দেশের বাড়ি
একটা শৌখিন গাড়ি, ছ’জনের বসার জায়গা। সিক্স-সিটার নামে পরিচিত মাঝারি মাপের একটা গাড়িতে সস্ত্রীক তিন বন্ধু রওনা দিয়েছেন ইচ্ছামতীপুরের উদ্দেশে। বেড়াতে যাওয়া, তবুও ঝটিকা সফর। সকালে গিয়ে রাতের মধ্যে ফিরে আসা।
তপসিয়া পেরিয়ে বানতলার রাস্তায় পড়তেই প্রথমে কিছুক্ষণ চামড়ার গন্ধ, চোখমুখ কুঁচকে কোনওক্রমে রাস্তাটা পার হওয়া, তারপর ঠান্ডা-ঠান্ডা মিঠে হাওয়া গায়ে লাগতেই সববার মন বেজায় ফুরফুরে। এ যেন উধাও হওয়া কোনও এক হারিয়ে যাওয়ার দেশে।
হু হু করে ছুটছে সিক্স-সিটার। রাস্তাটা বেশ মসৃণ, সরলরৈখিক, ফলে গাড়িতে গতি বাড়ছে ক্রমশ। দুপাশে মন ভালো করা সবুজ গাছগাছালি।
রাস্তাটার ডানদিকে পাশাপাশি চলেছে একটা ছোটো খাল। হয়তো নিকাশি খাল কেননা কটু গন্ধ ছাড়ছে এক-একবার।
চৌধুরী, ঘোষ, দত্ত আর ব্যানার্জি চারজনের বন্ধুত্ব পাড়ার একটি জিম-এর ক্লাবে। চারজনেই স্বাস্থ্যসচেতন, সকালে ক্লাবে কিছুক্ষণ শরীরচর্চা করে রাস্তার পাশে একটি চায়ের দোকানে কিছুক্ষণ পরচর্চা করে ফিরে যান যার-যার বাড়িতে। হঠাৎ ঘোষ খবর নিয়ে এলেন তাঁর এক অফিসীয় বন্ধু সুনির্মল কথায় কথায় বলছিলেন তাঁর দেশের বাড়ি ইচ্ছামতীপুরে। চাকরির খাতিরে তিনি কলকাতায় বাস করেন বটে, কিন্তু দেশের বাড়ি গেলে আর ফিরতে ইচ্ছে করে না। ঘোষ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে তার কাছে সব জেনে নিয়ে একদিন জিম-এর শেষে বললেন, চলুন একদিন সবাই মিলে ঘুরে আসি। আমার নিজের দেশের বাড়িতে তো আর যাওয়ার কোনও পথ নেই। অন্যের দেশের বাড়ি গিয়ে দেশের বাড়ির স্বাদ নিয়ে আসি।
দত্ত খুব শিগগির ইউরোপ ভ্রমণে যাচ্ছেন, বললেন, এখন আমি টেমস নদী, রাইন নদীর ধার দিয়ে বউয়ের সঙ্গে হাত ধরাধরি করে হেঁটে যাওয়ার স্বপ্ন দেখছি, এখন ইছামতীর ধার দিয়ে হাঁটলে সব ঘেঁটে যাবে, বলে তিনি রেহাই চাইলেন এ-যাত্রা।
অন্য তিনজন একটা সুবিধেমতো তারিখ বেছে নিয়ে বেরিয়ে পড়েছে ইচ্ছামতীপুরের উদ্দেশে।
মাঝেমধ্যে ঘড়ি দেখছিলেন চৌধুরী, একটু ছটফটে ধরনের মানুষ, জিজ্ঞাসা করলেন, আর কতক্ষণ লাগবে?
গাড়িতে ড্রাইভারের পাশের সিটে ব্যানার্জি, তাঁর ঠিক পিছনের প্রথম সিটে তিন বেটারহাফ— রুমেলা, মানে মিসেস চৌধুরী, দেবারতি, মানে মিসেস ঘোষ, আলপনা, মানে মিসেস ব্যানার্জি। আর একেবারে পিছনের সিটে চৌধুরী ও ঘোষ বসেছেন হাত-পা ছড়িয়ে।
চৌধুরীর উদ্বেগ দেখে দেবারতি গুনগুন করে গান ধরলেন, ‘কত দূর, আর কত দূর, ইচ্ছামতীপুর!’ দেবারতির গানের গলাটি বেশ ভালো, সামনে থেকে ব্যানার্জি বললেন, ওখানে গিয়ে আমরা দেবারতির গান শুনব।
রাস্তার দুপাশে চমৎকার সবুজ দেখে আলপনা চেষ্টা করছিলেন গাছগুলোর নাম জানার। তাদের ছাদের বাগানে কিছু ফুলগাছ ও পাতাবাহার আছে, সেখানে একটা মিনি বট্যানিক্যাল গার্ডেন করার ইচ্ছে, কিন্তু জায়গার বড়ো অভাব। আপাতত গাছগুলোর নাম জেনেও শান্তি। আর রুমেলা খুঁটিয়ে দেখছিলেন রাস্তাটার গতিপথ।
বহুক্ষণ পর একটা ছোটো গঞ্জ আসতে ঠিক হল, প্রাতঃরাশ এখানেই সারা যাক।
যে কোনও রোডসাইড হোটেলে টা-এর চেয়ে চায়ের স্বাদই বেশি মনোরম। ঘন দুধের গেলাসভর চা, অমৃতের চেয়ে সামান্য কম স্বাদু— কিছুক্ষণ তারিয়ে তারিয়ে শরীরের পেট্রল ভরে নিয়ে পুনর্যাত্রা।
ঘোষ বলছিলেন, দেশের বাড়ি শব্দটাই কীরকম মন-কেমন করা।
চৌধুরী বললেন, আমারও একটা ছিল, কিন্তু—
বলে বিবৃত করলেন মেদিনীপুরে তাঁদের পৈতৃক ভিটের কথা।
তিনজনের আলোচনা তখন যার-যার দেশের বাড়ি নিয়ে। স্কুলের পাঠ শেষ করে উচ্চশিক্ষার্থে তিনজনেই কলকাতার কলেজে পড়তে এসে কলকাতাতেই রয়ে গেলেন বাকি জীবন। তবে চৌধুরীর ইচ্ছে ছিল চাকুরিজীবন শেষ করে ফিরে যাবেন মেদিনীপুরের দেশের বাড়িতেই, একটা বাড়িও করে ফেলেছিলেন আত্মীয়পরিজনদের মাঝখানে, কিন্তু অবসরের পর দেখলেন কলকাতার মাটিতে এমন শিকড় গজিয়ে গেছে যে, আর গ্রামে ফিরে যাওয়া অসম্ভব। অতএব দেশের বাড়ি বিক্রি করে ফ্ল্যাট কিনে নিয়েছেন কলকাতায়।
ঘোষ বললেন, তাঁর হাওড়া জেলার আমতায় বাড়ির কথা। এখনও আত্মীয়স্বজন আছেন সেখানে, কিন্তু ফিরে গিয়ে থাকতে হবে ভাবলে আর মন চায় না। ব্যানার্জির অবস্থাও তদ্রূপ— দেশভাগের পর শিশুকাল থেকে উত্তর চবিবশ পরগনার বাড়িতে বড়ো হওয়া, কিন্তু রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে এখন সেই বাড়িঘর প্রায় ধূলিসাৎ। আত্মীয়স্বজন এখনও কেউ কেউ থাকেন সেখানে। এককালে প্রচুর ফলফলারির গাছ ছিল, প্রায় এক বিঘের সেই প্লট এখন হাহা-শূন্যি।
তিনজনের আপশোসবাক্য বেশ মজা দিচ্ছিল তিন গৃহিণীকে। দেবারতি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, একটা দেশের বাড়িটাড়ি থাকলে খারাপ হত না। মাঝেমধ্যে গিয়ে দু-দশদিন থেকে আসা যেত। কলকাতায় একঘেয়ে জীবন।
আলপনা বললেন, আমার শাশুড়ির মুখে শুনেছি খুব আত্মীয়স্বজনের যাতায়াত ছিল দেশের বাড়িতে। হঠাৎ অনেক রাতে পাঁচ-সাতজন চলে এলেন কুটুমবাড়িতে থাকতে। সেই রাতে আবার নতুন করে রান্নাবান্না। হুল্লোড় চলত বেশ ক’দিন।
রুমেলা বললেন, আমাদের নিজেদের বাড়িটা আর নেই ঠিকই, কিন্তু বিয়ে-পার্বণে মাঝেমধ্যে যেতে হয়, থাকতেও হয় দু-চারদিন। কিন্তু সেই দাবিটা আর নেই, নিজের বাড়ি থাকলে যা থাকত।
এমন কথোপকথনের মধ্যে একটা বড়োসড়ো গঞ্জ দেখে চৌধুরী খুঁটিয়ে দেখলে না রাস্তার ধারের পথনির্দেশক ফলক, বলে উঠলেন, দেখুন, এবারে মনে হচ্ছে আর সোজা রাস্তায় নয়, বাঁদিকের রাস্তায় বাঁক নিতে হবে।
ড্রাইভারও গাড়ির গতি কমিয়ে বাঁক নিতে নিতে বললেন, এই বাজারটা খুব বিখ্যাত চিংড়িমাছের জন্য। ইচ্ছে করলে ফেরার পথে ভালো বাগদা বা গলদা নিতে পারেন। দামে খুব সস্তা।
ফেরার পথে ভাবা যাবে, আগে ইচ্ছামতীপুর আমাদের হাতছানি দিচ্ছে, ব্যানার্জি মুখ গোমড়া করে বললেন। তাঁর আবার চিংড়ি মাছে অ্যালার্জি।
গাড়ি তখন হু হু করে ছুটছে গন্তব্য অভিমুখে। টানা তিন ঘণ্টা পেট্রল পোড়ানোর পর উপলব্ধি করা গেল বাতাসে ঠান্ডা নদী-নদী হাওয়া। তার মানে ইছামতী খুব কাছেই। তার অর্থ ইচ্ছামতীপুর আর দূরে নয়!
২.
যে-গন্তব্যে ছয় চরিত্র পৌঁছে গেল তার নাম অদৌ ইচ্ছামতীপুর নয়। ইছামতী নদীর পাড়ে এই বর্ধিষ্ণু ঘনবসতির জন্য ইচ্ছামতীপুর নামটাই পছন্দ হয়েছিল তাদের. এককালের জমজমাট মফস্বল শহর, কালের গতিতে এখন শুধু অতীত জীবনের সাক্ষী। চারদিকে বহু সাত-পুরনো বাড়ি, কোনও কোনওটা বেশ অভিজাত ধরনের। কয়েকটা তো রাজবাড়ির মতো দেখতে। তারই ফাঁকফোঁকর খুঁজে নতুন নতুন বাড়িও গড়ে উঠেছে অনেক— এ-যুগের প্ল্যানারদের তৈরি।
তবে লজ বা হোটেলের সংখ্যা এখন ক্রমবর্ধমান।
একটা নতুন ঝকঝকে হোটেল খুঁজে নিয়ে সেখানেই একটা দুপুরের অস্থায়ী ঠিকানা। দুপুরের খাওয়ার নির্দেশ দিয়ে এলেন ঘোষ, ইছামতীর টাটকা মাছসহ দুধসর চালের কাঁটার মতো ভাত। অতঃপর খোঁজখবর নেওয়া হল কী কী দ্রষ্টব্য আছে এই পুরনো বসতিতে। এখানকার জনবসতিতে চারশো বছরের ইতিহাস। তবে রাজরাজড়ার ইতিহাস নয়, সাধারণ বাসিন্দাদের ইতিকথা।
এই আধা-শহরটির প্রধান আকর্ষণ ইছামতী নদী। বিশাল নদীর ওপারেই বাংলাদেশের সাতক্ষীরা জেলার শ্রীপুর। অন্য পারে বাংলাদেশ বলেই এই শহরের পর্যটক-আকর্ষণ বেশি। বাংলাদেশ এপারের মানুষদের এক অনন্ত ভালোবাসার জায়গা।
হোটেলের সামনেই ইছামতীর একটা অংশ, তার বাঁধানো কিনারে সারি সারি সিমেন্টের চেয়ার। হোটেলের পর্যটকরা কেউ বসে, কেউ পায়চারি করছেন কিনারের পাশের পাকা রাস্তা দিয়ে। নদীর জল ছুঁয়ে আসা মারকাটারি হাওয়ায় ওপারের গন্ধ।
স্থানীয় তল্লাশিতে যা জানা গেল শহরের ভিতরের রাস্তা খুব সংকীর্ণ, কলকাতা থেকে নিয়ে আসা বড়ো গাড়ি নিয়ে ঘোরাফেরা করা যাবে না। ছ’জনে মিলে ঘুরতে এখানকার ভ্যানরিকশা ভাড়া করাই যুক্তিসঙ্গত। কিছু টোটোও আছে, তিনজন-তিনজন যাওয়া যেতে পারে, কিন্তু ভ্যান ভাড়া করে একসঙ্গে ঘুরলে অধিকতর মজা এই সিদ্ধান্ত সর্বসম্মত হতে ছ’জন উঠে বসলেন এক অভিজ্ঞ ভ্যানওয়ালাকে পথপ্রদর্শক হিসেবে পেয়ে। বছর সাতাশ-আটাশের যুবকটির মুখেচোখে অবিরল বাক্যপ্রবাহ।
ভ্যানরিকশা রওনা হতেই চাক্ষুষ হল ইচ্ছামতীপুরের আসল আভিজাত্য। এখানে অজস্র অফিস, সরকারি ও বেসরকারি। স্কুল-কলেজ-পোস্ট অফিস-ব্যাঙ্ক— সবই আছে আর পাঁচটা মফস্বল শহরের মতো। সেগুলোর অধিকাংশই নতুন বিল্ডিং। কিন্তু বড়ো রাস্তা ছেড়ে ভিতরের শিরা-উপশিরার মতো উপপথ বেয়ে শহর ঢুঁড়তে গিয়ে আবিষ্কৃত হল এখানকার প্রাচীনত্বই প্রকৃত অহংকার।
কতকালের পুরনো শহর, তিনশো-চারশো বছর বয়সি অট্টালিকাগুলি বিরাজ করছে উপপথের দুপাশে আপন মহিমায়। পুরনো আমলের নেমপ্লেটে একের পর এক নাম, নামের পাশে লেখা পেশা দিয়ে পরিচয়। কেউ প্রফেসর, কেউ অ্যাডভোকেট, কেউ ডাক্তার।
মাঝেমধ্যে ভ্যানরিকশা দাঁড় করিয়ে রেখে তারা দেখছিলেন বাড়িগুলির আভিজাত্য, কৌলীণ্য, বনেদিয়ানা। তারা বলাবলি করছিলেন শহরের প্রতিষ্ঠাকাল নিয়ে। আলোচনা করছিলেন জনপদের ইতিকথা নিয়ে। একদা নদীর পাশে জনবসতি গড়ে ওঠাই ছিল রীতি। ইছামতী এখানে মোহনার মুখোমুখি। অতএব বেশ বিশাল চেহারায়। তারই কিনার ঘেঁষে গড়ে তুলেছিল এই জনপদ যা এত বছর পরেও স্বমহিমায় বিরাজমান।
ভ্যানরিকশা চলেছে নানা ইতিবৃত্ত উপহার দিতে দিতে।
কোনও বাড়ির প্রাচীনত্ব বজায় রেখে তাকে রেনোভেট করা হয়েছে, বাস করছেন এ যুগের উত্তরাধিকারীরা। কোনও বাড়ির ধবংসাবশেষ পড়ে আছে হেলায়, বেরিয়ে পড়েছে খয়াটে ইঁট, ঢালাইয়ের নোনা-ধরা সুরকি। তাদের বুকে-পিঠে-মাথায় বট-অশ্বত্থের হইহই করে চড়ে বসা।
কোনও বাড়ির প্রায় সবটাই নতুন করে গড়ে নিয়েছেন বাসিন্দারা।
এরকমই একটি অট্টালিকা সারিয়ে-সুরিয়ে রং করে এখন চেহারা নিয়েছে একটি হোটেলের। গেটের কাছে নেমপ্লেটে লেখা: ঘোষ লজ।
ঘোষ লজ! সবাই কৌতূহলী। কেয়ারটেকারের কাছে খবর নিয়ে জানা গেল এটি ঠিক হোটেল নয়, হোমস্টে-টাইপের। পর্যটক ইচ্ছে করলে দিনপিছু ভাড়া দিয়ে বাড়ির মতো কাটিয়ে যেতে পারেন কয়েকটা দিন। ভিতরে রান্নার যাবতীয় সরঞ্জাম। কেউ চাইলে স্থানীয় বাজার থেকে সব কিনে-কেটে এনে রান্না করে খেতে পারেন।
আলপনার আবার হোম-স্টে-তে থাকার খুব ইচ্ছে, উল্লাস প্রকাশ করে বললেন, বাহ্, ভালো ব্যবস্থা তো!
চৌধুরী ঠাট্টা করে বললেন, ঘোষ, তুমি তো দেশের-বাড়ি দেশের-বাড়ি করছিলে, এই বাড়িটাকেই ধরে নাও তোমার দেশের বাড়ি। ‘ঘোষ লজ’ ধরে নাও তোমার।
রুমেলা তাতে ইন্ধন দিয়ে বললেন, হ্যাঁ। তা হলে পরের বার ইচ্ছামতীপুরে এসে আপনার বাড়িতে দু-দিন গেস্ট হব।
দেবারতির খুব পছন্দ হল বিষয়টা, বললেন, তাহলে এটাই আমাদের দেশের বাড়ি হোক। যখন খুশি আসা যাবে, দু’চারদিন কাটিয়ে যাব। ইছামতীর ফুরফুরে হাওয়া আর বাজারের টাটকা আনাজ আর মাছ কিনে রান্নাবাটি করে খাওয়া যাবে।
দেবারতির উল্লাস দেখে ঘোষের মুখখানা দিব্যি ফুরফুরে। যাক, তবু একটা দেশের বাড়ি পাওয়া গেল প্রায় নিরখরচায়। বললেন, ঠিক আছে, তাহলে সবার নিমন্ত্রণ রইল আমাদের সদ্য পাওয়া দেশের বাড়িতে। পরেরবার নিশ্চয়ই দত্তদা আর দত্তগিন্নিকেও পাওয়া যাবে।
আবার ভ্যানরিকশায় ঢনঢন ঢনঢন— নতুন শহরের আনাচকানাচ ঘুরে নতুন নতুন দ্রষ্টব্য আবিষ্কার করা। কোথাও পুরনো লম্বা-গড়নের একতলা বাড়ি, গেটের দুপাশে দুটি নয়নাভিরাম পাম গাছ, ভিতরে মানুষজন নেই। কোথাও রাজকীয় গড়নের বিশাল উঁচু দোতলা বাড়ির সামনের বারান্দা সুদৃশ্য থাম, তার তিনটে থামের একটি ধসে পড়েছে। পরিত্যক্ত বাড়িতে কেউ নেই থামটাকে নতুন করে গড়ে তুলতে। কোনও পাঁচিল-ঘেরা বাড়ির সামনে চমৎকার ফুলবাগান।
ঘুরতে ঘুরতে ভ্যানরিকশা আবার ইছামতীর কাছে। চোখ কাড়ল একটা ছবি-ছবি তিনতলা লম্বা বাড়ি, চারপাশে উঁচু পাঁচিল, লোহার সুদৃশ্য গেট। গেটের উপরে বড়ে নামফলক— তাতে লেখা ‘চৌধুরী বাগানবাড়ি’।
রুমেলা উচ্ছবসিত, বললেন, এ-বাড়িটা না দেখে যাওয়া যাবে না।
বাড়িটার সামনে ভ্যানরিকশা থেকে নেমে সবাই নেমে ঢুকে পড়লেন ভিতরে। এটা একটা গেস্ট হাউস। ভিতরে চমৎকার গাছগাছালি, একটা বড়ো শান বাঁধানো পুকুর। সবাই ঘুরছেন-ফিরছেন আর বলছেন, আহ্ এ তো স্বর্গের মাত্র দু’স্টেশন আগে!
ঘোষ অমনি বললেন, চৌধুরী তোমাদের যে এরকম একটা বাগানবাড়ি আছে তা অ্যাদ্দিন বলোনি তো!
চৌধুরী প্রথমে হতভম্ব, ‘আমার বাগানবাড়ি’। পরক্ষণে বুঝতে পেরে হো হো করে হাসি।
ব্যানার্জি তাতে ইন্ধন দিয়ে বললেন, বুঝেছি, তাই ইচ্ছামতীপুরে আসার প্রোগ্রামে চৌধুরীর এত উৎসাহ! আমাদের সারপ্রাইজ দেবে বলে!
চৌধুরী হাসি-হাসি মুখে বললেন, একজ্যাক্টলি। কীরকম সারপ্রাইজ দিলাম।
রুমেলার মুখেও খুশির ঝরনা, বললেন, যাক, ‘ঘোষ লজ’-এর পর ‘চৌধুরী বাগানবাড়ি’। অভাবনীয় প্রাপ্তি। তাহলে একটা প্রোগ্রাম করা যাক। ‘ঘোষ লজ’-এ প্রথমবার বেড়ানো। পরের বার আমাদের ‘চৌধুরী বাগানবাড়ি’। ফাইলাল?
দুই বন্ধু দুটি দেশের বাড়ি আবিষ্কার করে অতি পুলকিত। বেশ জমজমাট দেখাচ্ছে দু’জোড়া মুখ। এক অপ্রত্যাশিত উপহার। ভ্যানরিকশায় উঠে পরবর্তী দ্রষ্টব্যে যাওয়ার পথে দেবারতি বললেন, তা আমাদের দু’জনের দুটো দেশের বাড়ি হল। ব্যানার্জিদাদের হল না যে!
ব্যানার্জি হেসে বললেন, সবার ভাগ্যে কী সব হয়!
তাঁর কথার মধ্যে বোধহয় লুকিয়ে ছিল এক টুকরো হিউমার। তবু কোথাও কি একটু বিষণ্ণতার ছোঁয়া আছে! বোধহয় একটু ভারী হয়ে উঠল ভ্যানরিকশার আবহ।
ভ্যানরিকশা চলেছে ইছামতীর কিনারা বরাবর। চমৎকার হাওয়া বইছে। গরমের প্রাদুর্ভাবে কিছু বিরতি। জলের উপর তিরতির ঢেউ। একটা আধভাঙা বাড়ি দেখিয়ে রিকশাওয়ালা বলল, এই বাড়িতে গত বছর একটা বই শুটিং হয়েছিল। ওই যে, বাংলাদেশের কী এক নায়িকা আছে না!
বলতে বলতে রিকশা ঢুকে পড়ল আর একটা গলিতে।
সব গলিই আধভাঙা ইঁটের তৈরি। হাঁই হাঁই করে লাফাচ্ছে ভ্যানরিকশাটা। কেউ বলছেন, ‘ডান্সিং রোড নাকি!’ কারও কোমর ভাঙার উপক্রম। কেউ বলছেন, অনেক হয়েছে, এবার ফেরার পথ ধরি।
ভ্যানওয়ালা কিন্তু রেহাই দিতে চাইছে না, বলছে, ম্যাডাম, এখনও অনেক কিছু দেখার বাকি। এখনও তো মোহানা দেখাতে নিয়ে যাইনি!
মোহানা! সে কত দূরে? আলপনা আবার নতুন নতুন পথে যেতে উৎসাহী।
দাঁড়ান, আগে দুগ্গাদালান দেখিয়ে নিই।
দুগ্গাদালান? সে কোথায়? দেবারতির আবার পুজোআচ্চায় খুব মতি।
এই তো—
বলতে বলতে এক মহাপুরনো অট্টালিকার সামনে এনে দাঁড়ল করায় ভ্যানরিকশা। বাড়িটার অনেকটাই কালের করালগ্রাসে, যেটুকু আছে, সত্যিই দর্শনীয়।
সবাই হই হই করে নেমে ভিড় করলেন গেটের কাছে। নেমপ্লেট কিছুটা ঘসা হলেও পড়া যাচ্ছে। বাড়িটার নাম ‘হেভেন অন আর্থ’। তার নীচে ছোটো করে ‘ব্যানার্জি’স ভিলা’।
গেটটা বন্ধ। ভিতরে একটা বড়োসড়ো লন— যদিও তার ঘাসগুলি বড়োই মলিন। পাঁচিলের ধার ঘেঁষে কিছু ফুলের গাছ, কিছু পাতাবাহার। বাড়িটা দোতলা হলেও বেশ উঁচু— প্রায় তিনতলার সমান। ভিতরে একজন আধবুড়ো গোছের লোককে দেখে ঘোষ ডাকলেন— এই যে দাদা—
আধবুড়ো শ্লথ পায়ে এসে বললেন, কী ব-অলছেন?
এ-দেশের মানুষের কথায় যশোর-খুলনার টান। ঘোষ বললেন, এ-বাড়িতে কেউ থাকেন?
হ্যাঁ। এক শরিক বউছেলেমেয়ে নিয়ে থাকেন। মোট চারজন! আর কেউ থাকেন না!
আধবুড়ো কোমরে বাঁধা গামছাটা খুলে মুখ মুছতে মুছতে বললেন, আর আমি থাকি। বাড়ি চৌকি দিই। আমার নাম কানাইভাই। বাকি সব তো কলকাতায়। যে যার আলাদা। শুধু দুগ্গাপুজোর সময় একজোট হয়। অই যে দ্যাখছেন—
তার আঙুল অনুসরণ করে তাকিয়ে দেখা যায় অট্টালিকার সঙ্গে লম্বভাবে এক বিশাল দুর্গামণ্ডপ। এখন ফাঁকা।
ব্যানার্জি উৎসাহিত হয়ে জানতে চাইলেন, সবাই আসেন দুর্গাপুজোর সময়!
হ্যাঁ। বড়ো শরিকের বড়ো ছেলে পুজোর একমাস আগে এসে সব ব্যবস্থাপনা করে যান। প্রতিমা বায়না করে, পুরোহিত ঠিক করে, আর যা-যা লাগে তা একপ্রস্ত কেনাকাটি করে বাকি শরিকদের খবর দেন। তারপর পুজোর ক’দিন আগে থেকে সবাই এসে যান কলকাতা থেকে। তখন এই শুনশান বাড়িতে খুশির তুবড়ি ফোটে।
বাহ্, লোকটি বেশ গুছিয়ে কথা বলতে পারে।
ব্যানার্জি হঠাৎ বললেন, ইস, আমারও ইচ্ছে করে দেশের বাড়িতে যদি এরকম একটা পারিবারিক মিলন-উৎসব করতে পারতাম!
কানাইভাই বললেন, তা আপনারাও আসুন না দুর্গাপুজোর সময়। দেখবেন সবাই মিলে কি হুড়োমুড়ি করে চার-পাঁচদিন।
ঘোষ হঠাৎ বললেন, ব্যানার্জিদা, এই তো আপনি পেয়ে গেলেন দেশের বাড়ি। আপনি তো বলছিলেন আপনার বাড়িও ছিল ইছামতীর তীরে। তা এই তো— এটাও তো ইছামতীর তীরে— ‘ব্যানার্জি ভিলা’। কানাইভাই আপনার ডেরায় আমাদেরও নিমন্ত্রণ করে ফেললেন।
রুমেলা বললেন, ঠিক আছে, কানাইভাই, আমরা সবাই আসব ব্যানার্জিভিলার দুর্গাপুজো দেখতে।
কানাইভাই আরও এক কদম এগিয়ে গিয়ে বলল, প্রতিদিন দুপুরে পাড়ার সবার ভোগ খাওয়ার নেমন্তন্ন থাকে। আপনাদেরও নেমন্তন্ন দিয়ে রাখলাম। চারদিন পাত পেড়ে খাবেন।
তিনজোড়া মুখ তখন আলোয় আলো। বিকেলের সূর্যাস্তের রক্তিম আলোয় সবাই কিছুক্ষণ রঙিন। কানাইভাইয়ের সঙ্গে আরও কিছু কথোপকথন করে ওঁরা চড়ে বসলেন ভ্যানরিকশায়।
সেদিন ফেরার পথে সবাই বেশ ফুরফুরে মেজাজে। ঘোষ বলছিলেন, ব্যানার্জিদা, তাহলে আমরা সবাই এক-একটা করে দেশের বাড়ি পেয়ে গেলাম।
দেবারতি বললেন, আমার কিন্তু সবচেয়ে পছন্দ হল ব্যানার্জিদার দেশের বাড়ি। দারুণ হইহই ব্যাপার।
আলপনা হেসে বললেন, সত্যিই দারুণ। আমার দেশের বাড়িতে আপনাদের সবার নিমন্ত্রণ হল, অথচ আমাদের কোনও আর্থিক দায়দায়িত্ব নেই।
ব্যানার্জি কেমন যেন অন্যমনস্ক, তাঁর চোখদুটো স্মৃতিমেদুর, গাড়ির জানালা দিয়ে উড়ে আসা হাওয়ায় মাখামাখি হতে হতে বললেন, জানেন, কলকাতয় বহু বছর বাস করছি, কিন্তু শৈশব-কৈশোরের দেশকে আজও ভুলিনি। আমাদের সেই বাড়ি এখন আর নেই। মাত্র এক শরিক সেখানে বাস করে। বাকি সবাই কেউ টালিগঞ্জে, কেউ বারুইপুরে, কেউ পাতিপুকুরে, কেউ কুদঘাটে। একদিন আমরা কয়েকজন আলোচনা করছিলাম দেশের বাড়িতে যদি দু-তিনটে ঘর করে রাখি, মাঝেমধ্যে গেট-টুগেদার করে হইচই করতে পারি। কয়েকজনে গেলামও একদিন। কিন্তু যারা ওখানে আছে, তারা বলল, ‘তোমরা তো সবাই চলে গেছ, এখানে পাকাপাকি থাকবে না কেউ, শুধু শুধু কিছু জায়গা দখল করে রাখবে কেন! আমরা এই যে হাত-পা ছড়িয়ে বাস করছি তা আর পারব না!’ বুঝুন একবার। এক বিঘে জমি থেকে যদি দু-কাঠার উপর একটা বাড়ি করতাম, কী এমন অসুবিধে হত তাদের!
রুমেলা বলল, যাক, আপনার আর দুঃখ রইল না। পুজোর সময় সবাই মিলে ইচ্ছামতীপুরে আসব। দু’দিন ঘোষ লজে, দু’দিন চৌধুরী বাগানবাড়িতে থাকব,তারপর ব্যানার্জি ভিলায় চারদিন পাত পেড়ে—