দেব, দানব এবং মানব—দার্শনিক স্থিতি একাকার

চতুৰ্থ অধ্যায় – দেব, দানব এবং মানব—দার্শনিক স্থিতি একাকার

॥ ১ ॥

আমি প্রথমেই অবশ্য সমস্ত ব্যাপারটা ঘুলিয়ে দিতে চাই না। অর্থাৎ দেবতা-রাক্ষস এবং মানুষকে একই মঞ্চে উপস্থিত করে আমি এখনই এক মহান সাম্যবাদের প্রতিষ্ঠা করতে চাই না। তবে আমাদের দিক থেকে কিছু সুবিধেও আছে। আজকের সমাজে মানুষ যেহেতু যথেষ্ট সমাজে সচেতন এবং ততোধিক রাজনীতি-সচেতন, তাই আজকের রাজনীতি মাথায় রাখলেই আপনারা দেবতা-রাক্ষস এবং মানুষের সম্পর্ক বুঝতে পারবেন।

প্রথমেই খেয়াল রাখবেন মানুষের যত সম্পর্ক, সব কিন্তু দেবতার সঙ্গে, অসুর-রাক্ষসের সঙ্গে, দেবতা হলেন মহান রাজনৈতিক নেতার মত। তিনি জনগণের জন্য ভাবেন। লোক-সৃষ্টির মধ্যে যাতে উচ্ছৃংখলতা না আসে, উত্তম-অধমের যাতে স্থিতি-পরিবর্ত না ঘটে তার জন্য দেবতাদের চিন্তা আছে। এমনকি মনুষ্যলোকে অতিবৃষ্টি, দুর্ভিক্ষ, উত্তম ফসল—এগুলির ব্যাপারেও দেবতাদের হাত আছে। এত সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও দেবতাদের একেকজনকে কিন্তু সম্পূর্ণ স্বার্থহীন, কাম-ক্রোধ-লোভহীন এক মহান সাধু ব্যক্তি বলে ভাবার কোন কারণ নেই। রাজনৈতিক নেতা যেমন নিজের স্বার্থ ব্যাহত হলে, তাঁর দলীয় স্বার্থ বিঘ্নিত হলে, তখন আর জনগণের কথা ভাবেন না, অপিচ জনগণের দোহাই দিয়েই জনগণের ওপরেই অবিচার করেন, দেবতারাও কিন্তু ঠিক সেইভাবেই চলেন।

অবশ্য এক্ষেত্রেও দলের মুখ্য নেতা যদি কথঞ্চিৎ সৎ হন, তাহলে জনগণকে রাজনৈতিকভাবে প্রবঞ্চনা করা সত্ত্বেও তিনি যেমন খানিকটা জনগণকে তুষিয়ে-পড়িয়ে সামলে নেন, দেবতাদের মধ্যে কেউ কেউ সেটাও পারেন। অন্যদিকে, আগেই বলেছি, অসুর-রাক্ষসদের অবস্থা অনেকটা বিরোধী দলের জঙ্গী নেতাদের মত। তাঁদের মূল উদ্দেশ্য থাকে কীভাবে রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল করা যায়। গণতন্ত্রের খাতিরে বিরোধী নেতারা অবশ্য জনগণের দোহাই দেন, কিন্তু আদতে জনগণকে নিয়ে তাঁদের ভাবার সময় নেই। অসুর-রাক্ষসরা যেহেতু আধুনিক গণতন্ত্রের শরিক নন, অতএব পুরাণে-ইতিহাসে তাঁদের আর কষ্টকর জনগণকে নিয়ে মিথ্যের বেসাতি করতে হয়নি। তাঁরা অত্যন্ত স্থূলভাবে এবং স্পষ্টভাবে স্বর্গের রাজনৈতিক দখল নিতে চেয়েছেন।

অসুর-রাক্ষসের ব্যাপারটা আরও একভাবে প্রকাশ করা যায়। আমরা এখন যেমন প্রায়ই বলে থাকি—আরে! অমুক দলের নেতার সঙ্গে তমুক দলের নেতার ব্যক্তি-চরিত্রে বা দৃষ্টিভঙ্গীতে কোন পার্থক্যই নেই। এদের দলের নামটা শুধু আলাদা। বস্তুত কোন দল প্রথম যখন ক্ষমতায় আসে, তখন তাঁদের নেতা-মন্ত্রীদের আশ্বাসবাণী হয় দেবতার বরদানের মত। তারপর দিন যত যায়, ক্ষমতা যত বাড়ে, লোভ-লালসা আর প্রাপ্তিতে যখন ক্ষমতাসীন নেতাদের মাথা খারাপ হয়ে যায়, তখন পূর্বের বরদ দেবতা মানুষের কাছে অসুর-রাক্ষসে পরিণত হন।

আমাদের বিষ্ণু-পুরাণ বলেছে ভাল। দেবতারাই সেখানে বিষ্ণুর স্তব করছিলেন। দেবতারা বললেন—হে ঈশ্বর! আমরা যারা এই ইন্দ্র, সূর্য, অগ্নি, বায়ু ইত্যাদি ভেদে তোমার স্বরূপে আছি—সেই দেবস্বরূপ তোমাকে নমস্কার করি—বয়মেব স্বরূপং যৎ তস্মৈ দেবাত্মনে নমঃ। দেবতারা আবার বললেন—তোমার মূর্তির মধ্যে যেখানে শুধুই দম্ভ-অহংকার, শুধুই বিবেকশূন্যতা আর ক্ষমাহীনতা—আমরা সেই দৈত্যরূপী তোমাকে নমস্কার করি—তস্মৈ দৈত্যাত্মনে নমঃ।

একই সঙ্গে এটাও বলতে হবে—দেবতারা যেমন কেউ অন্তরীক্ষ লোকের বাসিন্দা নন এবং তাঁরা মানুষই, তেমনই অসুর-রাক্ষসরোও কেউ অন্য জগতের আলাদা কোন বিশিষ্ট জীব নন, তাঁরাও মানুষই। বিষ্ণুপুরাণে দেখা যাচ্ছে—সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মা সৃষ্টিকার্যে ব্রতী হয়েছেন। এদিকে তখন রাত্রি হয়ে গেছে। হয়তো ঘুমও পাচ্ছে খুব। রাত্রির তমসায় তাঁর মধ্যে তমোগুণ উদগ্র হয়ে উঠল। ঠিক এই অবস্থার মধ্যে তাঁর জঘন-দেশ থেকে অসুররা উৎপন্ন হলেন। অসুররা তাই তমঃস্বভাব। ব্রহ্মা যোগবলে তমঃশরীর ত্যাগ করলেন এবং দিনের বেলায় সত্ত্বোদ্ৰিক্ত অবস্থায় জন্ম হল দেবতাদের। সেদিক দিক দিয়ে অসুরেরা দেবতাদের বড় ভাই।

ব্রহ্মা সত্ব থেকেই পিতৃগণের জন্ম দিলেন। কিন্তু সৃষ্টি করতে বসা এক দেবকল্প ব্যক্তির মধ্যেও বা সত্ত্ব-ভাব কতক্ষণ বজায় থাকে? তাঁর মন একটু চঞ্চল হল, রজোগুণ প্রধান হয়ে উঠল ব্রহ্মার মনে। সৃষ্টি হল মানুষের। ব্রহ্মা আবার শরীর ত্যাগ করার চেষ্টা করলেন। যোগ-প্রভাবে অন্য শরীর পেলেনও, কিন্তু সেই শরীরেও রজঃ-স্বভাবটা গেল না। এদিকে আবার রাত্রি হয়ে গেছে। সারাদিন সৃষ্টির ধকলে প্রচণ্ড ক্ষিধেও পেয়ে গেছে, এবং ক্ষিধের সময় খাবার না পেয়ে বেশ একটু রাগও হল তাঁর। ঠিক এই অবস্থায় অন্ধকারে ব্রহ্মার ক্ষুধা থেকেই সৃষ্টি হল রাক্ষসদের। তাঁদের চেহারা হল উকট এবং তাঁদের দাড়ি-গোঁফও খুব বড় বড়—বিরূপাঃ শ্মশ্রুলাঃ জাতাঃ।

জন্মেই তাঁরা ক্ষিধের চোটে ব্রহ্মাকেই খেয়ে ফেলেন আর কি। এই অবস্থায় তাঁদের মধ্যে যাঁরা বললেন—অ্যাই! এরকম খায় নাকি? এঁকে রক্ষা কর। এই রক্ষার প্রবৃত্তি থেকেই তাঁরা রাক্ষস আর যাঁরা বললেন—না, সে হবে না, আমরা খাবই, তাঁরা হলেন যক্ষ। যক্ষণ মানে ভক্ষণ, সেই প্রবৃত্তির জন্যই তাঁরা যক্ষ।

অসুর, দেবতা, মানুষ, রাক্ষস—যেভাবেই এদের ‘ক্যাটিগোরি’ ভাগ করা হোক না কেন, মূল ব্যাপারটা কিন্তু সত্ত্বগুণ, রজোগুণ, আর তমোগুণের। আসলে এঁরা সবাই মানুষ। মানুষের মধ্যেই যাঁরা সন্ত্রপ্রধান, তাঁরা দেবতা। যাঁরা উৎকটভাবে রজঃপ্রধান তাঁরা রাক্ষস, আর যাঁরা তমঃপ্রধান তাঁরা অসুর। মহামতি গিরীন্দ্রশেখর বসু দেবতা-মানুষ-রাক্ষসের সম্বন্ধে পুরাণের প্রমাণ দিয়ে যা বলেছেন, আমি তা চলিত ভাষায় বলি—

পুরাণের শ্লোক বিচার করলে দেখা যায়—সভ্য মানুষের শত্রু দুই রকমের সমাজবহির্ভূত দল ছিল, এক রাক্ষস, দ্বিতীয় যক্ষ। রাক্ষসরা বিরূপ, শ্মশ্রুল এবং সব সময়েই ক্ষিধের জ্বালায় জ্বলছে। মানুষ মেরে, লুটপাট করে এরা জীবনযাপন করত। হয়ত আগে শুধু অনার্যদের মধ্যেই রাক্ষসের দল দেখা যেত। যজ্ঞাদি কার্যের জন্য ধনসামগ্রী এবং প্রচুর খাদ্য সংগৃহীত হলে রাক্ষসরা সব লুটপাঠ করে নিয়ে যাবে—এই ভয়ে ঋষিরা সবসময় শঙ্কিত থাকতেন। ঋগ্‌বেদেও বহু জায়গায় যজ্ঞপণ্ডকারী রাক্ষসদের উল্লেখ আছে। রাক্ষসরা অন্ধকারে প্রবল হয়ে উঠত। তাই রাক্ষসের অন্য নাম নিশাচর। এরা ‘ক্ষুৎক্ষাম’ অর্থাৎ সবসময়ই অভাবগ্রস্ত। আমরা এখন ডাকাত, চোর, গুণ্ডা বললে যা বুঝি, সেকালে রাক্ষস বললে তাই বোঝাত। আর্যদের মধ্যেও অনেকে রাক্ষস-বৃত্তি অবলম্বন করতেন। রাজা কল্মাষপাদ কিছুকাল রাক্ষস হয়ে নরহত্যা এবং লুটপাট করেছিলেন বলে পুরাণে উল্লেখ আছে। রাবণ ব্রাহ্মণ এবং রাজা হওয়া সত্ত্বেও সীতাকে হরণ করেছিলেন। তিনি নিজের রাজ্যে রাজা ছিলেন বটে, কিন্তু পরের রাজ্যে রাক্ষসবৃত্তি অবলম্বন করে লুটপাট করতেন। এখন যেমন কেউ কেউ গুণ্ডা বা ডাকাত লাগিয়ে শত্রুপক্ষের মানুষকে মারতে চেষ্টা করেন, সেকালেও সেইরকম ছিল। বিশ্বামিত্র রাক্ষস লাগিয়ে পুরাণকার পরাশরের বাবাকে হত্যা করিয়েছিলেন, এবং পরাশরও ক্রোধের বশে অনেক রাক্ষস দগ্ধ করেছিলেন—সে প্রমাণও আছে পুরাণে।

কাজেই দেখুন, আমি যে অসুর-রাক্ষসদের গণতান্ত্রিক মতে বিরোধী দলের মর্যাদা দিয়েছিলাম, গিরীন্দ্রশেখর তাঁদের ডাকাত, গুণ্ডা অথবা মাস্তানের পর্যায়ে নামিয়ে এনেছেন। আমরা অবশ্য অসুর রাক্ষস কিংবা দৈত্যদের এই পর্যায়ে নামিয়ে আনতে রাজী নই, কারণ রাক্ষস অসুর-দৈত্যদের মধ্যে অসাধারণ গুণসম্পন্ন প্রহ্লাদ, বৃত্র, বিরোচন, বলি অথবা রাবণকেও আমরা পেয়েছি। শুধুমাত্র অহংকার এবং স্ত্রী-দোষের জন্য আমরা তাঁদের গুণ্ডা-বদমাশদের পর্যায়ভুক্ত করতে চাই না, এবং তা করলে দেবতাদেরও অনেক সময় ওই পর্যায়েই নামিয়ে আনতে হবে। অতএব দেবতাদের অনন্ত সম্মানের নিরিখেই আমরা অসুর-রাক্ষসদেরও যথেষ্ট উন্নত স্তরের জীব বলে মনে করি। আসলে দেবতা এবং অসুর—এঁরা একই মুদ্রার এপিঠ আর ও পিঠ, এবং দেবতাদের সঙ্গে অনেক ব্যাপারেই তাঁদের কোন পার্থক্য নেই। এমনকি কোথাও কোথাও তাঁদের বুদ্ধি-বল-কৌশল এবং মহত্ব দেবতাদের থেকেও বেশি।

আমরা, শতপথ ব্রাহ্মণে দেখেছি—প্রজাপতি যেমন দেবতাদের সৃষ্টি করেছেন, তেমনই অসুর-রাক্ষসদেরও সৃষ্টি করেছেন। দুই পক্ষই তাঁর সন্তান—উভয়ে প্রাজাপত্যাঃ। অসুর আর দেবতাদের সম্পর্ক সাপ-নেউলের। জন্মের পর থেকেই তাঁদের শত্রুতা চলছে, একেবারে শাশ্বতিক বিরোধ। কিন্তু শতপথের বিবরণে দেখছি—অসুরেরা একসময় সবই জিতে নিয়েছিলেন এবং জেতার পর নিজেদের মধ্যে একটা ভাগাভাগি করে নেওয়ার কথাও ভেবেছিলেন।

নানা ভাবনা-চিন্তা করে পৃথিবীর মাপ-যোক আরম্ভ করে দিলেন অসুরেরা। দেবতারা তো প্রমাদ গণলেন। তারা ঠিক করলেন—ওই ওদের ভাগাভাগি করার সময়ই অসুরদের কাছেই যেতে হবে এবং গিয়ে বলতে হবে—বেশ তো ভাগাভাগি করে নিচ্ছ, আমাদের যদি এখানে কিছুই না থাকে, তাহলে আমাদের কী হবে—তদেষ্যামো যত্ৰেমামসুরা বিভজন্তে, কে ততঃ স্যাম যদস্যৈ ন ভজেমহীতি। দেবতারা যজ্ঞপতি বিষ্ণুর শরণ নিলেন—একটা ব্যবস্থা করতেই হবে। অসুরদের এই ভাগাভাগির মধ্যেই নিজেদের একটা হিল্লে করে নিতে হবে।

এবারে দেখুন, অসুররা কত ভাল মানুষ। দেবতারা যদি পুরো পৃথিবীর অধিকার পেতেন, তাহলে সূচ্যগ্র মেদিনীর অধিকারও অসুরদের দিতেন না। কিন্তু অসুররা সমগ্র পৃথিবীর অধিকার পেয়েও—অস্মাকমেবেদং খলু ভুবনমিতি—যথেষ্ট ভদ্রলোকের মতই দেবতাদের বললেন—তা তো বটেই। জায়গার ভাগ তোমাদের কিছু দিতে পারি ঠিকই, তবে তোমাদের এই বিষ্ণুর শুতে যতখানি জায়গা লাগে, ততটুকুই দেব, তার বেশি নয়—যাবদেবৈষ বিষ্ণুরভিশেতে তাবদ্‌বো দদ্ম ইতি।

এই কথাই অসুরদের কাল হয়ে গেল। বামন-বিষ্ণু আর বলি রাজার গল্প যাঁরা জানেন, তাঁরা বুঝতেই পারছেন—কীভাবে বিষ্ণু শুয়ে, ফুলে-ফেঁপে বড় হয়ে অসুরদের রাজ্য দখল করে নিলেন। টলস্টয়ের ছোট গল্পের নীতি—How much land does a man require—এ ক্ষেত্রে কাজ করল না। দেবতারা অসুরদের সঙ্গে তঞ্চকতা করলেন এবং অসুর-জিত সমগ্র পৃথিবী দখল করে নিলেন।

দেখুন, শতপথ ব্রাহ্মণ কি কাঠক সংহিতাকে আমাদের শাস্ত্রকারেরা বেদের সম-মূল্য দিয়ে থাকেন। সৃষ্টির প্রথম কল্পে এই গ্রন্থগুলি যা বলেছে, পুরাণ-ইতিহাস তার অনুবাদ করেছে মাত্র। তা আমরা যদি বেদের মধ্যেই দেবতাদের লোভ-হিংসা তঞ্চকতার পরিচয় পাই, তো মনুষ্যলোকেও তার ছায়া পাব। কাঠক সংহিতায় দেখা যাবে—দেবতারা এবং অসুরেরা একই সঙ্গে যজ্ঞ আরম্ভ করেছিলেন। দেবতারা যা যা করছিলেন, অসুররাও তাই তাই করে যাচ্ছিলেন। এমনকি কাঠক-সংহিতার মতে অসুরেরা ছিলেন দেবতাদের থেকে অনেক ভাল এবং অনেক বড় এবং জ্যেষ্ঠও বটে। বরঞ্চ কনিষ্ঠ দেবতাদের মধ্যে অন্যায় বেশি ছিল এবং তাঁরা ছিলেন ছোট ভাইদের মতই উচ্ছৃঙ্খল—কিন্তু এরই মধ্যে অঘটন ঘটিয়ে দিল শুধু সোমাহুতির হিসেব। দেবতারা এটা আগে দেখেছিলেন, এবং সঙ্গে সঙ্গে তাঁরা সোমের অধিকার ছিনিয়ে নেন। আর কি, এর পরে দেবতারাই অসুরদের চেয়ে বড় বলে গণ্য হলেন।

লক্ষণীয় বিষয় হল—অসুরেরা পূর্বে বড় ছিলেন, কি ভাল ছিলেন—সেটা কিন্তু বড় উল্লেখযোগ্য ঘটনা নয়। উল্লেখযোগ্য কথা হল—অনেক ক্ষেত্রেই অসুর-রাক্ষসেরা ভালই ছিলেন কিন্তু স্বয়ং দেবতারা তাঁদের ভাল থাকতে দেননি। তঞ্চকতা, মায়া, ছলনা—ইত্যাদি সমস্ত অন্যায় করে দেবতারা অসুর-রাক্ষসদের তাঁদের প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত করেছেন। সমুদ্র-মন্থনের সময় অসুরদের শক্তি-সামর্থ্য দেবতাদের প্রয়োজন ছিল। তাঁরা সেই শক্তির ব্যবহার করেছেন বটে, কিন্তু অমৃত উঠে এলে কী অসামান্য সঙ্কীর্ণতায় এবং নৃশংসতায় অসুরদের বঞ্চিত করা হল!

নারায়ণ মোহিনী মূর্তি ধারণ করে দেব-দানবের সামনে এসে দাঁড়ালেন। তাঁর মোহন সৌন্দর্যে অভিভূত অসুরেরা নিষ্পলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন তাঁর দিকে, তাঁদের মন একেবারে বিবশ হয়ে গেল। তাঁরা মোহগ্রস্তের মত অমৃত-কলশ তুলে দিলেন সেই মায়ামূর্তি মোহিনীর হাতে— স্ত্রিয়ৈ দানব-দৈতেয়াঃ সর্বে তদাত মানসাঃ।

আসলে এইটাই অসুর-রাক্ষসদের গণ্ডগোল। তাঁরা ইন্দ্রিয় বশে রাখতে পারেন। সমুদ্র-মন্থনে এত যে মহামূল্য বস্তু উঠল, সেদিকে তাঁদের একটুও মন নেই। তাঁদের বিবাদ এবং প্রতিবাদ ছিল শুধু দুটি বস্তু নিয়ে। একটা তো অমৃত। দ্বিতীয়টা লক্ষ্মীদেবী, আরও স্পষ্ট করে বলা ভাল সৌন্দর্যের সারভূত এক রমণী, স্ত্রীলোক—অমৃতার্থে চ লক্ষ্ম্যৰ্থে মহান্তং বৈরমাশ্রিতাঃ। তাঁদের এই মনস্তত্ত্ব বোঝার জন্য ভগবান হওয়ার দরকার হয় না। কেননা ভগবান নারায়ণ রীতিমত মানুষের মতই দেবস্বার্থে শুধু এক মোহিনী স্ত্রীরূপ ধারণ করলেন। ব্যাস! কেল্লা ফতে। তিনি ঠকিয়ে দিলেন অসুরদের।

লক্ষ্মী এবং অমৃতের জন্য অসুরদের যে যথেষ্ট ক্ষোভ এবং অভিযোগ ছিল সে কথা আমরা আগেও বলেছি। কিন্তু উপযুক্ত সময়ে তাঁরা যে সংযম রাখতে পারেন না, শুধু সেই দোষটুকু তাঁদের মনে থাকে না। ঋষি-মুনিরা মহামতি রাবণ সম্বন্ধেও কম প্রশংসা করেননি, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে স্ত্রীলোকের বিষয়ে রাবণের অসংযম এবং অহংকারই যে তাঁকে পতনের দিকে ঠেলে দিয়েছে, এ কথা তাঁরা বলতে দ্বিধা করেননি।

আমার বক্তব্যটা কিন্তু এর চেয়েও গভীরে। পুরাণে ইতিহাসে দেবতাদের যত লাভ এবং প্রাপ্তির বর্ণনা আছে, সেই লাভের বেশির ভাগটাই কিন্তু অসুর-রাক্ষসদের ফাঁকি দিয়ে। যদি বা ধরে নিই শাস্ত্রোক্ত বিধি-নিয়ম দেবতারা কিছু মানতেন, অথবা বৈদিক যাগ-যজ্ঞের ব্যাপারে তাঁদের সমীহ ছিল, অথবা গো-ব্রাহ্মণ পালন, শম-দম-তপস্যার কীর্তিতে তাঁরা ছিলেন অগ্রণী, তা হলেও বলতে হবে ভারতীয় ইতিহাস এবং পুরাণগুলি তাঁদের অন্যায়-অকর্তব্যগুলি মার্জনা করেনি। ঠিক যেমন মুনি-ঋষিরাও বিভিন্ন সাত্ত্বিক গুণে ভূষিত হলেও, তপস্যার শক্তিতে তাঁরা সমাজের মূর্ধণ্য-ভূমিতে প্রতিষ্ঠিত হলেও পুরাণকারেরা তাঁদেরও লোভ, মোহ এবং অহংকার সম্পূর্ণ মানবিকভাবেই ঘোষণা করেছেন।

আমরা বিভিন্ন দর্শন-শাস্ত্রে যেভাবে দেবতারে বিভিন্ন মানবিক দোষ-গুণ লক্ষ্য করব, পুরাণ-ইতিহাসেও তার পূর্বরূপ আছে এবং সাংখ্য-বেদান্তের মত দর্শনেও তার প্রতিফলন ঘটেছে। এমনকি সত্য, ত্রেতা অথবা দ্বাপর যুগের নানা মাহাত্ম্য ঘোষণা করে তাঁরা সেইসব যুগের শম-দম এবং তপঃশক্তির জন্য বিস্ময়-মুকুলিত হন, তাঁদেরই জানাই—এই বিস্ময় এবং আকুলতার কোন কারণ নেই। কারণ সত্য-ত্রেতা-দ্বাপর ইত্যাদি আমাদের পূর্ব-পূর্বতর কলিযুগেরই পর্বভাগ বা নামান্তরমাত্র। সাধারণ্যে দেবতা, মুনি-ঋষি, অসুর-রাক্ষস, অথবা স্বর্গ-নরক সম্বন্ধে যে দূরত্ব-বোধ আছে, সেই দূরত্ব-বোধের জন্যই মানুষের মধ্যে একটা সম্মান বা ভীতি তৈরি হয়েছে। একইভাবে সময়ের একটা বিশাল দূরত্বই মানুষের মনে সত্য-ত্রেতা-দ্বাপর ইত্যাদি যুগ সম্বন্ধে একটা অসামান্য তথা বিশিষ্টতার বোধ এনে দিয়েছে। অবশ্য, বড় বড় মতামত ব্যক্ত করে নানা নতুন সিদ্ধান্ত করার আগে দেবতা, মুনি-ঋষি অসুর-রাক্ষস এবং অবশ্যই মানুষের সম্বন্ধে পুরাণকারদের ভাবটা একটু বুঝে নিই। তাতে যেমন দর্শনের কথা বোঝবার সুবিধে হবে, তেমনই একান্ত মানবায়নের মাধ্যমে দেবতাদের সম্বন্ধে চরম রসিকতাগুলিও অর্থবহ হয়ে উঠবে।

॥ ২ ॥

তবে হ্যাঁ, পুরাণগুলি থেকে কয়েকটা জবর জবর শ্লোক উদ্ধার করে এখন যদি বেশ জোর দিয়ে বলি—দেবতারা সব মানুষই ছিলেন, আর কিছু নয়, তাহলে দার্শনিক স্থিতির দিক থেকে একটা বিরাট ফাঁক থেকে যাবে। বিশেষত ভারতবর্ষের ধর্মতত্ত্বে ঈশ্বর-দেবতা, অসুর-রাক্ষস এবং অবশ্যই মানুষ—এঁদের প্রত্যেকের পারস্পরিক সম্পর্ক যদি দার্শনিক দিক থেকে প্রতিষ্ঠিত না হয়, তবে আমাদের বিপদ বাড়বে বই কমবে না।

প্রথমেই মনে রাখতে হবে—ভারতবর্ষে দেবতত্ত্বের যে বিবর্তন ঘটেছে তাতে সব সময় দেবতাদের দার্শনিক স্থিতি একরকম থাকেনি। অবশ্য শুধু ভারতবর্ষে কেন, গ্রীক-রোমানদেরও অবস্থা এ বাবদে একইরকম। বৈদিক কালে ইন্দ্র, বায়ু, বরুণ, সূর্য—এঁদের প্রত্যেককে যখন যজ্ঞভাগ দিয়েছি তখন আলাদা করে এঁদের প্রত্যেককেই চরম স্তুতি করেছি। হয়তো সভ্যতার প্রথম কল্পে মানুষ যখন নানাবিধ প্রাকৃতিক বিপর্যয় আর ভীতিতে কখনও বিস্মিত, কখনও কম্পমান, তখন পর্যায়ক্রমে বিভিন্ন দেবতার চরম স্তুতি করেছে। অর্থাৎ অগ্নিকে যখন আবাহন করছি, তখন অগ্নিই চরম, আবার যখন সূর্যের উদ্দেশে মন্ত্র পড়ছি, তখন যেন সূর্যের থেকে বড় কিছু নেই। এইভাবে কখনও বরুণ, কখনও অগ্নি, কখনও সূর্য, কখনও বায়ু বৈদিক ঋষির মন্ত্র-কল্পনায় চরম উপাস্য হয়ে উঠেছেন। এরই মধ্যে ইন্দ্রকে যে আমরা দেবতাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ বলে মেনে নিয়েছি, তার কারণ এই নয় যে, তিনি দার্শনিকভাবে অন্যান্য দেবতাদের মূর্ধণ্যভূমিতে প্রতিষ্ঠিত হতে পেরেছেন; তার কারণ সম্ভবত ইন্দ্রের স্বভাব এবং বোধহয় যেহেতু সবচেয়ে বেশি বৈদিক মন্ত্র তাঁরই উদ্দেশে কীর্তিত বলে।

কিন্তু পর্যায়ক্রমে একেক সময় একেক দেবতার এই যে চরম স্তুতি—এই জিনিস কতদিন চলে? সভ্যতার বিবর্তনে মানুষের মধ্যে যখনই দার্শনিক মনন পরিণত হতে আরম্ভ করেছে, তখনই ঋষিদের মধ্যে এক দার্শনিক ক্লান্তি এসেছে। খোদ বেদের মন্ত্রের মধ্যেই এই ক্লান্তি ধরা পড়েছে হিরণ্যগর্ভ সূক্তে। ঋষি বলেছেন—এত ঘি পুড়িয়ে কোন্‌ দেবতার পূজা করব—কস্মৈ দেবায় হবিষা বিধেম? সৃষ্টির আদিকল্পে শুধু হিরণ্যগর্ভই বিদ্যমান ছিলেন। জন্মেই তিনি সর্বভূতের অধীশ্বর। তিনিই এই পৃথিবী আর আকাশকে ঠিক ঠিক জায়গায় প্রতিষ্ঠা করেন। অতএব তিনি ছাড়া আর কোন দেবতার উদ্দেশে ঘি পুড়িয়ে পুজো করব?

স্পষ্ট বোঝা যায়—অন্তত পণ্ডিতেরা তাই বোঝান যে, নানা দেবতার উদ্দেশ্যে যজ্ঞ করতে করতে ঋষিরা এবার বহুর মধ্যে একের সন্ধান আরম্ভ করে দিয়েছেন। এই একের সন্ধান মানেই দর্শনশাস্ত্রের চরম অন্বেষণ—সবার অন্বেষণ। সে অন্বেষণ বৈদিকদের বলতে বাধ্য করেছে—বাপু হে! পাখী হল গিয়ে ওই একটাই, কবি-পণ্ডিতেরা আপন কল্পনায় তাঁর নানা রূপ কল্পনা করেন—সুপর্ণং বিপ্রা কবয়ো বচোভিরেকং সন্তং বহুধা কল্পয়ন্তি। ১০

বেদের মধ্যে এই একত্বের অন্বেষণ একদিকে যেমন আমাদের উপনিষদের চরম এবং পরম একক ব্রহ্মতত্ত্বের দিকে ঠেলে দিয়েছে, অন্যদিকে এই অদ্বয়জ্ঞান-তত্ত্বই বৈদিক দেবতাদের প্রাচীন স্থিতি এবং সম্মান অনেকটাই নষ্ট করে দিয়েছে। ঔপনিষদিক জ্ঞানমার্গ অথবা ব্ৰহ্মতত্ত্বের বিস্তারিত বিচারের মধ্যে না গিয়েও যে গ্রন্থটিকে সমস্ত উপনিষদের সারাৎসার বলা যায়—সেই গীতার মধ্যে যখন বেদের মহান যাগ-যজ্ঞকে স্বার্থপরায়ণ ব্যক্তির পুষ্পিত, অতিরঞ্জিত বাক্যরাশিতে পরিণত করা হল—যামিমাং পুষ্পিতাং বাচং প্রবদন্ত্যবিপশ্চিতাঃ ১১—সেই দিন থেকেই ফলদাতা এবং যজ্ঞাধিপতি দেবতাদেরও কপাল পুড়ল। ইন্দ্র-অগ্নি, মিত্রাবরুণ অথবা সূর্য-সোমের পরিবর্তে পরবর্তী কালে ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বরের মত দেবতা-ত্রয়ীর আবির্ভাব হয়েছিল। ঠিকই, কিন্তু উপনিষদের সূক্ষ্ম আবহমণ্ডলের মধ্যে দিয়েই এই দেবতাদের সৃষ্টি। ফলে ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বরের মধ্যে অন্তত দুইজন, অর্থাৎ বিষ্ণু এবং শিব সব সময়েই পুরাণগুলির মধ্যে পর-ব্রহ্মের মহিমায় কীর্তিত। বিষ্ণু-নারায়ণ-কৃষ্ণ অথবা শিব-রুদ্র-মহেশ্বর-মহাদেবকে এমনভাবেই প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে যেন তত্ত্বগতভাবে তাঁরা নির্বিশেষ নির্বিকল্প হওয়া সত্ত্বেও তাঁরা যেন ঔপনিষদিক ব্রহ্মেরই সাকার এবং শারীরসংস্করণ।

উপনিষদের মধ্যেও যেখানে যেখানে—তিনি দেবতাদেরও দেবতা, তিনি বহু ঈশ্বরের মধ্যেও পরম ঈশ্বর—তং দেবতানাং পরমঞ্চ দৈবতম্। তমীশ্বরাণাং পরমং মহেশ্বরম্‌—এই ধরনের বাক্য ব্যবহার করা হয়েছে, সেখানে সেখানেই কিন্তু পুরাণকারেরা এক বিরাট পুরুষের সন্ধান পেয়েছেন। অর্থাৎ পরব্রহ্ম এখানে সাকার ঈশ্বরে রূপান্তরিত। বৈদিক পুরুষ-সূক্ত থেকে তাঁর মূল বিবর্তন আরম্ভ হয়েছে, উপনিষদের সর্বৰ্গত ব্যাপ্ত ব্রহ্মের কল্পনায় তিনি প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন, আর পৌরাণিকের উদার শ্লোকরাশিতে তিনি সর্বত্র পরিচিত হয়েছেন ঈশ্বর বলে, ভগবান বলে।

বস্তুত এই ওপরের পরিচ্ছেদটি নিয়ে আরও পঞ্চাশ পৃষ্ঠা লেখা এখানে অপেক্ষিত ছিল। কিন্তু তা করতে গেলে আমার পাঠকেরা আপাতত বিরক্ত বোধ করবেন। তবু ঈশ্বরের কথাটা তুললাম এইজন্য যে, ঈশ্বর আর দেবতার বেশ বড় রকমের একটা ভেদ আছে। ঈশ্বরের কল্পনায় আমরা রীতিমত গম্ভীর, ঠাট্টা-মশকরা দূরে থাকুক, পরম ঈশ্বরের কথায় আমরা সেই সব গভীর-কঠিন শব্দের আশ্রয় নিয়েছি যা আমরা ব্যবহার করেছি পরব্রহ্মের কল্পনায়। কিন্তু ভারতবর্ষের মনুষ্য-সমাজ বড় রসিক, বড় কৌতুকপ্রবণ। যে মুহূর্তে পরমেশ্বর স্বয়ং ভগবান মনুষ্যরূপ ধারণ করে ধরাধামে অবতীর্ণ হয়েছেন, সেই মুহূর্তেই কিন্তু সেই বিরাট পুরুষ একান্ত মনুষ্যোচিত নব-রসের বিষয় হয়ে উঠেছেন এবং অবশ্যই হাস্যরসও তার মধ্যে একটি।

তবু দেবতাদের নিয়ে কবিদের কটাক্ষ-কৌতুকের বিস্তার শুরু হবার আগে এটা পরিষ্কার মনে রাখা ভাল যে, দেবতা আর ঈশ্বর তত্ত্বগতভাবে এক বস্তু নয়। এ কথাটা বুঝলে পরে একদিকে যেমন ঈশ্বরের ওপর শ্রদ্ধারও অভাব ঘটবে না, তেমনই অন্যদিকে দেবতাদের নিয়ে, এমনকি ঈশ্বরকে নিয়ে রসিকতাটাও অনেক সহনীয় হয়ে উঠবে।

কথাটা যাস্ক থেকেই আরম্ভ করা দরকার। কেননা, তিনিই বোধহয় প্রথম ব্যক্তি যিনি দেবতার চেহারা নিয়ে মাথা ঘামিয়েছেন। বেদের সমস্ত শব্দরাশিকে সত্য বলে ধরে নিয়ে তিনি দুটি বিকল্প স্থাপন করেছেন, অর্থাৎ দেবতাদের চেহারাটা মানুষের মত হতেও পারে আবার নাও হতে পারে। দেবতাদের শরীর আছে—এই বাবদে তাঁর প্রথম যুক্তি হল—

বেদে দেবতাদের যত স্তুতি-প্রশংসা আছে সেগুলির ভাব এমনই যেন এক অতি চেতনধর্মী ব্যক্তির কাছে আমাদের আবেদন নিবেদন পেশ করা হচ্ছে। অতএব দেবতার আকারটা হয়তো চেতন পুরুষের মতই হবে।

দ্বিতীয়ত, মানুষের মধ্যে যেমন নামকরণ প্রথা চালু আছে, তেমনই দেবতাদেরও ততা কত নাম। ইন্দ্র, যম, বরুণ, সোম এমনকি যমজ দেবতারও নাম আছে। অতএব দেবতারাও মানুষের মতই।

তৃতীয়ত, অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ। হাত, পা, মাথার বিশেষত্বে আমরা যেমন মানুষের কল্পনা করি, তেমনই বেদের এক দেবতাকে আমরা বলেছি—কেমন সুন্দর গো হাত দুটি তোমার—ঋত ইন্দ্র স্থবিরস্য বাহূ; ১২ দৃঢ়মুষ্টিতে তুমি এই দ্যুলোক-ভূলোক ধারণ করে আছ? অথবা ইন্দ্রের কথা ছেড়েই দিলাম, তাঁর চোয়াল থেকে আরম্ভ করে হাত, পা, পেট—সবকিছুই কবি-ঋষির দর্শন-বর্ণনের বিষয়। এছাড়া সূর্যের সোনার বরণ হাত, আদিত্যের মুখ-মণ্ডল, মিত্রের চোখ আর সবার ওপরে—তদ্‌ বিষ্ণোঃ পরমং পদং—এসব দেখে পূর্বমীমাংসার দার্শনিক শবরস্বামী তাঁর প্রতিপক্ষের যুক্তি সাজিয়ে বলেছেন—হ্যাঁ, শ্রুতি-স্মৃতির মধ্যে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের এত বর্ণনা দেখে এরকম কথা মনে হতেই পারে যে, দেবতার শরীর মানুষের মতই হবে। নইলে, এই যে ইন্দ্রের ডান হাত, বাঁ হাত—এতসব বলছ, মানুষের চেহারা থাকলেই না তার ডান হাত, বাঁ হাত সম্ভব—পুরুষবিগ্রহস্য হি দক্ষিণঃ সব্যশ্চ হস্তো ভবতি! তারপর এই যে গলা পেট, চোখ, পা—এগুলিও মানুষের চেহারাই প্রমাণ, অতএব দেবতার শরীর আছে—এইটাই তো মানা উচিত—তস্মাদ্ বিগ্রহবতী দেবতা।

চতুর্থত, মন্ত্রবর্ণের মধ্যে ঋষি সোমরস প্রস্তুত করে ইন্দ্রের উদ্দেশ্যে বললেন—তাড়াতাড়ি এস বাপু! তোমার দুটি ঘোড়া আছে, দুটি ঘোড়া রথে যুতে চলে এস তুমি। তাড়াতাড়ির জন্য চারটি ছটি, আটটি এমনকি দশটি ঘোড়াও রথে যুতে চলে আসতে পার। ১৩ এই যে ইন্দ্রের দুই ঘোড়া থেকে দশ ঘোড়ার রথ, অথবা ঘোড়ায় চড়ে অথবা রথে করে পৃথিবী পরিপক্রমণ অথবা এই যে একেক জনের একেক রকম অস্ত্র, কারও বজ্র, কারও পাশ, কারও দণ্ড—এগুলিও তো দেবতাদের মানুষের কাছাকাছি এনে দিয়েছে।

পঞ্চমত, ক্রিয়াকর্ম যেগুলি আছে, যেমন ধরুন—খাওয়া, পান করা, যুদ্ধ করা, বধ করা, ঘোড়া চালানো, গর্জন করা, শোনা, দয়া করা, ঘুরে বেড়ানো, ক্রুদ্ধ হওয়া, খুশি হওয়া, হতাশ করা, বিয়ে করা—এই সমস্ত ক্রিয়াই যেমন মানুষের জীবন চালনা করে, তেমনই এইরকম আরও কত শত ক্রিয়া দেবতাদেরও জীবন চালনা করে।

পূর্বমীমাংসাদর্শনের ভাষ্যকার দার্শনিক-প্রবর শবরস্বামী প্রতিপক্ষের নানা যুক্তির অবতারণা করে সমস্ত ক্রিয়ার মধ্যে দেবতাদের খাওয়ার যুক্তিটাই খুব জব্বর করে ধরেছেন। তিনি বলেছেন—বেদে আছে—এই বিশ্ব তোমার জঠরে। অথবা ওই যে ভাষা—একেক বারে তিনি তিরিশ জালা সোমপান করেছেন—এসব তো দেবতার খাওয়ারই প্রমাণ। হ্যাঁ, প্রশ্ন তোলা যেতেই পারে—বেদের ওসব কথা বাড়াবাড়ি—অর্থবাদ। দেবতারা মোটেই খান না—ন দেবতা ভুঙ্‌ক্তে। যদি খেতেন তাহলে তো প্রতিনিের আহুতি-দেওয়ার ঘিও তত কমে কমে যেত, তা তো হয় না—যদি চ ভূঞ্জীত, দৈবতায়ৈ হবিঃ প্রত্তং ক্ষীয়েত। ১৪ ওঁরা বলেন—হয় হয়, জানতি পার না। দেবতারা হলেন মধুকরীর মত—ফুল থেকে মধু খেয়ে গেল মৌমাছি, বাইরে থেকে দেখলে ফুলের কিচ্ছুটি হল না; যেমন সুন্দর, সুগন্ধী, তেমনই থাকল। আসলে কিন্তু ফুলের অন্তঃসার নিয়ে গেল মৌমাছি। দেবতারাও তেমনই অন্নপানের রসটুকু খেয়ে যান, আমরা সাক্ষাতে বুঝতে পারি না—দেবতারা খেলেন—অন্নরসভোজিনী দেবতা মধুকরীবদবগম্যতে। ১৫

শবরস্বামীর কাছে এসব কিন্তু প্রতিপক্ষের উত্তর-প্রত্যুত্তর। নিজের মত প্রতিষ্ঠা করার জন্য তিনি প্রতিপক্ষের উত্তর-প্রত্যুত্তরের ঝামেলা আগেই মিটিয়ে নিচ্ছেন। হাইকোর্টে আইনের লড়াইতে দুঁদে উকিল যেমন তাঁর প্রতিপক্ষের যুক্তি নিজেই সাজিয়ে নেন এবং তারপর সে সব যুক্তি কেটে দেন, আমাদের পূর্বমীমাংসার উকিল শবরস্বামীও এতক্ষণ তাই করেছেন। বস্তুত শবরস্বামীর মত মীমাংসক-দার্শনিকদের যুক্তিতে দেবতার মূল্য খুব বেশি কিছু নয়। মীমাংসকদের কাছে বৈদিক যাগ-যজ্ঞের কর্মকাণ্ডটাই বড় কথা, দেবতাদের মূল্য তত নেই। এখানে যজ্ঞ-কর্মই প্রধান, দেবতা অপ্রধান, গুণীভূত।

মীমাংসকরা বলেন—মন্ত্রময়ী দেবতা। অর্থাৎ বেদে যেভাবে যখন যেটা করতে বলা হয়েছে, সেইভাবে যদি ঠিকঠাক সবকিছু করা যায়, মন্ত্র যদি পড়া যায় নির্ভুল উচ্চারণে, তাহলে নির্দিষ্ট ফলও হতে বাধ্য, দেবতার চতুর্দশ পুরুষের সাধ্য নেই মন্ত্রের ফল আটকান। মীমাংসকদের এই বিশ্বাস অনেকটা ‘চণ্ডালিকা’র প্রকৃতি মত—

পড় তুই সব চেয়ে নিষ্ঠুর মন্ত্র—
পাকে পাকে দাগ দিয়ে জড়ায়ে ধরুক ওর মনকে।
যেখানেই যাক, কখনো এড়াতে আমাকে
পারবে না, পারবে না।।

মুশকিল হল, দেবতাদের নানান ক্রিয়াকাণ্ড বৈদিক মন্ত্রগুলির মধ্যে এত বেশি মাত্রায় উচ্চারিত, যে প্রতিপক্ষের যুক্তিও সেখানে মীমাংসকদের জর্জরিত করে।

প্রতিপক্ষ বলেন—ও আবার কেমন কথা! তোমার যজমান দেবতার উদ্দেশ্যে কত ঘি পোড়াচ্ছেন, পুরোডাশ দিচ্ছেন—সে সব কী কিছুই নয়? তাছাড়া দেবতার উদ্দেশ্যে যজমানের দ্রব্যত্যাগই তো যাগ-যজ্ঞের অর্থ। যজমানের দেওয়া জিনিসগুলোই যে দেবতার ভোগে লাগে, সেটাই তো যাগ শব্দের অর্থ—ভোজনস্য তদর্থাৎ। ১৬

প্রতিপক্ষের উদাহরণ দিয়ে মীমাংসককে আরও বোঝন—কেন রে বাবা, বাড়িতে অতিথি আসলে কী হয়, কেমন হয়? তুমি টাকা-পয়সা খরচা করে নানা জিনিস কিনে অতিথি যেমনটি ভালবাসেন, তেমনটি রান্না করলে। তো, এই রান্না-বান্নার জন্য তোমার যে এত মেহনত, এত আয়োজন এত ত্যাগ—তার কারণটা কী? অতিথিই তো বটে। তাই যদি হয়, তবে অতিথিই তো প্রধান। সেটা মানতেই হবে বাপু। তেমনই এই অতিথির মত তোমার যাগ-যজ্ঞেও দেবতাই প্রধান, তাঁর জন্যই না যজ্ঞ। আর মীমাংসক! তোমার যেমন কথা বাপু, যদি দেবতার চেয়েও যজ্ঞটাই তোমার কাজে বড় হয়, তাহলে তো বলতে হবে—এই রান্না-বান্না পা-ধোয়ার জল, আর তেল-তাম্বূলের জোগাড়-যন্ত্রটাই বড় কথা, অতিথি লোকটা যেন কিছুই নয়?

মীমাংসক এত কথা শুনে চুপ করে থাকবেন না মোটেই। তিনি বলবেন—যজ্ঞটাই বড়, না, দেবতা বড়—সে ব্যাপারে তুমি কথা বলার কেউ নও। যা বলবে, শাস্ত্র বলবে। শাস্ত্র বলেছে—‘যজেত স্বৰ্গকামঃ’ অর্থাৎ পরলোকে স্বর্গ চাও তো যাগ-যজ্ঞ কর। এখানে যাগ করলে স্বর্গ পাবে—এ কথার মানে হল যাগের ফল স্বর্গ। কোন দেবতা এখানে ফলদাতা নন। বেদবিহিত যাগ নিয়ম-কানুন মেনে করে যাও, স্বর্গ তোমার হাতের মুঠোয়।

প্রতিপক্ষ বলবেন—এ আবার কেমন ধারা কথা? যাগ-যজ্ঞে ঠাকুর-দেবতার তো কোন অপেক্ষাই রইল না—এমন অহংকার ধম্মে সইবে না বাপু। তাছাড়া, ধর্মশাস্ত্র, নীতিশাস্ত্রও তো একটা আছে। তাঁরা বলেছেন—দেবতারা যদি অসন্তুষ্ট হয়ে তোমার বিপক্ষে দাঁড়ান, তবে ঈপ্সিত বস্তু তোমার হাতের মুঠোয় এসেও হাত গলে বেরিয়ে যাবে—

সুরেষু বিঘ্নৈকপরেষু কো নরঃ
করস্থমপ্যর্থমবাপ্তুমীশ্বরঃ ॥ ১৭

আর এই যে তুমি অত করে বললে—স্বর্গে যাবার বাসনা থাকলে যাগ-যজ্ঞ কর। তো সেই স্বর্গের রাজা তো ইন্দ্র। তিনি যদি তুষ্ট হন, তবে তো কেল্লা ফতে। স্বয়ং ঋক্‌বেদের ঋষি বলেছেন—জল, স্থল, অন্তরীক্ষ, স্বর্গলোক—সব জায়গাতে ইন্দ্রেরই আধিপত্য, এমনকি যাগ-যজ্ঞেও তাঁরই প্রভুত্ব এবং ফল দেবার, ক্ষমতাও তাঁরই সবচেয়ে বেশি—ইন্দ্রঃ ক্ষেমে যোগে হব্যে ইন্দ্রঃ। ইন্দ্রের যখন এতই ক্ষমতা, সেখানে তাঁরই পূজা আরাধনা করা, তাঁরই উদ্দেশে যজ্ঞ সম্পন্ন করা দরকার। সব ব্যাপারে যখন দেবতারই প্রভুত্ব, তিনি যখন ফলদাতা, সেখানে দেবতাকে না মেনে যাগ-যজ্ঞকে বড় করে দেখি কী করে?

মীমাংসক এবার জোর গলায় বলবেন—দেখ বাপু! শাস্ত্র। বেশি বোঝারও চেষ্টা কোর না। বেশি বোঝানোরও চেষ্টা কোর না। বেদ-ব্রাহ্মণ বলেছেন—ফল দেবে যাগ-যজ্ঞ, কর্ম, দেবতা নিমিত্তমাত্র। দেবতা ফল দিচ্ছেন—এমন কোন শ্রুতিপ্রমাণ নেই; কিন্তু যাগ-যজ্ঞের ফলে এটা হয়েছে, কি, ওটা হবে—সেটা শ্রুতিসিদ্ধ অর্থাৎ বেদ বলেছে—হবে, অতএব হবে। বেদ নিয়ে আলোচনা করবে, অথচ শব্দ-প্রমাণ মানবে না, তা তো হয় না। অতএব বাপু, যুক্তি-উদাহরণ বেশি দেখিও না। শব্দ-ব্ৰহ্ম, শাস্ত্র। তাছাড়া অত দেবতা-দেবতা করছ, হাত, মুখ, পা দেখিয়ে তাঁদের শরীর বানিয়ে দিচ্ছ, তাঁদের আবার ফল দেবার ক্ষমতাও স্বীকার করছ, তাহলে বলি—বেদে তো কত সব অচেতন দেবতার কথাও আছে। এই যে বলা হয়েছে—“বনস্পতিভ্যঃ স্বাহা”, “মূলেভ্যঃ স্বাহা”—এখানে এই বনম্পতি, অথবা গাছের শেকড়—এসব তো দেবতা হিসেবে কল্পিত। তাহলে এদেরও ফল দেওয়ার ক্ষমতা স্বীকার করতে হয়। অথবা স্বীকার করতে হয়, তাঁদের এক একটি দেব-শরীর আছে যা চেতনও বটে। ১৮

মীমাংসাকরা দেবতার শরীর, ক্ষমতা, চৈতন্য—সবই উড়িয়ে দিচ্ছেন। তাঁদের আরও একটা বড় যুক্তি হল—দেবতার ঐশ্বর্য, ক্ষমতা, কি, ভক্তের ইচ্ছাপূরণ—ওসব কল্পনামাত্র। বেশ তো, দেবতার অতই যদি ক্ষমতা, তবে বিভিন্ন জায়গায় একই সঙ্গে বেশ কয়েকটা যজ্ঞ আরম্ভ করা যাক। বিভিন্ন যজমান, বিভিন্ন স্থান, কিন্তু যজ্ঞ এক, দেবতাও এক। এসব ক্ষেত্রে প্রত্যেক স্থানে উপস্থিত হয়ে একই দেবতার পক্ষে সশরীরে এসে বিভিন্ন যজমানকে যজ্ঞ-ফল দেওয়া সম্ভব কিনা—এমন কথা সুধীদেরই বিচার্য। অথাৎ মীমাংসকরা দেবতার এত মাহাত্ম্য স্বীকার করলেন না। কারণ, প্রমাণ নেই। এমন প্রমাণ নেই যে, একই দেবতা বিভিন্ন যজ্ঞস্থলে আহূত হয়ে যজমানের ঈপ্সিত ফল দান করছেন। তাঁরা বললেন—বেদের মন্ত্রই বড় কথা, যজ্ঞ-কর্মই আসল। মন্ত্রই দেবতার শরীর, মন্ত্রের বলেই যজমানের ইচ্ছাপূরণ। তবে যে বেদের মধ্যে এত শত দেবতার নাম, মাহাত্ম্য, ঐশ্বর্য, ক্ষমতা—এগুলি অর্থবাদ, অতিশয়োক্তি। যজ্ঞে দেবতা গৌণ, নিমিত্তমাত্র।১৯

॥ ৩ ॥

মীমাংসকদের এইসব তর্ক-যুক্তিতে মহা-মুশকিলে পড়ে গেছেন বৈদান্তিকরা। আর শুধু বেদান্তী কেন, অনেকেই এই বিপদে তাঁদের যুক্তি-তর্ক শানিয়ে তুলেছেন। তাছাড়া এটাও ভাবুন একবার, ভারতবর্ষে মত দেশ—যেখানে বেদের আমল থেকে আজ পর্যন্ত শত দেবতাদের রাজত্ব, যেখানে তাঁদের প্রত্যেকের শরীর তো অতি সহজ কথা, যেখানে, তাঁদের গায়ের রঙ, চেহারার খুঁত, মায় কে কীরকম জামা-কাপড় পড়েন—তা পর্যন্ত পৌরাণিকদের কণ্ঠস্থ, সেখানে পাঁচ-ছটা জৈমিনির সূত্র আর তার ওপরে ভাষ্য রচনা করে দেবতাদের শরীর, ক্ষমতা, ঐশ্বর্য—সবই উড়িয়ে দিলাম—এই কী ভারতবর্ষের ধাতে সয়?

বেদান্তীরা, এমনকি শঙ্করাচার্যের মত কট্টর অদ্বৈত-বেদান্তী পর্যন্ত মীমাংসকদের এইসব কথায় একেবারে ফুঁসে উঠেছেন। ওঁদের বক্তব্য—জৈমিনি, কী শবরস্বামী বললেই কী শেষ কথা হল নাকি? বেদ-ব্রাহ্মণ কী কিছুই নয়! তাছাড়া এই যে এতকালের ইতিহাস-পূরাণ—বেদ-মূলক বলেই না এই সব গ্রন্থকে সবাই এত শ্রদ্ধা-ভক্তি করে শাস্ত্রের মর্যাদা দেয়! সেগুলি কী এতই ফেলনা নাকি?

শঙ্করাচার্য তো সোজাসুজি মহাভারতের সেই সূর্য-কুন্তীর মিলন-দৃশ্যটাই নিজের লেখার মধ্যে উদ্ধার করেছেন। সেই যে দুর্বাসার সেবা করে কুন্তী বর পেলেন নিজের ইচ্ছামত দেব-পুরুষের সঙ্গ লাভ করার। আর বর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই কুন্তী তাঁর মন্ত্র পরীক্ষার জন্য আহ্বান করলেন আকাশে উদীয়মান রক্তিম সূর্যকে। একলা ঘরে নির্জন অলিন্দে বসে আকাশ-লম্ব সূর্যের করস্পর্শ লাভ করে কুন্তী সূর্যের মধ্যে প্রথম প্রেমিক পুরুষের রূপ দেখতে পেয়েছিলেন—সোনার বরণ বর্ম-পরা, দিব্য কুন্তলে শোভমান। কুন্তীর বড় ভাল লেগেছিল। তিনি দুর্বাসার বশীকরণমন্ত্রে আহ্বান করেছিলেন দেবপুরুষকে।

হঠাৎ আকাশ থেকে মর্ত্য মানবীর সাদর আহ্বান শুনে দেব-পুরুষ কী করেছিলেন? তিনি নিজেকে দ্বিধা বিভক্ত করে একভাগে আকাশে থাকলেন আলোক বিকিরণ করার জন্য, আরেকভাগে দিব্য পুরুষের মনোমোহন রূপে ধরা দিলেন কুন্তীর বাহুপাশে। আর এই দৃশ্য দেখে শঙ্করাচার্য বলে উঠলেন—সম্ভব। নিশ্চয় সম্ভব। মীমাংসকেরা যতই বলুন, এক দেবতার পক্ষে বহুজনের যজ্ঞে অধিষ্ঠিত হওয়া অসম্ভব। আমরা বলি—সম্ভব। দেবতা আপন ঐশ্বর্যবলে যেমন একদিকে জ্যোতিষ্করূপে অবস্থান করতে পারেন, তেমনই ইচ্ছে অনুসারে শরীরও ধারণ করতে পারেন—অস্তি হি ঐশ্বর্য-যোগাদ্‌ দেবতানাং জ্যোতিরাদ্যাত্মভিশ্চাবস্থাতুং, যথেষ্টং চ তং তং বিগ্রহং গ্রহীতুং সামর্থ্যম্‌। মহাভারতে আছে—সূর্য যোগবলে নিজেকে দ্বিধা বিভক্ত করে কুন্তীর কাছেও এলেন আবার আকাশ থেকে তাপও বিকিরণ করলেন—যোগাৎ কৃত্বা দ্বিধাত্মানমাজগাম ততাপ চ। শঙ্করাচার্য এই ‘যোগ’ কথাটাতেই স্পষ্ট করে বললেন—‘ঐশ্বর্যযোগাৎ’ অর্থাৎ ঐশ্বরিক শক্তিতেই সূর্য পুরুষের রূপ ধরে এলেন কুন্তীর কাছে—আদিত্যঃ পুরুষো ভূত্বা কুন্তীমুপজগাম হ। ২০

বলা যায়—এসব তো ভাই ইতিহাস-পুরাণের কথা। মানুষের রচনায় ভ্ৰম-প্রমাদ থাকে। অতএব অপৌরুষেয় বেদে এসব পাবে না। শঙ্কর বললেন—কেন পাবে না। বেদের ব্রাহ্মণভাগে দেখ—ইন্দ্র মেষ হয়ে কাণ্বায়ন গোত্রের ঋষি মেধাতিথিকে হরণ করেছিলেন—মেধাতিথিং হি কাণ্বায়ণম্‌ ইন্দ্রো মেষো ভূত্বা জহার।

সত্যি কথা বলতে কি, শুধু এই একটা লাইন বলেই মহামতি শঙ্করাচার্য দেবতাদের শরীর স্বীকার করে নিয়েছেন। এমনকি একটু আগে আমরা যে বেদের প্রমাণে ইন্দ্রের হাত, মুষ্টি ইত্যাদি প্রত্যঙ্গের কথাবলেছি, তাঁর বৃত্ৰ-হত্যার কথা বলেছি অথবা যজমানের দেওয়া আহুতি স্বীকার করার কথা বলেছি—এগুলি মীমাংসকরা স্বীকার না করলেও শঙ্করাচার্য স্বীকার করেন। মীমাংসকের কথা শুনে শঙ্কর ভারী আশ্চর্য হয়েছেন। শঙ্কর বলেন—রূপ ছাড়া আবার দেবতা হয় নাকি? যার কোন রূপ, নেই, মূর্তি নেই—তার কথা ভাবব কী করে, ধ্যান করব কী করে—ন হি স্বরূপ-রহিতা ইন্দ্রাদয়ঃ চেতসি আরোপয়িতুং শক্যন্তে? দেবতা যদি ভক্তজনের মানসলোকে আরূঢ় না হন, তাহলে দেবতার উদ্দেশ্যে আহুতি দেওয়ারই বা মানে কী—ন চ চেতসি অনারূঢ়ায়ৈ তস্যৈ তস্যৈ দেবতায়ৈ হবিঃ প্রদাতুং শক্যতে। ২১

শঙ্করের এইসব কথার জবাব দেওয়া মীমাংসকদের পক্ষে বড় কঠিন হয়ে গেছে। হ্যাঁ, শঙ্কর এটা মানেন যে, ইন্দ্র, যমের মত বৈদিক দেবতারা মানুষের মত জীবই বটে, তবে তাঁরা উন্নত শ্রেণীর জীব। মানুষ থেকে তৃণ পর্যন্ত যে সজীব পরম্পরা আমরা। দেখতে পাই, তার মধ্যে জীবত্ব সমান হলেও তাদের জ্ঞান এবং ক্ষমতার তারতম্য আছে। অর্থাৎ মানুষ-জীবের থেকে নিম্নস্তরের জীব যারা, তাদের জ্ঞানও কম, ক্ষমতাও কম এবং একেবারে তৃণ পর্যন্ত গেলে প্রত্যেকের মধ্যে তারতম্যটাও যথেষ্ট চোখে পড়বে। ঠিক একইভাবে মানুষ-জীবের থেকে ওপরের দিকে যখন তাকাব, তখন দেখব মানুষ থেকে সেই সৃষ্টিকর্তা পর্যন্ত প্রত্যেকেরই একের থেকে অন্যের জ্ঞান এবং ক্ষমতা পর পর বেশি—জ্ঞানৈশ্বর্যাদ্যভিব্যক্তিরপি পরেণ পরেণ ভূয়সী ভবতীত্যেতৎ ন শক্যং নাস্তি ইতি বদিতুম্‌। ২২

আসলে মানুষের যেমন পুণ্যকর্ম, ভাল কাজের মাধ্যমে উত্তরোত্তর শ্রীবৃদ্ধি ঘটে, দেবতাদেরও তেমনই। মহাভারত-পুরাণে হাজারো উদাহরণ আছে, যেখানে অন্যায় এবং অনিয়মের ফলে দেবতাদের স্থানভ্রষ্ট হতে দেখছি, আবার অনেক মানুষকেও দেখছি অসাধারণ সংযম-নিয়মে অথবা সুকর্মে নিজেকে দেবতার পর্যায়ে নিয়ে যেতে। পাণ্ডব-কৌরবের বহুপূর্ব পুরুষ নহুষকে মনে আছে তো? সেই যিনি বনপর্বে অজগরের চেহারায় আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলেছিলেন ভীমকে। তিনি শাপগ্রস্ত হয়েই সর্পে পরিণত হয়েছিলেন—এই পতনের চেয়েও যেটা বড় কথা, সেটা হল—তিনি আপন যোগ্যতায় স্বর্গের ইন্দ্রপদ লাভ করেছিলেন।

আসলে ইন্দ্ৰত্ব একটা উপাধি। মার্কণ্ডেয় চণ্ডীতে দেখেছি স্বর্গের দেবতাদের হঠিয়ে দিয়ে মহিষাসুরই ইন্দ্র হয়ে স্বর্গের সিংহাসনে বসেছে। একইভাবে আরও অনেক অসুর-রাক্ষসকেও আমরা ইন্দ্রের আসনে বসতে দেখেছি। অসুর-রাক্ষস অথবা দেবতারা যেমন ইন্দ্রত্ব লাভ করেন, সেইভাবে কখনও বা মানুষও ইন্দ্র হয়ে বসেছে স্বর্গের দেবসভায়। নহুষ সেইরকমই একটা দৃষ্টান্ত।

নহুষের ইন্দ্র হওয়ার মধ্যে বেশ একটা গণতান্ত্রিকতাও ছিল। মর্ত্যভূমিতে তিনি সুন্দর রাজ্য শাসন করছিলেন। কিন্তু স্বর্গে বোধহয় উপযুক্ত নেতার অভাব ঘটেছিল। অবস্থা দেখে—ঋষিরা এবং দেবতারা ঠিক করলেন—নহুষকেই ইন্দ্ৰত্ব দেওয়া হোক। তিনি তেজস্বী, যশস্বী এবং ধার্মিক। নিজেদের সিদ্ধান্তের কথা তাঁরা নহুষকে জানালেন। নহুষ বললেন—আমি সামান্য মানুষ, আপনাদের মত বড় মানুষের ওপর কর্তৃত্ব ফলানো কি আমার কুলোবে? ইন্দ্র হতে গেলে শক্তি লাগে, সে শক্তি আমার নেই। সবাই বললেন—অমন কথা বলবেন না। আপনিই আমাদের রাজা হোন। আমরা আমাদের তেজ এবং শক্তি দিয়ে আপনার শক্তি বাড়াব। ২৩

গণতন্ত্রে যেমন বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যের সাংসদদের শক্তির ভিত্তিতেই প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা বৃদ্ধি হয়, বিভিন্ন অঞ্চলের নেতারা যেমন দল-মুখ্যকেই নিজের জনপ্রিয়তার শক্তি ধার দেন, এখানে মহাভারতে দেখছি শুধু দেবতাই নন, দেব-মানব-যক্ষ, ঋষি, রাক্ষস, সিদ্ধ-গন্ধর্ব সবারই তেজোবলে ঋদ্ধি লাভ করে মর্ত্যভূমির রাজা নহুষ ইন্দ্র হয়ে বসলেন স্বর্গে। নহুষ যখন স্বর্গের আধিপত্য লাভ করলেন তখন তাঁর সামনে ছিল ধর্মের অনুশাসন। কিন্তু ‘পাওয়ার’ পেলে সমস্ত রাজনৈতিক নেতার যা হয়, নহুষের তাই হল। ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে অধিষ্ঠিত হয়ে নহুষ ধর্মাত্মা নৃপতি থেকে কামাত্মা পুরুষে পরিণত হলেন—ধর্মাত্মা সততং ভূত্বা কামাত্মা সমপদ্যত। ২৪ নহুষের পতন হল। তাঁর ইন্দ্রত্ব গেল।

কাজেই মানুষের পক্ষেও ইন্দ্র হওয়া সম্ভব, অসুর-রাক্ষসের পক্ষেও ইন্দ্র হওয়া সম্ভব। এর উদাহরণ ইতিহাস-পুরাণে ভূরি-ভূরি আছে। মনে রাখা দরকার—পুরাণের দৈত্য-দানবেরা দেবতাদেরই বৈমাত্রেয় ভাই, অতএব ক্ষমতা, বুদ্ধি অথবা যশ কোনটাই তাঁদের কিছু কম নয়। বরঞ্চ আচার্য শঙ্করের মত মেনে বলতে হবে—মানুষের থেকে দেবতা, এমনকি অসুর-রাক্ষসদের বল-বুদ্ধি পর পর বেশি। আর বেশি বলেই দেবতাদের ব্যাপারটা মানুষের চেয়ে একটু অন্যরকম।

মানুষ পূর্বজন্মের কথা স্মরণ করতে পারে না, অতএব যদি বলি দেবতারাও পারেন না, তাহলে ভুল বলা হবে। ভুল এইজন্যে যে, মানুষের চেয়ে দেবতাদের ঐশ্বর্য অথবা ক্ষমতা বেশি। মহাপ্রলয়ে যখন সব নষ্ট হয়ে যায়, তখন কল্পান্তরে বিধাতাপুরুষ আবার বসেন সৃষ্টির তপস্যায়। তাঁর পূর্বকল্পের তপস্যা-বৈরাগ্য পরমেশ্বরের অনুগ্রহ বিফল হয় না মোটেই। শঙ্কর বলেছেন—প্রকৃতির নিয়মে যে বৃক্ষ-কুল বসন্তের পুষ্পশোভা আপন অঙ্গে ধারণ করেছিল, মাঝখানে প্রকৃতির নিয়মে পাতা-ঝরার মত প্রলয় হয়ে গেলেও আগামী বসন্তে যেমন আবারও ফিরে আসে সেই নববসন্তের শোভা, বিধাতাও তেমনই পূর্বপুণ্য-তপস্যায় এবং পরমেশ্বরের অনুগ্রহে পূর্ব সৃষ্টি স্মরণ করতে পারেন। ফলে কী হয়? শঙ্করাচার্য শাস্ত্রযুক্তি দিয়ে বললেন—অতীত কল্পে দেবতাদের যেমন রূপ ছিল, বর্তমান কল্পেও দেবতাদের সেই রূপ, সেই কাজকর্ম, সেই অভিমানই থাকে—

যথাভিমানিনো’তীতা স্তুল্যাস্তে সাম্প্রতৈরিহ।
দেবা দেবৈরতীতৈ র্হি রূপৈ র্নামভিরেব চ ॥ ২৫

অর্থাৎ অদ্বৈতবাদী বেদান্তীরা দেবতাদের কিন্তু উড়িয়ে দিলেন না। স্বীকার করে নিলেন—তাঁদের শরীর আছে। ওঁরা বলেন—দেবতাদের শরীর বোঝা যায় পাঁচ রকমে। দেবতাদের পাঁচ রকমের শরীর আছে। একে বলে বিগ্রহ-পঞ্চক। বিগ্রহ মানে শরীর। দেবতাদের শারীরিক অধিষ্ঠান পাঁচভাবে বোঝা যায়। এক, দেবতারা ইচ্ছেমত শরীর ধারণ করতে পারেন। দুই, যজ্ঞে দেওয়া আহুতি বা হবির্ভাগ তাঁরা ভক্ষণ করতে পারেন। তিন, তাঁদের ঐশ্বর্য বা সকলের ওপর তাঁদের প্রভুত্ব আছে। চার, মানুষের দেওয়া পূজা-উপাচারে তাঁরা প্রসন্ন হন। এবং পাঁচ, তাঁরা মানুষের ক্রিয়াকর্মের ফল দিতে পারেন। দেবতাদের যে শরীর আছে—এই পাঁচটা তার প্রমাণ। ২৬

শঙ্করাচার্য বলেছেন—বেদে-ব্রাহ্মণে যখন দেবতাদের শরীর সম্বন্ধে, স্পষ্ট কথা বলা আছে, তখন দেবতার শরীরটা তো মানতেই হবে। উলটো করে যদি প্রশ্ন করা যায়—এখন যেমন কোন দেবতা দেখতে পাচ্ছি না, তেমনই আগেও কোন দেবতা ছিল না। অর্থাৎ এখনকার মত আগেও কেউ দেবতার চেহারা দেখেনি, অথবা তাঁদের সঙ্গে কথাবার্তাও কেউ বলেনি। শঙ্কর বলেন—এ আবার কেমন যুক্তি—এখন আমরা রাজতন্ত্র দেখি না বলে সেকালে কী রাজাও ছিল না। এখন রাজসূয় যজ্ঞ হয় না বলে কী সেকালেও রাজসূয় যজ্ঞ হত না। তাহলে তো সমস্ত জগদ্‌-বৈচিত্র্যটাকেই অস্বীকার করতে হয়।

এটা মানতেই হবে যে, প্রাচীনেরা আপন ধর্ম-প্রভাবে দেবতাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন, কথাবার্তাও অবশ্যই বলেছেন। মন্ত্রজপের মাধ্যমে ইষ্ট-দেবতার দেখা মিলবেই মিলবে। তবে হ্যাঁ, আমাদের মতো সাধারণ মানুষের শক্তি-সামর্থ্যের সঙ্গে ঋষিদের শক্তি-সামর্থ্যের তুলনা কর না—ঋষীণামপি মন্ত্রব্রাহ্মণদর্শিনাং সামর্থ্যং নাম্মদীয়েন সামর্থ্যেন উপমাতুং যুক্তম্‌। ২৭ তাছাড়া শাস্ত্র-ফাস্ত্র যদি ছেড়েই দাও তো অধুনা যারা ‘ফোক্‌-ফোক্’ করে ডাক ছাড়ছেন, তাঁরা ফোক-ট্র্যাডিশনেই বিশ্বাস করুন। লোক-প্রসিদ্ধি যখন বলে যে, দেবতার শরীর আছে, দেবতা আছে, তখন দেবতা-ব্যাপারটা নিরাধার করে দেওয়া কেন বাপু—লোক-প্রসিদ্ধিরপি ন সতি সম্ভবে নিরালম্বনা অধ্যবসাতুং যুক্তা?

দেবতার শরীর মেনে নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই মহামতি শঙ্কর কিন্তু মনুষ্যভাবও স্বীকার করে নিলেন দেবতাদের। মানুষের চেয়ে তাঁরা বেশি বুদ্ধিমান-ব্রহ্মসূত্রের ব্যাখ্যায় একথা বললেও শঙ্করাচার্যের ব্যাখ্যাপত্তর যেভাবে চলেছে, তাতে স্পষ্ট বোঝা যায় দেবতাদের তিনি মানুষই মনে করেন। শঙ্করের মতটা খুব স্পষ্ট করে বোঝা যায় বৃহদারণ্যক উপনিষদের ভাষ্যব্যাখ্যায়। তিনি বলেছেন—অথবা এ কথাই বলা ভাল যে মানুষ ছাড়া দেবতা বা অসুরের কোন অস্তিত্বই নেই—অথবা ন দেবা অসুরা বা অন্যে কেচন বিদ্যন্তে মনুষ্যেভ্যঃ। ২৮

মানুষের মধ্যেই যাঁদের ইন্দ্রিয়-পরায়ণতা যথেষ্টই আছে এবং যাঁরা লোকোত্তর গুণের অধিকারী, তাঁরাই হলেন দেবতা—মনুষ্যাণামেব অদান্তা যে অন্যৈরুত্তমগুণৈঃ সম্পন্নাঃ তে দেবাঃ। ২৯ শঙ্করের এই কথাটা আমি একশ গুণ মানি। এতটাই মানি যে, রাম, কৃষ্ণ এবং চৈতন্যের মত অসাধারণ ব্যক্তিরা মানুষই ছিলেন বলে মনে করি, কিন্তু অতি উত্তম গুণের মাহাত্ম্যে তাঁরা দেবতা হয়ে গেছেন। শুধু দেবতা নয়, এঁরা ঈশ্বর পদবী লাভ করেছেন। শঙ্করের মতে মানুষ হল লোভ-প্রধান। শুধু লোভের কথা এইজন্য বলেছেন শঙ্কর যে, মানুষের কাম-ক্রোধের মূলে থাকে লোভ। লোকোত্তর দেবপুরুষেরা এই কাম-ক্রোধ-লোভ জয় করেছেন বলেই তাঁরা মানুষ থেকে দেবতা হয়ে যান। অপি চ অতিলোভী মানুষেরাই যখন হিংসায় ক্রূর হয়ে ওঠে, তখন তারাই অসুরের পদবী লাভ করে—লোভপ্রধানা মনুষ্যাস্তথা হিংসাপরাঃ ক্রূরাঃ অসুরাঃ। তাহলে একই মানুষই নিষ্ঠুরতা আর অনিষ্ঠুরতার গুণে কখনও অসুর কখনও দেবতা—তে এব মনুষ্যা অদান্তাদি-দোষত্ৰয়মপেক্ষ্য দেবাদিশব্দভাজা ভবন্তি। দেবতা, মানুষ আর অসুরের এই আত্যন্তিক পার্থক্যটা অবশ্য সত্ত্ব-রজ-তমের পার্থক্যেও ভাবা যায়—যা শঙ্করও ভেবেছেন এবং আরও বেশি করে ভেবেছেন সাংখ্য দর্শনের লোকেরা। সে কথায় পরে আসছি।

দেবতার মধ্যে এই মনুষ্যভাবটি এসে যাওয়ায় একদিকে যেমন বৈদিক যুগের শেষে তাঁদের ওপর একটা প্রচ্ছন্ন অবিশ্বাস এসে গিয়েছিল—যে অবিশ্বাস বা সন্দেহ ধরা পড়েছে প্রসিদ্ধ সেই ঋক্‌মন্ত্রের মধ্যে—তবে আর কার উদ্দেশ্যে ঘি পুড়িয়ে আহুতি দেব—কস্মৈ দেবায় হবিষা বিধেমঃ—ঠিক তেমনই এই সন্দেহ টিকে গিয়েছে একেবারে আধুনিক যুবা পর্যন্ত। নীতি-শাস্ত্রের কবি শ্লোক বেঁধে বলেছেন—দুর্বল-লোকই দেবতার মার খায় বেশি। এই যে দেবতার উদ্দেশ্যে হাজারো মন্ত্রে পশুবলির বিধান আছে, কই সেখানে তো হাতী-ঘোড়া বলি দেওয়ার বিধান নেই। আসলে হাতী বলি দেওয়াও অত সোজা নয়, ঘোড়া-বলিও মানুষের সাধ্যে বড় কুলোয় না। বাঘ-সিংহ বলি তো দূরের কথা—অশ্বং নৈব গজং নৈব ব্যাঘ্রং নৈব চ নৈব চ। অতএব দেবতার প্রীতির জন্য বেছে নেওয়া হল নিরীহ দূর্বল ছাগশিশুকে, কারণ মানুষ তাকে কব্জা করতে পারে ভাল, খেতেও পারে ভাল। দেবতারাও তাই শক্তের ভক্ত নরমের যম—দেবো দুর্বলঘাতকঃ। ৩০

দেবতার প্রতি এই যে আক্ষেপটুকু এসেছে, তার কারণ মানুষ দেবতাকে নিজেরই আদলে গণ্য করেছে। মানুষ যদি বাঘ-সিংহ মেরে বলি দিতে না পারে, শাস্ত্রের বিধানও আসবে সেই নিরুপায়তার সূত্র ধরেই। দেবতারাও কোথায় বাঘ-সিংহের মত হিংস্র পশু বলি হিসেবে চান না। কারণ সেটা জোটাতে গেলে, মানুষের ভক্তি বলে আর কোন জিনিস থাকবে না। দেবতারা উত্তমোত্তম গুণে গুণী মানুষই, অতএব মানুষের দুঃখ-কষ্ট তাঁরা বোঝেন।

শঙ্করাচার্য বলেছেন—মানুষের নাকি লোভ বেশি—লোভপ্রধান মনুষ্যাঃ। সেক্ষেত্রে নানা পুরাণ-ইতিহাস ঘেঁটে হাজারটা এমন উদাহরণ দিতে পারি যাতে বোঝ যাবে—লোভের ব্যাপারে দেবতারাও কিছু কম যান না। কিন্তু যত লোভই থাক, এমন বিশিষ্ট লোভহীনতার উদাহরণও আবার আছে—যাতে দেবতাদের মানুষের চেয়ে উচ্চভূমিতে আসন দিতে হবে, আর ঠিক এইখানটাতেই সত্ত্বগুণ অথবা রজস্তমের প্রশ্নটা আসবে।

॥ ৪ ॥

আমরা দেখলাম—অদ্বৈতপন্থী বৈদান্তিকরাও দেবতাদের পক্ষে দাঁড়ালেন। যে শঙ্করাচার্য ব্রহ্মতত্ত্বকে নিরাকার নির্বিশেষ বলতে বলতে প্রায় শূন্যের পর্যায়ে নিয়ে গেছেন, সেই শঙ্করও দেবতাদের পক্ষে উকিল দাঁড়ানোয় বড় সুবিধে হয়ে গেছে দেবতাদের। এর মধ্যে শঙ্করের উপাধি-তত্ত্ব, মায়া-তত্ত্বের সমস্যা দেবতাদের মাথায় চেপে বসবে, তবু শঙ্করের মত মায়াবাদীর হাতেও তাঁরা নিজের রূপ, গুণ এমনকি ক্ষমতা বজায় রাখতে পেরে ধন্য হবেন বলে মনে করি। বেদান্ত ছাড়াও দেবতারা অবশ্য আরও একবার দার্শনিক। প্রতিষ্ঠার সুযোগ পাবেন নিরীশ্বরবাদী সাংখ্য-দার্শনিকদের কাছে। সেও বড় কম কথা নয়। ষড়-দর্শনের মধ্যে অন্যতম প্রধান শরিক এবং জগৎকর্তা ঈশ্বরে অবিশ্বাসী সাংখ্যকেও যদি দেবতাদের সাহায্যে হাত বাড়াতে দেখা যায়, তবে আমাদের দিক থেকেও সুবিধে। আরও সুবিধে হয় যদি দেবতাদের প্রায় মানুষের মাহাত্ম্যেই আমরা ভাবনা করতে পারি।

তো সাংখ্য-দার্শনিকরা আমাদের সেই সুবিধেই দিয়েছেন। তাঁরা বলেন—দেবতারাও মানুষের মত সৃষ্টি-প্রক্রিয়ার একটা অঙ্গ, ভৌতিক-সৃষ্টির একতম কল্প। সৃষ্টিপ্রক্রিয়ায় দেবতারা যেমন একটা প্রকারমাত্র, তেমনই আর এক প্রকার হল পশু-পক্ষী-মৃগ-গাছেরা আর শেষতম প্রকার হল মানুষ। সাংখ্যতত্ত্বে দেবতারা হলেন আট রকম। শুনতে যতই অবাক লাগুক, এই আট কিসিমের দেব-পদবী যাঁদের আছে, তাঁদের মধ্যে একদিকে যেমন ব্রহ্মা, প্রজাপতি, ইন্দ্র, পিতৃগণ আছেন, তেমনই মাঝখানে আছেন গন্ধর্ব-নাগেরা এবং অন্যদিকে আছেন রাক্ষস এবং পিশাচেরা। প্রসিদ্ধ সাংখ্যগ্রন্থ যুক্তিদীপিকার অজ্ঞাত লেখক রাক্ষস-পিশাচদেরও দেবযোনির মধ্যেই গণ্য করেছেন—অষ্টবিকল্পো দৈবঃ—এবং বেদ-পুরাণের ভাবনায় এই কথা যুক্তিযুক্তই বটে। ৩১

সে যাই হোক, সৃষ্টির ব্যবস্থায় দেবতারা না হয় মানুষের সঙ্গে এক পংক্তিতেই বসলেন, কিন্তু মূলত তাঁরা যে মানুষের চেয়ে একটু উঁচু জাতের প্রাণী সে কথাটা বোঝানোর জন্য সাংখ্য-দার্শনিকেরা সত্ত্ব-রজ-তম-ভেদে তিনটে ‘লেয়ার’ তৈরি করেছেন উঁচু, নীচু এবং মধ্যস্থান। ঊর্ধ্বলোকে যাঁরা আছেন তাঁদের মধ্যে সত্ত্বগুণ বেশি—সত্ত্ববিশালঃ—তাঁরাই দেবতা। পাতালবাসী পশুপক্ষীমৃগেরা হল তমোবিশাল, তাদের মধ্যে তমোগুণ বেশি। আর মানুষ আছে মাঝখানে, তাদের মধ্যে রজোগুণ বেশি—রজোবিশালঃ। দেবতারা সত্ত্ববহুল বলে তাঁদের মধ্যে রজস্তমের বিকার নেই, তা কিন্তু নয়। তবে সে বিকার তাঁদের অল্প। একইভাবে মানুষ রজোবহুল বলে সত্ত্ব এবং তমো গুণের ছিটে-ফোঁটা তাদের মধ্যে নেই, সেটা ভাবাও ভুল। আসলে দেবতাদের মধ্যে সত্ত্বেরই প্রাধান্য, ঠিক যেমন মানুষের মধ্যেও রজোগুণের প্রাধান্য। অদ্বৈত-বেদান্তীরা অন্যভাবে হলেও দেবতাদের আপেক্ষিক উচ্চতা স্বীকার করেছেন একই কায়দায়, সে আমরা আগেই দেখেছি।

উচ্চ-নীচ ভেদ করে সাংখ্য দার্শনিকরা কিন্তু দেবতা আর মানুষকে আবারও মিলিয়ে দিলেন এক জায়গায়। তাঁরা বললেন—যতই সত্ত্বগুণের আধার হোন আর যতই উর্ধ্বলোকের বাসিন্দা হোন দেবতারা, জরা-মরণের দুঃখ তাঁদের মানুষের মতই। বুড়ো হওয়ার কষ্ট আর মৃত্যুর যন্ত্রণা—এ যেমন মানুষের আছে, তেমনই দেবতাদেরও আছে।

অন্যেরা বললেন—কেন জন্মের দুঃখটাই কি কম? মায়ের পেটে পুঁজ-রক্ত মেখে গর্ভের আঁধারে চক্ষু মুদে দশ মাস কাটানো—সেও কি কম দুঃখের? যুক্তিদীপিকার লেখক যুক্তি দিয়ে বললেন—দেখ বাপু? ওই জন্মের কষ্টটা দেবতাদের নেই, বিদ্যুতের ঝিলিকের মত এক লহমায় তাঁরা শরীর ধারণ করতে পারেন, এমন উদাহরণ ভূরি ভূরি আছে—তড়িদ্‌বিলসিতবৎ ক্ষণমাত্রেণ শরীরপ্রাদুভার্বাৎ। ৩২

জনান্তিকে চুপি চুপি বলে রাখি—দেবতাদের যে শরীর বলে একটা জিনিস আছে—বেদান্তীদের মত সাংখ্য দার্শনিকেরাও সেটা স্বীকার করে নিলেন। আর শরীর আছে বলেই দেবতার জন্ম-জরা-মরণ, কোনটাই স্বীকার করে নিতে তাঁদের বাধেনি। তাঁরা বললেন—জন্মের দুঃখটা না হয় কোনরকমে পূর্ব পুণ্যের ফলে উতরে গেলেন দেবতারা, কিন্তু জরা-মরণ আটকাবেন কী করে—জরামরণকৃতং তু তেস্বপি ন নিবর্ততে। ৩৩

আমরা সাধারণ জনেরা অবশ্য অন্যরকম শুনেছি। ইতিহাস-পুরাণে শুনেছি—স্বর্গের থানে কত সুখ। জরা-মরণ বলে কোন জিনিসই নেই সেখানে। স্বর্গের দেবতাদের অনন্ত যৌবন এবং সব সময়েই তাঁরা উর্বশী-রম্ভার কাঁধে হাত রেখে স্বর্গীয় দ্রাক্ষাফল খাচ্ছেন অথবা অমৃত পান করছেন। সাংখ্য বলে—ওসব যত শোনা যায়, তত নয় মোটেই। হ্যাঁ এটা তো ঠিকই—মানুষের আয়ুর চেয়ে দেবতাদের আয়ু অনেক বেশি। কিন্তু তাই বলে অজর অমর হয়ে চিরকাল তাঁরা স্বর্গভূমিতে রাজত্ব করে যাচ্ছেন—এ কথাটা ঠিক নয়। সাংখ্যমতে জরা কিংবা বিনাশ দেবভূমিতেও একইরকম। পুরাণের শ্লোক সংগ্রহ করে যুক্তিদীপিকা বলেছে—পুণ্যবল ক্ষীণ হলে স্বর্গ থেকে যখন দেবতাকে মরণান্তক বিদায় নিতে হয়, তখন দেবতাদের দেখায় ধূলি-মলিন, তাঁদের গায়ের রঙ বিবর্ণ হয়ে যায়, স্বর্গের সদ্যোচ্ছিন্ন মন্দার-মঞ্জরীও গলায় শুকিয়ে যায়—রজোবিষক্তিরঙ্গে বৈবর্ণং ম্লানপুষ্পতা। ৩৪

যতটুকু বলা হল—লক্ষণ মেলালে এটাকে জরা বলতে হবে। কিন্তু দেবতাদের যে মরণও আছে—তার প্রমাণ পাওয়া যাবে পুরাণে। পুরাণে দেখছি—চতুর্দশ মন্বন্তরে যখন সৃষ্টির সংহার-কাল উপস্থিত হল, তখন দেবতারা নিজেদের অন্তকাল বুঝে বিপদের আশঙ্কায় বড় ব্যাকুল হয়ে উঠলেন—ততস্তে অবশ্যভাবিত্ত্বাদ্‌ বুদ্ধা পর্যায়মাত্মনঃ। ৩৫ তাহলে দেখলেন—দেবতাদের কাছে জন্ম ব্যাপারটা বিদ্যুৎ-ঝলকের মত ফটাফট্‌ করে হলেও মরণটা অত ফট্‌ করে হয় না। তাছাড়া যে দেবতাদের অনন্ত যৌবন সম্বন্ধে আমরা প্রায় নিশ্চিত ছিলাম, নানা গবেষণায় দেখছি, তাঁদের অসুখ-বিসুখও কিছু কম নয় হাঁচি-কাশি নেই বটে, কিন্তু বড় বড় রোগ বেশ আছে।

যুক্তিদীপিকার দার্শনিক একেবারে বেদ থেকে নথি তুলে দেখিয়েছেন যে, দেবরাজ ইন্দ্রের মত লোকেরও কত কষ্ট। তাঁর নাকি একবার ‘ইনসোম্‌নিয়া’ ধরেছিল। সারা রাত তাঁর ঘুম হয় না, রাতভর শুধু বিছানায় ওঠেন আর বসেন। আর কে না জানে—রাতের পর রাত ঘুম না হলে উর্বশী-রম্ভার নাচ-গানেও তখন বিরক্তি আসে। শত যজ্ঞের ঘি-খাওয়া দেবরাজ ইন্দ্রের নাদুস-নুদুস শরীর একেবারে হাড়-জিরজিরে হয়ে গেল। অথচ দুনিয়ার লোক হাজার রকমের ‘প্রেসক্রিপশন’ দিয়েও তাঁকে ঘুম পাড়াতে পারল না—ইন্দ্রং ক্ষামমপি ন সর্বভূতানি প্রস্বাপয়িতুং নাশক্লুবন্‌। ৩৬ নানা চিকিৎসার পর এই মানুষ-ঋষিরাই অবশ্য তাঁর অসুখ সারিয়ে দিয়েছিলেন। তাঁরা ‘কামপোজ-ভ্যালিয়াম’ প্রভৃতির কড়া ডোজ্‌ দিয়ে ইন্দ্রের দফা-রফা করেননি। বরঞ্চ চিকিৎসা করলেন অদ্ভুত এক পদ্ধতিতে। আধুনিক চিকিৎসকরা এই প্রণালী ভেবে দেখতে পারেন। বৈদিক সাম-গানের নানা রকম ‘স্কুল’ আছে। ঋষিরা ‘ত্বাষ্ট্ৰীয়’ স্কুলের হালকা সাম-সঙ্গীতে ইন্দ্রের ঘুম ফিরিয়ে আনলেন—তম্‌ এতেন সাম্না ত্বাষ্ট্রীয়েণ অস্বাপয়দিতি। ৩৭ ইন্দ্র জানে বেঁচে গেলেন।

ইন্দ্রের কথা বলেই সাংখ্য দার্শনিক প্রজাপতির ব্রহ্মার বায়ু-রোগের কথাটাও উল্লেখ করেছেন। তাঁর শরীর খারাপ হয়ে যাবার কথা বললেও এই মুহূর্তে তাঁর ভাল হবার খবর আর দেননি সেই দার্শনিক। এই বিশাল জগৎসৃষ্টি করার পরিশ্রমে বেলা-অবেলায় খেয়ে না-খেয়ে যে অসুখ তিনি বাঁধিয়েছিলেন, তাতে আবার বয়সটাও তাঁর ভারী—এ অসুখ আর সেরেছিল বলে মনে হয় না। ফলে সাংখ্য-দার্শনিক শুধু বলে দিয়েছেন—প্রজাপতিকে বায়ুরোগ বড় জ্বালান জ্বালিয়েছে—প্রজাপতে র্বায়ুরক্ষয়ীৎ। ৩৮

ইন্দ্র গেলেন, প্রজাপতি গেলেন, এবার চন্দ্রের কথায় আসি। দেবতার রাজ্যে চাঁদ হলেন রাজা। সমুদ্র-মন্থনের নিট্‌-ফল অমৃত, সুধা অথবা সোম-রসের সঙ্গে চন্দ্রের নাম একার্থক হয়ে গেছে। যজ্ঞ করতে গেলে হাজার হাজার বছর আগে ঋষিরা চন্দ্রকে যে মাহাত্ম্য দান করেছিলেন, এখনও শান্তি-স্বস্ত্যয়নে সেই মাহাত্ম্য স্মরণ করে বলতে হয়—সোমং রাজানং হবামহে—আমরা রাজা সোমকে ডাকছি, তাঁকে আহুতি দিচ্ছি। পুরাণ-কথায় জানা যায় ব্রহ্মা, বিষ্ণু, রুদ্র এবং সূর্যের সারভৃত পরম আনন্দয় জ্যোতি যখন মহর্ষি অত্রির নয়নের মাঝখানে ঠাঁই দিয়েছিল, তখন তাঁর আনন্দাশ্রু থেকে জন্ম হয়েছিল জ্যোৎস্নার আধার চন্দ্রের। ব্রহ্মর্ষিরা তাঁকে স্তব করে নিজেদের প্রভু বলে বরণ করে নিয়েছিলেন—তত্র ব্রহ্মর্ষিভিঃ প্রোক্তমস্মৎস্বামী ভবত্বয়ম্। ৩৯

দেবরাজ্যে এমন সুন্দর একটা সৎপাত্র দেখে সাতাশটি মেয়ের বাবা দক্ষ-প্রজাপতি অত্যন্ত খুশি হয়ে সবগুলি মেয়েকেই দিয়ে দিলেন তাঁর হাতে। অশ্বিনী, ভরণী, কৃত্তিকা, রোহিণী, মৃগশিরা, আর্দ্রা—এইরকম সাতাশটি নক্ষত্রের স্বামী হয়ে চন্দ্রমা নিজের ঘরে ফিরলেন বটে, কিন্তু সাতাশজনকেই তিনি খুশি করতে পারলেন না। দক্ষের সব কন্যারাই যথেষ্ট সুন্দরী বটে, কিন্তু এঁদের সবার চেয়ে রোহিণী ছিলেন আরও বেশি সুন্দরী—অত্যরিচ্যত তাসান্তু রোহিণী রূপসম্পদা। ৪০ রোহিণীর রূপে-গুণে মুগ্ধ হয়ে চন্দ্রমা তাঁর অন্য জীবন-সঙ্গিনীদের অবহেলা করতে আরম্ভ করলেন। ছাব্বিশ জন নক্ষত্র-সুন্দরী চন্দ্রের হৃদয়-রসে বঞ্চিত হয়ে শুধু চেয়ে চেয়ে দেখেন—কেমন করে তাঁদেরই সহোদরা এক রমণী সুধাকর চন্দ্রকে মোহে আচ্ছন্ন করে রেখেছে। দিন। নেই রাত নেই চন্দ্র শুধু রোহিণীর ঘরেই পড়ে আছেন। রোহিণীর শরীর-সম্ভোগ এবং আন্তরিক সরসতায় চন্দ্রের মন-প্রাণ একেবারে আচ্ছন্ন হয়ে গেল। তাঁর ভাব-গতিক দেখে তাঁর অন্য স্ত্রীরা সকলেই মনে বড় কষ্ট পেলেন। তাঁদের বড় রাগও হল।

কুপিতা নক্ষত্র-সুন্দরীরা সবাই মিলে বাপের বাড়ি এলেন। লজ্জার মাথা খেয়ে বাবা দক্ষকে জানালেন মনের ব্যথা—দেখ বাবা! চন্দ্র শুধু রোহিণীকেই ভালবাসে, আমাদের দিকে ফিরেও তাকায় না কখনও—সোমো বসতি নাম্মাসু রোহিণীং ভজতে সদা।৪০ এ অবস্থায় আর ফিরে যাওয়া চলে না। আজ থেকে তোমার এখানেই আমরা থাকব। দক্ষ দেখলেন—একটি অতিসুন্দরী মেয়ের জন্য তাঁর অন্য ছাব্বিশটা মেয়ের জীবন বৃথা হয়ে যাচ্ছে। তিনি জামাইকে ডেকে বললেন—দেখ বাবাজীবন! সবগুলি স্ত্রীকেই তুমি সমানভাবে দেখার চেষ্টা কর, এমন অধর্ম আর কোর না।

দক্ষ এবার মেয়েদের বললেন—বলে দিয়েছি শশীকে, তোমার এবার যাও সেখানে, সে এবার তোমাদের সমদৃষ্টিতে দেখবে। দক্ষের মেয়েরা হুড়মুড় করে স্বামীর বাড়িতে ফিরে এলেন বটে। তবে কিসের কী, চন্দ্রের অবস্থা যা ছিল তাই। সেই রোহিণীর মুখ দেখে দেখে চাঁদের আর তিয়াষ মেটে না। ছাব্বিশ নক্ষত্রসুন্দরীর একজনকেও তিনি আদর করলেন না, ফিরেও দেখলেন না তাঁদের দিকে।

তাঁরা আবার সব বাপের বাড়ি ফিরে এলেন। বললেন—বাবা! আমরা তোমারই সেবা-শুশ্রূষা করে দিন কাটাব। ও বাড়ি আর যাব না। তোমার কথা তার এ কান দিয়ে ঢুকে ও কান দিয়ে বেরিয়ে গেছে—সোমো বসতি নাম্মাসু নাকরোদ্‌ বচনং তব। ৪১ দক্ষ আবার এলেন জামাই-বাড়ি। বললেন—সব বউকে সমানভাবে দেখ চন্দ্র, নইলে কিন্তু শাপ দেব আমি। চাঁদ-বউরা আবার ফিরে এলেন। কিন্তু শাপের ভয় দেখিয়েও দক্ষ চন্দ্রকে পথে আনতে পারলেন না। চন্দ্র একা রোহিণীকেই ভালবাসেন, তাঁর মনে দ্বিতীয় কোন রমণীর স্থান নেই। ছাব্বিশটি বউ আবার ফিরে এল বাপের বাড়ি। দক্ষ এবার আর ছাড়লেন না। ভয়ংকর ক্রোধে চন্দ্রকে শাপ দিলেন—তোমার যক্ষ্মা হবে।

বয়স্ক লোকেরা স্মরণ করবেন কিনা জানি না, তবে সেকালের নব-বিবাহিত যুবক অতিরিক্ত স্ত্রৈণ হলে অনেকেই ভয় পেতেন যে, ছেলের টি.বি. হবে। অতিরিক্ত শুক্রক্ষয়ে টি.বি. হয়—এই ছিল অনেকের ধারণা। ব্যক্তিগতভাবে বোধ হয়—এই ধারণা চন্দ্রের যক্ষ্মারোগের কাহিনী থেকেই এসেছে। যুক্তিদীপিকার সাংখ্য দার্শনিক—চন্দ্রের এই যক্ষ্মারোগের গল্পটা বলেছেন গদ্যে। আরও বলেছেন—চন্দ্র হলেন সোম-রাজা, সেই রাজাকে যক্ষ্মা ধরল বলেই রাজযক্ষ্মার জন্ম—চন্দ্রমা বৈ সোমো রাজা যদ্‌রাজানং যক্ষ্মো’গৃহ্নাত্ তদ্ৰাজযক্ষ্মস্য জন্ম। ৪২ রাজযক্ষ্মার কবলে পড়ে ক’দিনে চন্দ্রের শরীর শুকিয়ে কাঠি হয়ে গেল। দক্ষের কথা মেনে ছাব্বিশ নক্ষত্ররানীদের সঙ্গেও তিনি বসবাস করতে আরম্ভ করলেন। ওদিকে চলল নানা যাগ-যজ্ঞ, বৈশ্বদেব চরু দিয়ে অমাবস্যার রাত্রিতে রোগমুক্তির আরাধনা। কিন্তু এত যাগ-যজ্ঞ-আরাধনা করেও চন্দ্র কিন্তু যক্ষ্মা সারাতে পারলেন না—যুক্তিদীপিকার ভাষায়—নৈনং যক্ষ্মা উদমুঞ্চৎ। ৪৩

চন্দ্রের টি.বি. হওয়ার কাহিনীটা আমি যেখান থেকে বলেছি সেই মহাভারতেও কিন্তু যাগ-যজ্ঞ করে চন্দ্রের কিছু ফল হয়নি। কিন্তু মহাভারতের কবি-ঋষির হৃদয়ে করুণা প্রচুর। তিনি সরস্বতী তীর্থে চন্দ্রকে স্নান করিয়ে মাসের মধ্যে পনেরো দিন তাঁকে সুস্থ রেখেছেন। কিন্তু আর পনেরো দিন তাঁকে ক্ষয়-রোগ ছাড়ে না—মার্সাধঞ্চ ক্ষয়ং সোমো নিত্যমেব গমিষ্যতি। সেই থেকে অমাবস্যা তিথিতে সরস্বতী তীর্থে অথবা প্রভাসে ডুব দেন চন্দ্র। আর তার পর দিন থেকে পৃর্ণিমা পর্যন্ত তাঁর যক্ষ্মার উপশম হয়, শরীরে শ্রীবৃদ্ধি হয়। কিন্তু পৃর্ণিমার পর থেকে আবার যে কে সেই, অর্থাৎ সেই এক কথাই দাঁড়াল। চন্দ্রের যক্ষ্মা পুরোপুরি সারল না—নৈনং যক্ষ্মা উদমুঞ্চৎ।

সাংখ্য-দার্শনিক সিদ্ধান্ত নিলেন—তাহলে দেখ বাপু! দেবতাদেরও রোগ-জরা আছে—তস্মাদ্‌ দেবভূমাবপি জরাকৃতং দুঃখমস্তি। আর মরণের কথা যদি বল তাহলে তো গোপথ ব্রাহ্মণের মত প্রাচীন বেদাংশ থেকে উদাহরণ দিয়ে বলতে হবে—দেবতারা নাকি সংখ্যায় আগে ছিলেন পনেরোশ। তারপর নানা পাপ-তাপ করে সব ভাই মরে গিয়ে বেঁচে থাকলেন মোটে তেত্রিশ জন—সোদর্যানাং পঞ্চদশানাং শতানাং ত্রয়স্ত্রিংশদুদশিষ্যন্ত দেবাঃ। ৪৪ আমরা সাংখ্যের তত্ত্ব-যুক্তি অথবা বৈদিক প্রবচনের কথাটা বাদ দিয়ে যদি পুরাণের পরিসরে আসি তবে দেখব—মহর্ষি শৌনকের বারো-বছরের যজ্ঞ-স্থান, অসংখ্য মুনি-ঋষিদের তপোভূমি অমন যে নৈমিষারণ্য, সেইখানে নাকি একদা দেবতাদের শ্মশান ছিল। ধোঁয়া থেকে যদি আগুনের অনুমান সিদ্ধ হয়, তবে এই শ্মশান থেকেই বা কেন দেবতাদের মরদেহের অনুমান সিদ্ধ হবে না?

॥ ৫ ॥

যা দেখা যাচ্ছে, তাতে নিরীশ্বর সাংখ্যের কথাই বলুন আর অদ্বৈতপন্থী বেদান্তের কথাই বলুন—এঁরাই যদি দেবতার শরীর স্বীকার করেন, তো দ্বৈতবাদ, বিশিষ্টাদ্বৈতবাদ—এইসব বাদী-প্রতিবাদীরা যে দেবতার শরীরের কথাটা মানবেন, তাতে আর আশ্চর্য কী? আরও আশ্চর্য কথা কি জানেন, ব্রাহ্মণ্যধর্মের তথাকথিত বিরুদ্ধবাদীরা পর্যন্ত দেবতাদের শরীর মেনে চলেছেন। আজকাল একদল মুখে-জগৎ-মারা পণ্ডিত বেরিয়েছেন, যাঁরা দু-পাতা ইতিহাস পড়ে বৌদ্ধদের একেবারে ব্রাহ্মণ্য-দর্শনের জাতশত্রুর কক্ষে বসিয়ে দেন এবং এমন সব মত ব্যক্ত করেন, যা শুনলে পরে মনে হয়—তাবচ্চ শোভতে কেউ কেউ যাবৎ কিঞ্চিন্ন ভাষতে। তাঁরা একবারও বোঝেন না অথবা বোঝার মত বিদ্যে-বুদ্ধিও এঁদের নেই যে, বৌদ্ধধর্ম এবং দর্শন তথা ব্রাহ্মণ্য ধর্ম এবং দর্শন—দুটোই দুটোর ‘ইনট্যার‍্যাক্‌শনে’ লাভবান হয়েছে। এদের পারস্পরিক ঝগড়া-বিবাদ বৌদ্ধিক স্তরে এমন ক্ষুরধার শাণিত তর্কযুক্তি তৈরি করেছিল, যাতে একসময়ে দার্শনিক জগতে দুর্লভ উন্নতি প্রতিষ্ঠা হয়েছিল। অবশ্য এই সমস্ত স্বাস্থ্যকর মত-বিরোধ আজকের অগভীর স্বল্পাধীতী বক্তৃতজীবীদের জানার কথা নয়। তাঁরা জানেন বৌদ্ধ মানেই ব্রাহ্মণ্য-বিরোধী এবং ব্রাহ্মণ্য-বিরোধী হলেই জনমত তৈরি করার পক্ষে এখন বড় উপযুক্ত যন্ত্র। আসলে ব্রাহ্মণ্যতন্ত্র সম্বন্ধেও এঁদের ভাল ধারণা নেই, আবার বৌদ্ধতন্ত্র সম্বন্ধেও ভাল ধারণা নেই। ফল যা হয়, ভেদ-বমি।

যাই হোক, বৌদ্ধরা একভাবে বেদ-ব্রাহ্মণ্য বিরোধী বটে, কিন্তু ব্রাহ্মণদের দেব-সমাজকে তাঁরা মেনেছেন, তাঁদের শরীরও স্বীকার করেছেন। কোন কোন জায়গায় তাঁদের মত এবং কথাবার্তা, যথেষ্ট মৌলিকতা সত্ত্বেও, এত ব্রাহ্মণ্য দর্শন-ঘেঁষা যে আমাদের অবাক লাগে। আমি প্রখ্যাত বৌদ্ধ দার্শনিক আচার্য বসুবন্ধুর অভিধর্মকোশ থেকে প্রমাণ দিয়ে কথা বলব। অন্যান্য পালি গ্রন্থে শক্ক অথাৎ শত্রু ইন্দ্রের উপস্থিতি মাঝে মাঝে আছেই, এমনকি অন্যান্য দেবতা-উপদেবতাও সেখানে বেশ বিরাজ করছেন। তবে বসুবন্ধুর অভিধর্মকোশ দার্শনিক বই, কাজেই দেবতাদের কথাও সেখানে যা আছে, তা বৌদ্ধ দর্শনের নিজস্ব ধারা বজায় রেখেই।

কথা হচ্ছিল—মারা যাবার সময় কার কোন জায়গায় জ্ঞান রুদ্ধ হয়ে যায়। বসুবন্ধু বললেন—যারা নীচ স্তরের প্রাণী তাদের মন-প্রাণ নিরুদ্ধ হয়ে যায় অধমাঙ্গে, পায়ে। মানুষের নিরুদ্ধ হয় নাভিতে আর দেবতাদের জ্ঞান রুদ্ধ হয় হৃদয়ে অথবা কেউ কেউ বলেন মাথায়।৪৫ বৌদ্ধ মতে সমস্ত প্রাণীর মতই দেবতাদেরও শরীর আছে মরণও আছে। অন্য প্রাণীদের মরতে ভারী কষ্ট হয় ঠিকই, কিন্তু সুখে হলেও দেবতারও মৃত্যু আছে। মরে আর জন্মান না যাঁরা, তাঁরা হলেন বৌদ্ধ অৰ্হত্‌। কিন্তু অহঁতের জ্ঞানও নিরুদ্ধ হয় হৃদয়ে। দেবতা এবং অর্হত্‌দের বিজ্ঞান-নিরুদ্ধির স্থান একই হওয়ায় দেবতাদের আমরা অর্হত্‌দের প্রায় সমভূমিতে নিয়ে আসতে পারি।

দেবতাদের মরতে খুব কষ্ট হয় না বটে, তবে তাঁদের শারীরিক ভাবভঙ্গী দেখলে বোঝা যায়—এবার তাঁদের সময় হল। বসুবন্ধু বৌদ্ধ হয়ে দৈব-মরণের যেসব চিহ্ন বর্ণনা করছেন, তা আমাদের সাংখ্যের প্রবচনের সঙ্গেও মেলে, মেলে পুরাণের বর্ণনার সঙ্গেও। বস্তুত একভাবে সেকথা আমরা আগে বলেছি। বসুবন্ধু লিখেছেন—মরার আগে দেবতাদের পাঁচ ধরনের উপসর্গ দেখা দেয়। তাঁদের বস্ত্র আর অলঙ্কারের মাঝখান থেকে মিষ্টি একটা শব্দ বেরোতে থাকে। শরীরের তেজ একেবারে স্তিমিত হয়ে যায়। স্নান করলে গায়ে জল শুকোয় না (দেখবেন মৃতদেহে জল ছিটালেও এমনই হয়)। শরীরে চপল ভাব থাকলেও বুদ্ধি একদিকে ছাড়া অন্য দিকে কাজ করে না। আর চিরকাল যে শোনা গেছে দেবতাদের চোখের পাতা ওঠা-নামা করে না, মরণকালে নাকি সেই চোখে নিমেষ পড়ে অর্থাত্ চোখের পাতা খোলে এবং বোজে। ৪৬

এই লক্ষণগুলো নাকি গৌণ—উপনিমিত্তানি। এগুলো কখনও মেলে কখনও বা মেলে না—এতানি তু ব্যভিচারীণি। কিন্তু কতগুলো লক্ষণ আছে, সেগুলো নাকি দেবতাদের মরণের সময় দেখা যাবেই। যেমন—তাঁরা আর গায়ে কাপড় রাখতে পারেন না, মালা শুকিয়ে যায়—বাসাংসি ক্লিশ্যন্তি মালা স্নায়ন্তি। বসুবন্ধুর কথার সঙ্গে সঙ্গে স্মরণে আসে কবি-ঋষির কবিত্ব, পাণ্ডিত্য এবং মিলিয়ে দেবার ক্ষমতা—

ম্লান হয়ে এল কণ্ঠে মন্দারমালিকা,
হে মহেন্দ্র, নির্বাপিত জ্যোতির্ময় টিকা
মলিন ললাটে। পুণ্যবল হল ক্ষীণ,
আজি মোর স্বর্গ হতে বিদায়ের দিন
হে দেব হে দেবীগণ। বৰ্ষ লক্ষ শত
যাপন করেছি হর্ষে দেবতার মতো

দেবলোকে।

আচার্য বসুবন্ধুও কিন্তু দেবতাদের মরণটাকে ঠিক মরণের শব্দে চিহ্নিত করেননি। তিনি বলেছেন—চ্যবনধর্মণো দেবপুত্রস্য—অর্থাৎ স্বর্গ থেকে যাদের বিদায় হচ্ছে, চ্যুতি হচ্ছে, সেইসব দেবতাদের এইসব লক্ষণ দেখা যায়—গায়ের কাপড় রাখা দায়, গলার মালা শুকিয়ে যায়, দুই বগল দিয়ে ঘাম ঝরে পড়ে, গা দিয়ে দুর্গন্ধ বেরোয়, দেবতারা নাকি তখন আর নিজের আসনে বসে থাকতে পারেন না—কক্ষাভ্যাং স্বেদো মুচ্যতে, দৌর্গন্ধং কায়ে’বক্ৰামতি, স্বে চাসনে দেবপুত্রো নাভিরমতে।

দেবতার মরণচিহ্নে যা দেখা গেল, তাতে বেশ বোঝা যাচ্ছে বৌদ্ধ দার্শনিকরা দেবতাদের শরীর মানেন অবশ্যই। কিন্তু শরীর স্বীকার করে নিলেও অদ্বৈতবেদান্তীরা যেরকম তাঁদের জ্ঞান এবং ঐশ্বর্যে মানুষের থেকে অনেক উঁচু জায়গায় শিরোধার্য্য করেছেন, অথবা সাংখ্য যেমন তাঁদের সত্ত্ববিশাল ঊৰ্ব্বস্তরের জীব বলে মনে করেছেন, তেমনই বৌদ্ধ দার্শনিকরাও দেবতাদের ঊর্ধ্বলোকের বাসিন্দা বলেই মনে করেছেন—ঊর্ধ্বং দেবা বিমানেষু প্রতিষ্ঠিতাঃ। ৪৭ পৌরাণিকদের, মত বসুবন্ধুও দেবতাদের সভা, বাসস্থান, নন্দন-কানন সবই মাপযোক করে বসিয়েছেন। বলেছেন—তবে তাঁরা ঊর্ধ্বলোকের প্রাণী, তাঁদের হাব-ভাব, কাজকর্ম মানুষের থেকে আলাদা। এই যেমন মানুষের কাম-উপভোগ স্ত্রী-পুরুষের মৈথুনের মাধ্যমে তৃপ্ত হয়, কিন্তু দেবতাদের এই সঙ্গম-সন্তুষ্টি হতে পারে অতি সহজে, সামান্য চার-পাঁচটি ক্রিয়ার মাধ্যমে।

কোন রমণীকে সম্ভোগের ইচ্ছা জন্মালে শরীরে যে কামের উত্তাপ হয়, সেই উত্তাপ দেবতারা প্রশমন করতে পারেন সামান্য বায়ু-নিঃসরণের মাধ্যমে—তেষাং তু বায়ুনির্মোক্ষাদ্‌ দাহবিগমঃ, শুক্রাভাবাৎ। ৪৮ অন্যান্য উপায়ের মধ্যে একটি আছে আলিঙ্গনে। শুধুমাত্র ঈপ্সিতা রমণীকে আলিঙ্গন করেই দেবতারা মৈথুনের তৃপ্তি লাভ করতে পারেন। শুধুমাত্র হাত ধরেও এই সম্ভোগ সম্পূর্ণ হতে পারে, অথবা হতে পারে শুধু সপ্রেম দৃষ্টিপাতে অথবা শুধু হাসি দিয়েই—পার্বতীর মুখের পানে ধূর্জটির হাসি। বসুন্ধু, এই সবগুলি উপায়কে একসঙ্গে সমাস করে বলেছেন—দ্বন্দ্বালিঙ্গন-পাণ্যাপ্তি-হসিতেক্ষিত-মৈথুনাঃ। ৪৯

নানা দার্শনিক গ্রন্থ থেকে দেবতাদের দার্শনিক স্থিতিটুকু দেখালাম এইজন্য যে, কী সাংখ্য-বেদান্ত, কী বৌদ্ধ, সব দর্শনেই দেবতারা উচ্চস্তরের জীব হলেও মানুষের সঙ্গেই তাঁদের সাদৃশ্য সবচেয়ে বেশি করে দেখানো হয়েছে। অবশ্য একটা ব্যাপারে আমরা এখনও মূক থেকেই গেলাম, সেটা হল—ঈশ্বরের প্রসঙ্গ। পরম ঈশ্বর, যিনি জগৎ সৃষ্টি করেছেন, সেই ঈশ্বরের সঙ্গে কিন্তু সাধারণ দেবতাদের আকাশ-পাতাল তফাৎ। জগতে তৃণ থেক ব্রহ্মা পর্যন্ত সকলেরই জন্ম-মরণ জরা-ব্যাধি স্বীকার করে নিলেও পরমেশ্বরের সম্বন্ধে কিন্তু সে কথা খাটে না। শঙ্করাচার্যের মত অদ্বৈত দার্শনিক অবশ্য ঈশ্বরকে মায়ার উপাধির মধ্যে আটকে রেখেছেন, কিন্তু অন্যান্য সমস্ত আস্তিক দর্শন এবং দ্বৈতবাদী বেদান্তীরাও সবাই ঈশ্বরকে পরব্রহ্মেরই স্বরূপ বলে স্বীকার করেছেন। বিষ্ণু, নারায়ণ, কৃষ্ণ এবং শিব—এঁরাও ইতিহাস পুরাণে পরম ঈশ্বরেরই রূপ বা অবতার বলে স্বীকৃত। শঙ্করাচার্যের ব্রহ্মের সঙ্গে এদের পার্থক্য শুধু আকারে, গুণে।

আমি ঈশ্বরের স্বরূপ-বিচারে দার্শনিক তথ্যগুলি আর আলোচনা করব না, শুধু এইটুকুই বলব যে, পরম ঈশ্বর যখন মানুষের রূপ নিয়ে পৃথিবীতে এসেছেন—সে তিনি কৃষ্ণই হোন বা রামচন্দ্র, তিনি শিবই হোন অথবা পরমা প্রকৃতি উমা মহেশ্বরী—তখনই মানুষের ক্ষুদ্র সুখ ক্ষুদ্র আনন্দের পরিসীমার মধ্যেই তাঁদের থাকতে হয়েছে। দার্শনিক দিক থেকে দেখতে গেলে খুব ভাল একটা কথা বলা যায়। মনে রাখতে হবে—পরম ঈশ্বর যদি মানুষের রূপ ধরে পৃথিবীতে আসেন এবং তখন যদি তাঁর ঈশ্বরত্বের বোধ টনটনে থাকে, তবে আর মানুষের ঘরের সুখ-দুঃখ-আনন্দ তাঁকে লীলায়িত করবে না। নিজের ঐশ্বর্যবলে যিনি দৃষ্টিপোতমাত্রেই সমস্ত দুঃখকে আনন্দে রূপান্তরিত করতে পারেন, যিনি অঙ্গুলী-হেলনমাত্রেই সমস্ত বাধা-বিঘ্নকে সহজ সুকর করে ফেলতে পারেন, তিনি যদি মনুষ্য অবতারেও সেই ঐশ্বর্য দেখাতে থাকেন, তাঁহলে এই মর্ত্যভূমিতে আসার কোন মানে হয় না তাঁর।

কিন্তু যিনি জগৎ-সৃষ্টি করেছেন, তাঁর এই অতুল ঐশ্বর্য-প্রভুত্ব তিনি ভুলবেন কী করে? আর না ভুললে যশোমতীর ঘরে গোপাল হয়ে থাকা, অথবা পিতৃসত্য পালনের জন্য বনে যাওয়া, সাগর লংঘন করার জন্য পরিশ্রম করা অথবা শত শত গোপ-কিশোরীদের সঙ্গে নৃত্য-গীতে বাঁশির পঞ্চম লাগানো—এসব কিছুই বৃথা হত। দার্শনিকেরা বলেছেন—মহামায়া যেমন মানুষকে সংসারের চিত্র-বিচিত্র মোহে ভুলিয়ে রাখেন, তেমনই ভগবান বা পরমেশ্বরকে ভোলানোর জন্যও আরও একটি মায়াশক্তি আছেন। তাঁর নাম যোগমায়া। যোগমায়া পরম ঈশ্বরকে তাঁর ভগবত্তা এবং ঐশ্বর্য সম্বন্ধে অচেতন করে রাখেন। ফলে মানুষের দুঃখ শোক তাঁকে আকুলিত করে এবং মানুষের সুখ-আনন্দ তাঁকে মোহিত করে। এমন নয় যে, যোগমায়ার ক্ষমতাটা পরম ঈশ্বরের চেয়েও বেশি। ভগবান নাকি ইচ্ছে করেই মনুষ্যোচিত রূপ-রস-আনন্দ ভোগ করার জন্য যোগমায়াকে নির্দেশ দেন সাময়িকভাবে—অন্তত অবতার কাল পর্যন্ত—তাঁর ঈশ্বর-ভাব ভুলিয়ে রাখতে।

কিন্তু যে পর্যন্ত তাঁর ঈশ্বর-ভাব-ভোলা মনুষ্য-লীলা চলে, সেই অন্তর্বর্তী সময় ধরে পরম ঈশ্বর—সে তিনি রামই হোন অথবা কৃষ্ণ—মানুষের রসিকতা, ব্যঙ্গ-টিপ্পনী সবকিছুই ভোগ করেন বা উপভোগ করেন। দীর্ঘদিন বনে বাস করে, দিনের পর দিন চুলে-জল না দিয়ে রামচন্দ্রের মাথায় জটা পাকিয়ে যাওয়াই স্বাভাবিক, কিন্তু পিতৃসত্যের মাহাত্ম্য ভুলে রাবণ তাঁকে ভণ্ড তপস্বীই বলবেন, অধিকন্তু কৃত্তিবাসের সুরে তাঁর ধুয়া হবে—মাথাতে পাকালে জটা আঠা মেখে চুলে। অথবা কৃষ্ণের কথাই ধরুন। তিনি যতই বিদর্ভরাজনন্দিনী রুক্মিণীর ভালবাসার চিঠি পেয়ে তাঁকে গন্ধর্ব-মতে বিবাহ করুন, কিন্তু বাগে পেলে শিশুপাল তাঁকে বলবেনই—ব্যাটা লম্পট! আমার সঙ্গে যে মেয়ের বিয়ে হওয়ার পাকা কথা হয়েছিল, সেই বাগদত্তা বউকে বিয়ের পিড়ি থেকে উঠিয়ে নিয়ে গিয়ে ব্যাটা বিয়ে করেছিস, আবার এখন সেই বিয়ের কথা তুলছিস, তোর লজ্জা করে না—মৎপূর্বাং রুক্মিণীং কৃষ্ণ সংসৎসু পরিকীর্তয়ন্‌। ৫০ শিশুপাল কুরুসভায় সবাইকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলেছিলেন—ব্যাটা! তুই ছাড়া দ্বিতীয় কেউ নেই, যে এইরকম করে পরের বউ নিয়ে পালায়—অন্যপূর্বাং স্ত্রিয়ং জাতু ত্বদন্যো মধুসূদন। ৫১

বলতে পারেন—এ মোটেই রসিকতা নয়, এ তো রাগের ঝাল মেটানো। কথাটা আমরা অস্বীকার করি না। কিন্তু এও মানতে হবে রাগের যেমন ঝাল থাকে, তেমনই ভালবাসারও ঝাল থাকে। ঈশ্বর যখন মত্যলীলায় সম্পূর্ণ মনুষ্যায়িত, তখন তাঁর ভালবাসার লোকেরাই তাঁকে লঘু করে দেন। রামচন্দ্র সীতার কাছে ভালবাসার গালাগালি খান, কৃষ্ণ লাম্পট্যের কলঙ্ক লাভ করেন স্বয়ং প্রিয়তমা রাধার কাছে। আর প্রিয়তমা যদি মুখ খুলে গালাগালি পর্যন্ত পৌঁছতে পারেন, বিদগ্ধ কৃষ্ণ তখন কৃষ্ণদাস কবিরাজের জবানীতে বলেন—‘কোটি বেদস্তুতি হৈতে হরে মোর মন।’ ৫২ পরবর্তী সময়ে ঈশ্বরের ক্রিয়াকর্ম নিয়ে যত রঙ্গ-রসিকতা হয়েছে, তার মূলে আছে ভালবাসার ঝাল। শিবভক্ত, রামভক্ত, কৃষ্ণভক্ত—সকলেই তাঁদের ইষ্টদেবতার সঙ্গে যে ঠাট্টা-তমাশা করেছেন, তা এই ভালবাসার ঝোঁকেই। একটু বুঝিয়ে বলি।

আমরা প্রথমে নির্মল রসিকতার জন্য একটা উদাহরণ, আবার নির্মম রসিকতার জন্যও একটা উদাহরণ বেছে নেব। দেবতার জীবনে কতগুলি ‘কনভেনশনাল্‌’ ঘটনা—যা নাকি সাধারণ লোকেও জানে—সেইগুলি আগে মাথায় রাখতে হবে। যেমন ধরুন, শিব কৈলাস-পাহাড়ে থাকেন; বিষ্ণু অনন্তশয্যায় শয়ান। লক্ষ্মী পদ্মালয়া অর্থাৎ পদ্মবনেই তাঁর বাস, তিনি পদ্মাসনা ইত্যাদি। এবারে কবি রসিকতা করে সেটাকে কীভাবে দেখছেন দেখুন।

কবির ধারণা—লোকে দেবতার কাছে এটা-ওটা নানা জিনিস চায়। কেউ জীবনে বড় হতে চায়, কেউ টাকা-পয়সা চায়, কেউ মান চায়, কেউ রোগ-যন্ত্রণা থেকে মুক্তি চায়, কেউ বা শুধুই মুক্তি। মোট কথা—দেবতার কাছে মানুষের প্রতিনিয়ত চাওয়ার কোন শেষ নেই। বিশেষ করে এই কলিযুগে যেন চাওয়াটাই খুব বেড়ে গেছে। কবি মনে করেন—লক্ষ লক্ষ মানুষের এই চাই-চাই স্বভাব দেখেই শিব পালিয়ে গিয়ে বাসা বেঁধেছেন কৈলাসে এবং বিষ্ণু অনন্তশয্যায় ঘাপটি মেরে পড়ে আছেন—রুদ্ৰো’দ্রিং জলধিং হরিঃ। অন্যান্য সাধারণ দেবতারাও মানুষের চাওয়ার ভয়ে অন্তরীক্ষে বা স্বর্গে বসে আছেন। ওদিকে ধনদাত্রী লক্ষ্মীর কাছে তো প্রতি বৃহস্পতিবার যে পরিমাণ—এস মা লক্ষ্মী, বস মা লক্ষ্মী—করা হয়, তাতেই তিনি লুকিয়েছেন গিয়ে পদ্মবনে—লীনা পদ্মবনে সরোজনিলয়া মন্যে’র্থিসার্থাদ্‌ ভিয়া। ৫৩

এই কবিতায় যা আছে, তা অনেকটাই জনমনে পূর্বাহ্নে চিহ্নিত দেবতাদের বাসস্থান নিয়ে চমৎকারিত্ব সৃষ্টি করা। কিন্তু রসিকতা যখন নির্মলতার গণ্ডী ছাড়িয়ে নির্মম রসোদ্‌গার নির্লজ্জতার কোটিতে গিয়ে পড়ে, তার মধ্যেও কিন্তু চমৎকারিত্ব সৃষ্টির বাসনাটাই কবির থেকে যায়, অথচ চমৎকারিত্ব সৃষ্টির নামে যা বেরিয়ে আসে, তাকে রসিকতা না বলে বদ রসিকতা বলাই ভাল। বদ রসিকতা আছে কিম্বা থাকবে—সেটা কিন্তু বড় কথা নয়। বড় কথা হল—যে দেবতা সম্বন্ধে অসীম ভক্তি আছে জনমনে, সেই ভক্তি থাকা সত্ত্বেও কিন্তু তাঁর সম্বন্ধে দুটো খারাপ কথা বলতে মানুষের দ্বিধা নেই।

বস্তুত ধর্মচর্চা এবং মোক্ষমসাধনের সঙ্গেও বিপ্রতীপভাবে মানুষের কামনা বা রঙ্গরসিকতা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে, ভগবানের নামের সঙ্গেও শ্লেষাত্মক ধ্বনিতে কামনা প্রকাশ করতেও মানুষের বাধেনি। যেমন ধরুন শিবের নাম। মনে রাখতে হবে—শিবের কতগুলি নাম আছে। তার মধ্যে কতগুলি পাঠকের জানা। যথা শিব মস্তকে গঙ্গাপ্রবাহ ধারণ করেছিলেন বলে তিনি গঙ্গাধর। আবার মাথায় এক ফালি চাঁদ আছে বলে তিনি চন্দ্রচূড় (তুলনীয় মাইকেল: চন্দ্রচূড় জটাজালে আছিলা যেমতি জাহ্নবী)। পুনশ্চ ধর্মচ‍র্যা বা যোগসিদ্ধির কারণে তিনি নগ্ন দিগম্বর এবং অসুর-বিনাশের ক্ষেত্রে বা তপস্যার ক্ষেত্রে তিনি উগ্র। এই মাত্র চারটে পাঁচটা শিবের নাম নিয়ে কবি এবার কী খেলা খেলেছেন দেখুন। এক কাম-পিপাসু পুরুষের জবানীতে কবি এক রমণীর উদ্দেশ্যে বলছেন—তোমার স্তনদ্বয় একেবারে উগ্ররূপ—ইংরেজিতে পণ্ডিতেরা এর অনুবাদ করেছেন—hard of form like Shiva. এই স্তনদ্বয়ের ও্‌পরে গঙ্গার ধারার মত নেমে এসেছে সোনার হার—উগ্ররূপং কুচদ্বন্দ্বং হারগঙ্গাধরং তব। কবিপুরুষ এবার বলেছেম—তোমার ওই উগ্ররূপ স্তনদ্বয়ের ওপর চন্দ্রচূড় এঁকে দেব আমি (কামশাস্ত্র-মতে এক রকমের নখচ্ছেদ, যাতে প্রতিপদের চাঁদের আকারে পুরুষ-নখের দাগ পড়ে রমণীর বুকে)—তুমি শুধু অঙ্গের বসন মুক্ত করে দিগম্বর হও—চন্দ্রচূড়ং করিষ্যামি কুরু তাবৎ দিগম্বরম্‌। ৫৪

এই শ্লোকোক্তির মধ্যে উগ্র-গঙ্গাধর আর চন্দ্রচূড়-দিগম্বরের শব্দশ্লেষে ভীত হবেন না যেন। শিবের নাম-মাহাত্ম্যেই যেহেতু পাপ স্খলন হতে পারে, অতএব পাপ করতে কবির দ্বিধা নেই। শিবের মত একজন সাধা-সিধে সরল দেবতার নাম নিয়ে যেখানে দেবতার নামের মাহাত্ম্য বলেই পাপবৃদ্ধি ঘটে, তখন ভগবান শ্রীহরি সম্বন্ধে একটা উদাহরণ না দিয়ে পারি না। এই শ্লোকের মধ্যেও স্বল্পতম চমৎকারিত্ব নেই, তা নয়। তবে সে চমৎকারিত্বও এসেছে নির্ভেজাল শৃঙ্গার-বিকারের মাধ্যমে। কবির নির্লজ্জ বর্ণনায় যৌবনগর্বিতা কৃষ্ণ-মোহিনী রাধা একবার কৃষ্ণকে বলছেন—কৃষ্ণ, তোমার বড় সৌভাগ্য। ভাগ্য আছে বলেই লোকে এত তোমার নাম করে। এই যে তুমি, কবে না একটা ছোট্ট পাহাড় হাতে তুলেছিলে, তাতেই লোকে তোমায় ‘গোবর্ধনধারী’ বলে ডাকে। আর আমি যে তিন ভুবনের ধারক-বাহক তোমার মত মানুষকেও এই স্তনের আগায় ধরে রাখি, তবু লোকে আমার কথা খেয়ালও করে না—ত্বাং ত্রৈলোক্যধরং বহ্যামি কুচয়োরগ্রে ন তদ্‌ গণ্যতে। ৫৫

॥ ৬ ॥

রঙ্গ-রসিকতার আগেই যে কথাটা অবশ্য বলে নেওয়া ভাল, সেটা হল—দেব-জীবনের কোন্‌ কোন্‌ অংশ নিয়ে আপনার পক্ষে আলোচনা সম্ভব—সেটা পূর্বাহ্নেই জেনে নেওয়া। আপনি কাব্য-নাটক লিখতে চান, কবিতা লিখতে চান, তো সেখানে কাব্য-নাটকের মধ্যে দেবতার প্রতি মানুষের ভক্তি—সে তো আপনি দেখাতেই পারেন। কিংবা কোন দেবতা যুদ্ধে অলৌকিক শক্তি প্রকাশ করে যুদ্ধ-জয় করছেন—সেটা নথিবদ্ধ করাও কোন অন্যায় নয়। কিন্তু ধরুন, দেবতারা রমণে প্রবৃত্ত হচ্ছেন, কিম্বা মানুষোচিত চুম্বনালিঙ্গনে একেবারে শারীরিক প্রক্রিয়ায় মেতে উঠেছেন—এটা কাব্য-নাটকে লিখবেন কিনা—সেই নিয়ে আমাদের রস-শাস্ত্রে গভীর তর্ক আছে।

কথাটা আমি তুললাম এইজন্য যে, একজন, দেবতার বিষয়ে কবিদের রঙ-তামাশা দেখাতে গেলে, তার কতগুলো ‘প্রি-কন্ডিশন’ থাকে। পরিশ্রম বাঁচানোর জন্য রাঁধুনী যেমন গরম চায়ের কেত্‌লি উনুন থেকে নামানোর সময় আঙুলের আলতো ছোঁয়ায় মাঝে মাঝে দেখে নেন কতাট সহনীয়, তেমনই রঙ্গ-কৌতুকের আগে দেব-চরিত্রের অন্যান্য স্পর্শকাতর দিকগুলি কবিরা কতটুকু তাঁদের লেখনী স্পর্শ করে পরীক্ষা করে নিয়েছেন—সেটা দেখিয়ে নিলে আমাদের সুবিধে হয়। পুরাণ তথা আমাদের মহাকাব্য দুটির মধ্যে যেহেতু দেব-চরিত্রের বিভিন্ন ভাবগুলি অঙ্কিত হয়েছে এবং তাঁর মধ্যে দেবতাদের রতি-চিত্রও যেহেতু বহুলাংশেই স্পষ্ট, অতএব কবিরাও সেই রতি-রস যথেচ্ছ পরিবেশন করবেন—এটা কিন্তু যুক্তি নয়। কারণ পুরাণ ইতিহাস আমাদের দেশে ধর্মগ্রন্থের মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত। দেবতাদের কুকীর্তিকলাপ বর্ণনার সঙ্গে সঙ্গে পাঠককে এখানে অবহিত হতে হয়—ওঁরা দেবতা। দেবতারা যা পারেন বা যা করেন, তা মানুষের আচরণীয় নয়, করণীয়ও নয়।

কিন্তু এতসব মানসিক বাধা এবং ধর্মচেতনা থাকা সত্ত্বেও আমাদের কবিরা কিন্তু থেমে থাকতে পারলেন না। দেব-জীবনের নানা রোমাঞ্চকর ঘটনা এবং শৃঙ্গার-কৌতুক তাঁদের লেখনীকে তাড়িত করল। তাঁরা লিখতে আরম্ভ করলেন। লিখতে আরম্ভ করলেন পাকা সেই রাঁধুনীর কায়দায়—অতি উষ্ণ রতি-রস একটু একটু করে বার বার ছুঁয়ে ছুঁয়ে, পাঠককে সইয়ে সইয়ে। কিন্তু এমন স্পর্শকাতর বিষয়ে কতটা লেখা উচিত এবং কতটা লেখা উচিত নয়—এসব নিয়ে সঙ্গে সঙ্গে তর্ক আরম্ভ হয়ে গেল সমালোচক আলংকারিকদের মধ্যে। এক্ষেত্রে উদাহরণ এবং আলোচনার বিষয় হিসেবে প্রায় সব সময় বেছে নেওয়া হয় মহাকবি কালিদাসের লেখা কুমারসম্ভবের পরবর্তী অংশ। কালিদাস কুমারসম্ভবের প্রথম সর্গে পার্বতীর অতি অপরূপ রূপ বর্ণনা করে পাঠকের মনে অসামান্য চমৎকার সৃষ্টি করেছেন। কিন্তু দেবী পার্বতীর স্তন-জঘনের নিপুণ বর্ণনা সেখানে দিব্য মাহাত্ম্য নিয়ে পাঠকের মনে ধরা দিয়েছে। কালিদাস এইভাবে পাঠককে একটু সইয়ে নিলেন।

তারপর কুমারের তৃতীয় সর্গে অকাল বসত্নের সঙ্গে কামনার দেবতার আবির্ভাব ঘটল। নিতম্ব থেকে বার বার স্রস্ত বকুলের মালাখানি ঠিক জায়গায় নিবেশ করার জন্য কালিদাস পার্বতীর যে প্রত্যঙ্গ-সংস্থান বেছে নিয়েছেন, সইয়ে নেওয়ার ব্যাপার সেখানে আছে। মদন ভস্ম হল, কিন্তু নিখিল বিশ্ব যখন রতিবিলাপ-সঙ্গীতে মুগ্ধ হল, সেখানেও করুণ-রসের ছদ্মবেশে শৃঙ্গারের ভাষা সইয়ে নিয়েছেন কালিদাস। পার্বতীর তপস্যায় কাম প্রেমে পরিণত হল, ফুল ফলের পরিণতি লাভ করল। শিব-পার্বতীর বিয়ে হল। ভাষার ব্যঞ্জনায় অসামান্য কবি শুধু কুমার কার্তিকের সম্ভাবনা করে রাখলেন শব্দের অভিধা অতিক্রম করে ব্যঞ্জনার মতই।

সমালোচকেরা বললেন—কুমারসম্ভব কুমারের সম্ভাবনাতেই শেষ হয়ে গেছে। যে কবি এই কাব্যের অষ্টম সর্গে শিব-পার্বতীর সম্ভোগ বর্ণনা করেছেন, তিনি কালিদাস নন, অন্য কোন অধম কবি। টীকাকারেরা, মল্লিনাথ থেকে আরম্ভ করে আরও অনেকে লজ্জায় চোখ মুদলেন—ছ্যা ছ্যা, জগজ্জননী পার্বতী আর জগৎপিতা মহাদেবের সম্ভোগ-লীলা কি কোন ভদ্র কবি এমন করে বর্ণনা করেন? তাঁরা আর সপ্তম সর্গের পর কুমারসম্ভবের টীকাই লিখলেন না। ভাবখানা এই—খোকা যখন মাকে ডেকে নিজের পূর্বাবাসের ঠিকানা জিজ্ঞাসা করে—এলেম আমি কোথা থেকে—তখন ভারতবর্ষের মা-বাবা প্রত্যেকে লজ্জায় স্নেহ মাখিয়ে বলেন—তুই আমার ঠাকুরের সনে/ছিলি পূজার সিংহাসনে—অথবা আমার তোমার, সবার বাবা-মা হলেন সেই শিব আর পার্বতী—মাতা তে পার্বতী দেবী পিতা দেবো মহেশ্বরঃ। এই অবস্থায় কালিদাসের মত সত্তম কবির পক্ষে কি সম্ভোগ-সৰ্বস্ব অষ্টম সর্গ লেখা সম্ভব?

সুরে সুর মেলালেন কাশ্মীরবাসী মহান আলংকারিক মম্মটাচার্য কাব্যপ্রকাশের সপ্তম উল্লাসে কাব্যের দোষ দেখাতে গিয়ে তিনি লিখলেন—খবরদার! খবরদার! কবিরা সব সাবধান। মানুষের রতি-চিত্রে সম্ভোগ-শৃঙ্গার এমন কিছু অন্যায় নয়। কিন্তু সেই রতি-চিত্র যেন উত্তম দেবতার বিষয়ে একদম ফেঁদে বোস না। সেই বর্ণনা কেমন হবে জান? পিতা-মাতার সম্ভোগ বা রতিকেলির বর্ণনা যেমন অনুচিত এবং অসত্য, ঠিক সেই রকমই অনুচিত পিতৃ-মাতৃকল্প উত্তম-দেবতার রতি-বর্ণনা—কিংতু রতিঃ সম্ভোগ-শৃঙ্গাররূপা উত্তম-দেবতাবিষয়া ন বর্ণনীয়া। তদ্‌বর্ণনং হি পিত্রোঃ সম্ভোগবর্ণনমিব অত্যন্তমনুচিতম্‌। ৫৬

আলংকারিকের এই ফতোয়ার ওপরেও কিন্তু কথা বলার লোক আছেন এবং তিনি এমনই লোক যাঁকে সমস্ত আলংকারিকেরা এক বাক্যে মাথার ওপরে স্থান দেন। তিনি ধ্বনিকার আনন্দবর্ধন। মম্মটের সঙ্গে তাঁর মত মেলেনি, বরঞ্চ বলা উচিত আনন্দবর্ধনের অনেক মত মেনেও মম্মটই তাঁর মত মানতে পারেননি। বস্তুত আনন্দবর্ধন দেবতার সম্ভোগ-বর্ণনামাত্রেই তাকে অনুচিত বলতে রাজী নন। তাঁর বক্তব্য—দৃশ্য কাব্যই হোক, আর শ্ৰব্য কাব্যই হোক মহান রাজা অথবা দেবতাদের সম্ভোগবর্ণনা পিতা-মাতার রতিবর্ণনার মত অসভ্য ব্যাপারই বটে—সুতরামসভ্যম্‌। অপিচ মহাকবিরাও এ ব্যাপরে নিজেদের তত সংযত রাখতে পারেন না এবং এই অসংযম দোষের নিশ্চয়ই—মহাকবীনামপি অসমীক্ষ্যকারিতা লক্ষ্যে দৃশ্যতে। স দোষ এব।

এইরকম একটা সাধারণ মত প্রকাশ করেই আনন্দবর্ধন বলেছেন—তবে কিনা কবির শক্তি বা প্রতিভার ওপরে অনেক কিছুই নির্ভর করে। মহাকাব্য রচনা করার মত অসাধারণী শক্তি যদি থাকে, তবে অনেক কিছুই তাঁর মানায়। আনন্দবর্ধনের মতে কাব্যের দোষ দু-রকম। অব্যুৎপত্তিকৃত দোষ এবং অশক্তিকৃত দোষ। শক্তি হল প্রতিভা, নব-নবোন্মেষশালিনী প্রজ্ঞা—যাতে বর্ণনীয় কাব্য-মহাকাব্যের মধ্যে নূতনত্বের চমৎকার পাঠককে মুগ্ধ করে। আর ব্যুৎপত্তি হল ছন্দ, অলংকার এবং বর্ণনীয় বিষয়ের পৌবাপর্য ঠিক রেখে জিনিসটাকে ঠিক্‌-ঠাক্‌ দাঁড় করানো। কবি-সাহিত্যিক যদি সত্যিই প্রতিভাবান হন তবে তাঁর ব্যুৎপত্তিহীনতা প্রতিভার উচ্ছাসে ঢেকে দিতে পারেন। কিন্তু কবির যদি প্রতিভা না থাকে তবে সে দোষ তো বটেই, সঙ্গে সঙ্গে তাঁর ব্যুৎপত্তিহহীনতাও সবার আগে চোখে পড়বে—যস্ত্বশক্তিকৃতস্তস্য স ঝটিত্যবভাসতে। ৫৭

এতগুলো কথা বলে আনন্দবর্ধন এবার কালিদাসের প্রসঙ্গে আসছেন। তিনি বললেন—দেখ বাপু! উত্তম এবং পরিচিত দেবতার সম্ভোগবর্ণনার মধ্যে হয়তো একটা অনৌচিত্য আছে ঠিকই, কিন্তু মহাকবি যখন সেই সম্ভোগবর্ণনা করেন তখন তাঁর প্রতিভার আলোকচ্ছটায় অনৌচিত্য বা গ্রাম্যতা একেবারে ধুয়ে মুছে যায়—শক্তিতিরস্কৃতত্ত্বাৎ গ্রাম্যত্বেন ন প্রতিভাসতে। উদাহরণ? কোন্ কবির এত প্রতিভা? উদাহরণ দিন একটা। আনন্দবর্ধন বললেন—যথা কুমারসম্ভবে দেবীসম্ভোগবর্ণনম্‌। ৫৮

দেখুন, অলংকার এবং রসশাস্ত্রের জগতে যে নামের ওপরে কোন নাম নেই, সেই আনন্দবর্ধন যখন অষ্টম সর্গের ‘পাণিপীড়নবিধেরনন্তরম্‌’ সম্ভোগটাকে মেনে নিলেন, তখন আমরাও সুর চড়িয়ে বলি—এটা কিছুই অপূর্ব নয়, ঘটনা সামান্য খুবই। চরম মানবায়নের পথে আমরা জগজ্জননী পার্বতীর শৃঙ্গার-চেষ্টা যেমন অন্যায় মনে করিনি, তেমনই জগৎপিতা শিবের অহর্নিশ উদ্দাম রতিবিলাসও আমাদের কল্পনার বাইরে নয়। বস্তুত কুমারসম্ভবের প্রথম সর্গ থেকে সপ্তম সর্গ থেকে একটি সুন্দরী রমণীর মোহন রূপে ভুলে যে যোগী পুরুষটি ধৈর্য হারিয়েছিলেন—হরস্তু কিঞ্চিৎ পরিবৃত্তধৈর্যঃ—তাঁর নেত্রবহ্নিতে কাম-স্বরূপ যতই দগ্ধ হোক, তবু তাঁর মধ্যে সব ব্যবহারই ছিল মানুষের। এই একান্ত মানবায়নের পথ ধরে সেই যোগী মহাত্মার যদি বিয়ে-থা হয়েই থাকে, তবে সেখানে সম্ভোগ-তুষ্টিও থাকবে। এর মধ্যে অকালিদাসোচিত কী থাকতে পারে—তা অন্তত আমাদের বুদ্ধিতে আসে না।

প্রথম থেকে সপ্তম সর্গ পর্যন্ত যে শিব-পার্বতীর মধ্যে আমরা পিতা-মাতার খোঁজ করলাম না, হঠাৎ অষ্টম সর্গে সম্ভোগ-বর্ণনার সঙ্গে সঙ্গে সেই শিব-পার্বতীর মধ্যে পিতা-মাতার সাযুজ্য খুঁজে পেলাম—এটাই আমার কাছে এক অভিনব রসের কথা। তাছাড়া কবিরা না হয় খুব দুষ্টু। তাঁদের প্রতিভা আছে বলে তাঁরা না হয় হর-পার্বতীর শৃঙ্গার-বর্ণনা দিয়ে পাঠকের মনে চমৎকার সৃষ্টি করলেন। কিন্তু পুরাণ? পুরাণগুলির মর্যাদা তো ধর্মশাস্ত্রের। তাঁরা কেন দেবতাদের নামিয়ে আনলেন মানুষের শৃঙ্গার-ভূমিতে?

তপস্যাতপ্ত উমায় সঙ্গে শিবের মিলনের মধ্য দিয়ে কুমার কার্তিকের সম্ভাবনা করে দিয়ে কালিদাস না হয় আর কুমারসম্ভব লেখেননি। কিন্তু প্রথম সর্গ থেকে সপ্তম সর্গ পর্যন্ত উমার পয়োধর আর নিতম্বদেশের বর্ণনায় পার্বতীর প্রতি কালিদাসের যেমন খুব মাতৃভাব ফুটে ওঠেনি, তেমনই পুরাণকারেরাও শিব-পার্বতীর শৃঙ্গার বর্ণনায় খুব বেশি সংযম দেখাননি। রাধাকৃষ্ণের ক্ষেত্রে তো এই বর্ণনা প্রাবাদিক স্তরে পৌঁছেছে। এই বিশাল বিশাল দেব-দেবী তথা জগদীশ্বর-পরমেশ্বরদের শৃঙ্গার-কুতূহল, এবং অন্যান্য মানবিক গুণাগুণের কথা বলে পুরাণকারেরা যে পথ দেখিয়ে অন্য পরবর্তী কবিরা সেই পথেই চলেছেন।

আমি বরঞ্চ বলব—অতি পরিচিত এবং প্রিয়তম দেব-দেবীর প্রত্যঙ্গ-সংস্থান বর্ণনা করে পৌরাণিকেরা তথা কবিরা দেব-দেবীকে আমাদের আরও কাছে এনে দিয়েছেন। এই কাছে আনার ফলেই আমরা তথাকথিত স্বর্গের দেব-দেবীদের কখনও মনুষ্যোচিত ব্যবহারের ঊর্ধ্বে স্থাপন করিনি। পৌরাণিকেরা যা করেছেন, পরবর্তী সংস্কৃত কবিরা তার থেকে আরও এক কাঠি এগিয়েছেন। তারপর দেব-দেবীরা যখন নেমে এলেন আঞ্চলিক ভাষার কবিদের মুখে, তখন দেব-দেবীদের স্বর্গীয় মাহাত্ম্য আর কিছুই রইল না। মহা-মহা দেব-দেবীরা তখন শুধু মানুষের দৈনন্দিন দুঃখ-সুখের বেড়াজালের মধ্যেই ধরা পড়লেন না, মানুষের ঈর্ষা, কলহ, নোংরামি, অসভ্যতা, নেশা—সবই ঢুকে গেল দেব-দেবীর ব্যবহারে। তাঁরা খিস্তি-খেউড়ের বিষয়-বস্তু হয়ে পড়েছেন।

এই দৃষ্টিতে কংস-বধের কারণে মথুরা যাওয়ার জন্য কৃষ্ণ কোন ঐতিহাসিক গুরুত্ব পাননি। পুরাণের কবি যেখানে মথুরা-গত কৃষ্ণের জন্য রাধার মাথুর-বিরহের ইঙ্গিত দিয়েছেন, বৈষ্ণব পদকর্তাদের লেখনীতে তা কোমল-করুণ কান্ত পদাবলীর ছন্দে ধরা পড়ল বটে, কিন্তু পুরাণ-জানা কবিওয়ালা বা টপ্পা-গাইয়েদের হাতে পড়ে সেই মাথুর-বিরহের মর্যাদা কী হল, তার নমুনা রূপচাঁদ পক্ষীর জবানীতে—

আমারে ফ্রড্‌ করে কালিয়া ড্যাম্‌ তুই কোথায় গেলি।

আই অ্যাম ফর ইউ ভেরি সরি গোল্ডেন বডি হল কালি।।

হে মাই ডিয়ার, ডিয়ারেষ্ট, মধুপুরে তুই গেলি কৃষ্ট।

ও মাই ডিয়ার হাউ টু রেষ্ট, হিয়র ডিয়র বনমালী

(শুন রে শ্যাম তোরে বলি।।)

পুওর কিরিচির মিল্ক্‌-গেরেল, তাদের ব্রেষ্টে মারলি শেল,

ননসেন্স তোর নেই আক্কেল, ব্রিচ অব কন্ট্রাক্ট্‌ করলি। ৫৯

ইত্যাদি। একদিকে কৃষ্ণের এই অবস্থা, অন্যদিকে রূপচাঁদের মুখে শিবের অবস্থাও বড় মধুর নয়, মর্যাদাকর তো নয়ই। আগমনী গানকে কতটা মানবায়িত করলে বলা যায়—

গো মেনকা শোন তোর অম্বিকার দুর্গতি।
গাঁজা টেনে শ্মশানে যায় পশুপতি ॥
মাঠে ঘাটে বেড়ায় ছুটে কার্তিক-গণেশ দুই নাতি।।
শৈশব হতে যদি শেখাতে দুটিরে,বিশ্ববিদ্যালয়ে ওরা আসিত পাস করে,
অনায়াসে দুটিতে বিদ্যাবুদ্ধির জোরে হত হাইকোর্টের বিচারপতি।।
যত হট্টের সঙ্গে শিখেছে হট্টতা,কিরূপে তাহারা শিখিবে সভ্যতা,
অসিদ্ধ বালকের নাম সিদ্ধিদাতা, কলাবৃক্ষ যার সঙ্গতি।।
(দেখ) সংসৰ্গদোষেতে তোর দশভূজা,চণ্ডালের গৃহেতে লয় অগ্রে পূজা,
ভোলা মহেশ্বর দিন-রাত টানে গাঁজা, সঙ্গে সব আবাগের সন্ততি।।
কহে দীন দ্বিকর জুড়েইঁদুরে, ময়ূরে দুটি শিশু চড়ে,
মাতঙ্গীর সিংহ, বুড়োর বুড়ো এঁড়ে, কে দিবে গো ঘোড়া হাতী ॥ ৬০

ঠিক এই জায়গাটা থেকেই আমরা উল্টো দিকে যাত্রা করব। সংস্কৃতের পুরাণগুলিও নয়, বড় বড় কাব্য-মহাকাব্যও নয়, দেখব—কতশত সংস্কৃত কবি শুধু পৌরাণিকের সূত্র ধরে দেব-দেবীদের নিয়ে রঙ্গ-রসিকতার ক্ষেত্র প্রস্তুত করেছেন—যার পরম্পরাক্রমে কোথাও তৈরি হয়েছে কবিওয়ালা-টপ্লাওয়ালাদের গান আর কোথাও বা বাংলা প্রবাদ—কলির কেষ্ট, গোবর গণেশ, কেলে কার্তিক অথবা বোম্ ভোলা।

সুত্র

‘বিষ্ণুপুরাণম্‌’, ৩. ১৭. ১৭

তদেব, ৩. ১৭. ১৮

তদেব, ১. ৫. ২৮-৩১

তদেব, ১. ৫. ৪০

‘শতপথ ব্রাহ্মণ’, ১. ২. ৫, ১

তদেব, ১. ২. ৫. ৩

তদেব, ১. ২. ৫. ৪

‘মহাভারতম্‌’, ১. ১৪. ৪৮

তদেব, ১.১৪. ৪৬

১০ ‘ঋগ্‌-বেদসংহিতা’, ১০.১১৪. ৫; ১০. ১১৪. ৪ নং ঋকটিও প্রণিধানযোগ্য।

১১ ‘শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা’, ২ ৪২

১২ ‘ঋগ্‌বেদসংহিতা’, ৬. ৪৭. ৮

১৩ তদেব, ২. ১৮. ৪

১৪ জৈমিনি-প্রণীত ‘মীমাংসা-দর্শন’ ৯. ১. ৬ সূত্রের ওপর শবরস্বামীর টীকা, পৃ. ৭৩

১৫ তদেব, পৃ. ৭৩

১৬ তদেব, পৃ. ৭২

১৭ ‘মীমাংসা-দর্শন’, পণ্ডিত ভূতনাথ সপ্ততীর্থ সম্পাদিত, ২য় খণ্ড, পৃ. ৩২১

১৮ তদেব, পৃ. ৩২৪

১৯ ‘মীমাংসা-দর্শন’, সূত্র ৯. ১. ৯

২০ ‘বেদান্ত-দর্শনম্‌’, ১. ৩. ৩৩ সূত্রের ওপর শঙ্কর-ভাষ্য, পৃ. ৪৬০

২১ তদেব,, শঙ্করভাষ্য, পৃ. ৪৬৫

২২ তদেব, ১. ৩. ৩০ সূত্রের ওপর শঙ্করভাষ্য, পৃ. ৪৪৭

২৩ ‘মহাভারতম’, ৫. ১১. ৫-৭

২৪ দেব, ৫. ১১. ১০

২৫ ‘বেদান্ত-দর্শন’, ১.৩. ৩০ সূত্রে শঙ্কর কর্তৃক উদ্ধৃত পুরাণ-বচন।

২৬ বিগ্রহে হবিষাং ভোগ ঐশ্বৰ্য্যং চ প্রসন্নতা।

ফল-প্রদানমিত্যেৎ পঞ্চকং বিগ্রহাদিকম্ ॥

দেবতাদের এই পাঁচ রকমের শরীর অথবা বিগ্রহ পঞ্চক।

২৭ ‘বেদান্ত-দর্শন, ১. ৩. ৩৩ সুত্রের ওপর শঙ্কর-ভাষ্য দ্রষ্টব্য।

২৮ ‘বৃহদারণ্যক উপনিষদ্’, ৫. ২.৩ অংশে শঙ্কর-ভাষ্য দ্রষ্টব্য।

২৯ তদেব, ৫. ২. ৩ শঙ্কর-ভাষ্য

৩০ ‘সুভাষিতরত্নভাণ্ডাগারম’, পৃ. ১৫৬. ১৩৬

৩১ ‘যুক্তিদীপিকা, ৫৩ নং সাংখ্যকারিকা।

৩২ ‘যুক্তিদীপিকা, ৫৫ নং সাংখ্যকারিকা।

৩৩ তদেব।

৩৪ তদেব।

৩৫ ‘বায়ু-পুরাণম্‌’, ৭. ২৩।

৩৬ ‘যুক্তিদীপিকা’, ৫৫ নং সাংখ্য-কারিকা।

৩৭ তদেব, ৫৫ নং সাংখ্য-কারিকা।

৩৮ তদেব, ৫৫ নং সাংখ্য-কারিকা।

৩৯ ‘মৎস্যপুরাণম্‌’, ২৩.১০

৪০ ‘মহাভারতম্‌’ ৯. ৩৫. ৪৭

৪১ তদেব, ৯. ৩৫. ৫২

৪২ ‘যুক্তিদীপিকা’ ৫৫ নং সাংখ্যকারিকা।

৪৩ যুক্তিদীপিকার এই স্থলে যে পাঠ আছে তা নির্ভুল নয়। নির্ভরযোগ্য অন্য একটি সংস্করণে আমি যা লিখেছি, সেই পাঠ দেখেছি। সময়াভাবে সেই সংস্করণের সম্পাদকের নাম দিতে পারলাম না।

৪৪ গোপথ ব্রাহ্মণের এই পংক্তিটি যুক্তিদীপিকাতেই ধরা আছে। পৃ. ১৬৮

৪৫ “তেষামপি হৃদয়ে বিজ্ঞানং নিরুধ্যতে। মূধ্নীত্যপরে।”

বসুবন্ধু-বিরচিত অভিধর্মকোশম্‌, পৃ. ৫০৩-৫০৪

৪৬ বসুবন্ধু, ‘অভিধর্মকোশম্‌’ পৃ. ৫০৫

৪৭ তদেব, পৃ. ৫২৪

৪৮ তদেব, পৃ. ৫২৫

৪৯ তদেব, পৃ. ৫২৫

৫০ ‘মহাভারতম্‌’, ২. ৪৫. ১৮

৫১ তদেব, ২ ৪৫. ১৯

৫২ ‘চৈতন্য-চরিতামৃত’,১. ৪. ২৬

৫৩ ‘সুভাষিতরত্নভাণ্ডাগারম্‌’, পৃ. ৭১

৫৪ তদেব, পৃ. ৩১৮

৫৫ L. Stumbuck, ‘মহাসুভাষিতরত্নকোষ, vol. IV. Sl. 7247

৫৬ মন্মটচার্য বিরচিত ‘কাব্যপ্রকাশ’, পৃ. ৪৪৩।

৫৭ আনন্দবর্ধনকৃত ‘ধ্বন্যালোক’, পৃ ৩৪৬

৫৮ তদেব, পৃ. ৩৪৬

৫৯ অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, ‘বাংলা সহিত্যের ইতিহাস’, ৪র্থ খণ্ড, পৃ. ৩৩৭-এ উদ্ভূত।

৬০ তদেব, পৃ. ৩৩১-এ উদ্ধৃত।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *