দৈববাণী

দৈববাণী

ফ্ল্যাটের দরজা খুলতেই ওরকম বেশভূষোর একটা মানুষকে দেখে রমার ভয় পাওয়া উচিত ছিল। ঢাউস একটা কালো রেনকোট। মাথায় সেইরকমই একটা টুপি যা গল্পের গোয়েন্দারা পরে। ভারী কালো জুতো, হাতে আবার তিন-ব্যাটারির টর্চলাইট! ফ্ল্যাটে একলা থাকা কোনো মেয়েকে ভয় পাওয়ানোর পক্ষে এরকম চেহারা খুবই যথেষ্ট। রমা কিন্তু মোটেই ভয় পায়নি। অফিস থেকেই সুদীপ ফোনে জানিয়েছে বিকেলে ওর বন্ধু সুশান্ত আসছে। হয়ত ওর আগেই পৌঁছে যাবে ওখানে?

রমা দরজা খুলেই বলল, আপনি তো সুশান্ত। দাঁড়িয়ে রইলেন কেন? সুদীপ ফোনে সব জানিয়ে দিয়েছে। ডন স্কুলে এক সঙ্গে পড়তেন। ডানপিটে ছিলেন। খুব গল্প করতে ভালোবাসেন। তাই তো? সত্যি বললাম কিনা বলুন?

রজত অ্যাও হয়, অঁও হয় আওয়াজ করে ঘরটায় ঢুকে পড়ল। আঃ! একটা বেড়া অন্তত পেরুনো গেল। রমা মেমসাহেবি কায়দায় ওর পিছনে দাঁড়িয়ে রেনকোটটা খোলায় সাহায্য করতে এল। রজত ঝাঁ করে এক পাক ঘুরে, সলজ্জভাবে বলল, নো থ্যাংকস। কোটটা আর টুপিটা ভিজে আছে। তারপর কোটটা আর টুপিটা র‍্যাকে ঝোলাতে গিয়ে ওর মনে হল ক্ষুরটা ওর সঙ্গে রাখাই শ্রেয়। সুযোগ কখন, কীভাবে আসে কেউ জানে না। ক্ষুরটা ট্রাউজারের পকেটে রেখে টর্চটা রেনকোটের পকেটে ঢুকিয়ে রজত যখন বসার ঘরের মাঝখানটায় এল রমা তখন অবাক হয়ে ওর দিকে চেয়ে আছে। ওর মনে না হয়ে পারল না এরকম একটা গোছানে, স্বনির্ভর বন্ধু সুদীপের আর একটাও নেই। অন্যরা সবাই হাজির হয়ে ছোটোখাটো একটা হুকুম জারি করবেই। বাড়িতে কী ড্রিংকস আছে সে-খবরটাও অন্তত এতক্ষণে নিয়ে ফেলত। অবশ্য ইনি তো সবে এই প্রথম আবির্ভূত হলেন। পরে কী মূর্তি হয় কে জানে?

আরেকটা কথা। সুদীপের আর বন্ধুরা যে স্টেটাসের এ বোধ হয় সেখানে পৌঁছোতে পারেনি। ডনের ছেলের পক্ষে অধঃপতনই একরকম। ড্রেস দেখে কি সেটাই মনে হয় না? যাকগে, মানুষটা সুবিধের হলেই হল!

রমা জিজ্ঞেস করল, ঠাণ্ডা বা গরম কিছু খাবেন তো? রজত যেন প্রশ্নটা শুনতেই পায়নি। সে উলটে প্রশ্ন করল, কর্তা ফিরছেন কখন?

সেটার কী কোনো ঠিক আছে সুশান্তবাবু? চাকরির উন্নতি, জীবনের সাকসেস না কীসব বলেন না আপনারা? সে-সব ঘটলে অফিস ছেড়ে বাড়ি যাওয়ার পাটটা চুকে যায়। ওর বোধ হয় সেই ফেজ চলছে এখন।

কথাটা শুনতে শুনতে রজতের চোখ দুটো হঠাৎ ঝিলিক দিয়ে উঠল। আর প্রায় নিজের অজান্তে একটা জিজ্ঞাসা উচ্চারিত হয়ে গেল, এই এতখানি সময় আপনার একলা লাগে না? রজত বুঝতে পারল না, ও কেন এই প্রশ্ন করেছে। রমার মনে কোনো সন্দেহ জাগিয়ে তোলার কোনো মানেই হয় না এই স্টেজে। কিন্তু ওর আরেকটা সাংঘাতিক প্রশ্ন জানতে ইচ্ছে খুব। যা জিজ্ঞেস করলে ও এক্ষুনি ধরা পড়ে যাবে, আর রমা ওকে সোজা গেট আউট করে দেবে। ওর জানার ইচ্ছে হচ্ছে ডন স্কুলের ছেলেরা সত্যি কীরকম হয়।

রমা এতক্ষণ ভাবছিল। ও ভাবছিল এই লোকটা নাকি ডন স্কুলের এক কালের চালু ছেলে। এর কাছে এসব প্রশ্ন এত রহস্যময় কেন? এদের বউরাই তো সচরাচর রূপবতী, নিঃসঙ্গ, মেন্টাল কেস হয়। পুরুষের সাকসেস স্টোরির ডার্ক সাইড। কিন্তু ও মুখে বলল, আরে ছাড়ন সে-সব কথা। ওসব নিয়ে আর ভাবি না আজকাল। বরং আপনার কিছু মজার গল্প বলুন। শুনেছি আপনি দারুণ গল্পবাজ ছিলেন।

আজ সারাটা দিনে এই প্রথম বেশ ফুর্তি ফুর্তি লাগছে রজতের। ও বলল, হ্যাঁ হ্যাঁ সেই ভালো। তা কী গল্প শুনবেন বলুন?

-আপনার নিজের গল্প।

–না, না, আমার কোনো গল্প নেই।

—সে কী? একটা জ্বলজ্যান্ত লোক আপনি! আপনার কোনো গল্প নেই মানে!

—মানে আমার কোনো অতীত নিয়ে কিছু বলতেই ভালো লাগে না।

–সুদীপ কিন্তু মোটেই তা বলেনি। তা যাকগে, তাহলে বর্তমান নিয়েই কিছু বলুন।

–বর্তমান? তাহলে আরেকটা কথা বলি আপনাকে। এই বর্তমানের ওপরও না আমার কোনো বিশ্বাস নেই। আমরা যা যা আসলে দেখি তা যে আসলে তাই তারও তো কোনো মানে নেই। আপনি আমাকে যে সুশান্ত ভেবে নিয়েছেন আমি তো ঠিক সে-সুশান্ত নাও হতে পারি।

রমার মনে সাঁ করে সেই প্রথম মুহূর্তের সন্দেহটা খেলে গেল। লোকটা তাহলে সুশান্ত নয়? যদি না হয় তাহলে ওর কী উচিত নয় ওকে এখনই বিদেয় করে দেওয়া? সুদীপ এলে পর কী বলে পরিচয় করাবে? সুদীপ সন্দেহপ্রবণ মানুষ নয়। কিন্তু এরকম অজ্ঞাত কুলশীল একটি লোকের উপস্থিতি ও কিছুতেই পছন্দ করবে না।

রমা একটু ক্ষীণভাবে জিজ্ঞেস করল, আপনি কী ভুল ফ্ল্যাটে এসে পড়েছেন?

–ভুল না, না। ভুল হবে কেন? এটাই তো কথা ছিল। আমি আসব, আপনি থাকবেন। আপনি আমায় ভুল করবেন না প্লিজ। আমি বর্তমানের কথা বলছিলুম তো। বর্তমানকে সাধারণত লোকে ধ্রুব বলে জানে। যা চোখের সামনে ঘটে তা তো মিথ্যে না। কিন্তু প্রশ্নটা অন্যখানে। প্রশ্ন, কী ঘটে আর আমরা কী দেখি। অ্যাপিয়ারেন্স অ্যাণ্ড রিয়্যালিটির প্রশ্ন যেটা। আপনি এফ এইচ ব্র্যাডলি পড়েছেন?

রমা তার সারাজীবনের বইয়ের বিষয় ঘেঁটে এফ এইচ ব্র্যাডলির নামটা মনে করতে পারল না একটু লজ্জা হল এবং বেশ কিছুটা সম্রম হল উপস্থিত মানুষটির জন্য। সুদীপের বন্ধুরা সচরাচর এসব কথা বলে না। এইটেই আসলে মধ্যবিত্তের আদত খগ, ভাবল রমা। তারা অনেক আশ্চর্য, আশ্চর্য কথা জানে। রমা বলল, শুনেছি বলে তো মনে হচ্ছে না এই নামটা।

রজত একটা সিগারেট ধরিয়ে ফেলল। দেশলাইয়ের কাঠিটা সন্তর্পণে অ্যাশট্রেতে শুইয়ে রেখে বলল, দেখুন, আমি যদি বাস্তবিকই আপনার স্বামীর বন্ধু না হতাম তাহলে আমি হতাম মাত্র একটা অ্যাপিয়ারেন্স। যেহেতু আমি তা নই তাই কথা শেষ হওয়ার আগেই ক্রি. ক্রি. ক্রি…করে সজোরে ফ্ল্যাটের বেল বেজে উঠল। রজত ভাবল, এই যাঃ! পুরো সুযোগটা আমি বেকার গল্পে নষ্ট করলাম। পকেটে হাত চালিয়ে ও ক্ষুরটাকে একবার স্পর্শ করল। দরজার দিকে হেঁটে যাওয়া রমার নধর শরীরটার দিকে চাইতেই ওর হাতটা লোভে, উৎকণ্ঠায় ঘেমে উঠল। রজতের বড়ো ভয় এই বুঝি আসল বন্ধুটি হাজির হল। রজতকে বেরিয়ে যেতেই হবে একটু বাদে, অনেক ক্ষমা ভিক্ষা করে।

কিন্তু না। বাড়ির দরোয়ান এসে খবর দিয়ে গেল কাল সকালে পাম্পে জল আসবে না। পৌরসভার নোটিশ এসেছে।

বাঁচা গেল, বলে পকেট থেকে হাত বার করল রজত। রমা বলল, আই’ম সরি। আপনাকে এতক্ষণ কিছু না খাইয়ে বসিয়ে রেখেছি। আমাকে এক মিনিট এক্সকিউজ করুন। রমা চলে যেতে রজত সামনে পড়ে থাকা খেলার ম্যাগাজিনটা খুলে আনমনে ওলটাতে লাগল। আর হঠাৎ এসে থেমে গেল গাভাসকরের একটা ছবিতে। বিজ্ঞাপনের ছবিতে দেখাচ্ছে গালভরতি ফেনা নিয়ে সুনীল গাভাসকর দাড়ি কামাচ্ছে। গালের ওপর ক্ষুর চললে রজতের একটা অভূতপূর্ব অনুভূতি হয় ভেতরে। অনেক ক্লান্তি ঝরে যায়। রজতের জানতে ইচ্ছে হয় কে প্রথম ক্ষুর আবিষ্কার করেছিল? সে কী দাড়ি কামানোর জন্য, নাকি সব চেয়ে নিটোলভাবে গলা কাটার জন্য?

এ কি পুরুষ হয়েও গাভাসকরের ভক্ত? আমার তো ধারণা মেয়েরাই ওর সেরা ভক্ত আজকাল। রমা বেশ আওয়াজ করেই চায়ের ট্রে-টা সেনটার টেবিলে রাখল। দু-কাপ চা বানিয়ে একটা বাড়িয়ে দিল রজতের দিকে। নিজেরটায় চিনির বদলে গুলি গুলি স্যাকারিন মেশাল। বলল, আমার, জানেন ব্লাডে চড়া সুগার। চিনি খাওয়াও বন্ধ।

চায়ে একটা ছোট্ট চুমুক দিয়ে রজত বলল, একেকজন দৈববাণী শুনতে পায়। কিন্তু তারা জানে না সেটা সত্যি কি মিথ্যে। এই ধরুন না খবরের কাগজের খবরটাই। ইয়র্কশায়ার রিপার তো সমানে দাবি করছে সে দৈববাণী শুনতে পায়। তাও আবার কবরখানায়।

ওঃ গড! প্লিজ ওর কথা বলবেন না, আমার গায়ে জ্বর আসে। কথাগুলো প্রচন্ড ঘৃণা আর রাগের সঙ্গে বলে উঠল রমা। মুখটাকে যৎপরোনাস্তি ব্যাজার করে চা-টা পাশে ঠেলে দিল। যেন চাটুকু পাওয়ায়ও ওর ঘেন্না ধরে গেছে। রজত ওকে আশ্বস্ত করার জন্য খুব শান্ত গলায় বলল, রিপার কিন্তু একটা সৎ কাজ করছে, আপনাকে মানতেই হবে। সে দেশের সমস্ত বেশ্যাদের নিপাত ঘটাচ্ছে। তাই না?

রমার মনে হল ওর মাথায় রগ ছিড়ে রক্ত ছিটকে বেরিয়ে আসবে। এমনিতেই প্রেসারের রুগী সে। রাগে থর থর কাঁপতে কাঁপতে উঠে দাঁড়াল রমা। একটু হেঁটে গিয়ে হল-ল্যাম্পের ডাঁটিটা শক্ত করে চেপে ধরল। তারপর প্রাণপণে চেঁচিয়ে উঠল গেট আউট অব হিয়ার, ইউ রেচেড মেল শভিনিস্ট পিগ। আই সে গেট আউট। অ্যাণ্ড রাইট নাও।

এবার ধীরভাবে সিট ছেড়ে উঠে দাঁড়াল রজত। এবং সেরকম ধীর ‘উচ্চারণে’ বলল, আপনি বন্ধুর স্ত্রী। আমার প্রথম পদক্ষেপ আপনাদের বাড়িতে। একটা ছোট্ট উপহার এনেছিলাম। ধীর পদে এগিয়ে এসে পকেট থেকে বার করল ওর ক্ষুরটা, তারপর কবজির এক ঝটকায় খুলে ফেলল যন্ত্রটা। রমা তার সম্পূর্ণ রকম গোল হয়ে ওঠা চোখ দিয়ে দেখল ক্ষুরের ব্লেডে চাপ চাপ শুকনো রক্ত।

রমার মনে হল একটা সাপের ছোবলের মতন জ্বালা হচ্ছে ওর গলায়। ওর চোখের সামনে মানুষটা ক্রমশ ঘোলাটে হয়ে উঠছে। কিন্তু সে স্পষ্ট শুনতে পেল উপস্থিত মানুষটির কথা। সে বলছে, ক্ষুরের আঘাতচকিত, শার্প। বেদনা অপেক্ষাকৃত কম। তবে দাগ থেকে যাবে। পরপুরুষের সামনে অতখানি বুক খুলে বসতে পারবেন না। রমার এবার চৈতন্য হল ক্ষুরটা উড়ে গেছে তার স্তনের পাশ দিয়ে। এবং এটা মনে হতেই সে নিজের রক্তের ফোঁটাগুলোর ওপর আছড়ে পড়ে জ্ঞান হারাল।

ইয়েল লকের দরজা ঘড়াম করে বাইরে থেকে টেনে দিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নামতে লাগল রজত। একটা লম্বা-চওড়া সুবেশ যুবক শিস দিতে দিতে ওপরে উঠে গেল। রজতের ধারণা হল এই ছেলেটাই সুশান্ত। যার হয়ে এতক্ষণ প্রক্সি দিয়ে নেমে যাচ্ছে রজত। মরুকগে শালা ! এইটুকুই মুখ দিয়ে বেরুল ওর। ওর একবার গোনার ইচ্ছে হল রমা কত নম্বর, দুই না তিন চার? কিন্তু ওর ওসমস্ত একেবারেই ভালো লাগছে না এখন।

রজত চারটে একশো টাকার নোট সরিয়েছে রমার দেরাজ থেকে। চাকরি ছাড়ার পর এই প্রথম এতগুলো টাকা ওর হাতে। এত এত টাকা খরচ করার বেশি জায়গা ওর জানা নেই। এক সোনাগাছি ছাড়া। কিন্তু সোনাগাছিতে ওর খুব ভয়। গেলেই মাথায় খুন চাপবে, ক্ষুরটা খাই খাই করবে। এই ক্ষুরটাই ওর মস্ত লায়াবিলিটি আজকাল। কিছুতেই সঙ্গ ছাড়ে না। যখন-তখন গরম হয়ে ওঠে। রজতের ভারি করুণা জন্মাল ইয়র্কশায়ার রিপারের ওপর। হয়ত বেচারির কোনোই দোষ নেই। সব দোষ শালা…।

রজতের মুখ দিয়ে একটা শালা’ আওয়াজ শুনে একটা ট্যাক্সি ওর পাশে এসে খাড়া হয়ে গেল। বেসামাল সওয়ারি তুলতে ট্যাক্সিদের ভীষণ আহ্লাদ। বাবু, কিস তরফ যাইয়েগা? জানতে চাইল ড্রাইভার। রজত কিছুটা মাতালের ঢং-এ বলল, বঁহা জানা হ্যায় চলো। ড্রাইভার বুঝে নিল বাকিটা।

গাড়িটা যেখানে ছাড়ল ওকে সে-জায়গাটা ওর আবছা আবছা চেনা। পার্ক স্ট্রিটের পাশ দিয়ে বেরিয়ে গিয়ে দু-গলি পেরিয়ে একটা বেখাপ্পা এলাকা। ওই বাড়িটাও ওর আবছা আবছা চেনা। দিল্লি-আগ্রা থেকে ধরে আনা মেয়েদের আড়ত। কয়েকটা বাঙালিও আছে। তত ভালো কিছু না। ফিরিঙ্গি ফিরিঙ্গি ভাব, কিন্তু মোটেই তা নয়। পুরো ভেতো বাঙালি। অফিসের বসের এক বন্ধুকে একবার যেমন-তেমন ঢুকিয়ে বহুক্ষণ বাইরে দাঁড়িয়ে সিগারেট খেয়েছিল রজত। খুব গা ঘিনঘিন করছিল। যেমন আজও করছে। কিন্তু আজকে ওর মনে দারুণ বল এসেছে। পকেটে পয়সাও আছে, ক্ষুরও আছে। আর একটু নেশা করার ইচ্ছে।

দালালটা বাইরের ঘরেই সব মেয়েদের এনে দাঁড় করাচ্ছিল। বিরক্তির স্বরে রজত বলল, শান্তিতে মদটাও খেতে দেবে না হারামজাদা? তখন দালালটাই উঠে দাঁড়িয়ে ‘ভাগে ভাগো’ করে মেয়েগুলোকে ভাগিয়ে দিল ওপরে। পুরো পাঁইট একাই মেরে দিয়ে রজত বলল, নিয়ে চলো এবার। কীরকম কালেকশন দেখি তোমার। দালাল ওকে সিঁড়ি বেয়ে একটা সরু বারান্দায় নিয়ে দাঁড় করাল। তারপর ওর কানের কাছে মুখটা এনে ফিসফিস করে বলল, সোজা চার নম্বর ঘরে চলে যান সাহেব। বেলা আছে, দারুণ জিনিস।

রজতের পা একটু টলছিল। কিন্তু দৃষ্টি খুব পরিষ্কার। গুণে গুণে চার নম্বরে এসে পলকা দরজাটা পায়ে ঠেলে ঢুকল। ঘরে ডিম লাইট। কিন্তু সেই আলোতেও স্পষ্ট দেখল একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে দূরের কোণটায়। ছবির মতন চাহনি, মুখে দজ্জালের হাসি। ওকে দেখেই বলল, বেশ টেনেছ, না? না-হলে সাহস হয় না বুঝি?

রজতের বেদম হাসি পেল ওর কথায়। অপূর্ব অভ্যর্থনা বলতে হবে এটিকে। সামাল দেবার জন্য রোয়াবের মাথায় বলল, চল, চল, বেশি ফিকির করিসনে। মেয়েটাও বাঁই বাঁই পাক দিয়ে শাড়ি খুলতে খুলতে বলল, তোমার কাপড়চোপড় কী গায়েই থাকবে?

—হ্যাঁ থাকবে। তাতে তোমার কী?

–ক-দিন কাচোনি জামা-প্যান্ট?

–অ্যাই দ্যাখ, বেশি বকবি না।

রজত রেনকোটটা খুলে টাঙাবার জায়গা খুঁজছিল। পা টলমল করছিল বলে দেয়ালের পেরেকটাকে যুতে পাচ্ছিল না। কিন্তু অযথা হাঁটাচলা করতেও ওর ইচ্ছে হচ্ছিল না। শরীরটা ক্লান্ত, কিন্তু দেহের বাসনা ষোলো আনা। হুড়মুড়ি করলে শরীরটা বেঁকে বসবে। ওর এখন মনে পড়ে, রমার রক্তমাখা ক্ষুরটা ওর রেনকোটের পকেটে। ওটাকে যত্ন করে প্যানটুলুনের পকেটে চালান দিতে হবে। কিন্তু মাগিটা টেরিয়ে টেরিয়ে সব দেখছে দেখে ও ধমকে উঠল, অ্যাই মেয়ে। ওদিকে তাকা। দেখছিস না জামাকাপড় ছাড়চি?

ভারি লজ্জা রে আমার। তা এসেচো কেন কলির কেষ্ট? নাকি ভাবছ আমি তোমার মানিব্যাগ হাপিশ করব?

নাঃ! এই মেয়েটাকে নিয়ে কিসসু করা সম্ভব না। যা মুখ খারাপ না এদের। এদের জন্য রিপারই ঠিক আছে, ভাবল রজত। হঠাৎ ঝাঁ করে ক্ষুরটা বার করল সে। দেখছিস কী জিনিস? বেশি তেড়িবেড়ি করবি তো এক কোপে শালা কোপ্তা বানিয়ে দেব।

কিন্তু আশ্চর্য! মেয়েটা এখনও হেসে যাচ্ছে মিটিমিটি। হাসতে হাসতেই বলল, তুই শালা গাঁটকাটা আছিস, না?

—অ্যাই চোপ!

—তোর ওটাতে কি মুরগির খুন?

এবার স্বল্প আলোয় রজত নাপিতের মতন নাচাতে লাগল ওর রক্তমাখা ক্ষুরটা। মেয়েটার এখনও বিশ্বাস হয়নি রক্তটা মানুষের। ঘা পড়লে বিশ্বাস হবে। মেয়েটা চট করে ওর ব্লাউজের একটা তরফ খুলে বলল, দ্যাখো, এই যে দাগ না, এটা আমার লাভার রসুল ব্লেড দিয়ে করে দিয়েছিল? বিশ্বাস হয়?

নিজের ইচ্ছের বিরুদ্ধে রজতের মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল, রসুল কে? মেয়েটিও খুব একটা গা-ছাড়া ভাব করে বলল, লাভার ছিল। বিয়ে করতে চাইত।

—তা করলি না কেন?

–করব কী? ব্যাটা চাকরিই করে না। খাওয়াবে কী?

—কিছুই করত না?

—ওই আর কি তোমার মতন। ক্ষুর দিয়ে গাঁট কেটে বেড়াত। ওসব লোককে বিশ্বাস আছে। তার চেয়ে লাইনে নেমে যাও।

মেয়েটার শেষ কথাগুলো ঠিক কথা ছিল না। বিলকুল ক্ষুরের টান। রজতের সামনে সমস্ত ঘরটা, ওই খুদে জানালা, ওই ডিম লাইট, ওই মেয়েটা দোলনার মতন দুলতে লাগল। রজতের রগ বেয়ে প্রচন্ড ব্যথা চাড়া দিতে লাগল। সুস্থ থাকলে যেটাকে মনে হতে পারত মাইগ্রেন পেন! কিন্তু ও জানে এটা কীসের তাড়না। ও নিজেকে বোঝাতে চায় এটা দৈববাণী। বিশেষ করে ওরই জন্য উচ্চারিত। কিন্তু এই মুহূর্তে ওকে স্থির থাকতেই হবে। এ মেয়েকে ও জান থাকতে আঘাত করতে পারবে না। মুখপুড়ির বুকে দাগ দেখেছে রজত। বড়ো কষ্টের জীবন মেয়েটার। কিন্তু রজতের ক্ষুরের হাতও ধুকপুক করছে। ও খোলা ক্ষুরের ওপর ওর পাঞ্জা বসিয়ে প্রাণপণ চাপ দিল, যেন কী আরাম ওই চাপে।

একই সঙ্গে চিৎকার করে রজত ও বেলা যখন অজ্ঞান হয়ে মাটিতে পড়ল গোটা বাড়ির জানতে বাকি রইল না বাড়িতে দারুণ অনর্থ ঘটে গেছে। নীচে দাওয়ায় বসে বৃদ্ধমাসি বলল, এইসব বদ মাতালদের হাতে এইজন্য কচি মেয়েগুলোকে ছাড়তে নেই। যা বাবা দ্যাখ কী হল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *