1 of 2

দৈত্যের বাগানে শিশু

দৈত্যের বাগানে শিশু

যৌবনকালটা লালুর কেটেছে মামদোবাজিতে। মামদোভূতের ধড় আছে, মুড়ো নেই। লালুরও ছিল না। ধড় ছিল। সেটা দশাসই। ছেলেবেলা থেকেই তার চেহারাখানা বিশাল, দু-খানা বিপুল কাঁধের মধ্যে তার মুণ্ডুটা নিতান্তই ছোট দেখতে। মুখখানা ভালো নয়, কিন্তু সেই মুখে খুব সরলতা ছিল। ছিল নিষ্ঠুরতাও। মাথায় বুদ্ধি ছিল না। পনেরো–ষোলো বছর বয়সেও ক্লাস এইট-এর ছাত্র সে, তখন মদ খেতে শিখেছিল, খেলত জুয়া। পাড়ার লোক সেই বয়সের লালুকে অল্প–সল্প ভয় করতে শুরু করেছিল।

বাজারের মধ্যে স্টোভ সারাইয়ের দোকান করত হীরেন। রাতে দোকানের ঝাঁপ ফেলে ভিতরে জুয়ার বোর্ড বসাত। লালু ছিল সেই বোর্ডের মেম্বার। পাড়ার এবং এলাকার বিখ্যাত গুন্ডা ছিল ননী। ননীর মাকে ছিল দেখার মতো। সে ট্যাক্সিওয়ালাদের লুঠ করত, পার্ক স্ট্রিট, এসপ্লানেডের বিখ্যাত বার থেকে মাতালদের ভুলিয়েভালিয়ে নিয়ে যেত ময়দানে–পরনের অন্তর্বাস ছাড়া সব কেড়ে নিত, পকেটমারদের কাছ থেকে নিত কমিশন। ননী জীবনে টাকাটা খুব চিনেছিল। মাঝেমধ্যে সে হীরেনের দোকানের জুয়ার বোর্ডটা লুঠ করত। খুব টাকার দরকার হলেই এটা করত সে। হীরেনরা বরাবর ননীগুন্ডাকে দেখলেই বোর্ড ছেড়ে দিত।

একদিন লালু থাকতে না পেরে বলল –রোজ-রোজ বোর্ডটা ভেঙে দিয়ে যাও ননীদা, আমরা ঝুটঝামেলা কিছু করি না-কিন্তু কাজটা কি পুরুষের মতো হচ্ছে?

ননী একপলক তাকে দেখে বলল –শরীর বানিয়েছিস, না রে শালা? কিন্তু তুই খারাপ হয়ে যাবি লালু।

লালু ভয় খেয়ে বলল –কিন্তু আমরা তো তোমাকে কিছু বলি না কখনও। খেলাটা ভেঙে গেলে রোজ-রোজ ভালো লাগে না, তাই

ননী কেবল ঠান্ডা গলায় আবার বলল –তুই খারাপ হয়ে যাবি লালু। বিলা হয়ে যাবি—

টাকাপয়সা তুলে নিয়ে নদী হাত বাড়িয়ে লালুর কাঁধের জামাটা ধরে বলল –আয়।

ননী ডাকলে বেশিরভাগ লোকই প্রতিরোধের কথা ভুলে সম্মোহিতের মতো তার সঙ্গে যায়। অতবড় শরীর নিয়ে লালুও তার অর্ধেক মাপের ননীর সঙ্গে উঠল।

বাজারের পিছন দিকে একটা চাতাল, মফসসলের মেয়ে আর শিশুরা এখানে আনাজ নিয়ে বসে। রাতে জায়গাটা ভারী নির্জন, শুনশান। অদূরে একটা পশ্চিমাদের ঝোঁপড়া আছে, তাতে ঝাঁকামুটে মজুরদের বাস। কিন্তু তারাও নির্জনতারই অংশবিশেষ। ননীকে দেখলে তারা পাথর হয়ে যায়।

খুব জ্যোৎস্না সেদিন। সেই জ্যোৎস্নায় চাতালে এনে লালুকে দাঁড় করিয়ে ননী ঠান্ডা গলায় বলল –যদি বিশ্বাস থাকে তো ভগবানের নাম নে শুয়োরের বাচ্চা।

এতক্ষণ পর্যন্ত সব ঠিকই ছিল। ননী বেড়াল ইঁদুরের খেলাটা ঠিকই খেলতে পারত। ভয়ে নেংটি ইঁদুরের মতোই কাঁপছিল লালু। কিন্তু ননী ভুল করল গালটা দিয়ে।

লালুর বাপ নিরীহ মানুষ ছিলেন। কাজ করতেন সরকারি অফিসে। কেরানি। ছোটখাটো মানুষ। ছেলে-বউয়ের ওপর কোনও কর্তৃত্ব ছিল না। লালু যখন বড় হতে-হতে বিশাল চেহারা বিশিষ্ট হয়ে উঠল, ছেলের বাড় দেখে তিনি খুবই চিন্তিত হয়ে পড়লেন। তাঁর ছেলে এরকম বিরাট আকৃতির হয় কী করে তা তিনি খুব ভাবতেন। মাঝেমধ্যে স্ত্রীকে তাঁর সন্দেহ হত। তিনি বলতেন, এ-ছেলে আমার না নিশ্চয়ই।

লালুর মা ভারী অবাক হয়ে বলতেন–’তবে কার?’

আমতা-আমতা করে লালুর বাবা বলতেন–হাসপাতালে অদল-বদল হয়নি তো। মনে হয়। আমার বাচ্চা নিয়ে অন্য কেউ তার বিকট ছেলেটা পাচার করে গেছে।

এরকম অলক্ষুণে কথা শুনে লালুর মা ভীষণ চেঁচামেচি শুরু করতেন। পাড়ায় জানাজানি হত। লোকে হাসত। পাড়ার বউ–ঝিরা তাদের দুপুরের কূটকচালির আসরে লালুর মায়ের চরিত্র বিষয়ে ঘোরতর সন্দেহ প্রকাশ করত–ওটুকু মানুষের ওরকম দানবের মতো ছেলে হয় কখনও?

সেসব কথা লালুরও কানে আসত। সে স্পষ্টই বুঝতে পারত যে তার বাপ তাকে একটুও পছন্দ করে না। উপরন্তু তার জন্ম এবং পিতৃপরিচয় বিষয়ে নানা লোকের নানা সন্দেহ। কিন্তু কেন যেন নিজের বাপ এবং মার প্রতি লালুর একটা পাগলাটে ভালোবাসা ছিল। সে তার রোগা খিটখিটে সন্দেহপ্রবণ বাপকে ভালোবাসত খুব। মাঝেমধ্যে বাবা অফিস থেকে ফিরলে সে গিয়ে সন্ধেবেলা তার দানবীয় হাতে বাপের গা হাত-পা টিপে দিতে-দিতে বলত…আমি তোমার ছেলে, না বাবা?

বাপ সতর্ক হয়ে ক্ষীণ গলায় বলত–আরও ভালো হ লালু। তোকে দেখে যে ভয় লাগে আমার।

–ভয় কী বাবা। আমি ঠিক আছি।

লালুর বাবা ক্ষীণ গলায় বলতেন–অত জোরে দাবাস না-লাগে। চরিত্রটা একটু ঠিক রাখিস। বেড়ে উঠলেই হল না, বাড়ের সঙ্গে আবার সংযম চাই।

লালু সেসব বুঝত না। তার শরীর সব সময়ে ছটফট করে–সে করবে কী? কাজেই সে বাবার কথায় আমল দিত না, কিন্তু লোকটাকে প্রাণ দিয়ে ভালোবাসত।

কাজেই জ্যোৎস্না রাতে বাজারের পিছনের নির্জন চাতালে যখন তকে মারবার আগে। ‘শুয়োরের বাচ্চা’ বলে গাল দিল ননী তখনই একটা মারাত্মক ভুল করল। ওই গালাগালে হঠাৎ নিজের নিরীহ ছোটখাটো বাবার চেহারাটা লালুর মনে পড়ল। পলকে গরম হয়ে গেল গা। সরে গেল সমস্ত জড়তা। সে ঘুরে তার হোঁকা হাতে বুলেটের মতো একখানা ঘুষি ঝাড়ল ননীর মুখে।

তৈরি থাকলে এসব ঘুষি ননী সহজেই এড়াতে পারে। কিন্তু লালু সম্পর্কে সতর্ক হওয়ার কোনও কারণ ছিল না। হোঁৎকাটা ভয়ে কাঁপছে দেখে নিশ্চিন্ত মনে ননী একতরফা মারের জন্য তৈরি হচ্ছিল। আচমকা ঘুষিটা লাগল সেই সময়ে। একটা কোলবালিশের মতো চাতালে পড়ে গেল ননী।

‘বাপ তুলে গালাগাল! অ্যাঁ! বাপ তুলে?’ বিড়বিড় করে বলতে-বলতে লালু ননীর লাশ টেনে তুলল এক হাতে, অন্য হাত মোটরগাড়ির পিস্টনের মতো চালাতে লাগল। কোঁক-কোঁক করে কয়েকটা শব্দ করল ননী, তারপর চুপ হয়ে গেল। কিন্তু লালুর রাগ তখনও শেষ হয়নি। সে দু হাতে ননীর গলা টিপে ধরে বলছে তখনও-’আর বলবি? আর বলবি কখনও?’

লালু তখনও জানত না, তার হাতের চাপে ননীর গলার মেরুদণ্ডের দুটো হাড় ভেঙে গেছে, জিভ বেরিয়ে ঝুলছে, এবং অনেকক্ষণ ননী শ্বাস নিচ্ছে না।

বাজারের বন্ধ দোকানঘরের আড়াল আবডাল থেকে দৃশ্যটা দেখে হীরেন আর তার দলবল এসে জ্যান্ত লালু আর ননীকে আলাদা করল। হীরেনরা খুব খুশি। কিন্তু লালুর বিপদ বুঝে বলল  –তুই পালা। বাড়িতে গিয়ে শুয়ে থাক, কোথাও বেরোসনি। আবডাল দিয়ে বাড়িতে ঢুকবি, পাড়ার লোকে যেন দেখতে না পায়।

লালুর ভয় ঢুকল আবার। নেংটি ইঁদুরের মতো পালাল সে। ঘরে শুয়ে শুনল, পুলিশভ্যান আসছে যাচ্ছে। একটু রাতে বাজারের দিকটায় ননীর দলবল হুজ্জত শুরু করল। ঘরে শুয়ে কাঁপতে লাগল লালু।

কিন্তু ননী মরেই গেছে। কোনও ভয়ঙ্কর প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য সে আর ফিরবে না। তার দলবলও খুব একটা ছিল না। দু-চারদিন হামলা হল, খোঁজাখুঁজিও হল, কিন্তু লালুর গায়ে হাত পড়ল না। বাজারের হীরেন আর তার দলবল লালুকে আড়াল দিল কিছুটা। জুয়ার বোর্ডটা নিরাপদ করেছে লালু, কাজেই তার জন্য কিছু করতেই হয়।

লালু আবার রাস্তায় বেরোয়, হীরেনের আড্ডায় গিয়ে বসে, চোলাই খায়। তখন তার বিশ বছর বয়স।

পটাকে দেখে এখন আর বুঝবার উপায়ও নেই যে সে এক সময়ে কে বা কী ছিল। কিন্তু লোকে তখনও বলে–পটা মাস্তানের মতো অমন ওস্তাদ আর হয় না। কিন্তু কোন এক লীলাময়ীর কাছে ঘা খেয়ে পটা সব ছেড়ে সন্ন্যাসী হয়ে যায় কিছুদিন। লাইনের ওপারে ছোট্ট কালী মন্দির বানিয়ে রক্তবর্ণ পোশাক পরে পটা কিছুদিন খুব সাধনভজন করে। সামাজিক দুষ্কর্ম সবই ছেড়ে দেয়। পটার দাপটে যারা ম্লান হয়েছিল এতদিন–এই ফাঁকে তারা উন্নতি করে ফেলল। পটা কালী সাধনা করতে-করতে আড়চোখে দেখল সবই। কালীর মুখের ওপর লীলারানির মুখটা মাঝে-মাঝে ফুটে ওঠে। পটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে চুপ করে থাকে। মনটা খুব ছটফট করলে মাঠ থেকে যার তার পাঁঠা ধরে এনে বলি দেয়। এইরকমভাবেই জীবনটা কাটিয়ে দিচ্ছিল পটা। এখন বয়স হয়ে গেছে। কালীমন্দিরটা নিয়েই পড়ে আছে সে। তবু একটা চোখ তার সব সময়েই খোলা, পাড়ার দিকে নজর রাখে। কোন মাস্তান উঠছে, কেই বা পড়তির দিকে। এটা তার অভ্যাস, ছাড়তে পারে না।

ননী মরে গেলে সে একদিন লাইন পেরিয়ে পাড়ায় ঢুকল।

লালুর আত্মবিশ্বাস এখন অনেক বেড়ে গেছে। তার শরীরটা হোঁৎকা হলেও যে কাজের তা সে বুঝতে পারে আজকাল। মারপিট হুজ্জোত লাগলে সে সবার আগে যায়! লোকে তাকে রাস্তা ছেড়ে দেয়।

মোড়ের মাথায় পটা ধরল লালুকে।

–শোন।

লালু একটা চোখ কুঁচকে পটাকে দেখে। খুব একটা আমল দিতে চায় না। কিন্তু পটার রক্তবর্ণ পোশাক, উড়োউড়ো চুলদাড়ি, রোগা শুকনো চেহারার মধ্যে এখনও একটা কিছু আছে যাকে ঠিক উপেক্ষা করা চলে না। তাই লালু পটাকে আমল দেবে না করেও কাছে গিয়ে বলল –কিছু বলছ পটাদা?

–বলছি। গায়ে অত মাংস কেন তোর? ভারী শরীর নিয়ে কিছু করা যায় না-বুঝলি?

ব্যঙ্গের হাসি হাসে লালু, বলে–করা যায় না কী করে বুঝেছ?

পটা আধখোলা চোখে একটু চেয়ে থেকে বলে–ননীকে সাফ করেছিস বলে বলছিস। ননী তৈরি থাকলে তোর মতো চারজনকে জমি নেওয়াতো। আলপটকা মেরেছিস। তা সব সময়ে কি সেরকম হবে?

বলে রোগা হাতখানা বাড়িয়ে পটা বলল –এই হাতখানা ধরে দেখ, বুঝতে পারবি।

লালু আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে তার প্রকাণ্ড হাতখানা বাড়াল। পটা তার রোগা আঙুল দিয়ে লালুর পাঞ্জাটা ধরে আলতো চাপে মোচড় দিল একটু। ব্যথায় থরথর করে কেঁপে উঠল লালু। হাতখানা বুঝি কবজি থেকে ভেঙেই যায়।

–আহা, ছাড়ো ছাড়ো—

পটা মৃদু হাসে। ছেড়ে দিয়ে বলে–তাই বলছিলাম কি গায়ের মাংস আর একটু ঝরিয়ে দে। কারণ, নিজের মাংস নিজের শত্রু। লাইনের ওপারে মায়ের মন্দির আছে আমার জানিস তো! সেখানে বিকেল-বিকেল চলে আসবি। তোকে তৈরি করে দেব।

প্রচণ্ড বিস্ময়ে রোগা শুকনো চেহারার পটাকে কয়েক পলক দ্যাখে লালু। সে দেবী দত্তর আখড়ায় বিস্তর মাটি মেখেছে। যন্ত্রপাতি নেড়ে তৈরি রেখেছে শরীর, তবু এই রোগা দুর্বল পটার হাতের ক্ষমতার কাছে সে ছেলেমানুষ। ওস্তাদ একেই বলে!

পটা হাসল, আবার লালুর মুখ দেখে বলল –ননী চিরকালের গোঁয়ার, তার ওপর পয়সার লালচ। ওসব লালচ থাকলে মানুষ অন্ধ। নইলে তোর মতো আনাড়ির হাতে যায়?

লালু বুঝল যে সে এখনও আনাড়ি। মাস্তানির বিষয়টি এখনও বিস্তর শিখবার আছে। তাই সে বিকেল-বিকেল লাইন পেরিয়ে পটার মায়ের মন্দিরে যেতে লাগল।

প্রথম-প্রথম কয়েকদিন পটা কেবল নিজের ডানহাতটা মুঠো করে বাড়িয়ে দিয়ে বলত–মুঠো খোল।

পটার হাতে সেই মুঠো খুলতে সারা বিকেল প্রাণপণ চেষ্টা করে ঘেমে যেত লালু। পারত না। বলত কী দিয়ে তৈরি গো তোমার হাত পটাদা?

পটা হাসে, বলে–আজ যা, কাল আবার আসিস।

লালু সেলাম করে ফিরত। কিন্তু যাতায়াত বজায় রাখল সে। পটা শেখাত। বলত–এসব কাউকে শেখাইনি বড় একটা। এখন বুড়ো হয়ে যাচ্ছি, আমার সঙ্গেই সব চলে যাবে, তাই ভাবছি, তোকে দিয়ে যাই। কিন্তু দেখিস বাপু, লালচ বেশি করবি না, কখনও কোনও মেয়েমানুষের কেস নিবি না, গুরুকে মনে রাখবি।

লালু মাথা নাড়ে।

তারপর একদিন লালু মায়ের বাড়িতে পুজো দিয়ে বেরিয়ে এল। ভারী খুশি সে।

বিশাল শরীর এবং যথেষ্ট হিংস্রতা নিয়ে লালু ঘুরে বেড়াতে লাগল। শরীরের মাংস অনেকটা ঝরে গিয়ে, শরীরটা হালকা লাগে এখন। চলন্ত মালগাড়ির গা বাইতে পারে, টপকাতে পারে উঁচু দেওয়াল। সবচেয়ে বড় কথা আর টপ করে ভয় পায় না আগের মতো। পটা তাকে শিখিয়েছে, যখন হাঁটবি চলবি তখন চোখের মণি নড়বে ঠিক যেন দেওয়াল ঘড়ির পেণ্ডুলাম। হাঁ করে এক দিকে চেয়ে হাঁটবি না। চারদিকে নজরে রাখবি। তাই রাখে লালু। দু-খানা চোখ টকটক করে ডাইনে বাঁয়ে নড়ে তার, সবদিক নজর রাখে। এখন তার জীবন বিপজ্জনক।

ওয়াগন–ভাঙা হিসেবে লালু বেশ নাম করল। হাইওয়েতে মাঝে-মাঝে লরি বা মোটরগাড়িও থামায় সে। পাড়ার বেশিরভাগ দোকানদার তাকে খাজনা দেয়। রোজগারপাতি মন্দ না।

কিন্তু বিপদও আছে। ওয়াগন-ভাঙাদের পুরোনো দলটার সঙ্গে বিস্তর বোমাবাজি চলল কিছুদিন। পুরোনো দলটা ভেঙে যাচ্ছিল, লালুর দলটা তৈরি হচ্ছিল। বোঝা যাচ্ছিল, দিনকালে লালুর দলটাই দাঁড়িয়ে যাবে। কিন্তু বিনা হুজ্জতে নয়।

ঠিক দুপুরবেলা লালু পেটোপাড়ার ভিতর দিয়ে আসছিল। সেই সময়ে হঠাৎ সে দেখল কে যেন সুইচ টিপে সূর্যটা নিবিয়ে দিল। এমনকী সুইচ টেপার ফুটুস একটু আওয়াজ শুনতে পেল সে। অন্ধকারে মুখ থুবড়ে পড়ল রাস্তায়। তার গলায় সোনার চেনে বাঁধা বাঘনখ বেয়ে রক্ত পড়ছিল টপটপ।

হাসপাতালে তাকে দেখতে এল পটা। মাথায় বিরাট ব্যান্ডেজ নিয়ে পড়ে আছে লালু। গুলিটা বের করেছে ডাক্তারেরা, কিন্তু তবু মাঝে-মাঝেই মাথাটা অন্ধকারে ডুবে যাচ্ছে। সেই আলো আঁধারির ভিতরে সে পটাকে দেখে ক্ষীণ গলায় প্রশ্ন করল–পটাদা আমি মাইরি শেষ হয়ে গেলুম।

পটা গম্ভীর মুখে বলে–তোর একটা জিনিস নেই লালু। ওস্তাদ হতে গেলে সে জিনিসটা চাই

–কী সেটা।

–আর একটা ইন্দ্রিয়। আমি আগেই জানতাম, তোর সেটা নেই।

 –সেটা কীরকম জিনিস?

পটা একটু ভেবে উত্তর দিলকীরকম যেন ঠিক বোঝানো যায় না। চোখ কান ছাড়া আর একটা জিনিস। আমার মাথায় ঠিক রুমালের মতো একটা জিনিস আছে। সেটা সব সময়ে এদিক-ওদিক  ঝাঁপটা মারছে। আমার চোখের আড়ালে কোথায় কি হচ্ছে না হচ্ছে তা  ঝাঁপটা মেরে জানিয়ে দিচ্ছে আমাকে। কোন রাস্তা ঠান্ডা কোন রাস্তা গরম তা রাস্তা দেখেই আমি ধরতে পারি। মানুষের চোখের দিকে চেয়েই বুঝতে পারি যে কোন লাইনের লোক। তোর মুশকিল হচ্ছে তুই তা পারিস না। তোর শরীর আছে, কায়দাও জানিস, কিন্তু ও জিনিস তোর নেই।

ভারী হতাশ হল লালু। বলল , তা এখন আমি করব কী?

পটা বলল –তোর জখমটা ভালো নয়। মাথার চোট সারাজীবন জ্বালায়। নিজের হাতে তৈরি করেছি তোকে, এখন ভালো মন্দ কিছু হলে বুকে লাগবে বড়। তার চেয়ে তুই লাইন ছেড়ে দে।

লালুর মাথা আবার অন্ধকার হয়ে গেল এই কথা শুনে।

বুড়োবয়সে লালুর বাবা–মায়ের একটি মেয়ে হয়েছিল। তার তখন পাঁচ বছর বয়স। লালু তার এই রোগা টিঙটিঙে বোনটিকে ভালো করে লক্ষও করেনি কোনওদিন। হাসপাতালে থেকে ফিরে যখন কিছুদিন ঘরেই শুয়ে বসে থাকতে হল তাকে, ছোট বোনটি তার কাছে ঘুরঘুর করত। তার বিছানার কাছে বসে গুটি খেলত, পুতুলের সংসার বসত খুলে। কখনও বা রান্নাবাটি খেলায় লালুকে নেমন্তন্ন করত। এইভাবেই মায়া জন্মায়। লালু ঘরবন্দি বলেই আরও বেশি মায়াটা জন্মায়। তখনও মাঝে-মাঝে মাথা অন্ধকার হয়ে যায়, একটা দিক ফাঁকা ফাঁকা লাগে সব সময়ে। শরীরটা কাঁপে, নিজের জন্য ভারী একটা দুঃখ হয় তার। তখন সব ভুলবার জন্য বোনের সঙ্গে রাজ্যের খেলনা নিয়ে বসে লালু। আস্তে-আস্তে নিজের কথা ভুলে যায়। নিজেকে শিশুর মতোই লাগে তার।

.

তার দলটা দাঁড়িয়েই গেল। ওয়াগান–ভাঙার এমন ওস্তাদ দল বড় একটা আসেনি। দলের ছেলেরা এসে লালুর হিস্যার অংশ বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে যায়, কিন্তু তারাও বুঝতে পারে, লালু শেষ হয়ে গেছে। বোনের সঙ্গে সারাদিন খেলে-খেলে তার মুখ-চোখেও একটা শিশুর মতো হাবভাব। তারা বুঝতে পারে, লালু আর লাইনে নামতে পারবে না।

সেটা লালুও বোঝে। বুঝে একদিন সে তার হিস্যার টাকা ফিরিয়ে দিয়ে বলল –আমি বসে গেছি রে। ও টাকা ছুঁতে আমার লজ্জা করে। তোরা ভাগজোখ করে নে।

তারা খুব একটা আপত্তি করল না। টাকা ফেরত নিল।

লালু একটা শ্বাস ফেলে বোনের সঙ্গে খেলায় ডুবে গেল আবার। সে এখন এক পায়ে লাফিয়ে এক্কাদোক্কা খেলতে পারে। হাত চিৎ–উপুড় করে গুটি খেলতে পারে, পুতুলকে পরাতে পারে কাপড়।

।কিন্তু সেইসঙ্গে রোজগারও বন্ধ। সরকারি অফিসের টাকায় বাবা সংসার চালিয়ে নিচ্ছিল কোনওরকম। কিন্তু রিটায়ারমেন্টের সময় এসে গেল। লালুকে এখন আর তেমন ভয় করে না কেউ, বাবাও না। একদিন বাবা ডেকে বলল –লালু, তোমার মতিগতি ভালো হয়েছে, খুব সুখের ব্যাপার। কিন্তু রোজগারপাতির বুদ্ধি কই! শুধু ভালোমানুষিতে চলবে না।

লালু বুঝল। কিন্তু সে লেখাপড়া শেখেনি। পটা ওস্তাদের কাছে যা সে শিখেছে তা আর কাজে লাগাবার মতো ক্ষমতা তার নেই। তবু সে বোনের সঙ্গে খেলা ছেড়ে একটু-আধটু বেরোতে লাগল।

প্রথমেই গেল স্টেশনের গায়ে তাদের চায়ের দোকানটায়। দলের ছেলেরা এখানেই বসে।

সন্ধেবেলা। কয়েকজন বসে আছে। তাদের মধ্যে দুজন নীলু আর শানু লালুর চেনা-বাকি ক’জন নতুন। নীলু আর শানু খাতির করে তাকে বসাল। নতুনরা তাকে গ্রাহ্য করল না। এক দুইবার দেখে চোখ ফিরিয়ে নিল।

লালু নীলুকে বলল –আমার কিছু টাকার দরকার নীলু, দোকান করব।

নীলু মন দিয়ে শুনে ভেবে বলল –ধার না হিস্যা?

লালু মাথা নাড়ে–ওসব না। কাজে নামব।

নীলু আবার ভাবে। অনেক ভেবে বলে–দল ঠিক আগের মতো নেই লালুদা। পুলিশেরও হুজ্জত খুব। নতুন ছেলেরা এসেছে–তারা কাউকে বিশ্বাস করে না। তুমি নামতে চাও ভালো, আমি সবাইর সঙ্গে একটু কথা বলে নিই। কাল একবার এসো।

লালু গেল পরদিনও। নতুন ছেলেরা তার হোঁতকা শরীরটা চেয়ে দেখল মাত্র। নীলু গম্ভীরমুখে আড়ালে ডেকে বলল  তোমাকে নেবো। কথা হয়েছে। কিন্তু এখন দল বেড়ে গেছে অনেক, আমাদের হিস্যা বেশি থাকে না। পুলিসকে কত দিতে হয় তা তো তুমি জানোই। আর-একটা কথা, এখান থেকে ক্যাপিট্যাল বাগিয়ে সরে পড়বে তা হবে না। এলে থাকতে হবে। ভেবেচিন্তে এসো।

কথাটা লালু ভাবল অনেক। ওয়াগন–ভাঙা কিছু শক্ত কাজ না। গাড়ি জায়গা মতো দাঁড়ায়, পুলিশও বন্দোবস্ত মতো তফাতে থাকে। কেবল বন্ধ ওয়াগন খুলে মাল বের করা। কিন্তু ওই যে দল ওই দলটাই সাংঘাতিক। বহুকাল সে আর দল করেনি, এখন বুঝে চলা কী সম্ভব! একটু এদিক-ওদিক হলে লাশ পড়ে যাবে। পটাটা কী একটা ইন্দ্রিয়র কথা বলত, যেটা তার নেই। সেটা নেই ঠিকই। তাই একটু-আধটু ভয় করে লালুর! গলায় সোনার চেনে বাঁধা বাঘনখটা মুখে। পুরে, সে ভ্রূ কুঁচকে ভাবে। ভাবলেও কিছু সমাধান পায় না। মাথার ভিতরটায় একধারে এখনও জমাট অন্ধকার। সব সমস্যা গিয়ে সেইখানে সেঁধোয়। ভারি অস্থির লাগে তার।

তবু নামে লালু। দু-দিন তাকে কোনও কাজ দেওয়া হল না। দলের সঙ্গে থাকল কেবল। তিন চারদিন পর গাড়ি থামতে দরজা খুলে অভ্যাস মতো উঠে গেল লালু। পা দিল গমের বস্তায়। হাতে হাতলওয়ালা সরু হুক। তার পিছনে উঠল তিনচারজন নতুন ছেলে।

ওয়াগানের ভিতর অন্ধকার। যার হাতে টর্চ সে কেন যেন টর্চটা জ্বালল না। অন্ধকারেই বিপুল একটা বস্তা টেনে তুলল লালু। পাকসাট মেরে দরজার কাছে ফেলল। নীচে থেকে কারও বস্তাটা ধরার কথা। লালু বস্তাটা ঝুলিয়ে ধরে রইল, নীচে থেকে কেউ তা ধরল না। কিছু বুঝবার আগেই ওয়াগানের ভিতরের অন্ধকার থেকে হুক-এর সরু অংশটা কে যেন সজোরে বসাল তার কাঁধে। ব্যথায় চেঁচিয়ে উঠল সে, হাতের বস্তাটা পড়ল প্রথমে, তার ওপর পড়ল সে, পিছন থেকে একটা লাথি খেয়ে টাল সামলাতে না পেরে। ভারী শরীর তার, উঁচু ওয়াগন থেকে পড়ে বুদ্ধিভ্রংশ হয়ে সে কাঁধ চেপে বোকার মতো চেয়ে রইল কেবল। টলটলে রক্তে ভেসে যাচ্ছিল তার হাত। ওয়াগনের ভিতর থেকে একটা তীব্র টর্চের আলো এসে পড়ল তার মুখে। একটা গলার স্বর বলল –আমরা নতুন লোক পছন্দ করি না লালু। কেটে পড়ো।

লালু সেই টর্চের আলোর দিকে চেয়ে বলল –কিন্তু নীলু যে বলেছিল।

–নীলুও যাবে। তুমি পুরোনো লোক, দলটা তোমার হাতেই তৈরি–আমরা জানি। তাই তোমাকে জান–এ মারলাম না। পুরোনোলোক আমরা পছন্দ করি না। কেটে পড়ো।

লালু তার অন্ধকার মাথা দিয়েও ব্যাপারটা বুঝল। উঠে দাঁড়িয়ে বলল –কিন্তু আমার হিস্যা?

–যে গমের বস্তাটা নামিয়েছ ওটা নিয়ে যাও। বস্তাটা অবশ্য নিল না লালু। কিন্তু ফিরে গেল। আস্তে-আস্তে ইয়ার্ড পার হল, টপকাল রেলের লোহার বেড়া। অন্ধকারে গা ঢাকা দিয়ে ফিরে এল বাড়িতে।

পরদিন আবার শিশুর মতো মুখ নিয়ে ঘুম থেকে উঠল সে। খেলতে শুরু করল ছোট বোনের সঙ্গে।

দিনসাতেক বাদে খবর পেল, রেলে কাটা পড়ে নীলু মারা গেছে। শুনে একটু শিউরে উঠল সে। ছোট বোন মিলু পাড়ার রাজ্যের ছেলেমেয়ে জুটিয়ে আনে, তাদের নিয়ে সারাদিন খেলে লালু। নীলু মারা যাওয়ার খবর পেয়ে সে সেইদিন তাদের নিয়ে বাড়ির উঠোনের করবী গাছের নীচে বনভোজন করল। বাচ্চাদের হুল্লোড়ে ডুবে রইল সারাদিন।

কিন্তু এভাবে চলে না।

দত্তদের গাড়িটা গতবছর বেচে দিয়েছে। গ্যারাজটা খালি পড়ে আছে। লালুর খুব ইচ্ছে ওখানে একটা দোকান দেয়। মনোহারি দোকান। সামান্য কিছু থোক টাকা হলে চলে যায়।

সে বাবার কাছে টাকাটা চাইল প্রথমে। বাবা অবাক হয়ে বললেন–আমার প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকা ভাঙব? তোমার কি মাথা খারাপ! বুড়ো বয়সে আমাদের খাওয়াবে কে? তার ওপর তোমার বোনের বিয়ের জন্যও কিছু রাখতে হবে। কেরানির প্রভিডেন্ট ফান্ড তো বাপু রিজার্ভ ব্যাঙ্ক নয়। সামান্য দশ-পনেরো হাজার টাকা–

লালু বুঝল। বাবাকে সে এখনও ভালোবাসে। যাদের সে ভালোবাসে তাদের বিপন্ন মুখ দেখতে তার ভালো লাগে না।

একদিন সন্ধে পেরিয়ে শানু এসে হাজির। চুপিচুপি ডেকে নিয়ে বলল –লালুদা, কী করি বলো তো?

–কেন, কী হয়েছে?

–শোনোনি নীলু সাফ হয়েছে।

–শুনেছি।

–নতুন ছেলেরা আমাদের আর চাইছে না। নীলুকে রড মেরে লাইনে ফেলে রেখে সরেছে। আমি পালিয়ে আছি।

লালু একটু ভাবল। বলল –শানু, আয় তোতে আমাতে একটা মনোহারি দোকান দিই।

শানু হাসল তিন পয়সায় মাল কিনে পাঁচ পয়সায় বেচে দু-পয়সা লাভ? দূর, ওসব কি আমাদের পোষায়! অন্য কিছু বললো।

লালু কী বলবে ভেবে পেল না। কিন্তু সে দেখতে পাচ্ছিল, শানুর মাথার চুলে পাক ধরেছে, জুলপি বেশ সাদা। যখন দাঁড়ায় তখন একটু কুঁজো দেখায় ওকে। শানুর বয়স বেশি, লালুর চেয়ে অনেক বড়, লালু ওস্তাদ ছিল বলে তাকে দাদা বলে ডাকে।

লালু মাথা নেড়ে বলল –লাইন আমার নয়। কিছু টাকা পেলে আমি দোকান দেব।

 শানু বলে–টাকা পাচ্ছ কোথায়?

এই প্রশ্নটার উত্তর সহজে দিতে পারে না লালু। ভাবে।

শানু বলে–তুমি এখনও ওস্তাদ আছ। চলো, কিছু ক্যাপিটাল জোগাড় করি। পেলে আমিও ব্যাবসাতে নামব, অর্ডার সাপ্লাইয়ের।

বলতে-বলতে শানু তার কোমর থেকে একটা রিভলভার বার করে দেখিয়ে একটু চোখ টিপল।

রিভলভার বিস্তর দেখেছে লালু, নেড়েছেও অনেক। তবু এখন দেখে তার বুক কেঁপে উঠল। বলল –রেখে দে। মিলুটা দেখলে ভয় পাবে।

চোখের পলকে যন্ত্রটা লুকিয়ে শানু বলল –একটা কি দুটো কে করব তার বেশি না। বিশ্বাস কর, ক্যাপিটাল হলেই কেটে পড়ব।

একটা শ্বাস ফেলে লালু বলল –তাই চল তবে।

.

নাগরমল ওয়াগান ভাঙিয়েদের পুরোনো খদ্দের। তার গদিতে রাতবিরেতে মাল পৌঁছোয়। সকাল হতে–না-হতে বড় বাজারে তার পাইকারি আড়তে চলে আসে মাল। নগদ কারবার। স্টেশনের কাছাকাছি তাই তার একটা গদি আছে। সারাদিন ফাঁকা গদিতে একটা বাচ্চা ছেলে বসে মাছি তাড়ায়। ব্যাবসা শুরু হয় রাতে। অনেক রাত পর্যন্ত গদিতে আলো জ্বলে, ভিতরে নাড়াচড়া করে লোকজন। বাইরে অন্ধকারে বাতি নিবিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে দু-তিনটে লরি। ওয়াগন ভাঙিয়েদের দলে আছে বলে নাগরমলের তেমন ভয়ডর নেই। বাঁধা রেট-এর ব্যাবসা, টাকাপয়সা নিয়েও বড় একটা গোলমাল হয় না। আটটা–সাড়ে আটটা নাগাদ গদিতে ক্যাশ পৌঁছে যায়। ক্যাশের জন্য দারোয়ানও থাকে না। এগারোটা–বারোটার মধ্যে টাকা হাত বদল হয়ে যায়।

লালু আর শানু এক রাত্রে হানা দিল গদিতে। শানুর হাতে রিভলভার, লালুর হাতে রড। দুজনেই মুখে কালি মেখেছে, রুমালে বেঁধেছে মুখ। এতকাল পরে এইসব হুজ্জত করতে লালুর খুব ভয় করছিল বলে একটা দিশি মদের পাঁইট ভেঙে খেয়েছে দুজন।

নাগরমল একদম তৈরি ছিল না। লরির ড্রাইভাররা এ সময়টা কাছে পিঠে থাকে না, লরি ভিড়িয়ে মাল টানতে খাল ধারে যায়। গদিতে নাগরমল নিজে আর দুজন নিরীহ কর্মচারী।

এসময়ে ঝাঁপ ঠেলে দুজন ঢুকল। নাগরমল দৃশ্য দেখে হাঁ করে রইল।

রিভলভারটা নেড়ে শানু ক্যাশবাক্সটা দেখাল শুধু মুখে কিছু বলল  না। নাগরমল হাঁ করে বাতাস গিলে ফেলল। তারপর লালুর বুকের সোনার চেনে বাঁধা বাঘনখটা দেখল সে। লালুর বিশাল চেহারাটার সঙ্গে বাঘনখটা মিলিয়ে দেখতেই কয়েক বছর আগেকার লালুকে মনে পড়ে গেল তার। বলল –আরে রাম-রাম লালুবাবু, কী খবর? এসব কী হচ্ছে? যাত্রাপার্টি নাকি।

লালুর বুকটা বড় চমকে ওঠে। চিনে ফেলেছে নাগরমল। এখন আর উপায় কী? হয় এখন তিনটে লাশ ফেলে যেতে হয় নইলে নাগরমলের সঙ্গে একটা বন্দোবস্ত আসা যায়।

এক সময়ে নাগরমলকে লক্ষ টাকার মাল দিয়েছে লালু। সেটা নাগরমল ভোলেনি। বলল –কিছু ক্যাশকড়ি দরকার থাকে বলুন না? আপনার সঙ্গে তো অনেক বিজনেস করেছি। এসব ছিনতাই কি ভালো লালুবাবু? আপনার নামে পাড়া কাঁপত এক সময়ে

তিনটে লাশ ফেলার জন্য ট্রিগারে হাত রেখেছিল শানু। কিন্তু বয়সকালে নানা চিন্তা ভাবনা এসে যায়। বেপরোয়া হওয়া যায় না কিছুতেই। তারা দুজনেই ঘরপোড়া গরু।

লালু হতাশ হয়ে বলল –কিছু ছাড়ো নাগরমল, ব্যাবসা করব।

–কত?

–দু-হাজার করে দুজন।

 –নাগরমল ভাবতে লাগল।

–ভেবো না। সময় নেই। শানু বলল । নাগরমল শ্বাস ফেলে বলল –কাল দেব। বাড়িতে বসে পেয়ে যাবেন। আজকের ক্যাশ গোনা আছে।

–না দিলে কিন্তু—

নাগরমল হাসে-আপনার সঙ্গে বেইমানী? আমার প্রাণের ভয় নেই?

পরদিন নাগরমল নিজেই টাকাটা পৌঁছে দিল। বলল –কাল আমার ড্রাইভার, ক্লিনার আর কর্মচারীরা দেখেছে আপনাদের। তারাই বলেছে ওয়াগন ব্রেকারদের। খুব হইহই হচ্ছে ওদের মধ্যে। একটু দেখবেন দাদা–ওরা ভালো না। নীলুবাবু মরল, শানুবাবু পালাল; আমাকেও ব্যাবসা গুটোতে হবে।

লালু বুঝল। নাগরমল ভবিষ্যতের জন্য সতর্ক হচ্ছে। আর যেন লালু হানা না দেয়।

লালু টাকা নিয়ে বলল –এটা ধার হিসেবে নিলাম নাগরমল। শোধ দেব ব্যাবসা করে।

নাগরমল মুখের একটা ভঙ্গি করে বলল –যা বোঝেন। আপনার সঙ্গে তো অনেক বিজনেস করেছি! আপনি ভালো লোক।

দু-হাজার নিয়ে শানু কাটল। বাকি দুই হাজারে দত্তদের গ্যারাজটা ভাড়া নিয়ে মনোহারি দোকান খুলল লালু। দোকানে তার লজেন্স, বিস্কুট, চানাচুর, বেলুন আর খেলনাই বেশি। পাড়ার বাচ্চারাই তার প্রধান খদ্দের।

লাভালাভের হিসেব রাখতে পারে না লালু। বেচে যায়। পাড়ার লোকে যাতায়াতের পথে লালুর দোকান দেখে থমকে দাঁড়ায় দোকান দিলে নাকি হে?

এক গাল হাসে লালু–দিলাম। আমাকে একটু দেখবেন, কাকা।

বেবি ফুড কোথাও পাই না, এনে দেবে নাকি। ব্ল্যাকের দামই না হয় দেব।

–দেখব।

লালু এইরকমভাবে ব্যাবসা শুরু করল। মাল বেশি রাখে না, কিন্তু দুষ্প্রাপ্য জিনিস ঠিক এনে দেয়। ব্ল্যাকের দাম নেয়। খুব আস্তে-আস্তে সে টাকাপয়সার হিসাব বুঝতে শুরু করল। এখন বাচ্চারা দশ পয়সার চানাচুর চাইলে ঠোঙা ভরতি করে দেয় না। ছোট মাপের ঠোঙা বের করে। ফাউ দেয় না। পয়সা গোনে। মাসের শেষে স্টক মেলায়। পাড়ার মধ্যে পান–সিগারেটের একটা মাত্র দোকান, তার মালিক মদনা, কিন্তু মদনার ব্যবহার ভালো না, একটা মাত্র দোকান বলে দোকানটা চলে ভালো। দেখেশুনে লালু সিগারেটের একটা কাউন্টার খুলল, মুদির দোকানের সওদা রাখল কিছু কিছু, অনেক কষ্টে বের করল বেবি ফুডের লাইসেন্স। ফলে দত্তদের গ্যারাজ ঘরে তার দোকানটা হুহু করে চলতে থাকে। মাসে শ–তিনেক টাকা আয়।

মিলু এখন ইস্কুলে যায়। বাবা রিটায়ার করে বসে আছেন। বাইরের দিকের বারান্দায় পাতা ইজিচেয়ারে বসে সারাদিন খবরের কাগজটা উলটেপালটে পড়েন। মায়ের চোখে ছানি আসছে।

তবু মা সারাদিন ঘরের কাজ নিয়ে ব্যস্ত। লালু মাঝে-মাঝে বলে,–মা, তোমাকে একজন রান্নার লোক দেখে দিই।

মা হাসে, বলে রান্নার জন্যে পাকা লোক চাই। স্বঘর, ভিন্ন গোত্রের একটা মেয়ে। এনে দে দেখি।

লালু বড় লজ্জা পায়। গলার বাঘনখটা মুখে পুরে ভাবে।

পাড়ার গিন্নিবান্নিরা আগে লালুর দোকানে আসত না। তারা সভয়ে বলত বাব্বাঃ, লালু গুন্ডার দোকান? ওখানে মেয়েমানুষ যায় কখনও? কিন্তু ধীরে-ধীরে তাদের মত পালটায়। এখন পাড়ার বউ–ঝিরা আসে, আসে প্রৌঢ়ারা। লালু সবাইকে দিদি, মা, মাসি বলে ডেকে খুব খাতির করে।

সবচেয়ে বেশি ঝামেলা চাটুজ্জে খুড়িকে নিয়ে। লালুকে তার আফিং এনে দিতে হয়। আফিং নিতে এসে চাটুজ্জে খুড়ি পাড়া জানান দিয়ে চেঁচামেচি শুরু করে বিয়ে করছিস না কেন? তোর বাপ-দাদা বিয়ে করেছে, সংসারসুদ্ধ লোক করছে, তুই করবি না কেন? ত্রিশ বছর বয়স হল না। তোর! এরপর কি পাকা চুলে টোপর পবি? বিয়ে না করলে বুড়ো বয়সে পাগলামিতে ধরে, জানিস না?

–বিয়ে করব খুড়িমা, সময় পাচ্ছি কোথায়? একটু স্থিতু হয়েনি।

–হ্যাঁ, ঢেউ সরে গেলে ডুব দিবি। বয়সকালটা মামদোবাজিতে কাটালি, এখন বুদ্ধিশুদ্ধি একটু হয়েছে–এইবারে কোথায় পাকাঁপাকি বন্দোবস্ত করে বসবি তা নয়, কেবল উড়বার মতলব। বউ না থাকলে মামদোদের খপ্পরে পড়বি কবে।

ভারী বিব্রত হয়ে সে তাড়াতাড়ি বলে–করব শিগগিরই করে ফেলব বিয়ে। আর ক’টা বছর –মিলুটার একটা বিয়ে দিয়েনি–

–ও মা, ও তো গুয়ের গ্যাংলা মেয়ে–ওর বিয়ে হতে-হতে তোর বয়স বসে থাকবে? পুলিপিঠের ন্যাজ বেরুবার আশায় বসে থাক। তবে–

কিন্তু সময় বাস্তবিক বসে থাকে না। মিলু স্কুল ডিঙিয়ে কলেজে ঢুকল, দেখতে-না-দেখতে ধাঁ করে বড় হয়ে গেল। চোখে চশমা, শাড়ি পরা মিলু দোকানের সামনে দিয়ে কলেজে যায়। বিক্রিবাটার ব্যস্ততার মধ্যেও চোখ তুলে লালু এক-এক সময়ে দেখে মিলুকে। লালুর বোনটা ফরসা আর ছিপছিপে হয়েছে। চেহারায় অমিল, কিন্তু বড় ভাব দুজনে। দাদার ওই বিশাল শরীরটা যে খাটাখাটনিতে রোগা হয়ে যাচ্ছে তা একমাত্র মিলুই লক্ষ্য করে। গম্ভীর মুখে শাসন করে দাদাকে।

লালু ভাবে–এইবার মিলুর একটা বিয়ে দিতে হবে।

২.

পাঁচবছর পর।

এখন একা ঘরে লালুর বাস। শরীরটা তেমনি আছে তার। কেবল পেটে চর্বি জমেছে একটু, মাথার চুল কয়েকটা পেকেছে। ছত্রিশে পা দিল সে। চোখে চশমা। মিলুর বিয়ের পরপরই। প্রথমে বাবা গেল এক সকালে। সামনের বারান্দায় বসে ইজিচেয়ারে খবরের কাগজ মুখে ঘুমিয়ে পড়েছিল, আর উঠল না। দু-বছর পর মা। ফাঁকা ঘরে একা থাকে লালু। ভালো লাগে না। দিন। কেটে যায়।

লালু এখন পাড়ার ভালো লোক। লোকে বাকিতে জিনিস পায়, প্রশংসা করে। দোকানটা বিলেত বাকি পড়ে ঝাঁঝরা হয়ে আসছে। লালুর তাতে কিছু যায় আসে না। সে একা। চলে যাবে।

বিকেলের ডাকে মিলুর একটা চিঠি পেল লালু। তাতে লেখা–একবার এসো। খুব জরুরি দরকার।

বুকটা কেঁপে উঠল। মিলু বিয়েটা ভালো করেনি। নিজের পছন্দমতো বর বেছেছিল। ছেলেটা চোখা, চালু। কিন্তু মিলুর সঙ্গে মানায় না। গোত্র কিংবা ঘর ঠিকই ছিল তবু ছেলেটা বড় বেশি। চালু। বহু মেয়েকে বাঁদর নাচ নাচিয়েছে। বিলাসকে তাই পছন্দ হয় না লালুর। কিন্তু মিলুর বর বলে সমীহ করে চলে। সবসময়ে তার বুকের ভিতর খাঁখাঁ করে–মিলুকে নিয়ে থাকবে তো বিলাস? অন্য দিকে ঝুঁকবে না তো?

দোকানের সামনে একটা টুল পেতে শানু বসে থাকে আজকাল। পঞ্চাশ প্রায় ছুঁল সে। তার অর্ডার সাপ্লাইয়ের ব্যাবসাটা জমেনি। জোড়াতাড়া দিয়ে চালিয়ে নিচ্ছে। বয়সের জন্য নয় চিন্তার ভারেই কুঁজো হয়ে গেছে একটু। বয়সের তুলনায় বেশ বুড়ো দেখায়। লালুর সঙ্গে বসে দুরন্ত যৌবনকালের নানা গল্প করে। মাঝে-মাঝে বলে–এসব ঝিমোনো ব্যাবসা কি আমাদের লাইন? চল লালুদা আর-একবার হুজ্জত বাধাই, লুটেপুটে আনি। শেষজীবনটা সুখে কাটিয়ে দিই চলো। আমাদের আমলে এমন সোনার দিন আর আসেনি।

লালু হাসে। চুপ করে থাকে।

চিঠি যেদিন পেল সেদিনও শানু বসে আছে বাইরের টুলে। চিঠিটা ভাঁজ করে বুকপকেটে রেখে লালু উঠল, শানুকে বলল –দোকানটা একটু দেখিস শানু, আমি ঘুরে আসছি।

–চললে কোথায়?

–মিলুটা চিঠি দিয়েছে, কী আবার গোলমাল ওদের। শানু উদাস গলায় বলে–ওসব ছেড়ে দাও, লালুদা, যে যার মতো চলুক। সংসারের কোনও জ্ঞানই তো তোমার নেই।

–তা ঠিক। কিন্তু শানু সারা পৃথিবীতে ওই আমার একটা আপনজন।

শানু ভাবে। ভেবে বলে–সেটা সত্যি। ঠিক আছে। যাও।

.

বাইরের ঘরে উদাস শুকনো মুখে মিলু বসে আছে। তার হাঁটুর কাছে দু-বছরের বাচ্চা মেয়ে জুলেখা। লালুকে দেখে হরিণীর মতো সচকিত তাকাল মিলু।

–কী হয়েছে মিলু।

মিলু ঠোঁটে আঙুল  ছুঁইয়ে সতর্ক করে দিল, ইঙ্গিতে শোওয়ার ঘর দেখিয়ে বলল –ও আছে।

হাত ধরে বারান্দায় নিয়ে এল লালুকে। পায়ে-পায়ে ঘুরছে ছোট্ট জুলেখা। তাকে কোলে নিয়ে গায়ের শিশুগন্ধ বুক ভরে নেয় লালু। তার শৈশব ফিরে আসতে থাকে।

–কী হয়েছে?

–সেই একই ব্যাপার। আমাকে ওর পছন্দ নয়। পরশু রাতে মেরেছে।

–মেরেছে?

–হ্যাঁ। এই প্রথম। কিন্তু এখন মারটা চলবে। হাত এসে গেছে।

রাগে বোবা হয়ে গেল লালু, কষ্টে বলল –মিলু তোকে কেউ কখনও মারেনি।

মিলুর ঠোঁট কাঁপতে থাকে। চোখ ভরে জলে আসে।

–খুব লেগেছিল?

মিলু মাথা নাড়ে। লেগেছিল।

–ও কী চায়?

–কী জানি। বলে মিলু কাঁদতে থাকে।

–ও, তোকে চায় না।

–না।

–তবে আমার কাছে চল মিলু। বেশ থাকব ভাইবোনে।

–না। মাথা নাড়ে মিলু।

–তবে কী করবি?

–সেজন্যই তো তোমাকে ডেকেছি। কী করব বলো?

লালু, একটা শ্বাস ছাড়ে। বলে–ওর সঙ্গে একটু কথা বলি।

জুলেখাকে নামিয়ে দিয়ে লালু ঘরে আসে।

বিলাস বিছানায় শুয়ে আছে। ভারী ক্লান্ত আর রোগা দেখাচ্ছে তাকে। বিমর্ষ মুখ।

–বিলাস।

–উঁ!

–কী হয়েছে?

–বিলাস চোখে চায়। আস্তে করে বলে–ওকে জিজ্ঞাসা করুন।

–করেছি। তুমি ওকে মেরেছ। কেন?

বিলাস ঠোঁট উলটে বলে–ইচ্ছে।

–কেন মারবে? ওকে কেউ কখনও মারেনি।

–আমি মেরেছি। আমার ইচ্ছে। কার বাবার কী?

লালু ধমকায়। সমস্ত শরীর থরথর করে কাঁপে।

–তার মানে?

বিলাস উঠে বসে, একটা সিগারেট ধরায়। তারপর আস্তে-আস্তে বলে, শোধ নেবেন? নিন না! কিন্তু বলে রাখছি, ও আবার মার খাবে।

–না খাবে না।

–খাবে। কোনও শুয়োরের বাচ্চা ঠেকাতে পারবে না-

পলকে সব ভুল হয়ে যায়। ছত্রিশ বছর বয়স, চোখের চশমা–সব ভুল হয়ে যায়। পনেরো যোলো বছর আগেকার এক জ্যোৎস্নায় আলোকিত নির্জন চাতাল মনে পড়ে কেবল। আর শরীরের মধ্যে ঝড় ওঠে বহুকাল বাদে।

প্রকাণ্ড হাতখানা বাড়িয়ে বিলাসকে শূন্যে তুলে নেয় লালু। অন্য হাত আঘাতের জন্য উদ্যত।

মিলু ছুটে আসে, চিৎকার করে বলে–দাদা, মেরো না। মরে যাবে।

হকচকিয়ে যায় লালু। ঠিক তো! এইভাবে একদিন ননী গিয়েছিল তার হাতে। তারপরও পটা ওস্তাদের কাছে শেখা মার। কাজটা ঠিক হবে না। শিশুর মতো দু-হাতে ধরে বিলাসকে আবার মেঝের ওপর ছেড়ে দেয় লালু।

কিন্তু বিলাস ছাড়ে না। পয়সা জমানোর একটা মাটির ঘট রাখা আছে তাকে। বিলাস প্রথমে পাগলের মতো সেইটে  ছুঁড়ে মারে।

ভারী ঘটটা মাথায় লেগে চৌচির হয়ে ভেঙে যায়। লালুর সমস্ত শরীর বেয়ে পয়সার ধারা নেমে ঘরময় ছড়ানো থাকে। ক্ষীণ একটা রক্তের ধারা সেই সঙ্গে। বিলাস  ছুঁড়ে মারে জুলেখার খেলনা, কালির দোয়াত, পেপারওয়েট। তাতে খুশি হয় না। দু-হাতে ঘুষি মারে লালুর মুখে, পেটে মারে লাথি। বিলাসের বাবার একটা ভারী বাঁধানো ফটোগ্রাফ ছিল দেওয়ালে। রাগে পাগল হয়ে সেইটে টেনে আনে সে। কানা দিয়ে উপর্যুপরি মারতে থাকে মাথায় মুখে।  কাঁচ ভেঙে ঢুকে যায় লালুর চামড়ায়।

লালু ধীরে-ধীরে মেঝেতে বসে। তারপর দেওয়ালে হেলান দিয়ে চোখ বোজে। একটাও মার ঠেকাবার চেষ্টা করে না। জুলেখা চিৎকার করে কাঁদতে থাকে, মিলু চিৎকার করে দুজনের মাঝখানে এসে পড়ে, বিলাস তাকে হাতের  ঝাঁপটায় সরিয়ে দিয়ে পাগলের মতো আবার আক্রমণ করে লালুকে।

তারপর এক সময়ে সে থামে। চারদিকে চেয়ে দেখে। তার চোখে আতঙ্ক দেখা যায়। সে লালুর রক্তাভ বীভৎস নিস্পন্দ দেহখানা দেখে। হঠাৎ সংবিৎ পেয়ে কেঁপে ওঠে। দৌড়ে আলনা থেকে প্যান্ট টেনে নিয়ে পরে, গায়ে শার্ট চাপায়, খুব তাড়াতাড়ি ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়ে সে।

সদর দরজার কাছে গিয়ে হঠাৎ থমকে দাঁড়িয়ে ভিতরের ঘরের দিকে চেয়ে বলে–মিলু, মিলু আমাকে ক্ষমা কোরো–লক্ষ্মী সোনা আমার–

দাদাকে দু-হাতে জাপটে বসেছিল মিলু। পাথর হয়ে। তবু বিলাসের কথা তার কানে গেল। হরিণীর মতো সচকিত হয়ে উঠল সে। বিলাস–বিলাস কি তবে ভালোবাসে তাকে? এখনও? চকিতে বিদ্যুৎস্পর্শে উঠে দাঁড়ায় সে। ছুটে আসে দরজায়।

বিলাস সিঁড়ি দিয়ে কত দ্রুত নেমে যাচ্ছে। পালাচ্ছে।

শোনো, শোনো। ডাকে মিলু।

বিলাস তার ভয়ার্ত সুন্দর মুখখানা ঘুরিয়ে থমকে দাঁড়ায়।

দরজার চৌকাঠে হাত রেখে মিলু কাঁপতে থাকে, কাঁদে অস্ফুট গলায় বলে–তুমি কি এখনও আমাকে ভালোবাসো?

বিলাস দু-ধাপ সিঁড়ি উঠে আসে বলে,বাসি মিলু, চিরকাল বেসেছি। তুমি বোঝো না?

মিলু আস্তে করে বলে–তোমায় ভয় নেই, দাদা মরেনি। তুমি তাড়াতাড়ি ফিরো।

বিলাস অবিশ্বাসের চোখে খানিকক্ষণ চেয়ে থাকে। তারপর মাথা নাড়ে। ধীরে-ধীরে সিঁড়ি ভেঙে নেমে যায়।

ভাঙা  কাঁচ আকীর্ণ মেঝের ওপর শিশু জুলেখা দাঁড়িয়ে। তার চোখে জল, সে কাঁদছে। এক-পা এক-পা করে এগোচ্ছে লালুর দিকে।

ভাঙা, রক্তাক্ত মুখ তুলে লালু জুলেখাকে দেখল।

–আঃ জুলেখা, চারদিকে  কাঁচ মা, তোমার পা কেটে যাবে।

সে ফিসফিস করে বলল ।

জুলেখা তবু ভাঙা  কাঁচ মাড়িয়ে এক-পা এক-পা করে আসছে।

চোখের রক্ত মুছে নেয় লালু। তারপর দু-হাত বাড়িয়ে কোলে নেয় জুলেখাকে। শিশুগন্ধে তার বুক ভরে যায়।

–আঃ জুলেখা আমার তেমন লাগেনি মা। আমি ঘোড়া হই, তুমি আমার পিঠে চাপো। লালু শিশু হয়ে থাকে। লালু শিশু হয়ে যায়। ভাঙা মুখ, রক্তাক্ত শরীর, মাথার ভিতরে এক আংশিক অন্ধকার-তবু নিজেকে নিরভিমান লাগে তার। রাগদ্বেষহীন প্রকাণ্ড শিশুর মতো সে জুলেখাকে ভোলাতে থাকে। জুলেখাকে পিঠে নিয়ে আকীর্ণ  কাঁচ খণ্ড পয়সা রক্তের ফোঁটার ওপর সে হামা দিয়ে ফেরে সারা ঘর। মুখে তার অনাবিল হাসি।

দরজায় দাঁড়িয়ে দৃশ্যটা হাঁ করে দেখে মিলু।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *