দ্বিতীয় অধ্যায় – মণিপুরী বা মিতাই রাজবংশাবলী
১ পাখংবা
২ খৈ
৩ তনথিম
৪ কোয়েনিং গোয়েলবা
৫ পুনসিবা
৬ কনুখংবা
৭ মকুকখম্বা
৮ মনুপম্বা
৯ সমুরেবং
১০ কোলথৌবা
১১ ননুখিং অং
১২ খোস্তেকাছা
১৩ কোরলেহা
১৪ জায়বা
১৫ আয়ব
১৬ নিংলৌচেং
১৭ ইপল লালখৌবা
১৮ জালাওকৈপাম্বা
১৯ এরংবা
২০ সৈয়েম্বা
২১ লোতিরাংবা
২২ জোনয়ইরেলবা
২৩ ইউরেলথবা
২৪ থাউলথবা
২৫ চিতলথবা
২৬ থিংবৈছেনথবা
২৭ পুরলথবা
২৮ খোম্বা
২৯ মৈরম্বা
৩০ থংবিললথবা
৩১ খোংয়ম্বা
৩২ খেলহুবা
৩৩ লেইজলবা
৩৪ পুনসেবা
৩৫ নিংখৌখোম্বা
৩৬ কেয়ম্বা
৩৭ কোইরেম্বা
৩৮ লমচিংমনবা
৩৯ নোনাগিয়েল খোম্বা
৪০ কপোম্বা
৪১ তনংচোম্বা
৪২ চলুম্বা
৪৩ মৈয়াঙম্বা
৪৪ খকেম্বা
৪৫ খুলচোম্বা
৪৬ পখোম্বা
৪৭ চেরাইরংবা
৪৮ পাম হেইবা (করিম নওয়াজ)
৪৯ খখিলালথৌবা
৫০ নিংথৌখম্বা (ভরতসা)
৫১ মরম্বা (গৌরীশ্যাম)
৫২ চিং থংখম্বা (জয়সিংহ)
৫৩ মধুচন্দ্ৰ
৫৪ চৌরাজিৎ
৫৫ মারজিৎ
৫৬ গম্ভীর সিংহ
৫৭ নরসিং (সেনাপতি)
৫৮ দেবেন্দ্ৰসিংহ
৫৯ চন্দ্রকীর্ত্তি (গম্ভীরের পুত্র)
৬০ সুরচন্দ্র
৬১ কুলচন্দ্ৰ
৬২ চূড়াচাঁদ (নরসিংহের বংশধর)
মণিপুরের ইতিহাস
ত্রিপুরা রাজ্যের উত্তর-পূর্বকোণে এবং কাছাড় জেলার পূর্বদিকে মণিপুর রাজ্য অবস্থিত। এই রাজ্যের প্রকৃত ॥২৬৮॥ নাম মিতই- লেইপাক। মিতাই অর্থ মিশ্রজাতি; লেইপাক অর্থ মাটি, ভূমি। ইহার যৌগিক অর্থ মিশ্রজাতির বাসভূমি। শ্রীহট্ট নিবাসী অধিকারী ব্রাহ্মণগণ ইহাকে “মণিপুর আখ্যা দান করিয়াছেন। মহীভারতের ভৌগলিক তত্ত্ব জ্ঞাত থাকিলে তাঁহারা কখনই এই কুকার্য্য করিতেন না, এজন্যই আমরা ইহাকে জাল-মণিপুর বলিয়া থাকি।[১]
মিতাইলেইপাক পর্বত মধ্যস্থিত একটী সুন্দর দুন। পুরাকালে সেই দুন “লপ্তক” হ্রদ মধ্যে নিমজ্জিত ছিল। সেই হ্রদের মধ্য দিয়া “ইম্ফালতুরেল” ও অন্যান্য নদী প্রবাহিত হইতেছে। সেই সকল নদী প্রবাহিত কদম রাশিদ্বারা॥ ২৬৯॥ প্রথমত, ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দ্বীপ গঠিত হইয়াছিল। ক্ৰমে ক্ৰমে নদী প্রবাহিত কদমদ্বারা সেই সকল ক্ষুদ্র দ্বীপ সংযুক্ত হইয়া চারিটি অপেক্ষাকৃত বৃহৎ দ্বীপ গঠিত হয় যথা, মৈয়াং খোমান, আঙম, এবং লোয়াং। কামরূপের প্রবল উন্নতির সময় নির্বাসন দণ্ডের উপযুক্ত ব্যক্তিদিগকে এই সকল দ্বীপে ছাড়িয়া দেওয়া হইত। ক্রমে ঐ সকল নির্বাসিত ব্যক্তিগণ নাগা কুকি প্রভৃতি জাতীয় রমণীগণের সংযোগে এক ভিন্ন জাতীয় মানবের সৃষ্টি করিল[২]। ইহারাই মিতাই (মণিপুরী বা মেখলী) দিগের পিতৃপুরুষ। ক্রমে চারিটি দ্বীপ সংযুক্ত ॥২৭০॥ হইয়া “মিতাই লেইপাক” দুন গঠিত হইয়াছে। এই দুনটি ক্রমে উত্তর হইতে দক্ষিণদিকে ঢালু হইয়া গিয়াছে। ইহার দক্ষিণ পার্শ্বে অদ্যাপি লগতাক্ সরোবরের কিয়দংশ বর্ত্তমান রহিয়াছে। মণিপুর দুন, সমুদ্র বক্ষ হইতে প্রায় ১৬৬৭ হস্ত উর্দ্ধে অবস্থিত। ইহার আকৃতি বাদামী। ইহার দৈর্ঘ্য উত্তর-দক্ষিণে ৩৬ মাইল। পূর্ব পশ্চিমে পরিসর ২০ মাইল। পরিমাণ ফল ৬৫০ বর্গমাইল। ইহাই প্রকৃত মিতাই লেইপাক বা মণিপুর রাজ্য। ব্রহ্মযুদ্ধের পর গবর্ণমেন্টের সাহায্যে মণিপুরপতি যে সৈন্যদল প্রস্তুত করিয়াছিলেন ক্রমে তদ্বারা চতুঃপার্শ্বস্থিত পার্বত্য প্রদেশ অধিকার করিয়া লইয়াছেন। এজন্যই অধুনা মণিপুর রাজ্যের পরিমাণ ফল প্রায় ৭০০০ বর্গমাইল হইয়াছে। ইহার অধিবাসী সংখ্যা ৭৫ হাজার। রাজস্ব প্রায় বিংশতি সহস্র মুদ্রা। এই রাজ্যের রাজকর্মচারী সৈন্য ও সাধারণ ভৃত্যগণ সকলেই বেতনের পরিবর্তে নির্দ্দিষ্ট পরিমাণ ভূমি জায়গীর প্রাপ্ত হইয়া থাকেন।
মণিপুরের পার্বত্য প্রদেশে ত্রিপুরার ন্যায় বন্যহস্তী প্রাপ্ত হওয়া যায়। তদ্ব্যতীত নানা প্রকার মৃগ, বরাহ এবং ব্যাঘ্র এই অরণ্যে দৃষ্টিগোচর হইয়া থাকে। গৃহপালিত পশুর মধ্যে অশ্ব, মহিষ ও গবয়ই প্রধান। মণিপুরী ঘোড়া (বা গণি) সর্বত্র সুপরিচিত। কিন্তু অশ্ববংশের ক্রমেই অবনতি হইতেছে। মণিপুরে শৃগাল নাই এবং পক্ষী সমূহের মধ্যে অস্মদেশীয় কবিকুলপ্রিয় বসন্তের সহচর কোকিলের নিতান্ত অভাব।
মিতাই (মণিপুরিগণ) মধ্যামাকার, সবলশরীর, সমর প্রিয় কিন্তু অপরিণাদর্শী, অহঙ্কারী এবং পরজাতি বিদ্বেষ্টা। শেষোক্ত গুণটি তাহারা তাহাদের ইষ্টদেবতা গোস্বামী মহায়শদিগের নিকট হইতে গ্রহণ করিয়াছে।৪ বাহ্যাকৃতিতে ইহাদিগকে শান্ত প্ৰকৃতি বলিয়া বোধ হয়; প্রকৃত পক্ষে ইহারা সেরূপ নহে। মিতাইগণ বাঙ্গালিদিগের ন্যায় গো মহিষাদি দ্বারা হালচাষ করিয়া থাকে। মিতাই ভূমিতে ধান্য, কলাই, মুগ, খেসারি, ইক্ষু প্রভৃতি প্রচুর পরিমাণে উৎপন্ন হইয়া থাকে। সিখং ও নিয়েংল নামক স্থানে লবণ প্রাপ্ত হওয়া যায়। খারকোল এবং লৈতাং নামক গ্রামে রেশমের কারখানা আছে। মিতাইগণ প্রায়ই স্ব স্ব গৃহনির্মিত বস্ত্র পরিধান করে। রমণীগণ নানা প্রকার শিল্পকাৰ্য্যে সুপটু। কৃষি ॥২৭২। কার্য্যের অধিকাংশ স্ত্রীলোক দ্বারা সম্পাদিত হয়। পুরুষেরা অতি অল্প কাৰ্য্য করিয়া থাকে, অধিকাংশ সময় ইহারা নানা প্রকার ক্রীড়া কৌতুকে অতিবাহিত করে। মিতাইগণ নিতান্ত অশ্বপ্রিয়। ইহারা কখন কখন অর্থের অভাব হইলে স্ত্রী বিক্রয় করিয়া অশ্বক্রয় করিয়া থাকে। ইহাদিগের দাম্পত্য বন্ধন নিতান্ত শিথিল। প্রয়োজন অনুসারে ইহারা স্ত্রী বন্ধক, বিক্রয় এবং দান করিয়া থাকে। ইহাদের মধ্যে বাল্য বিবাহ প্রায় নাই। বিধবা বিবাহ প্রচলিত আছে। বিবাহের পূর্বে কোনও রমণী কানীন সন্তান প্রসব করিলে সেই সন্তানকে “ধর্মপুত্র” বলে।
পূর্বে উল্লেখ করা হইয়াছে যে, আধুনিক ব্রহ্মদেশের উত্তরাংশে প্রাচীন কালে শ্যানদিগের এক বিস্তৃত রাজ্য ছিল। তাহাদের রাজ্যের নাম পোয়াং। তাহার রাজধানী মাগুয়াংনগরী। ৬৯৯ শকাব্দে (৭৭৭ খ্রিস্টাব্দে) পোয়াংপতির ভ্রাতা শ্যামলুং কোন কাৰ্য্যবশত দূতস্বরূপ ত্রিপুররাজ সভায় প্রেরিত হইয়াছিলেন। ত্রিপুরা হইতে প্রত্যাবর্তন কালে রাজদূত শ্যামলুং মিতাই ভুমির মধ্যদিয়া গমন করেন। তৎকালে উলঙ্গ মিতাইগণ অরণ্যজাত দ্রব্যাদি উপঢৌকন লইয়া তাঁহার নিকট উপস্থিত হইয়াছিল। শ্যামলু মিতাইদিগের অবস্থা দর্শনে বলিলেন, পোয়াংরাজ তোমাদের নিকট হইতে কোনরূপ কর গ্রহণ করিতে ইচ্ছা করেন না, এক্ষণ হইতে তোমরা ॥২৭৩॥ বস্ত্র পরিধান করিবে, ইহাই তোমাদের জন্য রাজকর ধার্য্য হইল। একাদশ শতাব্দী পূর্বে পোয়াং রাজের ভ্রাতা শ্যামলুং যাহাদিগকে “বনমানুষ” বলিয়া বিবেচনা করিয়াছিলেন, অস্মদ্দেশীয় অবাচীন গোস্বামীগণ তাহাদিগকেই চন্দ্ৰ বংশীয় বভ্রুবাহনের বংশধর বলিয়া প্রচার করিয়াছিলেন।
এস্থানে আমরা মিতাই রাজবংশের সম্পূর্ণ ইতিহাস লিখিতে ইচ্ছা করি না। মিতাই রাজ বংশের বংশাবলী প্রকাশ করা হইয়াছে। উক্ত বংশাবলীর শীর্ষদেশে অর্জুন কিম্বা বভ্রুবাহনের নাম দৃষ্ট হইবে না। উক্ত বংশাবলীর মতে পাখংবা মণিপুর রাজ বংশের আদি পিতা। মিতাইগণ বলে “গুরুসিদবা” দেব মানবের অধিপতি তিনি মৃত্যুঞ্জয়। তাঁহার পত্নীর নাম “লাইমেনসিদবি”, তাঁহাদের দুই পুত্র, জ্যেষ্ঠ “সেনামহি,” কনিষ্ঠ “পাখংবা”। পাখংবা নাগকুলের ঈশ্বর, কনিষ্ঠ পুত্র পিতার পরম স্নেহভাজন ছিলেন। এজন্য গুরুসিদবা জ্যেষ্ঠ পুত্রকে অতিক্রম করিয়া কনিষ্ঠকে মিতাইভূমির আধিপত্য প্রধান করেন। মিতাইদিগের জাতীয় ইতিহাস, ভাষা এবং সামাজিক প্রাচীন আচার ব্যবহার অনুসন্ধান করিলে ইহাদিগকে নাগোপাসক অনাৰ্য্য বংশোদ্ভুত কোন জাতি বলিয়া সুন্দর রূপে বিবেচনা করা যাইতে পারে। শকাব্দের সপ্তদশ শতাব্দীর পূর্ববর্ত্তী ইতিহাস অনুসন্ধান করা বিড়ম্বনা মাত্র[৫]। ১৬২৪ শকাব্দে ৪৭ সংখ্যক নরপতি চেরাইরংবা সিংহাসনে আরোহণ করেন। তাঁহার শাসনকালে সামজুকপতি মিতাই রাজ্য আক্রমণ করিয়া পরাভূত হন। মিতাইগণ সেই বৃত্তান্ত অবলম্বন করিয়া “সামজুকঙবা” (সামজুক বিজয়) নামক ক্ষুদ্র গ্রন্থ রচনা করিয়াছিলেন। ১৬৩৬ শকাব্দে চেরাইরংবার পুত্র পামহেইবা সিংহাসনে আরোহণ করেন। ইনি সাধারণত “করিম নওয়াজ”[৬] বা “করিকরিমন—ওয়াজ” নামে পরিচিত। পামহেই বা ত্রিপুরেশ্বর দ্বিতীয় ধর্ম্মমাণিক্যের সমসাময়িক। ত্রিপুরেশ্বর যৎকালে মুসলমানদিগের সহিত বিষম সমরে লিপ্ত ছিলেন, সেই সময় পামহেইবা ত্রিপুরার সীমান্তরক্ষক একদল সৈন্য জয় করিয়া “তখলেংঙবা” (ত্রিপুরা বিজয়ী”) উপাধি ধারণ করেন। মিতাইগণ “তখলেংঙবা” নামক এক ক্ষুদ্র গ্রন্থে উক্ত বৃত্তান্ত লিখিয়াছেন।
পামহেইবার শাসন কালে শ্রীহট্ট নিবাসী অধিকারিগণ মিতাই ভূমিতে গমন পূর্বক সেই দেশকে মণিপুর, এবং অধিপতিকে বভ্রুবাহনের বংশধর বলিয়া প্রচার করেন। তদবধি মিতাইগণ “মণিপুরী” আখ্যা ধারণ পূর্বক হিন্দু শ্রেণীতে প্রবিষ্ট হইয়াছেন। অধিকারিদিগের কৃপায় ইহারা চৈতন্য সম্প্রদায়ের বৈষ্ণব বলিয়া পরিচিত হইয়াছেন। বিষ্ণুভাগবত (শ্রীমদ্ভাগবত), চৈতন্যভাগবত ও চৈতন্য চরিতামৃত ॥২৭৫॥ ইহাদের প্রধান ধৰ্ম্মগ্রন্থ। গোস্বামী মহাশয়গণ মিতাইদিগকে বাঙ্গালিসমাজে স্থাপন করিতে পারিলে আমরা সুখী হইব। কিন্তু নেড়া নেড়ীর ভাব ইহাদিগের মধ্যে সংক্রামিত হইয়াছে বলিয়া বোধ হয়। পামহেইবার উত্তর পুরুষ চিং তুং খোম্বার শাসনকালে নবদ্বীপের গোস্বামিগণ মিতাই ভূমিতে গমন পূর্বক রাজবংশীয়দিগকে মন্ত্র শিষ্য করিয়াছিলেন। গোস্বামিগণ তাঁহাকে ভাগ্যচন্দ্র আখ্যা প্রদান করেন। এই সময় হইতে তাঁহাদিগের একটি জাতীয় নাম, আর একটি হিন্দু নাম দৃষ্ট হয়। ভাগ্যচন্দ্রের সময়ে মণিপুরে “রাসক্রীয়া” সৃষ্ট হয়।
আমরা পূর্বেই বলিয়াছি যে মণিপুরিগণ নিতান্ত অপরিণামদর্শী। এজন্য বারংবার স্বত প্রবৃত্ত হইয়া ব্রহ্মরাজের সহিত আহাবেলিপ্ত হইয়াছে[৭]; চরমে তাহার ফল এই দাঁড়াইল যে, ১৭৭১ শকাব্দে ব্রহ্মরাজ মণিপুর রাজ্য উচ্ছিন্ন করিয়া ফেলিলেন। মণিপুরপতি মারজিত পূর্বেই কাছাড়পতি গোবিন্দচন্দ্র নারায়ণকে রাজ্যচ্যুত করিয়া কাছাড় অধিকার করিয়াছিলেন। এক্ষণ স্বরাজচ্যুত হইয়া কাছাড়ে গমন করত স্বীয় ভ্রাতা চৌরজীত, গম্ভীর সিংহ এবং বিশ্বনাথ সিংহের সহিত ভাগাভাগিতে কাছাড় ভোগ করিতে লাগিলেন। কিন্তু ব্রহ্মরাজ শীঘ্রই তাঁহাদের সুখের বাসা ভাঙ্গিয়া দিলেন। ব্রহ্মসৈন্য আসিয়া কাছাড় জয় করিল। গম্ভীর সিংহ ॥২৭৬ প্রভৃতি ভ্রাতৃগণ কাছাড়পতি গোবিন্দচন্দ্রের ন্যায় ব্রিটিশ গবর্ণমেন্টের আশ্রয় গ্রহণ করিলেন। ১৭৪৬ শকাব্দে গবর্ণমেন্ট প্রথম ব্রহ্মযুদ্ধ ঘোষণা করেন। গম্ভীর সিংহ পঞ্চশত সহচর সহ শ্রীহট্টে উপনীত হইয়াছিলেন। গবর্ণমেন্ট তাহাদিগকে অস্ত্রশস্ত্র দ্বারা সুশিক্ষিত করিয়া “গম্ভীর সিংহলেবী[৮] নামক সৈন্যদল সৃষ্টি করেন। ক্রমে এই দলের সৈন্য সংখ্যা পঞ্চদশ শত হইয়াছিল। প্রথমত কাপ্তান গ্র্যান্ত ওই সৈন্যদলের অধিনায়ক হইয়াছিলেন! তৎপর কাপ্তান পেম্বার্টন তাঁহার সহচর নিযুক্ত হল। গম্ভীর সিংহ ছায়ার ন্যায় সেই সৈন্যদল লইয়া কাপ্তান গ্র্যান্টের সঙ্গে প্রায় দেড় বৎসরকাল ভ্রমণ করিয়াছিলেন। কাপ্তান গ্র্যান্ট গম্ভীর সিংহের অসাধারণ সাহস, বল, যুদ্ধ- কৌশল এবং অলৌকিক বীরত্ব প্রভৃতি গুণরাশি দর্শনে বারংবার তাঁহার অনুকূলে গবর্ণমেন্টে রিপোর্ট করিয়াছিলেন। সেই ভীষণ ব্রহ্মসমরের[৯] প্রায় অবসানকালে কাপ্তান গ্র্যান্ট ব্রহ্মরাজ্যের উত্তরদিকস্থ কাইবো পরগণায় উপনীত হইয়া বিজয়বৃত্তান্ত বর্ণন পূর্বক (১৮২৬ খ্রিঃ অঃ ২৬ জানুয়ারি) টামু হইতে কমিশনর টকার সাহেব নিকট যে রিপোর্ট করেন, তাহার উপসংহারে ॥২৭৭। গম্ভীর সিংহের সম্বন্ধে যাহা লিখিয়াছেন তদপাঠে তাঁহাকে একজন অসাধারণ বীরপুরুষ বলিয়া অনুমিত হয়। ইহার অল্পকাল পরে (১৮২৬ খ্রিঃ অঃ ২৪ ফেব্রুয়ারি) গবর্ণমেন্টের সন্ধি পত্রের[১০] দ্বিতীয় প্রকরণের শেষাংশে ইহা লিখিত হইয়াছে যে, “যদি গম্ভীর সিংহ মণিপুরে প্রত্যাবর্তন করেন, তাহা হইলে ব্রহ্মরাজ তাঁহাকে মণিপুরপতি বলিয়া স্বীকার করিবেন”।[১১]
উক্ত সন্ধিপত্রের মর্ম্মানুসারে গবর্ণমেন্ট গম্ভীর সিংহকে মণিপুর সিংহাসনে স্থাপন করেন। গম্ভীর সিংহের সৈন্যদল দুইজন ইংরেজ সেনাপতির অধীনে রক্ষিত হইয়াছিল। গবর্ণমেন্ট সেই সকল সৈন্যের অস্ত্রাদি যোগাইতেন। ইংরেজ সেনাপতিগণের যত্নে ও গবর্ণমেন্টের ব্যয়ে মণিপুরে প্রায় পঞ্চ সহস্র সৈন্য প্রস্তুত হইয়াছিল। বাঙ্গালাদেশের পূর্ব সীমান্তবাসী অসভ্যদিগকে দমন করা এবং প্রয়োজন অনুসারে ব্রহ্মরাজ্যে উপস্থিত রাখিবার জন্য এই সকল সৈন্য প্রস্তুত করা হয়। এই সৈন্যদল “মণিপুর লেবী” নামে ইতিহাসে পরিচিত হইয়াছে। এই সৈন্যদলই মণিপুরের উন্নতি এবং অবনতির মূল কারণ। এই সৈন্যদলের সাহায্যে মিতাইগণ সপ্ত সহস্র বর্গমাইল ব্যাপী রাজ্যসীমা বিস্তার করিতে। ২৭৮ সক্ষম হইয়াছিল। এই সৈন্যদলের সাহায্যে দুর্দান্ত টীকেন্দ্রজিতের নিদয় সহচর থঙ্গাল জেনারেল, কুইন্টন, প্রিমটয় প্রভৃতি ইংরেজ রাজপুরুষদিগকে বলিদান করিতে সক্ষম হইয়াছিল।
১৭৫২ শতাব্দে মণিপুরীগণ কাছাড়পতি গোবিন্দচন্দ্র নারায়ণের উপাংশু হত্যা সম্পাদন করে।
ব্রহ্মযুদ্ধের পর হইতে মণিপুরের পূর্বদিগস্ত কাইবো পরগণা মণিপুরের রাজদণ্ডের অধীন হয়। ব্রহ্মরাজ ইহাতে অসন্তুষ্ট হইয়া উহা প্রত্যার্পণ করিবার জন্য ব্রিটিস গবর্ণমেন্টকে বারংবার অনুরোধ করেন। এবং ক্ষতিপুরণ স্বরূপ মনিপুরপতিকে বার্ষিক ছয়সহস্র টাকা প্রদান করিতে প্রতিশ্রুত হন। (১৮৩৪ খৃঃ ২৫ জানুয়ারি)।
১৭৫৬ শকাব্দে গম্ভীর সিংহ মানবলীলা সম্বরণ করেন। তাঁহার পুত্র চন্দ্রকীর্তি তৎকালে একবৎসরের শিশু। সেনাপতি নরসিংহ সেই শিশুকে সিংহাসনে স্থাপন পূর্বক স্বয়ং অভিভাবকস্বরূপ রাজ্যশাসন করিতে লাগিলেন। ১৭৫৭ শকাব্দে গবর্ণমেন্ট “মণিপুর লেবী” নামক সৈন্যদল সম্পূর্ণভাবে মণিপুরপতির হস্তে সমর্পণ পূর্বক মণিপুরে একজন পলিটিকেল এজেন্ট নিযুক্ত করেন। ১৭৬৬ শকাব্দে শিশু নরপতি চন্দ্রকীর্ত্তির জননী স্বীয় উপপতি নবীন সিংহের কুমন্ত্রণায় ॥২৭৯॥ নরসিংহকে হত্যা করিয়া স্বয়ং রাজ্যভার গ্রহণ করিবার জন্য লোলুপ হইলেন[১২]। একদা সন্ধ্যাকালে রাজপ্রতিনিধি নরসিংহদেবতা প্রণাম করিতেছিলেন, সেই সময় নবীনসিংহ তাঁহাকে আক্রমণ করেন, নরসিংহ বাহুমূলে তরবারীর আঘাত ধারণ করিয়া মস্তক রক্ষা করিয়াছিলেন। তাঁহার সহচরগণ দ্বারা নবীন সিংহ ধৃত হন। অন্যান্য চক্রান্তকারীগণ এই সংবাদ রাণীকে জ্ঞাপন করিলে, তিনি দশমবর্ষীয় পুত্র চন্দ্রকীৰ্ত্তিকে লইয়া কাছাড়ে পলায়ন করিলেন। নরসিংহ রাজভবনে গমন পূর্বক রাজ্ঞীর কার্য্যকলাপ শ্রবণ করত স্বয়ং সিংহাসনে উপবেশন ও রাজদণ্ড ধারণ করিলেন। নবীন সিংহের প্রাণদণ্ড হইল। তৎপর ৬ বৎসরকাল সুনিয়ম ও প্রবল বিক্রমে রাজ্য শাসন করিয়া ১৭৭২ শকাব্দে রাজা নরসিংহ পরলোক গমন করেন। তদনন্তর তাঁহার কনিষ্ঠ ভ্রাতা দেবেন্দ্র সিংহ সিংহাসনে আরোহণ করেন। কিন্তু তিনি তিন মাসের অধিক রাজ্য ভোগ করিতে পারেন নাই। গম্ভীর সিংহের একমাত্র পুত্র চন্দ্রকীৰ্ত্তি সিংহ সপ্তদশ বৎসর বয়ঃক্রমে বাহুবলে পৈত্রিক আসন অধিকার করেন। তাঁহাকে সিংহাসনচ্যুত করিবার জন্য রাজবংশীয় অনেকেই চেষ্টা করিয়া অবশেষে অকৃতকাৰ্য্য হইয়াছিলেন। ১৮৬১ খ্রিস্টাব্দে।। ২৮০। গবর্ণমেন্ট মণিপুরের পলিটিকেল এজেন্টের পদ
এবলিস করিতে প্রস্তাব করেন। মণিপুরপতি চন্দ্ৰকীৰ্ত্তি সিংহ এই সংবাদ শ্রবণে উক্ত প্রস্তাব যাহাতে কার্য্যে পরিণত না হয়, তজ্জন্যে ইন্ডিয়া গবর্ণমেন্ট সমীপে (১৮৬১ খ্রিস্টাব্দের ১৮ আগস্ট) এক আবেদন পত্র প্রেরণ করেন। তৎপর স্থানীয় কর্তৃপক্ষগণের মত গ্রহণান্তর ইণ্ডিয়া গবর্ণমেন্ট মহারাজ চন্দ্রকীর্ত্তির মতানুসারে কার্য্য করিতে সম্মত হইলেন। ৩৫ বৎসর রাজ্য শাসন করিয়া ১৮০৭ শকাব্দে চন্দ্রকীর্তি পরলোক গমন করেন। তদনন্তর তাঁহার জ্যেষ্ঠ পুত্র সুরচন্দ্র সিংহাসনে আরোহণ করেন।
মহারাজ সুরচন্দ্রের অভিষেক কালে তাঁহার কনিষ্ঠ বৈমাত্রেয় ভ্রাতা কুলচন্দ্ৰ যৌবরাজ্যে ও তৎকনিষ্ঠ সেনাপতির পদে নিযুক্ত হইয়াছিলেন। কিছুকাল পরে সেনাপতির মৃত্যু হওয়ায় চতুর্থ ভ্রাতা দুৰ্দ্দান্ত টীকেন্দ্রজিৎ উক্ত পদে নিযুক্ত হন। এইরূপে প্রায় ৫ বৎসর গত হইল, দুৰ্দ্দান্ত টীকেন্দ্রজিৎ নানা প্রকার কৌশলে পলিটিকেল এজেন্ট গ্রিমউড সাহেবকে বাধ্য করিয়াছিলেন। অবশেষে টীকেন্দ্রজিতের চক্রান্তে সুরচন্দ্র রাজ্য পরিত্যাগ পুর্বক বৃন্দাবন যাত্রা করিতে বাধ্য হন। (১৮৯০ খ্রিঃ অঃ সেপ্টেম্বর) টীকেন্দ্রজিৎ কুলচন্দ্রকে সিংহাসনে স্থাপন পূর্বক স্বয়ং যুবরাজ হইলেন। সুরচন্দ্র কলিকাতায় উপনীত হইয়া প্রকৃত অবস্থা গবর্ণর। ২৮১॥ জেনারেল সমীপে জ্ঞাপন করিলেন। ইন্ডিয়া গবর্ণমেন্ট এসম্বন্ধে আসামের শাসন কর্তার অভিপ্রায় জ্ঞাত হইতে ইচ্ছা করেন। পলিটিকেল এজেন্ট কুলচন্দ্রেকে রাজা টীকেন্দ্রজিতকে যুবরাজ স্বীকার করিবার জন্য জেদ করিতে লাগিলেন; আসামের চিফ কমিশনর সাহেব সেই তালে তাল বাজাইলেন। ইন্ডিয়া গবর্ণমেন্ট বাধ্য হইয়া টীকেন্দ্রজিতের কুকার্য্য অনুমোদন করেন (অর্থাৎ কুলচন্দ্রকে মণিপুরপতি বলিয়া স্বীকার করিলেন); কিন্তু টীকেন্দ্ৰজিৎ এই অন্যায় রাষ্ট্রবিপ্লবের নায়ক বলিয়া তাঁহাকে গ্রেপ্তার করিয়া আনিবার জন্য চিফ কমিসনরের প্রতি আদেশ করিলেন। কুইন্টন সাহেব সেই আদেশানুসারে কার্য্য করিবার জন্য মণিপুরে গমন করেন। কুইন্টন সাহেব দরবার গৃহে টীকেন্দ্রজীতকে গ্রেপ্তার করিতে মনস্থ করিয়াছিলেন (!!)। টীকেন্দ্রজিৎ অসুস্থতাবশতঃই হউক কিম্বা অন্য কারণেই হউক, দরবারে অনুপস্থিত হইলেন। তাঁহাকে ধৃত করিয়া আনিবার জন্য গোপনে সৈন্য প্রেরিত হইল (!!)। তৎকালে টীকেন্দ্রজিতের অধীনে ৪৪০০ পদাতিক, ৫০০ গোলোন্দাজ ও ৪০০ অশ্বারোহী সৈন্য ছিল। সুতরাং মুষ্টিমেয় সৈন্য লইয়া ইংরেজ কর্তৃপক্ষগণ টীকেন্দ্রজিতের সহিত যুদ্ধে প্রবৃত্ত হইলেন। তৎকালে মণিপুরে পঞ্চশতের অধিক গবর্ণমেন্টের সৈন্য ছিল না। সমস্ত দিন অনল ক্রিয়ার পর কুইন্টন সাহেব যুদ্ধ স্থগিত করিবার জন্য ॥২৮২॥ আদেশ করেন। তদনন্তর কুইন্টন, গ্রিমউড কর্ণেল, সীনি, লেপ্টেনেন্ট সিমসন ও কসিন্স সাহের টীকেন্দ্রজিতের সহিত আলাপ করিবার জন্য রাজপ্রসাদে গমন করেন। তথা হইতে প্রত্যাবর্তন করিবার মানসে তাঁহারা যখন প্রাসাদ হইতে বহির্গত হইলেন এমনি সাধারণ লোক দ্বারা লেপ্টেনেন্ট সিমসন ও পলিটিকেল এজেন্ট গ্রিমউড সাংঘাতিক রূপে আহত হন। সেই মুহূর্ত্তেই গ্রিমউড প্রাণ ত্যাগ করেন। তৎপর নিদয় থঙগাল জেনারেলের আদেশানুসারে কুইন্টন, স্কিন, কসিনস সাহেবকে বলিদান করা হইয়াছিল[১৩]। সেই পঞ্চ ইংরেজ রাজ-পুরুষের মুণ্ড একগর্ভে সমাহিত করিয়া অরিণামদর্শী মণিপুরিগণ বিশেষ প্রীতিলাভ করিল।
এই লোমহর্ষক ঘটনার সংবাদ ইণ্ডিয়া গবর্ণমেন্টের শ্রুতিগোচর হইলে, দলে দলে ব্রিটিশ সৈন্য মণিপুরে প্রেরিত হইল। নিরস্ত্র সাহেবদিগকে বলিদান করিবার সময় মণিপুরীগণ যে বীরত্ব প্রকাশ করিয়াছিল, এক্ষণ তাহাদের সেই বীরত্ব তিরোহিত হইল, এই সকল অপরিণামদর্শী কাপুরুষগণ স্ব স্ব পরিবারবর্গ পরিত্যাগ পূর্বক পলায়ন করিল। কিন্তু যথা সময়ে সকলেই ধৃত হইয়া ইংরেজ কর্তৃপক্ষগণ নিকট ॥২৮৩॥ উপস্থিত হইল। বিচারে কূলচন্দ্র নির্বাসিত, টীকেন্দ্রজিৎ ও থঙ্গাল জেনেরেল ফাঁসিকাষ্ঠে বিলম্বিত হইলেন। ইহা অবশ্যই স্বীকার করিতে হইবে যে কূলচন্দ্র, টীকেন্দ্রজিৎ প্রভৃতি ব্যাক্তিগণ স্ব স্ব পাপে প্রায়শ্চিত্ত ভোগ করিয়াছেন; কিন্তু সুরচন্দ্র ও তাঁহার উত্তর পুরুষগণ কোন পাপে চিরকালের জন্য তাঁদের পৈত্রিক রাজ্যটী হারাইলেন, গবর্ণমেন্টের এ বিচারের রহস্য আমরা বুঝিতে পারিলাম না। ১৮৯১ খ্রিস্টাব্দে নরসিংহের প্রপৌত্র পঞ্চম বর্ষীয় বালক চূড়াচাঁদকে গবর্ণমেন্ট মণিপুরের রাজকার্য্য নির্বাহ করিবেন। তিনি বয়োপ্রাপ্ত না হওয়া পর্যন্ত জনৈক ইংরেজ রাজপুরুষ মণিপুরের রাজকার্য্য নির্বাহ করিবেন ইংরেজ রাজপুরুষগণের সুশাসনে মণিপুরের উন্নতি এবং মণিপুরীদিগের চরিত্র সংশোধিত হইবে বলিয়া আমরা বিবেচনা করিতে পারি।
ক্ষুদ্র ও নগণ্য মণিপুরকে ইংরেজ বাড়াইয়াছিলেন, আবার ইংরেজের দ্বারাই সেই মণিপুরীর গর্ব খর্ব হইল। চূড়াচাঁদকে মণিপুরের রাজপদে প্রতিষ্ঠিত করিয়া গবর্ণমেন্ট অনুজ্ঞা করিয়াছেন যে চুড়াচাঁদ ও তাঁহার উত্তরপুরুষগণ’রাজা’ উপাধিধারণ করিবেন। মণিপুরের “রাজা” ব্রিটিস অধিকারে আসিলে তাঁহার সম্মানার্থে ১১টি তোপধ্বনি হইবে। রাজার জ্যেষ্ঠ পুত্রই রাজপদপ্রাপ্ত হইবেন। অনপত্যতা নিবন্ধন ব্যতিত রাজার ভ্রাতা কিম্বা অন্য কোন ব্যক্তি সেই ॥২৮৪॥ পদ প্রাপ্ত হইবেন না। গবর্ণমেন্টের অনুমোদন ভিন্ন কেহই রাজপদে প্রতিষ্ঠিত হইতে পারিবেন না। মণিপুরের রাজাকে নিয়মিতরূপে কর প্রদান করিতে হইবে; গবর্ণমেন্ট পশ্চাৎ সেই করের প্রকার ও পরিমাণ স্থির করিবেন। মণিপুরের শান্তিরক্ষার জন্য ১৩০০ শত ব্রিটিস সৈন্য তথায় থাকিবে।
ইংরেজ কর্তৃপক্ষগণের সুশাসনে অল্পকালে মধ্যে মণিপুরের রাজস্ব আশাতীত রূপে বর্দ্ধিত হইয়াছে। তাঁহারা কর্মচারি ও ভৃত্যবর্গের জায়গীর (চাকরাণ নানকার বা “লাল্লুপ”) প্রথা রহিত করিয়া রাজস্ববৃদ্ধির পন্থা পরিষ্কার করিয়াছেন। ১৮৮১ খ্রিস্টাব্দে মণিপুরের যে লোক সংখ্যা গৃহীত তদ্বারা মণিপুরের অধিবাসী সংখ্যা কিঞ্চিদুন সওয়া দুই লক্ষ নির্ণীত হইয়াছিল।
.
টীকা
১. আমাদিগের বিবেচনায় মিতাই লেইপাকের সহিত মহাভারতের কোন সংশ্রব নাই। মহাভারতে বর্ণিত মণিপুর প্রাচীন কলিঙ্গের অন্তর্গত একটি বিখ্যাত নগরী। অর্জুনের গন্তব্য প্রথাবলম্বনে আমরা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হইয়াছি। বিষ্ণুপুরাণের অনুবাদক পণ্ডিত এইচ, এইচ্, উইলসন সাহো ও এইরূপই নির্ণয় করিয়াছেন। (wilsin’s vishnu puran, vol, iv page 160) ডাক্তার জন উইলসন সাহেব ও মণিপুর কলিঙ্গের লিখিয়াছেন। (John Willson’s Indian cast vol-1, p-149) কনিংহাম সাহেবের মতে মহকৌশলের (বা দক্ষিণ কৌশলের) প্রাচীন রাজধানী মণিপুর নামে পরিচিত ছিল। মহাভারতোক্ত মণিপুর সমুদ্র তীরবর্তী নগরী, সুতরাং আমরা কনিংহামের মতানুমোদন করিতে পারিলাম না। (লেখক)
২. অদ্যাপি বাঙ্গালি হিন্দুগণ মণিপুরে মিশ্রজাতির সৃষ্টি করিতেছেন। ব্ৰাহ্মণগণ মিতাই রমণীর পানি গ্রহণ করিলে তাহার গর্ভজাত সন্তানগণ ব্ৰাহ্মণত্ব লাভ করিয়া থাকেন। কিন্তু হেই সন্তানের মাতার জাতি পরিবর্তন হয় না। উক্ত রমণী বিধবা হইলে কিংবা ব্রাহ্মণ স্বামী কর্তৃক পরিত্যক্তা হইলে পুনর্বার যে জাতির স্বামী গ্রহণ পারিবে সেই স্বামীর ঔরসজাত সন্তানগণ জাতিত্ব প্রাপ্ত হইবে। এইরূপে এক রমণীর গর্ভেই ব্রাহ্মণ ক্ষত্রিয় প্রভৃতি বিবিধ জাতি উৎপন্ন হইতে পারে।
৩. পেম্বার্টন সাহেব বলেন যে, মিতাইগণ তাতার জাতীয়। মণিপুরের ভূতপূর্ব পলিটিকেল এজেন্ট মেকক্লক সাহেব ও ডাক্তার ব্রাউন বলেন যে, মণিপুর দুনের চতুদিকস্থ পর্বতবাসী অনাৰ্য্য জাতি হইতে মণিপুরিগণের উৎপত্তি। বর্তমান রাজবংশটি যে নাগা জাতি হইতে উদ্ভুত এইরূপ অনুমান যুক্তি সংগত বটে, কারণ রাজ্যাভিষেক কালে অদ্যাপি রাজা ও রাণী উভয়েরই নাগা বেশ ধারণ করিয়া থাকেন। (Meeulloch’s Muunipore p. 4. and Brown’s Munnipore. p. 27 )
৪. ইহারা মূর্খ অধিকারী ব্রাহ্মণের প্রসাদ গ্রহণ করিবে, কিন্তু মহাপণ্ডিত শাক্ত ব্রাহ্মণের সৃষ্ট জলপান করিবেন না।
৫. অধিকরণ তথ্যের জন্য ব্রাউনের বিবরণ দ্রষ্টব্য- (পৃঃ ৫৮-৭৫)
৬. কোন কোন বঙ্গীয় লেখক ইহাকে পারসী ‘গরিবনওয়াজ’ করিয়া ফেলিয়াছেন।
৭. আধুনিক ইতিহাস কিন্তু ভিন্ন মত পোষণ করে “from 1755 A.D. upto the Treaty of Yandaboo in 1856 A. D. the history of Manipur is replete with the story of successive Burmese invasions and of how she resisted them and eventually triumphed over them’ (Roy, Jyotiramy, the History of Manipur, Calcutta 1958, p. 51 )
৮. মণিপুরী ও কাছাড়ী জাতি দ্বারা এই সেনাদল গঠিত হয়। মণিপুরবাসী কাছাড়ীগণ ‘কালাছা’ আখ্যা দ্বারা পরিচিত হইয়া থাকে।
৯. Wilson’s Burmese War P, 207.
১০. সন্ধির এই প্রকরণে ব্রিটিশ রাজের সঙ্গে গম্ভীর সিংহের রাজনৈতিক মৰ্য্যাদা অনুক্ত থাকিয়া যায়। শ্রীহট্ট সীমান্তকে ব্রহ্মদেশের আক্রমণের সম্ভাবনা হইতে মুক্ত রাখিবার অভিপ্রায়ে সন্ধিপত্রে মণিপুরকে এই রাজনৈতিক মৰ্য্যাদা দেওয়া হয়। কালের প্রবাহে ব্রহ্মের বদলে ব্রিটিশ আধিপত্য সূচিত হয়। (British Paramountey and Indian Renaissance, part 1, Bharatiya Vidya Bhavan Series, 1970 p, 10-28)
১১. Collection of Treaties Vol. I p. 213.
১২. Brown’s Manipure pp 66, 67.
১৩. Manomohan Ghosh’s Appeals of the Monipur Princes, pp, 7, 8.