দেবী – ১৭

১৭

নীলুর বাবা বারান্দায় বসে ছিলেন। নীলুকে বেরুতে দেখে তিনি ডাকলেন, ‘নীলু, কোথায় যাচ্ছ মা?’

‘একটু বাইরে যাচ্ছি।’

কিন্তু এইটুকু বলতেই নীলুর গলা কেঁপে গেল। গাল লাল হল। তিনি তা লক্ষ করলেন। বিস্মিত গলায় বললেন, ‘বাইরে কোথায়?’ নীলু জবাব দিল না।

‘কখন ফিরবে মা?’

‘আটটা বাজার আগেই ফিরব।’

‘গাড়ি নিয়ে যাও।’

‘গাড়ি লাগবে না। তোমার কিছু লাগবে বাবা, চা বানিয়ে দিয়ে যাব?’

‘না, চা লাগবে না। একটু সকাল সকাল ফিরিস মা। শরীরটা ভালো না।’

‘সকাল-সকালই ফিরব।’

বিকেলের আলো নরম হয়ে এসেছে। সব কিছু দেখতে অন্য রকম লাগল নীলুর চোখে। নিউ মার্কেটের পরিচিত ঘরগুলিও যেন অচেনা। যেন ওদের এক ধরনের রহস্যময়তা ঘিরে আছে।

.

‘কেমন আছ নীলু?’

নীলু তৎক্ষণাৎ তাকাতে পারল না। তার লজ্জা করতে লাগল। তার ভয় ছিল আজ হয়তো সে আসবে না। প্রিয়জনদের দেখা তো এত সহজে পাওয়া যায় না।

‘আজ তুমি দেরি করে এসেছ। পাঁচ মিনিট দেরি। তোমার তার জন্যে শাস্তি হওয়া দরকার।’

‘কী শাস্তি?’

‘সেটা আমরা চা খেতে-খেতে ঠিক করব। খুব চায়ের পিপাসা হয়েছে।’

‘কোথায় চা খাবেন?’

‘এইখানে কোথাও। আর শোন নীলু, চা খেতে-খেতে তোমাকে আমি একটা কথা বলতে চাই। খুব জরুরি কথা।’

‘এখন বলুন। হাঁটতে হাঁটতে বলুন।’

‘নাহ্। এই কথা হাঁটতে-হাঁটতে বলা যায় না। বলতে হয় মুখোমুখি বসে। চোখের দিকে তাকিয়ে।’

নীলুর কপালে বিন্দু-বিন্দু ঘাম জমল। নিঃশ্বাস ভারি হয়ে এল। সে কোনোমতে বলল, ‘ঠিক আছে, চলুন কোথাও বসি।’

‘কি বলতে চাই তা কি বুঝতে পারছ?’

‘নাহ্।’

‘বুঝতে পারছ, নীলু। মেয়েরা এইসব জিনিস খুব ভালো বুঝতে পারে।’

নীলুর গা কাঁপতে লাগল। অন্য এক ধরনের আনন্দ হচ্ছে। অন্য এক ধরনের সুখ। মনে হচ্ছে পৃথিবীতে এখন আর কেউ নেই। চারিদিকে সীমাহীন শূন্যতা। শুধু তারা দু’ জন হাঁটছে। হেঁটেই চলেছে। কেমন যেন এক ধরনের কষ্টও হচ্ছে বুকের মধ্যে।

ওরা একটি রেস্টুরেন্টে গিয়ে বসল।

‘চায়ের সঙ্গে আর কিছু খাবে?’

‘না।’

‘খাও না! কিছু খাও।’

সে বয়কে ডেকে কী যেন বলল। নীলু শুনতে পেল না। কোনো কিছুতেই তার মন বসছে না। সব তার কাছে অস্পষ্ট লাগছে।

‘কি নীলু, কিছু বল। চুপ করে আছ কেন?’

‘কী বলব?’

‘যা ইচ্ছা বল।’

নীলু ইতস্তত করে বলল, ‘আপনি ঐ বিজ্ঞাপনটা আবার দিয়েছেন কেন?

সে হাসল শব্দ করে।

‘দেখেছ বিজ্ঞাপনটা?’

‘হ্যাঁ।’

‘মন-খারাপ হয়েছে?’

নীলু কিছু বলল না।

‘বল, মন-খারাপ হয়েছে?’

‘হ্যাঁ।’

সে আবার শব্দ করে হাসল। তার পর ফুর্তিবাজের ভঙ্গিতে বলল, ‘আমি পত্রিকার অফিসে টাকা দিয়ে রেখেছিলাম। কথা ছিল প্রতি মাসে দু’ বার করে ছাপবে। তোমার সঙ্গে দেখা হবার পর তার আর প্রয়োজন ছিল না। কিন্তু সেটা বলা হয় নি। আগামী কাল বন্ধ করে দেব। এখন খুশি তো?’

নীলু জবাব দিল না।

‘বল, এখন তুমি খুশি? এইভাবে চুপ করে থাকলে হবে না, কথা বলতে হবে। বল, তুমি খুশি?

‘হাঁ’

সে আরেক দফা চায়ের অর্ডার দিয়ে একটা সিগারেট ধরাল। খানিকক্ষণ দু’ জনেই কোনো কথা বলল না। বাইরে সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে। পৃথিবী বড় সুন্দর গ্রহ। এতে বেঁচে থাকতে সুখ আছে।

‘নীলু।’

‘হাঁ’

‘তোমাকে যে-কথাটি আমি বলতে চাচ্ছিলাম সেটি বলি?’

‘বলুন।’

‘দেখ নীলু, সারা জীবন পাশাপাশি থেকেও এক সময় একজন অন্যজনকে চিনতে পারে না। আবার এমনও হয়, এক পলকের দেখায় একে অন্যকে চিনে ফেলে। ঠিক না?’

নীলু জবাব দিল না।

‘বল, ঠিক না?’

‘হ্যাঁ।’

‘তোমাকে প্রথম দিন দেখেই…’

সে চুপ করে গেল। নীলুর চোখে জল এল।

‘নীলু,আজ যদি তোমাকে আমাদের বাড়িতে নিয়ে গিয়ে সবার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিই, তাহলে তোমার আপত্তি আছে?’

নীলু ছোট্ট একটি নিঃশ্বাস ফেলল। জবাব দিল না। সে মুখ ঘুরিয়ে বসে ছিল। সে তার চোখের জল তাকে দেখাতে চায় না।

‘বল নীলু, আপত্তি আছে?’

‘আমাকে আটটার মধ্যে বাড়ি ফিরতে হবে।

‘আটটার আগেই আমরা বাড়ি ফিরব। এস উঠি।’

সে নীলুর হাত ধরল। ভালবাসার স্পর্শ, যার জন্যে তরুণীরা সারা জীবন প্রতীক্ষা করে থাকে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *