দ্বিতীয় অধ্যায় – মক্কাবাসীদের প্রতিরোধের ব্যর্থতা ও ইসলামের বিজয়
১. হযরত মুহাম্মদের (স) সমর প্রস্তুতি
বদরের যুদ্ধে বিজয়ের পর হযরত মুহাম্মদ (স) উপলব্ধি করেন যে, বিধর্মী কুরাইশদের সাথে এটিই শেষ যুদ্ধ নয়। অন্যকথায় তিনি পুনরায় সমর প্রস্তুতি গ্রহণ করতে থাকেন, যা হবে রক্তক্ষয়ী ও মারাত্মক সংঘর্ষ। তিনি সহজেই বুঝতে পারেন যে, বদরের যুদ্ধে প্রভাবশালী ও ধনাঢ্য কুরাইশদের বিপর্যয়ে তাদের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতা হ্রাস পায় এবং তা পুনরুদ্ধারের জন্য তারা অবশ্যই তৎপর হবে সিরিয়া থেকে মক্কায় যাতায়াতকারী কাফেলার নিরাপত্তা বিঘ্নিত হলে মক্কার বাণিজ্য ব্যহত হয় এবং এ কারণে প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য পৌত্তলিকগণ সর্বপ্রকারের সামরিক প্রস্তুতি গ্রহণ করতে থাকে। এ কারণে হয়রত মুহাম্মদ (স) শত্রুর মোকাবেলার জন্য তাঁর বাহিনীকে সংঘঠিত করতে থাকেন।
বদরের যুদ্ধের পরাজয়ের সংবাদ মক্কায় পৌছলে কুরাইশগণ বিশ্বাস না করলেও স্বল্পসংখ্যক সৈন্য নিয়ে মুসলমানদের বিজয় এবং যুদ্ধলব্ধ দ্রব্যসামগ্রীর (মাল-ই-গণিমত) ) পরিমাণ দেখে মদিনাবাসীদের মধ্যে যুদ্ধে অংশ গ্রহণের জন্য সাড়া জাগে। ৬২৪ খ্রিস্টাব্দের সেপ্টেম্বর মাসে যু আম্মারে যে মুসলিম অভিযান প্রেরিত হয় তাতে ৪৫০ জন সৈন্য অংশগ্রহণ করে। এছাড়া বিধর্মী গোত্রসমূহ যারা লোহিত সাগর এবং মদিনার মধ্যবর্তী অঞ্চলে বসবাস করতো, ইসলাম ধর্ম গ্রহণে আগ্রহী হয়, অবশ্য তাদের ধর্মীয় অনুপ্রেরণা ছাড়া মাল-ই-গণিমতের অংশ লাভই তাদের মুখ্য উদ্দেশ্য। বদরের যুদ্ধে বিপর্যয়ের পর কুরাইশগণ সমুদ্রতট দিয়ে প্রসারিত কোন কাফেলা পাঠাইনি। যখন কুরাইশগণ মক্কা থেকে উত্তরে উহুদের প্রান্তরের দিকে অভিযান করে তখন খুজা গোত্রের লোকেরা হযরত মুহাম্মদের কাছে পূর্বেই সংবাদ পাঠাই। এদিকে বিধর্মী যাযাবর গোষ্ঠী ইসলামে দীক্ষা লাভ করে নবীর বাহিনীতে যোগ দিতে থাকে। উদাহরণ বলা যায় যে, মুহারিব গোত্রের সকল সদস্য তাদের গোত্রপতি যুথুর বিন আল-হারিসসহ নবীর কাছে ইসলাম ধর্ম কবুল করে।
নবগঠিত মদিনা রাষ্ট্রের রক্ষণাবেক্ষণের জন্য অধিকসংখ্যক সৈন্য দ্বারা গঠিত সামরিক বাহিনী মক্কার সমর্থক যাযাবর গোষ্ঠীর মধ্যে যথেষ্ট প্রভাব ফেলে। আবু সুফিয়ান মদিনায় আক্রমণ পরিচালনা করলে হযরত মুহাম্মদ (স) ২০০ জন মুজাহিদ নিয়ে তা প্রতিহত করেন। খন্দকের যুদ্ধে মদিনা অবরোধের সময় সুলায়েম ও গাতাফান নামে যে গোত্র দুটি কুরাইশদের সাথে অংশগ্রহণ করে সে দুটি গোত্রের বিরুদ্ধে মুসলমান যোদ্ধাগণ আল-কুদর-এ অভিযান করেন। এই অভিযানে শত্রুপক্ষের অনেক উট বিতাড়িত হয়। এই ঘটনার কিছুদিন পর ৩০০ সৈন্যের এক মুসলিম বাহিনী সুলায়েম গোত্রের বিরুদ্ধে অভিযান করে। এই অভিযানে কোন যুদ্ধ লব্ধ দ্রব্য সামগ্রী পাওয়া না গেলেও এ ধরনের অভিযান মুসলিম বাহিনীতে শৃঙ্খলা ও সংহতি প্রতিষ্ঠায় সহায়তা করে।
হযরত মুহাম্মদের (স) সমর প্রস্তুতির অন্তরালে যে মনস্তাত্বিক ও আদর্শগণ প্রক্রিয়া কাজ করেছিল তা সহজেই উপলব্দি করা যায়। তিনি এটাও জানতেন যে তার পরিকল্পনা এবং একাগ্রতা কার্যকরী হবে। তিনি একমাত্র জানতেন যে, শত্রুপক্ষের সদস্যদের ধর্মান্তরীত করে তাঁর দলভুক্ত করতে পারবেন। বদরের যুদ্ধের পর পৌত্তলিকদের মধ্য থেকে উমায়ের বিন ওয়াহাব নামে এক ব্যক্তি তার বন্দী ভাইকে মুক্তিপণ দিয়ে ছাড়াবার জন্য মদিনায় আসেন। তিনি মদিনায় নব-গঠিত মুসলিম রাষ্ট্রের গঠন ও মুসলিম জীবন ধারা দেখে এতই মুগ্ধ হয়েছিলেন যে তিনি নবীর কাছে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। মূলত উমায়ের জুমা গোত্রের তরফ থেকে বদরের যুদ্ধে এক সদস্যের হত্যার প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য হযরত মুহাম্মদকে (স) হত্যা করার উদ্দেশ্যে মদিনায় আসেন। পক্ষান্তরে তিনি ইসলামে দীক্ষা লাভ করেন। বন্দীদের হত্যা না করে মুক্তিপণের বিনিময়ে ছেড়ে দিবার নীতি গ্রহণ করার মূলে দুটি কারণ ছিল : প্রথমত, তিনি উদার মানবিক নীতি গ্রহণ করেন (মাত্র একজন বন্দীকে হত্যা করা হয় গোত্রীয় কোন্দলের জন্য)। দ্বিতীয়ত, মুসলিম রাষ্ট্রের অর্থ সঙ্কট কাটাবার জন্য বন্দীদের মুক্তিপণ আদায় বিশেষ প্রয়োজন হয়ে পড়ে। নবী হত্যাযজ্ঞে বিশ্বাসী ছিলেন না; কবি আসমা, আৰু আফাক এবং কা’ব বিন আল- আশরাফ ব্যতীত অন্য কোন ব্যক্তিকে হত্যা করা হয় নি, কারণ তারা নবীর প্রতি অসম্মানজনক ভাষায় ব্যঙ্গাত্মকভাবে কবিতা রচনা করে। তিনি তাঁর সাংগঠনিক ক্ষমতা সুসংহত করেন এবং এখন থেকেই উপলব্ধি করেন যে, হত্যার চেয়ে সমঝোতা দ্বারা বিধর্মী মক্কার কুরাইশ গোত্রের সদস্যদের ইসলামের ছায়াতলে আনা সম্ভব। এর প্রয়োজন ছিল এ কারণে যে, বয়স্ক অভিজ্ঞ প্রশাসনিক দক্ষতাসম্পন্ন বিধর্মীগণ ইসলাম কবুল করলে তারা মুসলিম রাষ্ট্রের সংগঠনে অংশ গ্রহণ করতে পারবেন।
তৌহিদবাদে যাদের বিশ্বাস নেই তাদের প্রতি নবী করীম কঠোর মনোভাব ব্যক্ত করেন এবং যারা ব্যক্তিগতভাবে তাঁকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে ব্যঙ্গাত্মক কবিতা রচনা করে তারা ইসলামের শত্রু হিসেবে চিহ্নিত হয়। এ কারণে আসমা, আবু আফাক ও কা’বকে হত্যা করা হয়। তায়ী গোত্রের সদস্য কা’ব বিন আল-আশরাফ আরব বংশোদ্ভুত বলে দাবী করলেও তার মায়ের দিক থেকে ইহুদী গোত্র আল নাজিরের সদস্য ছিলেন। বদরের যুদ্ধে বিধর্মী কুরাইশদের পরাজয়ের সংবাদে কা’ব মক্কার দিকে রওয়ানা হন এবং তার ব্যঙ্গাত্মক কবিতা ও ইসলাম বিরোধী ভাষা দ্বারা কুরাইশদের দুঃখ ও বেদনাকে জাগরিত করার চেষ্টা করেন। এভাবে সে মুসলমানদের ওপর প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য প্ররোচনা দিতে থাকে। এটি এক ধরনের প্রতিহিংসা। এরপর কা’ব মদিনা আসে; কারণ মুসলিম কবি হাসান বিন সাবিত তাকে এবং তার আশ্রয়দাতাদের বিরুদ্ধে তীর্যক ভাষায় কবিতা রচনা করে প্রতিবাদ করেন। নবী মদিনায় তার অবস্থান বিপদজনক মনে করে তাকে নিধন করার ইঙ্গিত দেন। পাঁচজন সাহাবী তাকে হত্যার পরিকল্পনা করে। তাদের মধ্যে একজন ছিলেন কা’বের পালিত ভাই আবু নাইলা। আবু নাইলা কা’বকে মিথ্যা করে বলেন যে নবীর প্রশাসনে তারা খুব দুঃখ কষ্টে আছেন, তাদের পর্যাপ্ত খাদ্যদ্রব্য নেই যাতায়াতে নিরাপত্তা নেই এবং সবসময় বিধর্মী আরব গোত্রদের বিরোধিতার সম্মুখীন হতে হয়। এ কথা জেনে কা’ব তাদের (মদিনাবাসী) জন্য খাদ্যদ্রব্য পাঠান। কা’বের সাথে পাঁচজন সাহাবীর সাক্ষাতের স্থান ও সময় নির্ধারিত হলো। একদিন রাতে নির্দিষ্ট স্থানে কা’বের সাথে সাক্ষাতের সময় তারা তাকে হত্যা করলেন! ওয়ার্ট বলেন যে, তার মাথা কেটে নবীজীর পায়ের কাছে ফেলে দেওয়া হয়। (কিন্তু এর সমর্থনে তিনি কোন সূত্র উল্লেখ করেন নি। )
ইসলামের চিহ্নিত শত্রুকে নির্মূল করতে হযরত মুহাম্মদ (স) কখনোও ইতঃস্তত করেন নি। তাঁর তাৎক্ষণিক ও দ্রুত সিদ্ধান্ত দ্বারা তিনি প্রমাণ করতে চান যে তিনি অবজ্ঞার পাত্র নন। যারা তাঁকে ধর্মপ্রবর্তক ও নেতা হিসেবে স্বীকার করেছে তারা যারা তাঁকে অবজ্ঞা ও অসম্মান করে তাদের তুলনায় সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছেন। ধর্মীয় প্রেরণায় পৌত্তলিকগণ তৌহিদে বিশ্বাস স্থাপন করেনি : নব-দীক্ষিত মুসলমানগণ ইসলামী উম্মায় সামাজিক মর্যাদা লাভ করে এবং অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হয়। উহুদের প্রান্তরে মক্কাবাসীদের সংখ্যা ৩,০০০ হলেও তাদের বিজয় সেনাবাহিনীর আধিক্যের জন্য হয়েছিল এ কথা বলা যাবে না। (যদি তাই হতো তা হলে ৯৫০-১০০০ সৈন্যের মক্কাবাহিনী ৩১৩ জন মুজাহিদের কাছে বদরের যুদ্ধে পরাজিত হতো না) সংখ্যার দিক থেকে বিবেচনা করলে দেখা যাবে উহুদের যুদ্ধে মাত্র ২,০০০ মুসলমান অংশগ্রহণ করে।
২. বদরের যুদ্ধে বিপর্যয়ের মক্কাবাসীদের প্রতিক্রিয়া
বদরের যুদ্ধে পৌত্তলিকদের পরাজয় মক্কাবাসীরা বিশ্বাস করেনি; কিন্তু বাস্তবতার সম্মুখীন হয়ে তারা প্রতিশোধের পরিকল্পনা করতে থাকে। আবু সুফিয়ান এ সময়ে বিধর্মীদের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন এবং নিহত কুরাইশদের মৃত্যুর জন্য শোক পালন নিষিদ্ধ করে দেন। শোক পালন নিষিদ্ধ করার অন্তরালে যে মন-মানসিকতা কাজ করছিল তা হচ্ছে এ ধরনের শোক পালনে মদিনার মুসলমানেরা তাদের বিজয়ের জন্য আত্মপ্রসাদ লাভ করবে এবং বিধর্মীদের মধ্যে প্রতিহিংসা গ্রহণের যে স্পৃহা তা কমে যাবে। আবু সুফিয়ান তার বিধর্মী গোষ্ঠীর নৈতিক অবক্ষয় থেকে রক্ষার জন্য শোক পালন নিষিদ্ধ করেন। তিনি বীর দর্পে ঘোষণা করেন যে যতক্ষণ পর্যন্ত তিনি হযরত মুহাম্মদ (স)-এর বিরুদ্ধে সফলভাবে অভিযান পরিচালিত না করবেন ততক্ষণ পর্যন্ত গায়ে তেল মাখবেন না বা নারী স্পর্শ করবেন না। এ ধরনের মন-মানসিকতার ফলে মক্কাবাসীদের শোক পালন বন্ধ হয়ে যায়। কা’ব বিন আল-আশরাফ কবিতা রচনা করে বিধর্মীদের মধ্যে প্রতিহিংসার স্পৃহা জাগাতে থাকে। পরে কা’ব মদিনায় গেলে রসূলের উদ্দেশ্যে অপমানজনক ব্যঙ্গাত্মক কবিতা রচনার জন্য তাকে হত্যা করা হয়, যা পূর্বে বলা হয়েছে। যাহোক বিপর্যয়ের প্রথম ধাক্কা সামাল দিয়ে পূর্ণ উদ্দমে পৌত্তলিকগণ সমর প্রস্তুতি গ্রহণ করতে থাকে। এদিকে জুমা গোত্রের সাফওয়ান বিন উমাইয়া বিন খালাফা বদরের যুদ্ধে তার পিতার মৃত্যুর প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য উমাইর বিন ওয়াহাব নামের এক গোত্রীয় সদস্যকে মদিনায় অবস্থানকালে নবীকে হত্যা করার প্ররোচনা দেয়। উমাইর তার বন্দী ভাইএর মুক্তিপনের জন্য মদিনায় যান। কিন্তু মদিনায় গিয়ে পরিবেশ দেখে নবীর কাছে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। এ ঘটনায় আবু সুফিয়ান বিচলিত হলেও তিনি নিরুৎসাহ হলেন না। বাণিজ্যলব্ধ সমস্ত মুনাফা তিনি যুদ্ধের প্রস্তুতিতে ব্যয় করার কথা বললে সগোত্রীয়রা উদ্বুদ্ধ হলো।
বদরের যুদ্ধের দশ মাস পরে আবু সুফিয়ান তার প্রতিজ্ঞা পালনের জন্য ২০০ (৪০০) যোদ্ধা নিয়ে মদিনায় অতর্কীত আক্রমণ পরিচালনা করেন। এই অভিযানের মূল উদ্দেশ্য ছিল তার গোষ্ঠীর মধ্যে আত্মবিশ্বাস সৃষ্টি করা এবং পৃথিবীকে জানিয়ে দেওয়া যে কুরাইশদের ক্ষমতা বিলুপ্ত হয় নি। এই অতর্কীত আক্রমণের ফলে মুসলমানদের বিরুদ্ধে মহাবিজয় লাভের কোন আশা ছিল না। কিন্তু হযরত মুহাম্মদ (স)-এর অজ্ঞাতে তিনি মদিনার উপকণ্ঠে পৌঁছে প্রমাণ করতে চান যে মুসলিম বাহিনী কত অসহায়। মদিনায় অবস্থানকালে তিনি বনু নাজির নামে ইহুদী গোত্রের এক সদস্যের আতিথ্যগ্রহণ করেন এবং তার আগমনের নজির রাখার জন্য মক্কায় প্রত্যাবর্তনের পূর্বে দুটি বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেন এবং এক শস্য ক্ষেত্র নষ্ট করে দেন। ফিরে আসার সময় বিধর্মীগণ কয়েক বস্তা সাগুদানা (সাওয়িক) রাস্তায় ফেলে দেয় যা মদিনার মুসলিম সম্প্রদায় সংগ্রহ করে। ইবন হিশাম এই অভিযানকে ‘সাগুদানার অভিযান’ (The barley meal raid) বলেছেন।
আবু সুফিয়ান বৈরী পরিবেশে বলপূর্বক সিরিয়ায় কাফেলা পাঠানো থেকে বিরত থেকে এক বিশাল বাহিনী গঠনে আত্মনিয়োগ করেন। তার মূখ্য উদ্দেশ্য ছিল হযরত মুহাম্মদ (স)-এর ক্ষমতা ধ্বংস করা। যদিও আবু সুফিয়ান ঐতিহ্যবাহী ‘মসলা পথে কাফেলা পাঠাবার বিরোধী ছিলেন। তবুও তার প্রতিদ্বন্দ্বী সাফওয়ান বিন উমাইয়া মদিনার পূর্ব দিক থেকে প্রসারিত বাণিজ্য পথে কাফেলা পাঠাবার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। গোপনীয়ভাবে কাফেলা পাঠালেও বিধর্মীদের বাণিজ্যিক তৎপরতা ফাঁস হয়ে পড়ে এবং হযরত মুহাম্মদ (স) ১০০ জনের একটি দল যায়েদ বিন হারিসের নেতৃত্বে কাফেলার গতিরোধ করার জন্য পাঠান। এই অভিযানের ফলে মুসলমানগণ ১,০০,০০০ দিরহামের ধনসম্পদ হস্তগত করে। কাফেলায় আগত বিধর্মীগণ কোন প্রকার সংঘর্ষে না গিয়ে পালিয়ে যায়।
ইতোমধ্যে আবু সুফিয়ানদের নেতৃত্বে মদিনার বিরুদ্ধে বিশাল বাহিনী গঠিত হয়। তায়েফের তাকিফ এবং যাযাবর আবদ মানাত গোত্রে প্রতিনিধি পাঠিয়ে সৈন্য সংগ্রহ করা হয়। কুরাইশদের মিত্র আহারিস গোত্রও বিধর্মীদের সাথে যোগদান করে। ৬২৫ খ্রিস্টাব্দের ২৫ শে মার্চ ৩০০০ সদস্য বিশিষ্ট এক বিশাল বাহিনী নিয়ে মক্কাবাসী মদিনার দিকে অভিযান করে। এদের মধ্যে ৭০০ সৈন্য বর্ম পরিহিত ছিল। এই সমরাভিযানে ৩০০০ উট এবং ২০০ ঘোড়া ছিল। আবু সুফিয়ান প্রধান সেনাপতির দায়িত্ব পালন করেন। সহ-প্রধান হিসেবে সাফওয়ান বিন উমাইয়া বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। বিনা বাধায় বিধর্মীদের বিশাল বাহিনী ৬২৫ খ্রিস্টাব্দের ২৫ শে মার্চ মদিনার উপকণ্ঠে এসে পৌছায়। তারা উহুদ পাহাড়ের সন্নিকটে তাবু ফেলে। তারা শস্যক্ষেত্র ও চারণভূমির কাছে ইচ্ছাকৃতভাবে তাঁবু ফেলে যাতে মুসলমানেরা মদিনা থেকে আগ্রাসন শুরু করে। মরুদ্যানের বিভিন্ন অংশে মদিনাবাসী যে দুর্গ বা ‘আতাম’ গড়ে তুলে তা মক্কাবাসীদের অবরোধ প্রতিরোধ করার জন্য যথেষ্ট মজবুত ছিল।
৩. উহুদের যুদ্ধ (শনিবার হয় ৩২ শে মার্চ, ৬২৫ খ্রি.)
বিধর্মী মক্কাবাসী ওয়াদী আল-আকিকের দিকে অগ্রসর হয়ে মদিনার উপকণ্ঠে উহুদের প্রান্তরে এসে তাঁবু ফেলে ৬২৫ খ্রিস্টাব্দের ২১শে মার্চ তারিখে। তৎক্ষণাৎ হযরত মুহাম্মদ (স)-এর একজন গুপ্তচর শত্রুপক্ষের সৈন্যসংখ্যা ও তাদের অবস্থান সম্বন্ধে তাঁকে জানায়। প্রধান আনসারগণ তাঁর ঘরের সামনে পাহারা দিতে থাকেন। শুক্রবার ২২শে মার্চ তিনি যুদ্ধের জন্য গঠিত কাউন্সিলের একটি সভা আহ্বান করলেন। হযরত মুহাম্মদ (স) আবদুল্লাহ বিন উবায় এবং কয়েকজন প্রবীন সাহাবী মত প্রকাশ করেন এই মর্মে যে শহরে সুরক্ষিত অবস্থায় থেকে শত্রুর মোকাবেলা করা শ্রেয়। এর ফলে ঘরে ঘরে হাতাহাতি সংঘর্ষে বিধর্মীদের কাবু করা যাবে। কিন্তু তরুন মদিনাবাসী এই পরিকল্পনার বিরোধীতা করে। তারা যুক্তিসহকারে বলেন যে, শত্রুদের শস্য ক্ষেত্র ধ্বংস করতে দিয়ে চুপ করে বসে থাকা কাপুরুষতা এবং এর ফলে তাদের মর্যাদায় আঘাত আসবে। সুতরাং তারা শত্রুর মোকাবেলা করার জন্য তাদের বিরুদ্ধে অভিযান করা প্রয়োজন। হযরত মুহাম্মদ (স) সাক্ষাৎ সংঘর্ষের পথ বেছে নেন। দিনের শেষে মদিনাবাসী বিধর্মীদের বিরুদ্ধে সমরাভিযান করেন। তিনি বিধর্মী ইহুদী গোত্রের, যারা আবদুল্লাহ বিন উবায়ের মিত্র ছিল, কোন প্রকার সাহায্য গ্রহণ করেন নি। কিছুদূর অগ্রসর হয়ে মুসলিম বাহিনী রাতে যাত্রা বিরতি করে পরদিন সকলে উহুদ পাহাড়ের এক ঢালু এলাকায় তাঁবু ফেলে। এর ফলে শত্রুপক্ষ মুসলিম বাহিনী এবং মদিনা শহরের মধ্যবর্তী অঞ্চলে অবস্থান গ্রহণ করে।
উহুদের যুদ্ধ শুরু হবার পূর্বে মোনাফেক আবদুল্লাহ বিন উবায় এবং তার সঙ্গীদের মদিনা ত্যাগ ছিল রহস্যজনক। ঐতিহাসিক সূত্রে জানা যায় যে, তার প্রস্তাবিত পরিকল্পনা হযরত মুহাম্মদ (স) গ্রহণ না করায় প্রতিবাদস্বরূপ তিনি মুসলিম বাহিনী পরিহার করেন। কিন্তু এ তথ্য সঠিক নয়, কারণ তিনি নবীর সাথে যুদ্ধক্ষেত্র পর্যন্ত গিয়েছিলেন। সম্ভবত মদিনার বৃহত্তর জনগোষ্ঠীকে সম্ভাব্য শত্রুর আক্রমণ থেকে রক্ষার জন্য নবীর পরামর্শক্রমেই অন্যত্র যান। তবে তার উদ্দেশ্য যে, কি ছিল তা সঠিকভাবে জানা না গেলেও নবীর বিপর্যয়ে তার উল্লাস দেখে ধারণা করা যায় যে, তিনি মোনাফেকের মত বিরোধিতা করেন। তিনি যদি এককভাবে যুদ্ধে অংশ নিতেন তাতে এটি প্রমাণিত হত যে, তিনি নিরপেক্ষ কোন দলের সঙ্গে সংযুক্ত নন। এর ফলে যুদ্ধের শেষে ফলাফল যাই হউক না কেন, তার মর্যাদা অক্ষুণ্ণ থাকতো। শঠতার বশবর্তী হয়ে মোনাফেক আবদুল্লাহ আউস ও খাজরাজ গোত্রের মধ্যে সংঘটিত বুয়াসের যুদ্ধে এ ধরনের আচরণ করেন।
যুদ্ধের শুরুতে ওয়াদী আল-আকীক থেকে পৌত্তলিকেরা মুসলিম শিবির আক্রমণ করে। প্রথমে অশ্বারোহী বাহিনী অগ্রসর হতে থাকলে মুসলিম তীরন্দাজগণ তীর ছুড়ে তাদের গতিরোধ করে। এরপর হঠাৎ করে মল্লযুদ্ধের জন্য বিধর্মীদের শিবির থেকে একজন পতাকাবাহী যুদ্ধক্ষেত্রে এগিয়ে আসে। পতাকাবাহী অশ্বারোহীকে কেন্দ্র করে বিধর্মী ও মুসলিম বাহিনীর মধ্যে সংঘর্ষ বেধে যায়। আবদ আদ দার গোত্রের সদস্যদের পতাকার মর্যাদা রক্ষার দায়িত্ব দেওয়া হয় এবং তাদের নয় জন সদস্য বীর বিক্রমে যুদ্ধ করে মৃত্যুবরণ করে। তবুও বিধর্মীগণ মুসলমানদের পতাকা ছিনিয়ে নিতে পারে নি। এমতাবস্থায় মুজাহিদদের আক্রমনে ক্ষুদ্র কুরাইশ দল পিছু হটে যায়। এভাবে মুসলিম শিবিরে বিজয়ের যখন সকল আলামত উপস্থিত হলো এমন সময় একটি দুভাগ্যজনক ঘটনায় যুদ্ধের ফলাফল মুসলমানদের বিপরীতে চলে যায়। খালিদ বিন ওয়ালিদ (তখনও তিনি ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হন নি) তার অশ্বারোহী বাহিনী নিয়ে মুসলিম শিবিরে বিশৃঙ্খলার সুযোগে ঝাঁপিয়ে পড়েন। অন্যদিকে শত্রুপক্ষের তীরন্দাজগণ মুসলিম তীরন্দাজদের কাবু করে পিছনের দিক থেকে মুসলিম শিবির আক্রমণ করে। এর ফলে রণক্ষেত্রে এক প্রচণ্ড গোলযোগের সৃষ্টি হলো। অস্ত্রধারী সৈন্যরা হাতাহাতি সংঘর্ষে লিপ্ত হলো। এমন সময় গুজব রটলো যে, হযরত মুহাম্মদ (স) রণক্ষেত্রে নিহত হয়েছেন। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে মুসলিম পতাকাবাহী মুসাব, যার সাথে নবীর আকৃতির সাদৃশ্য ছিল, রণক্ষেত্রে নিহত হলে এই গুজব উঠে। অবশ্য সংঘর্ষে নবীর মুখে ও পায়ে আঘাত লাগে এবং তিনি রণক্ষেত্রেই মুচ্ছা যান। (অনেকের মতে বিধর্মী ইবনে কামিয়াবের প্রস্তারাঘাতে নবীর দুটি দাঁত শহিদ হয়। উহুদের প্রান্তরে ‘দান্দান শরিফ’ নামে একটি স্থান আছে, যেখানে আহত হয়ে নবী সংজ্ঞা হারান, হাজীগণ এখানে নফল নামাজ পড়েন।) অজ্ঞান অবস্থায় তাঁকে নিরাপদ স্থানে নিয়ে গিয়ে সেবা শুশ্রুসা করা হয়। যুদ্ধে যখন বিশৃঙ্খলা শূরু হলো তখন নবী তাঁর যোদ্ধাদের নিয়ে উহুদ পাহাড়ের এক ঢালু উপত্যকায় অবস্থান গ্রহণ করেন। সংঘবদ্ধ হয়ে মুসলিম বাহিনী পুনরায় যুদ্ধ আরম্ভ করে : কিন্তু ভুলক্রমে এর একাংশ হারিসা গোত্রের দিকে গেলে অসংখ্য মুজাহিদ নিহিত হন। এরপর মুসলিম বাহিনী পাহাড়ের ওপর অবস্থান নিলে কৌশলগত কারণে তারা সুরক্ষিত থাকে এবং কুরাইশগণ একারণে মুসলিম বাহিনীকে আক্রমণ থেকে বিরত থাকে। কিছুকাল উহুদের প্রান্তরে অবস্থানের পর আবু সুফিয়ান তার বাহিনী নিয়ে মদিনা নগরী আক্রমণ না করে মক্কায় প্রত্যাবর্তন করেন।
ইবন ইসহাক ও আল-ওয়াকীদীর বর্ণনা থেকে উহুদের যুদ্ধের যে ঘটনাবলী জানা যায় তাতে বিধর্মী মক্কাবাসীদের জয় এবং মুসলিম বাহিনীর পরাজয় উল্লেখ আছে। মুসলিম বিপর্যয়ের মূল কারণ ছিল এই যে, আইনায়েনের পাহাড়ের মধ্যবর্তী সংকীর্ণপথে অবস্থানরত ৫০ জন মুসলিম তীরন্দাজ নবীর আদেশ অমান্য করে যুদ্ধলব্ধ দ্রব্যসামগ্রীর লোভে স্থান ত্যাগ করে। এই অরক্ষিত পথ দেখে খালিদ বিন ওয়ালিদ পিছন এবং পশ্চাৎ দিক থেকে অতর্কীত আক্রমণ করে মুসলিম বাহিনীকে ছত্রভঙ্গ করেন। এ ঘটনা কুরআনের সূরা আল-ইমরানে (৩) ১৫২ আয়াতে বলা হয়েছে।
“আল্লাহ তাঁর প্রতিশ্রুতি পূর্ণ করেছেন যখন তোমরা তাদেরকে আল্লাহর অনুমতিক্রমে বিনাশ করছিলে এবং সে পর্যন্ত যে পর্যন্ত না তোমরা সাহস হারিয়েছিলে এবং নির্দেশ সম্বন্ধে মতভেদ সৃষ্টি করেছিলে এবং যা তোমরা ভালবাস তা তোমাদের দেখাবার পর তোমরা অবাধ্য হয়েছিলে। তোমাদের কতক ইহকাল চাচ্ছিলে এবং কতক পরকাল চাচ্ছিলে। সুতরাং তিনি পরীক্ষা করার জন্য তোমাদেরকে তাদের থেকে ফিরিয়ে দিলেন। এ সত্ত্বেও তিনি তোমাদেরকে ক্ষমা করলেন এবং আল্লাহ বিশ্বাসীদের প্রতি অনুগ্রহশীল।“
আরব ঐতিহাসিকদের পরিবেশিত উহুদের যুদ্ধের উপরোক্ত বিবরণ কতটুকু নির্ভরযোগ্য তা বিচার করা যাক।
রাসূলে করীমের আদেশ অমান্য করায় যে উহুদের প্রান্তরে বিপর্যয় ঘটে তা নিশ্চিত। প্রথম আক্রমণেই বিধর্মীগণ পিছু হটে গেলেও তীরন্দাজদের অবাধ্যতায় মুসলমানদের পরাজয় ঘটে। যখন রণক্ষেত্রে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয় এবং হযরত মুহাম্মদ (স) আহত হয়ে অজ্ঞান হয়ে পড়েন তখনই মুসলিম সৈন্যদের মনোবল ভেঙ্গে পড়ে। মুসলিম সৈন্যরা উহুদের উঁচু পাহাড়ে ভীত ও সন্ত্রস্ত হয়ে আশ্রয় নিয়ে এক দল মুজাহিদ হারিসা গোত্রে আশ্রয়ের জন্য গেলে তারা নির্মমভাবে নিহত হয়। রণক্ষেত্রে জুয়ায়েল বিন শুরাকা নামে এক মুজাহিদ প্রথম ঘোষণা করেন যে হযরত মুহাম্মদ (স) রণক্ষেত্রে নিহত হয়েছেন। কিন্তু তিনি চিৎকার দিয়ে যে ঘোষণা দেন তা শয়তানের প্ররোচনায় দেন; কারণ বাস্তবে তিনি সংজ্ঞাহীন হয়েছিলেন, মৃত্যুবরণ করেন নি। উহুদের প্রান্তরে এমন অনেক মুজাহিদ অংশ গ্রহণ করেন যারা নব-দীক্ষিত মুসলিম এবং তারা এক ওয়াক্ত নামাজ পড়ার সুযোগও পায় নি। এছাড়া কুয়ামা নামে মদিনার এক অমুসলমান মুসলিম বাহিনীতে বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করে। সে যুদ্ধে নিহত হয়ে শাহাদাতের দরজা না পেয়ে জাহান্নামে যায়। মুসলিম ঐতিহাসিকগণ খালিদের প্রতি বৈরী মনোভাবপন্ন থাকায় বলেন যে, তিনি বীর বিক্রমে পিছন দিক থেকে মুসলিম বাহিনীকে আক্রমণ করেন। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে কুরাইশদের মূল অশ্বারোহী বাহিনী ছিল সাফওয়ান বিন উমাইয়ার নেতৃত্বে।
উহুদের যুদ্ধে মুসলমানদের বিপর্যয়ের কারণ বিশ্লেষণ করতে গিয়ে ওয়ার্ট বলেন যে, মুসলিম বাহিনীর প্রথম আক্রমণ যতটা সাফল্যজনক বলে বর্ণনা করা হয়েছে ততটা হয়নি, কারণ সফল হলে মক্কার বিধর্মীদের তাঁবু থেকে পর্যাপ্ত যুদ্ধলব্ধ দ্রব্যসামগ্রী (মাল- ই-গণিমত) লাভ করতো। কিন্তু তারা শূন্য হাতে ফিরে আসে। তবুও একথা নিশ্চিত করে বলা যায় যে যুদ্ধের প্রথম দিকে সংখ্যাগরিষ্ঠ মক্কা-বাহিনীকে মুসলিম পদাতিক বাহিনী পয্যুদস্ত করেছিল। অপরদিকে যুদ্ধের শেষে মাল-ই-গণিমতের লোভে মুসলিম তীরন্দাজগণ তাদের অবস্থান ত্যাগ করে মুসলিম শিবিরে যে বিপর্যয় ঘটিয়েছিল তা সূরা ইমরানের (৩) ১৫২ আয়াতে স্পষ্টভাবে উল্লেখ আছে। যাহোক, উহুদের যুদ্ধে মুসলমানদের পরাজয়ের মূলে খালিদ বিন ওয়ালিদের রণকৌশল ও তৈজস্বিতা যে কাজ করেছিল তা বলাই বাহুল্য। অবশ্য প্রধান সেনাপতি আবু সুফিয়ানসহ বিধর্মী শিবিরে অনেক অভিজ্ঞ ও দক্ষ যোদ্ধা ছিল।
বদরের যুদ্ধে অল্পসংখ্যক সৈন্য নিয়ে বিশাল কুরাইশ বাহিনীকে পরাস্ত করলেও উহুদের যুদ্ধে কেন (বিধর্মীদের ৩০০০ এবং মুসলমানদের ১০০০) বিপর্যয় হলো এ নিয়ে পাশ্চাত্য বুদ্ধিজীবীগণ অনেক বিচার-বিশ্লেষণ করেছেন। ওয়ার্ট যথার্থই বলেন যে বদরের সাফল্য মুসলিম শিবিরে প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাস দেখা দেয় এবং তারা সামরিক শ্রেষ্ঠত্ব ও দাবি করে। সূরা আনফালের (৮) ৬৫ নম্বর আয়াতে উল্লেখ আছে, “হে নবী। বিশ্বাসীদেরকে সংগ্রামের জন্য উদ্বুদ্ধ কর, তোমাদের মধ্যে কুড়িজন ধৈর্যশীল থাকলে তারা দুইশত জনের উপর বিজয়ী হবে এবং তোমাদের মধ্যে একশত জন থাকলে এক সহস্র সত্য প্রত্যাখানকারীর উপর বিজয়ী হবে, কারণ তারা এমন এক সম্প্রদায় যার বোধ শক্তি নেই।”
উক্ত আয়াতে কুরাইশদের সামরিক দম্ভ ও শ্রেষ্ঠত্ব ক্ষুণ্ন করে মুসলমানদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস ও উৎসাহ উদ্দীপনা প্রদান করা হয় এবং হযরত মুহাম্মদ (স) সহজেই উপলব্ধি করেন যে, বদরের যুদ্ধ বিধর্মীদের সাথে সংঘর্ষের শেষ নয় বরং শুরু। মুসলিম বাহিনীর মনোবল সুদৃঢ় করার জন্য আল্লাহ সূরা আল-ইমরানের ১২২ থেকে ১২৬ আয়াত নাজেল করেন। এখানে বদরের যুদ্ধে গায়েবী মদদ অর্থাৎ তিনি সহস্র ফেরেশতা পাঠিয়ে মুজাহিদদের সাহায্য করার কথা বলা হয়েছে। ১২৫ আয়াতে উল্লেখ আছে।
“হ্যাঁ নিশ্চয়, যদি তোমরা ধৈর্য ধারণ কর এবং সাবধান হয়ে চল তবে তারা দ্রুতগতিতে তোমাদের ওপর আক্রমণ করলে আল্লাহ পাঁচ হাজার চিহ্নিত ফেরেশতা দিয়ে তোমাদের সাহায্য করবেন।” সূরা আনফালের ৬৫ ও ৬৬ আয়াতের সাথে ৬৬ ও ৬৭ আয়াত তুলনা করলে প্রতীয়মান হয়ে যে, পূর্বে যেখানে একশত মুজাহিদ এক হাজার বিধর্মীদের সাথে লড়াই করবে স্বীয় আত্মবল ও ধৈর্য্যের ওপর নির্ভর করে সেখানে পরবর্তী সূরায় বলা হয়েছে মুজাহিদদের একশত বিধর্মীদের দু’শত সৈন্যের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হবে। উহুদের যুদ্ধ বিপর্যয়ে হযরত মুহাম্মদ (স) বিধর্মীদের সৈন্যের আধিক্যকে বিশেষ গুরুত্ব দেন নি কারণ ইতিপূর্বে বদরে কম সংখ্যক মুজাহিদ নিয়ে তিনি বিধর্মীদের পরাজিত করেন। উপরন্তু, মুসলমানদের অশ্বারোহী বাহিনী না থাকায় কুরাইশগণ রণক্ষেত্রে আধিপত্য ছিল, যে কারণে খালিদ বিন ওয়ালিদ মুসলিম বাহিনীকে পিছন থেকে আক্রমণ করে বিপর্যস্ত করেন। আল-ওয়াকিদি মুসলিম বাহিনীর হতাহতের যে তালিকা দেন তাতে বেশিরভাগই কুরাইশ অশ্বারোহীদের দ্বারা আক্রান্তের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু হযরত মুহাম্মদ (স) এ ব্যাপারে সচেতন ছিলেন এবং অশ্বারোহী বাহিনীর আক্রমণ থেকে তাঁর মুজাহিদদের রক্ষার ব্যবস্থা করেন। সুতরাং মুসলিম দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বিবেচনা করলে প্রতীয়মান হবে যে, বিধর্মীদের সংখ্যাধিক্য অথবা তাদের শক্তিশালী অশ্বারোহী বাহিনী মুসলিম বিপর্যয়ের মূল কারণ নয় বরং বিশৃঙ্খলা এবং লুটতরাজের প্রবণতাই পরাজয়ের প্রধান কারণ। সূরা আল-ইমরানের (৩) ১৫২ নম্বর আয়াতে লুটতরাজের প্রসঙ্গে বলা হয়েছে। বদরের যুদ্ধের পর হযরত মুহাম্মদ (স) বৃহৎ মুসলিম বাহিনীর প্রয়োজনীয়তার কথা চিন্তাভাবনা করলেন। এ কারণে নব-দীক্ষিত মুসলিমানদের তিনি ইসলামের জন্য আল্লাহর রাস্তায় (ফি সাবিলিল্লাহ) জেহাদে উদ্বুদ্ধ করতে থাকেন। তাদেরকে ‘মাল-ই- গণিমত’ এর অংশ লাভের কথাও বলা হয়। তবে লুণ্ঠিত দ্রব্যের প্রতি যোদ্ধাদের লোভ যে কি মারাত্মক আকার ধারণ করতে পারে তা উহুদের প্রান্তরে অবাধ্য মুসলিম তীরন্দাজদের লূটতরাজই প্রমাণ করে। এ কারণে পরবর্তী যুদ্ধের প্রস্তুত গ্রহণের জন্য নবীকে অনেক সাবধান হতে হয়েছিল। তিনি ইহুদীদের সাহায্য গ্রহণ করেন নি। কারণ এর ফলে মুসলিম বাহিনীতে ঐক্য ব্যহত হবে এবং পরবর্তী সংঘর্ষে একটি অসম্মানজনক দৃষ্টান্ত স্থাপন করবে। এ প্রসঙ্গে বলা প্রয়োজন যে, মুসলিম বাহিনীতে ১০০০ সৈন্য থাকলেও মোনাফেক আবদুল্লাহ বিন উবাই তার ৩০০ যোদ্ধা নিয়ে রণক্ষেত্র ত্যাগ করলে মুসলিম শিবিরে সৈন্য সংখ্যা কমে দাড়াই ৭০০ তে।
সর্বশেষে উহুদ যুদ্ধের ফলাফল প্রসঙ্গে বলা যায় যে, এই রণাঙ্গনে মুসলিম বাহিনীর যেমন চরম ব্যর্থতা ও বিপর্যয় প্রকাশ পায় নি তেমনি মক্কার বিধর্মী কুরাইশদের এটি মহাবিজয় হিসেবে ধরা যায় না। এর মূল কারণ পৌত্তলিকদের সাথে মুসলমানদের সংঘাত এখানেই শেষ নয়। অবশ্য উহুদ ছিল মুসলমানদের জন্য প্রচণ্ড আঘাতস্বরূপ, এই যুদ্ধে আনসারদের মধ্যে সত্তর জন এবং মোহাজিদদের মধ্যে মাত্র চারজন নিহত হয়। (বদরের যুদ্ধে ৭০ জন পৌত্তলিক এবং ১৪ জন মুসলিম মৃত্যুবরণ করে) উহুদের প্রান্তরে হযরত মুহাম্মদের (স) চাচা বীর শ্রেষ্ঠ আমির হামজা শাহাদাত বরণ করেন। (কথিত আছে যে বদরের যুদ্ধে হামজা কর্তৃক আবু সুফিয়ানের স্ত্রী হিন্দার পিতা নিহত হলে হিন্দা রণক্ষেত্রে হামজার কলিজার অংশ ভক্ষণ করেন)। ওয়ার্ট এ ঘটনা উল্লেখ করেন নি। উহুদের যুদ্ধে মুসলমানদের বিপর্যয়ের মনত্ত্বাত্মিক প্রভাব ছিল খুবই প্রকট। এর মূল কারণ যে বলা হয়েছিল অল্পসংখ্যক সৈন্য নিয়ে গায়েবী মদদে বদরের যুদ্ধে জয়লাভ করলে উহুদের যুদ্ধে এরূপ না হওয়ায় মুসলিম সৈন্যগণ মুশড়িয়ে পড়ে। ইসলাম বিরোধীগণ প্রচার করতে থাকে এ কথা বলে যে, তা হলে আল্লাহ কি বিধর্মীদের মদদ দিচ্ছেন বা হযরত মুহাম্মদ (স) কি তাহলে নবী নন? মূলত আল্লাহ মুসলমানদের অনৈক্য, বিশৃঙ্খলা ও বিভেদ হলে কি বিপর্যয় হতে পারে দৃষ্টান্তমূলকভাবে তাই শিক্ষা দিয়েছেন। সূলা আল-ইমরানের (৩) ১৫৩ আয়াতে উল্লেখ আছে :
“স্মরণ কর, তোমরা যখন উপরের দিকে পালাচ্ছিলে এবং পিছনে কারও প্রতি লক্ষ করছিলে না যদিও রসূল তোমাদের পিছন দিক থেকে আহ্বান করছিলেন। পরে তিনি তোমাদের দুঃখের ওপর দুঃখ দিলেন যাতে তোমরা যা হারিয়েছ অথবা যে বিপদ তোমাদের ওপর এসেছে তার জন্য তোমরা দুঃখিত না হও। তোমরা যা কর, আল্লাহ তা বিশেষভাবে অবহিত।”
পুনরায় ১৬৬ আয়াতে বলা হয়েছে :
“যে দিন দু’দল পরস্পরের সম্মুখীন হয়েছিল সেদিন তোমাদের ওপর যে বিপর্যয় ঘটেছিল তা আল্লাহর অনুমতিক্রমেই ঘটেছিল : এটি বিশ্বাসীদের জানবাব (শিক্ষা) জন্য এবং মোনাফিকদের জানার জন্য।”
একই সূরার ১৭৮ ও ১৭৯ আয়াতে বলা হয়েছে, “সত্য প্রত্যাখ্যানকারিগণ (বিধর্মী মক্কাবাসী যেন কিছুতেই মনে না করে যে আমি কাল বিলম্বিত করি তাদের মঙ্গলের জন্য আমি কাল বিলম্বিত করি যাতে তাদের পাপ বৃদ্ধি পায় এবং তাদের জন্য লাঞ্ছনাদায়ক শাস্তি রয়েছে।”
“অসত্যকে সত্য থেকে পৃথক না করা পর্যন্ত তোমরা যে অবস্থায় রয়েছে আল্লাহ বিশ্বাসীদেরকে সে অবস্থায় ছেড়ে দিতে পারেন না…..”
পাশ্চাত্য ঐতিহাসিকগণ মনে করেন যে, আরব তথ্যসূত্রে উহুদ যুদ্ধের বিপর্যয়কে ঢাকা দেওয়া হয়েছে। অনুসন্ধান করে জানা যায় যে, এ কথা মোটেই সত্য নয়, বরং সম্পূর্ণ বিপরীত। বরঞ্চ মুসলিম ঐতিহাসিকগণ মুসলিম বিপর্যয় ও পরাজয়কে সঠিকভাবে বর্ণনা করেছেন এবং এর বীভৎসতাকে তুলে ধরেছেন। এর কারণ হতে পারে যে, যেহেতু আনসারদের মধ্য থেকে সত্তর জন (মোহাজেরদের সেখানে চার জন) শাহাদাৎ বরণ করেন সেহেতু তাদের দুঃখ-বেদনা তাদের বর্ণনায় প্রতিভাত হয়েছে। পক্ষান্তরে, কুরাইশদের পক্ষে মাত্র ২৩ জন নিহত হয় এবং উমাইয়া বংশের প্রতিষ্ঠাতার পূর্বপুরুষ আবু সুফিয়ানের পুত্র মুয়াবিয়া অক্ষত থাকেন।
সূরা আল-ইমরানের উপরোল্লিখিত আয়াতসমূহ নাজেলের মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল পরাজিত ও বিপর্যস্ত মুসলমানদের সান্তনা দেওয়া এবং তাদের আধ্যাত্মিক মনোবল বৃদ্ধি করা। কারণ জয়লাভ করেও বিধর্মী কুরাইশগণ বিশেষভাবে ঘৃণিত হয়েছে সত্যপ্রত্যাখ্যানকারী হিসেবে এবং পরবর্তী পর্যায়ে তারা মুসলিম বাহিনীর কাছে পর্যুদস্ত হয়। তাছাড়া, উহুদের প্রান্তরে মুসলিম বিপর্যয় বিধর্মী যাযাবর গোত্রগুলোকে হযরত মুহাম্মদ (স) এবং তাঁর সাহাবীদের ওপর হামলা করতে উৎসাহিত করে। এর ফলে বহু মুসলমান শহিদ হন।
যদিও উহুদের প্রান্তরে মুসলমানদের শোচনীয় পরাজয় হয়নি, তবুও এটিকে মক্কাবাদীদের জন্য কোন শুভ বিজয় বলে ধরা যাবে না। আবু সুফিয়ান যদি মনে করে থাকেন যে, উহুদের প্রান্তরে জয়লাভ করে মুসলিম ‘উম্মা’কে ধ্বংস করতে পেরেছেন তা হলে বলতে হবে যে এটি ভ্রান্ত ধারণা। উহুদের যুদ্ধের মূল কারণ ছিল বদরের যুদ্ধের পরাজয়ের প্রতিশোধ গ্রহণ অর্থাৎ রক্তপাতের স্থলে রক্তপাত। যদি আমরা ধরে নেই যে বদরের যুদ্ধে বিধর্মীদের মধ্যে সর্বমোট পঞ্চাশ অথবা সত্তর জন মৃত্যুবরণ করে তাহলে হিসেবে দেখা যাবে যে বদর (১৪) এবং উহুদের (৭০) যুদ্ধে (৮৪) বিধর্মীদের তুলনায় মুসলমানদের সামান্য বেশি সৈন্য মৃত্যুবরণ করে। তুলনামূলকভাবে বিচার করলে বলা যায় যে, বদরের যুদ্ধে ৭০ জন নিহত হয় কুরাইশদের পক্ষে অন্য দিকে উহুদের যুদ্ধে মুসলমানদের নিহতের সংখ্যা ৭৩; অর্থাৎ সামান্য অধিক। সেদিক থেকে বিধর্মী মক্কাবাসী আত্মতৃপ্তি লাভ করে। কিন্তু সামগ্রিকভাবে বিচার করলে এই হিসেব দিয়ে যুদ্ধের জয়-পরাজয়ের ফলাফল নির্ণয় করা যায় না। যদিও কুরাইশগণ মনে করে যে জীবনের পরিবর্তে জীবনের যে (life for life) প্রাক-ইসলামী রীতি ছিল তা চরিতার্থ হয়েছে। অবশ্য দম্ভভরে আবু সুফিয়ান বলেছিল যে, মুসলমান শিবিরে প্রচণ্ড হত্যাকাণ্ড হবে। যাহোক, বদর ও উহুদ যুদ্ধের বিশ্লেষণ করলে প্রতীয়মান হবে যে কুরাইশদের দলপতি আবু সুফিয়ানের সাথে মুসলিম উম্মার নেতা নবী করিম (স) সমপর্যায়ে রয়েছেন অন্ততঃ যুদ্ধাহত ব্যক্তিদের হিসেবে। আবু সুফিয়ান গর্বভরে বলেছিল যে মুসলিম উম্মাকে নিমূল করে পশ্চিম আরবে কাফেলা পথসহ প্রাধান্য বিস্তার করবে। কিন্তু বাস্তবে উহুদ প্রান্তর থেকে মদিনা শহরে আক্রমণ কুরাইশগণ পরিচালিত না করে আবু সুফিয়ান তার বাহিনী নিয়ে মক্কায় প্রত্যাবর্তন করেন। আবু সুফিয়ান উপলব্ধি করেন যে, উহুদের আকস্মিক বিজয় নব-প্রতিষ্ঠিত ইসলাম ধর্ম ও রাষ্ট্রকে সমূলে উৎপাটিত করা সম্ভব নয়। তাছাড়া এটাই শেষ সংঘর্ষ নয়। উপরন্তু, ইবন কামিয়ার দাবি যে সে হযরত মুহাম্মদকে (স) হত্যা করেছে তা তিনি বিশ্বাস করেন নি।
উহুদের প্রান্তরে সংঘর্ষের বিবরণ দিতে গিয়ে আল-ওয়াকিদি আমর বিন আল- আসের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন,
“আমরা যখন বীর বিক্রমে শত্রুপক্ষকে আক্রমণ করে বহু যোদ্ধাকে আহত করতে থাকলাম এবং এর ফলে তারা ছত্রভঙ্গ হয়ে গেল। কিছুক্ষণ পরে কুরাইশ সৈন্যগণ একতাবদ্ধ হয়ে আমাদের ওপর হামলা করে এবং এক পর্যায়ে ঘোষণা দেয় যে যুদ্ধে তারা জয়লাভ করেছে। তারা একথাও বললো যে তাদের সেনাপতি ইবন উবায় তার বাহিনী নিয়ে যুদ্ধক্ষেত্র ত্যাগ করেছে। এ কথা বলে বিধর্মীগণ রণক্ষেত্র ত্যাগ করে তখনও আনসারদের মধ্যে আউস ও খাজরাজদের অনেক যোদ্ধা উহুদের প্রান্তর ছিল না। এমতাবস্থায় আমরা বুঝে উঠতে পারিনি যে, কুরাইশগণ আবার সংঘবদ্ধভাবে পুনরায় আক্রমণ করবে কিনা? তাছাড়া আমাদের মধ্যে অনেকেই আহত অবস্থায় রণক্ষেত্রে পড়ে ছিল। এ ছাড়া অসংখ্য ঘোড়া তীরবিদ্ধ হয়ে যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছিল। শত্রুরা যুদ্ধক্ষেত্র ত্যাগ করলে আমরা আর-রাওহার দিকে অগ্রসর হলাম এবং হঠাৎ করে শত্রুপক্ষের কয়েকজন অশ্বারোহী আমাদের তাড়া করে; কিন্তু আমরা নিরাপদ স্থানে পৌঁছতে সক্ষম হলাম।”
আল-ওয়াকিদীর বিবরণ থেকে জানা যায় যে, বিধর্মী কুরাইশদের মদিনা আক্রমণের কোন অভিপ্রায় বা ক্ষমতা ছিল না। মোনাফেক আবদুল্লাহ ইবন উবায় মুসলিম বাহিনীর (১০০০) এক তৃতীয়াংশ (৩০০) যোদ্ধা নিয়ে চলে গেলে মুসলমান যে বিপর্যয় হয় সে কথা অনেক ঐতিহাসিক বলেছেন। তবে মুসলমানগণ ইবন উবায়ের উপর নির্ভর করেন নি কারণ তিনি যে বিশ্বাসঘাতক তার প্রমাণ আগেই পাওয়া গেছে। কুরাইশগণ মনে করে কূটনৈতিক চালে তারা ইবন উবায়ের সমর্থন লাভ করবে। কিন্তু তা সম্ভবপর হয় নি। কুরাইশগণ মক্কা প্রত্যাবর্তনকালে মুসলিম বাহিনী কর্তৃক লাঞ্ছিত হয়। এর ফলে তাদের পদাতিক সৈন্য এবং অশ্বারোহী মুসলমানদের প্রতিরোধের মুখে পড়ে। তাদের মনোবল ভেঙ্গে পড়ে। এমতাবস্থায় বিধর্মীগণ মক্কায় ফিরে যাওয়া শ্রেয় মনে করে।
দিনের শেষে হযরত মুহাম্মদ (স) এবং তাঁর সাহাবীগণ রণক্ষেত্রে শহিদদের দাফন করে মদিনায় ফিরে আসেন। সমস্ত রাত নবী যুদ্ধের পরিণতি ও সুদূরপ্রসারী প্রভাব সম্বন্ধে চিন্তাভাবনা করে দেখলেন যে তাঁর ক্ষয়ক্ষতি খুব মারাত্মক নয় এবং তাকে ভবিষ্যৎ অভিযানের জন্য প্রস্তুতি নিতে হবে। পরের দিন সকালে তিনি উহুদের যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী মুজাহিদদের ডেকে তাদের সঙ্গে পরামর্শ করলেন। সিদ্ধান্ত হলো যে, মক্কায় প্রত্যাবর্তনকারী বিধর্মীদের পশ্চাদ্ববণ করা উচিত। এমতাবস্থায় একদল মুজাহিদ তড়িৎগতিতে মক্কার দিকে অভিযান করলেন। এ ধরনের পদক্ষেপের উদ্দেশ্য ছিল এক তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তোলা এবং বিধর্মীগণ যাতে পুনরায় মদিনায় ফিরে এসে আক্ৰমণ না করতে পারে তার প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা। মক্কাবাহিনী প্রত্যাবর্তনকালে হামরা আল- আসাদ নামক স্থানে শনিবার রাত কাটায়। রবিবারে মুজাহিদগণ এখানে এসে উপস্থিত হলে বিধর্মীগণ পালিয়ে যায়। তারা সেখানে তিন অথবা চার দিন অবস্থান করে মক্কার বাহিনীর উপর নজর রাখেন। অবশ্য মুজাহিদগণ শত্রুর মুখোমুখি হয় নি। যদিও ধারণা করা হয় যে, তারা কাছাকাছি ছিল। মুসলমানদের অবস্থিতি জানাবার জন্য নবী করিম তাঁর সাহাবীদের রাতে কাঠ কুড়িয়ে তা জ্বালিয়ে দিতে বলেন। এ ছাড়া খুজা গোত্রের একজন যাযাবর মিথ্যা করে প্রচার করতে থাকে যে, পশ্চাদ্বাবনকারী মুজাহিদদের সংখ্যা অগণিত। এর ফলে বিধর্মীদের মনোবল আরও ভেঙ্গে পড়ে। তারা মুসলমানদের কাছাকাছি অবস্থান টের পেয়ে নিরাপদে মক্কায় ফিরে যায়। মুসলামানদের ওপর কোন প্রকারের আক্রমণ পরিচালিত হয় নি। অবশ্য আবু সুফিয়ান মিথ্যা প্রচারণা দ্বারা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে চান এবং হযরত মুহাম্মদের (স) নির্দেশে তাঁর বাহিনী নিরাপদে মদিনায় ফিরে আসে।
৪. যাযাবর বেদুঈনদের বিদ্রোহ
(ক) মক্কার সর্বশেষ সুযোগ : বিজয়ী বাহিনী নিয়ে আবু সুফিয়ান এবং অন্যান্য সমর নেতারা মক্কায় পৌঁছবার পূর্বেই উপলব্ধি করেন যে তাদের সাময়িক সাফল্য তাদের অবস্থানকে সুসংহত করতে পারেনি। তারা ইসলাম তথা মদিনা রাষ্ট্রকে ধ্বংস করতে পারেনি। উহুদের প্রান্তরে মুসলিম শিবিরের বিশৃঙ্খলতার সুযোগ নিয়ে তারা যুদ্ধে জয়লাভ করেছে কিন্তু এই ফলাফল সূদূরপ্রসারিত হয় নি। বিধর্মদের মধ্যে এ কারণে এক ধরনের হতাশা দেখা দিল। তারা ধারণা করলো যদি তারা মুসলিম বাহিনীকে সম্পূর্ণরূপে বিধ্বস্ত করতে না পারে তাহলে পক্ষান্তরে তারাই নিঃশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। উহুদের অভিযানে কুরাইশগণ তাদের শ্রেষ্ঠ যোদ্ধা সংগ্রহ করেছিল এবং পার্শ্ববর্তী পৌত্তলিক গোত্রসমূহ তাদের সাথে যোগদান করে। এ কারণে কুরাইশগণ মদিনার পূর্ব ও উত্তর পূর্বাঞ্চলে বসবাসকারী যাযাবর বেদুঈনদের ইসলামের বিরুদ্ধে প্ররোচিত করতে শুরু করে। তাদেরকে তাদের দলে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য তারা হযরত মুহাম্মদের (স) সামরিক দুর্বলতার মিথ্যা রটনা কুরাইশদের সামরিক শ্রেষ্ঠত্ব ও মর্যাদার কাহিনী, রণক্ষেত্রে অফুরন্ত লুণ্ঠিত দ্রব্যাদি লাভের আশা, এমন কি উৎকোচ দিতেও কুণ্ঠিত হয় নি। পঞ্চম হিজরী অর্থাৎ খ্রিস্টীয় ৬২৭ অব্দে মক্কাবাসী মদিনা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যে সমরাভিযান করে তার পটভূমি বিশ্লেষণ করলে প্রতীয়মান হবে যে, এ ধরনের কার্যকলাপের সাথে বিধর্মীরা জড়িয়ে পড়েছে।
কেবলমাত্র সুলাইম ও গাতাফান গোত্র থেকেই কুরাইশগণ তাদের বাহিনীতে সৈন্য সংগ্রহ করেনি, মিথ্যা প্রচারণা দ্বারা বিধর্মী কুরাইশগণ মক্কার উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত বনু দামরাকে বুঝাতে চেষ্টা করে যে উহুদের যুদ্ধের পর নবী শক্তিহীন হয়ে পড়েছেন। বনু দামরার দলপতি ৬২৬ খ্রিস্টাব্দের ৬ই এপ্রিল বদরের প্রান্তরে সমবেত বিশাল মুসলিম বাহিনী দেখে আশ্চর্যান্বিত হয়ে পড়েন। যাহোক, মদিনার আশেপাশে যাযাবর গোষ্ঠী নবীর প্রতি আস্থা রাখে : শুধু তাই নয় দূর-দূরাঞ্চলের যাযাবর বেদুঈনগণ মুসলিম বাহিনীতে যোগদান করতে থাকে।
মিথ্যা প্রচারণা ও বিশ্বাসঘাতকতা দ্বারা কুরাইশগণ তাদের নিজেদের উপকার অপেক্ষা অপকার করে। তাদের শঠতা ও মিথ্যাচার তখনই প্রমানিত হয় যখন অধিক সংখ্যক মুসলমান রণক্ষেত্রে উপস্থিত হয়। উহুদের যুদ্ধের বিপর্যয়ের পর হযরত মুহাম্মদের (স) ৬২৫ থেকে ৬২৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত মুসলিম বাহিনীর সংখ্যা বৃদ্ধি ও সুসংহতকরণে আত্মনিয়োগ করেন। এর মূখ্য উদ্দেশ্য ছিল মদিনার বিরুদ্ধে কুরাইশদের আক্রমণ প্রতিহত করা। নবী এক বিশ্বাসযোগ্য গুপ্তচর বাহিনী গঠন করে বিধর্মী গোত্রদের তৎপরতা সম্বন্ধে সবসময় খবর রাখতেন। নবী যখন সংবাদ পেলেন যে, যাযাবর বেদুঈনদের একটি দল মদিনা আক্রমণের প্রস্তুতি নিচ্ছে তখন তিনি আবু সালামার নেতৃত্বে ফাতানে বিধর্মী বনু আসাদ গোত্রের বিরুদ্ধে ১৫০ জন মুজাহিদসহ অভিযান পাঠান। এর পরের বছর ৬২৬ খ্রিস্টাব্দে হযরত মুহাম্মদ স্বয়ং ৪০০ জন মুজাহিদ নিয়ে বৈরীভাবাপন্ন বনু আনমার এবং থালাবা গোত্রের বিরুদ্ধে যাত-আরবিকাতে অভিযান করেন। এ সমস্ত অভিযান তেমন কোন তাৎপর্যপূর্ণ ছিল না এবং মাল-ই-গণিমতের পরিমাণও ছিল কম। কিন্তু সামরিক এবং মনস্তাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে এ সমস্ত অভিযান ছিল খুবই ফলদায়ক। কারণ এ ধরনের কার্যকলাপ মুসলিম সামরিক বাহিনীর শক্তি ও সংকল্পকে প্রমাণিত করে। উপরন্তু, মুসলমান বাহিনীর উত্তরোত্তর শক্তি বৃদ্ধিতে বিধর্মী কুরাইশগণ শঙ্কিত হয়ে পড়ে এবং মুসলিম বিরোধী কনফেডারেশন গঠনে বাধার সম্মুখীন হতে থাকে।
শত্রুর মোকাবেলার জন্য হযরত মুহাম্মদ (স) তাঁর গুপ্তচর বাহিনীর মাধ্যমে সংবাদ পেয়ে শত্রুপক্ষের আক্রমণের পূর্বেই তাদের আক্রমণ (Pre-emptive) করেন। এ ধরনের তৎপরতা মুসলিম বাহিনীর আত্মবিশ্বাস ও দৃঢ় মনোবল বৃদ্ধি করে। প্রয়োজনে শত্রুর নিধন তিনি অনুমোদন দেন। এ ধরনের ঘটনার কথা জানা যায় উহুদের যুদ্ধ এবং মদিনা অবরোধের মধ্যবর্তী সময়ে। বনু হুদাইল গোত্রের অঙ্গ গোষ্ঠী বনু লিহওয়ানের দলপতি সুফওয়ান বিন খালিদ বিন নুরাশ মুসলিম মুজাহিদ আবদুল্লাহ বিন উনাইস কর্তৃক নিহত হন। তিনি খাজরাজ গোত্রের সদস্য ছিলেন। মদিনা থেকে ইহুদী গোত্র বনু নাজির বিতাড়িত হয়ে খায়বারে বসতি স্থাপন করে। তাদের এক নেতা আবু রাফী সাল্লাম বিন আবি আল হুকাইক ইসলাম বিরোধী প্রচারণায় মত্ত হয়ে উঠে বনু গাতাফানের সাথে ষড়যন্ত্র করতে থাকে। মদিনার পাঁচজন মুসলিম, যার মধ্যে সুফয়ানের হত্যাকারী আবদুল্লাহ ছিলেন, খায়রাবে আবু রাফীকে হত্যা করে। হযরত মুহাম্মদ (স) তাঁর দূতদের ইসলাম ও তাঁর সম্বন্ধে কটুক্তি করার অনুমতি দেন যাতে প্রকৃত শত্রু চিহ্নিত করা যায়। এর ফলে ভবিষ্যতের শত্রুরা মিথ্যা প্রচালনা সম্বন্ধে সচেতন হয়ে পড়ে। শত্রুদের শঠতা, ষড়যন্ত্র ও বৈরীতা এমন এক মাত্রায় পৌছায় যে এ ব্যাপারে নবী সবসময় সচেতন থাকতেন। এ ধরনের দুটি ঘটনার উল্লেখ পাওয়া যায় আরব ইতিহাসে।
(খ) বীর মায়মুনা : বীর মায়মুনায় অবস্থিত কূয়ার কাছে বিধর্মীদের কর্তৃক মুসলিম নিধন সম্পর্কে পাশ্চাত্য ঐতিহাসিকগণ যে মন্তব্য করেছেন তা সঠিক নয়। এই ঘটনায় বহু মুসলিম নিহত হয়েছেন এবং এই বিপর্যয় অন্যান্য ইসলাম বিরোধী শত্রুদের উৎসাহিত করেছে। উহুদের যুদ্ধে পরাজিত মুসলমানদের মধ্যে কোন মারাত্মক প্রতিক্রিয়া দেখা যায় নি এবং হযরত মুহাম্মদ (স) এ ক্ষেত্রে সচেতন ছিলেন। বীর মায়মুনার হত্যাকাণ্ড একটি বিশ্বাসঘাতকদের বিচ্ছিন্ন ঘটনা।
বীর মায়মুনার কূয়ার কাছে মুসলমানদের শাহাদাতবরণের পিছনে যাদের হাত ছিল তারা হচ্ছেন আমিন বিন সা’হাব গোত্রের সদস্যগণ। এই গোত্রের প্রধান আবুল বারা’ আমির বিন মালিককে নবী ইসলাম ধর্ম গ্রহণের আহ্বান জানান। আবুল বারা’ নবীকে ধর্ম প্রচারের জন্য সাহাবীদের পাঠাতে বলেন। আবুল বারা’র অনুরোধে নবী বীর মায়মুনার যেখানে উর্বর শস্য ক্ষেত্র ছিল তাঁর সাহাবীদের সেখানে পাঠান। আবুল বারা’ তাদের নিরাপত্তার জন্য দায়িত্ব গ্রহণ করেন। আবুল বারা’র চারিত্রিক দৃঢ়তা ও বিশ্বাসযোগ্যতা সম্বন্ধে নবীর যথেষ্ট সন্দেহ ছিল। তবুও ইসলাম প্রচারের জন্য তিনি ৪০ থেকে ৭০ জন (কোন কোন ঐতিহাসিক ২০ জন বলেছেন) ধর্মপ্রচারক পাঠান। বনু আমির গোত্রের আমির বিন তোফায়েল নামে এক ইসলামবিরোধী সদস্য নবীর প্রেরিত মিশনের প্রধানকে হত্যা করে। শুধু তাই নয় আমির বিন তোফায়েল মুসলিম ধর্ম প্রচারকদের হত্যা করার জন্য তার গোত্রকে প্ররোচিত করে। কিন্তু আবুল বা’রা কর্তক প্রদত্ত নিরাপত্তার যে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল তা তার গোত্র ভঙ্গ করতে রাজি হয় নি। এরপর কুচক্রী বিধর্মীগণ পাশ্ববর্তী বনু সুলায়েমকে মুসলমানদের আক্রমণ করার জন্য উস্কানী দেয়। এর ফলে মুসলিম মিশনের প্রায় সকল সদস্য শাহাদাৎ বরণ করেন। এদের মধ্যে একজন আহত অবস্থায় মৃতবৎ রাস্তায় পড়েছিলেন। অপর একজন আমর বিন উমাইয়া আল-কিনানা বন্ধী হন। কিন্তু আক্রমণকারীদের সাথে তার সম্পর্ক ভাল থাকায় তাকে মুক্ত করে দেওয়া হয়।
বীর মায়মুনার ঘটনা হযরত মুহাম্মদের (স) জন্য খুবই মর্মান্তিক। তিনি সরল বিশ্বাসে সেখানে প্রতিনিধি দল পাঠিয়েছিলেন। গোত্র প্রধান আবুল বা’রা তাদের নিরাপত্তার প্রতিশ্রুতি দেয়; কিন্তু তার ভ্রাতুষ্পুত্র উচ্চাকাঙ্খী আমির বিন তোফায়েল বিশ্বাসঘাতকা করে বনু সুলায়েমকে হত্যাকাণ্ডে প্ররোচিত করে। ওয়ার্ট বলেন যে, হযরত মুহাম্মদ (স) আমির বিন তোফায়েলকে দুজনের মৃত্যুর ক্ষতিপূরণ (দিয়াত) দিলেও তিনি প্রায় চল্লিশজন সাহাবীদের মৃত্যুতে তার কাছে থেকে কোন ক্ষতিপূরণ দাবি করেন নি। অনেক ঐতিহাসিক ধারণা করেন যে, মুসলমান ধর্মপ্রচারকগণ নিশ্চয় এমন কিছু করেছেন যার জন্য তারা ক্ষতিপূরণ দাবি করতে পারেন নি। কিন্তু ওয়াটের মতে এ কথা সত্য নয়। ঘটনাটি বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে যে, আমির বিন তোফায়েল স্বগোত্রের স্থলে বনু সুলায়েমকে প্ররোচিত করে হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে : হত্যাকাণ্ডে তার নৈতিক দায়িত্ব থাকলেও যেহেতু অন্য গোত্র হত্যার জন্য দায়ী সেহেতু আমিরের এ ব্যাপারে কোন দায়দায়িত্ব ছিল না। এমনও ধারণা করা হয় যে, আমির বিন তোফায়েলের স্থলে বনু সুলায়েমের একজন সদস্য হযরত মুহাম্মদ (স)-এর পত্র বাহককে হত্যা করে। নবীর মুসলিম ধর্মপ্রচারকদের হত্যার জন্য ক্ষতিপূরণ দাবি না করার কারণ হিসেবে বলা হয়েছে যে তিনি বৈরীভাবাপন্ন বনু আমির এবং বনু সুলায়েমকে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত করতে চান। মূলত গোত্রপ্রদান আবুল বা’রার সাথে তার ভ্রাতুষ্পুত্র আমিরের কোন্দল ছিল। তার দলে সমর্থদের সংখ্যা অধিক থাকলেও আবুল বা’রা নবীকে মিশন পাঠাতে বলেন গোত্রে তার প্রাধান্য বৃদ্ধির জন্য”। নবী যখন মিশন পাঠান তখন কুচক্রী আমির যেহেতু তার গোত্রের প্রধান আবুল বা’রা নিরাপত্তার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন সেহেতু বনু সুলায়েমকে প্ররোচিত করে হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে তার চাচাকে বিব্রতকর পরিস্থিতির মধ্যে ফেলেন। এ ক্ষেত্রে বিশ্বাসঘাতক আমির গুপ্ত সংবাদ সরবরাহ করেন। যাহোক, বনু আমিরের মর্যাদা হত্যাকাণ্ডের ফলে ক্ষুণ্ণ হয় এবং মুসলিম কবি কা’ব বিন মালিক ব্যঙ্গাত্মক কবিতা রচনা করে তাদের ধিক্কার দেন। অন্যদিকে অপর এক কবি হাসান বিন সাবিত এই হত্যাকাণ্ডের জন্য বনু সুলায়েমকে দায়ী করেন এবং সম্পুর্ণ দায়দায়িত্ব বিশ্বাসঘাতক আমির বিন তোফায়েলের উপর চাপান। হযরত মুহাম্মদ (স) ঘটনাটি পর্যালোচনা করে স্থির করেন যে, মুসলিম হত্যাকাণ্ড হলেও বনু আমিরের ধর্মান্তরীত ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং তিনি আমির বিন তোফায়েলকে অভিশাপ দিলেও তাকে ক্ষতিপূরণ দেন।
(গ) আর-রাজি : বীর মায়মুনার মত আর-রাজিতে (নজদ সড়কে) প্রেরিত সাতজনের এক অভিযান ব্যর্থ হয় এবং তারা সকলই শহিদ হন। খলিফা আব্দুল মালিককে লিখিত উরওয়ার পত্র থেকে জানা যায় যে, কুরাইশদের মুসলিম বিরোধী তৎপরতার সংবাদ আহরণের জন্য নবী সাতজনের এক গুপ্তচর বাহিনী আর-রাজি নামক স্থানে পাঠান। এর উদ্দেশ্য ছিল কোন কোন গোত্রের সাথে কুরাইশগণ গোপন আঁতাত করছে তা জানা। ঘটনার বর্ননা দিতে গিয়ে আরব ঐতিহাসিকগণ বলেন যে, বনু লিহওয়ান তাদের দলপতির হত্যার প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য সুযোগের অপেক্ষায় ছিল। বনু লিহওয়ান উৎকোচ দিয়ে বনু খুজাইমার উপগোত্র থেকে দুজন সদস্যকে প্রভাবান্বিত করে। এ দুজন নবীর কাছে সংবাদ পাঠায় এই মর্মে যে তাদের কাছে একটি মিশন পাঠালে তারা ইসলাম কবুল করবে। আর-রাজি নামক স্থানে সাতজনের মিশন এসে পৌছলে প্রতারকদল স্থান ত্যাগ করে মুসলিম বিদ্বেষী বনু লিহওয়ানকে সংবাদ দেয়। এর ফলে সাত জনের মধ্যে চার জন সাহাবী শহীদ হন এবং বাকি তিন জনকে বন্দী করা হয়। মক্কায় যাবার পথে একজন বন্দী পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। কিন্তু পথিমধ্যে তরবারির আঘাতে তার মৃত্যু হয়। বাকি দু’জনকে মক্কায় বদরের যুদ্ধে বিধর্মীদের নিহত আত্মীয়দের কাছে বিক্রি করে দেওয়া হয়। পবিত্র মাসের শেষে এ দু’জন হতভাগ্য সাহাবীকে হারাম শরীফের বাইরে নিয়ে যাওয়া হয় এবং তারা ইসলাম ধর্ম ত্যাগ করতে অস্বীকার করায় তাদের শিরোচ্ছেদ করা হয়। বনু লিওয়ানের বিশ্বাসঘাতকতায় নবী তাদের অভিশাপ দেন। বিধর্মীগণ সাতজনকে গুপ্তচরবৃত্তির দায়ে অভিযুক্ত করে হত্যা করে।
(ঘ) মুসলমানদের শক্তিবৃদ্ধি : উহুদের যুদ্ধ থেকে মদিনা অবরোধ পর্যন্ত মুসলমানদের পরপর বীর মায়মুনা এবং আর-রাজিতে বিপর্যয় ঘটে সত্য কিন্তু উহুদের প্রান্তরে মুসলিম মনোবল ধ্বংস হয় নি এবং তাদের সামরিক ক্ষমতা ও স্পৃহা নিঃশেষ হয় নি। এর প্রমাণ হামরা আল-আসাদ এবং কাতাব গোত্রে (মার্চ-জুন, ৬২৫ খ্রি.) সাফল্যজনকভাবে অভিযান প্রেরণ। বীর মায়মুনা এবং আর-রাজির হত্যাকান্ডের কয়েক মাসের মধ্যে মুসলিম সামরিক শক্তি বৃদ্ধি পায়। হযরত মুহাম্মদ (স) ৬২৬ খ্রিস্টাব্দের এপ্রিল মাসে ১৫০০ পদাতিক এবং ১০ জন অশ্বারোহী নিয়ে একটি শক্তিশালী বাহিনী গঠন করতে সক্ষম হন। তিনি তাদের নিয়ে বদরের প্রান্তরে পৌছে শত্রুদের অপেক্ষায় রইলেন। উহুদের প্রান্তর থেকে মক্কায় ফিরে যাবার সময় আবু সুফিয়ান পরের বছর অর্থাৎ ৬২৬ খ্রিস্টাব্দে বদরের যুদ্ধে তাদের সাথে সংঘর্ষের আভাস দেন। এযাবৎ মুসলিম বাহিনীতে এত বিপুল সংখ্যক সৈন্য সমাবেশ হয় নি। আবু সুফিয়ান চ্যালেঞ্জ করলে নবীর তরফ থেকে ওমর বলেন যে তারা শত্রুর মোকাবেলা করার জন্য প্রস্তুত থাকবেন। আট দিন বদরে অপেক্ষা করেও মুসলিম বাহিনী আবু সুফিয়ানের ২০০০ পদাতিক এবং ৫০ জন অশ্বারোহীর সন্ধান পায় নি। সাক্ষাৎ সংঘর্ষ হয়নি এবং এ থেকে ধারণা করা হয় উভয় পক্ষ তাদের সামরিক শক্তি প্রদর্শন করেই ক্ষান্ত হয়। মুসলিম বাহিনীর গুপ্তচরেরা তাদের সামরিক শক্তির সংবাদ প্রচার করে শত্রুপক্ষকে মানসিকভাবে দুর্বল করার প্রয়াস পায়।
হযরত মুহাম্মদ (স) উপলব্ধি করেন যে, সামরিক শক্তি বৃদ্ধি এবং তৎপরতা ব্যতীত বৈরী মনোভাবাপন্ন বিধর্মী আরব গোত্রকে ধর্মান্তরীত করা যাবে না। তিনি এক্ষেত্রে কঠোর ও দৃঢ় নীতি অবলম্বন করেন এবং যারা ইসলামের প্রকাশ্য বিরোধিতা করছে তাদের হত্যার আদেশ দেন। ৬২৬ খ্রিস্টাব্দের মে মাসে আবু রাফীকে হত্যা করা হয়। ৬২৬ খ্রিস্টাব্দের জুন মাসে বনু থালাবা মুসলিম বাহিনী কর্তৃক আক্রান্ত হয়। এ ছাড়া মদিনার ৫০০ মাইল উত্তরে দু’মাত আল-জান্দালে মুসলিম বিরোধী ১০০০ আরবদের একটি দল সমবেত হলে তা বিতাড়িত করা হয়। ৬২৬ খ্রিস্টাব্দের আগস্ট এবং সেপ্টেম্বর মাসে মদিনা থেকে বহু দূরে অবস্থিত দু’মাত আল-জান্দালে সমরাভিযান করার যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে। কিন্তু বিচক্ষণ ও দূরদর্শী নবী এই অভিযান দ্বারা দুটি বিষয়ে বিশেষ গুরুত্ব দেন। প্রথমত, মক্কাবাসীদের সিরিয়া থেকে আগত কাফেলা পথ রুদ্ধ করে তাদের অর্থনৈতিক বিপর্যয় ঘটান। দ্বিতীয়ত, সামারিক শক্তির তৎপরতা দিয়ে আরবদেশের বিধর্মী গোত্রগুলোকে প্রভাবান্বিত করে ধর্মান্তরীত করা। তাছাড়া তিনি উত্তর আরবের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিধর্মী গোত্রগুলো কুরাইশদের সাথে মিলিত হয়ে যাতে কনফেডারেশন তৈরি করতে না পারে সে জন্য প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেন। ঐতিহাসিকগণ দু’মাত আল-জান্দলে সমরাভিযান আরব ভূখণ্ডের বাইরে ইসলাম প্রচারের ও রাষ্ট্র সম্প্রসারণের ইঙ্গিত বহন করে বলে মন্তব্য করেন। এতে প্রমাণিত হয় যে, উহুদের প্রান্তরে পরাজয়ে মুসলিম সামরিক বাহিনী সঙ্কুচিত হয় নি; বরং বৃদ্ধি পায়।
আল-ওয়াকীদীর মতে, নবী করিম ৬২৭ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারি মাসে বনু আল- মুসতালিকের বিরুদ্ধে সমরাভিযান করে আল-মুরাইসীতে পৌছান। ইবন ইসহাক এই অভিযান মদিনা অবরোধ ও খন্দকের যুদ্ধের পরে পরিচালিত হয় বলে মন্তব্য করেন। নবী সংবাদ পান যে আল-মুসতালক নামে এক বিধর্মী গোত্র মদিনা আক্রমণের পরিকল্পনা করছে। এ কারণে তিনি ঝটিকা আক্রমণে এই গোত্রকে পরাস্ত করে সকল সদস্যকে বন্দী করেন। এই অভিযান মোনাফেকদের ধ্বংস করে। আল-মুরাইশি মক্কার উত্তর-পশ্চিমে লোহিত সাগরের তটে অবস্থিত এবং এই অতর্কীত ও সাফল্যজনক অভিযান প্রমাণ করে যে বিধর্মী মক্কাবাসীদের যেখানে পূর্বে প্রাধান্য ছিল সেখানে ইসলামের আধিপত্য বিস্তার লাভ করছে।
উহুদের যুদ্ধ এবং মদিনা অবরোধের (খন্দকের যুদ্ধ) সময়কালে হযরত মুহাম্মদ (স) যদিও তাঁর বিরুদ্ধে বিধর্মী মক্কাবাসীদের কনফেডারেশন গঠনে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারেন নি, তবুও একথা নিশ্চিত করে বলা যায় যে, তিনি বদরের যুদ্ধের সফলতার পর অনেক বিধর্মীকে এই কনফেডারেশন যোগদানে নিরুৎসাহ করতে সমর্থ হন। উহুদের বিপর্যয়ের পর মুসলিম বাহিনীর সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে নব প্রতিষ্ঠিত ইসলামকে সুদৃঢ় করার জন্য।
৫. মদিনা অবরোধ : খন্দকের যুদ্ধ
মদিনা অবরোধ, যা ইসলামের ইতিহাসে খন্দকের যুদ্ধ নামে পরিচিত, ৬২৭ খ্রিস্টাব্দের ৩১শে মার্চ অর্থাৎ পঞ্চম হিজরীতে শুরু হয় এবং একপক্ষকাল স্থায়ী হয়। বিধর্মীদের মদিনা অবরোধ করার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল হযরত মুহাম্মদের (স) সামরিক শক্তিকে ধ্বংস করা। এ জন্য তারা দূর-দূরাঞ্চলের যাযাবর গোত্রদের তাদের কনফেডারেসীতে সামিল করার চেষ্টা করে। খায়বারের বনু নাজির নামে এক ইহুদি সম্প্রদায় মদিনায় তাদের ভূসম্পত্তি পুনরুদ্ধারের জন্য বিধর্মী কুরাইশদের কনফেডারেসীতে যোগদান করে। বনু গাতাফান সম্প্রদায়কে প্রলোভন দেখান হয় যে যদি তারা হযরত মুহাম্মদের (স) বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করে তাহলে তাদেরকে খায়বারের খেজুর বাগানে উৎপাদিত খেজুরের অর্ধেক প্রদান করা হবে।
বিধর্মী মক্কাবাসীদের কনফেডারেসীতে দুই কিংবা তিন বাহিনীতে সৈন্য সংখ্যা দাঁড়ায় ১০,০০০-এ। এই তিন বাহিনীর মধ্যে সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী ছিল বিধর্মী কুরাইশ এবং তাদের মিত্র গোষ্ঠী যাদের সাথে ৪০০০ সৈন্য ছিল। দ্বিতীয় বাহিনীতে গাতাফান গোত্র উপ-গোত্র ফাজোরা, আসজা এবং মুররা ছিল, যারা যথাক্রমে ১০০০, ৪০০ এবং ৪০০ সৈন্য সরবরাহ করে। তৃতীয় গোষ্ঠী ছিল সুলায়মী। তাদের বাহিনীতে ৭০০ সৈন্য ছিল। এ দিক থেকে বিচার করলে বিধর্মীদের পক্ষে মোট ৬৫০০ সৈন্য ছিল। ধারণা করা হয় যে, কুরাইশদের মিত্র আসাদ গোত্র ৩৫০০ সৈন্যসহ ইসলামের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করে। শত্রুপক্ষে ১০,০০০ সৈন্য ছিল কিনা সঠিকভাবে বলা না গেলেও একথা নিশ্চিত করে বলা যায় যে কুরাইশদের বাহিনীতে ক্ষিপ্রগতিসম্পন্ন ৩০০ অশ্বারোহী ছিল। ধারণা করা হয় যে গাতাফান বাহিনীতে সমসংখ্যক অশ্বারোহী ছিল।
বিধর্মীদের ১০,০০০ সৈন্যের বিপুল সমাবেশের মোকাবেলা করার জন্য হযরত মুহাম্মদ (স)-এর বাহিনীতে ছিল সর্বমোট ৩,০০০ সৈন্য। এই ৩,০০০ সৈন্য মদিনায় বসবাসকারী মুসলিম সম্প্রদায় থেকে গঠিত এবং উল্লেখ্য যে মদিনা সনদের শর্তানুযায়ী তখনও মদিনায় বসবাসকারী ইহুদী গোত্র বনু কুরাইযা মুসলিম বাহিনীতে যোগদান না করে নিরপেক্ষতা অবলম্বন করে। মদিনার মুসলমানদের মধ্যে বিশ্বাসঘাতকতার জন্য কয়েক জনকে মদিনা থেকে বহিষ্কৃত করা হয়, যারা বিধর্মী কুরাইশদের দলে যোগদান করে। এদের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখ্য আবু আমির আর-রাহিব। যাহোক, স্বল্পসংখ্যক হলেও ৩০০০ সৈন্য দ্বারা গঠিত মদিনা বাহিনীর মধ্যে হযরত মুহাম্মদ (স)-এর অনুপ্রেরণায় ঐক্য ও সংহতি ছিল। কিন্তু মুসলিম বাহিনীতে কতিপয় মোনাফেক (আবদুল্লাহ ইবন উবায়) ছিল যারা হযরত মুহাম্মদ (স)-এর যুদ্ধ পদ্ধতি সমর্থন করে নি এবং বিধর্মীদের সাথে মুসলিম বাহিনীর সংঘাতের ফলাফল সম্বন্ধে সন্ধিহান ছিল। পবিত্র কুরআনে তাদের প্রসঙ্গে বলা হয়েছে যে, “তারা মুসলিম বাহিনীর সমর্থনে যুদ্ধ থেকে বিরত থাকতে পারলে খুশী হত।” শুধু তাই না যুদ্ধের ফলাফল মুসলমানদের অনুকূলে না হলে এই বিশ্বাসঘাতকদল শত্রুপক্ষে যোগদানের সুযোগের অপেক্ষায় ছিল। ১
[১. সূরা আইয়াব (৩৩) ১২-১৩ : “এবং কপটচারিগণ ও যাদের অন্তরে ব্যধি আছে তারা বলছিল ‘আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের প্রতিশ্রুতি প্রতারণা ব্যতীত কিছুই না’।”
“এবং তাদের একদল বলেছিল হে ইয়াসরিববাসী, এখানে তোমাদের কোন স্থান নেই তোমরা ফিরে চল এবং তাদের মধ্যে একদল নবীর নিকট অব্যাহতি প্রার্থনা করে বলছিল, ‘আমাদের ঘরবাড়ী অরক্ষিত’, যদিও সেগুলো অরক্ষিত ছিল না, আসলে পলায়ন করাই ছিল তাদের উদ্দেশ্য।”]
উহুদের প্রান্তরে বিধর্মীগণ ওয়াদি আল-আকীকের মধ্য দিয়ে মদিনার দিকে আগমন করে এবং ওয়াদি আল-আকীক এবং উহুদ পাহাড়ের মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থান গ্রহণ করে। শত্রুপক্ষের সুদৃঢ় অবস্থানের ফলে মুসলিম বাহিনী উহুদের প্রান্তরে বেকায়দায় পড়ে যায়। কিন্তু মদিনা অবরোধের ক্ষেত্র হযরত মুহাম্মদ (স) এক নতুন যুদ্ধ কৌশল অবলম্বন করেন। ইতিপূর্বে অশ্বারোহী বাহিনীর পক্ষে মদিনা আক্রমণ করা সহজতর ছিল। কিন্তু তিনি নব-দীক্ষিত পারস্যবাসী সালমানের পরামর্শে মদিনা নগরীকে সুরক্ষিত করার জন্য একটি পরিখা বা খাল খনন করার নির্দেশ দিলেন। মদিনায় অবস্থানরত মুসলমানগণ যখন সংবাদ পেল যে মক্কা থেকে বিধর্মী কুরাইশগণ বিশাল বাহিনীসহ মদিনায় সমরাভিযান করেছে তখন মদিনার সমস্ত মুসলমান ছয় দিন ধরে মদিনার চারপাশে একটি পরিখা খনন করেন। পরিখা খনন সমাপ্ত হলে হজরত মুহাম্মদ (স) সাল পাহাড়ে তাঁর তাঁবু স্থাপন করে যুদ্ধ পরিচালনার প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। এ স্থানে অবস্থান করে তিনি উত্তর দিকের যুদ্ধ ক্ষেত্রের দিকে নজর দিতে থাকেন। সাল পাহাড়ের দিক থেকে শত্রুপক্ষের অগ্রগতির দিকে নজর দেওয়া সহজ ছিল।
ঘটনাচক্রে এই সীমানা দিয়ে শত্রুপক্ষের কয়েকজন অশ্বারোহী মদিনার অভ্যন্তরে প্রবেশের চেষ্টা করে। কিন্তু তাদের আক্রমণ তেমন সফলকাম হয় নি কারণ তারা সংখ্যায় ছিল খুব কম এবং তাদের আক্রমণ ছিল অপরিকল্পিত। এই আকস্মিক আক্রমণ ব্যতীত বিধর্মী মক্কাবাসীদের পক্ষে পরিখা পার হয়ে মদিনায় প্রবেশ করা সম্ভবপর হয় নি। রাতে তারা কয়েকবার পরিখা পার হবার চেষ্টা করে কিন্তু মুসলিম রক্ষীবাহিনীদের প্রতি আক্রমণে তারা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে। অশ্বারোহীবাহিনীর ব্যর্থতার ফলে পদাতিক বাহিনী পরিখা পার হয়ে মদিনা নগরীতে প্রবেশের চেষ্টা করে। কিন্তু অশ্বারোহী অপেক্ষা পদাতিক বাহিনী দুর্বল থাকায় তারা মুসলিম বাহিনীর সাথে হাতাহাতি লড়াই এ জড়িত হতে চায় নি। অশ্বারোহী ও পদাতিক বাহিনীর ব্যর্থতায় বিধর্মী কুরাইশগণ নিরুৎসাহ হল না। তারা সংঘবদ্ধভাবে কয়েকটি আক্রমন পরিচালনা করে। কিন্তু সফলকাম হয় নি। তারা আশা করে ছিল যে দক্ষিণ দিক থেকে ইহুদি কুরাইজা গোত্রকে মুসলমান বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনা করতে প্ররোচিত করতে সক্ষম হবে। কিন্তু এ ক্ষেত্রেও তারা ব্যর্থ হয়। উত্তর দিক থেকে শত্রু পক্ষের সমস্ত আক্রমণ সুসংবদ্ধ মুসলিম বাহিনী সার্থকভাবে প্রতিহত করে। এক পক্ষকাল ধরে পরিচালিত বিধর্মীদের অভিযান পরিচালিত হবার পর কোন সুফল দেখা না দেওয়ায় তারা বাধ্য হয়ে ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ল। মুসলিম বিরোধী কনফেডারেসীও ভেঙ্গে পড়ে। বিধর্মী বাহিনী ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দলে বিভক্ত হয়ে পড়লে তাদের বিরুদ্ধাচারণ বন্ধ হয়ে যায়। এছাড়া রাতে প্রচণ্ড ঠাণ্ডা এবং দিনে অসহনীয় গরম ও মরুঝড় অবরোধকারীদের মধ্যে হতাশার সৃষ্টি করে।[১] মদিনা অবরোধকালে ছয়জন আনসার এবং তিন জন বিধর্মী মক্কাবাসী নিহত হয়।
[১. সূরা আহযাবে (৩৩) ৯ আয়াতে উল্লেখ্য আছে “হে বিশ্বাসীগণ। তোমরা তোমাদের প্রতি আল্লাহের অনুগ্রহের কথা স্মরণ কর। যখন শত্রুবাহিনী তোমাদের বিরুদ্ধে সমাগত হয়েছিল এবং আমি তাদের বিরুদ্ধে ঝঞ্চা বায়ু এবং অদৃশ্য সৈন্যবাহিনী প্রেরণ করেছিলাম।”]
উহুদের যুদ্ধে মুসলিম বিপর্যয় সাময়িকভাবে ইসলামের প্রতি আঘাত মনে হলেও খন্দকের যুদ্ধ নবী করীমের (স) উন্নতমানের রণকৌশল, বুদ্ধিমত্তা ও সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত গুপ্তচর দ্বারা সংবাদ আহরনের প্রয়াসকে প্রমাণিত করে। বদর ও উহুদের যুদ্ধে প্রতীয়মান হয় যে, বিধর্মী অশ্বারোহীবাহিনী তাৎক্ষণিকভাবে মুসলিম অশ্বারোহী বাহিনীর উপর হামলা চালিয়ে কৃতকার্য হলেও অপেক্ষাকৃত শক্তিশালী পদাতিক বাহিনী শত্রুপক্ষে আক্রমণ চালিয়ে প্রচণ্ড নৈরাজ্য সৃষ্টি করতে পারত। পরিখা বিধৰ্মী অশ্বারোহীবাহিনীর অগ্রগতিতে বিঘ্ন সৃষ্টি করে। এর ফলে তাদের যে ৬০০ অশ্বারোহী সৈন্য ছিল তা পরিখার জন্য মদিনায় প্রবেশ করতে পারে নি।
মদিনা অবরোধ এবং খন্দকের যুদ্ধে বিধর্মী কুরাইশ বাহিনীর বিপর্যয়ের আর একটি কারণ ছিল। উহুদের যুদ্ধের সময় কুরাইশ বাহিনী যুদ্ধ শুরু হবার দশ দিন পূর্বে রণক্ষেত্রে আসে এবং এ সময় শষ্য ক্ষেত্রে শষ্যকর্তনের পর মাঠে যে ঘাস বিচালতি খণ্ড ছিল তা তাদের ঘোড়াদের পশু খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়। কিন্তু খন্দকের যুদ্ধের সময় হযরত মুহাম্মদ (স)-এর নির্দেশে শত্রুপক্ষের আগমনের পূর্বেই মাঠ থেকে শস্য কর্তন করে খড়, বিচালিসহ সমস্ত উজাড় করে ফেলা হয়। এটি নবী করীমের (স) একটি উল্লেখযোগ্য যুদ্ধ কৌশল, যার ফলে খন্দকের যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী পৌত্তলিক মক্কাবাসীদের ৬০০ ঘোড়া তাদের প্রয়োজনীয় খাদ্য পায় নি। এ ছাড়া পরিখা পার হতে গিয়ে অশ্বারোহীবাহিনী খাদে পড়ে যাবার সম্ভাবনা থাকে। উপরন্তু, আনসারগণ দিন রাত এই পরিখা পাহারায় নিয়োজিত ছিল। পরিখার যুদ্ধ একটি কৌশলগত যুদ্ধ এবং বিধর্মী মক্কার সৈন্যবাহিনীর এটি পরাজয়ের অন্যতম কারণ। এটি তাদের যুদ্ধকৌশলের অভাব অথবা অদূরদর্শিতার পরিচায়ক
বিধর্মীদের সামরিক ব্যর্থতার অন্য একটি কারণ হচ্ছে মুসলিম বাহিনীর শৃঙ্খলা, রণকৌশল, সংগঠন এবং নেতৃত্ব। উহুদের যুদ্ধে মুসলিম বাহিনী যদি ধৈর্য, শৃঙ্খলা এবং নিয়মানুবর্তিতা প্রদর্শনী করত তা হলে তাদের বিপর্যয় হত না। পরিখার যুদ্ধে বিধর্মীদের মধ্যে বিভিন্ন গোষ্ঠী দ্বারা গঠিত কনফেডারেসীর মধ্যে সংহতির অভাব ছিল। শুধু তাই নয় বিভিন্ন গোত্রের মধ্যে আত্মবিশ্বাসের অভাব ছিল। শত্রুপক্ষের এই বিশৃঙ্খলা অনৈক্য এবং আত্মবিশ্বাসের অভাবে মুসলিম সামরিক সাফল্য সুনিশ্চিত হয়। এই সুযোগে হযরত মুহাম্মদ (স)-এর কূটনৈতিক পদক্ষেপ বিশেষ কার্যকরী হয়। শত্রুপক্ষের প্রধান গোষ্ঠী বিধর্মী কুরাইশগণ ছাড়া অন্যান্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অঙ্গ সম্প্রদায়গুলো বিধর্মীদের সর্বাত্মক সমর্থন দেয় নি। বিশেষ করে গাতাফান গোত্রকে উৎকোচ দিয়ে কনফেডারেসীতে আনা হয়েছিল। অন্যদিকে যে সমস্ত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গোত্র বিধর্মীদের সাথে কনফেডারেসীতে যোগ দেয় তাদেরকে মুসলিম বাহিনীর বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ থেকে বিরত থাকার জন্য হযরত মুহাম্মদ (স) পারিতৌষিক প্রদানের ঘোষণা দেন। বিভিন্ন তথ্য সূত্র থেকে জানা যায় যে, বিধর্মীদের দল ত্যাগ করলে গাতাফান গোত্রকে মদিনার উৎপাদিত সর্বমোট খেজুরের এক তৃতীয়াংশ প্রদান করা হবে এরূপ একটি সমঝোতা হয়। কিন্তু গাতাফান গোত্র অর্ধেক দাবী করলে সমঝোতায় ভাটা পড়ে। অবশেষে তারা এক তৃতীয়াংশ ফসল গ্রহণ করতে রাজী হয়ে এক সমঝোতায় আসে। মদিনার গণ্যমান্য ব্যক্তিরা যখন এ ধরনের একটি সমঝোতার কথা জানতে পারলেন তখন তারা মদীনার মান-মর্যাদা ক্ষুণ্ণ হবার আশঙ্কা করলেন। তারা এ ধরনের গুপ্ত সমঝোতার কথা জেনে হযরত মুহাম্মদ (স)-এর সাথে সাক্ষাৎ করলেন। গাতাফান গোত্রের সাথে মদিনাবাসীদের খেজুর সংক্রান্ত বিষয়ে কোন সমঝোতা বা গুপ্ত চুক্তি হয়েছিল কিনা তা সঠিকভাবে জানা যায় না। তবে ধারণা করা হয় যে, গাতাফান গোত্র হযরত মুহাম্মদ (স)-এর সঙ্গে সমঝোতা করেছিল। বিধর্মী শিবিরের অন্যতম অঙ্গ গোত্র গাতাফানের এ ধরনের পদক্ষেপ একদিকে যেমন শত্রুপক্ষের দুর্বলতাকে প্রকাশ করে, অন্যদিকে কূটবুদ্ধির লড়াই-এ (battle of wits) মুসলমানদের সাফল্য সুনিশ্চিত হয়। এর অবশ্বম্ভাবী ফলাফল ছিল শত্রুপক্ষের সামরিক দুর্বলতা প্রকাশ এবং তাদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির ফলে ঐক্য ও সংহতির অভাব।
গাতাফান গোত্রের মত ইহুদী গোত্র বনু কুরাইজার মধ্যে ঐক্য, শৃঙ্খলা ও সংহতির অভাব ছিল। মদিনা সনদ অনুযায়ী মদিনা আক্রান্ত হলে মদিনায় বসবাসকারী ইহুদী গোত্রদের মুসলিম বাহিনীতে অংশগ্রহণ করে নগরী রক্ষার যে চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছিল তা খন্দকের যুদ্ধে প্রতিফলিত হয়নি। বনু কুরাইযার সদস্যগণ মদিনা রক্ষার জন্য অস্ত্র ধারণ না করলেও তারা খন্দক বা পরিখা খননের জন্য যন্ত্রপাতি সরবরাহ করে। পরবর্তীকালে শত্রুভাবাপন্ন ইহুদী গোত্র বনু নাজিরের হুয়াই বিন আখতাব নামে এক সদস্য কুরাইজা গোত্রকে প্রভাবান্বিত করে তাদেরকে মুসলিম বিদ্বেষী করে তোলে। হুয়াই তাদের বলে যে, মুসলিম বাহিনীর পরাজয় আসন্ন; এ কারণে তাদের সামরিক সাহায্য দান হবে নিরর্থক। এর ফলে বনু গাতাফান খন্দকের যুদ্ধে কোন প্রকার সাহায্য করেনি। ইহুদী কুরাইজা গোত্রের বক্তব্য ছিল এই যে, খন্দকের যুদ্ধে হযরত মুহাম্মদ (স) জয়লাভ করলে মুসলিম বাহিনী শত্রুভাবাপন্ন ও চুক্তির শর্তভঙ্গকারী কুরাইজা গোত্রের উপর প্রতিশোধ গ্রহণ করবে। এ কারণে তাদের অসহযোগিতার জন্য তারা গাতাফান এবং কুরাইশ গোত্র থেকে অগ্রীম যুদ্ধবন্দী দাবী করে। বিধর্মী গাতাফানও কুরাইশদের সাথে ইহুদী কুরাইজা গোত্রের এই গুপ্ত সমঝোতার সংবাদ লাভ করে হযরত মুহাম্মদ (স)-এর গুপ্তচরেরা কুরাইজা ও গাতাফান গোত্রের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির জন্য নানা ধরনের কুমন্ত্রণা দিতে থাকে। এর ফলে উভয় গোত্রের মধ্যে মারাত্মক ভুলবুঝাবুঝির সৃষ্টি হয়। এর ফলে মুসলিম বিরোধী দ্বিতীয় ফ্রন্ট খোলা সম্ভব হয় নি। উল্লেখ্য যে, মদিনায় বসবাসকারী ইহুদী সম্প্রদায় সব সময় মুসলিম সম্প্রদায়ের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। হযরত মুহাম্মদ (স)-এর কূটনৈতিক তৎপরতার ফলেই খন্দকের যুদ্ধে মুসলমানদের সামরিক সাফল্য সুনিশ্চিত হয়। কারণ মুসলিম বিরোধী এই জোট সাফল্যজনকভাবে দক্ষিণ দিক থেকে বানু কুরাইজার নেতৃত্বে সমরাভিযান করলে মুসলিম বাহিনী বিপর্যস্ত হত। এমন কি হযরত মুহাম্মদ (স) ব্যাপক কর্মকাণ্ডে ব্যহত হত।