১৬
পত্রিকা খুলে নীলু অবাক হল। সেই বিজ্ঞাপনটি আবার ছাপা হয়েছে। কথাগুলি এক। জিপিও বক্স নাম্বারও ৭৩। শিরোনামটিও আগের মতো—কেউ কি আসবেন?’ এর মানে কী? নীলুর ধারণা ছিল, এই বিজ্ঞাপনটি আর কোনো দিন ছাপা হবে না। এর প্রয়োজন ফুরিয়ে গেছে। কিন্তু এখন তা মনে হচ্ছে না। নীলুর ইচ্ছা হল দরজা বন্ধ করে কিছুক্ষণ কাঁদার। সে মুখ কালো করে বারান্দায় এসে দাঁড়াল। বারান্দায় তার জন্যে একটা বড় ধরনের চমক অপেক্ষা করছিল। মিসির আলি সাহেব দাঁড়িয়ে। তিনি বললেন, ‘এখানে কি আনিস সাহেব থাকেন?
‘স্যার আপনি? আমাকে চিনতে পেরেছেন?’
‘ও ইয়ে, তুমি। আমার ছাত্রী? কোন ইয়ার?’
‘থার্ড ইয়ার স্যার। নীলু আমার নাম। নীলুফার।’
‘ও, আচ্ছা। নীলুফার—তোমাদের তেতলায় আনিস সাহেব থাকেন নাকি?’
‘জ্বি।’
‘তাঁর কাছে এসেছি। উঠবার রাস্তা কোন দিকে?’
নীলু তাঁকে সঙ্গে করে তিনতলায় নিয়ে গেল।
‘ফেরবার পথে আমাদের বাসা হয়ে যাবেন স্যার। যেতেই হবে।’
‘আচ্ছা, দেখি।’
‘দেখাদেখি না স্যার, আপনি আসবেন।’
আনিস ঘরে ছিল না। রানু তাঁকে নিয়ে বসাল। সে খুবই অবাক হয়েছে। মিসির আলি বললেন, ‘খুব অবাক হয়েছেন মনে হচ্ছে?’
‘আপনি-আপনি করে বলছেন কেন?’
‘ও আচ্ছা, তুমি-তুমি করে বলতাম, তাই না? ঠিক আছে। এখন বল, আমাকে দেখে অবাক হয়েছ?’
‘হ্যাঁ।’
‘খুব অবাক হয়েছ?’
‘জ্বি। আপনি আসবেন ভাবতেই পারি নি।’
মিসির আলি সিগারেট ধরিয়ে হাসিমুখে বললেন, ‘তুমি তো শুনেছি সব কিছু আগে বলে দিতে পার, এটি তো পারার কথা ছিল।’
রানু থেমে-থেমে বলল, ‘আপনি লোকটি বেশ অদ্ভুত!’
‘তাই নাকি?’
‘হ্যাঁ। আপনার যুক্তিও খুব ভালো, বিশ্বাস করতে ইচ্ছা হয়।’
‘বিশ্বাস করলেই পার। আনিস সাহেব কখন আসবেন?’
‘এসে পড়বে।’
‘আমাকে একটু চা খাওয়াও। আর শোন, তোমাদের একটা কাজের ছেলে আছে নাকি? ওকে পাঠাও তো আমার কাছে।’
‘ওকে কী জন্যে?’
‘কয়েকটা কথা জিজ্ঞেস করব।’
.
মিসির আলি : কি নাম?
জিতু : জিতু মিয়া।
মিসির আলি : দেশ কোথায়?
জিতু : টাঙ্গাইল।
মিসির আলি : শুনলাম দু’-এক দিন আগে তুমি নাকি রাতের বেলা কি-একটা দেখে ভয় পেয়েছ?
জিতু : জ্বি, পাইছি।
মিসির আলি : কী দেখেছ?
জিতু : পাকের ঘরে এক জন মেয়েমানুষ। হাঁটাচলা করতাছে।
মিসির আলি : সুন্দরী?
জিতু : জ্বি, খুব সুন্দর!
মিসির আলি : রান্নাঘরে তো বাতি জ্বালানো ছিল?
জিতু : জ্বি-না
মিসির আলি : অন্ধকারে তুমি মানুষ কীভাবে দেখলে?
জিতু : নিশ্চুপ।
মিসির আলি : আমার মনে হয় জিনিসটা তুমি স্বপ্নে দেখেছ।
জিতু : নিশ্চুপ
মিসির আলি : আচ্ছা জিতু মিয়া, তুমি যাও। শোন, এক প্যাকেট সিগারেট নিয়ে এস আমার জন্যে। ক্যাপস্টান। নাও, টাকাটা নাও।
জিতু মিয়া চলে গেল। রানু ছোট্ট একটি নিঃশ্বাস ফেলে বলল, ‘ইউনিভার্সিটির সব মাস্টাররাই কি আপনার মতো বুদ্ধিমান?’
‘না। আমার নিজের বুদ্ধি একটু বেশি। আচ্ছা, এখন যে খুটখাট শব্দ শোনা যাচ্ছে, এই শব্দটার কথাই কি আনিস সাহেব আমাকে বলেন?’
রানু জবাব দিল না। মিসির আলি কান পেতে শুনলেন।
‘শব্দটা তো বেশ স্পষ্ট। রান্নাঘর থেকে আসছে না?’
‘হুঁ।’
‘এই শব্দটার কথাই আনিস সাহেব বলেন, তাই না?’
‘বোধহয়। আপনি রান্নাঘর দেখবেন? আপনি যাওয়ামাত্রই শব্দ থেমে যাবে।’
‘শব্দটা বেশির ভাগই রান্নাঘরে হয়?’
‘জ্বি।’
‘ইঁদুর-মারা কিছু বিষ ছড়িয়ে দিও, আর শব্দ হবে না। ওটা ইঁদুরের শব্দ। রান্নাঘরে খাবারের লোভে ঘোরাঘুরি করে। সেজন্যেই শব্দটা বেশি হয় রান্নাঘরে। বুঝলে?’
‘হুঁ।’
‘যুক্তিটা পছন্দ হচ্ছে না মনে হয়।
‘যুক্তি ভালোই। আরেক কাপ চা খাবেন?’
‘নাহ্, এখন উঠব। আনিস সাহেব মনে হয় আজ আর আসবেন না।’
‘না, আপনি আরেকটু বসুন। আপনাকে একটা গল্প বলব।’
‘আজ আর না, রানু। মাথা ধরেছে।’
‘মাথা ধরলেও আপনাকে শুনতে হবে। বসুন, আমি চা আনছি। প্যারাসিটামল খাবেন?’
‘ঠিক আছে।’
চা আসবার আগেই আনিস এসে পড়ল। তার অফিসে নাকি কী-একটা ঝামেলা হয়েছে। দশ হাজার টাকার একটা চেকের হিসেবে গণ্ডগোল। চেকটা ইস্যু হয়েছে আনিসের অফিস থেকে। আনিসের চোখে-মুখে ক্লান্তি। মিসির আলি বললেন, ‘আপনি বিশ্রামটিশ্রাম করেন। আমার জন্যে ব্যস্ত হবেন না। আমি রানুর কাছ থেকে একটা গল্প শুনব।’
‘কী গল্প?’
‘জানি না কী গল্প। ভয়ের কিছু হবে।’
রানু বলল, ‘না, ভয়ের না। তুমি গোসলটোসল সেরে এসে চা খাও।’
‘আমি গল্পটা শুনতে পারব না?’
‘নাহ্। সব গল্প সবার জন্যে না।’
আনিসের কপালে সূক্ষ্ম ভাঁজ পড়ল। সে কিছু বলল না। বাথরুমে ঢুকে পড়ল। রানু তার গল্প শুরু করল খুব শান্ত গলায়। মিসির আলি তাকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে লক্ষ করতে লাগলেন।
.
রানুর দ্বিতীয় গল্প
আমার তখন মাত্র বিয়ে হয়েছে। সপ্তাহখানেকও হয় নি। সেই সময় এক কাণ্ড হল।
আমার বিয়ে হয়েছিল শ্রাবণ মাসের ছ’ তারিখে। ঘটনাটা ঘটল শ্রাবণ মাসের চোদ্দ তারিখ। সকালবেলা আমার এক মামাশ্বশুর এসে ওকে নিয়ে গেলেন মাছ মারতে। নৌকায় করে মাছ মারা হবে। নৌকা বড় গাঙ দিয়ে যাবে সোনাপোতার বিলে। বড়শি ফেললেই সেখানে বড়-বড় বোয়াল মাছ পাওয়া যায়। বর্ষাকালের বোয়ালের কোনো স্বাদ নেই জানেন তো? কিন্তু সোনাপোতার বোয়ালে বর্ষাকালেই নাকি সবচেয়ে বেশি তেল হয়।
দুপুরের পর থেকেই হঠাৎ করে খুব দিন-খারাপ হল। বিকেল থেকে বাতাস বইতে লাগল। আমরা সবাই চিন্তিত হয়ে পড়লাম। ওরা আর ফেরে না। সন্ধ্যার পর থেকে শুরু হল প্রচণ্ড ঝড়। বাড়িতে কান্নাকাটি পড়ে গেল।
আমাদের বাড়িটা হচ্ছে কাঠের। কাঠের দোতলা। আমি একা-একা দোতলায় উঠে গেলাম। দোতলার কোণার দিকের একটা ঘরে আজেবাজে জিনিস রাখা হয়। স্টোররুমের মতো। কেউ সেখানে যায়টায় না। আমি ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে কাঁদতে শুরু করলাম। তখন হঠাৎ একটি মেয়ের কথা শুনতে পেলাম। মেয়েটি খুব নিচুস্বরে বলল—সোনাপোতার বিলে ওদের নৌকা ডুবে গেছে। কিছুক্ষণ আগেই ডুবেছে। এটা শোনার পর আমি অজ্ঞান হয়ে যাই।
মিসির আলি বললেন, ‘এইটুকুই গল্প?’
‘হাঁ।’
‘গল্পের কোনো বিশেষত্ব লক্ষ করলাম না।’
‘বিশেষত্ব হচ্ছে, সেদিন সন্ধ্যায় ওদের সত্যি-সত্যি নৌকাডুবি হয়েছিল। এর কোনো ব্যাখ্যা আছে আপনার কাছে?’
‘আছে। ঝড়বৃষ্টি হচ্ছিল, কাজেই তোমার মনে ছিল অমঙ্গলের আশঙ্কা। অবচেতন মনে ছিল নৌকাডুবির কথা। অবচেতন মনই কথা বলেছে তোমার সঙ্গে। মানুষের মন খুব বিচিত্র রানু। আমি উঠলাম।’
মিসির আলি উঠে দাঁড়ালেন। রানু তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বলল, ‘একতলার নীলু নামের যে-মেয়েটি আপনাকে এখানে নিয়ে এসেছে, সে আপনার জন্যে বারান্দায় অপেক্ষা করছে। যাবার সময় ওর সঙ্গে আপনার দেখা হবে।’
মিসির আলি বিস্মিত হয়ে বললেন, ‘তাতে কি?’
রানু বলল, ‘নীলু এই মুহূর্তে কী ভাবছে তা আমি বলতে পারব। ওকে জিজ্ঞেস করলেই দেখবেন আমি ঠিকই বলেছি। আমি অনেক কিছুই বলতে পারি।’
‘নীলু কী ভাবছে?’
‘নীলু ভাবছে এক জন অত্যন্ত সুপুরুষ যুবকের কথা।’
‘সেটাই তো স্বাভাবিক। এক জন অবিবাহিত যুবতী এক জন সুপুরুষ যুবকের কথাই ভাবে। এটা বলার জন্যে কোনো অতীন্দ্রিয় ক্ষমতার দরকার হয় না, রানু।’
মিসির আলি নেমে গেলেন। নীলু সত্যি-সত্যি বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিল। সে খুব অনুরোধ করল যাতে স্যার এক কাপ চা খেয়ে যান। কিন্তু মিসির আলি বসলেন না। তাঁর প্রচণ্ড মাথা ধরেছে। প্যারাসিটামল কাজ করছে না। সারা জীবন তিনি এত অষুধ খেয়েছেন যে অষুধ তাঁর ওপর এখন আর কাজ করে না। খুব খারাপ লক্ষণ।