দেবী আথেনার প্রত্ন-রহস্য
০১.
মার্চ মাসের মাঝামাঝি এক রবিবারের সকাল। ইলিয়ট রোড এলাকায় কর্নেলের অ্যাপার্টমেন্টে যথারীতি আড্ডা দিচ্ছিলুম। সোফার এক কোণে বসে প্রাইভেট ডিটেকটিভ কৃতান্তকুমার হালদার অর্থাৎ আমাদের প্রিয় হালদারমশাই খবরের কাগজ পড়ছিলেন। তার ডান হাতের আঙুলে একচিমটে নস্যি।
কর্নেল তার লেখার টেবিলে টাইপ করতে ব্যস্ত ছিলেন। অনুমান করা সোজা, তিনি নিশ্চয়ই কোনও বিরল প্রজাতির প্রজাপতি অথবা পাখির অঙ্গপ্রত্যঙ্গ নিয়ে প্রবন্ধ লিখছেন। তাঁর এইসব লেখা বিদেশি পত্রপত্রিকায় ছাপা হয় এবং শুনেছি কমপক্ষে একশো ডলারও দক্ষিণা পেয়ে থাকেন। তাই তাকে এসব সময় বিরক্ত করি না।
একটু পরে খবরের কাগজ রেখে হালদারমশাই নস্যি নিলেন এবং রুমালে নাক মুছে বললেন–জয়ন্তবাবুরে একখান কথা জিগাই।
বললুম–বলুন হালদারমশাই।
হালদারমশাই একটু হেসে বললেন–পথের মধ্যে কোনও কোনও মানষেরে দেখলে য্যান চেনা লাগে। একইরকম চেহারা, তার লগে কথা কইলেই দেখি সে আমার চেনা না। আপনার এরকম কখনও হয় নাই?
বললুম–হয়নি মানে! প্রায়ই হয়। এই সেদিনই তো প্রেসিডেন্সি কলেজের ফুটপাতে একটি মেয়েকে দেখে যেই বলেছি–আরে অক্ষি যে! কেমন আছ! অমনি মেয়েটি চোখ কটমট করে তাকিয়ে বলল–আপনি ভুল করছেন। পথ ছাড়ুন। বেগতিক দেখে কেটে পড়লুম। বলা যায় না মেয়েদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করছি ভেবে পিট্টি দেবার জন্য আজকাল রাস্তায় লোকেরা তো তৈরি হয়েই আছে।
হালদারমশাই বললেন–পঁয়ত্রিশ বৎসর পুলিশে চাকরি করছি। অনেক সময়ে দেখছি দাগি ক্রিমিনাল চেহারার মিল দেইখা সাবইনস্পেকটররা এক্কেরে ভালো মানষেরে ধইরা আনছে। একবার আমি নিজে একজনেরে ধরছিলাম। পরে জানা গেল সে লোকাল এম এল এ-র পোলা। বোঝেন কাণ্ড। আমার তো চাকরি যায়-যায়-অবস্থা।
এই সময় দেখলুম কর্নেল টাইপ করা শিটগুলি গুটিয়ে একটা খামে ভরছেন। তার দাঁতে কামড়ানো চুরুট। সাদা দাড়িতে একটুরো ছাই আটকে আছে। খামটা ড্রয়ারে ভরে উঠে দাঁড়াতেই ছাইয়ের টুকরোটা খসে পড়ল। তারপর তিনি এক সোফার কাছাকাছি তার ইজিচেয়ারে এসে বসলেন। মুখে মিটিমিটি হাসি। তিনি বললেন–হালদারমশাই তা হলে জয়ন্তদের দৈনিক সত্যসেবক পত্রিকার খবরটা পড়েছিলেন!
প্রাইভেট ডিটেকটিভ বললেন–হ্যাঁ কর্নেল স্যার, হেডিং দিছে গিয়া ভুলের মাসুল। খবরটা এমনিতে কিছু না, কিন্তু ভদ্রলোক চেনা লোক ভাই এক মাতালের লগে ভাব করতে গিয়া ঘুসি খাইলেন।
আমি বললুম–আমাদের কাগজে জায়গা ভরাট করার জন্য ওই ধরনের আজেবাজে খবর ছাপা হয়। তবে–
কর্নেল আমার কথার ওপর বললেন,-তবে তুমি নিজেদের কাগজের খবর নিজে কখনও পড় না সেটা স্পষ্ট। যাই হোক, খবরটা কিন্তু খুব ইন্টারেসটিং।
কর্নেলের কথা শুনে হালদারমশাই-এর সামনে থেকে কাগজটা টেনে নিলুম। তারপর খুঁজে বের করে চোখ বুলিয়ে নিয়ে বললুম–এটা নির্ঘাত আমাদের নতুন রিপোর্টার তরুণের লেখা খবর। কারণ পার্ক স্ট্রিটে মুনলাইট বারে সে আড্ডা দিতে যায়, তা আমি জানি। মাতালরা অনেক সময়ই একটুতেই মারামারি শুরু করে দেয়। এ তো শুধু একটা ঘুসির ওপর দিয়ে গেছে।
কর্নেল মুখে তেমনি হাসি রেখে বললেন–বলেছি ব্যাপারটা ইন্টারেসটিং, তার প্রমাণ এখনি হয়তো পেয়ে যাবে। দোতলায় লিন্ডাদের কুকুরটা খুব চাঁচামেচি করছে শুনছে পাচ্ছি। এ বাড়িতে নতুন কেউ এলে টমি খাপ্পা হয়ে ওঠে।
এই সময়েই বেল বেজে উঠল। কর্নেল যথারীতি হাঁক দিলেন-ষষ্ঠী! একটু পরে ষষ্ঠীচরণ এক ভদ্রলোককে ড্রয়িং রুমে নিয়ে এল। বয়সে তিনি প্রৌঢ়। পরনে সাফারি স্যুট। গায়ের রং উজ্জ্বল। হাতে একটা ব্রিফকেস। কিন্তু তারপরই চোখে পড়ল তার বাঁ-চোখের নীচে একটুখানি জায়গা লাল হয়ে আছে। অমনি চমকে উঠলুম। তা হলে এই ভদ্রলোকই কি কাল মুনলাইট বারে কোনও মাতালকে চেনা ভেবে আলাপ করতে গিয়ে ঘুসি খেয়েছিলেন!
ভদ্রলোক কর্নেলের দিকে হাত বাড়িয়ে বললেন–হ্যালো কর্নেল সরকার। আশা করি এক মিনিটও দেরি করিনি।
কর্নেল উঠে দাঁড়িয়ে তার সঙ্গে হ্যান্ডশেক করে বললেন–বসুন মি. সোম। এইমাত্র আমরা আপনার ঘটনাটা নিয়ে আলোচনা করছিলুম। না, আমি নিজে থেকে কিছু বলিনি। কাল সন্ধ্যার ঘটনাটা দৈনিক সত্যসেবক পত্রিকাই ভুলের মাসুল শিরোনামে ছেপেছে।
ভদ্রলোক সোফায় বসে প্রথমে হালদারমশাই পরে আমাকে একবার দেখে নিলেন। কর্নেল বললেন–হ্যাঁ, আলাপ করিয়ে দিই। উনি প্রাক্তন পুলিশ ইনস্পেকটর এবং বর্তমানে একজন নামকরা প্রাইভেট ডিটেকটিভ মি. কে কে হালদার। আর আমার এই তরুণ বন্ধুর নাম জয়ন্ত চৌধুরী। সত্যসেবক পত্রিকার স্পেশাল রিপোর্টার। আর হালদারমশাই, ইনি হলেন মি. শিলাদিত্য সোম, বিহারের ছোটনাগপুর অঞ্চলে এঁর একটা কারখানা আছে। কলকাতায় এঁর হেড অফিস। মাঝে মাঝে আসেন। আমি গত বছর রায়ডিহিতে মি. সোমের বাংলোবাড়িতে কয়েকদিন কাটিয়েছিলাম। পাহাড়-জঙ্গল মিলে এলাকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অসাধারণ।
ষষ্ঠীচরণ ট্রেতে কফি আর স্ন্যাক্স এনে সেন্টারটেবিলে রেখে গেল। কর্নেল বললেন–কফি খান মি. সোম। কফি স্নায়ুকে চাঙা করে। বিশেষ করে আপনার যা ধকল গেছে তা আমি বুঝতে পেরেছি।
আমরা কফি পানে মন দিলুম। মি. সোম আমার দিকে ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে একটু হাসবার চেষ্টা করে বললেন–খবরটা কি আপনিই লিখেছেন?
ঝটপট বললুম–মোটেই না মি. সোম। একে আমার মদ্যপানের অভ্যাস নেই, তার ওপর আমি কাজ করি সিরিয়াস কেসে।
মি. সোম কফিতে চুমুক দিয়ে গম্ভীর মুখে বললেন–মদ্যপানের অভ্যাস আমারও তত নেই, কিন্তু কাল পার্ক স্ট্রিটে বড্ড জ্যাম ছিল। আমার গাড়ি মুনলাইট বারের পাশেই আটকে গিয়েছিল। সেই সময়ই হঠাৎ দেখি আমার আবাল্য পরিচিত এক বন্ধু রাজকুমার মিত্র বারের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। এই ফাঁকে বলা উচিত প্রায় চার-পাঁচ বছর তার সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ হয়নি। এখন সে দাড়ি রেখেছে, তা হলেও অত চেনামুখ আমার ভুল হবার কথা নয়। বিশেষ করে ওর নাকের বাঁ-দিকে সেই আঁচিলটা অবিকল আছে। আমি তক্ষুনি ড্রাইভারকে ফুটপাত ঘেঁষে গাড়ি রাখতে বলে নেমে গেলুম। বারের দিকে এগোতেই সে ভেতরে ঢুকে গেল। আমিও ভেতরে ঢুকে তাকে খুঁজতে থাকলুম। আপনারা তো জানেন, বারের ভেতরে আলো খুব কম থাকে। একটু এগিয়ে যেতেই দেখলুম রাজু কোণের দিকে বসে আছে। আমি সোজা গিয়ে তার সামনে বসলুম। তারপর বললুম–রাজু তুমি এতদিন ছিলে কোথায়? আর মুখেই-বা দাড়ি রেখেছ কেন? অমনি সে বিকৃত মুখে বলল–কে মশাই আপনি আমাকে রাজু-রাজু করছেন? আমি আপনার রাজু নই। হাসতে হাসতে বললুম–কী আশ্চর্য! তুমি আমার সঙ্গে এমন বেয়াড়া রসিকতা করছ কেন? সেই সময় ওয়েটার তাকে এক পেগ হুইস্কি দিয়ে গেল এবং আমার দিকে তাকাল। আমি অগত্যা বললুম–রাজু যা খাচ্ছে তা-ই আমাকে দাও। রাজু গ্লাসে চুমুক দিয়ে ক্রুদ্ধ চোখে বলল–দেখুন আপনি ভুল করছেন। আমি রাজু নই। আমিও গ্লাসে চুমুক দিয়ে বললুম–আলবত তুমি রাজু। দাড়ি রাখলে কী হবে? দেখামাত্র চিনেছি। আশা করি তুমি পুলিশের ভয়ে গা ঢাকা দিয়ে বেড়াচ্ছ না। কথাটা পরিহাস করেই বলেছিলাম। কিন্তু রাজু সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়িয়ে আমার মুখে। প্রচণ্ড জোরে ঘুসি মারল। আমার হাতের গ্লাস পড়ে গিয়ে ভেঙে গেল। চেয়ার উল্টে আমি নীচে পড়ে গেলুম। দুজন ওয়েটার দৌড়ে এসে আমাকে ওঠাল। রাজু তখনও তর্জনগর্জন করছে। সেই সময়ই–কী আর বলব! চারদিকে মাতালের ভিড়; তারা তুমুল হল্লা করতে লাগল–বের করে দাও বের করে দাও।
একটানা এতগুলো কথা বলার পর মি. সোম ক্লান্ত হয়ে উঠেছিলেন। কর্নেল তাঁকে বললেন–ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছি। আপনি যদি সেন্টপার্সেন্ট শিওর হন যে সেই লোকটাই আপনার একসময়ের বন্ধু রাজকুমার মিত্র –
মি. সোম তার কথার ওপর বললেন–আপনাকে তো গত রাত্রে টেলিফোনে সবই বলেছি। রাজুর কলকাতায় এক বিধবা দিদি থাকে শ্যামবাজার এলাকায়। বার থেকে বেরিয়ে গাড়ি নিয়ে তখনই সেই বাড়িতে গিয়েছিলুম। ওর বিধবা দিদি সুজাতা দেবী বললেন–রাজু সকালে তার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল। সে মুখে দাড়ি রেখেছে। তাকে বলে গেছে যদি কেউ তার খোঁজ করে সে যেন বলে আমি লাখখাঁটিয়াজির বাড়িতে উঠেছি। শুধু এইটুকু বললেই হবে। সুজাতা দেবী এই লাখখাঁটিয়াজিকে চেনেন না বা তার ঠিকানাও জানেন না–এটাই সমস্যা।
প্রাইভেট ডিটেকটিভ গুলিগুলি চোখে তাকিয়ে কথা শুনছিলেন। উত্তেজনায় যথারীতি তার সরু গোঁফের সূক্ষ্ম ডগা তিরতির করে কাঁপছিল। আমি জানি হালদারমশাই উত্তেজনার চোটে যখন চোয়ালের দাঁতে দাঁত ঘষেন তখন গোঁফের ডগা ওইরকম কঁপে। তিনি বললেন মি. সোম, ভেরি ভেরি মিস্টিরিয়াস কেস। চেনা লোক যখন শুধু অচেনা হইয়া যায় না, বরং ফেরোসাস হইয়া উঠে তখন বুঝতে হইব তার পিছনে কোনও গণ্ডগোল আছে। কী কন কর্নেল স্যার?
কর্নেল বলেন–আপনি ঠিকই বলেছেন হালদারমশাই। আপনি একজন অভিজ্ঞ প্রাক্তন পুলিশ অফিসার। রিটায়ার করে প্রাইভেট ডিটেকটিভ এজেন্সি খুলেছেন; কাজেই এ ধরনের কেস আগেও হাতে নিয়েছেন।
–হঃ, ঠিক এইরকম একখান কেস পাইছিলাম। সেই লোকটা এক কোম্পানির লক্ষাধিক টাকা হাতাইয়া আত্মগোপন করছিল।
কর্নেল একটু হেসে বললেন–মি. সোম, আপনি আপাতত একটা কাজ করুন। আপনার উদ্দেশ্য যখন আপনার বন্ধুর রাজকুমার মিত্রের এই অদ্ভুত আচরণের কারণ জানা, তখন আপনি মি. হালদারের সঙ্গে কন্ট্রাক্ট করে নিন। তত বেশি টাকার ব্যাপার নয়।
মি. সোম হতাশ ভঙ্গিতে বললেন–তা হলে কি কর্নেলসাহেবের কাছ থেকে সরাসরি কোনও সাহায্য পাব না।
কর্নেল বললেন–না না, সাহায্য আপনি নিশ্চয়ই পাবেন, কিন্তু আগে আমার কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দরকার। হালদারমশায়ের হাত দিয়ে কিছু তথ্য পেলে তবেই আমি আপনার বন্ধুর ওই অস্বাভাবিক আচরণের সূত্র খুঁজে পাব।
মি. সোম একটু ইতস্তত করে বললেন–আমি একমাত্র আপনাকেই একটা গোপন কথা এই সূত্রে জানাতে পারি। প্লিজ জয়ন্তবাবু বা মি. হালদার যেন কিছু মনে না করেন।
আমরা দুজনে এক গলায় বললুম–না-না কিছু মনে করব না।
মি. সোম কর্নেলের দিকে অর্থপূর্ণ দৃষ্টে তাকালেন। কর্নেল উঠে দাঁড়িয়ে বললেন–চলুন আমার ছাদের বাগানে গিয়ে কথাটা বলবেন। দুজনে ড্রয়িং রুমের ভিতর দিয়ে হেঁটে শেষপ্রান্তে গিয়ে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে অদৃষ্ট হলেন।
হালদারমশাই চাপা স্বরে বললেন– যা-ই কন জয়ন্তবাবু, ভদ্রলোকরে আমার সুবিধার ঠেকতাছে না।
আমি বললুম–এ নিয়ে মাথা ঘামাবেন না হালদারমশাই। এই সুযোগে কিছু টাকা কামিয়ে নিন, তা ছাড়া আপনিও তো কর্নেলের মতো রহস্যের পিছনে দৌড়তে ভালোবাসেন। এমনও হতে পারে কেঁচো খুঁড়তে সাপ বেরিয়ে আসবে।
কথাটা গোয়েন্দাপ্রবরের মনে ধরল। তিনি আস্তে বললেন–হঃ, ঠিক কইছেন। একটু পরে কর্নেল এবং মি. সোম ফিরে এলেন। তারপর কর্নেল ইজিচেয়ারে বসে বললেন, হালদারমশাই, আপনি যেখানে যান আপনার সঙ্গে তো আপনার ডিটেকটিভ এজেন্সির কন্ট্রাক্ট ফর্ম থাকে, সেই ফর্ম বের করুন।
হালদারমশাই প্যান্টের পকেট থেকে ভাঁজ করা একটা কাগজ বের করলেন। কাগজটা মাঝামাঝি ছেঁড়ার ব্যবস্থা আছে। তিনি তার ক্লায়েন্টের নামধাম লেখার পর নীচের অংশে আবার সেইগুলো লিখলেন। তারপর মি. সোমের দিকে তাকালেন।
মি. সোম পকেট থেকে পার্স বের করে বললেন–আপনাকে আমি পাঁচ হাজার। টাকা দেব। এখন পাঁচশো টাকা অগ্রিম দিচ্ছি।
কন্ট্রাক্ট ফর্ম দুজনে সই করার পর একটা অংশ ছিঁড়ে হালদারমশাই তার মক্কেলকে দিলেন। অন্য অংশটা ভাজ করে নিজের পকেটে রাখলেন। তখন মি. সোমের হাত থেকে পাঁচশো টাকা নিয়ে বললেন–মিস্ট্রি আমি সলভ করুম। এ পর্যন্ত আমি কোথাও ব্যর্থ হই নাই।
মি. সোম ব্রিফকেস হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়ালেন। তারপর বললেন–আমি এখন দু-দিন কলকাতায় আছি। তারপর আমি রায়ডিহিতে ফিরে যাব। মি. হালদার। আমার এই নেমকার্ডটা রাখুন।
নেমকার্ড দিয়ে তিনি পা বাড়ালেন, কর্নেল তাকে বিদায় দিতে এগিয়ে গেলেন।
হাসতে হাসতে বললুম–আপনার সৌভাগ্য হালদারমশাই। দিব্যি একখানা কেস হাতে পেয়ে গেলেন। আপনার মক্কেলটিও পয়সাওয়ালা।
প্রাইভেট ডিটেকটিভ চুপিচুপি বললেন–কী এমন গোপন কথা যে আমার ক্লায়েন্ট আমারে কইলেন না। এ-ও একটা মিষ্ট্রি। কর্নেল ফিরে এসে বললেন হালদারমশাই আপনার কন্ট্রাক্ট ফর্মে রাজকুমার মিত্রের বিধবা দিদির ঠিকানা টুকেছেন তো!
-হঃ, টুকছি কর্নেল স্যার। কিন্তু আমার মক্কেল একটা গোপন কথা আমারে না কইয়া আপনারে কইলেন। এটা কেমন যেন ঠেকতাছে।
কর্নেল চুরুটের একরাশ ধোঁয়া ছেড়ে বললেন–কথাটা যথাসময়ে আপনি নিজেই জানতে পারবেন, যদি আপনি একটু চিন্তাভাবনা করে পা বাড়ান।
বার বার দেখে আসছি হাতে কেস পেলে গোয়েন্দাপ্রবর যেন আগের মতোই জাঁদরেল পুলিশ অফিসার হয়ে ওঠেন। তিনি উঠে দাঁড়িয়ে বললেন–কর্নেল স্যার তা হইলে আমি যাই গিয়া।
বলে তিনি সবেগে বেরিয়ে গেলেন। আমি বললুম–কর্নেল, আমার ধারণা রাজকুমার মিত্র কোনও অপরাধ করে ছদ্মবেশে গা ঢাকা দিয়ে আছেন। আপনি বরং লালবাজারে আপনার স্নেহভাজন ডি. সি. ডি. ডি. মি. অরিজিৎ লাহিড়ীকে ফোন করে জেনে নিন। আমার ধারণা সত্য প্রমাণ হবে। আমার কথা শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গেই ডোর বেল বাজল। কর্নেল যথারীতি ডাক দিলেন-ষষ্ঠী।
ষষ্ঠীর সঙ্গে এসে গেলেন লালবাজারেরই ডিটেকটিভ ডিপার্টমেন্টের সাবইনস্পেকটর নরেশ ধর।
নরেশবাবুকে দেখে আমি বলে উঠলুম–আরে আসুন আসুন। এখনই আপনার বস লাহিড়ীসাহেবের কথা হচ্ছিল।
নরেশবাবু সোফায় ধপাস করে বসে বিমর্ষ মুখে বললেন–আর লাহিড়ীসাহেব! আমার এখন চাকরি যায়-যায় অবস্থা। বাঁচালে কর্নেল সাহেবই বাঁচাতে পারবেন।
কর্নেল জিজ্ঞাসা করলেন–কী হয়েছে নরেশবাবু?
নরেশবাবু বললেন–গড়ের মাঠে অর্থাৎ ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ডের পশ্চিমপ্রান্তে একটা ডেড বডি পাওয়া গেছে। মাথার পিছন দিকে গুলি করে কেউ তাকে খুন করেছে। মর্গের ডাক্তারের আপাতত মত ঘটনাটা ঘটেছে গত রাত্রে দশটা থেকে এগারোটার মধ্যে। অথচ কাল রাত্রে ঠিক ওই সময়ই একটা ডাকাতদলকে ধরার জন্য আমি সদলবলে কাছাকাছি ওত পেতে ছিলুম। আমার বস অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার মহেন্দ্রবাবুকে তো জানেন। তাঁর যোগ্য জুটি ওসি কন্ট্রোল প্রবালবাবু। দুজনেই আমার ওপর খাপ্পা। কর্নেল ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে ছিলেন। মৃদু স্বরে বললেন–ভিকটিমের চেহারা কেমন?
নরেশবাবু বললেন, মাঝারি গড়ন, বেশ বলিষ্ঠ দেহ। মুখে দাড়ি আছে।
কর্নেল দ্রুত বললেন–তার কাছে এমন কিছু কি পাওয়া গেছে, যাতে তাকে শনাক্ত করা যায়?
নরেশবাবু বললেন, তার পার্সে এক সুন্দরী মহিলার ছবি আর কয়েকটা চিঠি পাওয়া গেছে তার
কর্নেল, তার কথার ওপর বলে উঠলেন–তার নাম রাজকুমার মিত্র?
নরেশবাবু সশব্দে নড়ে বসলেন। বললেন–ওঃ মাই গড! আপনি দেখছি সত্যিই অন্তর্যামী। হা, আমার মন বলছিল এই অবস্থায় আপনার কাছে ছুটে যাই। যদি বাইচান্স আপনি কোনও হদিশ দিতে পারেন।
কর্নেল গম্ভীর মুখে বললেন–নরেশবাবু, আমি যা ভাবছিলাম ঠিক তা-ই ঘটে গেছে। যথাসময়ে আপনি সব শুনবেন। আপাতত চলুন যেখানে বডি পড়েছিল সেই জায়গাটা দেখে আসি। ওঠো জয়ন্ত। তোমার গাড়ি চেপেই আমরা বেরবো। নরেশবাবুর জিপের চেয়ে তোমার গাড়ি আরামদায়ক।
.
০২.
আমাদের গাড়ি ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের পাশ দিয়ে ঘুরে বিগ্রেড প্যারেড গ্রাউন্ডের উত্তর-পশ্চিম কোণে গিয়ে থামল। গাড়ি থেকে নেমে আমরা নরেশবাবুকে অনুসরণ করলুম। একটা খালের ধারে সারিবদ্ধ অজস্র গাছ। ততক্ষণে মাঠের রৌদ্র বেশ প্রখর হয়েছে। মাঠে উঠে নরেশবাবু বাঁ-দিকে একটা জায়গায় আমাদের নিয়ে গেলেন। এমন রাস্তায় কোনও লোক চলাচল নেই, শুধু গাড়ির মিছিল চলেছে। নরেশবাবু হাঁটু দুমড়ে বসে বললেন–কর্নেলসাহেব এই দেখুন ঘাসের ওপর এখনও কিছুটা রক্তের দাগ দেখা যাচ্ছে।
কর্নেল দেখে নিজে বললেন–ডেড বডিটা কী অবস্থায় পড়ে ছিল?
নরেশবাবু বললেন, একটু কাত হয়ে পড়েছিল। মাথাটা ছিল এইখানে, তাই রক্তের দাগ দেখা যাচ্ছে।
কর্নেল ঘাসের ওপর ঝুঁকে কী সব পরীক্ষা করার পর বললেন–এখানে মাটিটা নরম, তা ছাড়া ঘাসগুলোও এখনও মাটির সঙ্গে এখানে-ওখানে চেপ্টে গেছে।
বলে তিনি আরও কিছুক্ষণ এদিক-ওদিক ঘুরে দেখার পর আবার ঘাসের ওপর ঝুঁকে পড়লেন, বললেন–হ্যাঁ, আমার ধারণা ভুল নয়।
নরেশবাবু জিজ্ঞাস করলেন-আপনার কী ধারণা?
–আমার ধারণা রাজকুমার মিত্রকে অন্য কোথাও গুলি করে মেরে এখানে এনে তার ডেড বডিটা ফেলে দেওয়া হয়েছিল। কারণ, আপনিও লক্ষ করুন মানুষের দেহের আকারের সমান জায়গা জুড়ে ঘাসগুলো অল্পবিস্তর দেবে গেছে।
নরেশবাবু বললেন–আপনি ঠিকই বলেছেন। খুনিরা গাড়িতে করে ডেড বডি নিয়ে এসে রাস্তায় গাড়ি দাঁড় করিয়েছিল।
কর্নেল হঠাৎ একটা গাছের ফাঁক দিয়ে রাস্তায় ধারের খালের ওপর দাঁড়ালেন। খালটাতে এখন জল নেই। কোথাও কোথাও ফাঁকা আবার কোথাও কোথাও ঘাস আর খুদে ঝোপে ঢাকা আছে। কর্নেল ঝুঁকে পড়ে খানিকটা জায়গা পরীক্ষা করার পর সোজা হয়ে দাঁড়ালেন।
নরেশবাবু জিজ্ঞাসা করলেন–কী ব্যাপার?
কর্নেল বললেন–এখানে জুতোর দাগ বেশ স্পষ্ট। আপনিও দেখতে পারেন। যারা বডিটা এনেছিল, তাদের জুতোর ছাপ এখনও মিলিয়ে যায়নি। আমার ধারণা দুজন লোক বডিটা তুলে নিয়ে গিয়ে ফেলে দিয়েছিল।
আমি বললুম–কী করে বুঝলেন?
কর্নেল গম্ভীর মুখে বললেন–জুতোর সোলের ছাপ দু-রকম। খালি চোখেই সেটা দেখা যাচ্ছে।
নরেশবাবু বললেন–কিন্তু তা হলে তো ওখান থেকে বডি যেখানে পড়েছিল সেই পর্যন্ত রক্তের দাগ থাকার কথা। সেভাবে কি রক্তের দাগ আছে?
কর্নেল একটু হেসে বললেন–খুনিরা বুদ্ধিমান। তাই সম্ভবত বডিটা তেরপল জাতীয় কোনও কাপড়ে জড়িয়ে এনে ফেলেছিল।
আমি বললুম–তারপর তারা রক্তমাখা তেরপল সঙ্গে করে নিয়ে গিয়েছিল।
এইসময় কর্নেল বাঁ-দিকে ঘুরে বাইনোকুলারে কী দেখছিলেন। বাইনোকুলার নামিয়ে তিনি সহাস্যে বললেন–জয়ন্ত তুমি সোজা উত্তর-পূর্ব ওই গাছগুলোর নীচে যাও। জিজ্ঞাসা করলুম–কেন?
নরেশবাবু কর্নেলকে জায়গাটা দেখিয়ে সেদিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলেন। হঠাৎ তিনি হন্তদন্ত হাঁটতে শুরু করলেন। জায়গাটার দূরত্ব আমার হিসেবে অন্তত দুশো মিটার।
অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিলাম। এতক্ষণে কর্নেল একটা চুরুট ধরালেন। তারপর মিটিমিটি হেসে বললেন–কী বুঝছ জয়ন্ত?
বললুম–বুঝতে পারছি খুনিরা খুব বোকা।
-বোকা না বুদ্ধিমান সেটা তুমি একটু পরেই বুঝতে পারবে। এইসময় দেখলুম নরেশবাবু হাত তুলে আমাদের ডাকছেন। আমরা তার কাছে গিয়ে দাঁড়ালুম। রেড রোড থেকে যে রাস্তাটা কোনাকুনি পার্ক স্ট্রিটের দিকে এগিয়ে গেছে, তার কাছাকাছি সারিবদ্ধ গাছের তলায় ঝোঁপঝাড়ের মধ্যে নরেশবাবু টুকরো করে কাটা সম্ভবত একটা তেরপল কুড়িয়ে একত্র করছিলেন। তিনি বললেন–কর্নেল আপনি ঠিকই বলেছিলেন। এই দেখুন সেই তেরপল, খুনিরা টুকরো টুকরো করে কেটে এখানে ফেলে গেছে। আর এই দেখুন, এই টুকরোগুলোতে চাপ চাপ রক্তের দাগ।
কর্নেল বললেন–ওগুলো কুড়িয়ে গাড়ির কাছে ফেরা যাক।
নরেশবাবু তাঁর জিপে জরাজীর্ণ তেরপলের পুঁটুলিটা রেখে দিলেন। বললেন–এগুলো ফরেনসিক ল্যাবে পাঠাতে হবে।
কর্নেল বললেন–তা হলে আর দেরি করবেন না। আপনি এক্ষুনি গিয়ে সেই ব্যবস্থা করুন।
নরেশবাবু বললেন–আপনারা কি এখান থেকে বাড়ি ফিরে যাবেন?
কর্নেল চুরুটের ধোঁয়ার মধ্যে বললেন–অনেকদিন গঙ্গা দর্শন করিনি। আগে একটু গঙ্গা দর্শন করে তারপর বাড়ি ফিরব।
নরেশবাবু সোজা রেড রোড ধরে চলে গেলেন। আমি বললুম–আমিও অনেকদিন গঙ্গা দর্শন করিনি।
কিন্তু আমাকে অবাক করে কর্নেল সামনে একটা বিশাল গাছের তলায় গিয়ে হাঁটু মুড়ে কী সব কুড়োতে থাকলেন। জিজ্ঞাসা করলুম-ওখানে কী কুড়োচ্ছেন? কর্নেল জবাব দিলেন না। একটু পরে বাঁ-হাতে প্যান্টের পকেট থেকে রুমাল বের করলেন। তারপর আমি কৌতূহলী হয়ে তার কাছে গেলুম। দেখলুম অনেকগুলো পোড়া ফিল্টার টিপড সিগারেটের টুকরো তিনি রুমালে বেঁধে নিলেন। হতবাক হয়ে ব্যাপারটা দেখছিলুম। কর্নেল গাড়ির কাছে এলে শুধু বললুম–আশ্চর্য!
হ্যাঁ, আশ্চর্যই বটে। গত রাত্রে এখানে দাঁড়িয়ে কেউ অন্তত এক প্যাকেট দামি সিগারেট টেনেছে।
বলে তিনি গাড়িতে সামনের সিটের বাঁ-দিকে বসলেন। আমি ডাইনের সিটে উঠে গাড়ি স্টার্ট দিলাম। তারপর বললুম–বাড়ি ফিরবেন তো?
কর্নেল বললেন–অবশ্যই। আপাতত ষষ্ঠীর হাতের এক কাপ কফি না খেলে আক্কেল গুড়ুম হয়ে যাবে।
কথাটা বলেই কর্নেল তাঁর বিখ্যাত অট্টহাসি হাসলেন। আমি এই হাসির কারণ জিজ্ঞাসা করলুম না। সোজা এগিয়ে ডাইনে ঘুরে পার্ক স্ট্রিটে পৌঁছলুম। তারপর ফ্রি-স্কুল স্ট্রিট হয়ে কর্নেলের অ্যাপার্টমেন্ট হাউসের ভিতরে ঢুকে গেলুম।
তিনতলায় কর্নেলের ডেরায় ঢুকে সোফায় ধপাস করে বসে পড়লুম। কর্নেল হাঁকলেন–ষষ্ঠী! কফি কিন্তু তাড়াতাড়ি চাই।
কর্নেলের ড্রয়িং রুমের দেয়াল ঘড়িতে তখন পৌনে বারোটা বেজেছে। একটু পরে ষষ্ঠীচরণ দু-পেয়ালা কফি রেখে গেল। কফি খাওয়া শেষ হলে কর্নেল টেবিলের ড্রয়ার থেকে চুরুটকেস বের করলেন। তারপর একটা চুরুট নিয়ে লাইটার জ্বেলে ধরানোর পর তিনি ইজিচেয়ারে চোখ বুজে বললেন–জয়ন্ত তুমি বলছিলে আশ্চর্য। সত্যি ব্যাপারটা আশ্চর্যই বটে। যে ওই গাছের তলায় দাঁড়িয়ে বা বসে এক প্যাকেট সিগারেট পুড়িয়েছে তার একটাই কারণ অনুমান করা যায়। দেখলুম সিগারেটের টুকরোগুলো কোনওটা আধখানা অবধি পোড়া, কোনওটা সিকিভাগ, আবার কোনওটা ফিল্টার টিল্ড অবধি পোড়া। আমি হিসাব করে বলে দিতে পারি এই বিদেশি সিগারেটগুলো মুঠ ধরে সে টেনেছে। জিজ্ঞাসা করলুম–সেই লোকটা কি রাজকুমার মিত্রের ডেড বডির জন্য অপেক্ষা করছিল?
–সম্ভবত। অন্তত যতক্ষণ না উল্টো কোনও প্রমাণ পাচ্ছি ততক্ষণ এমন ঘটনার সম্ভাবনার অনুপাত–৯০:১০।
কর্নেল, তেরপলটা খুনিরা অমন করে ছিঁড়ে গুটিয়ে ফেলে গিয়েছিল কেন?
-সোজা হিসেব। আস্ত তেরপল সঙ্গে নিয়ে যাওয়াও বিপদ ছিল। কারণ ও-তে রক্ত মাখা ছিল। তাই ওটা কোথাও ফেলে যাবার দরকার। কিন্তু আস্ত তেরপল। ফেলে গেলে লোকের চোখে পড়বে। ভবঘুরেরা ওটা কুড়িয়ে নেবে। তারপর রক্ত দেখে হইচই বাধাতেও পারে। তাই খুনিরা কোনও ঝুঁকি নেয়নি।
এইসময়ই টেলিফোন বাজল। কর্নেল চোখ খুলে সোজা হয়ে বসে রিসিভার তুলে সাড়া দিলেন। তারপর বললেন–বলুন হালদারমশাই।
—–
–হ্যাঁ, বলেন কী! সুজাতা দেবী তার ভাইয়ের খুনের খবর পেয়ে গেছেন? কীভাবে পেলেন তা কি জানতে পেরেছেন আপনি?
—–
–তা-ই বলুন, টেলিফোনে কেউ ওঁকে খবর দিয়েছে। কিন্তু উনি কি ভাইয়ের লাশ দেখতে গিয়েছিলেন?
——
-কী আশ্চর্য! উনি বডি শনাক্ত করে কান্নাকাটি কিছুই করেননি? একথা কি উনি আপনাকে বলেছেন?
—–
-ঠিক আছে। আচ্ছা একটা কথা, আপনি সুজাতা দেবীকে আপনার ক্লায়েন্ট মি. সোমের কথা জানাননি তো?
—–
-বাঃ, আপনি বুদ্ধিমানের মতো কাজ করেছেন। এক কাজ করুন, আপনি বাড়ি ফিরে যান। তারপর স্নানাহার করে নিয়ে বিকেল তিনটে চারটের মধ্যে আমার কাছে চলে আসুন। রাখছি।
কর্নেল রিসিভার রেখে আবার চেয়ারে হেলান দিয়ে চোখ বুজলেন।
অধীর আগ্রহে জিজ্ঞাসা করলুম-কর্নেল, হালদারমশাই সুজাতা দেবীর কাছে গিয়ে তার সঙ্গে আলাপ জমিয়েছেন মনে হল। কীভাবে আলাপ জমিয়েছেন তা বললেন না উনি?
কর্নেল গলার ভিতরে বললেন–সেটা তিনি এলে তার মুখেই জানতে পারব।
আমার ক্লান্তি এসেছিল, তাই সোফার কোলে আমিও হেলান দিলুম। কিছুক্ষণ পরে দেখলুম কর্নেল সোজা হয়ে বসে ড্রয়ার থেকে রুমাল বাঁধা সিগারেটের টুকরোগুলো বের করলেন। তারপর টেবিলে সেগুলো উচ্চতা অনুসারে সাজাতে থাকলেন। তারপর টেবিল থেকে একটা প্যাড নিয়ে কী সব লেখালেখি শুরু করলেন। আমি চুপচাপ তার এই অদ্ভুত ক্রিয়াকলাপ লক্ষ করছিলুম। প্রায় আধঘন্টা পরে তিনি সিগারেটের টুকরোগুলো একটা খামের ভেতর ভরে ড্রয়ারে ঢুকিয়ে রাখলেন।
এবার আমি সোজা হয়ে বসে হাসতে হাসতে বললুম–আপনি পারেনও বটে। আপনি কি সত্যিই হিসেব করছিলেন, লোকটা কতক্ষণ ধরে সিগারেট খেয়েছে? কর্নেল হাসলেন না, গম্ভীর মুখে বললেন–জয়ন্ত, মনে উদবেগ নিয়ে এই কিংসাইজ বিদেশি সিগারেট, ধরো–একটা সিগারেট টানতে কম পক্ষে দশ-বারো মিনিট লাগার কথা। আমি একটা সিগারেটগুলো ক্রমে ক্রমে লোকটা আরও দ্রুত টেনেছে। অত সিগারেট একসঙ্গে টানলে মাথা ঘোরা এবং জিভে জ্বালা হওয়া উচিত। তা সে যতই চেন স্মোকার হোক। তুমি হাসতে পার জয়ন্ত, কিন্তু এই বৃদ্ধ তার পাকাস্নায়ুর কল্যাণে সত্যে পৌঁছতেও পারে। লোকটা অন্তত তিন ঘন্টা ওই গাছতলাতে দাঁড়িয়ে বা বসে সিগারেট টেনেছিল।
আমি বললুম–অত রাত্রে ওখানে কেউ দাঁড়িয়ে থাকলে রাউন্ডে বেরোনো পুলিশের চোখে পড়ার কথা।
কর্নেল বললেন–ঠিক বলেছ, কিন্তু সে যদি টিপটপ পোশাক পরা কোনও ভদ্রলোক হয় এবং নীচে রাস্তায় তার গাড়ি দাঁড় করানো থাকে?
হতাশ হয়ে বললাম-ঠিক বলেছেন। পুলিশ তাকে ডিস্টার্ব করবে না।
বেলা দেড়টার মধ্যে স্নানাহার সেরে নিয়ে অভ্যাসমত আমি ড্রইং রুমের ডিভানে ভাতঘুম দেবার তালে ছিলুম। কর্নেল যথারীতি ইজিচেয়ারে বসে চোখ বুজে চুরুট টানছিল। একটু পরে দেখলুম তিনি টেলিফোনের রিসিভার তুলে ডায়াল করার পর কার সঙ্গে চাপা গলায় কথা বলছেন। জাদুঘর সদৃশ কর্নেলের এই ড্রয়িং রুমে বেশ প্রশস্ত। ডিভান থেকে কর্নেল অন্তত ফুট দশ-বারো দূরে বসে কথা বলছেন। কণ্ঠস্বর চাপা। তা ছাড়া দু-দুটো সিলিং ফ্যান যথাসাধ্য জোরে ঘুরছে। তার ফলে কান পেতেও শোনা যাচ্ছিল না, তিনি কার সঙ্গে কী কথা বলছেন। অগত্যা চিত হয়ে শুয়ে ভাতঘুমের চেষ্টায় মন দিলুম।
তারপর কখন ঘুমিয়ে গেছি কে জানে। ষষ্ঠীর ডাকে ঘুম ভাঙল। তার হাতে চায়ের কাপ প্লেট।
ষষ্ঠী হাসিমুখে বলল–বাবামশাই আর টিকটিকিবাবু চুপচাপ কিছুক্ষণ আগে বেইরে গেছেন। বলে গেছেন তোর দাদাবাবুকে চারটেয় চা দিবি।
উঠে বসে তার হাত থেকে চা নিয়ে বললুম–তোমার বাবামশাই নিশ্চয়ই আমার গাড়ি চুরি করে গেছেন?
ষষ্ঠী হাসতে হাসতে বলল-আজ্ঞে ঠিক ধরেছেন দাদাবাবু। আপনার ঘরে আপনার প্যান্ট ঝুলছে, তার পকেট থেকে বাবামশাই চুপিচুপি গাড়ির চাবি চুরি করছিলেন। আমি দেখে ফেলতেই উনি চোখ কটমটিয়ে তাকালেন। অমনি আমি কেটে পড়লুম।
এখানে একটা কথা বলার দরকার। কোনও ঘটনা ঘটলে যাতে আমি কর্নেলের কাছাকাছি থাকি, তাই উনি আমার জন্যে ওঁর বিশাল অ্যাপার্টমেন্টে একটা ঘর বরাদ্দ রেখেছেন। সেখানে আমার কয়েকপ্রস্থ পোশাক-আশাক, দাড়ি কাটা আর দাঁত মাজার সরঞ্জাম সব রাখা আছে।
এখন আমার পরনে পাঞ্জাবি আর পাজামা। চা শেষ করে ষষ্ঠীর হাতে কাপ প্লেট দিলুম। ষষ্ঠী এতক্ষণ চাপাস্বরে বলছিল, কীভাবে টিকটিকিবাবু অর্থাৎ প্রাইভেট ডিকেটটিভ হালদারমশই এসে কর্নেলকে উত্তেজিতভাবে কী সব বলেছেন এবং তারপর কর্নেল পোশাক বদলে আমার গাড়ির চাবি নিয়ে তার সঙ্গে বেরিয়ে গেছেন। ষষ্ঠী শুধু এইটুকু বুঝেছে কোথায়ও কিছু একটা ঘটেছে। যেখানে কর্নেলের তখনই না গেলে নয়।
ডিভান থেকে উঠে ফ্যান দুটোর সুইচ অফ করে আমি কর্নেলের শূন্যোদ্যান অর্থাৎ ছাদের বাগানে গেলুম। এই কিম্ভুতকিমাকার বাগান যেন অন্য কোনও গ্রহের। যত রাজ্যের বিদঘুঁটে ধরনের ক্যাকটাস, অর্কিড আরও সব ফুলন্ত ঝোপে ভর্তি। কিছুক্ষণ এখানে দাঁড়িয়ে থাকলে যতই ফুলের সৌন্দর্য থাক, কেমন যেন গা-ছমছম করে। একটা বেতের চেয়ার রাখাছিল। তাতে বসে আমি আকাশ দেখতে মন দিলাম। কিন্তু পাশের বাড়ির একটা প্রকাণ্ড নিম গাছে কাকের যা উপদ্রব, কান ঝালাপালা হয়ে উঠছিল। তবে ছাদের ওপর বেশ খোলামেলা বাতাস বইছিল। এ বাতাস প্রাকৃতিক। শেষ বেলার ফিকে রোদ ক্রমশ মিশে যাচ্ছিল। একটু পরে ষষ্ঠীচরণ এসে বলল-বাবামশাইরা এসে গেছেন। আমি এখন বাগানের সেবা করব। আপনি যান দাদাবাবু। বাবামশাইরা কফি খাচ্ছেন। আপনার কফিও ঢেকে রেখে এসেছি।
নেমে গিয়ে ড্রইং রুমে ঢুকে দেখি, হালদারমশাই ফুঁ দিয়ে কফি খাচ্ছেন। আর কর্নেল চাপাস্বরে তাকে কী যেন বোঝাচ্ছেন।
আমাকে দেখে গোয়েন্দাপ্রবর সহাস্যে বললেন–আয়েন, আয়েন জয়ন্তবাবু, বয়েন, ষষ্ঠীচরণ আপনার কফি রাখছে। সোফায় বসে কর্নেলের দিকে তাকালুম। তিনি মিটিমিটি হেসে বললেন–আজও তোমার গাড়ি চুরি করতে হয়েছিল। উপায় ছিল না। কারণ যে কাজটা করতে গিয়েছিলুম তাতে যথেষ্ট বিপদের ঝুঁকি ছিল। দরকার হলে দ্রুত কেটে পড়ার জন্য দ্রুতগতির বাহন পাওয়া ছিল অনিশ্চিত।
পাশ থেকে হালদারমশাই খি খি করে হেসে বললেন–আর কইবেন না। দিনদুপুরে মাইনষের বাড়ির তালা ভাইঙ্গা ঘরে ঢোকার ঝুঁকি কী সাঙ্ঘাতিক তা বুঝতেই পারছেন।
কফিতে চুমুক দিয়ে অবাক হয়ে বললুমকী সর্বনাশ! কর্নেল, ব্যাপারটা একটু খুলে বললে নিশ্চয়ই মহাভারত অশুদ্ধ হবে না।
কর্নেল হেসে উঠলেন। বললেন–ঠিকই বলেছ জয়ন্ত। ব্যাপারটা মহাভারতের মতোই জটিল। অবশ্য আমরা এখনও কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ পর্ব অব্দি পৌঁছতে পারিনি।
বিরক্ত হয়ে বললুম–ওহঃ কর্নেল! ব্যাপারটা একটু খুলে বলতে আর হেঁয়ালি করবেন না।
কর্নেল চুপচাপ কফি শেষ করার পর চুরুটা ধরালেন। ষষ্ঠী আগেই ঘরে আলো জ্বেলে দিয়ে গিয়েছিল। সেই আলোয় দেখলুম কর্নেল তাঁর প্যান্টের পকেট থেকে একগাদা ভাঁজ করা কাগজ বের করে টেবিলে রাখলেন। তারপর সেগুলোর ওপর পেপার ওয়েট চাপিয়ে রেখে মৃদুস্বরে বললেন–আমরা রাজকুমার রায়ের বিধবা দিদি সুজাতার ঘরের তালা ভেঙে এগুলো চুরি করে এনেছি। ঘরটা দোতলায়। সংকীর্ণ নির্জন একফালি পাঁচিল ঘেরা রাস্তা দিয়ে ঢুকে দোতলায় ওঠা যায়। নীচে একটা দরজা আছে। কিন্তু সেটার তালা সহজেই খুলে গিয়েছিল। গলির মোড়ে অষ্টপ্রহর সংকীর্তন চলছিল। একটা বটগাছের তলায়। লোকেরা তাই এদিকে কেউ ঘুরে তাকায়নি অবশ্য নীচের তলায় ভাড়াটেদের একটা মেয়েকে সুজাতার কথা জিজ্ঞাসা করলে সে বলেছিল–বাড়িউলি মাসি নিমতলা শ্মশানে ভাইয়ের মরা পোড়াতে গেছেন। ফিরতে অনেক দেরি হবে। মেয়েটি কীর্তনের আসরের দিকে চলে যাবার পর আমরা কাজে নেমেছিলাম।
বললুম–এই কাগজগুলো নিশ্চয়ই এই কেসে গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু আপনি কি মন্ত্রবলে জানতে পেরেছিলেন
বাধা দিয়ে হালদারমশাই বললেন–না জয়ন্তবাবু। আমি আইজ যখন সুজাতা দেবীরে মিট করি তখন তিনি টেবিলের নীচের ড্রয়ার খুলে এইগুলান দেখাইয়া কইছিলেন তাঁর ভাই রাজু একদিন কাগজ গুলান তাঁকে রাখতে দিয়া কইছিল–আমার যদি কোনও বিপদ হয় তুমি এগুলান পুলিশেরে দিয়ো। তখন আমি কইলাম–তা হইলে এখনও রাখছেন ক্যান? সুজাতা দেবী কইলেন–আমি এগুলান পড়ি নাই। আগে নিজে পড়ুম, তারপর দরকার বুঝলে পুলিশেরে দিমু। তখন ওনারে জিগাইলাম–ক্যান একথা কইতাছেন? উনি কইলেন–আমার লগে দাদা-বোন সম্পর্ক করছেন আপনি। তাই আপনারে কইতাছি। রাজু সারাজীবন অনেক খারাপ কাজ করছে আর আমারে তার ঝক্কি লইতে হইছে। কওন যায় না, এগুলানের মধ্যে আমারে জড়াইবার মতো কোনও কাগজ আছে কি না।
বললুম–কর্নেল, আপনার এই মার্কামারা চেহারা যদি দৈবাৎ কেউ দেখে থাকে সে সুজাতা দেবীকে নিশ্চয়ই সে কথা বলবে। কারণ দু-দুটো তালা আপনি ভেঙেছেন। সুজাতা পুলিশের কাছে রাগের চোটে এমন নালিশও করতে পারেন, আপনি তার ঘর থেকে সোনা-দানা হাতিয়েছেন।
কর্নেল তেমনি মিটিমিটি হেসে বললেন–আমাদের সৌভাগ্য জয়ন্ত। নীচের দরজার পাশে একটা প্রকাণ্ড নিম গাছ আছে। আর সুজাতার ঘরের অন্যদিকে একটা কারখানার উঁচু টিনের শেড। কাজেই আমাদের দুজনকে কেউ দেখতে পায়নি, এ বিষয়ে আমি শিওর। তা ছাড়া আমার কাছে একসেট মাস্টার-কি আছে, যেকোনও সাধারণ তালা এর যেকোনও একটা দিয়ে খুলে যায় এবং বন্ধও করা যায়। কাজেই আমার ধারণা, চুরি টের পেতে সুজাতা দেবীর সময় লাগবে। যাই হাক, এবার কাগজগুলোতে কী আছে দেখা যাক।
কিন্তু এইসময়ই ডোরবেল বেজে উঠল। কর্নেল অমনি ষষ্ঠী বলে হাঁক দিয়ে কাগজগুলো টেবিলের ড্রয়ারে লুকিয়ে ফেললেন।
ষষ্ঠী ততক্ষণে ছাদ থেকে নেমে এসেছিল। সে যাকে নিয়ে এল তিনি আর কেউ নন, লালবাজার গোয়েন্দা দফতরের এস. আই. নরেশ ধর। কর্নেল বললেন–আসুন নরেশবাবু, আমি আপনার প্রতীক্ষায় ছিলুম।
নরেশবাবু হাতে একটা ব্রিফকেস। তিনি সোফায় কর্নেলের কাছাকাছি বসে বললেন–ডি. সি. ডি. ডি. লাহিড়িসাহেব আপনাকে রিং করবেন তাকে আমি সব কথা খুলে বলেছি। রাজকুমার মিত্রের কাছে পাওয়া পাসটাও দেখিয়েছি। লাহিড়িসাহেব আমাকে বলেছেন-কর্নেল নিজের হাতের তাস হয়তো দেখাতে চাইবেন না। কিন্তু পুলিশের নিজের স্বার্থে আপনি ওই পার্সটা কর্নেলকে দেখাবেন। এসব ব্যাপার আমাদের মাথায় আসছে না। কর্নেলসাহেবের পাকা মাথায় তা আসতেও পারে।
বলে তিনি ব্রিফকেস খুলে একটা পুরু পেট মোটা পার্স কর্নেলের হাতে দিলেন। কর্নেল পার্সটা খুলেই বললেন–এ তো দেখছি প্রচুর টাকা ভর্তি।
নরেশবাবু বললেন–এক হাজার সাতশো চুরাশি টাকা, আর টাকা তিনেকের মতো কয়েন আছে। আপনি দ্বিতীয় চেনটা খুলুন।
কর্নেল পার্সটা সোজা করে ধরে বললেন–ওটা খুলছি। তার আগে প্রথম পৃষ্ঠাটা দেখে নি। রাজকুমারবাবু এক সুন্দরী ভদ্রমহিলার রঙিন ফোটো রেখেছেন। সম্ভবত ইনি তাঁর স্ত্রী অথবা প্রেমিকা।
নরেশবাবু বললেন–রাজকুমারবাবুর বয়স পঞ্চান্ন থেকে ষাটের মধ্যে। আর এই মহিলার বয়স পঁচিশ থেকে তিরিশ বছর। কাজেই একটা খটকা আছে। আপনি ছবিটা বের করে দেখুন। খটকা আরও বেড়ে যাবে। মহিলার নাম লেখা আছে।
কর্নেল ছবিটা সাবধানে বের করে টেবিলল্যাম্প জ্বেলে দিলেন। তারপর অভ্যাসমত আতস কাঁচ বের করে নামটা পড়ে বললেন–রঞ্জনা রায়। হ্যাঁ, খটকা বেড়ে গেল। তবে আজকাল মহিলারা কোনও পেশায় যুক্ত থাকলে পিতৃদত্ত নামই বহাল রাখেন। বিয়ের পরও পদবি বদলান না।
আমি উঁকি মেরে ছবিটা দেখছিলাম। এবার বললুম–কর্নেল এই ছবি তো আমি অনেক বিজ্ঞাপনে দেখেছি। ছবিটা আমার চেনা মনে হচ্ছে। নিশ্চয়ই ইনি বিজ্ঞাপনে মডেলিং করেন।
কর্নেল ছবিটা পার্সে আগের মতো ঢুকিয়ে রেখে বললেন–রাজকুমারবাবুর নেমকার্ডে দেখছি রায়ডিহির ঠিকানা লেখা। কার্ডটা অবশ্য পুরোনো।
নরেশবাবু বললেন–এবার দ্বিতীয় চেনটা খুলে দেখুন।
কর্নেল দ্বিতীয় চেনটা খুলে অনেকগুলো নেমকার্ড আর একটা ইনল্যান্ড লেটার বের করলেন। সেটা দেখে নিয়ে তিনি বললেন–চিঠিটা রাজকুমারবাবুকে কেউ লিখেছে। ঠিকানা-মাই গুডনেস! এ যে দেখছি আর. এন. লাখখাঁটিয়া অ্যান্ড কোম্পানির কেয়ার অফ-এ পাঠানো। ব্র্যাবোর্ন রোডের ঠিকানা।
নরেশবাবু মুচকি হেসে বললেন–আমার অলরেডি লাখখাঁটিয়া বাড়ির ঠিকানা খুঁজতে লোক লাগিয়েছি। আজ রবিবার, তাই ব্র্যাবোর্ন রোডে তার অফিস বন্ধ। আশা করি আজ রাতের মধ্যে যদি ঠিকানা না পাওয়া যায়, কাল তার অফিসেই গিয়ে হাজির হব।
কর্নেল ইনল্যান্ড লেটারটা খুলে আতস কাঁচের সাহায্যে দ্রুত পড়ে নিয়ে বললেন–চিঠিটা অদ্ভুত। ইংরেজিতে লেখা সংক্ষিপ্ত মুনলাইট বারে অপেক্ষা করবে। আমার যে লোকটি তোমার কাছে যাবে তার পরনে থাকবে নীল টি-শার্ট আর জিন্সের প্যান্ট। তার হাতে একটা ব্রিফকেস থাকবে। সেটার রং ধূসর। ওতেই। তোমার পাওনাকড়ি থাকবে। আমার লোক তোমাকে ব্রিফকেসটা দেবে। তুমি বাথরুমে গিয়ে ওটা খুলে গোপনে দেখে নিয়ে টাকাকড়ি যা বলেছ তা আছে কি না। এরপর তুমি আমার লোককে সঙ্গে নিয়ে গিয়ে জিনিসটি দেবে। সাবধান! এর অন্যথা হলে তুমি বিপদে পড়বে। ইতি শুভেচ্ছাসহ আর. আর।
নরেশবাবু বললেন–নামের আদ্যক্ষর। ঠিক নামটা তদন্তসাপেক্ষ।
কর্নেল চিঠি ভাঁজ করে রেখে গম্ভীর মুখে একগাদা নেমকার্ড দেখছিলেন। হঠাৎ তিনি একটা কার্ড তুলে নিয়ে বললেন–আর. কে. মিত্র, তার মানে রাজকুমার মিত্রই বটে। তলায় লেখা চিফ এজেন্ট। লাখখাঁটিয়া অ্যান্ড কোম্পানি অকশন। ডিপার্টমেন্ট। এই ঠিকানাটা চৌরঙ্গি রোডের। বলে কর্নেল নরেশবাবুর দিকে ঘুরে বসলেন।-নরেশবাবু, গত রাত্রে যারা রাজকুমারবাবুকে খুন করেছিল আমার ধারণা তারা ভাড়াটে খুনে। তা না হলে ভিকটিমের পকেট সার্চ করে সব কিছু নিয়ে পালিয়ে যেত।
আমি বলে উঠলুম–কেন? কর্নেল গাছতলায় দাঁড়িয়ে যে লোকটা অতক্ষণ সি–
কর্নেল চোখ কটমটিয়ে বললেন–উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপিয়ো না জয়ন্ত।
হালদারমশাই সায় দিয়ে বললেন–হঃ, এক কথার লগে অন্য কথা আইয়া পড়লে সব গণ্ডগোল হইয়া যায়।
নরেশবাবু মুচকি হেসে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন–বুঝে গেছি। কর্নেলসাহেব নিজের হাতের তাস এখুনি দেখাতে রাজি নন।
কর্নেল হাসতে হাসতে বললেন–মোটেও না। আমরা যখন ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ডের ঘটনাস্থলে ছিলুম তখন রাস্তার উল্টো দিকে এক ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে সিগারেট টানছিলেন। যতবার ঘুরেছি ততবার দেখেছি তার মুখে সিগারেট। আসলে ওখানে রাস্তায় একটা মোড় আছে। বাস মিনিবাস একটু থেমে যাত্রী। তোলে কিংবা নামিয়ে দিয়ে যায়।
অগত্যা সায় দিয়ে বললুম–একটা মিনিবাস এসে একটু থেমে চলে গেল। তারপর আর সেই ভদ্রলোককে দেখতে পাইনি। কিন্তু যাই বলুন, ওভাবে আমাদের দিকে তাকিয়ে কেউ দাঁড়িয়ে থাকলে তার প্রতি সন্দেহ হওয়া স্বাভাবিক কিনা।
কর্নেল বললেন–নরেশবাবু একটা অনুরোধ। এই মহিলার ছবিটা, এই নেমকার্ডটা যাতে লাখখাঁটিয়াদের অকশন হাউসের ঠিকানা দেওয়া আছে। আর এই চিঠিটা আমি আপতত রাখছি। আগামিকাল বিকেলের মধ্যেই এগুলো ফেরত পাবেন। আপত্তি নেই তো?
নরেশবাবু মৃদু হেসে বললেন–আপত্তির কারণ নেই। আপনার স্নেহভাজন ডি. সি. ডি. ডি. লাহিড়িসাহেব আমাকে বলে দিয়েছেন, আমি যেন আপনাকে কোনও কাজে বাধা না দিই।
কর্নেল সেই ছবিটা, নেমকার্ড এবং ইনল্যান্ড লেটারটা নিয়ে রাজকুমার মিত্রের পার্স নরেশবাবুকে ফেরত দিলেন।
নরেশ ধর ওটা ব্রিফকেসে ভরে উঠে দাঁড়ালেন, তারপর আমাদের সবাইকে নমস্কার করে বেরিয়ে গেলেন।
কর্নেল বললেন–হালদারমশাই আর এককাপ করে কফি হোক। কফি নার্ভ চাঙা করে। বলে তিনি হাঁক দিলেন–বাবা ষষ্ঠীচরণ! আর একবার আমাদের কফি খাওয়াও।
ষষ্ঠী ভেতর থেকে সাড়া দিয়ে বলল–যাচ্ছি বাবামশাই।
কর্নেল এবার ড্রয়ার থেকে সুজাতা দেবীর ঘর থেকে চুরি করা কাগজগুলো বের করলেন। তারপর একটার-পর-একটা কাগজ–সম্ভবত চিঠিগুলো, পড়তে শুরু করলেন।
হালদারমশাই মুচকি হেসে বললেন–এবার কেঁচো খুঁড়তে কয়খান সাপ বাইড়াইবে দেখা যাউক।
.
০৩.
কিন্তু আমাদের হতাশ করে কর্নেল এইসব কাগজপত্র থেকে একটা হেলে সাপও বের করে দেখাননি। তিনি বলেছিলেন–এতে কতকগুলো লোকের চিঠি আর শুধু টাকাকড়ির হিসেব লেখা আছে। তবে হালদারমশাই যখন সুজাতা দেবীর কাছে এই কাগজগুলোর গুরুত্বের কথা শুনেছিলেন, তখন এগুলো আরও ভালোভাবে পরীক্ষা করে দেখতে হবে।
হালদারমশাই বলেছিলেন–একটা কথা কইতে ভুইলা গেছি। আমার ক্লায়েন্ট আমারে তাঁর কইলকাত্তার অফিসের ঠিকানা দিছেন কিন্তু এখানকার বাড়ির ঠিকানা তো দেন নাই।
কর্নেল বলেছিলেন–হেড অফিসে মি. সোমের শ্যালক কারবার চালান। তার নাম ভুলে গেছি। তবে মি. সোম এখানে এলে হোটেলেই থাকেন। জানি না তিনি কোনও সূত্রে তাঁর বন্ধু রাজুর খুনের খবর জানতে পেরেছেন কি না।
আমি বলেছিলুম–জানতে পারলে তিনি নিশ্চয়ই আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করতেন। আমার ধারণা, কাল সোমবার তো উনি হেড অফিসেই থাকবেন। পরের দিন রায়ডিহি ফেরার কথা, তা-ই না কর্নেল?
কর্নেল হেলান দিয়ে চোখ বুজে টাকে হাত বুলাতে বুলাতে বলেছিলেন–হ্যাঁ, বরং হালদারমশাই কাল অফিস টাইমে ক্লায়েন্টের সঙ্গে দেখা করবেন।
-তা তো করুমই। উনি আমারে ওনার বন্ধু রাজুর ব্যাপারে খোঁজখবর লইতে কইছেন।
সে রাত্রে দেখেছিলুম, কর্নেল খাওয়ার পরও ওইসব কাগজপত্তর নিয়ে আতসকাঁচের সাহায্যে পরীক্ষানিরীক্ষা করতে ব্যস্ত। আমার ঘুম পেয়েছিল, নিজের। ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়েছিলুম। সত্যি বলতে কী, এ ধরনের খুনখারাপির রহস্য। কর্নেলের পাল্লায় পরে অসংখ্যবার আমার ঘুম নষ্ট করেছে। কিন্তু কালক্রমে ব্যাপারটা অনেক সয়ে এসেছে। তবু কিছুক্ষণ খুনের ঘটনাটা নিয়ে চিন্তভাবনা মাথায় এসেছিল। একবার সন্দেহ হয়েছিল মি. শিলাদিত্য সোম তাঁর বন্ধু রাজুর সঙ্গে সাক্ষাৎ এবং সংঘর্ষের যে বিবরণ দিয়েছেন, এদিকে আমাদের পত্রিকায় যে খবর বেরিয়েছে, এসবের মধ্যে যেন কী একটা তথ্যের ফাঁক থেকে গেছে। মি. সোমকে অমন করে তার বন্ধু ঘুসি মেরে ধরাশায়ী করবেন এটা আপাতদৃষ্টে আশ্চর্য ঘটনা। মি. সোম কি এমন কিছু বলেছিলেন যাতে রাজকুমার মিত্রের কোনও গোপন স্পর্শকাতর স্থানে আঘাত লেগেছিল?
বিছানায় বসে বেড-টি খাবার অভ্যাস আছে বলে দরজা শুধু ভেজিয়ে রেখেছিলুম। কর্নেলের অ্যাপার্টমেন্ট কেউ ঢুকে আমাকে আক্রমণ করবে এর কোনও কারণ নেই।
ষষ্ঠীচরণের ডাকে যখন ঘুম ভাঙল, তখন আটটা বাজে। তার হাত থেকে উষ্ণ চায়ের কাপ প্লেট নিয়ে সহাস্যে বললুম–গুড মর্নিং ষষ্ঠী।
ষষ্ঠী ফিক করে হেসে বলল–ভোর ছটায় বাবামশাই বিছানা থেকে উঠে যখন ছাদের বাগানে যাচ্ছেন, তখন এক ভদ্রলোক এসে ওনাকে এইরকম গুড মর্নিং বললেন।
জিজ্ঞাসা করলুম-তিনি কি এখন আছেন?
আজ্ঞে না। দাদাবাবু, তিনি বাবুমশাইয়ের সঙ্গে কথাবার্তা বলে মিনিট দশেক পরে চলে গেলেন।
–কর্নেল তাকে কফি খেতে বলেননি?
-হ্যাঁ, বলেছিলেন। কিন্তু তিনি তাড়া আছে বলে বেইরে গেলেন। আর বাবামশাই সোজা ছাদের বাগানে গিয়ে উঠলেন।
বলে ষষ্ঠী বেরিয়ে গেল। আমি জানি সে এখন কর্নেলের পাশে গিয়ে বাগান পরিচর্যায় তাঁকে সাহায্যে করবে।
বাথরুম সেরে রাত-পোশাক বদলে পাজামাপাঞ্জাবি পড়ে ড্রইংরুমে গেলুম। একটু পরেই কর্নেল ড্রইংরুমে এসে সম্ভাষণ করলেন–মর্নিং জয়ন্ত। আশা করি সুনিদ্রা হয়েছে।
বললুম–মর্নিং কর্নেল। আজ বেশ ঘুমিয়েছি। কর্নেল ইজিচেয়ারে বসে মুচকি হেসে বললেন–ষষ্ঠী নিশ্চয়ই তোমাকে বলেছে ভোরবেলায় একেবারে অসময়েই আমার সঙ্গে কেউ দেখা করতে এসেছিল।
–হ্যাঁ, বলেছে। কিন্তু ভদ্রলোককে সে চিনতে পারেনি।
কর্নেল হঠাৎ গম্ভীর হয়ে গেলেন। বললেন–ভদ্রলোককে আমিও চিনি না। অসময়ে বিরক্ত করার জন্য তো বটেই, আগে থেকে অ্যাপয়েন্টমেন্ট না করে আসার জন্য তিনি নিজেই ক্ষমা চেয়ে নিলেন।
–কিন্তু ব্যাপারটা কী খুলে বলুন।
এইসময়ই ষষ্ঠীচরণ দ্রুত দু-পেয়ালা কফি আর স্ন্যাক্স সাজিয়ে ট্রে-টা সেন্টার টেবিলে রেখে গেল। কর্নেল কফিতে চুমুক দিয়ে বললেন–ব্যাপারটা একটু অদ্ভুত। তিনি নিজের পরিচয় দিয়ে বললেন–তার নাম রণজিৎ রানা। টেলিফোনে তাকে নাকি কেউ প্রায়ই ধমকি দিচ্ছে, যদি তাকে পাঁচ লক্ষ টাকা না দেওয়া হয় তা হলে সে তাকে প্রাণে মারবে। অদ্ভুত ব্যাপার, তিনি নাকি এমন কিছু করেননি যাতে কেউ এভাবে হুমকি দিতে পারে।
-আপনাকে কি রণজিৎ রানা লোকটাকে খুঁজে বের করার জন্য অনুরোধ করতে এসেছিলেন।
–তা আর বলতে। আমি তাকে বললুম–আপনি পুলিশের কাছে না গিয়ে আমার কাছে এসেছেন কেন? তিনি বললেন–মি. শিলাদিত্য সোমের কাছে আমার কথা শুনেছেন। তার কেস নিয়ে থানা-পুলিশ করলে হিতে বিপরীত হতে পারে। তা ছাড়া পুলিশের ওপর তার ভরসাই নেই। জয়ন্ত! ভদ্রলোক ব্রিফকেস থেকে চেকবই বের করে বললেন–আমি আপনাকে ব্ল্যাংক চেক সই করে দিচ্ছি, আপনি নিজের খুশিমতো অ্যামাউন্ট নেবেন।
কথাটা শুনে হেসে উঠলাম। বললুম–উঃ কর্নেল, এমন করে লক্ষ্মীকে পায়ে ঠেলতে আছে! এ যে দেখছি স্বয়ং লক্ষ্মীদেবী নিজে থেকে আজ প্রত্যূষে আপনার কাছে এসেছিলেন।
কর্নেলও হেসে উঠলেন। বললেন–ডার্লিং, এই বুড়ো বয়সে আমার জেলে যাবার সাধ নেই।
-কেন একথা বলছেন?
–ধরো ওই চেক জাল হতেও পারে, আবার এমনও হতে পারে ব্যাংকে তার মাত্র দু-পাঁচশো টাকা পড়ে আছে। মোট কথা আমার ইনটিউশন বলছিল–এই লোকটা বিপজ্জনক।
-উনি আপনাকে নেমকার্ড দিয়ে যাননি?
কর্নেল বুক পকেট থেকে একটা ঝকঝকে সাদা কার্ড বের করে আমাকে দিলেন। দেখলাম তাতে ছাপা আছে রণজিৎ রানা। তার তলায় লাখখাঁটিয়া অকশন হাউস, ঠিকানা চৌরঙ্গি রোডের। অবাক হয়ে বললুম–এই নিলাম ঘরটির নামধাম তো আরও একটা কার্ডে দেখেছি। রাজকুমার মিত্রের সেই কার্ডটিতে একই নিলাম ঘরের ঠিকানা আছে না?
কর্নেল বললেন–তুমি ঠিক ধরেছ। ভদ্রলোককে মুখে আশ্বাস দিয়ে বললুম আমি যথাসময়ে আপনার সাথে যোগাযোগ করব। আপনি চেকবই রেখে দিন। আমার স্বভাব ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো। আপনার বন্ধু মি. সোমকে কথাটা জিজ্ঞেস করে জেনে নেবেন। মি. রানা ক্ষমা চেয়ে নিয়ে বললেন–আমার হাতে একটা জরুরি কাজ আছে। সেই জন্য আমাকে এক্ষুনি বোম্বে চলে যেতে হবে। আমি পরশু বিকেলের মধ্যে কলকাতায় ফিরব। আপনি দয়া করে যেন যোগাযোগ করবেন।
কফি শেষ করে কর্নেল চুরুট ধরালেন। তাকে জিজ্ঞেস করলুম–আচ্ছা কর্নেল নরেশবাবু বলেছিলেন–ডি. সি. ডি. ডি. লাহিড়ি সাহেব আপনাকে ফোন করবেন।
কর্নেল চুরুটের একরাশ ধোঁয়া ছেড়ে বললেন–অরিজিৎ ফোন করেছিল। তবে তখন রাত প্রায় পৌনে এগারোটা বাজে। সে জানে বারোটার আগে আমি শয্যাশায়ী হই না।
বললুম–লাহিড়িসাহেব কি এই কেসে খুব ইন্টারেস্টেড।
কর্নেল মিটিমিটি হেসে বললেন–অরিজিৎ প্রথমে আমল দেয়নি। মনে হল সম্ভবত সরকারি প্রশাসনের অন্য কোনও সূত্র থেকে এই কেসের ব্যাপারে খোঁজখবর নেওয়া হয়েছে।
কিছুক্ষণ পরে কর্নেল উঠে দাঁড়িয়ে বললেন–পোশাক বদলে নাও। আমরা বেরোব। তখনই ঘরে গিয়ে প্যান্ট আর টি-শার্ট পরে নিলুম। তারপর কর্নেলের সঙ্গে বেরিয়ে পড়লুম। কর্নেলের এখন মার্কামারা পোশাক, মাথায় টাক ঢাকা টুপি, গলা থেকে বাইনোকুলার আর ক্যামেরা ঝুলছে। গাড়িতে স্টার্ট দিয়ে জিজ্ঞেস করলুম-আপনি নিশ্চয়ই পাখি প্রজাপতি কিংবা দেশি অর্কিডের খোঁজে গ্রামাঞ্চলে যাচ্ছেন না? কর্নেল বললেন–গ্রামাঞ্চল না হলেও আমরা যেখানে যাচ্ছি সেটা একটা বাগানবাড়ি। গত রাতেই বাগানবাড়ির মালিককে ফোন করে জানিয়েছি, আমি আর জয়ন্ত তার ওখানে ব্রেকফাস্ট করব। বলা যায় না লাঞ্চও খেতে পারি।
অবাক হয়ে বললুম–আমরা তা হলে শমীক ভাদুড়ির বাগানবাড়িতে যাচ্ছি। কিন্তু হাওড়ার জ্যাম ঠেলে দিল্লি রোডে পৌঁছতে ব্রেকফাস্টের সময় পেরিয়ে যাবে না। ওদিকে রাস্তার অবস্থা এখন ভালোই। জি. টি. রোডে একটু-আধটু জ্যাম হতে পারে, তারপর মসৃণ রাস্তা।
শমীক ভাদুড়ির বাগানবাড়িতে এর আগে বেশ কয়েকবার পার্টি উপলক্ষে গেছি। রাতদুপুরে দিশি সাহেব-মেমদের মত্তমাতাল নৃত্যকলাও উপভোগ করেছি। ওই সব পার্টিতে ফিল্মের নায়ক-নায়িকাদেরও দেখেছি। আসলে শমীকবাবু একটা সাইড বিজনেস আছে, এবং তা হল ফিল্ম প্রোডাকশন।
বাগানবাড়িটার নাম সন্ধ্যানীড়। প্রায় পঁচিশ একর জমির ওপর ফুল-ফলের বাগান, মাঝখানটিতে দোতলা বিলিতি স্থাপত্যের ধাঁচে তৈরি একটি বাড়ি। চারদিক ঘিরে বারান্দা। সামনের দিকটায় একতলা কয়েকটা ঘর। সেখানে দারোয়ান, মালি আর কেয়ারটেকার সপরিবারে বাস করে। চারদিকে পাঁচিলের ওপর কাঁটাতারের বেড়া। আশেপাশে কাছাকাছি কোনও বসতি নেই।
শমীকবাবু চিত্র-বিচিত্র লম্বা পাঞ্জাবি আর পাজামা পরে পায়চারি করছিলেন। দু-ধারে চোখ ও মন মাতানো রং-বেরংয়ের ফুল বাগান।
আমরা গাড়ি থেকে নামলে যথারীতি তার ড্রাইভার এসে আমার গাড়িটা পার্কিং জোনে রাখতে গেল।
শমীকবাবু প্রথমে কর্নেলের তারপর আমার সঙ্গে করমর্দন করে সহাস্যে। বললেন–রবিবার রাত্তিরটা আমি এখানে কাটাই। বউ প্রথম প্রথম সন্দেহ করত। অন্তত বার দুই রাত্রে সারপ্রাইজ ভিজিটে হানা দিয়ে তার সন্দেহ ঘুচে গেছে। যাই হোক, কর্নেলসাহেব যখন গত রাতে জানালেন, এই অধমের মাটিতে তার শুভ পদার্পণ ঘটবে, তখন আমি সত্যি প্রথমে ঘাবড়ে গিয়েছিলাম।
প্রশস্ত ড্রইংরুমে ঢুকে আমাদের তিনি আরামপ্রদ আসনে বসালেন। তারপর কর্নেলের মুখোমুখি বসে চোখ নাচিয়ে চাপাস্বরে জিজ্ঞেস করলেন-কর্নেল সাহেব কি কোনও বিরল প্রজাতির পাখি বা প্রজাপতির খোঁজে এসেছেন?
লক্ষ করলুম তার এই কথার মধ্যে যেন অন্য কোনও অর্থ লুকিয়ে আছে।
কর্নেল একটু হেসে বললেন–হা, প্রজাপতি বলতে পারেন। তবে বিরল প্রজাতির কি না তা আপনি বলতে পারবেন।
শমীকবাবু অর্থপূর্ণ দৃষ্টিতে কর্নেলের দিকে তাকিয়ে ছিলেন। এবার আমার দিকে ঘুরে বললেন–জয়ন্তবাবু আপনাকেই জিজ্ঞেস করছি, সেবারকার মতো কোনও মিস্টিরিয়াস ব্যাপার যা কিনা আপনাদের সত্যসেবক পত্রিকার সারকুলেশন রাতারাতি বাড়িয়ে দেবে।
কর্নেল তার বিখ্যাত অট্টহাসি হেসে বললেন–মি. ভাদুড়ি আমাকে দেখলেই রহস্যের গন্ধ পান। শমীকবাবু জিভ কেটে উঠে দাঁড়ালেন–সরি। ভেরি সরি। সোয়া দশটা বাজছে। আসুন ডাইনিংরুমে যাওয়া যাক, এতক্ষণ ব্রেকফাস্ট রেডি হয়ে থাকারই কথা।
ডাইনিং রুমটাও বিশাল। ব্রেকফাস্টের আয়োজনও ছিল তেমনি ঠাসা। খেতে বসে কর্নেল কদাচিৎ কথা বলেন। এদিকে শমীকবাবু তাঁর নতুন ছবির পরিকল্পনা নিয়ে অনর্গল কথা বলছিলেন।
হঠাৎ কর্নেল জিজ্ঞেস করলেন–আপনার তো সব ছবিতে নায়িকার ব্যাপারে চমক দেবার অভ্যাস আছে। এই ছবিতে নিশ্চয়ই নতুন কোনও মুখ পাবলিক দেখতে পাবে।
শমীকবাবু সোল্লাসে বললেন–আলবাত। আমার ওই একটি ক্ষমতাই আছে। দেখবেন সারা দেশ কাঁপিয়ে দেব। আপনারা খাওয়া শেষ করুন, তারপর দোতলার প্রাইভেট চেম্বারে নিয়ে গিয়ে নতুন হিরোইনের ছবি দেখাব। কিছুক্ষণ পরে আমরা ঘোরানো সিঁড়ি বেয়ে কোণের দিকে একটা ঘরে ঢোকলুম। তারপর থমকে দাঁড়াতেই হল। দেয়াল জুড়ে অপরূপ ভঙ্গিতে এবং অর্ধনগ্ন পোশাকে একটি মেয়ের ছবি। মুখশ্রী অপরূপ লাবণ্যময়।
কর্নেল তারিফ করে বললেন–বাহ অপূর্ব।
শমীকবাবু মুখে আতঙ্কের কপটভঙ্গি ফুটিয়ে তুলে বললেন–কর্নেল, কর্নেল, আপনি আমার এই বিরল প্রজাতির প্রজাপতিটিকে জালে আটকাতে আসেননি তো?
-না, না। আপনি কিছু ভাববেন না। কথাটা বলে কর্নেল সামনের দেয়ালের একপ্রান্তে এঁটে রাখা একটা ছবির দিকে এগিয়ে গেলেন। তারপর বুক পকেট থেকে রাজকুমারবাবুর পার্সে পাওয়া ছবিটা বের করলেন। তিনি দুটো ছবিকে মিলিয়ে দেখছেন তা স্পষ্ট।
ওই ছবিটার দিকে তাকিয়ে আমিও চমকে উঠেছিলুম।
শমীকবাবু চোখ বড় করে বললেন–সর্বনাশ, সর্বনাশ, আপনি রঞ্জনাকে কোথায় পেলেন?
কর্নেল নির্বিকার মুখে বললেন–এই ছবিটি একটা খুন হয়ে যাওয়া মানুষের পার্সে পাওয় গেছে।
শমীকবাবু ধপাস করে সোফায় বসে পড়লেন। তা হলে আমি ঠিকই সন্দেহ করেছিলুম। কিন্তু কর্নেল গত বছর এমনি মার্চে একটা পার্টিতে রঞ্জনা নেচেছিল আর আপনি তখন জলসায় উপস্থিত ছিলেন।
কর্নেল বললেন–হ্যাঁ। গতরাত্রে রঞ্জনার ছবি দেখতে দেখতে আমার বার বার মনে হচ্ছিল এই যুবতিকে আমি নিশ্চয়ই কোথাও দেখেছি। তারপর হঠাৎ মনে হল ফিল্মের মেয়েদের নিয়ে পার্টিতে অনেক প্রোডিউসার গিয়ে থাকেন। পরক্ষণে আপনার কথা মনে পড়ে গেল। অমনি ভাবলুম একটা চান্স গিয়ে দেখা যাক না। যা-ই হোক আমি আপাতত সফল হয়েছি। এবার শুধু আপনার কাছে জানতে চাই রঞ্জনার ঠিকানা কী এবং সে এখন কী করছে?
শমীকবাবু বাঁকা মুখে বললেন–রঞ্জনার টাকার লোভই তার কেরিয়ারের সর্বনাশ ঘটিয়েছে। শুনেছি এক ব্যবসায়ীর পাল্লায় পড়ে সে ফিল্ম থেকে দূরে সরে গেছে। আর একটা কথা, আমার এক বন্ধুর কাছে এ-ও শুনেছি, সে ব্যবসায়ী কোনও অপকর্মে ফেঁসে গিয়ে গা ঢাকা দিয়েছে। আর রঞ্জনা অগত্যা বিজ্ঞাপনের মডেলিং করছে। কারণ ফিল্ম লাইনের কোনও প্রোডিউসার ওকে বিশ্বাস করেন না।
কর্নেল বললেন–রঞ্জনার ঠিকানাটা আমার চাই।
শমীকবাবু দেয়ালের র্যাক থেকে একটা মোটা নোটবই বের করে পাতা। ওল্টাতে থাকলেন। তারপর বললেন–হ্যাঁ, লিখে নিন কর্নেলসাহেব। কর্নেল তার। খুদে নোটবইয়ে ঠিকানা টুকে নিয়ে বললেন–টেলিফোন নম্বর নেই?
–ছিল। কিন্তু কেটে দিয়েছি। তার মানে পরে এই নম্বরে তাকে আর পাইনি।
কথাটা বলে শমীকবাবু একটু নড়ে বসলেন।–হ্যাঁ, একটা উপায় আছে। আমার এক বন্ধু প্রবীর ব্যানার্জির একটা বিজ্ঞাপনসংস্থা আছে। অনেক মডেলের সঙ্গে তার যোগাযোগ থাকা। স্বাভাবিক। এক মিনিট, দেখি তার কাছে কোনও খোঁজ পাই কি না।
শমীকবাবু ডায়াল করার পর সাড়া পেয়ে বললেন–প্রবীর! একটা জরুরি ব্যাপার তোমাকে রিং করছি। তুমি তো মডেলদের নিয়ে কাজ করো।
—–
–ইউ আর ড্যাম রাইট। এর আগে তোমার কাছ থেকে বেশ কিছু আনকোরা মডেলকে ফিল্ম লাইনে ডানা মেলতে দিয়েছি। হ্যাঁ, এর জন্য তোমার ক্ষতি হয়েছে। এটা স্বীকার করি।
—–
তা যা বলেছ, আজকাল মডেলের অভাব নেই। যাই হোক শোনো। তুমি রঞ্জনা রায়কে সম্ভবত চেনো। একসময় সে আমার কয়েকটা ছবিতে নায়িকার রোলে ছিল। ও হ্যাঁ! ইদানিং কীসের বিজ্ঞাপনে যেন তাকে দেখেছি।
—–
-বাঃ আমি তা হলে ভুল করিনি। এখন কাজের কথা। শোনো, আমার নতুন ছবিতে ওকে দরকার। ওর ফোন নম্বরটা হারিয়ে ফেলেছি। কারণ বুঝতেই পারছো। প্রায় তিন-চার বছরের গ্যাপ।
—–
–না না, তেমন কিছু ঝামেলা ওর সাথে আমার হয়নি। সচরাচর পেমেন্ট নিয়ে যে ঝামেলা হয়, তুমি তো জানো, আমার কাপড় এ ব্যাপারে ফুটফুটে ফরসা। কেউ বলতে পারবে না শমীক লাহিড়ি কাউকে ঠকিয়েছে। হ্যাঁ, বলো লিখে নিচ্ছি।
—–
শমীকবাবু ওর ফোন নম্বরটা লিখে নিয়ে বললেন–অ্যাড্রেসটা কি বদলেছে?
—–
-হ্যাঁ, বলো লিখে নি। বলে উনি ঠিকানা লিখে নেবার পর হেসে উঠলেন।
–দেখা যাচ্ছে তা হলে রঞ্জনার বেশ উন্নতি হয়েছে। থ্যাংকস প্রবীর। নতুন ছবির জন্য পার্টি দেব, তখন তোমাকে কিন্তু চাই। আচ্ছা রাখছি।
শমীকবাবু একটা কাগজের টুকরোতে রঞ্জনার ফোন নম্বর এবং নতুন ঠিকানা। লিখে কর্নেলকে দিলেন। কর্নেল তার খুদে নোটবইয়ে লেখা ঠিকানাটা কোট দিয়ে ওই নতুন ঠিকানা এবং টেলিফোন নম্বর টুকে নিলেন। কাগজের টুকরোটা অবশ্য তিনি বুক পকেটে ভরে রাখলেন। তারপর চাপাস্বরে বললেন–মি. লাহিড়ি এই মহিলাকে আমার খুবই দরকার। না, আমি তার কোনও ক্ষতি করব না। বরং তাকে পুলিশের হাত থেকে বাঁচাব।
শমীকবাবু মুচকি হেসে বললেন–বুঝেছি। তাকে এখনই রিং করব কি?
-হ্যাঁ, এমনকী তাকে যদি কোনও অছিলায় আজ এখানেই আনতে পারেন, আমার কাজটা খুব সহজ হয়ে যাবে। আমি কথা দিচ্ছি মি. লাহিড়ি, তার এতটুকু ক্ষতি তো হবেই না, বরং লাভই হবে। কারণ খুন হওয়া যে ভদ্রলোকের পকেটের পার্সে রঞ্জনার ছবি পাওয়া গেছে সেই ভদ্রলোকের খুনিদের কাছে সম্ভবত রঞ্জনা একটা ঝুঁকি। তাই তারা রঞ্জনার ক্ষতি করতেও পারে।
-কেন বলুন তো!
আমার সন্দেহ, রঞ্জনা তার প্রেমিক অর্থাৎ যে খুন হয়েছে তার খুনিদের সে চেনে। শুধু তা-ই নয়, এই খুনের কারণও সে হয় তো জানে। মি. লাহিড়ি আমার মনে হচ্ছে রঞ্জনা বিপন্ন।
-বলেন কী! তা হলে তো আমাকে এক্ষুনি তার সঙ্গে যোগযোগ করতে হয়।
বলে তিনি রিসিভার তুলে ডায়াল করতে থাকলেন। একটু পরে সাড়া পেয়ে তিনি বললেন–আমি শমীক লাহিড়ি বলছি। রঞ্জনা রায়ের সঙ্গে কথা বলতে চাই।
—–
–ঠিক আছে ধরছি। আমার নাম বললেই সে চিনবে। আপনি বলতেও পারেন আমি ফিল্ম প্রোডিউসার শমীক লাহিড়ি। আমাকে সে বাচ্চুদা নামে চেনে।
শমীকবাবু রিসিভার রেখে কর্নেলের দিকে তাকিয়ে রইলেন। আমার মনে হল উনি যেন বলতে চাইছেন, যে কাজে উনি হাত দেন তাতেই সফল হন। অর্থাৎ মুখে আত্মবিশ্বাসের স্পষ্ট ছবি ফুটে ওঠেছিল।
প্রায় মিনিট তিনেক পরে শমীকবাবু বলে উঠলেন–রঞ্জনা, বাচ্চুদা বলছি। আমি এখন দিল্লি রোডের ধারে আমার বাগানবাড়িতে আছি। না, একা নেই। দুজনে গণমান্য গেস্ট আছেন। যাই হোক শোনো-আহাঃ শোনোই না বাবা। তোমার বাচ্চুদা তোমাকে এখানে আজ লাঞ্চ খেতে নিমন্ত্রণ করছে … আহা পার্টি ফার্টি নয়। আমার নতুন ছবির কথা তুমি কি শুনেছ? … আরে মন খারাপ এখন রাখো তো। আমার নতুন ছবিতে আমি তোমাকে চাই। তা ছাড়া অন্যতম মাননীয় অতিথি। প্রকৃতি-বিজ্ঞানী কর্নেল নীলাদ্রি সরকারকে তুমি চেনো না। তিনি এ দেশের একজন বিখ্যাত মানুষ। তোমার মন খারাপের কোনও বিশেষ কারণ থাকলে …আহা কথার কথাই বলছি। ধরো তোমার পিছনে কেউ বজ্জাতি করতে নেমেছে। এই কর্নেলসাহেব তাকে ঢিট করতে পারবেন।… প্লিজ রঞ্জনা! লক্ষ্মীটি! জীবনে একবার অন্তত তোমার বাচ্চুদার কথা শোনো।…এক মিনিট। আমি গাড়ি পাঠাব? …তবে তো ভালোই। তুমি ড্রাইভ করে চলে এসো।
রিসিভার রেখে শমীকবাবু বললেন–তা হলে আপনার সেবা করতে পেরে ধন্য হলুম। কর্নেল বললেন–বাই এনি চান্স রঞ্জনা মত বদলাবে না তো?
মোটেই না। কারণ ওকে আমি হাড়ে হাড়ে চিনি। আপনার কথা শুনে এটুকু আঁচ করতে পেরেছি। ওর প্রেমিকই খুন হয়েছে।
আচ্ছা মি. লাহিড়ি, রঞ্জনার কথাবার্তা শুনে আপনার কি মনে হল সে এই খুনের খবর জানে?
শমীকবাবু মাথা নেড়ে বললেন–তেমন কিছু মনে হল না। তবে ওকে একটু নিস্তেজ মনে হচ্ছিল। শুধু বলল–আমার মন ভালো নেই।
শমীকবাবু উঠে দাঁড়িয়ে বললেন–চলুন আপনাদের থাকার ঘরটা দেখিয়ে দি, আর কফির ব্যবস্থা করি। আপনি তো কফির নেশায় সবসময় ছটফট করেন।
.
০৪.
দোতলার দক্ষিণে দিকের এই ঘরটি সুন্দর আসবাবপত্রে সাজানো। দু-ধারে দুটি বিছানা, এক পাশে সোফা সেট আছে, দক্ষিণের দিকে পর্দা তুলে কর্নেল দরজা খুললেন। ওদিকে প্রশস্ত ব্যালকনি। দুটো বেতের চেয়ার এবং একটা টেবিল আছে। শমীকবাবু নীচে চলে যাবার পর কর্নেল আর আমি ব্যালকনিতে বসলুম। চোখে পড়ল দূরে একটা বিস্তীর্ণ জলাশয়। রৌদ্রে ঝকমক করছে। কর্নেল চোখে বাইনোকুলার রেখে কিছুক্ষণ দেখার পর বললেন–ওটা তুমি লেক ভেবো না। গঙ্গার অববাহিকায় ওটা একটা বিল। লোকে বলে শনশনির বিল।
হাসি পেল। বললুম–এই অদ্ভুত নামের মানে কী?
কর্নেল বললেন–ওখানে গেলে বুঝতে পারতে। বাতাস যখন বিলের জলের ওপর খুব জোরে বয়ে যায়, তখন অদ্ভুত শনশন শব্দ ওঠে, তাই ওই নাম। তবে সরকার ওখানে পাখিদের একটা অভয়ারণ্য গড়বেন শুনেছি। কারণ শীতের মরশুমে ওখানে নানা দেশের পাখিরা ভিড় জমায়। বাইনোকুলারে এখনও ছড়িয়ে ছিটিয়ে হাঁসের কয়েকটা ঝাঁক খেলা করছে। জলটুঙিতে গাছপালার মাথায় অনেকগুলো সারস বসে আছে।
কথা বলতে বলতে একটা লোক কফি আর গ্লাসের ট্রে নিয়ে এল। শমীকবাবু বললেন–ওখানে আর একটা চেয়ার পাতার মতো জায়গা নেই। অতএব কর্নেলসাহেব ভেতরে এসে বসুন। বুঝলেন জয়ন্তবাবু, কর্নেলের কাছে বসে কফি খেলে কফির স্বাদই বদলে যায়।
ক্রমশ বুঝতে পারছিলুম ভদ্রলোক বেশ আমুদে প্রকৃতির। বোঝা যাচ্ছে ইনি একজন বিত্তবান মানুষ তো বটেই অথচ অন্য বিত্তবানদের মতো একটুও দেমাক নেই। উচ্ছল প্রাণবন্ত এই মানুষটিকে আমার খুব ভালো লাগছিল।
কফি খেতে খেতে উনি রঞ্জনার জীবন কাহিনি শোনাচ্ছিলেন। শোনার পর মনে হল একটি পরিবারের মেয়ে অনেক লড়াই করে লেখাপড়া শিখেছিল এবং মডেলিংকে পেশা করে নিয়েছিল। সেই সুযোগে সে ফিল্মে অভিনয়ের দিকে পা বাড়ায়। নায়িকা হিসেবে খ্যাতিও হয়েছিল, কিন্তু শমীকবাবুর মতে অর্থ কৌলিন্যের লোভে সে এক প্রৌঢ় ব্যবসায়ীর পাল্লায় পড়ে। তার সঙ্গে সে নাকি লিভটোগেদার করত। ব্যবসায়ী নাকি তাকে ফিল্ম লাইন থেকে সরিয়ে আনেন এবং নিজের ব্যবসার কাজে লাগান। শমীকবাবু বলছিলেন–এর অনেকটাই তার শোনা কথা। একটি সুন্দরী যুবতিকে কাজে লাগানো যায়, সেটা ঠিক কোন্ ধরনের ব্যবসা অনুমান করা চলে। সেটা কন্ট্রাক্টরি হতে পারে আবার স্মাগলিংও হতে পারে।
তার কথা শেষ হলে কর্নেল বললেন–আপনি যখন রঞ্জনা সম্পর্কে এত খোঁজখবর দিলেন, তখন আপনাকে আমার জানানো উচিত, রঞ্জনা যার পাল্লায় পড়েছিল তার নাম রাজকুমার মিত্র। ভদ্রলোক নিজে স্বাধীনভাবে ব্যবসা করতেন, তা কিন্তু বলা যাবে না। কারণ তিনি লাখখাঁটিয়া কোম্পানির নিলাম ঘরের একজন এজেন্ট ছিলেন। কাজেই বুঝতেই পারছেন, এজেন্ট হিসাবে রাজকুমারবাবুর কাজটা ছিল দেশে-বিদেশে ঘোরাঘুরি করে মূল্যবান অ্যান্টিক জিনিসপত্তর কেনা-বেচা। ধরুন কোনও রাজবংশের লোকের বাড়িতে দামি কোনও প্রাচীন জিনিস আছে, যার দাম হয়তো এ বাজারে লক্ষাধিক টাকা। রাজকুমারবাবু সেটা কম দামে কিনতে চান। কিন্তু পার্টিকে নোয়াতে পারছেন না, এসব ক্ষেত্রে একজন সুন্দরী যুবতি তার কাজ লাগতে পারে। কী বলছি তা আশা করি বুঝতে পারছেন।–ঠিক বলেছেন। বিশ্বস্তসূত্রে শুনেছিলুম রঞ্জনা একবার নাকি পুলিশের পাল্লায় পড়েছিল। তার কোনও গুণমুগ্ধ ভক্ত পুলিশ ডিপার্টমেন্টে থাকার জন্য সে বেঁচে যায়।
আরও কিছুক্ষণ রঞ্জনা সম্পর্কে কথা বলার পর কর্নেল উঠে দাঁড়ালেন। বললেন–আমি একবার আপনার বাগানবাড়ির পিছনে পোড়ো মাঠটা দেখে আসি। সেবার ওই মাঠে লালঘুঘুর একটা ঝাক দেখেছিলুম। তারা বিরল প্রজাতির ঘুঘু। শীতের শেষে এই পাখিগুলো পোডড়া মাঠে চরতে আসে।
বলে তিনি আমার দিকে তাকলেন–জয়ন্ত, তুমি বরং বিশ্রাম করো। মি. লাহিড়ি কি এখানে গল্প করবেন নাকি আমার সঙ্গী হবেন? শমীকবাবু করজোড়ে বললেন–রক্ষা করুন কর্নেলসাহেব। আপনার সঙ্গে এই প্রখর রোদে ঘুঘু দেখার ইচ্ছে আমার নেই। যদিও আমি আমার কাজকারবারে অনেক রঙের ঘুঘু দেখেছি।
কর্নেল হাসতে হাসতে চলে গেলেন। শমীকবাবু ব্যালকনিতে একবার উঁকি দিয়ে এসে বললেন–শ্রীমতীর আসতে হয়তো একটা বেজে যাবে। কারণ হাওড়ার জি. টি রোডে দুপুরের দিকে বড্ড জ্যাম হয়। জয়ন্তবাবু আপনি পোশাক বদলে স্নান করে নিতে পারেন। অ্যাটাচড বাথরুমটা আপনার পরিচিত। কোনও অসুবিধে নেই। আমি গিয়ে দেখি নরহরি রান্নার কী ব্যবস্থা করছে।
তিনি চলে যাবার পর আমি বাথরুমে একবার উঁকি মেরে দেখে সটাং বিছানায় চিত হলুম। শমীকবাবু লক্ষ করেননি আমরা সঙ্গে পোশাক-আশাক আনিনি। অবশ্য ওঁকে বললে এক প্রস্থ পোশাক জোগাড় হয়ে যাবে। কিন্তু কলকাতার ভেতরে এইসময় যে উষ্ণতা, এখানে তা নেই, বরং শীত যেন ওত পেতে বসে আছে। ফ্যানের হাওয়ায় তা টের পাচ্ছিলুম। তাই স্নান করার ঝুঁকি নিলুম না। বিছানায় লম্বা হয়ে শুয়ে কখন দু-চোখে ঘুমের ঘোর এসে গেছিল। কর্নেলের ডাকে তা কেটে গেল। তিনি সহাস্যে বললেন–ভাত না খেয়েই ভাতঘুম। উঠে পড়ো ডার্লিং। চোখ মুছে উঠে বসলুম। বললুম–লালঘুঘুদের দর্শন পেলেন নাকি।
কর্নেল মুচকি হেসে বললেন–তাদের দেখা পাইনি। তবে যার জন্য এখানে আসা তার দেখা পেয়ে গেছি।
অবাক হয়ে বললুম–কার দেখা?
কর্নেল চাপাস্বরে বললেন–তুমি বিছানায় বসেই পশ্চিমের জানলার পর্দাটা একটুখানি ফাঁক করো, তুমিও দর্শন পাবে।
পর্দা একটু ফাঁক করতেই চোখে পড়ল নীচে পশ্চিম দিকের গাছের ছায়ায় একটা চেয়ার পাতা, সেই চেয়ারে যে সুন্দরী যুবতি বসে আছে সে আমার চেনা। চেনা মানে ছবি দেখে চেনা। অর্থাৎ রঞ্জনা রায় সশরীরে রঙ্গমঞ্চে অবতীর্ণ। তার সামনে দাঁড়িয়ে দু-হাত নেড়ে কী সব বলছেন শমীকবাবু, কিন্তু রঞ্জনার মুখে নির্বিকার ভাব।
কর্নেল চোখ কটমটিয়ে চাপাস্বরে বললেন–দ্যাটস এনাফ।
ঘুরে বসে বললুম–আপনার সঙ্গে আলাপ হয়েছে তো?
কর্নেল ক্যামেরা আর বাইনোকুলার টেবিলে রেখে বাথরুমে ঢুকলেন। সেই সময় নরহরি এসে সেলাম দিয়ে বলল–লাঞ্চের টেবিল রেডি হয়েছে সাহেব। সাহেব আপনাদের জন্য ওয়েট করছেন।
বললুম–আমরা যাচ্ছি। কিছুক্ষণ পরে কর্নেলের সঙ্গে নীচে গেলুম। তারপর ডাইনিং রুমে ঢুকে দেখি রঞ্জনা আর শমীকবাবু বসে আছেন। খাদ্যের ব্যবস্থা দেখে তাক লেগে গেল। রঞ্জনা আমার দিকে একবার তাকিয়েই দৃষ্টি ঘুরিয়ে নিল। শমীকবাবু আমার সঙ্গে তার পরিচয় করিয়ে দিলে বললুম–আমাদের কাগজেও বিজ্ঞাপনের পাতায় আপনাকে দেখেছি। কাজেই আপনি আমার অপরিচিত নন।
রঞ্জনা একটু হাসবার চেষ্টা করে বলল–আমার সৌভাগ্য। তবে আপনার নামও আমার কেন যেন পরিচিত মনে হচ্ছে।
শমীকবাবু হাসতে হাসতে বললেন–এর আগে বলছিলে কর্নেলসাহেবকে কোথায় যেন দেখেছ। এমন যদি আরও কোনও ভদ্রলোককে এখানে এনে তোমার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিই অমনি বলবে তাকেও তোমার চেনা মনে হচ্ছে।
রঞ্জনা মুখে বিরক্তি ফুটিয়ে বলল–তোমার এই সব কাঁচা জোক আমার পছন্দ হয় না।
লক্ষ করলুম কর্নেল ততক্ষণে টেবিলের মধ্যিখানে রাখা স্থূপাকৃত সুগন্ধ আর চামচে নিজের প্লেটে তুলে নিচ্ছেন। দেখাদেখি আমিও তাই শুরু করলুম। শমীকবাবু বললেন–সরি, ভেরি সরি রঞ্জনা। এখানে আসা অবধি লক্ষ করছি, জোকের মুড নেই। থাক গে। ওই দ্যাখো কর্নেলসাহেবের খিদে পেয়েছে। তোমারও খিদে পাওয়া উচিত। লেট আস বিগিন দা ফিস্ট।
বলে তিনি চামচে ভাত তুলে রঞ্জনার প্লেটে দিলেন।
রঞ্জনা তার হাত থেকে চামচটা নিয়ে বলল–কর্নেলসাহেব পথ দেখিয়েছেন। হিজ হিজ হুজ হুজ।
শমীকবাবু বললেন–বাহ! এতক্ষণে তুমি স্বাভাবিক হতে পেরেছ।
খেতে খেতে কর্নেল বললেন–খাওয়ার সময় আমি কথা বলি না। কিন্তু এখন নিয়ম ভঙ্গ করে বলছি। এই মাছগুলো নিশ্চয়ই আপনার পুকুরের, কিন্তু ওই যে মাংসের প্লেট দেখতে পাচ্ছি ওগুলি নিশ্চয়ই বাজার থেকে কেনা। কর্নেল একটা কাঁটা চামচ দিয়ে এক টুকরো মাংস তুলে নিয়ে মুখে তুললেন। তারপর বললেন–মাই গুডনেস! এ তো মুরগি নয়। সম্ভবত বুনো হাঁসের মাংস।
শমীকবাবু মুচকি হেসে বললেন–মাঝে মাঝে আমি নিষিদ্ধ কর্মে আনন্দ পাই। রঞ্জনা তুমি অমন করে রুষ্ট চোখে তাকিয়ো না। আজ ভোরবেলায় আমার দক্ষিণ হস্ত কেতুচরণকে সঙ্গে নিয়ে শনশনির বিলে হানা দিয়েছিলুম। আমার বন্দুকের শব্দ বন দফতরখানিক পৌঁছোয়নি। এক লাইনে তিনটে হাঁস ছিল। অতএব একটা ছররা কার্তুজেই তিনটে হাঁস মারা পড়েছিল।
কর্নেলসাহেব আপনি বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের একজন বড় উদ্যোক্তা। কাজেই আমি দেখতে চেয়েছিলুম এগুলো কোন্ পাখির মাংস তা আপনি বুঝতে পারেন কি না এবং আপনার রিঅ্যাকশনই বা কী হয়।
কর্নেল নির্বিকার মুখে বললেন–যেহেতু আমি নিজে হাঁসগুলো মারিনি তাই এগুলোর মাংস খেতে আমার মনে কোনও পাপবোধ হচ্ছে না। সামরিক জীবনে বর্মার জঙ্গলে আমি খিদের চোটে সঙ্গীদের পাল্লায় পড়ে পাইথনের মাংসও খেয়েছি।
রঞ্জনার চোখে বিস্ময় কেঁপে ওঠল। সে বলল–কর্নেলসাহেব এবার আমি আপনাকে আর জয়ন্তবাবুকে চিনতে পেরেছি। দৈনিক সত্যসেবক পত্রিকায় আপনাদের রোমাঞ্চকর সব কীর্তি পড়েছি। তবে তা গত দু-তিন বছরে নয়। তারও আগে। আপনি একজন ডিটেকটিভ।
কর্নেল জিভ কেটে মাথা নেড়ে বললেন–প্লিজ রঞ্জনা, ওই কথাটা আমার কাছে একটা গালাগালি বলে মনে হয়। কারণ বাংলা ভাষায় টিকটিকি শব্দটা এসেছে ডিকেটটিভ থেকে। আমি টিকটিকি নই।
শমীকবাবু বললেন–কী সর্বনাশ! রঞ্জনা আপনাকে আবিষ্কার করে ফেলল দেখছি।
কর্নেল বললেন–দ্যাটস এনাফ। খাবার সময় কথা বলতে নেই।
খাওয়া শেষ হল বেলা দুটোয়। আমরা এবার নীচের তলার ড্রইং রুমে গিয়ে বসলুম। দেখলুম রঞ্জনা কর্নেলের কাছাকাছি বসেছে। কর্নেল হেলান দিয়ে চুরুট টানছিলেন। রঞ্জনার হাবভাব লক্ষ করে এখন আমার মনে হচ্ছিল সে তার প্রেমিক রাজকুমার মিত্রের হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে নিশ্চয়ই তার সঙ্গে কথা বলবার জন্য উদগ্রীব। শমীকবাবু যে রঞ্জনাকে রাজকুমারের হত্যাকাণ্ডের কথা ইতিমধ্যে জানিয়ে দিয়েছেন, তাতে কোনও ভুল নেই।
শমীকবাবু পাঞ্জাবির পকেট থেকে একটা সিগারেটের প্যাকেট বের করে বললেন–সিগারেট প্রায় ছেড়েই দিয়েছি। কিন্তু এখানে রঞ্জনা আসার পর আমি এত খুশি হয়েছি যে একটা সিগারেট না খেলেই নয়। আমার মনে সেই পুরোনো দিনগুলোর স্মৃতি ফিরে আসছে। জয়ন্তবাবু নিন একটু সেলিব্রেট করা যাক।
আমি সিগারেট ছেড়ে দিয়েছি। কিন্তু মনের ভিতরে উত্তেজনা থাকার জন্য এ সময় একটা সিগারেট টানার লোভ সমলাতে পারলাম না। সিগারেটটা নিয়ে। বললুম–এটা কী সিগারেট?
শমীকবাবু বললেন–মার্লবোরো। খাঁটি আমেরিকান ব্র্যান্ড। এসব সিগারেট আমি পয়সা দিয়ে কিনি না। আমেরিকা থেকে আমার বন্ধু-বান্ধবেরা কলকাতায় এলে উপহার দিয়ে যায়। বলে সকৌতুকে দুই চোখ নাচিয়ে তিনি চাপাস্বরে বললেন–এখানে আমার স্টকে আরও একটা প্যাকেট আছে। আপনাকে আমি সেটা উপহার দেব।
মাথা নেড়ে বললুম–সর্বনাশ! আবার সিগারেটের পাল্লায় পড়ে যাব। আমাকে বিপদের মুখে ফেলে দেবেন না প্লিজ।
কথাটা রঞ্জনার কানে গিয়েছিল। সে অপরূপ প্রা-ভঙ্গি করে বলে উঠল– বাচ্চুদার ওটাই তো জীবনের ব্রত। বাগে পেলে মানুষকে বিপদের মুখে ঠেলে দেন।
আমি বললুম–আপনাকে ঠেলে দিয়েছিলেন নাকি?
রঞ্জনা কিছু বলার আগেই শমীকবাবু বলে উঠলেন–এই রঞ্জনা, অকারণে আমার বদনাম দিয়ো না বলে দিচ্ছি। বলো কবে কোথায় কখন তোমাকে কী বিপদের মধ্যে ফেলেছিলাম?
রঞ্জনা নির্বিকার মুখে বলল–এখানে একজন ধুরন্ধর ডি–সরি, প্রখ্যাত রহস্যভেদী মানুষ বসে আছেন। কথাটা তুমি নিজেই যখন তুলেছ তখন আমি সিরিয়াস। তুমি আমাকে লাখখাঁটিয়াজির দেওয়া হোটেল এশিয়ার পার্টিতে একজন ছদ্মবেশী দুবৃত্তের দিকে ঠেলে দাওনি?
শমীকবাবু বিব্রত মুখে বললেন–ওহ! রঞ্জনা। সে তো কত বছর আগের কথা। আর ধরা যাক, সে যদি দুবৃত্তই হয় তুমি তার পাল্লায় পাড়ছিলেই বা কেন? কেন তুমি নিজে থেকে সরে আসোনি? এমনকী কেন তুমি আমার সাহায্য চাওনি?
রঞ্জনা রুষ্ট মুখে বললেন–আমি একটা ট্র্যাপে পড়ে গিয়েছিলাম। আমার কিছু করার ছিল না। তা ছাড়া তুমি ভুলে যাচ্ছ বাচ্চুদা, তোমাকে কতবার ফোন করেছি, কিন্তু তুমি ফোন ধরেনি। তোমার লোক টেলিফোনে আমার নাম জিজ্ঞেস করেছে আর আমার নাম শুনেই সে বলেছে–সাহেব বাইরে গেছে।
শমীক লাহিড়ি নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে কথা শুনছিলেন। হাসবার চেষ্টা করে বললেন–আশ্চর্য। আমি আমার লোককে কখনও তেমন করে কথা বলিনি। কিন্তু তুমি কি আমার সঙ্গে ঝগড়া করার জন্যই ছুটে এসেছ? এখানে আমার অনারেবল দুজন গেস্ট আছেন।
রঞ্জনা একই ভঙ্গিতে বলল–তুমি আজ সকালে টেলিফোনে যখন প্রকৃতি বিজ্ঞানী কর্নেল নীলাদ্রি সরকারের কথা বললে, তখনই নামটা আমার খুব চেনা মনে হয়েছিল। তাই আমি কৌতূহলী হয়ে উঠেছিলুম। আর তোমার ফিল্মের কথা বলেছিলে, সেটাও আমার পক্ষে একটু লোভের কারণ ছিল। হ্যাঁ, এখন আমার এই অভিশপ্ত জীবনে একটা কিছু নিয়ে থাকার দরকার মনে করেছিলুম।
কথা বলতে বলতে রঞ্জনার চোখে জল এসে গিয়েছিল। সে আঁচলে চোখ দুটো স্পঞ্জ করে আবার বলল–তখন তোমাকে বলেছি রাজুর মার্ডারের খবর আমার জানা। কারণ আজ খুব ভোরে সাদা পোশাকে দুজন পুলিশ অফিসার আমার বিজ্ঞাপন কোম্পানির এক ভদ্রলোককে সঙ্গে নিয়ে আমার বাড়িতে গিয়েছিলেন। তারা আমাকে অ্যারেস্ট করতে যাননি। আমার সঙ্গে রাজকুমারের সম্পর্ক নিয়ে জেরা করতে গিয়েছিলেন। আমি খোলাখুলি সব বলেছি। প্রায় ছ-মাস আগে তার সঙ্গে আমি সম্পর্ক শেষ করে দিয়েছি। এই ব্যাপারে রাজকুমারের লেখা চিঠিও আমি তাদের দিয়েছি। তারা বলে গেছেন দরকার হলে আবার তাঁরা আসবেন, এমনকী আমাকে লালবাজারেও যেতে হতে পারে।
লক্ষ করলুম শমীকবাবু ততক্ষণে আর একটা সিগারেট ধরিয়েছেন। আবহাওয়া গম্ভীর হয়ে গেছে দেখে কর্নেল হাসতে হাসতে বললেন–ও মাই গড! অবস্থা এমন ঘোরালো হয়ে উঠবে জানলে আমি কক্ষণও এখানে আসতুম না।
শমীকবাবু হঠাৎ হো হো করে হেসে ওঠলেন। কী আশ্চর্য ব্যাপার। আমি জানতুম রঞ্জনার সঙ্গে সাবধানে কথা বলতে হয়। বুঝলেন কর্নেলসাহেব, মেপেকুপে কথা না বললেই রঞ্জনার রিঅ্যাকশন হয় প্রচণ্ড। সেই সঙ্গে এবার সিরিয়াসলি বলছি–এই যখন-তখন ভীষণভাবে রিঅ্যাক্ট করার জন্যই রঞ্জনার কেরিয়ার ঝামেলায় পড়েছে। তা না হলে বাংলা ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে রঞ্জনার স্থান আজ কোথায় থাকত ভাবা যায় না। হ্যাঁ, কর্নেলসাহেব, রঞ্জনা বরাবরই আনপ্রেডিক্টেবিল।
কর্নেল রঞ্জনাকে সস্নেহে বললেন–আমি তোমাকে এবার থেকে তুমিই বলব। কিছু মনে কোরো না।
রঞ্জনা আস্তে বলল–কিছু মনে করব না। আমি আপনার মেয়ের বয়সি।
কর্নেল তাঁর বিখ্যাত অট্টহাসি হাসলেন। তারপর বললেন–মি. লাহিড়ি আরও কিছুক্ষণ থাকতুম, কিন্তু আমার এই মন খারাপ হয়ে থাকা মেয়েটির মানসিক স্বাস্থ্যের স্বার্থেই আমাদের ওকে এই সাজানো প্রকৃতির কোলে রেখে কলকাতা ফিরতে হবে। প্রায় তিনটে বাজে।
রঞ্জনা উঠে দাঁড়িয়ে বলল–আমি আপনাদের সঙ্গে বাড়ি ফিরব।
শমীকবাবু উঠে দাঁড়িয়ে বললেন–তুমি ফিরবে কী! তুমি যতই ঝগড়া করো আমি তাতে কান দেব না। তুমি এখানে থাকবে। তোমাকে আমার নতুন ছবিতে যে রোলটা দিতে চাই সেটা নিয়ে আলোচনা হবে। ছবির চিত্রনাট্যের একটা কপি আমার কাছে আছে। সেটা তোমাকে পড়ে শোনাব। তারপর রাতের খাওয়া সেরে আমিও তোমার সঙ্গে কলকাতা ফিরব।
রঞ্জনা গোঁ ধরে বলল–না, আমি এখন একটা ঝামেলার মধ্যে জড়িয়ে পড়েছি, একজন দুবৃত্ত নিজে খুন হয়ে আমাকেও ফাঁসিয়ে গেছে। তার পার্সে ন্যাকামি করে আমার ছবি রাখার কারণ কী আমি বুঝি না। বজ্জাত! স্কাউন্ট্রেল!
রঞ্জনার মুখ রাগে লাল হয়ে ওঠেছিল। কর্নেল বললেন–আমি বলি কী, রঞ্জনা তুমি মি. লাহিড়ির কথামতো কাজ করো। আফটার অল উনি তোমার গার্জেনের মতো। পুলিশের দিক থেকে কোনও চাপ এলে উনি সেটা ট্যাকল করতে পারবেন। চলো জয়ন্ত, এবার বেরোনো যাক।
রঞ্জনা জেদ ধরে বলল–কর্নেলসাহেব এখন আর ফিল্মের স্ক্রিপ্ট শোনার মুড আমার নেই। প্লিজ বাছুদা, তুমি কিছু মনে কোরো না। তুমি তো জানোই আমি কী এবং কেমন। তুমি তোমার ছবিতে আমাকে যদি নিতে চাও সেটা আমার সৌভাগ্য। বিশ্বাস করো বাচ্চুদা, আমার আর কিছু ভালো লাগছে না। বাড়ি ফিরে বিশ্রাম নিলে আমার মনমেজাজ ঠিক হয়ে যাবে।
সে আমাদের সঙ্গে ঘর থেকে বেরোল। এতক্ষণে আমার চোখে পড়ল ওর হাতে একটা ছোট ব্যাগ আছে।
পিছনে শমীকবাবু বলে উঠলেন–আমার পাগলি রে, খামখেয়ালেই জীবনটা দিব্যি এনজয় করছে।
রঞ্জনা একটু হাসবার চেষ্টা করে বলল–পাগলই পাগলি চেনে।
বাইরে বসন্তকালের সুন্দর বিকেল নেমেছে। পাখিদের ডাক শোনা যাচ্ছে। আমার এখানে একটা দিন থাকতে ইচ্ছে হচ্ছিল কিন্তু কর্নেল তাতে বাদ সাধলেন। আমি পার্কিং জোনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলুম। শমীকবাবু বললেন–আপনারা এখানেই দাঁড়ান। আমার ড্রাইভার মাধব আপনার গাড়ি এনে দিচ্ছে। বলে তিনি ডাক দিলেন–মাধব।
তখনই সকালে দেখা সেই লোকটা যেন মাটি খুঁড়ে বেরিয়ে আমাকে সেলাম দিয়ে বলল–গাড়ির চাবি দিন স্যার। আমি গাড়ি এনে দিচ্ছি।
চাবি নিয়ে সে আমার গাড়ির দিকে এগিয়ে গেল। ততক্ষণে রঞ্জনা নিজেই তার গাড়ির কাছে চলে গেছে। সাদা মারুতির দরজা খুলে সে গাড়ি স্টার্ট দেবার চেষ্টা করল। আমার গাড়িটা ততক্ষণে লনে এসে গেছে। আমি গাড়িতে উঠে গেলুম। কিন্তু কর্নেল গাড়িতে না উঠে পিছন ফিরে বললেন–রঞ্জনার গাড়ি স্টার্ট দিচ্ছে না। কিছু একটা গণ্ডগোল হয়েছে। আমি গিয়ে দেখি।
কর্নেল হন্তদন্ত পার্কিং জোনের দিকে এগিয়ে গেলেন। অগত্যা আমি গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়িয়ে রইলুম।
দেখলুম, রঞ্জনার গাড়ির বনেট তোলা, মাধব উঁকি মেরে ইঞ্জিনের ভিতর হাত ভরে কী সব নাড়াচাড়া করছে। কর্নেল গাড়ির ব্যাপারে কতটা বিশেষজ্ঞ, এ যাবৎ জানার সুযোগ পাইনি। কিন্তু তিনি এবং তার পাশে শমীকবাবু দাঁড়িয়ে কী সব। বলাবলি করছেন।
প্রায় কুড়ি-পঁচিশ মিনিট চেষ্টার পরেও গাড়ি স্টার্ট নিল না। শমীকবাবু সহাস্যে বললেন–দেখছ তো রঞ্জনা, তোমার বাহনের এখানেই থেকে যাবার ইচ্ছে। বরং মাধব আমার গাড়ি নিয়ে চলে যাক, তিন কিলোমিটার দূরে গাড়ি সারানোর একটা গ্যারেজ আছে। একজন মেকানিক ডেকে আনুক।
মাধব গম্ভীর মুখে বলল–আজকালকার এইসব গাড়ি একটুতেই বিগড়ে যায়।
ততক্ষণে রঞ্জনা গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়িয়েছে। তার মুখে ক্ষোভ, বিকেলের রোদে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। সে গাড়ির চাবি শমীকবাবুর হাতে দিয়ে বলল–আমার থাকার কোনও উপায় নেই। আমি জয়ন্তবাবুদের গাড়িতেই ফিরে যাচ্ছি।
শমীকবাবু বললেন–বাঃ, তারপর তোমার গাড়ি তোমার বাড়িতে কে পৌঁছে দিতে যাবে?
রঞ্জনা হাসবার চেষ্টা করে বলল–বাছুদাই পৌঁছে দেবে। ফিল্মের স্ক্রিপটাও আমাকে দিয়ে আসবে।
শমীকবাবু আবার একটা সিগারেট ধরিয়ে বললেন–ও! রঞ্জনা। তুমি আমার টেনশন বাড়িয়ে দিলে।
রঞ্জনা কোনও কথা না বলে আমার গাড়ির কাছে চলে এল। তার সঙ্গে কর্নেল আর শমীকবাবুও এলেন। কর্নেল বললেন–আমার সামনের সিটে বসার অভ্যাস। রঞ্জনা তুমি পিছনের সিটে আরাম করে বসো।
শমীকবাবু হাসতে হাসতে বললেন–মাইন্ড দ্যাট রঞ্জনা। তোমার গাড়ি আমি সারিয়ে দেব, কিন্তু তোমার গাড়ি তোমাকেই নিয়ে যেতে হবে।
রঞ্জনা নির্বিকার মুখে বলল–পরের কথা পরে।
এইসময় কর্নেল বলে উঠলেন–মাই গুডনেস! আমার ক্যামেরা আর বাইনোকুলার ওপরের দোতলার ঘরে রেখে এসেছি। আঃ কী ভুলো মন হয়ে যাচ্ছে দিনে দিনে। আসলে বয়স তো থেমে নেই।
তিনি গাড়ি থেকে নামবার চেষ্টা করতেই শমীকবাবু বললেন–আপনাকে কষ্ট করতে হবে না। নরহরি এনে দিচ্ছে। বলে তিনি হাঁক দিলেন–অ্যাই নরহরি।
.
০৫.
ফেরার পথে কর্নেল বাইনোকুলারে সম্ভবত পাখি খুঁজছিলেন। বিকেলের আলো ক্রমশ ফিকে হয়ে যাচ্ছিল। ব্যাকভিউ মিররে লক্ষ করছিলুম রঞ্জনা গম্ভীর মুখে বসে আছে। সুন্দরী মহিলাদের মুখে এধরনের গাম্ভীর্য আমার খারাপ লাগে। তাই মাঝে মাঝে একটু মুখ ঘুরিয়ে বলতে যাচ্ছিলুম, আমার গাড়িতে আপনার একটু অসুবিধা হতেই পারে। সেকেলে পুরোনো গাড়ি। কিন্তু প্রতিবারই কর্নেল ধমকের সুরে বলেছিলেন–হাইওয়েতে ড্রাইভ করছ, সাবধান জয়ন্ত। তাই রঞ্জনার সঙ্গে বার্তালাপের সুযোগই পাইনি। হাওড়া এলাকায় পৌঁছোনোর মুখেই প্রচণ্ড জ্যাম ছিল। এই সুযোগে কর্নেল হঠাৎ দরজা খুলে নেমেছিলেন। তারপর আমাকে অবাক করে ব্যাক সিটে রঞ্জনার পাশে গিয়ে বসেছিলেন।
রসিকতা করে বলেছিলুম-সাবধান রঞ্জনা! আমার বৃদ্ধ বন্ধু তোমাকে নিয়ে এমন খেলা শুরু করবেন যে তুমি টেরই পাবে না, তোমার পেট থেকে কী গুপ্ততথ্য উনি আদায় করে নিলেন?
রঞ্জনা এতক্ষণে একটু হেসে উঠেছিল। আমার কোনও গুপ্ততথ্য নেই। রাজকুমার একদিন ওভাবে প্রাণ হারাবে তা আমি জানতুম। কাজেই আমি তার সম্পর্কে যা জানি তা খুলে বলতে সবসময়ই তৈরি আছি। তা ছাড়া। কর্নেলসাহেবকে আমি নিজে থেকেই সাহায্য করতে চাই।
এরপর যানজট খুলে আমার গাড়ি যতই এগিয়েছে, ততই কানে এসেছে। কর্নেল আর রঞ্জনা চাপাস্বরে কথা বলছেন।
হাওড়া ব্রিজ পেরোনোর সময় কর্নেল বলেছিলেন–জয়ন্ত, রঞ্জনাকে নিউআলিপুরে তার বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে আমার বাড়ি ফিরব।
আমি বলেছিলুম–তা হলে আমাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যেতে হবে।
প্রথমে কর্নেলের, তারপর রঞ্জনার নির্দেশমতো একটা হাউসিং কমপ্লেক্সের গেটে পৌঁছে যখন গাড়ি দাঁড় করালুম, তখন প্রায় রাত আটটা বেজে এসেছে। রঞ্জনা গাড়ি থেকে নেমে কর্নেল এবং আমাকে বিদায় সম্ভাষণ করে গেটের একপাশ দিয়ে ভেতরে ঢুকে গেল। আমার চোখে পড়ল একজন উর্দি পরা দারোয়ান তাকে সেলাম দিচ্ছে।
কর্নেলের অ্যাপার্টমেন্টে ফেরার পর দেখি ড্রইং রুমের সোফায় প্রাইভেট ডিটেকটিভ হালদারমশাই নাক ডেকে ঘুমোচ্ছেন।
ষষ্ঠীচরণ বলল-উনি এক ঘন্টা আগে এসেছেন।
কর্নেল ঠোঁটে আঙুল রেখে ইশারায় তাকে থামিয়ে দিলেন। তারপর চাপাস্বরে বললেন–কফি।
ষষ্ঠী চলে গেল। কর্নেল চোখের ইশারায় আমাকে চুপ করে থাকতে বলে সাবধানে ইজিচেয়ারে বসলেন। আমি হালদারমশাইয়ের মাথার কাছে সোফার একটি আসনে চুপ করে বসলুম। তখনও হালদার মশাইয়ের নাক ডাকছিল। এবার দেখতে পেলুম তার মাথার তলায় তার ব্যাগ বালিশ হয়ে আছে। ব্যাগটা অবশ্য আমার চেনা। ওটার ভেতরে কী কী আছে আমি বলতে পারি। ছদ্মবেশ ধরতে যা যা লাগে সেই সব জিনিস।
একটু পরে গোয়েন্দাপ্রবরের নাক ডাকা থামল। তারপর তিনি চোখ খুললেন এবং তখনই তড়াক করে উঠে বসলেন। ফিক করে একটু হেসে তিনি বললেন–কর্নেল স্যার আইয়া পড়ছেন না কি আমি স্বপ্ন দেখতাছি।
কর্নেল বললেন–স্বপ্ন নয় হালদারমশাই। আগে বাথরুমে যান। চোখে জল ছিটিয়ে মুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে আসুন। আমি বুঝতে পেরেছি আপনার খুব ধকল গেছে।
–হঃ, ঠিক কইছেন। বলে তিনি সটান বাথরুমের দিকে চলে গেলেন। সেই সময় ষষ্ঠী ট্রেতে কফি আর স্ন্যাক্স সেন্টারটেবিলে রাখল। তারপর সে বলল-ওঃ বাবামশাই আপনারা যাবার পর থেকে খালি ফোন আর ফোন।
কর্নেল চোখ কটমটিয়ে বললেন–নামগুলো আর তাদের ফোন নম্বর লিখে রেখেছিস তো?
ষষ্ঠী বুকপকেট থেকে একটা কাগজ বের করে বলে–আজ্ঞে দুজন নাম বলেননি। তাদের মধ্যে একজন মেয়েছেলে। আর বাবামশাই নালবাজারের নাহিড়িসাহেব
কর্নেল কপট রাগ দেখিয়ে বললেন–আগে কাগজখানা দিবি তো। আর বল নালবাজারের নাহিড়িসাহেব তোকে কী বলেছেন?
ষষ্ঠী কাগজটা দিয়ে কাঁচুমাচু মুখে বলল-আজ্ঞে তিনি বলছিলেন আপনি ফিরলেই যেন ওনাকে ফোন করেন।
–ঠিক আছে। বলে কর্নেল দ্রুত কাগজটায় চোখ বুলিয়ে নিলেন।
এইসময়ই হালদারমশাই এসে পড়লেন। তিনি সোফায় তার ব্যাগের কাছে বসে বললেন–কফি খাইতে খাইতে কমু।
কর্নেল কফিতে চুমুক দিয়ে বললেন–আপনি আজ আবার সুজাতা দেবীর বাড়িতে যাননি তো?
হালদারমশাই বললেন–নাহ। গিছিলাম লাখখাঁটিয়া কোম্পানির অফিসে। মালিকের লগে দেখা করতে চাইছিলাম। কিন্তু উনি দেখা করলেন না। খুব বড় অফিস, অনেক লোক কাম করে। রিসেপশনিস্ট মাইয়াটা কইল–আপনি ওনার প্রাইভেট সেক্রেটারির লগে দেখা করতে পারেন।
–আপনি দেখা করলেন?
–হঃ। সে একজন বাঙালি পোলা। আমারে বসাইয়া কইল–কী কাম কন? আমি কইলাম-বড় বিপদে পড়ছি। আপনাগো কোম্পানির একজন লোক আমারে ঠকাইছে। সে কইল-কী নাম তার? আমি কইলাম-রাজকুমার রায়। অমনি সে খাপ্পা হইয়া কইল–ও নামে আমাদের কোনও লোক নাই। আপনি ভুল করছেন। আমি সুজাতা দেবীর থিকা রাজকুমার-এর একটা নেমকার্ড জোগাড় করছিলাম। কার্ডখান দেখাইয়া কইলাম–এই তো আপনাগো কোম্পানির লগে তার কাজকারবার আছে।
–তারপর কী হল?
হালদারমশাই ফিক করে হেসে বললেন–তখন যেন জোঁকের মুখে এক্কেরে লবণ পড়ছে। সে কইল-হা, এই লোকটার কথা ভুইলা গেছিলাম। অরে কোম্পানির কবে ছাড়াইয়া দিছে।
রাজকুমার রায় খুন হওয়ার কথা সে আপনাকে বলেনি?
-না, সে কয় নাই। একজন বেয়ারা সেই সময় কেবিনে ঢুকছিল। রাজকুমারের নামটা তার কানে গেছিল। সে কইয়া দিল–স্যার রাজকুমার রায় তো মার্ডার হইয়া গেছে,পুলিশ তার বডি পাইছে গড়ের মাঠে। কাগজে খবরটা বাইরাইছে। তখন সে পাশের টুল থেইকা চার-পাঁচখান কাগজ তুইলা নিল। তারপর পাতা উল্টাইয়া খবরখান পড়ল। তখন সে এক্কেরে একসাইটেড। আমারে কইল–আপনি অহন আইতে পারেন। আমি আরও দুই-চারখান কথা কওনের চেষ্টা করছিলাম, কিন্তু সে কইল–আমি অক্ষণে চইলা না গেলে সে লোক ডাকব। আমারে তার লোক জোর কইরা বাইরে ছুঁইড়া ফালাইব।
কর্নেল সহাস্যে বললেন–তখন আপনি নিশ্চয়ই কেটে পড়লেন?
-হঃ। ততক্ষণে আমি ধইরা ফেলছি খুব সেনসিটিভ স্পট এই রাজকুমার রায়।
কর্নেল বললেন–ধন্যবাদ, হালদারমশাই। আমার এটা জানার দরকার ছিল। আপনি ঠিকই ধরেছেন। রাজকুমার রায়ের হত্যাকণ্ড লাখখাঁটিয়া কোম্পানির কাছে সত্যি একটা সেনসিটিভ স্পট। তা এরপর আপনি কি ওই কোম্পানির অকশন হাউসে গিয়েছিলেন?
হালদারমশাই বললেন–হ্যাঁ, চৌরঙ্গিতে ওদের আর একটা লাল জিপ দাঁড়িয়ে ছিল। একজন পুলিশ অফিসার আমারে দেইখাই চিন্তে পারছিল। সে কইল–আরে, প্রাইভেট ঘুঘুমশাই এখানে ক্যান? আমি কইলাম–এদিকে একখানে গেছিলাম, হঠাৎ দেখি আপনাগো ভিড়। তাই ভাবলাম কোনও ডাকাতি হইছে নাকি মার্ডার। আমার চেনা অফিসার রাজেনবাবু কইল–মার্ডার। তবে এখানে না। গড়ের মাঠে। আমি আর কথা না বাড়াইয়া চইলা আইলাম।
কর্নেল চুরুটা ধরিয়ে হেলান দিয়ে বললেন–আর কিছু খবর আছে?
গোয়েন্দাপ্রবর আবার ফিক করে হেসে বললেন–আছে। আমার ক্লায়েন্ট মি. শিলাদিত্য সোমের অফিসে গেলাম। তখন প্রায় সাড়ে বারোটা বাজে। আইজ ওনার
অফিসে থাকার কথা ছিল। কিন্তু রিসেপশনিস্ট কইল মি. সোম আরজেন্ট কাজে বাইরে গেছেন। কী আর করি! মাইয়াটারে আমার কার্ড দেখাইয়া কইলাম–উনি আমার একখান কামের দায়িত্ব দিছেন। কামে অনেকটা সাকসেসফুল হইছি। তাই ওনারে আমার খুবই দরকার ছিল। সে কইল-সাহেব কোথায় গেছেন সে জানে না। সেখান থিকা আমি হোটেল এশিয়ায় গেলাম। ম্যানেজার মি. রঙ্গনাথন আমারে আপনার সাথে অনেকবার দেখছেন। তাই উনি আমারে চেনেন। উনি কইলেন–মি. সোম এই হোটেলেই ছিলেন। সকাল আটটায় হঠাৎ চেক আউট করছেন।
–আপনি আর কী করেছেন বলুন।
প্রাইভেট ডিটেকটিভ এবার গম্ভীর মুখে বললেন–আমি যে মোট চাইর জায়গায় ঘুরতাছি কিন্তু কল্পনাও করি নাই আমার পিছনে কোনও হালায় চর। লাগাইছে। হোটেল এশিয়া থিকা বাইরাইয়া টেক্সি খোঁজতাছি। খুদাও পাইছে। ভাবতাছিম বাড়ি গিয়া যাওয়ার পর একটুখানি রেস্ট লমু। তারপর আপনার এখানে আইবার প্লান ছিল। তো একখানা টেক্সি দাঁড় করাইছি, হঠাৎ আমার পিছন থিকা দুই হালায় আমার হাতের রিস্ট ধইরা ফেলল। তারপর একজন কইলটিকটিকির হাত দুইখান আগে ভাঙ্গুম, তারপর ঠ্যাং দুইখান ফাইরা ফেলব। হঠাৎ অ্যাটাকে আমি একটুখান নারভাস হইয়া পড়ছিলাম। আমার প্যান্টের পকেটে গুলি ভরা ফায়ার আর্মস আছে। কিন্তু তারা আমার দুইখান হাত ধইরা মোচড়। দিতাছে, তারপরই সেন্স ফিরল। পুলিশ লাইফে কত সাংঘাতিক গুন্ডারে ঢিট করছি। বুঝলেন না?
কর্নেল সহাস্যে বললেন–বুঝলুম। আপনার পুলিশের ট্রেনিং কাজে লাগালেন।
হঃ। হালদারমশাই উঠে দাঁড়ালেন, তারপর কীভাবে দুজনকে ঢিট করেছেন। সেই ভঙ্গিটা দেখালেন। সোফায় বসে এবার তিনি সহাস্যে বললেন–দুই হালার তলপেটে পর পর দুইখান বুটের ডগার হেভি স্ট্রাইক, দুজনেই বাপরে কইয়া ছিটকাইয়া পড়ল। টেক্সির দরজা খুইলা ভেতরে বসলাম। তারপর রিভলবার বাইর কইরা পিছনের দিকে সেই দুই শয়তানেরে হুমকি দিলাম–খুলি উড়াইয়া দিমু।
কর্নেল সকৌতুকে জিজ্ঞেস করলেন–দু-এক রাউন্ড ফায়ার করেননি তো?
-না, তবে টেক্সিওয়ালা আমার হাতে রিভলবার দেইখা ভয় পাইছিল। সে কইল–কোথায় যাবেন স্যার? কইলাম–সর্টকার্টে লেকভিউ রোড।
এতক্ষণ আমি বললুম–আপনার দুই রিস্টে ব্যথা করছে না তো?
গোয়েন্দাপ্রবর বললেন–ও কিছু না। এবার আপনারা কন। আপনারা কোথায় গেছিলেন?
কর্নেল বললেন কলকাতার বাইরে একখান বিরল জাতের প্রজাপতির খবর পেয়েছিলুম। সেই প্রজাপতি ধরতে বেরিয়ে পড়েছিলুম।
হালদারমশাই অবাক হয়ে বললেন–কী কাণ্ড! এমন একখান হেভি মিস্ত্রির চেয়ে প্রজাপতির পেছনে ছুটছিলেন।
কর্নেল মুচকি হেসে বললেন–সেই প্রজাপতি কম মিস্টিরিয়াস নয় হালদারমশাই।
হালদারমশাই হতাশ ভঙ্গিতে বললেন–যাউক গিয়া। সেই প্রজাপতি কি দেখছেন?
-দেখছি মানে? ধরে ফেলেছি।
–কন কী!
–হ্যাঁ, আপনাকে যথাসময়ে দেখাব।
প্রাইভেট ডিটেকটিভ হাই তুলে বললেন–এবার আমি কী করুম তা-ই কন? কর্নেল বললেন–আইনত মি. শিলাদিত্য সোম আপনার একজন ক্লায়েন্ট। আমার ধারণা রাজকুমার রায়ের হত্যাকাণ্ড খবরের কাগজে পড়েই তিনি কলকাতা ছেড়ে সম্ভবত রায়ডিহিতে নিজের বাড়িতে চলে গেছেন। তার এই হঠাৎ করে চলে যাওয়া–বিশেষত আপনাকে কিছু না জানিয়ে চলে যাওয়া তার উচিত হয়নি। তবে হালদারমশাই এই উচিত-অনুচিতের কথা মি. সোমের সঙ্গে দেখা হলে তার যেন বলবেন না। বরং আপনি তার হয়ে রাজকুমার রায়ের সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করতে গিয়ে যা কিছু পেয়েছেন সবই তাঁকে বলবেন। কিছু গোপন করবেন না। আপনার কথা শুনে তার কী রিঅ্যাকশন হয় তা লক্ষ করবেন এবং তিনি যা করতে বলবেন তা-ই করবেন।
হালদারমশাই বললেন–কিন্তু তারে পাইতাছি কোথায়?
–রায়ডিহিতে।
গোয়েন্দাপ্রবর চমকে উঠেছিলেন। রায়ডিহি গেলে সেখানে তারে পামু?
কর্নেল বললেন–আমার দৃঢ় বিশ্বাস সেখানে তাকে পাবেন। আজ রাতের ট্রেনেই আপনি সেখানে চলে যান। আমি আপনাকে কীভাবে যাবেন তা একটা কাগজে লিখে দিচ্ছি। খুব সুন্দর হিল স্টেশন রায়ডিহি। সেখানে শীতের সময় প্রচুর ট্যুরিস্ট যায়। এখনও এই মার্চ মাসে অনেক ট্যুরিস্টের দেখা পাবেন। আর আপনার ক্লায়েন্ট সেখানকার ঠিকানা তো আপনাকে দিয়েই গেছেন। তাঁর বাংলোবাড়িটা ওখানকার লোকেরা চেনে।
বলে কর্নেল টেবিল থেকে একটা কাগজের প্যাড টেনে কী সব লিখছিলেন।
হালদারমশাই সেই কাগজটা বিড়বিড় করে পড়ার পর ভাঁজ করে পকেটে ভরলেন। তারপর তিনি তাঁর ব্যাগটা তুলে নিয়ে কাঠে ঝুলিয়ে বললেন– কর্নেল স্যার! জয়ন্তবাবু! তা হইলে আমি যাই গিয়া।
হালদারমশাই বেরিয়ে যাবার পর বললুমআমি তো আজ অনেককিছু সূত্রে পেয়েছেন। ব্যাক সিটে বসে রঞ্জনা আপনাকে আশা করি অনেক ভাইটাল সূত্র দিয়েছে। কিন্তু আমি একটা ভালো জিনিস হাত ছাড়া করে এসেছি।
কর্নেল একটু হেসে জিজ্ঞেস করলেন–সেটা কি মার্কিন সিগারেট মার্লবোরোর একটা প্যাকেট, নাকি অন্য কিছু?
বললুম না। সিগারেট যদিও ছেড়ে দিয়েছি। আপনার এই রুমে চুরুট টানা দেখে মাঝে মাঝে ভাবি–আবার ধরি। কিন্তু আপনার তত মিলিটারি শরীর। তাই সাহস পাই না। আজ শমীকবাবুর বাগানবাড়িতে মালবোরোর স্বাদ আমাকে বুগ্ধ করেছিল। শুধু বুঝতে পারছি না, আমার না হয় মনে পড়ল না কিন্তু শমীকবাবুর কথা রাখা উচিত ছিল। অথচ উনি যেন বড্ড ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন রঞ্জনাকে আটকে রাখতে। যা-ই বলুন কর্নেল, আমার ঘোরতর সন্দেহ শমীকবাবুই দুষ্টুমি করে রঞ্জনার গাড়িটা কখন গোপনে বিগড়ে দিয়েছিলেন।
কর্নেল হাসলেন। রঞ্জনারও সেই সন্দেহ। সে আমাকে বলছিল–শমীকবাবু লোকটি মাঝে মাঝে বড্ড দুষ্টুমি করেন। তা ছাড়া খামখেয়ালিও বটে।
কথাটা বলে কর্নেল টেলিফোনের রিসিভার তুলে ডায়াল করলেন। তারপর সাড়া পেয়ে বললেন–অরিজিৎ আমার সৌভাগ্য যে তোমাকে এখন বাড়িতে পেলুম।
—–
-না, না, আমি গিয়েছিলুম আমার এক স্নেহভাজন বন্ধুর বাগানবাড়িতে। তারও আমার মতো বিরল প্রজাতির প্রজাপতি সংগ্রহের বাতিক আছে। তাই–
-না, প্রজাপতি আমি রূপকার্থে বলিনি।
—–
-ওহ ডার্লিং, তোমার লোকজনের দৃষ্টি মাঝে মাঝে আমাকে অবাক করে। অতএব স্বীকার করছি, তুমি প্রজাপতিটিকে যে নাম দিলে তা ঠিক। যাই হোক, তোমরা তো আমার চেয়েও ঘুঘু।
—–
-কী বললে? সরকারি ঘুঘু! বাহ, উপমাটি লাগসই। তো শোন– নরেশবাবুর কাছ থেকে ভিকটিমের পার্সে পাওয়া যা যা নিয়েছি, সবই ফেরত দিতে চাই। তুমি ওকে—
—–
–হ্যাঁ, আমার ধারণাও তা-ই। খুনি যারাই হোক, তারা ডেড বডি ফেলে দেবার কাজে এমন ব্যস্ত ছিল যে, ভিকটিমের পকেট সার্চ করে কোনও জিনিস নিয়ে যেতে ভুলে গেছিল। তুমি ঠিকই বলেছ অরিজিৎ। অপরাধীরা সর্বত্র নিজেদের অজ্ঞাতসারে এমন কিছু সূত্র রেখে যায় যা তাদের শনাক্ত করতে সাহায্য করে।
—–
–ঠিক বলেছ, তোমার সঙ্গে মুখোমুখি কাল দেখা হতেও পারে। আপাতত তুমি নরেশবাবুকে জানিয়ে দাও, আজ রাত্রে না হোক, কাল সকাল ন-টার মধ্যে তিনি যেন জিনিসগুলো ফেরত নিয়ে যান। গুড নাইট অরিজিৎ। রাখছি।
কর্নেল রিসিভার রেখে ঘুরে বসলেন, চাপাস্বরে জিজ্ঞেস করলুম-ডি. সি. ডি. ডি. লাহিড়িসাহেব কি তার হাতের তাসের অন্তত একখানিও আপনাকে দেখালেন?
কর্নেল নিভে যাওয়া চুরুটটা লাইটার জ্বেলে ধরিয়ে নিয়ে একরাশ ধোঁয়া ছাড়লেন। তারপর মৃদুস্বরে বললেন–পুলিশের নিজস্ব তদন্তরীতি আছে। আমার সঙ্গে তা মিলবে না। অরিজিৎ বলল-মর্গের রিপোর্ট অনুসারে রাজকুমারের পেটে যথেষ্ট অ্যালকোহল পাওয়া গেছে। তার মানে, কোনও কারণে তাকে প্রচুর মদ খাইয়ে তারপর গুলি করা হয়েছিল। পয়েন্ট আটত্রিশ ক্যালিবারের রিভলবারের একটা মাত্র গুলি। বুলেট খোলটা মাথার খুলির একটা খাঁজে আটকে ছিল।
বললুম–ভিকটিমের পার্সে পাওয়া চিঠিটা থেকে প্রমাণ হচ্ছে কেউ মুনলাইট বারে তাকে টাকা ভর্তি ব্রিফকেস দিয়েছিল, তার বদলে তার যে জিনিসটা দেবার কথা ছিল সে তা দিতে পারেনি।
কর্নেল ভুরু কুঁচকে বললেন–পারেনি বলছ কেন?
একটু ভেবে নিয়ে বললুম–টাকা যখন সে পেয়েই গেছিল, তখন সাধারণজ্ঞানে বলে, জিনিসটা তার না দেওয়ার কারণ ছিল না। কিন্তু যে কারণেই হোক জিনিসটা সে দিতে পারেনি।
–তার মানে তুমি বলতে চাইছ, সেই জিনিসটা রাজকুমারের অগোচরে কেউ হাতিয়ে নিয়েছিল?
আমার যুক্তি তো তা-ই বলে। জিনিসটা দিতে পারলে তাকে খুন হতে হবে কেন?
কর্নেল হেসে উঠলেন, বললেন–এমনও তো হতে পারে জিনিস হাতানো গেল অথচ টাকা দিতে হল না, ঠিক এই কারণেই রাজকুমারকে প্রাণে মারা হয়েছে।
আমি তর্কের ছলে বললুম–কর্নেল, অঙ্কটা আমি যদি অন্যভাবে কষি?
-কীভাবে শুনি।
–ভুললে চলবে না কর্নেল, রাজকুমার রায় ছিল একজন ধুরন্ধর এজেন্ট। বহু দামি জিনিস অল্প দামে হাতিয়ে সে লাখখাঁটিয়া কোম্পানিকে বেচেছে, কিংবা দরে না পোষালে বাইরে চালান করে দিয়েছে। এই ধরনের লোকেরা কাঁচাকাজ করে না। এক্ষেত্রে আমি বলব–টাকা সে ঠাণ্ডা মাথায় গুনে নিয়ে কোথাও তা সুরক্ষিত রেখে তারপর জিনিস দেবার কথা ভেবেছে, কিন্তু সেই জিনিস সে খুঁজে পায়নি। কেউ চোরের ওপর বাটপাড়ি করেছে। এরপর কল্পনা করা যাক সে তার ঘাতকদের কাছে সময় চেয়ে মদের আসর বসিয়েছে। তারপর–
কর্নেলের বিখ্যাত সেই অট্টহাসিতে ড্রইং রুম কেঁপে উঠল। তিনি উঠে দাঁড়িয়ে বললেন–তোমার কল্পনাশক্তির প্রশংসা করছি। কিন্তু রাত সাড়ে নয়টা বাজে, পোশাক বদলে আসি, তুমিও পোশাক বদলে এসো। আর একপ্রস্থ কফি খেলে স্নায়ুর বৈকল্য কেটে যাবে। গাড়ি চালিয়ে তোমারই বেশি ক্লান্তি।
কিছুক্ষণ পরে আমরা পোশাক বদলে কফি খাচ্ছিলুম, সেইসময়ই ডোরবেল বাজল, কর্নেল যথারীতি হাঁক দিলেন–ষষ্ঠী।
একটু পরে প্রৌঢ়া মহিলা ঘরে ঢুকলেন। তাঁর তাগড়াই চেহারা, পরনে সাদাশাড়ি, সিঁথিতে সিন্দুর নেই, হাত দু-খানিও আভরণহীন।
কর্নেল তাঁকে দেখেই উঠে দাঁড়িয়েছিলেন। বললেন–আসুন, আসুন সুজাতা দেবী। আমি আপনার কথাই ভাবছিলুম।
ভদ্রমহিলা চড়া গলায় বললেন–আমি বসতে আসিনি কর্নেলসাহেব। শুধু একটা কথা বলতে এসেছি। তাকে থামিয়ে কর্নেল বললেন–এক মিনিট। আমি অনুমানে আপনাকে চিনতে পেরেছি। কিন্তু আপনি কী করে আমাকে চিনলেন? আমার বাড়ির ঠিকানাই বা কে আপনাকে দিল?
সুজাতা দেবী তেমনি চড়া গলায় বললেন–আজ সকালে যে প্রাইভেট টিকটিকিবাবুটি আমার বাড়ি গিয়েছিল সেই মুখপোড়াই আপনার নাম-ঠিকানা দিয়ে বলেছিল–কোনও বিপদ-আপদ হলে আমি যেন আপনার কাছে আসি। আপনার চেহারার বর্ণনা সে দিয়েছিল। তাই ঘরে ঢুকেই আপনাকে চিনেছি।
কর্নেল নম্রভাবে বললেন–প্লিজ সুজাতা দেবী, আগে আপনি বসুন, তারপর ঠাণ্ডা মাথায় বলুন কী হয়েছে?
মহিলাকে দেখে আমার মনে হচ্ছিল এঁদেরই একসময় তা হলে রায়বাঘিনি বলা হত। তিনি কর্নেলের কথায় কান না দিয়ে বললেন–আমার ঘরে টেবিলের নীচের ড্রয়ারে হতভাগা রাজুর কিছু কাগজপত্তর ছিল, মুখপোড়া টিকটিকিবাবুকে মুখ ফসকে বলে ফেলেছিলুম–এগুলোর মধ্যে থেকেই রাজুকে খুনের কারণ এবং তার খুনিকে খুঁজে পাওয়া যেতে পারে। আজ সন্ধ্যার আগে রাজুর লাশ মর্গ থেকে ডেলিভারি নিয়ে নিমতলা শ্মশানে দাহ করতে গিয়েছিলাম। সেই সুযোগে মুখপোড়া টিকটিকিবাবু সেই গোপন কাগজপত্তর ঘরের তালা ভেঙে চুরি করে পালিয়েছে।
কর্নেল বললেন–কিন্তু তিনিই যে চুরি করেছেন তার কোনও প্রমাণ পেয়েছেন?
রায়বাঘিনি প্রায় গর্জন করে বললেন–সে ছাড়া আর কেউ নয়। কারণ তাকে ছাড়া এ পর্যন্ত কাউকেও ওই কাগজগুলোর কথা বলিনি।
কর্নেল একটু হেসে বললেন–সেই টিকটিকিবাবুর খোঁজেই কি আপনি আমার কাছে এসেছেন?
হ্যাঁ, তার ঠিকানা তো আমি জানি না। বলে কোমরের কাছে কাপড়ের একটা ভাঁজ খুলে দলা পাকানো একটা কাগজ বের করে সেটা খুললেন। বললেন–এই দেখুন তার নিজের হাতে লেখা আপনার নাম-ঠিকানা। এবার আপনি তাকে খবর দিয়ে বলুন যেন এক্ষুনি কাগজগুলো সে এখানে নিয়ে আসে।
কর্নেল বললেন–কিন্তু দুঃখের কথা সুজাতা দেবী, প্রাইভেট ডিটেকটিভ মি. হালদার আজ রাতের ট্রেনে রায়ডিহি গেছেন।
কথাটা শুনেই চোখ কপালে তুলে সুজাতা দেবী বললেন–আঁ! সে আমার বাপের বাড়ির দেশে গেছে! কেন বলুন তো?
কর্নেল একটু হেসে বললেন–আপনার ভাই রাজকুমারবাবুর খুনিদের খোঁজেই সেখানে গেছেন।
এবার সুজাতা দেবী বলে উঠলেন–সব চালাকি। ওই টিকটিকিবাবুই খুনির পক্ষের লোক। রাজু যে জিনিসটা বেচব বলেও বেচেনি, তারাই সেই জিনিসটার খোঁজে আমাদের পৈতৃক বাড়িতে হানা দিতে গেছে। দেখাচ্ছি মজা। বলে তিনি সবেগে ধুপধাপ শব্দ তুলে বেরিয়ে গেলেন।
.
০৬.
পরদিন সকালে কর্নেলের সঙ্গে কফি খেতে খেতে সুজাতা দেবীকে নিয়ে আলোচনা করছিলুম। আমার মতে সুজাতা দেবীর মুখে তার ভাইয়ের সেই গোপন জিনিসটারই কথা শুনেছি, যার জন্য তার ভাইয়ের প্রাণ গেল। তার মানে, ওই জিনিসটার কথা সুজাতা বিলক্ষণ জানেন এবং এ-ও বোঝা গেছে, সেটা সম্ভবত কোথায় লুকোনো আছে তা তিনি জানেন।
কর্নেল সায় দিয়ে বললেন–তুমি ঠিকই ধরেছ। কিন্তু সমস্যা হল ভদ্রমহিলার সঙ্গে ওই ব্যাপার কথা বলতে যাওয়া নিরাপদ নয়।
আমি হাসতে হাসতে বললুম–হা, রায়বাঘিনি আপনাকে কড়মড়িয়ে খেয়ে হজম করে ফেলবেন।
এইসময়ই টেলিফোন বাজল। কর্নেল রিসিভার তুলে সাড়া দিলেন। তারপর বললেন–বাঃ হালদারমশাই তা হলে নিরাপদে পৌঁছে গেছেন। আপনার ক্লায়েন্টের খবর বলুন।
—–
–সে কী! মি. সোম রায়ডিহিতে যাননি। আপনি শিয়োর।
—–
-তা হলে আপনি এক কাজ করুন, এমনও হতে পারে মি. সোম আপনার। মুখোমুখি হতে চান না। তাই বাড়ির লোকদের আপনার সম্পর্কে সতর্ক করে দিয়েছেন। কিন্তু আমি আপনাকে একটা পরামর্শ দিচ্ছি।
—–
–আপনি তো পুলিশ লাইফ থেকেই ছদ্মবেশ ধরতে ওস্তাদ। বিশেষ করে আমার পাল্লায় পড়েও আপনাকে বহুবার ছদ্মবেশ ধরতে হয়েছে। আপনি বরং একটা হোটেলে ঘর বুক করুন। তারপর সেখান থেকে বেরিয়ে গিয়ে কোনও গোপন স্থানে ছদ্মবেশে ধারণ করুন।
—–
–বাঃ ঠিক বলেছেন। সাধুবাবার ছদ্মবেশেই আপনাকে মানায় ভালো। ওই এলাকার বন-জঙ্গল ও পাহাড়ে গোপন জায়গায় অভাব নেই। সেখান থেকে ছদ্মবেশে ধরে বেরিয়ে আপনি মি. সোমের বাড়ির কাছাকাছি কোথাও ধুনি জ্বালিয়ে ধ্যানে বসুন। হাওর বাড়ির কাছাকাছি একটা প্রকাণ্ড বট গাছ আছে, তার তলাতেই আপনি ধুনি জ্বেলে বসুন এবং মি. সোমের বাংলোবাড়ির দিকে লক্ষ রাখুন।
—–
–আপনি তাকে দেখতে পেলে সোজা উঠে গিয়ে নিজের পরিচয় দেবেন। তারপর ওঁকে সব কথা খুলে বলবেন। তা ছাড়া জানতে চাইবেন উনি কেন আপনাকে এভাবে এড়িয়ে চলতে চেয়েছিলেন। এ লাইনে আপনি একজন দক্ষ লোক। আপনাকে বেশি কথা বলার দরকার দেখছি না। তবে একটা কথা মি. সোমকে দেখা পেলে বলবেন, তিনি যেন অবিলম্বে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেন। আপনি সোজা বলবেন মি. সোম আপনি বিপন্ন। ব্যস।
কর্নেল রিসিভার রেখে আমার দিকে তাকালেন, বললুম–কে জানে কেন গোড়া থেকেই মি. সোমকে আমার ভালো ঠেকছে না।
কর্নেল আমার কথার কোনও জবাব না দিয়ে তার সাদা দাড়িতে আঁচড় কাটতে থাকলেন।
কিছুক্ষণ পরে ডোরবেল বাজল। তারপর কর্নেল যথারীতি ষষ্ঠী বলে হাঁক দিয়ে মিটিমিটি হেসে চাপাস্বরে বললেন–ডার্লিং, তোমার প্রাপ্য মার্লবোরো সিগারেটের প্যাকেট সম্ভবত এখনই তোমার হাতে পৌঁছে যাবে। একটু পরে আমি অবাক হয়ে দেখলুম শমীক লাহিড়ি আর রঞ্জনা দেবী ঘরে ঢুকছেন। কর্নেল বললেন ওয়েলকাম মি. লাহিড়ি। ওয়েলকাম মিস রঞ্জনা রায়। আপনাদের গন্ধ আমি আগেই পেয়ে গেছি। জয়ন্তকে জিজ্ঞাসা করে দেখুন।
দুজনে সোফায় বসার পর আমি বললুম–কর্নেল বলছিলেন–আমার প্রাপ্য এক প্যাকেট মার্লবোরো সিগারেট এক্ষুনি নাকি আমার হাতে পৌঁছে যাবে।
শমীকবাবু হাসতে হাসতে তার রংচংয়ে পাঞ্জাবির পকেট থেকে সেই সিগারেটের প্যাকেট বের করে আমার হাতে গুঁজে দিলেন। বললেন–এই জন্য। আমরা মানে ওঁর প্রিয়জনরা ওঁকে অন্তর্যামী বলে থাকি।
কর্নেল একটু হেসে বললেন–অন্তর্যামী নই। আসলে দোতলায় মিসেস লিন্ডার কুকুরের হাঁকডাক শুনে বুঝতে পারি যিনি আসছেন তিনি কুকুরটার চেনা না অচেনা। দ্বিতীয়ত, একাধিক ব্যক্তি হলে কুকুরটা অদ্ভুত শব্দে ডাকাডাকি করে। মি. লাহিড়ি, আমার এই কান সামরিকজীবন থেকেই খুব প্রখর। যাই হোক, এছাড়াও আমার ইনটিউশন বলছিল, হয় আপনি কিংবা রঞ্জনা আমার কাছে আসবেন।
রঞ্জনা অপরূপ ভ্রূ-ভঙ্গি করে এবং ঠোঁটের কোনায় কেমন একটা হেসে বলে উঠল–বাচ্চুদার কথা বলতে পারছি না, তবে আমি আসব সে কথা আপনার মাথায় এসেছিল কেন তা কি জানতে পারি?
কর্নেল মুখে হাসি রেখেই বললেন–সে কথা তোমার নিজের জানা। জয়ন্তের গাড়িতে কাল সন্ধ্যায় তুমি যে সব কথা বলেছিলে তাতেই তোমার প্রশ্নের উত্তর লুকিয়ে আছে।
এদিকে শমীকবাবু সিগারেটের প্যাকেটটা আমাকে খুলতে না দিয়ে তিনি পকেট থেকে একটা ভোলা প্যাকেট বের করলেন। তারপর আমাকে সিগারেট দিয়ে। নিজেও একটা নিলেন। লাইটার জ্বেলে আমার সিগারেট ধরিয়ে দিয়ে নিজেরটা ধরালেন। তারপর বললেন–আমি সিগারেট ছাড়ব-ছাড়ব করার তালে ছিলুম, কিন্তু কাল কর্নেলসাহেব গিয়ে আমাকে এমন টেনশনে আটকে দিয়েছেন–বলার নয়।
কর্নেল একটু গম্ভীর হয়ে বললেন–আর ইউ সিরিয়াস মি. লাহিড়ি?
–অফকোর্স। বলে শমীকবাবু গলার স্বর চাপা করলেন–রাজকুমার রায়ের সঙ্গে আমার একসময় কিছুটা ঘনিষ্ঠতা ছিল। বিশেষ করে আমার ফিল্মের প্রয়োজনে কোনও সেটে সেকেলে বনেদি বাড়ির আসবাবপত্রের দরকার থাকলে, রাজকুমার সেগুলো ভাড়ায় জোগাড় করে দিত। অকশন হাউসের এজেন্ট হওয়ার সুযোগে, শুধু কলকাতা কেন মফসসল শহরেরও রাজা-জমিদার বংশের লোকেদের সঙ্গে তার পরিচয় ছিল। দরকার হলে তাদের বাড়িতে গিয়েও আমার টিম শুটিং করেছে। রঞ্জনা তোমার নিশ্চয়ই মনে আছে, নবাবগঞ্জের প্যালেসে তোমাকে নিয়ে শুটিং করেছিলুম। তো, এসবের জন্য রাজকুমারকে আমি ভালো কমিশন দিতুম। পরে রাজকুমার কী একটা পুলিশ কেসে জড়িয়ে পড়েছিল। তারপর থেকে তার সঙ্গে আর আমার যোগাযোগ ছিল না। সেই রাজকুমার খুন হয়েছে, এবং কালকের কাগজে তার খবর বেরিয়েছে। তার ওপর স্বয়ং কর্নেল নীলাদ্রি সরকার আমার বাগানবাড়িতে যেতে চেয়ে আমাকে ফোন করেছিলেন। ব্যাকগ্রাউন্ডটা আশা ক্লিয়ার হয়েছে।
রঞ্জনা বলল–এতে তোমার টেনশনের কারণ কী বুঝলুম না। তুমি যখন আমাকে কর্নেলের নাম করে ডেকে পাঠালে, তখন আমি অলরেডি পুলিশের জেরায় আক্রান্ত। অথচ আমি দিব্যি তোমার কাছে ছুটে গেলুম। আমার কিন্তু কোনও টেনশন হয়নি। এখনও হচ্ছে না। একটা বজ্জাত তার অপরাধের শাস্তি পেয়েছে। তাতে আমি খুশি।
শমীকবাবু ভুরু কুঁচকে তার দিকে তাকালেন। বললেন–তা হলে তুমি নিশ্চয়ই জানো রাজকুমার কোন্ অপরাধের শাস্তি পেল।
লক্ষ করলুম, রঞ্জনার মুখটা কয়েক সেকেন্ডের জন্য লাল হয়ে উঠে নির্বিকার দেখাল। সে বলল–নির্দিষ্ট কোনও অপরাধের কথা আমি জানি না এবং বলতেও চাই না। তুমি ভালোই জানো বাছুদা, রাজকুমারের একটা ডার্কসাইড ছিল।
শমীকবাবু ঠোঁটের কোণে বাঁকা হেসে বললেন–অন্তত এটুকু জানি, তুমি রাজকুমারের ডাকসাইডটা আমার চেয়ে অনেক বেশি জানো।
রঞ্জনা তেতো হাসির সঙ্গে বলল–সেটা টের পেয়ে রাফিয়ানটার সঙ্গ ছেড়েছিলুম কিন্তু একটা কথা শোনো বাছুদা, আমরা এখানে কর্নেলসাহেবের বাড়িতে তার সামনে বসে ঝগড়া করতে আসিনি।
ইতিমধ্যে ষষ্ঠীচরণ ট্রেতে কফি রেখে গিয়েছিল। কর্নেলের তাড়ায় ওরা কফির পেয়ালা তুলে নিলেন। কর্নেল কফিতে চুমুক দিয়ে বললেন–এসব ঝগড়াঝাটি নয়, একটা মৃত মানুষ সম্পর্কে বিতর্ক মাত্র। কাজেই আমি যদি রাজকুমারবাবুকে চিনতুম, তা হলে আমিও বিতর্কে যোগ দিতুম। বাই দা বাই, রঞ্জনার গাড়ি আশা করি সচল হয়ে কলকাতা পৌঁছেছে।
শমীকবাবু বললেন–জানেন কর্নেল, রঞ্জনার গাড়ির একটা দামি পার্টস এমনভাবে বিগড়ে গিয়েছিল ফেরার পথে তো বটেই, আসবার পথে কেন যে। অ্যাকসিডেন্ট হয়নি এটাই আমার আশ্চর্য লেগেছে। আসলে রঞ্জনার ভাগ্যটা ঈর্ষাজনক। কোন্ শুভগ্রহ যে ওকে গার্ড দিয়ে আসছে। সেটা জ্যোতিষীই বলতে পারেন। রঞ্জনা চুপচাপ কফি খেতে থাকল। কর্নেল বললেন–মি. লাহিড়ি কি আবার বাগানবাড়িতে ফিরবেন?
শমীকবাবু বললেন–না, আমার নতুন ছবির ব্যাপারে প্রাথমিক কাজকর্ম এবার শিগগির সেরে ফেলতে হবে। ছবির ডাইরেক্টর প্রতীক বাগচি বলছিলেন–একটা আউটডোর লোকেশন খুঁজে বের করতে হবে।
কর্নেল বললেন–কী ধরনের জায়গা আপনাদের দরকার।
শমীকবাবু বললেন–মাই গুডনেস! কর্নেলসাহেব আপনিই তো এ ব্যাপারে হেল্প করতে পারেন। আপনি সর্বচর মানুষ। আমাদের দরকার এমন একটা জায়গা যেখানে জঙ্গল, পাহাড় ঝরনা–এসব আছে।
কর্নেল বললেন–তা হলে আমি বলব বিহারের ছোটনাগপুর এলাকার রায়ডিহিতে চলে যান। ওখানে থাকার জায়গা প্রচুর। ট্যুরিস্ট বাংলো, ডাকবাংলো ইত্যাদি ছাড়াও ফরেস্টবাংলো তো আছেই, প্রাইভেট লজেরও অভাব নেই।
আমি, শমীকবাবু ও রঞ্জনার দিকে তাকিয়ে ছিলুম। দেখলুম রঞ্জনার চোখে চমক ঝিলিক দিল। আর শমীকবাবু নির্বিকার ভঙ্গিতে বললেন–রায়ডিহিতে তিনবার শুটিং করেছি। প্রথমবার রঞ্জনা ছিল হিরোইন। তার চেয়ে খুলে বলা ভালো, দ্যাট রোচড ফেলা –আই মিন, দা পুয়োর ভিকটিম রাজকুমারের পৈতৃক বাড়িই রায়ডিহিতে। কাজেই সে আমাদের তিনবারই অনেক সাহায্য করেছিল।
কর্নেল বললেন–বাই এনি চান্স শিলাদিত্য সোম নামে আপনি কি কাউকে চেনেন? রায়ডিহির একজন শিল্পপতিও বলা যায় তাকে।
শমীকবাবু বললেন–নামটা চেনা চেনা মনে হচ্ছে। কিন্তু ঠিক মনে করতে পারছি না।
রঞ্জনা মৃদুস্বরে বলল–এই ভদ্রলোককে আমি চিনি। মানে চিনতুম। দু-তিন বছর আগে হোটেল কন্টিনেন্টাল-এ একটা পার্টিতে রাজকুমার আমাকে তার সঙ্গে আলাপ করে দিয়েছিল। তার কিছুকাল পরে রাজকুমার আমাকে বলেছিল–তার এই বাল্যবন্ধু এখন তার প্রচণ্ড শক্র। মিথ্যা করে একটা পুলিশ কেসে ফাঁসিয়ে রাজকুমারকে তিনি নাকি ব্ল্যাকমেল করছেন। তার কিছুদিন পরেই রাজকুমার– নিপাত্তা হয়ে যায়। আমিও তখন তাকে ত্যাগ করেছি। কারণ তার ব্ল্যাক সাইড আমার কাছে আর মেনে নেওয়া সম্ভব হচ্ছিল না।
কর্নেল বললেন–থাক এসব কথা। বরং মি. লাহিড়ি তার নতুন ছবি উপলক্ষে কবে কোথায় পার্টি দিচ্ছেন বলুন।
শমীক লাহিড়ি সহাস্যে বললেন–অবশ্যই আপনি আর জয়ন্তবাবু যথাসময়ে আমন্ত্রণপত্র পাবেন। বলে তিনি ঘড়ি দেখে উঠে দাঁড়ালেন।-সর্বনাশ, এগারোটা বাজতে চলল। প্রতীক আমার বাড়িতে হিরোইনকে নিয়ে এগারোটায় পৌঁছোবে। কর্নেলসাহেব একটা ফোন করতে পারি?
কর্নেল টেলিফোন বক্সটা তুলে সেন্টার টেবিলে রাখলেন।
শমীকবাবু রিসিভার তুলে ডায়াল করে বললেন–নীলা! আমি একটা কাজে বেরিয়ে ছিলাম। তোমার প্রতীককাকু এলে বসতে বলবে। আমি এখনই যাচ্ছি। তিনি রিসিভার রেখে ফোন বক্সটা উঁচু টেবিলে যথাস্থানে রেখে দিলেন। তারপর রঞ্জনার দিকে ঘুরে তাকালেন।
রঞ্জনা বলল–আমার কোনও তাড়া নেই। আমি কর্নেলসাহেবের সঙ্গে গল্প করতে এসেছি। বাচ্চুদা লক্ষ্মীটি একটা ট্যাক্সি ডেকে নিয়ে তুমি চলে যেয়ো। অনেক ট্যাক্সি পেয়ে যাবে।
শমীকবাবু হো হো করে হেসে বললেন–দেখছেন কর্নেলসাহেব। একেই বলে গাছে তুলে দিয়ে মই কেড়ে দেওয়া। দৈবাৎ ট্যাক্সি পাই তো ভালো, তা না হলে বাসেই যেতে হবে।
রঞ্জনা চুপ করে থাকল। শমীকবাবু বেরিয়ে যাবার সময় একবার ঘুরে দাঁড়িয়ে বললেন–তোমাকে এর শাস্তি দেব। কী শাস্তি জানো? আমার নতুন ছবির বাইজির রোলের বদলে ঝি-এর রোল দেব।
অবশ্য তিনি কথা শেষ করে হো হো করে হাসতে হাসতে বেরিয়ে গেলেন।
কর্নেল চোখ বুজে চুরুট টানছিলেন। আমি বললুম–তা হলে বোঝা যাচ্ছে রঞ্জনা দেবী শুধু অভিনয় নয়, নাচ-গানেও পারদর্শিনী।
রঞ্জনা আড়ষ্ট হেসে বলল–বাচ্চুদা হয়তো ঠিকই বলে গেল। ভবিষ্যতে আমাকে ঝি-এর রোলে অভিনয় করতে হবে। কিন্তু না, তার চেয়ে আমি মডেলিং চালিয়ে যাব।
কর্নেল হেলান দিয়ে চোখ বুজে চুরুট টানছিলেন। একফালি নীল ধোঁয়া তাঁর প্রশস্ত টাক ছুঁয়ে ঘুরপাক খেতে খেতে ফ্যানের হাওয়ার মিলিয়ে যাচ্ছিল। ওই অবস্থা থেকেই তিনি বললেন–রঞ্জনা তোমাকে একটা কথা বলতে চাই। কথাটা তোমাকে জানি না কতটুকু বিচলিত করবে।
রঞ্জনা কর্নেলের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টে তাকিয়ে বলল–আজ আমি বিচলিত হয়েই আছি। আপনি যা বলতে চান শোনার মতো শক্তি আমার আছে।
এইসময় ষষ্ঠীচরণ কাপ প্লেট নিতে এল। সে আমাকে সিগারেট টানতে দেখে একগাল হেসে বলল-বাবুদাদা আবার সিগারেট খাচ্ছেন।
বললুম–দিশি সিগারেট নয় ষষ্ঠী, খাঁটি আমেরিকান সিগারেট।
ষষ্ঠী ট্রে তুলে একটু চমকে উঠে বলল-কী সর্বনাশ! অ্যাশট্রে তে ভর্তি।
ওর কথা শুনে তাকিয়ে দেখলুম সত্যি। অ্যাশট্রেতে সিগারেটের স্তূপ ঠাসাঠাসি হয়ে আছে। ষষ্ঠীকে অ্যাশট্রেটা দিয়ে বললুম–যাও এটাকে খালি করে নিয়ে এসো।
কর্নেল মুখটা একবার ঘুরিয়ে চোখ খুলে অ্যাশট্রেটা দেখি নিলেন। তারপর বললেন–মি. লাহিড়ি প্রচণ্ড টেনশনে ভুগছেন। তা সত্যি।
ষষ্ঠী অ্যাশট্রেটা নিয়ে গেল! রঞ্জনা মৃদুস্বরে বলল-নতুন ছবির টেনশন।
বললুম–নতুন ছবির জন্য শমীকবাবুর এত কীসের টেনশন?
রঞ্জনা বলল–সঠিক কারণ জানি না।
ষষ্ঠ অ্যাশট্রেটা রেখে যাবার পর কর্নেল বললেন–হ্যাঁ, যা বলছিলুম। আচ্ছা রঞ্জনা, আমি স্পষ্ট উত্তর চাই। তুমি কি রাজকুমার রায়ের হত্যাকাণ্ডের পর নিজেকে বিপন্ন বোধ করছ।
রঞ্জনা মুখ নামিয়ে আস্তে বলল–করছি। কিন্তু সেটা পুলিশ আমাকে জেরা করেছে কিংবা এই কেসে জড়িয়ে ফেলবে এইজন্য নয়। কর্নেল, গত রাত্রে আমাকে কেউ ঘুম থেকে জাগিয়ে টেলিফোনে হুমকি দিয়েছে।
–কী হুমকি?
–ব্যাপারটা আমার কাছে অস্পষ্ট। লোকটা হুমকি দিয়ে বলল–আমি যদি রাজকুমার রায়ের গচ্ছিত রাখা জিনিসটা ফেরত না দিই তা হলে আমাকে একইভাবে খতম করে গড়ের মাঠের সে ফেলে দেবে। আমি মিথ্যা করে জানতে চাইলুম ওটা কোথায় কার কাছে ফেরত দিতে হবে। তখন লোকটা বলল-কাল রাত এগারোটায় তোমার ফ্ল্যাটের কড়া নড়ার শব্দ পেলে তুমি দরজা খুলবে এবং সামনেই যাকে পাবে তার হাতে দেবে। সে আরও বলল–আমি যদি পুলিশ বা কাউকে একথা জানিয়ে তাকে ধরার জন্য ফাঁদ পেতে রাখি তা হলে সে তা আগেই টের পাবে। তারপর আমাকে গুলি করে মারবে।
কর্নেল আবার চোখ বুজে হেলান দিয়ে বললেন–লোকটার কণ্ঠস্বর কি তোমার চেনা মনে হয়েছে?
-না।
-এবার খুলে বলো রাজকুমার রায় তোমার কাছে সত্যিই কোনও জিনিস লুকিয়ে রাখতে দিয়েছিল কি না?
রঞ্জনা একটু ইতস্তত করে বলল–গত সপ্তাহে রাজকুমার কীভাবে ঠিকানা জোগাড় করে আমার ফ্ল্যাটে গিয়েছিল। সে একটা অস্বাভাবিক গড়নের ছোট ব্রিফকেস-না, ব্রিফকেস বলাও ভুল হবে। জিনিসটা ছিল কালো চৌকো গড়নের। আমার অনুমান ওটা ছিল ইঞ্চি ছয়েক লম্বা ও ইঞ্চি চারেক চওড়া, উচ্চতা প্রায় আট-নয় ইঞ্চি তো বটেই। মোট কথা বেঢপ গড়নের একটা প্যাকেট। ওটার রং ছিল কোথাও কিছুটা কালো আবার কোথাও কিছুটা ধূসর। আমার দৃঢ় ধারণা ওটা খুবই পুরোনো জিনিস।
এবার কর্নেল সোজা হয়ে বসে বললেন–তুমি নিশ্চয়ই জিজ্ঞেস করেছিলে ওতে কী আছে?
রঞ্জনাকে বিব্রত দেখাচ্ছিল। সে বলল–জিজ্ঞেস করেছিলুম। রাজকুমার বলেছিল তুমি তো জানো আমি অ্যান্টিক জিনিসের কেনা-বেচা করি। আমি বলেছিলুম–তা হলে এটা তোমার কোম্পানির জিম্মায় রাখলে না কেন? রাজকুমার বলেছিল-আমার মাথা খারাপ। এটা আমার নিজস্ব কারবার।
কর্নেল জিজ্ঞেস করলেন–তুমি কি জিনিসটা রেখেছিলে?
রঞ্জনা মাথা নেড়ে বলল–না, আমি ওটা রাখিনি। তার কারণ আমি ততদিনে জেনে গেছি তার কারবারে বেশ কিছু প্রতিদ্বন্দ্বী আছে এবং তারা তার শত্রু। আমার ভয় হচ্ছিল, যদি তাদের কেউ তাকে ফলো করে এসে থাকে তা হলে আমি বিপদে পড়ব। তাই আমি ওটা রাখিনি। একটা আশ্চর্য ব্যাপার কর্নেল। সেদিন রাজকুমার ওটা কয়েকটা দিন রাখার জন্য আমার পায়ে ধরতে এসেছিল। সে বলেছিল–এ দেশে বাজারে এটার দাম প্রায় পঞ্চাশ লক্ষ টাকা। কিন্তু তার পেছনে নাকি তার শত্রুপক্ষ ঘুরঘুর করে বেড়াচ্ছে। তাই সে বেগতিক দেখলে অগত্যা লাখখাঁটিয়া কোম্পানির কাছেই বিক্রি করে দেবে।
কর্নেল বললেন–ওটার ভিতরে কী আছে তুমি কি জিজ্ঞেস করেছিলে?
রঞ্জনা বলল–করেছিলুম। রাজকুমার বলেছিল–এতে নবরত্ন খচিত একটা দেবীমূর্তি আছে। আমি তখন তাকে জিজ্ঞেস করেছিলুম-তুমি এটা কোথায় পেলে? সে বলেছিল–যদি তুমি এটা অন্তত চারদিনের জন্য রাখো তা হলে আমি ঠিক জবাব দেব। আমি বলেছিলুম–তুমি যে সত্যি কথা বলছ তার তো গ্যারান্টি নেই।– রঞ্জনা জোরে শ্বাস ছেড়ে মুখ নামিয়ে নাখ খুঁটতে থাকল। কর্নেল তার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন–তা হলে শেষ পর্যন্ত তুমি ওটা রাখোনি?
রঞ্জনা বলল–না। তখন আমার ওকে অসহ্য লাগছিল। ওর হাত থেকে আমি জোর করে নিজেকে ছাড়িয়ে এসেছিলুম, আর আবার ও আমার সঙ্গে নিজেকে। সম্ভবত ছল করে জড়াতে চাইছে। আমি ততদিনে জেনে গেছি ওর হাত থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে না আনলে আমার জীবনটাই নষ্ট হয়ে যেত।
কর্নেল একটু চুপ করে থাকার পর বললেন–তা হলে বোঝা যাচ্ছে। রাজকুমারের শত্রুপক্ষের বিশ্বাস জিনিসটা তোমার কাছেই আছে। এক কাজ করো তুমি অন্তত আজ এবং কাল এই দুটো রাত হোটেল এশিয়ায় থাকো। আমি ম্যানেজার মি. রঙ্গনাথনকে ফোন করে সে ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। আর তুমি তোমার গাড়িটা তোমার ফ্ল্যাটের গ্যারেজে রেখে সোজা একটা ট্যাক্সি করে হোটেল এশিয়ায় চলে এসো। চিন্তা কোরো না। তোমার দিকে সাদা পোশাকের পুলিশ লক্ষ রাখবে এবং তোমাকে গার্ড দেবে।
রঞ্জনা একটু ভেবে নিয়ে বলল–আপনি আমার বাবার মতো। আপনি যা বলবেন আমি তা-ই করব।
বলে সে তার হ্যান্ডব্যাগ থেকে একটা চাবি বের করে বলল–এটা আমার ফ্ল্যাটের দরজার ডুপলিকেট চাবি। এটা আপনি রাখুন।
কর্নেল চাবিটা নিয়ে বুক পকেটে রাখলেন। তারপর বললেন–তোমার সঙ্গে রাজকুমারের ছাড়াছাড়ি হওয়ার পর রাজকুমার কোথায় থাকত তুমি কি জানো?
রঞ্জনা মাথা নেড়ে বলল–জানি না। তাকে কখনও জিজ্ঞেস করিনি। তবে উত্তর কলকাতায় তার এক বিধবা দিদি আছেন। মাঝে মাঝে তার কাছে গিয়েও সে থাকত শুনেছি। সে আমাকে সেই দিদির ঠিকানাও দিয়েছিল, তা আমি হারিয়ে ফেলেছি।
এবার কর্নেল টেলিফোনের রিসিভার তুলে ডায়াল করার পর সাড়া পেয়ে বললেন–প্লিজ পুট মি টু দা ম্যানেজার মি. রঙ্গনাথন…আই অ্যাম কর্নেল নীলাদ্রি সরকার।..হ্যালো মি. রঙ্গনাথন। একটা জরুরি দরকারে রিং করছি। আমার এক আত্মীয় মিস কমলিকা দেবীর জন্য একটা উপযুক্ত স্যুইট চাই…ওকে। সিট নম্বর থ্রি টু থ্রি। থার্ড ফ্লোর।… হা পেমেন্ট সে নিজেই করবে। আর একটা কথা মি. রঙ্গনাথন, কমলিকাকে বিশেষ কারণে স্পেশাল ব্রাঞ্চের পুলিশ গার্ড দেবে। আপনি তাদের আপ্যায়নে আশা করি ক্রটি রাখবেন না… না না, কোনও বিপজ্জনক ব্যাপার নয়। পরে সব জানাব। থ্যাংক ইউ।
রঞ্জনা ম্লান হেসে বলল–আপনার ওপর নিজের দায়িত্ব দিয়ে হয় তো বিব্রত করলুম।
কর্নেল সহাস্যে বললেন–মোটেও না। তোমাকে আমারই খুব প্রয়োজন। যাই হোক আর দেরি কোরো না। সম্ভব হলে তোমাদের হাউসিং কমপ্লেক্সের অন্য কোনও দরজা তুমি বেরিয়ে আসবে।
-বুঝেছি আমি তা হলে কমলিকা সরকার। বলে রঞ্জনা কর্নেল ও আমাকে নমস্কার করে বেরিয়ে গেল।
কর্নেল আবার টেলিফোনের রিসিভার তুলে তার স্নেহভাজন ডি. সি. ডি. ডি. অরিজিৎ লাহিড়ির সঙ্গে রঞ্জনা রায় ওরফে কমলিকা সরকারের হোটেল এশিয়ায় তিনশো তেইশ নম্বর স্যুইটে থাকা এবং তাকে স্পেশাল ব্রাঞ্চের পুলিশ দিয়ে রক্ষা করার ব্যাপারে কিছুক্ষণ ধরে কথাবার্তা বললেন। তারপর রিসিভার রেখে চুরুটটা অ্যাশট্রেতে ঘষে নিভিয়ে দিলেন।
আমি জিজ্ঞেস করলুম-রঞ্জনার ফ্ল্যাটে আজ রাত এগারোটায় কেউ যাবে, আপনি কি সে সম্পর্কে কোনও প্ল্যান করে ফেলেছেন?
কর্নেল গম্ভীর মুখে বললেন– ওই হাউসিং কমপ্লেক্সে রাত এগারোটায় কোনও আবাসিকের ফ্ল্যাটে যাওয়া বাইরের কারও পক্ষে সম্ভব নয়। এই ছোট্ট কথাটা রঞ্জনা কেন বুঝতে পারেনি জানি না। সিকিউরিটি ওখানে বেশ কড়া। কাজেই ফোনে হুমকি দেওয়া লোকটা ওখানেরই কোনও ফ্ল্যাটের বাসিন্দা অথবা কোনও বাসিন্দার কাছের লোক, যার ওই ফ্ল্যাটে বরাবর যাতায়াত আছে।
বললুম–ডি. সি. ডি. ডি মি. লাহিড়ি নিশ্চয়ই আপনাকে সাহায্য করবেন এবং আপনি রাতে রঞ্জনাদের হাউসিং কমপ্লেক্সে হানা দিয়ে লোকটাকে ধরে ফেলবেন। এই তো আপনার প্ল্যান।
কর্নেল ঘড়ি দেখে নিয়ে বললেন–দেখা যাক! লোকটা ঘুঘু দেখে থাকবে কিন্তু এই বৃদ্ধ ঘুঘুর মতো ঘুঘু দেখেনি। লেট আস ওয়েট অ্যান্ড সি।..
.
০৭.
দুপুর খাওয়ার পর যথারীতি ড্রইং রুমের ডিভানে শুয়ে পড়েছিলুম। তারপর কখন ঘুমিয়ে পড়েছি। ঘুম ভাঙল ষষ্ঠীচরণের ডাকে। তার হাতে চায়ের কাপ প্লেট। উঠে বসে বললুম–চারটে বেজে গেছে। তোমার বাবামশাই কোথায়? ছাদে বাগানের সেবা করছেন?
ষষ্ঠী একগাল হেসে বলল–আজ্ঞে না দাদাবাবু। উনি আজকেও আপনার গাড়ি চুরি করেছেন। নালবাজারের সেই টিকটিকিবাবু, কী যেন নাম–
নরেশবাবু!
–আজ্ঞে হ্যাঁ, তিনিই বটে। তিনি এসেছিলেন। কী কথা হল, তারপর দুজনে বেইরে গেলেন। উনি গেলেন ওনার জিপ গাড়িতে, আর বাবামশাই আপনার গাড়ি চালিয়ে নিয়ে গেলেন। ও হ্যাঁ, বলতে ভুলেছি। বাবামশাই তখন বাথরুমে। সেই সময় একটা ফোন এল। আপনি ঘুমোচ্ছিলেন। তাই ফোনটা আমি ধরলুম। ষষ্ঠী হেসে ফেলল। তারপর বলল–আমাদের টিকটিকিবাবুগো দাদাবাবু, হালদারমশাই। আমি ওনার সঙ্গে কথা বলতে যাচ্ছি বাবামশাই হঠাৎ এসে ফোন কেড়ে নিলেন। তারপর দুজনে কী কথাবার্তা হল বোঝা গেল না। থাক গে। আপনি চা খান। আমি ছাদের বাগান ঘুরে আসি। বলে সে চলে গেল।
এক সময় কোনও রহস্যময় ঘটনার ব্যাপারে কর্নেল আমাকে ফেলে রেখে একা কোথাও বেরিয়ে পড়তেন বলে আমার অভিমান হত। কিন্তু ক্রমশ বুঝতে পেরেছিলুম সর্বক্ষেত্রে কর্নেলের সঙ্গে আমার উপস্থিতি তদন্তের পক্ষে ক্ষতিকর। তাই আর অভিমান হত না, এখনও হয় না।
কর্নেল ফিরে এলেন সন্ধ্যা ছটায়। তারপর আমাকে কিছু না বলে সোজা ভিতরের ঘরে গিয়ে ঢুকলেন। একটু পরে ড্রইং রুমে ফিরে সহাস্যে বললেন–গুড ইভনিং জয়ন্ত। আশা করি ভালোই ঘুমিয়েছ।
বললুম–গুড ইভনিং কর্নেল। আপনার ফিরে এসে নির্বাক অন্তর্ধানে একটু অবাক হয়েছিলুম।
কর্নেল বললেন–সে মুহূর্তে আমি ছিলাম একজন গাড়ি চোর। কোন মুখে। তোমার সঙ্গে কথা বলি? তুমি কি জানো চোরেরা নিজের চুরির জন্যে লজ্জা পায়?
আমার খুব হাসি পেয়েছিল। হাসি চেপে বললুম–তা হলে বুঝে গেছি গাড়ির চাবি আগে আপনি আমার ঘরে ঝুলানো প্যান্টের পকেটে রাখতে গিয়েছিলেন।
–এগজাক্টলি। এখন আমি গাড়ি চোর নই। তাই স্মার্টলি তোমার সঙ্গে কথা বলব। এক মিনিট। ষষ্ঠী কফি আন।
ষষ্ঠী যতক্ষণ কফি না আনল, ততক্ষণ কর্নেল চোখ বুজে টাকে হাত বুলোতে থাকল। তারপর আমি কফির পেয়ালায় চুমুক দিয়ে বললুম–কিন্তু আপনার মাথার টুপিও কি যথাস্থানে রেখে এলেন?
কর্নেল মুচকি হেসে বললেন–টুপিতে একটা গলির দোতলা জানলা থেকে কোন সৎ গৃহিণী একরাশ আবর্জনা ফেলেছিলেন।
-আপনি কি গাড়ি থেকে বেরিয়ে তখন পায়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন?
কর্নেল বললেন–হ্যাঁ, পুলিশের গাড়ির কাছে তোমার গাড়িটা রেখে শর্টকার্টে রঞ্জনাদের হাউসিং কমপ্লেক্সের পিছনের দিকে ঢুকেছিলুম।
চমকে উঠে বললুমকী সর্বনাশ! নিশ্চয়ই ফাঁদ পাততে গিয়েছিলেন। রঞ্জনার শত্রুর তো তা হলে আপনাদের দেখে ফেলার কথা।
কর্নেল বললেন–আমরা দল বেঁধে যাইনি। অবশ্য আমাকে পুলিশের এক, বিশ্বস্ত সোর্সের ডেরায় গিয়ে ছদ্মবেশ ধরতে হয়েছিল। বুঝতেই পারছ। আমার কপালে একটা ছদ্মবেশ ছাড়া দ্বিতীয় উপায় নেই।
হাসতে হাসতে বললুম–বুঝে গেছি বস। শিখের ছদ্মবেশ।
কর্নেল বললেন–ঠিক ধরেছ। তবে নরেশবাবুকে ছদ্মবেশ ধরতে হয়নি। তার চেহারা প্লেন ড্রেসে আর পাঁচটা মধ্যবিত্ত বাঙালির মতো যারা বেশির ভাগই চাকুরে।
-তা হলে ঠিকঠাক ফাঁদ পেতে এসেছেন।
-হাউসিং কমপ্লেক্সে যে কমিটি আছে তার চেয়ারম্যান একজন প্রাক্তন জজসাহেব। ঘটনাচক্রে রঞ্জনার বি-ব্লকের ফ্ল্যাটের সমান্তরালে এ ব্লকে তিনি থাকেন। ওই দিকটা প্রচুর গাছপালার আড়ালে পড়েছে। অরিজিৎ লাহিড়ির সঙ্গে তার পরিচয় আছে। আমরা তার কাছেই সাহায্য নিতে গিয়েছিলুম। সব গোপন কথা খুলে না বললেও তাকে আভাস দিয়েছি, সম্ভবত হাউসিং-এর কোনও ব্লকে একজন বড় ক্রিমিনাল পরিচয় গোপন করে বাস করছে। যাই হোক আমরা যা যা চেয়েছি তার কাছে সব সাহায্যই পেয়ে যাব।
কফি শেষ করার পর একটা মার্লবোরো সিগারেট ধরিয়ে বললুম– ভেবেছিলুম, আমার কাগজের অফিসে গিয়ে সবাইকে উঁট দেখিয়ে এই সিগারেট টানব, কিন্তু কবে যে আপনার হাত থেকে মুক্তি পাব এবং আমাদের কাগজের জন্য একখান সেনসেশনাল স্টোরি নিয়ে হাজির হব জানি না। সবই আপনার ওপর নির্ভর করছে। ততদিনে এই প্যাকেটটা খালি হয়ে যেতে পারে।
কর্নেল এবার গম্ভীর মুখে বললেন–আমার লক্ষ্য দুটি। রাজকুমার রায়ের হত্যাকারী কে তা জানা এবং তার পঞ্চাশ লাখ টাকা দামের চোরাই দেবীমূর্তি। তবে আশা করছি আজ রাতে যদি খুনি ফাঁদে পা দেয়–অবশ্য সে খুনি না-ও হতে পারে। চোরাই জিনিসটার কথা নিশ্চয়ই সে খুনির মুখে শুনেছে–সে ফাঁদে পা দিলে এই কেসটার জটিল একটা জায়গা খুলে যাবে। এখান থেকে পরের ধাপটা পায়ের কাছে এসে যাবে।
জিজ্ঞেস করলুম–আমাকে এই নৈশ অভিযানের সঙ্গী করবেন তো?
কর্নেল বললেন–আপত্তি নেই। তবে এই বিপজ্জনক হানাদারিতে জড়ানোর চেয়ে তুমি হোটেল এশিয়ায় অন্তত আমি না পৌঁছনো পর্যন্ত রঞ্জনার সঙ্গে–সরি, কমলিকা সরকারের সঙ্গে আড্ডা দিয়ে কাটাতে পারো।
করজোড়ে বললুম–প্লিজ বস আপনার কমলিকা সেই রায়বাঘিনি মহিলার চেয়েও বিপজ্জনক। এইভাবে দুজনে কখনও সিরিয়াস হয়ে আবার কখনও হাল্কা চালে কথা চলছিল। তারপর মনে পড়ে গেল প্রাইভেট ডিটেকটিভ হালদারমশাইয়ের রায়ডিহি থেকে টেলিফোনের কথা। তখনই কথাটা কর্নেলকে জিজ্ঞেস করলুম।
কর্নেল বললেন–হ্যাঁ, হালদারমশাই সেখানে শিলাদিত্য সোমকে বাড়ি থেকে বেরোতে দেখেছিলেন। গাড়িতে চেপে মি. সোম তার কাছাকাছি হওয়া মাত্র। সন্ন্যাসীবেশী হালদারমশাই তাঁর গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে যান। মি. সোম প্রথমে তাকে চিনতে পারেননি। পরে হালদারমশাই পরিচয় দিলে তিনি বিব্রত মুখে বলেছেন–কলকাতা থেকে টেলিফোনে কেউ তাকে হুমকি দিয়েছে, রাজকুমার রায়ের বাল্যবন্ধু মি. সোম একটা চোরাই জিনিস লুকিয়ে রেখেছেন। সেটা ঝরনার ধারে আজ সন্ধ্যায় রেখে না এলে তার অবস্থা হবে তার বাল্যবন্ধুর মতোই। এই কারণে তার সঙ্গে অপরিচিত কেউ দেখা করতে এলে তাঁর বাড়ির লোক যেন বলে দেয় তিনি বাইরে গেছেন। মি. সোমের মতে এমনও হতে পারে সেই লোকটা জেনে গেছে তিনি একজন প্রাইভেট ডিটেকটিভ হায়ার করেছেন। কাজেই সেই ডিটেকটিভের নাম করেও সেই হুমকি দেওয়া লোকটা এখানে এসে তার বিপদ ঘটাতে পারে। তাই তিনি হালদারমশাইয়ের সঙ্গে দেখা করার ঝুঁকি নেননি।
কথাগুলো শোনার পর বললুম–মি. সোমের ওই অজুহাত আমার কাছে তত বিশ্বাসযোগ্য মনে হচ্ছে না।
কর্নেল চুরুটের ধোঁয়া ছেড়ে বললেন–আমি হালদারমশাইকে ফিরে আসতে বলেছি। তবে আজ রাতে আমাদের হানাদারির কথা জানাইনি।
জিজ্ঞেস করলুম –মি. সোম শেষ পর্যন্ত কী বলেছেন হালদারমশাইকে?
কর্নেল অন্যমনস্কভাবে বললেন কলকাতা থেকে কে তাকে হুমকি দিয়েছে, হালদারমশাই যেন তাকে খুঁজে বের করেন। দরকার হলে তিনি আরও কিছু টাকা অ্যাডভান্স করতে রাজি। যাই হোক, উনি আর টাকাকড়ি দেননি। ব্যাপারটা ওঁর কাছেও গোলমেলে ঠেকেছে। তাই আমার কথামতো আজ রাতের মধ্যেই কলকাতা পৌঁছোবেন। বাই দা বাই! জয়ন্ত! তোমার লাইসেন্স ও ফায়ার আর্মসটা নিশ্চয়ই এবাড়িতে তোমার ঘরে রেখেছে?
বললুম–হ্যাঁ, টেবিলের ড্রয়ারেই ওটা রাখা আছে। সল্টলেকে আমার ফ্ল্যাটে ওটা রেখে আসার ঝুঁকি আছে। আপনারই পরামর্শ কর্নেল।
কর্নেল কোনও জবাব দিলেন না। চোখ বুজে চুপচাপ চুরুট টানতে থাকলেন। ততক্ষণে আমার মধ্যে চাপা উত্তেজনার সঞ্চার হয়েছে। ঘড়ির কাটা যত ঘুরছে উত্তেজনারও তত বাড়ছে। এই অবস্থায় আমার আরও দুটো সিগারেট খাওয়া হয়ে গেল। এই স্তব্ধতা অসহনীয়। কর্নেলের ধ্যান ভাঙিয়ে বললুম–ক-টায় বেরোবেন?
কর্নেল যেন ধ্যানের ঘোরেই বললেন–ঘটনাস্থলে পৌঁছোব ঠিক রাত দশটায়। সেই সময়ই টেলিফোন বেজে উঠল। কর্নেল রিসিভার তুলে সাড়া দিলেন, তারপর ক্রমাগত হা, হুঁ এবং এই ধরনের কিছু অস্পষ্ট শব্দ আওড়ে গেলেন। তারপর রিসিভার রেখে বললেন–রঞ্জনাসরি। কমলিকার ফোন। এভাবে হোটেলে থাকতে তার অস্বস্তি হচ্ছে। কিন্তু আমার কথা সে অমান্য করবে না। বলে তিনি মুচকি হেসে আমার দিকে তাকালেন। জয়ন্ত তুমি বরং তোমার রিভলবার নিয়ে হোটেল এশিয়াতে কমলিকাকে পাহারা দিলেই পারতে। বুঝতে পারছি তোমার সময় কাটছে না। কারণ শমীক লাহিড়িকে দেওয়া সিগারেট তুমি যেভাবে পোড়াচ্ছ।
আমি বাধা দিয়ে বললুম–আর খাচ্ছি না।
কথাটা বলেই আমার মনে পড়ে গেল রবিবার ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ডের উত্তর-পশ্চিম কোণে, যেখানে রাজকুমারের লাশ পড়েছিল সেখানে একটা গাছের তলায় দাঁড়িয়ে কেউ প্রচুর সিগারেট খেয়েছিল এবং কর্নেল ফিলটার টিপসহ টুকরোগুলো কুড়িয়ে এনেছিলেন। মাই গুডনেস। সিগারেটের সেই টুকরোগুলো
এমনি মার্লবোরো সিগারেটের নয় তো? মনে আসামাত্র কথাটা মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল–আচ্ছা কর্নেল আপনি যে সিগারেটের টুকরোগুলো গড়ের মাঠ থেকে কুড়িয়ে এনেছিলেন, সেগুলো মার্লবোরো সিগারেট নয় তো?
কর্নেল নির্বিকার মুখে বললেন–হ্যাঁ, মার্লবোরো সিগারেট।
-তা হলে শমীকবাবু এই কেসের সঙ্গে
কর্নেল আমার কথার ওপর বললেন–জয়ন্ত মার্লবোরা সিগারেট এ দেশের অনেক শৌখিন লোকই খান। আবার চেইন্স স্মোকারও খুব কম নেই। সবসময় দুয়ে-দুয়ে চার হয় না।
–অর্থাৎ আপনার মতে উদোর পিণ্ডি আমি বুধোর ঘাড়ে চাপাচ্ছি, এই তো?
–আপাতদৃষ্টে ঠিক তা-ই। অন্তত যতক্ষণে না শমীক লাহিড়ির ব্যাপারে কোনও কু পাচ্ছি, ততক্ষণ ওই ভদ্রলোক সম্পর্কে কোনও কটাক্ষ করা উচিত নয়।
কিন্তু কর্নেল বিশ্বের সেরা গোয়েন্দারা বলেছেন–সন্দেহের তির সংশ্লিষ্ট প্রত্যেকের দিকে তাক করে রাখা উচিত।
কর্নেল হাসলেন।–তা ঠিক। তবে আপাতত আমাকে খুঁজে বের করতে হবে এই ঘটনায় যাদের আমরা চিনেছি তাদের মধ্যে অন্য কেউ মার্লবোরো খান কি না এবং তিনি এক জায়গায় দাঁড়িয়ে পুরো এক প্যাকেট সিগারেট টানার পরেও সুস্থ থাকতে পারেন কি না।
ষষ্ঠীকে কর্নেল নির্দেশ দিয়েছিলেন এ রাতের ডিনার আমরা ন-টার মধ্যেই সেরে নিতে চাই, কাজেই ষষ্ঠী ঠিক সময়ে ডাইনিংরুমে ডিনারটেবিল রেডি রেখেছিল। খাওয়ার পর প্যান্ট-শার্ট পরে আমার পয়েন্ট বাইশ ক্যালিবারের আগ্নেয়াস্ত্রে ছটা বুলেট ভরে প্যান্টের পকেটে নিলুম। আমার খুদে জাপানি টর্চটাও হাতে নিলুম। ঠিক এই টর্চ কর্নেলেরও আছে। ছোট হলেও এগুলোর আলো খুব জোরালো। পৌনে দশটায় ডোরবেল বেজেছিল। তারপর লালবাজার ডিটেকটিভ ডিপার্টমেন্টের এস. আই. ঘরে ঢুকেছিলেন। তাঁর প্লেন ড্রেস, তিনি গম্ভীর মুখে বলেছিলেন–একটা প্রাইভেট কার নিয়ে এসেছি। আমার পৌঁছোনোর আগেই নিউআলিপুরে চেতনা হাউজিং কমপ্লেক্সের চারদিকে আমাদের ফোর্স মোতায়েন থাকবে।
জিজ্ঞেস করলুম–লোকটা এলাকায় পুলিশের গাড়ি দেখে সতর্ক হয়ে যাবে না তো?
নরেশবাবু চোখ নাচিয়ে বললেন–কলকাতা বিদ্যুৎ সংস্থার ওই জোনের কেবল ফল্ট হবে রাত দশটায়। কাজেই চিন্তা করবেন না।
আমার জন্য আরও বিস্ময় অপেক্ষা করেছিল। নীচে গিয়ে ইলিয়ট রোড ধরে কিছুটা এগিয়ে যেতে হল। তারপর ওয়েলেসলির মোড়ে দুটো কালো অ্যামব্যাসাডর গাড়ি দেখতে পেলুম। নরেশবাবু যে গাড়িতে উঠলেন আমার চোখে পড়ল সেই গাড়ির ব্যাক সিটে একজন মহিলা বসে আছেন। আমরা উঠলুম পিছনের গাড়িতে। ড্রাইভারের পাশে প্লেন ড্রেসে একজন বসে ছিলেন। তিনি মুখ ঘুরিয়ে আমাদের নমস্কার করলেন।
আমরা শর্টকার্টে নিউআলিপুর পৌঁছে দেখলুম সত্যি চারদিকে অন্ধকার।
আমার অবশ্য গলি পথে ঢুকেছিলুম। গাড়ির হেডলাইটে তত বেশি লোকজন চোখে পড়ছিল না।
কিছুক্ষণ চলার পর হেডলাইটের আলোয় দূরে একটা কালো পুলিশ ভ্যান চোখে পড়ল। আমার সামনের পুলিশ অফিসারটি ড্রাইভারকে কিছু বললেন। আমাদের দুটি গাড়ির হেডলাইট নিভে গেল। তারপর গাড়ি দুটি ফুটপাতের বাঁ-পাশ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে গেল। আমরা নেমে গেলুম। তারপর নরেশবাবু চাপাস্বরে কর্নেলকে বললেন–বাঁ-দিকের গলিতে ঢুকে একটা ছোট পার্ক পড়বে।
কর্নেল মৃদুস্বরে বললেন–চিনি। পার্কের বাঁ-পাশে চেতনা হাউসিং-এর কয়েকটা ব্যাকডোর আছে। আমাদের সেকেন্ড ব্যাকডোর দিয়ে ঢুকতে হবে। কারণ। ওটা এ এবং বি-ব্লকের মাঝখানে।
নরেশবাবু তেমনি চাপাস্বরে বললেন–এই আবাসনের ম্যাপ নিশ্চয়ই রঞ্জনা দেবীর কাছ থেকে সংগ্রহ করেছেন?
কর্নেল বললেন–না, বিকেলে যখন এসেছিলুম, লক্ষ করে গেছি। এবার কিন্তু আমাদের চুপচাপ হাঁটতে হবে, যেন পায়ের শব্দ কেউ শুনতে না পায়।
পার্কটার কাছে গিয়ে অন্ধকারে বাঁ-দিকে সারিবদ্ধ বাড়িগুলোতে কোথাও কোথাও লন্ঠন বা মোমের আলো জ্বলছে দেখা গেল। আমরা এবার ডাইনে ঘুরে প্রথম গেট পেরিয়ে যেতেই অন্ধকারে কেউ মৃদু শিস দিল। নরেশবাবু তখনই পর পর দু-বার মৃদু শিস দিলেন। বুঝতে পারলুম পুলিশ সম্ভবত গোটা আবাসনটাই ঘিরে রেখেছে। দ্বিতীয় গেটটা ভেজানো ছিল। নরেশবাবু নিঃশব্দে সেটা ফাঁক করে ভিতরে গেলেন, আমরা তাকে অনুসরণ করলুম। কয়েক পা হেঁটেই নরেশবাবুর পায়ের কাছে ফেলা টর্চের আলো দেখে বোঝা গেল এটা ওপরে ওঠার সিঁড়ি। সিঁড়ি বেয়ে আমরা তিনতলায় পৌঁছোলুম। তারপর একটা দরজায় কর্নেল রঞ্জনার দেওয়া চাবিটা ঢুকিয়ে দরজা খুললেন। ভিতরে ঢুকে কর্নেল চাপাস্বরে বললেন–নরেশবাবু, আপনাদের মিসেস শমিতা সেনকে এই ঘরে একটা মোম জ্বালিয়ে অপেক্ষা করতে বলুন। উনি এখানে অপেক্ষা করবেন। এখন সাড়ে দশটা বাজে। কথামতো লোকটি এসে কড়া নাড়লে কিংবা দরজায় টোকা দিলে কী কী করতে হবে ওকে নিশ্চয়ই বুঝিয়ে দিয়েছেন।
পরে জেনেছিলুম-উনি ডিটেকটিভ ডিপার্টমেন্টের একজন মহিলা সাবইনস্পেকটর।
শমিতা সেন একটু হেসে বললেন–আমি নিজেকে বাঁচাতে পারব। এমনকী যদি বলেন–ভিকটিমকে কার্পেটে শুইয়ে দিতেও পারব।
কর্নেলের নির্দেশে আমরা পাশের ঘরে ঢুকলুম। এটা রঞ্জনার শয়নকক্ষ। বোঝ যাচ্ছিল রঞ্জনার ফ্ল্যাটটা তত বড় নয়। দরজার পর্দাটা নরেশবাবু একটু টেনে দিলেন। এ ঘরে আমরা এখন চারজন লোক। আমি, কর্নেল, নরেশবাবু এবং প্লেন ড্রেস পরা সেই পুলিশ অফিসার।
রঞ্জনার ড্রইং রুমে ততক্ষণে মোমবাতি জ্বলেছে। তার ক্ষীণ ছটা এ ঘরে পর্দার ফঁক দিয়ে এসে পড়েছে। আমরা চুপচাপ বিছানায় পা ঝুলিয়ে আছি। সময় কাটছে না। এ এক মারাত্মক সময়, তখন মনে হয় প্রতিটি সেকেন্ড অস্বাভাবিক দীর্ঘ।
কতক্ষণ পরে এগারোটা বাজল। আমার উত্তেজনা তখন চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে। কিন্তু আরও কিছুক্ষণ কেটে গেল। লোকটা কি তা হলে সব টের পেয়ে সতর্ক হয়ে গেছে?
আরও কিছুক্ষণ পরে বাইরে করিডরে আবছা পায়ের শব্দ শোনা গেল। তারপর দরজার কড়া খুব আস্তে তিনবার কেউ নাড়ল।
কর্নেল নিঃশব্দে উঠে দাঁড়ালেন। নরেশবাবু, তার সঙ্গী এবং আমিও উঠে দাঁড়ালুম। কর্নেল বেডরুমের দরজার কাছাকাছি গিয়ে দাঁড়ালেন।
ওদিকে ততক্ষণে মিসেস শমিতা সেনের দরজা খোলার শব্দ কানে এল। তারপর চাপা গম্ভীর স্বরে কেউ বলল–তুমি কে? মিসেস সেন তেমনি আস্তে বললেন–আমি রঞ্জনার মাসতুতো দিদি।
-সে শয়তানি কোথায়?
রঞ্জনার খুব জ্বর, তাই কম্বল মুড়ি দিয়ে বেডরুমে শুয়ে আছে। আমাকে সে বলেছে-রাত এগারেটায় কেউ কড়া নাড়লে তাকে দরজা খুলে বসতে বলবে। তারপর আমার কাছ থেকে একটা জিনিস নিয়ে গিয়ে তাঁকে দেবে। আপনি বসুন, আমি আসছি। পাশের ঘরে সোফায় লোকটা যে বসে পড়ল, তার শব্দ শুনেই বুঝলুম, তারপর লোকটা সাপের মতো হিসহিস করে শ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে বলল–দু-মিনিটের বেশি দেরি হলে আমি দুজনকেই গুলি করে মারব।
শমিতা সেন কর্নেলের পাশ দিয়ে এ ঘরে ঢোকামাত্র প্রথমে কর্নেল তারপর আমরা ড্রইং রুমে ঢুকে লোকটার ওপর টর্চের আলো ফেললুম। চারটে টর্চের জোরালো আলো পড়ামাত্র লোকটা উঠে দাঁড়াল। সে পকেট থেকে সম্ভবত আগ্নেয়াস্ত্রে বের করতে যাচ্ছিল, কর্নেল সোজা গিয়ে তার গলায় রিভলবারের নল, ঠেকিয়ে বললেন–চুপটি করে দাঁড়াও। নরেশবাবু, এর হাতে দুটো পিছনে টেনে হ্যান্ডকাপ পরিয়ে দিন। নরেশবাবু হ্যান্ডকাপ পরিয়ে দিলে সে চাপা গর্জন করে বলল–হ্যারামজাদি! বিশ্বাসঘাতিনী! যথাসময়ে এর শাস্তি পাবে।
কর্নেল বললেন–নরেশবাবু একে কি চিনতে পারছেন?
নরেশবাবু একটু হেসে বললেন–তার আগে আপনি বলুন এই ভদ্রলোকের ছবি আমাদের ক্রিমিনাল লিস্টে আপনাকে দেখিয়েছিলুম কি না?
আমি জিজ্ঞেস করলুম–এই লোকটাকে তো চিনতে পারছি না। এ কে?
কর্নেল বললেন–এর নাম কালুবরণ হাজরা। পরে এর পরিচয় সবিস্তারে পাবে।
নরেশবাবু বললেন–এগারোটা পঁচিশে বিদ্যুৎ আসার কথা। ততক্ষণ অপেক্ষা করা ঠিক হবে না। কর্নেল যদি রঞ্জনার ঘরে কিছু কাজ আছে বলে মনে করেন, তা হলে জয়ন্তবাবুকে নিয়ে অপেক্ষা করতে পারেন। আমরা আসামিকে নিয়ে যাই। কারণ আলো জ্বললে ব্যাপারটা অনেকের চোখে পড়তে পারে। এই দাগি মহাপুরুষের ফ্ল্যাট ডি-ব্লকের চারতলায়। এর রাজনৈতিক গার্জেন এর মাথা বাঁচিয়ে রেখেছে এতদিন।
আমি বললুম–তা হলে এর আগেও এ হাজরাবাবুকে আপনারা অনেকবার অ্যারেস্ট করেছেন।
নরেশবাবু বললেন–চারবার। হংকং-কলকাতা স্মাগলিং র্যাকেটে এ একজন বড় চাই। কিন্তু এবার এর উদ্ধার নেই। কারণ এর রাজনৈতিক গার্জেন ভোটে হেরে গদি হারিয়েছেন। তার পলিটিক্যাল কেরিয়ারও শেষ।
বলে নরেশবাবু কালুবরণ হাজরার কলার ধরে তার সঙ্গী এবং সঙ্গিনীসহ বেরিয়ে গেলেন।
কর্নেল বললেন–বোসো, জয়ন্ত। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই বিদ্যুৎ এসে যাবে। কলকাতা বিদ্যুৎ সংস্থার সঙ্গে পুলিশের এইরকমই বোঝাঁপড়া হয়েছে। আগে দরজাটা বন্ধ করে এসো। ছিটকিনি তুলে দিতে ভুলো না।
দরজা বন্ধ করে এসে বললুম–আমরা ফিরে যাব। কীসে?
–চিন্তা কোরো না। ব্ল্যাক অ্যামব্যাসাডর যেখানে দাঁড় করানো আছে সেখানেই থাকবে।
একটু ইতস্তত করে বললুম–এই আবাসনের গার্ডরা আমরা বেরিয়ে যাবার সময়ই আমাদের চার্জ করবে না তো? একটা হল্লা জুড়ে দিলেই
কর্নেল আমাকে থামিয়ে বললেন–আবাসন কমিটির সভাপতি সেই জজসাহেবকে আমি এখনই ফোনে সব বলছি। আলো আসুক।
মোমের আলোয় রঞ্জনার এ ঘরটা দেখছিলুম। তার রুচির প্রশংসা করতে হয়। ঘরটা সুন্দর করে সাজানো। তার নিজের কয়েকটা কাট-আউটও দেয়ালে আঁটা। আছে দুটো র্যাক ভর্তি বাংলা ও ইংরেজি বই।
কিছুক্ষণ পরেই আলো জ্বলে উঠল। কিন্তু কোনও সাড়া পড়ল না। বোঝা যায় সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে। কর্নেল সুইচ টিপে এ ঘরের আলো এবং পাখা চালিয়ে দিলেন। তারপর বেডরুমে গিয়ে ঢুকলেন। সেখানে আলো জ্বলে উঠল। তারপর শুনতে পেলুম কর্নেল রঞ্জনার বেডরুম থেকে টেলিফোন, করছেন। আমার ইচ্ছে হল রঞ্জনার বেডরুমটা একবার দেখে আসি। তাই সটান উঠে গিয়ে বেডরুমে ঢুকে পড়লুম।
অবাক হয়ে দেখলুম-কর্নেল বিছানার তলায় হুমড়ি খেয়ে বসে টর্চের আলোয় কিছু দেখছেন। জিজ্ঞেস করলুম–আপনি কি রঞ্জনার পিছনে গোয়েন্দাগিরি শুরু করলেন।
কর্নেল বললেন–তেমন কিছু না। এই নিচু খাটের তলায় একটা কাপড়ে জড়ানো জিনিস দেখতে পাচ্ছি। আমার পক্ষে ওটা টেনে বের করা অসম্ভব। আমার এই লম্বা চওড়া শরীরই অনেক সময় গুরুত্বপূর্ণ কাজে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। জয়ন্ত তুমি ওটা ওদিক থেকে টেনে বের করো।
কাপড়ে জড়ানো যে জিনিসটা আমি বের করলুম সেটা কর্নেল দ্রুত খুলে ফেললেন। বেরিয়ে পড়ল একটা ব্রিফকেস। কর্নেল ব্রিফকেসটা পরীক্ষা করে বললেন–এটার তালা বন্ধ আছে। জয়ন্ত দ্যাখো তো কিচেনে সরু ছুরি কিংবা স্ক্র ড্রাইভার খুঁজে পাও কি না।
আমি কিচেনে ঢুকে আলো জ্বেলে ওভেনের পাশে একটা ট্রেতে সুচালো একটা ছুরি পেলুম। এ ঘরে নিয়ে এসে কর্নেলকে সেটা দিতেই তিনি ব্রিফকেসের দুটো তালাই খুলে ফেললেন। ভিতরে একটা ভাঁজ করা শাড়ি। কর্নেল এটা তুলতেই চমকে উঠে দেখলুম ব্রিফকেস ভর্তি বান্ডিল বাঁধা নোটের তোড়া। বলে উঠলুম-অ্যাতো টাকা!
কর্নেল মৃদু হেসে বললেন–এটা মুনলাইট বারে রাজকুমার রায়কে দেওয়া সেই ব্রিফকেস!
.
০৮.
ব্রিফকেসটি বন্ধ করে কর্নেল সেই ছুরির ডগা দিয়েই তালা আটকে দিয়েছিলেন। তারপর দুটো ঘরের আলো পাখা বন্ধ করে আমরা বেরিয়ে এলুম। কর্নেল ব্রিফকেসটা আমাকে ধরতে দিয়ে ঘরের দরজা লক করেছিলেন। তারপর সেই ব্যাকডোর দিয়ে বেরিয়ে হাঁটতে হাঁটতে গিয়ে দেখেছিলুম কালোগাড়িটা অপেক্ষা করছে। কর্নেল ড্রাইভারকে বলেছিলেন–আপনি আমাদের হোটেল এশিয়ায় পৌঁছে দিয়ে চলে যাবেন।
বুঝতে পেরেছিলুম কর্নেল টাকা ভর্তি এই ব্রিফকেস নিয়ে রঞ্জনার সঙ্গে বোঝাঁপড়া করতে যাচ্ছেন।
এই পাঁচতারা হোটেলটা সারারাতই ভোলা থাকে। আমরা লবিতে ঢুকে দেখলুম ম্যানেজার মি. রঙ্গনাথন টেলিফোন কার সঙ্গে কথা বলছেন। কর্নেলকে দেখে তিনি নমস্তে করলেন। কর্নেল বললেন–এভরিথিং ও কে মি. রঙ্গনাথন?
মি. রঙ্গনাথন বললেন–এভরিথিং ইজ অলরাইট স্যার। আপনি কি আপনার আত্মীয়ার সঙ্গে দেখা করবেন?
কর্নেল বললেন–হ্যাঁ।
লিফটে উঠে আমরা তিনতলায় পৌঁছুলুম। দেখলুম দুজন সাদা পোশাকের পুলিশ করিডরে দাঁড়িয়ে হোটেলের গার্ডদের সঙ্গে গল্প করছে। কর্নেলকে দেখে তারা সবাই একসঙ্গে স্যালুট ঠুকল। হ্যাঁ, কর্নেলকে এদের চেনা স্বাভাবিক। কর্নেল এগিয়ে গিয়ে তিনশো তেইশ নম্বর গেটের দরজায় টোকা দিলেন। আই-হোলে রঞ্জনার চোখ দেখা গেল। তারপর সে দরজা খুলল। বলল–আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলুম। ম্যানেজার এইমাত্র টেলিফোনে আমাকে জানালেন আপনি আসছেন। অপারেশন সাকসেসফুল তো?
রঞ্জনা পরনে নাইট ড্রেস। সে কর্নেলের মুখোমুখি বসার পর একটু হেসে বলল–আপনার ব্রিফকেসটা তো খুব সুন্দর।
কর্নেল তেমনি হাসি মুখে বললেন–তুমি কি এটা চিনতে পারছ না?
অমনি রঞ্জনা চমকে উঠল। তারপর সে মুখ নামিয়ে বলল–আমি অপরাধী তা স্বীকার করছি। কিন্তু আপনি আমার বিশ্বাস ভঙ্গ করেছেন কর্নেলসাহেব।
কথাগুলো সে কান্নাজড়ানো গলায় বলল, কিন্তু কর্নেল এবার গম্ভীর মুখে বললেন–তুমি তো আমাকে ভালোই জানো। তুমি নিজেই স্বীকার করেছ, আমার কীর্তিকলাপ তোমার অজানা নয়।
রঞ্জনা দু-হাতে মুখ ঢেকে তেমনি কান্নাজড়ানো গলায় বলল-আপনি কেমন করে জানলেন ওই সর্বনেশে ব্রিফকেসটা আমার ঘরে আছে?
কর্নেল বললেন–থাকার সম্ভাবনা ছিল। এটা আমার অঙ্ক। রাজকুমার তোমার কাছে চোরাই দেবীমূর্তি রাখতে যায়নি। কারণ আমি ভালোভাবেই জানি ওটা সে কোথায় রেখে গেছে। তাই তুমি যখন বললে-রাজকুমার তোমার কাছে গোপনে গিয়েছিল, তখনই বুঝেছিলুম সে তোমাকে কী লুকিয়ে রাখতে বলেছিল। আমার অঙ্ক রাজকুমার টাকা হাতিয়েছিল কিন্তু পার্টিকে দেবীমূর্তি দেয়নি। তাই বেঘোরে তাকে মরতে হয়েছে।
রঞ্জনা চোখের জল মুছে মৃদুস্বরে বলল-আপনাকে যথাসময় সব খুলে বলতুম। কিন্তু আমারই বুদ্ধির ভুল, আমি একজনকে বাঁচানোর জন্য আপনাকে কিছু মিথ্যা কথা বলেছিলুম।
কর্নেল বললেন–কথাটা এখনি খুলে বললে আমার কাজের সুবিধা হয়।
রঞ্জনা মুখ নামিয়ে বলল–ঘটনার দিন। গত শনিবার দুপুরে হঠাৎ রাজকুমার ফোন করেছিল। ঠিক সন্ধ্যা সাতটায় আমি যেন গাড়ি নিয়ে পার্ক স্ট্রিটে মুনলাইট বারের সামনে উপস্থিত থাকি। আমি এর কারণ জিজ্ঞেস করলে সে বলেছিল-কোনও প্রশ্ন কোরো না। এ আমার জীবন-মরণ খেলার সময়। এতে তোমার কোনও ক্ষতি হবে না। সে আমাকে এমন অনুনয়-বিনয় করছিল যে, আমি তার কথায় রাজি হয়ে গেলুম।
–তা হলে তুমি শনিবার সন্ধে সাতটায় মুনলাইটের সামনে গিয়েছিলে?
গিয়েছিলাম। প্রায় কুড়ি-পঁচিশ মিনিট গাড়িতে বসে অপেক্ষা করার পর হঠাৎ বাঁ-দিকে ঘুরে দেখলুম রাজকুমার টলতে টলতে হেঁটে আসছে। তখন আমি তাকে নাম ধরে ডাকলুম। অমনি সে আমার গাড়ির পাশে এসে এই ব্রিফকেসটা আমার হাতে গুঁজে দিয়ে বলল–এখনই চলে যাও। এর ভিতরে কী আছে তা জিজ্ঞেস করার সুযোগ পেলুম না। শুধু দেখলুম দুজন তোক তার কাঁধে হাত রেখে যেন জোর করে তাকে কোথাও নিয়ে যাচ্ছে। গাড়ি স্টার্ট দিয়ে আবার একবার উঁকি দিলুম। লোক দুটো আর রাজকুমার একটা নীল রঙের মারুতিতে ঢুকে গেল। তারপর গাড়িটা জোরে বেরিয়ে গেল। বাড়ি ফিরে ব্রিফকেসটা খুলে আমার বুক কেঁপে উঠল। ব্রিফকেস ভর্তি নোটের বান্ডিল। তখন ওপরে একটা কাপড় ভাঁজ করে চাপা দিয়ে আরও একটা কাপড় দিয়ে ব্রিফকেসটা মুড়ে আমার খাটের তলায় ঢুকিয়ে রাখলুম।
কর্নেল জিজ্ঞেস করলেন-ব্রিফকেসটা খুললে কী করে?
রঞ্জনা বলল–আশ্চর্য ব্যাপার, ওটার হ্যাঁন্ডেলে সুতোয় বাঁধা দুটো চাবি ছিল। কথাটা বলে সে কর্নেলের দিকে নিষ্পলক দৃষ্টে তাকাল।-এখন বুঝতে পারছি আমার অজ্ঞাতসারে আমার ঘর সার্চ করার জন্য আপনি আমাকে এই হোটেলে থাকতে বলেছিলেন।
কর্নেল একটু হেসে বললেন–না, তোমার ওখানে থাকার ঝুঁকি ছিল। কারণ যে লোকটাকে আমার আজ রাত ফাঁদ পেতে পাকড়াও করেছি তাকে তুমি নিশ্চয়ই চেনো। সে থাকে সি-ব্লকে। মনে হল লোকটা তোমারও খুবই চেনা।
রঞ্জনা শান্তভাবে জিজ্ঞেস করল–কে সে?
-কালুবরণ হাজরা।
রঞ্জনা চমকে উঠেছিল। সে শ্বাসপ্রশ্বাসের সঙ্গে বলে উঠল-কালুদা? আমি কল্পনাও করিনি, কালুদা এমন কিছু করবে।
-তোমার এই কালুদার ক্রিমিনাল রেকর্ড আছে পুলিশের কাছে। তাকে তুমি কতটুকু চেনো?
রঞ্জনা বিব্রতভাবে বলল–কালুদা লাখখাঁটিয়া কোম্পানির অকশন হাউসে চাকরি করেন। তার সঙ্গে রাজকুমারের সূত্রেই আমার আলাপ। আমি কল্পনাও করতে পারছি না, অমন ভদ্র আর শান্ত মানুষ একটা পাপচক্রে জড়িয়ে আছেন। তিনিই আমাকে নিউআলিপুরে চেতনা হাউসিং কমপ্লেক্সের ওই ফ্ল্যাটটা কম দামে পাইয়ে দিয়েছিলেন। ওই আবাসনের প্রোমোটার কালুদার ঘনিষ্ঠ বন্ধু।
কর্নেল ব্রিফকেসটা রঞ্জনাকে ফিরিয়ে দিলেন। বললেন–এটা তোমারই প্রাপ্য।
রঞ্জনা ব্রিফকেসটা আলতো হাতে ধরে বলল–এটা আমার ঘরে রাখলে কোনও বিপদ হবে না তো?
-না। ওটা তোমাকে রাজকুমার রায় রাখতে দিয়েছিলেন। কাজেই ওটা তোমার। বলে কর্নেল ঘড়ি দেখে বললেন–তুমি কাল মর্নিংয়ে এখান থেকে চেক আউট করে সোজা তোমার ফ্ল্যাটে চলে যাবে। ফ্ল্যাটে পৌঁছেই যেন অবশ্যই আমাকে ফোন করবে।
আমরা দুজনে বেরিয়ে এলুম। লিফটে চেপে নীচের লবিতে নেমে দেখলুম ম্যানেজার মি. রঙ্গনাথন উদ্বিগ্ন মুখে দাঁড়িয়ে আছেন।
কর্নেল মৃদু হসে তাঁকে বললেন–কাল মর্নিংয়ে মিস কমলিকা সরকার চেক আউট করবে। আপনাদের ট্রান্সপোর্ট সেকশন থেকে তার জন্য গাড়ি ভাড়ার ব্যবস্থা করে দেবেন।
ম্যানেজার বললেন–আই মাস্ট ডু দ্যট। হোটেল থেকে বেরিয়ে অত রাতে ট্যাক্সি পাব কি না আমার চিন্তা ছিল। কিন্তু এই ফাইভস্টার হোটেলে মধ্যরাতেও বিদেশ থেকে প্লেনে কত লোক কলকাতায় আসেন। দেখলুম, হোটেলের লনে ট্যাক্সি থেকে দুজন ইউরোপিয়ান ভদ্রলোক নামছেন। কর্নেল গিয়ে সেই ট্যাক্সির ড্রাইভারকে বললেন–আপনার বাড়ি যাওয়ার তাড়া নিশ্চয়ই আছে, কিন্তু আমরা বেশি দূরে যাব না।
ট্যাক্সিওয়ালা কর্নেলকে দেখে প্রথমে সাহেব ভেবেছিল কিন্তু তার মুখে বাংলা শুনে বলল–আপনি বাঙালি?
ততক্ষণে কর্নেল এবং আমি ট্যাক্সিতে ঢুকে পড়েছি। কর্নেল বললেন আমাদের ইলিয়ট রোডে নামিয়ে দিলেই চলবে।
ট্যাক্সিওয়ালা বলল-চলুন। আমি ওই এরিয়াতেই থাকি।
সে রাতে শোবার আগে কর্নেলকে জিজ্ঞেস করেছিলুম, রঞ্জনা কাকে বাঁচানোর কথা বলছিল। তাকে সেই লোকটার কথা জিজ্ঞেস করলেন না কেন?
কর্নেল বললেন–ধীরে জয়ন্ত, ধীরে। আপাতত এই ধকলের পর ঘুমিয়ে পড়াটাই খুব জরুরি। গুড নাইট।
.
ষষ্ঠীচরণের ডাকে ঘুম ভেঙেছিল। সে বেড টি এনেছিল। তখন সকাল প্রায় আটটা।
কিছুক্ষণ পরে ড্রইং রুমে গেলুম। দেখলুম কর্নেল টেলিফোনে কার সঙ্গে কথা বলছেন। আমি বসার পর রিসিভার রেখে তিনি হাসি মুখে বললেন–মর্নিং জয়ন্ত। আশা করি সুনিদ্রা হয়েছে।
বললুম–মর্নিং কর্নেল। এ রাতে সত্যিই চমৎকার ঘুমিয়েছি।
কর্নেল বললেন–রঞ্জনা ফোন করেছিল তার ফ্ল্যাট থেকে। টাকা ভর্তি ব্রিফকেসটা তাকে ফেরত দিয়ে আমি নাকি তাঁকে বিপদের মুখে ঠেলে দিয়েছি। টাকার লোভ তার নেই। যাই হোক, বুঝতেই পারছ, এভাবে চোরাই টাকা ঘরে রেখে কারো স্বস্তিতে থাকার কথা নয়। কিন্তু আফটার অল টাকার প্রতি মানুষের দুর্বলতা থাকে। তা ছাড়া রঞ্জনার মুখ থেকে আরও গোপন তথ্য বের করতে হলে আমাকে এভাবেই এগোতে হবে। জয়ন্ত তুমি এই ব্রিফকেসের ব্যাপারে মুখ বুজে থাকবে।
অবাক হয়ে বললুম–রাজকুমারের হত্যাকাণ্ডে এই ব্রিফকেসটা জড়িত। কাজেই
আমাকে থামিয়ে দিয়ে কর্নেল বললেন–রঞ্জনার ঘর থেকে টাকা ভর্তি ব্রিফকেসটা খুঁজে পাওয়ার কথা শুধু তোমার এবং আমার এই দুজনেরই জানা। রঞ্জনা তো কখনও আগ বাড়িয়ে পুলিশকে বলবে না, তাকে রাজকুমার টাকা ভর্তি। একটা ব্রিফকেস রাখতে দিয়েছিল। তাকে আমি এইমাত্র টেলিফোনে আবার সতর্ক করে দিলুম।
ষষ্ঠীচরণ ট্রেতে দু-পেয়ালা কফি আর স্ন্যাক্স রেখে গেল। কফি খেতে খেতে বললুম–রায়ডিহির শিল্পপতি শিলাদিত্য সোম রাজকুমারের ঘুসি খেয়েই বার থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন। তাই পরের ঘটনা অর্থাৎ রঞ্জনার গাড়িতে রাজকুমারের ব্রিফকেস গুঁজে দেবার ঘটনা তিনি দেখেননি। এদিকে আশ্চর্য ব্যাপার তাকেও নাকি প্রাচীন রত্নখচিত দেবীমূর্তি ফেরত দেবার জন্য কেউ হুমকি দিয়েছে। এদিকে আপনার মুখে শুনেছি লাখখাঁটিয়া কোম্পানির অকশন হাউসের ম্যানেজার, কী যেন নামটা?
কর্নেল বললেন–রণবীর রানা।
বললুম–হা, এই ভদ্রলোককেও কেউ একই ব্যাপার হুমকি দিয়েছে। এটা গোলমেলে ব্যাপার।
কর্নেল বললেন–মোটেও গোলমেলে নয়।
-কেন?
–জয়ন্ত তোমাকে বরাবর বলে আসছি, তুমি বোঝে সবই, তবে দেরিতে। একটু চিন্তা করলেই বুঝতে পারবে, প্রথমত, যে হুমকি দিচ্ছে সে সঠিকভাবে জানেই না জিনিসটা কার কাছে আছে। দ্বিতীয়ত, আমরা গত রাতে সেই হুমকি দেওয়া লোকটাকে হাতেনাতে পাকড়াও করেছি।
একটু নড়ে বসে বললুম–মাই গুডনেস! তাই তো, ওই কালুবরণ হাজরাই সবাইকে হুমকি দিচ্ছিল। কাজেই বোঝা যাচ্ছে সে হয়তো রাজকুমার হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত।
কর্নেল সায় দিয়ে বললেন–ঠিক ধরেছ।
আমরা এইসব কথাবার্তা বলছি এমন সময় ডোরবেল বাজল। কর্নেল যথারীতি হাঁক দিলেন-ষষ্ঠী।
একটু পরে প্রাইভেট ডিটেকটিভ হালদারমশাই সবেগে ঘরে ঢুকে ধপাস করে সোফায় বসে পড়লেন। তারপর বললেন–ওহ কী কাণ্ড।
কর্নেল বললেন–একটু শান্ত হোন হালদারমশাই। আগে কফি খান। খেয়ে স্নায়ুকে চাঙা করুন। বুঝতে পারছি আপনি রাত জেগে ট্রেন জার্নি করে এসেছেন।
হালদারমশাই বললেন–এক্কেরে হাওড়া স্টেশন থেইকা আপনার বাড়িতে ঢুকছি। ট্রেনে শোয়ার বার্থ পাই নাই। সিটে বইয়া আইছি।
একটু পরের ষষ্ঠীচরণ তাঁর জন্য এক পেয়ালা কফি রেখে গেল। হালদারমশাই অভ্যাসমতো ফুঁ দিয়ে কফি খেতে খেতে বললেন–হাতে কখনও এমন ক্যাস পাই নাই। হঃ, ক্লায়েন্ট আমারে টাকা দিছে সত্য, কিন্তু এমন কখনও পাই নাই।
আমি জিজ্ঞেস করলুম-কেন বলুন তো?
গোয়েন্দাপ্রবর আড়ষ্ট হেসে বললেন–আমি কাইল সন্ধ্যায় ঝরনার ধারে গিয়া ওত পাতুম, তারপর লোকটারে ধইরা ফেলুম ঠিক করছিলাম। আমার ক্লায়েন্ট কইল সেই কামের জন্য ওনার হাতে লোক আছে। বোঝেন ব্যাপার। হাতে যদি লোক থাকে তা হইলে আমার হায়ার করছিল ক্যান তা বুঝলাম না। তা ছাড়া তা হইলে তিনিই বা গা ঢাকা দিয়া ছিলেন ক্যান। হেভি মিস্ত্রি।
কর্নেল বললেন–আপনার ক্লায়েন্ট মি. সোম আমাকে ভোর ছটায় ট্রাংকল করেছিলেন।
হালদারমশাই চমকে উঠে বললেন–উনি কী কইলেন আপনারে?
উনি বললেন–মি. হালদারকে আপাতত আমার দরকার নেই। আমি শিগগির কলকাতা যাচ্ছি। তখন দেখা হবে।
প্রাইভেট ডিটেকটিভ কফি শেষ করার পর একটিপ নস্যি নিলেন এবং নোংরা রুমালে নাক মুছে বললেন–আমি বড্ড টায়ার্ড। বাড়ি গিয়া চান করুন। তারপর হেভি একখান ঘুম দিয়া আপনারে ফোন করুম।
কর্নেল বললেন–ঠিক বলেছেন। এখন আপনার বিশ্রাম দরকার।
হালদারমশাই উঠতে গিয়ে হঠাৎ বসে তার কাঁধে ঝোলানো ব্যাগের চেন খুললেন। তারপর ভিতর থেকে একটা দোমড়ানো ভাঁজ করা কাগজ কর্নেলকে দিয়ে বললেন–এই কাগজখান আমি কুড়াইয়া পাইছি। আমার ক্লায়েন্টের গাড়ির থেইকা এই কাগজখান রাস্তায় পইড়া গেছিল, তা দেইখা আমি ওইটা কুড়াইয়া নিছিলাম। হেভি মিস্ত্রি। আপনি পড়লেই তা বুঝবেন।
বলে তিনি বেরিয়ে গেলেন। কর্নেলের অ্যাপার্টমেন্টের সদর দরজায় যে লকিং সিস্টেম আছে সেটা ভেতর থেকে দরজা খোলা যায় কিন্তু বাইরে থেকে ঢুকতে হলে চাবির দরকার হয়।
হালদারমশাই চলে যাবার পর বললুম–কাগজটাতে কী আছে? কর্নেল ততক্ষণে কাগজটার ভাঁজ খুলে আতশকাঁচের সাহায্যে খুঁটিয়ে পড়ছিলেন। একটু পরে বললেন–এটা একটা চিঠি। মি. সোমকে লেখা চিঠি। এক মিনিট।
বলে তিনি উঠে ভিতরের ঘরে গেলেন। কিছুক্ষণের মধ্যে ফিরে এসে ইজিচেয়ারে বসে তিনি আর একটা কাগজে লেখা চিঠির সঙ্গে মিশিয়ে দেখার পর গম্ভীর মুখে বললেন–আশ্চর্য জয়ন্ত, আমি ঘর থেকে এই যে চিঠিটা নিয়ে এলুম সেটা মৃত রাজকুমারের পার্সের ভিতর পাওয়া চিঠির জেরক্স কপি। আসল চিঠিটা নরেশবাবুকে কথামতো গতকাল ফেরত দিয়েছি। দুটো চিঠিই ইংরেজিতে লেখা একই হাতের লেখা এবং নীচে একই লোকের সংক্ষিপ্ত স্বাক্ষর। আর. আর. দুটো ইংরেজি আর।
আমি উঁকি মেরে দেখার পর বললুম–হ্যাঁ, একই লোকের লেখা চিঠি। মি. সোমকে কী লিখেছে সে?
কর্নেল বললেন–এই ডবল আর ভদ্রলোক রাজকুমারকে লিখেছিলেন মুনলাইট বারে তার লোক গিয়ে তাঁকে ব্রিফকেস ভর্তি পাঁচ লাখ টাকা দেবে।
বাধা দিয়ে বললুম–সে তো জানি। মি. সোমকে সে কী লিখেছে?
কর্নেল চোখ বুজে বললেন–লিখেছে মি. সোম যদি তার সঙ্গে গোপনে দেখা করেন তা হলে কথামতো জিনিসটা তার মাধ্যমে হংকং-এর মি. চিং হোয়াং-এর কাছে পৌঁছে দিতে বলবেন। মি. সোমের প্রতি তার আস্থা এখনও দৃঢ়। মি. সোম এই কাজের জন্য আগের মতো উপযুক্ত কমিশন পাবেন। তারিখ দেওয়া আছে গত শনিবারের।
একটু ভেবে নিয়ে বললুম–এই কেসের নেপথ্য দুটি ইংরেজি অক্ষর R.R. রয়ে গেছে। কর্নেল কী অদ্ভুত ব্যাপার দেখুন। নিহত রাজকুমার রায়ের নামের আদ্যক্ষর দুটো R। হ্যাঁ, আপনার মুখে লাখোটিয়া কোম্পানির অকশন হাউসের ম্যানেজারের নাম শুনেছি। কী যেন নামটা?
কর্নেল হাসলেন।–রণবীর রানা। আমি উৎসাহে বললুম–তা হলে আমরা তিনজন লোক পাচ্ছি যাদের নামের আদ্যক্ষর দুটো ইংরেজি R।
আমাকে চুপ করতে হল টেলিফোনের বিরক্তিকর শব্দে। একটা গুরুতর আলোচনার সময় এ একটা উপদ্রব।
কর্নেল রিসিভার তুলে সাড়া দিলেন। বললেন–হ্যাঁ, কর্নেল নীলাদ্রি সরকার বলছি। আপনি কি সুজাতা দেবী?
—–
কর্নেল সহাস্যে বললেন–না না, আমার কোনও অলৌকিক শক্তি নেই।
—–
না না, ভুল বোঝাবুঝির কিছু নেই। আপনার হতভাগ্য ভাইয়ের খুনিকে ধরার জন্য আমি আর প্রাইভেট ডিটেকটিভ মি. হালদার যে কাজ করেছি তা আপাতদৃষ্টে আপনার পক্ষে অপরাধ মনে হতেই পারে।
—–
–সুজাতা দেবী আমি আপনার হিতাকাঙ্ক্ষী। আমার সঙ্গে খুলে কথা বলার একটাই সুবিধে, আমি পুলিশ নই।
—–
–আপনি এখনই চলে আসুন। আমাকে যে আভাস দিলেন তাতে মনে হচ্ছে, আপনার আর এক মুহূর্তও দেরি করা উচিত নয়।
রিসিভার নামিয়ে রেখে কর্নেল আমার দিকে তাকালেন। আমি মুখে আতঙ্কের ছাপ ফুটিয়ে বললুম–সর্বনাশ! আপনার অ্যাপার্টমেন্ট আবার রায়বাঘিনির হানা। কর্নেল ভদ্রমহিলা এলে আমি লুকিয়ে পড়ব।
কর্নেল তার প্রশস্ত টাকে হাত বুলিয়ে বললেন–না, জয়ন্ত, রায়বাঘিনি এখন নেহাত মিনি বেড়াল হয়ে গেছেন।
–তার এই রূপান্তরের কারণ কী?
কারণ নিজের কানেই শুনবে।
এইসময় ডোর বেল বাজল। কর্নেল যথারীতি ডাক দিলেন–ষষ্ঠী।
আমি বোকার মতো ভেবেছিলুম সুজাতা দেবীর আবির্ভাব হচ্ছে। কিন্তু আমাকে নিরাশ করে ঘরে ঢুকলেন লালবাজারের ডিটেকটিভ সাবইনস্পেকটর নরেশ ধর। তিনি আমাদের দুজনকেই মর্নিং সম্ভাষণ করে সোফায় বসলেন। তারপর বললেন–আগে খবর না দিয়ে কর্নেলসাহেবের ডেরায় অনুপ্রবেশ করতে হল। তবে আগে এক পেয়ালা কফি। তারপর কথা।
নরেশবাবুকে উত্তেজিত দেখাচ্ছিল। ষষ্ঠীচরণ সবসময় কফির জন্য যেন কেটলি ওভেনে চাপিয়েই রাখে, আর জল ফুটাতেই থাকে। সে এক মিনিটের মধ্যে এক পেয়ালা কফি এনে সেন্টারটেবিলে রেখে গেল। নরেশবাবু কফিতে কয়েকবার চুমুক দেবার পর একটু হেসে বললেন–সুখবরই এনেছি কর্নেলসাহেব। কালুবরণ হাজরাকে গত রাত্রে ঘণ্টা চারেক জেরার পর সে স্বীকার করেছে রাজকুমারবাবুকে যেখানে খুন করা হয়েছিল সেই জায়গাটা সে চেনে। আমার সারারাত ঘুম হয়নি। ভোর পাঁচটায় তাকে সঙ্গে নিয়ে সেই জায়গাটা দেখতে গিয়েছিলুম। বেহালা এলাকায় একটা বাগানবাড়ি সেটা। বাড়ির দারোয়ান আগেই কেটে পড়েছিল। গেটের তালা ভেঙে আমরা ভিতরে ঢুকেছিলুম। ইংরেজ আমলের একটা একতলা বাংলো। একটা ডোবা আছে, নারকেল এবং অন্যান্য ফলের গাছ প্রচুর। বাড়িটার চারপাশে ঘন আগাছার জঙ্গল। সদর দরজার তালাও ভাঙতে হয়েছিল। সুইচ টিপে আলো জ্বেলে দেখলুম বসার ঘরে পুরোনো আসবাবপত্র। সবই উল্টেপাল্টে পড়ে আছে। হাজরা বলল-দামি জিনিসটা নাকি রাজকুমার এই বাংলোতেই লুকিয়ে রেখেছিল। কিন্তু বাংলোর চারটে ঘর তন্নতন্ন খুঁজে যখন জিনিসটা পাওয়া গেল না, তখন দুজন লোকের সঙ্গে রাজকুমারের ঝগড়া বেধে গেল। তারপর প্রচণ্ড মারামারি এবং শেষে একটা লোক রাজকুমারের মাথার পেছনে রিভলবারের নল ঠেকিয়ে গুলি করে এবং রাজকুমার মুখ থুবড়ে পড়ে যায়।
কর্নেল জিজ্ঞেস করলেন-লোক দুটোকে যদি কালুবরণ নাই চেনে তা হলে সে তাদের সঙ্গী হল কেন?
নরেশবাবু বললেন–কালুবরণ সেখানে গিয়েছিল তার বসের হুকুমে। ওই দুজনকে সে চেনে না। তার একমাত্র কাজ ছিল জিনিসটা সে নিয়ে এসে তার বসের কাছে পৌঁছে দেবে। আর ওই লোক দুটো তাকে গার্ড দিয়ে আনবে। হাজরা বলেছে–লাখখাঁটিয়া কোম্পানির অকশন হাউসে নানা ধরনের লোক চাকরি করে। তাদের অনেকেই গুন্ডা-মস্তান। সবাইকে সে চেনে না।
কর্নেল বললেন–তার বসের নাম সে কী বলেছে?
নরেশবাবু বললেন–বলেছে লোকটা নাকি অকশন হাউসের ম্যানেজার।
কর্নেল বললেন–নামটা নিশ্চয়ই রণবীর রানা।
নরেশবাবু কর্নেলের দিকে নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে বললেন–আপনি জানেন। কী আশ্চর্য!
কর্নেল একটু হেসে বললেন–নামটা জানা আমার পক্ষে কঠিন কিছু নয়। যাই হোক, বেহালার বাংলোবাড়ির মালিক কে জানতে পেরেছেন?
মালিক একজন রাজবংশধর। তিনি থাকেন রুদ্রগড়ে। হাজরা বলেছে রুদ্রগড় থেকে অ্যান্টিক কেনার সূত্রে তার সঙ্গে নাকি রাজকুমারের পরিচয় হয়েছিল। রাজকুমারের অনুরোধে তিনি ওই বাগানবাড়িতে তাকে থাকতে দিয়েছিলেন। বুঝতেই পারছেন, এই ধরনের জায়গা রাজকুমারের কারবারের পক্ষে নিরাপদ।
কর্নেল বললেন–বাঃ তা হলে রণবীর রানাকে আপনাদের জেরা করা উচিত।
নরেশবাবু সহাস্যে বললেন–পাখি উড়ে গেছে। রানার কোনও পাত্তা পাইনি।
কর্নেল বললেন–রাজকুমারকে লেখা সেই চিঠিতে স্বাক্ষর করা ছিল দুটো R। নরেশবাবু উঠে দাঁড়িয়ে বললেন–জাল গুটিয়ে এনেছি। এবার চলি কর্নেলসাহেব।
.
০৯.
নরেশবাবু চলে যাবার পর বললুম–কর্নেল, তা হলে যে দেখা যাচ্ছে পুলিশ আপনাকে টেক্কা মেরে দিল।
কর্নেল গম্ভীর মুখে সাদাদাড়িতে হাত বুলিয়ে বললেন–ডার্লিং, পুলিশের টেক্কার পিছনে এই বৃদ্ধের অবদান আছে।
কর্নেলের কথায় যেন প্রছন্ন অভিমান ছিল। তাই বললুম–ওঃ কর্নেল! আমি আপনাকে তাতিয়ে দিতে চাইছি। কারণ সত্যিই তো এখনও পুলিশ প্রকৃত খুনি এবং বহুমূল্য সেই অ্যান্টিকের খোঁজ পায়নি।
কর্নেল ইজিচেয়ারে হেলান দিয়ে চোখ বুজে অভ্যাসমতো দাড়িতে চিরুনি কাটতে থাকলেন। আমি এদিনের খবরের কাগজে মনোনিবেশ করলুম। ইংরেজি বা বাংলো কোনও কাগজই গত রাতের খবরটা ছাপাবার সুযোগ পায়নি। এমনও হতে পারে পুলিশ কর্তৃপক্ষের নির্দেশে হাজরা গ্রেফতারের খবর হয়তো চেপে যাওয়া হয়েছে। এইসময় আবার ডোরবেল বাজল। এবং কর্নেলের হাঁকের পর দেখলুম রায়বাঘিনি মহিলা মিনি বেড়াল না হোক, বিষাদ প্রতিমা রূপে ঘরে ঢুকলেন। দুজনকে নমস্কার করে তিনি সোফায় বসলেন।
কর্নেল চোখ খুলে স্মিত হেসে বললেন–আসুন সুজাতা দেবী, এতক্ষণ আপনারই প্রতীক্ষায় ছিলুম। বলুন কী হয়েছে?
সুজাতা রুমালে চোখ মুছে বললেন–আমার ভাই রাজু কোথায় থাকত তা একমাত্র আমি জানতুম। এক সময় তো সে থাকত আমার বাড়ির কাছাকাছি শ্যামপুকুরে। তখন সিনেমার একটা খারাপ মেয়ে তার সঙ্গে থাকত। তাই আমি সে বাড়িতে মাত্র একবারই গিয়েছিলুম। তো আজ সকালে হঠাৎ মনে হল রাজু বেহালার যে বাড়িতে থাকত সেই বাড়িতে গেলুম। গিয়ে দেখলুম গেটে পুলিশ পাহারা। লোকেরা ভিড় করে এদিকে-ওদিকে দাঁড়িয়ে আছে। পুলিশ আমাকে ঢুকতে দেবে না। বরং উল্টে অ্যারেস্ট করবে। কারণ আমি রাজুর দিদি। ওখানকার কিছু লোকের সঙ্গে আমার আলাপ হয়েছিল। মাঝে মাঝে রাজুর খবর নিতে যেতুম, তাই তো মোহনবাবু নামে এক ভদ্রলোক আমার আর রাজুর দুজনেরই পরিচিত। মোহনবাবু আমাকে দেখে এগিয়ে এসে চুপিচুপি বললেন–শুনছি ভোরবেলা এ বাড়িতে পুলিশ হানা দিয়েছিল। সত্যি মিথ্যে জানি না, আপনার ভাইকে নাকি ওই বাড়ির ভিতর খুন করা হয়েছিল। মোহনবাবুর পাশে দাঁড়িয়ে। ছিলেন সতুবাবু। তিনি কন্ট্রাক্টরি করেন। তিনি বললেন–দিদি, আমি নিজের চোখে দেখেছি, পুলিশের সঙ্গে রাজুবাবুদের কোম্পানির একটা লোক ছিল। আপনি হয়তো চিনবেন। অনেকবার তাকে এ বাড়িতে দেখেছি। তাগড়াই চেহারা, গায়ের রং কালো, মাথায় কাঁচা-পাকা চুলের টেরি আছে। গোঁফখানাও দেখবার মতো। নামটা–হ্যাঁ, কালুবরণ হাজরা।
সুজাতা দেবী চুপ করলেন। কর্নেল বললেন–আপনি কি বেহালা থেকেই আমাকে ফোন করেছিলেন?
–আজ্ঞে হ্যাঁ, কর্নেলসাহেব। আমি জোড় হাতে বলছি আপনি জ্ঞানীগুণী মানুষ। আপনি আমার ভাইয়ের খুনিকে ধরে দিন। সেই গোয়েন্দা ভদ্রলোক হালদারবাবু আমাকে পইপই করে বলেছিলেন–পুলিশমহলে আপনার খুব প্রভাব আছে। তা ছাড়া আপনি নাকি খুনি আর বজ্জাত লোকদের খুঁজে বের করে শাস্তি দেন।
কর্নেল বললেন–ম্যাডাম, গতকাল আপনি আমাকে বলেছেন–আপনার ভাই রাজুর লুকিয়ে রাখা কোনও দামি জিনিসের খোঁজখবর জানেন। আপনি মি. হালদারকে বলেছিলেন–আপনার ঘরের টেবিলের নীচের ড্রয়ারে রাখা কাগজপত্রের মধ্যেই সেই জিনিসটা খুঁজে বের করার সূত্র লুকিয়ে আছে।
সুজাতা বললেন–হ্যাঁ, কিন্তু সেই কাগজগুলো তো হালদারবাবুই রবিবার সন্ধ্যাবেলা হাতিয়ে এনেছেন। কাজটা নিশ্চয়ই অন্যায় বলব। কিন্তু এই জিনিসটার কথা পরে, আগে আমার ভাইয়ের খুনিদের ধরিয়ে দিন তা হলে মনে শান্তি পাব।
বলে তিনি চোখে আঁচল চাপা দিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলেন। কর্নেল তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন–প্লিজ সুজাতা দেবী, ভেঙে পড়বেন না। আমি কথা দিচ্ছি খুনিদের ধরিয়ে দিতে যথাসাধ্য চেষ্টা করব। কিন্তু আমার কাছে সত্যি কথা লুকোলে আমার পক্ষে এক-পা এগোনোও সম্ভব নয়। যাই হোক, আপনি এক পেয়ালা কফি বা চা আগে খেয়ে নিন। তা হলে আপনার নার্ভ চাঙ্গা হবে।
সুজাতা আবার করজোড়ে বললেন–আমার মুখে এখন কিছুই উঠবে না। কর্নেলসাহেব, আমাকে ক্ষমা করবেন।
কর্নেল তার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টে তাকিয়ে বললেন–আপনি কি সত্যিই জানেন সেই জিনিসটা আপনার ভাই কোথায় লুকিয়ে রেখেছে?
সুজাতা মুখ নামিয়ে মৃদুস্বরে বললেন–জিনিসটা রাজু রেখেছিল বেহালার ওই বাড়িতে। কিন্তু গত বৃহস্পতিবার সে এসে আমাকে বলেছিল বেহালার বাড়ি থেকে তার কেনা অনেক লাখ টাকা দামের জিনিসটা চুরি হয়ে গেছে। কথাটা শুনে আমি বলেছিলুম নিশ্চয়ই তোমার বাড়ির দারোয়ান কিংবা কাজের মেয়েটা ওটা চুরি। করেছে। সে বলেছিল–অসম্ভব। জিনিসটা সম্পর্কে ওরা কীভাবে জানতে পারবে। ঘরের তালা সবই মজবুত। কেউ তালা ভাঙেনি, অথচ জিনিসটা খুঁজে পেলুম না। এদিকে আমার কোম্পানি জিনিসটা কেনার জন্য আমাকে পাঁচ লাখ টাকা দেবে। টাকা নিলেও বিপদ, আবার না নিলেও বিপদ। কোম্পানি ভাববে আমি অন্য কাউকে বেচে দিয়েছি। ওরা সাঙ্ঘাতিক লোক দিদি।
কর্নেল বললেন–আপনি ভাইকে কী পরামর্শ দিয়েছিলেন?
সুজাতা বললেন–ওকে বলেছিলুম, তোর সমানে এখন দুটো পথ খোলা রাজু। তুই গা ঢাকা দে, রায়ডিহিতে তোর বাল্যবন্ধু সোমসাহেবের কাছে আশ্রয় পাবি। তাতে যদি অসুবিধা থাকে সেই জিনিসটার অবিকল নকল তৈরি করে ওদের দিয়ে তারপর যে টাকা পাবি তা-ই নিয়ে হংকং-এ পালিয়ে যা। ওসব দেশ তো তোর চেনা।
–আমি যতটুকু জানি, আপনার ভাই নকল জিনিসই দিয়েছিলেন, কিন্তু ওদের মধ্যে নিশ্চয়ই কোনও পাকা জহুরি ছিল! সে জিনিসটা নকল বলে বুঝতে পেরেছিল। তাই আপনার ভাইকে ওরা গুলি করে মারে।
সুজাতা দেবী মৃদুস্বরে বললেন, আমার ঘরের টেবিলের ড্রয়ার থেকে যে কাগজগুলো হারিয়েছে সেগুলোর মধ্যে কয়েকটা নাম-ঠিকানা আর একজনের লেখা কয়েক লাইন চিঠি ছিল। কর্নেলসাহেব আপনি দয়া করে সেই গোয়েন্দা ভদ্রলোকের কাছ থেকে সেগুলো চেয়ে নিন।
কর্নেল একটু হেসে বললেন–আপনি কি হালদারমশাইয়ের খোঁজে গিয়েছিলেন?
-হ্যাঁ, কাল আপনার বাড়ি থেকে ওনার খোঁজে গিয়েছিলুম। লেকভিউ রোড কি এখানে! গিয়ে দেখি ওনার ফ্ল্যাটে তালা দেওয়া আছে। পাশের লোকেরা কিছু বলতে পারল না।
-কাগজগুলো আপনাকে দেখাব–
অমনি সুজাতা দেবীর চোখ বড় হয়ে উঠল। তিনি যেন স্বস্তির নিশ্বাস ফেললেন। বললেন, তা হলে গোয়েন্দা ভদ্রলোক আমার উপকারই করেছেন বলব। ভুল বুঝে তাকে গালমন্দ করেছি।
কর্নেল ইজিচেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন–আমি ওই কাগজগুলো খুঁটিয়ে দেখেছি। কিন্তু কিছু বুঝতে পারিনি। আমি সেগুলো নিয়ে আসছি। আপনি আমাকে দেখিয়ে দেবেন কোন্ কাগজটার সূত্রে আপনি সেই লুকোনো জিনিসটার হদিশ পেয়েছিলেন।
বলে কর্নেল ভিতরে চলে গেলেন। সুজাতা দেবী এবার আমার দিকে তাকিয়ে বললেন–আপনি কি কর্নেলসাহেবের ছেলে?
হাসতে হাসতে বললুম–বয়েসের হিসাবে আমি তা-ই। তবে ওই দাড়িওয়ালা বৃদ্ধ ভদ্রলোক আমাকে বন্ধু বলেন, কখনও বলেন, ডার্লিং। মজার কথা ইংরেজি ভাষায় ডার্লিং শব্দের মানে প্রিয়। শব্দটা কিন্তু সাহেবেরা শুধু মেয়েদেরই বলে থাকেন। কিন্তু এই কর্নেল ভদ্রলোক ছেলেমেয়ে নির্বিচারে সবাইকে ডার্লিং বলেন। এ থেকে বুঝতে পারছেন উনি একজন বাতিকগ্রস্ত মানুষ!
এইসময়ে কর্নেল একটা খামের ভেতরে সেই কাগজগুলো নিয়ে এলেন। খাম থেকে তার টেবিলে ওগুলো একটা একটা করে বের করে পেপারওয়েট চাপা দিয়ে বললেন–সুজাতা দেবী আগে দেখে নিন এই কাগজগুলো কি না। তারপর আপনি আমাকে দেখিয়ে দিন কোথায় কোথায় সেই জিনিসটার উল্লেখ আছে।
সুজাতা দেবীকে মনে হল একেবারে ঝাঁপিয়ে পড়লেন টেবিলে। তারপর তিনি কাগজগুলো একটার পর একটা দেখতে থাকলেন। লক্ষ করলুম, ওগুলোর ভিতরে খুব পুরোনো, কম পুরোনো এবং অপেক্ষাকৃত নতুন নেমকার্ড অনেক আছে। সুজাতা দেবী দুটো পুরোনো নেমকার্ড এবং দু-খানা কাগজ বেছে নিয়ে কর্নেলকে দিলেন। বললেন–এই ছোট কাগজগুলো লেখা হিজিবিজি মনে হবে। আপনি আগে এই কাগজটাই দেখে নিন।
কর্নেল টেবিলল্যাম্প জ্বেলে দিলেন এবং টেবিলের ড্রয়ার থেকে আতশ কাঁচ বের করে ঝুঁকে বসলেন। কিছুক্ষণ পরে বড় কাগজটার দিকে দৃষ্টি দিলেন। আমার মনে হল এই কাগজটা কোনও প্যাড থেকে ছেঁড়া। দীর্ঘ পাঁচ মিনিট ধরে সবগুলো আতশ কাঁচে খুঁটিয়ে দেখার পর তিনি মুখ তুলে বললেন–সুজাতার দেবীর অনুমান সত্যি বলেই মনে হচ্ছে। এই ছোট্ট কাগজটা একটা চিঠি। এতে লেখা আছে, তুমি যে ছোট্ট প্যাকেটটা রেখে গেছ তা কৌতূহল বশে আমি খোলার চেষ্টা। করেছিলুম। কিন্তু খুলতে পারিনি। বিশ্বাস হয় না এর মধ্যে পঞ্চাশ লাখ টাকা দামের কোনও জিনিস আছে। তুমি শিগগির এসে এটা খুলে আমাকে দেখাও। তারপর দর নিয়ে কথা হবে। ইতি, বলে কর্নেল মুখ ঘোরালেন–এটার নীচে দুটো ইংরেজি অক্ষর আছে। শেষেরটা এল বলে মনে হচ্ছে। কিন্তু প্রথমটা বুঝতে পারছি না।
সুজাতা দেবী চাপাস্বরে বললেন–কর্নেলসাহেব আমি কিন্তু ঠিক ধরেছি, ওটা রাজুর এক বন্ধু নাম। সে সিনেমার লোক।
আমি চমকে উঠে বললুম–মাই গুডনেস! ওটা কি শমীক লাহিড়ির নামের আদ্যক্ষর।
সুজাতা দেবী চঞ্চল হয়ে বললেন–হা, হা, সে-ই বটে। মাঝে মাঝে গাড়িতে করে রাজু তার সঙ্গে আমার বাড়িতে আসত।
কর্নেল বললেন–আর ওই বড় চিঠিটা লিখেছেন যিনি, তার পুরো নামই লেখা আছে। কালুবরণ হাজরা। এই ভদ্রলোক আপনার ভাইকে লিখেছেন, খদ্দের পাওয়া গেছে। তুমি ভালো দামই পাবে। যেন ভুল করেও লাখখাঁটিয়া কোম্পানির অকশন হাউসের ম্যানেজার রণবীর রানাকে একথা জানাবে না। লোকটা ধড়িবাজ শয়তান। জিনিসটা হাতিয়ে তোমাকে প্রাণে মেরে ফেলতে পারে।
আমি বললুম–রহস্যের জট আরও জটিল হয়ে গেল বস। কেন রাজকুমারবাবু একাধিক লোককে গোপন কথা জানিয়েছিলেন।
জবাব দিলেন সুজাতা দেবী–ওগো ছেলে, রাজুকে আপনারা খারাপ ভাবতে পারেন। কিন্তু সে তার বন্ধুদের খুবই বিশ্বাস করত।
কর্নেল বললেন–তা হলে কি আপনার ধারণা আসল জিনিসটা সিনেমার ভদ্রলোকের কাছেই লুকোনো আছে?
সুজাতা দেবী বললেন–আমার বিশ্বাস ওই লোকটার কাছেই জিনিসটা আছে। আপনাকে বলা দরকার ওই লোকটাই রাজুকে একটা খারাপ মেয়েছেলের সঙ্গে ভাব করিয়ে দিয়েছিল। আমি মেয়েটার ছবি দেখেছি। সে নাকি সিনেমা করত।
কর্নেল বললেন–একটা নেমকার্ডে আপনার ভাইয়ের নাম-ঠিকানা দেখছি। ১৮/১ বি বি রোজারিও লেন, কলকাতা-৯। রাস্তাটা আমি চিনি। ওটা কলেজ স্ট্রিট এলাকার একটা ঘিঞ্জি গলি। ওই বাড়িতে আপনি কখনও গেছেন?
সুজাতা দেবী বললেন–একবার গিয়েছিলুম। সে প্রায় এক বছর আগের কথা। কিন্তু সেখানে ওই খারাপ মেয়েটাকে নিয়ে রাজু থাকত।
কর্নেল জিজ্ঞেস করলেন–ওদের কি বিয়ে হয়েছিল?
সুজাতা দেবী বাঁকামুখে বললেন–রাজু বলেছিল বিয়ে করেছি। কিন্তু মেয়েটার সিথিতে সিঁদুর হাতে শাঁখা-নোয়া কিছু দেখিনি।
আমি মুখ টিপে হেসে বললুম–লিভ টোগেদারের ব্যাপার।
সুজাতা দেবী প্রশ্ন করলেন–কী বললেন বাবা?
কর্নেল আমার দিকে চোখ কটমটিয়ে তাকালেন। তারপর বললেন–কিন্তু সুজাতা দেবী আমি অন্য একটা কথা ভাবছি। রাজকুমারবাবু যদি সত্যিই সিনেমার ভদ্রলোকের কাছে দামি জিনিসটা লুকিয়ে রাখতেন তা হলে কোন সাহসে তিনি দুবৃত্তদের সঙ্গে বেহালার বাগানবাড়িতে গিয়েছিলেন।
সুজাতা দেবী বললেন–ওই যে বলেছি আসল জিনিসটার বদলে রাজু আমার কথামতো হয়তো একটা নকল তৈরি করে রেখেছিল।
রাজকুমারবাবুর প্রাণের ঝুঁকি ছিল, তা সত্ত্বেও তিনি এমন করতে গেলেন কেন?
-সুজাতা দেবী খুব চাপাস্বরে বললেন–রাজুর কাছে পিস্তল ছিল। আমি সে পিস্তল দেখেছি। রাজু ভেবেছিল সে দরকার হলে ওদের গুলি করে মারবে।
কর্নেল মৃদু হেসে বললেন–দেখা যাচ্ছে তা তিনি পারেননি। তাঁর ডেড বডিতে পুলিশ খুঁজেও কোনও পিস্তল পায়নি। যাই হোক, আপনি আমাকে যে সূত্র ধরিয়ে দিয়েছেন তা মূল্যবান। আমি এবার সেই পথেই এগোব।
সুজাতা দেবী আবার চোখ মুছলেন, তারপর উঠে দাঁড়িয়ে বললেন–তা হলে আমি চলি কর্নেলসাহেব। ভগবান আপনাকে আশীর্বাদ করবেন, যদি আপনি রাজুর খুনিদের ধরিয়ে দিতে পারেন। বলে আমাদের দুজনকে নমস্কার করে তিনি বেরিয়ে গেলেন।
কর্নেল ষষ্ঠীকে ডেকে ব্রেকফাস্ট রেডি করতে বললেন। তখন প্রায় সাড়ে দশটা বাজে।
ব্রেকফাস্টের পর আরেক দফা কফি খেতে খেতে কর্নেলকে বললুম–বস, শেষ অব্দি আমার ডিটেকশনই সত্যি হতে চলেছে।
কর্নেল অন্যমনস্কভাবে বললেন–হুঁ হুঁ। দুয়ে দুয়ে সত্যিই দেখছি চার হতে চলেছে। শমীক লাহিড়ি ছাড়া মার্লবরো সিগারেট খাওয়া দ্বিতীয় লোককে যখন এ পর্যন্ত খুঁজে পাইনি, তখন ধরে নিতে হচ্ছে শনিবার গড়ের মাঠের উত্তর-পশ্চিম কোণে গাছে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে শমীক লাহিড়ি পুরো একপ্যাকেট সিগারেট উড়িয়েছিলেন। কিন্তু সমস্যা হল ওখানে দাঁড়িয়ে মধ্যরাত অব্দি উনি কার প্রতীক্ষা করছিলেন।
আমি বললুম–আমার অঙ্ক রাজকুমারবাবুর গোপন জিনিসটার কোনও খদ্দের ওখানে আসার কথা ছিল। এই অঙ্ক অনুসারে রাজকুমারবাবুর সঙ্গে খদ্দেরের আসার কথা। কিন্তু তার বদলে রাজকুমারবাবুর লাশ এসে পড়ায় তিনি সভয়ে তার গাড়িতে চেপে পালিয়ে গিয়েছিলেন।
কর্নেল কিছু বললেন না। চুপচাপ কফি খাওয়ার পর তিনি চুরুট ধরালেন। তারপর টেলিফোনের রিসিভার তুলে ডায়াল করলেন। সাড়া এলে তিনি বললেন–কর্নেল নীলাদ্রি সরকার বলছি। তুমি ঠিকঠাক আছে তো?
—–
-বাঃ। তোমাদের আবাসনের সভাপতি জজসাহেব তা হলে তোমার গার্জেন হয়ে উঠেছেন। ভালো। ভদ্রলোকের জজিয়তির স্বভাব এখনও যায়নি। আর হ্যাঁ, –তুমি কি পিছনের গেটের দিকে এবং বাইরের কোথাও পুলিশ গার্ড দেখেছ?
—–
ভেরি গুড। শোনো আমি জয়ন্তকে নিয়ে তোমার ওখানে যাচ্ছি। তোমার উদ্বেগের কারণ নেই। যাওয়ার দরকার আছে বলেই যাচ্ছি।
—–
-না না, তোমাকে লাঞ্চের ব্যবস্থা করতে হবে না। আমরা তোমার ওখানে বেশিক্ষণ থাকব না। আমরা এখনই বেরোচ্ছি। অবশ্য চা বা কফির আয়োজন করতে পারো। তুমি যখন আমার কীর্তিকলাপ সবিশেষ জানো, তখন একথা জানো আমাকে আমার সামরিক জীবন থেকে কফি আর চুরুটের ভূতে পেয়েছিল। রাখছি।
বলে কর্নেল হাসতে হাসতে রিসিভার রাখলেন। বললেন–জয়ন্ত কুইক। পোশাক বদলে এসো। আর একটা কথা এবার যখনই আমরা বাড়ি থেকে বেরোব তুমি তোমার ফায়ার আর্মস সঙ্গে নিতে ভুলবে না।
কিছুক্ষণ পরে আমরা দুজনে নীচে এলুম। তারপর কর্নেলের গ্যারেজ থেকে আমার গাড়ি বার করে লনে নিয়ে এলুম। কর্নেল আমার বাঁ-দিকে বসলেন। এখন তার পিঠে কিটব্যাগ আঁটা। গলা থেকে বাইনোকুলার আর ক্যামেরা ঝুলছে। মাথায় তাঁর প্রিয় টুপি। জিজ্ঞেস করলুম–আমরা রঞ্জনার কাছে যাচ্ছি তা বুঝতে পেরেছি। কিন্তু আপনি পিঠে ওই খুদে চৌকা কালো রংয়ের পৃথিবীটা কেন আর এঁটেছেন। প্রজাপতি ধরা জালের স্টিকটাও দেখতে পাচ্ছি। কোথায় প্রজাপতি ধরবেন?
কর্নেল মিটিমিটি হেসে বললেন–যথাসময়ে দেখতে পাবে। এখন ড্রাইভিং-এ মন দাও। তোমার হাতে এ বৃদ্ধের প্রাণ। আজ কর্নেলকে পথনির্দেশ দিণ্ঠে হল না। আমি চৌরঙ্গি হয়ে সোজা এগিয়ে রেলব্রিজ পেরোনোর পর ডাইনে ঘুরে নিউআলিপুরের দিকে চললুম। একটু-আধটু জ্যাম ছিল। আধঘণ্টা পরে চেতনা হাউসিং কমপ্লেক্সের গেট গিয়ে কর্নেলের নির্দেশে আস্তে হর্ন বাজালুম। তারপর সবিস্ময়ে দেখলুম রঞ্জনা গেটের ভিতরে দাঁড়িয়ে আমাদের জন্য প্রতীক্ষা করছে। দারোয়ান তার কথায় গেট খুলে দিল। গাড়ি ভিতরে ঢুকলে রঞ্জনা বলল–আমাকে। ফেলে যাবেন না জয়ন্তবাবু। পথ হারিয়ে ফেলবেন।
বলে সে ব্যাকসিটে উঠে বসল। এই হাউসিং কমপ্লেক্সের নকশা যিনি করেছিলেন তিনি সম্ভবত খেয়ালি মানুষ। গত রাত্রে ব্যাকগেট নিয়ে আমরা ঢুকেছিলুম। বেশি হাঁটতে হয়নি। এখন দেখলুম অনেকগুলো ব্লক ঘুরে বি-ব্লকে পৌঁছোতে হল। সত্যি কেউ দেখিয়ে না দিলে এই জটিল আবাসনের কোন্ ব্লক কোথায় চেনা কঠিন।
বি-ব্লকের কাছে তলার গ্যারেজে রঞ্জনার সাদা মারুতি দেখতে পেলুম। রঞ্জনা আমার ফিয়াট গাড়িটাকে তার পাশে রাখতে বলল। ওই ঝকঝকে আধুনিকার পাশে আমার পুরোনো ফিয়াট যেন এক গ্রাম্য মানুষ।
তিনতলায় রঞ্জনার ফ্ল্যাটে ঢুকে দেখলুম গত রাতে আলোয় যেমনটা মনে হয়েছিল এখন মনে হচ্ছে ফ্ল্যাটটা সাজানোর পিছনে রঞ্জনার সৌন্দর্যবোধের কোনও তুলনা হয় না। রঞ্জনা আমাদের সোফায় বসতে বলে ভেতরে গেল। আমি বললুম–কর্নেল কাল রাত্রে হাজরাবাবুকে এই ঘরে পাকড়াও করতে আসবাবপত্র এলোমেলো হয়ে গিয়েছিল। এখন দেখছি সোফা-সেটটা অন্যভাবে সাজিয়ে রাখা হয়েছে।
রঞ্জনা কফি আর ম্যাক্সের ট্রে নিয়ে ফিরে এল। সে কর্নেলের মুখোমুখি বসে বলল- আপনার ষষ্ঠীচরণের মতো কফি হবে না।
কর্নেল কফিতে চুমুক দিয়ে মুখ বিস্ময়ের ভঙ্গি এনে বললেন–ও মাই ডার্লিং, তুমি কফিতে ষষ্ঠীকে ছাড়িয়ে গেছ।
কিছুক্ষণ চুপচাপ কফি খাওয়ার পর কর্নেল চুরুট ধরিয়ে বললেন–তোমার কাছে দরকারে আসছি বলেছিলুম। এবার সেটা শোনো।
রঞ্জনা ব্যাগ্রদৃষ্টে তাকিয়ে বলল-কর্নেল আমার কিন্তু কেন যেন বড্ড ভয় করছে। আবার কোনও অপারেশনের সঙ্গে আমাকে থাকতে হবে না তো?
কর্নেল চাপাস্বরে বললেন–তুমি সিনেমা প্রোডিউসার শমীকবাবুকে তাঁর কলকাতার বাড়িতে একবার ফোন করে জেনে নাও তিনি আছেন কি না। থাকলে বলবে তুমি এখনই তাঁর কাছে একটা জরুরি কাজে যাচ্ছ। যদি উনি কাজটার কথা জিজ্ঞেস করেন–তুমি বলবে মুখোমুখি না হলে বলা যাবে না। উনি যদি পীড়াপীড়ি করেন আভাসে তোমাকে কী বলতে হবে সেটা বলে দিচ্ছি।
রঞ্জনা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাল। তাকে এবার একটু উত্তেজিত মনে হচ্ছিল।
কর্নেল বললেন–আগে আমার এ প্রশ্নের উত্তর দাও। তুমি কি জানো রাজকুমারবাবু প্রাচীন যে দেবীমূর্তিটা তোমার কাছে রাখতে এসেছিলেন এবং সেটা তুমি রাখোনি, সেই জিনিসটা প্রকৃতপক্ষে লুকোনো আছে সিনেমা প্রোডিউসার শমীক লাহিড়ির কাছে?
রঞ্জনা বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল–আপনি কীভাবে জানলেন?
যেভাবে যোক জেনেছি। তুমি জানো কি না বলল।
–বিশ্বাস করুন আমি জানি না। কিন্তু আমার মনে হচ্ছে রাজকুমারের পক্ষে এটা অসম্ভব কিছু নয়। কারণ আমার সঙ্গে রাজকুমারের পরিচয়ের আগেই সে আর বাছুদা ছিল ঘনিষ্ঠ বন্ধু, কথাটা বলেই রঞ্জনা উত্তেজনায় কণ্ঠস্বর চাপা করে আবার বলল–কর্নেলসাহেব, এটা খুবই সম্ভব। আমাকে কী করতে হবে তা-ই বলুন।
কর্নেল মৃদুস্বরে বললেন–তুমি আভাসে ওকে এটুকু জানিয়ে দিতে পারো মৃত্যুর আগে রাজকুমার তোমার নামে একটা চিঠি পোস্ট করেছিল। আজকের ডাকে সেটা তোমার হাতে এসেছে। চিঠিতে রাজকুমার লিখেছে–বাচ্চুবাবুর কাছে সে জিনিসটা অগত্যা লুকিয়ে রাখতে বাধ্য হয়েছিলুম। তুমি বাচ্চুবাবুকে সোজাসুজি বলল রাজকুমার জিনিসটা বিক্রির দায়িত্ব পেয়ে গেছে। এটুকু বলেই তুমি বুঝতে পারবে বাচ্চুবাবু তোমাকে কী বলবেন।
রঞ্জনা দ্বিধার সঙ্গে বলল–যদি সে চিঠি দেখতে চায়?
কর্নেল একটু হেসে বললেন–তুমি বলবে বেশি দেরি করলে খদ্দের হাতছাড়া হয়ে যাবে। তাই চিঠির কথা পরে আমি যা বলছি তা স্ট্রেটকাট বলছি। ঠিক এই কথাটা তুমি জোরালো হুমকির সুরে বলবে। এবার যাও ফোন করে দ্যাখো।
রঞ্জনা তার বেড রুমে টেলিফোন করতে গেল। দীর্ঘ প্রায় পাঁচ মিনিট পরে সে ব্যস্তভাবে এ ঘরে এল। সোফায় বসে বলল–আমার কথা শুনে বাচ্চুর্দা প্রথমে অস্বীকার করছিলেন। তখন আমি ওঁকে হুমকি দিয়ে বললুম–তুমি গণ্ডগোল করলে বিপদে পড়বে। তা ছাড়া নতুন ছবির জন্য তোমার টাকার দরকার। কাজেই তুমি যা বলার এখনি বলো। কর্নেলসাহেব, বাচ্চুদার এসব সময়ে টাকার জন্য মাথা খারাপ হয়ে থাকে। লাখ লাখ টাকা দরকার হয় ছবি তৈরিতে। তাই সে শেষ অব্দি আমার কথায় রাজি হল। তবে লেনদেন হবে দিল্লি রোডের ধারে তার বাগানবাড়িতে। বাচ্চুদা বলল–এসব কাজ রাতের দিকেই হলে নিরাপদ থাকা যায়। বুদ্ধি খাঁটিয়ে আমি বলেছি খদ্দেরের সঙ্গে একজন জুয়েলারও যাবেন।
কর্নেল সহাস্যে বললেন–তুমি বুদ্ধিমতী। তোমাকে তৈরি থাকতে হবে। তুমি বাচ্চুবাবুকে আর একবার ফোন করে জানিয়ে দিয়ে তুমি এখান থেকে রাত নটায় ওই দুই ভদ্রলোককে সঙ্গে নিয়ে বাগানবাড়ির দিকে রওনা হবে। আমি এবার উঠি।
রঞ্জনা জিজ্ঞেস করল–আপনার পিঠের ব্যাগে ওই স্টিকটা কি প্রজাপতি ধরার নেটের? আপনি এমন করে এখন কোথায় বেরোচ্ছেন? ঘটনাস্থলে ঠিক সময়ে আপনাকে দেখতে পাব তো? না পেলে আমি বিপদে পড়ব। বাচ্চুদার ওই বাড়িতে যারা থাকে তার সাংঘাতিক লোক।
কর্নেল তাকে আশ্বস্ত করে বললেন–তোমার চিন্তার কারণ নেই। আর একটা কথা বলে যাচ্ছি, তুমি রাজকুমারের চিঠির কথা বলছিলে, তার হাতের লেখার নমুনা পুলিশ জোগাড় করেছে। হাতের লেখা নকল করার মতো দক্ষ লোক লালবাজার ডিটেকটিভ ডিপার্টমেন্টে আছে। যদি এই কাজটা এখন গিয়ে করিয়ে নিতে পারি তা হলে তোমাকে রিং করব। একজন লোক তোমাকে চিঠিটা দিয়ে আসবে।
এই বলে কর্নেল রঞ্জনা এবং আমাকেও প্রচণ্ড অবাক করে বেরিয়ে এলেন।
.
১০.
চেতনা হাউজিং কমপ্লেক্স থেকে বেরিয়ে যাবার পর বললুম–আপনার এই ফাঁদে বাচ্চুবাবু পা দেবেন তো? তা ছাড়া আমি ভাবছি খদ্দের এবং জহুরি আপনি এত শিগগির কোথায় পাবেন?
কর্নেল নিভে যাওয়া চুরুট লাইটারে ধরিয়ে বললেন–এ নিয়ে তোমার ভাবনার দরকার নেই জয়ন্ত। তবে ফর ইয়োর ইনফরমেশন শুধু জানিয়ে রাখছি, গতরাত্রে তুমি যখন অঘোরে ঘুমোচ্ছিলে তখনই আমার মাথায় প্ল্যানটা আসে। তারপর ডি. সি. ডি. ডি. অরিজিৎ লাহিড়িকে ঘুম থেকে জাগিয়ে যা বলার সব বলে রেখেছি। কিন্তু একথা শুনে তুমি হেসো না, অরিজিৎ-এর মতে জহুরির ভূমিকায় আমাদের প্রিয় হালদারমশাইকে রাখলে খেলাটা দারুণ জমবে।
অবাক হয়ে বললুম–হালদারমশাই জহুরি! সর্বনাশ! কর্নেল, উনি যা হঠকারী মানুষ কী করতে কী করে বসবেন তখন হয়তো সব ভেস্তে যাবে।
কর্নেল একরাশ ধোঁয়ার সঙ্গে বললেন–জয়ন্ত তুমি ভুলে যাচ্ছ প্রাইভেট ডিটেকটিভ কৃতান্তকুমার হালদারকে আমরা যতই এ ফিগার অব জোক বলে মনে করি তিনি তা নন। পুলিশ জীবনে এইসব কাজে ওঁর অভিজ্ঞতা প্রচুর। যাই হোক এখন আমরা লালবাজার ডিটেকটিভ ডিপার্টমেন্টে যাব। কারণ চিঠিটা হয়তো রঞ্জনার জন্য জরুরি হয়ে উঠতে পারে।
কলকাতা পুলিশের লালবাজার হেড কোয়ার্টারে কর্নেল সুপরিচিত। ভিতরে গাড়ি রেখে আমরা দক্ষিণের ব্লকে সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় গেলুম। তারপর একেবারে সোজা ডি. সি. ডি. ডি. ওয়ান অরিজিৎ লাহিড়ির ঘরে। মিস্টার লাহিড়ি কর্নেলকে দেখে উঠে দাঁড়িয়ে সহাস্যে বললেন–আসুন বস। আপনার জন্য অপেক্ষা করছিলুম। কিন্তু আপনি কি লালবাজারে প্রজাপতি ধরতে এসেছেন?
কর্নেল বললেন–দিল্লি রোডের ওদিকে একটা বিশাল জলাশয় আছে। বন-জঙ্গলও আছে। সেখানে এই বসন্তকালে প্রজাপতিদের খেলা দেখে এসেছি। তবে এখন হাতে সময় কম, তোমাকে দ্রুত একটা কাজ করতে হবে।
-বলুন বস।
কর্নেল পকেট থেকে শমীক লাহিড়ির লেখা ছোট্ট দোমড়ানো চিঠিটা তাকে দিয়ে সংক্ষেপে নেপথ্য কাহিনি বর্ণনা করলেন। তারপর বললেন–তোমার এই চিঠিটার কথা তোমাকে বলেছি। নিহত রাজকুমার রায়ের হাতের লেখার নমুনা। তোমাদের কাস্টডিতে আছে। অবিকল সেইরকম হস্তাক্ষরে তোমাদের এক্সপার্ট ভদ্দরলোককে দিয়ে কী লেখাতে হবে আমি লিখে দিচ্ছি। একটা প্যাড দাও।
মিস্টার লাহিড়ি কর্নেলকে প্যাড দিলেন এবং কর্নেল দ্রুত যা সব লিখলেন তার মর্ম আমি রঞ্জনার বাড়িতেই শুনে এসেছি। কর্নেল কাগজটা মিস্টার লাহিড়িকে দিলেন, তারপর তিনি রিসিভার তুলে নরেশবাবুকে ফোন করলেন। আমি জানি এই দফতরের এ.সি এবং অন্যান্য অফিসাররা থাকেন ওয়েস্ট ব্লকের চারতলায়।
কিছুক্ষণ পরে নরেশবাবু হন্তদন্ত এসে কর্নেলকে দেখে বলে উঠলেন–মাই গড! আমি স্বপ্ন দেখছি না তো?
কর্নেল বললেন–নরেশবাবু, মিস্টার লাহিড়ি আপনাকে নিশ্চয়ই আমাদের প্ল্যানের কথা বলেছেন, তার একটা ত্রুটি শোধরাতে আমাকে আসতে হয়েছে। অবশ্য অরিজিতকে আজ ভোরে জানিয়েই এসেছি।
এরপর মিস্টার লাহিড়ি নরেশবাবুকে ডেকে কর্নেলের লেখা চিঠিটা দিয়ে চাপাস্বরে কিছু নির্দেশ দিলেন। আমার কানে এল শুধু একটা শব্দ। মোহনবাবু, বুঝলুম উনিই সেই নকলনবিশ এক্সপার্ট। কর্নেল বললেন–কফি খাব না অরিজিৎ। একটু আগে শ্রীমতী রঞ্জনা রায়ের ফ্ল্যাটে অনবদ্য কফি পান করে এসেছি। আমার মতে বরং তুমি নিজে রঞ্জনাকে ফোন করে জানিয়ে দিয়ে তোমার লোক তাকে চিঠিটা দিতে যাচ্ছে। হ্যাঁ, জুয়েলার বা খদ্দের আশা করি পেয়ে গেছ।
মিস্টার লাহিড়ি একটু হেসে বললেন–যাঁকে ঠিক করেছি তিনি নিজেই একজন বিখ্যাত জুয়েলারি কোম্পানির মালিক। তার কথামতো তার হাতে নোট ভর্তি একটা ব্রিফকেসও থাকবে। আপনি একজন জহুরির কথা বলেছিলেন, তার কি কোনও দরকার আছে?
কর্নেল মিটিমিটি হেসে বললেন–আছে। আর সেই রোলটা করবেন আমাদের প্রিয় হালদারমশাই। আমি এখান থেকে ওঁকে একটা রিং করতে চাই।
মিস্টার লাহিড়ি হাসি চেপে একটা টেলিফোন এগিয়ে দিলেন। কর্নেল ডায়াল করার পর তার সাড়া পেয়ে বললেন–হালদারমশাই কি এখনও ঘুমোচ্ছিলেন?
—–
-শুনুন, যা বলছি তা শুনে চমকে উঠবেন না, কিংবা ভড়কে যাবেন না যেন। আপনি চারটের মধ্যে লালবাজারে সোজা অরিজিৎ-এর ঘরে আসবেন।
—–
অরিজিৎ আপনাকে নিয়ে জোক করবে না। আর কাজের কথাটা বলি। অরিজিৎ আপনাকে সব বুঝিয়ে বলবে। আমি শুধু জানিয়ে রাখছি, আজ রাতে একটা ফাঁদ পাতা হবে। আপনাকে অবশ্যই ছদ্মবেশ ধরতে হবে। তবে সেটা পাকা জহুরির ছদ্মবেশ। অর্থাৎ আপনি ধাতু রত্ন খাঁটি কি না যাচাই করতে দক্ষ মানুষ। এর জন্য কষ্টিপাথর বাইনোকুলার আর যা সব লাগে সবই এখানে পেয়ে যাবেন।
—–
–বরং তা-ই করবেন। অরিজিৎ আজ অফিস ছেড়ে কোথাও যাবে না। কাজেই আপনি রিং করে এলে ভালো হয়। উইশ ইউ গুড লাক, ছাড়ছি।
রিসিভার রেখে কর্নেল উঠে দাঁড়ালেন। বললেন–তা হলে আমি আজ রাতের ফাঁদে আনাচেকানাচে থাকব, তা আশা করি বুঝতে পেরেছ। দিল্লি রোডের ধারে একটা ধাবা আছে, সেখানে উৎকৃষ্ট প্রকাণ্ড সাইজের পরোটা তৈরি হয়। ভিতরে আলুর একটা সুস্বাদু স্তর থাকে। আলু-পরোটা বলতে পারো। কাজেই আমরা এখনি বেরিয়ে পড়ছি।
অরিজিৎ লাহিড়ি উঠে দাঁড়িয়ে হাত বাড়িয়ে প্রথমে কর্নেলের সঙ্গে এবং পরে আমার সঙ্গে হ্যান্ডশেক করে বললেন–জয়ন্তবাবু আশা করি আপনার দৈনিক সত্যসেবক পত্রিকা একটা রোমাঞ্চকর স্টোরি পেয়ে যাবে। উইশ ইউ গুড লাক।
লালবাজার থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর বললুম–কর্নেল, আপনি একটা কথা কিন্তু জানানি।
কর্নেল বললেন, কোন্ কথা?
বললুম–সুজাতা দেবী কাগজগুলো আপনাকে বেছে দেবার আগেই তিনি প্রোডিউসার শমীক লাহিড়ির লেখা ছোট্ট চিঠিটা পড়ে নিয়েছেন তা আমাকে জানাননি।
কর্নেল সহাস্যে বললেন–বেশি জানলে মাথা গুলিয়ে যায়। তা ছাড়া তোমাকে চমক দেওয়ার দুষ্টুমি সম্পর্কে তুমি নিশ্চয়ই অবহিত, তাই না?
কর্নেলের কথায় হেসে ফেললুম। বললুম–তবে যা-ই বলুন, আপনাদের ফাঁদে পাখি পড়বে কি না আমার এখনও সন্দেহ আছে। আফটার অল শমীক লাহিড়ি একজন ধুরন্ধর লোক। বাইরে থেকে তাকে আমুদে প্রকৃতির মানুষ মনে হয়। বাই। দ্য বাই ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ডের উত্তর-পশ্চিম কোণে গাছের নীচে দাঁড়িয়ে শমীক লাহিড়ি শনিবার রাতে কার জন্য প্রতীক্ষা করছিলেন তা কি জানতে পেরেছেন?
কর্নেল বললেন–যথাসময়ে সবই জানা যাবে। এখন আর কোনও কথা নয়। আমার ভাবনা হচ্ছে হাওড়ার জ্যাম পেরোতে আমার লাঞ্চের সময় হয়ে যাবে। তা হোক, স্বয়ং বিবেকানন্দ বলেছেন, খালি পেটে ধর্ম হয় না। ডার্লিং, আমরা তো আজ একটা ধর্ম পালন করতেই যাচ্ছি, কী বলে?
কথাটা বলেই কর্নেল তাঁর বিখ্যাত অট্টহাসি হাসলেন।
এবার যা ঘটেছিল তা সবিস্তারে বর্ণনার কারণ দেখছি না। আমরা একটা পাঞ্জাবি ধাবায় প্রকাণ্ড আলু পরোটা সুস্বাদু তরকারিসহ খাওয়ার পর রওনা হয়েছিলুম।
শমীকবাবুর বাগানবাড়ির কিছুটা আগে বাঁ-দিকে একটা মোরাম বিছানো পথ দুরে এগিয়ে গেছে। সেই রাস্তায় মিনিট দশেক যাওয়ার পর ডান দিকে একটা আমবাগান ছিল। কর্নেলের নির্দেশে আম বাগানের ভিতরে গাড়িটা প্রায় লুকিয়ে রাখার মতো ঝোঁপঝাড়ের আড়ালে লক করে রেখে কনেলের সঙ্গী হয়েছিল। তখন প্রায় আড়াইটে বাজে। আমবাগানের পর কুলকাশের জঙ্গল কোথাও একটা করে নিঃসঙ্গ গাছ। তারপর চোখে পড়েছিল বিস্তীর্ণ একটা জলাশয়। আমাকে গাছতলায় দাঁড় করিয়ে রেখে কর্নেল বাইনোকুলারে জলাশয় দেখার পর বলেছিলেন–এখান থেকে শমীকবাবুর বাগানবাড়ি স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। পাঁচিলের আড়ালে বাড়ির কর্মচারীরা সম্ভবত ভাতঘুম দিচ্ছে অথবা তাস খেলছে।
বলেই তিনি একটা ঝোঁপের ওপর প্রকাণ্ড প্রজাপতি দেখে কিটব্যাগ থেকে জালের হাতলটা টেনে বের করে পা টিপে টিপে এগিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু প্রজাপতিটা মানুষের চেয়ে ধূর্ত। প্রজাপতিটা পুরুষ। ওটার গোত্র নাম ক্যালিশিয়া স্যাপিরা, এগুলোকে বাংলায় প্যাঁচা প্রজাতি বলা যায়। কারণ ওটার দুই ডানায় দুটো গোলাকার চোখের মতো চিহ্ন আছে। জয়ন্ত, এই প্রজাতির প্রজাপতির আসল ডেরা দক্ষিণ আমেরিকার ব্রাজিলে। কিন্তু আশ্চর্য ব্যাপার এরা একটানা প্রায় কুড়ি মাইল উড়তে পারে। তারপর জাহাজের মাস্তুলে নিরাপদ জায়গা বেছে নিয়ে দেশ দেশান্তরে পাড়ি জমায়। সঙ্গে কিন্তু তার সঙ্গিনীও থাকে। আমার হিসেবে এখানে পৌঁছোতে এদের তিন প্রজন্ম কেটে গেছে। জয়ন্ত, মানুষের রহস্যের চেয়ে প্রকৃতির রহস্য বিস্ময়কর এবং কম জটিল নয়।
বুঝতে পেরেছিলুম কর্নেল আমাকে ছাত্র ধরে নিয়ে এবার লম্বা চওড়া বক্তৃতা শুরু করেছেন। এইসব সময় মনেও হয় না এই বৃদ্ধ অবসরপ্রাপ্ত সামরিক অফিসার খুনখারাপি চুরি-ডাকাতির রহস্যের গন্ধ পেলেই সেদিকে ছুটে যান। অন্তত আজ সন্ধ্যা অব্দি তিনি প্রকৃতি বিজ্ঞানীর ভূমিকা চালিয়ে যাবেন।
সূর্যাস্তের পর আমরা গাড়ির কাছে ফিরে এসেছিলুম। অবাক হয়ে লক্ষ করেছিলুম তার কিটব্যাগের ভিতরে কফির ফ্লাক্স আছে। আমি জানি তার এই ফ্লাক্সটা আঠারো ঘন্টারও বেশি সময় পানীয়ের উষ্ণতা ধরে রাখতে পারে। অতএব আমরা মোটামুটি উষ্ণ কফি খেয়ে চাঙ্গা হয়েছিলুম। তারপর কর্নেল চুরুট ধরিয়ে বলেছিলেন–আমার প্ল্যানমতো রঞ্জনা তার গাড়িতে খদ্দের এবং জহুরিকে। নিয়ে সাতটা থেকে সাড়ে সাতটার মধ্যেই বাগানবাড়িতে পৌঁছোবে। এখানে মশার উপদ্রব আছে। চলো আমরা এখান থেকে বেরিয়ে দিল্লি রোডে যাই। বাগানবাড়ি। পেরোনোর সময় গাড়ির জানলার কাঁচ তুলে দেব। সাবধান জয়ন্ত, এখন দিল্লি রোডে রাতের ট্রাক চলাচল শুরু হওয়ার কথা। আমরা বাগানবাড়ি পেরিয়ে একটা বটগাছের তলায় অপেক্ষা করব। ওখানে একটা মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ আছে। পুলিশের গাড়ি এসে গেলে তারা এদিকে-ওদিকে একটু দূরে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকবে। এই অভিযান স্বয়ং ডি. সি. ডি. ডি. ওয়ান অরিজিৎ লাহিড়ি লিডার। সে আমাদের দিকে টর্চ জ্বেলে তিনবার আলোর সংকেত দেবে। এসো এই লাইম কংক্রিটের স্তূপটার ওপর বসা যাক।
ততক্ষণে আঁধার ঘনিয়ে এসেছে। আমাদের পাশ দিয়ে উজ্জ্বল আলো ফেলে ট্রাক এবং অন্যান্য যানবাহন চলে যাচ্ছিল। কিন্তু আমরা ছিলাম আলোর আড়ালে।
আবার সেই বিরক্তির সময়। যখন প্রতিটি সেকেন্ডকে সুদীর্ঘ মনে হয়। কতক্ষণে পরে কর্নেল আমার কাঁধে হাত রেখে বলেছিলেন, পুলিশ এসে গেছে। তার মানে নিশ্চয় রঞ্জনার গাড়ি ফলো করেই তারা এসেছে। চলো জয়ন্ত, আমরা গাড়িতে চেপে বাগানবাড়ির গেটে যাই। আমার হাতে ধরা থাকবে প্রজাপতি ধরার নেট এবং আমার প্রথম ভূমিকা হবে প্রকৃতি বিজ্ঞানীর। উঠে পড়ো, কুইক।
গাড়ি স্টার্ট দিয়ে যখন যানবাহনকে পাশ কাটিয়ে এগিয়ে চলেছি, তখন যুগপৎ উত্তেজনা এবং আশঙ্কায় আমার মন বিভ্রান্ত। সত্যি কি রাজকুমার রায়ের সংগৃহীত অতি মূল্যবান প্রাচীন দেবীমূর্তি দেখতে পাব!
কর্নেল গলার ভিতরে বললেন–আমার একটাই দুঃখ জয়ন্ত, শমীক লাহিড়ির এই বাগানবাড়িতে কিংবা বড় হোটেলে তার প্রথম ছবির দেওয়া পার্টিতে উপস্থিত থেকেছি। কিন্তু আমার দুর্ভাগ্য এযাবৎকাল আমার অনেক স্নেহভাজন বন্ধু শত্রু হয়ে গেছে। কিন্তু আসল কথা হল সামরিক জীবন থেকে আমি সবরকম চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি দাঁড়াতে চেয়েছি। কী আর করা যাবে।
আমাদের গাড়ি যখন বাগানবাড়ির গেটে পৌঁছেছিল তখন দেখেছিলুম গেটের সামনে কয়েকজন আমর্ড কনস্টেবল দাঁড়িয়ে আছে। কয়েকজন অফিসার আমাকে চিনতে পেরে নমস্কার করে বলেছিল, আসুন কর্নেলসাহেব, আপনি নিশ্চয়ই জয়ন্তবাবু। আমাদের লাহিড়ি সাহেব এখন দু-নম্বর লাহিড়িসাহেবের মুখোমুখি বসে আছেন।
কর্নেল মুচকি হেসে বলেছিলেন–মুখোমুখি দুই বরেন্দ্র ব্রাহ্মণ, শুনেছি বরেন্দ্র ব্রাহ্মণদের মধ্যে পারস্পরিক সৌহার্দ থাকে। অতএব, আপনাদের বস মি. লাহিড়িকে ট্যাকল করার দায়িত্ব আমাকেই নিতে হবে।
আমরা ভিতরে গিয়ে দেখলুম চারদিকে উজ্জ্বল আলো আর বাড়িটা পুলিশের পুলিশে ছয়লাপ। নরেশ ধর দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন। তিনি হাতের ইশারায় ভিতরটা দেখিয়ে বললেন, পাখি ফাঁদে পড়েছে।
কর্নেল জিজ্ঞেস করেছিলেন, আমাদের প্রিয় হালদারমশাইয়ের রোলটা কেমন দেখলেন।
নরেশবাবু চোখে হাসির ঝিলিক তুলে বলেছিলেন, এক কথায় অসাধারণ।
আমরা দুজনে ভিতরে প্রশস্ত ড্রয়িং রুমে দেখেছিলুম, ঘর ভর্তি ছড়িয়ে-ছিটিয়ে স্থানীয় থানার খাকি পোশাকের পুলিশ আর কলকাতার সাদা উর্দি পরা পুলিশের সঙ্গে সাদা পোশাকের সম্ভবত এনফোর্সমেন্ট এবং স্পেশাল ব্রাঞ্চের অফিসাররাও আছেন। কারণ এই অভিযান ভারতের সুপ্রাচীন কোনও দেবীমূর্তিকে উদ্ধারের অভিযান।
সেই মূর্তিটি অরিজিৎ লাহিড়ির হাতে শোভা পাচ্ছিল। সারা শরীরে কত রং-বেরংয়ের রত্নখচিত এক দেবীর সোনার মুকুট পরা মূর্তি। মূর্তিটি ছোট হলেও তার উজ্জ্বলতা চোখ ধাঁধিয়ে দিচ্ছিল। মিস্টার লাহিড়িসাহেব। দ্বিতীয় লাহিড়িসাহেবের মুখ নিচু এবং চোখ লাল। উল্টো দিকের আসনে বসে ছিল রঞ্জনা। তার দু-চোখে এখন ক্রোধের আগুন। ঘরে ঢুকতেই কানে ভেসেছিল তার ক্রুদ্ধ কণ্ঠস্বর–নির্বোধ রাজকুমার তোমাকে বিশ্বাস করে নিজের প্রাণ দিয়েছে। সে কী করে ভাববে তুমি তাকে প্রাণে মেরে এই মূর্তি হাতাবে।
কর্নেলকে দেখামাত্র অরিজিৎ লাহিড়ি সহাস্যে বলেছিলেন–হাই বস! আমাদের অন্তত একটা ধন্যবাদ দিন।
কর্নেল তার পাশে খালি আসনে বসে প্রথমেই প্রাইভেট ডিটেকটিভ হালদারমশাইকে বলেছিলেন–আপনাদের রোল আপনি সম্ভবত ঠিকঠাক পালন করেছেন।
হালদারমশাই একটু সংকোচের সঙ্গে বলেছিলেন–হ, যা করবার তা ঠিকঠাক করছি। আমাগো লাহিড়িসাহেবেরে জিগাইয়া জানতে পারেন।
অরিজিৎ লাহিড়ি বলেছিলেন–আমাদের হালদারমশাই-এর সত্যি কোনও তুলনা হয় না।
তার পাশে একজন প্রবীণ মানুষ স্যুট-টাই পরে হাতে একটি ব্রিফকেস নিয়ে বসে ছিলেন। তিনি কর্নেলকে নমস্কার করে বলেছিলেন-কর্নেলসাহেব কি আমাকে চিনতে পারছেন?
কর্নেল মুচকি হেসে বলেছিলেন–হ্যাঁ, মিস্টার চ্যাটার্জি।
এনফোর্সমেন্ট ডিপার্টমেন্টের সুখ্যাত ব্রতীন চ্যাটার্জিকে এই নিয়ে দু-বার দেখলুম।
.
সে রাতে কলকাতা ফিরতে প্রায় বারোটা বেজে গিয়েছিল। কর্নেল ও আমি আগে এবং পিছনে সাদা মারুতিতে রঞ্জনা ও হালদারমশাই। আমরা রঞ্জনাকে তার ফ্ল্যাটে পৌঁছে দিতে গেলুম। অত রাতে কর্নেলের ইচ্ছায় ক্লান্ত রঞ্জনাকে কফি করতে হল। কফি খেতে খেতে রঞ্জনা ঘটনাটা শোনাল।
সে মিস্টার ব্রতীন চ্যাটার্জি এবং হালদারমশাইকে সঙ্গে নিয়ে শমীকবাবু কথামতো রাত সাড়ে আটটায় বাগানবাড়িতে পৌঁছয়। তার আগেই শমীকবাবু এসে অপেক্ষা করছিলেন। চা খাওয়ার পর শমীকবাবু খদ্দেরের সঙ্গে প্রথমেই দর কষাকষি শুরু করেন। খদ্দের ব্রিফকেস একটুখানি খুলে তাকে নোটের বান্ডিল দেখিয়ে দেন। তারপর শমীকবাবু ওপরে গিয়ে লুকোনো জিনিসটি বের করে নিয়ে আসেন। রঞ্জনা ওই ছোট্ট বাক্সটি দেখেছিল। সে বলে-বাছুদা এটা খুলতে পারবে? রঞ্জনা অবাক হয়ে দেখে বাক্সটার একপাশে চাপ দিতেই সেটা খুলে যায়। তারপর আবার দরাদরি শুরু হয়। জহুরি রূপী হালদারমশাই দিব্যি পাকা জহুরির মতো কষ্টিপাথরসহ কয়েক রকমের পাথর আর আতশকাঁচ বের করে রত্নগুলো খুঁটিয়ে দেখার ভান করেন। তারপর তার সায় পেয়ে খদ্দের ভদ্রলোক আর এক দফা দরাদরি শুরু করেন। আসলে প্ল্যানমতে এটা ছিল সময় কাটানো কৌশল-যতক্ষণ না পুলিশের সাড়া পাওয়া যায়। ঠিক আধঘন্টা পরেই বদ্ধ ঘরের দরজায় কড়া নেড়ে নরহরি তার কত্তামশাইকে ডাকে। পুলিশই নরহরিকে এভাবে ডাকতে বলেছিল। দেবীমুর্তিটি কাঠের বাক্সে ভরে হাতে করে নিয়েই শমীকবাবু দরজা খোলেন। অমনি কলকাতা পুলিশের ডি. সি. ডি. ডি. ওয়ান মিস্টার লাহিড়ি শমীকবাবুর হাত থেকে ছোট্ট বাক্সটি কেড়ে নেন। একজন অফিসার শমীকবাবুর গলায় নল ঠেকিয়ে বসতে বলেন। তারপর শুরু হয়ে যায় চারদিক থেকে পুলিশের জেরা। জেরায় জেরবার শমীকবাবু ভেঙে পড়ে বলেন–আমার বন্ধু রাজকুমার রায় এটা বেচে ফেলতে চেয়েছিল। এখন সে বেঁচে নেই। তাই আমি এটা বেচে ফেলতে চেয়েছিলুম। অরিজিৎ লাহিড়ি তাকে জিজ্ঞেস করেন–গড়ের মাঠের গাছতলায় দাঁড়িয়ে আপনি কার জন্য অপেক্ষা করছিলেন? অনেকবার প্রশ্নের পর শমীকবাবু বলেন–লাখখাঁটিয়া কোম্পানির অকশন হাউসের ম্যানেজার জিনিসটা কিনতে চেয়েছিলেন। এই কাজের উপযুক্ত জায়গা ওই ভদ্রলোকই ঠিক করে দিয়েছিলেন। অধীর প্রতীক্ষার পর ম্যানেজার এবং তার সহকারী কালুবরণবাবুর গাড়ি এসে কাছেই থামে। ওঁরা দুজনে গাড়ির ডিকি থেকে কাপড়ে জড়ানো কী একটা জিনিস তুলে নিয়ে গিয়ে ফেলে দেন। তারপর ল্যাম্পপোস্টের আবছা আলোতে শমীকবাবু দেখতে পান ওটা একটা ডেড বডি। সেটা ফেলে দিয়ে দুজনে শমীকবাবুর দিকে এগিয়ে আসতেই তিনি ভয় পেয়ে এক লাফে নিজের গাড়িতে ওঠেন। তারপর পালিয়ে যান।
কর্নেল কফি পানের পর চুরুট ধরিয়ে বললেন–ওদের একজন ধরা পড়েছে। দ্বিতীয়জন শিগগির ধরা পড়বে। আমার ধারণা রঞ্জনা তার কালুদাকে চিনতে পারেনি। রঞ্জনা শুধু দেখেছিল দুজন লোক প্রায় জোর করে রাজকুমারকে নিয়ে গিয়ে গাড়িতে চাপাল। হ্যাঁ, রাজকুমারের মাথায় গুলি করেছিল কালুবরণ। কারণ, তার কাছ থেকে পুলিশ যে রিভলভার উদ্ধার করেছে সেটা পয়েন্ট ৩৮ ক্যালিবারের এবং মর্গের রিপোর্টে, তা ছাড়া ব্যালাস্টিক মিসাইল এক্সপার্টদের রিপোর্টে বলা হয়েছে রাজকুমারের মাথার ভিতর যে বুলেট খোলটা আটকে ছিল সেটা পয়েন্ট ৩৮ ক্যালিবারের রিভলভার থেকে ছোঁড়া।
প্রাইভেট ডিটেকটিভ হালদারমশাই ঘন ঘন নস্যি নিচ্ছিলেন। আর একটিপ নস্যি নিয়ে তিনি জিজ্ঞেস করলেন-আচ্ছা কর্নেলসাহেব, ওই দেবীমূর্তিটা তো চিনতে পারলাম না।
কর্নেল বললেন–ওটা সত্যিই দুর্লভ প্রত্নসামগ্রী। ওটা গ্রিক দেবী আথেনার মূর্তি। আমার অনুমান রুদ্রগড়ের রাজবংশের কোনও পূর্বপুরুষ ওটা গ্রিস থেকে সংগ্রহ করে এনেছিলেন। তার বংশধর অভাবের তাড়নায় মূর্তিটা রাজকুমারবাবুকে বিক্রি করেছিলেন। রাজকুমারবাবুর পেশাই ছিল রাজা জমিদার বংশীয়দের বাড়ি গিয়ে দুর্লভ অ্যান্টিক সংগ্রহ। যাই হোক, রঞ্জনা তুমি এবার শুয়ে পড়ো। আমার বিদায় হই।
রঞ্জনা একটু হেসে বলল–দুবৃত্ত হলেও বাছুদাটা বেশ অতিথিবৎসল লোক। আমাদের তিনজনকে সে যা খাইয়েছে তাতে আর আজ রাত্রে কিছু খাবার দরকার। হবে না।
কর্নেল উঠে দাঁড়িয়ে বললেন–চলি রঞ্জনা। তোমার নিরাপত্তার ব্যবস্থা পুলিশ বহাল রাখবে। অন্তত যতদিন না কোর্টে শমীক লাহিড়ি, কালুবরণ আর অকশন হাউসের ম্যানেজার রণবীর রানার বিরুদ্ধে মামলার ফয়সালা হয়। গুড নাইট।