রাজমালা - প্ৰথম ভাগ - উপক্রমণিকা
রাজমালা - দ্বিতীয় ভাগ
রাজমালা - তৃতীয় ভাগ
রাজমালা চতুৰ্থ ভাগ

দ্বিতীয় অধ্যায় – জেলা ত্রিপুরা

দ্বিতীয় অধ্যায় – জেলা ত্রিপুরা

জেলা ত্রিপুরা :- সৃষ্টি কাল হইতে ইহার পরিমাণ ও সীমা অবিশ্রান্ত পরিবর্তন হইতেছে। বিধাতা যেরূপ বিশ্বব্রহ্মাণ্ড লইয়া ক্রীড়া করিতেছেন, আমাদের বিধাতৃ-পুরুষ ইংরেজ কর্তৃপক্ষও এ বিষয়ে লইয়া তদ্রূপ অবিশ্রান্ত ক্রীড়া করিতেছেন, সেই সকল প্রাচীন কাহিনী পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে আলোচনা নিষ্প্রয়োজন।

অধুনা ত্রিপুরা জেলা ২৩.০’ এবং ২৪.১৬’ উত্তর অক্ষাংশ এবং ৯০.৩৬’ এবং ৯১.৬৯’ পূর্ব দ্রাঘিমা মধ্যে অবস্থিত। ইহার পরিমাণ ২৪৯১ বর্গমাইল। ১৮৯১ খ্রিস্টাব্দের গণনা অনুসারে ইহার অধিবাসী সংখ্যা ১৭৮২৯৩৫ নির্ণীত হইয়াছে।

এই জেলার পূর্বদিকে ত্রিপুরা (পার্বত্য) রাজ্য। উত্তরে জেলা শ্রীহট্ট ও ময়মনসিংহ পশ্চিমে মেঘনাদ নদ এই জেলাকে ময়মনসিংহ, ঢাকা, ফরিদপুর, ও বাখরগঞ্জ হইতে বিচ্ছিন্ন করিতেছে। দক্ষিণে নওয়াখালী জেলা কিন্তু নওয়াখালীকে ত্রিপুরা জেলার একাংশ মনে করিলে এই জেলার দক্ষিণ সীমা বঙ্গোপসাগর এবং এই জন্য কবি চূড়ামণি কালিদাস ত্রিপুরাকে “তালীবন শ্যামমুপকণ্ঠং মহোদধেঃ” বলিয়া বর্ণনা করিয়াছেন। তাল, খর্জুর, নারিকেল ॥৩১৭ গুবাক জাতীয় পাদপ শ্রেণী অদ্যাপি সেই প্রাচীন কবির বর্ণনার সভ্যতা ঘোষণা করিতেছে।

জেলা ত্রিপুরা একটি সমতল ক্ষেত্র। ত্রিপুরা পর্বতের পদমূল হইতে মৃত্তিকা ক্রমে পশ্চিমদিকে ঢালু হইয়া গিয়াছে। এক মাত্র লালময়ী ময়নামতী ব্যতীত ইহাতে কোন পর্বত বা উচ্চ ভূমি নাই। জেলার পূর্ব প্রান্তে পর্বতের প্রকৃতি বিশিষ্ট শ্বেত, রক্ত প্রভৃতি বিবিধ বর্ণ রঞ্জিত উচ্চ ভূমি এবং পশ্চিমে মেঘনাদনদের স্রোত প্রবাহিত কদমরাশি দ্বারা গঠিত নবীন “চর” সকল, নবাগত ব্যক্তিদিগের নয়নে দুইটি প্রাকৃত দৃশ্যরূপে পরিলক্ষিত হয়। ত্রিপুরার সমতল ক্ষেত্রের দক্ষিণ হইতে উত্তর দিকের ভূমি, নিম্ন ও স্বতন্ত্র প্রকৃতি বিশিষ্ট। আমরা পূর্বে বলিয়াছি শ্রীহট্ট জেলার দক্ষিণ পশ্চিমাংশ, ময়মনসিংহের পূর্বাংশ এবং ত্রিপুরা জেলার উত্তর পশ্চিমাংশ দর্শনে বোধ হয় এই স্থানে পূর্বে একটি বৃহৎ হ্রদ ছিল।[১] নদী স্রোতে প্রবাহিত কদমরাশি দ্বারা সেই হ্রদ ক্রমে শুষ্ক হইয়া অসংখ্য বিল সৃষ্টি করিয়াছে। বিলের বান্দী গুলিতে মনুষ্যের বাস হইয়াছে। বর্ষার জল প্লাবনে যখন সরাইল, নুরনগর প্রভৃতি পরগণা ভাসিয়া যায়, তৎকালে গ্রামগুলিকে তরুরাজি শোভিত এক একটি দ্বীপ বলিয়া বোধ হয়। বর্ষার সময় (আষাঢ়ের শেষ ভাগ হইতে আশ্বিন মাস পর্য্যন্ত) ॥৪১৮॥ সরাইল ও নুরনগর পরগণার অধিকাংশ ভূমি জলে নিমজ্জিত থাকে।

ত্রিপুরার পশ্চিম প্রান্ত দিয়া মেঘনাদ (মেঘনা) নদ প্রবাহিত হইতেছে। ইহার একটি প্রধান শাখা তিতাস নামে পরিচিত। তিতাস নদী গোয়ালনগরের নিকট মেঘনাদ হইতে বহির্গত হইয়া সরাইল পরগণা প্রদক্ষিণ করত লালপুরের নিকট মেঘনাদে পতিত হইতেছে। ত্রিপুরার পর্বত জাত হাওড়া, লৌহর প্রভৃতি অনেকগুলি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র স্রোতস্বতী তিতাসকে করদান করিতেছে। তিতাসের দৈর্ঘ্য প্রায় ৯২ মাইল হইবে। ত্রিপুরা পর্বতজাত গোমতী ডাকাতীয়া প্রভৃতি নদীগুলি মেঘনাদে পতিত হইতেছে। তদ্ব্যতীত আরও অনেকগুলি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র নদী এই জেলার মধ্য দিয়া প্রবাহিত হইতেছে। এই সকল নদ নদীর মধ্যে ডাকাতীয়ার দৈর্ঘ্য সর্বাধিক, তাহা ১৫০ মাইলের ন্যূন হইবে না। এই নদী সুয়াগাজির নিকট ত্রিপুরা জেলায় প্রবেশ করিয়াছে এবং চাঁদপুরের নিকট মেঘনাদের সহিত সংযুক্ত হইয়াছে।

ত্রিপুরার প্রধান নগরী কুমিল্লার ৫ মাইল পশ্চিমে লালময়ী ময়নামতী পর্বত অবস্থিত। উত্তর দক্ষিণে ইহার দৈর্ঘ্য ১০ মাইল। ইহার পরিধি ২১ মাইল। এই পর্বত সমতল ক্ষেত্ৰ হইতে গড়ে ৪০ ফিট উচ্চ। কিন্তু ইহার সর্ব্বোচ্চ শৃঙ্গ প্রায় ১০০ ফিট উচ্চ হবে। অধুনা এই পর্বতটি জঙ্গলাবৃত,॥৪১৯॥ কিন্তু প্রাচীনকালে এই পর্বতে মনুষ্যের বাস ছিল। ১৮৭৫ খ্রিস্টাব্দে”কালীর বাজার রাস্তা” প্রস্তুতকালে পবর্বত শিখরে একটি সুন্দর দুর্গ আবিস্কৃত হইয়াছে। সেই দুর্গের পার্শ্বে প্রস্তর নির্ম্মিত সুন্দর দেবমূর্ত্তিসকল প্রাপ্ত হওয়া গিয়াছে। আমরা পূর্বে রণবঙ্কমল্লের তাম্র শাসনের কথা উল্লেখ করিয়াছি, ১৮০৩ খ্রিস্টাব্দে তাহাও এই পর্বত মধ্যে পাওয়া গিয়াছিল ত্রিপুরার তদানীন্তন জজ-মেজেস্ট্রেট ইলিয়ট সাহেব তৎকালে সেই তাম্র শাসন কলিকাতার এসিয়াটিক সোসাইটীতে প্রেরণ করেন।

এই পর্বতটি ত্রিপুরার মহারাজ তাঁহার স্বাধীন রাজ্যের একাংশ বলিয়া জ্ঞান করিতেন। কোন কোন ইংরেজ কর্তৃপক্ষও এরূপ লিখিয়াছেন।[২] অল্পকাল হইলে গবর্ণমেন্টের সহিত এই পর্বত লইয়া মহারাজের একটি বিরোধ উপস্থিত হয়। অবশেষে গবর্ণমেন্ট ২১০০ হাজার টাকা সেলামী গ্রহণে লালময়ী পর্বতটি লাখেরাজ স্বরূপ মহারাজকে দান করেন কিন্তু ময়নামতী শৃঙ্গটি ত্রিপুরা রাজ্যের একাংশ বলিয়া স্বীকার করিয়াছেন।

প্রবাদ অনুসারে গোপীচাঁদ নামে জনৈক নরপতি এই পর্বতে বাস করিতেন। তাহার পত্নীর নাম ময়নামতী॥৪২০। এবং কন্যার নাম লালময়ী ছিল। তদনুসারে এই পর্বত লালময়ী ময়নামতী আখ্যা প্রাপ্ত হয়।

প্রাচীন কালে ত্রিপুরা রাজ্য পশ্চিম দিকে ব্রহ্মপুত্র দ্বারা সীমাবদ্ধ ছিল। সুতরাং আধুনিক ঢাকা ও ময়মনসিংহ জেলার কিয়দংশ তৎকালে ত্রিপুরা রাজ্যের আন্তর্ভূক্ত ছিল। মুসলমান ইতিহাস লেখকগণ বলেন লক্ষ্মণাবতীর (গৌড়ের) বিদ্রোহী “মালীক” (গবর্ণর) সুলতান মগিসুদ্দিন তুগ্রল সর্বপ্রথম ত্রিপুরা আক্রমণ করেন। পূর্বে প্রদর্শিত হইয়াছে যে, এই বর্ণনা সম্পূর্ণ সত্য নহে। প্রকৃত পক্ষে বাঙ্গালার স্বাধীন পাঠান নরপতিগণের রাজপাট সুবর্ণগ্রামে স্থাপিত হওয়ার পর তাহারা ত্রিপুরা আক্রমণ ও লুণ্ঠন করিতে প্রবৃত্ত হন। আমাদিগের বিবেচনায় সুলতান মগিসুদ্দিন আবুল মোজাফর ইলিয়াসহ সর্বপ্রথম (১৩৪৭ খ্রিস্টাব্দে) ত্রিপুরা আক্রমণ করেন। সে সময় হইতে সমতলক্ষেত্র মুসলমান রাজ্যভুক্ত হওয়ার সূত্রপাত হয়। ক্রমে পাঠান সুলতানগণ ত্রিপুরার সমতল ক্ষেত্র অধিকারের জন্য যত্ন করিতে লাগিলেন। ত্রিপুরেশ্বরগণ লক্ষ্মণসেনের ন্যায় কাপুরুষোচিত ব্যবহার করেন নাই। তাহারা যে কেবর হৃত। ৪২১॥ অংশ পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করিয়াছেন এমত নহে, সুযোগ মতে তাহারাও পূর্ববঙ্গ আক্রমণ করত পাঠানদিগের কৃত অত্যাচারের প্রতিশোধ লইয়াছেন।

রাজা তুডরমল্লের কৃত ওয়াশীল তুমরজমাতে ত্রিপুরার সমতল ক্ষেত্রের অধিকাংশ ভুক্ত হইয়াছে। আমরা পূর্বেই বলিয়াছি ওয়াশীল রুমুজমায় সীমান্তস্থিত যে সমস্ত মহালের তালিকা প্রদত্ত হইয়াছে সম্রাট আকবর তাহার করগ্রাহী ছিলেন না। কিন্তু বিখ্যাত শেরসাহ যে এই সকল স্থান কিছুকালের জন্য করতলস্থ করিয়াছিলেন এরূপ অনুমান নিতান্ত অসঙ্গত নহে, কারণ সীমান্তস্থিত মহাল সমূহের জন্য তুডরমল্ল শেরসাহের ওয়াশীল তুমরজমার নকল নবিস মাত্র। মুসলমানগণ তিন দিক হইতে ত্রিপুরার সমতর ক্ষেত্র আক্রমণ ও অধিকার করিয়াছেন। এজন্যই ওয়াশীল তুমরজমায় সরকার সুবর্ণগ্রাম, সরকার শিলহট্ট (শ্রীহট্ট) ও সরকার চট্টগ্রামের অন্তর্গত মহাল সমূহের তালিকার মধ্যে ত্রিপুরার কোন কোন অংশ সংযোজিত দৃষ্ট হইতেছে। ইতি পূর্বে সরকার শিলহট্ট ও সরকার চট্টগ্রাম ও ভুলুয়ার অন্তর্গত মহাল সমূহের নাম উল্লেখ করা হইয়াছে, তদ্ব্যতীত অন্যান্য মহারের নামের তালিকা নিয়ে লিখিত হইল।

সরকাল সুবর্ণগ্রাম

১। উত্তর সাহাপুর। রাজস্ব ৯৬১ টাকা ২ দাম।

২। বলদাখাল। রাজস্ব ১৭৩৫২ টাকা চার আনা। এই পরগনায় আধুনিক সংশোধিত নাম “বরদাখ্যাত”। রাজা তুডরমল্ল যৎকালে ওয়াশীল তুমরজমা প্রস্তুত করেন সেই সময় বলদাখাল খিজিরপুরের (সুবর্ণগ্রামের) সুবিখ্যাত ভৌমিক ইশা খাঁ মছনদে আলীর অধিকার ভুক্ত ছিল।৪ ॥৪২৩।।

৩। বোয়ালীয়া। রাজস্ব ৫৯৩৩ টাকা।

৪। পুরচণ্ডী। রাজস্ব ৩০০২ টাকা আট আনা।৫

৫। পাইটকাড়া। রাজস্ব ১০২ টাকা। এই পাইটকাড়ার কথা আমরা গ্রন্থের প্রারম্ভে বিশেষরূপে উল্লেখ করিয়াছি।

৬। বরদীয়া। রাজস্ব ৯০৭ টাকা ১২ আনা ২ দাম।

৭। টুবা। রাজস্ব ২৬২২ টাকা ১২ আনা।

৮। চাঁদপুর। রাজস্ব ৩০০০ টাকা।৬

৯। দক্ষিণ সাহাপুর। রাজস্ব ৫৯৯ টাকা ১২ আনা।

১০। রায়পুর। রাজস্ব ১১৩ টাকা ৬ আনা।

১১। সিংহেরগাঁও। রাজস্ব ৮৫০৯ টাকা ২ আনা। ॥৪২৫॥

১২। শকদি (শকড়ি)। রাজস্ব ৪৬১৯ টাকা ৮ আনা।

১৩। শিরচাল। রাজস্ব ৩২৫ টাকা

১৪। করদী। রাজস্ব ২২৩৯ টাকা বার আনা। অধুনা এই পরগণা মহবৎপুরের কুক্ষি প্রবিষ্ট হইয়াছে।

১৫। মেহেরকুল। রাজস্ব ২৫৯৮৬ টাকা ১২ আনা।

১৬। মেহার। রাজস্ব ১৫২০ টাকা৯।

১৭। মহীচাল। রাজস্ব ৬২৫ টাকা। ॥৪২৬।

১৮। নারায়ণপুর। রাজস্ব ২৩৫১৯ টাকা।১০

১৯। হুমনাবাজু। (হুসনাবাদ) রাজস্ব ৭০৩২ টাকা।১১ ॥৪২৮।।

এই সকল মহালের মধ্যে কতকগুলো সাক্ষাৎ সম্বন্ধে ত্রিপুরেশ্বরের করতলস্থ ছিল। অবশিষ্টগুলি সামতি নরপতি ও জমিদারগণের অধিকারভুক্ত ছিল। জমিদারগণ নিয়মিত রূপে ত্রিপুরাপতিকে কর দান করিতেন এবং সামন্ত নরপতিগণ ত্রিপুরেশ্বরের অধীনতা স্বীকার করিতেন। বলদাখালের অধিপতি ঈশা খাঁ কিয়ৎ পরিমাণে ত্রিপুরেশ্বরের অধীন ছিলেন। তুডরমল্ল যৎকালে রাজস্বের হিসাব প্রস্তুত করেন, তৎকালে আবুল ফজল ত্রিপুরাকে স্বাধীন রাজ্য বলিয়া বর্ণনা করিয়াছেন। ইংরজ বণিক ও ভ্রমণকারী রলফ ফিচের বর্ণনা দ্বারা আবুল ফজলের লিখিত বিবরণ সত্য বলিয়া প্রমাণিত হইতেছে।

মোগল সম্রাট জাহাগীরের আদেশ অনুসারে বাঙ্গালার নবাব ত্রিপুরা আক্রমণ করেন। এই সময় ত্রিপুরার সমতল ॥৪২৮॥ ক্ষেত্ৰপ্ৰকৃত পক্ষে মোগল সাম্রাজ্যভুক্ত হইয়াছিল। যে সকল পরগণা সামন্ত নরপতি কিম্বা জমিদারগণের অধিকারে ছিল, তাহা চিরকালের তরে ত্রিপুরেশ্বরদিগের করচ্যুত হইল। যাহা সাক্ষাৎ সম্বন্ধে ত্রিপুরেশ্বরের করতলস্থ ছিল, তাহা মোগলগণ অধিকার করিয়া লইলেন। সেই অংশ “সরকার উদয়পুর” আখ্যা প্রাপ্ত হয়। এই সরকার ৪টি পরগণায় বিভক্ত হইয়াছিল। নুরনগর, মেহেরকুল ব্যতীত অন্য দুইটি পরগণার নাম আমরা নির্ণয় করিতে পারি নাই। তৎকালে এই সরকারের রাজস্ব ৯৯৮৬০ টাকা অবধারিত হয়।

ধর চৌধুরী বংশের বংশাবলীর মতে ১০০৯ ত্রিপুরাব্দে (১৫৯৯ খ্রিস্টাব্দে) ত্রিপুরার সমতল ক্ষেত্র মোগল সাম্রাজ্যভুক্ত হইয়াছিল। মতান্তরে ১০২৩ কিম্বা ১০৩০ ত্রিপুরাব্দে এই ঘটনা হইয়াছিল। ত্রিপুরা একাদশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে অর্থাৎ ১০০৯ এবং ১০৩৫ ত্রিপুরাব্দের মধ্যকালে এই ঘটনা হইয়াছিল। এই সময় সরাইল পরগণাটী মহারাজের হস্তচ্যুত হয়। সরাইলের পূর্ব ও দক্ষিণ এবং লৌহগড়ের উত্তর দিকস্থ ভূভাগ মোগলাধিকারের পূবের্ব হিউং, বিউং ও কৈলারগড় নামক তিন ভাগে বিভক্ত ছিল। সরকার উদয়পুরের প্রথম শাসন কর্ত্তা নুরুল্লা খাঁ (বা নুরুল্লাবেগ) সেই তিন ভাগ একত্র করিয়া স্বীয় নাম অনুসারে তাহাকে নুরনগর আখ্যা প্রদান করেন১২। এইরূপে নুরনগর পরগণা সৃষ্টি ॥৪৩০। হইয়াছিল। ত্রিপুরার তদানীন্তন প্রধান নগরী নুরনগর আখ্যা প্রাপ্ত হয়। অধুনা সেই স্থান কসবা নামে পরিচিত। মোগল শাসন কর্ত্তা নুরুল্লা স্বীয় সহচর, কায়স্থ জাতীয় রামধর (প্রকাশ্য কায়েত রামধর) কে নুরনগরের চৌধুরীর১৩ পদে নিযুক্ত করেন। চৌধুরী রামধর নুরনগরে তালুকদারি প্রথা প্রবর্তিত করেন।

এই সময় মোগলগণ ত্রিপুরার সমতল ক্ষেত্রে কতকগুলি মুসলমান জমিদার নিযুক্ত করেন।

১০৩৫ ত্রিপুরাব্দে মহারাজ কল্যাণ মাণিক্য সিংহাসনে আরোহণ পূর্বক মোগলদিগের হস্ত হইতে সরকার উদয়পুরের উদ্ধার সাধন করেন। কিন্তু অন্যান্য পরগণাগুলি উদ্ধার করিতে পারেন নাই।

মোগল সম্রাট সাহ জাহনের শাসনকালে, বাংলার শাসনকর্তা সুলতান সুজা মহারাজ কল্যাণ মাণিক্য হইতে কর ॥৪৩০॥ গ্রহণ করিয়াছেন। ১৬৫৮ খ্রিস্টাব্দে সুজা যে জমা তুমারি প্রস্তুত করেন, তাহাতে সরকার উদয়পুরের অন্তর্গত ৪টি পরগণার রাজস্ব ৯৯৮৬০ টাকা লিখিত আছে।

কল্যাণ মাণিক্যের জ্যেষ্ঠপুত্র গোবিন্দ মাণিক্য মোগলদিগের করতলস্থ ছিলেন। কিন্তু তাঁহার কনিষ্ঠ ভ্রাতা ছিল মাণিক্য স্বাধীন ভাবে সিংহাসনে আরোহণ করত করদান করিতে বিরত হইলেন। মহারাজ গোবিন্দ মাণিক্যের পুত্র রাম মাণিক্য কিম্বা তৎপুত্র রত্ন মাণিক্য কখন স্বাধীন ও কখন অধীন ভাবে রাজ্য শাসন করিযাছিলেন। “সরকার উদয়পুরের” রাজস্ব উল্লেখে তাহারা স্বেচ্ছাপূবর্বক এক কপদকও বাঙ্গালার নবাবকে প্রদান করেন নাই। মহারাজ রত্ন মাণিক্য বাঙ্গালার নবাব মুরশিদ কুলি খাঁকে প্রতি বৎসর নানাপ্রকার উপঢৌকন প্রদান করিয়াছেন।

১৭৯৪ খ্রিস্টাব্দে ধৰ্ম্ম মাণিক্য সিংহাসনে আরোহণ করেন। ইহার অল্পকাল অন্তে মোগল সৈন্য ত্রিপুরার সমতল ক্ষেত্র লুণ্ঠন পূর্বক তদানীন্তন রাজধানী উদয়পুরে উপনীত হইল। মহারাজ প্রথমত তাহাদের সহিত সন্ধি সংস্থাপনে যত্নবান হইয়াছিলেন। পশ্চাৎ তাহাদের অত্যাচারে জ্বালাতন হইয়া একটি আশ্চর্য্য কৌশল অবলম্বন করেন। একদা পান ভোজন জন্য মোগলদিগকে রাজ ভবনে আহ্বান করা হয়। যথাকালে তাহারা মদিরা পানে উন্মত্ত হইলে দ্বার বন্ধ করিয়া ॥৪৩১॥ ত্রিপুর সৈন্যগণ তাহাদের অন্তেষ্টিক্রিয়া সম্পাদন করিয়াছিল। যাঁহারা মদিরা পান করেন নাই কেবল তাঁহারাই প্রাচীর উলঙ্ঘন পূর্বক প্রাণরক্ষা করিয়াছিলেন। যদিচ ধর্ম্মমাণিক্য একপ্রকার কৌশলে জয় লাভ করত স্বাধীনতা ঘোষণা করিলেন, কিন্তু এই সময় কয়েকটি পরগণা তাহার হস্তচ্যুত হয়। সেই সকল স্থানে মোগল জমিদার নিযুক্ত করা হইয়াছিল।

উল্লেখিত ঘটনার অল্পকাল পরে বাংলার নবাব ধর্ম্ম মাণিক্যের সহিত যে সন্ধি করেন, তাহাতে কেবলমাত্র পরগণা নুরনগরের জন্য বার্ষিক ২৫ হাজার টাকা ধার্য্য হয়। সম্রাট তাহাও সামরিক জায়গীর উল্লেখে বাদ দিয়াছিলেন।

১৭৩২ খ্রিস্টাব্দে ঢাকা নেয়াবেতের দেওয়ান মীর হবিব ছত্রমাণিক্যের প্রপৌত্র জগৎ রাম ঠাকুরের সাহায্যে ধর্ম্ম মাণিক্যকে জয় করিয়া ত্রিপুরার সমতল ক্ষেত্র অধিকার করেন। নবাব এই সংবাদ শ্রবণ পূর্বক বিজিত প্রদেশকে “রোসনাবাদ” আখ্যা প্রদান করিয়াছিলেন এবং রোসনাবাদ বাঙ্গালার রাজস্বের হিসাবে একটি অতিরিক্ত চাকলা বলিয়া গৃহীত হয়। জগত্তাম “রাজা জগৎ মাণিক্য” আখ্যা ধারণ পূর্বক রোসনাবাদের প্রথম জমিদার হইলেন। তৎকাল ॥৪৩২॥ চাকলে রোসনাবাদের রাজস্বের নিম্নলিখিতরূপ ধাৰ্য্য হইয়াছিল।

মহাল … রাজস্ব

রোসনাবাদ বাদ … ৯২৯৯৩
সামরিক জায়গীর নুরনগরের রাজস্ব … ২৫০০০
পর্বত হইতে হস্তী ধৃত করিবার খরচ … ২০০০০
———————————————-
৪৫০০০
——————————————-
৪৭৯৯৩

মহারাজ ধর্ম্মমাণিক্য মুরশিদাবাদ গমন করত নবাব সমক্ষে অধীনতা স্বীকার পূর্বক অল্প জমায় চাকলে রোসনাবাদ জমিদারী স্বরূপ পাওয়ার প্রার্থনা করেন। নবাব সুজাউদ্দিন তদনুসারে রোসনাবাদের বার্ষিক রাজস্ব পঞ্চ সহস্র মুদ্রা অবধারণ করত ধৰ্ম্মমাণিক্যকে প্রদান করিবার জন্য ঢাকার নবাবের প্রতি আদেশ করেন। প্রকৃত পক্ষে তৎকালে রোসনাবাদের রাজস্ব ৫০০০০ টাকা ধার্য্য হয়, তন্মধ্যে উল্লেখিত ৪৫০০০ টাকা বাদে অবশিষ্ট ৫০০০ টাকা প্রদান করা হইত ॥৪৩৩

রোসনাবাদ ব্যতীত ত্রিপুরার পরগণা সমূহ অন্যান্য জমিদারের অধিকারভুক্ত ছিল, তাহার তালিকা নিম্নে উদ্ধৃত হইল।

জমা তুমারি তকছিছি (বা তসখিসি) মোতালকে চাকলে জাহাগীর নগর। সন ১১৩৫ ফসলি (বঙ্গাব্দ)।

রাজস্ব বিভাগ :-

১। উত্তর সাহাপুর। রাজস্ব ৮৬৮৩ টাকা। কায়স্থ কুলজ শ্যাম বংশীয় চৌধুরীগণ এই পরগণার প্রাচীন জমিদার।

২। দুল্লাই : রাজস্ব ৪৭২৩ টাকা।

৩। দক্ষিণ সাহাপুর : রাজস্ব ৩৪১৭ টাকা।

৪। গঙ্গামণ্ডল : রাজস্ব ১৬৪৮৯ টাকা।

৫। লৌহগড় : রাজস্ব ৪৬৯০ টাকা।

এই দুইটি পরগণা বলদাখালের জমিদার আকা সাদেককে প্রদত্ত হইয়াছিল। ১১৭০ সালে তাঁহার কনিষ্ঠ পুত্র মির্জা জাফর এই দুইটি পরগণার অধিকারী ছিলেন। তিনি লৌহগড় পরগণাকে জাফরাবাদ আখ্যা প্রদান করেন। ১১৯৮ বঙ্গাব্দে এই দুইটি পরগণা শোভা বাজারের রাজা নরকৃষ্ণ বাহাদুর ক্রয় করেন।

৬। গুণানন্দী : রাজস্ব ১১৮১০ টাকা। ভরদ্বাজ গোত্রজ গুণার্ণব নামক জনৈক ব্রাহ্মণ এই পরগণার আদি জমিদার। মোগলদিগের অত্যাচারে গুণার্ণবের উত্তর পুরুষ ॥৪৩৪ উহার জমিদারী স্বত্ব পরিত্যাগ করেন। তদনন্তর বিষ্ণুবংশীয় কায়স্থ রামচন্দ্র চৌধুরী এই জমিদারী প্রাপ্ত হন। তাঁহার উত্তরপুরুষগণের জমিদারী ব্রিটিসাধিকার কালে নিলামে বিক্রয় হইয়াছে। হরিণা গ্রামে তাঁহাদের বাসভবনের চিহ্ন ও কীর্তি কলাপের ভগ্নাবশেষ অদ্যাপি দৃষ্ট হইয়া থাকে।

৭ : গোপালনগর ৬১৫ টাকা।

৮ : হোমনাবাদ। রাজস্ব ২৬৮১৭ টাকা। পূর্বে বর্ণিত হইয়াছে যে, প্রথমত দে তদনন্তর দাসবংশীয়গণ এই পরগণার জমিদার ছিলেন। তৎপর মোগল সম্রাট সাহা আলমের (বাহাদুর সাহার) শাসনকালে কোরেসী বংশীয় সাহাজাদা জাহান্দরের (অন্য নাম আমির মির্জা আগোয়ান খাঁ) পুত্র আমির মির্জা আব্রু খাঁ এই পরগণার জমিদারী প্রাপ্ত হন। তাঁহার উত্তরপুরুষগণ মধ্যে এই পরগণা বহু অংশে বিভক্ত হইয়াছিল। ১১৭০ সালে এই পরগণার মালিকের স্থলে তাঁহার উত্তরপুরুষ “দৌলত, জালাল, বক্স” এই তিনটি নাম লিখিত আছে। তাঁহাদের পুরুষ সন্তান মধ্যে চৌধুরী ইউছপ আলী অদ্যাপি এই পরগণার কিয়দংশ ভোগ করিতেছেন। উক্ত চৌধুরী সাহেবের দানশীলা ভগিনী “সবাব সাহেবা” ফয়েজন্নেছা স্বীয় পিতা, মাতা এবং স্বামীর উত্তরাধিকারিণী বলিয়া এই পরগণার বিশিষ্ট ॥৪৩৫। প্ৰাপ্ত হইয়াছে[১৪]। সাহাপুরের বিখ্যাত সৈয়দ বংশীয় চৌধুরী বসরত আলী

দৌহিত্র সূত্রে এই পরগণার কিয়দংশ প্রাপ্ত হইয়াছেন। অন্যান্য অংশ ক্রমে বিক্রীত হইয়া অন্যান্যের হস্তগত হইয়াছে[১৫]। ॥৪৩৬

৯ : করদী। রাজস্ব ৩০৫৮ টাকা।

১০ : কাশীমাপুর রাজস্ব ২৯৪৮ টাকা।

১১ : মাছুয়াখান।

১২ : এততাদপুর। রাজস্ব ২৭৩৬ টাকা।

কায়স্থ নাগ চৌধুরীগণ এই তিনটি পরগণার প্রাচীন জমিদার ছিলেন। ১১৭০ সালের তুমর জমাতে উক্ত বংশজাত নরোত্তম চৌধুরীর নাম লিখিত রহিয়াছে। তাঁহার উত্তর পুরুষগণ অদ্যাপি ইহার কিয়দংশ ভোগ করিতেছেন। কাশিমপুরের চৌধুরী বাটী দর্শন করিলে বোধ হয় ইহারা বিশেষ পরাক্রমশালী ছিলেন, ইহাদের বাস ভবন একটী সুদৃঢ় দুর্গের ন্যায় পরিলক্ষিত হয়। ইহার চতুদিকস্থ ১৬টা পরিখার চিহ্ন অদ্যাপি দৃষ্ট হইয়া থাকে।

১৩ : কাদবা। রাজস্ব ৯৯২৬ টাকা। সংস্কৃত

১৪ : আনিবাবাদ। রাজমালা গ্রন্থে লিখিত।

১৫ : বেজবাবাদ আছে যে, বাঙ্গালার শাসন কর্তা -দিল্লীর সম্রাট পুত্র (আজিম ওশ্মান?) ছত্র মাণিক্যের পুত্র উৎসব রায়কে (বৃত্তি স্বরূপ) এই জমিদারী দান করিয়াছিলেন। ১১৩৫ সালের জমা তুমারীতে এই জমিদারীর মালিকী ॥৪৩৭॥ স্থলে উৎসব রায়ের পুত্র রাজা বিজয়নারায়ণ রায়ের নাম লিখিত আছে। ক্রমে বিজয় নারায়ণের বংশধরগণ এই পরগণা ক্রয়ের অধিকার চ্যুত হইয়াছেন। কেবল অল্প কয়েকজনের কিঞ্চিৎ মালিকী উপস্বত্ব মাত্র রহিয়াছে। জমিদারীটি প্রথমত মহারাজ কাশীচন্দ্র মাণিক্য বাহাদুরের মেনেজার কোরজান সাহেবের হস্তগত হয়। অধুনা ইহা কলিকাতা নিবাসী মহারাজ দুর্গাচরণ লাহা ক্রয় করিয়াছেন।

১৬ : মহবৎপুর। ৬০৫৬ টাকা। সিংহেরগাঁও পরগণার কিয়দংশ এবং বরদীয়া ও বোয়ালীয়া পরগণা লইয়া এই পরগণা নূতন গঠিত হয়। ঢাকা নিবাসী “সেখ সাহেব” নামে পরিচিত জনৈক মুসলমান নবাব হইতে এই পরগণা প্রাপ্ত হন। তাঁহার উত্তরপুরুষগণ তাঁহাদের প্রধান কর্মচারীগণকে বেতনের পরিবর্ত্তে এক একটা বৃহৎ তালুক প্রদান করেন। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সময় এই সকল তালুক খারিজ হইয়া ছিল১৬। মূল জমিদারী ও সেই সকল তালুক ক্রমে নিলাম হইয়া যাইতেছে। ॥৪৩৮॥

১৭ : মহীচাল। রাজস্ব ৩৩২২ টাকা। এই পরগণার আদি জমিদারবংশের বিবরণ প্রাপ্ত হওয়া যায় না। আমাদের বিবেচনায় দত্ত চৌধুরীগণ ইহার প্রাচীন জমিদার ছিলেন। প্রায় দুই শতাব্দী অতীত হইল ব্রাহ্মণ বংশীয় জয়দেব রায় চৌধুরী নবাব সরকার হইতে এই পরগণার জমিদারী প্রাপ্ত হন। ১১৩৫ সালর তুমার জমাতে জয়দেবের পুত্র নরসিংহ রায় চৌধুরীর নাম লিখিত আছে। নরসিংহ রায়ের অধস্তন ষষ্ঠ, সপ্তম, অষ্টম পুরুষ এক্ষণ জীবিত আছেন। এই পরগণার অতি সামান্য অংশ এক্ষণ উহাদের হস্তে আছে। অধিকাংশ নীলাম ও বিক্রয় হইয়া অন্যের হস্তগত হইয়াছে।

১৮ : মেহার। রাজস্ব ৭৮৯৪ টাকা। দাস রাজবংশের পর একটি মুসলমান বংশ এই পরগণাটি প্রাপ্ত হন। ১১৩৫ সালের তুমার জমাতে সেই মুসলমান বংশজাত “হিংরাজ দুনা” নামক ব্যক্তিগণের নাম লিখিত আছে। ক্রমে তাঁহারাও হৃতসর্বস্ব হইয়াছেন। অধুনা এই পরগণা বহু অংশে বিভক্ত হইয়া ভিন্ন ভিন্ন ব্যক্তির হস্তগত হইয়াছে। কলিকাতার ঠাকুর বংশের কোন ব্যক্তি ইহার একটি বৃহৎ অংশ খরিদ করিয়াছেন।

১৯ : নারায়ণপুর। রাজস্ব ৩২৮৪ টাকা।

২০ : নয়াবাদ। রাজস্ব ৩০৫১ টাকা। কায়স্থ শ্যাম ॥৪৩৯॥ চৌধুরীগণ ইহার আদি জমিদার। চাঁদ ও গজেন্দ্র নামে দুই ভ্রাতা ছিল। চাঁদেরচর গ্রামে ইহারা বাস করিতেন। চাঁদের বংশধরগণ উত্তর-সাহাপুর প্রাপ্ত হন। গজেন্দ্রর বংশধরগণ নয়াবাদ প্রাপ্ত হইয়াছিলেন। চাঁদের বংশধরগণ অদ্যাপি উত্তর সাহাপুরের কিয়দংশ ভোগ করিতেছেন। কিন্তু গজেন্দ্রের বংশধরগণ নয়াবাদটি হারাইয়াছেন। ইতিপূর্বে কাশিমপুর মাছুয়াখাল প্রভৃতি মহালের প্রাচীন জমিদার নাগ বংশের কথা উল্লেখ করা হইয়াছে। সেই বংশের একটি কনিষ্ঠ শাখা বারদী গ্রামে বাস করিতেছেন, তদ্বংশজাত এক ব্যক্তি এই পরগণাটি ক্রয় করেন। এক্ষণ তাঁহার উত্তর পুরুষগণ এই পরগণা ভোগ করিতেছেন।[১৭]

২১ : পাইটকাড়া রাজস্ব ২২৩৭৭ টাকা। মিরহবিবের ত্রিপুরা বিজয় কালে মোগলগণ এই পরগণাটি অধিকার করত বলদাখালের জমিদার আকা সাদেককে প্রদান করেন। ১১৭০ সালের বন্দোবস্তী কাগজে উক্ত পরগণার মালিকীস্থলে জমিদার (আকা সাদেকের পুত্র) মির্জা আবদুল হুসমত (প্রকাশ্য আকা নবি) নাম লিখিত আছে। সেই জমিদার ॥৪৪০॥ বংশ হৃতসবর্বস্ব হইয়াছেন। কলিকাতা নিবাসী বিখ্যাত “প্রিন্‌স” দ্বারকনাথ ঠাকুর এই পরগণাটি ক্রয় করেন। তাঁহার মৃত্যুর পর ভূকৈলাসের ঘোষাল রাজগণ এই পরগণা ক্রয় করিয়াছেন।

২২ : রায়পুর। রাজস্ব ৮৬৪ টাকা।

২৩ : সিংহেরগাঁও। রাজস্ব ১৪৩৯৭ টাকা। সিংহ বংশের একটি শাখা রুসা গ্রামে বাস করতেন। ইঁহারা ২ আনা ১১ গণ্ডা হিস্যার মালিক ছিলেন। কোন কারণে তাঁহারা মুসলমান ধৰ্ম্ম গ্রহণ করেন। রূসার বর্তমান মুসলমান জমিদারগণ সেই বংশের দৌহিত্র। ক্রমে ইহারা সিংহেরগাঁও পরগণার আরও কতকগুলি অংশ খরিদ করিয়াছিলেন। সিংহেরগাঁও পরগণার মধ্যে ইহারাই এক্ষণ প্রধান জমিদার। করৈতলীর বসু জমিদারগণ সিংহ বংশের একটি দৌহিত্র শাখা হইতে উদ্ভুত। মূল জমিদার সিংহ বংশের অবস্থা এক্ষণ শোচনীয়।

২৪ : শ্যামপুর। রাজস্ব ২২৪৯ টাকা।

২৫ : শ্রীচাল (সিরচাইল) রাজস্ব ১৩২১ টাকা।

২৬ : সিঙ্গাইর। রাজস্ব ৩৫১৬ টাকা।

২৭ : শকদী রাজস্ব ২৯৪২ টাকা

২৮ : টোরা। রাজস্ব ১৪৩৮১ টাকা।

২৯ : চৌদ্দগাঁও। রাজস্ব ১৬০২ টাকা। রোসনাবাদ মধ্যে চৌদ্দগাঁও নামে অন্য একটি পরগণা আছে। এই জন্য ইহাকে “ঝলম চৌদ্দগাঁও” বলে। ১১৭০ সালে “মধু” নামক একব্যক্তি এই পরগণার জমিদার ছিলেন। ক্রমে ইহা বহু অংশে বিভক্ত হইয়া ভিন্ন ভিন্ন ব্যক্তির হস্তগত হইয়াছে।

সামরিক (নেজামত) বিভাগ।[১৯]

১। বলদাখাল। খালিসা জমা ৮৮৯৩ টাকা জায়গীর ৭৪৯৫০ টাকা। মেট ৮৩৮৪৩ টাকা।

পূর্বে বর্ণিত হইয়াছে যে, মোগল সম্রাট আকরের শাসনকালে এই পরগণা ইশা খাঁ মছনদে আলীর অধিকার ভুক্ত ছিল। আলমগীর (আঔরজেব) পাদসাহের ৪৪ জুলুসের (১৭০০ খ্রিস্টাব্দের), বাঙ্গালার নবাব নাজেম সাহাজাদা মাহাম্মদ আজিমের (প্রকাশ্য আজিম ওশ্মানের) এক খণ্ড “পরওয়ানা” পাঠে জ্ঞাত হওয়া যায় যে, তৎকালে বলদাখাল (ইশা খাঁ মছনদে আলীর উত্তর পুরুষ) দেওয়ান হয়বৎ মাহাম্মদ খাঁর ॥৪৪২॥ অধিকার ভুক্তছিল২০। ইহার অল্পকাল পরে আকা সাবেক পরগণাটি প্রাপ্ত হইয়াছিলেন। মির হবিবের ত্রিপুরা আক্রমণ কালে আকা সাদেক ইহার অধিকারী ছিলেন। আকা সাদেকের তিন পুত্র, জ্যেষ্ঠ মির্জা মাহাম্মদ এব্রাহিম, দ্বিতীয় মির্জা আবদুল হুসন (আকা নবি), কনিষ্ঠ মির্জা মাহাম্মদ জাফর। জ্যেষ্ঠ মির্জা মাহাম্মদ এব্রাহিম পরগণে বলদাখাল ও তদন্ত গত তপে কুড়িখাই প্রভৃতি প্রাপ্ত হন। দ্বিতীয় আবদুল হুসন পাইটকাড়া ও অন্যান্য কয়েকটি মহাল প্রাপ্ত হন। সর্ব কনিষ্ঠ মাহাম্মদ গাফর গঙ্গামণ্ডল ও লৌহগড় প্রাপ্ত হইয়াছিলেন।

মির্জা মাহাম্মদ এব্রাহিমের কোন পুত্র সন্তান জন্মে নাই। কেবল তিনটি কন্যা মাত্র ছিল। তাঁহারা তুল্যাংশে পৈত্রিক পত্তি ভাগ করিয়া লইয়াছিলেন, যথা :-

মির্জা মাহাম্মদ এব্রাহিম (প্রকাশ্য মির্জা ভেলা)

মির্জা মাহাম্মদ এব্রাহিম (প্রকাশ্য মির্জা ভেলা)

কনিষ্ঠা কন্যার পতি মির্জা হুসন আলি কালী— উপাসক ছিলেন। তাঁহার হৃদয়ে সংসার বৈরাগ্য উপস্থিত হইলে তিনি তাঁহার প্রাপ্য অংশের অর্দ্ধাংশ (২১৩।/ ক্রান্ত) মির আসরফ আলীকে দান করেন। তদনুসারে মির আসরফ আলী ও তাঁহার পত্নী বলদাখালের অর্দ্ধাংশের মালিক হন। তাঁহাদের এই অংশ বাকী রাজস্বের জন্য ১৮৩৫ খ্রিস্টাব্দে নীলাম হইলে, গবর্ণমেন্ট তাহা ১৯৫০০০ টাকা মূল্যে ক্রয় করেন। তদনন্তর মির্জা হুসন আলীর ২১৩।/ ক্রান্ত অংশ বাকী রাজস্বের জন্য ১৮৩৬ খ্রিস্টাব্দে নিলাম হইলে গবর্ণমেন্ট ৬৫০৬৬ টাকা মূল্যে ক্রয় করেন।

অবশিষ্ট।/৬॥//ক্রান্ত অংশের অধিকারী মাহাম্মদ ইব্রাহিমের দ্বিতীয় কন্যার বংশাবলী (বিহার), পাটনার নবাববংশের সহিত এক সূত্রে গ্রথিত; যথা :-

মাহাম্মদ ইব্রাহিমের দ্বিতীয় কন্যার বংশাবলী

রৌসন-আরা খানম স্বাধীন প্রকৃতি সম্পন্না রমণী ছিলেন। তাঁহার স্বামী মির্জ্জা মাহাম্মদ বাখর, তাঁহার আচরণে নিতান্ত বিরক্ত হইয়া একদিবস তাঁহাকে “বাইজী” বলিয়া উপহাস করেন। খানম স্বামীর উপহাস বাক্য শ্রবণে ক্রোধে দগ্ধ হইয়া বলিলেন, “আমার পিতার ভবনে[২২] বসিয়া আমাকে অপমানিত করিতেছ। এখনই আমার বাস ভবন হইতে বাহির হইয়া যাও।” মাহাম্মদ বাখর সেই বাক্য শ্রবণে তৎক্ষণাৎ স্বীয় শিশু পুত্রটিকে লইয়া পাটনায় গমন করিলেন। তদনন্তর তিনি গবর্ণমেন্টের অধীনে সৈন্য বিভাগে কার্য্য করিয়া জীবন যাপন করিয়াছিলেন। পুত্র মাহাম্মদ কাজেম আপনাকে মাতৃহীন বলিয়া জানিতেন। তিনি বয়ঃ প্রাপ্ত হইয়া তৎকালে বিষয় কর্মের অনুসন্ধান করিতেছিলেন সেই সময় জনৈক প্রাচীন ভৃত্যের নিকট শ্রুত হইলেন যে, তাঁহার মাতা জীবিত আছেন এবং তিনি অতুল সম্পত্তির অধিকারিণী, মাহাম্মদ কাজেমই তাঁহার একমাত্র পুত্র ও সম্পত্তির উত্তরাধিকারী। এই সংবাদ শ্রবণ করিয়া তিনি মাতার নিকট গমন করিবার জন্য ব্যাকুল হইলেন। একদা পিতার সমক্ষে স্বীয় অভিপ্রায়ে প্রকাশ করিলেন। তৎশ্রবণে পিতা বলিলেন” বৎস তুমি কখনও সেই পাপীয়সীর নিকট গমন করিও না।” পুত্র পিতার বাক্য অগ্রাহ্য করত পলায়ন পূর্বক মাতার নিকট উপস্থিত হইলেন। মাতা পুত্রকে স্নেহের সহিত ক্রোড়ে গ্রহণ করিলেন, কিন্তু যে সম্পত্তির লোভে পুত্র পিতার বাক্য অবহেলন পূর্বক মাতার নিকট আসিয়াছিলেন, মাতা পূর্ণাবস্থায় পুত্রকে সেই সম্পত্তি প্রদান করিতে পারিলেন না। যে সম্পত্তি প্রাপ্ত হইলে অদ্য তাঁহার পৌত্র এবং দৌহিত্র (পাটনার নবাব) গণ বার্ষিক ৪/৫ লক্ষ টাকা উপস্বত্ত্বলাভ করিতেন, মাতা তাঁহার অধিকাংশ বিনষ্ট করিয়া ফেলিয়াছেন; তিনি তাঁহার দুশ্চরিত্র কর্মচারিগণের সাহায্যে পরগণার ।০ অংশ বিক্রয় করিয়া ফেলিয়াছেন[২৩]। অবশিষ্ট ॥৪৪৭॥ ৬॥/৪ দন্তী অংশমাত্র রৌসনআরা খানম পুত্র প্রদান করিলেন। তাহাও ক্রমে ক্রমে সেই পুত্রের উত্তরাধিকারিগণের হস্তচ্যুত হইতেছে। চঞ্চলার ক্রিয়া এরূপই বটে।

গবর্ণমেন্ট বলদাখালের ॥২১৩।/ ক্রান্ত অংশ খরিদ করেন, ইহা পূর্বে উল্লেখ করা হইয়াছে। তাহার অধিকাংশ খণ্ড খণ্ড করিযা ১৮৬২-৬৩ খ্রিস্টাব্দে গবর্ণমেন্ট বিক্রয় করিয়াছেন। অধুনা নবাব খাজে আবদুল গণি বাহাদুর এই বৃহৎ পরগণার প্রায় তৃতীয়াংশের অধিকারী হইয়াছেন।

২। সরাইল- সতরখণ্ডল। খালীসা ও জায়গীর জমা ১১১০৮৪ টাকা।

পূর্বে বর্ণিত হইয়াছে যে, সম্রাট আকবরের পূর্বে সরাইল ॥৪৪৮॥ পরগণার কিয়দংশমাত্র শ্রীহট্ট সরকারের অন্তর্ভুক্ত হইয়াছিল।” ১০০৯ হইতে ১০৩৫ ত্রিপুরাব্দের মধ্যবর্তী কালে সমগ্র সরাইল পরগণা মোগল সম্রাটের কুক্ষি প্রবিষ্ট হয়। তৎকালে ঈশা খাঁ মছনদে আলীর জনৈক বংশধর- দেওয়ান মজলিস খাজি এই পরগণা জমিদারি স্বরূপ প্রাপ্ত হন। তাঁহার বংশাবলী ৪৫০ পৃষ্ঠায় প্রকাশ করা গেল।

প্রথম অবস্থায় সরাইল পরগণা শ্রীহট্ট চাকলার অধীন ছিল। দেওয়ান সাহেবগণ তাঁহাদের দেয় রাজস্ব শ্রীহট্টের আমিল নিকট প্রেরণ করিতেন। সম্রাট আঔরংজেবের শাসনকালে বাঙ্গালার নবাব সায়েস্তা খাঁ পর্তুগীজ ও মগ বোম্বাটীয়াদিগের অত্যাচার নিবারণ জন্য খিজিরপুরে[২৪] “নাউরা” (সমরতরী) বিভাগ সংস্থাপন করেন। এই বিভাগের ব্যয় নির্বাহ জন্য ক্ষুদ্র ও বৃহৎ ১১২টী মহালের রাজস্ব ৮৪৩৪৫২ টাকা “উমলে নাউরা” নামে নির্দ্দিষ্ট হইয়াছিল। এই সময় সরাইল—সতরখণ্ডল, চাকলে শ্রীহট্ট হইতে খারিজ হইয়া ঢাকা নেয়াবতের নেজামত সেরেস্তাভুক্ত হয়। সরাইলের জমিদার খালিসা অংশের রাজস্ব নেজামত সেরেস্তায় দাখিল করিতেন। কিন্তু জায়গীর অংশের রাজস্ব দ্বারা। ॥৪৪৯॥ ৪০ খানা কোস নৌকা সংগ্রাম কালে নবাবের আদেশানুসারে উপস্থিত রাখিতে বাধ্য ছিলেন।

দেওয়ান

পূর্বে বর্ণিত হইয়াছে যে, আকবরের পূর্বে সরাইল পরগণার একটি ক্ষুদ্র অংশ (সতরখণ্ডল) মুসলমানদিগের কুক্ষি প্রবিষ্ট হয়। ১০০৯ ত্রিপুরাব্দের পর সমগ্র সরাইল মোগলদিগের অধিকৃত হইয়াছিল। কিন্তু তিতাস নদীর পূর্বদিকস্থিত ভূখণ্ড তৎকালে সরাইলের সীমারেখার অন্তর্ভুক্ত হয় নাই। দেওয়ান নুর মাহাম্মদের পুত্র দেওয়ান নাছির মাহাম্মদ সেই অংশ ত্রিপুরেশ্বর মহারাজ (দ্বিতীয়) ধর্মমাণিক্য হইতে দান প্রাপ্ত হইয়াছিলেন। তৎসম্বন্ধে সরাইলে একটি আশ্চর্য্য প্রবাদ প্রচলিত আছে।

একদা নাছির মাহাম্মদ মৃগয়া করিবার জন্য ত্রিপুরা পর্বতে গমন করেন। জনৈক ত্রিপুর রাজকুমারও সেই স্থানে শিকার করিতে আসিয়াছিলেন, তাহা নাছির মাহাম্মদ জ্ঞাত ছিলেন না। ঘটনাক্রমে ও অজ্ঞাতসারে নাছির মাহাম্মদের নিক্ষিপ্ত গুলিতে রাজকুমার হত হন। রাজপুত্রের অনুচরগণ উল্লেখিত আকস্মিক ঘটনার বিবরণ অবগত হইয়া নাছির মাহাম্মদকে বধ করিতে উদ্যত হইল। নাছির নিরুপায় হইয়া পলায়ন পূর্বক পিতার নিকট উপস্থিত হইলেন। দেওয়ান নুরমাহাম্মদ সমস্ত বিবরণ অবগত হইয়া পুত্রকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করত ত্রিপুরেশ্বর সমক্ষে প্রেরণ ॥৪৫১॥ করিলেন। শৃঙ্খলাবদ্ধ নাছির মহারাজ ধর্ম মাণিক্যের সমীপে সরলভাবে সত্য ঘটনা প্রকাশ করিয়াছিলেন। ধর্ম পরায়ণ ধর্ম মাণিক্য তৎক্ষণাৎ শৃঙ্খল ছেদন পূর্বক জমিদার পুত্রকে মুক্তি প্রদান করিলেন। নাছির মাহাম্মদ মুক্তিলাভ করত করজোড়ে বলিলেন, “মহারাজ! এজগতে আমার স্থান নাই, যে পিতা আমাকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করিয়া আপনার নিকট পাঠাইয়াছিলেন, আমি সেই পিতার নিকট আর যাইব না। হয় মহারাজ আমাকে বধ করুন, নাহয় মহারাজ আমাকে আশ্রয় দান করুন!” সেই করুণ বাক্য শ্রবণে ত্রিপুরেশ্বর তাঁহাকে হর্ষপুর ডিহি দান করেন। নাছির মাহাম্মদ যে স্থানে স্বীয় বাস ভবন নির্মাণ করেন তাহা “নাছিরাবাদ” আখ্যা প্ৰাপ্ত হয়। ইহার আধুনিক অপভ্রংশ নাম “নিদারাবাদ”। অদ্যাপি সেই স্থানে প্রাচীন অট্টালিকা ও মসজিদের ভগ্নাবশেষ পরিলক্ষিত হয়।[২৫]

দেওয়ান নজর মাহাম্মদের দুই পুত্র। জ্যেষ্ঠ দেওয়ান নজমুদ্দিন হিং নয় আনা এবং কনিষ্ঠ দেওয়ান বক্সআলী ॥৪৫২ হিং সাত আনা প্রাপ্ত হন। এইরূপে প্রথমত সরাইল পরগণা দুই অংশে বিভক্ত হইয়াছিল। তৎকালে কোস নৌকার ও বিভাগ হইয়াছিল, তদনুসারে নয় আনার জমিদারি ২৩ কোসা ও সাত আনা জমিদারি ১৭ কোসা আখ্যা প্রাপ্ত হয়।

দেওয়ান নজমদ্দিনের এক পুত্র ও এক কন্যা জন্মে। সেই নয় আনা অংশ তাঁহাদের মধ্যে দুইভাগে বিভক্ত হইয়াছিল। পুত্র দেওয়ান জাফর আলী হিং পাঁচ আনা ১২ গণ্ডা ও চৌদ্দ কোসার জমিদার হইলেন এবং সেই কন্যার স্বামী দেওয়ান সুলতান মাহাম্মদ হিং তিন আনা আট গণ্ডা ও সাড়ে আট কোসার জমিদার হইলেন। দেওয়ান সুলতান মাহাম্মদের পুত্র (দেওয়ান নজমদ্দিনের দৌহিত্র) দেওয়ান মাহাম্মদের নাম ১১৭০ সালের বন্দোবস্তী কাগজে প্রাপ্ত হওয়া গিয়াছে ও সুতরাং দেখা যাইতেছে, যে সময় সরাইল শ্রীহট্ট হইতে খারিজ হইয়া ঢাকা নেয়াবতের অন্তর্ভুক্ত হয়, তৎকালে এই পরগণা উল্লেখিত তিনটি অংশে বিভক্ত হইয়াছিল।

ব্রিটিসাধিকারের আরম্ভে সরাইল পরগণা ময়মনসিংহ জেলা ভুক্ত হইয়াছিল। প্রচলিত শতাব্দী আরম্ভে মুরশিদাবাদ কাশিমবাজার নিবাসী বাবু জগবন্ধু রায় ময়মনসিংহ কালেক্টরিতে সেরেস্তাদারের কার্য্যে নিযুক্ত ছিলেন। ১৮০২ খ্রিস্টাব্দে দেওয়ান নাগরআলীর হিং পাঁচ আনা বার গণ্ডা অংশ বাকী ॥৪৫৩॥ রাজস্বের জন্য নিলাম হয়, তৎকালে সেরেস্তাদার মহাশয় কৌশলক্রমে যোগীরাম চৌধুরী নামত জনৈক মোক্তার দ্বারা অল্প মূল্যে তাহা ক্রয় করিয়াছিলেন। তাহার তিন বৎসর অন্তে তিনি স্বীয়পুত্র রামবাবু ও জয়বাবুর নাম আশ্চর্য্য উপায়ে সংযুক্ত করত “রামজয় রায়” নামে সেই মোক্তার হইতে একটি কবালা করিয়া লইয়াছিলেন। ১৮১৪ খ্রিস্টাব্দে পূর্বতন জমিদার সেই নিলাম রদের নালিস করিয়া জেলাকোর্টে জয়লাভ করেন। ১৮১৮ খ্রিস্টাব্দে সদর দেওয়ানী আদালত বাদীর মোকদ্দমা ডিসমিস করেন।

১৮৩১ খ্রিস্টাব্দে সরাইল পরগণা ত্রিপুরা জেলা ভুক্ত হয়। ১৮৩৬ খ্রিস্টাব্দে হিং সাত আনী বাকী রাজস্বের জন্য নিলাম হইলে জগবন্ধু বাবুর পৌত্র বাবু নরসিংহ রায় তাহা ক্রয় করেন।

১৮৪১ খ্রিস্টাব্দে দেওয়ান মছলন্দ আলী পরলোক গমন করেন। তিন আনা আট গণ্ডা অংশ তাঁহার দুই পুত্র বিভাগ করিয়া লইয়াছেন। জ্যেষ্ঠ দেওয়ান মনহরআলী বার আনা ও কনিষ্ঠ দেওয়ান ছমদদ্ আলী চার আনা প্রাপ্ত হন। ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দে দেওয়ান ছমদদ্ আলীর চার আনা হিস্যা তাঁহার স্ত্রীর কাবিনের দাবিতে বিক্রয় হইলে, মুনসী নাছিরউদ্দিন ক্রয় করেন। তদনন্তর তাহা বাবু মোহিনীমোহন বর্দ্ধন প্রভৃতির হস্তগত হইয়াছে। দেওয়ান মনহর আলীর মৃত্যুর পর ॥৪৫৪॥ তাঁহার স্ত্রী কাবিনের দাবিতে বার আনা অংশ বিক্রয় হইলে বাবু আশুতোষ নাথ রায় নাবালকের পক্ষে কোর্ট অব ওয়ার্ডের মেনেজার ক্রয় করিয়াছেন। সুতরাং খারিজা তালুক ও নিষ্কর ভূমি ব্যতীত বাবু জগবন্ধু রায়ের বংশধর বাবু আশুতোষনাথ রায় এখন এই পরগণার ১৫ আনা তিন গণ্ডা হিস্যার অধিকারী হইয়াছেন। অবশিষ্ট ১৭ গণ্ডার মালীক বাবু মোহিনীমোহন বৰ্দ্ধন প্রভৃতি ব্যক্তিগণ বটেন।

সতরখণ্ডল, সরাইলের অন্তর্গত হইলেও তাহা এক্ষণ একটি খারিজা মহাল হইয়াছে।

মির হবিব ধর্মমাণিক্যকে জয় করিয়া যৎকালে জগৎ মাণিক্যকে চাকলে রোসনাবাদের আধিপত্য প্রদান করেন সেই সময় বলদাখালের জমিদার আকা সাদেক ত্রিপুরার ফৌজদারের পদে নিযুক্ত হন। আধুনিক মেজেস্ট্রেট কালেক্টারের ন্যায় রাজস্ব ও শান্তিরক্ষা উভয় কার্যভার তাঁহার হস্তে সমর্পিত হইয়াছিল।

মহারাজ মুকুন্দ মাণিক্যের শাসনকালে (১১৪৬ বঙ্গাব্দে) সাময়িক জায়গীর ও হস্তী ধৃত করার খরচ ৪৫০০০ টাকা বাদে ৩৩৩০৫ টাকা রোসনাবাদের রাজস্ব ধার্য্য হয়। উক্ত রাজস্ব ব্যতীত মহারাট্টা চৌহুত ও খাশনবিসী আবওয়াব উল্লেখে ৮৯০০ টাকা অতিরিক্ত কর অবধারিত হইয়াছিল।

১৭৫৬ খ্রিস্টাব্দে ইষ্টইণ্ডিয়া কোম্পানির কর্মচারীগণ কাদবা ও চরপাতা নামক স্থান দুইটি বাণিজ্যাগার সংস্থাপন করেন। ত্রিপুরা পবর্বতজাত কার্পাস নির্মিত বাপ্পা বস্ত্রের বাণিজ্যই উল্লেখিত কুঠি স্থাপনের অভিপ্রায়। অন্যূন ১২ লক্ষ টাকার বাপ্তা ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানি দ্বারা প্রতি বৎসর বিদেশে প্রেরিত হইত[২৬]। এই বাপ্তা বস্ত্রের দালালী দ্বারা লৌহাগাড়ার সাহা পরিবার অতুল ঐশ্বর্য্যের অধিপতি হইয়াছিলেন। পূবর্ববঙ্গে ইহারা দ্বিতীয় জগৎশেঠ বলিয়া পরিচিত হন২৭। বিলাতী শিল্পীগণ আমাদের বাপ্তা বাণিজ্যের শিরে কুঠারঘাত করিয়াছেন। ১৮২৭ খ্রিস্টাব্দের পর হইতে বাপ্তার বহির্বাণিজ্য বিলুপ্ত হইয়াছে। আমরা ২৫।৩০ বৎসর ॥ ৪৫৬।। পূর্বেও বাপ্তা বস্ত্ৰ দর্শন করিয়াছি; কিন্তু অল্পকাল মধ্যে বাপ্তা বস্ত্র বয়ন কাৰ্য্য প্রায় বন্ধ হইয়া গিয়াছে।

১৭৬১ খ্রিস্টাব্দে ফেব্রুয়ারি মাসে ত্রিপুরায় ব্রিটিশ পতাকা উডডীন হইয়াছিল। ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মচারিগণ প্রথমত ত্রিপুরাকে নবাবের অধিকার হইতে বিচ্ছিন্ন করিয়া তাহাদের প্রাপ্ত প্রদেশ চট্টগ্রামের অন্তর্ভূক্ত করিতে যত্নবান হইয়াছিলেন। তাঁহারা প্রথম বৎসর চাকলে রোসনাবাদের বার্ষিক রাজস্ব ১০০০০১ টাকা নির্ণয় করেন।

১১৭০ বঙ্গাব্দের (১৭৬৩ খ্রিস্টাব্দের) বন্দোবস্তে বাঙালার অন্যান্য অংশের ন্যায় ত্রিপুরার সমতল ক্ষেত্রের অন্তর্গত মহাল সমূহের রাজস্ব অতিরিক্ত মাত্রায় বর্দ্ধিত হইয়াছিল। মাহাম্মদ রেজা খাঁর বন্দোবস্তে (১১৭২বঙ্গাব্দে) রোসনাবাদের রাজস্ব ১০৫০০০ টাকা নির্ণীত হয়। ১১৭৬ বঙ্গাব্দে ১৫৫০০১টাকা এবং ১১৮৮ বঙ্গাব্দে ১৬৮০০১ টাকা রোসনাবাদের রাজস্ব অবধারিত হইয়াছিল।

ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পাণীর দেওয়ানী প্রাপ্তির পর ত্রিপুরা দুই অংশে বিভক্ত হইয়াছিল। ত্রিপুরার রেসিডেন্ট সাহেবের হস্তে রোসনাবাদের শাসনভার অর্পিত হয়; কিন্তু ত্রিপুরা নওয়াখালীর অন্তর্গত অন্যান্য মহাল ঢাকার (জালালবাদ) রাজস্ব কর্মচারী রাজা হেমাৎ সিংহ ও যশরখার।৪৫৭॥ শাসনাধীনে ছিল (১৭৬৫ হইতে ১৭৬৯ খ্রিস্টাব্দে)। ১৭৬৯ হইতে ১৭৭২ খ্রিস্টাব্দে কেলসেল হেরিস ও লেম্বাট রোসনাবাদ ব্যতীত অন্যান্য অংশের শাসন কর্তা ছিলেন। ১৭৭২ খ্রিস্টাব্দে রাজস্ব আদায় ও সবর্বপ্রকার শাসন কার্য নির্বাহ জন্য কালেক্টর উপাধিধারী জনৈক ইংরেজ রাজপুরুষ নিযুক্ত হইয়াছিলেন। ১৭৮৮ খ্রিস্টাব্দে রাজস্ব আদায় জন্য দেশীয় নায়েব নিযুক্ত হয় এবং সাধারণ শাসন কার্য্য ইংরেজ রাজপুরুষ নির্বাহ করিতেন।

১৭৮১ খ্রিস্টাব্দে (সরাইল পরগণা ব্যতীত) ত্রিপুরা ও নওয়াখালীর সমতলক্ষেত্র দ্বারা একটি জেলা গঠিত হয়। এই জেলা প্রথমত “রোসনাবাদ ত্রিপুরা” আখ্যা প্রাপ্ত হয়। ইংরেজ রাজপুরুষগণ এই জেলাকে দুই অংশে বিভক্ত করিতেন; এক্ষণ যেমন বাঙ্গালা বলিতে গেলে বাঙ্গালা, বিহার উড়িষ্যা ও চুটিয়ানাগপুর বুঝায় এবং “বাঙ্গালার প্রপার” খাস বাঙ্গালাকে বুঝায় তদ্রূপ প্রথম অবস্থায় জেলা ত্রিপুরা বলিলে সমগ্র ত্রিপুরা ও ভুলুয়াকে বুঝাইত। কিন্তু “টিপার প্রপার” বলিলে কেবল চাকলে রোসনবাদকে বুঝাইত। ১৭৮১ খ্রিস্টাব্দে ত্রিপুরা জেলা গঠিত হইলে, রেসিডেন্ট লিক্ সাহেবের হস্তে ইহার শাসনভার সমর্পিত হয়। কিন্তু ফৌজদারি সংক্রান্ত কার্য্য তাঁহার হস্তে অর্পিত না হওয়ায় দেশে সম্পূর্ণ অরাজকতা বিরাজ করিতেছিল। ডাকাইতে দলবদ্ধ হইয়া ॥৪৫৮॥ দিবা দ্বিপ্রহরেও নরহত্যা, গৃহদাহ, পরস্বাপহরণ প্রভৃতি কাৰ্য্য অবাধে সম্পাদন করিত। তদানীন্তন জমিদারগণ মধ্যে মধ্যে কোন কোন ব্যক্তি ডাকাইতের আশ্রয় দাতা ছিলেন। ডাকাইত বংশের সাহায্যে তাঁহারা আত্মরক্ষা ও পরস্বাপহরণ প্রভৃতি কাৰ্য সম্পাদন করিতেন। ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দে ইংরেজ রাজপুরুষগণ ডাকাইতের অত্যাচার নিবারণ জন্য বিশেষ যত্নবান হইয়াছিলেন। তদবধি শান্তিময় ব্রিটিশ শাসনে দেশের উন্নতি সংসাধিত হইতেছে। কিন্তু ত্রিপুর রাজ্যে ব্রিটিশ পলিটিকেল এজেন্ট সংস্থাপিত হওয়ার পূর্বে কুকিগণ ত্রিপুরায় সমতলক্ষেত্রে আপতিত হইয়া সময় সময় কিরূপ অত্যাচার করিয়াছিল, তাহার বিবরণ যথা স্থানে বর্ণিত হইয়াছে।

পশ্চাৎ ক্রমে ক্রমে জজ মেজেস্ট্রেট প্রভৃতি কর্মচারী নিয়োগদ্বারা গবর্ণমেন্ট এই জেলার উন্নতি বিধান করিয়াছেন। পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে সেই সকল বর্ণনা নিষ্প্রযোজন। ত্রিপুরা জেলা হইতে নওয়াখালীকে কিরূপ কোন সময়ে বিচ্ছিন্ন করা হইয়াছিল তাহা যথাস্থানে বর্ণিত হইয়াছে। কিন্তু ত্রিপুরার অন্তর্গত অধিকাংশ ভূমি অদ্যাপি ঢাকা ময়মনসিংহ ও শ্রীহট্ট জেলার অন্তর্ভুক্ত রহিয়াছে।

.

টীকা

১। মূল ২৮৬ পৃষ্ঠা দ্রষ্টব্য।

২। Sutherland’s “Tipperah”

৩। রাজা গোপীচাঁদের গীত আমরা বাল্যকালে বৃদ্ধদিগের নিকট শ্রবণ করিয়াছি।

৪। অযোধ্যা প্রদেশবাসী কালিদাস গজদানি নামক রাজপুত যুবা হুসন সাহের রাজত্বকালে তাহার এক যুবতী কন্যার পাণি গ্রহণ করেন। তৎকালে কালিদাস ‘সুলেমান খাঁ’ আখ্যা প্রাপ্ত হন। সেই রাজকুমারীর গর্ভে কালিদাসের দুইপুত্র ও এক কন্যা জন্মে। পুত্রদ্বয়ের নাম ইশা, ইসমাইল এবং কন্যার নাম সাহেনসা বিবি। ছলিম খাঁ ও তাঁজখার সহিত যুদ্ধে কালিদাস নিহত হন। তাঁহার শিশু পুত্রদ্বয় শত্রু হস্তে অবরুদ্ধ হইয়াছিলেন। অবশেষে শত্রুগণ দাসস্বরূপ তাহাদিগকে বিক্রয় করে। তাঁহাদের মাতুল কুতুবদ্দিন বিশেষ যত্ন করত তুরান হইতে কালিদাসের পুত্রদ্বয়কে উদ্ধার করেন। ইশা খাঁ স্বীয় মাতুল কন্যা ফাতেমা খাতুনের পানি গ্রহণ করেন।

গৌড়েশ্বর দাউদ আকবরের সৈন্য কর্তৃক পরাজিত হইলে তাঁহার ছিন্ন ভিন্ন সৈন্যগণ তিন দলে বিভক্ত হইয়া করিম দাস, ইব্রাহিম ও ইশা খাঁর আশ্রয় গ্রহণ করে। তাঁহারা বঙ্গীয় বিখ্যাত সামন্ত নরপতি (জমিদার) গণের সাহায্যে আকবর সাহের সেনাপতিগণকে দীর্ঘকাল বাঙ্গালায় বিজয়ী পতাকা সংরোপিত করিতে দেন নাই। ইশা খাঁ সুবর্ণ গ্রামের নিকটবর্তী খিজিরপুরে বাস করিয়া মোগল সৈন্যের সহিত অবিশ্রান্ত আহবে লিপ্ত ছিলেন। ১৫৮৬ খ্রিস্টাব্দে বিখ্যাত ইংরেজ বণিক ও ভ্রমণকারী রল্ফ ফিচ তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ করিয়া লিখিয়াছিলেন (The chief king of all these countries is called Isacan, and he is the chief of all the other kings, and is a great friend of the christians)” এই সকল দেশের প্রধান রাজার নাম ইশা খাঁ তিনি অন্যান্য নরপতিগণ মধ্যে শ্রেষ্ঠ এবং খ্রিস্টান দিগের পরমবন্ধু।” ১৫৮৬ খ্রিস্টাব্দে ইংরেজ বনিক যাহাকে স্বাধীন রাজা বলিয়া লিখিয়া গিয়াছেন। ১৫৮২ খ্রিস্টাব্দে তুডরমল্ল কিরূপে সেই রাজার অধিকৃত প্রদেশ আকবরের রাজস্বের হিসাবে ভুক্ত করিলেন পাঠকগণ তাহার বিচার করিবেন।

৫। কায়স্থ কুল জাত দে বংশীয় পুরন্দর রায় ইহার আদি জমিদার। চণ্ডী প্রসাদ রায় তাহার কনিষ্ঠ ভ্রাতা। এই দুই ভ্রাতার নামে এই পরগণা পুরচণ্ডী আখ্যা প্রাপ্ত হয়। শ্রীপুরপতি কেদার রায় পুরন্দরের কন্যা বিবাহ করিবার জন্য যত্নবান হন। এজন্য পুরন্দর ও চণ্ডীপ্রসাদ শ্রীপুর পরিত্যাগ পূর্বক মেঘনাদের পূর্বতীরে আশ্রয় গ্রহণ করেন। এই পরগণা উত্তরকালে দুইভাগে বিভক্ত হয়। পুরন্দরের সন্তানগণ নয় আনা ও চণ্ডীপ্রসাদের সন্তানগণ সাত আনা প্ৰাপ্ত হন।

৬। তৎকালে চাঁদপুর একটি বৃহৎ বন্দর ছিল। দিক্ দেশীয় বণিকগণ এস্থানে বাণিজ্যার্থে সম্মীলিত হইতেন। সেই চাঁদপুর এক্ষণে মেঘনাদের গর্ভে শায়িত রহিয়াছে।

৭। সিংহ বংশীয়দিগের স্থাপিত একটি ক্ষুদ্র রাজ্য। প্রাচীনকলে সিংহেরগাঁও পরগণার পরিমাণ বর্ত্তমান সময় হইতে অধিক ছিল। আধুনিক মহৎপুর প্রভৃতি পরগণার অধিকাংশ এই পরগণা হইতে পরিগৃহীত। রাজা মানসিংহ এই ক্ষুদ্র রাজ্যের স্থাপন কৰ্ত্তা। ইনি সম্রাট আকবরের বহুকাল পূর্বে জীবিত ছিলেন। (ইহাকে কেহ বাঙ্গালার শাসনকর্তা মানসিংহ বিবেচনা করিবেন না) সিংহের গাঁও রাজ্যের স্থাপনকর্তা মানসিংহের একমাত্র পুত্র, “রাজা শ্রীনাথ লস্কর” ॥ শ্রীনাথের চারিপুত্র; জ্যেষ্ঠ কুমার মহেশচন্দ্র, পিতা কর্তৃক পরিত্যক্ত ও নির্বাসিত হইয়াছিলেন। কনিষ্ঠ রাজা রামচন্দ্র খাঁ, রাজা নিশ্চিন্তচন্দ্ৰ মৌলিক এবং রাজা প্রসন্ন চন্দ্র মৌলিক পৈত্রিক রাজতুল্য তিন অংশে বিভাগ করিয়া লইয়াছেন। তাঁহাদের উত্তর পুরুষগণ ক্রমে ক্রমে হৃত রাজ্য হইয়াছেন। কিন্তু সাধারণে অদ্যাপি তাঁহারা রাজা আখ্যা দ্বারা আখ্যাত হইয়া থাকেন।

৮। কর বংশীয় কায়স্থগণ ইহার আদি জমিদার ছিলেন। কর বংশ হইতে ব্রাহ্মণ চৌধুরীগণ এই পরগণা অধিকার করেন। ক্রমে ইহারা ও হৃত সবর্বস্ব হইয়াছেন। অধুনা করদী মহবৎপুর পরগণার অন্তর্গত একটি তপা মাত্ৰ।

৯। কায়স্থ জাতীয় দাস বংশীগণ মেহারের প্রাচীন জমিদার। ইহারা “রাজা” উপাধি ধারণ করিতেন। দাস রাজগণের গুরুবংশে প্রাতঃস্মরণীয় সববিদ্যা ঠাকুর জন্ম গ্রহণ করেন। তাঁহার সিদ্ধ পিঠ অদ্যাপি প্রদর্শিত হইয়া থাকে। যে স্থানে বসিয়া তিনি পূর্ণানন্দ নামক সেবকের সাহায্যে দশ মহাবিদ্যার দর্শন লাভ করেন, সেই স্থানে অদ্যাপি ভগবতীর পূজা হইয়া থাকে। পৌষ সংক্রান্তি দিবস ছাগ রুধিরে তথায় স্রোত প্রবাহিত হয়। নানা স্থান হইতে তীর্থযাত্রীগণ সর্বদা এস্থানে আগমন করিয়া থাকেন। সর্ব বিদ্যার সিদ্ধ পীঠ বলিয়া মেহার শক্তি সম্প্রদায়ের তীর্থ মধ্যে পরিগণিত হইয়াছে। মুসলমানেরাও দেবীর পূজার জন্য নানাবিধ দ্রব্য ও ছাগাদি উপহার দিয়া থাকে।

১০। কায়স্থ দে বংশীয় রামদেব ও কামদেব নামক দুই ভ্রাতা বোয়ালিয়া ও নারায়ণ পুর পরগণার আদি জমিদার। তাহাদের উত্তর পুরুষগণ দীর্ঘকাল এই দুইটি পরগণা উপভোগ করিয়াছেন। বিগত শতাব্দির মধ্যভাগে জনৈক মুসলমান জমিদার এই পরগণার কিয়দংশ অধিকার করেন। তাঁহার উত্তর পুরুষ সেখদাড়া নামক এক দুৰ্দ্দান্ত ব্যক্তি, প্রাচীন জমিদার বংশীয় রামেশ্বর চৌধুরীর কন্যার পাণিগ্রহণ করিবার জন্য লোলুপ হইলেন। রামেশ্বর জাতিপাত ভয়ে নারায়ণ পুর পরিত্যাগ করত বোয়ালীয়া আসিয়া, জ্ঞাতি বর্গের আশ্রয় গ্রহণ করেন। এই সুযোগ দুৰ্দ্দান্ত দাড়া সমগ্র নারায়ণ পরগণা অধিকার করিলেন। দাড়ার অনেকগুলি পুত্রকন্যা ছিল। তাঁহাদের সন্তান সন্ততি গণ এই পরগণাটি বহু অংশে বিভক্ত করিয়া লয়। বিখ্যাত শক্তি উপাসক মির্জা হুসন আলী মুসলমান দিগের উত্তরাধিকারীত্ব আইনের বিধান অনুসারে এই পরগণার কিয়দংশ প্রাপ্ত হন। তাঁহার স্থাপিত কালীদেবী মূর্ত্তি অদ্যাপি নারায়ণপুরে পূজিত হইয়া থাকেন। পরগণাটি বহু অংশে বিভক্ত হওয়ায় ক্রমে ক্রমে অনেক হিন্দু ও মুসলমান সেই সেই অংশ ক্রয় করিয়াছেন।

১১। প্রাচীন কালে কায়স্থ জাতীয় দে বংশীয়গণ এই পরগণার অধিপতি ছিলেন। তাঁহারা “রাজা” উপাধি ধারণ করিতেন। দে বংশীয় শেষ নরপতির একমাত্র কন্যা ছিল। দাস বংশীয় এক ব্যক্তি তাঁহার পানি গ্রহণ করিয়াছিলেন। তাঁহাদের একটি পুত্র জন্মে, তাঁহার নাম জানকী নাথ দাস। জানকীনাথের এক বৈমাত্রেয় ভ্রাতা ছিল, তাঁহার নাম সীতানাথ দাস। উভয় ভ্রাতাকে তাঁহাদের পিতা পরগণাটি দুই অংশে ভাগ করিয়া দিয়াছিলেন। জানকীনাথ নয় আনা ও সীতানাথ সাত আনা প্রাপ্ত হন। বহুকাল হইল এই পরগণা একটি মুসলমান পরিবারের হস্তগত হয়। তাঁহাদের ইতিহাস পরে বলিব।

১২। “হিউং বিউং কৈলারগড়।
এই তিন নুরনগর।” (প্রবাদ বাক্য)

১৭৯৫ খ্রিস্টাব্দে ২৮ জানুয়ারীর এক খণ্ড নিষ্পত্তি পত্রেও নুরনগর নামকরণের এইরূপ ইতিহাস প্রাপ্ত হওয়া গিয়াছে।

১৩। Chowdre the constable of small District. Glossary to the Appendix to History of Hindoostan. By Col. Dow.

১৪। নবাব ফয়জন্নেছা সাহেবার স্বামী চৌধুরী মাহাম্মদগাজি একজন প্রকৃত মিতব্যয়ী জমিদার ছিলেন। তিনি দানের উপযুক্ত পাত্র বিবেচনা করিয়া গোপনে প্রচুর অর্থ দান করিয়া গিয়াছেন। একটি জমিদারির উপস্বত্ব সৎকার্যে দান করিবার জন্য তিনি নির্দ্দেশ করিয়া গিয়াছেন। তিনি অপব্যয়ী ছিলেন না, এজন্যই তাঁহার মৃত্যুর পর তাঁহার পত্নী কন্যা প্রভৃতি উত্তরাধিকারিণীগণ প্রচুর অর্থ প্রাপ্ত হইয়াছেন।

১৫। হোমনাবাদের নবীন জমিদারদিগের মধ্যে আমরা দুইটি বংশের উল্লেখ করিতে পারি :-

এক. চৌহান ক্ষত্রিয় বংশীয় চতুরসিংহ নামে এক ব্যক্তি আজমির হইতে ত্রিপুরায় আগমন করেন। প্রথমত সামান্য ব্যবসা দ্বারা চতুরসিংহ কিঞ্চিত অর্থ সঞ্চয় করিয়া টাকা লগ্নির কারবার আরম্ভ করেন। তাঁহার পুত্র তিলকচন্দ্ৰ সিংহ পিতার ব্যবসায়ের উন্নতি করিয়াছিলেন। অবশেষে তিনি হোসনাবাদের কিয়দংশ ক্রয় করেন। তাঁহার পুত্র বাবু রামদুলাল রায় ও বাবু গোপাল কৃষ্ণ রায় এখন জীবিত আছেন। ক্রমেই তাঁহাদের অবস্থার উন্নতি হইতেছে। হোম- নাবাদ ব্যতীত মহবৎপুর, সিংহের গাঁও ও চৌদ্দগাঁও প্রভৃতি পরগণায় তাঁহারা জমিদারী অংশ ক্রয় করিয়াছেন।

দুই. সাহা বংশীয় ভজকৃষ্ণ চৌধুরী বাণিজ্য ব্যবসায় দ্বারা অর্থ সঞ্চয় করিয়া হোমনাবাদের কিয়দংশ ক্রয় করিয়াছিলেন। তাঁহার পুত্র বাবু কালা কৃষ্ণ চৌধুরী ও বাবু অমরকৃষ্ণ চৌধুরী এক্ষন জীবিত আছেন।

১৬। আধার মানিক্যের ব্রাহ্মণ বংশীয় হরি নারায়ণ চৌধুরী বরদীয়ার দাস মজুমদার, মহবৎপুরের রায় মজুমদার, বোয়ালীয়ার দে চৌধুরী, করদীর কর চৌধুরী আষ্ঠার বর্দ্ধন মজুমদার, খেরুদিয়ার দে চৌধুরী, কাঞ্চনপুরের গুপ্তগণ ও গোবিন্দ দীয়ার বসুগণ প্রধান তালুকদার ছিলেন।

১৭। মতান্তরে বারদীর নাগবংশীয়গণই এই পরগণার প্রাচীন জমিদার। তাঁহাদের আদি পুরুষ নয়ানন্দ নাগ নবাব হইলে এই পরগণাটি প্রাপ্ত হন এবং তাঁহার নাম অনুসারে ইহার নাম নয়াবাদ হইয়াছে।

১৮। এব্রাহিমপুর নামক আরও একটি পরগণা ইহার অন্তর্ভুক্ত দৃষ্ট হয়।

১৯। বলদাখাল ও সরাইল নামক বৃহৎ পরগণা দুইটি মোগলদিগের নাওরা মহাল। এই দুই পরগণার জমিদার যে কেবল নির্দ্দিষ্ট পরিমাণ কোস নৌকা যোগাইতে বাধ্য ছিলেন এমত নহে। এই দুইটি পরগণার সমস্ত রাজস্ব সমরতরী বিভাগে ব্যয় হইত। এজন্য এই দুইটি পরগণা নেজামত সেরেস্তার অধীন হইয়াছিল।

২০। J.A.S.B. vol. XLIII. Part 1 page 214.

২১। মাহাম্মদ এব্রাহিমের তৃতীয় কন্যার নাম দুষ্প্রাপ্য।

২২। থুল্লা গ্রামে ইহাদের বাসভবন ছিল।

২৩। রৌসন- আরা খানম প্রথমত এক আনা অংশ শ্যাম গ্রাম নিবাসী ব্রাহ্মণ বংশীয় মহেশ নারায়ণ রায়ের নিকট বিক্রয় করেন। তদনন্তর খানম সাহেবের পোদ্দার ভৃত্য সীতারাম সাহা সাড়ে বারো গণ্ডা অংশ ক্রয় করেন। নবীনগরের চৌধুরীগণ সেই সীতারাম পোদ্দারের সন্তান সন্ততি। তদনন্তর ঢাকা নিবাসী আমিরদ্দি দারোগা ৫॥ গণ্ডা অংশ ক্রয় করেন। দারোগা সাহেবের পুত্র গোলামৌলা সাহেব অধুনা বলদাখালের জনৈক খাতনামা জমিদার। তৎপর বলদাখালের বাটোয়ারার মোকদ্দমার খরচের জন্য তিন কড়া অংশ নিলাম হইলে ঢাকা নিবাসী খাজে আলী মিঞা (নবাব সাহেবের পিতা) তাহা ক্রয় করেন। তদনন্তর মহারাজা কাশীচন্দ্র মাণিক্য বাহাদুরের মেনেজার কোরজন সাহেব এক আনা ক্রয় করেন। অবশিষ্ট অংশ পশ্চাৎ ভিন্ন ভিন্ন ব্যক্তি ক্রয় করিয়াছিলেন। সীতারাম পোদ্দার ও আমিরদ্দি দারোগার অংশ ব্যতীত অন্যান্যের প্রায় সমস্তই নিলাম ও বিক্রয় হইয়া ঢাকার নবীন নবাব পরিবারের হস্তগত হইয়াছে।

২৪। আধুনিক নারায়ণ পুরের উত্তরাংশ খিজিরপুর নামে পরিচিত ছিল।

২৫। নাছির মাহাম্মদের গৃহ নির্ম্মাণ জন্য যে সকল লোক (ঘরামি) নিযুক্ত হইয়াছিল, তাহারা বৃহৎ কাষ্ঠের থাম (ঠুনি) পুঁতিবার কালে পরিশ্রান্ত হইয়া বলিয়াছিল :

“রাজারে পাইল ভূতে ঠুনি বহাইয়া মারে
নুর মাহাম্মদের পুতে”।

২৬। Hunter’s statistical Account of Bengal Vol VI p 288

২৭। লৌহগড়া চাঁদপুর হইতে প্রায় ৬ মাইল দূরে অবস্থিত। যিনি বঙ্গে দ্বিতীয় জগৎশেঠ বলিয়া পরিচিত হইয়াছিলেন; তাঁহার বাসভবন দর্শন করিবার জন্য ১৩০২ বঙ্গাব্দের বৈশাখ মাসে তথায় গমন করিয়াছিলাম। বাঙ্গালাদেশে এরূপ একটি প্রকাণ্ড বাড়ী বোধহয় আমরা অন্য কুত্রাপি দর্শন করি নাই। অট্টালিকার পতনাবস্থা আরম্ভ হইয়াছে। সেই বিনাশোখ অট্টালিকার মধ্যে তাঁহাদের ধনাগার স্থান দর্শন করিয়া আমরা অবাক হইয়াছি। ধান্য তণ্ডুলাদির গোলার ন্যায় একসময় যাহাদের টাকার গোলা ছিল, সেই পরিবারের একটি স্ত্রীলোক এক্ষণ পরের অন্নে প্রতিপালিত হইতেছেন। বিধাতার কি অপূর্ব লীলা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *