দ্র হয়ে উঠে। প্রখ্যাত ইমাম হাসান বসরী বসরার, ইমাম আবু হানিফা ও আবু ইউসুফ কুফার অধিবাসী ছিলেন। শিবলী নোমানী বলেন, “আমর ইবন-আল-আসের শাসনকালে ফুসতাত, কুফা ও বসরা অন্যতম শ্রেষ্ঠ ও জ্ঞানভাণ্ডারে সমৃদ্ধ নগরীতে পরিণত হয়। মুসলিম রাষ্ট্র পারস্য ও রোমান বায়জানটাইনের সংস্পর্শে আসলে ইসলামী সমাজ, রাষ্ট্রব্যবস্থা, কৃষ্টি, দৰ্শন, শিক্ষা প্রভৃতি ক্ষেত্রে আমূল পরিবর্তন দেখা দেয়।” ভেরহোভেন বলেন, “এরূপ চলতে থাকলে (যুদ্ধাভিযান) অকৃত্রিম আরবী ইসলাম আন্তর্জাতিকীকরণ হলো। প্রাচীন সভ্যতার সম্পদগুলো আহরণ করা হল।” মুসলিম বিজয়ের ফলে মুসলমানগণ প্রাচীন সভ্যতার ধারক ও বাহক হিসেবে দাবি করেন এবং তাদের মাধ্যমে পুনরায় তা ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ে। বেকার যথার্থই বলেন, “ইসলাম বিচ্ছিন্নতা থেকে মুক্তি পেয়ে প্রাচ্য-হেলেনিক সভ্যতার উত্তরাধিকারী হলো। একে বিশ্ব ইতিহাসের ক্রমবিবর্তনের সর্বশেষ যোগসূত্র বলে মনে করা হয়।
হযরত ওমরের চরিত্র
হযরত ওমর (রা) ইসলামের ইতিহাসে এমন একটি অসামান্য ব্যক্তিত্ব, যাঁর চারিত্রিক দৃঢ়তা, আত্মত্যাগ, সরল ও অনাড়ম্বর জীবনযাপন, প্রজাবাৎসল্য, উদ্যম, কর্মস্পৃহা, অসাধারণ পাণ্ডিত্য, অপ্রতিদ্বন্দ্বী রণকৌশল, দৃঢ় আত্মপ্রত্যয়, ন্যায়পরায়ণতা, সূক্ষ্ম বিচার-বুদ্ধি অপর খলিফাদের ম্লান করে দিয়েছে। হযরত ওমর (রা) ছিলেন গৌরবর্ণ, কেশহীন মস্তক ও বলিষ্ঠ দেহের অধিকারী। রাসূলে করীম (স) অপেক্ষা ১৩ বৎসরের কনিষ্ঠ ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা এবং আমির-উল-মুমেনীন অত্যন্ত সহজ, সরল ও অনাড়ম্বর জীবনযাপন করতেন। মূইর বলেন, “সরলতা এবং কর্তব্যনিষ্ঠা তাঁর মুখ্য নীতি ছিল। নিরপেক্ষতা এবং আত্মত্যাগ তাঁর কর্ম পদ্ধতিকে নিয়ন্ত্রিত করে।” তাঁর নির্দিষ্ট ভাতা ছিল খুবই স্বল্প। আহার ছিল খেজুর ও রুটি, পরতেন তালিযুক্ত জামা। কথিত আছে যে, পারস্য যোদ্ধা হরমুজ মদীনার বন্দী অবস্থায় আগমন করে খলিফা ওমর (রা)-কে মদীনা মসজিদের মেঝেতে বসে থাকতে দেখে আশ্চর্যান্বিত হন। জেরুজালেমের পথে রওয়ানা হবার পূর্বে এরূপ স্থির হয়েছিল যে, প্রভৃ ও ভৃত্য পালা বদল করে উটের পিঠে আরোহণ করবেন। যখন উট জেরুজালেমে পৌঁছল তখন সকলে মলিন ও ছিন্নবস্ত্র পরিহিত খলিফা ওমর (রা)-কে উটের লাগাম ধরে উটের পিঠে উপবিষ্ট ভৃত্যকে টেনে নিয়ে আসতে দেখে অবাক হয়ে গিয়েছিল। খলিফা তাঁর স্ত্রী বিবি কুলসুমকে প্রসূতির পরিচর্যার জন্য একজন নিঃস বেদুঈন মহিলার নিকট প্রেরণ করেন। মানুষের দুঃখ ও দুর্দশা দেখে তাঁর কোমল হৃদয় ব্যথিত হতো। আরব দেশে ও সিরিয়ায় দুর্ভিক্ষ দেখা দিলে তিনি ত্রাণ-ব্যবস্থা করেন। এমনকি তিনি স্বয়ং পৃষ্ঠদেশে শস্যের বস্তা বহন করে গরীব-দুঃখীদের কাছে পৌঁছে দিতেন।
ধন-দৌলত ও ঐশ্বর্যের প্রতি খলিফা ওমরের অনীহা ছিল। জাঁকজমক ও আড়ম্বরকে তিনি মনেপ্রাণে ঘৃণা করতেন। তিনি মনে করতেন, বিলাস-বাসন জীবনের সরলতা ও পবিত্রতা নষ্ট করে এবং এ কারণে মাদাইন এবং জালুলার যুদ্ধ-লব্ধ দ্রব্যসামগ্রী তাঁর নিকট প্রেরিত হলে তিনি ক্রন্দনরত অবস্থায় বলেন, “এ সমস্ত লুণ্ঠিত দ্রব্যের মধ্যেই আমি আমার লোকজনের ভবিষ্যৎ ধ্বংস দেখতে পাচ্ছি।” তাঁর এই ভবিষ্যদ্বাণী সত্য প্রমাণিত হয়েছিল। কারণ, বায়জানটাইন ও পারস্য সাম্রাজ্যের ঐশ্বর্যের উত্তরাধিকারী হয়ে উমাইয়া যুগে মুসলমানগণ চারিত্রিক দৃঢ়তা, মিতব্যয়িতা ও আত্মনির্ভরতা হারিয়ে বিলাস-বাসন ও অনৈসলামিক কার্যকলাপে লিপ্ত হয়ে পড়ে। বিশাল মুসলিম জাহানের খলিফা হয়েও তিনি ব্যক্তিগত নিরাপত্তার জন্য দেহরক্ষী নিযুক্ত করেননি এবং ঘটনাচক্রে আততায়ীর ছুরিকাঘাতেই তিনি মৃত্যুমুখে পতিত হন। ইসলামের একনিষ্ঠ সেবক ও সত্যবাদী (ফারুক) হযরত ওমর খোলাফায়ে রাশেদূনের মূল আদর্শ ও বৈশিষ্ট্যগুলো সংরক্ষিত করতে সক্ষম হন। হিট্টি বলেন, “হযরত ওমরের জীবনচরিত্র রচনার জন্য অল্প কথার প্রয়োজন; সরলতা, কর্তব্যজ্ঞান তাঁর জীবনাদর্শ ছিল এবং ন্যায়পরায়ণতা ও একাগ্রতা তাঁর শাসনের মূলনীতি ছিল।”
হযরত ওমর (রা)-এর মত ন্যায়পরায়ন, সত্যনিষ্ঠ এবং দায়িত্বজ্ঞানসম্পন্ন শাসক পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। ধর্মানুরাগ, কোমলতা, সংযম, বিচক্ষণতায় তিনি ছিলেন মহানবী (স)-এর প্রতিচ্ছবি। তাঁর মধ্যে বহুমুখী চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের সুষ্ঠু সমাবেশ দেখা যায়। আলেকজাণ্ডারের নির্ভীকতা ও বীরত্ব, এরিস্টটলের সাংগঠনিক দক্ষতা, তৈমুরের কঠোরতা, বুদ্ধদেবের কোমলতা, নওশিরওয়ানের ন্যায়পরায়নতা, ইব্রাহিমের ধর্মপরায়নতা, আবু হানিফার শিক্ষা ও ব্যুৎপত্তি-জ্ঞানের সংমিশ্রণ তাঁর মধ্যে পরিলক্ষিত হয়। আমীর আলী বলেন, “তিনি ছিলেন কঠোর অথচ ন্যায়নিষ্ঠ, দূরদর্শী, স্বজাতির চরিত্র সম্পর্কে অসাধারণ জ্ঞানসম্পন্ন এবং উচ্ছৃঙ্খল আরবদের একজন যোগ্য নেতা। তিনি কঠোর হস্তে শাসনকার্য পরিচালনা করতেন এবং বিজিত শহরের বিলাস-বাসন ও পাপাচারের সংস্পর্শে আসবার স্বাভাবিক প্রবৃত্তি থেকে যাযাবর বেদুঈনদেরকে এবং অর্ধসভ্য জনগণকে তিনি কঠোরভাবে অধঃপতনের পথ থেকে উদ্ধার করেন।”
বিচার বিভাগকে দুর্নীতিমুক্ত করবার জন্য হযরত ওমর উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। বিত্তবান ও জ্ঞানী ব্যক্তিদের তিনি বিচারক নিযুক্ত করতেন; কারণ, তাঁরা প্রলোভনে উৎকোচ গ্রহণ করবেন না। খলিফার ন্যায়পরায়ণতা ও নিরপেক্ষ বিচার ব্যবস্থা সকল যুগের জন্য আদর্শস্থানীয় হয়ে রয়েছে। উবাই-ইবন-কাব একবার খলিফা ওমর (রা)-এর বিরুদ্ধে বিচারপতি জায়েদ-ইবন-সাবিত-এর নিকট অভিযোগ করেন। আদালতে খলিফা উপস্থিত হলে জায়েদ স্বীয় আসন ছেড়ে উঠে সম্মান প্রদর্শন করলেন এবং কুরআন স্পর্শ করে শপথবাণী উচ্চারণ থেকে খলিফাকে বিরত করলেন। এতে খলিফা খুব অসন্তুষ্ট হলেন এবং জায়েদকে বিচারকার্যের অযোগ্য বলে ঘোষণা করলেন। খলিফার সূক্ষ্ম ও নিরপেক্ষ বিচারে বীরশ্রেষ্ঠ খালিদকেও তাঁর সম্পত্তির জন্য উপযুক্ত কৈফিয়ৎ প্রদানে বাধ্য করা হয় এবং খালিদ তা অমান্য করলে তাঁকে পদচ্যুত করা হয়। এ ছাড়া খালিদের ঔদ্ধত্য, নিষ্ঠুরতা ও অমিতব্যয়িতা খলিফা মোটেই পছন্দ করেননি। এ ঘটনায় খলিফার কঠোর মনোবল, বলিষ্ঠ নীতিজ্ঞান এবং সূক্ষ্ম বিচার-বুদ্ধির পরিচয় পাওয়া যায়। মদ্যপানের জন্য ওমর স্বীয় পুত্র আবু সাহমাকে ৮০ বার বেত্রাঘাতের আদেশ দেন। মানবতাবোধ হযরত ওমরের অন্যতম চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ছিল। এ কারণে তিনি খ্রিস্টান নাগরিক জাবালাকে ভৃত্যের উপর নিষ্ঠুরতার জন্য তাঁকে শাস্তি প্ৰদান করেন। কথিত আছে, “খলিফা ওমরের চাবুক অপরের তলোয়ার থেকেও বেশি ভয়ঙ্কর ছিল”। স্বজনপ্রীতির পরিপন্থী খলিফা হযরত ওমর নানাবিধ ব্যবস্থা গ্রহণ করেন যার ফলে সামাজিক বৈষম্য দূরীভূত হয়। প্রাদেশিক গভর্নর নিয়োগের সময় তিনি তাঁর অথবা মহানবীর গোত্রের প্রতি দুর্বলতা প্রকাশ করেননি। নির্ভীক, স্বাধীনচেতা ও ন্যায়নিষ্ঠ খলিফা নিজ সন্তানের তুলনায় জায়েদের পুত্র ওসামাকে বর্ধিত হারে ভাতা প্রদান করেন। সামাজিক বৈষম্য ও বিভেদ দূরীকরণের প্রচেষ্টায় খলিফা আমর-ইবন-আল-আসকে ফুসতাত মসজিদে নির্মিত মিম্বার ভেঙ্গে ফেলতে আদেশ করেন। তাঁর প্রধান যুক্তি ছিল ইসলামের সাম্যবাদ নীতিতে একজন মুসলমান অপর একজনের উপরে উপবিষ্ট হতে পারে না।
ইসলাম ধর্ম গ্রহণের পূর্বেই হযরত ওমর বাগ্মী ও বিদ্বান হিসেবে যথেষ্ট খ্যাতি অর্জন করেন। ইসলামে দীক্ষিত হবার পর তিনি কুরআন ও হাদীসে ব্যুৎপত্তি লাভ করেন ও অসাধারণ পাণ্ডিত্যের পরিচয় দেন। শাহ ওয়ালিউল্লাহর মতে, “হযরত ওমর (রা) মোটামুটি এক হাজার মুসলিম আইন ও ব্যবহার তত্ত্বের উপর, বিবিধ প্রশ্নের ওপর মন্তব্য ও অভিমত প্রকাশ করেন।” এজন্য তাঁকে একজন বিশিষ্ট আইনজ্ঞ ও মোহাদ্দেস বলে অভিহিত করা হয়। হিট্টি বলেন, “প্রকৃতপক্ষে মুসলিম কিংবদন্তীতে প্রাথমিক যুগের ইসলামের ইতিহাসে তাঁকে হযরত মুহাম্মদ (স)-এর পরেই সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ বলা হয়েছে।” তিনি মুসলমান লেখকদের দ্বারা তাঁর দান, বিচার এবং অসামান্য সরলতার জন্য প্রশংসিত হয়েছেন। তাঁদের মতে, “একজন খলিফার যে সমস্ত গুণাবলি থাকা প্রয়োজন যে সমস্ত মহৎ গুণ হযরত ওমরের ছিল। তাঁর নিষ্কলুষ চরিত্র সমস্ত ধর্মভীরু উত্তরাধিকারীর জন্য ছিল আদর্শ।”