দ্বাবিংশ পরিচ্ছেদ – গোবিন্দরামের বাটী
প্রাতঃকালে শ্বশুর-জামাতা কলিকাতায় গমন করিলে, একটি কৃষ্ণবর্ণা যুবতী গোবিন্দরামের দ্বারদেশে আসিয়া উপস্থিত হইল। দ্বারবান্ জিজ্ঞাসিল “কিয়া মাংতি?”
যুবতী হাসিয়া উত্তর করিল, “ভিতর্ মে যানে কি মাংতা।”
বাঙ্গালিনীর মুখে হিন্দী কথা শুনিয়া দ্বারবান্ কিঞ্চিৎ আশ্চৰ্য্য হইয়া তাহার মুখপানে তাকাইল, মুখ দেখিয়া মোহিত হইয়া গেল। তেমন সুন্দর মুখমণ্ডল, ললাট ও নাসিকা, তেমন মনোহর নয়নযুগল, কপোল ও ওষ্ঠাধর, সে আর কখনও দেখে নাই। বস্তুতঃ যুবতীর সমস্ত অবয়বে কোথাও একটুমাত্র খুঁৎ ছিল না, সে সুঠাম দেহলতা, সুনিপুণ ভাস্করকৃত শিল্পাদর্শের স্বরূপ।
যুবতী পুনশ্চ বলিল, “কিয়া দেখতে হো?”
দ্বারবান্ থতমত খাইয়া উত্তর করিল, “আপ্ ভিতর মে যাইয়ে, অন্দর্ মে যাইয়ে।”
যুবতী অকুতোভয়ে পুরীমধ্যে প্রবেশ করিয়া অন্তঃপুরে যাইয়া বলিল, “কোথা গো, মা, কোথা?”
ঝি উপরের দালান ঝাঁটি দিতেছিল, গরাদে ধরিয়া মুখ বাড়াইয়া জিজ্ঞাসিল, “কে গা?”
যুবতী উত্তর করিল, “ও গো চিনতে পারবে না, তোমাদের সিঁড়ী কোন্ দিকে?”
দেওয়ানের গৃহিণী বিনোদিনী দালানে আসিয়া জিজ্ঞাসিল, “কে রে?”
দাসী। কে এক মাগী এসে চীৎকার করছে।
বিনোদিনী। ছি ছি, চুপ কর, শুনতে পাবে যে। ওকে উপরে আসতে বল্গা।
দাসী। ঐ যে গো, তোমার ওই পূব ধারে সিঁড়ী উঠে এসনা।
এই কৃষ্ণবর্ণা যুবতী কলা। কলা আহুত হইয়া বিনোদিনীর সমীপে আসিয়া উপস্থিত হইল, এবং তাঁহার আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করিয়া জিজ্ঞাসিল, “তুমি কি দেওয়ান মহাশয়ের স্ত্রী?”
বিনোদিনী সলজ্জভাবে মস্তক অবনত করিল, কোন উত্তর দিল না।
কজ্জলা। বুঝতে পেরেছি, তুমিই আমার মা
বিনো। কি জন্য আসা হয়েছে?
কজ্জলা বলিল, “আমি বড় দুঃখিনী, আমার একখানি কুঁড়ে ঘর ছিল, ঘরখানি আগুন লেগে সেদিন পুড়ে গেছে—আমিও যদি সেই সঙ্গে পুড়ে মরতেম, তা হ’লে আমার সকল যন্ত্রণা শেষ হত। সে অগ্নিকুণ্ড হ’তে তোমার স্বামীই আমায় উদ্ধার করেন, তাঁর মত দয়ার সাগর আমি আর কোথাও দেখি নাই, আমার প্রাণরক্ষা ক’রে বললেন, ‘দেখ তুই নবমী-পূজার দিন আমার সঙ্গে একবার সাক্ষাৎ করিস, আমি তোর ঘর বাঁধবার জন্য কিছু টাকা দিব।’ তাই মা, তাঁর সঙ্গে একবার দেখা করতে এসেছি।”
দাসী। তুই ত বড় হ্যাঁচ্কারা মাগী দেখতে পাই, এই কাল রাত্তিরে আমাদের যথা-সৰ্ব্বস্ব চুরি গেছে, আর তুই কি না আজ রাত পোহাতেই ভিক্ষা মাগতে এসেছিস।
বিনোদিনী কিঞ্চিৎ বিরক্তভাবে বলিল, “চুরি গেছে তা ও কেমন করে জানবে? ওকে আসতে বলেছিলেন, তাই এসেছে।”
কজ্জলা। আমি শুনেছিলাম, তোমার বাপের বাড়ীতে ডাকাতি হয়েছিল, এখানেও আবার ডাকাতি হলো?
দাসী। আহা, বাবু চাকুরী করে এঁর জন্যে প্রায় দশ হাজার টাকার গহনা এনেছিলেন, সেগুলি সবই নিয়ে গেছে।
বিনো। এখন আরও যে অদৃষ্টে কি আছে, তা কে বলতে পারে। মা, আমার বড় ভয় হয়, পাছে তাঁর কোন অমঙ্গল ঘটে।
কজ্জলা। মা, তুমি ভেব না, আমি বলছি, তোমার মন্দ কখনও হবে না।
“আমি বেশ বুঝতে পারছি, আমার এ জীবন কেবল দুঃখেই যাবে; তা না হলে, আমায় আটবছরের রেখে, মা আমার মরে যাবেন কেন?” বলিয়া বিনোদিনী অধোবদনে কাঁদিতে লাগিলেন।
কজ্জলার কোমল হৃদয় করুণাপ্লাবিত হইল। বিনোদিনীর মলিন মুখ তাহার আর সহ্য হইল না, সে অবস্থায় বৈষম্য ভুলিয়া গেল, এবং চিবুক ধরিয়া তাঁহার মুখখানি উন্নত করিয়া, নিজ বসনাঞ্চলে নয়নজল মুছাইয়া দিয়া গদগদ স্বরে বলিল, “মা আমার সাক্ষাৎ কমলা, যার মুখ দেখলে বুক জুড়াইয়া যায়, সে কি কখন দুঃখ পায়? মা, তুমি কেঁদ না, তোমার স্বামীর কখনও অমঙ্গল হবে না—মা দুর্গা তাঁকে রক্ষা করবেন। তোমার সেই সকল অলঙ্কারগুলি যেদিন তোমার গায়ে দেখব, সেইদিন আমার জীবন সার্থক হবে। মা, এই হতভাগিনী কাঙ্গালিনীকে মনে রেখ।”
এইমাত্র বলিয়া কলা চলিয়া গেল—যতদূর তাহাকে দেখা গেল, বিনোদিনী অবাক হইয়া তাহার দিকে চাহিয়া রহিলেন।