দ্বাত্রিংশ পরিচ্ছেদ – তদারক
এক প্রকাণ্ড বটবৃক্ষের বিস্তৃত ছায়ায় ফৌজদারী বৈঠক হইয়াছে। ধনুরাকারে বিন্যস্ত পাঁচখানি চৌকীতে জগন্নাথ বক্সী, বিশ্বনাথ ঘোষ, রাঘব সেন, গোবিন্দরাম নিয়োগী এবং হলধর ঘোষ উপবেশন করিয়াছেন; কিঞ্চিদ্দূরে অপর একখানি চৌকীতে দীর্ঘশ্মশ্রু ফতেউল্লা বসিয়াছে। একপার্শ্বে জমাদার চৌকীদার প্রভৃতি দারোগার অনুচরবর্গ এবং ভীম সর্দ্দার, টিকারাম ও পাঁচজন দাঁড়ী-মাঝী; অপর পার্শ্বে আটজন ফৌজদারী সিপাহী ও কয়েকজন চাপরাসী দাঁড়াইয়া আছে, সম্মুখে বিস্তর লোকের-জনতা হইয়াছে। সকলেই নীরব, কেহ কোন কথা কহিতেছে না।
প্রথমে জগন্নাথ বক্সী সহাস্যবদনে বিশ্বনাথ ঘোষকে জিজ্ঞাসিলেন, “আপনার হস্তে পিস্তল কেন?”
বিশ্বনাথ। আত্মরক্ষার জন্য, ইহা সর্ব্বদাই আমি নিকটে রাখিয়া থাকি।
জগন্নাথ। আপনার ত ভারি ভয় দেখছি?
বিশ্বনাথ ঘোষ ঈষদ্ধাস্য সহকারে উত্তর করিলেন, “আপনার অপেক্ষা বোধ হয়, বেশি নয়।”
জগন্নাথ কিঞ্চিৎ অপ্রতিভ হইয়া বলিলেন, “সে যাহা হউক, এখন সকলেই ত উপস্থিত হইয়াছে, কার্য্য আরম্ভ করা যাউক না কেন? “
বিশ্ব। হাঁ, আর বেলা বাড়াইবার প্রয়োজন কি?
জগ। দারোগা সাহেব, তবে আসামীদের জবানবন্দী হোক।
ফতেউল্লা পাঁচজন দাঁড়ী-মাঝীকে সামনে আনাইয়া গোবিন্দরামকে নির্দ্দেশ করিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “ঐ বাবুকে তোরা সেদিন নৌকা করে নিয়ে গেছলি?”
মাঝী উত্তর করিল, “আজ্ঞে হাঁ হুজুর।”
দারোগা। বাবুর সঙ্গে আর কে ছিল?
মাঝী। ঐ টিকারাম আর ভীম সর্দ্দার ছিল।
দারোগা। আর কেউ ছিল না?
মাঝী। হাঁ, আর একটি স্ত্রীলোক ছিল।
দারোগা। সে স্ত্রীলোকটি বাবুর কে?
মাঝী। তা মশাই, আমরা জানি না।
দারোগা। আচ্ছা, বাবু কোথা যাচ্ছিলেন?
মাঝী। বাবু বলেছিলেন, কলিকাতায় যাবেন।
দারোগা। কলিকাতায় যাবেন বলেছিলেন, তা সেখানে যাওয়া হয় নাই?
মাঝী। তা কৈ আর সেখানে যাওয়া হ’ল, হুজুর?
দারোগা। কেন, যাওয়া হ’ল না কেন?
মাঝী। কামারহাটি ছাড়িয়ে, ঘোলঘাটের কাছে আসবামাত্র বাবু বললেন, “ঐ যে একখান নৌকা দেখা যাচ্ছে, ঐখানাকে ধরগে যা।”
ভীম সর্দ্দার অধর দংশন করিয়া সকোপে বলিয়া উঠিল, “শালারা ঠিক উল্টো বলছিস্, ধৰ্ম্ম পানে চেয়ে কথা ক।”
দারোগা। তুই এখন চুপ কর, তার পর?
মাঝী। তার পর, আমরা সেই নৌকাখানা ধরলাম। ভীম সর্দ্দার, টীকারাম আর বাবু সেই নৌকায় উঠে মারপিট আরম্ভ করলেন।
টিকারাম। নেই নেই—ও বাত্ নেহি, হাম্ তো কুছ্ নেহি কিয়া, হাম্ ত দরিয়া মে গীর গিয়া থা।
মাঝী। হাঁ, ও সেই হুড়াহুড়িতে জলে পড়ে গিয়েছিল বটে।
দারোগা। তার পর?
মাঝী। তার পর সেই নৌকার দুজন দাঁড়ী আর একজন চড়ন্দার জলে ঝাঁপ দিয়া পড়ল, তৎক্ষণাৎ একটা বন্দুকের আওয়াজ হ’ল, একটা দাঁড়ী নৌকার উপর পড়ে গেল, আর তার মুখ দিয়ে ভলকে ভলকে রক্ত উঠতে লাগল।
দারোগা। আচ্ছা, বলে যাও।
মাঝী। তারপর ঐ বাবু আর ঐ ভীম সর্দ্দার, সেই নৌকার মাঝী—এই ধৰ্ম্মদাসকে, বেঁধে ফেললেন, আর আমাদের বললেন, ‘তোদের নৌকাখানা এই নৌকার পাছায় বেঁধে নৌকা ফিরিয়ে নিয়ে শ্রীরামপুরে চল্।”
দারোগা। তবে বাবুর আর কলিকাতায় যাওয়া হ’ল না?
মাঝী। তা কৈ হ’ল হুজুর! বাবু আমাদের শ্রীরামপুরের থানার ঘাটে নৌকা লাগাতে বললেন। আমরা নৌকা ভিড়ালেম।
দারোগা। তার পর?
মাঝী। তারপর বাবু ধৰ্ম্মদাসকে আর ধনা মুচির সেই লাসটা থানায় দিয়ে এসে; আমাদের বৈদ্যবাটীর ঘাটে যেতে বললেন। আমরা সেইখানে গিয়ে নৌকা লাগালেম, আর বাবুর হুকুম মত এককুড়ি পাঁচটা রেসমের গাঁট, হাটের রাস্তায় তুলে দিলুম। তারপর বাবু আমাদের ভাড়া চুকিয়ে দিলেন, আমরা চলে গেলুম। যে নৌকা লুঠ হয়েছিল, সে নৌকাখানা এখনও আমাদের কাছে আছে।
দারোগা। আচ্ছা, তোরা এখন ঐখানে বসগে যা। ভীম সর্দ্দার কার নাম?
ভীম। আমার নাম
জগন্নাথ। বেটা ভীমই বটে, ঐ বেটাই নিশ্চয় খুন করেছে।
ভীম অধর দংশন করিয়া লৌহবদ্ধ হস্তদ্বয় জগন্নাথ বক্সীর দিকে বাড়াইয়া তৎক্ষণাৎ বলিল, “আর ঐ বেটা নিশ্চয় ঘুস খেয়েছে।”
ভীমের মুখ হইতে ঘুসের কথা উচ্চারিত হইতে-না-হইতে ফতেউল্লা বজ্রমুষ্টিতে তাহার মুখে একটা ঘুসি মারিল; কৃতজ্ঞ ভীম ঘুসি খাইয়া চুপ করিয়া থাকিবার পাত্র নয়, সে তৎক্ষণাৎ লৌহ- জড়িত দুইটি হস্ত সজোরে মিঞাসাহেবের মস্তকে ন্যস্ত করিয়া তাহাকে আশীর্ব্বাদ করিল। তিন- চারিজন চৌকীদার দৌড়িয়া আসিয়া ফতেউল্লার মস্তকে আর্দ্রবস্ত্র বাঁধিয়া দিল এবং ভীম সদারকে ধরিয়া তাহার বদ্ধ হস্তদ্বয় শৃঙ্খল দ্বারা পদ যুগলের সহিত যোজিত করিয়া তাহাকে সেইখানে বসাইয়া রাখিল।
জগন্নাথ। বেটা ভয়ানক বদমাস, ও যে সহজে কবুল করবে, তা বোধ হয় না।
ভীম। ওরে পাজী ও ঘুসখোর, ‘কবুল করবে’ কিরে? কি দোষ করেছি? কি কবুল করবো?
দারোগা। তুই খুন করিস নি?
ভীম। না।
দারোগা। তবে কে করেছে?
ভীম। তুই কি জানিস্ নি?
দারোগা। বেটা চালাকী পেয়েছে বটে? জমাদার-
জমাদার। হাজির—
দারোগা। বেটাকে বাঁদর-নাচ নাচাও।
জমাদার “বল্ শালা, বল্, কবুল কর” বলিয়া ভীমের পৃষ্ঠে সজোরে বেত্রাঘাত করিল। ভীম কিছুমাত্র বিচলিত হইল না–অম্লানবদনে সেই দারুণ প্রহার সহ্য করিল। সুতরাং দারোগার বাঁদর নাচ্ দেখিবার সাধ মিটিল না। কিন্তু সে বেত্রাঘাত দেওয়ানের হৃদয়ে বাজিল। তিনি বলিয়া উঠিলেন, “আহা, উহাকে মারিতেছ কেন? আমি ত পূর্ব্বেই দারোগাকে বলিয়াছি যে, আমি খুন করিয়াছি।”
দারোগা। চুপি চুপি আমার কাছে বলিলে ত চলিবে না, দশের কাছে কবুল করতে হবে।
দেওয়ান। আমি প্রকাশ্যে বলিতেছি যে, আমি খুন করিয়াছি।
দারোগা, হুগলীর ফৌজদারকে সম্বোধন করিয়া বলিলেন, “শুনিলেন ত।”
জগ। হাঁ, সকলেই শুনিলাম, আর বামালও আমার সামনে ঐ বাবুর বাড়ী হইতে বাহির হইয়াছে। কেমন বিশ্বনাথ, সব শুনলে? দেওয়ানের অপরাধ সপ্রমাণ হতে আর কিছু বাকী রহিল কি?
বিশ্ব। হাঁ, যথেষ্ট প্রমাণ পাওয়া গেছে।
জগ। তবে এখন কি আর আমি দেওয়ানকে খোলসা রাখিতে পারি?
“ওঁর হাতে হাতকড়ি দিতে চান? তা অবশ্য, আপনার কর্ত্তব্য আপনি অবশ্য করিবেন, কিন্তু এই সময়ে একটু সাবধান হওয়া আবশ্যক, দেওয়ানজী বড়লোক, ওঁর অনেক লোকজনও এখানে উপস্থিত আছে, এই সময়ে একটা দাঙ্গা-হাঙ্গাম হইবার বিলক্ষণ সম্ভাবনা।” ইহা বলিয়া বিশ্বনাথ ঘোষ করস্থ পিস্তল বাড়াইয়া ধরিয়া, সম্মুখের লোকদিগকে সরিয়া যাইতে বলিয়া একটি ফাঁকা আওয়াজ করিলেন, তৎক্ষণাৎ অপরদিক হইতে আর একটি বন্দুকের আওয়াজ হইল এবং বারজন সিপাহী হাবিলদারসহ তথায় আসিয়া শ্রেণীবদ্ধ হইয়া দাঁড়াইল। তখন তিনি করস্থ পিস্তল ঊরুদেশে ন্যস্ত করিয়া, দক্ষিণহস্ত প্রসারণপূর্ব্বক বলিলেন, “কৈ হাতকড়ী কাহার কাছে? আমায় দাও।”
দারোগা। আপনার তকলিফ্ স্বীকার করিবার দরকার কি? জমাদার, এই নাও, ঐ আসামীর হাতে পরাইয়া দাও।
বিশ্ব। একটু অপেক্ষা কর, আমি সেন মহাশয়কে একটা কথা জিজ্ঞাসা করিব।
রাঘব। আজ্ঞে করুন।
বিশ্বনাথ ঘোষ অঙ্গরাখার অভ্যন্তর হইতে একখানি কাগজ (জুলিয়ার এজেহার) বাহির করিয়া দেখিতে দেখিতে রাঘব সেনকে জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘পরশ্ব রাত্রি এক প্রহরের পর কেহ আপনার গুদামের চাবি চাহিতে আসিয়াছিল?”
রাঘব। কৈ না।
বিশ্ব। আপনি বেশ করিয়া স্মরণ করিয়া দেখুন।
রা। কৈ আমার ত কিছুই স্মরণ হইতেছে না।
বিশ্ব। আচ্ছা, আমি আপনাকে স্মরণ করাইয়া দিতেছি। যখন সেই লোকটি চাবি চাহিতে আসে, তখন আপনি বাইজী জুলিয়ার সহিত কথা কহিতেছিলেন?
রা। জুলিয়া ত পরশ্ব প্রাতে আমার এখান হইতে বিদায় হইয়া গিয়াছে।
বিশ্ব। না, না, জুলিয়াকে তখন আপনি বিদায় দেন নাই, তাঁহার সম্প্রদায়ভুক্ত অপরাপর ব্যক্তিদিগকে পৃথিবী হইতে বিদায় করিয়াছিলেন।
রা। আপনার কথার মর্ম্ম আমি ভাল বুঝিতে পারিতেছি না।
বিশ্ব। ক্রমশঃ পারিবেন। জুলিয়ার গহনার বাক্স কোথায় রাখিয়াছেন?
রা। তুমি দেওয়ানের আত্মীয়, তুমি যখন এখানে আসিয়াছ—তখনই বুঝিয়াছি, একটা গোলমাল উপস্থিত করিবে। মনে করিও না, উল্টা দাবী দিয়া তুমি আমার কিছু করিতে পারিবে। তোমার মত বিস্তর ফৌজদার আমি দেখিয়াছি, চালাকী অন্যস্থানে করিও, এখানে নয়।
বিশ্ব। আপনার সহিত চালাকী করা কি আমার খাটে? কিন্তু আমি বেশ প্রমাণ পাইয়াছি যে, আপনার একটা ভয়ানক ডাকাতের দল আছে; চতুর্থীর রজনীতে সেই দল, এই বৃদ্ধ হলধর ঘোষের বাড়ীতে ডাকাতী করিয়াছে; আর অষ্টমীর রাত্রিতে দেওয়ানের বাড়ী হইতে কম-বেশ দশহাজার টাকার গহনা বাক্স সমেত চুরি করিয়া আনিয়াছে, আর তুমি নিজে জুলিয়ার সম্প্রদায়- ভুক্ত চারিজন মুসলমানকে হত্যা করিয়া তাহার সমস্ত অলঙ্কার আত্মসাৎ করিয়াছ। তোমার ঠাকুর-দালানের নীচে একটা অন্ধকারময় প্রকাণ্ড ঘর আছে, সেই ঘরে জুলিয়ার ও দেওয়ানের গহনার বাক্স লুকাইয়া রাখিয়াছ, আর একটা টাকা লাসও সেই ঘরে পোতা আছে।
রা। আপনি স্বপ্ন দেখিতেছেন নাকি? যাহা মনে আসিতেছে, তাহাই বলিয়া যাইতেছেন যে।
বিশ্ব। আমি স্বপ্ন দেখিতেছি? না—তুমি জাগিয়া ঘুমাইতেছ? আচ্ছা, তোমার ঘুম আমি এখনি ভাঙ্গাইয়া দিতেছি—চাপরাসী, সেই স্ত্রীলোকটিকে আর ক্ষুদেকে এইখানে ডাকিয়া আন।
অনতিকাল মধ্যে চাপরাসীসহ কজ্জলা ও ক্ষুদে আসিয়া উপস্থিত হইল।
বিশ্বনাথ, জগন্নাথ বক্সীকে সম্বোধন করিয়া বলিলেন, “এই সেই প্রেতিনী—গত রাত্রে যাহাকে দেখিয়া আপনি ভয় পাইয়াছিলেন; এই সেই প্রেতিনী—যে আমাকে প্রেতলোকে লইয়া গিয়াছিল এবং সেই নরক-নিবাসী প্রেতাত্মাদিগের ভয়ঙ্কর রহস্য-কথা ও রহস্যব্যাপার সকল বুঝাইয়া দিয়াছিল; এই সেই প্রেতিনী—যে নর্তকী জুলিয়ার প্রাণরক্ষা করিয়াছিল। যান, ইহার সহিত যান, স্বচক্ষে সেই ভয়ানক স্থান—পুণ্যশ্লোক রাঘব সেনের সেই কীর্তিমন্দির দেখিয়া আসুন।
জগ। তুমি যখন দেখিয়াছ, তখন আমারই দেখা হইয়াছে।
বিশ্ব। না, না, তাকি হতে পারে? এ যে আপনার এলাকা; আপনি তথায় নিজে যাইয়া দেওয়ানের ও জুলিয়ার গহনার বাক্স বাহির করিয়া আনুন। আপনার চারিজন ও আমার চারিজন বরকন্দাজ আপনার সঙ্গে যাউক।
হুগলীর ফৌজদার আটজন সিপাহী সঙ্গে লইয়া, কজ্জলা প্রদর্শিত পথে প্রস্থান করিলে বিশ্বনাথ ঘোষ ক্ষুদেকে সম্মুখে ডাকিয়া বলিলেন, “দেখ, সব প্রকাশ হইয়া পড়িয়াছে, গোপন করা এখন বৃথা তোমাকে যাহা জিজ্ঞাসা করিব, যদি তাহার যথার্থ উত্তর দাও, তাহা হইলে তোমার সাজা অনেক কম হইতে পারিবে—এমন কি তোমায় ছাড়িয়া দিলেও দিতে পারি।”
ক্ষু। আমি কি জানি, মশাই?
বিশ্ব। তুমি যা জান, তাই আমি তোমায় জিজ্ঞাসা করিব। বল দেখি, পরশ্ব রাত্রি এক প্রহরের পর, তুমি রাঘব সেনের কাছে রেসমের গুদামের চাবি চাহিতে গিয়াছিলে কি না?
ক্ষু। আজ্ঞে—(নীরব
বিশ্ব। ভয় কি? বল না।
ক্ষু। আজ্ঞা, বলব আর কি?
বিশ্ব। তুমি সে চাবি লইয়া কি করিলে?
ক্ষু। পঁচিশ গাঁইট রেসম নিয়ে চাবিটা কৰ্ত্তাকে দিলাম।
বিশ্ব। তুমি সে রেসম লইয়া কি করিলে?
ক্ষু। দেওয়ানের গোলাবাড়ীর খড়ের মাচার নীচে লুকাইয়া রাখিলাম।
“আচ্ছা তুমি ঐখানে বস,” বলিয়া বিশ্বনাথ ক্ষুদের জবানবন্দী লিপিবদ্ধ করিতে লাগিলেন। এই অবসরে সেই অসংখ্য দর্শকমণ্ডলীর মধ্য হইতে একজন বৈরাগী রাঘব সেনের নিকটে যাইয়া বলিল, “সব ত প্রকাশ হইয়া পড়িল, আর উপায় নাই, চারিদিকে সশস্ত্র সিপাহীদল তোমায় ঘেরিয়া আছে; এখন তোমার আজন্মার্জ্জিত মহাপাতক সকল স্মরণ করিয়া হৃদয়ের সহিত অনুতাপ কর। হৃদয়ের সহিত একবার ‘পাপোহহং পাপকৰ্ম্মাহং’ বলিয়া দীনভাবে সেই দীন- দয়াময়ের অনুকম্পা প্রার্থনা কর।”
“তুইও আমায় পরিত্যাগ করলি!” মৃদুস্বরে এই কথা বলিয়া রাঘব সেন মস্তক অবনত করিল।
বিশ্বনাথ, বৈরাগীকে সম্বোধন করিয়া বলিলেন, “কে তুমি? এদিকে এস।”
বৈরাগী তাঁহার নিকট যাইয়া বলিল, “আমি রতন শর্ম্মা।”
বিশ্বনাথ। রতন শৰ্ম্মা।
রত্না। আমি সেই রত্নাপাখী—যাহার ভয়ে তিন জেলার লোক রাত্রে নিদ্রা যাইত না।
নাম শুনিয়া ফৌজদার শিহরিয়া উঠিলেন।
রত্না পুনর্ব্বার বলিল, “আমিই হলধর ঘোষ ও গোবিন্দরামের বাড়ীতে ডাকাতী করিয়াছি। আমি ইচ্ছাপূর্ব্বক ধরা দিতেছি, আমায় গ্রেপ্তার কর। অদ্য হইতে হুগলী, যশোহর ও চব্বিশ পরগণা নিষ্কণ্টক হইল।”
এই সময়ে হুগলীর ফৌজদার, দুইটি বাক্স লইয়া কজ্জলাসহ তথায় উপস্থিত হইলেন। বিশ্বনাথ তাহাকে জুলিয়ার এজেহার ও ক্ষুদের জবানবন্দী পড়িয়া শুনাইয়া বলিলেন, “ এক্ষণে আপনার যাহা কর্ত্তব্য হয় করুন—রাঘব সেনকে আমি কলিকাতায় চালান দিব। জুলিয়া— ফরিয়াদী, রাঘব সেন—আসামী।”
জগন্নাথ। দেওয়ান যে সম্পূর্ণ নিৰ্দ্দোষী, তাহাতে আর আমার কিছুমাত্র সন্দেহ নাই। আমি এক্ষণে ধৰ্ম্মাযুগী, ক্ষুদে আর হরি ঠাকুরকে হুগলীতে লইয়া যাইব।
“আর প্রধান ডাকাত রত্নাপাখীকে ছাড়িয়া যাইবেন?” হুগলীর ফৌজদারকে এই কথা বলিয়া বিশ্বনাথ কজ্জলার দিকে ফিরিয়া, রত্নাকে নির্দ্দেশ করিয়া জিজ্ঞাসিলেন, “তুমি ইহাকে চিন? “
কজ্জলা। ওঁকে আর আমি চিনি না?
রত্না। আমি ওর ঘরে আগুন দিয়াছিলাম, ও আর আমায় চেনে না?
কজ্জলা। উনি হরিপালের রামেশ্বর ভট্টচার্য্যির ছেলে, ভাট-পাড়ার বিদ্যানিধির পোড়ো, সুপাত্র দেখে হরিহর শিরোমণি ওঁকে কন্যাদান করেন, উনি সেই বিবাহ করে গিয়েছিলেন, আর কখনও স্ত্রীর মুখ দেখেন নি—তারপর এই রাঘব সেনের দলে মিশেছেন।
রত্না। কজ্জলা, তুই মানবী—না দেবী! তুই এ সকল কথা কেমন করে জানলি? কজ্জলা উত্তর করিল না।
বিশ্বনাথ জগন্নাথকে বলিলেন, “এই সেই বিখ্যাত ডাকাইত—রত্নাপাখী।”
জগন্নাথ। একে দেখে ত ডাকাত বলে বোধ হয় না।
কজ্জলা লঘুস্বরে বিশ্বনাথকে কি বলিল, বিশ্বনাথ চমকিয়া উঠিয়া তাহার মুখের দিকে একবার তাকাইলেন, তাহার পর জগন্নাথ বক্সীকে বলিলেন, “রতন স্বেচ্ছাপূর্ব্বক এখানে উপস্থিত হইয়া সমস্ত কবুল করিয়াছে, আর এই রমণী, যাহার সাহায্যে এই জটিল মামলার গূঢ়-রহস্য সকল প্রকাশিত হইয়াছে, উহার মুক্তি ভিক্ষা করিতেছে, অতএব আমি উহাকে খালাস দিবার জন্য আপনাকে অনুরোধ করি। উহাকে ছাড়িয়া দিলে যদি উপরওয়ালারা কৈফিয়ৎ চায়, সে কৈফিয়ৎ-আমি দিব। “
জগন্নাথ। তোমার অনুরোধ আমায় অবশ্যই রক্ষা করিতে হইবে।
রত্না। কজ্জলা, আমি তোর ঘরে আগুন দিয়াছিলাম—আর তুই আজ আমার জীবন-ভিক্ষা চাচ্ছিস! তুই মানবী—না দেবী?
কজ্জলা উত্তর করিল না।
বিশ্বনাথ ঘোষ দেওয়ানকে সম্বোধন করিয়া বলিলেন, “তোমার বাক্সটি তুমি বাছিয়া লও।” দেওয়ান নিজ সম্পত্তি গ্রহণ করিলেন, তিনি অপর বাক্সটি একজন চাপরাসীর হস্তে দিয়া বলিলেন, “এই বাক্স সাবধানে রাখিবে।” তৎপরে হাবিলদারকে ডাকিয়া বলিলেন, “এই বাক্স মধ্যে অনেক টাকার গহনা আছে, খুব হুঁসিয়ার থাকিবে, এখন ঐ সেনবাবুকে গ্রেপ্তার করিয়া কলিকাতায় যাইবার উদ্যোগ কর।” (দেওয়ানের প্রতি) “আর দেওয়ান, তোমাকেও একটা কথা বলি, এই অসামান্য গুণবতী রমণীর সাহায্যেই তুমি এই ঘোর বিপদ হইতে মুক্তিলাভ করিলে এবং তোমার অপহৃত অলঙ্কারও পুনঃপ্রাপ্ত হইলে, অতএব ইনি যাহাতে যাবজ্জীবন সুখ-স্বচ্ছন্দে থাকেন, তাহার উপায় করিয়া দিও, আর তোমার এই পরাজিত শত্রু রতনশর্ম্মা এক্ষণে তোমার কৃপার পাত্র, ইহাকেও দেখিও।”
সেই দিবস বেলা তৃতীয় প্রহরের সময় ফৌজদারদ্বয় আসামীদিগকে লইয়া স্ব স্ব স্থানে প্রস্থান করিলেন। হলধর ঘোষ, ভীম-সদার, টিকারাম, দেওয়ানজী, রতনশর্ম্মা ও কজ্জলা রত্নপুরাভিমুখে যাত্রা করিলেন।