দ্বাদশ অধ্যায়—দেবীমাহাত্ম্য ফলশ্রুতি
দেবী কহিলেন, এই সকল স্তব দ্বারা যে ব্যক্তি সমাহিত-চিত্তে আমার স্তুতি করিবে আমি তাহার সকল প্রকার বাধা নিশ্চয়ই বিনষ্ট করিব। মধুকৈটভনাশ, মহিষাসুরবধ ও শুম্ভ-নিশুম্ভ-বধরূপ মদীয় (আমার) মাহাত্ম্য একচিত্তে ভক্তিসহকারে যাহারা অষ্টমী, চতুর্দ্দশী, অথবা নবমী তিথিতে কীর্ত্তন করিবে বা শ্রবণ করিবে, তাহাদের পাপ কিংবা পাপজন্য আপদ্ কখনই থাকিবে না। তাহাদিগের দারিদ্র্য হইবে না; বন্ধু বিয়োগ হইবে না; শত্রু হইতে, দস্যু হইতে কিংবা রাজা হইতে কোন স্থলে ভয় থাকিবে না, এবং শস্ত্র, অনল ও জলসমূহ হইতেও ভয় থাকিবে না। অতএব মদীয় (আমার) মাহাত্ম্য সমাহিত হইয়া পাঠ করিবে ও শ্রবণ করিবে। আমার সেই মাহাত্ম্যই সর্ব্বোৎকৃষ্ট স্বস্ত্যয়ন (মঙ্গলের আগমন হয় যা দ্বারা, অর্থাৎ আপদ্ শান্তি কামনায় হোম ইত্যাদি বৈদিক মঙ্গলকর্মের অনুষ্ঠান)। ১–৬
মদীয় এই মাহাত্ম্য মহামারী-সমুত্থিত নানাবিধ উপসর্গ ও ত্রিবিধ উৎপাত (ত্রিবিধ দুঃখ) দূর করে। যে গৃহে আমার এই মাহাত্ম্য সম্যক্ প্রকারে প্রতিদিন পঠিত হয়, আমি সেই গৃহ পরিত্যাগ করি না; সেইখানে আমার সান্নিধ্য হয়। বলিপ্রদানে, পূজাসময়ে, হোমকার্য্য প্রভৃতি মহোৎসবে আমার এই সকল চরিত (কার্যকলাপ, জীবনবৃত্তান্ত) উচ্চারণ ও শ্রবণ করা উচিত। লোকগণ জ্ঞানপূর্ব্বকই হউক, বা অজ্ঞানপূর্ব্বকই হউক, আমার বলিযুক্ত পূজা বা হোম করিলে, সেই পূজা ও হোম আমি গ্রহণ করি। শরৎকালে বার্ষিকী যে মহাপূজা কৃত হয়, সেই পূজাকালে আমার এই মাহাত্ম্য ভক্তিপূর্ব্বক শ্রবণ করিলে মনুষ্য মৎপ্রসাদে (আমার অনুগ্রহে) সর্ব্বপ্রকার বিপদ্ হইতে মুক্তিলাভ করে এবং ধন, ধান্য ও সুত-সমন্বিত হয়। ৭–১২
আমার এই মাহাত্ম্য, এই শুভ উৎপত্তির কথা এবং যুদ্ধসমূহে পরাক্রম শ্রবণ করিলে পুরুষ নির্ভয় হয়। তাহার রিপুগণ (শত্রুরা) বিনষ্ট হয় ও কল্যাণ হয়। মদীয় মাহাত্ম্য শ্রবণকারী পুরুষগণের কুল (বংশ) আনন্দযুক্ত হয়। সর্ব্বত্রই শান্তিকর্ম্মে, দুঃস্বপ্নদর্শনে ও ভয়ঙ্কর গ্রহপীড়াকালে আমার মাহাত্ম্য শ্রবণ করিবে; শ্রবণ করিলে উপসর্গ ও দারুণ গ্রহপীড়া সকল শান্ত হয় ও মনুষ্যদৃষ্ট দুঃস্বপ্নও সুস্বপ্নের ন্যায় সুফল প্রদান করে (অর্থাৎ দুঃস্বপ্ন, সুস্বপ্নে পরিণত হয়)। আমার এই সকল মাহাত্ম্য ভূতবিশেষপীড়িত বালকগণের শান্তিকারক, মনুষ্যদিগের সংঘাতভেদে উত্তম মৈত্রীকরণ (দলাদলি হলে, সেখানে মৈত্রী স্থাপন করে), অশেষ দুর্ব্বৃত্তগণের উৎকৃষ্ট বলহারক (দুর্ব্বৃত্তদের শক্তিনাশ করে) এবং পাঠমাত্রেই ইহা রাক্ষস, ভূত ও পিশাচগণের বিনাশ করে। ১৩–১৮
আমার এই সকল মাহাত্ম্যই আমার সন্নিধিকারক (সান্নিধ্যে বা নিকটে নিয়ে আসে)। উৎকৃষ্ট পশু, পুষ্প, অর্ঘ্য, ধূপ, গন্ধ, দীপ, ব্রাহ্মণভোজন, হোম, প্রোক্ষণীয় (পূজার সময় পুরোহিত দ্বারা যে জল ছেটানো হয়) ও অন্যান্য বিবিধ ভোগ দ্বারা একবৎসরকাল দিবানিশি পূজা করিলে আমার যাদৃশ প্রীতি হয়, এই মাহাত্ম্য একবার মাত্র শ্রুত হইলেই আমার তাদৃশ প্রীতি হইয়া থাকে। আমার মাহাত্ম্য, শ্রুত হইলে, পাপ সকল হরণ করে এবং আরোগ্য প্রদান করে। আমার জন্মসমূহের কীর্ত্তন ভূতগণ হইতে রক্ষা করে। যুদ্ধসমূহে শত্রুনিবর্হণ যে মদীয় চরিত (আমার দৈত্যবিনাশকারী যুদ্ধের বিবরণ), তাহা শ্রবণ করিলে, পুরুষদিগের বৈরিকৃত (শত্রুজনিত) ভয় থাকে না। তোমরা যে সকল স্তুতি করিয়াছ, ব্রহ্মর্ষিগণ যে সকল স্তুতি করিয়াছেন এবং ব্রহ্মা যে সকল স্তুতি করিয়াছেন; সেই সকল স্তব পঠিত হইলে শুভমতি প্রদান করে। ১৯–২৪
দস্যুজনে বেষ্টিত হইলে, মিত্ররহিত স্থানে শত্রুগণ কর্ত্তৃক বেষ্টিত হইলে, সিংহ বা ব্যাঘ্র পশ্চাদ্ধাবিত হইলে, বনে বনহস্তী দ্বারা অনুসৃত হইলে, ক্রুদ্ধ রাজা কর্ত্তৃক বধার্থ আদিষ্ট (আদেশপ্রাপ্ত) হইলে, বন্ধনগত হইলে (কেউ যদি বেঁধে রাখে), মহাসমুদ্রে পোতস্থ (নৌকা, জাহাজ ইত্যাদি জলযানে অবস্থিত) হইয়া বায়ু দ্বারা আঘূর্ণিত হইলে, অতি ভয়ানক সংগ্রামে শস্ত্রসমূহ পতিত হইতে থাকিলে, অধিক কি, সর্ব্বপ্রকার ভয়ঙ্কর বিপত্তিতেই যন্ত্রণাভিভূত হইলে, মনুষ্য যদি মচ্চরিত্র (আমার কার্যকলাপ বা জীবনবৃত্তান্ত) স্মরণ করে, তাহা হইলে সর্ব্বপ্রকার সঙ্কট হইতে মুক্ত হয়। মদীয় চরিত যে ব্যক্তি স্মরণ করে, তাহাকে দূর হইতে দেখিয়া মৎপ্রভাবে (আমার প্রভাবে) সিংহাদি হিংস্রজন্তু, দস্যুগণ ও শত্রুসমূহ পলায়ন করে। ২৫–২৯
ঋষি কহিলেন, এই কথা বলিয়া চণ্ডবিক্রমা (ভীষণ পরাক্রম যার) চণ্ডিকা অবলোকনকারী দেবগণের সম্মুখ হইতে সেই স্থানে অন্তর্দ্ধান করিলেন। সেই নিহতবৈরী (যাদের শত্রু নিহত হয়েছে) দেবগণও নির্ভয়ে যজ্ঞভাগ ভোজন করত স্ব স্ব বিষয় অধিকার করিতে লাগিলেন। জগদ্বিধ্বংসী অতুল-বিক্রম দেবশত্রু শুম্ভ ও মহাবীর্য্য নিশুম্ভ যুদ্ধক্ষেত্রে দেবী কর্ত্তৃক হত হইলে, অবশিষ্ট দৈত্যগণ পাতালে গমন করিল। ৩০–৩৩
হে ভূপ! সেই দেবী নিত্যা হইলেও, এইরূপে পুনঃ পুনঃ উৎপত্তি লাভ করিয়া জগতের পরিপালন করেন। সেই ভগবতী এই বিশ্বকে মোহিত করেন, তিনিই এই বিশ্বকে প্রসব করেন, এবং তাঁহার নিকট প্রার্থনা করিলে তিনি সন্তুষ্ট হইয়া তত্ত্বজ্ঞান ও ঐশ্বর্য্য প্রদান করেন। হে মনুজেশ্বর (মনু যিনি ব্রহ্মার মানসপুত্র, তার থেকে জাত অর্থাৎ মনুর সন্তান অর্থাৎ মানবদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ অর্থাৎ রাজা)! তিনিই এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড ব্যাপ্ত করিয়া আছেন। তিনি প্রলয়সময়ে মহামারীস্বরূপিণী মহাকালীরূপে প্রাদুর্ভূতা হন। তিনি যথাকালে (বিনাশের সময়) মহামারী স্বরূপা এবং তিনি স্বয়ং নিত্যা অথচ ব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টিস্বরূপা। সেই সনাতনী দেবী যথাসময়ে প্রাণীদিগের পালন করিয়া থাকেন। মঙ্গলসময়ে তিনিই মনুষ্যদিগের গৃহে নানাবিধ ঐশ্বর্য্য প্রদান করেন। তাঁহার অভাবে বিনাশের নিমিত্ত লক্ষ্মী অন্তর্হিতা হইয়া থাকেন। তাঁহার স্তব করিলে এবং গন্ধ, পুষ্প, ধূপ, দীপাদি দ্বারা পূজা করিলে তিনি ধন, পুত্র ও কর্ম্মে শুভমতি প্রদান করিয়া থাকেন। ৩৪–৩৯
দ্বাদশ অধ্যায় সমাপ্ত॥১২॥
—