দ্বিতীয় অধ্যায় – বিবরণ

দ্বিতীয় অধ্যায় – বিবরণ

সীমা ও পরিমাণ : অধুনা ত্রিপুরা রাজ্যের সীমা এইরূপ প্রদর্শিত হইয়া থাকে। পূর্ব দিকে কুকি প্রদেশ, উত্তরে শ্রীহট্ট জেলা, পশ্চিমে শ্রীহট্ট ত্রিপুরা ও নওয়াখালী জেলা, দক্ষিণে চট্টগ্রাম। ইহার পরিমাণ ৪০৮৬ বর্গ মাইল। এই রাজ্য উত্তর অক্ষাংশ ২২°৫৯′ হইতে ২৪°৩১′ কলা এবং পূর্ব দ্রাঘিমা ৯১°১২′ হইতে ৯২°২৪′ কলা মধ্যে অবস্থিত।

প্রাকৃত বিবরণ :- ত্রিপুর রাজ্য একটি পর্বত ও অরণ্যময় প্রদেশ। ইহার মধ্য দিয়া ৬/৭ পর্বতশ্রেণী উত্তর দক্ষিণে ধাবিত হইয়াছে। একটি হইতে অন্য পর্বতশ্রেণী গড়ে ১০১২ মাইল দূরে অবস্থিত। পর্বতশ্রেণী সমূহের মধ্যে স্থানে স্থানে সুন্দর সমতল ক্ষেত্র ও জলাভূমি দৃষ্ট হইয়া থাকে। কোন কোন স্থানে কন্টক ও বনাকীর্ণ উপত্যকা অধিত্যকা বর্তমান রহিয়াছে

দেবতামুড়ার পশ্চিম দিকস্থ অনতি উচ্চ পর্বত সমূহ কোনরূপ শ্রেণীবদ্ধ নহে। কুমিল্লা হইতে দেবতামুড়া পর্বত সমসূত্র রেখায় ২৭ মাইল দূরে অবস্থিত। এই দেবতামুড়া হইতে প্রকৃত পর্বতশ্রেণী আরম্ভ হইয়াছে। দেবতামুড়া পর্বতশ্রেণী মধ্যে দেবতামুড়া শৃঙ্গ ৮১২ ফিট ও শৈশনমুড়া (৬) ৮১৩ ফিট উচ্চ। ইহার পূর্বদিকে আঠারমুড়া পর্বতশ্রেণী অবস্থিত; ইহার মধ্যে আঠারমুড়া ১৪৩১ ফিট ও জারিমুড়া ১৫০০ ফিট উচ্চ। তাহার পূর্বদিকে বচিয়া পর্বতশ্রেণী; তন্মধ্যে মাচিয়া শৃঙ্গ ১৩৭৪ ফিট উচ্চ। তাহার পূর্বদিকে সারদুইং পর্বতশ্রেণী, ইহার মধ্যে সারদুইং শৃঙ্গ ১৫০৯ ফিট উচ্চ তৎপূর্ব দিকে লংতারাই পর্বতশ্রেণী, ইহার মধ্যে সমবসিয়া ১৫৪৪ ফিট ও পেংকুই ১৫৮১ ফিট উচ্চ। তাহার পূর্বদিকে সংখলং পর্বতশ্রেণী, তন্মধ্যে সক্কল শৃঙ্গ ২৫৭৮ ফিট উচ্চ। তৎ পূর্বদিকে জামপুই পর্বতশ্রেণী, ইহার মধ্যে জামপুই শৃঙ্গ ১৮০০ ফিট এবং বেতলং শিব ৩২০০ ফিট উচ্চ। এই সকল পর্বতশ্রেণী নানাপ্রকার মৃত্তিকা ও বেলে প্রস্তরে গঠিত।

নদী :- এই রাজ্য মধ্যে অসংখ্য ক্ষুদ্র স্রোতস্বতী দৃষ্ট হইয়া থাকে। স্থানে স্থানে জলপ্রপাত ও উৎস পরিলক্ষিত হয়। এই পর্বতজাত নদী সমূহের মধ্যে গোমতী ও মনু সৰ্বপ্ৰধান।

গোমতী :- আঠারমুড়া পর্বতজাত ছাইমা এবং লংতরাই পর্বতজাত রাইমা নদীর সংযোগে গোমতী নদীর উদ্ভব হইয়াছে। এই নদী প্রায় ত্রিপুরা রাজ্যের মধ্য দিয়া প্রবাহিত হইতেছে। প্রাচীন রাজধানী অমরপুর, রাঙ্গামাটি ও উদয়পুর এই নদীর তীরে অবস্থিত। গোমতীর উৎপত্তি স্থানের নিকট কতকগুলি জলপ্রপাত দৃষ্ট হয়। এই সকল জলপ্রপাতের (৭) স্থানীয় নাম ডুম্বুর। কোন কোন ব্যক্তি বলেন, জলপ্রপাত সমূহের আকৃতি মহাদেবের হস্তস্থিত ডুম্বুরের ন্যায় বলিয়া শিবোপাসকগণ ইহাদিগকে ডুম্বুর আখ্যা দান করিয়াছেন। সর্বনিম্নস্থিত জলপ্রপাত দ্বারা একটি বৃহৎ কুণ্ড গঠিত হইয়াছে, সেই কুণ্ড মণ্ডলাকার, তাহার ব্যাস প্রায় ১০০ হস্ত; যে স্থানে জলরাশি প্রবল বেগে পতিত হইতেছে, সেই স্থানের গভীরতা ২০ হস্ত। জলপ্রপাত জাত কুণ্ডগুলি, রাণীকুণ্ড, কাছুয়াকুণ্ড, কমলাকুণ্ড ইত্যাদি বিশেষ বিশেষ নামে পরিচিত।

মনু নদী :- সংখলং পর্বতস্থিত খোয়াইশিব শৃঙ্গের নিকটবর্ত্তী স্থান হইতে এই নদী উদ্ভুত হইয়াছে। দেও, দুলাই প্রভৃতি অনেকগুলি গিরি নন্দিনী মনুকে করদান করিতেছে। শ্রীহট্ট জেলার মধ্যে মনু বড়বক্র নদীর সহিত মিলিত হইয়াছে।

হাওড়া :- একটি ক্ষুদ্র স্রোতস্বতী; ইহার তীরে ত্রিপুরার আধুনিক রাজধানী আগরতলা ও নূতনহাবিলি অবস্থিত।

খনিজ পদার্থ :- ফরাসী ভ্রমণকারী টেবার্নিয়ার লিখিয়াছেন— ত্রিপুরারাজ্যে এক প্রকার স্বর্ণ প্রাপ্ত হওয়া যায়, কিন্তু তাহা সম্পূর্ণ বিশুদ্ধ নহে। অধুনা সেই স্বর্ণের কোনরূপ নিদর্শন প্রাপ্ত হওয়া যাইতেছ না। এই রজ্যে পূর্বপার্শ্বে পাথুরিয়া কয়লা আছে বলিয়া শ্রুত হওয়া গিয়াছে, কিন্তু তাঁহার বিশ্বস্ত প্রমাণ প্রাপ্ত হওয়া যায় নাই। স্থানে স্থানে লবণ উৎস (৮) ও লবণাক্ত স্রোতস্বতী দৃষ্ট হইয়া থাকে। সেই সকল স্রোতস্বতীকে ‘নুনাছড়া’ বলে। জামপুই পর্বতশ্রেণীর দক্ষিণাংশে অবস্থিত একটি লবণ উৎস বিশেষ উল্লেখযোগ্য তাহার উত্তাপের পরিমাণ ৭২ ডিগ্রি দেখা গিয়াছে।

মৎস্য :- ত্রিপুরা পর্বতজাত স্রোতস্বতী ও জলাসমূহ নানা প্রকার মৎস্যে পরিপূর্ণ। বোধ হয় সমতল ক্ষেত্রবাসী বাঙ্গালিদিগের ভয়ে মৎস্যকুল নির্ভয়ে নিবিড় অরণ্যে বাস করিতেছে। গোমতীর উজান ভাগে ‘মহাশৌল’ নামক অত্যুৎকৃষ্ট মৎস্য প্রচুর পরিমাণে প্রাপ্ত হওয়া যায়। দেও, দুলাই, থাল, জুরী প্রভৃতি নদী সমূহের উজান ভাগ রুহিত, কাতল প্রভৃতি নানা প্রকার মৎস্যে পরিপূর্ণ।

অরণ্যজাত দ্রব্য :- এই রাজ্য তরু গুল্মে আবৃত। অরণ্যময় প্রদেশে নানাপ্রকার বৃহৎ বৃক্ষ জন্মিয়া থাকে। তদ্বারা মানবের ব্যবহার উপযোগী বহুবিধ দ্রব্যাদি প্রস্তুত হয়। জারুল, নাগেশ্বর, চাম্পালই প্রভৃতি দ্বারা নৌকা প্রস্তুত হয়। শাল, কালীবক্কল, কাঁচড়া, গর্জন[২] প্রভৃতি গৃহ নিৰ্ম্মাণ কার্য্যে উৎকৃষ্ট। পোমা, পিতরাজ, চামল, গাম্ভারী প্রভৃতি দ্বারা বাক্স, আলমারী প্রভৃতি নানাপ্রকার দ্রব্য প্রস্তুত হইয়া থাকে।

এই পর্ব্বত মধ্যে নানাপ্রকার বাঁশ জন্মে, তন্মধ্যে “মুলী” গৃহ নিৰ্ম্মাণ জন্য বিশেষ প্রয়োজনীয়। সুন্দি, গর্লাক, রাইচং (৯) ও জালি প্রভৃতি নানাপ্রকার বেত এই রাজ্যে উৎপন্ন হইয়া থাকে। কাঁচা গৃহের প্রধান আবরণ “ছন” নামক খড় প্রচুর পরিমাণে জন্মে। এই সকল অরণ্যজাত দ্রব্য দ্বারা পূর্ববঙ্গবাসীর মহোপকার সাধিত হয়, এবং ত্রিপুরেশ্বরও ইহার শুল্ক দ্বারা প্রচুর অর্থলাভ করিয়া থাকেন।

বন্যপশু :- এই রাজ্য ক্ষুদ্র ও বৃহৎ নানাজাতীয় জন্তুতে পরিপূর্ণ। হস্তী, গণ্ডার, গবয়, চামরি, নানাপ্রকার মৃগ, নানাপ্রকার ব্যাঘ্র, মহিষ, বরাহ, কৃষ্ণ ভল্লুক, হুল্লুক (হুক্কু), নানাপ্রকার বানর, লজ্জাবতী-বিড়াল, বন্য বিড়াল, বন্য কুকুর, বন্য-ছাগল প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।

হস্তী :- ত্রিপুরা পর্বত হস্তীর জন্য বিখ্যাত। এরূপ সুন্দর হস্তী ভারতের অন্য কোন অরণ্যে প্রাপ্ত হওয়া যায় না। পুং হস্তিগুলিকে দুই শ্রেণীতে বিভক্ত করা হয়, বৃহদন্তবিশিষ্ট হস্তী গুণ্ডা এবং দন্তবিহীন হস্তী মকনা আখ্যায় আখ্যাত হয়। হস্তিনীগুলি কুকী বলিয়া পরিচিত। কুন্তীর বৃহৎ দন্ত হয় না। হস্তিকুল দলবদ্ধ হইয়া অরণ্যে বাস করে। প্রত্যেক দলে একটি গুণ্ডা বা মকনা নায়ক থাকে। যখন অন্য কোন একটি গুণ্ডা বা মকনা তাহার প্রতিদ্বন্দ্বী হইয়া উঠে, তখনই উভয়ের মধ্যে ভীষণ সংগ্রাম আরম্ভ হয়। পরাজিত হস্তী নিহত কিম্বা দল হইতে তাড়িত হইয়া থাকে।

ত্রিপুরা পর্বত মধ্যে দলে দলে হস্তী বিচরণ করে। কিন্তু (১০) বর্ষাকালে অল্প হস্তী দৃষ্ট হইয়া থাকে। তাহার কারণ এই, ত্রিপুরা রাজ্যের পূর্বাংশে এক সহস্র বর্গমাইল বিস্তৃত, নানা প্রকার কন্টকাকীর্ণ তরু ও গুল্মে আচ্ছাদিত, একটি ক্ষেত্র আছে। ইহা বন্যহস্তীর প্রধান নিবাসভূমি। শিশির সমাগমে বহুসংখ্যক হস্তী এই কন্টকাকীর্ণ প্রদেশ হইতে বহির্গত হইয়া দলে দলে চতুর্দ্দিকে বিচরণ করে। বসন্ত ঋতুতে তাহারা পুনর্বার সেই স্থানে গমন করে। এই স্থান মনুষ্যের অগম্য, হস্তিকুল তাহাদের “দোয়াল” (বিস্তীর্ণ বৰ্ম্ম) দিয়া যাতায়াত করিয়া থাকে।

শীত ঋতুতে হস্তিকুল যখন চতুর্দ্দিকে বিচরণ করিতে থাকে, তখন তাহারা মনুষ্য কর্তৃক ধৃত হয়। খেদা, পরতালা ও ফাঁসী এই ত্রিবিধ প্রকারে হস্তী ধৃত হইয়া থাকে।

খেদা :- ইহার অর্থ খেদান বা তাড়ান। অর্থাৎ খেদাইয়া নিয়া একটি খোঁয়াড়ে আবদ্ধ করা। এই উপায়ে কখন কখন শতাধিক হস্তী একবারে ধৃত করা যায়। ত্রিপুরা রাজ্য মধ্যে খেদার জন্য ৭টি প্রশস্ত ক্ষেত্র আছে, ইহাদিগকে দোয়াল বলে যথা, ১) অমরসাগর দোয়াল, ২) মনু দোয়াল, ৩) ছাইমা দোয়াল, ৪) দেওগাং দোয়াল, ৫) ধলাই দোয়াল, ৬) কল্যাণপুর দোয়াল, ৭) কমলখাঁ দোয়াল। প্রথমোক্ত দোয়াল অমরসাগর নামক দীর্ঘিকার নিকটবর্ত্তী এজন্য ইহাকে অমরসাগর দোয়াল বলে, ইহাই প্ৰধান; অধিকাংশ হস্তী এই দোয়ালে ধৃত হইয়া থাকে। (১১)

শীতের আরম্ভে হস্তিদলের অনুসন্ধান জন্য পর্বত মধ্যে লোক প্রেরিত হয়, তাহাদিগকে “পাঁজালি” বলে। পাঁজালি কোন একটি দলের সন্ধান পাইলে, খেদা বিভাগের কর্তৃপক্ষকে সংবাদ দেয়। সেই সংবাদ প্রাপ্ত মাত্র তাঁহারা বহুসংখ্যক কুলি লইয়া তথায় গমন করেন। এই সকল কুলি দ্বারা হস্তীর দলটি ঘেরিয়া ফেলা হয়। ইহাকে “পাতাবেড়” বলে। পাতাবেড়ের কার্য্য আরম্ভ হইলেই নিকটবর্ত্তী সমতলক্ষেত্রে একটি প্রকাণ্ড খোঁয়াড় প্রস্তুত করা হয়। খোঁয়াড় প্রস্তুত হইলে তাহারা বিপরীত দিক হইতে বন্দুক ছাড়িয়া ও নানাপ্রকার গণ্ডগোল ও চীৎকার করিয়া কুলিগণ হস্তিদলের অভিমুখে অগ্রসর হইতে থাকে। ভীষণ শত্রু আসিতেছে বিবেচনায় ভীরু হস্তিগণ নীরব নিস্তব্ধ খোঁয়াড়ের দিকে গমন করত তন্মধ্যে প্রবেশ করে। হস্তীরদল প্রবেশ করিলে খোঁয়াড়ের দ্বার বন্ধ করিয়া দেওয়া হয়। খোঁয়াড় রক্ষা করিবার জন্য কুলি ও হস্তীর মাহুতগণ বর্শা হস্তে চতুর্দ্দিকে বিচরণ করিতে থাকে। ২/৩ দিন অনাহারে থাকিয়া হস্তিকুল দুর্বল হইলে, মাহুতগণ পোষা কুকী আরোহণে খোঁয়াড়ের মধ্যে প্রবেশ করে, ও মেষপালের ন্যায় হস্তিগুলিকে বন্ধন করিয়া ক্রমে ক্রমে বাহিরে লইয়া আসে এবং বৃক্ষে বন্ধন করিয়া রাখে।

পরতালা :- প্রতিদ্বন্দ্বী কর্তৃক পরাজিত হইয়া যখন প্রকাণ্ডকায় গুণ্ডা কিম্বা মকনা যূথভ্ৰষ্ট হইয়া ইতস্তত বিচরণ করে, (১২) কিম্বামস্তী (মদমত্ত) হইলে যখন তাহারা দল পরিত্যাগ পূবর্বক অরণ্য মধ্যে মনোমত কুন্তী অনুসন্ধান করিতে থাকে, তখনই পরতালা দ্বারা সেই গুণ্ডা কিম্বা মকনাকে ধৃত করা হয়। তদবস্থাপন্ন একটি পুং হস্তী দৃষ্ট হইলে মাহুতগণ বলবতী ও সুশিক্ষিতা ৫/৭টি কুন্তী লইয়া তাহার নিকট গমন করে। যে হস্তিনীর প্রতি তাহার আসক্তি দৃষ্ট হয়, সেই কন্কীটি তাহার এক পার্শ্বে রাখিয়া অপর পার্শ্বে অন্য একটি কুকী রাখিতে হয়। উভয় কুকীর মুখ বন্যহস্তীর লাঙ্গুলের দিকে রাখিয়া তাহারা তাহাকে সুদৃঢ়রূপে চাপিয়া রাখে। তখন বন্ধনকারী মাহুত অন্য কুন্তী লইয়া তাহার পশ্চাদ্দিকে গমন করে। কামোন্মত্ত গুণ্ডা বা মক্‌না যখন মনোমত কুকীর অঙ্গসংযোগে আত্মহারা হইয়া পড়ে, তখন সেই মাহুত কুকী হইতে অবরোহণ করত সুদৃঢ় রজ্জুদ্বারা তাহার পশ্চাদ্দিগের দুই পা বাঁধিয়া ফেলে। এইরূপ দুই তিনটি রজ্জুদ্বারা তাহার পদ বন্ধন করিয়া নিকটবর্ত্তী কোন বৃক্ষের সহিত সেই রজ্জুবন্ধন করিতে পারিলেই গুণ্ডা বা মক্‌না চিরজীবনের জন্য মনুষ্য হস্তে বন্দি হইল। ইহাই পরতলা শিকার

ফাঁসি শিকার :- ইহাদ্বারা প্রধানত বন্য কুন্তী ধৃত করা হয়। গুণ্ডা ও মা কদাচিত ফাঁসিতে আবদ্ধ হয়। গুণ্ডা কিম্বা মাকে ফাঁসিদ্বারা ধৃত করিতে গেলে প্রায়ই পোষা হস্তীর প্রাণ বিয়োগ হইয়া থাকে।(১৩)

একটি বন্য কুকী যূথভ্ৰষ্ট হইয়া যখন ইতস্তত বিচরণ করে, তখন মাহুতগণ অন্ত ত ২/৩টি পোষা কুন্তী লইয়া তাহার নিকট গমন করে। প্রত্যেক পোষা হস্তীর পৃষ্ঠে দুইজন লোক থাকে। একজন চালক আর একজন বন্ধনকারী। বন্ধনকারী একটি সূদৃঢ় রজ্জুনির্ম্মিত ফাঁদ লইয়া বসিয়া থাকে। এই রজ্জুর অপরদিক পোষা হস্তীর শরীরে বাঁধিয়া রাখে। পোষা হস্তী বন্য হস্তীর নিকটবর্ত্তী হইলেই মাহুত হস্তস্থিত বৃহৎ ফাঁদ বন্য হস্তীর মস্তকে ফেলিয়া দেয়। মস্তকোপরে ফাঁদটি পতিত হইলে বন্যহস্তী স্বীয় প্রকৃতি বশত গুণ্ডটি জড়াইয়া আনে, তখন সহজেই সেই ফাঁদ গলদেশে আসিয়া পতিত হয়। বন্য কুকীটি বিশেষ বলবতী হইলে পরে আরও দুই একটি ফাঁদ দ্বারা তাহাকে বন্ধন করা হয়। ইহাকে ফাঁসি শিকার বলে। ফাঁসিদ্বারা বন্য হস্তী কাবু হইয়া আসিলে তাহার পশ্চাদ্দিকের পদে রজ্জু বন্ধন করিয়া বৃক্ষের সহিত বাঁধিয়া ফেলে।

এই ত্রিবিধ উপায়ে ত্রিপুরার রাজসরকার হইতে হস্তধৃত করা হয়। হস্তি ব্যবসায়ীগণ মহারাজ হইতে পাট্টা লইয়া প্রতি বৎসরই হস্তী ধৃত করিয়া থাকে। ব্যবসায়ীগণকে ধৃত হস্তীর প্রায় চতুর্থাংশ রাজকর প্রদান করিতে হয়। হস্তীর শুল্ক হইতে মহারাজ কোন কোন বৎসর ২৩/২৪ সহস্র টাকা প্রাপ্ত হইয়া থাকেন।[৩] (১৪)

বন্য বিহঙ্গ :- ত্রিপুরা পর্ব্বত বন্য বিহঙ্গে পরিপূর্ণ। বিবিধ প্রকার সুবর্ণ রঞ্জিত কিম্বা কলকণ্ঠ, কোন জাতীয় পক্ষীর অভাব নাই। টিয়া, মদনা, চন্দনা প্রভৃতি কেবল তোতা জাতীয় পাখি প্রতি বৎসর ১০/১৫ হাজার ধৃত হইয়া ত্রিপুরা নোয়াখালী ও শ্রীহট্টের বাজার সমূহে বিক্রীত হইয়া থাকে। ত্রিপুরা রাজ্যের উত্তরাংশে ধনেশ পাখি দৃষ্ট হয়। ইহাদের দেহে বসা এত অধিক যে, সূর্যের আলোকে তাহাদের চলচ্ছক্তি থাকে না, তৎকালে মনুষ্যগণ অতি সহজে তাহাদিগকে ধৃত করে কিম্বা মারিয়া পেলে। ধনেশের বসা সূতিকা রোগের একটি মহৌষধি।

সর্প :- ত্রিপুরা রাজ্যে নানা প্রকার প্রকাণ্ডকায় অজগর সর্প দৃষ্ট হয়। গোক্ষুর কেউটা প্রভৃতি বিষধরেরও অভাব নাই। কোন কোন জাতীয় সর্প কুকিদের উপাদেয় খাদ্য।

.

টীকা

১. Tavernier’s Travels in India, P. 156.

২. এই গর্জ্জন বৃক্ষের নির্যাস হইতে গৰ্জ্জন তৈল জন্মে।

৩. অল্প কয়েক বৎসর হইল গবর্ণমেন্ট বার্ষিক ২৩ হাজার টাকা জমায় ত্রিপুরা রাজ্যের অন্তর্গত দোয়ালগুলি ইজারা লওয়ার প্রস্তাব করিয়াছিলেন। এই সূত্রে ইংরেজ কর্তৃপক্ষগণ সহিত কোনরূপ বিরোধ উপস্থিত হইতে পারে, এই আশঙ্কায় মহারাজ তাহাতে অসম্মত হন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *