দ্বারকানাথ ঠাকুর
দ্বারকানাথ ঠাকুর ১৭৯৪এ জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর ইংরেজি শিক্ষার সূত্রপাত হয় শেবোর্নের স্কুলে, ফার্সী ভাষাও কয়েক বছরের মধ্যে তিনি আয়ত্ত করেন। পালক পিতার মৃত্যুর পর তাঁকেই বিস্তৃত জমিদারী পরিচালনার ভার নিতে হয়। ফলে অল্প বয়সেই তিন প্রজাস্বত্ব এবং জমিদারী সংক্রান্ত আইনকানুনে বিশেষ দক্ষতা লাভ করেন। এরপর আইন অধ্যয়ন করে তিনি বহু রাজা মহারাজা ও জমিদারের আইন বিষয়ক প্রতিনিধি হন। এর সঙ্গে (কিছু প্রতিষ্ঠানের) ব্যবসায়িক প্রতিনিধিত্বও করতে থাকেন। ২৪ পরগণার সল্ট এজেন্ট ও কালেক্টরের সেরেস্তাদারের চাকরিও করেন। পরে তিনি ঐ দফতরের দেওয়ান পদ লাভ করেন। আবগারী, আফিম ও লবণ পর্ষদের দেওয়ানীও করতে থাকেন। কিন্তু স্বাধীন জীবনযাপনে আগ্রহী দ্বারকানাথ ১৮৩৪-এর আগস্ট মাসে চাকরি ত্যাগ করে ‘মেসার্স কার টেগোর অ্যাণ্ড কোম্পানি’ প্রতিষ্ঠা করেন ৷ এই কোম্পানির পরিচালনায় বিভিন্ন স্থানে তিনি কয়েকটি কারখানা স্থাপন করেন। আবার, তাঁর দয়া, দান ও জনকল্যাণ চিন্তাও ছিল অতুলনীয়। তখন এমন কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বা সামাজিক, রাজনৈতিক কিংবা দাতব্য প্রতিষ্ঠান ছিল না যা তাঁর সহযোগিতা বা পর্যাপ্ত আর্থিক সাহায্য লাভ করেনি। হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠা ও সংগঠিত করার ব্যাপারে তিনি সক্রিয় অংশ নেন। মেডিক্যাল কলেজের মঙ্গলের জন্যও তাঁর আগ্রহের অবধি ছিল না। ১৮৩৬-এর এপ্রিলে তিনি ল্যাণ্ড হোল্ডার্স সোসাইটি প্রতিষ্ঠা করেন ৷ প্রধানত তাঁরই প্রেরণায় ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট পদটি সৃষ্ট হয়। তিনি সংবাদপত্রের স্বাধীনতার একজন উৎসাহী প্রবক্তা ছিলেন।
১৮৪২-এর ৯ এপ্রিল তিনি ইউরোপ অভিমুখে যাত্রা করেন। রোমে তিনি পোপের সঙ্গে পরিচিত হন। ১০ জুন তিনি পৌঁছলেন লণ্ডন–এখানে তাঁকে সোৎসাহ অভ্যর্থনা জানান হল। ব্যক্তিগত ও প্রতিষ্ঠানগতভাবে তাঁকে কয়েকটি ভোজসভায় আপ্যায়ন জানান হয়। ১৬ জুন তিনি মহামান্য মহারাণীর সাক্ষাতের সম্মান লাভ করেন– তাঁর পূর্বে আর কোন ভারতীয়ের এ সম্মানলাভের সৌভাগ্য হয়নি। বাকিংহাম প্রাসাদে মহামান্য মহারাণী তাঁকে এক ভোজে আপ্যায়িত করেন। মহামান্যা মহারাণীর আমন্ত্রণে তিনি সেনাবাহিনীর কুচকাওয়াজ ও পূর্ণাবয়ব প্রতিকৃতি কলকাতাকে তাঁর মারফৎ উপহার দিবার অনুরোধ জানান, মহারাণী তাঁর প্রার্থনা মঞ্জুর করেণ। প্রতিকৃতি দুখানি কলকাতার টাউন হলের তিন তলায় এখনও টাঙানো আছে। দ্বারকানাথ স্কটল্যাও গিয়েছিলেন, সেখানেও যাত্রা করেন, ফেরার পথে ফ্রান্সের রাজা লুই ফিলিপ তাঁর সঙ্গে দেখা করে তাঁকে সম্মানিত করেন।
(প্রত্যাবর্তনের পর) দ্বারকানাথই ছিলেন কলকাতার সর্বাপেক্ষা প্রভাবশালী ব্যক্তি তাঁর বেলগাছিয়া ভিলা (এখন পাইকপাড়া রাজাদের সম্পত্তি) সেসময় প্রতি সন্ধ্যায় আমন্ত্রিত সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিগণকে প্রদত্ত ভোজসভা এবং অন্যান্য সামাজিক আমোদপ্রমোদে মুখরিত হয়ে থাকত।
১৮৪৫ এ তিনি পুনরায় ইংল্যান্ড অভিমুখে যাত্রা করলেন। পথে তিনি কায়রোতে মিশরের ভাইসরয়ের এবং নেসে ইটালির রাজার কাছ থেকে সংবর্ধনা লাভ করেন। (ইংল্যান্ডে) মহামান্যা মহারাণী বিশেষ আন্তরিকতার সঙ্গে স্বীয় বসবার ঘরে তাঁকে অভ্যর্থনা জানালেন। মহারাণীর ইচ্ছা অনুযায়ী তিনি সিংহাসনের পিছনে দাঁড়াবার অধিকার পেলেন–খুব অল্পসংখ্যক ব্যক্তিই এ মর্যাদার অধিকারী হতে পারেন। ভারতবর্ষ থেকে দ্বারকানাথ মহারাণীর জন্য কিছু উপহার নিয়ে গিয়েছিলেন। মহারাণী সাদরে সেগুলি গ্রহণ করেন। বিশেষ আমন্ত্রণে দ্বারকানাথ বাকিংহাম প্রসাদে গেলে মহারাণীর নির্দেশ অনুযায়ী তাঁকে মহারাণী ও প্রিন্স আলবার্টের ক্ষুদ্রাকৃতি প্রতিকৃতি উপহার দেওয়া হয়; তাতে লেখা রইল : ‘ভিক্টোরিয়া আর আলবার্টের পক্ষ থেকে দ্বারকানাথ ঠাকুরকে সাদর উপহার– বাকিংহাম প্রাসাদ, জুলাই ৮, ১৮৪৫।
এ বছরই তিনি আয়ারল্যান্ড পরিদর্শনে গেলে সেখানকার ভাইসরয় তাঁকে সাদর সংবর্ধনা জানান। ঐ বছর ‘ইন্ডিয়ান প্রিন্স’ নামে খ্যাত দ্বারকানাথকে ডাচেস অব ইনভারনেস এক ভোজসভায় আপ্যায়িত করেন। ঐ ভোজসভাতেই দ্বারকানাথের কম্পজ্বর পরিণত হয়। চিকিৎসার জন্য তাঁকে লন্ডন আনা হয়। কম্পজ্বর ক্রমে পালাজ্বরে পরিণত হয়। এই জ্বরে ভুগেই ১৮৪৬ এর ১ আগস্ট তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন; তখন তাঁর বয়স ৫২ বছর মাত্র। বেশ কয়েকজন সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি তাঁর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার যোগদান করেন। তাঁর শবাধারে দুটি রৌপ্যফলক বসিয়ে তাতে ইংরেজি ও বাংলায় লেখা হয়––বাবু দ্বারকানাথ ঠাকুর, জমিদার, ৫২ বছর বয়সে ১৮৪৬ এর ১ আগস্ট শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। (দ্বারকানাথের জীবনের বিস্তৃত বিবরণীর জন্য কিশোরীচাঁদ মিত্র লিখিত ও মেসার্স থ্যাকার স্পিঙ্ক অ্যান্ড কোম্পানি কর্তৃক ১৮৭০ এ প্রকাশিত ‘মেময়র্স অব দ্বারকানাথ টেগোর’ দ্রষ্টব্য)।
দ্বারকানাথ মৃত্যুকালে তিন সুশিক্ষিত পুত্র রেখে যান : দেবেন্দ্রনাথ, গিরীন্দ্রনাথ এবং নগেন্দ্রনাথ। এঁদের মদ্যে জ্যেষ্ঠ দেবেন্দ্রনাথ ‘ভারতীয় ঋষি’ নামে বিখ্যাত।