দেশের ভিতরে
বিংশ শতাব্দীর প্রথম দু’দশকে আমার জীবনে কি কি ঘটেছে সে-সব কথা শুরুতেই আমি খুব সংক্ষেপে বলেছি। তখনকার দিনের রাজনীতিক পরিস্থিতি সম্বন্ধেও সামান্য কিছু বলার চেষ্টা আমি করেছি। তার পরে বিদেশে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির প্রথম স্থাপনা ও কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের সহিত বিদেশে স্থাপিত ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির প্রথম সংযুক্ত হওয়া ইত্যাদিকে উপলক্ষ্য করে আমি অনেক কিছু বলেছি। এই উপলক্ষ্যে আরও অনেক কথা আমায় পরে বলতে হবে। এখন আমি বলার চেষ্টা করব দেশের ভিতরে কি কি ঘটেছিল।
আগেই আমি বলেছি যে ১৯২০ সাল আসতেই আমি স্থির করে ফেলেছিলেম, আমার জীবনের পেশা হবে রাজনীতি, সাহিত্যচর্চা নয়। ঊনপঞ্চাশতম বেঙ্গলী ব্যাটালিয়ন ভেঙে যাওয়ার পরে ১৯২০ সালের মার্চ মাসে কাজী নজরুল ইসলাম পূর্ব নির্ধারিত ব্যবস্থা অনুসারে কলকাতায় আমার সঙ্গে থাকতে আসে। ফৌজে সে কোয়ার্টার মাস্টার হাবিলদার ছিল। কথা হয়েছিল যে নজরুল ইসলাম কলকাতায় কাব্য ও সাহিত্যচর্চা করবে এবং রাজনীতিতেও যোগ দিবে। তখন তার বয়স একুশ-বাইশ বছর মাত্র। কলকাতা আসার অল্প কয়েক মাসের ভিতরেই নজরুল ইসলাম কবিপ্রসিদ্ধি লাভ করে।
সান্ধ্য দৈনিক “নবযুগ”
তিন-চারজনকে সঙ্গে নিয়ে নজরুল আর আমি একখানা সান্ধ্য দৈনিক পত্রিকা বা’র করেছিলেম। কাগজের নাম ছিল “নবযুগ”। লম্বায় ২৬ ইঞ্চি ও চৌড়ায় ২০ ইঞ্চি মাপের এক শীট কাগজ ছিল “নবযুগ”। ১৯২০ সালের ১২ই জুলাই তারিখে কাগজখানা প্রথম বা’র হয়েছিল। কাগজের প্রকৃত মালিক ছিলেন মিস্টার এ. কে. ফজলুল হক, কলকাতা হাইকোর্টের বকীল, এখন আমরা এডভোকেট বলি। কাগজে আমাদের লেখার স্বাধীনতা ছিল। তাতে গরম গরম লেখা ছাপা হতো আর জনগণের বিশেষ করে মজুরদের কথাও তাতে লেখা হতো। কাগজখানি কয়েক মাস মাত্র চলেছিল। “নবযুগ” বন্ধ হয়ে যাওয়ার কয়েক মাস পরে আমরা (আমরা মানে কুদ্দীন আহ্মদ সাহেব, নজরুল ইস্লাম ও আমি) অন্য একটি প্রচেষ্টায় লিপ্ত হই। স্থির করি যে একটি জয়েন্ট স্টক কোম্পানী রেজিস্ট্রী করে তার টাকায় একখানি বাঙলা দৈনিক বা’র করব। এই প্রচেষ্টায় আমরা বিফল হয়েছিলেম। [১২]
[12. এই সম্বন্ধে আমার “কাজী নজরুল ইসলাম : স্মৃতিকথা” (ন্যাশনাল বুক এজেন্সি প্রাইভেট লিমিটেড কলকাতা-১২ কর্তৃক প্রকাশিত) নামক পুস্তকে সবিস্তারে লিখেছি। এখানে আর তার পুনরাবৃত্তি করলাম না।]
দেশের ভিতরে কমিউনিস্ট পার্টি গড়ার প্রথম প্রচেষ্টা
আগে পরে চার জায়গায় ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি গড়ার চেষ্টা আরম্ভ হয়েছিল। উদ্যোক্তারা একত্র মিলিত হয়ে আলোচনা করে যে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তা নয়, প্রত্যেক জায়গায় পৃথক পৃথক ভাবে প্রথম উদ্যোক্তরা কাজ শুরু করেছিলেন। তাঁদের একজনের সঙ্গে আর একজনের পরিচয়ও ছিল না। ভারতবর্ষ একটি বিশাল দেশ। প্রথম চারটি জায়গার-কলকাতা, বোম্বে, লাহোর ও মাদ্রাজের, এক জায়গা হতে অন্য জায়গার দূরত্ব এক হাজার মাইলেও অনেক বেশী। এত দূরে দূরে থেকেও আমরা সারা ভারতের পার্টি গড়ার কাজে নেমেছিলেন। কারণ, কমিউনিস্ট আন্দোলন আন্তর্জাতিক। আমাদের সকলের মধ্যবিন্দু ছিল কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনাল। তার কেন্দ্র (হেড্ কোয়ার্টার্স) ছিল বহু হাজার মাইল দূরে, মস্কোতে। এই চারটি জায়গার প্রত্যেকটির সঙ্গে কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের স্বাধীনভাবে সংযোগ স্থাপিত হয়েছিল। কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালই কোনো কোনো ক্ষেত্রে আমাদের একজনের সঙ্গে অপরের (যেমন ডাঙ্গের সঙ্গে আমার) পরিচয় ঘটিয়ে দিয়েছিলেন।
আমাদের প্রথম উদ্যোক্তাদের মধ্যে কেউ কেউ কাজ আরম্ভ করেছিলেন ১৯২১ সালে যেমন শওকৎ উসমানী, (ভারতের প্রবাসী কমিউনিস্ট পার্টির সভ্য) আর কেউ কেউ করেছিলেন ১৯২২ সালের শুরুতে। ১৯২৪ সালে ভারত গবর্নমেন্টের পক্ষ থেকে ভারতের হোম ডিপার্টমেন্টের অন্তর্ভুক্ত সেন্ট্রাল ইনটেলিজেন্স ব্যুরোর ডিরেক্টর লেফটেন্যান্ট কর্নেল সি.কে. (Kaye) যখন কানপুর বলশেভক ষড়যন্ত্র মোকদ্দমার বাদী হিসাবে আসামীদের বিরুদ্ধে মামলা রুজু করছিলেন তখন তিনি তাঁর দরখাস্তে বলেছিলেন যে আসামী শ্রীপাট (দরখাস্তে শ্রীপাটই লেখা ছিল, শ্রীপাদ নয়) অমৃত ডাঙ্গে, মাওলা বখ্শ্ ওর্ফে শওকত উসমানী ও মুজফফর আহমদ ভারতের রাজ সম্রাটকে শাসন ক্ষমতা হতে বঞ্চিত করার উদ্দেশ্যে ১৯২১ সালে কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের সহিত ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছিলেন। কাজেই, এটা বুঝতে কোনো অসুবিধা হচ্ছে না যে কানপুরের আসামীরা যে অপরাধ করার জন্যে আদালতে অভিযুক্ত ও দণ্ডিত হয়েছিলেন তার সূত্রপাত ১৯২১ সালে হয়েছিল। আর কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের সহিত যোগ স্থাপন করাটাই ছিল তাঁদের আসল অপরাধ।
বাঙলা দেশে পার্টির সূত্রপাত
আমার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা বাঙলা দেশের। সেই জন্যে আমি বাঙলা দেশ হতেই কথা শুরু করব। বাঙলাদেশে যে মজুরদের ধর্মঘট ইত্যাদি হচ্ছিল তার কোনো প্রভাব আমার উপরে পড়েনি একথা বলা যায় না। ‘নবযুগ’ কাগজ পরিচালনার মধ্য দিয়েও আমার মন খানিকটা মজুরদের সমস্যার প্রতি উন্মুখ হয়ে উঠেছিল। কলকাতায় নাবিকদের ভিতরে ঘোরাফেরা করার অভ্যাস আমার ছিল। কিন্তু এটা যে তাদের ভিতরে আন্দোলন করার জন্যে আমি করতাম তা বলা যায় না। আমার জন্মস্থান সন্দ্বীপের লোকেরা তখনকার দিনে খুব বেশী সংখ্যায় জাহাজে চাকরী করতেন। তাঁদের ভিতরে আমার ঘোরাফেরা করার এটাই ছিল আসল কারণ। কিন্তু আমি তাঁদের ভিতরে যে যাতায়াত করতাম তাতে তাঁদের নানা সমস্যার প্রতিও আমার মন আকৃষ্ট হয়েছিল। জাহাজীদের দাবী-দাওয়া নিয়ে আমি ‘নবযুগ’ কাগজে অনেক লিখেছি।
আমার প্রথম মার্কসবাদ বিষয়ে সাহিত্য কেনা
এই অবস্থায় সাধারণভাবে মজুর আন্দোলন সম্বন্ধে সামান্য পড়াশুনা করার বাসনা আমার মনে জেগেছিল। সেই সময় আমাদের বন্ধু মাখনলাল গঙ্গোপাধ্যায় বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির অফিসে একদিন কথায় কথায় আমায় জানালেন যে কলেজ স্কোয়ারের চক্রবর্তী, চাটার্জী এন্ড কোম্পানী লিমিটেডের দোকানে মজুর সমস্যা সম্পর্কিত কিছু পুস্তুক ইংল্যান্ড হতে এসেছে। মাখন গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে আমাদের প্রথম পরিচয় পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায়ের মারফতে হয়েছিল। ইংরেজী ও বাঙলা ভালো লিখতেন। সাহিত্য বিষয়ে তিনি খুব পড়াশুনা করতেন। তাঁর সঙ্গে আমাদের ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব হয়েছিল। তিনি বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতিতে আসতেন। পর সমিতির অনেক কাজের ভারও তিনি নিয়েছিলেন। যাক আসল কথা এখন বলি। মাখন গঙ্গোপাধ্যায় যখন আমায় পুস্তক আমদানীর খবর দিলেন তখন আমি অতি কষ্টে দশটি টাকা জোগাড় করলেম। তখনকার দিনে আমার পক্ষে দশ টাকা জোগাড় করা কঠিন কাজ ছিল। এই টাকা নিয়ে আমি চক্রবর্তী, চাটার্জির দোকানে গেলাম। আমার সেদিন ধুতি-শার্ট পরা ছিল। মজুর সমস্যা সংক্রান্ত পুস্তকের কথা জিজ্ঞাসা করতেই দোকানের লোকেরা কেমন যেন চমকে উঠলেন এবং জিজ্ঞাসা করলেন, “আপনি কোথা থেকে এসেছেন”। আমি তখনই বুঝে নিলাম যে ও’রা ভয়ে ভয়ে ই সকল পুস্তক আমদানী করেছেন, আর আমাকে পুলিসের লোক বলে সন্দেহ করছেন। সঙ্গে সঙ্গেই আমি উত্তর দিলাম যে, “আমি মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক সাহেবের নিকট হতে এসেছি। তিনি আমার বন্ধু”। তাঁদের মুখের ভাবটা তখনই বদলে গেল। আমায় যত্ন করে তাঁরা শ্যামাচরণ দে স্ট্রীটের দোতলায় তাঁদের গুদামে নিয়ে গেলেন। এর পেছনে একটা ইতিহাস আছে।
আজকাল অলবার্ট হলের যে বাড়ী সকলে দেখতে পাচ্ছেন, যাতে অনেক পুস্তকের দোকান আছে ও কফি হাউস ইত্যাদি আছে, এটা হচ্ছে নূতন বাড়ী। জীর্ণাবস্থার সাবেক বাড়ীটি ভেঙে দিয়ে অলবার্ট ইনস্টিটিউটের কর্তৃপক্ষ বৰ্তমান বাড়ীটি তুলেছিলেন। পুরানো বাড়ীটি ভাঙার কারণে অনেক দোকন-পাট বাস্তুহারা হয়ে যায়। চক্রবর্তী, চাটার্জি এন্ড কোম্পানীরও সেই অবস্থা হয়। সমস্যা হয়েছিল যে কোথায় তাঁরা যাবেন। এই কোম্পানী যখন জয়েন্ট স্টক কোম্পানীরূপে রেজিস্ট্রী হয়েছিল তখন আমার বন্ধু মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক সাহেব তার কয়েকটি শেয়ার কিনেছিলেন। এই সূত্রে চক্রবর্তী, চাটার্জির সঙ্গে তাঁর পরিচয়। এই বাস্তুহারা অবস্থায় তাঁরই আনুকূল্যে কোম্পানী অকূলে কুল পেয়ে গেলেন। পাবলিক ওয়ার্কস, ডিপার্টমেন্টের ইঞ্জিনিয়ার মিস্টার তফজ্জুল আহমদের চার্জে প্রেসিডেন্সী কলেজ, হেয়ার স্কুল, সংস্কৃত কলেজ ও হিন্দু স্কুল প্রভৃতির বিল্ডিংগুলি ছিল। তিনি ও মোজাম্মেল হক সাহেব আবার ছিলেন একই পীরের মুরিদ (শিষ্য)। এই সূত্রে মোজাম্মেল হক সাহেব, ইঞ্জিনীয়ার সাহেবকে এই বলে একান্তভাবে ধরে পড়লেন যে “ভাই সাহেব, চক্রবর্তী, চাটার্জি এন্ড কোম্পানীর জন্যে সংস্কৃত কলেজের আউট হাউসে একটা দোকানের ব্যবস্থা আপনাকে করেই দিতে হবে”। এই আউট হাউসগুলি খালিই পড়ে থাকত। ইঞ্জিনীয়ার সাহেব রাজী হয়ে গেলে। তিনি কলেজে স্কোয়ার (বঙ্কিম চাটুজ্যে স্ট্রীট) ও কলেজ স্ট্রীটের মিলন স্থলে দুই রাস্তাতেই দরজাওয়ালা একটি চমৎকার দোকান ঘর তৈয়ার করে দিলেন। তাঁকে এখানে ওখানে কিছু কিছু পরিবর্তন করতে হয়েছিল। এই কারণে চক্রবর্তী, চাটার্জি এন্ড কোম্পানীতে মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক সাহেবের খুব কদর ছিল। মিস্টার তফাজ্জুল আহমদ সুবিখ্যাত আই-সার্জন ডাক্তার টি, আমদের বড় ভাই ছিলেন।
আমি ১৯২১ সালের নভেম্বর মাসের কথা বলছি। তখনকার দিনে পুস্তুকের দাম খুব সস্তা ছিল। দশ টাকার ভিতরে আমি কয়েকখানা পুস্তক কিনেছিলেম। তার মধ্যে ছিল লেনিনে পুস্তকাকারে মুদ্রিত একটি প্রবন্ধ— (১) “বলশেভিকেরা কি ক্ষমতা দখলে রাখতে পারবেন?” (২) লেনিনের “বামপন্থী কমিউনিজ্ম্- শিশু সুলভ বিশৃঙ্খলা” (৩) “পিপল্স্ মার্কস” (People’s Marx : Abrideged popular of `Captital’, Edited by Julian Borchardt, Translated in English by Stephen L. Trask, pp VII+284, Printed 1921.)। ভূমিকায় সম্পাদক লিখেছেন যে কার্ল মার্কসের ক্যাপিটালের এই সংক্ষিপ্তসার রচনার জন্যে তিনি ত্রিশ বৎসর কাল ক্যাপিটাল অধ্যয়ন করেছেন। আরও ক’খানা পুস্তক ছিল। এখন নাম মনে করতে পারছিনে। একখানা ছিল কার্ল মার্কসের ওপরে প্রশ্নোত্তরছলে লেখা। কভারের ওপরে মার্কসের ফটো ছাপানো হয়েছিল। এখানা ছিল বিরুদ্ধ পুস্তক, কোনো পাদ্রীর লেখা। একখানাও প্রাথমিক পুস্তক ছিল না। তখন ফিলিপ্স্ প্রাইসের স্মৃতিকথাখানি (My Reminiscences of the Russian Revolution) পেলে অন্তত পার্টির সংগঠন সম্বন্ধে কিছু জ্ঞান লাভ করতে পারতাম। এই পুস্তকখানা হাতে পেয়েছিলেম ১৯২২ সালের শেষার্ধে।
ফিলাফৎ আন্দোলন ও তার প্রভাবে সৃষ্ট অসহযোগ আন্দোলন দেশকে কাঁপিয়ে তুলেছিল। আমি এ দু’টি আন্দোলনের কোনোটিতেই যোগ দিইনি। তার মানে ফৌজদারী কার্যবিধি আইনের (The Criminal Procedure Code of India) ১৪৪ ধারার হুকুম অমান্য করে কিংবা অন্য কোনো কিছু করে জেলে যাইনি। নজরুল ইস্লাম অবশ্য কুমিল্লায় এই আন্দোলন সংসৃষ্ট মিছিলে যোগদিয়েছে এবং সেই সম্বন্ধে একাধিক সঙ্গীতও রচনা করেছে। পুরো ১৯২১ সাল আন্দোলনের কোনো রাজনীতিক সমালোচনাও আমরা করিনি, তার বিরুদ্ধেও আমরা লিখিনি। বরঞ্চ আন্দোলনকারীদের প্রতি কোনো অত্যাচার হলে তার তীব্র সমালোচনা আমরা করেছি। ১৯২০ সালে হিজরৎকারীদের ওপরে গুলি চালানোর বিরুদ্ধে তীব্র ভাষায় লেখার কারণে ‘নবযুগে’র জামিনের টাকা বাজেয়াফ হয়েছিল। ১৯২০ সালে আমাকে বঙ্গীয় প্রাদেশিক খিলাফৎ কমিটির সভ্য মনোনীত করা হয়েছিল। আমি সে পদ গ্রহণ করিনি। কিন্তু আমি যুক্ত খিলাফৎ-অসহযোগ আন্দোলনের মিটিংগুলিতে যোগ দিতেম, রাত্রের মিটিংগুলিতেও। শ্রমজীবী মানুষেরা দিনের বেলা নানা জায়গায় কাজ করতেন। তাঁদের মিটিং হতো রাত্রে।
১৯২১ সালের শেষের ক’মাস এভাবেই কাটছিল। আমার মার্কসবাদী সাহিত্য কেনার কথা আমি ওপরে লিখেছি। কিন্তু কিভাবে কি করব বুঝতে পারছিলেম না। এর আগে কোনো মার্কসবাদী সাহিত্য আমি পড়িনি। তখন আমরা ৩/৪সি, তালতলা লেনের বাড়ীতে রয়েছি। এ বাড়ীতেই নজরুল তার বিখ্যাত “বিদ্রোহী” কবিতা রচনা করেছিল। এই সময়ে আমাদের একটা অদ্ভুত যোগাযোগ ঘটে গেল। এই যোগাযোগ যাঁর মারফতে ঘটল তিনি খুব কাঙ্ক্ষিত ব্যক্তি ছিলেন না। অনেক পরে বুঝেছিলেম যে যাঁর সঙ্গে যোগাযোগ ঘটেছিল তিনিও ছিলেন অনাকাঙ্ক্ষিত ব্যক্তি।
আবদুর হাফিজ শরীফাবাদীর সঙ্গে আমার পরিচয়
আমি যখন বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতিতে কাজ করতাম তখন আব্দুর হাফিজ শরীফাবাদীর সঙ্গে আমার পরিচয় হয়। বর্ধমান জিলার লোক। প্রথম পরিচয়ের সময়ে বলেছিলেন যে তিনি কলকাতা ট্রেনিং (নর্মাল) স্কুলের ছাত্র। তখনকার দিনে নর্মাল স্কুলে বাঙলা ভাষার শিক্ষকদের শিক্ষা দেওয়া হতো। পরে দেখেছিলেম, আবদুল হাফিজ নর্মাল স্কুলে আর পড়েন না, কিংবা কখনও পড়তেন না। তিনি খদ্দরের পায়জামা, শিরওয়ানী ও টুপি পরে বেড়াতেন এবং কলকাতার বাড়ী বেচা-কেনার দালালী করতেন। বাকেরগঞ্জ জিলার হারানচন্দ্র দাস নামে একজনও এই ব্যাপারে তাঁর সঙ্গে ঘোরাফেরা করতেন।
নলিনী গুপ্তের আগমন
একদিন সকাল বেলা কাজী নজরুল ইসলাম ও আমি আমাদের ৩/৪সি, তালতলা লেনের বাড়ীতে বসে আছি এমন সময়ে আবদুল হাফিজ শরীফাবাদী আমাদের নিকটে এসে প্রায় কেঁদে ফেললেন। তাঁর এই কান্না আনন্দের হতে পারে, কারণ এই সংযোগ হতে টাকা পাওয়ার আশা করেছিলেন তিনি, কিংবা ভয়েরও হতে পারে, কেননা, বোমার ভয় ছিল তাতে। আমার বিশ্বাস, কান্নাটা ভয়েরই ছিল। উত্তেজিত কণ্ঠে তিনি বললেন, “আপনারা তলে তলে কি করেন, না করেন, তা আমি জানিনে, তবে আমার বিশ্বাস যে আপনার বিপ্লবী। সেই জন্যেই আপনাদের নিকটে ছুটে এলাম। কথা হচ্ছে এই রাশিয়া হতে একজন মস্ত বড় বিপ্লবী এসেছেন। তিনি জমাট দুধের খালি টিনের ভিতরেও বোমা তৈয়ার করতে পারেন। আর, অনেক টাকা আছে তাঁর নিকটে। তিনি বিপ্লবীদের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করতে চান। আপনার দু’জন তাঁর সঙ্গে দেখা করুন।” আমরা পরের দিন এই বিপ্লবীর সঙ্গে দেখা করতে যাব বলার পরে আব্দুল হাফিজ চলে গেলেন। তাঁর চলে যাওয়ার পর আমি নজরুল ইস্লামকে বললাম, “এ কোন্ ধরনের বিপ্লবী যিনি যাঁকে-তাঁকে বলে বেড়াচ্ছেন যে তিনি বোমা তৈয়ার করতে জানেন; আবার একথাও সকলকে জানিয়ে দিচ্ছেন যে তাঁর জিম্মায় প্রচুর টাকা আছে”। নজরুল বলল, “কাল বোঝা যাবে ব্যাপারটি কি? “
নলিনী গুপ্তের আত্মপরিচয়
পরের দিন সকাল বেলা আটটার পরে আবদুল হাফিজ এসে আমাদের আপার সার্কুলার রোডের (এখনকার আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রোড) একটি বাড়ীতে নিয়ে গেলেন। আমরা ভাড়াটে ঘোড়ার গাড়ী সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেম। খবর পেয়ে দোতালা হতে ট্রাউজার, জ্যাকেট ও হ্যাট পরিহিত একজন কালো খোঁড়া লোক নেমে এসে আমাদের অপেক্ষিত গাড়ীতে চড়লেন। একজন হারানচন্দ্র দাসের কথা আমি আগে বলেছি যিনি আবদুল হাফিজের সঙ্গে দালালী করতেন। তিনি আবার এই খোঁড়া ভদ্রলোকের গ্রামের লোক। দেখলাম তিনিও মরিয়া হয়ে গাড়ীতে চড়তে চাইছেন। তাঁর ভয় ছিল টাকার আণ্ডিল খোঁড়া মানুষটি পাছে তাঁর সব টাকা অন্য কোথাও না রেখে আসেন। আবদুল হাফিজ অতিকষ্টে হারান দাসকে নিবৃত্ত করলেন। নিজে তিনি গাড়ীখানা আমাদের বাসায় পৌঁছিয়ে দিয়ে নেমে চলে গেলেন। পথে আমরা কারুর সঙ্গে কেউ কোনো কথা বলিনি।
আমাদের বাসায় পৌঁছানোর পরে ভদ্রলোক আত্মপরিচয় দিলেন, বললেন, তাঁর নাম নলিনী গুপ্ত। বাকেরগঞ্জ জিলার ঝালকাটির নিকটবর্তী বেলদাখান গ্রামে তাঁর বাড়ী। নিজের সম্বন্ধে আরও অনেক কথা বললেন তিনি। জানালেন, ১৯১৪ সালে তিনি ইংল্যান্ডে চলে গিয়েছিলেন।[১৩] তখনও প্রথম মহাযুদ্ধ আরম্ভ হয়নি। যুদ্ধ আরম্ভ হওয়ার পরে তিনি নানান কারখানায় কাজ করেছেন। সব কারখানাতেই যুদ্ধ-সামগ্রী প্রস্তুত হতো। প্রথম যুদ্ধে যে হ্যান্ডগ্রেনেড্ বোমা ব্যবহৃত হয়েছে সেই বোমা প্রস্তুতকরণে তিনি পারদর্শী। তিনি যে যুদ্ধের জন্যে ভালো কাজ করেছেন তার জন্যে গ্রেট ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী লয়ড্ জর্জের সাই করা সার্টিফিকেট তাঁর নিকটে আছে। (আমরা অবশ্য এই সার্টিফিকেট দেখতে চাইনি)। যুদ্ধের পুরো সময় তিনি কারখানার কাজ করেছেন, যুদ্ধের পরেও অনেক দিন তিনি কাজ করেছেন। কাজ করার সময়ে তিনি বেলদাখান গ্রামে তাঁর আত্মীয়দের নিকটে মানিঅর্ডার যোগে ইংল্যান্ড হতে টাকা পাঠাতেন। ঝালকাটি পোস্ট অফিসে সেই টাকা যখন আসত তখন তা দেখে স্থানীয় লোকেরা অবাক হয়ে যেতেন। তাঁরা বরাবর জেনে এসেছেন ভারতের টাকা ব্রিটেনে চলে যায়। ব্রিটেন হতেও যে ভারতে টাকা আসতে পারে এটা তাঁদের ধারণার বাইরে ছিল।[১৪] ইত্যাদি অনেক কথা। নলিনী গুপ্ত আরও বললেন, অবশেষে একদিন ব্রিটিশ গবর্নমেন্ট জানতে পারলেন তিনি একজন বিপ্লবী। তখন গবর্নমেন্টের লোকেরা চমকে উঠলেন। তাঁরা ভাবলেন বড় ক্ষতি হলো। একজন ভারতীয় বিপ্লবীকে কিনা বিস্ফোরক পদার্থ তৈয়ার করতে শিখিয়ে দেওয়া হয়েছে। এর পরে নলিনীকে আর ইংল্যান্ডে থাকতে দেওয়া হলো না। আমরা জিজ্ঞাসা করলাম তাঁকে পাসপোর্ট দেওয়া হয়েছিল কিনা। কারণ, নলিনী যখন ইংল্যান্ডে গিয়েছিলেন (১৯১৪ সালে) তখন পাসপোর্ট বাধ্যতামূলক ছিল না। যুদ্ধের ভিতরেই তা আন্তর্জাতিকভাবে বাধ্যতামূলক হয়েছিল। নলিনী জানালেন, পাসপোর্ট তাঁকে দেওয়া হয়নি। একটা অস্থায়ী পরিচয় পত্র (Identitification Certificate) শুধু একবার ব্যবহারের জন্যে তাঁকে দেওয়া হয়েছিল।
[13. পুলিসের নিকট ১৯২২ সালের ডিসেম্বর মাসে বিবৃতি দেওয়ার সময় নলিনী বলেছেন তিনি ১৯১৫ সালে ইংল্যান্ডে পৌঁছেছিলেন।
14. পুলিসের নিকট বিবৃতিতে নলিনী বলেছেন দেশ হতে তাঁর এক দাদা মাঝে মাঝে তাঁকে লন্ডনে টাকা পাঠাতেন।]
তারপরে তিনি বার্লিন গেলেন। বার্লিন হতে অন্য ভারতীয় ন্যাশনালিস্ট বিপ্লবীদের সহিত গিয়েছিলেন মস্কো। কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের তৃতীয় কংগ্রেসের অধিবেশন শেষ হওয়া পর্যন্ত (১৯২১ সালের ২২ শে জুন হতে ১২ই জুলাই) তিনি মস্কো ছিলেন। আমাদের তিনি বললেন, “এখন আমি মস্কো হতে আসছি। উদ্দেশ্য, ভারতীয় বিপ্লবীদের সহিত কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের বৈপ্লবিক সংযোগ স্থাপন করা। সেই যে ১৯১৪ সালে আমি ইংল্যান্ডে গিয়েছিলেম তারপরে এই সবে দেশে ফিরলাম। জাহাজে চাকরী করে কলম্বো হয়ে ফিরেছি। অসুস্থ হয়ে কলম্বোতে আমায় ছয় সপ্তাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে থাকতে হয়েছিল”। অঢেল টাকা-কড়ি নিয়ে আসার কথা নলিনী গুপ্ত কিন্তু আমাদের কিছু বলেননি।
আমরা আমাদের কথা তাঁকে জানালাম। আমরা যে ছোট্ট দৈনিক কাগজ খানা সম্পাদনা করতাম তার ফাইলও তিনি আমাদের টেবিলের ওপর হতে নিয়ে উলটে পালটে দেখলেন, হেডিংগুলিও পড়লেন। আমি যে বই ক’খানা কিনেছিলেম সেগুলিও তাঁকে আমি দেখিয়েছিলেম। নলিনী গুপ্ত বললেন, “আমার তো মনে হয় আমি ঠিক জায়গাতেই এসেছি”।
আমরা নলিনী গুপ্তের সঙ্গে কোনো রকম তাত্ত্বিক-আলোচনা করতে চাইনি। কথাবর্তায় মনে হয়নি যে তিনি সেই আলোচনা করতে পারতেন। আমরা তাঁর নিকট হতে কমিউনিস্ট পার্টি ও কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের সাংগঠনিক রূপ সম্বন্ধেই শুধু ওয়াকিফহাল হতে চেয়েছিলেন। তিনি নিজের সম্বন্ধে অনেক অতিরঞ্জিত কথা যাঁকে-তাঁকে বলেছেন। তিনি রুশ দেশের বলশেভিকদের তরফ হতে এদেশের বিপ্লবীদের সঙ্গে সংযোগ করতে এসেছেন একথাও রটিত হয়েছিল এবং এই রটনার জন্যে তিনিই দায়ী। আমাদের মনে ভয় হয়েছিল যে নলিনী গুপ্তকে পেলে পুলিস গিরেফতার করবে। তাই, নজরুল ইস্লাম আর আমি তাঁকে একটা নিভৃত স্থানে নিয়ে গেলাম। তাঁকে আমরা অনুরোধ করলাম যে “আপনি কমিউনিস্ট পার্টি ও কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালেরও সাংগঠনিক চেহারাটা আমাদের ভালো করে বুঝিয়ে দিন”। তিনি কিন্তু আমাদের একেবারেই হতাশ করলেন। সংগঠন সম্বন্ধে কিছুই তিনি আমাদের বললেন না। আমাদের নিকটে তিনি ঝাড়া এক ঘণ্টা বোমা ও বিস্ফোরক সম্বন্ধে বক্তৃতা দিলেন। আমরা বুঝে নিলাম যে বোমা ও বিস্ফোরকের ব্যাপার সম্বন্ধে তিনি কিছু জানেন, কিন্তু কমিউনিস্ট মতবাদ ও কমিউনিস্ট পার্টি সম্বন্ধে তিনি কিছু জানেন না।
আমি আগেই বলেছি যে নলিনী গুপ্ত জার্মানী হতে ন্যাশনালিস্ট বিপ্লবীদের সঙ্গে মস্কো গিয়েছিলেন। তাঁদের ভিতর কেউ আগে কখনও নলিনীকে চিনতেন না। তবুও তাঁরা মস্কো যাওয়ার সময়ে তাঁকে সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন। তাঁদের ভিতর হতে একজন, ডক্টর ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত, ১৯৫৩ সালের এপ্রিল মাসে প্রকাশিত তাঁর “অপ্রকাশিত রাজনৈতিক ইতিহাসে”র নূতন সংস্করণে লিখেছেন যে নলিনী গুপ্তকে মস্কো রেখে আসার জন্যেই তাঁরা সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন।
মস্কোতে এম. এন রায়ের সহিত নলিনী গুপ্তের ধাপ্পাবাজি
মস্কোতে মানবেন্দ্রনাথ রায়কে একটা জবর রকমের ধাপ্পা দিয়ে নলিনী গুপ্ত তাঁর (রায়ের) প্রিয়পাত্র হয়ে গিয়েছিলেন। রায়কে নলিনী গুপ্ত বলেছিলেন যে তিনি সবে মাত্র ভারতবর্ষ হতে ফিরেছেন। যুদ্ধের পরে তিনি একবার ভারতবর্ষে গিয়েছিলেন। সেখানে রায়ের পুরনো সন্ত্রাসবাদী বিপ্লবী পার্টির বন্ধুদের সঙ্গে তাঁর (নলিনীর) দেখা হয়েছিল। তাঁরাই রায়ের সঙ্গে সংযোগ সাধনের জন্যে তাঁকে মস্কো পাঠিয়েছেন। মানবেন্দ্রনাথ রায় তাঁর বিচক্ষণতা সত্ত্বেও নলিনী গুপ্তের মতো লোকের দ্বারা প্রতারিত হয়েছিলেন। ১৯২১ সালে তিনি নলিনী গুপ্তকে তাঁর বার্তাবহরূপে ভারতে পাঠিয়েছিলেন এবং পাঠিয়েছিলেন মূলত তাঁর পুরনো সন্ত্রাসবাদী পার্টির বন্ধুদের নিকটে। কেউ যদি ইচ্ছা করেন তবে নলিনী গুপ্তকে কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের বার্তাবহও বলতে পারেন। কারণ এম. এন. রায় কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের হয়েই কাজ করছিলেন। রায় তাঁর ‘স্মৃতিকথা’র লেখা তাঁর জীবদ্দশায় শেষ করেছিলেন, কিন্তু তাঁর মৃত্যুর পরেও অনেক দিন তা ‘র্যাডিক্যাল হিউমানিস্ট’ নামক ইংরেজি সাপ্তাহিক ছাপা হয়ে চলেছিল। ১৯৫৪ সালের ১৩ই জুন তারিখের ‘র্যাডিক্যাল হিউমানিস্টে’ ছাপা হয়েছে :
“In the next few days there was a great flutter in the Indian delegation. Lenin had agreed to grant an interview. The Indian revolutionaries had been information that Lenin would receive three of their representatives chosen by themeselves. There were differences as regards the choice. Everybody considered himself to be more entitled to the honour and prvilege than the others. I could get all this information through Nalini Gupta, the only who did not share the general hostile attitude against me. He was also the only one among the Indian revolutionary organised some connection with the revolutionary organisations in India by frequently travelling back and forth secretly. He had met some of my friends in India and learned from them about my mission with which I has gone abroadk in the beginning of war. During his last visit to India shortly before he came to Moscow, he was instructed to contact me. So, from the very beginning my relation with him was of mutual trust and confidence” (The Radical Humanist, June 13th, 1954.)
বঙ্গানুবাদ : “পরের ক’দিন ভারতীয় ডেলিগেটদের মধ্যে বেশ নড়াচড়ার আভাস পাওয়া গেল। লেনিন তাঁদের মধ্য হতে তাঁদের দ্বারা নির্বাচিত তিনজন প্রতিনিধির সঙ্গে লেনিন দেখা করবেন। এই তিনজনের নির্বাচন সম্বন্ধে তাঁদের মতভেদ ছিল। বিপ্লবীদের ভিতরে প্রত্যেকেই ভাবতে লাগলেন যে এই সম্মান ও বিশেষ অধিকার পাওয়ার দাবী তাঁরই আর সকলের চেয়ে বেশী। আমি এ সকল খবর নলিনী গুপ্তের মারফতে পেতাম। নলিনী গুপ্তই বিপ্লবীদের ভিতর একমাত্র ব্যক্তি ছিলেন যিনি সাধারণত আমার প্রতি বিরূপ মনোভাব পোষণ করতেন না। ইউরোপে অবস্থানকারী ভারতীয় বিপ্লবীদের ভিতরে নলিনী গুপ্তই একমাত্র ব্যক্তি ছিলেন যিনি গোপনে ঘন ঘন ভারতে যাতায়াত করে ভারতীয় বিপ্লবী প্রতিষ্ঠানসমূহের সহিত সম্পর্ক রেখেছেন। তিনি ভারতে আমার কোনো কোনো বন্ধুর সহিত দেখা করেছেন এবং তাঁদের মুখে শুনেছেন কি কাজের ভার নিয়ে আমি যুদ্ধের শুরুতে বিদেশে গিয়েছিলেম। মস্কো আসার অল্পকাল আগে তিনি শেষবার ভারতে গিয়েছিলেন। তখন তাঁকে [আমার বন্ধুরা] উপদেশ দিয়েছেন যে তিনি যেন আমার সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করেন। এই কারণে তাঁর সঙ্গে আমার যে সম্পর্ক ছিল তা ছিল উভয়ের প্রতি উভয়ের বিশ্বাস ও ভরোসার সম্পর্ক।”
(“এম. এন. রায়ের স্মৃতিকথা”, র্যাডিক্যাল হিউমানিস্ট, ১৩ই জুন ১৯৫৪)
“র্যাডিক্যাল হিউমানিস্ট” পত্রিকায় মুদ্রিত এম. এন. রায়ের স্মৃতিকথা তাঁর বন্ধুদের সম্পাদনায় ১৯৬৪ সালে এলাইড পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড কর্তৃক পুস্তকাকারে প্রকাশিত হয়েছে। ডিমাই অক্টভো সাইজের ৬২৭ পৃষ্ঠার পুস্তক। বোধ হয় আরও অনেক বড় হয়ে যাওয়ার ভয়ে সম্পাদকরা রায়ের মূল লেখার অনেক অংশ বাদ দিয়ে দিয়েছেন। লেখার যে অংশটা আমি এখানে তুলে দিয়েছি, তাও তাঁরা বাদ দিয়েছেন। কিন্তু লেখার এই অংশটা তাঁরা বাদ না দিলেও পারতেন। তা হলে দুনিয়ার মানুষ, কম পক্ষে রায়ের গুণগ্রাহীরা জানতে পারতেন যে কি ভাবে তিনি নলিনী গুপ্তের দ্বারা প্রতারিত হয়েছিলেন। আমি আমার “প্রবাসে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি গঠন” (ইংরেজি তর্জমা The Communist Party of India and its Formation Abroad)[১৫] পুস্তকে একথার উল্লেখ করেছি। রায়ের গুণগ্রাহীরা দিল্লীর ‘Thought’ (থট) নামক ইংরেজি পত্রিকার পরিচালনা করেন। তাতে আমার পুস্তুকের সমালোচনা (June 16, 1962) হয়েছে।
[15. National Book Agency Private Ltd. Calcutta – 73]
সত্য কথাটা এই যে নলিনী গুপ্ত ১৯১৪ সালে ইংল্যান্ডে গিয়েছিলেন। আর, এম. এন. রায় শেষ ভারত ত্যাগ করেছিলেন ১৯১৫ সালে, অর্থাৎ নলিনী গুপ্তের শেষ ভারত ত্যাগ করার এক বছর পরে। নলিনী গুপ্ত নিজ মুখে আমাদের নিকটে স্বীকার করেছেন যে ১৯১৪ সালে তাঁর ইংল্যান্ডে যাওয়ার পরে ও ১৯২১ সালে এম. এন. রায়ের দ্বারা ভারতে প্রেরিত হওয়ার আগে আর কখনও তিনি ভারতে আসেননি। নলিনী গুপ্তের লম্বা দাঁড়িওয়ালা দুই খুড়তুতো কিংবা জেঠতুতো দাদা ছিলেন। তাঁদের নাম ছিল উমেশ দাশগুপ্ত ও যোগেশ দাশগুপ্ত। নলিনী গুপ্ত যখন ১৯২১-২২ সালে কলকাতায় ছিলেন তখন তাঁর এই দুই দাদার একজনের সঙ্গে তিনি আমার পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। তিনিও তখন বলেছিলেন যে “নলিনী ছয়-সাত বছর পরে দেশে ফিরেছে”। আরও ক’বছর পরে নলিনীর সহোদর দাদা মান্দালয়ের শশী গুপ্তও আমায় এই একই কথা বলেছিলেন। এখানে একটি কথা বলে রাখি। নলিনীদের পারিবারিক পদবী “দাশগুপ্ত”। তাঁদের গ্রামের লোকেরা এই দাশগুপ্তদের শুধু “দাশ” বলেন। গ্রামে নলিনীর ডাকনাম ঝড়ু দাশ। তিনি নিজেকে নলিনী গুপ্ত করেছেন। আর, তাঁর দাদা, শশী গুপ্ত শুধু ‘গুপ্ত’তে সন্তুষ্ট না থেকে নিজেকে ‘গুপ্ত’ করেছিলেন। যুদ্ধের ক’বছর কি করে নলিনী গুপ্ত ঘন ঘন ভারতে যাতায়াত করতে পারলেন? জাহাজে স্থান পাওয়া কি এতই সহজ ব্যাপার ছিল? তাছাড়া, নলিনী গুপ্ত তো যুদ্ধের চাকরী করছিলেন
মানবেন্দ্রনাথ রায় কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের তরফ হতে ভারতের সঙ্গে যোগাযোগের ভার পেয়েছিলেন। কিন্তু কাবুল হতে পাঞ্জাবের সঙ্গেসামান্য সংযোগ মাত্র তিনি স্থাপন করতে পেরেছিলেন। তাই নলিনী গুপ্তের মুখে তিনি যখন প্রথম শুনলেন যে তাঁর পুরনো সন্ত্রাসবাদী বিপ্লবী পার্টির বন্ধুরা নলিনীকে তাঁর নিকটে পাঠিয়েছেন তখনই তিনি আনন্দে অভিভূত হয়েছিলেন। বহু বৎসর পূর্বে ভারত ছাড়া ও জার্মানী হতে আসা ন্যাশনালিস্ট বিপ্লবীরা মস্কো এসে দর- কষাকষি করছিলেন। এমন সময়ে যদি সম্ভাবনা দেখা দেয় যে ভারতে অবস্থিত সন্ত্রাসবাদী বিপ্লবীরা তাঁর সঙ্গে যোগ দিতে পারেন তবে তো আনন্দে অভিভূত হওয়ারই কথা। জার্মানী হতে আসা ভারতীয় বিপ্লবীদের ভিতরেও পুরনো সন্ত্রাসবাদীরা ছিলেন। তবে তাঁদের ভারতে ফেরার সম্ভাবনা কম ছিল। আর নলিনী যাঁদের তরফ হতে এসেছেন তাঁরা ভারতেই রয়েছেন, সংখ্যায়ও অনেক বেশী। ব্যাপারটি ছিল খুবই সম্ভাবনাময়। কিন্তু ভারতবর্ষ হতে ওই সময়ে ওই ভাবে কাউকে মস্কো পাঠানো সম্ভব ছিল কিনা তা তিনি একবারও ভেবে দেখলেন না। মানবেন্দ্রনাথ বাঙলা দেশের সন্ত্রাসবাদী বিপ্লবীদের ভিতরে অজ্ঞাত অখ্যাত ব্যক্তি ছিলেন না, সন্ত্রাসবাদী বিপ্লবী সংগঠনগুলির কথা তিনি জানতেন, এসব সংগঠনের নেতাদেরও তিনি চিনতেন। তিনি যদি কষে নলিনী গুপ্তকে জেরা করতেন তবে তাঁর নিকটে ধরা পড়ে যেত যে নলিনী একজন ভুইফোঁড় ব্যক্তি।
১৯২১ সালের ২৩শে ডিসেম্বর তারিখে নলিনী গুপ্তের কলকাতা আগমন
নলিনী গুপ্ত ১৯২১ সালের ২৩শে ডিসেম্বর তারিখে কলকাতা পৌঁছেছিলেন। পুলিসের নিকটে দেওয়া বিবৃতিতে তিনি একথা বলেছেন। কলম্বো হতে ধানুষ্কোড়ি হয়ে তিনি সোজা কলকাতা এসেছিলেন। ধানুষ্কোড়ি হতে সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স ব্যুরোর ডিরেক্টর যে খবর পেয়েছিলেন তার দ্বারাও নলিনী গুপ্তের দেওয়া তারিখটি সমর্থিত হচ্ছে। আমি যে স্মৃতি হতে ১৯২১ সালে নভেম্বর মাসের কোন সপ্তাহে নজরুল ইস্লাম ও আমার সঙ্গে নলিনীর প্রথম দেখা হওয়ার কথা আগে কোনো কোনো জায়গায় লিখেছি তা ভুল। সাক্ষাৎ ওই বছরের ডিসেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহে হয়েছিল।
কলম্বোতে নলিনীর ছয় সপ্তাহ সময় নষ্ট হয়েছিল। সেইজন্য তিনি কলকাতায় পৌছা মাত্রই সন্ত্রাসবাদী বিপ্লবী নেতাদের সঙ্গে দেখা করার চেষ্টা আরম্ভ করেছিলেন। অমর চট্টোপাধ্যায়ের সহিত দেখা করার চেষ্টা তিনি সবেচেয়ে বেশী করেছেন। কিন্তু যতবার চেষ্টা করেছেন ততবারই প্রত্যাখ্যাত হয়েছেন। অথচ দীর্ঘ মিয়াদী কয়েকজন দণ্ডিত বন্দী ছাড়া সন্ত্রাসবাদী নেতারা সকলেই তখন জেলের বাইরে ছিলেন। প্রথম দিন প্রত্যাখ্যাত হওয়ার পরেই নলিনী আমার ও নজরুল ইস্লামের সঙ্গে দেখা করার চেষ্টা করেছিলেন এবং ডিসেম্বর (১৯২১) মাসের ভিতরেই আমাদের সঙ্গে তাঁর দেখা হয়েছিল। তিনি আমাদের নিকটে স্বীকার করেছেন যে তিনি সন্ত্রাসবাদী নেতাদের দ্বারা প্রত্যাখ্যাত হচ্ছেন। এই সব দেখা-সাক্ষাতের পরেই নলিনী তাঁর আত্মীয়দের সঙ্গে দেখা করার জন্যে বাকেরগঞ্জ জিলার বেলদাখান গ্রামে ও ভোলায় গিয়েছিলেন। মাত্র ১৩ দিন কলকাতা হতে তিনি তখন অনুপস্থিত ছিলেন। পুলিসের নিকটে বিবৃতি দিতে গিয়ে এসব কথা নলিনী বলেছেন।
সন্ত্রাসবাদী বিপ্লবী নেতারা নলিনী গুপ্তের সহিত দেখা করার ব্যাপারে যে এমন কঠোরতা অবলম্বন করেছিলেন তার কারণ আছে। প্রথমত, নলিনী গুপ্ত পূর্বে কোনো সন্ত্রাসবাদী বিপ্লবী পার্টির সভ্য ছিলেন না। আমার সঙ্গে তাঁর প্রথম দেখা হওয়ার পরে আমি তাঁকে এবিষয়ে প্রশ্ন করেছিলেম। তিনি এক মৃত সন্ত্রাসবাদী বিপ্লবী যুবকের নামোল্লেখ করেছিলেন। বলেছিলেন যে সুশীলকুমার সেন তাঁর বন্ধু ছিলেন। ১৯১৫ সালের এপ্রিল মাসে নদীয়া জিলায় একটি ডাকাতি করতে গিয়ে সুশীল সেন মারা যান। নলিনী গুহ লিখিত “বাংলায় বিপ্লববাদ” নামক গ্রন্থের পরিবর্ধিত সংস্করণে ( বৈশাখ, ১৩৬১) লেখা হয়েছে যে পুলিসকে লক্ষ্য করে তাঁর দলের লোকেরা গুলি ছুঁড়েছিলেন। সেই গুলিতেই সুশীল সেন মারা যান। যাক, মৃত ব্যক্তি কাউকে কিছু বলতে আসেন না। নলিনী গুপ্তের সঙ্গে সে সন্ত্রাসবাদী বিপ্লবী নেতাদের কেউ দেখা করতে চাইলেন না তার একটা বিশেষ কারণ আছে।
১৯১৩ সালে বর্ধমানে একটা খুব বড় রকমের বন্যা হয়েছিল। বন্যার্তদের সেবা করার জন্যে বিভিন্ন সন্ত্রাসবাদী দলের লোকেরা বর্ধমানে গিয়েছিলেন। সেবার উদ্দেশ্য তাঁদের তো ছিলই তাঁদের অন্য উদ্দেশ্য ছিল, আর্তের সেবার ভিতর দিয়ে তাঁদের পরস্পরের সহিত দেখা সাক্ষাৎ হয়ে যাবে, হয়তো তাঁরা নিজেদের বৈপ্লবিক কাজকর্মের প্রোগ্রামও খানিকটা ঝালিয়ে নিবেন। সন্ত্রাসবাদী বিপ্লবীরা ছাড়াও ছোট বড়ো নানা দলে ভাগ হয়ে আরও অনেকে বর্ধমানের বন্যাত্রাণে গিয়েছিলেন। নলিনী গুপ্তও ‘সঞ্জীবনী’ সম্পাদক কৃষ্ণকুমার মিত্রের সঙ্গে এই কাজে বর্ধমানে গিয়েছিলেন। সেখানে সকলের সঙ্গে সকলের দেখা সাক্ষাৎ হয়েছিল। সন্ত্রাসবাদী বিপ্লবী নেতাদের নলিনী গুপ্ত বন্যাত্রাণের কর্মক্ষেত্রে দেখেছিলেন। তাঁরাও দেখেছিলেন নলিনী গুপ্তকেস এবং চিনেছিলেনও। মিথ্যা কথা বলে একজনের সঙ্গে অপরের ঝগড়া বাধিয়ে দেওয়া নলিনী গুপ্তের একটা সহজাত দোষ ছিল। পরবর্তী সময়ে আমরাও তা উপলব্ধি করেছি। কোনো সন্ত্রাসবাদী বিপ্লবী নেতা যে নলিনী গুপ্তের সঙ্গে দেখা করতে সম্মত হলেন না এটাই ছিল তার দ্বিতীয় কারণ। ১৯২৪ সালে সন্ত্রাসবাদী বিপ্লবী নেতা অতুলকৃষ্ণ ঘোষের সঙ্গে আমি যখন কলকাতা প্রেসিডেন্সি জেলে একত্রে বন্দী ছিলেম তখন তিনি তাঁর বর্ধমানের অভিজ্ঞতার কথা স্মরণ করে আমায় বলেছিলেন যে “নলিনী একটি Scoundrel (পাজী)”।
এই অবস্থার সম্মুখীন হলে নলিনী গুপ্ত একেবারে হতাশ হয়ে পড়েছিলেন। তিনি যখন ভারতে আসছিলেন তখন এম. এন রায় দরকার হলে তাঁকে ন্যাশনালিস্ট ও খিলাফৎ আন্দোলনের নেতাদের সঙ্গে দেখা করতে বলেছিলেন। তাঁর আসল কাজ অবশ্য ছিল সন্ত্রাসবাদী বিপ্লবীদের সঙ্গে এম. এন. রায়ের সংযোগ স্থাপন করা। কারণ, নলিনী গুপ্ত তাঁকে বলেছিলেন যে তিনি সন্ত্রাসবাদী বিপ্লবী নেতাদের তরফ হতে মস্কো গিয়েছিলেন। কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের নিকট হতে টাকা পাওয়ার সম্ভাবনার কথা শুনেও সন্ত্রাসবাদী বিপ্লবী নেতারা তাঁদেরই একজন পুরনো বন্ধু মানবেন্দ্রনাথ রায়ের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনে এগিয়ে আসবেন না এটা নলিনী গুপ্তের ধারণার বাইরে ছিল। যাই হোক, হতাশাগ্রস্ত নলিনী গুপ্ত তাঁর গ্রামের লোক হারানচন্দ্র দাসকে (তাঁর নাম আমি আগে উল্লেখ করেছি) জিজ্ঞাসা করলেন-
“তোমরা তো কলকাতায় এত ঘোরাঘুরি কর, খিলাফৎ আন্দোলনের কোনো নেতাকে চেন না?”
হারানচন্দ্র দাস সঙ্গে সঙ্গেই জওয়াব দিলেন, “কেন চিনব না? আমাদের মৌলবী সাহেব রয়েছেন যে”।
হারানচন্দ্র দাসের এই মৌলবী সাহেব ছিলেন আমাদের আগে উল্লেখ করা আবদুল হাফিজ শরীফাবাদী। তাঁর খদ্দরের পোশাক দেখে কেউ তাঁকে কংগ্রেস খিলাফতের নেতা মনে না করে পারতেন না। এর পরের ঘটনাগুলির কথা আমি আগে উল্লেখ করেছি।
নলিনী গুপ্ত যে সন্ত্রাসবাদী বিপ্লবী পার্টির নেতাদের দ্বারা অবজ্ঞাত ও প্রত্যাখ্যাত হয়েছিলেন এই কথা আমি তাঁর মুখে শুনেছিলেম। আমাদের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার পরেও নলিনী গুপ্ত সন্ত্রাসবাদী বিপ্লবীদের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনের চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন। এটা তাঁর পক্ষে একটা প্রেস্টিজের ব্যাপার হয়ে পড়েছিল। বিখ্যাত আমেরিকান ডেন্টাল সার্জন ডক্টর সুবোধ সেনগুপ্তের এক খুড়তুতো ভাই কলকাতা ইলেকট্রিক সাপ্লাই কর্পোরেশনে চাকরী করতেন। তাঁর নাম ছিল অজয় সেনগুপ্ত। অবশেষে তিনি (অজয় সেনগুপ্ত) একদিন সত্য সত্যই নলিনী গুপ্তের সঙ্গে এজন সন্ত্রাসবাদী বিপ্লবী নেতার সাক্ষাৎ ঘটিয়ে দিলেন। তাঁর নাম ভূপেন্দ্রকুমার দত্ত। তাঁকে কেউ যেন ডক্টর ভূপেন্দ্রনাথ দত্তের সঙ্গে ভুল করে বসবেন না। এটা ১৯২২ সালের মার্চ মাসের কথা। ডক্টর দত্ত দেশে ফিরেছিলেন ১৯২৫ সারে। ভূপেন্দ্রকুমার দত্ত সন্ত্রাসবাদী বিপ্লবী মহলে সুখ্যাত ও সম্মানিত ব্যক্তি, আজও (১৯৬৭) বেঁচে আছেন। নলিনীর সঙ্গে ভূপেন্দ্রকুমারের প্রথম সাক্ষাৎ হয় ওয়েলিংটন স্ট্রীটে ডাক্তার টি.এন. রায়ের চেম্বারে। কিছুক্ষণ কথা হওয়ার পরে নলিনী তাঁকে সঙ্গে করে আমাদের তালতলা লেনের বাসা নিয়ে আসেন। সেখানে আমার সঙ্গেও তাঁর পরিচয় ও কথাবার্তা হয়। যতটা মনে পড়ে সময়টা ১৯২২ সালের মার্চ মাসের শুরু ছিল। তার একদিন কিংবা দু’দিন পরে নলিনী দেশ ছেড়ে চলে যায়।
প্রথম যেদিন নলিনী গুপ্তের সহিত নজরুল ইস্লাম ও আমার দেখা হয়েছিল সেদিন তিনি আমাদের নিকটে মানবেন্দ্রনাথ রায়ের আসল নাম উল্লেখ করেছিলেন। বলেছিলেন নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য (এম. এন. রায়ের আসল নাম) এক সময় নামকরা বিপ্লবী কর্মী ছিলেন। কিন্তু এখন তিনি টাকা-পয়সার ব্যাপারে অসদ্বৃত্তি অবলম্বন করেছেন। তিনি ভারতে আসার পথে বার্লিনে খবর পেয়ে এসেছেন কোন্ সুইস ব্যাঙ্কে নরেন্দ্রনাথের টাকা গচ্ছিত আছে। এবার ফিরে গেলে এই সম্বন্ধে নলিনী গুপ্ত নরেন্দ্রনাথের সঙ্গে বুঝাপড়া করে নিবেন। পরিষ্কার ভাষায় বলছিলেন না বটে, কিন্তু আকার-ইঙ্গিতে আমাদের এই বোঝাতে চাইছিলেন যে এবার ফিরে গিয়ে তিনিই হবেন কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের ভারত সম্পর্কিত প্রতিনিধি। এখানে আমি ভূপেন্দ্রকুমার দত্ত লিখিত তাঁর “বিপ্লবের পদচিহ্ন” নামক স্মৃতিকথা হতে কিঞ্চিৎ তুলে দিচ্ছি।
“বোধহয় ১৯২২ সালের গোড়ায় জার্মানী থেকে এম. এন. রায় এক ব্যক্তিকে পাঠান এখানে তাঁর বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করে অথবা তা সম্ভব না হলে অন্য যে কোনো উপায়ে এদেশে একটি কৃষক শ্রমিকের বিপ্লবী দল গড়তে। এই ব্যক্তি বোম্বেতে পুরনো পরিচিত এক বাঙালি বন্ধুর মারফত কয়েক জনের সহিত যোগাযোগ করে কলকাতায় আসেন, কিন্তু এখানে এম. এন. রায়ের পুরনো বন্ধুরা এই ব্যক্তির সঙ্গে দেখা করতে রাজী হন নাই-একথা পূর্বে উল্লেখ করেছি। আমি তখন কুন্তল ও চারুকে নিয়ে যশিদিতে। কয়েকদিনের জন্য কলকাতায় এসেছি সাতুদা (সাতকড়ি ব্যানার্জি) বলেন, এত বছর বাদে নরেন (এম. এন. রায়) এত বিপদ আপদের ভিতর একজন লোক পাঠাল, তার সঙ্গে কেউ দেখাও করবে না? যাদুদার অনুমোদন নিয়ে আমি ডাঃ টি. এন. রায়ের বাড়ীতে এই লোকটির সঙ্গে দেখা করি।
“ডাঃ টি. এন. রায় ও ডাঃ এ. সি. সেনগুপ্ত (দন্ত চিকিৎসক) তখন এক বাড়ীতেই থাকতেন। ওঁদের সামনেই প্রথম কথা হলো। লোকটি তো চাল দিতে শুরু করলো। বলে এম. এন. রায় কে? কে তাকে চেনে? লেনিনের কাছে যাতায়াত আমরাই… ইত্যাদি।
“বুঝলাম ধাপ্পা। ধমক দিয়ে বলি, আপনি কে মশাই? আপনার Credentials কি? কে আপনাকে চেনে?
“ব’লে উঠে আসছি-বাইরে এসে হাত ধরলোঃ কিছু মনে করবেন না।-রায়ই আমায় এই রকম বলতে বলেছে।”
(বিপ্লবের পদচিহ্ন, ১৬৬-৬৭ পৃষ্ঠা)
সন্ত্রাসবাদী বিপ্লবী পার্টির নেতারা কেউ যে নলিনী গুপ্তের সঙ্গে দেখা করতে রাজী হননি, আর তিনিই যে নিজেকে কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের প্রকৃত প্রতিনিধি বলে ধাপ্পা দিতে চেয়েছিলেন তা উদ্ধৃত লেখা হতে পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে। নলিনী আমাদের শুধু আকার-ইঙ্গিতে বলেছিলেন যে তিনি কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের প্রকৃত প্রতিনিধি। কারণ, আমরা তাঁর নিকট হতে এই বিশ্ব সংগঠনের সাংগঠনিক রূপটা বুঝতে চেয়েছিলেম। তিনি তা আমাদের বোঝাতে পারেননি।
কিন্তু ভূপেন্দ্রকুমার দত্তকে তিনি খোলাখুলি বলার ধৃষ্টতা দেখিয়েছিলেন যে তাঁরই সঙ্গে লেনিনের যোগাযোগ। “ধমক” খেয়ে পরে স্বীকার করেছিলেন যে মানবেন্দ্রনাথ রায়ই তাঁকে পাঠিয়েছেন। নলিনী চলে যাওয়ার পরে ভুপেন্দ্রকুমার দত্তের সঙ্গে আমার প্রথম যে দিন দেখা হলো সেদিন তাঁকে আমি জিজ্ঞাসা করলাম যে নলিনী কোনো সন্ত্রাসবাদী পার্টির সভ্য ছিলেন কিনা সেকথা কি তিনি তাঁকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন। উত্তরে তিনি বললেন যে জিজ্ঞাসা তিনি করেছিলেন। নলিনী যে কোনো সন্ত্রাসবাদী বিপ্লবী পার্টির সভ্য ছিলেন একথা তিনি ভুপেন্দ্রকুমারকে বলেননি। তবে, বলেছেন যে রাজাবাজার বোমার মামলার আসামী শশাঙ্ক হাজরাকে (প্রকৃত নাম অমৃতলাল হাজরা) তিনি চিনতেন। হাজরা তখন জেলের বাশিন্দা। সন্ত্রাসবাদী বিপ্লবী পার্টির এমন দু’জন ব্যক্তির নাম নলিনী করলেন যার একজন মৃত, আর একজন কারারুদ্ধ। যাচাই করার উপায় ছিল না। কিন্তু অমৃতলাল হাজরাকে নলিনী চিনতেন। কারণ, ন্যাশনাল আরকাইবের কাগজপত্র হতে জানতে পারা যাচ্ছে যে রাজাবাজার বোমা মামলার সংস্রবে ১৯১৪ সালের জুন মাসে নলিনী অমৃতলাল হাজরার বিরুদ্ধে পুলিসের নিকটে একটি বিবৃতি দিয়েছিলেন। তাতে তিনি বলেছিলেন যে ৭১/১, সীতারাম ঘোষ স্ট্রীটের মেসে থাকার সময়ে শশাঙ্ক ওরফে অমৃতলাল হাজরার সহিত তাঁর পরিচয় হয়। একবার রাজাবাজারে শশাঙ্কের ঘরে গিয়ে তিনি দেখতে পেয়েছিলেন একটি চামড়ার ব্যাগের ভিতরে প্রায় বিশটি রিভলবার রয়েছে। নলিনীর এই আজগুবী বিবৃতি হতে বোঝা যায় যে তিনি কোনো দিন কোনো সন্ত্রাসবাদী বিপ্লবী পার্টির সভ্য ছিলেন না।[১৬] পরে নলিনীদের ওই অঞ্চলের অনেকের সঙ্গে আমার পরিচয় ও যোগাযোগ হয়েছিল। ওদিককার বেশ কয়েকজন ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির সভ্যও হয়েছিলেন অবশ্য নলিনী গুপ্তের মারফতে নয়। গ্রামের একজন বৃদ্ধ ব্যক্তির নিকট হতে খবর নিয়ে জানা গেছে যে ঘুরে বেড়ানো বেকার যুবক ঝড়ু দাশ (নলিনী গুপ্তের ডাক নাম) গ্রামে বাস করার সময় কখনও কোনো সন্ত্রাসবাদী বিপ্লবী পার্টির সংস্রবে আসেনি, আর লেখাপড়ার দিক থেকে স্কুলের শেষ পরীক্ষাও সে পাস করেনি।
[16. ১৯১৪ সালের জুন মাসে অমৃতলাল হাজরার বিরুদ্ধে দেওয়া নলিনীর বিবৃতিকে আমি আজগুবী বলেছি এই কারণে যে কোনো একজন সন্ত্রাসবাদী বিপ্লবী নেতার নিকটে একসঙ্গে বিশটি রিভলবার থাকা সেকালে একেবারেই সম্ভব ছিল না। আমার বিশ্বাস যে পুলিসও নলিনীর বিবৃতি বিশ্বাস করেনি। এত বড় যে চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার আক্রমণ-তার জন্যে উদ্যোক্তারা সংগ্রহ করতে পেরেছিলেন মাত্র ষোলটি রিভলবার। তার মধ্যে চারটি জোগাড় করে দিয়েছিলেন একা আবদুর রেজ্জাক খান। এই তথ্য “সাপ্তাহিক বসুমতী”তে প্রকাশিত চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার আক্রমণের নেতা অনন্তলাল সিংহের লেখা হতে নিয়েছি। অমৃতলাল হাজরা ১৯১৩ সালে গিরেফ্ফার হয়েছিলেন।]
ভূপেন্দ্রকুমার দত্ত বিবৃত কোনো কোনো উক্তির সম্পর্কে আমি পরে এই পুস্তকের জন্য জায়গায় আলোচনা করব। শুধু একটি কথা আমি এখানে বলে রাখতে চাই যে প্রথম বারে নলিনী গুপ্তকে মানবেন্দ্রনাথ রায় বাঙলা দেশে মজুর কৃষক দলে গড়ে তুলতে পাঠাননি। রায়ের আগেকার পার্টির অর্থাৎ সন্ত্রাসবাদী বিপ্লবী পার্টির নেতাদের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনের জন্যেই শুধু তিনি নলিনীকে বাঙলা দেশে পাঠিয়েছিলেন, সেবারে নলিনী অন্য কোনো প্রদেশেও যাননি। তিনি। উপদিষ্ট হয়েছিলেন যে বিপ্লবীদের সঙ্গে যোগাযোগ ছাড়া যদি নলিনী কংগ্রেসওয়ালা ও খিলাফৎপন্থীদের সঙ্গেও যোগাযোগ করে আসতে পারেন সেটা অধিকন্তু। নলিনী একান্তই বার্তাবহরূপে এদেশে এসেছিলেন। প্রথম বারে তো বটেই, দ্বিতীয় বারেও।
এই নলিনী গুপ্তকে নিয়ে আমায় কম জ্বালা পোয়াতে হয়নি। তিনি যে কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের একজন বিশিষ্ট কেউ নন, লেখাপাড়ও তেমন কিছু জানেন না, এটা আমি বুঝেছিলেম। টাকা কড়িও যে তাঁর নিকটে ছিল না এটাও বুঝতে কষ্ট হচ্ছিল না। জানুয়ারী (১৯২২) মাসের শেষাশেষিতে কিংবা ফেব্রুয়ারীর শুরুতে নজরুল ইস্লাম কুমিল্লা চলে গেল। নলিনীর বোঝা ঘাড়ে নিয়ে আমি একাই থাকলাম। তিনি একদিন এক মুসলিম ভদ্রলোককে সঙ্গে নিয়ে এলেন। পরিচয় দিলেন যে তিনিও তাঁর সঙ্গে ইউরোপ হতে এসেছেন। কেন এসেছেন, কি করছেন তিনি কিছুই বললেন না। তবে, এটা শুনলাম যে দক্ষিণ ভারতের কোনো পোর্টে তিনি যাবেন। নলিনী তাঁকে বাঙলায় একখানা পত্র লিখে দিলেন, বললেন সেই পোর্টে যেন পোস্ট করে দেওয়া হয়। পাঁচ-সাত দিন পরে তাঁর সঙ্গে আমার কলকাতার রাস্তায় দেখা হলো। জিজ্ঞাসা করলাম আপনি যে এখনও এখানে? তখন তিনি আমার নিকটে তাঁর নিজের পরিচয় দিলেন। তাঁর বাড়ী কলকাতায়, বালু হাক্কাক লেন কিংবা এমন কোনো রাস্তায়। নাম আবদুল লতীফ। তিনি জাহাজের বাটলার। ইউরোপের কোনো পোর্টে তাঁর সঙ্গে নলিনীর পরিচয়। ফিরে এসে নলিনীকে এই কথা বলতে তিনি বললেন আবদুল লতীফ আমায় বলেছিলেন যে নলিনী ঠিক কথা বলেননি।
আবদুল লতীফকে দেখিয়ে নলিনী আমায় বোঝাতে চাইলেন, তিনি জাহাজে চাকরী করে এসেছেন। প্রথমটায় আমি অবিশ্বাস করিনি।
সন্ত্রাসবাদী বিপ্লবী পার্টির নেতাদের সঙ্গে তো তাঁর দেখা হলো না। নলিনী এবার ফিরে যেতে প্ৰস্তুত।
আমি তাঁকে জিজ্ঞাসা করলাম, “কি করে যাচ্ছেন?”
“জাহাজে চাকরী করে।”
জিজ্ঞাসা করলাম, “পেয়েছেন জাহাজ”?
নলিনী উত্তর দিলেন, “দাউদ সাহেবকে ধরেছি”।[১৭]
[17. মুহম্মদ দাউদ ইন্ডিয়ান সি-মেন্স ইউনিয়নের জেনারেল সেক্রেটারী, তখন আশলীপুর কোর্টের উকীল, পরে হাইকোর্টের ব্যারিস্টার। এখন বেঁচে নেই।]
একথা শোনার পরের দিন আমি দাউদ সাহেবের বাড়ীতে গেলাম। আগে হতে তাঁর সঙ্গে আমার পরিচয় ছিল। তাঁকে জিজ্ঞাসা করার পরে তিনি আমায় বললেন নলিনী গুপ্ত নামে একজন বিপ্লবী এরকম সাহায্য চাইছিলেন বটে। মনে মনে আমি আশ্চর্য হলাম। এরকম খোলাখুলি বললে কে সাহায্য চাইছিলেন বটে। মনে মনে আমি আশ্চর্য হলাম। এরকম খোলাখুলি বললে কে সাহায্য করতে আসবেন? আমাদের দ্বীপের লাত্তিলয়ালারা (নাবিকদের বোর্ডি কীপার্স) কলকাতায় আছেন। তাঁদের একজনের কাছে যেতে তিনি বললেন, “আমার তো ডেকের লোকের সঙ্গে কারবার। আপনার লোকটি ডেকে কাজ করে যেতে রাজী হলে আমি সাহায্য করতে পারি। নলিনীকে জিজ্ঞাসা করায় বললেন, তিনি নিশ্চয় ডেকে যাবেন। যে সেরাং নলিনীকে নিয়ে যাবেন তাঁর সঙ্গে বোর্ডিং মাস্টার আমার পরিচয় করিয়ে দিলেন। আমি সেরাংকে সঙ্গে করে নলিনীর নিকটে নিয়ে এলাম। নলিনী বললেন ইউরোপের যে কোনো পোর্টে তাঁকে নামিয়ে দিলে তিনি যেতে পারবেন। সেরাং বললেন, তাঁর বোর্টের গন্তব্যস্থল আমেরিকা। কলম্বো ও একটি ফরাসী পোর্টে জাহাজ থামবে। ফরাসী পোর্টটির নাম বললেন, ওরান। ওটা আলজিরিয়ার পোর্ট। নলিনী বললেন, তাতেই হবে। ব্যবস্থা হয়েছিল এই যে যেদিন জাহাজ কলকাতা ছাড়বে সেদিন সেরাং-এর একজন লোক হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়বে। তার জায়গায় সেরাং যে কোনো লোককে সঙ্গে নিয়ে যেতে পারেন। আমরা সেরাংকে একশ’ টাকা দিলাম। নলিনীর তথাকথিত বন্ধুরা পরে রটিয়েছেন যে সেরাংকে তিনশ টাকা দেওয়া হয়েছিল। নলিনী কিন্তু পুলিসের নিকটে বিবৃতিতে বলেছেন যে সেরাংকে একশ টাকাই দেওয়া হয়েছিল। মোট কথা, এক দিন রাত্রে আমি নলিনীকে খিদিরপুর ডকের কোনো একটি বার্থে জাহাজে চড়িয়ে দিয়ে এলাম। এর একদিন কিংবা দু’দিন আগে নলিনী গুপ্তের সঙ্গে ভূপেন্দ্রকুমার দত্তের দেখা হয়েছিল।
নলিনী চলে যাওয়ার পরে আমি ৩/৪সি তালতলা লেনের বাসা ছেড়ে দিয়ে ১০/১, ব্রাইট স্ট্রীটে উঠে গেলাম।
যতীন্দ্রনাথ মিত্র ও রমেশচন্দ্র দাশগুপ্ত
নলিনীর কাণ্ড কারখানার অনেক কথা এখনও বলা হয়নি। তিনি দু’জন লোককে রিক্রুট করেছিলেন। তাঁদের নিয়ে এসে আমার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন। একজনের নাম যতীন্দ্রনাথ মিত্র। ঢাকা শহরের ফরাসী (তখনকার দিনে ছিল) ইলাকায় বাড়ী। খুলনা জিলার কুখ্যাত ঘুসখোর পুলিসের দারোগা কামিনীকুমার মিত্রের ছেলে। তখন তিনি অবসর গ্রহণ করেছিলেন। যতীন্দ্রনাথ মিত্র বি.এ. পাস। দ্বিতীয় ব্যক্তির নাম রমেশচন্দ্র দাশগুপ্ত। তাঁর বাড়ী ছিল নলিনীদের বেলদাখান গ্রামে। কিন্তু তাঁর পিতা সন্ন্যাসী হয়ে গৃহত্যাগ করায় তিনি বানরীপাড়ার দিকে মাতামহরে নিকটে মানুষ হয়েছিলেন। মাতামহ ছিলেন একজন দেশবিখ্যাত আয়ুর্বেদীয় চিকিৎসক। যতীন মিত্র ছিলেন একজন স্বার্থপর, অরাজনৈতিক ব্যক্তি, আর রমেশ দাশগুপ্তের নেশা ছিল রাজনীতি। সঙ্গে সঙ্গে উদরান্নের জন্যে কিছু রোজগারও করতে চাইতেন। সুশিক্ষিত যুবক। যতটা মনে করতে পারছি গৌড়ীয় সর্ববিদ্যায়তন হতে বি.এ. পাস করেছিলেন। ত্যাগের দৃঢ়তা তার মধ্যে ছিল। স্থির হয়েছিল দু’জনেই পাসপোর্ট নিয়ে জার্মানী যাবেন। যতীন মিত্র আগেই পাসপোর্ট পেয়েছিলেন। রমেশ দাশগুপ্ত পেয়েছিলেন কিনা তা আমার মনে নেই। আমি নলিনীকে জিজ্ঞাসা করলাম, এঁদের কি জন্যে জার্মানী নিয়ে যাচ্ছে? নলিনী গুপ্ত বললেন, এঁরা কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের খরচে কিছু বিদ্যা শিখবেন, আর কাজ-কর্মে আমাদের সাহায্য করবেন। বললেন জানেন তো আমি প্রায়ই অসুস্থ থাকি, কমপক্ষে চিঠি-পত্রগুলি ডাকে দেওয়ার কাজ এঁরা করতে পারবেন। যতীন মিত্রের নিকটে পাসপোর্ট তো ছিলই, রাহা খরচও ছিল। তিনি বাড়ীতে ব’লে ক’য়ে এসেছিলেন। কথা ছিল নলিনী গুপ্ত জার্মানীতে পৌঁছেছেন খবর পেলে যতীন মিত্র এখান থেকে রওয়ানা হবেন। রমেশ দাশগুপ্ত যাবেন তার পরে। এঁদের দু’জনের জার্মানী যাওয়া সম্বন্ধে নলিনী আমায় যা বলেছিলেন তা থেকে পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছিল যে নলিনীই হবেন ভারত ও কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের মধ্যে যোগসূত্র। সে বিদ্যাবুদ্ধি ও যোগ্যতা যে তাঁর ছিল না সে-কথা তিনি একবারও ভাবেননি।
নলিনী গুপ্তকে আমি খিদিরপুর ডকে জাহাজে চড়িয়ে দিয়েছি, তিনি ইউরোপে পৌঁছে যাবেন এবং তাঁর পৌছাবার খবর কিছুকাল পরে পেয়ে যাব এই আশায় আমি রয়েছি, এর মধ্যে হঠাৎ একদিন কলম্বো হতে নলিনীর এক সুদীর্ঘ পত্র এলো। পত্রে তিনি যা লিখেছেন তা পড়ে আমি হতভম্ব হয়ে পড়ি। নলিনী গুপ্ত লিখেছেন : সেরাং আমাদের মিথ্যা কথা বলেছেন। এই জাহাজ ইউরোপের কোনো পোর্টে থামবে না, কলম্বো হতে সোজা চলে যাবে আমেরিকায়। নলিনীকে দিয়ে সেরাং কঠিন কাজ করিয়েছেন। কাছি টেনে টেনে তাঁর হাতে ফোস্কা পড়ে গেছে, ইত্যাদি। জাহাজ কলম্বো পৌঁছানোর আগেই নলিনী সব কথা ক্যাপ্টেনকে জানিয়ে দেন। ক্যাপ্লেট বললেন তিনি কলম্বো পোর্টে নলিনীকে নামিয়ে দিবেন, তবে তাঁকে নিরাপদে গেটের বাইরে পৌছিয়ে দিতে তিনি পারবেন না। রাত্রি বেলা নিজ দায়িত্বে নলিনী জাহাজ হতে নেমে পড়েন। গেটে দরওয়ান খানিকটা তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিলেন। নলিনী লিখেছেন তিনি সেই সুযোগে গেটের বাইরে চলে আসেন। তারপরে, তিনি লিখেছেন, যা হবার হয়েছে, টাকা পেলে তিনি কলম্বো হতেই ইউরোপে চলে যেতে পারবেন। চারশ’ টাকা তিনি চেয়েছেন আমার কাছ থেকে। আর লিখেছেন যতীন মিত্রকে আমি যেন সঙ্গে সঙ্গেই কলম্বো পাঠিয়ে দিই।
এখন কথা হচ্ছে যে টাকা আমি কোথায় পাই? আমার নিকটে টাকা ছিল না, নলিনী কোনও টাকা আমাকে দিয়েও যাননি। আমি যতীন মিত্র ও রমেশ দাশগুপ্তকে খবর দিলাম। যতীন মিত্র কলম্বো, অর্থাৎ জার্মানী যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হতে লাগলেন। তাঁর অন্য কোনো দিকে ভ্রুক্ষেপ করার প্রয়োজন নেই। তাঁর ধারণা যে আমাকেই টাকা বার করে দিতে হবে। রমেশচন্দ্র দাশগুপ্ত অন্য ধরনের লোক। তিনি আমার অবস্থা গভীর সহানুভূতির সহিত বিচার করার চেষ্টা করলেন। বললেন, “টাকার জন্যে আমায় যেখানেই আপনি পাঠাবেন, আমি যাব”। কিন্তু, কোথায় পাঠাব আমি তাঁকে? রামচন্দ্র ভট্টাচার্য (পরে ডক্টর রামচন্দ্র ভট্টাচার্য) বার্লিনে নলিনীর ছাত্রবন্ধু ছিলেন। তাঁক ভরোসা করেই নলিনী বার্লিনে এম. এন. রায়ের স্থলাভিষিক্ত হতে চেয়েছিলেন। কলকাতায় নলিনী যখন আমার নিকটে ছিলেন তখন তিনি রামচন্দ্র ভট্টাচার্যের এক বিশিষ্ট বন্ধুর সঙ্গে দেখা করেছিলেন। তিনি ছিলেন বর্ধমানের বিশিষ্ট উকীল নলিনাক্ষ বসুর নাতি (পৌত্র)। তাঁর নাম বিজয় বসু। রমেশ দাশগুপ্তকে আমি তাঁর নিকটে পাঠালাম সব খবর শুনে বসু কলকাতা এলেন এবং আমার হাতে একশত টাকার একখান নোট দিলেন। এই নোটখানাও আমি যতীন মিত্রকে দিয়ে তাঁকে কলম্বোর পথে রওয়ানা করে দিলাম।
কিন্তু নলিনীকে পাঠাবার জন্যে আমি টাকার চেষ্টা করতে থাকলাম। ভূপেন্দ্রকুমার দত্তকে আমি খুঁজিনি। কারণ, তিনি টি.বি. রোগী নিয়ে কলকাতার বাইরে ছিলেন। তাদের অন্য কোনো লোকের সঙ্গে তখনও আমার পরিচয় ছিল না। অনেক চিন্তা করার পরে আমি একদিন রাত্রে আবদুর রজ্জাক খানের সঙ্গে দেখা করতে গেলাম। ১৯১৩ সাল হতে আমি কলকাতার বাশিন্দা। মৌলবী মুহম্মদ আকরাম খানের সাপ্তাহিক “মোহাম্মদী” পত্রিকার অফিসে আমি যাতায়াত করতাম। এই সূত্রে আবদুর রজ্জাক খানের সহিত আমার পরিচয়। তিনি তখন কলকাতা মাদ্রাসার আরবী বিভাগে পড়তেন। মৌলবী মুহম্মদ আকরম খানের তিনি নিকট আত্মীয়,-মাসতুত ভাই ছিলেন, পরে তাঁর মেয়েকে বিয়ে করেছেন। রাজনীতির দিকে তাঁর খুবই টান ছিল। ভাবী সংগ্রামে কাজে লাগতে পারে ভেবে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়ে তিনি ইন্ডিয়ান ডিফেন্স ফোর্সে ভর্তি হয়ে সৈনিক শিক্ষা গ্রহণ করেছিলেন। সুভাষচন্দ্র বসু এই শিক্ষার জোরেই ১৯২৮ সালে কলকাতায় কংগ্রেসের অধিবেশনের সময়ে জেনেরেল অফিসার কমান্ডিং হয়েছিলেন। যাক সে কথা। ওই সময়ে আবদুর রজ্জাক খান হাকীম মসীহুর রহমানের ছেলে সামুজ্জামানের সহিত ভাগে উর্দু ভাষায় একখানা দৈনিক নিউজ শীট্ বার করেছিলেন। আপার চীৎপুর রোডে হাকীম সাহেবের দাওয়াইখানার তেতলায় আমি তাঁর সঙ্গে দেখা করি এবং নলিনী সংক্রান্ত সব কথা তাঁকে বলি। কলম্বোতে নলিনীকে পাঠাবার জন্যে তাঁর নিকট হতে আমি টাকাও চাই। তিনি বললেন পরের দিন তিনি কথাটা তাঁর দলের নিকটে তুলবেন। বুঝলাম তিনি একটি গোপন দলের সহিত সংসৃষ্ট। আমি তখন বালীগঞ্জে ১০/১, ব্রাইট স্ট্রীটে থাকি। পরের দিন রাত্রে খান সাহেব একজন বাঙালি ভদ্রলোককে সঙ্গে নিয়ে ওই বাড়ীতে এলেন। তাঁদের দলের তহবীল ও অন্য বিশেষ কাজের জিম্মায় ভদ্রলোকটি রয়েছেন ব’লে তাঁর সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে দিলেন এবং বললেন যে তাঁকে আমার কথাগুলি জানানো হয়েছে। আমার কথাগুলি মানে নলিনীকে পাঠানোর জন্যে টাকার কথা। ভদ্রলোকটি আমায় বললেন যে টাকা জোগাড়ের জন্যে তিনি বিশেষভাবে চেষ্টা করবেন। কি চেষ্টা তিনি করেছিলেন তা আমি জানিনে, পরে তিনি আমায় বলেছিলেন যে অনেক চেষ্টা করেও তিনি টাকা জোগাড় করতে পারেননি। তবে, আমাদের প্রদর্শিত রাজনীতিক পথে তিনি চলবেন ব’লে ওয়াদা করলেন। আবদুর রাজ্জাক খানও সেই ওয়াদা আগে করেছিলেন।
আগেই আমি বলেছি, যতীন্দ্রনাথ মিত্র কলম্বো চলে গিয়েছিলেন। আমার বিশ্বাস ছিল সেখান থেকে তিনি জার্মানী চলে যাবেন। কিন্তু একদিন সন্ধ্যার পরে হঠাৎ তিনি আমার বাসস্থানে এসে হাজির। বললেন নলিনী গুপ্ত কলম্বোতে গিরেফতার হয়ে গেছেন। তবে, টাকা পেলে তিনি চলে যেতে পারবেন, অর্থাৎ তিনি যদি ইউরোপে চলে যেতে চান তবে সিংহলের ব্রিটিশ পুলিস তাঁকে পশ্চিম ইউরোপে চলে যেতে দিবেন। এই কথা বলে তিনি আমার অতি দুর্বল ঘাড়ে চেপে বসে পড়লেন, আর টাকা সংগ্রহের জন্যে আমায় অতিষ্ঠ করে তুলতে লাগলেন। বোঝেন না আমি টাকা পাব কোথায়। রমেশ দাশগুপ্ত আর আমি ভাবি যতীন মিত্র কেন কলকাতায় এসে আমার ঘাড়ের ওপর বসে পড়লেন? কী তাঁর মনের বাসনা? শেষে একদিন রমেশ দাশগুপ্ত আসল ঘটনা আবিষ্কার করলেন। যতীন মিত্রের লেখা কিছু হিসাব তাঁর কাগজপত্র হতে বার হয়ে পড়ল। তাতে দেখা গেল যে নলিনী গুপ্ত তাঁর টাকায় জাহাজে টিকেট কিনে প্যাসেঞ্জার হয়ে ইউরোপে চলে গেছেন তিনি যতীন মিত্রকে বলে গেছেন যে ইউরোপে পৌঁছে তাকে টাকা পাঠাবার ব্যবস্থা করা হবে। সেই টাকা এলে তিনি যাবেন। এই কথাটাই ঠিক তা এইজন্যে বোঝা গেল যে নলিনীর জার্মানী পৌছানোর কিছুদিন পরে আমার নামে সুইস্ ব্যাঙ্কিং কর্পোরেশনের লন্ডন শাখার বরাবরে একত্রিশ পাউন্ডের একখানা চেক এল। সেই চেকখানা ডেন্টাল সার্জ ডক্টর সুবোধ সেনগুপ্তের হিসাবে জমা দিয়ে ক্যাশ করানো হয়েছিল। সব টাকাই যতীন মিত্রকে দেওয়া হয়েছিল। যতীন মিত্র প্রায় খোলাখুলি ডক্টর সুবোধ সেনগুপ্তকে বলেছিলেন যে টাকাটা আমি মেরে দিতে পারি।
জার্মানীতে গিয়ে এই যতীন মিত্র আমাদের পার্টির ওপরে বোঝা স্বরূপ হয়েছিলেন। এম. এন. রায় দুঃখ করে আমায় লিখেছিলেন, যতীন মিত্রকে এদেশে এনে ‘কুমার’ (নলিনী গুপ্তের দ্বিতীয় নাম) কি ভুলই না করেছে। লোকটি অপদার্থ ও অ-রাজনীতিক। তার নিকটে বৈধ পাসপোর্ট আছে। তাকে খবর নিয়ে দেশে যেতে বললাম। সে কিছুতেই যেতে রাজী নয়। যতীন মিত্র ওদেশে কিছু কাজ শিখতে চেয়েছিলেন। দেশে ফেরার পরে দেখা গেল যে জার্মান ভাষা ছাড়া আর কিছুই তিনি শিখেননি। কি একটা কাঠ চেরাই মেশিন বসাবার কাজ নাকি তিনি শিখেছিলেন। কিন্তু তা থেকে তাঁর কোনো চাকরী কোনো দিন হয়নি। যতীন মিত্র আর বেঁচে নেই।
কানপুর বলশেভিক ষড়যন্ত্র মোকদ্দমা (ভারত গবর্নমেন্টের দেওয়া নাম) সংক্রান্ত ন্যাশনাল আরকাইবের কাগজ-পত্র পড়ে দেখা যাচ্ছে যে যতীন মিত্রের নাম বারে বারে উল্লিখিত হয়েছে। সেক্রেটারী অফ্ স্টেট ফর ইন্ডিয়া দারুণ উৎকণ্ঠার সহিত যতীন মিত্রের সম্বন্ধে ভারত গবর্নমেন্টকে শুধু পত্র লিখে মনে সান্ত্বনা পাচ্ছেন না, তারও পাঠাচ্ছেন। আমার মনে হয় ভারতের সেন্ট্রাল ইনটেলিজেন্স ব্যুরোর জার্মানীতে অবস্থিত এজেন্ট অকারণে স্টেট সেক্রেটারী ও ভারত গবর্নমেন্টকে উত্তেজিত করে তুলেছিলেন। অনেকে আমার নিকটে জানতেও চান যে এই যতীন মিত্র কে? রমেশ দাশগুপ্ত আর বেঁচে নেই। আমি মরে গেলে যতীন মিত্রের এই ব্যাপারের বিষয়ে সত্য কথা বলবার আর কেউ থাকবেন না। এই কারণে এখানে তাঁর বিষয়ে আমায় কিছু লিখতে হলো।
মিথ্যা বলতেই নলিনী গুপ্ত অভ্যস্ত ছিলেন। তাঁর মিথ্যা কথাগুলি ধরাও পড়তে লাগল। তিনি আমাদের বলেছিলেন, জাহাজে চাকরী করে তিনি দেশে ফিরেছিলেন। কলম্বোর ব্যাপারে ধরা পড়ে গেল যে তাঁর নিকটে বিট্রিশ পাসপোর্ট ছিল। কলম্বো হতে টিকেট কিনে জাহাজের যাত্রী হয়ে বেশ নিশ্চিন্ত মনে তিনি পশ্চিম ইউরোপে চলে গেলেন। আবার তিনি জাহাজের যাত্রীরূপে যে কলম্বো হয়ে দেশে ফিরেছিলেন সেটাও তাঁরই কারণে জানাজানি হয়ে গেল। নলিনী যখন জাহাজে দেশে ফিরছিলেন তখন তিনি তাঁর এক সহযাত্রীকে ৫ পাউন্ড ধার দেন। এই সহযাত্রী ছিলেন জাকার্তার লোক। জাকার্তার লোকের ঠিকানা আবার নোট বুকে লিখে রেখেছিলেন নলিনীর একজন ইউরোপীয় সহযাত্রী (নলিনীর মতে আইরিশম্যান)। তিনি কলকাতা আসছিলেন। কলম্বো হতে লিখিত পত্রে নলিনী আমায় অনুরোধ করেন যে আমি যেন কত নম্বর গঙ্গাধর ব্যানার্জি লেনে গিয়ে সেই আইরিশম্যানের নিকট হতে জাকার্তার লোকের ঠিকানা নিয়ে তাঁকে পাঠিয়ে দিই। ঠিকানা আনতে গিয়ে আইরিশম্যানের নিকট হতে আমি জানতে পাই যে নলিনী তাঁর টিকেট-কেনা সহযাত্রী ছিলেন। ১৯২৩ সালে কলকাতা পুলিশের নিকট বিবৃতি দিতে গিয়ে নলিনী বলেছেন যে তিনি ব্রিটিশ পাসপোর্টধারী ছিলেন এবং প্রথমবারে মার্সাই (Marseilles) হতে ফরাসী জাহাজ Aukor-এর যাত্রীরূপে কলম্বো পৌঁছেছিলেন।
.
যে সেরাং নলিনী গুপ্তকে নিয়ে গিয়েছিলেন, সফর (Voyage) হতে ফিরে আসার পরে আমি তাঁর সঙ্গে দেখা করি। তিনি আমায় বললেন নলিনী গুপ্ত (জাহাজে অন্য নাম ছিল) তাঁকে বিপদে ফেলেছিল। তাতে তাঁর চাকরী তো চলে যেতই, বোডিং মাস্টারেরও লাইসেন্স বাতিল হয়ে যেত। সেরাং বললেন নলিনীকে একেবারে কাজ না করিয়ে নিয়ে গেলে তিনি ক্যাপ্টেনের নিকটে ধরাপড়ে যেতেন। কিছু কাজ না করিয়ে তাঁর উপায় ছিল না। নলিনী কাজ করতে চাইছিলেন না। কলম্বো পৌঁছাতে তখনো দেরী আছে, নলিনী সেরাংকে বলেন যে, তিনি বিপ্লবী ক্ষুদিরামের দলের লোক ইত্যাদি। এখানেও তিনি থামেননি, সোজা ক্যাপ্টেনের নিকটে চলে গিয়ে সব কথা বলে দেন। সেকেন্ড অফিসার সুপারিশ করে সেরাং ও বোর্ডি মাস্টারকে বাঁচিয়ে দিলেন। অর্থাৎ ক্যাপ্টেন তাঁদের বিরুদ্ধে কোনো রিপোর্ট করলেন না। নলিনী গুপ্তকে কলম্বো পোর্টে নামিয়ে দেওয়া হয়। সেরাং একথাও আমায় বললেন যে জাহাজ সত্যই একটি ফরাসী পোর্টে থেমেছিল। আমাকে তিনি শিপিং অফিসে গিয়ে কাগজ পত্র অনুসন্ধান করতে বললেন, কোম্পানীর কলকাতা অফিসেও অনুসন্ধান করতে বললেন। আমি সে-সব কিছু করিনি। পরে আমার অনুতাপ হয়েছিল এই জন্য যে আমার স্যালুনে চেষ্টা করা উচিত ছিল। স্যালুনের কাজ ডেকের মতো কষ্টকর নয়। নলিনী নিজেই দাউদ সাহেবকে ধরেছিলেন বলে আমি ডেকওয়ালাদের নিকটে যাই। ইন্ডিয়ান সিমেন্স ইউনিয়ন ডেক ও ইঞ্জিন রুমের ক্রদের নিয়ে গঠিত ছিল।
আসলে জাহাজে চাকরী করতে গিয়ে নলিনী আমাদের নিকটে মিথ্যা অভিনয় করেছিলেন। পাসপোর্ট যাঁর নিকটে ছিল, প্যাসেঞ্জার হয়ে যাওয়ার পক্ষে যাঁর পথে কোনো বাধা ছিল না, তাঁর পক্ষে জাহাজে চাকরী করার কি প্রয়োজন?
তারপরে, ১৯২৪ সালের মার্চ মাসে কলকাতা প্রেসিডেন্সী জেলের গেট হতে কানপুর পর্যন্ত পুলিসের হেফাজতে নলিনী আর আমি একসঙ্গে যাই। কানপুর জেলেও একত্রে থাকি। ১৯২২ সালের মার্চ মাসে নলিনীকে আমি যে কলকাতার খিদিরপুর ডকে জাহাজে তুলে দিয়েছিলেম তারপরে তাঁর সঙ্গে আমার এই প্রথম দেখা। জেলে গিয়ে নলিনীর সঙ্গে আমার যে কথাবার্তা হয় তা এইরূপ :
আমি। কলম্বোতে কি ঘটেছিল?
নলিনী। চিঠিতে আমি সত্যই লিখেছিলেম যে জাহাজ কলম্বো হতে সোজা- সুজি আমেরিকা চলে যেত। তাই কলম্বো নেমে যেতে বাধ্য হই।
আমি। আপনি তো যতীন মিত্রের টাকায় টিকেট কিনে ইউরোপে চলে গেলেন, তবে কেন আমার নিকটে খবর পাঠালেন যে আপনি কলম্বোতে গিরোর হয়ে আছেন?
নলিনী। যতীন মিত্র মিথ্যা রিপোর্ট দিয়েছে। আমি সত্য কথা আপনাকে জানাতে বলেছিলেম। আমি তাকে বলেছিলেম যে আপনার নিকটে টাকা পাঠানো হবে। সেই টাকায় সে জার্মানী চলে যাবে।
আমি। আপনার নিকটে তো পাসপোর্ট ছিল। তবে আপনি জাহাজে চাকরী করে যাওয়ার কেলেঙ্কারিটা করতে গেলেন কেন? পাসপোর্ট না থাকলে আপনি কলম্বোতে জাহাজের টিকেট কিনতে পারতেন না।
নলিনী। আমার নিকটে কোনো পাসপোর্ট ছিল না। ওই সময়ে ভারতীয় ইনটেলিজেন্স ব্রাঞ্চের লোকেরা কলম্বোতে গিজগিজ করছিলেন। তাঁদের ভিতরে বাঙলার অফিসাররাও অনেক ছিলেন। কারণ, প্রিন্স অফ ওয়েল্স্ সিংহল হয়ে দেশে ফিরছিলেন। আমার সঙ্গে এই ইনটেলিজেন্স অফিসারদের দেখা হয়। তাঁরা আমায় বলেন, “আপনি একজন বিপজ্জনক বিপ্লবী। আপনি আবার ভারতবর্ষে ফিরে যান এটা আমরা চাইনে”। তাঁদের এই কথায় সিংহল গবর্নমেন্ট একজন ভারতীয় ব্রিটিশ প্রজা বলে আমাকে একটা পরিচয়পত্র (Identification Certificate) দিলেন। তার বলেই আমি যাত্রীরূপে জাহাজে চড়ার টিকেট কিনতে পেরেছিলেম।
নলিনী গুপ্তের পুলিসের নিকটে দেওয়া বিবৃতি হতে এখন বুঝতে পেরেছি যে তিনি আগাগোড়া মিথ্যা কথা বলেছিলেন।
নলিনী গুপ্তের বিষয়ে দারুণ অনিচ্ছা সত্ত্বেও পরে আমায় আরও অনেক লিখতে হবে। তার হাতে মানবেন্দ্রনাথ রায় তো বোকা বনেছিলেন, আমরাও তার দ্বারা দীর্ঘকাল প্রতারিত হয়েছি। তার কাজকর্ম হতে বারে বারে মনে সন্দেহ জেগেছে বটে, তবে সেই সন্দেহকে আমরা মন হতে বারবার মুছে ফেলার চেষ্টা করেছি। ১৯২৭ সালে সে যে এদেশ হতে চলে গেল তার পরে তার সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক ছিল না। জার্মানীতে হিটলার ক্ষমতা দখল করার পরে তার সঙ্গে আমাদের পার্টির কোথাও কোনো সম্পর্ক ছিল বলে আমার মনে হয় না। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময়ে নলিনী দেশে ফিরেছিল। কি করে ফিরেছিল এবং দেশে এসে কি করে জীবিকা নির্বাহ করত তা আমরা জানিনে। আমাদের সঙ্গে কোনোও সম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টা সে করেনি। তার ভাইপোদের উপরে তার নিষেধাজ্ঞা ছিল যে তারা যেন কখনও কমরেড আবদুল হালীমের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ না করে। হালীমের সঙ্গেই তাদের পরিচয় ছিল।
১৯২১ সালে নলিনী গুপ্ত যে এম. এন. রায়কে ধাপ্পা দিয়েছিল তার উল্লেখ আমি আগে করেছি। কিন্তু রায়ের স্মৃতিকথা পড়ার আগে আমরা জানতে পারিনি যে কি কি মিথ্যা কথা বলে নলিনী গুপ্ত রায়ের বিশ্বাস অর্জন করেছিল। আমাদের যদি তা জানা থাকত তবে ১৯২২ সালেই আমরা রায়কে সাবধান করে দিতে পারতাম। ১৯১৪ সালের পরে (পুলিসের নিকটে নলিনী ১৯১৫ বলেছে) যে ১৯২১ সালেই নলিনী গুপ্ত দেশে ফিরেছিল এবং ১৯২২ সালের মার্চ মাসে তার দেশ ছাড়ার পূর্বক্ষণে একমাত্র ভূপেন্দ্রকুমার দত্ত ছাড়া অন্য কোনো সন্ত্রাসবাদী বিপ্লবী নেতা যে তার সঙ্গে দেখা করতে রাজী হননি, এই সত্য খবরগুলি আমি অন্তত ১৯২২ সালেই তাঁকে জানাতে পারতেম। নলিনীর কথাবার্তা হতেও তাঁর মনে কোনো দিন কোনো প্রশ্নোদয় হলো না এটা বড় আশ্চর্য কথা। জার্মানীতে হিটলারের ক্ষমতা দখলের পরেও সেদেশে নলিনী তার রেস্তোরাঁ চালিয়ে গেল, অথচ অন্য কোন ভারতীয় কমিউনিস্ট জার্মানীতে থাকতে পারলেন না,–এই থেকেও মানবেন্দ্রনাথের মনে কোনো প্রশ্ন জাগেনি। নলিনীর প্রতি পরিপূর্ণ বিশ্বাস রেখেই শেষ জীবনে তিনি তাঁর স্মৃতিকথা লিখে গেছেন।
নলিনী গুপ্ত মানবেন্দ্রনাথ রায়ের সঙ্গে ধাপ্পাবাজী করেছে। আমাদেরও সে অনেক ধাপ্পা দিয়েছে। তবুও আমাদের নাম-ধাম মানবেন্দ্রনাথ রায়ের নিকটে, অতএব কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের নিকটেও সে পৌঁছিয়ে দিয়েছে। তার নিজের অস্তিত্ব রক্ষার জন্যে এটা তাকে করতেই হতো। কিন্তু আন্দোলনের কাজ শুরু করতে না করতেই আমার যে কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের সহিত সংযোগ স্থাপিত হয়ে গেল তার জন্যে আমি নলিনীর নিকটে কৃতজ্ঞ।
বোম্বেতে পার্টি গঠন
বোম্বেতে কমিউনিস্ট পার্টির শুরু কিভাবে হয়েছিল এখন আমি সে কথা বলব। বোম্বের উইলসন কলেজ খ্রীস্টান মিশনারীদের দ্বারা পরিচালিত। বাইবল বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্য তালিকাভুক্ত না হলেও এই কলেজের কর্তৃপক্ষ বাইবলের ক্লাসে যোগ দেওয়া ছাত্রদের জন্য বাধ্যতামূলক করেছিলেন। তার বিরুদ্ধে ছাত্ররা তীব্র আন্দোলন করেন। কলেজের জুনিয়র বি এ ক্লাসের ছাত্র শ্রীপাদ অমৃত ডাঙ্গে এই আন্দোলনের নেতাদের মধ্যে ছিল। এইজন্যে তাকে কলেজ হতে বহিষ্কৃত (rusticated) করা হয়। অন্য ছাত্ররাও বহিষ্কৃত হয়েছিলেন। তাঁদের সকলের নাম আমি জানিনে, তবে ইন্টারমেডিয়েট ক্লাসের ছাত্র রঘুনাথ শিবরাম নিম্বকারও যে বহিষ্কৃত হয়েছিল এটা আমি জানি। এদের দু’জনাই পরস্পরের বন্ধু ছিল, উভয়ই সুবক্তা। এটা ১৯১৯ বা ১৯২০ সালের কথা। কলেজ হতে বহিষ্কৃত হয়ে নিম্বকার একটা দোকান খুলেছিল। এই দোকানের তরফ হতে সে কোনো কাগজের ব্যবসায়ীকে একখানি চেক দেয়। ব্যাঙ্কে টাকা ফুরিয়ে যাওয়ায় চেকের গ্রহীতা টাকা পেলেন না। চেকের লেন-দেনের ব্যাপারে মাঝে মাঝে এইরকম ঘটতে আমরা অনেক দেখেছি। কিন্তু নিম্বকারের বিরুদ্ধে তার জন্যে ফৌজদারী আদালতে মোকদ্দমা হলো এবং তার ছয় মাসের সশ্রম কারাদণ্ডও হয়ে গেল। জেল হতে মুক্তি পেয়ে নিম্বকার দোকান তুলে দিয়ে মুলসিপেটা (মুলসিপেটা জায়গার নাম) সত্যাগ্রহে যোগ দিয়ে (১৯২১-২২) আবার সে জেল খাটল।
“গান্ধী বনাম লেনিন” রচনা
কলেজ হতে বহিষ্কৃত হয়ে ডাঙ্গে অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দিয়েছিল। এই আন্দোলন অকৃতকার্য হওয়ার পরে ডাঙ্গে ও তার বন্ধুদের উদ্যোগে বোম্বের প্রাদেশিক কংগ্রেস কমিটির ভিতর একটি ‘র্যাডিক্যাল গ্রুপ’ গঠিত হয়েছিল। কিন্তু আমার আসল বক্তব্য তা নয়। ইতোমধ্যে ডাঙ্গে কিছু কিছু মার্কসবাদ- লেনিনবাদের পড়াশুনার করেছিল। তার ফলে সে রচনা করল তার ছোট ইংরেজি পুস্তক “গান্ধী বনাম লেনিন”[১৮]। ডাঙ্গে আমায় বলেছিল যে ১৯২১ সালের এপ্রিল মাসে এই পুস্তকখানি মুদ্রিত ও প্রকাশিত হয়েছিল। আমরা অবশ্য ১৯২২ সালের শেষার্ধের আগে এই পুস্তক দেখিনি। এটা বুঝতে কোনো অসুবিধা হয় না যে ডাঙ্গে মার্কসবাদ লেনিনবাদের দিকে ঝুঁকেছিল। ১৯২২ সালে ভারতের কমিউনিস্টরা বার্লিনে অফিস স্থাপন করেন। তখন থেকে আমাদের ডাকে পাঠাবার সব কিছু বার্লিনে পাঠানো হতো।
[18. Gandhi verus Lenin.]
‘গান্ধী বনাম লেনিন” এখন দুষ্প্রাপ্য। এই পুস্তকের লেখার বিষয়ে এখন আমি জোরের সঙ্গে কিছুই বলতে পারব না। আমার স্মৃতি হতে পুস্তকখানির বিষয়বস্তু মুছে গেছে বললেও তেমন অত্যুক্তি হবে না।
কিন্তু পুস্তকের এক জায়গায় সংক্ষেপে মুদ্রিত গান্ধী ও লেনিনের তুলনা “গণবাণী”তে উদ্ধৃত হয়েছিল। সেই উদ্ধৃতি আমি এখানেও ছেপে দিলাম। তা থেকে “গান্ধী বনাম লেনিন” সম্বন্ধে সকলে একটা ধারণা করে নিতে পারবেন।
সম উদ্দেশ্যে
বর্তমান সামাজিক গ্লানিগুলিকে নষ্ট করা, বিশেষ করে গরীবদের দুঃখ-কষ্ট দূর করা এবং যথেচ্ছাচারকে ধ্বংস করা।
গান্ধীর মতে মানুষের দুঃখ- কষ্টের কারণ : বর্তমান সভ্যতা, বিশেষ করে আধুনিক শিল্পানুষ্ঠানসমূহ এবং তদ্বারা | সঞ্জাত মানুষের দুষ্কর্মসমূহ। | লেনিনের মতে মানুষের দুঃখ কষ্টের কারণ : ধনিকের দ্বারা উৎপাদনের উপায়সমূহ ও ভূমি ইত্যাদি অধিকার, আর্থিক বৈষম্য এবং তার দ্বারা আত্মোৎপন্ন সম্পদে বঞ্চিত সম্প্রদায়ের দারিদ্রের অবনমন, অথচ এ সম্প্রদায়েরই দ্বারা মানবসমাজের বেশীরভাগ গঠিত। |
প্রতিকার | |
আধুনিক সভ্যতার সত্তা ও কলকব্জার বিনাশ সাধন। | বর্তমানের অর্জিত বস্তুগুলিকে রেখে দেওয়া এবং সেগুলিকে সর্বসাধারণের হিতের জন্য ব্যবহার করা, উপায়সমূহকে অর্থাৎ উৎপাদনের সর্বসাধারণের সম্পত্তিতে পরিণত করে যে অতিরিক্ত মূল্য (surplus value) এখন ধনীর পকেটে যাচ্ছে সেটাকে কাজে লাগানো। |
ক্রয়সমূহ | |
১। ধনিকের যথেচ্ছাচার ও অন্য সকল প্রকারের যথেচ্ছাচারকে অবশ্যই বিদুরিত করা। ২। যথেচ্ছাচার শক্তির উপরে বিন্যস্ত রয়েছে। ৩। সৈন্যদলে, খাজনা আদায়ের কাজে ও যথেচ্ছাচারীদের আইন প্রয়োগের কাজে যোগ দিয়ে বা সহযোগিতা করে এ শক্তিকে সম্ভবপর ও রক্ষা করেছেন তাঁরাই যাঁরা নির্যাতিত হয়েছেন। ৪। সকলেই অসহযোগ করুক, সৌধ আপনা হতেই ভেঙে পড়বে। ৫। ধর্ম ও নিরুপদ্রবতাই কেবলমাত্র একাজ সফল করতে পারে। কেন না ধর্ম আধুনিক অর্জিত অবদানসমূহের শূন্যতা কোথায় তার শিক্ষা দিবে। উপদ্রবের দ্বারা উপদ্রবই পাওয়া যাবে, আর নিরুপদ্রব অনুসৃত হবে নিরুপদ্রবের দ্বারা। ইতিহাসে বিপ্লবসমূহের যে অবস্থা দেখা গিয়েছে তাতে যথেচ্ছতন্ত্রের মূলোৎপাটনের সঙ্গে সঙ্গেই একটা ব্যবস্থাহীনতা দেখা দিয়ে থাকে। নিরুপদ্রবতা ও ব্যবস্থাহীনতা নিবারণ করবে। ৬। ধর্ম ও নিরুপদ্রবতার হাতে যখন যথেচ্ছতন্ত্রের পতন হবে, তখন তার ফলে সমাজে একটা ধর্ম-শৃঙ্খলা স্থাপিত হবে। কাজেই, নবকরণের শ্যূতায় সচেতন ধর্ম-সত্তা সর্বসাধারণের ভালোর জন্য নবকরণকে ধ্বংস করবে। মানুষ ও মানবতার বিবেক বিধিই তখন সমাজ বিধিতে পরিণত হবে। বিবেক তার স্বভাব অনুসারে সামাজিক মঙ্গলের জন্যে কাজ করবে। ধনিক-মজুরের গ্লানি, শ্রেণী সংগ্রামের গ্লানি, এরূপ সমাজ হতে দূর হবে। অতএব, মানুষকে পবিত্র কর। ৭। এ সকলের চরম পরিণতিতে ঈশ্বর ও ধর্মের উপাসকবৃন্দের একটা সমাজ গঠিত হবে এবং সে সমাজ বিবেকের অনুজ্ঞা অনুসারে জীবন ধারণ করবে। | ১। ধনিকের যথেচ্ছাচার ও অন্য সকল প্রকারের যথেচ্ছাচারকে অবশ্যই বিদূরিত করা। ২। যথেচ্ছাচার শক্তির উপরে বিন্যাস্ত রয়েছে। ৩। নির্যাতিতেরা স্বেচ্ছায় যোগ দেননি, জোর ক’রে তাঁদের যোগ দেওয়ানো হয়েছে, আর এ জোর নির্যাতিতদের মধ্য হতে সরবরাহ করা হয়েছে এমন কোনো কথা নেই। ৪। সকলে কখনো তা করবেন না, কেন না বর্তমান নির্যাতনের সহিত সমাজের অল্প সংখ্যক লোকের স্বার্থ বিজড়িত রয়েছে। অধিকাংশ লোকই কেবল এ সৌধ ভাঙার জন্য কাজ করবেন এবং এ কাজের অনুসরণও করবেন অধিকাংশ লোক। ৫। ধর্ম, নিরুপদ্রবতা এবং মানুষের এই শ্রেণীর অন্য কোনো ইচ্ছার দ্বারা অত্যাচার দূর হবে না। যথেচ্ছতন্ত্র মুক্তিদাতৃগণের বংশসমূহকে নির্মূল করা পর্যন্ত অগ্রসর হবে। কাজেই, এর মূলোৎপাটন ও নিবারণ নিতান্তই করা উচিত এরই উদ্ভাবিত উপায়সমূহের দ্বারা। যথেচ্ছতন্ত্রের পতনের পরে যে ব্যবস্থাহীনতা আসবে সেটা স্থায়ী জিনিস হবে না। ব্যবস্থাহীনতায় বিরক্ত মানুষ শীঘ্রই আবার একটা শৃঙ্খলায় বিবর্তিত হবে। ইতিহাস এরূপই বরাবর দেখিয়েছে। ৬। খুব বেশী রকম অগ্রসর হতে না পারলে, অনেকগুলি বাইরের শক্তির দ্বারা বিবেকের অনুজ্ঞাগুলি দোষিত হয়ে যায়। উন্নতবিবেক সাধারণ মানুষের মধ্যে পাওয়া যায় না এবং এর বিবর্তনের জন্য শতাব্দীর পর শতাব্দী আবশ্যক হয়। এ কারণে সর্বসাধারণের হিতের জন্য সকল মানুষকে কাজ করতে বাধ্য করা একান্ত আবশ্যক। ধনিকেরা এরূপ করতে রাজী হবেন না। তাই সর্বহারাদের উচিত তাদের একনায়কত্ব (dictatorship) প্রতিষ্ঠিত করে এই কাজটি করা। বাধ্যতার দ্বারা সর্বসাধারণের ভালোর জন্যে কাজ করতে ও সকল জিনিসকে রক্ষা করতে একটা অভ্যাস গঠিত হবে। তারপরে এ অভ্যাস অর্জিত প্রবৃত্তিতে পরিণত হবে। আর যখন প্রবৃত্তি অর্জিত হয়ে যাবে তখন স্বভাবতই একনায়কত্ব (dictatorship) বিলোপ পেয়ে যাবে, যেহেতু এটা একটা পরিবর্তনীয় আকার ও যন্ত্র মাত্র। ৭। এর পরিণতিতে হবে একটা কর্মীর সমাজ, অলসদের সমাজ নয়। এ সমাজ স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে সমষ্টির ভালোর জন্যে কাজ করতে থাকবে। |
রণছোড়দাস ভবন লোটবালা
ডাঙ্গের “গান্ধী বনাম লেনিন” পুস্তকখানি তাকে একটি সৌভাগ্য এনে দিয়েছিল। সেটা রণছোড়দাস ভবন লোটবালার [১৯] সঙ্গে তার পরিচয়। রণছোড়দাসের পিতা ভবনের আটা-ময়দার দোকান ছিল। তাই থেকে তাঁদের পারিবারিক পদবী লোটবালা হয়ে যায়। গুজরাতি ভাষায় আটা-ময়দাকে ‘লোট’ বলা হয়। রণছোড়দাস তাঁর বাবার আটা-ময়দার দোকান তুলে নিয়ে একটি বড় ময়দার মিলের প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তাঁর সেই মিলে আজও (১৯৬৭) কাজ চলেছে।
[19. Ranchoddas Bhavan Lotvala.]
বাবার মৃত্যুর পরে কলেজের পড়া ছেড়ে দিয়ে রণছোড়দাস বাবার ব্যবসায়ে যোগ দিয়েছিলেন। কিন্তু কলেজের পড়া ছেড়ে দিয়ে নিজে নিজে পড়াশুনা করা তিনি কখনও ছেড়ে দেননি। জীবনে তিনি অনেক কিছু হয়েছেন, জ্ঞান সমুদ্রে পাড়ি দিতে গিয়ে অনেক বন্দরেই তিনি তাঁর তরী ভিড়িয়েছেন। সনাতন সমাজের বর্ণভেদ ও শুরু পূজার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে তিনি আর্য সমাজে যোগ দিয়েছিলেন। আর্য সমাজের স্বামী নিত্যানন্দের নামে তিনি ‘নিত্যানন্দ লাইব্রেরী’ নাম দিয়ে বোম্বেতে তাঁর বাড়ীর নীচের তলায় বেশ বড় পাবলিক লাইব্রেরী স্থাপন করেছেন। গান্ধী যখন আমদাবাদে সবরমতীতে আশ্রম স্থাপন করেছিলেন তখন তার জন্যে তিনি এক হাজার টাকা চাঁদা দিয়েছিলেন। আবার ১৯২১ সালে অসহযোগ-খিলাফতের প্রোগ্রাম নিয়ে গান্ধীর সঙ্গে তাঁর মতভেদ, ঝগড়া ও ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। সেই সময় যাঁদের মন নূতনের জন্য উন্মুখ হয়ে উঠেছিল তাদের ওপরে রুশ দেশের অক্টোবর বিপ্লবের প্রভাব পড়া স্বাভাবিক। গান্ধীর সঙ্গে বিচ্ছেদ হওয়ার পরে লোটবালা মার্কসবাদী তত্ত্বের প্রতি ঝুঁকে পড়লেন। নিষ্ঠার সহিত মার্কসবাদের অধ্যয়ন করতে লাগলেন। দু’একখানি ছোট বই পড়ে তিনি থামলেন না, গভীর অভিনিবেশ সহকারে কার্ল মার্কসের ‘ক্যাপিটাল’ও তিনি পড়লেন। মনের এই অবস্থায় ১৯২১ সালের গ্রীষ্মকালে পার্বত্য স্বাস্থ্যনিবাস মহাবালেশ্বরে ছিলেন। সেইসময়ে কেউ তাঁকে ডাঙ্গের “গান্ধী বনাম লেনিন” পড়তে দিলেন। বোম্বেতে ফিরে এসে তিনি ডাঙ্গেকে খুজে বার করলেন। তিনি ডাঙ্গের জন্যে একটা মাসহারা ধার্য করলেন এবং ডাঙ্গে যেন তাঁর লাইব্রেরীতে মার্কসবাদের আরও অধ্যয়ন করতে পারে তার ব্যবস্থাও করে দিলেন। ইতোমধ্যে তাঁর লাইব্রেরী মার্কসীয় সাহিত্যের সংগ্রহে সমৃদ্ধ হয়ে উঠেছিল। ইন্দুলাল যাজ্ঞিক তাঁর লিখিত রণছোড়দাস ভবন লোটবালার ছোট জীবনীতে এতটা লিখেছেন। কিন্তু ১৯২৪ সালে কানপুর জেলে ডাঙ্গে আমাদের বলেছিল যে লোটবালার সঙ্গে দেখা করতে আসা মাত্রই তিনি বললেন, “তুমি লিখেছ এ বই? তোমার বয়স অল্প, এত তাড়াতাড়ি তুমি বই লিখতে গেলে কেন? তোমার জ্ঞান এখনও কাঁচা। তুমি আমার লাইব্রেরীতে আরও পড়াশুনা কর।” এ সব বলার পরেই লোটবালা ডাঙ্গের ভাতা স্থির করে দিয়েছিলেন। বেশ কিছুদিন ওইভাবে পড়ার পরে ডাঙ্গে হাঁফিয়ে উঠেছিল। সে লোটবালার নিকটে গিয়ে প্রস্তাব করল যে একখানি কাগজ সে বার করতে চায়। ডাঙ্গের ‘ সোস্যালিস্ট’ বা’র করার ব্যবস্থা লোটবালাই করে দিয়েছিলেন। ১৯২২ সালের আগস্ট মাসে ‘সোশ্যালিস্ট’ প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল। ‘কমিউনিস্ট পার্টির ইশতেহার’সহ ছোট ছোট কয়েকখানা পুস্তিকাও পুনমুদ্রিত হয়েছিল সে সময়ে লোটবালার টাকায়।
লোটবালা শুধু ময়দার কলের মালিক ছিলেন না। কয়েকখানি সংবাদপত্রেরও তিনি মালিক ছিলেন। কাজেই বড় প্রেসেরও মালিক ছিলেন তিনি। তবে, ব্যবসায়ী লোক হিসাবে সব কিছুর ওপরে তাঁর সতর্ক দৃষ্টি ছিল। ‘সোস্যালিস্ট’ হতে তাঁর বিরাট প্রেসের ওপরে বিপদ আসতে পারে ভেবে তিনি তাঁর প্রেসের বাড়ীর এক কোণে ‘লেবর প্রেস’ নাম দিয়ে একটি আলাদা প্রেস করে দিয়েছিলেন। শ্রীপাদ অমৃত ডাঙ্গে, কেশব নীলকণ্ঠ জোগলেকার ও লোটবালার বিশ্বস্ত কর্মচারী চিতলিয়াকে ক’রে দেওয়া হয়েছিল এই প্রেসের যুক্ত মালিক। জোগলেকার বোম্বের ছাত্র নয়, পুনাতে পড়াশুনা করেছিল এবং পুনা হতেই বি.এ. পাস করেছিল। কি ক’রে ডাঙ্গের সঙ্গে সে যুক্ত হয়েছিল তা জানিনে। কানপুরের মোকদ্দমার সংস্রবে গিরেফতার হওয়ার আগে ডাঙ্গে ঠাকুরদ্বারের যে বাড়ীতে ছিল সেই বাড়ীতে পরে জোগলেকারকে আমরা থাকতে দেখেছি। পার্বতে কোথাকার ছাত্র ছিলেন তা জানিনে, কিন্তু কমিউনিস্ট পার্টি গড়ার প্রাথমিক যুগে তিনিও ডাঙ্গের সঙ্গে ছিলেন। ১৯২৭ সালের শুরুতে বোম্বেতে যখন ওয়ার্কার্স এন্ড পেজান্টস্ পার্টি প্রথমে গঠিত হয়েছিল তখন পার্বতেও তার একজেকিউটিব কমিটির সভ্য হয়েছিলেন। তারপরে আর কখনও পার্বতেকে কমিউনিস্ট পার্টির কোনো কিছুতে দেখা যায়নি। মাঝে কোনো সময় তিনি গবর্নমেন্টের চাকুরীও গ্রহণ করেছিলেন।
আমি লোটবালার কথা বলছিলাম। বোম্বেতে প্রথম আমাদের যুগের কমিউনিস্টরা তার কাছ থেকে সাহায্য পেয়েছিলেন। অবশ্য এই সাহায্য ডাঙ্গেই পেয়েছিল সবচেয়ে বেশী এবং দীর্ঘ দিন ধরে। ১৯২৭ সালের মে মাসের ২৪ শে তারিখে জেল হতে মুক্তি পেয়ে আসার পরেও ডাঙ্গে লোটবালার নিকট হতে আর্থিক সাহায্য পেয়েছে। কিন্তু লোটবালার মধ্যে ক্রমশই পরিবর্তন আসতে থাকে। আমি তো বলেছি তিনি বহু বন্দরে তরী ভিড়াবার লোক ছিলেন। উনিশ শ’ ত্রিশের যুগে ট্রটস্কি সোবিয়েৎ দেশের কমিউনিস্ট পার্টি হতে বহিষ্কৃত হওয়ার পরে তিনি গভীরভাবে ট্রটস্কির লেখা পড়েন এবং ট্রটস্কিপন্থী হয়ে পড়েন, যদিও নিজেকে ট্রটস্কিপন্থী বলে তিনি এখনও ঘোষণা করেননি। ঊনিশ শ’ ত্রিশের যুগেই আচার্যের সঙ্গেও তাঁর পরিচয় হয়। এই সেই আচার্য যিনি তাশকন্দে আবদুর রবের ভারতীয় বিপ্লবী সমিতির সভ্য ছিলেন। মানবেন্দ্রনাথ রায় যখন ১৯২০ সালের অক্টোবর মাসে তাশকন্দে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি গঠন করেন তখন আবদুর রবকে বাদ দিয়ে আগে হতে এনার্কিস্ট হওয়া সত্ত্বেও তিনি কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দিয়েছিলেন। সোবিয়েৎ দেশ হতে পশ্চিম ইউরোপে ফিরে গিয়ে তিনি আবার এনার্কিস্ট হয়েছিলেন। ১৯৩৫ সালে তিনি ভারতে ফিরেছিলেন। কার চেষ্টায়, কি ভাবে তিনি ভারতে আসার নিষেধাজ্ঞার বেড়া পার হয়েছিলেন, তার রুশীয় স্ত্রীই বা কোথায় গেলেন, তা জানিনে। বোম্বেতেই থাকতেন তিনি। তাঁর সঙ্গে পরিচয় হয়ে লোটবালা এনার্কিস্টদের নানান সাহিত্য অধ্যয়ন করেন। এই সব কিছুর পরে লোটবালা Liberatarian Socialist হয়েছেন। এটা কি বস্তু তা আমি জানিনে। লোটবালা এখনও (ডিসেম্বর ১৯৬৭) বেঁচে আছেন। তাঁর বয়স এখন ৯২ বছর। কালা তিনি আগেও ছিলেন, এখন তিনি বদ্ধ কালা হয়েছেন। আজ তাঁর শরীর একটা মাংসপিণ্ড ছাড়া আর কিছুই নয়।
ঘাটে
নিম্বকারের নাম আমি আগে উল্লেখ করেছি। মুলসিপেটা সত্যাগ্রহের পরে সে কমিউনিস্টদের সঙ্গে যোগ দিয়েছিলেন। ১৯২৪ সালের মার্চ মাসে এস এ ডাঙ্গে গিরোর হয়ে কানপুরে যাওয়ার পরে ঘাটে অন্যান্য কমিউনস্টদের সঙ্গে কাজে সক্রিয় হয়ে উঠে। ঘাটের পুরো নাম সচ্চিদানন্দ বিষ্ণু ঘাটে। তার বাবা বিষ্ণু ঘাটে পুরোহিত ছিলেন। ঘাটে মহারাষ্ট্রীয় ব্রাহ্মণ পরিবারের লোক। তার বাবাই প্রথম ম্যাঙ্গালোরে জন্মগ্রহণ করেছিল। ১৯১৪ সালে ম্যাঙ্গালোরের জার্মান মিশন হাইস্কুল হতে সে স্কুল ফাইনাল পরীক্ষা পাস করে, আর ১৯১৭ সালে ম্যাঙ্গালোরের সেন্ট্ এলয়সিয়াস কলেজ [২০] হতে পাস করে সে আই. এ. পরীক্ষা। ১৯১৭ সালেই বোম্বে গিয়ে সিডেনহাম কলেজ অব কমার্সে সে ভর্তি হয়। কমার্স পড়ায় সচ্চিদানন্দ ঘাটের রুচি ছিল না, কিন্তু তার একসাইস্ অফিসার অগ্রজ (পরে সুপারিন্টেন্ডেন্ট হয়েছিলেন) তাকে কমার্স পড়াবেনই। এই নিয়ে অগ্রজের সঙ্গে তার ঝগড়া হয়ে গেল। আরও কিছু কিছু প্রতিবন্ধন তার পথে দাঁড়াল। সে পড়াশুনা ছেড়ে দিল। তারপরে দু’এক ঘাটের জল খেয়ে ঘাটে শ্রীকৃষ্ণ লজ নামক একটি হোটেলে চাকরী নিল। হোটেলের মালিক গোপাল ভট্ট তাকে পুত্রবৎ স্নেহ করতে লাগলেন। তিনিই ঘাটেকে আবার সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে পড়তে পাঠালেন (১৯২১)। ১৯২৩ সালে ঘাটে ইতিহাস ও অর্থনীতিতে [২১] অনার্স নিয়ে বি.এ. পাস করল।
[20. St. Aloysius College.
21. Economics.]
ঘাটের মতে শ্রীকৃষ্ণ লজ সোশ্যালিজমের বিষয়ে আলোচনার একটি আড্ডায় পরিণত হয়েছিল। সি. জি শাহের (সশিক্ষিত যুবক, লেখক, আলোচক ও রণছোড়দাস লোটবালার সেক্রেটারি) সঙ্গে ঘাটের বন্ধুত্ব হয়েছিল। ঘাটে লোটবালার নিত্যানন্দ লাইব্রেরীতে সোশ্যালিজম সম্বন্ধে পড়াশুনা করত। ১৯২২ সালের শেষ ভাগে ডাঙ্গের ‘সোশ্যালিস্ট’ নামক কাগজ বা’র হওয়ার পরে পিত্ৰে নামক একজনের মারফতে ডাঙ্গের সঙ্গে ঘাটের পরিচয় হয়। কিন্তু ঘাটে কমিউনিস্ট আন্দোলনে সক্রিয় হয়েছিল ১৯২৪ সালের মার্চ মাসে ডাঙ্গের গিরেস্তারের পরে। ঘাটের সঙ্গে ডাঙ্গের পরিচয় হওয়ার পরে ডাঙ্গা বিদেশ হতে আসা আমাদের পত্র-পত্রিকাগুলি শ্রীকৃষ্ণ লজের টেবিলে ছড়িয়ে রাখত। ১৯২৩ সালে নলিনী গুপ্ত তাই দেখে এসেছিল এবং আমাদের সামনেই কানপুর জেলে ডাঙ্গেকে সে এ কথা বলেছিল।
মিরাজকর
শান্তারাম এস. মিরাজকারের নাম হতেই বোঝা যায় যে তার পরিবার মিরাজের বাসিন্দা ছিল। মহারাষ্ট্রের একটি ছোট দেশীয় রাজ্যের নাম মিরাজ। মেট্রিকুলেশন পরীক্ষা দেওয়ার আগেই শান্তারাম মিরাজকারকে চাকরী গ্রহণ করতে হয়েছিল। সে ইংরেজি লিখতে পারত, ইংরেজিতে কথা বলতে পারত, সর্বোপরি স্কুলে তার দ্বিতীয় ভাষা ফ্রেঞ্চ ছিল। তাই ফরাসী ব্যাঙ্কে তার চাকরী সহজেই হয়ে গিয়েছিল। ব্যাঙ্কে চাকরীতে ঢোকার সময়েও রাজনীতির প্রতি মিরাজকারের আকর্ষণ ছিল। চাকরী করতে করতেই সে বোম্বে প্রাদেশিক কংগ্রেস কমিটির সভ্য নির্বাচিত হয়েছিল। ডাঙ্গেও একটা র্যাডিকাল গ্রুপ নিয়ে ওই কমিটিতে ছিল। তখনই ডাঙ্গের সঙ্গে তার পরিচয়। ‘সোশ্যালিস্ট’ বার হওয়ার পরে এই পরিচয় ঘনিষ্ঠতর হয়েছিল। কিন্তু কমিউনিস্ট পার্টিতে মিরাজকার যোগ দিয়েছিল ১৯২৭ সালে। ডাঙ্গে তখনও জেল হতে মুক্তি পায়নি। ১৯২৭ সালের জানুয়ারী কিংবা ফেব্রুয়ারী মাসে বোম্বেতেও বাঙলা দেশকে অনুসরণ করে ‘ওয়ার্কার্স এন্ড পেজান্টস পার্টি’ গঠিত হয়। মিরাজকার নির্বাচিত হয় তার প্রথম সেক্রেটারি। এই পার্টির মুখপত্ররূপে ‘ক্রান্তি’ নাম দিয়ে মারাঠি ভাষায় একখানি সাপ্তাহিক কাগজ বা’র হয়। তারও সম্পাদক হলো মিরাজকার। এই সময়ে মিরাজকার একটি দুঃসাহসিক কাজও ক’রে বসল। সে ১২৫ টাকা বেতনের ফরাসী ব্যাঙ্কের চাকরীটি ছেড়ে দিয়ে সামান্য ভাতা নিয়ে পার্টির সব সময়ের কর্মী হয়ে গেল। ব্যাঙ্কের এই চাকরীটি তার পরিবারের একমাত্র সম্বল ছিল। ১৯২৭ সালের জানুয়ারী-ফেব্রুয়ারী মাসের যুগে একটি গরীব কেরানী পরিবারের পক্ষে ১২৫ টাকা বেতনের একটি চাকরী ছিল পরম সৌভাগ্যস্বরূপ। সব কিছুর ওপরে মিরাজকরের বড় ছেলেটি তখন তার প্রথমা স্ত্রীর গর্ভে।
বোম্বেতে পার্টি গড়ার প্রথম অবস্থার কথাটাই শুধু আমি এখানে বললাম।