দ্বিতীয় অধ্যায় – যাত্রায় ভুল

২. যাত্রায় ভুল

শেখ মুজিব আমাদেরকে ঘাস খেতে বললে, আমরা তাই খেতাম, খালি হাতে মাটি কাটতে বললে, আমরা তাই তাঁর জন্যে করতাম। কিন্তু চেয়ে দেখুন, তিনি কি আচরণটাই না করলেন আমাদের সঙ্গে।

-মেজর ফারুক রহমান

.

মধ্য লন্ডনের হোটেল ক্ল্যারিজেস-এর এক বিলাসবহুল স্যুট। তবুও পৃথিবীর একটি নবতম অথচ অষ্টম জনবহুল দেশের প্রথম প্রেসিডেন্ট-এর অভিষেক অনুষ্ঠান এ পরিবেশে বেমানান। তা সত্ত্বেও লন্ডনে বাংলাদেশ মিশনের ভারপ্রাপ্ত প্রধান, রেজাউল করিম, শীতের এ পাতাঝরা সকালে শেখ মুজিবুর রহমানকে চুপিচুপি তার প্রতি বিধাতার সুদৃষ্টির ইঙ্গিতটুকু জানিয়ে দিলেন।

১৯৭২ সালের ৮ই জানুয়ারী। নয়টা গড়িয়ে গেছে। ঢাকায় ভারতীয় সেনাবাহিনীর কাছে পাকিস্তানের ৯৩,০০০ সৈন্যের আত্মসমর্পণের মাধ্যমে অর্জিত বাংলাদেশের আনুষ্ঠানিক স্বাধীনতার ঠিক ২৩ দিন অতিক্রান্ত হয়েছে কেবল। জুলফিকার আলী ভুট্টো অল্প কয়েকদিন আগেই কেবল পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট হিসেবে জেনারেল ইয়াহিয়া খানের স্থলাভিষিক্ত হয়েছেন। অপ্রত্যাশিতভাবেই সেদিন তিনি শেখ মুজিবকে তার তদানীন্তন সাংবিধান উপদেষ্টা, ডঃ কামাল হোসেনসহ পিআইএ’র একটি বোয়িং-এ করে গোপন ফ্লাইটে লন্ডন পাঠিয়ে দেন। তাকে লন্ডন কেন পাঠানো হয়েছিলো তার ইতিহাস তখন সঠিকভাবে কারও জানা নেই। কিন্তু সেদিন সকাল ৬-৩০ মিনিটে বিমানটি হিথ্রো বিমান বন্দর ছোঁয়ার সঙ্গে সঙ্গে একটি শ্বাসরুদ্ধকর নাটকের পরিসমাপ্তি ঘটলো। শেখ মুজিবের ভাগ্যের চরম অনিশ্চয়তাপূর্ণ নয়টি মাসের অবসান হলো।

দীর্ঘ ভ্রমণের পর শেখ মুজিবকে ক্লান্ত দেখালেও তিনি যে বেঁচে আছেন এবং গৌরবান্বিত বিজয়ীর ন্যায় বেঁচে আছেন তা তিনি নিজেই অনুভব করছিলেন, আর উৎফুল্ল জনতার ঢেউ তাকে ঘিরে ধরার জন্যে আনমনে অপেক্ষা করছিলো। তিনি ধীর ভঙ্গিতে এক রুম থেকে অন্য রুমে বিচরণ করতে লাগলেন, আর রেজাউল করিম তার পিছু পিছু ছুটছিলেন। তিনি দৃশ্যমান ফুলের অকুণ্ঠ প্রশংসা করছিলেন। ক্ষণে ক্ষণে মোটা গদির সোফায় তিনি বসে পড়ছিলেন। মনে হচ্ছিল সোফায় বসা কত আরাম তা দেখে নিচ্ছেন। কিন্তু কাঁচের বড় জানালাগুলো তাকে সবচেয়ে বেশী আলোড়িত করেছিল। চঞ্চল শিশুটির ন্যায় তিনি ঐ বড় বড় জানালা দিয়ে মাথা বের করে বাইরের রাস্তায় চলমান যানবাহন অবলোকন করছিলেন। পাকিস্তানের কারাগারে ফাঁসির হাতছানিতে ভরপুর চরম দুর্বিষহ একাকিত্বের নয়টি মাস কাটিয়ে তিনি এই যেন প্রথম-বারের মত আত্মার পূর্ণ পরিতৃপ্তির সাথে মুক্তির আনন্দ উপভোগ করছিলেন।

সানডে টাইমস-এর বিদেশ সংক্রান্ত উপ-সম্পাদক, নিকোলাস ক্যারোল আমাকে শেখ মুজিবের আগমন বার্তাটি শুনিয়েছিলেন। তিনি বিবিসি-র প্রচারিত খবর থেকে ঘটনাটি জানতে পেরেছিলেন। শেখ মুজিব আমার অনেক পুরনো বন্ধু। তাছাড়া, নিজ পেশার স্বার্থে আমি তার সঙ্গে অনেকদিন পরে দেখা হবার আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে উঠেছিলাম। তার রাজনৈতিক দীক্ষাগুরু হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর করাচীস্থ বাসভবনে ১৯৫৬ সালে আমাদের প্রথম দেখা হয়। তিনি অবশ্য পরবর্তীকালে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। ১৯৫৮ সালের গ্রীষ্মকালে ওয়াশিংটন, আরিজোনা, সানফ্রানসিস্কো এবং লস এঞ্জেলস-এর হোটেলে প্রায় মাসখানেক একই রুমে থাকাকালীন আামদের বন্ধুত্ব গড়ে উঠে। ঐটা ছিল যুক্তরাষ্ট্র সরকারের আমন্ত্রণক্রমে একটি সরকারী ভ্রমণ। হলিউড-এর প্যারামাউন্ট স্টুডিওতে নেয়া আমাদের ছবিটি আমি এখনও রেখে দিয়েছি।

ঐ সময়টা ছিল বেশ আনন্দের। শেখ মুজিব তখন রাজনীতিতে বেশ নূতন। গ্রীষ্মকাল। তিনি নিজের দেশে থেকে অনেক দূরে। আমার মনে পড়ে, তাঁকে প্রায়ই এই বলে চটাতাম যে, ‘আমি তাঁকে তার স্ত্রী চেয়ে বেশী জানি।’ ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশের অবস্থা বেশ খারাপ হয়ে গেলে, আমি আমার উদ্বিগ্ন বন্ধুটিকে বলেছিলাম, ‘তুমি এসব কিছু ছেড়ে দিয়ে হাত গুটিয়ে বসে পড় না কেন? তুমি তো তাস খেলেও এর চেয়ে ভাল জীবিকার্জনের ব্যবস্থা করতে পার।’ আসলেই তিনি তা পারতেন। আমি যদি ইন্দোনেশীয় ঐ তিনজন সাংবাদিককে খুঁজে বের করতে পারতাম, তাহলে আমার উক্তির প্রমাণ সহজ হতো।

আমরা গ্রান্ড ক্যানিয়ন থেকে ট্রেনে লস এঞ্জেলস যাচ্ছিলাম। সঙ্গে আমাদের ঐ তিনজন ইন্দোনেশীয় সাংবাদিক। রাতের ডিনার সেরে আমরা ‘ফ্লাশ’ খেলতে বসে পড়লাম। প্রথম দিকে হারজিতের তেমন একটা বালাই না থাকলেও পরক্ষণেই আমরা সাংঘাতিকভাবে হারতে শুরু করলাম। এ হারা থেকে নিজেদেরকে বাঁচানোর জন্যে খেলা ঐদিনকার মত ওখানেই বন্ধ করতে মুজিবের নিকট আমি প্রস্তাব করলাম। তিনি আমাকে থামিয়ে দিয়ে এটেনডেন্টকে একটি নূতন প্যাকেট আনতে বললেন। নূতন কার্ড এলে তিনি কার্ডগুলোক মিলিয়ে নিয়ে বেটে দিলেন। খেলা জমে উঠল। অপ্রত্যাশিত গতিতে ভাগ্য ফিরে গেল। শত চেষ্টাতেও ইন্দোনেশীয়রা আর কুলাতে পারল না। পরদিন ভোরে আমরা যখন লস এঞ্জেলস পৌঁছাই, অবাক বিস্ময়ে দেখি, আমি আর মুজিব তিনশ’ ছিয়াশি ডলার, একটি সোনার ক্যাপযুক্ত পার্কার-৫১ কলম আর একটি সর্পিল সোনার আংটি জিতে গেছি।

আমি মুজিবকে জিজ্ঞেস করলাম তিনি কিভাবে এটা সম্ভব করলেন। তার জবাব আজও আমার কানে বাজে। তিনি বলেছিলেন, ‘যখন তুমি কোন ভদ্রলোকের সঙ্গে খেলবে, তখন তোমাকে ভদ্রলোকের মতই খেলতে হবে আর যখন তুমি কোন বদমাশের সঙ্গে খেলবে, তখন তোমাকেও এর চেয়ে বড় বদমাশ সাজতে হবে। তা না হলে তুমি হেরে যাবে।’ তারপর হাসতে হাসতে তিনি আরও বললেন, ‘ভুলে যেয়ো না, আমার বেশ ভাল শিক্ষাগুরু রয়েছেন।’ পরে যখন তিনি পত্র-পত্রিকায় ‘হেডলাইন’ হতে লাগলেন—ভাগ্যে যখন তার একাদশীর চাঁদ দেখা দিল, তখন তার ঐ কথাগুলো আমার মনে পড়ে গেল। আমার ভবিষ্যদ্বাণী করতে একটুও দ্বিধা হলো না যে, তিনি অমানিশার অন্ধকারেও তার সঠিক পথ বেছে নিতে পারবেন।

অনেকদিন পর লন্ডনে আবারও আমাদের দেখা হয়ে গেল। শেখ মুজিব তখন তার জীবনের সবচেয় গুরুত্বপূর্ণ এক খেলায় পা বাড়াতে যাচ্ছেন। তার সঙ্গে উঠা-বসায়, কথাবার্তায় একটা জিনিস লক্ষ্য করা যাচ্ছিল যে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সবকিছু সম্বন্ধে এক অস্পষ্ট ধারণা নিয়ে নূতন দেশটির উড্ডয়নের নেতৃত্ব নিতে যাচ্ছিলেন।

কেবল তাই নয়, তিনি অতি সংগোপনে জুলফিকার আলী ভুট্টোর সঙ্গে একটি পরীক্ষামূলক সমঝোতায় আসার মনোভাব পোষণ করছিলেন, যার বদৌলতে পাকিস্তান ও সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত বাংলাদেশের মধ্যে একটা যোগসূত্র সৃষ্টি করবে।

আমি এই দুঃখজনক পরিকল্পনার ইঙ্গিত পেয়ে মর্মাহত হলাম। কারণ তা ছিলো স্বাধীনচেতা বাংলাদেশীর মানসিকতার সম্পূর্ণ পরিপন্থী। ঐ ইঙ্গিতটি শেখ মুজিবের ভাষায়, ‘তোমার জন্যে একটা বিরাট খবর নিয়ে এসেছি। আমরা পাকিস্তানের সঙ্গে একটা যোগসূত্র রাখতে চাচ্ছি। তবে এর বেশী কিছু তোমাকে এখনই বলতে পারছি না। অন্যান্যদের সঙ্গে এ ব্যাপারে আমাক আলোচনা করে নিতে হবে। আর খোদার দোহাই, এ বিষয়ে তোমাকে বিস্তারিত বলার আগে কিছু লিখো না কিন্তু।’

স্পষ্টতঃই, রাওয়ালপিন্ডির শহরতলীতে অবস্থিত একটি সরকারী রেষ্ট হাউসে মুজিব- ভুট্টো দীর্ঘ গোপন আলোচনাটি তাঁকে লন্ডন পাঠানোর পূর্বক্ষণেই অনুষ্ঠিত হয়েছিল। ঐ আলোচনাতেই পাকিস্তানের সঙ্গে ‘লিংক’ রক্ষার ব্যাপারে রাজী করানো হয়। আর এভাবেই চতুর ভুট্টো শেখ মুজিবকে প্রলুব্ধ করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামকে নস্যাৎ করার ঘৃণ্য প্রচেষ্টা চালিয়েছিলেন। সঠিক ফর্মূলাটা কি, শেখ মুজিব আমাকে বলেননি। তথাপি, আমি ভীত হয়ে পড়েছিলাম। আমি তাঁকে বললাম, ‘আপনি কি পাগল হয়েছেন? আপনি কি জানেন না, বাংলাদেশে কি ঘটে গেছে? এতকিছু ঘটে যাবার পর আপনি যদি পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের ‘লিংক’-এর ব্যাপারে আর একটি শব্দ উচ্চারণ করেন, আপনি বঙ্গবন্ধু হউন আর যাই হউন, জনগণ আপনাকে রাস্তায় ছুঁড়ে ফেলবে।’

শেখ মুজিব আমার কথার জবাব দিতে পারলেন না। ভারতীয় হাই কমিশনার বি, কে, নেহেরুের উপস্থিতিতে আামদের আলাপচারিতা ঐ পর্যন্তই রয়ে গেল। তিনি তার সঙ্গে গোপন আলাপে বসতে চাইলেন। শেখ মুজিবের মগজ ধোলাই শুরু হয়ে গেলো।

পাকিস্তানে কারারুদ্ধ অবস্থায় শেখ মুজিবকে সম্পূর্ণভাবে বহির্বিশ্ব থেকে আলাদা করে রাখা হয়। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বর্বর হত্যাযজ্ঞের কিছুই তিনি জানতে পারেননি। কোন চিঠিপত্র বা খবরের কাগজ তার কাছে পৌঁছায়নি। কোনো রেডিও তাকে শুনতে দেয়া হয়নি। এমনকি তার জেলার-এর সঙ্গেও তার আলাপ নিষিদ্ধ ছিল। তিনি জানতে পারেননি, তার প্রিয় দেশটাকে কিভাবে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ধ্বংস করে দিয়েছে, কিভাবে বিশ লাখ লোক নিহত হয়েছে তাদের হাতে। পৃথিবী যেমন মুজিবের ভাগ্যে কি ঘটেছে তা জানতে পারেনি, তেমনি তিনিও জানতে পারেননি তার সহধর্মিনী আর ছেলেমেয়েদের ভাগ্যের খবর।

পাকিস্তানের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বৃহত্তর দলের নেতা হিসেবে শেখ মুজিব তার প্রদেশের বৃহত্তর স্বায়ত্তশাসনের জন্যে দাবী জানিয়েছিলেন। সেই সাহসিকতাপূর্ণ দাবীর জন্যেই তাকে জেলে যেতে হয়েছিল। তখনকার সেই পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের দাবীই বাংলাদেশের স্বাধীনতায় বাস্তব রূপ লাভ করে।

কারামুক্তির পর শেখ মুজিব জাতীয় ‘বীর’ থেকে মানব দেবতায় পরিণত হন। কিন্তু নিহত হবার দিন পর্যন্ত পরিস্থিতি সম্পূর্ণ উল্টে গিয়েছিল। সে যা হোক, পত্র-পত্রিকাগুলোর হেডলাইন গর্জে উঠল, ‘মুজিব শব্দটি একটি যাদু’। মুজিব একটি অলৌকিক নাম।’

অন্ধকার থেকে আলোতে আসার অত্যন্ত কষ্টকর সুদীর্ঘ পথ পরিক্রমণের প্রভাব তাঁর শরীরে পড়তে শুরু করেছিল। শেখ মুজিব আমাকে বললেন, ‘আমার কিছু বিশ্রামে প্রয়োজন। আমি লন্ডনে কয়েকটা দিন আরাম করতে চাই। তারপর আমি আমার জনগণের মাঝে ফিরে যাবো। প্রত্যেকটা জেলায় ঘুরে ঘুরে আমার জনগণের সব কয়টা মুখ না দেখা পর্যন্ত আমি কোন কাজই করবো না।’ এই ছিল শেখ মুজিবের পরিকল্পনা। এ কথাগুলো শেষ করতে না করতেই টেলিফোনগুলো বাজতে শুরু করল।

তখন সময় সকাল সাড়ে দশটা। কলকাতার বাংলাদেশ মিশন থেকে টেলিফোন এসেছে। টেলিফোনের অন্য প্রান্তের জবাবে মুজিব বলছিলেন, ‘চিন্তা করো না। আমি নিরাপদ। আমি সুস্থ শরীরেই বেঁচে আছি। ঢাকায় টেলিফোন করে সবাইকে জানিয়ে দাও। কি ঘটেছে সবই বলবো। টিকে থাকবার জন্যেই বাংলাদেশের জন্ম হয়েছে। পৃথিবীর কেউ তা আর পাল্টাতে পারবে না।’ এছাড়া, ঐ স্যুটের বাকী তিনটি ফোনও একই সঙ্গে বেজে উঠলো। রেজাউল করিম এর একটা উঠিয়ে বললেন, ‘স্যার, ঢাকা থেকে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদ আপনার সঙ্গে কথা বলতে চান।’ এভাবে ঢাকা ও কলকাতা থেকে আরও বেশ কিছু ‘রিং’ এলো। তারপর দিল্লী থেকে মিসেস ইন্দিরা গান্ধী এবং আর একটি ১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রীট থেকে বৃটেনের প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হীথ টেলিফোনে আলাপ করলেন। বেলা এগারোটা নাগাদ ক্ল্যারিজেস হোটেলের ১১২ নম্বর স্যুটটি বাংলাদেশের অস্থায়ী রাজধানীতে পরিণত হলো।

এরই মধ্যে শেখ মুজিবের কাছে পরিষ্কার হয়ে উঠেছিল যে, তিনি যদি শিগগির ঢাকায় না পৌঁছেন, তাহলে বাংলাদেশে নবগঠিত সরকার দ্বিধাবিভক্ত হয়ে যেতে পারে। এমনকি গৃহযুদ্ধের সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেয়া যাচ্ছিল না। হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই- এর অবসান হয়েছিল ঠিকই, কিন্তু আওয়ামী লীগের ভেতরে অভ্যন্তীণ কোন্দল আর ক্ষমতার লড়াই বিপদজনক রূপ ধারণ করেছিল। আওয়ামী লীগ সরকারের কাছে স্বাধীনতা আন্দোলনের ভাবমূর্তি স্তিমিত হয়ে, বীতশ্রদ্ধার লক্ষণও দেখা দিতে শুরু করেছিল। ঐ মুহূর্তে শেখ মুজিবুর রহমানের উপস্থিতি একান্ত অপরিহার্য হয়ে পড়েছিল।

প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদ-এর নেতৃত্বে ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত আওয়াী লীগ সরকারকে ‘নামকাওয়াস্তে সরকার’ ছাড়া আর কিছুই আখ্যা দেয়া যায় না। এই সরকারের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন না উঠলেও নেতৃত্ব নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল। মুজিবনগর সরকার এদেশে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর গণহত্যা অভিযানের বিরুদ্ধে বাঙ্গালী জাগরণ আর প্রতিরোধ গড়ে তোলার ছত্রছায়া হিসেবে কাজ করেছিল। আসলে মুজিবনগর বলে এমন কোন জায়গা ছিল না। বিদেশে গঠিত (ভারতে) বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকার তাই প্রয়োজনের ডাকে সাড়া দিয়ে একস্থান থেকে অন্যস্থানে ঘুরে বেড়াত।

মুজিবনগর সরকারের ভূমিকার প্রকৃষ্ট প্রমাণ মেলে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর তারিখে। সেদিন ঢাকায় পাকিস্তানী বাহিনীর আনুষ্ঠানিক আত্মসমর্পণের সময়ে এ সরকারের কোন স্থানই ছিল না। তথাপি, তার কিছুদিন পরই আওয়ামী লীগারদেরকে ঢাকায় নূতন দেশে সরকার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা হলো। এর বৈধতার বিরুদ্ধে কোন প্রতিবাদই ওঠেনি সেদিন। কলকাতা থেকে মন্ত্রীবর্গ ঢাকায় এলে তাদেরকে সাদর সম্ভাষণ জ্ঞাপন করা হয়। উপস্থিত অন্যান্য রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের মধ্যে ন্যাপের প্রফেসর মোজাফফর আহমেদ এবং কমিউনিস্ট পার্টির মনি সিংও উপস্থিত ছিলেন।

প্রফেসর মোজাফফর আহমেদ এক পর্যায়ে একটি অন্তর্বর্তীকালীন জাতীয় সরকার গঠনের প্রস্তাব পেশ করেছিলেন। কিন্তু নবগঠিত সরকার তা প্রত্যাখ্যান করেন। সম্ভবতঃ এটাই ছিল ঐ সরকারের প্রথম এবং একমাত্র সঠিক সিদ্ধান্ত।

আওয়ামী লীগে অভ্যন্তরীণ দলীয় কোন্দল আর মন্ত্রীদের মধ্যে বহিঃশক্তির প্রভাব দারুণভাবে পরিলক্ষিত হচ্ছিল। অবশ্য ‘সিংহাসনটি’ তখনও খালি রাখা হয়েছিল।

এই সকল অভ্যন্তরীণ মতভেদ আর ক্ষমতার লড়াই-এর ফলে সৃষ্ট পরিস্থিতি সামলানো সরকারের মুখ্য কর্মে পরিণত হলো। অথচ অন্যদিকে দেশের অতি জরুরী এবং পর্বতপ্রমাণ সমস্যার দিকে নজরই দেয়া হচ্ছিল না। পাকিস্তানী হায়েনাদের হিংস্র থাবার চরম আক্রোশে দেশটি একটি বধ্যভূমি আর ধ্বংস্তূপে পরিণত হয়েছিল। দোকানপাটে ছিল না খাদ্যদ্রব্য কিংবা জীবন রক্ষাকারী কোন ওষুধ। দেশের প্রধান বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী পাট আর চা শিল্প ধ্বংস হয়ে গিয়েছিলো। ভারতে আশ্রয়গ্রহণকারী দেশের এক কোটি শরণার্থী ফিরে আসতে শুরু করল। তাছাড়া, দেশের ভেতরে প্রায় দু’কোটি লোক গৃহহীন হয়ে পড়েছিল। তাদের সকলের আশ্রয় আর খাদ্য-বস্ত্রের সংস্থান ঠিক ঐ মুহূর্তেই অতি জরুরী হয়ে পড়েছিল। কিন্তু যানবাহন, রাস্তাঘাট, ফেরী, সেতু ইত্যাদি চরমভাবে ধ্বংস করে দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থা একেবারে বিকল ও স্থবির করে দেয়া হয়েছিল। আন্তর্জাতিক রিলিফ সামগ্রী জায়গামত পৌঁছানো এক অলৌকিক ব্যাপারে পরিণত হলো। ঐ ধ্বংসস্তূপের মাঝে জনগণকে বাঁচানো আর একটা আসন্ন দুর্ভিক্ষকে ঠেকানোর জন্যে বাংলাদেশের ২৫ লক্ষ টন খাদ্য সামগ্রী একান্তই প্রয়োজন হয়ে পড়লো। কিন্তু আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছ থেকে এসব আসতে শুরু করল। দেশের ৬০,০০০ গ্রামে তা পৌঁছানো একরকম অসম্ভব হয়ে পড়েছিল। এদিকে ক্ষমতার লড়াই-এ খন্দকার মোশতাক আহমেদ গদিচ্যুত। মুজিবনগর সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ঢাকায় এসে দেখেন তারই জুনিয়র সহকর্মী, আবদুস সামাদ আজাদ তার গদি দখল করে বসে আছেন। প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদই মোশতাক আহমেদকে সরিয়েছিলেন। কারণ, মোশতাক পাকিস্তানের ভাঙ্গন এড়ানোর জন্যে আমেরিকার সঙ্গে গোপন ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়ে পড়েছিলেন। উদ্দেশ্য ছিল পাকিস্তানের সঙ্গে একটা রাজনৈতিক সমঝোতায় পৌঁছানো। চীনদেশে প্রেসিডেন্ট নিক্সনের ঐতিহাসিক সফরের আয়োজন করছিলেন ডঃ হেনরী কিসিঞ্জার। পাকিস্তানকে রাজনৈতিক সমাধানে পৌঁছুতে সহায়তা করে, ঐ সফরের ক্ষেত্র প্রস্তুতের জন্যে পাকিস্তানকে যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করাই ছিল তার উদ্দেশ্য। এ উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে আমেরিকা খন্দকার মোশতাকের সঙ্গে গোপন চুক্তিতে আবদ্ধ হবার সলাপরামর্শ শুরু করেছিলেন। মোশতাকের এ রাষ্ট্রবিরোধী চক্রান্ত তার সহকর্মীরা ভুলতে পারেনি। ঐ কর্মের ফলশ্রুতিতেই তার গদিচ্যুতি ঘটেছিল।

খন্দকার মোশতাক এ অপমান কষ্টে হলেও হজম করে নিলেন। কিন্তু তা তিনি ভুলেননি। পরে যখন সুযোগ এলো, তিনি তার অপমানকারীদের উপর চরম প্রতিশোধ নিয়েছিলেন।

দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি ঘটে গেলো। সাড়ে তিন লাখেরও বেশী আগ্নেয়াস্ত্র সাধারণ মানুষের হাতে রয়ে গেলো। বিভিন্ন ধরনের অভাব-অনটনে মানুষ হয়ে উঠলো অতিমাত্রায় বেপরোয়া। সর্বোপরি, প্রচুর অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত ‘গেরিলা বাহিনী’ সরকারের অবাধ্য হয়ে উঠেছিল। তাদের নেতৃত্বে ছিল শেখ মনি, নুরে আলম সিদ্দিকী, তোফায়েল আহমেদ, শাহজাহান সিরাজের মত ছাত্রনেতৃবৃন্দ। শেষ মুজিব ছাড়া অন্য কারও নির্দেশ শুনতে তারা অস্বীকৃতি জানালো। সুতরাং অবিলম্বে শেখ মুজিবের ঢাকায় প্রত্যাবর্তন অনিবার্য হয়ে পড়লো।

শেখ মুজিবের ঢাকা ফেরার পালা। নয়া দিল্লীতে স্বল্পক্ষণের যাত্রাবিরতি করবেন বলে মুজিব মনস্থ করলেন। দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে সক্রিয় সহযোগিতা প্রদানের জন্যে ভারতকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করাই এ যাত্রাবিরতির উদ্দেশ্য। ২১ বার তোপধ্বনির মাধ্যমে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপ্রধানের রাষ্ট্রীয় সম্বর্ধনার সূচনা করা হলো। নয়া দিল্লীতে আয়োজিত সেদিনের সেই লাল গালিচা সম্বর্ধনা উপস্থিত সকলকেই অভিভূত করেছিল। সেদিন ১০ই জানুয়ারী, ১৯৭২ সাল। ভোরবেলা। পালাম বিমান বন্দরে শেখ মুজিবুর রহমানকে অভিবাদন জ্ঞাপনের জন্যে উপস্থিত হয়েছেন, প্রেসিডেন্ট ডঃ ভি. ভি. গিরি, প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী, ভারতীয় প্রতিরক্ষা বাহিনীর তিন প্রধান, কেবিনেট মন্ত্রীবর্গ আর কূটনৈতিক মিশনের সদস্যবৃন্দ। সর্বোপরি, সর্বভারতীয় আপামর জনসাধারণের কণ্ঠস্বর, ‘অল ইন্ডিয়া রেডিও’র মনমাতানো ধারা বিবরণী।

ঐ সকালে সমগ্র ভারতের প্রাণের স্পন্দন যেন নয়া দিল্লীতে অনুভূত হচ্ছিল। প্রাণঢালা সম্বর্ধনার কোন দিকই সেদিন বাদ পড়েনি। শেষ মুজিব অপ্রত্যাশিত এ সম্বর্ধনায় বিমোহিত হয়ে পড়েন।

এর কয়েক ঘণ্টা পরেই মুজিব ঢাকার মাটিতে পা রাখেন। ঢাকায় প্রদত্ত সম্বর্ধনায় তিনি আরও অবাক বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে পড়েন। সব মিলিয়ে তাকে মানব দেবতায় পরিণত করার সকল ব্যবস্থা সম্পন্ন হলো।

লন্ডন থেকে ঢাকায় ফিরে শেখ মুজিব আমাকে বলেছিলেন, ‘নিজ দেশে এবং আমার জনগণের মাঝে ফিরে আসতে পেরে আমার মন আনন্দে নেচে উঠেছিল। কিন্তু তারপরই আমাকে হতে হলো ইতিহাসের ভয়াবহতম মানবসৃষ্ট দুর্যোগের মুখোমুখি। ওরা আমার তিরিশ লাখ লোক হত্যা করেছে। বর্বরেরা আমাদের মা-বোনদের ধর্ষণ করেছে। আর বাচ্চা ছেলেমেয়দেরকে কতল করেছে। দেশের ঘ-বাড়ীর তিরিশ শতাংশেরও বেশী ধ্বংস করে দিয়েছে। বাংলাদেশকে ওরা নিঃশেষ করে দিয়ে গেছে। দুর্ভিক্ষের সম্ভাবনা প্রকট। আমাদের সহায়তার প্রয়োজন। ‘

দেশের কারেন্সী, খাদ্য, শিল্প, বাণিজ্য, প্রতিরক্ষা, প্রশাসন ইত্যাদি নিয়ে তাঁর দুশ্চিন্তার অন্ত ছিলো না। কিন্তু তা খুব স্বল্প সময়ের জন্যে। দ্রুতগতিতে আবার তাঁর মতিগতিতে পরিবর্তন পরিলক্ষিত হলো। হাওয়া থেকে পাওয়া শক্তিতে তিনি যেন আবার আস্থা ফিরে পেলেন। তিনি আবারও মানব দেবতায় পরিণত হলেন।

শেখ মুজিবের ঢাকায় প্রত্যাবর্তনের ফলে দেশের ভেতরে গৃহযুদ্ধের সম্ভাবনা দূরীভূত হলো এবং দেশের ভেতরে সরকারে কর্তৃত্বের যে প্রকট অভাব দেখা দিয়েছিল তাও এতক্ষণে স্তিমিত হয়ে গেল। কিন্তু এতে করে সশস্ত্র দলের অপারেশন, মন্ত্রী পরিষদের ভেতরে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব ইত্যাদি সমূলে উৎপাটিত হলো না। মুজিবের উপস্থিতি কেবলই ঐ সবের উপরে একটি ক্ষণস্থায়ী আবরণের সৃষ্টি করেছিল।

শুরু হলো শেখ মুজিবের রাষ্ট্র পরিচালনার কাজ। তিনি জাতির পিতা বা দেশের প্রেসিডেন্ট না হয়ে তিনি যেন আওয়ামী লীগের প্রেসিডেন্ট-এ পরিণত হলেন। তিনি তার রাজনৈতিক সমর্থকদের বিভিন্ন চক্রান্তে নিজেকে জড়িয়ে ফেললেন। চক্রান্তকারীরা তার হাতে সর্বময় ক্ষমতা রাখার প্ররোচনা যোগাল। তাই তিনি দেশের প্রথম প্রেসিডেণ্ট না হয়ে প্রথম প্রধানমন্ত্রীর পদটি বাছাই করে নিলেন।

আগেই বলা হয়েছে, প্রেসিডেন্ট-এর পদটি শেখ মুজিবের জন্যে খালি রাখা হয়েছিল। প্রকৃতপক্ষে, লন্ডনে পৌঁছুলে তাঁকে প্রেসিডেন্ট হিসেবেই সম্বর্ধনা জানানো হয়। এবং সকলেরই এই ধারণা ছিল যে, তিনি প্রেসিডেন্ট হিসেবেই দেশের কার্যভার পরিচালনা করে যাবেন। কিন্তু ওয়েষ্টমিসটার স্টাইলের সরকার প্রধান শেখ মুজিব হলেন, দেশের শাসনকার্য পরিচালনার ক্ষমতা দিতে হবে প্রধানমন্ত্রীর উপর। তাহলে তাজউদ্দিন আহমেদ সে ক্ষমতার অধিকারী হয়ে পড়েন। মুজিবের দৃষ্টিভঙ্গি ছিল খুবই সংকীর্ণ। ক্ষমতার ব্যাপারে তিনি সব সময়ই একমুখো ধারায় বিশ্বাসী ছিলেন। সুতরাং ক্ষমতার জন্যে প্রয়োজনবোধে তিনি প্রধানমন্ত্রী হবেন—এ আর বিচিত্র কি। সাংবিধানিক পদ্ধতি অনুযায়ী দেশের সর্বময় ক্ষমতা প্রধানমন্ত্রীর হাতে অর্পিত হলে, তিনি প্রধানমন্ত্রী হবেন। আর যদি পদ্ধতি অনুযায়ী সর্বময় ক্ষমতা ‘প্রেসিডেন্ট’-এর হাতে অর্পিত হয়, তাহলে তিনি ‘প্রেসিডেন্ট’ পদটিই বেছে নেবেন। তাঁর পরিবারের লোকজন আর তাঁর নির্বোধ, চাটুকার উপদেষ্টাগণ তাকে দেশের সর্বময় ক্ষমতা গ্রহণের জন্যেই প্ররোচিত করলেন। কারণ, যত বেশী ক্ষমতা তাঁর হাতে থাকবে, তত বেশী অনুগ্রহ আর সম্পদের ফোয়ারা বইতে থাকবে চাটুকারদের মাথার উপরে।

প্রশাসন পরিচালনার যথেষ্ট দক্ষতা তাজউদ্দিন আহমেদ-এর ছিলো। কিন্তু তার সিনিয়র সহকর্মীরা কখনই তা পুরোপুরি মেনে নেননি। এমনকি মুজিবনগর সরকারের দিনগুলোতেও তাজউদ্দিনকে ভারতীয় সহায়তায় উচ্চপদে আসীন করা হয়েছে বলে তারা দুঃখ প্রকাশ করেছেন। তাজউদ্দিনের দক্ষতা থাকলেও তাঁরা তাকে ‘ভূঁইফোঁড়’ লোক বলে মনে করতেন। ‘ভারতপন্থী’ বলে একটি দুর্নাম তার নামের সঙ্গে বেঁধে দিয়ে তার অবস্থানকে অসুন্দর করে তোলা হলো।

শেখ মুজিব ঠিকই তাজউদ্দিনকে একপাশে সরিয়ে দিয়ে নিজেই প্রধানমন্ত্রী হয়ে বসলেন। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে রাষ্ট্র প্রধানের পদটি যেন তাঁর জন্যে পথের কাঁটা না হয়, সে ব্যাপারেও তিনি নিশ্চিত হয়ে নিলেন। আর সে কারণে তিনি অতিশয় ভদ্র এবং চরমভাবে অনুগত একটি অরাজনৈতিক ব্যক্তিত্বকে বাছাই করলেন। তিনি হলেন,

বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী। জনাব চৌধুরী মুজিবনগর সরকারের আন্তর্জাতিক মুখপাত্র হিসেবে পৃথিবী জোড়া খ্যাতি অর্জন করেন। প্রেসিডেন্ট চৌধুরী ছিলেন অতিমাত্রায় অনুগত। এবং তাঁর ভূমিকা সম্বন্ধে কোন রকম ভুল বুঝাবুঝি যাতে না হতে পারে, সে জন্যে তিনি তাঁর কোটের উপর একটা বড় মুজিব ব্যাজ ধারণ করতেন।

মুজিব শাসনের গোড়ার দিকে গণভবনের দৃশ্য ছিল মোগল শাসনের বিংশ শতাব্দীর নমুনা বিশেষ। সচিবালয়ে শেখ মুজিবের একটি অফিস থাকলেও তিনি খুব কম সময় সেখানে কাটাতেন। তাঁর সরকারি বাসভবন ছিল ‘গণভবন’। ঐ গণভবনকে তিনি তাঁর ব্যক্তিগত অফিসের মত ব্যবহার করতেন। তাঁর রুচি মাফিক ওখানে বিশ্রামের পরিবেশ সৃষ্টি করা হয়েছিল। ওখানে দলীয় লোকজন ও আবেদন-নিবেদনকারীরা দলে দলে ভিড় জমাতো। কেউ কেউ তাদের বঙ্গবন্ধুকে ফুলের মালা গলায় পরিয়ে দিতো, পা ধরে সালাম করতো, এমনকি কেউ বা তাঁর গলা জড়িয়ে ধরে উচ্চস্বরে কান্নায় ভেঙ্গে পড়তো। শেখ মুজিবও তাদের আবেগ উচ্ছ্বাস-এর সঙ্গে সজলচোখে একাত্ম হয়ে যেতেন। এরই ফাঁকে তিনি তাঁর কোন মন্ত্রীর সঙ্গে চুপিসারে আলাপ করে নিতেন। এমনকি রাষ্ট্রীয় কোন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সরকারী আমলাদেরকে নির্দেশও প্রদান করতেন। উপরন্তু, পৃথিবীর সর্বকনিষ্ঠ রাষ্ট্রের মুকুটহীন রাজাকে দেখতে আসতো এমন সব রিপোর্টার কিংবা ভিআইপিদেরকে সেখানেই তিনি সাক্ষাৎ দান করতেন।

শেখ মুজিবের কাছে যারা আবেদন-নিবেদন কিংবা সাহায্যের প্রত্যাশা নিয়ে আসতো, তাদের কাউকে তিনি বিমুখ করতেন না। তাদের প্রত্যেককেই তিনি তাঁর স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে আদর করে হাত বুলিয়ে দিয়ে বলতেন, ঠিক আছে যা, আমি ব্যাপারটি দেখছি। কিন্তু ঐ দেখা, তাঁর খুব কমই হয়ে উঠতো। পরে, মুসা নামে আমার এক সাংবাদিক বন্ধু শেখ মুজিবের হত্যা সম্বন্ধে বলতে গিয়ে বলেছিলেন, তিনি সবকিছুই করে দেবেন বলে প্রতিজ্ঞা করতেন এবং সব প্রতিজ্ঞাই বেমালুম ভঙ্গ করতেন।

অল্পদিনের মধ্যেই তাঁর এ দ্বিমুখী ভূমিকা পুরো ব্যবস্থাপনার মধ্যে অশুভ ফল দিতে শুরু করে। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দেশকে সঠিক পথে পরিচালনার জন্যে তাঁর সরকারের ভেতরে কঠোর শৃঙ্খলা/নিয়মতান্ত্রিকতা ঢুকিয়ে দেয়া প্রয়োজন ছিল। কিন্তু তিনি তা করতে পারলেন না। তিনি বঙ্গবন্ধু। স্বভাবগত তিনি অত্যন্ত উদার আর দয়ালু। একই সঙ্গে তিনি বঙ্গবন্ধু এবং দেশের প্রধানমন্ত্রী। দুই বিপরীত মেরুকে একত্রে মিলাতে গিয়েই অনিবার্যভাবে বিপর্যয়ের দিকে ধাবিত হতে লাগলেন।

প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হবার অল্প কিছুদিনের মধ্যেই দেশের অবস্থা কোন্ দিকে মোড় নিচ্ছিল তার একটি জ্বলন্ত উদাহরণ দিচ্ছি। ঈদুল আযহার অল্প কিছুদিন বাকী। আদমজী জুট মিলের কর্মচারীদের বকেয়া পাওনা সুরাহাকল্পে প্রত্যেকের এক মাসের বেতনের সমপরিমাণ টাকা তক্ষণই পরিশোধ করার জন্যে বঙ্গবন্ধু নির্দেশ প্রদান করলেন। পৃথিবীর বৃহত্তম জুটমিলের উপবাসী শ্রমিকদের মধ্যে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়ে গেছে।

পরদিন সকাল সাড়ে নয়টায় আমি মিলে পৌঁছলাম। কমপক্ষে তিন হাজার লোক গেটের বাইরে লাইন ধরে উৎফুল্লচিত্তে অপেক্ষা করছে। মিলের ভেতরে পে-মাস্টার সুসংগঠিত। কম্পাউন্ডে ডজনখানেক টেবিল সাজানো হয়েছে। প্রত্যেক টেবিলে একজন করে কেরানী, তার সামনে টালিবই, টিনের তৈরী টাকার বাক্স, কলম ও কালির দোয়াত। নাই কেবল টাকা। পে-মাস্টার বললেন, ঢাকা থেকে টাকা আসছে। আমরা টাকার জন্যেই অপেক্ষা করছি।

তারা অপেক্ষা করছে তা করছেই। বেলা দুটো বেজে গেলো। টাকার কোন পাত্তা নেই। অপেক্ষারত কর্মচারীরা এক পর্যায়ে রোষে ফেটে পড়লো। দেয়ালের ওপাশ থেকে ইট-পাটকেল এসে পড়তে শুরু করলো। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশিত টাকা তারা পেতে চায়। পে-মাস্টার উপায়ান্তর না পেয়ে জেলা প্রশাসনকে খবর পাঠালেন। জেলা প্রশাসক পুলিশ পাহারাকে জোরদার করার জন্যে সেনাবাহিনীর একটি দলকে পাঠানোর ব্যবস্থা করলেন।

সাংঘাতিক কিছু ঘটে যাবার আগেই তাদের একজন বঙ্গবন্ধুর কাছে খবর পাঠিয়ে দিলো। দু’ঘণ্টা পরে আমরা গণভবনে পৌঁছে গেলাম। একজন তরুণ অফিসার তখন মুজিবকে আদমজী মিলে উদ্ভূত পরিস্থিতির বর্ণনা দিচ্ছে। শুনে মুজিব ক্ষেপে গেলেন। তিনি বিশ্বাস করতে পারছিলেন না যে, তাঁর নির্দেশ পালিত হয়নি।

মুজিব জিজ্ঞেস করলেন, ‘তাদের টাকা দেয়া হয়নি কেন?’ আমি নির্দেশ দিয়েছিলাম আজ সকালের মধ্যে তাদের টাকা মিটিয়ে দেয়ার জন্যে। এর জন্যে দায়ী কে?

শেখ মুজিব রেগে আগুন হয়ে উঠলেন। ব্যক্তিগত সহকারী এবং সহকারী সচিববৃন্দ জনতার ভিড়ে এদিক-ওদিক কাউকে যেন খুঁজে ফিরছিলেন। অবশেষে খুঁজে বের করে অর্থমন্ত্রণালয়ের জনৈক কর্মকর্তাকে মুজিবের সামনে নিয়ে আসা হলো। ঐ কর্মকর্তা জানালো যে, নতুন নিয়ম অনুযায়ী কোন মিল এক লক্ষ টাকার বেশী ড্র করতে পারবে না। সে বঙ্গবন্ধুর, বিশেষ অনুমোদন এবং স্বাক্ষরের জন্যে অপেক্ষা করছিল। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর সাক্ষাতে আসা অসংখ্য দর্শনার্থী, দলীয়কর্মী, পুরানো বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজনের ভিড়ে তাঁর এমনিতেই তখন দম বন্ধ হবার উপক্রম। মন্ত্রীবর্গ, ঊর্ধ্বতন সরকারী কর্মচারী এবং তাঁর দাফতরিক অভিভাবকবৃন্দ রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ কাজের সামনে এই ব্যাপারটিকে নিয়ে তাকে মাথা না ঘামাতে অনুরোধ জানালেন। মুজিব অবশেষে তাঁর এক সিনিয়র আওয়ামী লীগারকে বললেন, ‘তুমি এক্ষুণি নারায়ণগঞ্জে চলে যাও।’ এবং কর্মচারীদের বল যে, ইন্‌শাল্লাহ, আগামীকাল তাদের পাওনা অবশ্যই মিটিয়ে দেয়া হবে।

মিলের ঐ তরুণ অফিসারটিকে বিলম্বিত লাঞ্চ-এ ডাকা হলে সে দুঃখ করে বলেছিল, ‘বঙ্গবন্ধু বৃষ্টি হবার জন্যে নির্দেশ দিতে জানেন। কিন্তু বৃষ্টি কেন হয় না, তা তিনি বুঝতে চান না। খোদা আমাদের সহায় হোন।

প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ, ফরিদপুর জেলার টুঙ্গীপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন পরিবারের ছয় ভাই-বোনের একজন। পরিবারটি মধ্যবিত্ত শ্রেণীর। তাঁর পিতা শেখ লুৎফর রহমান স্থানীয় জেলা কোর্টে চাকুরী করতেন। শেখ মুজিব গোপালগঞ্জ মিশন স্কুলে ভর্তি হলে, বেরিবেরি রোগে আক্রান্ত হলে লেখাপড়া বাধাগ্রস্ত হয় এবং তা তাঁর চোখের দৃষ্টির স্থায়ীভাবে ক্ষতিসাধন করে। তিনি ২২ বছর বয়সে হাইস্কুলের পড়া শেষ করেন।

অল্প বয়সেই এমন সব গুণাবলী তাঁর চরিত্রে পরিলক্ষিত হয়েছিল, যাতে করে ভারতীয় উপমহাদেশের রাজনীতিতে তিনি যে একদিন কেন্দ্রীয় ভূমিকায় অবতীর্ণ হবেন তা পরিষ্কার হয়ে উঠেছিল। তাঁর একটা গুণ ছিল অতিমাত্রায় ‘সমাজ সচেতনতা’ আর ছিল রাজনীতির প্রতি অদম্য আগ্রহ। মাত্র দশ বছর বয়সে নিজের ঘর থেকে ক্ষেত মজুরদের চাল বিতরণ করতে গিয়ে ধরা পড়ে যান। জিজ্ঞেস করলে মুজিব তাঁর পিতাকে বললেন, তাদের তো খাবার কিছুই নেই। আমাদের এগুলোর সবই আছে। ১৯ বছর পরে মুজিব যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের ছাত্র তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের অঙ্গনে মিনিয়্যাল স্টাফদের সমর্থন করতে গিয়ে আড়াই বছর কারাবরণ করেন। কিন্তু এর আগে, তার বয়স যখন ১৭, বৃটিশ বিরোধী এক বিক্ষোভ মিছিলের পুরোভাগ থেকে তাকে ধরে নিয়ে জেলে ঢুকানো হয়। জেল হয়েছিল ছয় দিনের। এই জেলের অভিজ্ঞতা তাকে রাজনীতির প্রতি আরও বেশী আকৃষ্ট করে তোলে।

১৯৪৮ সালের মার্চ মাসে পাকিস্তানের ‘জাতির জনক’ মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর বক্তব্য শুনতে উপস্থিত হন পল্টন ময়দানে। বক্তৃতায় জিন্নাহ উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা ঘোষণা করার সঙ্গে সঙ্গে উপস্থিত ছাত্র-জনতা প্রতিবাদে ফেটে পড়ে। তারা এ প্রতিবাদের ঝড় রাজপথে নিয়ে আসে। দেখতে দেখতে তা সারা প্রদেশে ছড়িয়ে পড়ে। ঐ কারণে দলীয় নেতৃবৃন্দের একজন হিসেবে শেখ মুজিবকে জেলে ঢুকানো হলো। জেল দেয়া হলো সাত দিনের। ঐ ভাষা আন্দোলনই ক্রমান্বয়ে তাঁর জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল।

লন্ডন থেকে ঢাকা প্রত্যাবর্তনের দু’সপ্তাহ পরের কথা। শেখ মুজিবের অভিষেক পর্ব শেষ হয়েছে। আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম লন্ডনে থাকতে দেশে ফিরে জনগণকে ঘুরে ঘুরে দেখার যে পরিকল্পনা তিনি করেছিলেন, তা তখনও তাঁর পরিকল্পনায় রয়েছে কিনা। আমার প্রশ্নে মুজিব অপ্রতিভ হয়ে পড়েন। রুক্ষভাবে তিনি আমাকে পাল্টা প্রশ্ন করলেন, ‘আমি এখন তা করি কিভাবে? তুমি কি দেখতে পারছ না, আমাকে দেশের জন্যে একটা প্রশাসন দাঁড় করাতে হচ্ছে? তিনি তাঁর ব্যক্তিগত ইচ্ছামতই তা করছিলেন। এতে করে দেশের সর্বোচ্চ থেকে সর্বনিম্ন সব জায়পাতেই নিষ্কর্মা, চাটুকারদের দল ভারী হয়ে উঠতে লাগলো। দেশের প্রতিটি রন্ধ্রে রন্ধ্রে স্বজনপ্রীতি আর দুর্নীতি এক অতি সাধারণ ব্যাপারে পরিণত হলো।

প্রতিরক্ষা বাহিনীতে মুক্তিযোদ্ধা নামে দু’টি শিবিরের সৃষ্টি হয়ে গেলো। ৩৫,০০০ অফিসার ও জোয়ান পাকিস্তানে দীর্ঘদিন আটক থাকার পর দেশে ফিরে এলে অবস্থা অধিকতর ঘোলাটে হয়ে উঠলো। প্রতিরক্ষা বাহিনীতে ‘মুক্তিযোদ্ধা’ আর ‘স্বদেশ প্রত্যাগত’- এই ভেদাভেদ সৃষ্টির কারণে রেষারেষি আর বিশৃঙ্খলা চরমে উঠলো। পরিণামে এটাই শেখ মুজিব, জেলে চারনেতা এবং প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের গুপ্তহত্যার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। দুঃখজনকভাবে ঐ সকল হত্যাকাণ্ডের জন্যে মুক্তিযোদ্ধারাই এককভাবে দায়ী ছিলেন।

১৯৭২ সালের মার্চ মাস শেষ হয়ে এসেছে। ঢাকায় এক জমজমাট গুজব ছড়িয়ে পড়েছে। অতিরিক্ত কাজের চাপে মুজিব অসুস্থ। তাই স্বাস্থ্য আর প্রশাসনিক প্রয়োজনে মুজিব পুনরায় তাজউদ্দিন আহমেদকে প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করছেন। আওয়ামী লীগকে পুনর্গঠনকল্পে মুজিব সরকারী দায়িত্ব থেকে সরে দাঁড়াচ্ছেন। তাজউদ্দিনকে জিজ্ঞেস করলে তিনি পরিষ্কারভাবে জানালেন, ‘কেউ আমার গলা কাটার চেষ্টা করছে।’ এ ব্যাপারে মুজিবের প্রতিক্রিয়াও ঠিক সেই পরিমাণ তীক্ষ্ণ ছিল। তিনি আমাক বললেন, ‘তারা কি মনে করে যে, আমি সরকার পরিচালনায় অক্ষম?’ সুস্পষ্টভাবেই স্বার্থান্বেষী মহলের উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এ গুজব প্রত্যাশিত লক্ষ্য অর্জন করেছিল। তারপর থেকেই মুজিব, তাজউদ্দিনকে সন্দেহের চোখে দেখতে শুরু করলেন এবং তাকে সাবধানতার সঙ্গে পর্যবেক্ষণ করছিলেন।

শেখ মুজিব এক অব্যক্ত অস্থিরতার মধ্যে দিন কাটাচ্ছিলেন। তিনি যতটা খুশীর ভান করতেন, আসলে ততটা খুশী তাঁর মনের কোণে জমা ছিল না। তাঁর সারাটি জীবনই কেটেছে মাঠে-ময়দানে, সাধারণ মানুষের মুখোমুখি হয়ে। আজ তিনি তাদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছেন। প্রশাসকের আবরণটাই তাঁর জন্যে কাল হয়ে দাঁড়িয়েছিল।

বাংলাদেশের পূর্ববর্তী ন’মাসের নাটকীয় ঘটনা প্রবাহ—আর যে চরম আত্মত্যাগ এবং দেশাত্মবোধের প্রমাণ দেখিয়েছিল এদেশের জনসাধারণ তা তাঁর বিবেকের মাঝে চিরদিনই একটা ‘শূন্যস্থান’ হিসেবে বিরাজ করার মত। কারাগারে চরম নিঃসঙ্গতার মাঝে সব কাটিয়ে ঐসব ঘটনা প্রবাহের কিছুই তিনি জানতে পারলেন না। সময় তাঁর জন্যে ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো। অথচ জাতি নূতন প্রত্যাশায় এক নবজীবনে পা বাড়ালো। সুতরাং যখন তিনি অন্ধকার থেকে আলোতে আবির্ভূত হলেন, তখন সত্যিকার অর্থে মুজিব যে স্থান থেকে ছিটকে পড়েছিলেন ঠিক সেই স্থান থেকেই আবার যাত্রা শুরু করলেন। সময়ের ব্যবধানে সৃষ্ট শূন্যতাকে পূরণ করার ক্ষমতা তার ছিল না। সে চেষ্টাও তিনি করেননি। তিনি ভয়ঙ্করভাবে ভুল করে যেতে লাগলেন। এভাবে বাংলাদেশের গঠনমূলক দিনগুলোতে বিকৃতির সূচনা হলো। ছয় মাসের মধ্যেই বিদ্রোহের বীজ রোপিত হয়ে গেলো।

মেজর ফারুক ঐ সমস্ত ঘটনাবলীর স্মৃতিচারণ করে বলল, ‘তিনি আমাদেরকে যদি ঘাস খেতে বলতেন, আমরা তাই খেতাম, যদি তিনি আমাদের খালি হাতে মাটি খুঁড়তে বলতেন, আমরা তাঁর জন্যে তাই করতাম। অথচ দেখুন, তিনি আমাদের সঙ্গে কি আচরণটাই না করলেন।

রিপভ্যান উইংকল বিছানার ভুল-পার্শ্ব থেকেই কেবল জাগলেন না, তিনি যাত্রাও শুরু করলেন ভুল পথে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *