দ্বিজাতিতত্ত্বের বিরোধিতা
দ্বিতীয়বার মুখ্যমন্ত্রী হবার পর হক এক নতুন ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। ভারতীয় জীবনের সমন্বয়ের ভাবধারাটিকে বিকশিত করার জন্য তিনি তৎপর হন। কেশবচন্দ্র সেনের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে তিনি যে দীর্ঘ ভাষণ দেন তাতে এই মনোভাব ব্যক্ত হয়। ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দের ৮ জানুয়ারি কলকাতাতে কেশবচন্দ্র সেনের আটান্নতম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষ্যে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। মুখ্যমন্ত্রী ফজলুল হক ছিলেন সভাপতি। তিনি বলেন: কেশবচন্দ্র ভারতের একজন মহান ধর্ম সংস্কারক ছিলেন। তিনি কথায় ও কাজে দেখিয়েছেন কিভাবে বিভিন্ন ধর্মের বিরোধ মেটাতে হয়, কীভাবে অনৈক্যের মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠা করতে হয় এবং কিভাবে বিরোধের মধ্যে শান্তি বজায় রাখতে হয়। ভ্রান্তপথ অনুসরণকারী স্বদেশবাসীদের সঠিকপথে পরিচালিত করবার জন্য ঈশ্বর কেশবচন্দ্রের মত একজন ঋষিকে ভারতে প্রেরণ করেন। কেশবচন্দ্রের জীবন থেকে ভারতবাসী এই শিক্ষাগ্রহণ করতে পারে যে, একতা ও ভালোবাসার দ্বারাই দেশ ও সম্প্রদায়ের সেবা করা সম্ভব। ভারতের ভবিষ্যৎ নির্ধারিত হবে বিরোধের মধ্য দিয়ে নয়, সমন্বয়ের মধ্য দিয়ে।১
এই সভায় ফজলুল হক ধর্ম সম্পর্কে যে মনোভাব ব্যক্ত করেন তা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। তিনি বলেন, সকল ধর্মের মূল কথাই এক। প্রকৃতপক্ষে বিভিন্ন ধর্মের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। তিনি বলেন:
…There is no diversity really in religion. All religions must be, from the basic point of view, One… The future of India would be decided not by strife but by harmony and concord would be the greatest benefactors of the country.২
লক্ষণীয় এই যে, ভারতের এক সঙ্কটময় মুহূর্তে ফজলুল হক কেশবচন্দ্রের অবদান স্মরণ করেন এবং সমন্বয়ের ভাবধারার প্রতি গুরুত্ব আরোপ করেন।
দ্বিতীয়বার মন্ত্রীসভা গঠনের পরে অনেক বাধাবিঘ্নের মধ্য দিয়ে তাঁকে এগুতে হয়। জিন্নার নেতৃত্বে মুসলিম লিগ এই মন্ত্রীসভার বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করে। ফজলুল হকের চরিত্র হননের জন্য জঘন্য কুৎসার আশ্রয় গ্রহণ করতেও জিন্নাপন্থীরা সঙ্কোচবোধ করেননি। তাঁদের হকবিরোধী আচরণের বিশদ বিবরণ ফজলুল হক লিখিত একটি পত্রে ও বিধানসভার কার্যবিবরণীতে পাওয়া যায়। ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দের ২০ জুন ফজলুল হক একটি দীর্ঘ পত্র বিভিন্ন মুসলিম নেতৃবৃন্দের নিকট প্রেরণ করেন। এই পত্রটি ২১ জুন হিন্দুস্থান স্ট্যান্ডার্ডে প্রকাশিত হয়। মুসলিম লীগ নেতারা প্রকাশ্যেই বলতে শুরু করেন: ফজলুল হক একটি মীরজাফর। তিনি মুসলমানদের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন। তিনি মুসলমানদের শত্রু। এই মন্ত্রীসভার আমলে গত সাত মাস ধরে মুসলিম লিগ নেতারা বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে প্রায় পাঁচশত সভা-সমাবেশ করেন। উদ্দেশ্য হল, মুসলমান সমাজে তাঁর প্রভাব নষ্ট করা। বিশেষ করে পূর্ব বাংলার সরল বিশ্বাসী মুসলমানদের মন তাঁরা বিষিয়ে দিতে চেষ্টা করেন। এইসব কাজে জিন্নাপন্থীরা আবেগপ্রবণ ছাত্র ও যুবকদেরও ব্যবহার করেন। এইভাবে তাঁরা ফজলুল হকের রাজনৈতিক জীবন খতম করতে চান। তখন বাংলাদেশের পরিস্থিতি ষড়যন্ত্রকারীদের পক্ষে খুবই উপযোগী ছিল। এই অবস্থায় ফজলুল হকের প্রয়োজনীয়তা জিন্না আর বিশেষ অনুভব করেননি।
ফজলুল হক বাংলাদেশে মুসলিম লিগের প্রভাব হ্রাস করতে পূর্ণ উদ্যমে কাজ শুরু করেন। তিনি ঘোষণা করেন, জিন্না পরিচালিত মুসলিম লিগের কোন নৈতিক অধিকার নেই রাজনৈতিক দল হিসাবে স্বীকৃতি দাবি করবার এবং মুসলমানদের নেতৃত্ব দেবার। এই নেতৃত্বের বিরুদ্ধে ফজলুল হক যেসব অভিযোগ করেন তা বিশদভাবে বিশ্লেষণ করে লেখেন:
১ মুসলিম লিগের নেতৃত্ব এক স্বার্থপর স্বৈরতান্ত্রিক গ্রুপের করায়ত্ত। অবাধে মত প্রকাশের কোন অধিকার এই নেতৃত্ব স্বীকার করেন না।
২ সমস্ত ক্ষমতাই একজন মাত্র ব্যক্তির অর্থাৎ জিন্নার করায়ত্ত। আর জিন্না যা বলবেন তাই হল লীগের আইন। তাঁর মতানুসারেই সমস্ত সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এক অসহিষ্ণু, স্বৈরতান্ত্রিক পদ্ধতিতে বিশ্বাসী ব্যক্তির হাতে পড়ে লীগ সমস্ত রকম গণতান্ত্রিক পদ্ধতি পরিত্যাগ করেছে। জিন্না সম্পর্কে ফজলুল হক কি মনোভাব পোষণ করতেন তা তাঁর নিজের ভাষায় এখানে উল্লেখ করা হল:
The whole atmosphere is entirely un-Islamic and undemocratic. It is the will of one man that prevails and the members of the League are generally not permitted to have any will or opinion of their own, and this one man is more haughty and arrogant than the proudest of the Pharaohs. To add to our miseries, this superman has been allowed to exercise irresponsible powers which even the Czars in their wildest dreams might have envied.৩
৩ ভারতের মুসলমানদের উপর প্রভাব আছে এবং তাদের প্রতিনিধিত্ব করে এমন কয়েকটি দলকে মুসলিম লিগে স্থান দেওয়া হয়নি। তাদের মধ্যে অন্যতম হল ‘জামিয়াত উলেমা-ই-হিন্দ’, ‘মোমিন’, ‘অহরর’, ‘খুদা-ই-খিদমতগার’, ‘খাকসার’ এবং সিন্ধু ও অন্যান্য প্রদেশের অ-মুসলিম লীগ মুসলমানগণ। ফজলুল হক বলেন, জামিয়াত উলেমা-ই-হিন্দ মুসলিম ধর্ম ও সংস্কৃতি সম্পর্কে অগাধ পাণ্ডিত্যের অধিকারী, ভারতের মুসলমানদের একটি বড় অংশ মোমিন দলভুক্ত, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের খুদা-ই-খিদমতগার, পাঞ্জাবের অহরর ও খাকসারদেরও যথেষ্ট প্রভাব আছে। সুতরাং এইসব দলের গুরুত্ব অস্বীকার করায় ফজলুল হক লিগের সমালোচনা করেন।
৪ খুবই লজ্জার কথা এই যে, মুসলিম লীগ নেতৃবৃন্দ অন্যায়ভাবে লীগের সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেবার জন্য গুণ্ডা ও অসামাজিক ব্যক্তিদের ব্যবহার করতে দ্বিধাবোধ করেননি। এই উদ্দেশ্য সাধনে তাঁরা মুসলিম লিগ সংবাদপত্রগুলিকে ব্যবহার করেন। তাতে কুৎসা ও মিথ্যা সংবাদ প্রচার করা হয়। প্রকৃত তথ্য সহ যদি কেউ এই সংবাদের উত্তর দেন তাহলে তা কখনই লীগের কাগজে ছাপানো হয় না।
৫ বর্তমানে মুসলিম লিগে অ-ইসলামি (un-Islamic) পরিবেশ বিদ্যমান। ইসলামের মূলনীতি সেখানে বর্জন করা হয়েছে। তাই লিগ নেতৃবৃন্দকে ‘প্রকৃত মুসলমান’ বলা চলে না। সুতরাং এই দল মুসলমানদের সর্বনাশের পথে নিয়ে যাবে। ফজলুল হক বলেন:
The present Muslim League atmosphere is un-Islamic. I feel very strongly that the Muslim League should be under the guidance of real and genuine Muslims. Before any one can claim to be a Muslim Leaguer, he must first be a true and genuine Muslim. The policy pursued by the present Muslim League is neither Islamic nor patriotic. It serves neither the Muslims nor anybody else. It pretends to be exclusively Muslim, claiming to serve Muslims alone, but really leading even the Muslims to political ruin and disaster.৪
উপরিউক্ত কারণগুলি ব্যাখ্যা করার পর ফজলুল হক ইসলামের মূলনীতি ‘ইসলামিক ভ্রাতৃত্ববোধকে’ ভিত্তি করে Progressive Muslim League নামক একটি নতুন দল গঠন করার পরিকল্পনা ঘোষণা করেন। এইজন্য তিনি কলকাতাতে একটি সাংগঠনিক কমিটি গঠন করেন। ঢাকার নবাব ও সৈয়দ বদরুদ্দোজা যথাক্রমে এই কমিটির সভাপতি ও সম্পাদক নিযুক্ত হন। ফজলুল হক প্রথমে বাংলাদেশে এই দল প্রতিষ্ঠিত করে ভারতের অন্যান্য প্রদেশেও এই দল গঠন করার কথা ভাবেন। অর্থাৎ একটি সর্বভারতীয় দল গঠন করা তাঁর উদ্দেশ্য ছিল। তাঁর মতে, মুসলিম লিগের কার্যকারিতা শেষ হয়ে গেছে। তাই এই নতুন দল প্রতিষ্ঠা করা একান্ত প্রয়োজন। ইসলামের মূল নীতিকে ভিত্তি করে এই দল গঠিত হলেও অন্য সম্প্রদায়ের অধিকারও এই দল রক্ষা করবে। কারণ মুসলমান ও অ-মুসলমানদের একতার মধ্য দিয়েই ভারতের রাজনৈতিক অগ্রগতি সম্ভব। ফজলুল হক লেখেন:
The Progressive Muslim League which I visualise would be distinctly Islamic in its ideals and would lead the Muslims to have a broad political outlook, while maintaining the utmost fidelity to the best interests of Islam, will also keep in view the interest of the country as a whole. In other words, the ideal of the Progressive Muslim League will be Islam first, and Islam throughout, but without ignoring the legitimate rights of other communities. I feel that it is also necessary to inculcate the great truth that Islam came with a mission for the whole of mankind and that it preached to the world catholicism and toleration in the highest form. Unity between Muslims and other communities has got to be regarded as a fundamental necessity for the political advancement of India.৫
এই চিঠির ছত্রে ছত্রে ফজলুল হকের নির্ভীকতা ও আত্মপ্রত্যয় ফুটে উঠেছে। মুসলিম লিগ নেতৃবৃন্দ তাঁর বিরুদ্ধে যে জঘন্য কুৎসা প্রচার করেন তাতে তিনি বিস্মিত হননি। কারণ ইতিহাসে এমনিভাবে অনেক মহান চরিত্র কলঙ্কিত করার অজস্র নিদর্শন পাওয়া যায়। পয়গম্বর মহম্মদকে পর্যন্ত অপমান সহ্য করতে হয়। এইসব তথ্য উল্লেখ করে ফজলুল হক বলেন, জিন্না তাঁকে অন্যায়ভাবে মুসলিম লিগ থেকে বিতাড়িত করেছেন। আর জিন্নার সমর্থকেরা লিগকে সংগঠিত করছে তাঁর প্রভাব বিনাশ করার জন্য। তাই তিনি সদম্ভে ঘোষণা করেন, বাংলার মুসলমানদের স্বার্থেই এমন মুসলিম লিগ এখানে থাকতে পারে না যেখানে তাঁর কোন ভূমিকা নেই। তিনি বলেন:
Mr, Jinnah passed an order of expulsion on me without the slightest justification and his followers in Bengal, for personal and other reasons, are busy organising the League in order to crush me politically. I feel that it will not be in the interest of the Muslims of Bengal that any Muslim League should function in Bengal in which I will not be allowed to take part, Of all Muslim political leaders, I have the greatest right to lead the League. I proposed to do so, and, with the mercy of Providence, I am determined to succeed in my efforts.৬
এইভাবে প্রগ্রেসিভ মুসলিম লিগ গঠন করে তার নেতৃত্ব দেবার জন্য ফজলুল হক প্রস্তুত হন।
অন্যায়ভাবে তাঁকে লিগ থেকে বহিষ্কার করায় ফজলুল হক জিন্নার বিরুদ্ধে কলকাতা হাইকোর্টে এক মামলা দায়ের করেন। তাতে অভিযোগ করা হয়, বাংলাদেশের স্বার্থে এবং সাম্প্রদায়িক মৈত্রী বজায় রাখবার অভিপ্রায়ে প্রোগ্রেসিভ কোয়ালিশন পার্টি ফজলুল হককে নেতা নির্বাচিত করে যে কোয়ালিশন মন্ত্রীসভা গঠন করেছে তা ভেঙে দেবার উদ্দেশ্যেই জিন্না তাঁকে বহিষ্কার করেছেন। সুতরাং এই আদেশ বাতিল করা হোক। অবশ্য জিন্না এইসব অভিযোগ অস্বীকার করেন। তিনি বলেন, ফজলুল হক নিজে মুখ্যমন্ত্রী থাকতে চান এবং বাংলাদেশে মুসলিম লিগকে দুর্বল করবার জন্য পুরোনো কোয়ালিশন ভেঙে দিয়েছেন। জিন্না একথাও বলেন, কলকাতা হাইকোর্টের এই মামলা গ্রহণ করবার কোন এক্তিয়ার নেই। কারণ তিনি বাংলাদেশে বসবাস করেন না। আর যেকারণে এই মামলা দায়ের করা হয়েছে তাও কোর্টের এক্তিয়ারভুক্ত নয়। কয়েক বছর ধরে এই মামলা চলে।৭
ফজলুল হক মনে করেন, জিন্নাকে বাধা দেবার একমাত্র উপায় হল হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে ঐক্যের মনোভাবকে সম্প্রসারিত করা, দ্বিজাতিতত্তে3র বিরুদ্ধে একই ভারতীয় জাতীয়বোধ বিকশিত করা। ইসলামের মূল নীতিকে আশ্রয় করে তিনি সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ দূর করতে চেষ্টা করেন। তাই তিনি উদ্যোগী হয়ে Hindu-Muslim Unity Conference-এর আয়োজন করেন। ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দের ২০ জুন শনিবার কলকাতার টাউন হলে এই সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। কংগ্রেস, হিন্দু মহাসভা, কৃষক প্রজা সমিতি, লিবারেল ফেডারেশন ও প্রগ্রেসিভ মুসলিম লিগ এই সম্মেলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে। ফজলুল হক পরিচালিত মন্ত্রীসভার সকলেই এর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ১৮ ও ১৯ জুন (১৯৪২ খ্রিস্টাব্দ) সংবাদপত্রে এই সম্মেলনের কর্মসূচি প্রকাশিত হয়। তাতে সবাইকে সম্মেলনে আমন্ত্রণ জানানো হয় এবং মহিলাদের জন্য পৃথক আসনের ব্যবস্থা করা হয়।৮ ২০ জুন প্রচুর জনসমাগম ও উৎসাহ-উদ্দীপনার মধ্যে সম্মেলনের কাজ শুরু হয়। মুর্শিদাবাদের নবাব বাহাদুর সভাপতিত্ব করেন। সম্মেলন উদ্বোধন করেন ফজলুল হক। এই সম্মেলনে বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক মৈত্রী বজায় রাখার জন্য একটি স্থায়ী অরাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান Council of the Hindu-Muslim Unity Association গঠন করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। অবশ্য এটা কোনো নতুন প্রচেষ্টা নয়। ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দেই মুর্শিদাবাদের নবাব বাহাদুর Hindu-Muslim Unity Association নামক একটি প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেন।৯ কিন্তু তখন বাংলাদেশের রাজনৈতিক-সামাজিক পরিবেশ অনুকূলে না থাকায় এই প্রতিষ্ঠানকে অনেক অসুবিধার সম্মুখীন হতে হয়। মুসলিম লিগ প্রবলভাবে এর বিরোধিতা করে। ১৯৩৭–১৯৪১ খ্রিস্টাব্দে বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পায়। স্বভাবতই মুর্শিদাবাদের নবাব বাহাদুরের প্রচেষ্টা সফল হয়নি। তাই প্রথম থেকেই তাঁর প্রতিষ্ঠিত সংগঠনটি মৃত প্রায় অবস্থায় পড়ে ছিল। ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দে ডিসেম্বর মাসে ফজলুল হক কর্তৃক দ্বিতীয়বার মন্ত্রীসভা গঠিত হবার পর বাংলাদেশে অনেকেই এই ধরণের প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজনীয়তা বিশেষভাবে অনুভব করেন।১০ এই সময়েই মুর্শিদাবাদের নবাব বাহাদুর পুনরায় এই উদ্দেশ্যকে সফল করার জন্য উদ্যোগী হন। হিন্দু-মুসলিম ঐক্য সম্মেলনের কর্মসূচি ঘোষিত হবার সঙ্গে সঙ্গেই মুসলিম লীগের নেতৃবৃন্দ এই সম্মেলনের বিরুদ্ধে বিষোদগার করেন এবং যেসব মুসলিম নেতৃবৃন্দ এই সম্মেলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তাঁদের তীব্র ভাষায় সমালোচনা করেন। তাঁরা ঘোষণা করেন, ঐসব মুসলিম নেতৃবৃন্দ মুসলিম সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্ব করেন না।
২০ জুন (১৯৪২ খ্রিস্টাব্দ) এই সম্মেলন উদ্বোধন করে ফজলুল হক এক অনবদ্য ভাষণে মুসলিম লিগের সমালোচনার উত্তর দিয়ে বলেন, তিনি নিশ্চয়ই মুসলিম সমাজের যাঁরা কলঙ্ক তাঁদের প্রতিনিধিত্ব করেন না। যাঁরা ইসলামের মূলনীতি অনুসরণ করে অন্য সম্প্রদায়ের অধিবাসীদের সঙ্গে শান্তিতে বসবাস করতে চান তিনি সেইসব মুসলমানদের প্রতিনিধিত্ব করতে পেরে গর্বিত। একজন প্রকৃত মুসলমানকে তাঁর প্রতিবেশীর প্রতি বন্ধুভাবাপন্ন হতেই হবে। তাই রাজনৈতিক বা ব্যক্তিগত স্বার্থ চরিতার্থ করবার জন্য হিন্দু ভাইদের সঙ্গে বন্ধুত্ব স্থাপন করার কথা ‘কোন প্রকৃত মুসলমান’ চিন্তা করেন না।১১ ফজলুল হক আরও বলেন, হিন্দু ও মুসলমানদের উপলব্ধি করতে হবে যে তাঁদের একসঙ্গে শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করতে হবে। প্রয়োজন হলে একই মাতৃভূমির মঙ্গলের জন্য একসঙ্গে প্রাণ বিসর্জন দিতে হবে। যাঁরা মুসলমানদের বোঝাচ্ছেন যে, মুসলিম সমাজের মুক্তি অর্জিত হবে বিভেদে এবং অনৈক্যে, ঐক্যে নয়, তাঁদের চালাকি সাধারণ মুসলমানেরা বুঝতে পেরেছেন। কারণ ইসলামের শিক্ষা শান্তি প্রতিষ্ঠার পক্ষে সহায়ক।১২ শান্তি বজায় না থাকলে অভ্যন্তরীণ মৈত্রী বিঘ্নিত হয়। আর মৈত্রীর ভাব না থাকলে মনের সম্প্রসারণ সম্ভব নয়। পরিশেষে ফজলুল হক বলেন, ২০ জুন সাম্প্রদায়িক মৈত্রী স্থাপনের প্রচেষ্টারূপে বাংলাদেশের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লিখিত থাকবে।১৩
ফজলুল হকের এই ভাষণ হিন্দুস্থান স্ট্যান্ডার্ড কাগজে যেভাবে প্রকাশিত হয়, তা এখানে উদ্ধৃত করা হল:
In opening the conference Hon’ble Mr. A. K. Fazlul Huq said that those who were connected with the administration of the province knew very well that real, genuine adminstration of the province knew very well that real, genuine administration in the true sense of the term was impossible unless there was an atmosphere prevailing in the country which promoted co-operation between different communities and helped the Government in maintaining peace, order and tranquillity or the furtherance of the common interests of the country.১৪
A writer in the columns of a local daily had remarked, the Chief Minister proceeded, that this conference was being convened by a number of Muslims who did not represent the Muslim community. So far as he (Mr. Huq) was concerned, he pleaded guilty to the charge that he did not represent the entire Muslim community of Bengal. He was proud that he did not represent that section of the Muslim community who were a disgrace to the Muslim community and who thought that the best interests of Islam would be served, not in co-operation but in distrust and quarrel with sister communities. He was proud he represented that section of the Muslim community who observed Islamic tenets ; he belonged to that section who believed in Islamic teaching, who desired frienship with Hindu brethren, not for political purposes or personal ends, but for this that in order to be a true Muslim he had got to be friendly with his neighbour and live in peace and amity with him.১৫
Hindus and Muslims must realise, Mr. Huq proceeded, that they had got to live together, sink or swim together and if need be, lay down their lives together for the good of their common motherland.১৬
A certain local newspaper had said, Mr. Huq remarked, that those who would be attending this conference were those Muslims who were shown ‘black flags’ in the country, thereby meaning that those who really represented the Muslims had not joined the conference. Mr. Huq could tell newspaper editors of this kind that the time was now absolutely past when mischief-makers could hoodwink the Muslim community in the belief that the salvation of the Muslim community lay not in unity but in disunity and discord. He did not think that the Muslim community was so foolish as not to see through this kind of stunt. The teachings of Islam were for peace and peace only; without peace there could not be internal harmony and without harmony there could not be any progress of any kind.১৭
The Chief Minister in conclusion expressed the hope that the 20th of June would be a red-letter day in the history of Bengal, marking new era of communal peace and harmony.১৮
সভাপতির ভাষণে মুর্শিদাবাদের নবাব বাহাদুর সমস্ত শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষকে একতাবদ্ধ হয়ে এক নবজীবনের ভিত্তি স্থাপনে উদ্যোগী হতে বলেন। তিনি হিন্দু ও মুসলমানদের পৃথক অস্তিত্বে বিশেষ কোনো গুরুত্ব আরোপ করতে রাজি নন। কারণ তিনি বিশ্বাস করেন, এক সম্প্রদায় অন্য সম্প্রদায়ের সাহায্য ব্যতিরেকে কিছুতেই অগ্রসর হতে পারবে না। তাঁদের শুধু নিজেদের ধর্মের কথা ভাবলেই চলবে না, গোটা জাতির কল্যাণের জন্যও তাঁদের দায়িত্ব পালন করতে হবে। তাঁর মতে, ধর্ম ও বর্ণ নির্বিশেষে সমস্ত শ্রেণি ও সম্প্রদায়কে সংঘবদ্ধ করতে না পারলে কোন প্রয়োজনীয় সংগঠন যথারীতি কাজ করতে পারে না। তিনি আশা করেন, হিন্দু-মুসলিম ঐক্যে বিশ্বাসী ব্যক্তিরা ভারতীয় জাতীয়তাবাদের আদর্শ বিকাশে কর্মরত হবার প্রয়োজনীয়তার প্রতি বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করবেন। এই সম্মেলন শুভদিনের সূচনা করবে এবং সকলের অনুকরণযোগ্য অক্ষয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করবে।১৯
তিনি বলেন, ভারতের সমৃদ্ধি ও জনসাধারণের কল্যাণ সম্পূর্ণভাবে নির্ভর করছে সকলের স্বার্থে হিন্দু-মুসলিম ঐক্য প্রতিষ্ঠা করে সহযোগিতার নীতিতে আস্থাবান হবার উপরে। দীর্ঘকাল ধরে এই দু-টি সম্প্রদায় সহোদরার মত পাশাপাশি বাস করছে। তাই আজ ভারতের রাজনীতির এক গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে তাঁদের উদ্যোগী হয়ে বিভেদের যে প্রাচীর পরস্পরকে খানিকটা আলাদা করেছে তা ভেঙে ফেলতে হবে—মিলনের সেতু নির্মাণ করতে হবে। একতাই ধ্রুব তারকার মতো তাঁদের পথ আলোকিত করে পরস্পরের হাত ধরে সামনের দিকে এগুতে সাহায্য করবে এবং বিভিন্ন স্তরের মধ্য দিয়ে তাঁদের জীবনকে আনন্দময় করে তুলবে।২০
তিনি সেই সমস্ত নেতৃবৃন্দের সমালোচনা করেন, যাঁরা একদলকে আর একদলের বিরুদ্ধে লাগাচ্ছেন এবং প্রতিনিয়ত বিভেদের বীজ বপন করে চলেছেন। ভারতের মাটিতে তাঁকেই প্রকৃত নাগরিক বলা চলে যিনি দেশাত্মবোধের দ্বারা পরিচালিত হয়ে সাম্প্রদায়িক মৈত্রী বজায় রাখতে বদ্ধপরিকর। অতীতে ভারতবাসীর যতই ত্রুটি থাক না-কেন এবং ভারতবাসী যতই অসুবিধার মধ্যে থাক-না-কেন, বর্তমানে তাঁরা ভারতের ভাগ্য নির্ধারণে সম্পূর্ণভাবে প্রস্তুত ও পারদর্শী। মুর্শিদাবাদের নবাব বাহাদুরের ভাষণ থেকে কিছু অংশ এখানে উদ্ধৃত করা হল:
A true citizen born on the soil India is he who is actuated by sentiment of patriotism to see complete understanding arrived at between these great communities living side by side in their resolve to stand firm in order to be benefited by the increasing glimmer of the dawn of India’s salvation. It is the demoralising effect often produced by unwholesome preachings of those bent upon setting up one party against the other that is detrimental to the welfare of our country. It is the work of repugnant machination of irreconcilable agitators.২১
মন্ত্রী ও ঢাকার নবাব হবিবুল্লাহ বাহাদুর সেই সমস্ত নেতাদের সমালোচনা করেন, যাঁরা মুখে জনসাধারণকে সেবার ও দেশকে ভালোবাসার কথা বলেন, অথচ জনসাধারণের মঙ্গলের জন্য অপরের সঙ্গে মিলিত হতে পারেন না। যদি তাঁরা সততার সঙ্গে চেষ্টা করেন তাহলে সহজেই সাম্প্রদায়িক মৈত্রী স্থাপন করা যায়। আর ভারতবাসী ঐক্যবদ্ধ না হলে স্বাধীনতা অর্জন করা সম্ভব নয়।২২ টি. সি. গোস্বামী বলেন, নিজেদের স্বার্থেই হিন্দু-মুসলিম ঐক্য প্রয়োজন। মন্ত্রী এস, কে, বসু বলেন, হিন্দু-মুসলিম ইউনিটি এসোসিয়েশন উভয় ধর্মের সংস্কৃতির ও সভ্যতার গৌরবময় ইতিহাস তাঁদের সামনে তুলে ধরবেন। অতীতে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ ও বিরোধ বাঙালি জাতির মর্যাদা ক্ষুণ্ণ করেছে। তাই আজ এক-জাতীর আদর্শ সম্বল করে সমৃদ্ধির পথে এগুবার জন্য প্রতিজ্ঞা করতে হবে।২৩ এন, সি, চ্যাটার্জী বলেন, উভয় সম্প্রদায়ের ধর্মের ও অধিকারের প্রতি পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও সহনশীলতা থাকা উচিত। বর্ধমানের মহারাজ বাহাদুর উদয়চাঁদ মহতাব বলেন,২৪ এই ঐক্য সম্মেলনকে একটি সঠিক পদক্ষেপ বলা চলে। প্রত্যেকের উচিত নিজ নিজ এলাকাতে হিন্দু মুসলিম ঐক্যের আন্দোলনকে সম্প্রসারিত করা।২৫
মন্ত্রী সামসুদ্দিন বলেন। সাধারণ মানুষের মধ্যে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ ছিল না। কতিপয় স্বার্থান্বেষী ব্যক্তি এই বিভেদ সৃষ্টি করেছেন। তাঁরা দেশের মস্তবড়ো শত্রু। তিনি বলেন:
Among the masses there was no communal disharmony, because both Hindus and Mussalmans realised that their vital interests were identical. It was only a handful of self-seekers who wanted to drive a wedge among the different communities. These people were the greatest enemies of the country and it should be the concern of all real well wishers of the country to see that these mischief makers were not able to mislead the masses.২৬
মন্ত্রী খান বাহাদুর হাসেম আলি খান বলেন, হিন্দু মুসলমানদের উপলদ্ধি করতে হবে যে নিজেদের স্বার্থে ও দেশের কল্যাণের জন্য তাঁদের একসঙ্গে কাজ করতে হবে। কলকাতার মেয়র হেমচন্দ্র নস্কর বলেন, বহু যুগ ধরে, হিন্দু-মুসলমান পরস্পর মিত্রতা বজায় রেখে শান্তিতে এই দেশে বসবাস করছেন। কিছুদিন আগেও বাংলাদেশের গ্রামে দেখা যেত হিন্দু-মুসলমান পরস্পরের ধর্মীয় ও সামাজিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করছেন। সম্প্রতি তাঁরা সাম্প্রদায়িক পার্থক্যের কথা শুনতে পাচ্ছেন। তিনি আশা করেন, দেশের বর্তমান সংকটের হাত থেকে পরিত্রাণের জন্য হিন্দু ও মুসলমান উভয়েই ঐক্যের প্রয়োজনীয়তা গুরুত্ব দিয়ে উপলব্ধি করবেন।২৭
আরও কয়েকজন নেতৃবৃন্দ এই ঐক্য সম্মেলনে ভাষণ দেন ও অংশগ্রহণ করেন। তাঁরা বলেন: ড. নলিনাক্ষ্য সান্ন্যাল, সৈয়দ বদরুদ্দোজা, হুমায়ুন কবির, হেমেন্দ্র প্রসাদ ঘোষ, এ, কে, এম, জ্যাকেরিয়া, মৌলানা আহমদ আলি, ডা. বিধানচন্দ্র রায়, কিরণশঙ্কর রায়, সত্যেন্দ্রনাথ মজুমদার, স্যার এ, এইচ, গজনভী, রাজেন দেব, সৈয়দ নৌশের আলি প্রভৃতি।২৮
শুভবুদ্ধি সম্পন্ন প্রতিটি ব্যক্তি ফজলুল হকের এই প্রচেষ্টাকে স্বাগত জানান। এই ঐক্য সম্মেলনের সাফল্য কামনা করে ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি মৌলানা আবুল কালাম আজাদ একটি অভিনন্দন বার্তা প্রেরণ করেন:
We have had enough of quarrels in the past and we may indulge in them in future if we so desire but it must not hinder us from creating an atmosphere of mutual confidence and goodwill at a time when the invader is knocking at our doors. I coredially wish this auspicious movement a complete success.২৯
লর্ড বিশপ অব ক্যালকাটা অ্যান্ড মেট্রোপলিটান অব ইন্ডিয়া এই সম্মেলনকে অভিনন্দিত করেন। তিনি ডা. শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জীর নিকট একটি চিঠিতে লেখেন:
India is in one sense the land of divisions with its numerous races, languages and religions, but diversity does not of necessity involve disunion. Where there is a spirit of mutual goodwill and fellowship, it both provides that the varied contributions which the several parties can make for the enrichment of the whole shall have their due effect, and also it does supply the necessary corrections of party prejudices. The Punjab has set an example which I sincerly hope Bengal will endorse by her own action.৩০
বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক মৈত্রী বজায় রাখার উদ্দেশ্যে এই হিন্দু মুসলিম ইউনিটি কনফারেন্সে যেসব প্রস্তাব গৃহীত হয় ফজলুল হকের ভূমিকা বিশ্লেষণ ও তৎকালীন বাংলা দেশের রাজনৈতিক অবস্থা পর্যালোচনায় তার গুরুত্ব অনস্বীকার্য। এই সম্মেলন গৃহীত প্রস্তাবসমূহে বলা হয়:
১ ভারত, বিশেষ করে বাংলা দেশ ও আসামকে আজ এক গুরুতর পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়েছে। বৈদেশিক আক্রমণ,আমাদের নিরাপত্তা, আমাদের বাসস্থান, আমাদের আশা-আকা´ক্ষা, আমাদের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক জীবনকে অর্থাৎ এককথায় যা আমরা ভালোবাসি ও মূল্যবান মনে করি তার সব কিছুকেই বিনষ্ট করতে উদ্যত। প্রতিদিন আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির অবনতি ঘটছে। এই অবস্থায় হতাশা ও পরাজয়ের মনোভাব দূর করার জন্য এবং সামাজিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে ধবংসের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য আমাদের সমস্ত শক্তি নিয়োজিত করা উচিত। এই দায়িত্ব পালন করতে হলে আমাদের সাম্প্রদায়িক মৈত্রী স্থাপন করার দরকার এবং সদিচ্ছা ও সহযোগিতার মনোভাব সৃষ্টি করা দরকার। বাংলাদেশের জনসাধারণের নিকট ঐক্য ও সংহতির প্রয়োজনীয়তা আর কখনোই এতটা জরুরি মনে হয়নি। কেবলমাত্র একতাবদ্ধ হলেই আমরা আসন্ন বিপদ থেকে রক্ষা পেতে পারি। বিভিন্ন দলের মধ্যে মতপার্থক্য থাকলেও দেশের আভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার প্রয়োজনে, ধর্ম ও বর্ণ নির্বিশেষে সকলের জন্য খাদ্যদ্রব্য, ওষুধপত্র ও অন্যান্য প্রয়েজনীয় সামগ্রী সংগ্রহ ও বন্টন করার জন্য এবং সমস্বার্থের কথা সাধারণের মধ্যে প্রচার করার উদ্দেশ্যে বাংলাদেশের প্রতিটি হিন্দু ও মুসলমানেরই ঐক্যবদ্ধ হওয়া দরকার। আর শান্তিবাহিনী গঠন করে যেখানেই সাম্প্রদায়িক মৈত্রী বিঘ্নিত হবার আশঙ্কা দেখা দেবে সেখানেই তা পাঠাতে হবে।৩১
২ এই ঐক্য সম্মেলন মনে করে, সাম্প্রদায়িক মৈত্রী ও সহযোগিতার পরিবেশ সৃষ্টি করবার জন্য একটি দীর্ঘ মেয়াদী ও আর একটি স্বল্প মেয়াদী কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে। এই উদ্দেশ্য সাধনে একটি স্থায়ী ট্রাস্ট ফান্ড তৈরি করে জনসাধারণের মধ্যে পুস্তিকা ও বত্তৃতা মুদ্রিত করে বিতরণ করতে হবে।৩২
৩ সাম্প্রদায়িক মৈত্রী বজায় রাখার জন্য, দেশের নিরাপত্তার স্বার্থে এবং জনসাধারণের মধ্যে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সংগ্রহ ও বন্টন করার উদ্দেশ্যে Council of the Hindu-Muslim Unity Association নামক একটি স্থায়ী অরাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান গঠন করতে হবে।৩৩
এই উদ্দেশ্যে ফজলুল হক একটি স্কিমও তৈরি করেন। এই জন্য বাজেটে Communal Harmony খাতে একলক্ষ কুড়ি হাজার টাকা ব্যবস্থা করেন এবং এই বাবদ প্রথমেই বাংলাদেশ সরকার ষোল হাজার টাকা মঞ্জুর করেন। সরকারি দপ্তরে এই স্কিম ‘মডেস্ট স্কিম’ নামে পরিচিত।৩৪
১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মাসে ভারত সফররত তুরস্ক প্রেস মিশন কলকাতাতে এলে তাঁদের সম্মানার্থে যে সভার আয়োজন হয় সেখানে ফজলুল হক দ্বি-জাতিতত্ত্বের সমালোচনা করে ভাষণ দেন। এই সভায় তিনি এই আশা পোষণ করেন যে, বিভিন্ন জনসমষ্টি নিয়ে এমন একটি রাজনৈতিক ও সামাজিক ব্যবস্থা ভারতীয়রা গঠন করবে যেখানে অতীত ভারতের গৌরব অম্লান থাকবে। ফজলুল হক বলেন:
Indians would evolve out of the heterogenous peoples of India a system, a political and social ideal, which will redound to the glory of India.৩৫
তুরস্কের প্রেস মিশনের প্রতিনিধি এম, অটয় বলেন, তুরস্ক প্যান ইসলামি মতবাদে অথবা প্যান ইসলামি যুক্তরাষ্ট্রে বিশ্বাসী নয়। তুরস্কে ধর্ম নিতান্তই ব্যক্তিগত ব্যাপার এবং দেশের শাসনতন্ত্র পরিচালনায় ধর্মের কোন ভূমিকা নেই। অটয় বলেন:
Turkey does not believe in Pan Islamism, or Pan-Islamic Federation of any kind, nor even Pan-Turkism.৩৬
মুসলিম লিগ নেতৃবৃন্দ সহজভাবে এইসব মন্তব্য গ্রহণ করতে পারেননি। বিশেষ করে এমন একটা সময়ে যখন তাঁরা ভারতে ধর্মকে একমাত্র অবলম্বন করে পৃথক রাষ্ট্রের দাবি করছেন।৩৭
যে-ঐক্যবদ্ধ বাংলা দেশ ও ঐক্যবদ্ধ ভারতের কল্পনা ফজলুল হকের ছিল, সেখানে কৃষকদের স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে। মোট কথা, তা পাকিস্তান বা হিন্দুস্থান হবে না, হবে ‘চাষীস্থান’।৩৮ এই শব্দটি তিনি ও তাঁর সহযোগীরা গ্রাম-বাংলায় সভা-সমিতি করতে গিয়ে প্রচলন করেন। তাঁরা বলেন, বাংলাদেশের সমৃদ্ধির জন্য জমিদার ও মহাজনদের শোষণ থেকে কৃষক সমাজকে মুক্ত করা দরকার। বাংলার মুসলমান কৃষকদের জিন্নার প্রভাব মুক্ত করাই ছিল তাঁদের মুখ্য উদ্দেশ্য। অবশ্য ‘চাষিস্থান’ সম্পর্কে কোন স্বচ্ছ ধারণা তাঁরা জনসাধারণের কাছে রাখতে পারেনি।
উপরিউক্ত তথ্য থেকে বোঝা যায় ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দের শেষার্ধ থেকে ফজলুল হক পাকিস্তান দাবির অযৌক্তিকতা উপলব্ধি করেন। তাছাড়া তিনি ঐক্যবদ্ধ ভারতের রূপ প্রাচীন ভারতের গৌরবময় ইতিহাসের ধারার সঙ্গে সামঞ্জস্য বজায় রেখে অক্ষুণ্ণ রাখার জন্য প্রয়াসী হন। তিনি প্রকাশ্যভাবে জিন্না, মুসলিম লিগ ও পাকিস্তান দাবির বিরোধিতা করেন। এই সিদ্ধান্তে সর্বত্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। অনেকেই ফজলুল হককে অভিনন্দন জানান।৩৯
অবশ্য জিন্না চুপ করে বসে থাকেননি। ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দের ২১ ফেব্রুয়ারি নয়াদিল্লিতে মুসলিম লিগ ওয়ার্কিং কমিটির সভায় ফজলুল হকের আচরণের সমালোচনা করে প্রস্তাব গৃহীত হয়। ৪০ জিন্নার পরামর্শ অনুযায়ী বাংলাদেশের লিগ ফজলুল হকের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করে। স্টেটসম্যান কাগজে শাহেদ নামক একজন লেখক প্রতি সপ্তাহে ‘Dar-el-Islam’ নামক প্রবন্ধে নিয়মিত লিগের নীতি প্রচার করতেন। তিনি ফজলুল হকের বিরুদ্ধে বিষোদগার করেন। পাকিস্তান প্রস্তাবের বিরোধিতা করায় তিনি ফজলুল হকের সমালোচনা করেন।৪১ তিনি অভিযোগ করেন, হক মন্ত্রীসভা অন্যায়ভাবে কয়েকটি জেলাবোর্ড থেকে মুসলিম লিগ চেয়ারম্যানদের অপসারণ করেছেন। ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দের ১ ফেব্রুয়ারি ফজলুল হক এই অভিযোগের উত্তর দেন এবং ৩ ফেব্রুয়ারি ফজলুল হকের পত্র দ্য স্টেটসম্যান কাগজে প্রকাশিত হয়। এই পত্রটি একটি বিখ্যাত দলিলরূপে ঐতিহাসিকদের কাছে স্বীকৃতি পাবে। এই পত্র পাঠ করলেই বোঝা যায়, ফজলুল হক তখনও জিন্নাকে এমন কোন সুযোগ দিতে চাননি যাতে জিন্না মুসলমানদের কাছ থেকে তাঁকে সহজেই বিচ্ছিন্ন করতে পারেন। কারণ ইতিমধ্যে পাকিস্তান দাবির স্বপক্ষে এক অন্ধ মোহ জিন্না সৃষ্টি করতে সক্ষম হন। আবার অন্যদিকে বাংলার কংগ্রেস নেতাদের সঙ্গে ফজলুল হকের আলোচনা তখনও ফলপ্রসু হয়নি। এই অবস্থা বিবেচনা করে ফজলুল হক পাকিস্তান প্রস্তাবের অবাস্তব দিক উদঘাটন করেন। খুবই সতর্কতার সঙ্গে ফজলুল হক পাকিস্তান প্রস্তাবের মূল উদ্দেশ্যকে আক্রমণ করেন। ফজলুল হকের বক্তব্য এখানে উল্লেখ করা হল:
১৯৪০ খ্রিস্টাব্দের ২৪ মার্চ পাকিস্তান প্রস্তাব গ্রহণের পর থেকেই আমি এই প্রস্তাবের বিরুদ্ধে মন্তব্য করা থেকে বিরত থাকি। আমি তখন থেকেই উপলব্ধি করেছিলাম যে, তাত্ত্বিকেরা পাকিস্তান প্রস্তাব সম্পর্কে বিভিন্ন সময়ে এমন সব উদ্ভট চিন্তাধারা প্রচার করছেন যার ফলে জটিলতা বৃদ্ধি পেয়েছে।… আমি অনুভব করেছি, পাকিস্তান সম্পর্কে অসত্য ধারণা সৃষ্টি করে বাংলার মুসলমানদের প্রতারিত করা হয়েছে। আমি স্বেচ্ছায় মৌনব্রতী হয়েছি, কারণ আমার মন্তব্য হয়তো ভুল ধারণার সৃষ্টি করতে পারে। আমি এমনকিছু বলিনি যাকে পাকিস্তান মতবাদের বিরুদ্ধাচরণ বলে অভিহিত করা যায়।… তবুও সাম্প্রতিককালে এই পরিকল্পনা সম্পর্কে যেসব মন্তব্য করা হয়েছে সেবিষয়ে আমি একটি মন্তব্য করতে চাই। আমাদের মনে রাখতে হবে ভৌগোলিক দিক থেকে বাংলার সংলগ্ন তিনটি প্রদেশ আছে, যথা, আসাম, বিহার ও উড়িষ্যা। যথাক্রমে আসাম, বিহার ও উড়িষ্যার মুসলমান জনসংখ্যার আনুপাতিক হার হল ৩৫ শতাংশ, ১০ শতাংশ এবং ৪ শতাংশ। সুতরাং এটা পরিষ্কার যে, বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থাকে মেনে নিয়ে ভৌগোলিক দিক থেকে সংলগ্ন প্রদেশগুলিসহ স্বায়ত্তশাসিত রাষ্ট্রসমূহ গঠন করা সম্ভব নয়। যদি বাংলাদেশকে দু-ভাগে বিভক্ত করতে হয় তার ফল হবে এই যে, যে-পূর্বাঞ্চল (Eastern zone) প্রধানতঃ মুসলিম অধ্যুষিত এলাকা হবে তাকে এমন চারটি প্রদেশ ঘিরে রাখবে যেখানে হিন্দুরা সংখ্যাগরিষ্ঠ থাকবেন। অতএব বাংলার মুসলমানদের এই বলে ধোঁকা দেবার কোন অর্থ হয় না যে এই ফর্মুলা পাঞ্জাব ও বাংলা উভয় অঞ্চলের পক্ষে শুভ হবে। বাংলার মুসলমানেরা উপলব্ধি করছেন যে, তাঁদের স্বার্থ সমগ্র ভারতের সঙ্গে যুক্ত। আমরা এই ভেবে কায়েদে আজমের উপর নির্ভর করেছিলাম যে, তিনি পাকিস্তান প্রস্তাব এমনভাবে পরিবর্তন করবেন যাতে বাংলার মুসলমানেরা অন্যান্য প্রদেশের মুসলমানদের সঙ্গে এবং সমস্ত প্রদেশের অন্য সম্প্রদায়ের অধিবাসীদের সঙ্গে আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার অর্জন করতে পারেন।৪২
এই চিঠি থেকে জানা যায়, পাকিস্তান প্রস্তাব যাতে যুক্তিসংগত হয় সেজন্য ফজলুল হক প্রয়োজনীয় পরিবর্তন করতে জিন্নাকে অনুরোধ করেন। আর পূর্বাঞ্চলে যে এই প্রস্তাব কার্যকারী করা সম্ভব নয় তাও তিনি বলেন। তাছাড়া তিনি কেবলমাত্র মুসলমানদের স্বার্থ রক্ষার কথা বলেননি। তিনি একই সঙ্গে অন্য সম্প্রদায়ের কথাও চিন্তা করেন। তাঁর কাছে বাংলার মুসলমানদের সমস্যা পাঞ্জাবের মুসলমানদের চেয়ে পৃথক মনে হয়েছে। তাই একই ফর্মুলায় এর সমাধান সম্ভব নয়। বাঙালি মুসলমানদের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার অর্জনের জন্য ফজলুল হক যেভাবে গুরুত্ব আরোপ করেন তাও লক্ষণীয়। বস্তুত, ফজলুল হকই সর্বপ্রথম পাকিস্তান প্রস্তাবের ত্রুটি উল্লেখ করেন এবং বাঙালি মুসলমানদের দৃষ্টি এদিকে আকর্ষণ করে।
তথ্যসূত্র
১ Speech delivered by A. K. Fazlul Huq dated 8 January, 1942. Vide Hindusthan Santard, I January, 1942.
২ Ibid.
৩ Letter of A. K. Fazlul Haq dated 20 June, 1942, addressed to Prominent Muslim Leaguers throughout India regarding his proposal for a Progressive All-India Muslim League. Vive Hindusthan Standard, 21 June, 1942.
৪ Ibid.
৫ Ibid.
৬ Ibid.
৭ Ibid, 25 July, 1947; Vide also Bengal Legislative Assembly Proceeding, Thirteen Session, 1942, Vol. LXII–No. 2, pp. 224-225.
৮ Hindusthan Standard, 18–21 June, 1942
৯ Ibid, 18 and 20 June, 1942.
১০ Ibid, 20 June, 1942.
১১ Speech delivered by A. K. Fazlul Huq at the Hindu-Muslim Unity Conference hald at Calcutta on 20 June, 1942. Vide Hindusthan Standard, 21 June, 1942.
১২ Ibid.
১৩ Ibid.
১৪ Ibid.
১৫ Ibid.
১৬ Ibid.
১৭ Ibid.
১৮ Ibid.
১৯ Proceedings of the Hindu-Muslim Unity Conference. Vide Hindusthan Standard, 21 June, 1942.
২০ Ibid.
২১ Ibid.
২২ Ibid.
২৩ Ibid.
২৪ Ibid.
২৫ Ibid.
২৬ Ibid.
২৭ Ibid.
২৮ Ibid, 18–21 June, 1942.
২৯ Ibid, 21 June, 1942.
৩০ Ibid.
৩১ Ibid.
৩২ Ibid.
৩৩ Ibid, পরিশিষ্ট ‘গ’ দ্রষ্টব্য—হিন্দু-মুসলিম ইউনিটি কনফারেন্সে গৃহীত প্রস্তাবসূমহ দেওয়া হল।
৩৪ Bengal Legislative Assembly Proceedings, Thirteenth Session, 1942, Vol. LXII–No. 1, pp. 173, 235; Amritabazar Patrika, 27 February, 1943.
৩৫ Statesman, 15 February, 1943.
৩৬ Ibid, 30 January, 1943.
৩৭ Ibid, 15 February, 1943.
৩৮ Ibid.
৩৯ Ibid.
৪০ Mansergh, Nicholas (Edited), The Transfer of Power 1942–7, Vol. 1, London, 1970, p, 229.
৪১ Statesman, 1 February, 1943.
৪২ Letter of A. K. Fazlul Huq, dated 2 February, 1943, Vide The Statesman, 3 February, 1943. পরিশিষ্ট ‘ঘ’ দ্রষ্টব্য—ফজলুল হক লিখিত পত্রটি দেওয়া হল।