দেবদূত

দেবদূত

যে সময়ের কথা বলছি পৃথিবীর বুকে তেমন সময় কখনও আসেনি৷ সম্ভবত আসবেও না৷ গল্পের স্থান কাল ও চরিত্র সমস্তই কাল্পনিক৷ আজকের পৃথিবীতে প্রচলিত কোনও বিশেষ ধর্মের সঙ্গে এ গল্পের কোনও যোগাযোগ নেই৷ বরঞ্চ সবক’টি ধর্মের গোড়ার কথা নিয়েই এই গল্প৷

ধরে নিন, মহাবিশ্বের কোনও প্রান্তে এমন এক গ্রহ আছে যেখানে পৃথিবীর মতোই মানুষ বসবাস করে৷ বছর দশেক আগেই এক ভয়াবহ যুদ্ধে প্রায় ধ্বংস হতে বসেছিল এ গ্রহের সভ্যতা৷ যে ক-জন বেঁচে যায় তারা আবার নতুন করে বসতি স্থাপন করে৷ ছোটো ছোটো জনপদ তৈরি হয়৷

এরকমই একটা জনপদের দিকে তাকাব আমরা৷ পাহাড় আর নদীর কোলে ছোটো একটা গ্রাম৷ খুব বেশি লোকজন থাকে না এখানে৷ সব মিলে শ-খানেক পরিবার৷ মারাত্মক যুদ্ধের ছাপ এখনও মিলিয়ে যায়নি গ্রাম থেকে৷ নানা সমস্যায় জর্জরিত তারা৷ কিন্তু ক্রমশ এই সমস্যা থেকে মুক্তির এক পথ খুলে যাচ্ছে তাদের সামনে৷ একজন বিশেষ মানুষের উত্থান ঘটতে চলেছে সমস্ত গ্রহ জুড়ে৷

(১)

সন্ধ্যার ঘনায়মান অন্ধকার নামতে চলেছে৷ বিকেল ফুরিয়ে আসছে দ্রুত৷ নিজের ছোটো কুঁড়েঘর থেকে বেরিয়ে মাঠের দিকে হেঁটে গেল লিফারুন৷ মাঠ পেরোলেই ছোটো একটা জঙ্গল শুরু হচ্ছে৷ আকাশ ছোঁয়া মহীরুহে পুরিপূর্ণ এক মানুষের হাতে তৈরি জঙ্গল৷ আজ থেকে বছর দশেক আগে জঙ্গলের প্রথম চারাগাছটা রোপণ করে প্রভু বিরান৷ চারাগাছ থেকে দীর্ঘদিনের যত্নে ধীরে ধীরে এই জঙ্গল তৈরি হয়েছে৷

জঙ্গলের ভিতরেই থাকে বিরান৷ কোনও ঘর কিংবা চার দেওয়ালের মধ্যে আটকে রাখা যায়নি তাকে৷ কেবল গ্রামের কেউ বিপদে পড়লে কোথা থেকে যেন খবর পেয়ে সে উদয় হয়৷ গভীর রাতে কোনও ফাঁকা মাঠে কিংবা পাথরের প্রাচীরের আড়ালে কোনও কিশোরী মেয়ে বিপদে পড়লে, গৃহহীন অসহায় ভিখারি অনাহারে থাকলে বিরানের পদধ্বনি কানে যায় তাদের৷ অবশ্য এ সবই বছর দশেক আগের কথা৷ এখন এ গ্রামের বুকে আর কোনও অপরাধ হয় না বললেই চলে৷ কেউ অনাহারে ঘুমোতে যায় না, মানুষের মনের গভীর থেকে হিংস্রতা কোথায় যেন মিলিয়ে গিয়েছে, ধর্মের হানাহানি নেই, বিদ্বেষ নেই, দশ বছর আগেই সদ্য যুদ্ধের ক্ষতই ধুঁকতে থাকা গ্রাম জুড়ে এক ইউটোপিয়া নেমে এসেছে৷

এই ইউটোপিয়ার মূল কারিগর বিরান৷ তার হাত ধরেই মানুষের মধ্যে আবার মনুষ্যত্ব ফিরে এসেছে৷ সমস্ত জীবজগৎ যেন প্রাণ ফিরে পেয়েছে৷ বিরান আর তার দলবলের উদ্যোগে গ্রামের একটা বড়ো অংশ জুড়ে তৈরি হয়েছে নিবিড় অরণ্য৷ সে অরণ্যের মধ্যেই ঘুরে বেড়ায় বিরান৷ ভারী রহস্যময় এক মানুষ সে৷

তবে লিফারুনের আজ নিঃশ্বাস নেওয়ার জো নেই৷ ভীষণ দরকারি একটা খবর আছে তার কাছে৷ যে করেই হোক এক্ষুনি জানাতে হবে বিরানকে৷ কিন্তু কোথায় পাবে তাকে? হয়তো জঙ্গলেরই কোনও গাছের কাণ্ডে হেলান দিয়ে বসে শূন্যে তাকিয়ে হারিয়ে গিয়েছে কোনও ভাবিকালের ভাবনায়, আধুনিক যুগের শেষ ঈশ্বরপ্রেরিত দূত সে, তাকে চাইলেই কাছে পায় কার সাধ্যি?

জঙ্গলের ভিতরে ঢুকতেই ডান দিকে পাতার উপরে খসখস করে একটা শব্দ পেল লিফারুন৷ কিছু যেন হাঁটাচলা করছে সেখানে৷ সে দ্রুত এগিয়ে গেল৷ তবে খানিক দূর এসে কিছুই দেখতে পেল না৷ মুখ ঘুরিয়ে নিতে যাচ্ছিল, এমন সময় কীসে যেন তার চোখ আটকে গেল৷

অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখল কয়েকটা হিলহিলে শরীর পড়ে রয়েছে ঘাসের উপর৷ সাপের বাচ্চা৷

পেছন ফিরতে গিয়ে থেমে গেল লিফারুন৷ একটা বিশেষ শব্দ ভেসে এসেছে৷ এ শব্দটা সে চেনে৷

আড়চোখে পেছনে তাকাতেই দেখতে পেল একটা মিটার দুয়েক লম্বা বিষাক্ত সাপ ফণা তুলে তাকিয়ে আছে তার দিকে৷ নড়ার উপক্রম করলেই ছোবল নেমে আসবে হাঁটুর পেছনদিকে৷

লিফারুনের বুকের ভেতরে রক্ত জল হয়ে গেল৷ আড়চোখে পেছনে চেয়ে থাকতে থাকতে একদিকে পা বাড়াতে গেল সে, খেয়াল করেনি কখন একটা ছোটো সাপ এসে পড়েছে তার জুতোর তলায়৷ লিফারুনের জুতোর নীচে থেঁতলে গেল সাপটার মাথা, সঙ্গে সঙ্গে হাঁটুর পেছনে একটা ভারী বাতাস অনুভব করল লিফারুন৷ সেই সঙ্গে একটা মিহি শিষের শব্দ৷

সাপটা থেমে গিয়েছে৷ আছড়ে পড়তে গিয়েও থেমে গিয়েছে ফণাটা৷ লিফারুন চেয়ে দেখল জঙ্গলের গাছের ফাঁক দিয়ে পায়ে পায়ে হেঁটে বেরিয়ে আসছে বিরানের দীর্ঘ দেহটা৷ তার চোখ দুটো স্বাভাবিকের থেকে বেশি উজ্জ্বল দেখাচ্ছে৷ সেই উজ্জ্বল দৃষ্টিতে ফণা তুলতে উদ্যত সাপটার দিকে চেয়ে আছে৷ যেন ইশারায় কিছু একটা নির্দেশ দিচ্ছে৷

লিফারুন অনুভব করল সদ্যসন্তানহারা সাপটা একটু একটু করে যেন শান্ত হয়ে পড়ছে৷ ক্রমশ ফণা নামিয়ে আঁকাবাঁকা হেঁটে সন্তানের থেঁতলানো শরীরটার কাছে এগিয়ে গেল সে৷

বিরান এগিয়ে এসে একটা হাত রাখল লিফারুনের পিঠে৷ তারপর নরম গলায় বলল, ‘ভয় পেলে চলবে না ভাই৷ ভয় পেয়ে মানুষ যা পাপ করে তা বোধহয় আর কিছুতে করে না৷’

‘কিন্তু সাপটা আমাকে…’

‘হুঁ, ছোবল মারতে চায়নি, প্রথমে শুধু ভয় দেখাতে চেয়েছিল৷ আসলে কী জানো? নিজের সন্তানের প্রতি ভালোবাসা প্রাণীকুলকে বেপরোয়া করে দেয়, সব অনুভূতিরই একটা ব্যালেন্স দরকার, ঘৃণা, লোভ, বিদ্বেষ, এমনকি ভালোবাসারও৷ যাই হোক…’

জঙ্গলের বাইরের দিকে হাঁটতে শুরু করে বিরান৷ তার গায়ে একটা সাধারণ সুতির জামা৷ তার নীচে ট্রাউজার৷ গায়ের রং রোদে-পোড়া তামাটে৷ দীর্ঘ ঋজু দেহ ছাড়া আর কোনও অলৌকিকত্বের ছাপ নেই৷

‘হঠাৎ আমাকে খুঁজছিলে কেন বলো তো? বেশ তো ছিলাম গাছপালার মধ্যে, তোমার ডাক কানে এল৷’

লিফারুনের বুকের ধুকপুকুনিটা কমে এসেছে এতক্ষণে৷ সে পাংশু মুখে বলে, ‘আপনার জন্য একটা খবর এনেছিলাম৷’ মিহি হেসে ওঠে বিরান, ‘দ্যাখো কাণ্ড, আমারও একটা খবর দেওয়ার আছে তোমাকে৷ তবে তুমিই আগে বলো না-হয়৷’

লিফারুন ঢোঁক গিলে বলে, ‘কাল সোহেরা থেকে একটা রিসার্চ গ্রুপ আসছে আমাদের এখানে৷ ওরা আপনার সঙ্গে একটু কথা বলতে চায়৷’

‘কথা বলবে? কী নিয়ে?’

‘আসলে…’ পরের কথাটা বলতে একটু দ্বিধা করে লিফারুন৷ বিরানের মুখের দিকে চায়৷ অসম্ভব একটা মায়া জড়ানো আছে মানুষটার মুখের ভাষায়৷ সংকোচ বেশিক্ষণ থাকে না, মন হালকা হয়ে যায়৷

‘ওরা আপনাকে একবার খতিয়ে দেখতে চায়৷ যদি দ্যাখে কোনও যন্ত্রপাতির কারসাজি নেই, তাহলে ওরা বড়ো করে একটা কনফারেন্সের ব্যাবস্থা করবে৷ সেটা যদি হয় তাহলে…’

‘সারা গ্রহের লোক আমার নাম জানতে পারবে, তাই তো?’

‘সেটা হলে একটা প্ল্যাটফর্ম পাব আমরা৷ যা আমরা বলতে চাই সেটা ছড়িয়ে দিতে পারব পৃথিবীর এতগুলো মানুষের মধ্যে৷’

একটু চিন্তিত দেখায় বিরানকে৷ জঙ্গল থেকে এতক্ষণে বেরিয়ে এসেছে ওরা৷ মাঠের একপ্রান্তে হারিয়ে গিয়েছে বিরানের চোখ৷

‘কথাটা মন্দ বলোনি ভাই৷ আমাদের গোটা গ্রহটা একখানা বারুদের স্তূপের ওপরে বসে রয়েছে৷ মানুষে-মানুষে খুনোখুনি, যুদ্ধ, বিদ্বেষ, এমনকি যে ধর্মের সৃষ্টি হয়েছিল মানুষকে সহাবস্থান, ঐক্য শেখাতে সেটাই আজ হিংসার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে৷ ভারী চিন্তা হয় আমার৷’

‘তাহলে আমি ওদের জানিয়ে দিই৷’

‘দাও৷ কিন্তু কাল আমি কথা বলতে পারব কি-না জানি না৷ কাল অন্য একজন আমার সঙ্গে দেখা করার বায়না নিয়েছেন আগে৷’

‘কে?’ মুখ তুলে জিজ্ঞেস করল লিফারুন৷

একটা আঙুল আকাশের দিকে তুলে ধরে বিরান, থমথমে গলায় বলে, ‘আজ ভারী অদ্ভুত একটা স্বপ্ন দেখলাম, জানো? মনে হল ঈশ্বর আমাকে বলছেন কাল স্বর্গ থেকে একদল দেবদূত দেখা করতে আসবেন আমার সঙ্গে, আমাকে কী একটা দেওয়ার আছে ওঁদের৷’

‘দেবদূত!’ আকাশের দিকে চায় লিফারুন৷

(২)

কুবোর মনটা খারাপ হয়ে ছিল সকাল থেকেই৷ বেলা বাড়তে রোদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে যেন বাড়তেই থাকল সেটা৷ তার বয়স আগের মাসে সতেরো পেরিয়েছে৷ তবে সেই অনুপাতে লম্বা হয়নি কুবো৷ ওদের বংশের এই নিয়ম৷ কুড়ি বছর বয়স অবধি সমস্ত গ্রোথ হরমোন যেন ঝিমিয়ে থাকে৷ সেটা পেরিয়ে গেলেই দুম করে জেগে উঠে একেবারে অস্ট্রিচ পাখির মতো দৌড় দেয়৷

আজও একটা চিরপাইন গাছের মাথায় উঠতে গিয়ে বাবার কাছে ধমক খেয়েছে৷ হাতে পায়ে ভারী দুরন্ত কুবো৷

আপাতত টিলার উপরে ওদের বাড়ি থেকে খানিকটা দূর হেঁটে এসে একটা শূন্যে বেরিয়ে-থাকা পাথরের ওপর বসেছে ও৷ দূরে জঙ্গলের প্রান্তরেখার দিকে চেয়ে মনে মনে কী যেন গুনগুন করছে৷

রোজ এই সময়টায় এখানে এসে বসে কুবো৷ রোন্নাও এসে বসে ওর ঠিক পাশটায়৷ রোন্না কথা বলতে পারে না৷ তাও ও এসে বসলে কুবোর মনটা ভারী শান্ত হয়ে ওঠে৷ ঘণ্টাখানেক সেইভাবে ঠায় বসে থেকে চলে যায় রোন্না৷

আজও পেছনে আওয়াজ পেয়ে ঘুরে তাকাল কুবো৷ রোন্না এসে দাঁড়িয়েছে ওর পেছনে৷ কুবো হাসল৷ ওর পাশের জায়গাটা দেখিয়ে বসতে বলল রোন্নাকে৷ পাশে বসে ওর হাত চেপে ধরল রোন্না৷ তারপর রোজকার মতোই চেয়ে থাকল মাটির দিকে৷

মুঠোর মধ্যে রোন্নার হাতটা নিয়েই কী যেন চিন্তায় হারিয়ে গেল কুবো, সবাই ওকে এত বকাঝকা করে কেন? বিরান তো সেবার বকেনি ওকে৷ হ্যাঁ, বিরানের সঙ্গে ওই একবারই দেখা হয়েছিল কুবোর৷ সেদিন সবে ভোর হয়েছে৷ মাঠের উপর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে লিলি নদী থেকে জল আনতে যাচ্ছিল কুবো৷ বিরান বলেছে ঈশ্বরের কৃপায় ওই লিলি নদীর জলে নাকি যাদু আছে৷ খেলেই রোগ সেরে যায়৷

কুবোর মায়ের আগেরদিন রাতে ভীষণ জ্বর এসেছিল৷ ভোর হতেই তা-ই পুকুরের ধারে ছুটেছিল কুবো৷ যেতে যেতে হঠাৎ দেখল ঘাসের ওপরে চাপচাপ রক্ত পড়ে আছে, যেন কাউকে খুন করা হয়েছে এখানে৷ কিন্তু আশপাশে তাকিয়ে কাউকে দেখতে পেল না সে৷ কেবল রক্তের দাগ একটা ঝোপের ভিতর দিকে চলে গেছে৷

অন্য কেউ হলে ওই দেখেই ভয়ে দৌড়ে পালিয়ে যেত৷ কিন্তু জন্মে থেকেই কৌতূহল আর বেপরোয়া ভাব অফুরন্ত আছে ওর ভিতরে৷ সেই সঙ্গে যোগ হয় দুরন্তপনা৷

তবে সেদিন খানিকটা ভয় ভয়েই ঝোপটার সামনে এগিয়ে গিয়েছিল কুবো৷ এবং বিড়ালের মতো শব্দহীন পদক্ষেপে কিছুটা এগিয়ে যেতেই আঁতকে উঠেছিল৷

ঝোপঝাড়ের ভিতরে বেশ কিছুটা জায়গায় গাছপালা ফাঁকা হয়ে আছে৷ সেখানে বসে আছে দামি জামাকাপড় পরা কয়েকটা লোক৷ কিছু একটা প্রাণীকে যেন গোল করে ঘিরে বসেছে তারা৷ মাঝে মাঝে তাদের গাঢ় নিঃশ্বাসের শব্দও আসছে৷ লোকগুলো ক্লান্ত৷

তাহলে কি ঘাসের উপরে এই প্রাণীটাকেই মেরেছে? কিন্তু আগুন তো চোখে পড়ছে না৷ তাহলে কি কাঁচা মাংস খায় এরা?

ভালো করে খেয়াল করতেই কিন্তু কুবো বুঝল প্রাণী নয়৷ ওরই বয়সের একটা বাচ্চা মেয়ে পড়ে আছে মাঝখানে৷ সারা শরীরে রক্তের দাগ৷ মাঝে মাঝে একটা চাপা আর্তনাদের মতো শব্দও করে উঠতে চাইছে সে৷ কিন্তু মুখ বাঁধা থাকায় সে আওয়াজ বেশিদূর ছড়াতে পারছে না৷

ব্যাপারটা দেখে এতটাই ভয় পেয়ে গিয়েছিল কুবো, যে ওর মুখ দিয়ে একটা মিহি শব্দও বেরিয়ে এসেছিল৷ তাতেই লোকগুলোর দৃষ্টি ফেরে ওর দিকে৷ হিংস্র পশুর মতো ওরা সবাই মিলে এগিয়ে আসে কুবোর দিকে৷ সে চোখের দিকে তাকিয়ে কুবোর ভয় আরও বেড়ে যায়৷ চেষ্টা করেও নড়তে পারে না সে৷ বুকের ভিতরে সমস্ত কৌতূহল রক্ত মাখামাখি হয়ে বরফের মতো ঠান্ডা হয়ে যায়৷

মাটির ওপরেই বসে পড়েছিল কুবো৷ ভেবেছিল আর কয়েক মুহূর্তের মধ্যে পশুগুলো ওর ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়বে৷ সেকেন্ড গুনছিল মনে মনে৷ কিন্তু দশ অবধি গোনার পরেও কিছু না হওয়ায় চোখ খুলতেই ও অবাক হয়ে গিয়েছিল৷

একটু আগে যে লোকগুলো হিংস্র জানোয়ারের মতো ঝাঁপিয়ে পড়তে চাইছিল ওর দিকে তাদের সবাই আপাতত পড়ে আছে মাটিতে৷ সবক’টা দেহের মাথা ঘাড় থেকে ছেঁড়া৷

আরও আশ্চর্যের ব্যাপার, সবক’টা মাথার ভিতর থেকে অন্তত এক ফুট বেরিয়ে এসেছে তাদের রক্তমাখা গোলাপি জিভটা৷ যেন ঘাড় থেকে মাথাটা আলদা করার আগে কেউ টেনে টেনে মুখ থেকে জিভগুলো বের করে নিয়েছে তাদের৷

একটা দীর্ঘদেহী মানুষ এগিয়ে আসে কুবোর দিকে৷ ওর মাথায় হাত রেখে নরম গলায় বলে, ‘নাম কী তোমার, ভাই?’

কুবো হতবুদ্ধি হয়ে গিয়েছিল, তা-ও লোকটার গলার স্বরে কী একটা যেন ছিল, খানিকটা সাহস ফিরে আসে ওর বুকের ভিতরে, ‘কু… কুবো৷’ লোকটা আবার তেমন নরম গলায় জিজ্ঞেস করে, ‘আর ওই যে মেয়েটা, পড়ে আছে মাটির ওপরে, ওর নাম জানো?’

কুবো দু-দিকে মাথা নাড়ায়৷ লোকটা একটা হাত রাখে কুবোর মাথায়৷ কী নরম আর উষ্ণ হাত! কুবোর সমস্ত শরীর জুড়িয়ে আসে, ‘বেশ, এই কাজটাই দিলাম তোমাকে৷’

‘কী কাজ?’

‘ওর মুখ থেকে ওর নামটা জানতে হবে তোমাকে৷’

‘কিন্তু ও তো…’ কুবো বলতে গিয়েও থেমে যায়৷

‘জানি, অসুস্থ, হুঁশ নেই৷ শরীরের অনেক জায়গায় ক্ষত হয়েছে৷ বেঁচে যাবে৷ তবে মনে আঘাত পেয়েছে তো, অনেকদিন কথা বলতে পারবে না৷ ততদিন ওর খেয়াল রাখা তোমার কাজ, ঠিক আছে ভাই?’

লোকটাকে এতক্ষণে চিনতে পারে কুবো৷ ওদের গোটা পাড়ার লোক এই লোকটার কথাই বলে সারাক্ষণ৷ ঈশ্বরের পাঠানো দূত৷ প্রফেট৷

‘আমি এবার আসি, এই মেয়েটার দায়িত্ব কিন্তু তোমার৷’

লোকটা পেছনে ফিরেছিল, কুবো প্রশ্ন করে, ‘আপনি বিরান? আমার বাবা বলে আপনি সব কিছু জানেন৷’

এবার শব্দও করেই হেসে ওঠে লোকটা, ‘তুমি ভারী বোকা তো কুবো৷ কোনও মানুষ কি সব জানতে পারে?’

‘আমার ইচ্ছা করে সব কিছু জেনে ফেলতে৷ বড়ো হলে আপনার মতো হতে চাই আমি৷’

আবার সেই হাতটা উঠে আসে কুবোর মাথায়, ‘বেশ তো, পড়াশোনা করো৷ মানুষের উপকার তো শুধু হাতে-পায়ে হয় না৷’

‘আমার মা অনেক পড়াশোনা করে৷ মা বলে ভগবান বলে কেউ নেই৷’

কুবো ভেবেছিল বিরান কথাটা শুনে রেগে যাবে৷ কিন্তু তার মুখের হাসিটা আরও বেশি করে ছড়িয়ে পড়ল, ‘ওই যে বললাম পড়াশোনা করো মন দিয়ে৷ সব কৌতূহল মিটবে৷ একদিন ঠিক এর উত্তর পেয়ে যাবে৷ আগে থেকে উত্তর ধরে নিয়ে এগোলে আর মজা কোথায়, তা-ই না?’

কথাগুলো বলে ধীরে ধীরে আবার কোথায় যেন মিলিয়ে গিয়েছিল লোকটা৷ আজও একা থাকলে শেষ কথাগুলো বাজে কুবোর কানে৷ ‘আগে থেকে উত্তর ধরে নিয়ে এগোলে আর মজা কোথায়, তাই না?’ সন্দেহ থেকেই তো মানুষের কৌতূহল হয়৷

কিন্তু এরপর আর কোনওদিন কুবোর দেখা হয়নি বিরানের সঙ্গে৷ কেউ সত্যি সত্যি বিপদে না-পড়লে বিরান দেখা দেয় না৷

তারপর থেকে অচেনা মেয়েটার সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছে কুবোর৷ প্রথম প্রথম নির্বাক স্বরেই হাউহাউ করে কাঁদত সে৷ মেয়েটার নাকি মা-বাবা নেই৷ এক মামার কাছে থাকে ও৷ মামা ভীষণ অত্যাচার করে বাচ্চা মেয়েটার উপরে৷

কুবো ওকে শান্ত করেছে, ‘আরে কাঁদছিস কেন রে, তুই জানিস, বিরানেরও মা-বাবা ছিল না৷ বাবা বলে, ওকে নাকি একটা লোক কুড়িয়ে পেয়েছিল৷ তারপর এক কসাই ওকে মানুষ করে৷’

এসব কথা শুনে শান্ত হয়নি রোন্না৷ তার চিবুক বেয়ে জলের ধারা বুকের ক্ষতগুলোর ওপরে নেমেছে৷ অবশেষে কুবো বুঝেছে, ওর গলার বিরানের মতো আশ্রয় নেই, যা মানুষের কান্না মুছে দিতে পারে৷ ও চুপ করে বসে থাকে পাশে৷ কাঁদতে কাঁদতেই একদিন থেমে গিয়েছে রোন্না৷

আজ এই পাথরের ওপরে বসে দূরে তাকিয়ে থাকতে থাকতে কুবো খেয়াল করল, আকাশের বুকে একটা বিশেষ জায়গায় এসে যেন জড়ো হতে শুরু করেছে মেঘগুলো৷ শুধু তাই নয়, সেই জায়গাটাকে ঘিরে আরও কিছু মেঘ চক্রের মতো আবর্তন করছে৷ যেন জমে-থাকা মেঘগুলোর ভিতরে উকিঝুঁকি দিয়ে কিছু একটা দেখার চেষ্টা করছে৷

‘কী হয়েছে বল তো ওখানে?’ রোন্নার দিকে চেয়ে জিজ্ঞেস করে কুবো৷ রোন্না কথা বলতে পারে না এখনও৷ দু-দিকে ঘাড় নাড়ায়৷

হঠাৎ মনে পড়ে যায় কুবোর৷ আজ সকালেই বাবাকে বলাবলি করতে শুনেছে৷ স্বর্গ থেকে দেবদূতরা নাকি আজ দেখা করতে আসবে বিরানের সঙ্গে৷

লিলি নদীর বাঁকের ঠিক পাশেই একটা বিরাট ফাঁকা মাঠ আছে৷ বিরানই নাম দিয়েছিল এই মাঠটার৷ নোয়ামনের মাঠ৷ সারাদিনে একবার অন্তত এই মাঠের ওপর কিছুক্ষণ হেঁটে আসে সবাই৷ খোলা হাওয়ায় মন চাঙ্গা হয়ে ওঠে৷ কাল রাতে সেখানে হাঁটতে গিয়ে কুবো দেখেছে মাঠের একেবারে মাঝখানে বিরাট একটা গোল জায়গা ঘিরে রাখা হয়েছে৷ কাল সারাদিন ওই জায়গাটার ভিতরে ঢুকতে দেওয়া হবে না কাউকে৷

দেবদূতদের এর আগে কেউ দেখেনি৷ তারা মানুষের মতোই দেখতে হবে নাকি অন্যরকম তা কেউ জানে না৷ তবে বিরান ভয় পেতে বারণ করেছে সবাইকে৷ বিরানের সঙ্গে কিছু বিশেষ দরকারে কথা বলতে আসছে তারা৷ তার বাইরে অন্য কোনওদিকেই মন দেবে না৷

আবার আকাশের দিকে চায় কুবো৷ জমা মেঘের জায়গাটা আপাতত একটা সবুজ রঙে ভরে উঠেছে৷ কিছু একটা যেন বেরিয়ে আসতে চাইছে মেঘের আড়ালে থেকে৷

‘দেবদূত৷’ লাফিয়ে ওঠে কুবো৷ রোন্নার দিকে চেয়ে বলে, ‘তুই বাড়ি চলে যা৷ আমি একটু পরে আসছি৷’

একটা দুষ্টু বুদ্ধি খেলে যায় ওর মাথায়৷

(৩)

মাঠের ধারে পিলপিলিয়ে জমা হওয়া লোকজনকে দেখে একবার ঢোক গেলে লিফারুন৷ সত্যি এত লোকের চিৎকার চেঁচামেচিতে কান পাতা দায় হয়েছে৷ তার ওপরে একটু আগে আকাশের গা বেয়ে রথ দেখা দিতেই তাদের উত্তেজনার পারদ আরও কয়েক ধাপ বেড়ে গিয়েছে৷

একটু আগে একটা বছর পনেরোর বাচ্চা ছেলে ভিড়ের ফাঁক গলে পৌঁছোতে চাইছিল বিরানের কাছে৷ লিফারুনই তাকে দেখতে পেয়ে ঘাড় ধরে বিদায় করেছে৷ এইসব জায়গায় এমনিতেই বাচ্চাকাচ্চা যত কম আসে তত ভালো৷

ছেলেটা কাতর কণ্ঠে জানিয়েছিল, ‘বিরান আমাকে চেনে৷ একবার একটা কথা বলেই চলে যাব৷’

‘এ শহরে সবাইকে চেনে বিরান৷ ভাগ এখান থেকে৷ এই মাঠের মধ্যে যেন না দেখি আজ৷’ ঘাড় ধাক্কা দিতে দিতে বলেছে লিফারুন৷ ছেলেটা চলে যেতে যেতে অভিসম্পাত করেছে ওকে৷ লিফারুনের ওসব দিকে মন দেওয়ার সময় নেই৷ আকাশের বুকে রথটা আরও বেশি করে স্পষ্ট হতে শুরু করেছে৷ অবাক হয়ে চেয়ে থেকেছে সেই দিকে৷

তারপর ক্রমশ মাটির ওপরে নেমে এসেছে রথটা৷ ভারী অদ্ভুত দেখতে সেটাকে৷ যেন তিনতলা বাড়ির সমান উঁচু সবুজ রঙের একটা ডিমের খোলস৷ মাটির সংস্পর্শে আসার সঙ্গে সঙ্গে একটা সাদাটে ধোঁয়ার স্রোত ছড়িয়ে পড়েছে মাঠ জুড়ে৷ মাঠে দাঁড়িয়ে-থাকা কারও কারও মনে হয়েছে, কিছু একটা যেন গোপন করতে চেয়েছে ধোঁয়াটা৷ ধোঁয়ার মধ্যে মিশে কারা যেন ছড়িয়ে পড়েছে মাঠের ভিড়ের মধ্যে৷

খানিকটা ভয় পেয়ে গেলেও বিরানকে মাঠের মাঝখানে ফাঁকা জায়গাটায় প্রবেশ করতে দেখেই ভয় কেটে গেছে সবার৷ হাত তুলে আশ্বস্ত করেছে সে৷

সোনালি রোদ খেলা করছে বিরানের সমস্ত শরীর জুড়ে৷ যেন আলাদা করে তার জন্যই ওইটুকু উজ্জ্বল আলো ছড়িয়ে দিচ্ছে সূর্যটা৷ এতক্ষণ চিৎকার করতে-থাকা জনতা বিরানকে দেখার বিস্ময়েই শান্ত হয়ে চেয়ে আছে তার দিকে৷

ক্রমশ সেই ডিমের মতো দেখতে রথটার বুকে একটা গোল দরজা তৈরি হল৷ সবাই ভেবেছিল এবার হয়তো তার ভিতর থেকে দেবদূত বেরিয়ে আসছে৷ কিন্তু সেসব কিছুই হল না৷ তার বদলে ধীরে ধীরে বেরিয়ে এল একটা মিটার দশেক উঁচু ধূসর রঙের চৌকো বাক্স৷

জমা-হওয়া ভিড়ের মধ্যে একটা কল্লোল উঠেই মিলিয়ে গেল৷ বাক্সটা, ধীর গতিতে সরতে সরতে এসে দাঁড়াল মাটির ওপরে৷

মৃদু গুঞ্জন তৈরি হয়েছিল৷ বিরান আবার এগিয়ে এসে শান্ত করল তাদের৷ কয়েক সেকেন্ড চোখ বুজে কিছু বোঝার চেষ্টা করল৷ তারপর গম্ভীর শান্ত গলায় বলল, ‘দেবদূত চাইছে আমি ওই বাক্সের ভিতরে গিয়ে ঢুকি, আমাকে যা দেওয়ার তা ওর ভিতরেই দেওয়া হবে৷ আপনারা কেউ ভয় পাবেন না৷’ জনতার গুঞ্জনের রূপ বদলে গেল৷ লিফারুন এগিয়ে এসে দু-একটা কথা বলল বিরানকে৷ তাকে চাপা স্বরে কিছু নির্দেশ দিল বিরান৷

ওদের থেকে একটু দূরেই সোহেরা থেকে আসা বিজ্ঞানীর টিম সার বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে৷ তাদের মুখ থেকে বিস্ময়ের ঘোর কাটতে চাইছে না৷ বিরান যে অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী, ঈশ্বরের প্রেরিত দূত, তা নিয়ে কোনও সন্দেহ আর নেই তাদের মনে৷

বড়ো করে একটা নিঃশ্বাস নিয়ে বাক্সটার দিকে এগিয়ে যায় বিরান৷

(৪)

মন খারাপ করে একটা গাছের তলায় এসে বসে পড়ে কুবো৷ বিরানকে ওর ভালো লেগেছে, কিন্তু ওর সঙ্গের লোকগুলো মোটে ভালো নয়৷ অত গা-জোয়ারির কী আছে? একবার দেখা করতেই তো গিয়েছিল৷

চোখটা ভরে আসে ওর৷ এদিকটায় আলো কমে এসেছে৷ যেন সব আলো ওই নোয়ামনের মাঠটাই শুষে নিয়েছে৷ বিস্তর ঝামেলা করে মাঠের ভিতরে ঢুকতে পেরেছিল আজ৷ যে লোকটা ধরেছিল, সে কয়েকবার চড়চাপটাও মেরেছিল ওকে৷ কানের পাশটা ব্যথা হয়ে আছে৷ সেখানে হাত বুলোতে বুলোতে কুবো অনুভব করে ওর শরীরটা ঝিমিয়ে আসছে ধীরে ধীরে৷ ঘুম পাচ্ছে৷

একটা নিশ্চিন্ত ভাব এসে জাপটে ধরে ওকে৷ পাথরের ওপরে মাথা রেখেই ঘুমিয়ে পড়ে কুবো৷

কতক্ষণ পরে ঘুম ভাঙে কুবো বুঝতে পারে না৷ চোখ মেলতেই দেখে আকাশের সাদা তুলোর মতো মেঘগুলো কালচে রং মেখেছে৷ সূর্যটা ঢাকা পড়ে গিয়েছে এতক্ষণে৷ এখান থেকে অন্তত কয়েক মাইল দূরে নোয়ামনের মাঠ৷ অথচ জনতার গুঞ্জন এখান থেকেও শোনা যাচ্ছে৷

হঠাৎ অন্য একটা ব্যাপার আবিষ্কার করে কুবো৷ উঁচু পাথরের ওপরে এই জায়গাটায় ও একা নেই৷ আর একটা লোক বসে আছে ওর পাশে৷ লোকটার গায়ে একটা চামড়ার জ্যাকেট জাতীয় পোশাক৷ বয়স বছর তিরিশের খানিক উপরে৷ দুটো হাত পেছনে ভর দিয়ে দূরের দিকে চেয়ে একমনে কী যেন ভেবে চলেছে লোকটা৷

ধড়ফড় করে উঠে বসে কুবো, ঝাঁজালো গলায় জিজ্ঞেস করে, ‘কে তুমি? এখানে বসে আছো কেন?’

লোকটা বিরক্ত হয়ে চায় ওর দিকে, ‘কেন? এখানে বসা মানা নাকি?’ ‘না মানা নয়,’ ঘাড় চুলকায় কুবো, ‘কিন্তু তুমি এখানে এলে কখন?’ ‘যখন তুমি ঘুমোচ্ছিলে৷’

লোকটার কথাবার্তা খারাপ নয়৷ একটু নিশ্চিন্ত হয়ে নিঃশ্বাস ছাড়ে কুবো, নরম গলায় বলে, ‘সবাই মাঠে গেছে দেবদূত দেখতে৷ তুমি যাওনি?’

‘কেন, আমি যাব কেন? আমার খেয়ে দেয়ে কাজ নেই নাকি?’

কুবো লোকটার কথায় অবাক হয়, ‘ভগবান নিজে দূত পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন আর তুমি দেখতে চাও না!’

লোকটা একটা বাঁকা হাসি হাসে, ‘বটে! তাহলে তোমাকে কে পৃথিবীতে পাঠিয়েছে?’

উত্তরটা দিতে যাচ্ছিল কুবো৷ থেমে যায়৷ ঘাড় নেড়ে বলে, ‘আরে ধুর, আমি তো একটা সাধারণ মানুষ৷ দেবদূতদের ডানা থাকে, গা থেকে আলো ছিটকে বের হয় তাদের৷’

‘মানে আগেও দেবদূত দেখেছ তুমি?’

বিরক্ত হয়ে উত্তর দেয় কুবো, ‘আরে আগে দেখব কেন? আমার বাবা মাঝে মাঝেই বলে৷’

‘মানে বাবা দেখেছে?’

মাটির ওপরে চাপড় মারে কুবো, ‘ধ্যাত্তেরি৷ বিরান বলেছে৷ বিরান যা বলে আমরা তাই বিশ্বাস করি৷’

‘বটে!’ আবার সেই বাঁকা হাসিটা ফিরে আসে লোকটার মুখে, ‘তাহলে তোমাকে লোকটা অমন খেদিয়ে দিল কেন বলো তো?’

কেমন যেন একটা সন্দেহ হতে থাকে কুবোর৷ বাবা বলেছে কিছু খারাপ লোক বিরানকে একদম সহ্য করতে পারে না৷ লোকজনের সামনে বিরানকে নিয়ে কিছু বলতে পারে না বটে, কিন্তু আড়ালে-আবডালে নাকি তারা সংগঠন তৈরি করছে তাকে মেরে ফেলবে বলে৷ লোকটার কথাবার্তা শুনে মনে হচ্ছে এ সেই দলের লোক৷

সন্দেহের চোখে তাকায় কুবো, ‘কী করে জানলে? তুমি ছিলে মাঠে?’ লোকটা জবাব দেয় না৷ মাঠের দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে গুনগুন করে কী যেন একটা গান ধরে৷

কুবোর কৌতূহলী মন আরও চঞ্চল হয়ে ওঠে, ‘আমাকে কী দরকার তোমার? এতগুলো পাথর থাকতে আমার পাশে এসে বসেছিলে কেন?’

‘তোমাকে ভারী পছন্দ হয়েছে আমার৷’ লোকটা নরম করে হেসে বলে৷

‘আমাকে! কেন?’

‘এই যে এত প্রশ্ন করো তুমি, এত কৌতূহল তোমার, সেই জন্য৷’

‘এর জন্যে কাউকে পছন্দ হয় নাকি? আমার বাবা বলে বেশি প্রশ্ন করতে নেই৷ সব কিছু নিয়ে কৌতূহল ভালো নয়৷’

লোকটা গম্ভীর মুখে বলে, ‘যারা কিছু না-জেনে বারবার প্রশ্ন করে, তাদের জন্যই মানুষের আজ এত ঠাটবাট৷ যারা আগেভাবেই সব উত্তর জেনে ফেলেছে কিংবা অন্যের কথা শুনে বিশ্বাস করে ফেলেছে তাদের জন্যেই যত গোলমাল৷’

কুবো আর কিছু বলে না৷ চুপ করে বসে থাকে৷ রোন্নাকে দেখতে পায়নি অনেকক্ষণ৷ সে মনে হয় আকাশে মেঘ দেখে আর বাড়ি থেকে বেরোবে না৷ এমনিতেই একসঙ্গে বেশি লোকজন দেখলে সে ভীষণ ভয় পেয়ে যায়৷

‘আচ্ছা তুমি আমার সঙ্গে এক জায়গায় যাবে?’ লোকটা নিজে থেকেই প্রশ্ন করে ওঠে৷

‘কোথায়?’

‘বললাম না আগে থেকে সব প্রশ্নের উত্তর জেনে ফেলতে নেই৷ যাবে কি না বলো আগে৷’

ভারী আতান্তরে পড়ে কুবো৷ লোকটার সঙ্গে যেতে তার ইচ্ছা করছে৷ আবার লোকটা বিপ্লবী দলের কেউ হতে পারে৷ যদি কোনওরকম ভাবে ক্ষতি করতে চায়? কুবো ভেবে দেখে লোকটা যখন এই পাথরটার উপরে উঠে বসেছিল তখন সে ঘুমোচ্ছিল৷ ক্ষতি যদি করার থাকত তাহলে তখনই করে ফেলতে পারত৷ বুকের ভিতর সেই কৌতূহলটা চাগিয়ে ওঠে ওর, উৎসাহিত স্বরে বলে, ‘চলো৷’

পাথর থেকে গড়িয়ে নেমে আসে লোকটা৷ তারপর একটা হাত বাড়িয়ে দেয় কুবোর দিকে৷

(৫)

হাতটা স্পর্শ করতেই কী যেন একটা ম্যাজিক খেলে গেল কুবোর শরীরে৷ মনে হল মাটি থেকে একটা বিদ্যুতের ঝলক এসে ঢুকেছে ওর গায়ের ভিতর৷ সামনের দিকে পা বাড়াতেই অবাক হয়ে গেল ও৷ সেই সঙ্গে একটা ঠান্ডা ভয়ের রেশ চেপে ধরল ওকে৷

‘আমার ছায়া পড়ছে না৷’ কাঁপা কাঁপা গলায় কুবো বলে৷

‘হুঁ’ তোমাকে এখন কেউ দেখতে পাবে না৷’

‘কিন্তু কেন?’

‘কারণ যেখানে আমরা যাচ্ছি, সেখানে আমাদের কেউ দেখতে পেলে আর রক্ষা থাকবে না৷’

আর কিছু জিজ্ঞেস করল না কুবো৷ বিস্ময়ের ঘোর এতটাই কামড়ে ধরেছে ওকে যে প্রশ্ন করতেও যেন ভুলে গিয়েছে৷

ওকে নিয়ে লোকটা চলল মাঠ পেরিয়ে৷ দুপুরের জোরালো রোদ ওকে স্পর্শ করেও করছে না৷ মনে হচ্ছে শরীরটা যেন ফিনফিনে হাওয়ার টুকরোতে পরিণত হয়েছে৷ অন্য সময়ের থেকে হাঁটার গতি অনেকটা বেড়ে গিয়েছে৷ লোকটা কোথায় নিয়ে চলেছে ওকে?

একটু পরে সম্মিলিত জনতার গুঞ্জনের আওয়াজটা বেড়ে উঠতেই কুবো বুঝতে পারল, মাঠের কাছে এসে পড়েছে ওরা৷ লোকটার মুখ এখন আগের থেকে আরও বেশি গম্ভীর দেখাচ্ছে৷

মাঠের উপরে কিছুটা হেঁটে আসতেই একটা বিরাট উঁচু ডিমের সামনে তার অর্ধেক উঁচু একটা বাক্স চোখে পড়ল কুবোর৷ সারি সারি লোক প্রায় নিঃশ্বাস বন্ধ করে চেয়ে আছে বাক্সটার দিকে৷ বিরানকে দেখতে পেয়েই খুশি হয়ে উঠল কুবো৷ চিৎকার করে ডাকার চেষ্টা করল, ‘বিরান, আমি কুবো’ এই যে…’

‘আঃ!’ লোকটা বিরক্ত হয়ে হাত ঝাড়া দিল, ‘বলেছি না, কেউ দেখতে পাবে না তোমায়, তা ছাড়া এখানে এত লোক৷ এসো দেখি, আমরা ওই বাক্সটার ভিতরে ঢুকব৷’

‘ওটার ভিতরে৷ কেন?’

‘সেটা ঢুকলেই দেখতে পাবে৷’

কুবো চেয়ে দেখল বিরানও পায়ে পায়ে এগিয়ে যাচ্ছে সেই বাক্সটার দিকে৷ কী হবে ওর ভিতরে?

কুবোর হাতটা এতক্ষণে আরও শক্ত করে চেপে ধরেছে লোকটা৷ ওর শরীর জুড়ে খেলতে থাকা বিদ্যুৎটা গতি বাড়িয়ে দিয়েছে৷ জনতার সম্মিলিত ডাক এখন জয়ধ্বনিতে পরিণত হয়েছে৷ সত্যি সত্যি আর কারও মনে কোনও সন্দেহ নেই— বিরান ঈশ্বরের পাঠানো এক দূত৷ শান্তির বার্তাবাহক এক প্রফেট৷

মাঠের ভিড়ের ফাঁক গলে এগিয়ে এল দু-জনে৷ জমা হওয়া ভিড়ের চিৎকারে কান পাতা দায় হয়েছে৷ কয়েকবার কুবোর গায়ে দু-একটা লোকের হাতও লেগে গেল৷ সে অবাক হয়ে দেখল হাতগুলো ওর শরীর ভেদ করে পেছনে চলে গেল৷

‘নাও, এবার ভিতরে ঢুকব আমরা৷’ লোকটা দাঁড়িয়ে পড়ে নির্দেশ দিল৷

‘কী করে?’ প্রতিবাদ করল কুবো, ‘দরজা নেই যে!’

‘আছে, দেখতে পাচ্ছ না কেবল৷ এসো আমার সঙ্গে৷’

এগিয়ে গিয়ে বাক্সটাকে স্পর্শ করল লোকটা৷ মনে হল যেন পোষা ঘোড়াকে আদর করছে৷ তার দেখা দেখি কুবোও গিয়ে হাত লাগাল দেওয়ালে৷ বাক্সের ঠান্ডা স্পর্শে শরীর কেঁপে উঠল৷

সত্যি কোনও দরজা নেই বাক্সের গায়ে, তা-ও নিরেট দেওয়ালটা বাধা হয়ে দাঁড়াল না ওর সামনে৷ সেই খেলতে থাকা বিদ্যুতের স্রোতটাই যেন ধাক্কা দিয়ে বাক্সের ভিতর এনে ফেলল ওদের দু-জনকে৷

চেয়ে দেখল, নিরেট কালো একটা হলঘরের মধ্যে এসে দাঁড়িয়েছে কুবো আর সেই লোকটা৷ এতক্ষণে সমস্ত ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছে সে৷ অসীম বিস্ময়ে লোকটার মুখের দিকে চেয়ে সে বলল, ‘তুমিই তার মানে দেবদূত?’ লোকটা মাথা নাড়ে, ‘না৷’

‘তাহলে তোমাকে ঢুকতে দিল কেন বাক্সটা?’

‘কারণ এই বাক্সটা আমি তৈরি করেছি৷ বাইরে ওই ডিমের মতো যে স্পেসশিপটা দেখলে, ওটাও আমার তৈরি৷’

‘তুমি…’ কুবোর মাথার ভিতরে সমস্ত হিসেব গুলিয়ে যায়, ‘তুমি কে তাহলে?’

‘তোমারই মতো মানুষ৷ শুধু তোমাদের এই গ্রহের নয়৷ তোমাদের চেয়ে আমাদের সভ্যতা কয়েক লক্ষ বছরের পুরনো৷ তোমাদের থেকে বেশ খানিকটা উন্নত আমরা৷’

‘তুমি দেবদূত নও?’ হতাশ গলায় কুবো জিজ্ঞেস করে৷

হাঁটু গেড়ে কুবোর সামনে বসে পড়ে লোকটা৷ তারপর তেমনই নীচু গলায় বলে, ‘না৷ কিন্তু তোমাদের একটা উপকারই করতে এসেছি আমি৷’

‘কী উপকার? বিরান তো সব কিছু পারে৷’

ওপরে-নীচে ঘাড় নাড়ে লোকটা, ‘সব কিছু পারে, কেবল একটা জিনিস ছাড়া, বিরান নশ্বর৷ ওর শরীরটা একদিন শেষ হয়ে যাবে৷’

‘তার মানে তুমি…’ ডগমগ খুশিতে ভরে যায় কুবোর মুখ৷

‘শশশখ’ ঠোঁটের ওপরে হাত রেখে কুবোকে চুপ করতে বলে লোকটা৷ চাপা ফিসফিসে গলায় বলে, ‘সব জানতে পারবে, আগে দ্যাখো কী হয়৷’

বিরানকে দেখতে পায় কুবো৷ বাইরে থেকে বাক্সের ভিতরে ঢুকে এসেছে সে৷ সে ভিতরে ঢুকতেই ঘরের একটা দিক আলোকিত হয়৷ মনে হয় বাক্সের ভিতরের পরিবেশটা ওদিকেই এগিয়ে যেতে বলছে বিরানকে৷

অপলক চোখে সেদিকে চেয়ে থাকে কুবো৷ বিরানের পায়ের শব্দ শোনা যাচ্ছে৷ কোথা থেকে মৃদু সুর ভেসে আসছে যেন৷ মিষ্টি কোনও সুর৷

হঠাৎ অন্য একটা শব্দও কানে আসে ওর৷ যেন বাক্সের ভিতরে কোথাও বাতাস বইতে শুরু করেছে৷ ভালো করে তাকাতে সে দেখতে পায়— একটা ঘন কালো ধোঁয়াটে শরীর৷ স্পষ্ট নয়, তাও বোঝা যায় একটা মুখ আছে তার৷ এবং সে মুখ হিংস্র৷

ক্রমশ সামনে এগিয়ে আসে প্রাণীটা৷ বিরান নির্ভীক হয়ে দাঁড়ায় তার সামনে৷ এতটুকু ভয়ের রেশ ছুঁতে পারেনি তাকে৷

সরু ফুটোর মধ্যে দিয়ে বাতাস বেরোনোর মতো একটা শব্দ করছে প্রাণীটা৷ তীক্ষ্ণ শব্দটা বুকের ভিতরে বরফ কুচি ঢেলে দেয় যেন৷ কুবোর বুক স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল৷ সে দেখল প্রাণীটা একটু একটু করে এগিয়ে আসছে বিরানের দিকে৷ হলঘরের ভিতরের বাতাস অসম্ভব ভারী হয়ে উঠেছে৷ আকারে কি বেড়ে উঠছে প্রাণীটা? কী চায় সে? এই লোকটা কেন বাক্সের মধ্যে করে এনেছে প্রাণীটাকে?

মিহি ধাতব একটা শব্দ বেরিয়ে এল প্রাণীটার মুখ থেকে৷ পরমুহূর্তে বিরানের মাথাটা কাঁধ থেকে ছাড়িয়ে নিল সে৷ রক্তের ধারা ছিটকে গিয়ে লাগল চারদিকের দেওয়ালে৷ চিৎকার করার সময়ও পেল না বিরান৷ তার মুণ্ডহীন রক্তমাখা বাকি শরীরটা লুটিয়ে পড়ল ঘরের মেঝেতে৷

ঘটনার আকস্মিকতায় ভয় ভুলে চেঁচিয়ে উঠেছিল কুবো৷ ওর পাশে দাঁড়িয়ে-থাকা লোকটা আরও শক্ত করে চেপে ধরার চেষ্টা করল হাতটা৷ কিন্তু পারল না৷ কুবো এক ঝটকায় হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে একটা ধাক্কা দিল লোকটাকে, ‘কী করলে এটা! বিরানকে মেরে ফেললে তুমি?’

‘শান্ত হও কুবো, আমি যা করেছি তোমার ভালোর জন্য করেছি৷ তোমাদের ভবিষ্যতের জন্য করেছি৷’

‘মিথ্যেবাদী, আমি সবাইকে বলে দেব যে তুমি…’

‘বলবে, তোমার কোনও ক্ষতি করব না আমি৷ তার আগে আমার কথাটা শোনো৷’ লোকটা দু-হাতে চেপে ধরে কুবোর ছোট্ট শরীরটাকে৷

‘বিরান ভালো লোক ছিল, আমাকে আর ওই বাচ্চা মেয়েটাকে…’ কান্নামাখা গলায় বলে কুবো৷

‘আমি তো বলিনি খারাপ মানুষ ছিল৷ তোমাদের যত সমস্যা তার সব ক-টার সমাধান করতে পারত বিরান৷’

‘তাহলে কেন মারলে ওকে?’

একটা অদ্ভুত হাসি খেলে যায় লোকটার মুখে, ‘কারণ ওকে মারা যায়, ওর মৃত্যু আছে৷ আজ না-হোক কাল ও মারা যেতই৷ ততদিন তোমাদের এই গ্রহতে আর কোনও গোলমাল থাকত না৷ সবাই সুখে থাকত, কিন্তু তারপর?’

লোকটা একটু থেমে বলতে থাকে, মনে হয় বহু দূর থেকে ভেসে আসছে লোকটার গলার আওয়াজ, ‘কুবো, আমি জানি না ভগবান বলে সত্যি কেউ আছে কি না, এ-ও জানি না তিনি মাঝে মধ্যে আমাদের মধ্যে দূত পাঠান কি না, তবে যদি সত্যি তাই হয় তাহলে প্রতিবার একটা বড়ো ভুল হয় তার৷

তিনি দূতদের অবিনশ্বর করে পাঠান না৷ তারা পৃথিবীতে শান্তি এনে দেয়, তাদের কথা শুনে চলে মানুষ, শুনতে শুনতে কবে যেন মানুষ বুঝে যায় তাদের কথা শুনলেই সব ঠিক হয়ে যাবে, পৃথিবীতে স্বর্গ নেমে আসবে, আসেও তাই৷ তারপর একদিন সেই প্রফেট মারা যান৷

মানুষ, সমাজ, রীতিনীতি সব বদলে যায়৷ প্রফেটের ফেলে-যাওয়া সিংহাসনে একটা শূন্যতা তৈরি হয়৷ সেই শূন্যতা ভরাট করতে ছুটে আসে কিছু লোভী মানুষ৷

সিংহাসনে বসেই তারা প্রফেটের মুখে নিজেদের ইচ্ছামতো কথা বসিয়ে দেন৷ তার ব্যাখ্যাকে ভেঙেচুরে নিজের ব্যাখ্যা চালাতে শুরু করেন৷ নিজেদের স্বার্থে মানুষে-মানুষে যুদ্ধ লাগিয়ে দেন৷ নিজেদের লোভ মেটাতে নতুন নিয়ম চালু করেন৷ মানুষ সেইসব নিয়মকেই ভগবানের বাণী ভেবে পালন করে যেতে থাকে৷ যে দেবদূত একসময় তাদের নিজেদের মধ্যে মারামারির হাত থেকে বাঁচিয়েছিল সেই তাদের অধঃপতনের কারণ হয়ে দাঁড়ায়৷

এই যুদ্ধ, এই অত্যাচারের হাত থেকে মানুষকে বাঁচাতে কয়েক হাজার বছর আর কোনও দূত পাঠান না ভগবান৷ দূত এসে যে একশো বছরের স্বর্গ উপহার দিয়েছিল মানুষকে, তা আরও হাজার বছরের নরকে পরিণত হয়৷’

এতদূর বলে একটু থেমে হাঁপাতে থাকে লোকটা৷ তারপর খানিকটা দম নিয়ে কঠিন গলায় বলে, ‘আমি আজ যা করেছি তাতে কিছু মানুষের ক্ষতি হবে আমি জানি৷ কিন্তু কয়েক হাজার বছরের অভিশাপ থেকে মুক্ত করেছি আমি মানুষকে৷’

কুবো চেয়ে দেখে সেই ধোঁয়াটে প্রাণীটা হাওয়ায় ভেসে গিয়ে ঢুকছে বিরানের শরীরের ভিতরে৷ একটু একটু করে যেন প্রাণ ফিরে আসছে তার মধ্যে৷

‘এসব আমাকে কেন দেখালে তুমি?’ ধরা গলাতেই প্রশ্ন করে কুবো৷

লোকটার মাথা হেঁট হয়ে আসে, ‘আমার একটা জিনিস দেওয়ার আছে তোমাকে৷’

‘কী?’

লোকটা আর কোনও উত্তর দেয় না৷ কুবো চেয়ে দেখে বিরানের ছিন্ন শরীরটার ঠিক পাশেই দাঁড়িয়ে আছে আর একটা বিরান৷ এরও মুখে সেই একই হাসি৷ আলাদা মানুষ বলে মনেই হবে না৷

বিরান এগিয়ে আসে ওর দিকে৷ কুবো ভয়ে একটু পিছিয়ে যায়৷ পাশের লোকটা অভয় দেয় ওকে, ‘ভয়ের কিছু নেই৷ ও কোনও ক্ষতি করবে না তোমার৷’

বিরান এগিয়ে এসে হাত রাখে কুবোর মাথায়৷ সঙ্গে সঙ্গে ওর ভিতরে কী যেন বদলে যায়৷ একটা অজ্ঞাত শক্তি যেন ওর শিরায় শিরায় সঞ্চারিত হয়ে পড়ে৷

‘বিরান যখন এখান থেকে বেরোবে তখন আর আগের মানুষ থাকবে না ও৷ আগের মতো ক্ষমতা থাকবে না৷ সবাই ধীরে ধীরে ভুলে যাবে ওকে৷ কিন্তু প্রকৃতি ওকে যে ক্ষমতা দিয়েছে সেটা নষ্ট হবে না৷’

কুবো কিছু বলতে পারে না, স্থির চোখে চেয়ে থাকে বিরানের দিকে৷

‘তোমাকে বলেছিলাম না, যারা প্রশ্ন করতে পারে, যারা চোখ বন্ধ করে কোনও আপ্তবাক্যে বিশ্বাস করে নেয় না, ক্ষমতা কেবল তাদের হাতেই মানায়৷’

বিরান এতক্ষণে এগিয়ে গিয়েছে বাক্সের বাইরের দিকে৷ আবার বাইরে থেকে ভেসে আসে জয়ধ্বনি৷

‘কুবো, আজকের পর থেকে যে ক্ষমতা তোমার শরীরে থাকবে তার কথা জানিও না কাউকে৷ শুধু মনে রেখো, কোনও বই, কোনও বাণী, কোনও নিয়ম সত্যি ঈশ্বরের কাছ থেকে আসছে, না কোনও লোভী মানুষের থেকে, তা যাচাই করার উপায় নেই৷ কেবল একটা কথা নিশ্চিত করে বলা যায়, যদি ঈশ্বর কোথাও থেকে থাকেন তাহলে তোমার মাথার ভিতরের ঘিলুটাও তাঁর সৃষ্টি৷ যদি কিছু সংকেত পাঠানোর হয়, তিনি সেখানেই পাঠাবেন৷ সেটাকে বিশ্বাস কোরো, অন্য কিছু নয়৷

সেটাকে কাজে লাগাও৷ এমন কিছু কাজ করো যাতে মানুষের ভালো হয়৷ প্রশ্ন করে, কৌতূহলী হয়ে, পড়াশোনা করে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে, গবেষণা করে, আবিষ্কার করে এমন আবিষ্কার, যা তোমার মৃত্যুর হাজার বছর পরেও মানুষের উপকার করবে, এমন আবিষ্কার, যা সত্যি না মিথ্যে তা নিয়ে হাজার বছর পরেও প্রশ্ন করা যাবে৷ কোনও কিছুর সন্দেহাতীত হয়ে যাওয়া ভারী বিপজ্জনক কুবো৷

যদি সত্যি এইসব পারো, তাহলে তোমার মৃত্যুর পরেও সভ্যতায় তোমার অবদান থেকে যাবে৷ যারা এসব পারে তারাই আসল দেবদূত কুবো৷’

আবার একটা হাওয়ার ধাক্কায় জ্ঞান হারায় কুবো৷ মনে হয় অন্তহীন একটা খাদের গভীরে পড়ে যাচ্ছে সে৷ অদ্ভুত সেই মানুষটার গলার আওয়াজ ক্রমশ দূরে হারিয়ে যায়৷

(৬)

চোখ মেলতে কুবো দেখে আবার সেই টিলার পাথরের উপরে এসে পড়েছে ও৷ রোন্না বসে আছে ওর পাশে৷ রাত নেমে এসেছে এতক্ষণে৷ টিমটিম করে তারা জ্বলছে আকাশে৷ ঘাড় তুলে পায়ের দিকে তাকাতেই টিলার একপ্রান্তে অন্ধকারের মধ্যে দাঁড়িয়ে-থাকা ওর নিজের ঘর চোখে পড়ে৷ নিশ্চিন্ত হয় কুবো৷ জানলায় আলো জ্বলছে৷

মনে হয় যেন দুপুরবেলা এই পাথরের উপর শুয়ে ও ঘুমিয়ে পড়েছিল৷ এতক্ষণ কি স্বপ্ন দেখছিল তাহলে?

হাওয়ার শনশন ছাড়া আর কোনও শব্দ নেই এখানে৷ ধীরে ধীরে কোমরে ভর দিয়ে উঠে বসে কুবো৷ রোন্না ওর দিকে চেয়ে মিষ্টি করে হাসে৷ মেয়েটাকে ভারী ভালোবাসে ও৷ মন কেমন করে খুব রোন্নার জন্য৷ কে জানে কবে ওর গলার স্বর শুনতে পাবে৷

রোন্নার হাতটা তুলে নেয় নিজের হাতে৷ রোজকার মতো আলতো করে হাত বুলিয়ে দিতে থাকে তার হাতে৷

‘আমার নাম রোন্না৷’ বহুদিন পরে নিজের বাকশক্তি ফিরে পেয়ে প্রথমবারের মতো বলে রোন্না৷

কুবো খুশি হয়৷ দূর দিগন্তের দিকে চেয়ে দেখে৷ মাইলের পর মাইল বিস্তৃত পড়ে আছে মানুষের ঘরবাড়ি৷ রোন্নার মুঠোর ভিতরে হাত রেখে সেদিকে চেয়ে তার মুখটা কঠিন হয়ে ওঠে৷

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *