দেবলীনার আশ্চর্য ক্ষমতা

দেবলীনার আশ্চর্য ক্ষমতা

‘দেবলীনা মুখার্জি৷’

‘প্রেজেন্ট স্যার৷’

নামের পাশে ‘p’ বসাতে বসাতে একবার চোখ তুলে তাকালেন বিনোদবিহারী৷ চশমার উপর দিয়ে জরিপ করে নিলেন বছর দশেকের মেয়েটাকে৷ চেহারায় তেমন কোনও অসুস্থতার ছাপ নেই৷ চশমাটা আঙুল দিয়ে নাকের আর একটু উপরে ঠেলে দিয়ে বললেন, ‘ছ’দিন অ্যাবসেন্ট… সার্টিফিকেট এনেছ?’

‘হ্যাঁ স্যার৷’ ঘাড় নীচু করে জবাব দেয় মেয়েটি৷

‘কী হয়েছিল?’

‘জ্বর৷’

বিনোদবিহারী স্কুলমাস্টারি করছেন তা-ও বছর ছত্রিশ হতে চলল৷ কোন ছাত্র সত্যি বলছে আর কে মিথ্যে তা গলার স্বর শুনেই বলে দিতে পারেন৷ আর কিছু না বলে রোলকলটা সেরে নিলেন তিনি৷ বোর্ডে একটা সুদ-কষা করতে দিয়ে বেঞ্চের দিকে এগিয়ে এলেন৷ মেয়েটা এখনও ঠায় সেইভাবে বসে আছে৷ বেঞ্চটার পাশে এসে কয়েক সেকেন্ড স্থির হয়ে থাকেন বিনোদবিহারী৷ তিনি জানেন, এই অবস্থায় যে কোনও ছাত্রছাত্রীরই বুক ঢিপঢিপ করে, কান লাল হয়ে ওঠে৷ স্কুলমাস্টার হওয়ার এই আশ্চর্য সুবিধাটুকু অ্যাডভেঞ্চারের মতো উপভোগ করেন তিনি৷

‘উঠে দাঁড়াও৷’ কঠিন গলার স্বর শোনা যায়৷

বিনা বাক্যব্যয়ে উঠে দাঁড়ায় দেবলীনা৷ তার চোখ এখনও নীচের দিকে৷

‘হোমওয়ার্ক করেছ?’

একটুক্ষণ পরে উত্তর আসে, ‘না স্যার৷’

‘কেন? সে তো আজ প্রায় এক হপ্তা আগে দিয়েছি৷’

আর কোনও কথা বলে না মেয়েটা৷ এতক্ষণে বিনোদবিহারীর কান গরম হতে থাকে৷ পড়াশোনায় গাফিলতি তিনি একদম সহ্য করতে পারেন না৷ যে মেয়ে পাঁচ দিন একটানা জ্বরে ভুগেছে, তার চোখ-মুখ এত উজ্জ্বল হয় কী করে? গলার স্বরেও এতটুকু অসুস্থতার চিহ্ন নেই৷ আজকালকার ডাক্তারগুলো কিছু না দেখেই সার্টিফিকেট লিখে দেয়৷ তাদের উপর রাগেই বোধহয় বিনোদবিহারীর হাতটা দেবলীনার কান লক্ষ্য করে উঠে আসে৷ সঙ্গে সঙ্গে একটা অদ্ভুত ব্যাপার ঘটে যায়৷ কোথা থেকে যেন বিড়বিড় করে কতকগুলো চাপা শব্দ ভেসে আসে৷ ষাট ছুঁইছুঁই বিনোদবিহারীর আচমকাই মনে পড়ে যায় ওঁর নিজের ছেলেবেলার কথা৷ অঙ্কে ফেল করে বাড়ি না ফিরে আম গাছের মাথায় টানা দেড় দিন লুকিয়ে থাকার কথা৷ রাগ কমে গিয়ে হাসি পায় ওঁর৷ মেয়েটার মাথায় আদরের হাত রেখে ফিরে আসতে আসতে নিজেই অবাক হয়ে যান তিনি৷ হঠাৎ ও কথাগুলোই বা কেন মনে পড়ল? বিড়বিড় করে শব্দগুলো হতেই… যা-ই হোক, ভাবনাটা মাথা থেকে সরিয়ে রেখে আঙুল দিয়ে আবার নেমে-আসা চশমাটাকে নাকের উপরে তুলে দিলেন অঙ্কের মাস্টার বিনোদবিহারী৷

টিফিনের সময় স্কুল থেকে বেরিয়েই দেবলীনাকে চোখে পড়ল মিনুর৷ স্কুলের বাইরেই যে লোকটা চাটাই পেতে বসে কাঁচা আমড়া আর ঘটি গরম বিক্রি করে, তার কাছে দাঁড়িয়ে কী যেন কিনছে৷ মিনু দ্রুতপায়ে সেদিকে এগিয়ে গেল৷ ওকে দেখতে পেয়ে অল্প হাসল দেবলীনা৷ তারপর কাগজের ঠোঙা ওর দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘আমড়া খাবি?’

‘কাসুন্দি-মাখানো?’ মিনু জিজ্ঞেস করে৷

‘নাঃ৷ সরষে খেতে মানা করেছে ডাক্তার৷’

‘তাহলে খাবি না?’

গুনে গুনে একটা এক টাকা আর দুটো দু-টাকার কয়েন লোকটার হাতে ধরিয়ে দিয়ে সামনে হাঁটতে থাকে দেবলীনা৷ মিনু তার পিছু নেয়৷

‘তোর তাহলে সত্যি জ্বর হয়েছিল?’

‘হ্যাঁ৷’ আমড়া চিবাতে চিবাতে দেবলীনা বলে৷

‘ধুর৷ নিশ্চয়ই বুনিপিসির বাড়ি ঘুরতে গিয়েছিলি৷’

কথাটা শুনে এক মুহূর্তে থমকে দাঁড়ায় দেবলীনা৷ ঠোঙাটা অন্য হাতে চালান করে ডান হাত দিয়ে চেপে ধরে মিনুর হাতটা৷ হাতের তালুটা তুলে এনে রাখে নিজের কপালে৷ সঙ্গে সঙ্গে মিনুর মনে হয় যেন না বুঝে গরম ভাতের হাঁড়িতে হাত দিয়েছে৷ এক্ষুনি ফোসকা পড়ে যাবে৷ চকিতে ছাড়িয়ে নেয় হাতটা৷

‘এ কী! এখনও এত জ্বর তোর!’

দেবলীনা আর কিছু উত্তর দেয় না৷ আগের মতোই হনহন করে হাঁটতে থাকে৷ মিনুর হাতটা এখনও তেতে আছে৷ যতই জ্বর আসুক না কেন, এত গরম হয় মানুষের কপাল? সে আবার দৌড়ে দেবলীনার পাশে চলে আসে৷

‘ডাক্তার কী বলেছে তোকে?’

‘তোর অত খবরে কী কাজ?’

‘শীত করছে না তোর?’

‘না৷’

‘মাথা ঘুরছে না?’

‘না৷’

‘শুধু গা গরম? আর কিছু হচ্ছে না?’

‘না৷’

মিনু এমন কিম্ভূত জ্বরের কথা আগে শোনেনি৷ কী তাড়াতাড়ি হাঁটছে দেবলীনা৷ মাটিতে যেন পা পড়ছে না ওর৷ খানিকটা দৌড়েই তাকে ধরতে হচ্ছে৷ এতক্ষণে মাঠের মাঝখানে এসে পড়েছে দু-জনে৷ একটু দূরে স্কুলেরই কতকগুলো ছেলে ইটের উইকেট সাজিয়ে ক্রিকেট খেলছে৷ এতক্ষণ দৌড়োতে দৌড়োতে হাঁফিয়ে গিয়েছিল মিনু, সে পিছন থেকে দেবলীনার জামা টেনে ধরে বলল, ‘দাঁড়া-না ছাতা৷ একটা কথা আছে৷’

‘কী কথা?’ আঁটি চুষতে শুরু করেছে দেবলীনা৷

‘স্যার যখন তোর কান মলতে যাচ্ছিল, তখন মুখে বিড়বিড় করে কী বলছিলি তুই?’

কথাটা কানে যেতেই পাথরের মূর্তির মতো স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল ও৷ মনে হল, আচমকা কীসের ভয়ে ওর উড়ন্ত পা দুটো আর চলতে চাইছে না৷

‘এই কথাটা আর কাকে বলেছিস তুই?’ থমথমে গলায় জিজ্ঞেস করে সে৷

‘কাকে আবার বলব?’ এতক্ষণে কিছু একটা রহস্যের গন্ধ পায় মিনু৷ আরও কিছুটা এগিয়ে আসে৷ দু-জনের মুখেই দুপুরের রোদ এসে পড়েছে৷ সারা মাঠ জুড়ে ছড়িয়ে-থাকা ধুলো তাদের ঘামে ভেজা মুখের উপর পুরোনো চাদরের মতো বিছিয়ে রয়েছে৷

‘বলব সব,’ আগের মতোই থমথমে গলায় বলে দেবলীনা, ‘কিন্তু তার আগে বল, এসব কথা কাউকে বলবি না৷’

মিনু ভুরু দুটো একটু কুঁচকে বলল, ‘তা কী করে হয়? প্লুটোকে তো বলতেই হবে…’

‘প্লুটো কে?’

‘আমার বিড়াল৷ ও কাউকে বলে না৷’

সাবধানি চোখে আশপাশে তাকায় দেবলীনা৷ ওদের ঠিক সামনেই দাঁড়িয়ে ব্যাট করছে একটা বড়ো ক্লাসের ছেলে৷ তার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ৷ মিনু তার হাত ধরে নাড়া দেয়, ‘কী হল, বল কী বলছিলি?’

সে কিন্তু একচুলও নড়ে না৷ তার খোলা চোখের পাতার মাঝে মণি দুটো উজ্জ্বল হয়ে জ্বলছে৷ গা-টা আরও গরম হয়ে উঠেছে৷ মিনুর মনে হল, কোথা থেকে যেন হাওয়ার ঝাপটা এসে ওর মুখে লাগছে৷ অদ্ভুত একটা ভয় জড়িয়ে ধরছে৷ তার মাঝেই আবার নীচু গলার সেই শব্দগুলো শোনা গেল, হ্যাঁ! আবার কিছু যেন বলছে দেবলীনা৷ তার বেশির ভাগই বোঝা যায় না৷ একটা অস্পষ্ট শব্দ বারবার কানে আসতে লাগল… স্তাসি… স্তাসি… কী আশ্চর্য! জ্বরের ঘোরে মেয়েটার কি মাথা খারাপ হয়ে গেল? হাতটা ধরে আর-একবার ঝাঁকুনি দিতে গিয়েও থেমে গেল মিনু৷ এর মাঝে অদ্ভুত একটা ঘটনা ঘটে গিয়েছে৷ বল করার জন্য বেশ কিছু দূর থেকে দৌড়ে আসছিল একটা ছেলে৷ অথচ বলটা ছোড়ার ঠিক আগের মুহূর্তে দাঁড়িয়ে পড়েছে সে৷ তার বলসুদ্ধ হাতটা মাথার উপর তোলা৷ একটা পা মাটি থেকে বেশ খানিকটা উঁচুতে৷ যেন অদৃশ্য রিমোট কনট্রোল টিপে কেউ পাথরের মূর্তিতে পরিণত করেছে ওকে৷ বাকি ছেলেগুলো কিছুক্ষণ অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকল সেদিকে৷ ছেলেটা যে মজা করছে না তাতে সন্দেহ নেই৷ কারণ কোনও জীবিত মানুষের পক্ষে ওইভাবে দাঁড়িয়ে থাকা সম্ভব নয়৷ একটু পরেই আবার স্বাভাবিক হয়ে মাটিতে আছড়ে পড়ল সে৷ সঙ্গীসাথিরা সবাই একসঙ্গে দৌড়ে গেল ওর দিকে৷

দেবলীনা দ্রুত কয়েকবার চোখের পাতা ফেলে মিনুর দিকে মুখ ঘুরিয়ে বলল, ‘চল, ছায়ায় গিয়ে বসি৷’

মিনু কিছু বলল না৷ উত্তেজনায় এখনও ওর পা কাঁপছে৷ ম্যাজিশিয়ানরা মাঝে-মধ্যে হিপনোটাইজ করে মানুষকে দিয়ে ইচ্ছামতো কাজ করিয়ে নিতে পারে৷ কিন্তু দেবলীনা সেটা শিখল কেমন করে? মিনিটখানেক গাছের ছায়ায় বসে বুকের ধুকপুকুনিটা একটু কমে এল মিনুর৷ সে জিজ্ঞেস করল, ‘তুই সত্যি ম্যাজিক শিখেছিস?’

‘না তো,’ চোখ বুজে উত্তর দেয় দেবলীনা৷

‘তাহলে?’

‘কী জানি রে৷ মঙ্গলবার রাতে ছ-মন্দিরের মাঠে একটা উল্কা পড়েছিল না? তো আমি উল্কা দেখব বলে বাবার সঙ্গে মাঠে গিয়েছিলাম৷ ফিরতে ফিরতে খুব জ্বর এল৷ ভীষণ গা গরম৷ উল্কাটা ভালো করে দেখাও হল না৷ ফিরে এলাম৷’

‘তারপর?’

‘তারপর সারারাত বিছানা থেকে উঠতে পারলাম না৷ জ্বরের ঘোরে ভুল বকছিলাম৷ ডাক্তার বলল, ঠান্ডা লেগে জ্বর এসেছে৷ ওষুধ দিল৷ দু-দিন পরে জ্বরটা সেরেও গেল৷ কিন্তু গা-গরমটা কমল না৷’

‘তারপর?’

‘রোজ সকালে একটা ওষুধ খেতে হত৷ এত বড়ো ওষুধ যে গিলতেই পারি না৷ সেদিন সকালেও মা জল আর ওষুধ নিয়ে এল৷ দেখেই ভয় লাগল আমার৷ হাত দিয়ে মুখ চেপে বললাম, অত বড়ো ওষুধ আমি খাব না৷ জানতাম কাজ হবে না৷ কিন্তু কী আশ্চর্য জানিস? মা হাসিমুখে ওষুধ নিয়ে চলে গেল৷ প্রথমে ভেবেছিলাম রাগ করে, পরে দেখলাম, মা যেন ভুলেই গিয়েছে কথাটা৷ তারপর থেকেই এরকম হচ্ছে৷’

‘কীরকম?’

‘ওই যে দেখলি৷ আমি যা বলি, সবাই তা-ই শোনে৷ কী করে হয় তা জানি না৷’

মিনু কিছুক্ষণ একটানা চুপ করে বসে থাকল৷ অনেক ভেবেও কিছু কিনারা করতে পারল না৷ শেষে গাছের গুঁড়িতে হেলান দিয়ে বসে উদাস মুখে বলল, ‘তার মানে তোর কথা শুনে সবাই চলবে৷ দুপুরবেলা ন্যাড়া ছাদে উঠলে কেউ বকবে না…’

‘ঘণ্টা পড়বে এবার৷ উঠে আয়৷’

দেবলীনার পিছন পিছন মিনুও উঠে এল৷ ওর মাথাটা মাটির দিকে ঝুঁকে আছে৷ কাঁধ নুয়ে পড়েছে৷ পায়ের কাছে পড়ে-থাকা একটা ইটের টুকরোকে লাথি মেরে সরিয়ে দিল৷

‘তুই আবার কী ভাবছিস?’

মুখের উপর এসে-পড়া এলোমেলো চুলগুলো সরাতে সরাতে মিনু বলল, ‘আমড়া সব খেয়ে ফেলেছিস?’

অল্প হেসে হাতের চাপে চেপটে-যাওয়া কাগজের ঠোঙাটা এগিয়ে দিল দেবলীনা৷

(দুই)

সকালে অফিসে যাওয়ার জন্য রেডি হচ্ছিল মহেন্দ্র৷ দরজার কাছে নূপুরের আওয়াজ পেয়ে আঙুলের ফাঁকে আধখাওয়া সিগারেটটা তড়িঘড়ি জানলার বাইরে ফেলে দিল৷ তারপর চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে বলল, ‘আজ ছুটি নাকি?’

মিনু সোফার উপর ঝাঁপিয়ে উঠে গড়িয়ে পড়ল৷ গুনগুন করে দু-এক কলি গান গাইল৷ সুরটা নিজেরই ভালো লাগল না৷ টেবিলের উপর থেকে বিস্কুটের কৌটোটা তুলে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখল৷ সেটাও ভালো লাগল না৷ আবার গড়িয়ে পড়ে বলল, ‘আজ আমার মনটা ভালো নেই৷’

‘বাবা৷ পেট ভালো না থাকলে ছুটি হয় শুনেছি, কিন্তু মন ভালো নেই বলে স্কুল কামাই বাপের কালে শুনিনি৷ তা ভালো নেই কেন?’

‘প্লুটোর শরীর ভালো নেই৷ সকাল থেকে যা খাচ্ছে, বমি করে ফেলছে৷’

‘আরও মাথায় তোলো বেড়ালকে৷ একে তো চোর, তার উপর পিটপিটে বদমাশ৷’

মহেন্দ্র প্লুটোকে একেবারে পছন্দ করে না৷ ওর মতে বেড়াল শয়তানের বাহন৷ ডাইনিরাও একখানা করে কালো বিড়াল পুষত৷ সরু গলায় ম্যাও ম্যাও করে মন ভোলালেও এক-একটা হাড়-শয়তান৷ মিনু অবশ্য এসবে তেমন একটা গুরুত্ব দেয় না৷ সে একবার বিছানার উপর ডিগবাজি খাবার চেষ্টা করল৷ কিন্তু তার আগেই মনে পড়ে গেল কালকের কথাটা৷ মহেন্দ্র এতক্ষণে রেডি হয়ে খেতে বসেছে৷ সে জিজ্ঞেস করল, ‘আচ্ছা মহেন্দ্রকাকা, স্তাসি মানে কী বলোতো?’

‘মানে হাসিম থাসি? এই তো কোন একটা দেশের প্রেসিডেন্ট হল…’

‘আরে ধুর৷ ওসব নয়৷ ধরো, খেলার মাঠে কেউ কাউকে বলল স্তাসি… আর অমনি সে থেমে গেল৷’

ভাতের উপর ডাল ঢালবে বলে বাটিটা তুলেও নামিয়ে রাখল মহেন্দ্র৷ অবাক চোখে মিনুর মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘তোদের স্কুলে গ্রিক পড়ানো হচ্ছে কবে থেকে?’

‘জানলে বলো৷ না-হলে আমি চললাম৷’ মিনু বিছানা থেকে নেমে পড়ে দরজার দিকে এগিয়ে যায়৷ মহেন্দ্র তাকে থামিয়ে দিয়ে বলে, ‘ওরে দাঁড়া দাঁড়া, বলছি৷ তোর জ্বালায় তো বিষম খাব দেখছি৷’

‘তাহলে বলো৷ এক্ষুনি বলো৷’

মহেন্দ্র হেসে একটু সামলে নিয়ে বলে, ‘গ্রিক ভাষায় স্তাসি মানে হল থামো বা দাঁড়াও—ওই জাতীয়৷ কিন্তু কথাটা তুই শুনলি কোত্থেকে?’

মিনু স্থির হয়ে দু-মিনিট ভেবে নিল৷ স্তাসির রহস্য ভেদ করার একটাই উপায়, কিন্তু সেটা করতে গেলে মহেন্দ্রকাকা বুঝে যাবে, সে কিছু একটা দেখেছে৷ দেবলীনাকে দেওয়া কথার খেলাপ করা হবে তাহলে৷ ভেবেচিন্তে সে বলল, ‘একটা গল্পে পড়ছিলাম৷’

‘ওঃ! রূপকথার গল্প?’

‘হুম…’

‘তাহলে গ্রিক রূপকথা৷’

‘তা-ই হবে৷ সেখানে একটা বাচ্চা মেয়ে যা বলে, লোকে তা-ই, শোনে৷’

‘উঁহুঁ… বাচ্চা মেয়ে নয়৷ দেবী এফ্রোডাইট৷ আর ওই ক্ষমতাটার নাম হল চার্মস্পিক৷’

‘সেইটা কী?’

‘মানে ওই আর কী… শুধু কথার জাল বিছিয়ে মানুষকে দিয়ে কিছু করিয়ে নেওয়া…’

‘আর?’

মহেন্দ্র হাসে, ‘আমার তো আর বিড়াল নেই, মনও খারাপ হয় না৷ তাই অফিসে যেতে হয় আমাকে৷ তোকে একটা বই দিয়ে যাচ্ছি বরং, পড়ে দেখ৷’

মহেন্দ্র বুকশেলফ থেকে একখানা মলাটবিহীন জরাজীর্ণ বই বের করে মিনুর দিকে বাড়িয়ে দেয়৷ বলে, ‘আমার ছোটোবেলার বই৷ ছিঁড়িস না আবার৷’

মিনু বই খুলে পাতা ওলটাতে থাকে৷ শুকনো লেখালেখিতে আগ্রহ নেই৷ ছবি দেখতে থাকে৷ হঠাৎ একটা ছবিতে চোখ আটকে যায়৷ দেবলীনার জ্বরটা যেন কীভাবে হয়েছিল? বইটা আরও কাছে নিয়ে এসে লেখাগুলো পড়ার চেষ্টা করে৷

(তিন)

আজ ভূগোল স্যার পরিতোষ বাগচি আসেননি৷ ক্লাসভরতি ছেলেমেয়ের দল যেন ছোটোখাটো একটা মেলা বসিয়েছে৷ একধারে চলছে কাটাকুটির আসর৷ দেওয়ালে অনুপস্থিত পরিতোষ স্যারের মুখ আঁকছে একজন৷ এতসবের মধ্যে মাথা বেঞ্চের উপর রেখে শুয়ে আছে মিনু৷ তার মনটা আজ কালকের থেকেও খারাপ৷ দেবলীনার মতো আশ্চর্য চার্মস্পিকের ক্ষমতা যদি ওরও থাকত তাহলে কী ভালোই না হত৷ মায়ের বকুনি খেতে হত না, বাবাকে দিয়ে নতুন ক-টা গল্পের বই আনিয়ে নিত৷ একটু বুদ্ধি খাটালে হেডস্যারকে বলে স্কুলের সিলেবাস থেকে ভূগোল সাবজেক্টটাই তুলে দেওয়া যেত৷ হতচ্ছাড়ি প্লুটোটা বেড়াল হয়েও ওর কথা শোনে না৷ দু-হাত দিয়ে কান চেপে ধরল ও৷ সঙ্গে সঙ্গে পিঠে কীসের ছোঁয়া লাগতে ফিরে তাকাল৷

‘কী রে? কী হয়েছে তোর?’ দেবলীনার গলা৷ মিনু মাথা তুলে একবার দেখে আবার মুখ নামিয়ে নিল, ‘কিছু হয়নি৷ তুই যা এখন৷’

‘এদিকে আয়৷ একটা জিনিস দেখাব৷’

‘কী জিনিস?’

‘আয় না আগে৷’

হাত ধরে ওকে বেঞ্চের একধারে নিয়ে যায় দেবলীনা৷ তারপর দেওয়ালের উপর সদ্য-আঁকা ছবিটা দেখিয়ে বলে, ‘ওই দেখ৷ পরিতোষ স্যার৷ দিব্যি হয়েছে না?’

মিনু চাপাস্বরে খিকিখক করে হেসে ওঠে, ‘বাঃ৷ মাকড়সার মতো পা৷ ডাইনোসরের মতো নুলো হাত আর মুখে ওটা বিড়ি? দে তো দেখি পেনসিলটা৷’

‘কেন?’

‘দে-না বাবা একবার৷’

মিনুর ছবি আঁকার হাত ভালো নয়, সে এক মিনিট চুপ করে ভেবে ছবিটার পাশেই পেনসিলে লিখতে থাকে,

পরিতোষ বাগচি/ দিন দিন দেকচি

তোর মোটা ভুঁড়িখানা ফুলছে৷

কানে বোবা, মুখে কালা/ নেই বুক, নেই গলা

কোনওমতে মুন্ডুটা ঝুলছে৷৷

তারপর দু-পা পিছিয়ে এসে খিলখিল করে হেসে ওঠে দু-জনেই৷ বেশ কিছুক্ষণ হাসাহাসির পর দেবলীনা বলল, ‘চল, গিয়ে বসে পড়ি৷’

‘এটা মুছবি না?’

‘একটু পরে৷ এখন তো কেউ আসবে না৷’

বেঞ্চের দিকে সরে আসতে আসতে মিনু কী যেন ভেবে হঠাৎ জিজ্ঞেস করে, ‘আচ্ছা উল্কাটার কত কাছে গিয়েছিলি তুই?’

‘খুব কাছে নয়৷ তবে মাটিতে পড়ে অনেকটা গড়িয়ে গিয়েছিল৷ সেই দাগটার উপরে দাঁড়িয়েছিলাম৷’

‘হুম…’

‘কেন বল তো?’

মিনু সাবধানি চোখে একবার চারদিকে তাকিয়ে ব্যাগের ভিতরে হাত ঢুকিয়ে দেয়৷ বের করে আনে মহেন্দ্রর দেওয়া মলাটবিহীন রূপকথার বইটা৷ ছবির জায়গাটা সামনে মেলে ধরে বলে, ‘এতে সব লেখা আছে৷ দেখে নে৷’

‘আমি এত পড়তে পারি না৷ তুই বল৷’

মিনুর মুখের বাঁদিকের কোণে একটা চাপা হাসি খেলে যায়৷ মনে মনে কিছু হিসেব কষে নিয়ে সে বলতে থাকে, ‘গ্রিক দেবী এফ… ইয়াফ… কী যেন…’

বইটার উপর আর-একবার ঝুঁকে পড়ে কিছু দেখে নেয়, ‘হ্যাঁ… এফ্রোডাইট৷ ওর গলার আওয়াজ ছিল এত মিষ্টি যে ও যা বলত, লোকে তা-ই করত৷ অন্য কিছু করার কথা ভাবতও না৷ এই ছিল ওর ক্ষমতা৷ এরকম চলতে চলতে ওর ভক্ত এত বেড়ে গেল যে বড়ো দেবতা অ্যাপোলোর ওকে হিংসা হতে লাগল৷ হিংসায় জ্বলেপুড়ে সে আদেশ দিল যে এফ্রোডাইটকে পুড়িয়ে মারা হবে৷ দুঃখ, কষ্ট আর রাগের মধ্যেও এফ্রোডাইট ঠিক করল, সে প্রতিশোধ নেবে৷ নিজে মরে গেলেও ওর ছেলেমেয়েরা যুদ্ধ করে অ্যাপোলোকে হারিয়ে দেবে৷ পোড়ানোর দিন সে শেষবারের মতো অনুরোধ করে যে ওর শরীরের পোড়া ছাই যেন সারা দুনিয়ায় ছড়িয়ে দেওয়া হয়৷ বুদ্ধিটা অ্যাপোলো বুঝতে পারল না৷ সে তা-ই করল৷ সেই আধপোড়া ছাই আকাশ বেয়ে নেমে আসতে লাগল দিনের পর দিন৷ উল্কার মতো ঝরে পড়তে লাগল৷ সেদিন মাঠে যে উল্কাটা এসে পড়েছিল, সেটা আসলে সেই ছাই৷’

কথাগুলো শেষ করে একটু দম নিল মিনু৷ ওর গলা শুকিয়ে গেছে৷ দেবলীনার মুখের দিকে একবার আড়চোখে তাকিয়ে নিল ও৷ ওরও চোখ জানলার বাইরে৷ সেদিক থেকে মুখ ফিরিয়ে একবার বইয়ের ছবিগুলো দেখল দেবলীনা দেবী এফ্রোডাইটের সারা শরীর পুড়ছে৷ জ্বলন্ত আগুনের মাঝে ওর পোড়া মুখের এককোণে মিহি একটা হাসি খেলে যাচ্ছে৷ একটা এফ্রোডাইটের আগুন আরও হাজার এফ্রোডাইটের জন্ম দেবে৷ একদিন না একদিন সন্তানদের নিয়ে আবার এখানেই ফিরে আসবে সে৷ মিনু লক্ষ করল, দেবলীনার কপালের ঠিক মাঝখানে একটা ছোট্ট তিল আছে৷ দেবতাদের যেখানে তৃতীয় চোখটা থাকে, ঠিক সেইখানে৷

কয়েক মিনিট চুপচাপ কেটে গেল৷ ক্লাসের হট্টগোল কখন যে কমে এসেছে তা দু-জনের কেউই বুঝতে পারেনি৷ চটক ভাঙল ভয়ানক একটা চিৎকারে৷ ভয়ার্ত চোখে তাকিয়ে দু-জনে দেখল, ঘরের ঠিক মাঝে হেডস্যার শেখরবাবু দাঁড়িয়ে আছেন৷ আগুনের দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন দেওয়ালে আঁকা ছবিটার দিকে৷ একটু আগেই তার পাশে ছড়া লিখেছে মিনু, ‘পরিতোষ বাগচি/ দিনদিন দেখচি…’

‘কে? কে করেছে এটা? অপদার্থগুলো৷ স্যারেদের সম্মান করতে শেখোনি, পড়াশোনা করতে এসেছ? ছি৷ সব কবিতা লেখা ছাড়িয়ে দেব আজ৷’

শেখর সামন্তর চিৎকারটা বোধহয় তিনতলা থেকেও শোনা গিয়েছে৷ গোটা ক্লাস থমথমে৷ মিনু জানে ছবি আঁকার শাস্তিটা বেশি নয়৷ কারণ কার্টুনটা যে স্যারের তা ছবিটা দেখে বোঝা যাচ্ছে না৷ মিনু আর দেবলীনার দিকে বেশ খানিকটা এগিয়ে এলেন হেডস্যার৷ আবার বাজ পড়ার মতো আওয়াজ শোনা গেল৷

‘কেউ করেনি? এমনি এমনি উদয় হয়েছে ওটা? বেশ৷ এবার আমি সবার হাতের লেখা মিলিয়ে দেখব৷’

এতক্ষণে মিনুর বুকে গরম তেলের ফোঁটা পড়তে লাগল৷ ‘র’-এর তলার ফুটকিটাকে একটু বেশিক্ষণ ধরে গোল করে সে৷ মিলিয়ে দেখলে একটুও সন্দেহ থাকবে না ছড়াটা কার লেখা৷ এত ভয়ের মধ্যে আগের মন খারাপটা এসে চেপে ধরল মিনুকে৷ দেবলীনার মতো ক্ষমতা যদি ওরও থাকত তাহলে এক্ষুনি অন্য কাউকে দিয়ে দোষ স্বীকার করিয়ে নিত৷

‘মৃন্ময়ী৷ কই, খাতা খোল দেখি৷’ কথাটা বলে শেখর সামন্ত এগিয়ে এলেন মিনুর দিকে৷ কাঁপা-কাঁপা হাতে ব্যাগের ভিতর হাত ঢোকাল ও, কিন্তু থেমে গেল৷ কী যেন ভেবে উঠে দাঁড়িয়েছে দেবলীনা৷ মিনুর একবারের জন্য মনে হল, দেবলীনা মুখে কিছু বললেই হেডস্যারকে আটকে দেওয়া যাবে৷ কিন্তু তাতেই বা কী? এতগুলো মানুষ আছে ঘরে, দেওয়ালের আঁকিবুকি তো আর মুছে দেওয়া যাবে না৷

‘ওটা আমি করেছি স্যার৷’ দেবলীনার গলা পাথরের মতো শান্ত৷ মিনুর দিক থেকে চোখ সরিয়ে ওর দিকে দৃষ্টি হানলেন হেডস্যার৷ উপর থেকে নীচ পর্যন্ত একবার জরিপ করে নিলেন৷ গনগনে লাল মুখে কয়েকটা হিংস্র রেখা খেলে গেল৷ ডান হাতটা সজোরে নেমে এল ছোটো মেয়েটার গালে৷

‘বেরিয়ে আয় এখানে৷’

দেবলীনার মুখটা চড় খেয়ে মিনুর দিকে ঘুরে গিয়েছিল৷ মিনু দেখল, সবার আড়ালে ঝকঝকে একটা হাসি খেলা করছে ওর মুখে৷ এমন অদ্ভুত হাসি মিনু আগে কখনও দেখেনি৷ সামনে তাকাতে হাসিটা নিজে থেকেই মিলিয়ে গেল৷ ওর কান ধরে হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে গেলেন হেডস্যার৷ অস্পষ্ট গলার স্বরে কাটা-কাটা কয়েকটা শব্দ শোনা গেল, ‘সাত দিন… সাত দিন যেন স্কুলের ধারে-কাছে না দেখি… আর কাল বাবা-মা-কে…’

মিনুর ভয়ের ভাবটা অনেকক্ষণ কেটে গিয়েছে৷ মনটা খারাপ হয়ে গেল ওর৷ সাত দিন হয়তো দেবলীনার সঙ্গে দ্যাখা হবে না৷ বেঞ্চে তার পাশের জায়গাটা খালি পড়ে থাকবে৷ উফ৷ ওর নিজের যদি ওরকম একটা… কথাটা মাথায় আসতেই এই মন খারাপের মাঝেও একঝলক হাসি খেলে গেল ওর মুখে৷ একটু আগেও তো নিজেই চাইছিল, কেউ ওর হয়ে দোষ স্বীকার করে নিক৷ কেউ বাঁচিয়ে দিক শাস্তির হাত থেকে… বন্ধুত্বের আশ্চর্য ক্ষমতা না থাকলে কি কেউ নিজের ঘাড়ে সব দোষ নিয়ে বাঁচিয়ে দিতে পারে বন্ধুকে?

জানলা দিয়ে বাইরে তাকাল মিনু৷ একটু একটু করে শীতের বিকেল নামছে৷ স্কুলের বাইরে পিচের রাস্তাটা গিয়ে মিশেছে আকাশের বুকে৷ সেই রাস্তার উপর দিয়ে বাবার হাত ধরে হেঁটে যাচ্ছে দেবলীনা৷ ওর মাথার উপরেই বিকেলের তারাগুলো ফুটে উঠছে একটা একটা করে…

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *