প্রাক-ইসলামী যুগ : রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট
মানব সভ্যতার বিকাশ
স্রষ্টার সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি মানব জাতি তমসাচ্ছন্ন তথা বর্বর যুগ হতে সভ্যতার আলোকে উদ্ভাসিত হয়েছিল। ইতিহাসের কোন যুগসন্ধিক্ষণে এটি সম্ভবপর হয়েছিল তা ঐতিহাসিকগণ নিরূপণ করেছেন। মানব সভ্যতার ইতিহাস ক্রমবিবর্তনের মাধ্যমে আত্মপ্রকাশ করেছে।
(ক) প্রাগৈতিহাসিক যুগ
গুহাবাসী আদিম মানুষ পুরাতন প্রস্তর যুগে বিভিন্ন ধরনের উৎকৃষ্ট পাথরের হাতিয়ার ব্যবহার করত এবং এগুলো দ্বারাই প্রমাণিত হয় যে, তারা অকাট মূর্খ অথবা পশুবৎ বুদ্ধিহীন অথবা হিংস্র, বর্বর ছিল না। গ্রাহাম ক্লার্ক বলেন, “এগুলো (পাথরের হাতিয়ার) আদিম মানবের কীর্তির জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত এবং এগুলোর ক্রমশ উন্নতি শুধুমাত্র দক্ষতাই নয়, বরং মানসিক চিন্তাধারার ক্রমোন্নতিও প্রকাশ করে।” এই কারণে প্রাগৈতিহাসিক যুগের বিশেষজ্ঞরা হাতিয়ারকে ‘মনের জীবাশ্ম’ (fossils of the mind) বলেছেন। পাকিস্তানের রাওয়ালপিণ্ডির নিকট সাওন উপত্যকায় ও বেলুচিস্তানের জোব অঞ্চলে পুরাতন প্রস্তর যুগের বহু প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন পাওয়া গিয়াছে। চিত্রশিল্পে গুহামানবের উৎকর্ষতার প্রমাণ পাওয়া যায় স্পেনের আলটামিরা গুহায় আবিষ্কৃত ষাঁড়, বাইসন, বলগা হরিণ প্রভৃতির দেওয়াল চিত্রে। প্রাচীন যুগের জীবজন্তুর ছবি আপাতদৃষ্টিতে বৈচিত্র্যহীন ও স্থূল মনে হতে পারে কিন্তু শৈল্পিক অভিব্যক্তি, বিভিন্ন রং-এর সুষ্ঠু ব্যবহার ও বাস্তবধর্মী ছাপ খুবই স্পষ্টরূপে এগুলোতে ফুটে রয়েছে। প্রাচীন মিসর, মেসোপটেমিয়া এবং সিন্ধু উপত্যকায় পুরাতন প্রস্তর যুগের মানুষ মৃত ব্যক্তিকে তার ব্যবহৃত আসবাবপত্রসহ সমাহিত করত। খ্রিস্টপূর্ব ৫,০০,০০০ হতে ১০,০০০ অব্দ পর্যন্ত ধরাধামে সর্বপ্রথম নিয়েনডারথাল মানব গোষ্ঠীর আবির্ভাব হয়। এ সময় থেকেই বর্তমান মানুষের এবং প্রাচীন প্রস্তর যুগের সূচনা হয়। প্রাচীন প্রস্তর যুগের শেষভাগে ক্রো-ম্যাগনন মানুষ হতে দ্বিপদবিশিষ্ট দণ্ডায়মান (erect) মানব জাতির উদ্ভব হয়েছে বলে মনে করা হয়।
মানব সভ্যতার দ্বিতীয় স্তর নব্য-প্রস্তর যুগ (Neolithic Age)। প্রাচীন প্রস্তর যুগে ব্যবহৃত হাতিয়ারের তুলনায় এ যুগের বিভিন্ন পাথরের উপকরণগুলো মসৃণ ছিল। গুহায় বসবাসকারী প্রাচীন প্রস্তর যুগের মানুষেরা জীব-জন্তু বধ করে জীবন ধারণ করত। কিন্তু নব্য-প্রস্তর যুগে মানুষ গুহা ছাড়িয়া সর্বপ্রথম সমতল ক্ষেত্রে ঘরবাড়ি নির্মাণ করে বসবাস করতে আরম্ভ করে। জমি হতে শস্য উৎপাদন করে তারা জীবনযাত্রা নির্বাহ করত। গুহামানব আগুনের ব্যবহার জানত কিন্তু খাদ্যদ্রব্য রান্না করবার প্রথা তখনও প্রচলিত হয় নাই। নব্য-প্রস্তর যুগে মানুষ সমাজবদ্ধ জীবরূপে জীবনযাত্রা শুরু করে এবং বিভিন্ন ধরনের মৃৎপাত্রে খাদ্য রান্না করে ভক্ষণ করত। প্রাচীন মিসর মেসোপটেমিয়া এবং সিন্ধু সভ্যতার আদিম যুগের এ ধরনের মৃৎপাত্র খনন কার্যের ফলে আবিষ্কৃত হয়েছে। সুইজারল্যান্ডের হ্রদে কাষ্ঠনির্মিত নব্য-প্রস্তর যুগের গৃহের ধ্বংসাবশেষ পাওয়া গিয়াছে। নব্য-প্রস্তর যুগের অপর একটি বৈশিষ্ট্য ছিল বন্য জবি-জন্তুগুলোকে মানুষের প্রয়োজনে গৃহপালিত জন্তুরূপে পরিণত করা। এ সময় কুকুর, হাঁস, ছাগল, ভেড়া, শূকর প্রভৃতি জীব-জন্তু পোষ মানান হয়। কুমারের চাকা আবিষ্কৃত হলে অসংখ্য মৃৎপাত্র নির্মিত হতে থাকে এবং তৈজসপত্ররূপে ব্যবহৃত হলেও শৈল্পিক দক্ষতা এবং চাতুর্যের পরিস্ফুটনও এগুলোতে দেখা যায়। রঞ্জিত মৃৎপাত্রের প্রচলন শুরু হয় আনাতোলিয়া ও ইরানে এবং সেখান থেকে এর প্রভাব নিকট প্রাচ্যে বিস্তার লাভ করে।
গার্ডনার বলেন, “স্থায়ীভাবে বসবাস করবার ফলে সংঘবদ্ধ সম্প্রদায় এবং শিল্প, ব্যবসা-বাণিজ্য প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গে দলপতির সমাধি-স্তম্ভ নির্মাণ শুরু হয়।” সমতলে মানুষ সর্বপ্রথম একত্রে বসবাস করিবার সুযোগ লাভ করে সমাজবদ্ধ জীবরূপে আত্মপ্রকাশ করে এবং এর ফলে রাষ্ট্র গঠন সম্ভবপর হয়। ধর্মকে রাষ্ট্রজীবনের অপরিহার্য অঙ্গ বলে ধরা হয়। ফলে, ধর্ম-মন্দির নির্মাণ হতে থাকে। ধর্ম থেকেই উদ্ভূত হয় বিভিন্ন ধরনের অনুষ্ঠান, রীতি-নীতি, পৌরাণিক গল্প, তত্ত্ব-কথা ইত্যাদি। স্থাপত্য-শিল্পের নিদর্শন দেখা যায় ব্রিটেনের সলসবেরীতে, স্টোনহেঞ্জে ( Stonehenge ) মোটামুটিভাবে খ্রিস্টপূর্ব ১০,০০০ হতে সম্ভবত খ্রিস্টপূর্ব ৬,০০০ অব্দে ধাতুর ব্যবহার প্রচলিত হবার পূর্ব পর্যন্ত সমকালকে নব্য-প্রস্তর যুগ বলা হয়ে থাকে। তাঁতের ব্যবহারই এই যুগের উৎকৃষ্ট শিল্প ছিল এবং এর প্রমাণ পাওয়া যায় মিসরের ফায়মো গ্রাহাম ফ্লার্ক বলেন, “ভূমধ্যসাগর থেকে সিন্ধু উপত্যাকা পর্যন্ত বিস্তৃত এলাকায় সঠিকভাবে চিহ্নিত নব্য-প্রস্তর যুগের সভ্যতার নিদর্শন বহন করে রয়েছে একই সঙ্গে রঞ্জিত এবং বক্রোদর ঝিনুকের সারি দ্বারা সজ্জিত মৃৎপাত্রগুলো।”
নব্য-প্রস্তর যুগের মানব সভ্যতাকে ধাতু আবিষ্কারের ফলে আরও সুদূর প্রসারী করা সম্ভবপর হয়। ধাতব যুগে সোনা, রূপা, তামা, ব্রোঞ্জ (Bronze) আবিষ্কৃত হয়ে মানুষের বিভিন্ন কাজে ব্যবহৃত হতে থাকে। সম্ভবত খ্রিস্টপূর্ব ৬,০০০ অব্দে মেসোপটেমিয়ায় সর্বপ্রথম সোনা পাওয়া যায়। সোনা ও রূপা প্রথমত মুদ্রারূপে ব্যবহৃত হত। তামার নির্মিত তৈজসপত্রও খননকার্যের ফলে আবিষ্কৃত হয়েছে। পারশোর খোরাসান অঞ্চলে সর্বপ্রথম টিনের ব্যবহারের কথা উল্লেখ আছে। টিন এবং তামার মিশ্রণে সৃষ্ট ব্রোঞ্জ সর্বাপেক্ষা প্রিয় এবং বহুল ব্যবহৃত ধাতু। মেসোপটেমিয়ায় একটি এশীয় ধাতব আবিষ্কার। ব্রোঞ্জের বাটালি, মাছ ধরার বড়শি, তরবারি প্রভৃতি খননের ফলে এই অঞ্চলে পাওয়া গিয়াছে। হিকসস আক্রমণের ফলে সর্বপ্রথম মিসরে ব্রোঞ্জের ব্যবহার প্রচলিত হয়। প্যালেস্টাইন ও সিন্ধু উপত্যকায় ব্রোঞ্জের নির্মিত বিভিন্ন উপকরণ আবিষ্কৃত হয়েছে।
ব্রোঞ্জ যুগে ব্যবসা-বাণিজ্যের সম্প্রসারণে মানব সভ্যতার বিকাশ হতে থাকে। গরুর গাড়ি এবং নৌকার বহুল ব্যবহারে এই সম্প্রসারণ সম্ভব হয়েছিল। মিসর, মেসোপটেমিয়া ও সিন্ধু উপত্যকায় যে প্রাচীন সভ্যতা গড়ে উঠেছিল তার মূলে ছিল নাগরিক জীবন পদ্ধতি। বৃহৎ সম্প্রদায় দলপতি দ্বারা শাসন করা সম্ভবপর না হওয়ায় রাজবংশের অভ্যুত্থান হয়।
(খ) ঐতিহাসিক যুগ
প্রখ্যাত ব্রিটিশ ঐতিহাসিক আরনল্ড টয়েনবি (Arnold Toynbee) পৃথিবীর ইতিহাসকে বিভিন্ন কৃষ্টির ক্রমবিকাশ বলে আখ্যায়িত করেছেন। মানব ইতিহাসের বিভিন্ন স্তরে বিভিন্ন অঞ্চলে যে বিশেষ বিশেষ কৃষ্টির উদ্ভব হয়েছিল তাকেই সভ্যতা বলা হয়ে থাকে। কৃষ্টির সমন্বয়ে সভ্যতা; যেমন- মেসোপটেমীয় সভ্যতা বলতে সুমেরীয়, আক্কাদীয়, ব্যবিলনীয়, অ্যাসিরীয় এবং চালদীয় কৃষ্টির সমন্বয়কে বুঝা যায়। সুতরাং কৃষ্টি অপেক্ষা সভ্যতার অর্থ ব্যাপক। দ্বিতীয়ত, সভ্যতা বলতে মানব ইতিহাসের ক্রমবিকাশ ও বিবর্তনে সেই স্তরকে বিশেষ করে বুঝতে হবে যখন লিখন-পদ্ধতি আবিষ্কৃত হয়েছে; শিল্প ও বিজ্ঞানের যথেষ্ট উৎকর্ষ সাধিত হয়েছে; রাষ্ট্রীয়, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও ধর্মীয় ক্ষেত্রে প্রভূত উন্নতি সাধিত হয়েছে।
প্রাগৈতিহাসিক যুগের সাথে ঐতিহাসিক যুগের প্রভেদ এই যে, ঐতিহাসিক যুগে সর্বপ্রথম লিখন পদ্ধতি আবিষ্কৃত হয় মেসোপটেমিয়ায় খ্রিস্টপূর্ব ৮০০০ অব্দে মানুষ ধ্যান- ধারণা, চিন্তা-ভাবনা, আবেগ-অনুভূতি স্থূল মাধ্যমে সর্বপ্রথম লিখিবার প্রচেষ্টা চালায়। ম্যালোয়ানের ভাষায়, “বিস্মিত হবার কোন কারণ নেই যে, এ সময়ে (‘জমদেদ নসর’ সময়কাল) মেসোপটেমিয়ায় সর্বপ্রথম লিখন-পদ্ধতি আবিষ্কৃত হয়। চতুর্থ উরুকের মন্দিরগুলো নির্মাণকালে আমরা মাটির পীঠিকায় (Clay tablets) অসংখ্য লেখা দেখতে পাই। প্রথম অবস্থায় লিখন-পদ্ধতি সমাজ জীবনের অপরিহার্য সজীব ও নির্জীব বস্তুর চিত্রের ছাপ সম্বলিত ছিল।” ভেড়া, গরু, দুধের বালতি, কৃষির যন্ত্রপাতি, মন্দিরের সম্মুখভাগ, মানুষের পায়ের তলা প্রভৃতির ছবি অঙ্কিত করে মনের ভাব প্রকাশ করা হত। এটিকে চিত্র-লিখন পদ্ধতি (অথবা Pictogram) বলা যেতে পারে।
একথা অবিসংবাদিত সত্য যে, সভ্যতা বিবর্তনশীল ও এটি চক্রাকারে আবর্তিত হতে থাকে। তথাকথিত ‘বর্বর’ যুগ হতে কোথায় ও কখন মানুষ আধুনিক সভ্যতার আলোক প্রাপ্ত হয় তা সঠিকভাবে বলা যায় না। তবে সভ্যতার উন্মেষের মূলে প্রধান কারণগুলো ছিল ক্রমবর্ধমান মানব সমাজের নাগরিকীকরণ, লোকসংখ্যা বৃদ্ধি, বিভিন্ন ধরনের সমাজ উন্নয়নমূলক কার্যকলাপ; যেমন- কৃষিকার্য, সেচব্যবস্থা, যানবাহনের উন্নতি, রাষ্ট্রীয় বিধান ও ধর্মীয় অনুশাসন প্রবর্তন, শিল্প, স্থাপত্য, শিক্ষা ও বিজ্ঞানের উৎকর্ষতা প্রভৃতি। পৃথিবীর প্রাচীনতম সভ্যতার নিদর্শন পাওয়া যায় নীল, ইউফ্রেটিস ও টাইগ্রীস এবং সিন্ধু নদের অববাহিকায়। বলা বাহুল্য যে, নিকট প্রাচ্যে (Near East) পৃথিবীর প্রাচীনতম সভ্যতাগুলোর উন্মেষ ও ক্রমবিকাশ ঘটে। নিকট প্রাচ্য বলতে ঐতিহাসিকেরা উত্তরে কাম্পিয়ান ও কৃষ্ণসাগরের মধ্যবর্তী অঞ্চল; দক্ষিণে লোহিত সাগর, পারস্য উপসাগর ও আরব সাগর; পূর্বে সিন্ধুনদ এবং পশ্চিমে ভূমধ্যসাগর ও নীলনদ পরিবেষ্টিত অঞ্চলকে বুঝিয়েছেন। এই সমস্ত নদীবিধৌত অঞ্চলে নিয়মিত পানি সরবরাহ, উর্বর ভূমি, অফুরন্ত প্রাকৃতিক সম্পদ, যানবাহনের সুযোগ-সুবিধা প্রভৃতি কারণে সভ্যতার বিকাশ সম্ভব হয়েছিল। মেসোপটেমীয় ও মিসরীয় সভ্যতা মানব ইতিহাসে সর্বপ্রাচীন বলে মনে করা হয়।
সেমিটিক জাতি
মানব সভ্যতার ইতিহাসে যে জাতির অবদান চিরস্মরণীয় হয়ে রয়েছে তার নাম সেমিটিক। সেমেটিক জাতির লীলাভূমি প্রাচ্যদেশে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের বাস ছিল; যেমন- ইতিহাস প্রখ্যাত ব্যবিলন, অ্যাসিরীয়, ফিনিসীয়, হিব্রু ইত্যাদি। সেমিটিক শব্দ পুরাতন বাইবেলের সাম (Shem) হতে উদ্ভূত হয়েছে। মনে করা হয়ে থাকে যে, হযরত নূহ (আ)-এর পুত্র সামের বংশধরগণ সেমিটিক, হামের পুত্র হ্যামিটিক (মিসরীয়) এবং ইয়াফাসের বংশধরগণ আর্য (ভারতবর্ষ, ইরান প্রভৃতি) নামে পরিচিত। হযরত ঈশা (আ), হযরত মুসা (আ) এবং ইসলামের মহানবী হযরত মুহম্মদ (স) এই সেমিটিক জাতির অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। উল্লেখযোগ্য যে, আরব দেশ সেমিটিক জাতির আদিভূমি ছিল। একেশ্বরবাদী ধর্ম প্রচারে সেমিটিক জাতি নেতৃত্ব দান করে এবং খ্রিস্ট ধর্ম ও ইহুদী ধর্মের তুলনায় ইসলাম সর্বশেষ একেশ্বরবাদী ধর্ম বলে পৃথিবীতে স্বীকৃতি লাভ করেছে।
বিভিন্ন নামে পরিচিত হলেও আসলে সেমিটিকগণ একই জাতি ছিল এবং একই স্থানে বসবাস করত। খ্রিস্টপূর্ব ৩৫০০ অব্দে সেমিটিক জাতির একটি অংশ আদি বাসভূমি আরব দেশ ত্যাগ করে টাইগ্রীস-ইউফ্রেটিস উপত্যকায় গমন করে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে থাকে। এই অঞ্চলে সুমেরীয় নামে একটি সুসভ্য অ-সেমিটিক জাতি পূর্ব থেকে বসবাস করত। পরবর্তীকালে এই সুমেরীয় এবং সেমিটিক জাতির সংমিশ্রণে ব্যবিলনীয় ও অ্যাসিরীয় সভ্যতার উৎপত্তি হয়। খ্রিস্টপূর্ব ২৫০০ অব্দে সেমিটিক জাতির অপর একটি শাখা সিরিয়া ও প্যালেস্টাইনে গমন করে সেখানে বসবাস করতে থাকে এবং হিব্রু সভ্যতা গড়ে তোলে। সেমিটিকদের অপর একটি শাখা ভূমধ্যসাগর ও লেবানন পর্বতের মধ্যবর্তী অঞ্চলে বসতি স্থাপন করে ফিনিসীয় সভ্যতার ভিত্তি স্থাপন করে। আরব দেশ সেমিটিক জাতির জন্মভূমির কথা প্রমাণ করবার প্রচেষ্টায় রবার্টসন স্মিথ বলেন, “বাস্তবিকপক্ষে সমগ্র প্রাচীন সেমিটিক অঞ্চলের অধিবাসীদের অপূর্ব চারিত্রিক সমজাতিকত্ব থাকার প্রত্যক্ষ প্রমাণ এই যে, কেবল তাদের মধ্যেই আরব জাতি ও আরবি প্রভাব স্থায়ীভাবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে।”
প্রাচীন মিসরীয় সভ্যতা
পৃথিবীর মধ্যে অন্যতম প্রাচীন ও সুসমৃদ্ধ সভ্যতার উন্মেষ হয় মিসরের নীল নদের অববাহিকায়। সম্ভবত অপর কোন সভ্যতা মানব জাতির ক্রমবিবর্তন, উন্নতি ও উৎকর্ষতায় এরূপ অবদান রাখতে পারে নাই। প্রাচীন মিসরীয় সভ্যতার সময়কাল সুদূর প্রসারিত। এই সময়কালকে কয়েক শ্রেণীতে ভাগ করা যায়; যেমন- প্রাক-ডাইনেস্টি (খ্রিস্টপূর্ব ৪০০০ ৩২০০), প্রাচীন রাজ্য (খ্রিস্টপূর্ব ৩২০০ – ২৩০০), মধ্যরাজ্য (খ্রিস্টপূর্ব ২১০০ – ১৭৮৮), বৈদেশিক হিকসস্দের আক্রমণ (খ্রিস্টপূর্ব ১৭৫০ – ১৫৮০) এবং মিসরীয় সাম্রাজ্য (খ্রিস্টপূর্ব ১৫৮০-১০৯০)।
প্রাক-ডাইনেস্টি (Pre-Dynasty) (খ্রিস্টপূর্ব ৪০০০ – ৩২০০ )
নীল নদের অববাহিকায় কোন সংঘবদ্ধ জাতির বসবাস শুরু হয় খ্রিস্টপূর্ব ৩২০০ সাল থেকে। এই কারণে খ্রিস্ট পূর্ব ৩২০০ সালের পূর্বের মিসরীয় ইতিহাসকে প্রাক- ডাইনেস্টি যুগ বলা হয়। এই যুগে মিসরে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র স্বাধীন নগর-রাষ্ট্রের উদ্ভব হয়। বলা বাহুল্য, এই রাষ্ট্রগুলো সংঘবদ্ধ ছিল না, যদিও একটি স্থূল কনফেডারেশন ছিল।
প্রাক-ডাইনেস্টি যুগে মিসরীয়দের জাতিগত বৈশিষ্ট্য ছিল এই যে, তারা ককেশাস জাতির ভূমধ্যসাগরীয় শাখার অন্তর্ভুক্ত। তারা ছিল খাট, কৃষ্ণকায় ও লম্বা-মাথাবিশিষ্ট জাতি; লম্বা নাক ও কাল চুল। নিগ্রো ও সেমিটিক জাতির সংমিশ্রণও তাদের মধ্যে দেখা যায়। তাদের ভাষায় সেমিটিক প্রভাব লক্ষণীয়।
প্রাক-ডাইনেস্টি যুগে মিসরীয় সভ্যতার সূচনা হয়। তারা বিভিন্ন ধরনের হাতিয়ার, অস্ত্রশস্ত্র ব্যবহার করতে জানত। মৃৎপাত্র নির্মাণ এবং মিনা করবার পদ্ধতিও তাদের অজানা ছিল না। তাছাড়া কৃষিকাজ, জলসেচ, জলাশয়কে কৃষিক্ষেত্রে রূপান্তরিত করবার কৌশল তারা উদ্ভাবন করে। তারা উন্নতমানের লিনেন কাপড় তৈরি করতে জানত। আইনবিদ্যা, লিখন পদ্ধতি, সৌর পঞ্জিকা আবিষ্কার করে তারা সুখ্যাতি অর্জন করে। খ্রিস্টপূর্ব ৪২০০ সালে প্রাক-ডাইনেস্টি যুগের মিসরীয়গণ সৌর পঞ্জিকা আবিষ্কার করে।
প্রাচীন রাজ্য (Old Kingdom) (খ্রিস্টপূর্ব ৩২০০ – ২৩০০ )
খ্রিস্টপূর্ব ৩২০০ সালে উত্তর ও দক্ষিণ মিসর একত্রীভূত হয়ে একটি সংঘবদ্ধ জাতিতে পরিণত হয়। এই জাতির প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন মেনেস। তিনি প্রথম রাজবংশের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেন। এরূপ আরও পাঁচটি রাজবংশ খ্রিস্টপূর্ব ২৩০০ সাল পর্যন্ত রাজত্ব করে। প্রথম দুই রাজবংশের রাজত্বকালে মিসরের রাজধানী ছিল উত্তর মিসরের থিবিসে। তৃতীয় রাজবংশের সময় রাজধানী স্থানান্তরিত হয় মধ্য মিসরে অবস্থিত মেমফিসে।
প্রাচীন মিসরীয় শাসন-ব্যবস্থায় পুরোহিততন্ত্রের প্রভাব প্রকটভাবে দেখা যায়। একচ্ছত্র অধিপতি রাজা ঈশ্বরের প্রতিনিধি হিসেবে রাজ্যশাসন করতেন। রাজা নিজেকে ঐশ্বরিক গুণাবলি ও ক্ষমতার অধিকারী মনে করতেন। এ কারণে তিনি নিজেকে সূর্য দেবতা ‘রে’ (Re)-এর সন্তান হিসেবে প্রচার করেন। তিনি সাধারণভাবে ‘ফেরাউন’ নামে পরিচিত ছিলেন। ফেরাউন (Pharaon) কথাটির উৎপত্তি হইয়াছে ‘পের-অ’ (Per-O) অর্থাৎ বৃহৎ গৃহ অথবা রাজ-পরিবার হতে। ঐশ্বরিক ক্ষমতা ও প্রাচীন আইন মোতাবেক তিনি রাজ্যশাসন করতেন। স্বীয় পরিবারের বাইরে তার বিবাহ নিষিদ্ধ ছিল।
প্রাচীন মিসরীয় ইতিহাসে রাষ্ট্র ও ধর্মের মধ্যে সুষ্ঠু সমন্বয় দেখা যায়। ফেরাউন স্বয়ং ছিলেন প্রধান পুরোহিত এবং তার অনুগত অসংখ্য পুরোহিত ও ধর্মীয় নেতা ছিল। শাসনকার্য পরিচালনার জন্য ফেরাউন রাজধানী ও দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে শাসনকর্তা (প্রধানমন্ত্রী), বিচারক, খাজাঞ্চী, স্থপতি প্রভৃতি নিয়োগ করতেন। ফেরাউনগণ বংশ পরস্পরায় সুযোগ-সুবিধা ভোগ করতেন।
প্রাচীন রাজ্যের সময় যুদ্ধবিগ্রহ বিশেষ পরিলক্ষিত হয় নাই। ফেরাউনগণ শান্তি ও শৃঙ্খলার সাথে রাজ্যশাসন করতেন। তাদের কোন নিয়মিত সেনাবাহিনী ছিল না। এই কারণে মিসরে যুদ্ধের পরিবর্তে শান্তি বিরাজ করত এবং ইহা একটি উন্নত ও সুসমৃদ্ধ দেশে পরিণত হয়। প্রাচীন রাজবংশের নৃপতিগণ পরাক্রমশালী ছিলেন।
খ্রিস্টপূর্ব ২৩০০ অব্দে প্রাচীন রাজবংশের পতন হয়। এর পর সামন্ত যুগের সূচনা হয়। এই যুগ (খ্রিস্টপূর্ব ২৩০০-২১০০) মিসরীয় ইতিহাসে একটি অনাচার, বিশৃঙ্খলা ও অরাজকতার যুগ নামে পরিচিত। সামন্তরাজদের মধ্যে কোন্দলের ফলে জন জীবন দুর্বিষহ হয়ে পড়ে। তাছাড়া নিগ্রো ও এশিয়াটিক জাতির মিসর অভিযান সামন্ত যুগে সংঘটিত হয়।
মধ্য রাজ্য (Middle Kingdom) (খ্রিস্টপূর্ব ২১০০-১৭৮৮) : প্রাচীন রাজ্যের যুগ অপেক্ষা মধ্য রাজ্যের শাসন দুর্বল হলেও ফেরাউনদের আধিপত্য পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়। কিন্তু এই যুগে প্রভাবশালী ফেরাউনদের কর্তৃত্ব খর্ব হতে থাকে এবং সামন্ত রাজ্য ও অভিজাত শ্রেণীর প্রতাপ বৃদ্ধি পেতে থাকে। একাদশ রাজবংশের আবির্ভাবের ফলে ফেরাউনদের রাজত্ব প্রাচীন মিসরীয় ইতিহাসে এক নবদিগন্তের সুচনা করে। দ্বাদশ রাজবংশের সময়ে জনসাধারণ রাজকার্যে অংশগ্রহণের সুযোগ পায়। জনগণ ভূসম্পত্তির অধিকারী হয়। এ কারণে দ্বাদশ রাজবংশের সরকারকে গণতান্ত্রিক সরকার বলে অভিহিত করা হয়। পুরোহিততন্ত্র বজায় থাকলেও এই যুগকে সামাজিক ন্যায়বিচার ও জ্ঞানবিজ্ঞান চর্চার এক স্বর্ণযুগ বলা হয়।
বৈদেশিক হিকসস্দের আক্রমণ (খ্রিস্টপূর্ব ১৭৫০-১৫৮০) : দ্বাদশ রাজবংশের পতনের পর খ্রিষ্টপূর্ব ১৭৫০ অব্দে বৈদেশিক হিকসসদের আক্রমণ মিসরীয় রাজতন্ত্রে কুঠারাঘাত করে। হিকসস্ পশ্চিম এশিয়ার একটি যাযাবর জাতি; তাদের ‘মেষপালক রাজা’ নামে অভিহিত করা হয়। তারা সর্বপ্রথম মিসরে ঘোড়া ও ঘোড়া চালিত যুদ্ধরথের প্রচলন করে। খ্রিস্টপূর্ব ১৫৮০ সালে মিসরীয়গণ সংঘবদ্ধভাবে অভিযান পরিচালনা করে হিকসসদের বিতাড়িত করে। অষ্টাদশ রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা প্রথম আহমদ এই অভিযান পরিচালিত করেন।
মিসরীয় সাম্রাজ্য (Egyptian Empire) (খ্রিস্টপূর্ব ১৫৮০-১০৯০) : খ্রিষ্টপূর্ব ১৫৮০ থেকে ১০৯০ সাল পর্যন্ত মিসরীয় ইতিহাসে একটি গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়ের সূচনা হয়। এ সময়ে অষ্টাদশ, ঊনবিংশ ও বিংশতি রাজবংশ রাজত্ব করে। এ যুগের বৈদেশিক নীতি ছিল আগ্রাসন ও বৈদেশিক অভিযান! হিকসসদের সঙ্গে যুদ্ধে মিসরীয়গণ যে বীরত্ব ও শৌর্য-বীর্য প্রদর্শন করে তার প্রতিফলন দেখা যায় এক বিরাট সৈন্যবাহিনী গঠন ও যুদ্ধাভিযানে। খ্রিস্টপূর্ব ১৪৭৯ সালে সিরিয়া ও ইরাকে রাজ্য বিস্তার করে মিসর সাম্রাজ্যের সীমানা বৃদ্ধি করে। ফনেসীয়, কালদীয়, হিটাইট ও অ্যাসিরীয়গণ তাদের পদানত হয়। কিন্তু তৃতীয় তুমস এই বিশাল রাজ্য সংগঠিত ও সুসংহত করতে পারেন নি। এ যুগের সর্বাপেক্ষা ক্ষমতাশালী নৃপতি ছিলেন তৃতীয় রামসিস। এ সময় শৌর্য-বীর্য ও জ্ঞানচর্চায় তারা যেমন উন্নতি সাধন করে অপরদিকে একাশি শতাব্দীর শেষ ভাগ হতে এর পতন শুরু হয়। এই পতনের মূলে ছিল বিভিন্ন সময়ে বৈদেশিক আক্রমণ।
মিসরীয় সভ্যতা
প্রাচীন মিসরীয় সভ্যতা মানব সভ্যতার ইতিহাসে অনন্য অবদান রেখেছে। অধ্যাপক ফ্লিন্ডার্স পেট্রি মিসরীয় সভ্যতাকে খ্রিস্টপূর্ব ১০,০০০ বৎসরের প্রাচীন বলে চিহ্নিত করেন।
প্রাচীন মিসরীয়গণের জীবনে ধর্মের প্রভাব ছিল খুবই প্রকট। গ্রিকগণ তাদের মানব জাতির মধ্যে সর্বাপেক্ষা ধর্মপ্রাণ বলে অভিহিত করেন। ঐশ্বরিক শক্তির প্রতি বিশ্বাস অন্যান্য ধর্মাবলম্বী হতে তাদের পৃথক করেছে। শুধু ধর্মীয় শাসন বা পুরোহিততন্ত্রেই নয়, সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং বিশেষ করে সাংস্কৃতিক জীবনেও ধর্মের অনুশাসনের প্রতিফলন দেখা যায়।
প্রাচীন জাতিসমূহের মধ্যে মিসরীয়গণই প্রথম ধর্মীয় বিশ্বাসের প্রচলন করে। তাদের প্রধান দেবতার নাম ছিল ‘আমন-রে’ (Ammon-Re)। কৃষিভিত্তিক ও নীল নদের উপর নির্ভরশীল মিসরীয় সভ্যতার অপর একজন দেবতার নাম ওসিরিস (Osiris)। তাকে নীল নদের দেবতাও বলা হয়। এই দুই দেবতা ব্যতীত অপর সমস্ত দেবদেবী বিশেষ প্রভাবশালী ছিল না। কথিত আছে যে, ওসিরিস তার দুষ্ট প্রকৃতির ভ্রাতা সেথ (Seth) কর্তৃক নিহত ও তার দেহ খণ্ডবিখণ্ড অবস্থায় নিক্ষিপ্ত হলে তাঁর পত্নী আইসিস (Isis) সেগুলো সংগ্রহ করে জোড়া দেন। এভাবে ওসিরিস পুনরুজ্জীবিত হন এবং তার পুত্র হোরাস (Horus) পিতৃহত্যার প্রতিশোধকল্পে সেথকে নিহত করেন। এভাবে প্রাচীন মিসরীয়দের মধ্যে পুনর্জীবনের প্রতি বিশ্বাস জন্মায়। যেহেতু ওসিরিস মৃতদের দেবতা সেহেতু মৃত্যুর পর পরজীবনে তার প্রভাব দেখা যায়!
প্রাচীন মিসরীয়দের ধর্মীয় জীবনে ‘বা’ অর্থাৎ ‘আত্মা’ এবং ‘কা’ অর্থাৎ ‘কায়া’র প্রভাব ছিল সর্বাধিক। মৃত্যুর পর ‘বা’ অন্তর্ধান করে পুনরায় তারাই কায়া বা ‘কা’-তে আশ্রয় নিত। এভাবে পুনর্জীবনের প্রতি তাদের বিশ্বাস জন্মায় এবং এই বিশ্বাসের ফলে তারা বিশালাকার পিরামিড তৈরি করে ফেরাউনদের মৃতদেহ ‘মমি’ করে সমাহিত করত। পুনর্জন্মে তাদের এই গভীর বিশ্বাসের জন্য মৃত-দেহের সঙ্গে নানাবিধ খাদ্যদ্রব্যও কবরের পাশে রাখা হত। এই বিশ্বাসের সঙ্গে জড়িত ছিল মৃতদের বিচার এবং তাদের শাস্তি অথবা পুরস্কার। যারা সৎ, সত্যবান, ধর্মভীরু তাদের পুরস্কারস্বরূপ ‘স্বর্গে’ এবং পাপীদের ‘নরকে’ পাঠানো হত।
মিসরীয় সাম্রাজ্যের যুগে পুরোহিততন্ত্র যখন চরম স্বৈরতন্ত্রের রূপ গ্রহণ করে এবং ধর্মবিশ্বাসের প্রতি আঘাত হানে তখন চতুর্থ আমেনহোটেপের নেতৃত্বে একটি ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলন শুরু হয়। খ্রিস্টপূর্ব ১৩৭৫ অব্দে তিনি পুরোহিতদের মন্দির হতে বহিষ্কার করে দেবদেবীর পূজা নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন এবং তার প্রজাদের ‘এটন’ (Aton) নামে এক নতুন দেবতার পূজা করতে নির্দেশ দেন। আমেনহোটেপ ইখনাটন নাম ধারণ করে ‘এটন’ বা একেশ্বরবাদের মতবাদ প্রচার করেন। একেশ্বরবাদের এই মূলমন্ত্র তিনিই প্রথম প্রতিষ্ঠা করেন এবং পরবর্তী পর্যায়ে ৬০০ বৎসর পরে ইহুদিগণ এই মতবাদ পুনর্জীবিত করেন।
জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চা
প্রাচীন মিসরীয়গণ জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চায় অশেষ অবদান রেখেছেন। মুক্তবুদ্ধির প্রসার সে যুগে ছিল এবং ধর্মের নিগড়ে চিন্তাধারা সীমিত ছিল না। মননশীলতার পরিচয় পাওয়া যায় পুরোহিত ও মুনি-ঋষীদের লিখনীতেই; যেমন- মেমফাইট ড্রামা (Memphite Drama)। তারা অনন্ত বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ডে বিশ্বাস করতেন। তাদের দর্শনের দৃষ্টান্ত রয়েছে ফাহোটেপের ম্যাক্সিমে (Maxims of Phahotep)। এটি নৈতিকতার উপর ভিত্তি করে রচিত ছিল। এই যুগের দর্শনশাস্ত্রের চর্চার নিদর্শন পাওয়া যায় ‘Song of the Harp-player’ এবং ‘Plea of Eloquent Peasant’-এ।
বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় বিশেষ করে ‘অঙ্ক শাস্ত্র ও জ্যোতির্বিদ্যায়’ প্রাচীন মিসরীয়গণ অসামান্য অবদান রেখেছেন। এই দুইটি শাখার উৎকর্ষতার মূলে ছিল নদ- নদীর জোয়ার-ভাটা সম্বন্ধে সম্যক জ্ঞান লাভ। তারা সর্বপ্রথম জ্যামিতি ও অঙ্ক (Arithmetic) শাস্ত্রের উদ্ভাবন করেন। তারা যোগ, বিয়োগ ও ভাগের পদ্ধতি জানত এবং দশমিক আবিষ্কার করে। খ্রিস্টপূর্ব ১৭০০ অব্দের একটি নথি হতে জানা যায় যে, প্রাচীন মিসরীয়গণ সুচিকিৎসক ছিল এবং চক্ষু, দন্ত এবং প্লীহা রোগে ব্যুৎপত্তি অর্জন করেন। তারা ‘হৃৎপিন্ডে’র কার্যাবলি ও নাড়ীর গতিশীলতা সম্বন্ধে জ্ঞান লাভ করে। অস্ত্রোপচারেও তারা অভিজ্ঞ ছিলেন এবং প্রথম ‘মেটিরিয়া মেডিকা’ প্রণয়ন করেন।
প্রাচীন মিসরীয়দের কীর্তি পরিলক্ষিত হয় সৌর পঞ্জিকা, নভোমণ্ডলের পরীক্ষা- নিরীক্ষা, সূর্যের সাহায্যে সময় নির্ণয় যন্ত্র (Sun dian), কাগজ ও কাচ তৈরির পদ্ধতির আবিষ্কারে।
বিশ্ব-সভ্যতায় মিসরীয়দের অবদান বিভিন্ন ক্ষেত্রে পরিব্যাপ্ত। তারাই সর্বপ্রথম এক ধরনের লিখন পদ্ধতি আবিষ্কার করেন। এটি চিত্র-লিখন রীতি বা hieroglyphic নামে পরিচিত। গ্রিক ভাষায় এর অর্থ পবিত্র লিখন অথবা খোদাই কাজ। এ পদ্ধতিতে চব্বিশটি চিহ্ন ছিল এবং প্রতিটি চিহ্ন একটি বিশেষ অর্থ প্রকাশ করত। প্রতিটি চিহ্ন পাশাপাশি খোদিত করে একটি শব্দ ও বাক্য প্রকাশ করা হত। এভাবে আদিম মানুষ মনের ভাব প্রকাশ করবার জন্য লিখন পদ্ধতি আবিষ্কার করে। ক্রমশ চিত্র-লিখন পদ্ধতিতে শব্দাংশ (Syllable) ও বর্ণমালা (Alphabet) রীতির প্রচলন হয়। প্রাচীন মিসরে তিন ধরনের লিখন পদ্ধতির নিদর্শন দেখা যায়। প্রথম দিকে চিত্র-লিখন ও পরবর্তী পর্যায়ে হিরাটিক (hieratic) বা ব্যবসা-বাণিজ্যের দ্রুত লিখন পদ্ধতি এবং ডেমোটিক (demotic), যা জনসাধারণ ব্যবহার করত।
সাহিত্য চর্চায় প্রাচীন মিসরীয়গণ অসামন্য কৃতিত্ব প্রদর্শন করেন। মিসরীয় সাহিত্য মূলত দর্শন ও ধর্মভিত্তিক। এর নিদর্শন দেখা যাবে ‘মেমফিস ড্রামা’ (Memphis Drama), ‘রয়াল সান হাইম’ (Royal Sun Hymn) প্রভৃতিতে। প্রথমটিতে সূর্য দেবতা ‘রে’ এবং দ্বিতীয়টিতে ইখনাটন কর্তৃক প্রবর্তিত একেশ্বরবাদের আলোচনা রয়েছে। এ ছাড়া গণ সাহিত্যের পর্যায়ে রয়েছে ‘Tale of the Two Brothers’।
শিল্পকলায় প্রাচীন মিসরীয়গণ অমর কীর্তি রেখে গিয়েছেন। এর জাজ্বল্য প্রমাণ এখনও মিসরের সর্বত্র পরিব্যাপ্ত। শিল্পের জন্য তারা শিল্পচর্চা করতেন না। জীবন দর্শন, সমাজ, ধর্ম, রাজনীতির প্রভাব তাদের শিল্পে প্রতিভাত। সজীব, বাস্তবধর্মী ও সমৃদ্ধ শিল্পকলার নিদর্শন দেখা যায় তাদের নির্মিত পিরামিড, মন্দির, ভাস্কর্য, দেওয়াল চিত্র, তৈজসপত্র, কাঠ ও পাথরে খোদাই করা বিভিন্ন দ্রব্যে। তামার হাতিয়ার প্রস্তুতের পূর্বে পোড়া ইট দিয়ে মাসতাবা ধরনের সমাধি নির্মিত হত। কিন্তু পরবর্তীকালে পাথরের ধাপবিশিষ্ট ত্রিকোণাকার পিরামিড তৈরি করা হয়। কায়রোর অদূরে গিজোর পিরামিড এখনও প্রাচীন মিসরীয় স্থাপত্য শিল্পের নজির বহন করছে। তের একর জমির উপর ২৩,০০,০০০টি চুনা পাথরে তৈরি গিজোর পিরামিড ৭৪০ ফুট উঁচু। বিশ বৎসর এক লক্ষ কারিগর-শ্রমিকের প্রচেষ্টায় এটি নির্মিত হয়। এর মধ্যে ফেরাউনের মমিকৃত সমাধি রয়েছে। বিশালাকার এই পিরামিডের রাজনৈতিক ও ধর্মীয় গুরুত্ব ছিল অপরিসীম।
পিরামিড ছাড়াও মধ্য রাজ্য ও সাম্রাজ্যের যুগে অসংখ্য বৃহৎ ও অপূর্ব কারুকার্যখচিত মন্দির নির্মিত হয়। এ সমস্ত মন্দির শুধু মিসরীয়দের ধর্মীয় বিশ্বাসের প্রতি প্রগাঢ় অনুরাগই প্রকাশ করে না, বরং শিল্পকলার উৎকর্ষতাও প্রমাণ করে। কারণাক, লুকসর, ফিলা, আবু সিমবেলে এ ধরনের অসংখ্য মন্দির দেখা যায়। এ সমস্ত মন্দিরের প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে পদ্মফুল অথবা তালগাছের আকৃতিতে স্তম্ভ, অপূর্ব খোদাই কাজ এবং সামনের ঢালু দেওয়াল ( Pylon facade) মন্দিরগুলো অবিনশ্বর মনে করে বিশাল আকারে তৈরি করা হত। স্থাপত্য-রীতিতে তারা অসামান্য অবদান রাখতে সক্ষম হয়।
স্থাপত্য ব্যতীত ভাস্কর্যেও প্রাচীন মিসরীয়গণ তাদের মৌলিকতা ও অপূর্ব বৈশিষ্ট্য রেখে গিয়েছেন। মাহাত্মা ও বিক্রম প্রকাশের জন্য ফেরাউনের প্রতিকৃতি যেমন আৰু সিমবেলে তৃতীয় রামসিসের মূর্তি, বৃহদাকারে খোদিত হত। কখনও কখনও পঁচাত্তর হতে নব্বই ফুট দীর্ঘ হত এই সমস্ত ভাস্কর্য নিদর্শন। অসংখ্য দেবদেবীর মূর্তি ব্রিটিশ মিউজিয়াম, কায়রোর জাতীয় মিউজিয়াম ও প্যারিসের ল্যুভে সংরক্ষিত আছে। এগুলোতে লক্ষ্য করা যাবে যে, মিসরীয় ভাস্করগণ বাস্তবধর্মী রীতিতে খোদাই কাজ করতেন না; কারণ এতে দেহের গঠন সুষ্ঠুভাবে প্রতিফলিত হত না এবং ভাবভঙ্গি থাকত অনড়। অবশ্য জনসাধারণের ভাস্কর্য মূর্তি, যেমন উপবিষ্ট লিপিকার (Seated Scribe) সহজ ও স্বাভাবিক ভঙ্গি প্রকাশ পেত।
প্রাচীন মিসরীয় চিত্রশিল্পের নিদর্শন দেখা যাবে মন্দিরের প্রাচীরে মমি ও তার কফিনের উপর। এ সমস্ত চিত্রকলায় প্রাচীন মিসরীয়দের ধর্মীয় ও সামাজিক জীবন প্রতিফলিত হয়েছে। অষ্টাদশ রাজবংশের আমলে থিবিসে নির্মিত মন্দির গাত্রে অসংখ্য দেওয়াল চিত্র (Fresco) দেয়া যায়। এ সমস্ত চিত্রে হারেম ও দরবারের দৃশ্যের পাশাপাশি সাধারণ মিসরীয়দের দৈনন্দিন কার্যাবলির আলেখ্য পরিলক্ষিত হয়। লুক্সরের মন্দিরগাত্রে লতাপাতা ও জ্যামিতিক নক্সার সঙ্গে বিভিন্ন মৌলিক উপাদান চিত্রিত হয়েছে। মিসরীয় চিত্রশিল্পের প্রধান দোষ ছিল যে, এগুলোতে পটভূমি বা পটপ্রেক্ষিত (Perspective) থাকত না। মনে হত, একটি দৃশ্যের উপর অপর একটি দৃশ্য চাপানো হয়েছে। তাছাড়া মূর্তিগুলোতে মুখাবয়ব থাকত পার্শ্বদৃশ্যে অর্থাৎ profile-এ।
প্রাচীন মিসরীয়গণ প্যাপিরাস নামক এক ধরনের নল-খাগড়া হতে কাগজ তৈরি করতে জানত। ১৩৫ ফুট লম্বা ও ১৭ ইঞ্চি চওড়া এই রকমের একটি কাগজ ব্রিটিশ মিউজিয়ামে রক্ষিত আছে। কেবল কাগজই নহে, সে সঙ্গে তারা দোয়াত এবং কলমও তৈরি করেন।
মৃৎ, স্বর্ণ, কাচ, তাঁত শিল্পেও প্রাচীন মিসরীয়গণ কৃতিত্ব অর্জন করেন। তারা বিভিন্ন ধরনের রঞ্জিত মৃৎপাত্র, খোদাই করা স্বর্নালঙ্কার, কাষ্ঠ খোদাই আসবাবপত্র, সূক্ষ্ম লিনেনের কাপড়, হাতির দাঁতের তৈজসপত্র, বাদ্যযন্ত্র, খেলনা প্রস্তুত করতে জানতেন। তুত-আন-খামনের সমাধি আবিষ্কৃত হবার পর প্রাচীন মিসরীয় চারু ও কারুশিল্পের দ্বারোদ্ঘাটিত হয়। এ ছাড়া ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য তারা জাহাজ নির্মাণ করতে জানতেন। দেওয়াল চিত্রে তাদের জাহাজের নিদর্শন দেখা যাবে। সে যুগে তামা ও সোনার আংটি মুদ্রা হিসেবে ব্যবহৃত হত, যদিও তখন মুদ্রার প্রচলন হয় নি। রালফ ও বার্ন যথার্থই বলেন, “বর্তমান যুগের গুরুত্ব বিচারে প্রাচীনকালের খুব কম সভ্যতাই মিসরীয়দের অতিক্রান্ত করতে পেরেছে।”
হেলেনিক, রোমান ও বায়জানটাইন সভ্যতা
গ্রিক বীর আলেকজান্ডার খ্রিস্টপূর্ব ৩৩১ অব্দে পারস্য বিজয় সম্পন্ন করবার সঙ্গে সঙ্গে প্রাচ্যে ইউরোপীয় গ্রিক সভ্যতা অনুপ্রবেশ করে। পারশ্য ছাড়াও মিসর, ব্যবিলন, সিরিয়া এবং ভারত উপ-মহাদেশের উত্তর-পশ্চিমাংশে গ্রিক প্রভাব বিস্তৃতি লাভ করে এবং প্রাচ্য ও গ্রিক সংস্কৃতির সংমিশ্রণে হেলেনিক সভ্যতার উন্মেষ হয়। গ্রিক জয় করে রোমানগণ ১৪৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দে হেলেনিক সভ্যতার উত্তরাধিকারী হয় এবং বিশাল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। রোমান সভ্যতার প্রভাব সুদূরপ্রসারী ছিল। রোমান সাম্রাজ্যের অধঃপতনে পূর্ব রোমান অথবা বায়জানটাইন রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়। খ্রিস্টীয় সপ্তম শতাব্দীতে মুসলমানগণ সিরিয়া, প্যালেস্টাইন ও মিসরে বায়জানটাইন রাজ্যের প্রাদেশসমূহ দখল করেন। অপরদিকে পারশ্যদের সাসানীয় সাম্রাজ্যও মুসলমানদের করতলগত হয়। এরূপে রোমান ও পারশ্য সভ্যতার সঙ্গে সেমিটিক সভ্যতার সংমিশ্রণ হলে এর প্রভূত উৎকর্ষ সাধিত হয়। ক্রসেডের সময় এই সভ্যতা মুসলমানদের হাতে পরিমার্জিত হয়ে ইউরোপে বিস্তার লাভ করে এবং এতে ‘রেনেসাঁ’ বা নবজাগরণের সূচনা হয়। স্পেন, সিসিলি ও আরব ভূখণ্ড হতে মুসলিম সভ্যতা সেমিটিক সভ্যতারূপে ইউরোপে আত্মপ্রকাশ করে। মসকাটির মতে, “আরব মরুভূমিতে সামাজিক ও জাতীয়তাবোধে উদ্বুদ্ধ ঐতিহাসিক যুগে বসবাসকারী একই ভাষাভাষী জনসাধারণকে সেমিটিক বলা হয়।” ইসলামের অভ্যুত্থান ও বিস্তৃতির ফলে বহু যুগব্যাপী আরবের বিচ্ছিন্নতার অবসান ঘটে। বেকারের মতে, “ইসলাম প্রাচ্য হেলিনিক সভ্যতার উত্তরাধিকারী হয়েছিলেন।” তাঁর ভাষায়, “বিশ্ব ইতিহাসের ক্রমবিকাশে এটি (ইসলাম) সর্বশেষ বন্ধনী” (link)।
মেসোপটেমীয় সভ্যতা
ম্যালোয়ান বলেন, “খ্রিস্টপূর্ব ৪০০০ অব্দে টাইগ্রীস-ইউফ্রেটিস নদীর উর্বর অববাহিকা সভ্যতার প্রথম আলোকে উদ্ভাসিত হয়েছিল।” গ্রিক ভাষায় মেসোপটেমিয়া শব্দের অর্থ দুটি নদীর মধ্যবর্তী স্থান। এই উর্বর কৃষিভূমিতে গম ও বার্লি উৎপন্ন হত এবং বিভিন্ন পশুপক্ষী প্রতিপালিত হত। অনুকূল প্রাকৃতিক পরিবেশে এই অঞ্চলে যুগ যুগ ধরে বহু জাতির বসবাসের ফলে সভ্যতা গড়ে উঠে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে গ্রামের সংখ্যা বাড়তে থাকে ও গ্রামগুলো শহরে পরিণত হয় এবং শহর সুসজ্জিত নগরে রূপান্তরিত হয়। খ্রিস্টপূর্ব ৪০০০ অব্দে মেসোপটেমিয়ার এরিদু শহরে কয়েক সহস্র লোকের বাস ছিল। অর্থনৈতিক, সামাজিক, ধর্মীয়, রাজনৈতিক প্রভৃতি সুযোগ-সুবিধা ধীরে ধীরে সভ্য মানুষের আয়ত্তাধীন হয়। স্থাপত্যশিল্পের সঙ্গে সঙ্গে লিখন পদ্ধতি আবিষ্কৃত ও উৎকর্ষ সাধিত হয়। মিসরীয় সভ্যতার সঙ্গে মেসোপটেমীয় সভ্যতার প্রভেদ এই যে, প্রথমটি নীতি-ধর্মভিত্তিক এবং দ্বিতীয়টি আইন-শাস্ত্রভিত্তিক। মেসোপটেমীয়দের পরকাল (hereafter) সম্বন্ধে কোন ধারণা ছিল না এবং এ কারণে মিসরীয়দের মত প্রস্তরের মন্দির এবং বিশালাকার সমাধি স্তম্ভ বা পিরামিড তারা তৈরি করতেন না। মিসরীয়রা পরকাল ও অমর আত্মায় বিশ্বাস করতেন বলে মৃত্যুর পর আত্মার ধারক দেহকে মমির আকারে অবিনশ্বর করবার চেষ্টা করতেন।
সুমেরীয় সভ্যতা
মেসোপটেমীয় সভ্যতার অগ্রদূত ছিল অ-সেমিটিক সুমেরীয় জাতি। খ্রিস্টপূর্ব ৫০০০ হতে ৪০০০ অব্দে তারা টাইগ্রীস-ইউফ্রেটিস নদীর মধ্যভাগে বসবাস করতে থাকে। তাদের আদিভূমি কোথায় সঠিকরূপে নিরূপণ করা যায় না; তবে সম্ভবত মধ্য- এশিয়ার কোন অঞ্চল হতে তারা মেসোপটেমিয়ায় আগমন করেন। লিখন পদ্ধতি, আইন-কানুন, ধর্মীয় অনুভূতি, ব্যবসা-বাণিজ্য, জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা সুমেরীয় যুগে সর্বপ্রথম আরম্ভ হয়।
সুমেরীয় সভ্যতার প্রাণকেন্দ্র ছিল এরিদু, নিপ্পুর, লাগাস, আল-উবাইদ, কিস এবং উর। খ্রিস্টপূর্ব ২০০০ অব্দে সুমেরীয়গণ ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র স্বায়ত্তশাসিত নগর রাষ্ট্রে বসবাস করতেন। রাষ্ট্রের প্রধান ছিলেন একাধারে কর্মাধ্যক্ষ, প্রধান পুরোহিত, সৈন্যাধ্যক্ষ এবং সেচকার্যের তত্ত্বাবধায়ক।
সুমেরীয় সভ্যতার অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল ব্যক্তি-স্বাতন্ত্র্য। প্রত্যেক নাগরিকের জমির স্বত্বাধিকার ছিল এবং তারা অবাধ শিল্প ও বাণিজ্যে অংশগ্রহণ করতে পারতেন। অবশ্য ভূমি-দাস প্রথা ( Serfdom) প্রচলিত ছিল। সুমেরীয় যুগে কৃষিকার্যের প্রভূত উন্নতি সাধিত হয়। উর্বর অববাহিকায় পর্যাপ্ত শস্য উৎপন্ন হত। সুমেরীয় ব্যবসায়ীরা দূর-দূরাঞ্চলে ব্যবসা-বাণিজ্য উপলক্ষে গমন করতেন। ব্যবসার লেনদেন চলত সোনা এবং রূপার পিণ্ড (Ingot) দ্বারা।
আইন-কানুন প্রণয়নে সুমেরীয়দের উল্লেখযোগ্য কৃতিত্ব ছিল। ঐতিহাসিকদের মতে ব্যাবিলনীয় রাজা হাম্মুরাবির বিখ্যাত আইন (Code of Hammurabi) সুমেরীয় রাজা দুঙ্গীর (Dungi) আইন-কানুনের পরিপূরক ছিল। পরবর্তীকালে এটি সমস্ত সেমিটিক জাতির ব্যবিলনীয়, অ্যাসিরীয়, চালদীয় এবং হিব্রু আইনরূপে সমাদৃত হয়েছিল।
প্রাচীন মিসরীয়দের তুলনায় সুমেরীয়গণ উন্নত ধরনের আধ্যাত্মিক মনোবৃত্তির পরিচয় প্রদান করতে পারেন নি। তাদের প্রধান দেব-দেবীর নাম ছিল সূর্যদেব শামস (Shamsh), বৃষ্টি ও ঝড়ের দেবতা ইন্লিল (Enlil) ও মাতৃদেবী ইসতার (Ishtar)। সুমেরীয়রা পরকালে বিশ্বাস করতেন না। মিসরীয় মমির কোন নিদর্শন এখানে পাওয়া যায় নি। কারণ তারা বাসগৃহের মেঝের নিচে কফিন ছাড়াই মৃতদেহ সমাহিত করতেন। সুমেরীয়দের স্তরে স্তরে নির্মিত ধর্ম মন্দিরকে জিগুরাত (Ziggurat) বলা হয়। উর-এর জিগুরাতটি এখনও সুমেরীয় স্থাপত্যের নিদর্শন বহন করে রয়েছে।
শিল্প ও স্থাপত্যে সুমেরীয়দের দান অপরিসীম। উর-এর রাজকীয় সমাধি থেকে খ্রিস্টপূর্ব ২৭০০ অব্দের বহু মূল্যবান স্বর্ণ, রৌপ্য, তামা, ব্রোঞ্জের অলঙ্কার উদ্ধার করা হয়েছে। রাজার মৃতদেহের সঙ্গে তার দাস-দাসীদের জীবন্ত সমাধি দেওয়ার একটি জঘন্য প্রথা প্রচলিত ছিল। ভাস্কর্যে, মূল্যবান পাথর কেটে নক্সা তৈরির দক্ষতায়, মৃৎশিল্পে ও হাতির দাঁতের কারুকার্যে সুমেরীয়গণ অভূতপূর্ব কৃতিত্ব অর্জন করে। স্থাপত্যশিল্পে তাদের প্রধান অবদান ছিল কাঁচা ইটের তৈরি জিগুরাত, ঘরবাড়ি এবং বিভিন্ন ইমারতে এবং বিশেষ করে খিলান, গম্বুজ ও ভল্টের ব্যবহারে।
মানব সভ্যতার ইতিহাস সুমেরীয় লিখন পদ্ধতির উদ্ভব একটি অবিস্মরণীয় ঘটনা। নল-খাগড়ার তৈরি এক প্রকার কলম (বা Stylus) দ্বারা নরম মাটির ট্যাবলেটে চাপ সৃষ্টি করে চিত্রাঙ্কন দ্বারা মনের ভাব ও অনুভূতি প্রকাশের প্রচেষ্টা সম্ভবত এটাই প্রথম। সুমেরীয়দের অপরাপর কৃতিত্ব ছিল পানি দ্বারা পরিচালিত ঘড়ি, চন্দ্রভিত্তিক বর্ষপঞ্জি, গুণ ও ভাগ করবার পদ্ধতি, ওজন ও পরিমাপ ব্যবস্থার প্রবর্তন ও প্রচলন। মেসোপটেমীয় সভ্যতার উন্মেষ, ক্রমবিকাশ এবং পরিপূরণে সুমেরীয়দের দান ছিল অপরিসীম।
আক্কাদীয় সাম্রাজ্য
প্রথম সারগন (Sargon I) খ্রিস্টপূর্ব ২৪০০ অব্দে সুমেরীয়দের পরাজিত করে আক্কাদ অঞ্চলে একটি নতুন সাম্রাজ্যের ভিত্তি স্থাপন করেন। ইলামাইটদের (Elamites) এবং ভূমধ্যসাগর পর্যন্ত সমগ্র উত্তর সিরিয়া দখল করে সারগন পশ্চিম এশিয়ায় প্রথম সেমিটিক রাজ্য স্থাপন করেন। আক্কাদীয়রা সুমেরীয় লিখন-পদ্ধতি, শিল্পকলা, ভাস্কর্য, বর্ষপঞ্জি, ওজন ও পরিমাণ ব্যবস্থা গ্রহণ করে। সুমেরীয় সভ্যতার উপর ভিত্তি করেই আক্কাদীয় সভ্যতার উন্মেষ ঘটে। আক্কাদীয় ভাস্কর্যের অপূর্ব নিদর্শন হচ্ছে খ্রিস্টপূর্ব ২২০০ অব্দের একটি প্রস্তরখণ্ড (Stele)। এই প্রস্তরখণ্ডে অসাধারণ দক্ষতা ও শিল্প চাতুর্যে রাজা নারামসিন (Naramsin)-এর দুর্গ অবরোধের দৃশ্যকে খোদাই করা হয়েছে। প্রথম সারগনের মৃত্যুর পর সুমেরীয়গণ বিদ্রোহ ঘোষণা করে কিন্তু দুর্ধর্ষ গুতি তাদের এ বিদ্রোহ দমন করেন। খ্রিস্টপূর্ব ২০০০ অব্দে সুমেরীয়গণ উর নগরীর নেতৃত্বে পুনরায় বিদ্রোহ করে এবং সুমার এবং আক্কাদ অঞ্চলে রাজ্য স্থাপন করে। এই যুগের সর্বশ্রেষ্ঠ নৃপতির নাম দুঙ্গী (Dungi)।
নব্য সুমেরীয় সাম্রাজ্য
দুঙ্গী ‘পৃথিবীর চারিটি অঞ্চলের নৃপতি’ (King of the four regions of the earth) উপাধি ধারন করে সমগ্র সুমেরীয় জাতিকে সংঘবদ্ধ করেন এবং সর্বপ্রথম একটি বিধিবদ্ধ আইন (Code) প্রচলন করেন। হাম্মুরাবির বিখ্যাত কোড (Code of Hammurabi) সম্ভবত দুঙ্গীর কোর্ড হতে গ্রহন করা হয়েছিল বলে মনে করা হয়। কারন, উভয়ের মধ্যে একই ধরনের নিয়ম-কানুন লিপিবদ্ধ ছিল। কৃষি, ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্পকলা, স্থাপত্য, ভাস্কর্য প্রভৃতি ক্ষেত্রে সুমেরীয় জাতি প্রভূত উন্নতি সাধন করেছিল এবং এর উপর ভিত্তি করেই ব্যাবিলনীয় সভ্যতা গড়ে উঠে। তারা পৌত্তলিক ধর্মাবলম্বী ছিল, তাদের দেব-দেবীর নাম ছিল সূর্যদেব শামস (Shamsh), বৃষ্টি এবং বাতাসের দেবতা ইন্লিল (Enlil), মাতৃদেবী ইসতার (Ishtar) প্রভৃতি। কিন্তু মিসরীয়দের মত মৃতদেহকে মমির মাধ্যমে সংরক্ষণের প্রচেষ্টা না থাকায় মনে হয় সুমেরীয়রা পরকালকে বিশ্বাস করত না। ব্যবহার্য দ্রব্য ও কফিন ছাড়াই মৃতদেহ বাসগৃহের নিচে সমাহিত করা হত। তাদের উদ্ভাবিত লিখন-পদ্ধতিকে বলা হত ‘কিউনাইফরম’ বা কীলকাকর (Cuneiform)। স্টাইলাস দ্বারা নরম মাটিতে বিক্ষিপ্তভাবে চাপ সৃষ্টি করে এই পদ্ধতিতে লিখা হত। এর পূর্বে অবশ্য চিত্র লিখন-পদ্ধতির প্রচলন ছিল। ফনেসীয়দের পূর্বে বর্ণমালা সৃষ্টি হয় নি বলে সুমেরীয়গণ এর ব্যবহার জানতেন না।
প্রাচীনতম ব্যবিলনীয় সভ্যতা
দুঙ্গীর মৃত্যুর পর সুমেরীয় সাম্রাজ্য ধ্বংস হয়ে পড়ে এবং আমোরাইট জাতি (Amorites) উত্তরাঞ্চল এবং ইলামাইট জাতি (Elamites) দক্ষিণাঞ্চল অধিকার করে। খ্রিস্টপূর্ব ২২০০ সালে সেমিটিক জাতিসম্ভূত আমোরাইটগণ আরব উপদ্বীপে উত্তরাঞ্চল হতে আগমন করে ব্যবিলন নামে একটি ক্ষুদ্র গ্রামে বসবাস করতে শুরু করে। ইরাকের বিখ্যাত টাইগ্রীস (দজলা) ও ইউফ্রেটিস (ফেরাত) নদীর মধ্যবর্তী উর্বর ভূ-ভাগকে মেসোপটেমিয়া বলা হয়। এ উপত্যকার ভূমিকে আরববাসিগণ ‘উম্মুল বিলাদ্’ অর্থাৎ সভ্যতার জন্মভুমি আখ্যা দেন। মেসোপটেমিয়ার উত্তরে অ্যাসিরীয় এবং দক্ষিণে ব্যবিলনীয় সভ্যতার লীলাভূমি ছিল। ব্যবিলনে আমোরাইটগণ বসবাস করতে থাকায় তারা প্রাচীন ব্যবিলনীয় বলে পরিচিত ছিল।
ব্যাবিলনীয় সাম্রাজ্য : সুমেরীয়দের অধঃপতনে উর্বর মেসোপটেমিয়া অঞ্চলে আক্কাদীয় রাজা প্রথম সারগন একটি বিশাল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। সুমার-আক্কাদ সাম্রাজ্য অসংখ্য প্রাচীর বেষ্টিত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র স্বাধীন নগর-রাষ্ট্রের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠে। প্রত্যেক নগর-রাষ্ট্রের একজন নৃপতি এবং নিজস্ব দেবতা ছিল। সারগন এই সমস্ত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাষ্ট্রগুলোকে সংঘবদ্ধ করে একটি কেন্দ্রীয় শাসন প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেন। সেমিটিক জাতির অপর একটি শাখা সিরিয়া হতে আগমন করে সুমার-আক্কাদ সাম্রাজ্যের দক্ষিনাঞ্চল অধিকার করে। আমোরাইট নামে পরিচিত এই জাতির দলপতি ছিলেন হাম্মুরাবি (খ্রিস্টপূর্ব ২১২৩-২০৮১)। হাম্মুরাবি (Hammurabi) ইউফ্রেটিস উপত্যকায় ব্যবিলনে নিজেকে সুপ্রতিষ্ঠিত করে কেন্দ্রীয় শাসন এবং সম্প্রসারণ নীতি দ্বারা একটি সুসংঘবদ্ধ সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হন। সুদক্ষ আইনবিদ, বিজ্ঞ শাসক ও সংগঠক হিসেবে হাম্মুরাবি কৃতিত্ব অর্জন করেন। ব্যাবিলনীয় সভ্যতার উন্মেষ এবং ক্রমবিকাশে তার অবদান ছিল অপরিসীম।
হাম্মুরাবির আইন : ১৯০১-০২ খ্রিস্টাব্দে সুসা নামক স্থানে ফরাসি পুরাতত্ত্ববিদ এম. ডি. মরগান একটি বিশাল শিলাখণ্ডে প্রাচীন ব্যবিলনীয়দের একটি লিপি আবিষ্কার করেন। প্যারিসের ল্যুভ জাদুঘরে সংরক্ষিত এই শিলালিপি “হাম্মুরাবির আইন” (Code of Hammurabi) নামে পরিচিত। সুমেরীয় রাজা দুঙ্গীর আইন-এর উপর ভিত্তি করে প্রবর্তিত হাম্মুরাবির বিখ্যাত আইনে বিশাল ব্যবিলন সাম্রাজ্যের অধিবাসীদের দায়িত্ব এবং কর্তব্য সম্বন্ধে বিবরণ ছিল। আইনের শাসনকে সুপ্রতিষ্ঠিত করে নব-প্রতিষ্ঠিত সংঘবদ্ধ ব্যবিলন সাম্রাজ্যে শান্তি এবং নিরাপত্তা বিধান করা হয়। ফৌজদারী দণ্ডবিধি ছিল খুবই কঠোর— ‘দাঁতের পরিবর্তে দাঁত’, ‘চোখের পরিবর্তে চোখ’-অর্থাৎ অপরাধের অনুরূপ শাস্তির বিধান ছিল। এই আইনে দরিদ্র, অনাথ, বিধবা ও অসহায় ব্যক্তিদের স্বার্থরক্ষার ব্যবস্থা ছিল। সুমেরীয় আইন অপেক্ষা হাম্মুরাবির আইন উন্নততর ছিল; কারণ, সুমেরীয় আইনে পলাতক দাসকে আশ্রয় দান করলে জরিমানা হত এবং ব্যভিচার দণ্ডনীয় ছিল না; অপরদিকে হাম্মুরাবির আইন অনুযায়ী উভয়ই ছিল গুরুতর অপরাধ। হাম্মুরাবির আইন পরবর্তীকালে রোমীয় আইন (Roman Law) এবং পাশ্চাত্যের আইন-কানুনকে প্রভাবান্বিত করে।
প্রাচীন ব্যবিলনীয় সভ্যতা ইতিহাসে একটি অনবদ্য কাহিনী রচনা করেছে। শিল্প- কলা, কৃষি-ব্যবস্থা, ব্যবসা-বাণিজ্য, লিখন পদ্ধতি, শিক্ষা, বিজ্ঞান প্রভৃতি ক্ষেত্রে ব্যবিলন প্রভূত উন্নতি সাধন করে। অধিকৃত সুমেরীয় শহরের কর্মচারীদের নিকট লিখিত হাম্মুরাবির ৫৫টি মাটির ফলক চিঠি আবিষ্কৃত হয়েছে। এ সমস্ত খোদাই করা মাটির ফলকের পাঠোদ্বার করে প্রাচীন ব্যবিলনের জীবনযাত্রা সম্বন্ধে নানা তথ্য জানা গিয়েছে; যেমন- কর আদায়ের পদ্ধতি, ইউফ্রেটিসে বন্যার পর করণীয় কর্তব্য, পশম ছাড়াবার নির্দেশ, ঘুষের শাস্তি প্রভৃতি।
সুমেরীয়দের মত প্রাচীন ব্যবিলনবাসীরা দেব-দেবীর পূজা করতেন। সুমেরীয়দের সুর্যদেব শামস ব্যবিলনীয়দের নিকট মারদুক (Marduk) নামে পরিচিত ছিল। প্রধান দেবতা মারদুক ছাড়া প্রেমের অধিষ্ঠাত্রী দেবী ইসতার (Ishtar), বায়ুর দেবতা মারুত্তস এবং অসংখ্য প্রকৃতি-দেবতা, নূর-দেবতা ও একাধিক ছোটখাট দেবতা ব্যবিলনীয়দের পূজনীয় ছিল। তারা বিশ্বাস করতেন যে, দেব-দেবী ভবিষ্যদ্বাণী করবার ক্ষমতার অধিকারী। পুরোহিত প্রথা একটি অতি প্রাচীন প্রথা এবং সুমেরীয়দের মত এটি ব্যবিলনেও প্রচলিত ছিল। গ্রহ-নক্ষত্রের গতির পরিবর্তন পর্যক্ষেণ করে ভবিষ্যদ্বাণী করা হত এবং পরবর্তীকালে এটি নব্য ব্যবিলনীয় অথবা কালদিয়ানদের মধ্যে প্রসারিত হয়ে পড়ে। কুসংস্কার, যাদুবিদ্যা (Witchcraft) এবং প্রেততত্ত্ব (Demonology) প্রাচীন ব্যবিলনীয় ধর্মের বৈশিষ্ট্য ছিল।
প্রাচীন ব্যবিলনে যে লিখন-পদ্ধতি প্রচলিত ছিল তা ‘কিউনাইফরম’ অথবা, কীলকাকার (Cuneiform) নামে পরিচিত। প্রাচীন মিসরীয় এবং সুমেরীয় চিত্রলিখন (Picture-writing) পদ্ধতি হতে এই পদ্ধতিতে পাথরের উপর খোদাই করে অথবা নরম মাটির ফলকে চাপ সৃষ্টি করে লিখা হত। এর ধারালো অক্ষর মাত্রাবিশিষ্ট চিহ্ন সমষ্টি দ্বারা গঠিত লিখন-পদ্ধতিতে মোটামুটি চার-পাঁচশত অক্ষর ব্যবহৃত হত। ব্রিটিশ মিউজিয়ামে সংরক্ষিত এই ফলকগুলো (Clay tablets) সম্ভবত খ্রিস্টপূর্ব তিন হাজার বৎসর থেকে খ্রিস্টীয় প্রথম শতাব্দী পর্যন্ত প্রচলিত ছিল। পার্চমেন্ট এবং কাগজের ব্যবহার তখনও প্রচলিত না থাকায় এই মাটির ফলকগুলোই পুস্তকের মর্যাদা লাভ করে। এইচ. জি. ওয়েলস বলেন, “ভগ্ন মৃৎপাত্রই ছিল তাদের বই, স্মারকলিপি এবং চিঠিপত্র।”
টাইগ্রীস এবং ইউফ্রেটিস নদীর উপত্যকা খুবই উর্বর থাকায় কৃষিকার্যে প্রভূত উন্নতি সাধিত হয়। গ্রিক ঐতিহাসিক হোরোডোটাস ( Herodotus) ব্যবিলনের শস্যের প্রাচুর্য এবং কৃষি ব্যবস্থার ভূয়সী প্রশংসা করেন। নদীর প্লাবন হতে কৃষিক্ষেত্র রক্ষার জন্য সুরক্ষিত বাঁধের ব্যবস্থা করা হয় এবং অনাবৃষ্টির প্রকোপ হতে ক্ষেত-খামার রক্ষার জন্য উপযুক্ত বাঁধ তৈরি করা হয়। হাম্মুরাবির আইনে কৃষিকার্যে অবহেলা এবং খাল ও বাঁধ নির্মাণে অনীহার জন্য কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা ছিল। সরকারি খাস জমি এবং ব্যক্তিগত মালিকানায় জমির স্বত্ব উভয়েরই প্রচলন ছিল। কৃষকগণ উৎপন্ন দ্রব্যের দুই-তৃতীয়াংশ মালিককে দিতে বাধ্য থাকতেন।
প্রাচীন ব্যবিলনীয় সভ্যতার অগ্রগতি কৃষিকার্য এবং ব্যবসা-বাণিজ্যে প্রভূত উন্নতির ফলেই সম্ভবপর হয়। হাম্মুরাবির আইনের ব্যবসা-সংক্রান্ত নির্দেশ হতে জানা যায় যে, অসাধুতার বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তির বিধান ছিল; এই কারণে ‘আইন’ ব্যবসায়ীদের অতিরিক্ত মুনাফা এবং লোভের জন্য সাবধান করে দেওয়া হয়। ব্যবসা-বাণিজ্য, ব্যাংক, শিল্প সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন ছিল। অংশীদারী, ব্যবস্থাপনা (এজেন্সি) প্রভৃতির জন্য উপযুক্ত দলিল করবার প্রথা ছিল। লিখিত দলিল অথবা সাক্ষী ব্যতীত কোন প্রকার ব্যবসায়িক আদান-প্রদান হলে মৃত্যুদণ্ডও প্রদান করা হত। প্রথমে বিনিময়ের ( Barter) মাধ্যমে ব্যবিলনীয়রা ব্যবসা-বাণিজ্য করতেন। হিসাব রক্ষার একটি নির্ভুল পদ্ধতি তারা আবিষ্কার করে এবং নির্দিষ্ট ওজন ও পরিমাপ প্রণালী (System of weight and measurement) প্রবর্তন করেন। এ কথা অনস্বীকার্য যে, সিন্ধু সভ্যতা এবং নীলনদের সভ্যতার সঙ্গে মেসোপটেমীয় সভ্যতার যোগাযোগ স্থাপিত হয়েছিল।
১৮৯৪ খ্রিস্টাব্দে ফরাসি প্রত্নতাত্ত্বিকগণ খননকার্য দ্বারা একটি প্রাচীন ব্যবিলনীয় স্কুলের ধ্বংসাবশেষ উদ্ধার করেন। ৫৫ বর্গফুট আয়তনবিশিষ্ট এই স্কুলে লিখন-পদ্ধতি শিক্ষা দেওয়া হত এবং নরম মাটিতে বিভিন্ন ধরনের আঁক দিয়া প্রায় ৩৫০টি চিহ্ন মুখস্থ করতে হত। এই স্কুলের দেওয়ালে লিখিত ছিল : “ফলকে লিখন পদ্ধতিতে যে উৎকর্ষ সাধন করবে সে সূর্যের ন্যায় উজ্জ্বল হবে” ( “He who shall excel in tablet writing shall shine like sun”)। সুমেরীয়দের ন্যায় ব্যবিলনীয়গণও সাহিত্য, চারু ও কারুশিল্পে প্রভূত উন্নতি সাধন করেন। বিখ্যাত ‘গিলগামেশ উপাখ্যান’ (Gilgamesh epic) সুমেরীয় উৎস হতে গ্রহণ করে ব্যবিলনীয় কবিরা অপূর্ব সাহিত্য সৃষ্টি করেন। এই উপাখ্যানের মুল বিষয়বস্তু ছিল বীরশ্রেষ্ঠ গিলগামেশ-এর অলৌকিক কার্যকলাপ। প্রাচীন ব্যবিলনীয় সাহিত্যের অপর একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হচ্ছে Babylonian Job |
ব্যবিলনের অধিবাসীরা বিজ্ঞানের বিভিন্ন ক্ষেত্রে যথেষ্ট অবদান রেখে গিয়েছেন। সেই যুগে চিকিৎসাবিদ্যার প্রভূত উন্নতি সাধিত হয় এবং কমপক্ষে ৫৫০ রকমের ঔষদের প্রচলন ছিল। জ্যোতিরশাস্ত্রে তারা যথেষ্ট অগ্রগতি সাধন করেন এবং নভোমণ্ডল সম্বন্ধেও তাদের সম্যক জ্ঞান ছিল। তারা রাশি চক্রকে (zodiac) বার ভাগে বিভক্ত করে নক্ষত্ররাজির নামকরণ করেন। তারা সূর্য ও চন্দ্রগ্রহণ সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারতেন এবং সূর্য ও জল-ঘড়ি আবিষ্কার করেন। বার মাসে বৎসর গণনা, চার সপ্তাহে মাস, বার ঘন্টায় দিন এবং ষাট মিনিটে ঘণ্টা গণনা ছিল তাদের সর্বশ্রেষ্ঠ অবদান। মিসরীয় পঞ্জিকার তুলনায় ব্যবিলনীয় পঞ্জিকা উন্নত ধরনের ছিল। অংকশাস্ত্রে তারা মৌলিক অবদান রেখে যেতে সক্ষম হয়। তাদের আবিষ্কৃত দশমিক গণনা-পদ্ধতি (Decimal system) আধুনিক জগতে সর্বজনবিদিত। উপরন্তু, তারা ওজন, দৈর্ঘ্য, প্রস্থ, শক্তি পরিমাপক প্রথার উদ্ভাবন করে।
অ্যাসিরীয় সভ্যতা (৭২২-৬১২ খ্রিস্টপূর্ব)
সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা : মেসোপটেমিয়া অঞ্চলে যে সমস্ত জাতি সভ্যতা গড়ে তুলেছিল অ্যাসিরীয়গণ তাদের মধ্যে অন্যতম। সুমেরীয়দের পর সম্ভবত অপর কোন জাতি একক এবং স্বাধীনভাবে প্রভুত্ব প্রতিষ্ঠা করে ভিন্নরূপ সভ্যতার দ্বারোদ্ঘাটন করে নি। অবশ্য একথা অনস্বীকার্য যে, সুমেরীয় এবং ব্যবিলনীয়দের দ্বারা প্রভাবান্বিত না হলে অ্যাসিরীয় সভ্যতার উন্মেষ হত কিনা বলা যায় না। মেসোপটেমিয়ার উত্তরাঞ্চলে পার্বত্য এলাকায় অ্যাসিরীয় নামে অপর একটি সেমিটিক জাতি মিসর এবং ব্যবিলনের পতনের পর প্রভুত্ব প্রতিষ্ঠা করে বসবাস করতে থাকেন।
পারিপার্শ্বিক অবস্থার চাপে অ্যাসিরীয়গণ একটি যুদ্ধপ্রিয় জাতিতে (Nation of Warriors) পরিণত হয়। প্রতিকূল পরিবেশে শত্রুর আক্রমণের ভীতি এবং ক্ষমতার লোভ দুর্ধর্ষ অ্যাসিরীয় জাতিকে যুদ্ধ-বিগ্রহে লিপ্ত করে এবং পরিশেষে একটি বিশাল ও শক্তিশালী রাষ্ট্র গঠনে সহায়তা করে। মায়ার্স-এর মতে, “অ্যাসিরীয় জাতির ইতিহাস প্রধানত অ্যাসিরীয় রাজাদের ইতিহাস।” যুদ্ধ-বিগ্রহ, রক্তপাত, অত্যাচার, নৃশংসতা প্রভৃতি দ্বারা দ্বিতীয় সারগণ একটি বিশাল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। উন্নত ধরনের সমরাস্ত্র, যুদ্ধ-কৌশল, ঘোড়ার রথ-এর প্রচলন (chariot), লৌহ আবিষ্কৃত হলে লৌহ নির্মিত তরবারি, তীর, ধনুক, দুর্গ ধ্বংসকারী যন্ত্র (battering ram), বর্ম, ঢাল, শিরস্ত্রাণ প্রভৃতি ব্যবহারের ফলে অ্যাসিরীয় রাষ্ট্র পৃথিবীর ইতিহাসে একটি সামরিক রাষ্ট্রে (Assyrian militarism) পরিণত হয়। সংগঠক হিসেবে তাদের কৃতিত্ব যেমন ছিল সর্বজনবিদিত, যুদ্ধে নৃশংসতার জন্যও তাদের কুখ্যাতি ছিল। অঙ্গচ্ছেদ করে ভীতি প্রদর্শনের নীতির (terror tactics) ফলে তারা অনেক দেশ জয় করে সত্য, কিন্তু এর ফলে পার্শ্ববর্তী শত্রুরাষ্ট্রের ষড়যন্ত্র ও চক্রান্তে তাদের সাম্রাজ্য ধ্বংস হয়ে যায়।
প্রাচীন ব্যবিলনীয় সভ্যতা কায়সাইটদের ( Kaissites) আক্রমণে ধ্বংস হলে পরবর্তীকালে এই অ্যাসিরীয়গণ সেমিটিক মেসোপটেমীয় সভ্যতার ধারক এবং বাহক হয়। খ্রিস্টপূর্ব ৩০০০ অব্দে সর্বপ্রথম তারা আসুরে একটি ক্ষুদ্র রাষ্ট্র কায়েম করে। খ্রিস্টপূর্ব ১৩০০ অব্দে দুর্ধর্ষ অ্যাসিরীয় জাতি মেসোপটেমিয়ার উত্তরাঞ্চল দখল করে ক্ষমতা বৃদ্ধি করে।
অ্যাসিরীয় সাম্রাজ্যের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা তৃতীয় টিগলাথ পাইলাজার (Tiglath Pileser III) ৭৪৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দে সিংহাসনে আরোহন করে ব্যবিলন অধিকার করেন। এর কিছুকাল পরে অ্যাসিরীয়রা দ্বিতীয় সারগণের নেতৃত্বে মেসোপটেমিয়ার উত্তরাঞ্চলে একটি শক্তিশালী সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়। রাজধানী আসুর-এর নাম হতে অ্যাসিরীয় সভ্যতার নামকরণ হয়েছে। খ্রিস্টপূর্ব ৭২২ অব্দে দ্বিতীয় সারগণ (Sargon II) সিংহাসনে আরোহন করে ইহুদীদের রাষ্ট্র সামারিয়া ( Samaria) দখল করেন এবং সেখান হতে বিলুপ্ত দশটি গোত্র-প্রধানদের (Lost Ten tribes) বন্দী করেন। দ্বিতীয় সারগণের মৃত্যুর পর তার পুত্র সেনাচেরিব (Senacherib) (৭০৫–৬৮১ খ্রিস্টপূর্ব) মিসর এবং প্যালেস্টাইন দখল করেন। অ্যাসিরীয় সাম্রাজ্যের সর্বশ্রেষ্ঠ নৃপতি আসুরব- নিপালের (Assurbanipal) (৬৬৮-৬২৬ খ্রিস্টপূর্ব) রাজত্বে অ্যাসিরীয়দের আধিপত্য মিসর, সিরিয়া, ফনেসিয়া, ইসরাইল প্রভৃতি অঞ্চলে বিস্তার লাভ করে। তাঁর মৃত্যুর পর অরাজকতা, স্বৈরতন্ত্র, প্রশাসনিক অক্ষমতা, সামরিক শক্তির হ্রাস প্রভৃতি কারণে অ্যাসিরীয় সাম্রাজ্যের অধঃপতন হতে থাকে। ৬১২ খ্রিস্টাব্দে দুর্ধর্ষ কালদিয়ান জাতির নেতা নেবুপোলাসার (Nabopolassar) অ্যাসিরীয়ার রাজধানী নীনিভা (Nineveh) আক্রমণ করে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করেন। এর ফলে অ্যাসিরীয় সাম্রাজ্যের পতন এবং কালদিয়ান রাজ্যের অভ্যুত্থান হয়।
সভ্যতা : অ্যাসিরীয় সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত থাকায় ব্যবিলন অ্যাসিরীয় সভ্যতাকে বিশেষভাবে প্রভাবান্বিত করে। আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে যে, তারা অনুকরণপ্রিয় ছিল; যার ফলে মানব সভ্যতার ইতিহাসে তারা বিশেষ কোন অবদান রেখে যেতে পারে নি। কিন্তু সূক্ষ্ম ঐতিহাসিক বিচারে তারা শিল্পকলা, শিক্ষা-দীক্ষা, জ্ঞান-বিজ্ঞান প্রভৃতি ক্ষেত্রে অতুলনীয় অবদান রেখে গেছে। তাদের সভ্যতার স্বাক্ষর বহন করে রয়েছে আসুর, নীনিভা, খোরসাবাদ, নিমরুদ প্রভৃতি ধ্বংসপ্রাপ্ত শহর। যুদ্ধপ্রিয় জাতি হিসেবে অ্যাসিরীয়গণ ব্যবসা-বাণিজ্য করাকে অসম্মানজনক মনে করতেন এবং এই কারণেই অ্যারামিয়ানদের (Arameans) উপর শিল্প এবং বাণিজ্যের দায়িত্ব অর্পণ করে। তারা কৃষি উৎপাদনের উপর নির্ভরশীল ছিল। জমির উপর স্বত্ত্বাধিকার ছিল মন্দিরের এবং বাড়ি ও জমি সৈন্যবাহিনীর মধ্যে বণ্টন করে দেয়া হত। কৃষি এবং শিল্পক্ষেত্রে ব্যবিলনীয়দের মত উৎকর্ষ সাধিত হয় নি। ব্যবিলনীয় আইন অ্যাসিরীয় আইনকে প্রভাবান্বিত করে সত্য কিন্তু অ্যাসিরীয়রা হুবহু ব্যবিলনীয় আইন নকল করে নি। এর প্রমাণ পাওয়া যায় গর্ভপাত (Abortion) এবং অপ্রাকৃতিক অপরাধে বিশেষ কোন শাস্তি প্রদান না করার প্রথায়। যুদ্ধ করতে হলে জনসংখ্যা বৃদ্ধির প্রয়োজন উপলব্দি করে অ্যাসিরীয়রা এই অপরাধে কঠোর শাস্তি প্রদান করতেন না। সুমেরীয় এবং ব্যবিলনীয় সভ্যতার নারীর স্থান ছিল খুব উচ্চে। কিন্তু অ্যাসিরীয়রা নারীর উপযুক্ত মর্যাদা দিতে জানতেন না। স্ত্রীকে স্বামীর দাসী মনে করা হত। সমাজে বহুবিবাহ প্রথা প্রচলিত ছিল। তালাকের অধিকার ছিল কেবল স্বামীর; বিবাহিত মহিলাদের অবগুণ্ঠন ব্যবহার করতে হত। ওমসস্টেডের মতে, “এটিই ছিল প্রাচ্যে মহিলাদের প্রাথমিক পর্দা-প্রথা।” অবশ্য অভিজাত শ্রেণীর মহিলারা রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করতেন এবং তাদের অনেকেই প্রাদেশিক শাসনকর্তার পদ অলঙ্কৃত করেন।
এটি সহজেই বোধগম্য যে, অ্যাসিরীয়দের মত একটি দুর্ধর্ষ সামরিক জাতি জ্ঞান- বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে ব্যবিলনীয়দের মত অগ্রগতি লাভ করতে পারে নি। কিন্তু যুদ্ধ পরিচালনার প্রয়োজনে তারা বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে নানা প্রকার আবিষ্কার করতে সক্ষম হন; যেমন বৃত্তকে ৩৬০ ডিগ্রীতে বিভক্ত করা, দ্রাঘিমারেখা এবং অক্ষরেখার মত ভৌগোলিক সংজ্ঞা নিরূপণ করা। তারা পাঁচটি উপগ্রহ (Planets) আবিষ্কার করে তাদের নামকরণ করেন। তারা গ্রহণের ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারতেন। চিকিৎসা শাস্ত্রে তারা ৫০০টি ঔষধের প্রক্রিয়া আবিষ্কার করে। সৈন্যবাহিনীকে রোগমুক্ত করবার প্রয়োজনে এটি করা হয়। বিভিন্ন রোগ নির্ণয় এবং প্রতিকার ব্যবস্থাও তারা করেন।
হিব্রু সভ্যতা
প্রাচীন প্রাচ্যের জাতিসমূহের মধ্যে হিব্রুদের স্থান নিঃসন্দেহে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। হিব্রু এবং ইহুদী শব্দদ্বয়ের অর্থ এক হলেও হিব্রু শব্দটি প্রাচীনতম; কারণ উত্তর সাম্রাজ্যের ধ্বংসের পর জুডাহ-এর অধিবাসীদের ইহুদী বলা হত। আরব দেশ হতে হিব্রু যাযাবর জাতি সর্বপ্রথম প্যালেস্টাইনে আগমন করে। হিব্রু শব্দের অর্থ ‘বিদেশী’ হতে এর প্রমাণ পাওয়া যায়। সম্ভবত খ্রিস্টপূর্ব ১৮০০ অব্দে তাদের আদিপুরুষ আব্রাহাম অথবা হযরত ইব্রাহিমের বলিষ্ঠ নেতৃত্বে স্বদেশভূমি ছেড়ে হিব্রুগণ মেসোপটেমিয়ায় বসতি স্থাপন করে। পরবর্তীকালে আব্রাহামের পৌত্র জ্যাকবের নেতৃত্বে তারা পশ্চিম দিকে যাত্রা করে এবং প্যালেস্টাইন দখল করে সেখানে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে থাকে। জ্যাকব ইসরাইল নামে সুপরিচিত এবং তিনিই ইসরাইলের জাতীয় ধর্মগুরু। প্যালেস্টাইনে দুর্ভিক্ষ দেখা দিলে তারা মিসরে গমন করে এবং সেখানে প্রাচীন মিসরীয় বাদশাহ ফেরাউনের অধীনে দাসত্ব গ্রহণ করতে বাধ্য হয়। পরবর্তীকালে হযরত মুসার নেতৃত্বে খ্রিস্টপূর্ব ১৩০০-১২৫০ অব্দে এই দাসত্ব-শৃঙ্খল হতে মুক্ত হয়ে মিসর থেকে সিনাই উপদ্বীপে আগমন করে। হযরত মুসা (আ) হিব্রু জাতিকে শুধু সুসংবদ্ধই করেননি, বরং তাদেরকে জেহোভার উপাসনায় আকৃষ্ট করেন। প্যালেস্টাইন হিব্রুদের জন্য আরব মরুভূমির তুলনায় ছিল স্বর্গপুরী এবং হিব্রু নেতা ও ধর্মগুরুগণ এটিকে “দুগ্ধ এবং মধুর দেশ” (Land flowing with milk and honey) বলে অভিহিত করেছেন। প্যালেস্টাইনের প্রাচীন ক্যানানাইট সাম্রাজ্য অথবা কেনান ধ্বংস করে হিব্রুগণ সেখানে একটি উন্নতমানের সভ্যতা গড়ে তোলেন। এ প্রসঙ্গে ডেভিদ অথবা হযরত দাউদের অবদান বিশেষ উল্লেখযোগ্য। তিনি ছিলেন জুডাহ্ গোত্রের জেসেসির (Jesses) পুত্র। তাঁর চল্লিশ বৎসরব্যাপী রাজত্বকাল হিব্রু জাতির ইতিহাসে গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়ের সূচনা করে। জেরুজালেম অধিকার করে তিনি একটি বিশাল সাম্রাজ্যের ভিত্তি সুদৃঢ় করেন। হিব্রুদের দশটি গোত্রকে সংঘবদ্ধ করে তিনি হিব্রু জাতিকে সুসংহত করেন। তাঁর বিশেষ স্থাপত্য-কীর্তি হল জেরুজালেমের অসংখ্য ইমারত। ডেভিদের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র সলোমন হিব্রু সভ্যতার ক্রমবিকাশে অশেষ অবদান রেখে গিয়েছেন। তিনি জেরুজালেমে একটি সুবৃহৎ ও অনিন্দ্যসুন্দর মন্দির নির্মাণ করেন। তিনি বিলাসিতায় মগ্ন থাকতেন। তাঁর মৃত্যুর পর হিব্রু জাতির অধঃপতন হতে থাকে এবং তাদের সাম্রাজ্য দুটি অংশে বিভক্ত হয়ে যায়; যেমন- উত্তরাংশ ইসরাইল এবং দক্ষিণাংশ জুডাহ। খ্রিস্টপূর্ব ৭২২ অব্দে অ্যাসিরীয় সাম্রাজ্য কর্তৃক ইসরাইল রাজ্য অধিকৃত হয় এবং এর পর হিব্রুগণ বিচ্ছিন্নভাবে বসবাস করতে থাকে বলে তাদেরকে ‘বিলুপ্ত দশটি গোত্র’ বলে অভিহিত করা হয়। ৫৮৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দে কালদিয়ার রাজা নেবুচ্যাডনেজার জুডাহ অধিকার করেন।
মানব সভ্যতার ক্রমবিকাশে হিব্রুদের অবদান অপরিসীম। ধর্মীয় ভাবধারার উন্মেষে তাদের অশেষ কৃতিত্ব রয়েছে। বলা বাহুল্য যে, খ্রিস্টান ধর্মের মূল উৎস বাইবেলে বর্ণিত অনেক ঘটনার উল্লেখ ইহুদী জাতির ধর্মগ্রন্থ তওরাত অথবা ওল্ড টেস্টামেন্টে (Old Testament) পাওয়া যায়। এ কারণে বাইবেলের দু’টি খণ্ড রয়েছে- একটি ওল্ড টেস্টামেন্ট এবং অপরটি নিউ টেস্টামেন্ট। ওল্ড টেস্টামেন্টে খ্রিস্টপূর্বাব্দ ৮৫০ হতে ১৫০ সাল পর্যন্ত লিখিত ঊনচল্লিশটি পুস্তক সন্নিবেশিত রয়েছে। হিব্রু জাতি সর্বপ্রথম প্রকৃতি পূজা, দেব-দেবীর উপাসনা প্রভৃতির স্থলে একেশ্বরবাদের প্রচলন করে এবং হযরত মুসার প্রভাবে হিব্রুগণ তাদের জাতীয় উপাস্য দেবতা জেহোভার আরাধনায় আকৃষ্ট হয়। ইসলামের নিরাকার আল্লাহর স্থলে জেহোভাকে তারা আকারবিশিষ্ট একেশ্বর বলে মনে করতেন। হযরত মুসাকে আইন প্রদানকারী এবং নৈতিক আদর্শের প্রতিভূ বলে মনে করা হত। হিব্রুদের মতে, তিনি সাইনাই পর্বতমালার শৃঙ্গে দশটি অনুশাসন প্রদান করেন।
সভ্যতার ক্রমবিকাশে হিব্রুদের যথেষ্ট অবদান রয়েছে। এর প্রমাণ পাওয়া যায় আইন, সাহিত্য, দর্শন, শিল্পকলা প্রভৃতি ক্ষেত্রে তাদের অসামান্য কৃতিত্বে ‘ডিউটোরোনোমিক কোর্ড’ নামে একটি নতুন আইন প্রণয়ন করে তারা যশস্বী হয়েছেন। এটি সম্ভবত ‘কভেনান্ট কোডের’ উপর ভিত্তি করে রচিত হয়েছিল। অনেকের মতে, হাম্মুরাবির কোড অপেক্ষা এই ইহুদী আইন উন্নত ধরনের ছিল। এ সমস্ত অনুশাসনে নিঃস্বদের স্বার্থরক্ষা, দাসদের মুক্তি, সূক্ষ্ম-বিচার, ভোজবাজীর নিন্দা, সুদ গ্রহণের শাস্তির ব্যবস্থা ছিল।
ঐতিহাসিকদের মতে, প্রাচীন প্রাচ্যের সাহিত্যক্ষেত্রে হিব্রুদের অবদান অনস্বীকার্য। তাদের সাহিত্য চর্চার নিদর্শন পাওয়া যায় ওল্ড টেস্টামেন্ট এবং এপোক্রিপায়। রাজা ডেভিদ প্লাসমের (Psalms) বৃহত্তম অংশের উদ্ভাবক ছিলেন। ধর্ম ব্যতীত হিব্রু সাহিত্যের মূল বিষয়বস্তু হচ্ছে বীরত্বগাঁথা, যুদ্ধ-সঙ্গিত এবং ভবিষ্যদ্বাণী। হিব্রু সাহিত্যের প্রখ্যাত প্রেমের উপাখ্যান হচ্ছে সলোমনের সঙ্গীতমালা (Songs of Solomon)। হিব্রু সাহিত্যের অন্যতম প্রধান অবদান হচ্ছে ‘জবের পুস্তক’ (Book of Job)। এই পুস্তকে নীতিমালার উপর ভিত্তি করে বিভিন্ন ঘটনার বর্ণনা রয়েছে এবং কুকর্মের প্রতি তীব্র অবজ্ঞা প্রকাশ করা হয়েছে। দর্শনে হিব্রু জাতির অমর কৃতিত্ব রয়েছে। ‘ওল্ড টেস্টামেন্ট’, ‘বুক অব প্রভাবস’ এবং ‘একলিসিয়াটিকাসের দর্শন’ প্রভৃতির নাম এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যেতে পারে।
শিল্পকলা ও স্থাপত্য-কীর্তির অসংখ্য নিদর্শন হিব্রু সভ্যতার গভীরতা এবং বৈশিষ্ট্যকেই নির্দেশ করে। জেরুজালেমকে সুসমৃদ্ধ নগরীতে পরিণত করে সলোমন অক্ষয় কীর্তি রেখে গেছেন। স্থাপত্য-কীর্তির অপূর্ব নিদর্শন জেরুজালেমের মন্দির হেরোড কর্তৃক ধ্বংস হবার পূর্ব পর্যন্ত শিল্পজগতের একটি বিস্ময় ছিল। ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে আবিষ্কৃত ‘ডেডসী স্ক্রল’ (Dead Sea Scroll) বা ‘মরুসাগরের দস্তাবেজ’ প্রাচীনতম হিব্রু ধর্মীয় সাহিত্যের নজির বলে মনে করা হয়। একটি গুহার অভ্যন্তরে পঞ্চাশটি মৃৎপাত্রে চামড়ার উপর হিব্রু ভাষায় লিখিত এই স্ক্রলগুলো খ্রিস্টপূর্ব ১৩০ হতে ৬৭ অব্দ পর্যন্ত ঐ অঞ্চলের একটি ধর্মীয় গোষ্ঠীর অবস্থানকে সুস্পষ্টরূপে প্রমাণিত করে।
পারস্য (সাসানীয়) সাম্রাজ্য
আরব উপদ্বীপের উত্তর-পূর্বে অবস্থিত বিশাল পারস্য সাম্রাজ্য ২২৪ খ্রিস্টাব্দে আরদাশির কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত হয়। সম্ভবত খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চাশ শতাব্দীর মধ্যভাগে আর্য জাতির কয়েকটি শাখা ইরানের পশ্চিমে অবস্থিত ভূখণ্ডে বসবাস শুরু করে। যারা ইরানের দক্ষিণে বসতি স্থাপন করে তাদেরকে পারসিক বলা হয়। শব্দটি ‘পারস’ অথবা ‘ফারস’ হতে গ্রহণ করা হয়েছে এবং এর প্রাণকেন্দ্র ছিল পারসিপলিস। ইরানের উত্তরাঞ্চলে যারা বসতি স্থাপন করে তারা ‘মেড’ নামে পরিচিত। ৫৫৯ খ্রিস্টপূর্বাব্দে দক্ষিণ পারস্যে সাইরাস যে বিশাল সাম্রাজ্য স্থাপন করেন উহা একামেনী বংশ নামে অভিহিত। ৫৩৯ খ্রিস্টপূর্বাব্দে তিনি কালদীয় সাম্রাজ্য ধ্বংস করে ব্যবিলন দখল করেন। ব্যবিলনের পতনে সেমিটিক প্রাধান্য বিলুপ্ত হয় এবং তৎপরিবর্তে আর্যদের কর্তৃত্ব মধ্য-এশিয়ায় সুপ্রতিষ্ঠিত হয়। সাইরাসের পুত্র ক্যামবিসাস ৫২৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দে মিসর দখল করেন। ক্যামবিসাসের সুযোগ্য পুত্র ও উত্তরাধিকারী মহান প্রথম দারায়ূস (৫২১-৪৮৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দে) একামেনী সাম্রাজ্যকে সুসংবদ্ধ করেন। বিদ্রোহ দমন, দেশজয়, সুশাসন প্রভৃতির ফলে পারস্য সাম্রাজ্য সমৃদ্ধির স্বর্ণশিখরে উপনীত হয়। পরবর্তীকালে দুর্বল এবং লালসাগ্রস্ত উত্তরাধিকারীদের রাজত্বকালে পারস্য সাম্রাজ্যের অধঃপতন হয় এবং এর ফলেই খ্রিস্টপূর্ব ৩৩১ অব্দে আলেকজাণ্ডারের পক্ষে অতি সহজেই এই সাম্রাজ্যকে ধ্বংস করা সম্ভবপর হয়।
গ্রিক শাসনের পর পার্থিয়ানগণ পারস্যে রাজত্ব করে এবং এরপর ২২৪ খ্রিস্টাব্দে আরদাশিরের নেতৃত্বে সাসানীয় রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়। তৃতীয় শতাব্দী হতে সপ্তম শতাব্দী পর্যন্ত সাসানীয় বংশ রাজত্ব করে। সাসানীয় সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা আরদাশির পাপাকের পুত্র ছিলেন এবং তাঁর জন্মস্থান ছিল পারস অর্থাৎ দক্ষিণ পারস্যে। ফেরদৌসীর ‘শাহনামায়’ সাসানীয় রাজবংশের ইতিহাস মূর্ত হয়ে রয়েছে। বিচক্ষণ শাসক এবং নির্ভীক যোদ্ধা হিসাব আরদাশির খ্যাতি অর্জন করেন। তাঁর রাজত্বেই জরথুস্ত্র ধর্ম (Zoroastrianism) প্রবর্তিত হয়। আরদাশিরের পুত্র প্রথম শাহপুর ২৪০ খ্রিস্টাব্দে সিংহাসনে আরোহন করেন। তাঁর রাজত্বে সাম্রাজ্যের উন্নতি সাধিত হয় এবং শিল্প-কর্মে নবজাগরণ দেখা দেয়। সাসানীয় বংশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নৃপতি ছিলেন দ্বিতীয় শাহপুর (৩০৯-৩৭৯ খ্রি.)। তিনি বীর-বিক্রমে রোমানদের সঙ্গে যুদ্ধ করেন। নওরেশওয়া সাসানীয় বংশের সর্বশ্রেষ্ঠ রাজা বলে পরিচিত। ন্যায়-বিচার, জনমঙ্গলকর কার্যকলাপের জন্য তিনি বিখ্যাত ছিলেন। সাসানীয় সম্রাট খসরু পারভেজ ৫৯০ খ্রিস্টাব্দে সিংহাসনে আরোহন করেন এবং ৬২৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত রাজত্ব করেন। নবী করীম (স) তাঁকে একটি পত্র দিয়া ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট করতে চাইলে তিনি উষ্মাবশত তা ছিঁড়ে ফেলেন। একথা শ্রবণ করে রাসূলে করীম (স) ভবিষ্যদ্বাণী করেন যে, যেভাবে তাঁর পত্রটিকে ছিঁড়ে ফেলা হয়েছে অনুরূপভাবে তার রাজ্য ছিন্নভিন্ন হবে। পরবর্তীকালে তৃতীয় ইয়াজদিগার্দ- এর রাজত্বকালে মুসলমান সেনাপতি সা’দ-বিন-আবি ওয়াক্কাস সাসানীয় রাজা ধ্বংস করে পারস্যে মুসলিম আধিপত্র কায়েম করেন।
জরথুস্ত্রধর্ম
পারসিকদের ধর্ম-বিশ্বাসকে সাধারণত জরথুস্ত্র ধর্ম বলা হয়ে থাকে। গ্রিকদের ভাষায় এর প্রবর্তককে জোরায়াস্টার বলা হয় : কিন্তু পারসিকগণ তাকে জরথুস্ত্র বলে অভিহিত করেন। খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চদশ শতাব্দী হতে এই ধর্মের উৎস অনুসরণ করা গেলেও, জরথুস্ত্রের আবির্ভাব সম্ভবত খ্রিস্টপূর্ব সপ্তম অব্দে হয়েছিল। সাধারণত তার ধর্মমত মাজদিয়ান নামে পরিচিত এবং এর মূল বৈশিষ্ট্য ছিল দেব-দেবীর পূজা ও মন্দিরে পশুবলী প্রথা উচ্ছেদ। প্রাচীন সুমার এবং ব্যবিলনীয়দের মত তাদের ঈশ্বর ভাল এবং মন্দ পরস্পরবিরোধী শক্তির উৎস। জরথুস্ত্র ধর্মের উপাস্য দেবতার নাম ‘আহুর মাজদা’ ( Ahur – Mazda)। ন্যায়, সততা এবং বিচক্ষণতার প্রতীক ‘আহুর মাজদা’ মঙ্গলের দেবতা এবং তার প্রতীক হল অগ্নি। এই কারণে পারসিকদের অগ্নি উপাসক বলা হয় এবং তাদের ধর্মের নামও মাজদের ধর্ম। অপরদিকে প্রতিদ্বন্দ্বী দেবতার নাম ‘আহরিমান’ ( Ahariman), যিনি অসত্য, পাপাচার, অমঙ্গল এবং দুষ্ট দেবতা নামে পরিচিত। এই দেবতা জরা, মহামারী, অনাবৃষ্টি প্রভৃতি ধ্বংসকারী শক্তির প্রতীক। মঙ্গল এবং অমঙ্গলের দ্বন্দ্বে সাধারণত জয় হয় মঙ্গল দেবতার এবং এর ফলে অসত্যের পরিবর্তে সত্যের জয় হয়। মানুষের মধ্যেও এই বিরোধী শক্তির সংঘাত রয়েছে এবং মঙ্গলের জয়েই তার মুক্তি নিহিত। মঙ্গল দেবতা তথা জরথুস্ত্র ধর্মের মূল ভিত্তি হচ্ছে শুভ চিন্তা, শুভ কথা এবং শুভ কর্ম (Good thoughts, good words, good deeds )।
অগ্নি উপাসক পারসিকগণ পরকালে বিশ্বাসী। তারা ত্রাণকর্তার আবির্ভাবে বিশ্বাস করে; মৃত ব্যক্তিদের পুনর্জীবন, পরকালের বিচার, স্বর্গ প্রভৃতি জরথুস্ত্র ধর্মে স্থান পেয়েছে। পারসিকগণ ‘আল্লাহ আদিষ্ট জাতি’ (divine race) বলে তাদের নশ্বর দেহ সমাহিত অথবা অগ্নিদগ্ধ করা হত না। মৃত্যুর পর একটি টাওয়ারে তা রাখা হত, যাতে স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় উহা বিনষ্ট হতে পারে। করাচি এবং বোম্বাইয়ের পারসিক সম্প্রদায়ের জন্য এরূপ ‘নিস্তব্ধ টাওয়ার’ ( Tower of Silence) রয়েছে। জরথুস্ত্রের মৃত্যুর পর তার অনুসারীরা ধর্মগুরুর মূল্যবান বাণীগুলোকে লিপিবদ্ধ করে রাখে। এই গ্রন্থের নাম ‘জেন্দাবেস্তা’। পারসিক ধর্ম হলেও জরথুস্ত্র ধর্ম ইহুদী এবং খ্রিস্টান ধর্মে প্রভাব বিস্তার করেছে। নৈতিক চরিত্র গঠনে এবং সততা রক্ষার মূলে জরথুস্ত্র ধর্ম বিশেষ অবদান রেখেছে। খোদা প্রদত্ত ধর্ম হিসেবে এটি অন্যতম প্রধান ধর্ম। খ্রিস্টান নীতিমালা জরথুস্ত্র ধর্ম দ্বারা প্রভাবান্বিত হয়েছিল। জরথুস্ত্র ধর্মের মূল বিষয়বস্তু যেমন- পরকাল, স্বর্গ প্রভৃতি ইহুদী, খ্রিস্টান এবং ইসলাম ধর্মে পরিলক্ষিত হয়।
ইসলামের আবির্ভাব
ইসলাম মানবজাতির ইতিহাসের সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ ধর্মরূপে আবির্ভূত হয়। প্রাক-মুসলিম যুগের ধর্মবিশ্বাসের মূলে কুঠারাঘাত করে ইসলাম শুধু একেশ্বরবাদই প্রতিষ্ঠা করে নি বরং পুরাতন কলুষিত সামাজিক, অর্থনৈতিক, ধর্মীয় ও রাজনৈতিক জীবনযাত্রায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধন করে। এই কারণে ইসলামের আবির্ভাব মনস্তাত্ত্বিক দিক হতে বিচার করলে খুবই সময়োপযোগী ছিল। কুর’আন শরীফে বর্ণিত আছে, “আল্লাহর নিকট সর্বাপেক্ষা সত্য ধর্ম হচ্ছে ইসলাম” এবং ইসলাম শান্তি, আত্মার মুক্তি, আল্লাহর উপর নির্ভরশীলতার প্রতীক। ইসলামের আবির্ভাব হয়, কুর’আনের ভাষায়, ‘সমস্ত মানবজাতির মঙ্গলের জন্য’। সাম্যবাদ ইসলামের মহৎ আদর্শ এবং এটি বিশ্ব-মুসলিম ভ্রাতৃত্ব সৃষ্টি করেছে। ইসলামের আবির্ভাবে তমসাচ্ছন্ন যুগের অবসান হয়ে মানব সভ্যতায় নতুন দিগন্তের সূচনা হয়। বিশ্ব সভ্যতার উন্মেষে ইসলামের দান অনস্বীকার্য। মার্টিন লিং বলেন, “মানব সমাজের প্রধান কাজ মুসলমানগণ সাধন করেছিলেন। সর্বশ্রেষ্ঠ দার্শনিক আল-ফারাবী ছিলেন মুসলমান; সর্বশ্রেষ্ঠ অঙ্ক শাস্ত্রবিদ আবু কামিল এবং ইব্রাহিম-বিন-সিনান ছিলেন মুসলমান; সর্বশ্রেষ্ঠ ভূগোল বিশারদ এবং বিশ্বকোষ রচয়িতা আল-মাসুদী ছিলেন মুসলমান এবং সর্বশ্রেষ্ঠ ঐতিহাসিক আত- তাবারীও ছিলেন মুসলমান। “