৭
নীলু ইউনিভার্সিটি থেকে ফিরে এসে দেখে তার বিছানার উপর চমৎকার একটি প্যাকেট পড়ে আছে। ব্রাউন কাগজে মোড়া প্যাকেটে গোটা-গোটা করে তার নাম লেখা। নীলুর বুক কেঁপে উঠল, বিলুর চোখে পড়ে নি তো? বিলুর খুব খারাপ অভ্যাস আছে, অন্যের চিঠি খুলে খুলে পড়বে। হাসাহাসি করবে।
নীলু দরজা বন্ধ করেই প্যাকেটটি খুলল। ছোট্ট চিঠি, কিন্তু কী চমৎকার করেই-না লেখা:
কল্যাণীয়াসু,
ইচ্ছা করেই তোমাকে আমি কম লিখি। তোমার চিঠি পড়ে-পড়ে খুব মায়া জন্মে যায়। এ বয়সে আমার আর মায়া বাড়াতে ইচ্ছা করে না। মায়া বাড়ালেই কষ্ট পেতে হয়। আরেকটি সামান্য উপহার পাঠালাম। গ্রহণ করলে খুব খুশি হব।
আহমেদ সাবেত
উপহারটি বড় সুন্দর। নীল রঙের একটি ডায়েরি। অসম্ভব নরম প্লাস্টিকের কভার, যেখানে ছোট্ট একটি শিশুর ছবি। পাতাগুলো হালকা গোলাপী। প্রতিটি পাতায় সুন্দর-সুন্দর দু’ লাইনের কবিতা। ডায়েরিটির প্রথম পাতায় ইংরেজিতে লেখা :
‘I wish I could be eighteen again’
A. S.
পড়তে গিয়ে কেন জানি নীলুর চোখে জল এল। এক জন সম্পূর্ণ অজানা-অচেনা মানুষের জন্যে মন কেমন করতে লাগল। লোকটি দেখতে কেমন কে জানে? সুন্দর নয় নিশ্চয়ই। বয়স্ক মানুষ, হয়তো চুলটুল পেকে গেছে। তাতে কিছু যায় আসে না। মানুষের বয়স হচ্ছে তার মনে। মন যত দিন কাঁচা থাকে, তত দিন মানুষের বয়স বাড়ে না। এই লোকটির মন অসম্ভব নরম। শিশুর মতো নরম। নীলুর মনে হল এই লোকটি স্বামী হিসেবে অসাধারণ ছিল। তার স্ত্রীকে সে নিশ্চয়ই সমস্ত হৃদয় দিয়ে ভালবেসেছে।
নীলু রাতের বেলা দরজা বন্ধ করে দীর্ঘ একটা চিঠি লিখল—আপনি এমন কেন? নিজের কথা তো কিছুই লেখেন নি! অথচ আমি আমার সমস্ত কথা লিখে বসে আছি। তবু মনে হয় সব বুঝি লেখা হল না। অনেক কিছু বুঝি বাকি রয়ে গেল। আপনি আমাকে এত সুন্দর-সুন্দর উপহার দিয়েছেন, কিন্তু আমি তো আপনাকে কিছুই দিই নি। আমার কিছু-একটা দিতে ইচ্ছা করে। কিন্তু আমি তো জানি না আপনি কী পছন্দ করেন। আচ্ছা, আপনি কি টাই পরেন? তাহলে লাল টকটকে একটা টাই আপনাকে দিতে পারি। জানেন, পুরুষমানুষের এই একটি জিনিসই আমি পছন্দ করি। কিন্তু হয়তো আপনি টাই পরেন না, ঢিলেঢালা ধরনের মানুষদের মতো চাদর গায়ে দেন। আপনার সম্পর্কে আমার খুব জানতে ইচ্ছে করে। এক দিন আসুন না আমাদের বাসায়, এক কাপ চা খেয়ে যাবেন। জানেন, আমি খুব ভালো চা বানাতে পারি। অন্য কেউ চা বানিয়ে দিলে আমার বাবা খেতে পারেন না। সব সময় আমাকে বানাতে হয়। গত রোববারে কী হল, জানেন? রাত তিনটেয় বাবা আমাকে ডেকে তুলে বললেন—মা, এক কাপ চা বানা তো, বড্ড চায়ের তৃষ্ণা পেয়েছে।
‘আপা, দরজা বন্ধ করে কী করছ?’
নীলু অপ্রস্তত হয়ে দরজা খুলল। বিলু দাঁড়িয়ে আছে। সন্দেহজনকভাবে তাকাচ্ছে।’কী করছিলে?’
‘কিছু করছিলাম না।’
বিলু বিছানায় এসে বসল, ‘আপা, তোমার মধ্যে একটা পরিবর্তন লক্ষ করছি।’
‘কী পরিবর্তন?’
‘অস্থির-অস্থির ভাব। লক্ষণ ভালো না আপা। বল তো কী হয়েছে?’
‘কী আবার হবে? তোর শুধু উল্টোপাল্টা কথা।’
‘কিছু-একটা হয়েছে আপা। আমি জানি।’
‘কী যে বলিস!’
‘আমার কাছে লুকোতে পারবে না আপা। আমার চোখকে ফাঁকি দেওয়া মুশকিল।’
‘যা ভাগ, পাকামো করিস না।’
বিলু গেল না। কাপড় ছাড়তে ছাড়তে বলল, ‘রানু আপাকেও আমি বললাম তোমার পরিবর্তনের কথা। তারও ধারণা, তুমি কারো প্রেমে পড়েছ।’
‘হুঁ, আমার তো খেয়েদেয়ে কাজ নেই। তা ছাড়া প্রেমটা আমার সঙ্গে করবে কে? চেহারার এই তো অবস্থা।’
‘খারাপ অবস্থাটা কী? রঙটা একটু ময়লা। এ ছাড়া আর কি?’
নীলু ছোট্ট একটি নিঃশ্বাস ফেলল।
‘নিঃশ্বাস ফেলছ কেন আপা? নিজের চেহারা সম্পর্কে তোমার এমন খারাপ ধারণা থাকা উচিত না। সবাই তো আর রানু আপার মতো হয় না, হওয়া উচিত নয়।’
‘উচিত নয় কেন?’
‘সুন্দরী মেয়েদের অনেক রকম প্রবলেম থাকে।’কী প্রবলেম?’
‘রানু আপার মাথা খারাপ–সেটা তুমি জান?’
‘কী বলছিস এ-সব!’
‘ঠিকই বলছি। আকবরের মা একদিন দুপুরে কি জন্যে যেন গিয়েছিল, শোনে রানু আপা নিজের মনে হাসছে এবং কথা বলছে।’
‘তাই নাকি?’
‘হ্যাঁ। কথাগুলো বলছে আবার দু’ রকম গলায়। আকবরের মা প্রথম ভেবেছিল কেউ বোধহয় বেড়াতে এসেছে। শেষে ঘরে ঢুকে দেখে কেউ নেই।’
‘সত্যি?’
‘হুঁ। রহমান সাহেবের স্ত্রী বললেন, একদিন নাকি আনিস সাহেব গভীর রাতে রহমান সাহেবকে ডেকে নিয়ে গেলেন তাঁর স্ত্রীর খুব অসুখ, এই কথা বলে। রহমান সাহেব গিয়ে দেখেন অসুখটসুখ কিচ্ছু নেই, দিব্যি ভালো মানুষ।’
নীলু মৃদু স্বরে বলল, ‘রানুর মতো সুন্দরী হলে আমি পাগল হতেও রাজি।’
বিলু হেসে ফেলল। হাসতে-হাসতে বলল, ‘কথাটা ঠিক বলেছ আপা।’
.
রানু প্রসঙ্গে পাওয়া সব তথ্য লিখে রাখবার জন্যে মিসির আলি সাহেব মোটা একটা খাতা কিনে এনেছেন। খাতাটির প্রথম পাতায় লেখা-
‘এক জন মানসিক রুগীর পর্যায়ক্রমিক মনোবিশ্লেষণ।’ দ্বিতীয় পাতায় কিছু ব্যক্তিগত তথ্য। যেমন—
নাম : রানু আহমেদ।
বয়স : সতের বৎসর (রূপবতী)।
বৈবাহিক অবস্থা : বিবাহিতা। (তের মাস আগে বিয়ে হয়)।
স্বাস্থ্য : রুগ্ণা।
ওজন : আশি পাউণ্ড।
স্বামী : আনিস আহমেদ। দি জেনিথ ইন্টারন্যাশনালের ডিউটি অফিসার। বয়স ৩৭। স্বাস্থ্য ভালো।
তৃতীয় পাতার হেডিংটি হচ্ছে—’অডিটরি হেলুসিনেশন।’ এর নিচে লাল কালি দিয়ে একটা বড় প্রশ্নবোধক চিহ্ন আঁকা। এই পাতায় অনেক কিছুই লেখা হয়েছে, আবার কাটাকুটি করা হয়েছে। যেন মিসির আলি সাহেব মনস্থির করতে পারছেন না কী লিখবেন। দু’টি লাইন শুধু পড়া যায়। লাইন দু’টির নিচে লাল কালি দিয়ে দাগ দেওয়া।
‘মেয়েটি অডিটরি হেলুসিনেশন হচ্ছে : সে একা থাকাকালীন শুনতে পায় কেউ যেন তাকে ডাকছে।’
পরের কয়েকটি পাতায় রানুর সঙ্গে তাঁর প্রথম সাক্ষাতের খুটিনাটি প্রতিটি বিষয় লেখা। এ পাতাগুলি পড়লেই বোঝা যায়, মিসির আলি নামের এই লোকটির স্মৃতিশক্তি অসাধারণ। অতি তুচ্ছ ব্যাপারগুলিও লেখা আছে। যেমন, এক জায়গায় লেখা— মেয়েটি বেশ কয়েক বার শাড়ির আঁচল টেনেছে। দু’ বার শব্দ করে আঙুল ফুটিয়েছে। আমি লক্ষ করলাম মেয়েটি পানি খেল মাথা নিচু করে। বেশ খানিকটা নিচু করে। যেন পানি পান করার ব্যাপারটি সে আড়াল করতে চায়।
নদীতে গোসলের গল্পটি লেখা আছে। গল্পের শেষে বেশ কিছু প্রশ্ন করা আছে। যেমন—
* এক জন মৃত মানুষ পানিতে ভেসে থাকবে। ডুবে থাকবে না। গল্পে মৃত মানুষটির ডুবে-ডুকে চলার কথা আছে। এ-রকম থাকার কথা নয়।
* পাজামা খুলে ফেলার কথা আছে। কিশোরীরা সাধারণত শক্ত গিট দিয়ে পাজামা পরে। গিট খুলতে হলে ফিতা টানতে হবে। ঐ মানুষটি কি ফিতা টেনেছিল, না পাজামাটাই টেনে নামিয়েছে?
* মৃত লোকটির কি কোনো পোস্ট মর্টেম হয়েছিল?
* তার আনুমানিক বয়স কত ছিল?
* প্রথম অসুস্থতার সময় কি মেয়েটি ঘুমের মধ্যে কোনো কথাবার্তা বলত? কী বলত?
*মেয়েটি বলল লোকটির নাম জালালউদ্দিন। কীভাবে বলল? লোকটির নাম তো জানার কথা নয়। নাকি পরে শুনেছে?
* জালালউদ্দিন-জাতীয় নামের কারো সঙ্গে কি এই মেয়েটির পূর্বপরিচয় ছিল?
প্রশ্নের শেষে তিনটি মন্তব্য লেখা আছে। মন্তব্যগুলি সংক্ষিপ্ত। প্রথম মন্তব্য—মেয়েটি যে-ঘটনার কথা বলেছে, তা বিশ্বাসযোগ্য নয়। দ্বিতীয় মন্তব্য—এই ঘটনা অন্য যে-সব ব্যক্তি প্রক্ষ করেছে তাদের সঙ্গে প্রথমে আলাপ করতে হবে। দ্বিতীয় মন্তব্যটি লাল কালি দিয়ে আন্ডারলাইন করা ও পাশে লেখা—অত্যন্ত জরুরি। তৃতীয় মন্তব্য—মেয়েটির অবশ্যই কিছু পরিমাণ এক্সট্রাসেন্সরি পারসেপশন আছে। সে কার্ডের সব ক’টি চিহ্ন সঠিকভাবে বলতে পেরেছে। আমি এ-রকম আগে কখনো দেখি নি। এই বিষয়ে আমার ধারণা হচ্ছে, মানসিকভাবে অসুস্থ রুগীদের এই দিকটি উন্নত হয়ে থাকে। আমি এর আগেও যে ক’টি অসুস্থ মানুষ দেখেছি, তাদের সবার মধ্যেই এই ক্ষমতাটি কিছু পরিমাণে লক্ষ করেছি। দি জার্নাল অব প্যারাসাইকোলজির তৃতীয় ভল্যুমে (১৯৭৩) এই প্রসঙ্গে রিভিউ পেপার আছে। অথর জন নান এবং এফ টলম্যান!