দেবতা কি গ্রহান্তরের মানুষ?

আমার কর্মজীবনের শুরুটা ময়মনসিংহ অ্যাগ্রিকালচারাল ইউনিভার্সিটিতে–লেকচারার, ভৌত রসায়ন।
মা ও ভাইবোনদের ঢাকার শ্যামলীতে রেখে আমি কর্মস্থলে যোগ দেওয়ার জন্য রওনা হয়েছি। মন যথেষ্টই খারাপ। ঢাকা শহরে একবার শিকড় বসে গেলে শিকড় ছেঁড়া কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। বাবার মৃত্যুশোক মা ও ভাইবোনেরা সামলে উঠতে পারেনি। তাদের সঙ্গে থাকা আমার জন্য খুবই জরুরি। আমি নিজেও পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে বছরের পর বছর হলে-হোস্টেলে থেকে ক্লান্ত। কিন্তু উপায় কী!
ঢাকার এক ওষুধ কম্পানিতে ভালো চাকরির সুযোগ ছিল, কিন্তু পেশা হিসেবে অধ্যাপনাকে অনেক আকর্ষণীয় মনে হলো।
অল্প কিছু বই সঙ্গে নিয়ে ময়মনসিংহ উপস্থিত হলাম। অল্প কিছু বইয়ের একটি জীবনানন্দ দাশের রূপসী বাংলা। পাঠক কি ভাবছেন এই গদ্যলেখক বিরাট কবিতাপ্রেমিক? ঘটনা তা না। এ বইটি আমি নিয়েছি সব কবিতা মুখস্থ করার জন্য। বন্ধু আনিস সাবেতের জীবনানন্দ দাশের অনেক কবিতা মুখস্থ। আমি ঠিক করেছি আনিস সাবেত যখন আমাকে দেখতে ময়মনসিংহে আসবেন, তখন পুরো রূপসী বাংলা মুখস্থ শুনিয়ে তাঁর পিলে চমকে দেব। পুরো কবিতার বই মুখস্থ করার পেছনে কাব্যপ্রেম নেই, আছে আনিস ভাইয়ের পিলে চমকে দেওয়ার বাসনা।
ক্লাস নিতে শুরু করেছি, দ্রুতই রুটিনের ভেতর ঢুকে গেছি। বক্তৃতা তৈরির ফাঁকে ফাঁকে চলছে কবিতা মুখস্থ। থাকি ভাড়া করা একটি একতলা বাড়িতে। প্রতি রুমে দুজন করে শিক্ষক। আমার রুমমেট ড. সিরাজুল কবির এক দিন অবাক হয়ে বললেন, সারা দিন কবিতার বই পড়েন, ব্যাপার কী?
আমি বললাম, শরীর ধুতে হয় সাবান দিয়ে। আর মন ময়লা হলে মন ধুতে হয় কবিতা দিয়ে।
সহকর্মী চোখ কপালে তুলে বললেন, কী বলেন, কী বলেন এসব! সত্যি?
অবশ্যই সত্যি।
দেখি আপনার কবিতার বই। আমিও রোজ শোবার আগে কবিতা পড়ে মন ধোলাই করব।
ড. সিরাজের কবিতা পাঠের উৎসাহে দ্রুত ভাটা পড়ল। কবিতা পড়ে তিনি জীবনানন্দ সম্পর্কে কঠিন সব কথা বলতে শুরু করলেন। সবচেয়ে কম কঠিন কথাটি হলো–“এই কবিকে বাংলাদেশের একটি বিশেষ জেলায় পাঠিয়ে দিয়ে সুচিকিৎসা করা অতীব প্রয়োজন ছিল।”
যাই হোক, আমার রুমমেট একটি বিষয়ে অতি উৎসাহে আমাকে সাহায্য করতে লাগলেন। কোনো একটি কবিতা মুখস্থ হলেই আমি তাঁর কাছে পরীক্ষা দিই। তিনি বই হাতে নিয়ে মিলিয়ে দেখেন আমি কোথাও ভুল করলাম কি না।
আড়াই মাসের মাথায় ড. সিরাজ আমার দুটি বিষয়ে নিশ্চিত হলেন।
১. হুমায়ূন আহমেদ নামক মানুষটিকেও একটি বিশেষ জেলায় পাঠিয়ে দ্রুত সুচিকিৎসা করা প্রয়োজন। দেরি হলে সমস্যা হতে পারে।
২. এ মানুষটির স্মরণশক্তি অত্যন্ত ভালো। (প্রসঙ্গক্রমে বলে রাখি, ঔপন্যাসিক হওয়ার অতি আবশ্যকীয় শর্তের একটি–ভালো স্মৃতিশক্তি)।
রূপসী বাংলার প্রতিটি কবিতা মুখস্থ হয়েছে। আনিস ভাইকে চমকে দেওয়ার প্রস্তুতি শেষ।
উনাকে চমকে দেওয়া গেল না। উনি আমাকে চমকে দেওয়ার ব্যবস্থা করলেন। পার্সেলে একটি প্যাকেট পাঠালেন। প্যাকেটে একটি বই। বইয়ের ভেতর তাঁর লেখা একটি চিঠি এবং দেড় শ টাকা। চিঠিতে লেখা–
হুমায়ূন,
আমি বিশেষ ঝামেলায় আছি। কী ঝামেলা, তা বলতে পারছি না। কোনো একদিন হয়তো বলব। ঝামেলার কারণে তোমার এখানে আসতে পারছি না। তোমার কাছে এসে হৈ চৈ করে যে টাকাটা খরচ করব বলে আলাদা করে রেখেছিলাম তা তোমাকে পাঠিয়ে দিলাম। এই সঙ্গে একটি বই। তুমি উদ্ভট বিষয় পড়তে ভালোবাস। এ বইটি যথেষ্টই উদ্ভট।
আনিস সাবেত
(অনেক দিন আগের কথা। আনিস ভাইয়ের চিঠিটা সংগ্রহে নেই। স্মৃতি থেকে লিখলাম। একটু আগেই লিখেছি আমার স্মৃতিশক্তি ভালো)।
আনিস ভাইয়ের পাঠানো বইটির নাম দেবতা কি গ্রহান্তরের মানুষ? লেখকের নাম এরিখ ভন দানিকেন। ভদ্রলোকের বাড়ি জার্মানিতে। তিনি ভূ-পর্যটক এবং শখের গবেষক। গবেষণার বিষয় প্রাচীন পৃথিবীর স্থাপত্যকলা। এই শখের প্রত্নতত্ত্ববিদের গবেষণার ফসল হলো জগদ্বিখ্যাত বই দেবতা কি গ্রহান্তরের মানুষ? পৃথিবীর সব কয়টি ভাষায় বইটি অনূদিত হলো। লেখক রাতারাতি বিশ্বখ্যাতি পেলেন।
বইটিতে লেখক বললেন, মানবপ্রজাতির শুরুর দিকে মহাকাশযানে চড়ে কিছু ভিনগ্রহের প্রাণী এসেছিল। তারা দেখতে মানুষের মতো। পৃথিবীতে সভ্যতার শুরুটা তারাই করে যায়। ভিনগ্রহের মানুষের কর্মকাণ্ড দেখে পৃথিবীর মানুষ ধরে নেয় এরাই দেবতা। তারা দেবতাদের পূজা শুরু করে। দেবতাদের জন্য মন্দির বানাতে থাকে।
প্রমাণ হিসেবে তিনি অতি প্রাচীন মন্দিরের কিছু দেবমূর্তির কথা উল্লেখ করলেন। এসব মূর্তি দেখে মনে হয় এরা স্পেস স্যুট পরে আছে। মাথায় হেলমেট। হেলমেটে অ্যান্টেনা।
লেখক দেখালেন মায়া সভ্যতার দেয়ালচিত্র, সেখানে মহাকাশযানে একজন নভোচারী বসে আছে।
লেখক মন্দিরের ছবি দিলেন। সব মন্দির আকাশের দিকে সরু হয়ে উঠেছে। দেখে মনে হয় নভোযান।
দানিকেন বললেন, পিরামিড বানানোর প্রযুক্তি মানুষের ছিল না। ভিনগ্রহের মানুষ বানিয়ে দিয়েছে। বালু থেকে গ্লাস বানাতে যে প্রচণ্ড তাপ লাগে সেই প্রযুক্তিও মানুষের ছিল না, কিন্তু গ্লাস এবং ফুলগোরাইটের অপূর্ব মূর্তি পাওয়া গেছে।
আমি বই পড়ে অভিভূত। আমার কাছে মনে হলো শখের এ প্রত্নতত্ত্ববিদ অসাধারণ কাজ করেছেন। দানিকেন সাহেবের ভূত অনেক দিন আমার মাথায় চেপে রইল। তিনি অনেকগুলো বই লিখলেন, সব জোগাড় করলাম। বইগুলো পড়ি আর ভাবি–ইস ভদ্রলোকের সঙ্গে যদি একবার দেখা করতে পারতাম?
বিস্ময়করভাবে এই সুযোগ তৈরি হলো। নর্থ ডাকোটা স্টেট ইউনিভার্সিটি তাঁকে আমন্ত্রণ জানাল বক্তৃতা দেওয়ার জন্য। আমি তখন সেই ইউনিভার্সিটির ছাত্র।
হল লোকে লোকারণ্য। দানিকেন ভিডিও ক্লিপিং দেখিয়ে চমৎকার বক্তৃতা করলেন। প্রমাণ করে দিলেন অতি প্রাচীনকালে ভিনগ্রহের মানুষ এসেছিল। মানবসভ্যতার শুরু তারা করে দিয়েছে। তুমুল করতালিতে বক্তৃতা শেষ হলো। দানিকেন বললেন, এই হলঘরে এমন কেউ আছে আমার পেশ করা হাইপোথিসিস যে বিশ্বাস করে না? কেউ কিছু বলল না, কিন্তু আমি উঠে দাঁড়ালাম। দানিকেন অবাক হয়ে বললেন, তুমি কেন বিশ্বাস করছ না?
আমি বললাম, আপনার হাইপোথিসিসে মানুষের উদ্ভাবনী শক্তি কর্মক্ষমতাকে ছোট করা হয়েছে।
দানিকেন বললেন, তুমি মানুষের উদ্ভাবনী ক্ষমতা নিয়ে ধোঁয়াটে কথা না বলে আমি যেসব যুক্তি দিয়েছি তা খণ্ডন করো। একটি করলেই হবে।
আমি বললাম, আপনি বক্তৃতায় বলেছেন, বালি থেকে কাচ বানাতে যে তাপ লাগে তা তৈরির ক্ষমতা মানুষের একসময় ছিল না, অথচ তারও আগে কাচের তৈরি মানুষের মাথার খুলির ভাস্কর্য পাওয়া গেছে।
তুমি এটা ভুল বলতে চাচ্ছ?
না। পৃথিবীতে প্রাকৃতিকভাবেই কাচ ও ফুলগেরাইট তৈরি হয়। বালুতে যখন বজ্রপাত হয় তখন ঘটনাটা ঘটে। প্রাকৃতিকভাবে তৈরি কাচ নিয়ে মূর্তি বানানো হয়েছে। ভিনগ্রহের মানুষের সহায়তার প্রয়োজন হয়নি।
দানিকেন আমার ওপর স্পষ্টতই রাগলেন, কিন্তু রাগ প্রকাশ করলেন না। মাথা ঝাঁকিয়ে বললেন, ইন্টারেস্টিং হাইপোথিসিস। আমার যে গবেষকদল আছে তাদের এই হাইপোথিসিসের কথা বলা হবে। আমরা তুচ্ছ বিষয়কেও গুরুত্ব দিই।
চৈনিক দার্শনিক কনফুসিয়াস বলেছেন, যে বস্তু আকাশে ওঠে তাকে একসময় মাটিতে নামতে হয়। দানিকেন সাহেব আকাশে উড়ছিলেন, তাঁকে কঠিন মাটিতে নামতে হলো। এই কাজটি করল আমেরিকান টিভি চ্যানেল অইঈ। তারা দানিকেন এবং তাঁর থিওরি নিয়ে এক ঘণ্টার একটি প্রতিবেদন তৈরি করল। বিজ্ঞানীদের কয়েকটি দল দানিকেনের প্রতিটি যুক্তি কঠিনভাবে খণ্ডন করল। প্রতিবেদনের আসল বোমাটি ছিল সব শেষে। সেখানে দেখানো হলো দানিকেন অর্ডার দিয়ে স্পেস স্যুট এবং মাথায় হেলমেট পরা মূর্তি বানাচ্ছেন। এসব মূর্তিই তিনি ব্যবহার করেছেন তাঁর গ্রন্থে। দানিকেনকে যখন এই ফাঁকিবাজির বিষয়ে প্রশ্ন করা হলো, তিনি শুধু হতাশ চোখে তাকালেন। কোনো জবাব দিতে পারলেন না, জবাব দেওয়ার চেষ্টাও করলেন না।

পাদটীকা
যে মানুষ ঈশ্বর কণা creation ex nihlo ) গবেষণাগারে তৈরি করেছে তার ক্ষমতাকে তাচ্ছিল্য করার কোনো উপায় এখন নেই, অতীতেও ছিল না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *