দ্বিতীয় অধ্যায় – সমাজতন্ত্রের পশ্চাৎপসরণ
পুঁজিবাদী সমাজের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর অনিবার্য দুঃখদুর্দশা ও ভোগান্তি। মানবচিত্তের স্বভাবজাত শুভবুদ্ধি এ অবস্থাকে মেনে নিতে পারেনা। স্বাভাবিকভাবেই এ অমানবিক ব্যবস্থার প্রতিক্রিয়ায় বিভিন্ন প্রকার মতবাদ ও জীবনাদর্শের উদ্ভব ঘটেছে যার মধ্যে অন্যতম প্রধান কারণ হচ্ছে সমাজতান্ত্রিক মতাদর্শ। অবশ্য সমাজতন্ত্র কোনো এক ব্যক্তির চিন্তাপ্রসূত মতবাদ নয়। এর বিভিন্ন ধরন রয়েছে; যেমন- ইউটোপিয়ান, ফ্যাবিয়ান, সিন্ডিক্যালিস্ট, গিল্ড, মার্কসিস্ট, মার্কেট, ডেমোক্রেটিক এবং অন্যান্য। সমাজতন্ত্রের এসব বহুবিধ প্রকারের পারস্পরিক তারতম্যের চুলচেরা বিশ্লেষণ বর্তমান প্রেক্ষাপটে অত্যাবশ্যক নয়। তবে সমাজতান্ত্রিক এসব মতবাদের মধ্যে কতক বৈশিষ্ট্য সাধারণ। সমাজতন্ত্রের ধারণা সমূহের সবগুলোই (কতিপয় ব্যতিক্রম ব্যতীত, যেমন-পল টিললিক, আর এইচ টাউনি এবং কুর্ট সুমেকার) তৎকালীন প্রবল সেকুলার আবহে লালিত হয়েছিল এবং বিশ্ব সম্পর্কে ধারণার ক্ষেত্রে এদের সবার দৃষ্টিভংগি ছিলো পুঁজিবাদী মতবাদের মতোই সেকুলার। পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থার সমানভাবে সমালোচনা করে এরা যুক্তি প্রদর্শন করেন যে, মুক্ত ও অনিয়ন্ত্রিত বাজারব্যবস্থা অনিবার্যভাবে সম্পদের অসম বন্টন ঘটিয়ে বিত্তশালীকে আরো বিত্তবান এবং দরিদ্র্যকে আরো দরিদ্র্যতর করে আয় ও সম্পদের অসম বন্টনের দুষ্ট চক্রকে চিরস্থায়ী রূপ দেয়। সমাজতান্ত্রি মতবাদসমূহ ব্যক্তি মালিকানা ও মজুরি ব্যবস্থাকে সকল অনিষ্টের উৎস হিসেবে চিহ্নিত করে ধারণা পোষণ করে যে, সম্পদের বিভিন্ন মাত্রায় জাতীয়করণ ব্যতীত দরিদ্র্য জনসাধারণের প্রতি ন্যায় বিচার করার সম্ভব নয়। যতদিন পর্যন্ত সম্পদের অসম বন্টন ব্যবস্থা ও বিশেষ স্বার্তভোগী শ্রেণী বিদ্যমান থাকবে, ততোদিন এমনকি গণতন্ত্রের পক্ষেও কার্যকর রূপ নেয়া সম্ভব নয়। সমাজতান্ত্রিক মতবাদসমূহ এমন একটি ভবিষ্যতের ধারণা পোষণ করে যখন জনগণ গণতান্ত্রিকভাবে বা বলপূর্বক পুঁজিবাদীদের কবল হতে সরকারের নিয়ন্ত্রভার গ্রহণ করবে এবং উৎপাদন উপকরণের জাতীয়করণ ও পরিকল্পিত উৎপাদন ও বন্টন ব্যবস্থার ভিত্তিতে শ্রেণী সংঘাতমুক্ত একটি গণতান্ত্রিক ও সুষম সমাজব্যবস্থার পত্তন ঘটাবে। অন্য কথায় তারা পুঁজিবাদী ব্যবস্থাকে আক্রমণ করে উৎপাদন ও বন্টন প্রক্রিয়ার এক ভিন্ন ব্যবস্থাপনার প্রস্তাব করে। সমাজতন্ত্রের এ নানাবিধ প্রকরণের মধ্যে মূল পার্থক্য বিশ্বব্যবস্থাপনা সম্পর্কে তাদে দৃষ্টিভংগিতে নয়, বরং অভিষ্ট লক্ষ্য অর্জনে তাদে কার্যপদ্ধতি বা কৌশলের মধ্যে নিহিত।
সমাজতন্ত্রের বহুবিধ প্রকরণের মধ্যে এখানে শুধুমাত্র মার্কসবাদী (Marxist) বাজারব্যবস্থা (Market) ও গণতান্ত্রিক (Democratic) -এই তিনটি চিন্তাধারার উপর আলোকপাত করা হবে। সমাজতন্ত্রের অন্যান্য ধারণাসমূহ এই তিনটি মূলধারার পূর্বসূরি এবং যেহেতু এগুলোর মূলধারা তিনটির মতো রাজনৈতিক প্রাধান্য বিস্তার করতে পারেনি, তাই তাদের আলোচনা দ্বারা সমাজতন্ত্রের মূর বিষয়বস্তু অনুধাবনে কোনো সুযোগের অবকাশ নেই।
মার্কসবাদ : বিশ্বদৃষ্টি ও কৌশল
জঙ্গি নাস্তিক্যবাদ (Militant Atheism)
মার্কবাদ হচ্ছে উনবিংশ শতাব্দীর প্রথম ও মধ্যভাবে উদ্ভুত বিভিন্ন আদর্শগত সংশ্লেষণ। এ আদর্শিক চিন্তাধারাগুলো হচ্ছে তৎকালীন সেকুলার মুক্তচিন্তা, হেগেলের দ্বান্দ্বিক মতবাদ, ফুয়েরবাকের বস্তুবাদ, মিচেলের শ্রেণী সংগ্রাম তত্ত্ব, রিকার্ডো ও স্মিথের অর্থনৈতিক দর্শন এবং ফরাসী বিপ্লবের জঙ্গি আহক্ষাণ। ইহুদী পিতামাতার সাত সন্তানের অন্যতম কার্ল মার্কস এসব চিন্তাধারা, বিশেষ করে সেকুলার ও নাস্তিক্যবাদী ধ্যানধারণার মধ্য দিয়ে বেড়ে ওঠেন। তার পিতা ধর্মের ব্যাপারে তেমন রক্ষণশীল ছিলেন না। বিশ্বাসের তাগিদে নয় বরং পেশার প্রয়োজনে তিনি পরবর্তীতে ধর্মান্তরিত হয়েছিলেন। যুবক বয়স হতে মার্কস গোঁড়া নাস্তিক হিসেবে পরিচিত ছিলেন যার দর্শনের মূল প্রতিপাদ্য হচ্ছে ‘ধর্মশাস্ত্রের সমালোচনাই সকল সমালোচনা শাস্ত্রের মূল ভিত্তি’।
অন্যান্য সমাজ বিজ্ঞানীর মধ্যে মার্কও সমাজব্যবস্থার রোগ নির্ণয় এবং প্রতিকার বিধানের চেষ্ট করেছিলেন। এই প্রক্রিয়ায় তিনি শ্রেণী বিচ্যূতি, শোষণ, উদ্বৃত্ত-মূল্য, ব্যক্তিগত সম্পত্তি, শ্রেণী সংগ্রাম, মজুরি-দাসত্ব, অর্থনৈতিক নির্ণয়বাদ নামক কতিপয় ধারণার প্রবর্তন করেন। কিন্তু লেখক হিসেবে সুবিন্যস্ত ও সাবলীল লেখনীর অধিকারী না হওয়ায় তার এই সব ধারণাগুলো অধিকাংশ ক্ষেত্রে অস্পষ্ট, অবোধগম্য ও ভাসাভাসা।
মার্কসের বিশ্লেষণের প্রধান তাত্ত্বিক ধারণা হচ্ছে ‘এলিনেশন’ (alienation) বা সম্পদের হস্তান্তর প্রক্রিয়া। বুর্জোয়া শ্রেণী কর্তৃক প্রলেতারিয়েত শ্রেণীকে শোষণের ফলে পুঁজিবাদী সমাজে এর উদ্ভব ঘটে। প্রলেতারিয়েত শ্রেণী হচ্ছে শিল্প শ্রমিক। উৎপাদন উপকরণের মালিক বিধায় তারা তাদের শ্রম বিক্রয় করে মজুরি-দাসত্বের শৃঙ্খলে আবদ্ধ হতে বাধ্য হয়। বুর্জোয়া শ্রেণী হচ্ছে পুঁজিবাদী, যারা উৎপাদনের উপকরণসমূহের মালিক ও নিয়ন্তা। প্রলেতারিয়েত শ্রেণী সকল উদ্বৃত্ত মূল্যের স্রষ্টা হওয়া সত্ত্বেও তাদেরকে দেয়া হয় সর্বনিম্ন মজুরি যা তাদের কোনো রকমে বেঁচে থাকা ও নতুন শ্রমদাস প্রজননের চক্রে বেঁধে রাখে।
বুর্জোয়া শ্রেণী শ্রমিক শ্রেণী কর্তৃক সৃষ্ট উদ্বৃত্ত-মূল্য আত্মসাতের মাধ্যমে ক্রমাগতভাবে ফুলে ফেঁপে ওঠে এবং প্রলেতারীয় শ্রেণীকে চিরস্থায়ী মজুরি দাসত্বের নিগড়ে আবদ্ধ করে। এই প্রক্রিয়া মানুষকে তার সহজাত মর্যাদা হতে বঞ্চিত করে অমানবিক যন্ত্রে মানবসত্তার বিচূর্ণিত ভগ্নাংশে পরিণত করে। মানব সত্তার সম্ভাববনাসমূহের পরিপূর্ণ বিকাশের সুযোগ হতে তারা নির্মমভাবে বঞ্চিত হয়। এই শোষণ প্রক্রিয়া পরস্পর স্বার্থ বিরোধী বিভিন্ন শ্রেণীতে বিভক্ত করে অনিবার্যভাবে শ্রেণী সংগ্রামের সূচনা করে। মানব ইতিহাসের গতিপথের ক্রমবিবর্তনে এই শ্রেণী সংগ্রামই মূল নিয়ন্তাশক্তি। ব্যক্তি মানুষ কোনো স্বাধীন সত্তা নয়, বরং ইতিহাসের এই দাবার ছকের অসহায় গুটি মাত্র। সমাজের বিভিন্ন শ্রেণীর বৈষয়িক স্বার্থের অনিবার্য সংঘাতই নিয়ন্ত্রণ করে মানব ভাগ্য (অর্থনৈতিক নির্ণয়বাদ)।
উপর্যুক্ত যুক্তি অনুসারে মানুষের চিন্তাধারা নয় বরং মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থাই ইতিহাসের মূল চালিকা শক্তি। বুর্জোয়া সমাজের ধর্ম ও রাষ্ট্র এ শ্রেণী সংঘাতের অবিচ্ছেদ্য অংশ এবং সর্বহারা শ্রেণীকে শোষণের জন্যে ধর্ম ও রাষ্ট্র উভয়কেই বুর্জোয়া শ্রেণী ব্যবহার করে। মানব সমাজের একাংশের ক্রমাগত দরিদ্র হতে দরিদ্রতর হওয়ার প্রক্রিয়ায় এ উভয় প্রতিষ্ঠান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। একটি শ্রেণীহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে এ এলিনেশন প্রক্রিয়া অপসৃত হবে এবং ইতিহাসের ক্রমবিবর্তনের এক পর্যায়ে রাষ্ট্রযন্ত্রেরই আর কোনো আবশ্যকতা থাকবেনা। তাই অত্যাবশ্যক প্রয়োজন হচ্ছে এ সমস্ত অববস্থার অপসারণ যে পরিপ্রেক্ষিতে মানুষ হয় অপমানিত, নিগৃহীত, পরিত্যক্ত ও শৃংখলিত। কিন্তু লক্ষণীয় যে, মার্কসীয় দর্শনের মধ্যেই অন্তর্নিহিত রয়েছে পরস্পর বিরোধিতা তথা চরম দ্বৈততা। মার্কসীয় দর্শনে একদিকে ব্যক্ত হয়েছে অর্থনৈতিক নির্ণয়বাদের চরম হতাশাব্যঞ্জক পরিণতির কথা, অর্থাৎ সেখানে শ্রেণী সংঘাত ও শোষণের অনিবার্য হাত হতে মুক্তির কোনো পথ নেই, অপর দিকে অর্থনৈতিক নির্ণয়বাদের কঠোর নিগূঢ় তত্ত্ব থেকে মানবতার মুক্তির স্বপ্নজাল বিস্তার করা হয়েছে।
মার্কসের মতানুসারে ‘ব্যক্তিস্বাতন্ত্রমূলক মানব প্রকৃতি বলে কিছু নেই’। এ মতবাদ মূলত অপরিবর্তনীয় ও স্থির এক ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যহীন সাধারণ মানব চরিত্রের নির্দেশ করে। যেহেতু ব্যক্তি মানুষের কোনো মৌলিক প্রকৃতি নেই, তাই মানুষের চেতনা রাজনৈতিক, সামাজিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক প্রক্রিয়ার মধ্যদিয়ে ক্রমাগত বদলে যাচ্ছে এবং এই পরিবর্তন তার জীবনে ‘বৈষয়িক অবস্থা তথা যে উৎপাদন পদ্ধতির সমাজে তার অবস্থান তা দ্বারা নির্ণীত হয়’। নরম্যান গ্রঅরাস মানব চরিত্র সম্পর্কে মার্কসের এ বহুল প্রচারিত মতের বিরোধিতা করেন। যাই হোক, মানব চরিত্র সম্পর্কে মার্কসের উপস্থাপিত ধারণা প্রামাণ্য বা গ্রহণযোগ্য নয়। তার ধারণা গ্রহণ করা হলে প্রকৃত প্রস্তাবে মার্কস ইতিহাসের বস্তুবাদী ধারণার উপর যে তাত্ত্বিক প্রাসাদ নির্মাণ করেছেন সেটাই ধ্বসে পড়ে। যদি ব্যক্তি মানব চরিত্র অপরিবর্তনীয় হয়, তবে মানব জীবনের বৈষয়িক অবস্থা ইতিহাসের গতিপথ নির্ধারণে ভূমিকা রাখতে বা ইতিহাসের দাবার ছকে মানুষকে নিছক গুটিতে পরিণত করতে পারেনা। এর দ্বারা মার্কসের নিজের মতবাদই খণ্ডিত হয়ে যায় অর্থাৎ মানব চরিত্রের এ অন্তর্নিহিত বৈশিষ্ট্যই তখন ইতিহাসের ক্রমবিবর্তনের বিরুদ্ধে কাজ করে যাবে। কিন্তু মার্কস ইতিহাসের দ্বন্দ্ববাদী যে ব্যাখ্যা দিয়েছেন তাতে আমরা মানব চরিত্র সম্পর্কে তার পূর্বতন ধারণার প্রতিফলন দেখতে পাইনা। প্রকৃতপক্ষে, মার্কসের পরস্পর বিরোধী চিন্তাধারার বীজ মার্কস উপস্থাপিত বিভিন্ন তাত্ত্বিক ধারণার মধ্যে যে অন্তর্নিহিত অসামঞ্জস্যতা রয়েছে তার মধ্যেই বিদ্যমান। একদিকে মার্কসের ইতিহাসের বস্তুবাদী ব্যাখ্যা মানব চরিত্রে অন্তর্নিহিত নিজস্ব বৈশিষ্ট্যকে স্বীকার করেনা, অন্যদিকে তার ‘এলিনেশন’ সম্পর্কিত ধারণাটি এমন এক বৈশিষ্ট্যের অপরিহার্যতা দাবি করে। মার্কসের বস্তুবাদী ঐতিহাসিক দ্বন্দ্ববাদ ও এলিনেশন সম্পর্কিত উপর্যুক্ত দুটি ধারণাই প্রকৃতপক্ষে পরস্পর বিরোধী ও সাংঘর্ষিক এবং এটাই মার্কসীয় দর্শন ও মতবাদ সম্পর্কে অস্পষ্টতা ও অসামঞ্জস্যতার যে সাধারণ অভিযোগ সমালোচক মহলে বিরাজিত তার মূল কারণ।
রণ কৌশলের ভুল প্রয়োগ
‘এলিনেশন’ প্রক্রিয়ার অবসানের একমাত্র উপায় হচ্ছে এর উৎস ব্যক্তিগত মালিকানার উচ্ছেদ সাধান। এর ফলে বুর্জোয়া শ্রেণীর সামাজিক আধিপত্য এবং তাদের রাজনৈতিক ও শোষণ-নিপীড়নমূলক ক্ষমতার বিলোপ ঘটবে। এই লক্ষ্যে সবচেয়ে কার্যকরী পন্থা হচ্ছে প্রলেতারীয় শ্রেণী কর্তৃক সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে পুঁজিবাদী ব্যবস্থার পতন ঘটানো। মার্কস ‘ইউরোপীয় সমাজতন্ত্রীদের প্রস্তাবিত শান্তিপূর্ণ পন্থায় সমাজ পরিবর্তনের ধারণাকে প্রত্যাখ্যান করেন। কেননা এ পন্থা শ্রেণী সংগ্রামের মৌলিক হাতিয়ারকে ভোঁতা করে দেবে। মার্কস পুঁজিবাদী সমাজ থেকে ধাপে ধাপে ক্রমবিবর্তনের ধারণাকেও বাতিল করেন দেন। কেননা সমাজে পুঁজিবাদী শাসক শ্রেণীর সর্বগ্রাসী ক্ষমতা ও শক্তির কারণে এ ধরণের পরিবতর্/ন সাধান করা সম্ভব হবেনা। গতানুগতিক সরকার কর্তৃক বন্টন ব্যবস্থার সংস্কার প্রচেষ্টাও সফল সমাজতন্ত্র বিনির্মাণ করতে পারেনা। ‘প্রত্যেকে তার যোগ্যতা অনুসারে কাজ করবে এবং ব্যকিব্ত মালিকানাধীন সকল উৎপাদন উপকরণের জাতীয়করণের মাধ্যমে একটি প্রগতিশীল ন্যায়পরায়নতাভিত্তিক সমাজ গঠিত হবে, যেখানে ক্রমান্বয়ে মজুরি, বিনিময়ের মাধ্যমে মুদ্রা, সামাজিক শ্রেণী বিভাজন এবং পরিশেষে রাষ্ট্রযন্ত্রের বিলুপ্তি ঘটাবে; সৃজিত হবে ‘বিবেক চেতনা ও উদ্দেশ্যমূলক নিয়ন্ত্রণের আওতায় উৎপাদক শ্রেণীর এক মুক্ত সমবায়ী ব্যবস্থা’। ফলে বুর্জোয়া পতন ও সর্বহারা (প্রলেতারিয়েত) শ্রেণীর বিজয় হবে আবশ্যম্ভাবী।
প্রলেতারীয় শ্রেণীকে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতায় অভিসিক্ত করে তাদের বিচ্ছিন্নতার অবসান, তাদের জীবন যাত্রা ও কর্মপরিবেশের উন্নয়ন এবং এভাবে শ্রেণী সংঘাত অবসানের মহতি উদ্দেশ্য যদিও প্রশংসার দাবিদার, তবু মার্কস প্রস্তাবিত উদ্দেশ্য সাধনের পন্থা ও কৌশল ভ্রান্তি ও ত্রুটিপূর্ণ। ইতিহাসের জড়বাদী মার্কসীয় মতবাদের দার্শনিক দিকটি বাদ দিলে তার লক্ষ্য অর্জনের রণকৌশল হিসেবে বাকি থাকে বুর্জোয়া শ্রেণীর উচ্ছেদ, উৎপাদন উপকরণসমূহের রাষ্ট্রীয়করণ এবং কেন্দ্রীয় পরিকল্পনাভিত্তিক অর্থনীতির প্রবর্তন। কিন্তু তিনি যৌক্তিক বিশ্বাসযোগ্যতার ভিত্তিতে উপস্থাপন করতে পারেননি যে, কিভাবে এলিনেশন প্রক্রিয়ার অবসান নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে তার প্রস্তাবিত মতাদর্শ ও পদ্ধতিগত কৌশল শোষণ ও মজুরি দাসত্বের অবসানের মাধ্যেমে প্রলেতারীয় শ্রেণীর আএর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নয়ন এবং কমিউনিজম প্রতিষ্ঠার উচ্চতর ধাপে একটি শ্রেণী বৈষম্যহীন সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার মধ্যদিয়ে সকল শোষণের অবসান ঘটবে।
পুঁজিবাদী ব্যস্থাপনার আওতাধীনে রাষ্ট্রযন্ত্র ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠান যদি শোষণের হাতিয়ার হয়ে থাকে তবে দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদী দর্শনে যা সমাজের একশ্রেণী কর্তৃক অন্য একটি শ্রেনীকে সম্পূর্ণ নির্মূলের প্রবক্তা- সে ব্যস্থাপনা উৎপাদন উপকরণের রাষ্ট্রীয়করণ ও কেন্দ্রীয় পরিকল্পনার মাধ্যমে যখন বিজয়ী শ্রেণীকে লাগামহীন ক্ষমতা প্রদান করা হবে, তখন জনগণের দুঃখ-দুর্দশা যে আরো বৃদ্ধি পাবে না তা আশংকা না করার কোনো যুক্তিসংগত কারণ নেই। দ্বান্দ্বিক দর্শন, শ্রেণীশত্রু হিসেবে চিহ্নিত করে একশ্রেণীর মানুষকে নির্বিচারে হত্যাকাণ্ড ও বলপূর্বক সম্পদ দখলে বিশ্বাসী মতাদর্শের ভিত্তিতে প্রতিটি সমাজে আর যাই হোক মানুষের ভ্রাতৃত্ব সৃষ্টি করা সম্ভব নয়। মানব হিতৈষী ভ্রাতৃত্ববোধের দর্শন দাবি করে সমাজের শক্তিশালী অংশ কর্তৃ সমাজের দরিদ্রতর ও ভাগ্য বিড়ম্বিত অংশের জন্যে ত্যাগ স্বীকার ও শর্তহীন সেবা প্রদান। অপর দিকে মার্কসীয় দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদী মতবাদ ডারউইনের ‘শক্তিমানের বেঁচে থাকার অধিকার’ ভিত্তিক চিন্তাদর্শনেরই প্রতিধ্বনি।
হত্যাকাণ্ড ও বলপূর্বক সম্পদ দখলের মাধ্যমে বুর্জোয়া রাষ্ট্রযন্ত্র উৎখাত করে প্রলেতারীয় শ্রণীর প্রতিনিধিত্বের ধ্বজাধারীরা যখন একচ্ছত্র ক্ষমতার মালিক ও একনায়কতান্ত্রিক বুর্জোয়া রাষ্ট্রযন্ত্র হতে অধিকতর ক্ষমতাশালী রাষ্ট্রযন্ত্রের নিয়ন্তা হবে তখন কি নিশ্চয়তা রয়েছে যে, তরা নিজেরাই শোষক ও নিপীড়কে পরিণত হবে না? মনে রাখা প্রয়োজন যে, কমিউনিস্ট মতাদর্শিক সর্বগ্রাসী রষ্ট্রযন্ত্রে জনগণের সবার অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে নয় বরং কতিপয় ব্যক্তিবর্গ দ্বারাই চালিত হবে। কেননা রাষ্ট্রের উচ্চ পর্যায়ের ব্যবস্থাপনায় সমাজের সকল সদস্যের অংশগ্রহণের ধারণা বাস্তবসম্মত নয়। সুতরাং পার্টির কতিপয় ব্যক্তি যারা একচ্ছত্র শাসন ক্ষমতাধারী রাষ্ট্রযন্ত্রের শীর্ষে থাকবে তারা পূর্বতন বুর্জোয়া শ্রণী হতেও অধিক নিপীড়নকারী বলে প্রমাণি হতে পারে। ব্যক্তিগত মালিকানাধীন সমাজে বিকেন্দ্রীভূত সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে শ্রমিক শ্রণি অন্তত কিছুটা স্বাধীনতা ভোগ করে। তার বিপরীতে উৎপাদন উপকরণসমূহের মালিকানা ও নিয়ন্ত্রিত রাষ্ট্রযন্ত্রে কতিপয় ব্যক্তিবর্গের হাতে ক্ষমতা কুক্ষিগত হলে শ্রমিক শ্রেণীর ততটুকু স্বাধীনতা ভোগেরও আর অবকাশ থাকবেনা। এর কি নিশ্চয়তা রয়েছে যে, ফরাসি বিপ্লবের উদ্দেশ্যে যেভাবে বিপ্লব সংঘটনকারীদেরই বিশ্বাসঘাতকতা দ্বারা পদদলিত হয়েছিল, একইভাবে মার্কসীয় বিপ্লবের পতাকাধারী সর্বহারা শ্রেণীর একনায়করা (Dictatorship of Proletariat) বিপ্লবের বাণীকেও প্রতারিত করবেনা? যদি এলিনেশন প্রক্রিয়ার জন্যে শুধুমাত্র সম্পদের মালিকানাই দায়ি হয়, তবে ব্যক্তিগত সম্পত্তির বিলোপের মাঝেই সমধান নিহিত –এ মার্কসীয় ধারণার সাথে একমত হতে কোনো অসুবিধা নেই। কিন্তু ব্যক্তিগত সম্পত্তি হলো মানব সমাজে বিভিন্ন ক্ষমতা রমাঝে একটি মাত্র উৎস। এছাড়াও ক্ষমতার অন্যান্য উৎস রয়েছে, যেমন- শারীরিক যোগ্যতা, মানসিক ক্ষমতা, শিক্ষা, সৃজনশীলতা, উচ্চাকাঙ্ক্ষা, কঠোর পরিশ্রম, পারিবারিক সম্পর্ক এবং সমাজ ও রাষ্ট্রে নেতৃত্বের অবস্থান। বিভিন্ন অমার্কসীয় পদ্ধতিতে ব্যক্তিগত সম্পত্তির পরিমাণ হ্রাস বা এর শোষণ ক্ষমতা ভোঁতা করে দেয়া সম্ভব হলেও সভ্যতার ভিত্তি ও স্থিতিশীলতা বিনষ্ট না করে মার্কসীয় পদ্ধতিতে ক্ষমতার অন্যান্য উৎসবসমূহের অপসারণ সম্ভব নাও হতে পারে। এটা মনে রাখা প্রয়োজন যে, এই এলিনেশন প্রক্রিয়া কোনো বিশেষ একক শ্রেণী বা গোষ্ঠীর আরোপিত বিষয় নয়। ক্ষমতা সম্পত্তি বা সামাজিক অবস্থান যেখান থেকেই আসুক না কেন অথবা যিনি এই ক্ষমতা ব্যবহার করবেন তিনি বুর্জোয়া বা প্রলেতারিয়েত যাই হোন না কেন, এরূপ ক্ষমতার অধিকারী যে কেউ এ ক্ষমতর অপব্যহার করতে পারে। তবে মার্কসীয় মতাদর্শে ক্ষমতার উৎস ব্যক্তগত সম্পত্তি বিলোপের পর উৎপাদন ব্যবস্থার কেন্দ্রীয় পরিকল্পনার মাধ্যমে সকল ক্ষমতা পলিটব্যুরোর সদস্যদের হাতে ন্যস্ত হয়, যারা চাকরি প্রদান ও সম্পদ বন্টন, পুরস্কার বা শাস্তি প্রদান, শ্রম শিবিরে প্রেরণের মতো সকল ক্ষমতার অধিকারী। আশ্চর্যের কিছু নেই যে, মার্কসীয় মতাদর্শ যেসব দেশে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, সেসব সমাজে এই মতাদর্শ এলিনেশন প্রক্রিয়ার অবস্থান পরিবর্তন ঘটাতে বা কমিয়ে আনতে ব্যর্থ হয়েছে। একটি ভুল ব্যবস্থাপত্র প্রকৃতপক্ষে রোগ নিরাময়ের পরিবর্তে তাকে আরো জটিল করে তোলে।
মার্কসের মতাদর্শ প্রকৃত প্রস্তাবে মানুষের উর অনাস্থাই প্রকাশ করে। এ মতবাদ মনে করে মানুষের চরিত্র কখনোই সংশোধন করা সম্ভব নয়। যেহেতু ব্যক্তিগত সম্পত্তি ক্ষমতার উৎস এবং শোষণের সুযোগ সৃষ্টি করে, তাই ব্যক্তিগত সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করাই সমীচীন। কিন্তু মনে রাখা দরকার যে, একদলীয় শাসন ব্যবস্থায় রাষ্টের শাসক ব্যক্ত বিপুল ক্ষমতার অধিকারী, যে ক্ষমতা ব্যক্তিগত সম্পদের মালিকদের ক্ষমতার চেয়ে অনেক বেশি। যদি একজন ব্যক্তিকে তার নিজস্ব ব্যবসা পরিচলনায় তিনি সামাজিক কল্যাণ সীমাকে লঙ্ঘন করবেন এ আশংকায় বিশ্বাস করা না যায়, তবে সামগ্রিক জাতীয় উৎপাদন ব্যবস্থা নিরঙ্কুশভাবে নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে একদলীয় রাষ্ট্রের শাসকবর্গকে কি করে বিশ্বাস করা যেতে পারে? পলিটব্যুরোর এ শাসক ব্যক্তিরা একই ধরনের মানুষের ভিতর থেকে এসেছে এ বিশ্বাস কি স্থাপন করা যায়না? পুঁজিপতিদের তুলনায় তারা কি দেবদূত? যদি তা না হয় তবে সকল উৎপাদন ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে তাদের হাতে যে বিপুল ক্ষমতা পুঞ্জিভূত হয় সে ক্ষমতা যে তারা তাদের স্বার্থে ব্যবহার করবেন না, তার নিশ্চয়তা কোথায়? মার্কস সম্ভবত এ ধরণের সম্ভাবনা আঁচ করতে পেয়েছিলেন। রাষ্ট্রহীন সমাজের যে স্বপ্ন তিনি দেখেছিলেন তার মূল কারণ বোধহয় এটি। কিন্তু মার্কস এটা বুঝতে পারেননি, যে রাষ্ট্রহীন সমাজে বিভিন্ন কায়েমী স্বার্থাবাদী মহলের পরস্পরের সংঘর্ষের ফলে শোষণ ও অবিচারের অধিকতর সম্ভাবনা থেকে যায়।
ত্রুটি বিচ্যুতি ও তার ফলশ্রুতি
বিপ্লব-উত্তর সময়ে মার্কসীয় কৌশল তথা উৎপাদন ব্যবস্থার রাষ্ট্রীয় মালিকানা ও কেন্দ্রীয় পরিকল্পনা পদ্ধতির মাধ্যমে যে সমস্ত সম্পদের সুষম ও দক্ষ বন্টন নিশ্চিতকরণ এবং স্বপ্নের বাস্তবায়ন হবে বলে আশা করা হয়েছিল। এর পেছনে যৌক্তিকতা ছিলো এই যে, ব্যক্তি মালিকানা যে সমস্ত অসম সুযোগ সুবিধা প্রদান করে তা একবার দূরীভূত করতে পারলে বাজারব্যবস্থার নিয়ন্ত্রণহীন ক্রিয়ার ফলে সম্পদের যে অদক্ষ্য ও অসম বন্টন ঘটে রাষ্ট্রতন্ত্র তা সংশোধন করে নিতে পারবে। কিন্তু প্রকৃত প্রস্তাবে মার্কসীয় চিন্তা দর্শনের ত্রুটির কারণে এ আশাবাদ বিফল হয়েছে।
ভ্রান্ত অনুমান
গণতন্ত্রের মতো সমাজতন্ত্রও প্রেক্ষাপট সম্পর্কে কতোগুলো ভুল ধারণা করে নিয়েছে। সঠিক ধারণার অভাবে দক্ষতা ও ন্যায়পরায়নতা উভয় লক্ষ্যই অর্জনে ব্যর্থ হয়েছে। কিন্তু একজন সাধারণ মানুষ এসব ধারণাগুলোর ভ্রান্তি উপলব্ধি করতে সক্ষম নয়। কেননা এসব অনুমানগুলো মার্কসীয় পুস্তকে তত্ত্বের আবরণে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। বর্তমান প্রেক্ষিতে মার্কসীয় দর্শনের এ ভুল অনুমানসমূহ বিস্তৃতভাবে আলোচনার অবকাশ নেই। যাই হোক, কতিপয় মার্কসীয় অনুমানের উপর আলোচনা বিষয়টি বুঝতে সহায়তা করবে।
অনাস্থা ও আস্থা
প্রথমত, মার্কসীয় বিশ্লেষণ সামাজিক কল্যাণকামীতার সীমারেখার মধ্যে ব্যক্তিগত সম্পত্তি ব্যবহারের ক্ষেত্রে ব্যক্তি মানুষের অবমতাকে নির্দেশ করে। এ মার্কসীয় সিদ্ধান্তের আলোকে ধারণা করে নেয়া হয়েছে যে, সমাজতান্ত্রিক ব্যস্থা প্রবর্তনের পর একই ব্যক্তি ভোক্তা, শ্রমিক, সরকারি কর্মচরী বা ব্যবস্থাপক হিসেবে নিজের ব্যক্তিস্বার্থকে ভুলে যেয়ে একমাত্র সমাজের সার্বিক কল্যাণবোধ দ্বারাই উদ্বুদ্ধ হবে। এর অর্থ দাঁড়ায় (ক) শ্রমিক শ্রণী আনুপাতিক হারে বস্তুগত প্রাপ্তির আশা ব্যতিরেকেই স্বার্থহীনভাবে দক্ষতা ও সততার সাথে কাজ করবে; (খ) কলকারখানার ব্যবস্থাপকগণ নিজেদের ব্যক্তিস্বার্থ, বাজার প্রতিযোগিতা, বাজার শক্তি দ্বারা নির্দেশিতভাবে উৎপাদনের উপকরণ ও উৎপাদিত পণ্যের ক্রয় বিক্রয় ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ ইত্যাদি প্রক্রিয়া দ্বারা চালিত না হয়ে দক্ষতার সাথে কর্ম সম্পাদনে সক্ষম হবে; (গ) সরকারি কর্মকর্তাবৃন্দ তাদের বিপুল কার্যনির্বাহী ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ ক্ষমতার কোনো অন্যায় সুযোগ নেবেনা। তাছাড়া সকল শ্রেণীর মানুষ ভোক্তা হিসেবে তাদের চাহিদা প্রয়োজনের সীমারেখার মধ্যে রেখে সম্পদের উপর অহেতুক চাপ হ্রাস করবে। উপর্যুক্ত পূর্বসিদ্ধান্তসমূহ বস্তুতপক্ষে অবাস্তব ধারণাপ্রসূত। কারণ সেকুলার একটি ব্যবস্থাপনায় সর্বজ্ঞ এক স্রষ্টার সামনে জবাবদিহিতার কোনো ধারণা বা অনুশাসন কাজ করেনা এবং একজন ব্যক্তি মানুষের জীবন সম্পর্কে দৃষ্টিভংগি মৃত্যু পরবর্তী কোনো জীবন সম্পর্কিত ধারণা দ্বারা প্রভাবিত নয়। এমতাবস্থায় একজন মানুষ বিত্ত-বৈভবের হাতছানিকে অগ্রাহ্য করে সব সময় নিঃস্বার্থভাবে কাজ করে যাবে- ধরণের ধারণা পোষণ করা অবান্তর আশাবাদ মাত্র। তাই সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় একজন মানুষ ব্যক্তিস্বার্থকে প্রাধান্য না দিয়ে কাজ করে যাবে -এ ধারণর কোনো যৌক্তিক ভিত্তি নেই। বিশেষত যখন আধ্যাত্মিকতার ভিত্তিহীন এ ধরণের জীন ব্যবস্থায় বস্তুগত জীবনের ভোগ বাসনাকে চরিতার্থ করাই একমাত্র লক্ষ্য হয়ে থাকে। এ কথা বিবেচনায় রখা হয়নি যে, ব্যক্তিগত লাভালাভের সুযোগের অভাবে তাদের উৎপাদন ও কর্মপ্রেরণা বিপুলভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। উপরন্তু জোরজবরদস্তিমূলক উপায়ে তা করতে চেষ্টা করা হলে নির্ধারিত সামাজিক লক্ষ্য অর্জনই ব্যাপকভাবে বিঘ্নিত হতে পারে।
বিভিন্নমুখী স্বার্থের সমন্বয় সাধন
দ্বিতীয়ত, এটা ধরে নেয়া হয়েছে যে, রাষ্ট্রযন্ত্র এমন এক শ্রেণীর ব্যক্তিবর্গ দ্বারা চালিত হ যাদের ব্যক্তিস্বার্থের সাথে সমাজের সামগ্রিতক স্বার্থের কেনো সংঘাত থাকবে না এটাও একটি ভুল ধারণা। কেননা একটি নিরঙ্কুশ একদলীয় রাষ্ট্রব্যবস্থায়ও ক্ষমতা কাঠামো আপেক্ষিক স্থান, আন্তঃজাতি ও অবস্থানজনিত বিভিন্নমুখী সুযোগ ও স্বার্থের দ্বন্দ্ব থেকে মুক্ত নয়। বস্তুত। নৈতিক চেতনার অনুপস্থিতিতে এমন কোনো পদ্ধতি বা ব্যবস্থার অস্তিত্ব নেই যা পরস্পর বিরোধী স্বার্থসমূহের সমন্বয় নিশ্চিত করতে পারে। একটি কেন্দ্রীয় পরিকল্পনাধীন অর্থনীতিতেও পূর্বনির্ধারিত সামাজিক লক্ষ্য অর্জনের জন্যে উৎপাদন উপকরণ বন্টনের ক্ষেত্রে বোক্তার চাহিদার সাথে সামষ্টিক মূল্যবোধের অস্ত্র ব্যবহারের প্রয়োজন হয়। পরিকল্পনাবিদদের সামাজিক লক্ষ্য নির্ণয়ের জন্যে একটি ভিত খুঁজে নিতে হয় এবং সে লক্ষ্যে এমন এক মূল্যবোধ মেনে চলেতে হয় যা বিশেষ শ্রেণীর স্বার্থ সংরক্ষণ করে। কিন্তু এ সামাজিক লক্ষ্য অর্জন ও সে জন্যে প্রয়োজনীয় মূল্যবোধ নিরূপনের দায়িত্ব কার উপর অর্পিত হবে? যেহেতু সামাজিক ব্যবস্থা পুঁজিবাদের মতোই সেকুলার ভিত্তির উপর স্থাপিত এবং সমাজতান্ত্রিক দর্শন ও বিবেচনায় ঐশী নির্দেশনার কোনো স্থান নেই, এমতাবস্থায় সামাজিক লক্ষ্য নির্ধারণ ও তা অর্জনের সহায়ক মূল্যমান ও মূল্যবোধ কি প্রক্রিয়ায় নির্ণীত হবে? যদি ব্যক্তি মানুষে ব্যক্তিসম্পদের মালিক বানিয়ে বিশ্বাস করা না যায় এ আশংকায় যে, ব্যক্তি মালিকানার সুযোগ নিয়ে সে অপরকে শোষণ করবেনা, তাহলে কি করে সেই একই ব্যক্তিকে বিশ্বাস করা যায় যে, সে নিজের স্বার্থ দ্বারা প্রণোদিত না হয়েই সমাজের জন্যে সার্বিক কল্যাণমূলক পণ্য উৎপাদন, বিন্যাস ও বিতরণের লক্ষ্য নির্ধারণ করবে? তারা কি তাদের ব্যক্তিস্বার্থের দ্বারা একটুও চালিত হবেনা? সমাজ কি প্রক্রিয়ায় তাদেরকে পরিচালন ও নিয়ন্ত্রণ করবে যাতে তাদের কৃতকর্ম দ্বারা শুধুমাত্র সমাজের অভীষ্ট কল্যাণমূলক উৎপাদনে নিজেদেরকে লিপ্ত রাখবে?
উপরন্তু কার্ল ম্যানহেমের সেই প্রশ্ন থেকে যায়, ‘পরিকল্পনাকারীদের পরিকল্পনা কে করবে?’ তাছাড়া সমগ্র সমাজের জন্যে কি পণ্য ও সেবা উৎপাদিত হওয়া প্রয়োজন তা নির্ধারণের সার্বিক দায়িত্ব গুটি কয়েক ব্যক্তিবর্গের উপর ন্যস্ত করার স্বপক্ষে কেনো গ্রহণযোগ্য যৌক্তিকতা নেই। ঐশী নির্দেশনার মূল্যবোধকে ধারণ করে যে সমাজব্যবস্থা নির্মিত নয়, এমন সমাজে ব্যক্তিমানুষ হিসেবে পরিকল্পনাবিদগণ বস্তুবাদী চেতনার ফলশ্রুতিতে তাদের স্বার্থকে জলাঞ্জলি দিতে পারবে না এটাই স্বাভাবিক। বস্তুত ঐশী নির্দেশনর মূল্যবোধ দ্বারা চালিত সমাজব্যবস্থার ক্ষেত্রেও সমগ্র উৎপাদন উপকরণ নিয়ন্ত্রণের সার্বিক ভার কতিপয় ব্যক্তির উপর অর্পন করা অতিশয় বিপজ্জনক। এরূপ বিপুল ক্ষমতা একনায়তন্ত্র এবং আমলাতন্ত্রের জন্ম না দিয়ে পারেনা, যা জনগণের কল্যাণের পরিবর্তে ব্যক্তির গোষ্ঠীস্বার্থকে চরিতার্থ করবে।
তথ্যের লভ্যতা
তৃতীয়ত, এটা ধরে নেয়া হয়েছে যে, কেন্দ্রীয় পরিকল্পনা পর্যদের নিকট সঠিক সিদ্ধান্তে উপনীত হবার নিমিত্ত ভোক্তার পছন্দ, উৎপাদন ব্যয় ও দ্রব্যমূল্যের সব তথ্য মওজুদ থাকবে। কিন্তু মুক্তবাজার ব্যবস্থা এবং চাহিদা ও সরবরাহের পারস্পরিক ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া যেখানে অনুপস্থিত সেখানে উপর্যুক্ত তথ্যের ক্ষেত্রে সঠিক সূচকসমূহ নির্ধারণ করাই সম্ভব নয়। এ পরিপ্রেক্ষিতেই হায়েক (Hyake) যুক্তি প্রদর্শন করেছেন যে, কর্তৃপক্ষের নিকট প্রয়োজনীয় উপাত্তসমূহ না থাকার কারণেই উৎপাদন উপকরণসমূহ বন্টনের সমাজতান্ত্রিক সমাধান বাস্তবসম্মত নয়।
উপর্যুক্ত উপাত্তসমূহ লভ্য হলেও অসংখ্য পণ্য ও সেবা উৎপাদনে কোনগুলো উৎপাদন উপকরণ প্রাপ্তির ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার পাবে তা নির্ধারণ করার পরিকল্পনা পর্যদের কতিপয় ব্যক্তির পক্ষে দুরূহ হবে। এ বিষয়ে তারা চেষ্টা করলেও তা হবে অত্যন্ত জটিল ও সময়সাপেক্ষ পদ্ধতি, যার ফলে পরিবর্তিত অবস্থার সাথে সামঞ্জস্যতা বিধান ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া হবে শ্লথ ও মন্থর। কিন্তু পণ্য সামগ্রী উৎপাদনে সম্পদ বন্টনের বিষয়টি জনকল্যাণের সাথে এতো বেশি সম্পৃক্ত যে, এ বিষয়ে সিদ্ধান্তগ্রহণের ভার কতিপয় ব্যক্তির উপর ন্যস্ত করা সমীচীন নয়। মুক্তবাজার ব্যবস্থার বিকেন্দ্রীকরণকৃত সিদ্ধান্ত গ্রহণ ব্যবস্থাই প্রকৃত প্রস্তাবে সর্বোত্তম ব্যবস্থা। যে ব্যবস্থাপনা পদ্ধতিতে উৎপাদক ভোক্তা ও সরবরাহকারী ব্যক্তিবর্গের সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণের সুযোগ নেই তাকে জনকল্যাণ সুনিশ্চিতকারী দক্ষ ব্যবস্থাপনা বলা যায় না।
আর যদি ভোক্তাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণের সুযোগই দেয়া হয়, তবে কিছু নৈতিক বাধ্যবাধকতার সীমারেখার মধ্যে তাদের চাহিদার দ্বারা নির্ণীত বাজার মূল্যের মাধ্যমে তাদের চাহিদা প্রকাশের সুযোগ প্রদান করা কি সঠিক হবেনা? বাজারমূল্য পদ্ধতি সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়াকে বিকেন্দ্রীভূত করে এবং ভোক্তা ও উৎপাদক শ্রেণীকে পরস্পরের উপর ক্রিয়া-প্রক্রিয়াকে সুযোগ দান করে ব্যক্তির প্রয়োজন ও চাহিদার সাথে দ্রুততরবাবে নিজেকে সামঞ্জস্যশীর করে নেয়, যা কেন্দ্রীয় পরিকল্পনাধীন ব্যবস্থাপনার অন্তর্গত জটিলতার জন্যে সম্ভব নয়। বিকেন্দ্রীকৃত বাজার অর্থনীতি অনেক বেশি স্থিতিস্থাপক এবং এ ব্যবস্থায় ব্যক্তি বিশেষের ভুল সিদ্ধান্ত বাজার শক্তির সাহায্যে সংশোধনের অবকাশ থাকে এবং সে ভুল সমাজের জন্যে সর্বাত্মক ক্ষতিকর হয়ে দাঁড়তে পারে না। এমনকি যদি সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা উৎপাদন উপকরণ বন্টনের পুঁজিবাদী ব্যবস্থাকেও গ্রহণ করে, তবুও ঐশী প্রত্যাদেশভিত্তিক সুষম ব্যবস্থাপনার অভাবে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে পুঁজিবাদী অনিবার্য পরিণতির অর্থনৈতিক বৈষম্যের বীজ বহন করতে হবে।
ভর্তুকির সুফল
চতুর্থত, এটা ধরে নেয়া হয়েছে যে, সেভিয়েত পণ্য মূল্য নির্ধারণ পদ্ধতিতে বিশাল ভর্তুকির ব্যবস্থা দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে সাহায্য করবে -এ ধারণাটিও ভুল বলে প্রমাণিত হয়েছে। ভর্তুকি ব্যবস্থা দরিদ্র জনসাধারণের, যাদের ক্রয় ক্ষমতা সীমিত তাদের চেয়ে সাধারণত ধনী সুবিধাভোগী গোষ্ঠীকেই বেশি উপকৃত করে। সোভিয়েত ইউনিয়নে খাদ্য ভর্তুকির পরিমাণ ছিলো জাতীয় আয়ের১০ বাগ যা ইইসি’র তুলনায় ৫ গুণ বেশি। এ ব্যবস্থার ফলে কৃষি পণ্যের কম মূল্যের কারণে উৎপাদক কৃষক শ্রেণী বঞ্চিত হয়েছে। ফলে তাদের উৎপাদনের স্পৃহা হ্রাস পেয়েছে। অপরদিকে অনুৎপাদক ধনীক শ্রেণী এতে বেশি উপকৃত হয়েছে।
সোভিয়েত পরিকল্পনা পদ্ধতিতে বিশাল আকারের ভুর্তকি হচ্ছে স্বাভাবিক ব্যবস্থা। সর্বক্ষমতাসম্পন্ন মূল্য নির্ধারণকারী রাষ্ট্রীয় কমিটিকে সামান্য আলপিন হতে ট্রাক্টর পর্যন্ত প্রায় বিশ মিলিয়ন দ্রব্যের মূল্য নির্ধারণ করতে হয়। এ কাজটি এতো দূরূহ যে, যতো লোকবল সমৃদ্ধ হোক না কেন, কোনো একক সরকারি সংস্তার পক্ষে তা নিষ্পন্ন করা সম্ভব নয়। এই একক সংস্থার পক্ষে ভোক্তার পছন্দ, চাহিদা এবং এ সংক্রান্ত প্রকৃত ব্যয় ইত্যাদি সম্পর্কিত সকল উপাত্ত সংগ্রহ না হওয়াই স্বাভাবিক। ফলে পরিকল্পনা কমিশন মূল্য পরিবর্তন না করার সহজ পন্থাই গ্রহণ করে। তাই বছরের পর বছর মূল্য অপরিবর্তিত থাকে, বিশেষ করে খুচরা মূল্য। যার পরিবর্তন রাজনৈতিকভাবে স্পর্শকাতর। এ ধরনের অপরিবর্তনীয় মূল্য কাঠামো, অদৃশ্য ভর্তুকি এবং উৎপাদন উপকরণ বন্টনে অন্যায্যতা ও অদক্ষতার জন্ম দেয়।
বিশাল আকারের ভর্তুকির ব্যবস্থা সীমিত সম্পদের অপরাধযোগ্য অপচয় ঘটায়। এই অপচয়ের ব্যাপ্তি একটি সাংবাদিক সম্মেলনে প্রদত্ত মিখাইল গর্বাচেভের বিবৃতি হতে সুস্পষ্ট হয়ে উঠে। তাতে বলা হয়েছিল, ‘শিশুরা একটি পাউরুটি দিয়ে বল খেলছে এটা সচরাচর দৃষ্টিগোচর হচ্ছে। মূল্য নির্ধারণ কমিটির চেয়ারম্যান ভেলেন্টিন পাভলভ তাই সঠিকভাবে মন্তব্য করেন যে, দ্রব্যমূল্যের চাহিদা ও সরবরাহের মধ্যে সংযোগ সাধনে সামান্যই ভূমিকা পালন করে, ফলে সৃষ্টি হয় পাইকারী ও খুচরা পণ্যের বিপুল ঘাটতি। এই ঘাটতির তীব্র সংকটের অবসান কখনো সম্ভব হবেনা। কেননা একনায়কতান্ত্রিক রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রিত প্রচার মাধ্যম ও গণতান্ত্রিক সকল পদ্ধতির কন্ঠরোধের মাধ্যমে কেন্দ্রীয় পরিকল্পনাকে চাপিয়ে দেয়া হয়। সোভিয়েত রাশিয়ার সিদ্ধান্তসমূহ উপর মহলে নির্ণীত হয় এবং সর্বস্তরে প্রতিপালিত হয়। রাশিয়ার একদলীয় ব্যবস্থা যা অতীতে শক্তিশালী সংস্থা কেজিবি কর্তৃক পরিচালিত এবং যেখানে গ্রেফতার, ‘বন্দি শিবির’ ও তথাকথিত ‘মানসিক হাসপাতাল’-এ প্রেরণের বিপুল ক্ষমতা বিদ্যমান এবং এ ক্ষমতার অপপ্রয়োগের বিরুদ্ধে কার্যত কোনো প্রতিষেধক নেই। ফলে সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ার মধ্যে অপরিবর্তনশীলতা থাকাই আবশ্যম্ভাবী। এই ধরণের একনায়কতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ভোক্তার চাহিদা অনুযায়ী স্বতঃস্ফুর্তভাবে পরিবর্তনের কেনো স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতির অস্তিত্ব নেই, অথবা সঠিক সিদ্ধান্তে পুরুস্কৃতি এবং বুল সিদ্ধান্তে শাস্তি দেবার কোনো ব্যবস্থা নেই। কেউ প্রশ্ন করতে পারে যে, অপরিবর্তিত স্থির মূল্য কি ভোক্তা শ্রেণীর জন্যে সুবিধাজনক নয়? কিন্তু খেয়াল খুশি অনুযায়ী যখন দ্রব্যমূলকে স্থির রাখা হয় এবং চাহিদা ও সরবরাহ সূত্র অনুযায়ী তা নির্ধারিত হতে দেয়া হয়না, তখন এ ব্যবস্থা অন্যায্যতা ও বৈষম্যের উৎসে পরিণত হয় এবং সম্পদ ব্যবহার, কর্ম প্রেরণা এবং দীর্ঘ মেয়াদী সরবরাহ তথা অর্থনীতির উপর ক্ষতিকর প্রভাব বিস্তার করে। ভোক্তাগণ একদিকে উৎপাদিত পণ্যের অপচয়ে লিপ্ত হয়, অন্যদিকে শ্রমিক ও উৎপাদক শ্রেণী তাদের পরিশ্রমের যথাযথ মূল্য হতে বঞ্চিত হয়। পণ্য দ্রব্যের মান কমে যায় এবং তা ভোক্তা শ্রেণীর উপযোগিতাভিত্তিক চাহিদা পূরণে ব্যর্থ হয়। যেখানে শুধুমাত্র ধনীক ও আমলা শ্রেণী তাদের চাহিা অনুযায়ী পণ্য ক্রয় করতে সক্ষাম হয়, কিন্তু দরিদ্র জনগোষ্ঠী অর্থের অভাবে প্রয়োজনীয় সামগ্রী হতে বঞ্চিত হয় অথবা লাইনে দাঁড়িয়ে তদের মূল্যবান সময়ের অপচয় করে। যেহেতু উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশ মোতাবেক উৎপাদন করা হয়, তই স্বাভাবিকভাবে দেখা দেয় কতিপয় পণ্যের ঘাটতি, আবার পাশাপাশি আরেক শ্রেণীর পণ্যের বিপুল উদ্বৃত্তি। এ অপ্রয়োজনীয় উদ্বৃত্ত পণ্য অবিক্রিত থেকে যায়। কিন্তু এর দায়বার কাউকে বহন করতে হয়না এবং একই ভুল ধারায় উৎপাদন অব্যাহত থাকে।
বৃহদায়তন খামার ও শিল্প প্রতিষ্ঠানের দক্ষতা
পঞ্চমত এটাও ধরে নেয়া হয়েছে যে, বৃহদায়তনের অর্থনৈতিক অসুবিধা, প্রতিযোগিতা ও বাজার শক্তির অনুপস্থিতি সত্ত্বেও বৃহৎ একচেটিয়া খামার এবং রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন শিল্পপ্রতিষ্ঠানসমূহ দক্ষতার সাথে কাজ করবে। এই ধারণাও ভুল বলে প্রমাণিত হয়েছে যে, বৃহদায়তন খামারগুলোতে সাধারণত অনেক প্রকারের ফসল, নানা জাতের গবাদি পশু উৎপাদন করা হয় এবং তাতে নিয়োজিত বিশাল আকারের কৃষি শ্রমিকগণ অনেকগুলো গ্রামে ছড়িয়ে বসবাস করে। ফলে এর তদারকি এক দুরূহ কর্মে পরিণত হয়। এজন্যে কৃষক, মালিক বা ভাগচাষী অনেক বেশি দক্ষতার সাথে একাজ সম্পন্ন করে, কেননা নানা ধরণের কজের অনেকগুলো সুচারুবাবে নিষ্পন্ন নাও হতে পারে এবং তা তদারকির অগোচরে থেকে যেতে পারে। ১৮৯৯ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নে কৃষি জমির মাত্র ০.৫ শতাংশ ব্যক্তিগত মলিকানাধীন ছিলো, তাতে উৎপাদন ছিলো সমগ্র কৃষি পণ্য উৎপাদনের ২৭ শতাংশ। এটা রাষ্ট্রীয় খামার ব্যবস্থার চেয়ে ব্যক্তি মালিকানাধীন কৃষি খামারের দক্ষতা প্রমাণ করে। কৃষি উৎপাদন হ্রাস ছাড়াও সরঞ্জামের অদক্ষ রক্ষণাবেক্ষণ এবং উৎপাদনের চুরিজনিত ক্ষতিও কম ছিলনা। এ ধরণের ক্ষতির সম্ভাব্যতা ব্যক্তি মালিকানাধীন খামারে তত প্রকট নয়। প্রতিযোগিতার চিরস্থায়ী অনুপস্থিতির ফলে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানগুলো উৎপাদন উপকরণের সর্বোত্তম ব্যবহার বা উদ্ভাবনী প্রচেষ্টার স্পৃহা হারিয়ে ফেলে। রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যবস্থার এটাই যৌক্তিক পরিণতি। ব্যবস্থাপকগণের যখন লাভ- লোকসানে কোনো হিস্যা নেই। তখন তখন তারা কেন স্বতঃপ্রবৃত হয়ে উদ্যোগ গ্রহণ করবে? যেহেতু বাজার অর্থনীতির চালিত মূল্যব্যবস্থা অনুপস্থিত এবং ব্যক্তিগতভাবে লাভ বা ক্ষতির কোনো প্রশ্ন নেই তাই ব্যবস্থাপক শ্রেণীকে ভালো উদ্যোগ গ্রহণে উদ্বুদ্ধ করার আর কোনো হাতিয়ার নেই। ভোক্তাশ্রেণীর চাহিদা এবং সে মোতাবেক উৎপাদক শ্রেণীর প্রতিক্রিয়া তথা উৎপাদন ও সরবরাহের মধ্যে সংযোগ সাধান করে বাজারব্যবস্থা। এ মৌলিক উৎপাদনটিরই সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় অস্তিত্ব নেই। ব্যবস্থাপনা তাই হয়ে দাঁড়ায় একদল রাজকর্মচারীর আদেশ জারীর এক প্রহসনে। তিনি বলেন : ‘ওয়েবার’ এর রাষ্ট্রীয় মালিকানা সম্পর্কে মন্তব্য এখানে প্রনিধানযোগ্য। তিনি বলেন, রাষ্ট্রীয় মালিকানা অর্থনৈতিক জীবনকে আমলাতন্ত্রের চক্রে আবদ্ধ করে এবং অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িত সকল শ্রেণীর মানুষকে প্রাণহীন আনুষ্ঠানিকতা দ্বরা জড়পিণ্ডে পরিণত করে। ফলে খণ্ডিত হয় দক্ষতা। উদাহরণস্বরূপ, সোভিয়েত ইউনিয়নে ওইসিডি দেশ সমূহের তুলনায় প্রতি উৎপাদন এককের জন্যে ২.৫ গুণ বেশি শ্রমশক্তি ব্যয়িত হয়। উপরন্তু সোভিয়েত খামার বা শিল্প প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপকগণের উৎপাদন উপকরণের মূল্য, উৎস বা উৎপাদিত পন্যের দামের উপর কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। এসব পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার অধীনে মস্কোর কেন্দ্রীয় পরিকল্পনা পর্ষদ দ্বারা নির্ণীত হয়। উৎপাদন উপকরণের সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান ও তার ব্যবহারকারী প্রতিষ্ঠানের একে অপরকে অর্থনৈতিক শর্তানুযায়ী বাছাই করার কোনো সুযোগ বা অবকাশ নেই। খামার বা শিল্প প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপকগণকে সেক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় সরবরাহ কমিটির নিকট অনুরোধপত্র প্রেরণ করতে হয়। কিন্তু এ কেন্দ্রীয় কমিটির পক্ষে দেশের প্রত্যন্ত প্রান্তরের সকল খামার বা শিল্প প্রতিষ্ঠানের বিশেষ স্বতন্ত্র স্থানীয় অবস্থা ও সমস্যা সম্পর্কে সম্যক ধারণা লাভ করা সম্ভব নয়। প্রতিটি কেসের স্বতন্ত্র বিশেষ অবস্থা বিশ্লেষণ করে ত্বরিত সমাধানে উপনীত হবার পর্যাপ্ত সময় বা স্পৃহাও তাদের থাকার কথা নয়। বাজারের অবস্থা অনুযায়ী প্রতিটি প্রতিষ্ঠাানের নিজস্ব মূল্যায়নের ভিত্তিতে উৎপাদিত পণ্যের প্রকৃতি বা পরিমাণ পরিবর্তন করারও সুযোগ নেই। উপরন্তু দক্ষতা বৃদ্ধি বা উন্নতমানের পণ্য সামগ্রী উৎপাদনের মাধ্যমে ব্যবস্থাপক বা শ্রমিকরা সরাসরি লাভবান হবে এমন কোনো নিশ্চয়তা নেই। একজন উদ্যমী ব্যবস্থাপক সমগ্র সোভিয়েত ব্যবস্থায় ক্ষুদ্ধ হতে পারেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও তার পক্ষে উন্নততর ব্যবস্থাপনা চালু করার কোনো পথ খোলা নেই। ফলশ্রুতিতে সোভিয়েত ব্যবস্থায় অর্থনৈতিক সম্পদসমূহ অর্থনীতির নিয়ম অনুযায়ী অদক্ষ ব্যবহার ক্ষেত্র হতে দক্ষ ব্যবহার ক্ষেত্রে দ্রুত স্থানান্তির হয়না।
তছাড়া কী পরিমাণ বিনিয়োগ করতে হবে, বর্তমান ও ভবিষ্যত প্রয়োজনের মধ্যে কীভাবে সমন্বয় সাধন করতে হবে এবং জনগণকে ভবিষ্যতের প্রয়োজনে কিভাবে স্বতস্ফুর্তভাবে ত্যাগ স্বীকারে উদ্বুদ্ধ করা যাবে তা নিশ্চিত করার কোনো পদ্ধতি সোভিয়ে ব্যবস্থায় উপস্থিত নেই। একটি কেন্দ্রীয় পরিকল্পনাধীন অর্থনীতিতে বিনিয়োগ সম্পর্কিত সিদ্ধান্ত গ্রহণ স্পষ্টতই পরিকল্পনা কমিশনের দায়িত্ব। বাজার বাজার সূচকের উঙ্গিত এবং সামাজিকভাবে সম্মত মূল্যবোধ ব্যতিরেকে দক্ষতার সীমায় পূঁজি বন্টনের জন্যে কোনো কার্যকরী উপযুক্ত ভিত্তি খুঁজে পাওয়া যায় না। অর্থনৈতিক সিদ্ধান্তসমূহ গৃহীত হয় নিছক রাজনৈতিক বিবেচনায় বা পরিকল্পনাবিদগণের ব্যক্তিগত রুচি বা প্রবণতা মোতাবেক।
কেউ যুক্তি প্রদর্শন করতে পারেন যে, পুঁজিবাদী অর্থনীতিতেও অবস্থা ভিন্নতর নয়। প্রত্যেক উৎপাদন খাতে কতিপয় রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের পরিবর্তে পুঁজিবাদী সমাজব্যস্থায় কতিপয় বিশাল একচেটিয়া কর্পোরেশন শুধু অর্থনীতিতেই প্রভুত্ব নয় বরং সামাজিক ও রাজনৈতিক অঙ্গনেও বিপুল প্রভাব বিস্তার করে থাকে। কার্যত পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে ভোক্তার সার্বভৌমত্বের ধারণাটির অর্থবহ কার্যকারিতার অভাব সর্বজনবিদিত। কোন পণ্য দ্রব্য উৎপাদন করতে হবে এবং তা কিভাবে করা হবে, কনজুমার ও শেয়ারহোল্ডারগণ সে সিদ্ধান্তের বিষয়ে কোনো মূখ্য ভুমিকা পালন করেনা। সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও করপোরেশন পরিচালনার বিষয়ে ব্যবস্থাপনা পর্ষদই মূখ্য ভূমিকা পালন করে থাকে। যেহেতু ব্যবস্থাপনা পর্ষদ সমাজের উপরের স্তরের ধনিক শ্রেণী হতে আগত কতিপয় পরিচালক ও বেতনভোগী পেশাজীবী দ্বারা গঠিত তাই সে পরিপ্রেক্ষিতে বিচার করলে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা ও পুঁজিবাদী ব্যবস্থার মধ্যে তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য পার্থক্য দেখা যায়না।
কিন্তু পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় অদক্ষতা ও বেইনসাফ বিদ্যমান সত্ত্বেও উপর্যুক্ত যুক্তিসমূহের কোনো শক্ত ভিত্তি নেই। প্রকৃতপক্ষে, সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থাধীন কোনো প্রতিষ্ঠানের ন্যায় পুজিবাদী বৃহৎ কর্পোরেশনগুলোর পণ্যের মান, পরিমাণ ও মূল্য নির্ধারিত হয়না। বাজার অর্থনীতির নিজস্ব নিয়ম এখানে কাজ করে। এমনকি যদি পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে একটি শিল্পে মাত্র গুটিকয়েক প্রভাবশালী প্রতিষ্ঠান বিরাজ করে এবং তাদের নিজেদের মধ্যে চাহিদা ও মূল্যের বিষয়ে বিশেষ সমঝোতা প্রতিষ্ঠিত থাকে, তবুও তাদের নিজেদের মধ্যে কিছু না কিছু প্রতিযোগিতা বিদ্যমান থাকবে, যদিও বা সে প্রতিযোগিতা পুঁজিবাদের প্রবক্তাগণ যে পরিমাণ সুষম প্রতিযোগিতার দাবী করে থাকেন তার চেয়ে উল্লেখযোগ্যভাবে কম হবে। পুঁজিবাদী ব্যবস্থার প্রত্যেকটি শিল্প প্রতিষ্ঠান বাজারের পরিস্থিতি সম্পর্কে নিজস্ব মূল্যায়ন ও বিশ্লেষণের ভিত্তিতেই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে এবং সিদ্ধান্ত ভুল হলে সেজন্যে লোকসানের ভার বহন করে। আবার কোনো কেন্দ্রীয় পরিকল্পনা পর্ষদের দ্বারস্থ বা অনুমতির অপেক্ষা না করেই তাদের এ ভুল সংশোধনের সুযোগ থাকে। এদিকে তারা যেমন তাদের সৃষ্টিশীলতা ও দক্ষতা দ্বারা লাভবান হতে পারে, অপরদিকে তাদের বিকল্প দ্রব্যের প্রতিযোগিতা, আমদানি এবং দক্ষতার সাথে পরিচালিত না হলে বাজার হতে উৎখাত হতে হবে এ আশংকারও মুখোমুখি হতে হয়। এসব বৈশিষ্ট্য সমূহ রাষ্ট্রীয় সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় অনুপস্থিত।
তিক্ত ফলাফল
অদক্ষ বন্টন ব্যবস্থা
কার্যত বাস্তবে যদি সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা বিঘোষিত লক্ষ্য অর্জনে সফল হতো, তাহলে উপরে এ ব্যবস্থার যে বিশ্লেষণ ও মূল্যায়ন করা হয়েছে তাকে একদেশদর্শী সমালোচনা ও বিভ্রান্তিকর প্রচারণা বলে চালিয়ে দেয়া যেত। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে মাথাভারী অনাবশ্যক জটিল কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণের নীতির ফলে এ ব্যবস্থা শ্রমিক ও ব্যবস্থাপক শ্রেণীকে প্রয়োজনীয় উদ্বুদ্ধকরণে ব্যর্থ হয়েছে। ফলে অর্থনীতির স্বাভাবিক নিয়মে অদক্ষ ক্ষেত্র হতে সম্পদের প্রবাহ সৃষ্টি হয়নি। পরিমাণে সমগ্র অর্থনীতিতে সৃষ্টি হয়েছে এক স্থবিরতা, যা পরিবর্তিত সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রয়োজনের সাথে সংগতি রাখতে হয়েছে ব্যর্থ। ফলশ্রুতিতে সোভিয়ে অর্থনীতির সবখাতে বিশেষ করে কৃষি খাতে উৎপাদন গুণগত ও পরিমাণে ব্যাপকভাবে হ্রাস পেয়েছে।
সোভিয়েত যৌথখামার ব্যবস্থা চিত্র সত্যিই করুণ। কর্মক্ষম জনশক্তির একতৃতীয়াংশ কৃষিখাতে নিয়োজিত, তবুও খাদ্যশস্যের ঘাটতি পূরণের জন্যে আমদানি জরুরি হয়ে পড়ে। বিশ্বের সর্ববৃহতৎ খাদ্যশস্য রপ্তানিকারক দেশ সোভিয়েত রাশিয়া এভাবে পরিণত হয়েছে বিশ্বের সর্ববৃহত খাদ্য আমদানিকারক দেশে। কঠোর বলপ্রয়োগ সত্ত্বেও সে দেশের বিপুল কৃষি সম্ভাবনাকে কার্যে পরিণত করা যায়নি। যোসেফ স্টালিন ব্যক্তিগতভাবে উইন্সটন চার্চিলকে বলেছিলেন, ‘যৌথ খামার ব্যবস্থার বিরোধিতার কারণে লক্ষ লক্ষ লোককে নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতে হয়েছে বা শ্রম শিবিরে নির্বাসিত হতে হয়েছে’। এর ফলে এ বাস্তব সত্যই প্রমাণিত হয় যে, শক্তি প্রয়োগ কখনো মানুষের ব্যক্তিস্বার্থ বা উচ্চতর মূল্যবোধ দ্বারা পরিচালিত হবার প্রবণতার বিকল্প হতে পারেনা। সোভিয়েত ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় পরিকল্পনা কমিশন এবং পলিটব্যুরোর সদস্যবৃন্দের সামনে অর্থনীতির নিয়ামক বাজারশক্তি দ্বারা নির্ণীত চাহিদা ও সরবরাহের কোনো ইংগিত রেখার অস্তিত্ব নেই বিধায় স্বাভাবিকভাবেই নিজস্ব স্বার্থ, ঝোঁক ও কমিউনিস্ট মতাদর্শ বুলির বাঁধা পথেই তারা অর্থনীতিকে চালিত করেন। ফলে অর্থনৈতিক ব্যবহারের নিমিত্তে সীমিত সম্পদ বন্টনের ক্ষেত্রে ঘটে অর্থনীতির নিয়ম বিহর্ভূত বিকৃতি। সোভিয়েত ইউনিয়নে তাই দেখা যায় অত্যাবশ্যক ভোগ্যপণ্যের বদলে ভারী ও সামরিক শিল্প বিকাশের অনাবশ্যক আড়ম্বরতা| সোভিয়েত ইউনিয়ন বিপুল অবকাঠামোগত মানবসম্পদের অধিকারী এবং জনগণের জন্যে প্রয়োজনীয় পণ্যসামগ্রী উৎপাদনে সক্ষম হওয়া সত্ত্বেও দেশটি দীর্ঘ সময় ধরে ভোগ্যপণ্যের সংকটে ভুগছে। জনগণের হাতে অর্থ থাকা সত্ত্বেও প্রয়োজনীয় সামগ্রী বাজারে লভ্য নয়। ঘাটতি সংকট এতো তীব্র আকার ধারণ করেছেন যে, সোভিয়েত নেতৃত্বও শঙ্কিত।
সোভিয়েত ব্যবস্থার অদক্ষতার ফলে সৃষ্টি হয়েছে নিম্নগামী প্রবৃদ্ধির হার। সোভিয়েত শাসনের প্রথম দিকে ১৯২৮-১৯৪০ সালে প্রবৃদ্ধির হার ছিলো বেশি উচ্চ, বাৎসরিক ৫.৮%। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কালে ১৯৪০-৫০ সালে তা ২.২%-এ নেমে আসে। যুদ্ধোত্তরকালে প্রবৃদ্দির হার পুনরায় বৃদ্ধি পেয়ে ১৯৫০-৬০ সালে ৫.৭%-এ উপনীত হয়। ফলে সোভিয়েত ব্যবস্থার কার্যকারিতা সম্পর্কে পুনরায় উচ্ছাস ব্যক্ত হতে থাকে এবং এ ব্যবস্থাকে নবযুগের দ্বারোদঘাটক ও উন্নয়নশীল দেশের জন্যে মডেল হিসেবে অভিষিক্ত করার হতে থাকে। কিন্তু এর পরবর্তী সময় হতে আবার সোভিয়েত প্রবৃদ্ধির হার ক্রমাগত হ্রাস পেয়ে ১৯৬০-৭০ সালে ৫.২%, ১৯৭০-৭৫ সালে ৩.৭%, ১৯৭৫-১৯৮০ সালে ২.৬% এবং ১৯৮০-৮৫ সালে ২.০% এ এসে দাঁড়ায়। পেরেস্ত্রয়কার অন্যতম তাত্ত্বিক চিন্তাবিদ ‘আগানবেগিয়ান’ উপস্থাপিত সংশোধিত হিসাব অনুযায়ী দেখা যায় প্রকৃত প্রস্তাবে ১৯৮০ দশকের প্রথমার্ধে প্রবৃদ্দিই ঘটেনি। এর ফলে সোভিয়েত ব্যবস্থার আবেদন বহুলাংশে হ্রাস পায়; বিশেষত যখন জাপান, পশ্চিম জার্মানী দক্ষিণ কোরিয়া তুলনামূলকভাবে কম সম্পদশালী হওয়া সত্ত্বেও উল্লেখযোগ্যভাবে উন্নয়নের স্বাক্ষর রাখে। উন্নত বিশ্বের সাথে সোভিয়েত ইউনিয়নের ব্যবধান ১০ বছরের মধ্যে পূরণের জন্যে স্টালিনের ১৯৩১ সালে বিখ্যাত আহ্বান শূণ্য আস্ফালনে পরিণত হয়। এমনকি ষাট দশকের মধ্যে সে ব্যবধান ঘুচিয়ে দেবার লক্ষ্যে ক্রুশ্চেভের আশাবাদও অবাস্তবায়িত থেকে যায়। প্রবৃদ্ধি হারের ক্রমাগত হ্রাস মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত অর্থনীতির মধ্যে ব্যবধান বাড়িয়েই তোলে। সাম্প্রতিক সময়ে তা আরো বৃদ্ধি পেয়ে চলেছে।
অসম বন্টন ব্যবস্থা
সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রবর্তনের মূল লক্ষ্য ছিলো জনগণের মধ্যে অর্থনৈতিক ন্যায়পরতা প্রতিষ্ঠা করা। কিন্তু সমাজতন্ত্র বাস্তবক্ষেত্রে বৈষম্য সামান্যই দূর করতে পেরেছে। সম্পত্তিহীন শ্রমিকশ্রেণী সম্পত্তি থেকেই বঞ্চিত রয়ে গেল। একজন পুঁজিপতির মালিকানাধীন কারখানার শ্রমিক হওয়ার বদলে সে আরো বেশি ক্ষমতাশালী একচেটিয়া রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন কারখানার শ্রমিকে পরিণত হলো। এ নতুন মালিকের পুরস্কার বা শাস্তি দেবার ক্ষমতা আবার অসীম। এখানে শ্রমিক শ্রেণী পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় তাদের যে অবস্থান ছিলো তা সত্ত্বেও অধিকতরভাবে ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু হতে দূরে রয়ে গেলো। পুঁজিবাদী রাষ্ট্রে শ্রমিক শ্রেণী ইউনিয়ন, মুক্ত প্রচার মাধ্যম এবং নির্বাচনের মাধ্যমে অন্তত কিছুটা প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হতো। উৎপাদন যন্ত্র এবং উৎপাদিত দ্রব্যের উপর শ্রমিক শ্রেণীর নিয়ন্ত্রণের স্বপ্ন এ নতুন ব্যবস্থাতেও বাস্তবের মুখ দেখল না। বস্তুত তাদের প্রকৃত অবস্থার আরো অবণতি ঘটলো।
কার্লমার্কস যে মজুরি দাসত্বের অবসান চেয়েছিলেন তা বরং আরো তীব্রতর হলো। পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় একজন শ্রমিকের অন্তত তার কর্মক্ষেত্র বাছাইয়ের সুযোগ রয়েছে। কিন্তু সোভিয়েত ব্যবস্থায় রাষ্ট্র নামক একমাত্র মালিক থাকায় সে সুযোগেরও কোনো অবকাশ নেই। পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় এক কারখানা ছেড়ে অন্য কারখানায় চলে যাবার যে স্বাধীনতা একজন শ্রমিক ভোগ করত, তা হারিয়ে সে এখন সারাজীবন একটি কারখানার শিকলে বাঁধা পড়ে গেলো। এখন সব কিছু নির্ভর করে তার উপরস্থ কর্মকর্তার উপর। কর্মকর্তা বদান্য হলে কারো অবস্থার উন্নতি ঘটতে পারে। কিন্তু সাধারণভাবে একজন শ্রমিক দক্ষতার সাথে অধিক পরিশ্রম করলেও সে জন্যে তার কোনো অতিরিক্ত পারিশ্রমিক পাবার কোনো সুযোগ এ ব্যবস্থায় নেই। অপরদিকে উর্ধতন কর্মকর্তা প্রতিহিংসাপরায়ণ চরিত্রের হলে কর্মচারীকে নীরবে নির্যাতন সয়ে যেতে হবে। অভিযোগ করারজন্যে তার সামনে কোনো দুয়ার খোলা নেই। যদি সে তার অধিকারের জন্যে লড়াই করতে চায়, তবে তা স্থান হবে বাধ্যতামূলক শ্রমশিবিরে। রাষ্ট্রীয় সমাজতন্ত্র তাই পুঁজিবাদী সমাজ থেকেও অধিকতর নিপীড়নমূলক হয়ে দাঁড়াল। শুধু এই কারণটিই কি মজুরি শ্রমিকের ভগ্ন বিচুর্ণ মানব সত্তায় পরিণত হওয়ার (এলিনেশন প্রক্রিয়া) জন্যে যথেষ্ট নয়? সোস্যাল ডেমোক্রেট ‘ক্রসল্যাণ্ড’ যথার্থই মন্তব্য করেছেন, ‘উৎপাদন উপকরণ হতে শ্রমিক শ্রেণীর বিছিন্নকরণের (এলিনেশন) অন্তর্নিহিত কারণ সমাজতান্ত্রিক সমাজেও বিদ্যমান। কারণ নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র শ্রমিক শ্রেণী হতে বহু দূরে। শোষণের সম্ভাবনা এবং পুঁজিবাদের সমস্ত লক্ষণ ও বৈশিষ্ট্যসমূহ এখানেও পূর্ণমাত্রায় বিদ্যমান।
সামাজিক বৈষম্য ও শ্রেণী পার্থক্যের ধারা এখানেও অপ্রতিহতভাবে চলতে থাকে। ‘মুরে ইয়ানোভিচ’ মন্তব্য করেছেন, ‘সোভিয়েত সমাজের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এর শ্রেণী ব্যবস্থা। সমাজের উপর স্তরের লোকেরাই ধনতান্ত্রিক সমাজের মতো উচ্চ আয়ের পদমর্যাদাসম্পন্ন চাকরিসমূহ পেয়ে থাকে। উল্লেখযোগ্য সংখ্যক সমাজতান্ত্রিক গবেষণায় দেখা গেছে শ্রমিকদের সন্তানদের জীবনের উচ্চাকাংখা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সৌভাগ্যের মুখ দেখার সুযোগ পায়নি। ‘শ্রমিক রাজত্বের’ বাগাড়ম্বর দ্বারা এ তিক্ত সত্যকে ঢেকে রাখার প্রচেষ্টা নেয়া হয়েছে। এককালের বিখ্যাত প্রবচন যে “রাষ্ট্রীয় মালিকানা শ্রেণীহীন সমাজ” প্রতিষ্ঠা করবে ভ্রান্তিতে পর্যবসিত হয়েছে। রাষ্ট্র শিল্পসমূহ অধিগ্রহণ করলে আর কোনো শ্রেণীবিশেষই রাষ্ট্রযন্ত্রকে নিয়ন্ত্রণ করবে না -এরূপ ধারণা করার কোনো যুক্তিসংগত কারণ নেই। এককেন্দ্রীক ব্যবস্থা যা মানব ভ্রাতৃত্বের মতবাদ বা স্রষ্টার সম্মুখে জবাবদিহিতার ধারণার উপর নয়, বরং দ্বান্দ্বিক মতবাদ এবং একশ্রেণী কর্তৃক অন্যশ্রেণীকে উৎখাত বা অধীনস্থ করার দর্শনের উপর ভিত্তিশীল তা হতে শ্রেণীব্যবস্থা আরো বেশি তীব্রতর হতে বাধ্য।
সোভিয়েত ইউনিয়নে ভোগ্যপূণ্য উৎপাদনকে অগ্রাধিকার প্রদান না কার ফলে জনগণের বিচ্ছিন্নকরণ (এলিনেশন) প্রক্রিয়া আরো জোরদার হয়েছে। খাদ্য, বাসস্থান ও জীবনের অন্যান্য অত্যাবশ্যকক সামগ্রীর সরবরাহ রয়ে গেছ। অপ্রতুল। নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের জন্যে শ্রমিকদের দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। বিপরীত পক্ষে প্রভাবশালী ও শক্তিধর ব্যক্তিবর্গের নিকট সব কিছুই সহজলভ্য। তারা শুধু বিনামূল্যে প্রসাদোপম বাড়ি ও গাড়িই নয়, গোপনভাবে প্রদত্ত অতিরিক্ত বেতন, হ্রাসকৃত মূল্যের দোকানো বিশেষ সুবিধাও ভোগ করে। এমনকি শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিদের বিনামূল্যে দ্রব্যসামগ্রী পাবার জন্যে রয়েছে বিশেষ দোকান। এ ব্যবস্থা সমাজে মানুষের শ্রেনী বিভক্তির সুস্পষ্ট দলিল। সেখানে অভিজাত শ্রেনীর জন্যে সকল প্রকার বিলাস সামগ্রীর সুযোগ রয়েছে, অতচ সাধারণ মানুষ নিত্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী হতেও বঞ্চিত। শ্রমিকদের মনোবল ও শৃঙ্খলাবোধের উপর স্বাভাবিকভাবে এ অবস্থা প্রবল প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। অবশ্য বিখ্যাত ‘নাভোসিবিরিস’ রিপোর্টে খ্যাতিমান অর্থনীতিকিদগণ অলস, দুর্নীতিপ্রবণ ও শৃঙ্খলাবোধহীন শ্রমিক সমাজ গড়ে ওঠার পিছনে অর্থনীতির অতিরিক্ত কেন্দ্রীকরণকে দায়ী করেন। তারা কারণ হিসেবে বিরাজমান শ্রেণী বৈষম্য, সামাজিক অন্যায়পরতা ও নৈতিক স্খলনজনিত পরিবেশের প্রতিক্রিয়া দেখতে বস্তুত ব্যর্থ হন। শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের ক্ষেত্রেও শ্রমিক শ্রেণীর সন্তানগণ উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ভর্তির সুযোগের বেলায় সমাজের উপর স্তরের প্রভাব ও বিত্তশালী ব্যক্তিদের সন্তানদের তুলনায় কম সুযোগ লাভ করে। সর্বস্তরের শিক্ষাব্যবস্থা অবৈতনিক হওয়া সত্ত্বেও সোভিয়ে শিক্ষাব্যবস্থায় পুরুষানুক্রমে সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্য টিকিয়ে রাখার প্রবণতা সুস্পষ্ট। এক্ষেত্রে সুযোগ লাভের শর্ত হয়ে দাঁড়ায় সামাজি সিড়িতে শিক্ষার্থীর শ্রেণীগত অবস্থান। ‘ইয়ানোভিচ’ লক্ষ্য করেছেন, যে শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ যত বেশি ভবিষ্যত লাভজনক পেশা সাথে সংযুক্ত তাতে শ্রমজীবী মানুষের সন্তানদের প্রবেশের সুযোগ তত কম এবং “সাদা কলারধারী পেশাজীবীদের সন্তানেরাই সেখানে সিংহভাব দখল করে আছে”।
অন্যান্য দিক থেকেও সোভিয়েত ব্যবস্থা অন্যায়পরতাপূর্ণ। কৃষক শ্রেণী শুধুমাত্র তাদের কৃষি জমিই হারায়নি, তারা তাদের উৎপাদিত ফসলের জন্যও যথাযথ মুল্য পায়না যা সরকার কৃর্তৃক হ্রাসকৃত ও পূর্বনির্ধারিত। সমগ্র সমাজতান্ত্রিক বিশ্বের মধ্যে সোভিয়েত ইউনিয়নেই আয় প্রয়োজনের তুলনায় নূন্যতম। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ফ্রান্সের তুলনায় সোভিয়েত ইউনিয়নে আয়ের বৈষম্য কম হতে পারে, কিন্তু তা অবশ্যই যুক্তরাজ্য ও নরওয়ের তুলনায় কম নয়। সমাজতন্ত্রী চিন্তাবিদ ‘সুইজি’র দৃষ্টিতে সোভিয়েত সমাজ আয় ও সুযোগের ক্ষেত্রে তীব্রভাবে বৈষম্যমূলক। এ কারণেই শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমেও কৃষক ও শ্রমিকদের তাদের পূর্ণশক্তিতে কাজ করার জন্যে উদ্বুদ্ধকরণে সফল হওয়া যায়নি। এভাবে এ ব্যবস্থা শুধুমাত্র ব্যক্তিগত সম্পত্তিই হরণ করেনি, এটা শ্রম ও প্রয়োজনের তুলনায় কম মজুরি প্রদান করে সর্বহারা উৎপাদক শ্রেণীর প্রতি বিরাট অবিচার সাধন করেছে। ‘সর্বহারার একনায়কত্ব’ এভাবে সর্বহারা শ্রেণীর দমনযন্ত্রে পরিণত হয়। তাই ‘সুইজি’ এ মর্মে মন্তব্য করতে বাধ্য হন যে, ‘মার্কসীয় মতাদর্শের দাবি পূরণে সোভিয়েত ইউনিয়ন পরিপূর্ণভাবে ব্যর্থ হয়েছে।
মিথ্যা স্বপ্ন
শ্রেণীহীন, বৈষম্যহীন, ভ্রাতৃত্বমূরক যে সমাজের স্বপ্ন কালমার্ক দেখেছিলেন, তা এভাবে ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। শ্রমিক শ্রেণী মজুরি দাসত্বের নিগড়ে বাঁধা পড়ে যায়। সামাজিক শ্রেণীবিভেদও অব্যাহত গতিতে চলতে থাকে। ‘সর্বহারার একনায়কতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠা লাভ করল না। রাষ্ট্রের অস্তিত্ব বিলুপ্তির মার্কসীয় ধারণার কোনো লক্ষণও কোথাও দৃষ্টিগোচর হলোনা, বরং রাষ্ট্র তার নিপীড়নমূলক অস্ত্র নিয়ে আরো জেঁকে বসল।
এ ব্যর্থতার কারণ সুস্পষ্ট। লক্ষ্যের সাথে দর্শন ও কৌশলের কোনো মিল ছিলনা। লক্ষ্য ছিলো ‘মানবতাবাদের প্রতিষ্ঠা’ একটি শ্রেণীহীন সমাজ, যেখানে কেউ কাউকে শোষণ করবে না, যেখানে সবাই সামষ্টিক কল্যাণের জন্যে কাজ করবে এবং সবার প্রয়োজন পূর্ণ হবে, যেখানে আয় ও সম্পদের কোনো বৈষম্য থাকবে না, ফলে এলিনেশন বা বিচ্ছিন্নকরণেরও কোনো প্রক্রিয়া থাকবেনা। কিন্তু এ উদ্দেশ্য সাধনের জন্যে ব্যবহৃত দর্শন ও কৌশল এ উদ্দেশ্যের সাথে সংগতিপূর্ণ ছিলনা। এ দর্শন দ্বান্দ্বিক মতবাদের প্রবক্তা, যাতে ঘৃণা, শ্রেণী সংঘাত ও উৎখাতের কথা বলা হয়েছে, ব্যক্ত হয়েছে সমগ্র উৎপাদন উপকরণের নিয়ন্ত্রণ কতিপয় ব্যক্তির হাতে সমর্পনের মতবাদ। গুটিকয়েক ব্যক্তিবর্গের হাতে বিশাল নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা অর্পন, অথচ তাদের ব্যক্তিস্বার্থ ও শ্রেণীস্বার্থকে নিয়ন্ত্রণ করার কোনো নৈতিক বা আধ্যাত্মিক প্রেরণা বা ব্যবস্থার অস্তিত্ব নেই। সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়া নির্ধারণকারী সামাজিকভাবে সম্মত কোনো নীতিমালা নেই -এমন ব্যবস্থা ক্ষমতা ও সুবিধাভোগী শ্রেণীর স্বার্থে তাদের অবস্থান অক্ষুন্ন রাখার লড়াইয়ে রূপান্তরিত হতে বাধ্য। এরূপ ব্যবস্থায় কোনোরূপ গণতন্ত্রায়নের প্রচেষ্টা সফল হতে পারেনা, কেননা শক্তিধর আমলাতন্ত্র তাদের সুবিধাভোগী অবস্থান অক্ষুন্ন রাখার স্বার্থে একে স্বভাবতই বাধা দেবে। ক্ষমতার ভাগবাটোয়ারাদার, তাদের তল্পীবাহক ও চাটুকাররাই শুধুমাত্র এ ধরণের একনায়তান্ত্রিক ব্যবস্থায় সুযোগ সুবিধার প্রত্যাশা করতে পারে।
তাই প্রথম থেকেই এ ব্যবস্থা সঠিক পন্থায় অগ্রসর হতে পারেনি। ত্রিশ দশকের মাঝামাঝি সময়ে লিও ট্রটস্কি সোভিয়েত ব্যবস্থাকে সমালোচনা করে বলেছিলেন, ‘প্রকৃত সমাজতন্ত্র শুধুমাত্র উৎপাদন উপকরণের মাধ্যমে আপনাআপনি অর্জন করা সম্ভব নয়; এর জন্যে প্রয়োজন অধিকতর গণতন্ত্র ও স্বাধীনতার বিকাশ, চর্চা ও অধিকতর ন্যায়পরতা সৃষ্টির উদ্যোগ’। ট্রটস্কির গণতন্ত্র চর্চার এ আকাঙ্খা সোভিয়েত ব্যবস্থায় বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি; কেননা পলিটব্যুরোর মুষ্টিমেয় সদস্যই এখানে সকল মানুষের জীবিকার হর্তাকর্তা এবং শ্রমিক শ্রেণীকে ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু হতে দূরে রাখার মাঝেই তাদের স্বার্থ নিহিত। সম্পদশালী বুর্জোয়া হতে ক্ষমতাশালী পলিটব্যুরোর সদস্যদের ভিন্নতর আচরণ করার কোনো কারণ নেই। নিজের স্বার্থসিদ্ধি লাভ করার স্বভাবজাত মানব প্রবণতাকে সীমারেখা মেনে চলতে বাধ্য করার কোনো কার্যকর পন্থা না থাকলে মার্কসের ‘প্রত্যেকে সাধ্যমতো কাজ করবে, প্রয়োজন অনুযায়ী ভোগ করবে’ -এই নীতির উপর ভিত্তিশীল সমাজের স্বপ্ন বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। বিনিময় মূল্য প্রাপ্তির আশা ছাড়া মানুষ সর্বশক্তি নিয়োগ করে না। তারা সর্বোচ্চ কাজের বিনিময়ে সর্বোচচ্চ প্রাপ্তিই আশা করবে। তাই এমন কোনো পন্থা থাকা দরকার, যাতে তারা সর্বোচ্চ কাজ করতেও অনুপ্রাণিত হবে; আবার বিনিময়ে তাদের প্রাপ্ত দাবিও সামাজিকভাবে গ্রহণযোগ্য সীমার মধ্যে থাকবে। কিন্তু বল প্রয়োগ ছাড়া মানুষের স্বার্থচিন্তাকে নিয়ন্ত্রণ করার আর কোনো পন্থা মার্কস দেখাতে পারেননি। তাই পুঁজিবাদের শক্তিশালী সমালোচনা উপস্থাপন করা সত্ত্বে মার্কস কোনো গঠনমূলক ও কার্যকর বিকল্প ব্যবস্থা পেশ করতে পারেননি। তা মানুষের স্বার্থপরতাকে সীমারেখা লঙ্ঘন করতে না দিয়ে একটি আদর্শ সমাজব্যবস্থা গঠন করার জন্যে প্রয়োজন শ্রেণী সংঘাতের বদলে প্রত্যেক মানবসত্তাকে ভ্রাতৃভাবে দেখা ও একটি সর্বসম্মত মূল্যবোধের শক্ত কাঠামোর মধ্যে থেকে সবাই সামষ্টিক কল্যাণের জন্যে কাজ করবে এমন চিন্তাধারায় সৃষ্ট একটি মতাদর্শ। পরবর্তী আলোচনায় দেখা যাবে, একমাত্র ধর্মই এ ধরনের চিন্তাধারা ভিত্তিক দর্শন ও ব্যবস্থাপনা প্রদান করতে পারে। কিন্তু মার্কস সকল ধর্ম ও ধর্মীয় মূল্যবোধকে প্রত্যাখ্যানো আহবান জানিয়েছিলেন। মানবিক মূল্যবোধে সমৃদ্ধশালি ঐতিহ্য ধ্বংসের পর যা মার্কস উপস্থাপন করেছিলেন তা হলো সমস্ত উৎপাদন উপকরণের উপর কর্তৃত্বশীর একটি একনায়কতান্ত্রিক রাষ্ট্র, যেখানে নীতিনির্ধারণের জন্যে কোনো সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা নেই, ব্যক্তিস্বার্থের লেলিহান শিখাকে নিয়ন্ত্রণের কোনো উপায় নেই। শুধু রয়েছে এক নিষ্ঠুর, ক্ষমাহীন প্রচণ্ড শক্তি। এমনকি একটি একনায়কতান্ত্রিক রাষ্ট্র আবার ইতিহাসের এক পর্যায়ে এসে আপনাআপনি বিলুপ্ত হয়ে যাবে বলে মার্কস বিশ্বাস করতেন। কিন্তু কিভাবে এ বিলুপ্তি ঘটবে মার্কস তা ব্যাখ্যা করেননি। যদি বুর্জোয়াগণ স্বেচ্ছায় ক্ষমতা ত্যাগে প্রস্তুত না হয়, তবে কিভাবে ধারণা করা যেতে পারে যে, প্রলেতারিয়েত পলিটব্যুরোর সদস্য হবার মাধ্যমে ক্ষমতা লাভের পর সে ক্ষমতা ত্যাগ করবে? বাস্তব সত্য হলো কমিউনিস্ট দেশসমূহে রাষ্ট্র বিলুপ্ত না হয়ে বরং উৎপীড়নের আরো শক্তিশালী যন্ত্রে পরিণত হয়েছে। ‘প্রকৃতির সাথে সংগতিপূর্ণ সমাজব্যস্থা’ আর বাস্তবতা লাভ করেনি। প্রলেতারীয় শ্রেণী সেই মজুর দাসই রয়ে গেল। মার্কসীয় বিপ্লব দ্বারা তারা কি পেলো? তাদের আয়ের বৃদ্ধি কিন্তু তারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, পশ্চিম জার্মানীর মতো দেশে সোভিয়েত রাশিয়া, পূর্ব ইউরোপ ও চীনের চেয়ে বেশি পাচ্ছে, যদিও তা বুর্জোয়া শ্রেণীর আয়ের মতো নয়। ফলত পুঁজিবাদের অবশ্যম্ভাবী পতন সম্পর্কিত মার্কসের ভবিষ্যদ্বানী ভুল বলে প্রমাণিত হয়েছে। সোভিয়েত নিরীক্ষা হতে লদ্ধ প্রায় সকল অভিজ্ঞতাই নেতিবাচক -যেমন, মজুরি প্রথাহীন রাষ্ট্রের কর্তৃত্ব মুক্তসমাজ, মুদ্রা ও শ্রেণী বৈষম্যহীন ব্যবস্থা সবই মরীচিকায় পরিণত হয়েছে। সর্বস্তরে গণতন্ত্রের অস্তিত্বহীনতা, সমালোচনা, নিষ্ঠুর দমন -এসবের দিকে তাকালে হতাশা আরো তীব্রতর হয়।
পুনর্গঠনের জটিলতা
‘নিয়ন্ত্রিত অর্থনীতিতে এলোমেলোভাবে বাজার অর্থনীতির কিছু দিক সংযোজনের চেষ্টা টেলিফোনের খুঁটিতে আঙ্গুর গাছের কলম লাগানোর প্রচেষ্টার মতোই ব্যর্থ হয়েছে’।
-জর্জ আর্বাতভ।
অবাস্তব চিন্তাধারার কারণে মার্কসবাদ যা যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে সমাজতন্ত্রীদের উপর ব্যাপক বুদ্ধিবৃত্তিক প্রভাব বিস্তার করেছিল, ক্রমান্বয়ে তা ক্রমবর্ধমান হারে আক্রমণের সম্মুখীন হলো। সংশোধনবাদ জনপ্রিয় হয়ে উঠল এবং মার্কবাদকে প্রায় ধ্বসিয়ে দিলো। সোভিয়েত অর্থনীতিবিদদের মধ্যে ক্রমবর্ধমানভাবে এ উপলব্ধি সৃষ্টি হলো যে, সোভিয়েত অর্থনীতির ব্যাপক সংস্কার অত্যাবশ্যক। সোভিয়েত নেতৃত্ব রাজনৈতিক সংস্কারের অপরিহার্যতার উপর জোর দিতে লাগলেন, যা মিখাইল গর্বাচেভ প্রবর্তিত ‘গ্লাসনস্ত’ ও ‘পেরেস্ত্রয়কা’ ধারণার মধ্য দিয়ে প্রতিফলিত হলো। কিন্তু সমস্যা হলো, এখনো এটা কারো কাছে সুস্পষ্ট নয় যে, সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোতে তাদের বিঘোষিত অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাবার জন্যে কতটুকু সংস্কার ও পুনর্গঠনের প্রয়োজন। যুক্তি প্রদর্শন করা হয় যে, ব্যক্তিগত সম্পত্তির পুনঃপ্রতিষ্ঠা, বিকেন্দ্রীকরণ ও পেরেস্ত্রয়কার প্রেক্ষিতে সুস্পষ্টিকরণ প্রয়োজন। তা হচ্ছে বিকেন্দ্রীকরণ, প্রতিযোগিতা, মূল্য সংস্কার, বিরাষ্ট্রীয়করণ এবং সম্পত্তি অধিকারের ক্ষেত্রে সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি নিজস্ব পরিচিত সম্পূর্ণ না হারিয়ে কতটুকু ছাড় দিতে প্রস্তুত। খণ্ড খণ্ড পরিবর্তন ও সুচিন্তিত ভিতহীন সংস্কার প্রচেষ্টা যেমন অকার্যকর হবে, তেমনি পুঁজিবাদের দিকে ত্বরিৎ যাত্রা প্রয়োজনীয় অবস্থার অনুকূল পরিবেশের অভাবে বর্তমান আর্থ-সামাজিক বৈষম্যকে আরো অবনতিশীল করে তুলবে মাত্র এবং সমাজতন্ত্রের মূল উদ্দেশ্যের কফিনে শেষ পেরেক পুতে দেবে। প্রশ্ন হলো, সমাজতন্ত্রেও গায়ে ইতোমধ্যে ব্যর্থ পুঁজিবাদের কিছু উপাদান লেপনের মাধ্যমে সেই কাংখিত বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনা কী সম্ভব, যা বিদ্যমান অর্থনৈতিক সমস্যা ও সামাজিক অস্থিতিশীলতাকে অতিক্রম করে সমাজতন্ত্রের বিঘোষিত লক্ষ্যে পৌছাতে সাহায্য করবে? দুর্ভাগ্যক্রমে সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির পুনর্গঠনের বিতর্কে পুঁজিবাদী ও সমাজতান্ত্রিক উভয় বিশ্বের বুদ্ধিজীবী মহল একটি মৌলিক বিষয়কে ভুলে যাচ্ছেন এবং তা হচ্ছে এ পুনর্গঠনের জন্যে মূলত সমাজতান্ত্রিক বিশ্ব দৃষ্টিভংগির নিজস্ব আদলেরই পরিবর্তন প্রয়োজন। আর্থ-সামাজিক পুনর্গঠন ও এর পেছনে প্রয়োজনীয় প্রেরণার ক্ষেত্রে নৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির যে ভূমিকা রয়েছে, উপযুক্ত বিতর্কে তাকে সামান্যতম স্থানও প্রদান করা হয়নি, যেন এটা কোনো গুরুত্বই বহন করেনা।
এটা উপলব্ধি করা হয়নি যে, সমাজতান্ত্রিক দেশে ভোগ্য পণ্য ঘাটতির জন্যে কেন্দ্রীয়ভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং ব্যক্তিগত সম্পত্তি ও বাজার মূল্যের অস্তিত্বহীনতাই যদি শুধুমাত্র দায়ী হয়, তবে পুঁজিবাদী দেশসমূহে ভোগ্য পণ্যের লক্ষ্য পূরণে সফল হবার কথা ছিলো। কিন্তু এ প্রয়োজন পূরণ কখনোই সম্ভব নয়, যতক্ষণ না এ খাতে প্রয়োজনীয় বিপুল সম্পদ বরাদ্দ করা হয়। ভোগ্য পণ্য খাতে প্রয়োজনীয় বাড়তি সম্পদের স্থানান্তর মানেই অন্য খাতসমূহ যথা প্রতিরক্ষা, মহাকাশ কর্মসূচি, ভারী শিল্প, মর্যাদাবৃদ্ধির খাত, এলিট শ্রেণীর জন্যে বিলাস সামগ্রী উৎপান এবং অন্যান্য বহু অর্থনৈতিক খাতসহ যেসব ভৌগোলিক এলাকা সম্পদ বন্টনের ক্ষেত্রে বেশি সুবিধা ভোগ করে আসছে তাতে কম বরাদ্দ, সম্পদের এরূপ পুনর্বিন্যাস সহজ কাজ নয়। এর জন্যে শুধু সামাজিকভাবে সম্মত মানদণ্ডই যথেষ্ট নয়, প্রয়োজন সুবিধাভোগী শ্রেণী ও এলাকার পক্ষ হতে ত্যাগ স্বীকারের শক্তিশালী প্রেরণা ও ইচ্ছা। ‘জীবন মাত্র একটিই -এ বিশ্বাসে বিশ্বাসী উপযুক্ত ভোগবাদীরা কেন এটা করতে যাবে? যদি উল্লিখিত অপ্রয়োজনীয় ব্যয় হ্রাস করা না হয়, তবে বাড়তি সম্পদ কোথা থেকে আসবে? মুদ্রার সরবরাহ বৃদ্ধি? এটা সৃষ্টি করবে সীমিত সম্পদের উপর বাড়তি চাহিদা এবং সামাজিক অর্থনৈতিক ন্যায়পরতা, যার মুখোমোখি দাঁড়িয়ে আছে বর্তমানে পুঁজিবাদী ও কল্যাণমূলক রাষ্ট্র সমূহ। ক্ষতিকর রাজস্ব ঘাটতি হ্রাসের প্রয়োজনীয়তা মনে রাখলে এ সমস্যার ব্যাপ্তি হৃদয়ঙ্গম করা আরো সহজ হবে। সোভিয়েত ইউনিয়নের রাজস্ব ঘাটতির পরিমাণ ছিলো ১৯৮০-৮৫ সালে ৩% এর কম। তা বৃদ্ধি পেয়ে ১৯৮৭ সালে হয়েছে প্রায় ৭% এবং ১৯৮৮ সালে ১৪%। ভোগ্যপণ্য উৎপাদন, কর্মসংস্থান ও প্রবৃদ্ধিকে ব্যাহত না করে এটা কী করে কমানো যাবে। এ জটিল প্রশ্নের উত্তর পাওয়া সম্ভব হয়নি। সরকারি ঋণের মাধ্যমে যদি এ সমস্যার সমাধানের চেষ্টা করা হয়, তবে আগামি কয়েক বছরের মধ্যে সোভিয়েত ইউনিয়ন ঋণগ্রস্ত উন্নয়নশীল দেশসমূহের মতো ঋণের সুদ পরিশোধের তীব্র সমস্যায় নিপতিত হবে। সোভিয়েত ইউনিয়নের সামনে রয়েছে তাই অর্থনীতি পুনর্গঠনের পর্বত প্রমাণ কঠিন কাজ এবং তা তাকে করতে হবে ক্রমবর্ধমান ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য বিকাশের যুগে অন্ধ ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থতার মুখে লাগাম পরানোর কোনো হাতিয়ারের যোগন ছাড়াই সবার চাহিদা পূরণের মাধ্যমে; বেকারত্ব না বাড়িয়ে বাজেট ঘাটতি হ্রাসের মাধ্যমে; মূল্যবৃদ্ধির প্লেগ আক্রান্ত অর্থনীতিতে বাস্তবসম্মত মূল্য কাঠামো বাস্তবায়নের মাধ্যমে। বাস্তবভিত্তিক পণ্য মূল্য ও বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময় হার প্রবর্তন এবং জন বাজেট ঘাটতি হ্রাসের জন্যে ভর্তুকি কমানো মানেই পৃষ্ঠপোষকতার বর্তমান ব্যবস্থার অবসান, যেখানে উৎপাদন ও আমদানি ব্যয়ের সাথে খুচরা মূল্যের কোনো সম্পর্ক নেই, যেথায় অন্তত তাত্ত্বিকভাবে সস্তা খাদ্য, বস্ত্র, ও বাসস্থানের ব্যবস্থা আছে এবং কর্মসংস্থান নিশ্চিত বলে ধরে নেয়া হয়। বাস্তবভিত্তিক মূল্য প্রবর্তনের ফলে অবশ্যম্ভাবীরূপে দেখা দেবে মুদ্রাস্ফীতির প্রতিক্রিয়া। যদি মজুরি ও পেনশন যুগপৎ বৃদ্ধি করা না হয়, তাহলে সর্বসাধারণ বিশেষতদরিদ্র শ্রেণীর জীবনযাত্রার মান তীব্রভাবে হ্রাস পাবে। ফলে গ্লাসনস্ত বা খোলামেলা সমালোচনার পরিবেশের প্রেক্ষিতে সামাজিকও রাজনৈতিক অীস্থতিশীলতা দেখা দেবে। আবার মূল্যবৃদ্ধির সাথে মজুরি বৃদ্ধি পেরেস্ত্রয়কা বা সংস্কার প্রচেষ্টার উদ্দেশ্য ব্যর্থ করে দেবে। পেরেস্ত্রয়কা দাবি করে যে, মজুরি বৃদ্ধি ঘটবেনা বা সে বৃদ্ধি আনুপাতিক হারে হবেনা। মজুরি নির্ধারণ করা হলোমূল্য ও মজুরি পরিবর্তন দ্বারা কিছু শ্রমিক অন্যদের চেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ফলে প্রকৃত আয়ের ব্যবধান বৃদ্ধি পেয়ে অধিকতর আয় ও সম্পদ বৈষম্যের সৃষ্টি হবে এবং গণচীনের মতো সামাজিক অস্থিতিশীলতার সৃষ্টি হতে পারে। বাজার অর্থনীতিতে এ ধরণের পরিবর্তন অল্প মাত্রায় প্রতি বছরই সংঘটিত হয়। কিন্তু তা দৃষ্টিগ্রাহ্যভাবে নজরে পড়েনা, যেরূপ জাজ্বল্যমানভাবে দৃষ্টিগোচর হবে সমাজতান্ত্রিক দেশে, যেখানে উপর্যুপরি দশরে ভ্রান্তি কয়েক বছরে অপনোদনের চেষ্টা নেয়া হবে। ফলে পৃথিবীর যে কোনো অর্থনীতির চেয়ে বিরাষ্ট্রীয়করণকৃত সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতিতে নৈতিক পুনর্জাগরণ ও আর্থ-সামাজিক সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা অনেক বেশি। অধিকন্তু অধিক দক্ষতার আশা কখনো বাস্তবায়িত হবেনা, যদি প্রতিষ্ঠানসমূহের উৎপাদন উপকরণের মান, পরিমাণ ও উৎস নির্ধারণ এবং কর্মচারীদের কর্মসম্পাদনের ভিত্তিতে নিয়োগ ও বরখাস্তের স্বাধীনতা না থাকে। নিশ্চিত বাজারের যে সুবিধা বর্তমানে প্রতিষ্ঠানসমূহ ভোগ করছে, সে সুবিধা সম্ভবত প্রত্যাহার করতে হবে। ফলে অনেক প্রতিষ্ঠান লোকসানের মুখোমুখি হবে। দক্ষতা অর্জনের জন্যে তাদেরকে শ্রমিক ছাঁটাই করতে হবে, যার ফলে দেখা দেবে বেকারত্ব। যেহেতু রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো বিশালাকারের, লোকসানকারী এমনসব প্রতিষ্ঠান বন্ধ করার ফলে সৃষ্ট সমস্যা বিশেষত বেকারত্বের পরিমাণ হবে বিশালাকৃতির। বাজারব্যবস্থার দিকে দ্রুত নিয়ে যাওয়ার ফলে সৃষ্ট সমস্যাবলী সামাল দেবার জন্যে সোভিয়েত ব্যবস্থা উপযুক্ত নয়। যে পর্যন্ত সোভিয়েত বাজারব্যবস্থার পৃষ্ঠপোষকতার ধারা ও আচরণ অব্যাবহত থাকবে, ততদিন বাজারব্যবস্থার আংশিক পুনরুজ্জীবন স্ববিরোধী বিষয়ে পরিণত হবে। পরিণত হবে। অধিকতর দক্ষতা অর্জনের জন্যে যদি যৌথ মালিকানা, কেন্দ্রীয় পরিকল্পনাসহ সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার নিজস্ব বৈশিষ্ট্য ও লক্ষ্যসমূহ পরিত্যাগ করা হয়, তবে সমাজতন্ত্রের আলাদা ব্যবস্থা হিসেবে চিহ্নিত হবার আর কী-ই বা অবশিষ্ট থাকে? বিরাষ্ট্রীয়করণের প্রশ্নটিও সমস্যাসংকুল। যেহেতু জাতীয়করণকৃত সকল সম্পদের মালিকানা সমগ্র জনগণের, তাই বিরাষ্ট্রীয়করণের মাধ্যমে কারো কাছে সম্পত্তির অধিকার হস্তান্তর প্রক্রিয়াও ইনসাফভিত্তিক হওয়া দরকার। এর জন্যে এ পর্যন্ত কোনো সুস্পষ্ট ও স্বচ্ছ নীতিমালা প্রণীত হয়েছে বলে মনে হয়না।
রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন খামার ও শিল্প প্রতিষ্ঠানসমূহে শেয়ারভিত্তিক ব্যবস্থার মাধ্যমে হস্তান্তরের একটি ধারণা গড়ে উঠেছে। কিন্তু এরূপ নিলাম সংঘটিত হবার পূর্বে সঠিক মূল্যায়নের ভিত্তিতে প্রকৃত মূল্য নির্ধারিত হওয়া প্রয়োজন, যা আবার বাজারব্যবস্থা কর্তৃক মূল্য ও লাভের পরিমাণ নির্ণীত হবার সুযোগ না থাকায় একটি সময়সাপেক্ষ ও কঠিন কর্ম। এরূপ মূল্যায়ন ব্যতিরেকে যাদের ভিতরের বিষয়ে জ্ঞান নেই তাদের বিশাল ঝুঁকি নিতে হবে। উপরন্তু এ নিলাম ব্যবস্থার নেতিবাচক দিক হচ্ছে সমাজতান্ত্রিক যুগে যারা সম্পত্তি পুঞ্জীভূত করতে পেরেছিল, শুধু তারাই এসব শেয়ার কিনতে সক্ষম হবে। ফলে যারা মালিকানাস্বত্ব ব্যতিরেকেই এতোদিন সুবিধাভোগী ছিলো, তারা এখন মালিকানাস্বত্ব লাভের মাধ্যমে আরো এক ধাপ এগিয়ে যাবে। তাহলে যাদের নামে সমাজতন্ত্র আনা হয়েছিল এবং যাদের নামে আবার তা ভাঙ্গা হচ্ছে, সেই প্রলেতারীয় শ্রেণী এখন কোথায় যাবে? যাই হোক, সম্পদের মালিকানা যদি জনগণের মধ্যে ন্যায়পরতার সাথে বন্টন করতে হয়, তাহলে জটিল প্রশ্নটি থেকে যায় যে, কীভাবে এটা সম্পাদন করা হবে, কে কিসের মালিকানা লাভ করবে এবং কতটুকু পরিমাণ? যদি শ্রমিকদের তারা যে খামার বা কারখানায় কাজ করছে তার অংশীদারিত্ব প্রদান করা হয়, তাহলে যারা কাজ করছেনা বা কম উৎপাদনশীল খামারে কাজ করছে অথবা এমন কারখানায় কাজ করছে যা দেউলিয়া ঘোষিত হয়েছে বা শিগগিরই ঘোষিত হবে, তাদের বেলায় কী হবে? যদি সবাইকে ক্রয়ের জন্যে কুপণ দেয়া হয়, তাহেল ব্যক্তি মালিকানায় হস্তান্তর প্রক্রিয়া আরম্ভ করার জন্যে অপেক্ষা করতে হবে। এই পদ্ধতি সময়সাপেক্ষ যা বর্তমান প্রেক্ষিতে বাস্তবায়নযোগ্য নয়। অধিকন্তু যারা অতীতে সম্পদ কুক্ষিগত করতে পেরেছে, তারা ক্রয়ের জন্যে প্রাপ্ত কুপনের সুবাদে অধিকতর সুবিধাজনক অবস্থানে চলে আসবে। ডারউইনীয় বাছাই পদ্ধতিও সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। গত কয়েকদশকে সোভিয়েত নেতৃত্বের কাঠামো দর্পভরে টিকে থাকার তত্ত্বের ভিত্তিতেই তা নির্ধারিত হয়েছে এবং বর্তমান ব্যবস্থার স্বপক্ষে একটি কায়েমী স্বার্থ তৈরি হয়েই আছে। নৈতিক পুনর্জাগরণ ব্যতিরেকে শুধুমাত্র পেরস্ত্রয়কা নীতির দ্বারা এ অবস্থার পরিবর্তন সম্ভব নয়। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান সমূহের কর্মকর্তাগণ বাজারনীতির বাস্তবতা মেনে নিতে মনস্তাত্ত্বিকভাবে প্রস্তুত নাও থাকতে পারে। তাই কলকারখানা ও খামারের অদক্ষ ব্যবস্থাপকদের অপসারণের জন্যে প্রয়াজন হবে নেতৃত্বের কঠোর হস্তক্ষেপ। যেহেতু এতে অসন্তোষ ও অস্থিরতা সৃষ্টি হবে, তাই নেতৃত্বকে ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্যে একই সাথে কায়েমী স্বার্থকে শান্ত করার প্রচেষ্টায় নিয়োজিত হতে হবে। সমাজতন্ত্রের কুফলসমূহ তথা ক্ষমতা ও ব্যবস্থাপনার অতিরিক্ত কেন্দ্রীকরণ, বিশালায়তন প্রতিষ্ঠানের অর্থনৈতিক অসুবিধা ইত্যাদি দূরীকরণ তাই সহজ কাজ নয়। প্রকৃত প্রস্তাবে ‘সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রত্যেক ব্যক্তির সংস্কারের স্বপক্ষে থাকার, আবার একই সাথে তাকে বিরোধিতা করার কোনো না কোনো কারণ রয়েছে।
বাজার সমাজতন্ত্র
সোভিয়েত ইউনিয়ন যখন তার অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় বাজার অর্থনীতির কিছু উপাদান সংযোজন করছে তখন পূর্ব ইউরোপীয় দেশ সমূহ (বুলগেরিয়া, চেকোশ্লোভাকিা, পূর্ব জার্মানী, হাঙ্গেরী, পোল্যান্ড ও রোমানিয়া), যুগোশ্লাভিয়া এবং চীন ইতোমধ্যে এমন এক পথ ধরেছে যা ‘বাজার সমাজতন্ত্র’ নামে অভিহিত। এমনকি চীন মাও সে তুং কর্তৃক বলপূর্বক চাপিয়ে দেয়া অমানবিক ও অস্বাভাবিক কমিউন ব্যবস্থার উপর গুরুত্ব আরোপ পরিত্যাগ করেছে। এতদসত্ত্বেও অধিকাংশ উৎপাদন উপকরণের রাষ্ট্রীয় মালিকানাভিত্তিক সোভিয়েত মডেলই এখনো এসব অর্থনীতির মূল মেরুদণ্ড।
সংস্কার ও পুনর্গঠনের মৌলনীতি হতে হবে উৎপাদন উপকরণ বন্টনের ক্ষেত্রে বাজার শক্তি ও ব্যক্তিগত উদ্যোগকে ভূমিকা পালন করতে দিয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়াকে আংশিকভাবে বিকেন্দ্রীকরণ করা এবং রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে উৎপাদন উপকরণ সংগ্রহ, উৎপাদন দ্রব্যের মূল্য নির্ধারণ এবং পরিচালনার ক্ষেত্রে অধিকতর স্বায়ত্বশাসন প্রদান। স্ব-শাসন নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠানগুলোর উপর থেকে উপরের অধিকাংশ নিয়ন্ত্রণ তুলে নিতে হবে। বাজার শক্তি কর্তৃক নির্ধারিত মূল্য, মজুরি এবং বিনিময় হারের প্রতিষ্ঠা নিশ্চিত করতে হবে এবং বাজেট ঘাটতি হ্রাসের জন্যে ভর্তুকির পরিমাণ কমাতে হবে। ভারী শিল্পের উপর পূর্বে যে অনাবশ্যক গুরুত্ব প্রদান করা হতো তা হ্রাস করতে হবে।
ব্যর্থতা ও পতন
এসব সংস্কার সকল দেশে সুসমভাবে প্রয়োগ করা হয়নি। এগুলো বুলগেরিয়া, চেকোশ্লোভাকিয়া, পূর্ব জার্মানী ও রোমানিয়ার তুলনায় যুগোশ্লাভিয়া, হাংগেরী, পোল্যান্ড ও চীনে অধিকতর ব্যাপকভাবে প্রয়োগ করা সম্ভব হয়েছে। কিন্তু এ দেশগুলোর কোনোটাই বাজার সমাজতন্ত্রের প্রবক্তারা তাত্ত্বিকভাবে যে পথ ও পদ্ধতি উপস্থাপন করেছেন সেভাবে বাজার শক্তির উপর আস্থা প্রদান ও অর্থনীতিকে বিকেন্দ্রীকরণের পথে অগ্রসর হয়নি। বাস্তবে সর্বত্রই অতিরিক্তভাবে এককেন্দ্রিক ও আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থার মৌলিক উপরিকাঠামো অটুট রয়ে গেছে। ফলে উৎপাদনশীলতা, প্রবৃদ্ধি ও পণ্যমানের ক্রমাবনতি এবং ঘাটতি সমস্যা যা এদেশগুলো সমাধান করতে চেয়েছে তা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। সমস্যাগুলো অসহনীয় হয়ে উঠলে ১৯৮৯ সালে পূর্ব ইউরোপের কমিউনিস্ট সরকারগুলো তাসের ঘরের মতো ধুলিস্যাৎ হয়ে পড়ে। ১৯৮৯ সালে তিয়েনমেন স্কয়ারের গণতন্ত্রের আন্দোলন পাশবিক শক্তির সাহায্যে দমন না করলে চীনের কমিউনিস্ট সরকার এতদিন হয়ত উৎখাত হয়ে যেত। প্রশ্ন হলো, লক্ষ্য অর্জনের দিক থেকে সোভিয়েত মডেলের চেয়ে কেন বাজার সমাজতন্ত্র অধিকতর সফলতা দেখতে পারলনা?
রাজনৈতিক গণতন্ত্র
অর্তনৈতিক সংস্কার কর্মসূচির সাথে রাজনৈতিক গণতন্ত্র চর্চা শুরু করা হয়নি। রাজনৈতিক একনায়কতন্ত্র ও নির্যাতনমূলক ব্যবস্থা অব্যাহত থাকে। রাজনৈতিক স্বধীনতার অস্ত্বিহীনতা অর্থনৈতিক সংস্কার কর্মসূচিকে বিকলাঙ্গ করে দেয় এবং অবয়বে বেড়ে ওঠার পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়। দমননীতি দ্বারা চালিত সরকারের কায়েমী স্বার্থ যেভাবে চরিতার্থ হবে সে পথেই সংস্কার কর্মসূচিকে চলতে দেয়া হয়। আংশিক ও অবিন্যস্ত সংস্কার কর্মসূচি অর্থনীতির পুনরুজ্জীবন ঘটাতে ব্যর্থ হয় বলে লক্ষ্যে উপনীত হওয়া সম্ভব হয়নি। এর সাথে দুর্নীতি ও অদক্ষতা সম্পদের অপচয় ঘটিয়ে ঘাটতি ও সংকটের সৃষ্টি করে। যদি অর্থনৈতিক কর্মসূচির পাশাপাশি রাজনৈতিক গণতন্ত্রও চালু হতো তবু তা যথেষ্ট বলে বিবেচিত হতো না। বিকেন্দ্রীকরণের সাহায্যেআমলাতান্ত্রিক লাল ফিতার অপসারণ এবং বাজার শক্তির পুনরাবির্ভাবের ফলে সম্পদের বন্টনে অবশ্য নিঃসন্দেহে দক্ষতার সৃষ্টি হতো। তবে তা বাজার অর্থনীতিতে জাতীয়করণকৃত শিল্প সংস্থায় যে দক্ষতা বিরাজমান তার চেয়ে অধিক হতোনা। উৎপাদন উপকরণের ব্যাক্তিগত মালিকানার অনুপস্থিতির ফলে বাজার অর্থনীতি থেকে যে স্বতঃস্ফুর্ত উদ্যোগ বেরিয়ে আসে উৎপাদন উপকরণের ব্যক্তিগত মালিকানার অভাবে তা বাজার সমাজতন্ত্রে পাওয়া কখনো সম্ভব নয়, ফলে উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হবেই। বাজার সমাজতন্ত্রকে যদি প্রকৃত অর্থে একটি কার্যকর ও প্রকৃত বিশ্বদৃষ্টির কাঠামোর মধ্যে বিন্যস্ত করা না যায়, তবে বাঞ্ছনীয় ন্যায়পরতা, যা বাজার অর্থনীতিও প্রদানের ব্যর্থ হয়েছে, তা কখনোই অর্জন করা সম্ভব হবেনা। শুধুমাত্র এ ধরণের বিশ্ব দর্শনভিত্তিক বাজার সমাজতন্ত্রই কাঙ্খিত লক্ষ্য পূরণে কর্মোদ্দীপনা সৃষ্টি, সুষম বন্টনব্যবস্থা ও আর্থ-সামাজিক পুনর্বিন্যাস ঘটাতে পারে। এরূপ দর্শনের অভাবে কার্যকর ব্যবস্থা ও কৌশল গড়ে উঠতে পারেনি। এসব বাজার সমাজতন্ত্র অভিমুখী দেশসমূহ তাই শুধুমাত্র তাদের নিজেদের সমস্যা সমাধানেই ব্যর্থ হয়নি উপরন্তু তারা বাজেট ঘাটতি মূল্যস্ফীতি, বেকারত্ব, উচ্চ বৈদেশিক ঋণ প্রভৃতি অর্থনৈতিক সমস্যা, এতোদিন যা পুঁজিবাদী অর্থনীতির নিজস্ব বৈশিষ্ট্য হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আসছিল, তার ঘূর্ণিপাকেও পতিত হয়েছে। অধিকন্তু আয়ের বৈষম্য বৃদ্ধি পেয়ে সামাজিক অস্থিতিশীলতার জন্ম দিয়েছে।
মূল্যস্ফীতি, বেকারত্ব ও ঋণ
উদারনীতি গ্রহণে অগ্রসর যুগোস্লাভিয়া, পোল্যান্ড, হাংগেরি এবং চিন এ বিষয়ে উত্তম উদাহরণ। মুল্যস্ফীতি ও শ্রমিক অসন্তোষের যাতাকলে আর্তনা করছে যুগোস্লাভিয়া ও পোল্যান্ড। উভয় দেশে প্রতি বছর মুদ্রাস্ফীতি বেড়েই চলছে। যুগোস্লাভিয়ার ১৯৭৯ সালে মুদ্রাস্ফীতির হার ছিলো ২১.২% যা বৃদ্ধি পেয়ে ১৯৮৯ সালে হয়েছে ১২৪০%। পোল্যান্ডে মুদ্রাস্ফীতি ১৯৭৯ সালের ৭.১% থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ১৯৮৯ সালে দাঁড়িয়েছে ২৪৫%। এ দু’দেশের মূল্যস্ফীতি ক্রমান্বয়ে বেড়েই চলছে যা ১৯৮৯ সালের ডিসেম্বরে এসে দাঁড়িয়েছে ২৬৮৫% এবং ৬৪০% এ। হাঙ্গেরী ও চীনে মূল্যস্ফীতির হার তুলনামূলকভাবে কম হলেও তা ক্রমাগত বেড়ে চলেছে। চীনে তা ১৯৮৩ সালের ২.০% হতে ছয় গুণ বৃদ্ধি পেয়ে ১৯৮৫ সালে ১১.৯% এ দাঁড়িয়েছে। চীনাদের যারা বিগত ৩০ বছর যাবত মূল্য স্থিতিশীলতা দেখে আসছে এ মূল্যবৃদ্ধি তাদের নিকট তীব্র আঘাত হিসেবে দেখা দেয়। ফলে প্রতিবাদ ও ছাত্র বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। পরিণতিতে অর্থনৈতিক সংস্কার কর্মসূচির রূপকার ও কমিউনিস্ট পার্টি প্রধান হু ইয়াও ব্যাংকে অপমানজনকভাবে পদত্যাগ করতে হয়। সরকার মূল্য বৃদ্ধির উপর নিয়ন্ত্রণ আরোপসহ সাময়িকভাবে অর্থনীতিকে উন্মুক্তকরণের নীতি শিথিল করে। ফলে ১৯৮৬ সালে মূল্যবৃদ্ধিতে বিরতি এসে মূল্যস্ফীতি ৭% এ নেমে আসে। কিন্তু মূল্যবৃদ্ধি রোধের এই ঢাকনি শক্তভাবে আটকে রাখা সম্ভ হলোনা। ১৯৮৬ সালে মূল্যবৃদ্ধিতে বিরতি এসে মূল্যস্ফীতি ৮.৮% এবং ১৯৮৮ সালে ২০.৭ এ এসে দাঁড়াল। অর্থনীতি উদারনীতিকরণ পুনরায় শুরু হলে চেপে রাখা মুদ্রাস্ফীতির বিস্ফোরণের সম্ভাবনা রয়েই গেল। বেকারত্ব বৃদ্ধি পেতে শুরু করলো। বেকারদের জন্যে অর্থনৈতিক পুনর্গঠনের মাধ্যমে বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা না করেই সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির উৎপাদন ব্যবস্থায় ছড়িয়ে থাকা অদক্ষতা হ্রাসের উদ্যোগ নেয়া হলে এ অবস্থা সৃষ্টি হতে বাধ্য। প্রথমদিকে বেকারত্বের কোনো অস্তিত্ব আছে বলে স্বীকার করা হলোনা। যুগোস্লাভিয়ায় বেকারত্বের পরিমাণ দাঁড়াল ১৫% যা ওইসিডি দেশের তুলানায় দ্বিগুণ এবং তা আরো বৃদ্ধি পেতে পারে।
পূর্ব ইউরোপীয় দেশসমূহ ও যুগোস্লাভিয়ার বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ বিশালাকারে বৃদ্ধি পেয়েছে। ১৯৮৫-৮৯ এ চার বছরে মার্কিন ডলার ৭১.৭ বিলিয়ন হতে মার্কিন ডলার ১০১.২ বিলিয়নে পরিণত হয়েছে। সবচেয়ে ঋণগ্রস্ত দেশ হাংগেরী, পোল্যান্ড ও যুগোস্লাভিয়ার মোট ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৯৮৯ সালে যথাক্রমে ২০.৬ বিলিয়ন, ৪৩.৩ বিলিয়ন এবং ১৯.৭ বিলিয়ন মর্কিন ডলার। চীনের বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ আরো দ্রুততরভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। ১৯৮০ সালের ৪.৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার হতে তা ১৯৮৯ সালে ৪৪.৯ মার্কিন ডলারে পরিণত হয়েছে এবং ভবিষ্যতে আরো দ্রুতগতিতে বৃদ্ধি পাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
সংস্কারের সমস্যা
সংস্কারের কৌশল হিসেবে যেসব পরামর্শ প্রদান করা হচ্ছে তা পুঁজিবাদের সেকুলার কাঠামোার সাথে সামঞ্জস্যশীলতার কাঁচিতে কেটেই প্রদান করা হয়েছে এবং সে পরামর্শগুলো হচ্ছে: সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা পুনুদ্ধারের জন্যে সরকারি ব্যয় কমাও ও ঋণ সংকোচনের নীতি গ্রহণ কর, বাজারের চাহিদা ও সরবরাহ দ্বারা মূল্য নির্ণীত হতে দাও, আমলাতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণ সরিয়ে ফেল এবং ব্যক্তি মালিকানা চালু কর। এগুলোর প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য হলেও আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থার মূল্য লক্ষ্য ন্যায়পরতা সমাধিকে ঢেকে দেবে। আবার এ পরিপূর্ণ পুনর্গঠন ও পুনর্বিন্যাস চিরায়ত মূল্যবোধ সমৃদ্ধ চিন্তাদর্শন ব্যতীত সেকুল্যার মূল্যবোধের কাঠামোয় অর্জন করা সম্ভব নয়। সামষ্টিক অর্থনৈতিক বৈষম্য ও ভারসাম্যহীনতা দূরীকরণের জন্যে সরকারি ব্যয় হ্রাস করা প্রয়োজন। কিন্তু জনকল্যাণ যখন সরকারি ব্যয়ের উপর মূলত নির্ভরশীল তখন এটা করা কঠিন, কেননা সরকারি ব্যয় হ্রাস রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার উপর বিরূপ প্রভাব ফেলবে- বিশেষত যখন ভর্তুকি তুলে নেয়া হবে; চাহিদা ও সরবরাহের স্বাভাবিক নিয়মে মূল্যকে নির্ণীত হতে দেয়া হবে; মজুরি বৃদ্ধির লাগাম টেনে ধরা হবে এবং ফলে প্রকৃত আয়া হ্রাস পাবে। অধিকন্তু হ্রাসকৃত সরকারি ব্যয়ের সাথে মিলে বিরাষ্ট্রীয়করণকৃত সংস্থাসমূহের ব্যয় কমানোর চেষ্টা বেকারত্ব বাড়িয়ে তুলবে। বেকারদের জন্যে কোনো কার্যকর সামাজিক নিরাপত্তার ব্যবস্থা না থাকলে রাজনৈতিক অস্থিরতা আরো তীব্র হবে। বিজাতীয়করণ জনগণের আয় ও সম্পদের ন্যায়পরতা অমীমাংসিত প্রশ্নটি আবার জাগিয়ে তুলবে, সোভিয়েত ইউনিয়নে যা ইতোমধ্যে আলোচনার বিষয়বস্তু হয়ে দাঁড়িয়েছে। এতে প্রতীয়মান হয় যে, সুচারুভাবে পরিকল্পিত এবং যুগপৎ দক্ষতা ও ন্যায়পরতা লক্ষ্য পূরণে সক্ষম পরিবর্তন কৌশল নিরূপন ব্যতিরেকে সংস্কার কতো কঠিন। সেকুলার কাঠামোর আওতায় সমাজতন্ত্রী অর্থনীতিকে ব্যক্তি মালিকানাধীন ব্যবস্থায় রূপান্তরের বিরুদ্ধে প্রভাব বিস্তার করবে। দরিদ্র ও বিত্তহীন জনগণ এভাবে ভোগান্তির সম্মুখীন হবে। অপরাধের মাত্রাও বৃদ্ধি পাবে। কেননা একনায়কবাদী রাষ্ট্রযন্ত্রের হাতে অপরাধ রোধের জন্যে নির্যাতনমূলক ব্যবস্থা ছাড়া আর কিছুই থাকেনা। সংস্কারবাদী সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতিসমূহ ফলে দ্বৈত সমস্যার সম্মুখীন- কী করে অতীতের বৈষম্য ও অন্যায়পরতাসমূহ দূর করা যায় যা বর্তমান আর্থ-সামাজিক অসন্তোষের জন্ম দিয়েছে এবং একই সাথে কিভাবে দুর্নীতি ও ভাসরসম্যহীনতা বৃদ্ধি না করে যুগপৎ দক্ষতা ও ন্যায়পরতা বিধান করা যায়। কল্যাণমূলক রাষ্ট্র ও গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের কৌশল যা সমাজতান্ত্রিক দেশসমূহ বর্তমান মডেল হিসেবে গ্রহণ করেছে তা সহায়ক না-ও হতে পারে। কেননা এ ধরনের মডেলের দেশসমূহ পূর্ব ইউরোপীয় দেশের মতো উচ্চ মূল্যস্ফীতি, বেকারত্ব ও ঘাটতির সমস্যায় ভুগছেনা। ভিন্নতর কোনো কৌশল অবলম্বন করা না হলে বর্তমানে সামাজিক গণতন্ত্রের দেশসমূহ যে সমস্যায় ভুগছে পূর্ব ইউরোপীয় দেশসমূহকে তার চেয়ে অধিকতর প্রকট সামষ্টিক ভারসাম্যহীনতা ও অন্যান্য সমস্যার সম্মুখীন হতে হবে। সংস্কার কর্মসূচিতে নৈতিক মাত্রা সংযোজন এবং আমূল আর্থ-সমাজিক পুনর্গঠনের পদক্ষেপ নেয়া না হলে পূর্ব ইউরোপীয় দেশসমূহকে উন্নয়ন তরান্বিত ও ঘাটতি পূরণের জন্যে সম্ভবত বিশালায়তনের ঋণের দিকে ঝুকে পড়তে হবে। এর ফলে জনগণকে আপাততঃ শান্ত রাখা সম্ভব হলেও দীর্ঘ মেয়াদে অন্যান্য জটিল সমস্যার সৃষ্টি হবে, যা বর্তমানে উন্নয়নশীল দেশসমূহ হাড়ে হাড়ে উপলব্ধি করছে।
গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র
গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রে মার্কসীয় বাঁধন-কষণ নেই। এতে বলপ্রেয়োগের উপর বিশ্বাস বা পুঁজিবাদের অবশ্যম্ভাবী পতনের ধারণা নেই। বরং এ মতবাদ বিশ্বাস করে যে, সমাজতন্ত্র আদর্শ হিসেবে গণতন্ত্র হতে অবিচ্ছেদ্য এবং শান্তিপূর্ণভাবে বিপ্লব ছাড়াই গণতান্ত্রিকভাবে ধাপে ধাপে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা সম্ভব। সমাজতান্ত্রিক লক্ষ্য অর্জনের জন্যে এর প্রথম দিকের প্রবক্তাগণ অবশ্য উৎপাদন যন্ত্রেও রাষ্ট্রীয় মালিকানা ও কেন্দ্রীয় পরিকল্পনার আবশ্যকতার কথা বলেছেন। সুম্পিটার সমাজতন্ত্রের সংজ্ঞা হিসেবে একটি প্রাতিষ্ঠানিক পদ্ধতিকে চিহ্নিত করেছেন, যেখানে উৎপাদন উপকরণ ও উৎপাদিত পণ্যের নিয়ন্ত্রণ একটি কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষের উপর ন্যস্ত। তার সমসাময়িক পণ্ডিত অস্কার ল্যাঞ্জ সমাজতন্ত্রকে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ ও কেন্দ্রীয় পরিকল্পনার সমার্থক হিসেবে চিহ্নিত করে তাকে ‘উৎপাদনের প্রধান উপকরণের সামাজিক মালিকানার’ কথা বলেছেন।
সোভিয়েত মডেল হতে বিচ্ছেদ
জনগণের উপর দমননীতির বিরূপ ফলাফল ও সোভিয়েত উৎপাদন ব্যবস্থার অদক্ষতা লক্ষ্য করে এ উভয় পন্থার উপর হতে গুরুত্বারোপ কমিয়ে আনা হলো। বাজারব্যবস্থা সম্পদের সুষম বন্টন উৎপাদন সংক্রান্ত অন্যান্য সমাধানে সক্ষম বলে প্রতীতি জন্মাল। যেহেতু ধনতন্ত্রের মূল ব্যর্থতা হচ্ছে বন্টন ক্ষেত্রে বৈষম্য ও ভারসাম্যহীনতা, সেহেতু ধনতন্ত্রের মূল ব্যর্থতা হচ্ছে বন্টন ক্ষেত্রে বৈষম্য ও ভারসাম্যহীনতা, সেহেতু ধনতন্ত্রের এই চারিত্রিক ত্রুটি দূরীকরণই হবে সমাজতন্ত্রের প্রধান কাজ। মিশ্র অর্থনীতির মাধ্যমে এ আরাধ্য কাজ সম্পাদন করা সম্ভব বলে ধারণা করা হলো। কেননা এ ব্যবস্থায় পাবলিক সেক্টর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এবং এ ব্যবস্থা ধনতন্ত্রের চরিত্র উল্লেখযোগ্যভাবে পরিবর্তন করে সমাজতন্ত্রের দিকে নিয়ে যাওয়ার জন্য কতিপয় পদক্ষেপ গ্রহণ করে। এই পদক্ষেপ সমূহ কী হবে সে সম্পর্কে প্রচুর মতভেদ থাকলেও গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের সমার্থক হিসেবে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক গণতন্ত্রের উপর ভিত্তিশীল কল্যাণমূলক রাষ্ট্রের ধারণার সাথে তা জনগুরুত্বপূর্ণ শিল্পসমূহের জাতীয়করণ, শ্রমনীতি সংস্কার, সামাজিক নিরাপত্তা (বেকার ভাতা, অবৈতনিক শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও পরিবহণ সুবিধা) ইত্যাদি নিশ্চিত করে। বিপরীত পক্ষে বিপ্লব, কেন্দ্রীয় পরিকল্পনা এবং সকল উৎপাদন উপকরণের রাষ্ট্রীয় মালিকানার সাথে কমিউনিজম সমার্থক পদবাচ্য হিসেবে পরিগণিত হয়। উনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে হল্যান্ডের ফ্যাবিয়ান সমাজতন্ত্রীগণ এবং জার্মানীর সংশোধনবাদীগণ যে মতবাদ প্রচার করে তার মূল সুর ছিলো ক্রমবিবর্তনবাদের অনিবার্য অনিবার্য বিজয়।
বিপ্লবী সমাজতন্ত্রী তাত্ত্বিকগণ এ ধরণের চিন্তাধারার প্রতি অনাস্থা ও অষন্তোষ প্রকাশ করেন। তাদের মতে ধনবাদী পরিবেশ কাঠামোর মধ্যে ক্রিয়াশীল সংসদীয় গণতন্ত্র ও শ্রমিক ইউনিয়নের সংশোধনবাদী অস্ত্র ব্যর্থ হতে বাধ্য। সংসদ ও শ্রমিক ইউনিয়নসমূহ সমাজের প্রভাবশালী অংশের স্বার্থকেই প্রতিফলিত করে এবং ধনবাদী সমাজে প্রভুত্ব করে বুর্জোয়া শ্রেণী। তাই সংশোধনবাদী অস্ত্রের দ্বারা ধনবাদের পতন ঘটানো সম্ভব নয়। এগুলো ধনবাদী সমাজের কাঠামো ও প্রতিষ্ঠানসমূহকেই শক্তিশালী করবে। সুতরাং সংশোধনবাদী পন্থা শুধুমাত্র ধনতন্ত্রের অস্তিত্বকেই দীর্ঘায়িত করবে। বিপ্লবীরা কল্যাণ রাষ্ট্রকে তাদের লক্ষ্য হিসেবে স্থির করেনি। তারা প্রকৃত সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আকাঙ্খাকে ধরে রাখল, যেখানে কল্যাণ রাষ্ট্রকে ছাড়িয়ে বিলুপ্তি ঘটবে শ্রণী বৈষম্যের এবং সকল উৎপাদন উপকরণের রাষ্ট্রীয়করণ ও মজুরি সম্পর্কের অবসানের মাধ্যমে সকল সম্পদের সম বন্টন নিশ্চিত হবে। কিন্তু পূর্বের আলোচনায় দেখা গেছে, এ বৈপ্লবিক দৃষ্টিভংগি মজুরি দাসত্বকে আরো সুদৃঢ় করেছে এবং দক্ষতাকে করেছে খর্ব। তাই এ ধরণের বৈপ্লবিক চিন্তাধারাকে বর্তমানে আর সমাজতান্ত্রিক দলসমূহ রাজনৈতিক মঞ্চ বা মেনিফেস্টো হিসেবে ব্যবহার করছে না, বরং তারা কল্যাণ রাষ্ট্রের চিন্তা দ্বারাই উদ্বুদ্ধ হচ্ছে। অধিকন্তু সোভিয়েত ইউনিয়ন কর্তৃক বৈপ্লবিক পন্থা পরিত্যাগের কারণে দৃশ্যমান ভবিষ্যতে এ মতবাদের নতুন অনুসারী তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। তাই পশ্ন দাঁড়ায়, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে রাষ্ট্রের ভূমিকা বৃদ্ধি ও ধনতন্ত্রের বন্টন ব্যবস্থায় কিছু কসমেটিক পরিবর্তন এনে দারিদ্র্যের অবসান, প্রত্যেকের প্রয়োজন পূরণ, আয় ও সম্পদের সুষম বন্টন তথা আদর্শ সমাজ প্রতিষ্ঠা সম্ভব কিনা? অথচ ইতিবাচক হতো উদ্বৃত্ত মূল্য বা আয় বন্টনের ক্ষেত্রে অন্যায়পরতা থাকা সত্ত্বেও অন্তত যদি বাজারব্যবস্থা বিভি ন্ন উৎপাদন উপকরণ বরাদ্দের ক্ষেত্রে দক্ষতা দেখাতে পারত। কিন্তু যেহেতু দেখা গেছে যে, বিভিন্ন উৎপাদন উপকরণ বরাদ্দের ক্ষেত্রেও বাজার অর্থনীতি দক্ষতা প্রদর্শনে ব্যর্থ হয়েছে, তাই এক্ষেত্রে গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র সম্পর্কে দীর্ঘ অভিজ্ঞতা এ সত্যকে সুদৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত করে। পশ্চিম ইউরোপের বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন সময়ে সমাজতন্ত্রী দলসমূহ ক্ষমতা এসেছে। তাদের মুখ্য উদ্দেশ্যসমূহ ছিলো দারিদ্র্য দূরীকরণ, রাষ্ট্র কৃর্তক সামাজিক নিরাপত্তা প্রদান, সম্পদের অধিকতর সমবন্টন, পূর্ণ কর্মসংস্থান এবং অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা। এ দলসমূহ যদিও অর্থনীতিতে কতিপয় প্রশংসনীয় সংস্কার প্রবর্তন ও শ্রমজীবীদের জীবনযাত্রার মান উন্ন করতে পেরেছে, তবুও তাদের মূল লক্ষ্যসমূহ অর্জনে তারা ব্যর্থ হয়েছে। এসব অর্থনীতির বিশাল সম্পদের ভিত থাকা সত্ত্বেও এখনো দারিদ্র ব্যাপক, মানুষের প্রয়োজন অপূর্ণ এবং আয় ও সম্পদের বৈষম্য বস্তুত বৃদ্ধি প্রাপ্ত। তাছাড়া ক্রমবর্ধমান বেকারত্ব, ভারসাম্যহীনতা ও অস্থিতিশীলতা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, দক্ষতা ও ন্যায়পরতা, উপর বিরূপ প্রভাব ফেলে চলেছে।
আপষকামী নীতি
গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের মতাদর্শ সফলতার মুখ দেখতে পায়নি। বাজেট ঘাটতি ও করের গুরুভারের কারণে এর কৌশল ও পদ্ধতি আক্রমণের সম্মুখীন হয়েছে। পরবর্তী পরিচ্ছেদে এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হবে। সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন এ কারণে আবেদন হারিয়েছে। যেসব দেশে গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র শক্তি অর্জন করেছে, সেখানে ‘নব্য ডানপন্থীদের’ পুনরুত্থান ঘটেছে; সমাজতন্ত্র বিরোধীরা ভোটারদের সহানুভূতি লাভ করতে সক্ষাম হয়েছে।
ফলশ্রুতিতে ১৯৮৩ এবং ১৯৮৭ সালে বৃটিশ লেবার পার্টি ১৯২৯ সালে চেয়েও প্রকট অর্থনৈতিক মন্দার জন্যে দায়ী রক্ষণশীল দলকে ক্ষমতাচ্যুত করতে ব্যর্থ হয়েছে। নির্বাচনে জয়ের জন্যে তিন মিলিয়ন বেকারের ইস্যুকে ব্যবহারে লেবার পার্টির ব্যর্থতার পরিপ্রেক্ষিতে ‘ইকনোমিস্ট’ ঘোষণা করে ক্রমবর্ধমান সরকারি ব্যয়ের সুবর্ণ যুগের বৈপ্লবিক ও উদার দানশীল মতবাদ সমাজতন্ত্রকে এখন পুরাতন ও সেকেলের বলে মনে হয়; সমাজতন্ত্র উত্তর ভবিষ্যতের ইউরোপের কাছে সমাজতন্ত্র আর কোনো আবেদন রাখে না।
আবার কতিপয় প্রথম সারির সমাজচিন্তাবিদ সম্পদ ও মুনাফার ব্যক্তি মালিকানাসহ ধনতন্ত্রের মৌল স্তম্ভগুলোর উপর সমাজতন্ত্রীদের আক্রমণের সারবত্তাকে প্রশ্ন করেছেন। ‘ফিউচার অব সোসালিজম’ গ্রন্থে ক্রসল্যন্ড মন্তব্য করেছেন, ‘মালিকানার ভিত্তিতে ধনতন্ত্রের সংজ্ঞা এবং একশত বছর পূর্বে ধনতন্ত্র কল্যাণকর ছিলো কিনা এ প্রশ্ন বর্তমান সকল তাৎপর্য হারিয়েছে, কেননা শুধু মালিকানা দ্বারা এখন আর সামাজিক সম্পর্কের সমগ্র প্রেক্ষাপট নির্মিত হয়না। রাজনৈতিক ব্যবস্থা এ সমাজের আন্তঃসম্পর্ক ও ন্যায়পরতার নিরিখে সমাজকে বিচার করা এখন বরং অধিক প্রাসঙ্গিক। জাতীয়করণ এখন আর গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত নয়। ফলে বৃটিশ এবং বহু ইউরোপীয় সমাজতন্ত্রী দল এখন নামে মাত্র যৌথ প্রথার সমর্থক। সমাজের উন্নয়ন ও দক্ষতার উপর মুনাফর প্রভাব এখন অনেক বেশি গুরুত্ব বহন করে। তাই ক্রসল্যান্ড মন্তব্য করেন যে, ‘এটা চিন্তা করা ভুল যে মুনাফার সাথে পুঁজিবাদের বিশেষ সম্পর্ক রয়েছে। পুঁজিবাদ বা সমাজতন্ত্রী যে, কোনো গতিশীল ব্যবস্থার ক্ষেত্রে মুনাফা ব্যবসায়িক কার্যক্রমের জন্যে অপরিহার্য ভিত্তি’। তাই ‘নোভাকের’ মন্তব্যের সাথ একমত হওয়া যায় যে ‘তত্ত্ব ও কার্য উভয় ক্ষেত্রে সমাজতন্ত্রীগণ পশ্চাৎপসরণ করেছে’। এমনকি সুইডেনের অর্থমন্ত্রী কিয়েল আরোফ ফেলট বলেন, আমাদের ধনতন্ত্র বিরোধী দল হিসেবে চিহ্নিত হবার প্রয়োজন নেই। ধনতন্ত্রের অনেক সমস্যা আছে, কিন্তু তার কোনো উপযুক্ত বিকল্প নেই।
আর যদি সমাজতন্ত্র সম্পত্তির ব্যক্তিগত মালিকানা ও মুনাফাকে স্বীকার করে নেয়, তাহলে ধনতন্ত্র থেকে সমাজতন্ত্রের পার্থক্য নিরূপণের কি মানদণ্ড অবশিষ্ট থাকে, বিশেষত যখন গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রে আয়ের বৈষম্য বৃদ্ধি পেয়ে থাকে ও সামাজিক শ্রেণী বিভক্তি প্রাধান্য বিস্তার করে? এমনকি ডানপন্থীরাও এখন রাষ্ট্র কর্তৃক অত্যাবশ্যকীয় সেবাসমূহের সরবরাহের সমর্থক। ট্রেড ইউনিয়নের প্রতি দৃঢ় সমর্থ তাই গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু বেকারত্বের বর্তমান উচ্চহারের কারণে ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের শক্তি বহুলাংশে হ্রাস পেয়েছে। ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন এখন আর ‘ক্ষমতার সম্পর্ক বিন্যাসে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনতে সমর্থ নয়। তাই উইলিয়াম ফাফ মন্তব্য করেন, উদারননৈতিক বামপন্থী বা রক্ষণশীল বামপন্থী কারো নিকট এখন জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য বৃহৎ কোনো কর্মসূচি নেই। আরভিং হাউই আরো দৃঢ়তার সাথে বলেন, ‘সমাজতন্ত্র দ্বারা এখন ার দারিদ্র্য দূরীকরণ বা শিল্পসমূহের জাতীয়করণ বুঝায়না’। আইনসংগতভাবে ক্ষমতা দখলের প্রচেষ্টায় এক নির্বাচনী রাজনীতির প্রয়োজনের প্রতি লক্ষ্য রেখে এতো বেশি আপোস করতে হয় যে, তার প্রাণশক্তি ও মৌলিক পরিবর্তন সাধনের নিজস্ব ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে- সেই পরিবর্তন যা চরিত্রকে পাল্টিয়ে দিতে পারে। বৃহত্তর জনগোষ্ঠী চাইলেই গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রকে সমর্থনের ক্ষেত্রে দোদুল্যমানতা দেখিয়েছে। এ আন্দোলন সুদৃঢ় শেকড় গাড়তে বাধ্য হয়েছে। এখনো এটা জনগণের খেয়াল বা শখের কাছে করুণা প্রার্থী। রক্ষণশীল বা সমাজতন্ত্রী দলের নেতৃত্বের শক্তির উপর এ দলগুলোর বিজয় নির্ভরশীল। জনগণ এ মতবাদের জন্যে দৃঢ় কদমে দাঁড়িয়ে জীবন মরণ লড়াই করতে রাজি নয়, যেমনভাবে তারা করে থাকে ধর্মীয় মতাদর্শের ক্ষেত্রে। জনচিত্তের এ ধরণের দোদুল্যমান অবস্থা কি গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের বিজয়কে নিশ্চিত করতে পারে? অপরদিকে বিপ্লবও কোনো সমাধান নয়। রাশিয়া এবং চীনের বিপ্লব অযুত-লক্ষ লোকের হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে, পেছনে রেখে গেছে এমন তিক্ত স্মৃতি যা গণতন্ত্র ও মানবাধিকার সম্পর্কে সজাগ কোনো মানুষেরই সমর্থন লাভ করতে পারেনা। এমনকি যেসব উন্নয়নশীল দেশে বিপ্লব বা সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, সেখানে মানবতার যা কিছু আদি অতিহ্য ছিল তার উপর ধ্বংসযজ্ঞ চালানো হয়েছে।
ভাবমূর্তিও বিনাশ
কার্যসম্পাদনের নিক্তিতে বিচার করলে দেখা যাবে গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র এর লক্ষ্য অর্জনে সাফল্য লাভ করেনি এবং ভস্যিতে নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা আসলেও এর অধিকতর সাফল্য লাভের সম্ভাবনা ক্ষীণ। কারণ এর লক্ষ্য এবং দৃষ্টিভংগির মধ্যে সামঞ্জস্যের অভাবের কারণে এ মতবাদ কার্যকর কর্মকৌশল রচনায় ব্যর্থ হয়েছে।
ধনতন্ত্রের মতো গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রও রেঁনেসা পরবর্তী সেকুলার দর্শনের ফসল। ধনতন্ত্রের বন্টন ব্যবস্থায় কিছু বাস্তবভিত্তিক পরিবর্তন সাধন করাই গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের একমাত্র সাফল্য। সার ও মাটির কিছু পরিবর্তন ঘটিয়ে লেবুর বীজ থেকে আম ফলানো কখনই সম্ভব নয়। বিশ্ব সম্পর্কে দৃষ্টিভংগির ব্যাপক পরিবর্তন, সর্বোপরি মানুষের চরিত্র ও স্বভাবের মৌলিক পরিবর্তন সাধন এবং কর্মকৌশলের উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন ব্যতিরেকে সমাজতন্ত্রের মানবতাবাদী লক্ষ্যসমূহ অর্জন কখনই সম্ভব নয়।
একটি প্রকৃত সমাধানে উপনীত হবার জন্যে নতুন বৈপ্লবিক চিন্তাধারার পরিবর্তে বামপন্থী চিন্তাধারাকে ‘আমেরিকানবাদের’ ছাঁচে ফেলে দেয়া হয়েছে। পরিবেশ সংরক্ষণবাদ বা শান্তিকামীতার মতো ইস্যুর সাথে গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রকে সম্পৃক্ত করা একটি প্রচেষ্টা নেয়া হয়েছে। যদিও এগুলোর সম্পৃক্তি অবশ্যই প্রয়োজন, তা সত্ত্বেও শুধুমাত্র এসবের অন্তর্ভুক্তিই মানুষের চাহিদাপূরণ, বৃহত্তর সমতা বা শ্রেণী বৈষম্যের অবসানকে নিশ্চিত করতে পারেনা। বুর্জোয়া দলগুলোও উৎসাহের সাথে এ ব্যবস্থাপত্র নিয়ে জনগণের সম্মুখে আসতে পারে। রায় হেটারসলে তার Economic Priorities for the Labour Government নামক সাম্প্রতিক গ্রন্থে দেখিয়েছেন যে গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের ভিত্তি কত সংকুচিত রূপ ধারণ করেছে। লেবার পার্টির এক কনফারেন্সে ‘নেইল কিনোক’ পূর্ববর্তী এক পক্ষকালের মধ্যে রক্ষণশীল দুটো দলের উপস্থাপনার মতোই নিখুঁতভাবে ধনতন্ত্রী সামাজিক বাজারনীতির এক এজেন্ডা উপস্থাপন করেন। লেবার পার্টির নেতার মতে, উক্ত দলের লক্ষ্য হচ্ছে ‘রক্ষণশীলদের চেয়েও দক্ষতার সাথে বাজার অর্থনীতিকে পরিচালিত করা’। লেবার পার্টির প্রধান হিসেবে কিনোকের নির্বাচন কার্যত ধনতন্ত্রের আরো উত্তম ব্যবস্থাপনার প্রতি পার্টির অঙ্গীকার ব্যক্ত করে। ফলে প্রতীয়মান হয় যে, গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র তার লক্ষ্য অর্জন ছাড়াই স্বকীয় ভাবমূর্তি হারিয়েছে।