বাংলাদেশে আমি নেই আজ কুড়ি বছর। এই কুড়ি বছরে দেশটা অনেক পাল্টে গেছে। বিটিভি নামে একটাই টিভি চ্যানেল ছিল, এখন শুনি প্রচুর চ্যানেল। কোনও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বা বেসরকারি মেডিকেল কলেজ তখন ছিল না, এখন শুনি ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়েছে ওসব। ট্যাক্স বলতে কিছু ছিল না রাস্তায়। তিন চাকার ‘বেবি ট্যাক্সি ছিল। এখন নাকি প্রচুর ট্যাক্সি ভিড়ও বেশি রাস্তায়। সবকিছু বেড়েছে। টাকা পয়সা, জনসংখ্যা, অজ্ঞতা, মূর্খতা, সহিংসতা, সংঘর্ষ, ধন, দৌলত, চাকরি, ব্যবসা, দারিদ্র, দরিদ্র, দুঃশাসন, দুর্নীতি, হরতাল, ধর্মঘট, নাস্তিকতা, ধর্মান্ধতা, হিজাব, ধর্ষণ- সব। বেড়েছে হত্যাকাণ্ড।
নির্বাচন হল বাংলাদেশে। নির্বাচন যেভাবে হওয়ার সেভাবেই হয়েছে, অথবা নির্বাচনের নামে এ প্রহসন ছাড়া কিছু নয়, দু’রকম কথাই শুনছি। প্রতিদিন এক দলের লোক আরেক দলের লোককে হত্যা করছে। ক্ষমতার লোভ রাজনীতিকদের উন্মাদ করে তুলেছে। খালেদা জিয়ার দলের সঙ্গে জামায়াতি সন্ত্রাসীদের আঁতাত অনেককালের। জামায়াতিরা অবাধে খুন-খারাবি করছে, দেশকে আস্ত একটা তালেবানি আফগানিস্তান বানানোর জন্য যা যা করার সবই করছে, এসব জেনেও খালেদা জিয়ার কোনও দ্বিধা নেই জামায়াতের সঙ্গে শুতে বসতে। শেখ হাসিনার দু’নৌকোয় পা দেওয়ার অভ্যেসও নতুন নয়। তিনি যুদ্ধাপরাধীদের শাস্তি চেয়ে যারা শাহবাগে আন্দোলন করেছিলেন, তাদের পক্ষে ছিলেন আবার হেফাজতে ইসলাম নামের এক মৌলবাদী সংগঠনের দাবিতে শাহবাগের নেতাদের বিরুদ্ধেও গিয়েছিলেন, শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চ ভেঙে দিয়েছিলেন, নাস্তিকদের ধরে ধরে জেলেও ভরেছিলেন। পরে এই হেফাজত হাসিনাকে না মানতে চাইলে এই হেফাজতকেও এক হাত নিয়েছেন। আবার শাহবাগের আন্দোলনকারীদের সমর্থন ফিরে পেতে ফাঁসি দিয়েছেন কাদের মোল্লাকে। দেশের ভালোর জন্য নয়, এই দুই নেত্রী প্রথম থেকে শেষ অবধি এ পর্যন্ত যা করেছেন, তা নিজের ভালোর জন্য, এতে সাধারণ জনগণের ভালো কিছু হয়নি। গদির জন্য পুরুষ রাজনীতিকের যত লোভ, তার চেয়ে কিছু কম লোভ নয় হাসিনার এবং খালেদার। ক্ষমতার জন্য দেশকে বধ্যভূমি বানাতে, দেশের সম্পদের সর্বনাশ করতে, মানুষের বাড়িঘর পুড়িয়ে দিতে, মানুষের গলা কাটতে তাদের কোনও আপত্তি নেই।
খালেদা তত্ত্বাবধায়ক সরকার চেয়েছেন। হাসিনা চাননি। প্রধানমন্ত্রী হাসিনা পদত্যাগ করবেন না, আর পদত্যাগ না করলে বিরোধী দলের নেত্রী খালেদা জিয়া নির্বাচনে অংশ নেবেন না। যে যার জেদ নিয়ে রইলেন। আর তাদের অনুসারীরা, অনুগতরা, অনুচররা নির্বিঘ্নে মানুষ মেরে গেল। মানুষের জীবন এখন এমনই মূল্যহীন হয়ে উঠেছে যে, মানুষ মরলে খুব একটা কিছু যায় আসে না কারও। নির্বাচনের সময় প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগ আর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিটা অর্থহীন দাবি, তেমনি যে নির্বাচনে বেশির ভাগ দলই অংশ নিচ্ছে না সেই নির্বাচন করাটাও অর্থহীন। অর্থহীন কর্মকাণ্ডই চলছে দেশে। যখন ক্ষমতার জন্য কামড়াকামড়ি চলতে থাকে, তখন লুটেরারা লোটে, ধনীরা আরাম করে, গরিবেরা মরে, মৌলবাদীরা গণতন্ত্রের শেকড় উপড়ে ফেলে ধর্মতন্ত্রের বীজ বোনে- বাংলাদেশের এই দৃশ্যটি অনেককাল চিনি।
বাংলাদেশে যখন বড় হচ্ছিলাম, কবে আমার আঠারো বছর বয়স হবে, কবে বড়দের মতো আমিও ভোট দিতে যাবো, তার অপেক্ষা করতাম। একদিন আমারও আঠারো হলো। সম্ভবত একবারই ভোট দিয়েছিলাম আমি, ময়মনসিংহ শহরে কমিশনার পদে দাঁড়ানো অলোকময় নাহাকে। এরপর আর কখনও ভোট দিইনি। দিতে ইচ্ছে করেনি। রাজনীতিটা কেবলই ক্ষমতার রাজনীতি… যেদিন থেকে বুঝলাম, রাজনীতি-নির্বাচন-ভোট এসবের ওপর থেকে উৎসহ হারালাম। সুইডেনের নাগরিক হওয়ার পর সুইডেনে ভোট দিয়েছি। একটা সত্যিকার গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের আর একটা নামকাওয়াস্তে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের নির্বাচনে আকাশ পাতাল পার্থক্য। অনেক দেশকে আমরা গণতন্ত্র নামে ডাকি। গণতন্ত্রের অনেক শর্তই যে দেশগুলো পালন করে না, সে দেশগুলোকে গণতন্ত্র আখ্যা দেওয়ার কোন মানে হয় না। নারী-পুরুষের সমানাধিকার যে দেশের আইনে নেই সে দেশে আর যা কিছুই থাক, গণতন্ত্র যে নেই, তা বলতে দ্বিধা অনেকের হয়, আমার হয় না। অনেক মানুষ ভয়ে ভোট দিতে যায়নি বাংলাদেশের নির্বাচনে। জামায়াতে ইসলামী দলের সন্ত্রাসীরা প্রচুর ককটেল ছুড়েছে। এদিকে যারাই ভোটারদের বাধা দিয়েছে ভোট দিতে, তাদের উদ্দেশ্যে গুলি ছুড়েছে পুলিশ। অনেকে মরেছে। একদিকে পুলিশের সন্ত্রাস, টিয়ার গ্যাস, গুলি, আরেক দিকে জামায়াতের সন্ত্রাসীদের বছরভর ককটেল, রগ কাটা, জবাই করা। জামায়াতি-বিএনপি সন্ত্রাসীরা হিন্দুদের ওপর চড়াও হয়েছে। হাজারো বাড়িঘর পুড়িয়ে দিয়েছে, ব্যবসাপাতি ধ্বংস করেছে। সহস হিন্দু আশ্রয়হীন। সহস হিন্দু দেশত্যাগের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কী নির্মম এই অত্যাচার। সংখ্যালঘু মুসলমানরা ভারতবর্ষে যে নিরাপত্তা পায়, তার হাজারভাগের একভাগও যদি পেতো সংখ্যালঘু হিন্দুরা বাংলাদেশে, তবে কোনো হিন্দুর বাড়িও পুড়তো না আজ, কোনো হিন্দুকে দেশত্যাগ করতেও হত না। বাংলাদেশের কোন সরকারই আজ অবধি সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা দিতে পারেনি। সব সরকারের আমলেই অমুসলিমরা শুধু অমুসলিম হওয়ার অপরাধেই খুন হয়েছে, ধর্ষিতা হয়েছে, সর্বস্বান্ত হয়েছে। এত যে বলা হয় আওয়ামী লীগ হিন্দুদের নিরাপত্তা দেয়। ছাই দেয়। দিলে নির্বাচনের সময় এত হিন্দুর জীবন বিপন্ন হত না। আওয়ামী লীগের মধ্যেই মৌলবাদী কম নয়, আওয়ামী লীগের মধ্যেও হিন্দুবিরোধী কম নয়। হিন্দুদের ওপর অন্যায় অত্যাচার ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। একুশ বছর আগে আমি ‘লজ্জা’ লিখেছিলাম। উপন্যাসটি তথ্যভিত্তিক। দেখিয়েছিলাম সরকার যদি হিন্দুদের নিরাপত্তা না দেয়, তবে দেশময় কী তাণ্ডব চলতে পারে, বলেছিলাম নিরাপত্তার অভাবে হিন্দুরা চলে যাচ্ছে দেশ ছেড়ে। একুশ বছরেও সমস্যার কোনো সমাধান তো হয়ইনি, বরং আরও বিকট আকার ধারণ করেছে। হিন্দুরা দেশ ছাড়ছে আগের চেয়ে আরও বেশি পরিমাণে। অমুসলিমরা আক্রান্ত হওয়া মানে দেশ ইসলামী মৌলবাদী রাষ্ট্রে পরিণত হওয়া। যখন এরশাদ সরকার রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম করেছিল, তখনই কি আমরা বুঝিনি অমুসলিমদের দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক বানিয়ে দেওয়া হচ্ছে, এবং এর কারণে অমুসলিমরা তাদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হবে! এত যে হাসিনাকে সেকুলার বলা হয়, হাসিনাও তো পারেনি সমাজকে ধর্মনিরপেক্ষ করতে, রাষ্ট্রকে ধর্ম থেকে আলাদা করতে।
জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কিছু মানুষ গেছে ভোট দিতে। মানুষ শান্তি চায়। এই শান্তিটুকুরই নিশ্চয়তা কোনো সরকারই দিতে পারছে না। খালেদা আর হাসিনার সরকারে কোনো পার্থক্য নেই। হাসিনা খালেদাকে অনুসরণ করে, খালেদা হাসিনাকে অনুসরণ করে। প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করো, তা না হলে নির্বাচন করবো না, … এই হুমকি আমরা দুই দলের কাছ থেকেই প্রায় প্রতি নির্বাচনের আগেই শুনছি। হাসিনা আর খালেদার চুলোচুলির সুযোগটা চমৎকার নিচ্ছে জামায়াতে ইসলামী। দেশটাকে একটা ইসলামী মৌলবাদী দেশ বানানোর স্বপ্ন প্রায় সফল করে ফেলেছে জামায়াতিরা। এখন দুই নেত্রীর ঝগড়া দেখে দেখে বীতশ্রদ্ধ হয়ে মানুষ মৌলবাদী দলের দিকেই ঝুঁকবে কি না কে জানে। এমনিতেই সমাজের গভীরে ছড়িয়ে গেছে মৌলবাদের শাখা-প্রশাখা। দেশ গোল্লায় গেলে দুই নেত্রীর কিছু যাবে আসবে বলে মনে হয় না, কিন্তু আমরা যারা সুস্থ সুন্দর সভ্য পৃথিবীর স্বপ্ন দেখি, আমরা খুব হতাশ হবো। অবশ্য আমাদের হতাশ হওয়ায় কার কী যায় আসে!
সূত্রঃ দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিন, ০৯ জানুয়ারি, ২০১৪