দৌড়

দৌড়

রবি যেদিন প্রথম এসে বলল—‘মা আমার সেলস ট্রেনীর চাকরিটা হয়ে গেল। ভাগ্যিস মোটরবাইকটা কিনেছিলুম!’ ঠিক সেই দিনই রাত্তিরবেলায় শুতে গিয়ে আমার হঠাৎ মনে হল আমি রাতটাকে একটা মানুষের মতো পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি। বেশ নীল রঙের কেষ্টঠাকুরের মতো, যদিও তাঁর হাত পা চোখ মুখ ইত্যাদি অঙ্গ প্রত্যঙ্গ কোথায় কেউ জিজ্ঞেস করলে আমি বলতে পারব না। কালচে নীল রঙ, চাঁদ ওঠেনি। আকাশময় তাই তারার ঝকমকানি। কেষ্টঠাকুরটি রাজকুমার হলেও তো গোপরাজকুমার! তারাগুলো কি আর চিরকিশোর সেই মূর্তির অলঙ্কারের মণি-মাণিক্য হবে? এত কথা আমার মনে এল। কেন না আমি আজকাল কিছু বললেই আমার তিন ছেলে মেয়ে বলে ওঠে—‘কেন? কেন? কেন?’ এই কেনর জবাব দেবার ক্ষমতা সব সময়ে আমার থাকে না। তাই মনে কোনও কথা উঠলেই তার কার্য কারণটা ভেবে রাখবার চেষ্টা করি। কেন যে কেষ্টঠাকুরের কথা মনে এল! কী জবাব এর? ভেবে ভেবে জবাব বার করি—আসলে এই সব পুরাণ কথা দেবদেবী আমাদের মধ্যে এমন ভাবে ঢুকে বসে আছে যে আর অন্যভাবে আমরা ভাবতে পারি না। হ্যাঁ, কী বলছিলুম? রাতটাকে আমি একটা বিরাট পুরুষের মতো দেখতে পেলুম! বিরাট, অসীম শক্তিধর, কিন্তু কিশোর। কালপুরুষটা জ্বলজ্বল করছে। কালচে নীলার মতো মখমল আকাশে। অন্ধকারের কেমন একটা অদ্ভুত গন্ধ আছে, টের পেলুম। তোমরা বলবে রাতে কতরকম ফুল ফোটে তারই গন্ধ পেয়েছো। হবেও বা।কিন্তু রাতের কয়েকটা ফুলের গন্ধ তো আমি চিনি! এ সেরকম না। এ যেন কিরকম একটা রহস্যময়, বিশাল, অজানার গন্ধ। গন্ধটা বাইরে থেকে আমার ভেতরে ঢুকে গেল, আচ্ছন্ন করে দিল আমাকে। যেন আমি আর আমি নেই, আমার ভেতরে যেন আর কেউ এসে আস্তে আস্তে বসছে। অনেকক্ষণ আমাদের বাড়ির একফালি ছাতে পায়চারি করতে করতে সেই রাত-কিশোর, সেই অজানার গন্ধ, সেই নিজের ভেতরে অন্য কারুর পা টিপে-টিপে প্রবেশ সব বোঝবার চেষ্টা করতে লাগলুম। উপভোগও করতে লাগলুম। তারপর যখন মনে হল এইভাবে আমি একেবারে হারিয়ে যাচ্ছি, তখন হঠাৎ যেন খেলা ভেঙে দিয়ে হেরো খেলুড়ির মতো দুড়দাড় করে নিচে নেমে এলুম। দুড়দাড় করে বললুম বটে কিন্তু সেটা আমার ভেতরের তাড়ার কথা ভেবে। আসলে আমার পায়ের শব্দ হয় না। শব্দ না করে কী ভাবে চলতে হয়, নিঃশব্দে কীভাবে হাসতে হয়, বা খুব বেশি হাসি পেলে আঁচল দিয়ে তাকে আড়াল করতে হয়, কীভাবে না চেঁচিয়ে কথা বলতে হয় এ আমার হিতৈষিণীরা কতদিন ধরে শিখিয়েছিলেন।

নিচে নেমে দেখি ওরা তিনজনে মিলে খুব গল্প আরম্ভ করে দিয়েছে। ওদের খেয়াল নেই ঘড়ির কাঁটা এগারটার দিকে যাচ্ছে। খুব তর্ক-বিতর্ক হচ্ছে। যদিও তার মধ্যে রাগারাগি নেই, কিন্তু বেশ তীব্রতা আছে। রবি, বিলু আর রিণি।

বললুম—‘কি রে, খাবি না?’

—‘এই তো তোমার জন্যেই অপেক্ষা করছিলুম। তাড়াতাড়ি তোমার খাওয়া-দাওয়ার পাট চুকোও তো! আজ একটা দারুণ লেট নাইট ফিল্ম আছে।’

—আমার গলায় উদ্বিগ্ন প্রতিবাদ উঠে এল, ভেতরে যেটা খুব উদ্বিগ্ন, বাইরে অবশ্য সেটা খুব নরমভাবে বেরোয়। ছবিটা আমি জানি, বড্ড বেশি এ-মার্কা। তিন ভাইবোনের একসঙ্গে বসে দেখবার নয়। থাকতে পারলুম না, বলে ফেললুম—‘ওই ছবিটা আর না-ই দেখলি!’

ওরা তিনজনে হেসে উঠল সমস্বরে। রবি, বিলু আর রিণি। আমার তিন ছেলেমেয়ে। বড় রবি বাইশ। মেজ বিলু কুড়ি। আর ছোট রিণি সতের। রবি, নতুন-চাকরি-পাওয়া রবি বললে—‘মা, তুমি এখনও ছেলেমানুষ আছ।! খেয়ে দেয়ে শুয়ে পড়।’ শোনো কথা, আমি রবির প্রায় ডবল-বয়সী, আমি হলুম গিয়ে ছেলেমানুষ, আমাকে অ্যাডাল্ট ছবির আওতা থেকে বেরিয়ে গিয়ে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়তে হবে। আর ওঁরা তিনজন পূর্ণবয়স্ক বাইশ, কুড়ি, সতের নিশ্চিন্তে রাত দেড়টা কি দুটো পর্যন্ত ছবিতে নর-নারীর জীবনের যতেক গোপনতার উদ্‌ঘাটন দেখবেন বসে বসে। খাবার জন্যে যে ছোট্ট জায়গাটা রান্নাঘরের সামনে রয়েছে সেইখানেই ছোট্ট টিভিটা বসানো আছে। আমি ওদের রুটি আর ডিমের ঝোল বেড়ে দিয়ে নিজের খাবারটা নিয়ে টিভির দিকে পেছন ফিরে বসলুম। খেতে খেতেই বোধহয় ছবিটা আরম্ভ হবে। গোড়াতেই একটা বেড-রুম সিন দিয়ে আরম্ভ। যাই হোক, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব খেয়ে নিয়ে ছেলেমানুষ আমি ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়লুম। জানি না কখন রিণি এসে আমার পাশে শোবে। হয় ফিল্ম শেষ হলে, নয় তার আগেই, ওর যদি ভাল না লাগে।

শুয়ে শুয়ে আমার ঘোর আসতে লাগল, আর ঘোরের মধ্যে আমি রবির গলা শুনতে পেতে লাগলুম,—সামান্য একটু হাসি মেশানো গলা ‘মা তুমি এখনও ছেলেমানুষ আছ!’ মা এখনও তুমি ছেলেমানুষ…ছেলেমানুষ কথাটা আমাকে ধাক্কা দিতে লাগল। আমি কখনও ছেলেমানুষ ছিলুম, যে ছেলেমানুষ থাকবো! হঠাৎ মনে পড়ে গেল মামার বাড়ি গিয়ে খাটের তলায় শুয়ে ‘ক্রৌঞ্চ-মিথুন’ বলে একটা বই পড়ে আমার কী বমি পেয়েছিল, তারপর আমার মাসতুত বোন যে নিয়মিত নিষিদ্ধ বইয়ের সরবরাহ করে যেত, সে আমার অবস্থা দেখে বেরসিক বলে বই দেওয়া বন্ধ করল। আমিও বেঁচে গেলুম। কিন্তু আরও একটা ভীষণ মজার ঘটনা ঘটেছিল। আমার এক স্কুল-টিচার দিদি আমাদের ভালো ভালো গল্প, উপন্যাস, রম্য রচনা পড়ে শোনাত। কিন্তু যতবড় উপন্যাসই হোক আমাদের হাতে কখনও ছাড়ত না। আমি আর আমার এক বোন মিলে শেষকালে ঠিক করলুম দিদির অনুপস্থিতিতে বই খুলে দেখতে হবে—কেন! তক্কে তক্কে রয়েছি। দিদি স্কুলে চলে গেছে। দুপুর বেলা দিদির আলমারির চাবি যোগাড় করে বার করলুম সেই বই—‘ঝিন্দের বন্দী’। পাতার পর পাতা উল্টে যাচ্ছি, অবশেষে আমার বোন বলে উঠল—‘পেয়েছি।’ গৌরীশংকর আর কস্তুরীর প্রেমের দৃশ্য। একটুখানি। সেইটুকু দিদি সাবধানে বাদ দিয়ে গেছে। তখন আমাদের চোদ্দ পনের বছর বয়স। দুজনে হেসে কুটিকুটি। এইভাবে ‘ইছামতী’র নিস্তারিণীর অবৈধ প্রেমকাহিনী এবং ‘ভবানী তখন তিলুকে গাঢ় আলিঙ্গনে আবদ্ধ করিলেন’ গোছের একটা লাইনও খুঁজে বার করেছিলুম। আর হেসে কুটোপাটি হয়েছিলুম।

একদিন আমার মেজছেলে বিলু এসে বলল—‘মা হাজার পাঁচেক টাকা পাবো?’

—‘কেন রে?’

—‘আমরা কয়েক বন্ধু, তুমি তাদের চেনো অলক, সামন্ত, টুটুল আর রুমি ছবি করব ঠিক করেছি।’

—‘ছবি করবি? ছবি?’

—‘মানে ফিল্ম, ডকুমেন্টারি করে সেল করব।’

—‘সে কি রে? কোনদিন এ সব বিষয়ে কিছু জানলি না, হঠাৎ ফিল্ম অমনি করলেই হল? তাও আবার পাঁচ হাজার টাকা! পাঁচ হাজারে ফিল্ম হয় নাকি?’

—‘ওহ, মা, য়ু নো নাথিং। আমার বইয়ের র‍্যাক যে ম্যাগাজিন আর বইগুলো আছে একটু উল্টে পাল্টে দেখো? টুটুল আর রুমির পুনের ট্রেনিং আছে। অলক রবীন্দ্র ভারতীর ফুল কোর্স করেছে। সামন্তর অনেক টাকা। আমার ইম্যাজিনেশন। তা ছাড়া যে যেরকম পারি টাকা দেবো। আমি তো জানি তুমি পাঁচ হাজারের বেশি চাইলে হার্ট ফেল করবে তাই…’

—‘তো কিসের ওপর ছবি করবি!’

—‘শের।’

—‘সে কি রে? চিড়িয়াখানার বাইরে কোনদিন বাঘ সিঙ্গি দেখেছিস? বাঘের ওপর ছবি করবি কি রে? মাথা খারাপ। ও সব মতলব ছাড়ো বিলু।’

বিলু বলল—‘উঃ, মা, তুমি একটা ইমপসিব্‌ল্‌, শের মানে উর্দু কবিতা, আজকাল হায়েস্ট ফ্যাশন, অর্ডার অব দ্য ডে। সেই কবিতার ওপর করব! হয়েছে তো? দাও এবার টাকাটা দাও। তুমি বড্ড ব্যাকডেটেড মা!’

পাঁচ হাজার টাকা ওকে দিলুম। টাকাটা জলে দিচ্ছি ভেবেই দিলুম। কিন্তু মাস ছয়েক পরে ও টাকাটা আমাকে ফেরৎ দিল। ভীষণ ব্যস্ত গলায় বলল-‘এবার মা কেরলের দিকে যাব, ট্যুরিজমের একটা কাজ পেয়েছি। ট্যুরিজমের একটা কাজ যদি ভালো করে করতে পারি তো একেবারে চেইন! পর পর পর পর পেয়ে যাব! এইবার প্রফিট আসতে শুরু করবে!’

‘ছেলেটা আমার বি-এসসি পাশ করে বসেছিল। এম-এসসিতে চান্স পায়নি বলে কয়েক মাস খুব গোমসা মুখে ঘোরাফেরা করত। আমি মনে মনে খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিলুম। তারপর কবে যে কি সব যে ট্রেনিং ফেনিং নিল, বন্ধুদের সঙ্গে মিলে পরামর্শ করতে আরম্ভ করল খেয়ালই করিনি। আমি বললুম—‘হ্যাঁ রে পরের বছর এম-এসসি’র জন্যে চেষ্টা করবি তো? ’

বিলু বলল—‘ওহ্ মা, কারেন্ট ইয়ারের ছেলেরাই চান্স পাচ্ছে না। তার আগের বছর! ও সব ছাড়ো তো! তুমি না বড্ড ব্যাকডেটেড। এম-এসসি পড়ে কী হয়? কিস্যু হয় না।’

সুটকেস গুছিয়ে, রুকস্যাক ঘাড়ে নিয়ে পরদিনই দেখি বেরিয়ে যাচ্ছে—মা কবে আসব বলতে পারছি না!

বললুম—‘সে কি রে? এই কোত্থেকে এতদিন পর ঘুরে এলি। এক্ষুনি আবার চলে যাচ্ছিস? কদিন একটু জিরিয়ে গেলে পারতিস।’

‘বিলু টান-টান হয়ে উঠে দাঁড়াল জুতোর ফিতে বেঁধে। তারপর বলল—‘পান চিবোতে চিবোতে পকেটে টিফিনকৌটা নিয়ে ধীরে-সুস্থে আপিস যাবার দিন চলে গেছে মাম্মি। যু আর হোপলেসলি ব্যাকডেটেড।’ গটগট করে বিলু চলে গেল।

কথাটা ওর মুখে কয়েকবারই শুনলুম—ব্যাকডেটেড, ব্যাকডেটেড। টূ ব্যাকডেটেড। হোপলেসলি ব্যাকডেটেড।

একটা লম্বা বারান্দা আমাদের চলে গেছে দক্ষিণ থেকে উত্তরে। বড্ড সরু। কাপড় শুকোতে দেবার জন্যে ব্যবহৃত হয়। আর রাজ্যের পায়রা ওপর থেকে বকম বকম করে বারান্দাটা নোংরা করে। ঝুলঝাড়া দিয়ে তাড়াবার চেষ্টা করলেও যায় না। তখনকার মতো চলে গেলেও আবার রাতে ফিরে এসে বক বকুম, বকুম, কুম, বকুম কুম করতে থাকে। সকালবেলায় বারান্দাটার আগাপাশতলা আমায় ধুতে হয়। পায়রাগুলো ফিরে আসলে আমার ভাল লাগে। কি রকম ঘুমপাড়ানিয়া, সুখজাগানিয়া পায়রার ডাক। বাকুম, কুম, কুম, বাকুম, বাকুম। যেন ডাকটা মুখ ফুটে বেরোয় না। গলার কাছেই আটকে থাকে। আমার ভাল লাগে। আমাদের বাড়িতে অমনি পায়রা ভিড় করে থাকবার জায়গা ছিল। দুপুরে সারা দুপুর ঝটপট ঝটপট, বাকুম, বাকুম, রাত্তিরেও ঝটপটাপট মাঝে মাঝে, আর কুম কুম কুম। যদি ছেলেমেয়েরা জিজ্ঞেস করে—পায়রার ডাক তোমার ভাল, লাগে কেন? ওরা ফিরে এলে খুশি হও কেন? কেন? কেন? তা হলে কি বলব? জবাবটা ভেবে রাখতে গিয়ে এইসব কথা আমার মনে এসে যায়। ওরা স্মৃতিজাগানিয়া পায়রা। সুখস্মৃতি। যখন মা বাবা, ভাই বোন। যখন স্কুল, গান, মুগ্ধ দিদিমণি, যখন দিদিমা, আদর, পান মুখে দিয়ে ধীরে সুস্থে অফিস যাওয়া—টিফিনে আজ লুচি, আলুর দম, তোদের চিংড়িমাছ দিয়ে পেয়াজকলির চচ্চড়ি আছে। কি আনবো অফিস-ফেরতা? কি আবার আনবে, ফলফুলুরি যদি কিছু সুবিধের মধ্যে পাও। পেয়ারা পাতায় নুন তেল দিয়ে দাঁত মাজ, ঝকঝকে হবে। হাসলে দাঁত ঝিকঝিকিয়ে উঠবে, রেলগাড়ি চলে গেল—ঝিক ঝিক ঝিক ঝিক ঝিক ঝিক ঝিক কু…উ…উ। তাই আমি পায়রাদের ফিরে-আসা পছন্দ করি। আমার তো ভবিষ্যৎ নেই। আছে শুধু রোমন্থনের অতীত। আর বর্তমান। বর্তমান! বারান্দায় দাঁড়িয়ে সামনের দিকে তাকালে আকাশটাকে, শহরের রাস্তাঘাট, বাড়ি-টাড়ি কেমন কাটা-ছেঁড়া লাগে। যেন অপারেশনের রুগী। কাটা ছেঁড়া হয়েছে, সেলাই এখনও হয়নি। কোনদিন হবে কি না জানিও না। আমাদের গলিটা আঠার ফুট মতন। মাঝে মাঝে হাঁড়ল গর্ত। দু-তিনটে বাড়ি বাদ দিয়ে এক এক জায়গায় আবর্জনার স্তূপ জমে আছে—তরকারির খোসা, মাছের আঁশ, ছেঁড়া কাগজ, ন্যাতা ক্যাঁতা, আরও সব জঘন্য নোংরা, অদূরে মানে বড় রাস্তার ওপর বেশ কয়েকটা লম্বা বাড়ি উঠেছে। ছ তলা, আট তলা। ফলে আরও দূরের দিকে তাকিয়ে যে বড় রাস্তায় গাড়ির চলা, মানুষজনের অবিরাম চলাফেরা, দোকানের আলো এ সব দেখতে পাব তার জো নেই। ঝকঝকে বাড়িগুলো। পিনু মানে পিনাকী, আমার মামাত দেওর, ওদের বাড়িটা আর দেখা যায় না। আমার এক ননদ কাছেই থাকেন, ওঁদের উঠোনে লম্বা তারে ধুতি শাড়ি শুকনো তা-ও আর দেখা যায় না। উঁচু, ঝকমকে বাড়িগুলোর পাশে যেন মাটির সঙ্গে মিশিয়ে যেতে চাইছে, মিয়োনো, দোতলা-তেতলাগুলো। শ্যাওলা ধরা, গাছ-গজানো, জানলার পাল্লাগুলো খাপছাড়াভাবে রং করা। ও মা! একটা ছ’ তলা তো রুবিদের বাড়ির ওপরই উঠেছে মনে হচ্ছে, তা হলে রুবিরা কোথায় গেল? যাঃ, আজকাল কেউ কারও খেয়াল রাখে না। কবে যে রুবিদের ওপর অমনি তেধেড়েঙ্গে একটা বাড়ি উঠল আমি জানিই না। খুব ব্যস্ত হয়ে ডাকি ‘রিণি রিণি’, রিণি ঘরের ভেতর কি ম্যাগাজিন পড়ছিল, উঠে এসে বলল—‘কি মা? কী হয়েছে?’

—‘রুবিরা কোথায় গেল? রুবিদের বাড়ির ওপর…?’

—‘কী আশ্চর্য! রুবিরা ওখানেই আছে! ওর ভেতরেই ওদের ফ্ল্যাট দিয়েছে। বড় রাস্তার দিকে মুখ করে ওদের ফ্ল্যাটটা তো তাই দেখতে পাও না।’

—‘এত ভাববার কী আছে! তুমি না…’

‘আমি একটা বিশেষণের জন্যে অপেক্ষা করি। কিন্তু রিণি তার কথা শেষ করে না।’ না বলে একটা টান দিয়েই অসমাপ্ত ম্যাগাজিনের কোলে ফিরে যায়। নাঃ। আমার সামনে লম্বা লম্বা বাড়ি। দৃষ্টি রোধ করে দাঁড়িয়ে আছে। সামনে তাকিয়েও কোনও লাভ নেই। আশপাশে হাঁড়ল গর্ত।

আবর্জনা, মোটরবাইকের গরগর, রুকস্যাক, চকচকে ম্যাগাজিনের মধ্যে রক্তের ফোয়ারা নগ্নপ্রায় নারী, ভিখারী শিশুর পাঁজরের ছবি। তাহলে আমি পায়রাদের দিকে ফিরব না কেন? বাক বাকুম, বাকুম, কুম, কুম,—উজ্জ্বল এক ঝাঁক পায়রার পিঠে চড়ে আমি সূর্যের উজ্জ্বল রৌদ্রে কেন নিচু আকাশ দিয়ে ছেৎলাপড়া, বেমানান রঙের বাড়ি আর বহুতলের অ্যানটেনা সঙ্কুল জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে উড়ে যাবো না চঞ্চল পাখনায় যেখানে মুগ্ধ দিদিমণি, সব পেয়েছির আসর, ডালে সম্বরার গন্ধ আর কু ঝিক ঝিক, ঝিক ঝিক ঝিক…। শুধু যদি ওরা বারান্দাটা এমন করে নোংরা না করত!

রিণি বলল ‘মা তুমি চাটা খুব ভাল করো। কিন্তু কফিটা ঠিক এসপ্রেসো হয় না। তুমি সরো। আমি করে নিচ্ছি।’

ডিমগুলো ও আগেই ভেজে নিয়েছে। কী সুন্দর টোপর হয়ে ফুলছিল ওমলেটগুলো। বেকিং পাউডার দিল। ডালের কাঁটা দিয়ে খুব করে ফেঁটানো, ভেতরে পেঁয়াজকুচি, চীজের টুকরো আর টোম্যাটো কুচি দিয়ে কী সুন্দর ভাঁজ করে ফেলল। নন-স্টিক প্যানে কী চটপট হয়ে গেল। একটু হলদেটে সাদা। যেন কাঁটালি চাঁপার রঙ। প্যানটা রবি প্রথম মাসের মাইনে পেয়েই কিনে এনেছে। কী রকম দৃষ্টি দেখ। জামা না, শাড়ি না, একটা নন-স্টিক প্যান। কী সুবিধেই যে আমার হয়েছে! আমার ছেলে, তালে-গোলে যে বড় হয়ে উঠেছে সে এইরকম বিবেচক হবে আমি ধারণাই করতে পারিনি!

আমি সরে এলুম। দেখলুম রিণি প্রত্যেকটা কাপে কফি চিনি সঙ্গে সামান্য দুধ-মেশানো জল দিয়ে প্রাণপণে ফেটাচ্ছে, কেমন সুন্দর ওপর থেকে গরম দুধ-জল ঢালছে চামচ নাড়তে নাড়তে, আর আধ ইঞ্চি করে ফেনা উঠছে কাপের ওপর। ঠিক দোকানের মতো। কাপ-প্লেটটগুলোও খুব সুন্দর, পাতলা, বিলু যাবার সময়ে কিনে দিয়ে গেছে। মিষ্টি না, শাল দোশালা না, একটা চমৎকার টিসেট। রিণি ট্রে বয়ে নিজেই নিয়ে গেল, আজ ওর ক’জন বন্ধু এসেছে। তারা ঝুপঝাপ মাসি-মাসি করে আমায় পেন্নাম-ঠুকলো, একজন খুব বাবার সঙ্গে বিদেশে ঘোরে সে গালে চকাস করে চুমু খেল। তারপর ওরা গল্পে মেতে গেল। পিরভা করণ, ইকোলজি, অলটারনেটিভ এনার্জি, সুষীম চৌধুরীর ডাঁট ভাঙতে হবে। উইকলিটা দারুণ। ইস্স্‌ শেরগিলের লাইফ…। ‘এই সমস্ত ছেঁড়া-ছেঁড়া কথা আমার কানে এল। কিচ্ছুই বুঝতে পারলুম না। কিন্তু রিণিটা আগে রান্নাঘরের ধার মাড়াত না। আজকাল এত ভাল পারছে ও এসব! আজ ওর খন্তি ধরা, প্যান ওল্টানো, ওমলেট ভাঁজ করবার কায়দা, কফির জল একবার নামানো একবার বসানোর ধরন, গ্যাসের নবটা চট করে সিম করে দেওয়া আবার বাড়িয়ে দেওয়া—এ সব দেখে আমি তাজ্জব বনে গেলুম। যে রিনিটা…। আজ এত ভাল পারছে! আশ্চর্য! কোনও আলাদীনের দৈত্যকে তো আমি পুরনো পিদিম ঘষে ডাকিনি! বলিনি ওদের স্বাবলম্বী করে দাও। ওদের বিবেচক, বুঝদার করে দাও! বলিনি তো আমি আর পারছি না। জীবনের এতগুলো বছর কোথা দিয়ে কেটে গেল বুঝতে পারিনি, হে দৈত্য আমায় মুক্তি দাও। ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’-এর হল্লার রাজার মত আমার ছুটি-ছুটি-ছুটি…ছুটি করে বাড়িময়, ছাতময়, রাস্তাময়, ময়দানময়, পৃথিবীময় এলোপাথাড়ি ছুটে বেড়াতে ইচ্ছে করল।

এতক্ষণ রিণির বন্ধুরা এসে বসে, রিণিকে সাহায্য করতে হবে বলে গা ধুতে যেতে পারিনি। এবার গেলুম। বাথরুমে দাড়ি কামানোর সুবিধের জন্যে রবি একটা বড় আয়না লাগিয়েছে। তাইতে আমার বুক পর্যন্ত পুরোটা দেখা যায়। মুখখানা ভাল করে দেখলুম। অন্য দিনও দেখি। চুল বাঁধতে দেখি, দাঁত মাজতে দেখি, মুখে সাবান দিয়ে সাবান ধুয়ে দেখি। রোজকার অভ্যেসের দেখা। কিন্তু আজকের দেখাটা অন্যরকম। দেখতুম একজন প্রাপ্তবয়স্ক তিন ছেলেমেয়ের প্রৌঢ়া বিধবা মাকে। আজ দেখলুম তেতাল্লিশ বছরের একজন মানুষকে, যে প্রকৃতির কোন রহস্যময় খেলায় বা নিয়মে মানুষ মেয়ে। এবং আবারও জীবনের কোনও অমোঘ চাঞ্চল্যকর নিয়মে বা খেলায় যে একই সঙ্গে ছেলেমানুষ, এবং ব্যাকডেটেড। দেখলুম আমার আধা-ফর্সা রঙে একটা কালচে ছোপ পড়েছে। শীতকালে যেমন সমস্ত গাছপালার ওপর পড়ে, চুলগুলো আমার এখনও, অনেক অযত্নেও অনেক, অনেক। পাকা-টাকা দেখতে পেলুম না। আমার যে বয়স তার থেকে মাত্র আর চার বছর বেশি বয়সে ঠাকুমা আপাদমস্তক বুড়ি হয়ে মারা গিয়েছিল। গরমের ছুটির দুপুরে তাঁর পাকা চুল তোলার কথা আমার খুব মনে পড়ে। আমার চিবুকের ডানদিকে একটা তিল। যারা তিলতত্ত্ব জানত, তারা মুখ গম্ভীর করে মাথা নেড়ে বলত ডানদিকে না হয়ে যদি ওটা বাঁদিকে হত তাহলে ওর ভাগ্য খুলে যেত। কিন্তু দক্ষিণ অঙ্গে তিল স্ত্রীলোকের ঠিক…। কিন্তু চিবুকটা দেখে আমার হঠাৎ মনে পড়ে গেল ষোল বছর বয়সে তোলা (নিশ্চয়ই বিয়ের জন্য) আমার একটা ছবি দেখে আমার বাবা এই চিবুকটা নেড়ে দিয়ে বলেছিলেন ছবিতে চিনুমার চিবুকটা ঠিক আসেনি। এই চিবুকটাই ওকে চিরকাল ষোল বছরের করে রেখে দেবে। এসব কথার গুরুত্ব তখন বুঝতুম না। মেয়ে নিয়ে বাবারা অনেক আদিখ্যেতা করে থাকেন। আমার সমগ্র মুখে-চোখে, নাকে, চুলে, কোথাও কিছু বলবার মত না পেয়ে বাবা হয়ত আদরের মেয়ের চিবুকটা নিয়েই পড়েছিলেন। কিন্তু এখন দেখলুম,—না, বাবা তাঁর পরিণত দৃষ্টি দিয়ে ঠিকই দেখেছিলেন। আদিখ্যেতা করেননি। চিবুকটা সত্যি ঠিক তেমনি আছে। তিনকোনা। তলার দিকটা সামান্য একটু গোল ভাব ছুঁয়ে গেছে। মাঝখানে ভাঁজ। অতিরিক্ত মাংস জমেনি আশপাশে, তলায় কোথাও আর ডানদিকে শুকতারার মতো ফুটফুট করছে সেই অশুভ তিল যা নাকি বাঁদিক ঘেঁষে হলে চিনুর ভাগ্য খুলে যেত। ডান অঙ্গে তিল স্ত্রীলোকের ঠিক…। চিবুকটা তেমনি আছে। ষোল বছরের চিবুক। কিন্তু মুখটা? সমস্ত মুখটা মলিন, চিন্তিত, কেমন বুড়োটে। আমার শোবার ঘরের আলমারিতেও একটা লম্বা আয়না আছে। রিণিই এটা বেশি ব্যবহার করে, শাড়ি পরবার সময়। পাট পাট করে কুঁচি দেবে। লম্বা আঁচল ভাঁজে ভাঁজে ঝুলিয়ে দিয়ে পিন করবে। তারপর পায়ের গোড়ালি দিয়ে টেনে টেনে এ দিকের শাড়ি ওদিকের শাড়ি সব সমান করবে। তো আমি আজ তার সামনেও গিয়ে দাঁড়ালুম। দেখি আয়না কী বলে? আয়না তো স্নো-হোয়াইটের সৎমাকে অনেক কিছু বলেছিল, বলত। দেখি সে আদ্যিকালের বদ্যিবুড়ি, বড়াইবুড়ি, ছেলেমানুষ, ব্যাকডেটেড চিনুকে কী বলে? আয়না বলল—‘চিনু তুমি রোগাও নয়, মোটাও ঠিক নও, তুমি বাপু কেমন থপথপে। কোনও খাঁজ-খোঁজ নেই, আকার নেই তোমার, সত্যি বলছি। কোনও গতি নেই শরীরটার মধ্যে।’ অথচ সেই ষোলো বছর বয়সে যখন বাবা আমার থুতনি নেড়ে আদর করেছিলেন তখন আমি রোজ স্কিপিং করতুম। চু-কিত্-কিত‌ খেলার সময়ে বিরোধী দলের কবল থেকে এমনভাবে নিজেকে মুক্ত করে নিয়ে বেরিয়ে আসতুম যে খেলুড়িরা আমার নাম দিয়েছিল—কই মাছ। আমি নাকি এমন পেছল যে হাজার বেড়াজালেও আমাকে ধরা যায় না। অথচ অথচ…এমনি মজা যে জীবনের প্রথম জালেই আমি ধরা পড়ে গেলুম। পরের বছর মা মারা গেলেন। বাবা তার পরের বছরই দিশেহারা হয়ে আমার বিয়ে দিয়ে দিলেন। পরের বছর, রবি, দু বছর বাদে বিলু, তিন বছর বাদে রিণি। আর তার পাঁচ বছর বাদেই ঠিক যেমন আমার মা দুম করে চলে গিয়েছিলেন, রবি-বিলু-রিণির বাবাও তেমনি বিনি নোটিশে দুম করে চলে গেলেন। তারপর সংসার ভাগ হল, ভাসুর দেওররা, আমার বাড়ির ভাগ, শাশুড়ির গয়নার ভাগ, দেশের জমির ভাগ সব বুঝিয়ে দিয়ে আলাদা করে দিলেন। এই সব, আর আমার স্বামীর জমানো কিছু টাকা, ইনসিওরের টাকা, ক্ষতিপূরণের টাকা এই সব দিয়ে কোনদিকে না তাকিয়ে ঘাড় গুঁজে তিনটি শিশু নিয়ে এতকাল কাটিয়ে এসেছি। কীভাবে এতগুলো বছর চলে গেছে টের পাইনি। তাই যখন রবি একদিন এসে বলল—‘মা, সেলস ট্রেনির চাকরিটা আমার হয়ে গেছে’, বিলু যখন ছবি করবার জন্যে পাঁচ হাজার টাকা নিয়ে আবার সেটা ফেরত দিল, আর হাতে সুটকেস, পিঠে রুকস্যাক নিয়ে গট গট করতে করতে বেরিয়ে গেল, রিণি যখন কফির কাপের ওপর আধ ইঞ্চি ফেনা তুলতে লাগল তখন আমার আলাদীনের দৈত্যটার কথা মনে পড়েছিল। আমি কেমন অবাক হয়ে গিয়েছিলুম। যেন একটা ঘোরের মধ্যে থেকে জেগে উঠলুম। যেন আমার জ্বর-বিকার হয়ে অনেকদিন কোমা ছিল, সবে জ্ঞান ফিরে এসেছে। রিণি যখন ফেনাগুলো তুলছিল জানতুম, চুপসে যাবে, কিন্তু যতক্ষণ ফেনাটা থাকে বুদবুদগুলো দেখতে মজা, চুমুক দিতেও মজা। আমারও ওই ফেণার দশা হবে না তো। এই ক’মাস আগে সামনের বাড়ির প্রীতিদি বিয়ে করলেন। ছোট ভাইবোনদের মানুষ করে। তাদের বিয়ে-থা দিয়ে তারপর নিজের এক সহকর্মীকে বিয়ে করলেন। পাড়াময় সব কী হাসি! সমালোচনা! মাথায় ফুল দিয়েছিলেন বলে টিটকিরি। আমার খারাপ লাগেনি। সত্যি বলতে কি, প্রীতিদির জন্যে ভালোবাসায়, শুভকামনায় মনটা ভরে গিয়েছিল। হঠাৎ মনে হল প্রীতিদি আমার চেয়েও দু’বছরের বড়। তবে কি আমি সত্যি ছেলেমানুষ! সত্যি ব্যাকডেটেড!

আমাদের বাড়ি একটু অলি-গলি দিয়ে শর্টকাট করলে লেকের বেশ কাছেই। চিলড্রেন্স পার্কের দিকটা দিয়ে ঢোকা যায়। যদি কোনওদিন ভোরবেলা রিণিকে নিয়ে যেতুম তো দেখতুম অনেকে হন হন করে হাঁটছে, অনেকে আবার ছুটছে। কিছু কিছু তরুণ যুবক অল্পবয়স্ক মেয়েদের সঙ্গে আলাপ জমাবার উদ্দেশ্যে আবার শরীর ফিট রাখবার জন্যেও ওই সময়ে বেরিয়ে পড়ে। রথ দেখা, কলা বেচা দুইই হয়। আমি রিণিকে একদিন জিজ্ঞেস করলুম—‘ওই যে সব লম্বা কিরকমের ড্রেস পরে ছুটছে ওগুলোকে কী বলে রে?’ রিণি বলল ‘ট্র্যাক স্যুট।’ ক’দিন পরেই এরা দু ভাই-বোন কলেজ অফিস বেরিয়ে গেলে আমি দোকান খুঁজে ওইরকম এক ট্র্যাক স্যুট আর একজোড়া ক্যামবিসের জুতো কিনে আনলুম। আর তার পর দিন ট্র্যাক স্যুটটা পরে তার ওপর একটা তোয়ালে আর চাদর চাপিয়ে হন হন করে হাঁটতে লাগলুম লেকের দিকে। পৌঁছেও হাঁটছি, হন হন করে হাঁটছি, হাঁপিয়ে পড়লে একটু বসছি, আবার হাঁটছি। যত বেলা বাড়ছে, পরিচিত মুখগুলোও বাড়ছে। আমি হয়ত চিনি না, কিন্তু তারা আমাকে চেনে। মাসিমা, হাঁটতে বেরিয়েছেন?’ ‘মাসি ডায়বিটিস নাকি? ডাক্তার বলেছে?’ জগিং করুন, জগিং করুন।’ এইসব কথা আমার হনহন হাঁটার তালে তালে কানের পাশ দিয়ে বেরিয়ে-যাওয়া হাওয়ার মতো পৌঁছয়, আমি সবেতেই কোনমতে ঘাড় নেড়ে, গটগট করে বেরিয়ে যাই। অর্থাৎ হ্যাঁ, আমি হাঁটতে বেরিয়েছি, হ্যাঁ আমার ডায়াবিটিস হয়েছে, হ্যাঁ ডাক্তার বলেছে, ঠিক আছে আমি জগিং করব। সাড়ে পাঁচটার মধ্যে বাড়ি ফিরে যাই। তোয়ালে দিয়ে ঘামগুলো বেশ করে মুছে ফেলি, একটু বিশ্রাম নিই। তারপর যখন ছেলেমেয়েরা ওঠে, দেখে আমি লম্বা ভিজে চুল মেলে মেঝের এক প্রান্তে বসে আনাজ কুটছি।

তারপর দেখলুম একটু দেরি হয়ে গেলেই বড্ড চেনা মুখের সঙ্গে দেখা হয়ে যাচ্ছে। মাসি, কাকি, চিনুদি, আরে! কখনও তো দেখিনি! দ্যাটস ভেরি গুড! ইত্যাদি ইত্যাদি। তাছাড়া আমার পায়ের পেশীগুলো বেশ টাইট হয়ে গেছে। আমার এখন দৌড়তে ইচ্ছে করে। টেনে দৌড়। কিন্তু ওই ভাইপো-ভাইঝি, ভাগ্নে-ভাগ্নি, বোনপো-বোনঝি, ছোটভাই-ছোটবোনদের সামনে দৌড়তে আমার কেমন যেন কেমন-কেমন লাগে। এদের মধ্যে কেউ একজন রবি-রিনিকে বলে দিয়ে এলেই হল তোদের মা’র মাথাটা দেখা। গোলমালের লক্ষণ দেখা দিয়েছে। তাই একদিন সবচেয়ে ভোরবেলার বাসে চড়ে আমি প্যাঁ পোঁ করে ভিক্টোরিয়ায় পৌঁছে যাই। সে-ও এক রকম দৌড়। খালি রাস্তা পেয়ে বাস-ব্যাটা বোঁ, বন বন করে ছোটে, আমার কানের পাশের চুলগুলো শাঁ শাঁ করে পেছনে উড়তে থাকে, মুখের ওপর দুরন্ত দস্যি হাওয়ার ঝাপট, মাঝে মাঝে অতর্কিত ব্রেক কষার জন্যে একটু সামনে হুমড়ি খেয়ে পড়ি। ভোরের বাস, যাত্রী বিশেষ নেই। কন্ডাক্টর এগিয়ে এসে বলে ‘দিদি লাগল না তো! এই ডেরাইভার, শালা রঘুনাথ, থোড়া দেখকে চালা না বাবা, দিদির যে লাগল। ’

ভিক্টোরিয়ায় ভারি অদ্ভুত দৃশ্য। ঠিক হিপোপটেমাসের মতো একটি দুটি মাংসপিণ্ড, স্পোর্টস গেঞ্জি আর শর্টস পরে, ম্যামথের শুঁড়ের মত থাই নাচিয়ে নাচিয়ে দৌড়চ্ছেন। ছোটার তালে তালে থাইয়ের সঙ্গে সঙ্গে অন্যান্য জায়গার অতিরিক্ত মেদ চর্বিগুলোও কত্থক নাচছে, দুনি তালে। বেশ কিছু মহিলাকেও দেখলুম একদম সীলমাছের মত, কি সিন্ধু ঘোটকের মত ঘোঁৎ ঘোঁৎ করতে করতে দৌড়চ্ছেন আর দরবিগলিত ঘর্মধারা মুছে যাচ্ছেন। এঁদের কাছে আমি শিশু। হিমালয়ের পাশে নেংটি ইদুরের ছানা। সুতরাং এক নং পুকুর অর্থাৎ, ক্যাথিড্রাল রোডের দিকের পুকুরটার পাশ দিয়ে মোটা মুটি বেড় দিয়ে দৌড়তে থাকি, এক পাক দৌড়ে অশ্বারোহী মূর্তির তলায় বসি, আবার দৌড়ই। আমার পাশ দিয়ে নতুন ওঠা ঘাস আর জলের গন্ধ বয়ে হাওয়া শনশন করে আমার পাশে পাশে দৌড়য়। বলে চিনু, চিনু, আর একটু জোরে, আর একটু…তোমার উড়ন তুলোর গুছিগুলো পেয়ে গেলেও যেতে পারো। আর যদি আরও জোর পারো, তাহলে একেবারে চাঁদের মা বুড়ির দেশে তোমায় পৌঁছে দিয়ে আমি সত্যি সত্যি হাওয়া হয়ে যাব। তারপর দুই ডুবে তুমি কী নেবে না নেবে সে তোমার ব্যাপার! তুলোর পেঁটরা চাও না অলঙ্কারের প্যাঁটরা চাও না রাজকুমারের প্যাঁটরা চাও সে তোমার ব্যাপার! আমি দৌড়তে দৌড়তে বলি, আগে তো ছোটার জন্যে ছুটি, তারপর হাওয়া তোমার সঙ্গে আমার প্রতিযোগিতাহীন প্রতিযোগিতা, কেন না তোমাকে তো আমি সত্যি-সত্যি হারাতে পারব না। তবে তুমি যদি একটু ভালবেসে আমার সহ দৌড়বাজ হও তো চাঁদের মা বুড়ির তুষাশীতল, মন-প্রাণ-ঠাণ্ডা করা শান্তির দেশে একমাত্র জীবিত মানুষ হয়ে উজ্জীবিত কিশোরী হয়ে আমি প্রবেশ করলেও করতে পারি বটে। তারপর বর, প্যাঁটরা ও সব আমার ব্যাপার। একটা মুশকিল হতে লাগল, অন্য যাঁরা দৌড়তে আসেন-বেশিরভাগই গাড়ি চড়ে। কাজেই অদ্ভুত বেশে বাড়ি ফিরে যাওয়ার তাঁদের কোনও অসুবিধে নেই। কিন্তু ফেরবার সময়ে ট্র্যাকসুট পরে আমার ট্রামে-বাসে একটু অসুবিধে হয়। আর একটা মুশকিল আমার মোটা বেণীটা, ছোটবার সময়ে শপাং শপাং করে আমার পিঠে চাবুক মারে। ভেবে-চিন্তে চুলটা কেটে অর্ধেক করে ফেললুম। পেছনে শক্ত করে একটা ঝুঁটি বেঁধে নিই। একজন বয়স্ক মহিলা আসেন মূর‍্যাভেন্যু থেকে। অশ্বারোহীর তলায় বসে তাঁর সঙ্গে ভাঙা হিন্দি আর ভাঙা ইংরেজিতে ভাব জমিয়ে ফেললুম। ফেরবার সময়ে তিনিই আমায় আমার গলির মোড়ে ছেড়ে যান। ভদ্রমহিলার মহা চিন্তা। ডাক্তার দু-স্লাইসের বেশি রুটি দিচ্ছে না। ক্লিয়ার চিকেন স্যুপ। দু টুকরো চিকেন, কচি মাছ পঞ্চাশ গ্রাম, বাঁধাকপি আর জল খেতে বলেছে। খিদে পেলেই জল। নো চকলেট, নো আইসক্রিম, নো ফ্রুটস বাট কিউকামবার, অ্যান্ড টী উইদাউট মিল্ক অ্যান্ড শুগার। আই অ্যাম সো ফন্ড অফ পোট্যাটোজ—ইনি এনি ফর্ম। হী ডাজন্ট লেট মী হ্যাভ ইভন এ হ্যান্ডফুল অফ গ্রেপস। হাউ মেনি টাইমস ক্যান ওয়ান হ্যাভ প্রেপফ্রুট জুস? ভদ্রমহিলা ককাতে থাকেন। সবেতেই নাকি প্রচুর প্রচুর ক্যালোরি। তাঁর ব্লড শুগার তিনশ পঁয়ত্রিশ। হার্টে মেদের চাপ পড়ছে। ডাক্তার বলেছে ইদার য়ু ফলো দিস রেজিমেন অর য়ু ডাই। ভদ্রমহিলা আমার পরামর্শ চান কোনটা গ্রহণ করবেন। আমি দ্বিতীয়টা অপছন্দ করি না। কিন্তু সে কথা তো তাঁকে বলা যায় না। তাঁকে প্রাণপণে বোঝাতে থাকি শাক খান, শাকে মিনার‍্যালস‍ আর ভিটামিন আছে। তিনি নিশ্চয় রোগা হবেন। ব্লাড শুগার কমবে, প্রেশার কমবে। একটু-আধটু আলুভাজা, আম, আঙুর, এইসব তাঁর প্রিয় জিনিস খেতে পারবেন। তবে হ্যাঁ বুঝেসুঝে।

আর একজন ভদ্রলোকের সঙ্গে আলাপ হল। কোন বড় কোম্পানির ম্যানেজিং ডিরেক্টর। আমাকে বললেন আই টেক ইন্‌‌স্‌পিরেশন ফ্রম ইউ। তুমিও নিশ্চয়ই একদিন আমারই মত ছিলে ডাক্তারের পরামর্শমতো খেয়ে আর ছুটে ছুটে এখন এত সুন্দর স্লিম হয়ে গেছ। ইয়োর স্কিন ইজ গ্লোয়িং। য়ু আর লুকিং লাইক আ বাডিং অ্যাথলিট।

আমি ভদ্রলোকের ভুল ভাঙিয়ে দিই না। আমি যে কোনদিনই তাঁর মত কুমড়োপটাশ ছিলুম না, শুধু ছিলুম কিছুটা আকারহীন, থপথপে থলথলে, সেটা তাঁর কাছে ভাঙি না। চুপ করে হেসে যাই। তিনি অবশ্য দূরের দিকে দুঃখিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলেন—‘বাট ইউ আর ইয়াং। লেট টোয়েনটিজ কি আর্লি থার্টিজএ যা পারা যায়, তা কি আর ফিফটিজ-এ হয়?’ আমি চমকে উঠলুম। গ্লোয়িং স্কিন, বাডিং অ্যাথলিট, লেট টোয়েনটিজ, এসব আমায় চমকে দিল। কিন্তু এখনও আমায় আরও দৌড়তে হবে।

আলমারির গায়ে লম্বা আয়নাটার সামনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখি। শায়া, ব্লাউস, ধনেখালি সরু পাড় শাড়ি, না কুঁচিয়ে পরা, তা সত্ত্বেও আকার বোঝা যাচ্ছে। মুখের চামড়া টান টান হয়ে আছে, যেন পাতলা করে কিছু ক্রিম মেখেছি। চুলগুলো, দাঁত সব ঝকঝকে করছে। চলতে ফিরতে পারি যেন হাওয়ায় ভেসে, বাঁক নিতে উঠতে বসতে কোনও কষ্ট নেই। একদিন দরজায় বেল শুনে তুরতুর করে নেমে দরজা খুলতে যাচ্ছি দেখে, রিণি মন্তব্য করল—‘মা তোমার কী হল? হুমড়ি খেয়ে পড়ে এবার একটা কাণ্ড করবে দেখছি?’ আমি তাড়াতাড়ি সামলে নিই।

এরপর আমি যোগ আর সাঁতারে ভর্তি হই। সেই সঙ্গে লাইব্রেরিতে। সাঁতার আমি চিৎ উপুড় সব জানি। ওসব আমায় শেখাতে হবে না। যোগও আমার অল্পবয়সে অভ্যেস ছিল। সাধা গলায় গান তুলে নেবার মতো, এতেও কোনও অসুবিধে হয় না। শুধু দৌড়টা সম্পূর্ণ করবার জন্যে এসব করি।

তারপর একদিন দোকানে গিয়ে দরকার মতো কিছু কেনাকাটা করি। সুটকেস গুছিয়ে নিই। হাতব্যাগ গুছিয়ে নিই। রাত্তিরবেলায় ছেলে মেয়েকে খেতে দিয়ে, নিজে খেতে খেতে বলি,—‘রবি চেকবইটা রাখ। হঠাৎ যদি দরকার হয় তুলবি। রিনি, দুজনের মত একটু রান্না করে নিতে পারবি না? রবিও সাহায্য করবে।’ ওরা অবাক হয়ে আমার দিকে তাকায় বলে—‘কেন? কী ব্যাপার? তুমি কোথাও যাচ্ছ?’

—হ্যাঁ, কাল ভোরের ট্রেনেই।

—সে কি? কে সঙ্গে যাবে? একা একা কোথায়…কেন! নিরুদ্দেশ হচ্ছো নাকি? কাগজে বিজ্ঞাপন দিতে হবে? টিভি-তে ছবি? কী করেছি আমরা?

আমি হেসে বললুম—‘এতগুলো প্রশ্নের জবাব কি করে দিই বল তো? আমার সঙ্গে কাউকে যেতে হবে না। আমি একাই পারবো। না, নিরুদ্দেশ হচ্ছি না। বড় জোর মাস ছয়েক। নিয়মিত চিঠি দিয়ে যাব। ভাবিস না। না তোরা কিছু করিসনি। আবার করেছিসও। ভাল করেছিস। কোথায় যাচ্ছি?’

—‘বলব না।’

—‘এত রহস্য কেন? মা তুমি কি চুপিচুপি কাউকে খুনটুন করে পালাচ্ছো?’ রিণি বলল।

—‘মা, ডোন্ট মাইন্ড, ইলোপ-টিলোপ করছ না কি কোনও মামু কাকুর সঙ্গে?’

—রবি বলল।

আমি বললুম—‘যতই কেন আমায় ক্ষেপাও আর তাতাও, আর একটা কথাও আমার মুখ দিয়ে বার করতে পারবে না। এইটুকু শুধু বলছি ভাবনার কিছু নেই। মাস ছয়েকের মধ্যে ফিরে আসব। চিঠি পাবে। তোমাদের যদি কিছু বিপদ-আপদ হয়, বাংলা কাগজে বিজ্ঞাপন দেবে। না হলে আমি সময় হলেই ফিরে আসব।’

লেকের কিছু কিছু গাছ চিনতুম। কিন্তু ভিক্টোরিয়ার বাগানে প্রায় কোন গাছই চিনতুম না—সর্বজয়া বা ক্যানার ঝাড় ছাড়া। গাছ প্রদীপের মতো দুধারে লালচে শক্ত শক্ত পাতা মেলে দাঁড়িয়ে থাকত ও কী গাছ? জানা ছিল না। গাছটা দেখলেই আমার মনের মধ্যে শত শিখায় প্রদীপ জ্বলে উঠত। গুঁড়ি গুঁড়ি পাতায় কুয়াশার মতো ওটাই বা কী গাছ? যেন রহস্যের ঘেরাটোপ পরে আমায় ডেকেই যাচ্ছে। ডেকেই যাচ্ছে। ডাকও নয় হাতছানি। কিন্তু এখানকার সব গাছপালা আমি মোটামুটি চিনি। সকলেই চেনে। কোথায় এসেছি? বলব না। এমন কি কোন ইস্টিশান থেকে কোন ট্রেন ধরে এসেছি সে সবও বলব না। তোমরা ভীষণ চালাক ধরে ফেলবে। অজ্ঞাতবাসের সময়ে পাণ্ডবেরা কী করেছিলেন? নিজেদের পুরনো পরিচয় মুছে ফেলে অন্য মানুষ হয়ে গেছিলেন না? কাউকে ঘুণাক্ষরেও জানতে দিয়েছিলেন নিজেদের গতিবিধি? নিজেদের পরিচয়? ভীম নিরুপায় হয়ে প্রায় ধরা দিয়ে ফেলেছিলেন আর কি! যাই হোক কোনও সূত্র আমি কাউকে দেব না। শুধু এইটুকু বলি যে কুঝিকঝিক করে যাওয়া হল না। ভোঁ করে দেবদত্ত কী পাঞ্চজন্যের পিলে চমকানো আওয়াজ চড়ে গিয়ে ছিলুম।

কত কত দিন হয়ে গেছে, তবু আমি এ জায়গায় অন্ধিসন্ধি চিনি। গলির মুখে জোড়া নিমগাছ। পাশ দিয়ে সরু একটা নোংরা গলি বেরিয়ে গেছে। গলির মুখে একটা টিউবওয়েল হয়েছে দেখছি। ডান দিকে অশথ গাছের তলায় গোল একটা পাথর তার ওপর কিছু ফুল বেলপাতা। একটু সাদা সাদা কস গড়াচ্ছে। অর্থাৎ দুধও ঢেলেছে কেউ। যতদিন যাচ্ছে মানুষের দেবতায় ভক্তি ততই বেড়ে যাচ্ছে। জীবনটা বড্ড অনিশ্চিত হয়ে গেছে তো! ওই তো ইস্টিশানের রেলিং-এর ধার ঘেঁষে মস্ত বড় শিরীষ গাছ। ইসস্ ঠিক তেমনি আছে। হাতির গুঁড়ের মত কালো নল বেঁকে আছে, ওইখান থেকে এক্সপ্রেস মেল ট্রেনরা জল নেয়। মাথায় করে ছোট ছোট ঝুড়িতে কয়লা বয়ে ডেঁয়ো পিঁপড়ের মত ভঙ্গিতে চলে যাচ্ছে এক সারি কয়লাকুড়ানি। শিরীষ গাছটার পেছন থেকে রিক্সা স্ট্যান্ড আরম্ভ হয়েছে। একটা রিক্সাতে উঠে বসে গন্তব্য বলে দিলুম। অমনি হাওয়ায় উড়তে লাগল খোকাটা। আমার বিলুর বয়সী হবে হয়ত।—‘এখখুনি পৌঁছে দিচ্ছি ছোড়দি।’

নির্দিষ্ট বাড়িটার কাছে এসে আমি অবাক। পলেস্তারা খসে গেছে। যেখান সেখান থেকে গাছ বেরিয়েছে। দরজা জানলায় রঙ নেই। মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল। তবু কড়া নাড়লুম। বেশ কিছুক্ষণ নাড়ার পর এক দশাসই চেহারার মহিলা এসে দরজা খুলে দিলেন। খুলেই বললেন—‘আমাদের কিছু কেনার নেই, সাবান, পাউডার, ধূপ, সিঁদুর কিছু না। আপনি আসতে পারেন।’ দরজা বন্ধ করে দিচ্ছিলেন। আমি বললুম—‘এটা ব্রজনাথ সিংঘির বাড়ি না?’

ভদ্রমহিলা একটু থতিয়ে গেলেন। বললেন—‘হ্যাঁ, তো কি?’

—‘আসলে আমি একটা ঘর ভাড়া খুঁজছিলুম। শুনলুম ব্রজনাথ সিংঘির বাড়ি অঢেল জায়গা। আমার একটু স্থান হতে পারে।’

—‘তুমি ক্যা?’

—‘আমার নাম চিন্ময়ী চক্রবর্তী। আমি কলকাতায় চাকরি করি। তা ওখানে কোনও হোস্টেলে জায়গা পেলুম না। তাই এই মফস্বল টাউনে এসেছি। একটু থাকবার জায়গা, আর খাবার ব্যবস্থা যদি হয়। মাসে এক হাজার টাকা করে দেবো।’

—‘কি বলল্যা? হাজার?’ মহিলার মুখ হাঁ হয়ে গেল। বুঝলুম এখনও এই টাউনে টাকার দাম বেশিই আছে। আমি তাড়াতাড়ি বললুম—‘আমি কলকাতায় খুঁজছি। পেলেই চলে যাব। মাস ছয়েকের মধ্যেই একটা পাওয়ার কথা আছে।’

—‘না না সে কথা বলছি না। বলছি আমাদের ঘর দুয়োর তোমার পছন্দ হবে কেন গো মেয়ে, আমাদের খাওয়া-দাওয়া…’

‘আমি বললুম—‘এখনও তো দেখিইনি, একটু যদি দেখান।’

—‘তুমি কী কর, মেয়ে?’

চিন্ময়ী চক্রবর্তীর। পরনে গোলাপি রঙের সালোয়ার আর সাদার ওপর গোলাপি বুটির কামিজ। একটা সাদা ওড়না বাঁ কাধ থেকে ভাঁজ করা অবস্থায় ঝুলছে। চুলগুলো মাথায় ঝুড়ির মত হয়ে আছে, কপালে ছোট্ট একটা গোলাপি টিপ। নখ সুন্দর করে কাটা। পায়ে কালো স্যান্ডাল।

আপাদ মস্তক দেখে নিয়ে প্রশ্নটা করলেন মহিলা। চিন্ময়ী বলল—আমি জার্নালিজম করি। মানে সাংবাদিকতা।’

ভদ্রমহিলা হাঁ করে রইলেন।

বললুম—‘খবরের কাগজে লিখি। খবরের কাগজের কাজ করি।’

—‘ওরে বাবা, ও পুঁটু, ধানু, জংলু খবরের কাগজের লোক এয়েছে রে।

মুহূর্তের মধ্যে বাড়ির ভেতর থেকে এক দঙ্গল ছেলে বার হয়ে এল, এবং একটি মেয়ে। রোগা, পাকানো চেহারা উল্টোপাল্টা জামাকাপড় পরা কিন্তু চোখগুলো জ্বলছে, মুখগুলোও বেশ উজ্জ্বল।

—‘কী চান। কী চান!’—একজন বলল।

আরেক জন বলল—‘তুই সর বে, কে আমি দেখছি, কোন সালী, কোন বাঞ্চোৎ।

চিন্ময়ী হাত তুলে থামাতে ইঙ্গিত করল ওদের। তারপরে বলল, ‘ঠিক আছে, আমি চলে যাচ্ছি। পেয়িং গেস্ট হয়ে থাকবার জন্য এসেছিলুম। এ বাড়িতে অনেক জায়গা আছে, কে একজন মহিলা ভাল রান্না করতে পারেন শুনে। তা আপনাদের এত আপত্তি থাকলে আমি চলে যাচ্ছি।’

পেছন ফিরতে ফিরতে চিন্ময়ী বুঝতে পারল মহিলা ছেলে মেয়েগুলোকে চুপি চুপি কিছু বলছে। মেয়েটিও কোমরে হাত দিয়ে ডাকল ‘এই যে শুনছেন?’

ফিরে দাঁড়িয়ে চিন্ময়ী বলল, ‘কী?’

—খাওয়া থাকার জন্যে দিমাকে আপনি হাজার টাকা দেবেন বলেচেন?’

—‘বলেছি।’

—‘তো থেকে যান!’

—‘এখানে আমার পোষাবে না মনে হচ্ছে—’ চিন্ময়ী আবার ফিরে দাঁড়াল।

—কেন? তিন-চারটে মিশ্রিত গলায় শোনা গেল।

চিন্ময়ী বলল—‘এই রকম বে-টে, শালী-টালি, মারমুখো ভাব এসব আমার চলবে না। কে জানে ভেতরে কিসের আড্ডা। মস্তানি-টস্তানি ; ড্রাগ-ট্রাগ ; সাট্টা-ফাট্টা। থাক আমি অন্য কোথাও খুঁজে নিচ্ছি। অনন্ত ঠাকুরমশায়ের বাড়িটাও তো আছে?’

ছেলে মেয়েগুলো সব পেছন থেকে এক দৌড়ে সামনে এসে চিন্ময়ীর পথ রোধ করে দাঁড়াল।—‘অনন্ত ঠাকুরের ছেলের বউ মরে গেছে। ছেলে হাত পুড়িয়ে খায়। বাড়িতে তিনটে খোকা-খুকু সব সময়ে খাই-খাই করচে। তোমাকে আস্ত গিলে খেয়ে নেবে।’ একজন বলল।

—আর একজন বলল—‘হুঁ ড্রাগ! ফ্যান ভাত জুটলে বেঁচে যাই, শাক সেদ্ধ আর আলুসেদ্ধর সঙ্গে, আবার ড্রাগ! আর সাট্টা-ফাট্টা রিকশঅলারা খেলে—আমাদের রেস্ত কোথায়?’

চিন্ময়ীর রিকশাঅলাটা তখনও বোধহয় মজা দেখতে দাঁড়িয়ে ছিল। মেয়েটা কোমরে হাত দিয়ে তার দিকে এগিয়ে গেল, ‘এই মদ্‌না, তুই সাক্ষী দে না আমরা সাট্টা খেলি না তোরা খেলিস!’—উত্তরে মদনা এবার সাইকেলে প্রাণপণে প্যাডল করতে করতে বেরিয়ে গেল।

—‘দেখলেন তো!’ মেয়েটা তেমনি কোমরে হাত দিয়ে বিজয়িনীর ভঙ্গিতে বলল।

চিন্ময়ী বলল—‘ওই সব শালী-টালি চলবে না আমার।’

—‘সরি ম্যাডাম’—একটা ছেলে এগিয়ে এসে বলল—‘ও সব আমাদের নিজেদের মধ্যে আদরের ডাক। আর বাইরের পার্টিকে ভড়কাতে খুব কাজে লাগে।

—‘ভড়কাতে হয় কেন?—চিন্ময়ী একটু কঠোর গলায় বলল।

—‘ভড়কাতে…মানে…হয়…এই আরকি!’ ছেলেটা স্পষ্ট করে কিছুই বলে উঠতে পারল না। তখন মহিলা এগিয়ে এসে বললেন—‘ও হতভাগারা বলতে পারবে নে। আমি বলচি। সিঙ্গি মশাইয়ের ছেলে আমাকে এই বাড়ি দেকাশোনার ভার দিয়ে চলে গেল। বিদেশ থেকে মাসে মাসে ট্যাকা পাঠায়। এই পুঁটুটা আমার বোনঝির মেয়ে, পটলটা ভাইপোর ছেলে। ওদের কেউ নেই তাই ঠাঁই দিয়েছি। সে কতা তো আর বাবু জানে না। আর এই সব বাকিগুলো, সব হাড়-হাভাতের দল। ছোটলোকের বাচ্চা, সর্বক্ষণ এখানে পড়ে আচে। সোনার নাতি-নাতনি আমার সঙ্গদোষে বজ্জাত হয়ে যাচ্চে মা। তুমি এখানে থাক। বিনিবামনীর রান্নার সুখ্যাত শুনে যখন এয়েচ!’

‘ছোটলোকের বাচ্চা’ পর্যন্ত শুনেই বাকি ছেলেগুলো মুখ আহত অভিমানে অস্বাভাবিক গম্ভীর করে চলে যাচ্ছিল। যেতে যেতে একজন বলল—‘চোর বাটপাড় থেকে বাঁচাতে হলে বোলো দিমা, খুব বাঁচাব।’

চিন্ময়ী চেঁচিয়ে ডাকল—‘এই ছেলেরা শুনে যাও।’ ওরা দাঁড়িয়ে গেল, কিন্তু কাছে এল না।

চিন্ময়ী বলল—‘আমি এ বাড়িতে থাকলে তোমাদের আপত্তি আছে? আমার যখন-তখন কাজ, বেরিয়ে যাই। জিনিসপত্র থাকবে। তোমরা একটু পাহারা না দিলে…। আমাকে অবশ্য কেউ কাবু করতে পারবে না। আমি কারাটে কুংফু সব জানি…।’ বলে সে ডান পাটা সোজা উঁচুর দিকে ধাঁই করে ছুঁড়ল।

—‘স-ব?’ পুঁটু এগিয়ে এল—‘আমায় শিখিয়ে দেবেন!’

—‘শেখা কি অত সহজ? শরীরটা আগে দুরস্ত করতে হবে পিটে পিটে!’ সঙ্গে সঙ্গে বলা নেই কওয়া নেই পুঁটু দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সটান পেছন দিকে হেলে চাকা হয়ে গেল। তারপর আবার অবলীলায় উঠে পড়ে হাত দুটো নামিয়ে হাতে ভর দিয়ে পা দুটো ওপর দিকে তুলে পীকক হয়ে গেল, তার ফ্রকের ঘের তলার দিকে ঝুলে পড়েছে, লাল সালুর ঝালর দেওয়া ইজের বেরিয়ে পড়েছে, সে দু-হাতে হন হন করে চলতে লাগল। ওদিকে পটলা পাক খেয়ে গোরুর গাড়ির চাকা হয়ে অন্তত বিশগজ চলে গেছে। তারপর আবার চক্রাকারে ফিরে সে বলল— ‘মাসকুলগুলো দেখুন!’ হাত ভাঁজ করে সে তার বাইসেপস ট্রাইসেপস দেখাতে লাগল, দু’জনেই বলল—এতে হবে না?’

‘হবে, হবে’—হেসে ফেলল চিন্ময়ী, ‘তবে সব কি আর শেখাতে পারব? কয়েকটা মোক্ষম প্যাঁচ শিখিয়ে দিতে পারি। কি হল? ধানু জংলু তোমরা বললে না তো কিছু?’

—‘পটলার দিমার ট্যাঁক ভারী হবে, তো আমাদের ছোটলোকের বাচ্চাদের কী বলবার আচে? এই সময়ে দিমা এগিয়ে এসে বললেন—‘আর ঢঙে কাজ নেই। অনেক ঢঙ দেখিয়েচ। বিকেলে মুড়ি ভেজে রাকবো, তেলেভাজাগুলো নিয়েসো দয়া করে। আপনি আসুন মা।’

ভেতরে ঢুকেই চিন্ময়ী একটা শক খেল। উল্লাসের শক, আবার আঘাত পাবার শক। চেনার ধাক্কা, চেনাকেও না চেনার ধাক্কা। সেই চতুষ্কোণ উঠোন। চারপাশে উঁচু দাওয়া। দাওয়ার ওপর সারি সারি লম্বা চওড়া দরজা। ওই তো রান্নাঘর। তার পাশেই খাবার ঘর, তারপর খানিকটা ফাঁক, চওড়া সিঁড়ি ওপরে উঠে গেছে। তার পাশে জ্যাঠামশাইয়ের চেম্বার-ঘর, তারপর এজমালি বৈঠকখানা। দাওয়ার উত্তর দিকে একটা দরজা। দুপাশে দুটো কলঘর। তার পাশে বামুনঠাকুর আর টেকন চাকরের আস্তানা।

শুদ্দুরের সঙ্গে থাকতে হচ্ছে বলে নীলকণ্ঠর বড্ড আফশোস ছিল। মাঝখানের দরজা দিয়ে ওপারে গেলেই, আর একটা মহল। ঠিক এই রকম ক্যারামবোর্ডের মত আর একটা উঠোন। সিংঘিবাবুদের। মেজদা বলত ‘সিঙ্গিমশাই, সিঙ্গিমশাই মাংস যদি চা-ও।’ অমনি জেঠিমা বেরিয়ে এসে বলতেন ‘কী হচ্ছে ভুতু, উনি তো আমাদের কোনও ক্ষতি করেননি! গুরুজনদের নামে ছড়া-কাটা আমি পছন্দ করি না।’ মেজদা হেসে বলত—‘বা রে, অমনি গোঁপ আর এমনি ঘ্যাঁক করে আওয়াজ করলে যদি আমার ছড়া মনে আসে! ছড়া তো ভাল জিনিস। ছড়া থেকে পদ্য, পদ্য থেকে কবিতা আর কবিতা থেকে রবীন্দ্রনাথ!’ জেঠিমা হাতের খুন্তিটা নীরবে নেড়ে, চোখ পাকিয়ে একটা রাগত ভঙ্গি করে রান্নাঘরে ঢুকে যেতেন। কচুর শাক রান্না হচ্ছে, কষতে কষতে জান বেরিয়ে যাবে তবে সেই অমৃতময় স্বাদ বার হবে।

সিংঘিবাবুদের উঠোনটার চারপাশে চারটে নর্দমার গর্ত ছিল। ছোড়দি বলত—‘দ্যাখ এটা হল দৈত্যদের ক্যারামবোর্ড।’ চিনু বা ছোটরা জিজ্ঞেস করত—‘দৈত্যরা কখন খেলে ছোড়দি!’ ছোড়দি বলত—‘অবশ্যই রাতে, সব্বাই, বিশ্বসংসারের স-ব ঘুমিয়ে পড়লে!’ চিনু বলত ‘ঘুঁটি কই? দৈত্যদের?’ ছোড়দি পাল্টা প্রশ্ন করত ‘বল দিকিনি, পারিস কি না!’ অনেক ভেবে, নিজের কল্পনাকে অনেক দূর টেনে-হিঁচড়েও দৈত্যদের ঘুঁটির খবর চিনু বার করতে পারত না। তখন ছোড়দি রহস্যময় হেসে বলত ‘আরে বোকা, আমরা, আমরা সবাই। সিংঘি জ্যাঠার ছেলেমেয়েরা কালো ঘুঁটি, আমরা সাদা ঘুঁটি। আর চিনু তুই রেড। তোকে নিয়ে সে কী লড়ালড়ি হয় তা যদি জানতিস!’ চিনু ভয়ে কাঁটা হয়ে যেত, দৈত্যদের ঘুঁটি হওয়াই যথেষ্ট ভয়াবহ। তার ওপর রেড, যার ওপর দু-দলেরই ঝোঁক। সারা রাত তাকে নিয়ে লড়ালড়ি হয়? সে ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করত—‘স্ট্রাইকার কই, ছোড়দি।’ ছোড়দি তখন এমন সোডার বোতল খোলার মত হেসে উঠত, যে উত্তরটা বোঝাই যেত না। অবশেষে তার চোখের জলে নাকের জলে অবস্থা থেকে অনেক কষ্টে বার হত স্ট্রাইকার হলেন সিংঘিমশাই আর আমাদের জ্যাঠামশাই।

—‘আমরা কেউ বুঝতে পারি না তো!’ চিনুর বোন মিনুর প্রশ্ন।

—‘বুঝতেই যদি পারবি তো আর দৈত্যদের কাণ্ডকারখানা বলেছে কেন। ঘুমের মধ্যে আমরা সব গুটিয়ে গোল হয়ে চাকতি মত ঘুঁটি হয়ে যাই। তবে চিনু একটু একটু বুঝতে পারে।’

—‘কই পারি না তো?’

‘ঘুমের মধ্যে চেঁচাস না?’

সত্যি ঘুমের মধ্যে চেঁচিয়ে-ওঠা, বিড়বিড় করে কথা বলা এইসব চিনুর অনেকদিন পর্যন্ত অভ্যেস ছিল। মা তার জন্যে একটা নোয়া পরিয়েছিলেন। জ্যাঠামশাই ওষুধ দিতেন। অব্যর্থ প্রমাণ। ঠিক ডমরুধরের কোমরে কুমীরের দাঁত পরিয়া থাকার মতো অব্যর্থ।

আপাতত সিংঘিবাবুদের সেই ক্যারামবোর্ড সেখা যাচ্ছে না। চক্কোত্তিদের অংশেরটা দেখা যাচ্ছে। ঝোপ, ঝাড়, শ্যাওলা, পেছল, কতদিনের আবর্জনা, সব সব। যাচ্ছেতাই। এইখানে তারা ব্যাডমিন্টন খেলত। শাটল্‌ককটা একদিন মাছের ঝোলের মধ্যে পড়ে গেছিল সেই থেকে রোববার সকালে ব্যাডমিন্টন বন্ধ। বড়দা দুদিকে দুটো দুশ ওয়াটের বালব লাগিয়ে দিয়েছিল। বিকেল থেকে সন্ধে, অনেক সময়ে রাত্রে, রান্না হয়ে যাবার পর রান্নাঘরে শেকল তুলে খেলা হত।

তার মুখ কুঁচকে উঠেছে দেখে দিমা ভয়ে ভয়ে বললেন—‘কী মা, পছন্দ হচ্ছে না?’

—‘এত নোংরা! পরিষ্কার করা যায় না!

—‘কেন যাবে না!’ পটলা এগিয়ে এল। —‘দুদিন সময় দিন, একেবারে মোজাম্বিক করে দোব।’

—‘দিও। এখানে তো ব্যাডমিন্টন খেলা যায়। তা দিমা আপনি কোথায় থাকেন?’

—আমি মা পটলা আর পুঁটুকে নিয়ে ওই ও-ই ঘরটায় থাকি।’

জ্যাঠামশায়ের চেম্বারটি এখন তাহলে দিমার দখলে। রাশভারি জ্যাঠামশাই, দজ্জাল দিমা।

—‘ওপরের ঘরগুলো কী হয়?’

‘—তালা দেওয়া আছে মা। ব্যাভার করার হুকুম নেই।’

—‘আমার তো দোতলার দক্ষিণ-পুবের ঘরটা ছাড়া হবে না।’

—‘তালা তোড় দেগা’—জংলু বলল।

দিমা বলল—‘তার দরকার হবে না। চাবির থলো আমার কাছে নুকোনো আছে, এই জংলু খবদ্দার কথাটা পাঁচ কান করিসনি। ওতে সব ফার্নিচার রয়েছে কি না! তা তুমি যদি ছ’মাসের জন্যে থাক, তার মধ্যে কি আর সিংঘিবাবুর ছেলে দিল্লি থেকে আসবে? আসবে নে কো!’

—তবে আমি ওপরেই থাকব। ফার্নিচার না হলে আমার চলবে কেন?’ বলতে বলতে চিন্ময়ী ওপরে উঠতে লাগল। সিঁড়িময় ধুলো, বেড়ালের কম্মো, ইঁদুরের নাদি। চিন্ময়ী চক্কোত্তির পেছন পেছন উঠতে থাকে ছেলেমেয়ের দল এবং দিমা। চিন্ময়ী লাফিয়ে লাফিয়ে উঠছে, আর ‘ইস কী করে রেখেছে?’ বলছে মাঝে মাঝেই। পটলাও লাফাতে লাফাতে চলেছে আর বলছে ‘স-ব মোজাম্বিক করে দেবো।’

পুব দক্ষিণের ঘরটাতে বেশ হাওয়া আসে, ফ্যানও ঝুলছে একটা সিলিং থেকে। আলোও জ্বলে একটা। সিঙ্গল বেড খাট, ভাল বিছানা, মোটা—রঙচটা সতরঞ্চি দিয়ে ঢাকা, একদিকে একটা আলমারি। চাবি দেওয়া, দেয়ালে র‍্যাক কয়েকটা। একটা আয়না ধূলিধূসরিত, একটা টেবিল, দুটো গদীমোড়া চেয়ার। একটা কোল পেতে-বসা ভালুকের মতো কৌচ।

দিমা বললেন—‘পাশেই কলঘর আছে মা।’

চিনু জানে। এটা আসলে জ্যাঠামশায়ের ঘর। তাদের ভাইবোনেদের অসম্ভব লোভ ছিল এই ঘরটার ওপর। জ্যাঠামশাই যখন নিচের চেম্বারে রুগী দেখতে ব্যস্ত সেই সময়ে চিনুরা ক’ ভাইবোন হুড়মুড় করে ঘরটাতে ঢুকে, কেউ খানিকটা জানলা ধরে বাঁদরের মত ঝুলে নিত। কেউ বাথরুমে গিয়ে খামোকা বেসিনে মুখ ধুয়ে নিত। কেউ আবার কাচের আলমারিতে বইয়ের সারির দিকে অভিনিবেশ সহকারে দেখত কিছুক্ষণ। কেউ চট করে টেবিলের ওপর-রাখা মেমসাহেব-নাচা ঘড়িটাতে অ্যালার্মের দম দিয়ে দিত, অমনি মেমসাহেবটা নাচতে আরম্ভ করত টুং টাং বাজনার সঙ্গে সঙ্গে। এসব জিনিস জ্যাঠামশায়ের রুগীদের উপহার। তা ঠিক সেই সময়ে টেকন চাকর কাঁধে লাল গামছা নিয়ে দৌড়তে দৌড়তে এসে ঘরে ঢুকত—‘কী করছি? অ মা, এ মিনিদিদি, অ চিনিদিদি, নুটুদাদা, যাও, যাও বলুচি।’

—‘হ্যাঁ, হ্যাঁ তোমাকে বেলুচিস্তানে পাঠিয়ে দিয়ে যাব’ বলতে বলতে তিন ভাই বোন দৌড় দৌড়।

ঘরটার মাঝখানে ধুলোর মধ্যে চটিশুদ্ধ পায়ের ছাপ ফেলে চিনু দাঁড়িয়ে রইল। সেই ঘর, যার জন্যে ছোটবেলা থেকে আকণ্ঠ লোভ। সেইখানে অবশেষে চিনু থাকতে পাবে। ঘরটা আর ঠিক সেই ঘর নেই। নেই সেই মেমসাহেব পুতুলঅলা ঘড়ি। সেই হাফ-সেক্রেটারিয়েট টেবিলের ওপর ঝকঝকে কাচের নিচে নানা দেশের সুন্দর সুন্দর ছবি। কাঁচের আলমারিতে পরপর সাজানো বাঁধানো বই। দেয়ালে বাবা-জ্যাঠামশায়ের বাবা-মার যুগল তৈলচিত্র। ছোট্ট ঠাকুমা নাকে নোলক, বেনারসী সামলাতে পারছেন না, এক পা তুলে দাঁড়িয়ে আছেন। গুঁফো ঠাকুর্দা টোপর হাতে চেয়ারে বসে। গোঁফের ফাঁকে সামান্য হাসি। নিশ্চয়ই নতুন-বউ-প্রাপ্তির। কিছু নেই। সবই বদলে গেছে। তবু সবই আছে। স-ব এনে ফেলতে চিনুর অসুবিধে হবে না। অসুবিধে হলে সে এত করে এত দূর দৌড়ে আসবে কেন? সে টেবিলের ওপর নিজের হালকা সুটকেসটা নামিয়ে রাখল, তারপর বলল—‘দিমা, এই আমার জিনিস রইল, কলকাতায় যাচ্ছি। ফিরতে হয়ত বিকেল হবে, তার মধ্যে এইসব গুছনো ফিটফাট চাই। এই নিন আপাতত একশো টাকা। আজকে মুরগী হবে, রাত্তিরে। এরা সবাই খাবে। আর আমাকে তুমি বললেই হবে। এই ছেলেমেয়েরা তোমরা আমাকে চিনুদি বলবে। তরতর করে সে নেমে গেল। দু-তিন কদমে রাস্তায়। তারপর চলতি একটা রিকশায় চড়ে ইস্টিশান।

কোথায় গেলাম? বলব না। আচ্ছা আচ্ছা বলব। সারা দুপুর একটা চমৎকার লাইব্রেরিতে কাটিয়ে, শেষ দুপুরে একটা কোর্স নিচ্ছি, তার ক্লাস করলুম। মাঝখানে একটা মাদ্রাজি রেস্তোরাঁয় একটা মহাকায় মশলা ধোসা আর কফি খেয়ে দুপুরের ভোজন সারলুম, বিকেলের দিকে এক গ্লাস ফলের রস খেয়ে কাজুবাদাম কিনে ট্রেনে উঠলুম। রিকশাতে উঠে সিংঘিবাবুর বাড়ি আসতে আসতেই দূর থেকে দেখলুম দোতলার পুব-দক্ষিণের ঘরে খুব ঝকঝকে আলো জ্বলছে। খুশি-খুশি মনে কড়া নাড়তেই পুরো বাহিনীসহ দিমা দরজা খুলে দিলেন। ঢুকতেই উঠোনটা দেখলুম আধা সাফ হয়েছে, কিন্তু দাওয়া, সিঁড়ি, ওপরের চকমিলোনো বারান্দা, এবং সর্বোপরি আমার থাকবার ঘরটি ঝকঝক করছে।

পুঁটু বলল—‘এত দেরি কেন?’

পটলা বলল—‘আমাদের মুড়ি-তেলেভাজা খাওয়া হয়ে গেল। তেলেভাজা ঠাণ্ডা হয়ে গেল।’

চিনু বলল—‘আমার শুধু চা হলেই চলবে। গা ধুয়ে নিই।’

রাত্তিরবেলা খাবার সময়ে হল মুশকিল। দিমা বললেন—‘আমি বামুনের মেয়ে মা, মুরগী ছুঁই না, তাই পাঁঠার মাংস করেছি।’

চিনু বলল—‘বেশ তো।’ কিন্তু প্রথম গ্রাস মুখে দিয়েই সে হড়হড় করে বমি করে ফেলল। বমি সামলাতে চলে গেল উঠোনে। মুখে-চোখে জল দিল, তবু বমি ভাব যায় না।’

দিমা বললেন—‘কি রে ধানু বোকা পাঁঠা আনলি না কি?’

ধানু বললে—‘ইস্‌স্‌, দিলেই হল। ধানুকে ফজল বোকা পাঁঠা দেবে! ঘাড়ে ক’টা মাথা! তাছাড়া খেতে তো ফাস্টো কেলাস হয়েচে।’

দিমা অপ্রস্তুত গলায় বললেন—‘ওমা, মেয়ে বোধহয় পাঁঠা খেতে পারে না গো, তাই মুরগীর কতা বলেছিল।’

ততক্ষণে চিনু নিজেকে সামলে নিয়েছে। আসলে বারো বছর সে মাংস খায়নি। এরকমটা যে হতে পারে তা তার মনে আসেনি। ছেলেমেয়েদের তো প্রায়ই রান্না করে দিয়েছে, এরকম গা-বমি তো করেনি! সে বললে—‘রান্না খুব ভালো হয়েছে দিমা।আমার শরীরটাই কেমন খারাপ খারাপ লাগছে।’

—‘তা হলে কি খাবে মা?’

—‘কিছু না খাওয়াই তো ভাল, বমি যখন হয়ে গেল। আপনার কি রান্না করেছেন?’

—‘আমি বেগুন পুড়িয়ে নিয়েছি মা। আর এখো গুড় আচে। খাবে?’

—‘না, না। গা-বমি করছে তো।’

—‘রাত-উপুসী থাকবে মা!’

চিনু মনে মনে ভাবল একটা হরলিক্স্‌-টিক্স্ কিনে রাখা দরকার।

যেদিন সত্যি-সত্যি উঠোনখানা মোজাম্বিক হয়ে গেল, এবং ওপর থেকে চিনুদিদি ব্যাডমিন্টনের নেট, শাটল কক আর র‍্যাকেট নিয়ে নেমে এল, সেদিন পটলা ধানু জংলু পুঁটুর মধ্যে হুড়োহুড়ি পড়ে গেল। একবার এ চাকা হয়ে যাচ্ছে, একবার ও। জংলু বলল—‘জাল খাটাবার খুঁটি কোথায় পোঁতা হবে দিদি?’

চিনু বলল—‘দেখ ভাল করে। মাঝখান বরাবর দু’পাশে গর্ত পেয়ে যাবি।’

—‘সত্যি তো! কী করে তুমি জানলে দিদি?’

—‘আমি কিছু কিছু ম্যাজিক জানি।’

—‘ম্যাজিক? আমায় শেকাবে?’—কোমরে হাত দিয়ে পুঁটু এগিয়ে এল।

—‘কত কি তুই শিখবি? কারাটে কুংফু। ম্যাজিক। আপাতত ব্যাডমিন্টনটাই শেখ।’

তারপর কিছুদিনের মধ্যেই দুর্দান্ত খেলা আরম্ভ হয়ে গেল।

মিক্সড ডাবলস্। এদিকে চিনু আর ছোড়দা। ওদিকে মিনু আর মেজদা।

ছোড়দা বলল—‘তোর ব্যাকহ্যান্ডটা ভাল। ফোরহ্যান্ড হোপলেস। নইলে মিনুর ওই সোজা শটটা তুলতে পারলি না? একটু ছুটে সামনে এগিয়ে গেলেই…’

মেজদা অর্থাৎ ভুতু স্ম্যাশের পর স্ম্যাশ করে যাচ্ছে। মিনু টুকটুক করে ড্রপ শট। মেজদা আর মিনুর জুটি জিতে গেল। চারপাশে দাওয়ার ওপর ভিড় করে দাঁড়িয়েছে বড়দা, ছোড়দি, সিঙ্গিমশাইয়ের বাড়ির ছেলেমেয়েরা। সবাই মিলে হল্লা করছে। এদের গেমটা হয়ে গেলেই আরও চারজন নামবে। কোনও দলকেই বেশি চান্স দেওয়া হবে না। নইলে অতজন খেলা শেষ করবে কী করে? দিমার রান্নাঘরের শেকল তোলা। পিঁড়ির ওপর পা ছড়িয়ে বসে দিমা খেলা দেখছে, আর মাঝে মাঝে হাই তুলতে তুলতে টুসকি দিচ্ছে। চেম্বার থেকে বেরিয়ে এসে জ্যাঠামশাই দু’দণ্ড জিরিয়ে খেলা দেখে গেলেন। মন্তব্য করলেন— ‘তোমাদের ঠিক ব্যালান্সড টিম হয়নি ভুতু। চিনুটার তাকত নেই, দম নেই। ব্যাডমিন্টন দমের খেলা। মেয়েটা খেতে পারে না। রাতে বিড়বিড় করে।’

—‘কিরমি আছে, কিরমি আছে। তাই মেয়েটা বাড়তে পারছে না।’ মা মাথায় ঘোমটাটা তুলতে তুলতে বলল—‘ওষুধ দিন না বটঠাকুর।’

—‘ওষুধ তো দিচ্ছি। মেয়েটাকে একটু তেতো খাওয়াতে পারছো না?’

—‘কী করব? ওয়াক তুলে ফেলে যে! আর জানেন তো, শুধু হাতে গুড়ের নাগরি থেকে মুঠো মুঠো গুড় তুলে চেটে চেটে খায়।’

—‘খাবেই! কৃমি ওকে ঘাড় ধরে খাওয়াবে বউমা। ওর দোষ কি?’

গো-হারান হেরে চিনুদি দাওয়ায় উঠতে উঠতে বলল—‘হ্যাঁ, আমি সারাদিন কোথায় না কোথায় ঘুরে ঘুরে সাংবাদিকতা করে বেড়াই, আর তোরা খেলে খেলে সে সময়ে হাত দুরস্ত করে ফেলিস।’ ‘হেরো! হেরো! হেরো!’ জংলু আর পুঁটু দুয়ো দিতে থাকে। হঠাৎ ঘুরে দাঁড়িয়ে চিনু বলে—‘এটা কিন্তু নিয়ম নয়। নিয়ম হল খেলার শেষে হেরো পার্টি আর জেতা পার্টি হ্যান্ডশেক করবে, এই এমনি করে’—এগিয়ে গিয়ে সে দেখিয়ে দিল। তারপর বলল—‘খেলা মানে আনন্দ, খেলা মানে ব্যায়াম, খেলায় হার-জিত আছেই। হেরে গেলেই হারা নয়, আবার জিতে গেলেই জেতা নয়।’

সারা সন্ধে একেক দিন গপ্প হয়। গঙ্গায় বাইচ খেলার গল্প বলে ওরা, চিনু বলে ক্যাসিয়াস ক্লের মহম্মদআলি হওয়ার গল্প, মারাদোনার ভাঙা পা নিয়ে মরণপণ খেলার গল্প, ফ্যারাডের বিজলি-বাতি আবিষ্কারের গল্প, বিদ্যাসাগরের দুধ খাওয়া ছাড়ার গল্প, খবরের কাগজের হকার এডিসনের ল্যাবোরেটরি তৈরি করার গল্প। শুনতে শুনতে খাওয়ার কথা মনে থাকে না। শুধু ওরা নয়। আরও জুটেছে ন্যাংলা, পচা, খেঁদি, কেষ্টা, ঝুমু, বালিশ। ভীষণ গাবদা গোবদা বলে ওর নাম বালিশ। দিমা এসে বলে—‘আজ কিন্তুক শুদ্ধ ছোলার ডাল, রুটি আর দুধ। এতগুলি রাবণের গুষ্টিকে খাওয়াতে হলে মা আমার দ্বারা এর চে বেশি হবে নে।’

চিনু বলে—‘ডালে কুচি কুচি করে নারকেল দিয়েছো তো? ও দিমা!’

জ্যাঠাইমা বলে—‘ওঃ মেয়ের যেমন তেমন হলে চলবে না, সব যার যেটি তার সেটি চাই। শ্বশুরবাড়ি গিয়ে যখন কুমড়োর ঘ্যাঁট খেতে হবে, তখন? ’

চিনু বলে—ঘ্যাঁট কেন? কুমড়ো দিয়ে, আলু দিয়ে, পটল দিয়ে, ছোলা দিয়ে কুমড়োর ছক্কা আর লুচি। নীলকণ্ঠ ঠাকুর করবে, তোমরা হাত দেবে না।’

বটুয়া থেকে পান বার করে মুখে পুরতে পুরতে নীলকণ্ঠ মহাগর্বের হাসি হাসছে।

দিমা বলল—‘ভাল হয়েছে তালে? আমি বলি কি জানি শহরের ফ্যাশনেল মেয়ে…’

—‘বাঃ, আমি তো তোমার রান্নার কথা শুনেই আরও—দিমা কচুর শাক খাওয়াবে?’

—‘কচুর শাক? তার জন্যে এত আহিংকে? ওমা, আমি কোতায় যাব গো! এই জংলু, তুলে আনিস তো কাল। নারকেলের তো অভাব নেই মা! তা নিরিমিষ্যি খাবে, না ইলিশমাছের মুড়ো দিয়ে?’

—‘নিরিমিষ্যি, নিরমিষ্যি!’ চিনু চেঁচিয়ে বলে ওঠে।

ধানু গম্ভীরভাবে বলে— ‘ইলিশ মাছ আলাদা হবে, একেবারে ঘাট থেকে নিয়ে আসব।’

পুঁটু বলে—‘মুড়োটা আর ন্যাজাটা দিয়ে অম্বল কোরো দিমা। ন্যাজার লালগুলো সব আমার! মা করত!’

—‘ইস্‌স্‌, আগে অম্বল চাই? মেয়ের রকম দেখ! টক আর মিষ্টি পেলে আর কিছু চাই না!’

মিনু আড়চোখে চাইল—‘দিদি, আর ঝাল?’

দুজনে মিলে ছুটির দুপুরবেলা তেঁতুল, লঙ্কা আর গুড় দিয়ে আচ্ছা করে জরিয়ে আঙুল চেটে চেটে খাওয়া আর হুস হাস। নাকের জলে, চোখের জলে। উঃ কি ঝাল দিয়েছিস রে দিদি! ঝাল না হলে জমে। মেজদা নামতে নামতে বলছে—‘হ্যাঁ, নামবে যখন তখন টের পাবি কিরকম জমে! পুরো ইনটেসটিন জ্বলিয়ে দিয়ে নামবে। তখন বলিস হে তেঁতুলের দেবতা, হে লঙ্কার দেবতা, আর করব না, আর করব না।’

মস্ত বড় কলেজের ঘাসে-ছাওয়া মাঠে নীল জিনস আর আলগা শার্টপরা একটি মেয়ে বসে। মাথায় ঝুঁটি। ওর কি কোনও বন্ধু নেই? ফাইল খুলে একমনে পড়ছে? না পড়ার ভান করছে? পাশ দিয়ে একদল ছেলেমেয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে।

—‘ওঃ পি. কে. সি. আজ যা পড়ালেন না, দুর্দান্ত!’

—‘আরে কীটসের ওপরেই তো ওঁর থিসিস। অক্সফোর্ডের। চালাকি নয়।’

—‘হ্যাঁরে নীতা, ফ্যানি ব্রন আর কীটস-কে নিয়ে লেটেস্ট বইটার কী যেন নাম বলছিলেন পি.কে. সি.?’

—‘আমি খেয়াল করিনি!’

—‘কী খেয়াল করিস তোরা? পি. কে. সি.-র ডোরাকাটা শার্ট, আর গ্যাবার্ডিনের পেন্টুল?’

—‘ভালো হবে না ঋত্বিক। টোয়েন্টিয়েথ সেঞ্চুরি শেষ হতে চলল এখন কীট্‌স‌ নিয়ে আর কে মাথা ঘামায় রে! যত্ত সব!’

—‘তো কী নিয়ে মাথা ঘামাবি! অ্যালেন গিনসবার্গ! লোকটা শেমলেসলি গে জানিস তো? ওই জন্যে অস্কার ওয়াইল্ড বেচারির জেল হয়ে গেল আর এখন সব যে যত পার্ভাটেড, তার তত নামডাক!’

—‘মেয়েদের মধ্যেও আছে, পুরনোকালে স্যাফো, ইদানীং এর মধ্যে মার্টিনা। কী রকম ডাঁটে থাকে!’

দলটা পাশ দিয়ে চলে গেল। একবারটি আড়চোখে তাকিয়ে দেখল জীনস-পরা মেয়েটি। দলের মধ্যে কোনটা কোনটা মেয়ের কথা, কোনটা ছেলের কথা বোঝবার জো নেই!

জ্যাঠামশাই বলছেন—‘না। কিছুতেই না। কো-এডুকেশনে দিলে মেয়ে বখে যাবে। নমুও তো মেয়ে-কলেজেই পড়েছে, ওর শিক্ষা-দীক্ষা কিছু কম হয়েছে? বাবা বলছেন—মেয়েটা অত ভাল রেজাল্ট করল দাদা, অত শখ…আর দেখুন বাবা গলা খাটো করে বললেন—এখানেও তো এত ছেলের সঙ্গে মিশেছে, সিঙ্গিবাবুর সুকৃতির সঙ্গে তো গলায় গলায়। গণ্ডগোল হলে তো এখানেও হতে পারে!’

—‘তা অবশ্য।’ জ্যাঠামশাইয়ের চিন্তিত গলা। বাইরে আড়িপাতা দলের ফিসফিসে হাসি।

য়ুনিভার্সিটির ক্লাস নতুন আরম্ভ হয়েছে। ব্লু জীনস, আলগা শার্ট, মাথায় ঝুঁটি ঢুকে পড়েছে। নোটস নিচ্ছে। ভীষণ মনোযোগ দিয়ে। ‘তুমি কোন কলেজ থেকে এসেছ ভাই!’ পাশের মেয়ে জিজ্ঞেস করছে। —‘শ্রীরামপুর কলেজ।’

—‘সে কী? আমিও তো শ্রীরামপুর কলেজ থেকেই এসেছি! তোমায় চিনি না তো!’

সেরেছে! আরে আমি তোমাদের থেকে অনেক সিনিয়র। মাঝখানে নানা কারণে পড়া বন্ধ হয়ে গেল। ‘তাই বলো!’

—‘য়ু দেয়ার, হুইচ ইজ দা শর্টেস্ট ট্র্যাজেডি অফ শেক্সপীয়র?’

ব্লু জীন্‌স্ উঠে দাঁড়াচ্ছে। —‘ইজ ইট ম্যাকবেথ সার?’

বহু আষাঢ়ের ওপার থেকে উত্তরটা ভেসে আসছে। মেঘের আড়ালে আবছা হয়ে। ‘সো য়ু হ্যাভ ডাউটস! সীট ডাউন অ্যান্ড ডোনট টক।’

পাশের মেয়েটি বললে—‘সরি। ভাই, আমার জন্যে তুমি বকুনি খেলে।’

আজকের মত লাইব্রেরির কাজ সারা। ধোঁয়া কাটাতে কাটাতে গোলাপি বুটির সালোয়ার কামিজ, খোলা চুল, ঢুকে যাচ্ছে। একটাও পুরো খালি টেবিল নেই। একটাতে একটি মাত্র ছেলে বসে সিগারেট খেয়ে যাচ্ছে। সামনে আধ-খাওয়া কফির কাপ।

গোলাপি কামিজ বলল এক্সকিউজ মি প্লিজ, আপনি কি কারও জন্যে অপেক্ষা করছেন?’

‘ওহ নো, নট অ্যাট অল। আই ক্যান ওনলি ওয়েট ফর গোদো, হু আই নো উইল নেভার অ্যারাইভ!

‘বসবার জায়গা পাচ্ছি না। বসতে পারি?’ ভড়কানো প্রশ্ন।

‘নো অবজেকশন।’

কফির অর্ডার। পকোড়া। ছোট ছোট কামড়। অল্প স্বল্প চুমুক। কোলের ওপর একা পত্রিকা নিয়ে অভিনেবিশ সহকারে পড়া। পত্রিকা ছাড়া গতি নেই।

‘ডোন্ট মাইন্ড, আপনি কি রিসার্চ স্কলার?’ ছেলেটির প্রশ্ন।

‘খানিকটা।’

‘খানিকটা মানে!’

রহস্যময় অথবা বোকা-চালাকির হাসি—‘আপনি?’

‘আমি কেউ না। কিছু না জাস্ট একটা ভয়েড।’

‘সে কী? আপনি ভূত নাকি?’

‘ভূতই বটে!’ ছেলেটির মুখে আত্মবিদ্রূপের হাসি—‘গোস্ট অফ দিস কনজিউমারিস্ট সোসাইটি, গোস্ট অফ দিস ওয়ার্ল্ড ব্লাইন্ডেড বাই দা ড্যাজলিং র‍অ্যাভেজেস অফ সায়েন্স। গোস্ট অফ দিস মকারি অফ এ সিভিলাইজেশন!

‘রাগী যুবকরা তাহলে এখনও আছে,’ গোলাপি সালোয়ার আত্মগত বলল।

‘কিছু বললেন? ছেলেটি বলল, তারপর চোখ ঘুরিয়ে বলল—‘এই তো দেখছেন টেবিলে টেবিলে গণ্ডা গণ্ডা যুবক-যুবতী বসে আছে। আড্ডা দিচ্ছে। জাস্ট আড্ডা স্‌প্লেনডিড আনকনর্সান!’

ডু দে থিংক হোয়ার দিস মকারি অফ ডেমোক্র্যাসি ইজ হেডিং ফর? ডাজ ওয়ান থিংক?’

‘আপনি কি বিপ্লবী?’

‘বিপ্লবী? হাসলেন! অল দা রেভোলিউশনস অফ দিস ওয়ার্ল্ড হ্যাভ এডেড দা ওয়ার্ল্ড টাইপ অফ অটোক্র্যাটস। ফ্রম রোবস্ পীয়ের টু স্ট্যালিন অ্যান্ড চাওসেসকু। দা ভেরি কনসেপ্ট অফ রেভল্যুশন হ্যাজ বীন গিলোটিন্ড।’

‘আপনি তাহলে কে? কী? গোলাপি সালোয়ার ভয়ে ভয়ে বলল।

‘কেন কবে, কোথায় গুলো জিজ্ঞেস করলেন না?’

‘ভয় করল। একটা দুটোর উত্তর দিলেই বর্তে যাব।’

তখন ছেলেটি সিগারেট ফেলে দিয়ে দম ছেড়ে হো হো হাহা করে হাসল।

তারপর বলল আমার নাম শ্রীমান সুশান্ত তালুকদার, এই হল কে। আমি একজন ফ্রি-লান্স জার্নালিস্ট—এই হল কী এম.এসসি ইন ইকনমিক্স, লো সেকেন্ড ক্লাস, ‘গরিবি হঠাও’-এর ওপর একটা বিস্ফোরক প্রবন্ধ লিখেছিলুম বলে খুব সম্ভব। পছন্দসই চাকরি পাইনি—এই হল কেন।

উনিশ শ ঊনষাট, বারোই জুলাই এই হল কবে। আর কোথায় হল—হট্টমন্দির।

‘ফ্রি লান্স জার্নালিস্ট, ফ্রি লান্সটা কী?’

‘আপনি কোন যুগে বাস করেন? নাকি মঙ্গলগ্রহ থেকে আসছেন? এখন তো ফ্রি লান্সেরই যুগ! সব কিছু নিজস্ব উদ্যোগ। গম্মেন্ট আমাদের স্বাবলম্বী হতে বলছে না?’

‘আপনি নিজে নিজেই খবর যোগাড় করে বেড়ান? লেখেন? ছাপায়?

‘হ্যাঁ, আমি নিজে নিজেই খবর বা স্টোরি যোগাড় করে বেড়াই। লিখি, ফটো তুলি। কখনও ছাপে, কখনও ছাপে না।’

‘তাতে আপনার চলে? কিছু মনে করবেন না!’

‘ওই জন্যেই তো বললুম হট্টমন্দিরে থাকি। একটা অবসলিট মেসে। ম্যানেজারবাবুর আমার ওপর বড্ড মায়া। একটি বিবাহযোগ্য কন্যা আছে। বড্ড দজ্জাল! কাউকে গছাতে পারছেন না। চিতাবাঘ যেমন ঝোপের পেছনে গুঁড়ি মেরে থাকে, শিকার কখন পাল্লার মধ্যে এসে যাবে তার অপেক্ষায়, তিনিও তেমনি বসে আছেন।’

চিনুর ভীষণ হাসি পেয়ে যাচ্ছিল। সে কফির কাপ মুখে তুলে বিষম খেল।

‘আপনার পরিচয় কিন্তু আমি এখনও পেলুম না’—যুবক বলল।

‘আমি সত্যিই মঙ্গলগ্রহের লোক আপনাদের গ্রহে বেড়াতে এসেছি। নাম চিন্ময়ী চক্রবর্তী। আমিও ফ্রি-লান্স জার্নালিস্ট।

সুশান্ত তালুকদারের মুখ গোল-হাঁ হয়ে গেল—‘তাহলে ফ্রি-লান্স জার্নালিস্ট মানে জিজ্ঞেস করছিলেন কেন?’

‘আসলে হতে চাই। এখনও হইনি। আপনি যদি একটু অন্ধি-সন্ধি গুলো বাৎলে দ্যান।’

‘নিজে পায় না শুতে আবার শংকরাকে ডাকে। সুশান্ত ধোঁয়া ছেড়ে বলল, ‘আমার নাম সুশান্ত হলেও আমি কিন্তু আসলে খুব অশান্ত। টের পেয়েছেন আশা করি।’

‘মোক্ষম! তবে পথগুলো আপনি বেশি রাগ না করে বাৎলে দেবেন তা-ও বুঝতে পেরেছি।’

আবার সিগারেট নামিয়ে হো হো হা হা।

এমন সময়ে ডান চোখের পাশ দিয়ে গোলাপি সালোয়ার একটি ভীষণ চেনা মেয়ে মুখ দেখে প্রায় টেবিল উল্টে উঠে পড়ল। বলল—‘আমি চললুম। টাকা রাখলুম, বিলটা প্লিজ মিটিয়ে দেবেন। চেনা মুখ আপাতত ডান দিকের শাখায় চলে গেছে। চিনু হুড়মুড় করে নিচে নেমে আবার হ্যারিসন রোডের দিকে হুড়মুড় করে ছুটল। রিনি কি দেখতে পেয়েছে? হঠাৎ দেখতে পেলে পরিষ্কার চিনতে পারবে না। কিন্তু সন্দেহ হবে। বাস স্টপে ভীষণ ভিড়। উদ্বিগ্ন মুখে দাঁড়িয়ে আছে, পেছন থেকে আচমকা প্রশ্ন হল—‘বৎসে, তুমি কি বাড়ি হইতে পলায়ন করিয়াছ?’ চমকে পেছন ফিরে চিনু দেখল সুশান্ত। সুশান্ত বলল, ‘না কি কোনও ভদ্র যুবককে সদ্য-সদ্য ল্যাং মারিয়াছ?’

এক সপ্তাহ পরে সুশান্ত তালুকদার ও মৃণ্ময়ী চক্রবর্তী দুজনে মিলে একজন নাম করা অর্থনীতিবিদ-এর সাক্ষাৎকার নিতে গেল। অর্থনীতি সম্পর্কিত প্রশ্নগুলো সুশান্তর, জীবন জগৎ ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা সম্পর্কিত প্রশ্নগুলো চিণ্ময়ীর। সাক্ষাৎকারটি একটি বিখ্যাত বাংলা দৈনিকের রবিবাসরীয় সংখ্যায় বেরোল। দক্ষিণাটা অর্ধেক করে চিণ্ময়ীকে দিতে গেলে চিণ্ময়ী বলল, ‘আমার ভাগটা এবারের মতো তোমায় দিয়ে দিলুম, সুশান্ত, গুরুদক্ষিণা।’

‘ঘুষ নয় তো?’ সুশান্ত অশান্ত চোখে চেয়ে বলল।

‘ঘুষ কী?’ ‘ওঃ চিনুদি, য়ু আর সামথিং আই মাস্ট অ্যাডমিট’ সুশান্ত বলল।

এইভাবেই চলছিল কিন্তু, একদিন সন্ধেবেলায় বাড়ি ফিরতে, দিমা নিঃশব্দে দরজা খুলে দিয়ে বললে

‘ওমা আমি কোতায় যাব গো মেয়ে! দিল্লি থেকে সুককিতিবাবু এয়েচে গো! আমার ওপর কী চোটপাট! আমাকে বোধহয় ছাইড়ে দেবে গো মা! শোনো টাকাকড়ির কতা আমি কিছু বলিনি, শুধু বলেছি ভদ্দরলোকের মেয়ে বড় আতান্তরে পড়েছিল…।’ দিমার সহজে চোখে জল আসে না, কিন্তু এখন কাঁদো-কাঁদো অবস্থা। চিনু বলল—‘পথ ছাড়ো দিমা। আমি দেখছি।’

‘ওমা কী সব্বনেশে মেয়ে গো, সে যে একেবারে রেগে বাঘ হয়ে আছে।’

‘সিঙ্গি হয়ে আছে বল?’ পটলা আর পুঁটু ফিকফিক করে হেসে ফেলল।

‘তোদের আর কি নংকাপোড়া। হেসে দিলেই হল। দিমা আছে, দিমা ঠিক খাওয়াবে। পরাবে। ভিক্ষে করে হোক, সিক্ষে করে হোক।’

চিনু বললে—‘দিমা, আমার জন্যেই তো তোমাদের এই অবস্থা। আমি খবরের কাগজের লোক। কাউকে ভয় পাই না। আমি বোঝাপড়া করে নিচ্ছি। কোনও ভয় নেই।’

আজকে তার পরনে হালকা বেগনি প্রিন্টের একটা শাড়ি। হাতে মস্ত বড় ব্যাগ। প্র্যাকটিস করবার জন্যে একটা ক্যামেরা তাতে, ভরে দিয়েছে সুশান্ত। দিমার যা গতর তাকে সহজে ঠেলা যায় না, তবু একরকম ঠেলে ঠুলেই ওপরে উঠল চিনু। চটির বেশ শব্দ করে জানান দিয়ে ঘরের দরজার সামনে এসে দাঁড়াল। ভালুক কৌচের কোলে বসে জনৈক ভদ্রলোক খুব মনোযোগ সহকারে চিনু মনোযোগ সহকারে চিনুর রেখে যাওয়া একটা ম্যাগাজিন পড়ছেন। চটির শব্দে তুলে তাকিয়েই তিনি চিত্রার্পিত হয়ে গেলেন।

এ কি? ‘চিনু না! তুই কোত্থেকে?’

‘আমি না হলে তোমার মতো সিঙ্গি মশাইয়ের ঘরে হুজ্জোতি করে ঢোকবার সাহস কার হবে বল? তার ওপর দিমার মত ওই রকম জাঁদরেল পাহারা।…তা মাথাটা কী করেছো!’

বেলের মত মাথাটাকে হাত বুলিয়ে সুকৃতি সিংহ বললেন, ‘কী জানিস! টাক হলে টাকা হয় ছোট্ট থেকে শুনে আসছি। তাই চেষ্টা চরিত্তির করে টাকটা করেই ফেললুম।’

‘তাহলে আগে যা ছিল তার চেয়েও এখন আরও অনেক টাকা হয়েছে?’

‘হয়েছে। বোনগুলো সব বাইরে পড়ল। দুটো দাদা বিদেশে পটাপট শেষ হয়ে গেল। বাবা কাকা সব্বারই সব তো এখন আমার!’

‘তবে!’

‘তবে কী?’

‘তবে, সিংঘিবাড়ির এমনি দশা কেন যে আমি কোনকালের ভাড়াটের মেয়ে আমাকে দুযুগ পরে এসে মোজাম্বিত করাতে হয়।

‘মোজাম্বিক? কী বকছিস?’

‘নিচের উঠোন, ঘরদোর, দালান-বারান্দা, সিঁড়ি কলঘর সব দেখা হয়েছে? মোজাম্বিক হয়নি? পটলা আমাকে আশ্বাস দিয়েছিল দুদিন সময় দিলেই সব মোজাম্বিক করে দেবে। তা দিয়েছে। রোজ পালিশ করছে। এই রকম লাল-সবুজ পেটেন্ট স্টোনের মেঝে ইদানীংয়ের মধ্যে দেখেছ? পটলা, পুঁটু, জংলু, ধানু দিমা এরা করেছে…।

ও হো হো হো সুকৃতি বুঝতে পারার হাসি হাসতে লাগলেন ‘তা পটলা, পুঁটু, এরা কারা?’

‘এরা কারা? জ্যাক অ্যান্ড জিল ওয়েন্ট আপ দা হিল, জানো তো?’

‘তা তো জানি কিন্তু…’

এরা সেই জ্যাক অ্যান্ড জিল। জ্যাকেরা পড়ছে। ডাউন দা হিল। মাথাগুলো বিগড়ে যাচ্ছে, আর জিলরাও পেছন পেছন হুড়মুড় করে পড়ছে তো পড়ছেই।

‘তুই তা হলে এখনও ধাঁধা ভালোবাসিস? ঠিক সেই আগেকার মত?’

সামনের আয়নায় এতক্ষণে দুজনের ছায়া পড়েছে। হঠাৎ সুকৃতি ঘুরে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘আরে চিনু, তোকে আমি উনিশ বছর বয়সের পর থেকে দেখিইনি! তোকে আমি কি করে এত দিন পরে চিনতে পারলুম বল তো? তুই তো খুব বেশি বদলাসনি। খালি কেমন ডাগর-ডোগর গেছো-টাইপের হয়ে উঠেছিস। কিন্তু আমি তো দেখছি বুড়ো হয়ে গেছি। মাথায় বেল, উদরে ডাব, মুখ ময় থলে? তুই আমার চেয়ে ক’ বছরের ছোট ছিলি? কাকাবাবু এখান থেকে আসানসোল বদলি হয়ে গেলেন, তার পরেই শুনলুম কাকিমা নাকি? তোর আর মিনুর নাকি এক লগ্নে, তোর নাকি তিনটে…ভুতুর কাছ থেকে শুনছিলুম…।

—‘সব নাকিগুলোই ঠিক শুনেছো। আবার যা নিজের চোখে দেখছ তা-ও ঠিক। আমি ভূত নই।’

—‘তবে কি তুই ভবিষ্যৎ?’

চিনুর চোখে এবার স্বপ্ন চিকচিক করছে। সে বলল— ‘বলছো? সত্যি বলছো? থ্যাংক ইউ। কিন্তু তোমার ইতিবৃত্ত আমি কিছুই জানি না সুকুদা।’

—‘সে তো অনেক কথা! ভুতু তোকে কিছু বলেনি?’

—‘ভুতু কোত্থেকে বলবে? সে ত জার্মানিতে ইন্ডিয়ার ভূত!’

সুকৃতি মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন—‘আমিও তো ওয়েস্ট জার্মানিতেই ছিলুম। সেখান থেকে সিভিল এঞ্জিনিয়ারিং-এর ইয়াবড় ডিগ্রি নিয়ে সুইডেন গেলুম। আমার চে’ একহাত লম্বা সুইডিশ মেমসাহেব বিয়ে করলুম। তারপর একদিন ঝগড়ার মুখে সে আমার সেই কোঁকড়ানো কালো চুলগুলো ধরে আচ্ছা করে ঝাঁকিয়ে বললে—‘হোয়াই কান্ট য়ু বি ব্লন্ড! ব্লন্ড! ব্লন্ড!’ বলে আমায় ছেড়ে চলে গেল। ব্লন্ডের খোঁজে। এখানে কিছুদিন হল ফিরে এসে দিল্লিতে নিজের ফার্ম খুলে বসেছি। তখন চুলগুলো সবে উঠতে শুরু করেছে। আবার একটা বিয়ে করেছিলুম পাঞ্জাবি। তো সেটাও টিকল না। সেও একদিন ঝগড়ার মুখে বললে—হোয়াই আর য়ু সো শর্ট! শর্ট! শর্ট! সে-ও টলের খোঁজে চলে গেল। তার পরেই টাক। আর ছপ্পড় ফুঁড়ে টাকা!’

—‘কী গুলতাপ্পিই দিতে পারো, বাব্বা! তা এখানে কি করতে হানা দিয়েছে!’

—‘ভাবছি এই হানাবাড়িটা বিক্‌কিরি…’

—‘খবরদার!’ চিনু বসে ছিল। সটান উঠে দাঁড়াল,—‘খবর্দার, এই বাড়ি বিক্রি করতে পারবে না। এ বাড়ি আমি অধিগ্রহণ করব, এ আমার মিউজিয়াম, এইখানে আমার ছোটবেলা, এইখানে আমার ছোটবেলা, এইখানে আমার কৈশোর, এইখানে আমরা দুটো বিশাল উজ্জ্বল সুখী পরিবার, এইখানে আমরা প্রতাপ-শৈবালিনী, এখানে এসে আমি সব ফিরে পেয়েছি। এই বাড়ি আমি যা বলবো, তাই করতে হবে। পটলা ধানুদের ওপর আমি একটা স্টোরি করছি, যদি এতটুকু বেচাল দেখি, তো তোমাকে ভিলেন বানিয়ে দেব। পেছনে ল্যাজ, উল্টোবাগে পা।’

—‘আর বেচাল না দেখলে?’

—সান্টাক্লজ, ফারের পোশাক, রুপোর টুপি।’

—‘তো তুই এ বাড়িটা নিয়ে কী করবি?’

—‘দিমার তত্ত্বাধানে এদের গড়ে তুলব। মারাদোনা, গাভাসকর, কাপ্রিয়াতি, স্টেফি গ্রাফ, ব্রুস লি…’

—‘বলে যা, বলে যা থামলি কেন? স্বপ্নে পোলাও খেলে ঘি বেশি করে ঢালতে হয়।’

—‘আমি একা ঢালছি না আজ্ঞে। তোমাকেও ঢালতে হবে। কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা ছোটাছুটি…’

—‘তো বদলে আমি কী পাব?’

—‘লবডঙ্কা। তবে তেমন লেগে থাকতে পারলে নোবেল প্রাইজ ফর পিসটা পেতে পার। প্রচারে আমি আর সুশান্ত তালুকদার সাহায্য করব।’

—‘তথাস্তু। তা শৈবালিনী কি চন্দ্রশেখরের কাছে ফিরে যাবে?’

—‘চন্দ্রশেখর নেই।’

—‘তাহলে কি প্রতাপের কাছে থেকে যাবে?’

—‘প্রতাপও নেই।’

—‘ওই বেটা সুশান্ত তালুকদার লরেন্স ফস্টর ও-ই তবে এখন প্রতাপ হয়ে গেছে?’

—‘লরেন্স ফস্টরও নেই।’

সুকৃতি খুব দুঃখিতভাবে মাথার টাকায় আস্তে আস্তে হাত বুলোতে লাগলেন। যেন টাকটাই যত অনর্থের মূল।

বিলু খুব উত্তেজিতভাবে পায়চারি করতে করতে বলল—‘মা-ও বলল, তোরাও অমনি যেতে দিলি? হোপলেস! প্যাক অব ফুলস্‌! একটা মধ্যবয়সী মহিলা, জীবনে কোনদিন নিজের চৌহদ্দির মধ্যে থেকে বেরিয়েছে কি না সন্দেহ! মাসে একটা দুটো করে চিঠি পাস—‘ভালো আছি, কিছু হলে খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দিস্‌!’ বাস! ছি! ছি! ছি! চিঠিগুলোর পোস্টগুলোর পোস্ট অফিসের ছাপগুলোও তো দেখবি!’

—‘দেখেছি! দেখেছি! রবি বলল—‘তুই দ্যাখ্‌, এক একটা এক এক জায়গা থেকে পোস্ট করা। শ্যামবাজার, কলেজ স্ট্রিট, পার্কসার্কাস, গড়েহাট। দ্যাখ, আমিও তো মোটরবাইক নিয়ে সারা কলকাতা দাপিয়ে বেড়াচ্ছি। দুটো চোখ সব সময়ে খোলা রাখি। কোথাও ভদ্রমহিলার টিকিটিও দেখতে পাই না। অথচ চিঠি আসছে সব কলকাতারই ভিন্ন ভিন্ন পোস্ট অফিস থেকে!’

—‘স্ট্রেঞ্জ! মানে মা ভদ্রমহিলা স্রেফ ইচ্ছে করে লুকিয়ে আছে, বলছিস! আমি যখন ছিলুম না তখন তোরা মাকে কে কী বলেছিস! নিশ্চয়ই মনে খুব কষ্ট পেয়েছে। কিছু একটা করেছিস!’ বিলুর উত্তেজিত পায়চারি আরও তেজোদৃপ্ত হয়ে ওঠে। ‘শী ইজ এ কোয়ায়েট টাইপ, কিন্তু ভীষণ অভিমানী!’

—‘অন গড ছোড়দা। আমরা কেউ কিছু বলিনি। কিচ্ছু করিনি!’

—‘তোদের কিছু না করাটাই একটা করা। তোরা মার দিকে কোনদিন চেয়ে দেখেছিস! সেই কোন ছোটবেলায় বাবা মারা গেল। জ্যাঠা-কাকারা নিজেদেরটা গুছিয়ে দূর করে দিল। মুখ বুজে এতগুলো বছর একটা বাচ্চা মেয়ে, উঃ, আমি ভাবতে পারছি না। কোনদিন আমরা চেয়ে দেখেছি মা কী খায়? কী পরে! কী করে সময় কাটায়? নিজেদের বন্ধু-বান্ধব নিয়েই মত্ত! এখন কী হবে?’

হঠাৎ রিণি ভীষণ কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল—‘দাদা, ছোড়দা, মা সেই রসময়ীর রসিকতার মত করেনি তো! কাউকে দিয়ে আগে থেকে লেখা চিঠিগুলো পোস্ট করাচ্ছে। মা হয়তো আর…’

বিলু বলল—‘স্টপ ইট রিণি, স্টপ ইট আই সে। ঠিক আছে ছ’মাসের জায়গায় আট মাস পর হয়ে গেছে। বিজ্ঞাপন দেওয়া যাক।’

রবি বিষন্ন মুখে বলল—‘ড্রাফ্‌টটা তুই-ই কর বিলু। আমার মাথাটা কেমন…!’

বিলু বলল, ‘রিণি তুই কর।’

একটু পরে রিণি কাঁপা কাঁপা হাতে তার খসড়টা এগিয়ে দিল। বিলু পড়ল—‘মা, তোমার এ কেমন রসিকতা! তোমার ছ’মাসের মেয়াদ অনেকদিন পেরিয়ে গেছে। আমরা তিনজনে খুব চিন্তিত। ফিরে এসো।’ পড়ে বিলু বলল—‘ওয়ার্থলেস। কেউ যদি একটা কাজ ঠিক করে পারিস। অভিমানে একটা মানুষ বাড়ি ছেড়ে গেল, তাকে অ্যাকিউজ করছিস! রসিকতা! খুব ফিরে আসবে!’ তারপর সে নিজেই খসখস করে লিখল লিখে পড়ে শোনাল—মা, তোমার বিলু কেরালা থেকে জীর্ণ-শীর্ণ হয়ে ফিরে এসেছে। লাংস ক্যান্সার। মৃত্যুশয্যায়। শেষ দেখা যদি দেখতে চাও তো, অবিলম্বে ফিরে এসো।’

এমন সময়ে হাতে সুটকেস, পিঠে রুকস্যাক, সাদার ওপর নীল ছাপ শাড়ি পরে, মাথার ঝুঁটি বেঁধে রবি-বিলু-রিণির মা চিন্ময়ী চক্রবর্তী সিঁড়ি দিয়ে টকাটক উঠে এলেন।

বললেন—‘কার লাংস ক্যান্সার? কে মৃত্যুশয্যায়? নিচের দরজা খোলা কেন? বাড়ির জিনিসপত্তর সব ঠিকঠাক আছে তো? আমার ননস্টিক প্যান? বোন চায়নার টিসেট? না চুরি ডাকাতি হয়ে গেছে?’ তিনজনেই সমস্বরে বলে উঠল—‘মা!’

চিন্ময়ী বললেন—‘দ্যাখো বাপু, আমার হাতে বেশি সময় নেই। চান করে, রিণি যদি কিছু রেঁধে-টেধে থাকে তো খেয়ে, নইলে না খেয়ে বেরিয়ে যাব। একজন ভীষণ খিটখিটে সাহিত্যিকের সাক্ষাৎকার নিতে যাব। তারপর পার্কস্ট্রিটে যাব ফটোগুলো নিতে। আমাতে আর সুশান্ততে মিলে ‘আর্চিন্‌স্‌‌, অর ফলিং আর্কএঞ্জেল্‌স্!’ বলে একটা স্টোরি করেছি। এ-ক্লাস ম্যাগাজিনে বেরোচ্ছে—পিক্‌স্‌ মৃন্ময়ী চক্রবর্তী। দেরি হতে পারে, ভেবো না।’

‘মা’—রবি ভয়ে ভয়ে বলল ‘সুশান্ত কে?’

চিন্ময়ী হেসে বললেন—‘সে এক ভীষণ অশান্ত তালুকদার। আমরা দুজন ফ্রিলান্স জানালিজ্‌ম্‌ করছি! আসবে এখন চোখ ঘোরাতে ঘোরাতে, দেখিস! ’

বিলু বলল—‘তুমি সাহিত্যিকের সাক্ষাৎকার নিতে যাবে? স্টোরি করছ? ফ্রিলান্স? আৰ্চিন্স অর…কি ব্যাপার বল তো?’

রিণি বলল—‘জানি তোমার আজকাল একটু একা একা লাগত। তাই বলে এই বয়সে…’ বলে রিণি হঠাৎ গোঁত্তা খেয়ে খেয়ে থেমে গেল। সে ছুটে এসে মাকে জড়িয়ে ধরে বলল—‘মা মা, হোয়াট হ্যাভ ইউ ডান টু ইয়োরসেলফ্‌! হাউ ডু য়ু ম্যানেজ টু লুক সো ইয়াং…’

বিলু আর রবি পর পর বলল—‘কোথায় গেছিলে? এতদিন কোথায় ছিলে?’

চিন্ময়ী হেসে বললেন—‘টাইম মেশিন পড়েছিস? এইচ. জি. ওয়েলসের? সেই টাইম মেশিনে চড়ে ছিলুম। তারপর দীর্ঘযাত্রা।

পেছনে, অনেক পেছনে।

আবার সামনে, অনেক সামনে।

যাতে তোদের পেতে গিয়ে জীবনের যে সময়টা শূন্য হয়েছিল

সেটা ঠিকঠাক ভরাট করে

আবার তোদের সঙ্গে সমানতালে

দৌড়তে পারি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *