দেবপুত্র কনিষ্কের কথা – চিত্রা দেব

দেবপুত্র কনিষ্কের কথা – চিত্রা দেব

কনিষ্কের কথা মনে আছে? কুষাণ সম্রাট দিগ্বিজয়ী বীর কনিষ্ক৷ যাঁর মাথা কাটা মূর্তিটা ইতিহাসের পাতায় অনেকবার চোখে পড়েছে৷ সেই কনিষ্ক৷ ছোটোবেলায় ছবি দেখে খুব দুঃখ হত৷ প্রাচীনকালের অধিকাংশ রাজাই কেমন দেখতে ছিলেন জানা যায় না, সম্রাট কনিষ্কের একটা বড়োসড়ো, সুন্দর মূর্তি মথুরায় যদি-বা পাওয়া গেল, তার মাথাটাই গেল হারিয়ে৷ মূর্তিটা আছে দিল্লির মিউজিয়ামে৷ যাক সে কথা, ওই মূর্তির মতোই রাজাধিরাজ কনিষ্কের জীবনের প্রায় সবটাই আমাদের অপরিচিত৷ এমনকী কে তাঁর পিতা, কে তাঁর সিংহাসনের উত্তরাধিকারী হলেন, কিছুই জানা যায় না৷ যদিও তিনি মহাপরাক্রমশালী বীর ছিলেন, রোম সাম্রাজ্যে তাঁর দূত গিয়েছিল, রোমানদের মতো তিনি স্বর্ণমুদ্রার প্রচলন করেন নিজের রাজ্যে এবং ভারতে কুষাণ রাজারাই প্রথম স্বর্ণমুদ্রা চালু করেন, তবু ইউরোপের কেউ তাঁর নাম শোনেনি৷ আর আমরাই-বা কতটুকু জানি তাঁর সম্পর্কে? কনিষ্ক বেঁচে আছেন তিব্বতে, চীন ও মঙ্গোলিয়ার কিংবদন্তিতে৷ বৌদ্ধদের কাছে সম্রাট অশোকের পরেই প্রিয় নাম হচ্ছে সম্রাট কনিষ্ক৷

সত্যিকথা বলতে কি, কুষাণ সম্রাটদের মধ্যে শ্রেষ্ঠতম হচ্ছেন কনিষ্ক৷ তাঁর আগে, দু-জন কুষাণ রাজার নাম শোনা যায়, প্রথম ও দ্বিতীয় কদফেসিসের৷ এঁরা কেউই ভারতের রাজা ছিলেন না৷ মধ্য এশিয়ার অনেক অংশ জুড়ে ছিল কুষাণ সাম্রাজ্য৷ আফগানিস্তান, পাকিস্তান, মঙ্গোলিয়া, তিব্বত ও চীনের কিছু অংশ এবং কাশ্মীর কুষাণ রাজাদের অধীনে ছিল, কনিষ্কের আমলে ভারতের অধিকাংশই চলে যায় তাঁর হাতে৷ ছোটো ছোটো অগুণতি রাষ্ট্র নিজেদের মধ্যে ঝগড়া করায় কুষাণ সাম্রাজ্য বিস্তার করা সহজ হয়৷

ভীম কদফেসিসের পরে রাজা হন কনিষ্ক৷ সেজন্য তাঁকে দ্বিতীয় কদফেসিসের ছেলে ভাবাই সংগত৷ কিন্তু প্রাচীনকালে লোকে ভাবত কনিষ্ক দৈবশক্তিসম্পন্ন রাজা এবং আসলে একজন ‘দেবপুত্র’৷ সে গল্পও পরে শোনাব৷ কনিষ্কের রাজধানী ছিল পুরুষপুর বা পেশোয়ারে৷ কনিষ্কের রাজত্বকাল নিয়েও সন্দেহ আছে৷ আমরা প্রখ্যাত ঐতিহাসিক দীনেশচন্দ্র সরকার মশাইয়ের মতটা গ্রহণ করতে পারি৷ তাঁর মতে, কনিষ্কের প্রথম রাজ্যবর্ষ থেকেই শকাব্দ আরম্ভ হয়, এই শকাব্দ শুরু হয়েছে ৭৮ খ্রিস্টাব্দ থেকে এবং এখনও আছে৷ বৌদ্ধ সাধুরা বলেন, চতুর্থ বৌদ্ধ মহাসম্মেলন আহ্বান করেছিলেন সম্রাট কনিষ্ক, কাশ্মীরে৷ আর এখানেই নতুন বৌদ্ধধর্মমত মহাযানবাদ প্রকৃত মর্যাদা পায়৷ কনিষ্ক প্রথম জীবনে মোটেই বুদ্ধভক্ত ছিলেন না৷ এ নিয়ে দু-একটি গল্প শুনিয়েছেন চীনের পরিব্রাজকেরা৷ তাঁরা বলেন, ‘শাক্যমুনি বুদ্ধ একবার শিষ্যদের নিয়ে পুরুষপুরে বেড়াতে আসেন৷ তখন শহরের বাইরে একটা এক-শো হাত উঁচু বিরাট গাছের নীচে বসে প্রিয় ভিক্ষু আনন্দকে বলেছিলেন, আমার নির্বাণের চার-শো বছর পরে কনিষ্ক নামে একজন রাজা এই দেশের রাজা হবেন আর এখানে একটি স্তূপ তৈরি করে আমার অস্থি ও দেহভস্ম সেখানে রাখবেন৷’

সত্যিই কনিষ্ক একদিন রাজা হলেন৷ দেশ জয় করতে করতে পুরুষপুরে এলেনও৷ বিজয়ী রাজারা সবসময় বিজিত দেশের ধনসম্পদ নিয়ে চলে যান৷ কনিষ্ক ঠিক করলেন বুদ্ধের ভিক্ষাপাত্র যা পুরুষপুরের একটি বিহারে রাখা আছে, সেটিও সঙ্গে নিয়ে যাবেন৷ পাত্রটি সাধারণ নয়৷ চাররকম দামি পাথর দিয়ে তৈরি করা৷ চকচকে এই পাত্রে দু-কুনকে চাল ধরে৷ এর বাইরের দিকটা নানা রঙের পাথরে উজ্জ্বল, তবে কালো রং-ই বেশি৷ সাড়ে পাঁচ ইঞ্চি মোটা৷ কিংবদন্তি, গরিব ভক্তেরা সামান্য একটি ফুল দিলেও পাত্র ভরে যায়, ধনীদের লক্ষ লক্ষ পুষ্পের ডালি দিয়েও পাত্র ভরা যায় না৷ কনিষ্ক এমন একটি অদ্ভুত জিনিস স্বদেশে নিয়ে যাবার প্রলোভন ত্যাগ করতে পারলেন না৷ বৌদ্ধ না হলেও কোনো ধর্মের প্রতি তাঁর বিদ্বেষ ছিল না৷ কারও ধর্মেও হস্তক্ষেপ করতেন না৷ রাজার ইচ্ছেয় কে বাধা দেবে? আর দিলেই-বা নিরস্ত্র ভিক্ষুদের কথা শুনছে কে? নির্দিষ্ট দিনে একটি সাজানো থালার ওপরে ভিক্ষাপাত্র নিয়ে একটি হাতির পিঠে চাপানো হল, সঙ্গেসঙ্গে কী আশ্চর্য! হাতিটি সেখানে বসে পড়ল, তাকে কিছুতেই ওঠানো গেল না৷

‘ঠিক আছে৷’ কনিষ্ক বললেন, ‘গাড়ি নিয়ে এসো৷’

এলো চার চাকার রথ৷ ভিক্ষাপাত্র তার ওপরে রেখে গাড়িতে জুড়ে দেওয়া হল আটটি মহাশক্তিশালী হাতি৷ কিন্তু এবারেও সেই একই ঘটনা ঘটল৷ হাতিরা হাজার চেষ্টা করেও গাড়িটি নড়াতে পারল না, চাকাও ঘুরল না৷ এবার কনিষ্ক নিজের ভুল বুঝতে পারলেন৷ বুঝলেন বুদ্ধের ভিক্ষাপাত্র গ্রহণ করার উপযুক্ত সময় এখনও আসেনি, তিনি সেখানেই একটি স্তূপ ও বিহার তৈরি করে দিলেন৷ সেখানেই হল তাঁর রাজধানী৷

একদিন ঘুরতে ঘুরতে কনিষ্ক দেখলেন, একটা ধবধবে সাদা খরগোশ লাফাতে লাফাতে যাচ্ছে৷ ভারি সুন্দর দেখতে৷ তিনি তখনই তার পিছু নিলেন, শিকার করবেন কিংবা জ্যান্ত ধরবেন বলে৷ খরগোশটা ছুটতে ছুটতে এসে শ্রীবুদ্ধ যে গাছের তলায় বসে কনিষ্কের কথা বলেছিলেন, সেখানে হারিয়ে গেল৷ কনিষ্ক অবাক৷ এদিক-ওদিক খুঁজছেন, হঠাৎ দেখেন, একটি রাখাল ছেলে আপনমনে একটা ছোট্ট স্তূপ তৈরি করছে৷ কনিষ্ক তাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘খোকা কী করছ?’ ছেলেটি বলল, ‘আমি স্তূপ তৈরি করছি৷ তথাগত বলেছিলেন, একজন বিজয়ী রাজা একটা স্তূপ তৈরি করবেন৷ আমি তোমাকে সেকথা মনে করিয়ে দিচ্ছি৷’

কনিষ্ক শুনে খুশি হলেন৷ বললেন, ‘ঠিক আছে, আমি এই স্তূপটিকে ঘিরে একটি বড়ো স্তূপ তৈরি করব৷’ এদিকে রাজার স্তূপ যত বড়ো হয়, রাখালের স্তূপ আপনা-আপনি উঁচু হয়৷ কনিষ্ক আবার বুঝতে পারলেন দেবতার ইচ্ছের কাছে নত হতে হয় তাই তিনি স্তূপ উঁচু করা বন্ধ করলেন৷ ইতিহাস বলে, দু-টি স্তূপই তৈরি করেছিলেন কনিষ্ক, মধ্যেরটি চার-শো হাত উঁচু, লোকে একে বলত ‘কনিষ্ক চৈত্য’৷

বৌদ্ধধর্ম নিয়ে কনিষ্ক পাঠ ও আলোচনা শুরু করলেন, কিন্তু দেখলেন, নানা মুনির নানা মত৷ এক-একজন আচার্য এক-এক রকম বৌদ্ধধর্মের কথা বলেন৷ তা হলে আসল কোনটা? সত্যি সত্যি বুদ্ধ কী বলতে চেয়েছিলেন? একজন সাধু বা অর্হৎকে তিনি প্রশ্ন না করে আর পারলেন না৷

অর্হৎ পার্শ্ব বললেন, ‘বুদ্ধের নির্বাণের পর অনেক বছর কেটে গেছে, কাজেই তিনি কী বলেছিলেন, আজকের আচার্যেরা তা জানেন না৷ এঁরা নিজেদের গুরুর কাছে যা শুনেছেন তাই বলেছেন৷’

শুনে কনিষ্ক খুব দুঃখ পেলেন এবং এক ধর্মমহাসভা ডাকবার ব্যবস্থা করলেন, যাঁরা ত্রিপিটক চর্চা করে প্রকৃত সত্য কী তা জানাতে পারবেন৷ হলও তাই৷ কাশ্মীরে এই সভা হল৷ বসুমিত্র সভাপতি৷ পাঁচ-শোজন যতি বা ত্রিপিটক বিশেষজ্ঞ বহু শ্লোক রচনা করলেন৷ তারপর কনিষ্ক তাম্রপত্রে এই শ্লোকগুলি খোদাই করে একটি স্তূপের মধ্যে রেখে দিয়ে নিজের দেশে ফিরে গেলেন৷ যাবার সময় কাশ্মীরের পশ্চিমদ্বার থেকে বেরিয়ে পুব দিকে মুখ করে হাঁটু গেড়ে বসে রাজ্যটি ভিক্ষুদের দান করে গেলেন৷ তিব্বতে এবং চীনে কনিষ্ক বৌদ্ধধর্ম প্রচারের ব্যবস্থা করেন৷ বিখ্যাত সিল্করোড বা চীন থেকে পারস্য পর্যন্ত যে বাণিজ্যপথটি ছিল, সেই পথটির ধারে ধারে তৈরি হল অনেক বৌদ্ধ স্তূপ৷ মূর্তি গড়ায় কনিষ্কের উৎসাহ ছিল, তাঁর সময়েই যে অনেক জায়গায় বুদ্ধের মূর্তি তৈরি হয় তার প্রমাণও আছে৷ তাই ‘দেবতাদের প্রিয় অশোক’ ও ‘দেবপুত্র কনিষ্ক’ বৌদ্ধদের এত প্রিয় ছিলেন৷

কণিষ্কের দৈবক্ষমতার গল্প শুনিয়েছেন আর একজন, তিনি হচ্ছেন আলবেরুনি৷ সেও বেশ মজার গল্প৷ কনিষ্ক তখন দিগ্বিজয়ী রাজা৷ নানা দেশ থেকে রাজারা উপহার পাঠান৷ এমনিতে কনিষ্ক বেশ ভালো লোক ছিলেন৷ সাধারণ মানুষ তাঁকে দেবতার মতো ভক্তি করে৷ একবার কান্যকুব্জরাজ তাঁকে কিছু উপহার পাঠালেন৷ তার মধ্যে ছিল একটা সুন্দর কাপড়৷ সম্রাটের মনে হল, এত সুন্দর কাপড় তিনি দেখেননি৷ ভারতবর্ষের কাপড় বিখ্যাত৷ কনিষ্ক তাড়াতাড়ি তাঁর নিজস্ব দরজিকে ডেকে পাঠালেন, সেই কাপড়ের একটা রাজপোশাক তৈরি করাবেন বলে৷ রাজ্যের সেরা দরজি এসে দাঁড়াতেই তিনি বললেন, ‘সূচিক, তুমি যত শীঘ্র সম্ভব এই কাপড় দিয়ে আমার পোশাক তৈরি করে দাও৷’ দরজিকে সেকালে বলা হত সূচিক৷

এক সপ্তাহ কেটে গেল৷ সম্রাট প্রতিদিন ভাবছেন আজ তাঁর নতুন পোশাক আসবে৷ পোশাক আর আসে না৷ কী হল? পাইক-পেয়াদা পাঠিয়ে সূচিককে ধরে আনা হল৷ বলল, ‘মহারাজ রক্ষা করুন, আমি নির্দোষ৷ আমি কোনো অপরাধ করিনি৷’

‘তোমার স্পর্ধা তো কম নয়৷ আমার পোশাক কই? সাতদিনেও তৈরি হল না?’

‘প্রভু, আমি মরে গেলেও এই কাপড় দিয়ে আপনার জামা তৈরি করতে পারব না৷’

‘তার মানে’

‘মহারাজ, কাপড়খানি মহামূল্যবান কিন্তু এর এক জায়গায় দু-টি পায়ের ছাপ আছে৷ যেভাবেই কাটি না কেন ওই মানুষের পায়ের ছাপ দু-টি পড়বে কাঁধের ঠিক নীচে৷ বহু চেষ্টা করেও তাই আমি আপনার পোশাক তৈরি করতে পারিনি৷’

কনিষ্ক বুঝতে পারলেন ব্যাপারটা৷ কান্যকুব্জের রাজা কৌশলে তাঁর পিঠে পদাঘাত করেছেন৷ রাগে সর্বাঙ্গ জ্বলে গেল৷ দরজিকে ছেড়ে দিয়ে তিনি সেনাপতিকে সেনা সাজাতে বললেন৷ এই অপমানের উত্তর দিতেই হবে৷

রাজাধিরাজ কনিষ্ক সসৈন্যে ভারতের দিকে যাত্রা করেছেন শুনে ঘরে ঘরে হাহাকার পড়ে গেল৷ কান্যকুব্জের রাজা শুকনো মুখে মন্ত্রীর কাছে এলেন, ‘মন্ত্রীমশাই, সর্বনাশ হয়েছে৷ আমি ধনেপ্রাণে মারা যাব৷ কনিষ্কের হাত থেকে আপনি বাঁচান৷’

বৃদ্ধ মন্ত্রী সব শুনে চটে গিয়ে বললেন, ‘মহারাজ, আপনি সর্বনাশ করেছেন৷ একজন শান্তশিষ্ট রাজাকে রাগিয়ে দিয়েছেন৷ কনিষ্ককে পায়ের ছাপ আঁকা কাপড় পাঠানো খুব অন্যায় হয়েছে৷’

‘যা হয়ে গিয়েছে, তার তো কোনো উপায় নেই৷ একটা ভুল করে ফেলেছি, এখন পারেন তো আমাকে বাঁচান৷’

মন্ত্রী বহুক্ষণ ভাবলেন৷ কনিষ্কর সঙ্গে যুদ্ধ করার প্রশ্নই ওঠে না৷ শেষে বললেন, ‘যা বলি শুনুন৷ আপনি আমার নাক-কান কেটে আমাকে বিকলাঙ্গ করে দিন৷ তারপর দেখি কী করতে পারি!’

প্রিয় মন্ত্রীর নাক-কান কাটতে রাজার খুব খারাপ লাগল৷ কিন্তু কী করবেন? নিজের ধনপ্রাণ বাঁচাবার জন্যই তাঁকে এখন মন্ত্রীর কথা শুনতে হল৷ মন্ত্রীকে সেখানে ফেলে রেখে রাজা রাজ্যের অন্য জায়গায় গিয়ে লুকিয়ে রইলেন৷ বিকলাঙ্গ মন্ত্রী যাত্রা করলেন কনিষ্কের পথে৷ পথেই দেখা হল রাজার সেনাবাহিনীর সঙ্গে৷ তাঁরা তাঁকে ধরে নিয়ে গেল কনিষ্কের কাছে৷ কনিষ্ক জিজ্ঞেস করলেন, ‘কে তুমি? এখানে কী করছ? তোমার অবস্থাই বা এরকম হল কী করে?’

মন্ত্রী বললেন, ‘রাজাধিরাজ, আমি চিরদিন আমার প্রভু কান্যকুব্জরাজকে সুপরামর্শ দিয়ে এসেছি৷ বলেছি সম্রাট কনিষ্কের আনুগত্য স্বীকার করতে, কিন্তু তিনি তা শোনেননি৷ আপনার পক্ষপাতি বলে তিনি আমাকে দেখতে পারতেন না৷ এখন আপনি রাজ্য আক্রমণ করবেন জানতে পেরে আমাকে রাজদ্রোহের শাস্তি দিয়ে তাড়িয়ে দিয়েছেন৷ আমি অপমানের প্রতিশোধ নিতে চাই, তাই আপনার কাছে এসেছি৷’

কনিষ্ক বললেন, ‘শীঘ্রই তোমার মনোবাসনা পূর্ণ হবে৷ আমি কান্যকুব্জরাজকে যমালয়ে পাঠিয়ে কান্যকুব্জ অধিকার করব৷’

‘আপনার জয় হোক,’ বলে হাতজোড় করে নমস্কার করে মন্ত্রী বললেন, ‘কিন্তু তা তো হবার নয়!’

‘কেন?’

‘আপনার আগমন সংবাদ পেয়ে তিনি রাজ্যের বাইরে এক গুপ্ত জায়গায় পৌঁছেছেন৷ সেখানে সহজে পৌঁছোবার একটা মাত্র দুর্গম পথ আছে, মরুভূমির মধ্যে দিয়ে৷’

‘বেশ তো, তাই যাব৷ সঙ্গে নেওয়া হবে প্রয়োজনীয় পানীয়৷ তুমি পথ দেখিয়ে নিয়ে চলো৷’

মন্ত্রী কনিষ্ককে এক বিশাল মরুভূমিতে নিয়ে গেলেন৷ পথ আর ফুরোয় না৷

নির্দিষ্ট দিন এল৷ পানীয় জল ফুরোল৷ ধু-ধু মরুভূমি ফুরোয় না৷ কনিষ্ক কান্যকুব্জর মন্ত্রীকে ডেকে পাঠালেন৷ বললেন, ‘তুমি পথ ভুল করনি তো?’

মন্ত্রী হেসে বললেন, ‘রাজাধিরাজ, শত্রুশিবির দূরে বটে, কিন্তু আপনার সর্বনাশের সময় এসে গেছে৷ আমরা মরুভূমির মাঝখানে এসেছি৷ এখান থেকে প্রাণ নিয়ে কেউ ফিরতে পারে না৷ জলাভাবে আপনারা সকলে মরবেন৷ এখন আমাকে যা শাস্তি দেবার দিন৷ আমি বিশ্বাসঘাতক মন্ত্রী নই৷’

কনিষ্ক সব বুঝতে পারলেন৷ তাঁর সেনাদলে হাহাকার পড়ে গেল৷ কিন্তু কনিষ্ক একা বেরিয়ে পড়লেন একটা বর্শা হাতে, ঘোড়ার পিঠে চেপে৷ ঘুরতে ঘুরতে একটা নীচু জমি দেখতে পেয়ে তিনি সেখানে গিয়ে বর্শা দিয়ে প্রচণ্ড আঘাত করলেন৷ অনেকখানি বর্শা বিঁধে গেল আর সম্রাট দেখলেন, একটা জলের রেখা বেরিয়ে আসছে৷ সবাই দেবানুগৃহীত রাজার জয়ধ্বনি দিল৷

মন্ত্রী বললেন, ‘মহারাজ, আপনি দৈবশক্তির অধিকারী৷ দেবতার সঙ্গে আমি ছলনা করতে চাইনি, মানুষের বিরুদ্ধেই কূটকৌশল প্রয়োগ করেছি৷ আমাকে এবং আমার প্রভুকে যা শাস্তি দেবার হয় দিন৷’

কনিষ্ক হেসে তাঁর প্রভুভক্তির প্রশংসা করে তাঁকে মুক্তি দিয়ে বললেন, ‘আমি পুরুষপুরে ফিরে যাচ্ছি৷ তোমার প্রভুভক্তির প্রশংসা করি, কিন্তু তোমার প্রভু উপযুক্ত শাস্তিই পেয়েছেন৷’

কনিষ্ক দেশে ফিরলেন৷ মন্ত্রীও কান্যকুব্জে ফিরলেন৷ ফিরে দেখেন, যেদিন কনিষ্ক জলের জন্য মাটিতে বর্শা পুঁতেছিলেন সেদিনই রাজার দেহ থেকে হাত-পা খসে পড়ে গেছে৷ বুঝলেন, দেবতাই তাঁকে শাস্তি দিয়েছেন৷

সম্রাট কনিষ্ক এভাবেই বেঁচে আছেন কিংবদন্তি আর লোককথার মধ্যে৷

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *