দে মা আমায় দেউলে করে
মা দুর্গা আসব-আসব করলেই পালাতে ইচ্ছে করে। হই, হল্লা, শব্দ, গুলতানি, ছ্যাঁচড়ামি, চ্যাংড়ামি, সব সহ্য হয়ে গেছে। বাঙালি হয়ে জন্মেছি, এসব তো সহ্য করতে হবেই। আমাদের ট্রাডিশান। আমাদের কালেই এমনটি হচ্ছে ভাবলে, ইতিহাস-বিমুখতা হবে। হুতোম কী লিখছেন দেখা যাক, ”বারো জনে একত্র হয়ে কালী বা অন্য দেবতার পূজা করার প্রথা মরক হতেই সৃষ্টি হয়—ক্রমে সেই অবধি ‘মা’ ভক্তি ও শ্রদ্ধার অনুরোধে ইয়ারদলে গিয়ে পড়েন।” বারোইয়ারি পুজোর অধ্যক্ষের কাজটা কী! চাঁদা আদায় করা, চাঁদার জন্য ঘোরা ও বারোইয়ারি সং ও রং তামাশার বন্দোবস্ত করাই তাঁর ভার হয়?’ চাঁদা আদায়ের ধরনটা কেমন ছিল? ‘কলকেতার বারোইয়ারি চাঁদা সাদারা প্রায় দ্বিতীয় অষ্টমের পেয়াদা ছিলেন।’ অষ্টম মানে, লর্ড কর্নওয়ালিসের অষ্টম আইন। জমির খাজনা আদায়ের সুবিধার জন্যে ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত’, পার্মানেন্ট সেটলমেন্ট।’ সরকার খাজনা সরাসরি আদায় করবেন না। খাজনা আসবে জমিদারের মাধ্যমে। জমিদাররা তাঁদের জমিদারি পত্তনি দিয়ে খাজনা আদায়ের ভার দিলেন পত্তনিদারের ওপর। পত্তনিদার আবার তার অধস্তন কয়েকটি শ্রেণি তৈরি করল, এইভাবে প্রকৃত প্রজা ও জমিদারের মধ্যে বেশ কয়েকটি মধ্যস্বত্বভোগী শ্রেণির উদ্ভব হল। প্রজাশোষণ ও অত্যাচারের মাত্রা তুঙ্গে চড়ল। অষ্টম আইন অনুসারে খাজনা উশুল করতে আসা পেয়াদারা ছিল, যেমন নির্মম, তেমনি নির্দয়। হুতোম সেই তুলনাই দিচ্ছেন, চাঁদা আদায়কারীরা দ্বিতীয় ‘অষ্টমের পেয়াদা’। ‘ব্রমত্তের জমির খাজনা সাদার মতো লোকের উনোনে পা দিয়ে টাকা আদায় কত্তেন—অনেকে চোটের কথা কয়ে বড় মানুষদের তুষ্ট করে টাকা আদায় কত্তেন।’ উনোনে পা মানে, হয় চাঁদা দাও নয় স্বর্গে যাও। ভিটে ছাড়া করে ছাড়বে! চোটের কথায় তুষ্ট করার নমুনাটি বড় মজার! একটি ঘটনার কথা হুতোম লিখেছেন—”আর একবার একদল বারোইয়ারি পুজোর অধ্যক্ষ শহরের সিংগি বাবুদের বাড়ি গিয়ে উপস্থিত, সিংগিবাবু সে সময় অফিসে বেরুচ্ছিলেন, অধ্যক্ষরা চার পাঁচজনে তাঁহাকে ঘিরে ধরে ‘ধরেছি’ ‘ধরেছি’ বলে চেঁচাতে লাগলেন। রাস্তার লোক জমে গ্যালো—সিংগিবাবু অবাক—ব্যাপারখানা কি? তখন একজন অধ্যক্ষ বললেন, ‘মহাশয়! আমাদের অমুক জায়গায় বারোইয়ারি পূজোয় মা ভগবতী সিংগির উপর চড়ে কৈলাশ থেকে আসছিলেন, পথে সিংগির পা ভেঙে গেছে; সুতরাং তিনি আর আসতে পার্চ্চেন না, সেইখানে রয়েছেন; আমাদের স্বপ্ন দিয়েছেন, যে যদি আর কোনো সিংগির যোগাড় কত্তে পার, তা হলেই আমি যেতে পারি। কিন্তু মহাশয়! আমরা আজ একমাস নানা স্থানে ঘুরে বেড়াচ্চি; কোথাও আর সিংগির দেখা পেলাম না; আজ ভাগ্যক্রমে আপনার দেখা পেয়েচি, কোন মতে ছেড়ে দোব না, চলুন! যাতে মার আসা হয়, তাই তদবির করবেন।’ সিংগিবাবু অধ্যক্ষদের কথা শুনে সন্তুষ্ট হয়ে বারোইয়ারি চাঁদায় বিলক্ষণ দশ টাকা সাহায্য কল্লেন।”
মা আসবেন সিংহবাহিনী হয়ে, বারোইয়ারি সাধকরা আমাদের কাছে চাঁদা সাধতে বেরোবেন, আমরাও বিলক্ষণ দশ টাকা দেব, তবেই তো বাঙালির এত বড় জাতীয় উৎসব বিলক্ষণ জমবে, এতে আতঙ্কের কী কারণ থাকতে পারে! আমাদের জীবনে দান-ধ্যান কোথায়? আত্মকেন্দ্রিক জীবন। দেশের জন্যে, দশের জন্যে নয়, পরিবারের জন্যে, পারিবারিক ভোগ ও দুর্ভোগের জন্যে উৎসর্গীকৃত। ছেলের এডুকেশান, পরিবারের অপারেশান, হৃদয়ের বাইপাস, যেন ইস্টার্ন বাইপাস, গলগল টাকার স্রোত। বাইপাসের দু’ধারে টাকা গলাবার বিলক্ষণ কিছু ব্যবস্থাও হয়েছে। কিন্তু চাঁদায় বাঙালির অ্যালার্জি। থানা পুলিশ, ধস্তাধস্তি। সতেরো বার ঘুরিয়ে ময়লা একটা পাঁচ টাকার নোট। নাসিকা রোদন—আর ভাই! যা দিনকাল! গঙ্গার ইলিশ, একশো আশি। অ্যান্টিবায়োটিক প্রায় অ্যান্টিসোস্যাল, এক ক্যাপসুল ছেচল্লিশ। হুতোম যে কৃপণের উল্লেখ করেছেন, আমরা সেই জাতে পড়ি না। আমারা নিজের জন্যে ব্যয়ে অকুণ্ঠ, সামাজিক কারণে ব্যয়ে অতিশয় কুণ্ঠ, আবার দেব-দেবীর চেয়ে আমরা ইদানীং গুরুকেই বড় বলে জ্ঞান করি। হুতোমে আছে বারোইয়ারি চাঁদা সাধকরা এক আদর্শ কৃপণের কাছে চাঁদা আদায়ে গেছেন। তিনি কেমন, তাঁর একচক্ষু কানা। ”বাবু বড়ই কৃপণ ছিলেন, বাবার পরিবারকে (অর্থাৎ মাকে) ভাত দিতেও কষ্ট বোধ কত্তেন, তামাক খাবার পাতের শুক্ল নলগুলি জমিয়ে রাখতেন, এক বৎসরের হলে ধোবাকে বিক্রি করতেন, তাতেই পরিবারের কাপড় কাচার দাম উসুল হত। (কৃপণবাবুর বৈঠকখানায় একটি মাত্র হুঁকো। যে হুঁকোয় নিম্নবর্ণের মানুষ তামাক খাবেন, সে হুঁকো উচ্চবর্ণের মানুষ ব্যবহার করবেন না। তাহলে উপায়? যে খাবে সে নিজের জন্যে কলাপাতার একটা নল বানিয়ে নিত। একালের সরবত খাওয়ার স্ট্র-র মতো। খাওয়া হয়ে গেলে নলটা বাবুর কাছে গচ্ছিত করে দিত। এক বছরের সঞ্চয়বাবু ধোপাকে দিতেন। ধোপা সেই কলাপাতা পুড়িয়ে যে ক্ষার তৈরি করত, তাইতেই বাবুর পরিবারের সারা বছরের কাপড় কাচা হয়ে যেত। বাড়তি পয়সা খরচ হত না।) বারোইয়ারি অধ্যক্ষেরা বাবুর কাছে চাঁদার বই ধল্লে’ তিনি বড়ই রেগে উঠলেন ও কোনমতে বারোইয়ারিতে একপয়সাও বেজায় খরচ করতে রাজি হলেন না। বারোইয়ারি অধ্যক্ষেরা অনেকক্ষণ ঠাউরে-ঠাউরে দেখলেন, কিন্তু বাবুর বেজায় খরচের কিছুই নিদর্শন পেলেন না—তামাম গুলি পাকিয়ে কোম্পানির কাগজের সঙ্গে বাক্সমধ্যে রাখা হয়—বালিসের ওয়াড়, ছেলেদের পোশাক বাবু অবকাশ মত স্বহস্তেই সেলাই করেন—-চাকরদের কাছে [বৃদ্ধ একজন মাত্র] তামাকের গুল, মুড়ো খেংরার দিনে দুবার নিকেশ নেওয়া হয়—ধুতি পুরোনো হলে বদল দিয়ে বাসন কিনে থাকেন। বাবুর ত্রিশ লক্ষ টাকার কোম্পানির কাগজ ছিল, এ সওয়ায় [এ ছাড়া] তার সুদ ও চোটায় বিলক্ষণ দশ টাকা আসত, কিন্তু তার এক পয়সা খরচ কত্তেন না। ( পৈতৃক পেশা) খাটি টাকায় মাকু চালিয়ে যা রোজগার কত্তেন, তাতেই সংসার নির্বাহ হত। কেবল বাজে খরচের মধ্যে একটা চক্ষু, কিন্তু চশমায় দুখানি পরকোলা বসান; তাই দেখে বারোইয়ারির অধ্যক্ষেরা ধরে বসলেন, ‘মশাই! আপনার বাজে খরচ ধরা পড়েছে, হয় চশমাখানির একখানি পরকোলা খুলে ফেলুন, নয় আমাদের কিছু দিন।’ বাবু এ কথায় খুশি হলেন, শেষে অনেক কষ্টে দুটি সিকি পর্যন্ত দিতে সম্মত হয়েছিলেন।”
একালের চাঁদা সবিকরা স্বভাব জানেন আমাদের, সেই কারণে নানা পদ্ধতিতে ‘ডুস’ দেওয়ার ব্যবস্থা রেখেছেন। প্রথমে ‘নর্মালি’ হয় কি না দেখেন, না হলে ইসবগুল, ম্যাগসালফ, গ্লিসারিন সাপোজিটারি, সব শেষে গুঁতো। চাঁদা বেরোবেই। না হলে কোটি টাকার ফেস্টিভ্যাল বছর-বছর হয় কী করে।’ ‘আচাভো’ ‘বোম্বাচাক’। পুজোর এই দুটি অনুষঙ্গের কথা হুতোম বলেছেন। আচাভুয়া মানে অসম্ভব, বোম্বাচাক মানে, ভম্বচক্র, অর্থাৎ ধোঁয়া, কিম্ভূতকিমাকার। সং-এর নৃত্য। চাঁদা, চিৎকার, অপমান, নির্যাতন। হাইওয়ে অবরোধ করে লরি ও যান আটক করে মহল্লার মস্তানি আমরা মেনে নিয়েছি। পুলিশি ব্যবস্থার প্রতিশ্রুতি, দমন ব্যবস্থার লগুড় নয়, প্যাঁকাটি। শত-শত সন্তানের শত অপকর্ম পুলিশমাতা সামলাবেন কী করে! মা ভগবতী পর্যন্ত এলে দিয়েছেন। ভুল মন্ত্রে মায়ের পদদলিত অসুর, পদপ্রহরণ উপেক্ষা করে ছিটকে বেরিয়ে এসে র্যাপের তালে-তালে নাচছে—হাতি ঘোড়া গেল তল, মশা বলে, দেখি কত জল! অসুর মায়ের প্রেমে পড়েছিলেন, সেই প্রেমই হিন্দি ফিলমি মিউজিকে আছড়ে পড়ছে—আই লাভ ইউ, ইলু, ইলু গডেস দুর্গা। জোর থাকলে বিলাইতি, কম জোরে দিশি, মার কাটারি বোম্বাচাক।
পশ্চিমবাংলার অন্য অনেক কিছুর সঙ্গে এটাকে আমরা মেনে নিয়েছি, সমুদ্রে পেতেছি শয্যা, শিশিরে কী ভয়! ভয় অন্য এক জায়গায়, সেটা স্বখ্যাত! স্বখাত সলিলে ডুবে মরি শ্যামা। হ্যান্ড পাম্পে জল তোলার জন্যে প্রথমেই মাথায় একটু জল ঢেলে দিলে, বেশি হ্যাচ্যাং হ্যাচ্যাং করতে হয় না। সামান্য চাপেই ভলক-ভলক জল। সংসারে প্রবেশের পর যথাকালে একটি সন্তানের আগমন। যেকালে সে পোশাক পরার অবস্থায় এল, শুভাকাঙ্ক্ষী সাত আত্মীয় পুজোর সময় সাত সেট জামা দিয়ে আল্হাদ করে গেলেন। অর্থাৎ টিউবওয়েলের মুখে জল ঢেলে গেলেন। পরের বছর পুজোয় খেলাটা জমে গেল। সাত আত্মীয়ের মাথায় মোট একুশটি বাচ্চা। সেই প্রথম আবিষ্কার করলুম, ছেলেদের চেয়ে মেয়েরা, ‘কস্টলি’। একটা ফ্রকের টাকায় তিনটে টিশার্ট তো হবেই। ওরা দিয়েছে আমরা যদি না দি, তাহলে খুব খারাপ দেখায়। এবারেও তো আসবে! আত্মীয়-স্বজনের ব্যাপার! কথা হবে, সমালোচনা হবে! সার্কিটে শর্ট সার্কিট। কেলো টু দি পাওয়ার ইনফিনিটি। নাও, মাল নামাও। বোনাস, মাসের মাইনে। ভাঙো লক্ষ্মী প্যাঁচা। বড়ই ছোট হাল। এ হালে পানি পাওয়া যাবে না। বাচ্চাতেই তো শেষ নয়! বড়রাও আছেন। দেবী দশভুজা, দশপ্রহরণ ধারিণী। পেটি বা পাতি মধ্যবিত্তের মাত্র দুটি হাত! ফিকসড ডিপোজিট ভেঙে ফেলো, ইনসিওরেন্স পলিসি জমা দিয়ে লোন নাও। ইয়ে হ্যায় ইজ্জত কি সওয়াল। তোমায় সাজাব যতনে কুসুম রতনে।
হরি সা মার্কেটে লটে মাল কেনো, পড়তায় পোষাবে। অসম্ভব! যাঁদের দিতে হবে তাঁরা উন্নাসিক। পয়সার কদমফুল। পারচেজের কোনও বাজেট নেই। যেখানে গিয়ে শেষ হবে, সেইটাই বাজেট। ডজন, ডজন চান্দেরি, বালুচরি, কাঞ্জিভরম, ব্যাঙ্গালোর সিল্ক, টাঙ্গাইল, তাঁদের কাছে কিছুই নয়। বড় দোকান তো হাটের মালই টিকিট মেরে, মারহাববা বাকসোয় পুরে তিন ডবল দাম হাঁকে। সে তো বুঝলাম! আমি মালে মারার টিকিটই বা পাই কোথায়, বাকসোই বা দেয় কে! হাতিবাগান, কলেজ স্ট্রিটেও একই সমস্যা। কোয়ালিটি হয়তো একই, কালচারটা আলাদা। ভাত একই কিন্তু খাওয়ার ধরনে জাত পালটায়—মেঝেতে, টেবিলে, আবার টেবিলেরও জাত আছে, পাত্রও বিভিন্ন, প্লেটে র তলায় মার কাটারি টেবিল ম্যাট। ভাত ক্রমশ জাতে উঠছে। সব মানুষই এক মানুষ, হাড় মাংসের খাঁচা, জন্মায়, মরে। রাজার পোশাকে সিংহাসনে রাজা, ছেঁড়া ট্যানায় ভিখারি। বস্তু বস্তুই, ড্রেসিং-এর কেরামতিতে জাত, বেজাত। একজন বললে, অসম আত্মীয়তায় এই অবস্থাই হয়। সমানে সমানে যে সোস্যালিজম তার বাইরে গেলেই ইউ এস এস আর। কেমন করে বোঝাই, সবাই তো শুরু করেছিলুম একভাবে, আমি যেখানে ছিলুম সেইখানেই পড়ে আছি, বাকি সবাই চড়চড় করে ওপরে উঠে গেল। কেউ হয়ে গেল প্রাোমোটার, কেউ ট্রেড ইউনিয়ান লিডার, কেউ কাউন্সিলার, কেউ টিউটোরিয়াল হোমের অমুকদাদা, কেউ ইনভেস্টমেন্ট ম্যাগনেট, একজন আবার রাজ-জ্যোতিষী! তাদের ছাতে মার্বেল, বাথরুমে দোলনা কমোড। গলায় সাতপাট মাফলার মেরে তিন কুলার সাঁটা ঘরে ঘুমোয়। সকালে সাত তুলসী মধু খায়। মুখে সদাসর্বদা কাবাব চিনি। গাড়ি চেপে চেপে সব নাড়ু গোপাল। হাতে একটি লাড্ডু ধরিয়ে দিলেই হয়।
কলকাতায় এখন গড়িয়া কালচার। স্বপাক আহারের মতো রমণীরা এখন নড়বড়ে, ওয়ান পাইস ফাদার মাদার, অধৈর্য পুরুষদের সাথসঙ্গ তো আর চান না, নিজেরাই ফিল্ডে নেমে পড়েন। কেনাকাটা বলি বটে, ব্যাপারটা তেমন সহজ নয়। কিনেই কেটে পড়ব তা নয়। ঘুরেঘুরে, ঘোরাঘুরি, দরাদরি করে একটা হল, তখনও আরও দশটে বাকি। দোকানের কর্মচারীরা যেন হিউম্যান রোবট। সিলিং-এর মাথায় দুজন। গুমোট গরমে কাঁচা কলা সেদ্ধ। ধুম করে লট নামছে, আবার লোফা যাত্রায় টং-এ চড়ছে। ওঠ বোস, বোস ওঠ, যেন জিমনাসিয়াম। মালিকের মুখে পেপার-কাট হাসি। পাঞ্জাবির বুক খোলা, বোতামের চেকনাই, গলায় পাওয়ারফুল লকেট। আসুন দিদি, দেখুন দিদি। চারে ভিড়লে স্ট্র গোঁজা মুখ খোলা বোতল। উপহারের নানা ব্যবস্থা, দোকানের নাম লেখা চটের ব্যাগ, পাঁচ সিকে দামের ডট পেন। পরিতৃপ্ত রাজহংসীর মতো হেলে-দুলে বাড়ি ফেরা। সব খুইয়ে এত তৃপ্তি একমাত্র বঙ্গবালারাই পেয়ে থাকেন। এরই নাম, ত্যাগের আনন্দ। এইটাই তো আধ্যাত্মিকতা—’আমার যা আছে আমি সকল দিতে পারিনি তোমারে নাথ—।’ একদা সাহেবি নিউ মার্কেট হল, বিচরণ ভূমি। হাল কেতা বোঝা সহজ নয়। টেকনিকও আলাদা। লজ্জা, ঘৃণা, ভয় তিন থাকতে নয়। দু:সাহসী দরাদরি। যা দাম বলবেন, প্রথমেই তাকে হাফ করে, ইঞ্চি-ইঞ্চি বাড়ো। পাঁচ দাগের বেশি কদাচ নয়। সাপে নেউলে খেলা। ওই হাফাহাফিতেও মাত্রাতিরিক্ত লাভ থাকাটা অসম্ভব নয়। এর পাশাপাশি নতুন কেতার শপিংসেন্টার হয়েছে। মনোহারী নাম। একতলা দোতলা, তিনতলা। কাউবয়রা টেক্সাসে পড়ে রইল, কলকেতার ছেলেরা পেছনে চামড়া সাঁটা জিনস পরে চামড়ার খোসা ছড়িয়ে ফেললে। বঙ্গললনারা যানবাহনে বস্ত্রহরণের ভয়ে শালোয়ার কামিজে ঢুকেছেন। সে মন্দ নয়, বাঙালিবাবুরা যেমন অনেক আগেই লটরপটর ধুতি ছেড়ে দো-চোঙা ধরেছেন। খরচের বহর সামলাতে এমনিই কাছায় কোঁচায় অবস্থা, তার ওপর যদি থাকত ধুতির কাছা-কোঁচা। এখন উৎসবে-পার্বণে কখনও-সখনও ধুতি পাঞ্জাবি পরেন ভিন্টেজ ড্রেস হিসেবে। হদ্দ বোকা বোকা, জামাই-জামাই দেখায়।
পুজো আসার আগেই সব বাজার কেমন জমজম, গমগম করে। আমাদের এই পুজো তো বিশাল এক ইণ্ড্রাস্ট্রি। যখন রেডিমেডের এত চল ছিল না, তখন আমার এলাকায় পুজোর কয়েকদিন আগে অনেক রাতে একটা কারণে আমাকে বেরোতে হয়েছিল। একটি ছেলে হারিয়ে গিয়েছিল, তারই তল্লাশে রাস্তায়-রাস্তায় ঘোরা। সে এক অপূর্ব অভিজ্ঞতা! গৃহস্থরা ঘুমে অচেতন, কেবল যেখানে যত দরজির দোকান ছিল, একতলা দোতলা সেলাই মেশিন উদ্দাম গতিতে চলছে। জোড়া-জোড়া হাঁটু উঠছে পড়ছে। বিপুল ঘড়ঘড় শব্দে মধ্যরাত কাঁপছে। যেন যুদ্ধ হচ্ছে। কোথাও-কোথাও রেডিও বাজছে। দূরপাল্লার স্টেশান থেকে আসছে উর্দু গজল। দমকা বাতাসে উড়ছে কাপড়ের ছাঁট। এমন বিনিদ্র উত্তেজনা বছরে একবার। পটুয়া পাড়ায় সাজসাজ রব। ব্লো ল্যাম্প দিয়ে প্রতিমা শুকনো হচ্ছে। প্রধান শিল্পী খাটিয়ায় চিত, পা টিপছেন তাঁর সহধর্মিনী। বিরামহীন কাজে শরীর সমস্যা। একটু পরেই লাফিয়ে উঠবেন। শত দুর্গা প্রস্তুতির পথে। কেউ চুল পরেছেন, কেউ পরবেন। অসুর তখনও বারবেল ভাঁজছেন। শোলাপট্টিতে পেটি-পেটি ডাকের সাজের, চালান এসেছে, শান্তিপুর কৃষ্ণনগর থেকে। সাদা জমিতে অভ্রের ঝিলিক। এ-রাত পৃথিবীর কোনও রাত যেন নয়। স্বপ্নলোকের দরজা খুলে মায়া নেমে এসেছে! মায়ের অস্ত্রশস্ত্র বাছাই করা হচ্ছে। পাটপাট চাঁদ মালা, শোলার কদম ঝুড়ি-ঝুড়ি!
রোলেকসের মালায় ম্যাকেনাস গোল্ড। গ্রেগরি পেকের মতো ছিপছিপে লম্বা এক মানুষ দেবদেবীর চুল তৈরি করছেন। হ্যাজাকের গরম আলোয় একদল তামাটে মানুষের তৎপরতায় মনে হচ্ছে, পৃথিবীর শেষ দিন বুঝি বা এসে গেছে।
বিশাল-বিশাল ট্রাক লিকারের মতো ধোঁয়া ছাড়তে-ছাড়তে শহরে ঢুকছে। সওদা আসছে দেশ-বিদেশ থেকে। মানুষ এই সময়টায় আত্মঘাতীর মতো আচরণ করে। প্রথমে হিসেবি, পরে লাগাম ছাড়া বেহিসেবি।
শ্রাবণীকে যদি শাড়ি দিলে, তো তার বালক ছেলে দুটো কী অপরাধ করেছে? রুমার এই শালোয়ারের সঙ্গে ওই জুতো যায় না। সকলেরই তো কিনলে এইবার তোমাকে কে কিনে দেবে? কেন তুমি! কে বলেছে, বাঙালির প্রেম শুকিয়ে গেছে? অভাবের আগুনে পুড়ে সোনা হচ্ছে। আয় ব্যয়ের দুটো দিক মিলবে না কোনওদিন, কিন্তু মনের সঙ্গে মন মেলাতে আমরা দেউলে হতেও রাজি।